বিভাগের আর্কাইভঃ জীবন

শৈশব স্মৃতি রাজাকার

হঠাৎ মনে পড়ল; শৈশবে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতাম। আমাদের অস্ত্র ছিল বাঁশের গুলতি। দেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে পাকি জারজদের স্মৃতি মনে জ্বলজ্বল করছে। পাকিরা পালিয়েছে দেশে রয়ে গেছে তাদের দুষ্কর্মের সাথী।

এখানে সেখানে রাজাকারের বাচ্চা গুলো ধরা পড়ছে, মানুষ ইচ্ছেমতো চড়, কিল, থাপ্পর দিচ্ছে। রাজাকার কি জিনিস আমরা জানিনা, দেখিনি কোনদিন। প্রায়ই দেখতাম মেছো বাঘ কিংবা খাটাশ পাড়ায় দেখা দিয়েছে, মানুষ দলবেঁধে বাঘ খাটাশ পিটিয়ে মেরে ফেলত। আমরা খুব ছোট; রাজাকার ধরার উত্তেজনা আমাদের ছুঁয়ে যেত কিন্তু আমাদের রাজাকারের কাছাকাছি ভিড়তে দেয়া হতো না। আমরা ভাবতাম রাজাকাররা হয়তো বাঘ খাটাশের চেয়েও ভয়ঙ্কর পশু।

একবার এক বন্য শুয়োর মানুষের তাড়া খেয়ে সভ্য পাড়ায় এসে ঢুকে পড়ল শুয়োর দেখে আঁতকে উঠল সবাই তবুও অসহায় প্রাণীর যাতে কোনো বিপদ না হয় সবাই মিলে পাকড়াও করে পুনরায় বনে পাঠিয়ে দেওয়া হল।

কয়েকদিন পরেই আমাদের পাড়ায় এক রাজাকার ধরা পরল এবার আমাদের ঠেকায় কে যেভাবেই হউক এই পশুকে দেখতে হবে। আমরা গুলতি যুদ্ধ থামিয়ে রাজাকার দেখতে গেলাম। রাজাকার দেখে খুব আশাহত হলাম; তাকে কোন ভয়ংকর প্রাণী মনে হল না; দেখতে ঠিক মানুষের মত। যে-ই রাজাকার দেখতে আসছে চড় দিচ্ছে, লাথি দিচ্ছে, থুথু দিচ্ছে। পাড়ার মস্তান লুঙ্গি উল্টিয়ে রাজাকারের গায়ে পেশাব করছে তবু তাকে কেউ ধমক দিচ্ছে না। শুয়োর ঘৃণিত প্রাণী তার নাম নিলেই ওযু নষ্ট হয়ে যায় তবু বিপদে পড়া শুয়োরকে এই মানুষেরাই নিরাপদে বনে পৌঁছে দিয়ে ছিল। একে খাটাশের মত মেরে ফেলছে না কিন্তু ঘৃণা উগড়ে দিচ্ছে। রাজাকাররা শুয়োরের চেয়েও ঘৃণিত এই প্রথম জানলাম…

কথিকা ০৯

ঘাসের ডগায় শিশির কণা সূর্য হয়ে হাসে
মনের যত দুঃখ স্মৃতি খেয়ার স্রোতে ভাসে।

জোছনা মাখা রুপালী চাঁদ হাত বাড়িয়ে ডাকে
কি হবে সুখ-স্মৃতি খুঁড়ে, দুঃখ নদীর বাঁকে।

গুড়ের চা

চার
মা কোনওদিন হেডমিস হতে পারবে না। হেডমিসের কেমন দূর-ময়না গলার আওয়াজ, যে-কোনও “ভাল্লাগে না” সারিয়ে দেওয়া হাসি, পাট-পাট শাড়ির কুচি, রাস্তা দিয়ে এক-ঢেউয়ে হেঁটে যাওয়া… আর মা তো ব্লাউজই পরে না। চাঁদের দিদি প্রতিদিন মিসের সঙ্গে স্কুলে যায়। চাঁদও হেডমিসের পাশাপাশি এক-ঘোরের মধ্যে হেঁটে যেতে চাইছে অল্প হোঁচট খেতে খেতে; শিবুকাকুর দোকানদার ছেলেরা, বটতলায় বসে আড্ডা মারা তার যত পায়ে-ঘা, প্যান্টের-ইলাসটিক-ঢিলে বন্ধু, সব হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে। শিমূলগাছ, তৃণাঙ্কুর ঘাস আর তাতে দড়ি-বাঁধা ছাগল ফিসফিস ক’রে বলবে, ইশ খুব ভুল হয়ে গেছে আপনাকে “এই চেঁদো” ব’লে ডাকা-টা! চাঁদ তখন প্রভাতীদির ছাত্রবন্ধু, সেই বড়দিমনি রাস্তায় যার মুখোমুখি পড়ে গেলে প্রণাম করে কেটে পড়তে হয়।

সরস্বতী পুজোয় গিয়ে সে দেখে এসেছে এক চুপিসাড় অচেনা পৃথিবীকে যেখানে দিদি প্রতিদিন পাঁচ ঘন্টার জন্যে গুম হয়ে যায়। পুট পুট ক’রে ভেঙে যাওয়া চক, ধুলোময় ডাস্টার, তিন কাঠির স্ট্যান্ডে বসানো ব্ল্যাকবোর্ড, একসঙ্গে জোড়া চেয়ার-টেবিল আর বিরাট পেতলের ঘন্টায় নির্মিত সেই রহস্য অমনিবাস। প্রতিদিন সকালে উঠে চাঁদ মাকে জিগ্যেস করেছে, আজ আমারে ইশকুলি ভোত্তি ক’রে দেবা তো, আর মা জবাব দিয়েছে, আজকে না, কালকে। কিন্তু সেই চিরকালীন আজ-এর একদিন যখন দিদি দিদিমনির সঙ্গে রওনা দিচ্ছে, মা হাসছে সৌজন্যমূলক ঘোমটার ভেতর থেকে, চাঁদ পায়খানায় বসে কোঁৎ পাড়ার মতো ক’রে চেঁচাল — আমিও ইশকুলি যাব। পরিবেশে প্রভাব সৃষ্টি হচ্ছে না দেখে সে দ্বিতীয়বার চিৎকার শানালো বুনো গলায়, যেমন আর ডি বর্মন, আর তারপরেই ছেলেটার শরীরে ভেঙে পড়ল কান্না। উঠোনে আমগাছের ছায়ামুগ্ধ কোনে বড় বড় দুব্বোঘাস, তার ওপর শুয়ে পড়ে লুটোপুটি খেতে লাগল। শিশিরে জব্‌জবে নীল সোয়েটার, ছোট ঢিল আর খড়কুটো ফুটতে লাগল পিঠে। মা তার একটা ডানা ধরে টানছে, উঠোনের উনুনে ধানসেদ্ধ ফেলে দিদিমা ছুটে এল, ছোড়দা ভাবছে, ওহ, আজ যা পেটানি খাবে না…! চাঁদের মাথার চুলে আমের শুকনো পাতা; সর্দি, চোখের জল আর শিশিরে ধুয়ে গেছে মুখ; কোঁচকানো ভুরুর ওপরে ছোট্ট কপাল, লম্বা চোখদুটো, ঠোঁট, থুতনি … সব পুরোনো মধুর মতো বিষণ্ণ লাল।

পাঁচ
— ছেলেটারে শুদু শুদু কষ্ট না দিয়ে ইশকুলি ভোত্তি করে দিচ্ছিস না কেন, নাদু?
— যা বোজো না, তা নিয়ে কথা বোলতি আসে না, মা। ওর বয়েস হইছে ইশকুলি পড়ার?
— তালি মিথ্যে মিথ্যে আশা দিস ক্যান্‌?
— যার ছল তারে ভাবতি দাও। মার চেয়ে দরদ মাসির, তারে বলে সব্বোনাশী!
— মানলাম, ছল তোর। কিন্তু ওরম ঠাস ঠাস ক’রে কোনও মা’য় তার বাচ্চারে চড়ায় নাকি! ব্যাচারা কাঁদতি কাঁদতি বাড়িত্থেকে বেরোয় গ্যালো।
— তোমার মোতন গায়ে ফুঁ লাগায় ঘুল্লি আর একচোখোমি কল্লি আমার চলে না। দোষের শাস্তি মার। আমার পরিষ্কার কথা, খাওয়াবো তত্ত্ব, হাগাবো রক্ত।
— ওরে আমার তত্ত্ব-খাওয়ানি রে! সকাল থেকে বাচ্চাগুলোরে দিছিস তো এক কাপ চা আর এক খুরি মুড়ি।
— আমার মাথা গরম ক’রে দিয়ে না, মা। এতগুলো হাঁ ভরাতি হলি মা লক্ষ্মীর ভাণ্ডারেও টান পড়ে। তারপর যদি থাকেন একজন ঘরশত্রু বিভীষণ!
— তুই বিভীষণ কারে বোলিস, নাদু?
— যারে কওয়ার তারেই কোইছি! এক বেলার জন্যি বারাসাতে ছোট্‌ঠাকুরপোর কাছে গিছিলাম। আসে দেখি, সরষেত্তেলের বোতল অদ্দেক খালি! সাধের ছোট নাতিরে মুসুরির ডালের বড়া ভাজে খাওয়ানো হয়ে গেছে। আজ মাসের দশ তারিক, বাকি মাস এই তেলে চলবে কী করে? নিজির সংসার হলি এ-কাজ কত্তি পাত্তে?
— আমি বড়া ভাজিনি। তোর সরষেত্তেলের বোতলে হাতও দিইনি আমি।
— আর দুদিন পরে তো চোখ বোজবা, এখনও মিথ্যে কথা ছাড়তি পাল্লে না। বাচ্চাগুলোর স্বভাব বিগড়ে দিয়ে যাচ্ছ, ছোটোটার মাথা তো খাইছ এর মদ্দিই, সবক’টা অমানুষ হবে। তার ভোগ ভুগতি হবেনে আমার।
— আমি তোর চক্ষুশূল হয়ে উঠিছি, তাই না? অন্ন ধ্বংস করতিছি তোর! তো সে কথাডা অ্যাতো ঘুরোয়ফিরোয় কওয়ার দরকার কী? পাকিস্তান থে’ আসার সুমায় সঙ্গে না নিলিই পাত্তিস।
— তা তো কোইনি। খাবা-দাবা, সংসারের এক কোনে পড়ে থাকবা। গা-জ্বালানি কথা বোলতি আসো ক্যানো? এ-মাসে নিতাই টাকা পাঠায়নি, তোমার জামাইয়ের মাইনে হোতি আরও এক সপ্তা, কাল রবিবার র্যাোশান তোলার পয়সা নেই। তোমার আর কী! সেদিন বললাম, মা উনোনে কয়লা পুড়তিছে, আমার হাত আটকা, কলাইয়ের ডালটা চাপায় দ্যাও। কী কোলে? এখন পারব না, পোড়ে কয়লা পুড়ুকগে! এই কথাডা আমি জীবনেও ভোলবো ভাবিছো! পিঠে খাও পিঠের ফোঁড় গোনো না, না?
— পুরোনো বিত্তান্ত তুলে তুই আমার পায়ে পা বাদায় ঝগড়া কোত্তিছিস, নাদু! তোমার কোন পাকা ধানে মই দিছি যে কারণে-অকারণে খোসবা; আমি কথা বোল্লিই অপরাধ! বাড়িতি এট্টা গরু থাকলি সেও হাম্বা করে, অথচ এ-বাড়িতি আমার কিছু কওয়ার জো নেই! ওনুমোতি দে, আমি তোর সংসার ছাড়ে চলে যাই।
— আমি ওনুও দেব না, মোতিও দেব না। তোমার যা মোনে চায় কোত্তি পারো।
— এমন এট্টা দিন যায় না যেদিন তুই বালবিধবা মা’রে না কাঁদায় জল খাইছিস। যদি এক ফোঁটাও বাওনের রক্ত আমার গায়ে থাকে, তাহলি এই মুখ আর এ-জীবোনে দেখতি পাবি না।
— ওমা, আমি আবার কী বল্লাম তোমারে! আমি তো মুখ বুজেই আছি। সকাল থে’ তুমিই গাচ্ছো, তুমিই বাজাচ্ছো! বেরোয় একবার দেখে আসো, কোনও চুলোয় জায়গা হবে নানে। এই জামাইয়ের হোটেলেই ফিরে আসতি হবে।

ছয়
গাছি উঠেছে নারকোল গাছে; গাছ খোড়োনো হবে, পাড়া হবে ঝুনো নারকোল। গাছিভাইয়ের সারা গায়ে উদ্ভিদের গুঁড়ো গুঁড়ো আঁশ আর ঘাম মিলে ঝাঁঝালো গন্ধ। গোড়ালিতে একগাছি গোরুর দড়ি, এক ফালি ধুতি ল্যাঙোট ক’রে পরা, পাছার দুটো আঁটিই দেখা যায়। চাঁদ আর তার এক বছরের ছোট বোন গোপা, যাকে অজানা কোনও কারণে সে গোপু বলে ডাকে, হেসে এ ওর গায়ে পড়ে যাচ্ছে। বলা হয়নি, এক ঘন্টা আগে চাঁদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাড়ার আজাদ হিন্দ সংঘে একটা চেয়ারে হাঁটুতে থুতনি রেখে বসে শীতে ঠকঠক ক’রে কাঁপছিল। মায়ের নির্দেশে মনিদা ওই অবস্থাতেই তাকে পেছন থেকে ধ’রে তুলে আনে। এখন সে ঘি দিয়ে এক থাল ফ্যানাভাত খেয়ে দিদির ঘরে-পরার সোয়েটারটা গা’য় স্কুলে ভর্তি হতে না পারার দুঃখ ভুলে নারকোলনাড়ু খাওয়ার আশায় উঠোনময় দৌড়ে বেড়াচ্ছে।

গাছি শুকনো ডেগো আর ফ্যাতরা কেটে ফেলছে নীচে আর চোখের সামনে ধক ধক ক’রে বড়ো হয়ে যাচ্ছে গাছটা! ফ্যাতরা দিয়ে ন্যাড়া পোড়া হবে দোলের আগের দিন। আজ আমাদের ন্যাড়া পোড়া/কাল আমাদের দোল/পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে/বলো হরিবোল। সব কবিতাতেই চাঁদের নাম, দেখেছ?

গাছি এক কাঁদি নারকোল মাটিতে নামিয়ে দিল দড়ি বেঁধে। আরে এ কী করলে গাছিভাই, এগুলো তো এখনও ঝুনো হয়নি, দুমড়ো! তখন মনিদা — দুমড়ো নারকোলের সেই গল্পটা বলো না, মা। আরে, আমার এখন অনেক কাজ। আচ্ছা, শোন। পাকিস্তানে আমাদের বাইরির কাজ করার, এই ধর ছাড়া-কাপড় কাচা, ঢেঁকিতে ধান ভানা এসবের এট্টা মুসলমান মেয়ে ছিল, আমারই বয়েসি, সালমা। তাকে একদিন জিগ্যেস করিছি, এই তোরা যে গোরুর মাংস খাস, খাতি কেমন লাগে রে! স্বাদ কেমন? তা সালমা বলে কী,
— ও ঠারোন, দুম্মো নায়েল খায়েসো?
— খাইছি তো!
— অ অ অ অ অ অয়, তবে তুমি গোরুর মাংসও খায়েসো।
— দূর হ’ মুখপুড়ি!

এই গল্পে হাসির কী আছে, চাঁদ বুঝতে না পেরে তাকিয়ে দ্যাখে বোন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ছোদ্দা জানিস, মা’র সঙ্গে দিদ্‌মার ঝগড়া হয়ে গেছে। মা বলল, তুমি রাবণ। দিদ্‌মা বলল, না, আমি বাওন। বলে বাড়িত্থেকে চলে গেল।

দিদিমা বিদায় নিলে চাঁদের অনেক ক্ষতি — প্রথম কথা শোয়া। সে খোপের ঘরে বুড়ির সঙ্গেই ঘুমোয় এবং যেটা পৃথিবীতে কেউ জানে না, ঘুমোনোর আগে তার কিশমিশের মতো শুকনো কচকচে মাই পুরে নেয় মুখে। তারপর রসগোল্লা-ক্ষতি তো আছেই। বাড়িতে মিষ্টি এলে দিদিমা নিজের ভাগেরটা রেখে দিয়ে মাকে লুকিয়ে তাকে খাইয়ে দেয়। মা দেখতে পেলেই ঘেন্না দেবে — খাসনে চাঁদ, তোর দিদ্‌মা ওটা বাঁধানো দাঁতের কৌটোয় রাখে দিছিল। সে আড়চোখে নারকোল-কাঁদির দিকে তাকিয়ে দুর্বল গলায় গোপুকে বলল, আমিও বাওন, আমিও চলে যাব।

(ধারাবাহিক)

শেখ হাসিনা, বেচে থাকুন বাংলাদেশের জন্য

Poli

মানবতার জননী
দেশরত্ন, বিশ্বনেত্রী শেখ হাসিনার শুভ জন্মদিন!..
দীর্ঘায়ু লাভ করুন
বেঁচে থাকুন বাংলাদেশের জন্য!..

আজ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠা কন্যা, স্বাধীন বাংলাদেশে ’৭৫ পরবর্তী সময়ে ইতিহাসের সবচেয়ে সফল রাষ্ট্রনায়ক, মাদার অফ হিউম্যানিটি, সম্প্রতি আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন গবেষণা সংস্থা দ্য স্টাটিসটিকস্ এর সেরা প্রধানমন্ত্রী জরিপে বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভাপতি জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার জন্মদিন।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নব পর্যায়ের বাংলাদেশের ইতিহাসের নির্মাতা। হিমাদ্রী শিখর সফলতার মূর্ত-স্মারক, উন্নয়নের কাণ্ডারি। উন্নত সমৃদ্ধ ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার। বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার একান্ত বিশ্বস্ত ঠিকানা, বাঙালির বিশ্বজয়ের স্বপ্নসারথি। বিশ্বরাজনীতির উজ্জ্বলতম প্রভা, বিশ্ব পরিমণ্ডলে অনগ্রসর জাতি-দেশ-জনগোষ্ঠীর মুখপাত্র, বিশ্বনন্দিত নেতা। বারবার মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা ‘নীলকণ্ঠ পাখি’, মৃত্যুঞ্জয়ী মুক্ত মানবী। তিমির হননের অভিযাত্রী, মাদার অব হিউম্যানিটি। আত্মশক্তি-সমৃদ্ধ সত্য-সাধক। প্রগতি-উন্নয়ন শান্তি ও সমৃদ্ধির সুনির্মল-মোহনা। এক কথায় বলতে গেলে সমুদ্র সমান অর্জনে সমৃদ্ধ শেখ হাসিনার কর্মময় জীবন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেধা-মনন, সততা, নিষ্ঠা, যোগ্যতা, প্রাজ্ঞতা, দক্ষতা, সৃজনশীলতা, উদার মুক্ত গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী ও দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে উন্নীত হয়েছে। এক সময়ের কথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ দারিদ্র্য-দুর্ভিক্ষে জর্জরিত যে বাংলাদেশকে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম করতে হয়েছে জননেত্রী শেখ হাসিনার কল্যাণমুখী নেতৃত্বে সেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বজয়ের নবতর অভিযাত্রায় এগিয়ে চলছে। বিশ্বসভায় আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

মধুমতি নদী বিধৌত গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রাম। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান। এই নিভৃত পল্লীতেই ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। মাতার নাম বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। তিনি বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান। শৈশব কৈশোর কেটেছে বাইগার নদীর তীরে টুঙ্গিপাড়ায় বাঙালির চিরায়ত গ্রামীণ পরিবেশে, দাদা-দাদির কোলে-পিঠে। পিতা শেখ মুজিবুর রহমান তখন জেলে বন্দি, রাজরোষ আর জেল-জুলুম ছিল তাঁর নিত্য সহচর। রাজনৈতিক আন্দোলন এবং রাজনীতি নিয়েই শেখ মুজিবুর রহমানের দিন-রাত্রি, যাপিত জীবন। বাঙালির মুক্তি আন্দোলনে ব্যস্ত পিতার দেখা পেতেন কদাচিৎ। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে শেখ হাসিনা ছিলেন জ্যেষ্ঠা সন্তান। তার কনিষ্ঠ ভাই-বোন হলেন- শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রেহানা এবং শেখ রাসেল। শেখ হাসিনা গ্রামবাংলার ধুলোমাটি আর সাধারণ মানুষের সাথেই বেড়ে উঠেছেন। গ্রামের সাথে তাই তাঁর নিবিড় সম্পর্ক।

শেখ হাসিনার শিক্ষাজীবন শুরু হয় টুঙ্গিপাড়ার এক পাঠশালায়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমপিএ) নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি তাঁর পরিবারকে ঢাকায় নিয়ে আসনে। পুরানো ঢাকার মোগলটুলির রজনী বোস লেনে বসবাস শুরু করেন। পরে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার সদস্য নির্বাচিত হলে আবাস স্থানান্তরিত হয় ৩ নম্বর মিন্টো রোডের সরকারি বাসভবনে। ১৯৫৬ সালে শেখ হাসিনা ভর্তি হন টিকাটুলির নারীশিক্ষা মন্দির বালিকা বিদ্যালয়ে। ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে বসবাস শরু করেন ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর। এ সময় শেখ হাসিনা ১৯৬৫ সালে আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন ঢাকার বকশী বাজারের পূর্বতন ইন্টারমিডিয়েট গভর্নমেন্ট গার্লস কলেজ (বর্তমান বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয়) থেকে। কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভানেত্রী (ভিপি) পদে নির্বাচিত হন। একই বছর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় কিশোর বয়স থেকেই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার রাজনীতিতে পদচারণা। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সর্ববৃহৎ ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেত্রী হিসাবে তিনি আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলন এবং ৬-দফা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু উত্থাপিত ৬-দফা দাবিতে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে এক অভূতপূর্ব গণজাগরণ সৃষ্টি হয়। শাসকগোষ্ঠী ভীত-সন্তস্ত্র হয়ে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। শুরু হয় প্রচণ্ড দমন-নির্যাতন-নিপীড়ন। আটক থাকা অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী দায়ের করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। তাঁর জীবন ও পরিবারের ওপর নেমে আসে গভীর শঙ্কা, অনিশ্চয়তা ও অসহনীয় দুঃখ-কষ্ট। এই ঝড়ো দিনগুলিতেই, কারাবন্দী পিতার আগ্রহে ১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম. এ ওয়াজেদ মিয়ার সাথে শেখ হাসিনা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের কিছুদিন পর শুরু হয় বাঙালি জাতির ১১-দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান। শেখ হাসিনা ছাত্রলীগ নেত্রী হিসেবে তাতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কাল রাতে বঙ্গবন্ধুকে যখন পাকহানাদার বাহিনী গ্রেফতার করে পাকিস্তানের করাচিতে নিয়ে যায় তখন বঙ্গবন্ধুর গোটা পরিবারকে ঢাকায় ভিন্ন একটি বাড়িতে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গৃহবন্দি থাকা অবস্থায় ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই গৃহবন্দি থাকাবস্থায় শেখ হাসিনার প্রথম সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে তিনি মুক্ত হন। ১৯৭২ সালের ৯ ডিসেম্বর তার কন্যা সন্তান সায়মা ওয়াজেদ পুতুল জন্ম লাভ করেন। ১৯৭৩ সালে শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট কালরাতে ঘাতকের নির্মম বুলেটে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। এসময় বিদেশে থাকায় পরম করুণাময় আল্লাহর অশেষ রহমতে প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।

১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ইডেন হোটেলে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক কাউন্সিল অধিবেশনের মধ্য দিয়ে জাতির এক ক্রান্তিলগ্নে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাঁকে সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ডাক আসে দেশ-মাতৃকার হাল ধরার। সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। এরপর দীর্ঘ ২১ বছর ধরে সামরিক জান্তা, স্বৈরশাসন ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে চলে একটানা অকুতোভয় সংগ্রাম। জেলজুলুম, অত্যাচার কোনোকিছুই তাঁকে টলাতে পারেনি এক বিন্দু।

১৯৯৬ সালের ১২ জুনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তাঁর সরকারের আমলেই ভারতের সাথে স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি। সম্পাদিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি। বাংলাদেশ অর্জন করে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৬.৪ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। মুদ্রাস্ফীতি নেমে আসে ১.৫৯ শতাংশে। দারিদ্র্য হ্রাস পায়। খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, ক্রীড়াসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ হাসিনার প্রথমবারের (১৯৯৬-২০০১) শাসনকাল চিহ্নিত হয় ’৭৫ পরবর্তী সময়ের স্বর্ণযুগ হিসেবে।

২০০১ সালের ষড়যন্ত্র ও কারচুপির নির্বাচনের পর বিএনপি-জামাত অশুভ জোট ক্ষমতা গ্রহণ করে। এ সময় দমন-নিপীড়নের মাধ্যমে জোট সরকার সারাদেশে কায়েম করে ত্রাসের রাজত্ব। হত্যা করা হয় ২১ হাজার দলীয় নেতা-কর্মীকে। ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট তদানীন্তন বিএনপি-জামাত জোটের সরকারি মদদে আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে চালানো হয় পরিকল্পিত নারকীয় গ্রেনেড হামলা; যার প্রধান লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা করা। গুরুতরভাবে আহত হলেও আল্লাহর অশেষ রহমতে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। তবে এই হামলায় আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতা-কর্মী নিহত হন। চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করেন অসংখ্য নেতা-কর্মী। বাংলাদেশ পরিণত হয় এক মৃত্যু উপত্যকায়। বিএনপি-জামাত জোট সরকারের মদদে সারাদেশে ধর্মীয় জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের ব্যাপক উত্থান ঘটে। আর তাদের এই দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান অকুতোভয় শেখ হাসিনা। বাংলার আপামর মানুষ তাঁর আহবানে রাজপথে নেমে আসে। ২০০৬ সালে ২৮ অক্টোবর বিএনপি-জামাত জোট সরকারের শাসনের অবসান হলেও সংবিধান লঙ্ঘন করে বিএনপির রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দীন আহমেদ নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ দখল করেন। হাওয়া ভবনের নির্দেশে চলতে থাকে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং এবং নির্বাচনী প্রহসনের প্রস্তুতি। গর্জে উঠে বাংলাদেশ। জননেত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। শুরু হয় গণ-আন্দোলন। বাতিল হয় পাতানো নির্বাচন। প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন ইয়াজউদ্দিন। ঘোষিত হয় জরুরি অবস্থা। ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত হয় নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

১/১১-এর পর শুরু হয় নতুন ষড়যন্ত্র। শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য হাজির করা হয় ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’। শেখ হাসিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফর শেষে দেশে ফিরে আসার সময় বেআইনিভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু সাহসিকা জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারি নিষেধাজ্ঞা, ষড়যন্ত্র ও মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে ২০০৭ সালের ৭ মে ফিরে আসেন প্রিয় স্বদেশ ভূমে। কিন্তু এর মাত্র দু’মাস পর ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই নিজ বাসভবন সুধাসদন থেকে শেখ হাসিনাকে দানবীয় কায়দায় গ্রেফতার করা হয়। জাতীয় সংসদ এলাকায় একটি অস্থায়ী কারাগারে তাঁকে বন্দি করে রাখা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় একের পর এক ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা। কারাগারে তাঁর জীবননাশের ষড়যন্ত্র চলে। তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। জীবন মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে চলতে থাকে গণসংগ্রাম ও আইনি লড়াই। আওয়াজ ওঠে শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে কোনো নির্বাচন নয়। বদলে যায় দৃশ্যপট। জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অর্জিত হয় ঐতিহাসিক বিজয়। এককভাবে আওয়ামী লীগই লাভ করে তিন চতুর্থাংশের বেশি আসন। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দ্বিতীয়বারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। গঠিত হয় মহাজোট সরকার। জননেত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন ও অমিত সম্ভাবনার শক্তিশালী ভীত রচিত হওয়ায় জনপ্রিয়তার অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যান শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে জননেত্রী শেখ হাসিনার নের্তৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার আজ সফলতার সাথে টানা তৃতীয় মেয়াদে চতুর্থবারের মতো দেশ পরিচালনা করছেন। সরকারের গৃহীত পদক্ষেপে দেশবাসী আজ সুফল পাচ্ছে। অমিত সম্ভাবনার দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে এক অপ্রতিরোধ্য গতিতে। বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে সকল প্রতিবন্ধকতা সমস্যা-সংকট ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশ আজ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে উন্নীত হয়েছে। ২০০৯ থেকে বিগত এক দশকে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের বিনির্মাণের অভিযাত্রায় যুক্ত হয়েছে অজস্র সাফল্য-স্মারক।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চুড়ান্ত নিষ্পত্তি, একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্য সম্পন্ন করা, সংবিধান সংশোধনের মধ্য দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, ভারত ও মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি ও সমুদ্রবক্ষে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ব্লু ইকোনমির নতুন দিগন্ত উন্মোচন, বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট সফল উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে মহাকাশ জয়, সাবমেরিন যুগে বাংলাদেশের প্রবেশ, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ, মেট্রোরেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, কর্ণফুলী টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, নতুন নতুন উড়াল সেতু, মহাসড়কগুলো ফোর লেনে উন্নীত করা, এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৯০৯ ডলারে উন্নীত, প্রবৃদ্ধি ৮.১ শতাংশ, দারিদ্র্যের হার হ্রাস, বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২২ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যাওয়া, ৯৪ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ-সুবিধার আওতায় আনা, যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন, স্বাক্ষরতার হার ৭৩.৯ শতাংশে উন্নীত করা, বছরের প্রথম দিনে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে নতুন বই পৌঁছে দেওয়া, মাদ্রাসা শিক্ষাকে মূলধারার শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত করা ও স্বীকৃতি দান, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, প্রত্যেকটি জেলায় একটি করে সরকারি/বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ, নারী নীতি প্রণয়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ, ফোর-জি মোবাইল প্রযুক্তির ব্যবহার চালুসহ অসংখ্য ক্ষেত্রে কালোত্তীর্ণ সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ।

এক বর্ণাঢ্য সংগ্রামমুখর জীবন জননেত্রী শেখ হাসিনার। সাফল্য গাঁথা এই কর্মময় জীবন কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না, ছিল কণ্টকাকীর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তিনি গৃহবন্দি থেকেছেন। সামরিক স্বৈরশাসনামলেও বেশ কয়েকবার তাকে কারা নির্যাতন ভোগ ও গৃহবন্দি থাকতে হয়েছে। বার বার তাঁর জীবনের ওপর ঝুঁকি এসেছে। অন্তত ২০ বার তাঁকে হত্যার অপচেষ্টা করা হয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তিনি অসীম সাহসে তাঁর লক্ষ্য অর্জনে থেকেছেন অবিচল।

সহজ সারল্যে ভরা তাঁর ব্যক্তিগত জীবন। মেধা-মনন, সততা, কঠোর পরিশ্রম, সাহস, ধৈর্য্য, দেশপ্রেম ও ত্যাগের আদর্শে গড়ে উঠেছে তাঁর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। পোশাকে-আশাকে, জীবন-যাত্রায় কোথাও কোন প্রকার বিলাসিতা বা কৃত্রিমতার কোনো প্রকার ছাপ নেই। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ও ধার্মিক। নিয়মিত ফজরের নামাজ ও কোরান তেলওয়াতের মাধ্যমে তাঁর দিনের সূচনা ঘটে। পবিত্র হজব্রত পালন করেছেন কয়েকবার।

একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তাঁর অবদান আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। ইতোমধ্যে তিনি শান্তি, গণতন্ত্র, স্বাস্থ্য ও শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস, তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার, দারিদ্র্য বিমোচন, উন্নয়ন এবং দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে সৌভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য ভূষিত হয়েছেন অসংখ্য মর্যাদাপূর্ণ পদক, পুরস্কার আর স্বীকৃতিতে।

নিখাদ দেশপ্রেম, দূরদর্শিতা, দৃঢ় মানসিকতা ও মানবিক গুণাবলি তাঁকে আসীন করেছে বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে। তিনিই বাঙালির জাতীয় ঐক্যের প্রতীক এবং বাঙালি জাতির সকল আশা-ভরসার নিরাপদ আশ্রয়স্থল। ’৭৫ পরবর্তী বাঙালি জাতির যা কিছু মহৎ অর্জন তা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই অর্জিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার জন্মদিন আজ গোটা বাঙালি জাতির জন্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন।

২৮.৯.২২
দাউদুল ইসলাম
( কবি ও প্রাবন্ধিক)

দুটি কবিতা

ডাকহরকরা
..
কোথা থেকে একজোড়া চোখ উড়ে এসে বসলো
তারপর থেকেই শুরু আলোর খ্যাপ
বিসর্গদিনে বাড়ছে দৈনিক খরচের হিসেব
দেখে যারে অনুপম কুয়োতলার ব্যাঙ এসে
নিচ্ছে ভালো মন্দের খবর!

জীবন যেমন
..
মানুষ লিখতে গিয়ে লিখে ফেলি জীবন
জীবন ‍মূলত সুখ! সুখ! খেলা
দুঃখ – কষ্ট – যতো নষ্টের মেলা
চুঁইয়ে পড়ছে আঙুলে ধরে রাখা সুখ
ওদিকে মাটি খুঁড়ে বাবা তুলে আনছেন স্মৃতি
মা বসে থেকে দিচ্ছেন ধৈর্য্য পরীক্ষা।

কবিতা

306

শান্ত এ নদী, থমকে যাওয়া জল;
তবুও নতুনের আনাগনায় থৈ থৈ পাড়
বহু শতাব্দীর পুরনো এই জলপথ
স্ব’গৌরবে বহমান স্মৃতির পরশ পাথর ছুঁয়ে
প্রকৃতির অনন্যশালী মহাকাব্য রচনা করছে।

নদীর জন্য এলিজি

উনচল্লিশ বছরে পরে
অভিশাপ মুক্ত হতে নদীর পাড়ে এলাম;
নদী কই এখানে তো ঝলমলে বিপণী!

কৈশোরের আবেগে অনিচ্ছা সত্ত্বে
জল বিয়োগ করেছিলাম
সেই পাপ উনচল্লিশ বছর ধরে কুরে কুরে খাচ্ছে।

অনিচ্ছার পাপ আমাকে স্বস্তি দেয়নি;
যারা ধর্ষণ করে হত্যা করে ফেলল
তারা কী করে সুখে থাকে!

ক্ষমা চাইবার আগেই নদীকে হত্যা করা হলো
জল বিয়োগের পাপ নিয়ে কবরে যেতে হবে।

ধর্ষকদের মৃত্যু হবে না, তারা অমর;
আরো অসংখ্য নদী ধর্ষিতা হওয়ার অপেক্ষায়।

প্রেম সৌন্দর্যহীন যে কারণে প্রেম সৌন্দর্যের প্রতি পিপাসিত

index প্রেম সৌন্দর্যের কামনা করলে বোঝা যায় যে প্রেম সৌন্দর্যহীন যে কারণে প্রেম সৌন্দর্যের প্রতি পিপাসিত।

“সক্রেটিস বলেছেন প্রেম দেবতা নয় মানুষও নয়” আমার কাছে প্রেমকে এমন কিছু মনে হয় যা অন্তরের স্বর্গ সত্তাকে দারুণভাবে প্রভাবিত ও আবেগ তাড়িত করে। যার দ্বারা একটি অমর প্রেমের উপাখ্যান তৈরি হয়। এই দেবতা স্বর্গে নয় মর্তের লৌকেই মানব রূপে বিরাজমান ও প্রতিষ্ঠিত। যে দেবতাদের সেই প্রেমের সূচিত শক্তির উচ্চতর চেতনা দ্বারা ভাস্কর্য হয়। তবে প্রেম সর্বদা সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট করে আপনি যদি বলেন সৌন্দর্য কি আমি মনে করি শারীরিক গঠন চেহারার সাদৃশ্য সৌন্দর্যই শুধু একজন মানুষের সৌন্দর্য নয় সৌন্দর্য সেটাই তা হল একজন মানুষের চতুর্পাশ্বিক গুণাবলী।

প্রেম সৌন্দর্যের কামনা করলে বোঝা যায় যে প্রেম সৌন্দর্যহীন যে কারণে প্রেম সৌন্দর্যের প্রতি পিপাসিত। প্রেমের সৃষ্টি বৃত্তান্ত কি এটা আমরা নানাভাবে উপলব্ধি করতে পারি প্রেমের সৃষ্টি বৃত্তান্ত একজন মানুষের হৃদয় থেকেই শুরু হয় এখন সেই মানুষটা ধনী গরিব ছোট বড় ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে হতে পারে। প্রেম কি দুঃখকে ভয় পায়? প্রেমের বহুল ব্যবহৃত সুখ-দুঃখের প্রবাদ বোঝায় যে মেক্সিমাম ক্ষেত্রে প্রেম দুঃখকে ভয় পায় কষ্ট কে ভয় পায় অনেক ক্ষেত্রে ভয় পায় প্রতিবন্ধকতা কে প্রেমের সফলতার হার শতভাগ না হলেও জগত প্রেম ও ভালোবাসার দাঁড়ায় মূল্যায়িত হয় সংজ্ঞায়িত হয়। জগতে প্রেম ভালোবাসা কোনোভাবেই প্রতারক হতে পারে না

প্রতারিত করবে এমনটাও নয় প্রেম জড়বস্তুর আধার হলেও তার প্রকাশভঙ্গি মানব সৃষ্ট প্রেম স্বতন্ত্র সত্তা কিন্তু মানুষ প্রেমকে ভালোবাসাকে প্রতারণার এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। প্রেমকে ভালোবাসাকে চাঁদ তারায় প্রকাশ করা হয় তারাই এই ধৃষ্টতা দেখায় প্রেমকে ভালোবাসাকে প্রতারণার এক মশাল বানিয়ে মানুষের অন্তরে বিষবৃক্ষ তৈরি করে চার খেসারত প্রতারণাকারীর বিপরীত মানুষগুলোকে দিতে হয়।

কিন্তু তারা জানেনা প্রেম মোহমুক্ত ভালোবাসা মোহমুক্ত জাগতিক সম্পর্কের এই মানুষ রূপের অমানসিকতা মানুষের মাঝে দেখা যায় তারা মুখ তো কখনোই হতে পারে না প্রেমে কষ্ট আছে থাকতে পারে এটা থাকবে তবে প্রেমে কখনোই সহিংসতা আসতে পারেনা শ্রেষ্ঠত্বের অংশীদার মাত্র একজন শিল্পীর চোখে প্রার্থীর জীবন।

যেমন সুন্দর প্রকৃতির রূপ রস গন্ধ যেমন সুন্দর সাবলীল অহিংস তেমনটি প্রেম হয় কিন্তু মানুষ হতে পারে না মানুষ অবলীলায় প্রতারণা করবে প্রতারণার করে প্রেমে শৌর্যবীর্যের অভাব নেই মানুষের কাছে প্রেমের অর্জন অত্যন্ত ভিন্ন মানুষের নীতি নৈতিকতা যেভাবে অর্থের প্রাচুর্যে ঢেকে পড়েছে সেখানে প্রেম কখনোই জাগ্রত হতে পারেনা।

গুড়ের চা

এক
শীতকাল পুরোনো নীল সোয়েটারের শক্তিপরীক্ষা নেয়।
শুরুতে মনিদার ছিল, তারপর ছোড়দা পরতো, এখন চাঁদের গায়ে। ক্যাশমিলনের তৈরি, কিন্তু তাতে বিচ্ছেদের ভাগ বেশি; ক্ষার-কাচায় আর টান খেতে খেতে উলগুলোর ফেস্টো বের হয়ে গেছে, হাওয়া পাস করে মাছের-চোখ ডিজাইনের ভেতর দিয়ে।

লেপেরও তুলো সরে গেছে স্থানে স্থানে; মুড়ি দিলেও যখন চোখে আলো আসছে, বুঝতে হবে ভোর হল মশারি খোলো। ঘুম থেকে উঠেই চলো রান্নাঘর, রাতের বাসি উনুন থেকে ঘুঁটের ছাই অধিকার করি, দাঁত মাজি যতক্ষণ না হাতে-দাঁতে কিচকিচ আওয়াজ। কিন্তু বিছানা ছাড়ার আগে হি-হি করতে করতে ওই নীল সোয়েটার পরে নেওয়া, যে সব সময় সমকালীন শীত থেকে পিছিয়ে আছে। তার নীচে হাফ প্যান্ট, থাইয়ের লোমগুলো যেন কাঁটানটে গাছ। এই পৃথিবীতে পাঁচ বছর বয়েসে পাজামা পরার নিয়ম বা পয়সা নেই।

বাইরে এসে দাঁড়ালে নতুন দিনের দরজা খোলার খুটখুট কানে আসবে। সেই শব্দ উঠোনের শালিখদল, পতিত কিন্তু ঝলমলে আমড়াপাতা আর সমতল কুয়াশার পাহাড়ি হয়ে ওঠার স্বপ্ন দিয়ে তৈরি। রোদের রশ্মি এতক্ষণে পৃথিবীতে নামছে, তাকে রাস্তা চিনিয়ে আনছে গুলকয়লার ধোঁয়া। তবু এখনও আমগাছের পল্লবে মাকড়সার জাল বিয়ের কনের মুক্তোমুকুটের মতো নেহার ফোঁটায় সেজে আছে। আবার পেয়ারাকুঁড়ির গা-য় সাদা তুলো জমাট-বাঁধা, নখ দিয়ে খুঁটেছ কি নীচে হোমিওপ্যাথ দানার চেয়েও ছোট ছোট পতঙ্গের ডিম, টিপলে দুধ বেরিয়ে আসে। এসব দেখতে দেখতে রোদের ফালিগুলো বড় হল, পুব দিকের ডোবা পেরিয়ে চাকা নামাল চাঁদের উঠোনে। তখন হাতে বোনা এক একটা খেজুরপাতার পাটি ওই রোদের স্লাইসগুলোর ওপর পেতে বই নিয়ে বসে যায় ছেলেমেয়েরা, আর গ্যাঙোর গ্যাঙ শুরু চার-পাঁচটা নিনাদিত গলায়। কেউ নিজের পড়া শুনতে পাচ্ছে না-র মধ্যে চাঁদ শুধু নিশ্চুপ হয়ে থাকে। মা টের পায়।
— মন কোথায় তোর?
— আমার ক্ষিদে পায়ে গেছে।
— বাহ, ঘুম থেকে উঠতি না উঠতিই ক্ষিদে! পেটে কী ভস্মকীট বাসা করিছে?

সোয়েটারের ওপর দিদিমা তুষের চাদর পরিয়ে দিয়েছিল ঘাড়ে গিঁট বেঁধে, তার মধ্যে কিছু একটা নড়ে ওঠে। “আবার তুই বিড়েল নিয়ে বসিছিস? এই তোর পড়াশুনো? দেখিসকানে, কোনওদিন ইস্কুলে ভোত্তিই করবো না তোরে, সারা জীবন মুখ্যু হয়ে ঘরে ব’সে বিড়েল ঘাঁটিস”।

এই শাসানি গণপ্রহারের চেয়েও সাংঘাতিক; চাঁদ প্রাণীটিকে তড়িঘড়ি মুক্ত করে দেয় — একটা ফুটফুটে সাদাবাদামি শিশু, যে চাদরের ওম হারিয়ে অখুশি মুখে এক লাফে আবার চাঁদের কোলে উঠে আসছিল। তখন ঘাতকের মতো তার ঘেঁটি ধ’রে শূন্যে ছুঁড়ে দেয় চাঁদ, আকাশে তিনচার ডিগবাজি খেয়ে বেড়াল ক্যাঁক ক’রে পেট দিয়ে পড়ে শুকনো উঠোনে।

দুই
এই দৃশ্যের গায়েই লেগে আছে বাড়ির খেজুরগাছ বেয়ে মনিদার উঠে যাওয়া। ঝট ক’রে রান্নাঘর থেকে একটা অ্যানামেলের গেলাস হাতে নিয়ে সেও ছোড়দা আর বোনের সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে যায়। মাটির ঠিলে গাছ থেকে নামিয়ে মায়ের শাড়ি-ছেঁড়ার ছাঁকনি দিয়ে মনিদা সবার গেলাসে কিছুটা করে প্রথম-কাটানের খেজুররস ঢেলে দিচ্ছে, ওমনি ছাঁকনি থেকে তিন চারটে কালো বোলতা ফড়ফড় ক’রে বাতাসে ওড়ে। নাক-জ্বালা-করা ঝাঁঝালো কিন্তু মিছরির মতো ঠান্ডা সেই রসে শিরদাঁড়ায় শীতের কাঁপুনি ফিরে আসে চাঁদের, লাফ দিয়ে খেজুরপাতার চাটাইয়ে উপনীত হয়। কিন্তু রোদে ব’সেও দাঁত-ঠকঠকি কমছে না কেন! পেছনে তাকিয়ে দ্যাখে ছোড়দা বেমালুম তার রোদ্দুর আড়াল ক’রে দাঁড়িয়ে! রাগে অন্ধ ছেলে “সর, শালা” ব’লে দাঁত-বের-করা দাদাটির দিকে ইঁটের টুকরো তোলে। ওমনি সে চেঁচিয়ে, “দ্যাখো মা, ভাই আমাকে শালা বলল”।

তাহলে কলোনির গাঙ্গুলিবাড়িতে খবরের কাগজ পৌঁছনোর আগেই দিনের প্রথম এফআইআর রুজু হয়ে গেল চাঁদের নামে। প্রতিদিন ছোট-বড় মিলিয়ে এরকম সাত-আটটা। বেলা যতই আকাশ বেয়ে ওঠে, তার নামের সঙ্গে অপহরণ, রাহাজানি, খুনের প্রচেষ্টার মতো অভিযোগ জড়িয়ে যায়; একটা টাটকা-ফ্রেশ সকাল শুধু চাঁদের অপকর্মের জন্যেই ক্রমে দুপুরবিকেল থেকে স’রে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সে অপরাধগুলো না করলে পৃথিবীতে… পৃথিবী না হোক, দত্তপুকুরে রাত নামত না কখনও। আর রাত্রি অনুৎপন্ন হলে কাজ থেকে ফিরে বাড়ির বড়রা কীভাবে আইন নিজেদের হাতে তুলে নেবে, আর কী ক’রে ভাইকে মার খাওয়ানোর আনন্দে খ্যা-খ্যা ক’রে হাসবে দাদা-দিদি?

তিন
তবে বিদ্যাভ্যাসে আকর্ষণীয় সব বাধা আছে। “দুউউউধ” ব’লে বড় রাস্তা থেকে একটা ফাটা গলা চিৎকার দিতেই তিন লাফে কলতলার পাঁচিলের ওপর রাখা বাটিটা হাতে তুলে নেয় চাঁদ। গোয়ালা হারানকাকুর দুধের ড্রামে খেজুরপাতা বসানো, সে মাসকাবারি যোগান হিসেবে এক ঘটি মানে আধ সের দুধ চাঁদের হাতে ধরা বোকনো বাটিতে ঢেলে দিল। তারপর তাদের টিউবয়েল থেকে ঝক-ঝক ক’রে জল ভ’রে নিল ক্যানে। এইভাবে চোখের সামনে দুর্নীতি দেখলে বাবা খুবই আপত্তি করেন। কিন্তু বাবা আর মা যথাক্রমে আদর্শ এবং তা থেকে দুশো মাইল দূরের বাস্তববাদ। মা-র পরিষ্কার কথা, জল তো ওরা মেশাবেই মেশাবে। পুকুরের পচা জলের বদলে বরং কলের ভালো জলই ঢালুক।

আসলে, ঘোষেরা কলকাতায় সাপ্লাই দেবে ব’লে ভেন্ডারে ক’রে দুধ নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রতিদিন তারা লেট, ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকে ব’সে থাকে, ছাড়ো-ছাড়ো ভাব, তখন রাস্তা দিয়ে বাঁক কাঁধে দৌড়োবে, মুখে এক প্রবল “ও ও ওয়, ও ও ও ও ওয়”। গার্ড সেই ফুসফুস-ফাটানো চিৎকারের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় ট্রেন, বদলে সে ফ্রিতে কিছুটা দুধ পেল কিনা সে প্রশ্ন অবান্তর। কিন্তু আজ স্টেশানে পৌঁছনোর আধ ঘন্টা পরেই দেখা গেল গোয়ালার ঝাঁক বাঁক কাঁধে মন্দ-মন্দ পায়ে আবার কলোনিমুখো। মছলন্দপুরে ট্রেন লাইনচ্যুত, এতক্ষণ কোলে মার্কেটে তাদের মহাজন ব’সে থাকবে না ব’লে অর্ধেক দামে গ্রামেই সব দুধ বেচে দেবে ঘোষ সম্প্রদায়। তখন দিদি স্কুলের যাওয়ার জন্যে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে “আর এক সের দুধ কেনো না মা, পায়েস খাবো!” অনুনয় রাখলে ঘরে চিনি বাড়ন্তের জন্যে মা কিন্তু-কিন্তু করেও শেষে আঁচলের গিঁট খুলে ফ্যালে। চাঁদ অবাক হয়ে দ্যাখে তাদেরই কলের জল দুধ হয়ে তাদেরই ঘরে ঢুকে গেল।

“ও মা, খাতি দেবা না?” ডাকে সেই ক্ষোভ মিশিয়ে দেয় সে, এবং সঙ্গে সঙ্গেই “আসে নিয়ে যাও” শুনে ভাইবোনদের দুমদাম দৌড় রান্নাঘরে। চাঁদ মুড়ির বাটি আর হাতলভাঙা কাপে চা সন্তর্পণে ধ’রে ফেরত আসে খেজুরপাটিতে। গুড়ের চায়ে প্রথম চুমুকেই প্রাণ জুড়িয়ে গেল, আহ কী মিষ্টি! এক মুঠো মুড়ি ফেলে দেয় চায়ের কাপে, তারপর কানের কাছে কাপ তুলে আনে। এখন কিছুক্ষণ সে খাওয়া ভুলে শোঁ-শোঁ সমুদ্রগর্জনে মোহিত হয়ে থাকবে।

(চলবে)

পবনে প্লাবন

3068

ডুব সাঁতারের শর্ত কিবা আছে
অনিয়মের খোলস যদি মুখে
বিমূর্ত সব হিসেব নিকেশ আছে
দুঃখ ছোঁয়া দৈন্যতার এই বুকে।

অপলক তাই চেয়ে যদি থাকি
দৃষ্টি চোখে রাগের পাহাড় চাঁপা
খুব করে তাই বিধতে পারো আঘাত
ব্যাথা সইবার খোলা বুকটা পাতা।

কথার খঞ্জর সবাই কী আর ভোলে
কেওবা পেয়েও হারায় দ্বীপের আলো
না বুঝে সে ভেঙে দিতে পারো
ভুল পথে তাই চলছো যদি আরো।

দূরত্ব টা নিপুণতার সাথে
বাড়িয়ে দিলে অনিয়মের হাতে
উগ্র স্বভাব শুধুই মেজাজ হারা
সব ফুরাবে ভরাডুবির সাথে।

ডুব কী দেবো, দুঃখ নদীর জলে
হাজার কর্ম সূর্যতাপে জমা
একা পথে চলছে এমন দিন
কাটুক না তাই, পারলে কোরো ক্ষমা।

এখন তখন

IMG-20 এখন আর রেডিও লাগে না। হাতের মোবাইলে প্লে স্টোরে লাখ লাখ অ্যাপস্ এর মধ্যে প্রচুর পারফেক্ট বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ইয়া দেবী সর্বভূতেষু করেই চলেছেন বছরের যে কোনো সময়ে।

আগে লোকেরা বেশী রাত্রি পর্যন্ত জাগতো না। এন্টারটেইনমেন্ট এর গণ্ডী ছিল সীমাবদ্ধ। হলে সিনেমা, রেডিওতে নাটক বা ছায়াছবির আসর কিম্বা বিনাকা গীত মালা আর খবর। ব্যস্। দশটা, সাড়ে দশটা, বড়জোর এগারটার পরে উঁচু ক্লাসের কয়েকজন পড়ুয়া বাদে সবাই ঘুমের দেশে চলে যেত। যে যত তাড়াতাড়ি ঘুমোত সে তত তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে উঠে পড়ত।

এখন সে সবের বালাই নেই। পাঁচ থেকে পঁচানব্বই রাত্রি দুটো, তিনটে অবধি ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, টুইটার, ইউ টিউব, অনলাইন শপিং বোঁ বোঁ করে ঘুরেই চলেছে। হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া কেউই রাত বারোটার বর্ডারের এপারে বিছানার দিকে তাকায় না। ফলে ভোর চারটেয় ঘুম থেকে উঠে মহালয়া শোনার গল্প এখন মিথ।

হরেকরকম অসুবিধা এখন নেই হয়ে গেছে মাইক্রো চিপসের কল্যাণে। রেডিও সারানোর জন্যে মিস্ত্রির দরজায় ধর্ণা দেওয়া নেই। আকাশছোঁয়া দাম দিয়ে চার কিম্বা ছয় ব্যাটারি কেনার হৃদয় বিদারক ধাক্কা নেই।

ইলেকট্রিক্যাল কানেকশনের মাঝপথে নেই হয়ে গিয়ে জিভের তোড়ে ইলেকট্রিক দপ্তরের শ্রাদ্ধ শান্তির সম্ভাবনা নেই। মহালয়া শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লে হাহুতাশ করতে করতে আরও এক বছর অপেক্ষা করা নেই। চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পারফেক্ট আওয়াজ বার করে আনার যুদ্ধ নেই। মহালয়া থেকেই পূজোর দিন গোনার দিনও ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। মফস্বলে এখনো ততটা নয়, বিশেষ করে বড় যান্ত্রিক শহরে মহালয়ার দিনই বড় পূজোর উদ্বোধন হয়ে রাস্তায় নেমে পড়ছে হুজুগে পাবলিক, তাই সেখানে পূজোর দিন গোনার মিষ্টি আনন্দ নেই।

সত্যিই অসুবিধা গুলো প্রায় নেই বললেই চলে। আর এতসব নেই এর ধাক্কায় আনন্দটাও কখন পেছনের দরজা খুলে নেই হয়ে গেছে, সেটা কেউই জানতে পারে নি।

ধর্মাধর্ম

30 একটা বিশাল প্রাসাদ ছিল। কী ছিল না সেখানে! বড় বড় হলঘরের মত শোবার ঘরই যে কতগুলো, তার হিসাব রাখতে রীতিমতো মোটা মোটা জাবদা খাতা লাগত। ছিল চকমিলান বারান্দা, বিস্তৃত খোলা আকাশ মাথায় উঠান, জাঁকজমক ওয়ালা ঝকমকে জলসাঘর, অজানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রার্থনার ঘর। ছিল, অনেক কিছুই ছিল। ছিল না শুধু স্বার্থপর আমার আমি। কখন যে চুপিসারে লোভের ময়াল ঢুকে পড়ল সেই প্রাসাদের অন্দরমহলে কেউ বুঝতে পারেনি।

একে একে আমাদের প্রত্যেককে গিলে ফেলতে শুরু করল সেই সাপ, সেই খাওয়া এখনো চলছে। ময়ালের পেটের ভেতরে গিয়ে আমরা ভাগ করা শিখলাম। টুকরো করতে শুরু করলাম আমাদের খাবার জায়গা, শোবার জায়গা, খেলার জায়গা, গল্প করার আর শোনার জায়গা, আদর করার জায়গা। আমাদের সবার প্রার্থনার জায়গা ভেঙে ছত্রখান হয়ে ছোট ছোট খুপরি হয়ে গেল। সেই খুপরিতে কোনক্রমে হাঁটু মুড়ে বসে আমরা তৈরী করে নিলাম আলাদা আলাদা ঈশ্বর, আলাদা আলাদা ধর্ম, আলাদা আলাদা আচার – বিচার – কুসংস্কার – নিয়ম – কানুন – ঘৃণা। আমাদের প্রার্থনার জায়গা থেকে উবে গেল ভালোবাসা।

কে হিন্দু, কবে থেকে হিন্দু, কীভাবে হিন্দু না জেনেই আমরা হিন্দু হলাম। ঠিক সেভাবেই আমরা হয়ে গেলাম মুসলমান, খ্রীষ্টান, ইহুদি, পার্শি, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ আরও কত কী! আমরা নানারকম তকমা এঁটে আমরাই শ্রেষ্ঠ সেটা প্রমাণ করার জন্যে হাতে তুলে নিলাম ধারালো থেকে তীব্রগতির শাণিত নানান অস্ত্র। যার যার শরীরে আমার মতই একই রঙের রক্তস্রোত বইছে, তাদের মাথা কেটে ফেলার চেষ্টা করতে লাগলাম। আমরা চোঙা ফুঁকে চিৎকৃত হলাম, “আমরা আধুনিক”।

আমরা শ্রীমদ্ভগবতগীতা পড়িনি। দেখেছি আমাদের টুকরো ঘরের কেউ মারা গেলে চিল চিৎকার করে কাঁদতে হয়, টিকি নাড়া মানুষের নিদান মত সিদ্ধ ভাত, কাচকলা খেতে হয়, মৃতের সম্পত্তির হিসাব নিতে হয় তড়িঘড়ি। আর অন্তিম দিনে পান, সুপারী, পৈতে, নগদ একটা টাকার কয়েন আর দশকর্মা ভাণ্ডার থেকে কেনা যত কম দামী সম্ভব একটা চটি গীতা নামের খেলনা বই দিতে হয় কিছু মনুর বংশধরকে। সেই চটি বই যাকে দেওয়া হয়, সেও পড়েনা। অথচ দেওয়া নেওয়া চলে কারন এটাই নাকি নিয়ম, এটাই নাকি ধর্মীয় আচার। সুতরাং ওই বিশালদেহী শ্রীমদ্ভগবতগীতা নামের বইটা আমরা পড়িনা। তার ভিতরে কী লেখা আছে আমরা জানিনা, জানতে চাই না।

আমরা শ্রীকৃষ্ণ জানি টিভির সিরিয়াল দেখে, জন্মাষ্টমীর দিন গুগুল ইমেজের হ্যাপি জন্মাষ্টমী ছবি থেকে, ইউটিউবে আমার মতই অন্য আরেক বেরাদরের আপলোড করা ভিডিও দেখে, ফেসবুকের অর্বাচীন পোস্ট দেখে, ইন্সটাগ্রাম বা ট্যুইটার বাণী দেখে। ঠিক এভাবেই আমরা রামায়ণ না পড়েই রাম চিনি, রাবণ চিনি, পুরাণ না পড়েও শিব চিনি, দুর্গা চিনি, মহাভারত না পড়ে দ্রৌপদী চিনি, কিছু না পড়ে বা না বুঝেই ঈশ্বর চিনি। আমরা আদতে কখনো কোনো বই পড়িনা। বেদ, উপনিষদ বলে কিছু আছে সেটা জেনেছিলাম ছোটবেলার পাঠ্যবই পড়ে। আমরা ধর্ম চিনি রাজনৈতিক হুহুঙ্কারে।

ছোট ছোট ঘরে থাকি নিজেকে আর নিজের পরিবারকে নিয়ে। কিন্তু নিজের ওইটুকু ঘরের অন্যদের সম্পর্কেও সদ্ভাবনা নেই আমাদের। হাজার কুচি কুচি অংশে নিজেদেরই কেটেছি ছিঁড়েছি। এ শূদ্র ও চণ্ডাল, এ ব্রাহ্মণ ও ধোপার বউ, এ কুলীন ও নাপিতের মেয়ে এরকম নাক উঁচু হাজার হাজার ভাগ। অথচ আমরা জানিই না যে শাস্ত্র বলে ‘জন্মে ব্রাহ্মণ হয় না, কর্মে ব্রাহ্মণ হয়’। জাতপাতের নোংরা অন্ধকারে নিজেদের গায়ে নিজেরাই পরম আদরে হাত বুলাই।

পাশের ঘরের প্রতিবেশীকে চিনিনা, জানিনা, জানার চেষ্টাও করিনা কখনো। প্রতিবেশীরাও আমাদের মতই কোরাণ, বাইবেল, জিন্দাবেস্তা, ত্রিপিটক নিজে পড়েনি। আমাদের মতই কারো মুখে শুনে যতটুকু জানা তার বাইরে যে কিছু থাকতে পারে তাই জানা হয় নি কোনদিন। তারাও নিজেদের ক্ষুদ্র ঘরের ক্ষুদ্র পরিসরে নানান ভাগে ভাগ হয়ে থাকতে ভালোবাসে। হীনযান – মহাযান, ক্যাথলিক – প্রোটেস্ট্যান্ট, শিয়া – সুন্নি – সুফি – মোহাজির টুকরো টুকরো অংশ এ ওকে সহ্য করতে পারে না, সে তাকে।

রাজনৈতিক ক্ষমতার লোভে রাজারা লড়াই করেছে। আমরা তাদের সৈন্য হয়ে ক্রুসেড লড়েছি, ধর্মযুদ্ধের নামে অন্যের ঘর দখলের চেষ্টা করেছি, জিহাদী হয়ে কাফেরের মাথা কেটেছি এটা জেনে যে একটা শত্রুর মাথা কেটে ফেলতে পারলেই স্বর্গে বা হেভেনে বা বেহেস্তে সুন্দরী হুরিদের বিছানায় পাব, ভালো ভালো খাবার পাব। আমরা একদিন যারা শুধুমাত্র মানুষ ছিলাম আজ মুখে হিংস্র রক্ত মেখে হিন্দুরাজ বানাতে চাই, ইসলামরাজ বানাতে চাই, খ্রীষ্টানরাজ বানাতে চাই। আমরা ভাবি আমাদের রাজ প্রতিষ্ঠা হয়ে গেলেই আর কোনো অভাব থাকবে না আমাদের।

আমরা পড়ি না। পড়ে সময় নষ্ট করি না। নিজের ধর্মের বই পড়ি না। অন্যের ধর্মের বইও পড়ি না। অন্যের ধর্মের কথা কানে এলে দু হাত কানের ওপরে চেপে ধরি, যাতে অন্যের ধর্মের কোনো ভালো শব্দ আমাদের কানে ঢুকে আমাদের বিধর্মী না করে দিতে পারে। যে বদ্ধ পাঁকে আমাদের জন্ম আমরা সেখানেই ক্রমাগত আরও দুর্গন্ধ হতে থাকা পাঁকের ভিতরে চোখ – কান বন্ধ করে জীবন কাটিয়ে দিই। সেই আমাদের পছন্দের নরক, সেই আমাদের প্রিয় দোজখ। আসলে আমরা জানি না যেখানে জ্ঞান থাকে সেটাই স্বর্গ, সেটাই হেভেন, সেটাই বেহেস্ত। আর নরক বা দোজখ জ্ঞানহীন কালো অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নয়।

আসলে আস্তে আস্তে চোরাবালির ভিতরে ডুবতে ডুবতে, ডুবছি সেটা না বুঝেই আমরা ধর্ম না জেনেও ধর্মরাজ হতে চাই।

.
(লেখা ©Soumitra Chakraborty, ছবি কৃতিত্ব এই দুঃসময়েও যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন সত্যিকারের মানুষ আছেন তাঁদের মধ্যে দুজন Intekhab Alam এবং নিধি কামদারের সৌজন্যে প্রাপ্ত।)

দীর্ঘ পথ … একটি ব্যর্থতার কবিতা

image_2

মানুষ আপনাকে
আপনার পাশে দীর্ঘ পথ চলতে প্রতিশ্রুতি দেবে
দরজার প্রথম পদক্ষেপ থেকে
অজস্র মানুষের ভিড় ঠেলে,
স্বতঃসিদ্ধ নির্জনতা পেরিয়ে অদৃষ্টের গন্তব্য পর্যন্ত।

কেউ কথা রাখে আবার কেউ রাখে না
আপনি কি পেয়েছেন
আপনি কি পাননি তা আপনার হৃদয় জানে।

মানুষ তার এক জীবনে ভেতরের কষ্ট
পরিচিত মানুষের ভিড় ঠেলে
গোপন করতে পারলেও একদিন জনসম্মুখে আসবে
আপনার প্রতি কেউ সহানুভূতি দেখাবে
আপনার প্রতি কেউ ভালবাসার হাত বাড়িয়ে দেবে
আসলে তারাই প্রকৃত মানুষ
যারা কথা রেখেছে কথা রাখে কথা রাখবে।

তারা যদি কথা রাখতো তাহলে
তাদের জীবনী অন্য ভাবে লেখা হতো
আজ হয়তো বিদ্রোহ হতো না
হৃদয়ের ভেতরে কান্নার আওয়াজ শুনতে পেতনা
তাইতো কারও স্মৃতি লেখা হয়
কষ্টের দাবানলে জ্বলতে জ্বলতে
কারও জীবন পেয়ে হয়তো ঘরেই কেটে যায়।

দয়া মায়া স্নেহ ভালবাসার বিপরীতে
কারও জীবন হয়তো এভাবেই কেটে যায়
কারও জীবন হয়তো প্রকাশ হয়
প্রকাশিত সেই জীবনের গল্প মানুষের সামনে আসে
হয়তো তখনই কেবল জানা যায়
সেই জীবনের গল্প।

কেউ একজন
জীবনের দীর্ঘ পথে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো
বলেছিলো আমাদের শরীর ফুটে বেরিয়ে আসবে অন্য শরীর।

প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ক্ষণস্থায়ী এই জীবনে
হাতে হাত ধরে পৃথিবীর শেষ গন্তব্যে পৌছাবো
এই ঘর থেকে এ রাস্তা থেকে
মাতৃভূমির এক পথ থেকে আরেক পথে
মানুষের জনসমাগম থেকে নির্জনতা পর্যন্ত।

বিশ্বাস তো করতেই হয়
কথা দিয়েছিলাম তার সময়ের সঙ্গী হবো
অসময়ের সঙ্গী হব জীবন থেকে পর জীবনের সঙ্গী হব।

এই সংক্ষিপ্ত জীবন আজ বড্ড একা
এই একাকী জীবন নিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর শেষ উপত্যকায়।

এই দীর্ঘ পথের পরে
জীবনের কোন বিশ্রাম ছিল না
পায়ের নরম কোমল পৃষ্ঠদেশ ফোস্কা পড়েছে
কিন্তু অন্তহীন পথ একাই চলেছি
কিন্তু গন্তব্য জানা নেই।

হুম, হয়তো ঈশ্বরকে দেখিনি
শুনেছি ঈশ্বর মানুষের হৃদয়ে বাস করে
মন্দিরে মসজিদে ঘোরাঘুরি করে
কিন্তু যে মানুষ ভালোবাসায় বিশ্বাসী
তার হৃদয়ে বাস করে কি?
আমার কাছে ঈশ্বর নামের অস্তিত্ব যেভাবে
এখন ধোকা বলে মনে হয়

পথ চলা পায়ের মতোই হৃদয়টা পাথর হয়েছে
চোখ হয়েছে ঝাপসা, ক্ষুধা দারিদ্রতা
এসব আমার কাছে উপভোগের ব্যাপার নয়
অনুন্নত পৃথিবীর দেশে দেশে মানুষ মরতো না অন্নহীন।

যদি প্রশ্নই করতে হয় প্রকৃতিকে কর
মিথ ঈশ্বরকে নয়
যদি প্রশ্ন করি শয়তান যখন শয়তান হয়নি
তবে তাকে কোন শয়তান প্ররোচনা দিয়েছিল?

জানি সময় ঈশ্বর সম্পর্কে ধারণা রাখেনা
আর সময় ঈশ্বর সম্পর্কে
দীর্ঘ পথ দীর্ঘ জীবন আর সংক্ষিপ্ত সময়
আমাদের ভেতরের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি
ঈশ্বরের অস্তিত্ব না হলেও বাস্তবতায়
সেই প্রিয় মানুষটিকে যতই ভুলে যেতে চেয়েছি
ততই ভালোবেসে ফেলেছি;

ঈশ্বর চাইলে সেই জায়গাটা দখল করতে পারত
সেই অভাবটা পূরণ করতে পারত
তার কারিশ্মাটিক ক্ষমতা বলে
ঈশ্বর হয়তো জানান দিতে পারতো
হে আমার বান্দা আমি আছি এমনটা কিছুই হয়নি সেখানেও ঈশ্বর ব্যর্থ

নাকি ঈশ্বর এসব কোন কিছুই চান না?
নাকি ঈশ্বর সৃষ্টির পরে সবকিছু ত্যাগ করেছেন?
কি প্রয়োজন ছিল এই পৃথিবীতে আসার?
কি প্রয়োজন ছিল এত কষ্ট
এত দুঃখ এত জ্বালা এত যন্ত্রণা সহ্য করার?

প্রকৃতি যদি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়
তাহলে আমি বলব ঈশ্বর নয়
প্রকৃতি আমাকে নিয়ন্ত্রণ করছে
এই মহাবিশ্ব প্রকৃতির অবয়ব
প্রকৃতি এই মহাবিশ্বের আশ্রয়দাতা
এখানে যা কিছুই ঘটে তাতে কারো হাত নেই।

চলছি একা
পৃথিবীর এই পথে পথে
দীর্ঘ পথ
অনন্ত পথ
এক আলোকবর্ষ থেকে অন্য আলোকবর্ষের অভিমুখে
এক গন্তব্য থেকে অন্য গন্তব্যের অভিমুখে
এক জীবন থেকে অন্য জীবনের পথে।

দীর্ঘদিন
দীর্ঘ সময়
আর দীর্ঘ ক্লান্তি শেষে
হয়তো এভাবেই হারিয়ে যাব
পৃথিবী স্মরণ রাখবে অন্য নামে অন্যভাবে।

বলতে পারো
এই মানুষটা এতটা ভালো না যে
খারাপ থাকলেও বলবে ভালো আছি
প্রকৃতি মানুষকে ভালো রাখতে জানে
কিন্তু মানুষ মানুষকে তার ভালো থাকার জায়গাগুলোকে নষ্ট করে দেয়

দীর্ঘ পথ
দীর্ঘ সময়
আর দীর্ঘ জীবন জুড়ে আমি সেই
আমি হয়তো সেই প্রিয় মানুষের দ্বারা নষ্টের শিকার।

তুমি কি কেবলই ছবি?

3021

এ লেখাটা আমার পছন্দের লেখার একটা। যে রাস্তাটার কাহিনী নিয়ে লেখা তা এখন ফুলে ফেপে একাকার হয়ে গেছে…

চাইলে এই একটা ছবি নিয়েই লেখা যাবে বিশাল ক্যানভাসের গল্প। অনেকে বলবেন রাজনীতির গল্প, কারণ রাজনীতি বাদে আমি অন্যকিছু লিখতে জানি না। আপনারা সঠিক হলেও ক্ষতি নেই। অন্যের কাছে যা রাজনীতি আমার কাছে তা জীবন। আমি যা লিখি তা আমার জন্যে জীবনের গল্প।

চোখে পরার মত এমন কিছু নেই ছবিটায়। শূন্য একটা রাস্তা। উঁচু-নিচু ও আঁকাবাঁকা হয়ে চলে গেছে দুরে বহুদূরে। মনে হবে আকাশের সাথে মিশে গেছে দিগন্ত রেখায়। শখের ছবি নয় এটা, অফিসের প্রয়োজনে তোলা। আমার গল্প ছবিকে ঘিরে কি হচ্ছে বা কি হতে যাচ্ছে তা নয়, বরং এ রাস্তায় কি হচ্ছে না তা নিয়ে এ লেখা।

ছ’মাস আগের কথা। অফিসের কাজে প্রথম যেতে হয় রাস্তাটায়। রাস্তা বলতে খোলা মাঠ ধরে বয়ে যাওয়া সূক্ষ্ম একটা রেখা। বলা হল দুমাসের ভেতর ফুটে উঠবে এর আসল চেহারা।

টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানির প্রতিনিধি হিসাবে আমার কাজ হবে এলাকায় ল্যান্ডফোন ও দ্রুতগতির ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক ডিজাইন করা। একটু অবাকই হয়েছিলাম খোলা মাঠের জন্যে হাইস্পিড ইন্টারনেটের কথা ভেবে। দুই মিলিয়ন ডলারের প্রকল্প। বাংলা টাকায় প্রায় ১৪ কোটি টাকা। টেন্ডার যেদিন চূড়ান্ত হয় অফিসের কোথাও কোন উত্তেজনা চোখে পড়ল না। প্রবেশ মুখে তরুণ, উদীয়মান ও উঠতি ব্যবসায়ীদের কাউকে জটলা করতে দেখা যায়নি। এ কাজে ৫০ বছরে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন গে-হার্ড ইনক্‌ নামের কোম্পানি কাজ পাওয়ায় অস্ত্র হাতে কেউ ঝাঁপিয়ে পড়েনি তাদের উপর।

রিও রাঞ্চো শহরের মেয়র টমাস সুইসট্যাক, অঙ্গরাজ্যের নব নির্বাচিত সিনেটর টম উডাল অথবা বিদায়ী গভর্নর বিল রিচার্ডসনকে ফোন করতে হয়নি নিজ ক্যাম্পের কাউকে কাজ দেয়ার সুপারিশ নিয়ে। টেন্ডারের একটা অংশ লোকাল প্রতিনিধি মারফত প্রেসিডেন্ট ওবামার অফিস হয়ে তার ১৫ বছরের মেয়ে মালিয়ার পকেটে যাবে এমনটাও কাউকে বিবেচনা করতে হয়নি। টেন্ডার হেটে গেছে টেন্ডারের পথে। ও পথে ওঁত পেতে থাকেনি ডেমোক্র্যাট অথবা রিপাবলিকান দলীয় হায়েনা।

রাস্তাটার কোন নাম ছিলনা। আর থাকলেও আমার মত সাধারণ প্রকৌশলীর তা জানার কথা নয়। কাগজপত্র ঘাটতে গিয়ে জানা গেল নাম হবে 19th Street। এর সামনে পেছনে ১৮তম ও ২০তম রাস্তা। নামকরণ নিয়ে অঙ্গরাজ্যের ডেমোক্রেট আর রিপাবলিকান নেতাদের মারামারি করতে হয়েছে এমন সাক্ষী কেউ দেবেনা। নাম হেটে গেছে নামের পথে।

ও পথে গভর্নর রিচার্ডসনকে দেখা যায়নি নিজের মা-বাবার কবর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। রাস্তার নাম নিয়ে যেমন কেউ মাথা ঘামায়নি তেমনি রাস্তা যেদিন খুলে দেয়া হবে রাজধানী সান্তা ফে হতে কারও আসার দরকার হবেনা। মোড়ে মোড়ে তোরণ নির্মাণের প্রয়োজন দেখা দেবেনা। ১৯তম রাস্তায় নামবে না মিডিয়ার ঢল। রাস্তা হেটে যাবে রাস্তার পথে, কারণ এটাই জনপ্রতিনিধিদের কাজ। আপনি বলবেন এ তো আমেরিকা, পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী দেশ, এ দেশে এমনটা হওয়াই তো স্বাভাবিক।

আপনি সঠিক হলেও আমার আপত্তি নেই। ঘুম ভেঙ্গে আয়নায় তাকালে যার মুখ দেখি সে একজন মানুষ। দুহাত, দুপা, দুকান আর দুচোখ ওয়ালা স্বাভাবিক মানুষ যার সাথে সামান্যতম পার্থক্য নেই রিও রাঞ্চো শহরের সাধারণ মানুষের।

অর্ধ শতাব্দী আগে যে আমেরিকায় সাদাদের বাসে কালোদের চড়ার সুযোগ ছিলনা সে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এখন কালো। চাইলে সবই সম্ভব, তবে তার জন্যে চাই মনের দরিদ্রতা হতে বেরিয়ে আসা। সন্দেহ নেই নিকট ভবিষ্যতে বদলে যাবে ১৯তম রাস্তার চেহারা। যে রাস্তার শুরুটা ছিল শূন্য হতে তাকে ঘিরে গড়ে উঠবে বিশাল এক জনপদ। মানুষ ও প্রকৃতির মাঝে নিবিড় সম্পর্কের যে চিরন্তন ধারা তার প্রায় দোর গোঁড়ায় পৌঁছে যাবে এলাকার জীবন। এ সব নিয়ে কেউ কথা বলবে না, উচ্চবাচ্য করবে না, ক্রেডিট নেবে না রাস্তার জন্ম নিয়ে।

১৯তম রাস্তা হতে হাজার হাজার মাইল দুরে পৃথিবীর অন্য কোথাও হয়ত তৈরি হবে আরও একটা রাস্তা। এ রাস্তার টেন্ডার লাভে দু’একটা জীবন ঝরে গেলেও কেউ অবাক হবেনা, ফেলবে না দু-ফোঁটা চোখের পানি। টেন্ডার কমিশনের জন্যে হা হয়ে থাকবে ক্ষমতার শীর্ষে বসে থাকা রাজনীতিবিদদের সন্তান, হা হুতাশ করবে বিরোধী দলের সন্তান। রাস্তার নাম নিয়ে হয়ত হাঙ্গামা হবে, উত্তাল হবে মিডিয়া। মিছিল আর ভাংচুর হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

শেষ পর্যন্ত আসবে উদ্বোধনের দিন। ব্যানার আর তোরণে ঢেকে যাবে উপরের আকাশ।

ভাষণ হবে, মানুষের পদভারে সয়লাব হবে এলাকা। কবর হতে মৃত বাবা অথবা স্বামীকে উঠিয়েও অনেকে বিক্রি করবে ভিন্ন মেরুর ১৯তম রাস্তায়। সময়ের প্রবাহে একই রাস্তা হারিয়ে ফেলবে তার চেহারা, পদে পদে তৈরি হবে মৃত্যু খাদ। আবারও টেন্ডার হবে। তবে এ যাত্রায় নতুন নয়, পুরানো ১৯তম রাস্তার জন্যে। এ ফাকে ঘুরে যাবে শতাব্দি…

কর্ম … সহায়ক … ভাগ্য

ভাগ্য পরিশ্রমীদের পরিবর্তন করে। ভাগ্য, ভাগ্যের উপর বিশ্বাসী মানুষদের স্বপ্নের মধ্যে বিভোর রাখতে পছন্দ করে। আপনার জীবনে কিছু সুযোগ সব সময় আসবে সেই সুযোগটা আসা মানে এই নয় যে আপনার ভাগ্য সহায় থাকবে আপনি পরিশ্রম করেছেন এই পরিশ্রমের মূল্যই ভাগ্য;

ভাগ্য সে সেজন্য এসেছে এবং তা আপনার জন্য সম্ভবপর হয়েছে। ভাগ্যের সম্ভবপর ব্যাপারগুলো পরিশ্রমের উপর নির্ভর করে, পরিশ্রমে যদি আপনি সফলতা পান তবেই আপনার ভাগ্য সহায় হয়।

(ভাগ্য কোন পড়ে পাওয়া ধন নয়) এটি বাঙালির প্রাচীন প্রবাদ আর ভাগ্য কোন চমৎকারই বিষয় নিয়ে আসে না যেকোনো পরিবর্তন অপরিবর্তিত নয় আপনার জীবনে পরিবর্তন তখনই আপনার সঙ্গ দিবে যতক্ষণ আপনি তাকে আপনার সঙ্গ থেকে বিমুখ করবেন না।

মনে রাখবেন আপনার জীবনে যা আসে তা আপনার পরিবর্তনের ফসল যা চলে যায় তা আপনার অসামঞ্জস্য কর্মের সাথে অসংগতিপূর্ণ।