বিভাগের আর্কাইভঃ অন্যান্য

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-১৮

ভিতরে গিয়ে দেখে এটা ইমিগ্রেশন অফিস। এন্ড্রু ইমিগ্রেশন অফিসারকে দিয়ে সই স্বাক্ষর করিয়ে পাশের ছোট জেটিতে ভিড়ে থাকা একটা ছোট স্পিড বোটের কাছে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বোটের চালককে ডাকল। একটু পরে ভিতর থেকে বোটের ড্রাইভার বের হয়ে এসেই কি কি যেন বলল। এন্ড্রু ওদের দেখিয়ে আবার কি বলল। ড্রাইভার ওদের নামার পথ দেখিয়ে দিল। এন্ড্রু গুডবাই বলে আবার দেখা হবার আশ্বাস দিয়ে চলে গেল।
বোট ছেড়ে দিল। প্রচণ্ড বাতাস বইছে, মাথার চুল এলো মেলো উড়ছে, ভীষণ ঠাণ্ডা গায়ের জ্যাকেটে বাতাস ফর ফর শব্দ তুলছে। বেশ ঠাণ্ডা বাতাস। ওরা আধ খোলা বোটের বাইরে থেকে ভিতরে গিয়ে ড্রাইভারের পিছনে বেঞ্চে বসল। আর ড্রাইভার দূরের একটা জাহাজ দেখিয়ে বলল ওই যে তোমাদের জাহাজ। প্রায় চল্লিশ মিনিটের মধ্যে ওই জাহাজের পাশে এসে ভিড়ল। একটু দূরে থেকে দেখতে পেয়েছিল জাহাজের পাশে যেখানে বোট ভিড়বে সেখানে একটা সিঁড়ি নামিয়ে রেখেছে। পাশে কয়েক জন জাহাজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বোট ভিড়ার পর ওরা এক এক করে সিঁড়ি বেয়ে জাহাজে উঠে গেল। নিশাত কোন দিন এমন সিঁড়ি বেয়ে উঠেনি বলে ভয় পাচ্ছিল। তাই দেখে উপর থেকে কে এক জন একটু আগেই হাত বাড়িয়ে নিশাতের কাঁধের ব্যাগটা নিয়ে ওকে ধরে উঠাল। জাহাজে উঠে দেখে ওর স্কুলে নিশাতের সিনিয়র মুকিত ভাই সবার সাথে দাঁড়িয়ে আছে। সেও অবাক হয়ে ওর দিকে এগিয়ে এসে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরল,
আরে নিশাত তুমি! আমি তো ভাবতেই পারছি না! কাকে দেখছি!
হ্যাঁ মুকিত ভাই আমিও দূর থেকে আপনাকে দেখে ভাবছিলাম চেনা চেনা লাগছে কে হতে পারে? যাক ভালোই হয়েছে আপনাকে পেয়ে।

চল ভিতরে যাই
বোট ড্রাইভার ওদের নামিয়ে দিয়ে ওরা যাদের জায়গায় এসেছে তাদের নিয়ে ফিরে গেল। মুকিত ইউনিফর্ম পরা ছিল কিন্তু নিশাত এই ইউনিফর্মের মানে কি জানে না। এর আগে কখন জাহাজে উঠেনি। জাহাজে উঠেনি বলতে এক বার যখন ক্লাস এইটে পড়ে তখন ওর বন্ধুর সাথে করাচীর মনওয়ারাতে নেভীর সাব মেরিন দেখতে গিয়েছিল। ব্যাস এই পর্যন্তই ওর জাহাজ সম্পর্কে ধারনা। মুকিত ভাই সবাইকে নিয়ে ভিতরে গিয়ে সবার থাকার কেবিন দেখিয়ে দিয়ে যার যার ব্যাগ রেখে নিয়ে গেল ক্যাপ্টেনের রুমে। ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন ওদের দেখে এগিয়ে এসে ওয়েল কাম জানিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল। সবার সাথে হ্যান্ডশেক করে সৌজন্য মূলক কিছু কথা বার্তা বলে যার যার সিডিসি চেয়ে নিয়ে খুলে সবার চেহারা মিলিয়ে দেখল। এবার ভিতরে দেখছে কে কোথায় কোন কোন জাহাজে কাজ করেছে। সব দেখে নিশাতকে বলল ও তুমি একে বারে নতুন। বেশ, মুকিত তুমি ওকে ভালো করে সব কিছু বুঝিয়ে দিবে। এর পর অন্যান্য যারা ছিল তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। এনামুলকে ওর কাজের জায়গা গ্যালিতে নিয়ে চীফ কুক অরবিন্দ সিনহার কাছে বুঝিয়ে দিল। সালেককে সারেং এর কাছে বুঝিয়ে দিয়ে নিশাতকে নিয়ে চীফ অফিসার অরুণ এর কাছে নিয়ে গেল। এখানে এসে কথায় কথায় বুঝল মুকিত ভাই সেকেন্ড অফিসার। জাহাজে ডেক অফিসার এবং ডেক ক্রু সবাই বাংলাদেশি তবে চীফ কুক সিনহা কোলকাতার। ক্যাপ্টেন ব্রিটিশ, চিফ ইঞ্জিনিয়ার গ্রীক এবং অন্য ইঞ্জিনিয়ার ও ইঞ্জিন ক্রু সবাই ফিলিপাইনের।

মুকিত ভাই স্টোর থেকে ওদের বিছানার চাদর বিছানা পত্র গোছলের সাবান, কাপড় ধোয়ার ডিটার্জেন্ট পাউডার আর যা যা লাগে সব বের করে দিয়ে সব গুছিয়ে ব্রিজে যাবার কথা বলে আবার চীফ অফিসারের কাছে গেল।
নিশাত তার জন্য সুন্দর পরিপাটি করে সাজান কেবিন দেখে অবাক হলো। এই টুক ঘরের মধ্যে বিছানা, মাথার পাশে একটা রিডিং লাইট, পাশের দেয়ালে জাহাজের লে আউট নক্সা, বিছানার নিচে জুতা রাখার বক্স, হাবি জাবি এটা সেটা রাখার ড্রয়ার, কাপড় চোপড় রাখার জন্য পাশে ছোট্ট একটা আলমারি, আলমারির এ পাশে তোয়ালে ঝুলিয়ে রাখার একটা হ্যাঙ্গার, একটা ছোট টেবিল, চেয়ার, টেবিলের উপরে সেলফের মত তাতে সেভিং ক্রিম টুথ ব্রাশ এই জাতিয় জিনিস রাখা যায়, তার উপরে একটা বেশ বড় আয়না, আবার ছোট্ট একটু খানি গোল একটা সিঙকে ঠাণ্ডা গরম পানির ব্যবস্থা, এর উপরেও শেভ হবার জন্য একটা আয়না আবার আয়নার উপরে একটা লাইট। জানালায় মোটা ভারি পর্দা। ফ্লোরে কার্পেট বিছানো, পুরো জাহাজটাই এয়ারকন্ডিশন্ড, গরম বাতাস বের হচ্ছে। এতো কিছু, এতো আয়োজন দেখে নিশাতের বেশ ভালো লাগল। বাহ! কি সুন্দর পরিবেশ। এমন চাকরী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। এতো আরামের ব্যবস্থা। এই সব ভাবছে আর বিছানা গোছাচ্ছে, ব্যাগ থেকে বের করে যেখানে যা রাখার সেগুলি গুছিয়ে রাখছে। নিশাত বরাবরই গুছিয়ে ছিম ছাম ভাবে থাকা পছন্দ করে। তার কাছে এমন পরিবেশ ভালো লাগার কথা। এই গুছিয়ে রাখছে আর ভাবছে এমন সময় মুকিত ভাই এসে জানাল নিশাত তোমার ডিউটি কিন্তু সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত আবার সকালে ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। এখন তোমার ব্রিজে না গেলেও চলবে তবে দেখতে চাইলে যেতে পার এখন আমার ডিউটি চলছে। তুমি অরুণ দাদার সাথে ডিউটি করবে। আমরা এখন মিডল ইস্টে চলে যাব। আচ্ছা ভালো কথা কিছু খাবে, ক্ষুধা লেগেছে?
না মুকিত ভাই হোটেল থেকে খেয়েই বের হয়েছি।
আচ্ছা তা হলে তুমি এগুলি সেরে উপরে এসো আমি যাই, নোঙ্গর তুলতে হবে।
মুকিত ভাই চলে গেল নিশাত একটু পরে সব সেরে ব্রিজে গেল। দেখে জাহাজ চলছে।
কত দিন লাগবে মুকিত ভাই?
কিসের?
না এই যে আমরা মিডল ইস্টে যাচ্ছি সেখানে যেতে
দশ/বার দিন লেগে যাবে যদি সুয়েজে ট্রাফিক না থাকে, এবার যাব সউদি আরবের রাস্তানুরাহ পোর্টে।
কিন্তু আমি যে জাহাজের কিছুই জানি না চিনি না।
তাতে কি, যারা নতুন আসে তারা কেউ কিছু জানে না, সব দেখিয়ে চিনিয়ে দিবো তুমি কিচ্ছু চিন্তা করোনা, আমার সাথে তোমার ডিউটি হলে ভালো হত তবে অরুণ দাদা খুব ভালো মানুষ দেখবে সে তোমাকে সব শিখিয়ে দিবে। আচ্ছা এবার দেশের কথা বল, কি অবস্থা?
বলেই একটু ভেবে বলল
না থাক পরে শুনব এখন ইমিগ্রেশন হবে জেটিতে জাহাজ ভিড়িয়ে নেই, অরুণ দাদাও শুনবে, চা কফি সবই আছে কি খাবে?
কিচেনে যেতে হবে?
না, এখানেই ব্যবস্থা আছে,
হ্যাঁ চা খেতে পারি
তা হলে ওই দেখ ওই ইলেকট্রিক জগে পানি গরম দাও আর দেখ ওখানেই চা পাতা দুধ চিনি সব আছে বানিয়ে নাও, আমাকেও এক কাপ দিও।
নিশাত চা বানাচ্ছে আর মুকিত ভাইর কথা শুনছে,
আর শোন, জাহাজের কিছু ভাষা আলাদা যেমন এখানে কিচেনকে বলে গ্যালি, আমরা যেখানে বসি, টিভি দেখি ওটার নাম সেলুন এরকম আরও অনেক কিছু আছে সে আস্তে আস্তে সব জানবে। আমার কাছে কিছু বই আছে ওগুলি নিয়ে পড়বে। আমি আগামী ভয়েজ শেষ করে ইংল্যান্ডে যাব চীফ মেট পরীক্ষা দেবার জন্য।
মানে অরুণ’দা যা তাই?
হ্যাঁ, তুমিও পারবে কয়েক বৎসর গেলে সরাসরি সেকেন্ড মেট পরীক্ষা দিও, এর মধ্যে যদি ভালো ভাবে সব কিছু শিখে নিতে পার তা হলে দুই এক বৎসরের মধ্যেই ক্যাপ্টেন তোমাকে থার্ড অফিসারে প্রমোশন দিতে পারে। কাজেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটু বই গুলি দেখবে। সেলুনেও দেখবে কিছু বই আছে সেগুলিও পড়তে পার। অবসর সময়ে আজে বাজে চিন্তা ভাবনা না করে, সিনেমা না দেখে পড়াশুনা করতে হবে।
কি কি পড়তে হবে?
অনেক কিছু, নেভিগেশন, সিম্যানশিপ, কম্পাস, চার্ট ওয়ার্ক, রুল অফ দা রোড, সিগনালিং, ফার্স্ট এইড আমি বলে দিবো সব। তোমার ভাগ্য ভালো আমার কাছে এসে পৌঁছেছ। কোন চিন্তা করবে না। কাজে মন দিবে কে কখন কি করে সব কিছু মন দিয়ে লক্ষ্য করবে, দেখবে তুমিও পারবে।
হ্যাঁ ঢাকা থেকে আমার মামা বলেছে এখানে নাকি এ ভাবে ক্যাপ্টেন পর্যন্ত হওয়া যায়?
হ্যাঁ। আচ্ছা ঐযে দেখছ পাইলট লঞ্চ আসছে?
হ্যাঁ ওই যে উপরে একটা লাল সাদা ফ্ল্যাগ উড়ছে ওইটা?
হ্যাঁ, ওটায় পাইলট আসছে, ও আমাদের নিয়ে জেটিতে ভিড়িয়ে দিবে।
পাইলট তো শুনেছি প্লেন চালায়
হ্যাঁ আসলে পাইলট মানে পথ প্রদর্শক, কাজেই যে পথ দেখিয়ে নেয় সেই তো পাইলট তাই না?
ও হ্যাঁ তাই, কিন্তু আপনারা একা জেটিতে ভিড়তে পারেন না?
পারি কিন্তু এটা নিয়ম না, কারণ প্রত্যেক দেশের হারবারের নিজস্ব কিছু কিছু নিয়ম থাকে, হারবারে পানির নিচে কোথায় কি আছে তা আমরা জানি না, ওগুলি এই পাইলটেরা জানে, এদেরও আমাদের মত সার্টিফিকেট আছে। এদের বিশেষ ভাবে এই হারবার এলাকার উপর ট্রেনিং দিয়ে পাইলট বানানো হয়। এটা আন্তর্জাতিক আইন।

কথা বলতে বলতে মুকিত ভাই জাহাজের স্পিড কমিয়ে এক সময় থামিয়ে দিল আর ওই পাইলট লঞ্চ এসে জাহাজের পাশে আগে থেকে নামানো সিঁড়ির কাছে ভিড়ল আর সিঁড়ি বেয়ে পাইলট উঠে এলো। পাইলটকে নামিয়ে দিয়ে লঞ্চ চলে গেল। জাহাজের স্পিড বাড়িয়ে দিল। পাইলট উপরে ব্রিজে উঠে এসে মুকিত ভাইর সাথে একটু কথা বলে যে স্টিয়ারিং করছিল তাকে কি সব অর্ডার দিচ্ছে আর সে সেই ভাবে স্টিয়ারিং করে করে এক সময় জাহাজ লন্ডন পোর্ট ইমিগ্রেশন অফিসের জেটিতে ভিড়িয়ে দিল। মুকিত ভাইকেও ইঞ্জিনের গতি সম্পর্কে বলছিল। জাহাজের সামনে পিছনে কোন রশি কখন বাধতে হবে পাইলট তাও বলে দিচ্ছিল। জাহাজ ভিড়ার পর কিছু কাগজ পত্রে ক্যাপ্টেনের সই নিয়ে পাইলট নেমে গেল। একটু পরে জেটির পাশে একটা পিক আপ এসে থামল।
ওটা দেখে জয়নুল বলল স্যার ওই তো ওরা এসে গেছে,
ইমিগ্রেশন অফিসার ও তার সহকারী এবং কাস্টম অফিসার জাহাজে উঠে এলো। মুকিত ভাই এবং পাইলট নিচে নেমে গেল। পাইলট এখান থেকে চলে গেল আর মুকিত ভাই অফিসারদের নিয়ে ক্যাপ্টেনের অফিসে ঢুকল। ওখানে জাহাজের সবার সিডিসি, ক্রু লিস্ট এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখে দেখে সই স্বাক্ষর দিয়ে চলে গেল। এবার এখান থেকে বের হয়ে ইংলিশ চ্যানেল, বে অফ ভিস্কি এবং জিব্রালটার প্রণালী হয়ে ভূমধ্য সাগর দিয়ে সুয়েজ খাল পাড় হয়ে আরব সাগর পাড়ি দিয়ে মিডল ইস্টে যেতে হবে। শুনে নিশাত খুব খুশি। একসাথে এত গুলা দেশ দেখতে দেখতে যাওয়া যাবে! এতদিন যে সব দেশের নাম শুধু ভূগোল বইতে পড়েছে আজ সেগুলি নিজ চোখে দেখতে পাবে! কি আনন্দ!

জাহাজ চলছে। মুকিত ভাই একটু পরে বলল যাও তুমি রেস্ট নাও রাতে তোমার ডিউটি আছে। নিশাত এসে বিছানায় শুয়ে পরল কিন্তু বইতে পড়া এবং গল্পে শোনা ইংলিশ চ্যানেলের বুকে তার জাহাজ সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে এই আনন্দে নিশাতের ঘুম আসছে না সে উঠে কেবিনের জানালা দিয়ে বাইরে খোলা সাগরের দিকে তাকিয়ে রইল কিন্তু দেশ ছেড়ে আসার পর গত কয়েকদিনের উৎকণ্ঠা, অনিশ্চয়তা এবং ক্লান্তির জন্য কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল। সন্ধ্যা সাতটার দিকে ঘুম ভেঙ্গে গেল। তাড়াতাড়ি ধরমর করে উঠে আশে পাশে সবকিছু নতুন এবং অচেনা দেখে বোঝার চেষ্টা করল আমি কোথায়? আস্তে আস্তে সব মনে পড়ল। আমি এখন জাহাজে। যে জাহাজে চাকরী করার জন্য দেশ ছেড়ে মা বাবা ভাই বোন ছেড়ে এত দূরে এসেছি গত কয়েকদিন ভরে। বিছানা ছেড়ে উঠে কেবিনের সিংকে মুখ ধুয়ে ব্রিজে চলে এলো। আরে নিশাত এসো এসো। এখনি এসে পড়েছ?
কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম
তাহলে আর আসার কি দরকার ছিল যাও তুমি রাতের খাবার খেয়ে ইউনিফর্ম পরে রেডি হয়ে এসো।
নিশাত ব্রিজ থেকে সরাসরি গ্যালিতে এসে দেখে এনামুল বসে আছে।
[চলবে]

এলেবেলে – ৩৫

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট এর লাগেজ চেক বড়ো অদ্ভুত। প্রথমে বিমান বন্দর এ ঢোকার পর লাগেজ স্ক্যান করে সংশ্লিষ্ট বিমান কোম্পানি লাগেজ টি গ্রহণ করে অন্য একটি কাউন্টারে পাঠানো হয়। সেখানে স্ক্যান করে উনারা গণহারে লাগেজ খুলে ম্যানুয়ালী চেক করেন। আপনার সাজানো গোছানো লাগেজ টা তছনছ করে ছাড়েন।

পৃথিবীর বিমান বন্দর এ এরকম অত্যাধুনিক লাগেজ চেকিং কোথাও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে।

লাগেজ ম্যানুয়ালী চেক করা হয় তখনই যখন স্ক্যান এ সন্দেহ জনক কিছু দেখা যায়। লাগেজ খুলে সন্দেহ জনক বস্তুটি ম্যানুয়ালী চেক করা হয়। পৃথিবীর অনেক দেশের 📺 টিভি তে বর্ডার সিকিউরিটি নামক অনুষ্ঠান আছে।অনুষ্ঠান গুলো খুবই জনপ্রিয়। আমাদের দেশের টিভি চ্যানেল গুলো বিমান বন্দর এর নিরাপত্তা এবং কাষ্টমস চেকিং এর উপর অনুষ্ঠান তৈরি করতে পারে।

চট্টগ্রাম বিমান বন্দর থেকে আমি ঢাকা যাব। আমার লাগেজ স্ক্যান করার পর যিনি স্ক্যান করেন তিনি আমার সর্বশেষ গন্তব্য জানার পর আমার কাছে বকশিস চেয়েছিলেন। এই হল অবস্থা।

আমাদের দেশের বিমান বন্দর গুলোতেই সবচেয়ে বেশি ইউনিফর্ম বিহীন কর্মরত মানুষ চোখে পড়ে। বিদেশের বিমান বন্দর এ ডিউটি ফ্রি শপ এ কর্মরত প্রত্যেক কর্মীদের নির্দিষ্ট পোষাক আছে।

নির্দিষ্ট পোষাক এবং নামের ব্যাজ যাত্রী এবং কর্মীদের কে আলাদা করতে সাহায্য করবে। নামের ব্যাজ থাকলে অবৈধ কাজ করতে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ইউরোপ আমেরিকা সিঙ্গাপুর হতে হলে নিয়ম মানতে হবে। শৃঙ্খলা আনতে হবে। হযবরল উন্নয়ন এ কেউবা এগিয়ে যেতে পারে সামগ্রিক উন্নয়ন অসম্ভব।

সুকান্ত ভট্টাচার্যের এর কবিতার মতো লাইনে দাঁড়াতে হবে।

হেঁটে চলেছি আমি বন জোছনায়……..

হেঁটে চলেছি আমি বন জোছনায়
পড়েছি রঙধনু রঙ শাড়ি
অপরূপ চন্দ্রাহার তারার গহনা
কানে পড়েছি জোনাকির দুল , হাতে ঝিনুকের চুড়ি
নি:শব্দ সীমাহীন গহীনে আকাশ হলো সাথী
একাকী হেটে চলেছি আমি বন জোছনায়
দেখেছি বাদুর আধারে ডানা মেলে যায় হীম জোছনায়
রহস্যময় আবেগীমন চায় পূর্ন স্পন্দন
যেতে চায় গভীর থেকে গভীরতম সমুদ্রে
যেখানে অনাবিল আনন্দ স্বপ্নের বিথীকায়
হেটে চলেছি আমি বন জোছনায়………..

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-১৭

দুপুরে খাবার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে, বিশ্রাম আর কি হল রুমে বসে টিভি দেখার পর নিশাত বলল চলেন বাইরে থেকে ঘুরে আসি। আমার একটা ক্যামেরা কেনার শখ অনেক দিনের দেখি যদি পাই নিয়ে আসব।
চলেন ঘরে বসে থেকে কি করবো তার চেয়ে ঘুরে আসি, আমরাও কখনো এই দেশে আসিনি।

আপনারা এর আগে কোথায় কোথায় গেছেন?
আমি বেশি গেছি ইস্টে, অনেক জায়গায় গেছি, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, হংকং।
ওদিকে কেমন দেখেছেন?
ওদিকে এরকম শীত নেই, গাছপালা আছে, সবুজ আছে, বিদেশে সব জায়গাই ভালো, মানে আমাদের দেশের মত এত চোর বাটপার পকেট মার নেই তবে দেখতে আমাদের দেশ সুন্দর যদি এই সব না থাকত তাহলে আমাদের দেশই সবচেয়ে ভাল দেশ হতো।
জাহাজে চাকরী করলে এই একটা সুবিধা তাই না? বিভিন্ন দেশ দেখা যায়। এইযে দেখেন এই আমি এখনও জাহাজি উঠিনি অথচ এর মধ্যে দুইটা দেশ দেখা হয়ে গেল!

৯।
ওরে বাব্বা যা ঠাণ্ডা, একটু চা হলে ভালো হতো।
চলেন দেখি হোটেলে যাই ওখানে চা বা কফি পাই কি না।
হ্যাঁ চলেন
তিন জনেই হোটেলে এসে দেখে দুপুরের খাবার খাচ্ছে কেউ কেউ।
তা হলে আমরাও খেয়ে যাই?
হ্যাঁ তা খারাপ হয় না আমি তখন তেমন খেতে পারিনি
ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করল এখানে কি মেনু আছে?
ওয়েটার মেনু এনে দিল।
মেনুতে দেখে সব ইংলিশ খাবার।
তাহলে আমাদের খাবার কি হবে?
নিশাত ভাই এক কাজ করেন ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করেন এশিয়ান খাবার আছে কি না!
আচ্ছা!
নিশাত ওয়েটারকে ডেকে বলল, তখন ওয়েটার বলল
দুঃখিত তেমন কিছু এখানে নেই তবে তোমরা ফিস অথবা চিকেন এন্ড চিপস বা রাইস খেতে পারবে
ওদের সাথে একটু আলাপ করে নিয়ে বলে দিল এখন ফিস এন্ড চিপস দাও রাতে চিকেন এন্ড রাইস খাব
হ্যাঁ আমিও
আমিও
আচ্ছা তা হলে সবার জন্য একই আইটেম
ওয়েটার চলে গেল। একটু পড়ে খাবার নিয়ে আসল তিনটা ডিশ ভরে, বিশাল এক টুকরা ভাজা মাছ, বেশ অনেক গুলো ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, অনেক সালাদ।
খেয়ে বেশ ভালই পেট ভরল। তবে নিশাত ভাবল এই শুরু হলো বিদেশের খাবার। এখন আর ইচ্ছে করলেই মায়ের রান্না খাবার পাওয়া যাবে না কিংবা মাকে জ্বালাতনের জন্য বলাও যাবে না যে এটা খাব না ওটা খাব না। এখানে যা পাওয়া যাবে তাই খেতে হবে।
খেয়ে দেয়ে ম্যানেজারের সাথে আলাপ করল কোথা থেকে কি কিনতে হবে। ম্যানেজার বলে দিল এখান থেকে পপলার টিউব স্টেশনে গিয়ে একটা করে রিটার্ন টিকেট নিয়ে হোয়াইট চ্যাপেল চলে যাও ওখানে যেয়ে ব্রিকলেন বা হোয়াইট চ্যেপেল থেকে তোমার যা খুশি কিনে আন।

ওরা হাঁটছে আর কথা বলছে। জিজ্ঞেস করে করে পপলার টিউব স্টেশনে এসে ম্যানেজারের কথা মত তিনটা অল্ডগেট ইস্ট রিটার্ন টিকেট নিয়ে সেন্ট্রাল লাইনের ট্রেনে উঠে পরল। অল্ডগেট ইস্ট নেমে টিউব থেকে বের হয়ে আবার জিজ্ঞেস করে করে ব্রিকলেনে চলে এলো। কথায় কথায় মার্কেটের নাম দেখার সুযোগ পায়নি। প্রায় সব দোকান সুন্দর ছিম ছাম সাজানো গুছানো। লন্ডন শহরের দোকান পাট! এগুলি কি আর আমাদের ঢাকা শহরের দোকানের সাথে তুলনা করা চলে? কিছু কিছু রাস্তার নাম বাংলায় লেখা, ব্রিকলেন এমনি আরও কিছু। রাস্তায়ও প্রচুর এশিয়ান এবং বাঙালি বলেই মনে হলো যদিও কারো সাথে কথা বলেনি এমনিই চেহারা দেখে যা মনে হয়েছে। দোকান পাট সব বাইরে থেকে দেখছে। বিচিত্র সব মানুষ গিজ গিজ করছে। বিভিন্ন রকমের পোশাক, বিভিন্ন চেহারা। ইংরেজ দেশ বলে যে সবাই ইংরেজ তা নয় অনেক বিদেশী দেখে একটু বিস্মিত হলো। এটা একটা আন্তর্জাতিক শহর বলে নানান জাতের নানান রঙের মানুষ থাকবেই। সবাই পায়ে হেঁটে এসেছে। মার্কেট এলাকায় কোন গাড়ি নেই, সম্ভবত গাড়ি পার্কিং এলাকায় রেখে এসেছে নয়ত টিউবে এসেছে।

নিশাতরা বাইরে থেকে কাচের দেয়াল দিয়ে দেখল একটা দোকানে কিছু ঘড়ি ক্যামেরা সাজানো রয়েছে এই দোকানে ঢুকে পরল। বিভিন্ন ডিজাইনের বিভিন্ন সাইজের সেলফে নানা রকম জিনিস সাজিয়ে রেখেছে। প্রতিটা জিনিসের সাথে কাগজের একটা কার্ডের মত আছে যাতে ওই জিনিসের বিবরণের সাথে দাম লেখা রয়েছে। যেখানে ক্যামেরা রয়েছে ওখানে গেল, ইয়াশিকা, অলিম্পাস, ক্যানন, পেনটেক্স নানা কোম্পানির তৈরি নানা মডেলের ক্যামেরা। এর মধ্যে একটা ইয়াশিকা ক্যামেরা দেখল তাতে যে দাম লেখা রয়েছে তাতে আজ সকালে স্টেনলি যে টাকা দিয়েছে তার চার ভাগের এক ভাগেই হয়ে যায়। ছোট বেলা থেকে একটা ইয়াশিকা ক্যামেরার খুব শখ। মেঝ মামাকে দেখেছে ইয়াশিকা ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে। ভাবনায় পরে গেল এতো টাকা দিয়েছে! কিনব না কি? থাক দেখি আগে জাহাজে যাই আরও কিছু দিন যাক পরে কেনার অনেক সুযোগ পাওয়া যাবে, কোথায় কত টাকা লাগে না লাগে তা না জেনে খরচ করা উচিত হবে না। হঠাৎ কোন প্রয়োজন হলে কে তাকে টাকা দিবে? এখানে তাকে কে চিনে? কার কাছেই বা হাত পাতবে নানা রকম সাত পাঁচ ভেবে কেনার ইচ্ছা বাদ দিল। দেখতে এসেছি দেখি কালই তো আর চলে যাচ্ছি না। দেখতে দেখতে এক জায়গায় দেখে নানা ধরনের অলংকার সুন্দর করে থরে থরে সাজানো রয়েছে নানা আঙ্গিকে নানা ধরনের। দেশে অলংকারের দোকান দেখেছে কিন্তু সে তো এর কাছে কিছুই নয়। এখানে হিরা বসানো, সাদা এবং গোলাপি মুক্তা বসানো কত রকমের ডিজাইনের। আবার একটা দেখল সাদা স্বর্ণ, এটা আবার কি? স্বর্ণ কি সাদা হয় নাকি? আগে তো কখন দেখিনি! এর দাম হলুদ স্বর্ণের চেয়ে অনেক বেশী। প্রতিটির সাথেই স্বর্ণের পরিমাণ, কি পাথর বা কত ক্যারেটের হিরা আছে দাম কত সব লেখা। নিরুর কথা মনে হলো। নিরু কি আমার হবে? আমি কি নিরুর জন্য এসব কিনতে পারব? আমার যদি এগুলি কেনার মত অত টাকা হয় তা হলে সব কিনে এক দিন নিরুকে অবাক করে দিবো, একটা একটা করে পড়িয়ে মুগ্ধ চোখে চেয়ে দেখব। এগুলি পড়লে ওকে কেমন দেখাবে? হঠাৎ করে এক বিদেশীর সাথে ধাক্কা লেগে নিশাতের নিরু স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল, সরি বলে সরে এলো।

কোথায় কেন যেন এসেছে, ও হ্যাঁ এই তো দোকানে। এর পরে গেল ঘড়ির কাছে। ওরে বাব্বা এতো দাম! অবাক হয়ে গেল, এই দাম দিয়ে কারা কিনে এগুলি? তার হাতে আগে কখন ঘড়ি ছিল না যে ঘড়ি রয়েছে সেটা মামা যে টাকা দিয়েছিল সে টাকা দিয়ে চিটাগাং থেকে একশ বিশ টাকায় কিনেছে। কত রঙ বেরঙ্গের ঘড়ি, কোনটা স্বর্ণের সংখ্যা, স্বর্ণের ডায়াল, স্বর্ণের চেইন স্টেনলি যা দিয়েছে তাতে কুলায় না এমন সব দাম আবার ওই টাকা দিয়ে বিশটাও কেনা যায় এমনও আছে। হবেই তো এদের পকেটে আর ব্যাঙ্কে কত টাকা। না বাবা আমার হাতে যা আছে এই যথেষ্ট শুধু সময় দেখা এই তো, আর কি হবে? আমাকে যে নিরুকে পেতেই হবে ওর জন্য আমার অনেক টাকার দরকার হবে। বাড়িতে মা বাবা, ভাই বোন এরা তো আমার পাঠান টাকার পথ চেয়ে রয়েছে। নিরুকে আনতে হলে অনেক টাকা জমাতে হবে, অনেক ত্যাগ করতে হবে, অনেক সহ্য করতে হবে। কাজেই এসব দেখে মন বিভ্রান্ত করা যাবে না। কিছু না বলে চলে যাওয়া নিরুর মুখ কিছুতেই ভুলতে পারছে না। নোমানের কথার খেই ধরে নিরু শুধু মাটির দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া একটা কথাও বলেনি। পরে এখানে আসার আগে বীণা আপার বাড়িতে শুধু অপেক্ষা করবে বলে বলেছে, কিন্তু এর মধ্যে নিশাত যাবার আগে যদি কিছু হয়ে যায়? তাহলে? অন্য কিছু মানে নিরুর বাবা যদি অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দেয়! তাহলে কি নিরু পারবে তাকে সত্য কথাটা বলতে? না না এ হতে পারে না। নিরু ঢাকা লালমাটিয়া কলেজে যখন ভর্তি হয়েছে তাহলে আর সহসা বিয়ের পরিকল্পনা মাথায় নেই বলেই মনে হয়। তবুও মনে একটা কিন্তু জেগেই রইল। ভুল করেছে মস্ত ভুল! অন্তত বীণা আপাকে কিছু ইঙ্গিত দিয়ে এলে পারত। এখানেও কিন্তু! কি ইঙ্গিত দিত? কি বলত? ওর এখন কি সঙ্গতি আছে?
চলেন এনাম ভাই, সালেক ভাই চলেন দেখার কোন শেষ নেই, এর চেয়ে বাইরে দেখি। কেনাকাটা যা করার পরে করব!
চলেন, তাই ভাল
চলেন, সিঙ্গাপুরে দেখেছি এখানের চেয়ে অনেক কম দাম
তাই নাকি?
হ্যাঁ, সিঙ্গাপুর ডিউটি ফ্রি দেশ। কেনাকাটা করলে ওখান থেকেই করবেন কিংবা দুবাই থেকেও করতে পারেন এই দুই দেশে কোন ডিউটি নেই একেবারে ট্যাক্স ফ্রি দেশ
ও আচ্ছা, বুঝেছি মানে ওখানে কোন কাস্টম ডিউটি নেই, তাই না?
হ্যাঁ, নিশাত ভাই কিছু খাবেন?
কি খাব, চলেন একটা করে কোক নেই, সবাই হাঁটছে প্রায় সবার হাতেই দেখছি কিসের ক্যান একটা। আমরা আর বাদ থাকি কেন, চলেন ওইতো ওই দোকান ওই যে সামনে বাম দিকে।
কোক কিনে সবাই হাঁটছে আর একটু একটু করে চুমুক দিচ্ছে। হঠাৎ সালেক বলল
দেখছেন ওই যে সিনেমা হল!

হ্যাঁ তাই তো, হিন্দি সিনেমা চলছে মনে হয়, চলেন তো দেখি, যদি হিন্দি সিনেমা হয় তা হলে দেখবেন?
হ্যাঁ দেখব না মানে, জানেন সিঙ্গাপুরে শোর পাস পেলেই হিন্দি সিনেমা দেখতাম, চলেন।
চলেন, আমি উর্দু হিন্দি সব জানি, আমার কোন অসুবিধা নেই!
একটু এগিয়ে হলের সামনে দেখে হেমা মালিনি আর ধর্মেন্দ্রের ছবি চলছে। টিকেটের দাম খুবই কম, মাত্র এক পাউন্ড। ওরা তিন জনে তিনটা টিকেট নিয়ে দেখে আরও কিছুক্ষণ পরে শো শুরু হবে। এই ফাঁকে বাইরে বের হয়ে আর কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে দেখল। সময় মত ফিরে এসে হলের ভিতর যেয়ে বসল। একে বারে আমাদের দেশের মত ব্যবস্থা। নিশাত কখনো ভারতের হিন্দি সিনেমা দেখেনি। করাচীতে থাকা সময়ে উর্দু সিনেমা দেখেছে। রাত নয়টায় সিনেমা শেষ হলে হল থেকে বের হয়ে আবার টিউবে করে পপলার এসে বাকি পথে হেটে হোটেলে ফিরে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পরল। বাইরে ভীষণ ঠান্ডা!
পরদিন আবার সারা দিন হেঁটে যত দূর যেতে পারে ঘুরে ঘুরে বেড়িয়ে নিলো।

১০।
পরদিন সকালে সাড়ে আটটার দিকে রুম সার্ভিস ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল, হ্যাঁ গুড মর্নিং।
ওপাশ থেকে স্টেনলির কণ্ঠে গুড মর্নিং ভেসে এলো। নিশাত, কি খবর তোমাদের, কেমন আছ?
হ্যাঁ ভালো আছি সেদিন সিনেমা দেখলাম এদিক ওদিক বেড়ালাম ভালোই কাটছে।
বেশ ভালো করেছ, জায়গা চিনে নিয়েছ। আচ্ছা শোন তোমাদের জাহাজ চলে এসেছে আজ দুপুর দুইটায় তোমরা রেডি হয়ে থেক এন্ড্রু গিয়ে তোমাদের জাহাজে পৌঁছে দিয়ে আসবে, মনে থাকবে?
হ্যাঁ মনে থাকবে না কেন?
তা হলে এখন রাখি, সময় মত রেডি হয়ে থেক।
ঠিক কাটায় কাটায় দুপুর আড়াইটায় সে দিনের সেই ড্রাইভার এসে হোটেলের গেটে গাড়ি রেখে ভিতরে ওদের দেখে বলল,
ও, তোমরা রেডি হয়ে বসে আছ, বেশ! চল গাড়িতে ওঠ।
সবাই যার যার ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে উঠার পর গাড়ি ছেড়ে দিল। টেমস নদীর পাড় ঘেঁসে যে রাস্তা গেছে ওই রাস্তায় মিনিট পাঁচেকের মধ্যে জেটির পাড়ে একটা ছোট অফিসের মত ঘরের পাশে গাড়ি রেখে ওদের সিডিসি গুলি চেয়ে নিয়ে বলল আমার সাথে মালামাল নিয়ে আস।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-১৬

এর পর দুপুরে দোতলা থেকে একটার মধ্যে লাঞ্চ করে উপরে রুমে গিয়ে একটু বিশ্রাম করে নিল রাতে লন্ডনের ফ্লাইট প্রায় আট ঘণ্টার জার্নি। শেষ বিকেলে সবাই ব্যাগ গুছিয়ে রেডি হয়ে নিচে নেমে রিসিপশনের কাজ সেরে যার যার সিডিসি নিয়ে বসে রইল। ঠিক সাতটায় সেই ড্রাইভার এসে হাজির।
ও, তোমরা রেডি?
হ্যাঁ চল, আমরা রেডি হয়েই আছি।
চল।
গাড়িতে উঠে বসার পর গাড়ি ছেড়ে দিল। সে রাতের মত আজ এত স্পিডে চালাচ্ছে না তবুও কম না, ৮০ মাইলের কাছা কাছি।
দুবাই এয়ারপোর্টে নামিয়ে গালফ এয়ারের চেক ইন ডেস্কের সামনে পৌঁছে দিয়ে ড্রাইভার গুড বাই বলে চলে গেল। একটু পরে প্লেনে উঠে সিট নম্বর দেখে বসে সিট বেল্ট বেধে নিল। লন্ডনে হিথ্রো এয়ারপোর্টে নামবে লন্ডনের সময় রাত নয়টায়। ওখানে নেমে আবার কি হয় কে জানে এ পর্যন্ত ভালোই কেটেছে, হাবিব কোথায় কি ভাবে কোন জাহাজে উঠল কিছু জানতে পারলাম না, কবে জানব কে জানে। ভাবতে ভাবতে বিমান বালার কণ্ঠ শোনা গেল বাহরাইন মোহাররেক বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করার বার্তা জানিয়ে দিল। একটু পরে ছোট বোইং 727 প্লেন মটরিং করে বেরিয়ে এসে রান ওয়ে দিয়ে এক দৌড়ে আকাশে উঠে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যে এরাবিয়ান গালফের উপর দিয়ে বাহরাইনের পথে এগিয়ে চলল। নিচে নীল সাগরের উপর দিয়ে আরবদের প্রিয় বাজ পাখির ছবি আঁকা গালফ এয়ারের প্লেন উড়ে চলছে। একটু পরে হালকা পানীয় নিয়ে এলো। এর পরে বাহরাইন থেকে টেক অফ করার পর পরিবেশন করবে রাতের খাবার। আধা ঘন্টারও কম সময়ের মধ্যে বাহরাইন বিমান বন্দরে প্লেন নামার পর ওরা বের হয়ে টার্মিনাল ভবনে চলে এলো। এখানে ট্রান্সফার ডেস্কে জিজ্ঞেস করে লন্ডনের প্লেন যে গেট থেকে ফ্লাই করবে তা জেনে নিয়ে ১২ নম্বর গেটে গিয়ে দেখে লোকজন প্লেনে উঠছে। লম্বা কিউ এর পিছনে দাড়াল। এক সময় প্লেনে উঠে বসার পনের বিশ মিনিট পড়েই প্লেন টেক অফ করল। প্লেন আকাশে উঠে যবার পর হালকা পানীয় সার্ভ করল। নিশাত এর আগে কখনও এত লম্বা প্লেন জার্নি করেনি। দুবাই থেকে বাহরাইন হয়ে সরাসরি লন্ডন।

যথা সময়ে লন্ডন হিথরো এয়ারপোর্টে নেমে দেখে মহা যজ্ঞ। কোথায় থেকে কোথায় যাবে কিছুই বোঝা যেত না যদি এখানে কঠিন শৃঙ্খলা না থাকত। এরো দেয়া আছে তাই দেখে দেখে ইমিগ্রেশন ডেস্কে চলে এসেছে এখানেও সেই চিঠি দেখাল আর অমনি সিডিসিতে হিথ্রো এরাইভ্যাল সিল লাগিয়ে ফেরত দিয়ে দিল। এর পর কাস্টম হয়ে বাইরে এসে দেখে নিশাত জামান এন্ড গ্রুপ লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে এক মহিলা দাঁড়ান।
ওদের এশিয়ান চেহারা দেখে জিজ্ঞেস করল নিশাত?
ইয়েস
ওকে, প্লিজ ফলো মি।
বলেই তর তর করে এগিয়ে গিয়ে বাইরে রাখা বিশাল গাড়ির কাছে এসে বলল ওঠ। এয়ারপোর্টের দরজা দিয়ে বের হয়ে ঠাণ্ডার একটা তীব্র ঝাঁকুনি লাগল কিন্তু গাড়িতে উঠে বুঝল হিটার চলছে। কোন কথা বলছে না কেউ। চুপ করে বসে রইল। নিশাতের বিশ্বাস হচ্ছে না সে এখন লন্ডন শহরে গাড়িতে করে ছুটে চলছে কোন এক অচেনা হোটেলের দিকে। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে নিয়ে এলো পপলারের পাশে হেইচএসবিসি ব্যাঙ্কের হেড কোয়ার্টারের কাছে এক হোটেলে। লন্ডন শহরে মরিসন হোটেলে। এই হোটেল দুবাইর হোটেলের মত কোন নামী হোটেল না মনে হলো। খুবই সাধারণ একটা বাড়ির মত মনে হলো। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে সামনের রিসিপশন কাউন্টারে বসে থাকা ম্যানেজারের সাথে ওই মহিলা যার বুকে নেম প্লেটে লেখা দেখেছে ক্যাথরিন যে হিথ্রো থেকে নিয়ে এসেছে, পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল এরা থাকবে। কাল এসে অফিসে নিয়ে যাব। ওদের গুড বাই বলে চলে গেল। ম্যানেজার ওদের সাথে কথা বলছিল, ওদের নিয়ে চারতলায় দুইটা রুম দেখিয়ে দিল একটাতে দুই বেড আর একটাতে এক বেড। নিশাত এক বেড যে রুমে ওই রুমে ওর ব্যাগ রেখে বের হয়ে এলো, ম্যানেজার হোটেলের নিচ তলায় খাবার ঘর দেখিয়ে সময় টময় বলে তার কাউন্টারে চলে গেল।
ওরা নিজেরা একটু গুছিয়ে নিয়ে সবাই নিশাতের ঘরে এসে বসল। কিছুক্ষণ এটা সেটা নিয়ে আলাপ করে নিশাত জানতে চাইল এখানে ওরা কেউ আগে এসেছে কি না। না আমরা আগে আসিনি।

এখানেও দুবাইর মত হোটেল তবে পার্থক্য একটাই আর তা হলো গরম আর শীত। দুবাইতে হোটেলের বাইরে দেখেছে প্রচণ্ড গরম আর এখানে শীত। রাতের খাবার প্লেন থেকেই খাইয়ে দিয়েছে বলে এখানে খাবার ঝামেলা নেই। যার যার রুমে ঢুকে শুয়ে পড়ল। সকালে উঠে দুবাইর মত সবাই নিশাতের রুমে আসল। এখান থেকে এক সাথে নাশতা খেয়ে আসল। দুবাইর মত এখানে ইন্ডিয়ান ডিশ নেই এখানে সব বিলাতি ইংলিশ নাস্তা। দুই তিন রকমের ব্রেড, বাটার, জ্যাম, ডিম, কলা এবং কফি। নাস্তা খেয়ে নিচে রিসিপসন ডেস্কের পাশে হল রুমে বসল ওরা তিনজনে। এখানে দুবাইর মত অত ভিড় নেই লোকজনও তেমন বেশি না। বসে থাকতেই ওদের ফোন এলো। কোম্পানির অফিস থেকে ফোন করেছে। রিসিপসন থেকে ওদের দিকে তাকিয়ে রবার্ট বলল ‘হু ইস নিশাত’?
ইয়েস আই এম নিশাত
প্লিজ টেক ইয়োর কল
হাই নিশাত গুড মর্নিং, আমি তোমার অফিস থেকে স্টেনলি বলছি
গুড মর্নিং স্টেনলি
কেমন আছ, পথে কোন অসুবিধা হয়েছে কি?
ভালো আছি, না কোন অসুবিধা হয়নি তোমাদের লোক জনেরা বেশ ভালো ভাবেই রিসিভ করেছে, দুবাইতেও যেমন এখানেও তেমন
বেশ, তা হলে তোমরা সবাই অফিসে চলে এসো
অফিসে?
হ্যাঁ এইতো হেঁটে আসলে মিনিট পনের লাগবে
কিন্তু আমরা যে কেউ অফিস চিনি না
ওহ সরি, তোমরা তো নতুন এসেছ, আচ্ছা একটু অপেক্ষা কর আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি
আচ্ছা ঠিক আছে,
কথা শুনে বুঝতে পারলো ইংরেজ নয়। ঠিক আছে একটু পরে তো যাচ্ছি তখন দেখা যাবে কে। মেঝ মামার কথা মত সব সময় ড্রেস আপ হয়েই থাকত, তা ছাড়া এটা বিদেশ, এখানে সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। ব্যাপ্টিস্টও বলে দিয়েছিল লন্ডনে যেন কখনও গরম কাপর ছাড়া কোথাও বের হবে না
নিশাত ওদেরকে বলল
চল বাইরে অপেক্ষা করি, অফিসে যেতে হবে গাড়ি পাঠাচ্ছে।
বাইরে বেশ ঠাণ্ডা
চার পাঁচ মিনিটের মধ্যে একটা নীল রঙের গাড়ি এসে হোটেলের গেটে থেমে যে ড্রাইভ করছিল সে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল তুমি কি নিশাত?
হ্যাঁ
আমি অফিস থেকে তোমাদের নিতে এসেছি
ও আচ্ছা, বলে গাড়িতে উঠে পরল।

তিন চার মিনিটের মধ্যে এক বিশাল অফিস বিল্ডিঙের গেট দিয়ে ঢুকে পরল। গেটের বাইরে পুরনো একটা বিরাট নোঙ্গর দাড় করা রয়েছে, গেটের ভিতরে ঢুকে বাম পাশে একটা গার্ডেন ক্লকে সকাল সাড়ে আটটা বাজছে, আসে পাশে অনেক ছোট ছোট গাছ দেখ বুঝে নিল এগুলি ফুল গাছ শীতের জন্য ন্যাড়া হয়ে গেছে হয়ত গরম কালে ফুল ফুটবে। নানা রঙের রকমারি পাথরে সাজানো, সামনের দেয়ালে অফিসের নাম লেখা ‘গ্রে ম্যাকেঞ্জি ম্যারিন সার্ভিসেস ই সি, লন্ডন’। এতো বড় আর এত সুন্দর অফিস দেখে নিশাত অবাক হয়ে গেল, এই এত বড় কোম্পানিতে কাজ করতে এসেছি! গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভার নেমে গেল। ওরাও ওর পিছনে নেমে এলো। অটোমেটিক দরজা একা একা খুলে গেল, নিশাত বিসমিল্লা বলে দরজার ভিতরে পা বাড়াল। ড্রাইভার হাতের ইশারায় বাম দিকে যেতে বলে বেরিয়ে গেল। বাম দিকে একটু এগিয়ে যেতেই একটা রুম থেকে এক ভারতীয় চেহারার অল্প বয়েসি এক লোককে বের হতে দেখল কিন্তু ওরা চিনতে পারেনি যে এই স্টেনলি। লোকটা ওদের দেখে বলল
তোমরা এসে পরেছ, বেশ, আমিই স্টেনলি। এসো আমার সাথে
বলে ওদের ক্রু সুপার রামস বটমের রুমে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিল। এ আবার ইংরেজ। ওদের বসতে বলল। কেমন লাগছে, কোন অসুবিধা হয়েছে কি না, এর আগে কখনো বিদেশে এসেছে কি না সব জেনে নিলো। নিশাত জানাল
আমি এই প্রথম বিদেশে এসেছি তবে এরা দুই জন আগে জাহাজে কাজ করেছে। এবার রামস বটম ওদের সিডিসি দেখতে চাইল।
সিডিসি দেখে বলল হ্যাঁ তোমার সিডিসি দেখছি একে বারে নতুন। বেশ, আশা করি আমাদের কোম্পানিতে কাজ করতে তোমার ভালোই লাগবে, আচ্ছা স্টেনলি তুমি ওদের কিছু টাকা এডভান্স দিয়ে দাও আর ওদের জাহাজ কবে আসবে সব কিছু বুঝিয়ে দাও।
আচ্ছা,
বলে ওদের নিয়ে আসার আগে রামস বটম উঠে ওদের সাথে হ্যান্ডশেক করে আবার বলল
নতুন এসেছ, কাজেই সাবধানে থাকবে, আর কোন অসুবিধা হলে সঙ্গে সঙ্গে তোমার জাহাজের ক্যাপ্টেনকে জানাবে।

ধন্যবাদ জানিয়ে ওরা স্টেনলির সাথে বের হয়ে স্টেনলির রুমে বসল। স্টেনলি কিছু কাগজ পত্র রেডি করে ওদের সই নিয়ে সবার হাতে কিছু স্টার্লিং পাউন্ড দিয়ে বুঝিয়ে দিল এই এক পাউন্ড সমান এত ডলার এবং তোমাদের বাংলাদেশের টাকায় এত টাকা। নতুন বিদেশে এসেছ ইচ্ছা মত খরচ করবে না। এদেশে কিন্তু টাকা খরচ করার অনেক পথ আছে কাজেই বুঝে শুনে খরচ করবে। নেহায়েত যা একান্ত দরকার তাই কিনবে আর বাকি টাকা বাড়িতে পাঠিয়ে দিবে। এক জন বিদেশির মুখে এ কথা শুনে নিশাত অবাক হয়ে গেল।
সত্যিই এই টাকার জন্যই দেশ, বাবা মা, ভাই বোন ছেড়ে এতো দূরে আসা। এতো ত্যাগের টাকা কি আর যেমনে সেমনে খরচ করলে চলবে? এদিকে আবার জীবনের প্রথম বেতন স্টার্লিং পাউন্ডে পেয়ে মনে একটা আনন্দও পেল। স্টেনলির প্রতি মন কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল। রামস বটমই বা কম কি সেও বলেছে সাবধানে থাকবে, কোন অসুবিধা হলে ক্যাপ্টেনকে জানাবে। বিদেশের মানুষ এত ভালো হয়? কাজে জয়েন করার আগেই টাকা! ভাবতেও কেমন অবাক লাগছে। আমাদের দেশে পুরো মাস না গেলে টাকার চিন্তাই করা যায় না। নিশাত মনে করল একবার বাড়ির কাছাকাছি এক ছেলেকে প্রাইভেট পড়িয়েছিল মাস দুয়েক কিন্তু তিনমাস পর সেই টাকা দিয়েছিল। এদের কি দিয়ে বানিয়েছে নিশাতের মাথায় কিছু আসছে না। এদের সভ্যতা কেমন?

স্টেনলি আবার শুরু করল এবারে তোমাদের কাজের কথায় আসি,
তোমাদের জাহাজ এখনো আসেনি, হয়ত আরও ২/১ দিন লেগে যাবে। ওরা ডান্ডি থেকে সেইল করবে, যাই হোক যেদিন আসবে আমি তার আগে তোমাকে ফোন করে জানাব। এ কয় দিন তোমরা ঘোরা ঘুরি করতে পার তবে বেশি দূরে কোথাও যাবে না। ওরা পুরনো মানুষ ওরা জানে ওদের কি কাজ, তুমি কি জান? তুমি চিটাগাঙে যে এপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়েছিলে ওতে বা যে আর্টিক্যালে সই করে এসেছ তাতে দেখেছ?
হ্যাঁ দেখেছি, আর ওখানে বুড়ো ব্যাপ্টিস্ট বলে দিয়েছে।
ও কে, মাই ফ্রেন্ডস তোমরা এখন যেতে পার, বাই, এখন মনে হয় একা যেতে পারবে তাই না?
হ্যাঁ পারব। কিন্তু,
কি কিন্তু কি?
আচ্ছা আমাদের সাথে যে হাবিব এসেছে যাকে দুবাইতে জাহাজে নিয়ে গেছে ও কোন জাহাজে আছে বলতে পারবে?
হ্যাঁ বস দেখি,
কম্পিউটারে খুঁজে বলল ও আছে ফরিদা নামের জাহাজে।
ওর সাথে যোগাযোগ করার কোন ব্যবস্থা আছে?
হ্যাঁ তুমি চিঠি লিখতে পার কিংবা কখনও কাছাকাছি পোর্টে এলে তখন ভিএইচএফ দিয়ে কথা বলতে পারবে
চিঠি লিখলে খামে ভরে ঠিকানা লিখে জাহাজের মেইল ব্যাগে করে এজেন্টের কাছে দিয়ে দিবে ওরাই ডাকটিকেট লাগিয়ে পোস্ট করে দিবে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, অবশ্যই
যাক নিশ্চিন্ত হলাম,
কেন ও কি হয় তোমার?
না এমনি কিছু হয় না তবে আমরা এক সাথে কলেজে পড়েছি আমার বন্ধু, আমাদের বাড়ির কাছেই ওদের বাড়ি।
গুড, তাহলে তোমাদের ভালোই হয়েছে, দুই বন্ধু কাছাকাছি থাকতে পারবে।
হ্যাঁ তাই। তাহলে আমরা উঠি এখন।
বাই বলে হ্যান্ডশেক করে বের হয়ে এলো।
রুমের বাইরে এসে আবার এদিক ওদিকে দেখল কি সুন্দর পরিষ্কার আর সাজানো অফিস, এতো মানুষ কাজ করছে অথচ নীরব, কোন সারা শব্দ নেই, কোথাও একটু খানি কাগজের টুকরো পড়ে নেই সারাটা ফ্লোর চকচক করছে।
গেট থেকে বের হয়ে গাড়ি যেদিক দিয়ে যেভাবে এসেছিল সে পথ ধরে হেঁটে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে এগিয়ে এসে ঠিক মরিসন হোটেলে পৌঁছল। হোটেলে পৌঁছে নিজের মনে বেশ একটু আনন্দ পেল। যে পথে কোন দিন আসিনি, সব নতুন রাস্তা ঘাট, নতুন শহর নিজের দেশ থেকে অনেক দূরে ভিন্ন মহাদেশে একা একাই আসতে পারলাম। যে পথে কোন দিন এই পায়ের ছাপ পরেনি সে পথ চিনে এসেছি।
[চলবে]

এলেবেলে-৩৪

আমাদের চট্টগ্রামে দুইটা ভাষা। একটা চাটগাইয়া আর একটা বাংলা।

আমরা যারা পুরনো দিনের মানুষ আমরা ছোটবেলায় শুধু চাটগাইয়াতেই কথা বলতাম। বাবা মা ভাইবোন আত্নীয় স্বজনদের সাথে সেই ভাষাতেই কথা বলতাম।
আর একটূ বয়স হলে স্কুলে গেলাম সেখানে আমরা বাংলা শিখলাম। আমাদের শিক্ষকরাও দোভাষী চাটগাইয়াও বলেন আবার বাংলাও বলেন। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে কেউ আবার বাংলা ছাড়া চাটগাইয়া জানে না। আবার স্কুলে গিয়ে কেউ আমার মতো দোভাষী হয়ে গেছে।

তারপর আমাদের বয়সের বন্ধু আত্মীয় স্বজনরা বিয়ে শাদী করলেন। বাচ্চা কাচ্চা হলো। সেই বাচ্চাদের সাথে আমার সেই চাটগাইয়া ভাষী বন্ধুরা বাংলাতেই কথা বলেন। চাটগাইয়াতে কথা বলেন না। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই উনাদের সেই বাংলাতে(!) গুরুচণ্ডালী দোষ আছে। যাক সে কথা।

এবার আসল কথায় আসি…
আমার সেই বন্ধু আত্মীয় স্বজন মামা চাচারা যখন আমাদের মতো পুরনো বন্ধু আত্মীয় ভাগিনা ভাতিজীর সাথে চাটগাইয়া তে কথা বলেন কি নিদ্বির্ধায় আমাদেরকে “তুই” সম্বোধন করেন। মজার ব্যাপার হলো সেই তিনিই উনার সন্তানকে “তুমি”বলেই বাংলাতে কথা বলছেন। তুই শব্দটা দুই অর্থে ব্যবহৃত হয় “তুচ্ছার্থে” এবং “আপনার্থে”।

প্রশ্ন হলো কোন অর্থে নিজের বাচ্চাকে “তুমি” বলেন ? আর আমাদেরকেই বা “তুই” বলেন !!

বাংলা মায়ের বাংলা ভাষা

“বাংলা মায়ের বাংলা ভাষা” কবিতাটি দেশাত্মবোধক কবিতা। বাঙালির আশা, বাঙালির ভাষা, বাংলা মাতৃভাষার উপর কবিতাটিতে আলোকপাত করা হয়েছে। বাংলা ভাষা সবার প্রিয় ভাষা, সবার পছন্দের ভাষা, সবার হৃদয়ের ভাষা। জাতীয় চেতনা জাগ্রত করার লক্ষ্য নিয়ে কবি কবিতাটির উপস্থাপনা করেছেন।

কোটি কোটি বাঙালির কণ্ঠে ধ্বনিত হোক বাংলার গান। কবির সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে সমস্বরে চিত্কার করে বলুন, “ বাংলা আমার মাতৃভাষা, বাংলা ভাষা আমার গর্ব। আমার আশার আলো, আমার মুক্তির দিশারী। বাংলার মাটি আমার সুখের স্বর্গধাম, বাংলা আমার হৃদয়ের গান,
বাংলা আমার প্রাণ, আমার প্রাণের দোতারা। বাংলা ভাষার মান
অক্ষুন্ন রাখা আমার সারা জীবনের ব্রত, আমার পবিত্রতম কর্তব্য।
আমার জীবন সাধনা।” সাথে থাকুন, পাশে রাখুন।
জয়গুরু! জয়গুরু! জয়গুরু!

বাংলা মায়ের বাংলা ভাষা
লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

বাংলা মায়ের বাংলা ভাষা
মাতৃভাষা আমার,
বাংলা আমার প্রাণের ভাষা
আমার অহংকার।

এই ভাষাতেই আমের গাছে
কোকিল গাহে গান,
এই ভাষাতেই আমরা শুনি
নদীর কলতান।

বাংলা আমার প্রাণের ভাষা
আমার অহংকার।
বাংলা আমার মায়ের ভাষা
সুন্দর চমত্কার।

এই ভাষাতেই বাংলার বাউল
একতারাটি ধরে,
মধুর সুরে বাউল গান গায়
হৃদয় ওঠে ভরে।

বাংলা আমার প্রাণের ভাষা
আমার অহংকার।
বাংলা মোদের মেটায় আশা
ভরসা সবাকার।

এই ভাষাতেই গান গেয়ে ভাই
চাষীরা করে চাষ,
রোদে পুড়ে জলে ভিজে ঘাম
ঝরায় বারোমাস।

বাংলা আমার মুখের ভাষা
ভারি চমত্কার।
বাংলা আমার প্রাণের ভাষা
আমার অহংকার।

এই ভাষাতেই মধুর সুরে
বাজে বাঁশের বাশি,
বাংলা আমার হদয়ের গান
শুনতে ভালবাসি।

বাংলা আমার মায়ের আঁচল
গলার কণ্ঠহার।
বাংলা আমার প্রাণের ভাষা
আমার অহংকার।

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-১৫

৮।
বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট নির্দিষ্ট সময়ে দুবাই এয়ার পোর্টে ল্যান্ড করল। নিশাত এবং সঙ্গীরা নেমে অন্যান্য যাত্রীদের সাথে ইমিগ্রেশন ডেস্কে এসে নিশাত সবার সিডিসি সংগ্রহ করে সবার সামনে কিউতে দাঁড়াল। এক সময় অফিসারের
ডেস্কের উপর চারটা সিডিসি নামিয়ে দিয়ে পিছনে সবাইকে দেখিয়ে দিল। ইমিগ্রেশন অফিসার সিডিসি খুলে এক এক করে সবার চেহারা দেখে দুবাই এরাইভ্যাল সিল লাগিয়ে ওদের ফেরত দিয়ে দিল। সিডিসি নিয়ে নিশাত একটু এগিয়ে এসে এদিক ওদিক দেখল কিন্তু ফিনলে অফিসের বুড়ো ব্যাপ্টিস্টের কথা মত ওদের এগিয়ে নেবার মত কাউকে দেখতে পেল না। মনে মনে ভাবছে সেই লোক আমাদের চিনবে কি ভাবে বা আমরাই বা ওকে চিনবে কি ভাবে! সবাই এসেছে নিশাতের নেতৃত্বে কাজেই ওর মাথা ব্যথা একটু বেশি। হঠাৎ করেই দেখতে পেল সামনেই কালো পোশাক পরা মোটা এক মহিলা নিশাত জামান এন্ড গ্রুপ লেখা একটা প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে ওদের দিকে আসছে।
নিশাত এগিয়ে গিয়ে বলল আমি নিশাত জামান আর ওই ওরা আমার সাথের।
বেশ বেশ এসো আমার সাথে।
বলে পিছনে ঘুরে দ্রুত হাটতে লাগল।

এত মোটা মানুষ এত দ্রুত হাঁটছে যে ওরা তার সাথে তাল মিলাতে হিম সিম খাচ্ছে। ৪/৫ মিনিট হেঁটে এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে একটু দূরে দাঁড়ান এক লোককে ইশারায় কি যেন বলল। এবার ওদের দিকে ঘুরে বলল তোমাদের মধ্যে হাবিব কে?
এই তো এই হাবিব।
আচ্ছা ঠিক আছে তোমার জাহাজ এখানে আছে আর তোমারা যাবে লন্ডন, তবে এখন না। এখন তোমরা সবাই হোটেলে যাবে ওখান থেকে হাবিব কাল জাহাজে যাবে আর তোমাদের ফ্লাইট কাল রাতে তোমরা কেউ হোটেল থেকে বের হবে না।
মহিলা কথা বলতে বলতেই একটা কাল রঙের বুইক গাড়ি পাশে এসে দাঁড়াল।
নাও গাড়িতে ওঠ।
তুমি যাবে না?
আরে না, আমার এখনো কত কাজ, একটু পরে পাকিস্তান থেকে ফ্লাইটে লোক আসবে ওদের রিসিভ করতে হবে, এই লোক তোমাদের হোটেলে নিয়ে যাবে। গুড নাইট বলে যেমনে এসেছিল অমনিই দৌড়ের মত চলে গেল।

ওরা একে একে গাড়িতে উঠে বসল, মাল পত্র বলতে আর কি, সবার সাথে একটা করে ব্যাগ ছাড়া আর কিছু নেই। বিশ্বের একটা নতুন দরিদ্র দেশের কয়েক জন তরুণ এসেছে নিজেদের ভাগ্য ফেরানোর স্বপ্নে বিভোর হয়ে। বিলাসিতা করার জন্য তো আর আসেনি। কিই বা থাকবে, দুই একটা সার্ট প্যান্ট, লুঙ্গি, গেঞ্জি, গামছা এই তো আর কি। ড্রাইভার সবাইকে দেখে নিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিল। জানালার কাচ খোলা ছিল একটু পরেই ওরা দেখল জানালার কাচ একা একাই উঠে বন্ধ হচ্ছে। নিশাত ভাবল সব অটো সিস্টেম। এয়ারপোর্ট এলাকা ছাড়িয়ে বড় রাস্তায় এসেই আস্তে আস্তে গাড়ীর স্পিড বাড়ছে ৫০, ৬০ থেকে একটু একটু করে ১০০ মাইল বেগে ছুটে চলেছে। নিশাত এর আগে বুইক গাড়ির নাম শুনেছে কিন্তু উঠে দেখার বা গাড়িতে চলার সুযোগ হয়নি। জীবনে এই প্রথম এত স্পিডে চলছে। ভয়ে একটু দম বন্ধ হওয়া ভাব। রাস্তার দুই পাশে সোডিয়াম বাতির আলোতে যতটুকু দেখা যাচ্ছে শুধু ধু ধু বালু আর বালুতে গজানো কিছু ছোট ছোট ঝোপ জাতিয় গাছ। যে গাছের ডাল বা পাতা ভাঙলে সাদা কস বের হয় তেমন কিছু ঝোপ ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। রাস্তার মাঝে একটু ফাঁকে ফাঁকে একটা একটা করে লাইট পোস্ট পিছনে চলে যাচ্ছে। সামনে দূরে ডান দিকে লাইন ধরা নানা রঙের বাতির কিছু ঝিলি মিলি দেখা যাচ্ছে। মনে হয় ওটাই শহর এলাকা। গাড়ি উল্কার গতিতে ছুটছে আর ভিতরে বসা কয় জন তরুণ ভাবছে এ কোথায় এলাম, সামনে ভাগ্যে কি আছে, কি হবে, কেমন হবে এই ভাগ্য। সাহস করে কেউ কোন কথা বলছে না চুপ চাপ বসে শুধু ভাবছে। গাড়ি চালাচ্ছে এক আরবি যুবক, তার পরনে সাদা আরবি পোশাক।

প্রায় আধা ঘণ্টা পর লক্ষ করল স্পিড কমিয়ে আনছে। বুঝতে পারলো হয়ত কাছে এসে পরেছি। আর একটু এগিয়ে বাম দিকে একটু ঘুরে একটা বিশাল আলো ঝলমল সুন্দর কারু কাজ করা এক বিশাল দালানের সামনে গেট দিয়ে ঢুকে দেখল বাগানে নানা দেশের পতাকা উড়ছে। নিয়ন সাইনে লেখা দালানের গায়ে নাম দেখে বুঝল এটা একটা হোটেল। হোটেলের পোর্টিকোর নিচে এসে গাড়ি থেমে গেল। ড্রাইভার ইংরেজিতে বলল তোমরা যার যার মালামাল নিয়ে আমার সাথে চল। সবাই যার যার ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে স্বয়ংক্রিয় দরজা পার হয়ে ভিতরে পা দিতেই একটা সুন্দর নরম সুগন্ধ ওদের স্বাগত জানাল। আহ! ভিতরে কি আরাম! একে বারে ঠাণ্ডায় গা জুড়িয়ে যায় যেন, পায়ের নীচে কার্পেটে পা ফেলতেই মনে হলো পায়ে কোন জুতা নেই। আরবি ড্রাইভারের পিছে পিছে সামনের দিকে এগিয়ে রিসিপশন ডেস্কের পাশে দাঁড়াল সবাই। কাউন্টারে ৩/৪ জন লোক কি কি সব করছিল। ড্রাইভার তাদের এক জনকে ডেকে ওদের দেখিয়ে দিয়ে আরবিতে কি বলল। সুন্দর চেহারার এক লোক ওদের পাসপোর্ট চাইল আর একটা বড় ভারী মোটা খাতা এগিয়ে দিয়ে যার যার নাম পাসপোর্ট নম্বর লিখতে বলল। সবার লেখা হলে নিশাত খাতাটা টেনে নিয়ে নিজের নাম ধাম সব লিখে আবার খাতাটা ওই লোকের দিকে ফিরিয়ে দিল। ড্রাইভার এবার ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গুড নাইট জানিয়ে চলে গেল। কাউন্টারের লোকটা ওদের হাতে একটা একটা করে চাবি ধরিয়ে দিয়ে পাশের লিফট দেখিয়ে সাত তলায় উঠে যেতে বলে দিল। সবাই এক সাথে লিফটে উঠে সাত তলার বোতামে চাপ দিয়ে উপরে উঠে এসে চাবিতে লেখা নম্বর মিলিয়ে যার যার রুম খুঁজে নিলো। সব গুলিই প্রায় পাশা পাশি। যার যার রুমে ঢুকে পরল। নিশাত রুমে ঢুকে কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে রুমের চারি পাশে ঘুরে ঘুরে দেখে অবাক হলো। এমন সুন্দর রুমে কি থেকেছে কোন দিন? দেখা শেষ হলে কাপড় বদলে বাথ রুমের কাজ সেরে এসে একে একে সবার রুমে গিয়ে সবাই ঠিক ঠাক মত আছে কিনা দেখে আগামী কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে ওর রুমে আসতে বলে এলো।

হাবিব জিজ্ঞেস করল আমার কি হবে কিছু বুঝেছিস?
কেন ওই মুটকি বলল না কাল সকালে জানাবে, এখন ঘুমিয়ে পর কাল দেখব কি করে। আমি যাই ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।
এয়ারকন্ডিশন রুমে ফিরে এসে নরম ধব ধবে বিছানায় শুয়ে কম্বলটা গায়ে দিয়ে শুয়ে পরল।
প্রায় সবারই সকাল হলো নয়টার দিকে। নিশাত কাল হোটেলের রিসিপশন থেকে দেখে হাতের ঘড়ি মিলিয়ে নিয়েছিল। একে একে সবাই এলো। নিজেরা একটু আলাপ করে নিচে নেমে গেল। নাশতা খাবার কি ব্যবস্থা দেখতে হবে আর কোন ম্যাসেজ আছে কি না তাও জানতে হবে। লিফট বেয়ে নিচে নেমে দেখে, রিসিপশনে কাল যারা ছিল এখন তারা নেই, যারা আছে তাদের এক জনকে জিজ্ঞেস করল
নাশতার কি ব্যবস্থা?
এখনো নাশতা করনি?
না আমরা কাল লেট নাইটে এসেছি এই মাত্র ঘুম থেকে উঠলাম আর তা ছাড়া ব্রেকফাস্ট কোথায় তাও জানি না।
ও আচ্ছা, ওই দিকে দেখ ডাইনিং রুম আছে ওখানে গিয়ে খেয়ে আস।
আচ্ছা আমাদের কোন ম্যাসেজ আছে?
রুম নম্বর প্লিজ
রুম নম্বর বলল
হ্যাঁ তোমাদের হাবিব কে?
এই যে এই হাবিব।
তোমাকে নেয়ার জন্য গাড়ি আসবে সকাল এগার টায় আর তোমাদের বাকি তিন জনের জন্য গাড়ি আসবে সন্ধ্যা সাতটায়। যাও ব্রেকফাস্ট করে এখানে এসো কথা আছে।
নাশতা সেরে ঘণ্টা খানিকের মধ্যে আবার কাউন্টারে এসে দাঁড়াল,
কি বলবে বলেছিলে
ও হ্যাঁ, তোমরা কিন্তু বাইরে যেয়ো না, এখানে লাউঞ্জে বসে টিভি দেখতে পার বা ও পাশে সর্বক্ষণ সিনেমা চলে তাও দেখতে পার কিন্তু বাইরে যাবে না বাইরে গিয়ে হারিয়ে গেলে তোমাদেরও বিপদ আমাদেরও বিপদ।
না না আমরা কেউ বাইরে যাব না, আমরা নতুন এসেছি কিছু চিনি না কোথায় যাব, কাজেই তোমাদের সে ভয় পেতে হবে না।

যা হাবিব তোর ব্যাগ নিয়ে আয় আমরা এখানেই বসি।
ঘড়িতে দেখে সাড়ে দশটা বেজে গেছে, হ্যাঁ আমি আসছি বলে হাবিব উপরে চলে গেল। ওরা নিচেই সুবিধা মত এক জায়গায় বসে পরল। সামনে টিভি চলছে আরবি চ্যানেল, কিচ্ছু বুঝে না। একটু পরেই হাবিব নেমে এলো।
নিশাত আমার ভয় করছে
আরে ধুর! কিসের ভয়? যেখানে যাচ্ছিস ওখানে নিশ্চয় দুই এক জন বাঙ্গালি পাবি, দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই যে এখন চলে যাচ্ছিস তোর সিডিসি নিবি না?
আরে হ্যাঁ, আমি তো ভুলেই গেছিলাম, চল
রিসিপশনে যেয়ে হাবিব রুমের চাবিটা দিয়ে বলল আমি এখন চলে যাব, কি করতে হবে?
হ্যাঁ দাড়াও, সেই সুন্দর বাধান বড় খাতাটা বের করে ওর সই নিয়ে একটা ভাউচারের মত কাগজ বের করে দিল সই করার জন্য, কোম্পানির কাছে বিল পাঠাবে বলে এটা রাখা হলো। ওগুলি রেখে সিডিসি ফেরত দিয়ে দিল।
দেখবি এটা সাবধানে রাখবি কিন্তু
হ্যাঁ মনে থাকবে।
কবিতাকে একটা চিঠি লিখে পাঠাবি
যাঃ কি যে বলিস
আরও কিছু টুকরা আলাপ হলো, একটু পরেই দেখে গেট দিয়ে সেই কালকের ড্রাইভার আসছে।
ওই যে হাবিব তোর সমন এসে গেছে
হাবিব ঘুরে দেখে উঠে দাঁড়াল। ড্রাইভার সাথে যাবার ইশারা করে বেরিয়ে গেল। হাবিবের সাথে সবাই বের হয়ে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিল। গাড়ি ছেড়ে যাবার আগে জানালায় মুখ রেখে নিশাত আবার বলে দিল ভয় বা চিন্তা কিছু করবি না। দেখলি তো কি ভাবে সব হচ্ছে।
হাবিবকে নিয়ে গাড়ি হোটেলের সীমানা থেকে বের হয়ে যাওয়া পর্যন্ত ওরা গেটে পোর্টিকোর নিচে রইল। মেইন গেট থেকে বের হয়ে গেলে আবার এসে যেখানে বসে ছিল সেখানে বসে টিভি দেখছে। বিরক্তিকর চ্যানেল। ভালো লাগছে না,
চলেন ভাই একটু হাটা হাটি করি আর নয়ত দেখি ওখানে কি সিনেমা চলছে।
চলেন।

কিছু করার নেই। কোন কাজ নেই। নিশাত ও পাশে সিনেমার সামনে বসে ভাবছে আর চারিদিকে দেখছে। এই যে এত বড় ফাইভ স্টার হোটেলে কি আর নিজের টাকায় থাকতে পারতাম কোন দিন? কত রকমের মানুষ আসছে যাচ্ছে। কেউ সুদৃশ্য বিশাল লাউঞ্জে বসে টিভি দেখছে নয়তো বই পড়ছে, কেউ রিসিপশনের কাউন্টারে হেলান দিয়ে সঙ্গীর সাথে কথা বলছে। তার পরেও সবার মধ্যে একটা চাপা ব্যস্ততা। বিভিন্ন ভাষায় কথা বলছে, বিভিন্ন জাতীর লোক জন। বিচিত্র গুঞ্জন তার মধ্যে আবার অদৃশ্য স্পীকারে মৃদু স্বরে মিউজিক বাজছে যেন একটা ভিন্ন জগতে এসে পরেছে। তার চির চেনা জগত এটা নয়। রাতারাতি এক ভিন্ন গ্রহে চলে এসেছে। মানিয়ে নিতে হবে এই পরিবেশ। নিজের পয়সায় এই হোটেলের গেটের ভিতরেই ঢুকতে পারত না। সে সাধারণ একজন নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান বাবা সাধারণ এক জন সরকারী কর্মচারী। কোম্পানির জোড়ে আজ এই ভিন্ন গ্রহে বসে ভাবতে পারছে। একটু আগে যে নাশতা করে এসেছে তা কি কখনো খেয়েছে? দেশে ঢাকায় এমন সোনার গাও হোটেল, ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেল রাস্তা দিয়ে যেতে আসতেই শুধু দেখেছে, কখনো ভিতরে ঢুকতে পারেনি। তবুও মনে হচ্ছে দেশের ওই সব হোটেল এর কাছে কিছুই নয়। ওর চেয়ে এর সৌন্দর্য অনেক বেশি। নিশ্চয়ই এই দুবাইতে এমন আরও অনেক হোটেল আছে হয়ত এর চেয়েও দামী। কোম্পানি কি আর তাদের অত বেশি দামী হোটেলে রাখছে? নিশ্চয় এর চেয়ে অনেক দামী হোটেল আছে। সেখানে কারা থাকে, কত টাকা থাকলে অমন হোটেলে থাকা যায়? নিশ্চয় আর যারা আছে তাদের সবাই ওর মত কোম্পানির টাকায় থাকছে না। হঠাৎ করেই নিশাতের মনে এক প্রশ্ন এলো, আচ্ছা যদি কোম্পানি বলে এই হোটেলে থাকার খরচ তার বেতন থেকে কেটে রাখবে, তা হলে কি উপায় হবে? ওকে বিক্রি করলেও তো এই ভাড়া দেয়া সম্ভব না। তা হলে কি হবে? কত কি সাত পাঁচ ভাবছে মাথা মুণ্ডু কিছু ঠিক নেই। অজানা অচেনা একেকটা নিত্য নতুন ভাবনা মনে আসছে যাচ্ছে। এমন সময় ওদের সাথে যে কুক সে এসে বলল
ভাই এখানে একা একা কি করছেন চলেন ওখানে ভালো একটা হিন্দি সিনেমা হচ্ছে দেখি
চলেন দেখা যায়, এ ছাড়া আর কিই বা করবো।
[চলবে]

মায়ার বাঁধন

বাঁধো আমাকে তুমি মায়ার জালে
অন্তস্থলে তোল তুমুল ঝড় —
আমার দু’পায়ে বেঁধে দাও পথ ,
আমি হাঁটব সেই পথ ধরে
অনন্ত কাল :
তুমিও রবে সাথে ,
আমরা উদ‍্যান কিম্বা বিশাল হাইওয়ে ধরে
একটু বেড়িয়ে আসতে পারি ।
অথবা যেতে পারি সমুদ্রের কাছাকাছি
আমরা শুনতে পারি সমুদ্রের গর্জন
আর ঢেউ এর তালে নিজেদের
হারাতে পারি ;
আমরা সমুদ্রের বুকে বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে
বলতে পারি জীবনের না বলা যত কথা
আমরা সমুদ্র স্নানে নামতে পারি !

আমরা দু’জনকে ভাগ করতে পারি
আধাআধি :–
আমরা দু’জনার চেতনায় ঘন হয়ে
থাকতে পারি
আজীবন অবধি ;
ভালবাসার বুনন যদি হয় নিঁখাদ
তবে বাঁধো আমাকে
ভালবাসার পূর্ণ অধিকারে
মায়ার বাঁধনে !

20.02.2019

অমর ২১শে ফেব্রুয়ারি………

২১শে ফেব্রুয়ারি তুমি
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো
স্বাধীনতার পটভুমি,
তোমার জন্যে পেয়েছি আজ
স্বাধীন মাতৃভূমি,
২১শে ফেব্রুয়ারি তুমি শহীদ মিনার
সকালের প্রভাত ফেরি
লক্ষ শহীদের ত্যাগের বিনিময়ে,
শহীদদের দেখা স্বপ্ন একটি দেশ
প্রিয় মাতৃভূমি প্রিয় বাংলাদেশ
একটি স্লোগান
বাংলা আমার মাতৃভাষা চির অম্লান,
২১শে ফেব্রুয়ারি আমার অহংকার
সন্তানহারা মায়ের চিৎকার
আজ আমি গর্বিত
আমি বাঙালি
বাংলা ভাষায় কথা বলি
হৃদয়ে ধারন করি
অমর ২১শে ফেব্রুয়ারি………….

— ফারজানা শারমিন

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-১৪

নিশাত ভিতর বাড়ি গিয়ে দাদিকে সামনে পেয়ে বলল দাদু আমরা কাল চলে যাচ্ছি।
আবার কবে আসবে?
জানি না, আব্বার ছুটি না হলে আসা হবে না,

আচ্ছা ঠিক আছে ভালো ভাবে থাকবে, মন দিয়ে পড়া শুনা করবে।
চাচীরা কোথায়?
দেখ তো রান্না ঘরে না কি?
নিশাত এগিয়ে যাচ্ছিল এমন সময় নিরু ওর ঘরে থেকে বের হয়ে রান্না ঘরে যাচ্ছিল। নিশাত ডাকল
নিরু চাচীরা কোথায়?
সবাই রান্না ঘরে। আপনারা তাহলে কালই যাবেন?
হ্যাঁ নিরু, কালই যাচ্ছি, চল চাচীদের একটু বলে যাই।
আসেন। মা, নিশাত ভাই এসেছে তোমাদের সাথে দেখা করতে, উনারা কাল চলে যাবে।
নিরুর চাচী রান্না ঘর থেকে উকি দিয়ে নিশাতকে ডাকল,
এই যে বাবা আমরা এখানে।
চাচী আমরা কাল যাচ্ছি।
আচ্ছা বাবা ভালো ভাবে থাকবে মন দিয়ে পড়া শুনা করবে।
ওখান থেকে বিদায় নিয়ে আসার পথে নিরু জিজ্ঞেস করল
সত্যিই আপনারা কাল যাবেন?
হ্যাঁ নিরু, আমি যেগুলি দেখিয়ে গেলাম সেগুলি মন দিয়ে পড়বে, না বুঝলে যুঁইকে জিজ্ঞেস করবে। আচ্ছা যুঁই কোথায় ওকে দেখছি না।
আপা পুকুরে।
পুকুরে কি করে একটু ডাকবে ?আমি ওকে তোমার পড়া দেখার জন্য বলে যাব।
আপনি যান মেঝ ভাইয়ের কাছে বসুন আমি ডেকে আনছি।
একটু পরেই যুঁই এসে বলল কি রে নিশাত তোরা তা হলে কাল যাচ্ছিস?
হ্যাঁ তাই বলতে এলাম। শোন তুই কিন্তু নিরুর পড়াটা একটু দেখবি, ও তো ভাল ছাত্রী মনে হলো, তা তুই একটু দেখলেই ওর অনেক সাহায্য হবে। দেখবি।
হ্যাঁ তোর বৌকে তো দেখে রাখতেই হবে, আচ্ছা তুই চিন্তা করিস না। এই নিরু এখন থেকে আমার কাছে নিয়ম করে বসবি। একা পড়বি না, আমার সাথে বসবি। মনে থাকে যেন।
নিশাতের দিকে তাকিয়ে, দেখলি তোর সামনেই কেমন অর্ডার দিয়ে দিলাম?
৭।
এর পরের দিন নিশাতরা ওই অত টুক নিরুর মনে গভীর একটা দাগ দিয়ে চলে গেল। নিরুর মনে যে দাগ কেটে গেল, নিরুর মনের যে জানালা খুলে দিয়ে গেল সে আর কিছুতে বন্ধ হবার নয়। সে তো ভিন্ন জগতের অনুভূতি, ভিন্ন সে ধ্যান, ভিন্ন জ্যোতি, ভিন্ন আকুতি। এত দিন যা ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত। এ যে কি এমন এক ব্যথা, এমন এক যাতনা যা কাউকে বলা যায় না, কাউকে দেখান যায় না। নিজের বুকের ভিতর তুষের আগুনের মত জ্বলতেই থাকে। নিতান্ত চেপে রাখা ছাড়া আর কোন পথ নেই। শুধু চোখের জলেই যার সমাধান। আশা পথ চেয়ে দিন যায়, রাত আসে। এক দিন ফিরে আসবে সে আজ হোক বা কাল। ফিরে যে তাকে আসতেই হবে, এই এক সান্ত্বনা বুকের গভীরে পুষে রেখে নিরু নিজেকে নিশাতের জন্য প্রস্তুত করছে।
দিন যায়, মাস যায়, বছরও চলে যায়। নিরুর কাছে মনে হয় যেন একটা যুগ যাচ্ছে। ক্লাসে নিয়মিত হাজিরা, যুঁইয়ের কাছে পড়া, সংসারের কিছু তদারকি এতেই দিন চলে যায়। ভাবে এমন হয় কেন, ও আমার কে? ওর জন্য এমন লাগে কেন? এক জন পুরুষ মানুষের প্রতি এমন টান কেন হয় কিছুতেই এর কোন জবাব খুঁজে পায় না। এই টান কোথা থেকে আসে, এই কি নিয়ম, যদি তাই হয় তা হলে ও কিছু বলে গেল না কেন? আবার ভাবে সেদিন তো বলেছেই “আমি থাকলে তোমার ভালো লাগবে?”এর চেয়ে কি আরও একটু খুলে বলতে পারত না? না, আমিই তো ওকে নিয়ে গেলাম না ও তো পুকুর পাড়ে যেতে চেয়েছিল। ওখানে গেলে কি বলত? না কি আমি যা ভাবছি ও তেমন করে ভাবছে না। তাই বা কি করে হয়, যুঁই আপা যখন অমন করে বলত তখন এত লজ্জা কি জন্! এই নানা ধরনের বিচিত্র প্রশ্ন তার মাথায় ঘুর ঘুর করে কোন ফাঁকে যেন চোখ দুইটা বন্ধ করে দেয়।

দেখতে দেখতে প্রায় দুই বৎসর চলে গেল নিশাতদের আসার কোন নাম গন্ধ নেই। নিরুর মনে যখন নানা ধরনের চিন্তা ভাবনা শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে তার ছোট্ট হৃদয়ের মাঝে নিশাতের জন্য একটা গভীর সাগর বানিয়ে ফেলেছে তখন দেশে শুরু হলো স্বাধীনতার আন্দোলন। তারপর মুক্তি যুদ্ধ। যুদ্ধ চলা কালীন এক দিন সত্যিই নিশাতরা কাউকে কিছু না জানিয়ে দেশে এসে হাজির।

এক দিন সকালে নিরু বাড়ির দক্ষিণ পাশে কুয়া থেকে পানি তোলার জন্য কুয়ায় মাত্র বালতি ফেলেছে এমন সময় সামনে তাকাতেই দূরে নিশাতদের বাড়ির ওদিক থেকে দুই পাশে ধান ক্ষেতের মাঝে বাধানো উঁচু রাস্তা দিয়ে শার্ট প্যান্ট পরা কে এক জনকে আসতে দেখে একটু থেমে গেল। চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু! হ্যাঁ তাই তো, বুকটা কেপে উঠল। হ্যাঁ সেই, যার জন্য এতো দিন অপেক্ষা, যার জন্য পথ চেয়ে কল্পনার জাল বুনে, দিন রাত যন্ত্রণা সয়ে এক উত্তাল সাগরের উন্মত্ত ঢেউ বুকে নিয়ে এতো গুলো দিন কেটেছে এ সেই। মানুষটা কেমন! একটা খবরও কি দিতে নেই? এমন কেন? আনমনা হয়ে কত কি এলো মেলো ভাবনা এসে জড়িয়ে গেল। হাত পা সব যেন কেমন আড়ষ্ট হয়ে এলো। বালতির রশি হাতেই ধরা রইল।
কি নিরু, কেমন আছ?
কণ্ঠ শুনে নিরুর ভাবনা থেমে গেল। বুকে এক অজানা কাঁপন অনুভব করল, গলা জিহ্বা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।

কি নিরু কথা বলছ না কেন?
কোন রকম একটু ঢোক গিলে বলল
কবে এলেন?
কই আমি যে বললাম, কেমন আছ তার কিছু বললে না?
হ্যাঁ ভালোই আছি, আপনি?
হ্যাঁ আমিও ভালো আছি, তুমি অনেক বড় হয়ে গেছ, প্রায় চেনাই যায় না।
নিরু এতো দিন যার পথ চেয়ে দিন রাত একটা ঘোরের মধ্যে কাটিয়েছে, নিজেকে সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে শুধু যার জন্য তৈরি করেছে আজ এই তাকে এমন হঠাৎ দেখে হত বিহ্বল হয়ে গেছে। মনে মনে বলল আমি কেমন আছি সে তুমি বুঝ না? তোমার পথ চেয়ে আমার দিন গুলি কি ভাবে গেছে সে বোঝার শক্তি তোমার কবে হবে, না কি কোন দিন হবে না? একটু স্থির হয়ে বলল
যান, ওই যে বাড়ির পিছনে মেঝ ভাই বাঁশ কাটছে ওখানে যান।
আমি এসেই তোমাকে দেখতে পাব ভাবতেই পারিনি। তোমাদের কি সৌভাগ্য কি সুন্দর পরিবেশে তোমরা থাক। তোমাদের এই কুয়ার পাড়টা কি সুন্দর, ও পাশে পুকুর পাড়ে ঝোপে পাখি ডাকছে, সামনে ধান ক্ষেতের বিশাল সবুজ প্রান্তরে বাতাসে ঢেউ তুলছে। আচ্ছা ওই যে ওটা কি পাখি?
নিরু নিশাতের দৃষ্টি অনুসরণ করে পাশে তাকিয়ে বলল ওটা মাছ রাঙ্গা।

কি চমৎকার পরিবেশে থাক তোমরা, চারি দিকে উঁচু নিচু ঝোপ ঝাঁর, তাতে নানা রঙের পাতা ফুল কত সুন্দর এ দেশ আর আমরা যেখানে থাকি শহরে সেখানে শুধু ইট লোহা কাঠ পাথরের দালান কোঠা আর তার সাথে মানুষের মনও তেমন হয়ে যায়!
এখানে আসার সময় তাই দেখলাম রাস্তার পাশে কি সুন্দর পানিতে ধানের ক্ষেত গুলি মনে হচ্ছে যেন ভাসছে। এই সবুজের মধ্যে থেকে থেকে তোমার মন কত সরল।
আমার সাথে কখনো ভালো করে কথাই বলেননি কি করে জানলেন আমার মন সরল, এ সব আপনার বানানো কথা।
না নিরু, আমি বানিয়ে কথা বলতে পারি না, যা সত্যি মনে হয় তাই বলি, বানানো কথা আমি কখনো ভাবতে পারি না। এই যদি এখন বলি এ বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে ভালো লাগে তোমাকে, এটাও সত্যি এবং মোটেই বানানো নয়। তোমার দুরন্তপনা, তোমার চঞ্চলতা আর তোমার এই হাসি ভরা মুখটা আমি এক দিনের জন্যেও ভুলতে পারিনি, তা কি তুমি জান?
তাই যদি হবে তবে এতদিন পরে আসলেন কেন নাকি যুদ্ধ শুরু না হলে আর আসতেন না?
কি যে বল তুমি!
নিরুর চোখ কুয়োর নিচে একেবারে গহীনে পানির উপরে স্থির হয়ে আছে। ও পাশে রাখালরা আসা যাওয়া করছে এদের মধ্যে যারা নিশাতকে চিনে তারা এসে একটু জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে, কবে এসেছে। ফাঁকে ফাঁকে ওদের কথার জবাব দিচ্ছে। নিরুর কানে কে যেন মধু ঢেলে দিচ্ছে, এই টুকু শোনার জন্যই এতো দিন অপেক্ষায় ছিলাম। আজ আমার সাধনা যেন পূর্ণ হতে চলেছে, আমার মনের কথা শুনতে পেয়েছে। নিরু ভিন্ন এক জগতে হারিয়ে গেছে, তন্ময় হয়ে শুধু শুনে যাচ্ছে। হঠাৎ নিশাতের মনে হলো নিরু ওর কথা শুনছে না কি! কি হলো তুমি আমার কথা শুনছ না?
লজ্জায় নিরুর ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেল। কোন রকম পিছনে ফিরে
ওই যে মা ডাকছে আমি যাই।
বলেই কুয়োয় বালতির রশি ছেড়ে এক দৌড়ে ভিতর বাড়ি। নিরুর যাবার পর নিশাতের মনে হলো তাইতো এটা গ্রাম, এভাবে একটা ছেলে একটা মেয়র সাথে খোলা কুয়োর পাড়ে দাঁড়িয়ে কথা বলা কারো নজরে এলে ফলাফল নিশ্চয় খুব একটা সুখের হবে না। নেহায়েত তারা গ্রামে থাকে না বলে হয়তো আপাত কেউ কিছু বলবে না তবে এর আগের বারে নিরুর মুখেই এই কথা সে শুনে মনে রেখেছে। কিন্তু নিরু? মুনি ঋষিরাই যেখানে ব্যর্থ সেখানে নিশাত আর কি! নারী হৃদয় বোঝার ক্ষমতা তার নেই। তবুও নিশাত হতভম্বের মত কিছুক্ষণ সেখানে দাড়িয়েই রইল। নিরুর এই হঠাৎ চলে যাওয়া কি শুধুই লোক লজ্জা না কি ভিন্ন কিছু? এমন করে কিছু না বলেই চলে যাবে? কিছুটা বোকার মতই দাঁড়িয়ে রইল। এ কথা কাউকে জিজ্ঞেস করা যাবে না। কেন, সরাসরি কিছু বলে গেলে কি হতো? কেন এমন হয়? লজ্জা, নাকি অন্য কিছু? তা হলে সে অন্য কিছু কি? আর কি হতে পারে? কোন জবাব খুঁজে না পেয়ে আস্তে আস্তে নিরুর দেখানো বাড়ির পিছন দিকে যেখান থেকে বাঁশ কাটার শব্দ আসছে সে দিকে চলে গেল।
[চলবে]

শব্দনীড় ব্লগ স্পন্সর করুন অথবা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিন

শব্দনীড় ব্লগের তাবৎ ব্যয়ভার নির্বাহে অর্থ প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি বিবেচনায় এনে, যেকোন প্রতিষ্ঠানের কর্ম পরিচিতি অথবা বিশেষ কোন ইভেন্ট প্রচার; যা শব্দনীড় এর বিজ্ঞাপন নীতিমালার আওতায় পড়বে, তা প্রচার এবং প্রসারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সবচেয়ে ভালো হয় কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘ মেয়াদের জন্য এককালীন অর্থযোগে শব্দনীড় ব্লগকে স্বেচ্ছায় স্পন্সর করতে পারেন। এতে করে ব্লগের তৃতীয় কলামের স্ক্রল লাইনে আপনার কার্যক্রম লাইভ প্রদর্শিত হতে থাকবে। নিউজ সাইটের জন্য সহায়ক।

Prog প্রদশর্নী মূল্যমান পার্থক্যে বিজ্ঞাপন প্রদর্শনের জন্য কয়েকটি স্থান যেমন :

০১. হোম পেজ হেডারের নিচে। প্রত্যেক পাতায় দেখা যাবে। মাপ 468×60 px
০২. হোম পেজ এর দ্বিতীয় কলাম। বিজ্ঞাপন মাপ 208×450 px
০৩. হোম পেজ এর তৃতীয় কলাম। বিজ্ঞাপন মাপ 180×450 px
০৪. ফুটার। বিজ্ঞাপন মাপ 940×80 px (প্রত্যেক পাতায় দেখা যাবে)

Divider 7a

শব্দনীড় বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষার অন্যতম জনপ্রিয় ব্লগ। দেশ আন্তর্জাতিক পরিসরে আপনার বিজ্ঞাপন শব্দনীড়ের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে পারেন।

sn_logo_new 2017

01743 918 919 [email protected]

logo_2 শব্দনীড় | বাংলা ব্লগ। Facebook Community

অলাভজনক প্লাটফর্ম শব্দনীড় বাংলা ব্লগে বিজ্ঞাপন দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
story

তুমি বলেছিলে ভালোবাসি…

যদি হৃদয়কেই করবে জখম তবে
সহসা কেন এসে দাড়ালে
এই অবেলায়,
ওই শেষ বিন্দুতে আমি আজো আছি
যেখানে তুমি বলেছিলে ভালোবাসি
কোথায় যেন আমি দাড়িয়ে
রই অযৌক্তিক অপেক্ষায়……

অনেকবার দেখেছি আয়নায়
এগিয়ে গিয়েছি কিন্তু
সে এক হারানো প্রতিধ্বনি,
নিজেকে লুকাতে চায় মানুষ অদৃশ্য খোলে
কিন্তু সব কিছুই কি নিজের
নজরে লুকানো সম্ভব ?
এই মৌন দাবির সত্যতা জানতে চায় হৃদয়…….

জানি না হঠাত্‍ করে সে করে গেছে
এক নিমিষে উথাল পাতাল,
বুকের মাঝে অদৃশ্য অনুভব ঝড়ের প্রতিধ্বনি
যদি হৃদয়কেই করবে জখম তবে
সহসা কেন এসে দাড়ালে
এই অবেলায়,
ওই শেষ বিন্দুতে আমি আজো আছি
যেখানে তুমি বলেছিলে ভালোবাসি………….

নিদয়া বন্ধুরে

বুকের ভেতর কেমনে ভাসে
একলা সমুদ্দুর –
বুকের ভেতর কেমনে বাজে
অচেনা এক সুর ।

বুকের ভেতর কেমনে কাঁদে
চেনা একখান মুখ –
চোখের ভেতর কেমনে পোড়ে
কাঙ্ক্ষিত সব সুখ !

বুকের ভেতর কেমনে বাড়ে
অচেনা সব কষ্ট :
বুকের ভেতর ভালবাসার
সব আশা যে নষ্ট!

ভালবাসার স্বপ্ন পোড়ে
ইচ্ছে ডানার রোদ্দুরে,
একলা কাটে মধ‍্যরাত্রি
ও নিদয়া বন্ধুরে ;

পেরিয়ে এলাম হাজার দুপুর
শুকিয়ে গেল সিন্দুরে ,
ছোট্ট মনে স্বপ্ন ভাঙে
আইলি না তো বন্ধুরে !!

16.02.2019

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-১৩

নিরু তাড়াতাড়ি হাতের জগ গ্লাস টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে পায়রার মত এক পলকের মধ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নিশাতও ভাবল হ্যাঁ তাহলে এই সেই যাকে আমি ভাবছি, যাকে আমি খুঁজছি। আমার মনের গোপন ভল্টে যার নাম লিখা আছে। যাকে সেই অনেক দিন আগে দেখেছিলাম বকুল ফুলের মালা গাঁথতে। তাহলে এইই সেই।
এর পর নিশাতরা যত দিন দেশে ছিল দুই এক দিন পরে পরেই ওদের বাড়িতে আসলে প্রায়ই সামনে পরত। দুই চার দিন ওকে দেখেই নিরু মিথ্যে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করত। এভাবে কি আর পালিয়ে থাকা যায়? কতক্ষণ পালিয়ে থাকা সম্ভব? এ তো সৃষ্টির বিধান। কোন আকাশ কুসুম ব্যাপার নয়। মানব জনমের প্রথম সত্য। এক দিন রাতে নিশাত শিহাবের সাথে ওদের বাড়ি এসে দেখে নিরু শিহাবের ঘরে বসে পড়ছে। হারিকেনের আলোতে নিরুর মুখের দিকে চেয়ে দেখল আজ যেন ওকে আরও বেশি সুন্দর লাগছে।
কি পড়ছ দেখি, ও ভূগোল! বুঝতে পার?
একটু চুপ থেকে বলল, না খুব কঠিন
কি বল! এ তো খুব সহজ বিষয়, দাও আমাকে দাও। এটা আমার খুব প্রিয় বিষয়।
বলেই দেরী না করে সামনে থেকে বইটা হাতে নিয়ে বুঝিয়ে দিল। ভূগোল বোঝার অজুহাতে আজ নিরু অতি কাছে থেকে নিশাতকে ভালো করে দেখার সুযোগ পেল। বিশ্বচরাচরে যত ঘটনা নিত্য ঘটে থাকে তার মধ্যে যা নিয়তির নির্দিষ্ট বিধান তা খণ্ডাবার কোন উপায় নেই। আজ নিশাতকে নিরুর কাছে আরও বেশি সুপুরুষ বলে মনে হলো। বোঝানো, কথা বলার ভঙ্গী, সবই যেন ভিন্ন। যা বলে তাই একে বারে অন্তরে গেঁথে যায়। আজকের মত ভূগোল শেষ করে নিশাত জিজ্ঞেস করল আর কোনটা?
জ্যামিতি।
দাও দেখি!
নিরু ঘর থেকে বের হয়ে ওর নিজের ঘর থেকে জ্যামিতি বই নিয়ে এলো। নিশাত ওটা নিয়ে যখন আলাপ করছে এমন সময় যুঁই এসে হাজির
কি রে তোর বৌ নাকি, এতো মনোযোগ দিয়ে পড়াচ্ছিস যে?
যুঁইয়ের মুখে কিছুই আটকায় না, ছোট বোন সম্পর্কে যে এই মন্তব্য করতে পারে তাকে আর কি বলবে! নিশাত মনে মনে খুশী হলেও মুখে একটু অবাক হবার ভাণ করে কৃত্রিম একটা বকুনি দিল যুঁইকে।
তুই যে কি, ছোট বোনকে নিয়ে কেউ এমন কথা বলে?

ওদের বন্ধু বান্ধবীর এই কথার ফাঁকে লজ্জায় রাঙ্গা নিরু উঠে বের হয়ে গেল। তাই দেখে নিশাত আবার বলল
দেখলি, ওর পড়াটা দিলিতো মাটি করে। নিজে কখনো একটু বসবি না আমি একটু দেখিয়ে দিচ্ছিলাম তাও দিলি শেষ করে। এর পরে কি ও আর আমার কাছে বসবে ভেবেছিস?
না বসলে না বসবে তাতে তোর কি? একটু ভেবে বলল, আচ্ছা দাড়া আমি ঠিক করে দিচ্ছি।
বলে ঘর থেকে বের হয়ে নিরুকে ধরে নিয়ে এসে যেখানে বসে ছিল ওখানে আবার বসিয়ে একটা মিষ্টি বকুনি দিয়ে নাক টেনে বলল এত লজ্জা কিসের? বসে কি পড়ছিলি পড়।
নিশাতকে বলল নে তোর ছাত্রীকে এনে দিলাম, কি পড়াচ্ছিলি পড়া।
কানে কানে বলল, দেখবি আবার আর কিছু পড়াতে যাবি না কিন্তু।
একটু থামবি নাকি আরও কিছু মুরুব্বি গিরি ফলাবি?
বলেই নিশাত নিরুর জ্যামিতি বই আর একটা খাতা নিয়ে যা পড়াচ্ছিল সেখানে থেকে আবার শুরু করল। কিছু ছবি এঁকে একের পর এক দেখিয়ে গেল, কি ভাবে কি লিখতে হয় মোটামুটি এক দিনে যতটা সম্ভব দেখিয়ে দিয়ে বলল
নাও এবার তুমি দেখ।
যুঁই, আমি আসি তাহলে, শিহাব তো এখন এলো না।
কাল আসবি?
শুনেই নিশাত সামনে বসা নিরুর দিকে তাকাল আর নিরুও নিশাতের দিকে। দুয়ে দুয়ে চার চোখের মিলন হলো। এক মুহূর্ত থেমে নিশাত যুঁইয়ের কথার প্রেক্ষিতে নিরুকে জিজ্ঞেস করল কি, কাল আসতে হবে? বলেই কোন জবাবের অপেক্ষা না করে বলল
হ্যাঁ আসতে পারি, আজ যা দেখিয়ে দিলাম এগুলি তুমি ঠিক করে রেখ কাল আমি এর পরের গুলো দেখিয়ে দিবো।

এই ভাবে বেশ কয়েক দিন গেল। এর মধ্যেই নিশাত আর নিরুর মধ্যে বেশ সুন্দর একটা ভাব জমে উঠেছে। এখন দুই জনেই দুই জনের চোখের ভাষা বুঝতে শিখেছে, মান অভিমান করতে শিখেছে। এক দিন না এলে কৈফিয়ত চাইতে এবং দিতে শিখেছে। দুয়ে দুয়ে চার হয় জ্যামিতির ছলে তাও শিখতে শুরু করেছে। নিশাত অনেক কিছু বলতে চেয়েছে কিন্তু পারেনি। যখনই বলবে ভেবেছে তখনই যেন মনে হতো কোথা থেকে একটা পাহাড় এসে ওর সামনে দাঁড়িয়েছে, এই পাহাড় ডিঙ্গিয়ে ওর কথা কি নিরুর কানে পৌঁছাবে কোনদিন? কণ্ঠ থেমে যেত গলা দিয়ে স্বর বের হতো না।
কাল কেন এলেন না, আমি আজ পড়ব না।
না পড়লে লোকে তোমাকে মূর্খ বলবে আমার কি হবে?
বলুক মূর্খ তাতে আমার কিছু হবে না।
থাক হয়েছে আর পাকামি করতে হবে না এসো, এখন থেকে যে কয় দিন আছি আর এমন হবে না।

ওদিকে যুঁইয়ের অত্যাচার দিনে দিনে বেরেই চলেছে। নিশাতকে দেখলেই নিরুকে ডেকে বলে এই নিরু ওই দেখ কে এসেছে, যা বরণ করে নিয়ে আয়। আবার নিশাতকেও একই ভাবে বলছে আমি কি জানি তোর বৌকে জিজ্ঞেস কর কিংবা নে এটা খেয়ে দেখ তোর বৌ বানিয়েছে। এদিকে নিশাতদের যাবার সময় ঘনিয়ে আসছে। নিশাতের বাবার ছুটি প্রায় শেষ। সামনে আর মাত্র পাঁচ ছয় দিন বাকী। তার পরেই আবার চলে যাবে নিশাতের বাবার কর্ম স্থল করাচী শহরে।

নিরু কিছু বলতে চেয়েছিল কি না তা নিশাত কোন দিন বুঝতে পারেনি। তবে নিরুর মনে নিশাত বেশ খানিকটা জায়গা দখল করে নিয়েছে এটা নিশাত বুঝতে পারে কিন্তু কত টুক তা বোঝার মত ক্ষমতা নিশাতের নেই। সে কথা বোঝার মত কোন গুরুর সন্ধান এখনো নিশাত পায়নি। নিরুও বুঝতে পারে নিশাত তার টানেই এ বাড়িতে আসে। কেউ কারো কাছে প্রকাশ হতে পারে না। নারীর লজ্জা ভূষণে পরিবেষ্টিত হয়ে নিরু কোন দিন কিছু বলতে পারে না। শুধু মনে মনে নিশাতকে দোষারোপ করে। এই তো আর কয়েক দিন পরেই চলে যাবে। আগের সেই চঞ্চলতা এখন নিরুর মধ্যে নেই, অনেক কমে গেছে। বাড়ির সব চেয়ে দুরন্ত মেয়ে এই নিরু হঠাৎ করে রাতারাতি নীরব নিস্তব্ধ যেন রাশভারী কোন মহিলা হয়ে গেছে। আগের সে হৈ চৈ নেই, দৌড়া দৌড়ী নেই, আগের সাথীদের এখন নিতান্ত ছেলে মানুষ বলে মনে হয়। আগের চেয়ে অনেক ধীর শান্ত হয়ে গেছে। তবুও হঠাৎ করেই সঙ্গীদের ছেড়ে আসতে পারে না। যারা কোন বিচার সালিশ নিয়ে আসে তাদের বিকেলের কোন সময় দিয়ে দেয়। সময় মত বিচার করে দিয়েই রান্না ঘরে মা চাচীর পাশে বসে থাকে, রান্নার যোগার এগিয়ে দেয়। বারেকের মাকে দিয়ে বাড়ির রাখাল সর্দার জয়নুলকে ডেকে এনে বাড়ির আশে পাশে সবজী লাগাবার নির্দেশ দেয়। বাবার মত কোন জমিতে কিসের চাষ করেছে তার খবর নেয়, কোন জমির নিড়ানি হচ্ছে, আজ কোন রাখাল কোথায় কি কাজ করছে সে খবর রাখে। জয়নুল মিয়া সিরাজ ভাইর এই মেঝ মেয়ের কাছে হিসেব দিতে পছন্দ করে। সিরাজ ভাই কিছু জিজ্ঞেস করলে বলে দেয় মেঝ মাকে বলে এসেছি, ও জানে। সিরাজ মাতব্বর অবাক হয় নিরু আবার এসব কবে থেকে শুরু করল। মনে মনে তার মায়ের কথা মনে করে স্বস্তি পায়, যাক মেয়েটা তা হলে দাদির মত হবে।

এক দিন নিশাত এসে দেখে যুঁই বা শিহাব ওরা কেউ নেই। শিহাবের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এমন সময় নিরু সামনে এসেই নিশাতকে দেখে থমকে গেল।
নিশাত অনেক সাহস করে বলে ফেলল তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।
কি কথা?
চল ঐ পুকুর পাড়ে যাই।
না এখানেই বলেন।
কেন, চল না ওখানে।
আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে?
কেন মাথা খারাপের কি হলো?
ওখানে কেউ দেখে ফেললে কি হবে জানেন?
কি হবে?
আপনি কি ছোট মানুষ কিছু বুঝেন না? এটা আপনাদের শহর না, এটা গ্রাম। এখানে সবাই সব কিছু মেনে নিতে পারে না।
ও, হ্যাঁ তা হতে পারে, কিন্তু এ যে কিছু একান্ত কথা যা এখানে বলা যায় না!
তা হলে চলেন ভিতরে চলেন।
হ্যাঁ তাই ভালো।
আগে নিরু শিহাবের ঘরের ভিতরে গেল, পিছনে নিশাত। নিশাত একটা চেয়ার টেনে বসল নিরু একটা খুটিতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে রইল।
এবার বলেন কি বলবেন।
আচ্ছা নিরু, তোমার মনে আছে, ওই যে তুমি বকুল ফুলের মালা গাঁথছিল আর আমি তোমার পিছনে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম।
কবে?
সে অনেক দিন আগে, ওই তোমাদের ঈদগাহের বকুলতলায়।
না, আমার কিছু মনে পরছে না। দাদু, যুঁই আপা, বড় আপা, মা এরা সবাই বলেছে আমি নাকি আপনাকে ছোট বেলায় দেখেছি কিন্তু ছোট বেলায় আপনাকে কোন দিন দেখেছি বলে আমার কিছুই মনে পরছে না। অনেক চেষ্টা করেছি খুঁজে পাইনি। হঠাৎ আজ এ কথা কেন?
না হঠাৎ না, সেদিন যখন তোমাকে দেখলাম তখন আমার মন বলছিল আমি যেন তোমাকে চিনি, আমার অনেক চেনা তুমি। কিন্তু কোথায় দেখেছিলাম তা কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না। বেশ কয়েক দিন ভাবার পর হঠাৎ করেই মনে এলো তোমাদের বাড়ির পিছন দিয়ে যাবার পথে বকুল ফুলের গন্ধ পেয়ে কেন যেন একটু এগিয়ে গেলাম আর ওখানে তোমাকে দেখলাম তুমি কুড়ানো ফুলের মালা গাঁথছ। আমার মনে হয় তুমিই সেই, সময়ের হিসেব করে মিলিয়ে দেখি তুমি ছাড়া আর কেউ নয়।
কি যে বলেন, কত জনে অমন মালা গাথে। আর কিছু দিন থাকলে দেখে যেতে পারতেন। যখন ফুল ফোটে কত জন এসে কুড়িয়ে নিয়ে যায়।

না নিরু, কত জন আর আমার মনে আঁকা ছবির মধ্যে অনেক ব্যবধান সে তোমাকে আমি কেমন করে বোঝাব বল?
এ কথা শুনে নিরু এই বয়সেই যেন সেই সুদূরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে কিসের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে। মনে হচ্ছে ওর সামনে দিয়ে ভবিষ্যৎ হেঁটে যাচ্ছে আর নিরু তাকিয়ে তাই দেখছে। নিশাতকে কি বলবে কিছু বুঝে উঠতে পারে না। অবাক হয়ে নিশাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মানুষটা কি বলতে চায় কিছু বুঝতে পারে না।
আপনারা কবে যাবেন?
সামনের মঙ্গল বারে।
আবার কবে আসবেন?
কি জানি, আব্বা কবে ছুটি পায়।
আপনি কি এখানে থেকে পড়তে পারেন না? আপনার দাদি আছে তার কাছে থাকবেন।
আমি থাকলে কি তোমার ভালো লাগবে?
এবার আর নিরু জবাব দিতে পারলো না, লজ্জা এসে ঘিরে ধরল। মাথা নিচু হয়ে গেল, হাত দিয়ে অযথাই ওড়নার আঁচল আঙ্গুলে জড়াচ্ছে। নিরু যা বোঝার তা বুঝে নিয়েছে। মনে মনে ভাবছে সে কি তোমাকে বলে দিতে হবে?
দেখি আব্বা আম্মাকে বলে দেখি যদি উনারা রাজি হয়।
এমন সময় শিহাব এসে পড়ায় ওদের কথা ওখানেই থেমে গেল। ওই দিন বাড়িতে ফিরে রাতে খাবার পর নিশাত বাবাকে তার এখানে থেকে যাবার কথা বলতেই তা সাথে সাথে নাকচ হয়ে গেল। যাবার আগের দিন নিরুর সাথে দেখা করতে এলো। প্রথমে শিহাবের সাথে দেখা হলো। শিহাবের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে বলল
চল দাদি আর চাচীদের সাথে একটু দেখা করে যাই।
যা তুই যা আমি আসছি।
[চলবে]