বিভাগের আর্কাইভঃ জীবন

চারটা উদ্ধৃতি

3018t

১.
জীবন নানাবিধ নাটকীয়তায় ভরপুর যদিও এর স্থায়িত্ব সংকীর্ণ, হ্যাঁ, সংকীর্ণ এই জন্যই বলছি যে সবকিছুর একটা গন্তব্য রয়েছে যেখানে এসে সেই নাটকের শেষ হয়। তবে এখানে নিখুঁত অভিনেতারাই তাদের গুরুত্বপূর্ণ অভিনয় দিয়ে সংকীর্ণ রূপরেখা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।

২.
দুঃখ হলো মানব জীবনের সবচেয়ে ব্যক্তিগত জায়গা দুঃখ কারো জীবনে গোপন থাকে কারো জীবনে প্রকাশ্য।

৩.
শরীর দেখিয়ে নারীরা উপরে উঠতে পারে যেখানে আত্মসম্মান নেই কিন্তু তাদের সেই চলন্ত যাত্রা সিঁড়ি বিহীন পথের মতোই দুর্ধর্ষ একবার সেখান থেকে পড়ে গেলে আর ওপরে ওঠার কোন সুযোগ নেই। শেষ পর্যন্ত তারা ব্যবহার হতে থাকে। কিন্তু নারীর ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা হাতে গনা হলেও সংখ্যার দিক দিয়ে নেহায়েত কম নয়। দেখে দেখে পদক্ষেপ নেওয়া সেই সমস্ত প্রকৃত নারীদেরকে এই ব্যাপারটায় জড়াচ্ছি না তবে যারা বিবেচনা হীন পথ বেছে নেয় এই কথাটি তাদের জন্যই সীমাবদ্ধ।

৪.
আমাদের সমাজে নারীর পাশাপাশি পুরুষ বেশ্যার সংখ্যাও অনেক তবে নারীকে আত্ম সম্মান হীন হয়ে বেঁচে থাকতে হয় পুরুষের ক্ষেত্রে টোটালি আলাদা। আসলে আমাদের এই সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে পুরুষের সকল অপরাধের মাঝে শিথিলতা বিদ্যমান; নারীর সম্মান গেলে পুরুষের আত্মসম্মানে চির ধরে অথচ আমাদের এই সংকীর্ণ সমাজে একজন পুরুষ নিকৃষ্ট অপরাধ করলেও সেখানে পুরুষের আত্মসম্মান নষ্ট হওয়ার কোন বালাই নেই কারণ আমাদের সমাজ রাষ্ট্র পরিচালিত হয় পুরুষের নিকৃষ্ট মনস্তাত্ত্বিক ভাবনা দ্বারা যেখানে প্রকৃত সত্যের কোন স্বরূপ নেই।

সেই হাত

তারপর একদিন শেষ হয়ে যাবে নতুন দিনগুলি
তুমি দাঁড়াবে গিয়ে পুরাতন মানুষদের ভীড়ে
ক্ষয়ে যাবে শরীরের সব শক্তি, ঝাপসা মনে হবে পৃথিবী
হাটতে গিয়ে বুঝবে শরীর অনেক ক্লান্ত
আকাশের নীল কিংবা একটি গোলাপকে দেখবে নতুন করে
বড় অচেনা মনে হবে সব মানুষকে
হয়তো অবাক করা শ্রান্ত চোখে নিষ্পলক খুঁজবে একটি হাত
যে হাত বড়ই আপন
যে হাতে হাত রেখে হাসিমুখে মৃত্যুকে করা যায় আলিঙ্গন
মহাকাল স্বাক্ষী থাকুক
সেইদিন যদি একটিবার ডাকো আমায়
যদি বেঁচে থাকি
তুমি পাবে এই হাত তোমার হাতে
যে হাতে হাত রেখে নির্ভয়ে ঘুমানো যায় সময়ের স্বপ্ন স্রোতে।

দাঁড়িয়ে থাকা বটবৃক্ষ

জীবন থেমে যাওয়া এক বটবৃক্ষ
একই জায়গায় অবস্থান করে দেখতে হয় দূর-দূরান্ত।
মাঝে মাঝে আমার দৃষ্টি দূরবর্তী মেঘের বুক চিরে দেখতে চায় তার ওপারের জীবন।

আমি লক্ষ্যভ্রষ্ট পথিক নই
আমার লক্ষ্য সেই ঠিকানা
যেখানে আমি আমার যাপিত জীবনের গল্প রচনা করব।

আমি কষ্টের অনুভুতি শূন্য মানুষ নির্দয় নয়
তাই কোন কিছুতে আর ভয় পাই না।

তবে কিছু কিছু সময় স্মৃতির সেই জীবন
মনে করিয়ে দেয় মুক্ত নস্টালজিয়া
যাঁর দরুন সুচিত তিরবিদ্ধ বিহঙ্গের মতো
অন্তরের মাঝ দরিয়ায় সুনামির সৃষ্টি।

শিহরিত জীবনের সেই দংশিত অতীত
আমাকে তখন কিছুটা ভয় পেতে বাধ্য করে
তাই কখনো একাই কাঁদতে থাকি
বেদনাবিদ্ধ হই, আবার এমনও হয় কাঁদতেই ভুলে যাই
কিংবা অনেক সময় কাঁদতে ইচ্ছে করলেও
চোখের জল অশ্রু হয়ে ঝরে না।

এটাই বুঝি সমন্বয়হীন জীবনের
এক চিলতে আদিখ্যেতা।
আমার এই অসামান্য জীবনের মঞ্চে
নিজের পরাজয় দেখলেও হেরে যাওয়ার দুর্বলতা
শক্তি হিসেবে সঞ্চারিত হয়।

আমি তো ভুলে যায়নি কিছুই
ভুলে যাওয়ার কথাও নয়
আছি থাকবো জীবনের প্রত্যেকটি পদক্ষেপে
দূরের ঠিকানা হয়ে; যদি কোনদিন নতুন করে
সেই স্বপ্নের বীজ রোপিত হয়।

মাঝে মাঝে আমার জীবনের মঞ্চ
আলোক উজ্জ্বল জনসভার মতো
সুখের মহাসমুদ্রে পরিণত হয়
দূরবর্তী জীবনের সেই গল্প গুলো।

এক সময় মনে হয়
আমিই সেই অন্ধকার, আমি সেই আলো
আর মহাসমুদ্রের বুকে ছুটে চলা ভাসমান মেঘ।

এইতো আমি
সেই আমি আজকের এই আমি
এখন আমার সবকিছুই পরিণত
তুমি হয়তো বুঝবে না সেই অতীত
সেই কষ্টের নবান্ন মেঘ হয়ে
হৃদয়ের মসনদে তুলেছিল ঝড়
আমি সেই ঝড়ের বুক চিরে
বেরিয়ে আসা একজন অসামান্য মানুষ।

আমি খুঁজছি সেই পথ
নিরব কান্নার জলসা ঘর থেকে বেরিয়ে আসা দরজা
সব ভুল শুধরে মুখোমুখি হব
আর নতুন পৃথিবীর বুকে
সৃজিত করব নতুন দিন নতুন বসন্ত।
সকল ব্যাথা, দুঃখ আর যন্ত্রণা থেকে প্রস্থান করে মিশে যাবো একাকার আত্মায়।

আবে শালে, তু জান্তা হ্যায় মে কৌন হো?

29841

ভোর ৩টা ৩০। প্ল্যান মাফিক এগিয়ে চলছে কুয়েত গামী ফ্লাইটের যাত্রা। যাত্রীরা একে একে প্রবেশ করছে। কেবিন ক্রুরা রোবট মার্কা হাসি দিয়ে তাদের স্বাগত জানাচ্ছে। উত্তরে কিছু একটা বলতে হয় এ অভ্যাসটা জাতিগত ভাবে আমাদের নেই, তাই ওদিকে মন না দিয়ে যাত্রীরা হাতের মালামাল নিয়ে পা রাখছে ভেতরে। তাছাড়া ওদিকে মনোযোগ দেয়ার মত মানসিক অবস্থায়ও নেই কেউ।

সবার মন খারাপ। বিমান বন্দরের বাইরে এখনো অপেক্ষা করছে পরিবারের অনেকে। শেষবারের মত কিছু একটা বলার চেষ্টায় হাতে ধরা মোবাইল ফোনের দিকে মনোযোগ সবার। আইলসে দাড়িয়ে উপরের কেবিনে হ্যান্ড-লাগেজ রাখার চেষ্টা করছে অনেকে। ধাক্কাধাক্কি কাড়াকাড়ির দিকে ভাল করে নজর দিলে মনে হবে সদরঘাট হতে রামপুরা গামী লোকাল বাসে উঠছে সবাই। চারদিকে এক ধরণের অসুস্থ প্রতিযোগিতা।

গোটা ফ্লাইটে এলোমেলো অবস্থা। এসব জায়গায় অলিখিত কিছু ভদ্রতা ও রীতিনীতি আছে। ওসবের তোয়াক্কা নেই কারও। কে কার আগে উঠবে এবং জায়গা দখল করে নিজের অবস্থান পোক্ত করবে তা নিয়ে ব্যস্ত। হঠাৎ করে গর্জনটা শোনা গেল। তাকাতেই দেখি আমার পেছনে দুটো সারির পর এক ভদ্রলোক তেড়েফুঁড়ে আসার চেষ্টা করছেন। টার্গেট একজন হোস্টেজ। ইংরেজি ‘f…’ শব্দ সাথে বাংলায় কিছু নান্দনিক গালাগালি হতে ধরে নিলাম মধ্য বয়সী যাত্রীর শেষ গন্তব্য কুয়েত সিটি নয়, বরং অধুনা বিশ্বের অন্যতম উন্নত শহর নিউ ইয়র্ক। অর্থাৎ লম্বা সময়ের জন্য আমার সহযাত্রী।

কিছুতেই থামানো যাচ্ছেনা ভদ্রলোককে। কেবিন ক্রুদের প্রায় সবাই এসে গেছে ইতিমধ্যে। যা যার মত চেষ্টা করছে এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার ইতি টানতে। যাত্রীদের সবার মনোযোগও এখন ওদিকে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছেনা। বরং ভদ্রলোকের গলার আওয়াজ রাজনৈতিক ভাষণের মত তীব্র হতে তীব্রতর হচ্ছে। এক মুখে হয়ে অন্য মুখে আসা তথ্যগুলো এক করলে যা দাঁড়াবে তার সারমর্ম হবে; আইলসে দাড়িয়ে উপরের কেবিনে হ্যান্ড লাগেজ রাখতে ভদ্রলোক অতিরিক্ত সময় নিচ্ছিলেন। তাতে সদ্য প্রবেশকরা যাত্রীরা আটকে যাচ্ছিল এবং লাইন লম্বা হয়ে ফ্লাইটের মূল ফটক পর্যন্ত চলে যাচ্ছিল। কাজ শেষ করে দ্রুত সিটে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করছিল হোস্টেজ। অনুরোধের ভাষায় নাকি যথেষ্ট বিনয় ও শালীনতা ছিলনা, তাই এ গর্জন।

সীটে বসে সবাই যার যার মত রায় দিচ্ছে… আলোচনা সমালোচনা চলছে। ভেতরের আবহাওয়া আরও উত্তপ্ত হচ্ছে। ইতিমধ্যে পাইলটও বেরিয়ে এসে যোগ দিয়েছেন দরকষাকষিতে। কিছুতেই থামছেন না নিউ ইয়র্ক গামী বাংলাদেশি যাত্রী। উনার দাবি কি সেটাও পরিষ্কার হচ্ছেনা। আমার পাশের ভদ্রলোকও নিউ ইয়র্ক যাচ্ছেন। মুখ তেনারও বন্ধ হচ্ছেনা। অনেকটা রানিং কমেন্ট্রি দিচ্ছেন আমার জন্যে। রাগত স্বরে অভিযোগ করলেন কুয়েত এয়ারওয়েজের এসব কেবিন ক্রুদের স্বভাব চরিত্র নিয়ে।

শুরু হতে আমি চুপ। এ নিয়ে নিজের মতামত শেয়ার করার মত পরিবেশ পরিস্থিতি ছিলনা। কিন্তু ভদ্রলোক অনেকটা জোর করলেন আমার মতামতের জন্যে। কোন ভণিতা না করে সরাসরি উত্তর দিলাম; আর কিছুক্ষণের ভেতর ঐ যাত্রীকে ফ্লাইট হতে বের করে দেবে। এবং তাতে স্থানীয় পুলিশের দরকার হলে সেটাও করা হবে। ভদ্রলোক বেজায় চটলেন আমার উপর।

ইতিমধ্যে দেড়-ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। যা আশ করা গিয়েছিল শেষপর্যন্ত তাই ঘটল; পাইলট এসে জানিয়ে দিল ভাইয়োলেন্ট এ যাত্রীকে নিয়ে তিনি আকাশে উড়বেন না।

এতক্ষণে হুঁশ হল রাজনৈতিক শক্তিতে বলিয়ান এই যাত্রীর। এই ফ্লাইট যে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের শক্তিমত্তা প্রদর্শনীর জায়গা না তা বুঝতে প্রায় দুই ঘণ্টা লেগে গেল। ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে অনেক। ভদ্রলোক একা নন। সাথে আছেন স্ত্রী, দুই সন্তান এবং বয়স্ক একজন মহিলা। হবে হয়ত মা অথবা শাশুড়ি।

ঘটনার নাটকীয়তা মোড় নিলো অন্যদিকে। এই ফ্লাইটে স্বামীকে কিছুতেই যেতে দেয়া হবেনা বুঝতে পেরে স্ত্রী জ্ঞান হারিয়ে (ভান করলেন) ফ্লোরে শুয়ে পরলেন। চারদিকে হাহাকার পরে গেল। কেবিন ক্রুরা দৌড়ে এসে পরিচর্যা শুরু করে দিল। শুরু হয়ে গেল ঘটনার দ্বিতীয় অংক।

আমি মিটিমিটি হাসি আর পাশের সহযাত্রীকে নিশ্চিত করি, স্ত্রীর এসব নাটক কাজে আসবেনা। ইজ্জতে আঘাতপ্রাপ্ত যাত্রীকে নামতেই হবে। এবং তা যত দ্রুত ঘটবে ততই আমাদের জন্যে মঙ্গল। একে একে ৫ জন যাত্রী নেমে গেল। জোর করা হল একজনকে, কিন্তু বাকি চারজন নেমে গেল নিজেদের ইচ্ছায়। অনেকটা সনাতন ধর্মের সহমরণের মত।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সহযাত্রীর দিকে তাকালাম আমি। রাগে ফুঁসছেন ভদ্রলোক। মনে মনে খুশি হলাম, বাকি পথ নিশ্চয় চুপ থাকবেন এবং অনাকাঙ্ক্ষিত বাক্যালাপ হতে আমাকে মুক্তি দিবেন। ফ্লাইট যখন আকাশে ডানা মেললো ততক্ষণে সকাল হয়ে গেছে। হয়ত ঢাকার আকাশ বাতাসে আজানের ধ্বনি ভেসে বেড়াচ্ছে। মেগা শহরে মানুষ হয়ত জেগে উঠতে শুরু করেছে কেবল।

কুয়েত সিটি হতে নিউ ইয়র্ক গামী কানেক্টিং ফ্লাইট ধরতে পারবো কিনা ভয়টা ততক্ষণে মগজে চেপে বসেছে।

প্রিয় বাসিনী

Untitl

জীবন এক নৈব্যক্তিক প্রশ্নের সমাহার
ভেতরের কামনাগুলো দক্ষ জাহাজের
ক্যাপ্টেনের মতো হলে বেশ ভালো হতো।
আদেশ নির্দেশ সব সংকাহীনভাবে
একসাথেই একীভূত হতো।

আসলে বন্ধনহীন কামনা
সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলেনা
ব্যক্তিত্বের পরিণত সম্পর্ক যদি
আভিজাত্যের প্রমোদ দিশায় বদলানো যেত
তবে হয়তো জীবন তার নিবিড় আলিঙ্গনে
হারাতো সুনিবিড় সরলতা।

যখন, এলোমেলো দহনে জ্বলেছি খরায়
আবার গড়েছি নিজেই নিজেকে।

যখন কেউ পাশে থাকার কথা
তখন চলেছে দূরে
যখন কেউ থাকার কথা দূরে
তখন এসেছে কাছে

আসলে প্রয়োজনহীন সবকিছু যেন
এলোমেলো ভাবে ছুটে চলছে
জীবনের এই অদম্য শিখায় জ্বলতে জ্বলতে
পথের পরে পথ পাড়ি দিয়েছি
এমন প্রকৃত কাউকেই পাইনি।

মৃত্যু তো এক শব্দহীন একনিষ্ঠ সংস্কৃতি
তার স্বরূপ স্বীকৃত ঈর্ষনীয়।
মহাকালের যাত্রায় যে গৌরবান্বিত পথ পাড়ি দিয়েছে
অধরে অধরে তার শব্দহীন উচ্চারিত কন্ঠস্বর
স্বর বর্ণের সুকোমল নস্টালজিয়া

এই সময়ের আলোকে দিগন্তর ওপারে ঘুমিয়ে যাওয়ার উচ্ছ্বাস,
রাত্রি দিনের অসমাপ্ত পথ স্পর্শ বিহীন চিহ্ন বিবর্তনের খেলায় মাতে

আমার কাছে কারো কারো জীবন
চিহ্ন বিহীন কষ্টের বিষন্ন সুটকেস
কোনদিন অধিকারের স্বীকৃতি পায়নি
যতবার প্রতিবাদ করেছে
ততবারই হয়েছে আহত রক্তাক্ত।
ততবারই দরজা থেকে ধাক্কা মেরে দেখিয়েছে অজানা পথ।

হ্যাঁ, আজ আমি নিজেই নিজেকে বলি,
মনে করি এ পথ তোমার…
আমি বারবার জেনেছি চেহারায় পুরুষ নয়
নারীর মতো পুরুষকে পুরুষ হয়ে উঠতে হয়
আর নারীকে নারী;

যেখানে অপরিপক্ক মস্তিষ্ক দ্বিধাদ্বন্দ মান
আগন্তকের অভাগ্য খোঁজে
সেখানে চোখ তার বৃষ্টির ধারা ছুঁয়ে
এগিয়ে যায় দূরবর্তী সমুদ্রের পথে
যেখানে একরাশ ঝড়ের পূর্বাভাস
নীলকন্ঠী সঙ্গীতের সুর
আর নিরানন্দ শঙ্খচিলের
পথ ছুঁয়ে ভেসে চলে সমুদ্রের বুকে
এক তামাটে শরীর।

নারী যখন পুরুষের মন খোঁজেনা
নারী যখন বাঁধাকপির মত নিজেকে অনুভব করে না
তখন অস্ফুট কন্ঠক হীন চিমনিতে কয়লার
ধোঁয়ায় জেগে ওঠে শ্বাসকষ্টের জীবন
তুমি হয়তো জানবে না কোনদিন।

অনিমেষ

অনিমেষ পাল নৌকার মাস্তুলে পাল খাটাবার কাজ করে, তার কাজ এটুকুই। এর পর ছইয়ের ভিতর ঘুম। অনিমেষ যদি ঘুম জমাত; তাহলে ব্যাংকের কোন ভোল্টে জায়গা হত না। ইদানীং অনিমেষ ঘুমোতে পারছে না, ঘন্টার পর ঘন্টা অসল বসে থাকছে। দুই চোখ বুজে দেখেছে কিন্তু ঘুম আসছে না। সেই মধুর দৃশ্য বারবার ভেসে উঠছে।

রবিন পোদ্দার মাঝি; নৌকার বস কী কুক্ষণে গত সপ্তাহে তার বাড়ি যাওয়া হয়েছিল। এই যাওয়াই কাল হলো। রবিনের স্ত্রী মালতী নিচু হয়ে তার পাতে ভাত বেড়ে দিয়েছিল, মালতীর গোপন অঙ্গের কিছু অংশ সে দেখে ফেলেছিল।

এই দেখানো ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছায় এই দ্বন্দ্ব তার কাটছে না। তার ঘুম হারাম হয়ে গেছে। কোনভাবেই এই দৃশ্য তাড়াতে পারছে না। উনিশ বছরের অনিমেষ বড় কষ্টে আছে, কষ্ট কথা কাউকে বলতে পারছে না।

রবিন পোদ্দারের বাড়ি পুনরায় যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা কিন্তু সেটাও হয়ে উঠছে না।

অনিমেষ বাতাসের গতি বুঝে পাল খাটায় কিন্তু নারীর মনের গতি বোঝা তার সাধ্যের বাইরে।

বীণাপাণি বনাম খেয়ালী

পাঁচ
শরীরগুলো মাঠে পড়ে আছে – ইঞ্জিন খুলে নিয়ে যাওয়া ওয়াগন; ঘাম, বর্ষার জল, গায়ের রঙ আর কাদা মিশে একাকার। শুধু বিকাশদা চটি-পাছায় ব’সে বিড় বিড় করছে, “পনেরো বছর সাব-ডিভিশান খেলছি, এমন গোল বাপের জম্মেও দেখিনি। বদমায়েশিটা কমালে ‘পোকা’ একদিন কলকাতা-মাঠ দাপাবে”। চাঁদ সেঁটে থাকে এদের পেছনে, প্রত্যেকটা কথা শুষে নেবে। যেমন, রজত হেড করতে উঠে দুবার কনুই মেরেছে অসীমের চোখে। “গান্ডু রতন কি বাঁশিটা পোঁদের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখেছিল তখন?” শুয়ে শুয়ে নবদার জবাব, “বাজিয়েছিল, ছ্যাপ-ভর্তি বাঁশি, শোনা যায়নি”। ছ্যাপ মানে থুতু, নব সাহা খুলনার লোক।

খেলার মূল গল্পের সঙ্গে জড়ানো, তারই প্রান্তসীমা থেকে উঠে আসা এই সব টুকরো কাহিনি মিলেই গোটা আখ্যান; না শুনলে বোঝা যাবে না খেলোয়াড়ের মন, তার সাহস আর অসহায়তা, বল নিয়ে হু-হু করে উইং ধরে ওঠার সময় সে কী ভাবে, সকালে বাজারে মাছ নিয়ে বসা বাবুয়াদা আর বিকেলে হলুদ-সবুজ জার্সি-পরা বাবুয়াদার মধ্যে তফাত কোন জায়গায়!

হেরো টিম বেশিক্ষণ বসে না মাঠে, খেয়ালীও বেরিয়ে গেছে। বীণাপাণির প্লেয়াররা এবার টলতে টলতে মাঠ পার হয়ে পাশের রেলপুকুরের দিকে হাঁটল, তাদের কিটব্যাগ বহন করছে সঙ্গীসাথীরা, চাঁদের হাতেও কে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিয়েছে – আছাড় খাসনে আবার!

রেল কোম্পানির তলাওটি প্রস্থে ছোট হলেও লম্বায় হ্রদের মতো। জলে বাতাস লেগে একটা তিরতিরে স্রোত সব সময়। পাড়ে দাঁড়ালে মাছের গায়ের গন্ধ; জলে নামলে শ্যাওলা-শামুক-জলঝাঁঝির পা এঁটে ধরা স্তব্ধতা। বর্ষায় টাপেটোপে ভরা সেই জলরাশিতে শরীর ছুঁড়ে দিতে থাকে ছেলেগুলো। এখান থেকে গল্পে আর চমক নেই। তোয়ালেয় মাথা মুছে ওরা নিজের নিজের কিট থেকে কোঁচকানো জামাপ্যান্ট পরে নেবে। ছোট চিরুনিতে চুল আঁচড়ে কেউ সোজা হেঁটে কেউ অল্প খুঁড়িয়ে গিয়ে বসবে কাশীকাকুর দোকানে। সেখানে গোগ্রাসে কাঁচা পাঁউরুটি-ঘুঘনি খাবার পর সবার হাতে তিরিশ টাকা ক’রে ধরিয়ে দেবে বীণাপাণির ম্যানেজার ষষ্ঠীতলা প্রাইমারি স্কুলের মাষ্টার কাল্টুদাস্যার। চাঁদের কলোনির পাশে চড়কপাড়ায় তারই স্কুলের বন্ধু ঋতুরাজদের বাড়ি তৈরি হচ্ছে। সেখানে সারাদিন কাজ করার পর দুটো মিস্তিরি আর তিনটে যোগাড়েও টিউবয়েলের জলে স্নান ক’রে শার্ট-ফুলপ্যান্ট প’রে পাতা-কেটে মাথার চুল আঁচড়ে নেয়। তারপর এসে বসে কাশীকাকুর দোকান থেকে একটু দূরে বাবলা ডেকরেটর্সে। সেখানে কনট্রাকটার শুকদেবজেঠু এসে ওদের মজুরি গুনে দেয়। দুই দল পাশাপাশি হাঁটলে ফট ক’রে বোঝা যাবে না কে রাজমিস্তিরি কে ফুটবল প্লেয়ার!

ছয়
কলপুকুরের জল অতিরিক্ত কালো হয়ে উঠেছে। বৃষ্টি নামবে ভেবে চাঁদ আকাশে তাকিয়ে খেয়াল করল বিকেল এখন পাস্ট টেন্স, জাঁকিয়ে সন্ধে নেমে গেছে চারপাশে। সর্বনাশ! অন্ধকার মানে সেজদার খটাস গাঁট্টা, মায়ের জোয়ারিপূর্ণ মুখনাড়া। কিটব্যাগ নামিয়ে রেখে চাঁদ রেলপুকুর প্রায় উড়ে পার হয়ে উল্টোদিকের ইঁটবাঁধানো রাস্তায় এসে পড়ে। ট্রেন-প্যাসেঞ্জারের যাতায়াতে সমৃদ্ধ জনপথ এখন নেতিয়ে আছে, একফোঁটা মানুষ নেই কোথাও, বটগাছের শেকড়ের প্যাঁচে দমবন্ধ হয়ে মরা রেল-কেবিনটা শুধু হাঁ ক’রে দেখছে তাকে।

এমন দৃশ্য থেকে ভয় জন্ম নেয়, স্পষ্ট জেনে গেল সে। ভয় একইসঙ্গে ওই ফাঁকা রাস্তা এবং কেবিনের ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে এসে তার শরীর ছুঁল, সেঁধিয়ে গেল ভেতরে। এই আতঙ্ক সম্পূর্ণ স্বাধীন, তার সঙ্গে ফুটবল ম্যাচ বা বাড়ির শাসনের একটুও জানাশুনো নেই। পড়তে বসার সময় যেমন সকাল, ভয়ের সময় হল সন্ধেবেলা। কারণ সায়ংকালে সবাই একা – টিউশান থেকে দেরি ক’রে ফেরা ছাত্রী, বাঁশবাগান অথবা জীবনসন্ধের মানুষ।

হাওয়ার বেগে ছুটছিল চাঁদ, এই রাস্তাটুকুর অভিশাপ পার হয়ে রেলস্টেশানে পৌঁছোতে পারলে গন্নাকাটা চা-ওলা ছেলেটা, ঢোলা খাকি হাফপ্যান্ট পরা হুড়ুমভাজার দোকানদার সব তার কাছে জীবনদায়ী ওষুধ। অর্ধেকটা ছোটার পর হঠাৎ খেয়াল করল এক দিদিমাবুড়িকে, রাস্তার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে কোমর সামনে ঝুঁকিয়ে কিছু তুলে নিচ্ছে রাস্তা থেকে। পথে ঘাটে পড়ে থাকা গোবর কুড়িয়ে নিয়ে যায় অনেক গরীব মানুষ, কিন্তু বুড়ি যেন তার অপেক্ষাতেই ওই পোজে স্থির হয়ে আছে। চাঁদ কি রেললাইন টপকে রেলকোয়ার্টার্সের পাশের রাস্তা ধরবে, যে রাস্তা আরও নিঃঝুম বড় বড় আম-জামরুল গাছে? আপাতত গতি কমানো যাক ভাবল সে, কিন্তু খেয়াল করল কোনওভাবেই দৌড় থামাতে পারছে না, হাওয়ার বেগে ভেসে যাচ্ছে বুড়ির দিকে।

সাত
ফুল ভলুমে চলা রেডিয়োর সেন্টার বদলাতে গেলে দুটো ব্যান্ডের মাঝখানে যে তীক্ষ্ণ ভয়ের চিৎকার ওঠে, হঠাৎ তেমন কান ফুটো করা শিসে সন্ধের নিশ্চুপ বাতাস ভ’রে গেল। বুড়ি তার তড়িৎক্ষেত্রে চাঁদকে ছুঁড়ে দিয়ে জাল গুটিয়ে আনছে দ্রুত, এভাবে যখন তাদের মধ্যে এক হাতের তফাত, তড়াক ক’রে মাথা তুলল বৃদ্ধা। চাঁদের নিঃশ্বাস-দূরত্বে সাদা ঘোমটার নীচে পোড়া কাঠকয়লা রঙের মুখ, চোখের কোটরে চোখ নেই, হাঁমুখের ভেতরে শুধু অন্ধকার। জ্বরের তড়কা এল তার শিরদাঁড়ায়, শীত করে উঠল গা, বুড়িকে ঠেলে-ধাক্কিয়ে পালাতেই হবে। স্বপ্নের মধ্যে আমরা যেমন দৌড়োই, সেই রকম ভারশূন্য ঋদ্ধিশূন্য ছুট দিতে চাইল একটা, আর সঙ্গে সঙ্গে দড়াম করে আছাড় খেল। বুড়িই কি তাকে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়েছে? মাটিতে পড়ে চাঁদের মাথা একটা ড্রপ খাচ্ছে, দুটো ড্রপ খাচ্ছে, প্রত্যেকটা ড্রপের সঙ্গে রক্তছোপ লেগে যাচ্ছে রাস্তায়। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে তার দুচোখে কৃতজ্ঞতা লেগে থাকল সব ধড়শরীরের জন্যে, ধড় না থাকলে আমাদের মাথা কোথাও থামত না, গড়িয়ে গড়িয়ে গোল লাইন পার হয়ে যেত…।

(শেষ)

চিরায়ত

বন্দী বিনিময় শুরু হয়ে গেছে। একজন আসবে, একজন যাবে।

দূরে বিস্তীর্ণ ভূমি, কি দারুণ বিস্তৃত। রোদ থেকে ঝলসে উঠছে কাকলী, প্রাণের কাকলী। বাতাসে শিস দিচ্ছে দুলে ওঠা কচি ধানের সবুজ। নরম ভাপ ওঠা রোদ। লোকটা বারান্দায় বসে এসব দেখে আর ভাবে, ভাবে আর দেখে। পাখির কিচিরমিচিরেও স্থির হয়ে আছে যে স্তব্ধতা সেটুকুই এখন তার সম্বল। ভালো লাগে উনার, ভালো লাগে পেরিয়ে আসা একটা জীবন।

কত বয়স ছিল যখন জেঠুর পিঠে চড়ে নিজেকে তুর্কী বীর সৈনিক মনে হতো? ভাবতেন বিশাল তলোয়ার ঝোলাবেন কোমরে সাথে থাকবে শিরস্ত্রাণ। কিংবা কোরবানীর হাটে বাবার আঙুলে আঙুল জড়িয়ে পশু নির্বাচন! ঈদ আসতো যেন অসহ্য এক খুশী নিয়ে। গোলাম রহমান, আতাউল্লাহ, মাঈদুল সবাই আসতো ঈদের নামাজ শেষে। বীরেনটাও আসত। কেউ তো বলেনি কখনো, ‘ওরে বীরেন তুই এলি কেন, তুই না হিন্দু?’ মা বসে থাকতো হরেক রকমের খাবার আগলে। দাওয়ায় পা লম্বা করে পিঠ সামনের দিকে ঈষৎ বাঁকিয়ে আলুথালু বসে থাকা মায়ের সেদিন আর অবসর হতো না ওভাবে বসে জিরোবার। বাবা, দাদু, জেঠুর রসনা তৃপ্ত হলে ফের ওদের নিয়ে ব্যাস্ত হতো মা। সরু চালের ভাত আর গরুর গোশতের ঝাল তরকারী, খাসীর গোশতও থাকতো বীরেনের জন্য সাথে কত রকমের পিঠা, কত তার নকশা। খেতে খেতেও উনারা যেন ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। তখন উনার বয়স ছিল কত?

এরপরে এক সময়ে গ্রামের এই বাড়ী ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমানো। ততদিনে দাদু, জেঠু নেই। ততদিনে উনি জানেন তলোয়ারের চেয়েও ধারালো এ.কে ফোরটি সেভেন। কাঁধ আঁকড়ে ঝুলে থাকে কাটা রাইফেল অথবা কোমরে শোভা পায় পিস্তল, উনি জানেন। জেঠুর প্রয়োজন এখানেই শেষ হয়ে যায় অন্য কোনো জীবন শুরুর বিনিময়ে। হলের জীবন তো সহজ জীবন নয় কেবল বাড়ীর বড়দের শাসনের কঠোরতা নেই এখানে। অবাধ স্বাধীনতা। কত মিছিল, কত মিটিং। ইউনিভার্সিটির ক্লাসই জীবনে মুখ্য নয় উনি জেনে যান গ্রামের চেয়েও বড় এক জীবনে উনি ঢুকে পড়েছেন। তিনি উৎফুল্ল, তিনি আনন্দিত। গোলাম রহমান বা আতাউল্লাহর কাঁধে হাত পেঁচিয়ে যেভাবে মাঠ ঘাট চষে বেড়াতেন, নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতারের কম্পিটিশন দিতে দিতে প্রাণপনে একে অপরকে ডেকে উঠতেন বন্ধু বন্ধু বলে। এখানে জীবন তেমন নয়। এখানে আছে প্রিন্স, অভি, মামুন যারা সবাই ওর দোস্ত। এখানে গলা জড়িয়ে ধরা নেই। প্রাণ দিয়ে বন্ধু বলে ডেকে ওঠা নেই। ওসব করে ক্ষ্যাতরা, উনি এখন সব জানেন। পকেটে টাকা না থাকলেও যাও আজিজ সুপারে, খেতে হলে মৌলী, সিলভানা নাহলে আড্ডা দাও মধুর ক্যান্টিন, ক্যাফেটেরিয়া বা ক্যাম্পাস শ্যাডোতে, ডাস বা টিএসসিতে। টাকা ভূতে যোগায়, টাকা অস্ত্রের জোর জোগায়।

কেমন কেমন করে জীবনের এই সময়টুকুও তার পার হয়ে যায়। চুকে যায় পড়াশোনার পাট। ঝুটা কাপড়ের ব্যাবসাতেও বাতাস লাগে যেন। দোস্তদের সাহায্য নিয়ে কি করে টিকে থাকতে হয় উনি জানেন, জেনে যান। অন্যের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে হয় ব্যাবসা তিনি জানেন। টেন্ডারে কিভাবে জিতে নেয়া যায় সব অলিগলি তিনি ঠিক ঠিক জানেন। ইউনিভার্সিটির জুনিয়র, রূপবতী মেয়ে দিনাও হয়ে যায় তার ছায়া। এরপরে কি আর পেছন ফিরে তাকায় কেউ? বড় ভাইকেও নিয়ে নেন নিজের সাথে ব্যাবসায়। বাবা মা খুশী। গ্রামের বাড়ি পড়ে থাকে বাড়িতেই। বাবা মা ভাই ভাবী আর দিনাকে নিয়ে মধুর এক সংসার। এরপরে তো পরপর তিনটি ছেলের জন্ম। ভাইভাবীর আবার উলটো তিন মেয়ে এক ছেলে। ততদিনে সবার আলাদা বাড়ি। বাবা মাও চলে গেছেন না ফেরার জগতে। এখন ঈদ মানেই সেমাই জর্দা, পোলাও বিরিয়ানী, মাটন কারি, রোস্ট আরো কত কি! সবই অভিজ্ঞ বাবুর্চির রান্না। পরিপাটি, সুস্বাদু। এছাড়া আছে শপিং। উনার এত সময় কই? এসব কেনাকাটা তো কম ঝামেলার নয়। প্রায় সাত দিন ধরে অফিসের ম্যানেজার তার দলবল নিয়ে সব কিনে টিনে আনে। লোকটাকে কিছুই ভাবতে হয়না। উনার ভাবী আর দিনাই ছোটাছুটি করে সব ম্যানেজ করে। গ্রামের একে এই দাও, তাকে সেই। নিজের বাচ্চাদের তো কথাই নেই। একেকজন জন্মদিনে গাড়ি পায়, দামী মোবাইল ফোন বা দামী ভিডিও গেইম প্লেয়ার পায় আর চলে রাতভোর পার্টি। সেইসব পার্টিতে চলে দেশ বিদেশের নানা খাবার। পিজ্জা, লাজ্জানিয়া, পাস্তা, কাচ্চি, নান, ফ্রায়েড চিকেন, আইসক্রিম, ফ্রেশজুসসহ আরও কত কি! বড়দের জন্য অন্য রকম পানীয়। আবার অনেকসময় দেশে পোষায় না, চলে যান সবাইকে নিয়ে দেশের বাইরে। পালটে গিয়েছে জীবনযাত্রা, সবই উপভোগ করেন তিনি। লোকটা বুদ্ধিমান। তিন ছেলেকেই বিদেশে পড়িয়েছেন। এখন একজন দেশে, অন্য দুজন বিদেশে থেকে ব্যাবসা সামলায়। দিনা মারা যাবার পর নিজেকে তিনি নির্বাসন দিয়েছেন বাবা মায়ের রেখে যাওয়া এই গ্রামের বাড়িটিতে। জীবন নিয়ে তার কোনো আক্ষেপ নেই, চাওয়া পাওয়া নেই। সুখি এক মানুষ। শুধু মাঝে মাঝে ছেলেদের কাজে বা ব্যাবসার প্রয়োজনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এর দায়িত্বটুকু তাঁর কাঁধে এসে পড়ে। তিনি সানন্দে তাঁর যোগাযোগের তারগুলো দিয়ে ছেলেদেরকে আরো ভালোভাবে আঁটোসাটো করে বেঁধে দেন। উন্নতি আর উন্নতিতে ছেলেরাও ভরে উঠছে। ছেলেরা বাবাকে অনুযোগ করে, ডাকে, ‘বাবা চলে আসো। নাহয় তোমার নিজের এপার্টমেন্টেই থাকো কিংবা আমাদের কারো সাথে আর তা না পোষালে বিদেশের ভাইয়ের কাছে, আসবে?‘ লোকটা হাসেন।

লোকটা তার গ্রামের বাড়ীটাকে গড়েছেন যেন রাজপ্রাসাদ। দোতলা ডুপ্লেক্স। এসি, জেনারেটর, আরাম আয়েস কি নেই তার? হ্যাঁ একটা জিনিস নেই। নেই গোলাম রহমান, আতাউল্লাহ, বীরেন কেউই। তাদেরকে ডাকলেও তারা আর আসেনা, এলেও কেমন জড়োসরো। তাদের কাঁধে হাত পেঁচিয়ে নদী পাড়ি দিতে ইচ্ছে জাগে তাঁর। গলাগলি করে হেঁটে যেতে ইচ্ছে করে মাঠের পর মাঠ। ভুলে যেতে চান এতদিনের দূরত্ব, ব্যাবধান। সময় এমনই এক ঘাতক। কখন নিহত করে রেখে গেছে তার ছেলেবেলাকে, ছেলেবেলার বন্ধুদেরকে উনি টেরই পাননি। এই কিছুদিন আগেও তো মাঈদুলটাকে যাকাতের টাকা পাঠাতো তাঁর বউ দিনা, সাথে শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা জোড়ায় জোড়ায়। ‘আহা ওরাই তো হক্কদার,’ এটা ছিল দিনার ভাষ্য। তিনি কৃতজ্ঞ হতেন দিনার প্রতি। ভাবতেন, ‘দেখো কান্ড! কতদিকে চোখ আমার বউটার।‘ তারপরও এখানে এসে দেখেন তিনি, তাঁর নিজের উচ্চতায় এতটাই বাড় যে উনার বন্ধুরা আর তাঁর নাগাল পায় না। এমনকি মোসাহেবী করবার জন্যেও যতটা লম্বা হতে হয় উনার বন্ধুরা তার চেয়েও অনেক নীচে পড়ে গেছে। লোকটা তাই একা। তবু তাঁর ভালো লাগে এই গ্রাম। এসি রুম ছেড়ে উনি বসে থাকেন নীচতলার খোলা বারান্দাটায়, যেখান থেকে দেখা যায় দূরের রূপালী নদী। ঝাপসা হয়ে আসা কালচে সবুজ গাছপালা। বাসার সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষ বা শিশুদের কলতান দেখতে উনার ভালো লাগে। ভালো লাগে জীবনের এই বেঁচে থাকা।

কদিন আগে ইটালী থেকে এসেছেন উনি। ছেলেদের ডাকে, ব্যাবসার প্রয়োজনে যেতে হয়েছিল। ওখানেই শুনেছেন কোভিড ১৯ বা করোনার কথা। এসব নিয়ে ছেলেরা তাকে বিস্তর জ্ঞান দিয়েছেন কেননা উনি এখন টিভি দেখেননা, ফেইসবুকিং করেন না। উনি কাজের লোক ছিলেন। এসবের জন্য সময় ব্যয় করাটা তার অপচয় বলে মনে হয়। তারপরও ছেলেরা তাকে হোয়াটসএপে এই রোগের নানা তথ্য পাঠায়। উনি একা মানুষ। বাসায় কিছু কাজের লোক ছাড়া আর তো কেউ নেই। তাই আইসোলেশনের কথা ভেবে উনি হাসেন। আর তাছাড়া ইতিমধ্যে একুশ দিন তো পার হয়েই গেছে! পরশু বীরেনটা এসেছিল। খুব কাঁচুমাচু মুখে কিছু টাকা চাইতে। ঢাকায় নাকি লকডডাউন শুরু ঝয়ে যাবে। তাই ওর ছেলে টাকা পাঠাতে পারছে না। বেতন পাওয়া না পাওয়া নিয়ে ছেলেটা নাকি নিজেই দোটানায় আছে। অনেক ইচ্ছে করছিল বীরেনের সাথে আড্ডা দিতে। কিনতু কি আড্ডা দেবেন? সামনে বসে থাকা চাষাভুসা মার্কা এক বৃদ্ধ যার শিক্ষাগত যোগ্যতা ম্যাট্রিক ফেল তার উপর সে এসেছে দয়া চাইতে, তার সাথে কি আর আড্ডা জমে? উনি বীরেনের প্রত্যাশার চেয়েও বেশী টাকা গুঁজে দেন ওর হাতে আর নরম স্বরে বলেন, ‘আমি তো আছিই। ছেলেকে বলিস চিন্তা না করতে। যখনই টাকা লাগবে চলে আসিস।‘ বীরেন নত চোখে, নত হাতে টাকা নিয়ে চলে যায়। আর উনি ভাবতে বসেন, এতটা আশ্বাস দেয়াটা ঠিক হলো কি? শেষে তো এরা অলস হয়ে উঠবে! নাহ এরপরে আর এতটা আস্কারা দেয়া ঠিক হবে না। আবার ভাবতে বসেন বীরেনের ছেলেটাকে তার কোনো প্রতিষ্ঠানে ঢুকিয়ে দেবেন কিনা। তাহলে অফিসে নিজেদের লোকদের পাশাপাশি একেবারে নিজস্ব কিছু স্পাইও তৈরী করে রাখা যায়। কে কি করছে, কি হচ্ছে কোন অফিসে সেগুলোও ছেলেরা সব খবরাখরর রাখতে পারবে। কারণ ইদানীং বড় ভাইয়ের মেয়েজামাই আর ছেলেটার সাথেও ভালোই গোলমাল চলছে উনার ছেলেদের। পরক্ষণেই মনে হয়, কি দরকার! অযথা গ্রামের এইসব লোকজনকে নিয়ে এত টানাটানি করবার? যার যার জীবন তার তার কর্মফলের দান। তিনি কে এসব ঠেকাবার? বরং খামোখা ছেলেরা বিরক্ত হবে। বলবে, ‘বাবা গ্রামে গিয়ে সমাজসেবার পাশাপাশি যতসব ছাইপাঁশ করে বেড়াচ্ছে।‘ কিংবা হেসে হেসে বলবে, ‘বাবা এবার কি তুমি রাজনীতিতে আবার সক্রিয় হবে?

ইলেকশন/টিলেকশনে দাঁড়াবে নাকি? তাহলে কিনতু মন্দ হয় না!’ এসব ভাবতে ভাবতেই উনার মাথাটা কেমন ভার ভার লাগে আর শরীরটা এত দুর্বল বোধ হয় যেন আর উঠে দাঁড়াতেই পারবেন না। তবু উনি উঠে দাঁড়ান। কোনো রকমে টলতে টলতে দোতলায় উঠে যান আর বেডরুমে রুমে ঢুকে নিজেকে বিছানায় এলিয়ে দেন। একটু ঘুমালেই সব ঠিক হয়ে যাবে, লোকটা ভাবে।

ঘুম যখন ভাঙ্গে তখন সন্ধ্যা কি রাত টের পাননা। শুধু টের পান কেমন জ্বর জ্বর লাগছে। উনার সাথে চার জন কাজের লোক থাকে। সবাই পুরুষ, নানা বয়সের, নানা যোগ্যতার। একজন শেফ, একজন বাটলার, একজন ক্লিনার আর একটা তরুন ছেলে নাম আরিফ। ছেলেটা গ্রাজুয়েট। উনার পিএস। ছেলেটা সারাক্ষণ উনার আশেপাশেই থাকে। উনি জানেন আরিফ উনার দরজার বাইরেই আছে তবু ওকে ডাকবার শক্তিও যেন উনার নেই। কোনোরকমে হাত বাড়িয়ে বেল টেপেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের দরজা খুলে আরিফ ভেতরে ঢোকে। আলো জ্বালিয়ে উনার দিকে তাকায় আর উদ্বিগ্নস্বরে ‘স্যার কি হয়েছে? খারাপ লাগছে? স্যার?’ বলতে বলতে খাটের দিকে ছুটে আসে। উনি কেবল বলতে পারেন, আমি টয়লেটে যাব।

এর পরের কয়েকটা দিন অন্যদের জন্য অনেক দ্রুত কাটলেও উনার জন্য সেটা হয়ে ওঠে ভয়াবহ। ঘুম আর জাগরণে উনি কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে এগুতে থাকেন। জ্বর, কাশি, পেটে ব্যথা, মাথা ব্যথা সব মিলিয়ে অসহ্য বিষয়। আর শ্বাসকষ্ট যেন ক্রমেই বাড়ছে। নিঃস্বাস নিতে এত কষ্ট? উনি দেখেন বাসার প্রেক্ষাপটও যেন কেমন বদলে গেছে। অফিসের বেশ কিছু লোক চলে এসেছে উনার বাসায়। উনার রুমের বাইরে তাদের ত্রস্ত আনাগোনা টের পান উনি যদিও কাজের লোকজনও খুব একটা সামনে আসেনা। এলেও সবার মুখে মাস্ক। অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে উনার নাকেমুখে ঢুকছে অক্সিজেন। তবু যেন আরাম নেই। অনেক কষ্টে ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় উনি ম্যানেজারকে বলেন, ‘আমার ছেলেরা কই? ওরা আসেনি? ছেলেদেরকে খবর দাও, এখানে আসতে বলো।‘ ম্যানেজার একটু অস্বস্তি নিয়ে তোতলাতে থাকে। আরিফ এসে বোঝায়, ‘স্যার এখন উনারা কিছুতেই আসতে পারবেন না। ঢাকায় লকড ডাউন চলছে। প্লেন থেকে শুরু করে গাড়ি ঘোড়া পথ ঘাট সব বন্ধ স্যার। একটু ধৈর্য্য ধরুন।‘ ভিডিও কলে আরিফ উনাকে ছেলেদের সাথে কথা বলিয়ে দেয়। বড় ছেলে অনুযোগ করে, ‘তোমাকে নিষেধ করেছিলাম বাবা ওখানে থাকতে, শুনলে না আমাদের কারো কোনো কথা। এখন ওখানে, ওই গন্ডগ্রামে কি করে চিকিৎসা করাব তোমার, বলো?’ আবার কখনো নাতি নাতনীরা কথা বলে, ‘গ্র্যান্ডপা গেট ওয়েল সুন’ উনি ঘোলা চোখে তৃষ্ণার্তের মতন ল্যাপটপ বা ফোনের ডিসপ্লের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

কদিন গেছে উনি জানেন না। উনি এখন হসপিটালে এটা বুঝলেন কি বুঝলেন না কে জানে! উনি দেখলেন সারা শরীরে কি সব পরা, হেলমেট লাগানো অনেকগুলো নারী পুরুষের ছোটাছুটি। আরিফ বলেছে, ছেলেরা চীন থেকে ডাক্তার, নার্স আনিয়েছে। উনার ভালো চিকিৎসা চলছে। কেন জানিনা শারিরীক এত কষ্টের ভেতরও উনি গোঁ গোঁ করে বললেন, ‘একবার আইমানকে আসতে বলো, ওকে দেখতে ইচ্ছে করছে’ আইমান উনার ছোট ছেলে। আরিফ বলে, ‘স্যার অফিসের সবাই আমরা আছি এখানে। আপনি চিন্তা করবেন না। আর আপনার নাতি নাতনীদের সেইফটির জন্যে আপনার ছেলেরা আসতে পারছে না। ডাক্তারের নিষেধ আছে।‘ উনি হতাশ হলেন কি?

আজ লোকটা চলে যাবেন। তার বুকের ভেতর এতটুকু নিঃশ্বাস অবশিষ্ট নেই। উনি তার কিছুই জানেন বা বোঝেন না। স্নেহের কোনো হাত উনার কপালে পড়েছে কি না তা নিয়েও নেই কোনো মাথাব্যাথা। শুধু ডাক্তাররা আর আশেপাশে যারা রয়ে গেছে তারা জানে উনি চলে যাচ্ছেন। কিনতু লোকটা তখন মাকে ডাকছে। দাওয়ায় বসে মা চিকন চালের ভাত আর ঝাল গরুর গোশত বেড়ে দিচ্ছে কালাই করা বাসনে। উনি বলছেন, আমার কষ্ট হচ্ছে মা। মা উনার কপালে হাত রাখলো। মায়া মায়া হাত। উনি বুঝলেন, মা ছাড়া আসলে এক জীবনে আর কেউই থাকেনা যে শুধুই ভালবাসে। উনি তখন মায়ের শরীরের ভেতর আরো ঘণ হয়ে ঢুকে পড়েন। উনি যেন মায়ের পেটের ভেতর চলে যেতে চান, এমনই ইচ্ছে জাগে মনে। বাইরে তখন প্রবল বৃষ্টি। উনি দেখতে চাইলেন জানালাটা বৃষ্টির ছাঁটে ভিজছে কিনা। কাউকে ডাকতে হবে, জানালা আটকাতে হবে, এইসব ভুলে উনি তখন বৃষ্টি কণাগুলোর সাথে সারা গ্রামময় ঘুরতে শুরু করলেন।

অনেক দূরে তখন মায়ের পেটের ভেতর একজন কাতরাচ্ছে ব্যথায়। যে শরীর সে চেনে না সেই শরীরের ব্যথাবোধ তাকে অবাক করছে। সে পরিচিত হচ্ছে কষ্টের সাথে, ব্যথার সাথে। সে তখন বাইরে আসবার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টায় ব্যাস্ত। সে ভাবছে, হয়তো একবার বাইরে বেরুলেই এই ব্যথা থাকবে না আবার ভাবছে যদি থেকেই যায়? সে বোঝে এইসব ব্যথা নিয়েই তাকে নামতে হবে পৃথিবীর বুকে। পরে কি হবে সেটা পরে ভাবা যাবে। আপাততঃ পৃথিবীই গন্তব্য। পৃথিবী আসলে কেমন? জীবনই বা কি? অনেক মানুষের উল্লাস, হাসি আনন্দ শুনতে শুনতে সেও কেমন ঘোরলাগা চোখে তাকায়। সে দেখে জল। সে দেখে বৃষ্টি কণাগুলোর হাত ধরে কেউ যেন চলে যাচ্ছে। ছায়া ছায়া কেউ। চলে যাচ্ছে ভেজা ভেজা হয়ে দূরে আরো দূরে। যে যাচ্ছে সে যেন হাসছে মুক্তির আনন্দে। সে তাকিয়ে থাকে অপসৃয়মান ছায়াটার দিকে। আর তার কান্না পায়, ভীষন কান্না। বন্দিত্বের যন্ত্রনায়, নতুন পৃথিবী কেমন জায়গা, ভয় কি তাহলে এটাই? এসব ভাবতে ভাবতে তারস্বরে সে চীৎকার করে ওঠে। বাইরে তখনো প্রবল বৃষ্টি।

একটি শিশু মায়ের নিরাপদ কোলে। সে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। দূরে বিস্তীর্ণ ভূমি, কি দারুণ বিস্তৃত। রোদ থেকে ঝলসে উঠছে কাকলী, প্রাণের কাকলী। বাতাসে শিস দিচ্ছে দুলে ওঠা কচি ধানের সবুজ। নরম ভাপ ওঠা রোদ। পাখির কিচিরমিচিরেও স্থির হয়ে আছে যে স্তব্ধতা, যে নীরবতা তার ভালো লেগে যায়, ভালো লাগতে শুরু করে সব কিছু, ভালো লেগে যায় নতুন এই জীবন। সে হাসে।

তোমাকে মান্যবর

Scr

কদর্য রাজার একদল জিঘাংসার কালিতে লিখে দিচ্ছে দৈনিক প্রতিদিন। নাট্যমঞ্চে সং সেজে একদল কুশীলব লিখে যাচ্ছে যাবতীয় অভিনয়। একদল মুখের নেকাব সরিয়ে আত্বস্থ করছে গালিবিদ্যা। ওখানে এখন খিস্তি-খেউরের বসন্ত উৎসব। নর্দমার নোংরা ঘেটে ঘেটে তুলে আনা দুঃশাসনের কাল!

এখানে চাল ডাল নুন তেল পান্তা আনতেই যাদের অকাতরে ঝরে যায় জীবনের ক্লেদ, অবশিষ্ট কাল; তারা ঠিক কবে প্রাত্যহিক দুর্বিসহ জীবনের ধারাপাত আত্বস্থ করে শেষবার আরেক মানুষকে বলেছিল ‘ভালো থেকো’ আর মনে নেই।

এখানে পশু ও পাশবিক ভঙ্গিকা রপ্তকারীরা অনায়াসে লিখে মানুষের সংবিধান! এখানে তাবৎ দুঃশাসকেরা আকাশের সামিয়ানা জুড়ে টাঙ্গিয়ে দিয়েছে নোটিশসমগ্র; এখানো বিদ্রোহ মানা, মাথা তুলে দাঁড়ানো যাবে না!

শোন হে মান্যবর তুমি ইতিহাস শেখোনি? জানো না মানুষের মাথা খুব বেশিদিন মাটিতে থাকে না?

সভ্য যুগে ত্রাসের রাজত্ব

299

সভ্য যুগের সভ্য মানুষ
স্বার্থের ধান্দায় থাকে বেহুশ,
মন্দের কদর ভালোর দোষ
ধর্মের বাণীতেও হয়না হুঁশ!

ধর্মের বাণী করে শ্রবণ
করে না কেউ দুষ্টের দমন,
পুণ্যের আশায় তীর্থে গমন
ফলায় না সভ্যতার ফলন।

সভ্য যুগে অসভ্যের শক্তি
দুষ্ট লোকদের করে ভক্তি,
জ্ঞানী লোকের খণ্ডন যুক্তি
কী করে আর মেলে মুক্তি?

সভ্য যুগের দেশ-বিদেশে
অসভ্য সভ্যতার সাথে মিশে,
অশিক্ষিত থাকে শিক্ষিত বেশে
ত্রাসের রাজত্ব দেশে-দেশে।

বীণাপাণি বনাম খেয়ালী

তিন
প্রভাতে উভয় সেনা করিল সাজন
কুরুক্ষেত্রে গিয়া সবে দিল দরশন
যে যার লইয়া অস্ত্র যত যোদ্ধাগণ
সিংহনাদ করি রণে ধায় সর্বজন

দিদিমার মুখে শুনে শুনে অর্ধেক কাশীরাম দাস মুখস্থ চাঁদের। খেলা দেখতে দেখতে হঠাৎ তার নবম দিনের যুদ্ধ মনে পড়ে গেল — দ্রোণাচার্যের পতন।

কিন্তু চাঁদ চিরকাল এক পয়ার থেকে উড়ে আর এক পয়ারে ডানা মুড়ে বসে। থঙ্গরাজের মতো হাইট বীণাপাণির গোলি কেষ্টদা, সে যেই খেয়ালীর স্ট্রাইকারের পায়ে ঝাঁপিয়ে গোল বাঁচিয়ে দিল, ওমনি জিভ নড়ে ওঠে একশো আট নামে :

হিরণ্যকশিপু-র উদর-বিদারণ
প্রহ্ললাদে করিলা রক্ষা দেব নারায়ণ
বলীরে ছলিতে প্রভু হইলা বামন
দ্রৌপদীর লজ্জা হরি কৈলা নিবারণ

শুণ্ডে শুণ্ডে জড়াজড়ি লেগে গেছে। কালমার্তণ্ড দাপিয়ে বেড়ায়, তাদের বুটের স্পাইকে খুরজ-খুরজ হয়ে গেল ঘাসের জনসমাজ। পায়ে পায়ে চার্জ ফেটে পড়ছে দোদমার মতো, কালো কাদা ছিটকে দর্শকের চোখেমুখে। প্রাণ জায় পর সম্মান না জায়। চাঁদের চোখ হাঁ ক’রে থাকে, গায়ে করলাকাঁটা, আর তার পা-সন্ধির পটল লোহাশক্ত হয়ে উঠেছে উত্তেজনায়। প্যান্টের পকেটে বাঁ হাত ঢুকিয়ে মুঠোয় ধ’রে থাকে, থুতনি ধক ধক ক’রে ঘোরে যেদিকে বল, আর ঠোঁট বাতাসের বেগে বিড়বিড় করছে পাঁচালি। এইমাত্র শিনবোনে বুটের লাথি খেয়ে বংকাকে ছটফট করতে দেখে চাঁদ আবার স্লিপ ক’রে লক্ষ্মীবন্দনায় চলে গেল :

বৃদ্ধা বলে পতিহীনা আমি অভাগিনী
কী কাজ শুনিয়া মম দুঃখের কাহিনি
পিতাপুত্র ছিল মোর অতি ধনবান
সদা ছিল মোর ভাগ্যে লক্ষ্মী অধিষ্ঠান…

চার
ফ্রিকিক ভন্ডুল ক’রে হলুদ কার্ড দেখেছিল পিকু, কিন্তু খেয়ালী এই লঘুদণ্ডে রেগে আরও লাল, কারণ তাদের কোচ কাম নির্ভরযোগ্য লেফট ব্যাক অপরেশ মুখার্জি মাঠের বাইরে শুয়ে, কোমরে বরফ ঘষা চলছে। টিম বেশ গগন-গগন খেলছিল, আর পনেরোটা মিনিট কাটাতে পারলে…! তারপর তোদের যেতে হবে না আমাদের পাড়ার ওপর দিয়ে সরকারি লাইব্রেরিতে, কামদেবপুর হাটে যাবি না অথবা কল্যাণী? ধ’রে ক্লাবঘরে বেঁধে রেখে দেব!

কিন্তু শুধু বল উড়িয়ে চললে কাদামাঠে অর্ধেক শট কেটে গিয়ে নিজেদেরই গোল লাইন টপকে দৌড়োয়। এই নিয়ে ন’নম্বর কর্নার পেল বীনাপাণি। পিকু ভয় খেয়ে নীচে নেমে গেছিল, আবার গুটিগুটি সেকেন্ড বারে এসে দাঁড়িয়েছে। নবদার কিক, কিন্তু খেয়ালির রজতদা, গিয়াসুদ্দিন এত লম্বা যে বলে অন্য কারও মাথা লাগানোর সুযোগ এন আই এল — নিল। তবু লবটা উঁচু হয়ে এগিয়ে আসছে, উঁচু হচ্ছে স্টপারদের মাথা, পিকু ভেবে নিল তার সামনে কেউ নেই — বল আর সে আর গোলপোস্ট। বাঁপায়ের বুড়ো আঙুলে গোটা শরীরের ভর এনে ডান পা মাটির সমান্তরালে কোমর পর্যন্ত তুলে ভলি নিল। কী আশ্চর্য, সব লাফানো মাথা এড়িয়ে বল সত্যিই পিকুর পায়ের কাছে গোঁত খেয়ে পড়ছে, পিকুর শটটা বল পৌঁছোনোর দু’সেকেন্ড আগে শেষ হয়েছে শুধু। কিন্তু নটরাজের মতো ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের ওপর বিদ্যুততাড়সে ঘুরে যেতে যেতে ছেলে সেটা বুঝে ফেলেছে। ঘূর্ণন না থামিয়ে আর এক চক্র কাটল সে, এবং দ্বিতীয় আবর্তনে ফের আগের জায়গাতে পৌঁছে পায়ে-বলে কানেক্ট করল। দ্বিতীয় পোস্টের কোনা দিয়ে বল জড়িয়ে গেল জালে।

জন্ম ধর্ম কর্ম

30fg

জন্ম সবার একইভাবে, ধর্ম ভিন্ন-ভিন্ন,
কর্মও ভিন্ন, তবুও কেউ ধন্য কেউ নগন্য।

কর্ম যার ভালো, ভাগ্যও হয় ভালো,
যদিও হয় কালো, জ্ঞানে বাড়ায় আলো।

মাথার মগজ একইরকম, জ্ঞান হয় ভিন্ন,
কেউ হয় সভ্য মানুষ, কেউ আবার বন্য।

জন্ম, কর্ম, ধর্ম, ভিন্ন-ভিন্ন মতান্তর,
এভাবেই চললে জগৎ, চলবে যুগযুগান্তর।

অল্পতে হও খুশি!

298

হরি বলে হরি, আমি ক্ষুধায় মরি!
দাও কিছু মোরে, পেটখানা ভরি।

হরি বলে হায়, বলি যে তোমায়,
কর্ম দোষে মরে ক্ষুধার জ্বালায়!
যার যার ভাগ্য কর্মতেই বদলায়,
কর্মতেই শাস্তি ভোগ কড়ায় গণ্ডায়।

হরি বলে হরি, বুঝতে না পারি,
অভাবে স্বভাব নষ্ট, নিজে কি করি।

হরি বলে শুনো, নেইতো অভাব,
শুধু অভাব,অভাব, এটা স্বভাব!
আছে প্রচুর, তবুও অভাবী ভাব,
অল্পতে হইও খুশি, গুছবে অভাব।

হরি বলে হরি, যদি যাই মরি,
বলবো না কবু আর ক্ষুধায় মরি।

মায়ের কোল বাবার আদর

299

মায়ের কোলে নিরাপদে
থাকতাম চুপটি করে,
সেই নিরাপদ হলো মাটি
মা যখন মরে।

বাবার সাথে ঘুরতে যেতাম
বাবার কাঁধে চড়ে,
সেই আনন্দ হলো মাটি
বাবা যখন মরে।

নষ্টের শিকার

2974

মানুষ আপনাকে
আপনার পাশে দীর্ঘ পথ চলতে প্রতিশ্রুতি দেবে
দরজার প্রথম পদক্ষেপ থেকে
অজস্র মানুষের ভিড় ঠেলে,
স্বতঃসিদ্ধ নির্জনতা পেরিয়ে অদৃষ্টের গন্তব্য পর্যন্ত।

কেউ কথা রাখে আবার কেউ রাখে না
আপনি কি পেয়েছেন
আপনি কি পাননি তা আপনার হৃদয় জানে।

মানুষ তার এক জীবনে ভেতরের কষ্ট
পরিচিত মানুষের ভিড় ঠেলে
গোপন করতে পারলেও একদিন জনসম্মুখে আসবে
আপনার প্রতি কেউ সহানুভূতি দেখাবে
আপনার প্রতি কেউ ভালবাসার হাত বাড়িয়ে দেবে
আসলে তারাই প্রকৃত মানুষ
যারা কথা রেখেছে কথা রাখে কথা রাখবে।

তারা যদি কথা রাখতো তাহলে
তাদের জীবনী অন্য ভাবে লেখা হতো
আজ হয়তো বিদ্রোহ হতো না
হৃদয়ের ভেতরে কান্নার আওয়াজ শুনতে পেতনা
তাইতো কারও স্মৃতি লেখা হয়
কষ্টের দাবানলে জ্বলতে জ্বলতে
কারও জীবন পেয়ে হয়তো ঘরেই কেটে যায়।

দয়া মায়া স্নেহ ভালবাসার বিপরীতে
কারও জীবন হয়তো এভাবেই কেটে যায়
কারও জীবন হয়তো প্রকাশ হয়
প্রকাশিত সেই জীবনের গল্প মানুষের সামনে আসে
হয়তো তখনই কেবল জানা যায়
সেই জীবনের গল্প।

আমাকে কেউ একজন
জীবনের দীর্ঘ পথে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো
বলেছিলো আমাদের শরীর ফুটে বেরিয়ে আসবে অন্য শরীর।
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ক্ষণস্থায়ী এই জীবনে
হাতে হাত ধরে পৃথিবীর শেষ গন্তব্যে পৌছাবে
এই ঘর থেকে এ রাস্তা থেকে
মাতৃভূমির এক পথ থেকে আরেক পথে
মানুষের জনসমাগম থেকে নির্জনতা পর্যন্ত।

আমি বিশ্বাস করেছিলাম তাকে
আমি কথা দিয়েছিলাম তার সময়ের সঙ্গী হবো
অসময়ের সঙ্গী হব জীবন থেকে পর জীবনের সঙ্গী হব।

এই সংক্ষিপ্ত জীবন আজ বড্ড একা
এই একাকী জীবন নিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর শেষ উপত্যকায়।
এই দীর্ঘ পথের পরে জীবনের কোন বিশ্রাম ছিল না
পায়ের নরম কোমল পৃষ্ঠদেশ ফোস্কা পড়েছে
কিন্তু অন্তহীন পথ একাই চলেছি কিন্তু গন্তব্য জানা নেই।

আমি হয়তো ঈশ্বরকে দেখিনি
শুনেছি ঈশ্বর মানুষের হৃদয়ে বাস করে
মন্দিরে মসজিদে ঘোরাঘুরি করে
কিন্তু যে মানুষ ভালোবাসায় বিশ্বাসী
তার হৃদয়ে বাস করে কি?
আমার কাছে ঈশ্বর নামের অস্তিত্ব যেভাবে
এখন ধোঁকা বলে মনে হয়

পথ চলা পায়ের মতোই হৃদয়টা পাথর হয়েছে
চোখ হয়েছে ঝাপসা, ক্ষুধা দারিদ্রতা
এসব আমার কাছে উপভোগের ব্যাপার নয়
অনুন্নত পৃথিবীর দেশে দেশে মানুষ মরতো না অন্নহীন।

যদি প্রশ্নই করতে হয় প্রকৃতিকে কর
মিথ ঈশ্বরকে নয়
যদি প্রশ্ন করি শয়তান যখন শয়তান হয়নি তবে তাকে কোন শয়তান প্ররোচনা দিয়েছিল?

আমি জানি সময় ঈশ্বর সম্পর্কে ধারণা রাখেনা
আর ঈশ্বর সময় সম্পর্কে
দীর্ঘ পথ দীর্ঘ জীবন আর সংক্ষিপ্ত সময়
আমাদের ভেতরের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি
ঈশ্বরের অস্তিত্ব না হলেও বাস্তবতায়
সেই প্রিয় মানুষটিকে যতই ভুলে যেতে চেয়েছি
ততই ভালোবেসে ফেলেছি;

ঈশ্বর চাইলে সেই জায়গাটা দখল করতে পারত
সেই অভাবটা পূরণ করতে পারত
তার কারিশ্মাটিক ক্ষমতা বলে
ঈশ্বর হয়তো জানান দিতে পারতো
হে আমার বান্দা আমি আছি এমনটা কিছুই হয়নি সেখানেও ঈশ্বর ব্যর্থ

নাকি ঈশ্বর এসব কোন কিছুই চান না?
নাকি ঈশ্বর সৃষ্টির পরে সবকিছু ত্যাগ করেছেন? আমার কি প্রয়োজন ছিল এই পৃথিবীতে আসার?
আমার কি প্রয়োজন ছিল এত কষ্ট
এত দুঃখ এত জ্বালা এত যন্ত্রণা সহ্য করার?

প্রকৃতি যদি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়
তাহলে আমি বলব ঈশ্বর নয়
প্রকৃতি আমাকে নিয়ন্ত্রণ করছে
এই মহাবিশ্ব প্রকৃতির অবয়ব
প্রকৃতি এই মহাবিশ্বের আশ্রয়দাতা
এখানে যা কিছুই ঘটে তাতে কারো হাত নেই।

আমি চলছি একা
পৃথিবীর এই পথে পথে
দীর্ঘ পথ
অনন্ত পথ
এক আলোকবর্ষ থেকে অন্য আলোকবর্ষের অভিমুখে
এক গন্তব্য থেকে অন্য গন্তব্যের অভিমুখে
এক জীবন থেকে অন্য জীবনের পথে।

দীর্ঘদিন
দীর্ঘ সময়
আর দীর্ঘ ক্লান্তি শেষে
আমি হয়তো এভাবেই হারিয়ে যাব
পৃথিবী আমায় স্মরণ রাখবে অন্য নামে অন্যভাবে।

আমি এতটা ভালো না যে
খারাপ থাকলেও বলবো ভালো আছি
প্রকৃতি মানুষকে ভালো রাখতে জানে
কিন্তু মানুষ মানুষকে তার ভালো থাকার জায়গাগুলোকে নষ্ট করে দেয়

দীর্ঘ পথ
দীর্ঘ সময়
আর দীর্ঘ জীবন জুড়ে আমি সেই
আমি হয়তো সেই প্রিয় মানুষের দ্বারা নষ্টের শিকার।