রিয়া রিয়া এর সকল পোস্ট

আমি


আমি

মাঝেমাঝে চুপ করে বসে থাকি আমি আমার পাশে। আমার আমিকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত রুদ্ধ শ্বাসে; আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকি, জুড়ে নিই টুকরো হৃদয়। খুঁজে পাই ব্যর্থ ইতিহাসের পাতায় এক নতুন পরিচয়।

ব্যস্ত দিনের শেষে যখন চাঁদ নেমে আসে, ডুবে যায় মন তখন গল্প উপন্যাসে; তারাগুলো মিটিমিটি তাকিয়ে দেখে আমায়। পার করি সময় ওদের ভালবাসার অভ্যাসে।

বই থেকে চোখ খুলে দেখি চারিদিকে আবছা আলো। কল্পনায় সব-ই রঙিন কিন্তু বাস্তবে সব সাদাকালো। সব আশা, নিরাশাদের ঘুম পাড়িয়ে জেগে উঠি যখন, খুঁজে পাই আমাকে, পুরনো আমি, যেমন আছি এখন।

আমি তুমি

তোমার হাতেই আমায় দিলাম
যতন করে রেখো।
কোথাও যদি হারিয়ে ফেলো,
একটু খুঁজে দেখো,
তোমার হাতেই আমায় দিলাম
তোমার করে রেখো।

সাত সুরেতে আমার সাথে
সোহাগ পরাগ মেখো,
মনের ঘরে বুকের কোণে
ওম চাদরে ঢেকো,
তোমার হাতেই আমায় দিলাম
আদর করে রেখো।

পালক মেঘে নীলচে আলোয়
ফাগুন তুমি ডেকো,
উড়ো পাতার গুঁড়ো ঘ্রাণের
আতর তুমি মেখো,
তোমার হাতেই আমায় দিলাম
আপন করে রেখো।

চিকন গাছের পাতার ফাঁকে
আমায় তুমি দেখো,
আলতো মনের চিলতে কোণায়
একটু জায়গা রেখো,
তোমার হাতেই আমায় দিলাম
আমার হয়েই থেকো।

সকালবেলার আলোয় বাজে বিদায়ব্যথার ভৈরবী

সকালবেলার আলোয় বাজে বিদায়ব্যথার ভৈরবী

সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের দশমী তিথিতে দেবী কৈলাস পাড়ি দেন। সেই কারণেই ‘বিজয়া দশমী’ নাম। কিন্তু এই দশমীকে ‘বিজয়া’ বলা হয় কেন? তার পৌরাণিক ব্যাখ্যা খুঁজতে গেলে একাধিক কাহিনি সামনে আসে।

দুর্গা পূজার অন্ত চিহ্নিত হয় বিজয়া দশমীর মাধ্যমে। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, এই দিনেই পিতৃ-আবাস ছেড়ে দেবী পাড়ি দেন স্বামীগৃহ কৈলাসের দিকে। এই দিনেই তাই দেবীর প্রতিমা নিরঞ্জন করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই দিনটিকে ‘বিজয়া দশমী’ বলা হয় কেন? কোন ‘বিজয়’-কেই বা চিহ্নিত করে দিনটি?

পুরাণে মহিষাসুর-বধ সংক্রান্ত কাহিনিতে বলা হয়েছে, মহিষাসুরের সঙ্গে ৯ দিন ৯ রাত্রি যুদ্ধ করার পরে দশম দিনে তার বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করেন দেবী। শ্রীশ্রীচণ্ডীর কাহিনি অনুসারে, আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে দেবী আবির্ভূতা হন, এবং শুক্লা দশমীতে মহিষাসুর-বধ করেন। বিজয়া দশমী সেই বিজয়কেই চিহ্নিত করে।

উত্তর ও মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই দিনে দশেরা উদযাপিত হয়, ‘দশেরা’ শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত ‘দশহর’ থেকে, যা দশানন রাবণের মৃত্যুকে সূচিত করে। বাল্মীকি রামায়ণে কথিত আছে যে, আশ্বিন মাসের শুক্লা দশমী তিথিতেই রাবণ-বধ করেছিলেন রাম। কালিদাসের রঘুবংশ, তুলসীদাসের রামচরিতমানস, কিংবা কেশবদাসের রামচন্দ্রিকা-য় এই সূত্রের সঙ্গে সংযোগ রেখেই বলা হয়েছে, রাবণ-বধের পরে আশ্বিন মাসের ৩০ তম দিনে অযোধ্যা প্রত্যাবর্তন করেন রাম, সীতা ও লক্ষ্মণ। রাবণ-বধ ও রামচন্দ্রের এই প্রত্যাবর্তন উপলক্ষেই যথাক্রমে দশেরা ও দীপাবলি পালন করা হয়ে থাকে। আবার মহাভারতে কথিত হয়েছে, দ্বাদশ বৎসর অজ্ঞাতবাসের শেষে আশ্বিন মাসের শু‌ক্লা দশমীতেই পাণ্ডবরা শমীবৃক্ষে লুক্কায়িত তাঁদের অস্ত্র পুনরুদ্ধার করেন এবং ছদ্মবেশ-মুক্ত হয়ে নিজেদের প্রকৃত পরিচয় ঘোষণা করেন। এই উল্লেখও বিজয়া দশমীর তাৎপর্য বৃদ্ধি করে।

যাইহোক, তিথি অনুযায়ী দশমী হলেও। বাড়ির প্রতিমা, মন্দিরের প্রতিমা একটাও বিসর্জন হয় নি এখনও। ঢাক তো বলেই দিচ্ছে আজ “ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন।” আবার তো সেই এক বছরের অপেক্ষা।

যারা এখনই “শুভ বিজয়া” পাঠিয়েছেন তাদের বলি, একটু সবুর করুন বন্ধুরা, আমার বাড়ির প্রতিমা নিরঞ্জন না হওয়া পর্যন্ত আমি কাউকেই “শুভ বিজয়া ” জানাতে পারবো না। :)

শুভ নবমী

“যেও না নবমী নিশি লয়ে তারা দলে”
তুমি গেলে দয়াময়ী এ পরাণ যাবে।”

এটাই তো আমাদের সবার মনের একান্ত কথা হয় নবমীর দিনে। সারা বছর ধরে যে উৎসবের জন্য আমরা অপেক্ষা করে থাকি, তার বিদায় ঘন্টা বাজিয়ে দেয় এই নবমী নিশি। তাই নবমী নিশিকে আমরা সবাই ধরে রাখতে আকুতি জানাই। আমাদের সমস্ত তিথি-নক্ষত্র হিসাব করা হয় চন্দ্রের অবস্থান দেখে। সেই অনুযায়ী মাসের তিরিশ দিনকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে, পনেরো দিন করে। ভাগ দুটো হলো শুক্ল পক্ষ ও কৃষ্ণ পক্ষ। মহানবমী এই শুক্লা নবমী যাকে শাস্ত্রে বলে ‘উগ্রপদা’। কথিত আছে নবমী তিথিতে মানুষের নাকি উত্তেজনা বাড়ে অর্থাৎ মানুষের মধ্যে অপরাধের প্রবণতা বাড়ে, অশুভত্বের দিকে মানুষ এই তিথিতে বেশী ঝুঁকে যায়। কিন্তু, এই অশুভত্বকে বিনাশ করে শুভশক্তির জয়ের জন্য তাই এই মহানবমী তিথিকেই অন্য নবমী তিথির মধ্যে শুভ ধরা হয়। জপ, তপ, উপাসনা এইসব তাই এই তিথিতে বেশি করে করা হয়। তাই নবমী পূজা ও বলিদান পর্ব আছে। ‘বলি’ শব্দের অর্থ উৎসর্গ, ত্যাগ। আমাদের অহঙ্কার, কাম-ক্রোধ ইত্যাদি হলো স্বরূপ বোধের প্রতিবন্ধক। এগুলিকে বিসর্জন দেওয়াই বলির তাৎপর্য।
তন্ত্রশাস্ত্রে আছে —
“কামক্রোধৌ ছাগবাহৌ বলিং দত্ত্বা প্রপূজয়েৎ”।

অর্থাৎ কামক্রোধরূপী ছাগ ও মহিষকে বলি দেওয়া। এই পূজার ক্ষণটিতে মায়ের চরণে স্ব স্ব অন্তরে স্থিত চন্ডমুন্ডরূপ যেমন, কাম-ক্রোধকে বিসর্জন দিয়ে থাকেন।

শ্রীশ্রীচন্ডীতে আছে, মহারাজ সুরথ ও সমাধি বৈশ্য নদীপুলিনে দেবীর পূজা করে নিজেদের শরীর থেকে রক্ত নিয়ে বলি দান করেন বা উৎসর্গ করেন। জীবশরীরে রক্ত মূল্যবান বস্তু। তাকে দান অর্থাৎ আত্মনিবেদন করলেন। এই পূজার শেষ পর্যায়ে হয় ‘হবন’ বা যজ্ঞ। দেবীর সামনে তাঁর নামে অগ্নিস্থাপন করে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। কিন্তু যজ্ঞ হলো একটি সম্পূর্ণ পৃথক পূজা। আগে যেমন প্রতিমাতে, ঘটে যে পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল তারই অনুষ্ঠান এখন অগ্নিতে অর্থাৎ যজ্ঞে। বৈদিক যুগের অনুকল্প হিসাবে এই কার্য হয়ে থাকে। অগ্নিকে সাক্ষী রেখে কল্পারম্ভে সঙ্কল্পিত কার্যের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

নবমীর বিশেষত্ব যদি কিছু থাকে তা হল এই হোম-যজ্ঞ অনুষ্ঠানের মধ্যে নবমীতেই মূলত হোম হয়ে থাকে, ব্যতিক্রমী নিয়মও থাকতে পারে। মূলত আঠাশটা বা একশো আটটা নিখুঁত বেলপাতা লাগে। বালি দিয়ে যজ্ঞের মঞ্চ বানিয়ে বেলকাঠ ঠিকভাবে নিয়মমতো সাজিয়ে পাটকাঠি দিয়ে আগুন ধরিয়ে ঘি’তে চুবিয়ে বেলপাতাগুলো নিবেদন করা হয়। তারপর সবার শেষে একটি কলা চেলীতে বেধে পান নিয়ে সেটা ঘি’তে চুবিয়ে পূর্ণাহুতি দেওয়া হয়। তারপর তার মধ্যে দই দেওয়া হয় ও দুধ দিয়ে আগুন নেভানো হয়।

আমার মনে হয় দুর্গামূর্তির মধ্যে এক রাজকীয় ভাব আছে, ছেলেমেয়ে (জানি তারা কেউই তার নিজের সন্তান নয় ) সবাইকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক যোদ্ধা, যিনি রূপং দেহি, যশং দেহি,আবার একজন সাধিকা, আমাদের সকলের কল্যাণকারি, আমরা যাকে মা বলি। এই মৃন্ময়ী মুখে তাঁর চিন্ময়ী রূপ দেখে মায়া হয়। মনে হয় আমাদের ঘরের মেয়ে। আমরা যতই নবমী তিথিকে বিদায় দিতে না চাইনা কেন, সে তো যাবেই। শুধু আমাদের মন বলে যাবে …

“ওরে নবমী নিশি ! না হৈওরে অবসান।
শুনেছি দারুণ তুমি, না রাখ সতের মান।।

শুভ নবমী।

শুভ অষ্টমী

আজ অষ্টমী পূজা, আজ সক্কাল সক্কাল স্নান সেরে নতুন পোশাক পরে অঞ্জলী দেবার দিন। যদিও অঞ্জলী সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত দেওয়া যায়!

অঞ্জলি:
অষ্টমী মানেই কিন্তু পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া নতুন জামাকাপড় পড়ে। স্নান করে শুদ্ধ বস্ত্রে ঠাকুরের সামনে তিনবার হাতে গঙ্গাজল নিয়ে আচমন করে এবার হাতে ফুল নিন ও তিনবার পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র পড়ে ঠাকুরের চরণে তা প্রদান করুন। এবার প্রণাম মন্ত্র অর্থাৎ “ওঁ সর্বমঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ সাধিকে, শরণ্যে ত্রম্ব্যকে গৌরী নারায়ণী নমস্তুতে” ইত্যাদি বলে অঞ্জলি শেষ করে মায়ের পায়ে ফুল দিতে হয়।

কুমারী পুজো:
সকল মেয়েই মা দুর্গার অংশ, তাই মৃন্ময়ী প্রতিমাকে পুজো করার পাশাপাশি কম বয়সের ছোট মেয়েদেরও পুজো করা হয়। পৌরাণিক কাহিনি অনুসরণে কুমারী পূজার উদ্ভব হয় কোলাসুরকে হত্যার মধ্য দিয়ে। উল্লেখ্য, কোলাসুর নামক অসুর এক সময় স্বর্গ-মর্ত্য অধিকার করে নেয়। ফলে বিপন্ন দেবরা মহাকালীর শরণাপন্ন হন। দেবতাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে দেবী মানবকন্যা রূপে জন্মগ্রহণ করেন কুমারী অবস্থায় কোলাসুরকে হত্যা করেন। এই সূত্রে কুমারী পূজার প্রচলন হয়।

বেলুড় মঠে স্বামী বিবেকানন্দ প্রথম কুমারী পূজা করেন ১৯০১ সালে। ষোলো বছরের মেয়ে পর্যন্তই কুমারী হিসাবে পুজো করা যায়। একটি মেয়েকে প্রথমে আমন্ত্রণ করে তাকে শাড়ি ও গয়না উপহার দিতে হয়। সেই শাড়ি ও গয়না তাকে পড়িয়ে মাতৃমূর্তির সামনে এনে উঁচু আসনে বসাতে হয়। কুমারীর পা জল দিয়ে ধুয়ে দেওয়া হয়। তারপর তার পূজা শুরু হয়। তাকে মিষ্টান্নাদি নৈবেদ্য প্রদান করা হয়। তার উদ্দেশে অঞ্জলি দেওয়া হয়। এইদিন ওই কুমারীকে দেবী দুর্গার রূপ হিসাবেই ধরা হয়।

বয়সের ক্রমানুসারে পূজাকালে এই সকল কুমারীদের বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। যেমন:
এক বছরের কন্যা – সন্ধ্যা
দুই বছরের কন্যা – সরস্বতী
তিন বছরের কন্যা – ত্রিধামূর্তি
চার বছরের কন্যা – কালিকা
পাঁচ বছরের কন্যা – সুভগা
ছয় বছরের কন্যা – উমা
সাত বছরের কন্যা – মালিনী
আট বছরের কন্যা – কুষ্ঠিকা
নয় বছরের কন্যা – কালসন্দর্ভা
দশ বছরের কন্যা – অপরাজিতা
এগারো বছরের কন্যা – রূদ্রাণী
বারো বছরের কন্যা – ভৈরবী
তেরো বছরের কন্যা – মহালপ্তী
চৌদ্দ বছরের কন্যা – পীঠনায়িকা
পনেরো বছরের কন্যা – ক্ষেত্রজ্ঞা
ষোলো বছরের কন্যা – অন্নদা বা অম্বিকা

শ্রীরামকৃষ্ণের মতে— সব স্ত্রীলোক ভগবতীর এক একটি রূপ। শুদ্ধাত্মা কুমারীতে ভগবতীর বেশি প্রকাশ। দুর্গাপূজার অষ্টমী বা নবমীতে সাধারণ ৫ থেকে ৭ বছরের একটি কুমারীকে প্রতিমার পাশে বসিয়ে পূজা করা হয়। চণ্ডীতে বলা হয়েছে:
যা দেবী সর্বভূতেষু
মাতৃরূপেণ সংস্থিতা
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তসৈ নমঃ নমঃ

সন্ধি পুজো:
মা দুর্গার আরেক রূপ হল মহিষাসুর-মর্দিনী। মহিষাসুর মর্দিনী অর্থাৎ তিনি এই অসুরের নিধন করেছিলেন। কিন্তু দুর্গা পুজোর পিছনে আরো অসুরবধের কাহিনী আছে, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সন্ধিপূজা। অষ্টমী শেষ হয়ে যখন নবমী তিথি শুরু হয়ে তখন সন্ধিপূজার মাধ্যমে মায়ের আরাধনা করা হয়। এই সন্ধিপূজা হল সেই সন্ধ্যার প্রতীক যখন মা দুর্গা চন্ড ও মুন্ড নামে দুই ভয়ঙ্কর অসুরকে বধ করেছিলেন।মূলত অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিস্থলে অর্থাৎ অষ্টমী শেষ হবার ২৪ মিনিট ও নবমী শুরু হবার ২৪ মিনিট এই সময়ের মধ্যে এই পূজা হয়। এই সময়ে মূলত দেবী চামুন্ডার পূজা করা হয়। এই পূজাতেই ১০৮ টি পদ্মফুল দেবীকে উৎসর্গ করা হয়। এর মূলে রামায়ণের কাহিনী আমরা সবাই জানি। রাবণ বধের জন্য রাম ১০৮ পদ্ম দিয়ে দেবীর পূজা করেন ও তারপর রাবণ নিধন হয়। সেই সূত্রেই এই সন্ধি পূজা করা হয়। দেবীর সামনে নানা রকম খাদ্যদ্রব্য কাঁচা অবস্থায় এবং রান্না করা ভোগ হিসাবেও রাখা হয়। ১০৮ টি মাটির প্রদীপ দেবীর সামনে জ্বালানো হয়।

কোনো কোনো জায়গায় এই দিন বলিও দেওয়া হয়। বলি হিসাবে পশুবলি নিয়ে অনেক নিষেধাজ্ঞা জারি আছে বলেই আঁখ, চালকুমড়ো এইসব বলি হিসাবে প্রদত্ত হয়।কোনো বছর অষ্টমী, নবমীর সন্ধিক্ষণ রাত ৮টাতেও হতে পারে আবার কোনো বছর ভোররাতেও হতে পারে। সেই সময় দেবীর গাত্রবর্ণ বা গায়ের রঙ ছিল স্বর্ণাভ বা সোনালী এবং তিনি হলুদ শাড়ি পরে অবতীর্ণ হন। তাঁর দশ হাত সজ্জিত ছিল দশ ধরণের অস্ত্রে। যখন মহিষাসুরের সঙ্গে ভয়ানক যুদ্ধে তিনি ব্যস্ত, সেইসময় মহিষাসুরের দুই বন্ধু চন্ড এবং মুন্ড পিছন থেকে দেবীকে আক্রমণ করে। রণনীতির চুক্তি ভঙ্গ হওয়ায় দেবী অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হন এবং রাগে তাঁর মুখ নীল হয়ে যায়। দেবী তাঁর ত্রিনয়ন উন্মীলিত করেন এবং চামুন্ডা রূপ ধারণ করেন। ঘনীভূত রক্তের কালীরই অন্য রূপ হল চামুন্ডা রূপ। চামুন্ডা রূপে দেবী দুর্গা চন্ড এবং মুন্ডের মাথা কেটে নেন তাঁর হাতের খড়গ দিয়ে। দেবীর এই চামুন্ডারূপেরই আরাধনা করা হয় সন্ধি পূজার মাধ্যমে।

শুভ অষ্টমী।

আত্মমর্যাদা

আত্মমর্যাদা

Self Dignity বা আত্মমর্যাদা বোধ শব্দটির সাথে আমরা সবাই কম বেশি পরিচিত। তবে আমাদের ব্যক্তিগত বা সামাজিক জীবনে এর গুরুত্ব কতখানি তা হয়ত অনেকেই অনুমান করতে পারিনা। আত্মবিশ্বাস এমন একটি ব্যাপার যা প্রথমে নিজের ভেতর উপলব্ধি করতে হবে। যখন আপনি নিজে নিজেকে আত্মবিশ্বাসী ভাবতে পারবেন কেবল তখনই নিজেকে আত্মবিশ্বাসী হিসেবে উপস্থাপন করতে পারবেন। কিছু আলোচনা :

১. আপনি কোন এক অনুষ্ঠানে গেলেন, আর আপনার কোন এক আত্মীয় বললো ‘তুই না একদম বোকা আর পরনির্ভরশীল।’ আর আপনি এই কথা শুনে নিজে তো কোন প্রতিক্রিয়া দেখালেনই না, উল্টো চুপচাপ বিশ্বাস করে ফেললেন কথাগুলো সত্যি। খুব হীনমন্যতায় ভুগতে লাগলেন, অসহায় বোধ করতে লাগলেন। ভেবে ভেবে হয়রান হয়ে গেলেন, আপনি আনস্মার্ট, বোকা, পরনির্ভরশীল। শুধু এটুকুই ভাবলেন না, আদৌ আপনি সেরকম কি না। খেয়ালই করলেন না, নিজের অজান্তেই কখন যেন আপনাকে বিচার করবার অধিকারটুকুও তাকে দিয়ে দিয়েছেন বুঝতেই পারলেন না। তাহলে এই ‘আমি’ যদি পরিপূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে সবার সামনে না দাঁড়াতে পারি, নিজেকে সবসময় পরনির্ভরশীল ভাবতে থাকি, তার জন্য দায়ী কে? এই আমিই।

মনে রাখবেন প্রতিটি জীবন এক একটা লড়াই। কারো বেশি, কারো কম। হয়তো আপনার লড়াই ভীষণ ছোট থেকেই, প্রতিকূল আবহে লড়াই করে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। কখনো অন্যায়ের সাথে আপোষ করেন নি। তার জন্য কখনোই আপনি সব্বাইকে ডেকে ডেকে বা স্বল্প পরিচয়ে বলতে যাবেন না আপনার জীবনের লড়াইয়ের গল্প। এতে আপনি করুণার পাত্র হবেন। আপনাকে দেখে, বা আপনার সাথে কথা বলে কখনোই যেন কেউ আঁচ না করতে পারে আপনার জীবনের ব্যক্তিগত কথা। দৃঢ় মানসিকতার হোন। আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছাড়া কখনোই কাউকে বুঝতে দেবেন না আপনার ব্যক্তিগত জীবন। আপনাকে যারা সত্যিই জানবে তারা করুণা নয় রেসপেক্ট করবে আপনাকে।

To hide feelings when you are near crying is the secret of dignity.

২. ছোটবেলা থেকেই কিন্তু আমরা অন্যের দেয়া সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত হয়ে অভ্যস্ত। এই যেমন ছোটবেলায় কাউকে যদি বলা হয় ‘তুই দেখতে ভাল না’ ‘ইশ তুই কালো, মোটা’। সে কিন্তু নিজেকে ভাল করে আয়নায় দেখেও না, অন্ধের মত বিশ্বাস করে ফেলে- সে সুন্দর নয়। কেউ যদি বলে ফেললো, ‘তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না’- ব্যস, ওটাই বানিয়ে ফেলি জীবনের একমাত্র বিশ্বাস, কোনদিন হয়ত কিছু একটা করে দেখানোর চেষ্টাও করিনা। আমার অমূলক ঐ বিশ্বাসটা কখন যেন আমার চিন্তাটাকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেছে, বুঝতেই পারিনা। নিজের চারপাশ দেখুন। আপনি এই বিশ্বের উৎকৃষ্টতম সৃষ্টি না হলেও নিকৃষ্টতমও নন। আপনি একজন সুস্থ্য স্বাভাবিক মানুষ এবং কারো না কারো চোখে অবশ্যই আপনি সুন্দর। কেউ আপনার শারীরিক সীমাবদ্ধতা নিয়ে ব্যাঙ্গ করলে পাত্তা দেবেন না। নিজের সৌন্দর্য আবিষ্কার করুন। আর আয়নায় নিজেকে দেখুন এবং মনে মনে বলুন :

May be I am not the best but certainly I am not the worst.

৩. কেউ আপনার মন ভেঙেছে ? কেউ আপনার প্রেম নিয়ে খেলছে? কেউ আপনাকে ঠকাচ্ছে? কখনই নিজেকে দোষারোপ করবেন না। মনে করুন যে যাবার সে চলে যাবেই। কিংবা ধরুন যে আপনার প্রেম, ভালবাসা নিয়ে খেলছে, প্রতিদিন আপনাকে মিথ্যে বলে ঠকাচ্ছে। তার জন্য মন খারাপ করবেন না। আবর্জনা আমরা আবর্জনার স্তুপেই ফেলে রাখি, তার অবস্থান ও সেইরকম জায়গায় রাখুন। জানবেন যে আপনাকে সত্যিই ভালোবাসে সে কখনোই আপনাকে ছেড়ে যাবেনা। শত ঝড় ঝঞ্ঝাতেও সে আপনার হাতই ধরে থাকবেন। আর যে চলে গেছে, বা প্রতারণা করছে, জানবেন, তার আপনাকে গ্রহণ করার মত ক্ষমতা-ই নেই। সে ভালোবাসা বোঝেই না। তাই যতটুকু ভালবাসা আপনার হৃদয়ে রয়েছে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোথাও আপনার জন্যও ততটা ভালোবাসা জমা রয়েছে। নিশ্চয়ই আপনি সে ভালবাসার সন্ধান পাবেন। তাই সারাদিনের শত ব্যস্ততার মধ্যেও নিজেকে সময় দিন। নিজেকে ভালবাসুন। নিজেকে গভীরভাবে ভালবাসুন-শুধু আপনি যেমন, আপনি যা-সে জন্য। তাই নিজের সম্পর্কে উচ্চতর ধারণা, নিজেকে নিঃশর্ত ভাবে ভালবাসা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় আমাদের জীবনে। মনে রাখবেন :

The best kind of people are the ones that come into your life and make you see sun where you once saw clouds. The people that believe in you so much, you start to believe in you too. The people that love your simply for being you. The once in a lifetime kind of people.

৪. নিজের কাজের ইতিবাচক সমালোচনা করুন, ভিতরের নেতিবাচক স্বত্বাটাকে গুরুত্ব কম দিন। দিনে যাই ভাল করুন না কেন, ধন্যবাদ দিন নিজেকে তার জন্য। আপনি নিজেকে কি কারণে ভালবাসেন, তা লিখে রাখুন প্রতিরাতে ঘুমোতে যাবার আগে। মাস শেষে যখন পড়বেন সবগুলো একসাথে, দেখবেন নিজের সম্পর্কে অনেক ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়ে গেছে। অন্যকে খুশি করার দরকার আছে, কিন্তু সারাদিনে অন্তত একবার এমন কিছু করুন, যা আপনি করতে সত্যিই ভালবাসেন। যে কাজটি আপনি করবেন, সম্পূর্ণ আপনারই জন্য, আপনার আত্ম উপলব্ধির জন্য।
সবকাজে সবটুকু সাফল্য আসবেই-এমন ধারণা থেকে বেরিয়ে আসুন। বরং নিজের ভুল গুলোকে শুধরিয়ে সেগুলোকে যৌক্তিক দিক থেকে বিশ্লেষণ করুন। নিজেকে ক্ষমা করতে শিখুন। আর একবার যদি এটা করতে পারেন, তবে নিজেকে প্রশংসা করতে ভুলবেন না কিন্তু। জানবেন :

Nothing is more important than how YOU feel and think about yourself.

৫. অন্যের সাথে নিজেকে তুলনা করার প্রবণতা থেকে থাকলে তা আজই বাদ দিন। আমরা একেকজন মানুষ একেকরকম, সবার ই আলাদা আলাদা ইতিবাচক আর নেতিবাচক দিক আছে বলেই মানুষ বৈচিত্র্যময়। তাই না? আরেকজন জীবনে কি পেল, আমি কি পেলাম না, আরেকজন কি হল আমি কি হলাম না, বা তার জীবনে কি আছে আমার কি নেই, এসব চিন্তা মাথায় আনার আগে একটিবার ভেবে দেখুন, আপনি কি পেয়েছেন, আপনি কি হয়েছেন আর আপনার কি আছে। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখুন, এবং আপনি যা, তার জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করুন। নিজের প্রতি সম্মান দেখানোর এটা শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। মনে রাখবেন, আপনার জীবন নামক এই গাড়িটার stearing কিন্তু সম্পূর্ণ আপনারই হাতে। তাই আজ থেকেই শুরু হোক, নিজের মত করে নিজেকে ভালবাসা, অনুভব করা আর সম্মান করা। সুতরাং অন্যের সাথে নিজেকে তুলনা করে আফসোস করবার বদলে চেষ্টা বাড়িয়ে দিন। সর্বোপরি, নিজের চরিত্রের সবল দিকগুলো চিহ্নিত করুন। ভুল থেকে শিক্ষা নিন এবং যা চলে গেছে তার জন্য অনুশোচনা রাখবেন না। মনে রাখবেন :

Politeness is a sign of dignity, not subservience.

_______________

তুই যে আমার সই

তুই যে আমার সই

আকাশগঙ্গার পথটা ধরে
আসবি কখন তুই?
দুর্গা নামেই ডাকে সবাই
তুই যে আমার সই।

দিগন্ত ওই মিশছে যে দেখ
সবুজ মাঠের ধারে
চলনা ওদের মিলন দেখি
লুকিয়ে ঝিলের পাড়ে।

ছাতিম ফুলের গন্ধে যে
উথাল পাথাল মন,
আয়না চলে আমার বুকে
সই, আমার কথা শোন।

আকাশ লাজে রাঙা
দেখ গোধূলির প্রেমে
ও সই, তোর হাতটা ধরে
চাঁদ ও আসুক নেমে।

শহর ও গলছে রে দেখ
উদাসী দুপুর
কৈলাস ছেড়ে আয় না চলে
বাজিয়ে নুপুর।

পদ্ম পাতায় খেলবো রে
সই, সাপ মই এর খেলা
শরৎ এলো, আয় চলে তুই
আর করিস না বেলা।।

স্মৃতির সরণি

স্মৃতির সরণি

মহালয়া চলে গেলো। পিতৃপক্ষের শেষ, দেবীপক্ষের শুরু। এইদিন পুর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে জল দিতে হয়, সারা বছর তারা তৃষ্ণার্ত থাকেন। কিন্তু মাতৃকুলের কি জল তেষ্টা পায় না? তাদের জল দেওয়ার রীতি নেই। আমি যেহেতু সৃষ্টি ছাড়া, নিয়মের তোয়াক্কা করি না। আমি জল দিই। তিনজনকে। তাদের মধ্যে দুজন মহিলা একজন পুরুষ। মহালয়ার দিন সারাদিন মন খারাপের ঘর বাড়ি হয় আমার ভেতর প্রতি বছর। যে পুরুষের উদ্দেশ্য আমি সক্কাল সক্কাল স্নান করে জল দিই তার জন্য।

তিথি অনুযায়ী মহালয়ার ঠিক দুদিন পরেই আমার জন্ম। অর্থাৎ দেবীপক্ষে। সেই সময় বাড়িতে আমার নাম রাখা নিয়ে হুলুস্থুল পড়ে যায়। তারপর রিয়া নামই বেছে নেওয়া হয়। মহালয়ার দিন নানান স্মৃতি ভীড় করে আসে। আমাদের একটা দেশলাই বাক্সের মতো বড় কাঠের রেডিও ছিলো। বাড়িতে তখনও টেলিভিশন আসে নি। একান্নবর্তী পরিবার ছিলো আমাদের। সব কিছুই নিয়মমতো। মহালয়ার আগে বাড়ি ঘর পরিষ্কার করা হতো। নতুন রং করা হতো। আমাদের এখনকার মতো যখন তখন জামা কেনা হতো না। পয়লা বৈশাখ আর পুজো বছরে এই দুবার নতুন জামা কেনা হতো। জেঠু, বাবা কাকাই তিনজন তিন রকম জামা দিতো। মহালয়ার আগের দিন রেডিও ঠিকমতো বাজছে কিনা দেখে নেওয়া হতো। দাদুর ঘরে ছিলো ওই রেডিও। রাতের বেলা বড়মা দাদুকে বলে রাখতেন “বাবা একটু জোরে চালাবেন রেডিও, যাতে আমরাও শুনতে পাই।”

যে পাড়ায় আমি বড় হয়েছি, সেখানে তখনও হিন্দু মুসলিম মিলে মিশে উৎসব করতো। এখনের কথা বলতে পারবো না। দীর্ঘ ১৮ বছর আমি শিকড়হীন। অর্থাৎ সেই পাড়া ছেড়ে এসেছি। আমরা কখনও ঘড়িতে এলার্ম দিতাম না। ছোটথেকেই জানতাম ভোরের আজানের সময় ঘুম থেকে উঠে পড়তে হবে, কারণ মহালয়া শুরু হবে। যেহেতু আমি দাদুর কাছেই ঘুমোতাম তাই খুব ছোটবেলায় অতো ভোরে দাদু জোরে রেডিও চালালে, আমার ঘুম ভেঙে যাওয়ার জন্য তুমুল কান্না জুড়ে দিতাম। “যেখান থেকে পারো আমার ঘুম এনে দাও।” বড়মা বলতেন “কাঁদিস না, একটু সকাল হলেই জেঠু ঘুম কিনে নিয়ে আসবে। ততক্ষণ কাকাইয়ের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। ওদিকে আওয়াজ যাবে না।” আমিও একরাশ বিরক্তি ভরা মুখ নিয়ে ওপরে উঠে গেলাম। কাকাই দরজা খোলা রাখতো, কারণ প্রতি বছর তো একই গল্প। আমি কাঁদতে কাঁদতে ওপরে উঠবো। কাকাই আমাকে রিয়া বলে ডাকতো না, একটা বিশেষ নামে ডাকতো। কাকাই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো আর আমি ঘুমিয়ে পড়তাম।

পুজোর আগে নতুন জামা কাপড়ের মতোই নতুন শ্যাম্পু সাবান, পারফিউম কেনা হতো। সারা বছরের শ্যাম্পু, সাবানের সাথে ওই শ্যাম্পু, সাবানের মিল থাকতো না। ওগুলোর মধ্যে কেমন একটা পুজো পুজো গন্ধ মিশে থাকতো। আমাদের বাড়িতে ষষ্ঠী, অষ্টমী আর দশমীর দিন নতুন জামা পরার রীতি। সেদিন সকাল সকাল স্নান করে নতুন জামা পরে মাঠে খেলতে চলে যেতাম। সেই সময়ে পুজোর জন্য HMV থেকে আলাদা গানের রেকর্ড বেরোতো। সেইসব গান পাড়ার প্যান্ডেলে বাজতো। একটা অদ্ভূত আনন্দে মন ভরে থাকতো। কিশোর কুমার, মহম্মদ রফি, মান্না দে, হেমন্ত, গীতা দত্ত, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখার্জী, ওই সময়ের সমস্ত গায়ক গায়িকা পুজোর গান রেকর্ড করতেন। সেইসব গান আজ মনকেমনিয়া।

পুজো আজও আসে। জামাকাপড় এখন দেওয়ার লোক কমে গেছে, নিজে নিজেই কিনি। পুজোর ঠিক এক মাস আগে বাবা ফোন করে জানতে চাইবেন “এইবার পুজোতে কি কি শাড়ি উঠেছে রে।” কখ‌নো বাবার কাছে কিছু চাই নি। আজও বলি তুমি জেনে কি করবে? বাবা বলেন দিতে হবে না, মা, বড়মা, কাকিমা, বোনদের, তাই জেনে নিই। উত্তরে আমি বলি, আমি সবার জন্য কিনে ফেলেছি বাবা, তোমাকে আর কিনতে হবেনা। তুমি তাঁত কিনে দিও সবাইকে। অঞ্জলি দেবে তাঁত পরে। বাবা হা হা করে হেসে ওঠেন। হয়তো বোঝেন যে রিটায়ার করেছেন বলে তার মেয়ে তাকে বেশি খরচ করতে দিতে চায় না। একদিন নাতি নাতনীদের নিয়ে তিনি বেরোন, যার যা পছন্দের কিনে নিতে বলেন। রিতিকা আমার মতোই, বলে দাদাই মা তো অনেক কিছু কিনে দিয়েছে তোমাকে আর কিছু দিতে হবেনা। বাবা বলে ওঠেন বড় হয়েছিস বুঝি?

পুজো এখনও আসে, সাথে ছোটবেলার সেই আনন্দ আর ফিরে আসে না। এখন সব কিছুই রোবটের মতো। হয়তো বড় বেশি যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি আজকাল।

মুক্তগদ্য: অচেনা পৃথিবী

অচেনা পৃথিবী

আজ আবার নির্ঘুম রাত। গানে গানে কেটে যাচ্ছে আর সাথে প্রিয় উপন্যাস। পৃথিবী চলেছে নিজের গতিতে। নদীকে পৌঁছে দিতে সাগরে। আজ তবে পৃথিবীর জরিমানা হোক। কেন সে সব নদীর হাত নিয়ে, সাগরের হাতে দেয়? কেন সব মন চুরি করে মেঘ হয়ে উড়ে যায় আকাশে? আর কেনই বা ঘাসেদের সব রঙ চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢেলে দেয় শিশিরে? তাই আজ পৃথিবীর জরিমানা হোক।

দূরে কোন রাতপাখির ডানার আওয়াজ। উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেকটা রাতে এসে মগজে ঘুরপাক খায় ভুলে যাওয়া কষ্টেরা। চলতে চলতে চেনা হয় আরেকটা অচেনা পথ। পুরনো পৃথিবীকে ঘিরে নেয় নতুন এক গান।

পৃথিবীর যত সব আবদার, দাবি কেড়ে নেওয়া হোক। সব তারা কেন আকাশের চুলে সাজায়? আর সব কষ্ট ভুলে গিয়ে কোন ফাঁকে মন খুঁড়ে, ভালোলাগা পুঁতে যায়? ঘাসেদের ফুলে ফুলে আলগোছে রামধনু কেন রং ছেপে দেয়? তাই আজ পৃথিবীর যত সব আবদার কেড়ে নেওয়া হোক।

চারিদিকে জলপাই আলোর মিছিলে শীতের আমেজ। আর রয়েছে নরম তুলোর বলের মতো আদুরে ইন্তি-বিন্তি বেড়াল ছানা। কুচিকুচি চোখ তুলে নিমেষে আদরের আবদার। ঘোলাটে দৃশ্যে দিন শুধু বেড়ে যায়। বড্ডো বেশি ভিড় যেন চারিদিক, নিঃশ্বাসে ভরে যায় বাতাস, উত্তাপ।

তবে পৃথিবীর মজলিশ বেঁধে দেওয়া হোক। রোজ কেন ভোর হলে পাখিদের কাকলিতে বাঁশিসুর ঢালা চাই? আকাশের কোণ ধরে রোজ রোজ কেন সোনালি রঙে আঁচল ছড়ায়? হাওয়ার কানে কানে বৃষ্টির ডাক-কেন লিখে দেয়? তাই আজ পৃথিবীর মজলিশে বাঁধা দেওয়া হোক।

ইতিহাস ঘুরে ঘুরে আসে, আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতি হারে। মনে হয় এই বুঝি ফাঁকি দিয়ে এগিয়েছে অনেকটা পথ, মূহুর্তে ভুল ভাঙে। আরবার ফিরে আসা একই বিন্দুতে, বৃত্তের কেন্দ্রে। ব্যাসার্ধ ছোট থেকে বড় হয় অথবা বড় থেকে ছোট। লুকিয়ে রাখে সবটুকুই। এই লুকানো একলা পৃথিবীকে বুঝে নিক আবরে সবরে, গল্পে, গল্পে। যদিও গ্রহণের শেষে সবটুকু ক্ষয়।

পৃথিবীর সব ভালো মুঠো মুঠো ছাই হয়ে যাক। কেন রোজ ভোর পাখিদের পালক চিনে হাওয়ায় ভেসে আসে? মাঝে মাঝে চিনচিনে ব্যাথা হয়ে কেন তারা জ্বালে রোজ সাঁঝ আকাশে? কেন জলপরী ডুব দেয় সাগরের ঢেউ ঘেঁষে? তাই আজ পৃথিবীর সব ভালো মুঠো মুঠো ছাই হয়ে যাক।

পৃথিবী ক্লান্ত হয়ে স্থির হয়ে থাক। কেন আকাশ ধুয়ে জল নামে পৃথিবীর চোখ। চোয়ালের কোনা ঘেঁষে বড় বেশি জেদ স্থির হয়। মগজের কোষে কোষে জন্ম নেয় মেঘ। জন্মান্তরের দোষে পুড়ে যায় শরীর। সন্ধ্যের নরম আলোয় চোখে পথে নামে সন্ন্যাসি গৈরিক আভা। পৃথিবী ক্লান্ত হয়।আজ তাই পৃথিবী পথ ভুলে যাক।

মিথ … দ্বিতীয় খণ্ড শেষ

২.
একটা ভালো উদাহরন হলো ট্রয় নগরী, যাকে ঘিরে ঘরে উঠেছে হোমারের ইলিয়াড। অনেক অনেক বছর ধরে এই শহরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়, বলা হয় এটা শুধুই কল্পনা, শুধুই মিথ। ১৮৬৮ সালে আসলেই এই শহর খুঁজে পাওয়া যায়। এঁকে তখন স্থান দেওয়া হয় ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু এর পরেও ইলিয়াডকে ধরা হয় ফিকশন হিসেবে, ফ্যান্টাসি হিসেবে, মিথ হিসেবে।

আমরা এটাই জানলাম, যে অনেক পুরনো বলেই মিথ, মিথ্যে নয়। প্রমাণের অভাব থাকলেই মিথ, মিথ্যে নয়। মিথের মাঝে লুকিয়ে থাকা অনেক গল্পই আসলে সত্যি হতে পারে। এটা অবশ্য খুবই সম্ভব যে মিথ বলে প্রচলিত অনেক লোককথা আসলে মানুষের তৈরি কল্পনা। অপার বিস্ময়ের এই সৃজনশীল কল্পনা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে ডিভাইন কমেডি, ইলিয়াড, ওডিসি, রামায়ণ, মহাভারত, ইত্যাদি। এ এক অসাধারণ মিথের সমাবেশ।

কিন্তু বাস্তবে চিন্তা, দর্শন, বিজ্ঞান তৈরী হয় স্থান, কাল তথা তার সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, আবহাওয়া ও সভ্যতার ভিত্তিতে। স্থান, কাল পাত্র ভেদে চিন্তার ধরনও আলাদা আলাদা হয়। এগুলো অর্জন করতে হয় জীবন থেকে, সমাজ থেকে, পারিপার্শ্বিকতা থেকে। পারিপার্শ্বিকতা মানুষকে শেখায়। প্রকৃতির সাথে তার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। প্রকৃতির অপার দান থেকে কিছু পাওয়ার জন্য যাযাবর জীবনের বিলুপ্তি ঘটিয়ে যখন কৃষি সভ্যতার পত্তন হয় তখন থেকেই শুরু হয় অবসর আর সৃষ্টির প্রতি অপার কল্পনা ও বিস্ময়। জীবন ও সময়ের প্রয়োজনে এই মিথ মানুষকে জানিয়েছে, অতীত ইতিহাস, মানুষকে আরও ভাবতে শিখিয়েছে। আর বাস্তবের মুখোমুখি হতে হতে মানুষ বিজ্ঞানকে ভাবতে শিখেছে। তখন বিজ্ঞান ও ধর্মদর্শনকে এরিষ্টটলের সামগ্রিক চিন্তার মোড়কে ভাবা হত। ধীরে ধীরে চিন্তার বিকাশ ঘটেছে, বিকাশ ঘটেছে জীবনদর্শন ও বিজ্ঞানের। এরিষ্টটলকে বলা হয় Father of science, ইবনে সীনাকে বলা হয় আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক, কবি হয়েও ওমর খৈয়াম ছিলেন একজন প্রতিথযশা বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানী আইনষ্টাইন বলেন, Science is lame without religion and religion is blind without science.

মহাকবি হোমারের সময় থেকেই গ্রীসের মিথলজিই সবচেয়ে বিশদ, ব্যাপক এবং জনপ্রিয়। তারও কিছু পরে মিথ স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ হয়। কিন্তু গ্রীসে মিথের শক্তি ও প্রভাব দুর্বল হয়ে আসে যুক্তিনির্ভর দার্শনিক আলোচনার অগ্রগতির সাথে প্যাগান ধর্মের ক্ষয় শুরু হওয়ায়। যুগে যুগে মিথের প্রতি মানুষের আগ্রহ ও বিশ্বাসের অন্যতম কারণ হচ্ছে প্রাকৃতিক নানা ঘটনাবলী সম্পর্কে জানার অসীম আগ্রহ। ব্যাখ্যাতীত ঘটনাগুলো সম্পর্কে ভাবতে গিয়ে জ্ঞাতে -অজ্ঞাতে মানুষ তৈরি করেছে একের পর এক মিথ। যার কোনটা একেবারেই কাল্পনিক আবার কোনটাতে আছে বাস্তব কাহিনীর সংমিশ্রণ।

‘মিথের মৃত্যু হয়েছে’ একথা খ্রিস্ট ধর্মশাস্ত্র বিশারদ বুল্টম্যান এবং কবি ফিলিপ লার্কিন বললেও মিথের বিনাশ নেই। আসলে তার ক্ষয়ও নেই। কেননা মিথ মাঝে মাঝেই রূপান্তরের মাধ্যমে নতুনভাবে আবির্ভূত হয় যেমন হয়েছে উত্তরাধুনিক শিল্প চিন্তায়। যুক্তি এবং কল্পনা যে মাপকাঠিতেই মিথকে বিচার করা হোক না কেন এর উপস্থিতি এবং বাস্তব প্রভাব অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। মানুষের সৃজনশীলতা এবং চিন্তাশীলতার নিদর্শন হচ্ছে মিথ। এর শিল্প মূল্য অনেক। মিথের ভবিষ্যৎ পরিণতি কি তা সময়ের বিচার। কিন্তু ধাপে ধাপে সভ্যতার যে বিকাশ এবং উৎকর্ষ ও ঐতিহ্যের স্বরূপ চিনতে পারি। এগিয়ে যেতে পারি শিল্পের নান্দনিক উৎকর্ষে। সংস্কৃতিকে দিত পারি নতুন মাত্রা।

সমাপ্ত।

মিথ … প্রথম খণ্ড

মিথ

মিথ কি? কাকে বলে? সাধারণত দেশের বা বিদেশের কালজয়ী রূপকথা, পৌরাণিক গল্প বা লোককথাকেই আমরা মিথ বলে থাকি। তা ছাড়াও এমন সব গল্পকে মিথ বলা হয়, যা আগে মানুষের মুখে মুখে গান হিসেবে প্রচলিত ছিল। তাহলে মিথ আসলে কি? কোথা থেকে মিথের উৎপত্তি? “মিথ” কথাটার অর্থই বা কি?

“মিথ” কথাটি এসেছে গ্রীক শব্দ Mythos থেকে, যার অর্থ হল anything uttered by a word of mouth. অর্থাৎ মুখ হতে নির্গত বা উচ্চারিত কোন কিছু “শব্দ” বা “লোককথা” বা “সত্য ঘটনা”। এ থেকে বোঝা যায় যে মূলত মানুষের মুখে মুখেই এই মিথ অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে পড়তো। এটাও বোঝা যায় এর শেকড় আসলে ছিলো সত্যের মাঝেই। মিথ শব্দটি আরও একটি শব্দের সাথে জড়িত আর তা হলো মিও, যার অর্থ “শেখানো”, অথবা “গোপন রহস্যের সন্ধান দেওয়া”।

খ্রিস্টপূর্ব ৭ম বা ৮ম শতকের দিকে মহাকবি হোমার মিথ শব্দটিকে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি “ইলিয়াড” লেখার সময় এই শব্দ ব্যবহার করেন, যার মাধ্যমে তিনি একটি সত্য তুলে ধরার চেষ্টা। এছাড়া দার্শনিক প্লেটো তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে mythos শব্দটি ব্যবহার করেছেন এমন কিছু বোঝাতে যা হয়তো বাস্তবিক সত্য নয় আবার পুরোপুরি অসত্যও নয়। মানুষ নিজে বাঁচার লক্ষে এবং নিজের কল্পনাকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে জন্ম দিয়েছে অসংখ্য মিথের। নিয়ানডার্থালরা সর্বপ্রথম আত্মার এক অলীক কল্পনা মানুষের মধ্যে রোপণ করেন। সেখান থেকেও মিথের শুরু বলা যায়। এইবার প্রশ্ন হল নিয়ানডার্থাল? বা কারা? মানব বিবর্তন বা মানুষের উৎপত্তি বলতে বিবর্তন এর মাধ্যমে অন্যান্য হোমিনিড এবং বনমানুষ থেকে একটি আলাদা প্রজাতি হিসেবে হোমো স্যাপিয়েন্স-দের উদ্ভবকে বোঝায়।

“মানুষ” বা “হিউম্যান” শব্দটি দ্বারা এখানে প্রকৃতপক্ষে কেবল হোমোগণ এ অন্তর্ভুক্ত প্রাণীদেরকে বোঝানো হচ্ছে, তাছাড়া তখন অস্ট্রালোপিথেকাস নামে আরও এক প্রজাতিকেও ছিল। আনুমানিক ২৩ লক্ষ থেকে ২৪ লক্ষ বছর পূর্বে আফ্রিকাতে হোমো গণটি অস্ট্রালোপিথেকাস গণ থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছিল হোমো গণে অনেক প্রজাতিরই উদ্ভব ঘটেছিল যদিও একমাত্র মানুষ ছাড়া তাদের সবাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এ ধরণের বিলুপ্ত মানব প্রজাতিগুলোর মধ্যে রয়েছে হোমো ইরেক্টাস যারা এশিয়ায় বাস করতো এবং হোমো নিয়ানডার্থালেনসিস যারা ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য জুুুড়ে ছড়িয়ে ছিল।

আরকায়িক হোমো স্যাপিয়েন্স-দের উদ্ভব ঘটেছিল আনুমানিক ৪০০,০০০ থেকে ২৫০,০০০ পূর্বের সময়কালের মধ্যে। আরকায়িক বলতে হোমো স্যাপিয়েন্স দের প্রাচীনতম সদস্যদের বোঝানো হয় যারা প্রজাতি গত দিক দিয়ে এক হলেও আধুনিক মানুষের চেয়ে কিছু ক্ষেত্রে পৃথক ছিল। নিয়ানডার্থালরা ছিলেন আধুনিক মানুষের প্রথম পূর্বপুরুষ, মানে মানুষের প্রাগৈতিহাসিক পূর্বপুরুষ। এঁদের অস্তিত্ব ছিল প্লাইস্টেসিন যুগে।প্লাইস্টেসিন হল ভূতাত্ত্বিক যুগের নাম। এর সময়কাল ছিল ২,৫৮৮,০০০ থেকে ১১,৭০০ বছর। ইউরোপ ও এশিয়ার কয়েকটি অঞ্চলে আনুমানিক ২ লক্ষ বছর আগে রাজত্ব করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওদের শরীর ছিল রোমশ। কিছুটা ঝুঁকে চলত। গড়ন শক্তপোক্ত। নিয়ানডার্থালরা পাথরের তৈরি অস্ত্রশস্ত্র বানাত। আর ছিল অসম্ভব বুদ্ধিমান। ৭ হাজার বছর আগে ওরা বেঁচে ছিল। আনুমানিক ৫০,০০০ বছর পূর্ব থেকে নিয়ানডার্থালদের সঙ্গে আফ্রিকার হাইডেলবার্গদের সরাসরি সংযোগ ঘটেছে। এর মধ্যে ভুলে গেলে চলবে না যে, আমরা দুটি প্রজাতি একই পূর্বপুরুষ তথা আর্কায়িক দের থেকে বিবর্তিত হয়েছি। সে হিসেবে তারা আমাদের খুব নিকট আত্মীয়।

আবার আসি মিথ প্রসঙ্গে, ঐতিহাসিক নানা ঘটনা ও চরিত্রের সাথে কল্পনার মিশেল মিথকে করেছে সমৃদ্ধ। তবে সময়ের সাথে সাথে এই ভাবনার বদল ঘটে। এক সময় আধুনিকতাবাদ এবং আর ওপরে উত্তরাধুনিকতাবাদে স্থান পায় এই মিথ। অনেক পৌরাণিক কাহিনীর আড়ালেই কিছু সত্য লুকিয়ে থাকে। লেভি ক্লদ স্ট্রস তার ‘স্ট্রাকচারাল এনথ্রপলজি ‘ গ্রন্থে দেখিয়েছেন, মানুষের সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক জগতের ব্যাখ্যায় মিথ মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করেছে। কল্পনা হল মানুষের মনের একটি মৌলিক প্রবণতা যার সূচনা দেখা যায় আদি যুগে। প্রাচীন ধর্ম ভিত্তিক ইতিহাসে মিথকে কেবল অদৃশ্য শক্তির বর্নণায়ই ব্যবহার করা হয়েছে। সেই সময় মহাবিশ্বের সৃষ্টি, প্রাকৃতিক ঘটনা এবং প্রাণীর জন্ম – মৃত্যু রহস্যের ব্যাখ্যার সন্ধান করা হয়েছে।

এই ব্যাখ্যা নানা কল্পিত পৌরাণিক চরিত্র এবং ঘটনার মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে যেখানে যুক্তির চেয়ে ধারণা ও বিশ্বাসই প্রাধান্য পেয়েছ। কিন্তু কালের বিবর্তনে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও দর্শনের উন্নতি ঘটতে থাকে। সত্য কি, তার ব্যাপারেই মানুষের ধারণা পরিবর্তিত হতে থাকে। ফলে সময়ের সাথে সাথে মিথের সংজ্ঞাও যায় বদলে। প্রথম দিকের বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকেরা প্রচলিত মিথের সত্যতা এবং স্থায়িত্বকাল নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এ থেকেই চলে আসে মিথের প্রতি সহজাত একটা সন্দেহ এবং অবিশ্বাস।

এর প্রায় ৪০০ বছর পরে মিথ সীমিত হয়ে যায় রূপকথা, প্রতীকী গল্প এবং ফিকশন জাতীয় গল্পে। এখনো মিথকে আমরা দেখি এভাবেই- একটা গল্প যার সত্যতার কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু ৪০০ বছর পুরনো একটা গল্প যে আসলেই মিথ্যা না কি সত্যি- সেটাই বা প্রমাণ করা যাবে কিভাবে? এটাও তো হতেই পারে যে একটা সময়ে বিভিন্ন সত্য ঘটনা মানুষ মিথের মাধ্যমেই প্রকাশ করতো- এবং তা বিশ্বাসও মিথোলজিতে থাকা এমন কিছু ঘটনা সত্য প্রমাণিত হয়েছে যাকে মানুষ নিছকই রূপকথা মনে করতো।

(আগামী খণ্ডে সমাপ্য)

পরকিয়া স্পেশাল ….

পরকিয়া স্পেশাল ….

গতকাল সারা দুপুর বসে T.S Eliot পড়ছিলাম, সেই চেনা কবিতা নতুন ভাবে আবার পড়তে পড়তে নতুন করে ভালোবেসে ফেলছিলাম কবিকে। কবিতাটি “The love song of J.Alfred Prufrock.”

এলিয়টকে বলা হয় কবিদের কবি। তার আগে বোদলেয়ার, মিল্টন এবং দান্তেকেও এই রকম বলা হতো। বাংলা কবিতা এলিয়টের সঙ্গে বেশ ভালোভাবেই পরিচিত। বাংলা কবিতার পাঠকেরা জানেন, তিরিশের আধুনিক কবিরা কতখানি অভিভূত হয়েছিলেন এলিয়টের কবিতা পড়ে। এলিয়টের উপর বাংলা কবিতার আধুনিকতাবাদ অনেকটুকু নির্ভর করেছে একসময়। আর তিরিশ ও তৎপরবর্তী কবিরাও ভাষা, শৈলী ও বিষয়বস্তুতে এলিয়টকে ধারণ করেছেন।

আমরা জানি রবীন্দ্রনাথও এলিয়টের কবিতা অনুবাদ করেছেন। এলিয়টের এই যে বৈশ্বিক প্রভাব, সেটি আসলে নিহিত তাঁর লেখনীর ভেতরেই। এলিয়ট বিংশ শতাব্দীর কবিতায় যে ধারাটির সংযোজন করেন তাতে বুদ্ধিবৃত্তির প্রাধান্যটি ব্যাপক হয়ে পড়ে, যুক্তি আকর্ষণ প্রয়োজনীয়তা পায়। আবার এই তিনিই যখন নিমগ্ন কোনো আধ্যাত্মচিন্তায়, তখন যুক্তি-বুদ্ধি-সত্যকে খাটো না করে বরং তা থেকেই ভেতরের যাত্রাটির সূচনাকে চিহ্নিত করেন। আমাদের সময় এলিয়ট ছাড়া আর কোনো কবি এভাবে দুটি ভিন্ন সমতলে আমাদের চেতনাকে এগিয়ে নিতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। এলিয়েট তাই একান্তই স্বতন্ত্র একটি ধারার সৃষ্টি করেছেন এবং কে না জানে, যে কোন কবির জন্যই এই স্বাতন্ত্র্য কতটা আরাধ্য। এলিয়টের আরো একটি বিশেষ অবদান এই যে, তিনি ইংরেজি কাব্যের ভাষাকে সংষ্কার করেছেন। এলিয়ট কবিতার ভাষাকে নিয়ে এসেছিলেন মুখের ভাষার কাছাকাছি। সাহিত্যে বিপ্লবের মানেটা আর কিছুই নয়, তা হচ্ছে মানুষের মুখের ভাষার কাছে ফিরে আসা- এই উপলব্ধিটুকু এলিয়টই বারবার আমাদেরকে দিয়েছেন।ফিরে আসা যাক এলিয়টের কাব্যে, বিশেষ করে “The love song of J.Alfred Prufrock.”

জীবনানন্দ এবং Eliot এই দুই কবিরই প্রধান উপজীব্য বিষয় হল আধুনিক সভ্যতার শূন্যগর্ভতা ও আকাঙ্খিত নারী- হৃদয়ের জন্য তীব্র অভাব বোধ। এই অভাববোধের ওপরেই লেখা তাঁর “The love song of J.Alfred Prufrock.” কবিতার নায়ক জীবনকে বহুভাবে দেখার ফলে কোন নারীর কাছে গিয়ে প্রেমের প্রস্তাব দেওয়া যায় কিনা এ বিষয়ে তীব্র সংশয় বোধ রয়েছে। শেষ পর্যন্ত প্রেমহীন নিঃসঙ্গ জীবনযাপন জীবনযাপন করেছেন। এই কবিতাটিতে কবি তাঁর জীবনবোধের গভীরতা ছাড়াও যে বিষয়ে প্রশংসার দাবী রাখেন তা হল – তিনি যে পাঠককে হাত ধরে একটু একটু করে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে তাকে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরিয়ে, বিভিন্ন পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত করেন। তারপর তাকে সেই অনিবার্য ও মোক্ষম প্রশ্নটির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়ে ভাবিয়েছেন যে সমাজের নিচের তলায়, উচ্চবিত্ত সমাজে, সর্বস্তরেই নরনারীর সম্পর্ক কি শুধু দেহকেন্দ্রিক, তাতে হৃদয়ের গভীরতার কোন স্থান নেই? শুধুমাত্র প্রয়োজন ভিত্তিক এই সম্পর্কের মধ্যে শান্তি কোথায়? উত্তরন কোথায়?

চারিদিকে পরকীয়ায় এবং কিছু বাণী

চারিদিকে পরকীয়ায় ছেয়ে গেছে, আমি নাহয় কিছু বাণী তুলে ধরি। প্রেম নিয়ে গুণীজনদের বাণী অনেক খোঁজাখুঁজি করে কয়েকটি বাণী সংগ্রহ করা গেলো। বাণীগুলো আপনাদের জানা থাকতে পারে। তারপরেও দিলাম।

১. বারবার একই ব্যাক্তির প্রেমে পড়া সার্থক প্রেমের নিদর্শন। (ব্রোটন)
২. প্রেম হল মানসিক ব্যাধি।(প্লুটো)
৩. প্রেম হল ধীর প্রশান্ত ও চিরন্তন। (কাজী নজরুল ইসলাম)
৪. সবকিছুর শুরু, মধ্য এবং অন্তই হচ্ছে প্রেম। (নফডেয়ার)
৫. যৌবনে যার প্রেম এলোনা তার জীবন বৃথা। (শংকর)
৬. একমাত্র প্রেমেই বিয়েকে পবিত্র করতে পারে। আর একমাত্র অকৃত্রিম বিয়ে হচ্ছে সেটাই, যেটা প্রেমের দ্বারা পবিত্রকৃত। (লিও টলষ্টল)

৭. ভালবাসার কোন অর্থ বা পরিমাণ নেই। (কাজী নজরুল ইসলাম)
৮. ভালবাসা দিয়েই কেবল ভালবাসার ঋণ পরিশোধ করা যায়। (আলেকজেন্ডার ব্রাকেন)
৯. অন্ধভাবে কাউকে ভালবাসলে তার ফল শুভ হতে পারেনা। (কারলাইন)
১০. যে ভালবাসে কিন্তু প্রকাশ করে কম সে ভালবাসার ক্ষেত্রে প্রকৃত। (জর্জ ডেবিটসন)
১১. গভীর ভালবাসার কোন ছিদ্রপথ নেই। (জর্জ হেইড)
১২. ভালবাসার নদীতে জোয়ার ভাটা আছে। (জন হে)
১৩. ভালবাসা হচ্ছে জীবনের বন্ধু। (জেমস হাওয়েল)
১৪. ভালবাসা হৃদয়ের দরজা মুহুর্তেই খুলে দেয়। (টমাস মিল্টন)
১৫. ভালবাসা দিয়ে মরুভূমিতে ফুল ফোটানো যায়। (ডেভিসবস)

১৬. ভালবাসা এমন একটি প্ল্যাটফর্ম যেখানে সব মানুষ দাঁড়াতে পারে। (টমাস মিল্টন)
১৭. মানুষের জীবন হলো একটি ফুল, আর ভালবাস হলো মধুস্বরূপ।(ভিক্টর হোগো)
১৮. পাখিরা বাসা বাধে লতা পাতা দিয়ে,
আর মানুষ বাধে ভালবাসা দিয়ে। (মুঃ ইসহাক কোরেশী)

১৯. একমাত্র ভালবাসা সারাতে পারে সব রোগ। (গঁতিয়ে)
২০. যাকে ভালবাস তাকে চোখের আড়াল করোনা। (বঙ্কিম চন্দ্র)
২১. ভালবাসতে শেখ, ভালবাসা দিতে শেখ।তাহলে তোমার জীবনে ভালবাসার অভার হবেনা। (টমাস কুলার)

২২. একমাত্র প্রেমেই বিয়েকে পবিত্র করতে পারে। আর একমাত্র অকৃত্রিম বিয়ে হচ্ছে সেটাই, যেটা প্রেমের দ্বারা পবিত্রকৃত। (লিও টলষ্টল)

যদি কেউ আপনাকে ভালবাসে, তবে কোন কিছুই তাকে আপনার থেকে দূরে সরাতে পারবে না ! আর যদি ভালবাসার অভিনয় করে, যাবার সময় কোন কিছুই তাকে ধরে রাখতে পারবে না !

বিরসিংহের সিংহ পুরুষের আজ জন্মদিন!

বিরসিংহের সিংহ পুরুষের আজ জন্মদিন!

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-
‘তাঁহার মহত্ চরিত্রের যে অক্ষয় বট তিনি বঙ্গভূমিতে রোপণ করিয়া গিয়াছেন তাহার তলদেশ জাতির তীর্থস্থান হইয়াছে।’

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১২ই আশ্বিন ১২২৭ সাল) ১৮২০ খ্রী: ২৬শে সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বংশীয় পদবী ছিল বন্দ্যোপাধ্যায়। বাবা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ঠাকুরদা রামজয় তর্কভূষণ।বিদ্যাসাগরের অজেয় পৌরুষ, মনুষ্যত্ব, স্বকীয়তা, মানবিক ঔদার্য, স্বতন্ত্র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, অনমনীয় দৃঢ় ব্যক্তিত্ব ও আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে তুলনা করার মতো বাঙালি চরিত্র খুবই কম আছে। বাংলা গদ্য সাহিত্য যার হাতে পেল গতি ও শ্রুতি।

তিনি হলেন ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর উনিশ শতকে অবিভক্ত বাংলায় শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তিনি হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহ প্রথা চালু করেন। তার প্রচেষ্টায় ২৬ জুলাই ১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহ আইন পাস হয়। নিজের ছেলের সঙ্গে এক বিধবা কন্যার বিয়ে দিয়েছিলেন। যাতে অন্যান্য হিন্দুরাও উৎসাহ বোধ করে। বিদ্যাসাগরের এ আইনের ফলে বঙ্গ-ভারতের কোটি কোটি বিধবাদের স্বামীর ঘরে আশ্রয় হয়েছিল। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর কলকাতা মেট্রোপলিটন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। এ কলেজের বর্তমান নাম ‘বিদ্যাসাগর কলেজ’, কর্মজীবনে ঈশ্বর চন্দ্র ছিলেন কলেজশিক্ষক। তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিত ছিলেন। এরপর তিনি সংস্কৃতি কলেজের সহকারী সম্পাদক ও সংস্কৃতের অধ্যাপক হন। কিছু দিন পর তিনি সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন।

সাহিত্যিক হিসেবেও ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের রয়েছে যথেষ্ট অবদান। তিনি সাহিত্যে সৃজনী প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি যখন অধ্যাপক ছিলেন, তখন বাংলায় উন্নত পাঠ্যপুস্তকের অভাব বোধ করেছেন। নিজের সাহিত্য প্রতিভাবলে বাংলা গদ্যের অভাব পূর্ণ করেছেন। তার জন্যই বাংলা গদ্যরীতি আপন পথ খুঁজে পায়। আর এ জন্যই ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের জনক বলা হয়। তার বিখ্যাত কয়েকটি গ্রন্থ হলো- শকুন্তলা, বোধোদয়, আখ্যান মঞ্জুরী, কথামালা, বেতাল পঞ্চবিংশতি ও সীতার বনবাস। শিশু শিক্ষার মান ও পাঠ সহজ করার জন্য লিখলেন ‘বর্ণ পরিচয়’, সংস্কৃত ভাষা সহজ ও সরলভাবে উপস্থাপনের জন্য লিখলেন ‘ব্যাকরণের উপক্রমনিকা’, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের এ সব গ্রন্থ দিয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য হয়েছে পরিপূর্ণ।মায়ের প্রতি ছিল বিদ্যাসাগরের অগাধ শ্রদ্ধা। মাকে তিনি দেবীর মতো শ্রদ্ধা করতেন। মায়ের প্রতিটি ইচ্ছা অকাতরে পূরণ করতেন। মায়ের ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর দামোদর নদী সাঁতার কেটে পার হয়েছিলেন। তাও আবার ছিল ভরা বর্ষায়।

বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগরের এই মৌলিক অভিধার জন্যই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে আমার যদি কোন কৃতিত্ব থাকে তবে এর দ্বার উদঘাটন করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।’ প্রথমেই বিদ্যাসাগরের চারিত্রিক দৃঢ়তার কথা বলেছিলাম। তার কয়েকটি উদাহরন দিই।

১. সংস্কৃত কলেজ থেকে চাকরি ছাড়ার সময় অনেকেই বলেছিলেন, ‘খাবেন কী করে?’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আলু-পটল বিক্রি করে খাব, কিন্তু যেখানে মর্যাদা নেই, সেখানে থাকব না।’

২. হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ মি. কার সাহেব টেবিলের ওপর জুতাসুদ্ধ পা তুলে পাইপ টানতে টানতে আলাপ করছিলেন। প্রতিদানে বিদ্যাসাগরও অনুরূপভাবে আলাপ করেছিলেন। শিক্ষা পরিষদের সেক্রেটারি এই আচরণের কৈফিয়ত্ চাইলে বিদ্যাসাগর উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম এদেশীয় নেটিভ অসভ্য, ভদ্রতা ও ভব্যতা জানি না। কার সাহেবের সঙ্গে সেদিন দেখা করতে গিয়ে তার কাছেই আমি এই আচরণ শিখেছি। একজন সুসভ্য ইউরোপীয়ের আচরণ এমন অশোভনীয় হতে পারে, আমার ধারণা ছিল না। আমি ভাবলাম এই বোধ হয় আপনাদের অভ্যর্থনার রীতি। তাই আমি এদেশি রীতিতে তাকে অভ্যর্থনা না করে, তার কাছে শেখা অনুযায়ী সেদিন তাকে অভ্যর্থনা করেছি। যদি কোনো অন্যায় হয়ে থাকে, এর জন্য আমি দোষী নই।’

৩. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর খদ্দরের চাদর পরতেন। শীত বা গ্রীষ্ম যাই হোক না কেন গায়ে শুধু চাদর আর কাঠের খড়ম পরেই সংস্কৃত কলেজে ক্লাস নিতে যেতেন। মাঘ মাসের শীতের সময় প্রতিদিন সকালে এভাবে ঈশ্বর চন্দ্রকে ক্লাস নিতে যেতে দেখে প্রায়ই হিন্দু কলেজের এক ইংরেজ সাহেব যাওয়ার পথে বিদ্যাসাগরকে ক্ষ্যাপানোর জন্য বলতেন, “কি হে,বিদ্যার সাগর, বিদ্যার ভারে বুঝি ঠান্ডা লাগে না তোমার?” বিদ্যাসাগর প্রতিদিন কথা শুনতেন, কিন্তু কিছু বলতেন না। একদিন শীতের সকালে ঠিক একইভাবে তিনি ক্লাস নিতে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে আবার সেই ইংরেজের সাথে দেখা। আবার সেই একই প্রশ্ন। এবার সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বর চন্দ্র তার ট্যামর থেকে একটা কয়েন বের করে বললেন, “এই যে গুজে রেখেছি, পয়সার গরমে আর ঠান্ডা লাগেনা। এবার হলো তো?

সমসাময়িক অন্যরা ছিলেন পোশাকে আধুনিক আর বিদ্যাসাগর ছিলেন মননে ও চিন্তা-চেতনায় আধুনিক। দেবতা হওয়া সহজ। কিন্তু মানুষ হওয়া যে কঠিন, এর প্রমাণ বিদ্যাসাগর। কারন ত্যাগ, সাধনা ও সততা দিয়ে মানুষ হতে হয় বিদ্যাসাগর আমাদের বুঝিয়েছেন। বিদ্যাগাসর তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা পেয়েছিলেন বাবা ও মায়ের কাছে। এ জন্যই বিদ্যাসাগর বলেছেনঃ- ‘যদি আমার দয়া থাকে তা পেয়েছি মা’র কাছে আর যদি বুদ্ধি থাকে তবে তা পেয়েছি বাবার কাছে।’ রামমোহন রায় মূর্তি পুজো করতেন না বলে তার মা আদালতে পুত্রের ছিন্ন মস্তক চেয়েছিলেন। আর

বিদ্যাসাগরের মা তাকে বলতেনঃ
‘যে দেবতা আমি নিজ হতে গড়িলাম, সে আমাকে উদ্ধার করবে কি করে? বাঁশ, খড় ও মাটি দিয়ে গড়া মূর্তিতে কী প্রকৃত দেবতা হয়! জীবন্ত মানুষই তো প্রকৃত দেবতা।’
তাঁর বাবা বললেন—
‘বাবা, ধরিবার পূর্বে বাবা ভাবা উচিত। ধরেছ তো ছেড়ো না, প্রাণ পর্যন্ত স্বীকার করিও।’

বিদ্যাসাগরের প্রকৃত মূল্যায়ন করেছেন মধূসূদন-
The man to whom I have appeal has the generosity and the wisdom of an ancient sage, the energy of one Englishman and the heart of a Bengali Mother.

বিষাদ স্বপ্ন

বিষাদ স্বপ্ন

জীবন জুড়ে মনের খামে
পূর্ণ হলো চিঠির বোঝা,
স্বপ্ন তো নেই – তবু কেন
এমনি করে তাকে খোঁজা ?
হৃদয় জুড়ে বিষাদ সাগর
এক দু’ফোটা চোখের জলে,
ঝলসে যাওয়া ইচ্ছেগুলো
কবর খুঁড়ে থাকতে বলে।

একলা কাটে বেরং জীবন
হৃদয়ে ক্ষত রক্ত নদী।
বইয়ে ভাঁজে শান্তি খুঁজি,
ইচ্ছে মৃত্যু থাকতো যদি!
দুঃখের ‘পরে দুঃখের পরত
শহর জুড়ে সুখের ডানা।
আমার আছে বিষাদ পাখা,
নীল আকাশে উড়তে মানা।

অলীক ভাবনা রাত্রি দুপুর
আবোল তাবোল স্বপ্ন দেখা।
অনন্তকালের অপেক্ষা আর,
জীবন স্রোতে ভাসতে থাকা।
বিষাদ নামে মনের খামে
পূর্ণ হলো চিঠির বোঝা,
ঝলসে যাওয়া স্বপ্নগুলোর
আকাশ জুড়ে জীবন খোঁজা।