রত্না রশীদ ব্যানার্জী এর সকল পোস্ট

সংক্রান্তি

অস্থির যুবার মতো ওলোট পালোট করা
আমার স্বভাবগত নয়।
তাই, থাকছি – থাকবোও।
অবশ্যই এ নিয়ে বিজ্ঞাপিত ভাবনা নয় আদৌ।
কারণঃ ভাবের কপাটে চাবি,
চাবিকাঠি অন্যের জিম্মায়।

কেমন রয়েছে গাঁথা বন্ধ্যা দাওয়ায়
নিরুপায়ী বে-আব্রু শরীর –
নিয়ত অনুগ্রহ জতুগৃহে
ঠায় বসে থেকে থেকে
আপাদমস্তক ঘন শক্ত ফসিল।

এখন, অবিশ্বাসী- ছইহীন-চটাওঠা
ডিঙি ঢুঁড়ে ঢুঁড়ে শুঁটকি গন্ধ ছাওয়া
ছাত্লা ধরা নোনা খোলচায়
একবিংশের সপ্রতিভ নারী
আমি ঠিক অস্তিত্বের নলেন সুগন্ধিটুকু
আলো – হাওয়াদের আনাচে – কানাচে
মাত্রাহীন হীনমন্যতায়,
সহজাত যন্ত্রণাতে
আবিস্কার করে করে যাই –
অস্থির যুবার মতো শস্ত্র হয়ে ফেরা
আমার যে স্বভাবে আসে না।

অস্থির যুবার মতো ভাঙ্গচুর করা
একেবারে স্বভাবেই নেই।
তাই, দিকচক্রবাল জোড়া
মুগ্ধ – প্রতিবন্ধী জাল কেটে
নিঃসাড়ে আসতে হলো
ভৈরবের গাজন তলায় –
বাউণ্ডুলে গাজন – যোগীর
খুলিনাড়া আজনা – বাজনা
জীয়ন্ত করোটীর স্নায়বিক ভাঁজে
বড়ো কষ্টে গেঁথে নিই –

ফিরবো তো নিশ্চয়ই,
আমার যে অস্থিরতা নেই- ই,
তাই ফিরবো সুনিশ্চিত্।
এবং শুধু ফিরবো যে তাই- ই নয়,
বছর কাটাবো ঐ দুর্গন্ধে সুগন্ধের ঘোরে।
গাজন – বাজনা তাই
মগজের ভাঁজে পুরে নেওয়া
আজকের তীব্র প্রয়োজন।

কিন্তু তবু বলে যেতে চাই –
গাজনে এসেছি বলে
সহজেই খাজনা ফুরাবো
এমন ভেবোনা —

অস্থির যুবার মতো সর্বস্ব গুঁড়িয়ে দেওয়া
যেহেতু স্বভাবগত নয় —

একান্তে গড়ছি তাই,
সর্বাঙ্গ নিঙরে আনা
তাবৎ কর্মক্ষমতায়
রোজ রোজ পাকা ধানে
মই দেওয়া ইদুঁরের
সর্বশেষ আশ্রয়ের কল।

___________
রত্না রশীদ
০১/১১/২০১৬

অঘ্রানের কিস্ সা শ্রাবণে

সেদিন বাড়ির বউটি নবানেরপুজো- আচ্চা- সেরে, ঘর- বর, ছেলে-পুলে, অতিথ্- পথিত্, পাখ- পাখালি সক্কলকে নবান্ নিবেদন করে পুকুরঘাটে জলকে – মাছকেও তাদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়ে এলো। মহানন্দে চিংড়িরানী পদ্মপাতায় হায় করে বসে মিষ্টি রোদে চুল শুকুতে শুকুতে নবান মুখে তুলতে যাবে, আর ওমনি যমকাক ওপোর থেকে হাঁক পাড়লো : ওলো, তোরে খাই।
এমনিতে চিংড়ির ভয় পেয়ে পদ্মপাতার তলায় লুকিয়ে পড়বার কথা। কিন্তু ভয়তো নয়, রাগ হলো ভীষন।
— হারামজাদা, তুই খাবি তো খাবি। কিন্তু ‘লো’ কেন বললি??
মূহুর্তের মধ্যে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে সাঁতরে চললো মাইলে র পর মাইল। যার তার কাছেতো আর সে প্রতিকার চাইতে পারেনা। একমাত্র ইলিশই তার সমগোত্রীয়। তার কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে দিন তো কাবার। মাঝরাতে গিয়ে সে কড়া নাড়লো,
— ইলিশভাই, ইলিশভাই ঘরে?
— এতো রেতে কে বা ডাকাডাকি করে?
—আমি চিংড়ি রানী…
— দাও বোনকে পিঁড়ি পানী…
তারপর যথাবিহিত সম্মান সহকারে ইলিশ জানলো, তাকে সাহায্য করতে পারলে তো সে ধন্যই হতো। তবে কিনা এতোটা রাত… আর পথও অনেক। তুমি বোন রুই য়ের কাছে যাও। সে তোমার প্রতিবেশি।

মনঃক্ষুন্ন চিংড়ি ওই রাতে আবার উজিয়ে গেল মাছের সেরা রুইয়ের কাছে, :
—রুই দাদা, রুই দাদা ঘরে?
— এতো রেতে কে বা ডাকাডাকি করে?
— আমি চিংড়ি রানি….
— দাও বোনকে পিঁড়ি পানি…
খাতিরদানির পর রুই জানালো, :
—তোমাকে সাহায্য করতে পারলে তো বর্তে যেতাম। তবে বুঝছোই তো, বেপাড়ার কেস। তুমি বরং তোমার পাড়ার কই, মাগুরকে বলো…

ক্রমে ক্রমে কই,মাগুর, ল্যাঠা, চ্যাং, ছিমুরি ইত্যকার যতরকম মাছ সবার কাছেই চিংড়ি তার অপমানের বিহিত চাইতে যায়, আর অভিন্ন উপদেশ শুনে শুনে যখন হতাশ, কাঁকড়া তখন এগিয়ে এলো, :
—কাককে শাস্তি দিতে হবে তো! ও আর এমনকি বেশি কথা। তুমি বোন এক কাজ করো দিকি। দু পয়সার মুড়ি কিনে আমার গর্তের চারপাশে ছড়িয়ে দাও। তারপর পদ্মপাতার আড়ালে গিয়ে গা ঢাকা দাও। দ্যাখো কি হয়!

শোনামাত্র চিংড়ি কাজ করে ফেললো।

খানিক পর কাক ছড়ানো মুড়ি দেখতে পেয়ে খুঁটে খুঁটে খেতে লাগলো। অনবধায় একটা সময় কাঁকড়ার গর্তে পা পড়তেই, কাঁকড়া মরন কামড় বসালো পায়ে। কাক না পারে নড়তে, না পারে উড়তে। আর চিংড়ির উল্লাস দ্যাখে কে! সে নাচতে নাচতে হাত তালি দিয়ে গাইতে লাগলো:

আমার সকল দাদায় হারলো,
কেবল কাঁকড়া দাদায় জিতলো।

কাকের কানে এই গান যেতেই, শক্ত হলো ঘাড়। সে তার তীক্ষ্ণ চঞ্চু জোড়া গর্তে প্রবেশ করিয়ে এক ঠোকরে কাঁকড়ার পেট ফুঁটো করে তাকে তুলে নিয়ে ডানা মেলে দিল আকাশে।

(লোকগল্প)

আউটডোরে একলব্য

তখন সবে চাকরিতে ঢুকেছি। তিন বছরের ছেলেকে কাঁধে ফেলে ব্ল্যাক ডায়মন্ডে বর্ধমান- আসানসোল ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করি। এক সহযাত্রী বন্ধু তাঁর কবিতার বই উপহার দিলেন। নাম, “আউটডোরে একলব্য”।

বহু বছর পর ঘটনাক্রমে স্মৃতিতে উঠে এল সেই বইটির শিরোনাম।

সেদিনের বর্তমান যখন স্মৃতিতে ফিরলো, সেই তিন বছরের ছেলে তখন মহানগরীর ১ম শ্রেণির সরকারি হাসপাতালের ইন্টার্ন। যার সঙ্গে তার স্টেডি এ্যফেয়ার, তিনি ও তাই। দেখা করতে গেলে মেয়েদের হোস্টেলে মায়েরা, ও ছেলেদের হোস্টেলে বাবারা আতিথ্য পান। বলছি প্রায় বছর দশেক আগের কথা।

তো, আমি সেদিন হবু লেডি ডাক্তারদের হোস্টেলে। ছাদ থেকে ইয়াব্বড় বড় চাঙড় খসছে যখন তখন। প্রায় তিনতলা হাইটের একতলা সাহেবি আমলের ছাদ থেকে ঝালরের মত মোটা ঝুলের জবরজঙ্ এবং তার বিচিত্র দুর্গন্ধ ( মেয়েরা দুঃখ করল,কাকিমা আমরা ঝুলঝাড়া নিয়ে খাটে উঠেও নাগাল পাইনা)। ইংরেজ আমলের বিশাল ডান্ডাওলা ভিনটেজ স্পেশিমেন সিলিং ফ্যান মিনিটে তিনটে পাক খেতে বিকট গর্জন ছাড়ে, ‘ঘটাং ঘট’ যেটা আমার কানে পৌঁছয়, ‘ঘ্যাঁচাং ফু, খাবো তোকে’….। অগত্যায় নাকের ডগায় তালপাখা নাড়তে নাড়তে রাতভোর পড়ে চলেছেন হবু লেডি ডাক্তাররা, কখনো রত্তিটাক ঘুমোচ্ছেন ও। মানুষ উঁচু লম্বা জানলা বরাবর তীব্রবেগে ঝর্নার চেহারায় নিষ্ক্রমিত হচ্ছে ওপোর তলার লেবার রুমের দুর্গন্ধী – পাইপ ফাটা জল। বাধ্যতায় বন্ধ জানলা সর্বক্ষণ। হাত- মুখ ধোবার বেসিন, টয়লেটের প্যান ছত্রিশ ভাগে ভাঙ্গা। এবং ওই ভাঙ্গা স্থানে মান্ধাতার আমলের পুরু ময়লার পলেস্তারা শতমন হারপিকেও হার মানেনা।

বারান্দা – সিঁড়ি সমেত গোটা বিল্ডিং কুকুর – বেড়াল – মশা- মাছির উন্মুক্ত অভয়নিবাস। ওদের উৎপাতে ঘরে একটা দানা খাবার রাখার উপায় নেই। মাঝরাতে নাইট সেরে পেটের ভেতর নাড়ি ভুঁড়ি ছেঁড়া ছুঁচোর কেত্তন নিয়ে রুমে ফিরে,অত রাতে না কিচেন- না ক্যান্টিন খোলা পেয়ে জল গিলে শুয়ে পড়া ছাড়া গতি নেই। ওদেরই মধ্যে একটু সচেতন একজন ব্যাগে ফেলে রাখা কাঁচা পাউরুটি চিবোতে চিবোতে, সারাদিনের গাধার খাটুনির ক্লান্তিতে, অসহায়ভাবে ঘুম রাজ্যে সেঁধিয়ে গেলে তার বুড়ো আঙ্গুল সমেত পাউরুটি মুখে তুলে ডালকুত্তা দে দৌড়।

মাঝরাতে আর আউটডোর কই!
ইমারজেন্সিতেই রক্তাক্ত একলব্য বাধ্য হ’ ল তার বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ, তারই দেখভালের দায়িত্বে থাকা সরকারী গুরুবৃন্দের শ্রীচরণে উচ্ছুগ্যু করে দিতে। এবং গুরুও, পরম্পরানুযায়ী, অত্যন্ত ভাল র‍্যাঙ্ক থাকা সত্বেও, আজীবনের জন্য তার সার্জারি পড়ার সুযোগ কেড়ে নিল।

আনন্দ-বল্কল

মানানো, বা না-মানানো দায়
ভালবাসা নিতে যাবে কেন ?
সেই অভ্যাসে বুঝি চেয়েও দেখোনা
রাত্রি জেগে রয়েছি এখনো।

ক্যাওটের জাল ছিঁড়ে ফালা হলে
বোষ্টমের কিই – বা এলো গেলো ?
অভিমুখী প্রেম তো এমনই
একতরফাই বুক যে টাটালো !

ছবি – টবি যা- ই কেন দাও,
নেই কোন ঘন মনোযোগ ,
একা হাতে কিভাবে যে নিই
য-তো মেরামতি – উদ্যোগ !

এক তরফাই নয় গেলামই বা পুড়ে আর জ্ব লে,
স্মৃতিগুলো তাজা রাখবোই আনন্দ- ঘন- বল্কলে।

_____________
রত্না রশীদ
২৫/১০/২০১৬

হাওয়া- পরিবার

হাওয়া- পরিবার

তিন পুরুষ ও নারী মিলে হাওয়ারা মোট ছ’ জন। ঠান্ডা পশ্চিমা হাওয়া “ঘিগের ঘিগের” ওয়ান্ নামের এক কাকের পাহারায় কাঠের ঘরে বন্দি থাকতো। চন্ডমূর্তী স্বভাবের এই নারী হাওয়াটি মাঝে মাঝে ফাঁকতাল বুঝে পালালে, সঙ্গে সঙ্গে ওয়ান্ তাকে জবরদস্তি ফিরিয়ে আনতো। কিন্তু কালক্রমে কাঠের আবাসটি ক্ষয়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেলে অবাধ্য পশ্চিমা হাওয়া বিশাল ঝড়ে গোটা পৃথিবীতে হালচাল মচিয়ে দিল।

দক্ষিণা হাওয়াবিবি “গুরুনডিলবে” বাস করতো “মুলিয়ান” নামে এক ঈগলের তত্ত্বাবধানে। মুলিয়ান “গুরুনডুডিলবে”র পিঠে চেপে আকাশে সফর করে বিশালাকায় মেঘস্তম্ভের নির্মাণ করতো।

দক্ষিনপূর্ববাতাস”ইয়েরাগে”র আবার তিন বৌ। যখন সে তার বৌদের সঙ্গে প্রেমে লিপ্ত হতো, “বাডথা”, “বিবিল” আর “বাম্বল” গাছেরা ফুলে- ফলে সমৃদ্ধ হয়ে উঠতো। বস্তুত ইয়েরাগে হ’ল বসন্তের প্রতীক।

উত্তর বাতাস “ডোরানডোরান”ও ছিল প্রকৃত প্রেমিক স্বভাবের। তার চুম্বন থেকে প্রস্ফুটিত হয়ে পুষ্প সাজে সেজে উঠতো কুলা, নুনগাহ্ আর কুরাজং গাছেরা। পূর্ববাতাসের নাম ছিল” গিনিয়াহমু”। সেও তার সাধ্যমতো পৃথিবীতে বিভিন্ন গাছে ফুল- ফল উৎপাদন করতো। তিন বাতাসের বৈধ তিন হাওয়া বৌরা এমন চন্ডমূর্তি ছিল যে তারা বৌদের মুখদর্শন করতোনা।

বছরে দুবার বিখ্যাত করোবরি উৎসবের সময় প্রত্যেক স্ত্রী – হাওয়া মুক্তি পেতো, কারন উৎসবে সবার উপস্থিতি ছিল বাধ্যতামূলক। ছাড়া পেয়েই ওই বন্য- উগ্রচণ্ডা হাওয়ারা অপরিসীম ক্রোধে সমস্ত গাছপালা ভেঙ্গে চুরে লণ্ডভণ্ড করে দিত, কারন গাছেরা তাদের স্বামীর কাছ থেকে প্রেম চুরি করে পুষ্পবতী- ফলবতী হয়েছে। এই চন্ডমুন্ডাদের স্বভাবের একদমই বিপরীতে পুরুষবায়ুূূরা ছিল অত্যন্ত ভদ্র- সভ্য। তাদের প্রেমস্পর্শেই পৃথিবী জুড়ে গাছে গাছে কচিপাতা, ফুল,ফল আসে। পৃথিবী মোহময়ী রূপে সেজে উঠতে পারে। রক্ষা পায় প্রাণীকুল।
_________________________________

A.W.REED. “Aboriginal Myths,Legends& Fables” থেকে অনুদিত।

একাগ্র একাঘ্নী

একাগ্র একাঘ্নী

অহংকারী একাঘ্নী যে কারো তুনীরে বসেনা।

ঈশানমুখী হয়ে ফিরেফাট্টা হাঁটা দেন তিনি।
মন- কেমন- মন্ত্রাবলী রুক্ষ যে হয়েছে বহুদিনই।

হতভম্বের খোয়ারী যে কাটতে কাটেনা!

এই নেই – হয়ে- যাওয়ার ঠা-ঠা-থাপ্পড় রোদ্দুরে
মন- কেমন- মন্ত্র মাত্রে তুলকালাম অশ্লীলতা বাড়ে।

পড়েথাকা- রয়েযাওয়া দু্র্ভাগ্যেরও কৃত্য থাকে, মাপে।
নেই জল- নেই মাটি – ফোঁপড়া স্থিতি –
নেই – উত্তাপে।

ঘু্র্নিমত্ত পৃথিবীর উদর- বিদরে – ভূমি
চলাচলে
নিরুপায়ী অন্ধস্য অন্ধ ঘনবদ্ধ ঘন
অন্তরালে
যত্নেরও ওপোর দিয়ে আরোআরো যত্নে
মুড়ে দিয়ে
সর্বশেষ, সেরা, আর দুর্মূল্যের আর্তি মাখিয়ে,
বুকছেঁচা প্রতীক্ষা আর রগছেঁড়া উৎকণ্ঠারদল
নিজেকে লুকোতে গিয়ে ভেবলিয়ে
ফের টলোমল……

ধাতব পেটিকা যদি আক্ষরিক এ্যতো তুলতুলে,
এমত একাঘ্নীবান মাথা গোঁজে কোন্
রসাতলে?
———————————————————-

শব্দবাহী

শব্দবাহী

কী দারুণ যে বোকামি করেছি!
তোমাকে বলেছি,
কলমের অভাবেতে
চিঠি লেখা হ’লো না আমার…..

অমনি তুমি খুলে দিলে পাঁজরার হাড়।

পাঁজরার হাড়ের দাপটে,
ফুল ফোটে পৃথিবীর তাবৎ কপাটে।

মিঁয়া- বিবি V/S ৩য় ব্যক্তি

মিঁয়া- বিবি v/s ৩য় ব্যক্তি
__________________

বর ঝিনুক আর বৌ-কাছিম অন্য আর পাঁচ জনের মতো বেশতো ছিল। তবে কিছুদিন গড়াতেই গিন্নী যথারীতি কর্তার ওপোর তিতিবিরক্ত হয়ে উঠলো। লাটসাহেব দিবারাত্রি সমুদ্রতীরে হাঁটুতে মুখ গুঁজে রোদ পোয়াবেন, আর হুকুৃম চালাবেন। আজই যেমন সাতসকালে :
– ওগো, খুব তেষ্টা পেয়েছে। শিগগিরি আমার সুমুখে কুয়ো খুঁড়ে দাও দিকিনি…
বৌয়ের বরফ-ঠাণ্ডা চোখ।– আমার যটা হাত, তোমারও তো তটাই…
– কার কটা হাত, আমার সে হিসেবে কাজ নেই। যা বলছি, করো। এমন ছোটোলোকের ঘরের মেয়ে, যে স্বামীকে তেষ্টার জলও একটু দেবে না……
কাছিম কাজ ফেলে একলাফে বরের সামনে, ঝাঁঝের সঙ্গে হাত নাড়িয়ে বললো,
– এইতো দুটো হাত।সকাল থেকে জ্বালানির কাঠ কেটেছি, এখন উনুন গড়ছি, আবার এই দুটো হাতেই তো গুষ্টির পিণ্ডি পাকাতে হবে। বাড়তি হাত কোথায় যে তোমার কুয়ো খোঁড়ার কাজে লাগাবো?

মেয়েছেলের মুখে কিনা এতো- এতো কথা!
ঝিনুক তড়াক্ করে একলাফে বৌয়ের ঘাড় চেপে ধরে দমাদ্দম পেটাতে লাগলো। বেশটি করে হাতের সুখ করে মনের ঝাল মিটিয়ে সোনামুখ করে জিজ্ঞেস করলো,
– আমার হাতের এই নিপুণ ব্যবহার কেমন লাগলো, সুইটি?
মিন্টিনটা, মানে কাছিম – বৌ, সিম্পলি দুহাতে ঝিনুককে তুলে মাথাটা বালিতে গুঁজে দিল। ব্যস, লেগে গেল দুতরফের ঝটাপটি – ঝটাপটির সঙ্গে ইনোভেটিভ গালাগালির তুমুল ছররা। আক্ষরিক জগঝম্প।

‘আকামা’ নামের এক বিশালদেহী তিমি সে মূহুর্তে সমুদ্রের তীর ঘেঁষে প্রাতঃভ্রমণ সারছিলেন। ওদের কাণ্ড দেখে বুঝলেন যে এক্ষুনি দুজনকে ছাড়িয়ে না দিলে কেউ না কেউ প্রাণে মারা পড়বেই। বিবেচনা মতো আকামা দুজনকে দুহাতে ধরে পরস্পরের উল্টোদিকে মুখ করে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললো, — খুব হয়েছে বাপু তোমাদের ঘরকন্না করা! জঙ্গলের পশুদের মতো বিহেব করছো। আর তোমাদের একসঙ্গে থেকে কাজ নেই। আজ থেকে ভদ্রভাবে যে যার মতো আলাদাভাবে বাঁচো।…

তৎক্ষনাৎ, আকামা তখনো পিছু ফিরতে সময় পায়নি, মিন্টিনটা ত্বরিতে তোড়ে তেড়ে এসে আঁচড়ে- কামড়ে রক্তাক্ত করে দিল তাকে, ওদিকে স্বামী ঝিনুক ও কোথা থেকে একটা লাঠি কুড়িয়ে এনে দমাদ্দম পেটাতে লাগলো তিমিকে।
তিমিতো হতবাক,—ওমা! আমি তো তোমাদের শুধু সাহায্য করতে চেয়েছি। অথচ তোমরা কিনা…….

স্বামী-স্ত্রী একযোগে খিঁচিয়ে উঠলো,
– সত্যি যদি সাহায্য করতেই চাও, তো পত্রপাঠ বিদেয় হও এখান থেকে। আর জীবনে কখনো কোন দাম্পত্য কলহে নাক গলাবে না।…
তড়িঘড়ি তিমি পালিয়ে বাঁচলো

সেই থেকে জীবনে আর কখনো বিশালদেহী তিমি সমুদ্রতীর ঘেঁষা অল্প জলের ধারেকাছেও আসেনা। নিজের রাজ্য, গভীর সমুদ্রে থেকেই নিজের চরকায় তেল দেয়।

আর আবহমান কাল ব্যাপী কাছিম দিবারাত্রি বালি খুঁড়ে গর্ত করেই চলেছে শুধুমাত্র নিজের ডিমগুলিকে সুরক্ষিত রাখার আকুলতায়। ঝিনুককে জল খাওয়াতে তার বয়েই গেছে।

A.W. Reed এর Aboriginal Myths, Legends & Fables থেকে অনুদিত।
___________________________________

নিয়ম- নিপাত্তা

নিয়ম- নিপাত্তা

চলে যার যাবার, সে নিয়ম- নিপাত্তা।
আমারো নিযুক্তি ছিল পড়ে ফেলা ওকে,
স্বপ্ন কিছু,অনেকটা তিতিক্ষায় ঢেকে
চেষ্টা ছিল দুর্নিবার, উধাও ভনিতা।

গন্তব্যে বিচ্ছেদ পুঁতে মাদারির খেল্
দুনিয়ার তীব্রতম ধোঁকা : ভালবাসা।
প্রাণকাঠি কুটিপাটি অযথায় ঠাসা
বিনারক্তে কাটাকুটি বুকেতে অঢেল।

ভাঁড়ারে ঢালেনি কিছু, এক শুধু জল,
কাদম্বিনী – প্রমাণ তবে দি’ কি প্রকারে?
মনই ছিলনা,শুধু ইঙ্গিত – আকারে
শব্দহীন চন্ডরাগ, উপেক্ষা অতল।

তা সত্বেও ফুটো চাল সারেনা ঘরামি
মূর্খ আজো মনে করে, তুমি খু – বি দামি।

————————————————-

বিয়ের গানে জীবিকা সন্ধান (৩)

বিয়ের গানে জীবিকা সন্ধান (১)
বিয়ের গানে জীবিকা সন্ধান (২)
বিয়ের গানে জীবিকা সন্ধান (৩)
___________________

জেনেনা জগতের কথা যখন, বিশেষে এই উপমহাদেশের বাংলাভাষী মেয়েদের, তখন ‘বিবাহ’ বা কথ্যে বিয়েকে তো অন্যতম জীবিকা হিসাবে মান্যতা দিতে আমরা বাধ্য। বিভিন্ন জায়গায় তথ্য জানাবার ফর্মে তো লিখতেও হয়, পেশা- গৃহকর্ম বা গৃহস্থালি। ইদানীং ওই একই ব্যাপারকে একটু এদিক ওদিক করে বলার রেওয়াজ হয়েছে ‘হোম মেকার’। তো, তেমনি এক হোম-মেকারের বৃত্তান্ত আজ।

নাম : গোলেমান বিবি
বয়েস : ৪৫ বছর
ঠিকানা : বর্তমানে নির্দিষ্ট কিছু নেই, তবে
আদত বর্ধমান জেলার মেয়ে।
স্বামীর নাম : ??
…..যাঃ ব্বাবা! কি গো পতি পরম গুরুর নাম মুখে আনবে না নাকি!

আর দুয়েকবার একটু বেশ চেপেচুপে
জিজ্ঞেস করতেই টুক্ করে খুলে দিল চোয়ালের খিল :
…. কোনডার নাম এগুতে বলবো?

আমার থতমত ভাব তুড়িতে উড়িয়ে দিয়ে আবারো তুবড়ি ছোটালো :
…..বাপ বিহা দেছেলো বারো বছরে ( ভাত – কাপড়ের অনুষ্ঠান বাঙালী মুসলমানদেরও একই ভাবে হয়, অর্থাৎ কিনা মেয়ের জীবন ও জীবিকা নিশ্চিত হলো)। নেকা জানিনা, পড়া জানিনা,ঘর জানিনা, পর জানিনা, শুদু ‘মা’ জানি, আর পোড়ার প্যাট জানি। পোঁদের কাপড় তুলি মাতায় দিয়ি ভাসুর- শ্বশুরকে শরম দ্যাকাই। নাকে শিগনি ঝরা বয়েস, ড্যানা ধরি বিড়াল – পার করি দেল সোদর বাপ – মায়ে ( বাবা – মা তো কোন ভাবেই মেয়ের সহোদর হতে পারেনা,অত্যন্ত নিকট ও রক্তের সম্পর্ক বোঝাতে গাঁ – ঘরের মেয়েরা সোদর কথাটা ব্যবহার করে। রক্তের সম্বন্ধও লাগে না, খুব পরিচিত পছন্দের মানুষজনকেও গুরুত্ব দিতে সোদর সম্ভাষণ করে। আমরা যখন তৃতীয়বার গেছি, আমাদের আহ্বান করলো, … এসো বুবু এসো, আমার সোদর এসো….)। তো, সেই ভাতার মিনসে আমার থেকি বিশ বছরকার বড়ো। আগের দু- দুটো বিবি ভাত খায়নে ( অর্থ নিজেরা স্বামীত্যাগ করেছে। আর স্বামী যদি বৌকে ত্যাগ করে, তখন বলা হবে – ভাত দ্যায়নে), পেলিয়েছে। ধুমসো ধুমসো ব্যাটা- বিটিরা মন হলিই কিল- চড় কষায় আমারে। তেবু, স-ব সয়ি ভাত খেয়িছি পাঁচটি বচ্ছর। নিত্যি রেতে পালা করি তিন ভেয়েতে মিলে ধাসতো মোরে। একজন যেখুন ধাসতো,আর দুজনায় পাহারা দেতো। আর, ওই দিশ্য দেকতি দেকতি নিজেদের শরীল গরম করতো। ন্যাংটো হয়ি জাং দোলাতো। গরম হয়ি শক্ত হলিই ফের ঝাঁপাতো। বুবু গো,
‘ফর্দাফাঁই’ হয়ি ছিঁড়ি যেতো মোর ‘অস্থানের শরীল’। ওই করি করি পাঁচ বছরে ছ’টা ছেলে। কে যে কার বাপ আমি লিজেও বুজিনি। তেখুন আমার এমুনি দুদ্দশা যে একটো কাগ পেলিউ তারে ধরে উড়ি পড়ি।”……

সামান্য দম্ নেয়। নিয়ে আবারও বেদম হয়ে পড়লো গোলেমান।…. পাথরচাপুরির একটো ফকির ভিক্ করতি আসতো ওই গাঁয়ে, আর তদ্দিনে আমি পুরুষের বদ নজর চিনায় এসপাট্।…. তো, দিনে-দুপুরে
তার সাথে এক বস্তরে বেইরে গ্যেলাম। দুপুর ভোর ঘর- গেরস্তি ঘুমে কাদা। রেতে তো আবার তিন মরদের পাহারা। তো, সেই ফকিরই আমার পেত্থম প্রেম বলো, আর ভাব- ভালবাসা বলো, স-ব। সবই। কিন্তুক উ ফকিরও তো বুবু( =দিদি) বিটাছেলে। পুরুষ জেতের কখুনো এক মেয়েমানষে শানায়? আর, আমি যেতি আমার বিছেনে নোংরা কাজ সইতিই পারবো, তালি কলমা পড়া ভাতার ছেড়ি আশমানের নিচোয় বিছেন্ পাড়ি কখুনো? …..
বড়ো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কেমন একটা হারিয়ে যাওয়া অবসন্ন গলায় বলতে থাকলো গোলেমান,… আমি ফিরেফিট্টি বুবু আবারও শ্যাষম্যাশ ওই না- হিল্লে হয়ি ভেসি বেড়াতি লাগলাম। তারপর থে, আজ মাছ বেচি – তো কাল শাগ বেচি। পরশু চাল বেলাক্ করি- তো তরশু শুঁকটি বেচতে বেরুই। তা যিখানিই যাই না কেনে বুবু, —-
থিতোবার সুযুগ পাইনে। কেউ না কেউ আমায় ঠিলে বার করবেই- করবে :

কালা বেরুলি বেরুলি ভত্তি দুকুর বেলা,
কালারে, তুই আমার গলার মালা—– (ধুয়া)
কালা তুর লেগে ঘর ছাড়লাম ওরে,
কালারে, তুই
আমার গলার মালা।
কালা বাপের ঘর, ভেয়ের ঘর,ভাতার ঘরে
তালা,

কালারে, তুই আমার গলার মালা।
কালা শাগ তুলে বেচতে গেলাম নতুনহাটের
মেলা,
কালারে, আমার গলার মালা।
কালা নতুনহাটের মেলায় খেলাম
ব্যপারীদের ঠ্যালা,
কালারে, তুই আমার গলার মালা।

কালা শুঁকটি লিয়ে বেচতে গ্যেলাম
মঙ্গলকোটের মেলা,
কালারে, তুই আমার গলার মালা।
কালা, মঙ্গলকোটের মেলায় খেলাম
পাইকেরদের ঠ্যালা,
কালারে, তুই আমার গলার মালা।

কালা বেতের ঝুরি লিয়ে গ্যেলাম
সদরঘাটের মেলা,
সদরঘাটের মেলায় খেলাম
মদোমাতালের ঠ্যালা,
কালারে, তুই আমার গলার মালা।

কালা আন্ডা লিয়ে বেচতে গ্যেলাম
বিজয়রামের মেলা,
কালা বিজয়রামের মেলায় খেলাম
বুড়োমিনষের ঠ্যালা,
কালারে, তুই আমার গলার মালা

কালা ডিংলি লিয়ে বেচতে গ্যেলাম
নবাবহাটের মেলা,
কালারে, তুই আমার গলার মালা,
কালা, নবাবহাটের মেলায় খেলাম
লালুস্টিদের ঠ্যালা,
কালারে, তুই আমার গলার মালা।

কালা তোর লেগে ঘর ছেড়ে এ্যলাম
তিন সন্ধে বেলা,
কালারে, তুই আমার গলার মালা
কালা, কুন্ দোষেতে ছেড়ে গেলি
জান্ করলি আলাছালা,
কালারে, তুই আমার গলার মালা।

কালা, তুর লেগে মাথা দুবো
চলতি রেলের তলা,
কালারে, তুই আমার গলার মালা।
কালা, তুর লেগে গলায় লুবো
কেস্তে, ছুরির ফলা,
কালারে, তুই আমার গলার মালা।
কালা, তুর লেগে ডুবে মরবো
অস্তদিঘীর তলা,
কালারে, তুই আমার গলার মালা।….

……খানিক দম নিয়ে, যন্ত্রণা -জর্জর গলায়
স্বগতোক্তি করে,…. তা বুবু, ই পুড়া প্যাটটোর লেগে কি কামই না ক্যরলাম বুবু, তাউ ই খবিশ প্যাটটো পুরতে জানেনা। স্বভাব ইচ্ছেয় কক্ষুনো কারুক্কে শরীল দেই নি বুবু। কিন্তুক মিছা বলবোনা বুবু, ভাত অভাবে আমার সে দ্যেমাক ও আর রইলোনি। তিনদিন — চারদিন — সিরিফ্ পানি পিয়ে পিয়ে যেখুন নিমতিতা পিত্তিপানি বেরোয় গলা দিয়ি, প্যেটের আঁতুড়ি বেইরে আসতি চায় উপবান( বমি) হয়ি,প্যেটের ভিতরি গরম আগুন লকলক্ করি জ্বলতি থাকে,বুবুগো ত্যেখুন, মিছা বলইবু না, আমার সতীয়ালী ছুঁচিবাইগিরি ওই দূর আকাশে কপ্পুর হয়ি মিলোয়ে যায়।..

… জানিনা কখন, ক-বেই, কোন্ নিশ্ছিদ্র তমসায় ডুবে গেছি। হাতে ধরে সাড় – এ ফিরিয়ে আনলো গোলেমানই।…..

…….. স- ব কাম নেড়ি- চেড়ি – করি – দেকি
এক্কেরে ‘সিদ্দোপিট’ বনি গেয়ি আমি বুবুু এখুন মেরাসিনী- গীদ্ গাউনীর দল গড়িচি।

…….. তা আয়- পত্তর হয় কেমন?

……..খেয়ি – পরি টিঁকে তো আছি বুবু। শরীল দিতি হয়নে কারুক্কে। দশ – বিশটা গাঁয়ের মানুষ কদর করে। আগাম করি বায়না দেয় গীদ্ গাবার। ই- দ্যাশ উ- দ্যাশ ঘুরি বেড়াই ঢোলটো বগলে লিয়ি। আর, তার চাইতিউ বড়ো বেত্তান্ত কি জানো বুবু,
আমার লিজস্ব একটো নাম হইয়েছে। আর অমুকের বেটি, তমুকের বিবি, ফলনার মা লয়কো। এক ডাকেই তল্লাটের প্রেত্যিকিই চিনে আমারে, ‘গোলেমান গীদ্ গাউনি।’ তুমাদের মা- বাপের দোয়াতে বুবু, এই গোলেমান বিবির মেরাসিনী দলে নয়- নয় করে বাইশটা মেয়ে গীদ্ গায়। তাদের লিয়িই আমি চাঁদের হাটে এই বেশ আছি। বুবুগো, এখুন গোলেমালে গোলেমালে পিরীত না করিউ, প্যাট আমার দিব্যি চলে যায়।……

…. আমি হাবার মতো স্থাণু হয়ে বসে থাকলাম। গলা অনেক -অনেকক্ষণ শব্দ বার করতে ভুলে বসে রইলো।
_______________

..

( সাক্ষাতকারটি ‘ নতুন চিঠি ‘ ৩৩ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত )

বিয়ের গানে জীবিকা … (২)

বিয়েরগানে জীবিকা সন্ধান … (১)
বিয়ের গানে জীবিকা … (২)

জাতি – ধর্ম নির্বিশেষে বাংলাভাষী মানুষজনের অনেকেই এখনো মেয়েদের গৃহকর্মকে জীবিকা বলে মনে করেন। তো,সেকারনেই অল্প বয়েসে মেয়ের বিয়ে দিয়ে মা-বাপ নিজেদের ঘাড়- মাথা হাল্কা করে নেন। অবশ্য এর পেছনে আরো অন্যান্য নানাবিধ পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতাও ক্রিয়াশীল থাকে। মা-বাপের সচেতনতার অভাব,তার চেয়েও বেশি নিরুপায়তা এখানে তাদের দিয়ে এই কাজ করিয়ে নেয়। তারা বিলক্ষণ জানেন, বিবাহিত জীবন তাদের মেয়েকে কেমনভাবে কাটাতে হতে পারে :

উসারায় বসে বিটি চালো পাছুড়ছে
চালো পাছুড়তে বিটি একমুঠো চাল খেয়েছে
উসারায় ছেলো শাউড়িবিবি গালে ঠোনা মেরেছে
এগনেয় ছেলো ননদিনী হেতের ছুঁড়ে মেরেছে
ঘরকে ছেলো সতীন মাগি জামাইকে টিপনী দিয়েছে
জামাই ছেলো দলিজে বসি, চুলের মুঠি ধরেছে
জুড়া পাচন বালির পিঠে দাগড়া করি মেরেছে ——

ঘরের এতো আদর – কদর মেয়েটিকে ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে ভাগ্যান্বেষণে প্ররোচিত করে। ঘরের বাইরে তার জন্য কি সমাদর অপেক্ষা করে আছে দেখুন :

অজয় নদী উলুথুলু আমার দামুদার নদী ভরা
সেই না নদীতে হারায়ে গেল আমার আশা- ভরসা

পার করো পার করো মাঝি সাঁঝ না লেগে গেলো
ঘরে রয়িছে কাঁচা ছেলে কেঁদে খুন হলো

পার করো পার করো মাঝি আঁধার লেগে গেলো
আমার স্বামী রয়েছে পথো চেয়ে ভেবে আকুল হলো

পার করো পার করো মাঝি রাত ঘনিয়ে এলো
আমার শাউড়ি রয়েছে আশা করে রেগে লাল হলো

পার করো পার করো মাঝি রাত পেরিয়ে গেলো
আমার শ্বশুর রয়েছে ভরসা করে মুখ কালি হলো

পার করো পার করো মাঝি ঠান্ডা লেগে গেলো
চোখের পানি নাকের পানি অঝোর ঝ’রে গেলো…

বলাই বাহুল্য কিডন্যাপ হওয়া বধূটিকে আর কখনো পরিচিত পৃথিবীতে দেখতে পাওয়া যায়নি।

এক একটা গান এক একটা ঠাস বুনোট কাহিনী, একটার খেই ধরে আরো অকথিত কাহিনী উঠে আসে বিয়ের গানের অবয়ব বেয়ে :

ঝিঙে বেচতে গেলি ঘুরে না এলি, শাকিনা আমার
মাছ ধরতে গেলি ঘুরে না এলি, শাকিনা আমার
শাক তুলতে গেলি ঘুরে না এলি, শাকিনা আমার
হাট করতে গেলি ঘুরে না এলি,
শাকিনা আমার
পাইকেরের ফাঁদে পড়লি ঘুরে না এলি,
শাকিনা আমার
খানকি পাড়ার নুংরা ঘরে চালান গেলি
শাকিনা আমার
দোরে দোরে ভিখ মেগে না মান খুয়ালি
শাকিনা আমার….

নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করে নেবার সুযোগ না পাওয়া নারীদের স্ববেশে বা লজ্জায় ছদ্মবেশে ভিক্ষা করা ছাড়া উপায় থাকে না। ওই কোনরকম একটা অগত্যার জীবিকা :

কাঠির মালা ঝুমঝুমবালা
কে বা নিবি আয় লো।
একটি দুটি পয়সার লেগে
হলাম ফিরিআলা লো।
বাবুর বাগান বাড়ীর ভিতর
একদিন কতোই নাচন কোঁদন লো।
একটি দুটি পয়সার লেগে হলাম ফিরিআলা লো।
শাক তুলিলাম মাছ ধরিলাম
হেনশেল ঘরে কুলুপ লো।
একটি দুটি পয়সার লেগে হলাম
ফিরিআলা লো।
মোল্লাবাড়ির বিবি আমি
তকদিরে কি ছিল লো।
একটি দুটি পয়সার লেগে
হলাম ফিরিআলা লো….

বাইরে বেরোবার ফলাফল দেখে – ঠেকে শিখে অন্তঃপুরে অগত্যায় নিজেকে আটকে রাখতে শেখে নারী। পুরোটা সংসার চেপে বসে তার ঘাড়ে :

সুপারি কাটুম কুচি কুচি সাজি ভরা পান,
দামাদ আমার এই সারে ( = অসাড়ে) ঘুমান।
দামাদের আব্বার পায়ে রাখি হাজারো সালাম
দামাদ আমার এইসারে ঘুমান।

হাঁসো পালি মুরগী পালি, করি গরু চরানের কাম,
দামাদ আমার এইসারে ঘুমান।
দামাদের আম্মার ঠেঙে রাখি
হাজারো সালাম।
দামাদ আমার এইসারে ঘুমান।

একডা গরু জংলা হইলে
দরমা(=বাজার দর) দিবে কম।
দামাদ আমার এইসার ঘুমান।
দামাদের চাচার ছামুতে রাখি
হাজারো সালাম
দামাদ আমার এইসারে ঘুমান।
______________________

(চলবে)

বিয়েরগানে জীবিকা সন্ধান (১)

..

বিয়েরগানে জীবিকা সন্ধান (১)
______________________

গান কুড়োবার নেশায় জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা পথে ছড়িয়ে এসেছি। তো, ওই নেশার খেই ধরেই একদিন পৌঁছে যাই মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জ – বালিঘাটায়। গলির গলি তস্য গলি দিয়ে, নবাবি আমলের পলেস্তরা- খসা, ইয়া মোটা মোটা দেওয়ালের মধ্যবর্তী ফাটলের মতো চুল-সরু রাস্তা ধরে পৌঁছে গেলাম আঞ্জুমানারা বেওয়ার কাছে। সতেরো বছর বয়েসে বিধবা হয়েছেন। পেটে তখন পাঁচ মাসের মেয়ে। স্বামী কিনু শেখ ‘বাংলা ইটভাটায়’ কাজ করতেন। মরে যেতেই আঞ্জুমানারা লোকের বাড়ির ঝি। তখনো রাইসমিল জন্ম নেয়নি। তাই,ধান সিজোনো, ধান শুকানো, ধান কোটা, চিঁড়ে কোটা, মুড়ি ভাজা– বিস্তর কাজ থাকত সম্পন্ন গেরস্তদের। সারাদিন পরের বাড়িতে খেটে বাড়ি ফিরে বিড়ি বাঁধতে বসতেন। বিড়ির কুলো কোলে করে বিড়ি পাকাতে পাকাতে তন্দ্রালু মাথা নেমে এসে ঠকাস্ করে পড়ত মশলার ওপোর। হেঁচে – কেশে একসা, কিন্তু ঘুৃম পালাত দুদ্দাড়। বেবশ চোখ জ্বেলে জ্বেলে এক হাজার বিড়ি বেঁধে মজুরি পেতেন চোদ্দ আনা( সেকালে)। …. “আল্লার কাছে কেতোই না ফরিয়াদ করিচি, হাজারে একটি ট্যাকা পাইয়ে দ্যাও গো আল্লা! হাতের আঙ্গুলের ডগাগুলান ক্ষইয়ে – টাটিয়ে বিষ হইয়ে গেলিউ একটি ট্যাকা আমরা প্যাতাম না, মা। সেই বিড়ি যেকুন এক টাকা হাজার হলো, পরানের খুশিতে গীদ্ বেঁধি আমরা বিয়ের আসরে গাইতে লাগলাম :

ট্যাকা হাজার ভাবনা কি আর
ঘরে বসি বেতন,
ওগো ডবকা ছুঁড়ি, পাকা বুড়ি
পয়সা কর উপায়জন (= উপার্জন)।

বিড়ির ব্যবসা ভাল, চলিত হইল
করো দিয়া মন,
ওলো ভাতারখাকি কপালপুড়ি
পয়সা করো উপায়জন।

চুলোশালে আখার উবরি (= উনুনের ওপর)
চাপিয়ে দিয়ে ভাত,
শাউড়ি-বৌয়ে যুক্তি করি
কাটবা বিড়ির পাত্।

ঘরের ছেলেপিলে জুটিয়ে লিয়ে
বাঁধো বিড়ি ময়না,
হাজার বিড়ি ষোল আনায়
এমুন সুযুগ হয়না।

ঘরের ইজ্জত ঘরে রইবে
ঘরেই বসি বেতন,
বিড়ির ব্যবসা ভাল, চলিত্ হইলো
করোগো দিয়া মন।……..

আঞ্জুমানারার গোটা জীবনটাই অনাথ জীবন। বাপ মরেছে বারো বছরে, স্বামী মরেছে সতেরো বছরে, একমাত্র ভাইয়ের আয়ু তিরিশ বছর। প্রাণে বাঁচতে কতরকম পেশাতেই যে হাত পাকিয়েছে সে! লোকের বাড়ির হরেক কাজ ছাড়াও করেছে কাঁচা সবজি কেনাবেচা,রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ, বিড়ি বাঁধা, তালাই – পাখা বোনা, এবং পাট উঠলে পাট কাচার কাজ। পাট কাচার কাজটি স্মরণে আসতেই পেট গুলিয়ে ওঠে আঞ্জুর। বললেন কাচতে কাচতে পচা দুর্গন্ধে হড়হড় করে বমি করতেন। ঘরে ফিরে উপোষ দিতেন। মুখে রুচতোনা কিছু বলে আগে খেয়ে তবে পাট কাচতে যেতেন। তো, খাদ্যের সদগতি সেই পাটপচা জলে।……
…… কথা বলতে বলতেই হঠাৎই আচমকা উল্টো করে আঁচড়ানো নিজের মাথার সামনেকার চুল দুহাত চেপে ফাঁপিয়ে আনলেন,—- স-ব কাজ করিচি মা, কিন্তুক্ এই ষাট বছর বয়েস হল, ই- গাঁ উ- গাঁ করে কেউ একটা বলুগ তো দিকি যে, মীরার (ওঁর মেয়ে) মায়ের কখুনো কুনো বেচাল দেকেচে! হাজার চাপ দিলিউ আমার সিঁথে ফাটবে না মা। কখুনো আরশি সামনে ধরিনি। সতেরো বছর বয়েস থেকিই মা থান পিঁদে আছি। কাউরির মুরোদ হয়নি আমার পানে হালকা চালে চায়।……
আশপাশের প্রত্যেকে সমর্থন করল সে কথা।
…… আমি মা আট পহর চব্বিশ ঘন্টা গতরপাত করিছি মেয়ের জন্যি, কিন্তুক হার মানিনি কক্ষুনো। না খেয়ি প্যাটে গামছা বেঁধি থেকিচি, কিন্তুক কাউরির কাচে হাত পাতিনি কখুনো, এক কাপ চা – ও কখুনো মেগে খাইনি।… আজ আমার বিটি সব্বোসুখি, ভাইপোকে জামাই করিচি, সে মা আল্লার দোয়ায় বিড়ির কারখানার ব্যাবসা দেকে।….

খানিক দম নিয়ে আঞ্জু আবারও বাঙ্ময় :
… আর আমার মা এমুনি তকদির, যে মানুষটাই আমার পানে আহা- উহু করে চেয়েছে, অমনি আমি তার কল্ল্যা (= মাথা) চিবিইচি রাক্কুসি হইয়ে। বাপ- ভাই – সোয়ামীর কতা তো শুনলে, আমার জানের জান ভাবীজান– আমার গীতের জুটি বিয়ান, সেউ আমারে ছেড়ি গেল এই তিন বচ্ছর হল। কাকে নিয়ে আমি এখুন গীতের আসর জমাই, বলো দিনি! আমি হতাম শাম, তো সে হতো রাধা। আমি মজনু, তো সে লাইলা। আমি রাজা, তো সে রাণী। সে তো শুধুই আমার বিটির শাউড়ি লয়,আমার চেরডা কালের সখি। অকালে ভাই চলে যেতে ওই ভাবীই এতোডা কাল আমার মাথায় ছাতা হইয়ে ডেঁইরে ছেলো। আমার গলায় আর গীদ তেমুন আসেনা, মা।….

তবু আমাদের পিড়াপিড়িতে একটা ‘কাপ্’
করে দেখালেন :

ছাগল চরাইতে গ্যেলাম
কাঁকল নদীর ধারে মা,
মা আমার বিহা দিলি না। ( ধুয়া)

ছাগল- চরা পয়সা গুলা
এগলা বসি খেলি মা,
মা আমার বিহা দিলি না।

হাঁকুকু– হাঁকুকু
বাজনা এলো দ্যাশেতে,
মা আমার বিহা দিলি না।

ও মোড়ল ভাই, ও মোড়ল ভাই
আমার ছাগল ছাড়ো না,
মা কেনে বিহা দিলি না।

উ পাড়ার শোভান শ্যেখ
আমার পথ তো ছাড়ে না,
মা কেনে বিহা দিলি না…

শেষ হতেই আবার আক্ষেপ ভাবী – সখি- বেয়ান এলাতান বেওয়ার জন্যে….. আর আমার গলায় তেমুন সুর খেলেনি গো…. অবশ্য আক্ষেপ করতে করতেই নতুন আর এক গানে আবারও দাপুটে সুর অনায়াস খেলা করতে শুরু করেছে আঞ্জুমানারা বেওয়ার মহার্ঘ গলায়।

সংক্ষেপিত। খুব তাড়াতাড়ি দ্বিতীয় পর্ব আসবে।

________________________________
( গানটি “মেয়েদের কথাকল্প” বইতে গ্রন্থিত হয়েছে। এ ছাড়াও সন্ধ্যা ৬:৪৫ মি: এ একাডেমী অফ ফাইন আর্টস্ এ শুনতে পাবেন থিয়েটার ওয়ার্কশপের নাটক “বিয়ে গাউনি কাঁদন চাপা”তে।)
________________________________

পদ্ম- তাজমহল

পদ্ম- তাজমহল

যে জন আমার হাত ছাড়িয়ে উল্টো পথে নজর ছড়িয়ে দিতে দু’টি বার ভাবলো না, উল্টে আমাকে দূরে ঠেলবার যাবতীয় যুক্তিগ্রাহ্য নখ- চুল- রেশমের পাথুরে প্রমাণ খুঁড়ে সযত্নে সাজিয়েছে অলীক – সাক্ষ্যসার …

তিনি দূর থেকে প্রণম্য রয়ে যাবেন। আরতো
কাছে যাবার যোগ্যতা রইলোনা। রইলোনা
আরোগ্যের, সেবারও অধিকার কোনো।
কিন্তু, কী মুশকিল! একতরফা ভালবাসি
যে এখনো। খুব খুব চাইলেও, অন্যমনা
বিবাগীর সুর গলায় যে এখনো আসেনা!
আবেগে টইটম্বুর হৃদপিণ্ডে তোমারই যে
নামজপ নিরন্তর দিবারাত্রি – চব্বিশ প্রহর।

তোমারি পায়ের ধুলোয় রঙচঙে এ পদ্ম- তাজমহল,
ধুই, মুছি, চুলের পালিশ দিয়ে শয্যা নিই আশ্চর্য কোমল!

আয় বৃষ্টি ঝেঁপে

আয় বৃষ্টি ঝেঁপে

এখন বর্ষার খবর- ছবি সবই মিডিয়া বাহিত। অল্প বৃষ্টিতেই কোন রাস্তায় কোমর অবধি জল, কোথাও থাক থাক ইটের ওপোর খাট তুলে দিয়ে অগোছালো সংসার আগলে থাকা, কোথাও মাথার ওপোর গামলা তার ওপোর বুড়িমাকে বসিয়ে জল পেরোবার চেষ্টা, এমনকি জনপ্রিয় অভিনেত্রী জুতো হাতে রিক্সায় বসে জল কাটাচ্ছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।

বর্ষার বিবরণ শুনেছিলাম আমার মাসি দিদা, ছোটবেলুনের দিদার কাছে। কোথায় লাগে মিডিয়ার থার্ড আই এফোর্ট!

ছোটবেলুন হলো বর্ধমান জেলার অন্তর্গত ভাতার থানার এক বর্ধিষ্ণু গ্রাম। আমার মায়ের মাসীর বাড়ি। তখনকার দিনে বোনের মেয়ে আর নিজের মেয়ের কোন তফাত থাকতো না। আমরাও আপন মামাবাড়ির আদর পেয়েছি ছোটবেলুনে।

তো, আমার মায়ের মাসি রানীদিদা নাতি- নাতনিদের জুটিয়ে নিয়ে সন্ধেবেলায় গল্পের আসর জুড়তেন। এমন কিছু রাজা-গজা- যুদ্ধ – বিগ্রহের কথা নয়, সাধারন নিত্যিদিনের সাদা সাপ্টা কথা দিদার মুখে, তাঁর বলার ঢংয়ে কেমন অসাধারন রঙীন হয়ে ফুটে উঠতো।

…. তো জানিস ভাই, সেকালে বর্ষাকালকে আমরা রীতিমতো সমীহ করে চলতুম। গাঁ- ঘরের ব্যাপার, বুঝতেই পারিস, আর তখন তো এমন বাড়ির দুয়োর পর্যন্ত বাস আসতো না, বর্ষাকালে যেদিকেই যাই দু- আড়াই ক্রোশ কাদা না ভেঙে পিচ রাস্তায় ওঠার তো বাগ নেই। আর বর্ধমান জেলার তো বিখ্যাত এঁটেল মাটির কাদা! পারতো পক্ষে কেউ বর্ষাকালে বাইরে বেরুতে চাইতোনা। আছাড়ি পিছাড়ি, হাত- পা ভেঙ্গে প্রাণ হাতে করে বাড়ি ঢোকাই তো দুষ্কর! তাই পারতপক্ষে বর্ষাকালে কেউ পথে বেরোতনা।

আর সে বর্ষাও কি যে সে!!
লাগাতার দশ- বারো দিন আকাশ কালো করে ঝমঝমানি বৃষ্টি। আশপাশ- সামনে পেছনে কোনও দিকে দৃষ্টি চলে না। স্নান করা কাপড় চোপড় তিন- চারদিনে ঘরের আওতায় শুকতো। শুকোবার পরেও কেমন স্যাঁতসেঁতে। আবার নতুন করে, রান্না হবার পর, উনুনের ওপোর বেতের ঝুড়ি উবুড় করে কাপড় – চোপড় সেঁকে গরম করে তবে যেয়ে পরনের যুগ্যি!

তো সারা সারা দিনরাতের লাগাতার ঝমঝমানি চতুর্দিক আঁধার করা বৃষ্টি।
আমাদের চাষবাসের ঘরে বর্ষাই তো ভরসা! বর্ষাতেই তো চাষআবাদ।বর্ষাই আশীর্বাদ।

আবার এমন তোড়ের লাগাতার বৃষ্টি সীমা ছাড়ালে আতঙ্কও এনে দেয়। বৃষ্টিরও তো রকমফের আছে ভাই। সারারাত বৃষ্টি হয়ে দিনে যদি রোদ ওঠে, তবে তা চাষের পক্ষে খুব মঙ্গল। গাছে পোকামাকড় লাগতে পারেনা। রোদের তেজে মরে যায়। আর উল্টোটা হলে কিন্তু বড়ই বিপদ। ডাকের কথাতেই আছে :
“দিনে জল রাতে তারা,
সে বছর নিশ্চিত খরা।”
তো, বর্ষা তো আর কারুর বশ নয় ভাই। যেমন বর্ষা, তেমন ফসল, তেমনই সারাটা বছরের জীবনযাপন।

তো, এই বর্ষাকে সমীহ না করে উপায় আছে!!

বর্ষা আসার মাস তিন- চার আগে থেকেই গাঁ- ঘরে সাজো সাজো রব। ভাতের ধান, মুড়ির ধান সব আলাদা আলাদা চেহ্নোত্ করা বস্তায় সিজিয়ে, শুকিয়ে, ভাঙ্গিয়ে এনে থাক করে লাট্ দেওয়া। বাড়ির কর্তা গিন্নির সঙ্গে পরামর্শ করে শহরের বাজার থেকে তিন চার মাস চলার মতো তেল- ঝাল- মশলা- ডাল- পাঁপড়- বাদাম – চিনি- ময়দা- সুজি ইত্যাদি ইত্যাদি এবং ইত্যাদির বিরাট ভাণ্ডার আগাম খরিদ করে গরুর গাড়ি বোঝাই করে ভাঁড়ার ঘর ভরিয়ে দিতেন। বাড়ির বৌ- ঝিরা চড়া রোদে পিঠ করে ঝোলের বড়ি, ভাজা বড়ি, চালকুমড়োর বড়ি, উচ্ছের বড়ি ইত্যাদি রকম রকম বড়ি বয়েম ভরে মুখ এঁটে রেখে দিতো। কি, না বর্ষা নামলে তো আনাজ কিনতে শহরে যাওয়া যাবেনা, আর শহর থেকেও কেউ গাঁয়ে হাঁটুভোর কাদা ঠেলে বিচতে আসতে পারবেনা। আর হতো আমসত্ত্ব, আমসি, গুড়আম, আমতেল ইত্যাদির স্টক। বড়ো বড়ো পাকা কুমড়ো, আলু, পেঁয়াজ সব ওপোরতলার আলাদা সব্জীঘরে হাওয়া খাইয়ে রেখে দেওয়া হতো। তার পরেও, মেয়ে বৌরা শীত ফুরোতেই বিরাট বিরাট বাঁধাকপি, ফুলকপি ঝিরি ঝিরি করে কেটে চড়া রোদে শুকিয়ে তুলে রাখতো বর্ষায় আনাজ আকালে তরকারিটা চালিয়ে নেবার জন্য। তাবাদে, ঘরের পুকুরের মাছ, হাঁসের ডিম তো পাওয়া যেতোই।

তবে শুধু পেটের কথা ভাবলেই তো হতোনা, আপদবিপদের কথাও আগাম ভেবে রাখতে হতো। মেয়ে – বৌ অন্তঃসত্ত্বা হলে, বর্ষার মধ্যে হবার দিন পড়লে, তাকে শহরে বাপের বাড়ি, কি শ্বশুর বাড়ি রেখে আসা হতো। দুকুলেরই নিবাস পাড়াগাঁ হলে মা সমেত নিকটাত্মীয়ের বাড়ি। ওতে কেউ কিছু মনে করতোনা। তখন ওটাই রেওয়াজ ছিল। সামাজিক কর্তব্য হিসেবে পালন ও করতো সবাই। আর হঠাৎ করে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে, গোটা গ্রাম এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে উদ্ধার করে দেবে বিপদ।
ডুলি বেঁধে কাঁধে করে যত কষ্টই হোক ঠিকপৌঁছে দেবে দূর শহরের হাসপাতালে।

বর্ষা এলেই হলোনা, তাকে রীতিমত সম্ভ্রমভরে বরণ করে তুলতে হতো আমাদের।

এলোমেলো দিন

এলোমেলো দিন

কথা দিয়েও তুমি এলেনা …
এলেনা তো।
ক- তো কিছু এলোমেলো হলো তুমি জানো?

জানোনা।

জানলার পাশ ঘেঁষে এবছরেই নতুন প্রসূতি ঝামুর- ঝুমুর কু্ঁড়ি- ফুলে হেলে যাওয়া যে বেলিগাছটা ছিল,
ওর গায়ে হাত না দেবার প্রতিজ্ঞা ভাঙচুর হয়ে গেলো তোমার আসার আশায়।
শ্বেতপাথরের পুজোর থালায় মালা নয়,তবু মালার মতই একটা একটা করে সুডৌল বিনি সুতোর মালা-মতো সাদা বেলি সাজালাম খাটের গা-ঘেঁষা সাইড টেবল্ জুড়ে।

ঠাম্মার আমলের সাবেকি চাঁদির বাসনপত্তর
আরো একবার গা- মুখ মেজে ঝাঁ- চকচকে রূপসী হয়ে উঠলো,
তুমি একটি বার এঁটো হাতে ছু্ঁয়ে দেবে বলে।
ওরাও আশাহত মুষড়ে মলিন।
তুমি এলেনা বলে …

কাশ্মীরী স্টিচের অতি সৌখিন,
কখনো প্রাণে -ধরে না-পাতা আনকোরা
বেডশিট, ম্যাচিং পিলো কভার,
আসার আশায় বহুক্ষণ দক্ষিণের জানলা
বেয়ে ভেসে আসা তেরছা রোদ্দুরে মিছিমিছি এলোমেলো মাখামাখি হলো……
তুমি তো এলেনা।

আরো যে কতো না- বলা দেওয়া- নেওয়া
রয়ে যায়।
আরো কতো, ক- তো যে …

দিনরাত এক করে চোখ বিঁধে ফুল তোলা রেশমী রুমাল … পিসি বকেছিল, রুমাল দিলে নাকি চির বিচ্ছেদ নিশ্চিত্। তাই ভেবে রেখেছিলাম একটা টাকা চেয়ে নেবো দাম …

কোন লেনদেন ব্যতিরেকেই যা ঘটার ঘটে গেলো …
খুঁটিয়ে জেনে নেওয়া তোমার পছন্দের
বেশ কিছু রেয়ার কালেকশন- বুকস্ …
‘আমার কুটির’ থেকে বেছে আনা
বাটিক প্রিন্টের কী দারুন একটা লেদার সাইড ব্যাগ….

বহু বেছে তবে আনা প্যান্টালুনসের
চোখ- টানা টাই আর কাফলিঙস্….
সব, স- ব বড়ো অসুবিধেয় ঠেলে ফেলে দিল …

আগাম উৎসর্গীত নৈবিদ্যির সর্বসেরা বাছাই জিনিষেরা,
একযোগে বড্ড বিপদে ফেলে দিল, জানো …
না পারি ফের আবার তুলে রেখে দিতে, না পারি প্রাণে ধরে জলে ফেলে দিতে …
বড্ড দোটানায় প্রাণ যায়, জানো ….

বড়ো এলোমেলো হয়ে গেলো স-ব।
সত্যি বড়ো টালমাটাল হয়ে গেলো …

এলে না যে … !!