সৌমিত্র চক্রবর্তী এর সকল পোস্ট

সৌমিত্র চক্রবর্তী সম্পর্কে

পরিচিতিঃ জন্ম বিহারের এক অখ্যাত বনাঞ্চলে বাবার চাকরীস্থলে। রসায়নে স্নাতকোত্তর এবং ম্যানেজমেন্ট পাশ করে কিছুদিন সাংবাদিকতা। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারী। একাধারে নাট্যকার, কবি এবং গল্পকার। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, পুস্তক পর্যালোচনা, বিভিন্ন ধরনের লেখা ছড়িয়ে আছে দেশ বিদেশের অসংখ্য পত্র পত্রিকায় ও সংবাদপত্রে। উৎপল দত্ত সহ বহু বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্বের কাছে শিখেছেন থিয়েটার। বহু বিচিত্র ও ব্যাপ্ত ময় তাঁর জীবন। বন, জঙ্গল, পশু, পাখি, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে তাঁর দীর্ঘকালের নিবিড় ও অন্তরঙ্গ পরিচয়। কবিতা ও বিভিন্ন লেখা লেখিতে তিনি মস্তিস্কের থেকে হৃদয়ের ভুমিকাকে বড় করে দেখেন। কবিতা, গল্প, নাটক এবং মুক্তগদ্য মিলিয়ে এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা নয়। প্রকাশিত গ্রন্থগুলি হলো বইছে লু, থিয়েটার কথা, তিতলিঝোরা, নীলপাখিকে উড়ো চিঠি, রাত্রি আমার নৈশপ্রিয়া, ব্রিজের নীচে বৃষ্টি, ২ একাঙ্ক, প্রতিলিপি এবং বেবুশ্যে চাঁদ, খণ্ড ক্যানভাস। ইতিপূর্বে অঙ্গন সহ কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। বর্তমানে অক্ষর বৃত্ত পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। নেশা ফটোগ্রাফি ও ভ্রমণ।

সুচেতনা তোমাকে ১

দেখতে দেখতেই রোদ্দুরের বয়স বেড়ে যায়
মেঘরাও ক্রমশই বাচাল থেকে বিজ্ঞ হয়ে ওঠে
আর আমি জানলার একপ্রান্তে বসে একমনে
তোমার দিনপঞ্জী দেখার চেষ্টা করি সুচেতনা!

সকালের চায়ের কাপে নৈমিত্তিক খুন ধর্ষণ কিম্বা
রাজনৈতিক রাহাজানির ছায়া পড়ে রক্তে সুগারের মাত্রা বাড়ায়,
গত শীতে যারা মারা গিয়েছিল কোনো আগাম খবর ছাড়াই
আজ এই চরম উষ্ণতার দিনে তাদের পারলৌকিক।

পায়রার পায়ের পাতায় বাঁধা ছিল গতকাল
পেলব দুর্বল হাত মুচড়ে দেওয়ার কুকীর্তি
তোমার বিছানায় ছিটকে পড়ার দুঃসময়
পরজীবি উদ্ভিদের ধর্ষণের হুমকি, ইত্যাদি এবং ইত্যাদি।

সারা সারাদিন, সারাটা দিন রোদ্দুর হেসে খিলখিল
অথচ সন্ধ্যে হলেই নেমে আসে মদ্যপানের দুর্গন্ধ
রাত্রি নামলেই এক্সপ্রেসওয়ে থেকে গলির অন্ধকারে
লোহিত কণিকা মাখা বীভৎস শ্বাপদ দাঁতের আনাগোনা।

জানলার একান্ত কোণে বসে আমার সামনে তৈরী হয়
ছাদ ফুঁড়ে নেমে আসা ত্রিমাত্রিক কল্পছবির অভেদ্য ঝালর
প্রত্যেক ফালিতে ওঁত পেতে বসে থাকে মরণঘাতি বৃশ্চিক
আর তুমি হারিয়ে যেতে থাকো ভারী ঝালরের ভুলভুলাইয়ায়।

ভালো থাকা না থাকা ৭

ছেলেবেলায় রুশদেশের উপকথা হাতে দিয়ে বাবা বলেছিলেন, ভাগ করে পড়তে হয়। গ্রামের বাড়িতে আমার সদাহাসিমুখ কাকিমা, হাতে মিষ্টি দিয়ে বলতেন, ভাগ করে খেও সোনা! আর তখন থেকেই ভাগ শব্দটা আমার মজ্জায় সাঁতারু হয়ে ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়া শুরু করেছিল।

আমার শ্রদ্ধেয় বয়স্করা ভাগ শব্দে রেখেছিলেন অসীম প্রীতি। দেশ কে মা বলেই চিরে ফেলেছিলেন তাঁরা ভাদুরে কুত্তার বিহ্বলতায়। সেই শুভ রাত্রি বারোটায় বাজির ঝলকানিতে উন্মাদিনী হয়ে ভাগের মা ডুবেছিলেন পঞ্চনদে-পদ্মায়।

প্রতিরাত আমাকে চোখ রাঙায় হিসেবের গরমিলে সুখপালকের ওম ভাগ করে নিতে পারিনি বলে। প্রতিদিন মাথা নিচু করে নীতি ভাগ হয় স্যুট টাই পরা অর্থজীবি লেজার খাতায়।

প্রত্যেক গণতান্ত্রিক বিহ্বলতায় ভোটবাক্স ভাগ হয়ে যায় ক্ষমতাশালীর পেটো, মাস্কেট আর পেশীর অনুপ্রেরণায়।

আনন্দ ভাগ করে লাফিয়ে উঠেই দুদল একশো ডেসিবেল হিংস্রতায় চিৎকার করে যায় -মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল। মান্নার গানও লজ্জায় খোঁজে দুই বারের মধ্যবর্তী শান্ত কবর।

মা গা নি ধা – পা গা নি ধা সা স্বরমায়ায় ভেসে সবুজ ঘাসে তিরতির তিতলি উড়ে বেড়ায় যে ছন্দব্যাকুলতায়, তার ডানা ভাগ করে বারবিকিউ এ মাতে দুর্গন্ধী ছদ্মবেশী।

ভাগবৃত্তে ঘুরতে ঘুরতে কখন যেন চুল সাদা হয়ে যায়, চামড়ায় সসংকোচ আত্মবিশ্বাসের অভাব। হঠাৎই এক সকালে আবিস্কার করি কখন যেন হৃদয় ভাগ হতে হতে হারিয়ে ফেলেছে কবন্ধ সময়।

ভালো থাকা না থাকা ৬

এক্কাপ ব্ল্যাক্কফি এক্ষান সিগ্রেট আর মনবসানো কিম্বা ভাসানো কিছু কবিতা, ব্যস, আচমকা ইচ্ছেয় টইটই না করা ছুটির দুপুরে আর্কি চাই!

কোনো কোনো সময় সম্পূর্ণ নিজস্ব। সেখানে টেনে রাখা গণ্ডিতে রাবণের বাপের ক্ষমতা নেই ঢোকার। সিগারেটের কুটি কুটি ছাই ওড়ে, ধোঁয়া ওড়ে ননপলিটিক্যাল নীল সাদা। হঠাৎ আদর ইচ্ছেয় জানলার বাইরে নিমগাছের বাকল ছাড়তে চলা ডালে কুবোর উন্মনা চাউনি, ছাউনি আড়াল করা মনের ভেতরে কোনো মুখের চলচ্ছবি দেখায়।

লোকাল ইএমইউ এর ভিড় ঠাসা কামরায় রিনরিন মোবাইল বেজে ওঠে, “তুই কই রে উন্মাদ!” শহরতলির পাতি রিক্সা বারোশো ঘোড়ার ভোক্সওয়াগন হয়ে যায়। ছাপানো সুদৃশ্য পাতার ভেতর থেকে নাচতে নাচতে বেরিয়ে আসে নির্বাচিত কবিতার কালো অক্ষর। টুংটাং শব্দের মৃদু মিউজিকে উদাসী পাগল শৈশবের খোলসে ডুব দেয় আরোও একবার। নীচে আগাছায় মোড়া দৈত্যের বাগানে হেমন্ত চুপটি করে বসে একচিলতে বিশ্রামে চোখ বোজে।

ভালো থাকা না থাকা ৫

একটা সময় পর্যন্ত ঘড়ির কাঁটায় তুরতুর হাঁটাচলা। কোন এক অপরিচিত ভীড় ভাড়াক্কায় অপেক্ষার টিকটক টিকটক। ট্যাক্সির উইন্ডস্ক্রিন ঝাপসা হয়ে যায় নাগাড় আকাশ কান্নায়। অথচ তখন বিষাদের আবহ জরুরী ছিল না।

ইঁট রঙ গলি বেয়ে তরতর … ওমনি আকাশ চোখ মুছে একগাল হেসে… ‘এসো হে জ্বেলে দিয়ে যাও প্রদীপখানি …’। লম্বা কালো অ্যাসফল্টের রাস্তা বেয়ে অচেনা এক ব্রিজের মাথায় পতপত পতপত পতাকা উড়িয়ে কোন দূর এক মন্দিরের দরজায় ঢং ঢং ঢং চার্চের ঘন্টা বেজে ওঠে। অবাক, ভীষণ অবাক করা শরৎ হেমন্তের সন্ধিক্ষণ পার্স থেকে ভেজা ন্যাপকিন বার করে যত্নে মুখ গাল ঠোঁট মুছিয়ে হাসে।

পঞ্চমুন্ডির আসনে খিলখিল হেসে ওঠে খিল্লিবাজ শকুন্তলার আত্মা। নেচার তার দুশো পঞ্চাশ এমএম জুম লেন্সে তুলে নেয় সদ্য পট বিবর্তনের গল্প। সানগ্লাসে রিফ্লেট হয় আগামী ঘৃণার নীল শার্ট প্রতিচ্ছবি। এখানেই শুরু হয়ে যায় পম্পেই নগরীর ধ্বংসের কাউন্টডাউন।

তুই ছুঁয়ে দিলে

তুই ছুঁয়ে দিলে বাজ ছুঁয়ে যায়
ছত্রিশঝোরা,
গাছ ঝলসানো ধূ ধূ উল্লাসে
একলা পাহাড়।

তুই ছুঁয়ে দিলে শতভিষা তারা
ইচ্ছেকোটরে
তাঁতি নিষ্ঠায় একমনে বোনে
রোশনি কুর্তা।

তুই ছুঁয়ে দিলে হরা ভরা ক্ষেত
প্লাবণবন্দী,
স্তর ক্রমে জমে পলি আর বালি
প্রত্নপ্রহরে।

তুই ছুঁয়ে দিলে বানজারা দেহ
খাইবার পাস
পার হয়ে গড়ে ঝাঁকড়াচুলের
মহেঞ্জোদারো।

তুই ছুঁয়ে দিলে সকালের চা
আপসে মিষ্টি,
বৈরী ভাবনা ছুঁড়ে ফেলে এক
আবেস্তা বেদ।

যাত্রা

এগালে মরচে ওগালে মরচে
নিঃসঙ্গ পড়ে আছে বৃদ্ধ. রেলপথ।

দুপাশে আগাছার অনর্গল মন্ত্রোচ্চারণ
জরায় খেয়েছে যৌবনের
সুগন্ধি পালিশ।

এখানে কোনো ঋত্বিক ঘটক নেই
রেললাইনের অন্তহীন দৌড়ানো
খপ করে মুঠোয় পুরে
ক্রশড নিষেধাজ্ঞার নাকের ডগায়
যিনি ক্যামেরার আঙুল
তুলে বলবেন –
অন – জুম – কাট…

পৃথিবীর প্রথম সাম্প্রদায়িক বিষের
নাম ক্রুসেড,
কারা যেন ভুল ভাবে
বিষ হলদে, বিষ নীল –
আসলে বিষের রঙ রক্ত।

কতকিছু পাওয়ার কথা ছিল অবেলায়
কত মনোযোগে পেতে রাখা
শিউলি ফুলের মায়া
নিখুঁত অবহেলায় নেই হয়ে যায়।

অর্জুন অহংও একসময়
বাতিল হয় নিরাবয়ব অন্যমনস্কতায়,
কঠিন কুয়াশায় নতুনের বহুদূরে
মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকে
অগোছালো রেললাইন।

এলোমেলো

পাখ শিকারি ব্যাধ হয়েছি
কিম্বা কালো রত্ন জেলে,
মাঝরাতে মাছ ধরতে গিয়ে
চাঁদ ধরেছি ঘোলা জলে।

আঁশবটিতে চারাপোনা
কাটতে গিয়ে বেড়াল কাটি
মৃত্যু এসে দরজা ভেঙে
দেওয়াল বেয়ে হাঁটেচলে।

তেলের কিসিম হরেক রকম
গর্ভগৃহে জোকার হাসে
মাছের তেলে মাছ ভেজে যায়
শুকনো ডাঙায় নৌকা চলে।

ভাতের পাতে মাছ ফেললেই
রান্না মাছও জ্যান্ত হয়ে
মুখ ভেটকে ভেংচি কেটে
সড়াৎ গলে গঙ্গা জলে।

ভালো থাকা না থাকা ৪

সন্ধ্যে ঝুপ করে নামতে না নামতেই তার গায়ে লাফিয়ে পড়ছে রাতের জাগুয়ার। তুড়ুক লাফানো কাঠবিড়ালী দু চর্কি পাক দিয়েই টুক করে চার দেওয়ালের কাঠামোর ভেতরে ঢুকে আয়েস করে জীবন মানে জী বাংলা দেখছে পঁচাত্তর হাজারী ডিভানে কাত হয়ে। আর রাস্তাটা এদিকে ওদিকে হেলতে দুলতে পাক বাংলা খাওয়া মাতালের মত টলোমলো টলোমলো পায়ে আকাশের পাঁশুটে আহ্লাদী বিড়ালগুলোর নরমানরম গরমাগরম লোমের বিছানা ছুঁয়ে ওপারে টুপ করে ডুব মেরেছে ফাঁকতালে।

অথচ এই রাস্তায় যেতে যেতে পেছনে ফিরে তাকায় না নাছোড় চল্লিশ। দিকভুলে যদি বা আলেঢালে চোখের বেহায়া পাতা আর সবেধন নীল না হোক কালো মণি তাকিয়েছে পেছনের ড্রপসিন পড়ে যাওয়া বেহাল মঞ্চের দিকে, ওমনি ধাঁ করে এপার ওপার সব ছায়া হয়েই মিলিয়ে যায়। পেছনের রাস্তা জুড়ে একে একে ফুটে ওঠে বুনো কুলের ঝোপ, ডালপালা মেলে গাভীন এয়োতির মত দুপুরের গল্প জুড়ে বসা ফলসা গাছ। ক্যাঁচকোচ শব্দ তুলে এগিয়ে যাওয়া হুররররহ্যাটহ্যাট বকা গাড়োয়ান সমেত দুই বলদের গাড়ি। গাড়ির পেছনে গাড়োয়ানের অজান্তে ঝুলতে ঝুলতে চলতে থাকে অনাবাদি শৈশব।

মৌরী লজেন্স, চাইইইইই কাচের চুড়িইইইইই, শিল কাটাওওওও, সিঁদ কাটা চোরের বারোয়ারী গল্প আর হাতে টানা রিকশা। দেখতে দেখতে কখন যেন সেখানেও সন্ধ্যে নেমে আসে। তফাৎ শুধু এখনকার মত একলা যাযাবরী নয়, সেই সন্ধ্যের মায়াপুরীর সারা আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকে হারিয়ে যাওয়া মায়ের আঁচলের গন্ধ।

ভালো থাকা না থাকা ৩

একটু একটু করে শিকারী বিড়ালের থাবায় ভর করে শীত এগিয়ে আসছে। পাতারা মুষড়ে হলুদ হবে এবার। সবুজ থাকতে থাকতেই চলে যাওয়া হয়তো ভালো। বিবর্ণ ঝরে যাওয়া পাতার বুকের ওপরে শুধু শীতার্ত পায়ের আনাগোনা।

“Let me die a youngman’s death
not a clean and inbetween
the sheets holywater death
not a famous-last-words
peaceful out of breath death”

ঘন কালচে বনের মাথার ঝাঁকড়া চুলের ভায়োলিনে হাওয়া ছড় বুলিয়ে চলে যায় একরাশ ভারাক্রান্ত সরগম উড়িয়ে দিয়ে। একান্ত কোটর থেকে উঁকি মেরে শীতের দুপুর দেখতে ভুলে যায় ব্যান্ডবাদক শজারু। পাতলা সরের মত নরম রোমান্টিক রোদ্দুর ঊর্ণি নদীর গমনের গিরিখাতে পরম আদরে বিছিয়ে রাখে গত জন্মের অপ্রেমের ইতিবৃত্ত।

“I want you to know one thing.
You know how this is:
if I look
at the crystal moon, at the red branch
of the slow autumn at my window,
if I touch near the fire
the impalpable ash
or the wrinkled body of the log,
everything carries me to you,

as if everything that exists,
aromas, light, metals,
were little boats that sail
toward those isles of yours that wait for me.

Well, now,
if little by little you stop loving me
I shall stop loving you little by little.
If suddenly you forget me
do not look for me,
for I shall already have forgotten you.

If you think it long and mad,
the wind of banners
that passes through my life,
and you decide
to leave me at the shore
of the heart where I have roots,
remember
that on that day,
at that hour,
I shall lift my arms
and my roots will set off
to seek another land.

But
if each day,
each hour,
you feel that you are destined for me
with implacable sweetness,
if each day a flower
climbs up to your lips to seek me,
ah my love, ah my own,
in me all that fire is repeated,
in me nothing is extinguished or forgotten,

my love feeds on your love, beloved,
and as long as you live it will be in your arms
without leaving mine.”

রাত্রিকাম কুয়াশায় জড়ায় বিস্তৃত কুমারী প্রান্তর। বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মধ্যে দাঁড়িয়ে অর্জুন, শিমুল আর ফলসার গাছেরা শৈশবের সুগন্ধি ফজরে অবগাহন করে। সুপ্তিনিবাসে যাওয়ার আগে মনে হয়, আঃ এ বেঁচে থাকা বড় দীর্ঘ ছিল! আঃ এ জীবন এক অকিঞ্চিৎকর অধ্যায়। একমাত্র এবং একটিই মাত্র জীবন কি বোঝাতে পারে সারাটা স্থলসময় কাটিয়েও গাছ ও মাটির নিগূঢ় সম্পর্কের বুনন কৌশল!

“if only if only you knew how i felt
if only if only you saw how i dwelt
every time i think of you my heart melts
if only if only i could tell you how i felt.”

.
© সৌমিত্র চক্রবর্তী।

ভালো থাকা না থাকা ২

মনে হয় ভালো আছি
গ্রীষ্মের শুকনো হাওয়ায়
তেতেপুড়ে, বর্ষায় গলে
যেতে যেতে কিভাবে যেন
হঠাৎ বেঁচে যাওয়া আফগানি
বরফে আঙুর খাওয়ার স্বপ্নে,
আর এই শীতের শীর্ষ বিন্দু
ছুঁয়ে ফেলার প্রারম্ভ হুইসলে
একান্ত জলসাখন্ড জড়ো
করতে চেয়েও বহু টুকরো
অসভ্যের মত হারিয়েই
থাকে কালচক্রের আসাযাওয়ায়,
তখনই প্রশ্নের নিস্পত্তি সময়
ভালো আছি?

কি জানি! ভালো থাকে কেউ!

ভালো থাকা না থাকা ১

ভালো থাকা না থাকা ১

গ্রীষ্ম আসে-গ্রীষ্ম যায়, শীত আসে-শীত যায়। স্লো মোশন থেকে প্রকৃতির আসা যাওয়ার নিরবিচ্ছিন্ন গল্পকে যদি হঠাৎ ফাস্ট মোডে চালিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে হুশহুশ করে পেরিয়ে যাবে কত রঙ, কখনো উজ্জ্বল কখনো বিবর্ণ। ইতিহাস বড় স্বার্থপর। নিজের স্বার্থের বাইরে একটাও মুখের ছবি সে মনে রাখেনা।

তবুও না চাইলেও ঝেড়েও ফেলে দিতে পারেনা অবাঞ্ছিত ভেঙে যাওয়া স্মৃতির আয়নার টুকরোগুলো। অন্ধকার খাঁজে ওপরের দিকে ভেসে ওঠে ঝলক দেওয়া আলোর কণা। হঠাৎ আলোর প্রতিফলন চোখের পাতায় ফেলে চোখ ধাঁধিয়ে দেয় মুহূর্তের জন্যেও। আর যতই লুকোতে চা’ক, ফাঁকে ফোকরে ভেসে উঠবে জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়া বহু ফুটিফাটা মুখ –”দাদা, আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম!”

স্বপ্ন অক্ষর

ঘুমের মধ্যে হাতের মুঠোয় ঝুপ করে এসে পড়ে
একঝাঁক চকোলেট
কার কেন কোথায় এসব উনকো ঝুনকো
স্বপ্ন মাকরূহ জাল বুনতে শুরু করলেই
মেঝে ফুঁড়ে কচি কচি হাতের
সফেদ বাদামি
আঙুলের গোছা পায়ের পাতায় সুরাইয়া
ঢেউ তুলে খেলতে খেলতেই সাঁ
করে স্বপ্নের চৌহদ্দির মধ্যে ঢুকে আসর বসায়
মুসাফির চল আগে বঢ়
তেরা কোই ওয়াতন নেহি…
ছোট্টবেলার তিন তিরিক্কে নয়
নামতা মুখস্থ করতে গিয়ে বারবার
বারবার হোঁচট খেতে খেতে
পরীক্ষার সাদা খাতা সামনে আকাশ পাতাল
ঘামের বিজকুড়ি
কেটে দুম করে মাটিতে আছড়ে ফেলা তৃতীয় বিশ্বের স্বপ্নদঙ্গল
মাঝেমধ্যে হা হা শব্দে জঙ্গল তাড়ানোর
বিকট মূর্তিতে ছুটে এলে
বিভ্রান্ত ভয়ার্ত ডোরাকাটা লাফিয়ে
পড়ে আরেক অনাহারীর ঘাড়ে
মূহুর্তে সময় চুষে খায় বর্তমানের
বোনম্যারো
আলোর উৎসব শেষ হলে নগর তাকিয়ে
দেখে অগ্নিদগ্ধ রক্তশূন্য লাশ।

চা

এক কাপ সকাল চায়ে
গুডমর্ণিং উইশ,
কাপে চুমুক ঠোঁটের মতোই
ভৈরোঁ রাগিনী।

এক কাপ চায়ের মধ্যে
অনড় ফাইল গলে
ডেবিট ক্রেডিট সরল সাদা
বসের মুখে মধু।

এক কাপ চায়েই যত
বিশ্ব রাজনীতি,
আমির থেকে ম্যাডোনা
পাশে বসে ঠেক এ।

এক কাপ চায়ের তেজে
এনার্জি ট্যাবলেট
রাত্রি হলেই ঘুমিয়ে পড়ি
সকাল চায়ের লোভে।

জেব্রা ক্রসিং

– কথা হয়ে গেছে? তাহলে যাই।
– কথা সব শেষ হয়! এমনকি শেষ কথার পরেও কিছু কথা থেকে যায়।
– কথা যত ছিল সেই অপার্থিব সন্ধ্যেয় একে একে ভাসিয়েছি জলে; তখন কথায় সৌরশক্তি, তখন কথায় জীবনমুখী গান।
– এমনকি রেগিস্তানের তাপ বিকিরণ করা বালির আলেঢালেও কথার তরঙ্গ উছলে ওঠে অনিবার; কথা শেষ হলে মাথার ওপরে শকুনির ঝাঁক, দূরে শ্বাপদের ফসফরাস চোখ।
– কতদিন হলো বিবাহবাসর শতরঞ্জি পেতে চোখচুরি খেলেনি! কতদিন! এখন সুগন্ধির আড়ালে রাসায়নিক গন্ধের নকল নির্যাস।
– ভালোলাগা আঙুলের টুকিটাকি কথা, তেল চকচকে নাকের আগায় স্ফূরিত কথা, গোলাপগন্ধী ঠোঁটের না বলা কথাসব কোন আশ্রয়ে গেল? শরনার্থী কথারা এখন কি সুখে আছে খুব?
– সুখ! সে তো কবেই ভূমিহীন রাতের নৈস্বরী আলোয়। আজ শুধু এপাশে ওপাশে উঁচুনিচু রাস্তার মাঝে একা পড়ে আছে একফালি বিবর্ণ জেব্রাক্রসিং।

ব্ল্যাঙ্ক

বেশ, তাহলে দুর্গাও চলে গেল হাত নেড়ে অকালে,
আজ মহরম, কদিন পরেই আলোর হুল্লোড়
আর অবশ্যই শব্দ বাজীর, তারপর-
একঘেয়ে শীতকালীন বিছানা ছাড়ার বিরক্তি
অফিসের নৈমিত্তিক কিচিরমিচির
ঝুম সন্ধ্যেয় তমো সত্ত্ব রজোঃ সবকটা শয়তানী
আঙুলের কিলবিল খেলার ফাঁকে
ও কুমির, তোর জলকে নেমেছি…

সেই কিশোরবেলা থেকেই পছন্দের প্রিয়
মুখদের কিছুতেই বলে উঠতে পারিনি
মাত্র চার অক্ষরের আদিম অথচ
সর্বব্যাপ্ত রোমান্টিক শব্দটা,
প্রত্যাখ্যানের কল্পিত গল্পরা চারপাশে
দেওয়াল তুলে ভালোবাসাবাসির গিরিখাতে
অবশ্যম্ভাবী পতনের ঝোঁক রুখে দিত:
অথচ আমার শরীরের অলিগলিতে
আনাগোনা করতো গাছ ফুল প্রশাখা
মৌমাছি গঙ্গাফড়িং হরহামেশাই,
অথচ মানুষের সামনে জিভের ওজন
একশো টনেরও বেশী, তোলে কার সাধ্যি!

উৎসবের ফুলঝুরির রোশনাই ফুরিয়ে গেলে
আমার শৈশব, আমার কিশোরবেলা
আতঙ্কিত হয়ে মায়ের হারিয়ে যাওয়া
আঁচল খোঁজে ডুবন্ত জাহাজী মৃত্যুভয়ে।