রত্না রশীদ ব্যানার্জী এর সকল পোস্ট

চকবন্দি চরাচর (৫)(উপন্যাসের অংশ)

কোরানের অচেনা শব্দপুঞ্জের ওপোর হাত বুলোতে বুলোতে কৃষ্ণা ইমোশনালি পৌঁছে গেল সেই ট্রানজিশনাল সময়ের বাগদাদ শহরে। একটার পর একটা গুপ্ত হত্যায় প্রাণ হারাচ্ছেন ইসলামের খলিফারা। উমাইয়া শাসকদের পঙ্কিল রাজনীতি এবং বসরা ও কুফার জনগনের অস্থির মেজাজ উত্যক্ত করে তুললো আল্ মনসুরকে। নিরাপত্তার কারণে তিনি অন্যত্র রাজধানী স্থাপনে উদগ্রীব হয়ে উঠলেন। তাইগ্রীস নদীরতীরে ১৪৫ হিজরি অর্থাৎ ৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত হল নতুন মহানগরী –‘বাগদাদ ‘ — নদীপথে বসরা হতে যার দূরত্ব ছিল কমপক্ষে ছ’ দিনের পথ। বাগদাদের উপাধি হল – শান্তির নগরী– বা ‘ দারুস্ সালাম ‘। রাজ- জ্যোতিষী নওবখত্ – এর একটি ভবিষ্যৎবানী থেকে গৃহীত। তিনি ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন যে, এই শহরের সীমানার মধ্যে কোনওদিন কোন খলিফাকে হত্যা করতে কেউ পারবেনা। এবং সত্যি সত্যি তাই ই ঘটেছিল। ভবিষ্যতের ইতিহাস বাধ্য হয়েছিল ওই ভবিষ্যৎবাণী মান্য করে চলতে। সাঁইত্রিশজন খলিফার মধ্যে একজনও এই বাগদাদ নগরীতে মারা যাননি। তবে বহু পবিত্র আত্মার সমাধি রয়েছে এখানে। সে কারনে বাগদাদের আরও একটি উপাধিপ্রাপ্তি ঘটলো, — “পবিত্র আত্মাদের দূর্গ”। এখানে চির শান্তিতে শুয়ে আছেন ইমাম মুসা আল কজিম, আবু হানিফা, ওলি ও সুফি সম্রাট আবদুল কাদির জিলানি। এবং আরো বহু মহৎ আত্মার অধিকারীগন।

স্বর্নাক্ষরে লেখা কোরানটির স্বর্নলিপির ওপোর হাত বুলোতে বুলোতে কৃষ্ণার মনোজগতে এক আলোড়ন খেলে গেল, ——প্রত্যেক জাতির এক একটা স্বর্নযুগ থাকে। এথেন্সের পেরিক্লিয়াস যুগ, রোমের অগাস্টান যুগের মতো বাগদাদে আল্ মনসুরের হাত ধরে শুরু হয়ে গেল মুসলিম জাহানের গৌরবময় যুগ। এখানে প্রতিষ্ঠিত থাকা অসংখ্য একাডেমী, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দুটি তাদের ঐশ্বর্য, ছাত্রসংখ্যায় ও গুনবত্তায় স- ব প্রতিষ্ঠানকে অতিক্রম করলো। নিজামিয়া কলেজ ও মুস্তানসারিয়া কলেজ। খলিফা মনসুরের আদেশে বিদেশি ভাষার সাহিত্য, বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত-এর অতি মূল্যবান গ্রন্থসমূহ আরবি ভাষায় অনূদিত হল। স্বয়ং খলিফা নিজেই ছিলেন অত্যন্ত উঁচুদরের পন্ডিত ও গাণিতিক। নিজেই আরবি ভাষায় অনুবাদ করলেন বহু প্রাচীন গ্রিক, পারসিক, বাইজানটাইন ও সিরীয় গ্রন্থাবলি। অনুবাদ করলেন অ্যারিস্টটলের কয়েকটি গ্রন্থ, ক্লডিয়াস টলেমির ‘দি আল্ ম্যাজেস্ট্’ ও ইউক্লিডের গ্রন্থসমূহ। আরো অনুবাদ করলেন জ্যোতির্বিদ্যার ওপর ভারতীয় গ্রন্থ ‘সিদ্ধান্ত’। অনুদিত হল ‘ভারতীয় উপকথা ‘
(হিতোপদেশ)।

আল্ মনসুর ও তাঁর সার্থক উত্তরাধিকারীরা যে শুধু বিভিন্ন দেশ থেকে আমন্ত্রণ করে আনা বিদ্বান ও জ্ঞানীদের অনুরাগী পৃষ্টপোষকই ছিলেন তা নয়, তাঁরা নিজেরাও অত্যন্ত যত্ন ও পরিশ্রম সহকারে জ্ঞানের প্রতিটি শাখার সশ্রদ্ধ অনুশীলন করতেন। শক্তি – সম্পদ- জ্ঞান —– একত্রিত হলে যা হয়, প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল ইসলামের স্বর্নযুগ।

…. সাংঘাতিক জোরে জোরে দরজায় কেউ ধাক্কা দিচ্ছে। দিন দুপুর না হলে চোর- ডাকাত ভেবে নেওয়া যেত স্বচ্ছন্দে। কৃষ্ণা কোরানটা যত্ন করে মুড়ে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে নিজের স্যুটকেশে রেখে দিল। তারপর ধীরে সুস্থে উঠে তবেই দরজার খিল খুললো।

(আর কিছুটা)

চকবন্দি চরাচর (৪)

গোরুরগাড়িটা বাড়ির সামনে এসে থামতেই,নামতে গেল কৃষ্ণা। ওকে অবাক করে, তক্ষুনি এক গিন্নীবান্নি মহিলা পাঁজা কোলে করে তুলে নিয়ে এসে একটা মাঝারি ঘরের খাটের ওপোরে বসিয়ে দিলেন। অমনি চতুর্দিক থেকে ছ’ মাস থেকে ছিয়াত্তর বছরের বিচিত্র সব মেয়েরা ঘন হয়ে ছেঁকে ধরলো ওকে। ভীষনই অস্বস্তিতে পড়ল কৃষ্ণা। কেউ ঘর ঝাঁট দিতে দিতে, কেউ গোয়াল পরিষ্কার করতে করতে, কেউ মাছ বাছতে বাছতে, কেউ ছেলেকে বুকের দুধ দিতে দিতে,—- যে যেমন ছিল সেই অবস্থাতেই ছুটে এসেছে নতুন বউ দেখতে। যতো না নতুন বউ দেখতে,তার হাজার গুন বেশি কৌতুহল হেঁদুর মেয়ে দেখার। বলা তো যায়না, হাত- পা- নাক- কান- মাথা কোন্ না দু- চারটে বেশি তো থাকতেই পারে। হেঁদুর বিটি এ্যাতো কাছ থেকে দেখার সুযোগ কি চট্ করে আসে!

ওদের গায়ের পায়ের ধুলোতে ঘর- বিছানা ভরে গেছে। কোন বাচ্চা কৃষ্ণার কোলে গড়িয়ে পড়ছে,কেউ কৃষ্ণার শাড়ি টেনে টেনে দেখছে,কেউ মনোমতো জায়গা দখল করতে না পেরে পরস্পর ধাক্কাধাক্কি করছে। তাদের গায়ের ঘাম, কাদা, নাকের শিকনি লেগে যাচ্ছে কৃষ্ণার গায়ে, শাড়িতে। তাদের মায়েদের অনর্গল বকবকানিতে অজস্র থুতু ছড়িয়ে পড়ছে চারিধারে। কাজ করুনীদের হাতের মাছের, গোবরের ক্ষারের গন্ধ, মুখের – বগলের দুঃসহ দুর্গন্ধ টিকতে দিচ্ছিল না কৃষ্ণাকে। মনে হচ্ছিল এক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে যাবে। ভয়ে, কষ্টে চোখ বুজে ফেলেছিল কৃষ্ণা। কিছু পর এক মাঝবয়সী মহিলা এসেই তাড়া দিয়ে বার করতে থাকলো সব্বাইকে :
— এই, যা সব এখন। পরে আবার আসবি।

–কেনে? বউকে আমাদের দেখতে দেবেনি?
— এতক্ষণ ধরে তো দেখলে, এবার ওকে একটু জিরেন দাও।
–পালঙ্এর উবরি বসে তো জিরেনই খেচে..
এবার একটু রাগত স্বরে : — বলছি না তোমাদের ঘর খালি করে দিতে…

কেউ কর্নপাত করলো না দেখে মহিলা তখন বাধ্য হয়েই কৃষ্ণাকেই হাত ধরে তুলে অন্য ঘরের দিকে নিয়ে যেতে লাগলেন, অমনি পিছু পিছু ধাবমান ছেলে- কাঁখে- কোলে পিলপিল করে মহিলাকুল। তখন আশমানি কৃষ্ণার হাত ধরে নতুন ঘরটায় ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিতে চাইলো, কিন্তু বাইরে থেকে হাত দিয়ে দরজা টিপে আটকে আছে কয়েকজন। বাধ্য হয়ে গলা তুললো আশমানি : — এ্যই, কপাট ছাড় বলছি,ছাড়। নইলে এই আমি কপাট দিলাম। কারুর হাত কাটুক,কি পা কাটুক, কি রক্তগঙ্গা বয়ে যাক আমি কিন্তু দায় নোব না।

বলে, যেই না আশমানি সপাটে দরোজা বন্ধ করেছে,বাইরে থেকে ভেসে এল জনতার গর্জন, —- গঙ্গা বওয়াবে না তো, আর কীই বা বওয়াবে তুমরা! হেঁদুর মেয়ে ঘরে তুলিছো এখুন গঙ্গাপানি লাগবেনে?

কৃষ্ণা অবাক হয়ে গেল শুনে। সেই তখন থেকে এতো এতো কথা হলো,আর লুফে নিল কিনা ওই একটি মাত্র শব্দ – ‘ গঙ্গা ‘?
তাও আবার ‘রক্ত ‘ অর্ধেক বাদ দিয়ে!! ও বুঝতে পারলোনা, হাসবে না কাঁদবে।

তখনো শোনা যাচ্ছে জনতার তর্জন, — তুমাদের ভাগিনবৌ বাপু খুব গিদিরি। আমাদিকে হাতে ধরে বার করি দিল। হেঁদুর বিটি, তাতিই দেখতে এলুম…..নালে, এই মরোম মাসে কেউ লোতুন বউ-র মুখ দ্যাহে!

ভীড় পাতলা হ তে হতে কৃষ্ণাকে ড্রেস চেঞ্জ করিয়ে সাজিয়ে গুজিয়ে ফ্রেস করে নিল আশমানী। কৃষ্ণার সম্পর্কিত জা। তারপর একে একে বাড়ির গিন্নিবান্নিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল,– এঁরা তোমার শাশুড়ি মা, আমারও।

চাচি শাশুড়ি, মামীশাশুড়ী, নানিশাশুড়িদের এক এক করে প্রনাম করার পর, নিজের শাশুড়িকে প্রনাম করতেই অন্যান্যদের মতো তিনিও ওর কপালে চুমু খেয়ে আশীর্বাদ করলেন। বললেন,—- মরোম মাস তো মা। তাতিই এখুন তুমাকে মুখ – দেখানি সুমসারের কিচু দিয়া গেলনি। এই বড়োচিজ্ খানি বুকে করি ধরি রেখো, মা। এঁর থিকেই মান- সম্মান – ইজ্জত – ইমান সব মিলবে। পারো তো দিনে দু-এক রুকু করি তেলাওয়াত্ করবা। সব দুঃখু দূর হয়ি যাবে। স্বামী – পুত্তুর নিয়ি দুধে- ভাতে থাকবে, মা।

বিশেষ কটা শব্দ থেকেই কৃষ্ণা বুঝে গেছে যে, শাশুড়িমা তাকে একটি কোরানশরিফ উপহার দিলেন। ঘরে যারা ছিলেন তাঁরাও যোগ করলেন,– এমুন দামীকি বড়ো চিজ্ ই দুনিয়ায় দুর্লভ, মা। যতন করি বুকে করি ধরি রেখি দিবা চেরডা দিন। তুমার যেকন ব্যাটার বউ আইসবে, কেবল তারি হাতে তুলি দেবা। তা ভেন্ন আর কারুরে এ চিজ্ কক্ষুনো দেবা না— মনে রাখবে কিন্তুক।

এ পর্ব শেয হলে, আশমানি কৃষ্ণার বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে লাগলো, — নাও, এবার একটু জিরিয়ে নাও দিকি। দরজাটা ভেতর থেকে লাগিয়ে নাও তো। আর হ্যাঁ, যত্ন করে তুলে রাখো কোরানটা। পুরোটা সোনার জলে লেখা। কোটি টাকা দিলেও আর পাওয়া যাবেনা কোথাও। এটা এদের পারিবারিক সম্পদ। আমার শোনা কথা যদি সত্যি হয়,সৈয়দ বংশের, খোদ বড়পির সাহেবের আমলে বাগদাদে হাতে লেখা এই সোনার কোরানটি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ। যত্ন করে তুলে রাখো।

যথার্থ হাঁ হয়ে গেল কৃষ্ণা আশমানির কথা শুনে। উড়ে গেল তার উন্মনা ভাব।দরজা বন্ধ করে কোরানটা কোলে নিয়ে নিবিষ্ট ভাবে বসে পড়লো সে। সে হরফ চেনে না। ভাষা বোঝেনা। কিন্তু প্রতিটি শব্দের ওপোর দিয়ে পরম মমতায় হাত বোলাতে বোলাতে সময়ের উজান বেয়ে সে ক্রমশ গিয়ে পড়তে থাকলো প্রাচীন সেই বাগদাদ শহরে.. সেই যে– সেই ট্রানজিশনাল সময়ে– একটার পর একটা গুপ্ত হত্যায় প্রান হারাচ্ছেন ইসলামের খলিফারা– উমাইয়া শাসকদের পঙ্কিল রাজনীতি এবং বসরা ও কুফার জনগনের অনিশ্চিত ও লঘুচিত্ত মেজাজ— উত্যক্ত করে তুললো আল্ মনসুরকে।

(ক্রমশ)

চকবন্দি চরাচর (৩)

দলে দলে গায়ে পড়া উপদেশদাতাদের অত্যাচারে, বাড়ির মানুষজন নিজেরা কোন আলাপ- আলোচনার সুযোগ পাচ্ছেনা। অথচ তা না হলে কার্যকরী কোন পদক্ষেপ নেওয়াও সম্ভব নয়।

আজ অসীমেশকে ছুটি নিতে বলা হয়েছিল। দুপুরে যে যেমন পারলো দুটি মুখে গুঁজে,বাইরের গেটে তালা দিয়ে আলোচনায় বসলো।

শুরু করলেন অসীমেশের দিদি। মায়ের মতো।শৈশবে মাতৃহারা অসীমেশ দিদির কাছেই মানুষ।
— আমি বলি কি অসীম, তুই কৃষ্ণাকে ঘরে তোল।

অসীমেশ মাথা নামিয়ে চুপ করে থাকেন।– উত্তর দেননা কোন। সেজদা বললেন,
— সে তো নিতেই হবে। কিন্তু কিভাবে কাজটা সুষ্ঠুভাবে করা যাবে, সেটা নিয়ে বরং ভাবো।

দিদি : ওদের দুজনকে ডেকে এনে আবার নতুন করে নারায়ন সাক্ষী রেখে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হোক।

সেজবৌদি : ঠিক এই কথাটাই আমি আগে রমাকে বলেছিলাম। বলেছিলাম আমার ওখানে, মানে চিত্তরঞ্জন থেকে ওদের বিয়ে দিয়ে দিতে, দায়িত্ব স-ব আমার। তো, রমা তো…

তাঁকে থামালেন সেজকর্তা :
–পুরনো কথা বাদ দাও তো। এখন আশু কর্তব্য স্থির করতে হবে। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে বড়।

অসীমেশ : নাহ্। এই স্টেজে এসে আর ওসব নারায়ন সাক্ষী – টাক্ষীর তামাশা করা যাবেনা।

দিদি : তামাশা বলছিস কেন? কিছু এমন দেরি হয়ে যায়নি। শুনতে পাচ্ছি তো এখনো ঘর ভাড়া পায়নি, সংসার পাতা হয়নি, তার আগেই যদি পারা যায়…..

অসীমেশ : তামাশা না করতে পারার আরো হাজারটা কারন আছে…..

দিদি : তুই জাতধর্মের কথা বলছিস তো! তো তাতে খুব কিছু আসে যায় না।অসবর্ণ বিয়ের বিধানও হিন্দুশাস্ত্রে রয়েছে……

অসীমেশ : বর্ণ কোথায়? বলো অসধর্ম….

দিদি : খুঁজলে তারও বিধেন পাওয়া যাবে। একটা ঘটনা ঘটবে মানুষের জীবনে, আর সেই সঙ্কটের সমাধান পাওয়া যাবে না শাস্ত্রে, তা কখনো হয়? তুই বরং কিছু শাস্ত্রীয় পন্ডিত- টন্ডিতের সঙ্গে…..

অসীমেশ : কোন্ শাস্ত্র? হিন্দু, না মুসলিম??

চুপ করে গেল সবাই। একপাশে রমা চোখে আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদেই চলেছে নিঃশব্দে। গিরিবালা তাঁর হরিনামের ঝুলির ভেতর হাত ঢুকিয়ে জপমালা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাম জপ করে চলেছেন। তাও নিঃশব্দে। মেয়েটার কীর্তিতে এই দুই মা-মেয়ের মুখের বুলি হ’রে গেছে এক্কেবারে। আপন- পর সবার চোখেই যেন একই কথা : “যেমন গাছ, তেমনি তো ফল হবে”।

সেজদা : আমাদের বাড়ির কাজ যখন, তখন হিন্দুশাস্ত্র অনুসারেই হবে।

অসীমেশ : কিন্তু কাজটা যাদের নিয়ে, তাদের একজন তো হিন্দু নয়। তাকে কি ভাবে হিন্দুশাস্ত্রের আওতায় আনা যাবে?

আবারও সবাই চুপ হয়ে গেল। ডাইনে- বাঁয়ে মাথা নাড়তে লাগলো অসীমেশ,… সমাধান সত্যি কিন্তু সহজ নয়। ভেবে দেখো তোমরা, কিভাবে সেই পরের ছেলেটাকে বলা যাবে, তোমার বাপ নেই, মা নেই, আত্মীয় – পরিজন – সমাজ- বন্ধু বলেও কেউ কোত্থাও নেই, আমার কন্যারত্নটিকে গ্রহন করার জন্য তুমি বাপু হিন্দু বনে যাও।…

কারুর মুখে কোন কথা নেই। অসীমেশই নাগাড়ে বলে যাচ্ছেন বুক হালকা করে,–
— এটা পিতৃতান্ত্রিক সমাজ। এখানে এখনো স্বামীর জাত-ধর্ম- কুল -পদবি সব স্ত্রীকে গ্রহন করতে হয়। কোন্ মুখে আমি ওর কাছে উলটোপুরাণ গাইবো? সমস্যাটা আমাদের, আর বলির পাঁঠা বানানো হবে ওকে? ধর্মের নামে এমন অধর্মে আমি নেই।….

কে -কি -কথা বা বলে! সব যেন জন্মবোবা সেজে বসে আছে।

….. তাহলে তোমরা সব গুরুজনেরা বরং আমায় অনুমতি দাও, আমিই সপরিবারে খ্রিষ্টান ধর্ম নিই। তখন বরং আমি বলতে পারার জায়গায় যেতে পারি যে, দ্যাখোবাবা-
তোমার জন্য আমরা খ্রিস্টান হয়েছি, এখন তুমিও খ্রিষ্টান হলে যথাবিহিতভাবে তোমাকে জামাই করে নিতে পারি।….

অসীমেশের শেষ বাক্যে আর চুপ থাকতে পারলো না তার সমবয়সী ভাগ্নে রঞ্জন,…….
..তুলে রাখো মামু তোমার ওসব বিপজ্জনক পরিকল্পনা। যাও বা বোনটার আমার স্বামী নিয়ে সুখী হবার সম্ভাবনা রয়েছে, ভেস্তে যাবে পুরো ব্যাপারটাই। না পাবে শ্বশুরবাড়ীর আশ্রয়, আর বাপের বাড়ির তো এই চিত্র।..

সবার সপ্রশ্ন চাউনির জবাবে রঞ্জন আরো খোলসা করলো বিষয়টা,…. তোমাদের তো কুয়োর বাইরে উঁকি মারারও দরকার পড়েনা, মেশোনি তো কখনো মুসলমান সমাজে। তাই বৃত্তের মধ্যে একজন মুসলমান পা রেখেছে কি ঘরগুষ্টি মিলে এমন ভাব দেখাচ্ছ যেন কীর্তনের আসরে আস্ত একটা ষাঁড় ঢুকে পড়েছে। ….ওরা কী বলে জানো? হিন্দুদের বাড়িতে খানাপিনায় আমাদের কোন বাধা নেই। কিন্তু খৃষ্টান বাড়ির খাদ্য আমাদের ধর্মনাশ করে দেয়। ওরা হারাম খায়– শুয়োর। এখন খৃষ্টান হলে তুমি তো দূরত্ব আরোই বাড়িয়ে দেবে গো!… তারচে বরং ধর্মটা ধর্মের জায়গায় থাক, ওটা সরিয়ে রেখে আমাদের মেয়ে – জামাইকে আমরা ঘরে তুলে নেবো। এনে সমস্ত আত্মীয় স্বজনকে ডেকে এনে স্রেফ একটা সত্যনারায়ণ।

এতক্ষনে, এই এতো এতো দিনের মৌনী ভেঙ্গে রমা বললো, — কিন্তু ওই পুজোর ব্যাপারে যদি ওদের আপত্তি থাকে?

….. নাগো মামী, না। আমাদের সত্যনারায়ণ আর ওদের সত্যপির, হলো গে টাকার এপিঠ -ওপিঠ। কথায় আছে, “হিন্দুর দেবতা হৈল মুসলমানের পির, দুই কুলে সেবা লয় হইয়া জাহির।”

তাঁর যে একহাতে কোরাণ, অন্যহাতে পুরাণ।

অসীমেশ : তোরা সেই ঘুরে ফিরে সত্যনারায়নেই এসে থামলি? গন্ডীর বাইরে বেরোনো খুব শক্ত, বল??

রঞ্জন: আাচ্ছা বেশ। ওদের নিয়ে তো আসি। তারপর দুপক্ষের আত্মীয়স্বজন নিয়ে না হয় একটা ওয়েডিং পার্টিই হবে’ খন। এবার তোমরা আর মুখ গোমড়া করে থেকোনা।

(আসবে আরো)
——————–

চকবন্দি চরাচর ( কিছুটা ) (২)

লাগাতার শুভানুধ্যায়ীর ভিড়। সকালের ব্যাচ বিদেয় না হতেই ঘাড়ের ওপোর উপুড় হচ্ছে দুপুর – বিকেল-রাতের জীবন্ত জ্ঞানভাণ্ডারসমূহ। ক্রমে ক্রমে ভূমিকা- টুমিকার ভদ্রতার বালাই ছিঁড়ে- খুঁড়ে- ফর্দাফাঁই হয়ে উড়ে গেছে ক- বে।এখন সরাসরি জবরদস্ত্ ঝাঁপ প্রসঙ্গেতেই :

— এভাবে কেঁদে কেটে বুক ভাসিয়ে সমস্যার সমাধান হয় নাকি!!

রমা : ভগবান কান্নার শাস্তি দিয়েছেন, তাই ভোগ করছি।

— মেয়েটাকে তো ঘরে ফেরাতে হবে।
নির্মোহে উচ্চারণ করেশুভাকাঙ্খীরা। আর ওই ছোট্ট ‘মেয়ে’ শব্দটিই বজ্রপাত ঘটিয়ে দেয় রমার বুকের ভেতর। কাঁদতে কাঁদতে হিক্কা উঠে যায় রমার। — কী? কী বলতে চাও তোমরা? মারবে? কাটবে? পুলিশে ধরিয়ে দেবে?

আত্মীয়স্বজনদের মতিগতি আতঙ্কে কণ্টকিত করে রমাকে। ভেতরে ভেতরে কাঁপতে থাকে সর্বক্ষণ। এই যদি ঘনিষ্ঠদের মনোভাব হয়, শত্রুরা তাহলে কি ভাবছে!! রাতের ঘুম উঠে গেছে রমার। আলগা তন্দ্রা তো আরো বিভীষিকা। চোখ বুজলেই দেখতে পায় জামাইয়ের রক্তাক্ত শরীর, আর মেয়ের বৈধব্যের বেশ। লাগাতার বারোদিন না খেয়ে, না ঘুমিয়ে নিরন্তর আত্মীয়স্বজনদের বিষবাণ হজম করতে করতে রমার শরীরে প্রেশার, সুগার দুই-ই আস্তানা গেড়ে বসেছে। যত দিন যাচ্ছে, ততই অসহ্য লাগছে চেনা-পরিচিত- আত্মীয়স্বজনদের মুখ।

তবু চেষ্টায় ক্ষ্যমা নেই,—আমরা ধর্ম মহাসভার মাথাদের সঙ্গে কথা বলেছি। একটা কিছু সমাধান ওঁরা বার করে দেবেনই। তোমাদের সম্মত হতে হবে। কালা- বোবা রমার বদলে ওর সেজো ভাসুর কথা বললেন।– বলুন, কি সম্মতি চান আপনারা, শুনি।

— এই ধরুন প্রথমেই একটা প্রায়শ্চিত্তির।

— দাঁড়ান, দাঁড়ান। প্রায়শ্চিত্তটা প্রথমেই কিভাবে হবে? মেয়েটাকে তো আগে ফিরিয়ে আনতে হবে। তবে তো তাকে দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করানো যেতে পারে।

— তা, তা কন্যার অভাবে পিতা প্রায়শ্চিত্ত করলেও চলে।

আমার ভাই কি অন্যায় করেছে, যে ওকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে?

সে আমরা কাশী পর্যন্ত লোক পাঠিয়ে দিয়েছি। তো ওঁরা বিধেন দিয়েছেন, উচিত মূল্য ধরে দিলে যজমানের হয়ে ওঁরাই কাজটা করে দেবেন।

উচিত মূল্য কতটি?

— সে ধরুন গিয়ে, ( খানিক মনেমনে বিড়বিড় করে) ধরুন, সব খরচ খরচা মিলেমিশে এই হাজার সত্তরে কুলিয়ে যাবে।

—বলেন কি!! স- ত্ত- র হাজার!”

—এটা কোন চমকাবার কথা হলো! বাঁড়ুজ্জে মশায়ের মেয়ের বিয়ে দিতে কোন্ না লাখ দুয়েক টাকা গলে যেতো। আর সত্তর হাজার আপনাদের বেশি মনে হচ্ছে?

—বেশ। দেখি ভাইকে বলে…..

একটু পরে দুভাই ফিরে এলেন। স্বামীকে এই আলোচনায় আসতে দেখে রমা অবাক। এতদিনের মধ্যে এই প্রথম।

— দেখুন, আপনাদের কথাগুলো ভাইকে বলেছি। এখন ওর কতক ছোটখাটো প্রশ্ন আছে..

— বলুন।

— প্রায়শ্চিত্ত না করে শুধু যজ্ঞ দিয়ে কাজটা সারতে পারবেন না?

— তাই কখনো সম্ভব? প্রায়শ্চিত্ত — ধর্মান্তরকরন– এগুলো সেরে না নিলে মেয়ে – জামাইকে ঘরে তুলবেন কি করে?

— প্রায়শ্চিত্ত কে করবে?

— ওসব আলোচনা আপনার দাদার সঙ্গে হয়ে গেছে…

–তবে? ধর্মান্তরকরনটা কি করতেই হবে?

— ওদের জাতে তুলতে গেলে তো করতেই হবে

— কাকে?

—আপনার মেয়ে- জামাই দুজনকেই।

— মেয়েটা নাহয় আমার, আবার জাতে উঠে এলো। কিন্তু জামাই রাজি হবে কেন?

— আপনার মেয়েকে ভালবাসে, তাই রাজি হবে।

— ওর বাবা- মা নেই? সমাজ- সংসার নেই? ও কি বানের জলে ভেসে এসেছে?

— তার আমি কি জানি? আপনাদের ভাল চাই, তাই…

— ভালই যদি চান,তবে যে প্রক্রিয়ায় আমার মেয়ের বদলে আমি, আমার বদলে অর্থমূল্য নিয়ে আপনি প্রায়শ্চিত্ত করছেন, ওই একই পদ্ধতিতে আমার মেয়ে – জামাইয়ের বদলে আপনি আপনার এক সাগরেদকে নিয়ে ধর্মান্তরিত হোন। মূল্য ধরে দেবে আমার দাদা। আর হ্যাঁ, ওইসব ভুজুংভাজুং যজ্ঞ-ফজ্ঞ আমার বাড়িতে হবেনা। আপনি কোথায় করবেন সেটা নিজে ঠিক করে নিন। খবর দিলে বাড়ি থেকে কেউ একজন যাবে। পেমেন্ট তার হাতেই পেয়ে যাবেন।

গালে বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় খেয়ে মাথা হেঁট করে তখনকার মত গেট পেরিয়ে বেরিয়ে গেল বটে, কিন্তু পরদিন থেকেই ধর্মমহাসভার লোকজনদের প্রকাশ্য তৎপরতা একশো গুন বেড়ে গেল।পাড়ায় পাড়ায় এখানে সেখানে জটলা হতে লাগলো। কারা যেন রাতের অন্ধকারে গেটের বাইরে পোস্টার দিয়ে গেছে, অসীমেশ ব্যানার্জীকে খুন করা হবে।কারন, সে নিজেই নাকি মেয়েকে বিনা পয়সায় পার করার জন্য বিধর্মীর ঘরে তুলে দিয়ে এসেছে।

সনাতনধর্ম তার জন্য বিপন্ন।

ওদিকে কর্মস্থলে, ঈর্ষাপরায়ন সহকর্মীরা, ঘোলাজলে মাছ ধরতে কোমর বেঁধে নেমে পড়লো।

(আরো আসবে)
—————-

চকবন্দি চরাচর (নির্বাচিত অংশ)

…… বামুনবাড়ির মরাশোক দশদিনে কেটে যায়— তবে এতো তুচ্ছের মরা নয় —- তার চেয়ে কয়েক কাঠি ওপোরে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন চরিত্রের বিভিন্ন মানুষ জন যেচে প্রেসক্রিপশন গুঁজে দিয়ে যাচ্ছে, কীভাবে এই মহাপাতক থেকে শাস্ত্রসম্মত ভাবে সবংশে রেহাই পেতে পারে।

বিচিত্র মানুষ জনের বিচিত্র ভঙ্গিমা। বাইরের গেট থেকেই কেউ হাঁউ- মাঁউ করে কাঁদতে কাঁদতে ঢুকছে, ছদ্মআকুলতায় তাকে সান্ত্বনা দিতে থাকছে তার স্বামী বা পুত্র। এদের এই সংসারেই এখন কে কাকে সান্ত্বনা দেয়! তবু নিজেদের শোক শিকেয় তুলে এগোতেই হয় পরমাত্মীয়ের কুম্ভীরাশ্রু মুছিয়ে দিতে। একদল বিস্তর কান্নাকাটি সেরে বায়না ধরলেন, যে করে হোক মেয়েটাকে ঘরে ফিরিয়ে আনতেই হবে। এতবড় একটা অনাচার চলতে দেওয়া চলেনা।
সবাই তো সেটাই চায়। তার জন্যই উতলা। কিন্তু, কিভাবে?
— কেন, পুলিশে ডাইরি করো….

–নিজের বাড়ির মেয়ের বিরুদ্ধে নিজেরা পুলিশে যাবো?
— মেয়ের বিরুদ্ধে কেন গো! ডাইরি করো সেই অজাত- কুজাত মোছলমানটার নামে গো!
— তা ওর তো নাম- ঠিকানা – বাপের নাম কিচ্ছুটি জানিনা। কি করে কি হবে?

— ওই যে গো, ওই বড়দির ছেলে প্রতীম– ওই হারামজাদাই তো এই কাণ্ডের মূল। ওকে ডেকে শুধোলেই তো স- ব পেয়ে যাবে।। — পরকে দোষ দিয়ে কী লাভ! আমার ভাগ্যে ছিল লেখা। নইলে অমন বুঝমান মেয়ে আমার! — ডুকরে ওঠেন রমা।
— আলোচনা গতি বাড়িয়ে ক্রমশঃ ষড়যন্ত্রে রূপ পেতে চলেছে…. পুলিশকে বললেই হবে আমাদের নাবালিকা মেয়েকে বিদেশ চালান করার জন্য ফুসলিয়ে নিয়ে গেছে… বলবো মেলা টাকা- গয়না সরিয়ে নিয়ে গেছে,… বলবো..বলবো….
শলাপরামর্শের মাঝে শলাকা র প্রাধান্য ক্রমশঃই গায়ে গতরে বাড়ছে…ও রমা, তুই রাজি থাকিস তো বল্ আমার ছোট শালার বন্ধু এই হালে হালে এখানে সেকেন্ড অ ফিসার হয়ে এসেছে। একবার কমপ্লেনটি করলেই হলো। তারপর বাছাধনের পিঠের ছালচামড়া তুলে নুনলঙ্কা ভরে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেবে….

কাঁদতে কাঁদতে আঁতকে ওঠেন রমা এদের এমন নির্মম কথাবার্তা শুনে।…হা ঈশ্বর! যার সম্বন্ধে কথাগুলো বলছ, আমার মেয়েটা যে রয়েছে তারই বুকে…

রমা মেটেই সায় দেয়না ওদের কথায়,.. দেখি,ওর বাবা অফিস থেকে ফিরুন….

গিরিবালা সটান এসে দাঁড়িয়ে যান মেয়ে রমার পাশে,… শোন, এইযে তোমাদের বলছি। খবরদার যেন জামাই বাবাজীবনের কানে এমন নোংরা কথাবার্তা না ওঠে। তোমরা চেনোনা আমার জামাইকে? সে এমন পাইকেরে প্যাঁচে পা ফেলবে? এসব কথাবার্তা একদম বলবেনা এবাড়িতে। আমার জামাই এর অমন পুলিশ বন্ধু কি কম আছে?

… তবে কি জীবনভোর মেয়েটা ওই মুসলমানটার খপ্পরে পড়ে থাকবে? এখনো তল্লাটে আছে… এরপর কেথায় হওয়া করে দেবে কেজানে? যা করার তড়িঘড়ি করতে হবে।

কিসের তড়িঘড়ি? আর ওসব প্যাঁচ- পয়জার কষে কিছু লাভ হবেনা। বুকে করে মানুষ করেছি, আমি চিনি আমার নাতনিকে। ওর আপনজনের যদি কোন অসম্মান করো, আবারও একবার দক্ষযজ্ঞ দেখতে পাবে তোমরা। তোমাদের চোখের ওপোরেই ও আত্মহাত্যা করবে…. শক্ত গিরিবালা যন্ত্রনায় গ’ লে গ’ লে হাপুষ কান্না কাঁদতে থাকলেন,… ততক্ষনে কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়েছেন রমা।
খানিক বিনিপয়সার সিনেমা দেখেপাততাড়ি গোটাতে থাকে পরামর্শদাতারা…এখন এবাড়িতে খাওয়া দাওয়ারও পরিপাটি যে নেই বিশেষ…..হাঁড়ি – হেঁশেল রমার জা – ননদের জিম্মাতে।

( আরও যাবে)

যদি প্রেম…. (৩)

গত দুদিন ধরে একটা কথাই বলে চলেছি, প্রেম একা একাই চালিয়ে যাওয়া সম্ভব, কারো সক্রিয় সহযোগীতা নাই বা জুটলো।

কথাটা সঠিক হলেও, শুরুটাতো প্রায়শই দ্বিপাক্ষিক ঘটনা।যদিনা সে প্রেম কারো অগোচরে ঘটে যায়। একজন হয়তো বা জানলোই না কোনদিন কী মহার্ঘ বস্তু তার সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে তারই উদ্দেশ্যে একজন নিজের প্রাণকুটুরীর গভীর গহীনে পরম মমতায় লালন করে চলেছে। এই প্রেম প্রকাশ্যতঃ প্রকাশ্যে আনা একেবারেই অসম্ভব বলেই একজন আজীবন এমন গুরুতর ভার কন্ঠলগ্ন করে বয়ে চলেন। তবে এতে অাবশ্যিকভাবেই তাঁর একজাতীয় তৃপ্তি থাকে, যে কারণে আমরা বাইরে থেকে যেটা গুরুভার ভেবে হাপসে মরছি, তাঁর সেটা আদপেই কোনো ভার বলেই মনে হয়না। তাই তিনি পারেন।নইলে কেউ তো তাঁকে মাথার দিব্যি দেয়নি এমন কণ্টকিত পথে চরণযুগল রক্তাক্ত করার জন্য, সমাজের বেঁধে দেওয়া মসৃন পথ তো উন্মুক্তই রয়েছেই সবার জন্য :

থোড়- বড়ি – খাড়া,
খাড়া- বড়ি- থোড়।

সবাই কিছু এমন ধরে- বেঁধে দেওয়া মসৃন পথের পথিক হতে নাও চাইতে পারেন। এই লঘুস্য লঘু ততোধিক সংখ্যালঘু প্রেমিক / প্রেমিকাদের কথাই এতক্ষণ বলে এলাম।

…ভালবাসা কারে কয়?
সে কি কেবলই যাতনাময়?…..

এমনিতে স্বভাবতই প্রেম এক দ্বিপাক্ষিক আচরন বিশেষ। একজন ভ্রুপল্লবে চন্দনের বনে ডাক দিলে, অন্যজন সাড়া দিলে,তারপর এগিয়ে পিছিয়ে দুজনে এগিয়ে নেন খেলা। কখনো কখনো এই সাড়া দেবার পর্বটি সঙ্গে সঙ্গে না ঘটে দীর্ঘায়িত হয়ে থাকে। মেপে নিতে চান প্রোপোজারকে। এই মাপাজোকার মাপকাঠি প্রয়শঃই, ব্যতিক্রম নেই বলছিনা, বস্তুগত লাভক্ষতির অঙ্কেই হয়ে থাকে। তারপর শুরু হয়ে যায়, ওই শব্দে যাকে প্রেম বলি তার অন্তহীন খেলা। এই সম্পর্কে আবশ্যিকভাবে অন্তরঙ্গতা প্রয়োজন। এবং ক্রমশঃ মন থেকে তা শরীর পর্যন্ত পৌঁছে থাকে।

পরবর্তীতে এই প্রেম কাউকে কাউকে নিজের কাজের প্রতি অতি সিরিয়াস করে তোলে। দিনের চব্বিশ ঘন্টাকে পারলে আটচল্লিশ কি বাহাত্তর ঘন্টা বানিয়ে মুখে রক্ততুলে পরিশ্রম করে সে আগামীর যৌথ স্বপ্নকে সাকার করার লক্ষ্যে। আক্ষরিক অর্থে উত্তরণ ঘটে যায় তার জীবনে।

আবার এর উল্টোটাও হরহামেশাই নজরে পড়ে। প্রেম করতে গিয়ে কেরিয়ারের বারোটাও অনেকে বাজিয়ে ফেলেন। এসব ক্ষেত্রে, অনেক সময়েই, পিছলে যায় প্রেম।

অদ্ভুত শুনতে মনে হলেও, কারো কারো প্রেম আবার ‘সেরে’ ও যায়। ওয়ান ফাইন মর্নিং ‘সেরে’ ওঠা ব্যক্তি তখনো পর্যন্ত রুগ্নজনটিকে নিজের কলার তুলে শ্রাগ করে নায়কোচিত / নায়িকাসুলভ ভঙ্গিতে অম্লান বদনে মেসেজ করবেন :
শোন, আমি আর তোমার প্রতি আগ্রহ খুঁজে পাচ্ছি না….

উল্টোদিক তো ভেবলে গিয়ে পপাত্ ধরনী চ হতেও ভুলে মেরে দেয়…. গতকাল রাত দুটো পর্যন্ত যে কিনা…..
এতটাই অবিশ্বাস্য যে পরমূহুর্তে অভিমান করতেও বাঁধে না… সাত সকালে ঠাট্টা করবেনা বলে দিলাম….

…. ঠাট্টা নয়, সিরিয়াসলি বলছি। এমনি যদি সাধারণ বন্ধু থাকতে পারো, থেকে যাও।বিশেষ সম্পর্ক আর টানতে চাইছি না আমি….

যার তখনো প্রেম ‘সারেনি’ তার জন্যে তখন একতরফাভাবে কান্নার সমুদ্রে বহু- বহুকাল উথালি পাতালি করা ছাড়া গত্যন্তর কিছু থাকে না। সবাই তো আর ম্যুড চেঞ্জের মতো মূহুর্তের ক্ষিপ্রতায় পার্টনার বদলে ফেলার এলেম ধরেনা!! এবং এসব ক্ষেত্রে আইন,সমাজ,পরিবার কারো কোনরকম মাথাব্যথা থাকেনা বলে অত্যন্ত সহজেই দ্য এন্ড্ টেনে দিতে পারা সম্ভবপর হয়।

অতি সম্প্রতি আবার অন্য একটা ট্রেন্ড্ ও দেখতে পাচ্ছি। অনেক সময়ই নারীর ‘রোগ’ না সারলে, সরাসরি ধর্মাবতারের এজলাসে গিয়ে, প্ররোচনা দেওয়া স্বত্বেও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের নালিশ জানিয়ে, আদালতের মধ্যস্হতায় ব্যাপারটাকে বিয়ে পর্যন্ত টেনে নেওয়া যাচ্ছে। অবশ্য ‘ প্রেম’ ততক্ষণে পগার পার। এবং এ বিয়েও কত কিছু দিনের জন্য টিঁকে থাকবে, তা অনুমানেও আসেনা। বলাই বাহুল্য মাত্র, এই জাতীয় বিবাহে প্রেমের চেয়েও বেশি সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে।

…. ওরা সুখের লাগি প্রেম চাহে, প্রেম মেলেনা/ শুধু সুখ চলে যায়।…..

_______________
© রত্না রশীদ ব্যানার্জী।

যদি প্রেম … (২)

ভালবাসতে দোসরের বাড়ানো হাত না পেলেও দিব্য চলে যায়। সে রকম মানসিক গঠন থাকলে, বেঁচে থাকার পরিসরে সারাটা জীবন দেবদাস বনে হাহুতাশ করে কাটিয়ে দেবার কোন প্রয়োজন পড়েনা। সে আবার কেমন প্রেম যা জীবনকে আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত করার বদলে কালোয় কালোয় ঢেকে দেয়! আমি যদি সত্যি ভালবেসে থাকি, তাহলে ঘটনা যা- ই ঘটুক না কেন, আমি আমার ভালবাসার প্রতি সশ্রদ্ধ থেকে, তারপর যা করার তা করবো। নিজের আবেগের প্রতি যদি আমি নিজে সশ্রদ্ধ না থাকি, তবে তো যে হাত ছাড়িয়ে পালিয়েছে সে তো ঠিকই করেছে বলতে হবে। কারণ শ্রদ্ধার বনেদ ছাড়া ভালবাসা দাঁড়াতে পারেনা।

রোজকার জীবনে যা দেখি, অতি কষ্টে মুখে আগুন তুলে প্রণয়কে পরিণয়ের ছামনাতলায় টেনে নিয়ে গিয়ে যে বাহাদুরিটুকু হলো, তার লাভের গুড় কখন যেন পিঁপড়েয় এসে সাবড়ে দেয়।

বছর কতক না পেরোতেই দুজনের উল্টোমুখে যাত্রা। আমি একদমই একথা বলছিনা যে,তাল ভঙ্গ হয়ে সুর কেটে গেলেও কোনক্রমে ধামাচাপা দিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া খুব সার্থকতার ব্যাপার। প্রত্যেকেরই নিজের জীবনকে নিজের মতো করে সাজাবার পরিপূর্ণ অধিকার আছে। তাই যাঁরা মানিয়ে নিতে না পেরে উল্টোপথে হাঁটা দিলেন, তাঁরা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেদের মতো করে নিয়েছেন। এব্যাপারে কারো কিছু বলার থাকতে পারে বলে মনে করিনা।

আমি তাঁদেরও শ্রদ্ধা করি, যাঁরা নিজেদের মধ্যেকার মনোমালিন্য বাইরে আসতে না দিয়ে সংসারের দাবি মিটিয়ে চলেন একদম মুখ বুজে। এটাও কম বড় পরীক্ষা নয়। যাঁরা নিজের টুঁটি চিপে ধরে আমৃত্যু সংসারের দাবি চুকিয়ে চলেন, তাঁদের স্যাক্রিফাইসকে কুর্নিশ। এঁরা পরস্পরেরআন্ডারস্ট্যান্ডিংয়েই এমত জীবনযাত্রা যাপন করে চলেন।

হিপোক্রিট মনে হয় তাঁদের যাঁরা উল্টোপথে হাঁটা দেবারও সাহস রাখেন না, আবার নিজের বিবাহিত পার্টনারকে সসম্মানে সংসারে প্রতিষ্ঠা করতেও জানেন না। এঁরা বাড়িতে বৈধ সম্পর্ক রেখেও বহির্মুখী, বহুগামি/ গামিনী। এঁরা না পারে বৈধ সম্পর্ককে সম্মান করতে, না পারে বৈধতা বহির্ভূত সম্পর্ককে ন্যুনতম গুরুত্ব দিতে। শ্রদ্ধা, সম্মান তো অনেক দূরের বস্তু। এঁরা নিত্যদিনের কাজকর্ম, বাজারহাট, চিকিৎসাদি, শখ শৌখিনতা, লোক লৌকিকতা, পি. এফ,গ্র্যাচুইটি, পেনশন, এল.আই.সি সর্বক্ষেত্রে নির্ভূলভাবে বৈধ পার্টনারের নাম বসাতে বিন্দুমাত্র ভুল করেন না, অথচ চক্ষু চর্মহীনভাবে দিনের পর দিন ঠকিয়ে যান বিবাহ বহির্ভূত পার্টনারটিকে।
এসব ক্ষেত্রে এঁদের কিছু বাঁধা লব্জ থাকে, যা দিয়ে দূর্বল করে ফাঁদে ফেলা হয় ভিকটিমটিকে :

১) কি করবো, সংসার না করলে নয় তাই করি, অথচ জীবনটা আমার শেষ হয়ে গেছে
২) কোনদিক দিয়ে ও আমার উপযুক্ত নয়
৩) আত্মীয়স্বজন, কোলিগদের কাছে পরিচয় দিতে মাথা কাটা যায়
৪) সংসারে টেকা যায়না, নোংরার হদ্দ, আমার বাড়িতে একদিন গেলে বমি করে ফেলতে হবে
৫) আমার সুবিধে অসুবিধের দিকে মোটে নজর নেই
৬) স্বার্থপরের চুড়ান্ত, নিজেরটুকু ছাড়া আর কিছু বোঝেনা
৭) আমাদের দাম্পত্য সম্পর্ক তো বহুযুগ আগে মরে গেছে। ওর সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই
৮) শ্বশুরবাড়ির পেষনে মারা গেলাম
৯) এমন একটা বিচ্ছিরি বিয়ের কারণে আজ আমি সম্পূর্ণ একা।
১০) আর বাঁচতে ইচ্ছে করেনা। কয়েকবার সুইসাইডের এ্যটেম্প্ ও নিয়েছিলাম। তুমি ছাড়া আমাকে কেউ আর বাঁচাতে পারবে না।
১১) এখন পার্মানেন্ট ডিপ্রেশনের শিকার। ওষুধ খেতে হয়। আমাকে দেখার কেউ নেই।
১২) আমাকে একটু আশ্রয় দেওয়া কি যায়না? একটু নির্দোষ মন খুলবার জায়গা?

এবম্বিধ শতেক নিন্দামন্দর পর অমোঘটি ছাড়া হয় :
দুশ্চরিত্র, কতজনের সঙ্গে যে ঢলিয়ে বেড়াচ্ছে… ইত্যাদি, ইত্যাদি।

একে কেউ প্রশ্ন করেনা যে, তুমি বাছাধন/ধনি এখন কি করছো? চণ্ডীপাঠ??

এতক্ষণে হাবা বনে যাওয়া টার্গেটটি একেবারে আবেগে – প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে কাত্, ঠিক ততদিন পর্যন্ত যতদিন না শিকারির নতুন টার্গেট জোগাড় হয়ে যাচ্ছে। ফলতঃ যা পেনাল্টি দেবার অবৈধ পার্টনার তো দেয়ই, দিতে বাধ্য। বুঝে, বা না বুঝে আগুনে হাত দিলে তো জ্বলতে পুড়তে বাধ্য। কিন্তু ভেবে দেখুন সেই বৈধ পার্টনারটির কথা। সব জেনে শুনে কিভাবে, কেমন করে এই অপমানের জীবন মেনে নিয়ে রোজ রোজ এক টেবিলে গা – ঘেঁষাঘেঁষি বসে মাছের ঝোল ভাত খাচ্ছেন, একমাত্র বিধাতাই জানেন।

আমি স্ত্রী – পুরুষ উভয়ের কথাই বললাম।

_______________
© রত্না রশীদ ব্যানার্জী।

যদি প্রেম…..(১)

ভালবাসতে দোসরের সাহায্য লাগেনা।

ভালবাসার রাজত্বে দরাজ বুক থাকলে, একাই একশো। কারোর বাড়িয়ে দেওয়া হাত ধরার প্রয়োজনই পড়ে না। যাকে ভালবাসতে চাই, সে জানুক বা না জানুক, কাছে থাকুক বা দূরে, ইহজগতে বা পরলোকে, ম্যাটার করেনা আদৌ। হ্যাঁ, তবে ভালবাসার নামে যদি কেউ ভবিষ্যৎ গোছাতে চায়, তার সমস্যা ভিন্ন। ভাল না বেসেও দিব্য আখের গুছিয়ে নেওয়া যায়। নিচ্ছেও তো আকছার।

সেই পুরনো লব্জ কপচাই।… প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে/ কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে।

দিল খোলা প্রেমিক / প্রেমিকা স্বত্বা কখন, কিভাবে,কিসের জন্য, কার প্রেমে পড়ে যায়, হাজার জিজ্ঞেস করলেও সে বলতে পারবে না। সত্যিকারের ভালবাসার হেতু নেই কোনো, ঈশ্বর প্রেমের মতোই অহৈতুকী। নারী- পুরুষের প্রেমের কথাই যদি বলি,একে অপরকে যখন ভালবাসে, সত্যি কি তার কোন যুক্তিগ্রাহ্য কারণ বিশ্লেষণ করা সম্ভব? তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ নারী/ পুরুষ কি আর কেউ কোথাও নেই, যে তার জন্যেই প্রাণপন করতে হবে? বাড়িঘর, সমাজ সংসার, জাত কুল মান, আত্মীয়স্বজন, এমনকি নিজের মা- বাবাকে পর্যন্ত পর ভেবে নিতে এতটুকুও আটকায় না। খুন করে ফেলার রেকর্ডও বহু। এটকুও মাথায় থাকেনা, যে সারাজীবন জেলে পচতে হবে, নয়তো ফাঁসি।

এতদূর না গিয়ে যারা প্রণয়কে পরিনয়ে পরিনত করতে পারে, তাদেরও একটা বড় অংশ কিছুদিন পরই স্বার্থ আর ইগোর লড়াইয়ে বিধ্বস্ত হয়ে পরস্পরকে দোষারোপ করতে করতে ময়দান ছাড়ে। বলির পাঁঠা হয় সন্তানেরা। প্রেম তখন কোথায়? সত্যিই কি ওটা প্রেম ছিল?

এই “সত্যিকারের প্রেম” নিয়ে অনেক বাজার চলতি রগড় আছে। সত্যিকারের ভূত দেখার মতো। সবাই শুনেছে যে আছে, কিন্তু চোখে দেখেনি কেউ।

তো সে যাই হোক, চোখে দেখেনি বলেই যে নেই, এতো কোন কথার কথা নয়। অনেক কিছুই দৃশ্যের আড়ালে থাকলেও, তা আছে। সত্যিকারের প্রেমের কতো উদাহরন তো চারিপাশেই আমাদের ছড়ানো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা পরিণয়ে পরিণতি না পেলেও তা আছে। আমাদের ইতিহাস, সাহিত্য এজাতীয় প্রেমের উদাহরণে উদ্ভাসিত। চর্বিত চর্বন উদাহরন হিসেবে অকারণ নামগুলো আর উল্লেখ করলাম না। সবাই জানেন।

আমাদের চারিপাশে দেখা প্রতিদিনের জীবন থেকেও এমন উদাহরন পেয়ে যাই। ভালবেসেও যেখানে পরিণয়ের সুযোগ নেই, সেখানে কী ভীষন নিষ্ঠাভরে উভয়ে উভয়ের সম্মান, সংসার রক্ষা করে চলেছে। বহুবছর যাবার পর,আত্মীয়স্বজন, চারিপাশের লোক যখন বুঝে যায় যে এরা কখনো কারো কোন ক্ষতি করতে পারবে না, তখন কেমন পরোক্ষ স্বীকৃতিও দিয়ে বসে। ছেলেপুলেরা মামা/ পিসি ডাকলেও বাড়তি সম্মান দিয়ে কাজেকম্মে, অসুখেবিসুখে ডেকে নিতে কসুর করেনা। নিরুচ্চারে প্রেম জিতে যায় এখানে। একে কি ‘নিকষিত হেম’ বলা যাবে?

শুরু করেছিলাম যা দিয়ে। ভালবাসতে কোন দোসরের সাহায্য লাগেনা। লাগেনা কোন আইনি শিলমোহর। আলম্মা ইকবাল যথার্থ বলেছেন, যদিও অন্য প্রসঙ্গে, মহব্বত্ হরওয়াক্ত বেদলিল হোতি হ্যয়।

কারোর ক্ষমতা নেই আমার কাছ থেকে আমার ভালবাসা কেড়ে নেয়। এ আমার অন্তরীন শক্তি, এবং সামর্থ্য। আজ প্রায় বিয়াল্লিশ বছর এক ভদ্রলোককে কায়মনোবাক্যে ভালবেসেছি। তিনি আর ইহজগতে নেই। কই কোথাও কিছু কম পড়েনি তো ভালবাসায়! আজ এক বিশেষ দিনে অজস্র মানুষের শুভেচ্ছা পেয়েও মন পুড়ে মরছে কেবল তাঁর জন্যই।

আর একটা প্রসঙ্গ উল্লেখে শেষ করবো। ভালবাসা যেন শবরীর প্রতীক্ষা। বছর- যুগ- কাল কেটে গেল, সুন্দরী যুবতী বুড়ি হয়ে পাকা ঝুনো নারকোল বনে গেল, তবু ভালবাসার প্রতীক্ষা ফুরোয় না– তিনি যে আসবেনই। ভক্তের টানে ভগবান না এসে যাবন কোথায়?? — আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হতো যে মিছে।
তাঁর জন্য কি নৈবেদ্য রাখবো? সর্বশ্রেষ্ঠ ফলটি।

কিভাবে ফলের শ্রেষ্ঠতা বোঝা যাবে? কেন? নিজে খেয়ে দেখবো। যেগুলো চেখে দেখবো মিষ্টি, যুগ যুগ ধরে তাঁর জন্য জমিয়ে যাবো, আর যেগুলো টক, তা দিয়ে আমার জীবন ধারন। শবরীর এই বহুকালীক উচ্ছিষ্ট ফল ( প্রসাদ?) গ্রহন করে নারায়ণ স্বয়ং ভালবাসার মানরক্ষা করেছিলেন।

কার ভালবাসা কোথায় যে ওঁৎ পেতে বসে থাকে! আমাদের পাড়ার শান্তি বুড়ি। সাতকুলে কেউ কোথাও নেই। এর ওর ঘরে ফাইফরমাশ খেটে, চেয়েচিন্তে পেট চালায়। ওর কি মরনের ভালবাসা দেখো! পাড়ার সাত- আটটা নেড়িকুত্তাকে প্রাণ দিয়ে আগলে রেখেছে। নিজের যেটুকু জোটে, আগে ওদের খাইয়ে, তবে নিজে। একদিন বাড়িতে খেতে বলেছিলাম। কিছুতে একটা গ্রাস মুখে তুললো না! বললাম যে, ওদের জন্যওও দোবো, তুমি খাও।

ভবি ভোলবার নয়। ওদের খাবারটাও নিয়ে সব একসঙ্গে মাখলো। মেখে সটান নিজের ঘরের পথে। সব ছেলেমেয়েকে সমান ভাগে দিয়ে তবে না নিজের কথা ভাবা চলে! কি বলবো বলুন! ওই ওর ভালবাসা। ওখানেই ওর শান্তি, মুক্তি স- ব।

একটা কুকুরকে, বিড়ালকে ভালবেসে একজন মানুষ যদি আক্ষরিক অর্থে ফিদা হয়ে যেতে পারে, মানুষ হয়ে একজন মানুষকে ভালবেসে সর্বস্ব উৎসর্গ করা কি
একান্তই অসম্ভব!!

_______________
© রত্না রশীদ ব্যানার্জী।

ভাঙ্গারাস

ভাঙ্গারাস

ঠিকই কথা বলেছো তো তুমি, পরিত্রাণকামী,
চাহিদায় ছিল আরো নির্নিমেঘ-চন্দ্রিলা রঙিলী,
শেষতক্ কোজাগরি নিশিক্রিয়া রম্যতার বলি-
এই বিরাশি-সিক্কাটিকে কীভাবে হজম করি আমি!

জল-স্থল-অন্তরীক্ষে প্রাণহাতে আমি কি যাইনি?
কখনো বুঝিনি কেন ‘প্রত্যাখ্যান’ শব্দটির মানে?
স্তরীভূত আবেগের দৃশ্যরূপ ফুল- পাখি- গানে
অন্ধ হয়ে যাওয়া মেয়ে শেষটুকু ধরতে পারেনি।

খুঁজেছি আতান্তরে ভালবেসে যা- যা খোঁজা চলে,
সাক্ষী ছিল নিশিরাত, সাক্ষী ছিল প্রভাতী সম্ভাষ,
পরশমণির খোঁজে য-ত-দূ-র সুখ-সহবাস,
ছিল নাতো অন্যমন, দৃষ্টিপাতে ‘কু’ ছিলনা বলে।

ওদিকের ক্রীজ্ ছিল তোমারই হাভালে, বোঝোনি?
আমি যদি না বুঝেছি তুমিওতো বোঝাতে পারোনি।

এখন যেমন

কিছু তাস গোছানোই থাকে, অল্পে কিছু আশা,
অভিমুখী অবিরত হাত মুন্সিয়ানা ছানে,
এই আছি এই নেই, আজকের নিঃশ্বাসের মানে,
পরিস্থিতিগতভাবে বদলে যায় কুশীলবী ভাষা।

চোখ তো দেখেছে রূপ-তেষ্টা-প্রেম-উচ্চাশা,
স্থাপত্য বৈভবে তবু অহংকারী মৃত বৃক্ষডাল–
কাকে যে ডোবাবে তুমি, কাকে দেবে বুকেরআড়াল,
ভুলেগেছো সংগোপনী রোদ-বৃষ্টি-শিশির-কুয়াশা।

এভাবেই যদি….

এভাবেই যদি রোজ চেরাজলে ডুবে যায়
নতমুখী পাপড়ি- বিন্যাস,
গহীন নোঙর- কাঁটা নাল্ হয়ে
নির্বিবাদী গ্রীবাকে জড়ায়,
অব্যর্থে খোয়া যায়
পদ্মকোরক ফোটা মগজ-বৃওের
তুলকালাম শব্দদেহীদের
নিশিঘোর মেদুর-মিছিল,
বদরক্ত খোয়ারীর অম্লজান রসের জারকে
যদি মূল সময়ই বয়ে বয়ে নষ্ট হয়ে যায়
ফেটে যায় বিনা আঁচে
আয়ওের যাবতীয় দুধেলা সরাই……..

তবে বিপন্ন ছায়াময়
হে হাওয়াহারী কল্পদ্রুম তুমি,
তুমি আর অলৌকিক পদ্মনাল নোঙর কাঁটায়
বিষন্ন সুষুম্নায় মায়াহীন কেন গাঁথো
কবোষ্ণ কোরকের অলীক মিথুন !!

————————
রত্না রশীদ
১৯/১০/২০১৬

কিশ- মিশ-ডে

সেবার ১৩ই ফেব্রুয়ারি এ্যডিলেডে আছি।

সপ্তাহান্তিক কেনাকাটায় শাশুড়ি – বৌমা গেছি। সেদিন একটু তাড়া ছিল। তাই মৌমা (ওর নাম মৌ) আমাকে ড্রাইফ্রুটস্, বিস্কিটস্, দুধ এর দিকে পাঠিয়ে নিজে আনাজ, ফল, মাছ, মাংসের দিকটায় গেল। উদ্দেশ্য, সময় সংক্ষেপ।

নতুন তো নই। মাস তিন-চার তো এই কাজ করছি। সানন্দে। এবারে কিন্তু মৌমার হাজারটা জিনিষ নেওয়া হয়ে গেলেও বিলিং কাউন্টারে আমাকে না পেয়ে, খুঁজতে চলে এলো, – কি গো, এ্যতো দেরি?
আমি আমার বোঝাই ট্রলি দেখিয়ে বললাম,
– আর বোলোনা, সবই তো পেলাম, কিন্তু কিশমিশ কই?
– সে কিগো, পেলেনা?
– তবে আর বলছি কি! নিজে পেলাম না বলে তো ওদের হেল্প চাইলাম। ক- ত্তো করে বুঝিয়ে বললাম,- রেইজিন, ক্যারান্ট্, ড্রায়েড গ্রেপস্, – বোঝে আর না। হাবার মতো খালি এপাশ-ওপাশ ঘাড় হেলায়।
অবাক হলো মৌমা, – ওসব কেন বলতে গেলে? বলবে তো, ‘সুলতানা’। বলেই একটা প্যাকেট তুলে এনে দেখালো,- এই দ্যাখো ছবি, আর সঙ্গে কি লেখা।
– ওমা! কিশমিশ হঠাৎ ‘সুলতানা’ কেন?
মৌমা মুখে হাসি টেনে বললো, – ও: মা। বুঝে দেখো, এসব রাজা- রানী, সুলতান- সুলতানাদের জন্যেই তৈরি যে!
-সে যাহোক, ইংরিজিই যদি না বলবে, তবে আমাদের কিশমিশ কি দোষ করলো?

এবার হাসিতে ফেটে পড়ে মৌমা ( শাশুড়ি বলে একটু রাখঢাকও নেই) – আরে তুমি যে কিছু চোখে চেয়েও দেখছো না। আসতে- যেতে, রাস্তায়-ঘাটে, পার্কে- মাঠে, ব্যাঙ্কে- হসপিট্যালে যার যখন ‘কিশি’ পাচ্ছে, তক্ষুনি জোড়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে। আমাদের দেশের মতো যত্রতত্র হিসি না করলেই হলো। কিশি অলওয়েজ এন্ড্ এভরিহোয়্যার স্পনটেনিয়াসলি এ্যলাউড। তা, এ্যতো যে ‘কিশ’ – এর চাষ, এর একটাও কিন্তু মিশ্ হয়না মা, সব একেবারে ঠিকঠিক জায়গায় গিয়ে পড়ে। এদেশে তুমি কিশমিশ কোথায় খুঁজে পাবে বলো?

_______________
© রত্না রশীদ ব্যানার্জী।

কাকচরিত্র

এমনভাবে সবাই ভেবলে যাবার ভান করল
যেন মাদারির খেল্ টা
সাতজন্মে কেউ দেখেনি কখনো।

অথচ, জন্মেতক্ প্রত্যেকের পোড়া- চোখ-ছবি :
একটা দো- আঁশলা কোন ব্যতিরেকে
পুরোপুরি গ্লোবটার হাওয়া -জল-মাটি
রক্তে – রাগে, আগুনে -বারুদে
রণশিল্পীর চাগিয়ে তোলা আঙরাখায়
জ্বলে- পুড়ে খাঁক হচ্ছিল – তো – হচ্ছিলই—-

সতর্ক দূরত্বের নিরাপত্তা মেখে
কারোরই তো চোখ ট্যারা হয়নি
টেরাকোটা – শিল্প উপভোগে !!

জঙ্গুলে কাক সব্বার মাংস খাবে।
আর আমাদের বহুদিন নিরিমিষি অহিংস – সংসার,
নাটমন্দিরে রক্তখাকি উপোষী হাঁড়িকাঠে
চালকুমড়ো- শশা- সুপুরি- আখের বলিটলি ——

কাকরাজের এযাবৎ সুরক্ষিত তেলালো ব্রহ্মতালু
দামাল ঈগলে আলপটকা ঠুকরে দিতেই
দালালস্ট্রিট জুড়ে নভোদীর্ন চিল- চিৎকার :

খা- খা- খা- খা – খা- খা –

__________
রত্না রশীদ
১১/১১/২০১৬

অন্তিমদৃশ্য

ছিলাটান্ শ্বাস-হাপর-তোড়-ফোড়
ক্ষত ও আরোগ্যের শেষাংশে
তুরীয় যোগমুদ্রা গ্রাসেই
ত্রাসে নাচে শায়িতের ক্ষণ

ততক্ষণে বিস্ফারিত তীক্ষ্ণ চেতনার
হাট্খোলা বালিহাসি তিরতিরে ডানায়
নম্রতুলি রক্ত ঢালে অস্তকার রোদ,

ততক্ষনে সুষুম্নার দীর্ঘায়ত নাব্য নির্জনে
দূরতম অচিহ্নিত গহীন কন্দরে
মায়াছায়া খেলে যায় খেলাভাঙা খেলা

আর এযাবৎ কষে রাখা ষট্চক্রি জটিল বুননে
নির্বাধ সুক্ষতায় কেটে – উড়ে – ভেসে – যায়
অগাধ স্বচ্ছতায় ভেসে – উড়ে – চলে – যায়
নির্মোহ ক্ষিপ্রতায় নাড়ি – কেটে – উড়ে – যায়
দৃশ্যতঃ নিপুনতায় গোড়া- ছিঁড়ে – মরে – যায়

কেটে – ছিঁড়ে – ভেসে – উড়ে-
প্রখর চলিষ্ণুতায় ডুবে- ডুবে – ডুবে যায়
জীব – মৌল – আলোকের রেণু সমাহার……

____________
রত্না রশীদ
২০/১০/২০১৬

অঙ্গরাগ

হাঁচড়- পাঁচড় কাঠ কুড়চ্ছি তো কুড়চ্ছিই।
ভেতরে – ভেতরে জ্বলে উঠতে যেহেতু
এখন আমার আর বাইরের উত্তাপ লাগেনা,
কাঠ- কুটো হাতে এলেও সেগুলো জ্বালিনা।

হাতে- পায়ে জমে আছে যেহেতু জন্মজ ওম্
রাত নেই- দিন নেই – পরিত্রানহীন হেনে যায়,
হামলে- দামলে সারি কুড়ুনীর ব্রত তড়িঘড়ি
দিন যায় অতিদ্রুত – অতি রকমের তাড়াতাড়ি—

ওদিকে রোদ অভাবে সোঁদা লেগে
কমজোরী সর্বাঙ্গ চিরে – ফেঁড়ে
বজ্রকীট বল্মীক বাল্মীকির ছদ্মবেশ ধরে
কূটজ কাল্পিক বৃক্ষের সর্বঅঙ্গ ব্যেপে
নিস্তারবিহীন চারু- অঙ্গরাগে
নিয়তির মহাকাব্য লিখে লিখে চলে …

_____________
রত্না রশীদ
২২/১০/২০১৬