শংকর দেবনাথ এর সকল পোস্ট
রসেকষে ভরা প্রবাদের ছড়া … শংকর দেবনাথ
আমার বাড়ি ছড়ার
আমার গ্রাম পাখির
গাছের সবুজ আঁখির-
চাষির হাসির স্বপ্নরাশির
নকসি করা কাঁথা-
মায়ের আঁচল পাতা।
আমার আকাশ নীলের
কল্পডানা চিলের-
বেড়ায় উড়ে অসীম জুড়ে
রূপকথাদের সাথে-
দিবস এবং রাতে।
আমার নদী ঢেউয়ের
তল পাবে না কেউ এর-
সোঁতায় সোঁতায় যায় সে কোথায়
সাত সাগরের দেশে-
স্বপ্নে হেসে ভেসে।
আমার বাড়ি ছড়ার
নিত্য নতুন গড়ার-
মুক্ত আগল। পাগল পাগল
ভালবাসায় মাখা-
আলো- আশায়। আঁকা।
প্রেমের পদ্য
ডাকছো আমায় চোখ ইশারায়
তোমার ঘরে-
তাইতো আমি কেবল ঘামি
গোপন জ্বরে।
দূরের বাঁশির সুরের হাসির
অরূপ কোণে –
কোন তিয়াসায় মন কী আশায়
স্বপ্ন বোনে!
মন নিয়েছো মান নিয়েছো
বন্ধু, এবার-
সময় কী গো হয়নি ওগো
আমায় নেবার!
ছড়াক্কা গাঁথাঃ কাকটা
ছড়াক্কাগাঁথা : কাকটা
ফাঁকটা বুঝে কাকটা নিয়ে মাংসের পিচ দোকান থেকে-
বসলো গিয়ে
পাশের বনে-
গাছের ডালে
তৃপ্ত মনে।
ব্যাপারখানা হঠাৎ করে শেয়াল মশায় ফেললো দেখে।
লোভের লালা ঝরঝরাঝর ঝরতে থাকে শেয়ালটার-
ভাবনারা সব
ইতর ইতর-
জমতে থাকে
মাথার ভিতর।
মাংসটুকু না পেলে আর ঘুচবে নাকো এ’হাল তার।
খানিক ভেবে নেবার পরে বুদ্ধি খোলে শেয়ালটার-
গাছের তলায়
এগিয়ে গিয়ে-
মিষ্টি কথার
সুর ঝরিয়ে
বললো – ও ভাই, ভক্ত আমি ভীষণ তোমার খেয়ালটার।
মিষ্টি গানের পক্ষী তুমি- লক্ষ্মীসোনা গাও না ভাই-
একটু মজি
তোমার গানে-
ছন্দ ও সুর
জাগাই প্রাণে।
কাক ভাবে- এই প্রশংসা ঠিক আমার আছে পাওনাটাই।
আনন্দে কাক জুড়লো কা কা- পড়লো ঠোঁটের মাংসখান।
খপ করে তা’
বাড়িয়ে হা-টা
গিলেই দিলো
শেয়াল টা টা।
ধোকায় পড়ে বোকাই সেজে কাকটা মলে নিজের দু’কান।
সুযোগ পেলেই এমনি করেই ফতুর করে চতুর লোক।
মিষ্টি কথায়
ভুললে পরে-
সব হারিয়ে
বোকাই মরে।
অতিশ্লাঘার মধ্যে থাকে লুকিয়ে লোভের নষ্টচোখ।
——-
বিঃদ্রঃ লেখাটি ছড়াক্কাজনক সতীশ বিশ্বাসের ছড়াক্কা পত্রিকায় প্রকাশিত
ও তে ওল
ওল খেয়ো না ধরবে গলা –
এই সাবধানবাণী-
প্রথম পাঠেই যোগীন্দ্রনাথ
করেছিলেন জানি।
ওল খেয়েছি না শুনে তাঁর
ছোট্ট নিষেধখানি-
হাজার ওষুধ খেয়েও এখন
যায় না সে চুলকানি।
– শংকর দেবনাথ
পরাণদাদার গল্প ৪
ভোজটা সেরে জোছনামাখা রাতে-
বাঁশের বাঁশি হাতে-
পরাণদাদা বসেন গিয়ে মাঠে।
মনবাউলা সুরের মধুবাসে-
কোন সুদূরে ভাসে-
বৃন্দাবনের নীলযমুনার ঘাটে।
নীরব রাতের সেই বাঁশিরব মেখে-
হঠাৎ ওঠে ডেকে-
রাতজাগা কোন পাখির ভালবাসা।
তাকিয়ে থাকে দূরের চাঁদ ও তারা-
ঝরান সুরের ধারা-
পরাণদাদা ছড়ান প্রাণের ভাষা।
ঠোঁট লেগে রয় মোহন বাঁশির মুখে-
পরাণদাদা সুখে-
যান বাজিয়ে দু’চোখ বুঁজে বুঁজে।
সেই বাঁশিসুর হৃদয়পুরের মাঠে-
স্বপ্ন হয়ে হাঁটে-
অরূপলোকের স্বরূপ খুঁজে খুঁজে।
পরাণদাদার গল্প ৩
সব্জিগুলোর কব্জি ছুঁয়ে
ভোরের বেলা উঠে-
পরাণদাদা গল্প শোনান
কল্প না তা মোটে।
হলুদ দুলের কুমড়ো ফুলে
ছোঁয়ান ভালবাসা-
পটল এসে দাঁড়ায় ঘেঁষে।
পরাণদা দেন আশা।
হলুদবনের সবুজ মনের
স্বপ্ন বুকে মেখে –
পরাণদাদা সরান না চোখ
লালশাকেদের থেকে।
আশায় বেঁধে বুকটা, বাসায়
ফেরেন যখন খেটে-
পরাণদাদার বারান্দাটায়
গল্প বেড়ায় হেঁটে।
পরাণদাদার গল্প
সরল-সাদা পরাণদাদা
লোকটি বড় ভালো,
মনের ভেতর বনের সবুজ।
নেই কোনো প্যাঁচ-কালো।
অভাব আছে। স্বভাবজাত
মিষ্টি হাসি ঠোঁটে।
মানুষ পেলে হুঁশ থাকে না।
কথার তুফান ছোটে।
দিন কেটে যায় খেটেখেটে
ফসল ক্ষেতে-ক্ষেতে।
কাজের শেষে সাঁঝের পরে
গল্পে ওঠেন মেতে।
রাত্রি আসে মাতৃরূপে।
পরাণদাদা শুয়ে-
বুকের মাঠে স্বপ্ন-সুখের
রূপকথা দেন রুয়ে।
অনুভব
হেসে মরা
রসেকষে ভরা প্রবাদের ছড়া বই থেকে ছোট্ট একটা ছড়া।
পরাণদাদার ছড়া – ১
পরাণদাদা ছড়ান ছড়া
বীজের মতন মাঠে-
সবুজ হাসির ছন্দরাশি
আলোর দিকে হাঁটে।
ধানকুমারীর প্রাণের বাড়ি
ঘ্রাণের সুখে হাসে-
পরাণদাদা ভরান হৃদয়
আশার অধিবাসে।
ধানজননির বুকভরা ক্ষীর
মুখভরা ঢেউ-দোলা,
পরাণদাদা জড়ান বুকে
ভরান ধানে গোলা।
উঠোন-ঘরে খড়কুটো আর
প্রাণের রসদ ভরা-
পরাণদাদা ছন্দে বাঁধা
পড়েন ধানের ছড়া।
যায় বারোটা বেজে
লেজ ঢুকিয়ে ফেসবুকে মা
কাটান সুখে বেলা-
ছেলে এবং মেয়ে দু’য়ের
এ্যাণ্ড্রয়েডে খেলা।
বাসায় এসে বাবাও বসেন
সামনে নিয়ে ল্যাপ,
ঘর মানে প্রেম ফেসবুক ও গেম
এবং হোয়াটস অ্যাপ।
নিথর ঘরের ভিতর সবাই
রয় গো বোবা সেজে-
আটটা ন’টা দশটা করে
যায় বারোটা বেজে।
কেন্নো আর শুঁয়োপোকা
-ও শুঁয়ো, অমন চুপচাপ পড়ে আছিস কেন ভাই? একদম নড়াচড়া করছিস নে আজ?
– ভাল লাগছে না। সারাশরীরে খুব ব্যথা করছে রে।
– কাল সারাবেলা আমাদের একটু বেশিই ঘোরাঘুরি করা পড়েছে। তাই বোধহয়…
কেন্নো আর শুঁয়ো। ওরা দুই বন্ধু। গলায় গলায় ভাব ওদের। রাতে একজায়গায় ঘুমোয় দু’জনে। দিনে একসাথে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। খেলা করে। গল্প করে। একজনের কষ্টে আর একজন ব্যথা পায়।
কাল সারাদিন ঘোরাঘুরির পর সন্ধেয় ওরা ঠাঁই নিয়েছিল একটা ভাঙাঘরের আবর্জনার মধ্যে। ক্লান্তির ঘুমে সারারাত কখন পার হয়ে গেছে ওরা ঠেরই পায়নি। সকালবেলা ঘুম থেকে জেগে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিল কেন্নো। কিন্তু শুঁয়োর কোনো নড়নচড়ন নেই। চুপ মেরে পড়ে আছে মড়ার মত।
কেন্নো আবার বলে- কেমন লাগছে রে তো..
কথাটা শেষ করার আগেই একটা অদ্ভূত শব্দ করে মোচড় খেতে লাগল শুঁয়ো। একবার সোজা হয় তো আবার কুঁকড়ে যায়। একবার চিৎ হয় তো আবার মোচড় খায়।
ভয় পেয়ে গেল কেন্নো। বন্ধুর যন্ত্রণায় সে কিছু না করতে পারার কষ্টে কেঁদেই ফেলল।
হঠাৎ কেন্নো দেখল শুঁয়ো একেবারে নিথর হয়ে গেছে। মরে গেল নাকি তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু। অজানা আতঙ্কে তার বুকের ভিতরে কেমন করে উঠল। নির্নিমেষ চোখে সে তাকিয়ে রইল বন্ধু শুঁয়োর নিস্পন্দ দেহের দিকে।
সহসা একটা ঝাড়া দিয়ে উঠল শুঁয়ো। আর কেন্নো অবাক হয়ে দেখল তার লোমশ খোলশের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে কী যেন একটা রঙিন ডানাওয়ালা অদ্ভূত প্রাণী। ভড়কে গেল।
বিচিত্র প্রাণীটি বেরিয়ে এসেই ডানা ঝাপটাতে লাগল।
নির্বাক হয়ে চেয়ে রইল কেন্নো। বন্ধুর এ কী দশা!
– তুই কে রে? প্রাণীটি কেন্নোকে বলে।
-আমি তোর বন্ধু শুয়ো। কিন্তু তোর এ কি হল ভাই?
– বন্ধু? উচ্চেস্বরে হেসে ওঠে প্রাণীটি।- আমি তোর বন্ধু? কি বিশ্রী দেখতে তোকে।
শুঁয়োর কথায় খুব কষ্ট পেল কেন্নো।
-তুই আমাকে ভূলে গেলি ভাই?
-মানে? ভোলাভুলির কি আছে? তুই আমার কোনোদিনই বন্ধু ছিলি না।
দেখ আমার কি সুন্দর নকসা করা রঙিন পাখা। আমি উড়তে পারি। তোর মত একটা কুৎসিত পোকার আমি বন্ধু হতেই পারি না।
– সব ভূলে গেলি শুঁয়ো। বিমর্ষ ধরা গলায় বলল কেন্নো।
– কি শুঁয়ো শুঁয়ো করছিস? রেগে গিয়ে বলে – আমি প্রজাপতি। ফুল আমার বন্ধু।
কেন্নো অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল প্রজাপতির দিকে। সত্যিই তো, সে আর শুঁয়ো নয়। প্রজাপতি। শুঁয়ো তার বন্ধু ছিল। কিন্তু কিভাবে এই পরিবর্তন হল কিছুই বুঝে উঠতে পারল না কেন্নো।
– আমি যাই, ওই ফুল আমাকে ডাকছে। রঙিন পাখা মেলে উড়ে গেল প্রজাপতি।
কেন্নো বন্ধু হারানোর ব্যথায় কুঁকড়ে গোল হয়ে পড়ে রইল।
পিঁপড়ের পাখা
এক.
মাছি আর পিঁপড়ে। দু’জনের মধ্যে ভারি ভাব। রাতে পাশাপাশি থাকে। বাবুদের বাড়ির ভেতরের কোনো এককোণে। আর যখনই সময় পায় গল্প করে। নানা সুখ-দুঃখের কথা বলে।
দুই.
-ও পিঁপড়ে- উড়তে উড়তে এসে মাছি বলে- বাবুদের বারান্দার কোণায় ক’দানা চিনি পড়ে আছে। খাবি তো চল্।
– চল্।
মাছি উড়ে উড়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। আস্তে আস্তে পিঁপড়ে পৌঁছে যায় খাবারের কাছে।
ওরা দু’জনে একসাথে খাবার ভাগ করে খায়।
পিঁপড়ে বলে- আমার যদি তোর মত ডানা থাকত, তাহলে কি সুবিধেই না হত।
– সে হতো ঠিকই। কিন্তু…
– এই দেখ না, আজ আমার এখানে আসতে কত সময় লেগে গেল। অথচ তুই-
– সে ইচ্ছে করলে একনিমেষেই চলে আসতে পারতাম। শুধু তোকে পথ দেখিয়ে আনার জন্যই ধীরে ধীরে এলাম।
– সে জানি। তাই তো বলছি, ভগবান ভারি একপেশে। তোকে পাখনা দিলেন আর আমাকে খুঁদে খুঁদে একগাদা পা। জানিস আমার মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগে। যখন দেখি তুই কি সুন্দর উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস।
– কি আর করা যাবে বল? ভগবান যাকে যা দেন, তাই নিয়েই খুশি থাকতে হয়।
-না আমি খুশি নই। ভগবানের কাছে নালিশ জানাব – মাছিকে ডানা দিলে। আমি কি দোষ করেছি? আমাকেও দিতে হবে।
-ভগবান যাকে যা দেন তাতেই তার মঙ্গল। অন্যরকম হলে বিপদ হয়।
তিন.
দু’দিন পিঁপড়ের সাথে দেখা করার সুযোগ হয়নি মাছির। আজ তাই সকাল সকাল পিঁপড়ের কাছে উড়ে আসে মাছি।
ডাকে- ও পিঁপড়ে! পিঁপড়ে-!
পিঁপড়ে কোনো উত্তর দেয় না।
-ও পিঁপড়ে- কি হলো তোর? কথা বলছিস নে কেন ভাই?
সহসা পিঁপড়ে হো হো করে হেসে ওঠে।
– অমন করে হাসছিস কেন ভাই?
-এই দেখ মাছি। আমার পাখা উঠেছে।
মাছি অবাক হয়ে তাকায় পিঁপড়ের দিকে। সত্যি তো। পাতলা পাতলা দু’টো পাখনাই তো দেখা যাচ্ছে ওর গায়ে।
-কীভাবে, কখন হলো এসব ?
-তোর কি হিংসে হচ্ছে?
– কি যে বলিস? কিন্তু আমি ভাবছি…
-এই দেখ আমি কেমন উড়বো এখন…
বলেই পিঁপড়ে উড়তে শুরু করলো।
-হা হা হা- এই দেখ আমি কত উপরে উঠে গেলাম উড়তে উড়তে।
-আর যাস নে ভাই।
-কেন রে? আমি তোর চেয়ে ভাল উড়তে পারছি দেখ-
হঠাৎ মাছি দেখে – একটা ছোট পাখি পিঁপড়ের দিকে উড়ে আসছে।
-ও পিঁপড়ে। আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় চিৎকার করে ডেকে ওঠে মাছি- সরে যা , ওই পাখিটি তোকে-
কথা শেষ হবার আগেই মাছি দেখে পাখিটির দুই ঠোঁটের ফাঁকে আটকে তার প্রিয় বন্ধু ছটফট করছে।