বিভাগের আর্কাইভঃ জীবন

বাঙালি সেকুলারের মনের পশু সঙ্কট

abu

১.
কোরবানি ঈদের পরদিন, রাত ৮টা। সুনসান পাড়া, নিরবতা বিদীর্ণ করে কেউ একজন তীব্র গতিতে বাড়ির কলাপসিবল দরজা ঝাঁকাচ্ছে। কল বেল থাকার পরও এভাবে দরজা ঝাঁকানো ভীতিকর, ভয় পেতে শুরু করেছি।

আতঙ্ক আর কৌতূহল মিশ্রিত মন নিয়ে দ্রুত দরজার সামনে গেলাম, মহল্লার এক ভায়ের ভয়ার্ত চেহারা, দু’হাতে সজোরে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছেন, ভেঙে ফেলতে চাইছেন। আমাকে দেখে কিছুটা সম্বিৎ ফিরে পেলেন, কাতর স্বরে বললেন,
– জলদি দরজার তালা খুলো, আমারে বাঁচাও.. প্লিজ বাঁচাও।

তাকে ঘরে এনে বসালাম। পরপর দুই গ্লাস পানি খেলেন। বোঝা গেলো খুব বিপজ্জনক কিছু ঘটেছে। জিজ্ঞেস করলাম,
– কি হইছে ভাই!
– তুমি তো জানো আমি দুইটা কোরবানি দেই। একটা পারিবারিকভাবে ঈদের দিন, আরেকটা একা দেই, ঈদের পরদিন।
– আমি তো জানতাম একটা দেন।

গত এক যুগ ধরে এই ভাইদের বাসায় একটা গরু কোরবানি দিতে দেখে আসছি, তিনি দুইটা পশু কোরবানি দেবার কথা বলায় কিছুটা বিস্মিত হলাম। সেই বিস্ময় ভাঙাতে তিনি জানালেন,
– না, একটা না। ঈদের দিন পারিবারিকভাবে কোরবানি দেই বনের পশু, আর ফেসবুকে সিরিয়াস হবার পর থেকে ঈদের পরদিন একা একা কোরবানি দেই মনের পশু।

একটা ঢোক গিলে জানতে চাইলাম,
– তা সমস্যাটা কি, ভাই?
– বিশাল সমস্যা। আজ দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর মনের পশুটারে জবাই দিবার জন্য পায়ে বাইন্ধা একটানে মাটিতে ফেলছি, মুহুর্তের মধ্যে ঝাড়া দিয়া খাড়ায়া গেলো, ফ্র‍্যাকশন অব সেকেন্ড খাড়ায়া রইলো, তারপর দিলো ঝাইররা দৌড়।
– বলেন কি! তারপর?
– আমিও পশুর পিছনে দিলাম দৌড়, টের পায়া ওই পশু গিয়া ঢুকলো সেলিনাদের বাসায়।
– সেলিনা? কোন সেলিনা! আপনাদের বাড়ির পাঁচ ছ’টা বাড়ির পর যে থাকে! মানে আপনার এক্স মানে প্রাক্তন..

কথা শেষ করতে না দিয়ে মহল্লার ভাই চেঁচিয়ে উঠলেন-
– চুপ। একদম চুপ। বিশ্বাসঘাতিনী, আইয়ূব বাচ্চু তাই বলেছেন ‘সেলিনা এখন অন্য কারো/আমার কেউ নয়..’
– ওহ! আচ্ছা। তবে সেলিনার কথা থাক, আপনার মনের পশুর কথা বলেন-
– বিকাল সাড়ে তিনটা থেকে সেলিনাদের গেটে দাঁড়ায়ে আছিলাম, কিন্তু মনের পশুটা ঢুকছে তো ঢুকছেই। বের আর হয়না। একটু আগে বের হইলো সেলিনার বড় ভাই, সাথে তার মনের পশু, তার মনের পশু আবার দুইটা- যমজ এলসেশিয়ান কুত্তা।
– বলেন কি!
– হ রে ভাই! সেলিনার বড় ভাইরে দেইখা সালাম দিলাম, তিনি সালামের জবাব নিয়া জিগাইলেন, ‘এইখানে কি করতাছো, বিলাল?’
– তারপর!
– আমি জবাব দিবার আগেই সেলিনার ভায়ের মনের পশু দিলো ধাওয়া, আমার পাছায় কামড়ায়া কিচ্ছু বাকী রাখে নাই, ধাওয়া খাইতে খাইতে এইখানে আয়া পরছি।

মহল্লার ভায়ের মনের পশু গেছে পালিয়ে, তার ওপর প্রাক্তনের বড় ভায়ের মনের পশু এক জোড়া এলসেশিয়ানের ধাওয়া খাওয়ার ভয়ে চুপচাপ আমার বাসায় বসে আছেন, দেখে মায়া লাগছে, কষ্টও হচ্ছে।

২.
মাঝরাতে তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো। এমন বৃষ্টিতেই চার পাঁচজন বন্ধু মিলে পাহারা দিয়ে মহল্লার বড় ভাইকে বাসায় পৌছে দিলাম। সকালে ঘুম ভাঙলো ভায়ের ডাকে, বৃষ্টি নেই কিন্তু বারান্দায় গোড়ালি পর্যন্ত পানি। রাস্তায় পানি বেশী, ময়লাও। ওই পানি পেরিয়ে মহল্লার ভাই চলে এসেছেন। বিস্ময় গোপন করে জানতে চাইলাম,
– এতো সকালে! কোনো সমস্যা, ভাই?
– সমস্যা মানে বিশাল সমস্যা।

একটা মাত্র জীবনে মানুষকে বহু বিশাল বিশাল সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়! ভোরের আলোয় মনটা বিষন্ন হয়ে উঠলো, বিষাদভরা কণ্ঠে বললাম,
– চলেন, ছাদে বসি। চা খেতে খেতে কথা বলি..

দু’জনে ছাদে উঠেছি। ক’টা চড়াই, বাবুই আর দোয়েল খাবার খাচ্ছে। প্রতিদিন এদের খাবার দেওয়া হয়, না দিলে ভোরে এসে চেঁচামেচি শুরু করে। পাখিগুলো আমাদের দেখে উড়ে গেলো না, ভাই বললেন,
– এগুলির দেখি অনেক সাহস!
– উড়ে যাবার পাখা আছে, ভয় কেনো পাবে?
– তা ঠিক! তা ঠিক!

চায়ে চুমুক দিচ্ছি, ভাই উশখুশ করছেন কিন্তু কথা শুরু করতে পারছেন না। অগত্যা আমিই প্রশ্ন করলাম-
– কি সেই বিশাল সমস্যা!
– প্রথম সমস্যা হলো, সেলিনার ভায়ের মনের জোড়া কুত্তা যে আমারে কামড়াইলো, এর জন্য কি নাভির গোড়ায় ইনজেকশন নিতে হইবো!

দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললাম,
– না, ভাই। মনের ইনজেকশনই বড় ইনজেকশন। দ্বিতীয় সমস্যাটা কি?

ভাই একটু কেশে নিয়ে শুরু করলেন,
– কোরবানি ঈদের পরদিন মানে গতকাল তো মনের পশুরে কোরবানি দিতে পারিনি, দৌড়ায়া সেলিনাদের বাড়িতে পালাইলো।
– হুম।
– কিন্তু কেলেঙ্কারি কাণ্ড ঘইটা গেছে-
– ছি: ছি: বলেন কি!
– হ, আমার মনের পশু তো সেলিনার মনের পশুরে নিয়া জঙ্গলে ভাগছে..
– ওহ! এতে আর সমস্যা কি?
– এইটাই তো সমস্যা! মনের পশু এখন তো আর মনের পশু নাই, পুরাই বনের পশু হয়া গেলো।
– এইভাবে তো ভাবি নাই! তবে আগামী ঈদের পরদিন কোরবানি দিবেন কি!

ভাই স্বস্তির স্বরে জানালেন,
– ওইটা নিয়া চিন্তা নাই। মনের পশু পালানোর আগে তিনটা বাচ্চা দিয়া গেছে, নাদুস নুদুস, মনের মাঠে নাপাম ঘাস খায়া খায়া বড় হইতাছে–

খুব কৌতূহল নিয়েই জানতে চাইলাম-
– বলেন কি! আচ্ছা ভাই, বছরে বছরে মনের পশু কুরবানি না দিয়া, মনের পশুর খামারটারে এক্কেবারে উচ্ছেদ করলে হয়না!

আমার বোকামিতে ভাই মৃদু হাসলেন,
– এইটা একটা কথা হইলো! মনের পশু কুরবানি দিতে কইছে, খামার উচ্ছেদ করতে তো কয়নি। তাছাড়া খামার বন্ধ করলে প্রতি ঈদে ফেসবুকের পাকপবিত্র ময়দানে মনের পশু কোরবানি দিমু কেম্নে!

‘কে এমনটা বলেছে’ এই প্রশ্নের উত্তর জানার সাহস হলো না, তাই চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম,
– সমস্যা কি আরও কিছু আছে?
– হুম
– কি সেটা?
– আমার গফরে বুঝাইতে পারিনা আমি শুধু তারেই ভালবাসি, আমার ১২টা গফের একটা গফও আমার এই কথাটা বিশ্বাস করে না।

মুরগির ডিম ফুটে ছাগলের বাচ্চা বের হলেও এতটা তাজ্জব হতাম না, তাজ্জবতা কাটিয়ে বললাম,
– দু:খজনক, মর্মান্তিক, বেদনাদায়ক–, এ তো অনেক বড় প্রব্লেমেটিক সমস্যা।
– এটা বড় সমস্যা না, সমস্যা হইলো আমার মনের পশুর লগে ওদের মনের পশুও যদি ভাইগা যায় তবে তো বিশৃঙ্খলা হয়া যাইবো।
– ভাগতে চাইলে ভাগতে দেন, বিশৃঙ্খলা হইবো ক্যান!
– বিশৃঙ্খলা হইবো না! ওগো ১২জনের মনে ১২টা পশু, আর আমার মনে পশু মাত্র ৩টা। অবস্থাটা বোঝা একবার, এক্কেবারে পরকীয়া হয়া যায় না!

সাহস নিয়ে বললাম,
– আপনার গফদের মনে আর বনে আসলে একটাই পশু, মানে ১২জন মিলে ১টা পশুরেই শেয়ারে পালতাছে, চিন্তা কইরেন না।
– এইটা হইলে তো ভালোই। কিন্তু একটারে নিয়া যদি বারো পশু পালায়! কিয়েক্টা অরাজকতা! এর থেকে পরিত্রাণের কি কোনো উপায় নাই!!

এই বিশাল সমস্যার সমাধান খুব কঠিন নয়, ভায়ের মনে হাইব্রিড পশু চাষ করলেই হবে। কিন্তু বলার ইচ্ছে হলো না, বাঙালি সেক্যুলারের মন বুঝা খুব কঠিন, তাদের মনের পশুরে বুঝা কঠিনতর, তাই ভায়ের চেহারার সাথে মিলিয়ে নিজের চেহারায় চিন্তার ভাব ধরে রাখি, যেনো কোরাসে চিন্তা করছি।

.
পুরানো লেখা।

মধ্য আয়ের দেশ

366

উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে দেশ,
দুর্মূল্যের বাজারে মানুষ হচ্ছে নিঃশেষ।
নেতারা খাচ্ছে পোলাও কাচ্চি বিরিয়ানি,
খেটে-খাওয়া মানুষ দিনদিন হচ্ছে ঋণী।

উন্নয়নের কারিশমা মাথায় ঋণের বোঝা,
জনগণ মরছে নেতা সাজে ওঝা।
দুর্মূল্যের বাজারে ভোজ্যদ্রব্য লাগামহীন ছুটছে,
অখাদ্য-কুখাদ্য গরিবের কপালে জুটছে।

নুন আনতে যাদের পান্তা ফুরায়,
তাদের নাভিশ্বাস উঠেছে নাকে ডগায়।
দেশ উন্নয়নে আলোকিত হচ্ছে চারদিক,
বিদ্যুৎ বিহীন অন্ধকার এদিক-সেদিক।

গরিবের মাথার ঘাম গড়াচ্ছে পায়,
কৃষকের আর্তনাদ ধ্বনি মুখরিত গাঁয়।
মেহনতি মানুষের শরীর হচ্ছে রক্তশূণ্য,
দুর্নীতিবাজ নেতাদের জীবন হচ্ছে ধন্য।

দেশের টাকা মানে জনগণের রক্ত,
দুর্নীতিবাজরা তা বিদেশে পাচারে রপ্ত।
নেতারা বিদেশে বানাচ্ছে আলিসান বাড়ি,
দেশেও থাকে তাদের বুলেটপ্রুফ গাড়ি।

গরিব মরে মরুক না খেয়ে থাকুক,
করোনা রোগে ভুগে ডেঙ্গুতে মরুক।
যত রোগের পাদুর্ভাব নেতাদের লাভ,
রিলিফ মেরে দেখায় মানবতার ভাব!

দুর্নীতির রাহু গলা টিপে ধরছে,
রাহুগ্রাসে গরিবেরা ধুকে ধুকে মরছে।
উন্নয়ন আর দুর্নীতি সমানতালে চলছে,
তবুও নেতাগণ মধ্য আয়ের দেশ বলছে।

.
নিতাই বাবু
১৪/০৮/২০২৩ইং।

অকবিতা

বাড়ছে বয়স চর্যাপদের গীতে
বনস্পতির ছায়ায় শুকোই ঘাম,
বোতাম ছেড়া শার্ট
ভীষণ আনস্মার্ট
হয়নি শেখা বাঁধতে জুতোর ফিতে,
পারফিউমের দেইনি কোনো দাম।

আমার নেশা কাঁঠালচাঁপার ঘ্রাণে
ঘোড়ার চালেই কিস্তি বাজিমাৎ,
আগুন বনে একা
ফুলকি ছুঁয়ে দেখা
ভস্ম করার খায়েশ প্রবল প্রাণে,
পুড়তে পুড়তে পোড়াই অকস্মাৎ।

কলার জুড়ে ঘামের মলিন দাগ
কলব ভরা অনেক হিসেব ঋণে,
তোমার চোখে রাখা
ইকারুসের পাখা
আমারও চাই ভালবাসার ভাগ,
উড়ালকাতর আলিঙ্গনের দিনে।

.
অকবিতা/২০১৭

সমগ্র আকাশ

mok

আমাদের জমানায় মুজিব ছিলেন না। যখন বড় হচ্ছি সানগ্লাস মেজরের রমরমা অবস্থা, চারদিকে প্রচুর খাল খনন কুমির আনা হচ্ছে। ঘোষক প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে, প্রথম বাংলাদেশ শেষ বাংলাদেশে পরিণত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু তিরোহিত; তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, কেউ তাঁকে খুঁজছে না।

খাল কাটা বিপ্লবীর করুণ অন্তের পরে বিশ্ব বেহায়ার আগমন, এসেই পূর্বমুখী সেজদা করা শুরু করে দিয়েছে। স্যাটেলাইট মেজর উল্টো পথে হাঁটার যে প্রথা শুরু করেছিল; লেজোহোমো সে পথে রকেট গতি লাগিয়ে নিয়েছে। বঙ্গবন্ধু উচ্চারিত হন না, তিনি ছিলেন বলে মনে হয় না।

বঙ্গবন্ধু ঘাতকের হাতে নিহতের সময় আমার বয়স পাঁচ, আওয়ামীলীগ পুনরায় ক্ষমতা আরোহণের সময় ২৬। বঙ্গবন্ধু বিহীন বাংলাদেশে আমরা বড় হয়েছি, বঙ্গবন্ধু ছাড়া বড় হয়েছি।

আমরা খালকাটার অনুসারী হতে পারতাম; অথবা বিশ্ব বেহায়ার, অনেকেই হয়েছে। বিষয়টা সহজ ছিল, রাবণের সহযাত্রী হওয়া সহজ কিন্তু সূর্যকে সবাই ধারণ করতে পারে না, পারে না বলে অন্ধকারের সহযাত্রী হয়।

কিন্তু আমরা সূর্যের অস্তিত্ব জানতাম, তাই কোন অন্ধকার আমাদের প্রভাবিত করতে পারেনি। কৃষ্ণ অন্ধকার কালে আমাদের বুকে বঙ্গবন্ধু সূর্য আলো দিয়েছিল। আমরা সেই আলোক ধারণ করেছি, করে আছি, থাকবো।

আমরা নিজেদের প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধুকে খুঁজেছিলাম, নিজেদের চিনবো বলে তাঁর ঠিক ঠিকানার প্রয়োজন ছিল। যখন তাঁকে পেয়ে গেলাম দেখলাম আমাদের আত্মায় তার ঠিকানা, তিনি ছেয়ে আছেন আমাদের মন-মগজ।

অন্ধকারে বঙ্গবন্ধু চিনেছিলাম। তখন তিনি আকাশের তারা হয়ে ছিলেন, এখন তিনি সমগ্র আকাশ হয়ে আছেন।

অহংকারী

ri

তোমাকে দেখিনি অনেকদিন। অনেকদিন কতদিনে যে হয়! সব অংক ভুল হয়! হিসেবের আঙুলে গরমিল! দূর থেকে ভেসে আসা রাতজাগা পাখিদের গান। কান পেতে থাকি। বাইরে শ্রাবণ বৃষ্টি, ঘরে বাজছে গজল।

কতদিন দেখিনা তোমায়। এইসব গান বড্ডো মন কেমন করা। ভালোবাসার গান। রাতজাগা চোখের মণিতে ঘুমের হলুদ রঙবাহার! বারান্দায় বিড়ালের অলস চলাফেরা।সেও ভালোবাসে আদর সময়! আমার মতোই কি তবে আহ্লাদী স্বভাব?

তোমাকে দেখিনা কতদিন হয়? ক্যালেন্ডারের পাতায় ঝিমানো সময়। রাতের আঁধারে একাকী অপেক্ষায় থাকি। কল্পনায় তোমার হাত ঘরে হেঁটে যাই দূর থেকে দূর! ঘুম নামে চোখে তবুও অপেক্ষায় থাকি যদি আসো! যদি বৃষ্টির মতো ঝমঝমিয়ে আসো। প্রার্থনার নীরব চাওয়ায় প্রতিদিন তোমাকে এভাবেই খুঁজে বেড়াই! তোমাকেই ভালোবাসি, শুধুমাত্র তোমায়। তুমি এলে তোমার ভালোবাসায় অহংকারী হই আমি।

কতোদিন তোমাকে দেখি না। ঘড়ির কাঁটায় থমকে আছে সময়। হয়তো আসবে না আর, তবুও তোমারই আসার অপেক্ষায় থাকি রোজ।

স্বাধীনতা

সরকারি অকর্মণ্যতা আর রাজনৈতিক দলগুলোর উস্কানিতে ১৯৪৬-‘৪৭ সালে ঐ সরকারি হিসেব মতই পাঁচ লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা গেছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়।
আমরা একবারের জন্যও সেই হতভাগ্যদের কথা স্মরণ করিনা।

স্বাধীনতা দিবস এল, চলে গেল ফের। আমরা মাংসভাত খেয়ে, শপিংমলে গিয়ে, আর ভুল সুরে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে একটা পতাকা তুলে একটা ছুটির দিন কাটালাম। অপদার্থ নেতাদের দোষ দিচ্ছি না, মুখে জয়হিন্দ, বন্দেমাতরম্ বললেও এর মানে মুষ্টিমেয় জানে।

ক্রমশঃ আমরা ইয়াংকি কালচারের অকর্মন্য নকলনবীশ হচ্ছি। ফাঁকিবাজ, অর্থলোলুপ, ঘুষখোর, চোর জাতি হচ্ছি আমরা। নিজের মুখের সামনে একটা জাতীয় পতাকার ছবি লাগালেই জাতীয়তাবাদী হওয়া যায় না। দেশ কে সত্যিকারের ভালোবাসতে হলে নিজের মন ও কাজ পরিষ্কার করতে হয়।

খেতু বাগদি ও গোপাল কাহার বেঁচে আছ! সেই যে পতাকা তোলা দেখতে গিয়ে হারিয়ে গেছিলে নির্বীজ জন অরণ্যে, তারপর দীর্ঘ ছিয়াত্তর বছর তোমাদের কথা উচ্চারিত হয় বছরের মাত্র দুটো দিনে। তোমার পরনের সেই ছেঁড়া ফাটা গামছাটা আজও জীবিত আছে খেতু? আর গোপালের তার একলৌতা জীবনের মতই আধময়লা ফ্যাকাশে ধুতি?

আমিও আর পতাকা তোলা দেখতে যাই না এখন। আমি এখন এলইডি বাহাত্তর ইঞ্চি জুড়ে ঘরজোড়া গমগমে হাততালির বুক চিরে সটান পৌঁছে যাই লালকেল্লার চওড়া পাঁচিলে। তোমাদের কথা আমাদের মনেও পড়ে না বিশেষ।

কতদিন যেন না খেয়ে সেদিন মানুষের জঙ্গলে গেছিলে তোমরা? আমরা এখন সকালে পাস্তা, দুপুরে ভুরুভুরে বাসমতী, সন্ধ্যেয় ব্ল্যাক ডগ আর রাতে বিরিয়ানি – রেশমি কাবাব। এখন আর কেউ না খেয়ে মরে না গো হাড়হাভাতে বোকা মানুষের ঝুন্ড।

পেটভর্তি হয়ে গেলে অবসর অবর সময় আমরা দেশ ভক্তির ভজন গাই। আমরা নিজেরাই নিজেকে দেশিকোত্তম উপাধি দিয়ে গলায় পরে নিই তেরঙা চাদর। সেই চাদরে এক এক রঙ এক এক সময়ে উজ্জ্বল হয়ে ছলকে উঠে রাজপথ, মাঠ আল, মাটির কুটির কিম্বা ঝকঝকে খিলান ওয়ালা বাড়ীর মেঝেতে লোহিত কণা আঁকে এন্তার। রাত গভীর হলে নেশার দমকে আমার গলা ভেঙে যায়। দুরকম গলায় চেঁচিয়ে উঠি – হর হর মহাদেও – আল্লাহু আকবর! আমার দুহাত আমার নিয়ন্ত্রণ ছুঁড়ে ফেলে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় মেতে যায়। ওহে বুদ্ধু গোপাল – খেতু, আমরা এখন চাঁদে উপগ্রহ পাঠাই।

শুধু রাত্তির ঝুম হয়ে এলে নেশার প্রথম প্রহর জমে উঠলেই তোমাদের দুজনের কুৎসিত কাটা মুণ্ডু চোখের সামনে দোলে, ঠাঠা করে হাসে, আমাকে বিদ্রুপ করে।

গোপাল কাহার – খেতু বাগদি আজকাল আমি রাতে ঘুমোতে পারি না যে!

ডিজিটাল বাংলাদেশ

out.

নাম তার নিতাই চন্দ্র, ডাকে সবাই বাবু,
নেই কোনও জমিদারি, বাবু ডাকে তবু।
লেখাপড়া নেই তেমন, শুধু অল্পকিছু জানা,
ইচ্ছে ছিল লেখাপড়ার, সমস্যা ছিল আনা।

যা হয়েছে নিজের চেষ্টায়, তা দিয়েই চলে,
ঘরে খাবার না থাকলেও সত্য কথাই বলে।
কাজে ছিল পাকা, হিসাবে ছিল ঠিক,
বে-হিসাবে চলতে গিয়ে, সব হলো বেঠিক।

জায়গাজমি নেই কিছুই, পরের বাড়ি বাসা,
স্বপ্ন বলতে জীবনটুকু, বেঁচে থাকার আশা।
এখন বয়সে সে কাবু, মাথায় পেকেছে চুল,
স্মরণশক্তি কমেছে খুব, হিসাবে করে ভুল।

শরীরের চামড়া হচ্ছে ঢিলে, গুটিকয়েক দাঁত,
চোখের দৃষ্টি নেই তেমন, ঝাপসা দেখে দিনরাত।
একসময় দৌড়াত খুব, ক্যামি ঘড়ির পেছনে,
সারাক্ষণ বসে থাকতো, টিভির পর্দার সামনে।

সেইদিন নেই বাবুর, এখন ডিজিটাল দেশ-বিদেশ,
হাতে হাতে মোবাইল ফোন, আগের দিন শেষ।
ছোট একটা যন্ত্র মোবাইল, ভেতরে সব তার,
দুনিয়াটা হাতের মুঠোয়, চিন্তা কীসে আর।

লেখাপড়া লাগে না লিখতে, মুখে বললেই হয়,
কী লিখবে আমায় বলো, গুগল মামায় কয়।
তাইতো সবাই লিখে যাচ্ছে, হচ্ছে সবাই কবি,
স্টুডিওতে যায় না কেউ, নিজেই তোলে ছবি।

কমেছে ক্যামেরার মান, ধূলিসাৎ স্টুডিওর ব্যাবসা,
ফটোগ্রাফার সবাই এখন, মোবাইল ছাড়া সমস্যা।
দুঃখ করে বাবু বলে, মোদের দিন তো শেষ,
তথ্যপ্রযুক্তির এই দুনিয়ায়, ডিজিটাল বাংলাদেশ।।

.
নিতাই বাবু:
১১/০৮/২০২৩ইং।

লজ্জাবতী ফুল

abu

আমার প্রিয় ফুলের নাম লজ্জাবতী ফুল। অন্য অনেক ফুল থাকতে লজ্জাবতী কেন প্রিয় বন্ধুরা প্রায়ই এমন প্রশ্ন করে থাকে। কোন ফুল কার প্রিয় হবে তার কোন ব্যাখ্যা থাকে না, যুক্তিও থাকে না।

লজ্জাবতী প্রিয় হওয়ার কারণ হচ্ছে আমার গভীর বিপদের সময় সে তার ডানা বাড়িয়ে দিয়েছিল। আমি তিপান্ন পেরিয়েছি। তিপান্ন থেকে পঞ্চাশ বিয়োগ করলে যা অবশিষ্ট থাকে তাও আমি পেরুতে পারতাম না যদি লজ্জাবতী দেবদূত হয়ে আমাকে উদ্ধার করতে না আসতো।

বাসায় উঠানের শেষে পুকুর। আমি উঠানে ফুটবল চর্চা করি ভবিষ্যতের সালাহউদ্দিন কিংবা পেলে। ফুটবলের সাথে পানির সখ্যতা এত বেশি কেন এখনো নির্ধারণ করতে পারেনি। আমি যতই পুকুর এড়িয়ে যেতে চাই ফুটবল ততই পুকুরে ঝাপিয়ে পড়ে।

ফুটবল পুকুরে পড়ে গেলে আমি চিৎকার করি; চিৎকার শুনে ঘর থেকে কেউ না কেউ এসে ফুটবল উদ্ধার করে দিয়ে যায়। একদিন বাসায় কেউ নেই। আম্মা রান্নাবান্নায় ব্যস্ত। একা আমি উঠোনে গোল প্রাকটিস করছি। পুকুরের উল্টো দিকে গোলপোস্ট। তবু কিক মারার সাথে সাথে বেয়াদব ফুটবল ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে পুকুরে লাফিয়ে পড়ে। পুকুরের পানিতে ফুটবল পড়ে গেছে কয়েকবার চিৎকার করে দেখলাম কেউ সাড়া দেয় না।

নিজের কাজ নিজেকে করতে হবে ভেবে ফুটবল উঠাতে পুকুরের পাড়ে গেছি; দেখলাম পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছি। পুকুরের পাড় থেকে পানিতে কিভাবে এলাম বুঝতে পারলাম না।

বয়স তিন সাড়ে তিন তবু আমাকে বেঁচে থাকতে হবে। হয়তো পাড় থেকে খুব বেশি দূরে যাইনি তাই রক্ষা পেলাম। পুকুরের চারপাশ ঘেঁষে অসংখ্য লজ্জাবতী। তাদের ডানা পুকুরের পানি পর্যন্ত বিস্তৃত। বাঁচার জন্য মানুষ খড়কুটো আঁকড়ে ধরে। আমি আঁকড়ে ধরলাম লজ্জাবতী।

লজ্জাবতী আঁকড়ে ধরে উপরে উঠে এলাম। পুকুরের চারপাশে অসংখ্য লজ্জাবতী লতা কোনদিন তাদের দিকে গভীর মনোযোগে তাকানো হয়নি, এবার তাকালাম। দেখলাম ছোট ছোট অসংখ্য গোলাপি ফুল ফুটে আছে। লজ্জাবতীর গায়ে হাত ছোঁয়ালাম লজ্জায় তারা গুটিয়ে গেল কিন্তু ফুলগুলি ঠিকই আমার দিকে তাকিয়ে রইল। যেন বন্ধুত্বের আহ্বান জানাচ্ছে। আমি সকৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে লজ্জাবতী ফুল দেখতে থাকলাম। মনে হলো জগতে এর চেয়ে সুন্দর কোন কিছু নাই। মনে হলো ঈশ্বর লজ্জাবতীর গায়ে ফুল হয়ে ফুটে আছেন।

লজ্জাবতী ফুল আমার প্রিয় ফুল। তাদের দিকে তাকালেই ঈশ্বরের প্রতিরূপ দেখি।

ভারতের মেট্রো বা পাতালরেলে চড়ার আনন্দ অভিজ্ঞতার গল্প

nit

একসময় ভারতের মাটিতে পা রেখেছিলাম, ১৪০০ বঙ্গাব্দ। তখন বৈশাখমাস। বাংলাদেশ থেকে বেনাপোল স্থলবন্দর হয়ে দালাল মারফত অতি কষ্টে সীমান্ত পেরিয়ে বনগাঁ রেলস্টেশন পৌঁছেছিলাম। আমার সাথে ছিল, আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ওর দুই বোন। যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল, জীবনটাকে একটু পরিবর্তন করার। কিন্তু না, জীবন তো পরিবর্তন করতে পারি-ই-নি, বরং ওখানে প্রায় দেড়বছর অবস্থান করে শেষাবধি শূন্য হাতে আবার ফিরে আসতে হলো। এরমধ্যে লাভ হয়েছিল, বিশাল ভারত-সহ ভারত ঘেঁষা ভুটানের কয়েকটা জায়গা দেখা হয়েছিল। তো যাক সেকথা, আসা যাক পোস্টের মূল কথায়।

ভারত যাবার পর আমার বন্ধু বাসায় অবস্থানের পর, আমার যেন কিছুই ভালো লাগছিল না। ভালো না লাগার কারণ ছিল, বাংলাদেশে ফেলে রাখা স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে চিন্তা। সেই চিন্তা মনের ভেতরে রেখেই কাটিয়ে দিলাম চার-পাঁচদিন। চার-পাঁচদিন পর একদিন সকালবেলা আমার বন্ধু কানাই বলল, “চল দুইজনে টাউনে গিয়ে ঘুরে আসি।”
জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় যাবি?”
কানাই বলল, “আজ তোকে মেট্রো ট্রেনে চড়াব। আর সময় পেলে হাওড়া, তারামণ্ডলও দেখাবো।”

এ-তো খুশির খবর! কিন্তু খুশির বদলে আমার কান্না আসতে লাগল! চিন্তা শুধু একটাই, তা হলো এখানে আসলাম বেশ কিছুদিন হয়ে গেল। অথচ কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না, হচ্ছে শুধু টাকা খরচ! এভাবে ঘুরে বেড়ালে কি হবে? আমার তো কিছু একটা করতে হবে। ভাবছি, কানাইর সাথে যাব কি যাব না! না গেলেও হয় না। শেষমেশ জামাকাপড় পড়ে কানাইর সাথে বের হলাম।

কানাই’র বাসা থেকে একটা অটো (সিএনজি) চড়ে গেলাম ধর্মতলা। এই ধর্মতলায় কোলকাতা শহরের বড় একটি বাসস্ট্যান্ডও আছে। আছে কোলকাতার বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার ট্রাম ও বাস সার্ভিস। অটো থেকে নেমে একটা চা দোকানে গিয়ে চা-বিস্কুট খেলাম। দোকান থেকে বের হয়ে ফুটপাতের দোকান থেকে সিগারেট কিনলাম। সিগারেট জ্বালিয়ে ফুঁকছি, আর হাঁটছি। এদিক-ওদিক তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখছি। একসময় একটা রাস্তার ফুটপাত দিয়ে হাঁটছি দুইজনে। দেখছিলাম, দুইটা দোকানের মাঝখানে মাটির নিচে যাওয়ার জন্য অনেক চওড়া জায়গা। নিচে যাওয়ার সুন্দর সিঁড়িও আছে।

কানাইকে জিজ্ঞেস করলাম, “নিচে কী?”
কানাই বলল, ”এটি হচ্ছে কোলকাতা শহরের ভূগর্ভস্থ পাতাল রেলস্টেশন। যাকে বলে পাতাল রেল বা মেট্রো ট্রেন বা মেট্রোরেল। তাই অনেকে বলে, মেট্রো ট্রেনস্টেশন।

বললাম, “তা হলে আমরা কি এখন এই স্টেশনেই যাচ্ছি?” কানাই বলল, ”হ্যাঁ, তোকে তো বাসা থেকে বাইর হবার আগেই বলেছি। এখন চল, নিচে স্টেশনের ভেতরে যাওয়া যাক। গেলেই বুঝতে পারবি, পাতাল রেল কাকে বলে!”

সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে নিচে নামতে লাগলাম। যতই নিচে যাচ্ছিলাম, ততই স্টেশনের ভেতরকার সৌন্দর্য দেখে অবাকও হচ্ছিলাম! এই মেট্রো ট্রেন হলো, পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কোলকাতা পরিবহণ সেবার মধ্যে একটি। এটির পরিসেবা কোলকাতা শহরের পার্শ্ববর্তী উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা পর্যন্ত। দ্রুত পরিবহন সেবা প্রদানকারী পরিবহণ ব্যবস্থাও বলা যায়।

জানা যায়, কোলকাতা মেট্রো ট্রেনের পথ ২৭.২২ কিলোমিটার। এই ২৭.২২ কিলোমিটার পথে ২৩টি মেট্রো স্টেশন রয়েছে। যার মধ্যে ১৫টি স্টেশন ভূগর্ভস্থ আর বাদবাকিগুলো উড়াল। এই পরিবহন সেবা চালু হয়েছিল ১৯৮৪ সালে এবং এটিই ভারতের প্রথম মেট্রো রেল পরিসেবা। এরকম পাতাল রেল সার্ভিস নাকি ভারতের রাজধানী দিল্লিতেও আছে।

আমরা দু’জন নিচের দিকে নামছিলাম, যত নিচে যাচ্ছি ততই সুন্দর! ঝকঝকা আলো আর লোকে লোকারণ্য। স্টেশনের ভেতরে গার্ডের সাথে পুলিশও আছে। তাদের ডিউটি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখা। কে কী করছে, কোথায় যাচ্ছে এগুলো ফলো করা। মূল স্টেশনে প্রবেশ করতে হলে, চাই টিকিট।

কম্পিউটারে টিকিট শো করলেই গেইট খুলবে, যাত্রী প্রবেশ করবে। এ ছাড়া আর প্রবেশ করার মতো কারোর সাধ্য নেই। কানাই কাউন্টার থেকে দুটা টিকিট কিনে আনল। আমরা যাব, ধর্মতলা থেকে টালিগঞ্জ। টিকিটের দাম নিল, ৫ টাকা করে ১০ টাকা। দুটো টিকিটই একসাথে, মানে একটা টিকিট। টিকিটের গায়ে লেখা আছে টু ম্যান।

ট্রেন আসার সময় হয়েছে। হুইসেল শোনা যাচ্ছে। কানাই বলল, ”শিগগির আয়।”

আমরা কম্পিউটার সিস্টেম গেইটের সামনে গেলাম। কানাই গেইটের পাশে থাকা বক্সে টিকিট ঢুকাল। টিকিটখানা শোঁ করে বক্সের পেছনে চলে গেল। আমরা গেইট পার হলাম, টিকিটখানা হাতে নিলাম। গেইটখানা ধরে আমি একটু ট্রাই করে দেখলাম! গেইট আর একটুও নড়ে-চড়ে না। টিকিটের গায়ে দুইজন লেখা। ঠিক দুইজন পার হওয়ার পরই গেইট বন্ধ। ট্রেন স্টেশনে এসে থামল। যাত্রিরা ট্রেন থেকে নামল। আমরা ট্রেনে ওঠার জন্য রেডি হয়ে সামনেই দাঁড়িয়ে আছি।

ট্রেন থেকে মাইকে বলছে, “টালিগঞ্জ যাওয়ার যাত্রিগণ ট্রেনে ওঠে আসন গ্রহণ করুন।” আমরা-সহ সব যাত্রী ট্রেনে ওঠে সিটে বসার পর ট্রেন থেকে আবার মাইকিং। বলা হচ্ছে, “যাত্রীদের অবগতির জন্য বলা হচ্ছে যে, আপনারা ট্রেনের দরজা ও জানালা থেকে দূরে থাকুন।” এর পরপরই ট্রেনের সব দরজা ও জানালা একসাথে শোঁ করে লেগে গেল! বুঝলাম, দরজার সামনে যদি কেউ দাঁড়ানো থাকত, তা হলে মৃত্যু অনিবার্য। তাই আগে থেকেই যাত্রীদের হুশিয়ার করে দেওয়া হয়, যাতে কোনও দুর্ঘটনা না ঘটে।

ট্রেন ছুটল দ্রুতগতিতে! জানালা দিয়ে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ট্রেন যাচ্ছে মাটির নিচ দিয়ে। কিছু দেখা যাবে কী করে? শুধু একটু শব্দ শোনা যাচ্ছে, শোঁ শোঁ শব্দ। ১০ মিনিটের মতো বসে থাকার পর আবার মাইকিং।
বলা হচ্ছে, “আমরা টালিগঞ্জ পৌঁছে গেছি! ট্রেন থেকে নামার জন্য প্রস্তুত হোন।”

কানাই বসা থেকে ওঠে দাঁড়াল, সাথে আমিও ওঠলাম। ট্রেন থামল। ট্রেন থেকে আমরা নেমে স্টেশনের বাইরে আসলাম। কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে চা-বিস্কুট খেয়ে তৈরি হলাম, ধর্মতলা আসার জন্য। এবার ট্রামে চড়ে আসব ধর্মতলা। ট্রাম দেখা হবে আর চড়াও হবে। তারপর ট্রাম দেখা হলো, ট্রামে চড়াও হলো। মেট্রোরেল বা পাতালরেলে চড়ার গল্পও শেষ হলো।

না, আমার বলার কিছু ছিলো না

জরুরী প্রয়োজনে পেনসিল আর কাটার কিনতে হবে, স্টেশনারিজ আইটেমের পরিচিত দোকানে ঢুকেছি। কাউন্টারে দাঁড়ানো নতুন সেলসম্যান, এক মাস আগেও তাকে দেখি নাই।

নতুন সেলসম্যানের কাছে এক প্যাকেট পেনসিল আর কাটার চাইলাম, সে অতি দ্রুততার সাথে হাসিমুখে এক প্যাকেট স্টেনসিল পেপার এগিয়ে দিলো।

এমন অবস্থা দেখে তাকে ভেঙে ভেঙে বললাম, প্রথমে এক প্যাকেট পেনসিল দিন, তারপর পেনসিল কাটার, যাকে শার্পেনারও বলে, তা দিন।

সেলসম্যান হাসিমুখে বলল, প্রথমেই বুঝছিলাম আপনে পেন্সিল কাটার চাইছেন, তবু টেনসিল পেপার (স্টেনসিল তার কাছে টেনসিল) দিয়া শিওর হইলাম।

সেলসম্যানের স্মার্টনেসে মুগ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনে আগে কোথায় জব করেছেন?

সে হাসিমুখে উত্তর দিলো ‘কেজিবি’তে ছিলাম। গত মাসে এখানে জয়েন করছি।’ সেলসম্যানের উত্তর শুনে যতটা বিস্মিত হলাম, জায়েদ খান হেলিকপ্টার চালিয়ে আমার মাথায় ল্যান্ড করলেও ততটা বিস্মিত হতাম না।

সেলসম্যানের বয়স পঁচিশ কি ছাব্বিশ বছর হবে। এদিকে পরাক্রমশালী রুশ গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি বন্ধ হয়ে এফএসবি চালু হয়েছে, সেও প্রায় তিন দশকের বেশী হয়ে এলো। অথচ মেঘমেঘ দুপুরে উপশহরের স্টেশনারিজ স্টোরে কেজিবি’র এক তরুণ স্টাফের মুখোমুখি কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছি।

ঘোর কাটিয়ে জানতে চাইলাম, আপনি কেজিবি’তে ছিলেন? কিন্তু কেজিবি তো ত্রিশ বছর আগেই বন্ধ হয়ে গেছে।

দোকান কাঁপিয়ে হেসে উঠলো সেলসম্যান, হাসতে হাসতে বললো, ভাই, আমাদের কেজিবি মানে কিশোরগঞ্জ ব্রাঞ্চ চালুই তো হইছে চাইর বছর আগে, আপনে এইটা কি কইতাছুন!

না, আমার বলার কিছু ছিলো না।

গোদনাইলের গান গাই

niii

আমাদের গোদনাইল খুবই সুন্দর পরিপাটি,
পাকা রাস্তায় মানুষ করে হাঁটাহাঁটি।
পূর্বদিকে শীতলক্ষ্যা নদী বন্দর উপজেলা,
পশ্চিমে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা নারায়ণগঞ্জ জেলা।

গোদনাইলে আছে ছোট-বড় অনেক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান,
আছে রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস আর শিল্প-প্রতিষ্ঠান।
আরও আছে খেলার মাঠ নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র,
আছে বাজার মার্কেট যেন সুখের প্রাণকেন্দ্র।

নারায়ণগঞ্জ শহর ঘেঁষে গোদনাইল অবস্থিত,
গোদনাইলের সৌন্দর্য দেখে মানুষ হয় স্তম্ভিত!
শহরে আছে যা গোদনাইলেও আছে তা-ই,
তাইতো সবাই সুখে-দুঃখে গোদনাইলের গান গাই।

ছবিটি অনেক আগে লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস্-এর পুকুর পাড়ে অবস্থিত ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ( ডিপিডিসি) নির্মাণাধীন ভবনের উপর থেকে তোলা।

নিতাই বাবু
২৩/০৬/২০২৩ইং।

গত জন্মের স্মৃতি, রঙ বদলের আগের শৈশব

পোয়া মাইল দূরে দোষ লাগা হিজল গাছ, তার আগে নদীর ঘাট, থৈ থৈ রইদ, আব্বাসের চায়ের দোকান, টিনের চালার নিচে আরামের ছায়া, কাহিল কুত্তার মতন ঝিমায় ছুটির দুপুর।

তামচিনির প্লেটে দুইটা গরম জিলাপি, সিরায় চুবচুবা, টেবিলে রাইখা যায় আব্বাসের ছোট পোলা, আব্বায় হাঁক দেয় “আব্বাইসা ডবল পাত্তি মাইরা এক গ্লাস চা, চিনি দিবা কম।”

জিলাপি খাওয়া শেষে হাঁটি, আব্বায় ধইরা রাখে হাত, পোয়া মাইল দূরে আগাছার বাগান, বাগানের শেষ পাড়ে একা হিজল, ডালাপালা ছড়ায়া একাকার, তার আধখানা ছায়া দীঘিতে সুনসান।

বাকী আধখানায় আব্বায় বিছায় চাদর, ব্যাগ থেকা বাইর করে চিনিগুড়া চাউল ভাজা ছাতু, পাওরুটির গুড়া, ঘিয়ের তালানি, সরষার মধু, মিঠাইয়ের গাদ, আর গোপন তত্ত্বে বানানো কালচা চাড়।

মৌন দরবেশ এক বানায় অনারোগ্য রোগের নিদান, টোপে মিলায় পিপড়ার বসত ভাঙা ডিম, কে জানে ওই ডিমে লাইগা আছে কোন অভিশাপ, দূর থেকা আড়চোখে আমাদের দেখে দুইটা গুই সাপ।

ছয় কাটা বড়শিতে অব্যর্থ রসুন টোপ, রুই মাছ ধরা হবে আজ, দোষ লাগা গাছের কাছে আসে না কেউ, আব্বার পিঠ ঘেইষা বইসা থাকি নিশ্চুপ, ফাতনায় দোল খায় ঘোর লাগা ঢেউ।

ডাঙ্গায় থাইকা মাছের লগে যুদ্ধ চলে না, টোপ গিলার পর শুরু হইবো হয়রানির খেলা, হিজলের ডালে একটা গিরগিটি রঙ বদলানো ভুইলা দেইখা যায় সব, এসব গত জন্মের স্মৃতি, রঙ বদলের আগের শৈশব।

০৬০৭২৩

রয়ে যাবে কিছু

nit

যদি বলি জীবনের গল্প
হবে নাতো বলা শেষ
কিছু রয়েই যাবে,
যদি শুরু করি লেখা
কাগজ ফোরাবে হবেনা শেষ
কলমের কালিও ফোরাবে।

তবুও থেকে যাবে কিছু-না-কিছু
কথা আর জীবনের গল্প
মানুষের কাছে অজানা,
হবেনা বলা আর লেখা
হবেনা গাওয়া জীবনের গান
মনের কামনা বাসনা!

স্বতন্ত্রের স্বাতন্ত্র্য সুপিরিয়রের মধ্যে ইনফিরিয়র কমপ্লেক্স তৈরি করে দেয়

শৃঙ্খলা নামক শৃঙ্খল সুপিরিয়র নামক এককের যাবতীয় ক্ষমতার চাবিকাঠি। আসলে সুপিরিয়র মাত্রেই আধারিত ক্ষমতা। আবার উক্ত একক একটা জেলখানা বা খোঁয়াড়ের পাহারাদার ছাড়া আর কিছু নয়, যা তার কর্মক্ষেত্র। শৃঙ্খলা তথা শৃঙ্খলের বাইরে বের হতে চাওয়া কোনো স্বতন্ত্রের স্বাতন্ত্র্য তাই সহ্য করা কোনো ‘ক্ষমতা’ বা সুপিরিয়রের পক্ষে দস্তুর নয়। হায়ার্কির সকল অধস্থানীয় এবং তার বাইরের সাধারণদের খড়-ভূষি দেওয়া হবে, চকচকে দড়ির গলান দেওয়া হবে, অথচ সেসব অস্বীকার করে খোঁয়াড়ের বাইরে ঘুরে বেড়তে চাইলে কেউই তা মানবেন না।

বিশেষ্য ও বিশেষণ আছড়ে পড়বে খোঁয়াড়ের বাইরে যেতে চাওয়া যে কোনো স্বতন্ত্রের পিঠে! স্বতন্ত্রের স্বাতন্ত্র্য সুপিরিয়রের মধ্যে ইনফিরিয়র কমপ্লেক্স তৈরি করে দেয়, তখন তাকে গুরুত্ব না দিয়ে সুপিরিয়রের উপায় থাকে না। আর সেখানেই সুপিরিয়রের সব মহিমার ভাঙচুর ঘটে যায়। তখন ঠ্যাঙা নিয়ে তারই পিছনে পড়ে থাকবে সেই সুপিরিয়র। সমন পাঠাবে, পেয়াদা পাঠাবে, জেলখানার ভিতরের জেলখানায় ঢুকিয়ে দিতে চাইবে। আসলে সুপিরিয়রের প্রতি যখন সে আনুগত্য প্রদর্শন করতে পারছে না, তার ঘাড় বেঁকে যাচ্ছে, এবং কিছু প্রশ্ন সত্যের সরগম ছুঁয়ে ফেলে সুপিরিয়রকে বিদ্ধ করছে তখন সুপিরিয়রের নখ-দাঁত তার ঘাড়ে বসে সেই অসহায় ঘাড়টিকে ভেঙে ফেলতে চাইবে এ তো ক্ষমতার অলিন্দে স্বাভাবিক তরিকা! কারও স্বাতন্ত্র্য ‘ক্ষমতা’র না-পসন্দ। ধমকে কাজ না হলে লাইনছুট তৃণভোজীকে বংশদন্ডের প্রহার করা ছাড়া উপায় কী? নিয়ন্ত্রণের কব্জায় না আনা পর্যন্ত সুপিরিয়রের শান্তি নেই। যেখানে যতটুকু ক্ষমতা তাই দিয়ে স্বাতন্ত্র্য ধ্বংস করে তার হেঁটোয় কাঁটা, জোড়া হাত পিছন দিকে বেঁধে, আর সেই অদ্বিতীয় ‘ঘাড়’ সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে স্বতন্ত্রকে বসিয়ে দিতে পারলে তবেই তো সুপিরিয়রের সাফল্য! বলির বাজনা বাজবে দ্রুত ঝাঁপতালে, আর সুপিরিয়র খড়্গের রক্ত মুছে প্রচন্ড কাপালিক – রক্তাম্বর, কপালে বড়ো করে সিঁদুরের তিলক, ঘামে চকচকে মুখ …। সিংহাসনে বসে ঠ্যাঙের উপর ঠ্যাঙ তুলে নাচাচ্ছেন আর মুখে আত্ম প্রসাদের হাসি।

কিন্তু ‘স্বতন্ত্র’ স্বতন্ত্র বলেই নির্ভয়। সুপিরিয়র যতই পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটিতে পুঁতে দিতে চাইবে, ততই সে শক্তিশালী হবে। সুপিরিয়র প্রতিবার হারবে। হারবে যত তত নিজের ক্ষমতাও জাহির করবে।

গ্রাম্যতা কিংবা সাদা গাভী

তুমি এখন কী কর! ঘাস কাটি। অর্থাৎ কিছু করি না। ‘ঘাস কাটা’কে যতই অকাজের কাজ হিসেবে চিহ্নিত করা হোক না কেন; ঘাস কাটা সহজ নয়। আমি কিছুদিন গরুর জন্য ঘাস কেটেছি, ঘাস কাটতে গিয়ে দেখলাম বিষয়টা জটিল। একবার তো মাপের হেরফেরে হাত কেটে গিয়ে ডাক্তার পর্যন্ত দৌড়াতে হয়েছে।

আমি যে সময়ের কথা বলছি সে সময় আমাদের পাড়া আরামবাগে কিছুটা ফাঁকা জায়গা ছিল। আমাদের শহর মৌলভীবাজারে অনেক মাঠ ছিল, ফাঁকা জমিন ছিল। এখনকার মত “ইটের উপর ইট/মধ্যে মানুষ কীট” অবস্থা হয়নি। মৌলভীবাজার তখনো পুরোদস্তুর শহর হয়ে ওঠেনি। মানুষের মধ্যে কিছুটা গ্রাম্যতা তখনও বিদ্যমান। মানুষ তখনও গ্রামে বসবাসের অভ্যাস পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারেনি।

পাকা কাঁঠাল খেতে হবে ভেবে আমরা তখনও গোঁফে তেল লাগানো শিখিনি। আমরা কব্জি ডুবিয়ে রসের পাতিল থেকে রসমালাই মুখে পুড়তাম। লুঙ্গি পাঞ্জাবি আমাদের পরিধেয় বস্ত্র ছিল। থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট কিংবা টি শার্ট কী জিনিস তখনও জানি না।

আমার জন্ম শহরে। আমার বাবার জন্ম গ্রামে; যদিও দীর্ঘ দিন ধরে কাজের সুবাদে শহরে বসবাস করছেন। শহরে বসবাস করছেন ঠিকই কেন যেন পুরোপুরি শহুরে হতে পারছেন না। শহুরে হতে চাইলে গ্রাম তাঁর মনে এসে ভিড় করে। এমন না যে আমার আব্বা চাষী ছিলেন কিংবা তার আব্বা অর্থাৎ আমার দাদা।

চাষের জন্য পর্যাপ্ত জমি আমাদের ছিল কিন্তু দাদা কিংবা বাবা সে অর্থে চাষী ছিলেন না। দাদা ছিলেন স্কুল মাস্টার। বাবার ছিল সরকারি চাকুরী। বাবা মুনসেফ কোর্টের সেরেস্তাদার বা চিফ একাউন্টেন্ট ছিলেন।

আমার রক্তে যে অক্ষর খেলা করে তা কিছুটা উত্তরাধিকার হিসাবে পাওয়া। দাদারও টুকটাক লেখালেখির অভ্যাস ছিল। তিনি গ্রাম বাংলার আদি শ্লোক ইংরেজিতে যাকে Verse কিংবা Couplet বলা হয় পদ্য ছন্দে খাতায় লিখে রাখতেন। বাবা আমাদের মত পুরোপুরি প্রবাসী না হলেও চাকুরীর কারণে নিজ জেলা শহর থেকে দূরে অন্যান্য শহরে থাকতেন। এক অর্থে তিনিও প্রবাসী ছিলেন। প্রবাসীরা অত্যন্ত নস্টালজিক হয় স্মৃতি বেদনায় তড়পায়। বাবা বিরহকাতরও ছিলেন। নববধূকে ফেলে দূরের শহরে কাজ তাঁর জন্য বেশ কষ্টের ছিল। তিনি সেই কষ্ট কথা খাতায় লিখে রাখতেন। অনেক বছর পরে অমুদ্রিত খাতাগুলি আবিষ্কৃত হলে আমরা একজন রোমান্টিক কবি তথা রোমান্টিক পিতার দেখা পাই।

আমাদের বাড়ি বা গ্রাম শহর থেকে খুব দূরে নয়। তিন সাড়ে তিন মাইলের মত হবে কিন্তু যেতে হতো নদী পার হয়ে। আমি শহুরে হওয়ায় নদী পারি দেয়া আমার জন্য ভীতিকর ছিল। খেয়া নৌকায় উঠলে ভয়ে কাঁপতে থাকতাম। আব্বার হাত কিংবা পাঞ্জাবি শক্ত করে ধরে থাকতাম। আব্বাকে দেখতাম কি অবলীলায় খেয়া নৌকার এদিক থেকে ওদিকে হাঁটছেন। কখনো উবু হয়ে নদী থেকে আজলা পানি তুলে মুখ ধুচ্ছেন কুলি করছেন। নদীর পানি আমার কাছে খুব একটা পরিষ্কার মনে হত না আব্বা অবলীলায় সে পানি দিয়ে কুলি করতেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তিনি বলেছিলেন বহতা পানি সাধারণত অপরিষ্কার হয় না। তিনি নদী পাড়ের মানুষ নদীর সাথে পাল্লা দিয়ে বড় হয়েছেন; সামান্য পানি তাকে কাবু করতে পারবে না।

আমাদের গ্রামের নাম ঢেউপাশা। নামকরণের ইতিহাস জানিনা কোন প্রবীণকে কোনদিন জিজ্ঞেস করিনি। এখন গ্রামের কোন প্রবীণ অবশিষ্ট নেই জিজ্ঞেস করলেও সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। নদীর ঢেউ এর সাথে পাশা খেলার কোন সংযোগ আছে কিনা জানিনা। তবে পাশা এবং ঢেউ দুটোই অভিজাত শব্দ। দুটি শব্দই আমাদের গ্রামের সাথে মানানসই। গ্রামটি ঐতিহ্যবাহী। ধামাইল গানের একচ্ছত্র অধিপতি রাধারমন দত্ত কিছুদিন আমাদের গ্রামে ছিলেন। তাঁর গুরু গোস্বামীদের আদি নিবাস ঢেউপাশায়। এখানেই তিনি দীক্ষা নিয়েছিলেন।

শিক্ষাদীক্ষায় আমাদের গ্রাম আশপাশের দু-দশ গ্রামের চেয়ে এগিয়ে ছিল। প্রাশ শত বৎসর বয়সী স্কুল এখনও গ্রামে বিদ্যমান।

বলতে খারাপ লাগছে আমাদের ছোট বেলায় যে গ্রামকে দেখে এসেছিলাম সে গ্রাম এখন আর নাই। আমার বাবা শহরে থেকে গ্রাম্য থাকতে চেয়েছিলেন, যে গ্রামকে আঁকড়ে ধরেছিলেন সে গ্রাম এখন প্রায় শহরে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। খেয়া পার কবেই উঠে গেছে। যে গ্রামে কখনও গরু গাড়ির দেখা মিলত না এখন দানব ট্রাকের চাকা সেই গ্রামের মাটিকে প্রতিনিয়ত ধর্ষণ করে। হাতে হাতে মোবাইল। বাড়িতে বাড়িতে স্যাটেলাইট।

প্রতিবার দেশে গেলে সময় করে বাড়ি ঘুরে আসি। বাড়ি বললাম ঠিকই কিন্তু জনমানব বিহীন ভিটা; দু-তিন কামরার একটা ঘর। আগে দেখাশোনার জন্য একজন ছিল; স্ত্রী পুত্র কন্যা নিয়ে থাকত। কয়েক বছর আগে তারা নিজের বাড়িতে চলে গেলে এখন ঘর ফাঁকা, তালাবন্ধ থাকে। এক সময়ের জমজমাট মাস্টার বাড়ি এখন খা-খা করছে। বাড়ির বাসিন্দারা এখন তিন মহাদেশের ছয়টি দেশে বসবাস করে।

প্রতিবার দেশে গেলে বাড়িতে যাই; কিসের টানে যাই ঠিক জানি না। খা-খা বাড়ি মানুষ নাই। পুকুরের অপর পাড়ে শুধু কয়েকটা কবর। দাদা দাদী এবং তাদের পূর্ব পুরুষেরা শুয়ে আছেন। কবরের টানে যাই বটে, তার চেয়েও বড় টান; একটা আম গাছ। বেহেস্তে হয়তো অত্যন্ত মজাদার ফল খেতে পারব কিন্তু সমস্ত মজাদার ফল একপাশে সরিয়ে আমি আল্লাহর কাছে শুধুমাত্র এই আমগাছ চাইবো। এর চেয়ে সুস্বাদু জীবনে আর কিছু খেতে চাই না।

প্রতিবার আমার লোভাতুর চোখ, লোভাতুর মন আমাকে বাড়িতে নিয়ে যায় শুধু এই আম গাছের জন্য। গৃহস্থালীতে পরিপূর্ণ বাড়ি যেখানে আজ বিরাণ মাঠ সেখানে আম গাছ কী করে পাবো! আমি জানি কবেই আমগাছ কেটে ফেলা হয়েছে। আমি জানি আমগাছ নির্দয় রাস্তার পিচের পেটে গেছে। আমি জানি স্যাটেলাইট ট্রাক ঘন ঘন উন্নয়নের বার্তা গ্রামে পৌঁছে দিচ্ছে। আমি জানি সরকারের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হচ্ছে আমরা গ্রামকে শহর বানানোর সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেছি বাংলাদেশে গ্রাম অবশিষ্ট থাকবে না।

আমার শৈশবের আম গাছ দাদা দাদীর কবরের পাশে শুয়ে আছে। দাদা দাদীর প্রায় চল্লিশ জন উত্তরাধিকার বছরে একবার না একবার গ্রাম ঘুরে আসে। আম গাছ কোন উত্তরাধিকার রেখে যেতে পারেনি তার অনুপস্থিতি কারো মনে ব্যাঘাত ঘটায় না। তার জন্য কেউ ব্যথিত হয় না। শুধু আমি সৌখিনতা আক্রান্ত হয়ে আম গাছে কাব্য খুঁজতে যাই।

কথা শুরু হয়েছিল ঘাস কাটা নিয়ে। আমার বাবা শহরে বাস করে গ্রামকে ভুলতে পারেননি বিধায় গ্রামের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় অনুসঙ্গ সন্তানদের স্বাস্থ্য-চিন্তায় সুষম খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে আমাদের বাসায় একটা গরুকে (গাভী) লালন পালন করতেন। শহরে গাভী পালন করা খুব সহজতর ছিল না কারণ পর্যাপ্ত জায়গার অভাব। আগে যেভাবে বলেছি তখনও শহরে কিছু ফাঁকা জায়গা ছিল সেসব ফাঁকা জায়গায় ঘাস গজাতো। আমাদের বাসা তখনও বর্ধিত করা হয়নি উঠোনে ফাঁকা জায়গা ছিল গরুর জন্য আলাদা ঘর বানানো হয়েছিল।

আমাদের সাদা গাই (গাভী) আমাদের পাড়ার সবার কাছে পরিচিত ছিল। কখনও আমাদের অগোচরে অন্য বাসায় ঢুকে গেলে তারা অত্যন্ত মায়া করে আমাদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে যেত। ধীরে ধীরে এসব বদলে যেতে লাগলো। পাড়ার স্থায়ী বাসিন্দারা একে একে প্রবাসী হতে থাকলে শূন্যস্থান পূরণে অন্যান্য জেলার বাসিন্দারা বসবাস করতে আসলো। স্থায়ী বাসিন্দাদের মত মহব্বত তাদের মনে ছিল না বিধায় আমাদের সাদা গাভী প্রায়ই খোঁয়াড় বন্দী হতে লাগলো।

মৌলভীবাজার পৌরসভার অধীনে একটা খোঁয়াড় ছিল শ্রীমঙ্গল বাসস্ট্যান্ডের কাছে। হাফিজা খাতুন উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে। গরু কিংবা ছাগল মুক্ত করার ফি ছিল দুই টাকা। আমাদের প্রায়ই দুই টাকা দিয়ে সাদা গাভীকে মুক্ত করে আনতে হতো।

এই সাদা গাভী পরিবারের সদস্য হয়ে গিয়েছিল। আব্বা যেভাবে আমাদের খেয়াল রাখতেন ঠিক সেভাবে গাভীকেও খেয়াল রাখতেন। নিজের সন্তানের মত পালন করতেন। লালনের বিনিময়ে আমরা তাঁকে প্রতিদান দিতাম না, গাভী আমাদের মত অকৃতজ্ঞ ছিল না। সে প্রতিদিন বালতি ভর্তি করে দুধ দিত আমরা সেই দুধ পান করে পরিতৃপ্ত হতাম।

সারাদিন খোঁয়াড়ে থাকার জন্য কোন দিন গাভী প্রয়োজনীয় ঘাস খেতে পারত না তখন আব্বা আমাকে ঘাস কেটে আনতে বলতেন। আমি কাচি নিয়ে ঘাস কাটতে যেতাম, ঘাস কাটা সহজ ছিল না। যথেষ্ট ঘাস না হলেও যতটুকু পারতাম কেটে নিয়ে আসতাম।

আব্বা স্থানীয় চালের আড়ত থেকে গুড়া নিয়ে আসতেন। ভাতের ফ্যানের সাথে মিশিয়ে গাভীকে খেতে দিতেন। যেদিন ভাতের ফ্যান থাকতো না সেদিন বালতিতে ঠান্ডা পানি নিয়ে গুড়া ঢেলে মিশিয়ে নিতেন।

সাদা গাভী এবং আমি প্রায় একসাথে বড় হয়েছি কিংবা গাভী হয়তো আমার বয়সের চেয়ে সামান্য বড়। আমার ধারণা ছিল মানষই শুধু বৃদ্ধ হয় এবং তারা মরে যায়। গাভীও যে বৃদ্ধ হতে পারে চিন্তায় আসেনি। আমাদের সেবা করতে করতে সাদা গাভী একদিন বৃদ্ধ হয়ে গেল। সে আগের মত দুধ দিতে পারে না। মানুষের বাসায় ঢুকে শিম গাছে মুখ দিতে পারে না। ভালো করে দাঁড়াতে পারে না।

গাভীর সন্তানকে আমরা কাজে লাগাতে পারতাম কিন্তু সে এঁড়ে বাছুর এবং অত্যন্ত দুরন্ত। মাঠে প্রথাগত ঘাস খাওয়া তার ধাতে নেই। মানুষের বাসায় বাসায় মুখ মেরে ফিরে। তার মাকে হয়তো সপ্তাহে একদিন খোঁয়াড় থেকে আনতে হতো। তাকে আনতে হয় সপ্তাহে সাত দিন কোন কোন দিন একাধিকবার। তার দুষ্টুমিতে অতিষ্ঠ হয়ে তাকে আব্বা গ্রামে চালান করে দিলেন।

আমাদের সাদা গাভী ধীরে ধীরে চলৎশক্তিহীন হয়ে গেল। সারাদিন বাসায় ঘুমিয়ে থাকে। ততদিনে পাড়ার ফাঁকা মাঠগুলো ভরাট হতে শুরু করেছে। ঘাস দিনে দিনে দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে।

একদিন দেখলাম একজন লোক আমাদের বাসায় এসেছে। তাকে কসাই হিসেবে চিনি। চৌমুহনায় মাংসের দোকান আছে।

কসাই যখন সাদা গাভী নিয়ে যায় আমার আব্বা সামনে যেতে পারেননি। কারণ তিনি কাঁদছিলেন। আমার চাচা গাভীকে কসাইয়ের হাতে সপে দিয়েছিলেন। গাভী বিক্রি করে আমরা ৫০০ টাকা পেয়েছিলাম। এই টাকা আব্বা কোনদিন খরচ করেননি কাউকে দান ও করেননি। গুরুত্বপূর্ণ দলিল দস্তাবেজের ভিতরে সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন। আমার আব্বা শহুরে হয়েছিলেন কিন্তু তার মন গ্রাম্য ছিল যেকোনো কিছুতেই তার চোখ আদ্র হয়ে উঠতো।