বিভাগের আর্কাইভঃ অন্যান্য

একদিন বৃষ্টি ও আমি

মাঝে মধ্যে কি যে হয় কবিতার শব্দরা
পালিয়ে বেড়ায় বহুদূরে —
গুচ্ছ গুচ্ছ শব্দরা তখন
ছোট্ট খরগোশ ছানা হয় ,
আর আমি চোখ বেঁধে খরগোশ ছানার পিছে ছুটছি অনন্ত কাল শিশির ভেজা ঘাসের বুকে ছুটে চলা নীল কিশোরীর মত:
দিন শেষে ক্লান্ত এই আমি বুঝতে পারি
খরগোশ ছানা আমার হাতের মুঠোয় বন্দি!
বৃথাই খুঁজেছি, পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে —
আমার একটা বিকেল ছিল সবুজ পাতা
রঙ ,
বিকেলটা পুড়ে যাচ্ছিল মধ‍্য দুপুরের
টানা রৌদ্রে :
বিকেল জুড়ে আমার কৃষ্ণচূড়া রঙ
স্বপ্নরা খেলা করে
স্বপ্ন কুড়োনো সময় তুলে রেখেছিলাম
গত গ্রীষ্মে;
শ্রাবণের বেনো জলে স্বপ্ন ধুয়ে গেছে
একবার
এবার অনেক সাবধান হয়েছি !

শহরের বিস্তীর্ণ আকাশ নিয়ে খেলছিল মেঘ
বৃষ্টির দারুণ ইচ্ছে হলো প্রকৃতি ভিজিয়ে দেবে ,
হঠাৎ এক শহর স্বস্তির বৃষ্টি নামলো !
রংধনু আকাশে তখন দৃশ্য অন‍্য রকম —
খোলা ছাদে বৃষ্টিতে ভিজে এই আমি একাকার ,
মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরছে মূষলধারায় ..
এক নিমিষেই জমাট বাঁধা কালচে সময়ে
কবিতার শব্দরা দূর্বোধ‍্য হয়ে উঠেছে ।

শত বিকেলের গভীর ঘুমে শেষের
রাত্রি
নৈঃশব্দ্যের জোনাক জ্বলা নিঝুম রাতে
শীত ঘুম স্বপ্ন ভেঙ্গে এই মাত্র
জেগে উঠেছে ,
অপার্থিব কবিতার এক পৃথিবী !

15.02.2019

শূন্য শহর //

আজ আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই ;
তাইতো পড়ে আছি ঘুণে ধরা শহরের চৌকাঠ ধরে ,
বখে যাওয়া শহরের কাছে কিছু চাওয়া নাই ;
এ সমাজের প্রচ্ছদ জুড়ে শুধু অার্তনাদ খেলা করে ৷

এ রঙের দুনিয়ায় কোন কিছুই চাওয়ার নাই ;
তাইতো চাওয়া পাওয়া সব জলাঞ্জলি দিয়েছি আজকে ,
সাদাকালো চোখেই রঙীন পৃথিবীটা সাজাই ;
যে সমাজে রঙবাহারী মুখ ও মুখোশ ঘুরে আজকে ৷

এসমাজে আজ কোন মানুষেরই বসতি নাই ;
এখানে আজ ভিক্ষুক লুটেরা’রা থাকে ঘাপটি মেরে ,
এখানে আজ মূখ্য যেন শুধু বেঁচে থাকাটাই ;
অথচ মরে গেলে মানুষ মূল্যহীন তখন মনে পড়ে।

তোমায় এতো ভালোবাসি বলে…..

তোমায় এতো ভালোবাসি বলে আকাশটা নীল রঙ্গে সাজে
আবার কখনো কখনো শ্রাবণের মেঘলা আকাশ….
এসেছে বসন্ত
শুভ্রতা ঝড়ে পড়ছে নরম ঘাসের উপর
মন হু হু করা দখিনা বাতাস স্নিগ্ধ
অরণ্য অঝর ঝর্নার মুখর শব্দ
ফুলের সৌরভ রহস্যময় সবকিছু এলোমেলো
কেবলই আমার প্রেমের মধ্যে
তোমায় এতো ভালোবাসি বলে ও হে প্রিয়…..

জানো প্রিয় ,
তোমায় এতো ভালোবাসি বলে পাহাড় গুলো বাজায় বাঁশি
পাখিরা গায় গান জোছনা দেয় আলো
বাদুর ডানা মেলে যায় ওই আধার পানে
সন্ধ্যার প্রদীপগুলো চেয়ে থাকে
এক রহস্যময় ভঙ্গিতে
তোমায় এতো ভালোবাসি বলে ও হে প্রিয়…..

জানো প্রিয়,
তোমায় এতো ভালোবাসি বলে বিস্তৃত এই নীল জলরাশির নাম সমুদ্র
অসীম সীমাহীন ছোঁয়ার নাম আকাশ
মিটিমিটি করে জ্বলে থাকা আলোর নাম নক্ষত্র
তোমায় এতো ভালোবাসি বলে আকাশ ও প্রকৃতি জুড়ে চলছে কতো আয়োজন কতো হেমন্তোত্‍সব
তোমায় এতো ভালোবাসি বলে ও হে প্রিয়……

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-১২

প্রায় চল্লিশ মিনিটের মধ্যেই ঢাকা ডমিস্টিক টার্মিনালে নেমে ভিতর দিয়ে ওরা আন্তর্জাতিক লাউঞ্জে এসে পৌঁছেই দেখে নিশাতের দাদি, মা বাবা সহ সব ভাই বোন এসেছে। নিশাত আরও যেন কাকে খুঁজছিল। এদিক ওদিক তাকাল কিন্তু
না কেউ কোথাও নেই। হাবিবের মা বাবা ভাই বোনদের দেখল। এগিয়ে এসেই দাদিকে সালাম করে নিলো। দাদি মাথায় হাত দিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলেন। এই বয়সে তোকে একা একা বিদেশ যেতে হচ্ছে। দাদির কথা জড়িয়ে জড়িয়ে আসছিল। নিশাত দাদিকে বুকে জড়িয়ে শিশুর মত বোঝাল। যাবার সময় কেঁদে মন দুর্বল করে দিবেন না, মন ভালো আছে তাই থাকুক। শুধু শুধু তাকে কেন দুর্বল করছেন? এমন না যে, না গেলে চলবে, যেতে যখন হবেই তা হলে আর কান্না কাটি করে কি হবে? একে একে মা বাবা সবাইকে সালাম করে মায়ের কাঁধে মাথা রেখে একটু আদর নিয়ে ছোট ভাই বোন দের বুকে নিয়ে আদর করে এদিক ওদিক কাকে যেন খুঁজে কাওকে না পেয়ে হাবিবকে নিয়ে এগিয়ে গেল চেক ইন কাউন্টারের দিকে। সাথের এনাম আর সালেক একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল। ওরা সহ চেক ইন কাউন্টারে এসে টিকেট, সিডিসি দেখিয়ে বোর্ডিং কার্ড নিয়ে নিলো। সাথে মালপত্র কিছু নেই শুধু সবার সাথে একটা করে হাত ব্যাগ। এর আবার কি ওজন হবে তাই মালামাল ওজনের ঝামেলা নেই। শুধু একটা ট্যাগ লাগানো। বোর্ডিং কার্ড নিয়ে আবার ফিরে এলো মা বাবার কাছে। আবার এক দফা সবাই মিলে বিচ্ছেদের গান গেয়ে মাইকে দুবাই যাত্রীদের প্লেনে আরোহণ করার ঘোষণা শুনে এগিয়ে গেল ইমিগ্রেশন কাউন্টারে। ওখানে জেমস ফিনলে অফিসের ক্রু ডিপার্টমেন্টের বুড়ো ব্যাপ্টিস্টের দেয়া খাম আর সিডিসি দেখাল। ইমিগ্রেশন অফিসার খাম খুলে চিঠি দেখে সবার সিডিসিতে ঢাকা ডিপার্চার সিল দিয়ে ফেরত দিয়ে দিল। ওরা এগিয়ে বোর্ডিং লাউঞ্জে গেল। একটু পরে প্লেনে উঠে সীট নম্বর দেখে খুঁজে যার যার সীটে বসে পরল। সব যাত্রী ওঠা হলে যাত্রীদের সীট বেল্ট বাধার ঘোষণা। নিশাত এর আগে বাবা মায়ের সাথে অনেক বার ঢাকা করাচী বা করাচী ঢাকা বিমানে ভ্রমণ করেছে কিন্তু হাবিবের এই প্রথম, কাজেই হাবিব নিশাতের কাছে কাছে থাকছে।

একটু পরেই প্লেন ট্যাক্সিং করে রাতের ঝল মল ঢাকা শহরের বাতি গুলি নিচে রেখে নিজের ডানা মেলে পাখির মত আকাশে উড়ে গেল। নানা ভাবনার পর আবার সেই নিরু। প্লেন তো বীণা আপার বাড়ির উপর দিয়েই যাচ্ছে। ওখানে নিরু কি করছে এখন, ঘুমিয়ে পরেছে? হাতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ভাবল এখন কি ও রাত জেগে গল্পের বই পড়ছে নাকি ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে? নিরু কি জানে এই প্লেনে কে যাচ্ছে?

৬।
সিরাজ চৌধুরী এক জন প্রভাবশালী ব্যক্তি। আশে পাশে দশ গ্রামে তার প্রতাপ। বিভিন্ন শালিস দরবার, আচার অনুষ্ঠানে সিরাজ চৌধুরী উপস্থিত না হলে সে অনুষ্ঠানের মান হানী হয়। গ্রামে যথেষ্ট জমি জমা, পাশের বাজারে বিশাল ব্যবসা। দেশ বিভাগের আলামত পেয়ে আগেই কোলকাতায় কাপড়ের যে ব্যবসা ছিল তা গুটিয়ে ভাইকে নিয়ে চলে এসেছিল। চল হাশেম এখন আর আমাদের এখানে থাকা ঠিক হবে না। গ্রামে ফিরে কোলকাতার ব্যবসার টাকা দিয়ে ঢাকায় কিছু জলা ভূমি কিনে রেখেছিল আজ যার দাম কোটি টাকার উপরে। বাকি টাকা দিয়ে স্থানীয় বাজারে একটা দোকান করেছে সেটা ছোট ভাই হাশেম দেখা শুনা করে। পৈতৃক জমিগুলি আগের মতই রাখাল চাকরেরা দেখে। দুই ভাই মিলে একান্নবর্তী সংসার। রাখাল চাকর, দোকানের কর্মচারী মিলে বাড়িটা একটা হাটের মত। বাড়িতে দৈনিক প্রায় এক মন চাউল না হলে চলে না। মাঝে মাঝে বাজারে ছোট ভাইকে সাহায্য করে। আশে পাশের যত দরবার শালিস করা আর বর্ষা এলেই লোহা কাঠের তৈরি জেলেদের মত এক মস্ত মাছ ধরার নৌকায় চেপে পদ্মার ইলিশ পাঙ্গাশ ধরার নেশা। এই নিয়েই তার দিন বেশ সুখে কেটে যায়। মাছ ধরার এমন কোন সামগ্রী নেই যা তার সংগ্রহে নেই। ও পাড়ার সুবল তার মাছ ধরার সঙ্গী বা সহকারীও বলা যায়। নৌকার যত্ন নেয়া, যন্ত্রপাতির যত্ন নেয়া গুছিয়ে রাখা এ গুলি সেই করে। কোথাও যাওয়া আসার পথে এক নজরে জমি জমা যা নজরে আসে তাই যথেষ্ট, বাড়িতে ফিরে বা ক্ষেতের আলে দাঁড়িয়ে প্রধান রাখাল জয়নুলকে বলে দেয় কি ব্যাপার জয়নুল মিয়া এই জমিতে কি আগাছার চাষ করেছ না কি বুনেছ কিছু বুঝতে পারছি না, পাশের জমিটা একটু দেখ ওর পিয়াজ গুলি কেমন সুন্দর হয়েছে আর তোমার এ অবস্থা হলে সংসার কোথায় যাবে? তাড়াতাড়ি নিড়ানি দেবার ব্যবস্থা কর।

বড় মেয়ে বীণার বিয়ে দিয়েছে ভাগ্নে কবিরের কাছে, ঢাকায় তার বাড়ি আছে, ভালো চাকরী করে বেশ সুখেই আছে। মেঝ মেয়ে নিরু গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে যায় আসে। পড়াশুনার চেয়ে বাবার মত মাতব্বরি করাতেই তার বেশি আগ্রহ। গ্রামের আর সব সম বয়সীদের নিয়ে তার সমাজ। তাদের মধ্যে বিচার সালিশ করা, ঝগড়া ঝাটির নিষ্পত্তি করা, গাছের মাথায় শালিকের বাসা থেকে বাচ্চা তুলে এনে পেলে পুলে বড় করা, সারা দিন এ গাছের ও গাছের ফল মুল পেড়ে বিলানো তার প্রধান কাজ। ওদের বাড়িটাও বেশ বড়, গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে বড় বাড়ি বলা যায়। বাড়ির সামনে পিছনে দুই দিকেই রাস্তা। সামনের রাস্তা দিয়ে উঠে ডান পাশে সাবেক আমলের পরিষ্কার টলটলে জলের বিশাল এক ইঁদারা, তার একটু দুরেই পুরনো এক জাম গাছ, বাম দিকে একটু ভিতরে একটা কত বেল গাছ। চারি দিকে ঘিরে নারকেল, খেজুর, সুপারি এবং নানা জাতের ফলমূলের গাছ পালায় ঘেরা বাড়ি। পশ্চিমে চাচাত ভাইয়ের বাড়ি। পূর্ব দিকে পুকুরের পাড়ে ঈদগাহ, তাদেরই পূর্বপুরুষদের ওয়াকফ করে দেয়া। নিরুর গণ্ডি অবশ্য এর মধ্যেই সীমিত। পুকুরে ডুবানো নৌকা তুলে মাছ ধরাও তার বাবার মত এক নেশা।

বাবা পদ্মা থেকে মাছ ধরে ফিরে এসে বাড়ির ঘাটে পৌছার আগেই ডাক ছাড়ে কই রে মা নিরু আয় দেখ কি এনেছি। নিরু এসে দেখে নৌকা তখনো ঘাটে ভিড়েনি। তাতে কি, এক লাফ দিয়ে পানিতে নেমে সাতরে নৌকার কাছে যেয়ে হাত বাড়িয়ে বাবার হাত ধরে নৌকায় উঠে পাটাতন খুলে মাছ দেখে চিৎকার করে বাড়ির সবাইকে ডেকে অস্থির। ততক্ষণে সুবল ঘাটে ভিড়ে লগির সাথে নৌকা বেধে ফেলেছে। নিরুর চিৎকারে মা চাচী ভাই বোনেরা এসে ধরা ধরি করে মাছ গুলি ভিতরে নিয়ে গেল। এবার ভিতর বাড়ির পালা। নিরুর মা হাঁক ছাড়ল বারেকের মা তাড়াতাড়ি মশলা বাট।
এই নিরু এখন একটু বড় হয়েছে। গ্রামের পাঠশালা ছেড়ে ঝিটকা হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছে। এক দিন স্কুল থেকে ফিরে দেখে অচেনা এক ছেলে চাচাত ভাই শিহাব আর বোন যুঁই এর সাথে শিহাবের ঘরে বসে সিনেমার নায়কদের মত সুন্দর ভাষায় কথা বলছে। কোঁকড়ানো চুল, সুন্দর চেহারা, পরিপাটি করে শার্ট প্যান্ট পরা। এই চেহারা তো আগে কখনো দেখেছে বলে মনে করতে পারছে না। মনে একটু বিস্ময় নিয়ে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বাড়ির ভিতরে এসে বই খাতা টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে এক দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে দাদির কাছে এসে জিজ্ঞেস করল
ওই যে ওই ঘরে মেঝ ভাই আর যুঁই আপার সাথে কথা বলছে ও কে?
কেন, তোর পছন্দ হয়েছে, ঘটক পাঠাবো?
তখনো সে এই ইঙ্গিতের পছন্দের মানে বোঝে না, ঘটক কে জানে না। তবে ওর মনে হলো ও যেমন সুন্দর খুঁজছে, যেমন সুন্দরের ছবি ওর মনে আঁকা আছে এ যেন সেই। আজ সেই ছবি যেন নিজের ঘরে খুঁজে পেয়েছে।

এ যে প্রকৃতির নিয়ম, যা একান্তই স্বাভাবিক। যে ভাবে এতো দিন ধরে এই পৃথিবীতে চলে এসেছে। অদৃশ্য ভালবাসা আর প্রেমের বন্ধন। যা কখনো কাউকে জানিয়ে ঢাক ঢোল পিটিয়ে আসে না। একান্ত নীরবে এসে ধরা দেয়। যা এখনো জীব জগতে সকল প্রাণীকে বিহ্বল করে রেখেছে। অদৃশ্য এক সুতার টান। নিরুও তার থেকে ভিন্ন কিছু নয়। নিরুর মাঝে কেমন যেন একটা পরিবর্তন এলো, মনটা কেমন যেন নাড়া দিয়ে উঠল।
আহা দাদু বল না ও কে? আগে তো ওকে কখনো দেখিনি।
দেখেছিস তোর মনে নেই, ওরা গ্রামে থাকে না। ওই পুরনো বাড়ির ফরিদের বড় ছেলে, ওর নাম নিশাত। তুই যখন খুব ছোট তখন দেখেছিস তোর মনে নেই।
ও আচ্ছা।
দাদিকে এ কথা বলে চলে এলো কিন্তু ওর মনে কেমন যেন একটা তৃষ্ণার্ত ভাবের উদয় হলো যা আগে কখনো হয়নি। কেন যেন আবার দেখতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু অবুঝ হলেও নারী মন তাই কোথা থেকে এক পাহাড় লজ্জা নেমে এসে সে ইচ্ছা থামিয়ে দিল। নিরু এই লজ্জার পাহাড় অতিক্রম করবে কি করে? একান্ন বর্তি সংসারে বড় হচ্ছে, বড় বোনদের দেখে আসছে তাদের কাছে এমন কিছু দেখেনি। যদিও এ বাড়ির আর সব মেয়েদের থেকে নিরু একটু ভিন্ন। তারা প্রায় সবাই ভীরু, নরম মেজাজের যেন মোমের পুতুল কিন্তু, নিরু তা নয়। সে তো অস্থির, দুরন্ত, চঞ্চল, দৌড়া দৌড়ী, লাফ ঝাপ হৈ চৈ যার স্বভাব। যেন চৈত্রের তপ্ত সূর্যের প্রখর তাপ। কিন্তু নিমেষের মধ্যেই নিরুর এ কি পরিবর্তন! নিরু দাড়িয়েই আছে। নিশাতের সাথে কথা বলার ফাঁকে যুঁই বেরিয়ে এলো ওর জন্য নারকেলের লাড়ু আর মুড়ি নিতে। বেরিয়ে দেখে দাদির পাশে নিরু দাঁড়িয়ে আছে।
নিরু, এক জগ পানি আর গ্লাস নিয়ে ও ঘরে রেখে আয়, আমি নাড়ু মুড়ি নিয়ে আসছি।

নিরু এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। কোন ভাবে পা টেনে রান্না ঘরে ঢুকে কলস থেকে এক জগ পানি ভরে ভালো করে একটা কাচের গ্লাস ধুয়ে এ ঘরের পাশে এসে দাঁড়িয়ে রইল। যুঁই এসে ওকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল
কি রে এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছিস কেন, আয় ভিতরে আয়।
সামনে যুঁই আর তার পিছনে নিরু ঘরে ঢুকতেই নিশাতের চোখে পড়ল। ফর্সা এক কিশোরী হালকা আকাশী নীলের উপর কাল ছাপার ফ্রক পরনে, মাথায় দুই বেণী, তাতে ফুল করে ফিতে বাধা, চুল গুলি কিছুটা কুঞ্চিত মনে হলো। মানুষ এমন সুন্দর হতে পারে? আমি কি এই ছবি আঁকতে চাইছিলাম? এই কি সেই যে ছবি আমি এতো দিন ধরে কোথায় দেখেছি কোথায় দেখেছি মনে হচ্ছে? চোখের দিকে তাকিয়েই নিশাত বুঝতে পারলো এ মেয়ে দুরন্ত। সাধারণ নয়, অসাধারণ কিংবা আরও কিছু। শিহাবের সাথে কথা বলছিল হঠাৎ কথা থেমে গেল। এক পলকে ওর দিকে চেয়ে রইল। কে? ওদের বাড়ির কেউ নিশ্চয়, কিন্তু কে? ওদিকে এক হাতে পানির জগ আর এক হাতে গ্লাস নিয়ে নিরু ঘরে ঢুকে এক নজর নিশাতের দিকে তাকিয়েই নিরুপায় দুটো চোখ মাটিতে নামিয়ে এক ভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। অদৃশ্য নিয়তির লীলা ভূমিতে এর মধ্যেই একান্ত নীরবে রোপিত হলো দুটি মনের প্রথম প্রেমের একটা নতুন অংকুর যা ওরা কেউ বুঝতে পারলো না। নিশাতের মনে হলো বিধাতা কি একে আমার জন্য পাঠিয়েছেন? হ্যাঁ, এ তো আমার। ওদের এ ভাবে দেখে যুঁই বলল
কি রে নিশাত কি হলো?
নিশাতের কানে সে কথা গেল না। যে ভাবে কিশোরীকে দেখছিল তেমনিই তাকিয়ে রইল। সে কোন এক অচেনা দূর দেশে চলে গেছে যেখানে প্রবল এক চৌম্বক শক্তি ওর চোখ দুটিকে আটকে রেখেছে। নিশাতের অন্তরাত্মা চিরাচরিত এক সুরের মূর্ছনায় সম্মোহিত হয়ে গেল। নিরুও ঠিক তেমনই একই সুতার এ প্রান্ত আর ও প্রান্ত যেমন তেমনি বিমোহিত হয়ে দাড়িয়েই রইল। পানির জগ গ্লাসের কথা ভুলে গেল। এতো দিন কোথায় ছিল? শিহাব একটু ধাক্কা দিয়ে বলল
কি রে নিশাত কি হলো?
তখন নিশাত সম্বিত পেয়ে জিজ্ঞেস করল কি বললি, এ কে?
জুই বলল আমার চাচাত বোন, বীণা আপার কথা মনে আছে?
কোন বীণা আপা, ওই যে ঢাকায় থাকে? বীণা আপা!
হ্যাঁ।
তার ছোট বোন নিরু, আগে দেখেছিস এখন বড় হয়েছে তাই চিনতে পারছিস না।
ও আচ্ছা।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-১১

নিশাত মনে মনে ভাবল আমরা দুই জনে আমাদের ডার্লিং এর সাথে দেখা করেই এসেছি।
ওরা বুড়োকে গুড নাইট জানিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে এলো। বুড়োর কাছে আসা যাওয়া করে এর মধ্যেই কিছু
ইংরেজি ভাব কায়দা শিখে নিয়েছে।
হাবিব বলল তাহলে আমরা এক জাহাজে থাকছি না?
তাইতো শুনলি।
আমি ভেবেছিলাম এক সাথে থাকব।
আমিও তো তাই ভাবছিলাম, ওই যে ওই লোকটার সাথে যখন কথা বলছিল তখন আমার সন্দেহ হলো তা হলে কি আমরাও দুই জায়গায় যাচ্ছি, তাই জিজ্ঞেস করলাম।
চল এখন আর কোথাও যাব না বাসায় যাই।
হ্যাঁ তাই চল, রাত জাগার জন্য কেমন যেন ভালো লাগছে না, ওহ! দর্জির দোকানে যাবি না?
ও, হ্যাঁ তাইতো আমি ভুলেই গেছিলাম। চল, আরে ওইতো সামনেই, দেখেছিস?
আরে হ্যাঁ ওইতো! দেখেছি!
দর্জির দোকানে মাপ দিয়ে সেদিনের মত সোজা হাবিবের খালার বাড়ি এসে খালার কাছে সারা দিনের বিবরণ দিয়ে কিছুক্ষণ টিভি দেখে খেয়ে দেয়ে বিছানায়। সকালে উঠে হাবিব নিশাতকে নিয়ে কাছা কাছি যে সব আত্মীয় আছে তাদের সাথে দেখা করতে গেল। ওখান থেকে বিকেল চারটার আগেই এসে বুড়োর কাছে।
ও, তোমরা এসেছ বলেই হাতের ঘড়ির দিকে দেখেই বলল ভেরি গুড একে বারে জাস্ট টাইম। গুড! ভেরি গুড! তোমরা আগামী রবিবার বিকেলে ফ্লাই করছ। এখান থেকে ঢাকা তারপর দুবাই আর তুমি দুবাই থেকে লন্ডন। দুবাইতে হাবিব থেকে যাবে এজেন্ট নিয়ে তাকে জাহাজে পৌঁছে দিবে আর তুমি এবং তোমার সাথে আরও যে দুই জন আছে ওরা সহ গালফ এয়ারে লন্ডন। ওখানে গিয়ে ২/৩ দিন থাকবে পরে জাহাজ এলে তখন জাহাজে যাবে।
কোন দুই জন?
বস, ওরা একটু পরে আসবে। ওহ, তোমাদের ড্রেস কবে দিবে, কাল না পরশু?
কাল দিবে বলেছে।
গুড, তা হলে কাল ড্রেস নিয়ে নিও। এখন ওই জেমস রয়ের কাছে যাও ওখানে আর্টিক্যালে সই করে আবার এখানে এসো।
এই জেমস, শুনছ?
কোণায় বসা হালকা পাতলা খাট মত এক জন বুড়োর দিকে তাকিয়ে বলল
বলেন স্যার শুনছি।
এই যে এই দুই জ্যান্টল ম্যানের আর্টিক্যাল রেডি করেছ?
হ্যাঁ রেডি, আসেন ভাই আপনারা এদিকে আসেন
যাও ওনার কাছে।

জেমস রয়ের সামনে এসে বসল।
আপনাদের বাড়িতে কি মানি অর্ডার পাঠাতে হবে?
মানে কি, আমরা তো নতুন কিছু জানি না, একটু খুলে বলেন প্লিজ।
অফিসে এসে যেখানে যা কথা বলা দরকার হচ্ছে হাবিব নিশাতকে ঠেলে দিচ্ছে, তুই বল। সবার সাথেই নিশাত কথা বলছে, হাবিব শুধু ওর সাথে রয়েছে। এর মধ্যেই নিশাত বুঝে ফেলেছে এখানে সব বিদেশি কাজকর্ম, বিদেশি স্টাইল। সবাই কথায় কথায় থ্যাঙ্ক ইউ, সরি, প্লিজ এই সব বলছে।
আপনারা যখন জাহাজে থাকবেন তখন আপনাদের বাড়িতে টাকা পাঠাতে হলে আমরা সেটা মনিঅর্ডার করে পাঠিয়ে দিবো। ও ভালো কথা, আপনারা কি জানেন, আপনাদের পুরো বেতন কিন্তু জাহাজে পরিশোধ করবে না।
তা হলে?
ওখানে মুল বেতনের ৬০% দিবে আর বাকি ৪০% টাকা এখানে শিপিং অফিসে জমা হবে। আপনারা যখন সাইন অফ করে এখানে আসবেন তখন আমরা সে টাকা শিপিং অফিস থেকে এনে আপনাদের দিবো। এটাই নিয়ম। ওখানে যা পাবেন তা দিয়ে নিজের যা লাগে তা কেনা কাটা করতে পারবেন দরকার হলে ব্যাংক থেকে বাড়িতেও পাঠাতে পারবেন। আর এমনি যদি এখানে কিছু টকা লাগে মনে করেন তা হলে কার নামে কোন ঠিকানায় পাঠাতে হবে তা এই যে এই খাতায় লিখে দিন।
বলে একটা বড় হিসাবের খাতার মত একটা খাতা ওদের দিকে ঠেলে দিল। নিশাত হাবিবের সাথে আলাপ করে নিলো।
তুই কি করবি, তোর কি বাড়িতে টাকা লাগবে?
লাগবে না, তবুও কিছু দিয়ে যাই।
কত দিবি?
কি জানি কত পর্যন্ত দেয়া যায় জিজ্ঞেস কর দেখি কি বলে।
আচ্ছা জেমস সাহেব, কত টাকা পর্যন্ত দেয়া যায়?
৫০০ টাকার বেশি না।
তা হলে আমার দুইশ হলেই হবে।
আমার একটু বেশি দরকার, আমি তিনশ দেই।
ওরা ওই খাতার ছক অনুযায়ী সব পূরণ করে দিল।
এটা হয়ে গেলে জেমস রয় দুই জনের নামে দুইটা ভিন্ন বইয়ের মত বের করে দেখিয়ে দিল এখানে এখানে সই করেন।
নিশাত হাতে নিয়ে দেখল, ওই বইতে ওদের নাম ঠিকানা, আইডি নম্বর, পদ, বেতন, জাহাজের নাম, জাহাজ কোন বন্দরে রেজিস্ট্রি হয়েছে এমন নানা ধরনের তথ্য লেখা। সই স্বাক্ষর হয়ে গেলে জেমস বলল যান এবার ওখানে যান। এবার বুড়োর টেবিলে এসে দেখে অচেনা দুই জন বুড়ো ব্যাপটিস্টের সাথে কথা বলছে। ওরা দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ শুনেই নিশাত বুঝল এরা ওদের মত নতুন নয়। ব্যাপ্টিস্ট এবার নিশাতকে বলল এই যে এই দুই জন তোমার সাথে যাবে। এ হচ্ছে এনামুল হক, তোমাদের কুক আর এ সালেক মিয়া, টোপাস মানে তোমাদের ক্লিনার। এদের দায়িত্ব কিন্তু তোমার।
আচ্ছা ঠিক আছে এখন তোমাদের আর কোন কাজ নেই তোমরা পরশু সকালে এসে সব কিছু নিয়ে যাবে। এখন তাহলে গুড নাইট।
এমন সময় দরজার দিকে দেখে শিকদার সাহেব আসছে।
দাঁড়াও যেয়ো না দেখি শিকদার কোন খবর পেয়েছে কি না জেনে যাও।

শিকদার, এদের কনফার্মেশন পেয়েছ? শিকদার এদিকে এগিয়ে এসে বুড়োর হাতে কয়েকটা কাগজ দিল। বুড়ো সেগুলি দেখে বলল নাও তোমাদের ফ্লাইটের ডিটেইলস নিয়ে যাও। সবার হাতে যার যার একটা ফ্লাইট সিডিউল দিয়ে দিল। নিশাত দেখে আগামী রবিবার বিকেল ৫টায় চিটাগাং থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে বাংলাদেশ বিমানে রাত ৯টায় দুবাই, দুবাই থেকে পরদিন রাত ৯টায় গালফ এয়ারে বাহরাইন হয়ে লন্ডন।
তা হলে আমরা কি এখন যেতে পারি?
ওকে মাই ডিয়ার, শনিবারে সকালে এসে সব কিছু নিয়ে যাবে আর ফ্লাইটের দিন দুপুর দুইটার মধ্যে এসে এখানে রিপোর্ট করবে, গুড নাইট।
গুড নাইট।
অফিস থেকে বের হতেই সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
নিশাত বলল, হাবিব আজ হলো মাত্র বুধবার তাহলে বাড়িতে একটা টেলিগ্রাম করে দেই, অন্তত ঢাকা এয়ারপোর্টে ওরা আসলে দেখা হবে।
হ্যাঁ চল টেলিগ্রাম অফিসে, দেখি খোলা আছে কিনা।
একটা রিকশা নিয়ে কাছের আগ্রাবাদ টেলিগ্রাম অফিসে গিয়ে হাবিব এবং নিশাত দুই জনেই নিজ নিজ বাড়িতে টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দিল, চিটাগাং থেকে আমাদের ফ্লাইট আগামী রবিবার বিকেলে, ঢাকা থেকে টার্মিনাল চেঞ্জ করার সময় কিছুক্ষণের জন্য দেখা হতে পারে, আপনারা সবাই ঢাকা এয়ারপোর্টে আসবেন। টেলিগ্রাম করে আবার আর একটা রিকশা নিয়ে মাদার বাড়ি খালার বাসায় ফেরার পথে বারেক বিল্ডিঙের কাছে এসে হাবিব নিশাতকে জিজ্ঞেস করল
কি রে নিশাত তোর কি হয়েছে আমাকে বলবি না?
নিশাতের কোন সারা নেই।
হাবিব আবার জিজ্ঞেস করল।
এবারেও নিশাত নিরুত্তর দেখে হাবিব নিশাতের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিতেই নিশাত চমকে উঠে বলল
কি হয়েছে?
তুই কি এখনই লন্ডন চলে গেলি?
না।
তাহলে সেদিন থেকেই দেখছি তোর কোন কথা নেই এখনও দুই বার ডাকলাম কোন সারা নেই, কি ব্যাপার কি হয়েছে আমাকে খুলে বল।

নিশাত মনে মনে বলল না রে হাবিব আমি লন্ডন যাইনি। আমি যেখানে গিয়েছিলাম সে তোকে এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। যেখানে নিরু নামের এক চঞ্চলা দুরন্ত হরিণীর মত এক মেয়ে আছে, সারা দিন ছুটে বেড়ায়, গুন গুন করে গান গায় যার মনের কোন এক গহীনে আমার জন্য একটু খানি জায়গা আছে এবং আমি সে কথা বুঝতে পারি। সেদিন সে আমাকে বলেছে আমার জন্য অপেক্ষা করবে।
হাবিব আবার তারা দিল, কি রে বলবি না?
না হাবিব কিছু হয়নি এমনিই ভাবছি কোথায় যাচ্ছি, কেমন হবে কি হবে এই সব।
তুই কি ভয় পাচ্ছিস?
আরে না, ভয়ের কি আছে, শুনলি না বুড়ো কি বলল, ওখানে এজেন্ট আছে না?
তাই বলে এমন মন খারাপ করে থাকবি না কি?
না মন খারাপ করলাম কোথায়?
এই যে কোন কথা বলছিস না, ডাকলে তার কোন জবাব দিস না। চল কাল তো কোন কাজ নেই, আলমাস হলে একটা সিনেমা দেখে যাই।
কাল?
হ্যাঁ, কাল দুপুরে বা সন্ধ্যার শো।
চল, দেখা যায়।
কথা বলতে বলতে খালার বাসা এসে গেল। বাসায় ঢুকে গত রাতের মত খালা খালুর সাথে আজ সারা দিনের ফিরিস্তি জানাল। ফ্লাইটের খবর শুনে হাবিবের খালাত ভাই বোনেরা সবাই আনন্দে লাফিয়ে উঠলো। পর দিন সকালে নাশতা খেয়ে আশে পাশে একটু ঘোরাঘুরি করা বাসায় ফিরে এসে দুপুরে খেয়ে আবার বের হলো আলমাস হলের দিকে। সিনেমা দেখে সন্ধ্যায় ফিরে এলো। যাবার আগে এক দিন পতেঙ্গা, ফয়েজ লেক আরও কোথায় কোথায় বেড়াল।

শনি বার সকালে এসে জেমস ফিনলের অফিসে বুড়োর সাথে দেখা করল। ওরা সবাই এসেছে। বুড়ো চা খাচ্ছে। নিশাতকে দেখে হ্যাল্লো ইয়াং ম্যান গুড মর্নিং!
গুড মর্নিং।
বুড়ো টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটা একটা করে বড় খাম বের করে তার ভিতরে থাকা ওদের টিকেট, ঢাকা এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন অফিসারকে লেখা চিঠি এবং আরও কিছু প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র বুঝিয়ে দিয়ে বলল এগুলি সব সাবধানে রাখবে। তোমরা এই প্রথম দেশের বাইরে যাচ্ছ সাবধানে থাকবে, ওয়েল ড্রেসে থাকবে। আর শোন মেয়েদের দিকে কিন্তু ভুলেও তাকাবে না বলে একটু হেসে দিল। কি, বুঝেছ?, অল ক্লিয়ার?
ইয়েস অল ক্লিয়ার।
ও কে, তাহলে কমপ্লিটলি রেডি হয়ে ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ নিয়ে কাল ঠিক দুপুর দুইটায় এখানে এসে ওই শিকদার সাহেবের সাথে দেখা করবে। উনি তোমাদেরকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবে।
হুট করেই শনিবার ফুরিয়ে গেল। রাতে নিশাতের চোখে ঘুম নেই। সারা রাত নিরু তার চোখের পাতা দিয়ে ধীর পায়ে কেমন একটা উদাস ছন্দে হেঁটে বেড়াল। গানের সুরে সুরে যেন কি কি বলেছে কিন্তু নিশাত তার কিছুই বুঝতে পারেনি শুধু কান পেতে দূর পাহাড়ের ঝর্ণাধারার তানের মত একটা সুর ওর কানে বেজেছে। মনে হচ্ছিল তুমি আমার তুমি আমার। চোখে ঘুমের কোন চিহ্ন নেই। সকালে হাবিব ডাকল
নিশাত উঠবি?
আমিতো উঠেই আছি।
উঠ, নাশতা করে সব গুছিয়ে নিই।

নিশাত উঠে হাত মুখ ধুয়ে খালার সাথে নাশতা খেয়ে হাবিবের সাথে এসে ব্যাগ থেকে সব কিছু বের করে আবার ভাজ করে কাপড় চোপর টুকি টাকি এটা সেটা সব গুছিয়ে সবার শেষে ক্রু ডিপার্টমেন্টের বুড়োর দেয়া প্যাকেট বের করে সিডিসি, আইডি কার্ড, টিকেট, চিঠি সব কিছু বুড়ো যে ভাবে বলে দিয়েছে সে ভাবে ভরে ব্যাগের পকেটে রেখে রেডি হয়েই বসে রইল। খালা আজ একটু তাড়াতাড়ি রান্না করে ওদের খাইয়ে দিলেন। বাসা থেকে একটায় বের হয়ে সময় মত অফিসে এসে পৌঁছে দেখে এনামুল আর সালেক মিয়া এখনো আসেনি। একটু অপেক্ষা করার পর ওরা এলো।
দুপুর তিনটা। সবাইকে নিয়ে অফিসের একটা বড় গাড়িতে শিকদার সাহেব চিটাগাং এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছালেন। এখানে ডমিস্টিক এয়ারপোর্ট তেমন কিছু দেখল না। শুধু টিকেট দেখে মালামাল চেক করে বোর্ডিং কার্ড দিয়ে দিল। শিকদার সাহেব সবার সাথে হ্যান্ড সেক করে বুড়োর মত মাগনা কিছু উপদেশ দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল আর ওরা প্লেনে উঠে বসল। একটু পরেই বিমান বালার ঘোষণা শুনে বুঝল প্লেন টেক অফ করতে যাচ্ছে। ঘোষণা শেষ হবার সাথে সাথেই প্রায় প্লেন রান ওয়ে দিয়ে ট্যাক্সিং করে এক সময় সো করে আকাশে উড়ে গেল। সামনে নিচে বঙ্গোপসাগর পরে রইল। নিশাত আর হাবিব মাত্র সেদিন পতেঙ্গা এসে এই সাগর দেখে গেছে।
[চলবে]

কোন পার্থক্য নেই

একসময় তোমাকে নিজের ছায়া মনে করতাম
তোমার চোখেই আমি নিজেকে দেখতে পেতাম
কখনোবা তোমার মাঝেই নিজেকেও হারাতাম
তোমার স্বপ্নগুলোকেও নিজের স্বপ্নই ভাবতাম ৷

কিন্তু !
প্রকৃতির মতো তুমিও নিজেকে বদলে ফেললে
আমিও হারিয়ে ফেললাম আমার ছায়াসঙ্গীকে
যে চোখে আমি হারিয়ে ফেলতাম এই নিজেকে
আজ সেই চোখ দেখি কামনার আগুন পুড়তে ৷

জানো ?
আমি নিজেই নিজেকে কখনো বিশ্বাস করিনি
তবুও কিন্তু তোমাকে বিশ্বাস করেছি ঢের বেশি
তোমার বিশ্বাসের মূল্য দিতে সঁপেছি নিজেকে
অথচ তুমি’ই দেখি অবিশ্বাসের খেলা খেললে ৷

সেই তুমি !
শরীরটাকে শেয়াল শকুনের মতো ছিঁড়ে খেলে
শুধু আমার ভালোবাসা-বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ,
বাদামের খোসার মতো খেয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলে
আর আমি আজ উচ্ছিষ্ট হয়ে ঘুরছি পথে পথে ৷

জানো ?
কোনো পার্থক্য নেই তোমার আর ধর্ষকের মাঝে
একজন ধর্ষক যা করতো তুমিওতো তাই করলে ,
তোমরা দু’জনেই আমার চোখে সমান আজকে
তুমি ভালোবেসে ধর্ষণ করো , ধর্ষক জোর করে ৷

ভালোবাসার পাখি……….

ভালোবাসার পাখি………

হে সুপ্রিয়
প্রেমের আকুতি দিয়ে
জয় করে নিয়েছো এই হৃদয়,
পৃথিবীটা যেন এক ফুলের বাগান
ভালোবাসার পাখি হয়ে গান গাইতে ইচ্ছে হয়,
বসন্তের প্রেম আমার
তোমাকে ছাড়া বেচে থাকা অসম্ভব !
ভালোবাসার জন্য আমরা
অনেক সয়েছি
এই বিরহের অবসান চাই
কেন এই যন্ত্রণা বিরহ এ দহন
তুমিহীনা প্রতিটা রাত যেন অমাবস্যার অন্ধকার…..

কুয়াশার ঝাঁপি খোলা রোদ

কুয়াশার ঝাঁপি খোলা রোদ

শাদা কাগুজে চিনি দধি মিশ্রিত কালোজাম
টকজল গন্ধ ওড়ে
মাছি ওড়ে, মানুষ ওড়ে…
পিঁপড়ার গুটি পা ক্যাশপ্যাট থেকে বাঁকা পথ ঘুরতে ঘুরতে
টিস্যুর মত পরিত্যক্তায় জমাট বাঁধে
দীর্ঘ ধূলির ভেতর গ্রাম ও শহর
সঞ্জীবিত সংযোগ, গল্পজোট, ধ্রুব পুরস্কার;

আজকের, ঘষামাজা সামাজিক তরুণের অভিমুখ
এক কাপ লাল চায়ের ফিরফিরে ফুঁ,
উষ্মতার ধোঁয়া, মন্থ পাঠের লোকালয়-
তীর্থঘোড়ার বেতাল ক্ষুরশব্দ, কুয়াশার ঝাঁপি খোলা রোদ
সৌমিত্র রঙের সকল গুমোটের খোলস ভাঙে।

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-১০

নিশাত বেরিয়ে যাবার পর নিরু ভাবতে বসল মানুষটকে কতদিন ধরে দেখছি কিন্তু কখনও এমন পাগলামি করেনি আজ কি হলো? কাল নোমান ভাই না জেনে অমন কথা বললই বা কি করে, একটু ইশারা ইঙ্গিতে রেখে ঢেকে বললেও পারত। যাক যা বলেছে বেশ করেছে তবুও যদি মানুষটার একটু বোধোদয় হয়। এমন পরিস্থিতিতে সবাই কি করে? আশেপাশে কাওকে এমন দেখছি না। কি করি এখন? কি করি? কতদিন ধরেইতো পথ চেয়ে রয়েছি এই বুঝি আজ কিছু বলবে বা কাল কিছু বলবে। কি ভাবছে সে? আমি বলব? কেন প্রথমে কি মেয়েরা বলে? একটু এগিয়ে এলে কি হতো? কিছু না বলে একেবারে হাত ধরে টেনে নিয়ে পাশে বসান? ঈশ বয়েই গেল! হুহ্! এতদিনে তার সময় হলো! ভেবেছিলাম ঢাকায় এলে মাঝে সাঝে দেখা হবে কিন্তু এ কি হলো? যাক যা হবার ভালই হয়েছে। আপনি তাড়াতাড়ি ফিরে আসুন। কতদিন পরে আসবে বলল, নয় মাস না? হ্যাঁ তাইতো! এই নয়টা মাস দেখতে পাব না!

দেখতে দেখতে দিন কেটে গেল। আজ রবি বার। সকাল থেকেই বাড়িতে একটা হুলস্থূল ভাব। বাবা আজ ছুটি নিয়েছেন। সকালে নাশতা করেই বাজারে গেলেন নিশাতের প্রিয় ইলিশ পোলাও রান্নার জন্য ইলিশ মাছের সন্ধানে। দুপুরে ইলিশ পোলাও রান্না করলেন মা। ভাই বোন সবাই এক সাথে খাবার সময় আলাপ হলো। বাবা স্টেশনে যাবেন, সাথে মেঝ ভাইও যাবে। তবে হাবিব সহ সবাই এক সাথে যাবে, ওদিকে হাবিবের সাথে ওর মা বোন আর বাবাও যাবে।

রাত আটটায় মাকে সালাম করে ভাই বোনদের কোলে নিয়ে বুকে নিয়ে আদর করে নিশাত বাবা আর মেঝ ভাইয়ের সাথে হেঁটে হাবিবদের বাড়িতে চলে এলো। এসে দেখে ওরা রেডি। হাবিবের বাবা মা বোন সহ সবাই স্টেশনে যাবে। প্রায় সাড়ে নয়টায় কমলা পুর স্টেশনে পৌঁছে সবাই এক জায়গায় দাঁড়ালো। নিশাত আর হাবিব টিকেট নিয়ে এসে সবাইকে নিয়ে প্লাটফর্মে ঢুকে দাঁড়িয়ে থাকা চিটাগাং মেইলের একটা বগিতে দেখে শুনে সীট নিয়ে কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে রেখে নেমে এলো। বাবা ভেজা চোখে কিছু উপদেশ দিলেন। নিশাত মনোযোগ দিয়ে শুনল। নিশাত আবার মেঝ ভাইকে কিছু উপদেশ দিল। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে গেছে, শেষ হুইসল দিয়ে দিয়েছে। প্লাটফর্মে আর দাঁড়াবার সময় নেই। উঠে সীটে বসে জানালা দিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে রইল। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। প্লাটফর্ম থেকে ওরা সবাই ওদের দিকে চেয়ে আছে। ট্রেন আস্তে আস্তে কমলাপুর ছেড়ে চিটাগাং এর দিকে যাচ্ছে। এক সময় ওরা সবাই চোখের আড়াল হয়ে গেল। পিছনে রেখে গেল নিরুর সাথে শেষ কথার এক টুকরা উষ্ণ স্মৃতি “দরকার হলে আমি সারা জীবন আপনার জন্য অপেক্ষা করব” এইতো আর কি চাই! তবুও মনের ভয় যেতে চায় না! যদি কিছু হয়ে যায়! অন্তত যুঁই অথবা বীণা আপাকে একটু ইঙ্গিত দিয়ে আসলে হতো না? নানা কথা এলোমেলো ভাবে আসছে যাচ্ছে। সারা পথে নিশাতের মুখে কোন কথা নেই। হাবিব বার বার জিজ্ঞেস করছে
কি রে তোর মন খারাপ লাগছে? এমন চুপ চাপ রয়েছিস কোন কথা বলছিস না!
কি বলব, যাচ্ছি তো।
আরে, বিদেশে যাচ্ছি কোথায় একটু আনন্দ উল্লাস করবি তা না মুখ কেমন করে রেখেছিস।
নিশাত মনে মনে বলল তুই জানিস না আমি কি ছেড়ে যাচ্ছি। আমিতো যাচ্ছি কিন্তু প্রাণ যে এখানে রয়ে গেল!

সকালে চট্টগ্রাম স্টেশনে পৌঁছে একটা রিকশা নিয়ে হাবিব মাদারবাড়ি ওর খালার বাড়িতে এলো। এখানে নিশাতকে কেউ চিনে না। হাবিব খালা খালু সবাইকে ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ওদের চট্টগ্রাম আসার উদ্দেশ্য জানাল। খালা খালু সবাই বেশ খুশি। হাত মুখ ধুয়ে আসার পর খালা তাড়াতাড়ি নাশতা এনে দিলেন। নাশতা খেয়ে আগ্রাবাদ জেমস ফিনলে অফিসে এসে ওদের নিয়োগ পত্র দেখালে বুড়ো ব্যাপ্টিস্টের টেবিল দেখিয়ে দিল। তার কাছে গিয়ে বলল আমরা এসেছি। বুড়ো কি এক ফাইল দেখছিল। ওদের দিকে তাকিয়ে বসতে বলল। একটু পরে ফাইল রেখে বলল
ইয়েস ইয়াং মেন্স হোয়াট কেন আই ডু?
ওরা আবার এই বুড়োকে নিয়োগ পত্র দেখাতে বুড়ো লাফ দিয়ে বলে উঠল
ওহ! ইউ আর হেয়ার, গুড! ভেরি গুড! তোমরা জান তোমরা কোথায় যাচ্ছ?
না।
তোমরা লাকি ইয়াং ম্যান, ডাইরেক্ট ব্রিটিশ জাহাজে যেতে পারছ, আপাতত লন্ডন যাবে, ওখান থেকে জাহাজে উঠবে।
কবে যেতে হবে?
দাড়াও, তোমাদের সিডিসি বানাতে হবে, টিকেট করতে হবে এমন আরও কিছু কাজ আছে সেগুলি হলে তখন বলতে পারব। মনে হয় ৩/৪ দিন লেগে যাবে। তোমরা রেডি হয়ে এসেছ?
হ্যাঁ, আমরা বাড়ি থেকে রেডি হয়েই এসেছি।
এখানে কোথায় থাকছ?
হাবিব বলল মাদারবাড়িতে আমার খালার বাড়ি।
দেখ, থাকার কোন অসুবিধা হলে সিম্যান হোস্টেলে থাকতে পার।
না কোন অসুবিধা নেই।
গুড।
তাহলে তোমাদের সাথে ছবি আনতে বলেছিলাম তা এনেছ?
হ্যাঁ এনেছি।
বলে ওরা দুই জনেই পকেট থেকে ছবি বের করে দিল।
না আমাকে সব গুলি দিতে হবে না একটা করে দিলেই হবে শুধু আইডি কার্ড বানাবার জন্য, অবশ্য আইডি কার্ড শিপিং অফিস থেকেও একটা দিবে, তোমদেরকে এখন শিপিং অফিসে পাঠাচ্ছি বাকিগুলি ওখানে লাগবে। আচ্ছা তোমরা একটু বস, আমি শিপিং অফিসের জন্য চিঠি রেডি করে নেই।
আচ্ছা ঠিক আছে।

বুড়ো পাশের এক জনকে ডেকে বলল এদের জন্য দুইটা চিঠি টাইপ করে নিয়ে আস।
আধা ঘণ্টার মধ্যে চিঠি নিয়ে এলে বুড়ো নিয়ে গেল তার বসের কাছে স্বাক্ষরের জন্য। একটু পরেই এসে দুই জনকে খামে ভরা দুইটা চিঠি দিয়ে বলে দিল রাস্তার ওপাশে যে সিজিও বিল্ডিং ওর চার তলায় শিপিং অফিস, তোমরা এই চিঠি নিয়ে ওখানে যাও। ওরা সিডিসি বানিয়ে দিবে।
সিডিসি কি?
পাসপোর্ট চেন?
হ্যাঁ চিনি।
এটাও ওই পাসপোর্টের মত, জাহাজে চাকরীর জন্য পাসপোর্টের পরিবর্তে সিডিসি ব্যবহার হয়। আচ্ছা যাও দেরি করো না তাড়াতাড়ি যাও।
ওরা দুই জনেই অফিস থেকে বের হয়ে ব্যাপ্টিস্টের কথা মত শিপিং অফিসে যেয়ে চিঠি দেবার পর ওরা কয়েকটা কাগজে সই স্বাক্ষর, টিপ, রেখে উচ্চতা ইত্যাদি মেপে বিকেল ৪টায় আসার জন্য বলে দিল। ওখান থেকে বের হয়ে আবার ব্যাপ্টিস্টকে জানাল। ঠিক আছে তোমরা বিকেলে ওটা নিয়ে তারপরে এসো। এর মধ্যে তোমাদের আর কিছু করার নেই।
ওখান থেকে বের হয়ে হাবিব বলল
চল, মামার বাড়ি যাই।
নিশাত চট্টগ্রামের কিছু চিনে না। হাবিবদের বাড়ি চট্টগ্রাম বলে ওর আত্মীয় স্বজনেরা অনেকেই এখানে।
চল।

হাবিবের মামা বাড়ি থেকে সরাসরি বিকেল ৪টার মধ্যে শিপিং অফিসে এসে হাজির। যার সঙ্গে কথা হয়েছিল সে একটা রেজিস্ট্রি বইতে স্বাক্ষর নিয়ে দুই জনকে সিডিসি আর আইডি কার্ড দিয়ে দিল। ওখান থেকে বের হয়ে আর কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে বই খুলে দেখছে এটা কি দিল। আইডি কার্ডে লেখা দেখল বাংলাদেশি নাবিকের পরিচয় পত্র। সিডিসি খুলে দেখে ওদের যাবতীয় বিবরণ লেখা সহ পাসপোর্টের মত একটা বই। ওই বই নিয়ে ব্যাপ্টিস্টের অফিসে এসে বুড়োর হাতে দিল। বুড়ো বলল ওকে মাই ডিয়ার, তোমরা এখন চলে যাও আমি কাল সকালে তোমাদের ফ্লাইট বুকিং করতে দিবো। এই যে এই ঠিকানা নিয়ে যাও এটা একটা টেইলরএর দোকান ওখানে গিয়ে এই চিঠি দিবে ওরা তোমাদের পোশাকের মাপ রাখবে। আগামী কাল বিকেলে এসে আর্টিক্যালে সই করবে আর ফ্লাইটের সময় জেনে পরে কি করতে হবে সে সব ওই যে শিকদার সাহেব বসে আছে তার কাছে জেনে যাবে, উনিই তোমাদের নিয়ে এয়ারপোর্টে যাবে।
নিশাত জিজ্ঞেস করল একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
কি কথা?
আমরা দুই জনে কি একই জাহাজে থাকব?
নো নো মাই ডিয়ার, তুমি যাবে লন্ডন আর ও যাবে দুবাই, তবে এখান থেকে তোমরা এক সাথে দুবাই পর্যন্ত যাবে। আরও দুই জন আছে তারাও তোমাদের সাথে যাবে।
ও দুবাই আর আমি লন্ডন কেন?
ওর জাহাজ দুবাইতে রয়েছে আর তোমার জাহাজ ডান্ডি থেকে সেইল করে লন্ডন আসছে মেরামত করার জন্য ওখানে পৌছাতে কয়েক দিন লাগবে, তাই তুমি লন্ডন যাবে। ভয় পেয়ো না ওখানে সব জায়গায় আমাদের এজেন্ট আছে তারাই তোমাদের দেখা শুনা করবে। এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করা থেকে হোটেলে থাকা এবং জাহাজে তুলে দেয়া পর্যন্ত সব তারা করবে। তোমাদের এ নিয়ে কিচ্ছু ভাবতে হবে না। আর কিছু?
না ঠিক আছে, কিন্তু আমাদের যোগাযোগ হবে না?
হ্যাঁ তা হবে যদি কখনো তোমাদের জাহাজ এক পোর্টে আসে তখন দেখা হবে না হলে কাছাকাছি থাকলেও ভিএইচএফে কথা বলতে পারবে।
তা হলে এখন যাও ডার্লিং এর সাথে দেখা করগে। আগামী কাল বিকেল ৪টার মধ্যে চলে এসো। মনে থাকে যেন।
হ্যাঁ মনে থাকবে।
[চলবে]

বন্ধুর চেয়ে একটু খানি বেশি

বন্ধুর চেয়ে একটু খানি বেশি

নীরব নিশুতি রাতের চোখে স্বপ্ন নীড় বাঁধা
মেঘের আঁচল শুভ্র জ‍্যোৎস্নায় ঢাকা
আমি তোমার জন্য হলুদ গোলাপ রেখেছি
তুমি বন্ধুর চেয়ে একটু খানি বেশি,
তোমার জন্য কবি হতে চেয়েছি
প্রেমিকা হতে পারিনি :
অথচ সে সত‍্য কথা
আজ ও তুমি মাননি !

আমি গোলাপ হতে চেয়েছি, শিশির স্বপ্ন ছুঁয়ে থাকব বলে
আমি থোকা থোকা হাসনাহেনা হয়ে ফুটেছি
শিশির স্বপ্ন মাখবো বলে ,
শেষ বিকেলে বকুল হয়ে ঝরেছি
শিশির কষ্ট স্পর্শ করব বলে….
সবুজ ঘাসে,
মাঠে-ঘাটে ধানের শীষে
সবুজ পাতায় শিশির উত্তাপ ভালোলাগে ।

নিঃশব্দে সবুজ অরণ্য শিশির নিঃশ্বাস ছুঁয়ে আছে
সোনালী ভোরের ডানাকাটা ঠোঁটে টুপটাপ
শিশির শব্দে —
রূপ কথার গল্প জমে ওঠে..
অন‍্য রকম এক পৃথিবীর বুকে:

আমি কামিনী হয়ে শিশির বুকে
থাকতে পারি —
আমি বেলী, গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা,কেয়া কদম
হয়ে ফুটতে পারি
শিশির শব্দে হারাবো বলে !

তুমি বন্ধু আমার একটু খানি বেশি,
তুমি প্রেমিক হতে চেয়োও না
যে কথা সত্য নয় —
আমি মানি না ।

07.02.2019

লেখালিখি নিয়ে ৩টা পর্যবেক্ষণ/মোটিভেশনাল স্পিচ

১.
লেখালিখি মোটেও কঠিন কাজ নয়। যার অক্ষরজ্ঞান আছে সে’ই লেখালেখি করতে পারেন। কারণ, মানুষ মাত্রই পরস্পর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে, গল্প বলে, ঘটনা বলে, এমন কি প্রতিটি মানুষই নিজের সাথে কথা বলে- এগুলোই লিখুন। নিজে লিখুন, নিজের মত করে লিখুন।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে- লেখালিখিকে তবে কঠিন কাজ বলা হয় কেনো। এই উত্তর দেবার আগে একটা উদাহরণ দেই- ছোটোবেলায় আপনার যে বন্ধুটি বাই সাইকেল চালিয়ে ভাব নিতো, সেও বলতো বাইসাইকেল চালানো সহজ, কিন্তু ব্যালেন্স রাখা কঠিন। অর্থাৎ ঘুরিয়ে বলা যে, বাইসাইকেল চালানো সহজ কম্ম নয়। মনে করে দেখুন, প্রথম যেদিন কাঁপা কাঁপা হাতে সাইকেলের হ্যাণ্ডেল ধরেছেন ওইদিন প্রথম দুই চক্কর খুব ভয় লেগেছে, তৃতীয় চক্কর থেকে ভয় কেটেছে আর পঞ্চম চক্করে গিয়ে তো মনে মনে বলেছেন- এটা এতো সোজা! লেখালিখির বিষয়টাও ঠিক তাই- প্রথমে ক’পাতা লিখুন, এরপর নিজেই বুঝবেন লেখালেখি কতটা সহজ।

কথা শুনে মুচকি মুচকি হাসছেন, আর মনে মনে বলছেন- ‘ওরে গর্দভ মোটিভেশনওয়ালা, লেখালিখি যদি এতোই সহজ হোতো তবে লেখকরা এমন ভাব নেয় কেনো যে লেখালিখি খুব কঠিন।’ খুবই সহজ উত্তর, পেশার ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী বাড়ানো মোটেও কাজের কথা নয়, ‘কে হায় টিপস বলে নিজের পেটে লাথি কষানোর সুযোগে দানে ভালোবাসে!

এবার খুব বিজ্ঞের মত কেউ কেউ প্রশ্ন করবেন- ‘লেখালিখি যদি এতোই সহজ তবে তবে ঘরে ঘরে রবীন্দ্রনাথ নেই কেনো! প্রতিটা পরিবারে পারিবারিক নজরুল নেই কেনো!’ বিনয়ের সাথেই বলছি- এটি ভুল প্রশ্ন, ভুল উদাহরণ। প্রথমত, রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন তার নিজের লেখা, আপনাকে লিখতে হবে আপনার নিজের লেখাগুলো। দ্বিতীয়ত, ঘরে ঘরে লেখক জন্মানোর মূল বাঁধা হচ্ছে ‘লেখালিখি কঠিন কাজ’ এই মানসিকতা।

এই পর্যন্ত যেহেতু পড়েছেন সেহেতু নিচের টুকুও পড়ুন, কাজে দিবে-

১. খোদ বিশ্বকাপ ফুটবলে কয়েক শো ফুটবলার খেলেন, কিন্তু ফোকাস থাকে বড়জোড় বিশ পঁচিশ জনের ওপর। এর মানে কিন্তু বাকীরা ফেলনা নন। লেখক হিসেবে বিশেষ হয়ে উঠতে হলেও একটু বাড়তি সময় দিতে হবে, ভাবতে হবে, পড়তে হবে, এবং সবথেকে বড় বিষয় হোলো- প্রশ্ন করতে হবে, তুলতে হবে।

২. যে বিষয়ে লিখবেন সে বিষয়ে বাস্তব জ্ঞান যতটা বেশী পারা যায় ততটা অর্জন করুন, অভিজ্ঞতা নিন। তারপর লিখুন। ড্রইং রুমে বসে বিপ্লবের গল্পটা লেখা যায়, অনেকেই লিখেন। কিন্তু যে মিছিলে ছিলো, আন্দোলনে নির্যাতনের শিকার হয়েছে সে যখন বিপ্লবের গল্পটা ড্রইং রুমে বসে লিখবে, তাতে রাজপথের উত্তাল ঘ্রাণ পাওয়া যাবে। আর দশটা গল্প থেকে তা বিশেষ হয়ে উঠবে।

৩. লেখক হবার জন্য এবং লেখার জন্য- এ দুটো ক্ষেত্রেই লেখকের দরকার নিজের সাথে কথা বলার অভ্যেস গড়ে তোলা। প্রতিদিন নিজের সাথে কথা বলুন, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বলুন। নিজেকে সময় দিন।

শেষে একটা অনুরোধ, আমার মত অধম এই কথাগুলো বলছে বলে যদি মানতে দ্বিধা জাগে, তবে ভাববেন- এ কথা মার্ক টোয়াইন বলে গেছেন, অথবা শেক্সপিয়ার বা রবীন্দ্রনাথ। এতেও সংকোচ লাগলে ভাবুন না হয় এ জবানী (জাওয়ানি নয়) সবিতা ভাবির।

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-৯

নিরু ঝিটকা স্কুল থেকে পাশ করে বের হলো। এখন ধানমন্ডিতে বড় বোনের কাছে থেকে লালমাটিয়া কলেজে পড়বে। বাড়ি থেকে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। নিরুর বাবা, বড় বোন আর নিশাতের দাদি আর মা একসাথে ঢাকা আসছিল। গাড়িতে নিরুর চোখের দিকে তাকিয়ে অনেকদিন পরে এই প্রথম নিশাত একটু অবাক হলো। এইতো এই চোখ আমি খুঁজছিলাম এতদিন! নিরু বড় হবার পর এত কাছে থেকে নিরুকে দেখার সুযোগ হয়নি এতদিনেও। আজ কাছে পেয়ে নিরুর চোখের দিকে তাকিয়ে অবাক হলো। এতদিন এই চোখ কোথায় ছিল? যে চোখে প্রশান্ত মহা সাগরের গভীরতা! যে চোখের দিকে তাকিয়ে থেকেই কাটিয়ে দেয়া যায় সারাটা জীবন! অবাক হয়ে চেয়ে ছিল পলক হীন। মানুষের অবস্থার পরিবর্তনের সাথে মানুষের ঋতু পরিবর্তনের সাথে তার মনের অনেক পরিবর্তন হয়। নিশাত এতদিন যেমন ছিল আজ আর তেমনটি নেই। আজ সে চাকরী নিয়ে লন্ডনের যাত্রী। নিরুকে এতদিন মনে মনে ভাল লাগলেও তা কেমন করে যেন কিসে চাপা পড়ে ছিল কিন্তু আজ সে লন্ডনের যাত্রী বলে তার দৃষ্টি ভঙ্গি বদলে গেছে। সে নিরুর চোখের চাওনি বা চোখের গভীরতা নিরূপণ করতে পারছে। মানিকগঞ্জে এসে গাড়ি থামিয়ে কিছু খাবার আর বীণা আপার ছোট বাচ্চার জন্য কি যেন কিনতে হবে বলে বীণা আপা গাড়ি থামতে বলল। নিশাতের মা নিশাতকে পাঠাল, বীণা আপাও বলল নিরু তুই যা ওর সাথে ও চিনতে পারবে না। এমন কি আনবে যে নিশাত চিনে আনতে পারবে না! যে কিনা মাত্র কয়েকদিন পরে একা একা লন্ডন যাচ্ছে সেই ছেলে আনতে পারবে না? নিশাতও নিষেধ করল না। সাথে নিরু আসছে বলে কোন প্রতিবাদ করেনি। নবীন সিনেমা হলের পাশে গাড়ি দাঁড়িয়েছিল আর গাড়ির সবাই নেমে একটু হাত পায়ের জড়তা ছাড়াচ্ছিল। ওরা রাস্তা পার হয়ে গড়পাড়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের কাছে যেতেই একটা মোটর সাইকেল হুট করে নিশাতের পাশে এসে ব্রেক করল। আরোহী পিছন থেকে নিশাতের কাঁধে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে জিজ্ঞেস করল
এই বাঙালি, কোথায় যাচ্ছিস?
নিশাত দাঁড়িয়ে পড়ল, নিশাতকে দেখে নিরুও দাঁড়াল। নিরুকে দেখে মটর বাইকের আরোহী নোমান বলল
কিরে তুই বিয়ে করলি কবে?
বিয়ে! কি বলছিস?
ফিসফিস করে বলল তাহলে এ কে?
এই চুপ! আস্তে করে বলল, সর্বনাশ করে ফেলেছিস! এ হলো শিহাবের ছোট বোন নিরু, ও লালমাটিয়া কলেজে ভর্তি হবার জন্য ঢাকা যাচ্ছে, ঐযে গাড়িতে সবাই আছে, আমরা কিছু কেনার জন্য নেমেছি
নোমান ভীষণ লজ্জা পেয়ে বলল সরি দোস্ত, কিছু মনে করিস না
না কি মনে করব! মনে মনে ভাবল তোর কথা যেন সত্যি হয়!
নোমানকে দেখিয়ে বলল নিরু এ আমাদের বন্ধু নোমান, শিহাব চেনে
নিরু নোমানকে সালাম দিয়ে বলল ভাই আপনার বাড়ি গোপীনাথপুর না?
হ্যাঁ, তুমি আমাকে চেন?
খুব ভাল করেই চিনি, আপনি ঊর্মির ভাই না? আমি ঊর্মির সাথেই পড়েছি, ও কোথায় ভর্তি হবে ভাইয়া?
ও এখানেই দেবেন্দ্র কলেজে ভর্তি হয়েছে
ও আচ্ছা, আমার কথা বলবেন, আমি ঢাকা যাচ্ছি, বড় আপার কাছে থাকব
নিশাতের লন্ডন যাবার ঘটনা নিয়ে নোমান আরও কিছু আলাপ করে নিশাতের লন্ডন যাত্রা আর জাহাজে চাকরীর কথা জেনে খুশী হয়ে বিদায় নিল।
নোমানকে বিদায় দিয়ে নিশাত বলল শুনেছ ও কি বলেছে?
নিরুর মুখ লাল হয়ে গেল, মাথা নিচু করে দাড়িয়েই রইল
মনে মনে ভাবল এ আবার কেমন মানুষ! এমন কথা কাউকে বলা যায়? না জেনে সে না হয় ভুল করেই ফেলেছ তাই বলে…………।
আচ্ছা দাড়াতে হবে না চলো
এইতো নোমানের এই কথায় মনে হয় এতদিনে ওরা দুই জনে মন দেয়া নেয়ার চিরাচরিত মহান কাজটা ওদের অজান্তে একান্ত নীরবে সেরেই ফেলল তবে নিরু এখনও বুঝতে পেরেছে কি না সে একটা সংশয় হয়ে রইল। সেদিন একটা বেকারিতে খাবার কিনতে কিনতে নিরুই প্রথম কথা বলল,
তাহলে আপনি লন্ডন চলে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ
আবার কবে ফিরবেন?
নয় মাস পরে, ফিরে আসলে আমাকে চিনতে পারবে?
পারব, আপনাকে এত দিন ধরে চিনি, এই কয় দিনেই ভুলে যাব? কি যে বলেন না!
আর সাধারণ কিছু টুকিটাকি কথাবার্তা হয়েছিল। সেদিন বেশি কিছু বলার সময় পায়নি বা সুযোগও হয়নি। সময় পেয়েছিল ঢাকায় যাবার পরে।

৫।
ঢাকায় পৌঁছে নিশাতদের বাড়ির পাশে ওদের নামিয়ে দিয়ে বীণা আপা নিরু আর চাচাকে নিয়ে চলে গেল। রাস্তায় চাচা নানা কথা জিজ্ঞেস করছিল কি চাকরী কেমন করে কোথায় থাকবে ইত্যাদি নানা কিছু। চাচা বেশ খুশি হয়েই বলেছিল যাক বাবা আমাদের গ্রামের মধ্যে তুমিই প্রথম লন্ডন যাচ্ছ কাজেই বাবার মান সম্মানের দিকে খেয়াল রেখো। ও ছোট বেলা থেকেই অনেক কষ্টে বড় হয়েছে, বাবা মায়ের সুখ শান্তির দিকেও লক্ষ রেখ।

বাড়িতে পৌছার একটু পরেই হাবিব এলো।
কিরে তোকে এমন চিন্তিত মনে হচ্ছে না কি ভুল দেখছি?
না চিন্তার কি আছে, কিছু চিন্তা করছি না। বল তোর কি অবস্থা, সব কিছু গুছিয়েছিস?
হ্যাঁ আমার মোটা মুটি কমপ্লিট, তোর কত দূর?
এই তো পরশু দর্জির কাছে কাপড়ের মাপ দিয়ে গ্রামে গিয়েছিলাম। দাদুর সাথে দেখা করে তাকে নিয়ে এইমাত্র আসলাম তবে এবার গ্রামে যেয়ে…………
এই পর্যন্ত বলেই থেমে গেল, মুখে আর কোন সারা নেই।
কি, গ্রামে যেয়ে কি?
না কিছু না।
না, কিছু একটা আছে তুই বলতে গিয়েও থেমে গেলি কেন?
না হাবিব কিছু না। আচ্ছা, তুই কবিতার সাথে দেখা করেছিস?
ও! বুঝেছি, তোরও এমন কেউ আছে, এত দিন কিছু বলিসনি কেন?
আমি কি বলি আর তুই কি বলিস?
হ্যাঁ গত কাল দেখা হয়েছে, কিন্তু তোর কথা কি বল।
নারে আমার তেমন কোন কিছু নেই।
আলাপ আর তেমন এগোয়নি। মা এসে গেল।
কি হাবিব, তোমার কি অবস্থা, সব কিছু গুছিয়েছ?
হ্যাঁ খালাম্মা।

সামনে আর মাত্র দুএক দিন বাকি। বাড়িতে ছোট ভাই বোনেরা আনন্দে বিভোর। দাদা বিদেশে যাবে। মা এটা সেটা যা নিশাতের পছন্দ তাই রান্না করছেন। সূর্য তার নিয়ম মত ডুবছে উঠছে। নিশাতের মনের বিষণ্ণ ভাব যাচ্ছে না। মা দেখে ভাবলেন কোন দিন বাড়ির বাইরে থাকেনি এখন হয়ত সবাইকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে বলে মন খারাপ তাই এক দিন সন্ধ্যায় নিশাতকে ডেকে বোঝালেন।
কি করবে বাবা যে বয়সে আর দশটা ছেলে বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করে সেই বয়সে তোমাকে রুজির সন্ধানে দেশের বাইরে যেতে হচ্ছে বলে মন খারাপ করে থেকো না। ওখানে গিয়ে আমাদের জন্য চিন্তা করবে না। মন দিয়ে কাজ করবে, সবার সাথে মিলে মিশে থাকার চেষ্টা করবে,
ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এ সব কথা নিশাতের কানে কিছু ঢুকছে আর বেশির ভাগই পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। মা জানে না নিশাতের কিসের ভাবনা।

পরদিন বিকেলে বীণা আপার বাড়িতে এলো। যাবার আগে দেখা করে যাবার উছিলায়। নোমানের ওই কথা বারবার মনে পরছে। আবার নিরু কি ভাবল জানা হলো না। কলিং বেল বাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, নিরুই দরজা খুলে দিয়েছিল।
আপনি!
হ্যাঁ আমি! চাচা কোথায়?
আমাকে ভর্তি করে দিয়ে তখনই বাবা বাড়ি চলে গেছে
ও আচ্ছ তুমি তাহলে ভর্তি হয়েছ?
হ্যাঁ
সেদিন, এত দিন পরে নিরুর সাথে দেখা হলো কিন্তু তেমন কিছুই আলাপ হলো না। নোমানের ওই কথার পর থেকেই মনে হতে শুরু করেছে যেন নিরু এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। চোখে মুখে কোন এক অচেনা মায়াবী ছাপ পড়েছে দেখতে আরও সুন্দর হয়েছে। এত দিনের চেনা সেই নিরু আর নেই এখন নিরুর চোখ কথা বলতে শিখেছে। চোখে ফুটে উঠেছে প্রশান্ত মহাসাগরের অতল গভীরতার ছায়া। এত দিনের নিরু আর আজকের নিরুর মধ্যে অনেক তফাত। আজকের নিরু পরিপূর্ণ এক নারী। তার স্বত্বায় জেগে উঠেছে নারী হৃদয়ের মমতা, প্রেম। এই নিরু কি নিশাতের জন্য অপেক্ষা করবে?
কি হলো! ভিতরে যেতে দিবে না? বলেই ঘরে ঢুকে নিরুর হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে সোফায় বসল। ভিতর থেকে বীণা আপা জিজ্ঞেস করল কে রে নিরু? অপ্রত্যাশিত প্রথম স্পর্শের ঘোর কাটিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে ভিতরে যেতে যেতে বলেছিল আপা নিশাত ভাই। মেয়েদের যে ষষ্ট ইন্দ্রিয় থাকে তাই দিয়ে অনুভব করে মনে মনে ভাবছিল হঠাৎ করে এই মানুষ এমন হলো কেন? তবে যাই হোক, এই আকর্ষণে কোন ইতর ইঙ্গিত নেই, কোন লালসা নেই, বরঞ্চ একটু কেমন যেন নির্ভরতার ছোঁয়া আছে। দেখা যাক সামনে কি হয়!
ওকে ভিতরে নিয়ে আয়
বসার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে পিছনে ঘুরে ইশারায় বলল আপা ডাকছে
নিশাত উঠে ওর পিছে পিছে আপার সামনে হাজির হলো। আমি কাল চিটাগাং চলে যাচ্ছি ওখান থেকে কয়েকদিনের মধ্যে চলে যাব হয়ত ঢাকায় আসা নাও হতে পারে আপা, দুলাভাই কোথায়? তোর দুলাভাই এখনও আসেনি
নিরু পাশেই ছিল, সব শুনল।
তাহলে আমি ওই ঘরে বসি?
যা বয় আমি আসছি
নিরু, ওকে চা নাস্তা দে। একটু পরে কাঁপা হাতে ভীত সন্ত্রস্ত পায়ে নিরু যখন ট্রে নিয়ে বসার ঘরে এলো তখন নিরুর হাত কাপতে দেখে নিশাত উঠে ট্রেটা নামিয়ে নিচ্ছিল কিন্তু নিরু ফিরে যাবার জন্য ঘুরে দাড়াতেই অন্য হাতে ওকে টেনে দাড় করিয়ে হাতের ট্রে নামিয়ে আবার ওকে নিয়ে পাশে বসল।
পালাচ্ছিলে কেন? কাল নোমান কি বলেছিল শুননি?
আমার ভয় করছে, ছেড়ে দেন আপা দেখে ফেলবে
নিরুর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় এবার মোটামুটি নিশ্চিত হলো এই আকর্ষণে নিরাপত্তার অভাব নেই, নির্ভরযোগ্য। এতদিন যার অপেক্ষা করেছে এ সেই হাত।
আপা দেখল তো কি হলো? আপারও এমন দিন গেছে, সে জানে
আজই এর একটা সমাধানে পৌছাতে হবে! এ ঘরে নিরুকে একা পেয়ে নিশাত জোর করে পাশে বসিয়ে সেই কথা কানে কানে বলছে। নিরু কি ভাবছে সে কথা বোঝার মত ধৈর্য বা জ্ঞ্যান কোনটাই নিশাতের ছিল না। নিশাতের হাতে বাধা পড়ে নিরু শুধু ভাবছিল এই মানুষটা হঠাৎ করে এমন পাগল হয়ে গেল কেন? যাকে সেই ছোট বেলা দেখে আসছি সেতো কোনদিন এমন ছিল না! শান্ত সৌম্য সহজ সরল একজন সুপুরুষ কিন্তু আজ কি হলো? কাল চলে যাচ্ছে বলে? যতক্ষণ নিশাত নিরুর হাত ধরে রেখেছিল ততক্ষণ বারবার উঠি উঠি করছিল।
আহ! ছাড়ুনতো! আপা এসে দেখে ফেলবে!
না, তুমি বল তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না!
ছাড়ুন না! আপা দেখে ফেললে কি হবে ভেবেছেন?
কিচ্ছু হবে না তুমি বল তুমি অপেক্ষা করবে!
ছাড়া পাবার জন্য মুখে যা আসে নিরু তাই বলে ফেলল,
দরকার হলে সারা জীবন আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব! এবার ছাড়ুন!
আস্বস্ত হয়ে নিশাত এবার নিরুকে ছেড়ে দিল। কোন রকম নিজেকে ছাড়িয়ে নিরু বলল
আজ কি হয়েছে আপনার, এমন ডাকাতের মত করলেন কেন? অমনিই পিছনে আপার পায়ের শব্দ পেয়ে পিছনে ফিরে দেখে আপা পর্দা সরিয়ে ভিতরে আসছে।
আপা, দুলাভাইয়ের আসতে দেরি হবে আমার আবার অনেক জায়গায় যেতে হবে আমি বরং উঠি আপনি দুলাভাইকে বলবেন আমার জন্য দোয়া করতে।
আর একটু বসে দেখ
দুলাভাইকে বলা তেমন জরুরী না। নিশাতের যা জানার তা জেনে ফেলেছে কাজেই
না আপা, আমাকে অনেক জায়গায় যেতে হবে, বলেই উঠে পরল।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-৮

খালাম্মা আমি বাড়ি যাই, হাবিব এলে আমাদের বাড়ি যেতে বলবেন
বিকেলে হাবিব এলো। দুই বন্ধু একে অপরকে জড়িয়ে কোলাকুলি করে বলল
আমি সাতার জানি না বলে মা রাজী হচ্ছে না। দেখ তুই একটু বুঝিয়ে দেখ কোন লাভ হয় না কি। তারপর রাতে
আব্বার সাথে কথা বলে দিন ঠিক করতে হবে তুইও খালুর সাথে আলাপ করে কি বলে কাল সকালে এসে জানাবি।
আচ্ছা আমি খালাম্মাকে বুঝাই। দেখি কি বলে।
একটু পরে হাবিব এসে জানাল না রে নিশাত খালাম্মা রাজী হচ্ছে না।
আচ্ছা আব্বা আসুক দেখি সে কি বলে। তুইও দেখ খালু কি বলে। কাল আবার আসবি।

কাল সকালেই হাবিব এসে হাজির।
কিরে খালু কি বলল, খালু কি খুশি হয়েছে?
হ্যাঁ আব্বা আম্মা সবাই খুব খুশি, তোর খবর কি?
মা রাজী হচ্ছিল না আব্বা বুঝিয়ে কোন রকম রাজী করিয়েছে তবে আব্বা খুশি হলেও চিটাগাং গিয়ে কোথায় থাকব সেই চিন্তা করছে।
এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই আমি আমার খালার বাড়ি থাকব, তুইও আমার সাথে থাকবি। তাহলে কবে যাবি ভাবছিস?
কিছু গোছ গাছ করতে হবে তা ছাড়া আব্বা কবে চিটাগাং যাবার ভাড়া যোগার করতে পারে তা ঠিক দেখে নিই আগে। আমার বাবার তো তোর বাবার মত অবস্থা না, তাকে একটু চেষ্টা করতে হবে। তবে আমার মনে হয় মোটা মুটি আগামী রোববারের মেইল ধরে গেলেই হবে। তোর কি মনে হয়?
হ্যাঁ আমিও তাই ভাবছি।
তা হলে দেখি আজ আব্বার সাথে একটা ফাইনাল ডিসিশন নিতে হবে, কি বলে না বলে আমি কাল তোকে জানাব।
ঠিক আছে তা হলে আমি এখন আসি।

সেদিন রাতে খাবার পর বাবা নিজেই জিজ্ঞেস করলেন। কবে গেলে সুবিধা হবে।
ওরা আগামী ২৩ তারিখের মধ্যে যেতে বলেছে কিন্তু আমার মনে হয় একটু আগে যেতে পারলেই ভালো। তাই ভাবছি আগামী ২১ তারিখে রবিবারের রাতের মেইলে যেতে পারলে হয়। হাবিব বলল ও ওর খালার বাড়ি থাকবে আমিও ওখানে ওর সাথে থাকতে পারব।
তা হলে ঠিক আছে তাই কর, দেখি এর মধ্যেই টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
নিশাতের মা বলল
যাবি যখন তোর মেঝ মামার সাথে দেখা করে বলে আয় দেখ ও কি বলে।
তাহলে সকালেই যাই?
যেতে চাইলে যা।
মায়ের মুখে কথাটা শুনে নিরুর কথা মনে হলো। নিরুর সাথে দেখা করতে হলে গ্রামে যেতে হবে কিন্তু গ্রামে যাবার সুযোগ একমাত্র দাদুর সাথে দেখা করা। এছাড়া গ্রামে যাবার কোন অজুহাত নেই!
আম্মা, গ্রামে যেয়ে দাদুর সাথে দেখা করব না?
হ্যাঁ অবশ্যই করবি। চল কাল যেয়ে আম্মার সাথে দেখা করিয়ে নিয়ে আসি!
হ্যাঁ আম্মা তাই ভাল হবে
সকালে উঠে নিশাত কাপড় বদলে মতিঝিলে মামার অফিসে চলে গেল। মামা অফিসে কি একটা জরুরী মিটিঙে ব্যস্ত।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর মামা এসে নিশাতকে দেখেই জিজ্ঞেস করল
কি রে, কি ব্যাপার এখানে এসেছিস?
মামা একটা ভালো সংবাদ আছে তাই মা বলল তোর মামার সাথে আলাপ করে আয়, তাই এলাম।
কি খবর?
আমি আর আমার বন্ধু হাবিব বিদেশের জাহাজে চাকরী পেয়েছি।
বাহ! বেশ ভালো কথা, তা দুলাভাই আপা কি বলে?
নিশাত এক এক করে সব বলল আর সাথে করে আনা নিয়োগ পত্রটা দেখাল।
মামা নিয়োগ পত্র পড়ে খুব খুশি। চিন্তা করিস না, তোর লেখা পড়া হলো না বলে মন খারাপ করিস না। এখানেও এক দিন জাহাজের ক্যাপ্টেন হতে পারলে অনেক দাম, অনেক বেতন পাবি। আমার বন্ধু আনিসকে মনে আছে? ও কিন্তু জাহাজের ক্যাপ্টেন। তা কবে যাবি ঠিক করেছিস?
হ্যাঁ, সামনের রবিবার রাতের মেইলে।
কেনা কাটা করেছিস কিছু?
না, কি কিনব, চিটাগাং যাবার টাকা দিতেই আব্বার অবস্থা কাহিল। থাক ওখানে যেয়ে বেতন টেতন পেয়ে যা লাগে কিনে নিবো।
বোকা ছেলে একটা দেশ থেকে বিদেশে যাবি এই ফকিরনির হালে যাবি নাকি? অন্তত কিছু কাপড় চোপর বানিয়ে নে। কি গায়ে দিয়ে যাবি?
বলেই মামা পকেট থেকে মানি ব্যাগ বের করে একশ টাকার দশটা নোট নিশাতের হাতে দিয়ে বলল
যা যা লাগে কিনে নিবি, কোন কিপ্টেমি করবি না। তুই এখন আন্তর্জাতিক পথে পা ফেলতে যাচ্ছিস কাজেই সেই ভাবে চলাফেরা করবি। যাবার আগে তোর মামির সাথে দেখা করে যাবি।
আচ্ছা মামা। হ্যাঁ মামির সাথে দেখা না করে কি যাব না কি, শুক্রবারে বাসায় যাব। সবার সাথেই দেখা করে যেতে হবে। তা হলে আমি আসি এখন?
কিছু খেয়ে যা।
না, বাসায় গিয়েই খাব।
দেখিস টাকা গুলি সাবধানে নিবি।
আচ্ছা মামা।

টকাটা পকেটে রেখে মামাকে সালাম করে অফিস থেকে বের হয়ে এসে নিশাতের মনে আনন্দের আর সীমা নেই। এক হাজার টাকা! নিশাত ভাবতেই পারছে না। এই এত টাকা ও কোথায় খরচ করবে? থাক বাবার কাছ থেকে তা হলে আর ওই টাকা নেয়ার দরকার নেই। মামা যা দিয়েছে এতেই চলে যাবে। সোজা বাসায় এসেই মাকে আনন্দ সংবাদটা জানাল। মা মামা আমাকে কেনা কাটা করার জন্য এক হাজার টাকা দিয়ে ফকিরনির মত বিদেশে যেতে নিষেধ করে দিয়েছে। ভালো জামা কাপড় বানিয়ে নিতে বলেছে।
তুই হলি ওর প্রিয় ভাগ্নে তোকে তো দিবেই। যাক বাবা ভালো হয়েছে, তাহলে ওখান থেকে আসার পথে গুলিস্তান থেকে সার্ট প্যান্টের কাপর কিনে নিয়ে আসলেই পারতি। এক কাজ কর কিছু খেয়ে আবার যা, কাপড় নিয়ে আয় আর তোর তো জুতাও নেই এক জোড়া জুতাও নিয়ে আসবি।
আচ্ছা মা আমি হাবিবকে নিয়ে যাই।
হাবিবকে নিয়ে গুলিস্তান গিয়ে দুইটা সার্ট, দুইটা প্যান্টের কাপড়, একটা ব্যাগ, গেঞ্জি আরও কিছু টুকি টাকি যা মনে পড়ল সে সব কিনে বাটার দোকান থেকে দেখে এক জোড়া জুতা, কিনে বাসায় চলে এলো। পর দিন সকালে মাকে নিয়ে বের হলো। কল্যাণপুরে দর্জির দোকানে আর্জেন্ট ডেলিভারি দেয়ার কথা বলে মাপ দিয়ে মায়ের সাথে গাবতলি গিয়ে ঢাকা আরিচা রুটের বাসে বানিয়া জুরি নেমে গ্রামে চলে গেল।

নিশাত জানে না তার ভাগ্য তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। হায়রে মানুষ তুমি জান না আজকে যে পাহাড় সমান সম্পদ পেয়ে তুমি আনন্দে আত্মহারা হয়েছ কালই সামান্য একটা ইঁদুর তার কত বড় ক্ষতি করতে পারে। কিংবা আজ তোমার সামান্য একটা পয়সা না থাকায় দুঃখে মন ভারাক্রান্ত হয়ে রয়েছে হয়ত কাল তোমার পকেটে দেখবে সহস্র মুদ্রার ঝলকানি। সবই সেই অদৃশ্য শক্তির কারুকাজ।

গ্রামে এসে প্রথমে নিজেদের বাড়িতে না ঢুকে পথের পাশে শিহাব যুঁইদের বাড়িতে গেল। যাবার সময় মাকে বলে গেল আপনি বাড়ি যান আমি আসছি।
কিরে নিশাত কবে এসেছিস?
এইতো আসছি।
কি খবর বল
শুনেছিস, আমি লন্ডন যাচ্ছি!
শুনে যুঁই আর শিহাব এক সাথে বলে উঠল, কি বললি
হ্যাঁ যা বলেছি সঠিক বলেছি
কবে যাবি?
এইতো এখান থেকে ফিরে রবিবারে চিটাগাং যাব ওখান থেকে দিন তারিখ ঠিক হলেই চলে যাব। এখানে এসেছি তোদের সাথে দেখা করতে।
ওমনিই যুঁই বলল, ঈশ তোর বৌয়ের সাথে দেখা করে যাবি না? ও তো ঢাকা যাবে লালমাটিয়া কলেজে ভর্তি হবে।
কথাটা শুনেই আনন্দ আর লজ্জায় নিশাতের মুখ লাল হয়ে গেল। কিছুক্ষণ কোন কথা বের হলো না। তাহলে? তাহলে কি নিরুকে না দেখেই চলে যেতে হবে? কোন কুল কিনারা পাচ্ছে না। একটু সময় থেমে পরিস্থিতি বুঝে আস্তে করে জিজ্ঞেস করল নিরু কোথায়?
কেন নিরুর কি দরকার? বৌকে দেখে না গেলে হবে না? ওতো মামার বাড়ি গেছে। আজই আসার কথা। বীণা এসেছে দুই তিন দিন হলো, ওকে নিয়ে যাবে। বীণা সহ ওদের মামা বাড়ি গেছে।
নিশাত উঠে দাঁড়িয়ে বলল তাহলে আমি যাই দাদুর সাথে দেখা হয়নি এখনও
ঢাকা যাবি কবে?
আগামী কাল যাব
তাহলে আবার বিকেলে আসবি?
নিশাত এতক্ষণে নিরুর সাথে দেখা হবার জন্য বিকেলে আবার এখানে আসার সুযোগ খুঁজছিল। যুঁইয়ের কথা শুনে সে সুযোগ পেয়েছে বলে একটু জোরেই বলল হ্যাঁ আবার আসব, শিহাব কোথাও যাবি?
না এখন আর কোথাও যাব না
তাহলে আমার সাথে চলনা মইন চাচার বাড়ি যাব এক সাথেই যাই
চল
দুইজনে এক সাথে নিশাতদের বাড়ি চলে এলো। হাতের ব্যগটা নামিয়ে রেখে দাদির সাথে দেখা করে শিহাবকে নিয়ে চলল মইন চাচার বাড়ি। চাচা বাড়িতে ছিল না, পারাগ্রামের কোন এক জমিতে নিড়ানি দিতে গেছে। একটু বসে মইন চাচার মাকে বলল দাদু আমি একটা খুব ভাল চাকরী পেয়েছি আমাকে লন্ডন চলে যেতে হবে ওখানেই চাকরী। দাদি খুব খুশি হয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে অনেকক্ষণ দোয়া করলেন। দাদিকে বলে আসল চাচা এলে আমাদের বাড়ি যেতে বলবেন
আচ্ছা দাদা আমি বলব, তুমি সাবধানে থেকো, শুনেছি বিলাতি মেমসাহেবদের কোন লাজলজ্জা নাই দেখবে আবার অমন কাউকে সাথে করে নিয়ে এসো না।
না দাদু আপনাকে সেজন্যে ভাবতে হবে না।
সন্ধ্যার আগে মইন চাচা এলে তাকে নিয়ে আবার শিহাবদের বাড়ি। বাড়িতে ওঠার আগেই বীণা আপাকে দেখল পুকুর পাড় থেকে বাংলা ঘরের দিকে আসতে। বুঝতে পারল বীণা আপার সাথে নিশ্চয়ই নিরু এসেছে। এখন ওকে দেখার সুযোগ খুঁজতে হবে। নিশাতকে দেখে বীণা আপা কতবেল গাছের নিচে দাঁড়াল।
নিশাত, যুঁই বলল তুই নাকি লন্ডন যাচ্ছিস?
হ্যাঁ আপা, যুঁই ঠিকই বলেছে।
বেশ, খুব ভাল কথা। তা ঢাকায় কবে যাবি?
কালকেই যেতে হবে।
কালই যাবি! তাহলে আমাদের সাথে চল, আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি।
আপা আমিতো একা না মাও আছে সাথে আবার দাদুও যাবে।
তাতে কি হলো এ তো আরও ভাল হলো। তারাও যাবে তোদের নামিয়ে দিয়ে আমি নিরু আর বাবা চলে যাব।
এখানে এ কথা সে কথা, নানা গল্পে গল্পে বেশ রাত হয়ে গেল। এখনও নিরুকে দেখার সুযোগ হয়নি। চাচীদের সাথে দেখা করার অছিলায় বীণা আপার সাথে ভিতরে চলে এলো। চাচীদের সাথে কথার ফাঁকে দেখল নিরু ছোট চাচাত বোনকে কোলে নিয়ে খাটের এক কোণায় বসে আছে। হারিকেনের মৃদু আলোতে যেন আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। চোখের দিকে তাকাল কিন্তু কোন সারা নেই দেখে মনটা একটু খারাপ হলো। আবার ভাবল কাল এক সাথে ঢাকা যাবার সময় প্রাণ ভরে দেখে নিবে।
[চলবে]

হরধনু ভঙ্গ ৩

ঝিলমিলঃ গোটা থাকলে ওটা স্কুলের কি উপকারে লাগত?
অমায়িকঃ চুপ! আর কোন প্রশ্ন নয়, নো ফারদার সিলি কোশ্চেন—উত্তর চাই উত্তর। স্যার কি এখেনে ছেলেখেলা করতে এসেছে ? উত্তর না পেলে আমি সবাইকে জেলে পুরব, তাতে যদি উত্তর না পাই পুরে দেব হাজতে। মনে রাখবেন আমার নাম অমায়িক হলেও রেগে গেলে আমি রাক্ষস হয়ে যাই।
ঝিলমিলঃ আপনি আমাকে ধমকাবেন না। আমার সম্মানের ব্যাপারে আপনি রাক্ষসগিরি দেখাতে আসবেন না। আমি তাহলে মহিলা সুরক্ষা আইনে আপনার পেনসন চটকে দেব।
অমায়িকঃ তাই বল—তুমি চক্রান্ত করেই এটা করেছ। আমার বরাবর সন্দেহ হত তুমি যেন কি একটা ভাঙ্গবার চেষ্টা করছ। তবে সেটা যে ওইটা মানে—স্যার, ওটা কি যেন বললেন?
পরিদর্শকঃ এই শেষবারের মত বলছি—হরধনু। বুঝেছেন?
অমায়িকঃ ঊনষাট বছর ছ’মাসে যদি না বুঝি তবে কবে আর বুঝব স্যার?
পরিদর্শকঃ তাহলে বলুন কে ভেঙ্গেছে হরধনু?
অমায়িকঃ আমার এই হিংস্র ষড়যন্ত্রকারী অ্যাসিস্টেন্ট ভেঙ্গেছে স্যার। আপনি চট করে রিপোর্টটা লিখুন আমি ঝট করে দস্তখৎ দিয়ে দিই।
ঝিলমিলঃ (উত্তেজিত) মাইন্ড ইয়োর ওয়ার্ড! আপনি আমাকে যা তা বলছেন আবার মিথ্যা দোষ চাপাচ্ছেন। আমি কিন্তু এসব সহ্য করব না।
অমায়িকঃ আপনার যা বলার কোর্টে বলবেন। স্যার আমি ওর নামে কেস করতে চাই। আপনি কেসটা লিখে নিন।
পরিদর্শকঃ দ্যুৎ! আমি কেন কেস লিখব? আমি লিখি রিপোর্ট।
পরিদর্শকঃ তাহলে আপনার শেষ কথা হল আপনি জানেন না যে কে হরধনু ভেঙ্গেছে?
অমায়িকঃ জানব না কেন? ঐ ম্যাডাম—আরে উনি গেলেন কোথায়? এই যে এদিকে আসুন—এখন বই উলটে কি বিদ্যা জাহির করছেন? থানা থেকে পুলিশ আসছে তৈরী থাকুন।
ঝিলমিলঃ আপনি তৈরী থাকুন। আমি সময়মত রহস্য ফাঁস করে দেব।
পরিদর্শকঃ না, আর পারছি না। সন্ধ্যা হয়ে আসছে।
বাবাঃ কি হয়েছে পরিষ্কার করে বলুন না।
অমায়িকঃ একটা গুরুত্বপূর্ণ দলিল ভেঙ্গে ফেলেছে ভাই।
পরিদর্শকঃ দলিল?
বাবাঃ দলিল কখনও ভাঙ্গে?
অমায়িকঃ সময় খারাপ হলে ঐসব হয়ে যায়।
ঝিলমিলঃ দেখছেন কি রকম অর্থহীন কথা বলে। আবার হয়েছে হেড মাস্টার।
রাজিবুলঃ হয়ত এরও কোন গভীর অর্থ আছে।
ফতিমাঃ বাবা আমি বাড়ী যাব।
বাবাঃ তাহলে আপনি স্বীকার করছেন তো আমার মেয়ে ঐ দলিল ভাঙ্গেনি?
পরিদর্শকঃ উঃ! এবার হয়ত আমিই পাগল হয়ে যাবো। ওরে ভাই, ওটা দলিল নয়।
রাজিবুলঃ উনিও আপনার আসল ভাই নয়।
অমায়িকঃ সব নকল বাবা, সবই নকল। এইরকম পরিপাটি মেয়ের মনে যে এতকূট বিষ আছে তা কে ভাবতে পারে? বলুন না ভাঙ্গার পরে দলিলটা কোথায় সটকালেন?
বাবাঃ মা ফতিমা, এসব কি হচ্ছে বলতো?
কতিমাঃ কি জানি বাবা কি হচ্ছে! আমার খালি বাড়ীর কথা মনে পড়ছে।
বাবাঃ চল মা তোকে বাড়ীতেই নিয়ে যাই (উভয়ের প্রস্থান)
অমায়িকঃ দেখলেন! কি অভদ্র! অনুমতি না নিয়েই চলে গেল। ওদের দেখে না স্যার আমারও বাড়ীর কথা, নলেন গুড়ের কথা মনে ভেসে উঠছে।
পরিদর্শকঃ বাড়ীর কথা?সে তো আমারও মনে পড়ছে। কি কুক্ষণে যে এখানে এলুম!
অমায়িকঃ পুলিশ কেন এখনও আসছে না? ম্যাডাম, একটু দেখুন না ওরা কখন আসবে?
ঝিলমিলঃ আপনার কি লজ্জাও নেই? কি করে বলেন যে আপনি একজন শিক্ষক?
অমায়িকঃ দলিলটা বার করো না। জোড়া লাগাবার চেষ্টা করি সবাই মিলে।
পরিদর্শকঃ আবার বলে দলিল! হরধনু কি করে দলিল হয়?
অমায়িকঃ হরধনু? সে আবার কি?
রাজিবুলঃ হয়ত রামধনুর কাছাকাছি কিছু।
পরিদর্শকঃ কি বললে, কি বললে? রামধনু না কি যেন বললে?
ঝিলমিলঃ রাজিবুল তুমি প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছো। হরধনু হল মহাদেবের দেওয়া একটা ধনুক। যা তিনি দিয়েছিলেন সীতাদেবীর পিতা জনক রাজাকে।
অমায়িকঃ সেকি! জনক রাজা! মহাদেব!
পরিদর্শকঃ আশ্চর্য!
ঝিলমিলঃ তা ভাঙ্গা সাধারণের পক্ষে সম্ভবই নয়। রামচন্দ্র তা ভেঙ্গে সবাইকে অবাক করে দেন।
অমায়িকঃ তাই বলো, রামচন্দ্র ভেঙ্গেছেন। ওর ভাঙ্গা তো ভাঙ্গা নয় তা গড়ার চেয়ে বড়।
রাজিবুলঃ তার মানে? ভাঙ্গা তো ভাঙ্গাই, তার মানে গড়া নয়।
অমায়িকঃ চুপ! একদম চুপ! তুই কালকের ফচকে ছোঁড়া, তুই কি বুঝবি? তুই ভাঙ্গলে বুঝতে পারতিস কত ধানে কত চাল। (ঘুরে) ম্যাডাম, আপনাকে স্যালুট, অভিবাদন—আপনি আমার চিরকালের গর্ব!
ঝিলমিলঃ আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই না।
পরিদর্শকঃ ওঃ! আপনি যে ব্যাপারটা জানতেন তা বুঝতে পারিনি।
ঝিলমিলঃ না। ভুলে গিয়েছিলাম। আগে প্রাইমারীতে ইতিহাসে ঐ গল্পটা ছিল। পরে আমার মনে পড়ল।
পরিদর্শকঃ শুনে আমারও প্রাণ জুড়িয়ে গেল। আমি ভেবেছিলুম আপনারা হয়ত উত্তরটা দিতে পারবেন না।
অমায়িকঃ কেন পারবে না? ও এম এ করেছে। আপনাকে বলিনি স্যার, ওর মত গুণী ভারতে কেন বাংলাদেশ বা পাকিস্থানেও আর একটি পাবেন না।
ঝিলমিলঃ সত্যি আপনি পালটি খেতে পারেন বটে!
পরিদর্শকঃ ঊনি আপনাকে কতই না ভুল বুঝেছিলেন।
অমায়িকঃ ভুল বুঝিনি স্যার। আমি ওর স্মৃতিকে উসকে দেবার জন্য –হেঃ হেঃ মানে ওকে দায়ী না করলে ও কি আর উত্তর খুঁজত?
পরিদর্শকঃ আমাকে বলতেই হবে যে এখানে একজন যোগ্য শিক্ষক আর বেশ কিছু ভাল ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে।
অমায়িকঃ আর প্রধান শিক্ষক? তার কথা বলবেন না? চলুন, চলো হে সবাই—আমার বাড়ীতে–নলেন গুড়ের পায়েস খেয়ে তারপর বিচার করবে।
পরিদর্শকঃ কি বিচার?
অমায়িকঃ আমি আর পায়েস এর মধ্যে কোনটা বেশী মিষ্টি। (সমবেত অট্টহাসি)
সমাপ্ত

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-৭

৪।
সদ্য স্বাধীন দেশে সব জিনিস পত্রের দাম দিনকে দিন বেড়েই চলছে। প্রকৃতি তার রুদ্র রূপ মেলে দিচ্ছে। জীবন হয়ে উঠছে কঠিন থেকে কঠিনতর। নতুন দেশ, নতুন অর্থনীতি, শূন্য ভাণ্ডার আর তার সাথে অবাধ চাহিদা। চারিদিকে শুধু
ক্ষুধা আর ক্ষুধা। বিরূপ পরিবেশ। এর মধ্যেই আবার প্রকৃতি নিয়ে এলো তার প্রচণ্ড হিংস্র মূর্তি। দেশে দেখা দিল বন্যা। এমনিই মানুষ সামাল দিতে পারছে না তার মধ্যে আবার এই দুর্যোগ। রেশন কার্ড নিয়ে নিশাত রাত তিনটায় রেশন দোকানে লাইনে দাঁড়াত, তবুও গিয়ে দেখত তার আগে আরও কয়েক জন এসে পরেছে। ঘুমে চোখ একা একাই বন্ধ হয়ে আসতে চাইত কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি আর ঘুমানো যায়? তীর্থের কাকের মত চেয়ে থাকত কখন সূর্য উঠবে কখন নয়টা বাজবে, কখন দোকান খুলবে! এই রেশন নিয়ে বাড়ি গেলে মা রান্না করবে। ক্ষুধা নামক জীবের অদৃশ্য শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য প্লাস্টিকের চাউল যা সেদ্ধ হতে জ্বালানী খরচ হত অনেক, পোকা ধরা দুর্গন্ধে ভরা কিছু গম আর কিছু চিনি এই ছিল রেশন কার্ডে বরাদ্দ। তবুও নিরুপায় মানুষকে তাই খেতে হত। শাক সবজি, ডাল, মাছ এসব তো আর রেশনে পাওয়া যায় না। ওগুলি পাবার ব্যবস্থা আছে কিন্তু তা অন্য ভাবে। বাজারে ওসব পাওয়া যায় কিন্তু তা কেনার সামর্থ্য খুব কম লোকের হাতে। বাড়িটা করতে গিয়ে নিশাতের বাবা কিছু ঋণ করেছিল। গ্রামের জমি বিক্রির টাকায় হয়নি। অল্প কিছু ঋণ করতে হয়েছিল। সেই ঋণ শোধ করতে গিয়ে নিশাতের বাবাকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। তার মধ্যে আবার ওদের পাঁচ ভাই বোনের লেখা পড়া।

ওই দুর্যোগের মধ্যেই মাছ ভাতের বাঙ্গালি তার চিরাচরিত অভ্যাস ছেড়ে খেতে শিখল গমের আটার রুটি। তাও আবার যারা দিচ্ছে তাদের অখাদ্য। আরও শিখল সরষের তেলের পরিবর্তে সয়াবিন তেলে রান্না। বুড়ি গঙ্গা আর তুরাগ নদী দিয়ে অনেক পানি বঙ্গোপসাগরে মিশেছে আবার সেই পানি সূর্যের তাপে বাষ্পায়িত হয়ে হিমালয়ে কিংবা কাঞ্চনজঙ্ঘা কিংবা মানস সরোবরে এসে জমেছে। এখান থেকে নদী বেয়ে আবার গেছে বঙ্গোপসাগরে। প্রকৃতি থেমে নেই। সে তার আপন গতিতে নিজ রূপে বয়েই চলছে। তার কোন তাড়া নেই, কোন অভাব নেই। আকাশের চন্দ্র সূর্য তারা নক্ষত্র রাজি সবই উদয় হয়েছে আবার অস্তও গেছে। বাতাস বয়ে গেছে সাথে করে কখনও উড়িয়ে নিয়েছে কিছু মেঘমালা, কখন শান্ত বেগে কখন অশান্ত ঝড়ের বেগে, কখন নিস্তব্ধ মৃদু বেগে। এই ভাবেই ক্যালেন্ডারের পাতা একের পর এক উলটে গেছে। ঘড়ির কাটা ঘুরে ঘুরে ঋতুর পরিবর্তন এনেছে। যত্নে সাজানো বাগানের এবং অযত্নে বেড়ে উঠা ঝোপ ঝাঁরে বন ফুলের অনেক কলি ঝরে গেছে আবার তার জায়গায় নতুন কুড়ি এসেছে। এগুলিও কিছু আধো ফোটা অবস্থায় ঝরে গেছে, কিছু ফুটে তার সৌরভ ছড়িয়েছে আবার কিছু ঠাই পেয়েছে কারো সাজানো ঘরের ফুল দানিতে নয়ত কারো প্রিয়ার খোপায় তার হিসেব কে রেখেছে কে জানে! এই ভাবেই বয়ে চলেছে জীবন নদীর শান্ত অশান্ত স্রোত। কোনটা সাগরে মহা মিলনে মিলিত হয়েছে আবার কোনটা মাঝ পথেই শুকিয়ে গেছে। আবার কোনটা কিছু দূর এগিয়ে মাঝ পথে এসে স্তব্ধ হয়ে থমকে গেছে। এই ভাবে চলেছে, চলছে এবং মহাকালের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চলতেই থাকবে। তার পর এক দিন হবে সব কিছুর অবসান। কেউ নিজের ইচ্ছে মত নিজের বাগান সাজাতে পারেনি। সব কিছু যেন কোন অদৃশ্য এক ভাগ্য নামের রিমোট কন্ট্রোলের হাতের পুতুল হয়ে ডানে বামে সামনে পিছনে চলছে। কে কার খবর রাখে?

ছোট বেলা থেকে নিশাতের ইচ্ছে ছিল ইঞ্জিনিয়ার হবে, মস্ত ইঞ্জিনিয়ার। নিজ হাতে বানাবে নানা রকম ইঞ্জিন যা মানুষের কাজে লাগবে, মানুষের দৈনন্দিন জীবন সহজ করে দিবে। কিন্তু তার সে স্বপ্ন থমকে গেল কলেজে ইলেক্টিভ ম্যাথে এসে। নিশাত বাবার কাছ থেকে সাধারণ গণিত বেশ ভালো বুঝে নিয়েছিল কিন্তু ক্যালকুলাস, স্ট্যাটিস্টিকস, ডাইনামিকসের ধাক্কায় সব থেমে গেল। নিশাত তার মাথায় এগুলি জোড় করেও ঢুকাতে পারলো না। ওদিকে বাবার এমন সামর্থ্য নেই যে এ জন্য তাকে আলাদা প্রাইভেট টিউশনের খরচ যোগায়। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে বায়োলজি নিয়ে পড়ে ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে এমন সিদ্ধান্ত নিলো। এতেও গবেষণার সুযোগ রয়েছে যথেষ্ট। কিন্তু কলেজ শেষ করে আর বেশি দূর এগুতে পারেনি। দেশের ক্রম বর্ধমান দুর্মূল্যের ফলে তার বাবা তাদের এই পাঁচ ভাই বোনের সংসার সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিল।
মানুষ মুখে যাই বলুক যতই বলুক দেশের জন্য দশের জন্য ভাবছে। আসলে তার কতটা সত্য তা নিশাত জানে না। নিশাত এখন ভাবছে আসলে এগুলি কিছু নয়। মানুষ ভাবে শুধু তার নিজেকে নিয়েই। সে তার নিজের চাহিদা, নিজের খেয়াল অভাব মেটাবে এটাই এক মাত্র উদ্দেশে। তার নিজের চাহিদা বাস্তব রূপ নিবে, মনে আত্ম তৃপ্তি পাবে, সাথে পাবে যশ প্রতিপত্তি, সম্মান আর সুখ। সুন্দরী শিক্ষিতা স্ত্রী, সাজানো বিলাস বহুল বাড়ি তাতে থাকবে ফুলের বাগান। আরাম আয়েশের যাবতীয় ব্যবস্থা। মালী, চাপরাশি ড্রাইভার সারাক্ষণ তাকে ঘিরে থাকবে। পাশে সুন্দরী স্ত্রী নিয়ে দামী গাড়িতে চলাফেরা করবে এমন অনেক কিছু। নিশাতও ভাবে এই যে আমি চাইছি আমাদের সংসারের বর্তমান অবস্থার উত্তরণ ঘটিয়ে সংসারের উন্নতি করবো, ভাই বোনদের নামী দামী স্কুল কলেজে পড়িয়ে উচ্চ শিক্ষিত করে তুলব, তাদের দামী পোশাক পরাব। সমাজে পাড়া প্রতিবেশীদের ঈর্ষার কারণ হবো তাদের চোখ ধাঁদিয়ে দিবো, সমাজের উন্নতি করবো দেশে বিদেশে নিজের খ্যাতি ছড়াবো তার মুলে কিন্তু ওই একই। নিজের স্বার্থ জড়ান রয়েছে।

মানুষ যতই বলুক তার অন্তর্নিহিত সারমর্ম সে নিজেই। নিজের পেটে ক্ষুধা রেখে কে কার জন্য কতটা পরতে পারে, কত দূর যেতে পারে? নিজের চলার শক্তি হারিয়ে কেউ বেশি দূর যেতে পারে না। এই হয়, এটাই স্বাভাবিক। মানুষের মনের খবর আমরা কতটা রাখতে পারি? এক জন আর এক জনের মনের কথা কতটা জানতে পারি? এক জনের সাথে আর এক জনের কতটা মিল থাকে? হয়তোবা তাই নয়ত কি জানি কেন নিশাতের মনে এক ঝড় বয়ে যাচ্ছে। হায়রে নিয়তি তোমার নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কি মানুষ তার ইচ্ছে মত কিছুই করতে পারবে না? এই বিশ্ব সংসারে তুমিই কি রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে মানব জীবনের স্টিয়ারিং ঘোরাবে?
এই সব ভাবনা নিয়ে যখন নিশাত ক্ষত বিক্ষত তখন এক দিন সহপাঠী পাশে কল্যানপুরের বন্ধু হাবিব এসে জানাল, এই নিশাত, জাহাজে চাকরী করবি?
কি করে?
এই যে দেখ আমি কি নিয়ে এসেছি.
বলে একটা খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন বের করে দেখাল। নিশাত সেটা নিয়ে পড়ে দেখল. চট্টগ্রামের এক শিপিং এজেন্ট জেমস ফিনলে জাহাজের জন্য কিছু ডেক ক্যাডেট চেয়েছে। প্রথমে ক্যাডেট হিসেবে জয়েন করবে পরবর্তীতে জাহাজে কাজের অভিজ্ঞতা হলে নির্দিষ্ট সময় পর পর ইংল্যান্ডে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে পরবর্তী উন্নত পদে উন্নীত হয়ে জাহাজের ক্যাপ্টেন পর্যন্ত হবার সুযোগ আছে।
দারুণ একটা খবর এনেছিস, বেশ ভালো করেছিস এটা এনে, তা তুই কি এপ্লাই করবি?
হ্যাঁ আমিও করবো।
তাহলে চল দুই জনে এক সাথেই করি। এক মাস যাবত কলেজ বন্ধ থাকবে কাজেই এর মধ্যে আর কোন ঝামেলা নেই।
যা যা কাগজ পত্র চেয়েছে সেগুলি যোগার করে বাবা মাকে না জানিয়ে নিশাত হাবিবের সাথে এপ্লিকেশন পাঠিয়ে দিল। কয়েক দিন পর ইন্টার্ভিউ লেটার এলো বাড়িতে। চট্টগ্রাম যেয়ে ইন্টার্ভিউ দিতে হবে এজন্য টাকার দরকার। এখন আর বাবাকে না জানালে চলছে না। বাবাকে জানাবার আগে মাকে জানাতে হবে। মা নিজেই যেন বাবাকে বলে। ওই দিন মাই জিজ্ঞেস করল তোর নামে এই চিঠি কিসের, কে দিয়েছে? নিশাত মাকে সব খুলে বুঝিয়ে বলল। সবার শেষে বাবাকে বলার জন্য অনুরোধ করল। মা ওই রাতে খাবার সময় বাবার সাথে এ নিয়ে আলাপ করতেই বাবাও রাজী হয়ে গেল। কবে যেতে হবে জানতে চাইলে নিশাত বলল আগামী সোমবার।
আচ্ছা ঠিক আছে।

রবিবার রাতের চিটাগাং মেইলে করে দুই বন্ধু এক সাথে রওয়ানা হয়ে পর দিন আগ্রাবাদে জেমস ফিনলে অফিসে এসে ইন্টার্ভিউ দিল। দুই জনেরই বেশ ভালো ইন্টার্ভিউ হয়েছে। মোটা মুটি যা যা জিজ্ঞেস করেছে সঠিক জবাব দিয়েছে। ইন্টারভিউ দিয়ে আবার রাতের মেইল ট্রেনে ঢাকায় ফিরে এলো। কয়েক দিন পরেই নিশাতের নামে আর এক চিঠি, ওই ফিনলে অফিস থেকে। সেদিন নিশাতের কলেজ বন্ধ বলে কলেজে যায়নি, বাড়িতেই ছিল। পিওন সরা সরি নিশাতের হাতে চিঠিটা দিয়ে গেল। দুরুদুরু বুকে চিঠি খুলে পড়ে দেখে আনন্দে মা বলে এক চিৎকার দিয়ে দৌড়ে মার কাছে এসে মার বুকে মাথা রেখে মাকে জড়িয়ে ধরল। হঠাৎ নিশাতের এই কাণ্ড দেখে মা অবাক হয়ে জানতে চাইল
কিরে কি হয়েছে?
আমার চাকরী হয়ে গেছে!
কোথায়?
ওই যে সেদিন ইন্টার্ভিউ দিয়ে এলাম ওখানে।
তা হলে কি চিটাগাং?
না মা একে বারে বিদেশের এক জাহাজে।
কি বললি?
হ্যাঁ মা এই যে দেখেন এই চিঠিতে সব লেখা আছে।
জাহাজের চাকরী?
হ্যাঁ মা!
তুই কি সাতার জানিস যে জাহাজে চাকরী করবি?
জাহাজে চাকরী করতে সাতার জানা লাগবে কেন? জাহাজের মানুষেরা কি জাহাজে থাকে না কি সাগরে ভেসে থাকে?
না বাবা, আমার ও চাকরীর দরকার নেই! আমার দাদাও জাহাজে চাকরী করেছে আমি জানি সব।
কি বলেন মা, এখন দেশের এই অবস্থায় এমন একটা চাকরীর সুযোগ হাত ছাড়া করা কি ঠিক হবে?
না, বললাম তো আমার ও চাকরীর দরকার নেই।
আচ্ছা ঠিক আছে আব্বা আসুক দেখেন আব্বার সাথে আলাপ করে দেখেন আব্বা কি বলে।
জেমস ফিনলে ইংরেজিতে লেখা চিঠিতে জানিয়েছে তোমাকে একটা ব্রিটিশ পতাকা বাহী জাহাজে ডেক ক্যাডেট হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। স্থান কাল বেতন সহ সব কিছু উল্লেখ করে নিয়োগ পত্রের শেষ প্যারায় বলেছে তুমি যদি উপরোক্ত প্রস্তাবে রাজী থাক এবং দেশ ছেড়ে বিদেশে যেতে আপত্তি না থাকে তা হলে অপর পাতায় বর্ণিত শর্ত মেনে এই চাকরী করতে চাইলে আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে আমাদের অফিসে সাক্ষাত কর। শর্তাবলী যাই থাক বেতনের কথা আর লন্ডনে যেয়ে জাহাজে জয়েন করার সুযোগ দেখে নিশাতের মাথা খারাপ হবার দশা। খুশীতে আত্মহারা। ইংরেজ জাত যতই সভ্য হোক ওরা কাউকে আপনি বলতে জানে না। সে যাই হোক। চিঠিতে যে সব শর্তাবলী রয়েছে তাতে আপনি আর তুমিতে কিছু যায় আসে না। তারপর এক লাফে দেশের বাইরে এবং সরাসরি লন্ডনে, যাবতীয় খরচ পত্র সবই কোম্পানি বহন করবে। তার উপর লোভনীয় বেতন, বেতনের সাথে আবার বেশ কিছু বাড়তি সুযোগ সুবিধা। এমন চাকরী হাত ছাড়া করার মত বোকামি এই মূহুর্তে করা কোন অবস্থায়ই উচিত হবে না। মা যতই নিষেধ করুক তাকে রাজী করাতেই হবে!
নিশাত বলল মা তাহলে আমি একটু হাবিবদের বাড়ি থেকে আসি দেখি ওর কি খবর। হাবিবের বাড়ি গিয়ে দেখে হাবিব বাড়ি নেই। হাবিবের বোন হাসি দরজা খুলেছে। হাবিবের কোন চিঠি এসেছে কি না জিজ্ঞেস করলে হাসি বলল হ্যাঁ দাদার একটা চিঠি এসেছে আজ। দেখি, আমাকে একটু দেখাও। হাসি নিশাতকে বসতে বলে ভিতরে গিয়ে চিঠিটা এনে নিশাতকে দেখাল। সেই একই চিঠি নিশাতের কাছে যেমন এসেছে তেমন। খুলে দেখে এতেও ওই একই কথা লেখা।
হাসি, জান এটা কিসের চিঠি?
না ভাইয়া।
চল ভিতরে খালাম্মার কাছে চল এক সাথেই বলি।
এমন সময় খালাম্মা মানে হাবিবের মা নিজেই এলেন। কি রে নিশাত তোকে এত খুশি লাগছে কেন?
খালাম্মা, শুধু আমি না, শুনলে আপনিও খুশি হবেন।
কি ব্যাপার?
হাবিবের একটা চাকরী হয়েছে বিদেশে, আমারও।
তাই নাকি বলিস কি?
হ্যাঁ খালাম্মা এই যে এই চিঠি দেখেন। এতেই সব লেখা আছে। ঐযে সেদিন যে ইন্টার্ভিউ দিয়ে এসেছি সেই চাকরী!
[চলবে]