নিতাই বাবু এর সকল পোস্ট

নিতাই বাবু সম্পর্কে

নিতাই বাবু ২০১৫ সালে তিনি শখের বশে একটা ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করে লেখালেখি শুরু করেন।তিনি লিখতেন নারায়ণগঞ্জ শহরের কথা। লিখতেন নগরবাসীর কথা। একসময় ২০১৭ সালে সেই ব্লগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ব্লগ কর্তৃক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জনাব সাঈদ খোকন সাহেবের হাত থেকে ২০১৬ সালের সেরা লেখক সম্মাননা গ্রহণ করেন। সাথে নগর কথক উপাধিও পেয়ে যান। এরপর সেই ব্লগে লেখালেখির পাশাপাশি ২০১৮ সালের জুলাই মাসে তিনি শব্দনীড় ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করেন। শব্দনীড় ব্লগে উনার প্রথম লেখা "আমি রাত জাগা পাখি" শিরোনামে একটা কবিতা। তিনি চাকরির পাশাপাশি অবসর সময়ে লেখালেখি পছন্দ করেন এবং নিয়মিত শব্দনীড় ব্লগে লিখে যাচ্ছেন।

নাম তার গুইসাপ

40447_o

বাড়িটা হলো তার পুকুরপাড়
বসে থাকে সে চুপচাপ,
উঁকি মারে সে এপার-ওপার
কে সে? চেয়ে দেখি এক সাপ!
কী সাপ আর কী নাম
কালসাপ নাকি সে লালসাপ?
রাজ্যে তো তার হরেক নাম
আসল নাম কি তার? নাম তার গুইসাপ!
কেউ বলে স্থল কুমির
কেউ গোসাপ, কোমোডো ড্রাগন,
দেখতে কিন্তু হুবহু কুমির
হঠাৎ যদি কেউ দেখে, শরীরে ধরবে কাঁপন!

.
(ছবিটি নিকটস্থ বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থার পুকুরপাড় থেকে তোলা।)

করোনা কালের ইতিহাস

download-1-30

২০১৯ সালের শেষদিকে প্রাণঘাতী নভেল করোনা ভাইরাস যখন গণচীনে আবির্ভূত হয়েছিল, তখনো এ-দেশের কোটি মানুষের মতো আমিও ছিলাম নির্ভয়ে। ভয়টা বেড়ে গিয়েছিল, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমদিকে। সে-সময় নিজের সহধর্মিণী জ্বর-সর্দি- কাশিতে ভুগতে ছিল। এই ডাক্তার, সেই ডাক্তার, এটা-ওটা করতে করতে কেটে গেলো, দিনেক ৭ দিনের মতো। তারপরও যখন সহধর্মিণীর শরীরের জ্বর-সর্দি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছিলাম না, তখন আমি রীতিমতো আমার সহধর্মিণীর আশা ছেড়ে দিয়ে নীরবে কাঁদতে লাগলাম। কারণ, সে-সময় গণচীনের করোনা ভাইরাস গণচীন থেকে উড়তে- উড়তে পৃথিবীর অনেক দেশে বিরাজ করছিল। কিন্তু আমাদের দেশে তখনো করোনা ভাইরাসের আগমনের খবর ছিলো না।

যদিও তখন আমাদের দেশে ঘাতক করোনা ভাইরাসের আগমন ঘটেনি, তবুও সহধর্মিণীর শারীরিক অবস্থার অবনতি দেখে আমার মনে শুধু করোনা ভাইরাসের করুণ সুর বাজতে ছিলো। আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম, হয়তো আমার সহধর্মিণীকে গণচীনের করোনা ভাইরাসে আক্রমণ করেছে। নিজের মনে এইরকম ভাবনা থেকে আমি নিজেও একরকম কাহিল হয়ে পড়লাম। কিন্তু নিজের চেনা-জানা ছাড়া অন্য কারোর সাথে এব্যাপারে কোনও কথা বলতাম না। না বলার কারণ ছিলো করোনা ভাইরাস। মনে মনে ভাবতাম! যদি কারোর কাছে সহধর্মিণীর জ্বর-সর্দির কথা বলি, তাহলে মানুষ মনে করবে আমার সহধর্মিণী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। সেই ভয়ে আমি মহল্লার অপরিচিত কারোর কাছেই এ-বিষয়ে কোনও আলাপ করতাম না।

একদিন পরিচিত এক ব্যক্তি আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “দাদা, দিদি কেমন আছে?” উত্তরে আমি বললাম, ‘বেশি ভালো না, দাদা।’ আমার কথা শুনে পরিচিত ব্যক্তি জানতে চাইলো, “দিদির কী এমন সমস্যা হয়েছে?” তখন পরিচিত ব্যক্তির কাছে সবকিছু খুলে বললাম। উনি আমাকে উনারই পরিচিত একজন বিজ্ঞ ডাক্তারের ঠিকানা দিলেন এবং খুব তাড়াতাড়ি সেই ডাক্তারের কাছে আমার সহধর্মিণীকে নিয়ে যেতে বললেন। উনার কথা শুনে আমি সেদিন সে-সময়ই ফোনের মাধ্যমে সিরিয়াল লিস্টে নাম লেখালাম। পরদিন বিকালে আমার সহধর্মিণীকে নিয়ে ওই বিজ্ঞ ডাক্তারের কাছে গেলাম। ডাক্তারের চেম্বারে আরও আরও রুগীদের সাথে কিছুক্ষণ বসে থাকার পরই আমার সহধর্মিণীর নাম ডাক পড়লো। ডাক্তার সাহেব রুগীর মুখে বিস্তারিত শুনে তিনটে পরীক্ষা-সহ কিছু ঔষধ লিখে দিলেন। এক-এক করে পরীক্ষাগুলো করানো হলো। রিপোর্ট বের হবে এর পরদিন।

ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরুলাম। ঔষধের দোকান থেকে তিনবেলার ঔষধ কিনলাম। বাসায় এসে রাতে এক-এক করে দুই-তিন পদের ঔষধ খাওয়ালাম। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখন কেমন লাগছে?’ বলল, “কই, আগের মতনই তো!” কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি গতকালের চেয়ে আমার সহধর্মিণী চেহারা- সুরত একটু ভালো। মনে মনে প্রভুকে ডাকতে লাগলাম! সকালেও এক ডোজ ঔষধ খাওয়ালাম। দুপুরবেলাও খাওয়ালাম। বিকালবেলা আবার সহধর্মিণীকে বিজ্ঞ চিকিৎসকের চেম্বারে নিয়ে গেলাম। ডাক্তারের দেওয়া শারীরিক পরীক্ষার রিপোর্টগুলো সংগ্রহ করে ডাক্তারের কাছে গেলাম।

ডাক্তার সাহেব পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট দেখে আবার ৭ দিনের ঔষধ লিখে দিয়ে বললো, “এই ঔষধগুলো ঠিকমত সেবন করে ৭দিন পর যেতে। প্রথমবারের ভিজিটের অর্ধেক মূল্য ভিজিট দিয়ে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরুলাম। ৭ দিনের ঔষধ কিনে বাসায় ফিরলাম। রাতে ঔষধ খাওয়াল। পরদিন সকালবেলা দেখি আমার সহধর্মিণীর শারীরিক অবস্থা গত দুইদিনের চেয়ে অনেক ভালো। চলতে থাকলো ঔষধ। আস্তে-আস্তে সহধর্মিণীও সুস্থ হতে লাগলো। ৭ দিন গত না হতেই আবার বিজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলাম। বিজ্ঞ চিকিৎসক আবার কিছু ঔষধ লিখে দিলেন। কিছু ১৫ দিনের, কিছু ১ মাসের। ঔষধ কিনে বাসায় আসলাম। দিন যতো গত হতে লাগলো, সহধর্মিণীও সেই আগের অবস্থায় ফিরে আসতে শুরু করলো। কেটে গেলো ফেব্রুয়ারি মাস।

একসময় মার্চ মাসের আগমণ ঘটলো। করোনা ভাইরাস নিয়ে দেশের চারদিকে শোরগোল শুরু হয়ে হলো। মার্চ ২০২০ দেশে প্রথম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রুগী সনাক্ত হলো। মার্চের শেষদিকে করোনা ভাইরাসে প্রথম মৃত্যু ঘটলো। সরকার রেডিও, টেলিভিশনে ও জাতীয় পত্রপত্রিকায় করোনা ভাইরাস থেকে নিরাপদ থাকতে দেশের জনগণকে সতর্কতা অবলম্বন করে চলা-ফেরা করতে বললো। পাশাপাশি বিশ্ব রোগ বিশেষজ্ঞ ও দেশের রোগ বিশেষজ্ঞরাও নানারকম পরামর্শ দিতে শুরু করলো। তাতেও যখন করোনা ভাইরাসের উপদ্রব কমানো যাচ্ছিল না, তখনই শুরু হলো লকডাউনের চিন্তা। একসময় সারা দেশই লকডাউনের আওতায় নেওয়া হলো। ঐ লকডাউনের ফলে ধর্মীয় উপসনালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বানিজ্যিক শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে গেলো। এমনকি সরকার দূরপাল্লার যানবাহন-সহ লোকাল যাত্রি পরিবহন ও বহির্বিশ্বের সাথে বিমান চলাচলও বন্ধ করে দিলো। মানুষের রুটিরুজির সংগ্রাম একেবারে থেমে গেলো।

তখন একদিকে শুরু হলো গরিব মানুষের হাহাকার ও ক্ষুধার্তের কান্না। অন্যদিকে বাড়তে লাগলো করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার। তখন দেশের প্রায় ১৭ কোটি জনগণ হয়ে পড়লো একরকম কর্মহীন ঘরবন্দী। জনগণের মনে বিরাজ করতে লাগলো করোনা ভাইরাসের ভয়! আর রাত পোহালে খাবারের চিন্তা। সাথে ভাইরাসের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো দেশের সর্বত্র।

তখন করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে দেশের মানুষ এমন ভীত হয়ে পড়লো যে, কারোর সাধারণ সর্দি-জ্বর হলে, ওই সর্দি-জ্বরের রুগীর পরিবারের সাথে সমাজের আরও দশটা পরিবারের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যেতো। বুড়ো মা-বাবাকেও রাস্তায় ফেলে দেওয়া হতো, যদি সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত হতো। দাদা-দাদি, ভাই-বোন কারোর জ্বর হলেই হতো সর্বনাশ। কোনোকোনো সংসারে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ফাটল ধরতে শুরু করছিল। তখন একদিকে মানুষের ছিলো না কাজকর্ম। অন্যদিকে ছিলো করোনা ভাইরাসের ভয় আর কর্মহীন মানুষের ক্ষুধার চিৎকার।

এমতাবস্থায় দেশে গণমানুষের সরকার সিংহভাগ কর্মহীন দরিদ্র জনগণ ও ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে ঘোষণা দিলো হাজার হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা। ওইসব প্রণোদনার মধ্যে ছিলো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য সুদ বিহীন ঋণ। গরিব সাধারণ মানুষের জন্য ছিলো রিলিফ-সহ নগদ অর্থের যোগান ও বিনামূল্যে করোনা ভাইরাস আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবার কার্যক্রম। যা এখনো দেশে কোথাও-না-কোথাও সেই কার্যক্রম চালু আছে। একসময় ধীরে ধীরে অচল হয়ে পড়া জনজীবনের সবকিছু আবার সচল হতে শুরু করলো। জনজীবনে কিছুটা স্বস্তি নেমে আসতে লাগলো। করোনা ভাইরাসের আক্রমণও কিছুটা হ্রাস পেতে শুরু করলো। মৃত্যুর হারও কমতে লাগলো।

পরিবর্তন ঘটতে শুরু হলো মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কিছু অভ্যাস। যেমন- মুখে মাস্ক পড়া। নিয়মিত হাত ধোয়া। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। স্যানিটাইজার ব্যবহার করা। সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা-রাতে গরম গরম লাল বা রং চা সেবন করা। ঘরের বাহির না হওয়া। দিনে অত্যন্ত দুই একবার ব্যায়াম করা। সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা-সহ আরও অনেক নিয়মকানুন। করোনা ভাইরাস থেকে দেশের জনগণকে বাঁচতে এসব নিয়ম দিক নির্দেশনাগুলো ছিলো দেশের বিজ্ঞ চিকিৎসকদের। এছাড়াও নির্দেশ ছিলো, কারোর সামান্য সর্দি-কাশি হলে সাথে সাথে নিকটস্থ ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হওয়া। অমুক নাম্বারে কল করে যোগাযোগ করা। তমুক নাম্বার থেকে সাজেশন নেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। করোনা ভাইরাস আক্রমণের ভয়ে দেশের জনগণও বিজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ মেনে চলতে থাকলো সবাই। একসময় মার্চমাস পেরিয়ে এপ্রিল, মে, জুন, জুলাই, আগষ্ট গত হতে লাগলো।

এরমধ্যেই শুরু হলো আমার বাম হাতের অনামিকা আঙুলে ব্যথা। প্রচণ্ড ব্যথা। মাঝেমধ্যে আঙুলের ব্যথায় পুরো হাতই অবস হয়ে যেতো। এভাবে দিন যায়, সপ্তাহ গড়ায়, কিন্তু আঙুলের ব্যথা নিরাময় হচ্ছিল না। বরং দিন-দিন বেড়েই চলছিল। তারপর নিকটস্থ ফার্মেসি থেকে ব্যথার ঔষধ কিনে সেবন করতে লাগলাম। কিন্তু তাতেও যখন কোনও উপকার পাচ্ছিলাম না, তখন পরিচিত এক ব্যক্তির সাথে নিজের হাতের আঙুলের সমস্যার কথা বললাম। উনি নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে চাকরি করতেন। উনি আমাকে হারের (অর্থোপেডিক্স) ডাক্তার দেখাতে বললেন। কিন্তু হারের ডাক্তার সম্বন্ধে আমার তেমন ধারণা ছিলো না বলে, আমি উনার মাধ্যমেই নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের সামনে থাকা এক হারের ডাক্তারের কাছে গেলাম। ওই ডাক্তারের ভিজিটি ছিলো ৮০০/= টাকা।

সিরিয়ালে নাম ডাক পড়লে আমি-সহ পরিচিত ব্যক্তি ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকলাম। করোনা কালে বিজ্ঞ হারের ডাক্তারের চেম্বারে প্রবেশ করে মনে হচ্ছিল যে, আমি যেন চাঁদের দেশে অবস্থান করছি। আর বিজ্ঞ ডাক্তার সাহেবকেও দেখা যাচ্ছিল চাঁদের নভোচারী। ডাক্তারের শরীরে ধপধপে সাদা প্লাস্টিকের জামা। যেটাকে বলা হয় পিপি। হাতে ডাবল গ্লাভস। মুখে ডাবল মাস্ক। চোখে বড় আকারের চাঁদের দেশে যাওয়া নভোচারীদের মতো চশমা। সামনে দাঁড়ানো আছে ডাক্তারকে সাহায্যকারী পিয়ন বা উনার কর্মচারী। আমি সত্যি ভয় পেলাম! অবাকও হলাম। কিন্তু এ-বিষয়ে কিছু বলার সুযোগ না থাকায়, কিছুই বললাম না, জিজ্ঞেসও করলাম না। শুধু আমাকে সাথে করে নিয়ে যাওয়া পরিচিত লোকটাকে কানে-কানে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ডাক্তার সাহেবের এ-অবস্থা কেন?’ জবাবে উনি বললো, “ডাক্তার সাহেব করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলো। গত একমাস আগে ডাক্তার সাহেব ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে থেকে ভাইরাস মুক্ত হয়েছেন। তাই উনার এই পোশাক, এই ড্রেস। উনি এখনও করোনা ভাইরাসের ভয়ে ভয়ে আছেন।” শুনলাম সব কথা। বুঝলাম অনেককিছু।

আমি ডাক্তার সাহেবের সামনা-সামনি বসলাম। আমার সামনে দেখতে পেলাম সাদা চকচকা কাঁচের গ্লাসের বাক্স। দেখতে হুবহু সিনেমা হলের টিকেট কাউন্টারের বুকিং এর মতো। বসার উপরিভাগে হাত ঢুকানোর জন্য বড় আকারের ছিদ্র আছে। ডাক্তার সাহেব আমার সমস্যা জানতে চাইলে, আমি আমার সমস্যার কথা বললাম। উনি আমাকে হাতের আঙুল দেখাতে বললেন। আমি গ্লাস বক্সের সেই ছিদ্র দিয়ে নিজের হাত ঢুকাতেই ডাক্তার সাহেবের কর্মচারী আমাকে সরাসরি হাত ঢুকাতে বারণ করলেন। আমি আর হাত ঢোকালাম না। চুপচাপ বসে আছি। ডাক্তার সাহেবের কর্মচারী একটা বড় স্যানিটাইজারের বোতল আমার সামনে এনে আমাকে হাত বাড়াতে বললো। আমি হাত বাড়াতেই আমার বাম হাতে স্প্রে করা শুরু করলো। দুই-তিন বার স্প্রে করার পর হাত ঢুকানোর অনুমতি দিলো। আমি গ্লাসের ছিদ্র দিয়ে বামহাত ঢোকালাম। ডাক্তার সাহেব আমার বাম হাতের ব্যথাযুক্ত আঙুলটা টেনে-টুনে, আর নেড়ে-চেড়ে দেখলো। যেই আঙুলটা ব্যথা, সেই আঙুলে সিপ্টিপিন দিয়ে গাঁই মেরে বললো, আমি টের পাচ্ছি কি-না। আমি বললাম, ‘টের পাচ্ছি এবং ব্যথাও পাচ্ছি!’ আমার কথা শুনে ডাক্তার সাহেব উনার কর্মচারীকে উনার হাতে স্যানিটাইজার দিয়ে স্প্রে করতে বললো।

কর্মচারী সাথে সাথে স্যানিটাইজারের বড় বোতল এনে প্যাঁচপ্যাঁচ করে ডাক্তার সাহেবের হাতে দুই-তিন বার স্প্রে করলো। এরপর ডাক্তার সাহেব উনার প্রেসক্রিপশন লেখার পেইড টেনে কলম দিয়ে লিখতে লাগলো। ডেসক্রিপশন লিখছে, আমি তাকিয়ে আছি। উনি বাম সাইটে দুই-তিনটে ঔষধ লিখে ডান সাইটে কী কী পরীক্ষা করতে হবে, তা লিখলেন। প্রেসক্রিপশন আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে সাথে যাওয়া লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী কী পরীক্ষা করতে হবে?’ সাথে যাওয়া লোকটি প্রেসক্রিপশন দেখে বললো, “প্রথমে করোনা ভাইরাস নমুনা পরীক্ষা করতে হবে। তারপর হাত ও আঙুলের রগের দুইটা পরীক্ষা করতে হবে।” সাথে যাওয়া লোকটিকে বললাম, ‘আমি করোনা ভাইরাস নমুনা পরীক্ষা করবো না। এতে আমার মরণ হলেও না। মোটকথা চিকিৎসার দরকারই নেই।’ আমার কথাগুলো ডাক্তার সাহেব শুনছিলেন, কিন্তু কিছুই বললো না। সাথে যাওয়া লোকটি আমার কথা শুনে একরকম অবাকই হলেন।

ডাক্তারের ভিজিট ৮০০/= টাকা বুঝিয়ে দিয়ে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে বাইরে এলাম। দুইজনে চা-সিগারেট পান করলাম। আমি আমার সাথে যাওয়া লোকটিকে বললাম, ‘দাদা, আপনি দয়া করে আবার একটু ডাক্তারের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন, করোনা ভাইরাস নমুনা পরীক্ষা ছাড়া চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্র দেওয়া যায় কি-না।’ উনি আমার কথা শুনে ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরে এসে বললো, “না দাদা, করোনা নমুনা পরীক্ষা করা ছাড়া উনি চিকিৎসা করবেন না।” সাথে যাওয়া লোকটির কথা শুনে আমি আর কিছুই বললাম না, সোজা বাসায় ফিরে এলাম।

এর দুইদিন পর পরিচিত লোকটার সাথে দেখা। জিজ্ঞেস করলো, “দাদা হাতের ব্যথার চিকিৎসার কী খবর? পরীক্ষা কবে করাবেন?” আমি বললাম, ‘না দাদা, আমি করোনা ভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা করতে নারাজ! লোকটা জিজ্ঞেস করলো, “কেন?” বললাম, ‘যেই দেশে ঘাতক করোনা ভাইরাস নমুনা পরীক্ষা নিয়ে সর্বত্র দুর্নীতি আর তেলেসমাতি চলছে, সেই দেশে এই জটিল পরীক্ষার কী এমন গ্যারান্টি আছে? দেখতেই পারছেন প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই সবার চোখে পড়ে নমুনা পরীক্ষার তেলেসমাতির খবর। আর আমি নাহয় পরীক্ষা করালাম, দাদা। কিন্তু পরীক্ষা করার পর যদি ভুল রিপোর্টে আমার পজেটিভ আসে, তাহলে আমার গরিবের সংসার-সহ ভাড়াটিয়া বাড়ির সবাইকে লকডাউনে ফেলে রাখা হবে। তাই আর নমুনা পরীক্ষা অন্তত আমি করবো না। এতে আমার কিছু হলে হোক।’ আমার কথা শুনে লোকটা আর কিছুই বললো না, সোজা উনার কাজে উনি চলে গেলো। আমিও আমার সিদ্ধান্তের মাঝেই রয়ে গেলাম। ভাবেই গত হয়ে গেলো বেশ কয়েক মাস।

কিন্তু আমি আগের চেয়ে অনেক ভালো আছি। আমার সহধর্মিণীও ভালো আছে। জানি না সামনের দিনগুলোতে কী হয়! আশা করি সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও যখন করোনা ভাইরাসের ভ্যাক্সিন প্রয়োগ শুরু হয়েছে। তখন সামনের দিনগুলো ভালোভাবেই অতিবাহিত হবে। রোগ আসে। রোগ নিরাময়ের ঔষধও আবিস্কার হয়। দিন মাস বছর গত হয়। ফেলে আসা দিনগুলো শুধু ইতিহাস হয়ে রয়। এটাও আমাদের জীবনেরই একটা ইতিহাস। যার শিরোনাম করোনা কালের ইতিহাস।

শীতলক্ষ্যার মরণব্যাধি

92915_o

শীতলক্ষ্যার মরণব্যাধি দেখতে যদি চাও,
সবাই মিলে বন্দর থানাধীন চৌরপরা যাও!
দেখবে সেথা শীতলক্ষায় পঁচা পানির ঢেউ,
নদী আজ হয়েছে খাল দেখে না যে কেউ।

পানির গন্ধে পাখি কাঁদে, কাঁদে নগরবাসী,
পঁচা গন্ধে কেড়ে নিলো সবার মুখের হাসি।
কলসি নিয়ে আসে না কেউ নদীর পানি নিতে,
কৃষককেও দেখিনা আর জমিতে পানি দিতে।

নদীর পানি আগে ছিলো ঝকঝকা পরিস্কার,
এখন দেখবে শীতলক্ষ্যায় ময়লার আবিস্কার।
বিশ্বাস যদি নাহয় কারোর দেখো সামনে এসে,
নদীর সামনে এসে দেখবে ময়লা আবর্জনা ভাসে।

নদীর পাড়ে উড়ে না আর মাছরাঙা, বক, কাক,
তাইনা দেখে রাষ্ট্র বলে, যাক– সব গোল্লায় যাক!
নদী মরছে আরও, তাতে কার কী আসে-যায়,
জনপ্রতিনিধিও বলে না কথা, থাকে স্বার্থের ধান্দায়!

সৎকর্মে সুখ

9996817_o

টাকা থাকলেই হয় না সুখ
সুখ আসে সবার সৎকর্মে,
পুরোহিতেরও থাকে শত দুখ
যদি মন না থাকে তার ধর্মে।
স্বর্গের সুখ দেখে না কেউ
দেখে সবাই জীবন থাকতে,
মৃত্যুর পরে সুখে আছে কেউ
তা শুনেছে কেউ কাউকে বলতে?
ধর্ম হলো সদা সৎপথে চলা
অসৎ পথে আসে দুখ,
সৎকর্মে নেই আপদ-বালা
শত কষ্টের মাঝেও পায় সুখ।

নদীর চরে জেলের নৌকা

6547_o

নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীর আজ অস্তিত্ব হারা,
নদীর মরণদশায় মরছে নদী পাড়ে থাকে যারা।
নদীগুলোতে আজ কালো কুচকুচে বিষাক্ত পানি,
দুর্গন্ধে হয় দমবন্ধ, মানুষ নাকে চাপে রুমাল খানি।

নদীতে শোনা যায় না ঢেউয়ের কোনও শব্দ,
নদীগুলো আজ রোগাক্রান্ত, তাই শব্দহীন স্তব্ধ।
তবুও নদী গিলে খেতে চলছে কতো হানাহানি,
শিল্পপতিরা দিনরাত নদীতে মেশাচ্ছে বিষাক্ত পানি।

শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, ধলেশ্বরী, করতোয়া,
পদ্মা, মেঘনা নদীতে হয়না কারোর কাপড় ধোয়া।
দেশের নদীগুলো আজ শুকিয়ে হয়েছে চৌচির,
নদীতে নেই মাছ, শুধু পোকামাকড় করে বিরবির।

নদী পাড়ের জেলেরা-সহ মানুষগুলো বড় অসহায়,
জেলেদের চলে না সংসার, কৃষক করে হায় হায়।
নদীর চর জেগেছে, জেলের নৌকা উঠেছে চরে,
জেলেদের ঘরে কান্না, শহরবাসী নানা রোগে মরে।

শুকিয়েছে পানি, বেড়েছে জেলেদের হাহাকার,
বিষাক্ত পানিতে বেড়েছে রোগ, শহরবাসী নির্বিকার।
স্বচ্ছ পানি নেই, পানের অযোগ্য, ফলে না ফসল,
পানির গন্ধে পাখিরাও কাঁদে, মরছে দেশের সকল।

তুমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু

197886

তুমি মোদের জাতির পিতা
তুমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান,
তুমি মোদের মুক্তির দিশারী
তুমি বন্দি থেকে মুক্তির শ্লোগান।
তুমি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি
তুমি বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক,
তুমি বাংলার ইতিহাস রচনাকারী
তুমি শুনেছ কতো চক্রান্তকারীদের দমক!
তুমি মোদের গর্ব অহংকার
তুমি বিশ্ব মানচিত্রে স্থায়ী নিশানা,
তুমি লাল-সবুজের পতাকা
তুমি পদ্মা মেঘনা যমুনা।
তুমি দিয়েছ উপহার বাংলাদেশ
তুমি রয়েছ ইতিহাসের পাতায় পাতায়,
তুমি দিয়েছ বুকের রক্ত ঢেলে
তুমি অমর, থাকবে লেখকের খাতায়।
তুমি মোদের আলোর দিশা
তুমি স্বাধীন বাংলার জয়বাংলা শ্লোগান,
তুমি মোদের অন্ধকারের আলো
তুমি বঙ্গবন্ধু, তুমি মহান।
___________________

.
ছবি এঁকেছেন, চিত্রশিল্পী লিটন–
আরামবাগ, নারায়ণগঞ্জ।

জীবনের গল্প-৩০ শেষ পর্ব

Image-64-1-1

জীবনের গল্প-২৯ এর শেষাংশ: রাত তখন আনুমানিক ৮ টার মতন বাজে। দিদির বাড়িতে তখনো কেউ ঘুমায়নি। সবাই ঘরে বসে টেলিভিশনে কবিগুরু রবীন্দ্র জয়ন্তীর অনুষ্ঠান দেখতে ছিল।

আমার বড়দি’র বাড়িতে দুইজন ব্যাচেলর থাকতো। ওদের বাড়ি ছিলো মেদিনীপুর। ওরা বীর পাড়ায় অবস্থিত একটা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে চাকরি করতো। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর ওই দুইজন ছেলের সাথে ঘুমানোর জায়গা হলো। পরদিন সকাল বেলা বড়দি আমাকে ঘুম থেকে জাগালো। বেলা তখন সকাল দশটার মতো বাজে। তখন ভাড়াটিয়া ছেলে দুটোও ঘরে ছিলো না। ওরা সকাল আটটার সাথে সাথেই ওদের কাজে চলে গিয়েছিল। দিদি আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ওখানেও কি তুই এতো দেরি করে ঘুম থেকে উঠিস?’ বললাম, ‘না দিদি, অনেক রাতে ঘুমিয়েছি তো, তাই একটু দেরিতে ঘুম ভাঙলো।’ এরপর ঘুম থেকে উঠে স্নানঘর থেকে হাত-মুখ ধুলাম। চা-বিস্কুট খেয়ে বের হলাম, ভুটানের উদ্দেশ্যে।

আমার বড়দি’র বাড়ি থেকে ভুটানের গুমটু’র ভাড়া ছিলো মাত্র ৩টাকা। দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটার। যানবাহন বলতে ছিলো জীপগাড়ি। মনে সাহস রেখে এদিক-সেদিক না তাকিয়ে গেলাম ভুটানের গুমটু এলাকায়। বিকাল পর্যন্ত ঘুরে-ফিরে দেখে আবার দিদির বাড়ি ফিরে আসি। আবার ক’দিন পর গেলাম ভুটানেরই একটা জায়গায়। জায়গাটার নাম ফুলসিলিং। আমার বড়িদি’র বাড়ি থেকে ফুলসিলিঙের ভাড়া ২০ টাকা। দূরত্ব অনেক। আবার আরেকদিন গেলাম ভুটানের সামসি এলাকায়। মোটকথা বীরপাড়া এলাকার চারদিকে থাকা ভুটানের সব এলাকা ঘুরে-ফিরে দেখতে দেখতে একসময় আমার পকেট ফাঁকা হয়ে গেলো। শেষমেশ উপায়ন্তর না দেখে আমার মেজো ভাগনার সাথে গাড়ির গ্যারেজে হেলপার হিসেবে কাজ করতে থাকি। বেতন পেতাম প্রতি সপ্তাহে ভারতীয় টাকা মাত্র ১০০/= টাকা। সপ্তাহে এই নামমাত্র ১০০/= টাকা হাতে পেয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে ফিনিশ করে আবার পকেট শূন্য হয়ে সপ্তাহের বাকি দিনগুলো অতিবাহিত করতে হতো। এরপর আবার পকেট গরম করার জন্য আশায় থাকতাম রবিবারে অপেক্ষায়।

এভাবে থাকতে থাকতে বীর পাড়ায় কাটিয়ে দিলাম প্রায় এক বছরের মতো। একসময় দেখলাম আমার বড়দি, জামাইবাবু-সহ ভাগিনা-ভাগ্নিরাও কেমন যেন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। যখন-তখনই দেখতাম তাদের চোখে-মুখে বিরক্তি ভাব। তারপর নিজে নিজেই বাংলাদেশে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিলাম। নন্দলাল নামে একজন লোকের সাহায্য নিয়ে বর্ডার পাড় করার দালাল খুঁজতে লাগলাম। বর্ডার পাড় করার দালালও পেয়ে গেলাম। কিন্তু আমার কাছে বাংলাদেশে আসার মতো কোনও টাকার ব্যবস্থা ছিলো না। তারপর তিনমাস পর্যন্ত পকেট খরচ কমিয়ে দিয়ে আসার খরচ জোগাড় করেছিলাম। আমি যে বিগত তিনমাস যাবত আসার প্রস্তুতি নিয়ে চলছিলাম, তা আর দিদির বাড়ির কাউকে জানতে দেইনি।

যেদিন বড়দি’র বাড়ি থেকে বাংলাদেশ চলে আসবো, তার আগের দিন রাতে বড়দি’র কাছে বলেছিলাম, ‘আগামীকালই আমি বাংলাদেশ চলে যাবো।’ আমার কথা শুনে বাড়ির সবাই হায়-হুতাশ শুরু করে দিলো। বলতে লাগলো, ‘কী ব্যাপার, কী হয়েছে, আগে বলিসনি কেন? আগামীকালই কেন যাবি? আরো কয়েকদিন থেকে যা’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমি কারোর কথায় গুরুত্ব না দিয়ে সোজা ব্যাচেলর ছেলে দুটোর সাথে শুয়ে রইলাম। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজের যাকিছু ছিলো, সেগুলো ব্যাগের ভেতরে ভরতে লাগলাম। বড়দি সামনে এসে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বললো, ‘সত্যি তুই এখনই রওনা দিচ্ছিস?’ বললাম, ‘হ্যাঁ দিদি, আমি এখনই রওনা হবো।’ জামাইবাবু থাকতে বললো, ভাগিনারা থাকতে বললো। কিন্তু না, আমি আর কারোর কথা শুনলাম না। হাতমুখ ধুয়ে জামা-প্যান্ট পরে যখন ব্যাগ কাঁধে তুললাম, তখন জামাইবাবু বললো, ‘একটু দেরি করো আমি বীরপাড়া বাজার থেকে আসছি।’ এই বলেই কামাইবাবু তাড়াতাড়ি বাইসাইকেল নিয়ে সোজা বীরপাড়া বাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। আমি আর জামাইবাবু কথায় গুরুত্ব দিলাম না, আশেপাশে থাকা বাড়ির সকলের কাছ থেকে বলে-কয়ে ব্যাগ কাঁধে ফেলে সোজা মেইন রোডের দিকে হাঁটা ধরলাম। উদ্দেশ্য গ্যারেজ লাইনে গিয়ে আমাকে সাহায্যকারী নন্দলাল’র কাছে যাবো। তারপর গ্যারেজ লাইনের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা দালালের বাড়ির ঠিকানায় রওনা দিবো।

এই উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যাগ কাঁধে ফেলে বড়দি’র বাড়ি থেকে বের হয়ে হাঁটতে লাগলাম। আমার পেছনে বড়দি-সহ অনেক মহিলারা গ্যারেজ লাইন মেইন রোড পর্যন্ত আসলো। জামাইবাবুও বীরপাড়া বাজার থেকে বাড়ি এসে আমাকে না দেখে গ্যারেজ লাইনে এসে কাঁধের ব্যাগ টেনে ধরলো। জামাইবাবু নিজের হাতেই ব্যাগের ভেতরে একটা শাড়ী কাপড়, আর এক পিস জামার কাপড় ও এক পিস প্যান্টের কাপড় ভরে দিলো।

কিছুক্ষণ পর নন্দলাল আসলে দুইজনে রওনা হলাম বর্ডার এলাকায়। ভারত-বাংলাদের বর্ডার এলাকা হলো রংপুর বুড়িমারী স্থলবন্দর। ভারতের ভেতরে বর্ডার এলাকায় গিয়ে সোজা চলে গেলাম দালালের বাড়ি। দালাল ছিলো নন্দলাল’র আগে থেকে পরিচিত। আমার সাথে টাকা ছিলো ভারতীয় ২,৮০০/= টাকা। ভারতীয় দালালের সাথে কথা হলো আমাকে বর্ডার পাড় করে ঢাকা বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দেওয়া। বিনিময়ে দালালকে দিতে হবে ভারতীয় ৬০০/= টাকা। তারপর আমার কাছে থাকা ভারতীয় টাকা থেকে দালালকে ৬০০/= টাকা দিয়ে বাদবাকি ২,২০০/= টাকা ভাঙানো হলো।

এরপর নন্দলাল আমাকে দালালের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে উনি উনার গন্তব্যে চলে গেলো। আমি থেকে যাই দালালদের বাড়িতে। কথা ছিলো কিছুক্ষণ পরই বর্ডার পাড় করে আমাকে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দিবে। কিন্তু না, তা আর হয়নি। ওরা আরও যাত্রী সংগ্রহ করার জন্য আমাকে তাদের ঘরে একরকম বন্দি করে রাখলো। সকাল ১১টা থেকে বিকাল পর্যন্ত যখন আর কোনও যাত্রী সংগ্রহ করতে পারছিলো না, তখন আমার সাথে থাকা টাকাগুলো জোর করে কেড়ে নিয়ে গেলো। এমনকি বড়দি’র দেওয়া শাড়ি, জামার কাপড়, প্যান্টের কাপড়-সহ আমার আরও ব্যবহারিক জামা কাপড়গুলো ছিনিয়ে নিলো। এরপর রাতের আঁধারে বাংলাদেশের ভেতরে এনে একটা বাড়ির পেছনে রেখে বললো, ‘এখানে একটু দাঁড়ান, আমরা বাংলাদেশের দালালের সাথে কথা বলে আসি।’ আমি নিরুপায় হয়ে তাদের কথামতো ওই বাড়ির পেছনেই দালালদের জন্য ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করতে থাকি। কিন্তু না, তারা আর আসলো না! ওরা আমাকে ওই বাড়ির পেছনে রেখেই পালিয়ে গেলো।

আমি তখন নিরুপায় হয়ে খালি ব্যাগটা হাতে নিয়ে ভয় ভয় মনে বাড়ির ভেতরে গিয়ে কেউ আছেন বলে ডাক দিলাম। আমার গলার আওয়াজ পেয়ে ঘর থেকে কয়েকজন নারী-পুরুষ বের হলো। আমি ছিলাম বাড়ির উঠানে দাঁড়ানো। আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কে আপনি? এখানে এতো রাতে কী করে এলেন? কোথায় যাবেন?’ তাদের কথার জবাবে সবকিছু খুলে বললাম। কিন্তু কেউ আমার কথা বিশ্বাস করছিলো না। কেউ বলতে লাগলো, ‘বিডিআর খবর দিয়ে তাদের হাতে উঠিয়ে দিতে।’ ওই বাড়ির একজন মুরুব্বি বললো, ‘লোকটা দুষ্কৃতিকারী হবে।’ আবার দুইএক জন বসলো, ‘না, দুষ্কৃতিকারী হলে এভাবে এখানে আসতোই না।’ তারপর তাদের মধ্যে একজন আমার ব্যাগ সহ সারা শরীর তল্লাশি শুরু করে দিলো।

তল্লাসি করে কিছুই যখন পায়নি, তখন ওদের একটু মায়া মায়া ভাব হলো। আমাকে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল। ভাত নেই, একমুঠো চাল ভেজে সামনে এনে দিল। খেতে পারলাম না। এক গেলাস জল পান করে বসে রইলাম রাত পোহানোর আশায়। রাত শেষে সকাল হলো। ওরা আমাকে বাংলাদেশের বুড়িমারী স্থল বন্দর নিয়ে এলো। ওরা আমাকে বুড়িমারী একটা বাস কাউন্টার দেখিয়ে দিয়ে চলে গেল। বিনিময়ে আমার হাতের ঘড়িটা ওরা নিয়ে গেলো। আমি ধীরেসুস্থে বাস কাউন্টারের ভেতরে প্রবেশ করলাম। বাস কাউন্টারে দায়িত্বে থাকা ম্যানেজার আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কোথায় যাবেন?’ বললাম, ‘দাদা আমিতো যাবো ঢাকা। তবে আমি দুর্ঘটনার শিকার!’ বললেন, ‘কোথায় এবং কীভাবে?’ সবকিছু খুলে বললাম। ম্যানেজার সাহেব শুনলেন। আমাকে হোটেলে নিয়ে খাওয়ালেন। ঢাকা পর্যন্ত একটা সিট দিয়ে দিলেন। সাথে ১০০ টাকাও দিলেন। কনট্রাক্টরকে বলে দিলেন, ‘রাস্তায় কিছু খাবার কিনে দিতে।’ গাড়ি ছাড়ল সন্ধ্যার সময়। ঢাকা গাবতলি পৌঁছলাম সকাল ৮ টায়। গাবতলি থেকে আসলাম সদরঘাট। লঞ্চে চড়ে গেলাম, আমার শ্বশুরবাড়ি। যাওয়ার সময় ছেলে-মেয়েদের জন্যও কিছু কিনে নিতে পারিনি, গেলাম খালি হাতে। তবুও আমাকে দেখে আমার ছেলে-মেয়ে দুটো খুবই খুশি। বলতে লাগলো, ‘আমাদের বাবা এসেছে।’ অথচ আমি ভারত গেলাম বড় আশা করে। আর দেশে ফিরলাম নিঃস্ব হয়ে।

যাইহোক, শ্বশুরবাড়িতে দুইদিন ঘোরাফেরা করে কাটালাম। তারপর তাদের বাড়ির নিকটে সুবচনী বাজারের পাশে সান স্লিক টেক্সটাইল মিলে চাকরি নিলাম। সেখানে কিছুদিন চাকরি করে আবার চলে গেলাম নারায়ণগঞ্জ। চাকরি নিলাম আগে কাজ করা মহিউদ্দিন স্পেশালাইজড টেক্সটাইল মিলে। একসময় ছেলে-মেয়ে দুটোকে স্কুলে ভর্তি করালাম। মেয়ে এসএসসি পাস করার পর ২০০৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে গোপালগঞ্জের এক ছেলের সাথে বিয়ে দিলাম। ছেলে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ২০১১ সালের ২০ মে হঠাৎ না ফেরার দেশে চলে গেলো। ছেলের রেখে যাওয়া Nokia c-3 মোবাইল দিয়ে ইন্টারনেটের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়লাম। একসময় ব্লগ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম নামে একটা ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করে নোকিয়া মোবাইলে ইংরেজি অক্ষরে লিখে একটা লেখা জমা দিলাম। সময়টা তখন ২০১৫ সাল।

কিন্তু ওই ব্লগে ইংরেজি লেখা প্রকাশ করা হয় না। আমিও দীর্ঘদিন ব্লগে চুপি দিই না। অনেকদিন পর ওই ব্লগে চুপি দিয়ে দেখি আমার ইংরেজি অক্ষরের লেখা বাংলা করা হয়েছে এবং লেখার শিরোনাম বাংলায় লিখতে অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু নোকিয়া মোবাইলে তো বাংলা লেখা যায় না। আমার অবস্থা তখন “কী করি ভেবে মরি” এই অবস্থার মতো। তারপর আমি যাদের কাজ করতাম, তাদের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার-কর্জ করে একটা সিম্ফনি এন্ড্রয়েড মোবাইল কিনে ওই ব্লগে জমা দেওয়া লেখার শিরোনাম বাংলায় লিখলাম, “আমিও মানুষ”। এরপর লেখা প্রকাশ হলো। লেখায় অনেক ব্লগাররা মন্তব্য করলো। সেসব মন্তব্যের জবাব দিতে গিয়েই ব্লগ, ফেসবুক -সহ অনলাইন ভিত্তিক দিনলিপি গুলোতে নিয়মিত লেখালেখির সাথে মিশে গেলাম।

একসময় ২০১৭ সালে ব্লগ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম থেকে সবার সহযোগিতায় সম্মাননাও পেয়েছিলাম। সেই থেকে আজ অবধি অভাবী সংসারের একবেলা খাবার না থাকলেও কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হয় আমার মোবাইলে ইন্টারনেট না থাকলে আর লেখালেখি করতে না পারলে। বর্তমানে এই লেখালেখিই যেন আমার অবশিষ্ট জীবনের নিশ্বাস। মনে হয় লেখালেখি বন্ধ হবে তো আমার নিঃশ্বাসও বন্ধ হয়ে যাবে। তাই শত চেষ্টা করেও লেখালেখি বন্ধ করতে পারছি না। শত কষ্টের মাঝেও কিছু-না-কিছু লিখেই যাচ্ছি। কিন্তু আমার এই নগন্য লেখা কে পড়লো আর কে পড়লো না, সেদিকে আমি ফিরে তাকাই না। আমি লিখেই যাচ্ছি, আমার শহরের গল্প, দুখী মানুষের গল্প আর আমার চলিত জীবনের গল্প।
সমাপ্ত।

জীবনের গল্প-১
জীবনের গল্প-২
জীবনের গল্প-৩
জীবনের গল্প-৪
জীবনের গল্প-৫
জীবনের গল্প-৬
জীবনের গল্প-৭
জীবনের গল্প-৮
জীবনের গল্প-৯
জীবনের গল্প-১০
জীবনের গল্প-১১
জীবনের গল্প-১২
জীবনের গল্প-১৩
জীবনের গল্প-১৪
জীবনের গল্প-১৫
জীবনের গল্প-১৬
জীবনের গল্প-১৭
জীবনের গল্প-১৮
জীবনের গল্প-১৯
জীবনের গল্প-২০
জীবনের গল্প-২১
জীবনের গল্প-২২
জীবনের গল্প-২৩
জীবনের গল্প-২৪
জীবনের গল্প-২৫
জীবনের গল্প-২৬
জীবনের গল্প-২৭
জীবনের গল্প-২৮
জীবনের গল্প-২৯

জীবনের গল্প-২৯

Image-64-1

জীবনের গল্প-২৮ এর শেষাংশ: বুঝেশুঝেই দিবে। আমি বড়দি’র কথা শুনে মুচকি হেসে দিদির বাড়ির ভেতরে গেলাম। আর মনে মনে বলতে লাগলাম, ‘দিদি আমরা বাংলাদেশি লোকেরা এরকমই। খরচের কাছে আমরা কখনোই হার মানি না।’

দিদির সাথে গেলাম বাড়ির ভেতরে। সাথে দিদির বাড়ির আশেপাশে থাকা আরও কয়েকজন ছিলো। এর পরমুহূর্তেই মধ্যেই দিদির বাড়ির আশেপাশের বাড়িতে খবর পৌঁছে গেলো। রবিন্দ্র নগর কলোনি এরিয়াতে থাকা প্রত্যেক বাড়ির মহিলা-পুরুষ দিদির বাড়ি আসতে লাগলো। সবাই বলতে লাগলো, ‘এতো বছর পর বুঝি দিদির কথা মনে পড়লো?’ কেউ আবার তাদের বাংলাদেশে থাকা বাড়ি-ঘরের কথাও জিজ্ঞেস করতে লাগলো। ওখানে বসবাসকারী বেশিরভাগ বাঙালি হিন্দুদের পূর্বপুরুষদের বাড়ি একসময় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলাশহরে ছিলো। কারোর বাড়ি ফরিদপুর, কারোর বাড়ি মুন্সিগঞ্জ, কারোর বাড়ি গোপালগঞ্জ। কিন্তু নারায়ণগঞ্জে কারোর আত্মীয়স্বজনের বাড়ি নেই। তাই কেউ নারায়ণগঞ্জের কথা জিজ্ঞেস করেনি। এমনকি আমার জন্মভূমি নোয়াখালীর কথাও কেউ জিজ্ঞেস করেনি। আমি তখন সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলাম, ‘এখানে থাকা কারোর বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সাইডে আছে কি-না?’ তখন আমার কথা শুনে সবাই বলছে, ‘না গো না। নারায়ণগঞ্জ নাম শুনেছি, কিন্তু কখনো সেখানে যাইনি। আমাদের কোনও আত্মীয়স্বজনও নারায়ণগঞ্জ থাকে না।’

আমার বড়দি বললেন, ‘আমার যখন বিয়ে হয়েছিল, তারও আগে থেকেই আমার বাবা, বড়দা নারায়ণগঞ্জ থাকতেন।’ বড়দির কথার শুনে আমি বললাম, ‘দিদি বাবা যেখানে চাকরি করতেন বা থাকতেন, সেই মিলের নামটা কি আপনার মনে আছে?’ আমার বড়দি বললেন, ‘নামটাতো পেটে আছে, কিন্তু মুখে নেই!’ আমি বললাম, সেই মিলের নামটা ছিল, আদর্শ কটন মিলস্। আমার কথা শুনে আমার বড়দি আবারও কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘হ্যাঁ রে হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস। ঐ আদর্শ মিলে মায়ের সাথে আমিও একবার গিয়েছিলাম। বড়দাও সেখানেই চাকরি করতেন, তাইনা রে?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ দিদি, দাদাও সেই মিলেই চাকরি করতেন।’

তখন আমার কথা শুনে বড়দি, জামাইবাবু, ভাগিনা-ভাগ্নি-সহ সবাই শতভাগ নিশ্চিত হতে পেরেছিল যে, এটা আমার ভাই, আর এটা আমার শালা, আর এটা আমাদের মামা। কিন্তু এর আগে আমি তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছিলাম বড়দি, আর জামাইবাবু দুইজনের মনের ভেতরে কেমন যেন একরকম সন্দেহের ভাব! সন্দেহের কারণ হলো, “ও-কি সত্যিই সেই কোলের শিশু নিতাই? নাকি অন্য কেউ?” যখন ঠিকঠাক সব বলতে পেরেছিলাম, তখনই তাদের মনের ভেতরকার সন্দেহটা দূর হয়েছিলো।

এর মধ্যে বড়দির কাছে মা-বাবা স্বর্গীয় হবার কথা বললাম। জামাইবাবু, দিদি দুইজনেই হায়-আফসোস করলেন। দিদি মা-বাবার কথা বলে কাঁদলেন। দিদি আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুই কি বিয়ে করেছিস?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ দিদি। একটা গরিবের মেয়েকে বিয়ে করেছি। দুইজন বাচ্চাকাচ্চাও আছে। একজন মেয়ে, আরেকজন ছেলে।’ তারপর আমার বড়দি আমাকে দেখতে আসা সবাইকে একটা করে মিষ্টি দিলো। সবাই তখন হাসাহাসি করে বলতে লাগলো, ‘দিদি, ‘আপনার ভাই কি বাংলাদেশ থেকে মিষ্টি গুলো এনেছে নাকি?’ আমি বললাম, ‘আমি যখন বাংলাদেশি, মনে করেন মিষ্টিও বাংলাদেশি। বলতে পারি আপনাদের এখানে এমন সুস্বাদু মিষ্টি পাওয়া যাবে না, তা আমি শতভাগ নিশ্চিত। এগুলো উন্নতমানের এবং খুবই দামি মিষ্টি।’ আমার কথা শুনে সবাই হাসতে লাগলো। আবার কেউ কেউ বলতে লাগলো, ‘জয় বাংলার লোক বড় চালু।’ আমার বড়দি বললো, চালু না হলে কি আর বাংলাদেশ থেকে একা একা এখানে আসতে পেরেছে? যাক না ক’দিন, তারপর সবাই বুঝবে আমার ভাই কত চালু!’

এরপর আমি সাথে নেওয়া ব্যাগটা খুললাম। ব্যাগ খুলে দিদির জন্য কানাইর দেওয়া শাড়িটা বের করে দিদির হাতে দিলাম। দিদি আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এটা আবার কেন নিয়ে এসেছিস। এটা কী ভারতের? না কি বাংলাদেশি? এমনিতেই কতো কষ্ট করে বাংলাদেশ থেকে এসেছিস। এতো বছর পর যে তোকে দেখতে পেরেছি, তাতেই আমি খুশি।’ আমি বললাম, ‘দিদি এই শাড়িটা কোলকাতায় থাকা আমার বন্ধু দিয়েছে। ওর নাম কানাই। ওর সাথেই কোলকাতা এসেছিলাম। শাড়িটা আপনার পছন্দ হয়নি?’ দিদি বললেন, ‘হ্যাঁ পছন্দ তো হয়েছে রে, তো আমি এই স্লিকের শাড়ি কখনোই পড়ি না। এটা বরং তোর বড় ভাগ্নিই পড়বে।’ বললাম, ‘তা আপনার খুশি!’ এভাবে কথা বলতে বলতে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে লাগলো। বড় ভাগিনা খবর পেয়ে ওর গ্যারেজ বন্ধ করে তাড়াতাড়ি বাসায় এসে আমাকে প্রণাম করলো। ওর ছোট দুই ভাই তখনো নিজেদের কাজে ব্যস্ত ছিলো।

আমার তিন ভাগিনা আর এক ভাগ্নি। দুই ভাগিনা মোটেও লেখাপড়া জানে না। তার মানে হলো, ওরা কোনো সময় স্কুলেই যায়নি। আমার বড়দির বিয়ের ১৫দিন পর এই ভারতে আসা। তখন তারা থাকতো বীরপাড়া থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে, ফালাকাটা নামক স্থানে। আমার জামাইবাবু ছিলেন একজন নেশার রাজা। তাকে নেশার সম্রাটও বলা চলে। কেননা, নেশার জগতের এমন কোনও নেশা বাদ নেই, যা আমার শ্রদ্ধেয় জামাইবাবু গ্রহণ করেননি। আমি যখন সেখানে গিয়েছিলাম তখনো দেখেছি জামাইবাবুর সাথে অনেকরকম মাদকের নেশা জড়িয়ে আছে। কাচ্চি মদ, বিড়ি, পান, নশ্বি (যেটা নাক দিয়ে টানে- হুবহু আমাদের দেশের শাহাজাদা গুল-এর মতন দেখতে), চা, মাঝেমাঝে সিদ্ধিও (গাঁজা) টানে। এর কারণেই আগে আমার বড়দির সংসারটা ছিল একেবারে এলোমেলো। মোট কথা নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা ছিল।

ছোট ভাগিনা দুজন যখন একটু বড় হলো, তখন স্কুলের চিন্তা না করে বড়দি নিজের সংসারের চিন্তা করে ওদের গাড়ির গ্যারেজে কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল। এরপর আস্তে আস্তে আমার বড়দি’র সংসারের অবস্থা একটু পরিবর্তন হলো লাগলো। একসময় ছেলে দুটোর রোজগারের টাকা দিয়ে বাড়ি করেছে। বাড়িতে রড-সিমেন্টের দালান তৈরি করেছে। বাড়িতে বাসা ভাড়াও দিয়েছে। জামাইবাবু নেশার জগতের সম্রাট হলেও, নিজের তামাকের ব্যবসা তখনো ছিলো। সেখানকার প্রায় লোকেরা তামাক, বিড়ি, পান-সিগারেট, মদ-গাজার নেশা বেশিরভাগ মানুষেই কম-বেশি করে থাকে।

তবে আমার গুনধর জামাইবাবু ছিলো সবার উপরে। মানে অষ্টধাতু যাকে বলে! সেখানকার প্রায় মানুষের নেশার অভ্যাস থাকার কারণে সেখানে তামাকের ব্যবসাটা হলো রমরমা ব্যবসা। আমার জামাইবাবু তামাকের ব্যবসাটা ছিলো আদি ব্যবসা। উনি নেশা-পানি যা-ই করুক-না-কেন, তামাকের ব্যবসা ছিলো উনার নিয়মিত। আগে এমন নিয়মিত ছিলো না। একদিন মদ পান করে বেহুঁশ হলে তিনদিন আর তামাকের গাট্টি নিয়ে বাজারে যেতো না। আগে যদি ব্যবসায় এমন নিয়মিত থাকতো, তাহলে আমার ভাগিনা-ভাগ্নিদের লেখাপড়া হতো। হয়নি শুধু আমার গুণধর জামাইবাবু কারণেই। জামাইবাবু ওমন উড়াউড়ির ভাবের জন্যই বড়দি ছেলে দুটোকে স্কুলে পাঠাতে পারেনি। আজীবনের জন্য বকলমই বানিয়ে রেখেছে।

তবে আমার ভাগিনা দুটো লেখাপড়া না করলেও মনেরমত কাজ শিখেছে। কাজ হলো গাড়ির মেকারের কাজ। এমন কাজই ভাগিনা দুটো শিখেছে যে, একটা চলন্ত গাড়ির শব্দ শুনে বলে দিতে পারে গাড়িটার সমস্যার কথা। বড় ভাগিনা অনেক আগেই ওস্তাদের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিয়ে, নিজেই আলাদাভাবে মিস্ত্রির কাজ করছে। মেজো ভাগিনা তখনো পরের গ্যারেজে কাজ করছিলো। বেতন হলো সপ্তাহে মাত্র ৩০০ টাকা। বেতন ছাড়াও সাথে কিছু এদিক-সেদিক ছিলো। বেতন ছাড়া এদিক-সেদিক যা পেতো, তা আর গ্যারেজ মালিক নিতো না। এদিক-সেদিকের উপার্জনের টাকা দিয়েই সারা সপ্তাহের পকেট খরচ হয়ে যেতো।

ভাগিনা দুটো লেখাপড়া জানে না, কিন্তু ভারতের সবকটি প্রদেশের ভাষা ওদের আয়ত্তে। ইংরেজিতেও কথা বলতে পারে। সবার ছোট ভাগিনা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে অস্থির হয়ে গেছে। লেখাপড়া করার কষ্ট সইতে না পেরে শেষ অবধি লেখাপড়া ছেড়েই দিয়েছে। তবে বেকার নয়। রাস্তার পাশে ওদের একটা দোকান আছে। সেই দোকানটায় বসে পান-বিড়ি-সিগারেটের ব্যবসা করে। ভাগ্নির কপালেও বেশি লেখাপড়া লাগতে পারেনি। ক্লাস ফাইভ পর্যন্তই শেষ! অথচ এই ভারতের বাড়িতে প্রায় সকল মানুষেই কমবেশি শিক্ষিত। এমনও দেখেছি, মা অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেও সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে শিক্ষিত করে তুলেছে। আর সেখানে আমার ভাগিনা-ভাগ্নি একেবারেই বকলম!

যাইহোক, সেদিন বড়দি’র কাছে উনার দুঃখ-সুখের কথা শুনতে শুনতে একসময় বড় ভাগিনা আমার সামনে এসে বললো, ‘মামা আমার সাথে চলো।’ ভাগিনার কথা শুনে দিদি বললো, ‘ওকে কোথায় নিয়ে যাবি? ও এসেছে অনেকক্ষণ হয়। এখনো খাওয়া-দাওয়া কিছুই করেনি। বাজারে গেলে আগে তোর মামাকে কিছু খাইয়ে দিবি।’ ভাগিনা বললো, ‘ঠিক আছে মা। এ নিয়ে তোমার মাথাব্যথার দরকার নেই। চলো মামা চলো।’ আমি ভাগিনাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় যাবে শুনি? এখান থেকে কতটুকু দূরে?’ ভাগিনা বললো, ‘এইতো মামা এখানেই। তুমি বাস থেকে যেখানে নেমেছ, সেখানেই। আমাদের বীরপাড়া বাজারে। চলো মামা, মজা হবে খুব। আজ বাজারের পাশেই একটা অনুষ্ঠান আছে। তোমাকে নিয়ে সেখানেই যাবো।’

মজার কথা শুনে ভাগিনার সাথে রওনা দিলাম। রাস্তায় দিয়ে হাঁটা অবস্থায় ভাগিনা আমাকে জিজ্ঞেস করছে, ‘মামা তুমি সিগারেট টানো না-কি?’ বললাম, ‘হ্যাঁ মামা অভ্যাস আছে।’ ভাগিনা আবারও জিজ্ঞেস করলো, ‘মামা তুমি কী সিগারেট টানো?’ বললাম, কমদামী একটা হলেই হয়ে যায়।’ আমার বড় ভাগিনা রাস্তার পাশে দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে আমার পকেটে ভরে দিল। এরপর মামা-ভাগিনা হাঁটা ধরলাম বীরপাড়া বাজারের দিকে।

হেঁটেই যাচ্ছি দুজনে। কারণ, দিদির বাড়ি থেকে বীরপাড়া বাজার অল্পকিছু দূরে। যাচ্ছি পায়ে হেঁটে। তখন সন্ধ্যা হয়েছিলো প্রায়। সেখানে সন্ধ্যার পরে বেশিক্ষণ দোকানপাট খোলা থাকে না। কারণ, সেখানকার বেশিরভাগ মানুষই খেটে খাওয়া। সরকারি অফিস-আদালত তেমন নেই। আছে শুধু একটা পোস্ট অফিস, একটা পুলিশ ফাঁড়ি, আর দু-একটা বেসরকারি ব্যাংক ও বীমার অফিস। পুরো এলাকার দুই দিকেই পাহাড়। ভুটান সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকা হলেও পাকা রাস্তা। প্যাঁক-কাদা কাউকে ডিঙাতে হয় না। গাড়িঘোড়ার বেশি একটা চাপ নেই। রাস্তার পাশে লাইট পোস্ট আছে। আমাদের শহরের মতন প্রতিদিন বিকালবেলা সেখানে বাজার মেলে না। বাজার বলতে বলা যায়, স্থায়ীভাবে থাকা মার্কেট আর কিছু দোকানের টুকটাক বেঁচা-কেনা।

ভাগিনার সাথে গেলাম বীরপাড়া বাজারে। ভাগিনা বাবাজি আমাকে নিয়ে প্রথমেই ঢুকলো একটা মিষ্টির দোকানে। আমি বাস থেকে নেমে যেই দোকান থেকে মিষ্টি কিনেছিলাম, সেই দোকানেই। কিন্তু আমি সেখানে নতুন, তাই ফলো করতে পারিনি। দোকানদার আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে। দোকানদারের মৃদু হাসি দেখে আমার ভাগিনা দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলো, ‘হাসলেন কেন?’ দোকানদার বললো, ‘উনি কি তোমার মামা?’ ভাগিনা বললো, ‘হ্যাঁ, আপনি জানলেন কী করে?’ দোকানদার বললো, ‘আ-রে উনিতো কয়েক ঘন্টা আগে আমার দোকান থেকে মিষ্টি কিনে নিয়েছে। আমি একটা রিকশা ডেকে তোমাদের বাড়িতে পাঠিয়েছি। চিন্তায় ছিলাম, রিকশাওয়ালা ঠিকমত তোমাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে কিনা। অবশ্য কিছুক্ষণ পরই রিকশাওয়ালা এসে আমার কাছে বলেছে। এখন ওনাকে দেখে খুব ভালো লাগলো, তাই হাসলাম। বসো বসো। কী খাবে তোমরা?’ দোকানদারের কথা শুনে আমার ভাগিনাও হেসে বললো, ‘ওহ্ আচ্ছা, তাই নাকি কাকা! আমিতো ভাবছিলাম আবার অন্যকিছু। জাগগে, আমাদের এক প্লেট করে রসমালাই আর দুটো করে নিমকি দিন।’

মিষ্টির দোকানের কর্মচারী আমাদের নিমকি আর রসমালাই দিলো। আমিও খেলাম, আমার ভাগিনাও খেলো। খুবই সুস্বাদু রসমালাই। যেই রসমালাইয়ের জুড়ি নেই। দোকানদারকে খাবারের দাম বুঝিয়ে দিয়ে দোকান থেকে বের হলাম। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত হয়ে গেছে। ভাগিনার সাথে পুরো বীরপাড়া বাজারটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। খুবই সুন্দর এক বাজার। দু-একটা টিনের চালের ঘর। আর দু’একটা ইটের দালান ঘর। বাদবাকি সব ঘরই টালির চালের ঘর। সেখানে টালির চালের ঘরই বেশি। কারণ হলো, টিনের চালের ঘরে নাকি গরম লাগে। ঘর ঠাণ্ডা থাকার জন্যই, সেখানকার মানুষে টালির চালই বেশি পছন্দ করে।

বাজারের পাশেই চা বাগানীদের কোয়ার্টার। দেখতে দেখা যায় আমাদের দেশের সরকারি সুইপার কলোনির মতন। ওদের শরীরের রঙ কালো হলেও ওদের ঘরদোর খুবই পরিস্কার। প্রতিদিন ওদের কলোনির সামনেই ওরা ওদের নিজেদের তৈরিকৃত মদ কেনাবেচা করে থাকে। ওদের নিজেদের বানানো মদের নাম হাড়িয়া। দেখতে হুবহু আমাদের দেশের মাঠা’র মতো।

ভাগিনার সাথে ঘুরেফিরে দেখে চলে এলাম বীরপাড়া বাজারে। ভাগিনা বাবাজি একটা চায়ের দোকানে নিয়ে গেলো। ‌‌‍দোকানের ভেতরে গিয়ে বসলাম। দোকানটা মাচাংঘর। কিন্তু খুব সুন্দর! ভাগিনা দুই কাপ চায়ের অর্ডার দিলো। দোকানদার হলো একজন নেপালি মেয়ে। দোকানে আবার মদও বিক্রি করে। মদের মধ্যে ভুটানি আর নেপালি মদই বেশি। সাথে আছে ওদের নিজেদের তৈরি মদ। ওখানে নেপালীরা যে মদ তৈরি করে, সেই মদ’কে ওখানকার ভাষায় বলে কাচ্চি মদ। আমরা বাংলাদেশে এগুলোকে বাংলা মদ বলে থাকি। চা পান করে দোকান থেকে বের হলাম। তবে দোকানটা চিনে রাখলাম আবার আসবো বলে।

তখন বৈশাখ মাস। এই বৈশাখ মাসের শুরুতে সেখানে নানারকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। প্রতিটি পাড়া মহল্লায় আর রাস্তাঘাটে। পুরো ভারতের মানুষই সংস্কৃতি প্রিয়। যাত্রা, নাটক, থিয়েটার, সিনেমা এসব ওদের কাছে খুবই আনন্দের। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরাও নিজের মহল্লায় নানারকম গান-বাজনার আয়োজন করে। ভাগিনা বাবাজি বাজারের পাশে আমাকে নিয়ে গেলো। দূর থেকেই রবীন্দ্র সংগীতের আওয়াজ আমার কানে আসছিলো। ভাবলাম ভাগিনা বাবাজি মনে হয় এখানকার কথাই বলেছিল। আমার ধারণায় ঠিক তা-ই হয়েছিল।

সেখানে প্রতি বছরই বৈশাখ মাসের ২৫ তারিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। তারই ধারাবাহিতায় বাজারের সব দোকানদাররা কবিগুরু স্মরণে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। সেই অনুষ্ঠানেই ভাগিনা বাবাজি আমাকে নিয়ে গেল। বসার সিট নেই। ভাগিনা সহ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ রবীন্দ্র সংগীত শুনলাম। এরপর বাসায় চলে এলাম। রাত তখন আনুমানিক ৮ টার মতন বাজে। দিদির বাড়িতে তখনো কেউ ঘুমায়নি। সবাই ঘরে বসে টেলিভিশনে কবিগুরু রবীন্দ্র জয়ন্তীর অনুষ্ঠান দেখতে ছিল।

চলবে…

জীবনের গল্প-৩০ শেষ পর্ব এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-২৮

Image-64

জীবনের গল্প-২৭ এর শেষাংশ: তারপরও তার অভাব নেই! এই টাকা দিয়েই তার ছোট সংসার খুব সুন্দরভাবে চলছে। জানলাম রিকশাওয়ালার কাছ থেকে। প্রায় ১০ মিনিট হতে-না-হতেই রিকশাওয়ালা আমাকে বলছে, ‘ও-ই যে রবীন্দ্র নগর কলোনি দেখা যাচ্ছে, দাদা।’

রিকশা চড়ে যাচ্ছিলাম, রবীন্দ্র নগর কলোনির দিকে। রাস্তার দু’পাশে বড়বড় নানারকম পুরানো গাছ। সেখানে ইটপাটকেলের তৈরি দালানঘর খুব কম। যা দেখা যায়, তা প্রায় সবই বাঁশখুটি ও কাঠের তৈরি টিনের ঘর। মাঝে-মাঝে ভুটানিদের কাঠের টংঘর। টংঘরের নিচে শুকর, ভেড়া, মুরগির খামার। উপরে থাকে ভুটানিদের থাকার ব্যবস্থা। ঘরগুলো দেখতে খুবই সুন্দর! বাড়ির চারদিকে নানারকম ফুলগাছ লাগানো থাকে। থাকে সুপারি গাছ সহ নানারকম ফল-ফলারি গাছও। অন্যান্য গাছের মধ্যে সেখানে সুপারি গাছই বেশি। হঠাৎ রাস্তার পাশে থাকা একটা দোকানে আমার চোখ পড়লো। দোকানটি খুব সুন্দর! একটি মেয়ে দোকানে বসা। পরনে লাল জামা আর তোয়ালের মতন ঘাগরি। এই পোষাক ওদের ঐতিহ্যবাহী পোষক। একে তো সাদা চামড়ার মানুষ, তার উপর লাল জামা ঠাঁসানো। দেখে মনে হচ্ছে গোধূলি লগ্নের লাল টুকটুকে সূর্যটা। রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই এই দোকানে কি সিগারেট পাওয়া যাবে?’

রিকশাওয়ালা বলল, ‘আজ্ঞে দাদা আপনার সিগারেট দরকার? সামনে আরও অনেক দোকান আছে। সেখান থেকে নাহয় নিয়ে নিবেন?’ আমি একটু জোর করেই বললাম, ‘দাদা এই মেয়েটির দোকান থেকেই নিয়ে নেন। আমার খুব সিগারেটের নেশা পেয়েছে।’ কিছুক্ষণ আগে মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি খেয়েছি তো, তাই এখন সিগারেটের দরকার। না হলে আমার বমি বমি ভাব হচ্ছে। আমার কাছে একটি সিগারেটও নেই। যদি দয়া করে এই দোকানটার সামনে একটু রাখতেন, তাহলে আমি এক প্যাকেট সিগারেট কিনে নিতাম।’ আমার কথা শুনে রিকশাওয়ালা তার রিকশা থামিয়ে বললো, ‘আচ্ছা দাদা ঠিক আছে, দোকানের সামনে যাচ্ছি।’

রিকশাওয়ালা দোকান ছড়ে একটু সামনে গেলেও, আমার কথা শুনে আবার দোকানের সামনে আসলো। দোকানে থাকা মেয়েটিকে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল, ‘দিদি আপকা কাছ সিগারেট হ্যায়? মেয়েটি বলল, ‘কিসকা সিগারেট চাইয়ে, ভাইয়া?’ সিগারেটকা নাম বাতাইয়ে?’ ওখানকার মানুষে ভারতের প্রায় সকল ভাষাই জানে। যখন যেই ভাষা দরকার, সেই ভাষাই তারা ব্যবহার করে। আমার যদিও হিন্দি ভাষা জানা নেই, তবু একটু আধটু বুঝি। তবে বলতে পারি না। রিকশাওয়ালা আর মেয়েটির কথা শুনে রিকশাওয়ালাকে বললাম, ‘দাদা দোকানদার মেয়েটি কি বাংলা জানে না?’ রিকশাওয়ালা বললো, ‘জানে দাদাবাবু, জানে। ওরা নেপালি। ওদের নিজস্ব ভাষা আছে। তারপরও আমাদের ইন্ডিয়ার সব ভাষাই ওদের জানা আছে। তবে দাদা ওরা বেশিরভাগ হিন্দি, নেপালি, আর ভুটানি ভাষাই ব্যবহার করে থাকে। এখন বলুন, আপনি কী সিগারেট কিনবেন?’ আমি রিকশাওয়ালাকে বললাম, ‘দাদা, এখানকার সিগারেটের নামতো আমার জানা নেই! আপনার পছন্দমতো ভাল এবং বেশি দামের এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে নেন।’

তখন কিন্তু সিগারেট আমার কাছে ছিলো। সিগারেট থাকা সত্ত্বেও মেয়েটিকে একটু ভাল করে দেখার জন্য এই ভাণ করালাম। রিকশাওয়ালা আমাকে বলল, ‘আজ্ঞে দাদা, আপনি রিকশা থেকে নেমে দেখিয়ে দিন। এখানে অনেকরকম সিগারেট আছে। আপনি যেটা চাইবেন, ঠিক ওটাই আপনাকে দিবে।’ আমি রিকশাওয়ালার কথা শুনে রিকশা থেকে নেমে দোকানের সামনে গেলাম। দেখি দোকানে চায়ের ব্যবস্থাও আছে। দোকানে সাজানো আছে, ভারতি, নেপালি, আর ভুটানি মদের বোতল। তবে ওখানে ভুটানের মদ-ই বেশি চলে। সেখানে রাস্তা-ঘাটে, হাট-বাজারে সবখানে বসেই, মদপান করা যায়। এমনকি চলন্ত বাসে বসেও অনেকে মদপান করে থাকে। কেউ কাউকে কিছু বলার সাহস পায় না। তবে ওরা যতই মদ্যপ হোক না কেন, মাতলামি খুব কমই করে থাকে। আর যেকোনো পূজাপার্বণে মানুষের ফ্যামিলি বাসায়ও, সবাই মিলে-মিশে মদপান করে থাকে। কি ছেলে, কি বুড়ো। মদ যেন তাদের পূজার প্রসাদ। মদ ছাড়া ওখানকার মানুষের কোনকিছু শুদ্ধ হয় না।

নেপালী মেয়েটির দোকানে চায়ের কেতলি দেখে রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দাদা আপনার চায়ের অভ্যাস আছে?’ রিকশাওয়ালা খুশিমনে বললো, ‘হ্যা দাদাবাবু আছে! আপনি আমাকে চা খাওয়াবেন? ওখানে কেউ কাউকে সহজে এক কাপ চা, অথবা একটা পাতার বিড়িও দেয় না। নিজের পকেটে বিড়ি থাকতেও পরের কাছ থেকে বিড়ি চেয়ে নেয়। রিকশাওয়ালা তাই খুশিতে আমকে জিজ্ঞেস করছে, “দাদাবাবু আপনি আমাকে চা খাওয়াবেন?” আমি হেসে বললাম, ‘হ্যা, খাওয়াবো মানে? নিশ্চয় খাওয়াবো। মেয়েটিকে বলুন আমাদের দুই কাপ চা বানিয়ে দিতে।’ আমার কথা শুনে রিকশাওয়ালা দোকানী মেয়েটিকে বাংলায় বললো, ‘দিদি আগে আমাদের দু’কাপ চা বানিয়ে দিন। পরে নাহয় সিগারেট দিবেন।’ এবার রিকশাওয়ালা মেয়েটির সাথে বাংলা ভাষায় কথা বলার তার মানে হলো, রিকশাওয়ালা আমাকে বুঝিয়ে দিল যে, মেয়েটিও বাংলা কথা বোঝে বা জানে। জবাবে মেয়েটি বলল, ‘ঠিক আছে দাদা, একটু বসেন। আমি আপনাদের চা বানিয়ে দিচ্ছি।’

আমরা দুজনেই দোকানের ভেতরে একটা টেবিলের পরে বসলাম। মেয়েটি চা বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেখানকার চা বানানোর খুব সুন্দর সিস্টেম। যা হবে তা নগদনারায়ণ। মেয়েটি একটা পাত্রে কিছু পরিমাণ তরল দুধ একটা পাত্রে ঢেলে, কেরোসিনের জ্বলন্ত স্টোভের উপরে রাখলো। অল্পকিছুক্ষণের মধ্যেই দুধ গরম হয়ে গেল। তারপর সেই গরম দুধে চা-পাতা আর চিনি মিশিয়ে দিল। ছাকনি দিয়ে ছেঁকে দুই কাপ চা দুইজনকে দিল। আমরা চা পান করলাম। বেশ মজাদার চা। গরুর খাটি দুধ দিয়ে তৈরি চা। তাও কাঁচা চা-পাতার তৈরি। এই চায়ের স্বাদই আলাদা। প্রতি কাপ চায়ের দান ভারতীয় ৬০ পয়সা। এক প্যাকেট সিগারেট নিলাম, দাম মাত্র ১০টাকা। সিগারেটের নাম, চার্ম। ফিল্টার কিং সিগারেট। সেখানকার লোকেরা এতো দামি সিগারেট খুবই কম মানুষেই টানে। সবাই হিসেব করে চলে। অকারণে অযথা কেউ একটি কানাকড়িও খরচ করে না। তাদের ধূমপানের মধ্যে বেশি প্রিয় হলো, শাল পাতার বিড়ি। সে হোক ধনীর দুলাল! হোক সে ফকির। বেশিরভাগ মানুষেই পাতার বিড়ি টানে। কারোর সম্মান অসম্মানের দিকে কেউ ফিরে তাকায় না। সবাই সবার নিজের ধান্ধায় মশগুল থাকে।

এরপর দোকানী নেপালী মেয়েটিকে ১১ টাকা ২০ পয়সা দাম দিয়ে, আবার ওঠলাম রিকশায়। আসার সময় দোকানদার মেয়েটি রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাই আপনার রিকশায় লোকটির বাড়ি কোথায়?’
রিকশাওয়ালা জবাব দিল, ‘বাংলাদেশ দিদি বাংলাদেশ।’
নেপালী মেয়েটি মুচকি হেসে বললো, ‘হুম, বহ্যত আচ্চা। এখন যাবে কোথায়?’ রিকশাওয়ালা জবাব দিলো, ‘উনি রবীন্দ্র নগর কলোনি যাবে। ওনার বড়দিদির বাড়িতে। কোলকাতা থেকে এসেছে কেবল।’ আমি রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি বাংলাদেশ বললেন? আপনি কীভাবে জানেন যে, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি?’ রিকশাওয়ালা বললো, ‘দাদা, আপনার বাড়ি বাংলাদেশে তা আমি জেনেছি, ঐ মিষ্টি দোকানদারের কাছ থেকে। তিনি আমাকে বলেছে, আপনার বাড়ি বাংলাদেশ। তাই বললাম দাদাবাবু। আমি রিকশাওয়ালাকে আর বেশি কিছু বলিনি। রিকশা চলছে, মেইন রোড ছেড়ে মহল্লার আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে। যাচ্ছে রবীন্দ্র নগর কলোনির দিকে। আমার মনের ভেতরে অনেক চিন্তা। শুধুই ভাবছি, আমার দিদি, জামাইবাবু ও ভাগিনা ভাগ্নিদের নিয়ে। দিদির সামনাসামনি গিয়ে, কীভাবে পরিচয়টা দিলে ভাল হবে, সেই চিন্তাই আমার মনের ভেতরে ঘুরপাক বেশি খাচ্ছিলো।

দুপুর শেষে বিকালের আগমন। দিদি’র ঘেঁষা চা-বাগান। চা-বাগান থেকে চা-পাতা তোলার মহিলারা আসছিল সারিবদ্ধভাবে। সেখানকার মানুষে তাদের বলে বাগানী। এদের সবার পেছনে ঝুলানো আছে, চা-পাতার ঝুড়ি। চা-বাগানে চা-পাতা সংগ্রহে নিয়োজিত থাকে বিহারের আদিবাসী মানুষগুলো। সেসব জনগোষ্ঠীদের সেখানকার ভাষায় বলে, মদোসিয়া। এদের গায়ের রঙ কালো কুচকুচে কালির মতন। দেখতে হুবহু নিগ্রোদের মতন। যা দেখলাম, রিকশা দিয়ে আসার সময়। আমার চোখে তারা কালো বর্ণের হলেও, তাদের চোখে তারা খুবই সুন্দর। এই কালো বর্ণের মাঝেও নাকি সুন্দরী মেয়ে অনেক আছে। এরা বেশিভাগ সময়-ই নেশার তালে মগ্ন থাকে। পথে-ঘাটে, পূজা-পার্বণে, হাটা চলায় সবসময়, সবখানে এরা মদপান করবেই। মদ ছড়া ওদের যেন উদ্ধার নেই। এরা রাস্তার পাশ দিয়ে সারিবদ্ধভাবে লাইন ধরে তাদের গন্তব্যে যাচ্ছে। আগে যাবে হয়তো তাদের কারখানায়। সারাদিনের সংগ্রহ করা চা-পাতা কারখানায় বুঝিয়ে দিয়ে, পরে হয়তো নিজেদের ঘরে যাবে। এসব দৃশ্য দেখতে দেখতে একসময় পৌঁছে গেলাম রবীন্দ্র নগর কলোনিতে।

রবীন্দ্র কলোনির মাঝখান দিয়ে রাস্তা। রিকশা যাচ্ছিল রবীন্দ্র নগর কলোনির গলি দিয়ে। পুরো রবীন্দ্র নগর কলোনিতে দুইটা গলি। গরমের দিন, কিন্তু আকাশ পরিষ্কার। বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা নেই। ভুটান সংলগ্ন এলাকা। দিদির বাড়ির সন্নিকটে ভুটানের সুউচ্চ পাহাড়। সেখানে বৃষ্টির দিনে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। রবীন্দ্র নগর কলোনি বীরপাড়া বাজার থেকে সামান্য একটু দূরেই ভুটান। এই রবীন্দ্র নগর কলোনিতে আগে চা-বাগানের কিছু উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের বাসভবন ছিল। হয়তো কারোর নাম রবীন্দ্র ছিল। তাই এর নামকরণ হয়েছে রবীন্দ্র নগর কলোনি। অনেক আগে থেকেই চা-বাগানের ওইসব কর্মকর্তাদের বাসভবনের আশে-পাশে বহিরাগতের বসবাস শুরু হয়েছিল। আমি যখন বড়দি’র বাড়ি গিয়েছিলাম, তখন চা-বাগানের সেসব কর্মকর্তাদের দেখা মেলেনি। দেখেছি উড়ে এসে জুড়ে বসা মানুষের বসবাস। আমার বড়দিদিও এখানে উড়ে আসা এক বাসিন্দা। তবে এই রবীন্দ্র নগর কলোনিতে বর্তমানে যারা বসবাস করছে, তাদের সবাই নিজস্ব জায়গার মালিক বনে গেছে। সরকারকে ট্যাক্স দিচ্ছে। পানির বিল প্রতিশোধ করছে। বিদ্যুৎ বিল দিচ্ছে। নিজেদের জায়গা কেনাবেচাও করছে, এই রবীন্দ্র নগর কলোনিতে থাকা মানুষগুলো।

রবীন্দ্র নগর কলোনির পশ্চিম পাশে চা-বাগান। ঠিক আমার দিদির বাড়ি থেকে ৪০-৫০ হাত দূরে বিশাল চা-বাগান। এই চা-বাগানটির শেষ খুঁজে পাওয়া বড়ই মুশকিল। বিশাল আওতা জুড়ে এই চা-বাগানটি। পূর্বদিকে বীরপাড়া টু ভুটান (গুমটু) মেইন রোড। উত্তরে বীর পাড়া বাজার অভিমুখী পথ। দক্ষিণে শিলিগুড়ি টু মিজোরাম মেইন রোড়। এই শিলিগুড়ি টু মিজোরাম মেইন রোডের দুপাশে রয়েছে, মাইলের পর মাইল চা-বাগান। রিকশা থামলো আমার বড়দি’র বাড়ির গেইটে। গেইট তখন লাগানো ছিলো। হয়তো বাড়ির ভেতরে সবাই ঘুমিয়ে ছিলো। রিকশাওয়ালা গেইটে টোকা দিয়ে বলছে, ‘কে গো, বাড়ির গেইট খুলুন। দেখুন বাংলাদেশ থেকে আপনাদের অতিথি এসেছে।’ বাংলাদেশ বলতে দেরি, আর গেইট খুলতে দেরি নেই। গেইট খুলেছে আমার বড়দি। আমি তখনো রিকশায় বসে বসে এদিক-ওদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। আমার বড়দি রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করছে, ‘কে? কার বাড়ির অতিথি গো?’ রিকশাওয়ালা বললো, ‘আজ্ঞে দিদি, উনি বাংলাদেশ থেকে এসেছে। মনে হয় আপনার ভাই।’

আমি তখন আমার বড়দি’র দিকে তাকাইলাম। আমার মায়ের চেহারা আর আমার বড়দি’র চেহারা একইরকম। আমার মনে হচ্ছিল যে, স্বয়ং আমার মা-ই সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি রিকশা থেকে নেমেই, বড় দিদিকে নমস্কার করলাম। আমার বড়দি’র নাম: রাধা রানী। সবাই রাধু রাধু বলেই ডাকতো। বড়দি আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম, ‘রাধু দিদি, আমি আপনার ছোটভাই নিতাই। এই কথা বলার সাথে সাথেই, দিদি আমাকে ধরে অঝোরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। মুহূর্তেই বাড়ির সামনে পিছনের সকল নারী-পুরুষ জড়ো হয়ে গেল। ঘর থেকে জামাইবাবু বাইর হয়ে আসলেন। ভাগিনা আসলো। অবিবাহিত একটিমাত্র ভাগ্নিও বের হলো। দিদি জিজ্ঞেস করলো আমার বড়দা’র কথা। বললাম, ‘বড়দা ভালো আছে দিদি। দাদাতো আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় একবার আপনাদের বাড়িতে এসেছিলো।’

এবার আমার বড়দিদি আমাকে পুরোপুরি ঠিকঠিক চিনতে পেরেছে। যদিও এতক্ষণ মনের ভেতরে একটু-আধটু গড়মিল ছিলো, বড়দা এখানে আসার কথা শুনে মনের গড়মিল দূর হয়ে গেলো। দিদির মনের ভেতর গড়মিলের কারণ হলো, আমার বড়দি’র যখন বিয়ে হয়, তখন আমার বয়স ছিল মাত্র দেড় বছর। আর আমি যখন দিদির সামনাসামনি, তখন আমি ৩০ বছরের একজন জবরদস্ত যোয়ান। আমি বুঝের হয়ে আমার বড় দিদিকে কোনও দিন দেখিনি। আর দেখবো-ই-বা কেমন করে? বড়দি’র বিয়ে হবার ১৫ দিন পরই, তারা সপরিবারে ভারত চলে আসে। এই আসাই এপর্যন্ত। আর আমি বড়দি’র সামনে এসেছি প্রায় ২৯ বছর পর।

এরপর দিদি বলছে, ‘আয়, বাড়ির ভেতরে আয়। কীভাবে আসলি, কবে আসলি তা পরে শুনবো। আগে ঘরে গিয়ে বোস। বড়দি’র বাড়ির ভেতরে যাবার আগে রিকশাওয়ালাকে ভারতের দুটো ১০ টাকার নোট হাতে দিলাম। রিকশাওয়ালা বললো, ‘সে কি দাদা! ভাড়া তো আমাকে মিষ্টির দোকান থেকে একবার দিয়েছে। আবার আপনিও দিচ্ছেন?’ আমি বললাম, ‘আ-রে দাদা, ওটা থাকুক। আমি এখন যা দিচ্ছি, তা আপনি নিয়ে নিন।’ আমার কথা শুনে রিকশাওয়ালা খুশি হয়ে বললো, ‘জয়বাংলার লোক গো দিদি। তাই এতো বড় আত্মা। বীরপাড়া বাজার থেকে এখানে এসে, কেউ দুই টাকার বেশি দেয় না। আর উনি আমাকে রাস্তায় চা সিগারেট খাওয়াইয়েছে। আবার কুড়ি টাকা দিয়ে দিলো। এতে আমার সারাদিনের কামাই, ওনাকে দিয়েই হয়ে গেলো।’ রিকশাওয়ালার কথা শুনে সবাই আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমার বড়দি বললো, ‘আমার ভাইতো এখানকার ভাড়া জানে না, তাই তোমাকে এতো টাকা দিয়েছে। ক’দিন পর যখন সব জানাশুনা হয়ে যাবে, তখন হয়ত আর দিবে না। বুঝেশুঝেই দিবে। আমি বড়দি’র কথা শুনে মুচকি হেসে দিদির বাড়ির ভেতরে গেলাম। আর মনে মনে বলতে লাগলাম, ‘দিদি আমরা বাংলাদেশি লোকেরা এরকমই। খরচের কাছে আমরা কখনোই হার মানি না।’

চলবে…

জীবনের গল্প-২৯ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-২৭

Image-64

জীবনের গল্প-২৬ এর শেষাংশ: কানাই বলল, ‘ধর্মতলা যাবো জলপাইগুড়ির একটা টিকেটের জন্য।’ তখন বুঝলাম আগামীকালই আমি বাঘা যতীন ত্যাগ করছি।

আমি তাড়াতাড়ি জামাকাপড় পড়ে নিলাম, কানাইতো আগেই রেডি। একটা অটো চেপে ধর্মতলা উত্তরবঙ্গের বাসস্ট্যান্ডে গেলাম। কিন্তু টিকেট আর কেনা হলো না। কারণ, তখন অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল, তাই আরও আগে থেকেই টিকেট কাউন্টার বন্ধ। টিকেট নিতে হলে সকাল ১০ টায় কাউন্টারে আসতে হবে। গাড়ি ছাড়বে দুপুর ২টায়। তা-ই হবে, টিকেট সংগ্রহ সকালেই হবে বললো, ‘কানাই।’ তারপর ধর্মতলা অনেকক্ষণ ঘুরাঘুরি করে রাত ১০টায় ফিরে এলাম বাঘা যতীন। সেদিন আমাদের ভাগ্যটা ভালোই ছিল। কেননা, বাংলাদেশ থেকে ভারতের বাঘা যতীন আসলাম অনেক দিন হলো। অনেক দিনের মধ্যে এই প্রথম বাড়িওয়ালার ঘরে রাতের খাবার কপালে জুটলো। সবাই একসাথে বসেই রাতের খাবার খেয়েছিলাম। খাবার শেষে বাড়িওয়ালার পরিবারের সদস্যদের জানিয়ে দিলাম, আগামীকাল বোনের বাড়ি রওনা দিচ্ছি। সেই সাথে ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্যও মিনতি করেছিলাম। আমার কথা শুনে বাড়িওয়ালী খুশি হলেও, তার ছেলে-মেয়ে দুটি খুশি হয়নি। বলল, ‘দাদা সেখানে সমস্যা হলে আবার আমাদের এখানে চলে এসো’ মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিয়ে কানাই-সহ তাদের ঘর থেকে বেড়িয়ে এলাম।

সেদিন রাতে আর আমার ঘুম হয়নি। সারারাত শুধু ছটফট করেছিলাম, নতুন জায়গায় যাবো বলে। দিদির বাড়ি নিয়ে চিন্তার শেষ ছিলো না, আমার! ‘দিদির যখন বিয়ে হয়েছিল, তখন আমার বয়স ছিলো মাত্র দেড় বছর। যা আমার মায়ের মুখে শোনা। আর এখন আমার বয়স ৩০ বছর পার হতে চলছে। দিদি আমার সামনে আসলে, আমি নিজেই দিদিকে চিনতে পারবো না। আর দিদি আমাকে চিনবে, এটাতো প্রশ্নই ওঠে না। শুনেছি আমার ভাগিনা ভাগ্নি ৪ জন। তারাও আমাকে চিনবে না। পরিচয় দেওয়ার পরও চিনবে না।’ এরকম ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ার পর কখন যে রাত ভোর হয়ে গেল, একটু টেরও পাইনি। সকাল হতে না হতেই ঘুম থেকে ওঠে হাত মুখ ধুয়ে রেডি হয়ে আছি। অপেক্ষা শুধু কানাই’র জন্য। কিন্তু কানাই ঘুম থেকে উঠছে না দেখে, আমি হাত-মুখ ধুয়ে বাইরে গেলাম, চা-দোকানে। কানাই ঘুম থেকে জেগে বুঝতে পেরেছে যে, আমি কোথায় আছি। ও মুখহাত ধুয়ে সোজা চা-দোকানে উপস্থিত। আমি তখন চা পান করছিলাম। কানাই আমার সামনে এসে দোকানদারকে এককাপ চা দিতে বললো। আমাকে বলল, ‘তাড়াতাড়ি করে চা শেষ কর, টিকেটের জন্য যেতে হবে।’ ওর কথা শুনে একটু তাড়াতাড়ি-ই চা শেষ করলাম। চেয়ের দাম দিয়ে রওনা হলাম, টিকেট সংগ্রহের জন্য ধর্মতলা। একটা অটো চেপে গেলাম ধর্মতলা।

উত্তরবঙ্গের সরকারি লাল বাস। এই বাসগুলোকে সবাই বলে রকেট। বিশাল বড় গাড়ি। দেখতেও খুব সুন্দর! চলেও দ্রুতগতিতে! টিকেটের মূল্য ভারতীয় ২৬০টাকা। টিকেটের দাম কানাই নিজের পকেট থেকেই দিয়েছিলো। টিকেটের দামটা ও আর আমার কাছ থেকে নেয়নি। গাড়ি ছাড়ার সময় দুপুর ২ টায়। এর আগে থেকেই গাড়ির সামনে হাজির থাকতে হবে। তখন সকাল ১১ টার মতো বাজে। তাড়াতাড়ি আবার চলে গেলাম বাঘা যতীন। বাঘা যতীন গিয়ে তাড়াতাড়ি স্নান করে রেডি হলাম। বাড়িওয়ালার ঘরে তখনও দুপুরবেলার রান্না হয়নি। বেলা ২ টার আগে আর রান্না হবার সম্ভাবনাও ছিলো না। এটা কানাইও টের পেয়েছিল। ও বুঝতে পেরেছিল আমাকে না খেয়েই রওনা দিতে হবে। তাই কানাই তাড়াতাড়ি করে একটা দোকানে গেলো। দোকান থেকে আমার জন্য একটা পাউরুটি কিনে আনলো। যাতে কিছু না খেয়ে ঘর থেকে বের না হই। তখন ঠিক দুপুর ১২টা। তাড়াতাড়ি অর্ধেকমত রুটি খেয়ে রেডি হলাম। কানাই’র দু’বোন ঘরের বাইরে অপেক্ষা করছে, বিদায় জানানোর জন্য। ওদের মনটাও খুব খারাপ! তা ওদের মুখের দিকে চেয়েই বুঝতে পেরেছিলাম। সাথে আছে বাড়িওয়ালার পরিবারবর্গ।

সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঘর থেকে বের হলাম। একটা অটো চেপে গেলাম ধর্মতলা বাসস্ট্যান্ড। তখন সময় ১টা। গাড়ি তখনও বাসস্ট্যান্ডে আসেনি। আসবে ঠিক টাইম মতো। এই ফাঁকে দুইজনে গেলাম কানাই’র পরিচিত একটা দোকানে। দোকানটা হলো শাড়ি কাপড়ের দোকান। কানাই আমার দিদির জন্য একটা শাড়ি কিনে দিয়ে বলল, ‘এটা দিদিকে দিবি। হাত খালি, নাহয় জামাইবাবুর জন্যও একটা কিছু দিতাম।’ আমি আর কিছু বলিনি, চুপচাপ শাড়িখানা ব্যাগের ভেতর ভরে নিলাম। এরপর তাড়াতাড়ি করে চলে এলাম বাসস্ট্যান্ড। এ সময়ের মধ্যেই বাস রেডি হয়ে স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরেই স্ট্যান্ড ত্যাগ করার প্রস্তুতি চলছে। কানাই আমাকে নিয়ে বাসে উঠে সিটে বসিয়ে দিল। আর যাবার পথে রাস্তার করণীয় বিষয়াদি কী কী, তা বুঝিয়ে দিল। ঠিক টাইম মতোই বাস স্ট্যান্ড থেকে বীরপাড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল।

কোলকাতা শহর পার হবার পরপরই শুরু হলো জ্যাম। কী কারণে যে, এই জ্যামের সৃষ্টি তা আর বুঝতে পারিনি। আর আমি বুঝবো-ই-বা কেমন করে। আমিতো সেখানে অতিথি মাত্র। রাত ১০টায় গিয়ে পৌঁছলাম চব্বিশ পরগনা কৃষ্ণনগর বাসস্ট্যান্ড। একটা বড় হোটেলের সামনে বাস থামলো। একএক করে বাসের সব যাত্রী নামল। সাথে আমিও নামলাম। এই কৃষ্ণনগর বাসস্ট্যান্ডে যাত্রীদের খাবারের হোটেল অনেক আছে। রাস্তার এপার-ওপারে অনেক রাত্রিকালীন দোকানও চোখে পড়লো। বাস থেকে নেমেই দেখাছি, সবাই যারযার মত বিভিন্ন হোটেলে ঢুকছে। আমিও একটা হোটেলে ঢুকে, আমার পছন্দমত কিছু খেলাম। সেখানে প্রায় ১ ঘণ্টা যাত্রা বিরতির পর, আবার রওনা দিল বীরপাড়ার উদ্দেশ্যে। সারারাত বাসেই বসেবসে ঝিমলাম। মাঝেমধ্যে কয়েকটা জায়গায় ভারতীয় বিএসএফ গাড়ি তল্লাসি করেছে। তবে আমি তেমন কোনও ঝামেলায় পড়িনি। আর পরবো-ই-বা কেন? আমার ভাষা তো একেবারে কোলকাতার মানুষের মতো। তাই পাসপোর্ট বিহীন হলেও, মনে সাহস ছিল অনেক বেশি।

পরদিন দুপুর ১২টার সময় পৌঁছলাম শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ি হলো, দার্জিলিং জেলার একটা শহর। এই শিলিগুড়ি হয়েই দার্জিলিং, নেপাল, ভুটান যাওয়ার পথ। শিলিগুড়ি যাত্রাবিরতি হবে প্রায় ১ ঘণ্টার মতন। এতো অনেক সময়। অনেকে আবার বাসস্ট্যান্ডের সাথে থাকা মার্কেটও যাচ্ছিলো, কিছু কেনা-কাটা করার জন্য। কিন্তু সেখানকার কোনও মার্কেট আমার চেনাজানা ছিলো না বিধায়, আমি আর কোনও দিকে গেলাম না। আমি খুঁজতে ছিলাম চা’র দোকান। একটা দোকান থেকে চা-বিস্কুট খেয়ে আবার বাসে উঠে বসলাম। সময়মত বাস শিলিগুড়ি থেকে ছেড়ে যাচ্ছে বীরপাড়ার উদ্দেশ্যে। তখন বাসের ভেতরে যাত্রীর সংখ্যা ছিলো আমাকে নিয়ে হবে ১০ থেকে ১২ জনের মতন। বীরপাড়া যেতে সময় লাগল প্রায় দেড় ঘণ্টার মতো। বীরপাড়া পৌঁছলাম দুপুর ২টায়। বাস থেকে বীরপাড়ার মাটিতে পা রাখলাম।

বীরপাড়া হলো, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জলপাইগুড়ি জেলার একটা থানা এলাকা। এই জায়গাটির তিনদিকে মিশে আছে ভুটান। ভুটানের পাহাড় ঘেঁষা সমতলভূমি, আর চা-বাগানের জন্য বিখ্যাত এই বীরপাড়া। বীরপাড়া বাজারটি ভারতের হলেও, এই বাজারে বেশিরভাগ দোকানদার, আর খরিদদার হলো ভুটানি। মোট জনসংখ্যার মধ্যে এক তৃতীয়াংশ ভুটানি আর নেপালি। মোট কথা ওই এলাকায় এই দুই দেশের মানুষেরই রাজত্ব। বীরপাড়া এলাকায় ভারতীয় টাকা আর নেপালি, ভুটানি টাকার মান সমান সমান। ভারতীয় টাকার চাইতে ভুটানের টাকাই বেশি চলে।

বাস থেকে নেমেই এদিক-সেদিক তাকাচ্ছিলাম। আমার সাথে ছিলো বাংলাদেশ থেকে নেওয়া কেবলমাত্র একটা ব্যাগ। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বীরপাড়া বাজারের ভেতরে গেলাম, কিছু মিষ্টি কেনার জন্য। জীবনে এই প্রথম বড়দি’র বাড়িতে আসা। খালি হাতে যাওয়াটা কেমন যেন ভালো দেখায় না। তাই কেজি দুএক মিষ্টির জন্য মিষ্টির দোকান খুঁজছিলাম। সাথে টাকার সংখ্যাও বেশি একটা ছিলো না! তবুও খালি হাতে যাওয়া ঠিক হবে না বলে মনে মনে ভাবছিলাম! গেলাম একটা মিষ্টির দোকানে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘প্রতি কেজি মিষ্টির মূল্য কত?’ দোকানদার বললো, ‘২৫ টাকা কেজি।’ মনে মনে বলছিলাম, বাঁচা গেল! আমার সাথে যেই টাকা আছে, তা দিয়ে বেশ হয়ে যাবে! দোকানদারকে বললাম, ‘চার কেজি মিষ্টি দিন।’ দোকানদার চার কেজির কথা শুনে দোকানদার একটু অবাকই হলেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজ্ঞে দাদা ঠিক করে বলুন তো কয় কেজি মিষ্টি নিবেন?’

দোকানদার অবাক হবার কারণ, সেখানে দুই কেজি মিষ্টি একসাথে কেউ কিনে না। আর আমি চাচ্ছিলাম চার কেজি! বিরাট ব্যাপারস্যাপার মনে হচ্ছিল দোকানদারের কাছে। তাই আমাকে ফের জিজ্ঞাসা, ‘ঠিক করে বলুন ক’কেজি নিবেন?’ আমি আবারও বললাম, ‘আমাকে ভালো দেখে চার কেজি মিষ্টি মেপে দিন। আমি আপনাকে মোট মূল্য হতে ১০টাকা কম দিব।’ আমার কথা শুনে দোকানদার হেসে বললেন, ‘তা দিবেন দাদা, তো আপনি যাবেন কোথায় শুনি?’ আমি বললাম, ‘আমি রবীন্দ্র নগর কলোনি যাবো।’ দোকানদার মিষ্টি মাপছে, আর আমকে জিজ্ঞেস করছে, ‘রবীন্দ্র নগর কলোনিতে আপনার কে থাকে দাদা?’ বললাম, ‘আমার বড়দি।’ আবারও প্রশ্ন, ‘আপনার বড়দি’র স্বামীর নাম কী দাদা?’ বললাম, ‘অমূল্য রতন পাল। আপনি কি চেনেন?’ দোকানদার জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনার জামাইবাবু কী করে?’ বললাম, ‘শুনেছি তামাকের ব্যবসা করে দাদা। তাও অনেক অনেক বছর আগের কথা। এখন যে কী করে, তা আমি সঠিকভাবে বলতে পারছি না। আপনি কি চেনেন?’

দোকানদার জিজ্ঞেস করলো, ‘আজ্ঞে কী বললেন! তামাকের ব্যবসা? আপনার ভাগিনা ভাগ্নিদের নাম জানেন? জানলে বলুন।’ বললাম, ‘ওরা তিন ভাই এক বোন। ওদের নাম: উত্তম, গৌতম, অষ্টম ও অনিমা।’ দোকানদার বললো, ‘আ-রে দাদা আপনার জামাইবাবুকে তো সবাই রতন পাল নামে ডাকে। আপনার দুই ভাগিনা গ্রেজে কাজ করে। এক ভাগিনা গাড়ির বড় মিস্ত্রি। আপনার বাড়ি মনে হয় বাংলাদেশে?’ আমি আর দোকানদারের সাথে মিথ্যা বলতে পারলাম না। আমি বললাম, ‘হ্যা দাদা আমার বাড়ি বাংলাদেশ। আমি আজ থেকে ১৫ দিন আগে একটা কাজের আশায় কোলকাতা এসেছিলাম। কাজটা হয়নি। তাই দিদির বাড়ি আসা।’ দোকানদার আমার কথা শুনে বললেন, ‘বসেন দাদা, বসেন। আগে কিছু খাবার খেয়ে নিন। আমি সাথে করেই আপনাকে আপনার দিদির বাড়ি পৌঁছে দিব।’ এই বলেই দুটি মিষ্টি একটা প্লেটে করে আমার সামনে এনে দিয়ে বললেন, ‘আজ্ঞে দাদা ঝটপট খেয়ে ফেলুন। আমি রিকশা দেখছি।’

আমি তখন অচেনা জায়গায় অপরিচিত লোক হলেও, আমি খুশিতে বসে বসে মিষ্টি খাচ্ছিলাম! মনে অানন্দও পাচ্ছিলাম! আবার চিন্তাও লাগছিলো! চিন্তা শুধু একটাই। তা হলো, যদি বড়দি আমাকে না চেনে? যদি তাদের বাড়িতে জায়গা না দেয়? যদি আবার কোলকাতা ফিরে যেতে হয়? এসব বিষয় নিয়েই চিন্তা। তারপরও ভয় পাচ্ছিলাম না। কারণ, এসেছি যখন একটা বিহিত হবেই হবে। এই মনোবল নিয়েই মিষ্টি দুটি খাচ্ছিলাম জোরেশোরে। এই সময়ের মধ্যেই দোকানদার রিকশা নিয়ে দোকানের সামনে হাজির হলো। রিকশাওয়ালাও আমার জামাইবাবুর পরিচিত ছিলো। দোকানদার আমাকে বললো, ‘দাদা এই রিকশাওয়ালা আপনার জামাইবাবুর বাড়ি নিয়ে যাবে। ও খুব ভালো করে আপনার জামাইবাবুকে চেনে। পরিচিত রিকশাওয়ালা যখন পেয়েছি, সাথে আর আমার যেতে হবে না।’

আমি আমার পকেট থাকে ভারতীয় একশো টাকার একটা নোট বের করে দোকানদারের হাতে দিলাম। দোকানদার বললো, ‘এই টাকা থেকে আপনাকে আর টাকা ফেরৎ দিচ্ছি না দাদা। আপনার রিকশা ভাড়া আর দিতে হবে না। ওর ভাড়া আমি দিয়ে দিব।’ এই কথা বলেই রিকশাওয়ালাকে বললো, ‘শোন বাপু, তুমি সাবধানে রতন পালের বাড়ি যাবে। বাড়ি গিয়ে, তার স্ত্রীর কাছে এই লোকটাকে পৌঁছে দিবে। জয়বাংলার লোক। এখানে নতুন। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে তুমি বাপু আমার কথা বলে দিও।’ রিকশাওয়ালা আমার কেনা চার কেজি মিষ্টি দোকান থেকে এনে, তার রিকশার উপরে রাখলো। আমি দোকান থেকে রিকশায় গিয়ে বসলাম। দোকানদার রিকশার সামনে এসে আমকে বললো, ‘সন্ধ্যার পর এখানে আসলে আমার দোকানে আসবেন দাদা। আমি খুবই খুশি হবো।’ আমি বললাম, ‘ঠিক আছে দাদা আসবো, কথা দিলাম।’

এই বলেই রিকশাওয়ালাকে বললাম, ‘আপনি এবার আমার দিদির বাড়ির নিয়ে চলুন। রিকশাওয়ালা ট্রিং ট্রিং করতে করতে রবীন্দ্র নগর কলোনির দিকে যাচ্ছে। ফাঁকা রাস্তা। গাড়ি নেই। নেই কোনও যানজট বা জ্যাম। রাস্তার দুই দ্বারে বড়বড় পুরানো গাছ। পুরো এলাকায় রিকশাও হবে হাতে গোনা কয়েকটা। রিকশাও বেশি সুন্দর না। কোনরকমভাবে তিনটে চাকা লাগানো আছে। হুকবডি নেই বললেই চলে। যেতে যেতে রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তার দৈনিক ইনকাম কত?’ উত্তরে রিকশাওয়ালা বললো, ‘সারাদিনে ১৫–২০ টাকার মতো ইনকাম হয়।’ এই টাকা দিয়েই তার সংসারে চারজন খানেওয়ালার খরচ। তারপরও তার অভাব নেই! এই টাকা দিয়েই তার ছোট সংসার খুব সুন্দরভাবে চলছে। জানলাম রিকশাওয়ালার কাছ থেকে। প্রায় ১০ মিনিট হতে-না-হতেই রিকশাওয়ালা আমাকে বলছে, ‘ও-ই যে রবীন্দ্র নগর কলোনি দেখা যাচ্ছে, দাদা।’

চলবে…

জীবনের গল্প-২৮ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-২৬

Image-6411

জীবনের গল্প-২৫ এর শেষাংশ: তারপর গেলাম একটা হোটেলে, কিছু খাওয়ার জন্য। কানাই সারাদিন বাইরে ছিল। ওর-ও ভাত খাওয়া হয়নি। তাই এই সন্ধ্যায় হোটেলে ঢোকা।

কানাই হোটেলে বসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী খাবি?’
বললাম, ‘রাতের খাবার তো বাসাই খাবো! এখন আর কী খাওয়া যায় ভাবছি! কানাই বলল, ‘ওইসব কিছু ভাবা দরকার নেই। রাতে বাসার খাবার কপালে জোটে কিনা সন্দেহ আছে। যা খাবার এখান থেকে খেয়ে নে।’ বললাম, ‘তা জুটুক আর না জুটুক, তাতে সমস্যা নেই। এখন হাল্কা পাতলা কিছু খেলেই হবে।’ কানাই বলল, ‘তাহলে বল, কী খাবি?’ বললাম, ‘এক প্লেট ভুনাখিচুড়ি খাবো।’ কানাই বলল, ‘ঠিক আছে তা-ই হবে।’

কানাই হোটেল বয়কে দুই প্লেট ভূনাখিচুড়ি দিতে বললো। কিছুক্ষণ পরই হোটেল-বয় দুই প্লেট ভুনাখিচুড়ি আমাদের সামনে এনে রাখলো। মুগডাল দিয়ে রান্না করা ভূনাখিচুড়ি। সাথে ছোট-ছোট টুকরা করা মুরগির মাংস। হোটেলটা অনেক বড়!ধর্মতলার মধ্যে এই হোটেলটাই সবার কাছে খিচুড়ির জন্য সুপরিচিত। খিচুড়ি খেয়ে হোটেল থেকে বের হয়ে দুইজনে গেলাম বাসস্ট্যান্ড। এখান থেকে উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গ, সব বঙ্গের বাসই ছেড়ে যায়। কানাই উত্তরবঙ্গের বাসের একজন হেলপারের সাথে আলাপ করল। জলপাইগুড়ি বীরপাড়ার ভাড়ার বিষয়ে জানলো। এখান থেকে কখন বাস ছেড়ে যায়, সে বিষয়েও খবর নিলো। এরপর আশে-পাশের অনেক জায়গায় ঘুরা হলো। এই ঘুরা-ঘুরির মধ্যেই রাত হয়ে গেল প্রায় ১০ টার মতো। এবার বাসায় ফেরার প্রস্তুতি নিয়ে অটো খুঁজছিলাম। কিন্তু রাত অনেক হওয়াতে শহরে অটোরিকশাও কমে গিয়েছিলো। যা দু’একটা পাচ্ছিলাম, ভাড়া দ্বিগুণ। বাধ্য হয়ে ডবল ভাড়াতেই ওটোতে চাপতে হলো।

ধর্মতলা থেকে অটোরিকশা করে গেলাম বাঘা যতীন। কানাই অটোরিকশা থেকে নেমেই একটা চা-দোকান থেকে দুইটা পাউরুটি কিনল। পাউরুটি কিনল এই কারণে যে, যদি বাড়িওয়ালার ঘর বন্ধ থাকে, তাই। বাড়ি গেলাম। বাড়ি নীরব। তখন কেউ মনে হয় সজাগ ছিলো না। সবাই ঘুমে বিভোর। দুইজনে কুয়ারপাড় গিয়ে হাত-মুখ ধুলাম। ঘরে এসে জামাকাপড় ছাড়লাম। কানাই সাথে নেওয়া পাউরুটি দুটো বিছানার উপর রেখে বললো, ‘আয় একসাথে বসে খেয়ে নিই!’ বললাম, ‘আমি এখন আর কিছুই খেতে পারবো না, তুই একটা খেয়ে আরেকটা রেখে দে। সকালে কাপড় নিয়ে মহল্লায় যাবার আগে খেয়ে যাস।’ কানাই বলল, ‘তুই খাবি না কেন? খেতে হবে! আয় শিগগির। তুই না খেলে আমিও খাব না।’ বললাম, ‘কী আর খাব রে কানাই, আমার কিছুই ভালো লাগছে না। না বুঝে, আর না শুনে হুটহাট করে তোর সাথে চলে এলাম! এখন তো দেখছি কাজের কাজ কিছুই হলো না। আমি তোর সাথে ঘুরছি, ফিরছি, খাচ্ছি। জানি না দেশে ওরা কী খাচ্ছে! কী করছে! কেমন আছে! ওদের কথা আমার বার-বার মনে পড়ছে! এখন যে কী করি! ভেবেই পাচ্ছি না। তুই আমাকে যে ভাবেই পারিস, আমার দিদির বাড়িতে পৌঁছে দে। দেখি সেখানে গিয়ে কিছু করা যায় কিনা!’

আমার কথা শুনে কানাই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। আমি এক গ্লাস জল ঢালছি পান করার জন্য। তা কানাই চেয়ে-চেয়ে দেখছে, কিচুই বলছে না। আমি জল পান করে খাটে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময় কানাই আমার হাত চেপে ধরে বলল, ‘দেখ তোকে নিয়ে আমিও খুব চিন্তায় আছি। রতন চক্রবর্তীর কথা শুনে কেন-ই-বা তোকে আমার সাথে আনলাম, সেই চিন্তাই করছি। তুই সাংসারিক মানুষ! এভাবে তোকে আমার সাথে এখানে আনা ঠিক হয়নি। এখন তোকে তোর দিদির বাড়ি পাঠালে, যদি তোর দিদি তোকে চিনতে না পারে? যদি তোর দিদিকে তুই চিনতে না পারিস? তা হলে তো অবস্থা আরও খারাপ হবে। এখন তুই যা সিদ্ধান্ত নিবি তা-ই হবে। এখানে আমি থাকি ভাড়া। বর্তমানে সাথে এখন উপযুক্ত দুই বোন। তোকে এখন আমার সাথে রাখতেও পারছি না, আবার তাড়িয়ে দিতে পারছি না। এখন তুই বল আমি কী করবো।’

কানাইর কথা শুনে আমি বললাম, ‘আমার সাথে ৫০০ টাকার মতো অবশিষ্ট আছে। এই টাকা থাকতে থাকতে তুই আমাকে আমার দিদির বাড়ি পৌঁছে দে। দিদি, জামাইবাবু ও ভাগিনাদের সাথে বুঝে দেখি কিছু করা যায় কি-না! আমার বিশ্বাস, দিদি আমাকে ফেলে দিবে না! আর ভাগিনারাও আমাকে নিয়ে বিরক্ত হবে না। যদিও জীবনে কোনও দিন দিদির বাড়ি যাইনি, তাতে কী হয়েছে? আমাকে ওরা ফেলবে না।’ আমার কথা শুনে কানাই বলল, ‘আচ্ছা তা-ই হবে। আগামী পরশুদিন আমি তোকে জলপাইগুড়ির বাসে উঠিয়ে দিচ্ছি। তুই তোর বড়দি’র বাড়ি গিয়ে দেখ কিছু করতে পারিস কিনা।’ বললাম, ‘ঠিক আছে তা-ই কর। দিদির বাড়ি পৌঁছে আমি তোকে চিঠি দিয়ে জানাবো।’ কানাই বলল, ‘ঠিক আছে তা-ই হবে। এখন আয়, একটা রুটি খেয়ে নে।’

কানাইর কথামত একটা পাউরুটি খেলাম। কানাইও খেল।
খাওয়া শেষে কানাই আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোর কাছে এখন টাকা আছে কত?’ বললাম, ‘পাঁচশো টাকা পুরো হবে না, কিছু কম হতে পারে।’ কানাই বলল, ‘এই টাকা থেকে আর একটা টাকাও খরচ করবি না। দুই চার পয়সা যা লাগে আমার কাছ থেকে চেয়ে নিবি, আমি দিবো। জলপাইগুড়ি যাওয়ার পর হঠাৎ করে কার কাছে টাকা চাইবি। ভারতের বাড়ি। নিজের কাছে না থাকলে কেউ দিবে না।’ বললাম, ‘সেই বুঝ আমার বোঝা হয়ে গেছে তোর বন্ধুর বাড়ি যাওয়ার পর থেকেই। এখন আমি খুবই হুশিয়ার! অন্তত ভারতে যতদিন থাকবো, ততদিন।’ আমার কথা শুনে কানাই বলল, ‘হ্যাঁ তা হলেই এই দেশে কিছু করতে পারবি। এখানে থাকলে, এখানকার মানুষের মতোই চলতে হবে, বুঝলি?’

এরপর কথা বলতে বলতে একসময় দুজনে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল যে কখন হয়েছে তা আর আমাদের জানা নেই। কানাইর মেজো বোন দরজার কাড়া নাড়ছে, আর দাদা দাদা বলে ডাকছে। ওঠলাম ঘুম থেকে। কানাইও ওঠল। তখন সকাল ১০ টা। কানাইর বোন ডলি বলল, ‘আজ আর তোমার মহল্লায় যাওয়া হবে না দাদা।’ কানাই বলল, ‘তুই এখন যা, আমি হাতমুখ ধুয়ে রেডি হচ্ছি। মহল্লায় না গেলে আমার একটু সমস্যা হবে।’ আমি বললাম, ‘পকেটে টাকা না থাকলে-তো সমস্যা হবেই। তুই আলসেমি না করে তাড়াতাড়ি করে মহল্লায় বেরিয়ে পড়।’ ডলি বলল, ‘দাদা, কাকীমা রুটি বানিয়েছে। তোমাদের দুইজনের জন্য চারটে রুটি নিয়ে আসি?’ কানাই বলল, ‘না থাক, দরকার নেই। আমরা সামনের হোটেল থেকে কিছু খেয়ে নিবো, তুই যা।’

ডলি চলে গেল। কানাই তাড়াতাড়ি করে হাতমুখ ধুয়ে আসলো। আমি ওর আগেই হাতমুখ ধুয়ে বসে আছি। বিক্রি করার মতো কাপড়গুলো নেওয়ার জন্য ভ্যানগাড়ি আগেই রেডি থাকে। মহল্লায় যাবার আগে ভ্যানগাড়ির ড্রাইভারকে আর খুঁজতে হয় না। কাপড়গুলো ধরাধরি করে ভ্যানগাড়িতে নিয়ে ওঠালাম। কানাই মহল্লায় চলে গেল। আমি আজও সেদিনের মতো একা হয়ে গেলাম। একা একাই বাঘা যতীন এলাকাটা একটু ঘোরা-ঘুরি করলাম। দুপুরের আগেই বাসায় গেলাম, স্নান করার জন্য। এ ছাড়াও আরও একটা উদ্দেশ্য ছিল তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার। উদ্দেশ্য হলো, এখানে আসার পর বাড়িওয়ালার ঘরে কোনও দিন দুপুরে খাওয়া হয়নি, তাই। খেয়েছি হয়ত দু’একদিন সকালে।

স্নান করার জন্য পলির কাছ থেকে সাবান চেয়ে নিয়ে গেলাম লেকে। স্নান করে এলাম বাসায়। কানাইর দু’বোন আগেই বাড়িওয়ালীকে বলে রেখেছে যে, নিতাই’দা আজ দুপুরবেলা ভাত খাবে। স্নান করে বাসায় গিয়েই দেখি পলি বসে আছে আমার অপেক্ষায়। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি রে, তুই এখানে বসে আছিস কেন?’ পলি বলল, ‘দাদা, এখানে এসেছ পর্যন্ত একটা দুপুরেও আমাদের সাথে বসে খাওনি। আজ আমি আর ডলি আগেই বাড়িওয়ালী কাকীকে বলে রেখেছি নিতাই’দা দুপুরে খাবে। এখন আমার সাথে আস, সবাই একসাথে বসে খাবো।’ পলির কথা শুনে মনে মনে হাসলাম! রক্তের সম্পর্ক নেই! তবুও এতো মায়া। বসে আছে একসাথে খাবে বলে। ও কে বললাম, ‘তুই যা আমি জামাকাপড় পরে এক্ষুণি আসছি।’

পলি চলে গেল বাড়িওয়ালার ঘরে। আমি জামাকাপড় পরে বাড়িওয়ালার ঘরে গেলাম খেতে। ডলি, পলি আর বাড়িওয়ালার মেয়েটা ভাতের থাল সামনে রেখে আমার অপেক্ষায় বসে আছে। আমাকে দেখেই পলি বলছে, ‘এইতো দাদা এসে গেছে। বসেন দাদা বসেন।’ বসলাম ওদের একপাশে ঠিক চোরের মতন চুপ করে। ভাত মেখে খাচ্ছিলাম। হঠাৎ বাড়িওয়ালী কাকী আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘বাবা তুমি তোমার বোনের বাড়ি কবে যাচ্ছ?’ আমি থতমত হয়ে বললাম, ‘কাকীমা কানাইর সাথে কথা হয়েছে দু’এক দিনের মধ্যেই যাবো।’ কাকীমা বললো, ‘দেখ সেখানে গিয়ে কিছু করতে পার কিনা।’ বললাম, ‘হ্যাঁ কাকীমা, দেখি সেখানে যাওয়ার পর সবকিছু বুঝা যাবে।’ লজ্জায় লজ্জায় কোনওরকমে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ঘর থেকে বের হলাম।

বাড়িওয়ালির কথা শুনে আমার বেশি ভালো লাগেনি। কেননা, এই ক’দিনে ভারতের হিসাব-কিতাব আমার জানা হয়ে গেছে, তাই। তারা পারে না, জোর করেই একটা অতিথিকে তাড়িয়ে দেয়! যদি সম্ভব হতো, তা হলে তা-ই করতো। এসব ভাবতে ভাবতে নিজের কাছে নিজেকেই খুব ছোট মনে হচ্ছিলো! কিন্তু কিছুই করতে পারছিলাম না। পারলে তখনই বাঘা যতীন ত্যাগ করতাম। কিন্তু না, তা আর হচ্ছিলো না। মন খারাপ করেই কানাইর বাসায় এসে শুয়ে রইলাম।

একসময় বিকাল হয়ে গেলো। কানাই মহল্লা থেকে বাসায় আসলো। কিন্তু কানাই যে কখন এলো, তা আর আমি টের পাইনি। ও মহল্লা থেকে এসে হাতমুখ দুয়ে আমাকে ঘুম থেকে জাগালো। জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু খেয়েছি কিনা! আমি বললাম, ‘খেয়েছি।’ তখন সন্ধ্যা ঘোর হয়ে রাতের পালা। কানাই বলল, ‘চল ঘুরে আসি।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় যাবি শুনি? কানাই বলল, ‘ধর্মতলা যাবো জলপাইগুড়ির একটা টিকেটের জন্য।’ তখন বুঝলাম আগামীকালই আমি বাঘা যতীন ত্যাগ করছি।

চলবে।

জীবনের গল্প-২৭ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-২৫

Image-6411

জীবনের গল্প-২৪ এর শেষাংশ: কানাই বুকিং-এ গিয়ে শিয়ালদার টিকিট নিল দুইটা। ওঠলাম ট্রেনে। রাত ১১টার সময় পৌঁছলাম শিয়ালদা স্টেশনে। এদিন বাসায় যেতে রাত হয়েছিল প্রায় ১ টা।

কানাই’র ভাড়া বাড়িতে গিয়ে দেখি বাড়িওয়ালার ঘর বন্ধ! কানাইর দু’বোন রাতে বাড়িওয়ালাদের ঘরে থাকে। কানাই’র বোনদের সমবয়সী বাড়িওয়ালার একটা মেয়ে আছে। ওর সাথেই রাতে ঘুমায়। দোতলা বাড়ি। রাত ১১টার পরপরই দোতলায় উঠার সিঁড়ি গেইটটা বন্ধ থাকে। তাই কানাই’র দু’বোনকেও ডাক দেওয়ার কায়দা নেই। আমার পেটের ক্ষুধার জান যায় যায় অবস্থা। এখন খাবো কী, সেই চিন্তায়ও শরীর অস্থির! ওমনি ফুল প্যান্টের পকেটে হাত পড়লো। দেখলাম অর্ধেক পাউরুটি প্যান্টের পকেটে। পাউরুটি ছিলো ফুলিয়া রেলস্টেশন থেকে কেনা। ট্রেনের হুইসেল শুনে তাড়াতাড়ি করার সময় আর পাউরুটি পুরোপুরি খাওয়া হয়নি। খাওয়ার বাকি যতটুকু ছিলো, তা ফুল প্যান্টের পকেটে ভরে দৌড় দিয়েছিলাম, ট্রেন ধরার জন্য। সেই অর্ধেক পাউরুটিই এখন রাতের খাবারের সম্বল। ভাগ্য ভালো ফুলিয়ার অর্ধেক পাউরুটি প্যান্টের পকেটে ছিল। না হয় আমার অবস্থা খুবই খারাপই ছিল।

যাই হোক, দুইজনে হাত-মুখ ধুলাম। কানাইকে বললাম, ‘কানাই, এখন কী খাব রে?’ কানাই বললো, ‘কী আর খাব! এখন দুইজনে কুয়ার জল খেয়ে ঘুমিয়ে থাকি। খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠে দোকানে গিয়েই খাব।’ আমি হেসে বললাম, ‘শুধু জল খাব কেন? সাথে পাউরুটিও খাব!’ কানাই বলল, ‘এতো রাতে তুই পাউরুটি পাবি কোথায়? একটা দোকানও খোলা নেই! আমার একটুও মনে ছিলো না যে, বাড়িওয়ালার ঘর বন্ধ থাকবে। মনে থাকলে আসার সময়ই শিয়ালদা থেকে কিছু সাথে করে নিয়ে আসতাম। যাক, তা আর আফসোস করে লাভ নেই! জল খেয়েই শুয়ে থাকি।’ কানাইর কথা শেষ হতে না হতেই আমি পকেট থেকে অর্ধেক পাউরুটি বের করলাম। রাখলাম কানাইর সামনে বিছানার উপরে। অর্ধেক পাউরুটি দেখে কানাই বলল, ‘সে-কি-রে? ফুলিয়ার পাউরুটি? পুরোটা খাসনি? দেয় কদ্দুর, খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।’ শেষতক তা-ই হলো! অর্ধেক পাউরুটি থেকে অর্ধেক-অর্ধেক করে খেয়ে, দুইজনে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালবেলা ঘুম থেকে আমি একটু দেরি করে ওঠালাম। কানাই উঠেছে আমার আগে। কানাই এখানে আসার পর ও-আর কাজে যায়নি। কানাই ভারতে মহল্লায়-মহল্লায় ফেরি করে কাপড় বিক্রি করে। অনেকদিন পর আজ মহল্লায় যাবে বলে মনস্তাপ করেছে। ও প্রতিদিন সকালে বের হয়। আসে সন্ধ্যার পর। এতক্ষণ সময় আমি কী করবো, কোথায় যাবো, এসব নিয়ে কানাই থাকে খুব চিন্তায়! আমি ঘুম থেকে ওঠেই দেখি কানাই মহল্লায় যাবার জন্য ভ্যানগাড়িতে কাপড় ওঠাচ্ছে। আমি বললাম, ‘কিরে! কোথায় যাবি?’ কানাই বলল, ‘অনেকদিন হলো মহল্লায় যাওয়ায় হয় না। তাই ভাবছি আজ মহল্লায় যাবো। না গেলেও হয় না। হাত একেবারেই খালি।’ আমি বললাম, ‘তা হলে আমাকেও সাথে নিয়ে যা। ঘুরে দেখে আসি তোর ব্যবসা আর বেচা-কেনা।’ কানাই বলল, ‘না তুই বাসায় থাক! আমি তাড়াতাড়ি করেই বাসায় ফিরে আসবো। যাচ্ছি শুধু কিছু বাকি টাকা আদায় করার জন্য।’ আমি বললাম, ‘একটু দাঁড়া, আমি হাত-মুখ ধুয়ে নিই, তারপর একসাথে বের হবো।’ তা-ই হলো। আমি হাত-মুখ ধোয়া পর্যন্ত কানাই রাস্তায় অপেক্ষা করছে। আমি সাধারণ বেশে বাসা থেকে বের হলাম। কানাই আমার অপেক্ষায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।

সামনে যেতেই কানাই বলল, ‘চল সামনের চা-দোকান থেকে দুইজনে চা-বিস্কুট খেয়ে নিই। আবার কখন-না-কখন আসি, তার কি ঠিক আছে?’ আমি বললাম, ‘চল চা-বিস্কুট খেয়ে নিই। আর আমার তো এমনিতেই চায়ের খুব অভ্যাস।’ কানাই-সহ চা-বিস্কুক খেলাম। কানাই চা-বিস্কুটের দাম দিয়ে রওয়ানা দিল মহল্লায়। আমি এখন একা এক অচেনা দেশে কাঙাল মানুষ। এখানে এখন আর আমার ঘনিষ্ঠ পরিচিত কেউ নেই। কানাই মহল্লায় যাবার পর আমার এখন কিছুই ভালো লাগছে না। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। ভাবছি বাসায় না গিয়ে টাউন থেকে গিয়ে ঘুরাফেরা করি। কিন্তু টাউনের অলি-গলিও আমার কাছে অপরিচিত। আবার ভাবছি, হোক অপরিচিত, তাতে কি হয়েছে? আমি চলবো আমার মতে। যেথায় খুশি সেথায় যাবো। কিন্তু যাবো কোথায়? এখন সকাল মাত্র ১০টা বাজে। এসব ভাবতে-ভাবতে একা-একা রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। এ সময় একটা অটোরিকশা (সিএনজি) এসে আমার সামনে দাঁড়াল। আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় যাবেন দাদা? ধর্মতলা যাবেন? আসেন।’

অটোরিকশার ভেতরে দুইজন যাত্রী বসা। তারাও হয়ত ধর্মতলাই যাবে। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। তাই অটোরিকশার ড্রাইভার আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কি দাদা, যাবেন?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ যাবো। তো আপনি গাড়ি নিয়ে কোথায় যাবেন? আমি কিন্তু ধর্মতলাই যাবো।’ ড্রাইভার বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ দাদা, আমারও ধর্মতলা পর্যন্তই শেষ। আসেন আসেন গাড়িতে উঠুন।’ উঠলাম অটোতে। অটো চলছে। আমি অটোতে বসে মনে মনে বলছি, ‘সেদিন কানাইর সাথে গিয়েছিলাম। তাড়াহুড়োর মধ্যে ভালো করে ঘুরে দেখা হয়নি। আজ আমি একা। সাথে টাকাও আছে। আশা করি কোনও সমস্যা হবে না। মনটাও বেশি ভালো লাগছে না। দেশের কথা মনে পড়ছে। আমার বড়দিদির বাড়ি জলপাইগুড়ি জেলার বীরপাড়া। কীভাবে যেতে হয় তাও জানা নেই। এখানে যদি কাজের কোনও ব্যবস্থা না হয়, তা হলে তো বড়দিদির বাড়িতেই যাতে হবে। জলপাইগুড়ি বড়দিদির বাড়ি গেলে দিদি আমাকে চিনবে কি না? যদি না চিনে? যদি তার ওখানে আমাকে থাকতে না দেয়? তা হলে যাবো কোথায়?’

একসময় অটো ধর্মতলা পৌঁছালো। অটো থেকে নেমে ড্রাইভারকে ভাড়া দিলাম ৬ টাকা। ধর্মতলা হলো কোলকাতা শহরের এক ব্যস্ততম জায়গা। এখান থেকেই ভারতের বিভিন্ন শহরে যাবার বাস সার্ভিস। রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটছি। দেখছি! এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি! সামনেই একটা চা-স্টল। বসলাম সামনে থাকা একটা চেয়ারে। দোকানদার জিজ্ঞেস করল, ‘কী খাবেন দাদা? চা বানিয়ে দিবো?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ দাদা, ভালো করে এক কাপ চা বানিয়ে দিন।’ দোকানদার আমার দিকে বারবার তাকিয়ে-তাকিয়ে কি যেন ফলো করছে। কিন্তু কিছুই জিজ্ঞেস করছে না। চা বানিয়ে সামনে এনে দিয়ে বললো, ‘দাদা বাবুর বাড়ি কোথায়? কোথা-ই-বা যাবেন?’ এরপর দোকানদার আমার সামনে এসে বসল। আমি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে চা-পান করতেই, আবার বলল, ‘কোথায় যাবেন? আমি বললাম, ‘কোথাও যাবো না দাদা। এসেছি একটু ঘুরতে।’

চায়ের দোকানে আমি ছাড়া তখন আর কোনও কাস্টমার ছিল না। দোকানদার আমাকে আবারও করলো, ‘আপনাকে দেখে ভারতের মানুষ বলে মনে হয় না। মনে হয় আপনি জয় বাংলার লোক। এখানে আপনার কে থাকে? আমিও কিন্তু জয় বাংলার লোক, দাদা। আমাদের বাড়ি ছিল ফরিদপুর জেলায়। এখানে আমরা অনেক পুরানো। আমার জন্মও এই ভারতেই। জয় বাংলায় কোনও দিন যাওয়া হয়নি। তাই জয় বাংলার লোক দেখলেই মনটা খাঁ-খাঁ করে ওঠে দাদা।’

দোকানদারের কথা শুনে আমি বললাম, ‘আমার বাড়ি ও দেশ, দুটোই বাংলাদেশে। এখানে এসেছি আমার এক বন্ধুর সাথে। এসেছি একটা কাজের আশায়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি দাদা। এবার দেশে ফিরে যাবার পালা। হয়ত দু’একদিনের মধ্যেই দেশে চলে যাব। তাই আপনাদের কোলকাতা শহরটা একটু দেখতে এসেছি।’ আমার কথা শুনে দোকানদার বলল, ‘এখানে আপনার বন্ধু ছাড়া আর কেউ নেই?’ বললাম, ‘আছে দাদা, তা তো অনেক দূরে! সেই জলপাইগুড়ি। সেখানে আমার আপন বড় বোনের বাড়ি। তবে দাদা, কীভাবে যে যেতে হয়, তাও আমার জানা নেই।’ দোকানদার বললো, ‘জলপাইগুড়ি? কীভাবে যাবেন? যেদিন যাবেন, সেদিন আমার সাথে দেখা করবেন। আমি আপনাকে জলপাইগুড়ির বাসে উঠিয়ে দিবো। এই তো জলপাইগুড়ি বাসস্ট্যান্ড দেখা যাচ্ছে। একটু সামনে গেলেই দেখবেন, উত্তরবঙ্গের সকল জেলায় যাওয়ার বাস।’

দোকানদারের কথা শুনে আমি হেসে বললাম, ‘আচ্ছা দাদা, ঠিক আছে। আমি যেদিন জলপাইগুড়ি যাবো, সেই দিন আপনার সাথে দেখা করে যাবো। এই নিন, আপনার চা-সিগারেটের দাম রাখুন।’ পাঁচ টাকার একটা নোট হাতে দিতে গেলেই দোকানদার রাগ হয়ে আমাকে বললো, ‘যান তো দাদা, জলপাইগুড়ি যেদিন যাবেন, সেদিন দিবেন। এখন এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করে যাবার সময় আবার এক কাপ চা পান করে যাবেন।’ দোকানদার চায়ের মূল্য আর নিল না, আমিও তাকে জোর করে দিতে পারলাম না!

চলে গেলাম, উত্তরবঙ্গের বাসস্ট্যান্ডের সামনে। একটা টিকিট কাউন্টারে গিয়ে জানলাম, জলপাইগুড়ি বীরপাড়ার ভাড়া কত? ভাড়া ২৬০ টাকা। বীরপাড়া যেতে সময় লাগবে ২০ ঘণ্টার মতো। এখন আর আমার ভালো লাগছে না, শুধু বড়দিদির বাড়ি যাবার চিন্তাই করছি। এদিকে দুপুর হয়ে গেছে বহু আগেই, অথচ আমার খবর নাই। এই দিন ধর্মতলার অনেক জায়গায় ঘুরা-ঘুরি করেছি। তাই কখন যে দুপুরের সময় হয়ে গেছে, একটু খেয়ালও করতে পারিনি। আবার একটা অটো করে বাঘা যতীন কানাই’র বাসার সামনে এলাম। বাসায় গিয়ে কানাইর বোন পলিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কানাই কখন আসবে রে?’

পলি বলল, ‘কখন যে আসে, তা কি ঠিক আছে? আপনি কোথায় গিয়েছিলেন দাদা? আপনাকে অনেক খুঁজেছি, মহল্লার প্রতিটা দোকানে। জিজ্ঞেসও করেছি। কেউ বলতে পারানি। আমরা আপনার জন্য খুবই চিন্তায় ছিলাম। কানাইদা কাপড় নিয়ে মহল্লায় যাবার সময় আপনার কথা বলে গিয়েছিল, আপনার দিকে লক্ষ্য রাখতে। লক্ষ্য তো দূরের কথা, আপনার পাত্তাই নেই। দুপুরে কী খেয়েছেন? মনে হয় কিছুই খাননি। এখন তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে আসেন, ভাত খাবেন।’

পলির কথা শুনে আমি বললাম, ‘আমি বাইরে থেকে খেয়ে আসেছি। তোরা খেয়েছিস তো?’ পলি বলল, ‘এখন বিকাল ৪ টা বাজতে লাগল দাদা, এখনও কি না খেয়ে থাকা যায়? আমরা আপনার বার চেয়ে-চেয়ে এই মাত্র খেলাম।’ আমি বললাম, ‘বেশ করেছিস! আরও আগে খেয়ে নিতে পারতিস। আমার জন্য শুধু-শুধু কষ্ট করলি? ডলি খেয়েছে? ও এখন কোথায়? পলি বলল, ‘ও খাওয়া-দাওয়া করে এখন ঘুমাচ্ছে।’ বললাম, ‘আমাকে তেলের শিশি আর শাবানটা একটু এনে দে, আমি স্নান করে একটু ঘুমাবো। কানাই আসলে আমাকে ডেকে দিবি।’

পলি শাবান-সহ রেলের শিশি এনে দিল। আমি লেকে গেলাম স্নান করতে। কোলকাতা শহরে বেশি একটা পুকুর নেই। আছে মহল্লায়-মহল্লায় বিশাল-বিশাল লেক। সেখানকার মানুষেরা সবাই লেকে স্নান করে। মানুষের সুবিধার্থে সিটি কর্পোরেশন এই লেকগুলো তৈরি করে দিয়েছেন। আর বেশিভাগ মানুষের বাড়িতে কিছু না থাকলেও একটা কুয়া অবশ্যই থাকে। বাসার প্রতিদিনের ধোয়া-মোছার কাজ ওই কুয়ার জলেই করে থাকে। আমি লেক থেকে স্নান করে এসে বিছানায় গিয়ে শুলাম। শরীর খুব ক্লান্ত! সারাদিন গেল দুই কাপ চায়ের উপর। না খেয়ে থেকেও বললাম, খেয়েছি। কারণ, বাড়িওয়ালি কেমন যেন বিরক্ত-বিরক্ত ভাব দেখায়, তাই। বিছানায় শরীরটাকে লেলিয়ে দেওয়ার সাথে-সাথেই ঘুমিয়ে পড়লাম। কানাই মহল্লা থেকে এসেছে সন্ধ্যাবেলা। কানাই এসেই আমাকে ঘুম থেকে ডেকে ওঠাল। আমি ঘুম থেকে উঠে বললাম, ‘কখন এসেছিস?’

কানাই বলল, ‘এই-তো এলাম! তুই এতো সময় করে ঘুমাচ্ছিস যে? দুপুরে খেয়েছিস?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ খেয়েছি। তুই কোথায় খেয়েছিস? কী খেয়েছিস? কানাই বলল, ‘আমি মহল্লায় বেরুলে দুপুরে আর খাওয়া হয় না। এই সামান্য চা-বিস্কুট হলেই হয়ে যায়। এর বেশি কিছু আর লাগে না।’ কানাই ওর ব্যবসার কাপড়গুলো এক সাইট করে রেখে স্নান করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি বিছানা থেকে নেমে কুয়ায় গেলাম, হাত-মুখ ধুতে।

কানাই স্নান করে এসে জামাকাপড় পরে আমাকে বলল, ‘চল আমার সাথে।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায়?’ কানাই বলল, ‘ধর্মতলা থেকে একটু ঘুরে আসি।’ আমি বললাম, আমিতো সকালে একবার ধর্মতলা গিয়েছিলাম। ঘুরেফিরে অনেককিছু দেখে এলাম। জেনেও এলাম। আমার কথা শুনে কানাই জিজ্ঞেস করল, ‘কী দেখে আসলি আর কী জেনে আসলি?’ বললাম, ‘আমার বড়দিদির বাড়ি জলপাইগুড়িতে কীভাবে যেতে হয়, তা জেনে আসলাম। কানাই বলল, ‘বেশ করেছিস, আমার সাথে চল আমি তোকে পুরো ধর্মতলা ঘুরাবো।’

জামাকাপড় পড়ে কানাই-সহ অটোতে চড়ে গেলাম ধর্মতলা। অটো থেকে নেমেই চা-দোকানদারের সাথে দেখা করলাম। কানাইকে বললাম, ‘এই লোকের বাড়ি আমাদের দেশে ফরিদপুর। সকালে চা-দোকানদারের আপ্যায়নের কথাও বললাম। তারপর গেলাম একটা হোটেলে, কিছু খাওয়ার জন্য। কানাই সারাদিন বাইরে ছিল। ওর-ও ভাত খাওয়া হয়নি। তাই এই সন্ধ্যায় হোটেলে ঢোকা।

চলবে…

জীবনকে গল্প-২৬ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবিকার সন্ধান!

131686661_302_o

ভোর হতে জীবিকার সাথে যুদ্ধ শুরু!
রাতদুপুর অবধি চলে তুমুল যুদ্ধ!
এই যুদ্ধের শেষ কোথায় হে গুরু?
শিশুকাল পেরিয়ে কেউ হয়েছে বৃদ্ধ!
তবুও হচ্ছে না জয়! সদা পরাজয়!
কবে হবে শেষ, জীবনের এই যুদ্ধ?
তবুও থেমে নেই জীবন, থামছে না যুদ্ধ!
চেষ্টা শুধু বেঁচে থাকার জীবিকার সন্ধান!
সকাল-দুপুর, রাত-বিরেত, যুবক-বৃদ্ধ,
ধনী-গরিব, কৃষাণ-কৃষাণীর চেষ্টা সমান-সমান!
তাতে হয় কারোর জয়, কারোর পরাজয়!
তবুও সকলেরই লক্ষ্য জীবিকার সন্ধান!

জীবনের গল্প-২৪

Image-6411-8

জীবনের গল্প-২৩ এর শেষাংশ: কিন্তু তা আর হল না কানাইর জন্য। ও আমাকে সিনেমা দেখাবে, তাই তাড়াতাড়ি করে ট্রামে ওঠল। যাবে টালিগঞ্জ। সেখানে গিয়ে শাহরুখ খান অভিনীত “বাজিগার” ছায়াছবি দেখাবে।

যেই কথা সেই কাজ! হাওড়া থেকে ট্রামে চড়ে গেলাম ধর্মতলা। সেখান থেকে বাসে চড়ে গেলাম টালিগঞ্জ। ছায়াছবি দেখা হবে, মেনকা সিনেমা-হলে। সিনেমা দেখবো রাত্রিকালীন শো। শো আরম্ভ হবে রাত ৯ টায়, শেষ হবে রাত ১২টায়। ছায়াছবি ‘বাজিগার’ নায়ক শাহরুখ খান, নায়িকা কাজল অভিনীত। দেখলাম, ভারতের সিনেমাহলে বড় পর্দায় সিনেমা। খেয়াল করলাম, সেখানকার মানুষ খুবই সংস্কৃতি প্রিয়। অনেকেই একবেলা খাবার না খেয়েও সেই টাকা দিয়ে তারা সিনেমা দেখে। এমনও পরিবার দেখেছি, তাদের রান্না-বান্না চলে পাথর-কয়লা দিয়ে। সেই পাথর-কয়লা থেকে একটি-দুইটি করে কাঁচ-কয়লা প্রতিদিন রেখে দেয়। যখন একদিন রান্না করার মত কয়লা জমা হয়ে যায়, তখন গৃহিণী তার স্বামীর কাছ থেকে সেই টাকা আদায় করে নেয়। পরে সেই টাকা দিয়ে তারা স্বামী-স্ত্রী দুইজনে গিয়ে সিনেমা দেখে। যেদিন সিনেমা দেখবে, সেদিন ঘরে ফিরে আর রান্না-বান্না করবে না। সিনেমা দেখে আসার সময় কিছু চানাচুর বা বিস্কুট সাথে নিয়ে এসে তা-ই খেয়ে থাকবে। তবু সিনেমা দেখা চাই-ই-চাই। এ ছাড়াও যেকোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে দলে-দলে যোগদান করে থাকে। যেমন- যাত্রাপালা, লোকনাট্য, থিয়েটার, কবিগান সহ নানারকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। আর আমাদের দেশে বর্তমানে সিনেমা হলে তো কেউ যায়-ই না। অনেক স্থানে দর্শক সংকটে সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

যাক সে কথা। সেদিন টালিগঞ্জ মণিকা সিনেমাহলে সিনেমা দেখে বাসায় ফিরতে রাত হয়েছিল প্রায় দেড়টা। কানাই আগেই জানত যে, এত রাতে বাসায় গেলে বাড়িওয়ালার ঘর বন্ধ থাকবে। তাই সিনেমা দেখে আসার সময়ই দুইটা পাউরুটি কিনেছিল। বাসায় গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে একটা পাউরুটি খেয়ে বিছানায় গিয়ে শুলাম। কিন্তু কিছুতেই আমার ঘুম আসছে না, মনটা কেমন যেন ছটফট করছে। মনে পড়ছে স্ত্রী ও সন্তানদের কথা, আর দাদা বৌদির কথা। আবার ভাবছি নিজের পকেটের কথাও! আবার ভাবছি যেখানে যাব সেখানকার কথা। এই ঘুরা-ঘুরির মধ্যে নিজের বেশকিছু টাকা খরচও হয়ে গেল। পকেট শূন্য হয়ে গেলে কানাই যদি সহযোগিতা না করে? হয়ত করবে। তা-ও ক’দিন করবে? ওরও তো এখানে একটা সংসারের মতো আছে। যদিও বিয়েশাদী এখনও করেনি, তাতে কী হয়েছে? দুইটা বোন তো সাথে আছে! আমাকে একা বাসায় রেখে কানাইও কোনও কাজে কর্মে যেতে পারছে না। এসব কিছু ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম, তা নিজেও জানিনা।

এভাবে এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করতে করতে কেটে গেলো প্রায় পাঁচ দিনের মতোন। ছয় দিনের মাথায় কানাই বলল, ‘তাড়াতাড়ি জামাকাপড় নিয়ে রেডি হয়ে নে, ফুলিয়া যাবো।’ কানাইর কথা শুনে আমি জামাকাপড় ব্যাগের ভেতরে ভরে প্রস্তুত হলাম। বাড়িওয়ালার ঘরে গিয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিলাম। কানাইর দু’বোনকে বললাম, ‘এক দেশ থেকে আরেক দেশে এসেছিস, ভালোভাবে চলাফেরা করবি। এমনভাবে চলবি, যাতে অন্য কেহ কোনও খারাপ মন্তব্য না করতে পারে।’ এরমধেই কানাই রেডি হয়ে আমাকে ডাকল! আমি কানাইর সামনে এসে বললাম, ‘আমি রেডি আছি, চল বাইর হই!’

কানাইর ভাড়া বাসা থেকে শিয়ালদা রেলস্টেশন অনেকদূর। এতদূর রিকশা যাবে না, তাই একটা অটোরিকশা রিজার্ভ নিলাম। তবুও শিয়ালদা যেতে বেজে গেল সকাল ১০টা। শিয়ালদা থেকে ফুলিয়া যেতে সময় লাগল, ২ ঘণ্টার মতো। ফুলিয়া হলো পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার একটা থানা এলাকা। ফুলিয়া রেলস্টেশনের একটু পূর্বদিকে গেলেই রতন চক্রবর্তীর বাড়ি। কানাই আমাকে নিয়ে গেল রতনদার বাড়িতে। আসলে রতনদার কোনও বাড়ি নেই! আছে শুধু বাড়ি করার মতো একটুখানি জায়গা। বর্তমানে যেই লোকটা রতনদার জায়গা দেখাশুনা করে তার নাম গৌরাঙ্গ। একসময় এই গৌরাঙ্গ দাদা আমার খুবই কাছের মানুষ ছিলো। আগে বাংলাদেশে থাকতে একই মহল্লায় আমরা বসবাস করতাম। তিনি যে রতনদার জায়গা দেখাশোনা করছে, তা আর আমার জানা ছিল না।

গৌরাঙ্গ দাদা আমাকে দেখেই বলল, ‘কী রে নিতাই কেমন আছিস? কীভাবে এলি। বাসার সবাই কেমন আছে।’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ দাদা, আমি ভালো আছি, আর বাসার সবাই ভালো আছে। এখানে এসেছি কানাইর সাথে। তো আপনি কেমন আছেন? বৌদি কোথায়?’ গৌরাঙ্গদা বললো, সবাই ভালো আছি।’ কথা বলতে বলতে ঘর থেকে পিঁড়ি এনে দিয়ে বলল, ‘বস।’ তখন গৌরাঙ্গদা’র বউ (বৌদি) বাসায় ছিল না। বৌদি গেছে কোনও এক জায়গায় বেড়াতে। এরপর কানাই গৌরাঙ্গ দাদাকে বিস্তারিত খুলে বলল। গৌরাঙ্গ দাদা শুনলেন। কানাইর কথা শুনে গৌরাঙ্গ দাদা বললো, বেশতো, ভালো করেছিস। এবার ওকে রতনের জায়গায় একটা ঘর তৈরি করে দে, ও থাকুক।

কানাই কোনও কথা বলছে না, চুপ করে বসে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে রে? আমি তো কিছু বুঝে ওঠতে পারছি না।’ কানাই আমাকে বললো, ‘কিছু একটা তো হয়েছে রে। খেলা দেখাব, রতন না হয় রতনের বউকে।’ আমার আর বুঝতে অসুবিধা হলো না। তারপরেও আমি বললাম, ‘রতনদা’র ঘর কোনটা গৌরাঙ্গ দাদা? রতনদার ঘরে গিয়ে একটু বসি। এখানে থাকি বা না থাকি, রতনদার ঘরটা দেখেই যাই।’ গৌরাঙ্গদা বললো, ‘রতনের ঘর তো তার জমিতে পরে আছে, ঠেলে ওঠাতে হবে। কানাইকে বল ঘরখানা ওঠানোর ব্যবস্থা করতে।’ গৌরাঙ্গদা’র কথা শুনে কানাই বললো, ‘হয়েছে আর ঘর দেখতে হবে না, দেখবো এবার রতনকে।’ আমি কানাইকে বললাম, ‘কানাই তুই এখানে থাকিস, অথচ তুই কিছুই জানিস না! এটা কী বিশ্বাসযোগ্য?’ আমার কথা শুনে কানাই বললো, ‘বিশ্বাস কর আমি জানি না যে, রতন চক্রবর্তীর বাড়ি নেই। যদি জানতাম, তা হলে অন্তত আমি তোকে আমার সাথে আনতাম না।’

কানাইর কথা শুনে আমি বললাম, ‘যা হবার হয়েছে এখন তোর বাসায় চল। আগামীকাল একটু কষ্ট করে দেখবি, কোনও মিলে সিট খালি আছে কি না। যদি এখানে কোনও কাপড়ের মিলে চাকরি না পাই, তা হলে আমি চলে যাবো দিদির বাড়িতে।’ আমার কথা শুনে কানাই কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো। হয়ত আমার কথায় ওর একটু লজ্জাবোধ হচ্ছিল। লজ্জা তো পাবার কথাই, কারণ ও-ই-তো আমাকে এখানে আনলো। আর রতন চক্রবর্তীর সাথে ও-ই কথা পাকাপাকি করেছিল। এখন আমার কথায় ওর একটু লজ্জা লাগা স্বাভাবিক।

কিছুক্ষণ পর কানাই আমাকে বললো, ‘শুন, কষ্ট করে যখন এখানে এসেছিস, তো একটা কিছু করতেই হবে। দরকার হয় ট্রেনে, বাসে, ট্রামে ফেরি করে বাদাম বিক্রি করবি। একটু কষ্ট আর ধৈর্য ধরে থাকতে পারলেই, এখানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নিতে পারবি। কানাইর কথা শুনে আমি বললাম, ‘তা পরে দেখা যাবে, এখন অন্তত এখান থেকে চলে যাই।

কানাই বললো, ‘যাব, আগে তোকে নিয়ে ফুলিয়া এলাকাটা একটু দেখাই। এখানে ছোট ছোট অনেক টেক্সটাইল মিল আছে। যদি কপাল ভালো হয়, আর যদি একটা মিলে কাজ হয়ে যায় ক্ষতি কী? তাহলে রতন চক্রবর্তীর আর দরকার হবে না।’ আমি বললাম, ‘চল তাহলে। বেলা অনেক হয়েছে, আবার তো বাসায় ফিরতে হবে।’ আমার কথা শুনে কানাই বললো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে চল। এরপর কানাই আর আমি গৌরাঙ্গ দাদার কাছ থেকে বলে-কয়ে বিদায় নিলাম।

আসলাম ফুলিয়া রেলস্টেশন। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল হবার পালা। ক্ষিদে পেয়েছিল খুব! কানাইকে কিছু না বলার আগেই, কানাই বুঝতে পেরেছে। কানাই আমাকে বললো, ‘দেখ, এটা ভারত। এখানে মানুষ খুবই হিসাব করে চলে। গৌরাঙ্গ দাদা আমাদের খুবই কাছের লোক হয়েও দুপুরের খাবারের কথা কিছু বলল না। আর আমাদের বাংলাদেশ হলে কী হতো? নিজেরা না খেয়েও অতিথিকে খেতে দিতো।’ আমি বললাম, ‘যা হবার হয়েছে, এখন চল একটা হোটেলে যাই। আগে কিছু খেয়ে নেই।’

গেলাম ফুলিয়া রেলস্টেশনের বাইরে! খাবারের কোনও হোটেল নেই। ফুলিয়া হলো মফস্বল এলাকা। এখানে বহিরাগত মানুষের বসবাস কম। হোটেলে কেউ খাবার খেতে আসে না। তাই হোটেলের ব্যবসাও কেউ করে না। অথচ এই ফুলিয়া রেলস্টেশনের একটু পশ্চিমে কোলকাতা থেকে উত্তরবঙ্গ যাওয়ার মেইন রোড। আছে বাসস্টপ আর অনেক বড় বাজার। তবু একটা খাবারের হোটেল নেই। আছে দুই একটা চা দোকান আর কয়টা মিষ্টির দোকান। হোটেল খুঁজে না পেয়ে একটা চা দোকানে গেলাম। চা দোকান থেকে দুইটা পাউরুটি কিনে গেলাম মিষ্টির দোকানে। মিষ্টির দোকান থেকে দুইজনে চারটে মিষ্টি নিয়ে পাউরুটি দিয়ে খেলাম।

এরপর কানাই আমাকে নিয়ে গেল একটা টেক্সটাইল মিলে। এই কাপড়ের মিলে তৈরি হয় ৬০ কাউন্টের সুতার গ্রে মার্কিন কাপড়। এই কাপড়গুলো ডাইং ও প্রিন্ট করে প্রস্তুত করা হয় শাড়ি। মিলে গিয়ে কানাই কর্তব্যরত সুপারভাইজারের সাথে আমার ব্যাপারে আলাপ করলো। সুপারভাইজার আমাকে একটা চালু তাঁতের সামনে নিয়ে গেলো। সাথে কানাইও আছে। সুপারভাইজার আমাকে বললো, ‘মেশিনটা বন্ধ করুন তো!’ আমি সাথে সাথে মেশিনের হেন্ডেল ধরে চালু মেশিনটা বন্ধ করলাম। মেশিনটা বন্ধ করে পাঁচ মিনিট পর আবার চালু করে দিলাম। মেশিন চলছে। আমার মেশিনে হেন্ডেল ধরা দেখেই সুপারভাইজার বললো, ‘এই তো দেখছি তাঁতের ওস্তাদ। আগে কোথায় কাজ করেছে?’ কানাই বললো, ‘আপনাকে তো আগেই বলেছি, ও বাংলাদেশ থেকে এসেছে। এখন আপনাদের মিলে কি কাজ করা যাবে?’ সুপারভাইজার বললো, ‘বর্তমানে আমাদের এখানে কোনও সিট খালি নেই। সিট খালি হতে আরও মাসেকখানি দেরি হতে পারে।’

আমি সুপারভাইজার বাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনাদের এখানে ‘ব’ গাঁথার কোনও লোক লাগবে কি না?’ সুপারভাইজার বাবু বললো, ‘আমি আপনার কথা বুঝে উঠতে পারছি না যে, ‘ব’ গাঁথা কাকে বলে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘শানা এবং বয়ার ভেতর দিয়ে সুতা ভরার কাজটাকে আপনারা কী বলেন?’ আমার কথা শুনে সুপারভাইজার বাবু বললো, ‘ওহ! বুঝেছি বুঝেছি, ওটাকে আমরা রেসিং বলি। আর যিনি এই কাজটা করে থাকে, তাকে বলি রেসিংম্যান।’ আমি বললাম, ‘আমার এই কাজটাও জানা আছে। যদি আপনার এখানে এই কাজের লোক না থাকে, তাহলে আমাকে এই কাজটা দিতে পারেন।’

সুপারভাইজার বাবু হেসে বললো, ‘দুঃখিত! এই কাজটা এলাকার একজন লোকে করে। আর আপনি তো এই কাজ এখানে করতে পারবেন না। কেননা, আপনার তো হেলপার নেই। এই কাজ করতে হলে আগে দরকার হেলপার। কিন্তু আপনার তো তা নেই! তাহলে কাজটা করবেন কী করে?’ আমি আরও জিজ্ঞেস করলাম, ‘থাক এই কাজও আমার দরকার নেই! এখন শুনি আপনাদের এখানে তাঁতিদের মজুরি দিয়ে থাকেন কীভাবে?’ সুপারভাইজার বাবু বললো, প্রতি এক গজ কাপড় বুননকারিকে ৬০ পয়সা মজুরি দিয়ে থাকি।’ আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘একজন তাঁতিকে কয়টা করে মেশিন চালাতে দেন?’ সুপারভাইজার বাবু বললো, ‘দুইটার বেশি মেশিন কেউ কি চালাতে পারে? আর পারলেও আমরা দেই না। কারণ, বেশি মেশিন দিলে বুননের সময় কাপড় খারাপ করে ফেলে, তাই।’ আমি সুপারভাইজার বাবুকে বললাম, আমাদের বাংলাদেশে একজন তাঁতি অন্তত ৬ থেকে ৮ টা করে মেশিন চালায়।’

আমার কথা শুনে সুপারভাইজার বাবু মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারে বসে পরলো! চেয়ারে বসে বসে আমার দিকে আর কানাইর দিকে শুধু তাকাচ্ছে। এমনভাবে তাকাচ্ছে, যেন সুপারভাইজার বাবু বোবা হয়ে গেছে। সুপারভাইজার বাবুর এই অবস্থা দেখে কানাই বললো, ‘কি স্যার কিছু বলছেন না যে? আমারা তাহলে এবার আসি?’ সুপারভাইজার বাবু বললো, ‘দেখুন, আপনারা দিল্লি চলে যান। অনেক টাকা কামাতে পারবেন। ওখানে অনেক উন্নতমানের কাপড় তৈরির মেশিন আছে। সেসব মেশিন আপনাদের জন্যই দরকার। এখানে কাজ করে আপনাদের কখনোই পোষাবে না। এখানে যারা তাঁত চালায়, তাদের সকলের বাড়িই মিলের আশেপাশে। তাদের কোনরকম বাজার করার টাকা হলেই হলো। সেটা তো আপনাদের বেলায় চলবে না দাদা। আপনাদের চাই ভালো টাকা বেতনের চাকরি।’ সুপারভাইজার বাবুর কথা শুনে আমি বললাম, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, দেখি কী করা যায়!’

এরপর মিল থেকে কানাই আর আমি চলে এলাম বাইরে। তখন রাত প্রায় ৮ টার মতো বাজে। কানাই বললো, সর্বনাশ হয়েছে রে। এতো রাত হয়ে গেল, একটু টেরও পেলাম না। চল শিগগির ফুলিয়া রেলস্টেশনে। রাত ৯টায় একটা ট্রেন আছে, সেটা না ধরতে পারলে বিপদই হবে।’ এরপর কানাই আর আমি তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলাম। আসবো কোলকাতা-টু-শিলিগুড়ি মেইন রোডে। হাইওয়ে পার হয়ে গেলাম ফুলিয়া রেলস্টেশনের সামনে। তখন রাত ৯ টা বাজতে ৩০/৩৫ মিনিট বাকি আছে। আমার খুব ক্ষিদেও পেয়েছে। কিন্তু কানাইকে কিছু বলতেও পারছি না যে, কানাই আমার ক্ষিদে পেয়েছে। আমার অবস্থা দেখে কানাই বুঝতে পেরেছে যে, আমার ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে। কানাই আমাকে বললো, ‘ট্রেন আসতে এখনও সময় আছে, চল কিছু খেয়ে নিই।’ কানাইর কথা শুনে আমি খুবই খুশি হয়ে বললাম, ‘আমিই তোকে বলতাম যে, আমার খুব ক্ষিদে লেগেছে! তার আগেই তুই বলে ফেললি? এখন চল একটা চা দোকানে যাই, ঝটপট কিছু খেয়ে নিই।’

গেলাম একটা চা দোকানে। আবারও নিলাম দুইটা পাউরুটি আর দুই কাপ চা। চা খেতে না খেতেই শোনা যাচ্ছে ট্রেনের হুইসেল। আমি কেবল পাউরুটিটা অর্ধেক খেয়েছিলাম। হুইসেল শোনার পর আর খেতে পারিনি। তাড়াতাড়ি করে চা টা গিলে রুটিটা পকেটে ভরলাম। দোকানদারকে চা-রুটির টাকা দিয়ে দে দৌড়। আমার মতো কানাইরও একইরকম অবস্থা ছিলো! দুইজনেই স্টেশনের দিকে দৌড়াচ্ছি। আসলাম স্টেশনে। কানাই বুকিং-এ গিয়ে শিয়ালদার টিকিট নিল দুইটা। ওঠলাম ট্রেনে। রাত ১১টার সময় পৌঁছলাম শিয়ালদা স্টেশনে। এদিন বাসায় যেতে রাত হয়েছিল প্রায় ১ টা।

চলবে…

জীবনের গল্প-২৫ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

মহান বিজয় দিবসের সাক্ষী হয়ে আজও বেঁচে আছি

061393

বিজয় দিবস হলো, মুক্তিযুদ্ধ। আর মুক্তিযুদ্ধ হলো মুক্তির জন্য যুদ্ধ। যা শুরু হয়েছি, ১৯৭১ সালে সংঘটিত তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র বাঙালির সশস্ত্র সংগ্রাম। যার মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসাবে পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালী নিধনে ঝাঁপিয়ে পড়লে একটি জনযুদ্ধের আদলে মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা ঘটে। তারপর দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাঙালির এই মহান বিজয়।

আমি তখন ৮ বছরের এক নাবালক শিশু। বাবা আর আমার বড়দা চাকরি করতেন নারায়ণগঞ্জ। বাবা চাকরি করতেন নারায়ণগঞ্জ বর্তমান সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন গোদনাইল চিত্তরঞ্জন কটন মিলে। আর বড়দা চাকরি করতেন নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানাধীন লক্ষণখোলা আদর্শ কটন মিলে। আমার মা আর তিন বোন সহ থাকতাম নোয়াখালী বজরা রেলস্টেশনের পশ্চিমে মাহাতাবপুর গ্রামে, আমাদের বাড়িতে। তখনকার সময় ঘরে-ঘরে এত রেডিও টেলিভিশন ছিলো না। পুরো একটা গ্রামে বিত্তশালী কোন ব্যক্তির বাড়িতে হয়তো একটা কাঠের বাক্সের মত রেডিও থাকতো। টেলিভিশন তো ছিল স্বপ্নের সোনার হরিণ! ছিল না বললেই চলে।

আমাদের মাহাতাবপুর গ্রামে এক বাড়িতে ছিল, ওয়ান বেন্ডের একটা রেডিও। বাড়িটার নাম ছিল বড়বাড়ি। খবরের সময় হলে সারা গ্রামের মানুষ ওই বড়বাড়িতে ভীড় জমাতো, খবর শোনার জন্য। মায়ের সাথে আমি আর আমার তিন বড়দিদিও যেতাম খবর শুনতে। শুনতাম পঁচিশে মার্চের কাল রাতের ভয়াবহ ঘটনার কথা। শুনতাম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক ঢাকায় অজস্র সাধারণ নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, বাঙালী পুলিশ হত্যা ও গ্রেফতারের কথা। শুনতাম ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সহ দেশের বহু জেলা শহরে জ্বালাও পোড়াও এর কথা। আমার অভাগিনী মায়ের চোখে তখন ঘুম ছিল না। উদরে ক্ষুধা ছিল না। মুখে হাসি ছিল না। কাঁদতে কাঁদতে মায়ের চোখ নদীতে অবশিষ্ট জল ছিল না।

আমার মা স্বামী আর সন্তানের জন্য মায়ের কান্নাকাটি আর থামছিল না। পাগলের মত হয়ে আমার মা শুধুই ঘুরে বেড়াতেন, স্বামী সন্তানের খবর জানার জন্য। এদিকে ঘরে খাবার নেই, টাক-পয়সা কিছু নেই। তখনকার সময় গ্রামের স্বচ্ছল স্বাবলম্বী গৃহস্থদের বাড়িতে গিয়েও দুই কৌটা চাউল হাওলাৎ পাওয়া যেত না। তাদের কাছে থাকলেও দিত না। কারণ আমার বাবা আর বড়দার কোন খোঁজখবর ছিলো না, তাই। এভাবেই না খেয়ে-না-খেয়ে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটতে লাগলো আমাদের।একসময় তুমুল যুদ্ধ শুরু হলো! যুদ্ধ শুরু হবার পর কেটে গেল দুই মাস।

১৯৭১ সালের মে মাসের দিকে আমার বাবা সহকর্মীদের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করে অনেক কষ্ট করে বাড়িতে আসে। শুনলাম বড়দা শরণার্থী হয়ে চলে গেল ভারতে। তবু বাবার আগমনে মায়ের কান্নাকাটি দূর হলো। আমার মা বাবাকে পেয়ে সন্তান হারা ব্যথা বুকে চাঁপা দিয়ে এই হট্টগোলের মাঝেও বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো।

অনেক কষ্ট করে এক পাড়াপড়শী একজোড়া কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে মুড়ির ব্যবসা শুরু করলো, আমাদের পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য। একদিন বাবা বিক্রি করার জন্য মুড়ির বস্তা বাজারে রাখলো। এমন সময় হৈচৈ শোনা যাচ্ছে, পাকবাহিনী বাজারে হানা দিয়েছে। রাস্তার ধারে কয়েকটা দোকানে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। এই খবর ছড়িয়ে পড়া মাত্রই বাজারের মানুষ এদিক-সেদিক ছোটাছুটি শুরু করে দিলো। বাজারটিতে একেক পণ্যের একেক সাইট ছিলো। বাবার সাথে মুড়ি বিক্রেতা আরও অনেকেই ছিলো। সবাই সবার মুড়ি বস্তা নিয়ে পালাতে শুরু করে দিলো। বাবা আর পালাতে পারছে না, মুড়ির বস্তাটার জন্য। হুড়াহুড়ির কারণে মুড়ির বস্তাটা কেউ আর বাবার মাথায় উঠিয়ে দিচ্ছিল না। বাপ-ছেলে দুইজনেই মুড়ির বস্তাটা নিয়ে অনেক চেষ্টা করলাম, কিন্তু মুড়ির বস্তাটা বাবার মাথায় আর উঠিয়ে দিতে পারলাম না। তখন বস্তাটা ধরেই বাবা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভয়ে বাবাকে ঝাপটে ধরে কাঁদতে শুরু করলাম। মনের ভেতরে ভয়! পাকবাহিনীরা গুলি করে মানুষকে মেরে ফালে, তাই এতো ভয়!

বাবা এক হাতে বস্তা আরেক হাতে আমাকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক কষ্টের মুড়ির চালান। সেজন্য বাবা মুড়ির বস্তা রেখেও পালাতে পারছে না। এরমধ্যে পুরো বাজার জনশূন্য হয়ে গেল। সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেলো। বাজারের কয়েকটা দোকানে লাগানো আগুনের তাপ শরীরে লাগতে শুরু করলো। চারজন পাকবাহিনী বাবার সামনে এসেই রাইফেলের বাঁট দিয়ে বাবাকে আঘাত করলো। বাবা মুড়ির বস্তা ছেড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। বাবাকে বললো কলেমা বাতাও। বাবা কলেমা বলতে পারল না। বাবা কাঁপছে আর কাঁদছে। পাকবাহিনী আমার দিকে বড়বড় চোখ করে কয়েকবার তাকালো। আমি বাবাকে ধরে কান্নাকাটি শুরু করে দিলাম। তাঁদের দয়া হলো। তারা আর আমাদের কিছুই বললো না, সোজা বাজারের দিকে চলে গেল। বড় হয়ে বুঝতে পেরেছি আমার কান্নাতে হয়তো তাদের মায়া লেগেছিল। তাই তারা আমাদের কিছু না বলে সোজা বাজারের ভেতরে চলে গেল। এর কিছুক্ষণ পরই পাকবাহিনী তাদের সাঁজোয়া যান নিয়ে বাজার ত্যাগ করলো। সেদিন আর আমাদের সব মুড়ি বিক্রি হলো না। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাবা কয়েক সের মুড়ি বিক্রি করেছিল। তারপর কোনরকমে বাবা-সহ বাড়ি চলে আসি।

বাবা সেই রাইফেলের আঘাতে পুরোপুরিভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাবা রাইফেলের বাঁটের আঘাতে, ৬/৭দিন আর বাজারে যেতে পারেনি। তখন আমাদের গ্রামে তেমন কোনও নামিদামি ডাক্তারও ছিল না। পুরো গ্রামে কেবল একজন মাত্র ডাক্তার ছিলো, তাও হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। সেই ডাক্তারের ঔষধ মেশানো জলপড়া খেয়ে ক’দিন পর বাবা সুস্থ হলেন। আবার শুরু করে দিলেন মুড়ি নিয়ে জীবনসংগ্রাম।

এর মধ্যে আমাদের বাড়িতে মুক্তিবাহিনীদের সন্ধ্যাকালীন আড্ডার আসর শুরু হলো। এর কারণ– আমাদের বাড়িটা ছিল বজরা রেলস্টেশন থেকে আসতেই মাহাতাবপুর গ্রামের প্রথম বাড়ি, তাই। অর্থাৎ আমাদের বাড়িটিই ছিল গ্রামে প্রবেশদ্বারের প্রথম বাড়ি। আমাদের বাড়ির আগের গ্রাম হলো, ‘হিলমুদ’। হিলমুদ গ্রামের পরেই বজরা বাজার ও রেলস্টেশন। তাই আমাদের বাড়িটা ছিল মুক্তিবাহিনীদের পছন্দের বাড়ি।

আমার দুই জেঠা ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত পাকিস্তানি পুলিশ। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা প্রতিদিন সন্ধ্যার পর আমাদের বাড়িতে আসতো। এসেই আমার দুই জেঠার সাথে বসে গল্প করতো। মাঝেমাঝে চা’র আড্ডা হতো। বাড়িতে বানানো মুড়ির মোয়া থাকতো। নারিকেল কোরা সহ মুড়ি তাদের দেওয়া হতো। তারা আনন্দের সাথে খেতো আর জেঠা মহাশয়ের সাথে কথা বলতো। সময়সময় জেঠার সাথে বসে বসে নিজেও তাদের কথা শুনতাম। মা চা বানিয়ে দিতেন, সেই চা তাদের এনে দিতাম। সেসব হৃদয়বান মুক্তিযোদ্ধাদের কথা কোনদিন ভুলবো না। পাকবাহিনী আর রাজাকার বাহিনীদের ভয়ে অনেক মানুষই গ্রাম ছেড়ে শরণার্থী হয়ে ভারত চলে গেছে। আমাদের তেমন টাকা-পয়সা ছিল না বিধায় আমরা নিজ গ্রামেই থেকে যাই।

আমাদের ভরসাই ছিল একমাত্র হৃদয়বান মুক্তিযোদ্ধারা। সেসব বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সু-নজরের কারণে, রাজাকার আর পাকবাহিনীরা গ্রামের একটা বাড়িতেও ক্ষতি করতে পারেনি। এভাবে চলতে চলতে কেটে গেল দীর্ঘ ৮ মাস। সময় তখন নভেম্বর ১৯৭১ সাল। রেডিওর শুধু সংবাদ ছিল আকাশবাণী কোলকাতার বাংলা সংবাদ। প্রতিদিন সন্ধ্যার পরপর মায়ের সাথে বড়বাড়িতে গিয়ে রেডিওর খবর শুনতাম। মুক্তিবাহিনীদের কাছেও একটা রেডিও ছিলো। যা দিয়ে তারা খবর শুনতো। তখন চারিদিকে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের জয়জয়কার। জাগায় জাগায় ঘটতে লাগলো পাকবাহিনীর পরাজয় এর আত্মসমর্পণ। আর পিছু হঠার খবর। সামনেই ডিসেম্বর মাস। পুরো ডিসেম্বর মাসই ছিল সবচেয়ে বেশি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। কুকুর পাগল হলো যেমন এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি করে মানুষকে কামড়ায়, ঠিক সেই অবস্থাই হয়েছিল পাকবাহিনীদের বেলায়। তারা ঠিক হিংস্র জানোয়ারের মতো হিংসাত্মক হয়ে উঠলো। নিরস্ত্র সাধারণ মানুষদের গুলি করে মারতে লাগলো।

তাদের মুখে ছিলো শুধু ইদুর কাঁহা (হিন্দু)? মুক্তিবাহিনী কোন আদমি হ্যাঁ? এটাই ছিল তাদের প্রথম জিজ্ঞাসা। হিন্দুদের বেশি খুঁজতো এই কারণে যে, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে পার্শ্ববর্তী ভারত সহযোগিতা করছিল, তাই। আমাদের বীর বাঙালিরা ভারত গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করার ট্রেনিং নিয়ে আসছে, তাই। তাই পাকবাহিনীদের প্রথম শত্রুই ছিলো ভারত ও হিন্দু। রাস্তাঘাটে পাকবাহিনীরা চেকপোস্ট বসিয়ে মুক্তিবাহিনী আর হিন্দুদের খুঁজতো। যাকেই ধরতো, আগেই জিজ্ঞেস করতো, ‘তুমি হিন্দু না মুসলমান?’ যদি বলতো, আমি মুসলমান। তাহলে আদেশ আসতো, ‘কলমা পড়ে শোনাও।’ কলমা পড়ে শোনানোর পরও বলা হতো, ‘কাপড়া উঠাও।’ কাপড় উঠিয়ে দেখানোর পরই ওরা নিশ্চিত হতো লোকটি হিন্দু না মুসলমান। হিন্দু হলে মৃত্যু অনিবার্য। আর মুসলমান হলেও তবু সন্দেহ থেকেই যেতো!

সন্দেহ শুধু একটাই, তা হলো, এই লোক সাধারণ মানুষ, না মুক্তিবাহিনী? অনেক সময় সাধারণ মানুষকে মুক্তিবাহিনী সন্দেহ করে মেরেও ফেলেছে ঐ হিংসাত্মক পাকবাহিনীরা। আবার অনেকসময় একটু স্বাস্থ্যবান মানুষদেরও ধরে নিয়ে মেরে ফেলতো। তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে দেশীয় রাজাকারবাহিনীও হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড শুরু করে দিলো। কার বাড়িতে কয়টা যুবতী মেয়ে আছে, সেসব তালিকা পাকবাহিনীদের কাছে পৌঁছাতে লাগলো। সময়-সময় পাকবাহিনীদের মনোরঞ্জনের জন্য, বাড়ি থেকে জোরপূর্বক যুবতী মা-বোনদের তুলে নিয়ে যেতো। এসব দেশীয় আলবদর-রাজাকাররাই পাকবাহিনীদের সবকিছু শিখিয়েছিলো। অচেনা রাস্তাঘাট চিনিয়ে দিয়েছিলো। হিন্দুদের কিভাবে চেনা যায়, সেটাও শিখিয়েছিল।

একসময় ডিসেম্বরের আগমন ঘটলো। সেইসাথে পাকবাহিনী সহ তাদের দোসররাও মানুষ খেকো রাক্ষসের মতন হয়ে উঠলো। ডিসেম্বরের প্রথম থেকে এভাবে চলতে চলতে একসময় সারাদেশেই পাকবাহিনী পরাজয় বরণ করতে লাগলো। ১৫ ডিসেম্বর দেখেছি, মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো থেকে রাজাকারদের হাত বেঁধে রাস্তা দিয়ে নিয়ে যেতে। সেই দৃশ্য দেখার জন্য গ্রামের অনেক মানুষের মধ্যে আমিও রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। মা-বাবা বড় দিদিদের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছি। মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে জয়বাংলা ধ্বনি শুনেছি। গ্রামের হাজার হাজার মানুষের মুখেও শুনেছি জয় বাংলার জয়ধ্বনি। পাকহানাদার বাহিনী পরাস্ত হলো। আল-বদর রাজাকার বাহিনীর শত কুচক্র শলাপরামর্শ ধূলিসাৎ হলো।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকা-সহ সারাদেশে বিজয়ের আনন্দ মিছিল বের হলো। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে আর লক্ষ মা-বোনদের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে বিজয় অর্জিত হলো। বাংলাদেশ নামে একটি দেশ পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান পেলো। বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটলো সারাবিশ্বে। আর আমি এই বিজয়ের সাক্ষী হয়ে আজও বেঁচে আছি।

ছবি: গুগল থেকে সংগ্রহ।