বিভাগের আর্কাইভঃ অণুগল্প

মামুনের জোড়া অণুগল্প

‘এতোদিনে বুঝিলেন মহাশয়
মাসে মাসে বেতন কেন হয়,
চাকুরির মধ্য আছেন বলে
এ ছাড়া অন্য কিছু নয়।’

– অনেক আগে দেখা একটা নাটকের শেষে এই গানটি ছিল। একদিন একজন অফিসের বসের মনে হল, ‘তিনি বেতন কেন পান? কি এমন কাজ করেন তিনি যে তাকে বেতন দিতে হবে?’ এই চিন্তায় এই বস ভদ্রলোক অস্থির হয়ে গেলেন। সাব-অর্ডিনেটদেরকে জিজ্ঞেস করেন,
: আমি বেতন কেন পাই?
: স্যার, আপনি আমাদেরকে নির্দেশ দেন বিভিন্ন কাজের জন্য, তাই পান।
: তোমাদের আমি কি নির্দেশ দেই?
: নির্দেশ তো আগেই দেয়া আছে স্যার, আমরা সেটাই পালন করি।

-এই উত্তরটা ও বসের মনঃপুত হল না। নির্দেশ যদি আগেই দেয়া হয়ে থাকে তবে তার আর প্রয়োজন কিসের। বাসায় এসে বউ-ছেলেমেয়েকেও একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন। তাঁরা বলেন যে, তার সংসারে বউ-ছেলেমেয়েরা আছে , তাদেরকে পালতে হবে বিধায় তিনি বেতন পান। এটাও পছন্দ হয় না তাঁর।

পরবর্তীতে তিনি ধরে ধরে সবাইকে এই একই প্রশ্ন করেন। এক পর্যায়ে তার বউ তাকে একজন সাইক্রিয়াটিস্ট এর কাছে নিয়ে যান। সেখানে সাইক্রিয়াটিস্ট তাকে জিজ্ঞেস করেন,
: আপনাকে চাকুরী দেবার সময় কি এপয়েন্টমেন্ট লেটার দেয়া হয়েছিল?
: হ্যা, হয়েছিল।
: আপনি কি রিটায়ারমেন্টের কোনো নির্দেশ সম্বলিত কাগজপত্র পেয়েছেন?
: জী না, পাই নাই।
: তাহলে তো আপনাকে বেতন নিতেই হবে। ওটা (রিটায়ারমেন্টের) না পাওয়ার জন্যই আপনাকে বেতন দেয়া হয়।

এবার বস ভদ্রলোক খুব সহজেই বুঝতে পারলেন।

আমাদের দেশেও উচ্চপদস্থ সরকারী আমলা, মন্ত্রী, এমপি এদের ভিতরও হয়তো ঠিক এই বোধ কাজ করে। কিন্তু তাদের ভিতর ঐ বস ভদ্র লোকের মতো অস্থিরতা নেই বিধায় কোনো লজ্জাও নেই। এইজন্যই তাঁরা নির্লজ্জ ভাবে জনগনের টাকায় প্রতিপালিত হয়। আর একতরফা শুধু নেবারই প্র্যাকটিস করেন তারা। আর এই জন্যই নির্বাচন এলে আমাদের দুয়ারে জোড়হাত করে ভিক্ষুকের মতো দাঁড়িয়ে থাকেন তারা। বাকি সময়গুলিতে জনগনের জন্য কিছু করেছেন কিনা, সেটা বেমালুম ভুলে থাকেন!

এক একজন বেহায়া, নির্লজ্জ এবং অকৃতজ্ঞ ভিক্ষুক!

#বেতন_কেনো_পাই_অণুগল্প_৪৭৬

****
কামিনী রায় এর একটা কবিতা পড়েছিলাম অনেক আগে-
‘… করিতে পারি না কাজ
সদা ভয় সদা লাজ
সংশয়ে সংকল্প সদা টলে
পাছে লোকে কিছু বলে…।’

আর একটা গল্প শুনেছিলাম…

এক বাবা ও ছেলে তাদের গাধাটা বাজারে বিক্রী করতে নিয়ে গেল। পথে বাবা গাধার পিঠে চড়েন আর ছেলে পায়ে হেঁটে যায়, এ দৃশ্য দেখে পথচারী ক’জনের উক্তি,
: দেখ, কেমন বাপ! নিজে আরামে যাচ্ছে, আর ছেলেটাকে এই রোদ্দুরে হাঁটায়ে নিয়ে যাচ্ছে।

একথা শুনে ছেলেকে গাধার পিঠে চড়ানো হল। বাবা এখন হাঁটছেন। কিছুদূর যাবার পরে আরো ক’জনের উক্তি,
: এ কোন যুগরে বাবা! নিজে গাধায় চড়ে বৃদ্ধ বাবাকে হাঁটায়ে নিয়ে যাচ্ছে, এমন কুলাঙ্গার ছেলে তো আর দেখি নাই!

এই কথা শুনে আবার বাপ-বেটা দু’জনেই এবার গাধার পিঠে চড়লেন। পথে এবার কিছু পশুপ্রেমিকদের মন্তব্য,
: দেশ থেকে মায়া-মমতা সব উঠেই গেল মনে হচ্ছে। এই অবলা পশুটি কথা বলতে পারে না বলে কি এভাবে অত্যাচার করতে হবে?

এবার দু’জনে দু’জনের মুখের দিকে তাকিয়ে নীরবে মাথা নাড়লেন। এরপরের দৃশ্য…
একটা গাধাকে বাঁশের সাথে চার পা বেঁধে বাপ-বেটা কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে দেখে অনেক মানুষ খুব মজা পেল। কেউ কেউ আনন্দে হাততালি দিতে দিতে ওদের পিছু নিলো। মোটকথা কিছু একটা করার তাঁরা পেয়ে গেছে দেখে খুব ভাল লাগছিল সবার। এমন সময় একটা বাঁশের সাঁকো সামনে এলো। পার হতে গিয়ে মজা দেখতে আসা লোকজনের চিৎকারে গাধাটা ভয় পেয়ে চারপা’র বাঁধন খুলে ফেলার চেষ্টা করল এবং বাপ-বেটার কাঁধ থেকে নীচে খালে পড়ে গেলো। অনেক পানি থাকায় আর পা বাঁধা থাকায় গাধাটির জলে ডুবে মৃত্যু হল। তখন কিছু লোক এসে সেই বাপ-বেটা দু’জনকে বলল,
:এমন গাধামি কি কেউ করে? গাধাকে কাঁধে করে নিয়ে আসার দরকারটা কি?

একবার আমার বাবরি চুল রাখার পরে অফিসে আমার সামনে এবং আড়ালে অনেকে এই চুল নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করেছে। কেন ভান্ডারীদের মত চুল রেখেছি… বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরেছে ইত্যাদি ইত্যাদি কথা শুনে শেষে এক রাতে চুল একেবারে ছোট করে ফেললাম। পরেরদিন অফিসে আসার পরে ক’জন আমাকে দেখে বলল,
: এইটা একটা কাজ করলেন? কি সুন্দর লাগতো আপনাকে বাবরি চুলে!

আমি কি উত্তর দিবো কিংবা রাগ করা উচিত হবে কিনা সেটা ভাবতে লাগলাম।

ঠিক এভাবেই আমাদের দেশে যে কোনো ভাল কাজ করতে গিয়ে, জনে জনে প্রদত্ত মতামতের প্রভাবে, সেই ভালো কাজগুলিও শেষ পর্যন্ত পানিতে পড়ে সলিল সমাধি লাভ করে। আর উদ্যোক্তাকে সেই সমাধির পাশে বসে গাধাটির মালিকের মতো করুন নয়নে গাইতে হয়-
“তোমার সমাধি
ফুলে ফুলে ঢাকা…।।”

#পাছে_লোকে_কিছু_বলে_অণুগল্প_৪৭৭

ভাঙ্গনের_শব্দ_শুনি_অণুগল্প

১.
একদিন ঘুম ভেংগে চেয়ে দেখি মা নেই বিছানায়, আমি বড্ড আদুরে বাবুটা তার, অনেক মন খারাপ হল আমার। :(

খুঁজতে বের হলাম একা একা, পৃথিবীর এমন কোনো জায়গা বাকি রাখলাম না মাকে খুঁজে খুঁজে, শেষে এক বিশাল বরফ ঢাকা প্রান্তরে এসে থামলাম। থামলাম সামনে আর পথ ছিল না বলে।

শুভ্রতায় ছেয়ে আছে চারিদিক। একটি মাত্র গাছ আমার সামনে দাঁড়িয়ে। মুখোমুখি বৃক্ষ আর আমি। গাছটিই আমায় জানায় এটাই ‘ডেড-এন্ড’। ফিরে যাবার হয়েছে সময়।

তবুও আমি মাকে খুঁজতে ‘ডেড-এন্ড’কে ও পাড়ি দিতে রাজী ছিলাম! কিন্তু মা ছিলেন আমার পিছনে। মাথার উপর। ফেলে আসা পথের প্রতিটি অণুতে অণুতে। অলিতে গলিতে। বরফ চাইয়ের সুক্ষ্ণ ফাটলে।

আমি দেখলাম না। আমি পিছু ফিরলাম না। তাই জানলাম না, মা ছিলেন আশেপাশে।

আজো আমি আর সেই নাম না জানা বৃক্ষটি মুখোমুখি সেই বিরান প্রান্তরে। ডেড- এন্ডের পাহারাদার আর আমি, নিজেদের ভিতর এক জটিল সমীকরণে ব্যস্ত থাকি।

মা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকেন ঠিক আমার পিছনে। আদুরে প্রিয় বাবুটা কখন ফিরে তাকায়!

আমি কি তাকাই?
ফিরিনা আমি। কেবলি খুঁজে মরি।

মাকে খুঁজতে হয়না.. মা থাকেন সবসময়.. অনুভবে কল্পনায় মাখামাখি। আমি আমার মায়ের আঁচলের নরম আদর ছিলাম।

ছিলাম?
এখন কি আর নেই?
একবার মা হারিয়ে গেলে, আর পাওয়া যায় না।

২.
আমি কোনো একসময়ে আমার পুরোপুরি বিদ্রোহী জীবনে আবিষ্কার করলাম, আমি নিজেকে দুই ভাগ করে ফেলেছি, ‘জলে বাস- কুমির নয়, জলের সাথে বিবাদ’!

অনুভুতি শাঁখের করাত হয়ে কাটতে লাগল, বাবার পরিচয় বহন করছি, তাকেই আবার স্বীকার করতে পারছি না.. তাকে আঘাত করছি, আবার সেই আঘাতে নিজে কষ্ট পাচ্ছি.. কিছুতেই আর মিশতে পারছি না, কোনমতেই নিজেকে ছাড়াতেও পারছি না!

আমি একজন মানুষ দু’জন হয়ে গেলাম, একজন সবল শ্রেণীর অংশ, অন্যজন দুর্বল শ্রেণীর.. এক দ্বৈত জীবন, আসলে দুইয়ে মিলে আমি বোধ হয় এই দুটো ধারা থেকে ভিন্ন আরেক ধারার মানুষ হয়ে গেলাম!

শেষে একদিন…

বাবা কিছুক্ষণ লড়াইটার মাঝখানে বসে রইলেন। এক সময় চাপা গলায় বললেন, ‘অসম্ভব!’ কর্তা পুরুষ নিজের অজান্তে ঘোষনা দিয়ে ফেললেন। বিদ্রোহ সইবেন না।

কেউ জিজ্ঞেস করল না কি অসম্ভব। সবাই বুঝতে পারছিল, একসাথে থাকা অসম্ভব।

মা আসলেই কণার জেদ সইতে পারছিলেন না। প্রতিদিনের বিরোধের সাক্ষী হওয়া বাবা আর আমি শিহাবের জন্যও কঠিন ছিল। আড়ালে আরো কত সত্য ছিল কে জানে।

আমি অতটুকু শুনেই বললাম, ‘তাহলে আমরা আপনার সাথে না থাকি?’

অবচেতনে আমি কি নিজের একটা রাজত্ব চাইছিলাম? বাবা কি তা বুঝলেন? কেন বললেন না, ‘ঘরটা ভেঙ্গো না।’

#ভাঙ্গনের_শব্দ_শুনি_অণুগল্প_৪৯৪

★ অণুগল্পটি প্রথম পুরুষ/নাম পুরুষে লেখা।

যখন_মেঘ_সরে_যায়_অণুগল্প

যখন মেঘ সরে যায়, উত্থিত শিশ্নের মত ধীরে ধীরে চাঁদেরকণারা ঘিরে ফেলে সমগ্র দৃশ্যপট।

ফুল গাছের আড়াল থেকে সে হেঁটে আসে চাঁদ হয়ে, ওর শরীরে আলপনা এঁকে চলে কামনা শিশুর দল!

আজ যে তার আসার কথা, যুবতী হৃদয়ে বিষম ব্যথা, ভালবাসা ছুঁয়ে যায় তার কানায় কানায়.. জোছনারা অপেক্ষায় চরম বিহ্বলতায়!

আজ ও কি তবে আসবে না সে?

#যখন_মেঘ_সরে_যায়_অণুগল্প_৪৯৫

পারুর রুপার কৌটো // অণুগল্পঃ ৫০৬

শিহাব পারুর চোখগুলো ভাল করে দেখে। শান্ত… স্নিগ্ধ.. শিহাবের পারু! ওর কথাগুলোকে মনে হলো বাতাস, শিহাবের চুল এলোমেলো করে দিয়ে কোথায় যেন উড়ে যাচ্ছে।

ভাবনায় পেয়ে বসে শিহাবকে। ভাবতে থাকে…

জীবন খুব সুন্দর! ভাল লাগার অসহ্য সুখ নিয়ে কত কাছাকাছি আছে দু’জন!! মুহুর্তগুলো চলে যাচ্ছে দ্রুত। জীবনে সময় এতো কম!! তবুও জীবন তো।

পারুর কাঁধে মাথা রেখে বসে রইলো শিহাব। তাঁর হাতে একটা বই… রবীন্দ্রনাথ… গল্পগুচ্ছ। পারু পড়ছে, শিহাব পাশে আছে। যতক্ষণ থাকা যায়।
এক জীবন কতটুকু সময়?

চোখ দিয়ে নেমে এল দু’ফোটা জল। শিহাবের ইচ্ছে করল, পারুর সযত্নে গড়া রুপার ‘প্যান্ডোরার বাক্সটির’ ভেতরে যত্ন করে তা রেখে দেয়। আশার সাথে নিরাশা মিশে একাকার হয়ে যাক!

কতটা কষ্ট পেলে অনুভূতি অশ্রু হয়? ঝরে পড়া প্রতিটি স্বেদ বিন্দুর ভিতর জমাট বাঁধা- এক একটি মহাকাব্য!
কষ্টগুলো নিজের চেতনার সব ক’টি অনুভবে ছুঁয়ে-দেখে অনুভব করা একজন শিহাব, নরম মোম হয়ে গলে যায়। ভেংগে যায়.. কুয়াশার অস্পষ্টতায় ডুবে যায়। আবার জেগে উঠে!

তবে একজন অনুভবক্ষম শিহাবের বেলায় বেদনারা কৃষ্ণচুড়ার সবুজকে লালের লালিমায় ছেয়ে দেয়। বিবর্ণকে বর্ণীল করে। অশ্রু কাব্য?

দূর থেকে ভেসে আসা সন্ধ্যা আরতি, শিহাবকে বিষন্ন করে.. আরও। মন উদাস করা প্রলুব্ধতায় সে ব্যথিত হয়। আবারও দু’ফোটা অশ্রু ওর অগোচরে ঝরে পড়ে পারুর রুপার কৌটায় নিরবে জমা হয়। এত কাছে থেকেও পারু কি শিহাবের ভাবনাগুলো বুঝতে পারে? সে কি শিহাবের অশ্রুগুলো ওর রুপার কৌটায় জমিয়ে রাখতে চাইছে?

বাউরি বাতাসে ভেসে বেড়ানো গল্পগুচ্ছে মগ্ন পারুর কয়েকটি অবাধ্য চুল শিহাবের চিবুক নিয়ে খেলে। আত্মবিস্মৃত শিহাবের দৃশ্যমান দশ দিক সহ অদৃশ্য সকল দিকগুলি মুহুর্তে বন্ধ হয়। একটি দিকই নিজেকে প্রকাশ করে সেদিকে শিহাবকে গিলে নেয়। ওটা পারুর দিক। শিহাবের পারু!

‘ওহ পারু! প্রিয়দর্শিনী আমার।’ ভাবতেই পারু প্রিয় বইকে আলতো করে পাশে রেখে দেয়। চোখ তুলে তাকায়। নিরবে জ্বলে ওঠে। চোখের তারায় ভালোবাসা। শিহাব ডুব দেয়।।

#পারুর_রুপার_কৌটো_মামুনের_অণুগল্প_৫০৬

স্ফুলিঙ্গ_অণুগল্প_৪৬৫_৪৬৬_৪৬৭

[একজন গল্পকার একই গল্পকে ভিন্ন ভিন্ন আংগিকে লিখতে পারেন। আর লেখকের লেখায় পাঠক সেইভাবে ‘রিয়্যাক্ট’ করবেন। লেখক তার লেখার দ্বারা পাঠক মনকে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক-উভয় দিকেই তাড়িত করতে পারেন।

আমি একটি অণুগল্পকে তিনভাবে লিখে দেখিয়েছি। একই ‘থিম’ কিন্তু গল্পত্রয় এর চরিত্রগুলি নেতিবাচক ও ইতিবাচক- উভয় দিকেই নিজেদের চরিত্রকে প্রস্ফুটিত করেছে। এই লেখাটি মূলত লেখকদের উদ্দেশ্য করেই লেখা। লেখকগণ পাঠকদের সামনে লেখায় যে ‘ম্যাসেজ’ দিবেন, সেটা কিভাবে হওয়া উচিত, লিখনীতে নেতিবাচকতা কতটুকু পরিহার করবেন এসব লেখককে অনুভব করে প্রকাশ করতে হবে।

যাইহোক, তিনটি গল্প পড়ে পাঠক অনুভব করুন, গল্পের চরিত্র দুইটির ভিতরে তিন প্রেক্ষাপটে আপনারা কোনটিতে নিজেদেরকে দেখতে চান। ]

১.
স্ফুলিঙ্গ (নেগেটিভ মানসিকতা)

___________________________

সারা রাত কলেজের পরীক্ষার খাতা কেটে সেই ভোর চারটায় ঘুমাতে গেছে মাহতাব। কাল শুক্রবার। ভেবেছে বারটা পর্যন্ত একটানা ঘুমাবে। ঘন্টা দুই ঘুমিয়েছে কেবল, তখনি কণা ওকে ডাকতে থাকে।

: অ্যাই, ওঠতো। দেখ মা কি পাঠিয়েছে!

প্রচন্ড রাগ নিয়ে বউয়ের দিকে তাকায়। ঘুমজড়ানো লাল চোখ পিটপিট করে বউয়ের হাসিমুখ দেখে। আরো রাগ বাড়ে। বিছানার সামনের মেঝেতে পড়ে আছে জিনিসগুলো। বেশ বড়সড় একটি প্লাষ্টিকের ম্যাট, সাদা পলিথিনে ভর্তি আতপ চাল, কোরবানির গরুর গোশত- কিছু কাঁচা, হাঁড়িতে রান্না করাও দেখল বেশ খানিক। চোখ পুরোটা মেলে এগুলোর সাথে আচারের ডিব্বার পাশে মুড়ি এবং খইয়ের টিন দেখতে পেলো।

অবশেষে খুব ঠান্ডা স্বরে কণাকে জিজ্ঞেস করে,

: এগুলোর সাথে আমার জন্য তোমার বাবার পুরনো দু’ একটা জামাও দেয় নাই?

মাহতাবের অতি শীতল কথাগুলো কণার ভিতরে কোথায় যেন ওলটপালট করে দেয়। সে মুহুর্তে জ্বলে উঠে।

আগুন জ্বলে দু’দিকেই।

২.
স্ফুলিঙ্গ (একজনের নেগেটিভ এবং অন্যজনের পজিটিভ মানসিকতা)

__________________________________________

সারা রাত কলেজের পরীক্ষার খাতা কেটে সেই ভোর চারটায় ঘুমাতে গেছে মাহতাব। কাল শুক্রবার। ভেবেছে বারটা পর্যন্ত একটানা ঘুমাবে। ঘন্টা দুই ঘুমিয়েছে কেবল, তখনি কণা ওকে ডাকতে থাকে।

: অ্যাই, ওঠতো। দেখ মা কি পাঠিয়েছে!

প্রচন্ড রাগ নিয়ে বউয়ের দিকে তাকায়। ঘুমজড়ানো লাল চোখ পিটপিট করে বউয়ের হাসিমুখ দেখে। আরো রাগ বাড়ে। বিছানার সামনের মেঝেতে পড়ে আছে জিনিসগুলো। বেশ বড়সড় একটি প্লাষ্টিকের ম্যাট, সাদা পলিথিনে ভর্তি আতপ চাল, কোরবানির গরুর গোশত- কিছু কাঁচা, হাড়িতে রান্না করাও দেখল বেশ খানিক। চোখ পুরোটা মেলে এগুলোর সাথে আচারের ডিব্বার পাশে মুড়ি এবং খইয়ের টিন দেখতে পেলো।

অবশেষে খুব ঠান্ডা স্বরে কণাকে জিজ্ঞেস করে,

: এগুলোর সাথে আমার জন্য তোমার বাবার পুরনো দু’ একটা জামাও দেয় নাই?

মাহতাবের অতি শীতল কথাগুলো কণার ভিতরে কোথায় যেন ওলটপালট করে দেয়। সে মনের ভেতরে মুহুর্তেই জ্বলে উঠে, আবার দপ করেই নিভে যায়।

ভাবে, আহারে বেচারা, কাজের চাপে কী দশা!

আবেগে কাণ্ডজ্ঞান ভুলে যাওয়ায় নিজেকে শাসায় কণা,
বড় অন্যায় হয়ে গেছে!

উঠে যায় মাহতাবের দিকে-
কপালে হাত রেখে আস্তে করে বলে- স্যরি!

বাইরে তখন সকালের মিষ্টি রোদের সাথে শরতের মেঘের খুনসুটি!!

৩.
স্ফুলিঙ্গ (স্বামী স্ত্রী উভয়ের পজিটিভ মনোভাব)

_____________________________

সারা রাত কলেজের পরীক্ষার খাতা কেটে সেই ভোর চারটায় ঘুমাতে গেছে মাহতাব। কাল শুক্রবার। ভেবেছে বারটা পর্যন্ত একটানা ঘুমাবে। ঘন্টা দুই ঘুমিয়েছে কেবল, তখনি কণা ওকে ডাকতে থাকে।

: অ্যাই, ওঠতো। দেখ মা কি পাঠিয়েছে!

প্রচন্ড রাগ নিয়ে বউয়ের দিকে তাকায়। ঘুমজড়ানো লাল চোখ পিটপিট করে বউয়ের হাসিমুখ দেখে। আরো রাগ বাড়ে। বিছানার সামনের মেঝেতে পড়ে আছে জিনিসগুলো। বেশ বড়সড় একটি প্লাষ্টিকের ম্যাট, সাদা পলিথিনে ভর্তি আতপ চাল, কোরবানির গরুর গোশত- কিছু কাঁচা, হাড়িতে রান্না করাও দেখল বেশ খানিক। চোখ পুরোটা মেলে এগুলোর সাথে আচারের ডিব্বার পাশে মুড়ি এবং খইয়ের টিন দেখতে পেলো।

স্ত্রীর উচ্ছ্বসিত হাসিমুখ দেখে রাগটা গিলে ফেলল মাহতাব। কণার এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমাদের বিয়ে হয়েছে কত বছর বল তো? মা কি এখনো বোঝেন না তোমাকে ভালবাসার জন্য আমার কোন উপঢৌকনের প্রয়োজন নেই?’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলে, ‘যাক, এসেই যখন গিয়েছে, তুমি বরং মাংসটা চাপিয়ে দাও। সারারাত ঘুমাইনি লক্ষ্মীটি, একটু ঘুমাই, আমি উঠে মাকে ফোন করে থ্যাঙ্ক ইউ জানাব’।

খুশি হয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় কণা। আসলেই খুশিতে মাহতাবের ঘুমের কথাটা একদম মনে ছিলোনা, ভীষণ ভুল হয়ে গিয়েছে! দুপুর তিনটা পর্যন্ত আর বাচ্চাদেরও ঐদিকে যেতে দেবেনা সে। ততক্ষণে মাহতাবের প্রিয় কাচ্চি বিরিয়ানী রান্না হয়ে যাবে। ঘুম থেকে উঠে কি সারপ্রাইজড’ই না হবে সে!

ওদিকে স্ত্রীকে হাসিমুখে যেতে দেখে মাহতাবের মনটাও ভাল হয়ে যায়। আজ ঈদের দিন বকা দিলে মনটা খারাপ হত বেচারীর। শাশুড়ি যতই মনে করুন তাঁর উপহার উপঢৌকন তাঁর আহ্লাদী মেয়ের সংসার টিকিয়ে রেখেছে, সহজ সরল বৌটাকে সে আসলেই অনেক ভালোবাসে। একটু বোকা মেয়েটা, কিন্তু সে আসলেই মাহতাবকে অনেক ভালোবাসে। নিশ্চিত সে বাচ্চাদেরও আর দুপুর তিনটা পর্যন্ত এমুখো হতে দেবেনা। ভালোই হোল, এখন বারোটার পরিবর্তে তিনটা পর্যন্ত ঘুমোনো যাবে!

#স্ফুলিঙ্গ_অণুগল্প_৪৬৫_৪৬৬_৪৬৭

দ্য_কালারব্লাইন্ড_অণুগল্প


গতরাতে একটা ছবি আঁকা শুরু করেছিলাম।

নির্দিষ্ট কিছু নয়। কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চেয়েছিলাম। তাই আমার কাজের ক্ষেত্রটাকে বেছে নিলাম সময় কাটানোর জন্য। রঙ আর তুলির সমন্বয়ে আমার হৃদয়ে অনেক আগে থেকে প্রচ্ছন্ন একটি মুখচ্ছবিকে ফুটিয়ে তুলতে চাইলাম। একটু একটু করে অগ্রসর হলাম। জীবনের সকল মেধা-দক্ষতা ব্যবহার করে, সেই হাসিমুখটিকে তুলে আনতে চাইলাম। কিন্তু রাতে কিছুই হলো না।

নিজেকে এক বর্ণান্ধ শিল্পী বলে মনে হল আমার! একজন ‘কালার ব্লাইন্ড’। যা কিছুই আঁকি- যে রঙে আঁকি-কিছুই দেখি না।

গত পনের বছরে আঁকার তাড়ণা তুলির পর তুলি আঁকিয়ে নিয়েছে আমাকে দিয়ে।

আজ মনে হচ্ছে আমি বুঝি নিজেই দেখি না কি আঁকি?
আজ জীবনের ক্যানভাসে আঁকা ছবিটায়ও কোনো রঙ নেই!

ছবি জুড়ে শূণ্যতা! শূণ্যতা যেন হঠাৎ সারা পৃথিবীতে!!

রঙ নেই জীবনেও আমার.. আমি এক বর্ণহীন..অসহায়.. নিঃসীম নিঃসংগতা মাঝে ডুবে থাকি নিঝুম নিমগ্ন সুখে!?।।

#দ্য_কালারব্লাইন্ড_অণুগল্প_৪৬৮

অনুগল্প- ১

অনিমেষকে প্রায় প্রতিমাসেই একবার সাড়ে তিনশ কিলোমিটার দূরে যেতে হয়। সুপর্নার কাছে ব্যাপারটা অজানা। কাল যখন সুপর্নার সাথে ফেসবুকে চ্যাট করছিলো তখন সে নিজের মধ্যে ছিলো না। অনিমেষ এর টেক্সট দেখে সুপর্নাও বুঝতে পারে না।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই ক্লায়েন্ট এর কাজ শেষ করে হোটেলের কাছেই এক সুপার মার্কেটে গিয়ে কেনা কাটা করতেই মনে পড়লো এই সুপার মার্কেট এর পয়েন্ট কার্ড 💳 করা হয় নাই।

সে ভাবে এই ফাঁকে কার্ডটা করে নিলেই হয়। ভেবেই চলে গেল সুপার মার্কেটের সার্ভিস কাউন্টার এ। এক সুন্দরী সেলসষ্টাফ অনিমেষ এর সাহায্যে এগিয়ে এলো। কথা শুরু করতেই অনিমেষ সেই মহিলার মুখের গন্ধ সহ্য করতে পারলো না। তাঁর পয়েন্ট কার্ড করার ইচ্ছেই উবে গেল।

অনিমেষ এর মনে পড়ে গেল ২০১৪ সালে পাসপোর্ট এর মেয়াদ শেষ হলে টোকিও তে গিয়েছিল নতুন পাসপোর্ট করতে। শিনজুকুর হোটেলের কাছেই অনেক খাবার এর দোকানের মধ্যে ভারতের খাবারের দোকানে রাতের খাবারটা সেরে নেবে ভেবেছিলো। দোকানের সামনে যেতেই এক ভারতীয় খুব ভালো করে ক্রেতাদের ডাকছে। তার কথা শুনতে অনিমেষের নাকে সেই লোকের বগলের উদ্ভট গন্ধ ভেসে এলো অনিমেষের নানরুটি আর চিকেন খেতেই ইচ্ছে হলো না। পাশের থাই খাবারের দোকান থেকে রাতের খাবার সেরে নিল। পরদিন বাংলাদেশে এমবেসি থেকে ফেরার পথে মেগরু ষ্টেশানে এক নেপালী রেষ্টুরেন্টে আগের রাতের ভারতের খাবার খাওয়ার ইচ্ছেটা পুরন করলো।

আজ সকালের সার্ভিস কাউন্টারের সেই ঘটনার পর অনিমেষ সুপর্নার চুমু খেতে চাওয়ার ম্যাসেজ পেলো। অনিমেষ এর হাতে সময় কম থাকায় একটা সস্তা চুল কাটার দোকানে গেল এক হাজার আশি ইয়েন দিয়ে পনেরো মিনিটে চুল কাটলো। বাইশ বছর ধরে এই দেশে থাকলেও এই রকম দোকানে দ্বিতীয়বার চুল কাটলো সে।

এরপর সে হোটেলের কাছেই এক অনসেন এ গেল। ছয়শ আশি ইয়েন এর টিকেট কেটে স্নান করতে ঢুকে গেল। অনসেন এ বড় বড় বাথটাব অনিমেষ লক্ষ্য করলো অনসেন এ এক চল্লিশ এবং বিয়াল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর দুটো বাথটাব। এই সব অনসেন এ জন্মদিনের পোষাকে যেতে হয়। শরীরে কোন প্রকার কাপড় রাখা চলে না। বাইশ বছরে অনিমেষ এইসবে অব্যস্ত হয়ে গেছে। স্নান শেষ করে সে ৭৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর সাউনাতে অনেক কষ্টে পাঁচ মিনিট পার করলো। আজ সুপর্না তাঁকে চুমু খেতে ডেকেছে। কোথাও কোন অপ্রিয় গন্ধ রাখা চলবে না।

অনিমেষ সুপর্নার চুমুর কথা ভাবতে থাকে…

অণুগল্প : সাদাসিধা_আরেক_দুপুর

একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ভিন্ন ডিপার্টমেন্টে অনেক ছেলেমেয়ের সাথে দুটো ছেলে মেয়ে পড়তো। একজন জগৎ সংসার ভোলার জন্য রাতদিন নেশায় ডুবে থাকতো। অন্যজন সংসার করবে বলে সবার অমতে বিয়ে করে অকূলে পড়লো।

এরা একদিন সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর সিড়িতে এক আড্ডায় বন্ধুদের ভীড়ে পড়ে পরিচিত হলো। ছেলেটার লাল চোখ, ফর্সা মুখ আর আরো কী কী ব্যাপারের কম্বিনেশন মেয়েটার কেমন যেন লাগলো। বান্ধবীর কাছে সে জানলো ছেলেটা অসুখী, কারণ অজানা। মেয়েটা ভাবলো, সংসারও এক রকম নেশাই, প্রতিদিন মানুষকে ধ্বংস করতে থাকে। দু’জনের মধ্যে একটা মিল পেলো সে।

এই দুপুরের পর আরো একদিন ওখানেই নিঃসংগ বসে ছিলো মেয়েটা, নিঃস্ব,পরাজিত, নির্বান্ধব। ছেলেটা হাসিমুখে সৌজন্যমূলক কিছু কথা বলে চলে গেলো। মেয়েটা নিজের নিঃস্বতার ছবি দেখলো ছেলেটার চোখেমুখে। কিছু বললো না। সংসার একা মানুষের ভীড় ছাড়া আর কী?

কিভাবে যেন ওদের ভিতরে এক অদ্ভুত ভালোলাগা হয়ে গেলো! কিন্তু কেউ কাউকে প্রকাশ করলো না।

সাদামাটা দু’টো দুপুর।
কেউ জানতো না কুড়ি পঁচিশ বছর পর সাদাসিধা আরেক দুপুরে তাদের আবার যোগাযোগ হয়ে যাবে।

পুরানা দিনের কথা ভেবে, কিম্বা আল্লাহ নিয়তিতে তাদের জন্য নতুন কিছু দিন রেখেছিলেন বলেই হয়তো তারা আবার চিনে নিলো দু’জন দু’জনকে। কিন্তু এই চিনে নেয়াটা তাদের জন্য নতুন এক বিড়ম্বনায় ফেলে দিলো। পুরনো সময়ের হৃদয়ের সেই অনুভূতিগুলোকে আজ আর ওরা আগের মত অনুভব করতে পারলো না। হৃদয় যদিও একই শরীরে একই রয়ে গেছে, কিন্তু কালের বয়ে যাওয়ায় আর নতুন কিছু হৃদয়ের সাথে অনুভূতির লেনদেনে একসময়ের চিরচেনা হৃদয়টা আজ কেমন অচেনা মনে হতে লাগলো।

সবকিছু সময়ের প্রয়োজনে যদিও বা ফিরে আসে, কিন্তু ভালোলাগা একবার চলে গেলে সেটা আগের মত আর অনুভূতিতে জোনাক জ্বলা রাত কিংবা শেষ বিকেলের আলোয় ঝলমলে মায়াবী প্রহরকে সাথে নিয়ে আসে না।

#সাদাসিধা_আরেক_দুপুর_অণুগল্প_৪৬৯

রোমান্স_অণুগল্প_৪৯২

‘রিমোট কন্ট্রোল আনতে বলেছিলাম, আনোনি… এ্যাকুরিয়ামের মাছের খাবার, তাও?’

চাকুরি জীবনে বছর দুই আগেও উইকেন্ডে সে বাসায় এলে, বউয়ের এই অনুযোগগুলিকে রোমান্স পূর্ববর্তী অনুঘটক হিসেবে অনুভব করতো শিহাব। হয়তো বউ সাপ্তাহিক এই বিশেষ দিনটিতে, দুই মেয়ের তীক্ষ্ণ চাহনির সামনে নিজেকে আড়াল করার অপচেষ্টা করতো অনুযোগের মোড়কে।

শিহাব জানতো বলেই কণার অফুরন্ত লিস্টের বেশীরভাগ জিনিস-ই ইচ্ছে করে ফেলে রেখে আসতো, আনতো না।

এখন প্রতিদিন অফিস থেকে বাসায় ফেরা। নেই কোনো অনুযোগ, কিছুই আনতে বলে না কণা এখন। তাই বলে রোমান্স বিষয়টি কি নিস্পৃহতায় ভুগছে?

মোটেও না।
জীবনের এই বয়সে এসে রোমান্স ছাড়া আর আছেই বা কি? যেভাবেই হোক, কিভাবে যেন ব্যাপারটা হয়েই যায়। চাই অভিযোগ কিংবা অনুযোগের অনুঘটক থাকুক বা নাই থাকুক।

রোমান্সে রোমান্সে কেটে গেলো শিহাবের এক জীবন!
আর কিছু চাই?

#রোমান্স_অণুগল্প_৪৯২

পার্শ্বচরিত্র

সিমুলেশন ল্যাবে বসে আছি। টিচার তখনো আসেনি। সবাই যার যার ইনস্ট্রুমেন্টস নিয়ে ব্যস্ত। ল্যাব এসিস্টেন্ট এসে পাওয়ার পয়েন্টে ডাটা টেবিল, ডায়াগ্রাম ওপেন করে দিয়ে গেছে। সবাই ব্যাগ থেকে ল্যাব রিপোর্ট বের করে একেক করে টেবিলের উপরে স্তূপ করে রাখছে। একজন আমার সামনে রিপোর্ট এটেন্ডডেন্স সীট পাস করে দিলো, আমার ঠিক উপরের ঘরে কোনও সিগনেচার নেই। কলম বামে টেনে একঘর উপরে যেতে নামটা পড়লাম, মালিহা মাইশা।
আমার ঠিক উপরেই যেহেতু নাম, তার মানে আমার ডান পাশের টেবিলেই থাকার কথা। আশ্চর্য প্রায় সাত মাস এই ল্যাবে দুইটা ল্যাব করছি, অথচ আমার ডান পাশের টেবিলে কে বা কারা ছিল সেটাই জানি না। আমি কি এতটাই আনমনা থাকি ! থাম্ব আঙ্গুল দিয়ে ক্লিক পেন বারবার ওঠা-নামা করছি। এটেন্ডডেন্স সীটে সিগনেচার করছি দেখে পাশ থেকে নাইম বলে উঠলো,
– কি রে নিজের নাম ভুলে গেছিস নাকি? সই টা দে, পাস কর!

এই গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। মালিহা মাইশা নামের কাউকে আমি চিনিই না, তাকে ভাবনায় নিয়ে আসা একদম উচিত না। আমার এখন উচিত ল্যাব এক্সপেরিমেন্টে ফোকাস করা। এই ল্যাবগুলো খুব বিচ্ছিরি। পিন আউট ডায়াগ্রাম দেখে দেখে সার্কিট বানিয়ে বসে থাকতে হয়, কখন টিচার এসে দেখবে- গ্র্যান্ড করবে তারপর পাওয়ার কানেকশন দিতে হবে। সবকিছু ঠিক থাকলে ডাটা টেবিলে ভেল্যু তুলে তারপর আবার টিচারের সিগনেচার নিয়ে ল্যাব থেকে বের হতে হবে। কম্পোনেন্টগুলোও মারাত্মক খবিশ। সিরিয়াল নাম্বার দেখে নিতে হয়, সিরিয়াল নাম্বার থাকে পিন আউটের বিপরীত পিঠে। এত ছোট ছোট করে লেখা থাকে যে পড়তে গেলে রীতিমত চোখ খুলে হাতে নিয়ে পড়তে হয়।

নিজেকে অনেকবার কমান্ড দিয়েছি অলরেডি, ফোকাস জাহিদ! ফোকাস! এই বুড়ো সাদা মাথার টিচার মোটেও ভালো গ্রেড দেয় না, ফোকাস! ফোকাস।
কিন্তু কিছুতেই ফোকাসটা ল্যাবে দিতে পারছি না। সব ফোকাস চলে গেছে মালিহা মাইশার দিকে।

ল্যাব সীট হাতে নিয়ে হয়ত ভাবতে বসে গেছি, মালিহা’টা কে? তাকে আমি আগে দেখেছি কী?
সে আমাকে দেখেছে? নাকি সেও আমার মত বেখেয়ালি!
আমি কী আজ ল্যাব থেকে বের হয়ে তাকে খুঁজে বের করব? নাকি ফেসবুকে খুঁজব?
নক দেব? কী বলব নক দিয়ে? ল্যাবে আসেনি কেন? সুস্থ আছে কিনা, এসব?
বেশি বেশি হয়ে যাবে না? সব ছেলেই একইরকম, গায়ে পড়ে কথা বলতে আসে, এসব ভাববে না তো!
দেখা যাবে সে হয়ত ইঞ্জিনিয়ারিং আর পড়বে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে হয়ত চীনে যাচ্ছে মেডিকেল পড়তে!
আরও অনেক অনেক সম্ভাব্যতা আছে। হতে পারে তার জ্বর কিংবা গাড়িতে করে আসছিল, গাড়ি এক্সিডেন্ট করে ঠ্যাং ভেঙে গেছে! হতেই পারে। একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।

ল্যাব থেকে যখন বের হলাম, তখন সন্ধ্যা ৬ টা। বুধবারের এই ল্যাবটা একদম সন্ধ্যা বানিয়ে দেয়। চারদিকে এত রোদ ঝলমল পরিবেশ দেখে ল্যাবে যাই আর যখন বের হই মনে হয় এক আকাশ অন্ধকার সাথে করে বের হয়েছি। ক্যাম্পাসের লাল দেয়াল পেরিয়ে আইডি-কার্ড পাঞ্চ করে যখন বাইরে বের হই, শীত কিছুটা লাগে লাগে যেন। দু’চারজন যাদেরকে চিনি কোনমতে হাই হ্যালো বলে পাশের চায়ের দোকানে গিয়ে বাঁশের বেঞ্চের উপরে বসি। অনেকক্ষণ ল্যাবে বসে থাকতে থাকতে এমন অভ্যাস হয়ে গেছে যে, বের হয়েই একটা কফি-টাচ আর ব্যানসন না ধরাতে পারলে যেন প্রাণ উশখুশ করে।
সিগারেটে টান দিতেও দিতেও সেই যেন মালিহা মাইশা’র কথাই ভাবছি। কিন্তু কী কী ভাবছি সেগুলো ঠিক সুনির্দিষ্ট নয়। হয়ত, ল্যাব থেকে বের হয়ে এরকম সন্ধ্যায় সে কী কী করে বা করতে পারে সেগুলো ভাবছি। নিশ্চয়ই বাসায় চলে যাবে। বাসা দূরে হলে দ্রুতই ক্যাম্পাস ত্যাগ করবে আর যদি কাছে হয় তাহলে হয়ত বন্ধুদের সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দেবে।
মেয়েরা সাধারণত বাইরের টং দোকানগুলোতে কম আসে। তারা ভেতরের গ্রাউন্ড ফ্লোরের ক্যাফেটাকে বেশি গুরুত্ব দেয়। সেখানে ওয়াইফাই আছে, যদিও খুব স্লো। আমি দুই তিনবার ইউজ করেছি।
এসব ভাবতে ভাবতে একটা সিগারেট শেষ হয়ে গেল। কফিও শেষ। এই গল্প শেষ করে এবার আমাকেও বাসায় যেতে হবে।

একটা গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে ওঠা চাট্টেখানি কথা না, মূল চরিত্র হতে গেলে সব সময়ের লেখকের সাথে সাথে থাকতে হয়। লেখক যেভাবে ভাবে নিজেকে সেভাবে ভাবনায় মানিয়ে নিতে হয়। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে অনেক কিছু করতে হয়। আমি নিজে কখনো কোনো গল্প লিখে উঠতে পারিনি। গল্প লিখতে গেলে মনে হয় এখুনি সবকিছু গুলিয়ে ফেলব। গল্পের অনেক চরিত্র, অনেক দুশ্চরিত্র, অনেক পার্শ্বচরিত্র।
এত চরিত্রের ভীড়ে পাঠকের চোখ কীভাবে কেবলমাত্র মূল চরিত্রের দিকে আটকে রাখতে হয় সেই আঠা রেসিপি আমার জানা নেই, আর তাই গল্প লেখা হয় না আমার।
আজ অবচেতনভাবে একটা জিনিস খেয়াল করে যাচ্ছি, সেই প্রায় ল্যাবে যাওয়া থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত মালিহা মাইশা বেশ ভালোকরেই আমার অলিখিত গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে বসে আছে, অথচ গল্পটা আমার কেন্দ্রীয় চরিত্রে আমাররই থাকার কথা।

আমি যদি, এই-সবকিছু টাইপ করে মালিহাকে একটা ইমেইল করে দেই কেমন হবে? নিশ্চয়ই সে খুব বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে যাবে! সে কি ভাববে? আমি তার প্রেমে পড়ে গেছি? সে কী আমাকে মেইলের রিপ্লাই দেবে?
সে কী ব্যাপারটা বন্ধুদের জানাবে? আমাকে দেখে সবাই হাসাহাসি করবে? শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা কী কেবল গল্পের মধ্যেই থাকবে, নাকি বাস্তবে রূপ নেবে? গল্প সত্যি হয়ে গেলে সেটা আবার কেমন গল্প!

————————————————-

জাহিদ অনিক
ছবিঃ গুগল
২২ শে নভেম্বর, ২০১৮

ও কেন এত সুন্দরী হলো // অণুগল্প ৪৯৬

একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য স্নাতকোত্তর করে বাবা-মার সাথে ছিলাম। দেশের অন্যতম এক সমৃদ্ধ বিভাগীয় শহরে। পরিপূর্ণ জীবন আমলা বাবার নিয়ন্ত্রণে বেশ আনন্দময়। ইচ্ছেঘুড়ির নাটাই বাবার হাতে থাকলেও যথেচ্ছা উড়াবার স্বাধীনতা ছিল আমার। উড়াচ্ছিলাম। বাউরি বাতাসে নিজেও ভেসে যাচ্ছিলাম।

এ অবস্থায় বর্ডার সংলগ্ন একটি স্কুল ও কলেজের দায়িত্ব চাপলো আমার ঘাড়ে। দায়িত্ব নিলাম। সুন্দরভাবে পালন করলাম। উপভোগও করলাম সেই সময়টুকু।

পরিবারের বড় ছেলে। লেখাপড়া শেষ। সুন্দর চাকরি। বিয়ের জন্য আদর্শ বয়স। বাবা-মা বিয়ের জন্য অত্যন্ত তৎপর। বাবা সরকারি চাকুরীজীবি হবার কারণে, আমাদের বেড়ে ওঠা এবং মেলামেশা ছিল বাবার কলিগ পরিবারগুলোর সাথেই। সবার ভিতরে থেকেও, এই বিশেষ সার্কেলটি ছিল ক্ষমতার দম্ভে পরিপূর্ণ প্রাচুর্যের অধিকারী এক আলাদা শ্রেণি। যেখানে অন্য শ্রেণির সাথে শ্রেণি সংঘাত ওভাবে না থাকলেও এক আলাদা সমীহ জাগানিয়া অনুভবে তাড়িত হত অন্যরা।

যাইহোক, মা-বাবা থেকে আলাদা আরেক শহরে চাকুরির কল্যাণে নির্বাসিত একাকি জীবন কাটাই সপ্তাহের ছয় দিন। আর আর্কের টুলুর গান শুনি, ‘এই একেলা জীবন, ভালো লাগে না আমার…’। নিজের ভিতরেও একজন প্রিয়দর্শিনীর অভাব অনুভব করছিলাম।

একদিন মায়ের ফোন। তখন গ্রামীন ফোনের পোষ্ট পেইড যুগ। আমার বর্ডার সংলগ্ন কলেজের আবাসিক ভবনে আ্যান্টেনা দিয়ে কোনমতে নেটওয়ার্ক পাই। মা আমাকে শহরের বাসায় চলে আসতে বললেন। খুবই নাকি ‘আর্জেন্ট’।

বাসায় পৌঁছাতেই আমাকে বলা হলো, ‘আমরা মেয়ে পছন্দ করেছি, আজ অমুক আংকেলের বাসায় তোমাকে দেখবেন মেয়ে পক্ষ।’ আমাকে শ্রেফ জানানো হলো। এক মুহুর্তে নিজেকে কোরবানির পশুর মত মনে হলো। একটু গাইগুঁই করার চেষ্টা করলেও লাভ হলো না। বাবার সামনে ‘না’ বলার মত সক্ষমতা তখনও অর্জন করিনি।

খুব কাছের ক’জন বন্ধু ছিল আমার। মনের কষ্টটা ওদেরকে শেয়ার করতে চাইলাম। আমাদের আবাসিক এলাকা থেকে একটু দূরে অন্য আরেক এলাকায় থাকতো তারা। এটাও এক সরকারি কলোনি। বাবার কলিগদের বাসস্থান।

এক ভরা দুপুরে গেলাম ওদের কাছে। সিগ্রেটের ধোঁয়ায় নিজেদেরকে ঝাঁপসা করে দিয়ে আমার টেনশনের কথাটা উপস্থাপন করলাম। বাবা মেয়ে পছন্দ করে ফেলেছেন। এখন মেয়েপক্ষ আমাকে পছন্দ করলেই গেছি।

বন্ধুরা আমাকে টিপ্পনি কাটার পাশাপাশি হইহই করে আমাকে নিয়ে পড়লো। আমার অবস্থা কেন জানি ওদের আনন্দের খোরাক হলো। হয়ত এমনই হয় বন্ধুর বিয়ে সংক্রান্ত বিষয়গুলিতে।

আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম ডি-টাইপের বিল্ডিং এর সামনের এক চিলতে সবুজের ওপর বসে। এল-টাইপের পিচের রাস্তা মাঠটাকে আবাসিক ভবনগুলির থেকে আলাদা করেছে। ফাগুনের পাতা ঝরার দিন। রাস্তার দু’পাশের প্রাচীন বৃক্ষগুলি এলোমেলো বাতাসে নিরবচ্ছিন্ন পাতা ঝরিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় তাকে দেখলাম!

ছেলেবেলা থেকেই সুন্দরের প্রতি আমার তীব্র আকর্ষণ। নারীর সুন্দর মুখশ্রী এবং রঙ তাদের ফিগারকে উহ্য রেখেই আমার অনুভবে দোলা দিয়ে যেত। ‘দুধে আলতা গাত্রবর্ণ ‘ কিংবা টোকা দিলে যেসব নারীর শরীরে রক্ত জমে যায়, এমন লাল-সাদা বর্ণ আমার ভিতরে আলাদা আবেদন জাগাতো (আমাকে বর্ণবিদ্বেষী ভাবাটাও কিন্তু ভুল হবে)। আমার ভিতরের ভালোলাগাটা ওভাবেই প্রকৃতিগতভাবেই জন্মেছে, সেখানে আমার দায় কোথায়?

ডি-টাইপের এক তলা থেকে যখন সে বের হলো, প্রথম দর্শণেই আমার ভিতরের আমি নিজেকে জানালাম, ‘আমার পাঁজরের হাড় থেকেই একে বানানো হয়েছে! এ ছাড়া আমি সম্পূর্ণ অসম্পূর্ন।’

পিচের রাস্তা দিয়ে গ্রীবা উঁচু করে উদ্ধত এবং নমনীয়’র মাঝামাঝি এক ভংগীতে সে হেঁটে যাচ্ছিলো। রাস্তার অপর পাশ দিয়ে আমাদের পাশ কাটানোর সময় সে আমাদের দিকে ফিরে তাকালো। ওর দৃষ্টিতে কি ছিল জানি না, আমি লুটপাট হয়ে গেলাম!

আমার ভিতরে কোথায় যেন বেজে চলছিল, ‘ও কেন এত সুন্দরী হলো’!

বাবার পছন্দের মেয়েকে দেখতে যেতে হবে, সে কেমন হবে, আমার তাকে কতটুকু ভালো লাগবে, তাদের আমাকে পছন্দ হবে কিনা ইত্যকার ভাবনা-চিন্তায় বিব্রত মন আমার। মনের আকাশ জুড়ে মেঘ জমেছে। ঝড় না উঠেও বাতাসটাতে ঘোর লেগেছে। ঠিক এমন এলোমেলো সময়ে আঁচল উড়িয়ে সে খোলা চুলে আমার সামনে এলো! আমি মুগ্ধ হলাম। ভালোলাগা ভালোবাসার আগুনে পুড়ে প্রেমে পরিণত হলো!

আমার ভাবনার চোয়াল শক্ত হতে থাকলো। জীবনে এই প্রথম ‘পছন্দের মেয়ে দেখা’ বিষয়ে বাবাকে ‘না’ বলার মানসিক প্রস্তুতি নিতে থাকলাম।

সেদিন। আসরের নামাজের পর। আমাদের পুরা পরিবার সেই ‘অমুক’ আংকেল’ এর বাসায়। বাবাকে না বলা হয়নি আমার। যেতেই হলো।

বসার ঘর। ভাইদের সহ বাবা-মা ভিতরে সবে আসন গ্রহন করেছেন। দরজার মুখে দাঁড়ানো আমি। নিজেকে নিয়ে প্রবেশ করব। ভিতরে একবার অলস দৃষ্টি বোলালাম। আবারও মুগ্ধতা!

তবে এবার আমি অবাক হলাম! দুপুরের বাউরি বাতাসে আমাকে লুটপাট করা হেঁটে যাওয়া এলোকেশী সেই মেয়েটি মাথায় সবুজ একটি ব্যান্ড পরে বসে আছে। আমাদের চার চোখের মিলন হলো ‘আনুষ্ঠানিকভাবে’!

মুহুর্তে প্রাণে আমার মন জেগে ওঠে। এতদিনের পরিচিত পৃথিবীটা একটুখানি বদলে যায় ‘ওকে’ অপ্রত্যাশিত ভাবে হঠাৎ সামনে পেয়ে। অপুর হৈমন্তিকে ‘পাবার’ মত আমিও ‘পাইলাম’ অনুভবে তাড়িত হলাম!

এরপর.. অনেকগুলি বসন্ত কেটে গেলো পাওয়া-না পাওয়ার গোলকধাঁধার ধোঁয়াশা ভূবনে। তবে ভালোবাসা আর প্রেম আমাদের ছেড়ে যায়নি কখনো। আমরা মানে আমি আর আমার লাল বউ, জীবনের প্রতিটি কঠিন সময়ে, শ্রেফ ভালোবাসায় মেখে মেখে- হৃদয়ের এপিঠ ওপিঠ তন্নতন্ন করে সুখ খুঁজেছি। কখনও হতাশ হইনি। সে আমাকে আগলে রেখেছে। মায়ায়, ভালোলাগায় আর মুগ্ধতায় যে নিরন্তর প্রেমময় আবহ তৈরী করে রেখেছে সে, যার বাইরে আমার কখনোই যাবার প্রয়োজন পড়েনি। অচল আমার থেকে সকলেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, সে আমাকে আরো কাছে টেনে ওর বুকে ছোট্ট চড়ুই বাবুর মত আগলিয়েছে।

এখনো সে আমার ভালোলাগার প্রথম প্রহর! এখনও শীতের নরম রোদের মত মায়াবী কোমল! সে উষ্ণতায় চোখ মুদে যাওয়া এক শীতের সকালে রোদ আর সাদা মেঘের ভিতরের মৃদু খুনসুটি। এরকম আরও অনেক অনেক বহু অনেক কিছুই সে!

‘ওকে ছাড়া আমি সম্পূর্ণ অসম্পূর্ণ ‘- হাসপাতালটির সামনে বাস থেকে নামার সময় ভাবে শিহাব। ভাবনার ভ্রান্তিবিলাসে ধীর পায়ে এলোমেলো শিহাব কখন যে বিশেষায়িত এই হাসপাতালের দেড় তলার ‘টেস্ট রিপোর্ট ‘ নেবার কিউতে দাঁড়িয়েছে.. ধীরে ধীরে পেছন থেকে কিউতে সবার সামনে এসেছে, বলতে পারবে না। সময় ছিল স্থির.. মনের ভিতর ঝড় উঠেছে। গভীর সমুদ্রে ডুবে যাবার প্রচন্ড ‘সাইনাস পেইন’ অনুভবের প্রখর সীমায়। কিন্তু খড় কুটো ধরে ভেসে থাকার মত কিছুই নেই। অন্য সব কিছুর মত শিহাবের লাল বউই ওর জন্য আঁকড়ে ধরার একমাত্র খড় কুটো। সে-ই ডুবে যাচ্ছে, কাকে আঁকড়ে ধরবে শিহাব?

বায়োপ্সি রিপোর্ট হাতে ভাংগাচুরা একজন শিহাব হৃদয়ের গভীরতম জায়গা থেকে নিজের ইশ্বরের কাছে মিনতি জানায়, ‘ওকে ছাড়া আমি একমুহুর্তও থাকতে পারব না, আমাকে একা করো না!’

এক বিশেষায়িত হাসপাতালের দেড় তলা একটি কক্ষে ইশ্বর নিজের আলো এবং আঁধার দিয়ে একজন শিহাবকে জড়িয়ে রাখে। বাইরে সুর্য ডুবন্ত প্রায়। চলে আলো-আঁধারের মাঝে নিরন্তর দখল নেবার অন্তহীন খেলা।।

দুইটি অণুগল্প

দুইটি অণুগল্প
_________

টানা হাঁটবার পর, সামনের পথ কিছুটা ঢালু হয়ে এসেছে, অনুভব করল আমান। দু’পাশের ‘অ্যাকাশিয়া’ (আকাশী)’ গাছগুলোর সৃষ্ট টানেলটি- মায়াবি সবুজ! দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। ভালোলাগাদের চোখের পাঁপড়িতে মৃদু কম্পন ওঠে। সময় যেন পলকের তরে থেমে যায়।

কলেজ ফিল্ডে তিন যুবক। ফাকা গোলপোষ্টের পেছনে গোল হয়ে বসা। আমানকে দেখে ঘোলা চোখে একপলক তাকায়। সিগ্রেট মিশ্রিত মারিজুয়ানার হালকা মিষ্টি ঘ্রাণ বুকে নিয়ে নেচে আসা দমকা হাওয়া, আমানের নাসারন্ধ্রে ঝড় তোলে। ওর দৃষ্টির প্রখরতা ছেলেগুলোর নির্লিপ্ত চাহনির সামনে কেমন নিষ্প্রভ হয়ে আসে।

স্মৃতির চড়ুইগুলো কি আরো ধুসর ছিল? আমান হাটে আর ভাবে। একজন পরাজিত মানুষ। যার স্মৃতির চড়ুইগুলো কেবলই ধুষর থেকে ধুসরতর। আমান। একজন অতি সাধারণ মানুষ। অন্তর্মুখী জীবনে অভ্যস্ত একজন পলাতক মানব। পলাতক সময়ের বুকে হারিয়ে আছে।

সময় কত বদলে গেছে এখন। ইচ্ছে-অনিচ্ছের গন্ডি নূণ্যতম মূল্যবোধেরও ‘থোরাই কেয়ার’ করে। বড্ড বোবা সময় এখন। চোখে ঘষা কাচের দৃষ্টি। আর ব্রেইনে কিছু Pre-Arranged Instructions নিয়ে বেচে থাকা রোবট মানুষগুলোর, অনুভূতি ক্রমেই শুণ্য হয়ে আসছে। অনুভূতিহীন ভালোবাসায় ওদের হৃদয় একদিন ঠিকই মরে যাবে। এখন প্রয়োজন অনুভূতির ব্যবচ্ছেদ।

শুণ্য অনুভূতি নিয়ে যে পৃথিবীতে ভালোবাসা ধুঁকে মরে, কেমন সেই পৃথিবী? একটু থমকে দাঁড়ায় আমান। সামনের সবুজ টানেলটিকে এখন কালচে লাগছে। ভালোবাসাহীন সেই পৃথিবীর শেষ মানুষ দুজন যদি ওরা হত! সে আর তার প্রিয়দর্শিণী। মৃত হৃদয়কে জাগিয়ে তুলতে সে সক্ষম ছিল। এক পলাতক চাঁদের পিছু ধেয়ে, সেই যে চলে গেল…..
আমান হাঁটে আর ভাবে,
‘পলাতক রাত বিরহী চাঁদের টানে সব সময়েই কি ফিরে? আপন নীড়ে?

এক সন্ধ্যায়- যে সন্ধ্যায় আলো সবুজ, পথ সবুজ- এমনই পথে নিজের চোখের আলোয় জ্বলে উঠে, এক প্রিয়দর্শিনী, আমানের হাত ধরে হাঁটবে বলেছিল। আর আমানও হাঁটতে চেয়েছিল। এখনো আমান একাই পথ হাঁটছে। চরম শুণ্যতায় ডুবে থাকা নিঃসঙ্গ প্রহরগুলোই এখন আমানের বন্ধু। ছায়াসংগী!

এই ছায়াসঙ্গীদেরকে সাথে নিয়ে আজো আমান অপেক্ষায় তৃষ্ণাতুর! অনুভূতিতে বেদনাবোধ বড্ড তীব্র অনুভূত হয়। আমানের পথগুলো এখন কালো, আঁধারে ঢাকিয়াছে বিশ্বচরাচর। এই পথ ধরে অন্ধকারে নিরন্তর এক সুপ্ত আশায় আমান পথ চলে। ওর অনুভবে কল্পনায়, সেই আঁধারকে ভেদ করে, সবুজ ব্যান্ড মাথার এক প্রিয়দর্শিনী, হাজার বছর পথ চলার ক্লান্তিকে উপেক্ষা করে ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। একটু হাসে। আমানের হাত ধরে, সবুজ টানেলের ভিতর দিয়ে ওকে জীবনের পথে নিয়ে যায়!

কিন্তু প্রিয়দর্শিনীরা একবার চলে গেলে কখনো ফিরে কি?

#পথের_বাঁকে_অণুগল্প_৪৬৩

★★
‘কখনো কোনো মাকে বিয়ে করিস না’- অনেক আগে নিজের মায়ের বলা কথাগুলি আজ বড্ড কঠিনভাবে মনের গভীরে বেজে ওঠে ইসতিয়াকের। সেদিন কথাগুলি ঠিকমতো বুঝে আসেনি ওর।

অন্ধকার রাস্তা ধরে ভরা পূর্ণিমায় হেটে হেটে আজ সব বুঝে আসে। মায়ের পছন্দের মেয়েটিকে বিয়ে না করে নিজের পছন্দের এক ‘সিংগেল মাদার’কে বিয়ে করেছিলো। ভালোবেসে ছিলো ইসতিয়াক একজন স্বামী পরিত্যক্তা মাকে। কিন্তু সেই মা কেনো ইসতিয়াককে ভালোবাসতে পারলো না যেভাবে সে চেয়েছিলো?

আসলে ভালোবাসা ভাগ হয়ে যায়। কুমারি নারীর ভালোবাসা তার পুরুষটির জন্য বিয়ের শুরুতে যতটুকু থাকে, বিয়ের পরে সন্তান এলে তা ক্রমশ: হ্রাস পায়। আর ইসতিয়াক তো এক বাচ্চার এক মাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো! ওর মা সেই কথাই বুঝিয়েছিলেন।

একজন সিংগেল মাদারের সাথে আজ কয়েকবছর ঘর বেধে নিজের চাহিদামতো ভালোবাসা না পেয়ে একজন ইসতিয়াক ভিতরে ভিতরে কষ্ট পেতে থাকে। কষ্ট ভালোবাসার ‘রিটার্ণ ব্যাক’ ভালোবাসা না পাওয়ায়.. কষ্ট নিজের মায়ের কথা না শোনায়.. কষ্ট ভালোবাসার ভাগ হওয়ায়!

হায় প্রেম!
দু’ধারি খঞ্জরের মতো যেতে আসতে কেবলি আঘাত দেয়।
– কেবলি আঘাত দেয়? এই আঘাত তো এক সময় অনেক মধুর লেগেছিলো তোমার, ভুলে গেলে? এখনো কি ভালোবাসো না তাকে?

নিজের মনের প্রশ্নে বিব্রত ইসতিয়াক চলার পথে থমকে দাঁড়ায়। পূর্ণিমার আলোয় নিজের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়,
– হ্যা! ওর আঘাত আনন্দ এখনো দেয় আমাকে। ভালোবাসি! এখনো আগের মতই ভালোবাসি তাকে। আজো হৃদয়বান আছি আমি। ভালোবাসা সাঁতার শেখার মতো। একবার শিখলে ভুলে কি কেউ?

#ভালোবাসি_ভালোবাসি_অণুগল্প_৪৬৪

কেন্নো আর শুঁয়োপোকা

-ও শুঁয়ো, অমন চুপচাপ পড়ে আছিস কেন ভাই? একদম নড়াচড়া করছিস নে আজ?
– ভাল লাগছে না। সারাশরীরে খুব ব্যথা করছে রে।
– কাল সারাবেলা আমাদের একটু বেশিই ঘোরাঘুরি করা পড়েছে। তাই বোধহয়…

কেন্নো আর শুঁয়ো। ওরা দুই বন্ধু। গলায় গলায় ভাব ওদের। রাতে একজায়গায় ঘুমোয় দু’জনে। দিনে একসাথে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। খেলা করে। গল্প করে। একজনের কষ্টে আর একজন ব্যথা পায়।

কাল সারাদিন ঘোরাঘুরির পর সন্ধেয় ওরা ঠাঁই নিয়েছিল একটা ভাঙাঘরের আবর্জনার মধ্যে। ক্লান্তির ঘুমে সারারাত কখন পার হয়ে গেছে ওরা ঠেরই পায়নি। সকালবেলা ঘুম থেকে জেগে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিল কেন্নো। কিন্তু শুঁয়োর কোনো নড়নচড়ন নেই। চুপ মেরে পড়ে আছে মড়ার মত।

কেন্নো আবার বলে- কেমন লাগছে রে তো..
কথাটা শেষ করার আগেই একটা অদ্ভূত শব্দ করে মোচড় খেতে লাগল শুঁয়ো। একবার সোজা হয় তো আবার কুঁকড়ে যায়। একবার চিৎ হয় তো আবার মোচড় খায়।

ভয় পেয়ে গেল কেন্নো। বন্ধুর যন্ত্রণায় সে কিছু না করতে পারার কষ্টে কেঁদেই ফেলল।
হঠাৎ কেন্নো দেখল শুঁয়ো একেবারে নিথর হয়ে গেছে। মরে গেল নাকি তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু। অজানা আতঙ্কে তার বুকের ভিতরে কেমন করে উঠল। নির্নিমেষ চোখে সে তাকিয়ে রইল বন্ধু শুঁয়োর নিস্পন্দ দেহের দিকে।

সহসা একটা ঝাড়া দিয়ে উঠল শুঁয়ো। আর কেন্নো অবাক হয়ে দেখল তার লোমশ খোলশের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে কী যেন একটা রঙিন ডানাওয়ালা অদ্ভূত প্রাণী। ভড়কে গেল।
বিচিত্র প্রাণীটি বেরিয়ে এসেই ডানা ঝাপটাতে লাগল।

নির্বাক হয়ে চেয়ে রইল কেন্নো। বন্ধুর এ কী দশা!
– তুই কে রে? প্রাণীটি কেন্নোকে বলে।
-আমি তোর বন্ধু শুয়ো। কিন্তু তোর এ কি হল ভাই?
– বন্ধু? উচ্চেস্বরে হেসে ওঠে প্রাণীটি।- আমি তোর বন্ধু? কি বিশ্রী দেখতে তোকে।
শুঁয়োর কথায় খুব কষ্ট পেল কেন্নো।
-তুই আমাকে ভূলে গেলি ভাই?
-মানে? ভোলাভুলির কি আছে? তুই আমার কোনোদিনই বন্ধু ছিলি না।
দেখ আমার কি সুন্দর নকসা করা রঙিন পাখা। আমি উড়তে পারি। তোর মত একটা কুৎসিত পোকার আমি বন্ধু হতেই পারি না।
– সব ভূলে গেলি শুঁয়ো। বিমর্ষ ধরা গলায় বলল কেন্নো।
– কি শুঁয়ো শুঁয়ো করছিস? রেগে গিয়ে বলে – আমি প্রজাপতি। ফুল আমার বন্ধু।

কেন্নো অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল প্রজাপতির দিকে। সত্যিই তো, সে আর শুঁয়ো নয়। প্রজাপতি। শুঁয়ো তার বন্ধু ছিল। কিন্তু কিভাবে এই পরিবর্তন হল কিছুই বুঝে উঠতে পারল না কেন্নো।

– আমি যাই, ওই ফুল আমাকে ডাকছে। রঙিন পাখা মেলে উড়ে গেল প্রজাপতি।

কেন্নো বন্ধু হারানোর ব্যথায় কুঁকড়ে গোল হয়ে পড়ে রইল।

অণুগল্প : রঙ_আমি_এবং_আমার_ইশ্বর

আমার ইশ্বর আমাকে বিবর্ণ করে পাঠিয়েছেন। পরবর্তীতে নিজেও নিজের রঙ হারালাম নিজের প্রতি সুতীব্র অভিমানে। থাক, সে কথা আলোচনার প্রয়োজন দেখি না কোনো।

এজন্যই রঙ এর প্রতি তীব্র আকর্ষণ আমার! বর্ণীল হতে চায় মন। তার উপর আমি কালার-ব্লাইন্ড। দেখুন তো :)

ইশ্বরের কাছে রঙ চাইলাম। তিনি দিলেন। মনে আমার। মনে মনে রংগীণ হয়ে উঠতে লাগলাম।

একই সময়ে, আমাকে এক গোলামের জীবনও দিয়েছিলেন তিনি। সপ্তাহে প্যারোলে একদিনের মুক্তির ব্যবস্থা করলেন। তাতেই আমি সন্তুষ্ট রইলাম। নিজের জন্য আর কিছু চাইলাম না তার কাছে। অন্যদের চাওয়া পূরণে ব্যস্ত রইলাম।

তখন রঙ আসা শুরু করল, আমার ভিতরে-বাহিরে! সর্বত্র.. ধীরে ধীরে। আমি জেলখানায় আমার ডেস্কে বসে থেকেই আকাশ দেখি। পেজা তুলার মত মেঘ দেখি আমার রিভলবিং চেয়ারে হেলান দিয়ে। রিল্যাক্স করে করে, রঙ দেখি আমি। আমাকে দেখান তিনি।

কাউকেই নিরাশ করেন না তিনি।

একই সময়ে, ইটপাথরের কংক্রিট বিষন্ন নগরের এক চিলতে আকাশ, উঁকি মেরে দেখে যায় আমি ঠিক আছি কিনা। আমার ইশ্বর দেখতে পাঠান। আমি অনুভব করি। ঐ মুহুর্তে তিনি রঙ হয়ে আমাকে ছুঁয়ে থাকেন। তাও অনুভব করি আমি…

মাঝে মাঝে ঈদ পুজো-পার্বণে আমার জন্য স্পেশাল প্যারোলের ব্যবস্থা করা হয়। তখনও আমি রঙ এর সন্ধানে এদিক সেদিক, বিভিন্ন দিকে ঘুরপাক খাই। প্রকৃতির রঙ এর সাথে মিশে যাবার অনুশীলন হয় এই সময়ে আমার। আমি অভিজ্ঞ হই। ‘তিনি’ এগুলি সব আমার জন্য করান।

সব সময় একা তিনিই সাথে থাকেন আমার।

একসময়, ক্রমশঃ সময় শেষ হয়ে আসতে থাকে.. বাজে বিচ্ছেদের সুর। আবার ফিরে যাওয়া। কংক্রিট বিষন্নতার ধারে চিরে ফালাফালা হবার অনুভূতি অনুভবে অপেক্ষা করে। এক্সিকিউট হবার অপেক্ষায় উত্তেজনাকর মুহুর্ত কাটে, চরম নির্লীপ্ততায়। তবুও কোথায় যেন খারাপ লাগাটা থেকেই যায় :(

তারপরও..বড্ড কষ্ট লাগে, মাঝে মাঝে। এই জীবন অসহ্য মনে হয়। তখনই আমি মনের রঙসাগরে ডুব দেই।
শান্তি পাই?

জানি না।
তবে রঙ দেখি.. অনুভবে কল্পনায়। প্রখর দিব্যজ্ঞানে.. শরীরের প্রতিটি অণুতে অণুতে পশমে পশমে! তিনি রঙ এর সাথে থাকেন। আমিও রঙ কে ঘিরে থাকি।

আমার উপর সন্তষ্ট হয়ে, আমার ইশ্বর- পরবর্তী সাপ্তাহিক প্যারোলগুলিতে, অসাধারণ কিছু বর্ণীল জায়গাগুলিতে আমার দুই বাবুর হাত ধরে, ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়াবার অবাধ স্বাধীনতা দেন।

আমাকে আমার ইশ্বর অনেক ভালবাসেন! কারণ আমি তাকে একটু একটু অনুভব করতে শিখেছি :)

______________________________
#রঙ_আমি_এবং_আমার_ইশ্বর_অণুগল্প_৪৯১

অণুগল্প : এখন_আমার_বেলা_নাহি_আর_

শিহাব আর কণা। পারিবারিকভাবে বিবাহিত জীবনের ঊনিশ বছর পার করেছে গেলো মাসে। নিরবচ্ছিন্ন ‘না সুখ-না দুঃখ’ টাইপের বৈবাহিক জীবনে অভ্যস্ত। ভালোই চলছিলো।

দু’জনে যার যার স্বচ্ছল বাবা’র সাথে থাকাকালীন জীবনে কষ্ট তেমন অনুভব করে নাই। এভাবে চলতে চলতে একদিন নিজেদের সেই জীবন থেকে আরেক মধ্যবর্তী জীবনে প্রবেশ করে তারা।

শিহাবের নিজস্ব কিছু ভাবনা-চিন্তা এবং লাইফস্টাইলের কারণে, শিহাব-কণার বৈবাহিক জীবন সেভাবে সমৃদ্ধ হয় নাই। এই না হওয়াটা অর্থের নিরিখে। যাইহোক, এর ভিতরেই ওদের সন্তান এলো। তাদের নিয়ে ভালোবাসায় মাখামাখি চারজনের সময় এক প্রকার কেটেই যাচ্ছিলো।

হঠাৎ কণা অসুস্থ হয়ে পড়ে। কোনোরুপ আভাস ছাড়াই। অসুখ-বিসুখ বলে ক’য়ে আসবে এমনও তো না।

এক সকালে বাসে শিহাব-কণা পাশাপাশি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের উদ্দেশ্যে যাত্রা। বিবাহিত জীবনের ঊনিশ বছরে এমন পর্যায়ের মুখোমুখী দু’জনের কেউই আগে হয়নি। আগে তো টুকটাক জ্বর-সর্দি টাইপ ছাড়া ‘রোগ মহাশয়’ এভাবে সামনে আসেন নাই।

জানালার পাশে কণা। বাসের ডান সারিতে। পাশে শিহাব। জানালার দিকে ঘাড় কাত করে আছে কণা। ওর দিকের রাস্তার পাশের দ্রুত ধাবমান গাছপালা, বাড়ি, দালান-কোঠা দেখছে। কিছু ভাবছে? কি ভাবে সে?

জানালা ভেদ করে আসা মধ্য নভেম্বরের শীতের মায়াবী কোমল রোদ মাখা কণাকে শিহাবের কাছে বড্ড নরম মনে হলো। ওর হাতের ‘পর নিজের হাত রাখে শিহাব। কণা ফিরে তাকায়। শিহাব বলে,
-কি ভাবো?
– কিছু না।

কণার কোমল হাতে শিহাবের হাত অপেক্ষাকৃত দৃঢ় হওয়ায় কণা শিহাবের চোখের দিকে তাকায়। নিরবে কি কণাকে আস্বস্ত করতে চায় শিহাব? তাই কি হাতের এই অপেক্ষাকৃত দৃঢ় স্পর্শ! কণা মৃদু হাসে। শিহাব ও তাকায়। কষ্টেরা কি কণার চোখে ভাসে?

‘ভয় পাচ্ছ?’- জানতে চায় শিহাব।

উত্তর না দিয়ে শিহাবের হাতও একই দৃঢ়তায় স্পর্শ করে কণা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। উত্তর খোঁজে? সময় নেয়? উত্তর জানে না বলেই কি?

শেষে শিহাবের দিকে ফিরে একপলক দেখে। ম্লান হেসে জানতে চায়,
– বায়োস্পি করতে কি ব্যথা লাগে?

সামনের দিকে ফিরে শিহাব। দূরে রিয়ার ভিউ মিররে ড্রাইভারের চেহারা দেখা যাচ্ছে। আরো দু’এক যাত্রীর মুখের কিছু অংশ। উইন্ডস্ক্রিণ ভেদ করে সকালের রোদেলা আকাশ, অন্য ধাবমান যানবাহনের এলোমেলো চলন্ত দৃশ্য- এসব দেখা দিলেও শিহাব অন্য কি যেন দেখে।

ওর পাশের মেয়েটি আবারো ডানে কাত হয়ে বাইরের দৃশ্য দেখায় মগ্ন। প্রশ্ন করে উত্তরের অপেক্ষা না করেই মুখ ফিরিয়েছে সে। উত্তর জানতে চায় না বলে?

আশপাশ বিস্মৃত হয় শিহাব। কোথায়ও কেউ নেই। সে আর কণা। মুহুর্তে বিগত ঊনিশটি বছর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণুমুহুর্ত সমেত সামনে হাজির হয় শিহাবের। এই বছরগুলিতে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় অনেক কষ্টই দিয়েছে শিহাব কণাকে। কিছুটা নিজের প্রকৃতিগত কারণে, কিছুটা পারিপার্শ্বিকতার জটে পড়ে।

ঊনিশ বছর ধরে এত ব্যথা সহ্য করা মেয়েটি আজ কিনা জানতে চাইলো, আ্যানেশথেশিয়া দ্বারা নিজের শরীরের সামান্য কোষ নিতে গেলে সে ব্যাথা পাবে কিনা! আহ!

আসলেই কি এটাই জানতে চাইলো কণা? সে কি শিহাবের থেকে শক্তি পেতে চাইলো? শিহাব কি কণার শক্তি হতে পারবে? পেরেছে কি বিগত দিনগুলিতে?

মহাসড়ক ধরে এক চলন্ত বাসে, মধ্য নভেম্বরের এক শীতের সকালে, শিহাবের পাশে বসা মেয়েটিকে হঠাৎ ওর কাছে ঊনিশ বছর আগের কণা মনে হয়। মায়াবী কোমল, বড্ড নরম! ভালোলাগারা যেন মুহুর্তে প্রজাপতির ডানায় ভর করে ভালোবাসার আগুনে পুড়ে পুড়ে প্রেম হয়ে ওঠে।

কণার হাত নিজের আরো কাছে টেনে নেয়। ওর হাতে আলতো চাপ দিয়ে নিরবে উত্তর দেবার চেষ্টা করে সাথেই আছে। কণা কি বুঝে?

নিজের পাওয়ার গ্লাস ঝাঁপসা হয়ে ওঠে শিহাবের। গলার কাছে কিছু একটা আটকে আসে। বুকের কাছটায় চিনচিন আলোড়ন চাপচাপ অনুভব নিয়ে হাজির। চোখ ভিজে আসে শিহাবের। বাতাস কণার চুল নিয়ে খেলছে, সেদিকে তাকিয়ে থেকে ভাবে শিহাব, ‘কিছুই করতে পারলাম না তোমার জন্য’।

এক জীবনে একজন শিহাব, কেনো একজন কণার জন্য কিছু করতে পারে নাই ভেবে ভেবে ক্লান্ত এক শীতের সকাল, মুহুর্তে এক বিষন্ন মধ্য দুপুরে পরিণত হয়। পতিত অতীত ভয়ংকর ভবিষ্যৎকে সামনে নিয়ে অসহায় বর্তমানকে ওলটপালট করে চলে।।

_______________________________
#এখন_আমার_বেলা_নাহি_আর_অণুগল্প_৪৯০