ট্যাগ আর্কাইভঃ মামুনের অণুগল্প

ভাঙ্গনের শব্দ শুনি


বাবা কিছুক্ষণ লড়াইটার মাঝখানে বসে রইলেন। এক সময় চাপা গলায় বললেন,
– অসম্ভব!
কর্তা পুরুষ নিজের অজান্তে ঘোষনা দিয়ে ফেললেন। বিদ্রোহ সইবেন না।
কেউ জিজ্ঞেস করল না কি অসম্ভব। সবাই বুঝতে পারছিল, একসাথে থাকা অসম্ভব। মা আসলেই রুপার জেদ সইতে পারছিলেন না। প্রতিদিনের বিরোধের সাক্ষী হওয়া বাবা আর শফিকের জন্যও কঠিন ছিল। আড়ালে আরো কত সত্য ছিল কে জানে।
শফিক অতটুকু শুনেই বলল,
– তাহলে আমরা আপনার সাথে না থাকি?

অবচেতনে শফিক কি নিজের একটা রাজত্ব চাইছিল? বাবা কি তা বুঝলেন? কেন বললেন না,
– ঘরটা ভেঙ্গো না।

এক চতুর্থাংশ সুখ (অণুগল্প ৪০০)

অবশেষে ৪০০তম অণুগল্পটিও লেখা হলো। আরো ৬০০ অণুগল্প লেখা বাকী এখনো…
_________________________________________

চলার নামই জীবন। জীবন সুখ-দু:খের মহাসম্মেলন। প্রত্যেকেরই যার যার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে এ ব্যাপারে। প্রাপ্তির নিরিখে এই দেখার ভিন্নতা এবং বিচিত্রতা।

জীবনের এই পর্যায়ে এসে শায়লা নিজেকে এক বিরান মরুভূমিতে আবিষ্কার করে। যেখানে সুখগুলি সাদা মেঘ হয়ে ওকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। দু:খগুলি ধুয়ে ধুয়ে সুখ হবে সেই আশায়, বিস্তীর্ণ প্রান্তর পাড়ি দিয়েছে নিজের মতো করে এতদিন।

তবে সেই পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিলো না। অধিকাংশ পথই ছিলো কন্টকময়। কাছের সম্পর্কগুলি ফুল হয়ে যতটা কোমলতার পরশ দিয়েছে, কাটার তীক্ষ্ণতর আঘাত ছিলো তার চেয়েও বেশী! তবুও মানিয়ে চলার চেষ্টা ছিলো শেষ সময় পর্যন্ত। তারপরও..

একজন মানুষের সহ্যক্ষমতারও একটা নির্দিষ্ট সীমা আছে। সেই সীমা পার হওয়াতে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে, নিজের একাকীত্ব কে সংগী করে ফিরে চলেছে সে। স্বামী-সংসার, সেই সাংসারিক জীবনে ভূমিকা রাখা প্রিয় মানুষটির আরো কিছু প্রিয়জনদের কিছু অপ্রিয় কর্মকান্ডের কারণে, জীবন নিক্তিতে সুখের পরিমাপটুকু আর করা হলো না। মেঘগুলি বরষা হয়ে দু:খগুলিকে ধুয়ে ধুয়ে সুখেরকাঁটাও যদি করতে পারতো!

সুখের এক চতুর্থাংশও যদি পেতো এক জীবনে! জীবন কতটুকু আর? এমন কেনো জীবন?

দুইটি অণুগল্প


১।
দেশের ভিটেমাটি টুকুও বিক্রী করে ছেলে বাবাকে নিয়ে এলো নিজের বাসায় রাখবে বলে। এরপর এক আরেক পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে বাবা দেখেন দিনদিন প্রতিদিন, অতি কাছের মানুষটির মুখোশের আড়ালের আরেক চেহারা। জীবনকে অনুভব করেন প্রহসনের এক মূর্ত উপহাস রুপে।
অত:পর.. একদিন
এক আলোসবুজ পথ ধরে, কোনো এক সাঁঝের বেলায়, ছেলে বাবাকে ‘বাবা নিবাসে’ রেখে যায়। অতীত বর্তমান তন্ন তন্ন করে সেই প্রথম রাতটিতে বাবা খুঁজে ফিরেছেন কেবলি একটি প্রশ্নের উত্তর, ‘ভুলটা কোথায় ছিল..?
দীর্ঘ সেই রাতটি অবশেষে ভোর হয়েছিল যদিও, একজন বাবা ঐ রাতেই নিজেকে হারিয়েছিলেন।।

#নিশ্চুপ_মাঝরাত

২।
‘নিজকে নিজের মতো স্বার্থক করে নাও, সফলতার মাপকাঠি যেহেতু আপেক্ষিক তাই সবার ক্ষেত্রে সফলতা সম্ভব নয় ।
জীবনের গল্প সুখ দুঃখের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। এটাই তো জীবন।’
খুব প্রিয় এবং কাছের মানুষ বলেছিলেন কথাগুলি। বাসায় এলে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসলেই দুনিয়ার চিন্তা-ভাবনা মাথায় জুড়ে বসে শাহেদের। পাশের সোফায় এবং ডিভানে বসে হিন্দী সিরিয়ালে মগ্ন ওর পরিবারের অন্যরা।
ওর কাছের মানুষদের চিন্তাগুলি কি তাদের নিজ নিজ ভূবন গড়ে নেয়ায়, সেখানে শাহেদের অবাধ যাতায়াত নেই দেখেই বোধহয়-ডাইনিং টেবিলে বসলে আসা তাঁর নিজ চিন্তাগুলি ওকে সঙ্গ দেয়? বন্ধুর মত!
চিন্তাবন্ধু নাম দেয়া যায় কি?
একবার বউয়ের দিকে তাকায়। সে তখন টিভির পর্দায়। বড় মেয়ে মোবাইলে নেটে ব্যস্ত। তবে এর ভিতর দিয়ে পর্দার চরিত্রগুলিতে মনোনিবেশ, কি মা’র সাথে টুকরা আলাপ- সিরিয়াল সংক্রান্ত-ই বেশীরভাগ। এরা এক একজন ‘সিরিয়াল বিশেষজ্ঞ’। মেয়ে যে আসলে কি দেখে বা চালায়- শাহেদ আজকাল ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।
ছোট ছেলে ও ব্যস্ত। এরা দু’ভাইবোন সারাদিন ইংরেজি f আকৃতির মত ডিসপ্লের দিকে নির্ণিমেষ চেয়ে থাকে। অফিস যাওয়া আসার পথে, এমন বাস ভর্তি f দের চোখে পড়ে আজকাল শাহেদের। ছেলে এখন গেমস খেলছে।
ওদের সবার একটা আলাদা জগত গড়ে উঠেছে। শাহেদের জগত কোনটা? সে তো এদেরকে নিয়েই এক জগতের সন্ধানে জীবন পার করছে। ওরা কি ভিন্ন জগতের বাসিন্দা? ওদের প্রবেশ পথে কি এমন সাইনবোর্ড ঝুলানো থাকে ‘No Trespassing For You Only’?
নিজের চাকরি, দিনের প্রায় চৌদ্দ ঘন্টা খেয়ে ফেলে যাওয়া আসা মিলিয়ে। বাকিটুকুতে যা সময় দেয়া সবাইকে। হাতে থাকে বন্ধের দিন। ঘুমকাতুরে শাহেদ ঘুমে কাটায় প্রায় দিনের অর্ধেক।
‘ এই সাইনবোর্ডের দায় তোমার কি নেই একটু ও?’
নিরবে ভাতের দলা নাড়াচাড়া করছে দেখে, টিভির পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে মিলি জিজ্ঞেস করে,
– কি হলো? রান্না ভাল হয়নি নাকি?
শাহেদ নিরুত্তর থেকে মাখানো ভাতের এক দলা মুখে দেয়। উত্তরের অপেক্ষায় থাকে মিলি। একটু কি অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে সে? সিরিয়ালের ‘ক্রুশিয়াল মোমেন্ট’ চলে যাচ্ছে? ভ্রুর হাল্কা কুঞ্চন কেন তবে? অবশ্য আজকাল শাহেদ অনেক ভুলভাল দেখে। বকে। ভাবে ও সেভাবে.. নিজের মনে।
এত ভুল কেন জীবনে? মস্তিষ্কের প্রশ্নের উত্তর দেয় না মন। মিলি কিছু জিজ্ঞেস করায় মন আর সে- দু’জনেই ওর দিকে ফিরে তাকায়,
– অফিসের হোটেলের রান্না খেয়ে খেয়ে এখন আমার রান্না ভাল লাগছে না আর?
ভাতের প্লেট একটু দূরে ঠেলে দেয় শাহেদ। বাউলে পানি ঢেলে হাত ধোয়। প্লাস্টিকের বোতল থেকে কয়েক ঢোক পানি পান করে। তৃষ্ণা মেটে?
এরপর মিলির দিকে তাকিয়ে বলে,
– সিরিয়ালগুলিতে আজকাল এসব ও শিখাচ্ছে নাকি?
– মানে?
নাকের উপরটা কাকলাসের শরীরের মত লাল হয়ে উঠে মিলির। এক্ষুনি রেগে যাবে। শাহেদ সামাল দেয় এই বলে,
– তুমি ভাল করেই জানো যে তোমার রান্নার সামনে আর কেউ দাঁড়াতে পারে না আমার কাছে। তারপর ও আউল ফাউল কথা কেন বলো?
আগের রঙ ফিরে পায় নাকটি। তবে ওখানেই সব শেষ হয় না। সিরিয়াল গুরুত্ব হারিয়েছে নারীর কাছে! সে এখন আবেগী হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। যখন মিলি জানায়,
– দেখলাম তো, কখনো তোমার খাবার হোটেল থেকে কিছু এনেছ আমাদের জন্য?
ছেলেমেয়েদেরকে ও নিজের দিকে টানার অপচেষ্টা? সফল হয়। ওদের কান হরিণের মত। সবসময় খাড়া সজাগ থাকে। তবে এদের সাথে হরিণের পার্থক্য এক জায়গায়, হরিণ যে কোনো তুচ্ছাতিতুচ্ছ শব্দের উৎস খুঁজে বের করতে সজাগ হয়। ছেলে আর মেয়ে, তাদের বাবার বিপক্ষে যায় এমন সব কথায় f পজিশন থেকে I অবস্থানে চলে আসে।
দুই ছেলেমেয়েকে পাশে নিয়ে আক্রমনে নামে মিলি,
– বৃহস্পতিবার দুপুরে খাও না তো, তরকারিটা আমাদের জন্য নিয়ে এলে ও তো পারো? বিল তো দেয়া-ই লাগে।
এবার অসহ্য লাগে শাহেদের কথাবার্তাগুলি। মস্তিষ্ক বিপদ সংকেত দেয়। ক্রোধ বিপদজনক সীমার দিকে এগিয়ে চলেছে। শাহেদের ইচ্ছে করে মিলিকে এগুলি বলতে,
– তুই আর তোর মা হলি খয়রাতির জাত। জীবনে খাওয়া ছাড়া কিছু বুঝলি না?
বউয়ের মা’কে এক্ষেত্রে বেশীরভাগ সময়েই অহেতুক টেনে আনা হয়। ভদ্রমহিলারা বেশীরভাগ সময়েই আরোপিত অভিযোগের সাথে সামান্যটুকুর ও সংশ্রব রাখেন না। তারপর ও বউকে কথার আঘাতে তীব্রভাবে ঘায়েল করতেই ওনাদেরকে আনার লোভটুকু স্বামীরা কেন জানি সম্বরণ করতে পারে না।
কিন্তু মিলির দিকে তাকাতেই সব ভুলে যায় সে। নাকের নিচটা ঘেমে ভিজে আছে মিলির। তীক্ষ্ণ চোখে শাহেদকে দেখছে সে। ফ্যানের বাতাসে চুল উড়ছে তাঁর। অবাধ্য দু’একটা চুল চোখের উপর পড়েই সরে যাচ্ছে। ডান গালের তিল.. এসব কিছু মিলিয়ে মিলিকে দেখে শাহেদের রাগ পড়ে যায়.. ধীরে ধীরে। সেই অদৃশ্য সাইনবোর্ডটির অস্তিত্ব এই মুহুর্তে আর অনুভব করে না একটুও!
মিলি ও কি শাহেদের এখনকার পরিবর্তনটুকু লক্ষ্য করছে?
মিলিকে ধরে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে শাহেদের। আপনাতেই শাহেদের টোন চেঞ্জ হয়ে যায়, নিজে ও টের পায়না কিভাবে কি বলছে সে,
– আসলে টানাটানির ভয়ে আনি না আমি। অন্য কিছু না।
মিলি অবাক হয়! লোকটা একটু ও গালাগাল করলো না আজ! কিন্তু ক্রোধের শুরুটার সকল উপসর্গ শুরু হয়েছিল। দেখেছে ও সে। আবার কেন জানি তীক্ষ্ণ রেখাগুলো সমান হয়ে মিলিয়ে ও যায়। ঐ দু’টি চোখে সেই প্রথম দিনের ভাললাগার চমক এই কিছুক্ষণ আগে দেখেছে সে। শাহেদের চোখে।
চোখ?
কোন চোখ?
একজন পুরুষের কতগুলি চোখ থাকে?
তবে শাহেদের চোখে তাকালে সেই প্রথম থেকেই নিজেকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেবার ইচ্ছে হত মিলির! আজ বহুদিন পর সেই ইচ্ছেটার জন্ম হচ্ছে দেখে মিলি ও অবাক হয়। ওর পুড়ে যেতে ইচ্ছে করে!
‘নাহ! আমার মানুষটা আমাকে এখনো আগের মত ফিল করে! আমি ও করি। ওকে আমার আরো সময় দেয়া দরকার।’
নিজের খোলস বদলে এক অতিপরিচিত মিলি উঠে দাঁড়ায়। শাহেদকে জিজ্ঞেস করে,
– চলো, হাঁটতে বের হই। তুমি-ই তো বলো সবসময়- after dinner walk half a mile, কি? বলো না?
মেয়ে এবং ছেলের অবাক চাহনির সামনে শিহাব দাঁড়িয়ে মিলির প্রশ্নের উত্তর দেয়,
– হ্যা :) বলেছি অনেকবার আমি। চলো, বের হই।
রাতের প্রথম প্রহরে নির্জন পিচের পথে, এক জোড়া নব-দম্পতি হাত ধরে হেঁটে চলে। কিছুক্ষণ আগে ওদের খোলস বদল হয়েছে। হৃদয়ের পলেস্তারা খসে খসে- হৃদয়গুলি নতুন হৃদয়ে পরিণত হয়। হৃদয়ের পুনর্গঠন!
পুনর্জনম বললে ভুল হবে কি?

#হৃদয়ের_জোছনায়_বসে_থাকা

বংশ

নিশ্চুপ বিকেল। রমজানের শেষ ভাগ। ঝুম বৃষ্টি। নিজের চেম্বারে শিহাব। বড় মেয়ে ফোন করেছিল। কথা হল। ঈদের কেনাকাটা সংক্রান্ত।
আর তিনদিন পরেই ঈদের ছুটি। এবার আর বাড়ি যাওয়া হল না শিহাবদের। নাড়ির টান। এর অনুকূলে ভাসা হল না। টিকেট পেতে পেতে ও.. কনফার্ম হল না।

‘তুমি কি আসলেই যেতে চেয়েছিলে? যদি চাইতে তবে টিকেট কোনো ব্যাপারই ছিল না।’ – নিজের কাছ থেকে এমন রুঢ় কমপ্লিমেন্ট, ভ্রু কুচকান ভংগির সাথে সাথে শিহাবের ভেতরটা ও কি একটু তেতো.. কিছুটা বন্ধুর করে তোলে?

আজ বড় মেয়ের সাথে কথা হল। মেয়ে কিছু প্রশ্ন করেছে। উত্তর দিতে পারেনি। নিশ্চুপে নিজেকে সরিয়ে নিলেও, মনের ভিতরে কোথায় যেন প্রশ্নগুলি জ্বালা ধরাচ্ছিল। চুপি চুপি। অথচ নির্বাক মৌণতায় ধারাল ইস্পাতে চিরে যাওয়া অনুভবের রেশ রয়ে যায়..দীর্ঘক্ষণ।

‘বাবা! আমি তোমার মেয়ে, আমি কি তোমার বংশ না?’
– কেন বলছ?
‘ বলই না।’
– কেউ কি তোমাকে কিছু বলেছে?

মেয়ে ওর কিছুক্ষণ চুপ থাকে। বাইরে উন্মাতাল আবহাওয়া। অন্য শহরে মেয়ের মনেও বুঝি এমন ভাংগাচুরা। শিহাব অনুভব করে। একজন বাবা বুঝতে চান! মেয়েকে। মেয়েটা বড়ই হয়ে গেল.. বোধহয়!

‘ দাদু ফোন করেছিল। সবার কথা বলা শেষে চাচীর কথা বললেন। জুলাইয়ে বাবু আসার ‘ডেট ‘। দাদু বললেন দোয়া করতে, যেন ছেলে হয়। মরার আগে তিনি যেন বংশ দেখে যেতে পারেন।’

এক বৃষ্টিভেজা শহরে ক্লান্ত শিহাব নীরবে মেয়ের কথা শোনে। নিশ্চুপ থাকে।

‘ বাবা, আমি কি দাদুর বংশ নই? তুমিও কি এমন ভাবো?’

বাবার নীরবতা কি এক ভিন্ন শহরে এক মেয়ের কাছে অসহ্য ঠেকে? তাই যখন সে বাবাকে পরবর্তী প্রশ্ন করে, শিহাব মেয়ের ভেতরের ভাংগাচুরা, উথাল-পাথাল- সব কিছুর দলাপাকানো এক ভিন্ন টোন শুনতে পায়।

‘ আমি তবে কী, বাবা? একজন মেয়ে!?’

আরো বেগে নেমে আসে বৃষ্টি। টানা বয়ে চলায় থাই-গ্লাসের ওপাশটা ঝাপসা দেখে শিহাব। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে হৃদয়ের এপিঠ ওপিঠ- দু’পিঠেই। এর মাঝে এক বিষন্ন বাবা, উত্তর খুঁজে বেড়ান।
বৃষ্টির দিনে। এক বেলাশেষের অবেলায়। বিষন্নভূমে.. যেখানে নীরবতা এক প্রচন্ড কোলাহলকে সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়.. প্রশান্তি চিরে দেয়া অনুভবকে হাত ধরে নিজের দিকে টেনে নেয়!

#বংশ_অণুগল্প_২৭৯

অণুগল্প: ১৯৯/২০০

FB_IMG_1486974305853
শিমুলে আগুন জ্বেলে এলো ফাগুন
ফুলে ফুলে মৌমাছির মৃদু গুনগুন

– ফাগুনের প্রথম দিনে সকলকে শুভেচ্ছা।
_____________________________

গত বছর ফাগুনের প্রথম দিনে এক কোকিল কিভাবে যেন ‘ডিমপাড়াসম্ভবা’ হয়ে কাকের বাসায় ডিম পাড়তে গিয়ে গলাধাক্কা খেলো। কাকের বাসার অন্য বাবুগুলো বড্ড হেসেছিল সেদিন। তবে কাকবাবুগুলোর ভেতর একটার চোখ ফুটেনি, ওর দমকে দমকে শরীর কাঁপানো পিচকি হাসিটা সেদিন কোকিলের মনে শেলের আঘাত দিলো। যার এখনো চোখই ফুটেনি, সে হাসির কি বুঝলো? এতটা অপমান কোকিল সহ্যই করতে না পেরে বসন্তের কোকিল হবে ভাবলো। আগে সে অন্য ‘সিজনের’ কোকিল ও ছিল। সময়ে অসময়ে কুহু কুহু করে বিরক্তি উৎপাদন করতো।

কাকের প্রতি এক তীব্র প্রতিশোধ স্পৃহায় কোকিল ভয়ংকর হয়ে উঠে। মন ও মননে। কিন্তু কাক বাবুগুলির অবুঝ কাজে ওর ভিতরে বাস করা কোকিলমায়ের ভেতরে জন্ম নেয়া মাতৃস্নেহ ওদের প্রতি তরল হয়ে সৌরভে আশপাতকে মাতিয়ে রাখে।

কাকের সাথে দীর্ঘ ছ’মাস চেষ্টা করে অবশেষে আবার বন্ধুত্ব করতে সক্ষম হয় কোকিল। অন্তরে বিষ একই ছিল। একদিন কোকিলের দূরসম্পর্কের ভাইয়ের মেয়ের বিয়ের কথা বলে কাককে রাজস্থানের এক জায়গায় নিয়ে যেতে রাজী করায় কোকিল। দুস্তর মরুর এক পানিহীন প্রান্তরে কাককে নিয়ে উপস্থিত হয়। দু’জনে পানির অভাবে ডিহাইড্রেশনে মৃতপ্রায়। কোকিল নিজের জন্য আগে থেকেই নির্দিষ্ট এক জায়গায় পানি লুকিয়ে রেখেছিল। সে খোঁজার ছল করে কাককে একা ফেলে অন্য দিকে তার উদ্দিষ্ট পথে চলে গেল। কাকও অন্য দিকে পানির খোঁজে আগায়।

অনেক পরে একটা প্রায় পরিত্যক্ত কলসীর অনেক নিচে পানি দেখতে পায় কাক। তাদের ছেলেবেলায় দাদাদের মুখে মুখে চলে আসা একদার সেই জ্ঞানী পুর্বপুরুষের মিথ চট করে মনে পড়ে যায়। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে ধাপে ধাপে। জীবন বাঁচে কাকের। তখনই কোকিল আসে। তৃষ্ণার্তের ভান করে। বন্ধুত্ব টিকে থাকে। এইবারও প্রতিশোধ নেয়া হয় না কোকিলের।

পহেলা বৈশাখের পান্তা- ইলিশের উৎসব শেষ হবার আরো একমাস পরে দ্বিতীয় সুযোগটি এসে যায়। একদিন বেল গাছের উপর দিয়ে উড়ে যাবার সময় পাকা বেল দেখে কোকিল। অনেক আগে জানা এক টোটকার কথা মনে পড়ে তার। গাছের পাকা বেল কাককে খাওয়াতে পারলেই কাজ হয়। কাক উন্মাদ হয়ে যাবে চিরতরে।

– দোস্ত, বেল পাকছে গাছে, দেখছো? কোকিলের কথার জবাবে কাক শুধু বলে,
– গাছে বেল পাকিলে তাতে কাকের কি?

কিন্তু গাছের নিচে ততক্ষণ কোকিল নেমে থেমেছে। কাক গাছের ডালে। দৃষ্টিতে নিরব চাহনি, কোকিলের কাছে উপায় খোঁজে যেন। বসন্তের কোকিল সব বুঝে। বলে,
– তোমার ফাইটার বাহিনীর আরো এক স্কোয়াড্রণ ডাকো। সবাইকে দুই পায়ে দুটি এবং মুখে একটি করে নুড়ি আনতে বলবে। এরপর একযোগে অনেক উপর থেকে বেল লক্ষ্য করে নুড়ি নিক্ষেপ করবে। বেল আপনাতেই পড়ে যাবে। কুহু কুহু…’

সব কিছু অ্যারেঞ্জ করতে কাক সময় নেয়.. হয়েও যায়.. উপর থেকে নুড়ির আঘাতে বেল পড়ল পড় মালির ঘাড়ে। বেলের আঘাত মাথায় লেগে বসন্তের কোকিলের ‘ইন্সট্যান্ট’ মৃত্যু ঘটে।

বসন্তের কোকিলরা অপরের জন্য গর্ত খুড়ে সেই গর্তেই সব সময় কেন জানি নিজেরা-ই পড়ে যায়। হায়.. 😀

#বসন্তের_কোকিল_মামুনের_কাক_সম্পর্কীয়_দ্বিতীয়_গল্প_অনুগল্প_১৯৯

★★
জীবনের দিনগুলি নিজেদের মত সামনে এগিয়েছে কেবল। তাঁকে জিজ্ঞেস করার মত ভদ্রতাটুকুর ও ধার ধারেনি। এমনতর জীবন।
সবার-ই কি এমন?

ওড়না ফেলে দেবার বয়স পেরিয়ে, পড়ন্ত বিকেলে খোলা চুলে, মদির হাওয়ার পরশ বুলানো সেই স্বাদ ভুলেছেন কবে!
এখন রুপালী চমক জাগা নিরব সময়। এমন কেন এখন সময়! দু:সহ লাগে কেন.. কখনও কখনো?

দাওয়ায় বসলে, পেছনের বিস্তীর্ণ ধানি জমিতে- দখিনা বাতাসের এলোমেলো ছুঁয়ে দেয়ার শব্দ বুকে নেয়া লিলুয়া বাতাস- এখনো ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর উপর! নাকের নথ দুলিয়ে দিয়ে যায় এখনো। একজন দোদুল্যমান সেই নথের দিকে নির্ণিমেষ চেয়ে থাকতো! দৃষ্টির ছুঁয়ে যাওয়া ভাললাগার সেই প্রহরে, দাওয়ায় বসে থেকে ভাললাগাটুকু অনুভব করত সে! আর ভালবাসা ফিরিয়ে দিতে চাইত। সেই সব প্রহরগুলি লিলুয়া বাতাসকে নিমন্ত্রণ দিয়ে, এখন ও কদাচিত আসে.. যায়.. হারায়।

কেবল আগের মত শিউরে উঠার সেই অনুভবটুকু আজ আর নেই। কারো চলে যাওয়ায় ওরা ও পিছু নিয়েছে তার। শূণ্যতায় ছেয়ে যাওয়া অন্তর! ইদানিং বড্ড ভঙ্গুর লাগে ওর কাছে।

সব কিছু আগের মতই আছে। তবু ও যেন কিছুই নেই। শূণ্যতা চারিদিকে। শূণ্যতা সারা আকাশ জুড়ে। একাকীত্ব ভেসে বেড়ায় বাতাসে বাতাসে।

তারপর ও.. সবই তো ঠিক লাগে। তবু ও এই নিঃসঙ্গতা কেন? বুকের মাঝে! আজকাল বড্ড বাজে।

‘সব কিছু এখানে আছে
কিছু নেই আমার কাছে’
কেন এমন মনে হয় আজকাল?

ঐ তো কাছারিঘরের পাশ দিয়ে সেই পায়ে চলা পথ। খালের সামনে থমকে দাঁড়িয়েছে। আগে একটা সরু বাঁশের সাঁকো ছিল। সেখানে এখন ছোট্ট কালভার্ট। স্মৃতিরা ও সময়ে এভাবে হারায় কেন?

মানুষটা কাজ শেষে রাতে যখন ঘরে ফিরত, উঠানের বাতাবি লেবুর ফুলের ঘ্রাণে মৌ মৌ বাতাস, মনকে অজানা আকর্ষণে প্রলুব্ধ করত। তখন বড্ড প্রলুব্ধ হতে ইচ্ছে করত।

সেই বাতাবি লেবু গাছটি এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে! এখন ও বাতাস বয়। সুরভি ছড়ায়। কিন্তু তাতে প্রলুব্ধ হবার উপকরণটুকু কেন জানি থাকে না আর! সাঁকো পার হয়ে আসা সেই রাতের মানুষটির পদশব্দ ও শুনা হয় না দীর্ঘদিন।

এখন রুপালী ঝিলিকের পড়ন্ত সময়। চোখ ভুলভাল দেখে। তাই সবকিছু চোখে পড়লে ও, একজন ফিরে আসা মানুষকে কেবল চোখে পড়ে না। বসন্তের প্রথম প্রহরগুলিও ইদানিং নিরবে আসে..যায়!

ফিরে আসা মানুষেরা-ই কখনও কখনো হারানো মানুষ হয়ে যায়.. কারও না থাকায় থেকে যায় কেবলি শূণ্যতা! একজন মানুষ না থাকা মানে অনেক কিছুই নাই।।

#শূণ্যতায়_ডুবে_গেছি_আমি_অণুগল্প_২০০

★ ছবি: নেট থেকে কপি করা।

৫টি অণুগল্প

[ লেখক যখন উত্তম পুরুষে/ প্রথম পুরুষে লেখেন, তখন সেটা লেখকের নিজের জীবনের বলে ধরে নেয়াটা ভুল হবে। লেখক তার আশেপাশের চরিত্রদের অনুভব করেন, সেখান থেকে গল্প নেন, লেখার সাবলীলতার স্বার্থে প্রথম পুরুষে লেখা হয় কখনো কখনো।
পাঠককে মনে রাখতে হবে বিষয়টি। ]

একটা পুরো বোতল ফেন্সিডিল খেয়ে নিয়েছি। তারপর কারওয়ান বাজার থেকে আনা ‘জিনিসের’ চারটা স্টিক। চরম!! আমার সমস্ত শরীরে চনমনে চিনচিনে অনুভব! দু’চোখ বুজে আসছে। দেহে অদ্ভুত এক শ্রান্তি। পুলক। চরম আবেশ!

অগ্রহায়নের এক মাঝদুপুরে আমি হাইওয়ের পাশে দাঁড়ানো। নীল আকাশ। রোদটুকু শরীরে কোমলানুভূতির উদ্রেক করছে। রোদের কণার উষ্ণ পরশে আমি ভিজে যাচ্ছি.. ডুবে যাচ্ছি.. ক্রমশ:।

কিন্তু আমার দেহের এই অনুভব আমার মনে একটুও লাগছে না। গত আটমাস ধরে আমি একা। দৈনন্দিন জীবনের রুটিন এখন বদলে গেছে। আটমাস আগের আমি বোধহয় এখন আর সেই আমি নই।

হুটকরে এক বিকেলে ডেকে নিয়ে আমাকে অব্যহতি পত্র হাতে ধরিয়ে দেয়া হল! কষ্ট পাবার চেয়ে অবাক হয়েছিলাম বেশী। স্টাফ হবার কারণে, এতগুলি বছর টানা জব করেও যাবার বেলায় একেবারে শূণ্য হাতে চলতি মাসের বেতন নিয়ে বাসায় ফিরতে হল আমায়। এই অমানবিক আইন কারা বানিয়েছে জানি না। সংস্কার করলে ভাল হয়।

আমার বউয়ের সাথে টুকটাক ঝগড়া লেগেই থাকত। তবে এর মানে এমন নয় যে আমাদের ভিতর ভালবাসা ছিল না। ছিল। অনেক ভালবাসতাম আমি। সে ও। তবে বউটা ছিল সোজা ধরণের। যে যা বলত সহজেই বিশ্বাস করত।

আমার দু:সময়ে বউয়ের কাছের মানুষদের চেহারা পালটে গেল। যেভাবে চাকরিটা যাবার পরে, পরিচিতদের পালটে ছিল। এমনই কেন হয়? মানুষ মানুষের দু:সময়ে কেন তাকে করুণার চোখে দেখে? কেন মনোভাব একই থাকে না! ভিতরের মানুষটা একবার ভালবেসে আবার সেই একই হৃদয় নিয়ে কাউকে ঘৃণা করে কিভাবে?

বউটা আমার সরল বলেই অন্যের কান কথায় মজে গেল। আর পরিবেশ পরিস্থিতিও ছিল আমার প্রতিকূলে। একটা চাকরিও পাচ্ছিলাম না। ইন্টারভিউ দিয়েই যাচ্ছিলাম। হচ্ছিল না। মানসিক ভাবে আমি দিন দিন ভেংগে ক্ষয় হচ্ছিলাম কেবলি। ঘর ভাড়া দিতে পারছিলাম না। মুদি দোকানে অনেক বাকি হওয়ায় অন্য পথে বাসায় ফিরতে হত। মাছবাজারের রাস্তা-ই ভুলে গেলাম।

ফ্ল্যাটের অন্যরা জেনে গেছে। আগে চলা-ফেরায় সামনা সামনি হলে কথা হত। মৃদু সৌজন্যতার প্রকাশ স্বাভাবিক ভাবেই হত। আজকাল কিংবা কিছুদিন আগে থেকে আমি যেন সবার কাছে অচ্ছুতে পরিণত হলাম।

যা বলছিলাম, একদিন ইন্টারভিউ দিয়ে বাসায় ঢুকতে গিয়ে তালাটা চোখে বড্ড কঠিন লাগল। চাবি ছিল না আমার কাছে। মোবাইলে কল করেও বউকে পেলাম না। মোবাইলের সুইচড অফ। কি করব ভাবছিলাম, পাশের ফ্ল্যাটের ভাবী দরজা খুললেন। আমাকে দেখে আবার ভিতরে গিয়ে চাবি এনে দিলেন। বউটা আমার যাবার আগে চাবিটা ওনার কাছে রেখে গেছে।

বউ বুদ্ধিমতী হয়েছে দেখলাম। আমার বিছানায় একটা নোট রেখে গেছে। দু’লাইনের।
‘তোমার সাথে আমার আর থাকা সম্ভব হচ্ছে না। চলে গেলাম আমি।’

তাই বলে কি আমাকে নেশায় বুদ হয়ে থাকতে হবে.. ফেন্সিডিলের বোতলে সুখ খুঁজতে হবে? – এটাই বলবেন তো?
হ্যা! আমার দেশে যতদিন এই মাদক প্রবেশ করবে, আমি সেবন করব। সিস্টেমের আমূল পরিবর্তন করুন আগে, সিস্টেম যারা রক্ষা করছেন, আগে তাদের ভিতরের লোভটুকু দূর করুন, তবেই মাদকের মত এমন জীবন ধ্বংসকারী উপকরণ আসা বন্ধ হতে পারে।

পদক প্রাপ্ত বিখ্যাত কেউ কেউ যদি নেশা করতে পারেন, বিখ্যাত ঔপন্যাসিকেরা যদি সুরার মত্ততার অনুভবে বিলীন হতে পারেন, তবে একজন আমজনতা হিসাবে আমি ও ফেন্সিডিল খেতে পারি। এ ব্যাপারে আমাদের সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতামত জানতে পারলে ভাল লাগত। টক শোতে তো প্রায়ই দেখি-শুনি, বিভিন্ন ব্যাপারে ওনারা গুরুগম্ভীর ব্যাখ্যা প্রদান করছেন। এ বিষয়টি নিয়েও নিশ্চয়ই তাদের ভাবনা চিন্তা রয়েছে।

একটা চব্বিশ বাজে। প্রায় পৌণে এক ঘন্টা ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। আর ভাবছিলাম এসব আবোলতাবোল একা একা।

আমার মা আসছেন। আজ অনেক বছর পরে আসছেন তিনি। আমি ডাকিনি তাকে। আমার এই দু:সময়ে আমি কাউকে ডাকিনি। নিজের থেকেও আসেনি কেউ। এমনই হয়?

মা বাসা চিনেন না। আমার অন্য আত্মীয় স্বজনদের মত? নাহ! মা আসলেই চিনেন না। তাই এই ঘোর দুপুরে, হাইওয়ের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। মোবাইলে কথা হয়েছে। এখনো অনেকটা দূরে। আমাকে এতক্ষণ এক জায়গায় দাঁড়ানো দেখে, অদূরের চা’র দোকানের খদ্দের এবং অন্যরা বোধহয় কিছু ভাবছিল। আমি কয়েকবার তাদের দিকে তাকালে, প্রতিবার হাসিমুখে তাদেরকে আমার দিকেই তাকানো দেখতে পেয়েছি।

প্রচন্ড চা’র তেষ্টা পেয়েছে। আগেই খেয়ে নেয়া যেত। একবার মোবাইল ডিস্পলেতে সময় দেখি। মাকে ফোন করে জেনে নেয়া যায়, কোথায় আছেন এখন। কিন্তু ফোন করলাম না। যদিও চা আর সিগ্রেটের জন্য ফিলটা কমে যাচ্ছে। এমন মনে হলেও গেলাম না। ডান দিক থেকে মা আসবেন। সেদিকে তাকিয়ে থেকে থেকে আমার ঘাড় ব্যথা হয়ে গেল। তবুও আমার মা আসছেন বলে কথা।

‘তুমি কি বিশাল মা ভক্ত?.. ‘মা অন্তপ্রাণ কেউ?. – নাহ! যা ভাবছেন তা নয়। আমি প্রচন্ড মা বিদ্বেষী। মাকে ভাল লাগে না আমার। মা আমার বিয়েটা মেনে নেন নাই। তবে মা তারপরও কেন জানি আমার সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে থাকেন। যখন প্রচন্ড কষ্টে থাকি আমি, আমার চেতন-অবচেতনে মা থাকেন। আমি নিরন্তর মাকে ঘৃণা আর ভালবাসায় ওলটপালট করতে থাকি.. অনুভুতির ব্যবচ্ছেদ করতে থাকি..।

হাইওয়েতে মা’র অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার মনে পড়ল, বায়েজিদ বোস্তামী ছেলেবেলায় ঘুমন্ত মায়ের শিয়রে পানির গ্লাস হাতে সারা রাত দাঁড়িয়ে ছিলেন।

‘তুমি ও কি বায়েজিদ বোস্তামী হতে চাইছ?
হাসলাম আমি। প্রশ্নকর্তাকে জানাই — এভাবে ফেন্সিডিল খেয়ে খেয়ে?
নাহ! আমি বায়েজিদ বোস্তামী হতে চাই না। আমি কিছুই হতে চাই না। একসময় মানুষ হতে চাইতাম। কিন্তু…

একটা ট্যাক্সি ক্যাব ঠিক আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমার ঘোর কাটে না। সব কিছুকে আরো অবাস্তব মনে হয়। হ্যালুসিনেশন! সব উদ্ভ্রান্তির খেলা। মায়ের পাশে কেউ বসে নেই। আমি ভুল দেখছি।

আমার বউ মায়ের পাশের দরোজা খুলে বের হয়। আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমার হাত ধরে হেসে বলে, ‘চলো বাড়ি যাই’।।

#আমার_বাড়ি_ফেরা_অণুগল্প_১৮৮

★★
এখন অনেক রাত।
আমি রুপা.. একাকী সামনের বারান্দায় বসে আছি। শরীরে এবং মনে এক অদ্ভুত আবেশ জড়ানো। নিশ্চুপ এই মাঝ রাতে কত কিছুই যে মনে হচ্ছে।

শেষ পর্যন্ত আমাদের ভিতরের খরা কেটে গেছে। কিছুক্ষন আগে বৃষ্টি নেমেছিল… তবে কোনো ঝড় ছিল না। একটানা ঝির ঝিরে বৃষ্টি। মিনহাজের সাথে যে দূরত্ব টুকু এই ক’মাসে তৈরী হয়েছিল, নতুন করে ভালোবাসার শান্ত লেকে ইঞ্জিন ছাড়া নৌকায় করে সময় কাটিয়ে সেই দূরত্ব আমরা নিমিষে পার করেছি… ঢেউয়ের তালে তালে কখনো মিনহাজ … কখনো আমি…।

মিনহাজ আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। গোসল করার পরে চুলগুলো না আঁচড়ানোতে ওকে আরো আকষর্নীয় লাগছে। ল্যাপটপটা আমার সামনে বাড়িয়ে দিয়ে সে বললো,
-নেও।

আমি ওর দিয়ে তাকিয়ে হাত দিয়ে সেটা সরিয়ে দিয়ে বললাম,
– নাহ। ওর কাজ ফুরিয়েছে।
– কেন? রাত জেগে সুজনের সাথে চ্যাট করবে না? ঘুম আসবে তোমার?

আমি হাসলাম। মন থেকেই। আগে হলে কি করতাম জানি না। তবে এই মুহুর্তে এই অপ্রিতীকর প্রশ্নেও হেসে বললাম,
– হ্যা! আসবে। তুমি আছো না।
এরপর দু’লাইন গেয়েও শোনালাম ওকে ওর প্রিয় গানের কলি-‘যখন তুমি আছো আমার সনে’

মিনহাজ আমার চোখে চেয়ে থেকে আমার হাত ধরে কাছে টেনে আনে… একটা পুরুষালি তৃষিত অধর তৃষ্ণা মেটাতে খুব কাছাকাছি চলে আসে আমার!
নিশ্চুপ মাঝ রাতে… কোথাও কোনো শব্দ নেই। শুধু ভালোবাসা অন্ধকারের হাত ধরে জোনাকি হয়ে ভেসে বেড়ায়। আমি স্বেচ্ছায় সাড়া দেই ভালোবাসায় ভিজে ভিজে।
… … …

আমি সুজন।
স্ট্যাচুর মত বিছানায় বসে আছি।
আজ রুপাকে নেটে না পাওয়াতে ওর মোবাইলে ফোন দিয়েছিলাম। অনেক কথা হলো। এখন একটা বিচ্ছিন্ন অনুভুতি নিয়ে আমি চিন্তা করছি। রুপা আজ আমাকে জানিয়ে দিয়েছে, সে কেবলি আমার একজন ফেসবুক ফ্রেন্ড। অন্য কিছু যেন ভেবে আমি কষ্ট না পাই। গত ছ’মাস ধরে আমাদের ভিতর যেটা চলে আসছিল- তাকে কি নাম দেয়া যায়? ভালোবাসা বা প্রেম তো বলা যাবে না। প্রেম আমি করেছি আমার বউ মিলির সাথেই। তবে কেন রুপার সাথে এই নতুন করে আবেগের শিকলে আটকে যেতে চাইছি আমি? কবেকার কয়েকটা ভুলের প্রকাশের ভিতরেই কি শেষ হয়ে যাবে আমার হৃদয়ের সকল ভাললাগা?
এতই ঠুনকো ভালোবাসা!

আবার এটাও মনে হলো আমার, আজ রুপা ওর মনের ভিতরের চাওয়াটাকে শেষ করে দেয়াতেই কি এই ভাবে ভাবছি আমি মিলিকে নিয়ে?

তবে ভাবনার জগতে আর একটা নতুন দিকের সন্ধান ও পেলাম অবশ্য। রুপা বলেছে, মিনহাজের সাথে যতো কিছুই হোক না কেন, তাকে সে ভালবেসেছে… একবার ভালবাসলে তাকে আর ত্যাগ করা যায় না। সত্যিকারের ভালোবাসা কখনো মরে না। সেটা পলিতে আটকে যেতে পারে। কিন্তু তুমুল বৃষ্টি বা ঝড়ে সেই পলি ভেসে গিয়ে ভালবাসার নতুন ঝকমকে চেহারাটা ঠিকই ফুটে উঠে।

বিদ্যুৎ চমকের মত আমি ও তখন রুপার জায়গায় মিলিকে বসাই। সে ও তো আমাকে ভালবেসেছে। তবে আমার ধারনাটা সম্পুর্ণ ভুল ছিল। মিলি এখনো আমারই রয়ে গেছে। কাগজের কয়েকটা টুকরোর উপরে কয়েক লাইন লেখা দিয়ে কি সেটা ঢেকে দেয়া যায়?

মিলি হয়তো এক সময়ের ওর ভাললাগাকে সম্মান দিতে ঐ চিঠিগুলিকে গুলোকে রেখে দিয়েছে। একটা গোপন মধুর স্মৃতি হিসেবে… যদিও সেই স্মৃতি আমার সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। তবুও স্মৃতি তো, হোকনা মিলির আগের জীবনের অন্য কারো সাথে সম্পর্কযুক্ত।

নিজেকে বড্ড ছোটলোক বলে মনে হলো আমার কিছুদিন আগের ভাবনা-চিন্তা মনে করে।

মিলি শুয়ে শুয়ে কি যেন পড়ছিল। সেদিকে তাকিয়ে আমি এক পরম মমতা অনুভব করি! মুহুর্তে যে হৃদয় রুপার দিকে ঝুকে ছিল সেটা দিক পরিবর্তন করে মিলি অভিমুখী হয়ে পড়ে। ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন…

মিলি বই রেখে আমারর দিকে তাকায়। ওর চোখে সেই পুরনো আলো জ্বলে উঠতে দেখে হৃদয়ে হাজার পাওয়ারের বাল্বটা আমার আবার জ্বলে উঠে। হৃদয় ভেসে যায় আবেগের টানে! দুটি হৃদয় দু’দিক থেকে ভিন্ন ভিন্ন ভালোলাগা যা আমাদের জন্য ছিল না- সেটার মায়া কাটিয়ে এক হয়ে যায়…
একটা ঝড় উঠে… অনেক দিনের পরে।

এরপর শুধু একটানা বৃষ্টি…। আমি ভেসে চলি মিলির উষ্ণ প্রস্রবণের ছোঁয়ায় পরম আবেশে! ওর নি:শ্বাসে নি:শ্বাসে বের হওয়া ভালোবাসায় আমি গলে যেতে থাকি।।

#কি_কথা_তাহার_সনে_অণুগল্প_৬৮

★★★
মায়ের পাশে বসে শায়লা বেশ ভালোলাগা অনুভব করে। এই বয়সেও ‘মা মা’ এক ঘ্রাণে এখনো আপ্লুত হয়। মায়ের দিকে তাকায়। মা হাসেন। হাসি কেন জানি সংক্রামক। শায়লাও হেসে ফেলে। মা ওর হাতে নিজের হাত রাখেন। আলতো চাপ দেন।
আদর? ওকে আশ্বস্ত করেন! পাশে আছেন এটাই কি বুঝান?

শায়লার পাশে এখনো কেন মাকে থাকতে হবে? ওর পাশে থাকার একজন মানুষ তো বাবা পছন্দ করে-ই দিয়েছেন? বিয়েও হয়ে গেছে। হ্যা, আকদই তো বিয়ে। এরপর যা রয়েছে, সেটা তো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

আচ্ছা, ইমতিয়াজকে বাবা পছন্দ করেছেন, এই ভাবনাটা ওর মনে কেন এলো? শায়লা কি তবে ইমতিয়াজকে পছন্দ করেনি?

#মামুনের_অণুগল্প_২৩_পছন্দ

★★★★
– নাস্তা দিয়েছি। খাবে এসো।

বউয়ের ডাকে ভাবনার জগত থেকে শিপন ফিরে আসে। প্রবেশ করে ওর নিজের তিন সদস্যের একান্ত ভূবনে। ডাইনিং টেবিলে বসে মোবাইল সেটটি পাশে রাখতেই সুমি জিজ্ঞেস করে,

– কার সাথে কথা বললে?
– বাবা-মা’র সাথে
– ও

ব্যস। এইটুকুই। সুমি শিপনের বাবা-মায়ের ব্যাপারে কখনোই এর বেশী আগ্রহ দেখায় না। এই একটি শব্দ ‘ও’ অনেক অপ্রকাশিত কথাকেই তুলে ধরে যেন। ছোট্ট একটি শব্দে সুমির শ্বশুর শ্বাশুড়ির ব্যাপারে ওর নির্লীপ্ততারই বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। ঠিক এই মুহুর্তগুলোতে শিপন দীর্ঘশ্বাসও ফেলে না। সুমি সব লক্ষ্য করে। শিপনের ব্যাপারে সব কিছুই সে সুক্ষ্ণ ভাবে অনুভব করে। তাই নিজের কষ্টগুলোকে শিপন বড্ড নির্মমভাবে গিলে ফেলে। হৃদয়ে কষ্টকর অনুভূতিগুলোর নগ্ন খোঁচাগুলোও সে সহ্য করে যায় হাসিমুখে।
সুমি কি এসব বুঝে?

মহানগরের একটি সুদৃশ্য ফ্ল্যাটে এক দম্পতি নিজ নিজ চিন্তা-চেতনায় বেঁচে থাকে। যার যার মত করে। জীবনের আসল দিকটি এখন আয়নার অপর পীঠে পরিণত হয়েছে যেন। তাই ইদানিং বিপরীত দিকটিকেই আসল ভাবে তাঁরা। নিরন্তর এক যান্ত্রিক সুখানুভূতিতে ভেসে যেতে যেতে ওরা নিজ নিজ হৃদয়ের ওপরেও কেমন এক প্রলেপ ফেলে যাচ্ছে। আয়নার পিছনের পারদের মত। তাই এখন সেখানে নিজেদেরকে ছাড়া অপর কেউই আর তাদের কাছে দৃশ্যমান নয়। নিজেদেরকে নিয়েই ভীষণ ব্যস্ত তারা। তবে শিপন এই মুখোশ জীবনের ভিতরেও আরো একটি মুখোশ পরে থাকে। সেই মুখোশটি আসল। আর মেকী মুখোশ থেকে সময়ে সময়ে সে বের হয় এবং জীবনের আসল দিকটি দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু সুমি এসবের কিছুই জানতে পারে না।

আসলে সে জানার চেষ্টাই করে না। জীবনের একমুখী রাস্তায় একেলা ড্রাইভ করতেই সে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।

#ওয়ান_ওয়ে_স্ট্রিট_অণুগল্প_২৪

★★★★★
বাবা-মা’র সাথে মোবাইলের মাধ্যমে রিপনের সাথে যোগাযোগটুকু রয়েছে। প্রতিদিনই সে কয়েকবার ওনাদের সাথে কথা বলে। অদৃশ্য এই যোগসূত্রটিকে সে কঠিনভাবে ধরে রেখেছে। নিজের জীবিকার প্রয়োজনে অত্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটাতে হয় রিপনকে। তারপরও বাবা-মা’র উপস্থিতি সে নিজ হৃদয়ে ধারণ করে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায়। মোবাইল ফোন এই কাজটি করতে ওকে সাহায্য করে।

দুই ঈদের একটি সে গ্রামের বাড়িতে বাবা-মায়ের সাথে করে। অন্যটি রোমানার বাবা-মায়ের সাথে। কালেভদ্রে ঢাকায় আসেন তাঁরা। তখন রোমানার সময়গুলো খুব ভালো যায়। তবে তার মানে এই নয় যে, এখন বা বছরের অন্য সময়গুলো খুব খারাপ কাটে। রিপনও সময়টা খুব উপভোগ করে। ওদের শূন্য ফ্ল্যাটটি তখন বেশ জমে উঠে। রোমানার আনন্দে রিপনও আনন্দিত হয়।

কিন্তু রোমানা কি রিপনের আনন্দকে এভাবে উপভোগ করে? সে কি আসলেই জানে কিসে তাঁর আনন্দ? কিংবা রিপন কি চায়? সেভাবেই কখনোই কি রোমানা ভাবে?

তবে এগুলো নিয়ে রিপন দুঃখ করে না। সে খুবই বাস্তববাদী মানুষ। যথাসম্ভব সব দিক মানিয়ে চলার চেষ্টা করে। সংসারের সুখ শান্তি যাতে বজায় থাকে,সেই চেষ্টাই করে যায় সবসময়। ওর জীবন দর্শণ হল, এক একটি দিন করে করে বেঁচে থাকা…সবাই মিলে… আনন্দের সাথে।

#এইতো_জীবন_অণুগল্প_২৫

ছয়টি তিন লাইনের অণুগল্প

FB_IMG_1486046013246

পুরুষ আর নারী-একে অপরের পরিপূরক।

নারী পুরুষের অলংকার, পুরুষ নারীর অহংকার।

কি প্রয়োজন জোর করে বুঝতে যাবার?

#দূর্বোধ্য

★★
বাঁশঝাড়ের আড়াল থেকে যখন হেসে উঠল চাঁদ , কুয়াশার মত ঝরে পড়ছিল চাঁদেরকণা আপন ছন্দে।

মেয়েটি হেঁটে এলো এক আদিম জংলী ফুল হয়ে যার এলোচুলের আড়াল বুকের নো-ম্যানস ল্যান্ডকে আরো দৃশ্যমান করছিল থেকে থেকে।

বাঁশঝাড় আর চাঁদ সেদিন আর জন্মে পুরুষ হবার প্রার্থনায় কাটিয়েছিল বিনিদ্র রজনী।।

#নিষিদ্ধ_উপত্যকা

★★★
ঈশ্বর সর্বাগ্রে মানুষ বানিয়ে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন এবং মানুষের সুন্দর জীবনযাপনের নির্দেশিকা হিসেবে ধর্মকে মানুষের পিছনে রেখেছেন।

কিছু মানুষ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধর্মকে সামনে নিয়ে এসে মানুষকে পিছনে ফেলে দেয়!

এই পৃথিবীতে যত মসজিদ-মন্দির-গীর্জা বা যে কোনো ধরণের উপাসনালয়ের প্রতি আমার নিরন্তর একই ভালবাসা, কারণ আমি জানি মানুষ সেখানে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকলেও একই ঈশ্বরের উপাসনা-ই করে।

#একজনই_তিনি

★★★★
-রিমোট কন্ট্রোল আনতে বলেছিলাম, আনোনি.. একুরিয়ামের মাছের খাবার, তা ও?

উইকেন্ডে সে বাসায় এলে, মেকুরাণীর এগুলো রোমান্স পূর্ববর্তী অনুঘটক হিসেবে কাজ করে, দুই মেয়ের তীক্ষ্ণ চাহনির সামনে নিজেকে আড়াল করার অপচেষ্টা?

রায়হান জানে বলেই মিলির অফুরন্ত লিস্টের বেশীরভাগ জিনিস-ই ইচ্ছে করে ফেলে রেখে আসে, জীবনে এখন রোমান্স ছাড়া আর আছেই বা কি?

#রোমান্স

★★★★★
একদিকে নিজের বাবা-মা, অন্যদিকে রুপার আব্বা-আম্মা আর মাঝখানে রাসেল, সম্পর্কের শুরুর দিকে চলেছিল টানাপোড়েন।

মাঝখানে পথ গেলো বেঁকে, ক্রমশঃ নির্জণ একটি একমুখী রাস্তায় সময়ের সাথে সাথে সন্তরণ আর সামনে এগিয়ে যাওয়া।

ডেড-এণ্ডে পৌঁছে দেখা গেল যে কোথায়ও নেই কেউ, সোজা রাস্তাটির পথই খুঁজে পেলো না শেষে।।

#মাঝখানেতে_পথ_গিয়েছে_বেঁকে

★★★★★★
পুরনো ভারী কাঠের সেক্রেটারিয়েট টেবিলের উপরে পুরু কাঁচ দেয়া, কবিতার বইটি পাশের খোলা ডায়েরিটি নিয়ে নির্বাক পড়ে আছে।

কত শত সহস্র কথার ফুলঝুরি রয়েছে এর পাতায় পাতায়!

বইটি বন্ধ করার আগে লাল রিবনটি দিয়ে মার্ক করে রাখতে ভুললো না সে অর্ধেক পড়া প্রিয় কবিতাটি, জীবনও আসলে অর্ধেক পড়া প্রিয় কবিতার মত।।

#জীবন_প্রিয়_কবিতার_অর্ধাংশ

অণুগল্পঃ ১৮৪, ১৮৫

14915650_709148795907255_2674962049551625413_n(1)

মিলি শুক্রবার সাধারণত কোথাও যান না । ছুটির দিনে ছেলে মেয়েরা, তাদের বাবা কোন না কোন ভাবে ঘরের বাইরেই সময় কাটায়। একা বারান্দায় বসে থাকতে তাঁর ভালো লাগে । টি ভি দেখার অভ্যাস নাই । কখনো বই পড়েন । কখনো লেখালেখি করেন । আজ একটু ভিন্ন হচ্ছে সব । ছেলেমেয়েরা বাসায় থাকবে । মিলি আর ফরহাদ নেভাল বিচ যাচ্ছেন । ফরহাদের কয়েকজন স্কুল ফ্রেন্ড জোড়ায় জোড়ায় আসবেন । মেয়ে বন্ধুদের মধ্যে দু’জন একা আসবেন । একজন বিয়ে করেন নি । অন্যজনের বিয়েটা টিকে নি। ছেলেদের মধ্যেও একজন একা আছেন । কেন একা তা’ মিলি জানেন না । ফরহাদের সাথে মিলি বেশ কিছুদিন হলো কোথাও যাওয়া ছেড়েই দিয়েছেন । নির্দিষ্ট কোন ঘটনা ছিল কিনা তাঁর মনে নেই ।
বিয়ের প্রথম বছরের কিছু ঘটনা মনে এলো তাঁর । ফরহাদ অফিসে যাচ্ছিলেন । মিলি তাঁর পাশ ঘেঁষে দাঁড়ানো । কিছু নিয়ে হাসছিলেন । ঠিক কোন কারণে বোঝা গেলো না , হঠাৎ ফরহাদ মিলির দিকে তাকিয়ে বললেন,
– সব মেয়েই মেয়ে, স্পেশাল বলে কিছু নাই।
কথাটা শুনে যত অবাক হলেন মিলি ফরহাদের মুখের দিকে তাকিয়ে তার চেয়ে বেশি কষ্ট পেলেন । মানুষটার মুখে কঠিন ভাব । আহত মনে চুপচাপ সরে দাঁড়ালেন … কিছু হয়েছিলো ফরহাদের । মিলি জানতে পারেন নি । কিছু হয়েছিলো মিলির। ফরহাদ জানতে পারেন নি। সেই এক পা সরে আসাটা ছিল ফরহাদের জীবন থেকে মিলির আরেক পৃথিবীর দিকে সরে আসা।
বিচ্ছেদের শুরু কি এই মুহূর্তটাতে হয়েছিলো? নিশ্চয় তারও আগে । মিলি জানে না। মনে পড়লো ঘৃণায় বিকৃত একটা মুখ । ফরহাদের বন্ধু । মিলির আত্মীয় । বিয়ের বহু আগে এক রাতে এই লোকটা তাঁর দরজা খোলা পেয়ে বিছানায় উঠে এসেছিলো সাপের মতো নিঃশব্দে । একটা শব্দ করতে পারেনি মিলি সেদিন। তাঁর একটা শব্দে ওই লোভী লোকটা তার আশ্রয় হারাতো। শহরের পথে পথে রাত কাটাতে হতো তাকে। খেতে পেতো না। লোকটার অসহায় মা বোনের চেহারাগুলি মনে করে দাঁত চেপে সয়েছিলো। ভুল করেছিলো। ভুলের মাশুল দিয়েছে দিনের পর দিন..
লোকটা ছায়ার মতো অনুসরণ করেছে তাকে। আর রাতে দিনে যখন তখন সুযোগ খুঁজে বের করেছে। শেষ পর্যন্ত একদিন মিলি সেই সম্পর্কটা অস্বীকার করতে পেরেছিলো। সেদিন থেকে যতবার সামনে পেয়েছে মিলিকে লোকটা ‘ পঞ্চাশ টাকার মেয়ে’ কথাটা না বলে সামনে থেকে সরেনি। এমন কি ফরহাদের সামনেও। আর ফরহাদ নির্বিকার তার সাথে গল্প করেছে, বন্ধুত্ব রেখেছে। একটা বারের জন্য নিঃশব্দেও একটু রাগ তার চেহারায় প্রকাশ পায়নি। মিলি জেনে নিয়েছে মিলির অপমান ফরহাদের অপমান নয়।
এমন হাজার ঘটনা , হাজার স্মৃতি খড় কুটোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে যায় সুখের মুহূর্তগুলিকে। বিশ্বাস মরে যাবার পর ভালোবাসা থাকে? শুধু শরীরটা থাকে। শুধু নিয়ম গুলি থাকে। পৃথিবীতে সব মানুষের একই নিয়ম, একই জীবন – এই বিশ্বাস হবার পর মিলি আর ফরহাদের সংসার ছাড়ার চিন্তা করে না। ভিতরের মানুষটা একা হয়ে গেছে। বাইরের জীবনে কী আছে নেই তাতে খুব বেশি কিছু আসে যায় না।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিলি বারান্দা ছেড়ে বেডরুমে গেলেন। রেডি হতে হবে। ফরহাদের জন্য। ও কিভাবে চায়.. পছন্দ করে :) এতদিনে কি জানা হয়নি ওর?
সেই সন্ধ্যায় মিলি যখন ভালোলাগা আবেশ চোখে ঢেউ আর আকাশের মিতালী দেখছিলেন,, খুব কাছাকাছি বসে ঘোরলাগা চোখে ফরহাদ ও তাঁকে দেখছিলেন। আনমনা মিলি তাকে এক পলক দেখলেন। কাছে এগিয়ে গেলেন। ফিরে এলেন। কাছাকাছি। নতুনভাবে?
মুখে অস্ফুট হাসিটুকু রয়ে গেল, আজ ফরহাদ অনেক বছর পর সেটা দেখতে পেলেন।।

#মামুনের_অণুগল্প_সম্মতি

★★
‘সম্পর্কের ভিতরে থেকে আসলে সম্পর্কের স্বরূপ বুঝা যায়না..’
এই কথা সে আমাদের দু’জনের দেখা করার দিনগুলির যে কোনও একদিন বলেছিল। শুনে কিছুক্ষণ চুপ থেকেছিলাম আমি। হৃদয় ভেংগেছে তার আগে একবার। ভাংগা হৃদয় জোড়া দিতে শেষে আমার কাছে। সেই থেকে সে আমার মেঘবালিকা!
ওর লাইনগুলি মাথায় ঘুরপাক খায়। তাই জিজ্ঞেস করি তাকে,
– খুব সুন্দর একটা লাইন। আমি কি তোমার এই কথাটা আমার লেখায় ইউজ করতে পারি?
– অবশ্যই, যদি তুমি মনে কর। আমার মেঘ বালকের কথা শুনতে চেয়েছিলে। এখন বলি?
– হ্যা!বলো।
একটুক্ষণ চুপ থাকে। নিজের মনে গুছিয়ে নিয়ে বলে,
– ‘ওর’ জীবনে সুখ জিনিসটা খুব কম। কোথায়ও শান্তি পায় না সে… ওর মনের তল আমি পাইনি। নাহ! এভাবে বলাটা ঠিক না। আমি সে চেষ্টাই হয়ত করি নি। সে আমার জন্য অনেক কিছু করেছে… অনেক কিছু!
মুহুর্তগুলি নিশ্চুপ থাকে। আমরা ও। আমি-ই নিরবতা ভেংগে জানতে চাই,
– কেন কষ্ট পাচ্ছ?
– আসলে আমার মনের অপরাধবোধ আমাকে কষ্ট দিচ্ছে! ও অন্য এক বালিকার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে… ওদের কাছে আসা… ওদের মিলন এ সব কিছুই আমার জন্য পেইনফুল ছিল। … আমি হিংস্র হয়ে উঠেছিলাম। রাক্ষসের মত তাকে গিলে খাবার চেষ্টা করেছিলাম!
– তুমি উত্তেজিত হয়ো না।
– আর উত্তেজনা… এখন আর কিছুই অনুভব করি না।
– এটা ও খারাপ। তোমার ভিতরের বোধগুলোকে মরে যেতে দিও না।
আমার চোখে তাকায় সে নিরবে। ঐ চোখের মৃদু তিরষ্কার অনুভব করে লজ্জা পাই। সে হেসে বলে,
– তুমি দু’রকমের কথা বললে না? এই বললে উত্তেজিত হয়ো না। আবার বলছ বোধগুলোকে মরে যেতে না দিতে?
– কষ্ট পাবার ক্ষেত্রে উত্তেজিত না হতে বলেছি। কিন্তু অন্যান্য বোধ যেমন ভালবাসা, হাসি-কান্না, সুখ-দুখ, এগুলো – মানে তোমার রেসপন্স যেন নষ্ট না হয়।
– ‘এখন আমার সব কিছুই আছে, ভালোবাসা, শুধু ভালোবাসা নেই’- তপনের এই গানের সুরেই বললাম।
এবার আমি হেসে তাকাই তার পানে, সামান্য রংগ করার লোভ ছাড়ি না,
– মেঘ বালিকারা তপনের গান ও শুনে নাকি?
– হি হি হি.. কেন মেঘ বালিকা হয়েছি বলে আমার মনের খোরাক নেই নাকি?
– নাহ, তা বুঝাই নাই। তুমি ও তো দেখছি মেকুরদের মেকুরাণীদের মত কথার মারপ্যাচ করছ?
– মেঘ বালিকা না আমি? মেকুরাণী আর আমি তো একই প্রজাতির।
– ঠিক আছে। বুঝলাম। অন্য কোনো মেঘ বালককে কেন গ্রহন করছ না?
– আর ঐ পথে উড়তে চাইছি না।
আবারো সব কিছু থেমে যায়। শুধু ওর হৃদয়ের সিস্টোল-ডায়াস্টোলের ফলে কম্পনহেতু সৃষ্ট শব্দ শুনতে পাই। বন্ধুর মত ওর হাত ধরে বলি,
– অবশ্য এটা তোমার ব্যাপার। তবে একবার পথ হারালে যদি পথকেই ভয় পাও, তবে চলবে?
– আর কোনো বালককে যে আমি ‘ওর’ মত অনুভব করতে পারি না! তোমাকে কীভাবে বুঝাব?
– আমি বুঝতে পারছি…
– নাহ! তুমি পারছ না। তুমি না পাওয়ার বেদনা কি সেটা কখনো বুঝেছ?
– তোমার মত হয়ত পারছি না। কিন্তু প্রত্যেকের জীবনেই না পাওয়ার বেদনা রয়েছে। তবে সেটা আলাদা আলাদা। সব কিছু মিলিয়ে আর কি। তুমি বললে না, “সম্পর্কের বাইরে এসেই আমি সম্পর্কের মূল্য বুঝেছি…”
– হ্যা, বলেছি।
– কি বুঝলে?
– বুঝলাম, সুখের চেয়ে শান্তি ভালো… প্রেমের চেয়ে বন্ধুতা!
– সত্যি কথা বলতো… এটা কি তুমি পাওনি বলে মনে হচ্ছে? নাকি অরিজিন্যালিই বন্ধুতা ভাল?
– আমি আমার কথা বলতে পারি..
– তোমার কথা-ই তো শুনতে চাচ্ছি
সে আমার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। মুখোমুখি আমার সামনে বসে। আমার দুই কাধে হাত রেখে, চোখের পানে চেয়ে হাসে। ওর মন কেঁদে চলে, তাই হাসিতে আধার মিশে থাকে। চোখের আলোয় জ্বলে ওঠে না। নিস্প্রাণ সবরে বলে যায়,
– প্রেম করে দেখেছি…শান্তি পাইনি
– শান্তি কিসে সেটা কি আগেই নির্ধারণ করে নিয়েছিলে?
– নাহ! এখন আমি সত্যি সত্যি আমার জীবনটা উপভোগ করছি…
– এটা ও তোমার মুখের কথা নয় তো? হৃদয় হয়ত অন্য কিছু বলছে?
– হতে পারে।…
দূরকে কাছে করার যন্ত্র বেজে ওঠে। কিছুক্ষণ হু হা করে সে আমার দিকে তাকিয়ে ক্ষমা প্রার্থণার হাসি হেসে জানায়,
– শোন, আজ যেতে হচ্ছে আমায়। তুমি কিছু মনে করলে নাতো?
– না, না। মনে করার কিছু নেই। আবার কবে দেখা হবে?
– জানি না। তবে পৃথিবীটা তো ছোট। হয়ত কোথাও না কোথায়ও দেখা হয়েই যাবে। তোমার সাথে সময় কাটিয়ে ভাল লাগল আজ। নিজেকে অনেক হাল্কা মনে হচ্ছে।
– ভাল থেকো বালিকা! তোমার মনের ভিতর থেকে সকল বিষন্নতা দূর হোক!
বালিকা পরম মমতায় আমার মাথার চুলগুলি এলোমেলো করে দিয়ে ওর গন্তব্যের দিকে হেটে যায়… আজ খুব সুন্দর ভাবে সেজে এসেছিল সে!সুন্দর!!
আমি ছাদে বসে রইলাম একা একা… ওর গমন পথের দিকে তাকিয়েভাবছি- কেন এতো বিষন্নতা এই নজরকাড়া সুন্দরের ভিতর!!!

#মামুনের_অণুগল্প_সম্পর্কের_ভিতর_বাহির

★ Photo Credit: Noen Laine

বাবার স্পঞ্জের স্যান্ডেল

15000673_893622927439930_4878078832832409951_o
বাবুটা!
খেলনাটা কিনে দেই নাই বলে কি গাল ফুলিয়ে আছ এখনো? ভিতরে ভিতরে ফুঁসছ নিশ্চয়ই। আমার-ই মত।
তোমার মা তুমি দুষ্টুমি করলে কি বলেন তোমাকে-আমাকে নিয়ে?
‘ও প্লাস না! বাপের রক্ত। স্বভাব চরিত্র ও বাপের মত হবে না তো কি।’- এমনই তো বলতো সে, মনে পড়ে বাবুটা?

খেলনা টা কিনে দেব তো। আর কিছু দিন। তুমি কি ক্যালেন্ডার দেখতে শিখেছ, বাবুটা?

হাসছ, বাবার কথা শুনে? ‘পাগলা বাবা আমার’ এমন ভাবছ না তো? তুমি কি কখনো এভাবে ভাবো, বাবুটা? বাবাকে নিয়ে!

তুমি হাসো বাবার কথা শুনে। আর গ্রিলের ওপারে গেলেই বাবাকে নিয়ে হাসেন অন্য মানুষেরা। তোমার সামনে থেকে সরে গেলে, বাবা ও কি অন্য মানুষ হয়ে যান?

তোমার
তোমার মায়ের
তার মায়ের
তোমার বাবার মায়ের?
এভাবে সবার আড়াল হলে তোমার বাবা মানুষটা কেমন হয়ে যায়?

তুমি জানবে না। এখন। সামনে জানবে। প্রচুর সময়। বাবা জানবেন না। সময় নেই। তাই তোমাকে বলা। তুমি যেদিন জেনে-বুঝে অনুভবে বাবা মানুষটিকে দেখবে, সেদিন -ই তুমি আমাকে দেখবে।

তুমি কি কখনো আমাকে দেখতে চেয়েছ? এভাবে ভাবতে তোমার কেমন লাগছে, বাবুটা?

এই শহর। এখানে প্রচুর অলি-গলি। এই অলিতে গলিতে, গ্রিলের ওপারে চলে যেতেই, বাবারা ক্রমশ: ভিন্ন মানুষে পরিণত হন। এখানে রাক্ষুষী সন্ধ্যা নামে। সেখানে বাবারা ছায়ায় হারিয়ে যান। নিজেদের কায়া হারিয়ে খুঁজে ফেরেন। শ্রেফ তোমার জন্য, বাবুটা! এই বাবা হেটে চলে। সবার মত কায়ার খোঁজে।

বড্ড বন্ধুর পথ। একজন বাবা বছর তিন আগে, এক জোড়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল কিনেছিলেন- নব্বই টাকা দিয়ে। এক পাটির তলায় ছিদ্র হয়েছে। মন খারাপের বিকেলগুলিতে, কালো রাজপথ সেই ছিদ্র দিয়ে আকাশ দেখে নির্ভার হতে চায়।

পথে কাঁটা বিছানো। কতটা জানো?
সমগ্র বিশ্ব যন্ত্রণার পেরেক বিছিয়ে বাবাকে স্বাগত জানায়। নিরবে।

বাবা আরও নিরবে হেঁটে চলেন। নিঝুম নিমগ্ন সুখে। তুমি কি অনুভব করছ, এখন বাবুটা? বাবাকে!

বাবুদের নিজেদের যদি কোনো জাদুঘর থেকে থাকে, তবে সেখানে সবার আগে- বাবার এক জোড়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল শোভা পাবে!
শুধু তোমার জন্য বাবুটা! সমগ্র বিশ্ব পায়ে দলিয়ে হেটেছেন তোমার বাবা.. অণুক্ষণ যন্ত্রণা সয়েছেন। তবু হেঁটেছেন। থামেন নাই।

তুমি কি গ্রিলের ওপার থেকে এখন বাবাকে দেখছ?
তুমি কি ‘আমাকে’ দেখতে পাচ্ছ!

খেলনা টা কিনে দেবো তো বাবুটা!
সপ্তাহটা ঘুরুক…।।

★ ছবিঃ Akm Azad

কয়েকটি অণুগল্প এবং একটি ছোটগল্প

FB_IMG_1485715701211

‘মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে চলে…’ সর্বশ্রেষ্ঠ হৃদয়বিশেষজ্ঞের হৃদয়ের আর্তি অনুভব করতে করতে আমান ভাবে,
– আমার জগতের সব আলো পারু নিয়ে গেলেও, সে কি নিজের অন্ধকারকে দূর করতে পেরেছে সেই আলোয়?

একজন দেবদা’ কে দাসে পরিণত করে পারু কি আলোর মিছিলের দূরতম তারা? … এই মুহুর্তে একজন দেবদাসের উত্তরসুরীর উদভ্রান্ত অনুভব!

#কি_কথা_ছিলো_যে_মনে_অণুগল্প_১৪৮

★★
পাতা ঝরার দিনে, দু’পাশের গাছগুলোর নুয়ে পড়া মাথার সৃষ্ট সবুজ টানেল বরাবর সামনে হেঁটে চলেছে শিহাব লম্বা পিচ ঢালা পথটি ধরে।

রিতার মোবাইলে কখন থেকে রিং হচ্ছে, ধরছে না, আবার করতেই সুইচড অফ শোনালো, আশেপাশের সবুজ নিমিষে রং হারিয়ে কালচে হয়ে উঠলো ওর কাছে।

হৃদয়টা চিরে যেতে যেতে গভীর থেকে একটা অনুভবই উঠে এলো, রিতা যখন সম্পর্কটা রাখতেই চাইছে না, তবে কেন এভাবে বিরক্ত করা?

#পাতা_ঝরার_দিনে_অণুগল্প_১৪৯

★★★
রাহাতের দিনগুলো ঘড়ির কাটা ধরে কেটে যাচ্ছে। শনি থেকে শুরু হয়ে সেই বৃহস্পতিবারে এই রুটিন শেষ হয়। তাও একদম রাত দশটায়। নিজের পরিবারের সকলে কেমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সে এক জায়গায়, বউ ছেলেমেয়ে আর এক জায়গায়। বাবা-মা ভাইয়েরা অন্য আর এক এলাকায়।

এদের সকলের সাথে যোগাযোগ বলতে গেলে সেই এক বিনা তারে কথা বলা।
মোবাইল।

রেখা আগে প্রতিদিন কয়েকবার কথা বলতো। এখন সপ্তাহে কদাচিৎ দু’একবার কথা হয়। তাও ঠেকে গেলে। মোবাইলে টাকা ভরে দিও তো (রাত দশটায় মোবাইলের ব্যালেন্স শেষ হয়ে গেলে)।

মেয়ে পিম্পি যখন ওর ক্লাশের পড়ালিখায় আটকে যায়, তখন বাবাকে ফোন করে। ইংরেজী কোন শব্দের মানে বুঝছে না কিংবা কেমিস্ট্রির কোনো সংকেত নিয়ে সন্দিহান, তখনই বাবার কাছে জানতে চায়। আর ছোট ছেলে বৃহস্পতিবারে ওর জন্য কোন খেলনাটা নিয়ে আসতে হবে সেটা বলে দেবার জন্য বাবাকে মনে করে।

সপ্তাহব্যাপী প্রচণ্ড শারীরিক এবং মানসিক কষ্টে রাহাত বউ, ছেলেমেয়েকে মনে মনে কাছে পাবার চেষ্টা করে। ওরা কি ওদের এই প্রিয় মানুষটির জন্য একটুও কষ্ট অনুভব করে?

নিজে যখন রাহাত ওদেরকে ফোন করে, ওদের ফোন বেজে চলে। ওপাশের মানুষগুলো রাহাতের ফোন রিসিভ কেন করে না? নিজের আব্বাকে বা আম্মাকে ফোন করলে দুটো কি তিনটে রিঙ হবার সাথে সাথেই ওনারা ফোন ধরেন। তাঁরা কি রাহাতের ফোনের অপেক্ষায় ই থাকেন? অথচ তাদেরকে সেভাবে ফোন করা হয়ে উঠে না।

হঠাত-ই রাহাত নিজেকে এক বিরানভূমির মাঝে আবিষ্কার করে। দু’পাশের দিগন্ত বিস্তৃত মরুভুমির এক পাশে নিজের পুর্বপুরুষ, অন্য পাশে উত্তরপুরুষ। সে উত্তরপুরুষের দিকে একটু বেশী ঝুঁকে থাকলেও তারা ওর দিকে কেন জানি ঝুঁকতে চায় না। আর পুর্বপুরুষ ওর দিকে মুখিয়ে থাকলেও রাহাতের সেদিকে ফিরতে কেন জানি একটু আলসেমিতে ধরে। এক বাবা ওর দিকে ফিরে থাকে… সে অন্য এক ছোট বাবার হৃদয়ের উষ্ণতাকে পাবার জন্য ওর দিকে ফিরে থাকা বাবার হৃদয়কে এখন আর আগের মত অনুভব করতে পারে না।
পারে না? না কি চায় না?

সে নিজে আজ একজন বাবা। সপ্তাহব্যাপী একাকীত্বকে শেষ করে যখন নিজের ছোট বাবার কাছে ফিরে যায়, নিজের বড় বাবার কষ্টটা বাসায় ফিরবার পর নিজের এক দিনের মিলনের আনন্দ উপভোগ করার সময়ে চকিতে অনুভব করে। কিন্তু বড় বাবার কাছে ছেলে হিসেবে ফেরাটা কি আসলভাবে হয়? আদৌ কি ফেরা হয়?

তিনপুরুষের এই চিরন্তন মায়াবী খেলায় রাহাত নামের এক মধ্যবর্তী বাবা নিজেকে বড্ডো অসহায় ভাবে উপলব্ধিতে অনুভব করে নিরন্তর ছটফট করে।

#মরুতে_অণুগল্প_১৫০

★★★★
ছোট হবার অনেক যন্ত্রনা।
এগুলোর মধ্যে নিজের কাছে ছোট হয়ে যাওয়ার মত বেদনা… হৃদয়কে চিরে দিয়ে যায় যেন। কেউ কি হৃদয় ফালাফালা হবার অনুভূতিতে বিদীর্ণ হয়েছ?
ঐ মুহুর্তটি বধ্যভূমিতে নিয়ে যাবার সময়ে চুড়ান্ত তরবারির একটি আঘাতকে কল্পনা করে বাস্তবে প্রতিটি মুহুর্তে হাজারো তীক্ষণধার তরবারির সহস্র আঘাত অনুভবের সামিল বৈ আর কিছু কি? ভুক্তভোগীমাত্রই অনুধাবন করবে।

রাহাত শেষ পর্যন্ত নিজের কাছেই ছোট হয়ে গেল। গত বছরব্যাপী একটি পারিবারিক জটিল সম্পর্কের শেষ না হওয়া একটা কানাগলির ডেড এন্ডে এসে খাবি খাচ্ছিল। রিতাকে নিয়েই ভালোলাগা না লাগার চুড়ান্ত পরিণতি জানার পরও সেখান থেকে কাউকে পথের মাঝখানে একা ফেলে সরে আসার পলায়নপর মনোবৃত্তি নেই বলেই সে সম্পর্কগুলোকে তাদের সাভাবিক গতিতে চলতে দিতে পারছিল না।
প্রয়োজন ছিল একটিকে একবারে ইরেজ করে বাকিগুলোকে যত্ন করার।

রিতা ওর ঘর সংসার নিয়ে বেশ ছিল। বেশ আছে। কিন্তু ভালোবাসা নামের একটি জটিল মানসিক তাড়নায় সে রাহাতকে নিজের ভূবনের এক সাময়িক অবিচ্ছেদ্য চরিত্রে রুপ দিতে চাচ্ছিল। নিজের পরিবারের মানুষটির প্রতি এক ইচ্ছেকৃত অবহেলা? জেদ? অথবা নেই নেই ভালোবাসা জেনেও নিজেকে আরো একবার চেষ্টা করানোর এক নিরন্তর প্রয়াস? ওর মানুষটি ভুল একজনের ভিতরে অন্য সঠিক কাউকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করে যাচ্ছে দাম্পত্য জীবনের বছরগুলি।
রিতাই সেই ‘ভুল একজনের’ চরিত্রে অভিনয় করছে।

দু’দিন হল রাহাত রিতার সাথের সম্পর্কটিকে সেই পথের মাঝে ফেলে এসেছে। আজ দু’দিন পৃথিবীটি বড্ড বর্ণহীন… বেসুরো। এমন একটি আমানত ইচ্ছাকৃত নষ্ট করে ফেললো, যাতে রিতা প্রচন্ড ঘৃণা করে ঐ পথের মাঝ থেকে নিজের মানুষটির দিকে ফিরে আসে।
ভালোবাসা একবার হৃদয়ে জন্ম নিলে এত সহজে একেবারে নিঃশেষ হয় না।এর অনেক শক্তি। অপেক্ষা এই শক্তিকে আরো বাড়িয়ে তোলে।

নিজেকে সুকান্তের ‘প্রিয়তমাসু’ কবিতার সেই বাতিওয়ালার মত মনে হচ্ছে-
” আমি যেন সেই বাতিওয়ালা,
যে সন্ধ্যায় রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে
অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ,
নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার । ”

শীতের রাতে প্রচন্ড বাতাস বইছে। ঝড় উঠেছে রাহাতের মনেও। নিজের কাছে ছোট হয়ে থাকা এক মধ্যবয়স্ক প্রিয় একজন মানুষের জন্য এই মুহুর্তগুলোতে ফালা হবার অনুভূতি নিয়েই অপেক্ষা করে। সবগুলো সম্পর্কের মাঝের দেয়ালগুলোকে এই বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যাক না!

সবাই ভালো থাকুক যার যার ভূবনে।
সবাই কাছে থাকুক।।

#সবাই_জেগে_আছে_অণুগল্প_১৮৩
_______________________________
প্রতিদিন সকালে মসজিদে যান নামাজ পড়তে। সেখান থেকে মর্ণিং ওয়াকে বের হন। রোজকার অভ্যাস। আজ বছর দশ হলো সরকারি চাকুরী থেকে অবসর নিয়েছেন। এখন অফুরন্ত অবসর। কিন্তু সময় যে কাটেনা!

আজও একা একা হাঁটতে বের হয়েছেন। মসজিদটা বাজারের ঠিক মাঝে। গার্লস স্কুলের পিছনদিকে। ফজরের নামাজে যে ক’জন মুসল্লী আসেন তাদের ভিতরে কয়েকজন হলেন মৌসুমি মুসল্লী। এরা গরমের সময় এই ফজরের নামাজ পড়তে পারেনা। মনে হয় ঘুম থেকে উঠতে পারে না। আর শীতের রাত দীর্ঘ হওয়াতে এবং সকালে মর্ণিং ওয়াকে যাবার জন্য এরা বাধ্য হয়ে ভোরে উঠে। মর্ণিং ওয়াক এদের কাছে যতটা না স্বাস্থ্যকর, তার থেকে বেশী স্ট্যাটাস মেইনটেইনের পরিচায়ক।

জায়গায় জায়গায় পীচ উঠে খোয়া বের হয়ে আছে। বাজার থেকে মেইনরোডে গিয়ে মিশে যাওয়া এই রাস্তাটার সংস্কার হয়না অনেকদিন। ভাঙা যায়গাগুলোতে সাবধানে পা ফেলে ফেলে এগোতে হচ্ছে। এই ৬৯ বছর বয়সে এসে এখন অনেক কিছুই দেখে শুনে করতে হচ্ছে। সামনে কবির সাহেবকে দেখতে পেলেন। তিনি ও সাদেক সাহেবের মতো প্রাতঃভ্রমনে বের হন। একটু পা চালিয়ে কবির সাহেবের পাশে চলে এলেন। তবে এইটুকুতে হাফিয়ে উঠলেন। কবির সাহেব পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে একবার ফিরে তাকালেন। নিঃশব্দে সালাম বিনিময় করলেন ইশারায়। হাতে তাসবিহ রয়েছে। জিকিরে ছিলেন মনে হয়।

কিছুদুর নিঃশব্দে হাঁটলেন দু’জন বুড়ো খোকা। একসময় তাসবিহ পকেটে পুড়ে কবির সাহেব বললেন,
: তারপর সাদেক সাহেব? কি খবর?
: আলহামদুলিল্লাহ!
: কেমন যাচ্ছে দিনকাল?
: চলছে আর কি…

আবার কিছুক্ষণ চুপ করে হেঁটে চললেন। বলার আর কিই বা আছে। এই বয়সে এসে হেঁটে হেঁটে অনর্গল কথা বলা যায়না। তবে কোথাও বসতে পারলে এবং একবার কথা ধরিয়ে দিতে পারলে আর থামানোই তখন দায় হয়ে যায়। সাদেক সাহেবের বউ তো ওনাকে কতবার যে বকা দেয় এই বেশী কথা বলার জন্য। বউ এর কথা মনে আসতেই কেন জানি মনটা আনন্দে ভরে উঠতে লাগল। যদিও এই দুজনের ভিতর সারাদিন ঝগড়া লেগেই থাকে। কেউ দেখলে মনে করবে ওনারা একজন আর একজনকে সহ্যই করতে পারেন না। তবে আসলে সাদেক সাহেবের তার বউয়ের প্রতি যে কি পরিমাণ ভালবাসা অবশিষ্ট রয়েছে, সেটা শুধু তিনি একাই জানেন।

কবির সাহেব একটু এগিয়ে ছিলেন। চলার গতি একটু স্লথ করে বললেন,
: কি চিন্তা করছেন ভাই?
: কিছু না। এমনিতেই…
: মাহফুজের সাথে কথা বার্তা হয়?
হু এবং হ্যা এর মাঝামাঝি গোছের একটা উত্তর দিয়ে সাদেক সাহেব হাঁটার গতি একটু বাড়িয়ে দিলেন। একটু দুঃখও পেলেন, রাগও হলেন কিছুটা। মাহফুজ তার বড় ছেলে। বিয়ে করে এখন হল্যান্ডে বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকে। সেই যে কয়েক বছর আগে বাবা-মাকে দেশে রেখে চলে গেলো, আর আসে নাই। প্রথম দিকে ফোনে কথাবার্তা যাও একটু হতো… ইদানিং সেটা কমতে কমতে একেবারে শুন্যের কোঠায় চলে এসেছে। এলাকার সবাই এটা জানে। আর জানে বলেই ইচ্ছে করেই এই প্রসঙ্গটা সাদেক সাহেবের সামনে তোলে। যাতে করে তিনি কষ্ট পেতে পারেন।

অবাক হয়ে মাঝে মাঝে ভাবেন, মানুষ কেন অন্য একজন মানুষকে বিনা প্রয়োজনে কষ্ট দেয়? অন্য কোনো পশুর ভিতরে নেহায়েত খাবারের প্রয়োজন ছাড়া এই প্রবনতা দেখা যায়না। তবে কি মানুষ পশুর থেকেও নীচে নেমে যাচ্ছে?
হয়তোবা।

এইযে কবির সাহেব মাহফুজের কথাটা তুলে তার মনটা খারাপ করে দিলেন! কি লাভ হল তার? কবির সাহেবের মেঝ মেয়ে যে নিজের ইচ্ছেয় পালিয়ে বিয়ে করেছে সেটা জিজ্ঞেস করে তিনিও তো তাকে বিব্রত করতে পারেন এখন?

বজ্রাহতের মত থমকে দাঁড়ালেন সাদেক সাহেব।
একি ভাবলেন তিনি?

যে কবির সাহেবকে মনে মনে গালমন্দ করলেন তার দুর্বল জায়গার প্রসঙ্গ তোলাতে- সেই একই কাজও তো এইমাত্র তিনি নিজেও মনে মনে ভাবলেন! তাহলে অন্যদের সাথে তার পার্থক্যটা কোথায় রইলো? কবির সাহেবও দাঁড়ালেন। একটু বিরক্ত হয়েই বললেন,
: আবার কি হলো?
: একটা খারাপ কথা চিন্তা করে ফেলেছি? আপনাকে নিয়ে…
: মানে? ঠিক বুঝলাম না। কি খারাপ কথা?
: তা বলা যাবে না। তবে… মাফ করে দিয়েন ভাই সাহেব। এটা চিন্তা করা ঠিক হয় নাই।

এই বলে সলজ হেসে আবার হাঁটা শুরু করলেন। একটু অবাক হয়ে কবির সাহেব ও তাকে অনুসরণ করলেন।

ফিরোজা বেগম অস্থির হয়ে বারান্দায় পায়চারি করছেন। লোকটা মর্ণিং ওয়াক থেকে এখনো যে এলোনা। কখনো তো এইরকম দেরী হয়নি। আজ যে কেন হচ্ছে? বাসায় ও কেউ নেই যে খুঁজতে পাঠাবেন। নিজের ও হাঁটুতে ব্যথা। সালেহা নামের যে কাজের মেয়েটিকে ফুলটাইম রেখেছেন, সেও গতকাল ছেলের অসুস্থতার জন্য গ্রামের বাড়িতে গেছে। আর মোবাইলটা ও সাদেক সাহেব ঘরে রেখে গেছেন। এতোই ভুলোমনা…!!

এর আগেও একবার মেয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়ে হারিয়ে গেছিলেন। ভাগ্য ভাল মোবাইল ছিল সাথে। শেষে মেয়ে জামাই গিয়ে বাসায় নিয়ে আসে। এরপর থেকে যেখানেই যাক সাথে মোবাইল নিয়ে যেতে বলে দিয়েছেন। কিন্তু তার কথা শুনলে তো!

ফিরোজা বেগমকে আর আধা ঘন্টা চিন্তায় রেখে সাদেক সাহেব বেশ হাসিমুখে ঘরে ফিরলেন। ফিরোজা বেগম মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও চোখেমুখে রাগ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
: কোথায় ছিলে?
: এইতো হেঁটে আসলাম।
: তাতো জানি। কিন্তু এতো দেরী করলে কেন? কবির ভাইকে ফোন করেছিলাম। তিনি বললেন আরো আধা ঘন্টা আগেই হাঁটা শেষ করেছ তোমরা?

চুপ করে রইলেন। কি বলবেন ভেবে পেলেন না। ছোট বাচ্চা যেমন মায়ের কাছ থেকে কিছু লুকাতে চেষ্টা করে কিন্তু ধরা খেয়ে যায়- সাদেক সাহেবের অবস্থাও ফিরোজা বেগমের সামনে এলে এরকমই হয়। ফিরোজা বেগম ওনার এই অসহায় অবস্থাটা বেশ উপভোগ করেন। সেটা সাদেক সাহেব জানেন না।
ফিরোজা বেগম ও কি জানেন যে সাদেক সাহেব ইচ্ছে করেই তার এই অসহায় অবস্থাটা ওনার সামনে ফুটিয়ে তোলেন? যাতে করে ফিরোজা বেগম তাকে ইচ্ছে মত গাল-মন্দ করতে পারেন। আর এই গাল-মন্দটা তিনিও বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেন।
এখন নিঃসঙ্গ এই দু’জনের উপভোগ করার আর রয়েছে-ই বা কি!?

কিন্তু আজ সকল সীমা অতিক্রম করে ফেললেন ফিরোজা বেগম। সাদেক সাহেব বড় ছেলে মাহফুজের সাথে মোবাইলে কথা বলতে জাফরের দোকানেই যে ছিলো এতোক্ষণ, সেটা বেশ ভালোই বুঝলেন।
: তুমি আবারও ‘ওর’ সাথে কথা বলতে গিয়েছিলে?
সাদেক সাহেব কোনো জবাব দিলেন না। এতে আরো রেগে গেলেন তিনি।
: আর কত নিজেকে ছোট করবে? তোমাকে না একবার বলেছি ওকে নিজের থেকে আর ফোন করবে না… কেন করলে? যে বাবা-মায়ের সাথে সম্পর্ক রাখতে চায় না… তুমি কেন জোর করে সম্পর্ক গড়তে চাও?

রেগে ফিরোজা বেগম নিজের রুমে চলে গেলেন। একই জায়গায় কিছুক্ষণ স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইলেন সাদেক সাহেব। একটা কথারও কোনো উত্তর দিতে পারলেন না। প্রতিদিন হেঁটে আসার পর ২০ মিনিট বিশ্রাম নিয়ে কুসুম গরম পানিতে গোসল করে নেন। ওনার বউ নিজে পানিটা গোসলখানায় এনে তাকে ডেকে নিয়ে যান। আজ শরীরের ঘাম অনেক আগেই শুকিয়ে গেছে। কিন্তু ফিরোজা বেগম এতোটা রেগেছে যে সব কিছু মনে হয় ভুলে গেছে।

ধীরে ধীরে নিজের স্টাডিতে চলে এলেন। চাকুরী থাকা অবস্থায় এই চারতলা বিল্ডিঙটা বানিয়েছিলেন। দু’তলার পুরোটায় নিজেরা থাকেন। এতো বড় বাড়িতে দু’জন মাত্র মানুষ। বাকী রুমগুলো অহেতুক পড়ে আছে। ইচ্ছে করলে ভাড়া দিতে পারতেন। কিন্তু ফিরোজা বেগমের ইচ্ছে না। তার মনের গোপন কোনো এক যায়গায় এখনো ছেলের ফিরে আসার সম্ভাবনাটা জাগ্রত রয়েছে। ছেলে-বউ-নাতীদের নিয়ে এই সাজানো সংসারটায় আবারও কলরব উঠবে এই আশা এখনো তিনি জিইয়ে রেখেছেন। এটা সাদেক সাহেব ও ভালো করেই জানেন।

তার কোনো অভাব নেই। যে পরিমাণ টাকা ঘরভাড়া পান তা দিয়ে একটা সংসার খুব সুন্দর ভাবে হেসেখেলে কাটিয়ে দিতে পারে। এছাড়া ব্যাংকে প্রচুর টাকা ফিক্সড ডিপোজিট রাখা আছে। ছেলের কোনো দরকারই ছিল না বিদেশে পড়ে থাকার। আজও সকালে অনেকক্ষণ কথা বলেছেন ছেলের সাথে… নাতীদের সাথে। ছেলে ফোন করলেই ভালো আছেন কিনা জিজ্ঞেস না করেই টাকা-পয়সা লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করে!

হায়রে!
এই সাদেক সাহেব কি টাকার কাঙ্গাল?
সেতো সম্পর্কের কাঙ্গাল… ভালবাসার কাঙ্গাল!

ভাবনা-চিন্তায় অনেক আগের দিনে ফিরে যান। মাহফুজের স্কুল জীবনে…সবে মাত্র অফিস থেকে এসেছেন। অনেক রাত হয়ে গেছে। ছেলে বাবাকে দেখে চাইনিজ খেতে চায়। সবে মাত্র অফিসের পোশাক ছেড়েছেন। আবার ড্রেসআপ হয়ে ছেলেমেয়ে ও ফিরোজাকে নিয়ে নিজে ড্রাইভ করে চাইনিজ হোটেলে গেলেন… ভালো কলেজে চান্স পায়নি ছেলে। নিজে লাইন-ঘাট করে যেভাবেই হোক ম্যানেজ করে নিলেন। অথচ এজন্য তাকে কতটা ছোট হতে হয়েছে তা কাউকে আজও বুঝতে দেন নাই।
এই ছেলেকে নিয়ে তার তেমন কোনো আশা ছিলনা। ইচ্ছে ছিল বাবা-মাকে নিয়ে একসাথে থাকবে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন ভালো যায়গায়। সে ঢাকায় থাকে। বছরে একটা ঈদ সে বাবা-মায়ের সাথে করে। ছেলেমেয়েদের সাথে ঐটুকুই যোগাযোগ রয়ে গেছে তাদের। মেয়ের দিক থেকে…

আশেপাশের বাড়িগুলোতে যারা আছেন তাদের সবাই একসাথে থাকে- ছেলেমেয়ে নিয়ে। ছোট ছোট বাচ্চাদের দিনভর হই হুল্লোর তার ব্যালকনি থেকে কিংবা ছাদে গেলে শুনতে পান। কি একটা অভাববোধ বুকের বাম পাশটাকে মোচর দিয়ে যায়… খুব কষ্ট পান তখন।
নিজের নাতীদের কথা মনে পড়ে… যমজ ছেলে হয়েছে মাহফুজের। কিন্তু ছবিতেই যা দেখেছেন। নাতীদের জন্মের পরে একবারও আসে নাই ওরা। তবে বাবা-মাকে হল্যান্ডে আসার জন্য অনেক বলেছে… একটা জেদ আঁকড়ে ধরে আছে ফিরোজা বেগম। সে নমনীয় না হওয়াতে সাদেক সাহেব ও যেতে পারছেন না।

এলাকায় তিনি অন্যতম ধনী। সবাই সমীহ করলেও এই ছেলের দিক থেকে তাকে আঘাত করে… এটা করে সবাই একধরণের বিকৃত আনন্দ লাভ করে থাকে। কথা প্রসঙ্গে ওদের নিজ নিজ ছেলে কি করেছে… এবারে ঈদে কি দিয়েছে… কোথায় কোথায় নিয়ে গেছে… মোটকথা ঘুরে ফিরে ঐ ছেলের প্রসঙ্গেই চলে আসে। এজন্য ওনারা দু’জন নিজেদেরকে বলতে গেলে একটা জেলখানায় বন্দী করে রেখেছেন। এই জেলখানাটা তার ছেলে তাদেরকে উপহার দিয়েছে।
এখন আর মনের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হয় না… বের হতে হতে হৃদয়টাকে এতটাই শীতল করে দিয়েছে যে উৎস মুখটাই ফ্রীজ হয়ে গেছে। এখন আর সেখানে সহজে কোনো ভাবের উদয় হতে চায় না… কেবলই একটা বোবা কান্না…কিছুটা কষ্ট!

আজ ছেলের সাথে মোবাইলে কথা বলে আসার সময় একটা পোস্টার দেখল স্কুলের দেয়ালটাতে। ছবিতে এক বৃদ্ধ বাবাকে এক ছেলে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসছে। সেখানে বাবার জবানীতে লিখা আছে,
“… একটা সময় ছিল, যখন আমার ছেলেকে রোজ স্কুলে ছাড়তে যেতাম… আজ ও আমায় ছাড়তে এসেছে… তফাৎ শুধু এটাই, বিকেলে আর নিতে আসবে না…”

সাদেক সাহেব ভাবলেন তার ছেলে তাকে এরকমই একটা বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গেছে।
কিন্তু একই সাথে নিজেকে তার ছেলের যায়গায় দাড় করালেন। সাদেক সাহেবের যৌবনকালে ফিরে গেলেন। ওনার বৃদ্ধা বাবা-মাকে গ্রামের বাড়িতে রেখে তিনিও তো শহরের বাসায় বছরের পর বছর বউ-ছেলেমেয়েকে নিয়ে বাস করেছেন। খুব কম সময়ই বাবা-মাকে দেখতে গেছেন। তারাও গ্রামের বাড়ি ছেড়ে শহরের দম-বন্ধ পরিবেশে থাকতে চাননি। তিনিও তেমন জোরাজুরি করেন নি। তবে আজ কেন নিজের ছেলের এই দূরে থাকা নিয়ে আক্ষেপ?
কেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিতে কষ্ট পাচ্ছেন?

এই কষ্টটা কি তার প্রাপ্য নয়?
মাহফুজ কি দেখে নাই তিনি তার বাবা মারা যাবার পরে তিনি নিজের বৃদ্ধা মাকে কীভাবে দিনের পর দিন একা রেখেছেন… প্রতি মাসে টাকা পাঠিয়েছেন ঠিকই… কিন্তু তার মা ও তো টাকার কাঙ্গাল ছিলেন না! সে ও তো ভালবাসার… স্নেহের ধনের একটু স্পর্শের কাঙ্গাল ছিলেন।
এই কাঙাল অবস্থায়ই তিনি মারা গেলেন। আর সাদেক সাহেব তখন অফিসের কাজে সমুদ্রের মাঝে। ফিরলেন সপ্তাহখানেক পরে। তখন তো আর যোগাযোগ এতো উন্নত ছিল না। নিজের মাকে শেষ দেখাও তিনি দেখতে পেলেন না।

আজ নিজের স্টাডি রুমে বসে অতীত ভেবে ভেবে একজন সাদেক সাহেব বর্তমানে বসে কষ্ট পাচ্ছেন…
চোখের কোণ বেয়ে অশ্রুধারা বয়ে চলেছে…।

ফিরোজা বেগম এসে তাকে এই অবস্থায় দেখে অবাক হলেন! নিজের কিছুক্ষণ আগের ব্যবহারের জন্য অনুতপ্ত হলেন মনে মনে।
ভাবলেন তার বকা দেবার জন্যই মনে হয় সাদেক সাহেব কষ্টে কাঁদছেন।
কাছে এসে তার কাঁধে হাত রাখলেন…।

এক ষাটোর্ধ বৃদ্ধ তার জীবন সঙ্গিনীকে কাছে পেয়ে আরো আবেগী হয়ে উঠলেন। ফিরোজা বেগমের ছোঁয়া সাদেক সাহেবের মনের এতদিনের সুপ্ত কষ্টকে বের করে আসার পথকে আরো সহজ করে দিল। তিনি তার বউ এর দিকে ফিরে বলতে থাকেন,
: আমি ভুল করেছি… বিরাট ভুল করেছি
: ঠিক হয়ে যাবে… সব ঠিক হয়ে যাবে। কিচ্ছু ভেবো না। ও না আসুক আমরাই যাবো ওর কাছে।

সাদেক সাহেব যে জিনিসটি এতোদিন চাইছিলেন সেটা এতো সহজেই হয়ে গেলো! তারপর ও তিনি খুশী হতে পারলেন না। তার কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেলো। যে দূরত্ব তার ছেলের সাথে তৈরী হয়েছে সেটা তো তিনি ইচ্ছে করলেই যেকোনো সময় কমিয়ে আনতে পারবেন… সেই পরিস্থিতিও তৈরী হয়েছে।
কিন্তু তিনি ছেলে হিসাবে যে দূরত্ব তৈরী করে রেখেছিলেন- সেটা আজ কীভাবে কমাবেন?

কিছু কিছু দূরত্ব আছে যেটা সময় থাকতেই কমাতে হয়…

আজ বড্ড দেরী হয়ে গেছে… একজন সাদেক সাহেবের জন্য।।

#বুমেরাং_মামুনের_ছোটগল্প

জোড়া অণুগল্প

IMG_20170129_115331
নিজের পানে দৃষ্টি ফেলে রাখি
একজন মানুষ আজীবন একাকি :(
______________________________

নতুন বছরে পাপার দেয়া নতুন ডাইরি খুলে প্রথম পাতায় পাপার লিখাগুলো পড়ে ফোরে পড়ুয়া বাবুটা.. ওর ছোট্ট হৃদয়ের বাবু চিন্তাগুলো এলোমেলো ধাপ হেলায় অতিক্রম করে ওকে হাসায়!

‘ পাপাটা যে কি! ডাইরিতে পড়ালিখার কথা না লিখে গল্প- কবিতা লিখতে বলেছে.. তাও লাল বল পেন দিয়ে 😀 … আবার তিনচুলওয়ালা একটা বাবুও একে দিয়েছে .. পাপাও কি একটা বাবু?’

বাবুটা কি কখনো জানবে পাপাও ওর আম্মুটার একটা বাবু ছিল.. ছিল তার আম্মুর আঁচলের নরম আদর.. ওর বাবু মনটাকে এই নগরজীবনে মাটি এনে দিতে দিতে কতদিন এই বুড়ো বাবুটা সেই আঁচলের নরম রোদগুলোর কোমল ছায়ায় মন জুড়াতে পারে না.. কখনো বুঝবে এই বিবর্ণ পাপার কায়া হারানোর ইতিহাস!

#দুই_বাবু_অণুগল্প_১৮০

★★
মাহতাব সাহেব বউয়ের সাথে কথার এক পর্যায়ে নিজের বই সংশ্লিষ্ঠ ভালোবাসার একজনের সাথে গতরাতের কৃত কষ্ট দেওয়া প্রসংগটি তুললে বউ বললো-
‘ তুমি পারো কেবলি কষ্ট দিতে সবাইকে! কেন এমন কর?’

মুহুর্তে মাহতাব এক আদিগন্ত ভাবনা-চিন্তায় প্রগলভ হয়.. কষ্ট পায়.. নিজেকে বড্ড ছোট মনে হয়.. আজকাল কেন সবসময় ভুলগুলি বড্ড প্রকট হয়?

একই সময়ে সাথে থাকা বউটির কথার ভিতরের অন্য একটি সুরও আজ বড্ড নগ্ন হয়ে সামনে এলো, ‘.. পারো কেবলি কষ্ট দিতে সবাইকে..’ বউ ও কি সবার ভিতরে?

#অন্য_সুর_অণুগল্প_১৮১

দুইটি অণুগল্প

FB_IMG_1485449034795

রিক্সাটা ছেড়ে দিয়ে, অন্ধকার সিঁড়ির একচিলতে আলোয় পথ দেখায় অভ্যস্ত আরমান, নিজের দরোজার সামনে থমকে দাঁড়ায়!

ফ্ল্যাটের দরোজার বুকে নিজের নামটি সুন্দরভাবে ছিলো এতদিন। নেই এখন! শেষের একটি অক্ষর নি:সংগ মুখব্যাদান করে চেয়ে আছে, ছিড়ে ফেলেছে কেউ। এতো উঁচুতে বাবুদের দুষ্টুমি নাগাল পায় না।

মৌচাক নগরে মধু অন্বেষণকারী শ্রমিক মধুমক্ষির মৌ-বিড়ম্বনা?

মৌ-বিড়ম্বনা!
বাহ!
নিজের মনে হাসে আরমান। ডোরবেলের নবে আলতো ছুঁয়ে দেয়। আর ভাবে,
– জীবনটা ইদানিং লিকার চা’য়ে যেনো এক চামচ ইয়ার্কি।।

#মৌ_বিড়ম্বনা_অণুগল্প

★ লিকার চা’য় এক চামচ ইয়ার্কি কথাটি প্রিয় কবিদা’ সৌমিত্র চক্রবর্ত্তীর। অনুমতি নিয়েছি আগেই ব্যবহারের জন্য।
__________________________

★★
নিজের ব্যালকনিতে একা আমান। সামনের একটু দূরের দুইতলা ভবনের ছাদে এই শীতে প্যান্ডেলবিহীন কিছু মানুষ একত্রিত হয়েছে। প্রচন্ড আওয়াজে সাউন্ডবক্স বাজছে- বার বার এই লাইনটা শুনতে পাচ্ছে-
‘রুপবানে নাচে কোমর দুলাইয়া’

একটু কি বিরক্ত হয় আমান?
এটা নিজেকে জিজ্ঞেস করাতে বিরক্তি আরো বাড়ে বৈ কমে না.. একটুও।
নিজের ওপর বিরক্ত অনেক আগে থেকেই। জন্মের সময় থেকেই কি? প্রচন্ড একটা যুদ্ধের মাঝামাঝি চরম এক দু:সময়ে ধরায় আগমন! ব্যতিক্রম একটু অবশ্যই। সুক্ষ্ম একটা বৈষম্য অনুভব করে। নিজের প্রতি। ওর ইশ্বরের পক্ষ থেকে। অন্যদের সাথে তুলনা করলে। নিজের সাথে।

বৈষম্য কাছের এবং দূরের মানুষদের থেকেও অহর্নিশ অনুভব করে চলে। তবে ধরা যায় না। কেবল সে-ই অনুভব করে। অন্যেরা নয়? দেখা যায় না, ধরা বা ছোয়া যায় না। আমান ছুতে পারে, অন্যরা বুঝে না। এজন্যই সুক্ষ্ণ ভেবেছে।

চরম বিরক্ত আমানের ব্রেইন পরিচিত হ্যালুসিনেশনে ডুবতে চায়। রুপবানে নাচুক কোমর দুলাইয়া। সারা দেশটাই নেচে চলেছে যখন।

বিরক্ত ভাবনাগুলো বিরহের ডানা মেলে বিবর্ণ হতে শুরু করে.. সব দিন.. প্রতিদিন.. এভাবেই একদিন?

এখন প্রতিদিনই এক একটি একদিন!

#বৈষম্য_অণুগল্প

জীবন এমনই

FB_IMG_1485329590836
নিজের জীবনের আঠাশ বছরে পা দিতে আর সপ্তাখানেক বাকী রোমেলের। পঁচিশ বসন্তে চাকুরিতে ঢুকেছিলো। তখন সে আর রাবু। রাবেয়া রাবু নাম ধারণ করেছিলো ওদের বিয়ের পরেই। রোমেল এর সিংহভাগ কৃতিত্ব দাবী করতেই পারে। অন্যরা ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়েছে।

এই তিন বছরে দুই থেকে তিনে পৌঁছেছে ওরা। পিম্পি ওদের মাঝের সেতু হয়েছে। মা-বাবা আর দুই বোন অন্য শহরে। জীবন একরকম কেটেই যাচ্ছিলো ওদের। অম্ল-মধুর আছে-নাই এমন এক সর্পিল পথে চলছিলো জীবন।

এমন সময় হুট করে চাকরিটা চলে গেলো রোমেলের। সেদিন বাসায় ফিরে রাবুকে নিয়ে দীর্ঘসময় চুপচাপ কাটিয়েছিলো। অনিশ্চিত ভবিষ্যত কি একধরণের চাপে রেখেছিলো? চাপ তো সবসময়েই ছিলো। তবে নির্বাক হয়ে যাবার মতো.. হোক না সামান্য সময়ের জন্য.. ছিলো কি?

সময় পার হয়। চাকরি পায় না। একদিন একমাত্র সঞ্চয় ডিপিএসটি ম্যাচিউরড হবার আগেই ভাংগাতে ব্যাংকের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় রোমেল। গত তিন বছর ধরে তিল তিল করে জমানো সঞ্চয়টুকু এই ইটপাথরের বিশাল অট্টালিকার পেটে পরম মমতায় রেখেছে সে। আজ সেই শিশুকে ‘প্রি-ম্যাচিউরড’ ভূমিষ্ঠ করাতেই হচ্ছে।

নিজের মনে ভাবনায় ছিলো। তাই ঘোরের ভিতর কখন কিউতে দাঁড়িয়েছে, কাউন্টার ম্যানের সাথে কথা বলেছে, তার মেশিন এবং হাতে টাকাগোনা দেখেছে! সবই না দেখার মতোন। টাকার বান্ডিল ওর দিকে বাড়িয়ে দিতেই নিয়েছে। পকেটে পুরেছে। এরপর বের হতে পিছু ফিরেছে।

সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা দেবার আগে থেমে যায়। টাকাটা গুনে দেখা দরকার ছিলো। ব্যাংকের দরোজার সামনের সিঁড়ি লাগোয়া ডাম্পিং প্লেসে এসে দাঁড়ায়। বান্ডিলের টাকার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যায়। অবাক হয়। আবার গোনে।

তৃতীয়বার গোনা শেষ। বিচিত্র অনুভব একসাথে ঘিরে ধরে রোমেলকে। প্রায় আট হাজার টাকা বেশী দিয়েছে ক্যাশের দায়িত্বরত লোকটি!

ভিতরের শয়তান নিমেষে এসে হাজির হয়। সাথে নিয়ে আসে আরো কিছু পুরনো বন্ধুদের। লোভ, আকাঙ্ক্ষা, বিলাসী মনোভাব ওদের অন্যতম। শয়তান মিচকি হেসে বলে,
– সোজা হাটার উপর থাক। ডাইনে বায়ে কোথায়ও তাকাইস না। আট হাজার টাকা বাইঞ্চোত!! দ্রুত ভাগ..।

ভিতরের রোমেল বিব্রত হয়। ওর শুভবুদ্ধি ওর পা দু’টি আটকে রেখে নিরবে চেয়ে থাকে। লোভকে সামনে ঠেলে দিয়ে আকাঙ্ক্ষা বিদ্রুপ করে,
– দাঁড়িয়ে রইলি যে বড়? শীত আসছে। পিম্পির জন্য একটা লাল সোয়েটার.. সেই যে পছন্দ করেছিলো রাবু, ওটা নিতে হবে না?

একটু লোভী হয়ে উঠে রোমেল। ভিতরের নিজের অসহায় অবস্থা উপলব্ধি করে। ভাংগাচুরা চলে। চলে মানসিক টানাপড়েণ। শয়তান সুযোগের সদ্ব্যবহার করে পুরোদমে। মুখে মধু ঢেলে সে জানায়,
– তোমার একটা ভালো পোশাক নাই। জুতো জোড়াও গোড়ালি আর তলিতে সেলাইয়ের ফোড় নিয়ে ধুকছে। একটা কেডস অবশ্যই তোমার দরকার। মিনিমাম হাজার দুই খসে যাবে এতে। আর চাকরি খুঁজছো তুমি। এই তল্পিমার্কা পোশাক নিয়ে চাকরি পাবে? এজন্যই তো হচ্ছে না তোমার কিছু? আগে দর্শণধারী, পরে গুণবিচারি- জানো তো হে?

একটু নড়ে চড়ে ওঠে পা দু’টি। সামনে বাড়াতে উদ্যত হয় মস্তিষ্কের এক অংশের নির্দেশে। কিন্তু অন্য অংশ নিস্ক্রিয় থাকে। শয়তান ভিতরের নফসকে টেনে বাইরে আনতে অন্য অস্ত্র বের করে,
– সামনে থার্টি ফাস্ট। গত বছর তুমি বড়াই করে জানিয়েছিলে, এবার সবাইকে এন্টারটেইন তুমি-ই করবে। আরে বলদ, এবার কেডস মেডস কিনেও দুইটা টাকিলা তো নিতেই পারবি। ভাব একবার?

ভাবতে থাকে ভিতরে বাইরে দুইয়ে মিলানো এক রোমেল। অনিশ্চিত অনাগত সময় সামনে আসে এক পলক। একে একে অনেক কিছু হাজির হয়। সেখানে বাসা ভাড়া থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চাহিদা নিজেদের চেহারা দেখিয়ে যায় ওকে।

দ্বিতীয়বার কাউন্টারের কাছ থেকে ফিরে আসার সময় বড্ড নির্ভার দেখায় রোমেলকে। জীবনের পথের শুরুতে রয়েছে সে কেবল। সামনে বিস্তর পথ পাড়ি দেয়া বাকী। সেই পথ কখনো বন্ধুর। কখনো সরল। ষড় রিপুর প্রলোভন.. কষ্ট-ক্লেশ.. দুনিয়ার মায়া.. সম্পর্কগুলির ভিতরের টানাপড়েণ – এসব কিছু মিলিয়েই এই জীবনের পথ।

এক জীবনে যে কেউ একবারই এই পথে হাটার সুযোগ পায়। পরিশুদ্ধ হয়ে পথের শেষে পৌঁছায় ক’জন?

জীবনের পথের শুরুতে দাঁড়িয়ে নতুনভাবে শুরু করা একজন রোমেল স্মিত হাসে। বড্ড বিচিত্র মানব মন। বড্ড বিচিত্র!!

★ Photo Credit: Akm Azad

ওম

এক শীতের সন্ধ্যা। পুরোপুরি সন্ধ্যা বলা চলে না। রাত আসি আসি করছে। আকাশে চাঁদ থাকলে ও ম্লান প্রভায় চারপাশ হালকা আলোয় উদ্ভাসিত। শীত বেশ ভালো-ই। অবশ্য কানটুপি-জ্যাকেট আর জুতোয় ঢাকা পদযুগল নিয়ে শীতের পরিচ্ছদে আচ্ছাদিত হয়ে একে সহনীয় মনে হতে পারে। সক্ষম আপট-ডেট মানুষদের বেলায়।

স্ট্রিট লাইট থাকলেও বালবগুলি জ্বলছে না। এমন রাস্তা দিয়ে একটি ব্যাটারিচালিত ভ্যান ছুটে চলেছে। ওর যাত্রীদের চেয়ে ভ্যানচালকেরই যেনো তাড়াটা বেশী। একজন মা তাঁর শিশু বাবুটাকে নিয়ে বসে আছে। বাবুটার খোলা পা দু’টি চাঁদের ম্লান আলোয়ও বড্ড চোখে পড়ছে। মা’র পরণে সাধারণ শাড়ি। সেটা দিয়ে কোনোমতে মাথা ঢেকে রয়েছেন তিনি।

আরেকজন যাত্রী। মধ্যবয়স পার করে এসেছেন বছর দশেক আগে। সাথে একটি নতুন লেপ নিয়ে ফিরছেন বাড়িতে। কুটুম্ব এসেছে বাড়ি। মেয়ে-মেয়েজামাই। বাজারে বসে থেকে এই লেপটি বানিয়েছেন। তারও মনে মনে তাড়া। মফস্বল শহরে শীত অনেক তাড়াতাড়ি নামে। এতক্ষণে ওদের খাওয়া-দাওয়া শেষ হবার কথা।

ভ্যানচালক একটু অপেক্ষাকৃত ভালো রাস্তায় গিয়ে আরো গতি বাড়িয়ে দেয়। দ্রুত চলার কারণে পাশ কাটানো বাতাস শীতল থেকে শীতলতর হয়ে শরীরে কামড় বসায়। বাবুটা মানুষ হয়ে জন্মাবার দায়ে কেঁপে কেঁপে উঠে। মা অনুভব করেন। নিজের শরীর ছাড়া উষ্ণতা দেবার মতো বাবুটার জন্য আর কিছুই তাঁর কাছে এই মুহুর্তে নেই। হৃদয়ের উষ্ণতার সাথে সাথে কিছু ক্ষুদ্র প্রশ্বাস ও বের হয়ে বাবুটাকে ছুঁয়ে দিয়ে যায়!

লেপওয়ালা যাত্রীকে সামনে নেমে যেতে হবে। তিনি তাদের এই ভ্যানযাত্রার মাঝপথে বাবুটার মাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়েছিলেন তাঁরা কোথায় নামবেন। সেই হিসেবে এখনো অনেকটা পথ এই ভ্যানে তাদেরকে যেতে হবে। শীত, একটা নগ্ন পায়ের শিশু এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের একজন সাধারণ রমনী- যিনি একজন মা; এই ত্রিভুজ অনুভূতি তাকে কিছুটা বিষণ্ন করে তুলে। ভাবনার দোলাচালে তাকে কিছুক্ষণ দুলিয়ে যায়। এর শুরুটা অবশ্য সেই পথের মাঝে শুরু হয়েছিলো। আর তাঁর নিজের পথের শেষে এসে, আরো একটা চিন্তা চতুর্ভুজ ভাবনাকাশে তাকে পাক খাইয়ে চলে। সেখানে মেয়ে-মেয়েজামাই, শীত এবং একজন বাবা মূখ্য ভূমিকা পালন করে চলেন।

তাঁর নির্দিষ্ট জায়গাটিতে এসে ভ্যান থামাবার অনুরোধ করেন। ভাড়া মিটান। এরপর নিজের নতুন কেনা লেপটির দিকে তাকান। নিজের শোবার ঘরে- তাঁর এবং তাঁর বউয়ের জন্য বরাদ্দ আটপৌড়ে লেপটি ভাসে মনের চোখে। একই সাথে লেপবিহীন একটি শীতের রাত… নিজের বউ আর তিনি…। নিজের ঠিকানায় পৌঁছাতে অর্ধেক পথ বাকী এমন এক মা-ছেলের নন আপটু-ডেট পরিচ্ছদ। এসব কিছু ভেবে ভেবে-ই একজন মানুষ হয়ে উঠেন তিনি সামান্য সময়ের জন্য।

অবাক মা’য়ের চোখের বিহ্বল দৃষ্টির সামনে তিনি পরম মমতায়, লেপটি পরিমাপমতো খুলেন। সেখানে বাবুটিকে আবৃত করেন। শেষে শিশুটিকে মানবহৃদয়ের সত্যিকারের উষ্ণতার ওমে ছুঁয়ে দিয়ে, নিজের বাড়ির পথে ফিরে চলেন।

তখন রাত নেমেছে। রাতের প্রথম লগন। গোল থালার মতন পূর্ণ চাঁদেরকণা গ্রাস করে চলে দৃষ্টির প্রান্তসীমার এপিঠ-ওপিঠ।।

কয়েদী নাম্বার ৪৪০৮৮৭

FB_IMG_1485096270095
সাড়ে পাচ বছর প্রায় আমি এই কন্ডেম সেলে। মৃত্যুর অপেক্ষায়।
সাড়ে পাচ বছর ঠায় কারো বা কিছুর জন্য অপেক্ষা করা তোমার কাছে কেমন মনে হয়?
মরছিলাম আমি প্রতি পলে পলে। মুহুর্তে। ঘন্টায়.. প্রতিটি সুর্যোদয় এবং সুর্যাস্তে!

দুর্ভাগ্য আমার। একজন মুক্ত মানুষ হিসেবে আমি আয়েশ করে, একটা সুর্যোদয় কিংবা সুর্যাস্ত দেখতে পারিনি.. বিগত বছরগুলিতে।

নিজের সেলে একাকী। দুপুরের খাবার শেষ করে একটু ঝিমানি মত এসেছিল কেবল। ভাত ঘুমে ঢলে পড়া কোনো ক্লান্ত প্রহর কল্পনায় আনতে চাইছিলাম বোধহয়।

এমন সময় ওনারা এলেন। সমন নিয়ে। সময় হয়েছে। অবসান হয়েছে অপেক্ষার। আমি হাসলাম তাদের মুখের ওপর। স্বস্তির হাসি :)

একজন ডাক্তার এলেন। অনেক কিছু পরীক্ষা করে কেন জানি আমার বাম হাতের বৃদ্ধ আংগুলটিতে বেশী সময় লাগালেন।
আমাকে কি যেন পড়ে শুনালেন। আমি শুনলাম। ঘোরের ভিতর। আমার তখন ঘোর লাগা ঘোর! কয়েদি নাম্নার ৪৪০৮৮৭ এর ঘোর।

আসলে আমি তখন আমার ভিতরের পাহাড়, নদী আর সাগরকে বিদায় জানাতে মগ্ন ছিলাম।

সময় বয়ে চলে একসময় সন্ধ্যা পেরিয়ে মধ্যরাতকে সাথে নিয়ে এলো..

আমি নিজে শুদ্ধ হলাম।
একজন কিছু পাঠ করেছিলেন। আমি নির্ণিমেষ চেয়েছিলাম তার ঠোঁটের দিকে। মুগ্ধ হয়েছিলাম কিনা?

পাগল নাকি!
মুগ্ধ হবার ওটা যথার্থ সময় ছিল কি? এই শেষ সময়ে ও আমার মেজাজ বিগড়ে দিও না তো।

আমাকে শেষ ইচ্ছের কথা জানাতে বললেন কতৃপক্ষের দায়িত্বশীল একজন। ডেপুটি জেলার হবেন হয়তো। কারণ জেলার সাহেবকে চিনি আমি। আসলেই কি চিনি?

কিছু খেতে ইচ্ছে করছে কিনা জানতে চাওয়া হলেও নিশ্চুপ ছিলাম আমি। তারপরও কিছু একটা হাতে করে এনেছিল এক রক্ষী। আমি ফিরেও চাইলাম না সেদিকে।

সবশেষে প্রার্থণা করার সুযোগ দিতে চাইলে প্রশ্নকর্তার চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কার কাছে করব?’ তিনি নিশ্চুপ রইলেন।

একসময় জল্লাদরা এলো। আমার হাত পেছনে ভদ্রভাবে নিয়ে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দিলো। বলল, ‘চলুন স্যার!’ আমি তাদের দিকে তাকিয়ে হাসলেও, তারা ছিল নিস্প্রাণ। পাথরের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো পলকহীন চোখে। জল্লাদদের চোখ পাথরের-ই হতে হয়।

আমাকে যম টুপি পরাতে চাইলে, প্রথমবারের মত আমি সরব হলাম। বললাম, ‘ আমার এত বছরের থাকার পরিচিত জায়গাটুকু আমি খোলা চোখে যেতে চাই। আমাকে বধ্যভূমির প্রবেশদ্বারের আগে পরিয়ে দিও।’

আইনে নেই। তাই পরতেই হল। আমার দু’পাশে দু’জন জল্লাদ আমাকে শক্ত করে ধরে হাটিয়ে নিয়ে চলল। আমার আপন আধার ঘোর অন্ধকারের দিকে আমাকে টেনে নিয়ে চলল!

আমি হেটে যেতে যেতে, পাহাড়-নদী-ঝর্ণাদের মনে মনে ডাকলাম, ওরা দূর থেকে আবছা প্রচ্ছায়ার মত নিশ্চুপ রইলো। কাছে এলোনা।
তখন আমি কাছের মানুষদেরকে মনের চোখে দেখার চেষ্টা করলাম। বরাবরের মত আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, তারা আরো দূরে সরে গেলেন আমাকে দেখে। যেন একমাত্র অচ্ছুত মানুষটি যেন আমি।

সহকারী জল্লাদরা আমাকে সাথে নিয়ে, অল্প ক’টি ধাপ পার হয়ে- আমাকে প্রধান জল্লাদের হাতে হ্যান্ডওভার করল।

আমার কাছের মানুষদেরকে শেষবারের মত ভাবলাম। ‘আমি যাদের যাদের এই জীবনে সবচেয়ে বেশী ভালবেসেছি, সবচেয়ে বেশী আঘাত আমাকে তারা-ই দিয়েছে’, আমার গলায় ফাঁসির নট যথাস্থানে বাধার সময়ে এই কথাই মনে পড়ল।

সব চুপচাপ। সময় থেমে আছে। নির্দিষ্ট ক্ষণের অপেক্ষা করছে সময়কে ঘিরে অন্যরা।
‘কেবলমাত্র তোমাদের ঘৃণা অবহেলায়ই আজ ঝুলে যেতে হলো আমায়!’ পতনের নিম্নগতির প্রথম অণুমুহুর্তে এই ছিল কয়েদি নাম্বার ৪৪০৮৮৭ এর অণুভাবনা।।

★ ছবি: ফাসির মঞ্চের

★★ পরিস্থিতি দেখে কয়েক জায়গার চন্দ্রবিন্দু ভয়ে পালিয়েছে।