বিভাগের আর্কাইভঃ অন্যান্য

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-৬

এই গানইতো গত নয় মাস ধরে শুনছে কিন্তু আজ যেন অন্য রকম মনে হচ্ছে, আজ এই গানের সুরে আলাদা একটা আমেজ, আলাদা এক অনুভূতি। আজ যে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে! সবাই যখন ক্লান্ত হয়ে থেমে গেল তখন সারা জীবনের জন্য একটা সোনালী স্মৃতি সৃষ্টি করে থেমে গেল শুধু গানের রেশটা রয়ে গেল। নিশাত উঠে মইন চাচা সহ বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল পিছন থেকে নিরু একটু জোরেই বলল। খেজুর গাছ কাটার সময় আজ হান্নান ভাইকে দিয়ে হাড়িতে এলাচ দিয়ে রেখেছি কাল সকালে এসে রস খেয়ে যাবেন। কাকে উদ্দেশ্য করে বলা তা নিশাত ভালো করেই বুঝল আর বুঝল যুঁই। পিছন থেকে ডেকে যুঁই বলল শুনেছিস, তোর বৌ কি বলল? নিশাতের কানে আজকের এই রাতে যুঁইয়ের কথাটা সুমধুর হয়ে বাজলো। নিরুর চেহারা কেমন হয়েছিলো তা আর মৃদু চাঁদের আলোতে পিছন ফিরে দেখা হয়নি। তবে নিশাতের অন্ধ-দৃষ্টি তা ঠিক অনুমান করে নিয়েছিল। পরদিন আর রাত পোহায় না, হে যামিনী কেন আজ বিদায় নিচ্ছ না তুমি?

দেশ স্বাধীন হলো। নতুন দেশ। নিশাতের বাবা তার ছুটির কাগজ পত্র নিয়ে ঢাকায় এলেন। সাথে নতুন দেশ, নতুন রাজধানী ঢাকা শহর দেখার জন্য নিশাতও এলো। নিশাতের মামার সেই ধানমন্ডির বাসায় উঠল। পরদিন তার বাবা সেক্রেটারিয়েটে গেলেন কি করা যায় সেই উদ্দেশ্যে। ভাগ্য ভালো সেক্রেটারিয়েটে তার কাগজ পত্র দেখে পর দিন থেকে কাজে জয়েন করতে বলে দিল। বাবার চাকরী হয়ে গেল। নিশাত ২/৪ দিন নতুন দেশের রাজধানী শহরে বেড়িয়ে বাড়ি ফিরে এলো। বাবা ঢাকায় রয়ে গেলেন। ফেরার দিন বাবা বলে দিলেন দুই এক মাসের মধ্যে একটা বাসা পেলে তোমাদের নিয়ে আসব, কলেজে ভর্তি হতে হবে। মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করবে বেশি ঘোরা ঘুরি করবে না।

সময় চলে যায়। আকাশে তারা জ্বলে, চাঁদ ওঠে, জোসনা ছড়ায়। আবার সূর্য ওঠে। শীতের সোনালি বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়। ইছামতী নদী দিয়ে পানি পদ্মায় গিয়ে মিশে আবার সেই পানি পদ্মা থেকে মেঘনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে মহা মিলনের জন্য মিশে যায়। গ্রামের মেঠো পথ ধরে ঝাঁকা মাথায় হাটুরেরা হাট থেকে নানা সওদা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরে। নিশাত পথের পাশে হালটে বসে বসে চেয়ে দেখে। কলই ক্ষেতে নীল ফুল ফোটে, সিম ধরে আবার সেগুলি ফসল হয়ে উঠে। কৃষকেরা মাথায় করে বাড়ি নিয়ে আসে। সোনালী গম ক্ষেতের আড়ালে আবার সূর্য তার রক্তিম আভা ছড়িয়ে দিগন্তে হারিয়ে যায়। দোয়েল, শালিক, ঘুঘু পাখি ডেকে ডেকে বিষণ্ণ দুপুরের মায়া ছড়িয়ে দেয়। এ ভাবেই প্রকৃতি তার অস্তিত্ব জানিয়ে দেয়, আমি আছি। সবাই তার নিজস্ব ভঙ্গিতে চলতে থাকে কিছুই থেমে থাকে না। নিশাতের জীবনও থেমে থাকে না। নিরুর সাথে নিয়মিত না হলেও প্রায়ই দেখা হয়। ক্ষণিকের জন্য চারটি চোখে কি যেন এক দুর্বোধ্য ভাষায় কথা হয়। সে কথার মানে অন্য কেউ বোঝে না। তবে এটুক বোঝে যে কিছু একটা আদান প্রদান হলো। এই আদান প্রদানের রেশ কোথা থেকে কোথায় যাবে দুইজনের কেউ অনুমান করতে পারে না।

এক দিন সন্ধ্যায় মাঠ থেকে ফিরে নিশাত দেখল বাবা এসেছেন। রাতে খাবার পর বাবা বললেন ঢাকায় বাসা পেয়েছেন। তোমরা সবাই আগামী শুক্রবারে চলে এসো। একটু কাগজ আন আমি ঠিকানা লিখে দিই। নিশাত উঠে তার রাফ খাতা আর একটা কলম এনে বাবার হাতে দিলে বাবা ঠিকানা লিখে নিশাতকে বুঝিয়ে দিলেন গাবতলি বাস স্ট্যান্ডে নেমে কি ভাবে যেতে হবে বুঝিয়ে দিলেন। নিশাতের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন, কি চিনে আসতে পারবে না কি আমি আসব?
না, আপনাকে আসতে হবে না, আমি যেতে পারব।

ঢাকায় যাবার দিন ঠিক হবার পর থেকেই নিশাতের মনটা বিষণ্ণ, কি জানি কি এক আশঙ্কা। শীতের শেষে প্রকৃতিও যেন নিশাতের মনের সাথে যোগ দিয়েছে। নিরুর বোন যুঁই এর সাথেও তেমন কথা জমে উঠে না, শিহাবের সাথেও খুব একটা দেখা সাক্ষাত নেই বললেই চলে। গাছের সবুজ পাতা সেই কবেই ঝরে গেছে মাঠ ঘাটের সবুজ তাজা ঘাস গুলিও যেন শুকিয়ে হলুদ বিবর্ণ হয়ে গেছে। বাঁশ ঝাড়ের পাতা গুলি ঝরে গিয়ে কাঠির মত দাঁড়িয়ে রয়েছে। চারি দিকেই কেমন যেন একটা শুকনো মলিন ভাব। সূর্য ডোবার আগে দিগন্তের রক্তিম আভার সাথে গরু বাছুরের পায়ের ধুলো, রাখালের পায়ের ধুলো, বাড়িতে বাড়িতে কলই গম মাড়ানোর ধুম। পিঁয়াজ খেতের ফুল গুলি শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে আসছে কখন যেন কৃষক এসে তুলে নিয়ে যাবে। বিলের ধারে সকাল বেলা বক পাখি ধ্যানে মগ্ন থাকছে না। রোদের তেজ যেন ক্রমেই বেড়ে চলেছে। তাহলে কি ওরাও নিশাতের মনের কথা বুঝতে পেরেছে?

যাবার আগে সন্ধ্যা বেলা শিহাবদের বাড়ি এলো। শিহাব বাড়ি নেই, যুঁই বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল কিরে, তোরা তাহলে কালই চলে যাবি? কখন যাবি, আয় ভিতরে আয়। আজ আমাদের খৈ বানিয়েছে, হাট থেকে বাবা দৈ এনেছে একটু খেয়ে যা। ভিতরে নিয়ে বসতে বলে রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। দরজার পাশে এসে দাঁড়াল নিরু। যুঁই একটু পরে এক হাতে দৈ খৈ এর পেয়ালা আর এক হাতে এক গ্লাস পানি এনে নিশাতের সামনে টেবিলে নামিয়ে রেখে বলল নে খা। আবার কবে আসবি না আসবি তার ঠিক নেই। তোদের বাড়িতে তাহলে কেউ থাকবে না সবাই চলে যাবি?
আর কে থাকবে বল?
বিষণ্ণ মনে যুঁই বলল বাবা মনে হয় আমাকে মানিকগঞ্জের কলেজে ভর্তি হতে দিবে না, কাজেই আমার পড়া শুনা বন্ধ। তুই কিন্তু বাবাকে বলে যাবি অন্তত তুই ঢাকায় যে কলেজে ভর্তি হবি শিহাবকেও যেন সেখানে ভর্তি হতে দেয়। এসব কথার কিছু নিশাতের কানে ঢুকছে কিছু ঢুকছে না। তার মন রয়েছে দরজার ওপাশে। ও কি একটু ভিতরে আসতে পারছে না। মনে একটা সূক্ষ্ম অভিমান এসে ভর করল। কেন? এখন কি আমার ভিতরে যাওয়া সাজে? তাহলে যুঁই কি বলবে? তুমি একটু এ ঘরে আসতে পারছ না কেন? আর কিছু ভাবতে মন চাইল না। কোন রকম খৈ খেয়ে যুঁইকে বলল শিহাব এলে ওকে রাতে দেখা করতে বলবি। বলেই বের হয়ে বাড়ি চলে গেল।

৩।
পরদিন ওরা ঢাকায় চলে এলো। মিরপুর এলাকায়। বাবা যেভাবে ঠিকানা লিখে বলে দিয়েছিলেন সেই অনুযায়ী ঠিক ভাবে আসতে কোন অসুবিধা হয়নি। গাবতলি নেমে নতুন শহর বলে একটু ইতস্তত লাগছিল তবুও আসতে পেরেছে। নিশাত কলেজে ভর্তি হলো, ছোট ভাই বোনেরা স্কুলে। কয়েক মাস থাকার পর মা এক দিন নিশাতের সাথে পরামর্শ করলেন, পরের বাড়িতে থেকে মাসে মাসে এত গুলি টাকা ভাড়া দিয়ে সংসার চালান কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আমি ভাবছি যদি নিজেদের একটু জায়গা হত তাহলে যেমন তেমন একটু টিনের চাল বেধে থাকার ব্যবস্থা করতে পারলে এই ভাড়ার টাকা গুলি বেচে যেত।
তা হয় কিন্তু জমি কেনার এত টাকা পাবেন কোথায়?
কেন, গ্রামের বাড়িতে আমাদের এজমালি জমি গুলি আছে সেগুলি থেকে আমরা কি পাই ওগুলি বিক্রি করে দিলে যে টাকা আসবে তা দিয়ে হয়ে যাবে।
বেশ ভালো কথা, আব্বার সাথে আলাপ করে দেখেন কি বলে।

নিশাতের বাবা বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পর হাত মুখ ধুয়ে চা নাস্তা খাবার সময় নিশাতের মা কথাটা তুললেন। শুনে সেও মোটা মুটি সম্মতি জানাল। এবার গ্রামের ওই সব টুকরা টুকরা জমি, পুকুর, বাগানের অংশ যেখানে যা ছিল সব বিক্রি হয়ে গেল। শুরু হলো ঢাকায় জমি খোজার পালা। এক সময় তাও হয়ে গেল। যেখানে ভাড়া থাকত তার কাছেই ছোট এক টুকরো জমি পেয়ে রেজিস্ট্রি ইত্যাদি যা করার তাও হয়ে গেল। নতুন জমিতে কোন রকম কাচা মাটির একটা দোচালা টিনের ঘর। পাশে বাঁশের বেড়ার চাল দেয়া রান্না ঘড় আর কাচা একটা টয়লেট বানানোর কাজ হয়ে গেল। এবার একটা শুভ দিন শুভ লগ্নে তারা নতুন বাড়িতে উঠে পরল। কাচা পাকা যাই হোক নিজেরতো! মাস শেষে ভাড়ার টাকা গুনতে হবে না। বাইরের দিকে আস্তে আস্তে বাঁশের বেড়া দিয়ে ভিতরে কিছু শাক সবজির বাগান করে নিলো। পাশেই একটু খোয়ারের মত করে কয়েকটা মুরগী। এইতো নিজের বাড়ি আর ভাড়া বাড়ির তফাত। এখন থেকে ভাড়াতো দিতে হয়ই না উপরন্তু কিছু শাক সবজী সহ ডিম মাংসের খরচও কমে গেল। যত ছোটই হোক আর যত সামান্যই হোক ঢাকা শহরে নিজের একটু খানি কুটিরের দাম যে কি তা হারে হারে বোঝা যাচ্ছে।

এক দিন সকালে কলেজে যাবার আগে নিশাত বাগানে সবজির যত্ন করছে এমন সময় একটু দূরে খোলা রাস্তায় নজর গেল। দেখল সবুজ শাড়ি পরা এক জন মহিলা আর তার সাথে বাচ্চা কোলে নীল কামিজ গায়ে এক মেয়ে এদিকে এগিয়ে আসছে। হঠাৎ চেনা চেনা মনে হলো। আরও একটু কাছে এলে দেখল নিরু আর তার বড় বোন বীণা আসছে। বীণা মাঝে মাঝেই আসে। কাছেই বাড়ি। পাশে যখন ভাড়া বাড়িতে থাকত তখনও এসেছে কয়েক বার। কিন্তু সেই আসা আর আজকের আসার মধ্যে কোথায় যেন একটু পার্থক্য মনে হলো নিশাতের কাছে। আজ যেন এক ভিন্ন সুর বেজে উঠল নিশাতের মনে।

বিশ্বে প্রতিনিয়ত কত কিছুই ঘটে যাচ্ছে তার সব কিছু মনের চোখে সব সময় ধরা পরে না। আবার অনেক কিছু আজ যে রকম মনে হয় সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথেই ভিন্ন জনের কাছে ভিন্ন ভাবে ধরা দেয়। সময়, কাল, স্থান ভেদে ভিন্ন রূপ ধারণ করে। এ ও ভালো। এক ধরনের বৈচিত্র্য। প্রকৃতি যেমন খেয়াল পাল্টায় ঋতু বদলায় মানুষের মনও তেমন। আজকে যা ভালো লাগছে কাল তা আঁকড়ে ধরে রাখতে পারছে না। শুধু পার্থক্য এ টুক যে ঘড়ির কাটা মহা কালের সাথে মিলনের জন্য বার বার ঘুরেই চলেছে। দক্ষিণ মেরু থেকে অনেক বাতাস উত্তর মেরুর দিকে বয়ে গেছে। পৃথিবীতে অনেক ক্ষুধা তৈরি হয়েছে।

বীণা নিরুকে নিয়ে নিশাতদের বাড়িতে এসেছে। চাচীর সাথে দেখা করার জন্য। গতকাল নিরু এসেছে গ্রামের বাড়ি থেকে। ওকেও সাথে করে নিয়ে এসেছে। নিরুর স্কুল বন্ধ হলেই একটা দিনও দেরি না করে সোজা বড় বোনের কাছে এসে কাটিয়ে যায়। নিরু গ্রাম থেকে আসার সময় এই এটা ওটা যা গ্রামের বাড়ি থেকে শহরে আনতে হয়, ক্ষেতের কিছু মটর শাক, ধনে পাতা, কলার মোচা, গাছের কিছু ফল মুল, কাচা আম, কিছু আম সত্ত্ব, নারকেলের লাড়ু, গাছের পাকা কুমড়োর মোরব্বা যা কিনা মা নিজে বানিয়েছে, কয়েকটা গাছ পাকা কত বেল। ঢাকা শহরে কি আর গাছ পাকা কত বেল পাওয়া যায়! যা পায় সব জাগ দেয়া। যা খেয়ে বড় হয়েছে সেই ছোট বেলায় যা নিয়ে মন কষা কষি হয়েছে, যা নিয়ে ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখেছে সে দিন গুলির স্মৃতি কি মনে পড়ে না? সেই বাড়ির ঘাটের নয়তো চৌরাস্তার ছবি, সেই গন্ধ আবার পিছনে ফিরে দেখতে ইচ্ছে করে না? তাই আসার আগে মা পোটলা বেধে এগুলিও দিয়ে দেয়। বীণা আবার তাই কিছু চাচীর জন্যে নিয়ে এসেছে। চাচীও ওগুলি পেয়ে বেশ খুশি।
মা সিঙ্গারা বানালেন, রান্না ঘরের পাশে পিঁড়িতে বসেই চা সিঙ্গারার পালা শেষ। মা বায়না ধরলেন নিরুকে নিয়ে এসেছিস আজ দুপুরে এখানে খেয়ে যাবি, কবির আসবে সেই সন্ধ্যায় কাজেই আর চিন্তা কি? বাড়িতে ভাড়াটিয়ারা আছে। অকাট্য যুক্তি দেখালেও প্রথমে বীণা আপা একটু আমতা আমতা করে শেষ পর্যন্ত রাজী হয়ে গেল। নিশাতের মা রান্না ঘর থেকে বের হয়ে নিশাতকে একটা মুরগী বের করতে বলে কলেজে যাবার তাগিদ দিলেন। নিশাত আস্তে করে বলল আজ কলেজ বন্ধ।
বন্ধ! তখন যে বললি তাড়াতাড়ি যাবি!

বলেছিলাম না কি! কি জানি ভুলে বলেছি মনে হয়। আচ্ছা থাক কলেজে আজ যেতে হবে না তার চেয়ে মুরগীর খাঁচার বেড়া গুলি জায়গায় জায়গায় ভেঙ্গে গেছে ওগুলি ঠিক করি কাজে লাগবে। মুরগী বেরিয়ে যায় ধরে আনতে আপনার কষ্ট হয়।
মা কি বুঝলেন তা নিশাত জানে না তবে মা আর চাপা চাপি করেননি। নিশাত একটা মুরগী বের করে পাশের বাড়ির কালামকে ডেকে জবাই করে মার হাতে এনে দিয়ে ঘর থেকে সাড়াশি গুনা তার এনে আবার লেগে গেল খোয়ার ঠিক করার জন্য। মন কাজে ছিল না। হাত দুটাই শুধু নেট বাধার কাজে উঠা নামা করছে। এক সময় পিছনে চেনা পায়ের শব্দ শুনে ফিরে দেখে নিরু এসে দাঁড়িয়ে তার মুরগীর খামার দেখছে। নিশাতকে পিছনে তাকাতে দেখে নিরু বলল বাহ্ বেশ সুন্দর! এক এক করে মুরগী গুলি গুনে দেখে বলল পনেরটা! নিশাত পিছনে তাকিয়ে বলল তুমি আবার এখানে কেন, যাও তোমার চাচীর কাছে গিয়ে বস। এ কথা শুনে নিরু আর একটা মুহূর্ত দেরি না করে চলে গেল। মনে বিষাদের করুন সুর বেজে উঠেছিল। সেদিন ঢাকায় আসার সময় একটু দেখা দিয়ে আসতে পারনি আজ আমি নিজে এসেছি কোথায় দুটি কথা বলবে তা না করে বলে কি না যাও চাচীর কাছে যাও। আমি কি চাচীর কাছে এসেছি? আমি এসেছি শুধু তোমাকে একটু দেখতে। তুমি কেন বুঝলে না। নিশাত আবার পিছনে ফিরে ওকে দেখতে না পেয়ে কেমন যেন বিদিশা হয়ে গেল। এ কি করলাম যার জন্য কলেজে গেলাম না তাকে এ কি বললাম! কি হে নিশাত! তুমি কোন ধরনের মানুষ? এ যে তোমার প্রথম প্রেম তা কি বুঝতে পারছ না? ওদিকে নিরু এসে সেই যে চাচীর কাছে বসল যতক্ষণ ও বাড়িতে ছিল ততক্ষণ কারো সাথে আর একটি কথাও বলে নি।
[চলবে]

হরধনু ভঙ্গ ২

পরিদর্শকঃ আপনি বোধহয় এই স্কুলের শিক্ষিকা অথবা কোন ছাত্রের—
ঝিলমিলঃ না, না কোন ছাত্রের নয় স্কুলের—
অমায়িকঃ অন্যতম শিক্ষিকা। বাংলায় বিএ, ভুগোলেও বিএ আবার কিসে যেন একটা এম এ। আমার এই একজন মাত্র হেল্পার স্যার, ভয়ে ভয়ে থাকি কখন ফুস করে চলে যায়।
পরিদর্শকঃ তা আপনার স্কুলে ছাত্র ছাত্রী কত?
অমায়িকঃ তা প্রায় ১২৫ হবে। সবাই ওদিকের ঘরগুলোতে বসে মুখস্থ করছে। আমি এই কয়েকজন উত্তম ছাত্র ছাত্রী নিয়ে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।
পরিদর্শকঃ মাত্র দু-জন টীচার?
ঝিলমিলঃ ছ’মাস পরে হয়ে যাবে একজন।
অমায়িকঃ তখন আর তোমাকে কে পায়? তুমিই রাজা আবার তুমিইমন্ত্রী। রাজিবুল, একটু এদিকে এসো তো বাবা, ( রাজিবুল আসে) মানে স্যার আপনার আসার কথা শুনে আমার মেয়ে নলেন গুড়ের পায়েস করেছে ওটাই আনতে পাঠাচ্ছি।
পরিদর্শকঃ না, না তার কোন দরকার নেই, রাজিবুল তুমি বসো (রাজিবুল আবার বসে)
অমায়িকঃ হ্যাঁ, স্যার যা বলে তাই করো তবে জীবনে কখনও নখ দিয়ে দাঁত কাটবে না—মনে থাকবে?
ঝিলমিলঃ আপনি একটু খেয়াল করে কথা বার্তা বলুন।
অমায়িকঃ কেন? আ-আমি কি খেয়াল গায়ক যে খেয়াল করব? এটা গুরুচরণ প্রাথমিক বিদ্যালয় এখানে খেয়াল, ঠুংরির দরকার কি? বাই দ্য বাই—স্যার, আপনার এখানে আসতে কোন কষ্ট হয়নি তো?
পরিদর্শকঃ না, সে এমন কিছু নয়। আচ্ছা অমায়িকবাবু, আমি কি আপনার ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে একটু আলাপ করতে পারি?
অমায়িকঃ করুন না- করুন করুন। ম্যাডাম, সব ঠিক আছে তো?
ঝিলমিলঃ আছে আছে। (স্বগতঃ নিজের যে ঠিক নেই সেটা কে বলবে!)
পরিদর্শকঃ কি নাম তোমার?
ফতিমাঃ আমার নাম ফতিমা, আমি ক্লাস ফোরে পড়ি। আমার দেশের নাম ভারত। রাজধানীর নাম দিল্লী। রাজ্যের নাম পশ্চিনবঙ্গ রাজধানীর নাম কলকাতা। জেলার নাম দঃ ২৪ পরগণা আর মহাকুমার নাম ডায়মন্ডহারবার।
পরিদর্শকঃ ওকে, ওকে—তোমার নাম?
উৎপলঃ আমার নাম উৎপল ঘরামী, বাবার নাম বলরাম ঘরামী, গ্রামের নাম চাঁদপুর,পাড়ার নাম চৈতন্যখোলা সাত নম্বর।
পরিদর্শকঃ কেন সাত নম্বর কেন?
উৎপলঃ না –মানে—সবাই সাত নম্বর বলে। ছ নম্বর টা চৈতন্য পোলের ওদিকটায়। পাঁচ নম্বরে এই ইস্কুল।
ঝিলমিলঃ ইস্কুল নয়—স্কুল বল।
অমায়িকঃ বলবে আস্তে আস্তে সব বলবে—এইতো সবে শুরু গো মা!
ঝিলমিলঃ কি? কি যে সব বলে!
পরিদর্শকঃ যাকগে যাকগে—তোমার নাম কি?
হামিদাঃ (দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে) আমার নাম হামিদা। আমিও ক্লাস ফোর।
পরিদর্শকঃ আচ্ছা হামিদা, এমন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম করতে পারো যার নামের শেষে দা আছে?
হামিদাঃ আমি কি যে কোন স্বাধীনতা সংগ্রামীকে দাদা বলে সম্বোধন করতে পারি স্যার?
অমায়িকঃ করোনা যতদূর পারবে চেষ্টা করো।
হামিদাঃ নেতাজী দা, ক্ষুদিরাম দা, —
পরিদর্শকঃ থাক, থাক, আর বলতে হবে না। মাষ্টারমশায়, আপনি কি বলতে পারবেন?
অমায়িকঃ আমি যা বলার পরে প্রাইভেটে বলব। এখন যা বলার আমার অ্যাসিস্টেন্ট বলবে।
ঝিলমিলঃ মাস্টার-দা। এ আর এমন কি শক্ত?
পরিদর্শকঃ হামিদা, ব-দ্বীপ কাকে বলে?
হামিদাঃ প্রদীপের মত কিছু একটাকে হয়ত বলে?
পরিদর্শকঃ না, মোটেই তা নয়—ব-দ্বীপ জ্বলে না।
রাজিবুলঃ তাহলে স্যার হয় সলতে নিভে গেছে নতুবা ওতে তেল নেই।
ঝিলমিলঃ এই চুপ! তোমাকে প্রশ্ন করা হয় নি।
রাজিবুলঃ আমাকে কি প্রশ্ন করা হবে না স্যার?
পরিদর্শকঃ (একমনে কাগজ দেখে—হ্যাঁ হবে, করা হবে) ইয়ে বলত প্রশ্ন কবিতা কার লেখা?
রাজিবুলঃ তালগাছ কবিতার কবির লেখা।
অমায়িকঃ হঠাৎ তালগাছ কেমন করে এল?
পরিদর্শকঃ ছেলেটি বুদ্ধিমান, কিন্তু হঠকারী। এবার আমি আসল প্রশ্নটি করব।
অমায়িকঃ তাই বলুন, এবার আসল—এতক্ষন যা হল সবই ওপরওয়ালার ছল।
পরিদর্শকঃ হরধনু কে ভেঙ্গেছে? (উত্তেজিত) বলুন কে ভেঙ্গেছে হরধনু?
অমায়িকঃ (অতি বিস্ময়ে ও আতংকে) অ্যাঁ? ভেঙ্গে দিয়েছে? বল বল কে এই সর্বনাশ করলি? (রাজিবুলের দিকে চেয়ে) তুই, তুই ভেঙ্গেছিস, তুই হচ্ছিস হঠকারী।
মনে রাখিস কথাটা আমি বলিনি স্যার বলেছে। আর ওপরওয়ালা যখন বলেছে তখন তুই হঠকারী না হলেও হঠকারী। বল বাবা, কেন তুই এই শেষ বয়েসে আমার বুকের পাঁজর ভেঙ্গে দিলি?
ঝিলমিলঃ আপনি এত ভেঙ্গে পড়বেন না স্যর? লোকে কি ভাববে?
পরিদর্শকঃ দেখুন, আমাকে ফিরতে হবে। আমার সময় নষ্ট করবেন না। তাড়াতাড়ি জানান কে ভেঙ্গেছে?
রাজিবুলঃ আমি ভাঙ্গিনি স্যার। তবে কেউ না কেউ ভেঙ্গেছে নতুবা ওটা গোটাই থাকত।
(ক্রমশঃ)

আপনার প্রোফাইলে ছদ্মনাম কেন?

আপনার প্রোফাইলে ছদ্মনাম কেন?

প্রিয় ফেসবুক বন্ধুগণ কেমন আছেন? আশা করি দয়াময়ের অশেষ কৃপায় সবাই ভালো আছেন। আমিও আপনাদের সকলের আশীর্বাদে ভালো আছি। বন্ধুগণ, আজ আমি আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি কিছু “ছদ্মনাম” নিয়ে। বন্ধুগণ, অনেকের ফেসবুক প্রোফাইল দেখি ছদ্মনামে। প্রোফাইল ছবিটাও একপ্রকার বনজঙ্গলের ছবি। এসব দেখে ভাবি, আর ছদ্মনাম নিয়ে ইতিহাস ঘেঁটে সময় কাটাই। ইতিহাস ঘেঁটে যা পেয়েছি, তা আমার লেখার মাঝে প্রকাশ করছি। আগে আমার মোবাইল ব্যবহার ও অনলাইনে প্রবেশ বিষয়ে কিছু লিখতে চাই। আশা করি সবাই সাথে থাকবেন। আর আমার এই নগণ্য লেখাও পুরোটা পড়বেন।

আমি ২০০৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে একটা মোবাইল কিনি। মোবাইলটি ছিল নোকিয়া ১১১০ মডেল, দাম ছিল মাত্র ৩৬০০ টাকা। এই মোবাইলটা দিয়ে (GPRS) সার্ভিস বা ইন্টারনেট কানেকশন পাওয়া যেত না। আগেই বলেই রাখা ভালো, তখন ছিল 2G। এখন 3G শেষ হয়ে 4G চালু। শুনেছি কোনও একসময় চালু হতে যাচ্ছে অজানা G। প্রযুক্তির যুগে এটা আমাদের জন্য একটা ভাগ্যও বটে। যেখানে আগে আমরা একটা ওয়ান ব্যান্ডের রেডিওর পেছনে সারাক্ষণ দৌড়াতাম। সেখানে আজ ছোট্ট একটা যন্ত্রের ভেতরে রেডিও সহ অনেককিছু থাকে। যাই হোক, এর পর ২০০৭ সালে নোকিয়া সি থ্রী একটা মোবাইল ব্যবহার শুরু করি। ওই মোবাইলটা ছিল আমার ছেলের রেখে যাওয়া স্মৃতি। তখন থেকেই আমার এই তথ্যপ্রযুক্তি যুগের অনলাইনে প্রবেশ।

প্রথমে গুগল প্লাস পরে ফেসবুক ইউটিউব সহ বহু ওয়েবসাইটে ছিল আনাগোনা। যা এখনো চলছে যথারীতি। দিনরাত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অন্তত ২০ ঘন্টাই অনলাইনে থাকা চাই। ব্লগ আর ব্লগার সম্বন্ধেও আগে আমার তেমন কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না। বাংলাদেশের স্বনামধন্য পত্রিকা ‘প্রথম আলো’তে একসময় নাগরিক সাংবাদিকতার একটা সাইট ছিল। সেখানে দেশের অনেক স্বনামধন্য লেখকরা লিখতেন, নিজেদের একান্ত অনুভূতি প্রকাশ করতেন। তারপর আস্তে আস্তে অনলাইন ভিত্তিক বহু ব্লগ সাইট তৈরি হয়। এগুলো যথাক্রমে; টেকটিউনস, সামহয়ারইনব্লগ, মুক্তমনা ব্লগ, টিউনারপেজ, পিসিহেল্পলাইনবিডি, টেকটুইটস, প্রথম আলো ব্লগ, নাগরিক ব্লগ, টিউটোরিয়ালবিডি, সুডোল্যাব সহ ছিল ইংরেজী ব্লগ ও ফোরাম।

এসব অনলাইন ভিত্তিক ব্লগ বা দিনলিপিতে অনেক নামীদামী লেখকরাই লিখতেন। অনেকে নিজের নাম গোপন করে ছদ্মনামে লিখে যেতেন। এই “ছদ্মনাম” নিয়ে যদি কিছু লিখতে যাই, তাহলে ছদ্মনামের পুরো ইতিহাস টানতে হয়।

ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ছদ্মনাম কোনো ব্যক্তি বা ক্ষেত্রবিশেষে কোনো গোষ্ঠীর কাল্পনিক নাম। ছদ্মনাম ব্যবহারের প্রধান উদ্দেশ্য কোনো ব্যক্তির প্রকৃত পরিচয় গোপন রাখা। শুধুমাত্র লেখকেরাই ছদ্মনাম ব্যবহার করেন না, গ্র্যাফিটি শিল্পী, প্রতিবাদী আন্দোলনকারী অথবা সন্ত্রাসবাদী এমনকি কম্পিউটার হ্যাকারেরাও ব্যবহার করেন এই জাতীয় নকল নাম। অভিনেতা, গায়ক বা অন্যান্য শিল্পীরা অনেক সময় নিজেদের জাতিগত পরিচয় গোপন রাখার জন্য মঞ্চনাম ব্যবহার করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার একাধিক ব্যক্তি একক ছদ্মনামের আড়ালেও লিখে থাকেন। কোনো রচনার সহকারী লেখকবৃন্দের ক্ষেত্রেও এই জাতীয় ছদ্মনাম গ্রহণের প্রবণতা দেখা যায়।

বাংলা ভাষাতে ছদ্মনাম গ্রহণের প্রথাটি সুপ্রচলিত। কৈশোরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “ভানুসিংহ ঠাকুর” ছদ্মনামে কয়েকটি কবিতা রচনা করেছিলেন। বিশিষ্ট লেখক রাজশেখর বসু স্বনামে অনুবাদ সাহিত্য, প্রবন্ধ ইত্যাদি রচনা করলেও, তাঁর প্রসিদ্ধ শ্লেষাত্মক গল্পগুলি লিখতেন “পরশুরাম” নামে। এমন আরও অনেকই ছিলেন ছদ্মনামে। তাদের মধ্যে কয়েকজন কবি ও লেখকদের ছদ্মনাম ও প্রকৃত নাম নিম্নরূপ।

ছদ্ম নাম——— ——প্রকৃত নাম
• ভানুসিংহ—— ——রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
• কমলাকান্ত——— —–বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
• অনিলা দেবী —— —শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
• নীল লোহিত —— —-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

তাহলে বুঝাই যাচ্ছে যে, এই ছদ্মনাম অনেক অনেকদিন থেকেই প্রচলিত। যা এখনো চলছে দেশ বিদেশের অনলাইন ভিত্তিক দিনলিপিতে আর কবি লেখকদের মাঝে। যেমনটা দেখা যায় অন্যান্য ব্লগেও। এসব ছদ্মনামের লেখকদের লেখায় মন্তব্য দিতে বাঁধে খটকা। ছদ্মনামে বোঝা যায় না লেখকের লিঙ্গ পরিচয়। তাই অনেক সময় সম্মোধন করতে গিয়ে ভাইয়ের জায়গায় বোন লিখে ফেলে কেউ কেউ।

যেমন; লেখকের লেখা পড়ে পাঠক মন্তব্য লিখলো এভাবে–”সম্মানিত দিদি, আপনার অসাধারণ লেখনী পড়ে অনেককিছুই জানা হলো। এই অসাধারণ লেখাটি আমাদের মাঝে শেয়ার করার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাই।”

পরবর্তীতে মন্তব্যকারী বিপাকে পড়ে যান। আর লজ্জাও পেয়ে থাকেন সমসময়। লজ্জায় পড়ে এই কারণে যে, লেখা বা পোস্ট করেছেন একজন পুরুষ লেখক। ছদ্মনাম ছিল, “আকাশের তারা”। অথচ সম্বোধন করা হলো লেখিকা ভেবে।

“আকাশের তারা” ছদ্মনামটিতে কি বোঝা যায়, লেখক নারী -না-পুরুষ? বোঝা মুশকিল। আবার প্রোফাইল ছবিটাও থাকে নকল, হয়ত ফুলের, না হয় কোনও পশুপাখির। তাই ধন্যবাদ জানাতেও মুশকিল হয়ে পড়ে। আমি নিজেও সময় সময় এরকম মুশকিলে পড়েছিলাম। যেমন পড়েছি ফেসবুকে, তেমন পড়েছিলাম অনলাইনে লেখবার অন্যান্য দিনলিপিতে। এখানে একজন ছদ্মনামের লেখকের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। ছদ্মনামটি ছিল “বাংগাল”। এই নামের লেখকের আসল নামটি আজও জানা হলো না। জানা হলো না তার লিঙ্গ পরিচয়। অথচ এই লেখকের লেখার সাথে আমার হৃদয়ের সম্পর্ক বহু আগে থেকে। সম্মানিত লেখক “বাংগাল” এর প্রতিটি পোস্ট পড়তাম + মন্তব্যও লিখতাম।

যাক সেই লেখক আর লেখা, এই সোনেলা দিগন্তেও এমন বহু ছদ্মনামের লেখক দেখা যায়। তাদের লেখায় মন্তব্য দিতে মন চাইলেও দিতে দ্বিধাবোধ হয়। কেন হয়? হয় এই কারণে যে, দিদির জায়গায় যদি দাদা সম্মোধন করে ফেলি, তাই। অনেক সময় এরকম উল্টাপাল্টা করেও ফেলি। তখন আবার দ্বিতীয় মন্তব্য টেনে দুঃখপ্রকাশ করতে হয়।

এখানে উপরোল্লিখিত “ছদ্মনাম’র কবি ও লেখকদের বহুকাল থেকে মানুষ চিনে। তাদের ছদ্মনামের পাশাপাশি আসল নামও মানুষে জানে। সম্মানিত লেখক কবিদের এই ছদ্মনাম ইতিহাসের পাতায় লেখা। এই পৃথিবী নামক গ্রহটি যতদিন থাকবে, ততদিন তাঁরা এই ছদ্মনামেই মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবে। কিন্তু আমরা যারা ছদ্মনামের লেখক, তাদের মানুষে চিনবে জানবে কী করে? চিনবে শুধু ছদ্মনামধারী লেখকের পরিবারবর্গ। এ ছাড়া অন্য কেহ চেনার উপায় আছে বলে আমার মনে হয় না। কেননা, ছদ্মনামের “বাংগাল” যদি আমার সামনে দিয়ে হেটে যায়, তারপরেও আমি চিনবো না যে, এটা সম্মানিত লেখক “বাংগাল” বা “আকাশের তারা”।

বর্তমানে ছদ্মনামের ছড়াছড়ি চলছে সামাজিক যোগাযোগ সাইট ফেসবুকে। চলছে দেশের স্বনামধন্য অনলাইন ভিত্তিক লেখবার দিনলিপি ব্লগগুলোতেও। আগেকার সময় প্রতিবাদী লেখকদের লেখায় মানুষের মনে প্রতিবাদের ঝড় উঠত। তাঁরা মানুষের কল্যাণের জন্য লিখে যেতেন, তাই হয়ত তাদের ভয় ছিল। রাষ্ট্রের নজর এড়ানোর জন্য তারা ব্যবহার করতেন ছদ্মনাম। যাতে মানুষ সরাসরি তাদের না চেনে।

কিন্তু আজ আমরা যারা লেখালেখি করছি, তাদের মধ্যে সবার লেখাই কী প্রতিবাদী লেখা? কোনও ধর্ম অবমাননা লেখা? কোনও রাষ্ট্র বিরোধী লেখা? তাহলে কিসের ভয়? কেন ছদ্মনাম? কেন নিজের প্রোফাইলে নকল ছবি? কেন-ই-বা আত্মগোপনে থাকা? কেন-ই-বা কাছে থেকে দূরে সরে থাকা? এসব প্রশ্নগুলো শুধু থেকেই যায়, উত্তর মেলে না। আপনাদের কাছে কোনও উত্তর আছে কি?

শুভ জন্মদিন

শুভ জন্মদিন
লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

এসো হে পঁচিশে জানুয়ারী! পুনর্বার,
শুভবার্তা পৌঁছে দাও কর্ণে সবাকার।
আজিকার দিনে মোর হইল জনম,
কবিতায় লিখে কবি ভাণ্ডারী লক্ষ্মণ।

শীতের কুয়াশা যত কাটুক এবার,
পুলক জাগুক মনে আজি সবাকার।
বসন্তের আগমনে কবি আজি কয়,
মনে দাও সুখ শান্তি, সাহস দুর্জয়।

পুলকিত ধরা আজি শুভ জন্মদিনে,
আলোময় সারাবিশ্ব আঁধার বিহনে।
তরুশাখে বিহগেরা করিছে কুজন,
সোনালী কিরণ আজি ছড়ায় তপন।

এসো হে পঁচিশে জানুয়ারী বারেবার,
মুছে যাক সব কালো কাটুক আঁধার।
শীতের জড়তা যত কাটুক এবার,
আনো কঠিন উত্তাপ বসুধা মাঝার।

শুভ জন্মদিন আজি সকলেই কয়,
আপনবেগেতে হেরি বহিছে অজয়।
শুভেচ্ছার বিনিময়ে দিন হয় শুরু,
সবাকারে তাই আমি কহি জয়গুরু!

ঘন ঘন আসে বার্তা কেহ ফেসবুকে,
শুভ জন্মদিন কেহ কহে হাসিমুখে।
শুভ জন্মদিন যেন আসে বারেবার,
সৃষ্টি হোক নব-রূপে নব কবিতার।

কবিতার আসরের যত কবিগণ,
শ্রদ্ধা আর নমস্কার করুন গ্রহণ।
এসো হে পঁচিশে জানুয়ারী বসুধায়,
লিখেন লক্ষ্মণ কবি তাঁর কবিতায়।

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-৫

টাকার নোট গুলি ঘড় ভরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছিলো। তার পিছনে কিউতে দাঁড়ানো পাকিস্তানি লোকেরা তামাশা দেখছিল। নিশাত স্থির থাকতে পারেনি, কাচের কাউন্টারের উপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে লোকটার মাথার চুল টেনে ধরে বলেছিল ‘কিউ নেহি যায়গা ইয়ে তেরা বাপকা রুপিয়া হায় কিয়া দিখা তেরা সরকারি হুকুম দিখা। পিছন থেকে এক পাঞ্জাবি লোক এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো কিতনা রুপিয়া? যাদা নেই স্রেফ ৫০ রুপিয়া। শুনে সে কেরানীকে বলে বুঝিয়ে তারপর সে টাকা পাঠায়। সেই দিনই বুঝতে পেরেছিল স্বাধীনতা আমরা এখনো পাইনি। স্বাধীনতা আমাদের অর্জন করতে হবে। মামার বাসায় ২/১ দিন থেকে তারা সোজা চলে এসেছিলো ঢাকা ছেড়ে মানিকগঞ্জের অদূরে ছয়য়ানি গালা নামের ছোট্ট এক গ্রামে। মামার গাড়িই তাদের মালামাল সহ বানিয়া জুরি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলো। বর্ষা কাল বলে গাড়ি আর যেতে পারেনি। সেখানে থেকে নৌকায় করে এসেছিলো গালা ইউনিয়নের ছয় আনি গালা গ্রামে। তখন মুক্তি যুদ্ধের তোলপাড়। নিশাত সেই পোস্ট অফিসের ক্ষত এখনো ভুলেনি। গ্রামে তার সমবয়সী চাচা, অন্যান্য চাচাত ভাইদের সাথে বুদ্ধি পরামর্শ করে মুক্তি যুদ্ধে যাবার দিন তারিখ ঠিক ঠাক করে ফেললো। গোপন চুক্তি হলো। কে কে যাবে, কখন কোথা থেকে কি ভাবে যাত্রা শুরু হবে সব পরিকল্পনা অত্যন্ত চুপি চুপি করা হলো। কাক পক্ষীতেও টের পায়নি।
লুঙ্গী, গামছা, গুড় চিরা সব কিছুই বেধে রেডি। রাত ১২টায় চাচাতো ভাই শিহাব আরও কয়েক জনকে সঙ্গে নিয়ে আসলে এক সাথে রওয়ানা হবে। রাত জেগে বসে রইলো, এক সময় মোরগে বাগ দিল, কাকের কা কা ডাক শুরু হলো, পাখীরা কিচির মিচির করতে করতে বাসা ছেড়ে রওয়ানা হলো, ঘড়ের বেড়ার ফাঁক দিয়ে ভোরের মৃদু আলো এসে ঢুকল কিন্তু শিহাব এলো না। তার বদলে এলো বাবা।
কি, মুক্তি যুদ্ধে যাওয়া হলো না?

বাবা টের পেলেন কি ভাবে? কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না! কি জানি কোথায় কোন ভুল করে ফেলেছি সব পরামর্শ ফাঁস হয়ে গেছে! বাবা বললেন
তুমি কখনো গ্রামে থাকনি, গ্রামের কাচা রাস্তায় খালি পায়ে হাটনি, গাছে উঠতে পারো না, সাতার জানো না তুমি মুক্তি যুদ্ধ করবে কি ভাবে, তার চেয়ে চল বিজয় নগরে সুশীল বাবুর কাছে নিয়ে যাই উনি অন্তত তোমাকে মুক্তি যোদ্ধা না হোক উপযুক্ত ট্রেনিং দিয়ে তাদের সহকারী বানিয়ে দিবেন। এই দিয়েই মোটা মুটি দেশের কাজ করার সুযোগ পাবে।
যুদ্ধে যাওয়া হলো না বলে যতটা খারাপ লাগছিল নিজেকে যতটা নিঃস্ব মনে হচ্ছিলো, অকর্মণ্য মনে হচ্ছিলো বাবার কথা শুনে তা থেকে কিছুটা স্বস্তি পেলো। তখনই সুশীল বাবুর বাড়ির পথে রওয়ানা হলো। পনের বিশ মিনিটের মধ্যে চলে এলো। এখানে এসে দেখে তার মত অনেকেই সেখানে উপস্থিত এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো শিহাবও ওখানে রয়েছে। শিহাবের সাথে চোখা চোখি হতেই একটা ষড়যন্ত্রের আভাস দেখতে পেলো ওর চোখে মুখে। ও! আচ্ছা, তাহলে তুমিই এই কাজ করেছ?

স্কুলে যেমন স্কাউটিংয়ের ক্লাস হোতো, সুশীল বাবুও সেই ভাবে তার হবু মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সহকারীদের সামনে দাঁড়িয়ে হাতে একটা রাইফেলের মত কি এক অস্ত্র নিয়ে ভাষণ দিচ্ছিলেন। পাশে মেশিন গান রাইফেল এইগুলিও রয়েছে, পরে জেনেছে ওটার নাম স্টেন গান। বাবা আর সুশীল বাবু একই স্কুলে পড়তেন। বাবাকে দেখেই সুশীল বাবু থেমে গেলেন। এসো বাদশা, বাবার গ্রামের নাম বাদশা। বাবা নিশাতকে দেখিয়ে বললেন এই হলো আমার বড় ছেলে, একে আপনার কাছে দিয়ে গেলাম কাজে লাগাবেন। ওর খুব ইচ্ছা দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করে। সুশীল বাবু খুশি হয়ে ওকে কাছে টেনে নিয়ে মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন এমন ছেলেই আমার দরকার, যাও বাবা ওই ওখানে বস বলে হাত দিয়ে তার সামনের ব্যাটেলিয়ন যে খেজুর পাতার মাদুরে বসেছে সে দিকে দেখিয়ে দিলেন, বাবাও এক পাশে বসলেন। সুশীল কাকা আবার শুরু করলেন। কি ভাবে শত্রু পক্ষের এলাকা পার হয়ে নিজ দলের কাছে পৌঁছান যায়, কি ভাবে শত্রুকে আক্রমণ করতে হয়, নিজেকে রক্ষা করা, অস্ত্র রক্ষা করার নানা খুঁটিনাটি কৌশল তিনি বলে যাচ্ছেন। এই ভাবেই বেশ কয়েকদিন গেল। ভোরে আজানের পর থেকেই শুরু হয় আর বেলা একটু উপরে উঠলে যখন মানুষের চলা ফেরা শুরু হয় তখন শেষ হয়।

নিশাতের সারা দিন কাটে এ গ্রামে ও গ্রামে ঘুরে ঘুরে, সুযোগ পেলেই শিহাবদের বাড়ি। ওই বাড়িতে কি যেন অদৃশ্য এক সুতায় বাধা কি একটা আকর্ষণ আছে যা এখনো বুঝে উঠেনি। এদিকে শিহাবও ওর ঘনিষ্ঠ জনদের মধ্যে এক জন। ওই ঘটনার পর থেকে শিহাবের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না। একটু দূরে দূরেই থাকে। বুঝতে পেরে শিহাবই একদিন এগিয়ে এসে হাত চেপে ধরে বলল দেখ তুই আগরতলা থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসে কাজ করতে পারবি না জেনে বুঝেই আমি মইন চাচার সাথে পরামর্শ করে চাচাকে বলে দিয়েছিলাম। আমাকে ভুল বুঝবি না, তার চেয়ে এটাই ভালো হয়েছে এখানেও আমরা সবাই এক সাথে থাকতে পারবো।
নিশাতদের একটা চার ব্যান্ডের ট্রানজিস্টার ছিল। সন্ধ্যা হলেই পাড়ার প্রায় সবাই এসে জমা হতো ওদের বাড়ি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনার জন্য। নিশাত, শিহাব, মইন চাচা এরাও শুনত। বিশেষ করে চরম পত্র আর দেশাত্মবোধক গানগুলি।

দেশ স্বাধীন হবার আশা নিরাশার স্বপ্ন আর নানান আলাপ আলোচনার মাঝে দিনগুলি বৈশাখী ঝড়ের মত উত্তাল গতিতে ছুটে চলেছিল। সুশীল বাবুর দেয়া ট্রেনিং শেষ এখন তা কাজে লাগাবার পালা। এখন তার আদেশে সঙ্গী সাথিদের সাথে নিয়ে গোলা বারুদ, সংবাদ, রসদ ইত্যাদি পৌঁছানোর কাজ চলছিল। সুশীল বাবু নিশাতকে দূরে কোথাও পাঠাতেন না। তাই কাজ শেষ হতেই শিহাবদের বাড়ি। ওখানে না গেলে কি জানি কি একটা অপূর্ণ থেকে যায়, নানা ছল ছুতায় ও বাড়িতে যেতেই হয়। মূলত এই এখন থেকেই শিহাব আর যুঁইয়ের সাথে ঘনিষ্ঠতা। ও বাড়ি গেলেই যুঁইয়ের লাগামহীন ইয়ার্কি ফাজলামি সত্যেও যেতে হয়। বেশি দূরে না, ওদের বাড়ি থেকে দেখা যায়। মাত্র কয়েক পা পথ। পথই যেন কেমন করে টেনে নিয়ে যায়, সারা দিন যেখানে যাই হোক দিনের শেষে এক বার অন্তত যেতেই হয়। গায়ের সবুজ প্রান্তর, খোলা আকাশ, খোলা বাতাস নিশাতকে কানে কানে বলে যায় কি হলো নিশাত আজ তুমি এখনো যাওনি! বেচারা নিশাত আর কি করে তাই যায়। কাউকে কিছু বলতেও পারে না। এই যে মইন চাচা এতো কাছের মানুষ কোথায় কি হচ্ছে কি করছে তার সব কিছু চাচার কাছে না বলা পর্যন্ত স্বস্তি নেই সেই মইন চাচাকেও বলতে পারছে না। যা আছে তা শুধু তার একান্ত আপন মনেই আছে। কারো কাছেই তা প্রকাশ করতে পারছে না, কেমন একটা চাপা অস্থিরতা নিয়েই দিন গুলি চলে যাচ্ছে।

দিন কারো জন্যই থেমে থাকছে না। নিশাতের দিন গুলিও থেমে নেই, চলে যাচ্ছে। সুশীল বাবুর নির্দেশে কাজ করতে গিয়ে এলাকার অনেক কিছুই চেনা হয়ে যাচ্ছে, অনেক লোক জনের সাথে আলাপ পরিচয় হচ্ছে। এই ভাবেই এক দিন দেশ স্বাধীন হলো। পাকিস্তানিরা মিত্রবাহিনী ভারতীয় সৈন্যদের কাছে আত্মসমর্পণ করল। রেডিওতে খবর শুনে সবাই একে একে জড়ো হলো সুশীল বাবুর বাড়িতে। বিজয় পতাকা ওড়াতে হবে। আনন্দ হবে, উৎসব হবে, স্বাধীনতার উৎসব। বাসি স্বাধীনতার উৎসব নয়। স্বাধীনতা বার্ষিকী নয় একেবারে জীবন্ত স্বাধীনতা। সদ্য স্বাধীনতার উৎসব। এর কি কোন তুলনা আছে না কারো সাথে এর তুলনা করা চলে! কয়জনের ভাগ্যে এই উৎসব জোটে? এই দেশে আরও কত কোটি কোটি মানুষের জন্ম হবে কত কি হবে কিন্তু আজকের এই দিনের স্বাদ কজনে দেখবে? সুশীল বাবু নিশাতের হাতে এক টাকার একটা নোট দিয়ে বললেন যাও ঝিটকা থেকে বাংলাদেশের পতাকা কিনে আন। কোন রকম টাকাটা হাতে নিয়েই দৌড়। দেড় মাইল পথ প্রায় দৌড়েই এলো। একটা মুহূর্ত নষ্ট করার উপায় নেই। উল্লাস কমে যাবে, আনন্দের গতি ধীর হয়ে যাবে। সুখের স্রোতে ভাটা পরে যাবে। পতাকা কিনেই তা বগল দাবা করে আবার দৌড়। বাজার থেকে বেড় হয়ে এসে পথে গ্রামের মেঠো পথের পাশে সবুজ গম খেতের গমের শীষে বেধে কখন যে পতাকাটা আটকে রয়ে গেছে তা বুঝতে পারেনি। বাড়ির কাছে এসে যখন দেখে বগলের পতাকা নেই, কি হলো? আবার উলটো দৌড়। বেশ খানিকটা পথ এসে দেখে গমের শীষের সাথে পতাকা ঝুলছে। নিয়ে আবার দৌড়। বাড়িতে এসে দেখে বিশাল আয়োজন। সমস্ত এলাকার মানুষ চলে এসেছে। সবুজের মাঝে রক্ত লাল আর তার মাঝে দেশের মানচিত্র আঁকা পতাকা বাঁশের তৈরি মাস্তুলের মাথায় বেধে ওড়ানো হলো। হারমোনিয়াম তবলা রেডি ছিল, পাশে দাঁড়িয়ে সবাই স্বাধীন ভাবে, মনের উচ্ছ্বাসে চিৎকার করে এক সুরে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গাইল। সে যে কি শান্তি, কি উল্লাস তা কি আর ভাষায় বলা যায়? সে শুধু অনুভূতি দিয়ে অনুভবের। জাতীয় সঙ্গীতের পর আরও দেশাত্মবোধক গান হলো। কে যেন কলতা বাজার থেকে মিষ্টি এনেছিল। গানের পরে মিষ্টি বিলানো হলো। সুশীল কাকার বাড়িতে খেজুরের গুড় দিয়ে ক্ষীর রান্না হয়েছিল কলাপাতায় করে সে ক্ষীর বিলানো হলো। হৈ চৈ শেষ করে গভীর রাতে শিহাব এবং মইন চাচার সাথে বাড়ির দিকে রওয়ানা হলো। পথে আসতে আসতে ভাবছিল এমন দিনে নিরুকে এক নজর না দেখলে কি আর স্বাধীনতার সুখ পূর্ণ হয়? যে করেই হোক একবার যেতেই হবে। কি ছুতা ধরে এই এতো রাতে যাওয়া যায় তাই ভাবতে ভাবতে হাঁটছিল।

বেশি ভাবতে হলো না। বাড়ির কাছে আসতে শুনতে পেল ওই শিহাবদের বাড়ি থেকেই গানের সুর ভেসে আসছে। স্বাধীনতার উৎসবের ঢেউ এখানেও তোলপাড় হচ্ছে। জোসনা রাতে দুয়ারে খেজুর পাতার পাটি বিছিয়ে তাতে বসে সব বোনেরা মিলে গাইছে। সবার মাঝে বসা নিরুর কণ্ঠটাই বেশি করে কানে বাজছে। যে গান শুনে বাঙ্গালির রক্তে উত্তাল স্রোত বেয়ে উঠেছিল, যে গান শুনে বাঙ্গালি হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল সেই সব গান। বোনেরা হাতে তালি বাজিয়ে বাজিয়ে গাইছিল। নিশাতরাও এসে যোগ দিলো পাটির এক পাশে বসে। শিহাব তাড়া দিলো ‘এই এইভাবে শুধুই হট্টগোল করে গান গেয়ে কি উৎসব হয়, যা চা নিয়ে আয়। শুনেই নিরু মাঝখান থেকে লাফ দিয়ে উঠে এক দৌড়ে বাড়ির ভিতর চলে গেল। কিছুক্ষণ পরেই কয়েকটা কাপ, জগ ভরে চা আর তার সাথে এক গামলা গুর মুড়ি নিয়ে এলো এক এক করে। গুড় মুড়ি শেষ হলে আবার মেঘ বিহীন আকাশে বৃষ্টির মত সুরের ঝঙ্কার। চারিদিকে শীতের কুয়াশা ঢাকা মেঠো পথ বেয়ে সে ঝংকার ছড়িয়ে গেল দূরে অনেক দূরে। আজ যে পরিপূর্ণ স্বাধীনতার উল্লাস!
[চলবে]

হরধনু ভঙ্গ

[গুরুচরণ স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে কয়েকজন পড়ুয়া এবং দুইজন শিক্ষক। শিক্ষকরা আলোচনারত।]

অমায়িক পাড়ুইঃ তাহলে বলছেন আমার ছাত্ররা পুরোপুরি প্রস্তুত। মানে আসন্ন সাক্ষাৎকারের মোকাবিলায় ওরা তৈরী।
ঝিলমিল মুখার্জীঃ বললাম তো যা বলার বলেছি এবং যা করার করেছি।
অমায়িকঃ না মানে যদি একটু জোর দিয়ে বলেন তাহলে আমার ভরসাটা জমাট হয়, অর্থাৎ কংক্রীট হয়। আচ্ছা ম্যাডাম, আপনাকে কি আমি বলেছি আর ছ’মাস পরে আমার রিটায়ারমেন্ট?
ঝিলমিলঃ অসংখ্যবার বলেছেন। এইমাত্র আরো একবার বললেন। যদি কিছু মনে না করেন—শুনতে শুনতে আমি যেন হাঁফিয়ে উঠেছি।
অমায়িকঃ ও! আপনার বয়স কত?
ঝিলমিলঃ এটা আবার কি ধরণের প্রশ্ন? আমার বয়স ২৯।
অমায়িকঃ ঐ কারণে আপনি আমার ব্যাথা, বেদনা, উদ্বেগ, জ্বালা, আতংক কিছুই বুঝতে পারছেন না। আসলে উনত্রিশ বছরে কিছুই বোঝা যায় না। যখন আপনার বয়স হবে উনষাট বছর ছয়মাস তখন, কেবল তখনই আপনি সবকিছু গভীরভাবে। মর্মে মর্মে উপলদ্ধি করতে পারবেন।
ঝিলমিলঃ ও! আচ্ছা! শুনে আস্বস্ত হলাম যে একদিন আমি পারব। কিন্তু আজ তাহলে কি করব?
( বাইরে থেকে—আসব স্যার?)
অমায়িকঃ হ্যাঁ,হ্যাঁ, এসো, এসো। ( রাজিবুল প্রবেশ করে)
রাজিবুলঃ বসব স্যার?
অমায়িকঃ হ্যাঁ, বসবে বৈকি। বেঞ্চির উপর অবনত হয়ে বস। আর তোমার ওই দাঁতগুলি গোপন করে, মুখটি বন্ধ করে একটু ইতিহাস ভূগোলের চিন্তা কর—এই ম্যাডাম আপনি একটু দেখুন তো ও সব পারে কিনা।
( আসব স্যার? এইবার ফতিমা উঁকি মারে)
ঝিলমিলঃ এসো। ওইখানে বসো কোন গোলমাল করবে না।
এইসময় চীৎকার করে উৎপল নামের এক ছাত্র –
উৎপলঃ দিদিমণি, হামিদা দাঁত নিয়ে নখ কাটছে।
ঝিলমিলঃ চুপ! বলেছি না চীৎকার করবে না? একি হামিদা, তুমি আবার দাঁত দিয়ে নখ কেটেছ?
হামিদাঃ না, ম্যাডাম। ও মিথ্যা করে নালিশ করছে।
অমায়িকঃ না, না, নখ দিয়ে কখনও দাঁত কাটবে না। এতে দাঁতের ময়লা নখে গিয়ে বুকের অসুখ করতে পারে।
ঝিলমিলঃ কি?!
অমায়িকঃ আচ্ছা হামিদা অসুখ কথার মানে কি?
হামিদাঃ ওর মানে জ্বর ডায়েরিয়া নয়ত সর্দি-কাশি, বাতের বেদনা।
ফতিমাঃ তার কোন মানে নেই—আচ্ছা স্যার, অসুখ মানে ব্রণ বা ফোঁড়াও হতে পারে?
অমায়িকঃ চুপ! মুর্খের দল! আমি তোমাদের কাছে কোন অসুখের নাম চাইনি, অসুখ মানে জিজ্ঞাসা করেছি। যে মানে জানে না, সে কিছুই জানে না—আশা করি আমি কি বলতে চাইছি তা তোমরা বুঝতে পারছ?
ফতিমাঃ হ্যাঁ, কিন্তু ফোঁড়া কেন অসুখ হবে না সেটা বুঝতে পারিনি।
রাজিবুলঃ কিন্তু স্যার এমন কি কোন অসুখ হতে পারে যার কোন নাম নেই? আর যার নাম নেই তার থাকা আর না থাকা সমান নয় কি?
ফতিমাঃ তুমি চুপ করো। অসুখ কোন অসুখের নাম নয়, আর ফোঁড়া থাকা আর না থাকা কখনও সমান নয়।
ঝিলমিলঃ তোমার কি হয়েছে ফতিমা? তুমি তখন থেকে ফোঁড়া ফোঁড়া করছ কেন?
রাজিবুলঃ হয়ত ওটাই ওর অসুখ।
ফতিমাঃ হ্যাঁ হয়েছে।সারা পৃথিবীতেই কারও না কারো ফোঁড়া হয়। এই স্কুলের সক্কলের কখনও না কখনও ফোঁড়া হবে। রাজিবুল দেখো তোমারও হবে।
অমায়িকঃ ঝিলমিল,
ঝিলমিলঃ বলুন—
অমায়িকঃ এরা কারা? এরা কি সব আইনস্টাইন না প্লেটো? এরা একটা সামান্য কথা নিয়ে এত মাঞ্জা দিচ্ছে কেন? এত প্যাঁচ কষছে কেন? ও! আমি পাগল হয়ে যাবো, এদিকে ছ’মাস পরেই আমার রিটায়ারমেন্ট—
( বাইরে থেকে এক ভদ্রলোক প্রবেশ করে)
পরিদর্শকঃ এটাই কি গুরুচরণ স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়?
অমায়িকঃ হ্যাঁ, হ্যাঁ এটা ঐ বিদ্যালয়। মানে বিদ্যালয় হিসেবে আদর্শ আর খাঁটি। আপনি নিশ্চয় বিদ্যালয় পরিদর্শক?
পরিদর্শকঃ ঠিক অনুমান করেছেন। আপনি?
ঝিলমিলঃ উনি এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অমায়িক মান্না।
পরিদর্শকঃ নমস্কার।
অমায়িকঃ না, না, স্যার কি যে করেন? আমার এই ছমাস আর মাত্র চাকরি আছে –এখন আমি শুধু আপনাকে নমস্কার করতে চাই এক তরফা। আর দেখবেন স্যার রিপোর্টে যেন কিছু গোলমাল না হয়।
পরিদর্শকঃ মানে?
অমায়িকঃ সে আমি পরে বলব। এই তোমরা সব স্যারকে নমস্কার করো।
(সবাই তাই করে) (ক্রমশঃ)

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-৪

মাস্কাট আউটার এঙ্কারেজে পৌঁছে ফরিদাকে খুঁজে পেতে কোন অসুবিধা হলো না। ফরিদার এক মাইলের মধ্যে ওদের দেয়া ইটিএ অনুযায়ী ঠিক ভোর সাড়ে পাঁচটায় নোঙ্গর করে রেডিওতে গ্রে বাহরাইনকে জানিয়ে দিল।

ব্রিজের টুকিটাকি কিছু গোছগাছ করতে করতে সকাল ছয়টা বেজে গেল। ব্যাস, এখনকার মত ওর ডিউটি শেষ। এবার নিজের রুমে গিয়ে পোশাক বদলে আবার গরম গোসল দিয়ে একটু আগে তারেকের বানানো বিরাট দুই স্যান্ডউইচ খেয়ে আর ক্ষুধা নেই বলে সরাসরি বিছানায়। এয়ারকন্ডিশন রুমে কম্বল গায়ে শোবার প্রায় সাথে সাথেই ঘুম।

ঘুম ভাঙল দুপুর একটায়। উঠে সবাইকে ফরিদার নিমন্ত্রণের কথা জানালো।
অরুণ’দা বলল সবাই কি আর যেতে পারবো জাহাজ নোঙ্গরে রয়েছে জাহাজে থাকবে কে?
শুনে তারেক বলল আপনারা সবাই যান আমি থাকবো। শফিক ভাইর সাথে আমার একটু দরকার ছিল তা রাতে রেডিওতে কথা বলে সেরে নিয়েছি।
আচ্ছা বেশ তাহলে তুমি থাক।
নিশাত আবার এই সব সামাজিকতা নিয়ে বেশ সতর্ক। দেশে সব আত্মীয় স্বজন বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রাখার কাজটা সে নিরলস ভাবে নিয়মিত করে যেত। এটা ওর কাছে একটা দায়িত্বের মত মনে হতো। কারো কোন নিমন্ত্রণে সময় মতো হাজির হতো, বলতো অবশ্যই যাবো। যাবো না কেন, সমাজে বাস করি না? আমরা সামাজিক জীব না? এক জন আরেক জনের কাছে না গেলে কি হয়? অবশ্যই যেতে হবে!

বিকেলে জাহাজের ক্যাপ্টেনের অনুমতি নিয়ে নিলো। দুপুরে খাবারের পর শাহিনকে নিয়ে ওদের জাহাজে ইঞ্জিন চালিত রাবারের ডিঙ্গি পাম্প করে, ইঞ্জিনে তেল ভরে টেস্ট করে লাইফ জ্যাকেট, রেফট নিয়ে রেডি করে রেখেছিল। ক্রেন দিয়ে ডিঙ্গি নামিয়ে তাতে করে ফরিদায় এসে পৌঁছল। তারেক রেডিওতে বলে দিয়েছিল। কাছে এসে দেখে ওখানকার সবাই এসে জাহাজে ওঠার জন্য সিঁড়ি নামিয়ে জাহাজের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ইমরান, শফিক, হাবিব সবাই।
হাবিব এবার বল কি আয়োজন করেছিস।
আরে মাত্র এলি এখনি কি একটু ধৈর্য ধর দেখবি কি করেছি।
না তুই আগে বল, তুই তো জানিস আমার সমস্যা কোথায়, কত রিস্ক নিয়ে ডিঙ্গিতে করে এসেছি। শুধু তোদের ডিঙ্গি নেই বলে এসেছি না হলে কি আমাকে আনতে পারতি?
আরে বেকুব দেখ এই সাগরের দিকে তাকিয়ে দেখ কোন কিনারা দেখা যায়?
নতুন করে আবার কি দেখতে বলছিস, আমি সাগরে বাস করি না কি আকাশে বাস করি?
আচ্ছা এখন বল এই কুল কিনারাহীন সাগরে সাতার জানলেই কি আর না জানলেই কি! তুই যদি সাতার জানতি তাহলে সাতরে কোথায় যেতে পারতি কোথায় গিয়ে উঠতি?
জ্ঞান দিয়ে ভুলাতে পারবি না, মাস্টারি করিস না বল কি করেছিস।
আরে পাগল এখনি কি এখন একটু ড্রিঙ্কস খা খাবার সময় হোক তখনই দেখবি।
না তুই বল।
তাহলে চল গ্যালিতে (জাহাজের কিচেন) চল, নিজেই দেখ।
সত্যিই গ্যালিতে গিয়ে দেখেত নিশাতের মাথা খারাপ হবার অবস্থা। চিংড়ি ভর্তা, শুঁটকির ঝুরি, রূপ চান্দা মাছ ভাজি, তাজা ম্যাকারেল মাছ ভুনা, মাংস ভুনা আর পাতলা ডাল।
রূপ চান্দা কোথায় পেলি?
বলিস না কুয়েত থেকে আসার পথে দেখি জেলেরা ফিশিং ট্র্যাপ ফেলে রেখেছে, জাহাজ কাছে নিয়ে ক্রেন দিয়ে সেই ট্র্যাপ উঠিয়ে দেখি বোঝাই মাছ। সব নিয়ে এসেছি। এই ম্যাকারেলও। অনেক মাছ ছিল। তোরা যাবার সময় কিছু নিয়ে যাবি।
নিশাত এবার একটু শান্ত হলো।
চল এবার সেলুনে চল।
কেক আর কোক খেতে খেতে হৈ চৈ। শাহিন মহসিনের নাচা নাচি, টেবিল ঠুকে তবলা বাজিয়ে গান সবই হলো।
চল এবার খেতে যাই।
হ্যাঁ যাবো তবে তারেক একা রয়েছে ওর জন্য আগে কিছু দিয়ে দে না হলে পরে মনে থাকবে না।
সত্যিই হাবিব কয়েকটা প্যাকেটে করে তারেকের জন্য এই সব অমূল্য খাবার আর ফ্রিজ খুলে দুই বালতি ভরা মাছ ওদের ডিঙ্গিতে নামিয়ে রেখে এলো। এবার সবাই খেতে বসল। ফরিদার বাঙ্গালি কুক চিটাগাংয়ের আব্দুল হাই, চমৎকার সব রান্না করেছে। নাক পর্যন্ত ডুবিয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে আবার এক তরফা আড্ডা দিয়ে রাত নয়টায় জাহাজে ফিরে এলো।

২।
ফরিদা থেকে ফিরে এসেই কম্বল গায়ে বিছানায় শুয়ে পরেছে। রাত বারোটায় ডিউটি। যদিও নোঙ্গর করা অবস্থায় ডিউটি তেমন কিছু না শুধু কয়েকটা বিয়ারিং দেখা এবং রাডারে চোখ রাখা। নোঙ্গর পিছলে জাহাজ সরে যাচ্ছে কি না তাই লক্ষ রাখা। চা, কফি, জুস কোক যা খুশি যত খুশি খাও। ব্রিজে বসে যা খুশী কর কোন বাধা নেই শুধু নিদ্রা দেবীর আরাধনায় মগ্ন না হলেই হলো। সেই রকম শিক্ষাই দিয়েছে তাদের বিভিন্ন ক্যাপ্টেন। বলতেন ইউ আর গোইং টু বি এ কিং অফ এ স্মল কিংডম সো, ইউ স্যুড গ্রো দ্যাট ওয়ে, আই ডিজায়ার দিস। ইওর এটিচুড, ইওর ম্যানার স্যুড বি লাইক দ্যাট, ইউ স্যুড নট বি এন অর্ডিনারি ম্যান ইউ স্যুড বি এ পারফেক্ট জ্যান্টল ম্যান, দিস ইস মাই ড্রিম। ঠিক এই রকম কঠিন নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে থেকে নিশাত হয়ে উঠেছে একজন আদর্শ মানুষ।

অথচ সে সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘড়ের ছেলে। জন্ম নানা বাড়ি ঢাকা শহরের অদূরে। বাবা মার প্রথম সন্তান হিসেবে বেশ আদর যত্নেই বেড়ে উঠেছে। ছোট বেলা থেকেই সৌখিন জীবন যাপন তার পছন্দ। তবে বাবার সাধ্য সীমার বাইরে কখনো কিছু দাবী করেনি। পোশাক আসাক যাই ছিল তা চকচকে ইস্ত্রি করা ছাড়া কোন পোশাক তাকে কেও কখনো পড়তে দেখেনি। পায়ের জুতা জোড়াও সবসময় চকচক করতো। সেই ছোট বেলায় যখন সে মাত্র থ্রিতে পড়তো তখন থেকেই নিজের কাপর কয়লার ইস্ত্রিতে পাখা দিয়ে বাতাস করে কয়লা জ্বালিয়ে ইস্ত্রি করে পড়তো। নিজের জিনিষ পত্র ঘড় দরজা নিজেই গুছিয়ে পরিষ্কার করে রাখতো। নিজের স্কুলের কাপর চোপর ধুয়ে শুকিয়ে ইস্ত্রি করে গুছিয়ে রাখতো, সাথে বাবা মার কাপরও ইস্ত্রি করে দিত মাঝে মাঝে। তবে জুতা পালিশের ব্যাপারে তার একটা খুঁতখুঁতানি ভাব থেকেই যেত। এই কাজটাতে সে কখনোই তৃপ্তি পেত না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে জুতা পালিশ ওয়ালাদের দেখত কেমন করে তারা জুতা পালিশ করছে। আবার বাড়ির কাছের লন্ড্রির সামনে দাড়িয়েও দেখত তারা কোন কাপর কি ভাবে ইস্ত্রি করছে। বাসায় এসে সেই ভাবে চেষ্টা করতো। এভাবেই অনেক কিছু শিখে নিয়েছিলো। কুলি মজুর, ঠ্যালা গাড়ি ওয়ালা, কাঠ মিস্ত্রী, আকাশ, বাতাস, নীল প্রশান্ত সাগর, মাটির ধরণী, কারো কাছ থেকে শেখার কিছু বাকী রাখেনি। ওর বিশাল কৌতূহলী মন যার কাছে যা পেত তাই ধরে রাখত। মা যখন সেলাই মেশিন নিয়ে বসতেন তখন তার কাছে বসে দেখত মা কি ভাবে কেঁচি দিয়ে কাপর গুলি কেটে তা আবার সেলাই করে কি সুন্দর জামা পাজামা বানিয়ে ফেলছে। ওর অবাক চোখ শুধু বিস্মিত হত।

সব কাজের লোকদের বেশ সমীহ করে চলতো, কখনো কাউকে ছোট ভাবতে পারতো না। এরা কি সুন্দর করে সব কিছু বানিয়ে ফেলছে এই থেকে তাদের প্রতি একটা শ্রদ্ধা বোধ আসতো ওর মনে। সংসারের কাজ মা একাই করতেন বাসায় কোন কাজের মানুষ ছিল না তাই সবসময় মাকে এটা ওটা কাজে সাহায্য করত। আটা মাখা, ঘড় ঝাড়ু দেয়া, কাপর গুছিয়ে রাখা থেকে শুরু করে ছোট ভাই বোনদের কান্না থামানো এমনকি রান্নার কাজেও মাকে সাহায্য করতো। সার্টের বোতাম ছিঁড়ে গেলে কিংবা কোথাও একটু সেলাই খুলে গেলে নিজেই ঠিক করে নিতো মাকে কখনো বলতো না। এই ভাবেই ধীরে ধীরে কখন যেন সংসার নামের বিশাল নাট্য মঞ্চের সকল কুশীলবের অভিনয় তার মুখস্থ হয়ে গেছে তা সেও বুঝতে পারেনি। মা শেখাতেন কি ভাবে বাজার থেকে তাজা সবজী চিনে কিনতে হয়, কি ভাবে তাজা মাছ চেনা যায়, বাসায় নতুন অচেনা কোন অতিথি এলে তার পরিচয় কিভাবে জানতে হয়, কি ভাবে অতিথি আপ্যায়ন করতে হয়, কোথায় কখন কি খেতে হয় কি খেতে হয় না। সব কিছু।

বাবা মাসের প্রথমে বেতন পেয়ে বাসায় এসে খেয়ে দেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বাজারে যাবার সময় নিশাতকে সাথে নিয়ে যেতেন। সেদিন সকাল থেকে মাকে দেখত তেলের বোতল, বাজারের ব্যাগ ধুয়ে মুছে শুকিয়ে রাখতে, বাজারের লিস্ট করতে আর তাই দেখে নিশাত বুঝতে পারতো আজ মাসের প্রথম, নিশ্চয়ই বাবা বাজারে যাবেন। বাবার সাথে বাজারে যেয়ে লক্ষ করতো বাবা কোন দোকান থেকে কি কিনছে, কি ভাবে দামাদামি করছে, কোন দোকানে কি জিনিষ পাওয়া যায়। বাজার শেষ করে সাইকেলের চার চাকার ঠ্যালা গাড়িতে মালামাল উঠিয়ে দিয়ে বাসার ঠিকানা দিয়ে দিতেন গাড়ি ওয়ালাকে। সে বাসায় মাল পৌঁছে দিত। আর ওদিকে বাবা তাকে নিয়ে যেতেন মিষ্টির দোকানে। দেখ বাবা তোমার কি পছন্দ। নিশাত ঘুরে ঘুরে চানাচুর, ডাল ভাজা কিংবা বাদাম ভাজা দেখিয়ে দিত আর তাই দেখে বাবা রসিকতা করেই বলতেন তোমাকে নিয়ে এলাম মিষ্টি কিনতে আর তুমি এসব কি দেখাচ্ছ?
হ্যাঁ মা তো মিষ্টি খায় না তাই মায়ের জন্য এগুলি নিবেন।
ও আচ্ছা আচ্ছা বেশ তাহলে বল তোমার জন্য কি নিবে?
একটা কিছু হলেই হবে।
মিষ্টি আর ঝাল কিছু নিয়ে বাবার হাত ধরে বাসায় এসেই মার হাতে ঠোঙ্গাটা দিয়ে দিত। বাবা সরকারি চাকরী করতেন কিন্তু তিনি ছিলেন অত্যন্ত ন্যায় পরায়ণ লোক, কোন অসদুপায় অবলম্বন করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। যা বেতন পেতেন সচ্ছল ভাবে না হোক মোটা মুটি ভাবেই চলে যেত, বিলাসিতা করা হয়ে উঠত না। এখনো নিশাতের পরিষ্কার মনে আছে যখন সে ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে উঠেছিল তখন স্কুলের টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে বাবার হাতে কিছু টাকা তুলে দিয়ে একটা ইলেকট্রিক ইস্ত্রি কিনে আনার জন্য বলেছিল। বাবা তাই দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন তুমি এতো টাকা কোথায় পেলে? যাই হোক সেই দিনই বাবা সন্ধ্যায় দোকানে গিয়ে একটা ইস্ত্রি কিনে এনেছিলেন। নতুন চকচকে ইস্ত্রি পেয়ে নিশাতের আনন্দ দেখে কে, বারবার উলটে পালটে দেখছে। প্লাগে কানেকশন দিয়ে দেখে নিলো গরম হচ্ছে কি না। গরম হতে দেখে সে যে কি খুশী। সাথে সাথেই নিজের স্কুলের জামা প্যান্ট, বাবার জামা মায়ের শাড়ি সব ইস্ত্রি করে ফেললো।

পাকিস্তানের করাচী শহরেই এতদিন বড় হয়েছে। সবে মাত্র স্কুল ফাইনাল শেষ হবার পর পরই শুরু হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। যুদ্ধ চলা কালীন জুলাই মাসে ওরা করাচীর সব ছেড়ে চলে এলো নিজ দেশে। ঢাকা এয়ারপোর্টে নামার আগেই প্লেনের জানালা দিয়ে দেখতে পেল পাকিস্তানি আর্মিরা নানা রকম অস্ত্র হাতে এয়ারপোর্ট ঘিরে রেখেছে। দেখেই মেজাজ বিগড়ে গেল। বাবা মা যেতে দিক বা না দিক আমিতো অবশ্যই মুক্তি বাহিনীতে যাব, তখন দেখবি মজা। ব্যাটারা পরের দেশ দখল করে রেখেছ আবার অস্ত্র দেখাচ্ছ? এয়ারপোর্টের বাইরে এসে দেখে মেঝ মামা দড়িয়ে আছেন। বাবা আগেই টেলিগ্রাম করে জানিয়ে রেখেছিলেন।
মামার গাড়িতে করে তার ধানমন্ডির বাসায় এলো। পথে বৃষ্টি ভেজা, কাদা মাখা চাপা রাস্তা, শেওলা ধরা দালান কোঠা দেখে মনটা দমে গেল। পরক্ষনেই আবার মনে জোড় ফিরে এলো যাই হোক এই হলো আমার নিজ দেশ। পরের চাকচিক্য দেখে ভুলে থাকলে চলবে না, নিজের যা আছে তাই নিয়েই মাথা উঁচু করে বাচতে হবে, এরই নাম জীবন, এরই নাম স্বাধীনতা। আবার মনে হলো এইতো যুদ্ধ শুরু হবার পর এখানে আসার মাস দুয়েক আগে বাবা দাদির জন্য কিছু টাকা পাঠাতে দিয়েছিলেন। করাচী শহরে তাদের স্থানীয় পোস্ট অফিসে গিয়ে টাকা সহ মানিঅর্ডার ফরমটা পোস্ট অফিসের কেরানির হাতে দেয়ার পর যখন সে দেখল ইস্ট পাকিস্তানে যাবে তখনই সে ফরমটা ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলো মুখে বলেছিল ইস্ট পাকিস্তানমে রুপিয়া নেহি যায়গা, ভাগো ইহাছে।
[চলবে]

শব্দনীড় অনলাইনে থাকা কতটা দরকার মতামত জানতে চাই

সতত অপর্যাপ্ততা এবং অর্থপ্রাপ্তির সুনিশ্চিত সম্ভাবনা না থাকার পরও শব্দনীড় ব্লগ গত এপ্রিল’১৮ থেকে অনিয়মিত ভাবে দুই দফা বন্ধের পর নিয়মিত ভাবে চলছে।

শব্দনীড় লেখকরা কেউ হয়তো স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আবার কোন কোন লিখা আরোপিত। তাদের কেউ কেউ তাদের লিখায় পাঠক মন্তব্যের উত্তর করছেন, কেউ নিজের পোস্টে তো উত্তর করেছনই না উপরন্তু অন্যের লিখা পড়া দূরে থাক; পাঠ প্রতিক্রিয়ায় একটি শব্দও খরচা করছেন না। নিজে লিখুন এবং অন্যের লিখা পড়ুন, মন্তব্য এবং প্রতি-মন্তব্যে ব্লগিং হোক আনন্দের এটাই ছিলো শব্দনীড় এর চাওয়া। এই চাওয়া কতটা পূরণ হয়েছে মূল্যায়নের ভার আপনাদের উপর রইলো।

শব্দনীড়কে বাঁচিয়ে রাখতে আপনাদের সঙ্গ এবং আর্থিক অনুদান দুটোই প্রয়োজন। যা সম্ভব দশের সহযোগিতা এবং আন্তরিকতা ভালোবাসায়। দুঃখজনক যে আমরা ২/৩ হতে পেরেছি; দশ হতে পারিনি। প্রয়োজন এককালীন বাৎসরিক খরচা। প্রতি মাসে শব্দনীড় ব্যায় কম বেশী প্রায় ৩,৫০০ টাকা। বাৎসরিক হলে কিছুটা সাশ্রয়।

ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের প্রদর্শনের আবাহন করা হলেও কোন সাড়া মেলেনি। দুই একজন ক্ষুদ্র বা আংশিক সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে এলেও ধীরে ধীরে তাও হিমঘরে যাবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এভাবে অনলাইন প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না। যেখানে পারস্পরিক সম্পর্কও দিন দিন দূরত্ব বাড়িয়ে চলে !!

আপনার অনুদান ছোট হলেও ক্ষতি নেই। শব্দনীড় এর হিসাব খাতে স্বনাম প্রকাশ অথবা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হিসেবেও আপনি থাকতে পারেন শব্দনীড়ের পাশে। যে কোন অনুদান পাঠাতে শব্দনীড় এর অফিশিয়াল এবং পার্সোনাল হিসাব নাম্বার সংগ্রহে রাখুন। শব্দনীড় সর্বজনীন। মুক্ত বাক্ স্বাধীনতায় শব্দনীড় সকলের পাশে।

প্রবাস থেকে :

13014951_1264109813618225_1805744498_n

Azad Kashmir Zaman
Mobile # 01743 918 919
NID : 464 228 1987
www

শব্দনীড় অনলাইনে থাকা কতটা দরকার আপনার মতামত জানতে দিন।

কবি কাকাতুয়া ( একাংক নাটিকা)

একটি মধ্যম আলোকিত কক্ষ। একটি বড় ও একটি ছোট টেবিল। একপাশে ডাঁই করে রাখা কিছু প্লাষ্টিকের চেয়ার। পেছনে কাঠের তিনতাকে কিছু নূতন পুরানো বইপত্র। এক যুবতী চেয়ারে বসে একমনে কিছু পড়ছেন। উপরে একটি ব্যানারে লেখা ধ্রুবতারা কবিতা ক্লাব।
মনোঃ ভেতরে আসতে পারি আজ্ঞে?
যুবতীঃ আসুন।
মনোঃ নমস্কার।
যুবতীঃ নমস্কার।
মনোঃ ধ্রুবতারা ক্লাবের সম্পাদক কি আপনি?
যুবতীঃ তা বলতে পারেন। আমি সম্পাদক মন্ডলীর একজন।
মনোঃ আজ্ঞে! পুনরায় নমস্কার।
যুবতীঃ হুম! এত ঘন ঘন নমস্কার দিচ্ছেন কেন?
মনোঃ আজ্ঞে! একটা ভদ্রতা হিসেবে আর একটা ঐ মন্ডলীর সদস্য হিসেবে মোট দুটো দিলাম।
যুবতীঃ বুঝলাম। কিন্তু উদ্দ্যেশ্য কি সেটা বলুন।
মনোঃ আজ্ঞে! বলব বলেই এসেছি।
যুবতীঃ অত আজ্ঞে আজ্ঞে করছেন কেন বলুন তো?
মনোঃ আজ্ঞে! ওটি হল প্রাচীন বাংলার বাগধারা।
যুবতীঃ কিন্তু আমি তো প্রাচীন নই। তাই কি?
মনোঃ আজ্ঞে না। আপনি মনোহর। পীন পয়োধর।
যুবতীঃ কি! কি! বললেন আপনি?
মনোঃ আজ্ঞে আপনি ভেরোনিকা আর নয়ত মালবিকা।
যুবতীঃ নট দ্যাট! নট দ্যাট! তার আগে যেটা বললেন।
মনোঃ ( একটু চিন্তা করে) আজ্ঞে আগের কথা বড্ড ভুলে যাই। তবে ডাক্তার বলেছে চিন্তার কিছু নাই।
যুবতীঃ ওঃ! হোপলেস!( চীৎকার) আপনি এবার থামবেন?
মনোঃ আজ্ঞে আপনি বললে থামব নতুবা এগোব।
যুবতীঃ হোয়াট ননসেন্স! এগোবেন মানে?
মনোঃ আজ্ঞে! জীবনের লক্ষ্যের পানে এগিয়ে চলাই মানব ধর্ম।
যুবতীঃ (আশ্বস্ত হয়ে) তাই বলুন! আমি ভাবলাম আপনি আমার দিকে এগোতে চাইছেন।
মনোঃ আজ্ঞে! মধ্যিখানে টেবিল কি করে এগোই!
যুবতীঃ (উত্তেজিত হয়ে) তাই বলুন! টেবিল না থাকলে কি করতেন আপনি? (ড্রয়ার থেকে একটা আপেল কাটা ছুরি বার করে) বলুন কি করতেন?
মনোঃ (দু-পা পিছিয়ে) ম্যাডাম! আপনি কি পাগল?
যুবতীঃ আমি নয়, আপনি পাগল! আর আমি খুব ভাল করে জানি আপনার মত পাগলদের কি করে শায়েস্তা করতে হয়।
মনোঃ পাগল তো নয় ম্যাডাম। আমি একজন কবি।
যুবতীঃ (থমকে গিয়ে) কবি? কি নাম আপনার?
মনোঃ আজ্ঞে! আমার নাম মনোবর। বড় বড় কবিরা আমার বন্ধু।
যুবতীঃ কি নাম আপনার বড় বড় কবি বন্ধুদের? বলুন, চুপকরে থাকবেন না।
মনোঃ এলোমেলো টুম্পা, তারপর ঝুম্পা, তারপর বিক্রমাদিত্য প্রভৃতি।
যুবতীঃ না। কোন চেনা নাম পেলাম না। আপনার কথা একটুও বিশ্বাস করিনা।
মনোঃ আপনার নাম কি ম্যাডাম?
যুবতীঃ কেন? আমার নাম জেনে আপনি কি করবেন?
মনোঃ আজ্ঞে আপনার হাতে আমার রচনারাশি সমর্পন করব।
যুবতীঃ কি রচনা করেন আপনি?
মনোঃ আজ্ঞে! আমি যে কোন গদ্যকে পদ্যে রূপান্তর করতে পারি।
যুবতীঃ বটে! যে কোন গদ্যকে তাই না? বেশ যান ঐ চেয়ারে গিয়ে বসুন।
(আগন্তুক একটি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে।)
যুবতীঃ যে কোন গদ্যকে আপনি পদ্যতে রুপান্তর করতে পারেন। তাই তো? বেশ। ‘সে কাল এখানে এসেছিল’ এই বাক্যকে পদ্যে রূপান্তরিত করুন।
(আগন্তুক মাথা নীচু করে একটি কাগজে কলম দিয়ে কিছু লিখতে থাকে। এই সময় ফোন বাজে। যুবতী ফোনে কথা বলে)
যুবতীঃ আমি না তোমাদের ব্যাপারগুলো শুধু দেখি। তোমাদের রোজই কত যে কাজ থাকে। এখানে আবার এক উদ্ভট এসে হাজির হয়েছে। হাঃ হাঃ! মজার ব্যাপার। চলে এসো দেখতে পাবে। কতক্ষন? ও আচ্ছা! রাখছি। ( আগন্তুকের দিকে চেয়ে) কি হল আপনার কবিবর? কতক্ষণ লাগাবেন?
মনোঃ আজ্ঞে কাজ সম্পন্ন হয়েছে। শোনাব?
যুবতীঃ হুম! শোনান।
মনোঃ প্রথমে সাধারন রূপ শোনাই। গদ্যরূপ-সে এখানে এসেছিল। সাধারণ পদ্যরূপ হবেঃ ‘এসেছিল হেথা সে।’ গদ্য কবিতায় ওটা হবেঃ ‘তার পায়ের ধূলোয় এদেশ ছিল।’ আমার প্রিয় কবি এলোমেলো টুম্পা স্টাইলে লিখলে এটা হবেঃ ‘হতচ্ছাড়া সেই পা দুটো/ দুয়ার আমার টপকেছিল/ আমার শূন্য আকাশগুলি/ প্রশান্ত কাল মুচড়ে দিল।’ যদি জয় গোস্বামী স্টাইলে লিখি তাহলে ওটা হবেঃ ‘এই তো এইখানে থ্যাবড়ান পদছাপ তার/ তার মানে মুন্ডহীন ধড় একটা / কি যেন এক নামও ছিল।’
যুবতীঃ ( বিস্মিত হয়ে) হুম! পাস মার্কের মত হয়েছে। আচ্ছা কারো স্টাইল ফলো না করে আপনার নিজের স্টাইলে এই গদ্যটা পদ্যে অনুবাদ করুন তো।
মনোঃ আজ্ঞে! গদ্যটা বলুন।
যুবতীঃ ‘রাত ভোর বৃষ্টি হল’ এই হচ্ছে আপনার গদ্য।
মনোঃ ( আবার লেখে। তারপর মুখতুলে বলে) আঁধার চিরে আঁধার ফুড়ে / আকাশ ভেঙে রাত্রিভোর/ জলের চাদর সব ডোবাল/ রাস্তা-নালা এ ঘরদোর।
যুবতীঃ দেখুন আমার আক্রমণাত্মক ব্যবহারের জন্য আমি দুঃখিত। মানে আমাদের মধ্যে একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে বাট ওটা এমন কিছু ব্যাপার নয়।
মনোঃ আজ্ঞে! ঐ ভুল বোঝাবুঝির একটা পদ্যরূপ দিয়ে দেব?
যুবতীঃ না, না, না, সেটা দেবার কোন দরকার নেই। প্লীজ! ওটা আপনি করতে যাবেন না। আসুন না আমরা অতীতটাকে টোট্যালি ব্ল্যাকআউট করে বর্তমান নিয়ে আপনাকে আমাকে নিয়ে, বাংলার কবিতা নিয়ে নতুন করে কিছু ভাবি।
মনোঃ আজ্ঞে! যা বলেছেন! শুধু ঐ টেবিল আর ছুরিটা যদি না থাকত তবে কবিতা এক অন্যধারায় ঝরে পড়তে পারত! হাঃ! হাঃ! হাঃ!
অতঃপর উভয়ে হাসতে হাসতে পরস্পরের দিকে একটু আগিয়ে মঞ্চে স্থির হয়ে যায়।
সমাপ্ত

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-৩

আমাদের দেশের কেউ যদি এই ভাবে কোন দেশে পৌছাতে পারত তাহলে আমরাও আজ বিশ্বজুড়ে রাজত্ব করে বেড়াতাম। কি জানি তারা কেউ কি এভাবে চিন্তা করেছিলো? মনে হয় না। কারণ ইতিহাস দেখলে দেখা যায় আমাদের

দেশের কোন নাবিক টেন্ডল বা সারেঙ্গের উপরে যেতে পারেনি। তাদের কারো কি ক্যাপ্টেন হবার সাধ জাগেনি? জাগলে কি আর এমন হতো! নিজেই নিজের প্রশ্নের জবাব দেয়। হঠাৎ করেই ওর ভাবনার তার ছিড়ে যায়। এতক্ষণে কফি শেষ হয়ে গেছে, অনেকক্ষণ খালি কফির কাপ স্ক্রিনের এক পাশে না নামিয়ে রেখে হাতেই ধরে বসে সামনে তাকিয়ে ভাবছিল।
ঘড়ির দিকে তাকাল, পরবর্তী পজিশন নেয়ার সময় হয়েছে। এবার উঠে এলো। রাডারের পর্দায় চেয়ে দেখে প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরে সামনের পাঁচ ডিগ্রি ডানে একটা জাহাজ দেখা যাচ্ছে। ঘড়িতে আবার সময় দেখে চার্ট টেবিলের কাছে এসে পজিশন নিয়ে নিলো। জাহাজ কোন দিকে ড্রিফট করেনি। স্টিয়ারিং হুইলের সামনে জাইরো কম্পাসের মনিটরে তার নিজের হেড দেখে নিলো, জাহাজ কত ডিগ্রী কোর্সে চলছে। কোর্স ঠিক আছে। একটু পরে আবার রাডারের পর্দা। যে জাহাজ দেখা গিয়েছিল সেটা তাদের স্টার বোর্ড (ডান) সাইড দিয়ে পিছনের দিকে চলে যাচ্ছে। আজকের মত ছয়টা বেজে গেল, আবার অরুণ এলো।

তাকে সব কিছু বুঝিয়ে দিল, তার এই সময়ের মধ্যে জাহাজ তেমন কিছু ড্রিফট করেনি। শান্ত সাগরে ড্রিফট করবেই বা কেন তা ছাড়া তারেক ভালো স্টিয়ারিং করে। নিজের রুমে এসে পোশাক বদলে গোসল দিয়ে চলে গেল সোজা কিচেনের পাশে ডাইনিং রুমে। খেয়ে দেয়ে এসে কিছুক্ষণের জন্য সেলুনে বসল। সাগরের মাঝে কোন টিভি চ্যানেল পাবে না। জাহাজ চলছে, সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত নয়ত ঘুমে। সেলুনে দাবা, তাস বা সময় কাটাবার মত অনেক কিছুই আছে ওগুলি সে কোনটা পছন্দ করে না। কোন রকমে এক বোর্ড খেলেই আর দাবার চাল দিতে পারে না কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়। ঘোড়া চালিয়ে দেয় সোজা কিংবা নৌকা চালায় ঘোড়ার মত আড়াই ঘর পাশে আর তাস দেখলেই মাথা ঘুরে।
প্রজেক্টরে একটা সিনেমা চালাল কিন্তু, বেশিক্ষণ বসা যাবে না নাইট নেভিগেশন আছে। চলন্ত জাহাজে ডিউটির সময় ঝিমানোর কোন উপায় নেই। তাড়াতাড়ি ঘুমুতে হবে। বিশ পঁচিশ মিনিট দেখে এসে শুয়ে পরল। কখন যে কি কি সব আজগুবি ভাবনা কোথা থেকে যে উড়ে এসে মাথায় ভিড় করে কে জানে। দিনের ভাবনার মধ্যে অনেকটাই নিরুর দখলে থাকে। তারপর আবার নতুন যোগ হয়েছে লাল পাড় নীল শাড়ি। মনে হচ্ছিল গভীর নীল সাগরের পাশ দিয়ে লাল স্রোতের একটা নদী বয়ে যাচ্ছে। সেই মেয়েটি, যার জন্য শাড়িটি কিনেছে তাকে এই শাড়িটা কি বলে দিবে? আদৌ কি দেয়া হবে তাই ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে।

রাত পৌনে বারোটায় শাহিন এসে ডেকে দিল। জাহাজে এই নিয়ম। পরবর্তী ডিউটির লোকদের ঘুম থেকে ডেকে দেয়া। উঠে চোখ মুখ ধুয়ে ডিউটির পোশাক বদলে হাতে একটা সোয়েটার নিয়ে এলো। রাতের খোলা সাগরে শীত লাগতে পারে। তারেককে নিয়ে এক সাথে ব্রিজে এলো। ওদের দেখে অরুণ’দা হেসে ইয়ার্কি করে বলল গুড মর্নিং ক্যাপ্টেন নিশাত, ওরা দুই জনেই এক সাথে তার জবাবে বলল
গুড মর্নিং টু ইউ। ওকে স্যার- নাউ ইউ ক্যান গো টু বেড এন্ড হ্যাভ এ গুড ড্রিম।
অরুণ’দা নিশাতের সিনিয়র কিন্তু হাসি তামাশা ইয়ার্কি ফাজলামি সমানে চলে। তারেক এগিয়ে গেল মিজানের স্টিয়ারিং সিটের পাশে। মিজান চলে গেল তারেক ওর সিটে বসল স্টিয়ারিং হুইল ধরে।
নাও দেখ চার্ট দেখে নাও বলে অরুণ’দা চার্ট টেবিলের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল ঘণ্টা খানিক পর কোর্স চেঞ্জ করতে হবে।
চার্টে রুট প্ল্যান দেখে নিশাত বলল আচ্ছা ঠিক আছে। কোর্স কত চলছে?
বলেই কম্পাসের দিকে দেখে নিলো।
আচ্ছা ঠিক আছে আপনি যেতে পারেন, নাকি একটু কফি খেয়ে যাবেন?
তুমি যা বল না! এখন যাবো ঘুমাতে আর তুমি বলছ কফি খেতে!
তাতে কি, সব কিছু ঠিক ঠাক থাকলে আপনি ঘুম থেকে উঠে দেখবেন জাহাজ মাস্কাটের আউটারে নোঙ্গর করে আছে। আচ্ছা গ্রে বাহরাইনকে কি আমাদের স্পেন ইটিএ (এস্টিমেটেড টাইম অফ এরাইভ্যাল) জানিয়েছেন?
হ্যাঁ, সে তো বাহরাইন থেকে ছাড়ার সময় বলেছিলাম।
ওরা তো জাহাজ না পৌঁছা পর্যন্ত অস্থির হয়ে থাকে তাই জিজ্ঞেস করলাম, একটা মজার ব্যাপার কি জানেন কাল আমার ডিউটিতে একবারও ডাকেনি।
এখনো আমি ডাকিনি ওরাই ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলো।
ইটিএ কত দিয়েছেন?
মাদ্রিদ ফেয়ার ওয়ে বয়া আগামী ১৮তারিখ ভোর সাড়ে পাঁচটা। নাও আর পণ্ডিতি করতে হবে না সময় মতো জাহাজ পৌঁছে দিও। আমি যেন উঠে দেখি জাহাজ নোঙ্গরে। এখন জাহাজ চালাও আর কফি খাও আমি চললাম বলেই ব্রিজ ছেড়ে হাসতে হাসতে বের হয়ে গেল।

নিশাত যথারীতি রাডার, জাহাজের হেড এর পজিশন, কোর্স সহ সব কিছু রুটিন চেক আপ করে ইলেকট্রিক জগে কফির পানি গরম দিল। কালো কফি। কাল কফির পোড়া পোড়া গন্ধটা নিশাতের দারুণ ভালো লাগে। সাথে সামান্য চিনি। মিষ্টি বেশি খায় না, ভালো লাগে না। রাতে চলন্ত জাহাজে ব্রিজের এই ডিউটিতে কালো কফি এক দারুণ জিনিস। কে যে এই কফি আবিষ্কার করেছিলো তাকে পেলে অন্তত একটু ধন্যবাদ জানান উচিত! কফি বানিয়ে এক কাপ তারেকের হাতে দিয়ে নিজে একটা নিয়ে আবার তার প্রিয় সেই স্টার বোর্ড সাইডের সাইড লাইটের স্ক্রিনের উপর বসল। এতক্ষণে ব্যস্ততার জন্য লক্ষ করেনি এখন চোখ পরল সামনের সাগরের দিগন্ত রেখা থেকে জেগে উঠছে বিরাট চাঁদ। চাঁদ থেকে চকচকে একটা রূপালী মেঠো পথের মত এসে পৌঁছেছে ওদের জাহাজের সামনে।
তারেক চাঁদটা দেখেছ?
তাই দেখছি।
কি সুন্দর তাই না?
হ্যাঁ।
ইস আমি যদি এখন এই পথ দিয়ে হেঁটে যেতে পারতাম!
মনে মনে এই পথ বেয়ে চলে গেল অনেক দূরে। হাতের কফির কাপে এখনো একটা চুমুকও দেয়া হয় নি। কফি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, কাপটা হাতেই ধরা রয়েছে। রাতের এই তারা ভরা খোলা আকাশের নিচে সাগর বুকে চাঁদ থেকে বয়ে আসা এমন পথে কার না একটু হেঁটে বেড়াতে ইচ্ছা করে! নিশাতের কি দোষ? সে তো এমন দায়িত্ব জ্ঞান হীন না। সে যতই ভাবুক না কেন কাজের দিকে তার পুরো খেয়াল। সাগর যতই উত্তাল মাতাল হোক না কেন তার ডিউটির সময় জাহাজ এক আধ মাইলের বেশি ড্রিফট হবে না। লোড আনলোডের সময় তো পাইপ লাইন, পাম্প, প্রত্যেকটা ভাল্ব, জয়েন্ট লিক করছে কি না, টেম্পারেচার ঠিক আছে কি না, পাম্পিং প্রেসার ঠিক আছে কি না, কোন গ্রেডের তেল কোন ট্যাঙ্কে যাচ্ছে, এক ট্যাঙ্কের তেল লিক করে ভিন্ন ট্যাঙ্কে যাচ্ছে কি না সব তার নখ দর্পণে।
এক হাতে কফির কাপ আরেক হাতে টর্চ থাকবেই, তার বয়লার স্যুটের পকেটে আস্ত এক ওয়ার্কশপ। বার বার করে তার চোখ সব কিছুর উপর দিয়ে ঘুরছে। সে নিজে ঘুরছে ডেকের এ মাথা থেকে ও মাথা। কখনো কোন গাফিলতি বা অবহেলা বা অমনোযোগ নেই। সম্পূর্ণ দায়িত্ব সচেতন। তবে খোলা সাগরে ব্রিজে ডিউটির সময় কিংবা অবসর সময় কিংবা বহির্নোঙরে নোঙ্গর করে থাকার সময় যখন ডিউটি করে তখন তার বিস্মিত চোখ অবাক হয়ে বারবার নতুন সব দৃশ্য দেখে নেয় আর ভাবে বিধাতার কি অপূর্ব সৃষ্টি যা নিজ চোখে না দেখলে বোঝা কত কঠিন!

এখন জাহাজ চলছে। এখন কোন অবস্থায় সাগর বুকে চাঁদের বিছান পথে কোন ভাবেই বেড়ানো চলবে না। আবার জাহাজে ফিরে এলো। কাপে চুমুক দিয়ে দেখে ঠাণ্ডা বরফ হয়ে গেছে। উঠে এসে আবার পানি গরম দিল, তারেককে জিজ্ঞেস করলো আর এক কাপ চলবে কিনা।
নিশাত ভাই আমি এখন আর না।
আচ্ছা বলে সে নিজে এক কাপ নিয়ে এবার ব্রিজের ভিতরে বসল। বাইরে ঠাণ্ডা লাগছে। বসে তারেকের সাথে নানা বিষয় নিয়ে আলাপ। কখনো নিজ দেশের আবহাওয়া, রাজনীতি, দেশি খাবার, প্রেম ইত্যাদি। হঠাৎ করেই একেক প্রসঙ্গ আসে আবার তা হঠাৎ করেই মিলিয়ে যায়।
দেখলাম কাল তোমার চিঠি এসেছে তা বাড়ির কি খবর?
না নিশাত ভাই তেমন কোন বিশেষ খবর নেই, এই কেমন আছ, আমরা ভালো আছি এই সব যা গতানুগতিক তাই।
হ্যাঁ তাইতো হবে, তুমি আর কি চাও?
কেন এর বাইরে আর কিছু থাকতে পারে না তাই আর কি। আচ্ছা নিশাত ভাই, ফরিদাকে (একটা জাহাজের নাম) একটু ডেকে দেখেন তো পান কিনা, শুনলাম ওরা নাকি মাস্কাটে আছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, আপনি যখন বাইরে ছিলেন তখন আমি শুনেছি ওরা গ্রে বাহরাইনের সাথে কথা বলছিল।
আচ্ছা দাঁড়াও এখনি ডাকছি।
বলে উঠে এসে রেডিওর রিসিভার হাতে নিয়ে ডাকতে শুরু করলো
‘ফরিদা ফরিদা দিস ইস প্যাসিফিক ম্যারিনার কলিং’
সাগর বুকে ইথার এর মাধ্যমে হাবিবের কণ্ঠে ভেসে এলো ফরিদার জবাব
‘ইয়েস প্যাসিফিক দিস ইস ফরিদা প্লিজ কাম ডাউন টু চ্যানেল ১৯’
চ্যানেল পরিবর্তন করে ১৯ এ এসে আবার ডাকল ফরিদাকে। ওপাশ থেকে এলো হাবিবের কণ্ঠ,
কিরে নিশাত তোদের মাস্কাট ইটিএ আমি জানি তা তোরা কি শিডিউলে আছিস নাকি চেঞ্জ হবে?
না, উই আর ইন শিডিউল!
আচ্ছা তোরা এখান থেকে শুধু ফ্রেশ ওয়াটার নিবি নাকি বাঙ্কারও (জ্বালানি তেল) নিবি?
দুইটাই লাগবে, আজ সী খুবই শান্ত কাজেই আমরা একেবারে কাটায় কাটায় পৌছাতে পারবো, এইতো আর মাত্র ৩৫ মাইল দূরে আছে, মাস্কাটের লাইট দেখা যাচ্ছে। ওদিকে আবার অরুণ’দা বলে গেছে তাকে যেন সকালে ব্রিজে আসতে না হয় তার আগেই যেন আমি নোঙ্গর করে রাখি। তাছাড়া আমরা যে ইটিএ দেই তা সাধারণত মেইনটেইন করি, আমরা তোদের মত নাকি? মনে নেই ওই যে রাস্তানুরাহ থেকে ইটালি ফেরার পথে কি কাণ্ড করেছিলি?
না রে সে তো হঠাৎ একটা দুর্যোগের কারণেই হয়ে গিয়েছিল।
আচ্ছা শোন, মনির কি ফ্লাই করতে পেরেছে খবর পেয়েছিস?
হ্যাঁ ও এতো দিনে বাংলাদেশে পুরোন হয়ে গেছে।
যাক ভালো হয়েছে, আমার সাথে মানামাতে দেখা হয়েছিল।
হ্যাঁ বলেছে, ওরা যেদিন দুবাই আসছিল সেদিন আমরা কুয়েত থেকে এখানে আসছিলাম তখন আমার সাথে কথা হয়েছে।
তাহলে তোরা এখানে কত দিন যাবত আছিস?
এইতো আজ কয়েক দিন হবে, তোদের ও এখানে দেরি হবে আমাদের পরে তোরা বের হবি কাজেই তোরা সবাই আজ বিকেলে আসবি আমাদের জাহাজে।
সেতো আসব কিন্তু এত দেরি কেন?
এদের ফ্রেশ ওয়াটারে কি যেন সমস্যা তাই
এখানে আয় আলাপ হবে তখন সব জানবি, আসবিতো?
নিশাত আমতা আমতা করছে দেখে হাবিব বলে দিল ভয় করিস না লাইফ জ্যাকেট পরে আসবি আর এক্সট্রা রেফট নিয়ে আসবি।
আচ্ছা ঠিক আছে আসবো। তোরা কোথায় নোঙ্গর করেছিস?
আমরা একটু সাউথে আছি।
আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে, আমি তোদের কাছাকাছি এঙ্কর ড্রপ করবো।
হ্যাঁ তাই করিস।
আচ্ছা শোন, তারেক মনে হয় শফিক ভাই এর সাথে কথা বলবে, উনি কি ডিউটিতে?
হ্যাঁ আছে দে ওকে।

নিশাত গিয়ে স্টিয়ারিং ধরে তারেককে কথা বলার জন্য পাঠিয়ে দিল। তারেকের কথা শেষ হলে বলল নিশাত ভাই আপনি আরও একটু থাকেন আমার ক্ষুধা লেগেছে কিছু খেয়ে আসছি।
শোন আমারও ক্ষুধা পাচ্ছে মনে হয় আমার জন্যও কিছু নিয়ে এসো।
কি খাবেন?
তুমি যা খাও তাই নিয়ে এসো।
কিছুক্ষণ পর তারেক গরম দুইটা স্যান্ডউইচ আর এক গ্লাস অরেঞ্জ জুস নিয়ে এসে চার্ট টেবিলে নামিয়ে রেখে বলল
দেন এবার আমার হাতে দেন আপনি খেয়ে নেন।
[চলবে]

ভাবনা

আপনার ভাবনাকে আপনি কতদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন? যতদূর আপনি ভাবনার গণ্ডি তৈরি করতে পারবেন।
এই ভাবনার গণ্ডি আপনি কতদূর প্রসারিত করতে পারবেন? যতদূর আপনি আপনার জ্ঞান বোধ বুদ্ধি প্রসারিত করতে পারবেন।
এই জ্ঞান বোধ বুদ্ধি আপনি কতদূর প্রসারিত করতে পারবেন? যতদূর যত বেশি আপনি শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবেন।
এই শিক্ষা আপনি কতদূর কতটা বেশি প্রসারিত বা জমা করতে পারবেন। যতদূর বা যতটা বেশি আপনি প্রকৃতির থেকে মানুষের থেকে বই থেকে আপনার দুচোখ খোলা জীবন থেকে গ্রহণ করতে পারবেন।
ভাবনা হল পুঞ্জীভূত জীবনের দু এক ফোঁটা রস। সেই ভাবনার মধ্যে সৃষ্টি থাকলে অথবা সৃষ্টিমূলক কিছু ভাবলে তার অনেকদিক অনেক মুখ তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু ভাবনার মধ্যে ধ্বংসমূলক কিছু থাকলে তার মুখ একটা। শুধু ধ্বংস বা শেষ। যার আর অন্য কোন ভাবনা নাই। দিক নাই। দিশা নাই।
কিন্তু সৃষ্টির শুরু নাই শেষ নাই শুধু তৃপ্তি আছে। আদিগন্ত জীবন আছে। তাই ভাবুন। ভাবার জন্য জীবন সঞ্জয় করুন। তার থেকে ভাবনার নির্যাস বের করে জীবনকে রসসিক্ত করুন।

যেভাবে বহু হল

লেখা জিনিসটা খুব একটা সুবিধার কিছু নয় বলে মনে হচ্ছে। কেননা এতে গা জুড়োবার কোন ব্যাপার নেই। যত উত্তমই লেখো তা বেশীক্ষণ হাতে গরম থাকবে না। আর সর্বদা উত্তম তো সোনার পাথরবাটির মত অসম্ভব ব্যাপার। এ-সবই কিছুক্ষণের আমোদ প্রমোদের মত ব্যাপার।

প্রেমও ঠিক তাই। সবারই মনে হচ্ছে একটা অতি গভীর প্রেম হলেও হতে পারে। কিন্তু এমন মায়ের লাল দেখিনি যার হয়েছে বা হলেও ধরে রাখতে পেরেছে। দুর্দান্ত প্রেমিকদেরও যখন দেখি তাস আর চুল্লুতে সময় কাটাচ্ছে তখন যেন সক্রেটিসের আত্মা আমায় ভর করে–সক্রেটিসের বউ একদিন দেখে সক্রেটিস এক রোয়াকে বসে ছেলে ছোকরাদের জ্ঞান বিতরণ করছে। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বৌদি তখন হাতের কাছে পেল এক আখগাছ সেইটা উৎপাটন করে বসাল সক্রেটিসের পিঠে বেজায় এক ঘা।
ঘটনাক্রমে আখটা গেল তিনটুকরো হয়ে। সক্রেটিস, ঈশ্বর তাকে যেন দীর্ঘজীবী করেন, তখন ছোকরাদের বললেন চোখের সামনেই তোমরা দেখলে এক কিভাবে আন্দোলিত হয়ে বহুর রূপ ধারণ করে–।

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-২

কয়েকদিন পরেই নিশাত তাদের বাড়ির পাশেই পথের পাড়ে বিরাট এক লেবু গাছের নিচে বসে সমবয়সী মইন চাচার সাথে গল্প করছিলো এমন সময় ওরা কয়েক জন এক সাথে ওই পথেই স্কুলে যাচ্ছিল। হঠাৎ চোখে চোখ পরে গেল।

কি কথা হলো কি না হলো কে জানে! ওর পথ চলা থেমে গেল। ইতিমধ্যে সাথের সঙ্গীরা সবাই কিছুটা এগিয়ে গেছে, চট করে প্রায় দৌড়ের মতই এগিয়ে গিয়ে তাদের সাথে মিশে গেল। জাহাজে চাকরীতে আসার আগে সামান্য কথা হয়েছে তারপরে প্রথম ভয়েজ করে দেশে ফেরার পর সে আলাপ কিছুটা গাড় হয়েছে। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার সময় থেকে শুরু করে যতদিন দেশে ছিল ততদিন প্রতিদিন একবার হলেও দেখা হয়েছে দুইজনে একসাথে বেড়িয়েছে ছবি তুলেছে। সে ছবি নিশাতের কেবিনে সাজিয়ে রেখেছে এই এর জন্যই তাহলে নিয়ে নিই, নাকি? নিজেকেই প্রশ্ন করল! গায়ের রঙ ফর্সা, গোল ধরনের চেহারা, গালের ডানপাশের তিল আর থুতনির নিচের আঁচিলটা চোখে পরার মত, দীর্ঘ এক হারা গড়ন, চোখে পরার মত সুন্দরী বলা চলে। নীল জমিনে লাল পাড় শাড়ি মানাবে ভালো। কিন্তু!! না, কোন কিন্তু নয়! যে করেই হোক এ শাড়ি তাকে দিতেই হবে। যে যা বলে বলুক। গতবার কত কি কিনে দিতে চেয়েছে কিন্তু আপার ভয়ে লোকলজ্জার ভয়ে কিছুই নিতে চায়নি। প্রথম ভয়েজেও যা নিয়েছিল তার কিছুই নেয়নি। সেগুলি নিশাতের আলমারিতেই তোলা রয়েছে। যাক, যদি নাই নেয় তাহলে এটাও আলমারিতে তুলে রাখবে।
শেষ পর্যন্ত নিশাতই কিনে নিয়ে দোকান থেকে বেড় হয়ে দেখে মনির তখন বাইরে দাঁড়ানো।
কিরে, তোর হাতে এটা কি, কী কিনলি?
না, কিছু না।
চল, ওই দোকানে দেখি।
না রে মনির, আমার ভালো লাগছে না, আমি জাহাজে চলে যাব, তুই যা।
বলেই বাস স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটা শুরু করলো। পিছন থেকে মনির ডাকল কিন্তু সে ডাক নিশাতকে ফেরাতে পারলো না।

কিছু দূর গিয়ে বুঝতে পারলো ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে। পাশের দোকান থেকে এক ক্যান ঠাণ্ডা আপেল জুস নিয়ে বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালো। কি হলো আজ? নিশাতের কিছুই ভালো লাগছে না। এই নিশাত পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি লম্বা, গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা, মাথায় কোঁকড়ানো চুল, ছিপছিপে গড়নের কঠিন ব্যক্তিত্বের মানুষ, সেই নিশাতের কি হলো আজ? সারাদিন বাইরে ঘুরবে, বাইরে খাবে এই মনে করেই তো বেড় হয়েছিলো। এখন তার সব কিছু কেমন যেন ওলট পালট হয়ে গেছে কিছুই মনে করতে পারছে না।

এক হাতে শাড়ির প্যাকেট আর এক হাতে জুসের ক্যান, আর মন চলে গেছে সেই ঢাকা শহরে সোবহান বাগের বীণা আপার বাড়িতে যেখানে আছে নিরু নামের সেই মেয়েটি। ও কি এখন বই খাতা হাতে ক্লান্ত দেহে কলেজ থেকে রিকশায় চেপে বাড়ি ফিরছে, না কি আজ ক্লাস বন্ধ বলে আপার সাথে আপার ঘর সংসার সামলাচ্ছে? কি রঙের কামিজ পরেছে আজ, দেখতে কেমন লাগছে? এই শাড়িতে কি ওকে মানাবে? শাড়িটা দেবার সময় কি বলবে? এই সব ভাবনায় যখন সে হারিয়ে গেছে তখন একটা বাস এসে দাঁড়ালো। কোথাকার বাস কোথায় যাবে তা কিছু না দেখেই পকেট থেকে বাস ভাড়া ২৫ ফিলস ভাংতি বের করে ড্রাইভারের হাতে দিয়ে টিকেট নিয়ে পিছনের একটা সিটে বসে পড়লো। বাস এসে দাঁড়ালো মোহাররেকে। নেমে কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে খেজুর বাগানের মধ্যে গিয়ে বাগানের ছায়ায় বসে পড়লো।

বেশ গরম আজ, এপ্রিল মাস। এখনই এমন গরম জুন জুলাই মাসে কি হয় কে জানে! ওর পরনে লেভীস এর নীল জিনস, গায়ে হালকা আকাশ নীল টি শার্ট আর পায়ে ইতালির আরাম দায়ক জুতা তবুও ঘেমে ভিজে গেছে। বাগানের ছায়ায় কিছুক্ষণ বসে থেকে জুড়িয়ে নিলো। হাতের জুস তখন শেষ হয় নি। ঘাম শুকানোর পরে উঠে একটু হেঁটে সাগর পাড়ে একটা বড় পাথর পেয়ে তাতে বসে সাগরের দুর দিগন্তের দিকে তাকিয়ে রইলো। হাতের কাছে পাওয়া দুই একটা ঝিনুক কুড়িয়ে সাগরের পানিতে ছুড়ে দিল, আর একটা ঝিনুক নিয়ে উঠে গিয়ে বসল সাগরের ঢেউ যেখানে আসছে যাচ্ছে সেখানে।

বসে বসে ঝিনুক দিয়ে বালুকা বেলায় সেই মেয়েটির নাম লিখল। নিরু। তার বুকের ভিতরে যে নাম লিখা রয়েছে যা কেউ জানে না, শুধু সে একাই বয়ে বেড়াচ্ছে। একটু পরেই ঢেউ এসে সে নাম মুছে দিল। আবার লিখল আবার মুছে দিল। এই এক খেলা পেয়ে বসল নিশাতকে। নাম লিখছে আর ঢেউ এসে তা মুছে দিচ্ছে। মনে মনে হেমন্ত কুমারের গাওয়া সেই গান গুন গুন করছে “এই বালুকা বেলায় ……………” কত দিন থেকে ভাবছে এই নাম? না, মনে পরছে না। হয়ত সেই ছোট বেলায় যখন গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যেত আর ওকে দেখত চঞ্চলা হরিণীর মত দৌড়ে বেড়াতে। জাম গাছে উঠে জাম পেড়ে সবাইকে বিলাত নিশাতকেও দিতো। ওদের বাড়ির দক্ষিণ পাশে কুয়ার পাড়ে একটা জাম গাছ ছিল, এখন নেই। পুকুর পাড়ের গাব গাছে উঠে পাকা টস টসে হলুদ গাব পেড়ে এনে নিশাতকে দিতো, আহা সেই গাবের সে কি ঘ্রাণ এখনো মনে আছে। বাড়ির পূর্ব পাশে ছিল ঈদগাহ, ওদেরই পূর্ব পুরুষদের ওয়কফ করা। ঈদগাহের উত্তর পাশেই একটা বিশাল বকুল গাছ ফুলে ফুলে একাকার হয়ে যেত আর তার গন্ধে পুরো এলাকাটাই বদলে যেত।

শহরে থাকা নিশাত বকুলের গন্ধ নেয়ার জন্য গাছের কাছে দাঁড়াত আর বাতাস তার কানে কানে বলত, শুধুই কি বকুলের গন্ধ নেবার জন্য এখানে এসেছ? একটু এগিয়ে দেখ আরও কিছু আছে। বালক নিশাত অনভ্যস্ত বন পথে পায়ে পায়ে ঝোপ ঝাড় ডিঙ্গিয়ে দেখতে পেল সেই মেয়েটি আপন মনে কুড়ানো বকুল ফুলের মালা গাঁথছে। কি করবে এই মালা দিয়ে? ভোর বেলা অনেকক্ষণ ধরে বালিকার মালা গাথা দেখল, সেই তখন থেকেই কিনা! কোন ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকার পাতায় সে দিন তারিখের কথা লেখা নেই। ওই নাম নিশাতের বুকের ভিতর কোন এক গোপন ভল্টে লিখা হয়ে গিয়েছিল নিশাতের অজান্তে যা সে জানতেও পারেনি। এই নামটা যে কে লিখে রেখেছে তা কেউ জানে না। নিশাত নিজেও না। তখন শিহাব বা যুঁই কারো সাথে তেমন একটা ভাব জমে উঠেনি।

এই গোপন ভল্টের চাবি নিশাত ছাড়া কারো কাছেই নেই। যখন মনে হয় গোপন ভল্টের গোপন চাবি দিয়ে সে নিজেই শুধু খুলে দেখে সে সব স্মৃতি গুলি, বার বার, এ ভাবে ও ভাবে উলটে পালটে। আচ্ছা, নিরু কি জানে এই গোপন ভল্টের কথা? কেন জানে না, কেন? কখন যেন আবার ওই পাথরের উপর গিয়ে বসেছে। বসে বসে সূর্য ডোবা দেখল। উঠতে মন চাইছে না। সাগরের নোনা জলের কণায় আকাশ লাল হয়ে গেছে। দিনের আলো নিভে গেছে। দূর দিয়ে চলে যাওয়া জাহাজের নেভিগেশন বাতি দেখা যাচ্ছে, পিছনে ঘুরে দেখে শহরের আলোর ঝলকানি জ্বলে উঠেছে। এতক্ষণে মনে হলো ক্ষুধা লেগেছে। প্যাকেটটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। হেঁটে বাস স্ট্যান্ডে এসে বাসে করে জাহাজে চলে এলো।

মনে একটা বিষণ্ণ ভাব নিয়ে নিশাত জাহাজে ফিরে এসে দেখে শাহিন, জয়নুল ওরা সবাই রাতের খাবার খেয়ে সেলুনে বসে টিভি দেখছে, এরামকো চ্যানেলে একটা ডকুমেন্টারি ছবি চলছে। ওর প্রিয় সিরিজ কিন্তু আজ কোন আগ্রহ নেই। সেলুনে উঁকি দিয়ে দেখেই ফিরে এলো নিজের রুমে। পিছন থেকে শাহিন ডাকল কিন্তু তার কোন জবাব দিল না। কাপড় বদলে গরম জলে ঝারা একটা গোসল দিয়ে খেয়ে দেয়ে এসে আবার বসল সেলুনে। এর মধ্যে রাত সাড়ে নয়টা বেজে গেছে।
সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত ওদের সাথে টিভি দেখল। জয়নুল বার বার জিজ্ঞেস করল কি কি করলে, কোথায় গেলে কিন্তু তার কোন জবাব নেই। ওরা আর চাপাচাপি করল না। জানে, নিশাত মাঝে মাঝেই হারিয়ে যায়, তখন হাজার ডাকাডাকি করেও ওকে ফেরান যায় না। আপন মনে বিভোর হয়ে থাকে। রাত সাড়ে এগারটা পর্যন্ত টিভি দেখে উঠে এলো। বারোটা থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত ডিউটি। ডিউটির পোশাক পরতে হবে।

তার পরে ওরা বাহরাইনে তিন দিন ছিল এর মধ্যে আর কোথাও যায়নি। তৃতীয় রাতে সিতরা ট্যাংকার বার্থের আউটার এঙ্কারেজে এসে নোঙ্গর করলো। আধা ঘণ্টা পর পাইলট এসে জাহাজ জেটিতে নিয়ে গেল। এই জেটি কিনারা থেকে দশ মাইল সমুদ্রের দিকে। জেটিতে ভেরার পর ট্যাঙ্কে গ্যাস আছে কিনা বা পাইপ লাইনে কোন লিক আছে কি না, লিক করে সমুদ্রে তেল ভেসে যাবে কি না তা দেখার জন্য জেটি কর্তৃপক্ষের লোকজন এলো। তাদের সাথে হাই হ্যালো করে সাথে নিয়ে দেখাল। একটু পরেই আবার আসবে ইমিগ্রেশন, কাস্টমের লোকজন। তাদের অপেক্ষা। এই দেশে ওদের কোম্পানির রিজিওনাল হেড অফিস। তাছাড়া এখানে ওরা প্রায়ই আসে বলে কাস্টম ইমিগ্রেশন তেমন কোন ঝামেলা করে না। শুধু নিয়ম পালনের জন্য এসেই কাগজ পত্রে সই স্বাক্ষর করে চলে যায়। তবুও এই ফর্মালিটি গুলি শেষ না হলে জাহাজ লোড শুরু করতে পারে না। এক সময় সব কিছু হয়ে গেলে জাহাজ লোডিং শুরু হলো। লোডিং এর সম্পূর্ণ দায়িত্ব ওর। ক্রুড ওয়েল লোড করে স্পেন নিয়ে যাবে। লোডিং এবং তার পরে মাপজোক হিসাব নিকাশ ইত্যাদি ফর্মালিটি সারতে সারতে সকাল দশটা বেজে গেল। এখন পাইলটের অপেক্ষা। আধা ঘণ্টার মধ্যেই পাইলট এসে ওদের জাহাজ জেটি থেকে বের করে আউটার এঙ্কারেজে পৌঁছে দিয়ে নেমে পাইলট লঞ্চে করে চলে গেল আর ওরা যাত্রা শুরু করলো স্পেনের দিকে। কয়েক দিনের পথ।

জাহাজ চলছে। কিছুক্ষণের মধ্যে পিছনে ফেলে আসা মুক্তা দ্বীপের দেশ বাহরাইন দিগন্ত রেখার সাথে মিশে গেল। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি, অথৈ নীল সাগরের বুক চিড়ে এগিয়ে চলছে। এই সময় সাধারণত সাগর কিছুটা উত্তাল থাকে কিন্তু আজ বেশ নীরব শান্ত। সাগর কি নিশাতের মনের কথা জানতে পেরেছে? পারার তো কথা, সেদিন বার বার করে সাগরের বালুকা বেলায় লিখা নাম মুছে দিচ্ছিল তখন কি আর পড়ে দেখেনি কার নাম মুছে দিচ্ছে! দুপুর বারোটা বেজে গেছে, নিশাত ব্রিজে এলো।
ব্রিজ হলো জাহাজের সব চেয়ে উঁচু অংশ যেখান থেকে জাহাজ নিয়ন্ত্রণ করে। এখানে নেভিগেশন সহায়ক নানা ধরনের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সাজান থাকে। হাই ফ্রিকোয়েন্সি রেডিও, ওয়ারলেস, ম্যাগনেটিক কম্পাস, জাইরো কম্পাস, স্টিয়ারিং ইন্ডিকেটর, ট্রিমিং ইন্ডিকেটর, ইকো সাউন্ডার, রাডার, থার্মোমিটার, হাইগ্রমিটার, আর থাকে লঙ্গিচুড ল্যাটিচুড মেপে জাহাজের অবস্থান দেখার জন্য ডেকা ন্যাভিগেটর, জিপিএস, নেভিগেশন লাইটের ইন্ডিকেটর, চার্ট(সামুদ্রিক ম্যাপ) ইত্যাদি নানা কিছু। জাহাজ চলন্ত অবস্থায় প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় তার পজিশন দেখে চার্টে চিহ্ন দিয়ে রাখতে হয়, এতে তার গতি সম্পর্কেও জানা হয়ে যায় এবং বিগত এক ঘণ্টায় কত দূর ক্রুজ করেছে এবং ডানে বা বামে কোন দিকে ড্রিফট করছে কি না তাও বোঝা যায়। ওদের জাহাজে ওরা পাঁচ জন বাঙ্গালি। ওদের সাথে আছে দুই জন ইরানি, পাঁচ জন ইন্দোনেশিয়ান এবং তিন জন ব্রিটিশ।

নিশাত ডিউটিতে এসে চিফ অফিসার অরুনের কাছ থেকে সব কিছু বুঝে নিলো। অভ্যাস মত এক বার রাডারের পর্দা দেখে নিলো, চার্টে এক নজর চোখ ঘুড়িয়ে আনল। রুটিন মাফিক যা যা দরকার সব দেখে দুই কাপ কাল কফি বানিয়ে তারেককে এক কাপ দিয়ে নিজে এক কাপ নিয়ে ব্রিজের বাইরে সাইড লাইটের স্ক্রিনের উপর যেয়ে বসল। সব ঠিক আছে। আশে পাশে ৫০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে কোন জাহাজ নেই।
স্টিয়ারিং করছিলো তারেক। জাহাজে এসে নেভিগেশনের সাথে দায়িত্ব বোধ, কঠিন নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা, মার্জিত আচরণ, পরিচ্ছন্নতা সব কিছুই শিক্ষা পেয়েছে স্কটিশ ক্যাপ্টেন আলস্টার ক্যাম্পবেল, নেভিগেশন বিশেষজ্ঞ সাবেক সাউদি নেভীর সিএনসি ইংলিশ ক্যাপ্টেন মার্টিন, সীম্যানশীপ বিশেষজ্ঞ ডাচ ক্যাপ্টেন হ্যাগওয়েল এর কাছে। অনেক কিছুই শিক্ষা পেয়েছে। সে এখন দক্ষ নাবিক, কদিন পরেই হবে এই রকম কোন এক জাহাজের কর্ণধার বা ক্যাপ্টেন। পরিচালনা করবে জাহাজের সার্বিক দায়িত্ব। বয়সে তরুণ, মনে রঙ্গিন স্বপ্ন। নিশাতের মনে আবার একটু ভিন্ন ধরনের স্বপ্ন।
সে ভাবে কি ভাবে মানুষের জন্য, দশের জন্য, দেশের জন্য কিছু করা যায় বড় কিছু। অনেক বড়। নিজের না হোক মানুষের মঙ্গল হবে এমন কিছু। ও ভাবে এক সময় এই পথে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা শুধু মাত্র একটা ড্রাই কম্পাস সম্বল করে আকাশের সূর্য তারা নক্ষত্র আর দিগন্ত রেখা দেখে অনুমান করে নিজের অবস্থান নিরূপণ করে সম্পূর্ণ অনিশ্চিতের উপর ভিত্তি করে পালের জাহাজ নিয়ে কি ভাবে এই সাগর পাড়ি দিয়েছে আজ আমরা জিপিএস ব্যবহার করেও হিম সিম খাচ্ছি। যে জিপিএস মাত্র তিন মিটার এদিক সেদিক হয়। এই বিশাল কুল কিনারা বিহীন সাগরের মধ্যে তিন মিটার এমন কিছু নয়। তবুও কেমন দিশা হারিয়ে ফেলি। অথচ ক্যাপ্টেন কুক কি ভাবে অস্ট্রেলিয়া পৌঁছল, কলম্বাস কি নিয়ে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমেরিকা পৌঁছল নিশাতের কাছে এ এক বিস্ময়!
[চলবে]

ল্যাম্পপোষ্ট

ল্যাম্পপোষ্ট
কতকাল নির্বিকার দাঁড়িয়েই আছে।
কচুবন গেছে, নালাও বুঁজেছে।
গাছ পালা অনেক সাফ হবার পর
এখন ফ্ল্যাটের জানালাও তাকে চিহ্ণিত
বিপদ বলে ডাকে।
সে কি কারো ডাক বোঝে?
মান অপমান?
ইতিহাস-কথকতা, প্রেম?
সে কি শুধু আমাদেরই প্রয়োজন
নাকি সমাধিস্থ প্রজ্ঞা অথবা
আমাদের সকল প্রতীক্ষার
লম্বমান ছবি চিরায়ত!

কত কথা নড়ে গেল
প্রতিজ্ঞা ফানুস হয়ে উড়ে গেল
সরকার , গদী, নদী
আঁকাবাঁকা পথ বদলালো
শুধু ঐ রয়েগেল নির্বিকার।

আসা যাওয়ার পথে অর্থহীন
দেখা হচ্ছে তবু এই তো ব্যাপার।

একান্ত মার্জনীয়

সুপ্রিয় বন্ধুরা, এতদিন নীরব দেখে কি ভেবেই নিয়েছিলেন য়াহা! লোকটা বুঝি হারিয়েই গেল! না বন্ধুরা হারাইনি বা ভুলেও যাইনি। জীবনের তাগিদে নিতান্ত ব্যস্ততায় কিছুটা আড়ালে ছিলাম। আজ একটু সুযোগ পেয়ে আবার আসলাম এই শব্দনীড়ের ছায়ায়। আশা করি এই দীর্ঘ অনুপস্থিতি স্বগুনে মার্জনা করবেন। না একেবারে খালি হাতে আসিনি, আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি একটি নিটোল প্রেমের সম্পূর্ন উপন্যাস “মম চিত্তে নিতি নৃত্যে”

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে-১ (২৭)
১।
আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই নিশাতের মনে কেন যেন বেশ একটা চক চকে ঝরঝরে ভাব। ভীষণ ভাল লাগছে। কিন্তু, কি যে সে কারণ তা সে নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না। বাইরে যাবে, নিজের খেয়াল মত ঘুরবে, বেড়াবে এই
জন্য না কি বিশেষ কারো কথা মনে পরেছে! যাই হোক, সে কারণ খোঁজার কি এমন প্রয়োজন? মন ভালো আছে, ভালো লাগছে এইতো বেশ! আর কি আছে এই বিদেশে? মরুভূমির দেশে সাগরে ভেসে থেকে এর চেয়ে আর কি চাইতে পারে? এই যথেষ্ট। সকালের টুকিটাকি কিছু কাজ ছিল, সেগুলি সেরে চিফ অফিসারকে বলে জাহাজ থেকে নেমে গেল। আজ তার শোর লিভ। মানে, আজ তার ছুটি। সাগর ছেড়ে মাটিতে চলার অনুমতি। নোনা জলের সাগর ছেড়ে সে আজ সারা দিন মাটির উপর ঘুরে বেড়াবে। এরাবিয়ান গালফের ছোট্ট দ্বীপ বাহরাইনের মানামা শহর। এখানে তার ব্রিটিশ পতাকাবাহী ‘প্যাসিফিক মেরিনার’ তেল বাহি ট্যাংকার জাহাজ রুটিন মেইনটেন্যান্স এর জন্য এসেছে।

তিন দিন থাকবে, তারপর আবার চলে যাবে এশিয়া কিংবা ইউরোপের এ বন্দর ছেড়ে ও বন্দরে । ওরা কোন বন্দরে লোড বা আনলোড করার জন্য দুই তিন দিনের বেশি সময় পায় না। কোথাও আবার সাগর পাড় থেকে পাঁচ দশ মাইল দূর থেকেই লোড আনলোড করে চলে যেতে হয়। তখন দূরের শহরের বাতি নয়তো প্রায় আকাশের কাছে পৌঁছে যাওয়া দালান গুলি দেখে স্বপ্নের কোন দেশের মত মনে হয়। আজ নিশাতের মনে খুবই আনন্দ। সাগরের বুকে ছোট্ট দ্বীপ শহরে সারা দিন একা একা ঘুরে বেড়াবে। কখনো বাসে চেপে, কখনো ট্যাক্সিতে কিংবা পায়ে হেঁটে।

সাগরের বুকে গাং চিলেদের নিঃশব্দে নীলাকাশে ওড়া, মাঝে মাঝে ডলফিনের ঝাঁকের জলকেলি, খোলা নীল আকাশ, নীল আকাশের নিচে নীল সাগরের নীল ঢেউ, ঢেউ এর চূড়ায় সাদা ফেনার লুকোচুরি নিশাতের মনকে উদ্ভ্রান্ত করে কোথায় যেন নিয়ে যায়। কোথায় যে সে হারিয়ে যায় সে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। আজ একটু ভিন্ন রকম। আজ সাগর ছেড়ে সে নেমে এসেছে মাটির পৃথিবীতে। মাটির গন্ধ নেয়ার জন্য, মাটির ছোঁয়া পাবার জন্য।

জাহাজ থেকে নেমে হেঁটে ডকের বাইরে এসে পাশের স্টোর থেকে এক ক্যান ঠাণ্ডা জিঞ্জার এল কিনে মুখটা খুলে এক চুমুক দিয়ে ক্যান হাতে পাশের বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াল।
হঠাৎ মন পরিবর্তন করল। না, আজ কোন বাস ট্যাক্সি নয়, আজ শুধু হাঁটবে। হাটতে হাটতে চলে এলো মানামা শহরে। এদিক সেদিক ঘুরে ঘুরে শেষ পর্যন্ত এলো চেনা পাকিস্তানি সিঙ্গারার দোকানে। এখানে ১০০ ফিলসে কাগজের প্লেটে চারটা সিঙ্গারা আর তার সাথে চাটনি। সাধারণ আলুর সিঙ্গারা কিন্তু কি ভাবে বানায় কে জানে, ভীষণ মজা। আর তার সাথের চাটনিটা আরও বেশি মজার। বিশেষ করে এই চাটনির লোভটাই বেশি। বাহরাইনে এলেই এই সিঙ্গারা তার চাই। নিজে যেতে না পারলেও যেই যাক তাকেই বলে দেয় আমার জন্য সিঙ্গারা এনো। আরও একটু চাটনি চেয়ে নিলো। দোকানে কোন বসার জায়গা নেই, রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে খেতে হয়, কোন পানিও নেই। আলাদা করে পানি বা সফট ড্রিঙ্ক যার যা পছন্দ তা কিনে নেয়, এ জন্য আলাদা ৫০ ফিলস। তার হাতে এখনো সেই জিঞ্জার এলের ক্যান রয়েছে। ক্যানটা দোকানের কাউন্টার টেবিলের উপর রেখে এক হাতে প্লেট ধরে আর এক হাতে খাচ্ছিল। সিঙ্গারা শেষ হলে হাতের খালি প্লেট বিনে ফেলে দিয়ে শেষ চুমুক দিয়ে ক্যানটাও বিনে ফেলে দিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলো।

উদ্দেশ্য হীন ভাবে। কোন গন্তব্য নেই। মার্কেটে মানুষ গিজ গিজ করছে। প্রায় সবাই যার যার গাড়ি রেখে এসেছে শহরে ঢোকার আগে ওই সাগর পাড়ের পার্কিং এলাকায়। কেউ জোড়ায় জোড়ায়, কেউ তার মত একা। শিশু, কিশোর, তরুণ তরুণী, যুবক বৃদ্ধ, কালো, ককেশিয়ান, সাদা নানা রকমের নানা রঙের মানুষের ভিড়। আমাদের দেশের ছোট ছোট চায়ের দোকানের মত বাইরে সামিয়ানা টানান রয়েছে তার নিচে বয়স্ক লোকেরা টেবিলের চার পাশে বসে বিশাল কলকির হুক্কা টানছে আর গাওয়া (এক ধরনের কাল কফির মত) খাচ্ছে, হুক্কার নল এর হাত থেকে ওর হাতে বদল হচ্ছে। কেউ দোকানির সাথে দামাদামি করছে, কেউ কিনছে, আবার তার মত কেউ শুধু দেখছে।

সাজানো দোকান পাট তো রয়েছেই তার পাশে আমাদের দেশের ফুটপাতের মত ক্যানভাসের চাদর বিছিয়ে খোলা দোকানও আছে। বাচ্চাদের খেলনা, তৈরি পোশাক, ঘর সাজাবার নানা রকমের সৌখিন জিনিসপত্র, পারফিউম, আতর, মশলা রাখার সুন্দর রেকাবি, মোম দানি, নানা রকম কারু কাজ করা ছবি বাধানোর ফ্রেম, আরও কত কি। হঠাৎ তার চোখে পরল এই রকম এক খোলা দোকানের এক দোকানি মিসরিয় কারুকাজ করা ধুপ দানির মত একটা পাত্রে ছোট ছোট কাঠের টুকরোর মত কি যেন জ্বলন্ত কয়লার আগুনে ছেড়ে দিতেই ধোয়ার সাথে ভুর ভুর করে একটা মন মাতানো সুগন্ধ ভেসে এলো ওর নাকে। জাহাজ থেকে নামার সময় স্যেনেল ফাইভ স্প্রে করে এসেছে এ গন্ধ সে গন্ধকেও হার মানানো গন্ধ। মনে কৌতূহল হলো, এটা কী? জিজ্ঞেস করবে কিন্তু নিশাত আরবি তেমন জানে না। তার ছোট বেলা কেটেছে করাচী শহরে তাই উর্দু ভালোই জানে। তারপর আবার জাহাজে চাকরী করতে এসে পৃথিবীর নানা দেশে ঘুরতে গিয়ে ইংরেজিটাও ভালোই রপ্ত করে নিয়েছে। কাজেই, কোথাও তেমন অসুবিধা হয় না। তবুও এগিয়ে গিয়ে আরবি যা জানে তাই আর উর্দু হিন্দি ইংরেজি মিশিয়ে দোকানিকে জিজ্ঞেস করলো।
ইয়েমেনি দোকানিও সেই ভাবে জবাব দিল।
কেন, আগে দেখনি? এগুলির নাম হলো আগর, বাংলাদেশ থেকে আসে। বিশাল একটা গাছ থেকে মাত্র চার বা পাঁচশ গ্রাম আগর বের হয় বলে খুব দামী জিনিষ।
কত দাম?
পাঁচ গ্রামের এই প্যাকেটের দাম দশ দিনার।

নিশাত ভেবে দেখল যাদের পকেটে এতো দিনার বা ডলার আছে, যাদের পকেটের দিনার বা ডলার দিয়ে ব্যাঙ্ক গুলি চলছে তারা ছাড়া এগুলি আর কে ব্যবহার করবে! তাদের ঘরের স্বপ্নিল আবেশ তৈরির জন্য কিংবা রাতের মোহময়তা বাড়াবার জন্য তারাই এগুলি জ্বালাতে পারে। আমার দেশেও এমন জিনিষ আছে যা আমার জানা ছিল না অথচ এই পেট্রো ডলারের দেশের ধনী লোকেরা তা ব্যবহার করছে! কি বিচিত্র এই পৃথিবী!
আগরের খবর জেনে খুশি মনে আবার চলল উইন্ডো শপিং করতে। পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা আজকালের ব্যস্ত মানুষের জীবন সহজ করার জন্য কি কি আবিষ্কার করেছে! বাজারে কি কি নতুন জিনিষ এসেছে তাই দেখার জন্য। ইলেকট্রনিক্সের দোকান, নানা ধরনের যন্ত্রপাতির দোকান, তৈজস পত্রের দোকান দেখে বের হয়ে কাপড়ের দোকানে ঢোকার পথেই মনিরের সাথে দেখা। মনির নিশাতের সাথে নিশাতের ২য় ভয়েজে এক জাহাজে ছিল সেই থেকেই বন্ধুত্ব। এখন ও অন্য আর এক জাহাজে আছে, সেও শোর লিভ নিয়ে কেনা কাটা করার জন্য এসেছে।
কিরে নিশাত, কেমন আছিস?
ভালো, তোর কি খবর, ইস তোকে দেখে হিংসা হচ্ছে রে!
কেন, হিংসা কেন?
ভয়েজ শেষ করে দেশে যাচ্ছিস হিংসা হবে না?
তুইও তো আর কদিন পর যাচ্ছিস।
না, আমার দেরি হবে কারণ আমার রিলিভার না এলে আমাকে ছাড়বে না বলেছে, আবার ওদিকে চিটাগাংয়ের এজেন্ট রিলিভার পাচ্ছে না।
যাক আর কিছু দিন থাক, অসুবিধা কি তোর জন্যে কি আর কেউ পথ চেয়ে বসে আছে?
যাক বাদ দে ওসব, এখন বল কি করবি?
কিছু কেনা কাটার জন্য এসেছি।

তোরা না কাল দুবাই যাচ্ছিস তাহলে এখান থেকে কিনবি কেন, এখানে তো দাম বেশি।
না, দুবাই পৌঁছবো রাতে আর আমার ফ্লাইট সকালে, টিকেট করে ফেলেছে শুনেছি, তাই ওখানে সময় পাবো না। বেশি কিছু কেনার নেই শুধু ভাবীর জন্য একটা শাড়ি।
ও তাহলে চল।
না তোর সাথে এতো দিন পর দেখা হলো চল আগে কিছু খেয়ে নিই।
কি খাবি, আমি এই মাত্র সিঙ্গারা খেয়ে এসেছি।
হ্যাঁ আমিও ভেবেছি তুই বাহরাইন এসেছিস আর এখনো সিঙ্গারা খাসনি এ হয় কি করে?
চল তুই খেয়ে নে।
না থাক, ভাবীর শাড়িটা আগে কিনে নেই তার পর দেখবো।
বা হাতে এক দোকান দেখে, এই দোকানই তো।
দুজনে দোকানে ঢুকে এদিক ওদিক খুঁজে যেখানে শাড়ি রয়েছে সেখানে গেল। অনেক শাড়ি দেখল কিন্তু কোনটাই মনিরের পছন্দ হচ্ছে না।
দেখ নিশাত এই সব মেয়েলি কেনা কাটা আমার কাজ না, তুই একটা দেখে দে।
বারে, এ আবার কি ধরনের কথা বলছিস, আমি কি তোর ভাবীকে দেখেছি? যাকে দেখিনি তার জন্য কি পোশাক বাছাই করা যায়?
শেষ পর্যন্ত নিশাতকেই একটা বাছাই করে দিতে হলো।
লাল পাড় নীল শাড়ি।
পছন্দ হয়েছে তোর?
হ্যাঁ খুব!
তাহলে দেখ দাম কত। দোকানির সাথে দামাদামি ঠিক হলো। মনির পকেটে হাত দিয়েছে দিনার বের করবে। হঠাৎ পকেট থেকে হাত বেড় করে বলল,
নারে নিশাত ভাবীর এই শাড়ি পছন্দ হবে না, এটা নেয়া যাবে না।
কি হলো, আবার এ সিদ্ধান্ত কেন?
ভাবির নীল রঙ পছন্দ না।
তাহলে এ কথা আগে মনে করিসনি কেন, এখন দোকানি বলবে কি? আমি বলছি তুই এটা নিয়ে নে, পছন্দ না হলে দেশ থেকেই না হয় আর একটা কিনে দিবি আর এটা অন্য কাউকে দিবি। তাছাড়া বিদেশ থেকে মনে করে নিচ্ছিস এটা কি কম? আমার তো মনে হয় ভাবী এতো অবিবেচক না, উনি খুশিই হবেন। নিয়ে নে, নাহয় আর একটা দেখ।
না চল অন্য দোকানে যাই।

মনির তো বলেই হাঁটা শুরু করে দিল। নিশাত তা পারলো না। নিশাত পরে গেল এক সমস্যায়। এখন কি করে! তার শাড়ি পরার মত এক মা ছাড়া আর কেউ নেই। মার জন্য এই শাড়ি চলে না। বোন আছে এক জন কিন্তু, সে এখনো ফ্রক ছেড়ে শাড়ি পরার মত হয়ে উঠেনি। এদিকে দোকান থেকে বেড় হয়েও আসতে পারছে না। দোকানে দাঁড়িয়ে ভাবতে ভাবতে যার কথা মনে হলো তাকে কি এই শাড়ি দেয়া যায়? কি ভাবে দিবে? কি বলে দিবে? যার সাথে আলাপ মাত্র শুরু হয়েছে এই তাকে কি করে এই শাড়ি দিবে? সে কি এই শাড়ি নিবে ওতো কিছুই নিতে চায় না!

গ্রামে যখন যেত তখন তাদের বাড়িতে ছিল নিশাতের বেশি যাতায়াত। ওর বড় চাচাত ভাই শিহাব আর বোন যুঁই ছিল নিশাতের সহপাঠী এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই সুবাদে না কি যেন কোন সুবাদে ওই বাড়িতেই দিনের বেশির ভাগ সময় কাটত। ও বাড়িতে গেলেই যুঁই ছোট বোনকে ডেকে বলতো দেখ কে এসেছে! তোর হবু বর এসেছে যা বরন কর গিয়ে! ছোট বোনের সাথে এভাবে কথা বলতে যুঁই এর মুখে একটুও আটকাত না। যা মনে আসে তাই বলে ফেলে। নিশাতও তার প্রতিটি পা ফেলার শব্দ বুঝতে পারতো, আসে পাশেই আছে। নীরবে নিভৃতেই তা অনুভব করতো। কাউকে কখনো সে কথা বলতে পারেনি। ওর সাথে কথা যা হয়েছে তা শুধু চোখে চোখে। তবে নিশাত এখনো নারী চোখের ভাষা বোঝার মত জ্ঞানী হয়ে উঠে নি। বরাবরই সে একটু উদাসীন, ভাবুক প্রকৃতির। এক দিন সকাল থেকে ফিজিক্সের কি একটা কঠিন চ্যাপ্টার নিয়ে ওরা তিন জন মাথা ঘামাচ্ছিল, এর মধ্যে দুপুরের খাবার সময় বয়ে যাচ্ছে তাই যুঁই বলল এখন আর বাড়ি যাবি কেন চল এখানে খেয়ে নে। নিশাত রাজী হয়ে ওদের সাথেই খেতে বসে গেল। আর যেন কি কি ছিল মনে নেই তবে বাতাসি মাছ আর বেগুনের চচ্চড়ি মুখে দিয়েই বলল বাঃ চমৎকার হয়েছে। আর যায় কোথায়?
সঙ্গে সঙ্গে যুঁই বলে উঠলো, হবে না, রেঁধেছে কে জানিস? তোর বৌ রেঁধেছে! নে খা, খেয়ে অভ্যাস কর বলেই আর এক চামচ উঠিয়ে নিশাতের পাতে দিয়ে দিল।

লজ্জায় নিশাতের নাক কান যেন গরম হয়ে উঠলো। কেন বোকার মত এ কথা বলতে গেল ভেবে নিজেকে মনে মনে বকল। সেদিন আর কোন কথা না বলে চুপ চাপ খেয়ে বাড়ি চলে এসেছিলো।
[চলবে]