রত্না রশীদ ব্যানার্জী এর সকল পোস্ট

বাঙালি মুসলিম সমাজে প্রচলিত ব্রত ও মানত

বাঙালি মুসলিম সমাজে প্রচলিত ব্রত ও মানত

সমাজবদ্ধ গৃহী মানুষ ঐশ্বরিক শক্তির কাছে পার্থিব কামনায় যখন নিষ্ঠাভরে বিশেষ ধর্মীয় আচার – আচরণ পালন করে -তখন তাকে ব্রত বলা যায়। ‘ব্রত’ কথাটির সাধারণ অর্থ হ’ল নিয়ম- সংযম। এই নিয়ম সংযমের মধ্যে দিয়ে ‘কামনা’ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত পুণ্যকর্মের অনুষ্ঠান ই হলো ব্রত। ব্রতের উৎপত্তির কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বাংলার ব্রত’ গ্রন্থে জানিয়েছেন, নানা ঋতুর মধ্যে দিয়ে, নানান সব ঘটনা মানুষের চিন্তাকে আকর্ষণ করেছে এবং এই সকল ঘটনার মূলে দেবতা- অপদেবতার নানারকম কল্পনা করে নিয়ে তারা শষ্য কামনায়, সৌভাগ্য কামনায়, এমনই নানা কামনা চরিতার্থ করার জন্য ব্রত করেছে, কি আর্য, কি ‘অন্যব্রত’, সব দলই। ব্রত পালনের ইতিবাচক দিকটি হলো ব্রতীর মঙ্গল হওয়া, আর নেতিবাচক দিক হিসেবে বলা চলে, শত্রু, বা কোন অশুভ শক্তি ব্রতীর কোন ক্ষতি করতে পারবেনা।

ইসলামি শরিয়ত কিন্তু ব্রত- মানতের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করেছে, – “মানত্ মানুষকে এমন কোন জিনিস এনে দিতে পারে না যা তার জন্য ( আল্লাহ কর্তৃক) নির্ধারিত ছিল না। হাঁ, মানত্ মানুষকে ঐ জিনিসের কাছে পৌঁছে দেয় যা তার জন্য নির্ধারিত করা ছিল। ফলতঃ আল্লাহতালা কৃপণের মাল বের করে থাকেন -(বুখারী)।”

ডঃ মোমেন চৌধুরীর মতে, প্রকৃতপক্ষে কোন মুসলিম ব্রত নেই। তবে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বলছে, লোকায়ত জীবনে মুসলিম আমজনতার পালনীয় ব্রত- মান্নতের সীমা সংখ্যা নেই। একেশ্বরবাদের পাশাপাশিই রীতিমতো নিষ্ঠার সঙ্গে ভজন- পুজন করা হয় সংখ্যাতীত শাহ – গাজী – পীর- পীরানি- বিবি মায়েদের, এঁদের কাছে বিভিন্ন পার্থিব কামনায় মানত্ মাগা হয়, —
এগুলিকে ব্রত ছাড়া আর অন্য কিছু বলা যায়না।

মুসলিমদের মধ্যে যারা পীরবাদের ঘোর বিরোধী, তারা এই ব্রত- মানত্ গুলিকে ‘শেরেকি’ বলে চিহ্নিত করেন। বলেন হিঁদুয়ানি চাল। এ জাতীয় কথা বহু যুগ ধরেই চলেছে, অদূরে থেমে যাবার ও কোন লক্ষ্মণ নেই। কিছু ব্রতের নাম উল্লেখ করছিঃ

১. সত্যপীরের ব্রত। ২. খোয়াজ খিজিরের ব্রত। ৩. দশবিবির ব্রত( শুধু নারীরা করেন)। ৪. সৈয়দা বিবির ব্রত( ঐ)। ৫. বারো ইমামের ব্রত। ৬. শবে মিরাজের ব্রত। ৭. ফাতেহা মিলাদের ব্রত। ৮. মাদারপীরের ব্রত। ৯. আসন পীরের ব্রত ( নারী কর্তৃক)। ১০. হাজির পীরের ব্রত ( ঐ)। ১১. কালু পীরের ব্রত (ঐ)। ১২. কানু পীরের ব্রত (ঐ)। ১৩. দাতা পীরের ব্রত। ১৪. বালাপীরের ব্রত। ১৫. জেন্দাপীরের ব্রত। ১৬. জাহির পীরের ব্রত। ১৭. বদর পীরের ব্রত। ১৮. মছলন্দি পীরের ব্রত। ১৯. পাঁচ পীরের ব্রত। ২০. সোনাপীরের ব্রত। ২১. মানিক পীরের ব্রত। ২২. রাহী বা মুসাফির পীরের ব্রত। ২৩. জিজিঁর পীরের ব্রত। ২৪. মুসকিল আসান পীরের ব্রত। ২৫. শাহ্ জংলী পীরের ব্রত। ২৬. বন বিবির ব্রত। ২৭. বাস্তুবিবির ব্রত। ২৮. ওলা/ শীতল বিবির ব্রত। ২৯. উদ্ধার বিবির ব্রত। ৩০. বুড়ো পীরের ব্রত। ৩১. ষষ্ঠী / ষেটেরা বিবির ব্রত ( নারীর)। ৩২. ঘাউয়া পীরের ব্রত। ৩৩. ইমাম ব্রত।

____________
(খণ্ডিত ও সংক্ষিপ্ত)
ইহলৌকিক সুখ শান্তি কামনায় মূর্তিপুজা বাদ রেখে বাঙালি মুসলিম জনগন ব্রত মানত পালন করেই থাকেন। তবে সবাই যে নয় এটা বলাই বাহুল্য।

শাশুড়ি সমাচার

শাশুড়ি সমাচার

ঠাম্মা- দিম্মারা ছড়া কাটতেনঃ
ঝি জব্দ কিলে / হলুদ জব্দ শিলে
মেয়েমানুষ জব্দ হয়/ শ্বশুরবাড়ি গেলে।

এ প্রবাদ আজ পরিত্যক্ত। থালায় বসিয়ে গৌরীদানও আর হয়না। শাশুড়ি ও কচি বউকে পই- পই পাখিপড়া করে সংসারের পাঠদান করার কোনো সুযোগ আর পাননা। বস্তুত অধুনা গায়ে- গতরে, বয়সে – শক্তিমত্তায়, বুদ্ধি – বিদ্যাবত্তায়, শক্ত – সমর্থ বৌমার আতঙ্কে (বোমাতঙ্কের থেকে কী তফাৎ) শাশুড়ি কুল আজ কোনঠাসা। ছড়ার তিন নম্বর লাইনের অন্তিম শব্দটি ‘করে’ শব্দটির সঙ্গে স্থানবদল করেছে। ফলতঃ শাশুড়িদের স্বর্ণযুগ ইতিহাসে চলে গেছে। সে যুগে হুট্ বলতেই গোঁসা হলে কাশীগমনের হুমকি দিয়ে বৌ- ব্যাটাকে ব্ল্যাকমেল করা চলতো। আর একটু বলবতী সধবা হলে তো কথাই নেই, – তখনো মুখচোরা বৌমাটিকে ‘দেখতে নারি, তোর চলন ব্যাঁকা’ বলে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে বশংবদ ছেলেটিকে আবারও ছাদনাতলা ঘুরিয়ে আনা ছিল জলভাত ব্যাপার।

অধুনা শাশুড়ি তিন প্রকারঃ
ক) ক্রিমিনাল
খ) মায়ের মতো
গ) ক এবং খ – এর মাঝামাঝি। যার কাছে যেমন তার কাছে তেমন। চলনসই মাখা-সন্দেশ, যেমন ছাঁচে ফেলতে চায় সংসার।

ক) ক্রিমিনালঃ – যাদের কাছে পানের থেকে চুন খসারও দরকার পড়ে না। নিজেদের লোভ আর স্বার্থসিদ্ধির জন্যে যারা অন্দরমহলে দেদার দেশলাই – কেরোসিন – এ্যাসিডের বোতল – বিষের শিশি হাতের কাছেই মজুত করে রাখে। ওইসব কষাই, ফাঁসুড়ে, জল্লাদ শাশুড়িদের সমাজ – সংসার – আইন কোনো কিচ্ছু নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। যে করেই হোক পথের কাঁটা উপড়ে ফেলতে, থেঁতলে যেতে এদের দুবার ভাবতে হয়না। এরা জন্মসূত্রে ক্রিমিনাল। পুলিশ ও প্রশাসনের সাবজেক্ট। আমার লেখা পড়ে ওদের কচু হবে। তাই ওরা আলোচনা থেকে বাদ।

খ) মায়ের মতোঃ বিরল প্রজাতির এই মহিলারা কস্মিনকালেও কক্ষনো কারো আলোচনার মশলা জোগান না। পারসেন্টেজেও আসেন না। তাই বাদ পড়লেন এঁরাও।

গ) চলনসইঃ মনোমত বউমা পেলে এঁরা সুখী হবেন। কপালগুণে উল্টোটা হলে নিত্যকার লোকহাসাহাসির ভয়ে, নিরাপত্তাহীনতার আতঙ্কে জীয়ন্তে মরে থাকবেন। এই চলনশীল শাশুড়ি গোষ্ঠীর মধ্যে সমীক্ষা চালিয়ে একটা গড়পড়তা ছবি আপনাদের কাছে তুলে ধরছি।

এঁদের পক্ষের সম্ভাব্য আশঙ্কাগুলি হলোঃ
১) পরের মেয়ে বেনোজল হয়ে ঢুকে পড়ে আমার ঘোরোজল পেটের ছেলেটিকে বার করে নিয়ে যাবে না তো?
২) সংসারে থেকেই যদি যায়, আমার পাতে অবহেলার ভিক্ষান্ন ছুঁড়ে দেবে না তো?
৩) এতকাল ধরে, এতো কষ্ট সয়ে যে সোনার সংসার গড়ে তুললাম তা ছারখার করে দেবে না তো?

এই প্রশ্নত্রয়ীর ক্রমানুযায়ী উত্তর দিয়েছেন শাশুড়িরাঃ
ক) পুরোপুরি গৃহবধূ সধবা শাশুড়িঃ ১) মেয়ের মতো ভালবাসবো, তাও যদি আলাদা হতে চায় হবে। মেনে নেবো। ২) নিজেদের অন্ন নিজেরাই দুটি ফুটিয়ে নোবো। আর,হে ঈশ্বর! আমি যেন কর্তার আগে চোখ বুজতে পারি। ৩) শিখিয়ে পড়িয়ে মানিয়ে গুনিয়ে নোবো। তবু যদি একান্তই না মানে, আলাদা হবে। সংসারে লক্ষীর আসনে ভূতনেত্য করতে দেবো না।

খ) একা হয়ে যাওয়া বিধবা শাশুড়িঃ
১) উত্তর নেই, নির্বাক। অনুমান করে নিলাম স্বগতোক্তি করছেন, “কাকে ছেঁটে ফেলতে আলাদা হবি, খোকা”? ২) মানুষের মৃত্যু কেন তার ইচ্ছাধীন নয়?
৩) আমার কপালে তো কিছুই হলোনা, ওরা যেভাবে পারে, যেমনভাবে ইচ্ছে, সুখের আশ্বাস জাগিয়ে তুলুক, এই পোড়াচোখে তো দেখে যেতে পারবো নিজের সন্তানের আনন্দ – দীপশিখা।

গ) স্বোপার্জিতা কর্মরতা শাশুড়ি ( সধবা, বিবাহ বিচ্ছিন্না বা বিধবা)
১) ছেলে -বউয়ের জীবন তাদের নিজস্ব, ব্যক্তিগত। ওদের যেভাবে, যেখানে থাকতে ভালো লাগবে, সেভাবেই সেখানেই থাকুক না। ২) এ সুযোগ দেবো না। ৩) ‘আমার সংসার’ ‘আমার সংসার’ বলে এতো মাতামাতির কিছু নেই। ওদের মতো করে ওরা যেটা করবে, তার নামও সংসারই। আদৌ সন্ন্যাস বা বানপ্রস্থ নয়।

সমস্ত উত্তর গুলোর একটাই ‘কী ‘ পয়েন্ট, – এ্যাডজাস্টমেন্টের সঠিক সুলুক সন্ধান জানা না থাকায়, কমবেশি প্রত্যেকের সুরেই অসহায়তা, নিরাপত্তাহীনতা। এসব ক্ষেত্রে চটজলদি রেডিমেড টিপস্ হয়না। তবু দেখুন নাঃ

১) সব পরিস্থিতিতে মোটামুটি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করুন। ২) প্রত্যাশার পারদ নিচে নামিয়ে রাখুন। ৩) ছোটোখাটো দোষ ত্রুটি ওভারলুক করুন, কিন্তু ইচ্ছাকৃত নীচতা- ক্ষুদ্রতা বুদ্ধিদীপ্ত ভাবে রুখে দিন। ৪) তরবারি দিয়ে দাড়ি চাঁচবেন না। হোক না সে আপনার একান্ত বাধ্য পুত্রটির পত্নী, তার যোগ্যতাকে যথাযথ সম্মান দিন। ৫) সর্বোপরি ভেবে নিন, এ যুগটাই এমন।
আহ্লাদীরা কেবলই ভালবাসা দখল করে নেয়। বিনিময়ের অঙ্ক ওদের হিসেব করতে শেখায়নি কেউ। ওই তো গান গেয়ে ছেড়ে দিয়েছে, “… দাদা অঙ্ক কী কঠিন…”

ছোট্ট একটা ঘটনা দিয়ে শেষ করবো। এটা আমার ছোটবেলা থেকে অদ্যাবধি প্রাণের প্রিয় বন্ধু ও সম্পর্কে মাসী অধ্যাপক ছায়া মুখার্জির বয়ানে শুনতে হবেঃ

“গ্রীষ্মের ছুটিতে বোনেরা সবাই ছেলেপুলে নিয়ে বাপের বাড়ি ( বাঁকুড়া জেলার সোনামুখি) জুটেছি। যার যার ঝাঁপি থেকে অনর্গল শাশুড়িকৃত্য বেরুচ্ছে। শুনশান্ ঘুঘু ডাকা গ্রীষ্মের লম্বা দুপুরের গল্প, ফুরোয় আর না। হঠাৎ সদর দরজার রাস্তার মুখ থেকে আমার পাঁচ বছরের বোনঝির চিল্ – চিৎকার। ভয়ে পড়ি কি মরি করে বাড়িসুদ্ধ লোক হাজির খাঁ খাঁ করা রোদে পোড়া রাস্তার ওপোর —-। একা একজন হতদরিদ্র পরিশ্রান্ত কালিঝুলি মাখা মাথার ওপোর বিরাটকার চুড়োয় বাঁধা রুক্ষ চুলের ভয় পেয়ে যাবার মতো চেহারার এক বয়স্কা আদিবাসী মহিলা ক্লান্ত পায়ে ধীরেধীরে পেরিয়ে যাচ্ছে পথ, —- তার দিকে আঙুল দেখিয়ে ভয়ার্ত বোনঝি বললো, “ওই দ্যাখো দ্যাখো, ওই যে একটা শাশুড়ি যাচ্ছে দ্যাখো, এক্ষুনি আমাকে শ্বশুরবাড়ি টেনে নিয়ে যাবে।”

পাঁচ বোনের হতবাক মুখের ওপোর জ্বলন্ত দৃষ্টির থাপ্পড় মেরে মা শুধু বলেছিলেন, “ছিঃ! ছেলেমেয়েদের সামনে গুরুজনদের এই ছবি এঁকে ধরতে তোমাদের লজ্জা করেনা? এই তোমাদের শিক্ষা!”

_____________
( ‘এবং প্রবন্ধ’ থেকে)

সঙ্গিনীর নাম নিঃসঙ্গতা

সঙ্গিনীর নাম নিঃসঙ্গতা।

তিন থেকে তিরানব্বই – যে কারোর কাছে অনায়াসে পৌঁছে যেতে পারে উক্ত সঙ্গিনীটি –অবহেলা, মনোযোগহীনতা, বা বিচ্ছিন্নতার রন্ধ্রপথ ধরে। হ্যাঁ, রন্ধ্রপথ পেতেই হবে। লৌহবাসরে কালনাগিনীর ওই একমাত্র প্রবেশপথ। খোলামেলা রোদ হাওয়ার হাট করা দরোজায় নিঃসঙ্গতা নামক সঙ্গিনীটি আদপে পা বাড়ায় না। ওর আগমন ও স্থিতি, নিবাস ও নিকেশি কার্যক্রমের জন্য এক ভয়াবহ অন্ধকার রন্ধ্রপথ জরুরি।

পছন্দের রন্ধ্র ধরে নিজের টার্গেটটি বাছার ক্ষেত্রে সে মোটামুটি থাবা বাড়ায়
ক) বাল্যেঃ
১. উচ্চাকাঙ্খী বাবা- মায়ের একমাত্র সন্তান
২. নিম্নমধ্যবিত্ত আটচালার বিপরীতে ‘পশ’ এলাকায় বাস
৩. যৌথান্নের হাঁড়ি ফুটিফাটা হয়ে গেছে কবেই
৪. রূপকথার বই পড়ার বয়েস এখনো হয়নি, অথবা হলেও বাড়িতে বইপড়া নামক বিলাসিতার রেওয়াজ নেই
৫. পরিবারের মনোনীত জন ছাড়া আর সবার সাথে মেলামেশা ও বন্ধু তৈরিতে নিষেধাজ্ঞা
৬. তিনকুলে চোদ্দপুরুষে লোলচর্ম বৃদ্ধ – বৃদ্ধা নেই, বা থাকলেও সুসজ্জিত ফ্ল্যাটে তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ
৭. নির্জীব খেলনা ও ইলেকট্রনিক যন্ত্রসঙ্গী
৮. অন্যান্য।

সঙ্গিনীটি পদার্পণেই শিকারটিকে বাড়াবাড়ি রকমের আত্মমগ্ন করে তুলবে, অন্যের উপস্থিতি তিক্ত লাগতে থাকবে। যে আদত দূরত্ব ছিলই বাবা -মার সঙ্গে তা ক্রমশ বাড়তে বাড়তে ভয়াল গহ্বরের চেহারা নেবে, ক্রমশ নিজের সঙ্গেও বিচ্ছিন্নতা বাড়তে বাড়তে মেলাঙ্কলিয়া রূপান্তরিত হবে ডেলিঙ্কোয়েন্সি তে। বিশেষ কিছু বুঝে উঠবার বয়েস আসবার আগেই তকমা পড়ে যাবে গায়ে- ‘প্রবলেম চাইল্ড’। নীট ফল—হয় পরনিগ্রহ, নয় আত্মনিগ্রহের সুনিশ্চিত পরিনমন।

খ) যৌবনেঃ
১. কাছের জনেরা যদি মুখ ফেরায়
২. যদি স্বেচ্ছাদূরত্ব রচনা করেন সাফল্যের হাতছানিতে (অস্বাভাবিক উচ্চাকাঙ্খা)
৩. যদি সাফল্য পেয়ে গেলে গজদন্তমিনারে বসবাস শুরু করে দ্যান
৪. নিজেকে অসাধারণ ভেবে নিয়ে কোনো দল বা সঙ্ঘের ছোঁয়াচ এড়িয়ে চলেন
৫. যদি বই পড়ার পাট না থাকে
৬. যদি নান্দনিক শিল্পকলা বা সমাজসেবামূলক কাজে যুক্ত না থাকেন
৭. প্রাণহীন যন্ত্রই যদি একমাত্র বন্ধু হয়
৮. যদি কোন সদর্থক নেশা না থাকে
৯. অন্যান্য।

প্রথমেই সঙ্গিনীটি ভিকটিমের সর্বায়বে রাশভারি মুখোশ এঁটে দেবে। আশপাশের নিকটজনদের এড়িয়ে শুধু নয়, দাপটে বশীভূত করতে চাইবেন। যতো তীব্র হবে সে প্রচেষ্টা, ততটাই দ্রুত বেগে নিকটজনেরা পাশ কাটিয়ে পালিয়ে বাঁচবে। যে দু- চার আত্মজনের পক্ষে পালিয়ে বাঁচা একান্তই অসম্ভব, অত্যাচারিত হবে তারা মানসে, মননে, এমনকি শারীরিক ভাবে হওয়াও অসম্ভব নয়। ফলতঃ হত্যা – আত্মহত্যা – জীবিতে মৃত্যুর দহন পোড়ন। মেলাঙ্কলিয়া টু এ্যলিয়েনেশন,ভায়া ডেলিঙ্কোয়েন্সী। সঙ্গিনী শুধুই ওই নিঃসঙ্গতা। সঙ্গিনী বললাম, কারণ পুরুষই সচরাচর এর বেশি প্রিয়, খুব সহজে খাপ খুলতে পারে না নারীর কাছে। নারী জন্মগতভাবে, স্বভাবগতভাবে অনেকটাই সাংসারিক ও সামাজিক।

এযাবৎ সংখ্যাগরিষ্টে সামান্যে ব্যাপৃতা, কাজেই উচ্চাকাঙ্খা, অসামান্য প্রত্যাশা এবং তার প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তিতে নিঃসঙ্গতা গ্রাস করতে পারে না তাকে চট করে। বেঁচে থাক আমাদের কাপড় কাচা ডিটারজেন্ট এবং বাসন মাজার ‘নিম্বুক্ষার কেক’, এর পিছু পিছু বউ- ঝিয়ের সঙ্গে মুখ চালাচালি, তেলের শিশি ভাঙ্গার কারনে শিশুর ওপোর তোড়- তড়পানি, হলুদ জব্দ করা কিল্ গত মৌতাতে রূপান্তরিত হয়ে আবহমান কালের এই গৃহস্থালি প্রক্রিয়া অমৃতের উৎস হয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে উচ্চাশা বিহীন, তুঙ্গ – লক্ষ্য বিবর্জিত কোটি কোটি মা- ঠাকুমা, মাসি-পিসিদের। অবশ্যই পাশাপাশি যুৎসই সঙ্গত দিয়ে গেছে ছেঁড়া – ফাটা- কাপড়ে গড়া নক্সিকাঁথার শিল্পকলা, রামায়ণ – মহাভারত – কোরান- পুরাণের নিয়মিত পঠন ও শ্রবণ, ছেলে ভোলানো ঘুমপাড়ানি ছড়া, আচার- আমসত্ত্ব, খই-মুড়কি, পিঠে – পায়েস, মোয়া- নাড়ুর সৃজনী শিল্প,সর্বোপরি নিজের চারপাশের প্রতিটি জনের সুখ -সুবিধে,আনন্দ – আহ্লাদের ব্যবস্থা করার ব্যস্ততায় নিজের সুখ কী জিনিস সেটাই বুঝতে না পারা এই নমস্য সাধারণীদের সঙ্গ নিঃসঙ্গতার এক্কেবারে না পসন্দ্।

গ) তার বাছা শিকার বার্ধক্যেঃ
১. অবসরপ্রাপ্ত পুরুষ — হঠাৎ করে যার দিন তিন চব্বিশ বাহাত্তর ঘন্টার হয়ে গেছে
২. স্ত্রী বিয়োগ অথবা চিরতরে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ায় প্রতিদিনের অভ্যস্ত জীবনযাপনে হঠাৎ করে অনেকটা ভ্যাকুয়াম তৈরি হয়ে যাওয়া
৩. শরীর মনের অশক্তি এতোকালের লালন করে আসা আসক্তির নাগাল না পাওয়া
৪. স্বাবলম্বী সন্তানের সংসার ছোট করে দেওয়া
৫. চাইলেও শিল্পচর্চা বা সমাজসেবামূলক কাজে শরীরের সহযোগিতা না পাওয়া
৬. অন্যান্য।

এই পর্বে হত্যা নেই, শুধুই আত্মহনন। এইসব কিছু একযোগে বা এককে, চতুষ্পার্শ্বে বিচ্ছিন্নতার ঘেরাটোপ রচে, যুগের এ্যাতো এ্যাতো বিলাস বৈভব, চুড়ো করা দেখানে সফলতার উচ্ছ্বাস, উঁচু উঁচু হাইটেকের যত্রতত্র বিজয় নির্ঘোষ, —- বুড়োঠোঁট অসহায়ে বিড়বিড় করে, …. নিঃসঙ্গতা নাম্নী সঙ্গিনীর হাত চেপে ধরে… ‘দেয়ারস্ এবসোলিউটলি নো হাইটেক টু ওভারকাম দিস ডিসট্যান্স’।

মোহময়ী শক্তিময়ী সঙ্গিনীর বগলদবা হয়ে কেউ নিরালম্বে ঝুলে পড়েন সিলিং থেকে, কেউ তার ঠান্ডা কোলে জান্ জুড়ান বিষ পেয়ালা মুখে তুলে, কেউবা আবার খ্যাতির দ্যুতি পিঠ- আড়াল করে স- ব ছেড়েছুড়ে এই অহংকারী সঙ্গিনীকে নিয়ে জলকেলিতে মগ্ন হ’ন গঙ্গার গহীনেঃ

সবাই চলে গেছে —
শুধু একটি মাধবী তুমি
এখনো তো তবু জেগে আছো—
কে- ন, কতো আর জেগে জেগে
দেখে যাবে আমার
চোখের জলের একাকার……

________________
( ‘এবং প্রবন্ধ’ বই থেকে)

অ- সুখ

অ- সুখ

রক্তে চিনি উচ্চগ্রাম।

মগডালের ক্যালরি বারণ,
তলাকার শেকড় বাকড় ও—

এমনও গিয়েছে দিন
রুখা শুখা ফুটাফাটা
বাড়ন্তের দিন প্রতিদিন

অতি মধুর সম্পর্কের
চিড়্- জোড়্ – ফাট্
বাড়তে বাড়তে শেষতক্

হাঁ-হাঁ- খোলা দরোজা সপাট্।

______________
(বন- বনেদ- বনসাই)

হা-বসন্তের দিন

হা-বসন্তের দিন

টবজোড়া ফুল ফোটালেও
বসন্ত ঘেঁষেনা এই
প্রাণহীন কংক্রিটের বনে—

বালি, ইঁট, ঘাসের আস্তরে
কন্টিকারী, আকন্দ, ধুতরো জঙ্গলে
কোনঠাসা বসন্তের চাপা হাহাক্কার …

তবুও পাটিগণিতেই জীবন টাটাবে!!

ওড়ো, পোড়ো, কি দোর্দণ্ডে ঘর ই জোড়ো
হিসেবে তিনের বেশি নয়।

_________________
বন- বনেদ- বনসাই থেকে

চাঁচড়

চাঁচড়

প্রোমোটারি দৌরাত্ম্যে
দখিনাদুয়ার ঝেঁপে সোকপিট স্থানসংকোচ
অথচ, অব্যয়ী সর্বনাশ
মাতমে মেতেছে চৈত্রে পলাশের শিমুলের বেশে
ধুন্ধুমার জ্বালা বুকে
গনগনিয়ে পুড়তে থাকি প্রতিদিন প্রতিটা প্রহর—-

অগত্যার উসকাঠিতে হা- বসন্তের দিনে- উপদিনে
অব্যর্থে আগুন দিই বর্ণচোরা সংস্কারের
আগল- বেড়াতে…

________________________
( বন- বনেদ- বনসাই কাব্যগ্রন্থ থেকে)

গরজ বালাই কবি- আবদুর রশীদ চৌধুরী

গরজ বালাই
কবি- আবদুর রশীদ চৌধুরী

—————————————
(১)
মাসির মা কে পিসির বড়ো প্রয়োজন —
বড়ো কাছছাড়া তারা,
সম্পর্কটা বেশ রগড়ের।
বোধহীন বোধি বেসামাল,
সামলাতে তো ওটারই দরকার ;
না পারলে তাপ্পি মারতে মারতে
বেশ কিছুটা শেষ করা চলে….

(২)

ময়নার একটা পিছন আছে।
এবং পিছনটাই আগাটা টানে—-
ওটা মানুষটার ভেতরের ছবি।
ওটার মাপ হওয়া দরকার,
এলাকায় যেতে হয় তাই,
ওই এলাকাই বলে দেবে
ওর ঠিকুজি, ওর চড়াই – উৎরাই,
ওর গভীরতা, ওর গহন,

ওর জীবনবৃত্তের মাপহীন
ঘনত্ব,….. উৎকর্ষতা।

********************************

আয়না

চাইনি দেখতে তোমার ছেঁড়াখোঁড়া শতচ্ছিন্ন মুখ,
মরমে শেকল আঁটা
মানসিক গভীর অসুখ,
ভেজা চোখ ঘন হলে
মেনেছি প্রগাঢ় হলো ভাব,
সুস্বাদিত ত্বকে ঝাঁপ —
— জেনেছি প্রেমিক স্বভাব—

যুদ্ধে মন নেই আমার।
চাইনি, খুঁজিনি তাই
সাবধানী লুকানো খঞ্জর।

ত্রিতাপ-ত্রিশূল আর ত্রিফলা-ত্রিপল
একই অঙ্কের পরিনত অদলবদল।

********************************

সঙ্গত

সঙ্গী হলেই যে সবসময়
সঙ্গতেই বাজতে হবে
এমনটা ভেবে নেওয়া সঙ্গত নয়।
সঙ্গীটির গাল টপকে সর্বদা সঙ্গীতই টপকাবে,
এমনটা ভেবে নেওয়াও যুক্তিযুক্ত নয়।

সময় আমাদের এ সবই শিখিয়েছে–
জানি,
তবু প্রজ্বলন্ত নিদাঘের ধুলোওড়া শুনশান প্রান্তরে
প্রাণভয়ে ছুটে আসা তাড়াখাওয়া
জীবের আদলে
বেবাক মর্যাদা ভুলে
যদি শুন্য হাত পেতে ফেলি
মনে মনে বন্ধু ভেবে নিয়ে—

খুবই কি বিরক্ত হবে তুমি?
নিজেরই সপাট খোলা সদরটা দেখে?

সাদা ক্যানভাস

যে যাকে ভালবাসে, সে- ই তার ভয়।
আছে, তবু নেই হয়ে কৃচ্ছতায় ভাসা,
পেতে রাখা ফাঁদে দেবে ইচ্ছাব্রতী – পা,
সন্ধ্যারতি খেয়ে যাবে আখড়া – আশ্রয়।

মৃত্যু নিশ্চিত্ জেনেও যুদ্ধ নেবে মাথা,
কারো কারো এমনই জন্মরোগ থাকে।
যত কেন ভেতর- বার ছতিচ্ছন্ন হোক
স্বকীয় স্বভাব তবু হাঁটে না অন্যথা।

ভুল পাহাড়ের কোলে ঝুলন্ত রূপ- কল্পকথা
এধারে- ওধারে সব লট্কে প’ড়ে কুচি কুচি সুখ,
খুঁটে নিতে নাজেহাল অন্যব্রতী রক্তমুখী প্রাণ,
মজুতে রং ও তুলি, র’য়ে যায় ক্যানভাস সাদা।

ঘন হ’য়ে প্রাণে বেঁধে মৃত্যুযোগ ও ঠেলি,
তবু তো সুজন তুই পরই র’য়ে গেলি।

বানিজ্যেতে যাবো

হয় তোমাকে চেয়ে আর নষ্ট সময় জুড়বো না,
নয় তোমাকেই বুকে বিঁধে নোবো আমরন।
এমনি ইচ্ছে হলো, আর উল্টো
পথ নিলে, কোন্ সংহিতা এঁকে গেছে
এ নিয়ম? কোথায় রেফারেন্স পেলে?

কী জটিল ধূপ- ধুম্রজালে শুন্যতায়
ভেসে আছে এ হৃদয় পোড়ানো সুগন্ধের
সারে সারে নাহ্য পন্থা ডিঙি সমুদয়।
পাল তো তোলাই আছে। বৈঠায় তোমারি
আঙ্গিকে এ- যে নক্সা কাটা কঠোরপ্রত্যয়!!

ভুল-শৃঙ্গার

একটা খুব শান্তিনিকেতনী গিফ্ট্ নিয়ে
এদান্তি বড়োই বেতালায় বেজেই চলেছি, -ক’দিন।
তালেবর স্মৃতিচারী বড়ো জব্দে নাজেহাল মন ও মনন।
ভুল তাই হয়ে যেতে পারে বেমালুম যখন ও
তখন।

এখন কোথায় যে পোক্ত বেড়া টেনে তুলে দিয়ে
সজীব জমিন্কে ইচ্ছালীন – স্ববশে রেখে দিতে হয়,
জায়গা বিশেষে তার চুলচেরা হিসেবের ভাগ
বুঝে নিতে বেমালুম ভুল হয়ে যেতে পারে ।

ভুল তো হতেই পারে, – ভুল হয়ে যায়,
সততই স্বতঃস্ফুর্ততায়।

আর ভুলেরও তো হিস্ট্রী – জোগ্রাফী থাকাই সম্ভবঃ
ধুল্ চেহ্ রে পে থা, পর আইনা সাফ্ করতা গয়া …

এতো চাপ্ – এতোখানি মনের উওাপ–
সহজেই ভুল করে দিতে পারে হিসেবের ভাগ।
কোথায় যে নীলপদ্ম চোখ চেয়ে ডাহুকের বিলে,
কোন্ চরে চিৎপাতে পড়ে আছে আবাগী – সংসার,
কোথায়ই বা দেবীদহে শ্মশান- উল্লাস ঘিরে তান্ডবের নাচ–
স-ব টুকু আগে থেকে জানা- চেনা থাকলেও
ভুল কিন্তু বেমালুম হয়ে যেতে পারে।
ভুলভাল হতে পারে বহু যতনের গাঁথা কবরীবিন্যাস,
ভুলভাল কেশগুছি, ভুল গ্রন্থি প্রয়োগ বিশেষে–
পুরুষী হাতের আনাড়ীপনায় ভুল তো হবেই হবে —
জায়গা বিশেষে ভুল করে যেতে থাকবে প্রেমিকের হাত।

তখন, ভুল সুরে উদ্ভাসিত পুরুষের সজীবন্ত
নাচার উচ্চারঃ
‘এসো সই, শালুক ফুলের বেড়ে বেঁধে দিই
বিনুনী তোমার’ …..

ভাঙ্গারাস

ঠিকই কথা বলেছো তো তুমি, পরিত্রাণকামী,
চাহিদায় ছিল আরো নির্নিমেঘ-চন্দ্রিলা রঙিলী,
শেষতক্ কোজাগরি নিশিক্রিয়া রম্যতার বলি-
এই বিরাশি-সিক্কাটিকে কীভাবে হজম করি আমি!

জল-স্থল-অন্তরীক্ষে প্রাণহাতে আমি কি যাইনি?
কখনো বুঝিনি কেন ‘প্রত্যাখ্যান’ শব্দটির মানে?
স্তরীভূত আবেগের দৃশ্যরূপ ফুল- পাখি- গানে
অন্ধ হয়ে যাওয়া মেয়ে শেষটুকু ধরতে পারেনি।

খুঁজেছি আতান্তরে ভালবেসে যা- যা খোঁজা চলে,
সাক্ষী ছিল নিশিরাত, সাক্ষী ছিল প্রভাতী সম্ভাষ,
পরশমণির খোঁজে য-ত-দূ-র সুখ-সহবাস,
ছিল নাতো অন্যমন, দৃষ্টিপাতে ‘কু’ ছিলনা বলে।

ওদিকের ক্রীজ্ ছিল তোমারই হাভালে, বোঝোনি?
আমি যদি না বুঝেছি তুমিওতো বোঝাতে পারোনি।

ধারাপাত

কটাচোখ আলোটাও ধূমভিজে ঘোলা—-
সত্যি গো,আলোটাও বেমালুম
ভিজে ঢোল।

এই -বা কেমন ধারার ছোঁচা ধারাপাত!!!
না- ই যদি চোখ খোলে কুঁড়ির পাপড়ি একটাও
ভেঙে যাক সশব্দে কথাদের তুমুল দালান…..

চুর্ হোক নিক্তি মাপা যুৎ করা
ঢিমে কর্তাল্।

রঙ্- ঢং-এবং….

হলো কি, ময়ুর- ময়ুরী জোড়ে
বর্ষাবনে বেড়াতে এসেছে।

মেঘে মেঘে ভিড়াক্কার,
অন্ধকারে হানাবাড়ি খর- বনতল,

এ্যাতো মেঘ- এ্যাতোটাই কাজলী আকাশ
তবু কোনো সুরে নেই, ছন্দে নেই,
নাচে নেই ঘন মনোযোগ,
কুলভাঙ্গা ভুল স্রোতের
অগত্যার বাধ্যবাধকতায়
দু- পক্ষই শশব্যস্তে
সশঙ্ক পালক ঝরায়।