বিভাগের আর্কাইভঃ জীবন

বীণাপাণি বনাম খেয়ালী

এক
চাঁদের বাড়ি পার হলেই দুপাশে দুই পুকুর, বর্ষায় রাস্তার ওপর দিয়ে ডান পুকুরের জল বাঁয়ে গিয়ে মেশে — বাচ্চাদের জন্যে খুব চমৎকার নদী। এখন বসন্তে শিমূলগাছের মানচিত্র থেকে ব্যাডমিন্টনের ফেদার-ককের মতো ফুল মাটিতে পড়ে থেঁতো হচ্ছে। শীত এলে তাদের ফলগুলো রোয়াঁ-জাগা পেস্তাসবুজ ছোট ছোট হাত-গ্রেনেড — শিরা বরাবর ফেটে গিয়ে তুলো উড়বে। তাছাড়া, নিরাপদ অবতরণের খোঁজে বাতাসে ভেসে বেড়াবে সূক্ষ্ম কাপাস, পেছনে একটা চিমসানো বীজ নিয়ে। ভয়ে কাঁটা হয়ে সেই পথটুকু হাঁটে চাঁদ, কলোনির যে-কোনও বাড়ির দাওয়া থেকে গুরুগর্জিত গলা না শোনা যায়, “আবার হ্যাক্কা মারতে বেরোনো হচ্ছে? এই বাঁদর, বাড়ি যা।”

রেল লাইন পেরিয়ে এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে উঠে মুক্তি! এবং মুক্তিসূর্য রেল কেবিনের মাথায় ঝুঁকে পড়েছে, তার আঁচ কাদায় পড়া ফুটবলের মতোই। এদিকে চাঁদের শার্টের সবচেয়ে নীচের বোতাম ছেঁড়া ব’লে ঘন বাতাসে জামার ঝুল পতাকা হয়ে ওঠে। পুরোনো হাফপ্যান্টটা জলকাচা হতে হতে ছোট হয়ে কুঁচকির কাছে, অথচ শরীর বড় হচ্ছে সেই সংকোচনের বিপরীত মুদ্রায়। বর্ষার জল খাওয়া পটলের মতো সেই অঙ্গকে আঁট জামাপাকড় যেন ক্ষেপিয়ে তোলে; বন্ধুরা দেখতে পেলেই টুং ক’রে আঙুলের টোকা দেবে, শুধু বাড়িতে মা বা সেজদারই চোখে পড়ে না কিচ্ছু।

কাজেই, চাঁদ খুব সাবধান — শার্টের কানাত হাওয়ায় উড়ে তাকে অশ্লীল ক’রে দেবে না তো? মাঠে একটাও মেয়ে-দর্শক নেই ব’লে দুটো দল উদোম দুই গোলপোস্টের কাছে ইস্তিরি-করা জার্সি পাট ভেঙে পরে নিচ্ছে। চাঁদ বীণাপাণি সংঘের সমর্থক হিসেবে তাদের দঙ্গলের কাছেই দাঁড়ায়, ফুটবলাররা পায়ে বল নাচাচ্ছে কাদা বাঁচিয়ে সাইড লাইনের বাইরে, কেমন লোমওলা ভারি থাইয়ের, ঝলমলে জার্সির রাজপুত্র সব; সে একটু দূরে দাঁড়াল আশায় আশায়… বল ছিটকে এদিকে এলে শট জমাবে। অথচ চটিপরা কাঠি-পায়ে প্রাণপণ কিক করলেও শটপুটের মতো সেই মহাস্থবির ফুটবল আস্তে গড়ায় প্লেয়ারের দিকে, উল্টে বলের সেলাই লেগে চাঁদের পায়ের শিরা শুলিয়ে যায়। একটু পরে সে নিজেকে নিজেই গুপ্তচর নিয়োগ ক’রে বিপক্ষ শিবিরে অভিযান করবে, শোনা যাক খেয়ালি সংঘ কী কূটকৌশল আলোচনা করছে। কিন্তু টাকমাথা সিনিয়াররা মাঠে বসে কামিনী-কৌশল নিয়ে ব্যস্ত… “এই বাচ্চা, ভাগ এখানে থেকে”! চোখভর্তি অপমান নিয়ে চাঁদ আবার বীণাপাণিতে ফিরে দেখছিল বিকাশদার গোড়ালিতে সাদা ব্যান্ডেজ, ড্রেস করছে না। ভালোই হল, বিকাশ পাল ঝুলিয়ে দেওয়া প্লেয়ার, বদলে তাদের নিবাধুই কলোনির রোগা-প্যাঁটকা পিকু খেলবে। পুরো ধানি লংকা, শুধু বিড়ি খায় ব’লে বেশি দম পায় না বুকে।

দুই
আস্তে আস্তে মাঠে ছাতাসমাবেশ দ্যাখা গেল — যত দর্শক, তত কালো বাদুড়। চাঁদের মাথা খালি; বাড়ি থেকে আসতেই দিচ্ছিল না, আবার ছাতা দেবে? মোটে মা রাঁধে না, তার তপ্ত আর পান্তা! এদিকে লম্বা বাঁশি দিয়ে ম্যাচ শুরু করে দেয় রতনদা, রোগা কিন্তু শিক্ষিত, তার চুনসুরকি ঝ’রে পড়া বাড়ির সবুজ দরজায় লেখা আছে রতন কুমার দে, এমএ (রিডিং)।

মোষযুদ্ধ লেগে গেল। প্লেয়ারদের গায়ে-ফোস্কা-ফেলা ফোঁস-ফোঁস, গলায় খোমানোর শব্দ আর অনেক দিনের পুরোনো তামাকপাতার মতো ঘামের দুর্বাস বগলে। যখন সাইড লাইনে ছররা কেটে থ্রো ইন বাঁচাচ্ছে, চারপাঁচ জন দর্শকও প্লেয়ারের সঙ্গে পড়ে গিয়ে কাদামাখা। আর বল কর্নার ফ্ল্যাগের দিকে ছুটে গেলে বাকি তিন দিকের দর্শক মাঠে নেমে আসবে ভালো ক’রে দেখার মানসে, ওমনি লাইন্সম্যান হলুদ পতাকা তুলে তাড়া ক’রে যায়। আকাশ থেকে দেখলে — কালো সমুদ্রপাখির ঝাঁক চারকোনা ঢেউ নিয়ে সবুজ ঘাসের ওপর ভাসছে।

ওই আকাশেই চাপ বেঁধে আছে মেঘের গ্রানাইট, একজন খেলোয়াড় একবার মাটিতে গড়ালেই বংশপরিচয় হারাচ্ছে, তখন তাকে অন্য প্লেয়ারের থেকে আলাদা করে কে! তবু তার মধ্যে বীণাপাণির সবচেয়ে বলশালী রাইট আউটের নাম মেথর! সে আসলে এক তরতাজা গয়লা শ্রী বারিদবরণ ঘোষ, কিন্তু মিশমিশে এবং লোহাগড়ন গতরের জন্যে ছোটবেলায় বন্ধুদের কাছে পাওয়া ওই খ্যাপানো নামেই আজ আঞ্চলিকভাবে বিখ্যাত। মেথর গরীব গ্রামবাসীদের বিদেশ বসু, বল নিয়ে কচুগাছের গোড়া ওপড়ানোর মতো ঘোঁত-ঘোঁত স্পিডে গোল লাইন পেরিয়ে চলে যায়… পেছল মাঠে তার দুর্বল ব্রেক আরওই কাজে আসছে না। এই ভাবে হাফ-টাইম জাগল। যে খেয়ালি সংঘকে বীণাপাণি যেখানে পাবে হারাবে, সে এখনও গোললেস করে রেখেছে। ভাবনার ব্যাপার!

মধ্যান্তরে মাঠে প্রচুর খোসাবাদামওলা সক্রিয় হয়ে ওঠে, ঘটিগরম ঘুরে ঘুরে হাতেগেলাসে ঝকর-ঝকর ঝাঁকুনি দেয়। কাঁচা পেঁয়াজের গন্ধ আর বাদামের খোলা ভাঙার পুট শব্দে বাতাসে ঝিম। চাঁদের হাতে পয়সা নেই, জিভে জল আছে শুধু। সে জীবনে কোনও একদিন পুরো দু’টাকার ঘটিগরম কিনে বাঁহাতে খুব সাবধানে ঠোঙাটা ধ’রে (একটা দানাও পড়ে না যায়) ডানহাতে ঢেলে ঢেলে মাঠের ফাঁকায় ব’সে খাবে। রাক্ষস ছোড়দা বা হ্যাংলা বোনটা — কেউ ধারেকাছে নেই তখন।

ভালো কথা, পিকুকে আজ খেলানো হবে না-ই ঠিক ছিল; সেভেন-এ-সাইড ম্যাচেই ও চলে, পায়ের কাজ ধুয়ে কি জল খাবো, এসব মাঠে ডিফেন্স এক টিক মারলেই পিকুকুমার চিৎ। এখন প্রথমার্ধে ড্র হওয়ার পর তাকে ঢলঢলে জার্সি প’রে সাইড লাইনে ছুটতে দেখা গেল। খেয়ালি সংঘের স্টপাররা নাকি কোনও ফরোয়ার্ড এগিয়ে এলেই তুড়ে মুখ খারাপ করছে, শুনে মাথা গরম ক’রে বার পোস্টের ছ’হাত ওপর দিয়ে মারছে বীনাপাণি। সরকারি কলোনির ছেলে পিকুর খিস্তিতে পুব-পাকিস্তানের আন্তরিকতা, কিন্তু সে মা সরস্বতীর ক্লাবের হয়ে প্রথমবার নেমে অশৈলী কিছু করল না। হাফ টাইমের পর নিজেদের হাফ লাইনের কাছে ফ্রিকিক পেয়েছে খেয়ালী, ওদের পেটমোটা ব্যাকি অপরেশদা বল জায়গায় বসিয়ে মোশান নিতে পিছিয়ে গেছে খানিক, পিকু আনমনে বলের কাছে দাঁড়িয়ে, অপরেশদা ছুটে এসে শট নেওয়ার আগের সেকেন্ডে সে বুটের এক টোকায় বল সরিয়ে দিল। ব্যাকির শটটা ফলস হয়ে গেল পুরো, ভারি শরীর ফুট তিনেক শূন্যে লাফিয়ে উঠে “বাবা রে” ব’লে দড়াম ক’রে মাটিতে।

(আর একটু বাকি)

কবি

মতি উদ্দিন শখের কবি। পান-সুপারি, বিড়ি-সিগারেট, শরাব কিংবা তহুরা অন্য কিছুতে তার আসক্তি নেই। শুধু কবিতা। কবিতা তার আরাধ্য। কবিতা ছাড়া অন্য কোন প্রার্থনা নেই।

মতি উদ্দিন নির্বিরোধী মানুষ; কারো সাতেপাঁচে থাকেন না। কাজ, ঘর এবং সংসার। এর বাইরে কবিতা।

তার সময় কম, কাজ এবং সংসারের বাইরে কবিতার জন্য সময় বের করা প্রায় সম্ভব হয় না। তবু তিনি কবি; আড়াই ফর্মার কবিতার বইয়ের জনক।

নতুন পাণ্ডুলিপি তৈরি হচ্ছে, কাজ সংসার সামলিয়ে পাণ্ডুলিপি সামলাতে তার গায়ের ঘাম ঝরছে। পাণ্ডুলিপি তৈরি করা পাহাড় কাটার চেয়েও কঠিন, ভারী পাথর বয়ে নিয়ে যাওয়ার চেয়েও কঠিন। গত কয়েকদিন ধরে এই কঠিন কাজ তিনি করছেন।

সব কাজ শেষ হলে স্ত্রী ঘুমিয়ে গেলে তিনি বসেন, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাগজ একত্র করে মমতার অক্ষর সাজান। কাটাকুটি করেন।

দীর্ঘ আড়াই মাসের পরিশ্রমে পুনরায় আড়াই ফর্মা পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়ে গেল, আনন্দে তার চোখে জল এল। পাণ্ডুলিপির খুশিতে একটা সিগারেট ধরালেন; অথচ তিনি সিগারেট খান না। অনভ্যাসের দরুন ক্রমাগত কাশতে থাকলেন, স্ত্রীর ঘুম ভেঙ্গে গেল। স্ত্রী সাহিত্য প্রেমী নন কিন্তু স্বামীর কবিতা পাগলামিতে তার সায় আছে। বেচারা কবিতায় থাকলে ভাল থাকে। স্বামীর জন্য চা বানিয়ে আনলেন।

রাতের শেষ প্রহরে স্ত্রীর চায়ে চুমুক দিতে দিতে তার মাথায় নতুন কবিতা ভর করল, তিনি পুনরায় টেবিলে বসলেন।

পাশের মসজিদ থেকে ফজরের আযান ভেসে আসছে, স্ত্রী জেগে দেখলেন কবিতার টেবিলে মাথা রেখে স্বামী ঘুমাচ্ছেন। আহারে কবি, তার মায়া হতে লাগলো। তিনি ডাকতে গেলেন কিন্তু দেখলেন স্বামী জাগছেন না।

কবিতার টেবিলে মতি উদ্দিনের মৃত্যু হল। স্ত্রী দেখলেন সাদা কাগজে কবিতার এক লাইন; ‘মৃত্যু তুমি চায়ের কাপে এলে’… স্ত্রী ভয় পেলেন। তিনি গ্যাসের চুলায় কাগজ জ্বালিয়ে ফেললেন।

মতি উদ্দিনের স্ত্রীর পুনর্বিবাহ হলো মাস তিনেক পরে, ভদ্রলোকও কবি। সার্বক্ষণিক কবি। স্ত্রীকে সারাক্ষণ কবিতায় ব্যস্ত রাখেন… স্ত্রী মাঝেমধ্যে নতুন স্বামীকেও চা বানিয়ে খাওয়ান।

আগস্ট এলে আমি কি যেন হারিয়ে ফেলি

a04d160

আগস্ট এলেই গভীর রাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়
প্রতি রাতেই ঘুম ভেঙে যায়।
জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছি
আঘাত পেয়েছি
অবহেলা পেয়েছি
অল্প শোকে হয়েছি কাতর
অধিক শোকে হয়েছি পাথর
সসীম শোকে হয়েছি নিথর
অসীম শোকে হয়েছি নিষ্ঠুর
আর আগস্ট এর শোকে হয়েছি বিমূঢ়।

আগস্ট এলেই কি যেনো একটা হারিয়ে ফেলি,
হয়ে যাই হতভম্ব, নির্বাক
হয়ে যাই হতবুদ্ধি, হতবাক
আগস্ট এলেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলি।

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো,
মুয়াজ্জিনের সুমধুর আযানের ধ্বনি
সাথে সাথেই ব্রাশফায়ারের গুলির শব্দ
গুলি আর আযানের ধ্বনির মিশ্রণ
এক অজানা ভয় এবং ক্ষোভের বিস্ফোরণ।

আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম কে যেনো বলে উঠলো,
“এই মাত্র ওরা আমাকে নিচতলার ড্রয়িং রুমে গুলি করলো”
ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায় আমার জানা ছিলো,
বুঝলাম এটা শেখ কামালের কণ্ঠ।

আমি বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠলাম,
ঘড়িতে এখন ভোর চারটা পঁয়তাল্লিশ।
কত তারিখ আজ?
মোবাইলের ক্যালেন্ডার দেখলাম
আজ ১৫ই আগস্ট
কত সাল এটা ?
আবারো মোবাইলের ক্যালেন্ডার দেখলাম
এটা উনিশ্য পঁচাত্তর সাল।

একটি ভারি নারী কণ্ঠ ভেসে এলো,
“বিচার করো”
“বিচার করো”
আরে ! এটা কী বঙ্গমাতার কণ্ঠ না?
আবারো মোবাইলের ক্যালেন্ডার দেখলাম
এটা উনিশ্য পঁচাত্তর সাল।
মুয়াজ্জিনের কন্ঠে তখন “হাইয়া আলাস ছলা”
সাথে সাথেই আবারো বিস্ফোরিত বারুদের গোলা।
এবার দুটি কন্ঠ ভেসে এলো,
“আমরা শেখ নাসের এবং শেখ জামাল বলছি”
আমি বললাম, জ্বি বলুন,
“বিচার করো”
“বিচার করো”
আমি কি যেনো একটা হারিয়ে ফেললাম।

আমি হতভম্ব, নির্বাক
আমি হতবুদ্ধি, হতবাক
আমি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললাম
বিছানায় পড়ে গেলাম।

একটু তন্দ্রা আসতেই দুটো নারী কণ্ঠ ভেসে এলো,
“আমরা সুলতানা কামাল এবং রোজী জামাল বলছি,
ওরা এই মাত্র আমাদের গুলি করলো”

আজ কত তারিখ?
এটা কী মাস?
কত সাল এটা?
বিছানা থেকে উঠে লাইট জ্বেলে
দেয়ালে ঝোলানো কাগজের ক্যালেন্ডার দেখলাম
১৫ই আগস্ট উনিশ্য পঁচাত্তর সাল।
মুয়াজ্জিনের আযানের শেষ কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে
গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত কে যেনো সিঁড়ি থেকে নিচে পড়ে যাচ্ছে !
আমি কি যেনো একটা হারিয়ে ফেললাম।

আবার বেশ কয়েকটি কণ্ঠ পর পর ভেসে এলো,
“আমি ধানমন্ডি তেরোর এক থেকে শেখ ফজলুল হক বলছি,
এইমাত্র আমার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী সহ আমাকে মেরে ফেলেছে”
“মিন্টু রোড থেকে আমি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত বলছি
এই মাত্র আমাকে এবং আমার স্ত্রী সহ তেরো জনকে ব্রাশ ফায়ার করেছে”

আমি আর বিছানায় থাকতে পারলাম না
একটু আগেই আযানের সুমধুর ধ্বনি
মিশে হয়ে গেছে অস্ত্রের ঝনঝনানি
উঠে দাঁড়াতেই শৈশব পেরিয়ে আসা এক কিশোরের কণ্ঠ,
“প্রতিশোধ নিন”
“প্রতিশোধ নিন”
আমি নিশ্চিত এটা শেখ রাসেলের কণ্ঠ।

আমি উঠে ওজু করে
ফজরের নামাজ পড়তেই
বুকের ভেতর এক ভয়ঙ্কর আগুনের
লেলিহান শিখা জ্বলে উঠলো
শরীরের সব লোম দাঁড়িয়ে গেলো
প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠেছে আমার শরীরে
একাত্তরের সকল মুক্তিযোদ্ধার সাহস এখন আমার ভেতরে
অদম্য দুর্বার প্রলয়ংকরী এক মহাশক্তির স্পন্দন শরীরের ভেতরে।

না – আমি আর কাঁদবো না
চুয়াল্লিশ বছর বাঙালিরা অনেক কেঁদেছে
চোখের সমস্ত পানি আজ শুঁকিয়ে গেছে
বাঙালিরা এখন আর কাঁদবে না
বাঙালিরা আজ শোককে শক্তিতে পরিনত করেছে
এবার প্রতিশোধ প্রতিরোধ বিচারের পালা
শোক কাটিয়ে এবার ঘুরে দাঁড়ানোর পালা
এবার জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণের পালা
বাঙালিদের এবার সোনার বাংলা গড়ার পালা।

হঠাৎ একটি প্রবল ভারী কন্ঠ – যেখানে বজ্র কণ্ঠের রেশ রয়ে গেছে,
আমি উঠে দাঁড়াতেই তিনি বললেন, বসো।
আমি বললাম, প্রিয় জাতির পিতা – আপনি কেমন আছেন?
তিনি বললেন, “আমি জানি ২১ বছরে ৪২ বছর পিছিয়ে গেছে আমার সোনার বাংলা কিন্তু আর দেরি করো না- তোমরা আমাকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে- এবার দ্রুত প্রতিশ্রুতি পুরণ করো”

আমি বিছানায় শুয়ে পড়লাম
একটু তন্দ্রা আসতেই আবার সেই কিশোরের কন্ঠঃ “প্রতিশোধ নিন – প্রতিশোধ নিন”
আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম,
“প্রতিশোধ নেবো-আমি প্রতিশোধ নেবো-তোমরা আমেরিকা কানাডা লিবিয়া যেখানেই পালিয়ে থাকো আমি আসছি প্রতিশোধ নিতে – আসছি……।”

আমার ছোট মেয়ে কণ্ঠ ভেসে এলো, “বাবা কি হয়েছে?”
আমি চোখ মেলে দেখি আমার ছোট মেয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি জানতে চাইলাম, আজ কত তারিখ?
আমার মেয়ে বললো, আজ ১৫ই আগস্ট
এবার জানতে চাইলাম, এটা কতো সাল?
উত্তর দিলো দুই হাজার উনিশ সাল।

মনের ভাবনা

298

আমি মজুর আমি গরিব আমি চির দুখী,
সারাদিনে একবেলা খাই তাতেই আমি সুখী।
নাইবা থাকুক টাকা-পয়সা প্রচুর ধনসম্পত্তি,
দিবারাত্রি খেটে মরি তবুও নেই কোনও আপত্তি।

খাই-বা-না খাই তবুও আছি অনেক ভালো,
যদি থাকতে ধনসম্পত্তি ছড়িয়ে দিতাম আলো।
সেই আলোতে আলোকিত হতো লোকসমাজ,
কেউবা হতো ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার কেউবা মহারাজ।

সুখী জীবনে দুঃখ আমার নেই তো টাকা কড়ি!
থাকতো যদি বিলিয়ে দিতাম অর্থ কাড়ি-কাড়ি।
অর্থ নেই মোর মনটা আছে দেবার সামর্থ্য নাই,
নিজেরই নাই জমিজমা তবুও বিলিয়ে দিতে চাই।

একজন দেবতা ও কিছু স্বপ্ন ভাঙ্গার গল্প

2971

29735

সময়টা ভাল যাচ্ছিল না আমাদের জন্যে। আব্বার মৃত্যু সাথে বড় ভাইয়ের সীমাহীন উদাসীনতা সব মিলিয়ে পঞ্চাশ বছর ধরে চলে আসা শিল্প-কারখানা ধ্বংসের মুখোমুখি চলে গিয়েছিল।

আমি তখন ঢাকায় একটা ম্যানুফেকচারিং কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক হিসাবে কাজ করি। ভাল চাকরি, আকর্ষণীয় গার্ল ফ্রেন্ড সহ জীবন ছিল স্বপ্নময়। বিদেশ চ্যাপ্টার মনে হয়েছিল অতীতের কিছু।

মা তখনও বেঁচে। দেশের ট্রাফিক ব্যবস্থায় তখনও মহামারী লাগেনি। ঢাকা হতে ঘণ্টা খানেকের পথ। প্রায়ই বাড়ি যাই। কোন এক উইক-এন্ডে মা দরজা আটকে সবাইকে নিষেধ করলেন কেউ যেন ঘরে না ঢোকে। আমি ধরেই নিয়েছিলাম বিয়ে করার তাগাদা নিয়ে আবারও সবক দেবেন এবং আমি শিং মাছের মত পিছলে যাব।

না, সে যাত্রায় বিয়ের কোন তাগাদা ছিলনা। মা যা বললেন তা শুনে আমি হতবাক। অব্যবস্থার কারণে আমাদের শিল্প-কারখানা হুমকির মুখে। যে বড় ভাইকে দেবতার মত বিশ্বাস করে এসেছি তিনি এখন বেপরোয়া। আয়-রোজগারের সবটার দখল নিয়েছেন ইতিমধ্যে। উনার স্ত্রী একধাপ এগিয়ে যমুনার ওপার হতে বাপের বাড়ির সবকটা অকর্মণ্যকে এখানে আনিয়েছেন। এবং ধীরে ধীরে গ্রাস করা শুরু করেছেন।

মা জানালেন, ভৈরবের দিকে আমাদের জুট মিলে যে মালিকানা ছিল সেটাও বেহাত হওয়ার অবস্থা। বিবেচনার দায়িত্বটা আমার উপরই ছেড়ে দিলেন। এবং আশ্বাস দিলেন আমি যে সিদ্ধান্ত নেই তার সাথে গোটা পরিবার থাকবে। শুরু হল জীবনের অপ্রত্যাশিত ও অপরিকল্পিত এক অধ্যায়।

চাকরি ছেড়ে চলে আসি পৈত্রিক ভূমিতে। পরিবারের সবাইকে ডেকে জানান দেই নিজের সিদ্ধান্ত। এখন হতে আমিও অংশীদার হবো পারিবারিক আয়-রোজগারে। জীবনের ভাল সময়টা বোধহয় এখানেই কাটাই। মা’র পাশাপাশি পরিবারের সবাই আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। ক্ষয়িষ্ণু একটা শিল্প-কারখানার শুরু হয় পরিবর্তন ও পরিবর্ধন। সাথে যোগ দেন আমাদের বড়ভাইও। ভুলটা বোধহয় এখানেই হয়েছিল।

৩ বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর বাকি সবাইকে নিয়ে গড়ে তুলি গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রি। ১৫০ জনেরও অধিক শ্রমিক কর্মচারী নিয়ে শুরু হয় আমাদের নতুন যাত্রা। পরিবারকে নিয়ে যাই নতুন এক সামাজিক ও আর্থিক উচ্চতায়।
জেলা শহরের কোলাহলে কাটানো এ সময়টা আমার জন্যে ছিল অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা। শ্রমিক-কর্মচারীদের দৈনন্দিন জীবন হয়ে যায় আমার জীবন। ওদের দুঃখ, কষ্ট ও আনন্দের অংশীদার হয়ে মিশে যাই জৌলুষ-হীন নতুন এক জীবনে। পাশাপাশি পরিবারের জন্যে উন্মোচিত হয় উন্নতির নতুন দিগন্ত। কদিন আগে হিল্লি দিল্লী, লন্ডন, মস্কো করা আমি বনে যাই জেলা শহরের যন্ত্রিক জীবনে।

বেশিদিন লাগেনি পরিবর্তনের হাওয়া লাগতে। ঢাকা ত্যাগের কদিন আগে বন্ধুর তাগাদা ও সহযোগিতায় অস্ট্রেলিয়ায় স্কীল মাইগ্রেশনের জন্যে এপ্লাই করেছিলাম। বাড়ি গিয়ে তা ভুলেই গিয়েছিলাম।

হঠাৎ করেই ফোনটা পেলাম। থাইল্যান্ড হতে আমার নামে একটা প্যাকেট এসেছে। আমার সামান্যতম ধারণা ছিলনা কি ছিল ঐ প্যাকেটে। প্রাক্তন অফিসের হিসাবরক্ষক নিজেই হাজির হলেন। এবং সাথে ছিল মাইগ্রেশন কোয়ালিফিকেশনের সব কাগজপত্র।

কাউকে কিছু না বলে আমি প্রায়ই ঢাকা যাই। ইংরেজি পরীক্ষা সহ বাকি কাজ শেষ করি। এবং কোন এক সুন্দর সকালে বাড়ির মিশন শেষ করে উড়ে যাই আমার নতুন ঠিকানা সিডনি অস্ট্রেলিয়ায়।

বোধহয় এমন একটা মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিলেন বড়ভাই ও উনার স্ত্রী। বাকি ভাইদের কাউকে কাউকে হাত করে আবারও বসে যান চালকের আসনে। এ যাত্রায় আর্থিক লেনাদেনা আগের তুলনায় ছিল প্রায় দশগুণ। মহোৎসব শুরু হয় অপচয়ের। দেনার বোঝা বাড়তে শুরু করে। একদিকে গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং অন্যদিকে ব্যাংক। ত্রিমুখী চাপে ভেঙ্গেপরে উৎপাদন কাঠামো। শুরু হয় আন্তপারিবারিক কলহ। এবং এক সময় গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দেয় তাদের সংযোগ। পতন হয় বিশাল এক শিল্প প্রতিষ্ঠানের।

জরুরি ভিত্তিতে আমি যখন অস্ট্রেলিয়া হতে ফিরে আসি অনেক দেরী হয়ে গেছে। একসময়ের কোলাহল-মুখর শিল্প প্রতিষ্ঠান ততদিনে পরিণত হয়েছে মৃত্যুপুরীতে। অনেক কষ্টে বাঁচানো গেছে শিল্পের ছোট একটা অংশ। এবং সে অংশ এখনো ধুকে ধুকে টিকে আছে। যখনি এর সামনে দাঁড়াই সেলুলয়েডের ফিতার মত সামনে আসে ফেলে আসা জীবনের চারটা বছর। সামনে আসে দেবতার মত মানা বড় ভাই এবং তার শ্বশুর পক্ষের ক্ষুধার্ত হায়েনার দল।

ম্যারাথন মিটিং শেষে কঠিন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে এ যাত্রায়। সবাই খুশি তা নয়, মন খারাপ হয়েছে অনেকের। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী শিল্প প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থ ছিল সবার ঊর্ধ্বে।

জেলা শহরের এদিকটায় আমার ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এ নিয়ে কাউকে কোন ইঙ্গিত দিইনি। কারণ দূরে থাকলেও শিল্পের চাকা ঘুরবে কিনা তার অনেকটাই নির্ভর করে আমার উপর। যে ৫০-৬০ শ্রমিক এখনও আমাদের ছেড়ে যায়নি তাদের অনেকে অশ্রুসিক্ত নয়নে আমাকে স্বাগত জানিয়েছে। বলেছে কারখানার উত্থান পতনের কাহিনী। বলেছে তাদের জীবনের গল্প। এও বলেছে আমি ফিরে এলে এ ক্ষয়িষ্ণু প্রতিষ্ঠান কোন এক জাদুবলে আবারও জেগে উঠবে। আবারও শত শত শ্রমিকের পদভারে মুখরিত হবে এ প্রতিষ্ঠান।

কিন্তু হায়, ওরা জানেনা আমি এখন অন্য জগতের মানুষ, এক কালের সংসার ও সামাজিক বন্ধন হতে মুক্ত ঈগল পাখি এখন বাকি দশজনের মতই চাল ডাল তেল চিনির হিসাবে মিশে গেছে…।

মোরাল অব দ্যা স্টোরি: পৃথিবীতে দেবতার চেহারায় কোন বড় ভাই নেই। আছে জীবন যুদ্ধে সহজ রাস্তা খুঁজে বেড়ানো গ্রীডি কিছু মানুষ। সাথে আছে হায়েনার চেয়েও হিংস্র কিছু জীবন সঙ্গিনী। জীবন যুদ্ধে লড়াই করতে চাইলে কথিত এসব দেবতা ও তার দলবল হতে দূরে থাকাই শ্রেয়।

ভাল থাকুক যৌবনের এসব অলিগলি। টিকে থাকুক মানুষ ও মানুষের ভাল-মন্দ লাগার কিছু স্বপ্ন।

মা (১৫)

অতঃপর দিন শেষে গল্পের থালাগুলো তুলে রেখে দিতেন মা
তারপর
বিকাল
সন্ধ্যা
রাত
পেরিয়ে ভোর!
গল্পের থালাগুলো নামানোর মতো আর কোন মানুষ নেই!
মা
আমার
নিজেই
গল্প হয়ে
আছেন জীবনে।

দুর্ভোগ

q

সবুজে সমবৃদ্ধি
কোলাহলে অনাবৃতি,
জাগ্রত মহল
কাগজই সম্বল!

রূপের দুনিয়ায়
মগজে পোকা,
বাস্তব চিত্তে
আগ্নেয়াস্ত্রর খেলা!

মানবিক দৃশ
জগতের উৎস,
সমাদৃত অরণ্যে
কলঙ্কের মূলমন্ত্র!

ভালো কাজে
রোইয়াছে চোখ,
মন্দ কাজে
নাই গো কোনো সুখ!

স্বর্গের লোভ
দুনিয়ার ভোগ,
মানব রূপে
রোইয়াছে চোখ!

চারকোনে দিক
সত্যের কনিশ,
নিত্যনতুন ন্যায়
তৈরী হয় ব্যয়!

ভোগের তারণায়
সৃষ্ট লোভ,
অন্ন হারায়
তীক্ষ্ণ রোগ!

মুক্ত মঞ্চে
নেই মুক্তি,
তস্করী তো আজ
খোলা প্রবৃদ্ধি!

আত্মত্যাগ এ
মৃত আত্মা,
প্রতিনিয়ত করছে
তারা আত্মহত্যা!

নীতিতে দোষ
মুখে রস,
সমাজতন্ত্র তো
কল্পনাতেই জোস!

উষ্ণ হওয়ায়
সজীব জীবন,
দোষ করা তো
কলবের কারণ!

অবক্ষয়তা
দুর্ভোগের ঊর্ধে,
অনুধাবন তো
সৃষ্টির পক্ষে!

কল্পে শক্তি
উন্মাদ এ ভক্তি,
তিরস্কার তো
মানবের মূলনীতি!

অর্থ সিক্তই
নীরব উৎস,
পিপীলিকা বলে
মানব সবচেয়ে নৃশংস!

শক্তিতে ভক্তিতে
মানবতা আজ যাচ্ছে কিসে,
লুণ্ঠন করে যাচ্ছে তারা
সবকিছু নিঃশেষ করে!

যাত্রায় বিরতি
মাঝপথে হয়রানি,
দিন শেষ দেখা যায়
ওইসব রাজতন্ত্রের মূলনীতি!

আর নয় নাগাসাকি আর নয় হিরোসিমা

শোনো-
ঘরের কোণে নির্জীব
চতুঃস্পার্শে তৈরী করা
আপাত ভঙ্গুর শান্তি ভাঙতে না চাওয়া
মানুষের দল-
শোনো এক গল্প বলি-
রক্তাক্ত সে কলঙ্ক শুনে যদি ক্ষুব্ধ হও
দুঃখ আসে,ক্রোধে ফেটে পড়তে চায় মন
জানিও তা পরে।

সে দিনটা ছিল টাকা রং সূর্যের
স্নেহাশীষে ধোয়া,
অগনিত ফুটফুটে শিশু
সোনালী গমের ক্ষেতে
বিকিরণ করে সুখ খেলায় খেলায়-
তরুণী গৃহিনী জল সন্ধানে-
চাষীরা এসেছে মাঠে-
মজুর গিয়েছে কলে-
শিক্ষিকা একাগ্র অধ্যাপনায়-
কে জানতো এত সুখ
প্রকৃতির ভালবাসা এ সৌন্দর্য
কেড়ে নিতে মানুষই পাঠাবে দূত
জীবন্ত শয়তান…!!

হঠাৎ বিস্ফোরণে
চারিদিক কালো হয়ে আসে,
মাটির গভীরে ফাটল,
ধোঁয়ার কুণ্ডলী, আগুনের লেলিহান শিখা,
আকাশ এসেছে নেমে
সমতলের মাংস ছিঁড়ে নিতে।

সময় চলে তার আপন গতিতে
ধোঁয়ামেঘ সরে.আগুনের ধিকিধিকি,
অনেকেই বেঁচে নেই।

দগ্ধ গলিত সেই শবস্তুপ মাঝে
কোনো মানবসন্তান হেঁটে আসে
জীবন্ত কংকাল হয়ে-
হাড় আছে, মাংস নেই-
তলপেটে ঝুলন্ত থলথলে নাড়ী-
নাক নেই, ঠোঁট নেই-
চোখে তার পাতা নেই-
গায়ে পোড়া চামড়া কোথাও বা ঝুলছে-
দু কদম হেঁটে এসে
বিস্মিত ঘৃণা ছুঁড়ে
মাটিতে লুটিয়ে পড়ে
আর ওঠে না।

এই হলো নাগাসাকি
এই হলো হিরোসিমা
এই হলো পরমাণু
যুদ্ধের বিভীষিকা।
শোনো বিশ্বের আপামর মানুষ-
তোমরা কি চাও, এভাবে ধ্বংস হোক
গর্বের সভ্যতা?

পাঁচশো কোটি প্রাণ ধ্বংসে মেতে উঠুক
পাঁচশত খামখেয়ালী শয়তান?
বন্ধু,আজকের এ রণাঙ্গনে
সজোরে একযোগে হাঁক দাও-
আমরা চাই না যুদ্ধ
বন্ধ হোক রণদামামা
বন্ধ হোক মারণবোমা
আকাশযুদ্ধ-মিসাইল দৌড়!
আমরা অন্ন চাই, বস্ত্র চাই
মাথার ওপরে চাই একখণ্ড আচ্ছাদন,
আমরা বাঁচতে চাই,
বন্ধ হোক এ তাণ্ডবের বীভৎস লীলা…!

সে তূর্যনিনাদে কেঁপে উঠবে
ঔপনিবেশিক ভিত,
সাম্রাজ্যবাদী প্রভুরা চুরমার হবে
শব্দের অমোঘ আঘাতে,
যুদ্ধলিপ্সার শিকড়
উপড়ে বিলীন হবে
মহাকাশের অন্ধকারাচ্ছন্ন গর্ভে।

তারপর!-
সোনালী গমের ক্ষেতে
আবার খেলবে শিশু,
তরুণীর ঠোঁটে হাসি
ফিরে এসে হবে বিদ্যুচ্চমক,
এ সুন্দর গোলকে ভাসবে
অপার শান্তির নীলিমতা,
মানুষ উঠবে বেঁচে
প্রকৃত মানুষ হয়ে।

ফেরা

জগতের অপর পাড়ে
হেঁটে হেঁটে কতকিছু খরিদ করলাম।

আমার সঞ্চয়ে আছে
স্ট্যাচু অফ লিবার্টি
আইফেল টাওয়ার
বুর্জ আল খালিফা
ব্লু মস্ক
বার্লিন ওয়াল
বাকিংহাম প্যালেস।

আছে
ইজিপ্টের দুই প্রস্থ পিরামিড
আর বেবিলনের সেই ঝুলন্ত উদ্যান।

শাহজাহানের স্মৃতি বিজড়িত তাজমহলে
প্রেমের ওয়াদা করে
প্রেমিকাকে নিয়ে নায়েগ্রা ফলসে উড়াল দেই।

আমস্টারডামের রেড লাইট ডিস্ট্রিকে
এক নীল নয়না কয়েক ঘণ্টার সার্ভিস শেষে
পঞ্চাশ শতাংশ ছাড়ে রাজি হয়ে যায়।

মরক্কোর গ্রাম্য কুটিরে তাজিন খেয়ে
হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে
তের ঘন্টার বিশ্রাম।

প্রফুল্ল মনে আমি যখন ঢাকার আকাশে
তখন মনে পড়ে; আনসার মাঠের মন গাছ
ছাড়া আর কোনো সঞ্চয় অবশিষ্ট নেই।

সবকিছুই মেকি; মন গাছ জগতের একমাত্র সত্য,
যত দূরে যাই, বার বার ফিরে আসি আনসার মাঠে।

জীবনচক্র

Life

আমার পিতা কয়েক বছর আগে গত হয়েছেন
আলনায় যেখানে তাঁর পাঞ্জাবি ঝুলানো থাকতো;
সেখানে ঝুলছে বড় ভাইয়ের চেক শার্ট।
আলনায় তাকালে বাবা ক্ষণিকের জন্য উঁকি দেন,
কিন্তু চেক শার্টই বাস্তবতা। বাবা ক্রমেই বিস্মৃত হচ্ছেন।

কদুর লতি বিরূপ আবহাওয়া অবজ্ঞা করে
উঁকি দিচ্ছে, ভোরের পাখি আমার মা এখন শয্যাশায়ী।
এই দুদিন আগেও আগাছা পরিষ্কারে সক্ষম ছিলেন।
কদু অকৃতজ্ঞ নয়, পরিচর্যার বিনিময়ে
নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে মরিয়া।

কদুর পরিপূর্ণ অবয়ব দেখলে মা খুশি হতেন
কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। উঠোন মা থেকে এখন অনেক দূরে।

পুকুরের ওইপাশে পেয়ারা গাছ ছিল, সীমানা নিয়ে
পাশের বাড়ির সাথে ঝগড়া। একরাতে ক্রোধে তারা
পেয়ারা গাছ কেটে ফেলে। বড় আপা চোখের পানি
আটকাতে পারে না। পেয়ারা গাছের কাছে
তার অনেক স্মৃতি জমে আছে।

সাইকেলের চেনে পা আটকে গেলে অনেক রক্ত ঝরেছিল,
চাচা বলেছিলে সাইকেল বদলে
অন্য সাইকেল কিনে দিবেন। বড় ভাই নাছোড়বান্দা
জীবন গেলেও সাইকেল ছাড়বেন না।
এই সাইকেলের দুই চাকায় তার কৈশোর যৌবনে পৌঁছেছে।
একদিন এক ট্রাক সাইকেল দুমড়ে মুচড়ে দিল, অল্পের জন্য
বেঁচে গেলেন বড় ভাই। সাইকেল ছাড়তে হল,
চাইলেই সবকিছু ধরে রাখা যায় না
অনেক কষ্টে বুঝতে পারলেন।

সাড়ে পাঁচে প্রথম লুঙ্গি পরি, হেদায়েত উল্লাহ হাজম
সুন্নতে খতনায় মুসলমান বানিয়ে ছিল।
শিশ্নের যন্ত্রণায় লুঙ্গি অনেক আরামদায়ক।
জীবনের প্রথম লুঙ্গি টিনের ট্রাংকে অনেকদিন সংরক্ষিত ছিল।

গত শীতে ট্রাংকের গুপ্তধন খুঁজতে গিয়ে দেখি
লুঙ্গির অবস্থা নড়বড়ে, ফেলে দিতে অনেক কষ্ট পেয়েছি।

এক সময় ঘুড়ির পিছনে দৌড়াতাম। এখন সার্টিফিকেট
ফাইলবন্দি করে অফিসে অফিসে দৌড়াচ্ছি।
জুতোর তলা ক্ষয় যাচ্ছে, হালকা হয়ে যাচ্ছে মাথার চুল।
আমি জীবন ধরতে চাচ্ছি, জীবন পিছলে যাচ্ছে…

উত্তর খুঁজে পাই না

3fe35

কেন তোমাকে ভালোবাসি
এর উত্তর খুঁজে পাইনা
তুমি শ্যামলী – গৌর গড়ন হলেও
মুগ্ধ হবার কারণ খুঁজে পেতাম
অর্থ বিত্ত ছোটবেলা থেকেই আমাকে টানে নি
এই বিষয়ে অনাগ্রহের কারণ আমি খুঁজতেও যাই নি
তাহলে আগ্রহ আছে কিসে?
আগ্রহ? ভাবতেই হাসি পায়
কে এই পৃথিবী নামক পাগলা গারদ বানিয়েছে!
কোন পাগল মানুষ বানিয়েছে
মন বানিয়েছে
প্রেম দ্রোহ সংঘাত যুদ্ধ হত্যা এবং জন্ম মৃত্যু খেলা বানিয়েছে
তা বানাক, কিন্তু আমি কেন তোমাকে ভালোবাসি এর উত্তর খুঁজে পাই না।

তোমার দেহ দেখে কিছুটা কামভাব জাগে
তবে তা এতো অল্প যেনো সপ্তাহে একবার বা দুইবার তার বেশি না
আমি পুরুষ, সিদ্ধ পুরুষ নয় – একেবারে জাগবে না এটা মিথ্যা কথা
কিন্তু এতোটুকু কামভাব তুমি না হয়ে অন্য নারী হলেও জাগতো
তাহলে কেন আমি তোমাকে ভালোবাসি
এর উত্তর খুঁজে পাই না।

আচ্ছা! তোমাকে ভালোবাসতে হবে কেন
ভ্রান্ত বিশ্বাস ভেবে নিয়ে বিশ্বাসকে সংশোধন করেছি বহুবার
ভুল ভালোবাসা মনে করে ঘষে ঘষে মন থেকে মুছে দিয়েছি
কিন্তু কেন বেশিদিন ভুলে থাকতে পারি না
কেন মন থেকে চিরতরে মুছে দিতে পারি না
এর উত্তর খুঁজে পাই না
কেন আমি তোমাকে ভালোবাসি
এর উত্তর খুঁজে পাই না।

একজন মানুষ চাই

672851

একজন মানুষ চাই
মানুষ তার সৃষ্টির চেয়ে বড় নয়

জীবন যদি একটা পথ হয়
তবে সে পথে অনেক জীবনের সন্ধান পাবেন।
এই পথ পরিচর্যার জন্য নির্দিষ্ট মানুষের প্রয়োজন
জীবন একটি বৃক্ষ স্বরূপ হলেও হতে পারে;
তবে সে বৃক্ষের একেকটি পাতা মানব জীবনের একেকটি কোষ।

সেখানে একটি পাতা ঝরে গেলে
একটি কোষের মৃত্যু হবে
এর জন্য নির্দিষ্ট মানুষের পরিচর্যার প্রয়োজন হয়।

জীবন একটি স্বাধীন সত্তা
যাতে জীবন স্বাধীন থাকে
তার জন্য কিছু পরিবেশ তৈরি করতে হয়।
স্বাধীন আইন প্রণয়ন করতে হয়।
যাতে সেই স্বাধীন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে
স্বাধীনতা বলবৎ থাকে
এর দেখভালের জন্যও একজন মানুষের প্রয়োজন।

জীবন একটি লম্বা পথ।
জীবন একটি লম্বা বটবৃক্ষ।
জীবন একটি লম্বা ও বিস্তৃত মরুভূমি।
জীবন একটি লম্বা ও বিস্তৃত সাগর- মহাসাগর।

জীবনের এই বিস্তৃত পথে
যাতে তার পরিবেশ দূষণ না হয়
সেটা দেখ-ভালের জন্য মানুষের প্রয়োজন।

কারণ জন্ম যেখানে একা মৃত্যুও হবে একা
কিন্তু মানুষ তার মাঝখানে
একাকী পথ পাড়ি দিতে পারে না
মানুষ তার বয়সের মাঝখানে
সুবিসাল সাম্রাজ্য তৈরি করে
যে সাম্রাজ্যের ভেতরে একটা মহাকালের আবহমান মায়াজাল রচিত হয়।

সেই মায়াজালের আবদ্ধতা থেকে বাইরের মহাজগতে ফিরতে কষ্ট হয় বলেই একজন মানুষের প্রয়োজন। মানুষ অমর নয় তবে মানুষের কর্মগুলো অমর হয়।
মানুষ ধর্মের প্রবর্তক, মানুষ কর্মের প্রবর্তক,
মানুষ তার এক জীবনের পথ ধরে অনেক কিছু প্রবর্তক হয়।

কিন্তু একজন মানুষ
শুধু তার নিজেরই প্রবক্তক হতে পারে না
মহাকালের এই ভ্রাম্যমান পৃথিবীতে
মানুষের নিদর্শনই বলে দেয়
মানুষ তার কর্মের চেয়ে বড় নয়
মানুষ তার সৃষ্টির চেয়ে বড় নয়।

এসব প্রকাশ করার জন্য হলেও একজন মানুষ চাই।
যে হবে আত্মার আরতি
তাছাড়া জীবন অপূর্ণই রয়ে যায়
তাছাড়া জীবন মর্মর ধ্বনির মত ক্লান্তই রয়ে যায়।

মুহূর্তের ডাক!

আমি মাবিয়া, আমার তেমন ভাবে বড় কোনও বর্ণনা না দিলেও চলবে। কারণ নিজেকে বর্ণনা করতে গেলে দেখা যাবে তখন মূল কথায়ই আসা হবে না। তবে এই টুকু বলতে পারি আমি অন্য সব সাধারণ মানুষদের থেকে একটু বেশি সাধারণই বটে।

আসলে কেও যদি আমাকে হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করে আমার জীবনের সব থেকে খুশির মুহূর্ত কি? তবে সত্যি বলতে আমি একটু ঘাবড়ে যাই। আমি তখন কিছুক্ষণ ভাবি। ভাবতে ভাবতে জীবনের একটু পেছনে চলে যাই। আমার অতীতের মুহূর্তগুলো বইয়ের পাতার মতো ঘাঁটাঘাঁটি করতে থাকি। আসলে কি, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার মধ্যেও কিন্তু একটা সুন্দর মুহূর্ত আছে। অজান্তেই এর মধ্যে কতো ঘটনা এই মস্তিস্কের মনে পরে যায়। যেমনটা এখানেরই উদাহরণ দিলাম। লিখাটা লিখার আগে মুহূর্ত খুঁজতে যেয়ে কতো সুন্দর মুহূর্তের সাথে পুনর্মিলনী করে নিলাম। মনটা তাই ভালো লাগছে।

যাই হোক আমার সুন্দর মুহূর্তটা একটু তুলে ধরি। জীবনে অনেক সুন্দর মুহূর্ত আছে তবে তুলে ধরার জন্য বেছে নিলাম আমার প্রথম মেলায় যাওয়া আমার দাদির সাথে। খুব ছোট্ট ছিলাম আমি। জীবনে তখন দুঃখের বলতে কোন অনুভব বা অনুভূতি ছিল না। চোখের সামনের যা আসত সবই সুন্দর ছিল।

আমি আমার দাদির হাত ধরে ছিলাম যেন কোন ভাবেই ভিড়ের মাঝে হারিয়ে না যাই। রঙ বেরঙ এঁর জিনিস গুলো আমার চোখকে মুগ্ধ করে দিলো। আমি প্রচণ্ড অবাক হয়ে এদিক সেদিক দেখেও যেন দেখার শেষ করতে পারলাম না। এতো মানুষ ছিল আমার চারো পাশে। সবার ভিড়ের মাঝে হঠাৎ দূরে একটা অদ্ভুত শব্দের বেশ বড় একটা বস্তু দেখতে পেলাম।

দাদি! দাদি! দাদি! আমাকে ঐ বড় বস্তুটার দিকে নিয়ে যাও না প্লিজ। আমি আমার দাদির হৃদয়। হাঁটা ধরলাম বলা মাত্র। আমার ছোটো ছোটো পা হাঁপাতে হাঁপাতে গন্তব্যের দিকে ছুটে চলল। আমার খুশি ছিল আকাশ সমান। আমি এখন যেমন ছোট্ট বাচ্চাদের খুশি মুখটার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি সেদিন দাদিও হয়তো আমার দিকে বার বার তাকিয়ে হাসছিল। বাচ্চাদের মনটা কতো পবিত্র হয় তাই না? নতুন কিছু একটা দেখলেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়।

সে দিন আমার সাথে ঠিক এমনটাই হয়ে ছিল। আস্তে আস্তে আমি গেলাম, হ্যাঁ! আমার জীবনের প্রথম অন্যতম খুশির মুহূর্ত। বড় একটা হা করে বস্তুটা ঘুরতে দেখছি আর তার অদ্ভুত শব্দে বুকের হার্ট বিট যেন ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। ভয় হচ্ছে খুব শব্দের উপর। কিন্তু বস্তুটার প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যাচ্ছে।

“এটাকে নাগর দোলা বলে” দাদি বলল আমাকে। আমি তেমন করে দাদির কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম না। আসলে কানের সামনে বাহারি শব্দের সাথে দাদির প্রতিটা কথা গুলো শুধু বাতাস এঁর মতো কথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে আমার কাছে আস্তে পারছিল না।

হঠাৎ বস্তুটা থেমে গেল! আমি কৌতূহলী… নষ্ট হয়ে গেল নাকি? ভাবছিলাম আর দাদি আমাকে বস্তুটার সামনে নিয়ে যেয়ে বসিয়ে দিলো। আমার সাথে আরো তিনটা মানুষ। আমি তাদের বেশি একটা মনোযোগ দিলাম না।
হঠাৎ লোকগুলো হাত দিয়ে বস্তুটাকে ঘুরানো শুরু করল। চোখের এক পলকেই আমি আকাশ এঁর দিকে উঠে গেলাম। আমি অবাক! হুট করে নিছে নেমে যাচ্ছি আবার হুট করে আকাশ এঁর দিকে উঠে যাচ্ছি।

এতো সুন্দর কেনো অনুভূতিটা? আমি নিজেই হতভম্ভ! উপরে উঠলেই সারাটা মেলা দেখা যায়। জমকালো আলোতে বাহারি রঙ্গের জিনিস গুলো আমার চোখকে ধাঁধিয়ে দিলো! পৃথিবী কি এতোই সুন্দর?

সব কিছুর মাঝে একটা অপরূপ হাসি নিয়ে আমার দাদি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আজ কতোটা বছর হয়ে এলো নাগর দোলায় চড়তে পারি কিন্তু এই হাসিটা আর দেখতে পাই না!

প্রাণঘাতী হামলার মুখে যেসমস্ত রাষ্ট্রনায়ক প্রাণ হারিয়েছেন

294

একটা দেশের রাষ্ট্রনায়ক মানেই অনেক অনেক ক্ষমতার অধিকারী। এককথায় বলতে গেলে রাষ্ট্রনায়ক হলেন গোটা একটা দেশের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক ক্ষমতাধর ব্যক্তি। এতো এতো ক্ষমতার অধিকারী হওয়া স্বত্ত্বেও কখনও-কখনও তাঁরা অসহায় হয়ে পড়েন আততায়ীর কাছে। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও কিছুই করার থাকে না ক্ষমতাধর রাষ্ট্র নায়কদের।

তো এই পৃথিবীতে সভ্যতার সূচনা লগ্ন থেকে এ যাবত কাল পর্যন্ত যেসব রাষ্ট্রনায়ক আততায়ীর কাছে হার মেনেছিল, সে সকল রাষ্ট্রনায়কদের একটা ছোট তালিকা দেখানো হলো।

১.
বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতা পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিও ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নং বাড়িতে কিছু উশৃংখল সেনাবাহিনীর সদস্যরা সপরিবারে তাঁকে হত্যা করে।

২.
বাংলাদেশের ৮ম রাষ্ট্রপতি ছিলেন, জিয়াউর রহমান। ১৯৮১ সালের ৩০শে মে দেশের দক্ষিণ-পূর্ব বন্দর নগরী চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একদল অফিসার কর্তৃক তিনি নিহত হন।

৩.
ভারতের জাতির পিতা ছিলেন, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারিতে রাজধানী দিল্লির এক সন্ধ্যাকালীন প্রার্থনাসভায় যোগ দিতে গিয়েছিলেন। সেখানেই তাঁকে পর পর তিনটি গুলি করে হত্যা করেন, এক হিন্দুত্ববাদী।

৪.
১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর সকাল ৯টা ২০ মিনিটে তাঁর সফদরজং রোডের বাসভবনের বাগানে হাঁটছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা। বাড়ি থেকে এক ব্রিটিশ সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দিতে তাঁর আকবর রোডের অফিসে যাওয়ার জন্য রওনা হয়েছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। ঠিক সেই সময়েই তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালান তাঁর রক্ষীরা।

৫.
আব্রাহাম লিঙ্কন ছিলেন আমেরিকার ষোড়শ প্রেসিডেন্ট। তাঁকে ১৮৬৫ সালের ১৪ এপ্রিল, একটি থিয়েটারে মাথার পিছন থেকে গুলি করে খুন করেন আততায়ী। সন্ধে ৬টা নাগাদ লিঙ্কনের উপর হামলা হয়। পরের দিন সকাল ৭টায় মৃত্যু হয় তাঁর।

৬.
১৮৯৪ সালে ফরাসি প্রেসিডেন্ট মারি ফ্রাসোঁয়া সাদি কার্নটকে ছুরি মেরে খুন করা হয়। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ফরাসি প্রেসিডেন্ট কার্নট তখনও সাত বছর পূর্ণ করেননি। অথচ এরই মধ্যে জনতার বিপদে-আপদে তাঁর যথা সময়ের উপস্থিতি তাঁকে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে দেয়। লোকের মুখে মুখে কার্নটের সততা, নীতিপরায়ণতার কথা। সেই সময়েই একটি জনসভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে খুন হন কার্নট।

৭.
পাকিস্তানের প্রথম এবং একমাত্র মহিলা প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো। ১৯৮৮ এবং ১৯৯৩ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। মাঝে প্রায় ন’বছর আড়ালে থেকে আবার ২০০৭ সালে দেশে ফেরেন ভুট্টো। ঠিক করেন নির্বাচনে লড়বেন। প্রচারও শুরু করে দেন। কিন্তু ভোটের ঠিক দু’সপ্তাহ আগে একটি জনসভায় হত্যা করা হয় ভুট্টোকে।

৮.
রাজীব গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তিনি ছিলেন প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধীর বড় ছেলে। তিনি রাজীব গান্ধী ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁকে হত্যা করা হয় ১৯৯১ সালের ২১ মে। রাজীব তখন ভোটের প্রচারে দক্ষিণ ভারতে। তামিলনাড়ুর শ্রীপেরুমবুদুরে একটি জনসভা ছিল। সভাস্থলে পৌঁছে বুলেটপ্রুফ গাড়ি থেকে নেমে ডায়াসের দিকে এগোচ্ছিলেন রাজীব। একের পর এক শুভার্থীরা মালা পরিয়ে দিচ্ছিলেন তাঁক। শুভেচ্ছা জানিয়ে পা ছোঁওয়ার পরই কোমরে বাঁধা আরডিএক্স বেল্টে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটান। ঠিক ১০টা বেজে ১০ মিনিটে। সাথে সাথেই প্রাণ হারায় প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী।

৯.
আমেরিকার ৩৫ তম প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিকে হত্যা করা হয় ১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর ডালাসে। হুড খোলা গাড়িতে সওয়ারি ছিলেন সস্ত্রীক প্রেসিডেন্ট। তাঁর হন্তক লি হার্ভে ওসওয়াল্ড রাস্তার ধারের একটি বাড়ির ছ’তলা থেকে প্রেসিডেন্টের মাথা লক্ষ্য করে তিনটি গুলি চালান।
লেনিনের ভাবশিষ্য ছিলেন মার্কসবাদী বিপ্লবী লিওন ট্রটস্কি। তিনি ছিলেন রুশ বিপ্লবের প্রথম সারির নেতা। ১৯৪০ সালের ২১ অগস্ট তাঁকে হত্যা করা হয়।

১০.
মার্টিন লুথার কিং ছিলেন আমেরিকান ব্যাপ্টিস্ট মন্ত্রী এবং আফ্রিকান-আমেরিকান মানবাধিকার কর্মী। আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার গণআন্দোলনের নেতা ছিলেন মার্টিন। ভারতের মহাত্মা গান্ধীর অহিংসা আন্দোলন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের বৈষম্যমূলক আচরণের বিরোধিতা করে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৬৮ সালে মার্টিনকে সামনে থেকে গুলি করে খুন করা হয়।

১১.
আধুনিক বিশ্বে সর্বশেষ রাষ্ট্রনায়ক হত্যার ঘটনা সংঘটিত হয় জাপানে। ২০২২ সালের ৮ জুলাই জাপানের প্রাক্তন এবং দীর্ঘতম সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রীর শিনজো আবেরও সম্ভবত তা-ই হল। শিনজোকে হত্যা করলেন টেটসুয়া ইয়ামাগামি। যিনি নিজের বয়ানে জানিয়েছেন, শিনজোর কাজে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই তাঁকে হত্যা করা হয়।

এতেই বোঝা যায় যে, এই পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবকিছুই অনিশ্চিত! কেবল জীবের মৃত্যুর নিশ্চিত।

নদী ও জীবন…

001

জন্মভূমি নিয়ে আমার কোন উচ্ছ্বাস নেই। নেই বিশেষ কোন টান। যে নাড়ির টান বছরের পর বছর ধরে দীর্ঘ ও শক্ত হয়েছিল তা ঢিলে ও সংকুচিত হয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে। চাইলেও তা আগের মত জোরা লাগাতে পারিনা। লাগানোর ইচ্ছা আছে তাও নয়।তবু এখানে ফিরে আসি। কেন আসি তার কোন উত্তর নেই। হতে পারে বুকের ভেতর লুকানো কিছু দীর্ঘশ্বাস বাইরে এনে নিজকে হালকা করার তাগাদা।

সব বিবেচনায় কেন জানি মনে হচ্ছে এটাই হয়ত আমার শেষ আসা। দৈব ও অলৌকিক কিছু না ঘটলে এখানে তেমন কিছু করার নেই আমার। হুট হাট করে ছুটে আসার প্রেক্ষাপট গুলো এখন অতীত।

সে সব সোনালী অতীতের মূলে ছিলেন আমার মা। পৃথিবীর যে কোনায়ই ছিলাম না কেন তিনি ডাকলে আমি আসতাম না এমনটা ছিল অসম্ভব। বছরে দু’বার তিনবারও ছিল আমার আসা যাওয়া। হোক তা অস্ট্রেলিয়া অথবা দূরের দেশ আমেরিকা হতে। কেবল সোভিয়েত দেশের ১২ বছর ছিল ব্যতিক্রম। চাইলেও আসার সুযোগ ছিলনা সময়, সুযোগ ও আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে।

002

003

004

আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মেঘনা নদী। শীতের জরাজীর্ণ দৈন্যতা, বর্ষার ভরা যৌবন, বসন্তের মৌ মৌ গন্ধ, সবকিছু পাশে নিয়ে আমি বেড়ে উঠেছি।

এ নদী ছিল আমার সবকিছুর সাক্ষী। নিজের কষ্টগুলো ভাগাভাগি করার একমাত্র মাধ্যম। প্রতি মাঘে নদীর তীর ঘেঁষে জমে উঠা বাউলের মেলা ছিল স্বপ্নের মত। এক মাঘ শেষ হলে অন্য মাঘের আশায় দিন গুনতাম তীর্থের কাকের মত। গুণটানা নৌকার পালে হাওয়া লাগার জন্যে প্রার্থনায় বসে যেতাম। যারা কাঁধে করে এ ভার বইতো তাদের কষ্ট চোখ ঝাপসা করে দিত।

সে নদী আজও আছে। বয়ে যাচ্ছে আগের মতই। বদলে গেছে অনেক কিছু। গুণটানা নৌকা এখন দৃশ্যপট হতে মুছে যাওয়া কিছু স্মৃতি। এ স্মৃতি নতুন প্রজন্মের কাছে গল্প করলে হয়ত বিশ্বাস করবেনা।

নদীর ওপারটা ছিল দ্বীপের মত। চর অঞ্চল হিসাবে জানতাম আমরা। আধুনিক সুবিধার ছিটেফোঁটাও ছিলনা ঐ এলাকায়। বিদ্যুতের আলো দেখতে নদী পাড়ি দিয়ে অনেকে আসতো এ পাড়ে। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে তাকিয়ে থাকত ঢাকা হতে চট্টগ্রাম-গামী ট্রেনগুলোর দিকে।

005

006

007

008

এলাকার মানুষ ধরেই নিয়েছিল এটাই তাদের জীবন। নদী পাড়ি দিয়ে জীবিকার সন্ধানে শহরের অলিগলিতে ঢুঁ মারা, দিন শেষে সদাই করে ঘরে ফেরা… এভাবেই কেটে যেত পুরুষদের জীবন।

সে নদীতে এখন সাঁকো হয়েছে। বিদ্যুতের আলো এখন ঘরে ঘরে। নদীর এপার এখন আর দূরের দেশ নয়, বরং বাড়ির আঙ্গিনা। পরিবর্তনের ছোঁয়া ঘরে ঘরে।

ঘাটে হতে এখনও লঞ্চ ছেড়ে যায়। কোথায় যায় তা কোনদিনও জানা হয়নি। শুনেছি কুমিল্লার হোমনার দিকে যায়। একটা সময় ছিল যখন লঞ্চই ছিল দাদাবাড়ি যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম। এখন হয়ত সে পথ বন্ধ। কারণ সড়ক পথের উন্নতি হয়েছে। শুক্রবার সকালে এক বিয়েতে যোগ দিতে দাদাবাড়ি যাচ্ছি। আমার ছোট ভাই নিশ্চয়তা দিল ওখানে পৌঁছতে বিশ মিনিটের বেশি লাগবেনা। আসলে বদলে গেছে মানুষের জীবন।

১০ বছর আগেও ছুটিতে বেড়াতে এলে রাস্তায় পরিচিত অনেকের সাথে দেখা হয়ে যেত। মেঘনায় যাওয়ার রাস্তা ধরলে একে একে অনেক সালাম দিত। আগ্রহভরে জিজ্ঞাস করত কবে আসলাম, কতদিন থাকবো। পাশের টং হতে বেরিয়ে এসে হাউমাউ করে লংকা কাণ্ড বাধিয়ে বসত কেউ কেউ। জোর করে টংয়ে ঢুকিয়ে এক কাপ চা আর একটা সিঙ্গারা খাওয়ার দাওয়াত দিত। অনেকের কাছে এ ছিল দেনা শোধের মত। মনে করিয়ে দিত আমি নাকি তাকে আমাদের শিল্প কারখানায় শ্রমিক অথবা দারোয়ানের চাকরি দিয়ে কৃতজ্ঞতায় দায়ে আবদ্ধ করেছি। এ চা, এ সিঙ্গারা সে দায় হতে মুক্তি পাওয়ার আকুল চেষ্টা।

আজ আবার সে পথে হেঁটে গেলাম। চারদিকের টং গুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। ওদের ব্যবসা এখনো চালু আছে। এক দোকানে দেখলাম গরম গরম পরোটার সাথে ভাজি দিয়ে নাস্তা খাচ্ছে অনেকে। অনেক দোকান হতে কোরান তেলাওয়াত ভেসে আসছে। অথচ একটা সময় ছিল যখন হিন্দি গানের প্লাবনে ভেসে যেত গোটা এলাকা।

আজ একটু ধীরেই হাঁটলাম। আশায় ছিলাম হয়ত দোকান হতে কেউ বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করবে আমার কুশল। নাস্তা খাওয়ার জন্যে কেউ টানাটানি করলে আজ ইচ্ছা ছিল না করব না। বসে পরবো বিনা বাধায়। অথচ একটা সময় ছিল যখন আমাদের পরিবারের কারও জন্যে ওসব দোকানে কিছু খাওয়া ছিল ‘অসম্মানের’।

না, আজ আর কেউ ডাকেনি। কেউ সালামও দেয়নি।
বদলে গেছে প্রজন্ম। বদলে গেছে মানুষের জীবন। সাথে বদলে গেছে মানুষের বেঁচে থাকা।

সব বিবেচনায় নিজকে মনে হল আগন্তুক। জীবনের সমীকরণ মেলানো প্রবাসী কেউ। এমন প্রবাসী এখন ঘরে ঘরে। এসব নিয়ে কারও কোন কৌতূহল নেই। মানুষ চলছে জীবনের সন্ধানে। মিশে যাচ্ছে জীবন যুদ্ধে। সেখানে আমার মত কাউকে যেচে এসে সালাম দেয়ার যথেষ্ট সময় নেই কারও হাতে।

পরনের লুঙ্গিটা ছিল বিপদজনক সঙ্গী। সব সময় সচেতন থাকতে হয়েছে কখন ইজ্জতের সবকটা চেম্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়।

আমার একটাই লুঙ্গি। এর বয়স কম করে হলেও ২০ বছর। দেশে আসার সময় নিয়ে আসি। ফেরার পথে সাথে করে নিয়ে যাই। কেবল আমার শহরে এলেই আমি শহুরে লেবাস হতে বের হয়ে ফিরে যাই সোনালী অতীতে।
ভাল থেকো প্রিয় শহর। সুখে থেকো শহরের মানুষ। আমার কথা মনে হলে নদীর কাছে যেও। এ নদী ও আমি একই নাড়ির। দুজনকে আলাদা করে দেখতে যেওনা।

009

010

011

013

014

015

017

018