রোমেল আজিজ এর সকল পোস্ট

রোমেল আজিজ সম্পর্কে

শখের বশে কবিতা লেখা শুরু, কিন্তু নিজেকে কবি বলে পরিচয় দেন না। প্রচুর বই পড়েন, বই পড়া পছন্দ করেন, শুধুমাত্র কবিতার বই নয় যেকোন বই। আর মাঝে মধ্যে টুকিটাক লেখালেখি। বর্তমানে শখের বশেই সম্পাদনার সাথে যুক্ত আছেন "দ্বিপ্রহর" কবিতা ও গল্প সংকলন এবং "দ্বিপ্রহর" ম্যাগাজিনের সাথে। প্রিয় কবি জীবননান্দ দাশ, এছাড়া রবীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসু, হেলাল হাফিজ, শামসুর রাহমান, সুনীল, আবুল হাসানের কবিতাও প্রিয়। প্রিয় উপন্যাসিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। পড়ালেখা ছাড়া বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন, পছন্দ করেন একা একা বেড়াতে। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় জিনিস ঘুম আর অপ্রিয় জিনিস ধর্মীয় তর্ক....

নিরঞ্জনের না বলা কথা – ২৫

মাধ্যমিক শেষেই আমাদের সুতো
ছেঁড়ার গল্পটা শুরু, কেউ মফস্বলে
কেউ শহরে এভাবে বিচ্ছিন্ন আমরা
কাটা পড়া ঘুড়ির মতোন।

ঈদ পূঁজোয় ক্ষনিকের হৈ হুল্লোড়
ছুটির শেষে অলিকপানে দৌড়,
এভাবে বয়ে চলা সময়ের মাঝেও
কেউ কেউ কারোতে মগ্ন বিভোর।

কিছু সুতো যায় ছিঁড়ে
আবার কেউ কেউ সেই সুতোয়
রং মেখে স্বপ্নের জাল বুনে।
তাই হয়তো কখনো নিরঞ্জনকে
আমরা আশাহত হতে দেখিনি,
বিপাশার তাচ্ছিল্য, বাঁকা হাসি
সবই মিশে যেতো নির্লিপ্ততায়
একাকী বুনে যাওয়া জালে

শীত শেষে
এক শিমুল রাঙা লালচে বিকেলে বললাম,
” জাল বুনতে শেখার আগে
জাল মারা শিখতে হয়,
তা কি জানিস নিরঞ্জন? ”

চোখ না তুলেই
শান্ত স্বরে শুধু বলল,
” আগে সাঁতার শিখে
কেউ কি জলে নামে রে অরুণ,
জলে নেমেই যে তবে
পরে সাঁতার শিখতে হয়……..

নগর জীবন

সীমাহীন নিয়ে সীমাবদ্ধতা নিয়ে
অলীক পানে আমাদের ছুটে চলা,
ইটের উপর ইট গেঁথে যে নগর গড়ে উঠে
সেই নাগরিক দেয়ালের পেছনেও
কিছু না কিছু, না বলা গল্প থাকে।

সুতো ছিঁড়ে গড়িয়ে যাওয়া শার্টের বোতাম
খাটের নিচে খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে আসে
প্রায় ভুলে যাওয়া হাজার মলিন বিস্মৃত স্মৃতি।
চুলের ক্লিপ, বিবর্ন টিপ, মরচে পড়া টাই পিন,
প্রতিটা বস্তুই একেকটা গল্প হয়ে সামনে দাঁড়ায়।
জীবনের ব্যাস্ততায় আমরা ভুলে যাই
আমাদের দেয়ালেও দু ‘একটা জানালা আছে।
সেই জানালা দিয়ে দেখা যায়
শুক্লপক্ষের রাতে আকাশভরা জোছনা,
শ্রাবণ রাতের ঘন বর্ষনে হাত বাড়িয়ে
ছোঁয়া যায় বৃষ্টির শীতল জল।

ব্যাস্ততার মিথ্যা অভিনয়ে ডুবে
সপ্তাহান্তে চালাই বুনো উল্লাস।
ভুলে যাই দেয়ালের ওপাশেও
অচেনা হাজার মানুষ আছে।
সেই মানুষগুলোর চোখেও
আছে সীমাহীন অদেখা স্বপ্ন…

দূরে কোথাও

মধ্যরাতে দক্ষিণ জানালা
হয়ে যায় কালের আয়না,
রাস্তা নেড়ি কুকুরের গর্জনে
ঢেকে যায় লঞ্চের হুইসেল।

জ্বলে লাল নীল হলুদ বাতি
রেন্টাল, কুইক রেন্টাল,
পাওয়ার হাউজের উপর।

ম্রিয়মান উদাস তারা ভাসে,
সপ্তর্ষিহীন আঁধার আকাশে।
গলায় নামে তরল আগুন
রক্ত রংয়ে মগজ ঘোলাটে
ফুসফুস ভরা ধোঁয়ার বিষে,
মাথার ভিতর ঘুরছে যেন –
দূরে কোথাও
কে হাসে, কে হাসে…

মাধবীলতা

মাধবীলতা বেড়ে উঠছিল
সে-সময়, সকাল – বিকেল।
এ-পাড়া ও-পাড়া বেড়াতে বেড়াতে
উড়তে উড়তে দূরে দূরে
জড়িয়ে গিয়েছিল, অদৃশ্য সুতোয়।

যেদিন মাকড়সা এলো
বুনলো নতুন জাল
পুরনো সুতোয়;
সেদিন থেকে দিন ফুরালো-
ফিরলো না আর সুদিন
মাধবীলতার…

কত দিন যে সমুদ্র দেখিনা

তুই কী জানিস তোর দু’চোখে
আলো আঁধার খেলা করে,
খেলা করে মৌনতার বিষণ্ণ রঙ।

মন খারাপের দিনে
আমি আকাশ দেখিনা,
দেখি অস্থির চোখের
অফুরান কৌতুহল।

জানিস অনুসৃতা,
কত দিনে যে আমি
সমুদ্র দেখিনা,
সমুদ্র যে গিয়েছে ডুবে
তোর দু’চোখের অতল…

নিরঞ্জনের না বলা কথা – ২৪

পথ কখনো সরল রেখার মতো চলে না,
সরলরেখার মত চললে নিরঞ্জন বিপাশার
আর না বলা কোন কথা থাকতো না।

শীত গ্রীষ্ম বর্ষার দিনগুলো
তাই কেটে যেতো নিমিষেই।
এক শিউলী ঝরা হিমের সকালে
জিজ্ঞেস করেছিলাম –
“চাইলেই যদি পাওয়া যেতো
সেই পাওয়ার তো কোন মূল্য নেই,
বিপাশা নামক অনিশ্চয়তার পেছনে
আর কত ছুটবি তুই নিরঞ্জন? ”

সদা গম্ভীর নিরঞ্জন,
ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসি
রেখে দিয়ে শুধু বললো –
“অনিশ্চয়তার কারনেই
জীবন এতো কঠিন,
অনিশ্চয়তার কারনেই
জীবন এতো সুন্দর …”

থার্মোমিটার‬

পারদের ঘর যখন একশো দুই ছুঁই ছুঁই,
এখান থেকে আমার ভেসে চলা শুরু।
মহাকর্ষের নিয়ম ভেঙে,
তখন আলোর বেগে ছুটে চলা…

নিউরনে নিউরনে হাজার
আলোক বাতি…
লাল-নীল-হলুদ-সবুজ
নীল-লাল-সবুজ-হলুদ,
চারদিক রিমঝিম
ঝিমঝিম রিমঝিম।

চোখে ভাসে স্কুলের বেঞ্চ
চক -ডাস্টার, পাটিগণিত।
স্রোতের অনুকূল প্রতিকূল ছাপিয়ে
কানে বাজে ছলাৎ ছলাৎ…

সেখান থেকেই আমার ডুবে যাওয়া শুরু
পারদের ঘর এখন একশো চার ছুঁই ছুঁই…

নিরঞ্জনের না বলা কথা – ২৩

শীতের রাতে রসের হাঁড়ি
কিংবা গ্রীষ্মে আম কাঁঠাল,
চুরি করলেও আমরা কখনো
ঘরের খেয়ে বনের মোষ
তাড়ানোর মতো ছিলাম না।

বিপাশার কল্যাণে নিরঞ্জন ছিল
বয়সের তুলনায় অতি গম্ভীর।
মাঝ কৈশোরে আমাকেও
অর্ধেক বুড়ো বানিয়ে দিয়েছিল।
এর মাঝেই একরাতে বিশু,
সৌমেন আমি মিলে দিলাম
বিপাশার বাড়িতে হানা।
ভূড়ি ভোজন শেষে
মুরগির হাড় সব ফেলেছিলাম
নিরঞ্জনের ঘরের পেছনে।

সন্ধ্যায় পারমানবিক রাগ নিয়ে
ফেটে পড়লো আমাদের নিরঞ্জন,
কপালের বাঁ দিকের কাটা দাগটা
দেখলে এখনো মনে হয়,
আমরা বোধহয় সেদিন শুরু
বিপাশার শখের মুরগি খাইনি,
খেয়ে ফেলেছিলাম নিরঞ্জনের
হৃদয় জড়ানো বাঁ পাশের পাঁজর

চার দেয়াল

বাম দিকের নীল দেয়ালটা
শোনায় আমায় দুঃখে গাঁথা
অন্ধকার রাত্রিগুলোর কথা।

ডান দিকের সবুজ দেয়ালটা
মনে করায় বর্ষায় সিক্ত
শালবনের নির্জনতায়
অচিন কুহকের টানে
একাকী হারিয়ে যাওয়া।

পেছনের হলুদ দেয়ালটা
স্বাক্ষী হয়ে আছে দাড়িয়ে,
জোনাকজ্বলা শীত রাত
আর মেঘলা জোছনার মাঝে।

সামনের লাল দেয়ালটা বলে
গোধূলীলগ্নের রক্তাভ আকাশের
পরাজিত সূর্যটার কথা,
যেকিনা তোর মতোই আলো হয়ে
রাখে ঘিরে সারাবেলা সংগোপনে,
আবার তোর মতোই অবেলায়
ডুব দিয়ে হৃদয় পোড়ায়,
রেখে যায় অনিশেষ
স্মৃতির পোড়া ছাই।

বদলে যাওয়া সময়

মাছরাঙাদের জীবনও বদলে গেছে অসময়ে,
দেহ বিচ্ছিন্ন ঝলমলে রঙিন পালকগুলোতে
এখন লেগে আছে রক্তের কালচে দাগ।

সময় দিয়েছে বদলে
ঘাস ফড়িংয়েরও জীবন,
যেভাবে পাল্টে দিয়েছে
নদী -নারী -বন!

সময় বহমান, নদী প্রবাহমান;
বহমান -প্রবাহমানের দোলাচলে
গাংচিল উড়ে যে নদীর বুকে,
সেই নদীও বদলায় পথ
ক্ষুদ্র চরের বাধার কাছে।

ক্ষুব্ধ নদীও ব্যার্থ হৃদয়ে বদলায় পথ,
ভেঙে দিয়ে লোকালয় ;
বদলিয়ে দেয় তোরই মতন
অনুশোচনায় আক্রান্ত হাজার জীবন।

কেউ সুখে নেই

ওপাড়ার শালিকটার কথা মনে আছে কি তোর,
প্রতিবেশীর ছাদে শুকাতে দেওয়া ধান খেয়ে ফেলত?
আজ দেখলাম সিঁড়ির উপরে চুপ করে বসে আছে
মাছরাঙার মত গম্ভীর হয়ে, চঞ্চল আদুরে পাখিটা।

মনে কি আছে তোর, বিরেণদের বাড়ির পেছনে
পরিত্যক্ত মন্দিরে থাকা, কালো বিড়ালটার কথা?
কাল দেখছিলাম কেমন যেন বিষণ্ন হয়ে হাঁটছিল
ভাঙা কার্ণিশের ধারে।

আছে কি মনে তোর, সেই মেয়েটার কথা?
স্কুল থেকে ফেরার সময়
আমি ভুল করেও তার দিকে তাকালে
হিংসায় জ্বলে উঠতো তোর দু ‘চোখ।
সেদিন দেখলাম মুছে গিয়ে সেই হাসি,
মেয়েটা হয়ে গিয়েছে কেমন যেন নিশ্চুপ!

জানিস অনুসৃতা,
ইদানীং আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবি-
আহ্নিক গতি মেনে চলা এ পৃথিবীতে,
ভাল নেই কেউ, কেউ সুখে নেই।

কবিতার মুক্তি চাই

নিষ্প্রেশিত কিছু শব্দের আর্তনাদ
শুনতে কি পাও না তুমি,
অবুঝ ছন্দ-বৃত্তের শেকল থেকে
কবিতা আজ চায় মুক্তি।

বৃত্তের সীমাবদ্ধ পথের পরিধি
বন্য ঘাসে যাবে ঢেকে একদিন,
বৃদ্ধ ছন্দ গুলো হবে ম্লান
আমাদের পূর্ব পুরুষদের মতন;
রয়ে যাবে ইতিহাসে
স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে,
যেভাবে মঙ্গলকাব্য চর্যাপদ আছে বেঁচে
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে।

জানি বন্দী শব্দগুলো
একদিন পাবে মুক্তি,
সৃষ্টি করবে নতুন পথ।
যে পথে হাঁটবে কবিতা,
সদ্য হাঁটতে শেখা শিশুর মত।
বন্দী অব্যক্ত কল্পনা গুলো
ছুটবে সে পথে,
সুফিয়া কামালের সেই দস্যি
নওল কিশোরকে হারাতে।

কেন ভুলে যাও তুমি
অগ্রজদের অমর বাণী –
‘পথ পথিকের সৃষ্টি করে না
পথিকই করে পথের সৃষ্টি ‘।

মানুষের গল্প-৭

অবরুদ্ধ সেনাদলের আর
কোন যে উপায় থাকে না,
রক্ত নাও নচেৎ রক্ত দাও;
পরাজয়ে যে ডরে না বীর।

স্মৃতিময় শৈশব,
দুরন্ত কৈশোর ,
উচ্ছ্বল তারুণ্য;
একে একে সবই
ভাসে চোখে।
তবুও জীবন নিতে হয়
নিজ জীবনের জন্যে,
নিজ জীবন দিতে হয়
অপর জীবনের জন্যে।

কে তুমি, কে আমি ?

আমি তো নই
কোন লোকাল বাসের
ভাঙা কাঁচের জানালা,
আমি তো নই
কোন পরিত্যক্ত ট্রেনের
মরচে ধরা কামরা।

আমি তো নই শীতের
কোন রাত জাগা পাখি,
আমি তো ভুল তোমার
মিথ্যা স্বপ্নের ভাতি।

১১-০৯-২০১৫