
শেখ মুজিব ও সোনার বাংলার বর্তমান প্রেক্ষাপট
আজ সেই রক্তাক্ত ১৫ আগস্ট, এমন নেতার বিয়োগান্তে বাঙালির শোকের দিন। আজ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ৪২তম শাহাদাত বার্ষিকী। শেখ মুজিবর রহমান পৃথিবীর মানচিত্রে একটি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। শুধু তাই নয় তিনি বাংলার তিতুমীর, সূর্যসেন,ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, সুভাষ বসু, আলাওল, পদাবলী, মুকুন্দ দাস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাসকে ছাড়িয়ে হলেন ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী’। আর তাই বঙ্গবন্ধুর চেহারা কোটি কোটি বাঙালীর মুখচ্ছবি।
আজ সেই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ৪২তম শাহাদাত বার্ষিকীতে বাঙালি জাতি ভুলে গেছে বাংলার ইতিহাস। ক্ষমতা আর হিংসার বশে ইতিহাসকে করে চলেছে নানা মুখে বিকৃত। ইতিহাস আর ইতিহাস নেই। যেন ছেড়া কাঁথা। সেই ছেড়া কাঁথা আজও সোনার বাংলায় প্রতিয়মান। কাঁথা যেদিকেই গায় জড়ানো হোক না কেন সকল দিকেই বেধে যায়, ছিড়ে যায়, এমনি নষ্ট হয়ে গেছে আমাদের মূল ইতিহাস। এখন ক্ষয়ে ক্ষয়ে পড়তে শুরু করেছে। এভাবে চলতে থাকলে বাংলার ইতিহাস বলে কিছুই থাকতে না।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নোবেল জয়ী পশ্চিম জার্মানীর নেতা উইলি ব্রানডিট বলেন, “মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে তারা যেকোন জঘন্য কাজ করতে পারে।”
বর্তমানের পরিপেক্ষিতে বলা যায় সোনার বাংলা তথা নোংরা বাংলা কখনোই আলোর মুখ দেখতে পারে না বা পারবে না যতদিন আমাদের নোংরামি দূর না হবে। আমরা এমন বাঙালি জাতি যে ভাল কাজের মর্যাদা কখনোই দিতে জানি না। সম্মান করতে জানি না যে সম্মান প্রাপ্য। শুধু রাজনীতি নয় শিল্প-সংস্কৃতিতেও এর প্রভাব। বাংলা স্বাধীন হয়েছে এমন কথাটি অনেকে বিশ্বাস করতেই পারে না। শেখ মুজিবর রহমান, জিয়াউর রহমান, মাওলানা ভাসানী, এ কে ফজলুল হক নামের যে কয়েজন ব্যক্তি এই বাংলার বুকে জন্ম নিয়েছিলেন এবং এই বাংলাকে সোনার বাংলায় রুপান্তরিত করেছেন সেটাই আজ স্বপ্নের মতো।
সকল বাংলার কারিগরদের এখন আর তেমন মর্যাদা দেয়া হয় না। আমাদের দু’টি দল তারা শুধুই তাদের সম্মান ছিনিয়ে নিতে ব্যস্ত। আমি হলফ করে বলতে পারি এভাবে সম্মান অর্জন আর নর্দমায় জল ঢালা একই কথা। দেশ কারিগর সবাইকে সঠিক সময়ে সম্মান করুন। দেশ উন্নত হবে, দেশের মানুষ প্রকৃত দেশ প্রেমিককে পরিণত হবে। দেখা যায় রাজনৈতিক ক্ষমতার বল-এ আমরা এতোটাই নিকৃষ্ট জাতিতে পরিণত হয়েছি যে, মানুষকে মানুষ ভাবতে পারি না।
আর হয়তো একারণেই সেদিন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক নীরদশ্রী চৌধুরী বাঙালিদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেছেন, “বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি বিশ্বের মানুষের কাছে নিজেদের আত্মঘাতী চরিত্রই তুলে ধরেছে”।
শুধু এতোটুকুই ভাবতে পারি আমি নিজেই মানুষ বাকিরা সমাজ ও দেশের কীট-পতঙ্গ, তবে বলতেও ভয় হয়। আজ বাংলার অন্যতম ব্যক্তি যার নাম, যার কণ্ঠের স্বর কর্ণ স্পর্শ করলেই শরীরের প্রতিটি লোম সজারু কাটার মতো দাড়িয়ে স্যালুট করে সেই মহান ব্যক্তি সোনার বাংলার রূপকার শেখ মুজিবর রহমান তাকে নিয়েও বর্তমান নীতিহীন রাজনীতিতে কত রঙ তামাশা করে বেড়াই। মুছে দিতে মরিয়া বাংলার হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙালি শেখ মুজিবর রহমানের নাম।
শুধু বিরোধী দলের একার দোষ সেটা বলবো না, দোষ আমাদের সবার। রাজনীতিকে আমরা নর্দমার বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত করেছি। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে গান্ধীকে নিয়ে তো এতো কথা উঠেছে না তাদের রাজনীতিতে। তবে আমাদের বেলায় কেন এতোটা কাদা ছুড়াছুড়ি। আমরা এতো এতো জ্ঞানী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দেখি, বই পুস্তকে তাদের নাম ধাম পড়ি, শুনি; কই তারা তো দেখি হিংসা বিদ্বেষ ছাড়া কিছুই জন্ম দিতে পারেনি। তারা যদি প্রকৃত জ্ঞানী-গুণী হয়েই থাকতেন তাহলে শেখ মুজিবর রহমানের মৃত্যুবাষির্কী-উদযাপনের নামে সরকার দলীয় নেতা কর্ম কোটি টাকা খরচ করতে পারতো না, পারতো না রাস্তাঘাটে মঞ্চ তৈরী করতে, যেখানে সাধারণ মানুষের ব্যবহার অপরিহার্য।
আজ সোনার বাংলায় বুদ্ধিজীবিরাও দলকানা। স্রোতের অনুকূলেই গা ভাসাতে মরিয়া কিছু বুদ্ধিজীবিরাও। দলকানা হওয়ার কারনেই তারা দলীয় মদদে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যেকে সত্য প্রচার করে বেড়ায়। আমাদের ইতিহাস কি শুধুই একজনের ? নাকি এই ইতিহাস সৃষ্টি করতে লক্ষ প্রাণের রক্ত বির্সজন দিতে হয়েছে ?
শুধু শেখ মুজিবরের কথা বললে ভুল হবে, জিয়াউর রহমানের ভূমিকা এদেশে অবশ্যই রয়েছে। রয়েছে মাওলানা ভাসানী, তাজ উদ্দীন আহম্মদ, একে ফজলুল হক আরও অনেকে। এদের যদি আমরা সম্মান করতে না পারি তাহলে আমি মনে করি এদেশের কেউ সম্মানের যোগ্যতা রাখে না। সবাই ভণ্ড।
বেগম জিয়া আমাদের মতো এতো ছোট ব্যক্তি নয়, তার সম্মান অনেক। তিনি দেশের প্রতিনিধিত্বকারী। এজন্য তার বিবেক জ্ঞান সূর্যের মতোই উজ্জ্বল থাকতে হবে। বেগম খালেদা কেন আমাদের গর্বের নেত্রী শেখ হাসিনাকেও মনে রাখতে হবে তিনি কেমন মহৎ মানুষের সন্তান। আসলে হাতের পাঁচ আঙ্গুল এক হয় না। কারো না কারো বিসর্জন একটু বেশি দিতেই হয়। পৃথিবীর বুকে নাম লেখার জন্য মহৎ কাজ করতে হয় নয়তো সবচেয়ে খারাপ কাজ করতে হয়।
আমাদের দেশের রাজনীতিতে যদি এভাবে দিন অতিবাহিত হতে থাকে তাহলে এদেশ একদিন কুকুর বেড়ালের দেশে পরিনত হবে। মানুষ বলে কেউ থাকবে না। শুধু মানুষের কাঠামোতে পুতুল হয়ে থাকবে বাঙালি জাতি। আওয়ামীলীগ বিএনপি দেশের বড় শক্তিধর দু’টি দল এরা এখন রাজনীতির অপব্যবহার করা ছাড়া আর কিছুই করছে না। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছে না। কারো ভেতর সহানুভূতি কিংবা ক্ষমা নামক গুণ নেই বললেই চলে। প্রতিহিংসার রাজনীতি সোনার বাংলাদেশে।
আচ্ছা ক্ষমতার উচ্চশিখরে উঠলেই কি মানুষ ভুলে যায় মৃত্যুর কথা? নাকি তারা ভাবে তাদের মৃত্যু বলে কিছুই নেই। কেন তারা কেউ ভাবে না এ পৃথিবীতে আমরা খুব বেশি দিনের জন্য আসিনি। আমরা সবাই একদিন আপনজন রেখে চলে যাবো। কিন্তু আমরা কি রেখে যাচ্ছি আগামী প্রজন্মের জন্য। আমাদের রাজনীতি আগামী প্রজন্মের জন্য রেখে যাচ্ছে রক্তের মদ, মানব গোস্তের কাবাব।
যে যতোই শেখ মুজিবর রহমানকে বাংলার ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে চান না কেন এটা কখনোই সম্ভব নয় এটা ভাবেন। শুধু তাই নয় বাংলাদেশ যতদিন আছে ততদিন শেখ মুজিবর রহমান, জিয়াউর রহমান, মাওলানা ভাসানী, তাজ উদ্দীন আহম্মদ, একে ফজলুল হক আরও অনেকে সবার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। নাম হত্যা না করে আসুন সোনার বাংলাকে সোনার পরিণতি করি। সবুজের বাংলাকে সবুজে পরিপূর্ণ করি।
সর্বোপরি তুলে ধরতে চাই দ্য টাইমস অব লন্ডন এর ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সংখ্যায় বলা হয় ‘সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সবসময় স্মরণ করা হবে। কারণ, তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোন অস্তিত্ব নেই।’ একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকান্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।’ আজও তেমনই হচ্ছে, হয়তো এভাবেই চলছে….