সৌমিত্র চক্রবর্তী এর সকল পোস্ট

সৌমিত্র চক্রবর্তী সম্পর্কে

পরিচিতিঃ জন্ম বিহারের এক অখ্যাত বনাঞ্চলে বাবার চাকরীস্থলে। রসায়নে স্নাতকোত্তর এবং ম্যানেজমেন্ট পাশ করে কিছুদিন সাংবাদিকতা। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারী। একাধারে নাট্যকার, কবি এবং গল্পকার। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, পুস্তক পর্যালোচনা, বিভিন্ন ধরনের লেখা ছড়িয়ে আছে দেশ বিদেশের অসংখ্য পত্র পত্রিকায় ও সংবাদপত্রে। উৎপল দত্ত সহ বহু বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্বের কাছে শিখেছেন থিয়েটার। বহু বিচিত্র ও ব্যাপ্ত ময় তাঁর জীবন। বন, জঙ্গল, পশু, পাখি, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে তাঁর দীর্ঘকালের নিবিড় ও অন্তরঙ্গ পরিচয়। কবিতা ও বিভিন্ন লেখা লেখিতে তিনি মস্তিস্কের থেকে হৃদয়ের ভুমিকাকে বড় করে দেখেন। কবিতা, গল্প, নাটক এবং মুক্তগদ্য মিলিয়ে এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা নয়। প্রকাশিত গ্রন্থগুলি হলো বইছে লু, থিয়েটার কথা, তিতলিঝোরা, নীলপাখিকে উড়ো চিঠি, রাত্রি আমার নৈশপ্রিয়া, ব্রিজের নীচে বৃষ্টি, ২ একাঙ্ক, প্রতিলিপি এবং বেবুশ্যে চাঁদ, খণ্ড ক্যানভাস। ইতিপূর্বে অঙ্গন সহ কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। বর্তমানে অক্ষর বৃত্ত পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। নেশা ফটোগ্রাফি ও ভ্রমণ।

সেই লোকটা

আকৃতিবিহীন ঝুপড়ির তেলচিটে কালো বেঞ্চিতে বসে লোকটা ভাত খাচ্ছিল। আলুসেদ্ধ, ডাল আর চালকুমড়োর আধসেদ্ধ তরকারি আবেগবর্জিত হয়ে চালান হয়ে যাচ্ছিল আগ্নেয়গহ্বরে। শস্তা জিনসের শার্ট তেলকালি ময়লার কোলাজে অপরূপ অয়েলপেন্টিং।

প্যান্টের অবস্থা তার চেয়েও খারাপ সময়ের চিহ্ন বয়ে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে বছরের পর বছর। ওপর আর নীচের দুই আব্রুতেই কুটিল ছেঁড়া উঁকি মেরে যাচ্ছে ক্রমাগত।
ভয়ংকর ময়লা শস্তার কোল্ডড্রিঙ্কের প্লাস্টিকের যে বোতলে জল আছে সেই ছোট্ট থলি নিম্নাঙ্গ ছাড়াই দিব্যি বইছে জলভার।

লোকটা জল আনে কেন? সে তো পয়সার বিনিময়ে নির্মল জলের সংজ্ঞা শোনেনি কখনো! লোকটা জল আনে কেন? জলীয় বিবাদ তার চব্বিশ ঘন্টাই ছুঁয়ে থাকে অপরা বিষাদে। এক কামরার আট বাই দশের অ্যাসবেস্টসের ছাউনি আর অপুষ্ট বউ খান দুই কর্পোরেশনের স্কুলের নাবাল বেড়ালিবাচ্চা ছাড়াও এক তোরঙ্গ বিস্তর হাবিজাবি তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত পেরিয়ে রোজই নরম ভোরে উঠে শেয়ারিং পায়খানায় উবু হয়ে বসে সে।

ফুটপাতের সাড়ে পাঁচ দামী কালো দন্তমঞ্জন রগড়ে দাঁতের ছাল চামড়া উঠে গেলে সালফার মেশানো কমদামী গুঁড়ো চিনির শরবৎ চা খেয়েই দে দৌড় দে দৌড় …
একদিন রাস্তায় এক টিভি চ্যানেলিয়ান তাকে পাকড়াও করে জিজ্ঞেস করেছিল, “আপকা রিলিজিয়ন কেয়া?”
লোকটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল।
বিরক্ত প্রশ্ন আবার ছিটকে এসেছিল, “আরে আপনি কি?”
লোকটা ফ্যালফ্যাল করে দেখেছিল।
লোকটা ঠাস্ করে মেরেছিল গালে বসা মশার বাচ্চা।
লোকটা গুটখার পিক পিচ করে ছিটিয়ে বলেছিল, “ঠিকাদারী লেবার বাবু!”
ঝুপড়ির পার্লারী ত্বকবিহীন অন্ধ গর্তের ভেতরে তখন বেঞ্চিতে নামগোত্রহীন জলের ময়লা বোতল।
হাপুস হুপুস শব্দে পরম তৃপ্তিতে একমনে আলুভাতে ডাল চালকুমড়ো ভাত খেয়ে চলেছিল অচ্ছে অনাগরিক ভারতবর্ষ।

চাঁদ আমার অষ্টাদশী

কবিতা লিখিনা আমি প্রলাপ আঁকি,
রোজ রাতে চাঁদ নেমে চুমু খায় গালে-
চাঁদ তাতেই বিভোর!
ঘুম ঘুম অন্ধকারে ছায়ারা যেই এঁকেবেঁকে খেলে
অবসরে টুং টাং আবহ পেছনে
গান করি আমি, আমাদের দুজনের গান;
চাঁদ গালে হাত রেখে চুপ করে শোনে-
চাঁদ তাতেই বিভোর!
চরাচর নিথর তখন, ঝিঁঝিঁপোকা নীরব আলসে
এপারের ধ্বনি ঢেউ ওপারে লবণ সমুদ্রকূলে…
হঠাৎই থেমে যাই আকুল জিজ্ঞাসায়,
-আছো তুমি?
-শুনছি। শুধু এটুকুই ঘোর রাতে জ্যোৎস্না মাখায়।
অমনি চারিদিকে ফুলঝুরি নকশা তুলি,
চাঁদের গোপণ কোনে ভরে দিই
বহুদিন সঞ্চিত উপোসী আদরের উচ্ছল ঝর্ণা-
চাঁদ তাতেই বিভোর!
মাঝেমাঝে অমাবস্যা চুরি করে চাঁদ
ঝড়ের মাতনে প্রশ্নরা উথাল মাতাল
সম্পর্কের রেশম সুতো টুকরো হয়ে ছত্রখান,
কিন্তু ফের যেই কৃষ্ণপক্ষ তলায় অতলে, অভিমান
বদলায় ব্যাকুল ইচ্ছেয়, চাঁদ ফের উঁকি মারে,
আবার হাজারো শব্দ-গান-ছবি-আদরের মেলা,
আমি তো ডুবেই আছি অষ্টাদশী
শতাব্দী প্রাচীণ তরুনী চাঁদের দখলে-
চাঁদও তাতেই বিভোর!

ঊর্ণি চূর্ণি ১৫

নান্দনিক হাওয়ায় তখন উড়ে বেড়াচ্ছিল চূর্ণ জল
অগুনতি সুন্দরী তিতলি আর অ্যাড্রিনালিন গন্ধে বিবশ পুরুষ,
খোলা গেট দিয়ে মাঝেমধ্যে হুশ করে ঢুকে আসছিল
ফরেন লিকারের মায়াস্বপ্ন চলকানো হালকা ঝিমাই রোদ্দুর।
কারুশিল্প ভবনের লিফটের ভেতরে, মোহরকুঞ্জে, ছায়া ছায়া আড়ালে আবডালে
ঝাঁপিয়ে পড়ছিল নিখুঁত গোলাপী চুমুর ঝড়;
উতল অবতলের সমভূমি মালভূমি পেরিয়ে ছুটে যাচ্ছিল গভীর জলে ডুবে যাওয়ার পাগল ইচ্ছে
তক্ষুনি মাইকে ঘোষণা হলো পৃথিবীর সব নিষিদ্ধ নদী উন্মুক্ত করা হলো যান চলাচলের জন্য।

ভালো থাকা না থাকা ১৫

প্রথম পৌষের শিশির কাঁপছে। ঝরছে টুপ টুপ টুপ…। চারপাশের ক্রিসমাস ইভের উচ্ছ্বসিত আলো আর শব্দবাজীর ওপরে পর্দা ফেলে রাত্রি হাঁসের ছন্দে হেঁটে এগিয়ে আসছে। কুয়াশার রঙ বদলে যাচ্ছে ঘন্টায় ঘন্টায়, সেকেন্ডে সেকেন্ডে। রাত্রি গাঢ় হলেই বড় অভিমান জড়ায় হে মহাজন! পৌষরাত বাঁশি বাজিয়ে বলে যায় “…জাগতে রহো…”! এগিয়ে যেতে চাইলেই বাধা দেয় একের পর এক মহাশূন্য থেকে নেমে আসা বিষাদ ঝালর।

যারা এসেছিল, একে একে ফিরে গেছে তারা। সঙ্গী করে নিয়ে গেছে বর্ষার আকাশ চেরা বিদ্যুৎ ঝলক। যারা চলে গিয়েছিল একে একে ফিরেছে আবার, সময়ের লুডোর ছকে ছক্কা দান ফেলে জিতে নিতে রক্তস্নাত শাঁখ। বিছানায় ইতিউতি ছড়িয়ে আছে অ্যালেন ফিশার, লরেন্স আপটন। দু হাতের তালুর রেখায় শক্তি, বিনয়, ভাস্কর, নীরেন্দ্রনাথ। চোখের তারায় তুলিযুদ্ধ করে হুসেন। ব্যাকগ্রাউন্ডে একমনে গোলাম আলির মন্তাজ। যারা আসে, থাকার জন্য নয়, যারা চলে যায় ফিরে আসে মানচিত্র হুবহু বদলে ফেলে অচেনা অভিযাত্রী হয়ে।

“In darkened depths of the Derwent, down there beneath the bridge,
midst twisted steel and concrete a tale of tragedy lives,
in mud and murk a monument, a hidden eerie thing,
the dark art of disaster, shaded hues of gray and grim.

Formed in fog by the hand of fate, sculptor extraordinaire,
his creation of destruction, its all laid out down there,
down there among the fishes, with the eel, the bat like skate,
final finishing touches to a dark and haunting place.

While weed and slime and algae wave as phantoms in their flight,
from shadowed shapes of death and dread come eerie forms of life,
there be rust there in the ruins feeding upon the death,
a crow among the carrion will stay ‘til nothing’s left.

When river rolls beneath the bridge it knows the taste of salt,
it knows too the highland rains the gorges and the gulch
and now it knows the monument, that hidden eerie thing,
the dark art of disaster, shaded hues of gray and grim!”

হাওয়ায় মিষ্টি গন্ধের চিতার ভস্ম অবশেষ ছড়িয়ে নতুন ধানের গন্ধ টা টা করে চলে গেছে কখন। নোম্যানসল্যান্ডে কোনো ফুল নেই, ফল নেই, পাতা নেই, কুঁড়ি নেই। অমাবস্যার কালোয় চিৎকৃত হয় শকুনি সন্তান। রাত্রির গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে। মধ্যরাত্রে দ্রুত ফুরিয়ে আসে সিগারেটের মজুত স্টক। কোথাও কি লাল সিগন্যাল, হলুদ সিগন্যাল জ্বলছে… নিভছে… জ্বলছে… নিভছে! সবুজ সিগন্যালের দল ঘুমায় নিশ্চিন্ত, নির্ভার। মেরুদন্ড ক্রমশই ঝুঁকে যায় দ্বিতীয় দশকের শেষ প্রান্তের দিকে এগিয়ে চলা বুলেট ট্রেনের। ফ্যাশন প্যারেডের ফাঁকা চারণভূমিতে হাঁটছে নিয়ানডারথাল মানুষ।

সম্পর্ক

বৃষ্টিরা এলোমেলো সাঁতরায় ঝিনুকিগতিতে
ঠান্ডাও ঝুপ্পুস সোজা এসে গেঁথে যায়
কথাসব ডুবে থাকে মদির ভোদকার গ্লাসে
রাস্তা ও ফুটপাত হেঁটে যায় মিউট প্রোফাইলে

ছয় পায়ে একমনে জাল বোনে সিদ্ধ মাকড়
ছিঁড়ে যায়, রিফু করে, ফের ছিঁড়ে গেলে
ক্যানভাসে হাসি ফোটে স্লোমোশান রক্তপাতে

ভালো থাকা না থাকা ১৩

এই যে ঝাড়া দেড়ঘণ্টা বাসের সিটে উসখুস, এদিক ওদিক লচক্কা মাল ফাল ফিরিতে দেখেও রীতিমতো টায়ার্ড।

দুই কি তিনজনের ফূর্তির জোগানে শালা আস্ত রামপাঁঠার ঝুন্ড রাস্তায় থেবড়ে ঝালমুড়ি ফুরি সাঁটিয়ে মেজাজে জাপানি তেলের রগরগে টক ঝাল মিষ্টি কাহানীর সোয়াদ নিচ্ছে হাত পা সবুজে ছড়িয়ে। ঠিক মোড়ের পিনপয়েন্টে কাক চড়াই হাগা শোভিত কোমায় চলে যাওয়া অস্পষ্ট হেব্বি ভিআইপি মনে মনে গাল পাড়ছে বেজাতিকে।

বাসটা দাঁড়িয়েই আছে, তার সামনে বীর্যশূন্য ভেড়ার পালের দল লাইন দিয়ে, কারো ট্যাঁফো করার হিম্মতও নেই। বীর বালকদের অফুরান কথা মাইক্রোফোনের সামনে মিডিয়ার সামনে কামুক গতিতে এগোয়। বসে থাকতে থাকতে কশেরুকার প্রান্তিক টার্মিনালের মাঝখানে আঁকাবাঁকা শেকড় বেরোয় বাদামী ভীতু লুচ্চা। সামনের পড়ে থাকা এক্সপ্রেসওয়ের বুকে পেটে পিএনপিসির জম্পেশ লাইভ টেলিকাস্ট চলতে থাকে। শাল্লা আপনি বাঁচলে বাপের নাম!

ভালো থাকা না থাকা ১৪

নলেন গুড়। শব্দটার মধ্যেই আপসে ফুরফুরে সুগন্ধি একঝলক হাওয়া। আমি আবার একে খেজুর গুড়ও বলি। আসলে ছোটবেলায় ভাবতাম নলেন বোধহয় কোনো অপ্রাকৃত মিষ্টি জাতীয় জিনিসের নাম। দুটোকে মেলানো যেত না কিছুতেই। তবে সেই স্বাদ, সেই গন্ধ এখন আর তেমন করে পাই না।

সেই মালভূমির দেশ থেকে সমতলের গঙ্গার পলিমাটির দেশে যখন আসতাম, ভোরের আলো ছুঁই ছুঁই অন্ধকারে বিছানায় মশারি ফাঁক করে একটা গ্লাস এগিয়ে আসতো। কনকনে ঠান্ডা অথচ পৃথিবীর সবচাইতে মিষ্টি আর অদ্ভুত স্বর্গীয় গন্ধের সেই গ্লাসের ভেতরে টলমল করত সদ্য জিরেন কাটের রস। আলো ফুটতে না ফুটতেই উড়তাম। কোত্থেকে কিছু অচেনা কালো মুসকো লোক এসে বাড়ির সীমানা পাঁচিলের বাইরের বাগানে বিশাল কড়াইয়ে ক্রমাগত বিশাল হাতা ঘুরিয়ে চলত।

আর ওমনি সেই আশ্চর্য সোনালি আভায় মোড়া হালকা চকলেট রঙের তরলের মধ্যে থেকে সাঁ করে নাকের ভুলভুলাইয়া পেরিয়ে একমাথা কালো চুলে ঘেরা ছোট্ট বাক্সে সারেগামা গাইতে গাইতে সেঁদিয়ে যেত এক ভালো গন্ধের একঝাঁক রেশমি সুতো। এখনকার মতো চালাক হয়নি সেই পৃথিবীর মানুষেরা। চিনির ভেজাল দিয়ে নলেন খুনের বুদ্ধি সেইসব মাথামোটা লোকদের ছিলনা।

আমাদের ছোট্ট মুঠোয় এককুচি পাটালি পেয়ে নাচতে নাচতে ফিরতাম কিম্বা দে ছুট্ গঙ্গার পাড়ে। বেলা সামান্য বাড়লে মিষ্টি নলেন রোদ্দুর ঘুঙুর বাজিয়ে হাঁক দিত, “সন্যাসী ময়রার নলেন মাখা সন্দেএএএএশ…”!

রাত্রি ঘেরা বাড়ী

– কেমন আছ সার্কাসের দুখিনী নন্দিনী, এই বিস্রস্ত বিকেলে?
– ভালো নেই। অনুশোচনার জল নদী ছাড়িয়ে মাঠ, মাঠ ছাড়িয়ে পুকুর, পুকুর ছাড়িয়ে রাস্তা, ঘরের উঠোন …মেঝে থইথই …
– ভুল পায়ের ছাপে পা রেখেছিলে মনে হয়। চোখ খোলা থাকলে অনেক কুদৃষ্টি পাশ ফিরে শোয়, ভুলেছিলে নিশ্চয়ই।
– ডুবন্ত আঁকড়ায় এমনকি পচা খড়। না শ্বাস না বাস কোনো কিছুতেই বাড়ানো হাত কাজে আসেনা।
– বিকেল শেষ হলে সকাল আসেনা কখনো, আসেনি কোনো উদভ্রান্ত উদ্বেগে। জানতেই যদি তবে এত কেন হাহুতাশ?
– মানুষই তো ভাবে। বাঁচার বহুভুজ কোণে মাকড়সা ও বাঘ দুজনেই সমান মাংসভূক। শুধু সম্মান বিক্রি হয় ক্যানিবল হাটে।
– ছুটির রোশনাইএ মত্ত আশপাশ, এ দীর্ঘ বিকেলে তোমার তো আনন্দে সাঁতার দেবার কথা ছিল! তাহলে আজ কেন এত আফসোস ছেঁড়াপাতা হাতে?
– ভাগ করার ঈশপের গল্প পড়েছ? এও তাই, কালনেমির লঙ্কা ভাগ পুড়িয়ে ছাড়খার করে দেয় প্রত্যেক বাঁচার সেকেন্ড। একচ্ছত্র সম্মান চাই আমার।
– দুর্ভোগ স্তর সাজিয়েছে, হাতে মোটা কালো রং ব্রাশ। সাবধানে ডিভাইডার এড়াও, ডাইনে বাঁয়ে তাকাও নির্দ্বিধায়, পথ বুঝে নিলে, শ্বাপদ এড়িয়ে এগোও।
– শ্বাপদও খিদে পেলে শিকারে বেরোয়। এ বধ্যভূমিতে মানুষই শ্বাপদ। বিশ্বাস কার হাতে রাখি, বুঝিনা কিছুই।
– তাহলে রাত নামুক। চোখ বুজে একান্ত ঈথারস্লটে প্রার্থনা ভাসাও, মানুষ, মানুষ হোক হে দুর্বোধ্য সময়। তারারা হাঁটুক রাজপথে। সূর্য চুমু দিক নবান্নের সদ্যজাত ধানের গোলায়। স্তিমিত গলায় বলো…
– আমেন।

ভালো থাকা না থাকা ১২

সকলের যখন ঘুম থেকে ওঠার সময় হয়
আমি তখনই ঘুমোতে যাই,
মানুষের তৈরী বাঁধ ভেঙে ফেলে
দুচোখের পাতায় হুড্রুপ্রপাতের বেগে
ঝাঁপিয়ে পড়ে দুষ্টু ঘুম;
সকালের কিশোরী রোদ্দুর জানলায়
এসে থমকে দাঁড়ায়,
‘আহা, ওকে শান্তির দেশে থাকতে দাও!’
সাত সকালের কুয়াশা কেটে ছুটে যায়
দূর প্রান্তিক সব্জীবাহী ট্রাক,
ড্রাইভারের পাশে খুপরি জানলায়
উঁকি দেয় ঈশ্বরের নীল কিশোর মুখ।

বাজারের ধূপগন্ধের হাওয়া ঝাপটা দেয়
নিত্য থলি হাতে ভাঙাচোরা অবয়বজুড়ে
কাটা পোনার তত্ব আউড়ে
স্তনের মাঝের উপত্যকায় ওজন
কারচুপির ছক কষে বাওড়া মাছওয়ালি।
বাসের চাকা ঘোরে, অটোরিক্সা
শস্তার গাঁদায় মেকআপ কমপ্লিট করে
নিজেকেই ঘুরে ফিরে দেখে পাঁচ ইঞ্চির আয়নায়।

সকলেই ব্যস্ত খুব, ঝনঝন শব্দে
খোলা বন্ধ হয় গোসাপের চামড়ায়
বেআইনি পার্সের আব্রু।
সবাই যখন ব্যস্ত রীতিমতো
আমি তখনই ঘুমাই নিশ্চিন্ত আবেশে
জঞ্জাল বাড়তে থাকে জানলার বাইরে।

ভালো থাকা না থাকা ১২

মনখারাপ। গভীর বিষাদ জড়িয়ে ধরছে রোজ। বিস্তীর্ণ এক বুজে যাওয়া নদীর চর ধরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ পা ডুবে যাচ্ছে। চেষ্টা করছি পা তুলে আনার। পারছি না। একটা পা তুলতে গেলেই অন্য পা আরোও তলিয়ে যাচ্ছে। বুক পর্যন্ত ডুবে গেছি। বুকের পাঁজর ওঠানামা করছে বিগত শতকের অ্যান্টিক হাপরের মত। হাঁপাচ্ছি আর চোখ ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করছি এমনকি মাথার পেছনেও। আশ্চর্য! এই দিগবিস্তারী চোরাবালির চরে অনেকেই ডুবছে। কারো রং কালো, কারো সাদা, কেউ হলদেটে। মাথা পর্যন্ত, বুক পর্যন্ত, কোমর পর্যন্ত ডুবে আছে। কারো শুধু চুলটুকু দেখা যাচ্ছে। এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু আগাছা। কোনোটা ত্রিশূলের মত, কোনোটা চাপাতির মত, কোনো আগাছার আকার খাঁটি কালাশনিকভ রাইফেলের। বালির চরের রং পাল্টে যাচ্ছে। কোথাও গেরুয়া, কোথাও সবুজ, কোথাও ঘন কালো। আকাশটাও কি কালো হয়ে আসছে!

পুরা সচ জানতে আর জানাতে গিয়ে যে মানুষটাকে গিলে খেয়েছিল বুলেট, তিনি বৃথাই বিশ্বাস করতেন খবরের কাগজ গণতন্ত্রের তৃতীয় স্তম্ভ। তিনি জানতেন না খট্টর খট্টাশ রা ঝাঁ চকচকে বিদেশী জাম্বো লাইফস্টাইলের জন্যে সাপের আর ব্যাঙের গালে একই ঠোঁটে চুমু খায়। তিনি জানতেন না ওই গণতন্ত্রের ধ্বজা উড়ানো গোল বাড়ীর প্রধান মুখ সাটাঙ্গে লুটিয়ে পড়ে অর্থলোলুপ যৌনভাতি চর্চকের লোমযুক্ত পায়ে শুধু দু মুঠো ভোটের জন্যে। তিনি জানতেন না। তাঁরাও জানতেন না, যাঁরা সব্জি মান্ডিতে গেছিলেন, যাঁরা স্কুল অফিস আদালত ফেরতা, যাঁরা হাসপাতাল থেকে ফিরছিলেন ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, তাঁরা আর বাড়ী ফিরবেন না কোনোদিন।

নাদির শাহ্ অট্টহাসি হাসছে। তাইমুর লঙ হাসছে ঠা ঠা শব্দে। হুন, শক, ইউরোপের বার্বেরিয়ানরা হাসছে বিকট কাচভাঙা আওয়াজে। দাউদাউ জ্বলছে আগুন। ঈশ্বর শব্দ থেকে অক্ষর গুলো ছিটকে সরে যাচ্ছে। আলাদা হচ্ছে ঈশ্বরের যৌথ পরিবার। আগুন … আগুন … চড়চড় করে ফেটে যাচ্ছে তাজমহল, মোনালিসার ছবি, মাইকেলেঞ্জলোর ফ্রেশকো, রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড, ওডিসি, সহস্র এক আরব্য রজনী। পুড়ে যাচ্ছে ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন, দ্য কিড, দ্য গ্রেট ডিক্টেটর, পথের পাঁচালী। হানাদারদের ঘোড়ার খুরে উড়ছে ধুলো। ভয়ঙ্কর শ্বেত সন্ত্রাসের মেঘ ঢেকে ফেলছে অরণ্য খণ্ড। চোরাবালি গিলে ফেলছে স্বপ্ন।

ভালো থাকা না থাকা ১১

তোমার আর আমার ফিরে আসার ঠিক মাঝখানে বয়ে চলেছে এক লাজুক প্রান্তিক রেল স্টেশন। মাছ আর মৌমাছি খেলা করে একান্ত প্রবাল প্রাচীরে। মাঝেমাঝে লাল নীল সবুজ হাওয়া মস্তিষ্কের ব্যালান্স খুলে ফেলে মেলোড্রামা করে তুমুল আবেগে। তুমি ফেরো, আমি ফিরি, আর সব চলে যায় দূরের বিস্তীর্ণ রেলের বারান্দায়।

মাতাল রাত্রি নামে ফিসফিস ইস্পাতি চাকার ঘূর্ণনে। দেখতে দেখতে তুমি আর আমি, আমি আর তুমি হয়ে যাই ক্যামোফ্লেজড পাশাপাশি ছুটে যাওয়া গানমেটাল রেলের লাইন। আমাদের তুরন্ত্ গতির অজস্র ফাঁকফোকর ভর্তি করেছে সংখ্যাহীন পাথরের টুকরো। মাঝেমধ্যে ছুটে চলার নীলিম অবসরে কোনো কোনো পাথর ঠোকাঠুকি খেলে। আগুন ছিটকে আসে ডাইনে বাঁয়ে, সমান্তরাল ইগোর ট্র্যাকে। লাইনের দুধারের মরে যাওয়া খড় রং শুকনো ঘাস ওঁত পেতে থাকে। কখনো টুকরো আগুন ছিটকে এলেই মৃত ঘাসের পুঞ্জ সেটা চুরি করে। বুকের ক্রোমোস্ফিয়ারে গোপন লকারে যত্নে রেখে দেয় সেই আগুন।

মানুষ খোঁজে, অনন্ত পেরিয়ে যাওয়া ফাঁসিদেওয়ার মাঠ পেরিয়ে, কালীয়দমনের বিল পেরিয়ে, রূপগঞ্জের গ্রাম্য হাট পেরিয়ে, বুড়ো বটের হাজার শেকড়ের আজুবাজু অলিগলি পেরিয়ে খুঁজতে থাকে প্রাচীন অগম আগুনের পাখি। রেল লাইনের আমি তুমি মুচকি হাসি সেই উদগ্র কামনার ভাষা মর্সকোডে পড়ে ফেলে। আগুন লুকিয়ে থাকে, আমি তুমি ছুটে যাই মানুষ হাঁটে আলুথালু। গোপন বিজন বনে আশ্চর্য এক পাখি ডেকে যায় এক টানা, টুই…টুই…টুই…!

ভালো থাকা না থাকা ১০

কোথায় যেন গম্ভীর সুরে একটানা একটা ঘন্টা বেজেই চলে, ঢং ঢং ঢং…। বিকেল ঘনিয়ে সন্ধ্যে নামে, সন্ধ্যার আয়ু শেষে জড়ায় পরম আদরে রাত্রি। ঘন্টার শব্দের কম্পনাঙ্ক দিনের আলোয় চাপা পড়ে যায় ক্ষণভরি স্মৃতির মানুষের হৈ হট্টগোলে।

কিন্তু রাত্রি বাড়লেই দ্বিপদের তৈরী নকল আওয়াজ কমতে থাকে। আর রাস্তা, ঘাট, এই চরাচর, মহানগরের প্রান্তিক ফুটপাত, গ্রামীণ বাঁশের খুঁটির সাথে জোড় বাঁধা কুঁড়েঘর, আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়া কুয়াশায় মোড়া মাঠকুয়ো, কনফেশনে মগ্ন চার্চ, শীৎকার ভাসিয়ে খদ্দেরের মনোরঞ্জনে শস্তার মেকআপ নেওয়া বেশ্যালয়, একান্ত পীড়িত স্যালাইন চলতে থাকা হাসপাতালের ছমছমে করিডোর পেরিয়ে ছড়িয়ে যায়, দিগন্ত আবৃত করে সেই ভুবনডাঙ্গার ঘন্টা – ঢং ঢং ঢং…।

শব্দাঙ্কের গভীরতা ছিন্নভিন্ন করে স্বল্পদৈর্ঘ্যের হৃদবাস। হৈমন্তিক রাত্রির উটচরা মরুভূমির বালির পায়ের দাগে দাগ বুলিয়ে নেমে আসে হিম। শহুরে ছোটখাটো মানুষ, গ্রামীণ ছোটখাটো মানুষ ঘুমিয়ে পড়লে আখড়ার বেতলতা ঘেরা সীমান্ত ছাড়িয়ে চারপাশে খেলে বেড়ায় বাউলের মরমিয়া গলা, ‘কয় জনম পার হলি ও মন, মানুষ হলি কই…!’ আশ্চর্য সেই চাঁদক্ষরণে আপনমনে সঙ্গত করে অলৌকিক ঢং ঢং ঢং…।

ভালো থাকা না থাকা ৯

ভালো থাকা না থাকা ৯

অগ্রহায়ণের পাতলা হিম জড়িয়ে ধরছে টুপটুপ। ফুরফুরে পপকর্নের মতো শিশির নেমে আসছে মেঘের গর্ভগৃহ থেকে ভিসা পাসপোর্ট ছাড়াই। নরম অন্ধকার পেতে দিচ্ছে নক্সীকাঁথার নক্সাদার আসন। রুক্ষ রাঢ়ের মাটি অভিমানে ক্রমশঃ কালো, ক্রমশঃ শক্ত হয়ে আসছে।

আসছে শীতের প্রস্তুতিতে ঝরে যাওয়া সূক্ষ্ম লোমগুলো আঁতিপাঁতি খুঁজেই চলেছে একটানা অধ্যবসায়ে। পাথুরে লাল জীবজন্তুর চলমান ফসিলের দল বিষন্ন নুইয়ে যাওয়া ঘাড় টলমল করতে করতে নিজের একঘেয়ে কালো গর্তে ফিরে আসছে। আকুল সিদ্ধেশ্বরী বাঁশি এখানে বাজেনা। নিশিও এখানে রাতে বেরোতে ভয় পায়। শ্বাপদের শ্বাস হিমেল হাওয়াকে মাইনাস দুশো তিয়াত্তর ডিগ্রির দিকে ঠেলে নিয়ে যায়।

রাত্রির গোল ঢাকনা মিশে যায় নিশ্চুপ সূতপুত্রের স্বপ্নযাত্রায়। সি শার্পে কন্ঠ ভাসিয়ে দিয়ে দেশছাড়া ব্যাকুল ভোজপুরী খুঁজে চলে ফেলে আসা উগ্র রঙের সকাল। ‘কোই তো লৌটা দে…লৌটা দে রে মুঝে…বিতি হুই বচপনা সুবহ্…!

ভালো থাকা না থাকা ৮

মাঝেমধ্যে টিকটিকি টা বেরোয় শতছেঁড়া বিচিত্র জলের নক্সাকাটা দেওয়ালে টাঙানো সেই ননীচুরির ( এত জিনিস থাকতে কৃষ্ণ যে কেন ননী চুরি করে খেত কে জানে! ননী বেশি খেলে পেটখারাপ হয় জানি। ) ছবির ক্যালেন্ডারের পেছন থেকে। ওপর নীচে আড়াইবার ঘাড়কে চক্কর কাটিয়ে আওয়াজ করে টিকটিক। মোটেও কোনো আহ্লাদ হয়না। কেননা সবকিছু গুবলেট হয়ে আসল সময়ে ঠিকঠিক হয়না।

শীত পড়ছে কি? ভোর রাতে কুয়াশার প্রলেপ? দিব্যি মোটা চাদরেই চলে যাচ্ছে এখনো। বাইকে হাওয়া ঠকানো প্লাস্টিক জামা। পুকুরের পাড় দিয়ে যাবার সময়ে দশটায় অন্যসময় বেশ চোখজুড়ানো স্নানের ছবি নজরে পড়ে। কিন্তু শীত পড়লেই সেখানেও সময় পাল্টায়। আয়াত টা যেমনতেমন, যাত্রাও জলুস হারায়।
ভিনজেলার খেজুরগুড়ের কারিগর সবে আসতে শুরু করেছে। আরো জমিয়ে ঠান্ডা না পড়লে নলেনের সেই রঙ রূপ গন্ধ কিছুই খুলবে না। এখন তো প্রথম কাটের রস নামবে, বৈচিত্রহীন।

সাপেদেরও ভরপেট খেয়েদেয়ে টয়লেট পটি করে মাস তিনেকের তোফা কুম্ভকর্ণ ঘুমে যাবার সময় হয়ে গেল। অন্তত তিনমাস চাষীবাসী মানুষ ভরপেট বাংলু খেয়ে রাতের অন্ধকারে নিশ্চিন্তে মাঠের আলে লটপটে পা ফেলে বাড়ীর ছলাকলা বিবর্জিত বউএর খপ্পরে ফিরতে পারবে। অন্তত মনসার চামচারা ফোঁস করে ছুবলে আত্মারাম পগাড়পার করে দেবেনা গ্যারান্টেড।

তাহলে তাই থাক, যে যার ইচ্ছেমত ঠান্ডায় পিকনিকে মাতুক, আমরাও জয় বাবা অঘ্যানসুন্দরের জয় হেঁকে আপিস কাটি সন্ধের দোহাই দিয়ে।

সুচেতনা তোমাকে ২

হাঁড়ি-থালা আজ উল্টিয়ে রাখ্ সুচেতনা
বাইরে নিবিড় গ্রীষ্মদহণ আভাস
এখন নাহয় অরন্ধনই হোক
বাস্তুসাপেরা ছেড়েছে দখল খাস।

চাল বাড়ন্ত নোট বাড়ন্ত ঘরে
হাঁপানির টান দিন প্রতিদিন ডাগর
রাস্তা খন্দ মাছেদের মরা চোখ
চুরি হয়ে গেছে কুঁড়ের শ্লীলতা আগড়।

বাবুয়ানি যত বিপ্লব স্বাধীনতা
কাগজে কলমে ল্যাপিতে মাউসে বাঁধা
ফ্যান্সি প্রেমের কোণ ছাড়্ সুচেতনা
দেওয়ালে মিছিলে টেবিলে মোমেতে ধাঁধাঁ।

যুদ্ধ যুদ্ধ খেলাটা যারাই খেলে
আরশোলা দেখে তারা করে হার্টফেল
সুচেতনা তুই নিজের পায়েই দাঁড়া
ভাঙতে পারবি আলতা সিঁদুর জেল!