রিয়া রিয়া এর সকল পোস্ট

অভিমান

অভিমান

স্বপ্নকে হাত বাড়িয়ে বললাম,
এই তো পেতেছি হাত, দাও বিষ।
স্বপ্ন আঁজল ভরে দিলো তীব্র হেমলক।

রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে ছন্দকে বললাম,
আমায় আগমনীর গান শোনাতে পারো?
সে শোনালো বিসর্জনের বাজনা।

সমর্পিত হৃদয়ে ঝরে পড়ে
আকাশ ভাঙা বৃষ্টি, আর
চারপাশে নির্বাসিতের গান।

অভিমানে স্তব্ধ হয় ভালবাসা।।

তারপর? বল তারপর

মাঝে মাঝে একলা সময়ে
মেঘের আড়ালে লুকোয় চাঁদ।
বেঁচে থাকার তাগিদে বুঝে নিই
হাওয়াদের এলোমেলো হাত।

তারপর?

পায়ের নিচের নোনা জল
ধুয়ে দেয় তারাখসা রঙ।
অনেকটা ক্লান্ত হয় ভোর
শ্রান্ত হয় মিঞা কি সারং।

তারপর?

সবুজ যত গাছ জল ছাঁচে
পাড় ভাঙে মনের উঠোন
আজও নির্ঘুম একলা রাত
সাথে নিয়ে বাখ, বেঠোফেন।

তারপর?

ধীর ধীরে অশান্ত হয় মন
চোখের কোলে টলটলে নদী।
অভিমানে বে-আব্রু সঙ্কোচ।
সাগর হতে পারতাম যদি!

তারপর?

কুয়াশায় ঢেকেছে আকাশ
লুকিয়ে রাখে ঘর ছাড়ার গল্প
রোদের সুরে অবিশ্বাসের রেশ
মেঘ মল্লার শুনছি অল্প অল্প।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন

আজ আমার অত্যন্ত প্রিয় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থুড়ি পদ্য (কারণ তিনিই বলে গেছেন “আমি কবিতা লিখিনা, পদ্য লিখি” ) এক আশ্চর্য ব্যাপার, বোধহয় কিছুটা তাঁর প্রথম জীবনের বোহেমিয়ান জীবনধারার মতই “UNPREDICTABLE” যা প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর, ছন্দের বিবর্তনে নেশা জাগিয়ে রাখে চিরন্তন ! কত অবিস্মরণীয় কবিতার লাইনের জন্মদাতা, যা এখনো মুখে, মুখে ফেরে। শক্তি চট্টোপাধ্যায় ছিলেন জীবনানন্দ-উত্তর যুগের বাংলা সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রধান আধুনিক কবি। এই কবি বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বিশেষভাবে পরিচিত এবং আলোচিত ছিলেন। তিনি জন্মগ্রহন করেছিলেন নভেম্বর ২৫, ১৯৩৪ অর্থাৎ আজকের দিনে।

তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: কাব্য- ‘সোনার মাছি খুন করেছি’, ‘হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান’, ‘ধর্মে আছো জিরাফেও আছো’, ‘ছিন্নবিচ্ছিন্ন’, ‘প্রভু নষ্ট হয়ে যাই’, ‘পাড়ের কাঁথা মাটির বাড়ি’ প্রভৃতি।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে একটা মজাদার গল্প বলে গেছিলেন অভিনেতা রবি ঘোষ –“..কোন মদ্যপায়ী লেখক বা গুনী ব্যক্তি হলফ করে বলতে পারবে যে তাকে একদিন রাত্রে GOVT. STATE BUS DRIVER বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে! পারবে না। নাম করা লোকজন বাড়ি পৌঁছবার জন্য দামি গাড়ী আনতে পারে..আনতে পারে লরি, কিন্তু শক্তি চট্টোপাধ্যায় একটা আস্ত খালি STATE BUS আনতে পারে। কারণ – সেই STATE BUS এর DRIVER শক্তির কবিতার ভক্ত। ” এই রকম বহু ঘটনা আর কবিতার দ্বারা সৃষ্টি শক্তি নামক একটি মিথ যা আমাদের এখনো বিস্মিত করে, স্তম্ভিত করে।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কিছু কবিতাঃ-

**অবনী বাড়ি আছো

দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া
কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছো?’

বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে
পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস
দুয়ার চেপে ধরে–
‘অবনী বাড়ি আছো?’

আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী
ব্যথার মাঝে ঘুমিয় পড়ি আমি
সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছ

** যেতে পারি, কিন্তু কেন যাবো?

ভাবছি, ঘুরে দাঁড়ানোই ভালো।
এতো কালো মেখেছি দু হাতে
এতোকাল ধরে!
কখনো তোমার ক’রে, তোমাকে ভাবিনি।

এখন খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে
চাঁদ ডাকে : আয় আয় আয়
এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে
চিতাকাঠ ডাকে : আয় আয়
যেতে পারি
যে-কোন দিকেই আমি চলে যেতে পারি
কিন্তু, কেন যাবো?
সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমো খাবো

যাবো
কিন্তু, এখনি যাবো না
একাকী যাবো না অসময়ে।।

** একবার তুমি

একবার তুমি ভালোবাসতে চেষ্টা কর –
দেখবে, নদীর ভিতরে, মাছের বুক থেকে পাথর ঝরে পড়ছে
পাথর পাথর পাথর আর নদী-সমুদ্রের জল
নীল পাথর লাল হচ্ছে, লাল পাথর নীল
একবার তুমি ভাল বাসতে চেষ্টা কর |
বুকের ভেতরে কিছু পাথর থাকা ভাল – ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়
সমস্ত পায়ে-হাঁটা পথই যখন পিচ্ছিল, তখন ওই পাথরের পাল একের পর এক বিছিয়ে
যেন কবিতার নগ্ন ব্যবহার, যেন ঢেউ, যেন কুমোরটুলির সলমা-চুমকি-জরি-মাখা প্রতিমা
বহুদূর হেমন্তের পাঁশুটেনক্ষত্রের দরোজা পর্যন্ত দেখে আসতে পারি |
বুকের ভেতরে কিছু পাথর থাকা ভাল
চিঠি-পত্রের বাক্স বলতে তো কিছু নেই – পাথরের ফাঁক-ফোকরে রেখে এলেই কাজ হাসিল –
অনেক সময় তো ঘর গড়তেও মন চায় |
মাছের বুকের পাথর ক্রমেই আমাদের বুকে এসে জায়গা করে নিচ্ছে
আমাদের সবই দরকার | আমরা ঘরবাড়ি গড়বো – সভ্যতার একটা স্থায়ী স্তম্ভ তুলে ধরবো |
রূপোলি মাছ পাথর ঝরাতে ঝরাতে চলে গেলে
একবার তুমি ভালবাসতে চেষ্টা করো |

** চতুর্দশপদী কবিতাবলী–
শক্তি চট্টোপাধ্যায়

ভালোবাসা পেলে সব লন্ডভন্ড করে চলে যাবো
যেদিকে দুচোখ যায়- যেতে তার খুশি লাগে খুব ।
ভালোবাসা পেলে আমি কেন পায়সান্ন খাবো
যা খায় গরিবে, তাই খাবো বহুদিন যত্ন করে ।
ভালোবাসা পেলে আমি গায়ের সমস্ত মুগ্ধকারী
আবরণ খুলে ফেলে দৌড় ঝাঁপ করবো কড়া রোদে…
ভালোবাসা পেলে জানি সব হবে । না পেলে তোমায়
আমি কি বোবার মতো বসে থাকবো-
ভালোবাসা না পেলে কি আমার এমনি দিন যাবে
চোরের মতন, কিংবা হাহাকারে সোচ্চার , বিমনা–
আমি কি ভীষণ ভাবে তাকে চাই ভালোবাসা জানে।

***
‘শিশিরভেজা শুকনো খড়’

শিশিরভেজা শুকনো খড় শিকড়বাকড় টানছে
মিছুবাড়ির জনলা দোর ভিতের দিকে টানছে
প্রশাখাছাড় হৃদয় আজ মূলের দিকে টানছে
ভাল ছিলুম জীর্ণ দিন আলোর ছিল তৃষ্ণা
শ্বেতবিধুর পাথর কুঁদে গড়েছিলুম কৃষ্ণা
নিরবয়ব মূর্তি তার, নদীর কোলে জলাপাহার …
বনতলের মাটির ঘরে জাতক ধান ভানছে
শুভশাঁখের আওয়াজ মেলে জাতক ধান ভানছে
করুণাময় ঊষার কোলে জাতক ধান ভানছে
অপরিসীম দুঃখসুখ ফিরিয়েছিলো তার মুখ
প্রসারণের উদাসীনতা কোথাও ব’সে কাঁদছে
প্রশাখাছাড় হৃদয় আজ মূলের দিকে টানছে

***স্টেশন ভাসিয়ে বৃষ্টি’

মনে পড়ে স্টেশন ভাসিয়ে বৃষ্টি রাজপথ ধ’রে ক্রমাগত
সাইকেল ঘন্টির মতো চলে গেছে, পথিক সাবধান…
শুধু স্বেচ্ছাচারী আমি, হাওয়া আর ভিক্ষুকের ঝুলি
যেতে-যেতে ফিরে চায়, কুড়োতে-কুড়োতে দেয় ফেলে
যেন তুমি, আলস্যে এলে না কাছে, নিছক সুদূর
হয়ে থাকলে নিরাত্মীয় ; কিন্তু কেন? কেন, তা জানো না।
মনে পড়বার জন্য? হবেও বা । স্বাধীনতাপ্রিয়
ব’লে কি আক্ষেপ? কিন্তু বন্দী হয়ে আমি ভালো আছি।
তবু কোনো খর রৌদ্রে, পাটকিলে কাকের চেরা ঠোঁটে
তৃষ্ণার চেহারা দেখে কষ্ট পাই, বুঝে নিতে পারি
জলের অভাবে নয়, কোন টক লালার কান্নায়
তার মর্মছেঁড়া ডাক; কাক যেন তোমারই প্রতীক
রূপে নয়, বরং স্বভাবে – মনে পড়ে, মনে পড়ে যায়
কোথায় বিমূঢ় হয়ে বসে আছো হাঁ-করা তৃষ্ণায়!

আমি

মাঝেমাঝে চুপ করে বসে থাকি আমি আমার পাশে
আমার আমিকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত রুদ্ধ শ্বাসে;
আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকি, জুড়ে নিই টুকরো হৃদয়
খুঁজে পাই ব্যর্থ ইতিহাসের পাতায় এক নতুন পরিচয়ে।

ব্যস্ত দিনের শেষে যখন চাঁদ নেমে আসে,
ডুবে যায় মন তখন গল্প উপন্যাসে;
তারাগুলো মিটিমিটি তাকিয়ে দেখে আমায়
পার করি সময় ওদের ভালবাসার আঙিনায়;

বই থেকে চোখ খুলে দেখি চারিদিকে আবছা আলো
কল্পনায় সব-ই রঙিন কিন্তু বাস্তবে সব সাদাকালো।
সব আশা, নিরাশাদের ঘুম পাড়িয়ে জেগে উঠি যখন,
খুঁজে পাই আমাকে, পুরনো আমি, যেমন আছি এখন।

গণিতচর্চা

গণিতচর্চা

গণিত কথাটির অর্থ হল গণনা সম্পর্কীয় শাস্ত্র। এটি বিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান শাখা। গণিতের শুরু কবে ও কোথায় এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। অনেকের মতে গণিতের আদিভূমি মিশর। যদিও এ নিয়ে বিতর্ক আছে। এর কারণ সেই সময় ব্যাবিলন এবং চীন এর পাশাপাশি আমাদের ভারতবর্ষেও উন্নতমানের গণিত চর্চা হত, যার স্বপক্ষে বহু প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাই অনেক পণ্ডিতের মতে ভারতবর্ষই গণিতশাস্ত্রের উৎপত্তি স্থল। প্রশ্ন আসতে পারে এমন দাবি করার পিছনে যুক্তি কী? সিন্ধু সভ্যতাকেই ধরে নেওয়া হয় ভারতের মাটিতে গণিতের পথচলার শুরুর সময়কাল। কারণ, এর আগের কোনো সভ্যতার নিদর্শন আজও আমরা খুঁজে পাইনি। সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে যে লিপির নিদর্শন পাওয়া গেছে তা আজও পাঠ ও মর্মোদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। তাই সে যুগের গণিতচর্চার প্রকৃত স্বরূপ আজও আমাদের অজানা। তবে ধ্বংসাবশেষে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন নিদর্শন দেখে একথা অনুমান করতে অসুবিধা হয় না যে, এই উপত্যকাবাসীদের গণিতজ্ঞান যথেষ্ট উন্নতমানের ছিল। এই সভ্যতার উন্মেষ হয়েছিল ৩৫০০ – ৩৩০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দের মধ্যে। সুতরাং ভারতীয় গণিতই প্রাচীনতম কিনা তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও মিশর, সুমেরীয় বা চীনের থেকে যে পিছিয়ে ছিল না এ কথা অনস্বীকার্য।

মূলত, ভারতবর্ষে গণিত এর চর্চা সেই বৈদিক যুগ থেকে হয়ে আসছে। বৈদিক মনীষীগণ দ্বারা গণিতের পরিপূর্ণ চর্চাই ভারতবর্ষের জ্যোতির্বিজ্ঞানকে উৎকর্ষের শিখরে উঠতে সাহায্য করেছিল বলে মনে করা হয়। বৈদিক যুগে গণিতের ভিত্তি বেদে বর্ণিত ১৬ টি সূত্র ও ১৩ টি উপসূত্রে অন্তর্নিহিত ছিল। বৈদিকযুগে মূলতঃ দশমিক পদ্ধতিতেই গণনাকার্য সম্পন্ন হত। যজুর্বেদ সংহিতায় প্রাপ্ত বিভিন্ন সংখ্যা যেমন; অর্বুদ(১০০০০০০০), নর্বুদ(১০০০০০০০০), সমুদ্র(১০০০০০০০০০), পরার্ধ(১০০০০০০০০০০০০) থেকে জানা যায় যে বিশালায়তন সংখ্যার ধারণাও হিন্দু গণিতজ্ঞদের কল্পনাতীত ছিল না। সমসাময়িক কোনও জাতি সম্ভবত এত বৃহৎ সংখ্যা কল্পনা করতে সক্ষম ছিল না। নিম্নে বর্ণিত সংখ্যাপ্রবাহ দুটিকে লক্ষ্য করা যাকঃ
১, ৩, ৫,…,৯৯
২৪, ৪৮, ৯৬, ১৯২,………,৩৯৩২১৬

প্রথমটির নাম সমান্তর প্রগতি এবং দ্বিতীয়টির নাম গুণোত্তর প্রগতি। ‘তৈত্তিরীয় সংহিতা’ ও ‘পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণ’ এ যথাক্রমে উপরোক্ত প্রগতিগুলির উল্লেখ পাওয়া যায়। এত গেলো পাটিগণিতের কথা। ‘শতপথ ব্রাহ্মণ’ এ জ্ঞানেরও পরিচয় পাওয়া যায়। আমরা অনেকেই জানি, বৈদিক যজ্ঞানুষ্ঠানে একটি অন্যতম উপকরণ ছিল ‘মহাবেদী’; যার আকৃতি হল সমদ্বিবাহু ট্রাপিজিয়াম। এই সমদ্বিবাহু ট্রাপিজিয়াম এর ক্ষেত্রফল এবং বাহু-উচ্চতার বিভিন্ন সম্পর্ক হিন্দুরা জানতেন। ঋণাত্মক রাশি সম্পর্কেও তারা অবগত ছিলেন। সংস্কৃত ভাষায় আরেকটি অন্যতম সূত্র হল “শুলভা সূত্র” শুলভা শব্দের অর্থ দড়ি বা ঐ ধরনের কিছু। এই শুলভা সূত্র ব্যবহার করা হত হিন্দুদের মৃত্যুর পর বেদী তৈরীর কাজে। এটি এক ধরনের বৈদিক জ্ঞান, যেখানে বিভিন্ন ধরনের আগুনে পোড়ানোর বেদীর বিভিন্ন অর্থ তুলে ধরা হয়েছিল। উদাহরণ স্বরুপ বলা যায়, যারা স্বর্গে যেতে ইচ্ছুক, শুলভা সূত্র অনুযায়ী তাদের আগুনে পোড়ানোর বেদী হবে বকের আকৃতির। যারা ব্রাক্ষনদের মত পৃথিবী জয় করতে চায়, তাদের বেদী হত কচ্ছপ আকৃতির। এছাড়া রম্বস আকৃতির হবে তাদের বেদী, যারা অজাতশত্রু হতে চায়! বেদ থেকে প্রাপ্ত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সূত্রগুলো হল:

অপাস্তমব্য
বৌধয়ন
মানব
ক্যাত্যায়ন
মৈত্রয়নী (মানব এর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ)
বরাহ
বধূলা
হিরন্যকেশ (অপাস্তমব্য এর সাথে সাদৃশ্য পূর্ণ)

এই সূত্রগুলোর বেশির ভাগই আবিষ্কৃত হয় ৮০০ থেকে ২০০ খ্রীষ্টপূর্বে। যাদের মধ্যে সবচাইতে প্রাচীন সূত্র হল বৌধয়ন। মজার ব্যাপার, অপাস্তমব্য ও বৌধয়নের সাথে পীথাগোরাসের সূত্র ও পীথাগোরিয়ান এরীয়র সাদৃশ্য লক্ষ্য করা গেছে। বিভিন্ন জ্যামিতিক আকৃতি, যেমন চতুর্ভূজ ও বর্গের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা গেছে বৌধয়নের ভেতর। এছাড়া আছে, একটি সুনির্দিষ্ট জ্যামিতিক ক্ষেত্রের ক্ষেত্রফলকে অন্য একটি জ্যামিতিক ক্ষেত্রের ক্ষেত্রফলে রূপান্তর করার পদ্ধতি। আরো একটি বিস্ময়কর ব্যাপার হল, এই সূত্রের ভিতর √2 এর মান অত্যন্ত নির্ভুলভাবে বের করার উপায়ও বলা হয়েছে। যা আমরা পানিনি দ্বারা বর্ণিত ইতিহাস থেকে জানতে পারি।

এরপর প্রায় ১০০০ বৎসর গণিতের মৌলিক গবেষণার ক্ষেত্রে হিন্দুদের বিশেষ একটা অবদান লক্ষ্য করা যায় না। পরবর্তীতে আর্যভট্ট্‌ (৪৭৬-৫৩০), ব্রহ্মগুপ্ত (৫৮৮-৬৬০ খ্রিঃ), বরাহমিহির (ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ), গলস্ন (ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম ভাগে), ভাস্কর (ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ ভাগে), মহাবীরাচার্য (নবম শতাব্দী ), শ্রীধর আচার্য (একাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ), শ্রীপতি (একাদশ শতাব্দী), ভাস্করাচার্য (দ্বাদশ শতাব্দী) প্রমুখ মনীষীবৃন্দের কর্মালোকে হিন্দু গণিতশাস্ত্র আবার বিশ্বসভায় নিজের স্থান সুদৃঢ় করে তোলে। গণিতশাস্ত্রে হিন্দু মনীষীদের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য অবদান হল দশমিক স্থানিক অঙ্কপাতন পদ্ধতি ও ‘শূন্য’ এর আবিষ্কার। অবশ্য এর আগে খ্রীষ্টপূর্ব ২০০ তে পিঙ্গলের ‘ছন্দসূত্রে’ শূন্যের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। আর্যভট্ট রচিত ‘আর্যভটীয়’ নামক গ্রন্থে দ্বিঘাত প্রথম মাত্রার অনির্ণেয় সমীকরণের সমাধান ও π এর নির্ভুল মান এর উল্লেখ পাওয়া যায়। বর্গমূল নির্ণয়ের পদ্ধতিও আর্যভট্টের আবিষ্কার। এসময়ের আরেকজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হলেন ব্রহ্মগুপ্ত। তিনি পিরামিড ফ্রাস্টাম এর আয়তন নির্নয় সম্পর্কিত সূত্র আবিষ্কার করেন। যাঁর কথা না বললে এই লেখা অপূর্ণ থেকে যাবে তিনি হলেন ভাষ্কর। তাঁর লেখা বিখ্যাত গ্রন্থখানি হল চারখন্ডে সমাপ্ত ‘সিদ্ধান্ত শিরোমণি।’ যার প্রথম ২টি খন্ড লীলাবতি ও বীজগণিত এ পাটীগণিত ও বীজগণিত এর বিভিন্ন বিষয় আলোচিত হয়েছে। “একটি ঋণাত্মক রাশিকে অপর একটি ঋণাত্মক রাশি দ্বারা গুণ করলে ধনাত্মক রাশি এবং একটি ঋণাত্মক ও অপর একটি ধনাত্মক রাশি গুণ করলে ঋণাত্মক রাশি পাওয়া যায়”, বীজগনিতের এই সিদ্ধান্ত ভাষ্কর এর আবিষ্কার। গণিত এর ছাত্র মানেই, “x=(-b±√(b^2-4ac))/2a” সূত্র সম্পর্কে অবগত। যার আবিষ্কারকের নাম শ্রীধর। দ্বিঘাত সমীকরণের মাত্রা নির্ণয়ের এই সূত্রটি ‘শ্রীধরাচার্যের উপপাদ্য’ নামে প্রচলিত। এতো গেল পাটীগণিত ও জ্যামিতির কথা। এরপর ত্রিকোণমিতি। ত্রিকোণমিতিতেও হিন্দুদের সাফল্য অনস্বীকার্য। বরাহমিহির ‘পঞ্চসিদ্ধান্তিকা’ গ্রন্থে sin30 ও sin 60 এর মান নির্ণয় করে দেখিয়েছেন। বর্তমান ত্রিকোণমিতিতে ব্যবহৃত মূল সূত্রগুলিও বরাহমিহির এর আবিষ্কৃত।

এই হল আমাদের গণিতশাস্ত্র; যার মাহাত্ম্য, যার অবদান বলে শেষ করা যাবে না। হাজার হাজার বছর আগে যখন পৃথিবীতে জ্ঞান ও ধর্মকে একত্রিত করা হয়েছিল ঈশ্বরের উপাসনার জন্য, ঠিক তখন থেকেই আমাদের ভারত উপমহাদেশেও জ্যামিতি, গণিত ও ধর্মের বিভিন্ন রীতির সংমিশ্রন ঘটেছিল। সেই সময় সনাতন ধর্ম এতটাই সমৃদ্ধশালী ছিল যে, যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ভাবতেই অবাক লাগে যে সময় পৃথিবীর অধিকাংশে মানবসভ্যতার ছোঁয়া পর্যন্ত লাগেনি তখন ভারতবর্ষের বিভিন্ন আশ্রমে ঋষিগণ নিমগ্ন ছিলেন বিজ্ঞানের মহাযজ্ঞে। এর কারণ বৈদিক যুগে এদেশের সমাজ ব্যবস্থা মূলত ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। ধর্ম কর্মের জন্য প্রয়োজন হত নানা ধরণের যজ্ঞাদি ক্রিয়া কান্ড। এই যজ্ঞানুষ্ঠানের একটি অপরিহার্য অঙ্গ ছিল যজ্ঞবেদী নির্মাণ। যার জন্যই সংখ্যা ও জ্যামিতির বিভিন্ন বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্যই গণিতবিদ ও পুরোহিতদের অনুপ্রাণিত করেছিল গণিতশাস্ত্রকে বিভিন্ন ধর্মবিষয়ক কাজে ব্যবহার করার।

___________________________________
তথ্যসূত্রঃ- ভারতীয় গণিতের ইতিহাস – প্রাচীন ও মধ্যযুগ
– কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

টিকটিকি বৃত্তান্ত

টিকটিকি বৃত্তান্ত

সেই প্রাচীনকাল থেকে টিকটিকির সঙ্গে একই ছাদের নিচে আমাদের বসবাস। এমনকি কুসংস্কার বশত দৈনন্দিন জীবনের অনেক শুভ-অশুভ বা সত্য-মিথ্যার বিচারক হিসেবে টিকটিকিকে মেনে নিয়েছি আমরা। তবে সেসবের পক্ষে-বিপক্ষে কোনো আলোচনায় এখন আমরা যাব না। আলোচনা করব মসৃণ খাড়া দেয়ালে টিকটিকি ফসকে পড়ে না গিয়ে কিভাবে চলাফেরা করে?

ছোটবেলা থেকেই এই প্রশ্নটা আমরা শুনে আসছি এবং করেও আসছি। সবার মাথায়ই এক সময় না এক সময় এই প্রশ্নটা আসে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এটাই যে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য বিজ্ঞানীদের কম কষ্ট করতে হয়নি। এরিস্টটলও এটা নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন। বেশ বিতর্কও হয়েছে অনেক এটা নিয়ে। যাই হোক এখন ব্যাপারটা মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে যে টিকটিকির দেয়ালে আটকে থাকার পেছনে আমাদের চেনা পরিচিত একটা বল দায়ী যার নাম হচ্ছে ভ্যান ডার ওয়ালস ফোর্স।টিকটিকির পায়ের নিচের অংশকে যখন অনেক ম্যাগ্নিফাই করে দেখা হয় দেখা যায় এতে খুব সরু সরু চুলের মত লাখ লাখ (প্রায় ১ মিলিয়ন) তন্তু আছে। এদেরকে setae বলে। এখানেই শেষ না।প্রত্যেকটা setaর মাথায় আরো চিকন এবং আরো অসংখ্য তন্তু আছে। এরকম অনেক তন্তু থাকায় যে সুবিধা হয় তা হচ্ছে দেয়ালের সাথে কনটাক্ট পয়েন্টের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায় এবং সারফেস এরিয়াও বেড়ে যায়। ভ্যান ডার ওয়ালস ফোর্স হচ্ছে বিভিন্ন সমযোজী যৌগের (এমনকি জৈব যৌগগুলোর) অণুর মধ্যে ক্রিয়াশীল অত্যন্ত দুর্বল মানের বল। অণুগুলো পরস্পরের কাছাকাছি হলে তখনই এই বল কাজ করে। একটু দূরে চলে গেলেই আর কাজ করেনা। অণুর সংখ্যা যত বাড়বে এই বলও ততই শক্তিশালী হতে থাকবে।

এখন যেহেতু কন্টাক্ট পয়েন্ট অনেক বেশি তাই দেয়াল আর টিকটিকির পায়ের মধ্যে বিদ্যমান অণুর সংখ্যাও অনেক বেশি। তাই তাদের মধ্যে ক্রিয়াশীল ভ্যান ডার ওয়ালস বলও এখন আর নগন্য নয়। তাই টিকটিকিও দেয়ালের সাথে আটকে থাকে। বিশ্বাস করা কষ্ট হলেও সত্যি যে একটা টিকটিকি তার পায়ের সবগুলো spatulae ব্যবহার করলে ২৮০ পাউন্ড বা ১২৭ কেজি ভর নিয়েও দেয়ালে আটকে থাকতে পারে যেখানে একটা টিকটিকির ভর ৫০ বা ১০০ গ্রামের কাছাকাছি।

যতোই মনকে বোঝানোর জন্য টিকটিকি বৃত্তান্ত বলি না কেন, একে আমি মনে মনে ডায়নোসর ভেবে ভয় পাই।

বন্ধ ঘরের কাব্য

বন্ধ ঘরের কাব্য

দেখেছো কখনও শব্দের চোখে ফোঁটা ফোঁটা জল জমতে ?
এক ফোঁটা-দু ফোঁটা -তিন ফোঁটা,
টুপ টুপ করে ঝরে পড়তে চিবুক বেয়ে,
আঙুল ছুঁয়ে খাতার পাতায় মনের খাতায়?

কালবৈশাখী ঝড়ে যখন ধুলো ওড়ে,
তখন কেন চোখ, মুখ রুমালে ঢাকো?
সাহস করে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে দেখো একবার,
প্রশান্ত মহাসাগরের অজানা দ্বীপের গন্ধ এসে ভিড়বে আঙিনায়।

কখনো কখনো খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখো।
দেখবে তোমার ছাদের কার্নিশে পায়রাদের বকম বকম
কতগল্প শোনাবে তারা তোমায় গত রাতের মেঘপরীদের।
তাদের ডানায় করে আনবে দেখো তোমার জন্য রাত শিশিরের জল।

বন্ধ ঘরে কখনো নিজের সাথে গল্প করে দেখো।
নিজের ভুল গুলোকে অকপটে স্বীকার করে দেখো।
ভালবাসার কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ মেলে ধরে দেখো।
যেনো,যাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসা যায়,
তার কাছেই বারংবার নতজানু হওয়া যায়।
দেখবে নতুন করে ভালোবাসাকে ভালোবেসে ফেলবে।

মনখারাপের দিনগুলোতে নিঃশব্দে কখনও বালিশে মুখ লুকিয়ে কেঁদেছো ?
একা একা গভীর রাতে ছাদে হেঁটেছ কখন?
দেখবে কত তাড়াতাড়ি সব কিছু আলোকময় হয়ে ওঠে।
কত তাড়াতাড়ি নিজেকে আবিষ্কার করতে পারবে নতুন করে।
মাঝে মাঝে গোধূলিবেলায় হেঁটে যেও যেকোন অজানা রাস্তা ধরে।
ছায়াদের সাথে নিয়ে আমিও হাঁটি তোমার সঙ্গে তোমার ছায়া হয়ে।

বছরের প্রথম বৃষ্টিতে ভিজেছো?
ভিজে দেখো একবার,
কিংবা ছেলেবেলার মতো করে
কাগজের নৌকো বানিয়ে
একটা একটা করে ভাসিয়ে দিও
সেই বৃষ্টির জমা জলে।

মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে কবিতার কান্না শুনেছ কখন?
আজ না হয় আমার এই মনটাকে
শরীর থেকে ব্যবচ্ছেদ করে দেখো
তুমি আর তুমিই থাকবে সেই ভাগাভাগিতে।
আর আমি? আমি তো আছি তোমার মন জুড়ে।
আজ তবে কবিতারই ব্যবচ্ছেদ করা হোক,
একেবারেই নিরপেক্ষ ব্যবচ্ছেদ।

জন্মদিনে একগুচ্ছ হুমায়ুন আহমেদ!

জন্মদিনে একগুচ্ছ হুমায়ুন আহমেদ!

** মনে তীব্র ব্যাথা কমানোর একটি উপায় হচ্ছে কিছু লেখা। যে লেখা ব্যক্তিগত দুঃখকে ছড়িয়ে দেয় সবদিকে। – হুমায়ুন আহমেদ (আমার ছেলেবেলা)।

** যারা সবসময় মিথ্যা কথা বলে তাদের চেহারায় একটা মাইডিয়ার ভাব থাকে।……………..
মানুষের অনেক অদ্ভুদ ক্ষমতার একটি হচ্ছে মিথ্যা বলার ক্ষমতা | কল্পনা শক্তি আছে বলেই সে মিথ্যা বলতে পারে। যে মানুষ মিথ্যা বলতে পারেনা সে সৃষ্টিশীল মানুষ না- রোবট টাইপের মানুষ।
-হুমায়ুন আহমেদ (তন্দ্রাবিলাস)।

** বুদ্ধিমানের কাছ থেকে দশ হাত দুরে থাকবে আর বোকাদের কাছ থেকে একশ হাত দুরে থাকবে।
-হুমায়ুন আহমেদ (হিমুর মধ্যদুপুর)।

** কাউকে বিরক্ত করার সবচে সহজ পথ হচ্ছে তাকে অনুকরণ করা। সে হাসলে হাসা। সে ভুঁরু বাঁকালে ভুঁরু বাঁকানো, সে কাশলে কাশা।
– হুমায়ুন আহমেদ (একজন হিমু কয়েকটি ঝিঁ ঝিঁ পোকা)।

** কোন সৃষ্টিশীল কাজ যখন কেউ করে তখন কাউকে না কাউকে পাশ লাগে যে সেই কাজটা এপ্রিশিয়েট করবে।
– হুমায়ুন আহমেদ (একজন হিমু কয়েকটি ঝিঁ ঝিঁ পোকা)।

** লাজুক মানুষের আত্নবিশ্বাস কম থাকে।
– হুমায়ুন আহমেদ (ফিহা সমীকরণ)।

** অসম্ভব বুদ্ধিমান মানুষ সবসময় এই ছেলেমানুষীটা করে। তাদের বুদ্ধির ছটায় অন্যকে চমকে দিতে চায়।
– হুমায়ুন আহমেদ (আমি এবং আমরা)।

** যাদের মনের ভেতরের অবস্থাটা থাকে বিশৃঙ্খল এবং হয়তোবা অসুন্দর তারা বাইরের পৃথিবীটাকে সুন্দর এবং সুশৃঙ্খল দেখতে চায়, সে কারনে হাতের লেখার মত তুচ্ছ বিষয়েও তাদের মনোয়োগী হতে দেখা যায়।
– হুমায়ুন আহমেদ (আমি এবং আমরা)।

** বেশীরভাগ সময় আমরা মনের কথা বলতে পারিনা বলে কষ্ট পাই।
– হুমায়ুন আহমেদ (দারুচিনি দ্বীপ)।

** চিন্তাহীন জীবন যাপন করা উচিৎ।
-হুমায়ুন আহমেদ (চলে যায় বসন্তের দিন)।

লিট ভাষার কিছু শব্দ

কিছুদিন আগেই একটা বাংলা, অংক মিশিয়ে বেংলিশে লেখা দেখে, তা উদ্ধার করতে হিমসিম খেতে হয়েছিল। আজ সেই ভাষা নিয়েই কিছু কথা।

ফেসবুকে ছাড়াও নানা মেসেজে প্রায়ই দেখা যায় অনেকে সংক্ষিপ্ত ভাষায় লিখছেন। যেমন আজকাল অনেকে GREAT কে GR8 লেখেন কিংবা NICE কে 9c লেখেন। আমরা অনুকরণ প্রিয়, অনেককে লিখতে দেখি বলেই নিজেরাও লিখি। বুঝি বা না বুঝি আপটুডেট থাকতে হবে তো!

একটু জেনে নিই ,বর্ণ ও সংখ্যা এক হল কীভাবে। আর এটি আসলে ব্যবহার করে কারা। এই অদ্ভুত ভাষার নাম হচ্ছে লিট (LEET)। লিট ভাষায় মূলত ASCII চিহ্ন ব্যবহার করা হয় মূল শব্দকে লুকনোর জন্য। লিট এর প্রথম ব্যবহার শুরু হয় ৮০ এর দশকে Bulletin Board System (BBS) এ। এটি মূলত তৈরি হয় BBS সদস্যদের মাঝে কোন গোপন বা নিষিদ্ধ বিষয় নিয়ে বার্তা আদান প্রদান এর উদ্দেশে।

অনেকের মতে ষাট এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এর শীতল সম্পর্ক চলাকালীন সময় এ যুক্তরাষ্ট্র এর গোয়েন্দারা এর সূত্রপাত করেন যেন গোপন তথ্য শত্রুর হাতে না যেতে পারে। কালের পরিক্রমায় ৯০ এর দশক এ কম্পিউটার হ্যাকিং এর সূচনা হলে এটি হয়ে ওঠে হ্যাকারদের ভাষা যাকে তারা নাম দেয় LEET বা 1337 1=L ; 3=E ; 7=T। আর বর্তমানে লিট ভাষা ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে ইমেইল বা ফেসবুকে।

লিট ভাষায় একক বা দ্বি শব্দগুচ্ছ দিয়ে আপনি মনের ভাব প্রকাশ করতে পারেন। এই ভাষায় ইংরেজি ব্যাকরণ ব্যবহারের কোন বাধ্যবাধকতা নেই।

লিট ভাষার কিছু শব্দ

that = dat
look at = peep
newbie = n00b
why = y
and = SPamp dude = d00d
hacker = h4x0r
hello = ping to/two = 2
friends=n00bz

আপনি যদি লিট ভাষা ব্যবহার করতে চান তাহলে আপনাকে বেশি দূর যেতে হবে না। গুগলে গিয়ে English to Leet বা Leet Translator লিখে সার্চ দিলে এমন অনেক সাইট পাবেন। Lit ভাষা নিয়েও অনেক লেখা পাবেন। আর তাছাড়া এর জন্য রয়েছে পিডিএফ বই ও সফটওয়্যার। তাহলে দেখবেন আপনার অচেনা শব্দগুলো কেমন পরিচিত হয়ে ওঠে, আর এভাবেই হয়তো বা আপনি হয়ে উঠতে পারেন লিট স্পিক এ পারদর্শী।

(যদিও আমি রপ্ত করতে পারিনি এই ভাষা)

ভোরাই

ভোরাই

আজ আরও একবার সুন্দর ভোর এসে ঘুম থেকে আলতো আদরে জাগিয়েছে আমায়। ঘুম ঘুম আধা আধি চোখে তাকিয়েছি জানলার ওপারে। হিম মাখামাখি নরম গালিচার মতন সকাল, চেয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ জানলার বাইরে।

আজকে আবার, আরো এক বার খুশি চলে এলো বেড়া ডিঙিয়ে, মনের এইপারে। অচেনা চোখে চেনা ছায়া দেখে অবাক অভিমানী এই দীঘি চোখের মেয়ে।

কি যে লিখি? ঠিক কি লিখি? মিঠে ভোরের কাছেই জানতে চেয়েছি আজকেও। পরে ভেবেছি “কি হবে জেনে? সব জানা শেষ পর্যন্ত মিশে যায় অজানায়।

তারপর কোথা দিয়ে সময় পেরিয়ে চলে। ফেলে আসা দিনের কিছু ছবি চলে আসে চোখের সামনে আলগোছে। রাত জেগে হাতে রং তুলি। চাঁদ ঢোকে শীতল হাওয়া সাথে নিয়ে আমার ঘরে।

চারপাশে আস্তে আস্তে নিস্তব্ধতা মেখে নিলে, মন তার দরজা খোলে। অচেনা, বহুদূরে বন্ধুর সাথে হয় মতবিনিময়। একে একে কি যে সব বলে চলি। কিছু কথা একদম আনকোরা, কিছু কথা তুলে রাখি সিন্দুকে, জেনে বুঝে।

মনের এই ভালোবাসা-মন্দবাসা, চোখ চিনে নেয় আধো অন্ধকারে, কবিতা পড়ি আর কবিতার রেশটুকু রেখে দিই মনের কুলুঙ্গীতে, আবার সেই হালকা ঠোঁট ঘেঁষা হাসিটাও রেখে দিই, গুনগুন করে রবিঠাকুরের সেই গান খানি গেয়ে দিয়ে আবার ঘুম ডেকে নিতে চায় এ দুচোখ। ঘুম এসে ওমমাখা চাদরে ঢেকে নেয়। এই বার পুরোপুরি শব্দহীন হয় রাত।

খুশির পশরা সাজিয়ে আমি ভাবি, আজকে কি নাম যে দিই এই খুশীকে ?

দাশগুপ্ত বাড়ির কালী প্রতিমার ছবি

দাশগুপ্ত বাড়ির কালী প্রতিমার ছবি।

“জয়ন্তী মঙ্গলাকালী ভদ্রাকালী কপালিনী
দুর্গা শিবা ক্ষমাধাত্রী স্বাহা স্বধা, নমোহস্তুতে”

‘কালী’ শব্দটি ‘কাল’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ রূপ, যার অর্থ “কৃষ্ণ, ঘোর বর্ণ” (পাণিনি ৪।১।৪২), মহাভারত অনুসারে, এটি দুর্গার একটি রূপ (মহাভারত, ৪।১৯৫), আবার হরিবংশ গ্রন্থে কালী একটি দানবীর নাম (হরিবংশ, ১১৫৫২)। ‘কাল’, যার অর্থ ‘নির্ধারিত সময়’, তা প্রসঙ্গক্রমে ‘মৃত্যু’ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। এর সমোচ্চারিত শব্দ ‘কালো’র সঙ্গে এর কোনও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। কিন্তু লৌকিক ব্যুৎপত্তির দৌলতে এরা পরস্পর সংযুক্ত হয়ে গেছে। মহাভারত-এ এক দেবীর উল্লেখ আছে যিনি নিহত যোদ্ধা ও পশুদের আত্মাকে বহন করেন। তাঁর নাম কালরাত্রি বা কালী। সংস্কৃত সাহিত্যের বিশিষ্ট গবেষক টমাস কবার্নের মতে, এই শব্দটি নাম হিসাবে ব্যবহার করা হতে পারে আবার ‘কৃষ্ণবর্ণা’ বোঝাতেও ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে। তন্ত্র ও পুরাণে দেবী কালীর একাধিক রূপভেদের কথা পাওয়া যায়। তোড়ল তন্ত্র মতে কালী অষ্টধা বা অষ্টবিধ। যথা – দক্ষিণাকালী, সিদ্ধকালী, গুহ্যকালী, মহাকালী, ভদ্রকালী, চামুণ্ডাকালী, শ্মশানকালী ও শ্রীকালী। মহাকাল সংহিতা অনুসারে আবার কালী নববিধা। এই তালিকা থেকেই পাওয়া যায় কালকালী, কামকলাকালী, ধনদাকালী ও চণ্ডিকাকালীর নাম।

কালীকে দুর্গার ললাট থেকে উৎপন্না বলা হয়েছে। যথা—”দুর্গার ললাটে জাতা জলদবরণী।” —এই বাক্যের তাৎপর্য যে, ললাটের সংকোচনেই ক্রোধভাব প্রকাশিত হয় বলে সদা ক্রোধান্বিতা; রণরঙ্গিনী করাল-বদনা কালীকে ললাট-সম্ভবা বলা হয়েছে। বাস্তবিক কালীও দুর্গার রূপান্তর বিশেষ। ক্রোধাবস্থাপন্না শক্তিই কালী। ভয়ানক ভাবান্বিতা বিশ্বব্যাপিনী শক্তি—এই অর্থে ঈশ্বরের নাম কালী। কালীর মূর্তি ও সংগ্রামকর্ম—দুইই ভয়ংকর। কালীর বাসস্থান শ্মশান, হাতে খড়্গ, শরীর রক্তমাখা, গম্ভীর গর্জন করেন, যুদ্ধে মেতে থাকেন, গলায় মুণ্ডমালা, সংক্ষেপে বললে, কালীর ভয়ানক বেশ, কালীপূজার কাল অমাবস্যা তিথি ও ঘনঘোর অন্ধকার রাত। মৃতদেহের উপর বসে, শ্মশানে তাঁর সাধনা করতে হয়। পূজার বাদ্যযন্ত্র ঢাক ও উপহারের ফুল টকটকে লাল রঙের জবা। তান্ত্রিকেরা আবার পঞ্চ-মকার দিয়ে ভয়ানক সাধনপ্রণালীর বিধানও দিয়েছেন। মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন—এই পঞ্চ-মকারের প্রায় প্রত্যেকই বাইরে থেকে দেখলে এক এক ভয়ানক সাধন-প্রণালী। বাইরে থেকে—এই কথা বলার তাৎপর্য এই যে, ওই পঞ্চ-মকারের আধ্যাত্মিক ভাব অত্যন্ত নির্মল ও উচ্চ। লোকনাথ বসু তাঁর হিন্দুধর্ম মর্ম নামক বইয়ে পঞ্চ-মকার সম্পর্কে আগমসারের যে এক অংশ উদ্ধৃত করেছেন, তার তাৎপর্য এই যে, ঐ স্থানে মদ্য বলতে পানীয় মদ বোঝায় না, তা ব্রহ্মরন্ধ্র থেকে ক্ষরিত অমৃতধারা বা ব্রহ্মানন্দ; মাংস মানে দেহের মাংস নয়, তা হল জিভের সংযম; মৎস্য বলতে মাছ বোঝায় না, তা হল শ্বাসনিরোধ (প্রাণায়ম); মুদ্রা মানে টাকাপয়সা নয়, বরং আত্মাতে যে পরমাত্মা মুদ্রিত হয়ে আছেন, সেই তত্ত্বজ্ঞান এবং মৈথুন বলতে যৌনসংগম বোঝায় না, তা হল জীবাত্মাতে পরমাত্মার মিলন।

চামুণ্ডাচর্চিকা কালীর পূজা বাংলা ও বাংলার বাইরে প্রাচীন উৎসব হলেও বর্তমান আকারে কালীপূজা আধুনিক কালের। ষোড়শ শতাব্দীতে নবদ্বীপের প্রসিদ্ধ স্মার্ত পণ্ডিত তথা নব্যস্মৃতির স্রষ্টা রঘুনন্দন কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যায় লক্ষ্মীপূজার বিধান দিলেও, কালীপূজার উল্লেখ করেননি। ১৭৬৮ সালে রচিত কাশীনাথের কালী সপর্যাসবিধি গ্রন্থে দীপান্বিতা অমাবস্যায় কালীপূজার বিধান পাওয়া যায়। ডঃ শশীভূষণ দাশগুপ্তের মতে, “কাশীনাথ এই গ্রন্থে কালীপূজার পক্ষে যে ভাবে যুক্তিতর্কের অবতারণা করিয়াছেন, তাহা দেখিলেই মনে হয়, কালীপূজা তখনও পর্যন্ত বাঙলা দেশে সুগৃহীত ছিল না।” তবে খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলায় কালীপূজার প্রচলনের কিছু কিছু প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে।

সপ্তদশ শতকের নবদ্বীপের প্রথিতযশা তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকে বাংলায় কালীমূর্তি ও কালীপূজার প্রবর্তক মনে করা হয়। পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ স্বয়ং কালীমূর্তি গড়িয়া পূজা করিতেন। আগমবাগীশের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিয়া বাংলার সাধক সমাজ অনেকদিন চলেন নাই; লোকে ‘আগমবাগিশী’ কাণ্ড বলিয়া তাঁহার পদ্ধতিকে উপেক্ষা করিত।” অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কালীপূজাকে জনপ্রিয় করে তোলেন। এই সময় রামপ্রসাদ সেনও আগমবাগীশের পদ্ধতি অনুসারে কালীপূজা করতেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ঈশানচন্দ্র ও বাংলার ধনী জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় কালীপূজা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

মারাঠি থেকে অনুবাদ … ছত্রিশ বাহানা

ছত্রিশ বাহানা
– মারাঠি থেকে অনুবাদ।

ভূমিকা : গল্প- সখুবাঈ। যেভাবে ঘরে মজুত খাবার শেষ হয়ে গেলে অদিবাসী পরিবার খাবারের পরিবর্তে কন্যাসন্তানদের অন্য লোকেদের বাড়ি পাঠানো হয় তাদের ছোট ছোট বাচ্চাদের দেখাশোনা করতে। খুব অল্প বয়সে সখুবাঈকেও পাঠানো হয়েছিল অন্যের শিশু দেখাশোনা করার জন্য। তিনি তখন এতোই ছোট যে শিশুটিকে তিনি দেখাশোনা করেন তাকে কোলে তোলার ক্ষমতা ছিলো না। তিনি কেবল দোলনায় দোলাতে পারতেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সখুবাঈয়ের জীবনের ঘটে গেছে নানা ঘটনা। সেইসব ঘটনা থেকে তিনি যোদ্ধার মতোই বেরিয়ে এসেছিলেন। কখনও তিনি ভয় পেয়েছেন তাকে আক্রমণ করা হবে, কখনও ভয় পেয়েছেন তাকে ডাইনী আখ্যা দেওয়া হবে। সমাজ তাকে বহিষ্কার করবে। তা সত্ত্বেও তিনি লড়াই চালিয়ে গেছেন আদিবাসী মেয়েদের মুক্তির জন্য। সাখুবাঈয়ের জীবন এমন এক ইতিহাসের অঙ্গ যা পরিচিত হওয়া প্রয়োজন।

সাখুবাঈ গভিট দাহনু তালুকের বন্দঘর মেঘপাড়া অঞ্চলের এক আদিবাসী রমনী। তিনি ভূমিহীন শ্রমিক, প্রান্তীয় চাষীদের মধ্যে কর্মরত গণসংস্থা কষ্টকারী সংঘটনের সঙ্গে কাজ করেছেন। সখুবাঈ গ্রামের লোকেদের একজোট করে সংঘটন গড়ে তুলেছেন। তার জীবন ছিলো সংগ্রামের তাই ক্রমশ তিনি হয়ে উঠেছিলেন দৃঢ়চেতা রমনী। অদিবাসী অঞ্চলে মেয়েদের পড়াশোনার সুযোগ পাওয়া মুশকিল। জেলা পরিষদ স্কুলগুলো মোটামুটি কাজ করে না। তাছাড়া বেঁচে থাকার প্রয়োজনে গ্রামের লোকেরা গ্রামের বাইরে কাটায় বছরের ন’মাস। আর চাষ করার জন্য ফিরে আসে তিনমাস। মীনা তোঢাড়ের বাবা কালুরাম তোঢাড়ে তৈরী করেছিলেন ভূমিসেনা। এবং মীনা তৈরী করেছেন একটি আশ্রম স্কুল। সেখানেই বড় হয়েছেন সাখুবাঈ। পড়াশোনা করেছেন। চাষাবাদ করেন এবং সখুবাঈ অবসর সময়ে লিখে রাখতেন কিছু লোকগাঁথা। সেখান থেকেই একটি গল্পের অনুবাদ দেওয়া হলো।
______________________________

ছত্রিশ বাহানা

এক সময়ে এক কুঁড়ে বাস করতো। গল্পকার গল্প শুনেই তার সময় কাটতো। সেইসব গল্পের মূল ছিলো মেয়েরা। অর্থাৎ মেয়েদের হালচাল সম্বন্ধে পুরুষদের সব সময় সতর্ক থাকা উচিৎ। কারণ পুরুষদের প্রতারণা করতে মেয়েরা অনেক রকম ছলনার আশ্রয় নিতে পারে। সে এই জন্য সবসময় ‘ছত্রিশ বাহানা’ শব্দটি ব্যাবহার করতো। এর অর্থ হলো – ছত্রিশ রকমের ছলনা।

লোকটি প্রত্যেকদিন তার কাহিনীকারের থেকে ফিরে এসে তার স্ত্রীকে মারতো। তার স্ত্রীর কাছে সে ওই ‘ছত্রিশ রকমের বাহানা দেখতে চাইতো। স্ত্রী কয়েকদিন পর্যন্ত তার মার সহ্য করলো। প্রথমে সে তার স্বামী ওই কাহিনীকারের কাছে যাতে না যায় সেই চেষ্টা করলো। কিন্তু ব্যার্থ হলো। তারপর সে একদিন ঠিক করলো তার নির্বোধ স্বামীকে উচিত শিক্ষা দেবে।

তখন বর্ষাকাল চলছিল। গ্রামের সবাই চাষের কাজে ব্যস্ত। কাহিনীকার নিজের জমিতে চাষের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। যার ফলে স্বামীর মারের হাত থেকে স্ত্রী সাময়িক মুক্তি পেয়েছে। তখন সে উপায় ভাবতে লাগলো স্বামীকে শিক্ষা দেওয়ার। কিভাবে সংসারে শান্তি আনা যায়। তাদের জমি ছিলো পাহাড়ের ঢালু জায়গায়। স্বামী প্রতিদিন চাষের কাজে চলে যায়। আর স্ত্রী সংসারের কাজ সামলে দুপুরে স্বামীর খাবার নিয়ে মাঠে যায়। হঠাৎই একদিন স্ত্রী পাহাড়ের নীচে জলাশয়ে অনেক ছোট ছোট মাছ দেখতে পেলো। সে তখন ইচ্ছেমতো মাছ ধরলো। জলের পাত্রে রাখলো। তারপর নিজেদের জমিতে গেলো। স্বামী তখনও কাজে ব্যস্ত দেখে মাছগুলো জমিতে ছেড়ে দিলো। তারপর স্বামীকে বললো ‘দেখো আজ আমাদের জমিতে কি পেয়েছি।’ এমন একটি জায়গায় মাছ দেখে স্বামী অবাক। সবগুলো মাছ ধরে ঝুড়িতে রাখলো। এবং এর জন্য স্বামী উদযাপন করতে চাইলো। তাই স্ত্রীকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে মাছগুলো রান্না করতে বললো। আর নিজে গেলো মদ খেতে। ইতিমধ্যেই স্ত্রী মাছগুলো রান্না করে চিলেকোঠায় লুকিয়ে রাখলো। মদ খেয়ে নেশাগ্রস্ত স্বামী বাড়ি ফিরে মাছ খেতে চাইলো। স্ত্রী এইকথা শুনে অবাক হওয়ার ভান করলো। তখনই স্বামী একটা লাঠি দিয়ে স্ত্রীকে ভীষণ মারতে লাগলে, স্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে বাইরে এসে সাহায্য চাইলেন। স্ত্রীর কান্না শুনে সব প্রতিবেশীরা তার উঠোনে এসে জড়ো হলো। সব পুরুষরা প্রথমে স্বামীর পক্ষ নিয়েছিলো। স্বামী তাদের মাছে কাহিনী শোনালো। স্বাভাবিক ভাবেই অতো উঁচু জায়গার জমিতে মাছ কখনোই পাওয়া যাবে না। গ্রামবাসীরা ধরেই নিলো লোকটি মাতাল। এবং স্ত্রীকে মারার জন্য, তাদের মিথ্যে বলার জন্য ভীষণ মারতে লাগলো।

ধীরে ধীরে সবাই চলে গেলে স্ত্রী চিলেকোঠা থেকে মাছ বের করলো। তারপর স্বামীকে বললো – “আমার ছত্রিশ বাহানার মধ্যে আজ মাত্র একটা দেখলে। এবার নিজেকে শোধরাও, না হলে এখনও আমার পঁয়ত্রিশটা বাহানা বাকি।”

_______________
অনুবাদ- রিয়া চক্রবর্তী।

মারাঠি থেকে অনুবাদ … গল্পকার ও শ্রোতা

গল্পকার ও শ্রোতা
– মারাঠি থেকে অনুবাদ।

ভূমিকা : গল্প- সখুবাঈ। যেভাবে ঘরে মজুত খাবার শেষ হয়ে গেলে অদিবাসী পরিবার খাবারের পরিবর্তে কন্যাসন্তানদের অন্য লোকেদের বাড়ি পাঠানো হয় তাদের ছোট ছোট বাচ্চাদের দেখাশোনা করতে। খুব অল্প বয়সে সখুবাঈকেও পাঠানো হয়েছিল অন্যের শিশু দেখাশোনা করার জন্য। তিনি তখন এতোই ছোট যে শিশুটিকে তিনি দেখাশোনা করেন তাকে কোলে তোলার ক্ষমতা ছিলো না। তিনি কেবল দোলনায় দোলাতে পারতেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সখুবাঈয়ের জীবনের ঘটে গেছে নানা ঘটনা। সেইসব ঘটনা থেকে তিনি যোদ্ধার মতোই বেরিয়ে এসেছিলেন। কখনও তিনি ভয় পেয়েছেন তাকে আক্রমণ করা হবে, কখনও ভয় পেয়েছেন তাকে ডাইনী আখ্যা দেওয়া হবে। সমাজ তাকে বহিষ্কার করবে। তা সত্ত্বেও তিনি লড়াই চালিয়ে গেছেন আদিবাসী মেয়েদের মুক্তির জন্য। সাখুবাঈয়ের জীবন এমন এক ইতিহাসের অঙ্গ যা পরিচিত হওয়া প্রয়োজন।

সাখুবাঈ গভিট দাহনু তালুকের বন্দঘর মেঘপাড়া অঞ্চলের এক আদিবাসী রমনী। তিনি ভূমিহীন শ্রমিক, প্রান্তীয় চাষীদের মধ্যে কর্মরত গণসংস্থা কষ্টকারী সংঘটনের সঙ্গে কাজ করেছেন। সখুবাঈ গ্রামের লোকেদের একজোট করে সংঘটন গড়ে তুলেছেন। তার জীবন ছিলো সংগ্রামের তাই ক্রমশ তিনি হয়ে উঠেছিলেন দৃঢ়চেতা রমনী। অদিবাসী অঞ্চলে মেয়েদের পড়াশোনার সুযোগ পাওয়া মুশকিল। জেলা পরিষদ স্কুলগুলো মোটামুটি কাজ করে না। তাছাড়া বেঁচে থাকার প্রয়োজনে গ্রামের লোকেরা গ্রামের বাইরে কাটায় বছরের ন’মাস। আর চাষ করার জন্য ফিরে আসে তিনমাস। মীনা তোঢাড়ের বাবা কালুরাম তোঢাড়ে তৈরী করেছিলেন ভূমিসেনা। এবং মীনা তৈরী করেছেন একটি আশ্রম স্কুল। সেখানেই বড় হয়েছেন সাখুবাঈ। পড়াশোনা করেছেন। চাষাবাদ করেন এবং সখুবাঈ অবসর সময়ে লিখে রাখতেন কিছু লোকগাঁথা। সেখান থেকেই একটি গল্পের অনুবাদ দেওয়া হলো।
______________________________

গল্পকার ও শ্রোতা

অনেক বছর আগে, এক গ্রামে দুই বন্ধু বসবাস করতো। একজন ছিলো গল্পকার এবং অন্যজন শ্রোতা। একদিন তারা অনেক দূরের জঙ্গলে গেলো এবং সেখানে বসে তারা একের পর এক গল্প শুরু করলো। এদিকে যে খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, ওদের আর নজর নেই। দিন শেষ হয়ে একসময় রাতও পার হয়ে গেলো। সঙ্গে আনা খাবার পচে যাচ্ছে তাদের খেয়াল নেই। তারা এতটাই গল্পের মধ্যে ডুবে ছিলো। একসময় তারা সেই জঙ্গলেই অনাহারে মারা গেলো। দুদিন পরে কিছু পথচারী সেও রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলো। তারা দুটো মৃতদেহ দেখে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলো এরা দুজন কে? এক জন বললো হয়তো কোনো পরদেশী। তখন তারা সেই মৃতদেহ নিজেদের গ্রামে নিয়ে গিয়ে কবর দিলো।

এদিকে অনেক দিন ধরে গল্পকার আর শ্রোতার কোনো খবর নেই দেখে তাদের স্ত্রীরা খুঁজতে বের হলো। জঙ্গলের মধ্যে খুঁজতে খুঁজতে তারা হাজির হলো এক কবরস্থানে। সেখানকার লোকেদের জিজ্ঞেস করলো – “ও গ্রামের অধিকারী বলো তো, এরা কি আমাদের স্বামী?” গ্রাম অধিকারী বলল – “আমরা এদের মৃত অবস্থায় পাই। পাশে না খাওয়া খাবার। তাদের আমরা এক সঙ্গে মাটির তলায় কবর দিই।” তখন স্ত্রীদের কথায় কবর খুঁড়ে হাড়গুলো বের করা হলো। তখন স্ত্রীরা আবার জানতে চাইলো – “ও গ্রাম অধিকারী, এদের মধ্যে কে গল্পকার আর কে শ্রোতা?” কেউ উত্তর দিতে পারলো না।

স্ত্রীরা তখন অধিকারীর কথামত হাড়গুলো একটা থলিতে ভরে কাছাকাছি একটা পুকুরে নিয়ে গেলো। হাড়গুলোকে জলে ডুবিয়ে দিলো। যিনি শ্রোতা তিনি এমনভাবে গল্পগুলো আত্মস্ত করেছিল যে তার হাড় গুলো ভারী হয়ে গিয়েছিল। ফলে সেগুলো ডুবে গেলো। অন্যদিকে গল্প বলতে বলতে গল্পকারের শরীর প্রায় খালি হয়ে গিয়েছিল। ফলে তার হাড়গুলো ভেসে রইলো।

অধিকারী বললেন – “তোমাদের স্বামীর হাড়গুলো এবার বাড়ি নিয়ে যাও। এখন তোমরা জানো কোন গুলো গল্পকার এর হাড় আর কোন গুলো শ্রোতার হাড়। হালকা এবং ভারী। সৃষ্টিকর্তা এবং গ্রহীতা। গল্পকার এবং শ্রোতা।”

_______________
অনুবাদ- রিয়া চক্রবর্তী।

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ সুকুমার রায়, জন্মদিনে শ্রদ্ধা

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ সুকুমার রায়, জন্মদিনে শ্রদ্ধা।

হাঁস ছিল, সজারু, (ব্যাকরণ মানি না),
হয়ে গেলে “হাঁসজারু” কেমনে তা জানি না।
বক কহে কচ্ছপে “বাহবা কি ফুর্তি!
অতি খাসা আমাদের বকচ্ছপ মূর্তি।”

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ শিশুসাহিত্যিক ও ভারতীয় সাহিত্যে “ননসেন্স্ রাইমের” প্রবর্তক। তিনি একাধারে ছিলেন লেখক, ছড়াকার, রম্যরচনাকার ও নাট্যকার। ৩০শে অক্টোবর ১৮৮৭ সালে কলকাতার এক ব্রাহ্ম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক, বিজ্ঞান লেখক, চিত্রশিল্পী, সুরকার ও শৌখিন জ্যোতির্বিদ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি ও ব্রাহ্ম সমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে বিধুমুখী দেবীর দ্বিতীয় সন্তান অর্থাৎ সুকুমার রায় জন্মেছিলেন বাঙালি নবজাগরনের স্বর্ণযুগে। সুবিনয় রায় ও সুবিমল রায় ছিলেন তাঁর দুই ভাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন উপেন্দ্রকিশোরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, এছাড়াও পারিবারিক বন্ধু ছিলেন জগদীশ চন্দ্র বসু, আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। ছোটদের জন্য অনেক মজার ছড়া লিখে গেছেন। যেগুলো আজও সমান ভাবে বড়দের মধ্যেও জনপ্রিয়।

“মাথায় কত প্রশ্ন আসে, দিচ্ছে না কেউ জবাব তার-
সবাই বলে, “মিথ্যে বাজে বকিসনে আর খবরদার!”
অমন ধারা ধমক দিলে কেমন করে শিখব সব?
বলবে সবাই “মুখ্য ছেলে”, বলবে আমায় “গো গর্দভ!”
কেউ কি জানে দিনের বেলায় কোথায় পালায় ঘুমের ঘোর?
বর্ষা হলেই ব্যাঙের গলায় কোত্থেকে হয় এমন জোর?
গাধার কেন শিং থাকে না, হাতির কেন পালক নেই?”

এমন আজগুবি অথচ সার্থক রচনা ছিলো সুকুমার রায়ের।‘আবোলতাবোল’ গ্রন্থের ভূমিকায় নিজেই লিখেছিলেন, ‘যাহা আজগুবি, যাহা উদ্ভট, যাহা অসম্ভব, তাহাদের লইয়াই এই পুস্তকের কারবার। ইহা খেয়াল রসের বই, সুতরাং সে রস যাঁহারা উপভোগ করিতে পারেন না, এ পুস্তক তাঁহাদের জন্য নহে।’

১৮৯৫ সালে মাত্র আট বছর বয়সে সুকুমারের প্রথম কবিতা ‘নদী’ প্রকাশিত হয় ‘মুকুল’ পত্রিকায়। এরপর ন’বছর বয়সে ‘টিক্ টিক্ টং’ লেখেন ইংরাজি শিশুপাঠ ‘Hickory,Dickory,Dock’-এর অনুবাদ হিসাবে। ১৯০৪ সালের নভেম্বর মাসে মাত্র ১৭ বছর বয়সে ‘বয়েজ ওন পেপার’-এর দ্বারা শ্রেষ্ঠ আলোকচিত্রী হিসাবে পুরস্কৃত হন তিনি। এরপর ১৯০৬ সালে রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় বি.এস.সি (অনার্স) পাশ করেন কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে এবং তারপরেই প্রতিষ্ঠা করেন ‘ননসেন্স ক্লাব’ ১৯০৭-এ। এর মুখপাত্র ছিল ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’ নামের একটি পত্রিকা। এই সময় থেকেই তাঁর আবোল-তাবোল ছড়ার আত্মপ্রকাশ।

“হেড অফিসের বড়বাবু লোকটি বড় শান্ত,
তার যে এমন মাথার ব্যামো কেউ কখনো জানত ?
দিব্যি ছিলেন খোসমেজাজে চেয়ারখানি চেপে,
একলা বসে ঝিম্‌ঝিমিয়ে হঠাৎ গেলেন ক্ষেপে !
আঁৎকে উঠে হাত পা ছুঁড়ে চোখটি ক’রে গোল,
হঠাৎ বলেন, “গেলুম গেলুম, আমায় ধরে তোল !”
তাই শুনে কেউ বদ্যি ডাকে, কেউবা হাঁকে পুলিশ,
কেউবা বলে, “কামড়ে দেবে সাবধানেতে তুলিস।”

আমাদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে চিন্তার ধরণও পাল্টে যায়। বড় এবং ছোটদের চিন্তা এক হওয়া কখনও সম্ভব নয়। বড়দের ভাবনা জটিল হলেও ছোটদের ভাবনা সহজ-সরল। ছোটদের জগত ভিন্ন, আলাদা। শিশু ও কিশোর মনের সাথে তালমিলিয়ে যে সাহিত্য রচিত হয় মূলত তা-ই শিশু সাহিত্য। সপ্তম শতকে ল্যাটিন ভাষায় আদি শিশু সাহিত্য রচিত হয়। ঊনবিংশ শতকে জার্মান রূপকথা, এডওয়ার্ড লিয়ারের book of nonsense, লুইস ক্যারলের alice in wonderland প্রভৃতি শিশু সাহিত্যে এক অনন্য সংযোজন। ১৯১১ সালে সুকুমার রায় ‘গুরুপ্রসন্ন ঘোষ স্কলারশিপ’ নিয়ে আলোকচিত্র ও মুদ্রণপ্রযুক্তির ওপর উচ্চতর শিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে যান এবং কালক্রমে ভারতের অগ্রগামী আলোকচিত্রী ও লিথোগ্রাফার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। হাফটোন মুদ্রণ প্রযুক্তির ওপর ১৯১২ সালে তিনি ‘Halftone Facts Summarized’ রচনা করেন যা Penrose Annual-এ প্রকাশিত হয়। এই সময়ে তিনি ইংল্যান্ডের ‘Royal Photographic Society’-র সদস্য নিযুক্ত হন। এরপর ১৯১৩ সালে তাঁর রচিত ‘Standardizing the Original’, ‘Penrose Annual’ – এ প্রকাশিত হয় এবং ‘Pin-hole theory’–র ওপর একটি রচনা ১৯১৩-এর জুলাই মাসে ‘The British Journal of Photography’ – তে প্রকাশিত হয়।

সুকুমারের ইংল্যান্ডে থাকাকালীন সময়েই পিতা উপেন্দ্রকিশোর উন্নতমানের রঙিন হাফটোন ব্লক তৈরি ও মুদ্রণক্ষম একটি ছাপাখানা স্থাপন করেন এবং ছোটদের মাসিক পত্রিকা ‘সন্দেশ’-এর প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত করেন ১৯১৩ সালে। এই বছরের ২৯শে সেপ্টেম্বর সুকুমার স্বদেশে ফিরে আসেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কালীমোহন ঘোষের সাথে। দেশে ফিরেই সুকুমার যোগ দেন ব্রাহ্মসমাজের সংস্কারপন্থী গোষ্ঠীর সাথে এবং ১৯১৪ সালে ‘সাধারন ব্রাহ্মসমাজের’ যুগ্ম সচিব পদে নিযুক্ত হন।পরবর্তীতে উপেন্দ্রকিশোর মারা যাওয়ার পর সুকুমার রায় ‘সন্দেশ’ পত্রিকার কাজ নিজের হাতে তুলে নেন।

“যে আনন্দ ফুলের বাসে, যে আনন্দ পাখির গানে,
যে আনন্দ অরুণ আলোয়, যে আনন্দ শিশুর প্রাণে,
যে আনন্দে বাতাস বহে, যে আনন্দ সাগর জলে,
যে আনন্দ ধূলির কণায়, যে আনন্দ তৃণের দলে,
যে আনন্দে আকাশ ভরা, যে আনন্দ তারায় তারায়,
যে আনন্দ সকল সুখে, যে আনন্দ রক্ত ধারায়,
সে আনন্দ মধুর হয়ে তোমার প্রাণে পড়ুক ঝরি,
সে আনন্দ আলোর মত থাকুক তব জীবন ভরি।”

১৯১৯ সালের ১৩ই ডিসেম্বর কালীনারায়ণ গুপ্তর নাতনি শ্রীমতি সুপ্রভা দাসের সাথে বিবাহ হয় এবং দুই বৎসর পরে ১৯২১ সালের ২য় মে সত্যজিতের জন্ম হয়। ১৯২২ সালে তিনি দ্বিতীয় ভারতীয় হিসাবে ‘Royal Photographic Society’-র সহকর্মী নিযুক্ত হন। এই সময় থেকেই সুকুমার রায় কালাজ্বরে (লেইশ্নানিয়াসিস) আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এক বছর পরে ১৯২৩ সালের ১০ম সেপ্টেম্বর মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি হল ‘আবোল তাবোল’,’পাগলা দাশু’,’হেশোরাম হুশিয়ারের ডায়েরি’,’হ য ব র ল’ তাঁর উল্লেখযোগ্য কাবগ্রন্থ।

“মেঘ মুলুকে ঝাপসা রাতে,
রামধনুকের আব্‌ছায়াতে,
তাল বেতালে খেয়াল সুরে,
তান ধরেছি কণ্ঠ পুরে।
হেথায় নিষেধ নাইরে দাদা,
নাইরে বাঁধন নাইরে বাধা।
হেথায় রঙিন আকাশতলে
স্বপ্ন দোলা হাওয়ায় দোলে
সুরের নেশার ঝরনা ছোটে,
আকাশ কুসুম আপনি ফোটে
রঙিয়ে আকাশ, রঙিয়ে মন
চমক জাগে ক্ষণে ক্ষণ।
আজকে দাদা যাবার আগে
বল্‌ব যা মোর চিত্তে লাগে
নাই বা তাহার অর্থ হোক্
নাই বা বুঝুক বেবাক্ লোক
আপনাকে আজ আপন হাতে
ভাসিয়ে দিলাম খেয়াল স্রোতে।”
______________________

জীবনে কতটুকু শুদ্ধ থাকলে শান্তভাবে মৃত্যুকে বরণ করা যায়!

জীবনে কতটুকু শুদ্ধ থাকলে শান্তভাবে মৃত্যুকে বরণ করা যায়!

সক্রেটিস হলেন উদাহরণ, বিচারের শেষ মুহূর্তে শাস্তি এড়াতে না পারলেও মৃত্যুদণ্ডকে এড়াতে পারতেন সক্রেটিস। তখন এথেন্সের বিচার ব্যবস্থায় অপরাধ চিহ্নিত হবার পর অপরাধীকে জিজ্ঞেস করা হতো, সে কী শাস্তি চায়। পাঁচশ’ জুরির উপস্থিতিতে সক্রেটিসকেও জিজ্ঞেস করা হলো, তিনি কী শাস্তি চান। কিন্তু যেহেতু তিনি নিজেকে অপরাধী মনে করতেন না, তার আচরণ ছিলো স্বভাবসুলভ অনমনীয়। তিনি শাস্তির পরিবর্তে পুরস্কারের প্রস্তাব করেন! উদ্বেগহীন সক্রেটিস প্রস্তাব করলেন, প্রাইটেনিয়াম হলে তাকে নিয়ে যেন বিশেষ এক ভোজের আয়োজন করা হয়। এটি প্রথাগতভাবে গ্রীসের বীরদের জন্য করা হতো। তাই জুরিরা ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন এবং বিপক্ষের জুরি সংখ্যা হঠাৎই ১৮০ থেকে ২২০ এ উঠে গেলো। বিচার নিয়ে ঠাট্টাকারী সক্রেটিসের জন্য কঠিন শাস্তির প্রস্তাব আসলো। মৃত্যুদণ্ড বা শাস্তি নিয়ে সক্রেটিসের উদাসীনতার এখানেই শেষ নয়। শিষ্য আর বন্ধুরা মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত সক্রেটিসের জন্য মৃত্যুদণ্ডের পূর্ব পর্যন্ত এক মাস পেরোলে মুক্ত রাখার আবেদন করেছিলেন। তাতে আদালত মুক্তিপণ হিসেবে ৩০০০ দ্রাকমা দাবী করে, কিন্তু সক্রেটিস মাত্র ১০০ দ্রাকমা দিতে রাজি হন। অতএব জেলেই থেকে গেলেন দণ্ডপ্রাপ্ত সক্রেটিস। ওদিকে সময় হয়ে এলো হেমলক পানের।

মৃত্যুর দিনের সন্ধ্যেবেলা সক্রেটিস তার শিশুপুত্র মিনেজেনাস কে বললেন, তুমি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। স্বাভাবিকভাবে হাসিখুশি এবং শান্ত সক্রেটিস। তাকে ঘিরে বসে আছেন তার ভক্ত শিষ্য ও বন্ধুরা। মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই তাদের গুরুর মৃত্যুর দৃশ্য মঞ্চায়িত হবে। সাক্ষী হতে হবে এক অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর। শিষ্যরা সকলেই হতাশা আর আসন্ন বিচ্ছেদের বেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে আছেন। ওদিকে সক্রেটিস তার মৃত্যুর পরের পোশাক গোছানো নিয়ে ব্যস্ত। তিনি পড়ে নিচ্ছেন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পোশাক, কারণ তিনি চান না মৃত্যুর পর কেউ তার গায়ে হাত দিক। শিষ্য আর বন্ধুদের কাছ থেকে কিছু সময় আলাদা হয়ে পরিবারের সকলের সাথে কথা বলে নিলেন।

জেল কর্মকর্তা একটু সময় আগে শেষ বিদায় জানিয়ে গেলেন। তার দু’চোখ ছিলো অশ্রুতে পূর্ণ। তিনি বলে গেলেন যে, সক্রেটিস ছিলেন তার অভিজ্ঞতায় শ্রেষ্ঠ আসামি, সবচেয়ে ভদ্র আর অসম্ভব সাহসী। কিছুক্ষণ পরই হেমলকের রসে পূর্ণ পাত্র নিয়ে প্রবেশ করলো জল্লাদ। তীব্র এই হেমলক হৃদপিণ্ডে গিয়ে পৌঁছে নিমিষে শরীরকে অসাড় করে দেয়। জল্লাদ নিরাবেগ কণ্ঠে বললো, এই পাত্রে এক ফোঁটা হেমলকও যেন বাইরে না পড়ে! সবটুকু পান করতে হবে! সক্রেটিস জল্লাদকে নিশ্চয়তা দিয়ে বললেন, একটি ফোঁটাও নষ্ট হবে না। তারপর তিনি কিছুক্ষণ প্রার্থনা করলেন। রুদ্ধ নিঃশ্বাসে সকলেই তাকিয়ে আছে সক্রেটিসের উদ্বেগহীন শান্ত মুখটির দিকে। মানসিকভাবে সকলেই অস্থির, একমাত্র সক্রেটিস ছাড়া। প্রার্থনা শেষ করে বিষের পাত্র তুলে নিলেন সত্তর বছরের সক্রেটিস। পান করে নিলেন সবটুকু হেমলক রস, এক নিঃশ্বাসে। বিকৃত মুখভঙ্গি দেখলেই বুঝা যায় কেউ বিষ পান করছে, কিন্তু সক্রেটিসকে দেখে তা বুঝার উপায় নেই। তার মুখ বিন্দুমাত্র বিকৃত হয় নি। জলপানের মতো পান করেছিলেন তিক্ত বিষ। উপস্থিত সকলে উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলেন। একজন শিষ্য মৃগীরোগীর মতো কাতরাচ্ছিলেন। সক্রেটিস তাকে কোলে নিয়ে চোখেমুখে জল দিয়ে সুস্থ করলেন।

পাষণ্ড জল্লাদ এবার দিলো তার নিষ্ঠুরতম নির্দেশটি। জল্লাদ বললো, এবার সক্রেটিসকে কিছুক্ষণ হাঁটাচলা করতে হবে যেন বিষটুকু ভালোভাবে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। শিউরে ওঠে শিষ্যরা না না ধ্বনিতে মুখর করে তুললো জেলকক্ষটি। ভাবলেশহীন সক্রেটিস তা-ই করলেন। নিজের জীবনের বিনিময়েও তিনি জল্লাদের দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা দিতে চান। তিনি উঠে পায়চারি করতে লাগলেন। একসময় নিস্তেজ হয়ে এলো তার পা যুগল। অসাড় হয়ে এলো তার বিশালাকৃতির শক্ত দেহখানি। নিজের হাতেই মুখ ঢেকে শুয়ে পড়লেন তিনি। এবার সবাই শান্ত, একটি শব্দও নেই কারও মুখে। কিছুক্ষণ সবই নিশ্চুপ, শান্ত। হঠাৎ মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে সক্রেটিস বললেন, ক্রিটো, একটি মুরগি ধার করেছিলাম আমাদের পরিবারের জন্য। মনে করে তা আসক্লিপিয়াসকে শোধ করে দিও। এই তার শেষ বাক্য, যেন শেষ মুহূর্তে নিজেই নিজের বিচার করছিলেন। তারপর সবকিছু আবারও নিশ্চুপ। আর কোন শব্দ হয়নি।

এর থেকেই বোঝা যায়, জীবনটা কতটুকু শুদ্ধ হলে এ’পাড়া থেকে ও’ পাড়ায় যাবার মতো করে পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়া যায়।

ঋণ স্বীকার :
প্লেটো’র ‘এপোলজি’ এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বরণীয় মানুষ স্মরণীয় বিচার।