বিভাগের আর্কাইভঃ জার্নাল ও ডায়েরী

দুর্ধর্ষ ২৯শে এপ্রিল

২৯ এপ্রিলের পরদিন সকালের কথা-
সমস্ত বাগান লণ্ডভণ্ড!
লণ্ডভণ্ড না বলে নিঃচিহ্ন বলাই যথার্থ হবে,
শেকড় শুদ্ধ উপড়ে ভেসে গেছে প্রতিটি বৃক্ষের বসত ভূমি!
কিছু ফুল ফুটেছিল বসন্ত গুণে, কিছু ছিল বারোমাসি
আর কিছু একান্তই প্রাকৃতিক…
আচ্ছা ফুলের কি আত্মা থাকে?
ফুলের আত্মারা এখন কোথায়? এই প্রলয়ঙ্করী ঝড়, জলৌচ্ছাস
ওরা কি পারতো না ফুলেদের বাঁচিয়ে রাখতে?

রাস্তার ওপারে একঘর উদ্বাস্তুর বাস ছিলো-
কোথা থেকে যেন এসেছিলো গত বৈশাখে, পুরুষটার দু হাতে দু’কন্যা
সমুদ্রের মত চোখ তাদের, গেরুয়া বসনের রমণী টা নিশ্চই তাদের মা
এক হাত বুকে চেপে পীযুষ শিশুটিকে কাঁধে ঘুম পড়িয়েছে অন্য হাতে
প্রাগৈতিহাসিক কালের একটি একতারা
ওরা বেশ ক্ষুধার্ত ছিলো, পিপাসায় কাঠ হওয়া মুখ রোদের মত ঠা ঠা করছিলো
গ্রামের কেউই তাদের চিনে না- অথচ, কেউ জল,কেউ গরম ভাত
কেউ কেউ বন্দোবস্ত করছিলো তাদের রাত কাটাবার…
ওরা ঠিক আছে তো?

মাঠ আর নদী মিলে মিশে একাকার জলে, থইথই জল
মস্ত বড় বড় গাছ, পাখির বাসা, মুরগীর খোঁয়াড় আর অগণিত মৃত দেহ
যেভাবে নদী আর প্রান্তর একাকার
যেভাবে জল,মল, রক্ত, বর্জ্য একাকার
সেভাবে মৃতদেহরা একাকার; কি মানুষ , কি পশু- জন্তু জানোয়ার
কোথাও কোন স্থল অবশিষ্ট নাই,
ক্লান্ত- পরিশান্ত জলের স্রোত, তীব্রতাও আছে এখনো
থেকে থেকে ভেসে আসছে আহাজারি, চিৎকার!…

সে দিন সূর্য উঠেছিলো
কিন্তু নিজেকে বারবার লুকচ্ছিল আড়ালে
লজ্জায় হোক কিংবা কোন দ্বিধায়- আসলে কেউ কারো চোখে তাকাচ্ছিলো না!

বিধ্বস্ত মনে আমি বারবার প্রার্থনায় নিমগ্ন হয়ে চাইলাম
চেষ্টা করলাম চোখের দু’ফোটা জল মিশিয়ে দিতে জলোচ্ছ্বাসের সাগরে
দু চোখের পাতায় কম্পন বোধ করলাম, তারপর চোখ বন্ধ করলাম…
অন্তঃকর্ণ ফেটে যাচ্ছিলো সীমাহীন গর্জনে…
কোথাও হতে ভেসে আসা আর্তনাদ
পচন ধরা লাশের উপর অসংখ্য শকুনের উন্মাদ নৃত্য
কাঁক গুলো ততক্ষণে তৃপ্ত উদর পূর্তি শেষে…তবুও
রাজি নয় ভাগের খাবার হাত ছাড়া করতে

একটি লাল বেনারসি ভেসে উঠে আসে, মেহেদী রাঙ্গা হাত
চুলের গোছায় গুজে থাকা বেলি ফুলের মালা
অবিশ্বাস্য এক নিষ্পাপ চেহারা, ঠিক যেন সাগর তলা হতে মুক্তো উঠে এসেছে
যেন এখুনি মুচকি হাসবে অথবা লজ্জায় লাল…

এত সব মানুষ, এত জীবন… সবাই শুয়ে আছে…ঘুমিয়ে আছে
যে দিকে তাকিয়েছি দেখেছি- নিঃস্পন্দ দেহ
যে দিকে ছুটে গিয়েছি দেখেছি পথ- অপথ এক হয়েছে সব
কোথাও কোন ধর্ম দেখিনি, কোন বাচ বিচার দেখিনি
গর্তের পর গর্ত খোঁড়া হয়েছে যে টুকু অবশিষ্ট ছিলো স্থলভাগ
নারী পরুষ, শিশু বৃদ্ধ একসঙ্গে সমাধিস্থ হয়েছিলো!
সমাধিস্থ হয়েছিলো গরু বাছুর জীব জন্তুর
আর কেউ কেউ তাও পায়নি…
স্রোতের তোড়ে ভেসে গিয়েছে, অথবা জমির অভাবে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে!

পৃথিবীর কোন সুগন্ধিই সে দিন দুর্গন্ধের মুখোমুখি হতে পারেনি
তাছাড়া গন্ধের তোয়াক্কা না করে জীবন খুঁজছিল জীবন
চিৎকারে আর ক্ষিপ্রটায় শিশু খুঁজছিল মাতৃকোল, একটু সহনীয়তা;
রাতের অন্ধকার ছিলো জলের মত
সাইক্লোন সেন্টার গুলো গিজগিজ করেছে কোথাও কোন ঠাঁই নাই…
অগাধ… অঠাই সর্বত্র! অবর্ণনীয় এক আঠালো বাতাস- থমথমে
ওভাবেই রাত্রি নামে- সকাল নামে…

……তারপর এক নিদারুণ মহামারী
জলের দাগ চিনে চিনে দুর্ভিক্ষ ঢুকে গিয়েছিলো প্রতিটি গৃহে- জমিনে;
আমরা তখন জীবন বুঝতাম না, মরণ বুঝতাম না
আমরা কেবল ক্ষুধা বুঝতাম, বই বুঝতাম- যা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে আছে
আমরা জামা বুঝতাম- বাবার হাতে মোয়া বুঝতাম…

একেক টা দিন যুদ্ধগ্রস্থ, বিধ্বস্ত
বাবারা অন্নের সন্ধানে মরিয়া, আর মায়েরা খড় কুড়ো যা পায়…
এভাবে ঘুরে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বিগত হলো- দেড় যুগ
আজো আমার কানে বাজে সহস্র কণ্ঠের দুর্বল আর্তনাদ, বাঁচার মিনতি
আজো উড়ে যাওয়া আত্মারা ফিরে ফিরে আসে অমোঘ প্রত্যাশায়…
===================================

২৯ এপ্রিল ১৯৯১ ইতিহাসের ভয়াল প্রলয়ংকরী দিন। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হেনেছিল স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। রাতের অন্ধকারে মুহূর্তের মধ্যে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল উপকূলীয় এলাকা। দেশের অন্যান্য এলাকার মত পাহাড়-সাগরবেষ্টিত চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকা সেদিন ঘূর্ণিঝড়ের ছোবলে বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয়েছিল। ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় কক্সবাজার, মহেশখালী, চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালী, পতেঙ্গা, সীতাকুণ্ড, কুতুবদিয়া, চকরিয়াসহ বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকা। সর্বোচ্চ ২২০ কিলোমিটার গতিবেগে বয়ে চলা ঝড়, জলোচ্ছ্বাসে বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয় দেশের ১৫ জেলার ২৫৭ টি ইউনিয়ন। মারা যায় লাখ, লাখ মানুষ। এখনও বাতাস বইলে চট্টগ্রামের উপকূলীয় জনগণ আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। ১৯৯১ সালে ঘটে যাওয়া সেই প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের কথা উপকূলবাসী তথা দেশের মানুষের কাছে অম্লান হয়ে রয়েছে। ২৯ এপ্রিল এই ভয়ংকর রাতে হাজার হাজার মানুষ হারিয়েছে পরিবার পরিজন। আপনজনদের সাথে ভেসে গেছে মাথা গোঁজার ঠাঁই। এ ঘূর্ণিঝড়ে দেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে চট্টগ্রাম জেলার উপকূলীয় এলাকা কুতুবদিয়া। শুধু কুতুবদিয়া সেদিন আনুমানিক ৪৫ হাজার মানুষ নিহত এবং কয়েকশ’ কোটি টাকার সম্পদ বিলীন হয়েছে। ২৯ এপ্রিলের সেই প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসে কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার ২৫ হাজার নারী-পুরুষ প্রাণ হারায়। পাশাপাশি হাজার হাজার গবাদি পশু প্রাণ হারায়। সম্পদের ক্ষতি হয় প্রায় হাজার কোটি টাকার।

সেই মহাপ্রলয় এর ২৭ বছর পর ও আমাকে সেই রাতের ভয়ংকর স্মৃতি আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। সেই রাতে আমাদের ঘরে আমি আর আমার বাবা ছাড়া বাকীরা সবাই ফেনী নানার বাড়িতে ছিলো। আমাদের তখন টিনের ঘর। টিনের ছাউনি টিনের বেড়া, ফলে বাতাসের তাণ্ডবনৃত্য আর গাছগাছালির প্রচণ্ড আঘাতে অবর্ণনীয় ভীতি কাজ করেছিল। এরর মধ্যে উঠোনের একটি আমগাছ, একটি নারকেল গাছ উপড়ে পড়ে। আমরা ভয়ে ছিলাম কারণ আমাদের ঘরের চার দিকে নারকেল সুপারি আর আমগাছে ভরা ছিলো।

পরদিন সকালে বাতাস কমে আসে, কিন্তু আশপাশের অন্যান্য বাড়িঘর আর অন্যান্য ক্ষয় ক্ষতি গুলো দৃশ্যমান হয়ে উঠছিল। মহান আল্লাহ পাকের দরবারে সেই দিনের কাছে আমরা পানহা চাই। আর পার্থণা করি তাদের জন্য যারা সে দিন প্রাণ হারিয়েছেন। সে সব বোবা পশুর জন্য যারা ভয়াবহ মৃত্যুকে বরণ করেছে বন্দী অবস্থায়। আর পানহা চাই আগামীর জন্য। আল্লাহ যেন সবাই কে হেফাজত করেন। তার রহমতের আশ্রয়ে ঠায় দেন।

_____________________
লেখক: দাউদুল ইসলাম
২৯শে এপ্রিল ২০১৯ মিরসরাই।

২৪শে এপ্রিল রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ভয়াবহ দিন!…

২৪শে এপ্রিল রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ভয়াবহ দিন!…

লম্বা হচ্ছে লাশের সারি

মৃত্যুর মিছিল, লম্বা হচ্ছে লাশের সারি
রক্তের স্রোত, মাংসের দলা, চূর্ণ বিচূর্ণ হাড় গোড়
রক্ত,শরীর, প্রাণ, আহাজারি
যন্ত্রণার আর্ত-চিৎকারে ভারী হয়ে গেছে গোটা বাংলাদেশের বাতাস
চারিদিকে হা হুতাশ; শোকের মাতম, মর্মস্পর্শী দৃশ্যপট
নির্বাক মনুষ্যত্ব! বিমূঢ় জাতির অন্তর্যামী…

কে শুনবে কার কান্না
কে গুছাবে কার বেদনা
ভাষা হীন মানুষ কি বলে দেবে সান্ত্বনা!

এখানে সীমানা ছাড়িয়েছে সীমানার প্রাচীর
কে স্বজন, কে নারী কে পুরুষ
কে শিশু, কে কিশোর; মরণ এসে কেড়ে নিয়েছে সেই পরিচয়
এখন সবাই লাশ! মৃত্যুর মিছিলের যাত্রী
আর কোন ভোর ভাঙবেনা তাদের ঘুম
আর কোন ধ্বংস যজ্ঞে পোহাবেনা রাত্রি।
==================

সাভারের রানা প্লাজার ট্র্যাজেডি, নিমতলী চুড়িহাট্টা, বনানী ট্র্যাজেডি… তনু, ত্বকী, নুসরাত ( জানা অজানা অসংখ্য শিশু কিশোর ধর্ষণ, খুন, বলাৎকার..) আবার কাঁদালও সমগ্র জাতিকে। বাংলাদেশের বুক কে আবার কাঁপিয়ে দিলো। শত লাশের বিভীষিকা আবার আমাদের ধিক্কার দিয়ে বলে গেলো একটি মাত্র বাক্য “অমানুষ”। আমরা অমানুষ হতে হতে সত্যি সত্যি ভুলে গেছি মানুষ নামের জাতিটির বৈশিষ্ট্য, আমরা ধিক্কার শুনতে শুনতে হারিয়েছি মানুষ হয়ে বাঁচার অধিকার!!

আজ পর্যন্ত কেউই শুনিনি পশুর পাখির হাতে নির্মিত বাস ভবন ধসে যাবার কথা। আমরা কেউই বলতে পারবো না কোন জন্তু জানোয়ারের লোভ লালসা মেটাতে অন্য জন্তু জানোয়ার বলি দান দিতে হয়। পশুরাও ক্ষুধা নিবারণ করার পর এমন অগ্রাসী স্বভাব দেখায় না যেমনটি মানুষ দেখায়। বিবেকের কি রকম বিপর্যয় হলে আমরা বারবার একই ভুল একই অপরাধে অপরাধী হই?

১১জুলাই ২০১১ চট্টগ্রামের মিরসরাইতে সড়ক দুর্ঘটনার প্রাণ হারিয়ে ৪২ জন নিষ্পাপ শিশু, সমগ্র দেশ কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। আমাদের নেতা নেত্রীরা লোক দেখানো মায়ায় ছুটে গেলো, মিডিয়া থেকে শুরু করে সচেতন সমাজের সকলেই নানা রকম বক্তৃতা। বিবৃতি দিয়ে মিডিয়া গরম করলো আর দু দিন পর সব ভুলে গেলো। এখনো প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় অসংখ্য মানুষ জীবন দিচ্ছে। ২০১৩ সালে চট্টগ্রামে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভার ভেঙ্গে আরেকটি লাশের মিছিল তৈরি করেছিলো।

অল্প কিছুদিন আগে, সেই সঙ্গে একই বছরে গার্মেন্টসে আগুনে পুড়ে মারা গেলো শতাধিক মানুষ, যাই ঘটুক দু’চার দিন পর সব স্বাভাবিক! কেউই কিছু মনে রাখেনা। অপরাধীরা অপরাধ করেই চলে। কেউই কোন নিয়ম মানে না, সকল অনিয়মই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাড়ী নির্মাণ থেকে শুরু করে জীবন যাপনের জন্য আমাদের নানা রকম উপকরণ তৈরিতেই আমরা চরম গাফিলতি করি। খাদ্যে অনিয়ম, চিকিৎসায় অনিয়ম, রাস্তায় চলাচলে অনিয়ম, আইন না মানার অভ্যাস
শিক্ষা, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান কর্ম ক্ষেত্র, সব জায়গাতেই অনিয়ম করতে করতে নিয়মের কথা ভুলেই গেছি। আর সবচেয়ে যেই সত্যটি ভুলে গেছি তা হচ্ছে আমরা যে মানুষ এই কথাটা।

দেশ বিদেশ (জার্নাল – ডায়েরী )

১২.
নেডা – নামে যে ল্যাঙ্গুয়েজ শিক্ষক আমাদের ক্লাস নিচ্ছেন – ভদ্রমহিলার বয়েস মিনিমাম ৭৫ হবে। ছয় ফিট লম্বা প্রায় -স্লিম। শরীর শক্ত পোক্ত হলেও প্রায় বাঁকা হয়ে গেছেন মহিলা। কিন্তু খুব উদ্যমী। ওরা এন্থোয়াসিয়াসটিক শব্দটাকে খুব গুরুত্ব দেয়। কাজ যাই করা হোক কাজ সেটা কাজই। শতভাগ এফোর্ট এতে দিতেই হবে। নইলে যে কাজ কাজই করা হোক না কেন সে কাজ সে বেশি দিন কন্টিনিউ করতে পারবেনা। তার মানে হলো কাজে এতোটুকু খুঁত থাকলে চাকরী থাকবে না।

আট ঘন্টা চাকরীর টাইম হলে আট ঘন্টার মাঝখানে আধা ঘন্টা ব্রেক এবং বাকী সাড়ে সাত ঘন্টা তাকে কাজ করতে হবে। এইসময় কোনো বিরাম নেই। ইন্টারভিউতে তাই জিজ্ঞেস করা হয় তার ভারী কাজ করতে কোনো ধরনের সমস্যা আছে কিনা বা ফিজিকাল কোনো সমস্যা আছে কিনা সেটাও জেনে নেয়া হয়। তাই প্রতিটা জবের পাশে এই উদ্যম শব্দটা খুবই আবশ্যিক ভাবে থাকে।

উনি লেকচারের মাঝখানে প্রায় নিজের ফ্যামিলি, ছেলেমেয়ের গল্প করেন। তার মেয়ে আইটি প্রফেশনাল। কথায় কথায় এখানে ধনী, গরীব এবং মধ্যবিত্তের একটা ফারাকের কথা বলেন। ধনীদের এটা সেটা, মধ্যবিত্তের এই প্রবলেম সেই প্রবলেম ইত্যাদি। গর্বের সাথে জানালেন ওনার মেয়েকে কোনো প্রাইভেট স্কুল বা কলেজে পড়াননি। সরকারী স্কুল কলেজে আর দশজনের মতো পড়িয়েছেন। বুঝলাম যে এখানেও বাংলাদেশের মতো ধনী গরীবের স্কুল আছে। কিন্তু ধনীর স্কুল কেমন গরীবের স্কুল কেমন খুব জানতে ইচ্ছে করছে। তবে প্রতিটা স্কুলের সামনেই বড় মাঠ আছে। ঘন সবুজ সে মাঠ দেখলে আপনাতেই মন ভালো হয়ে যায়। মাঠে বাচ্চারা হইচই করে খেলে। ফুলের মতো বাচ্চাদের এই আনন্দ দেখতে ভালোই লাগে।

প্রতিদিন ঘর থেকে বেরুলে মুল অস্ট্রেলিয়ানদের চাইতেও বেশী চোখে পড়ে আরবদের। মাঝে মাঝে মনে হয় মধ্যপ্রাচ্যে আছি। এখানে আরবী ভাষা জানলে চাকরি কনফার্ম। বড় ছোট সব চাকুরীর বেতন একই। তবে অড জবে সেলারী সবচাইতে বেশি। নীচে একটা ক্লিনার জবের বিজ্ঞপ্তি দেখলে বোঝা যাবে ক্লিনার হতেও এদেশে যোগ্যতা লাগে।

সেখানেও অভিজ্ঞতা তো লাগেই আবার ইংলিশ ফ্লুয়েন্ট স্পিকার হতে হবে।
Cleaner – Full time
SEGS
Waterloo NSW
Apply Now
$22 – $30 an hour
Part-time, Temporary, Contract, Commission, Volunteer, Casual, Subcontract, Permanent.

We are looking for someone who can immediate start. We are seeking a Cleaner with C1 EXPERIENCE in the Sydney Metropolitan area.
Applicants MUST
– Have at least 2 YEARS cleaning experience and 1 YEAR C1 experience
– Must have good personal hygiene
– Punctual and reliable
– Attention to detail
– Must be fluent in English
Duties include
– Cleaning floors with Paroling, Scrubber, cleaning toilets, windows and other duties
– Experience using scrubbing machines highly desirable
– Following a daily schedule
– Training and inducting cleaner/s
– Insuring site is to standard
– Liaising with Management
– Rectifying issues on site

অস্ট্রেলিয়া গড়ে উঠেছিলো কয়েদিদের দিয়ে। আঠারো শতকে লন্ডনের একদল অপরাধী যারা সাজাপ্রাপ্ত হয়েছিলো, দেশের কারাগারে স্থান সংকুলান না হওয়ায় তাদের পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল এই নির্জন এলাকায় এবং সাজার মেয়াদ শেষ হলে তাদের ফিরিয়ে নেয়া হয়নি। তাদের বলা হয়েছিল এখানেই এই নতুন জায়গায় তাদের নিজেদের উদ্যেগেই বসতি তৈরী করতে হবে। তখন ছিলো এখানে শুধু অস্ট্রেলিয়ান কিছু আদিবাসী। স্বাভাবিক ভাবেই অবরিজিন এবং এই নতুন বসতি স্থাপনকারী কয়েদিদের সাথে বিরোধ হলেও অবশেষে কয়েদিরা মিলেই যে রাষ্ট্র তৈরী করে সেটি অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু খুব অল্প সময়েই এতো চমৎকার উন্নত এবং সমৃদ্ধশালী দেশে কিভাবে পরিণত হলো সে বিষ্ময়।

এখনো অস্ট্রেলিয়ায় মাত্র ২৫ মিলিয়ন (আনুমানিক) মানুষ এবং যেহেতু এখনো অস্ট্রেলিয়ায় নিজেরা খুব বেশী সংখ্যক না তাই এখানে ভিন দেশীয়দের স্কিল মাইগ্রেশন এবং বিভিন্ন ভাবে মাইগ্রেশন দেয়া হয়। স্টুডেন্ট হয়ে একবার আসতে পারলে এবং রেজাল্ট ভালো করলে সিটিজেনশিপ পাওয়াটা কঠিন না। আবার রিফিউজিদের আশ্রয় দিচ্ছে এই দেশ। রিফিউজিদের সুন্দর বাসা দেয়া হয়, প্রতি সপ্তাহে সেন্ট্রাল লিঙ্ক থেকেও ভালো একটা এমাউন্ট দেয়া হয়। তাই সিরিয়ান রিফ্যুজিদের এখানে অভায়রণ্য, রোহিংগা প্রচুর। একসময় রোহিঙ্গারা এখানে বোটে করে এসেছে। এখন অবশ্য আর সেই সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। তবে যারা এসেছে তারা বেশ ভালো আছে। তাদের দুই বেডরুমের বাসা, টিভি সহ দেয়া হয় প্লাস প্রতি সপ্তাহে তাদের চলার মতো টাকা তো দেয়াই হয় এবং ছেলেমেয়েদের জন্য স্কুল ফ্রী। এবং তাদের ভরনপোষনের জন্যেও একটা এমাউন্ট দেয়া হয়। এটা অনন্তকাল দেয়া হবে না।সেজন্য সরকার তাদের ফ্রী ইংলিশ কোর্স অফার করে এবং এরপরে চাকরি পেলে সেন্ট্রাল লিংকের টাকা পাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। তাই ওরা সেন্ট্রাল লিংকের টাকা নেয় এবং ক্যাশ জব করে। ক্যাশ জব করলে সেটা ব্যাংকে যাবে না ফলে সে সেন্ট্রাল লিংকের টাকাও পেতে থাকবে আর ক্যাশেও ইনকাম করতে থাকবে। এই কাজটা রোহিংগারাই বেশী করে।

এখানে আছে প্রচুর লেবানিজ। পাঞ্চবোল, লাকেম্বা, ব্যাঙ্কসটাউন ওয়েলিপার্কে প্রচুর লেবানিজ। লেবানিজদের ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারের কারণে তাদের নিজেদের কম্যুনিটির লোকদের জব পাওয়াটা অনেকটাই সহজ। তবে তারা এখানে এসে পড়াশোনা করছে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ছাড়াও সব সিস্টেমেই তারা পড়ছে। বিত্তশালী হয়েছে। পাঞ্চবোল লাকেম্বা, ব্যাঙ্কসটাউন সাবার্বে লেবানিজদের ব্যবসা বাণিজ্যের স্বর্গরাজ্য। তবে আরবদের অধিক বিয়ে এবং প্রচুর সন্তান নেয়ার বিষয়টা যেনো অনেকটা ইনভেস্টের মত। প্রতি বাচ্চার জন্য সেন্টার লিঙ্ক থেকে প্রতি সপ্তাহে একটা ভালো এমাউন্ট পাওয়া যায়। সব পাওয়ার পরেও হতাশা, যন্ত্রনা থাকে।

আমার এক সিরিয়ান মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব হলো। খুব সরল মেয়েটা জানালো সে তিনবার সুসাইডের এটেম্পট নিয়েছিল। কিন্তু তিনবারই বিফল হয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম এতো মরতে চায় কেন সে ?
প্রেম আছে নাকি ? সে জানালো প্রেম না। সংসারে অশান্তি তাদের। ওরা নয় ভাইবোন। বড় তিন ভাই বিয়ে করেছে। তাদের বউ বাচ্চা মিলে বড় সংসার। যদিও দুই ভাই তাদের সাথে থাকে না। কিন্তু বাকী ভাইবোন তো আছে। সে বলে যে এতো বড় পরিবার। প্রতিদিন নতুন নতুন নাটক সংসারে। ওর বোন একজন ডিভোর্সড। জিজ্ঞেস করলাম কি সমস্যা ? সে উত্তর করলো ওর হাজব্যান্ড গায়ে হাত তোলে। অত্যাচারের মাত্রা বেশী হলে সে ডিভোর্স দিয়ে চলে এসেছে। সিরিয়ান এই মেয়েটার নাম শাইমা। ওর বোনের নাম ইসরা ইয়াতিম। শাইমা বললো – জানো আমাদের আরব পুরুষরা খুব এরোগেন্ট। কথায় কথায় গায়ে হাত তুলে। বললাম তোমার কি ইচ্ছে আছে ভিন্ন কমিউনিটিতে বিয়ে করার ? সে জানালো না সে ইচ্ছে নেই।

আমাদের ক্লাসে আছে এক কোরিয়ান মেয়ে। ওর নাম জেনি। আমি ওকে জিজ্ঞেস করছিলাম তোমার দেশ কোথায় – সে এমনভাবে কোরিয়া শব্দটাকে বললো আমি শুনলাম ক্রিয়া – ওরে বার বার জিজ্ঞেস করলেও সে একই ভাবে ক্রিয়া বলল। মনে মনে এই ক্রিয়া দেশ কোথায় আছে সেটা ভাবছিলাম। এরপর বললো সে এসেছে তার পার্টনারের কাছে। তার পার্টনারও কোরিয়ান। কিন্তু সে তার মা-বাবার সাথে অস্ট্রেলিয়ায় আগেই মাইগ্রেন্ট হয়ে এসেছে। ফেসবুকে প্রেম হয়েছে তার সাথে। সেই এপ্লাই করে তাকে নিয়ে এসেছে। স্ত্রীকে আনার যে প্রক্রিয়া একই প্রক্রিয়া পার্টনার আনার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সে তার পার্টনারের বাসায় পার্টনারের মা-বাবার সাথে থাকে। পার্টনারের মায়ের আবার আগের হাজব্যান্ডের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। এখনের হাজব্যান্ড তার চাইতে দশ বছরের ছোট এবং আগের ঘরের ছেলে পরের ঘরের আর একটা মেয়ে, ছেলের গার্লফ্রেন্ড এবং স্বামী সহ চমৎকারভাবে মিলে মিশে আছেন।

জেনিকে জিজ্ঞস করলাম ‘জেনি এই যে তুমি এখানে চলে এসেছ তোমার বাবা মা কি টেনশন করেন অথবা তোমার কোনো খরচ পাঠান না ? সে বললো – নো, নেভার – আই এম ওল্ড। আর একদিন জেনিকে জিজ্ঞেস করলাম – জেনি তুমি কি তোমার বয়ফ্রেন্ডকে বিয়ে করবে ? সে উত্তর করলো – নো –
কেন জিজ্ঞেস করলে সে বললো – নো মিন্স নো –
আমি চুপ করে গেলাম – বাংলাদেশের কাদামাটি লেগে আছে গায়ে – ভাবনার চেঞ্জ আনতে হবে ভাবছিলাম।

১৩
আজ ট্রেনে সামনে বসলো চরম সুন্দরী এক অস্ট্রেলিয়ান মেয়ে। অবশ্য ওরা অনেকেই ভীষন সুন্দর। লালচে সোনালী চুলের মিশেলে মেয়েটার হাত পা সবকিছু এতো সুন্দর। চোখে পড়েছে সিলভার কালারের চশমা। ওর ওভারকোট, ব্যাগের রং জুতোর রং সব এক। আমি ওর দিকে একটু পর পর তাকাচ্ছি আর ভাবছি ওর মা নিশ্চয়ই খুব সুন্দরী। আশ্চর্য যে, ওর পাশেই বসেছে এক ঘন কৃষ্ণবর্ণের মেয়ে। সাথে ওর বাচ্চা। দুজনই এতো কালো যে কালোর যেন দ্যুতি ছড়াচ্ছে।

ওরা দুজন পাশাপাশি বসাতে আমি দুজনের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম ওদের দুজনের মনের মধ্যেকার ভাবনা চিন্তা না জানি কেমন ! রং যাই হোক মানুষের ভেতরে তো রক্ত একই রকম। একই রকম অরগান শরীরে। আমি এখানে কোনো কালো মেয়েকে খুব উচ্ছ্বল হয়ে হাসতে দেখিনি। খুব যেন মন খারাপ। কারো দিকে তাকায় না। শুধু নিজস্ব ঘরানার মানুষজনের সাথেই কথা বলে। আচ্ছা ওরা হাসে না কেন ? ওরা কি অন্যদের মনের ভাষা বোঝে ? হয়তো আমার ধারনা ভুলও হতে পারে।

মানুষ তো আসলেও রেসিস্ট। রেসিসিজম থেকে মুক্তি নেই। আমি কালো মেয়ের বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। ওর বয়েস মাত্র একবছর বা তার বেশি কিছু হতে পারে। আশ্চর্য এটুকু বাচ্চা আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লো। নিশ্চয়ই এই ছেলে জিনিয়াস হবে। মানুষের চোখের ভাষা মনের ভাষা বোঝার ক্ষমতা তো বড়দেরই হয় না। আর শিশু !!

আর একদিন ট্রেনে বসেছি অপেরা হাউস যাবো। আমাদের পেছনে বসেছে এক জাপানী / চাইনিজ মেয়ে (জাপানী, চাইনিজ, ফিলিপিনি, ইন্দোনেশিয়ান, ভিয়েতনাম সবার চেহারা প্রায় একই রকম)।
মোটা সোটা ফরসা চেহেরার মেয়েটা ফোনে অনবরত কথা বলছিল তার নিজের ভাষায়। শব্দগুলো অচেনা হলে শুধু যেনো শব্দই হয়। তাৎপর্য নেই কোনো শব্দের। সমস্যা সেটা নয়। কিন্তু সে কথার মাঝখানে তিনবার মিয়াও মিয়াও বললো। আবার কয়েকটা শব্দের পরেও সে মিয়াও মিয়াও করলো।
মিয়াও মানে কি -তার ভাষায় কে জানে !
সেদিন নেভিটাসে আমাদের ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাসে লিসেনিং শোনানো হলে এক আরব মেয়েকে রেচেল জিজ্ঞেস করলেন বলতে পারো সে কি বলেছে ? ওয়াও ওয়াও ছাড়া তো কিছু বুঝলাম না – মেয়েটা উত্তর করলো –
ক্লাস ভর্তি হাসির ফোয়ারায় দুলে উঠলো রুম –
নেভিটাসের শিক্ষক বললেন প্রথম অস্ট্রেলিয়ায় মাইগ্রেন্টরা যখন আসে এই সময়টা হলো হানিমুন পিরিয়ড। হানিমুন পিরিয়ডে কোনো টেনশন থাকে না। আনন্দের ঘোরে সময় যায়। কিন্তু জবে ঢোকার পরে ব্যস্ত হলে তখন হানিমুন পিরিয়ড কেটে যায় – টানা আট ঘন্টা কাজের সময়টা খুবই কঠিন পরিশ্রম করতে হয়। সে সময় হানিমুনকাল স্বপ্নই মনে হয়। হয়তো ওনার কথাই সত্যি।
আমি জীবনকে ভ্রমন মনে করি সে সুখে যাক আর দুঃখেই যাক। জীবনের এই জার্নিকে এঞ্জয় করি –
“লাইফ ইজ রিয়েলি বিউটিফুল”

১৪
মিশেল আমাদের সুইম ইন্সট্রাকটর। আবার একই সাথে নেভিটাসের ল্যাংগুয়েজ শিক্ষক। অত্যন্ত হাসিখুসী মিশেল খুব বন্ধুবৎসল এবং স্টুডেন্টদের প্রিয় শিক্ষক। শেখানোর প্রতিটা ক্ষেত্রে সে খুব সিরিয়াস এবং ধৈর্যশীল। আমি সাঁতারের ক্ষেত্রে একটু হুড়োহুড়ি করি। মিশেল আমাকে বলে শুনো তুমি হাত মুভ করবে স্লোলি – ভেরি স্লো। ডোন্ট হারি।
আমাদের সাথে প্রচুর আরব মেয়ে আছে। ওরা তাড়াতাড়ি শব্দটাকে বলে ইয়াল্লা – আমরা যখন সাঁতারের জন্য সবাই একসাথে রওনা দিলে মিশেল হাসতে হাসতে বলে – হেই গাইজ – ইয়াল্লা – লেটস মুভ –
সুইমিং পুলে যাবার আগে ক্লাসে কিছুক্ষণ সাঁতার সম্পর্কিত বেশ কিছু ধারণা দেয় মিশেল। সাঁতার শেখা হবে বলে সরাসরি সুইমিং পুলে নেয়া হয় না। মিশেলকে বলতে ইচ্ছে করে মিশেল ক্লাসে সাঁতার না শিখলে কি হয় ?কিন্তু মিশেল নাছোরবান্দা। সে ক্লাসেই অর্ধেক সাঁতার শিখিয়ে ছাড়বে। কিন্তু সুইমিংপুলে যখন সাঁতার শিখতে গেলাম তখন বুঝলাম এই ক্লাসে প্রাথমিক লেসনটাও দরকার আছে আসলে।

সে যাই হোক ল্যাপটপে সাঁতার সম্পর্কিত বিভিন্ন টপিক দেখছিলাম। সেখানে কুইজ, সাঁতারের অভিজ্ঞতা ইত্যাদি লেখালেখি করছিলাম। আমি মিশেলকে ডেকে বললাম মিশেল আমি পরের মডিউলে যেতে পারছিনা। তুমি কি একটু হেল্প করবে ? মিশেল আমার পাশে চেয়ার না থাকাতে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে আমাকে দেখিয়ে দিলো। এখানের শিক্ষকদের এই উদার মানবিক বন্ধুসুলভ দিকটা আমাকে খুব আপ্লুত করে। শিক্ষকরা ছাত্র/ছাত্রীদের সাথে এতোটাই বন্ধুসুলভ যে কে উপরে বসলো কে নীচে বসলো তাতে শিক্ষকের সম্মান হানি হয়ে গেলো অথবা ছাত্র শিক্ষকের দূরত্ব কতটুকু থাকা উচিত কতটুকু থাকা উচিত না সেটা নিয়ে টেনশন থাকার চাইতেও যে বিষয়টাতে গুরুত্ব দেয়া হয় সে হলো স্টুডেন্ট আসলে কতটুকু শিখলো। ভিকারুননেসা নুন স্কুলের ছাত্রী অরিত্রর জন্য দুঃখ হল। আহা এইসব দেশে থাকলে এইরকম তাজা প্রাণ অকালে ঝরে যেত না।

আমাদের ভাতিজা হাবিব খান আর তার স্ত্রী জোহরা ক্যনবেরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তারা ক্যানবেরাতেই থাকে।ওদের ছেলের নাম হিলমি। সে এখানে একটি সরকারী স্কুলে ক্লাস ফোরে পড়ে। মজার কথা হলো স্কুলে কোনো পরীক্ষা নেই। বিভিন্ন রকমের ক্লাস টেস্ট হয়। সে টেস্টের মার্ক একে অন্যেরটা দেখবে না। কেন প্রশ্ন করা হলে জানা গেলো এতে যে কম নাম্বার পেয়েছে তার মন খারাপ হবে।

বাচ্চারা যা পড়াশোনা করবে সবটাই স্কুলে। বাসায় কোনো পড়াশোনা নেই। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়াশোনা নিয়ে চাপ নেই। বাচ্চারা তাই বাসায় পড়েই না। আমার মনে পড়লো দেশের বাচ্চাদের কথা। এই সময় বাচ্চারা স্কুলে তো পড়েই। বাসায় এসে আবার তিন থেকে চারজন শিক্ষকের কাছে পড়ে। নইলে কোচিং করে। মা বাবা বাচ্চা সবাই শুধু পড়াশোনা আর স্কুল নিয়ে হয়রান। কিসের খেলাধুলা কিসের কি। তার উপর তাদের জন্য খেলার মাঠ নেই। ওরা জন্ম থেকেই হচ্ছে রোবট। সেই বাচ্চারাই বড় হচ্ছে নানান ধরনের মানসিক সমস্যা নিয়ে। সত্যিই দুঃখ হয় আমাদের দেশের বাচ্চাদের জন্য। আমাদের শিশুদের জন্য সত্যিকার শৈশব দেয়া আদৌ কি সম্ভব হবে? কে জানে ?

“যে বসন্তে ফুল ফুটেনি” উপন্যাসের কিয়দংশ

“যে বসন্তে ফুল ফুটেনি” উপন্যাসের কিয়দংশ

পাপ নিয়ে আমার নিজস্ব একটি হাইপোথিসিস আছে। আমি মনে করি প্রতিটি মানুষ শিশু নিষ্পাপ অবস্থায় পৃথিবীর মুখ দেখে। আর এজন্যই শিশুদের ফুলের সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে। ফেরেস্তার সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে। আর এই জন্যই শিশুর শরীরের রঙ কালো হউক কিংবা ফর্সা হউক তার চেহারায় একটা পবিত্র এবং লাবণ্য সদা বিরাজমান থাকে। মূলতঃ তখন শিশুর অবয়বে সৃষ্টিকর্তার সৌন্দর্য জ্যোতি রূপে প্রকাশিত হয়। আমরা তখন শিশুদের আদর করে গালে হাত বুলিয়ে দিই, চুমোয় চুমোয় শিশুর গাল লাল করে দিই।

এরপর দিন যায়। মাস যায়। বছর যায়। শিশু কিশোর হয়। কিশোর যুবক হয়। যুবক পৌঢ় হয়। পৌঢ়ও একদিন বৃদ্ধ হয়। যতোদিন গড়ায় শিশুর মুখের কমনীয়তা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। একটা সময় মুখ থেকে স্বর্গীয় সেই লাবণ্য উদাও হয়ে যায়। তখন আর চুমু দিতে ইচ্ছা করে না। ভালোবাসতে মন চায়না। এটাই পৃথিবীর রীতি। এভাবেই চলে এসেছে। এভাবেই চলতে থাকবে। আমার প্রশ্ন হলো, শিশুসুলভ কোমলতা বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের মুখ থেকে বিলীন হয়ে যায় কেনো? আমার ধারণা, মানুষের বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার পাপের মাত্রা এবং পাপের বোঝা বড় হতে থাকে। আর সেই পাপের ছায়া ছায়াবাজির মতো আমাদের মুখের পবিত্রতার স্থানটি দখল করে নেয়। তখন মানুষকে বিশ্রী দেখায়। কুৎসিত দেখায়। যে মানুষ যতো বেশি পাপ কাজ করে, তার মুখ ততো বেশি শ্রী হীন হয়। চেহারার দিকে তাকালেই পাপী পাপী মনে হয়।।

আসলে সৃষ্টিকর্তার চাওয়া কী? আমার ধারণা এবং বিশ্বাস সৃষ্টিকর্তা চান তিনি মানুষকে জন্মের সময় যেমন নিষ্পাপ অবস্থায় পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, প্রতিটি মানুষ মৃত্যুর সময় তেমনি নিষ্পাপ অবস্থায় তাঁর কাছে ফিরে আসুক। এই নিষ্পাপ অবস্থায় ফিরতে পারা মানেই পরমাত্মার সাথে মিলনের একমাত্র ১০০% গ্যারান্টি। তা না হলে জেল, জরিমানা অর্থাৎ দোযখের আগুনে কোটি কোটি বছর পুড়িয়ে পুড়িয়ে আত্মাকে পবিত্র করা হবে।

অতঃপর সেই পাপী আত্মাটি পরমাত্মার সাথে মিলনের উপযুক্ত হবে। যতো দিন না সে পাপমুক্ত হবে, ততোদিন তার শাস্তি চলতেই থাকবে। চলতেই থাকবে।।

জিদ মানুষকে মুহুর্তের মধ্যে নিঃস্ব করে

মানুষের মন বুঝতে হলে তাঁকে তাঁর নিজের উপর ছেড়ে দাও তবে তাঁর হাল ছেড়না। তুমি যদি বুঝে থাকো সে ভুল করছে তবুও তাঁর অদৃষ্টের উপর ছেড়ে দাও ভুল করুক এবং ভুল থেকে শিক্ষা নিক। সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে নজরে রাখো। দেখো নতুন কোনো বড়ো ধরনের ভুলের মধ্যে জড়িয়ে যাওয়ার আগে সাবধান করো যখন সে তাঁর ভুল বুঝতে পারবে সে নিজেই ক্ষমা চেয়ে নেবে।

জিদ মানুষকে মুহুর্তের মধ্যে নিঃস্ব করে। দুজনের মধ্যে যখন তৃতীয় ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটবে সেখানে সম্পর্ক নামক বন্ধনে তিক্ততা তৈরি হয়। শেষ পর্যন্ত সেই সম্পর্কে মরিচীকা বাসা বাঁধে।

তাই প্রত্যেকটি সম্পর্কে বিশ্বাস থাকাটা জরুরী। আজ তুমি তাকে যেভাবে দেখছ সেটাকে তাঁর জীবনযাপনের প্রকৃত রূপ ভাবতে পারো।

তোমার কাছে যা গল্প আরেকজনের কাছে সেটাই বাস্তবতা হতে পারে এই জন্য যদি তাঁর সবকিছু অবিশ্বাস্য মনে হয় তবে তুমি ভুল করছ।

মানুষ যখন তৃতীয় মাত্রার জালে আটকা পড়ে তখন তাঁর মধ্যে সবকিছুই ধুম্র ধোঁয়াশা লাগে। আসলে সে বুঝতেই পারেনা কি হারাতে যাচ্ছে। বিনিময়ে কি পেতে যাচ্ছে। প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত নিজের বিবেক আর বিবেচনা বোধ থেকে নেয়া উচিৎ।

অহংকার জিদ মানুষের জীবনে অহেতুক। এইসব অহেতুক মনোভাবনা দিয়ে সত্যকে আড়াল করা হয়। জিদ অহংকারে যদি সাফল্য থাকতো তাহলে পৃথিবীর ইতিহাস নতুনভাবে লিখা হতো।

অহেতুক জিদ সম্পর্কের প্রকৃত বন্ধনকে ছোট করে দেয়। বিস্তৃত পৃথিবী একটি মানুষের কাছাকাছি থেকে সংকীর্ণ হয় দূরে চলে যায় যার পরিণতি হয় বিভাজন। কিছু সম্পর্ক হয় এ্যামিবার মতো। যা সৃষ্টি থেকে বিস্তৃতি লাভ করে তুমি যদি প্রজননে বিশ্বাসী না হও তাহলে তোমাকে বিভাজনেই আস্থাশীল হতে হবে।

অথচ তোমাকে বিশ্বাসে আস্থাহীন না হয়ে বিবেক বিবেচনায় আস্থাবান হওয়ার কথা। আমি বিশ্বাস করি প্রত্যেকটি মানুষ বিশ্বাস দিতে পারেনা। প্রত্যেকটি মানুষও রাখতে পারেনা বিশ্বাসের মর্যাদা।

তুমি যদি বিশ্বাসের বদলে সন্দেহপ্রবণ হও তবে তোমাকে সুসংগত ভাবা যাবেনা। সুস্থ মানুষরা সুস্পষ্ট থাকে সুসম্পর্ক বজায় রেখে।

সন্দেহপ্রবণরা বাহানা খোঁজে নতুনভাবে জাল বিস্তার করে তাঁর মুল উদ্দেশ্যে পৌঁছানোর। আসলে উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ সমীচীন। উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ অনৈক্যের বিরুদ্ধে নৈতিক কিম্বা নৈকট্যের।

জীবন কোনো পরজীবী আগাছা নয়। আজ তোমার প্রাপ্তিযোগ থেকে যে দিন চলে যাবে আগামীকাল হয়তোবা সেদিন আর আসবে না। ঘরের আসবাবপত্র ভেঙ্গে গেলে নতুনভাবে গোছানো যায় নতুনভাবে তৈরি করা যায়। সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলে জোড়াতালি দিয়ে আবারও একত্রিত হতে পারে কিন্তু মন ভেঙ্গে গেলে বিশ্বাস ভেঙ্গে গেলে আস্থা হারিয়ে গেলে আর কোনোদিনই পাওয়া যায়না।

তাই বলবো বিশ্বাস করো। যে তোমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে পেরেছে তাঁকেই তুমি ভালোবাসো যে তোমার ভালোবাসার মর্যাদা দিতে জানে।

এই পৃথিবী সত্যাগ্রহদের জন্য আরামপ্রদ না। এই পৃথিবী মিথ্যুক আর প্রতারকদের জন্য অভয়ারণ্য। সবচেয়ে বড়ো কথা সত্য সবাই নিতে পারেনা।

সত্য যাঁর নিকট অধরা তাঁর কাছে প্রত্যেকটি সত্য হেয়ালি মনে হবে হাস্যকর মনে হবে সন্দেহজনক মনে হবে দুর্বোধ্যতাকে পুঁজি করে পরিচ্ছন্ন পথ আবিষ্কৃত হয়না।

দুর্বোধ্যতাকে পুঁজি করে সুখী জীবনের সংজ্ঞা খুঁজে পাওয়া যায়না। প্রকৃতরা সবসময় আস্থার মর্যাদা দেয়।

স্বপ্ন যদি গভীর হয় ঘুমিয়ে থাকাটা অবাস্তব মনে হবে। আমি বাস্তবতা বিশ্বাসী মানুষ। আমি জেগে থেকে যা পরিকল্পনা করি বাস্তবে তাঁর একটি রূপরেখা তৈরি করি।

তা নিয়ে আলোচনা করি। আমি মানুষ; আমার মুখমণ্ডল যেমন উন্মুক্ত আমার চিন্তাধারা ও তেমনি মুক্ত, স্বচ্ছ। তুমি আমাকে স্বচক্ষে যা দেখছো দূর থেকে তাঁর বিপরীত না।

তাইতো আমি নিরন্তর পৃথিবীর একজন ভূপাতিত লক্ষ্যভেদী মানুষ। আমার অলক্ষ্যে বয়ে চলে মিশরের নীল নদ আমার চোখের মধ্যে বয়ে চলে চিনের হুয়াংহ নদী তবুও মানুষ জেগে উঠে অলক্ষ্যের লক্ষ্যে।

এভাবেই একদিন মানুষের বিবেকের মুক্তি ঘটে। এই পথ চলতে চলতে একদিন শেষ হবে। যখন ক্লান্ত শরীর নিয়ে কোথাও বসে পড়বে আর জীবনের লাভক্ষতির হিসাব করবে তখন তুমি ঠিক ধরতে পারবে এই জিদ অহংকার তোমাকে কি দিয়েছে তুমি কি পেয়েছ আর কি পাওনি।

নভেম্বর ১৭, ২০১৮।

দেশ বৈদেশ

**
আজ ট্রেনে সামনে বসলো চরম সুন্দরী এক অস্ট্রেলিয়ান মেয়ে। অবশ্য ওরা অনেকেই ভীষন সুন্দর। লালচে সোনালী চুলের মিশেলে মেয়েটার হাত পা সবকিছু এতো সুন্দর। চোখে পড়েছে সিলভার কালারের চশমা। ওর ওভারকোট, ব্যাগের রঙ জুতোর কালার এক।

আমি ওর দিকে একটু পর পর তাকাচ্ছি আর ভাবছি ওর মা নিশ্চয়ই খুব সুন্দরী। আশ্চর্য যে, ওর পাশেই বসেছে এক ঘন কৃষ্ণবর্ণের মেয়ে। সাথে ওর বাচ্চা। দুজনই এতো কালো যে কালোর যেন দ্যুতি ছড়াচ্ছে। ওরা দুজন পাশাপাশি বসাতে আমি দুজনের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম ওদের দুজনের মনের মধ্যেকার ভাবনা চিন্তা না জানি কেমন ! আমি এখানে কোনো কালো মেয়েকে খুব উচ্ছ্বল হয়ে হাসতে দেখিনি। খুব যেন মন খারাপ। কারো দিকে তাকায় না। শুধু নিজস্ব ঘরানার মানুষজনের সাথেই কথা বলে।
আচ্ছা ওরা হাসে না কেন ? ওরা কি অন্যদের মনের ভাষা বোঝে ?
মানুষ তো আসলেও রেসিস্ট। রেসিসিজম থেকে মুক্তি নেই।
আমি কালো মেয়ের বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। ওর বয়েস মাত্র একবছর বা তার বেশি কিছু হতে পারে। আশ্চর্য এটুকু বাচ্চা আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লো। নিশ্চয়ই এই ছেলে জিনিয়াস হবে। মানুষের চোখের ভাষা মনের ভাষা বোঝার ক্ষমতা তো বড়দেরই হয় না। আর শিশু !!

**
নেডা – নামে যে ল্যাঙ্গুয়েজ শিক্ষক আমাদের ক্লাস নিচ্ছেন – ভদ্রমহিলার বয়েস মিনিমাম ৭৫ হবে। ছয় ফিট লম্বা প্রায় -স্লিম। শরীর শক্ত পোক্ত হলেও প্রায় বাঁকা হয়ে গেছেন মহিলা। কিন্তু খুব উদ্যমী। ওরা এন্থোয়াসিয়াসটিক শব্দটাকে খুব গুরুত্ব দেয়। তাই প্রতিটা জবের পাশে এই উদ্যম শব্দটা খুবই আবশ্যিক ভাবে থাকে। উনি লেকচারের মাঝখানে প্রায় নিজের ফ্যামিলি, ছেলেমেয়ের গল্প করেন। তার মেয়ে আইটি প্রফেশনাল। কথায় কথায় এখানে ধনী, গরীব এবং মধ্যবিত্তের একটা ফারাকের কথা বলেন। ধনীদের এটা সেটা, মধ্যবিত্তের এই প্রবলেম সেই প্রবলেম ইত্যাদি। গর্বের সাথে জানালেন ওনার মেয়েকে কোনো প্রাইভেট স্কুল বা কলেজে পড়াননি। সরকারী স্কুল কলেজে আর দশজনের মতো পড়িয়েছেন। বুঝলাম যে এখানেও বাংলাদেশের মতো ধনী গরীবের স্কুল আছে। কিন্তু ধনীর স্কুল কেমন গরীবের স্কুল কেমন খুব জানতে ইচ্ছে করছে। তবে প্রতিটা স্কুলের সামনেই বড় সবুজ মাঠ আছে। সেই মাঠ আবার প্রতিদিন যত্ন করে ঘাস কেটে একে সবুজ মসৃণ আদল দেয়া হয়। বাচ্চারা হইচই করে খেলে, ইচ্ছামত দৌড়াদৌড়ি করে। দেশের বাচ্চাদের কথা ভাবলে কষ্টই লাগে। ঢাকা চিটাগাং বড় শহরগুলোতে বাচ্চাদের জন্য খেলার মাঠই নেই।

ভালো হলো অস্ট্রেলিয়া এখন মিক্সড মানুষের দেশ। কত সংস্কৃতি কত দেশের মানুষ যে এখানে আসছে – এসেছে – দেখলে অবাকই হতে হয়। সিরিয়ান রিফ্যুজিদের এখানে অভয়ারণ্য, রোহিংগা প্রচুর। আমাদের ক্লাসে আছে এক কোরিয়ান মেয়ে। ওর নাম জেনি। আমি ওকে জিজ্ঞেস করছিলাম তোমার দেশ কোথায় – সে এমনভাবে কোরিয়া শব্দটাকে বললো আমি শুনলাম ক্রিয়া – ওরে বার বার জিজ্ঞেস করলেও সে একই ভাবে ক্রিয়া বলল। মনে মনে এই ক্রিয়া দেশ কোথায় আছে সেটা ভাবছিলাম। এরপর বললো সে এসেছে তার পার্টনারের কাছে। তার পার্টনারের বাসায় পার্টনারের মা-বাবার সাথে থাকে। ওর মা এর আবার আগের হাজব্যান্ডের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। তার হাজব্যান্ড তার চাইতে দশ বছরের ছোট এবং আগের ঘরের ছেলে পরের ঘরের আর একটা মেয়ে এবং ছেলের গার্লফ্রেন্ড এবং স্বামী সহ চমৎকারভাবে মিলে মিশে আছেন। জেনিকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম -জেনি তুমি কি তোমার বয়ফ্রেন্ডকে বিয়ে করবা ? সে বলে যে -নো – কেন জিজ্ঞেস করলে সে বলে যে নো মিন্স নো –
আমি চুপ করে গেলাম – বাংলাদেশের কাদামাটি লেগে আছে গায়ে – ভাবনার চেঞ্জ আনতে হবে চিন্তা করছিলাম –

**
আজ দুপুরে বেরোতেই উষ্ণ বাতাস, রোদের তেজ – বুঝলাম একদিনেই শীত চলে গেলো বলে এখানে – কেউ কেউ এখনো ফুল হাতা সোয়েটার, জ্যাকেট পড়েছে। আহা বসন্ত – বসন্তের শুরুতেই হাড়ের ভেতর ফুটে যাওয়া শীতকে বিদায় জানাতে পেরে এতো ভালো লাগছিলো। এখানের শীত কাতরই করে আমাকে। নেভিটাস থেকে বের হলে কয়েক গজ সামনে একটা বড় মাঠ পড়ে। মাঠের সামনেই ব্যাঙ্কসটাউন লাইব্রেরী। মাঠের পাশে পাশে বেঞ্চি দেয়া আছে। আর গাছের এতো নুয়ে পড়া। মনই কেমন করে আমার – আজ বেরোতে বেরোতে সন্ধ্যা হলে বের হয়ে এমন চমৎকার বাতাস আর সন্ধ্যার আলো-আঁধারী পরিবেশে মনই ভালো হয়ে গেলো। এরকম সময়ে উচ্চ দার্শনিক চিন্তাই মনে আসে। আহা এই পৃথিবীতে মানুষ আসবে মানুষ যাবে। আর আমরা সব মানুষ খাওয়া পড়া বাঁচার জন্য সংগ্রাম করতে থাকবো করতেই থাকবো – ইত্যবসরে জীবন পার হয়ে একদিন বলবে এই পৃথিবী তোমার জন্য নয়।

না হোক – তবু এই সময় পাখির কোলাহলে এমন ঝিম ধরা আনন্দ হলো। চোখের চারপাশে উপরে নীচে আশে পাশে নিরব নির্জন মাঠে এক দৌড়ে পার হয়ে ছেলেবেলার মত মনে হলো ছুঁয়ে যাই সব আনন্দ। আহা জীবন – এতো ছোট কেন ! এত সংকীর্ণ কেন ?
তবু মন কেমন করা এই আকাশ বাতাসে বেঁচে থাকা আর একবার সার্থক মনে হলো ।

মনোরম পরিবেশ আর একজন একাকী মানুষ।

কারো অপেক্ষায় বেঞ্চিগুলো।

ইতিহাসের পাতিহাস

প্রত্যেকেরই নিজস্ব ইতিহাস থাকে, আমারো আছে, মাঝে মাঝে আমি ইতিহাসের ছাত্র হয়ে যাই, একদম সর্বোচ্চ নাম্বার পাওয়া ছাত্র, যার মাথার পুরোটাতেই গিজগিজ করছে ইতিহাস, আজ তেমিন একটা দিন, ঘুরেফিরে হারানো বন্ধু, পরিচিতজন, আত্মীয়, হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকারা মাথায় গিজগিজ করছে।

অতীত ফুরিয়ে যায় না
একটা বিয়ে বাড়ির কথা মনে পড়ছে
আমার বড়ভায়ের বিয়ে, তা বছরষোল হবে বয়স, জামাই এর হুলুদের সভাস্থলে আসন পেতে বসে আছি, ভাবখানা এমন যেন বিয়েটা আমারই।

হঠাৎ আসল বরের আগমনে মুখরিত চারপাশ, তাড়াহুড়া করে উঠতে যেয়ে কখন যে কিশোরীর লাল শাড়িতে জড়িয়ে গেছি বুঝতেই পারিনি, সম্বিত ফিরে পেতেই বুঝতে পারলাম মেয়েটিকে নিয়ে আমি ষ্টেজের পেছনটাতে পড়ে আছি, কিযে লজ্জা তার মুখে তারপর আর কি দে দৌড়, এই মেয়েটাই আমাকে প্রথম প্রেমিক বলে জাতে উঠিয়েছে পরবর্তিতে।

তাকে ভুলতে হলে আমার অনেক ভুলতে হবে,
কৈশোর ছাড়ছিল না বলে একদিন তার জন্য শোক দিবস পালন করে নিলাম, ব্যস আর কি যায় যায় দিন।

মুখর যে গান থেমে গেছে
থেমে গেছে তরঙ্গ তমাল,
থেকে গেছে পান্ডুলিপি,
থেকে গেছি পাঠক হয়ে।

থাক প্রেম থাক তোলা, কর্মহীন পূর্ণ অবকাশে হয়ত অন্য কোন এক আলোচনায় আবার প্রেম উঠিয়ে আনব।

“যে বৃক্ষ আকাশ চুমে আছে
তার সাথে তুলনা হতে পারে তোমার অভিমানের,
ডালপালা ছড়িয়ে অভিমান ছোটে আকাশ পানে
নিচ থেকে মাঝেসাঝে জল ঢালি,
বাচিয়ে রাখি অভিমান।
আরো কিছুকাল জমুক ঘৃণা।”

আজ যাই
মাথায় শুধু প্রেমই ঘুরপাক খাচ্ছে, পাছে ইতিহাসের থলে থেকে বেড়াল না বেরিয়ে যায়। ভাল থাকুন।

৫১ তম মৃত্যু বার্ষিকী মহান বিপ্লবী চে’গুয়েভারা কে লাল সালাম

১৯৬৭ সালে আজকের দিনটিতে নিরস্ত্র অবস্থায় নয়টি গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল বন্দী চে গুয়েভারাকে। সেই নয়টি গুলিতে মারা যায়নি চে’র মতবাদ। আজন্ম বিপ্লবী চে-স্মরণে এই আয়োজন —–

#চে’র সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্তঃ
এর্নেস্তো “চে” গুয়েভারা (স্পেনীয়: tʃe geˈβaɾa চে গেবারা) (১৪ জুন,

[১] ১৯২৮ – ৯ অক্টোবর, ১৯৬৭) ছিলেন একজন আর্জেন্টিনীয় মার্ক্সবাদী, বিপ্লবী, চিকিৎসক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, গেরিলা নেতা, কূটনীতিবিদ, সামরিক তত্ত্ববিদ এবং কিউবার বিপ্লবের প্রধান ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল এর্নেস্তো গেবারা দে লা সের্না (স্পেনীয়: Ernesto Guevara de la Serna)। তবে তিনি সারা বিশ্ব লা চে বা কেবলমাত্র চে নামেই পরিচিত। মৃত্যুর পর তাঁর শৈল্পিক মুখচিত্রটি একটি সর্বজনীন প্রতিসাংস্কৃতিক প্রতীক এবং এক জনপ্রিয় সংস্কৃতির বিশ্বপ্রতীকে পরিণত হয়।

[২] তরুণ বয়সে ডাক্তারি ছাত্র হিসেবে চে সমগ্র লাতিন আমেরিকা ভ্রমণ করেছিলেন। এই সময় এই সব অঞ্চলের সর্বব্যাপী দারিদ্র্য তাঁর মনে গভীর রেখাপাত করে।

[৩] এই ভ্রমণকালে তাঁর অর্জিত অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে এই অঞ্চলে বদ্ধমূল অর্থনৈতিক বৈষম্যের স্বাভাবিক কারণ হল একচেটিয়া পুঁজিবাদ, নব্য ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ; এবং এর একমাত্র সমাধান হল বিশ্ব বিপ্লব।

[৪] এই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে চে রাষ্ট্রপতি জাকোবো আরবেনজ গুজমানের নেতৃত্বাধীন গুয়াতেমালার সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫৪ সালে সিআইএ-এর ছকে গুজমানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলে চে-র বিপ্লবাত্মক আদর্শ আরও বদ্ধমূল হয়। পরবর্তীকালে মেক্সিকো সিটিতে বসবাসের সময় তাঁর সঙ্গে রাউল ও ফিদেল কাস্ত্রোর আলাপ হয়। চে তাঁদের ছাব্বিশে জুলাই আন্দোলনে যোগ দেন। মার্কিন-মদতপুষ্ট কিউবান একনায়ক ফুলজেনসিও বাতিস্তাকে উৎখাত করার জন্য গ্রানমায় চড়ে সমুদ্রপথে কিউবায় প্রবেশ করেন।

[৫] অনতিবিলম্বেই চে বিপ্লবী সংঘের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড পদে তাঁর পদোন্নতি হয় এবং বাতিস্তা সরকারকে উৎখাত করার লক্ষ্যে দুই বছর ধরে চলা গেরিলা সংগ্রামের সাফল্যের ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

[৬] কিউবার বিপ্লবের পর চে নতুন সরকারে একাধিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য, বিপ্লবী আদালতে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্তদের আপিল পুনর্বিবেচনা ও ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড প্রদান।

[৭] শিল্পোদ্যোগ মন্ত্রী হিসেবে খামার সংস্কার আইন প্রবর্তন, কিউবার জাতীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক বাহিনীর ইনস্ট্রাকশনাল ডিরেক্টরের ভূমিকা পালন, এবং কিউবান সমাজতন্ত্রের প্রচারে বিশ্বপর্যটন। এই পদাধিকারের কল্যাণে তিনি মিলিশিয়া বাহিনীকে প্রশিক্ষণ প্রদানের সুযোগ পান; ফলত এই বাহিনী পিগ উপসাগর আক্রমণ করে তা পুনর্দখলে সক্ষম হয়।

[৮] কিউবায় সোভিয়েত পরমাণু ব্যাসিলিস্টিক মিশাইল আনার ক্ষেত্রেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

[৯] চে ছিলেন এক বিশিষ্ট লেখক ও ডায়েরি-লেখক। গেরিলা যুদ্ধের উপর তিনি একটি প্রভাবশালী ম্যানুয়েল রচনা করেন। তরুণ বয়সে দক্ষিণ আফ্রিকায় মোটরসাইকেলে ভ্রমণের স্মৃতিকথাটিও তাঁর অত্যন্ত জনপ্রিয় রচনা। বৃহত্তর বিপ্লবে অংশ নেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি ১৯৬৫ সালে কিউবা ত্যাগ করেন। প্রথমে কঙ্গো-কিনসহাসায় তাঁর বিপ্লব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর তিনি বলিভিয়ায় বিপ্লবে অংশ নেন। এখানেই সিআইএ-মদতপুষ্ট বলিভিয়ান সেনার হাতে বন্দী ও নিহত হন চে।

[১০] চে গুয়েভারা একাধারে ইতিহাসের এক নন্দিত ও নিন্দিত চরিত্র। বিভিন্ন জীবনী, স্মৃতিকথা, প্রবন্ধ, তথ্যচিত্র, গান ও চলচ্চিত্রে তাঁর চরিত্রের নানা দিক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। টাইম পত্রিকার বিংশ শতাব্দীর সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী ১০০ জন ব্যক্তির তালিকায় তাঁর নাম প্রকাশিত হয়।

[১১] আবার গেরিলেরো হেরোইকো নামে আলবের্তো কোর্দার তোলা চে-র বিখ্যাত ফটোগ্রাফটিকে “বিশ্বের সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ ফটোগ্রাফ” হিসেবে ঘোষিত।

#গুয়েভারার প্রতি -সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়
আমার ঠোঁট শুকনো হয়ে আসে, বুকের ভেতরটা ফাঁকা
আত্মায় অভিশ্রান্ত বৃষ্টিপতনের শব্দশৈশব থেকে বিষণ্ন দীর্ঘশ্বাস
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরধী করে দেয়-
বোলিভিয়ার জঙ্গলে নীল প্যান্টালুন পরা
তোমার ছিন্নভিন্ন শরীর
তোমার খোলা বুকের মধ্যখান দিয়ে
নেমে গেছে
শুকনো রক্তের রেখা
চোখ দুটি চেয়ে আছে
সেই দৃষ্টি এক গোলার্ধ
থেকে চুটে আসে অন্য গোলার্ধেচে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।

শৈশব থেকে মধ্য যৌবন পর্যন্ত দীর্ঘ দৃষ্টিপাত
আমারও কথা ছিল হাতিয়ার নিয়ে তোমার পাশে দাঁড়াবার
আমারও কথা ছিল জঙ্গলে কাদায় পাথরের গুহায়
লুকিয়ে থেকে
সংগ্রামের চরম মুহূর্তটির জন্য প্রস্তুত হওয়ার
আমারও কথা ছিল রাইফেলের কুঁদো বুকে চেপে প্রবল হুঙ্কারে
ছুটে যাওয়ার
আমারও কথা ছিল ছিন্নভিন্ন লাশ ও গরম রক্তের ফোয়ারার মধ্যে
বিজয়-সঙ্গীত শোনাবার-কিন্তু আমার অনবরত দেরি হয়ে যাচ্ছে!
এতকাল আমি এক, আমি অপমান সয়ে মুখ নিচু করেছি
কিন্তু আমি হেরে যাই নি, আমি মেনে নিই নি
আমি ট্রেনের জানলার পাশে, নদীর নির্জন রাস্তায়, ফাঁকা
মাঠের আলপথে, শ্মশানতলায়
আকাশের কাছে, বৃষ্টির কাছে বৃক্ষের কাছে,
হঠাৎ-ওঠাঘূর্ণি ধুলোর ঝড়ের কাছে
আমার শপথ শুনিয়েছি, আমি প্রস্তুত হচ্ছি, আমি
সব কিছুর নিজস্ব প্রতিশোধ নেবো
আমি আমার ফিরে আসবো
আমার হাতিয়অরহীন হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়েছে, শক্ত হয়েছে চোয়াল,
মনে মনে বারবার বলেছি, ফিরে আসবো!

চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়-
আমি এখনও প্রস্তুত হতে পারি নি, আমার অনবরত
দেরি হয়ে যাচ্ছে
আমি এখনও সুড়ঙ্গের মধ্যে আধো-আলো ছায়ার দিকে রয়ে গেছি,
আমার দেরি হয়ে যাচ্ছেচে,
তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়!

চে গুয়েভারার প্রতি (#দাউদুল ইসলাম) আমার নিবেদন-

থম থমে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন
বাতাসে ক্ষুধার্তের দীর্ঘশ্বাস
একটি বজ্রপাত সারাদুনিয়া কম্পিত
একটি আর্তনাদ বিদ্যুৎ চমকিত;
একটি কলম বন্দুকের মত সরব গর্জন,
নিরবে নিরবে ছড়িয়ে পড়ে পরম ধর্ম
ঘরে ঘরে জন্ম নে যার আলোকরশ্মি
এসো ফিরে ফিরে
এসো হে চেতনা; এসো নতুন উল্লাসে
হে চে’গুয়েভারা
হে বিপ্লবের পরম্পরা
কলম হাতে নয় বন্দুকের পবিত্র পল্লবে
আজ যে তোমার বড্ড প্রয়োজন
শীতের কনকনে ঠান্ডা
কুয়াশাচ্ছন্ন মাঠে তোমার অগ্নিঝরা বক্তৃতা
রাত্রির ঘাঢ় অন্ধকারে ঢাকা ঘুমন্ত পৃথিবী
দূর্গম পথ পেরিয়ে তোমার দুরন্ত চলাচল
মায়ের বুকে গুজে থাকা শিশুর কান্নার বদলে ক্রোধ
ওরে চে এ’যে সাম্রাজ্যবাদের প্রথম পরাজয়
তুমি আর একবার জ্বালাও সেই চুরুট
আর একবার উঠে বস সেই ঘোড়ায়
আর একবার চুটে চলো অরণ্যে-পথে প্রান্তরে;
আর একবার জাগাও বিপ্লব
আমরা আছি সেই অপেক্ষায় প্রতিটি অহর্নিশ ভরে।

লেখক #দাউদুল ইসলাম (কবি ও প্রাবন্ধিক)

দেশ – বৈদেশ

১০
অস্ট্রেলিয়া এখন মিশ্রকালচারের দেশে পরিণত হয়েছে। এত এত মাইগ্রেন্ট বিভিন্ন দেশ থেকে এখানে এসেছে এবং আসছে যে আমার মনে হয় একসময় অরিজিনরা নিজেদের হারিয়ে ফেলবে তাদের মধ্যে। চাইনিজ মনে হয় প্রায় সবচাইতে বেশী মাইগ্রেন্ট হয়ে আসছে। সারাক্ষণ নিজেদের মধ্যে পাখির মতন কিচকিচ করে কথা বলে। তারা যেখানেই যায় সাথে করে ঘরে তৈরী খাবার নিয়ে যায়। অল্পবয়সী মেয়েগুলো খুব মিষ্টি দেখতে। ওদের মুখের স্কিন যেন লেমিনেটেড শীট। আমার হিংসেই হয়। এতো পলিশ কি করে থাকে এরা !! আমাদের নেভিটাসের ক্লাসে প্রায় চাইনিজ মেয়ে /মহিলা/পুরুষ সাথে করে এককাপ/গ্লাস লেবু স্লাইস মেশানো হালকা গরম পানি সাথে নিয়ে বসে। পুরো ক্লাসে একটু পরে পরে এই মিক্সড পানি পান করে।

আমরা নিজেদের ব্যপারে এতো কেয়ার করি না। অথচ ওরা সবসময় কেয়ারফুল। সম্ভবত এজন্য ওদের স্কিন সবসময় চকচকে, পলিশড। এখানে আমরা যেহেতু পি আর নিয়ে এসেছি তাই আমাদের চিকিৎসা ফ্রি। বাংগালী ফ্রী পেলে বিষও খায়। আমরাও বিষ খেতে দেরী করছিনা। সব ধরনের টেস্ট চিকিৎসা করিয়ে নিচ্ছি। বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষায় দেখা গেলো আমার পেটে ব্যাক্টেরিয়া, শরীরে হিমোগ্লোবিন কম, আয়রন কম, এমনকি ক্যালসিয়াম ও ভীষন কম। ভাবছিলাম আমরা গরীব দেশের মানুষ বলে এই অবস্থা নাকি আমাদের খাবারের মধ্যে ভেজাল নাকি আমি নিজেই নিজের ব্যপারে সবসময় অসতর্ক। মেয়েরা তো বেসিকেলি এমনি হয়।

সেদিন ডাক্তারের অপেক্ষায় বসে আছি – অপেক্ষা বাংলাদেশের মত এখানেও করতে হয় – তবে পার্থক্য হলো এখানে ডাক্তার সাহেব নিজেই এসে রোগীকে ডাকেন। কোনো কম্পাউন্ডার নেই যে তার দাপটে রোগী হয়রান হবে। যাই হোক এখানে প্রচুর আরবী ভাষাভাষী মানুষও সিটিজেনশীপ নিয়ে বাস করছে। একজন আরব বিশেষ করে লেবানিজরা প্রায়ই চারটা বিয়ে করে। এরপর তাদের আরো সদস্যদের আনার ব্যবস্থা করে। এবং এই যে এতোগুলো বিয়ে করে ওদের স্ত্রীদের তাতে কোনো আপত্তি আছে বলে মনে হয় না। এক বুড়োর চার স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী আমার আম্মার সমান, দ্বিতীয় স্ত্রী আমার বয়সী, তৃতীয় স্ত্রী আমার ছোটবোনের বয়েসী আর চতুর্থ স্ত্রী আমার মেয়ের বয়সী। এতে তাদের সমস্যা নেই। ওরা বান্ধবীর মতো চলাফেরা করে। কিন্তু দীর্ঘাঙ্গী মেয়েগুলো দেখতে অসম্ভব সুন্দর। এখানে ওরা সবাই একসাথে থাকে বলে ওদের ইনকাম প্রচুর। যেমন একজনের ঘরে সাত থেকে আটজনই যদি ইনকাম করে সে অবশ্যই ধনী /সম্পদশালী যাদের অনুপরিবার তাদের চাইতে। এখন এখানে তারা ব্যবসা করে চাকরি করে প্রতিষ্ঠিত। অস্ট্রেলিয়ানদের চাইতেও সম্ভবত।

যাই হোক ডাক্তারের ডাকের অপেক্ষায় বসে আছি। এক আরবী মা তার তিন মেয়ে আর একজন সাথে গভর্নেস (সম্ভবত) নিয়ে এসেছে। এজন্যই মনে হলো গভর্নেসের গায়ের রঙ কালো আর ওদের গায়ের রঙ পশ্চিমাদের মতই। মেয়ে দুটোর বয়স হবে সাত বা আট। ওদের চুল বড়। এত বড় যে সুন্দর করে বেণী করে রেখেছে। আমি পিচ্চিটাকে ডেকে বললাম এসো তোমার ছবি তুলি। সে রাজী হলো। সুন্দর ছবি তুললো। কিন্তু ওদের গভর্নেস ডেকে ওকে বলে দিলো যে অপরিচিত কারোর কথায় ছবি তুলতে হয় না (যদিও তার কথা শোনা যায় নি কিন্তু ধরে নিলাম )। গভর্নেস মেয়েটা কালো মোটা আর ফ্লুয়েন্ট ইংলিশে কথা বলে। একটু অপমান লাগলো আমার। মেয়েটা হাসিখুশি ছিল খুব, দুই বোন চমৎকার খেলছিলো কিন্তু ওর কথায় সেও আপসেট হয়ে অসহায় ভাবে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। আমি সামান্য হেসে চোখে চোখে অভয় দিলাম – আহা ব্যপার না তো !!

আরব শিশু –

সবগুলো মেয়ে বাচ্চার চুল সোনালী এবং কোমর অবধি – বিষয়টা ভাবার মতো

১১
আমার আম্মা বলতো আমি শুকনাতেও আছাড় খাই। আর আব্বা বলতো ‘তোর হাতে কি কোনো রগ নাই ? কিছু ধরলেই পড়ে যায় !! এসব শুনতে শুনতে অভ্যেস হয়ে গেছে বলে আর কেউ বললে পাত্তা দেই না। সেদিন আমাদের ক্লাসে সিদরা নামে পাকিস্তানী মেয়েটা বললো – জানো সেদিন তোমার ছেলে কি বললো ?
হাসতে হাসতে তার দিকে ফিরলাম – আচ্ছা বলতো কি বললো !
‘তোমার সাথে বেরোলে তোমাকে নাকি ওরা কিছুক্ষণ পরে খুঁজে পায় না। তুমি নাকি হারিয়ে যাও”।
সে আবার যোগ করলো – তুমি নাকি কবি মানুষ, তাই আনমনা – বলে সে আবার হাসতে হাসতে পড়ে যাচ্ছিলো।
আমি হাসলাম। এরকম ঘটনা যে প্রায়ই হয় সেটা ভেবে নিজেই হয়রান হলাম। আমার ছেলেমেয়েরাও যে এই বিষয় নিয়ে কিঞ্চিত চিন্তিত থাকে এতে আত্মপ্রসাদ নাকি আত্মতুষ্টি হয় সেটা বুঝতে পারছিলাম না। সে যাই হোক – নিজের ব্যপারে এমন একটু আধটু ধারণা আবার সত্যি প্রমাণিত হলো সেদিন সত্যি সত্যিই যখন ব্যাঙ্কসটাউনের শুকনা ঝকঝকে পোলিশ রাস্তায় আছাড় খেয়ে পা’য়ে ফ্র্যাকচারই করে ফেললাম। এর কি কোনো মানে আছে ?

ব্যাঙ্কসটাউন যে এরিয়াতে ইংলিশ ভাষা শিক্ষার ক্লাস হয় সে জায়গায় যেতে রেলস্টেশন থেকে একটা মার্কেট, মাঠ, ব্যাঙ্কস্টাউন লাইব্রেরী পার হয়ে যেতে হয়। এই লাইব্রেরী দেখে তো আমার মাথা খারাপ। এতো বড়, সুন্দর ঝকঝকে লাইব্রেরী যে মনই ভালো হয়ে যায়। লাইব্রেরীতে ঢোকার মুখে থিয়েটার, একটা টেকওয়ে ফুডশপ এরপর লাইব্রেরী। লাইব্রেরীর সামনে একপাশে আছে সুইমিং পুল। আপনি ইচ্ছে করলে সুইমিংপুল সামনে রেখেও বই পড়তে পারেন। অনেকে বাচ্চা নিয়ে যায়। তাদের বাচ্চাদের জন্য শোয়ার ব্যবস্থা আছে। শুয়ে বসে সব ভাবে পিনপতন নিরবতায় বই পড়তে পারবেন। ৫০০০ স্কয়ার মিটারের তিনটা ফ্লোরের এক সুবিশাল লাইব্রেরী। শুয়ে বসে রিলাস্কিং মুডেও বই পড়ার ব্যবস্থা আছে। কম্পিউটার ইউজিং ফ্রি ওয়াইফাই সহ। মন খারাপ হলে গাছের পাতাদের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতেও বই পড়তে পারবেন কেননা লাইব্রেরীর ভেতর থেকে কাচের জানালা দিয়ে দেখা যায় সুবিশাল মাঠ, বৃক্ষ, পাখির কোলাহল। কত হাজার ধরনের বই যে আছে – আছে পৃথিবীর সব বিখ্যাত বই।

আছে নানান ধরনের জার্নাল, ম্যাগাজিন। ভোগের মত ফ্যাশন ম্যাগাজিন ও আছে। তবু নিজের ভাষায় বই দেখলে অথবা পড়তে পেলে ভালো লাগে নিশ্চয়। ইংরেজী বই অনেকটা যেনো সব তরকারী রান্না হলেও লবন ছাড়া সব স্বাদ মাটি এরকম। সব আছে অথচ কিছুই নাই। একবার কলেজে (আমার জব করতাম যেখানে) একজন ইংলিশে বিজ্ঞাপন রেডি করছিলেন ছাত্র ভর্তির জন্য। আমি বলছিলাম নিজের ভাষা হলো এমন যে দেখা মাত্র হৃদয়ে গেঁথে যাবে কিন্তু পরের ভাষা আগে পড়বে তারপরে বুঝবে তারপর সে রেসপন্স করবে। এটা একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। নিজ দেশ ছেড়ে আসলে সেই অনুভবটা আরো তীব্র হয়।

কবি আবদুল হাকিম বলেছিলেন ‘দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়। নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যায়।।” আমাদের তো দেশ ভালো লাগে, ভাষাকেও প্রাণের অধিক ভালোবাসি। তবু এই দেশ বিদেশ মানুষের আসা যাওয়া -এটা চলবেই – ক্রমশ এই পৃথিবী ছোট্ট গ্রামের মত হয়ে গেলে সব ভাষাই আমাদের ভাষা, সব দেশই আমাদের দেশ, পুরো পৃথিবীই একটা গ্রহ – এর বাইরে যেতে হলেও আমাদের এর মাটিতেই মিশতে হবে – আহা পৃথিবী ! আর কি অসম্ভব সুন্দর এই বেঁচে থাকা !!

ব্যাঙ্কস্টাউন লাইব্রেরীর অন্দর মহল

ব্যাঙ্কসটাউন লাইব্রেরী

লাইব্রেরীর সামনে রয়েছে মন উদাস করা পার্ক

দেশ-বৈদেশ


মালয়েশিয়ার লাংকাউই – সমুদ্রের পাড়ে এক দল থাকেন যারা প্যারাস্যুটে ওঠার ব্যাপারে গাইড করেন এবং যে বা যিনি প্যারাস্যুটে উঠবেন তার সাথে গাইড হিসেবে থাকেন একজন। আমাদের গ্রুপের সবাই প্যারাস্যুটে উঠে ভীষন এক্সাইটেড। স্মিতা, দুরন্ত, সুমন, মইনুল সবাই বল্লো ওঠো তুমি। কোন ভয় নেই।

আমার উচ্চতা ভীতি আছে এটা কোন রকমেই তাদের বোঝাতে পারলাম না। ঠেলে ঠুলে পাঠানো হলো আমাকে। ওঠার আগে আমাকে একটা ড্রেস পরিয়ে দেয়া হল, একটা বেল্ট সামনে পেছনে আর বসার জন্য একটা বেল্ট দুহাতে ধরার জন্য মোটা রশি এবং পেছনে আমার গাইড। যখন উড়ে যাব তখন অন্যরা বললো “রান রান রা -আ- ন –”

কিছুদিন আগে সিঁড়িতে ওঠার সময় পায়ে ভীষন ব্যথা পেয়েছিলাম।
তখনো ব্যথা ছিল তবু দৌড়ালাম। মূহুর্তেই আমরা মাটি ছেড়ে শুন্যে উঠলাম। নীচের মানুষ গুলো সব ছোট হতে হতে মিলিয়ে গেল। আমার পাশে গাইড সে একটা কথাও বলছিল না। এত সুন্দর আকাশ নীচে সমুদ্রের সবুজ জল – ঠান্ডা গা জুড়ানো বাতাস, ঘন সবুজ পাহাড় – নীল আসমান – ধীর গতিতে পাখির মত উড়তে থাকা – পাখিরই রয়েছে এমন সুন্দর জীবন, আত্মবিশ্বাস – উড়তে পারার বিশ্বাস –বিকেল ছিল ওই সময়টা – কি যে অসাধারণ ঠান্ডা মৌন ঋষির মত এই পৃথিবী – ব্যাখ্যাতীত সব – সব সুন্দর ব্যাখ্যা করা যায় না – কিন্তু কিছুই উপভোগ করতে পারছিলাম না। ভয়ে টেনশনে আমি পর্যুদস্ত ।
মনে হচ্ছিল যদি পড়ে যাই বেঁচে উঠব কি করে -এই আতংক আমাকে সারাক্ষণ ঘিরে ছিলো। অনেকটা আকাশ পথে উড়ে উড়ে একসময় ধীরে ধীরে নীচে নামতে লাগলো প্যারাস্যুট। অদৃশ্য মানুষ গুলো ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকলো। আস্তে আস্তে প্যারাসুট মাটি স্পর্শ করলো । হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম যেন। জোরে নিঃশ্বাস নিলাম – আহ ! কি অসাধারণ এই বেঁচে থাকা –
সবাই জিজ্ঞেস করছিল কেমন লাগছিল ! কেমন লাগছিল !
অনেক সুন্দর এমাজিং, বিশ্বাস করার চাইতেও সুন্দর- বলতে পারলাম না –
রবীবাবুর সেই গানের কথা মনে পড়লো ‘ অনেক কথা যাও যে বলি কোনো কথা না বলি-

মালয়েশিয়ায় স্পাইডারম্যানের সাথে পায়ে পায়ে’-

মালয়েশিয়া – বুকিত বিনতাং


যে অবস্থাতেই থাকি সেটাকে আমি অভিজ্ঞতা বলি। কে আছে যে তার সব দিন সমান আনন্দে কাটে ? সেদিন ক্লাসে নিজের সম্পর্কে লিখতে বলাতে দেশের কথা এতো তীব্রভাবে মনে পড়লো আমি ক্লাস থেকে বের হয়ে গেলাম। আশ্চর্য! চোখের পানি কিছুতেই থামছে না। চোখের জলের কিছু ধর্ম আছে , যেমন বন্যার পানির মতো বাঁধ ভেংগে উপচে পড়া। যখন কিছুতেই সামলাতে পারছিলাম না, আমি হাল ছেড়ে দিলাম। যা বুকের ভেতর থেকে আসে সে আসুক – যদি ভাসিয়ে নেবার হয় সে নিক, সে আপনাতেই থেমে যাবে। জীবনের ধর্ম গতিশীলতার মতো ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হবে জীবন। জীবন থেমে থাকার নয় –

সিডনীর পাঞ্চবোলে যখন আমরা আছি তখন ভাবছিলাম এতো গ্রামীন ভাব – বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া পরিবেশ বান্ধব ভীষন। পাখিরা মানুষকে ভয় পায় না। পাখি এতো পাশে এসে দাঁড়ায় যে , যেনো জানে তারা নিরাপদ। এতো বেশী বৃক্ষের সারি – নাগরিক জীবনকে সুশীতল শান্তির পরশ দেয়। আমার ছেলে দুরন্ত বলে – কিন্তু মা এখানের গাছ পালা দেশের মত এতো বেশী সবুজ না। আমিও তাই ভাবি। অথবা হতে পারে এখনো এখানে শীত। শীত যাই যাই করছে। এই সময়টা তো পাতা ঝরার সময়। পাতা হলুদ হয়ে বিবর্ণ হবে এরপর ঝরে যাবে। তাই দেখা যায় প্রায় গাছের শাখা আছে কিন্তু একটা পাতাও নেই। চিকন উর্ধ্বমুখী শাখায় গাছগুলো পত্রশুন্য ।

সে যাই হোক মুল সিডনী শহরে গেলে ভুল ভেঙ্গে গেলো। হাইরাইজ চকচকে ঝকঝকে বিল্ডিং, নারী পুরুষ ছুটছে তো ছুটছেই। এরই মাঝে প্রদীপের নীচে অন্ধকারের মতন দুএকজন ভিক্ষুককে বসে থাকতে দেখেছি রাস্তার পাশে। একজন আবার উবু হয়ে দুহাতের ভেতর মুখ লুকিয়ে হাত দুটো দিয়ে ধরে রেখেছে একটা বক্স যাতে কয়েন জমা হবে। যদিও ওরা মনে হয় না বাংলাদেশের ভিক্ষুকের মত গরীব। বেশ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, কাপড় চোপড়ে এত দরিদ্র না। তবু মনটা কেন যেনো খারাপ হলো তাদের জন্য। সেন্ট্রাল লিংক তো বেকার ভাতাও দেয়। আর এক স্বাস্থ্যবতী মহিলাকে দেখেছি গীটার বাজিয়ে ভিক্ষা করতে। ভালই গাইছে। ফরসা চেহারা, ভীষন হেলদি, চকচকে লিপস্টিক ঠোঁটে, প্রায় ছয় ফিট লম্বা মহিলাকে ভিক্ষুক ভাবতে কষ্ট হয়।

এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা এতো মনোরম যে মাঝে মাঝে মনে হয় আহা বাংলাদেশে যদি এমন হতো তাহলে কতই না ভালো হতো। যেমন পাঞ্চবোল থেকে যদি টাউন হলে যেতে হয় তবে প্রায় দশটা বা পনেরটা জায়গা টাচ করতে হয়। এক মিনিট পরে পরে স্টেশন। তার মানে শহরের নাগরিকদের যাতায়াতের সুব্যবস্থার জন্য প্রতিটা জায়গাতেই ট্রেনের ব্যবস্থা আছে। যদিও এতো ভালো যাতায়াত ব্যবস্থা তারপরেও আমার তীব্র ভাবে রিকসা জার্নির কথা মনে হয় –
সন্ধ্যার পরে রিকশায় উঠলেই ঝিরি ঝিরি বাতাস – উপরে আকাশ, চাঁদের সাথে সাথে চলা –
আহা -আমাদের গেছে যে দিন -একেবারেই কি গেছে !!

sydney তে আকাশ স্পর্শ করা স্থাপনা সব
হাইড পার্ক

দেশ -বৈদেশ

বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়া যাবার পথে তিনবার প্লেন বদল হলো আমাদের। প্রথম বাংলাদেশ বিমানে করে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা, এরপর থাই এয়ারে ঢাকা থেকে থাইল্যান্ড দুই ঘন্টার জার্নি, থাইল্যান্ড থেকে অস্ট্রেলিয়া দীর্ঘ নয় ঘন্টার জার্নি।
বাংলাদেশ বিমান যদিও মোটামোটি স্মুদ চলেছে কিন্তু থাই এয়ার দুটোই আকাশে উঠে এমন ঝাকাঝাকি শুরু করলো – ভয়াবহ ভয়ে সময় কাটলো । তবু ওদের দুর্দান্ত সুন্দরী এয়ারহোস্টেস দেখে চোখ আটকে থাকে। কিন্তু ওদের ভাষা বিদ্ঘুটে শোনায় মেয়েগুলোর মুখে। নামা এবং ওঠার সময় ওরা ওদের ভাষাতেই সম্ভবত ওয়েলকাম বা বিদায় জানায়। আইয়া বা এই ধরনের একটা শব্দ বলে যে মেয়েগুলোর মুখে যেনো মানাচ্ছে না এই শব্দগুলো । তবু নিজেদের ভাষা বলে কথা ।

থাইল্যান্ড এয়ারপোর্ট

কিন্তু থাইল্যান্ডের এয়ারপোর্টে নেমেই চোখ জুড়িয়ে যায়। জানতাম এই সংক্ষিপ্ত ট্রানজিটে নামা সম্ভব না তাই ভাবলাম জানালা দিয়ে দেখে নেই থাইল্যান্ড। যদিও খুব বেশি দেখা সম্ভব না তবু বোঝা যায় খুব প্ল্যানড শহর। রাস্তাঘাট বিল্ডিং, দীর্ঘ নদীও সরু ফিতার মত মনে হয়। বাংলাদেশ থেকে যখন প্লেন উপরের দিকে উঠে বিশেষ করে চট্টগ্রাম এয়ারপোর্ট থেকে তখন সমুদ্র আর কর্ণফুলির জল খুব মন কেমন করা অনুভুতি এনে দেয়।
কি হবে – কি হবে না- কি আছে কি নেই কেন এই জীবন এই ধরনের অহেতুক বোধের জন্ম নেয় সম্ভবত আকাশযানে উঠলেই। বড় বেশী অকিঞ্চিৎকর মনে হয় এই জীবন। আহা কেন এই ছুটোছুটি – বড্ড নিরর্থক এই জীবন —


আরববাসী এখানে এত বেশী যে আমার খুব অবাক লাগে। বলা যায় যে এখানে তারা খুব স্বাধীন জীবন যাপন করে। সম্ভবত তাদের দেশে এতোটা স্বাধীন জীবন যাপন তাদের সম্ভব ছিলো না। মেয়েরা খুব যে নাক মুখ ঢেকে রাখে তা নয় তবে ভালো করে মাথা ঢাকা হিজাব পড়া কিন্তু ফ্রিকোয়েন্ট চলাফেরা সম্ভবত স্বাধীনতার স্বাদ এনে দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। ধনী দেশ কিন্তু স্বাধীনতা না থাকলে সমস্ত ধন সম্পদ ও যে অর্থহীন যাকে পরাধীনতার স্বাদ নিতে হয় তারাই জানে। স্বাধীনতা এবং পর্যাপ্ত স্বাধীনতা মানুষকে মানুষ হতে শেখায়। পরাধীনতা এবং একই সাথে জীবন যাপনের জন্য অপর্যাপ্ত অর্থ স্বাধীনতা থাকলেও সে স্বাধীনতাও অর্থহীন মনে হয়।


কি যে ওয়েদার ! কিছু বুঝতে পারি না। শুধু ক্লান্তি লাগে। ঘুম আসে সারাদিন। সময় পেলেই ঘুমিয়ে কাটাই। নেভিটাসে সপ্তাহে চারদিন ক্লাস। নেভিটাস ইংরেজী ভাষা শিক্ষা কোর্সের ইন্সটিটিউট। এখানে (অস্ট্রেলিয়া) যারা রেসিডেন্সি নিয়ে আসে সরকার তাদের এই কোর্সটা ফ্রী অফার করে। সিরিয়ান রিফিউজি প্রচুর এখানে। এরপর আছে মিশর, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, ইন্ডিয়ান, বার্মার রিফিউজি, চীন এবং আরো বহু দেশের মানুষজনের মিলনমেলা। শিক্ষার্থীদের তিনটা ভাগে ভাগ করা হয়। যারা খুব কম জানে তাদের লেভেল ১, যারা মোটামোটি জানে তাদের লেভেল ২ এবং যারা এক্সপার্ট তাদের লেভেল ৩। আমি পড়লাম লেভেল ২ এ আর দুরন্ত পড়লো লেভেল ৩ এ। সে যেহেতু দেশেই ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েছে তাছাড়া মালয়েশিয়াতেও সে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়েছে। তার ইংলিশ অনেক স্পিডি। সে তাই মাঝে মাঝে ক্লাসে যায়।

আমার অবাক লাগে সিরিয়ানদের দেখলে। ওদের জীবন যাপন পোশাক আশাক ফিগার ফেইস সবই পশ্চিমাদের মতই। এমনকি কারো কারো চুলও সোনালী। চোখগুলো শুধু কালো। খুব মিশুক।
মেয়েরা – মেয়েরা ওরা খুব হইচই করে মজা করে কথা বলে। আমরা সিরিয়ানদের সাথে এক বাসে ছিলাম। ওরা আরবী ভাষায় গান গাইছিলো। তবে যেটা হলো ওদের ছেলেরা সম্ভবত কাজ করে বলে সিরিয়ান ছেলেরা এখানে পড়তে আসে না। কয়েকজন সিরিয়ান অল্প বয়েসী মেয়ে বয়স ২৭ – ২৮ এর বেশী না। ওদের তিনটা করে বাচ্চা। আশ্চর্য খুব হাসিখুশী, ফ্যাশনেবল। কি করে মেনেজ করে ! অবাক লাগে। আর একজন মহিলা ওনার হয়তো ৪০ এর উপরে বয়স তার ছয়টা বাচ্চা। নেভিটাসের বেশীরভাগই মেয়ে শিক্ষার্থী। অতএব সবারই বাচ্চা আছে। তাদের বাচ্চাদের জন্য আবার চাইল্ড কেয়ারের ব্যবস্থা আছে। ওই ছয় বাচ্চার মা দুজন বাচ্চা নিয়ে আসে সাথে করে। মহিলার সাথে দুটো মেয়ে শিশু। একটা ট্রলিতে দুজন বাচ্চা রাখার ব্যবস্থা। সেদিন ওর বাচ্চা দুটোকে দেখে অবাক হলাম। অদ্ভুত সুন্দর। যেনো বেহেশত থেকে এদের আনা হয়েছে।

কাল আমার ম্যাডাম বললেন – সবাই যেনো দুপুরের লাঞ্চ নিয়ে আসে সাথে করে প্লেট। প্রত্যেক দেশের মানুষ তার নিজস্ব ঘরানার খাবার নিয়ে আসবে। গতকাল সন্ধ্যায় প্ল্যান করলাম আমি পোলাও আর চিকেন ফ্রাই নিয়ে যাব। সকালে উঠে রান্না করে নেব। সারাক্ষন মনে মনে এটা পরিকল্পনায় আছে। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে দেখি বারটা বাজে। আশ্চর্য এ কি রকম ব্যপার। দুরন্ত দুইটা বাজে এলো নেভিটাস থেকে। সে বললো ‘গেলা না কেন মা। কতজন কত রকম খাবার আনলো’।
কি আর করা – মিসই করলাম –


ব্যাংকসটাউন (নেভিটাস ) টু তামারামা বিচ–

তামারামা সমুদ্র সৈকত

তামারামা সমুদ্র সৈকত

নেভিটাস থেকে বলা হলো যে আমাদের তামারামা সমুদ্র সৈকত দেখাতে নিয়ে যাওয়া হবে। সমুদ্র সৈকতে নেয়া হবে ভাল কথা। কিন্তু সমুদ্রে কি কি বিপদজনক ঘটনা ঘটতে পারে সে সম্পর্কে প্রতিটা ক্লাসেই কিছু না কিছু ব্রিফিং দেয়া শুরু হলো। সমুদ্রে শার্ক থাকতে পারে, কুমির থাকতে পারে, কয়েক ধরনের জেলি ফিস আছে। কিছু নিরীহ কিছু বা ভয়াবহ। সমুদ্রে কোথাও বা কারেন্ট আছে। সে জায়গা গুলোতে যাওয়া যাবে না। সাঁতার কাটতে একা যাওয়া যাবে না। বিপদে কিভাবে হাত নাড়াতে হবে সমুদ্র গিয়ে আরো কত কি। যাই হোক গত ৪ তারিখ আমরা সবাই নেভিটাসের অঙ্গনে হাজির হলাম। হাওদা নামে ইরানী মেয়েটা সে এসেছে তার দুই বাচ্চা নিয়ে। একটার বয়স সম্ভবত ছয় মাস আর একটার দুই বা তার কিছু বেশী। সে হয়রান এই বাচ্চাদের নিয়ে ।

চারটা বাস ঠিক করা হলো। সে বাসে করে আমরা সবাই নেভিটাসের শিক্ষার্থীরা যাবো। হাওদা একা পেরে উঠছিল না তার বাচ্চাদের নিয়ে। বাংলাদেশের এক মেয়ে এগিয়ে এলো। সে পিচ্চিটাকে সামলালো আর বড়টাকে হাওদা। এরপর আবার ট্রলিটা নিয়ে বাসে ওঠা। ওর কষ্ট দেখে মনে হলো আহা পৃথিবীর সব মায়েরই সমান কষ্ট।

নেভিটাসে আমাদের লেভেল ২ এর ম্যাডাম এক মরিশাসের মহিলা। ছয়ফিটের মত লম্বা একটু শ্যামলা ছোট চুলের খুব হাসিখুশী একটানা সকাল সাড়ে আটটা থেকে দুপুর ঠিক দুইটা পর্যন্ত ক্লাস নেন কোনোরকম ক্লান্তি ছাড়াই। মরিশাসে তিনটা ভাষায় মানুষ কথা বলে। ওদের মাতৃভাষার সম্ভবত কোনো বর্ণ নেই। ফ্রেঞ্চ ভাষায় তাই লেখাপড়া চলে। ইংরেজীটাও ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজের মত শিখতে হয়। বাসে উনি আমার পাশে বসেছিলেন। নিজেদের ভাষায় কি অসম্ভব তাড়াতাড়ি কথা বলে যাচ্ছিলেন। কথার শেষে বার বার মেসি মেসি বলছিলেন। জিজ্ঞেস করলাম মেসি মানে কি। তখন উনি বললেন যে মেসি হলো ধন্যবাদ। ফ্রেঞ্চ ভাষায় ধন্যবাদকে মেসি বলে।

যাই হোক শহর পেরিয়ে যখন সমুদ্র সৈকতে পৌছালাম তখন আমাদের সবাইকে কয়েকটা গ্রুপে ভাগ করে একটা বড় হলরুমে নেয়া হলো। আয়োজকরা সবাই পড়েছে হলুদ গেঞ্জি, লাল শর্টস। হলুদ গেঞ্জির কলার লাল। উজ্জ্বল রঙ। তামারামা বিচে স্কারশানের আয়োজক নেভিটাসে লেভেল ২ এর শিক্ষক মিসেল। মিসেল সারাক্ষল হই চই করা ফুর্তিবাজ মহিলা। মিসেল ও হলুদ গেঞ্জি লাল শর্টস পড়লো। আমি ভাবলাম সকালে হয়তো নাস্তার আয়োজন করা হয়েছে। কিসের কি – আবার সেই প্যাঁচাল। সমুদ্রে কি কি বিপদ ঘটতে পারে সে সম্পর্কে তিন থেকে চারজন ব্রিফিং করলো। আবার বড় বড় স্টিকার দিয়ে বিপদজনক চিহ্নগুলো দেখানো হলো। সমুদ্র দেখতে গেলাম এরপর। মনে পড়ে গেলো কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কথা। কত যে বিশাল আমাদের এই সমুদ্র সৈকত। সেই তুলনায় তামারামা সমুদ্র সৈকতকে নদীর তীরই মনে হয়। বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রের যে উত্তাল ঢেউ এর ওঠা নামা সে এক অবর্ণনীয় ইতিহাস মনে হলো। তবে এই সমুদ্রের ঢেউ যে কম ভয়ংকর তা বলা যাবে না। এরই মাঝে কিছু তরুণ ইয়টে সমানে ঢেউ এর সাথে পাল্লা দিয়ে উড়ছে দেখতে ভালই লাগে আবার ওদের সাহসের প্রশংসা না করে পারি না ।

দুপুর ঠিক একটা বাজে আমাদের লাঞ্চ দেয়া হলো। মেনু – একটা বান , একটা সসেজ (বিফ অথবা পোর্ক যার যেটা পছন্দ ), সালাদ বাদাম সহ, জুস আর পানি। খাওয়া দাওয়া শেষ এবার ফেরার পালা। পাকিস্তানী আর একটা মেয়ে তার মেয়েকে নিয়ে হয়রান হচ্ছিল। আমার কর্তা তাকে বললো তোমার ট্রলি আমাকে দাও। তুমি ফ্রী যাও। মেয়েটা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। মেয়েরা আসলেও মায়ের জাত। তার পোষাক আশাক যতই আধুনিক হোক ভেতরে সে মমতাময়ী মা। সিরিয়ান ছোট ছোট মেয়েরাও ছেড়া ফাটা জিন্স সোনালী চুল, আইল্যশে ভর্তি চোখ নিয়ে ট্রলি ঠেলে ঠেলে নিলেও মনে হয় পৃথিবীর সব মা- এর হৃদয়ই তো সমান মমতায় আদ্র ।

দেশ – বৈদেশ

এখানের (অস্ট্রেলিয়া) বাড়িগুলো দেখলে কেমন একটা শান্তি শান্তি ভাব হয়। অধিকাংশ বাড়িগুলো একতলা বা দুতলা এবং টালির ছাদ। ছোট ছোট গেট। আমার কাছে অনেকটা নির্জন গ্রামের মত লাগে। রাস্তাঘাট ক্লিন – গাড়িগুলো প্রতিটা বাড়ির সামনে দাঁড় করানো। গ্যারেজ থাকলেও যেহেতু এখানে সবারই গাড়ি থাকতেই হয় এবং ইজি বাহন রিক্সার মত কোনোকিছু সম্ভব না।

অভিবাসী হয়ে আসলে যে কাজগুলো প্রথম সেরে ফেলতে হয় এগুলো হল ইংলিশ কোর্স সেরে ফেলা টেক্স ফাইল করা এবং মেডিকেল টেস্ট সেরে ফেলা। এরপর আস্তে ধীরে জব অথবা ব্যবসা যাই করার করা যাবে। আজ ইংলিশ কোর্সে ( নেভিটাস) নিজেদের এন্ট্রি করতে গিয়ে ইরাকী এক মেয়ের সাথে পরিচয় হল। দেখতে অনেকটা বাংগালী মেয়েদের মতই কিন্তু বেশ লম্বা আর মিষ্টিমত মেয়েটার সাথে তার একবছরের শিশু। সেও নেভিটাসে ইংলিশ কোর্সে ভর্তি হতে এসেছে। ইরাক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ বলে সে কিছুটা হতাশ। তার স্বামী ইরানের। ইরাকের ভাষা আরবী হলেও ইরানের ভাষা ফার্সী । আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি কেন এখানে রেসিডেন্সি নিয়ে এসেছি।
আমি কিছু বলবো বলবো ভেবে চুপ রইলাম।
আমার মনে হলো আমরা মনে হয় ভাসমান হয়েই রইলাম। মানুষ তো আসলে অনিশ্চিত জীবনের দিকেই ফিরে। আজ ধানমন্ডি হলে কাল যে মায়ানমার কিংবা এমেরিকা থাকব না সে কে বলতে পারে!!


আজ শীত কম বলে ভাবলাম হাফ হাতা সোয়েটার পড়ে বের হই।
এখানে ২ থেকে ১২ /১৩ বা ২২ পর্যন্ত তাপমাত্রা ওঠানামা করে।
বাংলাদেশে তাপমাত্রা ২ ডিগ্রী হলে দেশের অর্ধেক মানুষই হয়তো মারা যেতো। যাই হোক ট্রেনে করে পাঞ্চবোল (যেখানে আমরা থাকি ) থেকে ব্যাঙ্কসটাউন গেলাম। শীত লাগছিলো না যে তা নয় কিন্তু ভাবলাম ব্যপার না। নেভিটাসের ক্যাম্পাসে ঢুকতেই শীত কম লাগলো। হিটার অথবা চারদিকে ব্লক বলে একটু হালকা উষ্ণ থাকে ক্যাম্পাস। কিন্তু ক্লাস রূমে বসতেই আফসোসে মরে গেলাম। কোট অথবা ভারী শীতের কাপড় না পড়ার দুঃখে মনে হলো আত্মহত্যা করি। আমাদের ম্যাডাম বললেন তোমার কি খারাপ লাগছে ? তুমি চাইলে বাইরে ঘুরে আসতে পারো।

ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে ঘুরতে লাগলাম। শীত বেশি লাগলে সমস্যা হলো ঘুম ও আসে বেশী। এখানে সব কিছু এত অরগেনাইজড। আভেন আছে। পানির হিটার আছে। তবে কেউ কোনো কিছু নোংড়া করতে পারবে না। যেহেতু বাংলাদেশের মত গরীব দেশের মত এত এত পিয়ন নাই যে সবাই নোংড়া করবে আর পিয়ন /চাপরাশি ক্লিন করে দেবে। অফিসার শিক্ষক সবাইকেই নিজের কাজ নিজেই করতে হয়।
অনেকগুলো ফাকা রুমের একটা রুম হলো প্রেয়ার রূম। ভাবলাম সেখানে বসি। ওমা ঢুকতেই দেখি সেখানে বিছানা পাতা। কম্বল আছে। কিছু জায়নামাজ বিছানো ফ্লোরে, পাশে একটা লম্বা টুলে কিছু হিজাব আর রেহালের উপর কোরান শরীফ। কম্বল গায়ে দিয়ে শুতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি বারটা বাজে। ততক্ষণে তাপমাত্রা কমলেও এতটা কমেনি। তবু চলে।

২ টা বাজার পরে বের হতেই দেখি রোদ বেড়েছে। কিনতু বাংলাদেশে শীতের দুপুরে এতোটা রোদ থাকে যে শীত পালায়। এখানে রোদের যেনো বা তেজই নাই। রোদ ও মৃদু। নেভিটাস ক্যাম্পাস থেকে একটু হাঁটলেই পার্ক। খেলার বড় মাঠ। আর সামনে ব্যাঙ্কসটাউন লাইব্রেরী। মাঠের মাঝে রোদ কিন্তু আশে পাশে এতো ছায়া ছায়া – দোকান বিল্ডিং এর ছায়া – গাছের ছায়া। তাতে শীত বেড়ে যায় আরো। শীতে অশান্তি লাগে। এতো শীত ভালো লাগে না। সূর্যের তেজ কেনো বাড়ে না এইটা গবেষনা করতেছি আসার পর থেকেই —


এই নদীর নামটা জানা হলো না। কিন্তু পুরো নদীর ধারটাকে বলে ‘ডলস পয়েন্ট’। এতোটাই বিস্তৃত এই নদীর ধার আর কত যে নীল তার পানি। স্রোত পুকুরের মত। দেখলেই মন কেমন করে। অথচ এত সুন্দর নদী এর নাম নেই – হয়তো আছে, আমি জানি না।
এই নদীটার একটা নাম দিলাম আমি মনে মনে।
পৃথিবীর সুন্দর দেশগুলোর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার একটা বিশেষ স্থান রয়েছে। কিন্তু কেনো যেনো আমার এর পরিবেশ ফেইস আমার দেশের মতই লাগে। আহা আমার জলা নদী, আমার গ্রামের গাঙ, সরু রাস্তা আর ধু ধু ধান ক্ষেত – সেও তো খুব নীরব। জীবনানন্দের সময়ে আরো নির্জন ছিলো এই ধানক্ষেত নদী আর সরু পথ।

মাঝে মাঝে যখন একা হাঁটি, আনন্দে অথবা স্বাধীনতার আনন্দে আমার দৌড় দিতে ইচ্ছে করে। দেশে কি আমার স্বাধীনতা ছিল না ? ছিলো অবশ্যই। দেশেও তো পাল ছিড়ে ছুটে যাবার মত স্বাধীন ছিলাম। তবু এই দেশের পরিবেশ আমার শান্ত নিরিবিলি গ্রামের মতই লাগে। শুনশান নীরব রাস্তাঘাট, গাড়ি চলে যাবার হুশ হাশ শব্দ আর শান্ত নির্জন ঘরগুলো একতলা অথবা দুতলা। প্রচুর জমি -আর জমির অভাব নেই বলে শহরের বিল্ডিং গুলো উপরের দিকে মাথা তুলে না। এতে সুবিধা হলো আকাশ দেখা যায়।

আমার চোখ আকাশের দিকে চলে যায়, মসৃন নীরব ফুটপাত আর মাঝে মাঝে ফুটপাতের পাশের দোকানে প্রায়ই আরব নারী পুরুষের চলাফেরা বেশ লাগে – আরব নারী পুরুষ আসলেই ভীষন সুন্দর। মাখনের মত গায়ের রঙ, পর্যাপ্ত হাইট – মেয়েরা প্রায় পাঁচ ফিট পাঁচ /ছয় বা সাত আর ছেলেরা পাঁচ আট বা নয় বা তার চাইতে বেশী। মেয়েরা প্রায়ই মিডি টাইপের জামা, ফুল হাতা টি শার্ট টাইপ গেঞ্জি আর মাথায় হিজাব। চোখে ঘন কাজল আই শেডো সহ ধরনের কসমেটিক্সের ব্যবহার করবেই। ভালোই লাগে। এদের চোখ আরো সুন্দর। আমার সাথে নেভিটাসে মিয়ামি নামের এক লেবানিজ মেয়ে আছে। ওর ছাব্বিশ বছর বয়েস। তিন বাচ্চার মা সে। ওর চুল সোনালী আর কালোর মিশেল। গায়ের রঙ ভীষন সুন্দর। খুব ফ্যাশনেবল। আমি জিজ্ঞেস করলাম তিন বাচ্চা নিয়ে তুমি এতো মেনেজ করো কিভাবে ?
সে বলে – আরে আমি শুধু চোখই সাজাই। আর চুল গুলো কালার করেছি বলে চুলে হাত বোলালো । বুঝলাম সে আসলেই ভীষন সুন্দরী।

ছেলেরা প্রায়ই দাড়িসহ ভীষন সুপুরুষ। এখানে ওরা বেশ ভদ্র। আরব পুরুষদের দুর্দান্ত বদনাম আছে। জানিনা এখানের এরা এমন কিনা। মাঝে মাঝে দেশের জন্য মন কেমন করে। আমার মা বাবা ভাই বোন আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব কলিগ সবার জন্যই মন কেমন করে। যে জব করতাম সে জবের জায়গাটার জন্যেও ভীষন মায়া লাগে।
তবু
‘আমার হারিয়ে যাবার মানা নেই। – সত্যিই মানা নেই –
কিন্তু মানুষের শিকড় থাকে গভীরে, অসীমের পানে ছেড়ে দিলেও সে তার মূলে ফিরে আসে। আমার শিকড় কোথায় ? আমাদের শিকর কোথায় !! সে মাটির গভীরে আরো গভীরে প্রোথিত –
আহা মাটি আমার সে সোনার চেয়েও খাঁটি —

অঞ্জলি লহো হে কবি

যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে, অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে –
কাজী নজরুল ইসলাম

কাজী নজরুল ইসলাম (মে ২৫, ১৮৯৯ – আগস্ট ২৭, ১৯৭৬), (জ্যৈষ্ঠ ১১, ১৩০৬ – ভাদ্র ১২, ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ), অগ্রণী বাঙালি কবি, বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় বাঙালি কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, সংগীতস্রষ্টা, দার্শনিক, যিনি বাংলা কাব্যে অগ্রগামী ভূমিকার সঙ্গে সঙ্গে প্রগতিশীল প্রণোদনার জন্য সর্বাধিক পরিচিত। তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম সাহিত্যিক, দেশপ্রেমী এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি। আজ তাঁর ৪২তম প্রয়াণ দিবস।

পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ – দুই বাংলাতেই তাঁর কবিতা ও গান সমানভাবে সমাদৃত। তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁকে বিদ্রোহী কবি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাঁর কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ। বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুল সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার। তাঁর কবিতা ও গানে এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে। অগ্নিবীণা হাতে তাঁর প্রবেশ, ধূমকেতুর মতো তাঁর প্রকাশ। যেমন লেখাতে বিদ্রোহী, তেমনই জীবনে –- কাজেই “বিদ্রোহী কবি”। তাঁর জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে উভয় বাংলাতে প্রতি বৎসর উদযাপিত হয়ে থাকে।

নজরুল এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মীয়। স্থানীয় এক মসজিদে মুয়াজ্জিন হিসেবে কাজও করেছিলেন। কৈশোরে বিভিন্ন থিয়েটার দলের সাথে কাজ করতে যেয়ে তিনি কবিতা, নাটক এবং সাহিত্য সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। এসময় তিনি কলকাতাতেই থাকতেন। এসময় তিনি ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। প্রকাশ করেন বিদ্রোহী এবং ভাঙার গানের মত কবিতা; ধূমকেতুর মত সাময়িকী। জেলে বন্দী হলে পর লিখেন রাজবন্দীর জবানবন্দী। এই সব সাহিত্যকর্মে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ছিল সুস্পষ্ট। ধার্মিক মুসলিম সমাজ এবং অবহেলিত ভারতীয় জনগণের সাথে তার বিশেষ সম্পর্ক ছিল।

তার সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালবাসা, মুক্তি এবং বিদ্রোহ। ধর্মীয় লিঙ্গভেদের বিরুদ্ধেও তিনি লিখেছেন। ছোট গল্প, উপন্যাস, নাটক লিখলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। বাংলা কাব্য তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দেন। এটি হল ইসলামী সঙ্গীত তথা গজল। এর পাশাপাশি তিনি অনেক উৎকৃষ্ট শ্যামাসংগীত ও হিন্দু ভক্তিগীতিও রচনা করেন। নজরুল প্রায় ৩০০০ গান রচনা এবং অধিকাংশে সুরারোপ করেছেন যেগুলো এখন নজরুল সঙ্গীত বা “নজরুল গীতি” নামে পরিচিত এবং বিশেষ জনপ্রিয়।

মধ্যবয়সে তিনি পিক্‌স ডিজিজে আক্রান্ত হন। এর ফলে আমৃত্যু তাকে সাহিত্যকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। একই সাথে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে ১৯৭২ সালে তিনি সপরিবারে ঢাকা আসেন। এসময় তাকে বাংলাদেশের জাতীয়তা প্রদান করা হয়। এখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

বিপ্লবী শহীদ ক্ষুদিরাম বসু’র অমর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা


হে বিপ্লবী
হে মহা বিদ্রোহী ক্ষুদিরাম
তোমায় জানাই প্রণাম !!

আজ অগ্নিযুগের বিপ্লবী শহীদ ক্ষুদিরাম বসু’র ( জন্ম- ৩রা ডিসেম্বর ১৮৮৯, মৃত্যু- ১১ই আগস্ট ১৯০৮) ১১০-তম মৃত্যুবার্ষিকী।

ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের শুরুর দিকের সর্বকনিষ্ঠ বিপ্লবী। ফাঁসিকাষ্ঠে মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর ৭ মাস ১১ দিন।

বিপ্লবী শহীদ ক্ষুদিরাম বসু’র অমর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

৭৮তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা … শুভ জন্মদিন স্যার আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একজন শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সুবক্তাসহ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এক গুণীজন। বাংলাদেশের বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন সমাজসংস্কারক। শিক্ষক হিসেবে তার খ্যাতি কিংবদন্তিতুল্য। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি যার মাধ্যমে গত চার দশক ধরে ‘আলোকিত মানুষ চাই’ আন্দোলনের পুরোধা-র ভূমিকা তিনি পালন করছেন। তিনি ষাট দশকের একজন প্রতিশ্রুতিময় কবি হিসেবে পরিচিত। সে সময় সমালোচক এবং সাহিত্য সম্পাদক হিসাবেও তিনি অনবদ্য অবদান রেখেছিলেন। সাহিত্যে অবদানের জন্যে লাভ করেছেন র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার, একুশে পদক ও বাংলা একাডেমী পুরস্কার। আজ স্যারের ৭৮তম জন্ম দিন।

১৯৩৯ সালে কলকাতার পার্ক সার্কাসে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস বাগেরহাট জেলার কচুয়া উপজেলার অন্তর্গত কামারগাতি গ্রামে। তাঁর পিতা আযীমউদ্দিন আহমদ ছিলেন একজন স্বনামধন্য শিক্ষক। পিতার শিক্ষক হিসেবে অসামান্য সাফল্য ও জনপ্রিয়তা শৈশবেই তাকে শিক্ষকতা পেশার প্রতি আকৃষ্ট করে।

স্যার আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ শিক্ষক হিসেবে জনপ্রিয়তার সর্বোচ্চ শিখর স্পর্শ করেছেন। অধ্যাপক হিসেবে তাঁর খ্যাতি কিংবদন্তিতুল্য। তিনি শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন ১৯৬১ সালে, মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজে খণ্ডকালীন প্রভাষক হিসেবে। পরবর্তীতে তিনি কিছুকাল সিলেট মহিলা কলেজে শিক্ষকতা করেন। ১৯৬২ সালের পহেলা এপ্রিল তিনি রাজশাহী কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে সরকারি চাকুরি জীবন শুরু করেন। সেখানে পাঁচ মাস শিক্ষকতা করার পর তিনি ঢাকায় ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজে যোগ দেন (বর্তমানে সরকারি বিজ্ঞান কলেজ)। এই কলেজে তিনি দু’ বছর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র তেইশ। এরপর তিনি বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কলেজ ঢাকা কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ জালালউদ্দিন আহমেদের আমন্ত্রণে সেখানে যোগদান করেন। ঢাকা কলেজেই তিনি তাঁর শিক্ষকতা জীবনের স্বর্ণযুগ অতিবাহিত করেন। সে সময় ঢাকা কলেজ ছিল দেশসেরা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মিলনস্থল। অধ্যাপক আবু সায়ীদ যখন ঢাকা কলেজে যোগ দেন তখন কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কথাসাহিত্যিক ও গদ্য লেখক শওকত ওসমান৷ ঢাকা কলেজের শিক্ষকতা জীবন তিনি অত্যন্ত উপভোগ করতেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন-

ছেলেবেলায়, স্কুল থেকে কলেজে উঠে, অর্থনীতির বইয়ে পড়েছিলাম কেন একজন শিল্পপতি, কন্ট্রাক্টর বা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীর চেয়ে একজন শিক্ষকের বেতন কম৷ যুক্তি হিসেবে সেখানে বলা ছিল একজন শিক্ষকের জীবন কাটে মার্জিত, পরিশীলিত পরিবেশে, বৈদগ্ধময় ব্যক্তিদের সাহচর্যে, উচ্চতর জীবনচর্চার অবকাশময় আনন্দে৷ জীবনের সেই মর্যাদা, তৃপ্তি বা শান্তি ঐ ব্যবসায়ী বা নির্বাহীর জীবনে নেই৷ এই বাড়তি প্রাপ্তির মূল্য দিতে শিক্ষকের আয় তাদের তুলনায় হয় কম৷ ঢাকা কলেজের শিক্ষকতায় ঐ তৃপ্তি আমার এত অপরিমেয় হয়েছিল যে কেবল বেতন কম হওয়া নয়, আমার জন্য হয়ত বেতন না-থাকাই উচিত হত৷ এই পাওয়া যে কতটা তা বুঝেছিলাম কিছুদিনের জন্য অন্য কলেজে গিয়ে৷

তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করবার সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু ঢাকা কলেজে প্রাণবন্ত, সপ্রতিভ, উজ্জ্বল ছাত্রদের পড়ানোর তৃপ্তি, শিক্ষক-জীবনের অনির্বচনীয়তম আস্বাদ ছেড়ে তিনি যেতে চাননি ৷তাঁর মতে, বাংলা বিভাগে যোগদান করাটা আমার কাছে সবচেয়ে ভালো ছাত্রদের ছেড়ে সবচেয়ে খারাপ ছাত্রদের পড়াতে যাওয়ার মত মনে হয়েছে।

অধ্যাপক আবু সায়ীদ কখনোই ক্লাসে রোলকল করতেন না। রোলকলকে তার কাছে মনে হতো সময়ের অপব্যয়। তাই বছরের পয়লা ক্লাসেই ঘোষণা করে দিতেন রোলকল না করার ৷ তিনি বলেন, অনিচ্ছুক হৃদয়কে ক্লাশে জোর করে বসিয়ে রেখে কী করব? আমার চ্যালেঞ্জ ছিল এক ধাপ বেশি: কেবল শিক্ষক হওয়া নয়, সব ছাত্রের হৃদয়ের কাছে পৌঁছানো, সব ছাত্রের হৃদয়কে আপ্লুত করা।

ক্লাশের সেরা ছাত্রটাকে পড়ানোর চেষ্টা করার চেয়ে তিনি পড়াতে চেষ্টা করতেন ক্লাশের সবচেয়ে বোকা ছাত্রটাকে। সারাক্ষণ তাকেই বোঝাবার চেষ্টা করতেন, কেননা তার বোঝা মানে ক্লাসের বাকি সবার বোঝা।

স্যারের এরকম আরো অনেক মন্তব্য ও উক্তি রয়েছে যা আসলে একজন মানুষ কে অনায়েষে নাড়িয়ে দিতে পারে, যেমন – “আমি যদি উন্নত জাতের হাস মুরগী পালন, গোখামার তৈরি, এ ধরণের কাজগুলো করতাম তাহলে এতদিনে কত টাকা যে কামিয়ে ফেলতাম। কিন্তু পড়লাম মানুষের উন্নতি নিয়ে- আলোকিত মানুষ। (হেসে) না বুঝি নিজে না পারি অন্যকে বোঝাতে।”
“বুদ্ধিজীবীরা আবার আমাকে বুদ্ধিজীবী মনে করেনা, কারণ আমি হাসি। বিদ্যাবুদ্ধি তো আর কারো চেয়ে কম ছিলনা, শুধু ওই একটা জায়গাতে মার খেয়ে গেলাম, আমার হাসি। হাসলে পরে তুমি আর বুদ্ধিজীবী থাকতে পারবেনা। আপনি হাসেন? তারমানে তো আপনি লাইট!”
“কিন্তু সুন্দর মুহূর্তগুলো আমরা মনে রাখিনা, ভুলে যাই। কে ১০০ দিন রসগোল্লা খাইয়েছিল সেটা আমরা মনে রাখিনা, কিন্তু কে একদিন কান মুচড়ে দিয়েছিল তা মনে রেখে দিয়েছি।”
“আসলে জীবন ছোট নয়, আমাদের সুখের মুহূর্তগুলো ছোট। তাছাড়া জীবন ছোট মনে হওয়ার কারণ হচ্ছে স্মৃতির অভাব। আমরা কখনো বর্তমানে থাকিনা, হয় থাকি ভবিষ্যতে, নাহয় অতীতে। আমরা পাওয়াকে ভুলে যাই বলেই মনে হয় কিছুই পাই নাই। ইত্যাদি…

স্যারের একটি বইএর প্রকাশনা অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ছে। “ভাঙো দুর্দশার চক্র” গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে স্যারের দে বক্তব্য টি কোয়ান্টাম মেথড ওয়েব সাইড থেকে কপি কর দে হয়েছে-
প্রতিদিনই বহু মানুষ আমাদের দেশ থেকে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে অন্যান্য দেশে স্থানান্তরিত হচ্ছেন। কিন্তু আমার ধারণা, কোনো মানুষের মধ্যে যদি আলো, শক্তি, প্রতিভা থাকে; তিনি কখনই দেশত্যাগ করেন না। আর করলেও ফিরে আসেন। ফজলে হাসান আবেদ, হুমায়ূন আহমেদ, জাফর ইকবাল; ওনারাও দেশ ছেড়েছিলেন। কিন্তু আবার ফিরেও এসেছেন। তারা অনুভব করতে পেরেছিলেন; তাদের আত্মার যে-আনন্দ, জীবনের যে-পরিচয়; সেটা তাদের মাতৃভূমি।
বিদেশে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে কোনো বড় কাজ করা খুবই কঠিন। আমাদের অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, আজকের অনুষ্ঠানের যিনি প্রধান অতিথি বিদেশে অনেক সুযোগ পেয়েছিলেন। ইচ্ছে করলেই তিনি সাফল্য অর্জন করতে পারতেন। কিন্তু সেটাকে প্রত্যাখ্যান করে এই গরীব দেশটাকে ভালবেসেছেন। এই দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণের চেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। তিনি খুবই অসাধারণ একজন মানুষ। আরো আগেই তাকে আমার বই উৎসর্গ করা উচিৎ ছিল। আমি তাকে কোনো একটি বই উৎসর্গ করতে এত দেরি করায় লজ্জিত ও সংকুচিত বোধ করছি।

একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে আমাদের দেশে যে, নেই দেশে ভ্যারেন্ডা বৃক্ষ। একটি গাছ যতটা বিস্বাদ হওয়া সম্ভব, ঠিক ততটাই বিস্বাদ; এই ভ্যারেন্ডা গাছ। সেজন্যেই অবণীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন; ভ্যারেন্ডা গাছ কি কেউ খায়? খায় না। কিন্তু আখ গাছ খায় কেন? কারণ, ভ্যারেন্ডা গাছের মধ্যে স্বাদ নেই কিন্তু আখ গাছের মধ্যে মাধুর্য আছে। মানুষ সেখানেই যাবে, যেখানে সে মাধুর্য পাবে। যে-দেশে কিছুই নেই, সে-দেশে এতটুকু একটি গাছও বৃক্ষ। আমরা হচ্ছি সেই ধরনের ভ্যারেন্ডা।

আমাদের জাতির মধ্যে অসম্ভব মেধা ও কর্মোদ্দম আছে। তারা এই দেশকে অনেক উপরে নিয়ে যাবে। আরো অনেক বড় বড় মানুষেরা আসবেন। এ দেশ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দেশে পরিণত হবে। এটা আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি।

গ্রামের দিকে একটা কথা আছে যে, ভিক্ষুকের পায়ে লক্ষ্মী। ভিক্ষা পেতে হলে, হাঁটতে হবে। যে-যত হাঁটবে, তার ভিক্ষা তত বেশি। এটা সাধারণ হিসাব। আমাদের করণীয় একটাই। সেটা হলো জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত কাজ করে যেতে হবে। আমরা কেউই চিরদিন বাঁচব না। কিন্তু যতদিন বাঁচব, আমার একটাই কাজ; আমার এই জীবনকে তার সর্বোচ্চ মহিমা দান করা। সেটা আমাদের সবাইকে করতে হবে। তাহলেই আমরা অশান্তি, দুঃখ, হতাশা ও নৈরাশ্যের হাত থেকে বাঁচতে পারব। একটি আনন্দময় জীবন শেষ করে এই পৃথিবী থেকে চলে যাব।

একটা গাড়ি পাহাড় বেয়ে উপরে উঠার সময় আপনি বলবেন, গাড়িটি উঠছে বা উপরে যাচ্ছে অর্থাৎ উত্থান হচ্ছে। কিন্তু গাড়িটি পাহাড় থেকে নিচে নামার সময় বলতে পারবেন না যে, পতন হচ্ছে। গাড়িটি নিচের দিকে নামলেও তার চাকাটা সামনের দিকে যাচ্ছে। তাহলে তো সে সামনের দিকে এগোচ্ছে। আপাত দৃষ্টিতে যাকে আমরা নৈরাশ্য বা পতন মনে করছি, সেটা আসলে উত্থান। সুতরাং আমরা চিরদিনই উত্থানের মধ্যে আছি। পতন, হতাশা বা নৈরাশ্য বলে কিছু নেই। এগুলো আমাদের মাথার অলীক কল্পনা দিয়ে তৈরি করা বিভ্রম।

দুঃখ-কষ্ট, মৃত্যু আছে কিন্তু কোনোটিই স্থায়ী নয়; সাময়িক। এগুলোকে অতিক্রম করতে হবে। আমি যতবড় আশাবাদীই হই। কেউ ভীষণভাবে আঘাত করলে, আমার অজান্তেই আমার ভেতর থেকে একটা আর্তনাদ শোনা যাবে। কিন্তু সে আর্তনাদই শেষ কথা নয়। কাজ, সংগ্রাম, শ্রম আর আক্রমণের মধ্যেই আমাদের জীবন। আমাদের অনেক দুঃখের কারণ হচ্ছে আশাহীনতা। বাইবেলে একটা কথা আছে, “And whosoever liveth and believeth in me shall never die” যে বিশ্বাস করবে সে বেঁচে থাকবে; সে মরবেনা। বিশ্বাস আর আশাটা যেন সবার মধ্যে থাকে। নৈরাশ্য বলতে কিছু নেই। আমি এই কথাটাই সবাইকে বলব যে, নৈরাশ্যের মত অনস্তিত্বশীল বিভ্রমে বিশ্বাসী হবেন না। এটা আশারই অন্যরূপ মাত্র।

আসলে স্যার কখনোই বন্দিত্ব সহ্য করেন নি। তিনি যেমন উদার তেমনিই মুক্ত, স্বাধীন চেতনার মানুষ। “ভাঙো দুর্দশার চক্র” গ্রন্থের পরতে পরতে সেই বক্তব্যই স্পষ্ট করা হয়েছে।

স্যার সব সময় আত্মমর্যাদা , আত্মসম্মান কে প্রাধান্য দিয়েছেন নিচের উক্তি থেকেই তা অনুভব করা যায়, যেমন- “আমাদের দেশে সবাই একটা ‘পা’ চায়, পায়ের নিচে পড়ে থাকতে চায়।”
“আমি বলি, সম্মান করতে হলে মাথা উঁচু করে কর। তুমি তো নিজেকে ধ্বংস করে ফেলছ। আর যে নিজেকে ধ্বংস করে দিচ্ছে তাকে দোয়া করেই কি লাভ, দয়া করেই কি লাভ।”
“শক্তিমান মানুষের পরিচয় হচ্ছে বাড়াবাড়িতে। এই যে তোমার আশেপাশে এত সমস্যা, এত কিছু হচ্ছে। কই তোমার তো কোন বাড়াবাড়ি দেখিনা।”

আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের জন্মই হয়েছে জাতিকে বাড়িয়ে নেয়ার এগয়ে নেয়ার জন্য, দুর্দশার বৃত্ত ভাঙ্গার জন্য ! এইযে আলকিত মানুষ চাই আন্দোলন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মাধ্যমে ১৯৭৮ সালে যার জন্ম। স্যার আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সবার আগে অনুভব করেছেন যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমাদের প্রয়োজন অসংখ্য উচ্চায়ত মানুষ। আলোকিত মানুষ চাই- সারা দেশে এই আন্দোলনের অগ্রযাত্রী হিসেবে প্রায় তিন দশক ধরে তিনি রয়েছেন সংগ্রামশীল। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র গড়ে উঠেছে একটু একটু করে, অনেক দিনে। এই দীর্ঘ সময়ে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মুখে নানা উথথান পতনের মধ্য দিয়ে তাঁকে এগোতে হয়েছে। মূলতঃ দেশের আদর্শগত অবক্ষয় দেখে তা থেকে উত্তরণের জন্যে অধ্যাপক সায়ীদ এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এ প্রসঙ্গে স্যার বলেন:

দেশের এই সার্বিক অবক্ষয় এবং সম্ভাবনাহীনতার ভেতর সীমিত সংখ্যায় হলেও যাতে শিক্ষিত ও উচ্চমূল্যবোধসম্পন্ন আত্মোৎসর্গিত এবং পরিপূর্ণ মানুষ বিকশিত হওয়ার পরিবেশ উপহার দেয়া যায়, সেই উদ্দেশ্য নিয়েই আমরা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র গড়ে তুলতে চেষ্টা করছি। তিনি অনুভব করতেন- একজন মানুষ যাতে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার অধ্যয়ন, মূল্যবোধের চর্চা এবং মানবসভ্যতার যা-কিছু শ্রেয় ও মহান তার ভেতর দিয়ে পরিপূর্ণ মনুষ্যত্বসম্পন্ন হয়ে বেড়ে উঠতে পারে- আমরা এখানে সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাই। কাজেই আমাদের এই প্রতিষ্ঠানটি একটি প্রাণহীন, কৃত্রিম, গতানুগতিক প্রতিষ্ঠান নয়; এটি একটি সর্বাঙ্গীণ জীবন-পরিবেশ।

এই মহা মনিষীর জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে পেরে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। ধন্য বোধ করছি। পরিশেষে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাঈদ স্যারের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।

______________________________
লেখকঃ দাউদুল ইসলাম। কবি ও প্রাবন্ধিক।
লেখার সূত্র জোগাড়ঃ কোয়ান্টাম, মুক্ত বিশ্বকোষ,
ভাঙ্গো দুর্দশার বৃত্ত গ্রন্থ, ও স্যারের বিভিন্ন বক্তব্য।