রোমেল আজিজ এর সকল পোস্ট

রোমেল আজিজ সম্পর্কে

শখের বশে কবিতা লেখা শুরু, কিন্তু নিজেকে কবি বলে পরিচয় দেন না। প্রচুর বই পড়েন, বই পড়া পছন্দ করেন, শুধুমাত্র কবিতার বই নয় যেকোন বই। আর মাঝে মধ্যে টুকিটাক লেখালেখি। বর্তমানে শখের বশেই সম্পাদনার সাথে যুক্ত আছেন "দ্বিপ্রহর" কবিতা ও গল্প সংকলন এবং "দ্বিপ্রহর" ম্যাগাজিনের সাথে। প্রিয় কবি জীবননান্দ দাশ, এছাড়া রবীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসু, হেলাল হাফিজ, শামসুর রাহমান, সুনীল, আবুল হাসানের কবিতাও প্রিয়। প্রিয় উপন্যাসিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। পড়ালেখা ছাড়া বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন, পছন্দ করেন একা একা বেড়াতে। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় জিনিস ঘুম আর অপ্রিয় জিনিস ধর্মীয় তর্ক....

তুমি চলে যাওয়ার পর

তুমি চলে যাওয়ার পর,
আমি দিন দিন একটা
জীবন্ত বৃক্ষে পরিণত হয়েছি ।

পাহাড়ি বৃষ্টি, বসন্তের বাতাস
কিংবা ভোরের কুসুম আলো,
একাকী কিছুই ভালো লাগে না আর ।
শতাব্দীর পর শতাব্দী জেগে থাকা
প্রাচীন নিঃসঙ্গ তারাগুলোর মতোই,
নিজেকে একাকী মনে হয় ।

সময়ের সাথে সাথে বৃক্ষ-
দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়,
বৃদ্ধ বৃক্ষ অফুরান ছায়া দিয়ে যায়
কাউকে দেয় নিরাপদ আশ্রয়,
তবুও কিছু ডাল শূণ্যই থেকে যায়
হারানো পাখি ফেরার আশায়;
একাকী অপেক্ষায়, যায় কেটে সময়
প্রাচীন বৃক্ষ আরো প্রাচীনতর হয়…

নিরঞ্জনের না বলা কথা – ২৮

উদ্বাস্তু মেঘগুলো যখন
উত্তর দক্ষিণ ছুটে চলে,
সেদিন আর বৃষ্টি হয় না।

এমনই এক গুমোট গরম লাগা বিকেলে,
উড়ন্ত মেঘের অদৃশ্য পথ দেখতে ছিলাম।
পাশে বয়ে যাওয়া নদীর
ঢেউয়ের শব্দ ছাপিয়ে
চিরচেনা সেই কণ্ঠস্বর।

-এই দিকটায় অনেক দিন
আসা হয় না, তাই না অরুণ?

-ঈষৎ চমকে, শুধু বললাম,
জীবন কি সবসময় এক পথে ছুটে?

– কি বুঝাতে চাচ্ছিস তুই?

-সময়ের সাথে সব পথই পাল্টায়,
বিপাশার পথ পাল্টানো,
সে তো সময়ের অপেক্ষা।

আনমনা নিরঞ্জন কিছুক্ষণ
চুপ থেকে, শুধু বললো–
“সব পথই যদি পথ পাল্টাতো,
নদী সবসময় সমুদ্রে ছুটতো না,
সমুদ্রও নদীর পথে ছুটতো।”

নিরঞ্জনের না বলা কথা ২৭

“সেখানে তখনো কাঁচপোকা ছিল
মেঘ তুলোর অবিরাম বর্ষণ নয়,
সে জলে ভাসতো না কোন কিছু
ভাসাতো আমাদের ক্ষুদ্র সময়।

জেগে থাকা পাপ মেনে
ঘুমায় সেখানে জারুল,
অতীতের রং মুছে
আমরা তখনও ব্যাকুল।”

-কী বলছিস, ছাইপাশ!

-তুই বুঝবি না।

– না বুঝলে চুপ কর।
বিপাশার রাগ কমেনি এখনও বুঝি!

– আচ্ছা অরুণ,
রাগ আর অভিমানের পার্থক্য বুঝিস?

-না, আমিতো আর নিরঞ্জন নই।

এরপর আচমকাই প্রগলভ হয়ে
নিরঞ্জন শুধু বললো-
“শুধুমাত্র রাগ একাকী নিরর্থক,
আবেগ সংমিশ্রিত রাগই
হয়ে যায় নির্বিষ অভিমান”।

নিরঞ্জনের না বলা কথা ২৬

সদ্য ঘুম ভাঙা কাউকে
মৃত্যু সংবাদও দিতে নেই,
প্রশ্ন তো ঢের দূরের জিনিস।
এই বোধটুকু আছে বলেই
নিরঞ্জনকে নিয়ে এতো কথা।

বৈশাখের অলস এক তপ্ত দুপুরে
হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে দেখি,
একা একা নিবিষ্ট মনে প্রায়
আদুল গায়ে মেঝেতে বসা,
আমাদের নিরঞ্জন।

– কিরে কখন এলি, ডাকলি না যে?

– তুইতো ঘুমোচ্ছিলি।

– তো কি হয়ছে, তুই হঠাৎ অসময়ে?

– জানিস অরুণ, ভয়ংকর খুনীও
ঘুমের মাঝে খুব অসহায় থাকে।

– কী জানি!

– হুম, পড়েছিলাম কোথায় যেন।
আচ্ছা বল তো,
ঘুমালে বিপাশাকে কেমন দেখায়?

– কিভাবে বলবো,
সেই সৌভাগ্যতো আমার হয়নি!

ঝড়ের বেগে দাঁড়িয়ে,
আরক্ত চোখে শুধু বললো,
“জীবন নিয়ে রসিকতা
করতে হয় না রে অরুণ,
বন্ধুত্ব মানেই হাসি তামশা না।”

প্রতীক্ষা

নারকেলের ডালে স্থির
বসে, কালো কাক;
বুভূক্ষু চাহনিতে তার
জীবনের নির্মম বাস্তবতা,
ভেসে উঠে অস্পষ্ট আলোয়।

পিলপিল করে মানুষগুলো যাচ্ছে
পুরোনো সেই একঘেয়ে কাজে,
তাদের নেই কোন কষ্ট,
নেই কোন আনন্দ, রোমাঞ্চ;
আছে শুধুই হতাশা।
যন্ত্রমানবের মত ঘুরছে তারা,
সমৃদ্ধ করছে এই সভ্যতা।

মাঝে মাঝে তারা থামে
উর্বশীর কৃত্রিম ছায়ায়,
সুরে বেসুরে ঢালে
জমানো সব সুধা।

তবুও কালো কাক
আছে বসে, প্রতীক্ষায়
সময় পরিবর্তনর আশায়;
কিন্তু
ব্যস্ত মানুষগুলোর তাতে আর
কী আসে, কী যায় ???

শর্ত

মধ্য চৈত্রের দুপুরে যে লু হাওয়া
শহরতলীর গলি জুড়ে বয়ে যায়,
অনেকটা সেভাবেই জীবন ছুটে
নানান ভুল শর্তের বেড়া জালে।

ষড়ঋতু নিয়ম মেনেই চলে,
ষড়রিপুর কোন নিয়ম নেই।
হয়তোবা তাই এখন আর-
বিষণ্নতা আমাদের পোড়ায় না
আমরাই বিষণ্নতার আগুনে পুড়ি,
তাই হয়তোবা এখন আর-
বিষণ্নতা আমাদের ডোবায় না
আমরাই বিষণ্ণতার জলে ডুবি।

মদিরা কণ্ঠনালীতে গড়ালেই
সব মানুষ মাতাল হয় না,
মাতাল হয় লোভ-ঘৃণা-পাপে।

নগরস্রোত

ফুটপাত ঘেঁষে দুরন্ত বেগে ছুটে চলা ট্রাকের চাকায়
উড়ে যাওয়া ধূলোর কান্নাও শুনতে পায় পাথরকনা,
পিচ উঠা রাস্তার গর্তে জমে থাকা নোংরা জলেরও
আছে হাজার না বলা দুঃখ গাঁথা।

ডাস্টবিনের বাইরে ছড়িয়ে থাকা আবর্জনার মূল্য
নেড়িকুকুরের চেয়েও কম বুঝেনা পথ শিশু,
চার চাকার কাঁচের দেয়ালের আড়ালে
শীতলতায় ডুবে থাকা দেহ গুলো জানেনা
বৃদ্ধ রিকশা চালকের ঘামের আত্ম অহংকার।

জীবন চলে, জীবন বয়ে যায়
মুখে কুলুপ, চোখে ঠোলা এঁটে,
নগরস্রোতে মানুষ যায় হারিয়ে।

মেঘদূত

যাও মেঘদূত,
চুপিচুপি বলো কথা
তাহার কানে …

যাও মেঘদূত,
চুপিচুপি বলো এই
অসীম আঁধারে …

যাও মেঘদূত, রাত্রি দ্বিপ্রহরে
চুপিচুপি বলো আমার কথা
এই অসীম আঁধারে তাহার কানে …

অনুতাপ

যে মাঝি বৈঠা মারে স্রোতের হীতে,
সেই মাঝিই জানে
জীবন সামনে কি করে ছুটে।

যে নারী করে প্রণয় ভ্রান্ত মোহে,
সেই নারীই বুঝে
সবই একদিন বেলা শেষে।

যে নাবিক মাতাল চোখে দূর আকাশ দেখে,
সেই নাবিকই বুঝে
একাকীত্বের জ্বালা এক সমুদ্র কষ্ট নিয়ে বুকে।

যে পুরুষ করে গমন রমন সুখে,
সে পুরুষই ভুগে
হতাশায়, পুঁড়ে অনুতাপের বহ্নিশিখে…

নীরব কোলাহল

সেই কবেই থেমে গেছে
চৌরাস্তার কোলাহল,
এক এক করে গেছে কেটে
ঊনিশটি বছর !
কিন্তু হুল্লোড় থামেনি আজো
শহরতলীর কোনে ;
একাকী পড়ে থাকা
শেষ বাড়িটায়।

মনে পড়ে এখনো –
ভর দুপুরেও নীরবতায় থাকতো ডুবে,
বুনো অর্কিডে ঘিরে থাকা
অদ্ভুত সেই শেষ বাড়িটা।

রাত গভীর হয়, কাটে সময় ;
শেষ বাড়িটা প্রাণ ফিরে পায়।
শরাব শঙ্খ তনু যখন
মিলেমিশে হয় একাকার ;
সময় যে তখন –
এই রাত্রি দ্বিপ্রহর …

শব্দান্ধ

যেখানে উড়ে আকাশে
শঙ্খ শকুনের দল,
সেখানে নাহয় দিব ছুঁড়ে
এক মুঠো সফেদ মেঘ ফুল।
.
লিওনিদোভিচ ঘুমিয়ে থাকুক
ভিজুক ওষ্ঠ অগ্নি সরাবে,
ত্রিদিব মোহে ডুবুক পৃথিবী
শব্দান্ধের তাতে কী যায় আসে?
.
চলুক হরণ রাম রাবনে
সীতার তাতে কী দায় আছে,
ভাসুক কলম লোহিত জলে
হতাশা বাড়ে যে মিথ্যা আশ্বাসে।

অচিন শহর

রংচটা ধূসর অচিন এ’শহরের
অসংখ্য বিবর্ণ দেয়ালজুড়ে,
হয়তোবা রয়েছে লেখা
হাজারো অদৃশ্য লাইনের
পঙ্কিলতার নির্মম ইতিহাস।

ডাস্টবিন উপচেপড়া ময়লা
ঢাকনাহীন ম্যানহোল,
মানুষ, মানুষ আর কোলাহল
চলে অবিশ্রান্ত, অবিরাম।
এসব নিয়েই শাসক শোষিতের
মিথ্যায় ভরা অভিশপ্ত এ’শহর।

অথচ আমাদের গ্রামটা ছিল
ঐতিহ্যের সমাহারে ভরপুর,
বর্ষায় শাপলা শালুক
শীতের তালপুকুরের ঘাট,
ভোরের একেলা জলফড়িং।

গল্পের মতো শৈশব কৈশোর,
জোছনার মতো উৎসব
হেমন্তের পাকা ধান,
সবই আজ বিস্মৃত ম্লান
শহুরে কুহকের টানে।
সবই আজ নিষ্প্রাণ
কাছাকাছি থেকেও,
দেয়ালের এপাশ-ওপাশে…

অপাংক্তেয়

শেষ যে উল্কাটা খসে পড়লো,
সে পথে এখনো খুঁজলে পাবে
আমাদের পায়ের ছাপ।
.
হয়তোবা এ কয়দিনে
শীতের কিছু ঝরা পাতা,
শিমুলের বিচ্ছিন্ন তুলো
অথবা বন মোরগের
পাখার ঝাপটার ধূলো,
দিয়েছ ঢেকে ছাপগুলো।
ধূলোয় পাতায়
যায় ঢেকে স্মৃতি গুলো।
.
অভিমান অভিযোগে
হারায় নিঃসংগ সময়,
কাটে দীর্ঘ রাত্রির পরে
দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা বিহীন
দীর্ঘ এক একটা দিন।
কাটে দীর্ঘ দিনের পরে
একেকটা নির্জন রাত্রি
দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা বিহীন।

কল্পিত সুখের ভ্রম

শব্দের গায়ে মরীচিকা পড়ছে,
কৃষ্ণপক্ষের ঝরে যাওয়া উল্কার মতো
ক্ষয়ে যাচ্ছে শব্দ গুলো,
আমার অলেখা কবিতার।

ছন্দ ব্যাকরণ পড়েছিলাম স্কুলে,
সেই যে কবে !
যে বছর যমুনা সেতু হলো
তার আগে থেকেই জানতাম
দীর্ঘতম শুধু সেতুই হবে,
সম্পর্ক নয়।

কেউ বাস্তবতাকে সঙ্গী করে
যায় চলে অবেলায়,
কেউবা আবার দেয় ধোঁকা
দিন অথবা রাতে,
তাতে তার আর
কিইবা আসে যায় ?

গোপন রেখে
মনের অভিলাষ,
কেন যে দেয় তারা
মিথ্যা আশ্বাস ?
প্রণয় কিংবা প্রশ্রয়
যায় ডুবে সব,
কল্পিত সুখের আশে ;
নিরাপদ ভবিষ্যৎ নামক এক
কুহকের পোতাশ্রয়ে …

মানুষের গল্প -৮

হোক সাদা কিংবা কালো;
রঙে কী বা যায় আসে !
হাসির পেছনে ছুঁরির ফলা
লোভীরাই যে পুঁড়ে
আত্ম অনলে শেষে।

শান্তির শপথে পায়রা পুষে;
অহংকারী কি পায়,
শান্তি অবশেষে ???