প্রবাল মালো এর সকল পোস্ট

প্রবাল মালো সম্পর্কে

ক্রমশ অবচেতনে বেড়ে যায় জয় আর পরাজয়ের বোঝা, ক্লান্ত আমি- নিজেকে লুকোই বালকের প্রথম প্রেমের চিহ্নের মতো। কোনো অর্জন নেই আমার- কেবলই অবক্ষয়-ধ্বংস-মৃত্যু, জয়ের আনন্দে বিহ্বলতা নেই- আছে গোপন কান্না, প্রতিটি প্রাপ্তির পেছনে উপলব্ধি ঘৃণার-সংশয় বোধের, প্রকৃতির নীরবতা-নম্রতার পেছনে হিংস্রতার প্রেতছায়া, মৃত্তিকার অগভীরে শেকড়ের ভয়ংকর নগ্নতার ছাপ, নদীর ঢেউয়ের গোপনীয়তা থেকে দোয়েলের সুমিষ্ট শিসের ঘ্রাণ, ঘাসের বেড়ে ওঠা নীরবে- কিছুই তো অজানা নয় মানুষগুলোর, তবু কেন এই অশনি সংকেত! ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে স্বীকারোক্তি দেবে কে? তোমার স্মৃতিগুলোতো ক্রমে অস্পষ্ট, তবুও তোমার দেহের ভঙ্গিমা সবচেয়ে সুখকর- সরল জীবনের মতো, সে-জীবন খোঁজে কবি, কবিতা, প্রেমিক, ঘাস, হৃদয়; তবু কেন মানুষ নয়!

মানুষের কাছে যাবো না

জঙ্গলে যাবো
মঙ্গলে যাবো
মানুষের কাছে যাবো না।
মানুষের কাছে গেলে
ভালোবেসে ফেলি,
ভালোবাসা তো চাইবো না!

দিন কেটে যাক
রাতগুলো ফুরাক,
অাকাশের পানে চাবো না।
বৃষ্টি হোক
জানালায় বসে
জল কখনো ছোঁব না।
যত ব্যথা অাছে
যত কথা অাছে
মানুষের কাছে কবো না।
জঙ্গলে যাবো
মঙ্গলে যাবো
মানুষের কাছে যাবো না।

ডাকলে ডাকুক
রাতের কোকিল
ঘরহারা অার হবো না।
উঠলে জ্যোৎস্না
কিসের যন্ত্রণা
সিদ্ধার্থ অার হবো না।
মুখোমুখি বসে
কেটে যাক সন্ধ্যা
চোখে চোখ অার রাখবো না।
জঙ্গলে যাবো
মঙ্গলে যাবো
মানুষের কাছে যাবো না।

মানুষের কাছে গেলে
ভালোবেসে ফেলি,
ভালোবাসা তো চাইবো না!
জঙ্গলে যাবো
মঙ্গলে যাবো
তোমার কাছে যাবো না।

মুখোশ

কোথাও কোনো মানুষ নেই
কোথাও দেখি না কোনো মানুষ
শুধু দু’পাঅলা জন্তু দেখি
মানুষ দেখি না, দেখি মুখোশ।
.
ছেলেবেলায় মেলা থেকে অামরা কিনতাম মুখোশ —
বাঘের মুখোশ সিংহের মুখোশ
নানা রকম জন্তুর মুখোশ,
অামি খুঁজে ছিলাম মানুষের মুখোশ, পায়নি।
মানুষের মুখোশ পাওয়া যায় না–
মানুষ হয়ে ওঠে মুখোশ-মানুষ।
.
এই যে তুমি অামি অামরা দু’জন
এই যে অামি তুমি দুটি মুখোশ
মানুষ কোথায়?
কেন যে তবু খুঁজে ফিরি একটি মানুষ!
.

স্বার্থপর

অনেক কষ্টে পেয়ে গেছি কয়েকটি দুঃখ
চাইলে তুমি দিয়ে দেবো তা ভেবো না
একটি দুঃখ দিলো আমায় মরা নদী
একটি দুঃখ দিলো আমায় একলা শালিখ
একটি দুঃখ দিলো আমায় জ্যোৎস্না-রাত্রি
একটি দুঃখ তুমি দিতে যদি!
তা না দিয়ে চাইলে দুঃখ কবির কাছে?
দুঃখ ছাড়া কবির বলো কী বা আছে!

অনেক কষ্টে পেয়ে গেছি কয়েকটি দুঃখ
চায়লে তুমি দিয়ে দেবো তা ভেবো না
আমার দুঃখ একেবারেই সাদা-কালো
কোনোটি শুধুই সাদা
কোনোটি বেজায় কালো
কোনোটি আবার অন্ধ হয়ে খুঁজছে আলো
তবু তুমি চাইলে দুঃখ কবির কাছে?
যাও না দূরে- বহুদূরে তাদের কাছে
যারা রঙিন, যাদের রঙিন দুঃখ আছে
আমি তোমায় করুণা করে দুঃখ দেবো-
তা ভেবো না,
অনেক কষ্টে পেয়ে গেছি কয়েকটি দুঃখ!

প্রেমহলাহল

বিষন্ন এই দিন কেটে যায়
যাবার কথা হয়তো আছে,
ধ্বংসস্তুপে নুড়ি কুড়াই
গড়বো প্রাসাদ ধুলোর মাঝে।
.
আমি আমার প্রাসাদ জুড়ে
দেখেছি কেবল মৃতের ছায়া,
তুমি তোমার স্বপ্নপুরে
খুঁজছো কেবল মায়ার কায়া।
.
দিনের আলো শেষ হলো আজ
আমি অন্ধকারে বিপথগামী,
স্বপ্নগুলো লুট হলে কি
তবেই আমরা পথে নামি?
.
জানালায় বসে আজ সকালে
তুমি দেখছো কিসের আলো?
কেবল আমি মৃত্যু দেখি
স্বপ্ন জুড়ে আঁধার-কালো।
.
তুমি তোমার সুখের ঘরে
আঁধার দেখে মুখ যে লুকাও,
অথচ আমার আঁধার ঘরের অবশিষ্ট স্বপ্নগুলো
নিষ্ঠুরতায় তা-ও কেড়ে নাও।

অপরিচিতা

১.
ইদানিং একটু বেশি অপরিচিত মনে হয় তোমাকে,
ঘুম থেকে উঠে যখন দেখি- তুমি বেশ কিছুক্ষণ আগে
বিছানা ছেড়ে উঠোনে করছো পায়চারি,
রাতের উদাসীন চুলে তেল দিচ্ছো, বেণী তুলছো
সযত্নে কিংবা খোঁপায় গেঁথে নিচ্ছো মাধবীলতা;
তখন মনে হয়, দিনে দিনে তুমি
দূরে সরে যাচ্ছো আমায় থেকে…
অপরিচিত হয়ে যাচ্ছো তুমি।
অথচ তুমি কাছে ছিলে না কোনোদিন-
এখনও আমাদের পরিচয়ই হয়নি।
.
২.
তোমাকে দেখিনি কোনোদিন,
বিশ্বাস করো তোমাকে দেখিনি;
তবে মেঘাচ্ছন্ন রাতের আকাশে অন্ধকার দেখে দেখে
রাতের পর রাত জেগে রাত শেষে মনে হয়-
তোমাকে দেখেছি বহুবার!

উত্তরাধনিক প্রজাপতি

জ্যোৎস্নায় সারারাত গা ভিজিয়েও মুছতে
পারি না অপরাধ প্রবণতার ছাপ,
সত্যের মতো লেগে থাকে আমার
চোখে-মুখে পাতার ছায়া।
মাটিতে চোখ রেখে মাকে বলি- ‘আমি…
আমি ভালো আছি, মা। বিশ্বাস করো,
আজ কাউকে সকালের গল্প বলিনি;
বিশ্বাস করো মা, আমি ভালো আছি-
আমি সমুদ্র দেখেও কাঁদিনি।’

বাবার কপালের ভাজ আমি বুঝি
খাবার টেবিলে মায়ের নীরবতা আমি বুঝি
কিন্তু দুঃখীনি মা আমার- প্রজাপতি কেনো
বোঝে না সরলতার সত্য মূল্য?
আমি যদি আকাশকে ভালোবেসে
আরো একটু শুভ্রতার স্বপ্ন আঁকি,
বিলাসী প্রজাপতি মাথার রোদচশমা
চোখে নামিয়ে বলে- ‘সকালে নয়, দুপুরে নয়,
সন্ধ্যায় আমরা পেরিয়ে যাবো রেললাইন আর
শেখাবো উত্তরাধনিক মানবিক সম্পর্ক।’

দুপুরের রোদে ঘাসফুল

নীরবতার ঘনত্ব বুঝিয়ে দেয় হাত ঘড়ির টিকটিক শব্দ
ঝি-ঝি পোঁকা ছাড়া আর কোনো মহৎ কবির গান নেই
প্রিয় অরুন্ধতী, তোমাকে না- ভুলে আছি নিজেকেই।
দিন দিন প্রতিদিন রক্তে ভেজে মৃত্তিকা
মানবতার ওষ্ঠে জমে প্রতারক ধুলো
অন্ধগলির পতিতা শেখায় সীতার সতীত্ব;
বড়ই আজব এদেশ এসময়, অরুন্ধতী!
দুপুরের টানাপোড়েনে কাটে রাত্রিদিন
একটি শিশু ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়
এক পা দু পা করে এগিয়ে যায় পৃথিবীর পথে
সভ্যতার চাকা ঘুরতে দেখে মিথ্যে সুখে ঘুমায় পিতা

অরুদ্ধতী, তোমার ঘুম তো ভাঙলো না!
বেজন্মা সভ্যতার উপর এতো ঘৃণা তোমার?
সত্যি করে বলো তো অরুদ্ধতী-
তুমি কি দুপুরের রোদে বিবর্ণ ঘাসফুল?

জলকথা

শ্মশানের ভস্মে জলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি
ভস্ম ওড়ে ভস্ম মাটিতে মিশে যায়
ভস্ম ভেসে যায় নদীতে অজানার দিকে
মাটির গন্ধে ঘুম যাও তুমি
আমি বলি- ‘ভালোবাসি।’
শ্মশানের ভস্মের বুকে জল
শ্মশানের ভস্ম ওড়ে বাতাসে
আমার বুকে শ্মশান
ভস্ম নেই, পোড়া হৃদয়
‘দেখবে কী ক’রে বলো?’

জল নিয়ে এসো তুমি শ্মশানে
জল না নিয়েই এসো তুমি শ্মশানে
ঘুম যেও মাটির সোঁদা গন্ধে এ বুকে
দেখো, আগুন মুহূর্তে কী ক’রে নেভে
জল ছাড়া- শুধু তোমার একটু স্পর্শে

মিলিত মিছিল

তখনো গত সন্ধের ফোটা সন্ধ্যা মালতি
অামাদের মিলিত স্বপ্নের মতো
দিনের অালো পেয়ে বিবর্ণ হয়ে যায়নি,
তখনো অামাদের অসংখ্য অাকাক্ষিত
স্লোগান অামরা না হারিয়ে
বুক পকেট চেপে ধরে অাছি অবশিষ্ট কিছু,
তখনো অামাদের স্বপ্নভ্রন হত্যার উদ্দেশ্যে
অামরা যায়নি গোপন ক্লিনিকে।
.
তখন অামরা কেউ জেগে ছিলাম
তখন অামরা কেউ ঘুমিয়ে ছিলাম
তখন অামরা কেউ লাল স্বপ্নগ্রস্থ ছিলাম
.
তখনই হঠাৎ – অতি অকস্মাৎ
এই দেশ এই মাটি কাঁপিয়ে
অর্ধমৃত মানুষকে নাড়িয়ে দিয়ে
মৌলবাদ ও কলুষতাকে পায়ে মাড়িয়ে
এ শহর জেগে ওঠে স্বপ্নস্লোগানে।
.
ঐ শোনো অর্ধমৃত, ডাক দিয়ে যায় মিছিল
ঐ শোনো তন্দ্রাচ্ছন্ন তরুন, ডাক দিয়ে যায় মিছিল
ঐ শোন স্বপ্নগ্রস্থ মানুষ, ডাক দিয়ে যায় মিছিল
.
একবার নয়
দুইবার নয়
মানুষ জেগেছে বহুবার
মানুষ জেগেছে বহুবার মানুষের জন্য
স্বপ্নগ্রস্থ জেগেছে বহুবার স্বপ্নের জন্য
চন্দ্রগ্রস্ত জেগেছে বহুবার রুটির জন্য।
.
শুনতে কি পাও?
অামাদের রক্তে অামাদের ধমনীতে
ডাক দিয়েছে মিছিল
এ শহর চৌচির করে দিয়ে ডাক দিয়েছে মিছিল
চৌরাস্তার মোড় থেকে ডাক দিয়েছে মিছিল
শুনতে কী পাও!
শুনতে পাও না- মিছিলের ডাক?

শ্রী অাকাশকৃর্তন

কতটুকু চাও তুমি? কতটুকু পেয়েছ তুমি আর?
না চায়লেও দিতে পারি আরো অনেক বেশি।
বুকের ব্যপ্তি দেখে হৃদয়ের বিশালতা নির্ণয়ের
এমন ধৃষ্টতা দেখিও না, প্রিয় মৃত্তিকাপাখি।
আকাশের বিশালতা মাপতে হলে
তোমাকেও উঠতে হবে অনেক উপরে-
উঠতে হবে চিল ওড়া আকাশে।
প্রিয় মৃত্তিকাপাখি, মাটিতে দাঁড়িয়ে যে আকাশকে
তুমি পাও সে বড় খণ্ডিত আকাশ;
চিল ছাড়া কোনো পাখি জানে না আকাশসমগ্র,
দিগন্তে না মেলালে পাখি বোঝে না আকাশের গান।

এসো, এসো হে প্রিয় মৃত্তিকাপাখি, আমরা
দিবানিশি রচি শ্রী আকাশকীর্তন।
এসো, এসো হে ডানাহীনপাখি, আমরা
রাধার মতো জপি প্রিয় আকাশ নাম।

চিলেকোঠায় মৃত্যু

ঘর না হয় না-ই বাঁধবো- পাখিদের জন্য একটি ঘর বানাবো,
মস্ত একটা বাড়ি বানাবো চড়ুই টিয়া শালিখ ময়নার জন্য।

নিজস্ব কিছুই থাকবে না আমার-
যা কিছু আমার তার সবই হবে পাখিদের।
খেটে-খুঁটে বালিকা পড়িয়ে মাস শেষে যে পয়সা পাবো
তা দিয়ে পাখিদের জন্য কিনবো ধান গম কাউন,
আর তার বিনিময়ে পাখিরা যদি সন্তুষ্ট হয়ে
মাথা গুঁজবার একটা ঠাঁই দেয় তাদের
বাড়ির চিলেকোঠায়- তবেই আমি খুশি;
একা একা চিলেকোঠায় সমস্ত দিন
একা একা চিলেকোঠায় সমস্ত রাত
অনধিকার চর্চা করে শুনে নেব পাখিদের ব্যক্তিগত
আলাপন, ওদের ঘর সংসার সন্তান-সন্ততির খবরাখবর।

একদিন সন্ধ্যায় সব পাখি ঘরে ফিরবে ঘরের টানে
একদিন জ্যোৎস্নারাতে চিলেকোঠায় একাকিত্বে আমার মৃত্যু হবে
জানবে না কেউ, কেউ জানবে না- কেবল পাখিরা কানাকানি করবে…

জলসূত্র

#০১
ঝরা পাতার কার্পেট রেখেছি পেতে- এবার এসো জল
রাত্রিদিন ক্লান্তিহীন চৈতন্যে দিয়ে যাও অস্থির দোলা
বেড়ে ওঠে রকমারি বৃক্ষ-তরুলতা ভেতরে ভেতরে
নিস্তব্ধ দিঘীর জলে হঠাৎ অবাধ্য বালকের ঢিল
নেই, কিছু নেই- তবু রক্তের ভেতরে শিশিরের ঘ্রাণ
মাঝরাতে আকাশে অলিখিত ব্যর্থ মেঘপঙ্‌তিমালা
কুমার বাড়িতে তৈরী হয় অনিন্দ্য সৌন্দর্যের প্রতিমা!
সত্যি যদি যাবে জল, ভালবেসো আলোকবর্ষ দূরত্ব
যদি দেখি ভুলে পেরিয়ে এসেছি অবগাহনের কাল
তবে শুরূ হোক আমাদের রাত্রির নক্ষত্র আলাপন।

#০২
অভিঘাত থেকে বুঝেছি আত্ম-কথপোকথন কতটা
জরুরী, কেবল জ্যোৎস্নারঙা জোনাকি বলেনি একথা-
শত অলোকবর্ষ দূরে থেকেও মানুষ নক্ষত্রপ্রেমী।
এখানে অন্ধকার; এখানে যে কোনদিন জ্বালেনি সন্ধ্যা
প্রদীপ- তার উঠোনে কাল বিকেলে উড়ে আসুক, ঝরে
পড়ুক আমাদের কৈশরের দোরঙা স্বপ্নময় ঘুড়ি।

#০৩
অতটা কাছে নয় জল, সামান্য দৃশ্যের নিকটবর্তী হও
কৈশরের ফেলে আসা কুয়াশা ঢাকা বালিকা হয়ে এসো জল
যদি জেনেই থাকো, আমাদের আদি মাতা ও মাতৃভূমি জল
কেন তবে দূরত্বের সুত্র ভুলে সমান্তরাল এ রেলপথ
আজন্ম জানু পেতে আছি আঘাত দেবে তো দাও, হে প্রজাপতি
পুঁড়ে গেলে স্বর্ণমন্দির শুধু নষ্ট হয় পুরোনো কারুকার্য
দেখো, নিভৃত এক স্বর্ণককামার কিভাবে চালিয়ে যায় হাত
একাগ্র হাতুড়ি-বাটাল ঠুকে ঠুকে গড়ে তোলে কাব্যপ্রতিমা!