আন্‌ওয়ার এম হুসাইন এর সকল পোস্ট

আন্‌ওয়ার এম হুসাইন সম্পর্কে

শ্লোগান দেয়া মিছিলগুলো আমাকে খুব মোহন করে ডেকেছিল

আধুনিক রোজার সাড়া জাগানো কিছু সহীহ তরিকা

রোজার ইতিহাস গুরুত্ব ইত্যাদি নিয়ে মওলানা সাহেবদের দিনরাত সবক শুনতে শুনতে যারা বিরক্ত হয়ে উঠেছেন অথবা বিরক্ত হওয়ার মত শোনার সময় যাদের নাই তাদের জন্য আমার সাড়া এই কিছু তরিকা আছে যাতে করে আপনি আধুনিক কায়দায় সহি রোজা রাখতে পারবেন।

সেহরির কমপক্ষে এক ঘন্টা আগে উঠবেন। উঠেই ফেসবুকে লগইন করুন। সেহরি বিষয়ক স্ট্যাটাস দিন। বিশেষ কোন বান্ধবী/ বান্ধব যদি থাকে তাকে জাগিয়ে দিন। জাগিয়ে দিয়ে ঘন্টা খানেক কথা বলুন। রোজা রেখে খালি পেটে দিনের বেলা কথা বলে আরাম নেই। তাই এই সময়টি কাজে লাগান। ফজরের আগে রোজা শুরু হয় না। সুতরাং এই সময় মনের দুয়ার, মুখের লাগাম সব খুলে কথা বলুন। সব থেকে ভাল হয় সারারাত না ঘুমালে। রাতের খাবার খেয়ি ফোনালাপ শুরু করুন। নতুন নতুন বান্ধবী খুঁজে বের করুন। তাদের ইফতারির দাওয়াত দিন। সেহরির দাওয়াতও দিতে পারেন। আধুনিক রোজা সংস্কৃতির বিশেষ অনুষঙ্গ সেহরি পার্টি। তাই সেহরি পার্টী আয়োজনে ভুলবেন না। ঘুমিয়ে পড়লে পার্টি মিস হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই রাতে ফেসবুক, সিনেমা, পার্টি এসবে ব্যস্ত থাকলে সেহরি পার্টীতে অংশগ্রহন সুনিশ্চিত। আধুনিক সহীহ রোজার তরিকায় সেহরি পার্টির স্থান অনেক উঁচুতে। সেহরিতে চিকেন ফ্রাই, লবস্টার, ম্যাগি নুডলস, হরলিক্স মিশ্রিত দুধ, বিফকারি রাখতে পারেন। সেহরি পার্টিতে সেলফি তুলতে কোন ভাবেই ভুলবেন না। পার্টির ফাঁকে ফাঁকে সেহরি পার্টির সেলফি ফেসবুকে আফডেট করুন। খাবার কতটুকু ইয়াম্মি ছিল সে স্ট্যাটাস দিতে ভুলবেন না। সিগারেটের অভ্যাস থাকলে শেষবারের মত সিগারেট খেয়ে নিন।

সেহরি পার্টি শেষে ঘুমিয়ে নিন। রোজার অজুহাতে বেশ একটু দেরিতে অফিসে যেতে পারেন। অফিস না থাকলে বারোটার আগে ঘুম থেকে উঠার দরকার নেই। বারোটায় ঘুম ভাঙলে সাথে উঠে পড়বেন না যেন, নিদেন পক্ষে একটা পর্যন্ত গড়াগড়ি দিন। উঠে গোসল সারুন। গোসল করে পাঞ্জাবি পরে মুখে রোজাদার রোজাদার ভাব নিয়ে বের হম। পকেটে একটা টুপি রাখতে ভুলবেন না। ইফতারির সময় কাজে লাগবে। বিভিন্ন মার্কেটে যান। বন্ধু বান্ধবিদের ফোন দিয়ে তাদেরকে আসতে বলুন। বিভিন্ন মার্কেটে ঘোরাঘুরি করে ক্ষুধা লেগে গেলে, কোন একটা ফুডকোর্টে বসে খেয়ে নিতে পারেন। আর সহ্য করতে পারলে ইফতার পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।

সেহরি পার্টি না থাকলে বাসায় জেগে থাকাই উত্তম। ছোট রাত, না ঘুমিয়ে একেবারে সেহরি খেয়ে ঘুমদিন। সেহরির সময় টিভি চ্যানেল গুলো একবার ঘুরে আসতে পারেন। বিরক্ত লাগলে দরকার নাই। ঘুমানোর আগে অবশ্যই বান্ধবী/ বান্ধবীদের সাথে ফোনালাপ সেরে নিবেন। এই সময় আলাপ না হলে বান্ধবী রাগ হতে পারে না। রোজা অবস্থায় কাউকে রাগানো বুদ্ধিমানের কাজ না। যাদের একাধিক বান্ধবী আছে তারা এই রাতকে কাজে লাগান। ইফতারের পরে, মাঝরাতে, সেহরির আগে-পরে এভাবে শিডিউল করে সকলের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখুন। বাংলাদেশে পররাষ্ট্রনীতির মত সকলের সাথে বন্ধুত্ব কারো সাথে শত্রুতা নয় এই নিয়ম মেনে চলুন। তবে আপনার বান্ধবীর তালিকায় ভারতের মত কেউ থাকলে আপনাকে বিশেষ সাবধানে থাকতে হবে। এই ঈদে কাকে কি গিফট দিবেন সেটা ভেবে রাখুন। আপনি যদি বিশেষ চালাক প্রকৃতির হোন তাহলে কোন কোন গার্ল ফ্রেন্ডের কাছ থেকে গিফট আদায় করতে পারবেন। এমনকি আপনার গার্লফ্রেন্ড অন্য বয়ফ্রেন্ডের কাছ থেকে পাওয়া উপহার আপনার হাতে তুলে দিয়ে বলবে, এটা আমি শুধু তোমার জন্য নিজের হাতে কিনেছি (নিজের হাতে বানিয়েছিও বলে ফেলতে পারেন)। সবই নির্ভর করে আপনি তাদের কিভাবে ম্যানেজ করতে পারেন তার উপর।

আধুনিক রোজায় ফেসবুকের গুরুত্ব অপরিসীম। সেহরি পার্টি ইফতার পার্টি এসবের খবরা-খবর, সেলফি তো আছেই তাছেড়া এই মুমিন বান্দার জন্য কয়টা লাইক? আমীন না বলে যাবেন না কেউ, মুমীন বান্দারা শেয়ার করুন মার্কা প্রচুর স্ট্যাটাস, ছবি আসে। এইগুলোতে লাইক কমেন্ট শেয়ার করতে পারেন। নিজেও এসব পোস্ট দিতে পারেন। না হলে আপনি প্রকৃত রোজাদার ফেসবুকার না।
বিভিন্ন ব্যাংক, ফাইনান্সিয়াল প্রতিষ্ঠান ইফতারিতে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে। চেষ্টা করুন এর প্রত্যেকটি অফার গ্রহন করতে। ইফতারি বিষয়ক স্ট্যাটাসে অবশ্যই ইফতারির দাম লিখতে ভুলবেন না। কত দামী ইফতারি খেলেন তা জাতিকে জানানোর দরকার আছে। আর যেদিন ইফতার পার্টি থাকবেনা বাসায় জম্পেশ ইফতারির ব্যাবস্থা করুন। বিভিন্ন টিভিতে রান্নার অনুষ্ঠান দেখে দেখে ইফতারির আইটেম তৈরি করুন। ইফতারিতে গাজরের হালুয়া, ম্যাগি নুডলস, পুডিং, স্টার হালিম/মামা হালিম, ট্যাং/রুহ আফজা থাকা বাঞ্চনীয়। টিভি’র আজান শুনে ইফতার শুরু করুন। ইফতার এশার নামাজের আগে শেষ হওয়া সমীচীন নয়। ইফতারির সময় মাথায় টুপি থাকলে ভাল দেখাবে। মেয়েরা সারাদিন বেপর্দা ঘুরাঘুরি করলেও ইফতারির সময় মাথায় কাপড় দিন।

সারাদিনে শরীরে অনেক ধকল গেছে এবারে বিশ্রাম নিন, ফেসবুকে লগইন করুন।

বিপরীতে হীত

আর সকলের মতই আমার বন্ধু-বান্ধব আছে। তাহাদের সাথে আড্ডা দিয়া, গল্পে গানে মাতিয়া উঠিয়া বেশ যাইতেছিল। হঠাৎ আমাকে ফেসবুকে পাইল। আমার আর আগের মত আড্ডা গল্প গানে মাতিয়া থাকিতে ভাল লাগে না। সারাক্ষণ ফেসবুকেই মজিয়া থাকি। বাইরের দুনিয়ার চেয়ে ফেসবুকে ঘুরিঘুরিই আমার নেশা হইয়া গেল। আগে ছেলেরা উলটা পালটা মোবাইল নম্বর টিপিয়া বান্ধবী পাতাইয়া প্রেম করিবার চেষ্টা করিত। রাত জাগিয়া আন্দা-গোন্দা নাম্বার টিপাটিপি করা ছেলদের প্রধান নেশা ছিল। এখন আর সেই ঝামেলা নাই। ফেসবুকে মেয়ের অভাব নাই। তাহাদের সাথে বন্ধুত্ব পাতাইয়া চ্যাট করিয়া আমার ভালই যায়। মাঝে মাঝে দুই একটা মেয়ে রূপী ছেলের পাল্লায় পড়িয়া, শেষ-মেস তাহাদিগকে হিজড়া বলিয়া গালি দিয়া ব্লক মারিয়াছি।

মামুন ঠিক উলটা। ফেসবুক সে দুই চোখে দেখিতে পারে না। ফেসবুক ইউজ করিয়া ছেলেমেয়েরা যে উচ্ছন্নে যাইতেছে তার প্রধান নমুনা হিসেবে সে আমাকেই সাব্যস্ত করিত। এই জাতির অন্ধকার ভবিষ্যৎ নিয়া সে হর হামেশাই অতিশয় উদ্ভিগ্ন থাকিত। আর জাতির অগ্রগতির পথে যে সমস্ত বাধা আছে তাহার মধ্যে প্রধানতম হইল এই ফেসবুক। ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা না শিখিয়া ফেসবুকিং করিতেছে। সারারাত চ্যাট করিয়া সকালে ক্লাসে ঝিমাইতেছে। ভবিষ্যতের জন্য যে একটা নিতান্ত বন্ধ্যা প্রজন্ম আসিয়া উপস্থিত হইতেছে এই দুশ্চিন্তায় তার ঘুম আসিত না। ইদানিং বন্ধুবান্ধব ত্যাগ করিয়াছি। তাহকে এখনো ত্যাগ করি নাই। সবাইকে তো আর ত্যাগ করা যায় না। কিন্তু তার আত্যাচার আর উপদ্রব দিন দিন বাড়িয়াই চলিতেছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমার ফেসবুকের পিছনে লাগিয়া থাকাকে সে নিজের মহান কর্তব্য করিয়া নিয়াছে। সকাল নাই, সন্ধ্যা নাই সারাক্ষণ আমার সাথে তর্ক জুড়িয়া দিতে পারিলেই সে বাঁচিয়া যায়। সারাক্ষণ ফেসবুকের বিরুদ্ধে লাগিয়া থাকিয়া হাতের কাছে আমাকে পাইয়া সে আমাকেই ফেসবুক মনে করিয়া আমার গুষ্ঠি উদ্ধার করিতেছে। আমি সারাক্ষণ নতুন বান্ধবী, নতুন গ্রুপ, নতুন পেজ এই সব লইয়া মজিয়া থাকি। সুতরাং তার সাথে অকারণ তর্ক করিয়া বাজে সময় খরচ করিবার মত, অত সময় আমার নাই। তাহাতে সে দমিয়া যাইবার পাত্র ছিল না। বরং দ্বিগুণ উৎসাহে সে, কেন আমার ফেসবুকিং করা উচিত নহে, এই বিষয়ে বক্তৃতা দিতে শুরু করিত। অন্য কেউ হইলে হাতাহাতি হইয়া, বন্ধুত্বের ইতি ঘটিত। কিন্তু মামুনের বেলায় আমি বরাবরই ছাড় দিয়া আসিয়াছি। মামুনকে কেন এত পছন্দ করি সে কথা আমিও ঠিকভাবে বুঝিতে পারি না।

দিনের পর দিন এই ভাবে আমাকে উৎপাত করিয়া সে ক্ষান্ত হইল না। একদিন সে ঘোষনা করিল সে দেশ জাতির কল্যাণ কামনায় ফেসবুকে জয়েন করিবে। আমি বেশ তাজ্জব হওয়ার ভান করিলেও, মনে মনে বেশ খুশি হইলাম, তাহার এতদিনের লম্বা লম্বা কথার বেশ একটা যুতসই জবাব দিতে পারিব বলিয়া। বলিলাম দেশ ও জাতির কল্যাণ কামনায় মিলাদ মাহফিল, দোয়া মোনাজাত হইতে দেখিয়াছি। কিন্তু ফেসবুকে একাউন্ট খোলা বোধ হয় এই প্রথম। এই দিক হইতে তুই বেশ একটা রেকর্ড করিলি। আমার উপহাস কে পাত্তা না দিয়া সে বলিল ফেসবুকের বিরুদ্ধে জাতিকে উদবুদ্ধ করিতেই সে ফেসবুকে জয়েন করিবে। আমার মত রংবাজি করিবার জন্য নহে। ফেসবুকে সে ফেসবুকের বিরুদ্ধেই প্রচারনা চালাইবে। জাতিকে সে বুঝাইবে কেন আমাদের ফেসবুক ব্যবহার করা উচিত নহে। আমি মামুন কে চিনিতাম সুতরাং আগাগোড়াই বিশ্বাস করিলাম।

সত্যি সত্যি সে ফেসবুকে একাউন্ট খুলিল। দেশ জাতি রাষ্ট্র নিয়া লম্বা লম্বা বক্তৃতা দিতে লাগিল। তর তর করিয়া তাহার ফ্রেন্ড এবং ফলোয়ারের সংখ্যা বাড়িতে লাগিল। এখন সে আর আমার পিছনে লাগে না সারাক্ষণ ফেসবুকেই পড়িয়া থাকে। আমি হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিলাম। মাঝে মাঝে তার এই রকম ফেসবুকিং দেখিয়া মুখ টিপিয়া হাসিতাম। এই ভাবে আমাদের মামুন ফেসবুকে বেশ একটা সেলেব্রেটি তে রূপান্তরিত হইল। একদিন আমি বলিলাম ফেসবুকিং কেমন লাগিতেছে। আমার কথায় উত্তেজিত হইয়া সে বলিল তুমি ভাবিয়াছ তোমার মত উচ্ছন্নে যাওয়ার জন্যই আমি ফেসবুকিং করিতেছি। আমি মিশন লইয়া ফেসবুকে আসিয়াছি। এখন সময় হইয়াছে আমি আমার ফ্রেন্ড ও ফলোয়ারদের লইয়া ফেসবুক বিরোধি আন্দোলনে ঝাঁপাইয়া পড়িব। আমি কৌতুক বোধ করিলাম। বলিলাম, তোমরা কি ফেসবুকের বিরুদ্ধে হরতাল, অবরোধের মত কর্মসূচী দিব। সে জানাইল, তাদের এই কর্মসুচী পুরোপুরো অহিংস। আমি বলিলাম, সাধু!

আমি আমার মতই চলিতে ছিলাম। আমার ফেসবুকে পরিচিতের চেয়ে অপরিচিতের সংখ্যাই বেশি ছিল। বলাবাহুল্য তাহাতে ছেলে অপেক্ষা মেয়ের সংখ্যা অধিক। জগতে আমার মতই অনেক মেয়ে রাত্রি জাগিয়া ফেসবুক লইয়া পড়িয়া না থাকিলে আমার পক্ষে দুনিয়ার জগতসংসার বাদদিয়া ফেসবুকে ঘরসংসার পাতিয়া বসা নিতান্ত অবিবেচকএর কাজ বলিয়া মনে হইত। একাধিক মেয়ের সাথে আমার ঘনিষ্টতা রহিয়াছে। তাহদের সাথে চ্যাট করিতে গিয়া আমার টাইপিং স্পিড নীলক্ষেতের টাইপিষ্টদের হারাইয়াদিবার সক্ষমতা অর্জন করিয়াছে। বিদ্যুৎগতিতে আমাদের যে আলাপ চলে তাহা সভ্যসমাজে স্বীকার করা আমার মত অর্বাচীনের পক্ষেও অসম্ভব ছিল। চোখের নীচে কালি করিয়া রাত জাগিয়া আমি যে রসাস্বাধন করিতেছিলাম তাহা আমার একলার আর আমার অপরিচিত বান্ধবীদের নিজস্ব। ফেসবুকের নির্জনতা আমাদের আলাপকে অল্পদিনেই এমন এক স্থানে উপনীত করিল যেখানে কোন রাখঢাক সভ্যতা সুশীলতাকে বাহুল্যবোধ হইতে লাগিল। ক্লাসে সুশীলা মেয়েদের দেখিলেই আমার মনে হইত এইরকম ভদ্রতার লেবাস পরিয়া রাতের বেলা তোমরা কি কর তাহা আমার ভালই জানা আছে। ভাগ্যিস মামুন আমার এই রূপটি জানে না। জানিলে তাহার মত শুচিগ্রস্তলোক আমার ছায়া মাড়াইত কিনা সন্দেহ। আর আজকাল অবশ্য আমার সম্পর্কে ভাবিবার সময় তাহার নাই। সে সত্যি সত্যি ফেসবুকে তোলপাড় শুরু করিয়া দিয়াছে। ফেসবুক যে জাতিকে ধ্বংস করিতেছে ইহা অকুণ্ঠে বলিতে লাগিল। আমাদের যে ফেসবুকের ভার্চুয়াল জগত ফেলিয়া বাস্তবে ফিরিয়া আসা উচিত আর দেশ জাতি ভবিষ্যতের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করা উচিত এই মন্ত্র সে মুহুর্মুহু জপিতে লাগিল। তাহার ফলোয়ার বন্ধুরা দুইভাগে বিভক্ত হইয়া তাহাকে টানিয়া লইয়া চলিল। কেহ বলিল বাঙালি টেকনোলজি ইউজ করিতে জানে না। তা দ্বারা এ জাতি নিজেদের উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি করিয়া থাকে। আজকাল এমন হইয়াছে ছেলেরা পথে ঘাটে, ইস্কুল কলেজে ক্লাসে, বাথ্রুমে, অফিসে, আদালতে এমনকি মসজিদেও তাহারা ফেসবুক লইয়া পড়িয়া থাকে। ভার্চুয়াল জগতে পড়িয়া থাকিয়া তাহারা বাস্তবতা বিবর্জিত কান্ডজ্ঞানহীন দায়িত্বশূণ্য মাকালে রূপান্তরিত হইবে। কিভাবে ইহাদেরকে রক্ষাকরা যায় এই নিয়েও ব্যাপক তর্ক বিতর্ক হইল। কেহ বলিল সকলের একযোগে ফেসবুক বন্ধ করিয়া দেওয়া উচিত কেহ বলিল তাহা একেবারেই ভাল হয় না, বরং সীমিত আকারে ব্যবহার করা উচিত, আন্দোলনে যাওয়ার পরামর্শও অনেকে দিল। তথ্যমন্ত্রনালয়ে স্মারকলিপি, মানববন্ধন , অনশন সকল রকমের প্রস্তাবই আসিল। রিরুদ্ধমতও জোরালো। তাহারা ইহাদের কে প্রাচীন জরাগ্রস্থ অন্ধকারের পেঁচা বলিয়া গালি দিল। কেহ কেহ কাণ্ডজ্ঞানহীন মূর্খ বলিতেও দ্বিধা করিল না। যুগের সাথে তালমিলাইয়া না চলিলে যে কিরকম পিছাইয়া থাকিতে হয় সে বিষয়েও বিস্তর আলোচনা হইল। দেশ জাতির কথা উঠিলে মিশরের তাহরির স্কয়ারের দৃষ্টান্ত উত্থাপন করিয়া একেবারে দাঁতভাঙা জবাব দেয়ার চেষ্টা চলিল।

কিন্তু হঠাৎ যেন একটা ছন্দপতন লক্ষ করিলাম। মামুন কে ফেসবুকে পাওয়া যায় না। রুমে তাহাকে পাইনা। আমি কথা কম বলিলেও সে কম বলিয়া থাকিতে পারে না। অনর্গল না বকিলে তাহার ভাত হজম হইতে আমি কখনো দেখি নাই। তাহার ভক্তরা নিজেরা বাদানুবাদ করিতেছে কিন্তু তাহাকে আগের মত সরব দেখিতেছি না। সুতরাং সে আবার কি নিয়া পড়িল সেটা লইয়া আমি কিঞ্চিত চিন্তিত হইলাম।

সেইদিন বিকেলবেলা কাঁটাবন মোড়ে একটি রেস্তোঁরার দোতালায় বসিয়া খাবারের অর্ডার দিব এমন সময় কোনার টেবিলে চোখ আটকিয়া গেল। মামুন অপরিচিত এক মেয়েকে নিয়া বসিয়া আছে। আমাকে দেখিয়াছে কিনা বুঝি নাই। আমি আমার খাওয়া শেষ করিয়া আমার বিলটি হাতে লইয়া তাহাদের টেবিলের পাশে গিয়ে বলিলাম, স্যার বিল টা———। আমার দিকে তাকাইয়া মামুন হাসিল। বুঝিলাম সে আমাকে আগেই দেখিয়াছে।

বেশি পীড়াপিরি করিতে হইল না। সে ঝাড়িয় কাশিল। ঝাড়িয়া কাশিলে যাহা বুঝিলাম তাহা হইল এই ফেসবুক বিরোধী আন্দোলনে সে যখন ফেসবুকেই ঝড় তুলিতেছিল, তখন এই নিরতিশয় সুন্দরি তাহার বিরুদ্ধে উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছিলন। তবে আর সকলের মত তিনি প্রকাশ্যে কমেন্ট করিতেন না, তাহার কঠিন কঠিন সব যুক্তি মামুনের ইনবক্সে আসিয়া জমা হইত। অবশেষে ফেসবুক ফেসবুকের জায়গায় রহিল আর তাহারা দুইজন এই রেস্তোরাঁতে আসিয়া এক হইল।

মনে মনে ভাবিলাম সারাবছর ফেসবুকিং করিয়া একটা মেয়ের নাম্বার বাহির করিতে পারিলাম না, আর সে কিনা পুরো মেয়েটাকেই বাহির করিয়া আনিল। সেই দিনই ফেসবুক একাউন্টটা ডিএ্যাক্টিভেট করিয়া দিলাম।

এই মহিমান্বিত রজনীতে আমরা কি করব

ইসলামী শরীয়তে যে কয়টি গুরুত্বপূর্ণ রাত আছে তার অন্যতম হল লায়লাতুল বরাত আমাদের দেশে যা শবে বরাত নামে পরিচিত। বাকী রাতগুলো হল লায়লাতুল ক্বদর বা শবে ক্বদর এবং ঈদের রাত্রিগুলো।

এই সমস্ত রাতের অসীম ফজিলত রয়েছে। এই সব রাত আসলে আমাদের জীবনে আসে বোনাস হিসেব। আসে আত্মশুদ্ধির জন্য। আর আসে পরকালীন পাথেয় অর্জনের এক দারুণ সুযোগ নিয়ে। এইসব রাত তওবা ও অনুতাপ করার জন্য, পাপ হতে পূণ্যের পথে আসার জন্য, জীবনকে সুপথে পরিচালিত করার দৃড় শপথ নেয়ার জন্য, সর্বপোরি আল্লাহ ও রসূলের ( দঃ ) নৈকট্য ও ভালবাসা অর্জনের জন্য।

শবে বরাতের প্রতিটি ক্ষণ তাই অতি মূল্যবান। এটি আপনার মালিকের পক্ষ থেকে আপনার জন্য বিশেষ দয়া ও রহমত। এ রাতের প্রতিটি মূহুর্ত আমাদেরকে আল্লাহর সন্তুষ্টি’র জন্য ব্যয় করা উচিত। নফল ইবাদত, নামাজ, কোরআন শরীফ তেলাওয়াত, মিলাদ মাহফিল, জিকির আসকার ইত্যাদির মাধ্যমে সারারাত অতিবাহিত করা উচিত। ফরজ নামাজগুলো অবশ্যই জামাতে পড়বেন। এ রাতে এমন কোন প্রোগ্রাম রাখবেন না যাতে ইবাদতে বিঘ্ন ঘটে। একাগ্রচিত্তে আল্লাহ ও রসূলের ( দঃ ) দিকে মনোনিবেশ করুন। দান খয়রাত করুন, চেষ্টা করুন অভাবী ও সাহায্যপ্রার্থীদেরকে ফিরিয়ে না দিতে। ভালখাবার তৈরি করুন । নিজেরা খান, অন্যকে খাওয়ান। আমাদের দেশে এ রাতে হালুয়া রুটি তৈরির প্রচলন আছে তা করতে পারেন। কোন সমস্যা নাই। কিছু কিছু লোক আপনাকে হালুয়া রুটি তৈরি করত নিষেদ করবে। এরা এক ধরনের বেকুব বটে। খাবার দাবার হালাল হলেই সেটা করা যায়, খাওয়া যায় এতে কোন নিষেদ নাই। আমাদের দেশে আমরা ছোলামুড়ি দিয়া ইফতার করি, ঈদের দিন সেমাই পাকাই। এগুলো কোনটাই অবৈধ নয়। একইভাবে শবে বরাতে হালুয়া রুটি খেলে অন্যকে খাওয়ালে ভাল’র চেয়ে মন্দ কিছু নাই। আল্লাহতো অন্যকে খাওয়ানো পছন্দ করেন। নিজে খাবেন, গরীব দুঃখী, আত্মীয় বন্ধুকে খাওয়াবেন। তবে এই খাওয়া দাওয়া যাতে ইবাদতে বিঘ্ন না ঘটায়। এ রাতে গোসল করাও পূণ্যময়। এ রাতে গোসলের প্রতি ফোটা পানির জন্য রয়েছে অতি উত্তমপ্রতিদান। এ রাত হল ভাগ্যরজনী। এ রাতে মানুষের আমলনামা আল্লাহর নিকট পেশ করা হয়। পরবর্তী এক বছরের জন্ম মৃত্যু, রিজিক সুনির্দিষ্ট হয়।

এ রাত ক্ষমার রজনী। হাদীস শরীফের ভাষ্য অনুযায়ী এ রাতে বনু কালবের ছাগ-পালের পশমের চেয়েও অধিক বান্দাকে আল্লাহ ক্ষমা করেন। এ রাতে জান্নাতের প্রথম দরজায় এক ফেরেশতা দাঁড়িয়ে বলেন আজ রাতে রুকুকারীর জন্য রয়েছে সুসংবাদ। একই ভাবে বাকী দরজাগুলো তে যথাক্রমে সিজদা, জিকির, আল্লাহর ভয়ে ক্রনদনকারী, তসবিহ থলিলকারী ও মুমীন মুসলমানদের জন্য সুসংবাদ ঘোষনা করা হয়। সপ্তম দরজা হতে বলা হয় প্রার্থনাকারীদের প্রার্থনা মন্জুরের নিশয়তা আর অষ্টম দরজা হতে ক্ষমার নিশ্চয়তা ঘোষনা করা হয়।

এ রাতে আল্লাহর সাথে শরিককারি, অহংকারী, হিংসুক, ব্যাভিচারি, পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, যাদুকর-গণক প্রভৃতিকে ক্ষমা করা হয় না। এছাড়াও এই তালিকায় মদ্যপ, খুনী, জুয়াড়িরাও রয়েছে। তবে এই সব অপকর্ম হতে কায়মনোবাক্যে তওবা করলে আল্লাহ তা’লা ক্ষমা করে দিবেন।

মহানবী ( দঃ ) এই রাতে কবর জিয়ারত করতেন। জান্নাতুন বাকীতে যেতেন। সুতরাং এ রাতে কবর জিয়ারত করুন। মা-বাবা, দাদা, দাদী, নানা,নানী আত্মীয় স্বজনের কবর জিয়ারত করুন, তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। আল্লাহতো ক্ষমাশীল। হয়তো এ রাতের প্রার্থনা আপনার স্বজনের আজাব আনন্দে পরিনত করে দিতে পারে। আর স্মরণ করুন তাদের মত আপনাকেও একদিন কবরবাসী হতে হবে। সেই কবরে যাবার পাথেয় আপনার কতটুকু আছে?

প্রার্থনা করুন নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, বাবা মা ভাই বোন সন্তান সন্ততি আত্মীয় ও বন্ধুর জন্য, দেশের জন্য, দশের জন্য, সমস্ত মুসলিম জাহানের জন্য। জীবিতদের জন্য। মৃতদের জন্য। সুস্থদের জন্য। অসুস্থদের জন্য। শিশুদের জন্য বৃদ্ধদের জন্য। ইহকাল ও পরকালের জন্য। ঈমান ও আমলের জন্য। আল্লাহর রসুলের ( দঃ ) সুপারিশ লাভের জন্য।

যা করবেন না
১। আড্ডাবাজি
২। আতশবাজি
৩। অযথা সময় নষ্ট করা
৪। হাসি ঠাট্টা আমোদ-ফূর্তি করে বাজে সময় পার করা।
৫। নেটে, ব্লগে, ফেসবুকে ফাও সময় নষ্ট করা।
৬। মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকা
৭। গান বাজনা, নাটক সিনেমা, টিভি এই সব নিয়ে সময় কাটানো।
৮।অন্যের ইবাদতে বিঘ্ন ঘটানো।

কেন লিখি?

আজ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর জন্মদিন বা মৃত্যুদিন কোনটাই না। কিন্তু মানিক বাবু এমন একজন যাকে নিয়ে জন্মদিন বা মৃত্যুদিন ছাড়াও যেকোন দিন আলোচনা করা যায়। সব লিখকই লিখার জন্য ভেতর থেকে একটা তাগিদ অনুভব করেন। সেই তাগিদ থেকেই তাঁদের লিখা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কেন লিখতেন? তাঁর উত্তর তিনি দিয়েছেন কেন লিখি নামে এক প্রবন্ধে। ১৯৪৪ সালে ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের পক্ষ থেকে কেন লিখি শিরোনামে একটি সংকলন বের হয়েছিল। সেখানেই বের হয়েছিলে মানিকের এই প্রবন্ধ। ‘লেখা ছাড়া অন্য কোন উপায়েই যে কথা জানানো যায় না সেই কথাগুলি জানাবার জন্যই আমি লিখি।’ আমার প্রিয় লেখকদের একজন মানিক। তাঁর সৃষ্টি বিষ্ময় ঘোর নিয়ে আমি পড়ি। আজ তাই মানিকের সেই লেখাটি হাজির করলাম আপনাদের জন্য। শব্দনীড়ে ছোট-বড় যে সব লেখক বৃন্দ আছে, তারা এ থেকে ঢের উপকার পাবেন বলে আমার বিশ্বা। বেশি বক বক না করে সরাসরি তাঁর কাছেই আপনাদের নিয়ে যাই।

কেন লিখি
–মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

লেখক হবার ইচ্ছে সম্বন্ধে হঠাৎ সচেতন হইনি। স্কুল জীবনের শেষের দিকে ইচ্ছেটা অল্পে অল্পে নিজের কাছে ধরা পড়েছিল। কিন্তু সে ইচ্ছে হাত মেলেছিল বহু দূরের ভবিষ্যতে – সঙ্গে সঙ্গে লেখবার তাগিদ যোগায়নি। অধিকাংশ স্কুল কলেজে হাতে লেখা মাসিকপত্র থাকে। সারা বাংলায় ছড়ানো গোটা দশেক স্কুলে আর মফস্বল ও কলকাতায় গোটা তিনেক কলেজে আমি পড়েছি। লিখবো? এই বয়স আমার। বিদ্যাবুদ্ধি অভিজ্ঞতা কিছু আমার নেই। কোন ভরসায় আমি লিখবো? লেখা তো ছিনিমিনি খেলা নয়। বাড়িতে লুকিয়ে লেখার চেষ্টাও আমি কখনও করিনি। আমার অধিকার নেই বলে।

১৩৩৫ সালেও – যে বছর আমি প্রথম লেখা লিখি, – আমার এ মনোভাব বদলায়নি। বরং আরও স্পষ্ট একটা পরিকল্পনা হয়ে দাড়িয়েছে। বয়সের সীমা ঠিক করেছি। তিরিশ বছর বয়সের আগে কারো লেখা উচিত না – আমি সেই বয়সে লিখবো। এর মধ্যে তৈরি হয়ে নিতে হবে সব দিক দিয়ে। কেবল অভিজ্ঞতা সঞ্চয় নয়। নিশ্চিন্ত মনে যাতে সাহিত্য চর্চা করতে পারি তার বাস্তব ব্যবস্থাগুলোও ঠিক করে ফেলবো।

হ্যাঁ তখন আমার বিজ্ঞানের দিকে ঝোঁক পড়েছে। কিন্তু তাতে কি এসে যায়? তখনও বিশ্বাস করিনি, আজও বিশ্বাস করি না যে, বিজ্ঞানের সঙ্গে সাহিত্যের বিরোধ আছে। বিজ্ঞান ও সাহিত্যের সম্বন্ধ এযুগের অতি প্রয়োজনীয় যুগধর্ম।

স্বীকার করছি, ১৩৩৫ সালে এসব তত্ত্বকথা মানতাম না – অস্পষ্ট অনুভূতি ছিল মাত্র। কিন্তু বিজ্ঞান-প্রেমের সঙ্গেই দৃঢ়তর হতো লেখার সঙ্কল্প। কলেজ থেকে তখনকার বালিকা-বালীগঞ্জের বাড়িতে ফিরতাম, আলোহীন পথহীন অসংস্কৃত জলার মতো লেকের ধারে গিয়ে বসতাম – চেনা অচেনা কোন একটি প্রিয়ার মুখ স্মরণ করে একটু চলতি কাব্যরস উপলব্ধি করার উদ্দেশ্যে। ভেসে আসতো নিজের বাড়ির আত্মীয়-স্বজন আর পাড়াপড়শীর মুখ, জীবনের অকারন জটিলতায় মুখের চামড়া যাদের কুচঁকে গিয়েছে। ভেসে আসতো স্টেশনে ও ট্রেনে ডেলি প্যাসেঞ্জারদের মুখ – তাদের আলাপ আলোচনা, ভেসে আসতো কলেজে সহপাঠীদের মুখ – শিক্ষার খাঁচায় পোরা তারুণ্য-সিংহের সব শিশু, প্রাণশক্তির অপচয়ের আনন্দে যারা মশগুল। তারপর ভেসে আসতো খালের ধারে, নদীর ধারে, বনের ধারে বসানো গ্রাম – চাষী, মাঝি, জেলে, তাঁতিদের পীড়িত ক্লিষ্ট মুখ। লেকের জনহীন স্তব্ধতা ধ্বনিত হতো ঝিঁঝির ডাকে, শেয়াল ডেকে পৃথিবীকে স্তব্ধতর করে দিতো, তারারা চোখ ঠারতো আকাশের হাজার ট্যারা চোখের মতো, কোনদিন উঠতো চাঁদ। আর ওই মুখগুলি – মধ্যবিত্ত আর চাষাভূষো – ওই মুখগুলি আমার মধ্যে মুখর অনুভূতি হয়ে চ্যাঁচাতো – ভাষা দাও – ভাষা দাও।
আমি কি জানি ভাষা দিতে?…

…একদিন কলেজের কয়েকজন বন্ধু সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করছে। আলোচনা গড়াতে গড়াতে এসে ঠেকলো মাসিকপত্রের সম্পাদকের বুদ্ধিহীনতা, পক্ষপাতিত্ব, দলাদলি প্রবণতা ও উদাসীনতায়। বললাম, ‘কেন বাজে কথা বকছো? ভালো লেখা কি এত সস্তা যে, হাতে পেয়েও সম্পাদকেরা ফিরিয়ে দেবেন? মাসিকগুলি তো পড়ো, মাসে ক’টা ভালো গল্প বেরোয় দেখেছো? সম্পাদকেরা কি পাগল যে, ভালো গল্প ফিরিয়ে দিয়ে বাজে গল্প ছাপবে? ভালো দূরে থাক, চলনসই একটা গল্প পেলে সম্পাদকেরা নিশ্চয় সাগ্রহে ছেপে দেয়।’
অনেক কথা কাটাকাটির পর বাজি রাখা হলো।
বাজি হলো এই। আমি একটি গল্প লিখে তিন মাসের মধ্যে ভারতবর্ষ, প্রবাসী বা বিচিত্রায় ছাপিয়ে দেবো। যদি না পারি – সে কথা আর কেন?

আমি জানতাম পারবো। কোনদিন এক লাইন লিখিনি, কিন্তু গল্প তো পড়েছি অজস্র। সাহিত্য হবে না, সৃষ্টি হবে না, কিন্তু সম্পাদক ভোলানো গল্প নিশ্চয় হবে। আমি কেন, যে কেউ চেষ্টা করলেই একরকম গল্প লিখতে পারে।
তখন মনে পড়লো পূর্ববঙ্গের এক স্বামী-স্ত্রীর কথা। বাস্তব জীবনে নাটকীয় প্রেমের চরম অভিজ্ঞতা ওদের দেখেই আমি পেয়েছিলাম। স্বামী বাশিঁ বাজাতেন। বাঁশের বাঁশি নয়, ক্ল্যারিওনেট। প্রায় পায়ে ধরে তাঁকে আসরে বাজাতে নিয়ে যেতে হতো – গিয়েও খুশি হলে বাজাতেন, নইলে বাজাতেন না। বাড়িতে বাজাতেন – স্ত্রীকে শ্রোতা রেখে। বছরখানেক আমি শুনেছিলাম। বেশিক্ষন বাজালে তাঁর গলা দিয়ে রক্ত পড়তো।

এদের অবলম্বন করে এক ঘোরালো ট্র্যাজিক প্লট গড়ে তুলে গল্প লিখলাম। নাম দিলাম অতসী মামী। ভাবলাম, এই উচ্ছা্সময় গল্প, এই নিছক পাঠকের মন ভুলানো গল্প, এতে নিজের নাম দেবো না। পরে যখন নিজের নামে ভালো লেখা লিখবো, তখন এই গল্পের কথা তুলে লোকে নিন্দে করবে। এই ভেবে বন্ধু ক’জনকে জানিয়ে, গল্পে দিলাম ডাক নাম – মানিক। কল্পনাশক্তি একটা ভালো ছদ্মনামও খুঁজে পেলো না।
বাংলা মাসের মাঝামাঝি। বিচিত্রা আপিসে গিয়ে গল্পটা দিয়ে এলাম।

একদিন সকালে ভাবছি, কলেজে যাবো কি যাবো না। একজন ভদ্রলোক বাড়িতে এলেন। আমার ‘অতসী মামী’ গল্পের জন্য পারিশ্রমিক বাবদ নগদ টাকা হাতে তুলে দিয়ে দাবী জানালেন, আর একটি গল্প চাই।

তারপর সব ওলোট পালট হয়ে গেল। সব ছেড়ে দিয়ে আরম্ভ করলাম লেখা।
হঠাৎ একটা গল্প লিখে মাসিকে ছাপিয়ে কি কেউ লেখক হতে পারে? হাত মক্‌স করতে হয় – কঠিন সাধনায় জীবনপাত পরিশ্রমে মক্‌স করতে হয়। কেরানীর বেশি খেটে লিখতে না শিখে জগতে আজ পর্যন্ত একটি ছোট খাটো লেখকও লেখক হতে পারেননি। হঠাৎ কি কেউ লিখতে শেখে, না পারে? সাহিত্য সাধনার জিনিস। এ সাধনার সূত্রপাত কি ভাবে হয় অনেক সাহিত্যিকের জীবনে তার চমকপ্রদ উদাহরণ আছে। আজ সাহিত্যিক মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘প্রথম লেখা’ লিখবার কাহিনীতে তার একটা নমুনা পাবেন।

এখনো আত্মীয়স্বজন আপসোস করেন, ‘তোর দাদা লেখাপড়া শিখে দু’হাজার টাকার চাকরি করছে, তুই কি করলি বলতো, মানিক? – না একটা বাড়ি, না একটা গাড়ি – ‘আপনারা কি বলেন?…

এক বোকা বাবার গল্প শোন

খুব তাড়াহুড়া করে বাসায় ফেরে রাশিদুল। দরজায় খুলতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে জারা। দুহাতে বাবাকে জড়িয়ে বুকে মাথা গেঁথে দেয়। মা এসে জিজ্ঞেস করে এত দেরী করেছ কেন? মেয়ে দুহাতে বাবার বুকে থাপ্পড় দিতে থাকে। বাবার চশমা ধরে টানাটানি করে। মেয়েকে নিয়ে রাশিদুল ফ্যানের নিচে বসে। বাসের ভীড়ের ধাক্কাধাক্কিতে গা ঘেমে নেয়ে একাকার। শুধু ঘামাঘামি হলে হত, তুমি দাঁড়িয়ে আছ শতেক ধাক্কা সহ্য কর। শতেক জন এসে পা মাড়িয়ে দিয়ে যাবে। কিছু বলাও যাবে না। কেউ কেউ বলে। এই নিয়ে ঝগড়া শুরু হয়। মাঝে মাঝে হাতাহাতিও হয়। আসলে কারোই দোষ নাই। সবার মেজাজ খারাপ থাকে। লেগে যায়। কন্ডাক্টর এসে বারবার ভাড়া চেয়ে বিরক্ত করে। আর বসে থাকলে দেখা যাবে আরেকজনের পশ্চাদ্দেশ তোমার মুখের উপর কিংবা তার দুই রানের মাঝামাঝি পয়েন্টটা তোমার গায়ে এমনভাবে সেট করে রেখেছে তোমার বমি পাচ্ছে কিন্তু তোমার কিছু করার নাই। ঐ লোকটারও দোষ নাই। তার পিছনে এমন ঠাসাঠাসি অবস্থা তার নিজের জান ত্রাহি ত্রাহি করছে। সারাদিনের অফিসের শেষে এই সমস্ত ধাক্কাধাক্কি ঘষাঘষি পার করে বাসায় এলে মেয়েটা যখন নাকের ফুটোয় দুই আঙুল ঢুকিয়ে দেয় কিংবা চুল ধরে টানা করে তখন রাশিদুলের আর কিছু মনে থাকে না। মেয়ের এখনো কথা ফোটেনি। বায়না ধরতে পারে না। রাগ করতে পারে না। অভিমান করে না। একটু উঁ আঁ আর নাচানাচিতেই রাশিদুলের মনে হয় কত সুখের জীবন। মেয়ের মা চা এনে দেয়। মেয়েকে সাবধানে ধরে চায়ে চুমুক দেয়। উড়ুৎ উড়ুৎ করে চা খায়। এই নিয়ে জারার মা কত হাসাহাসি করে, তবু এই অভ্যাস যায় না তার। কিন্তু আজকে চা ঠাণ্ডা হয়ে যায়, রাশিদুলের খেয়াল থাকে না। উড়ুৎ উড়ুৎ করার দরকার পড়ে না। মেয়েকে বুকের মাঝে ঝড়িয়ে ধরে, আরো জোরে জড়িয়ে ধরে। বউ রান্নাঘর থেকে এসে জিজ্ঞেস করে ‘কি হইছে তোমার? শরীর খারাপ?’

না শরীর খারাপ না। শরীর তার খারাপ করে না। কিন্তু আজকে জারাকে দেখলেই তার –, তার কি—-? কি, সেটা সে নিজেই বুঝতে পারে না। কিছু একটা করা দরকার? কি করবে? তার কি করার আছে। এই শহরে দেড় কোটি মানুষের ভীড়ে সে কি? খড়কুটা; একটা ধূলিকণা মাত্র। জারা এখন বাবার গায়ে হিসু করে দিয়েছে। জারার হিসুতে ধূলিকণা ধুয়ে যায় না। জমাট বাঁধে। জারার হিসু পরিষ্কার করার কথা মনে থাকে না। বউ এসে জারাকে নিয়ে যায়। কিন্তু জারা রাশিদুলের মনের ভেতর বেড়ে উঠে বড় হয়ে যায়। জারার চারিদিকে কিলবিল করে ভাইরাস। দৈত্যের মত সে ভাইরাস শুঁড় বাঁকিয়ে বাকিয়ে এগিয়ে আসে। অসহায় জারা আর্ত চিৎকার করে।বাবা! বাবা!! আকাশ বাতাস ভারী হয়ে আসে চিৎকারে। মেয়ের চিৎকারে রাশিদুল কি করে? রাশিদুলের হাতে কোন ভ্যাকসিন নাই। রাশিদুল হাতড়ায়, খালি হাতড়ায়, ভ্যাকসিনের খোঁজে। ভ্যাকসিন পায় না। পায় মোবাইল। মোবাইল হাতে নিয়ে ফেসবুকে ঢুকে। মেসেজ দেয় সবাইকে যে আছে যেখানে। সবাইকে সে রিকোয়েস্ট করে,

“আগামি শুক্রবার (০৪/০৫/২০১৭) সকাল ৯ টা থেকে ৯.৩০ পর্যন্ত আমি একজন নাগরিক ও একজন পিতা হিসেবে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়াতে চাই, হযরত আলি আর আয়শার হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে, যারা হযরত আলি আর আয়শা হত্যার বিচার চান আশা করি আপনাদের ও সাথে পাব”।

শুক্রবার সকালে, কেউ আসেনি, কেউ আসে না, কেউ না।
শুধু রাশিদুল একা দাঁড়িয়ে থাকে, একা। হাতে তার মত একা একটা প্ল্যাকার্ড, বিষণ্ণ ও বিপ্লবী।

ইমোশন

মার্ক টোয়েন একদিন সকাল বেলা বাইরে বেরুবার জন্য রেডি হচ্ছিলেন। একটা জামা বের করে দেখলেন ওটার বোতাম নাই। নিজের মনে বকাবাদ্য করে ওটা ফেলে দিয়ে দ্বিতীয় আরেকটা বের করলেন, ওটারও একই অবস্থা। এবারও একচোট গালাগালি করে নিয়ে আরেকটা বের করে গায়ে দিলেন। দেখলেন এইটারও বোতাম নাই। এইবার মাথাখারাপের মত অকথ্য-কুকথ্য ভাষায় ইচ্ছেমত গালিগালাজ করে নিলেন। গালিগালিতে কড়াইল বস্তি ফেইল। এরপর চতুর্থ জামা বের করে পরতে গিয়ে দেখেন তাঁর স্ত্রী পেছনে দাঁড়িয়ে।

এবার স্বামীকে অপ্রস্তুত করতে তাঁর সম্ভ্রান্ত স্ত্রী, স্পষ্ট উচ্চারণে সমস্ত গালিগালাজ একে একে রিপিট করলেন।

মার্ক টোয়েন কিঞ্চিত লজ্জিত হয়ে বললেন, উচ্চারণ ঠিকই আছে। কিন্তু ইমোশনটা নাই।

ইমোশন এমন একটা জিনিস যেটা পারফেক্টলি দিতে না পারলে, কমিউনিকেশন ব্যর্থ হয়ে যাবে।

প্রোক্রাস্টেস এর বিছানা

প্রোক্রাস্টেস এর একটা সরাইখানা ছিল। সেইটা ছিল এথেন্স এবং ইলিউসিস এর পথের ধারে। প্রোক্রাস্টেস এর অতিথি সৎকার ছিল গতানুগতিক পদ্ধতির বাইরে। সে পথিকদের ধরে নিয়ে আসত আর বেশ খানাপিনা করাত। তারপর তাকে শুতে দিত বেশ আরামদায়ক বিছানায়। শর্ত ছিল যে খাটে শুবে সেই খাটে একদম এঁটে যেতে হবে। যদি কেউ খাট থেকে লম্বা হত প্রোক্রাস্টেস তার পা কেটে নিত। আর কেউ যদি খাট থেকে ছোট হত তবে তাকে অদ্ভুত উপায়ে টেনে লম্বা করত। কোন উপায়েই পথিকদের জীবিত থাকার কোন উপায় ছিল না। প্রোক্রাস্টেস এর খাটে কেউ খাপেখাপ মিলে শুইতে পারছে এই ধরনের রেকর্ডও নাই। এই সবই হল গ্রীক পুরাণের কিচ্ছা।

আমাদের জামানায় আমরাও কিন্তু প্রোক্রাস্টেস এর মত চিন্তা করি। ধইরা নেই যে কোন কিছু আমাদের ধরে নেয়া স্টান্ডার্ডের মতই হবে। এর বাইরে কিছু নাই। থাকলে সেইটা ধইরা বাইন্ধা আমরা আমাদের স্টান্ডার্ডের মাঝে সেট করে নেবই। কিন্তু কখনই আমাদের চিন্তার সীমাবদ্ধতা ভেবে দেখব না। আমরা আমাদের স্কুলে ভর্তি হই বা ভর্তি করাই সবাইকে একই ছাঁচে গড়ে তোলার জন্য। স্কুলে ভর্তি করানো আমার কাছে অনেকটা প্রোক্রাস্টেস এর বেডে শোয়ানো। স্কুলে বাচ্চাদের মেধা ও বুদ্ধি অনুসারে কারিকুলাম তৈরি করা হয় না। বরং বাচ্চাদেরকেই স্কুলের কারিকুলাম মেনে চলতে হয়।

শেয়াল ও বুদ্ধিজীবী

একবার এক বুদ্ধিজীবী বনের পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে একদল শেয়ালের সাথে উনার দেখা হয়ে গেল। এত শেয়াল দেখে তিনি ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি দৌড়ে পালাবেন কিনা সেটা ভাবতে ভাবতে দেখলেন, সে পথ নাই। পেছনের দিকেও আরো একপাল এসে হাজির হয়েছে। এত শেয়াল দেখে তাঁর ভিরমি খাওয়ার উপক্রম। তিনি ঠিক কোন দিকে দৌড় দিবেন সে সিদ্ধান্ত নিতে নিতে তারা তাঁকে চারদিকে ঘিরে দাঁড়াল। এই প্রেক্ষিতে কি করনীয় সেটা নির্ধারণে তিনি তাঁর উৎকৃষ্ট মগজ হাতড়ে কোন উপায় বের করতে পারলেন না। ভয়ে নিজের চোখ বন্ধ করে নিজেক শেয়ালের পালের হাতে সমর্পণ করে দিলেন।

দীর্ঘক্ষণ চক্ষু বন্ধ রাখার পরে দেখলেন নিজের উপর কোন ধরনের আক্রমন এমন কি আঁচড়েরও আভাস পাওয়া গেল না। তখন তিনি চোখ খুললেন। খুলে দেখলেন, সব শেয়াল সামনের ডান পা কপালে তুলে তাঁকে স্যালুট দিচ্ছে। তাদের মধ্যে নেতা শেয়ালটি সামনে এসে বলল, হে মহাজন, আপনি আমাদের সালাম গ্রহন করুন।
আমরা শেয়াল নিখিল বাংলার
সকলেই আপনার ফলোয়ার
বাকী শেয়ালগুলা বলল, হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া।
শেয়ালদের ধ্বনিতে আকাশ বাতাস বন বাঁদাড় মুখরিত হল। মাননীয় বুদ্ধিজীবির দেহে প্রাণ আসল। তিনি হাত তুলে তাদের সালাম গ্রহন করলেন।

সহসা, এক শেয়াল চিৎকার দিয়ে উঠল। বাঘ, বাঘ আসছে বাঘ। সাবধান! সাবধান!! শেয়ালগুলো সব এদিক সেদিক পালাতে লাগল। এদিকে বুদ্ধিজীবী সাহেব মরিয়া হয়ে বললেন, আমাকে রেখে যেওনা। প্লিজ।‘
শেয়ালনেতা, দাঁড়িয়ে বলল, হুজুর একটা কাজ করুন, আপনি সমস্ত কাপড় চোপড় খুলে দাঁড়িয়ে থাকুন। ভাল হয় যদি, ন্যাংটা হয়ে গাছের ডালে ঝুলে থাকেন। বাঘেরা ন্যাংটা মানুষ দেখেনি কোনদিন। সে আপনাকে ভূত ভেবে আর কিছু করবে না। বলে সেও লুকিয়ে গেল।

তখন মাননীয় বুদ্ধীজীবি মহাশয় আর কি করবেন, কাপড়-চোপড় সব খুলে সম্পূর্ন নগ্ন হয়ে আদি ও আসল চর্ম সম্বল করে গাছের ডালে ঝুলে পড়লেন।

পাশের গাছে দুষ্ট বান্দরেরা তখন হাসতে লাগল।

আকাশের তারা সবসময় সুন্দর দেখায় [Halo Effect]

সিলিকন ভ্যালীর একটা ফার্ম, সিস্কো, একসময় ছিল নতুন অর্থনীতির বরপুত্র। সাংবাদিকরা এর সর্বসাফল্য নিয়ে অকুণ্ঠ প্রশংসা করতঃ এর চমৎকার গ্রাহক সেবা, নির্ভুল কৌশল, দক্ষ অধিগ্রহণ, অদ্বিতীয় কারবারী সংস্কৃতি, সহজাত দক্ষ ক্যারিশমাটিক সিইও। দুই হাজার সালের মার্চমাসে এইটা ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে দামী কোম্পানী।

পরের বছর সিস্কোর শেয়ারের দাম ৮০% পড়ে গেলে, সাংবাদিকরা সুর পালটানো শুরু করে। হঠাৎ করে কোম্পানীর প্রতিযোগীতামূলক সুবিধাগুলোকে ধ্বংসাত্মক ত্রুটি হিসেবে চিহ্নিত করা হলঃ বাজে গ্রাহক সেবা, ধূমায়িত কৌশল, বেকুবমার্কা অধিগ্রহণ, পঁচা কর্পোরেট সংস্কৃতি এবং একজন বেকুব সিইও। এসব যখন বলা হচ্ছে, তখন কিন্তু কোম্পানীর না কোন কৌশল বদলানো হয়েছে, না সিইও পালটানো হয়েছে। যা পাল্টেছে তা হল কোম্পানীর চাহিদা, সেটা হয়েছে ডটকম ক্রাশের ফলশ্রুতিতে, তা কিন্তু কোম্পানীর কোন ভুল-ত্রুটির জন্য নয়।

যখন কোন বিষয়ের কোন একটা দিক আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয় আর সেটা পুরো বিষয়টার প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রভাবিত করে সেটাকেই আমরা বলি হেয়লো এফেক্ট (Halo effect) বা জ্যোতিষ চক্কর বলতে পারি। সিস্কোর ক্ষেত্রে এই জ্যোতিশ্চক্র বিশেষভাবে উজ্জ্বল ছিল। সাংবাদিকরা সিস্কোর শেয়ার মূল্য দেখে টাস্কি খেয়েছে আর কোন ভেতরের কোন খবর না নিয়েই ভেবেছে পুরো বিজনেসটা নিশ্চয়ই চকচকে আর টকটকে।

হেয়লো এফেক্ট সব সময় একইভাবে কাজ করে, আমরা কোন সহজলভ্য বা উল্লেখযোগ্য কোন তথ্য বা বিবরণ নিয়েই পুরো ব্যাপারটা সম্পর্কে ধারনা করে ফেলি। যেমন কোন কোম্পানীর আর্থিক অবস্থা থেকে বাড়তি যাচাই বাচাই ছাড়াই আমরা খুব সহজে কোম্পানীর ব্যাবস্থাপকদের পরিচালনা ক্ষমতা বা এর কোম্পানির বিজনেস কৌশলের সম্ভাব্যতা নিয়ে উপসংহারে চলে যাই। আমরা প্রায়শই সফলতা বা শ্রেষ্ঠত্ব আরোপ করি যেখানে এগুলো খুব সামান্যই আছে, যেমন, আমরা যখন শুধু খ্যাতির উপর ভিত্তি করেই কোন ম্যানুফ্যাকচারার থেকে পন্য কিনি। . হেলো এফেক্টের আরো একটা উদাহরণ হল, আমরা ধরে নিই এক ধরনের ব্যবসায়ে সফল সিইওরা অন্য যেকোনে ব্যবসায়েও সফল হবে, এবং আরেকটা বিষয় হল, তারা তাদের ব্যক্তি জীবনেও নায়ক বনে যায়।

মনোবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড লী থর্নডাইক প্রায় শত বছর আগে, এই হেলো এফেক্ট আবিষকার করেন। তাঁর উপসংহার ছিল, যে কোন একটি গুণ ( উদাহরণস্বরূপঃ সৌন্দর্য, সামাজিক অবস্থা, বয়স) ইতিবাচক বা নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে এবং তা পুরো ব্যাপারটাতে এর একটা অসমান প্রভাব থাকে। সৌন্দর্য হল সবচেয়ে বেশি গবেষনা করা উদাহরণ। ডজন ডজন গবেষণা দেখিয়েছে যে, আমরা দেখতে ভাল লোকদেরকে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই/ এমনি এমনিই ধরে নিই যে তারা সুপ্রিয়, সৎ এবং বুদ্ধিমান। আকর্ষনীয় লোকজন তাদের পেশাগত জীবনে সহজেই এই সুবিধা পেয়ে থাকে এমনকি স্কুলেও এই হেলো এফেক্ট দেখা যায় যেখানে শিক্ষকরা অসচেতনভাবেই দেখতে ভাল বাচ্চাদেরকে বেশি মার্ক দিয়ে থাকে।

বিজ্ঞাপনের সাথে এই হেলো এফেক্টের এর দারুন সংযোগ আছেঃ টিভিতে, বিলবোর্ডে, ম্যাগাজিনে যেসব সেলিব্রেটিরা আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসে তাদের দিকে একবারটি দেখুন। কিভাবে রজার ফেদেরারের মত একজন পেশাদার টেনিস খেলোয়াড় কিভাবে একজন কফি মেশিন বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেন, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, যদিও সেটা সফল বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে কোন বাধা নয়। আমরা সেলিব্রেট্রিদেরকে এতবেশি বিজ্ঞাপনে দেখি যে, আমরা কখনো চিন্তাও করি না কেন এটা-সেটার বিজ্ঞাপনে তাঁদেরকে দেখানোটা আদৌ আমাদের জন্য কোন গুরুত্ব বহন করে কিনা। কিন্তু এটাই হল হেলো এফেক্টের সবচেয়ে সেয়ানা পার্টঃ এটা আমাদের অবচেতন মনে কাজ করে। যা কিছু রেকর্ড করা দরকার তা হল, আকর্ষণীয় মুখ, আকর্ষনীয় জীবনধারা (লাইফস্টাইল) এবং ঐ নির্দিষ্ট পণ্য।

জোরালো নেতিবাচক প্রভাবের সাথে সাথে হেলো এফেক্ট বড় ধরনের অবিচারের দিকে নিয়ে যেতে পারে এবং এমনকি যখন জাতীয়তা, লিঙ্গ, অথবা বর্ণ সবকিছুর ব্যাপারে বাঁধাধরা চিন্তার দিকে নিয়ে যেতে পারে। কেউ বর্ণবাদী কিংবা লিঙ্গ-বিদ্বেষী না হয়েও এসবের স্বীকার হতে পারে। হেয়লো এফেক্ট আমাদের দৃষ্টি মেঘাচ্ছন্ন করে দেয় যেমনটা দেয় সাংবাদিক, শিক্ষক এবং ভোক্তাদের।

কদাচিৎ এই প্রভাবের নির্মল দিক দেখা যায় – হতে পারে সেটা স্বল্পমেয়াদী, আপনি কখনো প্রেমের সাগরে ভেসেছেন? If so, যদি তাই হয়, তাহলে আপনি জানেন, কতটা নিখুঁত মনে হতে পারে একজন কে। আপনার মনের মানুষকে মনে হবে পুরো একটা প্যাকেজ, আকর্ষণীয়, বুদ্ধিমান, পছন্দনীয় এবং উষ্ণ। এমনকি আপনার বন্ধুরা অনেক কিছু নেতিবাচক দিক পয়েন্ট আউট করতে পারে, আপনি এর কোন কিছুই দেখেন না, বরং মনে হয় সেগুলোও কত সুন্দর!

প্রকৃত বৈশিষ্ট বুঝতে হেয়লো এফেক্ট আমাদেরকে বাধা দেয়। এটা কাটাতে হলে আপনাকে ফেসভ্যালু বাদ দিয়ে চিন্তা করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্টগুলো সামনে নিয়ে আসতে হবে। বিশ্বমানের অর্কেস্ট্রাওগুলোতে বাছাইয়ের সময় পর্দার আড়ালে ক্যান্ডিডেটদেরকে পারফর্ম করতে হয় যাতে লিঙ্গ, বর্ণ, বয়স এবং চেহারা কোন ভূমিকা রাখতে না পারে। সবচেয়ে বড় কথা হল আপনার, যথাযথ তথ্য নেয়ার ও বুঝার মত ধৈর্য্য থাকতে হবে।

[রলফ ডবেলি থেকে অনূদিত]

শোফার নলেজ (মুখ ও মুখোশ)

ম্যাক্স প্লাংক সাহেব ১৯১৮ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবল প্রাইজ জেতেন। ঐ বছর তিনি জার্মানি ভ্রমনে যান। সেখানে প্রচুর অভ্যর্থনা- সংবর্ধনা পান, স্বাভাবিকভাবেই প্রচুর বক্তৃতা করা লাগে। প্রতিটি সেমিনারে-সভাতে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের উপর একই বক্তৃতা শুনতে প্লাংকের শোফার সেটা মুখস্থ করে ফেলেছিল। একই বিষয় শুনতে শুনতে সে কিছুটা বিরক্তও হয়ে উঠেছিল। সুতরাং সে প্লাংক সাহেবকে এক চমৎকার প্রস্তাব দিল। বলল, একই বক্তৃতা দিতে দিতে আপনি নিশ্চয় বিরক্ত হয়ে উঠেছেন। মিউনিখের সভায় আপনি শোফারের টুপি পরে সামনে বসে থাকবেন। আর আমি মিস্টার প্লাংক সেজে বক্তৃতা করব। সন্দেহ নেই ব্যাপারটা আমাদের দুজনের জন্যই বৈচিত্র নিয়ে আসবে। ড্রাইভারের এ সৃজনশীল প্রস্তাবটা প্লাংকের খুব মনে ধরল। তিনি বললেন, তথাস্তু।
সুতরাং নির্দিষ্ট দিনে মিউনিখের নামজাদা সব প্রফেসরদের সামনে প্লাংকের শোফার কোয়ান্টাম কেকানিক্সের উপর লম্বা বক্তৃতা দিল। আর প্লাঙ্ক শো’ফার সেজে বসে রইলেন। সভাশেষে একজন প্রফেসর দাঁড়িয়ে একটা প্রশ্ন করলেন। তখন প্লাঙ্করূপী ড্রাইভার বলল, মিউনিখের মত জায়গায় কোন জাঁদরেল প্রফেসর এরকম সিম্পল প্রশ্ন করতে পারে তা আমার জানা ছিল না। এটার উত্তর দেয়ার জন্য তো আমার ড্রাইভারই যথেষ্ট বলে সে ড্রাইভাররুপী প্লাঙ্ককে দেখিয়ে বলল, আমার ড্রাইভার এ প্রশ্নের জবাব দিবে।

আমেরিকার প্রখ্যাত ইনভেস্টর ও ব্যবসায়ী চার্লি মুঙ্গারের মতে দুই ধরনের জ্ঞান আছে। প্রথমটা হল আসল জ্ঞান। যার জন্য লোকে অনেক পরিশ্রম করে, রাত জাগে, পড়ালেখা করে। দিনরাত খেটে-খুটে কোন একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে বুৎপত্তি অর্জন করে। আরেকটা হচ্ছে, শোফার নলেজ। (শোফার নলেজ)। এইটাকে আমরা লোকদেখানো বিদ্যা বলতে পারি। এই ধরনের লোকেরা মূলত বিদ্যা জাহিরের ক্ষেত্রে ওস্তাদ হয়ে থাকে। সুন্দর ভঙ্গি আর সুন্দর চুল কিংবা চমৎকার হাসিই হয়ত তাদের বক্তৃতার মূলধন। অনেকটা টিভি নিউজ প্রেজেন্টারদের মত, অন্যের তৈরি করা খবর তারা চমৎকার উচ্চারণে দেখে দেখে স্মার্টলি পড়তে পারে।
.
দুঃখজনক ব্যাপার হল, এখনকার সময়ে আসল নলেজ আর শোফার নলেজ আলাদা করা খুবই কঠিন হয়ে গেছে। নিউজ প্রেজেন্টারদের ক্ষেত্রে আমরা তবু বুঝতে পারি যে, এই নিউজের আসল মালিক তারা নয়। সবাই জানে তারা শুধু পাঠক।

সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে এটা বুঝতে পারা আরো বেশি কঠিন। সাংবাদিকদের অনেকেই সত্যিকারের জ্ঞান অর্জন করে। অনেক ঝানু রিপোর্টার আছেন যারা সুদীর্ঘ সময়ের পরিশ্রমে একটা নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। একটা জটিল বিষয় বুঝতে ও বুঝাতে তাদের আন্তরিক চেষ্টা থাকে, এর পেছনে সময় দেন। দীর্ঘ পড়াশোনা করেন। তারপর তারা ঐ বিষয়ে বিশ্লেষণ দেন। কিন্তু বেশিরভাগ সাংবাদিকরা শোফার নলেজের কাতারেই পড়ে। তাঁরা ভাসা ভাসা জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে বিশ্লেষন দাঁড় করিয়ে ফেলেন। আর দেখা যায়, তাদের স্বল্প ও বেমানান জ্ঞানের কারনে বিশ্লেষন হয়ে উঠে একচোখা, শ্লেষ-বিদ্বেষ আর আত্মতৃপ্তিতে ভরপুর।
কারবারী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও একই জিনিস দেখা যায়। যে কোম্পানী যত বড় তার জন্য তত বড় স্টার সিইও দরকার। উৎসর্জন ( Dedication ), ঐকান্তিকতা (Solemnity ), দক্ষতা, নির্ভরযোগ্যতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এই সমস্ত শক্তি ও গুণাবলীর চেয়ে স্টার হওয়াটাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। দক্ষতা ও যোগ্যতার চেয়ে মেকাপটা বেশি হয়ে উঠে। শেয়ারহোল্ডার ও সাংবাদিকরা প্রায় মনে করেন, লোকরঞ্জনের ক্ষমতা মানুষের কর্মদক্ষতা বাড়িয়ে দিবে। বাস্তবে যা কখনোই নয়।

শোফারকে গার্ড দেয়ার জন্য ওয়ারেন বাফেট সুন্দর তরিকা দিয়েছেন, সেটা হল, যোগ্যতার বৃত্ত (Circle of Competence)। প্রত্যেকের উচিত নিজের সামর্থ্য ও যোগ্যতার একটা বৃত্ত টেনে নেয়া। এই বৃত্তের ভেতরে থাকবে সেই সব যাতে আপনি প্রত্যক্ষ জ্ঞানবলে পরিপূর্ণ দক্ষ। আর বাইরে থাকবে সেই সব যা আপনি আংশিক বোঝেন। মুঙ্গারের মতে, আপনার উচিত সার্কেল অব কম্পিটান্স এর ভেতরে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখা। এটা ইম্পর্টেন্ট না সার্কেলটা কত বড়। ইম্পর্টেন্ট হচ্ছে, সার্কেল পরিধি কোথায় তা জানা। আপনি যদি যেখানে আপনার কম্পিটেন্স নাই সেখানে খেলতে যান তবে নিশ্চিতভাবে আপনি হারবেন। এজন্য আগে নিজের দক্ষতা গুলো নির্দিষ্ট করে নিন। এবং অবশ্যই নিজের সার্কেলের ভেতরেই খলুন।
সবশেষে যা বলা দরকার তা হল, শোফার নলেজ সম্পর্কে সচেতন থাকা চাই। কোম্পানীর মুখপাত্র, নিউজ প্রেজেন্টারদের সাথে প্রকৃত জ্ঞানীকে গুলিয়ে ফেললে হবে না। এটা আপনি কিভাবে করবেন? দেখবেন, প্রকৃত বিশেষজ্ঞ নিজের সীমা জানেন, কি জানেন আর কি জানেন না সে বিষয়ে তারা সচেতন। যদি তারা নিজেকে সার্কেল অব কম্পিটান্স এর বাইরে দেখেন, তখন তারা খুব সহজেই বলেন, ‘আমি জানি না।‘ লজ্জা নয়, এমনকি প্রচ্ছন্ন গৌরবের সাথে।
শোফারের কাছে আপনি সব কিছুই শুনবেন, কিন্তু কখনোই শুনবেন না, ‘আমি জানি না। ‘

[রলফ ডবেলি’র দ্যা আর্ট অব থিংকিং ক্লিয়ারলি অবলম্বনে]

২০১৭ সালে পড়া বই

প্রিয় শব্দনীড় ব্লগারবৃন্দ ২০১৭ সালে আপনাদের পড়া সেরা বইগুলোর একটা তালিকা করতে চাই। আপনাদের পড়া দেশী-বিদেশী ভালোলাগা বইগুলো মন্তব্যের ঘরে জানান। সাথে অবশ্যই লেখকের নাম দিবেন। দু এক কলম লিখে দিলে তো আরও ভাল। ২০১৮ সালে কি পড়তে চান সেই নিয়েও আলোচনা হতে পারে। কোন বইগুলো পড়বেন সে নামগুলোও লিখুন।

লিটলম্যাগ পতঙ্গ

শব্দনীড়ে কবি মোকসেদুল ইসলামের লিটল ম্যাগাজিনের জন্য নাম চেয়ে দেয়া পোস্ট অনেকে হয়ত করেছেন অথবা করেননি। তবে নাম এসেছিল অনেকগুলিই। আমরা অনেক ভাল ভাল প্রস্তাব পেয়েছি। এত নামের ভীড়ে নাম সিলেকশনে আমাদের বেশ ভিরমি খেতে হয়েছে। শেষে পতঙ্গ নামটি সিলেক্ট হয়। শব্দনীড়ের সকলের শুভকামনা প্রত্যাশি নতুন লিটল ম্যাগাজিন ‘পতঙ্গ’।

শব্দনীড় মূলত সাহিত্যমনাদের আড্ডাখানা। তাই আশাকরি অনেক বন্ধুদের স্বতস্ফূর্ত সহযোগীতা পাব।

কোথায় পাব তারেঃ শহীদুল জহির

দক্ষিণ মৈশুন্দি, ভূতের গলির লোকেরা পুনরায় এক জটিলতার ভিতর পড়ে এবং জোড়পুল ও পদ্মনিধি লেনের, ওয়ারি ও বনগ্রামের, নারিন্দা ও দয়াগঞ্জের লোকেরা তাদের এই সঙ্কটের কথা শুনতে পায়; তারা, ভূতের গলির লোকেরা বলে:

আমরা পুনরায় আব্দুল করিমের কথায় ফিরে যেতে চাই, কারণ কয়েকদিন থেকে আমরা মহল্লায় শুনতে পাচ্ছিলাম যে, সে ময়মনসিং যাচ্ছে; কিন্তু আমরা তার এই কথাকে গুরুত্ব না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিই। তখন একদিন বৃহস্পতিবার বিকালে আমাদের মহল্লা, ভূতের গলির ৬৪ নম্বর বাড়ির মালিক আব্দুল আজিজ ব্যাপারি ঠোঙ্গায় করে গরম ডালপুরি কিনে ফেরার পথে আব্দুল করিমের সঙ্গে তার দেখা হয় এবং সে বলে আহো মিঞা, ডাইলপুরি খায়া যাও।

আব্দুল করিমের হঠাৎ করে ডালপুরি খাওয়ার দাওয়াত গ্রহণ করতে লজ্জা লাগে এবং সে বলে যে, ডালপুরি খেলে তার বুক জ্বালা করে; কিন্তু আব্দুল আজিজ ব্যাপারি তার কথায় পাত্তা না দিয়ে বলে, আহো আহো, মজার জিনিস, তুমিতো খালি নিজেরে লয়া থাক!

তখন আব্দুল করিমকে মেনে নিতে হয়, সে আজিজ ব্যাপারির ঘরের ভিতরে ঢুকে ঘনায়মান অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ডালপুরি খায় এবং বলে, ডাইলপুরির মইদ্দে ডাইল নাইকা, হুদা আলু!

আঃআঃব্যাপারি : হঁ। ডাইলের দাম বাইড়া যাইতাছে কেমুন, দেখ না!

আঃকঃ : আপনের লাইগা ডাইল লয়া আমুনে।

আঃআঃব্যাপারি : কইত্থন?

আঃকঃ : আমি মৈমনসিং যাইতাছি বেড়াইতে।

তারপর আব্দুল আজিজ ব্যাপারি যখন জিজ্ঞেস করে, ময়মনসিং তার কী কাজ, সে বলে যে, সে আসলে আকুয়া যাচ্ছে; এবং আব্দুল আজিজ ব্যাপারি যখন আকুয়া কোথায় তা বুঝতে পারে না, সে বলে যে, সে আসলে ফুলবাড়িয়া যাবে। তখন আব্দুল আজিজ ব্যাপারি যখন ফুলবাড়িয়া কোথায় তাও বুঝতে ব্যর্থ হয়, সে বলে যে, ময়মনসিংয়ের কাছেই একটা জায়গার নাম আকুয়া এবং আকুয়ার কাছেই ফুলবাড়িয়া। এই কথা শুনে আব্দুল আজিজ ব্যাপারি তাকে আর একটা ডালপুরি অথবা আলুপুরি দেয়, আব্দুল করিম দ্বিতীয় পুরিটা খায়, খেতে খেতে সে পুনরায় বলে, এই হালারা আলু দিয়া ডাইলপুরি বানায়, ডাইলের দাম বাইড়া যাইতাছে, আপনের লাইগা আমি ডাইল লয়া আমুনে।

আঃআঃব্যাপারি : মৈমনসিংথন?

আঃকঃ : হঁ, ক্যালা!

আঃআঃব্যাপারি : মৈমনসিং তুমার কী কাম?

আঃকঃ : আমার বন্দু আছে, বেড়াইবার যামু।

আঃআঃব্যাপারি : তুমার বন্দু মৈমনসিং!

আঃকঃ : ক্যালা, থাকা পারে না?

আব্দুল করিম তখন অবধারিত চক্করের মধ্যে পড়ে যায়, আব্দুল আজিজ ব্যাপারি তাকে ছাড়ে না, সে তার হাতে ঠোঙ্গার শেষ পুরিটা তুলে দিয়ে বলে, কওতো ব্যাপারটা কী?

আঃকঃ : না, এমনেই। আমারে কইলো আমাগো বাইতে বেড়াইতে যাইয়েন; ভাবলাম কইছে যখন বেড়ায়া আহি গা।

আঃআঃব্যাপারি : মৈমনসিং তুমি বন্দু পাইলা কই?

আঃকঃ : পাইলাম, একদিন মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে গেছিলাম, বাসস্ট্যান্ডে কথা হইলো, কইলো, মৈমনসিং বেড়াইতে আইসেন।

আমরা মহল্লার লোকেরা, সেদিন রাতে আমাদের দিবসে কর্ম শেষে ক্লান্ত-অবসরে আব্দুল করিমের ময়মনসিং যাওয়ার সর্বশেষ খবর শুনি এবং বলি, পোলাটা হালার ভোদাই, এবং আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, খোরশেদ আলমের এই বেকার ছেলেটার মানুষ হতে পারার আর সম্ভাবনা নাই। পরদিন শুক্রবার জুম্মা নামাজের পর মহল্লায় আলি আকবরের সঙ্গে তার কথা হয় এবং আমরা তা জানতে পারি; আলি আকবর রহমতগঞ্জে আড়ৎদারি করে, জুম্মা নামাজ শেষে বাসায় ফেরার সময় পথে আব্দুল করিমের সঙ্গে তার দেখা হয়, এবং সে বলে, কি মিঞা আব্দুল করিম, তুমি নিহি মৈমনসিং যাইতাছ?

আঃকঃ : হঁ, চাচা—আস সালামালেকুম।

আঃআঃ : ক্যালা, কী কাম তুমার মৈমনসিং, ধান্ধা কী?

আঃকঃ : না, এমনেই, কুনো কাম নাই, মনে করলাম ঘুইরা আহি।

আঃআঃ : হুদাহুদি ঘুরবার যাইবা!

আঃকঃ : হঁ। আপনে এইবার কী রাকবেন?

আঃআঃ : কী রাখুম?

আঃকঃ : না, কইতাছি আড়তে এইবার কী বান্ধাই করবেন?

আলি আকবরের মেজাজ খারাপ হয়, সে বলে যে, তার আড়তের কারবারে গণ্ডায় গণ্ডায় জিনিস বান্ধাই করা থাকে, এবং তখন আব্দুল করিম তাকে আখের গুড় বাঁধাই করার পরামর্শ দেয়। সে বলে, গুড় বান্ধাই করেন, আমি ফুলবাইড়া যাইতাছি, আপনের লাইগা আউখা গুড় লয়া আমুনে।

আঃআঃ : তুমি না কইলা মৈমনসিং যাইতাছ?

আঃকঃ : হঁ, মৈমনসিংথন যামু আকুয়া, আকুয়াত্থন ফুলবাইড়া। ফুলবাইড়ায় ভাল গেণ্ডারি হয়, গেণ্ডারিত্থন ভাল আউখা গুড় হয়; আপনের লাইগা গুড় লয়া আমুনে।

আমাদের মনে হয় যে, আইএ পাস বেকার এবং অলসের রাজা আব্দুল করিম আসলে মহল্লার লোকের সঙ্গে খেলা করে, সে তার পিতার ক্রমাগত অভিযোগ এবং গালমন্দের মুখে দিশাহারা হয়ে এই কায়দা বের করে; তার এই সব কথার কোন মানে নাই, সে জীবনে কোথাও যায় নাই এবং যাবে না। তখন আর এক বৃহস্পতিবারে সে পুনরায় আব্দুল আজিজ ব্যাপারির দেখা পায়। আব্দুল আজিজ ব্যাপারি সন্ধ্যায় পুনরায় ডালপুরি কিনে বাড়ি ফেরার সময় আব্দুল করিমকে দেখে।

আঃআঃব্যাপারি : কি তুমি অখনতরি মহল্লায় আছ?

আঃকঃ : থাকুম না ক্যালা!

আঃআঃব্যাপারি : তুমি না মৈমনসিং যাও!

আঃকঃ : যামু।

আঃআঃব্যাপারি : আমার লাইগা ডাইল আনবা?

আঃকঃ : আপনি কইলে আনুমনে।

আঃআঃব্যাপারি : আমিতো মিঞা আড়ৎদারি করি না, দুকানদারি করি।

আঃকঃ : আড়ৎদারিকরণ লাগে নিহি? খাটের নিচে ফালায়া থুইবেন, পরে বেচবেন।

তখন আব্দুল আজিজ ব্যাপারি তাকে ডালপুরি খেয়ে যাওয়ার কথা বলে, কিন্তু আব্দুল করিমের পুনরায় লজ্জা করে এবং আব্দুল আজিজ ব্যাপারি সাধে, আহো আহো আলুপুরি হইলেও খাইতে ভাল। আব্দুল করিম তখন আব্দুল আজিজ ব্যাপারির বাসায় ঢুকে প্লাস্টিকের বেতের চেয়ারে বসে আলুপুরি খায় এবং কথা বলে।

আঃকঃ : আপনে কইলে আপনেরে ডাইল আইনা দিবার পারি, আমিতো যামুই বেড়াইবার লাইগা, আহনের সুময় লয়া আমুনে দুই/চাইর মণ।

আঃআঃব্যাপারি : তুমার বাপেরে কও না ক্যালা?

আঃকঃ : লাভ নাইকা।

আঃআঃব্যাপারি : ক্যালা?

আঃকঃ : মিল খায় না।

মহল্লায় তারপরেও আমাদের মনে হয় যে, আব্দুল করিম আসলে বদমায়েশি করছে; সে শেষ পর্যন্ত কাউকে ঠকাবে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিতভাবে বলতে না পারলেও আমাদের মনে হয় যে, তার আচরণের ভেতর চালাকি আছে এবং আব্দুল আজিজ ব্যাপারি যখন তার পিতার প্রসঙ্গ উত্থাপন করে তখন চালাকির বিষয়টা মনে হয় পরিষ্কার হয়ে যায়, তার তখন আসলে জবাব দেয়ার মত কিছু থাকে না। কিন্তু তারপরেও আমরা সম্ভবত নিশ্চিত হতে পারি না, কারণ পরবর্তী শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর রায়সা বাজারের হোটেল মালিক বাবুল মিঞার সঙ্গে তার কথা হয়, বাবুল মিঞাই তার সঙ্গে প্রথম কথা বলে ফাঁদে পড়ে। বাবুল মিঞা যখন তার ময়মনসিং যাওয়ার কথা জানতে চায়, সে বলে যে, সে দুই/চার দিনের মধ্যেই যাবে এবং তারপর আব্দুল করিম পুরাতন প্রসঙ্গে আসে।

আঃকঃ : হুনলাম ডাইলের দাম নিকি বাইড়া গেছে, আপনেরা অখনে আলু দিয়া ডাইলপুরি বানান!

বাঃমিঞা : হঁ, আলু দিয়াই বানাই, কিন্তু আলুর দামওতো হালায় কম না!

আঃকঃ : আমিতো মৈমনসিং যাইতাছি, আপনি কইলে আপনের লাইগা আলু লইয়া আমুনে দুই/চাইর/দছ মণ।

বাঃমিঞা : আরে না, এত আলু দিয়া কী করুম!

আঃকঃ : ক্যালা, আপনের হোটেলে আলু লাগে না?

বাঃমিঞা : লাগে, আমিতো পাইকারি কিনি পড়তা পইড়া যায়।

আঃকঃ : কিন্তু আমি ফুলবাইড়া যাইতাছি, ওইখানে ভাল আলু হয়, আপনে কইলে আপনের লাইগা আমি আদ্দেক দামে আলু আইনা দিমুনে।

তখন এই চাপের মুখে বাবুল মিঞা তার কৌশল বদল করে।

বাঃমিঞা : তুমি মৈমনসিং যাইতাছ ক্যালা?

আঃকঃ : কাম নাই, বয়া রইছি, ভাবলাম ঘুইরা আহি।

বাঃমিঞা : কাম নাই! বাপের লগে দুকানে বহ না ক্যালা?

আঃকঃ : নাটবল্টুর দুকানদারি করুম না। আমি অন্য ব্যবসা করবার চাই, কিন্তু আব্বায় রাজি না।

আমরা যখন বাবুল মিঞার সঙ্গে আব্দুল করিমের এই আলাপচারিতার কথা শুনি আমাদের এই প্রথমবারের মত মনে হয় যে, আব্দুল করিম হয়তো এক ধরনের জীবিকার কথা ভাবছে; আমরা অবশ্য একেবারে নিশ্চিত হতে পারি না, কারণ, খামখেয়ালি ও অকর্মণ্য আব্দুল করিমের কিছু করতে পারার বিষয় আমাদের একেবারেই বিশ্বাস হতে চায় না। এবং দশ/পনেরো/বিশ দিন পরেও আমরা যখন তাকে মহল্লায় দেখি আমাদের পুনরায় মনে হয় যে, এটা তার এক ধরনের খেলাই; অথবা হয়তো সে এই সবকিছুর দ্বারা তার পিতাকেও বোঝানোর চেষ্টা করে যে, সে নিষ্কর্মা হয়ে থাকতে চায় না। কিন্তু তার ময়মনসিং যাওয়ার খবর আসে না, সে মহল্লাতেই থেকে যায়; আমাদের মনে হয় যে, হয়তো আব্দুল আজিজ ব্যাপারি ডাল কিনতে না চাওয়ায় এবং আলি আকবর আখের গুড় কিনতে না চাওয়ায় অথবা বাবুল মিঞা আলু কিনতে না চাওয়ায় তার ময়মনসিং যাওয়া হয় না। তখন ৬৪ নম্বর বাড়ির আব্দুল আজিজ ব্যাপারির সঙ্গে তার পুনরায় দেখা হয় এবং আব্দুল আজিজ ব্যাপারি পুনরায় তাকে ডালপুরি খাওয়ার দাওয়াত দেয়।

আঃকঃ : আপনে এত ডাইলপুরি খান ক্যালা?

আঃআঃব্যাপারি : আর কী খামু? বাপ-দাদায় খায়া গেছে, আমিও খাই!

আঃকঃ : ডাইলপুরির মইদ্দে হুদা আলু, আপনেরে কইলাম ডাইল আইনা দেই!

আঃআঃব্যাপারি : মৈমনসিং থন?

আঃকঃ : হঁ।

আঃআঃব্যাপারি : তুমি যাইবা কবে?

আঃকঃ : যামু, দেখি।

আঃআঃব্যাপারি : কবে?

আঃকঃ : যামু, মনে করছিলাম আপনেগো লাইগা কিছু জিনিসপত্র লয়া আহি, কিন্তু আপনেগোতো দেখি কিছুই দরকার নাইকা!

আমরা পুনরায় এই সকল কথা শুনি এবং বলি, হালার বলদ; কারণ, আমরা জানতে পারি যে, এত কথার পরও আব্দুল আজিজ ব্যাপারি আব্দুল করিমের সঙ্গে ডালের ব্যবসা করতে রাজি হয় না। এভাবে কতদিন কাটে তার হিসাব আমরা ভুলে যাই, কিন্তু আব্দুল করিমের ময়মনসিং এবং ফুলবাড়িয়া যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিবৃত হয় না। তখন কোন এক শুক্রবারে আব্দুল আজিজ ব্যাপারি তৃতীয়বারের মত ঠোঙ্গায় করে ডালপুরি নিয়ে ফেরার সময় সন্ধ্যার মুখে আব্দুল করিমের সঙ্গে তার দেখা হয় এবং পুনরায় সে তাকে ডালপুরি খেয়ে যাওয়ার জন্য ডাকে।

আঃআঃব্যাপারি : আহো।

আঃকঃ : আলুপুরি?

আঃআঃব্যাপারি : আহো, খায়া যাও।

তখন আব্দুল আজিজ ব্যাপারি তার ময়মনসিং যাওয়ার প্রসঙ্গ পুনরায় উত্থাপন করে, তুমার মৈমনসিং যাওয়ার কী হইল? আমরা মহল্লায় যখন এই কথা শুনি আমাদের সন্দেহ থাকে না যে, আব্দুল করিম আমাদের সঙ্গে মশকারিই করে এবং আমরা তার পাতা এই ইয়ার্কির ফাঁদে ক্রমাগত ফেঁসে যেতে থাকি; আমাদের মধ্যেও হয়তো ইতিমধ্যে এই খেলার প্রবৃত্তি জেগে উঠেছিল এবং এ রকম মনে হয়েছিল যে, আমাদের উচিত তাকে এখন পালাতে না দিয়ে চেপে ধরা এবং আমাদের সঙ্গে এই সব বাজে রসিকতা করার জন্য উপযুক্ত শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করা। কিন্তু আমাদের জন্য আরও বিস্ময় বাকি ছিল, তৃতীয় দিন আব্দুল করিমের হাতে হলুদ রঙের গরম এবং তেল জবজবে ডাল অথবা আলুপুরি তুলে দেয়ার পর আব্দুল আজিজ ব্যাপারি তাকে যে প্রশ্নটি করে আমরা বুঝে পাই না এই প্রশ্ন তাকে কেন আগে করা হয় নাই, অথবা আমরাও কেন একবারও এই কথাটা ভাবি নাই! তৃতীয়বারের মতো ডালপুরি খাওয়ানোর পর আব্দুল আজিজ ব্যাপারির মাথায় প্রশ্নটি আসে কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর শুনে সে বিমূঢ় হয়ে পড়ে; কারণ, সে যখন বলে, তুমার বন্দুর নাম কি? আব্দুল করিম জানায় যে, তার বন্ধুর নাম, শেফালি।

আঃকঃ : আমি মৈমনসিং এইবার যামু। আপনে চাইলে আপনের লাইগা ডাইল আইনা দিবার পারি।

আঃআঃব্যাপারি : শেপালি কে? শেপালি তুমার বন্দু হইল কেমনে?

আঃকঃ : ক্যালা, হয়া পারে না?

আঃআঃব্যাপারি : অরে পাইলা কই?

আঃকঃ : পাইলাম।

আঃআঃব্যাপারি : কই পাইলা, মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে?

আঃকঃ : হঁ।

আঃআঃব্যাপারি : তুমারে কইলো বেড়াইতে যাওনের লাইগা!

আঃকঃ : হঁ।

আঃআঃব্যাপারি : তুমার বাপে তুমার উপরে এ্যার লাইগাই চেতে!

আঃকঃ : ক্যালা?

আঃআঃব্যাপারি : চেনা নাই জানা নাই একটা মাইয়া কইলো বেড়াইতে যাইয়েন, আর তুমি ফাল পাড়তাছ!

আঃকঃ : ক্যালা?

আঃআঃব্যাপারি : তুমি মিঞা আদতেই একটা ভোন্দা, তুমার বাপেরে এইসব কথা কইও না, কইলে তুমারে লৌড়াইবনে!

আমাদেরও মনে হয় যে, আসলেই আব্দুল করিম একটা গাধা! কিন্তু তারপর আমরা আব্দুল আজিজ ব্যাপারির মত পুনরায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি, কারণ, আব্দুল করিম এসব কথা এবং তিরস্কার মেনে নিতে রাজি হয় না। আব্দুল আজিজ ব্যাপারির ডাল অথবা আলুপুরি খাওয়ার জন্য সে তার বকাঝকা করতে পারার অধিকার মেনে নেয় না।

আঃকঃ : আমি এই মাসেই যামু, আপনেরা যাই কন।

আঃআঃব্যাপারি : তুমি ক্যালা যাইবা, ওই মাইয়ারে দেখনের লাইগা?

আঃকঃ : হঁ, ক্যালা?

আঃআঃব্যাপারি : তুমি ঢাকার বাইরে গেছ কুনোদিন?

আঃকঃ : হের লাইগা যায়া পারুম না?—অসুবিধা নাইকা, যায়া পারুম, ঠিকানা লেইখা লইছি।

ভূতের গলির লোকদের কাছে তখন আব্দুল করিম এবং তার ময়মনসিং যাওয়ার প্রসঙ্গের চাইতে শেফালি প্রসঙ্গ বড় হয়ে ওঠে, দক্ষিণ মৈশুন্দি এবং ভূতের গলির এই মহল্লার লোকদের দিন উত্তেজনায় ভরে যায়, হালায় প্রেম করে নিহি, তারা বলে। তাদের মনে হয় যে, আব্দুল করিম বেকার বলেই তার পক্ষে এইসব করা সম্ভব; তখন মহল্লার লোকেরা বেকার থেকে প্রেম করাকে ঘৃণা করতে শেখে; তারা ভুলতে পারে না যে, শেফালি একটা মেয়ে এবং আব্দুল করিম বলে যে সে তার বন্ধু! ফলে মহল্লার লোকদের রাতের ঘুম বিঘি্নত হয়, সারাদিনের কর্মক্লান্ত দেহ নিয়ে তারা বিছানায় জেগে থাকে, জীবনের ব্যর্থতা এবং অপচয় বোধ তাদেরকে গ্রাস করতে উদ্যত হয় এবং তারা কেমন বিষণ্ন হয়ে পড়ে; তাদের মনে হয় যে, বেকার থাকাইতো ভাল আব্দুল করিমের মত! আব্দুল করিম তার অলস সময় শুয়ে বসে কাটায় এবং দূরবর্তী শেফালির গল্প করে, তার ময়মনসিং যাওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যায় না। আব্দুল আজিজ ব্যাপারি অথবা আলি আকবর অথবা বাবুল মিঞার সঙ্গে তার আবার দেখা হয়, তারা যখন বলে, তুমার যাওয়া হইল না? তখন সে তার এই ব্যর্থতার দায় তাদের ওপর চাপায়, বলে, যামু, কইলাম আপনেগো লাইগা কিছু লয়া আহি, আপনেরাতো রাজি হইলেন না! মহল্লার লোকেরা যখন এই কথা শোনে তারা খুব চমৎকৃত হয়, তারা বলে, খোরশেদ আলমের এই পোলাটা হালায় দেখছনি কেমুন সেয়ানা হয়া উঠছে! তখন একদিন আব্দুল আজিজ ব্যাপারি ডালপুরি কিনে বাড়ি ফেরে, পথে সে আব্দুল করিমকে খোঁজে তাকে চতুর্থ দিনের মত ডালপুরি খাওয়ানোর জন্য, কিন্তু তাকে দেখা যায় না।

মহল্লার লোকেরা যখন এই কথা শোনে এবার তারা আব্দুল আজিজ ব্যাপারিকে গাধা বলে গাল দেয়, তারা বলে, এই হালায় ব্যাপারির বাচ্চা খালি ডাইলপুরি খায়, আর এই বেকার বদমাইশ পোলাটারে লয়া নাচে! কিন্তু পরবর্তী সময়ে মহল্লার লোকেরা তাদের মত বদলায় এবং আব্দুল আজিজ ব্যাপারির বুদ্ধিমত্তার বিষয়ে তাদের শ্রদ্ধা ফিরে আসে। কারণ, তারা আব্দুল আজিজ ব্যাপারির ডালপুরি খাওয়ার গল্প বিস্তারিতভাবে জানতে পারে এবং তাদের মনে হয় যে, আব্দুল করিমের চালাকির দিন এবার শেষ হবে। ভূতের গলির লোকেরা জানতে পারে যে, আব্দুল আজিজ ব্যাপারি ডালপুরি খাওয়ার জন্য আব্দুল করিমকে খোঁজে বটে তবে তাদের বাসায় গিয়ে ডেকে বের করে আনে না, তার বদলে সে প্রতীক্ষা করে; মনে হয় যেন আব্দুল আজিজ ব্যাপারি ছিপ ফেলে বসে থাকে, তবে তার প্রতীক্ষার কাল দীর্ঘ হয় না। তিন দিন পর কোন এক বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়, অথবা বুধবারও হতে পারে, সে আব্দুল করিমের দেখা পায় এবং উৎফুল্ল হয়ে ওঠে, কি মিঞা তুমারে দেখি না ক্যালা? তখন আব্দুল আজিজ ব্যাপারির বোধহয় মনে হয় যে, আসল কথায় সরাসরি না গিয়ে একটু সময় নেয়া যাক; ফলে সে আব্দুল করিমকে একটু খেলানোর সিদ্ধান্ত নেয় এবং বলে, তুমি তাইলে মৈমনসিং গেলা না? তবে সেদিন বৃহস্পতিবার কিংবা বুধবার সন্ধ্যায় ডালপুরির ঠোঙ্গা নিয়ে বসা আব্দুল আজিজ ব্যাপারি এবং আব্দুল করিমের মধ্যেকার খেলাটা হয়তো একতরফা ছিল না, পারস্পরিক ছিল। মহল্লার লোকেরা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখে যে, আব্দুল করিমও খেলোয়াড় খারাপ না; কারণ, সেদিন আব্দুল আজিজ ব্যাপারির কথা শুনে সন্ধ্যার নরম অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে সে হাসে এবং বলে, আপনে যাইবার কন? তার এই কথা শুনে আব্দুল আজিজ ব্যাপারি হকচকিয়ে যায়, কিন্তু বুদ্ধি হারায় না, সে দ্রুত চাল বদলায় এবং এতে আব্দুল করিম ফেঁসে যায়; আব্দুল আজিজ ব্যাপারির জেরার মুখে আব্দুল করিমকে তার ময়মনসিং ভ্রমণ এবং শেফালির বৃত্তান্ত ভেঙে বলতে হয়।

আব্দুল করিম বলে যে, কোন একদিন দুপুরে তার কোন এক বন্ধুর সঙ্গে মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে বেড়াতে গেলে সেখানে তারা এই অল্প বয়স্ক গ্রামের মেয়েটিকে পায়, মেয়েটি একা এবং সম্ভবত অসুস্থ ছিল। তাদের সামনে গাড়িতে বসে মেয়েটি বাস ছাড়ার আগেই জানালা দিয়ে মুখ বের করে বমি করে, তারপর হয়তো কুলি করার জন্য অথবা পানি খাওয়ার জন্য সে যখন বাস থেকে নেমে আসে তার পা টলমল করে এবং আব্দুল করিম তা দেখে। তখন আব্দুল করিম তাকে তার বাহু ধরে নিয়ে এসে একটা কাঠের বেঞ্চে বসায়, হোটেল থেকে পানি এনে খাওয়ায় এবং তখন সে জানতে পারে যে, মেয়েটার নাম শেফালি; এবং তখন শেফালির সঙ্গে তার সব অলৌকিক কথাবার্তা হয়। আব্দুল আজিজ ব্যাপারির প্রশ্নের মুখে সে বলে যে, সে যখন দেখে বা বুঝতে পারে মেয়েটা একা বাড়ি ফিরছে এবং সে অসুস্থ তার বড় মায়া হয় এবং সে বলে, তুমি একলা যায়া পারবা? আব্দুল করিমের কথা শুনে হয়তো মেয়েটার মজা লাগে, সে বলে, কী কইন, পারতাম না ক্যারে, এল্কা কত্তো গেলাম! তখন, তারপর, বাস না ছাড়া পর্যন্ত তাদের দুজনের মধ্যে আলাপ হয় এবং তখন আব্দুল করিম জানতে পারে যে, ময়মনসিং ছাড়িয়ে আকুয়া যেতে হয়, তারপর আকুয়া থেকে ফুলবাড়িয়া; সেখানে কত চাল, কত ডাল, কত আখ এবং গুড় হয়, সেখানে কত আলু শিম এবং বেগুন জন্মে, এবং এসব জিনিস কত সস্তা দামে ফুলবাড়িয়া হাটে বিক্রি হয়।

তখন কোন এক সময় মেয়েটা হয়তো তাকে বলে, আমরার বাইত বেড়াইবার যাইন যে; এবং আব্দুল করিম একটা কাগজে মেয়েটার ঠিকানা লিখে নেয় এবং বলে, মৈমনসিং যাইনিকা কুনো দিন, যুদি যাইবার কও যামুনে একদিন, দেইখা আমুনে তুমারে! সেদিন এটুকু শোনার পর আব্দুল আজিজ ব্যাপারির কাছে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় এবং তার মনে হয় যে, এটা আব্দুল করিমের একটা খেলাই, এবং সে হয়তো নিজের সঙ্গেই খেলে, শেফালি এবং ময়মনসিং বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে সে হয়তো তার জীবনের কর্মহীনতার ভেতর এই এক অবলম্বন গড়ে তোলে। তখন আব্দুল আজিজ ব্যাপারি তার নিষ্ঠুর সিদ্ধান্তটি নেয়, তার বোধহয় মনে হয় যে, চালাকি করার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে হয়তো তার চাপা মারার এই প্রবণতা দূর হবে; ফলে সে বলে, তুমি যাও, আমার লাইগা পাঁচ কেজি ডাইল লয়া আইয়ো, যুদি দেখি যে পড়তা ভালা পড়তাছে পরে বিশি কইরা আনামুনে। কিন্তু মহল্লার লোকেরা বলে যে, আব্দুল আজিজ ব্যাপারির মত তারাও আব্দুল করিমকে বুঝতে পারে নাই, কারণ, আব্দুল আজিজ ব্যাপারির কথা শুনে সে বলে যে, সে ডাল কিংবা আলু কিংবা গুড় এনে ব্যবসা করার পরিকল্পনা বাদ দিয়েছে, সে এখন এমনি বেড়াতে যাবে। তার এই কথা শুনে আব্দুল আজিজ ব্যাপারির হয়তো ভাল লাগে না, পরাজিত এবং অপমানিত লাগে, এবং তার আর কিছু বলার থাকে না; সে একটা ডালপুরি আব্দুল করিমের হাতে তুলে দিয়ে বলে, ঠিক আছে, লও খাও, এবং আব্দুল করিম শেষ পুরিটাও মজা করে খায়।

ভূতের গলির লোকদের কাছে তখন ব্যাপারটা রহস্যজনক হয়ে দাঁড়ায়, তাদের মনে হয় যে, আব্দুল করিম হয়তো মহল্লার মানুষদের এবং নিজেকেও বোকা বানায় মাত্র; তাদের সন্দেহ যায় না, ফলে আব্দুল আজিজ ব্যাপারি পুনরায় ডালপুরি অথবা আলুপুরি কিনে আব্দুল করিমকে খোঁজে, তারপর তাকে যখন পুনরায় একদিন রাস্তায় পায় তাকে সে তার বাড়িতে নিয়ে যায়, বলে, আহো তুমিতো ডাইল আইনা দিবা না, আহো আলুপুরি খায়া যাও! সেদিন আব্দুল আজিজ ব্যাপারি তাকে বলে, তুমি তাইলে মৈমনসিং এমনেই বেড়াইবার লাইগা যাইতাছ? মহল্লার লোকেরা বলে যে, অবশেষে আব্দুল আজিজ ব্যাপারি হয়তো বিষয়টি বুঝতে পেরেছিল এবং আব্দুল করিম যখন নমুনা হিসাবে পাঁচ কেজি ডাল এনে দিতে পুনরায় অস্বীকার করে তখন সে খেলাটা জারি রাখার চেষ্টা করে, যাতে আব্দুল করিম এখন ভেগে যেতে না পারে। তার কথা শুনে আব্দুল করিম যখন ঘাড় নাড়ে এবং বলে, হঁ এমনেই যামু, তখন সে বলে, তুমি তুমার লগে আমার দুলাল মিঞারে লয়া যাও না ক্যালা, তুমি শেপালিরে দেইখা আইলা, অয় হাট বাজারে কী পাওন যায় দেইখা আইলো। আব্দুল আজিজ ব্যাপারির হয়তো মনে হয়েছিল যে, আব্দুল করিম তার এ প্রস্তাবে রাজি হবে না; কারণ, এত কথার পর তার হয়তো মনে হয়েছিল যে, আব্দুল করিমের ময়মনসিং যাওয়ার এসব কথাবার্তা তারপরেও হয়তো ভুয়া এবং শেফালিও কাল্পনিক। কিন্তু মনে হয় যে, তার ধারণা পুনরায় ভুল ছিল, আব্দুল করিম তার কথায় রাজি হয়ে যায় এবং বলে, তাইলেতো খুবই ভাল হয়, দুইজনে গপসপ মাইরা যাওন যায়—অসুবিধা হইব না, শেপালিগো বাইতে বড় টিনের ঘর আছে, আরামে থাকন যাইবনে; দুইজনে বেড়ায়া বুড়ায়া আমুনে।

ভূতের গলির লোকেরা এই গল্প করে :

আমরা তখন সব জানতে পারি, আব্দুল করিম ময়মনসিং রওনা হয়, সঙ্গে যায় আব্দুল আজিজ ব্যাপারির বড় ছেলে দুলাল মিঞা; ভূতের গলিতে একমাত্র আলি আকবর এবং বাবুল মিঞা ছাড়া আমরা সকলেই এই ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট হই—আব্দুল করিমের পিতা খোরশেদ আলমও অবশ্য খুশি হয় না। যাহোক আমরা খুশি হই, কারণ আমাদের মনে হয় যে, সঙ্গে দুলাল মিঞা থাকায় পরে আমরা সব ঘটনা বিশদ জানতে পারব, আব্দুল করিমের উপায় থাকবে না বানিয়ে মিথ্যা কথা বলে আমাদের ঠকানোর।

এভাবে আব্দুল করিম এবং দুলাল মিঞার যাত্রা শুরু হয়, আব্দুল আজিজ ব্যাপারির বাড়িতে শেষবার ডালপুরি খাওয়ার এক/দুই দিন পর, পরবর্তী মঙ্গলবার, দিনটা ভাল বলে, খুব সকালে তারা দুইজন সত্যি রওনা হয়; আমাদের বিশ্বাস হতে চায় না, কিন্তু তারা কাঁধে এয়ার ব্যাগ ঝুলিয়ে রিঙ্া চেপে মহল্লা থেকে বের হয়ে যায়, এবং যখন সত্যি তারা যায়, আমরা তিন/চার দিন পর তাদের প্রত্যাবর্তনের আশা করি, আমরা বলি, হয়তো পাঁচ/সাত দিনও লাগতে পারে,—কিন্তু সেদিন রাতেই তারা মহল্লায় ফিরে আসে। পরে আমরা আব্দুল করিম এবং দুলাল মিঞার কাছ থেকে এই ভ্রমণ বৃত্তান্ত শুনি।

দুলাল মিঞা বলে যে, সেদিন সকালে মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছার পর, তারা প্রথমেই এক সমস্যার মধ্যে পড়ে; কারণ, তারা দেখে যে, ফুলবাড়িয়া যাওয়ার দুই রকমের বাস রয়েছে, তারা চাইলে ময়মনসিংয়ের বাসে করে ময়মনসিং যেতে পারে, সেখান থেকে ফুলবাড়িয়া; অথবা তারা সরাসরি ফুলবাড়িয়ার বাস ধরতে পারে। কিন্তু আমরা, মহল্লার লোকেরা, তাদের সঙ্কটের বিষয়টি বুঝতে পারি না, আমরা বলি, এইটা কুনো কথা, তরা ফুলবাইড়া যাবি, ফুলবাইড়ার ডাইরেক্ট বাসে যাবি। কিন্তু দুলাল মিঞা বলে, শেফালি আব্দুল করিমকে যে ঠিকানা দেয় তাতে বলা ছিল, ঢাকা মহাখালী থেইকা বাসে চইড়া মৈমনসিং, মৈমনসিং গাঙ্গিণার পাড় থেইকা ফুলবাইড়ার বাসে কইরা ফুলবাইড়া। এ কথা শুনে সমস্যার প্রকৃতিটা আমরা বুঝতে পারি, এবং দুলাল মিঞা বলে যে, আব্দুল করিম শেফালির দেয়া নির্দেশনা অনুসরণের সিদ্ধান্ত নেয়, তারা ময়মনসিংয়ের বাসে চেপে বেলা বারটার সময় ময়মনসিং পৌঁছায়; তারপর গাঙ্গিণার পাড়ে বাস বদল করে যখন ফুলবাইড়ার মুড়ির টিন বাসে চড়ে তাদের খুব খিদে পায় কিন্তু বাস ছেড়ে দেয়ার উপক্রম করায় তারা আপাতত ভাত খাওয়ার ইচ্ছা ত্যাগ করে ঝাল মুড়ি কিনে খায়। ময়মনসিং থেকে রওনা হওয়ার দুই ঘণ্টা পর তারা ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছায়, দুলাল মিঞা বলে যে, এর পর তাদের আসল সঙ্কট শুরু হয়, কারণ, তারা কিছুই খুঁজে বের করতে পারে না, কেবল একটি মেয়ের নাম ছাড়া মনে হয় আব্দুল করিমের আর কিছুই জানা ছিল না, কিন্তু কেবল একটি মেয়ের নাম কি কাউকে জিজ্ঞেস করা যায়? বলা যায়, আপনেরা শেপালিরে চিনেন, অগো বাড়ি কুন দিকে?—বলা যায় না, ফলে, দুলাল মিঞা তার উপর ক্ষেপে।

দুঃমিঞা : তুমার মত এমুন ভোদাইতো হালায় আমি জিন্দেগিতে দেখিনিকা!

আঃকঃ : ক্যালা, এই কতা কচ ক্যালা?

দুঃমিঞা : নাম ছাড়া আর কিচ্ছু জান না, তুমি খুঁইজা বাইর করবা কেমনে এই শেপালিরে?

আঃকঃ : তুই আইলি ক্যালা? তরে আমি আইবার কইছিলাম!

দুঃমিঞা : আমি কি জানি নিহি যে, তুমি এমুন কাম কইরা রাখচো, নাম ছাড়া কিচ্ছু জান না!

কিন্তু দুলাল মিঞা বলে যে, তার কথায় আব্দুল করিম বিচলিত হয় না; সে বলে, দেখ না কেমনে বাইর করি! তারা তখন বাসস্ট্যান্ডের একটা চায়ের দোকানে বসে চা খায়, হয়তো শিঙ্গাড়া বা নিমকিও, কারণ, আব্দুল করিম তাকে বোঝায় যে, শেফালিদের বাড়ি গিয়েই এখন তারা খেতে পারবে। তখন দুলাল মিঞা এই চায়ের দোকানে বসে শেফালির বাড়ির ঠিকানা লেখা কাগজটা প্রথম দেখে, সে আমাদেরকে বলে, এমুন ঠিকানা হালায় আমি বাপের জন্মে দেখিনিকা; তখন তার কথা শুনে আমাদের মনে হয় যে, এমন অদ্ভুত বিষয় আমরাও কখনো শুনি নাই। কিন্তু দুলাল মিঞা অনেক কথা ঠিকমত বলতে পারে না, তখন আমাদের মনে হয় যে, শেফালির ঠিকানা লেখা আব্দুল করিমের কাগজটা আমাদের দেখা দরকার; ফলে আমরা তখন আব্দুল আজিজ ব্যাপারির শরণাপন্ন হই এবং তাকে বলি, আমরা কইলে আমাগো কথা হুনবো না, আপনেতো অরে ডাইলপুরি খাওয়ান, অরে কন আমাগো কাগজটা দেখাইতে। আব্দুল আজিজ ব্যাপারি আমাদের দাবির যৌক্তিকতা সম্পর্কে একমত হন এবং জানান যে, এ রকম একটি কাগজ আমাদের অবশ্যই দেখতে পারা দরকার এবং তিনি তার ব্যবস্থা করবেন। পরে আব্দুল আজিজ ব্যাপারি কাগজটা সংগ্রহ করে এবং আমরা সেটা দেখতে পাই; সে তখন আমাদেরকে বলে, পোলাটা খারাপ না, পরথম কইছিল যে কাগজটা নাইকা, ফালায়া দিছে, কিন্তু আমি যখন কইলাম, আমি তুমার বাপের বন্দু আমার কথা হুনবা না? তখন আয়া কাগজটা দিয়া গেল, কইলো, লন এইটা আপনেরে দিয়া দিলাম! তখন আমরা, ভূতের গলির লোকেরা কাগজটা দেখি।

একটা সাদা কাগজে প্রথমে ঠিকানা লেখা ছিল :

মোছাঃ শেপালি বেগম

ফুলবাইড়া
মৈমনসিং

এরপর ছিল পথের নির্দেশ :

ঢাকা মহাখালী বাসস্ট্যান
মৈমনসিং শহর, গাঙ্গিনার পাড়

গাঙ্গিনার পাড়—আকুয়া হয়া ফুলবাইড়া বাজার, থানার সামনে উল্টা দিকে হাঁটলে বড় এড়াইচ গাছের (কড়ই গাছ) সামনে টিএনউ অপিস টিএনউ অপিস সামনে রাইখা খাড়াইলে, বাম দিকের রাস্তা—নাক বরাবর হাই স্কুল ছাড়ায়া বরাবর সুজা, ধান ক্ষেত, কাঁটা গাছ, লাল মাটি, বামে মোচড় খায়া নদী

আহাইলা/আখাইলা/আখালিয়া নদী

নদী পার হয়া ব্রিজ পিছন দিয়া খাড়াইলে
দুপুর বেলা যেদিকে ছেওয়া পড়ে তার উল্টা দিকে,
ছেওয়া না থাকলে, যেদিকে হাঁটলে পায়ের তলায় আরাম লাগে সেই দিকে নদীর পাড় বরাবর এক মাইল হাঁটলে দুইটা নাইরকল গাছ দুই নাইরকল গাছের মইদ্দে খাড়ায়া গ্রামের দিকে তাকাইলে
তিনটা টিনের ঘর দেখা যাইব
তিনটা ঘরের একদম বাম দিকের ঘরের পাশ দিয়া যে রাস্তা গেছে সেই রাস্তা ধইরা
আগাইলে চাইর দিকে ধান ক্ষেত, পায়ে হাঁটা আইলের রাস্তা দূরে চাইর দিকে আরো গ্রাম
ক্ষেতে পাকা ধান যেদিকে কাইত হয়া আছে, সেই দিকে, অথবা, যুদি ধানের দিন না হয়,
যেদিকে বাতাস বয় সেই দিকে গেলে পাঁচটা বাড়ির ভিটা দেখা যাইব,
তিনটা ভিটা সামনে দুইটা পিছনে,
পিছনের দুইটা বাড়ির ডালিম গাছওয়ালা বাড়ি।

দুলাল মিঞা বলে, এই হালার মাতারি এত কথা কইছে, কিন্তু বাপের নাম, গ্রামের নাম, কিছু দেয় নাইকা; কিন্তু সে বলে যে, তারপরেও ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডে চায়ের দোকানে বসে যখন ঠিকানার এই বর্ণনা দেখে সে চমৎকৃত হয় এবং আব্দুল করিম তার দিকে তাকিয়ে বলে, ঠিকানা ঠিক আছে না? দুলাল মিঞা আমাদেরকে বলে, তার তখন মনে হয়, ঠিকানা হয়তো ঠিক আছে, হয়তো দুই নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে তাকালে শেফালি বেগমদের গ্রাম দেখা যাবে, হয়তো ডালিম গাছ তলায় শেফালি বেগম উদয় হবে এবং আব্দুল করিমের মুখের দিকে তাকিয়ে বলবে, আইছুন, চিন্না আইবার পারলাইন, আহুইন! কিন্তু ধান গাছের শুয়ে থাকা এবং সূর্যের ছায়া দেখে পথ ঠিক করার প্রসঙ্গে সে বিভ্রান্ত বোধ করে, তার মনে হয় যে, এমন ঠিকানার কথা সে জীবনে শোনে নাই, তবে, তবু সে বুঝতে পারে যে, কিছুই না থাকার চাইতে হয়তো এ অনেক ভাল; এবং সে আব্দুল করিমের কথা শুনে বলে, হঁ ঠিক আছে, অখনে খুঁইজ্জা পাইলে হয়!

তখন ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে তারা আর একবার শুরু করে, পাকা রাস্তা ধরে আলিয়া মাদ্রাসা পার হয়ে, কলেজের সামনে তারা ঝাঁকড়া প্রাচীন কড়ুই গাছের তলায় এসে হাজির হয়, এই গাছের সামনেই টিএনও-র অফিস বিল্ডিং; তারা পুরনো দিনের অভিযাত্রীদের মত কাগজে লেখা পথনির্দেশ অনুসরণ করে এগোয়; টিএনও-র অফিসের দিকে মুখ করে দাঁড়ালে তারা দেখে যে, একটি হেরিংবোন ইটের রাস্তা এই অফিসের সীমানা দেয়াল ঘেঁষে বাঁ দিক দিয়ে চলে গেছে, দুই ধারে পাকা ধানের জমি, এই পথ ধরে এগিয়ে তারা এক চৌমাথায় পৌঁছায়, তখন ডান দিকে রোদের ভেতর কাত হয়ে থাকা সোনালী রঙের আমন ধানের বিস্তীর্ণ মাঠের পরে তারা একটা সাদা রঙের দালান দেখতে পায়, তাদের মনে হয় যে, এটা হয়তো হাইস্কুল হবে, কিন্তু এতদূর থেকে বুঝতে না পেরে তাদের মনে হয় যে, তারা কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারে, ভাই অইটা কি ইস্কুল? কিন্তু কোন লোক না পেয়ে তারা কাগজটা আবার পড়ে, হাইস্কুল ছাড়ায়া সুজা, এবং তারা বুঝতে পারে যে, তারা যে পথে এসেছে সে বরাবর সোজা হবে; তখন তারা চৌরাস্তা পার হয়ে মেঠো পথে পড়ে, এই রাস্তা ধরে কিছুক্ষণ এগোনোর পর তারা দেখে যে, মাটির রঙ এখানে লাল হয়ে উঠেছে, রাস্তার দুই পাশ ফণিমনসার ঝোপে পূর্ণ হয়ে আছে এবং তারা বুঝতে পারে যে, তারা ঠিক পথেই আছে এবং সহসাই তারা এই পথের মোচড় পার হয়ে আখালিয়া নদীর পাড়ে গিয়ে হাজির হয়। আমরা দুলাল মিঞার কাছ থেকে জানতে পারি, তারা তাদের সামনে সংকীর্ণ কিন্তু খাড়া এবং গভীর একটি নদী খাত দেখতে পায়, নদীর তলদেশ তখন ছিল প্রায় শুকনো, পানির একটি ক্ষীণধারা অতিকষ্টে টিকে ছিল। দুলাল মিঞা বলে যে, নদী পেয়ে যাওয়ায় তার উৎসাহ বাড়ে, কারণ, সে বলে যে, নদী হচ্ছে এমন এক বস্তু যা দেখলে সব সময় মনে হয়, কোথাও এসে পৌঁছলাম।

আমরা জানতে পারি যে, গজারি গাছের খুঁটি এবং তক্তা দিয়ে তৈরি একটা চওড়া সাঁকো সমর্থ সম্ভোগরত প্রেমিকের পিঠেরমত ঈষৎ বাঁকা হয়ে নদীর দুই পাড়ের লাল মাটি স্পর্শ করে পড়ে ছিল; সেই দুপুরে অথবা দুপুরের পর দুলাল মিঞার পিছনে আব্দুল করিম আখালিয়া নদীর সাঁকোর ওপর উঠে আসে। দুলাল মিঞা বলে যে, নদীর অন্য প্রান্তে পৌঁছে তারা যখন পুনরায় পাড়ের ওপর অথবা সাঁকোর কিনারায় দাঁড়ায় তারা দেখে যে, তাদের ছায়া দেহের মায়া ত্যাগ করে দূরে যেতে চায় না, পায়ের নিচে পোষা কুকুরের মত শুয়ে থাকে। দুলাল মিঞা বলে, ছায়া দেখে যখন এগোনোর উপায় থাকে না, তারা দ্বিতীয় নিয়মটি অনুসরণ করতে চায়; তখন আব্দুল করিমের এই রকম মনে হয় যে, কোন দিকে হাঁটলে আরাম লাগবে সেটা বুঝতে হলে পায়ের জুতা খুলে ফেলা দরকার; সে দুলাল মিঞাকে বলে, খাড়া আমি খুলতাছি, তর খুলোন লাগব না। দুলাল মিঞা আমাদেরকে বলে যে, এই জুতা খুলতে গিয়েই সমস্যা দেখা দেয়, আব্দুল করিম সাঁকোর কাঠের রেলিঙের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে একটু কুঁজো হয়ে ডান পায়ের হাঁটু ভেঙে পা উঁচু করে জুতার ফিতা খোলার চেষ্টা করে, এবং ভুল প্রান্ত ধরে টেনে ফিতায় গিঁট লাগিয়ে ফেলে; তারপর টানাটানি করার ফলে গেরোটা বিষ গেরো হয়ে দাঁড়ায়। সে এবার হাঁটু গেড়ে এক পায়ের উপর বসে কিছুক্ষণ ফিতা ধরে টানাটানি করে, নখ দিয়ে খুঁটে খোলার চেষ্টা করে, এবং অনেক পরিশ্রমের পর সে যখন ফিতার জট শেষ পর্যন্ত খুলতে পারে তখনই সমস্যাটা দেখা দেয়। সে ঘাড় তুলে দুলাল মিঞার দিকে তাকায়; দুলাল মিঞা আমাদেরকে বলে, আমি ভাবলাম যে বোধহয় ঘাড় সুজা করবার লাগাইছে। কিন্তু আমরা দুলাল মিঞার কাছ থেকে জানতে পারি যে, ব্যাপারটা আসলে তা ছিল না, আব্দুল করিম উপরের দিকে তাকিয়ে যা বলে তাতে দুলাল মিঞা প্রথমে বিভ্রান্ত বোধ করে তারপর তার মেজাজ খারাপ হয়, কারণ, আখালিয়া নদীর সাঁকোর কাঠের পাটাতনের উপর এক পায়ের উপর বসে থেকে দুলাল মিঞার মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলে, ল দুলাইলা, যাইগা।

দুঃমিঞা : কী কও!

আঃকঃ : ল ফিরা যাই।

দুঃমিঞা : ক্যালা?

আঃকঃ : এমনেই, ল যাইগা।

দুঃমিঞা : অহনে এই কথা কও, আইলা ক্যালা!

আঃকঃ : আইলাম, ল অখন যাইগা।

দুঃমিঞা : আমারে আনলা ক্যালা?

আঃকঃ : তুই আইলি ক্যালা!

আমরা দুলাল মিঞার কাছ থেকে শুনি যে, এরপর আব্দুল করিম তার জুতার ফিতা পুনরায় বেঁধে উঠে দাঁড়ায় এবং দুলাল মিঞার সকল প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে ফিরতি পথ ধরে, বস্তুত তারা হয়তো কখনোই আখালিয়া নদী অতিক্রম করে নাই; এবং দুলাল মিঞাকে বাধ্য হয়ে তার পিছনে আসতে হয়। তখন দুলাল মিঞা ফিরে যাওয়ার আগে বাজারে গিয়ে জিনিসপত্রের দরদাম যাচাই করে দেখার কথা বলে, কিন্তু আব্দুল করিম কিছু শোনে না, নদীর সাঁকোর উপরে তার কী হয়, সে বলে যে, প্রথমে তারা বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে ফিরতি বাসের খোঁজ করবে, কারণ, তাদের ঢাকা যাওয়ার শেষ বাস ধরতে হবে, তারপর সময় পেলে তারা বাজার ঘুরে দেখতে পারে। কিন্তু সেদিন তাদের ফুলবাড়িয়া বাজার ঘুরে দেখা আর হয় না, হয়তো সব ডাল, সব চাল, আলু এবং গুড় নিয়ে দোকান অথবা হাটের লোকেরা প্রতীক্ষায় থাকে, কিন্তু আব্দুল করিম এবং দুলাল মিঞার সময় হয় না। তারা যখন টিএনও অফিসের সামনে পৌঁছায় তারা একটু দূরে কলেজের সামনে একটি বাস দেখতে পায়, বাসের হেলপার চিৎকার করে, ওই ঢাকা ঢাকা, লাস্ট বাস লাস্ট বাস, ছাইড়া গেল ছাইড়া গেল; দুলাল মিঞা বলে যে, তখন তাদের দৌড়ে গিয়ে এই বাস ধরা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না।

ভূতের গলির লোকেরা পরে বলে যে, তাদের জানা ছিল আব্দুল করিম এরকমই কিছু একটা করবে, তারপর তারা আব্দুল করিমের কথা পুনরায় ভুলে যায়; কিন্তু মহল্লায় আব্দুল আজিজ ব্যাপারি ডালপুরি খাওয়ার অভ্যাস বাদ দিতে পারে না, সে কখন কখন ডাল অথবা আলুপুরি কিনে আনে, এবং যখন আব্দুল করিমকে দেখে তাকে কখনো পুরি খেয়ে যাওয়ার কথা বলে, আহো ডাইলপুরি খায়া যাও, তখন আব্দুল করিম তার বাড়ির বৈঠকখানায় বসে ডাল অথবা আলুপুরি খায়, এবং বলে, হালারা আলু দিয়া ডাইলপুরি বানায়!

——————০——————-

** এই পোস্ট টি আমাদের সম্মানিত মুরুব্বী কে উৎসর্গ করা।

আগারগাঁও কলোনিতে নয়নতারা ফুল কেন নেই

আগারগাঁও কলোনিতে নয়তারা ফুল কেন নেই সে কথা কে বলতে পারে? হয়ত সেখানে নয়ততার ফুল আছে অথবা অন্যকোন ফুল আছে। এতদিনে হয়ত কলোনিটাই নাই। এতকথা কে বলতে পারে? কত লোকেইতে আগারগাঁও থাকে, কিন্তু এইসব খবর বলতে পারে কেবল ভূতের গলির, দক্ষিণ মৈশুন্দির শহীদুল জহির। শুধু আগারগাঁও কলোনির খবর না শহীদুল আরো খবর দিবেন ‘ডুমুর খেকো মানুষ’, ‘ডলু নদীর হাওয়া’ এইসবের। কোথায় পাব তারে – সেই খবরও আপনি পাবেন শহীদুল জহিরের কাছে। অবশ্য যদি আপনি এইসব জানতে চান। শব্দনীড়ের ব্লগারদের যে অবস্থা তাতে কেউ শহীদুল জহিরের কাছে কোন খবর চাইবেন তা বিশ্বাস করা কষ্ট। তবুও বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর এই ভেবে মনেকরি শব্দনীড়ের অনেকেই হয়ত শহীদুল জহিরকে চেনেন।

১৯৫৩ সালে জন্মের পর ২০০৮ সালে মৃত্যুর আগে তিনি ‘ডুলু নদীর হাওয়া, কোথায় পাব তারে, আগার গাঁও কলোনীতে নয়নতারা ফুল কেন নেই, পারাপার, ডুমুরখেকো মানুষ, ইন্দুর বিলাই খেলা, ঘেয়ো রোদের প্রার্থনা নিয়ে, আমদের কুটির শিল্পের ইতিহাস, কাঠুরে ও দাঁড়কাক এইরকম আরো অনেক গল্প লিখেন। জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা, সে রাতে পূর্ণিমা ছিল, আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু, মুখের দিকে দেখি এইসব উপন্যাসও তিনি লিখেন।

শহীদুল জহির কেমন লিখতেন? সেটা জানতে হলে তাঁর লিখা পড়তে হবে। আমার ভাল লাগে। তাঁর গল্প বলনের স্টাইল আমার পছন্দ। অন্যান্য গল্পকারের সাথে যে সুন্দর একটা পার্থক্য টেনে নিয়ে আসতে পেরেছেই সেইটাই আমার পছন্দ। অব্যয়ের ব্যবহারের এমন সুন্দর ছন্দময় গতি অন্যান্য লেখকের মাঝে আপনি পাবেন না। কয়েকটা গল্প পড়ে দেখেন কেমন লাগে আপনার।