নিতাই বাবু এর সকল পোস্ট

নিতাই বাবু সম্পর্কে

নিতাই বাবু ২০১৫ সালে তিনি শখের বশে একটা ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করে লেখালেখি শুরু করেন।তিনি লিখতেন নারায়ণগঞ্জ শহরের কথা। লিখতেন নগরবাসীর কথা। একসময় ২০১৭ সালে সেই ব্লগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ব্লগ কর্তৃক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জনাব সাঈদ খোকন সাহেবের হাত থেকে ২০১৬ সালের সেরা লেখক সম্মাননা গ্রহণ করেন। সাথে নগর কথক উপাধিও পেয়ে যান। এরপর সেই ব্লগে লেখালেখির পাশাপাশি ২০১৮ সালের জুলাই মাসে তিনি শব্দনীড় ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করেন। শব্দনীড় ব্লগে উনার প্রথম লেখা "আমি রাত জাগা পাখি" শিরোনামে একটা কবিতা। তিনি চাকরির পাশাপাশি অবসর সময়ে লেখালেখি পছন্দ করেন এবং নিয়মিত শব্দনীড় ব্লগে লিখে যাচ্ছেন।

জীবনের গল্প-২৩

Image-6411-8

জীবনের গল্প-২২ এর শেষাংশ: চিঠিতে জানিয়ে দিলাম, আমি মঙ্গল মতো কলিকাতা পৌঁছেছি। চিঠি পাঠালাম এই কারণে যে, আমার জন্য যেন কোনও প্রকার চিন্তা না করে, তাই। তারপর ঘুরেফিরে কেটে গেল আরও বেশকিছু দিন। আমার চিন্তাও বাড়তে লাগল।

এখন আর কিছুই ভালো লাগছে না। চার-পাঁচদিন পর একদিন সকালবেলা কানাই বলল, ‘চল দুইজনে টাউনে গিয়ে ঘুরে আসি।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় যাবি?’ কানাই বলল, ‘আজ তোকে মেট্রো ট্রেনে চড়াব। আর সময় পেলে হাওড়া, তারামণ্ডলও দেখাবো।’

এ তো খুশির খবর! কিন্তু খুশির বদলে আমার কান্না আসতে লাগল। চিন্তা শুধু একটাই, তা হলো এখানে আসলাম বেশ কিছুদিন হয়ে গেল। অথচ কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না, হচ্ছে শুধু টাকা খরচ। এভাবে ঘুরে বেড়ালে কি হবে? আমার তো কিছু একটা করতে হবে। ভাবছি, কানাইর সাথে যাব কি যাব না! না গেলেও হয় না। শেষমেশ জামাকাপড় পড়ে কানাইর সাথে বের হলাম।

কানাইর বাসা থেকে একটা রিকশায় চড়ে গেলাম ধর্মতলা। এই ধর্মতলায় কোলকাতা শহরের বড় একটি বাসস্ট্যান্ডও আছে। আছে কোলকাতার বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার ট্রাম ও বাস সার্ভিস। রিকশা থেকে নেমে একটা চা দোকানে গিয়ে চা-বিস্কুট খেলাম। দোকান থেকে বের হয়ে ফুটপাতের দোকান থেকে সিগারেট কিনলাম। আমি সিগারেট জ্বালিয়ে টানছি আর হাঁটছি। এদিক-ওদিক তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখছি। একসময় একটা রাস্তার ফুটপাত দিয়ে হাঁটছি দুইজনে। দুইটা দোকানের মাঝখানে মাটির নিচে যাওয়ার জন্য অনেক চওড়া জায়গা। নিচে যাওয়ার সুন্দর সিঁড়িও আছে। কানাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘নিচে কী?’ কানাই বলল, ‘এটি হচ্ছে কোলকাতা শহরের ভূগর্ভস্থ পাতাল রেলস্টেশন। যাকে বলে পাতাল রেল বা মেট্রো ট্রেন। তাই অনেকে বলে, মেট্রো ট্রেনস্টেশন।’ আমি বললাম, ‘তা হলে আমরা কি এখন এই স্টেশনেই যাচ্ছি?’ কানাই বলল, ‘হ্যাঁ, তোকে তো বাসা থেকে বাইর হবার আগেই বলেছি। চল এখন নিচে স্টেশনের ভেতরে। গেলেই বুঝতে পারবি, পাতাল রেল কাকে বলে!’ সিঁড়ি বেয়ে নিচে গেলাম। স্টেশনের ভেতরকার সৌন্দর্য দেখে অবাকও হলাম!

এই মেট্রো ট্রেন হলো, পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কোলকাতা পরিবহণ সেবার মধ্যে একটি। এটির পরিসেবা কোলকাতা শহরের পার্শ্ববর্তী উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা পর্যন্ত। দ্রুত পরিবহন সেবা প্রদানকারী পরিবহণ ব্যবস্থাও বলা যায়। জানা যায়, কোলকাতা মেট্রো ট্রেনের পথ ২৭.২২ কিলোমিটার। এই ২৭.২২ কিলোমিটার পথে ২৩টি মেট্রো স্টেশন রয়েছে। যার মধ্যে ১৫টি স্টেশন ভূগর্ভস্থ আর বাদবাকিগুলো ভূতলস্থ এবং উড়াল; এই তিন প্রকারেই স্টেশনই রয়েছে। এই পরিবহন সেবা চালু হয়েছিল ১৯৮৪ সালে এবং এটিই ভারতের প্রথম মেট্রো রেল পরিসেবা। এরকম পাতাল রেল সার্ভিস নাকি ভারতের রাজধানী দিল্লিতেও আছে।

আমরা দু’জন নিচের দিকে নামছি, যত নিচে যাচ্ছি ততই সুন্দর। ঝকঝকা আলো আর লোকে লোকারণ্য। স্টেশনের ভেতরে গার্ডের সাথে পুলিশও আছে। তাদের ডিউটি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখা। কে কী করছে, কোথায় যাচ্ছে এগুলো ফলো করা। মূল স্টেশনে প্রবেশ করতে হলে, চাই টিকিট। কম্পিউটারে টিকিট শো করলেই গেইট খুলবে, যাত্রী প্রবেশ করবে। এ ছাড়া আর প্রবেশ করার মতো কারোর সাধ্য নেই। কানাই কাউন্টার থেকে দুটা টিকিট কিনে আনল। আমরা যাব, ধর্মতলা থেকে টালিগঞ্জ। টিকিটের দাম নিল, ৫ টাকা করে ১০ টাকা। দুটো টিকিটই একসাথে, মানে একটা টিকিট। টিকিটের গায়ে লেখা আছে টু ম্যান। ট্রেন আসার সময় হয়েছে। হুইসেল শোনা যাচ্ছে। কানাই বলল, ‘শিগগির আয়।’

আমরা কম্পিউটার সিস্টেম গেইটের সামনে গেলাম। কানাই গেইটের পাশে থাকা বক্সে টিকিট ঢুকাল। টিকিটখানা শোঁ করে বক্সের পেছনে চলে গেল। আমরা গেইট পার হলাম, টিকিটখানা হাতে নিলাম। গেইটখানা ধরে আমি একটু ট্রাই করে দেখলাম! গেইট আর একটুও নড়ে-চড়ে না। টিকিটের গায়ে দুইজন লেখা। ঠিক দুইজন পার হওয়ার পরই গেইট বন্ধ। ট্রেন স্টেশনে এসে থামল। যাত্রিরা ট্রেন থেকে নামল। আমরা ট্রেনে ওঠার জন্য রেডি হয়ে সামনেই দাঁড়িয়ে আছি।

ট্রেন থেকে মাইকে বলছে, ‘টালিগঞ্জ যাওয়ার যাত্রিগণ ট্রেনে ওঠে আসন গ্রহণ করুন।’ আমরা-সহ সব যাত্রী ট্রেনে ওঠে সিটে বসার পর ট্রেন থেকে আবার মাইকিং। বলা হচ্ছে, ‘যাত্রীদের অবগতির জন্য বলা হচ্ছে যে, আপনারা ট্রেনের দরজা ও জানালা থেকে দূরে থাকুন।’

এর পরপরই ট্রেনের সব দরজা ও জানালা একসাথে শোঁ করে লেগে গেল! বুঝলাম, দরজার সামনে যদি কেউ দাঁড়ানো থাকত, তা হলে মৃত্যু অনিবার্য। তাই আগে থেকেই যাত্রিদের হুশিয়ার করে দেওয়া হয়, যাতে কোনও দুর্ঘটনা না ঘটে। ট্রেন ছুটল দ্রুতগতিতে! জানালা দিয়ে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ট্রেন যাচ্ছে মাটির নিচ দিয়ে। কিছু দেখা যাবে কী করে? শুধু একটু শব্দ শোনা যাচ্ছে, শোঁ শোঁ শব্দ। ১০ মিনিটের মতো বসে থাকার পর আবার মাইকিং। বলা হচ্ছে, ‘আমরা টালিগঞ্জ পৌঁছে গেছি! ট্রেন থেকে নামার জন্য প্রস্তুত হোন।’

কানাই বসা থেকে ওঠে দাঁড়াল, সাথে আমিও ওঠলাম। ট্রেন থামল। ট্রেন থেকে আমরা নেমে স্টেশনের বাইরে আসলাম। কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে চা-বিস্কুট খেয়ে তৈরি হলাম, ধর্মতলা আসার জন্য। এবার ট্রামে চড়ে আসব ধর্মতলা। ট্রাম দেখা হবে আর চড়াও হবে। দেখাম ট্রাম! ট্রামে চড়লামও।

ট্রাম হলো কোলকাতা শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন ব্যবস্থা। এটি এ দেশের প্রথম ও একমাত্র পরিসেবা প্রদানকারী ট্রাম। জানা যায়, এটি এশিয়ার প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম পরিবহন ব্যবস্থা। এই ট্রাম পরিসেবা প্রথম চালু হয়েছিল, ১৮৭৩ সালে। শোনা যায়, প্রথমে ঘোড়ার সাহায্যে না-কি ট্রাম চালানো হতো। এই ট্রাম কিন্তু ঝুলন্ত ট্রাম নয়! এ হলো রোড ট্রাম। যা বাস রোডের পাশ দিয়ে চলে। এই ট্রামের চলার রাস্তা হলো রেললাইন। ট্রাম দেখতে হুবহু রেলগাড়ির মতনই। তবে ট্রেনের মতো এত চওড়া নয়, সামান্য চিকন। বগি থাকে দুইটি, ড্রাইভার একজন। কন্ট্রাক্টর একজন। এক বগি থেকে অন্য বগিতে যাওয়া যায়। যাত্রী যেখানে খুশি, সেখানেই ওঠানামা করতে পারে। এই রোড ট্রামও চলে বিদ্যুতের সাহায্যে। তবে চলে আস্তে-আস্তে।

ট্রামে চড়ে আসলাম ধর্মতলা। এবার যাব রানী ভিক্টোরিয়া পার্কে। এই ভিক্টোরিয়া পার্কটি ছিল যুক্তরাজ্য ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাণীর নামে। রানী ভিক্টোরিয়া ১ মে ১৮৭৬ সালে ভারত সম্রাজ্ঞী উপাধি ধারণ করেন। তার স্মৃতিকে ধরে রাখতেই, তার নামে ‘রানী ভিক্টোরিয়া’ পার্ক নির্মাণ করেন ভারত সরকার। পার্কটি খুবই সুন্দর! পার্কের মাঝখানে আছে রানী ভিক্টোরিয়া ভাস্কর্য। প্রতিদিন বিকালবেলা এই পার্কটিতে থাকে লোকে লোকারণ্য। পার্কের গেটের সামনে বসে হরেকরকমের দোকান। যেন আমাদের দেশের এক বৈশাখী মেলার মতো। দেখলাম ভিক্টোরিয়া পার্ক। রানী ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে বাইর হলাম সন্ধ্যার একটু আগে। এ দিন তারামণ্ডল দেখার আর সুযোগ হল না। চলে এলাম কানাইর বাসায়। কানাই বলল, ‘আজ যখন তারামণ্ডল দেখা হল না, তা হলে আগামীকাল দেখব।’

রাতের খাবার খেয়ে দুইজনে শুয়ে রইলাম। পরদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠলাম। তখন মনে হয় বেলা ১০ টার মতো বাজে। ঝটপট দুইজনে স্নান করে খাওয়া-দাওয়া করলাম। দিনটি ছিল রবিবার। ভারতের সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তাড়াতাড়ি না গেলে, তারামণ্ডল আজও দেখা হবে না। কারণ, ছুটির দিনে তারামণ্ডলে লোক অনেক বেশি হয়। কানাই আমাকে নিয়ে বের হলো তারামণ্ডল দেখানোর জন্য। এটি হলো দক্ষিণ কোলকাতার জওহরলাল নেহেরু রোডে। এর পাশে আছে, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল। এটি হলো মহাকাশচর্চা কেন্দ্র ও প্ল্যানেটরিয়াম জাদুঘর। নাম রাখা হয়েছে, এমপি বিড়লা তারামণ্ডল। এই তারামণ্ডলটি সাঁচীর বৌদ্ধ স্তুপের আদলে নির্মিত, একটি একতলা ভবনে অবস্থিত। শোনা যায়, এই প্ল্যানেটরিয়ামটি এশিয়ার বৃহত্তম প্ল্যানেটরিয়াম। এটি ছাড়াও নাকি ভারতে আরও দুটি তারামণ্ডল আছে। একটি চেন্নাইতে, অপরটি হায়দ্রাবাদে অবস্থিত।

আমি যখন ভারতে গিয়েছিলাম, তখন তারামণ্ডলের ভেতরে যাওয়া বাবদ প্রবেশ মূলা ছিল ২টাকা। তারামণ্ডলের ভেতরে গেলাম। দেখলাম তারামণ্ডল। ভেতরে যাবার পর আমার মনে হচ্ছিল যে, আমি যেন মহাকাশে ভাসমান অবস্থায় আছি! ইউটিউবে বা টিভিতে যেভাবে মহাকাশের দৃশ্য দেখি, ঠিক সেই ভাবেই দেখছি!

তারামণ্ডল থেকে বাইর হলাম দুপুরবেলা। দুপুরের খাবারের সময় হওয়াতে গেলাম এক হোটেলে। ভাত মাছ আর মুগের ডাউল দিয়ে পেট ভরে ভাত খেলাম। দুইজনের খাবারের বিল হলো, ৩০ টাকা। হোটেল থেকে বাইর হয়ে আমি কানাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এবার কোথায় যাবি?’ কানাই বলল, ‘জীবনে তো হাওড়া ব্রিজের অনেক কেচ্ছা-গিবত শুনেছিস! এবার বাস্তবে দেখে যা।’ বললাম, ‘চল, হাওড়া ব্রিজটা দেখি!’

সেখান থেকে ট্রামে চড়ে গেলাম, হাওড়া। হাওড়া ব্রিজের সামনে যাচ্ছি পায়ে হেঁটে। ব্রিজে ওঠতেই আমার চোখে পড়ল, ব্রিজে লাগানো একটা সাইনবোর্ডের দিকে। সাইনবের্ডের লেখা আছে, এই ব্রিজটির নির্মাণকাল ও কিছু নির্দেশনা। ব্রিজটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব রক্ষার জন্যও জনগণের প্রতি অনুরোধ করা হয়েছে।

জানা যায়, হাওড়া ব্রিজটি উনিশ শতকের অন্যতম নিদর্শনের একটি। এটি হুগলি নদীর উপর অবস্থিত। এটি কোলকাতা ও হুগলি শহরের মধ্যে সংযোগরক্ষাকারী সেতু। এই হাওড়া ব্রিজ ছাড়াও হুগলি নদির উপর আরও ব্রিজ আছে। সেগুলির মধ্যে এই হাওড়া ব্রিজ হলো অন্যতম। এটি এশিয়া মহাদেশের মধ্যে একমাত্র ভাসমান সেতু। ব্রিজটি সম্পূর্ণ লোহার এঙ্গেল ও নাট-বল্টু দ্বারা তৈরি। এর মাঝখানে কোনও পিলার বা খুঁটি নাই। দেখে মনে হয় এটি যেন মাধ্যাকর্ষণের শক্তিতে ঝুলেছে। ব্রিজটি নির্মাণের পর একবার এক স্টিমারের নোঙর ছিঁড়ে ব্রিজের সাথে সংঘর্ষ হয়। এর ফলে ব্রিজটির মাঝখানের বেশকিছু অংশ বিধ্বস্ত হয়। এরপর ১৯৭৪ সালে ব্রিজটি পুনঃনির্মাণ করে যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

এই হাওড়া ব্রিজটির বিজ্ঞপ্তি নোটিশে লেখা আছে, ব্রিজটি ১,৫২৮ ফুট দীর্ঘ। এর প্রশস্ত লেখা না থাকলেও বোঝা যায়, ব্রিজটি প্রশস্ত ৫০ থেকে ৬০ ফুট হবে। ব্রিজটির মাঝখানে আছে যানবাহন চলাচলের জায়গা। দুই পাশে মানুষ চলাচলের জন্য ৬ থেকে ৭ ফুট প্রশস্ত রাস্তা। আমি কানাইর সাথে যখন ভারত গিয়েছিলাম তখন ১৪০০ বঙ্গাব্দ, ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দ। দেখলাম ব্রজিটিতে তখন কোনও ভারি যানবাহন চলাচল করে না। এর মূল কারণ হল, ব্রিজটি মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে তাই। এটি কোনও একসময় বিধ্বস্ত হয়ে যাবে বলে ভারতের বড় বড় প্রকৌশলী ইঞ্জিনিয়ারদের ধারণা। তাই ভারত সরকার ব্রিজটির পাশে আরেকটি ব্রিজ তৈরি করে রাখে। সেই ব্রিজটি ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের নামে নামকরণ করে রাখা হয়, বিদ্যাসাগর সেতু। হাওড়া ব্রিজ থেকে একটু ডানদিকে তাকালেই বিদ্যাসাগর সেতুটি দেখা যায়। কানাই বলল, ‘তোকে যদি রাতের বেলা এখানে আনতে পারতাম, তাহলে আরও ভালো লাগত। এখানে দাঁড়িয়ে বিদ্যাসাগর সেতু যেভাবে দেখছিস, রাতে আরও সুন্দর দেখায়। তখন মনে হয় না যে, আমরা ভারত আছি। মনে হয় ইউরোপের কোনও এক শহরে দাঁড়িয়ে আছি!’

দেখলাম হাওড়া ব্রিজ! পায়ে হেঁটে গেলাম ওপারে, আবার আসলামও পায়ে হেঁটে। তখন সূর্যটা ঢুববে ঢুববে মনে হচ্ছিল। ভাবছিলাম, আরেকটু দেরী করে রাতের সৌন্দর্যটা উপভোগ করি। কিন্তু তা আর হল না কানাইর জন্য। ও আমাকে সিনেমা দেখাবে, তাই তাড়াতাড়ি করে ট্রামে ওঠল। যাবে টালিগঞ্জ। সেখানে গিয়ে শাহরুখ খান অভিনীত “বাজিগার” ছায়াছবি দেখাবে।
চলবে…

জীবনের গল্প-২৪ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

ভয় যতো ভয়

602757_n

এখন আর রাত-বিরেতে অন্ধকারে–
রাস্তায় চলতে করে না তেমন ভয়!
কারণ আগের মতো চোর-ডাকাত–
এখন আর তেমন নেই, সব লোকে কয়!

ভয় যতো ফেসবুক নিউজফিডে–
ফেসবুক ব্যবহারকারীর টাইম লাইনে,
একটা স্ট্যাটাস ও একটা মন্তব্যের জেরে–
কতো পরিবার শেষ হচ্ছে দিনে-দিনে!

ধর্ম অবমাননার গুজব রটিয়ে–
মাইক বাজিয়ে প্রতিবাদ করে,
দলেদলে মিছিল করে দিনে-রাতে–
তারপর আগুন জ্বালায় ঘরে ঘরে।

তাই করে ভয়, মনে হয়–
ফেসবুক বুঝি এখন নিরাপদ নয়!
কার পোস্টের লাইক/কমেন্টের জেরে–
কখন যেন কী হয়! ভয় যতো ভয়!

লেখাপড়া

123953453_32

লেখাপড়ার হয়না কোনও শেষ,
জীবনের শেষপ্রান্তেও পড়া যায় তো বেশ!
জীবন যাঁদের পড়ার মাঝে,
লেখার মাঝেই গড়ে তাঁরা সোনার দেশ!
পড়তে পড়তে হয় বিদ্বান,
লিখতে লিখতে হয় লেখক আর কবি!
তাঁদের লেখাই জেগে ওঠে,
জনতার প্রাণ ও আমার জন্মভূমির ছবি!

জীবনের গল্প-২২

Image-6411-8

জীবনের গল্প-২১ এর শেষাংশ: সব টাকা বাইর করার দরকার নেই। কোনও বাটপার দেখলে তোর পেছনে লাগবে। ভারতের বাড়ি, টাকার খুব দাম!’ আমি কানাইর কথামত কিছু টাকা সামনের পকেটে রাখলাম। আর বাদবাকি টাকা প্যান্টের ভেতরের পকেটে রাখলাম। ভগবানকে ডাকতে ডাকতে গেলাম গেইটের বাইরে।

স্টেশনের বাইরে গিয়ে চা-বিস্কুট খাচ্ছিলাম, এমন সময় ট্রেনের হুইসেল শোনা যাচ্ছিলো। ট্রেনের হুইসেল শুনে আমার বুকের ভেতরে কামড়া-কামড়ি শুরু করেছিলো। কখন আমি স্টেশনের ভেতরে যাব, সেই চিন্তায় আমার চা-বিস্কুট খাওয়া শেষ। ঝট-পট দোকানদারকে চা-বিস্কুটের দাম দিয়ে দৌড়ে চলে গিয়েছিলাম স্টেশনের ভেতরে। ভেতরে যাবার পর কানাই জিজ্ঞেস করলো, ‘কী খেয়েছিস? এতো ঝট-পট চলে এলি যে?’ কানাইর কথা শুনে আমি বললাম, ‘আরে ভাই, আমিতো ট্রেনের হুইসেল শুনেই চলে এলাম। তুই না একবার বলেছিস– ইলেক্ট্রিক ট্রেন, হুইসেল দিতে দেরি ছুটতে দেরি নেই! সেই কথায় আমি কোনোরকম খেয়ে দৌড়ে চলে এলাম।’ কানাই হেসে বলল, ‘ট্রেনের ইঞ্জিন ঘুরিয়ে সামনে নিয়ে লাগাবে। এই জন্যই হুইসেল দিয়েছিল। ইঞ্জিন ঘুরিয়ে লাগানোর পর ট্রেন ছাড়বে। ট্রেন ছাড়ার আগে মাইকেও বলে দিবে। আর মাইকে বলা কথাগুলো বাইরে থেকেও শোনা যাবে। এখন চল, ট্রেনে ওঠে সবাই বসে পড়ি।’ আমি তখন হাঁফাতে হাঁফাতে বললাম, ‘ওহ-হো, এই খবর? আমিতো মনে করেছিলাম ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে! তাই চা-বিস্কুট ফেলে রেখে চলে এলাম। চল চল ট্রেনে উঠে বসে পড়ি।’ তারপর সবাই হাসতে হাসতে কানাইর দু’বোন-সহ ট্রেনে উঠে বসলাম। আমি এর আগেও নাম শুনেছিলাম ইলেক্ট্রিক ট্রেন। কিন্তু কোনও দিন চড়িনি। এই ট্রেন আমাদের দেশের সাধারণ ডিজেল চালিত ট্রেনের মতনই। কিন্তু বিদ্যুতের সাহায্যে চলে। যা ১৯০০ সালের প্রথমদিকে ভারতবর্ষে আবির্ভাব হয়েছিল।

এর আগে একসময় পাথর কয়লা দ্বারা এই রেলগাড়ি চালানো হতো। এতে যেমন ছিলো ব্যয়বহুল খরচ, তেমন হতো আবার পরিবেশ দূষণ। পরিবেশ দূষণের কারণ হলো, এই কয়লা চালিত রেলগাড়ি চলাচলের সময় রেলগাড়ির ইঞ্জিন থেকে প্রচুর পরিমানে সাদা-কালো ধুয়া বের হতো। এতে রেললাইনের আশে-পাশে থাকা গাছগাছালি-সহ স্থানীয় কৃষকদের ফসলী জমির ফসলের ব্যপক ক্ষতি হতো। একসময় পরিবেশবাদীরা পরিবেশ দূষণ হচ্ছে বলে রেলগাড়ির ধূয়াকে দায়ী করেছিল। তারা মতপ্রকাশ করেছিল, “পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে হলে, ইঞ্জিন থেকে বাইর হওয়া ধূয়া বন্ধ করা জরুরি।” তাদের এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই আবিষ্কার করা হয় ডিজেল চালিত রেল ইঞ্জিন। এতেও খরচ তেমন বাঁচাতে পারেনি! আবার পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর রেলের কালো ধূয়াও তেমন বন্ধ করতে পারছিল না। এরপর অনেক বছর চেষ্টার বিনিময়ে তৈরি করা হয়, বিদ্যুৎ চালিত ট্রেন।

তবে তখনও বিশাল ভারতে বৈদ্যুতিক ট্রেনের পাশা-পাশি ডিজেল চালিত ইঞ্জিনও অনেক ছিলো। ছিলো টু-ইন-ওয়ান সিস্টেম ট্রেন ইঞ্জিন। মানে একটা ট্রেন ইঞ্জিনে ডিজেল ও বিদ্যুৎ দুটোই থাকতো। আরও সহজ করে বললে বলা যেতে পারে– একটা ট্রেন ইঞ্জিন ডিজেলেও চলতো, আবার বিদ্যুতেও চালানো যেতো। এই ইঞ্জিনগুলো দূরপাল্লায় যাতায়াতের ট্রেনগুলোতেই বেশি ব্যবহার করা হতো।

যাইহোক, আমার ওই প্রথমই বৈদ্যুতিক ট্রেনে চড়া। ট্রেনের বগিগুলো অনেক চওড়া! দুইপাশে বসার লম্বা টেবিল। মাঝখানে বেশ খানিকটা খালি জায়গা। খালি জায়গার উপরে আছে সারি সারি হাতা। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীগণ এই হাতায় ধরেই গন্তব্যে পৌঁছায়। আমরা যেই ট্রেনে চড়ে যাচ্ছিলাম, এটি চিল বনগাঁ টু শিয়ালদা। তা-ও আবার ওই রুটে রাতের জন্য ছিলো শেষ ট্রেন। তাই যাত্রীও ছিলো সীমিত। পুরো বগিতে কানাইর দু’বোন-সহ আমরা যাত্রী ছিলাম, ৭/৮ জনের মতো। ট্রেনের হুইসেল যখন শোনা যাচ্ছিলো, তখন আমি ট্রেনের টেবিল সিটে বসে বসে ভাবতেছিলাম, এবার হয়ত ট্রেন ছাড়ছে! ঠিক তা-ই হয়েছিলো। হুইসেল দেওয়ার সাথে সাথে ট্রেন ছুটে চললো।

বাংলাদেশর ডিজেল ট্রেনও স্টেশন থেকে ছাড়ার আগে হুইসেল দেয়। কিন্তু ট্রেনের হুইসেল শুনেও দৌড়ে এসে ট্রেনে ওঠা সম্ভব হয়। ভারতের বৈদ্যুতিক ট্রেনের বেলায় তা-আর সম্ভব হয় না। হুইসেল দেওয়ার সাথে সাথেই শোঁ! মানে, ট্রেন আর দেখা যাবে না। ট্রেন চলছে দ্রুতগতিতে! আমি বসা কানাইর পাশে। কানাইর দু’বোন সিটের এককোণে বসা। ট্রেন অনেকক্ষণ চলার পর নাম না জানা একটা স্টেশনে থামল। ট্রেন ছাড়ার আগে আমাদের বগিতে তিনজন ফেরিওয়ালা উঠেলো। একজন বাদাম নিয়ে। আরেকজন আপেল, আরেকজন চানাচুর নিয়ে। কানাই ওর দু’বোনকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এই তোরা কি বাদাম খাবি? না আপেল খাবি?’ দু’বোন বললো, ‘বাদাম খাব।’ আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুই কিছু খাবি?’ আমি বললাম, ‘এখন কিছু খাব না।’

ওরা তিনজনই বাদাম কিনে খাচ্ছে। মুহূর্তেই আমার মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে গেলো। মনটা খারাপ করেই একা একা বসে অনেককিছুই ভাবতে লাগলাম! আজ পহেলা বৈশাখ, ১৪০০ বঙ্গাব্দ। আমার বৌ বাচ্চা-কাচ্চা সবাই বাংলাদেশে। আমি কী করলাম! ওরাই-বা-কী করবে? আমার চিন্তার যেন শেষ নেই! কেন আসলাম! কোথায় যাবো! কী করবো! এমন হাজার প্রশ্ন মনের ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্নের উত্তর মেলাতে পারছি না। চিন্তায় আমার দেহ-মন দুটোই যেন ভারী হয়ে যাচ্ছে। ভাবতে লাগলাম বার-বার!

ভাবনার এক ফাঁকে কানাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কানাই, আমরা কোথায় গিয়ে নামবো?’ কানাই বলল, ‘আমরা এখন প্রথমে দমদম যাব। ওখানে আমার এক বন্ধু থাকে। তার বাসায় আজকের রাতটা থাকব। কাল সকালে আবার ট্রেনে করে যাব শিয়ালদা। এই গাড়িতে করে যদি শিয়ালদা যাই, তবে রাত হয়ে যাবে প্রায় তিনটে। এতো রাতে দু’বোনকে সাথে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। সমস্যাও হতে পারে। তাই আজ রাতটা দমদম বন্ধুর বাসাই থাকব।’ আমি বললাম, ‘এখন তো রাত ১১টার মতো বাজে। দমদম পৌঁছতে কয়টা বাজবে?’ কানাই বললো, ‘রাত ১২টার মতো বাজতে পারে।’

কানাইর কথাই ঠিক হলো। রাত ১২টা দশ মিনিটের সময় ট্রেন দমদম পৌঁছাল। দু’বোনকে নিয়ে আমরা ট্রেন থেকে নামলাম। তখন দমদম স্টেশনটা নিরব নিস্তব্ধ! কোনও মানুষজন নেই। ভারতের মানুষ এমনিতেই অনেক হিসাব করে চলে। বাইরে বেশি রাত করে না। সবাই চলে নিজের ধান্ধায়। কী করবে আর কীভাবে চলবে এসব নিয়ে তারা বেশি চিন্তা করে। বাংলাদেশের মতো অযথা রাস্তাঘাটে, হাট-বাজারে আড্ডা দেয় না। আর এখন তো রাত ১২ টারও বেশি! তাই দমদম রেলস্টেশনটা একেবারেই জনশূন্য। ট্রেন থেকে যে-কয়জন যাত্রী নামল, সেই ক’জন মানুষও ক্ষণিকের জন্য। যাত্রীরা যার-যার গন্তব্যে চলে গেলে স্টেশনে আর কোনও মানুষই থাকবে না বলে আমার মনে হচ্ছিলো।

সবাই স্টেশনের ভেতর থেকে বাইরে গেলাম। আমি এদিক-ওদিক দেখলাম, কোনও চা-দোকান আছে কি না। নেই, কোথাও কোনও চা-দোকান এতো রাতে খোলা নেই। নেই কোনও রিকশা বা ভ্যানগাড়িও। দমদম স্টেশন থেকে কানাইর বন্ধুর বাড়ির দূরত্ব প্রায়ই দুই কিলোমিটারের পথ। সাথে তিন-চারটা বড়-বড় ব্যাগ। সেই সন্ধ্যার পর থেকেই টেনশন আর হাঁটা। আমার শরীর একরকম ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু কিছু বলতেও পারছি না যে, আমি খুবই ক্লান্ত অনুভব করছি। কী আর করা! দুই কিলোমিটার পথ খুব কষ্ট করে হেঁটে, কানাইর বন্ধুর বাসায় পৌঁছালাম। ভারতের বাড়ি। হিসেবি মানুষের দেশ। ভাই আর বন্ধু, অসময়ে কেউ কারোর জন্য মাথা ঘামায় না। নিজের আপন বোনও ভাইকে দুইদিন জায়গা দিতে চায় না। কোনও লোকের বাড়িতে একবেলা খাবার যেমন-তেমন, পরের বেলাই হিসাব কষতে শুরু করে।

কানাইর বন্ধুর বাড়ির গেইটের সামনে গিয়ে সবাই দাঁড়ালাম। কানাইর বন্ধুটির নাম, প্রদীপ। কানাই বন্ধুর নাম ধরেই অনেক ডাকতে লাগলো! কারোরই সাড়াশব্দ নেই। অনেকক্ষণ ডাকার পর, বন্ধুটি চোখ মুছতে মুছতে গেইটে আসলো। গেইটে এসেই জিজ্ঞেস করলো, ‘কী-রে, এতো রাতে?’ কানাই বললো, ‘বাংলাদেশ থেকে এলাম। যেতে হবে শিয়ালদা। কিন্তু শিয়ালদা পৌঁছতে অনেক রাত হয়ে যাবে। তাই তোদের বাড়ি এলাম, রাতটা কাটানোর জন্য। খুব ভোরে উঠে চলে যাবো।’ প্রদীপ জিজ্ঞেস করলো, ‘সাথে ওরা কারা?’ কানাই আমাকে দেখিয়ে দিয়ে বললো, ‘ও আমার বন্ধু। আর ওরা আমার ছোট দুই বোন।’ কথা বলতে বলতেই প্রদীপ বাড়ির গেইট খুলতে লাগলো। এমন সময় প্রদীপের বৃদ্ধ মা সামনে এসে প্রদীপকে জিজ্ঞেস করলো, ‘প্রদীপ, কে আসলো রে? এতো রাতে কোত্থেকে?’ মায়ের কথায় প্রদীপ জবাব দিল, ‘মা, আমার বন্ধু কানাই, দু’বোন নিয়ে বাংলাদেশ থেকে এসেছে। আজকের রাতটা আমাদের এখানে থাকবে ওরা। সকাল হলেই চলে যাবে।’ প্রদীপের মা বললো, ‘আয়, ওদের ভেতরে নিয়ে আয়। রাত অনেক হয়েছে। ওরা কী বাইরে থেকে খাওয়া দাওয়া সেরে এসেছে? না আমার কিছু করতে হবে? আমার শরীরটাও ক’দিন যাবত বেশি একটা ভালো যাচ্ছে না। আসো আসো ভেতরে আসো শিগগির।’

প্রদীপ আগে, আমরা চারজন পেছনে পেছনে যাচ্ছি বাড়ির ভেতরে। অনেক বড়ো ঘর! পুরানো বিল্ডিং। দেয়ালের চারদিক নক্সা করা কারুকার্য। ঘরের ভেতরে সুবিশাল আয়তাকার অতিথিশালা আর চারদিক দামী চেয়ার বসানো। দেয়ালে রয়েছে নানা রঙের ছবি টানানো। আমাদের সাথে নেওয়া ব্যাগগুলো মেঝেতে রেখে সবাই বসলাম। প্রদীপের মা একটা প্লেটে করে কিছু বিস্কুট নিয়ে আসলো, অতিথিশালায়। বিস্কুটগুলো সামনে দিয়ে বললো, ‘খাও বাবা সকল। এতো রাতে আর কোনও ঝামেলা করবো না। এগুলো খেয়ে শুয়ে পড়ো। সকালের খাবার খেয়ে তোমরা যাবে।’ কানাই বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে মাসিমা, আমরা হাত মুখ ধুয়ে তারপর খাব। আর সকাল বেলাও আমাদের জন্য আপনার কিছু করতে হবে না। আমাদের খুব ভোরবেলা উঠেই রওনা দিতে হবে।’

প্রদীপের মা শোবার ঘরে চলে গেলো। প্রদীপ তখনও অতিথিশালায়। কানাইর সাথে শোফার একপাশে বসে ঝিমাচ্ছে। কানাই প্রদীপকে বললো, ‘কি হলো রে প্রদীপ? ঘুমিয়ে পড়লি নাকি? আমরা কে কোথায় ঘুমাবো একটু বলে দে?’ প্রদীপ চোখ ডলতে-ডলতে সোফা থেকে ওঠে বললো, ‘ভেতরে আর জায়গা নেই যে! তোদের সবাইকে এখানেই কষ্ট করে ঘুমাতে হবে।’ এই কথা বলেই প্রদীপ আরেক ঘরে চলে গেল। অতিথিশালায় তখন আমরা চারজন ছাড়া কেউ ছিলো না। পেটের খুদায় আর ঠিক থাকতে পারছি না। খুদা নিবারণের জন্য মাসিমার দেয়া বিস্কুটগুলো সবাই মিলে-মিশে হজম করলাম। অতিথিশালায় তিনটে সোফা ছাড়া আর কোনও বিছানাপত্র ছিল না। কানাই একটায়, আমি একটায় আর দু’বোন একটা সোফায় ঘুমিয়ে পড়লো। সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও আমার চোখে ঘুম ছিলো না। আমার শুধু চিন্তা! ভারতের এমন কেচ্ছা-কাহিনী আমি অনেক আগেই শুনেছিলাম। কিন্তু স্বচক্ষে দেখিনি। কানাইর সাথে যাবার পর-ই নিজ চোখে দেখার ভাগ্য হলো। যেমনটা দেখলাম, কিছুক্ষণ আগে কানাইর বন্ধু প্রদীপদের বাড়িতে আসার পর।

বাংলাদেশে একজনের বাড়িতে কোনও অতিথি আসলে, কত না সমাদর করে। অতিথির জন্য রাত আর দিন কোনও বিষয় থাকে না। অতিথিকে সমাদর করাটাই বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আর এখানে রাত হয়েছে বলে যত যন্ত্রণা! কিছু খাও আর না খাও, সকালবেলা চলে যাও! আমি ভাবছিলাম, যার কাছে যাব, সে যদি এমন করে? তাহলে কোথায় যাব? কানাইর কাছেও ক’দিন থাকব! বড় দিদির বাড়ি গেলে, বড় দিদি যদি আমাকে দেখে বিরক্ত হয়? তাহলে যাবো কোথায়? চাকরি যদি মনোমত না হয়, তাহলে? এমন আরও অনেক অনেক প্রশ্ন নিয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম! একসময় সকাল হল। সময় তখন ভোর ৫টা। সূর্য মামা তখনও উঁকি দেয়নি। আমারা অনেক রাতে ঘুমিয়েছিলাম, তাই সবাই তখনও ঘুমে বিভোর। সেসময় প্রদীপের মা এসে সবাইকে ডেকে বলছে, ‘ওঠো ওঠো গো বাবা সকল। সকাল ৫টা বাজে। তোমরা যখন শিয়ালদা যাবে, সকাল পৌনে ছয়টার সময় একটা ট্রেন আছে। তাড়াতাড়ি ওঠো। ট্রেনটা ধরতে পারলে নিরিবিলি যেতে পারবে।’ প্রদীপের মায়ের কথা শুনে আমি ওঠে কানাইকে বললাম, ‘এই কানাই, তাড়াতাড়ি করে রেডি হয়ে নে। ছয়টা বাজতে আরো ৪৫ মিনিট বাকি আছে, ট্রেনটা হয়ত ধরতে পারব।’

কানাই কুরমুড়ি দিয়ে ওঠে ওর দু’বোনকে ঘুম থেকে ওঠাল। প্রদীপদের বাড়িতে আর কিছু খাওয়া হল না। চলে আসলাম দমদম রেলস্টেশনে। স্টেশনে এসে একটা চা-দোকানে সবাই চা-বিস্কুট খেয়ে সকালের নাস্তা সারলাম। এরপর কানাই তাড়াতাড়ি করে স্টেশনের ভেতরে গিয়ে চারটে টিকেট কিনল। ট্রেন আসার পর সবাই ট্রেনে গিয়ে বসলাম। ট্রেন শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছালো সকাল ৮টায়। শিয়ালদা স্টেশনের বাইরে এসে একটা অটো রিজার্ভ করলাম। অটো দিয়ে যাচ্ছি আর দেখেছি সেখানকার ১৪০০ বঙ্গাব্দ, বর্ষবরণ উৎসবে সাজানো রাস্তার আশ-পাশ। মনে হয়েছিলো, প্রতিটি রাস্তার মোড়ে-মোড়ে, মহল্লায়-মহল্লায় এখানে-সেখানেই বর্ষবরণের আয়োজন হয়েছিলো। কোথাও-কোথাও বৈশাখী লোকজ মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চও দেখা গেলো। অটো চলল প্রায় ৩০ মিনিটের মতো। নামলাম বাঘ যতীন রেলস্টেশনের বিপরীতে এক মহল্লায়। সেখান থেকে একটু পায়ে হেঁটে গেলাম কানাইর ভাড়া করা বাসায়।

এই জায়গাটার নাম বাঘা যতীন কেন হলো তা কানাইর কাছে জানতে চাইলাম। জবাবে কানাই বলল, “এই বাঘা যতীনের বাড়ি ছিল আমাদের বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার কয়া গ্রামে। তার পিতার নাম উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং মাতার নাম শরৎশশী। বাঘা যতীন শৈশব থেকেই শারীরিক শক্তির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। শুধুমাত্র একটি ছোরা দিয়ে তিনি একাই একটি বাঘকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছিল বলে, তাঁর নাম রটে যায় বাঘা যতীন। এখানে থেকেই নাকি বাঘা যতীন লেখাপড়া শিখেছিলেন। তিনি একসময় হয়ে উঠেছিলেন একজন বাঙালি ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী নেতা। ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের সম্মুখ যুদ্ধে উড়িষ্যার বালেশ্বরে তিনি গুরুতর আহত হন। কিছুদিন বালাসোর হাসপাতালে থাকার পর অবশেষে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর একসময় ভারত ব্রিটিশ থেকে স্বাধীনতা লাভ করেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাঘা যতীন স্মরণে জায়গার নাম রাখা হয় বাঘা যতীন।’ বর্তমানে বিশ্ববিখ্যাত সার্চ ইঞ্জিন গুগলে সন্ধান করলেও বাঘা যতীন-এর বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়।

এই বাঘা যতীন এলাকার কানাই এখন স্থায়ী বাসিন্দা। ও আরও অনেক আগে থাকেই যেই বাড়িতে থাকে, সেই বাড়িওয়ালার ঘরেই কানাই খাওয়া-দাওয়া করে। কানাই থাকে একা। কিন্তু এখন কানাইর সাথে আরও তিনজন দেখে বাড়িওয়ালার মাথায় হাত। এখন কানাইকে কিছু বলতেও পারছে না, আবার সইতেও পারছে না। আমি সেটা ভালো করে ফলো করতে লাগলাম। তাদের এমন ভাবটা বোঝা যেতো তখন, যখন খাবার খেতে যেতাম। সেখানে দুইদিন থাকার পর কানাইকে বললাম, ‘আমাকে রতন চক্রবর্তীর বাড়ি নিয়ে চল। এখানে তোর সমস্যা হচ্ছে।’ তখন কানাই বলল, ‘যাবো আরো দুইদিন পরে। আগে তোকে কোলকাতা শহরটা একটু ঘুরিয়ে দেখাই। ওখানে গেলে-তো আর সহা-শিগগির আসতে পারবি না। তাই কিছু সুন্দর-সুন্দর জায়গা দেখে যা, চিনেও যা।’ আমি বলছিলাম, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, তা-ই হবে।’ কানাইর কথায় আর অমত করেনি। দুইদিন কানাইর সাথে শুধু ঘোরাফেরা করতে লাগলাম।

এদিকে রতন চক্রবর্তীর স্ত্রীর ভারত আসার কথা ছিলো, আমাকে সুন্দর একটা ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু না, তিনি আর আসছে না। কানাইও তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। এই অপেক্ষার মধ্যে কেটে গেল আরও দুইদিন। এর এক ফাঁকে আমি নিকটস্থ পোস্ট অফিস থেকে একটা চিঠির খাম (এনভেলপ) কিনলাম। নিরিবিলি সময়ে একটা চিঠি লিখে পাঠালাম, আমার স্ত্রীর ঠিকানায়। চিঠিতে জানিয়ে দিলাম, আমি মঙ্গল মতো কলিকাতা পৌঁছেছি। চিঠি পাঠালাম এই কারণে যে, আমার জন্য যেন কোনও প্রকার চিন্তা না করে, তাই। এভাবে কেটে গেল আরও বেশ কয়েকদিন। আমার চিন্তাও বাড়তে লাগল।
চলবে…

জীবনকে গল্প-২৩ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

বন্দী আমি

908842_n

চোখ থাকতে অন্ধ আমি
থাকি বদ্ধ ঘরে,
পায়ে আমার শিকল বাঁধা
হাঁটতে নিষেধ করে!
গলায় আমার সাঁড়াশি আঁটা
শব্দ করা মানা,
হাত দুটোও বাঁধা আমার
বুকে পাথর খানা!
যেন কারাগারে বন্দী আমি
চার দেয়ালের ভেতর,
নাই যে কোনও আইনের শাসন
সেই দুঃখে কাতর!

জ্ঞানের আলো

images

সূর্যের আলো নাহয় ঢেকে রাখুক মেঘে,
তাতে তোমার লাভ কি হায় রেগে-মেগে ?
তোমার জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দাও–
রাত শেষে ভোরে, ঘুম থেকে জেগে!
সূর্যের আলো থেকেও আলোকিত জ্ঞান,
যা থাকে সৃষ্টির সেরা জীবের মস্তিষ্কে!
সেই জ্ঞানভাণ্ডার সদা রেখেছেন প্রভু খুলে!
বিলিয়ে দাও, ছড়িয়ে দাও, দিকে দিকে!
সূর্য থেকে আলো কেড়ে আলোকিত চাঁদ,
জীবের জ্ঞানের আলোতে মিটে জীবনের স্বাদ!
সেই জ্ঞান রেখো না বন্দী, স্বেচ্ছায় বিলিয়ে দাও।
তাতে হবে কেউ জ্ঞানশূন্য, জানিয়ে দাও!

জীবনের গল্প-২১

Image-6411-8

জীবনের গল্প-২০ এর শেষাংশ: আমি বললাম, ‘হ্যাঁ আমি পুরোপুরিভাবে রেডি আছি। ওঁদের তো শ্বশুরবাড়ি রেখে এসেছি আজ দিইদিন হলো। আর আমিতো এখন বড়দা’র বাসায়ই থাকছি।’ কানাই আমার কথা শুনে বলল, ‘ঠিক আছে, আর কোনও টেনশন নেই। এবার যাবার পালা।’

এই বলেই কানাই চলে গেলো ওদের বাসায়। আমি বড়দা’র বাসায়ই থেকে গেলাম। এর পরদিনই কানাই আমার বরদা’র বাসায় এসে ভারত যাওয়ার দিনক্ষণ জানালো। দিন-তারিখ নির্ধারণ করা হলো, ২৭ চৈত্র ১৩৯৯ বঙ্গাব্দ। ১০ এপ্রিল ১৯৯৩ ইং রবিবার। রাত পোহালেই রবিবার। সকালবেলা বড়দা’র বাসায় নাস্তা সেরে জামাকাপড় পড়ে রেডি হচ্ছিলাম। জামাকাপড় পড়তেই বড়দাদা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় যাবি?’ আমি বললাম, ‘আমি কানাইদের বাসায় যাচ্ছি। আজই মনে হয় রওয়ানা দিতে পারি। আমার জন্য আশীর্বাদ রাখবি।’ বড়দাদা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, ‘এখনই ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দিবি নাকি?’ বললাম, ‘না, যেতে যেতে হয়তো সন্ধ্যা হতে পারে। তো একটু আগেই যাচ্ছি, কানাইর সাথে কিছু কাজ আছে।’ আমার কথা শেষ হলে বড়দাদা আমার হাতে ৫০০/= টাকা দিয়ে বললো, ‘যা, ভগবানকে স্মরণে রেখে দেখে-শুনে চলবি।’

অবশ্য বড় দাদাকে এর আগেও ভারতের ব্যাপারে বিস্তারিত খুলে বলেছিলাম। তাই হয়তো বড়দাদা আগে থেকেই আমার জন্য কষ্ট করে হলেও ৫০০/= টাকা রেখে দিয়েছিল। তাই ওই ৫০০/= টাকা যাবার দিন আমার হাতে তুলে দিয়েছিল। বড়দা’র কাছ থেকে ৫০০/= টাকা নিয়ে দাদার বাসা থেকে বের হলাম, কানাইদের বাসার উদ্দেশ্যে। কানাইদের বাসায় গেলাম। তখন প্রায়ই দুপুর হয়ে গিয়েছিল। কানাইদের বাসায় চলছে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব। কানাইর মা আমাকেও খেতে দিলেন। সবার সাথে বসে আমিও দু’মুঠো খেলাম।

খাওয়াদাওয়া শেষে কানাই আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘সাথে টাকাপয়সা কিছু এনেছিস?’ বললাম, ‘হ্যাঁ আছে কিছু! তা হাজার খানিক হবে।’ কানাই বলল, ‘তা চলবে। ওখানে গেলে তো আর টাকার অভাব হবে না। আমি নিজেই তোকে মাসেকখানি চালাতে পারব।’ কানাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘রওনা দিবি কয়টা বাজে?’ কানাই বলল, ‘যেই গাড়ি করে আমরা যাবো, সেই গাড়ির সুপারভাইজার এই মহল্লারই। সুপারভাইজার আসলেই আমরা রওনা দিব।’ এরপর সন্ধ্যা হবার সাথে-সাথে কানাই-সহ ওর দুই বোন আর আমি রেডি হয়ে আছি বাসের সুপারভাইজারের অপেক্ষায়। সুপারভাইজার আসলেই রওনা দিব, সেই আশায়। সন্ধ্যার একটু পরেই বাসের সুপারভাইজার কানাইদের বাসায় আসলো। কয়জন যাবে এবং কী কী সাথে নেওয়া হবে, তার একটা বিবরণ জেনে নিলো। এর কিছুক্ষণ পর সবাই রওনা দিলাম।

প্রথমে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা-গাবতলি। সেখান থেকে উঠলাম কেয়া পরিবহনে। যাওয়া হবে বেনাপোল বাংলাদেশ-ভারত বর্ডারে। বর্ডার পার হয়ে ভারত। বেনাপোল যেতে যাতে রাত ভোর হয়ে গেলো। বাস থেকে নামলাম সকাল ৭ টায়। বাসের বেশিরভাগ যাত্রীদেরই ছিল বৈধ পাসপোর্ট। ছিল না শুধু আমাদের ক’জনের। পাসপোর্ট না থাকলেও কোনও সমস্যা নেই, সাথে আছে বিনা পাসপোর্টে ভারত পাঠানোর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সুপারভাইজার। বাস টার্মিনালে যাওয়ার সাথে-সাথেই বর্ডার পাড় করার দালাল রেডি। সুপারভাইজার দালালের কাছে আমাদের চারজনকে বুঝিয়ে দিলেন। দালালকে পাড় করার বিনিময়ে দিতে হবে, জনপ্রতি ২০০ টাকা। দালালের সাথে কথা পাকা-পাকি হয়ে গেল বাস কাউন্টারের ভেতরেই। এরপর সাথে নেওয়া জিনিসপত্রের ব্যাগগুলো আর আমাদের বহন করতে হয়নি; যা করার দালালের লোকজনই করেছে। দালালদের ভ্যানগাড়ি করে আমাদের নিয়ে গেল দালালদের বাড়িতে।

ভারত বর্ডার সংলগ্ন বাড়ি। মনোরম পরিবেশ আর সৌন্দর্যময় জায়গা। অন্যান্য গাছ-গাছালির মধ্যে সেখানে বাঁশ গাছই বেশি। বাসস্ট্যান্ড থেকে যাওয়ার সময় দেখা যায়, বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়েই রাস্তা। রাস্তাও বেশ সুন্দর, আঁকা-বাঁকা চিকন রাস্তায় বাইসাইকেলের ছড়াছড়ি। আমরাও চারজন চারটা সাইকেলে চড়েই যাচ্ছিলাম। বাঁশ ঝাড়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, আর এদিক-সেদিক তাকিয়ে দেখছি। দেখে মনে হলো এ-যেন সাইকেলের রাজত্ব। বেনাপোল বর্ডার এলাকায় যার কিছুই নেই, তার একটা বাইসাইকেল মনে হয় অবশ্যই আছে। ওখানকার দৈনন্দিন জীবন চলার একমাত্র সঙ্গী হল, বাইসাইকেল। বেনাপোল বর্ডার সংলগ্ন মানুষের হাটবাজার, মালামাল পরিবহণ-সহ সবকিছুই বাইসাইকেলের ওপর নির্ভর। সাইকেল দিয়েই নেওয়া হচ্ছে বর্ডার পারা-পারের যাত্রীদের। সময়-সময় বর্ডার নিরাপত্তায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের কড়া নজরদারিও থাকে। সেসময় পাসপোর্ট বিহীন মানুষকে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। ওইরকম সমস্যায় পড়ে গেলাম আমরাও। বর্ডার ক্লিয়ার নাই, তাই। বর্ডার সংলগ্ন দালালদের বাড়িতেই বন্দি অবস্থায় থাকতে হয়েছিল তিনদিন।

তিনদিন বন্দি থাকার পর যেদিন বর্ডার পার হবো, সেদিন বিকালবেলা দালাল এসে আমাদের জানিয়ে দিল আজই বর্ডার পার করা হবে। ঠিক তা-ই হল। সন্ধ্যার সময়ই দালালদের তাড়াহুড়ো বেড়ে গেল। সেদিন ঝামেলা একটু কম হয়েছে আমাদের। কারণ, সেদিন আমরা চারজন ছাড়া ভারত যাবার যাত্রী আর কেউ ছিল না। তাই মনে হলো বর্ডারে তিনদিন বন্দী থাকার মূল কারণই ছিলো, যাত্রী সংগ্রহ করার একটা চালাকি। কিন্তু এই তিনদিনের মধ্যে একজন যাত্রীও সংগ্রহ করতে না পেরে শেষমেশ আমাদের নিয়েই রওনা দিলো। আমাদের সাথে দালালরা চারজন। ওরা আমাদের সাথে নিয়ে রাতেরবেলা পায়ে হেঁটে বাঁশ ঝড়ের চিপাচাপা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলো। দালালরাও ছাঁটছে, আমরাও দালালদের সাথে হাঁটছি।

দালালরা হাঁটছে আর বলছে, এখন বর্ডার উত্তপ্ত! খুব সাবধানে হাঁটবেন। কোনও আওয়াজ করবেন না। আজকে লাল সিগনাল। বিএসএফ-এর কড়া নজরদারি। ওদের কথা শুনে বুঝতে আর অসুবিধা হলো না যে, এসব হলো ভুয়া! আমাদের ভয় দেখানোই ছিলো ওঁদের বাহানা। ওঁরা দালালরা খুবই স্বার্থবাদী। টাকা ছাড়া কিছুই বোঝে না। বর্ডারে তিনদিনের কষ্টের কথা মনে পড়লেই আমার শরীর এখনও শিউরে ওঠে। তিনদিন আটকা থাকা অবস্থায়, দালালদের ঘর থেকেও আমাদের বের হতে দেয়নি। শুধু ভয় আর ভয় দেখিয়েই আমাদের বন্দিশালায় বন্দী করে রেখেছিলো। এই তিনদিনে দালালদের কোনও কথার অবাধ্য হতে পারিনি। কোনোকিছু নিয়ে কথা কাটাকাটি করতে গেলেও সম্মুখে বিপদ দেখা যেতো। বর্ডারে তিনদিন খুব কষ্ট করে ছিলাম। তিনদিনের থাকা খাওয়ার খরচও দেওয়া দালালদের দিয়েছিলাম। ওদের কর্কশ ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলাম। শেষমেশ তিনদিন পর তাদের কথামত সেদিন সন্ধ্যার পর রাতের বেলা গেলাম একটা খালপাড়ে।

বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে যখন খালপাড় গেলাম, তখন খালে কোনও নৌকা ছিল না। রাতের জোৎস্নার আলোতেই পথ চলছি দালালদের সাথে আমরা চারজন। তখন খালের স্বচ্ছ পানিতে দেখা যায়, জোৎস্নার ঝিকিমিকি। খালের প্রস্থতা কম হলেও খালটি ছিল দেখতে খুবই সুন্দর। খালের উঁচু দুই পাড়েই গাছগাছালি ভরা। শুনেছিলাম ভারত-বাংলাদেশ বর্ডারে কাটাতারের বেড়া থাকে। কিন্তু খালপাড়ে কাটা তারের বেড়া নাই। খালের ওপারেই ভারত বর্ডার সীমান্তরক্ষী বিএসএফ ক্যাম্প। রাত তখন আনুমানিক ৮টা, নিরব নিস্তব্ধ এক জনশূন্য এলাকা। দালালদের একজন মুখ দিয়ে খুব জোরে একটা শিশ দিল। শিশ দেওয়ার সাথে-সাথে দুইজন লোক-সহ একটা নৌকা আসল। দালালরা বললো, ‘তাড়াতাড়ি গিয়ে নৌকায় উঠেন। আর নৌকার মাঝিকে ২০০ টাকা দিয়ে দিবেন। ওপারে যাওয়ার পর, নৌকার মাঝিই সব ব্যবস্থা করে দিবে।’

আমরা নৌকায় গিয়ে উঠে বসলাম। মাঝি নৌকা ছেড়ে দিল। নৌকা পাড়ে ভিড়তেই দেখা যায়, দুইজন লোক দাঁড়িয়ে আছে যাত্রীদের অপেক্ষায়। নৌকার মাঝি লোক দুইজনকে ভালো করে বলে-কয়ে বুঝিয়ে দিলো। যেন যাওয়ার সময় কোন প্রকার অসুবিধা না হয়। নৌকার মাঝিকে তার পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে, নৌকা থেকে নামলাম। পহেলা বৈশাখ ১৪০০ বঙ্গাব্দ ১৯৯৩ ইংরেজি ভারতের মাটি স্পর্শ করলাম। নৌকা থেকে নেমেই ভারতের দালাল ওই দুইজনের সাথে আবার হাঁটতে লাগলাম। যেই দুইজন দালালদের সাথে আমরা যাচ্ছি, তাদেরও দিতে হবে জনপ্রতি ১০০/= টাকা করে, ৪০০/= টাকা। তাদের কাজ হলো, বনগাঁ যাওয়ার গাড়ীতে উঠিয়ে দেওয়া।

হাঁটতে লাগলাম বাঁশ ঝাড় আর সবজি ক্ষেতের ভেতর দিয়ে। চারিদিকে শুধু বাঁশগাছ আর সবজি খেত। সবজি খেতের মাঝখান দিয়েই পথ। রাতের জোৎস্নার আলোতেই হাঁটতে লাগলাম, ভারতের দালালদের সাথে। বাড়িঘর খুব একটা নেই। ভারতের বর্ডার এলাকায় বেশিরভাগ জায়গাই ফসলি জমি। আছে কদ্দুর পর-পর বিএসএফ এর ক্যাম্প আর দু’একটা বাড়ি। আমার খুব ভয়-ভয় লাগছিলো, যদি বিএসএফ এর ছোঁড়া গুলি গায়ে এসে লাগে? সেই ভয়ে আমি কাঁপছি আর হাঁটছি। দালাল-সহ আমরা যাচ্ছিলাম খুব সাবধানে। প্রায় আধাঘণ্টা হাঁটার পর, শোনা যাচ্ছে গাড়ির শোঁ-শোঁ শব্দ। আমি তখন মনে মনে প্রভুকে ডাকছি, হে প্রভু! তুমি রক্ষা কর! এভাবেই একসময় একটা পাকা সড়কের সামনে সবাই এসে দাঁড়ালাম।

বনগাঁ যাবার গাড়ি আসার আগেই ভারতীয় দালালদের ৪০০/= টাকা বুঝিয়ে দিলাম। বনগাঁ যাবার গাড়ি আসতেই দালাল হাত নেড়ে সিগনাল দিল। গাড়ি থামল। দালাল দুইজন আমাদের সাথে নেওয়া ব্যাগগুলো বাসে উঠিয়ে দিল। বাস ২০ মিনিট চলার পর বনগাঁ পৌঁছে গেলো। বাস থেকে সবাই নামলাম বনগাঁ রেল স্টেশনের সামনে। আমরা যাব শিয়ালদা। ট্রেন ছাড়বে রাত ১০ টায়। রেলস্টেশনের সামনে যখন গেলাম, তখন রাত ৯ টা। শিয়ালদা যাবার ট্রেন ছাড়তে আরও একঘণ্টা বাকি। এই একঘণ্টা বনগাঁ রেলস্টেশনেই বসে থাকতে হচ্ছে। এদিকে অনেক পথ হেটে আসার পর আমার অবস্থা কাহিল! আমি পেটের ক্ষুধায় কাতর হয়ে গিয়েছিলাম। বড্ড খিদা লেগেছিলো আমার। বাস থেকে নামার পর বনগাঁ রেলস্টেশনের সামনে থাকা খাবারের দোকানগুলো দেখে আমার পেটের ক্ষুধা আরও বেড়ে গেলো। আমি কানাইকে বললাম, ‘হে রে কানাই! এখান থেকে কিছু খেয়ে নিলে হয় না? আমার খুব খিদে পেয়েছে রে!’

আমার সাথে তাল মিলিয়ে কানাইর দু’বোনও কানাইকে বলল, ‘সত্যি দাদা, খুব খিদে লেগেছে! কিছু খেয়ে নিলে ভালো হয়।’ কানাই বলল, ‘এখানে কিছু এদিক-সেদিক ব্যাপার আছে! সবাই একসাথে যাওয়া যাবে না। সবাই একসাথে গেলেই বিপদে পড়তে হবে। আর নানারকম ঝামেলাও হবে। কারণ, এখানকার মানুষ খুবই চালাক! আমাদের দেখেই বুঝে ফেলবে আমারা বাংলাদেশি। তখন হয়ত পুলিশের ঝামেলায়ও পড়তে পারি।’ কানাইর দু’বোন বলল, ‘তা-হলে কী কিছু খাওয়া যাবে না?’ কানাই বলল, ‘আগে স্টেশনের ভেতরে যাই, পরে দেখা যাবে।’ আমি বললাম, ‘তা-হলে চল, স্টেশনের ভেতরেই যাই!’ সাবাই আস্তেধীরে রেলস্টেশনের দিকে রওনা দিলাম। ভেতরে গিয়ে নিরিবিলি এক জায়গায় সাথে নেওয়া ব্যাগগুলো রাখলাম। এরপর কানাই আমাকে বলল, ‘তুই ব্যাগগুলোর সামনে একটু দাঁড়া, আমি ওদের নিয়ে হোটেলে যাই। ওদের নিয়ে আসার পর, তোকে নিয়ে আবার বাইরে যাব।’ আমি বললাম, ‘যা, একটু তাড়াতাড়ি আসবি।’

কানাই স্টেশনের বাইরে যাবার আগে বলল, ‘কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বুঝে শুনে জবাব দিবি। আর কেউ যদি জিজ্ঞেস করে যে, কোথায় যাবেন? তা-হলে বলবি, শিয়ালদা যাব। যদি জিজ্ঞেস করে কোত্থেকে এসেছেন? তাহলে বলবি, বনগাঁ হাই স্কুলের পূর্বপাড় থেকে এসেছি। বেশি কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইলে বলবি, আপনার এতো দরকার কী? উল্টো তাকেই প্রশ্ন করবি, আপনার বাড়ি কোথায়? আপনি কোথায় যাবেন? এখানে কেন ইত্যাদি ইত্যাদি। তা-হলে দেখবি, প্রশ্নকারী ব্যক্তি তোর কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এদেশ হল শক্তের ভক্ত, নরমের যম, বুঝলি।’

কানাই ওর দু’বোনকে নিয়ে স্টেশনের বাইরে গেল কিছু খেতে। আমি একা দাঁড়িয়ে আছি। সাথে নেওয়া ব্যাগগুলো আমার পাশে। আমার ভেতরটা কেমন যেন ভয়ে কাঁপছিল। আমি ভয় ভয় মনে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি। স্টেশনে থাকা ট্রেনের টিটিকে দেখলেও আমার শরীর ছমছম করছিলো। কারণ, আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি। সাথে নেই পাসপোর্ট। ধরা পড়লেই প্রথমেই আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধী! একবার ধরা খেলে আর রক্ষা নাই। যদি ধরা পড়ে যাই, দেশে রেখে আসা দুটো সন্তানের দশা কী হবে? ওদের কে দেখবে! স্ত্রীর কী গতি হবে? বিনা পাসপোর্টে কেন-ই-বা আসলাম! না আসলেও তো হতো। আমার চিন্তার শেষ নেই! কানাইও আসছে না। সিগারেটে অভ্যস্ত লোক আমি। সাথে একটা সিগারেটও ছিলো না। আমি যেন একটা মহাসাগরের মাঝখানে পড়ে আছি। কিন্তু আমার ধারেকাছে একটা লোকও ছিলো না। আমিই পুরো বনগাঁ রেলস্টেশনের ভেতরে একা বসে আছি। আর মনে মনে ভাবছি! কানাই আসছে না কেন? ওরা কি পুলিশের হাতে ধরা পড়লো নাকি!

এমন অনেককিছু ভাবতে-ভাবতে একসময় কানাই ওর দু’বোনকে নিয়ে হাজির হল। ওদের দেখে আমার যেন প্রাণ ফিরে এলো। মনের চিন্তাও দূর হলো। আমার তখন সাহস হচ্ছিল। এতক্ষণ ভয়ে আমার শরীরের সমস্ত রক্ত বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। আমাকে একা রেখে বাইরে গিয়ে কানাইও আমার কথা ভাবতেছিল, ‘যদি কেউ আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করে। আর যদি আমি উল্টাপাল্টা কিছু যদি বিলে ফেলি? তাহলে তো মহা বিপদ। ভারতের পুলিশের হল রাজার হাল! তাঁদের সহজে দেখা যায় না। আবার কাউকে ধরলে আর ছুটানো যায় না। আবার ভারতে বাটপারের অভাব নেই। সব জায়গায়, সবখানে বাটপারদের রাজত্ব। যদি কোনও বাটপারের কবলে পড়ি?’ এমন চিন্তা নিয়ে তাড়াতাড়ি করে কানাই চলে এলো।

কানাই এসেই আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কি রে? ভয়ে ছিলি নাকি? আমি তো তোর জন্য খুবই চিন্তায় ছিলাম। তুই এখানে নতুন! তোর ভাষাও বাংলাদেশী। কথা বললেই ধরা খাওয়ার জোগাড়! আবার কোনও জায়গার নামও জানিস না। এসব চিন্তা করে আমি তাড়াতাড়ি চলে এলাম। এখন বল, তোকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেছে?’ আমি বললাম, ‘আরে না, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেনি। আর জিজ্ঞেস করলে জবাব দিতাম। তবে তোদের আসতে দেরি দেখে আমি নিজেই একটু চিন্তায় ছিলাম। ভেবেছিলাম, যদি কোনও বিপদে পড়িস, তা-হলে তো মহাবিপদ হবে। এখন তোদের দেখে একটু ভালো লাগছে। এতক্ষণ শরীরটা অস্থির লাগছিল। এবার আমাকে কিছু খাওয়া? আমার খুব খিদা পেয়েছে রে।’

আমার কথা শুনে কানাই বলল, ‘এখন-তো এখানে ওদের একা রেখে স্টেশনের বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না। আমি তোকে দেখিয়ে দিচ্ছি! তুই বরং একা গিয়েই ঝটপট কিছু খেয়ে আয়। ওখানে আটার রুটি, চা-বিস্কুট সবই আছে। তুই তাড়াতাড়ি যা। ঝটপট না করলে সমস্যা হবে। কারণ, কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন আসবে। ট্রেন আসলে আর বেশি দেরি করে না। যাত্রী উঠতে নামতে যতক্ষণ দেরি, ততক্ষণই। কারেন্টের ট্রেন। হুইসেল দিলেই ছুটলো। তুই যা তাড়াতাড়ি করে কিছু খেয়ে আয়।’ কানাইর কথা শুনে আমি প্রথমে ভয় পেয়ে ছিলাম। পরে ক্ষুধার জ্বালায় সাহস করে বললাম, ‘বাইরে যাওয়ার সময় স্টেশনের গেইটে থাকা গার্ড কিছু জিজ্ঞেস করবে?’ কানাই বলল, ‘না না, গার্ড কিছুই জিজ্ঞেস করবে না। তুই তাড়াতাড়ি গিয়ে খেয়ে আয়। ট্রেন আসার সময় হয়ে গেল।’ আমি বললাম, ‘আচ্ছা যাচ্ছি!’ আমি যাওয়ার আগে কানাই জিজ্ঞেস করল, “বর্ডার থেকে যেই টাকা বদল করে দিয়েছি, সেই টাকা থেকে কিছু টাকা আলাদা করে রাখ। সব টাকা বাইর করার দরকার নেই। কোনও বাটপার দেখলে তোর পেছনে লাগবে। ভারতের বাড়ি, টাকার খুব দাম!’ আমি কানাইর কথামত কিছু টাকা সামনের পকেটে রাখলাম। আর বাদবাকি টাকা প্যান্টের ভেতরের পকেটে রাখলাম। ভগবানকে ডাকতে ডাকতে গেলাম গেইটের বাইরে।
চলবে…

জীবনের গল্প-২২ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

হায়রে হায়!

4102_n

কারোর দেখছি বাইডেনের চিন্তায় জীবন চলে যায়!
আচ্ছা বলুন তো–
ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হোক, আর বাইডেন প্রেসিডেন্ট হোক,
তাতে এই বাংলার মানুষের কী আসে-যায়?
যেই দেশে নিজের ভোটের নেই কোনও ঠায়-ঠিকানা!
সেই দেশের মানুষের ভিন্নদেশীয় ভোট নিয়ে যতো ভাবনা!
আচ্ছা বলুন তো–
বর্তমানে এদেশের কোনও ভোটকেন্দ্রে কি ভোটার দেখা যায়?
তবু্ও তো টেলিভিশনের পর্দায় লক্ষলক্ষ ভোটের হিসাব দেখা যায়!
হায়! হায়! হায়! এই লজ্জা রাখি কোথায়?
তারপরও দেশের মানুষ ভিনদেশের জয়গান গায়!

বিটিভি সহ দেশীয় চলচ্চিত্র কি একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে?

কোনোএক সময়ের সাদাকালো টেলিভিশনের হুলুস্থুল শেষ হয়ে শুরু হয়েছে কালার টেলিভিশনের সু-সময়। সাথে ডিশএন্টেনা আর ওয়াইফাই নামের ইন্টারনেট সংযোগে বিশাল পর্দার স্মার্ট টেলিভিশন। বর্তমানে দেখা যায় দেশের আনাচে-কানাচে, ঘরে-বাইরে, হাট-বাজারে এসব টেলিভিশনের ছড়াছড়ি। এমনকি রাস্তার পাশে থাকা বস্তির ঝুপড়ি ঘরেও চলছে কালার টেলিভিশনের পাশাপাশি স্মার্ট টেলিভিশন। এসব টেলিভিশনের সামনে বসে ছেলে বুড়ো সবাই মনের আনন্দে রঙিন পর্দায় প্রদর্শিত কত কী উপভোগ করছে।

মহল্লার গলিতে থাকা প্রতিটি মুদি দোকান, চা’র দোকানেও থাকছে টেলিভিশন নামের এই জাদুর বাক্সটা। চা পান করছে, সিগারেট ফুঁকছে, আর চোখ রাখছে টেলিভিশনের দিকে। এঁদের মাঝে থাকা বুড়ো বয়সের কাউকে যদি জিজ্ঞেস করি, ‘কেমন চলছে বর্তমান স্যাটেলাইট যুগে আমাদের দেশীয় নাটক,সিনেমা, বিটিভি’র গরম নরম খবর?’ এককথায় উত্তর আসে, “না, বেশি ভালো না! ওইসব আর এখন দেখতে ভালো লাগে না। দেশীয় টিভি চ্যানেলেও আগের মতো নাটক, পুরানো দিনের ছায়াছবি দেখানো হয় না। যদিও কোনও চ্যানেলে দেশীয় ছায়াছবি প্রদর্শিত হয়, তবুও এ-যুগের ছেলে-পেলেরা সেসব ছায়াছবি মোটেও দেখে না। আর বিটিভি তো কেবল রাষ্ট্রীয় যাদুর বাস্কের মতো সাজিয়ে রেখেছে।”

কথাগুলো কিন্তু বাস্তব সত্যি কথা। বর্তমানে শহরে বসবাসকারী কেউ সিনেমাহলে তো যায়-ই-না, বিটিভি’ বা অন্যান্য দেশি চ্যানেলের দেশীয় নাটকগুলোও কেউ দেখে না। দেখে হিন্দি ছায়াছবি। তামিল এ্যাকশন ছবি। রেসলিং মারামারি। স্টার জলসার ধোঁকাবাজি নাটক। আর স্মার্ট টেলিভিশনে ওয়াই-ফাই সংযোগে তো বিশ্ববিখ্যাত সার্চ ইঞ্জিন গুগলের ইউটিউব থাকছেই। এসব নিয়েই বর্তমান সময়ের প্রায় লোকেই ওইসব নিয়েই মজে থাকে। তাই ৬০-৭০ বয়সের অনেক বুড়ো-বুড়িরা আফসোসের সাথে এসব কথাগুলো বলে থাকে।

আমি যেই এলাকায় বসবাস করি, সেই এলাকার একটা ছোট বাজারের একপাশে আমার কর্মস্থল। সামনে একসাথে তিন-চারটে চা’র দোকান। প্রতিটি দোকানেই টেলিভিশন নামের যাদুর বাক্সটা সেট করা আছে। তা-ও আবার কালার টেলিভিশন। কোনো-কোনো দেকানে স্মার্ট টেলিভিশনও আছে। এসব দোকানগুলোতে সকাল থেকে রাত দু’টা পর্যন্তও কাস্টমারের ভিড় থাকে। সকাল থেকে রাতদুপুর পর্যন্ত ভিড় থাকে বিশেষ করে টেলিভিশন দেখার জন্যই। টেলিভিশনে চলতে থাকে বিভিন্ন চ্যানেলের বিভিন্ন অনুষ্ঠান। কিন্তু বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) নামের রাষ্ট্রীয় বাক্সটা কেউ ভুলেও চুপি দিয়ে দেখে না। এমনকি রিমোট কন্ট্রোলের কত নম্বর বাটনে চাপ দিলে বিটিভি চ্যানেল আসবে, দোকানদার তাও জানে না।

শুধু একজন দোকানদারই বা কেন? যাঁদের বাসা-বাড়িতে টেলিভিশন নামের এই যাদুর বাক্সটা আছে, তাঁরাও কেউ বিটিভি, আর বিটিভি ওয়ার্ল্ড চ্যানেলটি দেখে না! জানেও না রিমোট কন্ট্রোলের কত নম্বর বাটনে বিটিভি চ্যানেল। তা দেখে মনে হয় আকাশ প্রযুক্তি ডিশএন্টেনা আর ব্রডব্যান্ড ওয়াই-ফাই ইন্টারনেটের কারণে চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের রাষ্ট্রীয় চ্যানেল বিটিভি। এর সাথে সাথে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে দেশীয় সব টিভি চ্যানেল। এসব দেখে আগেকার সময়ের কথা মনে পড়ে যায়। যে-সময়টা ছিল বিটিভি’র জয়জয়কার সময়। সে-সময়ের কথা ভাবতে গেলে নিজের কিছু স্মৃতিকথা এখানে শেয়ার করতে হয়!

IMG_2

উপরের ছবিটি হলো একটি জনবহুল মহল্লা। মহল্লায় থাকা একটা চা’র দোকানে চলছে কালার টেলিভিশন। দেখছে ভারতীয় ছায়াছবি। বাংলাদেশী চ্যানেলের কিছুই দেখে না।

আমার জন্ম ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে। আর সাদাকালো টেলিভিশন আবিষ্কার হয়, ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে। আমাদের দেশে টেলিভিশন আসে ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে। তাও তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের আমলে। নাম ছিল ইস্ট পাকিস্তান টেলিভিশন। তার মানে এই বঙ্গদেশে টেলিভিশন আসার বছরখানেক আগেই আমার জন্ম হয়েছিল। একটু বোঝার বয়স হতেই টেলিভিশন দেখা শুরু করেছি। সেই দেখা শুরু হয়েছিল, স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে। তখন আমরা সপরিবারে থাকতাম, নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানাধীন লক্ষ্মণখোলা গ্রাম সংলগ্ন আদর্শ কটন মিলে।

তখন কিন্তু এদেশের অনেকেই রঙিন টেলিভিশন চোখেও দেখেনি। এই বঙ্গদেশে রঙিন টেলিভিশনের আগমন ঘটে, ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে। সেসময় ওয়াই-ফাই তো দূরের কথা, ডিশএন্টেনাও ছিল না। ডিশএন্টেনা কাকে বলে, তাও কেউ জানত না। সাদাকালো টেলিভিশনের পর্দায় যা দেখতাম, তা শুধু বাংলাদেশ টেলিভিশন নামের বিটিভি থেকে সম্প্রচার হওয়া অনুষ্ঠানগুলোই দেখতাম।

আদর্শ কটন মিলের ভেতরে টেলিভিশন ছিল না। বন্দর থানাধীন লক্ষ্মণখোলা এলাকায় জনতা ক্লাবে একটা সাদাকালো টেলিভিশন ছিল। আর একটা ছিল, শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিমপাড় চিত্তরঞ্জন কটন মিলের শ্রমিক কর্মচারীদের ক্লাবে। মানুষের ভিড়ে লক্ষ্মণখোলা জনতা ক্লাবে দেখার সুযোগ না হলে, চলে আসতাম শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিমপাড় চিত্তরঞ্জন কটন মিলের ক্লাবে। তখন এদেশে বড়বড় নেতাদের ক্যাডার নামের কোনও অস্তিত্ব ছিল না। ছিল মাস্তান বা রুস্তমের রাজত্ব।

IMG_202

উপরের ছবিটিও একটি জনবহুল মহল্লার চা’র দোকান। দোকানে বসে কালার টেলিভিশনে দেখছে ভীনদেশী ছায়াছবি। বিটিভি’র গন্ধও নেই!

যেসব রুস্তমরা একটু বেশি বাহাদুরি দেখাতো, তাদের বলতো পাইন্না রুস্তম। ওইসব রুস্তমদের গলায় বাঁধা থাকতো একটা রুমাল। অনেক রুস্তমদের হাতেও রুমাল বাঁধা থাকত। তাঁরা থাকতো বড়বড় সরদারদের অনুগত। মানে সরদারদের চামচা। আর সরদার মানে ডাকাত সরদার, মিলের লাইন সরদার, চোরের সরদার, হাট-বাজারের সরদার। বর্তমানে যাদের বলা হয় নেতা। প্রত্যেক এলাকায় ওইসব সরদারদের গৃহপালিত পশুর মতো রুস্তম বা পাইন্না রুস্তম থাকতো। ওইসব রুস্তমদের জ্বালায় ঠিকমত টেলিভিশন দেখতে পারতাম না। কারণ প্রতিটি ক্লাবেই ক্রামবোর্ড থাকতো। বেশিরভাগ সময়ই রুস্তমরা ক্লাবের মাঝখানে ক্রামবোর্ড খেলায় ব্যস্ত থাকতো। রুস্তমদের রুস্তমিতে আর ঠিকমত টেলিভিশন দেখা হতো না।

আবার রুস্তমদের একটু ডিস্টার্ব হলে, গালি-গালাজ-সহ মারধরও করতো। সেই সময়ে টেলিভিশন দেখতে গিয়ে রুস্তমদের হাতে অনেক মার খেয়েছি। তবু বিটিভির অনুষ্ঠান দেখেছি। বিটিভি ছাড়া তখন অন্যকোনো চ্যানেল ছিল না। আর অন্যকোনো চ্যানেলের ব্যাপারে কারোর কোনও ধারনাও ছিল না।

একবার সারা দেশে জিকির উঠেছিল যে টেলিভিশন এন্টেনারের সাথে সিলভারের বাটি, না হয় সিলভারের সরা লাগালে নাকি ভারতের অনুষ্ঠান দেখা যায়! সেই জিকিরে ঢাকা-সহ সারাদেশে একযোগে শুরু হয়েছিল, টিভি এন্টেনার সাথে সরা আর সিলভারের বাটি লাগানোর মহোৎসব।

সিলভারের বাটি আর সরা লাগিয়ে দর্শক তখন কিছুদিন ভারতীয় দূরদর্শন কোনরকম দেখতে পেরেছিল। তারপরও কিন্তু বিটিভি’ই ছিল মানুষের একমাত্র দেখার চ্যানেল, নিজেদের চ্যানেল, আনন্দের চ্যানেল। বিকাল ৫টায় পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মধ্যদিয়ে শুরু হতো বিটিভির অনুষ্ঠানমালা। শেষ হতো রাত ১১টায় বাংলা সংবাদ শিরোনামের পর। কোনোদিন রাত ১১টায় বাংলা শিরোনাম সংবাদের শেষ পর্যন্তও বসে থাকতাম টেলিভিশনের পর্দার দিকে চোখ রেখে। ভাবতাম খবরের পর হয়তো আরও কিছু দেখাবে। কিন্তু না, বাংলা সংবাদ শিরোনাম শেষ হবার পরই টেলিভিশন চালক, টেলিভিশনের সুইচ অফ করে দিতো। মন খারাপ করে বাসায় চলে আসতে হতো।

বাসায় আসলে হতো আরেক বিপদ। বড়দা, নাহয় বাবার হাতে খেতে হতো মার। নাহয় থাকতে হতো না খেয়ে। টেলিভিশন দেখতাম মনের সুখে, বাসায় এসে মরতাম মার খেয়ে, নাহয় মরতাম ক্ষুধার জ্বালায়। তবু টেলিভিশনে বিটিভির অনুষ্ঠান দেখতাম। আগের দিনের মার খাওয়ার কথা ভুলে গিয়ে, পরদিন আবার মনের আনন্দে টেলিভিশনের সামনে গিয়ে বসতাম। তখন সপ্তাহের সাতদিনই রাত ৮টার বাংলা সংবাদের পর একটা করে ইংরেজি ছায়াছবি থাকতোই। আরও থাকতো প্রতিমাসে একদিন পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি। থাকতো বাংলা নাটক, নৃত্যানুষ্ঠান, সাপ্তাহিক সিরিজ বাংলা নাটকের পর্ব।

ইংরেজি ছায়াছবিগুলো সম্প্রচার করা হতো একঘন্টা করে। একেকটা ইংরেজি সিরিয়াল একবছর দেড়বছর সময় ধরেও চলতো। যেমন ছিল, হাওয়াই ফাইভও, সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান, বায়োনিক ওম্যান, speech 1999-সহ আরও কিছু ইংরেজি ছায়াছবি। লেখাপড়া গোল্লায় গেলেও ইংরেজি সিরিজগুলো নিয়মিতই দেখতে হতো।

IMG_20201
একটা অফিসে ওয়াইফাই সংযোগের মাধ্যমে ইউটিউব থেকে ওয়াজ শুনছে।

আর বাংলা সাপ্তাহিক ধারাবাহিক নাটকগুলো একেকদিন একেকটা করে দেখানো হতো। তা প্রতি সপ্তাহের প্রতিদিন। ওইসব ধারাবাহিক নাটকগুলোও ছিল মনমাতানো। সে সময় অনেক ধারাবাহিক নাটকই প্রচুর জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। যেমন ‘সকাল সন্ধ্যা’, ‘ভাঙনের ‘শব্দ শুনি’, ‘আমি তুমি সে’ ইত্যাদি। এরপর ৯০ দশকের দিকে আসে সংশপ্তক, কোথাও কেউ নেই। তাও ছিল জনপ্রিয় নাটক। আরও অনেক নাটক ছিল, সেগুলোর নাম আর এখন মনে পড়ছে না।

সে-সময় প্রতিদিন চেষ্টা করতাম, রাত ৮টার আগেই টেলিভিশনের সামনে থাকতে। কোনরকম লেখাপড়া শেষ করেই, টেলিভিশনের সামনে ওঁত পেতে বসে থাকতাম। টেলিভিশন দেখার জন্য ওঁত পেতে শুধু আমিই থাকতাম না, থাকতো সেই সময়ের আমার মতো টেলিভিশন পাগল আরও অনেকেই। এখন আর ওইরকম টেলিভিশন পাগল দেখা যায় না। দেখা যায় ভারতীয় স্টার জলসা, জি-সিনেমা-সহ বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন চ্যানেল ও ছবি দেখার পাগল।

সেই সময় মানুষের ভিড়ে অনেকসময় টেলিভিশনের সামনে জায়গা পেতাম না। জায়গা হতো দূরে, আর না হয় গাছের ডালে। টেলিভিশন দূর থেকে বেশি ভালো দেখা যায় না। তাই সবসময় টেলিভিশনের সামনেই বসার জায়গা রাখার চেষ্টায় বেশি থাকতাম। তখনকার দিনে টেলিভিশন আর বিটিভি যে মানুষের কাছে কত স্বাদের বিনোদন ছিল, তা আর লিখে বোঝানো যাবে না। মানুষ ক্লাবের সামনে গাছের উপরে বসেও বিটিভির অনুষ্ঠানমালা উপভোগ করতো।

একদিন টেলিভিশন দেখতে গিয়ে আমাদের সমবয়সীদের সাথে লেগে যায় হট্টগোল। সেই গোলযোগের সূত্র ধরেই আদর্শ কটন মিলে আসে শ্রমিক কর্মচারীদের জন্য ১৭ ইঞ্চি সাদা-কালো টেলিভিশন। সেই থেকে কাউকে আর মিলের বাইরে গিয়ে টেলিভিশন দেখতে হতো না। মিলের শ্রমিক কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা মিলের ভেতরেই টেলিভিশন দেখতো। তখনকার সময়ে বাংলা ছায়াছবি সিনেমাহলে মুক্তি পাবার আগে রেডিওতে সেই ছায়াছবির কিছু গান, কিছু সংলাপ প্রচার করা হতো। তা দেখে সিনেমা পাগলরা সিনেমাহলে গিয়ে ভিড় জমাতো।

তখনকার সময়ে পুরো নারায়ণগঞ্জ শহরে ছয়টি সিনেমাহল ছিল। প্রত্যেকটি সিনেমাহলেই প্রতিদিন প্রতিটি শো-তেই হাউসফুল দর্শক হতো। সিনেমাহল মালিকদের তখন ছিল রমরমা ব্যবসা। সেই ব্যবসা কেড়ে নিয়েছে বর্তমান যুগের আকাশ প্রযুক্তি ডিশএন্টেনার ভারতীয় চ্যানেলগুলো আর ইন্টারনেট ভিত্তিক ইউটিউব। সাথে কেড়ে নিয়েছে এদেশের চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত থাকা সবার কিসমত। কেড়ে নিয়েছে দেশের বিনোদন প্রেমীদের মনমানসিকতা। সাথে ধ্বংস আর বিলুপ্তি হতে লাগলো দেশের সিনেমাহল গুলো।

তাই এখন আর ওইরকম বিটিভি পাগল নেই। সিনেমা পাগলও নেই! ঘরে ঘরে আছে ভারতীয় স্টার জলসা, জি-সিনেমা-সহ বিভিন্ন দেশের চ্যানেলের ছবি দেখার পাগল। বর্তমান ডিজিটাল যুগের বিটিভি ও আকাশ প্রযুক্তি ডিশএন্টেনার সংযোগ সবার ঘরে ঘরে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ ওয়াই-ফাই। যা দিয়ে বিশাল পর্দার এলসিডি এন্ড্রোয়েড টেলিভিশনে বিশ্ববিখ্যাত সার্চ ইঞ্জিন গুগলের ইউটিউব-সহ বিভিন্ন ওয়েবসাইটে থাকা ছায়াছবি, নাচ-গান দেখা যায়, উপভোগ করা যায়।

তাই শহরের রাস্তার ধারে, মহল্লার অলিতে-গলিতে থাকা বিদ্যুতের খাম্বায়, টেলিফোনের তার খাম্বায় কেবল সংযোগের জট মানুষের নজরও কাড়ে। এসব ডিশ ব্যবসায়ীরা গ্রাহকদের কার আগে কে সংযোগ দিবে এই নিয়ে একসময় খুবই ব্যস্ত থাকতো। সময়-সময় এসব ডিশএন্টেনার সংযোগ দেওয়া নেওয়া নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে হানাহানি হতেও দেখা যেতো। তবে এখন আর তা হয় না। এখন ডিশ আর ওয়াইফাই ব্যবসায়ীদের যার যার মহল্লাভিত্তিক একটা নির্ধারিত সীমানা নির্ধারণ করা আছে। যার যার নির্ধারিত সীমানায় গ্রাহকদের ডিশএন্টেনা আর ওয়াইফাই সংযোগ দিচ্ছে, আর মাসে মাসে শ্লিপ কেটে বিল নিচ্ছে।

গ্রাহকও এই আকাশ প্রযুক্তির ডিশএন্টেনা আর ইন্টারনেট সংযোগে আজ ঘরে বসেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অর্ধশত চ্যানেলে অনুষ্ঠান দেখছে। ওয়াইফাই সংযোগে ফেসবুক, টুইটার-সহ বিশ্বের যে কোনো সামাজিক যোগাযোগ সাইটে যেতে পারছে, দেখতেও পারছে। তাই আমাদের দেশের মানুষ দেশীয় ছায়াছবি, নাটক বিটিভি’র সব অনুষ্ঠান দিনদিন বর্জন করে চলছে। এমনকি মানুষ এখন রাষ্ট্রীয় বিটিভি-সহ দেশীয় কোনও টিভি চ্যানেলে সম্প্রচার হওয়া কোনও জরুরি সংবাদ টুকুও টেলিভিশনে শুনে না, দেখেও না। এ-সবের কারণ শুধু একটাই, প্রথমত ডিশএন্টেনা। দ্বিতীয়ত এই যুগের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ওয়াইফাই সংযোগ।

তাই মনে হয় আমাদের দেশের চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত থাকা অভিনেতা, অভিনেত্রীদের প্রতিবেশী দেশ ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাছে ধর্না দিতে হচ্ছে এবং তাঁদের হুকুম মেনে অভিনয় করে জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে। এছাড়া তাঁরা আর কোনও উপায় খুঁজে পাচ্ছে না বলেই মনে হয়।

বর্তমানে বিটিভি-সহ চলচ্চিত্র এবং সিনেমাহল গুলোর এরকম দৈন্যদশা চলার পরও সরকার এসবের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। সরকার শুধু জোর দিচ্ছে সিনেমার মান উন্নয়নের দিকে। সরকারের এমন তাগিদে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থাও আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে ভালো মানের ছায়াছবি নির্মাণ করার জন্য। বর্তমানে অনেক ভালো মানের ছায়াছবি নির্মাণও করছে! তবুও আগের মতো দেশের মানুষকে সিনেমা হলমুখী করতে পারছে না।

পারছে না শুধু বর্তমান যুগের আকাশ প্রযুক্তি ডিশএন্টেনা আর ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের কারণে। তাহলে কি একদিন পাকিস্তানের চলচ্চিত্রের মতো আমাদের দুর্দশা বরণ করতে হবে? যাতে এমনটা নাহয়, তার আগেই সরকারকে এবিষয়ে সময় থাকতেই ভেবে দেখা দরকার বলে অনেকেই মনে করেন। সময় থাকতে যদি সরকার এবিষয়ে ভেবে না দেখে, তাহলে আকাশ প্রযুক্তি ডিশএন্টেনা আর ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের কারণে একদিন আমাদের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন-সহ দেশীয় চলচ্চিত্র ধ্বংস হয়ে যাবে!

স্রষ্টার বিচার আস্তেধীরে

1228_n

মহান স্রষ্টাকে যে গালমন্দ করে হাসে,
তাতে মহান স্রষ্টার কী যায়-আসে?
ভুল বুঝে যে ভাঙে দেবতার মূর্তি,
সে কি পায় কবু পাপ থেকে মুক্তি?
যার পাপ সে ভুগে, অন্যে ভুগে না,
কী পাপের সাজা তার, কেউ জানে না!
স্রষ্টার বিচারকার্য শুরু হয় আস্তেধীরে,
সময় হলেই হয় বিচার পাপীকে ঘিরে।

ড্রাইভার মালেক বলছি

চাকরি একখান পেয়েছি আমি সরকারি
ঘুষ দিয়ে আর তেল মেখে,
হোকনা সেটা পিয়ন নাহয় ড্রাইভারি
সেদিকে ফিরে আর কে দেখে?

চাকুরে তো নয় যেন এক কারবারি
চোখের সামনে টাকার খনি,
বছর যেতেই কোটি টাকার ছড়াছড়ি
হয়ে গেলাম দেশের বড় ধনী!

আমি এখন সরকার ঘোষিত কোটিপতি
আমার আছে শতকোটি টাকা,
ঘুরিয়ে দিলাম আমার জীবনের গতি
থমকে দিলাম রাষ্ট্রের চাকা!

আমি হলাম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক
নাম আমার আব্দুল মালেক,
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সবাই আমার প্রতিপালক
আমিই সব, আমি ড্রাইভার মালেক।

আদরের সন্তান

035_n

জন্মদাতা জন্ম দিলো, গর্ভে ধরলো অভাগিনী মা!
কতো কষ্টে যে রাখলো গর্ভে, তা জানে অভাগিনী মা!
একসময় সন্তান জন্ম হলো, মায়ের মুখে হাসি ফুটলো!
অন্ধকার ঘর আলো হলো, মা-বাবার মনে শান্তি পেলো।
সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন শুরু হলো, একসময় স্কুলে দিলো।
সন্তান বড় হলো! লেখাপড়া শিখে শিক্ষিত হলো।
দেশ ও দশের নেতা হলো, বড় একজন ব্যবসায়ী হলো।
মা-বাবা বৃদ্ধ হলো, একসময় তাদের মৃত্যুও হলো!
দুই-চার দিন লোক দেখানো কান্না-কাটি করা হলো!
তাদের রেখে যাওয়া ধনসম্পদ সবকিছু সন্তানের হলো!
কিন্তু তাদের কবর তাদের জায়গায় দেওয়া হলো না!
কবর দেওয়া হলো গোরস্থানে, নিজের জায়গায় হলো না!
চার দিনের দিন খরচ হলো, চল্লিশ দিনের দিনও হলো!
তাদের বিদেহি আত্মার শান্তি কামনা করা হলো!
পাড়া প্রতিবেশীদের দেখানো হলো, এরপর ভুলে গেলো!
মাস গেলো, বছর গেলো, মা-বাবা কবরেই শুয়ে রইলো!
তাদের কথা কেই-বা মনে রাখলো? সবাই ভুলে গেলো!
আর প্রতিবছরই এই মাজারে সেই মাজারে দৌড়াদৌড়ি!
অমুকের মৃত্যুবার্ষিকী জন্মবার্ষিকী নিয়ে কত পাড়া-পাড়ি।
প্রতিবছর দলবল নিয়ে মাজারে যেতে গাড়ি করে বায়না!
অথচ মা-বাবার কররে বা শ্মশানে বছরে একদিনও যায়না!
হায়রে আদরের সন্তান!

চিরসুখী সেই জন

kgo

চিরসুখী তো সেই জন, যার নেই ধন;
আছে সুন্দর মন, আনন্দে থাকে সারাক্ষণ!
চিরসুখী তো সেই জন, যার নেই জ্বালা;
আছে মনে আনন্দ, হাসিখুশি থাকে সারাবেলা!
চিরসুখী তো সেই জন, যার নেই লোভ;
আছে ধৈর্য, প্রকাশ পায় না ক্ষোভ!
চিরসুখী তো সেই জন, যার নেই অহংকার;
আছে সহ্য, করে না কাউকে তিরস্কার!
চিরসুখী তো সেই জন, যার নেই ভাবনা;
আছে মৃত্যুর চিন্তা, করে স্রষ্টার আরাধনা!
চিরসুখী তো সেই জন, যার নেই ঘরবাড়ি;
আছে পথেঘাটে, পরের বাড়িই তার বাড়ি!
চিরসুখী তো সেই জন, যার নেই ক্ষমতা;
আছে নিন্দিত হয়ে, তবু্ও দেখায় সক্ষমতা!
চিরসুখী তো সেই জন, যার নেই বিলাসিতার স্বাদ;
আছে ধৈর্য্য শক্তি , সহজে করে নাতো প্রতিবাদ!
চিরসুখী তো সেই জন, যার নেই চাওয়া-পাওয়া;
আছে খেয়ে না খেয়ে, অল্পতেই পরম পাওয়া!

.
ছবি গোদনাইল চৌধুরীবাড়ি বাসস্ট্যান্ডে হাত পেতে দশের কাছে চেয়ে খাওয়া একজন বিকলাঙ্গ। ছেলেটির নাম: মোহাম্মদ শরিফ।

বই পড়ে জ্ঞানী হও

200_n

কেউ কাগজ ছাপায়, কেউ বই তৈরি করে
কেউ বই বিক্রি করে, কেউ বই কিনে,
কেউ বই ছিড়ে ফেলে, কেউ বই পড়ে
কেউ শিক্ষিত হয়, কেউ চোর হয় দিনে-দিনে!
বই পড়ে হয় ডাক্তার, কেউ হয় ইঞ্জিনিয়ার
কেউ হয় নেতা, কেউ হয় বড় ব্যবসায়ী,
কেউ করে শিক্ষকতা, কেউ করে অহংকার
কেউ হয় মহামানব, কেউ হয় সর্বগ্রাসী!
বই পড়ে হয় জ্ঞানী, হয় শিক্ষিত অজ্ঞানী
কেউ হয় কবি, কেউ হয় বড়ো সাহিত্যিক,
কেউ হয় রাষ্ট্রীয় চোর, কেউ রাতা-রাতি ধনী
কেউ ছড়ায় আলো, কেউ হয় সাংঘাতিক!

জীবনের গল্প-২০

Image-6411-8

জীবনের গল্প-১৯-এর শেষাংশ: তখন কালীগঞ্জ শুভাঢ্যা ইউনিয়ন এলাকার পরিস্থিতি এতটাই খারাপ ছিলো যে, ভাড়া বাড়ি থেকে প্রাণভয়ে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে মিলের ভেতরে থাকতাম। মিলের ভেতরে অন্তত তিন-চার দিন সপরিবারে অবস্থান করেছিলাম।

বাবরি মসজিদ নিয়ে সে সময়ে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা তুলে ধরলাম। ভারতের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ কিন্তু ভারতীয় উগ্রবাদী হিন্দু সম্প্রদায় ধংস করে ১৯৯০ সালে অক্টোবরের শেষদিকে। আমি তখন নারায়ণগঞ্জ গোদনাইল এলাকায় মহিউদ্দিন স্পেসালাইজড টেক্সটাইল মিলে। বাসাও ছিলো মিলের সাথেই। সেসময় ভারতের অযোদ্ধায় বাবরি মসজিদ ধ্বংস করায় বাংলাদেশী মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে সংগঠিত হয় দাঙ্গা। তখন বাবরি মসজিদ ভাঙার জেরে এদেশের হিন্দুদের উপর অক্টোবর থেকে শুরু করে নভেম্বরের ২-৩ তারিখ পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে দমনপীড়ন চলতে থাকে। কিন্তু আশার কথা হলো, তখন বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা শহরে জ্বালাও পোড়াও ধর মার হলেও, নারায়ণগঞ্জ জেলায় ভয়াবহ তেমন কিছু ঘটেনি।

কিন্তু ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ তেমন কিছু না ঘটলেও, ওই ঘটনার সূত্র ধরেই ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জেলা শহরে হিন্দুদের উপর বিরামহীন অত্যাচার, নির্যাতন, লুটপাট, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণের মত জঘন্য নিষ্ঠুরতা চলতে থাকে। সেই সময়কার ঘটনায় অনেক মা বোনের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছিল। অনেক হিন্দুদের প্রাণহানিও ঘটেছিল। অনেক বোনদের ধর্মান্তর করে বিবাহ করা হয়েছিল। এই সহিংসতার সময় আমি ঢাকা সদরঘাটের নদীর ওপারে কালিগঞ্জ রশিদ স্লিক টেক্সটাইল মিলে চাকরিরত অবস্থায় ছিলাম। সেই নির্যাতনের দৃশ্য আজো চোখের সামনে ভেসে উঠে। তখন আমি আমার বাচ্ছা-কাচ্চা নিয়ে এক হিন্দু বাড়িতে ভাড়া থাকতাম। আমার মিলের মালিক একজন মুসলমান হয়েও, মালিক নিজে মিলে এসে ম্যানেজারকে নির্দেশ দিলেন আমার পরিবারবর্গ নিয়ে মিলের ভিতরে আশ্রয় নিতে। তারপর সপরিবারে মিলের ভিতরে আশ্রয় নিয়ে প্রাণে বেঁচে যাই।

যাই হোক, রশিদ স্লিক মিলে তিন-চার দিন পর পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হলে; আবার ভাড়া বাসায় গিয়ে উঠলাম। এরপর থেকে আবার রশিদ স্লিক মিলে নিয়মিত কাজ করতে লাগলাম। কিন্তু একসময় সেই মিলেও বেশিদিন কাজ করতে পারিনি, কিছু অসাধু শ্রমিক কর্মচারীদের জ্বালায়! ওদের দাবি-দাওয়া নিয়ে ওদের সাথে থাকলেও, পরবর্তীতে মালিকের পক্ষ নিয়ে উল্টো আমাকেই দোষী সাব্যস্ত করে। কিন্তু মিলের মধ্যে ওরা হলো শ্রমিক, আর আমি ছিলাম মালিকের বেতনভুক্ত কর্মচারী। তবুও আমি সবসময় শ্রমিকদের পক্ষেই কথা বলতাম। এটাই ছিলো আমার একমাত্র দোষ। এতে গা জ্বালা ধরে মালিকের আপন ভাগিনা ম্যানেজার রিপন মিয়ার। মালিক মোয়াজ্জম সাহেবের বাড়ি ছিলো বিক্রমপুর। ম্যানেজার রিপনের বাড়িও বিক্রমপুর। মিলের ডিজাইন মাস্টার ছিলেন, আমাদেরই হিন্দু ধর্মীয় একজন। নাম মৃণাল কান্তি সরকার।

তাকে আমি যেমন বাঘের মতো ভয় পেতাম, তেমন আবার পীরের মতো শ্রদ্ধা করতাম। উনার অনুপুস্থিতে মিলের ডিজাইনের টুকিটাকি কাজ আমিই চালাতাম। এতে তিনি উপরে উপরে খুবই খুশি ভাব দেখাতেন, ভেতরে ভেতরে থাকতেন রাগে গোস্বায়। কিন্তু আমি উনার মুখের হাসিটাই সবসময় দেখতাম, রাগ গোস্বা নিয়ে মাথা ঘামাতাম না। শেষ পর্যন্ত উনিই পীরের ভুমিকা নিয়ে নাটের গুরু সেজে মালিকের সাথে বসে থাকে।

যে কারণে আমি দোষী হয়েছিলাম– “সামনে ছিল ঈদ-উল-ফিতর। মিলে ছিলো না প্রোডাকশন। তাঁতিদের ছিলো করুণ অবস্থা। এরমধ্যে ঘোষণা আসে ঈদে কাউকে বোনাস দেওয়া হবে না। মিলের সব তাঁতিদের মাথায় ভেঙে পড়লো মহাকাশ। মিলের সব তাঁতি আমাকে খুবই মান্য করতো। ওরা আমার কাছে ওদের কথা জানালো। ওদের কথা হলো, ‘যে করেই হোক ঈদে বোনাস আদায় করতেই হবে, আপনি আমাদের সাথে থাকবেন। এতে কারের চাকরি চলে গেলেও, বোনাস আদায় করা হবে।’ আমার সম্মতি চাইলে আমি ওদের সাথে থাকবো বলে কথা দিই। একসময় ঈদ ঘনিয়ে এলে শ্রমিকদের এক কথা দুই কথায় মিল উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। মিল ম্যানেজার, মাস্টার আমাকে অফিসে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ওদের সাথে আমি আছি কিনা?’ আমি বললাম, ‘যেখানে সবাই একসাথে মিলে-মিশে কাজ করি। সেখানে ওদের সাথে না থাকাটা হবে বেঈমানী। আমি ওদের সাথেই আছি। আমার কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে মিল থেকে চলে যেতে বললো।’ আমি সাথে সাথে মিল থেকে বেরিয়ে যাই। তারপর দেখা গেলো মিলে থেকে শুধু আমি একাই বেরুলাম, আর একজনও বের হয়নি। সবাই সামান্য কিছু ঈদ বকসিস পেয়ে দিব্বি বহাল তবিয়তে কাজ করতে থাকে।” কিন্তু আমি আর মিলের সামনেও গেলাম না।

চাকরির সন্ধানে গেলাম ইসলামপুর আমার আগের মালিক মিলন সাহেবের কাছে। তিনি আমাকে দেখে খুবই খুশি হলেন। বসতে বললেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় আছি।’ বললাম, ‘বর্তমানে বেকার। থাকি নদীর ওপার কালীগঞ্জ। ছিলাম মোয়াজ্জেম সাহেবের ভাড়া নেওয়া রশিদ স্লিকে। উনি মোয়াজ্জেম সাহেবের কথা শুনে চিনতে পেরে বললেন, ‘ওহ্, মোয়াজ্জেম? এলিগেন্ট ফেব্রিকসের মালিক?’ বললাম, ‘হ্যা স্যার!’ তখন মিলন সাহেব বললো, ‘আমিতো তোমাকেই খুঁজছিলাম। কিন্তু তোমার কোনও খোঁজ পাচ্ছিলাম না। আমি ঢাকা গুলশান এলাকায় নতুন করে একটা মিল করেছি। ২০টি তাঁত বসিয়েছি। মিল অলরেডি চালু আছে। কিন্তু ড্রয়ার করার লোকের সমস্যা। তোমাকে পেয়ে চিন্তামুক্ত হলাম। তুমি আগামীকালই গুলশান আমার মিলে চলে যাও!’ আমি মিলন সাহেবের কথা শুনে স্বর্গসুখ পেলাম। আমিও একরকম চিন্তামুক্ত হলাম।

তিনি আমাকে ৫০০/= হাতে দিয়ে উনার মিলের ঠিকানা লিখে দিলেন। আমি বাসায় আসার পথে কিছু বাজার-সদাই করে বাসায় আসলাম। পরদিন সকালবেলা মিলন সাহেবের দেয়া ঠিকানামতো চলে গেলাম ঢাকা গুলশান। সেখানে গিয়ে দেখি পরিচিত আরও দুইএক জন তাঁতি সেই মিলে কাজ করছে। তাদের দেখে খুবই ভালো লাগলো। সেদিন আর কোনও কাজ করলাম না, পরদিন কাজ করার জন্য সবকিছু ঠিকঠাক করে আবার সন্ধ্যার পর কালীগঞ্জ নিজের বাসায় ফিরে গেলাম। পরদিন সকালে গুলশান মিলে গিয়ে কাজ করা শুরু করি। আমার ফ্যামিলি বাসা থেকে যায় রশিদ স্লিকের সাথেই। বাসায় আসতাম প্রতি শুক্রবার। শনিবার সকালে আবার গুলশান মিলে চলে যেতাম।

এভাবে মিলন সাহেবের গুলশান মিলে মাসেক ছয় মাসের মতো খুব সুন্দরভাবে কাজ করেছিলাম। একসময় বর্ষাকালের আগমন ঘটে। গুলশান এলাকায় যেখানে মিলটি ছিল, সেই এলাকাটি নিচু এলাকা। এলাকাটির নিচু হওয়াতে, সামান্য বৃষ্টিতেই পুরো এলাকা বন্যার মতো হয়ে যেতো। তার উপর আবার বন্যার সিজন। একসময় ভারি বর্ষণের কারণে মিলের ডিপার্টমেন্টের ভেতরে পানি ঢুকে যায়। পানির বেড়ে যাওয়ার কারণে মিল মালিক মিলন সাহেব কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। মিলের সব শ্রমিকদের পাওনা টাকা বুঝিয়ে দিয়ে ১৫দিন ছুটি ঘোষণা করে। তখন আমি বাসায় চলে যাই। মিল থেকে যেই টাকা বেতন পেয়েছিলাম, তা ছিল খুবই সামান্য।

কয়েকদিন পরই ছিলো বাসা ভাড়া দেওয়ার তারিখ। কিন্তু হতে টাকা ছিলো খুবই কম। তখন নিজের গিন্নীর সাথে বোঝাপড়া করলাম, কী করা যায়! গিন্নী বুদ্ধি দিলো, সে কিছুদিনের জন্য ছেলেমেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি গিয়ে থাকবে। এই কিছু দিনের মধ্যে একটা ভালো চাকরি খুঁজে নিতে। গিন্নীর কথায় রাজি হয়ে তা-ই করলাম। গিন্নীকে শ্বশুরবাড়িতে রেখে, চলে আসলাম নারায়ণগঞ্জে বড় দাদার বাসায়। বড় দাদার কাছে বর্তমান অবস্থা খুলে বললে, দাদা আমাকে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য ৫০০/= টাকা টাকা দেয়। এরপর সেখানে দুইদিন ঘোরাঘুরি করে আবার চলে গেলাম শ্বশুরবাড়িতে। শ্বশুরবাড়ি থেকে গিন্নীকে নিয়ে আবার চলে আসলাম কালীগঞ্জ নিজের বাসায়। কিন্তু অনেক ঘোরাঘুরি করেও কোথাও আর চাকরি ব্যবস্থা করতে পারছিলাম না। এভাবেই কয়েকদিন কেটে গেলো।

ক‘দিন পর হঠাৎ কানাই ভারত থেকে নারায়ণগঞ্জ আসে, ওর দুই বোনকে ভারত নিয়ে যাওয়ার জন্য। কানাই নারায়ণগঞ্জ এসেই আমার খবর সংগ্রহ করে জানতে পারল, আমি কালীগঞ্জ আছি। কানাই আমার খোঁজে চলে গেলো কালীগঞ্জ রশিদ স্লিক মিলে। সেখানে গিয়ে জানতে পারলো আমি চাকরি ছড়ে গুলশান চলে গেছি। কানাই মিলের দারোয়ানের কাছে আমার বাসার ঠিকানা চাইলে, দারোয়ান কানাইকে নিয়ে আমার বাসায় রওনা হয়। পথিমধ্যে আমার সাথে দেখা। আমি বাসা থেকে চা দোকানে যাচ্ছিলাম। কানাইকে দেখে আমি অবাক! তারপর কানাইকে নিয়ে চা দোকানে গেলাম। সাথে রশিদ স্লিকের দারোয়ান চাচাও। চা-বিস্কুট খেলাম। আমার বর্তমান অবস্থা বললাম, কানাই শুনলো। এরপর কানাই বললো, ‘তুই আমার সাথে ভারত যাবি?’ আমি বললাম, ‘আগে বাসায় চল, তারপর কথা হবে।’ কানাইকে নিয়ে গেলাম বাসায়। সময়টা তখন ১৯৯৩ সালের মার্চমাস। ১৩৯৯ বাংলা চৈত্রমাস।

বাসায় যাওয়ার পর কানাইকে দেখে গিন্নী ও অবাক! কানাই আমার গিন্নী কে বললো, ‘ওকে আমি আমার সাথে ভারত নিয়ে যাবো। এখানে থেকে ও কিছুই করতে পারবেনা। তুমি বৌদি আপাতত কয়েক মাস বাপের বাড়িতে থাকবে। তারপর ওখানে ওর একটা চাকরি অথবা যেকোনো কাজ ঠিক হলে গেলেই তোমাকে ওখানে নিয়ে যাওয়া হবে। তুমি কি রাজি?’ কানাইর কথায় আমার গিন্নী কিছুই বলেনি, শুধু বললো, আচ্ছা দাদা তা পরে দেখা যাবে।’ কানাইও আর বেশিকিছু না বলে শুধু বললো, ‘আমি যা বলে গেলাম, তা তোমরা বুঝে দেখবে। আমি চললাম। এই বলেই কানাই সেদিনের মত আমার বাসা থেকে ওদের বাসায় চলে যায়।

কানাই চলে যাওয়ার পর আমি আমার গিন্নী কে বললাম, ‘কানাই যে ভারত যাওয়ার কথা বলে গেল, এখন তোমার অভিমত কী?’ আমার গিন্নী বলল, ‘তুমি যদি ভারত যাও, তবে-তো চাকরি, বাসা দুটোই ছাড়তে হবে।’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ তা-তো ছাড়তেই হবে। তুমি মাসেক ছ’মাসের জন্য বাপের বাড়িতে থাকবে। ওখানে একটা ব্যবস্থা করে নিতে আমার বেশ একটা সময় লাগবে না। আমি মাসেক তিন-মাস পর এসে তোমাকে নিয়ে যাব।’ গরীবের মেয়ে স্বামীর কথায় বিশ্বাসী। তাই আর আমার কথায় অমত করেনি। আমি যে-ভাবে বলেছি, ও তা-ই মেনে নিচ্ছে। গিন্নীর সাথে কথা একরকম পাকা-পাকি হয়ে গেল।

পরদিন আবার কানাই আমার মিলে আসলো। কনাইকে নিয়ে আমি বাসায় গেলাম। কানাই আমার গিন্নী কে জিজ্ঞেস করলো, ‘বৌদি, আমি যে গতকাল বলে গিয়েছিলাম তা তোমরা কী বুঝ পরামর্শ করলে?’ আমার গিন্নী বললো, ‘কানাইদা, আপনি যা ভালো মনে করেন তাই করবেন। ওখানে গিয়ে যদি ভালো একটা কাজকর্ম করতে পারে, তাহলে তো ভালোই হবে।’ কানাই বললো, ‘নিতাই তো আমার ওস্তাদ। আবার আমার বড় ভাইয়ের মতো। ওর ভালোই আমার ভালো। তোমরা শান্তিতে থাকবে, এটাই আমি চাই। এখানে তো তোমরা সারা বছর কষ্টই করে যাচ্ছ। ওখানে গেলে তোমাদের কোন কষ্ট হবে না। এব্যাপারে তুমি একশভাগ নিশ্চিত থাকতে পার! আর আমি নিতাইকে যার ওখানে নিয়ে যাবো, তার নাম রতন চক্রবর্তী। তাকে নিতাইও খুব ভালো করে চেনে জানে। সেই লোক নগর খানপুর থাকে। তার একটা বাড়ি আছে ভারত চব্বিশ পরগনা জেলায়। জায়গার নাম ফুলিয়া। সেই বাড়িতেই তোমরা থেকে বাড়ি দেখাশুনা করবে। এতে ভালোই হবে।’ এই বলেই কানাই আমার বাসা থেকে চলে গেলো ওদের বাসায়। পরদিন আমি নগর খানপুর রতন চক্রবর্তীর সাথে দেখা করে বিস্তারিত আলাপ আলোচনা করে ভারত যাবার প্রস্তুতি নিই।
চলবে…

জীবনের গল্প-২১ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।