বিভাগের আর্কাইভঃ সমকালীন

প্রশ্ন……..??

ষষ্ঠ শ্রেনীর একজন শিক্ষার্থীকে শিখানো হচ্ছেঃ
ইসলাম শিক্ষাঃ সমস্ত শক্তির মালিক আল্লাহ।
সামাজিক বিজ্ঞানঃ জনগন ই সকল ক্ষমতার উৎস।
সাধারন বিজ্ঞানঃ সমস্ত শক্তির উৎস সুর্য্য।
গনিতঃ ৩% হারে ৫০০০ টাকা কত বছরে সুদে আসলে ৬৫০০ টাকা হবে।
ইসলাম শিক্ষাঃ সুদ সম্পর্কিত ১০ ব্যক্তি জাহান্নামী।

কেন এই দ্বিমুখি শিক্ষা ব্যবস্থা ? এ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা কিভাবে, কেন, কোথা থেকে আসল ?

প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং আত্মিক অধঃপতন

ব্রিটেনের বিচার মন্ত্রণালয় ও জাতীয় পরিসংখ্যান বিভাগ কিছুদিন আগে এক ভয়ঙ্কর তথ্য প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, প্রতিবছর ইংল্যান্ডে ৮৫ হাজার নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এছাড়া আরও ৪ লাখ নারী যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। পরিসংখ্যান থেকে আরও জানা যায়, ২০১৩/১৪ সালে ৪৫ ভাগ যৌন অপরাধ ঘটেছে শিশুদের বিরুদ্ধে, যাদের বয়স ১৬ বছরের নিচে। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ব্রিটেনের ৯০ ভাগ নারীই পরিচিত লোকদের লালসার শিকার। শুধু খোদ ব্রিটেন নয় পশ্চিমা সভ্যতার ধারক-বাহক প্রায় দেশেই একই অবস্থা। আমেরিকার জাতীয় আইন বিভাগের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, সেখানে প্রতি বছর ২ লক্ষ ৩৭ হাজার ৮৬৮ জন নারী ধর্ষিত হয়। উপরোক্ত পরিসংখ্যান যে কোন সুস্থ ও চিন্তাশীল মানুষকে উদ্বিগ্ন না করে পারে না। আর মানবজাতির জন্য এ এক বিরাট লজ্জা।

এই অবস্থার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে স্মার্ট ফোন ও ল্যাপটপে পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা। ৬৫ ভাগ কিশোর পর্নোগ্রাফিতে মারাত্মকভাবে আসক্ত হয়ে পড়েছে। যান্ত্রিক প্রযুক্তি একদিকে যেমন জীবনকে সহজলভ্য করছে অন্যদিকে এর অপব্যবহার মানুষকে পশুবৎ আচরণ করতে বাধ্য করছে। কোন জিনিস ভালো কি মন্দ তা সম্পূর্ণ নির্ভর করে সেই জিনিসের ব্যবহারের ওপর। একটা অস্ত্র দিয়ে ডাকাতি বা খুন করা যায়, সেই অস্ত্রই খুনীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করে অসহায়কে রক্ষা করা যায়। অস্ত্র নিজে দায়ী নয়, যে সেটাকে ব্যবহার করবে সে দায়ী। পাশ্চাত্য সভ্যতা বর্তমানে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করছে অন্যায়ভাবে। রেডিও-টেলিভিশন, ইন্টারনেট ইত্যাদি মানুষকে ভালো অনেক কিছুই শিক্ষা দিতে পারত কিন্তু এগুলি বর্তমানে মানুষকে হত্যা, সহিংসতা, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অপরাধ, নগ্ন যৌনতা ইত্যাদি শিক্ষা দিয়ে তাকে পশুর পর্যায়ে নামিয়ে দিচ্ছে।

এই যৌনতা, নগ্নতা, বেহায়পনা, শিশু নির্যাতন-এক কথায় সমস্ত রকম অশ্লীল কার্যকলাপ বন্ধের জন্য অনেক সভা-সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, র‌্যালি, সমাবেশ, বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে টকশো প্রভৃতি করা হচ্ছে, বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে, প্রচলিত আইন কঠোর থেকে কঠোরতর করা হচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। পরিসংখ্যান বলছে দিন দিন তা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। আলোচকগণের সামনে ভয়ঙ্কর রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও তারা প্রচলিত মূল্যবোধের বাইরে কোন কথা বলেন না। প্রচলিত মূল্যবোধে কখনও বর্তমানের এ সমস্ত অশ্লীল কার্যকলাপ বন্ধ হবে না। তার প্রমাণ পরিসংখ্যান। অথচ আমরা যদি একটু পিছন দিকে তাকাই, যে সময় স্রষ্টার দেওয়া মূল্যবোধ পৃথিবীতে কার্যকর ছিল তখন যুবতী নারী গায়ে স্বর্ণের অলঙ্কার আচ্ছাদিত করে শত শত মাইল নির্ভয়ে অতিক্রম করত। বর্তমানে যা কল্পনাও করা যায় না। কল্পনা করা যাক বা না যাক, স্বীকার করা হোক বা নো হোক- এর পরিণতি থেকে আমরা রেহাই পাচ্ছি না। বাইরে আমরা খুবই চাকচিক্য চেহারা আর সুখী সুখী ভাব দেখালেও অন্তরের দিক থেকে চূড়ান্ত দৈন্যতায় ভুগছি।

পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর আত্মহত্যার তালিকার দিকে তাকালেই আমরা এই বাস্তবতা টের পাই। মানুষ সাধারণত পরিসংখ্যান দেখে চোখ ছানাবড়া করে ফেলে, কিন্তু পরিবেশের সাথে মিশে থাকায় উপলব্ধি করে কম। যার কারণে মানুষের ঐ শক্তিটুকু ক্রমশ ভোঁতা হয়ে যায়। কিন্তু একটু গভীর দৃষ্টিতে তাকালে দেখা যাবে এই সভ্যতার ভেতরটা এতই ফাঁপা হয়ে গেছে যে সামান্য বাতাসেই এটি যে কোন সময় ধূলিস্মাৎ হয়ে যেতে পারে।

বর্তমানে নৈতিকতাহীনতার এই নারকীয় অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে, সভ্যতাকে পুনর্গঠন করতে হলে প্রচলিত মূল্যবোধ ত্যাগ করে মানুষের সামনে স্রষ্টার দেওয়া মূল্যবোধ গ্রহণের বিকল্প কিছু নেই।

খুনি যানবাহন ও আমাদের বিবেক

দেশের দুজন কৃতী মানুষ তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরকে খুন করেছিল একটি যানবাহন। তা নিয়ে আদালতে মামলা হয়েছিল। সেই মামলার বিচারকার্য সম্পন্ন হয়েছে। আমাদের মনে আছে- ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে ঘিওর উপজেলার জোকা এলাকায় চুয়াডাঙ্গা পরিবহনের বাসের সঙ্গে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরকে বহনকারী মাইক্রোবাসের সংঘর্ষ হয়। এতে তারা দুজনসহ ঘটনাস্থলেই পাঁচজন প্রাণ হারান। গুরুতর আহত হন আরো তিনজন। নিহত ব্যক্তিরা হলেন- তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর, মাইক্রোবাস চালক মোস্তাফিজুর রহমান, প্রোডাকশন সহকারী ওয়াসিম হোসেন ও জামাল হোসেন। দুর্ঘটনায় আহত হন তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ, শিল্পী ঢালী আল মামুন ও তার স্ত্রী দিলারা বেগম জলি। তারা কাগজের ফুল ছবির শুটিং স্পট দেখে মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার শালজানা গ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরছিলেন। এ ঘটনায় ওই দিনই ঘিওর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) লুৎফর রহমান বাদী হয়ে বাসের চালক জামির হোসেনকে আসামি করে মামলা করেন। ঘটনার পরদিন বাসের চালক জামির হোসেনকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এরপর ওই বছরের ১৭ নভেম্বর তিনি জামিনে মুক্ত হন।

বেপরোয়া গতিতে বাস চালিয়ে চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ পাঁচজনকে হত্যার দায়ে বাসচালক জামির হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। মানিকগঞ্জের অতিরিক্ত দায়রা জজ আল-মাহমুদ ফায়জুল কবীর এই আদেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে মামলার একমাত্র আসামি জামির হোসেন ওরফে জমির ড্রাইভারের জামিন বাতিল করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। রায় ঘোষণার সময় আদালতের কাঠগড়ায় থাকা জামিরকে নির্লিপ্ত দেখা যায়। রায়ের পর পুলিশ তাকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যায়। বিচারক তার আদেশে বলেন, জামির হোসেনের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০৪ ও ৪২৭ ধারার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তাকে ৩০৪ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো তিন মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হলো। আর দণ্ডবিধির ৪২৭ ধারার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও দুই হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরো এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো।

মামলা দায়েরের আট মাস পর জামিরের বিরুদ্ধে মানিকগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। এতে জামির হোসেনের বিরুদ্ধে পাঁচটি ধারায় অভিযোগ আনা হয়। এগুলো হচ্ছে- বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো (ধারা ২৭৯), সাধারণ জখম (৩৩৭), গুরুতর জখম (৩৩৮ক), খুন নয় এমন নরহত্যা (৩০৪) ও মালামাল ক্ষতিগ্রস্ত করা (৪২৭)। এর মধ্যে আদালত গত ২২ ফেব্রুয়ারি ৩০৪ ও ৪২৭ ধারায় জামিরকে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি প্রদান করেন। সবচেয়ে অবাক করা কথা হচ্ছে, এই ড্রাইভারের লাইসেন্সটি মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল। রায়ে বলা হয়েছে, বিআরটিএ’র রেকর্ড মোতাবেক দুর্ঘটনার সময় জামির হোসেনের চালক লাইসেন্সটি তিন বছরের মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল। পরে তিনি লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদনের একটি স্লিপ আদালতে জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু বিআরটিএ থেকে প্রাপ্ত পত্রে স্পষ্ট বলা হয়, জামিরের দেয়া স্লিপটি ছিল ভুয়া। সেটি বিআরটিএ থেকে সরবরাহ করা হয়নি।

রায়ে আরো বলা হয়, অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স পরিবহনের বাসটির ফিটনেস সনদের মেয়াদ ছিল না। একই সঙ্গে আসামি বাসটির গতি নিয়ন্ত্রণকারী যন্ত্রটি (স্পিড গভর্নর) কারসাজি করে রেখেছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রিত গতির চেয়ে অধিক গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। বিআরটিএ’র উপপরিচালক আবদুস সাত্তার দুর্ঘটনাকবলিত দুটি যানবাহনের তদন্ত করেন। তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, গতি নিয়ন্ত্রক যন্ত্রটি কারসাজি (ট্যাম্পার্ড) করা ছিল।

হ্যাঁ, প্রিয় পাঠক, বাংলাদেশে যানবাহন এভাবেই খুনি হয়ে উঠছে। মাননীয় বিচারক তার রায়ে বলেছেন- এজাহার, অভিযোগপত্র, খসড়া মানচিত্র, বিআরটিএ’র চিঠি, জব্দ করা ভুয়া ও মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স, নিশ্চিত মৃত্যু থেকে বেঁচে যাওয়া প্রত্যক্ষদর্শীর অভিন্ন ও অকাট্য সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, আসামি বাসটিকে বৃষ্টি ও বাঁকের মধ্যে অবহেলার সঙ্গে বেপরোয়া গতিতে চালিয়ে একটি মিনিবাসকে ওভারটেক করে মাইক্রোবাসটিকে নির্মমভাবে আঘাত করেন। এর ফলে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ পাঁচটি তরতাজা প্রাণ ঝরে যায়। আসামির বেপরোয়া আচরণ ও অবহেলার কারণেই এই পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে।

এই রায়টি ঘোষিত হওয়ার পর বাংলাদেশে সড়ক পরিবহন ধর্মঘট শুরু হয়েছে। কারা এই ধর্মঘটে মদত দিচ্ছে? আমার মনে আছে, এই নির্মম দুর্ঘটনার পর আমি ‘ভোরের কাগজ’-এ একটি লেখা লিখেছিলাম। ‘যখন তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের সমাধির দিকে তাকাবো’- শিরোনামে লেখাটি ২০১১ সালে ২২ আগস্ট ছাপা হয়েছিল। সেই লেখার কিছু অংশ আমি আবারো আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই। আমি লিখেছিলাম- ‘তারেক মাসুদ একসময় যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। মিশুক মুনীরও ছিলেন কানাডায়। দুজনেই দেশে ফিরে গিয়েছিলেন। কেন গিয়েছিলেন? সেই প্রশ্নটি আমি বারবার করি। তারা তো বিদেশে থাকলে ভালোই করতেন। কেন গেলেন দেশে? গিয়েছিলেন এই দেশকে কিছু দেয়ার জন্য। দেশের মানুষের মননকে শাণিত করার জন্য। দেশের প্রজন্মকে আলোর উজ্জ্বল পথ দেখাার জন্য। কিন্তু কী পেলেন তারা? প্রাণ দিতে হলো। চলে যেতে হলো চিরতরে। গত কদিন থেকে আমি বিষয়টি যতবার ভাবছি, ততবারই প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হচ্ছি। এই দেশ, এই মাটি তাদের এভাবে হত্যা করতে পারল?’

আমি এই প্রশ্নটি আবারো করছি। আজ দেখা যাচ্ছে, একটি চক্র দেশকে ধর্মঘটের নামে অচল করে দিতে চাইছে। বাংলাদেশে সড়ক নিয়ন্ত্রণ করে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন। এদের নেতা কে? সরকারি দল ও বিরোধী দলের কিছু সিনিয়র নেতা আছেন যারা শ্রমিক নিয়ন্ত্রণ করেন। এরাই দেশে নিজ নিজ সরকারের সময়ে হাজার হাজার ভুয়া ‘ড্রাইভার’ বানাবার কসরত করেন। আজ দাবি উঠেছে, বন্দুকের লাইসেন্সের মতো ড্রাইভিং লাইসেন্সেও কড়াকড়ি করা হোক। কারণ একটি গুলি একজন লোক খুন করে। আর একজন বাস বা ট্রাক ড্রাইভার শত শত যাত্রীর জীবন বিপন্ন করে। এই যুক্তিটি সরকারি মহল কীভাবে নেবে? আমরা প্রায়ই টিভিতে দেখি, ভাঙা বাসগুলোকে রং করে রাস্তায় নামানো হচ্ছে। ভেতরের ইঞ্জিনের অবস্থা কী? তা কে দেখবে? না, বাংলাদেশে তা দেখার লোক নেই। কেন নেই?

সংবাদ বেরোচ্ছে, কোনো কোনো মন্ত্রীও নাকি এসব খুনি শ্রমিকদের মদদ দিচ্ছেন। কেন দিচ্ছেন? খুনি তো খুনিই। সে খুন যেভাবেই করুক। পরিবহন ধর্মঘটের নামে দেশজুড়ে নৈরাজ্য গড়ে তোলার পাঁয়তারা করা হচ্ছে। মানুষ হত্যার লাইসেন্স চাইছে এসব খুনিরা। অপরাধ যে করবে, সে আইনের চোখে দোষী সাব্যস্ত হলে শাস্তি পাবে। এটাই আইন। তাহলে আজ কি আদালত অবমাননা করে ধর্মঘটের নেতৃত্ব দেয়া হচ্ছে না?

ধর্মঘট আহ্বানকারী সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি হলেন শাজাহান খান। যিনি সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্য। সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি হলেন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙা। সরকারের প্রভাবশালী দুই মন্ত্রী যখন দুই পরিবহন সংগঠনের শীর্ষ নেতা তখন দেশবাসীকে জিম্মি করে লাগাতার পরিবহন ধর্মঘট কার স্বার্থে? এমন প্রশ্ন তুলেছে যাত্রী অধিকারের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন সংগঠন।

সারা দেশে পরিবহন ধর্মঘটের বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, যত দ্রুত সম্ভব অযৌক্তিক ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেয়া উচিত। ধর্মঘট আহ্বানকারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আদালত এ রায় দিয়েছেন, জনগণ দেয়নি। রায়ের সঙ্গে জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই। তাহলে জনগণ কেন কষ্ট পাবে?’ কী এক আজব কিছু মানুষের মানসিকতা। খুনিকে বাঁচাতে তারা দেশ অচল করে দিতে চাইছেন?

মিশুক মুনীরের স্ত্রী মঞ্জুলী কাজী রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। তিনি মিডিয়াকে বলেছেন, ‘এটি একটি যুগান্তকারী রায়। বিজ্ঞ আদালত বিচার-বিবেচনা করে রায় দিয়েছেন। হাইকোর্টে যদিও আপিল করার সুযোগ আছে। আমি আশা করি রায় বাস্তবায়ন হবে। এই রায় নজির হিসেবে ব্যবহার হবে, অন্য যারা স্বজন হারিয়েছেন, তারাও বিচার পাবেন।’

মিশুক মুনীরের স্ত্রী বলেছেন, একজন দোষী গাড়িচালকের বিচার হলে অন্যরা সতর্ক হবেন। তারা বুঝবেন, কাউকে হত্যা করলে পার পাওয়া যাবে না। আইনটির শুধু কঠোর প্রয়োগ প্রয়োজন। তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘ওই ভয়ঙ্কর দিনে তারেক, মিশুকসহ আরো যাদের আমরা হারিয়েছিলাম, পৃথিবীর কোনো আদালত আর তাদের ফিরিয়ে দিতে পারবে না। তবু তাদের অনুপস্থিতিতে এতগুলো বছর যে দুর্বিষহ যন্ত্রণা আমরা সয়েছি, এই রায় কিছুটা হলেও তার দায় মেটাল।’

কিন্তু সবকিছুই আজ ম্লান করে দিতে চাইছে কিছু শ্রমিক নেতা। তারা দেশকে জিম্মি করতে চাইছে। সম্প্রতি সড়ক পরিবহন আইনকে যুগোপযোগী করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় চালক দোষী প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের দাবি ওঠে। কেউ কেউ আবার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখারও দাবি জানান। কিন্তু পরিবহন শ্রমিক ও মালিকদের পক্ষ থেকে বরাবরই নতুন আইনে এ রকম বিধান না রাখার দাবি জানানো হয়েছে। সর্বশেষ আইনে পাঁচ থেকে তিন বছর পর্যন্ত চালকের শাস্তি বহাল আছে। যদিও কয়েক বছরেও আইনের চূড়ান্ত খসড়া সম্ভব হয়নি।

মানুষ এখন ক্রমশ ক্ষেপে উঠছে। ধর্মঘট অনতিবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি। তারা বলেছে, উচ্চ আদালতে যাওয়ার পরিবর্তে ডাকা এ পরিবহন ধর্মঘট পেশিশক্তি দেখানো হচ্ছে। জনগণকে জিম্মি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার একটি সুগভীর নীলনকশা উল্লেখ করে বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, সরকার যখন জনস্বার্থে তথা যাত্রীর স্বার্থে বা সড়ক নিরাপত্তার স্বার্থে কিছু ভালো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায় তখনই কিছু স্বার্থান্বেষী মালিক-শ্রমিক নেতারা এতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তারা ধর্মঘটের নামে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে সরকারের নেয়া সিদ্ধান্তগুলোর বাস্তবায়নের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। প্রকৃতপক্ষে তারা কি গাড়িচাপা দিয়ে মানুষ হত্যাকে বৈধতা দিতে চায়? এসব স্বার্থান্বেষীদের ষড়যন্ত্রে সড়ক নিরাপত্তা আজ চরমভাবে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। সড়কে মাছির মতো, পাখির মতো মানুষ মরছে। প্রত্যাশিত একের পর এক রায়গুলো সরকারের একটি সদিচ্ছার প্রতিফলন হলেও এ রায় তথা আদালতকে চ্যালেঞ্জ করে ডাকা পরিবহন ধর্মঘট বন্ধে সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

মানুষকে আজ ঘুরে দাঁড়াতে হবে। বিবেক জাগ্রত করতে হবে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো থেকে বিরত থাকতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চাপে রাখতে হবে- ফিটনেস নিয়ে যেন গাফিলতি না হয়। কাজটি সহজ নয়। কিন্তু তা করে যেতে হবে। না হলে এই খুনি যানবাহনকে রোধ করা যাবে না।

_________________________________
দৈনিক ভোরের কাগজ। ঢাকা। শনিবার, ৪ মার্চ ২০১৭

আত্মহত্যা, ইসলাম ও আই এস

মানুষ আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় এবং সেরা সৃষ্টি (ইসরা ১৭/৭০)। মানুষকে আল্লাহ ‘নিজের দু’হাত দ্বারা সৃষ্টি করেছেন’ (ছোয়াদ ৩৮/৭৫)। অতএব জীবন দানের মালিক যিনি, তিনিই কেবল জীবন নিতে পারেন। কেউ তাতে অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করলে সে মহাপাপী হবে এবং জাহান্নামী হবে। তাই তিনি মানুষকে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি অত্যন্ত দয়াশীল’ (নিসা ৪/২৯)। তিনি সাবধান করে বলেন, যদি কেউ সীমা লংঘন ও অত্যাচার বশে এ কাজ করে, তাহ’লে সত্বর আমরা তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব’ (নিসা ৪/৩০)। অতঃপর যদি কেউ আল্লাহ্র নিষেধাজ্ঞাকে সম্মান করে আত্মহত্যার মত কঠিন পাপ থেকে বিরত হয়, তার জন্য মহা পুরস্কার ঘোষণা করে আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা কবীরা গোনাহ সমূহ থেকে বিরত হও, যা থেকে তোমাদের নিষেধ করা হয়েছে, তাহ’লে আমরা তোমাদের পাপ সমূহ মার্জনা করব এবং তোমাদেরকে সম্মানজনক স্থানে প্রবেশ করাব’ (অর্থাৎ জান্নাত দান করব) (নিসা ৪/৩১)।

আত্মহত্যা মহাপাপ। এরপরেও মানুষ আত্মহত্যা করে। নিঃসন্দেহে সেটি করে যখন তার সামনে কোন উপায়ান্তর না থাকে। এরপরেও কোন মুমিন আত্মহত্যা করতে পারে না। কেননা এটা করলে সে ইহকাল ও পরকাল দু’টিই হারাবে। তাকে এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, উপায়-উপাদানের মালিক আল্লাহ। নিরুপায় মানুষ আল্লাহ্র উপর একান্ত ভরসা করে বৈধ পন্থায় চেষ্টা করে গেলে আল্লাহ অবশ্যই তার জন্য উত্তম পথ বের করে দিবেন। এ ব্যাপারে তিনি তার অনুগত বান্দাদের আশ্বস্ত করে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, তার জন্য তিনি উপায় বের করে দেন এবং তাকে এমন উৎস থেকে রূযী দেন, যা সে কল্পনাও করেনি’ (তালাক ৬৫/২-৩)। তিনি বলেন ‘যারা আমাদের পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, অবশ্যই আমরা তাদেরকে আমাদের পথসমূহে পরিচালিত করব। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সাথে থাকেন’ (আনকাবূত ২৯/৬৯)
(মাসিক আত-তহরীক থেকে সংগৃহিত)

সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! বর্তমানে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে চরমপন্থা একটি বড় ফিৎনা রূপে আবির্ভূত হয়েছে। কিছু পথভ্রষ্ট মুসলমান আত্মহত্যার মাধ্যমে ভীতি সঞ্চারকে বৈধ ও উত্তম কাজ মনে করছে এবং তরুণ ও যুবকদেরকে ভুলিয়ে এর ক্রীড়নকে পরিণত করছে। যখন তাদের পক্ষ থেকে চরমপন্থী কার্যক্রম পরিচালিত হয়, তখন তাদেরকে দমন করার নামে আমেরিকা ও ইউরোপের পক্ষ থেকে বৈশ্বিক সন্ত্রাস শুরু হয়ে যায়। যার দরুন সম্পদ ধ্বংস হয়, নিরপরাধ লোকজন মারা যায়, নিষ্পাপ শিশু, নারী ও বৃদ্ধরা বলির পাঠা হয়। উল্লিখিত দু’ধরনের চরমপন্থা ও সন্ত্রাস সম্পর্কে জাতিকে সতর্ক করা এখন সময়ের দাবী এবং ইমামদের দায়িত্ব। চরমপন্থা চরমপন্থাই, যা ইসলামে হারাম। অনুরূপভাবে আত্মহত্যাও হারাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

مَنْ تَرَدَّى مِنْ جَبَلٍ فَقَتَلَ نَفْسَهُ، فَهْوَ فِى نَارِ جَهَنَّمَ، يَتَرَدَّى فِيهِ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيهَا أَبَدًا، وَمَنْ تَحَسَّى سَمًّا فَقَتَلَ نَفْسَهُ، فَسَمُّهُ فِى يَدِهِ، يَتَحَسَّاهُ فِى نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيهَا أَبَدًا، وَمَنْ قَتَلَ نَفْسَهُ بِحَدِيدَةٍ ، فَحَدِيدَتُهُ فِى يَدِهِ، يَجَأُ بِهَا فِى بَطْنِهِ فِى نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيْهَا أَبَدًا-

‘যে ব্যক্তি কোন পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে সে জাহান্নামের আগুনে পুড়বে। আর চিরকাল সে জাহান্নামের ভিতর ঐভাবে লাফিয়ে পড়তে থাকবে। আর যে ব্যক্তি বিষপানে আত্মহত্যা করবে তার বিষ জাহান্নামে তার হাতে থাকবে। চিরকাল সে জাহান্নামের মধ্যে তা পান করতে থাকবে। আর যে লোহার আঘাতে আতমহত্যা করবে সে জাহান্নামে উক্ত অস্ত্র হাতে নিয়ে স্বীয় পেটে বিদ্ধ করতে থাকবে এবং চিরস্থায়ীভাবে তথায় থাকবে’।[4]

এই হাদীছ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আত্মঘাতী হামলা হারাম। আত্মহত্যাকারী জাহান্নামে থাকবে। এভাবে তার কর্মকান্ড ভয়-ভীতি সৃষ্টিকারী এবং রক্তারক্তি ছাড়া কিছুই নয়। ভীতি সঞ্চারের মাধ্যমে অন্যায়ভাবে কারো রক্ত ঝরানোও হারাম। যেমন আল্লাহ তা‘আলার বাণী,مَنْ قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الْأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعًا وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَا أَحْيَا النَّاسَ جَمِيعًا ‘যে কেউ জীবনের বদলে জীবন অথবা জনপদে অনর্থ সৃষ্টি করা ব্যতীত কাউকে হত্যা করে, সে যেন সকল মানুষকে হত্যা করে। আর যে ব্যক্তি কারো জীবন রক্ষা করে, সে যেন সকল মানুষের জীবন রক্ষা করে’ (মায়েদাহ ৫/৩২)। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ دِمَاءَكُمْ وَأَمْوَالَكُمْ حَرَامٌ عَلَيْكُمْ كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا فِى شَهْرِكُمْ هَذَا فِى بَلَدِكُمْ هَذَا ‘নিশ্চয়ই তোমাদের রক্ত ও সম্পদ তোমাদের জন্য হারাম। যেমন এই (আরাফার) দিন, এই মাস (যিলহজ্জ) ও এই শহর (মক্কা) তোমাদের জন্য হারাম’।[5] মুসলমানের রক্ত যেমন সম্মানিত, তেমনি তার সম্পদও সম্মানিত। আত্মঘাতী হামলা ও বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে ধ্বংসলীলা চালানো অবৈধ ও হারাম।

সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! আজ ‘আইএস’-এর মাধ্যমে ইসলামিক স্টেট কায়েম করার ছুতোয় চরমপন্থী কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। মানুষের সামনে তাদের স্বরূপ তুলে ধরা আলেম, মসজিদের ইমাম ও খতীবদের মৌলিক দায়িত্ব। কেননা অনেক মুসলমান পদভ্রষ্ট হয়ে তাদের দলে চলে যাচ্ছে এবং ইসলামের বদনামের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এমতপরিস্থিতিতে জুম‘আর খুৎবা, ওয়ায-নছীহত এবং সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের মাধ্যমে লোকদেরকে সচেতন করা যরূরী। নতুবা আল-কায়েদার বাহানায় একবার ইরাক ও আফগানিস্তান ধ্বংস হয়েছে। আর এখন ‘আইএস’-এর বাহানায় মুসলিম বিশ্ব বরবাদ হবে।

আসলে ‘আইএস’ একটা খারেজী ও ইহূদী সংগঠন। যার প্রতিষ্ঠাতা ইহূদী বংশোদ্ভূত আবুবকর বাগদাদী। যিনি স্বীয় নাম ইলিয়ট শামউন পরিবর্তন করে আবুবকর বাগদাদী রেখেছেন এবং নিজেকে ‘আমীরুল মুমিনীন’ আখ্যা দিয়েছেন। আর নির্দ্বিধায় মানুষ হত্যা শুরু করে দিয়েছেন। যার কারণে তার বর্বর খুনোখুনি যেন চিৎকার দিয়ে বলছে যে, ইসলামের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা তো মানবতাকে ধ্বংস করার জন্য এসেছি। আর যদি সে ইহূদী না হয়ে থাকে তাহ’লে খারেজী সম্প্রদায়ের সরদার। যে ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন يَمْرُقُونَ مِنَ الدِّينِ مُرُوقَ السَّهْمِ مِنَ الرَّمِيَّةِ ‘তারা দ্বীন থেকে এমনভাবে বের হয়ে যাবে যেমন তীর শিকার ভেদ করে বেরিয়ে যায়’।[6]

তারা আকার-আকৃতিতে মুসলমান মনে হবে, ছালাত আদায় করবে, কুরআন তেলাওয়াত করবে। কিন্তু তাদের অবস্থা এমন হবে যে, তারা পৃথিবীতে সবচেয়ে নিকৃষ্ট সৃষ্টি হবে। যাই হোক না কেন, তাদের ভয়াবহতা সম্পর্কে জাতি ও দেশবাসীকে অবহিত করা এখন সময়ের অনিবার্য দাবী। আর এ কাজ ইমাম ও আলেমগণ যেভাবে করতে পারবেন, অন্য কেউ তা করতে পারবে না। এজন্য লেখনী, আলোচনা, খুৎবা, সাংবাদিকতা এবং অন্যান্য মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষজনকে বলতে হবে যে, ইসলাম এই ধরনের ভীতিকর ও চরমপন্থী কার্যক্রমকে আগাগোড়াই অপসন্দ করে এবং মুসলমানদেরকে তা থেকে বিরত থাকার শিক্ষা দেয়।

———+——–++-

বর্তমান পরিস্থিতিতে ইমামদের দায়িত্ব ও কর্তব্য

মূল (উর্দূ) : ড. রহমাতুল্লাহ সালাফী
কাঠিহার, বিহার, ভারত।
অনুবাদ : তানযীলুর রহমান
শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।

[সৌজন্যে : পাক্ষিক তারজুমান, দিল্লী, ৩৬ বর্ষ, ২১তম সংখ্যা, ১-১৫ই নভেম্বর ২০১৬, পৃঃ ১৪-১৭

[1]. বুখারী হা/৭২৫৭; মুসলিম হা/১৮৪০।
[2]. বুখারী হা/৮৯৩।
[3]. বুখারী হা/৩৬৭৩।
[4]. বুখারী হা/৫৭৭৮।
[5]. মুসলিম হা/১২১৮।
[6]. বুখারী হা/৩৩৪৪।

গভীরে যে ভাঙন চলছে তা রোধ করার উপায় কি?

একজন দাগী অপরাধী কিংবা একজন কুষ্ঠরোগী, যাকে সমাজের সবাই ঘৃণা করে বা দূরে থাকতে চায়, তারও একটি আশ্রয় থাকে। সেই আশ্রয়ের নামই পরিবার। অথচ মানবসভ্যতার আজকের এই পর্যায়ে এসে আমরা প্রত্যক্ষ করছি এমন বিস্ময়কর সব ঘটনা যা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়।

প্রতিদিনের পত্রিকার পাতা খুললেই সংবাদ পাই, সদ্যজাত সন্তানকে মা পলিথিনে মুড়িয়ে ডাস্টবিন বা নর্দমায় ফেলে রেখে যাচ্ছেন কিংবা ছাদ থেকে ছুড়ে মারছে। শিশুটির মৃত্যু হওয়ার আগেই কুকুর-বেড়াল তার হাত-পা খুবলে খেতে শুরু করছে। বাবা সন্তানকে হত্যা করছে, কুপিয়ে, বিষ খাইয়ে, শ্বাসরোধ করে ইত্যাদি নানা উপায়ে। কখনো আবার সন্তানদের হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যা করছে। ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রীর খুনোখুনিতো একেবারে সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এ কোন সমাজরে ভাই?

যারা গভীরভাবে ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করবেন তারা আতঙ্কিত না হয়ে পারবেন না। এটা সুস্থ মানবসমাজের চিত্র হতে পারে না। এমনকি পশুদের সমাজেও এটা অতি বিরল ঘটনা যে মা-বাবা শিশু শাবককে হত্যা করছে।

জরবাদী, ভোগনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন দুইয়ে মিলে মানুষকে এতটাই লোভী, স্বার্থ পর, আত্মকেন্দ্রিক করে তুলেছে যে, ব্যক্তিগত সুখ-সম্ভোগের জন্য রাষ্ট্র কিংবা সমাজের স্বার্থ তো দূরের কথা মানুষ তার পরিবারের স্বার্থও ভুলতে শুরু করেছে। অন্যদিকে অন্যায় ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, জীবনের নির্মম বাস্তবতা তাকে হতাশ, অস্থির, অসামাল করে তুলছে। ফলে সে জিঘাংসা আর ক্রোধের বশবর্তী হয়ে নিজ সন্তানের মাথায় বাড়ি দিতে যেমন দ্বিধা করছে না, নিজের গলায় দড়ি নিতেও দ্বিতীয়বার ভেবে দেখছে না। একেবারে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা।

পাশ্চাত্যের অনুকরণে আমরা বিশ্বাস করছি যে, বস্তুগত এই উন্নতিই আমাদের সকল সুখের আধার। আমাদের সরকার রাস্তাঘাট খুরতে খুরতে একাকার করে ফেলছে। আমাদের বাচ্চাগুলো পড়তে পড়তে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে। আমাদের মায়েরা বাচ্চার স্কুলের গেটের বাইরে বেঞ্চে বসে থেকে মাজা ব্যথা করে ফেলছে। কিন্তু এই ‘উন্নতি’র দৌড় যে মাকাল ফলের মতো প্রতারণায় পূর্ণ তা কে বুঝবে? আমাদের হাজার বছরের বিশ্বাসভিত্তিক জীবনাচরণ, আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের ধর্মভিত্তিক নীতি-নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে কেবল বস্তুগত উন্নতি আমাদের সুখ দিতে পারবে না। তা তাদের মতো কেবল উপভোগ করতেই শেখাবে, সুখী হতে নয়।

হাস্যকর লাগে যখন দেখি আজও আমাদের বুদ্ধিজীবী, সমাজচিন্তকরা সেই প্রভু পশ্চিমা পণ্ডিতদের অমুক অমুক বইয়ের উদ্ ধৃতি দিয়েই এই সংকটের সমাধান দিচ্ছেন। আর দুঃখ লাগে যখন আমাদের সরকারের মন্ত্রীরা বলেন, পরিস্থিতি খুব খারাপ। নতুন আইনের কথা চিন্তা করা হচ্ছে। তারা সমাজের অবক্ষয় রোধ করবেন আইন দিয়ে! সুস্থ মানুষ এমনটা ভাবে কিভাবে? কথিত বুদ্ধিজীবী আর শাসকদের এই অন্ধত্ব আর মানসিক দাসত্ব যতদিন না ঘুচবে কোনভাবেই পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব নয়।

ধর্ম সংক্রান্ত সংকট থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হবে!

(গত ফেব্রুয়ারী ২৮, ২০১৭ইং তারিখে “ধর্ম সংক্রান্ত সংকট থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হবে” এই শিরোনামে একটি লেখা লিখেছিলাম অনেকেই মন্তব্য করেছে যে লেখাটি অতি সংক্ষিপ্ত বা সারসংক্ষেপ হয়েছে ও লেখাটি আরও বিস্তারিত হওয়া দরকার। মন্তব্যর পরিপেক্ষিতে বিস্তারিত লেখার চেষ্টা করলাম।)

বর্তমান সময়ে চলমান মহাসংকটের পরিধিকে একত্রে চিন্তা করতে গেলে কোনো বিবেকবান চিন্তাশীল মানুষ স্থির থাকতে পারে না। মানবজাতি তার ভিতরে, আত্মিকভাবে দেউলিয়া, বাইরে সর্বপ্রকার বিপর্যয়ের শিকার। কারো কোনো নিরাপত্তা নেই, চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য বিরাজ করছে, শোষণমূলক পুঁজিবাদ মাত্র আটজন ব্যক্তির হাতে পৃথিবীর অর্ধেক জনগোষ্ঠীর সম্পদ তুলে দিয়েছে, দুর্বৃত্তরা সম্মানের আসন পাচ্ছে, শিক্ষক ছাত্রের হাতে মার খাচ্ছে, সৎ ব্যক্তি জীবনমানের ঊর্ধ্বশ্বাস দৌড়ে সর্বত্র পিছিয়ে পড়ছে। সমস্ত দুনিয়াটা যেন এক নরককুপে পরিণত হয়েছে।

পৃথিবীর চারদিক থেকে আর্ত মানুষের হাহাকার উঠছে- শান্তি চাই, শান্তি চাই। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচারে, দরিদ্রের ওপর ধনীর বঞ্চনায়, শোষণে, শাসিতের ওপর শাসকের অবিচারে, ন্যায়ের ওপর অন্যায়ের বিজয়ে, সরলের ওপর ধুর্তের বঞ্চনায়, পৃথিবী আজ মানুষের বাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। নিরপরাধ ও শিশুর রক্তে আজ পৃথিবীর মাটি ভেজা। পরিসংখ্যান বলছে, পৃথিবীর প্রতিটি দেশে খুন, হত্যা, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, ধর্ষণ ইত্যাদি সর্বরকম অপরাধ প্রতি বছর বেড়ে চলেছে ববং বেড়ে চলেছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এর শেষ কোথায়? এর পরিণতি চিন্তা করে সুস্থমস্তিষ্ক মানুষ আজ দিশাহারা। এর ওপর আবার ভয়াবহ বিপদ দাঁড়িয়েছে পারমাণবিক অস্ত্রের যা যে কোনো মুহূর্তে সমস্ত মানবজাতিসহ পৃথিবী গ্রহটাকেই ভেঙে ফেলতে সক্ষম।

আমাদেরকে যেমন মানবজাতি সম্পর্কে চিন্তা করতে হবে তেমনি বাঙালি জাতিকে নিয়েও চিন্তা করতে হবে, মুসলমান সম্প্রদায়কে নিয়েও চিন্তা করতে হবে। বাংলাদেশের বাসিন্দাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার বড় কারণ হচ্ছে এ দেশের ৯০% জনগণ ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান আর পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো চলমান সভ্যতার সংঘাতে একটার পর একটা মুসলিমপ্রধান দেশ ধ্বংস করছে, দখল করে নিচ্ছে, তাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করছে, কোটি কোটি জনগণকে উদ্বাস্তু করছে। বাংলাদেশকেও যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করার অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলমান আছে বলে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীসহ অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তি বারংবার উল্লেখ করেছেন।

বর্তমানে বিশ্বে ধর্ম প্রধান ইস্যু, ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলো ধর্মবিশ্বাস ও ইসলাম-বিদ্বেষকে রাজনৈতিক ট্রাম্প কার্ড হিসাবে ব্যবহার করছে। এই ধর্ম সংক্রান্ত সংকট থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হলে ধর্ম নিয়ে এখন সবাইকে কথা বলতে হবে, নইলে দেশ রক্ষা করাই মুশকিল হয়ে যাবে।

ইউরোপের রেনেসাঁ ও বর্তমান সংকট:

আমরা যদি অতীতের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করি দেখতে পাব যে, ঠিক এমনই সঙ্কটময় কালে ইউরোপে রেনেসাঁর সূত্রপাত হয়েছিল, যে সময়টিকে আমরা মধ্যযুগীয় বর্বরতার সময় বলে আখ্যায়িত করি। সেখানে ধর্মযাজক ও রাজতন্ত্রের যৌথশাসন মানুষের জন্য শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। ধর্মের নামে যাবতীয় অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক চিন্তা, কূপমন্ডকতা, অন্ধত্বের প্রসার চূড়ান্তরূপ ধারণ করেছিল। কোনো চিন্তাশীল মানুষ, দার্শনিক, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী বা যে কোনো পরিবর্তনকামী মানুষ গির্জার অনাচারের বিরুদ্ধে টু শব্দ করলেই তাকে পুড়িয়ে মারা হতো, শূলে চড়ানো হতো, গিলোটিনে শিরচ্ছেদ করা হতো, ফুটন্ত তেলের পাত্রে ফেলে দেওয়া হতো। ধর্মের নামে পৈশাচিক বর্বরতা ও অভিজাত শ্রেণির শোষণ থেকে মুক্তির জন্য পথের সন্ধান করতে লাগল মানুষ। তারা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ধারণা উদ্ভাবন করলেন। প্রস্তাব করলেন শোষণমুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। শিল্পীরা তাদের ছবি ও ভাস্কর্যের মধ্যে এমন বিস্ময়কর মেধার প্রতিফলন ঘটালেন যা শত শত বছর পরেও গবেষণার বস্তু হয়ে আছে। নাট্যকারেরা অচলায়তন ভাঙার নাটক লিখলেন, সাহিত্যিকরা লিখলেন কবিতা, উপন্যাস। সবকিছুর উদ্দেশ্য ছিল একমুখী – এমন একটি সমাজ গড়ে তোলা যেখানে মানুষ কেবল পরকালের সুখের প্রলোভনে পৃথিবীতে অবর্ণনীয় দুঃখ সহ্য করবে না বরং পার্থিব জীবনেই স্বর্গসম শান্তিময়, নিরাপদ জীবন যাপন করবে, বাকস্বাধীনতাসহ সকল মানবাধিকার পূর্ণরূপে উপভোগ করবে। রেনেসাঁর একটি অর্থ হচ্ছে পুনর্জন্ম। রেনেসাঁ মধ্যযুগীয় বর্বরতার মহাশ্বশ্বানে নতুন ফুল ও ফসলের আগমনী গান শোনালো। উদারনৈতিক গণতন্ত্র, সাম্যবাদসহ বিভিন্ন মতবাদের জন্ম হল, সমাজ ব্যবস্থায় ভাঙাগড়া চলতে লাগল। সেই ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল সমগ্র পৃথিবীতে এমনকি আমাদের এখানেও। কিন্তু পরিণামে আমরা কী দেখতে পেলাম? আমরা অনেক প্রযুক্তি পেলাম, বস্তুগত অগ্রগতি পেলাম কিন্তু শান্তি পেলাম না। মানুষ ভেবেছিল এমন একটি পৃথিবী পাবে যেখানে শাসনব্যবস্থায় তার অংশগ্রহণ থাকবে, মন খুলে কথা বলতে পারবে, তার পরিপূর্ণ ব্যক্তিস্বাধীনতা থাকবে। অথচ বাস্তবে কী দেখছি? সেই দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার, দরিদ্রের উপর ধনীর বঞ্চনা। যেভাবে আজ আকাশ থেকে বোমা ফেলে, মিসাইল ছুঁড়ে ইরাকসহ একটার পর একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রকে নানা প্রকার অজুহাত দাঁড় করিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে তাতে ব্যক্তি স্বাধীনতা দূরের কথা, দেশ রক্ষার ক্ষেত্রে কোনো রাষ্ট্রের সীমানারও বিশেষ কোনো তাৎপর্য আর থাকে না। কেবল চোরাকারবারীদের মাদকদ্রব্য, গরু ইত্যাদি পাচার নিয়ন্ত্রণ এবং অবৈধ অভিবাসী আখ্যা পাওয়া উদ্বাস্তু অসহায় জনতাকে বাধা দেওয়ার কাজে সীমান্ত কাঁটাতার ব্যবহৃত হচ্ছে। রেনেসাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত সভ্যরাষ্ট্রগুলো সম্মিলিতভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোটি কোটি মানুষ হত্যা করার মধ্য দিয়ে যে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়েছে সেটার পর যে স্বপ্ন নিয়ে বস্তুবাদী দর্শনের রেনেসাঁ ঘটেছিল সেই স্বপ্ন ধূলায় মিশে যায়। তখন থেকে আর কোনো মানবতাবাদী শান্তিদায়ক আদর্শ পৃথিবীতে আধিপত্য করছে না, তখন থেকে চলছে জবরদস্তিমূলক শাসন, পারমাণবিক অস্ত্রের শাসন।

জঙ্গিবাদ ইস্যুটি একটি অতি কার্যকর পন্থা যাকে দক্ষতার সাথে ব্যবহার করে যুদ্ধক্ষেত্র তথা অস্ত্রের বাজার সম্প্রসারণ করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়ার মতো রাষ্ট্রগুলো। জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে তারাই কয়েকটি ধর্মব্যবসায়ী আরব রাষ্ট্রের সহযোগিতায় প্রয়োজনীয় শত্রুরূপে সৃষ্টি করছে।

জেহাদ-কেতাল, উন্মাদনা ও জঙ্গিবাদ

অনেকেই জঙ্গিবাদের উৎপত্তির দায় কোর’আনের উপর চাপাতে ব্যস্ত থাকেন। অথচ জেহাদ আর সন্ত্রাস কখনও এক নয়। প্রতিটি মানুষকে এখন এই ফারাক বুঝতে হবে যেন কেউ কোর’আন দেখিয়ে জেহাদের কথা বলে কাউকে সন্ত্রাসে লিপ্ত করতে না পারে। একইভাবে ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকে উস্কানি দিয়ে ক্ষেপিয়ে তুলে দাঙ্গা পরিস্থিতি (গড়ন) সৃষ্টি করা, অপর কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উপর ধর্মীয় নৃশংসতায় হামলা চালানো আর ইসলামের জেহাদ-কেতাল এক বিষয় নয়, এদের মধ্যে সামান্যতম সংশ্লিষ্টতাও নেই।

কেবল মানুষের অজ্ঞতাকে পুঁজি করেই ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী দুর্বলের উপর ফতোয়াবাজি করে উশৃঙ্খল জনতাকে ‘তওহীদী জনতা’ আখ্যা দিয়ে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হামলা চালায়। আবার ভিন্নমতের মানুষকে গুপ্তহত্যা করারও কোনো বৈধতা আল্লাহ-রসুলের ইসলাম দেয় না। তবু জেহাদের নাম দিয়ে সেটা বেশ জোরেসোরেই চালিয়ে যাচ্ছে কিছু গোষ্ঠী। ধর্মের নামে চলা এসব ভয়ঙ্কর অপকর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে মানুষের মনকে দিন দিন বিষিয়ে তুলছে, মুসলিমদেরকে ঘৃণার পাত্রে পরিণত করছে। আমরা অকাট্য যুক্তি, দলিল ও প্রমাণসহকারে এসবের বিরুদ্ধে আদর্শিক লড়াই করে যাচ্ছি, যেন এসব ভ্রান্ত ব্যাখ্যার বিষয়ে এ দেশের আপামর ধর্মবিশ্বাসী জনগোষ্ঠী সোচ্চার হয়। আমরা দ্ব্যার্থহীন ভাষায় বলছি, এগুলো একটাও ইসলাম নয়।

হুজুগনির্ভর ধর্মোন্মাদনা ইসলামে নেই:

এটা সরল সত্য যে গুজব বা হুজুগ কখনওই কোনো শুভফল বয়ে আনতে পারে না। বরং এ দুটোকে ব্যবহার করে সর্বযুগে রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিল করে কিছু মহল। ভাবতে অবাক লাগে মুসলমানেরা কী করে হুজুগ আর গুজবে অভ্যস্ত হয়ে উঠলো! একটা গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় আর মুহূর্তের মধ্যে হাজার হাজার মানুষ হৈ হৈ রৈ রৈ করে ধ্বংসাত্মক ও সহিংস কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। এতে বদনাম হয় ধর্মের, অবমাননা হয় আল্লাহর, রসুলের। শোনা কথায় কান দিয়ে আকস্মিক আবেগের বশে কোনো কাজ করা আল্লাহর সরাসরি নিষেধ, ইসলাম এর ন্যূনতম সম্ভাবনাকেও প্রশ্রয় দেয় না বরং নির্মূল করে দেয়। উড়ো কথা প্রচার করা বা কারো উপর অপবাদ আরোপ করা ইসলামের দৃষ্টিতে দ-নীয় অপরাধ।

রসুলাল্লাহর জীবনে এমন একটি ঘটনাও নেই যেখানে সাহাবীরা গুজবে মেতে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ক্ষতিসাধন করেছেন। তিনি দাঙ্গাবাজ ছিলেন না, তিনি ছিলেন যোদ্ধা। তিনি চিরকাল নিজের সেনাবাহিনীর চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন আর দুর্বল শত্রুকে ক্ষমা করেছেন, এটাই তাঁর জীবনে আমরা বার বার দেখতে পাই। এটাই হচ্ছে বীরত্বের নিদর্শন। বীর যুদ্ধ করে, কাপুরুষ দাঙ্গা করে।

ফতোয়াবাজ কথিত আলেমরা আজ হিন্দুর বিরুদ্ধে, কাল কাদিয়ানীর বিরুদ্ধে, পরশু অমুক ব্যক্তির বিরুদ্ধে নাস্তিকতা বা কাফের-মুরতাদ ফতোয়া দিয়ে গলা ফাটিয়ে ওয়াজ করে একটি উত্তেজনা সৃষ্টি করে দেন। ফলে কোনো সংখ্যালঘু দুর্বল শ্রেণি ধর্মোন্মাদ তওহীদী জনতার রোষাণলে ভস্মীভূত হয়ে যায়। বিগত সময়ে কত মানুষকে তারা হত্যা করেছে, কত মানুষের বাড়িঘর তারা জ্বালিয়ে দিয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এটাই হচ্ছে ফিতনা। যখন এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটে তখন তা চলে যায় স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর হাতে। তারা এটা নিয়ে নোংরা রাজনীতির খেলায় মেতে ওঠে।

এই ফেতনা সৃষ্টিকারীদের পরিণতি কী হবে?

আল্লাহর রসুল এ কথাটিও সুস্পষ্টভাবে বলে গেছেন যে তাঁর উম্মাহর মধ্যে কারা ফেতনা সৃষ্টি করবে। তিনি বলেছেন, এমন সময় আসবে যখন- (১) ইসলাম শুধু নাম থাকবে, (২) কোর’আন শুধু অক্ষর থাকবে, (৩) মসজিদসমূহ জাঁকজমকপূর্ণ ও লোকে লোকারণ্য হবে কিন্তু সেখানে হেদায়াহ থাকবে না, (৪) আমার উম্মাহর আলেমরা হবে আসমানের নিচে সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব, (৫) তাদের তৈরি ফেতনা তাদের ওপর পতিত হবে। [আলী (রা.) থেকে বায়হাকী, মেশকাত]
যারা ধর্মের শিক্ষা দিয়ে, ধর্মের কাজ করে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করে, ধর্মকে জীবিকার হাতিয়ারে পরিণত করে তারা সমাজে প্রচলিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যভাষণের শক্তি ও যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। সে যখন একজন অসাধু ব্যক্তির থেকে সুবিধা গ্রহণ করে তখন তার মস্তক সেই টাকার কাছে বিকিয়ে যায়, সেই সাথে ধর্মও বিক্রি হয়ে যায়।

সুতরাং এখনও সময় আছে ধর্মব্যবসায়ীদের হাত থেকে ধর্মানুভূতির নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে নিতে হবে, মানুষকে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা দিতে হবে যেন তারা আর কারো দ্বারা প্রতারিত না হয়। এই ক্ষেত্রটিতে গণমাধ্যমগুলোর কার্যকর ভূমিকা নেওয়া অপরিহার্য বলে আমরা অনুভব করি। কিন্তু আমাদের কথা হচ্ছে ধর্মের বিরোধিতা করে, ধর্মবিদ্বেষ প্রচার করে এই সন্ত্রাসকে রোখা যাবে না। ধর্মীয় দলিল দিয়ে করতে হবে, ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা তুলে ধরার মাধ্যমেই বিকৃত শিক্ষার অপনোদন অপসারণ করতে হবে। আল্লাহর দয়ায় সেই আদর্শ আমরা লাভ করেছি এবং সেটা প্রচারের মাধ্যমে ইসলামের নামে প্রচলিত ভ্রান্তি নিরসনের চেষ্টা করছি।

আমরা সকল অধর্মের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, সন্ত্রাস জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে, কূপমন্ডকতকার বিরুদ্ধে যে মহাজাগরণ সৃষ্টির চেষ্টা করছি, সেই রেনেসাঁ ঘটানোর সংগ্রামে আপনারা যারা সমাজ পরিবর্তনের জন্য ব্লগে লেখালেখি করছেন তাদেরকে আমাদের সাথে চাই। আমরা বিশ্বাস করি, সেটা আপনারাই আপনাদের লেখুনির মাধ্যমে ঘটাবেন। আমরা মাঠের মানুষ, মাঠে কাজ করছি। আপনারা যে দায়িত্বশীল অবস্থানে আছেন সেখান থেকেই এ লড়াইতে আমাদের সহযোগিতা করবেন বলে আশা করি। নব্বই দশকে আফগানিস্তান যুদ্ধপরবর্তী সময়ে আমাদের দেশেও একটি শ্লোগান বারবার শোনা গেছে যে, “আমরা হবো তালেবান, বাংলা হবে আফগান”। নানা কারণে এ জাতীয় শ্লোগান এখন আর রাজপথে দেওয়া না হলেও সেই চেতনা কিন্তু অদৃশ্য হয়ে যায় নি, বরং বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, প্রসারিত হয়েছে। আমরা হেযবুত তওহীদ তালেবান হতে চাই না, বাংলাকেও আফগান বানাতে চাই না। আমরা জানি আফগান এখন বোমায় চষা জমি, পুরো দেশটা একটি বৃহৎ গণকবরের রূপ নিয়েছে। তাদের দেশের লক্ষ লক্ষ শিশু প্রতিবন্ধী হয়েছে, লক্ষ লক্ষ নারী ধর্ষিতা হয়েছে, তালেবানরা তাদের রক্ষা করতে পারে নি। আমরা নিয়তিবাদী নই, আমরা বিশ্বাস করি মানুষ যতটুকু চেষ্টা করে ততটুকুই সে ফল লাভ করে। এজন্য আমাদের এখন সম্মিলিতভাবে জাতির অবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টা চালাতে হবে। এটা পরিবর্তনের সময়, এটা মহাকালের যুগসন্ধিক্ষণ।

বাংলাদেশের মানুষ ও পদ্মাসেতু

পদ্মাসেতু হচ্ছে, কাজ এগিয়ে চলেছে। হ্যাঁ, সবকিছু ঠিক থাকলে এই প্রকল্প সময় মতোই শেষ হবে। কানাডার আদালতে প্রমাণিত হয়েছে, এ নিয়ে বাংলাদেশ কোনো দুর্নীতি করেনি। টরন্টোর এক আদালত বিষয়টি খোলাসা করেছে। কানাডার মন্ট্রিলভিত্তিক প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের সাবেক তিন কর্মকর্তাকে নির্দোষ রায় দিয়ে খালাস দিয়েছেন ওই আদালত।

এই রায়ের ফলে জিতেছেন বাংলাদেশের মানুষ। জিতেছে বাংলাদেশ। পদ্মাসেতু প্রকল্পে যে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনেছিল বিশ্বব্যাংক, তা থেকে বাংলাদেশ রেহাই পেয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেওয়ার কথা ছিল বিশ্বব্যাংকের। কিন্তু দুর্নীতির চেষ্টার অভিযোগ এনে ২০১২ সালে এ প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায় বিশ্বব্যাংক। অভিযোগ ছিল, কানাডীয় কোম্পানি এসএনসি-লাভালিনকে কাজ পাইয়ে দিতে দুর্নীতির চেষ্টা হচ্ছে। এতে সরকারি, বেসরকারি কর্মকর্তা ও এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তারা জড়িত। ওই সময় রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশকে (আরসিএমপি) এই খবর জানিয়েছিল বিশ্বব্যাংকের ইন্টিগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্সি (আইএনটি) বিভাগ। এ নিয়ে কানাডার আদালতে মামলা হয়। এই মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন এসএনসি-লাভালিনের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস, প্রতিষ্ঠানটির আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ শাহ ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডীয় ব্যবসায়ী জুলফিকার আলী ভূঁইয়া।

এই ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই রায়ের পর প্রতিক্রিয়ায় তিনি মিডিয়াকে বলেছেন, ‘কানাডার আদালতের এই রায় প্রমাণ করে, পদ্মাসেতু নিয়ে আমাকে জড়িয়ে বিশ্বব্যাংক যে অভিযোগ করেছে, তা সর্বৈব মিথ্যা।’

পদ্মাসেতু দুর্নীতির মামলায় সাবেক সেতুসচিব ও বর্তমান শিল্পসচিব মো. মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়াকে সেই সময় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে তিনি জামিন পান। তিনি বলেছেন, ‘এখন অনেকে আমাকে প্রশ্ন করেছে, বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে কিছু করবো কি না। আমি মনে করি সেটার আর প্রয়োজন হবে না। কারণ বিশ্বব্যাংকের শিক্ষা অনেক আগেই হয়ে গেছে। পদ্মাসেতু প্রকল্পে না থাকতে পারাটা তাদের জন্য বিরাট ক্ষতি, এটা তারা স্বীকারও করেছে। এ জন্য ওই সময়ে থাকা অনেকের চাকরিও গেছে।’

পুরো ঘটনার কড়া সমালোচনা করেছেন সজীব ওয়াজেদ জয়। ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি বিশ্বব্যাংক, সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইউনূসের কড়া সমালোচনা করেছেন। এই প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছিল বলে যেসব সমালোচনাকারী সরব হয়েছিলেন, তাদের ক্ষমা চাওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন জয়। তিনি আরো লিখেছেন, ‘বিশ্বব্যাংক মনগড়া প্রমাণ হাজির করেছিল। আমি নিজে এসব প্রমাণপত্র দেখেছি। এগুলো একেবারে বানানো। কোনো কিছুরই বিশদ প্রমাণ নেই। একটা অজানা সূত্রের কথা বলা হয়েছিল। যার নাম কখনো প্রকাশ পায়নি। এমনকি কানাডার আদালতও তা খুঁজে পাননি।’
সজীব ওয়াজেদ জয় মোটেও বাড়িয়ে বলেননি। এই ঘটনার মাধ্যমে গোটা বাংলাদেশের মানুষকে ছোট করা হয়েছিল। হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছিল। কারা করেছিল এটা? কী মতলব ছিল এর নেপথ্যে? দেশি-বিদেশি মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদগুলো থেকে আমরা জানছি- কানাডার সুপেরিয়র কোর্ট জাস্টিস ইয়ান নর্ডেইমারের সামনে ফেডারেল ক্রাউন এটর্নি তানিত গিলিয়াম বলেন, তিনি আর কোনো তথ্যপ্রমাণ চাইবেন না। একই সঙ্গে তিনি বিচারকের কাছে এসএনসি লাভালিনের ওই তিন কর্মকর্তাকে খালাস দেওয়ার আবেদন করেন। তিনি আদালতে স্বীকার করেন, ‘ওয়্যাটেপ’ প্রমাণ ছাড়া তার কাছে আর কোনো প্রমাণ নেই, যার ভিত্তিতে ওই ব্যক্তিদের যৌক্তিকভাবে অভিযুক্ত করা যায়। ইয়ান নর্ডেইমার এর আগে রায় দিয়েছিলেন, আরসিএমপির এক কর্মকর্তা অভিযুক্ত ওইসব ব্যক্তির ব্যক্তিগত যোগাযোগ বা কথোপকথনে আড়ি পেতে পাওয়া যে তথ্য হাজির করেছেন তার যথার্থ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাই ফোনে আড়ি পেতে পাওয়া তথ্যপ্রমাণ নাকচ করে দেন আদালত। একই সঙ্গে আরসিএমপির তদন্তের সমালোচনা করা হয়। বিচারক ইয়ান নর্ডেইমার তার দেওয়া রায়ে লিখেছেন, ‘ইনফরমেশন টু অবটেইন (আইটিও)তে পাওয়া যেসব তথ্য হাজির করা হয়েছে তা আন্দাজ (স্পেকুলেশন), পরচর্চা (গসিপ) ও গুজব (রিউমার) ছাড়া কিছু নয়। সরাসরি বাস্তবসম্মত প্রমাণ উপস্থানে কিছুই করা হয়নি, যা দিয়ে ওইসব রিউমার ও স্পেকুলেশনকে সমর্থন করা যায়।’

আমরা ভুলে যাইনি পদ্মাসেতুতে এই দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক তার অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছিল। বলা হয়েছিল ২৯০ কোটি ডলারের পদ্মাসেতু প্রকল্পের কাজ এসএনসি-লাভালিনকে পাইয়ে দিতে এ সংস্থার ওই তিন কর্মকর্তা বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের ঘুষ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এ অভিযোগে বিশ্বব্যাংক পদ্মাসেতু প্রকল্প থেকে পিছিয়ে পড়ে। ওই প্রকল্পে বাংলাদেশ সরকার ৫ কোটি ডলারের নির্মাণ সুপারিভিশন কন্ট্রাক্ট করার জন্য কোম্পানি খুঁজছিল। পদ্মাসেতু প্রকল্পে প্রাথমিক ঋণদাতা হিসেবে এগিয়ে এসেছিল বিশ্বব্যাংক। কিন্তু সবই এলোমেলো হয়ে যায় ওই কথিত দুর্নীতির খবরে।

আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যারা এই দানবীয় ষড়যন্ত্র করেছিল- তারা কি পেরেছে পদ্মাসেতু ঠেকাতে? না, পারেনি। প্রথম থেকেই বাংলাদেশ সরকার দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আসছিল। ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংকের সরে দাঁড়ানোর চূড়ান্ত ঘোষণার একদিন আগেই নিজস্ব অর্থায়নে এই পদ্মাসেতু নির্মাণের ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ সরকার। নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মাসেতু হচ্ছে। ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকার এ প্রকল্পে এই পর্যন্ত ৪০ শতাংশের মতো বাস্তবায়িত হয়েছে।
আমাদের মনে আছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুব স্পষ্ট করে বলেছিলেন- ভিক্ষা চেয়ে নয়, হাত পেতে নয়, বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু তৈরি করছে। তিনি জোর দিয়েই বলেছিলেন- ‘বাংলাদেশ পারবে। আমি বিশ্বাস করি। লাখো শহীদ রক্ত দিয়ে এ দেশ স্বাধীন করেছে। এখন এ স্বাধীন দেশের মানুষই পদ্মাসেতু নির্মাণ করবে। শত বাধার মুখেও বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে, তারা পারে। অনেক ঝড়-ঝাপ্টা-চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আমরা পদ্মাসেতু নির্মাণ কাজ শুরু করেছি। অনেক বাধার পর আমরা পদ্মাসেতু নির্মাণ কাজ শুরু করেছি। এখন এ কাজ যেন নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে পারি সে জন্য সবার দোয়া ও সহযোগিতা চাই।’

পদ্মাসেতু করার সাহস বাঙালি জাতিকে একটি আলাদা গরিমা দিয়েছে। মনে পড়ছে, ২০১৩ সালে জাতীয় সংসদে ৩০০ বিধিতে দেওয়া বিবৃতিতে এ কথা বলেছিলেন মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সময় সংসদে উপস্থিত ছিলেন। অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন- ‘পদ্মাসেতু বাস্তবায়নে একদিকে আমরা যেমন বদ্ধপরিকর, তেমনি এ প্রকল্প বাস্তবায়নে আমরা কোনো ধরনের দুর্নীতি সহ্য করবো না। আমি দুদকের তদন্তকাজে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দলের সম্পৃক্তিও চাই। বিশ্বব্যাংক আমাদের অনুরোধ রেখেছে এবং বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, এতে অন্যান্য প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো প্রভাব পড়বে না এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত কার্যক্রমে তারা সম্পৃক্ত থাকবে।’ তিনি এও বলেছিলেন- ‘আমি বলতে চাই, প্রথমত, পদ্মাসেতু প্রকল্পে এখন পর্যন্ত কোনো দুর্নীতি হয়নি। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতির সম্ভাবনা নিয়ে যেসব কথা উঠছে, এর প্রতিটি বিষয়ই আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশন গভীরভাবে অনুসন্ধান করেছে এবং করছে। আমাদের লক্ষ্য হলো, এই প্রকল্পে যেখানে আমাদের দেশের সব মানুষ আগ্রহান্বিত ও নিবেদিত, সেখানে কোনো ধরনের দুর্নীতি হতে আমরা দেবো না। পদ্মাসেতুতে উন্নয়ন-সহযোগীদের অর্থায়ন আর নেই। কিন্তু তারা যেসব দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের কথা বলছে, সেগুলো আমরা তদন্ত করছি এবং তদন্ত চূড়ান্ত করে তার প্রতিকার করবো।’ অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে এই মহান সংসদে ঘোষণা করছি, নিজেদের অর্থায়নে পদ্মাসেতুর বাস্তবায়ন আমরা এই অর্থবছরেই শুরু করছি। আমরা সারা জাতিকে নিশ্চিত করতে চাই যে এই প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি চলবে না।’

বাংলাদেশের মানুষ চিঠি দিয়ে, সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন প্রয়োজনে তারাও এই প্রকল্পে যথাসাধ্য অর্থ দেবেন। দশ টাকা, বিশ টাকা দিয়ে হলেও এগিয়ে আসতে চেয়েছিলেন এই দেশের আপামর মানুষ। এই যে মানুষের শক্তি- সেটাই সম্ভব করেছে পদ্মাসেতুর অগ্রযাত্রা।

২০১৮ সালের মধ্যে ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার কথা রয়েছে। এই সেতুর উপর দিয়ে ট্রেনও চলবে। বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নের সবচেয়ে বড় প্রকল্প এই পদ্মা সেতু। প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের এই সেতু দিয়ে ঢাকাসহ দেশের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি সড়কপথে যুক্ত হবে দক্ষিণ জনপদের ২১ জেলা। এ সেতু হলে দেশের আর্থিক প্রবৃদ্ধি ১.২ শতাংশ বাড়বে, প্রতিবছর ০.৮৪ শতাংশ হারে দারিদ্র্য বিমোচন হবে বলে আশা করছে সরকার।

হ্যাঁ- বাংলাদেশ বীরের দেশ। শহীদের দেশ। ভাষা আন্দোলনের দেশ। এই দেশের মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে জানে। তারা দাঁড়িয়েছেনও। পদ্মাসেতু প্রকল্প আমাদের পাঁজরকে শক্ত করেছে। আমরা এই শক্তিকে আরো পরিণত করতে পারবো।

_____________________________________
দৈনিক খোলাকাগজ। ঢাকা। ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ মঙ্গলবার।

ধর্ম সংক্রান্ত সংকট থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হবে……!

বর্তমান সময়ে চলমান মহাসংকটের পরিধিকে একত্রে চিন্তা করতে গেলে কোনো বিবেকবান চিন্তাশীল মানুষ স্থির থাকতে পারে না। মানবজাতি তার ভিতরে, আত্মিকভাবে দেউলিয়া, বাইরে সর্বপ্রকার বিপর্যয়ের শিকার। কারো কোনো নিরাপত্তা নেই, চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য বিরাজ করছে, শোষণমূলক পুঁজিবাদ মাত্র আটজন ব্যক্তির হাতে পৃথিবীর অর্ধেক জনগোষ্ঠীর সম্পদ তুলে দিয়েছে, দুর্বৃত্তরা সম্মানের আসন পাচ্ছে, শিক্ষক ছাত্রের হাতে মার খাচ্ছে, সৎ ব্যক্তি জীবনমানের ঊর্ধ্বশ্বাস দৌড়ে সর্বত্র পিছিয়ে পড়ছে। সমস্ত দুনিয়াটা যেন এক নরকুপে পরিণত হয়েছে।

পৃথিবীর চারদিক থেকে আর্ত মানুষের হাহাকার উঠছে- শান্তি চাই, শান্তি চাই। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচারে, দরিদ্রের ওপর ধনীর বঞ্চনায়, শোষণে, শাসিতের ওপর শাসকের অবিচারে, ন্যায়ের ওপর অন্যায়ের বিজয়ে, সরলের ওপর ধুর্তের বঞ্চনায়, পৃথিবী আজ মানুষের বাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। নিরপরাধ ও শিশুর রক্তে আজ পৃথিবীর মাটি ভেজা। পরিসংখ্যান বলছে, পৃথিবীর প্রতিটি দেশে খুন, হত্যা, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, ধর্ষণ ইত্যাদি সর্বরকম অপরাধ প্রতি বছর বেড়ে চলেছে ববং বেড়ে চলেছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এর শেষ কোথায়? এর পরিণতি চিন্তা করে সুস্থমস্তিষ্ক মানুষ আজ দিশাহারা। এর ওপর আবার ভয়াবহ বিপদ দাঁড়িয়েছে পারমাণবিক অস্ত্রের যা যে কোনো মুহূর্তে সমস্ত মানবজাতিসহ পৃথিবী গ্রহটাকেই ভেঙে ফেলতে সক্ষম।

আমাদেরকে যেমন মানবজাতি সম্পর্কে চিন্তা করতে হবে তেমনি বাঙালি জাতিকে নিয়েও চিন্তা করতে হবে, মুসলমান সম্প্রদায়কে নিয়েও চিন্তা করতে হবে। বাংলাদেশের বাসিন্দাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার বড় কারণ হচ্ছে এ দেশের ৯০% জনগণ ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান আর পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো চলমান সভ্যতার সংঘাতে একটার পর একটা মুসলিমপ্রধান দেশ ধ্বংস করছে, দখল করে নিচ্ছে, তাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করছে, কোটি কোটি জনগণকে উদ্বাস্তু করছে। বাংলাদেশকেও যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করার অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলমান আছে বলে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীসহ অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তি বারংবার উল্লেখ করেছেন।

বর্তমানে বিশ্বে ধর্ম প্রধান ইস্যু, ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলো ধর্মবিশ্বাস ও ইসলাম-বিদ্বেষকে রাজনৈতিক ট্রাম্প কার্ড হিসাবে ব্যবহার করছে। এই ধর্ম সংক্রান্ত সংকট থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হলে ধর্ম নিয়ে এখন সবাইকে কথা বলতে হবে, নইলে দেশ রক্ষা করাই মুশকিল হয়ে যাবে।

ভাষা বাংলার চিন্তায় ভাবনা

বাংলা বই ও বাংলা ভাষা ক্রমশ অধঃগামী। আর এ আলোচনা রাস্তা ঘাটে গ্রাম বাংলার অলিতে গলিতে শোনা যায়। প্রথমে জানার চেষ্টা করা যেতে পারে। আমরা পড়াশুনা করি কেন?
ভবিষ্যতে সেই পড়াশুনা দ্বারা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য। এক্ষেত্রে বাংলা ভাষার মাধ্যমে জ্ঞান এবং শিক্ষা তথা ডিগ্রী ভবিষ্যতে কতটা কার্যকরী। অর্থাৎ বাংলায় তেমন কাজ আছে কি? ধীরে ধীরে মন্দার বাজারে কর্মক্ষেত্র কমছে। কাজের জন্য বাংলা ছেড়ে অ-বাংলাভাষীতে যেতে হচ্ছে। এবং ভবিষ্যতে আরও যেতে হবে। তাহলে বাংলা ভাষার সাথে থেকে এ রকম কর্ম প্রচেষ্টায় পিছিয়ে পড়তে হয়। শিক্ষালাভ যদি অন্য ভাষার সাথে করে থাকি তাহলে বাংলাতে থাকতে অসুবিধা হবে না। আবার বাংলা ভাষার বাইরে তো অসুবিধাই হবে না। তার মানে বাংলা ভাষার জন্য পিছিয়ে পড়া।
বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে যে যার মাতৃভাষার সাথে ইংরেজী বা অন্য ভাষায় শিক্ষার বিস্তার ঘটায়। যে বা যারা উচ্চ শিক্ষায় পারদর্শী হতে পারল তারা সহজেই বাইরে ছড়িয়ে পড়ল আর যারা মোটামুটি শিক্ষা অর্জন করে তারা সেখানেই কিছু কাজ কর্ম জুটিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে শুরু করে দেয়। বাংলা ভাষা অঞ্চলে এই কর্ম সংস্থান একটা মস্ত বড় ফ্যাক্টর।
উচ্চ শিক্ষায় ইংরেজী ছাড়া কিছু হবে না। অনার্স কোর্স থেকে শুরু করে কম্পিউটর, সায়েন্স, থিসিস গবেষণা এবং ডাক্তারী ইঞ্জিনিয়ারিং নার্সিং ম্যানেজমেণ্ট ভোকেশনেল সবেতেই ইংরেজী প্রয়োজন।
পেটের খিদে মেটার পর শুরু হয় মনের চাহিদা। সব বাবা মা ছেলের মিনিমাম খিদে মেটানোর সংস্থানের রাস্তা খোঁজে। সেখানে প্রথম অফসান চলে ইংরেজী। পারুক না পারুক। কেন না বাংলায় কিছু হবে না। সে বাংলাতে থেকে কিংবা বাংলা ভাষাতে থেকে। এই বাংলাতেই বাইরের অনেকেই বিজনেস করছে কেন না বাংলার নিজস্ব বাংলাভাষী সংস্থান কোথায়?
এর পরবর্তী অবস্থান বাংলায় চর্চা। শুরুতেই সেখানে গলদ বড় আকারে বিস্তারিত সেখানে এই চর্চা রহিত। কর্মক্ষেত্রে কোন চিঠি চাপাটি পড়া বা লেখা কোনটাই বাংলায় নেই। সে সরকারী হোক বা বেসরকারী। সমস্ত প্রায় ওয়েবসাইট নির্ভর। পুরোটাই ইংরেজী। ফলে কর্মক্ষেত্রে প্রায় সবাই বাংলা ভাষা কেবল নিজেদের মধ্যে বলে আর সকালে চোখ বোলানো খবরের কাগজ পড়ে। অর্থাৎ কোন অফিস আদালতে বাংলা অনেকটাই প্রবেশ নিষেধ। যে টুকু অচেনা অজানা ঠকমক বাংলা ভাষায় দু একটা দরখাস্ত আসে তাও বোধগম্যের বাইরে। এর বাইরে কিছু শিক্ষক মহাশয় এবং সাহিত্যপ্রেমী ও লিখিয়েরা এবং বাংলা ভাষাভাষী ছাত্রছাত্রী বাংলা বই নাড়াচাড়া করে।
তাহলে বাংলা ভাষার প্রসার বা বাংলা ভাষা কিভাবে জগতে নিজস্ব স্থানে অটুট থাকবে। এর পর আছে সাহিত্যপ্রেমী ও লিখিয়ে। অর্থাৎ যারা গল্প উপন্যাস ও কবিতা লিখছে। তারা কতটা টানতে পারছে পাঠক সমাজকে। বইমেলায় নামী প্রকাশক কতটা সবে নামকরা বা অনামীদের স্থান দিচ্ছে তার মূল্যায়নে কিছুটা হলেও ভাষা অবস্থিত হয়। সেখানে দেখবেন সেই বঙ্কিম শরৎ হয়ে সুনীল শীর্ষেন্দু সুচিত্রা জীবনানন্দ শঙ্খ জয় শ্রীজাততে থেমে গেছে। পরবর্তী তেমন আসছে না।
কেন আসছে না? নামী প্রকাশক বাধা দিচ্ছে, না কি গভীরতার অভাব আছে? ভাবার বিষয়। উপরে উপরে ভেসে বেড়ানো কেউ সহজে নেবে না। কালের নিয়মে তার হারিয়ে যাওয়া নিশ্চিত। অল্প ভাবনা অল্প পাঠ অল্প নিরীক্ষণ এবং অল্প বিষয়ীকরণ এই বাংলা ভাষা হারিয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী নয়তো?
নাক ঘুরিয়ে পাঠককে বোকা বানানো, সরকারী তকমা বা অন্য পুরস্কারে পুরস্কৃত লেখক বা কবি কেউকেটা হয়ে যান। কত পুরস্কার। অথচ তিনি হয়তো জানেন না “অর্থাৎ পেছন ফিরিয়ে সিগারেট খায়”।
আবার অনেকেই আছেন তাঁর বই বিক্রির খতিয়ান প্রকাশ্যে বিতরণ করেন। কিন্তু লাভ কি হচ্ছে? বাংলা ভাষাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? যদিও গল্প উপন্যাসের বই বিক্রি হচ্ছে তাও একবার পড়ার পর তাকে আর ছুঁয়ে দেখছে না। পরবর্তী প্রজন্মকে বলছে – ওটা থাক বাবা, তুই বরং শীর্ষেন্দু পড়। সুচিত্রা পড়। কিংবা চেতন ভগত। তাহলে আপনার বই বিক্রি হয়ে কি লাভ হল? ভাবুন। আপনার সামনে বা বইমেলায় অটোগ্রাফের জন্য বই কিনল ( কেন না বেশির ভাগ লেখক নিজের বই ছাড়া কোন ডাইরি বা অন্যের লেখা বইয়ে অটোগ্রাফ দিতে চান না)। তারপর ফেলে রেখে দিল। তাহলে বাংলাভাষা কি করে এগোবে?
অর্থাৎ আসল বিষয় হল গভীরতা। যা খুবই প্রয়োজন। তার জন্য নিজেকে পড়ার সাথে নিরীক্ষণ করা খুবই জরুরী। বাংলা ভাষায় যে গভীরতা রবীন্দ্রনাথ বিস্তৃত করে গেছেন, জীবনানন্দ প্রসারিত করে গেছেন তার আরও তলদেশে ডুব সাঁতার দিতে হবে। এবং লেখক হিসেবে কবি হিসেবে সেই মুক্তো তুলে আনতে হবে। না হলে তুমি আমি নিয়ে লেখা, চুটকি, ছড়া, বোরোলীনে সারানো ক্ষতের মত ক্ষত থেকে যাবে। আর ভাষা হবে পঙ্গু।
বাংলা ভাষা হারিয়ে গেছে, হারিয়ে যাবে চিৎকার করে কি লাভ? সেই বনলতা সেন, সেই চিত্ত যেথা ভয় শূন্য, সেই শেষের কবিতা, সেই রক্তকরবী, সেই চাঁদের পাহাড়, সেই মনোজদের অদ্ভূত বাড়িতে বাংলা সাহিত্য আটকে গেছে। যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল তারা আবার ঘরের ভেতরে। ভাসছে উপরে উপরে।
সে তুলনায় অন্য ভাষা আরও তলদেশে ডুবছে। খুঁজে আনছে মুক্তো। সেক্সপীয়ারকে সাথে করে অনেকটা দূর পাড়ি দিয়েছে। বাংলা ভাষা বাঁচানোর এটাও অন্যতম রাস্তা। আমি আমার ছেলেকে ধমকে বলতেই পারি যা ওদিকে যা। সে আমাকে দেখিয়ে এগিয়ে যাবে। যদি তার মনের মত হয় সে নিজেই সে পথে যাবে না হলে হঠাৎ রাস্তা পাল্টে ফেলবে। সে রকম বাংলা বই আপনাকে দেখিয়ে কিনবে কিন্তু যদি রসদ না পায় খেলো কথায় তাকে ভোলানোর চেষ্টা করা হয়। তাহলে সে রাস্তা বদল করবেই। এখনকার এ রকম অনেক লেখক আছে। উদাহরণও দেওয়া যেতে পারে তাতে লাভ হবে না। দায়িত্ব সবার।
লেখক বা কবি বা এই চর্চার সাথে যুক্ত সবাই এক গোত্রীয় হওয়া উচিত। সবার উচিত আলোচনায় গভীরতায় অগ্রবর্তী হওয়া। অর্থাৎ পেছনে কেউ নেই। যারা চর্চায় তারা প্রত্যেকের লেখা পড়ুক। আত্মগম্ভীরতা বড্ড বেশি দেখা যাচ্ছে। ভাবছে আমার বই তো বেশ বিক্রি। তাহলে আর ওদিকে তাকিয়ে লাভ কি?
এবার আসা যাক গ্রাম বাংলার কথা। যাদের ভরসায় কিন্তু বাংলা ভাষা এখনও জীবন্ত উজ্জীবিত। খেটে খাওয়া জীবনযাত্রায় বাংলাভাষা স্বমহীমায় প্রতিষ্ঠিত। গাঁথা গান পাঁচালি যাত্রা মঙ্গলকাব্য গীতিকা কীর্তন লোকগান ভাটিয়ালী এখনও নানান ভাবনা চিন্তায় নিজের মত প্রচারিত। সেই মাটির সাথে বাংলা ভাষা শালুক ফুল তোলে ডিঙি বায় বৃষ্টিতে ভিজে চাষ করে। শহুরমুখী তথাকথিত ধীরে ধীরে বাংলাভাষা ছেড়ে দিচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতির সাথে মিশে থাকা এই সব মানুষী বাংলাভাষার পরম হৃদয়। এদের জন্যই কোনদিন কোনভাবেই বাংলাভাষা হারিয়ে যাবে না।

ভাষার বিকৃতি, ভাষার আরাধনা

বাংলাদেশে একটি শব্দ খুবই পরিচিত। ‘আর-জে’। রেডিও জকি। বাংলাদেশে একটি ব্যাপক বিপ্লব ঘটিয়েছে এফএম রেডিও। এই খবরটি অনেকটাই তলিয়ে যেতে বসেছে। এর কারণ, মানুষ এখন টিভি, ইন্টারনেট নিয়েই ব্যস্ত। ব্যস্ত ফেসবুক, টুইটার নিয়ে। তারপরও তরুণ প্রজন্মের মাঝে একটা ক্রেজ তৈরি করেছে এই রেডিও ব্যান্ড। তার একমাত্র কারণই ওই রেডিও জকির নতুন নতুন ভাষ্য।

প্রিয় পাঠক, আপনারা কি সেই ভাষ্য মাঝেমধ্যে শোনেন? কী বলেন এই রেডিও জকিরা? তারা কি বাংলা বলেন? কোন বাংলা ভাষা ব্যবহার করেন তারা? বাংলার সঙ্গে ইংলিশ মিলিয়ে একটা ভাষা তৈরি হয়েছে বেশ আগেই। কেউ বলেন, ‘বাংলিশ’, কেউ বলেন ‘বাংরেজি’। এই বিষয়টি সম্প্রতি আবার সামনে এসেছে। এ নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন- ‘নতুন প্রজন্মের ইংরেজি ঢঙে বাংলা বলার প্রবণতা ছাড়াতে কী করা যায়, সে পথ বের করতে হবে।’ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এই আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা কথ্য ভাষা বলব, ঠিক আছে। দয়া করে আমাদের ভাষার যে প্রচলিত ধারা সেটাকে এভাবে বিকৃত করে .. বাংরেজি বলে ফেলছি; এটা যেন আর না হয়। এদিকে একটু বিশেষভাবে দৃষ্টি দেয়া উচিত।’ তিনি বলেন, ‘এটা ছেলেমেয়েদের মধ্যে সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে। যেন ওইভাবে কথা না বললে তাদের মর্যাদাই থাকে না। এই জায়গা থেকে আমাদের ছেলেমেয়েদের সরিয়ে আনতে হবে। যখন যেটা বলবে, সেটা সঠিকভাবে বলবে, সঠিকভাবে উচ্চারণ করবে, সঠিকভাবে ব্যবহার করবে।’

প্রধানমন্ত্রী ১৯৫২-এর ভাষা শহীদদের স্মরণ করে বলেন, ‘আমাদের ভাইয়েরা জীবন দিয়ে, রক্ত দিয়ে এই ভাষা আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন। এর মর্যাদা আমাদের রক্ষা করতে হবে। আমাদের ছেলেমেয়েদের এই ভাষা শিখতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করে বলেছেন, ‘এই ইনস্টিটিউট একদিন তাদের গবেষণা, ভাষা সংরক্ষণ, ভাষা সম্পর্কে আরো জ্ঞান সংরক্ষণ করবে। প্রত্যেকটা ভাষার উৎস কী, কীভাবে বিকশিত হলো, কীভাবে ভাষা বিভিন্ন জাতির কাছে এলো, তা নিয়ে গবেষণার আধার হয়ে উঠবে। আমরা সেভাবে এই ইনস্টিটিউটকে গড়ে তুলতে চাই। আশা করি, বিশ্বের বুকে একদিন এই ইনস্টিটিউট আলাদা মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হবে।’ প্রধানমন্ত্রী মনে করিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলা ভাষাভাষীর স্থান ষষ্ঠ। সেই হিসাবে জাতিসংঘের একটি ভাষা হিসেবে বাংলাকে গ্রহণ করে কিনা- এ ব্যাপারে আমরা প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। যদিও এটা কার্যকর করতে অনেক রকম সমস্যা আছে। তবুও আমরা আমাদের দাবিটা তুলে রেখেছি। আমরা দাবিটা একদিন বাস্তবায়ন করতে পারব।’

প্রধানমন্ত্রীর এই আশাবাদের যথেষ্ট যৌক্তিকতা আছে। বাংলা ভাষাভাষীরা এখন বিশ্বে দাঁড়াচ্ছেন মাথা উঁচু করে। তারা দেখিয়ে দিচ্ছেন, একাত্তরের শৌর্য-বীর্যের ধারাবাহিকতা। কিন্তু এই বাংলাদেশেই একটি শ্রেণি বাংলা ভাষাকে নিয়ে এমন মশকারা করছে কেন? ‘দৈনিক শ্রমিক কণ্ঠ’ নামের একটা কাগজের প্রথম পাতা ছবিসহ ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। তাতে তারা মহান একুশে ফেব্রুয়ারিকে বলেছে- ‘মহান স্বাধীনতা দিবস’। এই কাগজের সম্পাদক কে? এখানে কারা সাংবাদিকতা করেন? এমন চিত্র বাংলাদেশে বাড়ছেই। টিভিতে দেখলাম, নতুন প্রজন্মের কেউ কেউ বলছে, তারা শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানাতে শহীদ মিনারে এসেছে! এরা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। এদের কি শেখানো হচ্ছে? কারা তা শেখাচ্ছেন?

একুশের চেতনার সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির সম্পর্ক খুবই প্রগাঢ়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তা ছিল বাংলায়। সেটি ছিল নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ২৯তম সাধারণ অধিবেশন। অধিবেশনে সভাপতি ছিলেন আলজেরিয়ার মুক্তি সংগ্রামের নেতা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা আবদেল আজিজ বুতেফ্লিকা। সভাপতি ‘বাঙালি জাতির মহান নেতা’ হিসেবে পরিচিতি জানিয়ে বক্তৃতা মঞ্চে আহ্বান করেছিলেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বাঙালির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু সদর্পে বীরোচিত ভঙ্গিমায় আরোহণ করেছিলেন বক্তৃতা মঞ্চে। প্রথম এশীয় নেতা, যিনি এই অধিবেশনে সবার আগে ভাষণ দিয়েছিলেন। দৃপ্ত পায়ে বক্তৃতা মঞ্চে উঠে ডায়াসের সামনে দাঁড়ালেন বঙ্গবন্ধু। মুহুর্মুহু করতালি। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা শুরু করেন মাতৃভাষা বাংলায়। যে ভাষার জন্য ঢাকার রাজপথে বাঙালি বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। সেই ভাষায় প্রথম ভাষণ জাতিসংঘে। বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষাকে বিশ্ব দরবারে আবার ঠাঁই করে দিলেন। এর আগে ১৯১৩ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল প্রাপ্তির মধ্যদিয়ে বিশ্ববাসী জেনেছিল বাংলা ভাষার উজ্জ্বল অক্ষরগুলো। এর ষাট বছর পর ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে উচ্চারণ করলেন বিশ্বসভায় বাংলা ভাষার অমর শব্দগুলো। জাতিসংঘে বিশ্বের সব নেতা নিজ নিজ মাতৃভাষাতেই ভাষণ দিয়ে থাকেন। জাতিসংঘের সরকারি ভাষা ছয়টি- ইংরেজি, ফরাসি, রুশ, চীনা, স্প্যানিশ ও আরবি। এই ৬ ভাষাতেই বক্তৃতা রূপান্তরিত হয়ে থাকে। আমরা আজ সেখানেই আমাদের বাংলা ভাষাকে যুক্ত করার প্রচেষ্টা করছি জোরালোভাবে।

আমার মনে পড়ছে, ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন বলেছিলেন, ‘যে ভাষার জন্য সংগ্রাম হলো, জীবন দিতে হলো সেই বাংলা এখনো সর্বস্তরে চালু হয়নি- এটা কোনোভাবেই ঠিক নয়। মনে রাখতে হবে, বাঙালিদের ভালো করে ইংরেজি শিখতে হলেও বাংলা জানতে হবে। কারণ ভালো বাংলা ছাড়া ভালো ইংরেজিও শেখা যাবে না।’ ২০০৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৪তম সমাবর্তন বক্তৃতায় আব্দুল মতিন বলেছিলেন, ‘সর্বস্তরে মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠা করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ভাষাবিদ, রাজনীতিবিদ, লেখক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের নিয়ে একটি কমিশন গঠন করতে হবে। এই কমিশনের দেয়া রিপোর্ট ও সুপারিশের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।’ তার আশাবাদ ছিল- ‘আমরা ১৯৫২ সালে যে স্বপ্ন দেখেছিলাম, ১৯৭১ সালে যে স্বপ্ন বুকে ধারণ ও লালন করেছিলাম, তা আজো পূরণ হয়নি। আজকের তরুণ ছাত্ররাই পারে সেই অপূর্ণ ও অসম্পূর্ণ স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে। তার জন্য দরকার অবারিত দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগ।’

এই কথাগুলো আজকের প্রজন্মকে মনে রাখতে হবে। আজ আঞ্চলিক ভাষার কথা বলা হচ্ছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ভাষা বেশ শুদ্ধ। এরকম বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাতেই আলাদা আলাদা আঞ্চলিক ভাষাগুলো আমাদের ভাষাকে আরো প্রাচুর্যময় করেছে। আঞ্চলিক ভাষা আমাদের ভাষা থেকে হারিয়ে যাবে না। তারপরও ভাষার শুদ্ধতার জন্য যেমন কাজ করা দরকার তেমনি এর আঞ্চলিক ভাষাগুলোর সংরক্ষণ করাও আমাদের দায়িত্বের আওতায় পড়ে। কালের আবর্তে আমরা প্রমিত ভাষার চর্চা করে যাবই। কিন্তু ইচ্ছা করলেই আঞ্চলিকতাকে আজই শুদ্ধ হিসেবে সবার কাছে গ্রহণযেগ্য করা সম্ভব হবে না। তা সম্ভবও নয়। কিছু আঞ্চলিকতা বাংলা ভাষাকে আরো বেশি মধুর করে তুলেছে আমাদের মনের ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে। কত বিচিত্র এই বাংলা ভাষা। বিচরণ না করলে কখনই বোঝা যাবে না বাংলা ভাষা বলার ভঙ্গিমায় কী রকম আলাদা আলাদা ব্যকুলতা রয়েছে। যা আমাদের কথা বলার আত্মতৃপ্তি সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

আরো যে বিষয়টি মনে রাখা দরকার, এই ভূখণ্ডে আরো অনেক জাতি-গোষ্ঠীর বাস আছে। তারাও তাদের মায়ের ভাষায় কথা বলবে, পড়ালেখা করবে, সংস্কৃতির চর্চা করবে। বাঙালি সেদিন স্লোগান তুলেছিল- ‘বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা চাই’। এখানেই বাঙালির ভাষা সংগ্রামের অনন্যতা। তার সংগ্রামে কোনো উগ্র জাতীয়তাবাদ কিংবা জাতিগত সংকীর্ণতার চিন্তা স্থান করে নিতে পারেনি। কিন্তু ব্যর্থতাও আছে।

আমরা কি পেরেছি প্রতিটি বাঙালি সন্তানকে তার নিজের মাতৃভাষাকে চেনাতে, জানাতে, পাঠে সক্ষম করতে? আমরা কি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে বর্তমান প্রজন্মের মননে-ধ্যানে-অনুশীলনে বাংলা ভাষাকে বিশেষ স্থান করে দিতে পেরেছি? পেরেছি কি বাংলাদেশের ভাষাভাষী মানুষকে তার মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার দিতে? একজন বাঙালির সন্তানেরা যদি জন্মের পর তার নিজের ভাষায় কথা বলার, সেই ভাষাতেই লেখাপড়া করার অধিকার থাকে তাহলে একজন আদিবাসী সন্তান কেন তার মাতৃভাষায় শিক্ষিত হতে পারবে না? বায়ান্নর ৬৫ বছর পর আজো কেন সমাজে শ্রেণিবৈষম্য, শোষণ, সাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্রহীনতা দেখতে হবে? বাংলা ভাষার আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম আজ সারাবিশ্বেই স্বীকৃত। মাতৃভাষার জন্য সংগ্রাম করে একুশ যে আজ আন্তর্জাতিক দিবসে পরিণত হতে পেরেছে তার মূল কারণই হচ্ছে এই সংগ্রামের আত্মার মধ্যে কোনো উগ্রজাতি বিদ্বেষ বা জাতীয় সংকীর্ণতা ছিল না। আমরা প্রত্যেক জাতির মাতৃভাষার বিকাশের পক্ষেই ছিলাম। আমরা সেই ভাষার আরাধনা চাই। ভাষার বিকৃতির রোধ চাই। চাই মানুষ দাঁড়াবে ভাষার শক্তি নিয়ে। শুদ্ধ ভাষার চর্চা করে। সঠিক ইতিহাস চর্চা করে। শুধু ফেব্রুয়ারি মাসেই নয়, বছরজুড়ে ভাষার চর্চা হোক পরিশুদ্ধভাবে। আসুন আমরা এই ধ্যানে ও মননে ঐক্যবদ্ধ হই।

______________________________________
দৈনিক ভোরের কাগজ। ঢাকা। শনিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ধর্মবাজেরা কখনোই ধর্মের মঙ্গল করতে পারেনি

গত তিন মাসে এমন কোন দিন নাই যে দিন ৪/৫ টি মাদ্রাসা বা মসজিদ কর্তৃপক্ষ ওয়াজ মাহফিলের চাঁদার জন্য আসেনি, এদের মধ্যে প্রাইভেট মাদ্রাসা যে গুলোতে ছাত্র ছাত্রীদের মাসিক ২০০ -২৫০ টাকা ফি দিতে হয়। বিষয় টা রীতিমত অসহ্য রূপ ধারণ করছে।

এসব ওয়াজ মাহফিলের গুরুত্ব কতটুকু তা আয়োজকেরাই জানেন। ধর্ম প্রচার বা সেই জাতীয় কিছু হলে এসব মাহফিলে অন্যান্য সকল ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণ করানোর চেষ্টা থাকতো, কিন্তু দাওয়াত দিতেই ওরা মাইকিং করে ” ইসলাম প্রিয় তৌহিদ জনতা…”

আমার প্রশ্ন হচ্ছে- যে ব্যক্তি তৌহিদের অন্তর্ভুক্ত তার তো মাহফিলের দরকার নাই। আর যদি দরকার ও থাকে তাহলে এই সমস্ত মাহফিলের জন্য চাঁদাবাজি করার দরকার কি? আর উত্তরে ওরা বলে মাহফিলের খরচ, মাদ্রাসার তহবিল গঠন ইত্যাদি …

মাহফিলের খরচের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি খরচ হচ্ছে যারা ওয়াজ করে তাদের সম্মানী, ( যদিও বিষয়টা এখন রীতিমত দর কষাকষির পর্যায়ে চলে গেছে ) অর্থাৎ পুরো বিষয় টি ধর্মবাজী আর এই ধর্মবাজেরা কিন্তু কখনোই কোন ধর্মের মঙ্গল করে নি।

আমি কোরান পড়ি নিয়মিত। কোরানের কোথার ওয়াজ মাহফিলের কথা উল্লেখ নাই। শিক্ষা ও আল্লাহ সচেতনতার কথা বলা আছে, আর ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করার নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু বর্তমান পেক্ষাপটে যে দৃশ্য টা স্পষ্ট তা হচ্ছে অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় এখন ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি বেড়ে চলেছে। পর পর তিন সপ্তাহে একই জায়গায় তিন পক্ষের মাহফিল! কেন?

বলে কিনা ঐ সপ্তাহে ওরা যে মাহফিল করেছে তার জবাব! আবার এমনও দেখা যায় একই মহল্লায় একই গ্রামে একই দিন একাধিক ওয়াজ মাহফিল। কেন?
কে কার চেয়ে বেশী মানুষ জড়ো করতে পারে আর কে কার চেয়ে বেশী টাকা (চাঁদা) ওঠাতে পারে।

প্রত্যেক পক্ষই আল্লাহ আর আল্লাহর রসুলের কথা বলছে, তবে এত বিভেদ কেন? এত মত পার্থক্য কেন? এসব কি বাড়াবাড়ি নয়? আমি আল্লাহর শোকর করি- কারণ আল্লাহ আমাকে আমার দিন শুরু করার সুযোগ দেন দান করার মাধ্যমে। আর সেটা আমি খুব আন্তরিক এ নীরব মুহূর্তে করে থাকি। এবং নিয়মিতই করে থাকি। আর এতে আমার অন্তরে প্রশান্তি মিলে।

কিন্তু তথাকথিত ওয়াজ মাহফিলের নামে এই চাঁদাবাজির জন্য যখনই কেউ আমার কাছে আসে আমার অস্বস্তি লাগে। কারণ- আমি দান করতে অভ্যস্ত, চাঁদা দিতে নয়। আর সেই দান যেই দান আমার কল্যাণ ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হয়।

আমার সাথে যে কেউ দ্বিমত পোষণ করতে পারেন, অথবা এসব ওয়াজ মাহফিলের পক্ষে হাজারো যুক্তি দেখাতে পারেন, আমি তাদের অসম্মান করি না। আমি শুধু বলতে চাই ধর্ম তাই যা প্রশান্তি এনে দেয়। আল্লাহ তার হাবিব কে ওহির মাধ্যমে সর্ব শেষ গ্রন্থ দান করেছেন, এর আগে তিনি তার বান্দাদের প্রতিটি জনপদে স্ব স্ব ভাষার রসুল ও নবী পাঠিয়ে গ্রন্থ দান করেছেন, আর কোরান হচ্ছে তাদের সর্বশেষ ও শুদ্ধ সংস্করণ-

মানুষের এক জীবনে যা কিছু দরকার- ইহকাল ও পরকালে সফল হবার জন্য যা কিছু দরকার তার সব কিছু তিনি সহজ সরল ভাষা কোরানে উল্লেখ করেছেন, শিখিয়ে দিয়েছেন, তা ছাড়া নবীজী (সাঃ) সমগ্র জীবনী-তো নিদর্শন হিসেবে রয়েছেই। আমার মনে হয়না রসুল ( সাঃ) জীবনী বা আদর্শের বাহিরে অন্য কোন কিছু পৃথিবীর কোন মানুষ পা প্রাণীর জন্য প্রয়োজন রয়েছে।

বিদায় হজ্বের ভাষণে নবীজী সে কথাও উল্লেখ করে গেছেন, যে- তোমার জন্য আমি দুটি আলোক বর্তিকা রেখে যাচ্ছি একটি হচ্ছে আল্লাহর কালাম (কোরান) আর অন্যটি হচ্ছে আমার জীবনী আদর্শ ( হাদিস)

আমি বুঝিনা মানুষ কেন এত বিভ্রান্ত! যখন তাদের সামনে দু টি অনির্বাণ শিখা প্রজ্বলিত।

মাফ করবেন প্রিয় পাঠক-
আমি ধর্মের ছাত্র নই আর এই বিষয়ে আমার নূন্যতম জ্ঞানও নাই। আমি শুধু জানি ধর্ম – কর্ম খুব সহজ সরল সাবলীল একটি পথ, যেখানে বাড়াবাড়ির কোন স্থান নাই। আল্লাহ সকলের সহায় হওন।

দাউদুল ইসলাম। ২৭ ফেব্রুযারী ১৭

উপাসনাসর্বস্ব ব্যক্তিজীবনকেন্দ্রিক ধর্মের যে রূপটি বর্তমানে দাঁড়িয়েছে তা কোথা থেকে আসলো?

16830887_1441769379190764_1571831122358442782_nযুগে যুগে মহান আল্লাহর নিকট থেকে আসা প্রতিটি ধর্মই ছিল পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। সার্বিক জীবন কীভাবে পরিচালিত হবে তার পথনির্দেশই ছিল ধর্ম। প্রতিটি ধর্মেই আইন-কানুন, দণ্ডবিধি, অর্থনীতিসহ যাবতীয় বিষয়ের নির্দেশনা ছিল। প্রতিটি ধর্মের নামও ছিল ইসলাম (শান্তি) আর ফলও ছিল শান্তি। প্রতিটি ধর্মের ভিত্তি ছিল তওহীদ (আল্লাহ ছাড়া হুকুমদাতা নেই)। এই শেষ ইসলামের সাথে অন্যগুলোর পর্থক্য হলো এই যে, অন্য ধর্মগুলো ছিল একটি নির্দিষ্ট এলাকা ও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রযোজ্য আর শেষ ইসলাম হলো কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রযোজ্য।
.
বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী ধর্মভিত্তিক জাতি হলো খ্রিষ্টান। এই খ্রিষ্টধর্ম কীভাবে সৃষ্টি হলো সে সম্পর্কে দুটি কথা এখানে বলে নিতে চাই-
—-
ইহুদি আলেমরা (রাব্বাই, সাদ্দুসাইরা) মুসা (আ.) এর ধর্মগ্রন্থ তৌরাত এর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে তা প্রয়োগ করত এবং এই ক্ষেত্রে তারা অত্যন্ত বাড়াবাড়ি করত। তৌরাতের বিধি-বিধান, আইন-কানুন, দণ্ডবিধি ইত্যাদি তখনকার সময়ের প্রেক্ষাপটে ইহুদি জাতির জন্য প্রযোজ্য ছিল কিন্তু তা নিয়ে বাড়াবাড়ি ও অতি বিশ্লেষণের ফলে সেই ধর্ম মানুষকে শান্তির পরিবর্তে চরম অশান্তিতে ফেলেছিল। তখন প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল রাব্বাই, সাদ্দুসাইদের বাড়াবাড়ি ও অতিবিশ্লেষণের হাত থেকে ধর্মকে তার সরলরূপে ফিরিয়ে আনা, তবেই কেবল সমাজে শান্তি আসবে। তখন মহান আল্লাহ ইহুদি জাতির জন্য পাঠালেন নবী ঈসাকে (আ.)।
.
ঈসা (আ.) এসে ঘোষণা দিলেন, “আমি বনী-ইসরাইলের পথভ্রষ্ট মেষগুলোকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য আমি এসেছি।” যেহেতু তখনও ইহুদিদের দীন (জীবনব্যবস্থা) অবিকৃতই ছিল তাই তিনি নতুন কোনো দীন (জীবনব্যবস্থা) নিয়ে আসলেন না। তিনি কেবল কিছু উপদেশ নিয়ে আসলেন যেন মানুষ সেগুলো অনুসরণ করে সৎচরিত্রবাণ হতে পারে এবং ধর্মের সঠিক উদ্দেশ্য বুঝতে পারে। ইহুদিরা যদি ঈসা (আ.) এর ঐ উপদেশগুলো গ্রহণ করত তবে ইহুদি ধর্ম পূর্ণাঙ্গতা পেত, তৌরাত ও ঈসা (আ.) এর উপদেশগুলো একত্র হয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ দীন তৈরি হতো।
.
কিন্তু ইহুদিরা ঈসা (আ.) এর উপদেশ গ্রহণ করার পরিবর্তে তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করল। ঈসা (আ.) এর অন্তর্ধানের পর ‘পল’ নামে একজন লোক ঈসা (আ.) এর আদর্শের প্রতি ঈমান আনল এবং ঈসা (আ.) এর কয়েকজন শিষ্যকে নিয়ে ইউরোপে এই ধর্ম প্রচার শুরু করল যদিও ইহুদিদের বাইরে এই আদর্শ প্রচার করা ঈসা (আ.) এর কঠোর নিষেধ ছিল। ঈসা (আ.) এর উপদেশগুলো তখনকার সময়ের জন্য অত্যন্ত সময়োপযোগী ও হৃদয়গ্রাহী ছিল কিন্তু তা মোটেও পূর্ণাঙ্গ দীন (জীবনব্যবস্থা) ছিল না, সেগুলো ছিল কেবল চরিত্র সৃষ্টির প্রেরণা ও উপাসনাসর্বস্ব। এই ধর্ম ইউরোপে ব্যাপকভাবে গৃহীত হলো ঠিকই কিন্তু বিপত্তি দেখা দিল যখন এই ধর্ম দিয়ে সমাজ পরিচালনা করতে যাওয়া হলো। যেহেতু সমাজ পরিচালনার নীতিমালা এই উপদেশগুলোর মধ্যে ছিল না তাই ধর্মযাজকরা বাধ্য হয়ে নিজেদের মনগড়া ফতোয়া (বিধি-বিধান) দিয়ে সমাজ পরিচালনা করতে লাগল। সমাজে নেমে আসল অন্যায়-অবিচার।
.
এর ধারাবাহিকতায় মধ্যযুগে এসে ইউরোপ এমন বর্ববর হলো যে, ধর্মের নামে মানুষকে পুড়িয়ে মারা, ফুটন্ত তেলের কড়াইয়ে মধ্যে ফেলে দেওয়া, মৃত পশুর পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে, হিংস্র জন্তু দিয়ে খাওয়ানোসহ বহু অমানবিক কর্মকাণ্ড প্রতিষ্ঠিত হলো। একদিকে রাজা ও সামন্ত প্রভুদের অত্যাচার অন্যদিকে ধর্মযাজকদের নির্যাতনে সাধারণ মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হলো। তখন কিছু চিন্তাশীল মানুষ সিদ্ধান্ত নিল যে, রাষ্ট্র পরিচালনায় ধর্মকে আর ব্যবহৃত হতে দেওয়া যাবে না। রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে সেটার সিদ্ধান্ত নেবে মানুষ আর ধর্ম কেবল ব্যক্তিগতভাবে পালন করা যাবে।
.
১৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজা ৮ম হেনরির রাজত্বকালে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো। জন্ম হলো ধর্মনিরোপেক্ষতাবাদের। ধর্মের নামে স্থবিরতা, অন্ধত্ব, কূপমণ্ডূকতা অনেকাংশেই দূর হতে থাকল। এটিই ছিল ইউরোপে রেনেসার মূল ভিত্তি। ধর্মের নামে বহু মিথ্যা খ্রিষ্ট ধর্মের মধ্যে প্রচলিত হয়েছিল, কিন্তু মানুষ ধর্মের সেই মিথ্যার বিরুদ্ধে কথা বলতে পারত না ধর্মযাজকদের ভয়ে। ধর্মের সাথে বৈপরিত্ব আছে এমন বৈজ্ঞানিক সত্য প্রকাশ করার কারণে বহু বৈজ্ঞানিককে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করার ফলে মানুষের উপর থেকে ধর্মের আইনী বিধিনিষেধ লোপ পেল এবং সমাজে প্রচলিত অনেক মিথ্যার বিরুদ্ধে কথা বলার সুযোগ সৃষ্টি হলো, বৈজ্ঞানিক সত্য উদ্ঘাটনের সুযোগ সৃষ্টি হলো, মানুষের প্রতিভা বিকশিত হবার পরিবেশ তৈরি হলো। শুরু হলো নব নব আবিষ্কার, সূচনা হলো নতুন যুগের। এই পরিবর্তনের হাওয়া লাগল সমগ্র পাশ্চাত্য দুনিয়াই। মানুষ ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে আকৃষ্ট হতে লাগল ধর্মনিরোপেক্ষতার প্রতি।
.
এখানে মনে রাখতে হবে ধর্মনিরোপেক্ষতার জন্ম হয়েছে খ্রিষ্টধর্মের সেই সমস্ত মিথ্যা ও জবরদস্তিমূলক নীতির বিরুদ্ধে যা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা কোনো নীতি নয়, বরং খ্রিষ্টান পোপদের তৈরি বানোয়াট ফতোয়া। আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা নীতি যদি সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয় তবে কখনোই তা মানুষের অশান্তির কারণ হবে না, সেখানে জবরদস্তি থাকবে না। ইউরোপে যখন মধ্যযুগের বর্ববরতা চলছে মুসলিম দুনিয়ায় তখন শান্তির সুশীতল বাতাস বইছে। মুসলমানরা সম্পদের প্রাচুর্যে, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, শিল্প-সংস্কৃতিতে, চরিত্রিক গুণাবলিতে, সামরিক শক্তিতে এক কথায় সমস্ত দিক দিয়ে তখন উন্নতির চরম শিখরে উঠেছে। পৃথিবীর শিক্ষকের জাতি, অনুকরণীয় জাতি, অনুসরণীয় জাতি তখন মুসলিমরা। আর এর মূল ভিত্তি ছিল ত্রুটিহীন পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা ‘ইসলাম’।
.
কাজেই ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করার নীতি তথা ধর্মনিরোপেক্ষতা খ্রিষ্টধর্মের জন্য প্রযোজ্য হলেও ইসলাম নামক পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থার জন্য প্রযোজ্য নয়। কেবল ব্যক্তিজীবনকেন্দ্রিক উপসনা সর্বস্ব ধর্মের যে রূপটি আমরা দেখতে পাই তা ধর্মনিরোপেক্ষতার জন্মের পর থেকেই প্রচলিত হয়েছে এবং এটা মূলত খ্রিষ্টধর্মের জন্যই প্রযোজ্য। ইসলাম, সনাতন, ইহুদি ইত্যাদি ধর্মের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়।

মানবজাতী আজ মহা সংকটে ……..!

প্রতিটি সংকট মানুষকে দু’টো সম্ভাবনার মুখোমুখী দাঁড় করায়। হয় সে সংকট উত্তরণের পথ উদঘাটন করে নিজেকে অধিকতর উন্নত অবস্থানে নিয়ে ইতিহাসের অংশ হয় অথবা সেই সংকটে নিমজ্জিত হয়ে কালের গহ্বরে হারিয়ে যায়। মানবজাতির সঙ্গে সঙ্গে এ দেশের বাঙালি জাতিও আজ তাদের সুদীর্ঘ কণ্টকময় পথ পরিক্রমার অন্ত্যে এমন একটি যুগসন্ধিক্ষণে (Crossroads in time) এসে উপনীত হয়েছে যেখানে তাদের এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা চলমান বিশ্বের বহুমুখী সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কোন দিকে পা বাড়াবে।

বর্তমান সময়ে চলমান মহাসংকটের পরিধিকে একত্রে চিন্তা করতে গেলে কোনো বিবেকবান চিন্তাশীল মানুষ স্থির থাকতে পারে না। আমরা তাদের কথা বলছি না যাদের দৃষ্টি আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্বার্থপরতায় অন্ধ হয়ে গেছে, নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বাইরে চিন্তা করার শক্তি লুপ্ত হয়ে গেছে।

আমরা মুখ থাকতেও যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে মূক ও বধির হয়ে থাকে তার কথা বলছি না। আমরা সেই উন্নত প্রাণীর কথা বলছি সমাজের অধিকারবঞ্চিত দুর্বল মানুষের দীর্ঘশ্বাস যার হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে; যার কান দিয়ে সে ধর্ষিতার ক্রন্দন, বাস্তুহারার হাহাকার শুনতে পায়। আমরা জড়বুদ্ধি, কূপমণ্ডুক চিন্তাহীন প্রাণীর কথা বলছি না, বরং সেই প্রাণীর কথা বলছি যে সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠ হয়েছে তার অসাধারণ মেধাসম্পন্ন মস্তিষ্কের আশীর্বাদে যার দ্বারা সে অতীতে অসংখ্য মহাসঙ্কটের সমাধান আবিষ্কার করেছে।

আজ মানবজাতি তার ভিতরে দেউলিয়া, বাইরে সর্বপ্রকার বিপর্যয়ের শিকার। কারো কোনো নিরাপত্তা নেই, চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য বিরাজ করছে, শোষণমূলক পুঁজিবাদ মাত্র আটজন ব্যক্তির হাতে পৃথিবীর অর্ধেক জনগোষ্ঠীর সম্পদ তুলে দিয়েছে, দুর্বৃত্তরা সম্মানের আসন পাচ্ছে, শিক্ষক ছাত্রের হাতে মার খাচ্ছে, সৎ ব্যক্তি জীবনমানের ঊর্ধ্বশ্বাস দৌড়ে সর্বত্র পিছিয়ে পড়ছে। সমস্ত দুনিয়াটা যেন এক নরককুণ্ডে পরিণত হয়েছে।

আমরা ধর্মগ্রন্থে নরকের বর্ণনা পড়েছি, রেনেসাঁযুগের শিল্পি বত্তিচেল্লির রংতুলিতে দান্তের ইনফার্নো দেখেছি, কিন্তু আজ সেই নরককুণ্ড নিজেদের চোখেই দেখতে পাচ্ছি, আলাদা করে আর নরক দেখার প্রয়োজন নেই। এখন এই নরক থেকে বের হওয়ার জন্য আপাতত স্বার্থচিন্তা ত্যাগ করে সকল চিন্তাশীল মানুষের চিন্তা করা অনিবার্য হয়ে পড়েছে।

প্রকৃতপক্ষে কেউ ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে কি?

16730622_1854733054784759_2151654945094531071_nযাকে ধারণ করা হয় সেটা ‘ধর্ম’। অভিধানে শব্দটির অর্থ করা হয়েছে- স্বভাব, শক্তি (সংসদ বাংলা অভিধান), প্রকৃতি, প্রত্যেক জীব বা বস্তুর নিজস্ব গুণ (বাংলা একাডেমি অভিধান)।
.
অর্থাৎ প্রত্যেক বস্তু বা জীব যে স্বভাব, গুণ বা বৈশিষ্ট্য ধারণ করে সেটাই তার ধর্ম। প্রকৃতিতে এমন কোনো বস্তু বা শক্তি নেই যার নিজস্ব কোনো ধর্ম নেই। আর এই ধর্মকে অস্বীকার করে বা ধর্মনিরপেক্ষ থাকে- এমন সাধ্যও কারো নেই। প্রত্যেককে কোনো না কোনো ধর্ম ধারণ করতেই হয়। আগুনের ধর্ম পোড়ানা। আগুন যদি এই ধর্ম হারিয়ে ফেলে তাহলে সেটা কি আর আগুন থাকে? চুম্বক যদি তার আকর্ষণ ক্ষমতা হারায় তাহলে সেটাকে কি চুম্বক বলা যায়? যায় না। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে ধর্মকে ধারণ করার মধ্যেই বস্তুর সার্থকতা নিহিত।
.
একই কথা প্রযোজ্য মানুষের ক্ষেত্রেও। মানুষকেও কোনো না কোনো ধর্ম ধারণ করেই জীবনযাপন করতে হয়। এক্ষেত্রে মানুষের সামনে কেবল দুইটি রাস্তা। একদিকে ন্যায় ও সত্য, অন্যদিকে অন্যায় ও অসত্য। পরিণতিও দুইটি- শান্তি ও অশান্তি। এখন হয় তাকে ন্যায় ও সত্য ধারণ করতে হবে, নতুবা অন্যায় ও অসত্যকে।
.
আলো নেই মানেই অন্ধকার আছে, দিন নয় মানেই রাত। তেমনি কেউ সত্য ও ন্যায় ধারণ করল না মানেই সে অন্যায় ও অসত্যকে ধারণ করল। এখানে ধর্মহীন বা ধর্মনিরপেক্ষ থাকার চিন্তা যদি কেউ করেন সেটা হবে অলীক কল্পনামাত্র। তবে হ্যা, আপনি যদি ধর্ম বলতে মানুষের প্রকৃতিজাত গুণ বা বৈশিষ্ট্য না বুঝে কতগুলো আনুষ্ঠানিকতা, রীতি-নীতি, নির্দিষ্ট লেবাস, আর শাস্ত্র হাতড়ানোকে বুঝে থাকেন তাহলে কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা অলীক বিষয় থাকে না। সেক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা যথার্থ বলেই প্রতীয়মান হয়।
আনুষ্ঠানিকতা, রীতিনীতি, পোশাক-আশাক কোনো সার্বজনীন ও শাশ্বত বিষয় নয়। ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের ভিন্ন ভিন্ন লেবাস, ভিন্ন ভিন্ন শাস্ত্র। প্রার্থনা পদ্ধতিও একেক সম্প্রদায়ের একেক রকম। সেক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা রাষ্ট্র যদি বলে, আমি কোনো বিশেষ শাস্ত্রের, বিশেষ লেবাসের, বিশেষ আনুষ্ঠানিকতার লোকের উপর অন্য কোনো বিশেষ শাস্ত্রের, লেবাসের ও আনুষ্ঠানিকতা পালনকারী লোকের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী নই, আমার কাছে সবাই সমান, তাতে দোষের কিছু নেই, বরং তেমনটাই সকলের কাম্য হওয়া উচিত। এই অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতা অলীক তো নয়ই, বরং খুবই বাস্তবসম্মতই বলা চলে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে- ধর্ম তো বর্তমানের মত আনুষ্ঠানিকতা ও লেবাসসর্বস্ব বিষয় নয়।
.
মূল ধর্ম হচ্ছে ঐ ন্যায়, ঐ সত্য যা আমাদেরকে শান্তি এনে দিবে, যাকে ধারণ করে স্বার্থপর মানুষ পরোপকারী হবে, আত্মকেন্দ্রিক মানুষ আত্মত্যাগী হবে। ফলদায়ক বৃক্ষের ডাল-পালা থেকে শুরু করে শেকড়-বাকল পর্যন্ত, সবকিছুর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে- ফল। সেই ফলটাই যদি না পাওয়া গেল তাহলে ডাল-পালা-লতা-পাতার কী মূল্য? ধর্মের আত্মা হলো ন্যায় ও সত্য। সেই আত্মাকেই যখন ভুলে যাওয়া হয়েছে, ধর্মকে যখন কেবল লেবাস-সুরত, আর আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে, ধর্মবিশ্বাসী মানুষের ঈমানকে অপব্যবহার করে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে, তখন স্বভাবতই ধর্ম তার আবেদন হারিয়েছে। আর সেই সুযোগে যুগের প্রয়োজনেই জন্ম হয়েছে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র। চিন্তাশীল ও যুক্তিশীল মানুষ ধর্মের নামে এই অন্ধত্ব, জড়ত্ব ও কুপমণ্ডূকতা দেখে ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে ওই ধর্মনিরপেক্ষতার ছাতার নিচে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। ধর্মের প্রতি তারা এখন বীতশ্রদ্ধ!
.
আমরা হেযবুত তওহীদ যখন ধর্মের কথা বলি, ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত- সকল অঙ্গনে ধর্মের উপযোগিতা তুলে ধরি, তখন ঐ ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদে উদ্বুদ্ধ লোকগুলো মনে করেন আমরাও বুঝি প্রচলিত আনুষ্ঠানিকতাসর্বস্ব, পোশাকী ধর্মের কথাই বলছি। ফলে পুরো বক্তব্য না শুনেই অনেকে আমাদেরকে ভুল বোঝেন, তিরস্কার করেন। তারা কবে অনুধাবন করবেন যে, ধর্ম কোনো আনুষ্ঠানিকতার নাম নয়? তারা কবে বুঝবেন- সত্যই ধর্ম, আর মিথ্যাই অধর্ম?

প্রয়োজনে – ০১৭২২ – ৬০৬০৪৫।

অমর একুশে এবং আমরা বাঙালি

bangla-language

একুশে ফেব্রুয়ারি! এতদিন ছিল শহীদ দিবস আর এখন স্বীকৃতি পেয়েছে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবসের। এটা আমাদের গর্ব, বাংলা আমাদের অহংকার!
ছোট বেলায় আমি নিজে এই দেশের বাহিরে বাবা মার সাথে এই বাংলাদেশের বাইরে অবস্থান করেছি। সেখানে বাংলা স্কুলেই পড়তাম। ২১শে ফেব্রুয়ারি এলেই স্কুল থেকে প্রভাতফেরীতে বের হতাম, টিচাররা সেফটিপিন দিয়ে বুকে কাল ব্যাজ আটকিয়ে দিতেন। সবাই একে একে লাইন ধরে বের হতাম। বেশ অনেকদিন পরে বাংলা কোন সিনেমার একটা গান “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি” গাইতাম। তখন আস্তে আস্তে বুঝতে শিখেছি ভাষা কাকে বলে মাতৃ ভাষা কাকে বলে। আমরা তখন ঘর এবং স্কুলের বাইরে ভিন্ন ভাষায় কথা বলতাম।
একসময় পেপার পত্রিকা পড়ে জানলাম ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস কেমন করে হয়েছে কে এবং কারা এই ভাষার জন্য শহীদ হয়েছিল। তাদের জন্য বুকে কষ্ট হতো আবার নিজেরা বাংলায় কথা বলতে পারি বলে গর্বও হোতো। এই বিশ্বের একমাত্র বাংলা ভাষার জন্যই যুদ্ধ করতে হয়েছিল জানলাম। আরও জানলাম ব্রাজিলিয়ানরা একটা গান গায় “ফিরিয়ে দাও আমাদের ভাষা” ওদের ইতিহাস এখনও আমি জানি না আসলে জানার সুযোগ পাইনি।
21 February Unique Facebook Covers (4)
ইদানীং একটা ব্যাপার দেখে খুবই অবাক লাগে এই ফেব্রুয়ারি মাস এবং ২১শে ফেব্রুয়ারির দিন এলেই আমাদের মনে পড়ে আমরা বাঙালি, বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের দরদ উথলে উঠে কিন্তু এই মাস পার হয়ে গেলেই আমরা একটু শিক্ষিত যারা তারা কথার সাথে ২/১টা ইংরেজি না বলতে পারলে তাকে ছোট বা মূর্খ ভাবি। ভিন্ন ভাষা জানা বা বলতে পারা প্রয়োজন সে আমি আমার জীবনের ৩৬ বৎসর বিদেশের নানা দেশে থেকে এসে হারে হারে বুঝতে পারি। কিন্তু বিদেশে আমি নিজেকে বাংলা দেশের এবং আমার ভাষা বাংলা বলে নিজেকে গর্বিত মনে করেছি কিন্তু ভেবে পাইনা অনেকেই এতে লজ্জা পায় কেন!
এদেশে দেখি সরকারি অফিসে বাংলায় নথিপত্র লেখা এবং পত্র যোগাযোগ করা সরকারি ভাবে বাধ্য করা হয়েছে। খুব ভাল লাগে। অপেক্ষায় আছি কবে আমাদের এই বাংলা ভাষায় উচ্চ শিক্ষা নেয়া যাবে । কিন্তু বেসরকারি অফিসে কেন এই বাংলা ভাষা চালু হচ্ছে না? সরকার কেন এদিকে দৃষ্টি দিচ্ছে না? কেন এই দেশের মানুষ “আমি বাংলা পড়তে পারি না, আমি বাংলা লিখতে পারি না” বলে গর্ব বোধ করে?
আমাদের বাংলা ভাষার দাবী জানানো, যুদ্ধে প্রাণ দেয়ার কথা বিচার করে এই দিনটিকে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস প্রচলিত হয়েছে এতে মনটা আরও আনন্দ পায়। কিন্তু দুঃখ লাগে যখন দেখি এই মাসটা চলে গেলে সবাই বাংলার প্রতি কেমন যেন অবজ্ঞা দেখায়। আমি ভাল বাংলা জানি না, কম্পিউটারে বাংলা লিখতে পারি না, বাংলা বানানে হাজার হাজার ভুল। তাহলে কি আবার আমাদেরকে এই বাংলার জন্য যুদ্ধ করতে হবে? এসব দেখে ভীষণ অবাক লাগে। কবে তোরা বাংলা শিখবি, কবে তোরা বাঙালি হবি?
এই একটাই প্রশ্ন আমার।
আছে কেও যিনি আমার প্রশ্নের জবাব দিবেন!