
★
‘মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে চলে…’ সর্বশ্রেষ্ঠ হৃদয়বিশেষজ্ঞের হৃদয়ের আর্তি অনুভব করতে করতে আমান ভাবে,
– আমার জগতের সব আলো পারু নিয়ে গেলেও, সে কি নিজের অন্ধকারকে দূর করতে পেরেছে সেই আলোয়?
একজন দেবদা’ কে দাসে পরিণত করে পারু কি আলোর মিছিলের দূরতম তারা? … এই মুহুর্তে একজন দেবদাসের উত্তরসুরীর উদভ্রান্ত অনুভব!
#কি_কথা_ছিলো_যে_মনে_অণুগল্প_১৪৮
★★
পাতা ঝরার দিনে, দু’পাশের গাছগুলোর নুয়ে পড়া মাথার সৃষ্ট সবুজ টানেল বরাবর সামনে হেঁটে চলেছে শিহাব লম্বা পিচ ঢালা পথটি ধরে।
রিতার মোবাইলে কখন থেকে রিং হচ্ছে, ধরছে না, আবার করতেই সুইচড অফ শোনালো, আশেপাশের সবুজ নিমিষে রং হারিয়ে কালচে হয়ে উঠলো ওর কাছে।
হৃদয়টা চিরে যেতে যেতে গভীর থেকে একটা অনুভবই উঠে এলো, রিতা যখন সম্পর্কটা রাখতেই চাইছে না, তবে কেন এভাবে বিরক্ত করা?
#পাতা_ঝরার_দিনে_অণুগল্প_১৪৯
★★★
রাহাতের দিনগুলো ঘড়ির কাটা ধরে কেটে যাচ্ছে। শনি থেকে শুরু হয়ে সেই বৃহস্পতিবারে এই রুটিন শেষ হয়। তাও একদম রাত দশটায়। নিজের পরিবারের সকলে কেমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সে এক জায়গায়, বউ ছেলেমেয়ে আর এক জায়গায়। বাবা-মা ভাইয়েরা অন্য আর এক এলাকায়।
এদের সকলের সাথে যোগাযোগ বলতে গেলে সেই এক বিনা তারে কথা বলা।
মোবাইল।
রেখা আগে প্রতিদিন কয়েকবার কথা বলতো। এখন সপ্তাহে কদাচিৎ দু’একবার কথা হয়। তাও ঠেকে গেলে। মোবাইলে টাকা ভরে দিও তো (রাত দশটায় মোবাইলের ব্যালেন্স শেষ হয়ে গেলে)।
মেয়ে পিম্পি যখন ওর ক্লাশের পড়ালিখায় আটকে যায়, তখন বাবাকে ফোন করে। ইংরেজী কোন শব্দের মানে বুঝছে না কিংবা কেমিস্ট্রির কোনো সংকেত নিয়ে সন্দিহান, তখনই বাবার কাছে জানতে চায়। আর ছোট ছেলে বৃহস্পতিবারে ওর জন্য কোন খেলনাটা নিয়ে আসতে হবে সেটা বলে দেবার জন্য বাবাকে মনে করে।
সপ্তাহব্যাপী প্রচণ্ড শারীরিক এবং মানসিক কষ্টে রাহাত বউ, ছেলেমেয়েকে মনে মনে কাছে পাবার চেষ্টা করে। ওরা কি ওদের এই প্রিয় মানুষটির জন্য একটুও কষ্ট অনুভব করে?
নিজে যখন রাহাত ওদেরকে ফোন করে, ওদের ফোন বেজে চলে। ওপাশের মানুষগুলো রাহাতের ফোন রিসিভ কেন করে না? নিজের আব্বাকে বা আম্মাকে ফোন করলে দুটো কি তিনটে রিঙ হবার সাথে সাথেই ওনারা ফোন ধরেন। তাঁরা কি রাহাতের ফোনের অপেক্ষায় ই থাকেন? অথচ তাদেরকে সেভাবে ফোন করা হয়ে উঠে না।
হঠাত-ই রাহাত নিজেকে এক বিরানভূমির মাঝে আবিষ্কার করে। দু’পাশের দিগন্ত বিস্তৃত মরুভুমির এক পাশে নিজের পুর্বপুরুষ, অন্য পাশে উত্তরপুরুষ। সে উত্তরপুরুষের দিকে একটু বেশী ঝুঁকে থাকলেও তারা ওর দিকে কেন জানি ঝুঁকতে চায় না। আর পুর্বপুরুষ ওর দিকে মুখিয়ে থাকলেও রাহাতের সেদিকে ফিরতে কেন জানি একটু আলসেমিতে ধরে। এক বাবা ওর দিকে ফিরে থাকে… সে অন্য এক ছোট বাবার হৃদয়ের উষ্ণতাকে পাবার জন্য ওর দিকে ফিরে থাকা বাবার হৃদয়কে এখন আর আগের মত অনুভব করতে পারে না।
পারে না? না কি চায় না?
সে নিজে আজ একজন বাবা। সপ্তাহব্যাপী একাকীত্বকে শেষ করে যখন নিজের ছোট বাবার কাছে ফিরে যায়, নিজের বড় বাবার কষ্টটা বাসায় ফিরবার পর নিজের এক দিনের মিলনের আনন্দ উপভোগ করার সময়ে চকিতে অনুভব করে। কিন্তু বড় বাবার কাছে ছেলে হিসেবে ফেরাটা কি আসলভাবে হয়? আদৌ কি ফেরা হয়?
তিনপুরুষের এই চিরন্তন মায়াবী খেলায় রাহাত নামের এক মধ্যবর্তী বাবা নিজেকে বড্ডো অসহায় ভাবে উপলব্ধিতে অনুভব করে নিরন্তর ছটফট করে।
#মরুতে_অণুগল্প_১৫০
★★★★
ছোট হবার অনেক যন্ত্রনা।
এগুলোর মধ্যে নিজের কাছে ছোট হয়ে যাওয়ার মত বেদনা… হৃদয়কে চিরে দিয়ে যায় যেন। কেউ কি হৃদয় ফালাফালা হবার অনুভূতিতে বিদীর্ণ হয়েছ?
ঐ মুহুর্তটি বধ্যভূমিতে নিয়ে যাবার সময়ে চুড়ান্ত তরবারির একটি আঘাতকে কল্পনা করে বাস্তবে প্রতিটি মুহুর্তে হাজারো তীক্ষণধার তরবারির সহস্র আঘাত অনুভবের সামিল বৈ আর কিছু কি? ভুক্তভোগীমাত্রই অনুধাবন করবে।
রাহাত শেষ পর্যন্ত নিজের কাছেই ছোট হয়ে গেল। গত বছরব্যাপী একটি পারিবারিক জটিল সম্পর্কের শেষ না হওয়া একটা কানাগলির ডেড এন্ডে এসে খাবি খাচ্ছিল। রিতাকে নিয়েই ভালোলাগা না লাগার চুড়ান্ত পরিণতি জানার পরও সেখান থেকে কাউকে পথের মাঝখানে একা ফেলে সরে আসার পলায়নপর মনোবৃত্তি নেই বলেই সে সম্পর্কগুলোকে তাদের সাভাবিক গতিতে চলতে দিতে পারছিল না।
প্রয়োজন ছিল একটিকে একবারে ইরেজ করে বাকিগুলোকে যত্ন করার।
রিতা ওর ঘর সংসার নিয়ে বেশ ছিল। বেশ আছে। কিন্তু ভালোবাসা নামের একটি জটিল মানসিক তাড়নায় সে রাহাতকে নিজের ভূবনের এক সাময়িক অবিচ্ছেদ্য চরিত্রে রুপ দিতে চাচ্ছিল। নিজের পরিবারের মানুষটির প্রতি এক ইচ্ছেকৃত অবহেলা? জেদ? অথবা নেই নেই ভালোবাসা জেনেও নিজেকে আরো একবার চেষ্টা করানোর এক নিরন্তর প্রয়াস? ওর মানুষটি ভুল একজনের ভিতরে অন্য সঠিক কাউকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করে যাচ্ছে দাম্পত্য জীবনের বছরগুলি।
রিতাই সেই ‘ভুল একজনের’ চরিত্রে অভিনয় করছে।
দু’দিন হল রাহাত রিতার সাথের সম্পর্কটিকে সেই পথের মাঝে ফেলে এসেছে। আজ দু’দিন পৃথিবীটি বড্ড বর্ণহীন… বেসুরো। এমন একটি আমানত ইচ্ছাকৃত নষ্ট করে ফেললো, যাতে রিতা প্রচন্ড ঘৃণা করে ঐ পথের মাঝ থেকে নিজের মানুষটির দিকে ফিরে আসে।
ভালোবাসা একবার হৃদয়ে জন্ম নিলে এত সহজে একেবারে নিঃশেষ হয় না।এর অনেক শক্তি। অপেক্ষা এই শক্তিকে আরো বাড়িয়ে তোলে।
নিজেকে সুকান্তের ‘প্রিয়তমাসু’ কবিতার সেই বাতিওয়ালার মত মনে হচ্ছে-
” আমি যেন সেই বাতিওয়ালা,
যে সন্ধ্যায় রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে
অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ,
নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার । ”
শীতের রাতে প্রচন্ড বাতাস বইছে। ঝড় উঠেছে রাহাতের মনেও। নিজের কাছে ছোট হয়ে থাকা এক মধ্যবয়স্ক প্রিয় একজন মানুষের জন্য এই মুহুর্তগুলোতে ফালা হবার অনুভূতি নিয়েই অপেক্ষা করে। সবগুলো সম্পর্কের মাঝের দেয়ালগুলোকে এই বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যাক না!
সবাই ভালো থাকুক যার যার ভূবনে।
সবাই কাছে থাকুক।।
#সবাই_জেগে_আছে_অণুগল্প_১৮৩
_______________________________
প্রতিদিন সকালে মসজিদে যান নামাজ পড়তে। সেখান থেকে মর্ণিং ওয়াকে বের হন। রোজকার অভ্যাস। আজ বছর দশ হলো সরকারি চাকুরী থেকে অবসর নিয়েছেন। এখন অফুরন্ত অবসর। কিন্তু সময় যে কাটেনা!
আজও একা একা হাঁটতে বের হয়েছেন। মসজিদটা বাজারের ঠিক মাঝে। গার্লস স্কুলের পিছনদিকে। ফজরের নামাজে যে ক’জন মুসল্লী আসেন তাদের ভিতরে কয়েকজন হলেন মৌসুমি মুসল্লী। এরা গরমের সময় এই ফজরের নামাজ পড়তে পারেনা। মনে হয় ঘুম থেকে উঠতে পারে না। আর শীতের রাত দীর্ঘ হওয়াতে এবং সকালে মর্ণিং ওয়াকে যাবার জন্য এরা বাধ্য হয়ে ভোরে উঠে। মর্ণিং ওয়াক এদের কাছে যতটা না স্বাস্থ্যকর, তার থেকে বেশী স্ট্যাটাস মেইনটেইনের পরিচায়ক।
জায়গায় জায়গায় পীচ উঠে খোয়া বের হয়ে আছে। বাজার থেকে মেইনরোডে গিয়ে মিশে যাওয়া এই রাস্তাটার সংস্কার হয়না অনেকদিন। ভাঙা যায়গাগুলোতে সাবধানে পা ফেলে ফেলে এগোতে হচ্ছে। এই ৬৯ বছর বয়সে এসে এখন অনেক কিছুই দেখে শুনে করতে হচ্ছে। সামনে কবির সাহেবকে দেখতে পেলেন। তিনি ও সাদেক সাহেবের মতো প্রাতঃভ্রমনে বের হন। একটু পা চালিয়ে কবির সাহেবের পাশে চলে এলেন। তবে এইটুকুতে হাফিয়ে উঠলেন। কবির সাহেব পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে একবার ফিরে তাকালেন। নিঃশব্দে সালাম বিনিময় করলেন ইশারায়। হাতে তাসবিহ রয়েছে। জিকিরে ছিলেন মনে হয়।
কিছুদুর নিঃশব্দে হাঁটলেন দু’জন বুড়ো খোকা। একসময় তাসবিহ পকেটে পুড়ে কবির সাহেব বললেন,
: তারপর সাদেক সাহেব? কি খবর?
: আলহামদুলিল্লাহ!
: কেমন যাচ্ছে দিনকাল?
: চলছে আর কি…
আবার কিছুক্ষণ চুপ করে হেঁটে চললেন। বলার আর কিই বা আছে। এই বয়সে এসে হেঁটে হেঁটে অনর্গল কথা বলা যায়না। তবে কোথাও বসতে পারলে এবং একবার কথা ধরিয়ে দিতে পারলে আর থামানোই তখন দায় হয়ে যায়। সাদেক সাহেবের বউ তো ওনাকে কতবার যে বকা দেয় এই বেশী কথা বলার জন্য। বউ এর কথা মনে আসতেই কেন জানি মনটা আনন্দে ভরে উঠতে লাগল। যদিও এই দুজনের ভিতর সারাদিন ঝগড়া লেগেই থাকে। কেউ দেখলে মনে করবে ওনারা একজন আর একজনকে সহ্যই করতে পারেন না। তবে আসলে সাদেক সাহেবের তার বউয়ের প্রতি যে কি পরিমাণ ভালবাসা অবশিষ্ট রয়েছে, সেটা শুধু তিনি একাই জানেন।
কবির সাহেব একটু এগিয়ে ছিলেন। চলার গতি একটু স্লথ করে বললেন,
: কি চিন্তা করছেন ভাই?
: কিছু না। এমনিতেই…
: মাহফুজের সাথে কথা বার্তা হয়?
হু এবং হ্যা এর মাঝামাঝি গোছের একটা উত্তর দিয়ে সাদেক সাহেব হাঁটার গতি একটু বাড়িয়ে দিলেন। একটু দুঃখও পেলেন, রাগও হলেন কিছুটা। মাহফুজ তার বড় ছেলে। বিয়ে করে এখন হল্যান্ডে বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকে। সেই যে কয়েক বছর আগে বাবা-মাকে দেশে রেখে চলে গেলো, আর আসে নাই। প্রথম দিকে ফোনে কথাবার্তা যাও একটু হতো… ইদানিং সেটা কমতে কমতে একেবারে শুন্যের কোঠায় চলে এসেছে। এলাকার সবাই এটা জানে। আর জানে বলেই ইচ্ছে করেই এই প্রসঙ্গটা সাদেক সাহেবের সামনে তোলে। যাতে করে তিনি কষ্ট পেতে পারেন।
অবাক হয়ে মাঝে মাঝে ভাবেন, মানুষ কেন অন্য একজন মানুষকে বিনা প্রয়োজনে কষ্ট দেয়? অন্য কোনো পশুর ভিতরে নেহায়েত খাবারের প্রয়োজন ছাড়া এই প্রবনতা দেখা যায়না। তবে কি মানুষ পশুর থেকেও নীচে নেমে যাচ্ছে?
হয়তোবা।
এইযে কবির সাহেব মাহফুজের কথাটা তুলে তার মনটা খারাপ করে দিলেন! কি লাভ হল তার? কবির সাহেবের মেঝ মেয়ে যে নিজের ইচ্ছেয় পালিয়ে বিয়ে করেছে সেটা জিজ্ঞেস করে তিনিও তো তাকে বিব্রত করতে পারেন এখন?
বজ্রাহতের মত থমকে দাঁড়ালেন সাদেক সাহেব।
একি ভাবলেন তিনি?
যে কবির সাহেবকে মনে মনে গালমন্দ করলেন তার দুর্বল জায়গার প্রসঙ্গ তোলাতে- সেই একই কাজও তো এইমাত্র তিনি নিজেও মনে মনে ভাবলেন! তাহলে অন্যদের সাথে তার পার্থক্যটা কোথায় রইলো? কবির সাহেবও দাঁড়ালেন। একটু বিরক্ত হয়েই বললেন,
: আবার কি হলো?
: একটা খারাপ কথা চিন্তা করে ফেলেছি? আপনাকে নিয়ে…
: মানে? ঠিক বুঝলাম না। কি খারাপ কথা?
: তা বলা যাবে না। তবে… মাফ করে দিয়েন ভাই সাহেব। এটা চিন্তা করা ঠিক হয় নাই।
এই বলে সলজ হেসে আবার হাঁটা শুরু করলেন। একটু অবাক হয়ে কবির সাহেব ও তাকে অনুসরণ করলেন।
ফিরোজা বেগম অস্থির হয়ে বারান্দায় পায়চারি করছেন। লোকটা মর্ণিং ওয়াক থেকে এখনো যে এলোনা। কখনো তো এইরকম দেরী হয়নি। আজ যে কেন হচ্ছে? বাসায় ও কেউ নেই যে খুঁজতে পাঠাবেন। নিজের ও হাঁটুতে ব্যথা। সালেহা নামের যে কাজের মেয়েটিকে ফুলটাইম রেখেছেন, সেও গতকাল ছেলের অসুস্থতার জন্য গ্রামের বাড়িতে গেছে। আর মোবাইলটা ও সাদেক সাহেব ঘরে রেখে গেছেন। এতোই ভুলোমনা…!!
এর আগেও একবার মেয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়ে হারিয়ে গেছিলেন। ভাগ্য ভাল মোবাইল ছিল সাথে। শেষে মেয়ে জামাই গিয়ে বাসায় নিয়ে আসে। এরপর থেকে যেখানেই যাক সাথে মোবাইল নিয়ে যেতে বলে দিয়েছেন। কিন্তু তার কথা শুনলে তো!
ফিরোজা বেগমকে আর আধা ঘন্টা চিন্তায় রেখে সাদেক সাহেব বেশ হাসিমুখে ঘরে ফিরলেন। ফিরোজা বেগম মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও চোখেমুখে রাগ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
: কোথায় ছিলে?
: এইতো হেঁটে আসলাম।
: তাতো জানি। কিন্তু এতো দেরী করলে কেন? কবির ভাইকে ফোন করেছিলাম। তিনি বললেন আরো আধা ঘন্টা আগেই হাঁটা শেষ করেছ তোমরা?
চুপ করে রইলেন। কি বলবেন ভেবে পেলেন না। ছোট বাচ্চা যেমন মায়ের কাছ থেকে কিছু লুকাতে চেষ্টা করে কিন্তু ধরা খেয়ে যায়- সাদেক সাহেবের অবস্থাও ফিরোজা বেগমের সামনে এলে এরকমই হয়। ফিরোজা বেগম ওনার এই অসহায় অবস্থাটা বেশ উপভোগ করেন। সেটা সাদেক সাহেব জানেন না।
ফিরোজা বেগম ও কি জানেন যে সাদেক সাহেব ইচ্ছে করেই তার এই অসহায় অবস্থাটা ওনার সামনে ফুটিয়ে তোলেন? যাতে করে ফিরোজা বেগম তাকে ইচ্ছে মত গাল-মন্দ করতে পারেন। আর এই গাল-মন্দটা তিনিও বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেন।
এখন নিঃসঙ্গ এই দু’জনের উপভোগ করার আর রয়েছে-ই বা কি!?
কিন্তু আজ সকল সীমা অতিক্রম করে ফেললেন ফিরোজা বেগম। সাদেক সাহেব বড় ছেলে মাহফুজের সাথে মোবাইলে কথা বলতে জাফরের দোকানেই যে ছিলো এতোক্ষণ, সেটা বেশ ভালোই বুঝলেন।
: তুমি আবারও ‘ওর’ সাথে কথা বলতে গিয়েছিলে?
সাদেক সাহেব কোনো জবাব দিলেন না। এতে আরো রেগে গেলেন তিনি।
: আর কত নিজেকে ছোট করবে? তোমাকে না একবার বলেছি ওকে নিজের থেকে আর ফোন করবে না… কেন করলে? যে বাবা-মায়ের সাথে সম্পর্ক রাখতে চায় না… তুমি কেন জোর করে সম্পর্ক গড়তে চাও?
রেগে ফিরোজা বেগম নিজের রুমে চলে গেলেন। একই জায়গায় কিছুক্ষণ স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইলেন সাদেক সাহেব। একটা কথারও কোনো উত্তর দিতে পারলেন না। প্রতিদিন হেঁটে আসার পর ২০ মিনিট বিশ্রাম নিয়ে কুসুম গরম পানিতে গোসল করে নেন। ওনার বউ নিজে পানিটা গোসলখানায় এনে তাকে ডেকে নিয়ে যান। আজ শরীরের ঘাম অনেক আগেই শুকিয়ে গেছে। কিন্তু ফিরোজা বেগম এতোটা রেগেছে যে সব কিছু মনে হয় ভুলে গেছে।
ধীরে ধীরে নিজের স্টাডিতে চলে এলেন। চাকুরী থাকা অবস্থায় এই চারতলা বিল্ডিঙটা বানিয়েছিলেন। দু’তলার পুরোটায় নিজেরা থাকেন। এতো বড় বাড়িতে দু’জন মাত্র মানুষ। বাকী রুমগুলো অহেতুক পড়ে আছে। ইচ্ছে করলে ভাড়া দিতে পারতেন। কিন্তু ফিরোজা বেগমের ইচ্ছে না। তার মনের গোপন কোনো এক যায়গায় এখনো ছেলের ফিরে আসার সম্ভাবনাটা জাগ্রত রয়েছে। ছেলে-বউ-নাতীদের নিয়ে এই সাজানো সংসারটায় আবারও কলরব উঠবে এই আশা এখনো তিনি জিইয়ে রেখেছেন। এটা সাদেক সাহেব ও ভালো করেই জানেন।
তার কোনো অভাব নেই। যে পরিমাণ টাকা ঘরভাড়া পান তা দিয়ে একটা সংসার খুব সুন্দর ভাবে হেসেখেলে কাটিয়ে দিতে পারে। এছাড়া ব্যাংকে প্রচুর টাকা ফিক্সড ডিপোজিট রাখা আছে। ছেলের কোনো দরকারই ছিল না বিদেশে পড়ে থাকার। আজও সকালে অনেকক্ষণ কথা বলেছেন ছেলের সাথে… নাতীদের সাথে। ছেলে ফোন করলেই ভালো আছেন কিনা জিজ্ঞেস না করেই টাকা-পয়সা লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করে!
হায়রে!
এই সাদেক সাহেব কি টাকার কাঙ্গাল?
সেতো সম্পর্কের কাঙ্গাল… ভালবাসার কাঙ্গাল!
ভাবনা-চিন্তায় অনেক আগের দিনে ফিরে যান। মাহফুজের স্কুল জীবনে…সবে মাত্র অফিস থেকে এসেছেন। অনেক রাত হয়ে গেছে। ছেলে বাবাকে দেখে চাইনিজ খেতে চায়। সবে মাত্র অফিসের পোশাক ছেড়েছেন। আবার ড্রেসআপ হয়ে ছেলেমেয়ে ও ফিরোজাকে নিয়ে নিজে ড্রাইভ করে চাইনিজ হোটেলে গেলেন… ভালো কলেজে চান্স পায়নি ছেলে। নিজে লাইন-ঘাট করে যেভাবেই হোক ম্যানেজ করে নিলেন। অথচ এজন্য তাকে কতটা ছোট হতে হয়েছে তা কাউকে আজও বুঝতে দেন নাই।
এই ছেলেকে নিয়ে তার তেমন কোনো আশা ছিলনা। ইচ্ছে ছিল বাবা-মাকে নিয়ে একসাথে থাকবে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন ভালো যায়গায়। সে ঢাকায় থাকে। বছরে একটা ঈদ সে বাবা-মায়ের সাথে করে। ছেলেমেয়েদের সাথে ঐটুকুই যোগাযোগ রয়ে গেছে তাদের। মেয়ের দিক থেকে…
আশেপাশের বাড়িগুলোতে যারা আছেন তাদের সবাই একসাথে থাকে- ছেলেমেয়ে নিয়ে। ছোট ছোট বাচ্চাদের দিনভর হই হুল্লোর তার ব্যালকনি থেকে কিংবা ছাদে গেলে শুনতে পান। কি একটা অভাববোধ বুকের বাম পাশটাকে মোচর দিয়ে যায়… খুব কষ্ট পান তখন।
নিজের নাতীদের কথা মনে পড়ে… যমজ ছেলে হয়েছে মাহফুজের। কিন্তু ছবিতেই যা দেখেছেন। নাতীদের জন্মের পরে একবারও আসে নাই ওরা। তবে বাবা-মাকে হল্যান্ডে আসার জন্য অনেক বলেছে… একটা জেদ আঁকড়ে ধরে আছে ফিরোজা বেগম। সে নমনীয় না হওয়াতে সাদেক সাহেব ও যেতে পারছেন না।
এলাকায় তিনি অন্যতম ধনী। সবাই সমীহ করলেও এই ছেলের দিক থেকে তাকে আঘাত করে… এটা করে সবাই একধরণের বিকৃত আনন্দ লাভ করে থাকে। কথা প্রসঙ্গে ওদের নিজ নিজ ছেলে কি করেছে… এবারে ঈদে কি দিয়েছে… কোথায় কোথায় নিয়ে গেছে… মোটকথা ঘুরে ফিরে ঐ ছেলের প্রসঙ্গেই চলে আসে। এজন্য ওনারা দু’জন নিজেদেরকে বলতে গেলে একটা জেলখানায় বন্দী করে রেখেছেন। এই জেলখানাটা তার ছেলে তাদেরকে উপহার দিয়েছে।
এখন আর মনের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হয় না… বের হতে হতে হৃদয়টাকে এতটাই শীতল করে দিয়েছে যে উৎস মুখটাই ফ্রীজ হয়ে গেছে। এখন আর সেখানে সহজে কোনো ভাবের উদয় হতে চায় না… কেবলই একটা বোবা কান্না…কিছুটা কষ্ট!
আজ ছেলের সাথে মোবাইলে কথা বলে আসার সময় একটা পোস্টার দেখল স্কুলের দেয়ালটাতে। ছবিতে এক বৃদ্ধ বাবাকে এক ছেলে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসছে। সেখানে বাবার জবানীতে লিখা আছে,
“… একটা সময় ছিল, যখন আমার ছেলেকে রোজ স্কুলে ছাড়তে যেতাম… আজ ও আমায় ছাড়তে এসেছে… তফাৎ শুধু এটাই, বিকেলে আর নিতে আসবে না…”
সাদেক সাহেব ভাবলেন তার ছেলে তাকে এরকমই একটা বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গেছে।
কিন্তু একই সাথে নিজেকে তার ছেলের যায়গায় দাড় করালেন। সাদেক সাহেবের যৌবনকালে ফিরে গেলেন। ওনার বৃদ্ধা বাবা-মাকে গ্রামের বাড়িতে রেখে তিনিও তো শহরের বাসায় বছরের পর বছর বউ-ছেলেমেয়েকে নিয়ে বাস করেছেন। খুব কম সময়ই বাবা-মাকে দেখতে গেছেন। তারাও গ্রামের বাড়ি ছেড়ে শহরের দম-বন্ধ পরিবেশে থাকতে চাননি। তিনিও তেমন জোরাজুরি করেন নি। তবে আজ কেন নিজের ছেলের এই দূরে থাকা নিয়ে আক্ষেপ?
কেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিতে কষ্ট পাচ্ছেন?
এই কষ্টটা কি তার প্রাপ্য নয়?
মাহফুজ কি দেখে নাই তিনি তার বাবা মারা যাবার পরে তিনি নিজের বৃদ্ধা মাকে কীভাবে দিনের পর দিন একা রেখেছেন… প্রতি মাসে টাকা পাঠিয়েছেন ঠিকই… কিন্তু তার মা ও তো টাকার কাঙ্গাল ছিলেন না! সে ও তো ভালবাসার… স্নেহের ধনের একটু স্পর্শের কাঙ্গাল ছিলেন।
এই কাঙাল অবস্থায়ই তিনি মারা গেলেন। আর সাদেক সাহেব তখন অফিসের কাজে সমুদ্রের মাঝে। ফিরলেন সপ্তাহখানেক পরে। তখন তো আর যোগাযোগ এতো উন্নত ছিল না। নিজের মাকে শেষ দেখাও তিনি দেখতে পেলেন না।
আজ নিজের স্টাডি রুমে বসে অতীত ভেবে ভেবে একজন সাদেক সাহেব বর্তমানে বসে কষ্ট পাচ্ছেন…
চোখের কোণ বেয়ে অশ্রুধারা বয়ে চলেছে…।
ফিরোজা বেগম এসে তাকে এই অবস্থায় দেখে অবাক হলেন! নিজের কিছুক্ষণ আগের ব্যবহারের জন্য অনুতপ্ত হলেন মনে মনে।
ভাবলেন তার বকা দেবার জন্যই মনে হয় সাদেক সাহেব কষ্টে কাঁদছেন।
কাছে এসে তার কাঁধে হাত রাখলেন…।
এক ষাটোর্ধ বৃদ্ধ তার জীবন সঙ্গিনীকে কাছে পেয়ে আরো আবেগী হয়ে উঠলেন। ফিরোজা বেগমের ছোঁয়া সাদেক সাহেবের মনের এতদিনের সুপ্ত কষ্টকে বের করে আসার পথকে আরো সহজ করে দিল। তিনি তার বউ এর দিকে ফিরে বলতে থাকেন,
: আমি ভুল করেছি… বিরাট ভুল করেছি
: ঠিক হয়ে যাবে… সব ঠিক হয়ে যাবে। কিচ্ছু ভেবো না। ও না আসুক আমরাই যাবো ওর কাছে।
সাদেক সাহেব যে জিনিসটি এতোদিন চাইছিলেন সেটা এতো সহজেই হয়ে গেলো! তারপর ও তিনি খুশী হতে পারলেন না। তার কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেলো। যে দূরত্ব তার ছেলের সাথে তৈরী হয়েছে সেটা তো তিনি ইচ্ছে করলেই যেকোনো সময় কমিয়ে আনতে পারবেন… সেই পরিস্থিতিও তৈরী হয়েছে।
কিন্তু তিনি ছেলে হিসাবে যে দূরত্ব তৈরী করে রেখেছিলেন- সেটা আজ কীভাবে কমাবেন?
কিছু কিছু দূরত্ব আছে যেটা সময় থাকতেই কমাতে হয়…
আজ বড্ড দেরী হয়ে গেছে… একজন সাদেক সাহেবের জন্য।।
#বুমেরাং_মামুনের_ছোটগল্প