বিভাগের আর্কাইভঃ ইতিহাস-ঐতিহ্য

কামরূপ কামাখ্যা কি সত্যি যাদুর দেশ?

আমাদের দেশে ওঝা, বৈদ্য কবিরাজ, ফকির, সাধু, সন্যাসীর অভাব নেই। গ্রামে, গঞ্জে, হাটে বাজারে, শহরে, বন্দরের আনাচে-কানাচে, রাস্তাঘাটে, ফুটপাতে সবখানেই এসব ওঝা, বৈদ্য আর ফকির সাধুদের আনাগোনা চোখে পড়ে। তাঁরা সবসময়ই কামরূপ কামাখ্যার দোহাই দিয়ে তাবিজ কবচ মানুষের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ইচ্ছেমত টাকাপয়সা ছিনিয়ে নিচ্ছে। তাঁদের মুখে কামরূপ কামাখ্যার কথা শুনে মানুষ একরকম অন্ধকারে থেকে যাচ্ছে। এশিয়া মহাদেশের মধ্যে যতগুলো দেশ আছে, এসব দেশের বেশিরভাগ মানুষই একরকম অন্ধবিশ্বাসী হয়ে বিভিন্ন ওঝা, বৈদ্য, ফকির, মাস্তান, সাধু, সন্যাসীদের শরণাপন্ন হয়ে থাকে। এই অন্ধবিশ্বাসী মনোভব ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, মিয়ানমার, বাংলাদেশ হলো অন্যতম।

এসব দেশের মানুষের মনে যেমন আছে বিশ্বাস, তার চেয়ে বেশি আছে অবিশ্বাস। নিজের ঘরের মানুষটাকে বিশ্বাস করতে চায় না, অথচ একজন ভণ্ড সাধু, ওঝা, ফকির, মাস্তানের কথা বিশ্বাস করে থাকে। আবার যেমন দয়ালু, তার চেয়ে বেশি কৃপণ। আপন মায়ের গর্ভজাত ভাই না খেয়ে থাকলেও, তাকে কিছুই দিবে না। অথচ একজন ভণ্ড ফকিরের কথা বিশ্বাস করে তাকে হাজার হাজার টাকা দান দক্ষিণা দিয়ে দেয়। এই হলো আমাদের অন্ধবিশ্বাসের কিছু নিয়মনীতি।

আমাদের দেশের মানুষ অনেকেই জানে না যে কামরূপ কামাখ্যা আসলে কী! কামরূপ কী? কামাখ্যা কী? জানে না কামরূপ কামাখ্যা কোথায় এবং কোন স্থানে। কামরূপ কামাখ্যার তথ্যবিধান না জানার কারণে, ওঝা, বৈদ্য, ফকির, সাধুদের মুখে কামরূপ কামাখ্যার কথা শুনেই কিছু অন্ধবিশ্বাসী মানুষ ভয়ে থরথর করে কাঁপতে শুরু করে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কথিত ফকির সাধুগণ ঘোড়ার লোম, বাঘের ছাল, মহিষের শিং, আগাছা, পরগাছা, বালু, মাটি খাওয়াইয়া আর তাবিজের ভেতরে ঢুকাইয়া হাতিয়ে নিচ্ছে সহজসরল মানুষের কষ্টার্জিত টাকাপয়সা। ওইসব ওঝা বৈদ্যদের মুখে শুধু কামরূপ কামাখ্যার দোহাই বেশি থাকে।

এদেশের কিছু ভণ্ড ওঝা ফকিররা বলে, “কামরূপ কামাখ্যা হলো যাদুর দেশে! সেখানে মানুষ যেতে পারে না। যদি কেউ প্রাণপণ চেষ্টা করে একবার কামরূপ কামাখ্যা পৌঁছতে পারে, তাহলে সে আর ফিরে আসতে পারে না। যদিও আসে তো অনেক সাধনার বলে।”

অনেক ওঝা ফকির বলে, “আমি আসেছি প্রায় দুই যুগ পরে। অনেক তন্ত্রমন্ত্র শিখে আসেছি। আমি ইচ্ছে করলে এখন যা খুশি তা-ই করতে পারি, দেখাতেও পারি। কিন্তু না, তা আমি করবো না। আমি মানুষের উপকার করার জন্য খুব কষ্ট করে কামরূপ কামাখ্যা থেকে আপনাদের মাঝে ফিরে আসেছি।”

আবার অনেক সাধু সন্যাসী বলে, “কামরূপ কামাখ্যায় পুরুষ মানুষ বাঁচে না। সেখানে পুরুষ মানুষের খুবই অভাব! সেখানে প্রতিবছর বিশেষ একটি সময়ে সিংহে ডাক দেয়। সিংহের ডাক পুরুষের কানে গেলে সেই পুরুষের পুরুষলিঙ্গ পড়ে যায়। তার মানে হলো, ঐ পুরুষের আর পুরুষত্ব থাকে না। সেই পুরুষ হিজড়ায় রূপান্তরিত হয়ে যায়।”

আবার অনেক ওঝা কবিরাজ বলে, “যখন সিংহে ডাক দেওয়ার সময় হয়, তখন সেখানকার নারীরা পুরুষের পুরুষত্ব আর পুরুষলিঙ্গ টিকিয়ে রাখার জন্য যারযার পুরুষকে মাটির গর্তের ভেতরে রেখে উপরে ঢাকঢোল বাজাতে থাকে। যাতে সিংহের ডাকের শব্দ পুরুষের কানে না যায়।”

আবার অনেক ফকির বলে, “কামরূপ কামাখ্যা যাবার পথে একটা নদী আছে। নদীর এপারে মানুষের ঘনবসতি থাকলেও, ওপাড়ে শুধু নারী। নদীর ওপাড়ে হলো কামরূপ কামাখ্যা রাজ্য। নদীর এপার ওপাড় বনজঙ্গল আর নানান জাতের বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য। যিনি কামরূপ কামাখ্যা যেতে ইচ্ছুক, তিনি নদীর পাড়ে গিয়ে নদীর জল স্পর্শ করার সাথে সাথে ওপাড় থেকে একটা মাঝিবিহীন ডিঙি নৌকা তাঁর সামনে চলে আসবে। ডিঙি নৌকায় ওঠার সাথে সাথে নৌকা এপার থেকে ওপাড়ের উদ্দেশে রওনা হতে থাকবে। নৌকা নদীর ওপাড় ভিড়তেই তাঁর সামনে হাজির হয়ে যাবে কয়েকশ কামাখ্যা নারী। তখন আগত পুরুষমানুষটিকে নিয়ে শুরু হবে টানাটানি। কেউ বলবে, আমার ঘরে যাবে। কেউ বলবে আমার ঘরে থাকবে। এভাবে চলবে বাকবিতণ্ডা। অবশেষের কামরূপ কামাখ্যার বুড়ো সরদারনী এসে কয়েকজন নারীর মাঝে পুরুষমানুষটিকে ভাগ করে দিবে। শর্ত থাকবে, এঁদের মাঝে ৭ দিন, আর ওদের মাঝে ৭ দিন। এভাবে চলতে থাকবে পুরুষমানুষটির জীবন। অনেক নারীদের সাথে মেলামেশার কারণে কিছুদিন যেতে না যেতেই পুরুষমানুষটির শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। এরপর পুরুষমানুষটি নানানরকম অজুহাত দেখিয়ে নিজ দেশে ফিরে আসতে চাইবে।

“তখন কামরূপ কামাখ্যার নারীরা বলে, “তোমাকে তো আমরা বেধে রাখিনি? তুমি মুক্ত অবস্থাতেই আছো! তুমি ইচ্ছে করলেই তোমার দেশে চলে যেতে পার!” নারীদের মুখে এসব কথা শুনে পুরুষমানুষটি রাতের আঁধারে পালিয়ে আসার প্রস্তুতি নিয়ে হাঁটতে থাকে। সারারাত হাঁটতে হাঁটতে শরীর প্রায় অবসন্ন হয়ে পড়ে। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে দেখে যেখান থেকে হাঁটা শুরু করেছে, ঠিক সেখানেই রয়ে গেছে। এভাবে অনেকদিন চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে অনেকেই আর ফিরে আসতে পারে না। অবশেষে সেখানেই থেকে যায়। কেউ যদি আসতে পারে, তো অনেক তপস্যার বিনিময়ে আসতে হয়।”

কামরূপ কামাখ্যা থেকে নিজ দেশে ফিরে এসেই শুরু করে দেয় তেলেসমাতি ফৌকরালী চিকিৎসা। আর সহজসরল কিছু মানুষও মনের বিশ্বাসে রোগমুক্তির আশায় ওইসব কামরূপ কামাখ্যাবেশী ফকির, সাধু, ভণ্ড ওঝাদের শরণাপন্ন হতে থাকে।

আবার অনেক বুড়ো-বুড়ির মুখে শোনা যায়, “কামরূপ হলো পুরুষ, আর কামাখ্যা হলো নারী। কামরূপ রাজা ছিলেন, একজন বিখ্যাত যাদুকর। জাদুমন্ত্রই ছিল তাঁর একমাত্র শক্তি। কামাখ্যা দেবীর ছিলেন খুবই সুন্দরি রূপবতী। কামরূপ রাজা কামাখ্যা দেবীর রূপ দেখে একসময় কামাখ্যা দেবীকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু কামরূপ রাজার এমন প্রস্তাবকে কামাখ্যা দেবী প্রত্যাখ্যান করে। তারপরও কামরূপ রাজা তাঁর উজির নাজির আর সৈন্যসামন্ত দিয়ে বারবার কামাখ্যা দেবীর কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতেই থাকে। কামাখ্যা দেবী বিরক্ত হয়ে একসময় রাজি হয়ে যায়, শর্ত দিয়ে। শর্ত হলো, নদীর এপার হলো কামাখ্যা দেবীর রাজ্য, আর ওপাড় হলো, কামরূপ রাজার রাজ্য। নদীর এপারও পাহাড়, ওপাড়ও পাহাড়। কামাখ্যা দেবীকে বিয়ে করতে হলে নদীর ওপাড়ে থাকা পাহাড় একরাতে মধ্যে এপারের পাহাড়ের সাথে একত্রিত করে দিতে হবে। তা হতে হবে সন্ধ্যা শুরু থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত সময়ে। কামাখ্যা দেবীর শর্ত কামরূপ রাজা হাসিমুখে মেনে নেয়।

“একসময় দিনক্ষণ নির্ধারণ করা হলো। সন্ধ্যালগ্ন শুরু থেকে কামরূপ রাজা তাঁর তন্ত্রমন্ত্র দিয়ে এপারের পাহাড় ওপাড়ে চালান করতে লাগলো। রাতদুপুরে কামাখ্যা দেবী ধ্যানে বসে দেখতে পায়, কামরূপ রাজার পাহাড় কামাখ্যা দেবীর রাজ্যের পাহাড়ের সাথে একত্রিত হতে সামান্য বাকি। কিছুক্ষণের মধ্যের কামরূপ রাজার রাজ্যের পাহাড় কামাখ্যা দেবীর রাজ্যের পাহাড়ের সাথে একত্রিত হয়ে যাবে। দুই রাজ্যের দুই পাহাড় একত্রিত হয়ে গেলেই, যাদুকর কামরূপ রাজাকে তাঁর বিবাহ করতেই হবে। তাহলে তো কামাখ্যা দেবী কামরূপ রাজার কাছে হেরেই গেল। এই হার কিছুতেই কামাখ্যা দেবী মেনে নিতে পারবে না। তাই কামাখ্যা দেবী তাঁর আধ্যাত্মিক তন্ত্রমন্ত্র শুরু করে দেয়। একপর্যায়ে কামাখ্যা দেবী একটি মোরগের রূপধারণ করে এবং কামরূপ রাজার কানের সামনে কুক্কুরু কু আওয়াজ করে। কামরূপ রাজা মোরগের ডাক শুনে ভাবলো যে, হয়ত সূর্যোদয় হতে শুরু করেছে। তাই তাঁর তন্ত্রমন্ত্র থামিয়ে দেয়। এর ফলে কামরূপ রাজার তন্ত্রমন্ত্র দ্বারা চালান করা পাহাড় কামাখ্যা দেবীর পাহাড়ের সাথে মিশতে পারলো না। কামরূপ রাজা কামাখ্যা দেবীকেও আর বিয়ে করতে পারলো না।” এরকম আরও অনেক রূপকথার কাহিনী লোকমুখে এখনো প্রচলিত আছে।

আসলে ঘটনাটা কী? সত্যি কি কামরূপ কামাখ্যা যাদুটোনার দেশ? নাকি সবই ভুয়া? মনে হয় সবই ভুয়া! কেননা, বিশ্ববিখ্যাত ভিডিও শেয়ারিং সাইট ইউটিউবে যখন কামরূপ কামাখ্যা মন্দিরের ভিডিওগুলো দেখি, তখন মনে হয় না যে, কামরূপ কামাখ্যা সত্যিকারের যাদুটোনার দেশ। এসব ভণ্ড ওঝা, ফকির, সাধুদের বানানো কথা মাত্র। সত্যিকারার্থে কামরূপ হলো একটা, আর কামাখ্যা হলো হিন্দু শাস্ত্রের পবিত্র শক্তিপীঠের এক পীঠ। যার নাম কামাখ্যা শক্তিপীঠ বা কামাখ্যা মন্দির।

youtube.com/watch?v=eJNUXVMq3VY

তাহলে জেনে নিতে পারি কামরূপ কী আর কামাখ্যা-ই-বা কী? কামরূপ কামাখ্যার ব্যাখ্যা দিতে হলে, আগে হিন্দু শাস্ত্রে বর্ণিত ৫১ শক্তিপীঠ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে হয়।

শক্তিপীঠ হলো, হিন্দুধর্মের পবিত্রতম তীর্থস্থানগুলোর অন্যতম। লোকবিশ্বাস অনুসারে, শক্তিপীঠ নামাঙ্কিত তীর্থগুলিতে দক্ষ রাজার কন্যা দেবী দাক্ষায়ণী সতী
দেহের নানান অঙ্গ ও দেহে থাকা স্বর্ণালঙ্কার ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, নেপাল, পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে রক্ষিত আছে। শাস্ত্রমতে ৫১টি শক্তিপীঠের কথা বলা হয়ে থাকলেও, শাস্ত্রভেদে শক্তিপীঠের সংখ্যা ও অবস্থান নিয়ে মতভেদও আছে। তবে এই ৫১টি পবিত্র শক্তিপীঠ মন্দির এবং স্থান ইতিহাসের পাতায় সুলিখিতভাবে বর্ণিত রয়েছে। তাহলে শক্তিপীঠ কী এবং কীভাবে?

সনাতন ধর্মের শাস্ত্র ঘেঁটে আর বিভিন্ন অনলাইনভিত্তিক তথ্যানুসন্ধানে জানা যায় সত্যযুগের এক ঘটনার ইতিহাস। সত্য যুগের কোনও এক সময়ে মহাদেবের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দক্ষ রাজা বৃহস্পতি নামে এক যজ্ঞের আয়োজন করেন। দক্ষ রাজার কন্যা ছিলেন, দাক্ষায়ণী সতী দেবী। কন্যা সতী দেবী দক্ষ রাজার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যোগী মহাদেবকে বিবাহ করায়, দক্ষ রাজা মেয়ে এবং মহাদেবের উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাই দক্ষ রাজা তাঁর যজ্ঞানুষ্ঠানে মহাদেব ও সতী দেবী ছাড়া প্রায় সকল দেব-দেবীকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। পিত্রালয়ে পিতার আয়োজন করা যজ্ঞানুষ্ঠান হচ্ছে জানতে পেরে সতী দেবী মহা খুশি। কন্যা খুশি পিত্রালয়ের জাঁকজমক আয়োজনে। কিন্তু নিমন্ত্রণ পাননি! তাতেও সতী দেবী দুঃখিত নয়, বরং খুশি! কারণ, দক্ষ রাজা সতী দেবীর জন্মদাতা তাই। যজ্ঞানুষ্ঠানের দিন যথাসময়ে মহাদেবের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সতী দেবী তাঁর অনুসারীদের সাথে নিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন। কিন্তু সতী দেবী আমন্ত্রিত অতিথি না হওয়ায়, তাঁকে যথাযোগ্য সম্মান দেওয়া হয়নি। সত্যিকারার্থে দক্ষ রাজা মহাদেবকেই অপমান করেন। সতী দেবী তাঁর স্বামীর প্রতি পিতার এ অপমান সহ্য করতে না পেরে যোগবলে আত্মাহুতি দেন।

সতী দেবীর শোকে শোকাহত মহাদেব রাগান্বিত হয়ে দক্ষ রাজার যজ্ঞ ভণ্ডুল করেন এবং সতী দেবীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রলয় নৃত্য শুরু করে দেন। মহাদেবের এমন প্রলয় নৃত্যে পৃথিবী কাঁপতে শুরু করে। তখন অন্যান্য দেবতা মহাদেবকে তাঁর প্রলয় নৃত্য থামাতে অনুরোধ করেন। সকল দেবতাদের অনুরোধে অবশেষে যোগী মহাদেব তাঁর প্রলয় নৃত্য থামিয়ে একরকম শান্ত হন। এরপর বিষ্ণুদেব তাঁর সুদর্শন চক্র দ্বারা সতী দেবীর মৃতদেহ ছেদন করেন। এতে সতী দেবীর মৃতদেহে থাকা স্বর্ণালঙ্কার সহ ৫১ খণ্ড হয়ে যায়। এই ৫১টি দেহখণ্ডসমূহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পড়ে এবং পবিত্র শক্তিপীঠস্থান হিসেবে পরিচিতি পায়। যেমন– একস্থানে পড়েছে, হাত, একস্থানে, পায়ের আঙুল, একস্থানে পায়ের নূপুর। এভাবে ৫১টি খণ্ড ৫১ স্থানে পতিত হয়ে মন্দির স্থাপন হয়ে যায়।

এসব পবিত্র শক্তিপীঠগুলো আদিকাল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের নানা স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। শক্তিপীঠ মন্দিরগুলোর মধ্যে নেপালে রয়েছে ২টি, ভারত-নেপাল সীমান্তে ১টি, শ্রীলংকায় ১টি, পাকিস্তানে ২টি সহ বাংলাশেও পবিত্র শক্তিপীঠ রয়েছে মোট ৬টি।

বাংলাদেশে যেসব স্থানে পবিত্র শক্তিপীঠ মন্দির রয়েছে, সেসব শক্তিপীঠ মন্দিরগুলো হলো–
১। ভবানী মহাপীঠ, চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়ার চন্দ্রনাথ মন্দির। এখানে সতী দেবীর ডান হাত পতিত হয়েছিল।
২। জয়ন্তী মহাপীঠ, বাউরভাগ, কানাইঘাট, সিলেট। এখানে সতী দেবীর বাম জঙ্ঘা পতিত হয়েছিল।
৩। গ্রীনা মহাপীঠ, জৈনপুর, গোটাটিকর, দক্ষিণ সুরমা, সিলেট। এখানে সতী দেবীর গলা পতিত হয়েছিল।
৪। অপর্ণা মহাপীঠ, ভবানীপুর, করতোয়া নদীর তীরে, শেরপুর। এখানে সতী দেবীর পায়ে থাকা নূপুর পতিত হয়েছিল।
৫। যশোরেশ্বরী মহাপীঠ, ঈশ্বরীপুর, শ্যামনগর, সাতক্ষীরা। এখানে সতী দেবীর হাতের তালু ও পায়ের পাতা পতিত হয়েছিল।
৬। সুগন্ধা মহাপীঠ, শিকারপুর, গৌরনদী, সন্ধ্যা নদীর তীরে, বরিশাল। এখানে সতী দেবীর নাসিকা পতিত হয়েছিল।

বাদবাকি ৩৯টি শক্তিপীঠই রয়েছে ভারতে। তারমধ্যে কলকাতার কালীঘাটে পতিত হয়েছিল, সতী দেবীর মুখ খণ্ড ও আসাম রাজ্যের কামরূপ জেলার নীলাচল পাহাড়ের পাদদেশে কামাখ্যায় পতিত হয়েছিল সতী দেবীর যোনি খণ্ড। যোনি দিয়েই ফকির, সাধু, রাজা, বাদশাহ, পুরুষ আর মহাপুরুষ এই সুন্দর পৃথিবীতে আগমন। তাই সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দুরা আসামের কামরূপ জেলার কামাখ্যা মহাশক্তিপীঠ স্থানে যোনি পূজা করে থাকে। দাক্ষায়ণী সতী দেবীর দেহের ৫১টি শক্তিপীঠের মধ্যে এই দুইটি মহাশক্তিপীঠ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও, কামাখ্যা শক্তিপীঠই বেশি গুরুত্ব বহন করে। তাই এই স্থানকে সব তীর্থের মধ্যে সেরা তীর্থচূড়ামণিও বলা হয়ে থাকে।

কামাখ্যা মন্দির:
মন্দির চত্বরে দশমহাবিদ্যার মন্দিরও আছে। এই মন্দিরগুলিতে দশমহাবিদ্যা অর্থ্যাৎ ভুবনেশ্বরী, বগলামুখী, ছিন্নমস্তা, ত্রিপুরাসুন্দরী, তারা, কালী, ভৈরবী, ধূমাবতী, মাতঙ্গী ও কমলা – এই দশ দেবীর মন্দিরও রয়েছে। এর মধ্যে ত্রিপুরাসুন্দরী, মাতঙ্গী ও কমলা প্রধান মন্দিরে পূজিত হন। অন্যান্য দেবীদের জন্য পৃথক মন্দির আছে।হিন্দুদের, বিশেষত তন্ত্রসাধকদের কাছে এই মন্দির একটি পবিত্র তীর্থ। প্রতিবছর গ্রীষ্মকালে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব অম্বুবাচী মেলা। শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান সহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ ও জেলাশহর থেকে এই মেলায় লক্ষলক্ষ লোকের সমাগম ঘটে। সেখানে মানুষ পুণ্যলাভের আশায় যায়। পূজা দেয়। মানসী করে। পাঁঠাবলি দেয়।

মূল কথা:
আসাম রাজ্যের কামরূপ জেলায় কামাখ্যা মন্দির হওয়াতে, তাই মানুষে কামরূপ আর কামাখ্যা এক সাথে মিলিয়ে বলে কামরূপ কামাখ্যা। আসলে দুটি শব্দই আলাদা আলাদা শব্দ। কামরূপ হলো আসাম রাজ্যের একটি জেলার নাম। আর কামাখ্যা হলো একটি বিখ্যাত মন্দির বা তীর্থস্থান। যা লোকে বলে থাকে একসাথে।

আমার বড়দিদির বাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার বীরপাড়া। আমি বড়দিদির বাড়ি গিয়েছিলাম ১৯৯১ সালের মাঝামাঝি সময়ে। সেখানে গিয়ে কামাখ্যা মন্দিরের খুঁটিনাটি তথ্য সেখানকার লোকমুখে শুনেছি। কিন্তু সময় আর অর্থের কারণে সামনে থেকেও কামাখ্যা মন্দিরে যাওয়ার ভাগ্য হয়নি। কামাখ্যা মন্দির নিয়ে সেখানকার মানুষের মুখে শুনেছিলাম, সেখানে আছে কিছু ভণ্ড উলঙ্গ সাধু সন্যাসীদের আস্তানা। এরা গাঁজা নামের সিদ্ধি সহ নেশা জগতের সবধরনের মাদকসেবনকারী। সবসময় মাদক সেবন করে নেশায় ভুত হয়ে নানারকম তন্ত্রমন্ত্রের ধ্বনি দিতে থাকে। আর অন্ধবিশ্বাসী ভক্তগণ পুণ্যলাভের আশায় সেসব সাধু সন্যাসীদের চরণে লুটিয়ে পড়ে। যা আমাদের দেশে থাকা মাজার মন্দিরে এরকম দেখা যায়। কিন্তু কোন ধরনের কোন যাদুবিদ্যার সুবাতাস কারোর চোখে পড়েনি। তবুও মানুষের কাছে কামরূপের কামাখ্যা মন্দির মন্ত্রতন্ত্র ও সাধনার এক রহস্যময় স্থান হিসেবেই রয়ে গেছে। যা এখনো অনেক মানুষের কাছে যাদুর দেশ হিসেবে বিবেচিত।

______________________
তথ্য সংগ্রহ উইকিপিডিয়া থেকে।

বিশ্ব কবিতা দিবস…

গতকাল ছিলো বিশ্ব কবিতা দিবস… কবিতার উচ্চারণে ভেসে যাক সকল অন্যায়-অবিচার… কবিতায় মুক্তি হোক বিশ্ব মানবতার। ২১ মার্চ, বিশ্ব কবিতা দিবস। ১৯৯৯ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর ত্রিশতম অধিবেশনে একুশ মার্চকে বিশ্ব কবিতা দিবস (World Poetry Day) হিসেবে পালনের ঘোষনা করা হয়। কবিতা সংস্কৃতির এক নান্দনিক উপাদান, কবিতা সমাজের অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে অনড় উচ্চারণ।

পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিনিয়ত উড়িয়ে দেয়া হয় অজস্র কবিতার রঙ বেরঙের পালক। আমাদের মানবিক চেতনার চিরসুন্দর আঙ্গিনায় ওরা বর্ণিল বেলুনের মতো উড়ে যায় ভিন্ন বোধ, ভিন্ন অনুভূতি, ভিন্ন ভাষার সুবাস ছড়িয়ে। তাইতো চেক রিপাবলিকের কবি, Jarosav Seifert, Nobel Prize in Literature 1984, তাঁর To Be a Poet কবিতায় লিখেছেন,

“Life taught me long ago
that music and poetry
are the most beautiful things on earth
that life can give us.
Except for love, of course.”

কিছুটা অনুবাদ করলে এইরকম বলাই যায় …

“ভালবাসা ব্যতীত জীবনের আরও একটি সবচেয়ে সুন্দর আশীর্বাদ হল,
কবিতা ও সঙ্গীত।”

মনের ভাষা যা প্রকাশ করা যায় না সরাসরি তা অনেক সময় কবিতা হয়ে কলমে আসে। ঝরে পড়ে কাগজের বুকে । কবিতা একটি শক্তি , একটি অনুপ্রেরণা। আমরা সবাই কবিতা লিখি একটি আলাদা আলাদা অনুভূতি থেকে। তবে সব কবিতাই একসময় আমার বা অন্যর মনের ভাষার রূপ নেয়। কবিতায় প্রেম, দ্রোহ সব ফুটে ওঠে স্পষ্ট ভাবে। কবিতা হোক মানবতার মুক্তির সনদ।

কবিতা না থাকলে পৃথিবীর আর কী এত সুন্দর ও ছন্দময় হত! জানি না। জানি না কোথায় চন্দ্রপ্রভার রূপ এত মোহ জাগানিয়া শব্দে গাঁথা হত, জানি না কোথায় তুষার ঝরার শব্দগুলো জমা হত! জানি না আর কী দিয়ে তোমার-আমার কথাগুলো কবিগুরুর গানের সুরে বাঁধা হত? মেক্সিকোর কবি অক্টাভিও পাজ (Octavio Paz, Nobel in Literature 1990) তাঁর Motion কবিতায় লিখলেন,

“If you are the first snow
I am he who lights the hearth of dawn….
If you are the morning tide
I am the first bird’s cry….
If you are the sleeping land
I am the green cane”….

কিছুটা অনুবাদ এইরকম হতে পারে …

“তুমি যদি হও প্রথম বরফ,
তবে আমি হবো ভোরের শুকতারা,
“তুমি যদি হও প্রভাত স্রোত,
আমি হব প্রথম পাখির ডাক।
তুমি যদি হও সুপ্ত ভূমি,
আমি হব সবুজ ফসল অপার।”…..

কবিতা দর্শন। কবিতা মূল্যবোধের হাতিয়ার। কবিতা শেখায় বিনয়ী হতে, সহিষ্ণু হতে, মানবিক হতে। কবিগুরু তাই মাত্রাবৃত্তে লিখলেন,

“আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার
চরণধুলার তলে ।
সকল অহংকার হে আমার
ডুবাও চোখের জলে ।”
…….

আমাদের প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথের যে কবিতা আমি মনেপ্রাণে ধারণ করি তা হলো …

“আমারে না যেন করি প্রচার
আমার আপন কাজে ;
তোমারি ইচ্ছা করো হে পূর্ণ
আমার জীবন-মাঝে।” (গীতাঞ্জলি)

কয়েকবছর আগে আন্তর্জাতিক কবিতা দিবস উপলক্ষে UNESCO প্রধান Ms Irina Bokova বলেন, “Poetry is one of the highest forms of linguistic and cultural expression. Giving complete creative and verbal freedom, it is an integral part of peoples’ identities and, like music, dance and art, also often helps us to create our own personal identity.”

সত্যিইতো, কবিতা স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ। সেই স্বাতন্ত্র্য সংস্কৃতির, ভূ-প্রকৃতির এমনকি জাতির সোনালী ইতিহাসেরও। জীবনানন্দ তাঁর কবিতায় লিখলেন,

“হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর উড়ে উড়ে কেঁদো নাকো ধানসিড়ি নদীটির পাশে!” (হায় চিল, বনলতা সেন কাব্য)

অথবা

“সোনালি ধানের পাশে অসংখ্য অশ্বত্থ বট দেখেছিল, হায়,
শ্যামার নরম গান শুনেছিলো — একদিন অমরায় গিয়ে
ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিলো ইন্দ্রের সভায়
বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিলো পায়। ”
(বাঙলার রূপ আমি দেখিয়াছি, রূপসী বাঙলা কাব্য)

এই যে চিল, ধানসিড়ি নদী, অশ্বত্থ, শ্যামা, খঞ্জনা , ভাঁটফুল ,প্রতিটি উপাদান এই বাঙলার রূপের প্রসাধনীর মতো। কবিতা কত সুন্দর হয়ে ওঠে প্রকৃতিকে তুলে ধরে। কত স্বতন্ত্র্য এই রূপ! কবিতায় কবির স্বাতন্ত্র্য রূপ ও স্পষ্ট হয়ে উঠে। কবিতা তথা সৃষ্টি কর্মের মাধ্যমে কবিও কাব্য সৃষ্টির পৃথক সত্ত্বা। এই পার্থক্য বুঝতে হলে বুঝতে হয় কবির সৃষ্টি, গভীর উপলব্ধি করতে হয় কাব্যের বার্তা। প্রতিটি কবি তাঁর নিজ নিজ সৃষ্টিতে পৃথক। তাই সেখানে তুলনা অমূলক, নিরর্থক। প্রকৃতি মানেই বৈচিত্র্যতা, প্রকৃতি মানেই ভিন্নতা। এখানে বিশালতা বৈচিত্র্যে, আকার কিংবা সংখ্যায় নয়। এই বৈচিত্র্যতার সবচেয়ে সুন্দর মিল হল সৌন্দর্য্য। আমাদের আর এক প্রিয় কবির কথা অনুযায়ী বলতেই পারি…

“কবিতা কবির অহংকার,
কিন্তু অহংকারীরা কবিতার কেউ নয় ”

তাহলে কবিতার অকৃত্রিম অভিন্নতা কী? কোথায় তার সেই সৌন্দর্য্য অন্তর্নিহিত?

কবিতা হলো অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে তীব্র উচ্চারণের আঘাত। কবিতা হলো অশান্তির দেয়ালগুলো ভাঙার কামান, কবিতা হলো অনাদিকালের প্রেম-ভালবাসার সতেজ সুর। আর কবিতার অভিন্নতা এখানেই। তাই তো কবিতাই পারে পৃথিবীকে সমন্বিত করতে।

এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম!…

এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম! জয় বাংলা…

‘ভায়েরা আমার,
আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। কী অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামীলীগকে ভোট দেন।

আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করবো এবং এই দেশকে আমরা গড়ে তুলবো। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় ২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস, বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস-এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে ১০ বছর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ৬দফা আন্দোলনে ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯ এর আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গনতন্ত্র দেবেন – আমরা মেনে নিলাম। তারপরে অনেক ইতিহাস হয়ে গেলো, নির্বাচন হলো। আপনারা জানেন। দোষ কী আমাদের? আজকে আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সাথে দেখা করেছি আপনারা জানেন – আলাপ আলোচনা করেছি। আমি শুধু বাংলা নয় – পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে তাকে অনুরোধ করলাম ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না। তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, প্রথম সপ্তাহে মার্চ মাসে হবে। তিনি মাইনে (মেনে) নিলেন। আমরা বললাম, ঠিক আছে, আমরা এসেম্বলিতে বসবো। আমরা আলোচনা করব। আমি বললাম, বক্তৃতার মধ্যে, এসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করবো- এমনকি আমি এ পর্যন্তও বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব। জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন, বলে গেলেন যে আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরও আলোচনা হবে। তারপরে অন্যান্য নেত্রীবৃন্দের সঙ্গে আলাপ করলাম। আপনারা আসুন,বসি। আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করি। তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসে তাহলে কসাইখানা হবে এসেম্বলি। তিনি বললেন যে যাবে তাকে মেরে ফেলা দেয়া হবে। যদি কেউ এসেম্বলিতে আসে তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত দোকান জোর করে বন্ধ করা হবে। তার পরেও যদি কেউ আসে তাকে ছান্নাছাড় করা হবে। আমি বললাম, এসেম্বলি চলবে। তারপরে হঠাৎ ১ তারিখে এসেম্বলি বন্ধ করে দেওয়া হলো।

ইয়াহিয়া খান সাহেব প্রেসিডেন্ট হিসেবে এসেম্বলি ডেকেছিলেন। আমি বললাম যে আমি যাবো। ভুট্টো সাহেব বললেন তিনি যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তানের থেকে এখানে আসলেন। তারপরে হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হল। দোষ দেওয়া হল বাংলার মানুষকে। দোষ দেওয়া হল আমাকে। বন্ধ করে দেয়ার পরে এদেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠলো। আমি বললাম শান্তিপূর্নভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন। আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সব কিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিলো। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল।

কী পেলাম আমরা? যা আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব-দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে- তার বুকের ওপরে হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু- আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু – আমরা বাঙালীরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি যখনই এদেশের মালিক হবার চেষ্টা করেছি – তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তারা আমাদের ভাই। আমি বলেছি তাদের কাছে একথা। যে আপনারা কেন আপনার ভাইয়ের বুকে গুলি মারবেন? আপনাদের রাখা হয়েছে যদি বহিঃশত্রু আক্রমণ করে তার থেকে দেশটাকে রক্ষা করার জন্য। তারপরে উনি বললেন – যে আমার নামে উনি বলেছেন আমি নাকি স্বীকার করেছি যে ১০ তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স হবে। আমি উনাকে একথা বলে দিবার চাই – আমি তাকে তা বলি নাই। টেলিফোনে আমার সঙ্গে তার কথা হয়। তাকে আমি বলেছিলাম, জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান, ঢাকায় আসেন, কিভাবে আমার গরীবের ওপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের ওপর গুলি করা হয়েছে। কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কী করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তার পরে আপনি ঠিক করুন – আমি এই কথা বলেছিলাম। আমি তো অনেক আগেই বলেছি কিসের আর টি সি? কার সঙ্গে বসবো? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে, তাদের সঙ্গে বসব? হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে, বা আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করে, ৫ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন এবং যে বক্তৃতা করে এসেম্বলি করেছেন- সমস্ত দোষ তিনি আমার উপরে দিয়েছেন – বাংলার মানুষের উপরে দিয়েছেন।

আমি পরিষ্কার মিটিংএ বলেছি যে এবারের সংগ্রাম আমার মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ভায়েরা আমার, ২৫ তারিখে এসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি, যে ওই শহীদের রক্তের ওপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারেনা। এসেম্বলি কল করেছেন, আমার দাবী মানতে হবে। প্রথম, সামরিক আইন- মার্শাল ল’ উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত দিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবো, আমরা এসেম্বলিতে বসতে পারবো কি পারবো না। এর পূর্বে এসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না। জনগণ সে অধিকার আমাকে দেয় নাই। ভায়েরা আমার, তোমরা আমার উপর বিশ্বাস আছে?

আমি, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্টকাচারি, আদালত ফৌজদারি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিস্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সেইজন্য সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে, সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা ঘোড়াগাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে। শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমিগভার্মেন্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোন কিছু চলবেনা। ২৮ তারিখে কর্মচারিরা যেয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপরে যদি বেতন দেয়া না হয়,

আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয় তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল – প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু – আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো। আমরা পানিতে মারবো।

তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। ভালো হবেনা। সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবেনা।
আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামীলীগের থেকে যদ্দুর পারি তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করবো। যারা পারেন আমার রিলিফ কমিটিকে সামান্য টাকাপয়সা পৌঁছে দেবেন। আর এই ৭ দিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইরা যোগদান করেছেন, প্রত্যেকটার শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছায়ে দেবেন। সরকারী কর্মচারিদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়া হল, কেউ দেবেনা। শোনেন মনে রাখবেন, শত্রু বাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে। এই বাংলায় হিন্দু মুসলমান, বাঙালি-নন বাঙালি, যারা আছে তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আমাদের উপরে। আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন রেডিও টেলিভিশনের কর্মচারিরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে, তাহলে কোন বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেননা। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোন বাঙালি টেলিভিশনে যাবেননা। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোন বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। দুই ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মায়নাপত্র নেবার পারে। কিন্তু পূর্ববাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবেনা। টেলিফোন টেলিগ্রাফ আমাদের এই পূর্ববাংলায় চলবে, এবং বিদেশের সঙ্গে নিউজ পাঠাতে হলে আপনারা চালাবেন। কিন্তু যদি এই দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝেশুনে কাজ করবেন।

তবে আমি অনুরোধ করছি – আপনারা আমাদের ভাই – আপনারা দেশকে একেবারে জাহান্নামে ধ্বংস করে দিয়েন না। জীবনে আর কোনোদিন আপনাদের মুখ দেখাদেখি হবেনা। যদি আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের ফয়সালা করতে পারি তাহলে অন্ততপক্ষে ভাই ভাই হিসেবে বাস করার সম্ভবনা আছে। সেইজন্য আপনাদের অনুরোধ করছি আমার এই দেশে আপনারা মিলিটারি শাসন চালাবার চেষ্টা আর করবেন না। দ্বিতীয় কথা – প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় – প্রত্যেক ইউনিয়নে – প্রত্যেক সাবডিভিশনে – আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল। এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।’

এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম! জয় বাংলা…
আপনারা আমার উপরে বিশ্বাস নিশ্চই রাখেন – জীবনে আমার রক্তের বিনিময়েও আপনাদের সঙ্গে বেইমানি করি নাই। প্রধানমন্ত্রীত্ব দিয়ে আমাকে নিতে পারেনাই। ফাঁসিকাষ্ঠে আসামী দিয়েও আমাকে নিতে পারেনাই। যে রক্ত দিয়ে আপনারা আমাকে একদিন জেলের থেকে বাইর করে নিয়ে এসেছিলেন এই রেসকোর্স ময়দানে আমি বলেছিলাম – আমার রক্ত দিয়ে আমি রক্ত ঋণ শোধ করব – মনে আছে? আমি রক্ত দেবার জন্য প্রস্তুত। আমাদের মিটিং এইখানেই শেষ। আসসালামু আলাইকুম। জয় বাংলা।’

আমরা কি ভুলে গেছি ভারতের অবদানের কথা?

আমরা কি ভুলে গেছি ভারতের অবদানের কথা?

ফেব্রুয়ারি মাস শেষ হয়ে মার্চ মাসের শুভ যাত্রা শুরু হয়ে গেল। মার্চের শুরুতেই মনে পড়ে যায় সেই ১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা মার্চের কথা। আমি তখন ৭থেকে ৮বছর বয়সের এক নাবালক শিশু। এখনো স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের সেসব কথা আমার বেশ মনে আছে। মনে আছে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের সাথে ভারতের অবদানের কথাও।

১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ডাকে বাংলার মুক্তিকামী মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, পাক হানাদার বাহিনীদের ওপর। সেসময় নিরস্ত্র মুক্তিকামী জনতাকে সর্বদিক দিয়ে সহযোগিতা করেছিলে, তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি। দিয়েছেন সৈন্য, দিয়েছেন গোলাবারুদ। লক্ষলক্ষ বাঙালি শরণার্থীদের নয় থেকে দশ মাস অতিথির মর্যাদায় খাওয়াইয়ে ছিলেন।

সেসময় বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধবিদ্যার ট্রেনিং সহ অস্ত্রসস্ত্র সাথে দিয়ে বাংলায় পাঠিয়েছেন, হানাদার বাহিনীর সাথে লড়াই করতে। সাথে দিলেন তাঁর দেশের সেনাবাহিনী।

নয় মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধে কত যে ভারতীয় সৈন্য প্রাণ হারিয়েছিল, তা আমার জানা না থাকলেও, সরকারের কাছে তার একটা হিসাব ঠিকই আছে বলে মনে হয়! সাথে প্রাণ হারিয়েছেন, আমাদের অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা সহ ত্রিশ লক্ষ মানুষ। সম্ভ্রম হারিয়েছেন, অগণিত আমার মা ও বোনেরা।

ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে আর অসংখ্য মা বোনের সম্ভ্রমের পাশাপাশি ভারতীয় সৈন্যদের অবদানের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি মহান স্বাধীনতা। পেয়েছি বাংলাদেশ নামে এক নতুন দেশ। স্থান পেয়েছি বিশ্ব মানচিত্রে। আজ আমরা স্বাধীন দেশের স্বাধীন বাঙালি জাতি।

স্বাধীনতা পরিবর্তী সময় থেকে আস্তে আস্তে আজ আমরা মধ্য আয়ের দেশে পদার্পণ করতে সক্ষম হয়েছি। কিছুদিন পর হয়ত আমরা উন্নত দেশের তালিকায়ও থাকবো বলে আশা করি।

১৯৭১ সালের দিকে ফিরে তাকালে প্রথমে ভাবতে হয়, এতো অল্প সময়ের মধ্যে আমরা কী করে স্বাধীনতা অর্জন করলাম? তখন তো আমাদের সৈন্য ছিল না, অস্ত্র ছিল না, যুদ্ধ করার মতো ট্রেনিংও ছিল না। ছিল না যুদ্ধবিমান। ছিল না গোলাবারুদ কামান। আমাদের তখন ছিলাম না খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা।

তখন তো আমরা ছিলাম, পাকিস্তানিদের গোলামের মতন। তাহলে আমরা কী করে, কার সাহসে ক্ষমতায় থাকা একটা দেশের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পরলাম? আবার যুদ্ধে জয়ীও হয়ে গেলাম? আমরা কি একবার ভেবে দেখেছি, তখন সাহসদাতা, আর অস্ত্রসস্ত্রের যোগানদাতা কে ছিল? ছিলেন, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত।

তখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ডাকে যদি ভারত এগিয়ে না আসতো, তাহলে কি আমরা পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে লাঠিসোঁটা নিয়ে যুদ্ধ করে জয়ী হতে পারতাম? মোটেই না।

তার মানে নয় মাসে নয়, নয় বছরেও পাকবাহিনীদের সাথে যুদ্ধ করে বিজয়ের সম্ভাবনা আমাদের ছিল না। আমরা কিছুদিন লাঠিসোঁটা নিয়ে দৌড়ঝাঁপ দিতে পারতাম ঠিক, শেষমেশ নিজেদের লেজ নিজেরাই গুটিয়ে দুই হাত তুলে তাঁদের কাছে ধরা দিতাম। তাঁরা মুক্তিকামী যোদ্ধাদের কিছু বন্দি করে, কিছু মেরে, তাঁরাই আবার দেশ শাসন করতেন। আমরা আর পেতাম না স্বাধীনতা। আমরা পেতাম সেই আগের মতন পরাধীনতা। আমাদের পায়ে বাঁধা থাকতো পরাধীনতার শিকল।

ভারতের বিশেষ অবদানে আজ আমরা স্বাধীন বাঙালি। দাবি করি বাংলাদেশি। আজ আমরা স্বাধীনতা পেয়ে পাখির মতন ডানা মেলে দেশবিদেশ ঘুরছি, চাকরি করছি, প্রবাসে থাকছি, দেশে টাকা পাঠাচ্ছি। দেশ উন্নত হচ্ছে। সাথে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা, সাথে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ।

কিন্তু ভারতের কথা আমরা বেশিরভাগ বাঙালিরা মুখে তো আনি-ই-না, বরং ভারতের কোনও সুসংবাদও শুনতে চাই না। এখন ভারত হলো বেশিরভাগ বাঙালিদের কাছে এক শত্রুর মতন। আর পাকিস্তান হলো সজাতি দেশ। অর্থাৎ: ভারত হলো, হিন্দু বিধর্মীদের দেশ, আর পাকিস্তান হলো, আমাদের দ্বীনের নবীর উম্মতের দেশ।

কিছুকিছু বাঙালিদের এরকম মনভার দেখা যায় তখন, যখন ভারত বনাম পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ শুরু হয়; কিংবা জম্মু কাশ্মীর নিয়ে ভারত পাকিস্তান উত্তেজিত হয়। আর সীমান্ত নিয়ে যুদ্ধযুদ্ধভাব দেখা দিলে।

তখন কিছুকিছু পাকিস্তান প্রেমী ভাইয়েরা সেই ১৯৭১ সালে ভারতের অবদানের কথা ভুলে গিয়ে, পাকিস্তানের জয়গান গাইতে থাকে। আর সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলোতে স্ট্যাটাস দিতে থাকে পাকিস্তানের জয় হোক, ভারতের ক্ষয় হোক। পাকিস্তান জিন্দাবাদ, ভারত ধান্ধাবাজ, নিপাত যাক।

বর্তমানে কাশ্মীর সীমান্তে বাজছে যুদ্ধের দামামা। থেমে থেমে উভয়পক্ষে গোলা ছুড়ছে পাল্টাপাল্টি। ভূপাতিত করছে একে অপরের যুদ্ধবিমান। চলছে উভয়পক্ষের হুমকি ধমকি। এরমধ্যে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে জয়গান গাওয়া শুরু হয়ে গেছে পাকিস্তান প্রেমীদের। তাঁরা তাঁদের হিংসাত্মক এমনভাব প্রকাশ করছে নিজ নিজ টাইমলাইনে। এটা একরকম যুদ্ধ বেধে দেওয়ার উস্কানির সামিল। এটা কি ঠিক? ঠিক হতে পারে, না-ও হতে পারে। কারণ, এদেশের সবাই তো আর এই দেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিল না। কিন্তু যুদ্ধ কোনোদিন সমস্যার সমাধান দিতে পারে না। যুদ্ধ শুধু সহিংসতাই বাড়িয়ে দেয়। শত সমস্যার সমাধান হয় আলোচনার মাধ্যমে। এটা আমাদের সবাইকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে।

একসময় আমাদের দেশের অনেকেই স্বাধীনতার বিপক্ষে থেকে, পাক হানাদার বাহিনীদের নানাভাবে উৎসাহিত সহ নানাবিধ সাহায্য সহযোগিতা করেছিল। যার কারণে সেসময়ে দেশ স্বাধীন হতে দীর্ঘ নয় মাস সময় লেগেছিল।যদি এদেশের সবাই স্বাধীনতার স্বপক্ষেই থাকতো, তাহলে দেশ স্বাধীন হতে আরও কম সময় লাগতো বলে মনে করি।

তবুও ওইসব স্বাধীনতা বিরোধী বিবেকহীন মানুষের সাহায্য পেয়েও পাক হানাদার বাহিনীরা আমাদের মুক্তিসেনাদের পরাজিত করতে পারেনি। ভারতের সহযোগিতায় খুব কম সময়ের মধ্যেই আমাদের মুক্তিবাহিনীরা হানাদার বাহিনীদের পরাজিত করে দেশ স্বাধীন করতে সক্ষম হয়েছিল।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঐসব পাকিস্তান প্রিয় মানুষগুলো আবার বলতে শুরু করল, “ভারত দেশ স্বাধীন করে এই দেশের সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে গেছে”। এটা ছিল ঐসব পাকিস্তান প্রিয় মানুষদের ধারনা।

এতে বুঝা যায়, উপকারীর গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলানোর সামিল। উপকারী উপকার করলো নিজের জানমাল দিয়ে, এখন উপকার পাওয়া মানুষগুলো দিচ্ছে উপকারীকে মিথ্যে অপবাদ। আসলে তা কি সত্যি? মনে হয় মোটেই না। কেননা, এখন তো আমাদের ঘরে কিছুই ছিল না। ছিল শুধু বাপদাদার ভিটেমাটিটুকু। এ ছাড়া তো আমাদের আর কিছুই ছিল না! ছিল না, বন্দুক। ছিল না টাকার সিন্দুক। ছিল না অস্ত্রসস্ত্র। ছিল না, গোলাবারুদ। ছিল না কোনও যুদ্ধবিদ্যা শেখা।

তাহলে ভারত দেশ স্বাধীন করে দিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের দেশ থেকে কী ছিনিয়ে নিতে পারে? তখন আমাদের দেশে কি হিরার খনি ছিল? স্বর্ণের খনি ছিল? তেলের খনি ছিল? ছিল না! তাহলে ভারত যাবার সময় সাথে করে নিল টা কী? নিয়েছে, তাঁরা আসার সময় সাথে করে যাকিছু এনেছে; তা-ই নিয়েছে। এ ছাড়া আর কিছুই নেয়নি। বরং আরও কিছু ফেলে রেখে তাঁরা এদেশ ত্যাগ করে তাঁদের নিজের দেশে চলে গিয়েছে। আমরা বেশিভাগ বাঙালিরা মনে মনে মনকলা খেয়ে এরকম চিন্তাভাবনা করে নিজেদের আরামের ঘুম হারাম করে থাকি, দিনের পির দিন, আর রাতের পর রাত। তাই শোনা কথায় চিলের পেছনে পেছনে দৌড়াতে থাকি।

আসলে আমরা আগের সবকিছু ভুলে গেছি। আমরা ভুলে গেছি সেসব কথা আর ইতিহাস। ভুলে গেছি আমাদের স্বাধীনতার সাথে ভারতের বিশেষ অবদানের কথা। সেসময়ে ভারতের অবদানের কথা স্বীকার করতেও আমাদের কেমন যেন লজ্জাবোধ হয়। আমরা আসলে এক আশ্চর্য বাঙালি জাতি। আমরা শুধু পেতেই চাই, কাউকে কারোর ন্যায্য সম্মানটুকুও দিতে জানি না।

যাই হোক, পরিশেষে এইটুকু বলতে চাই; আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই! আমরা উস্কানি দিতে চাই না, আমরা মীমাংসা চাই। জয় হোক মানবতার।

সবাইকে ভালোবাসা দিবসের শুভেচ্ছা

সবাইকে ভালোবাসা দিবসের শুভেচ্ছা

গত হলো ঋতুরাজ বসন্ত পহেলা ফাল্গুন। আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন’স ডে বা ভালবাসা দিবস। পহেলা ফাল্গুন আর ফেব্রুয়ারির ভালোবাসা দিবস যেন একই সুতায় গাঁথা। পহেলা ফাল্গুনের আগমনে যেমন গাছেরা নতুন সাজে সজ্জিত হয়, ফুলেরা সুভাস ছড়ায়; তেমনিভাবে মানুষের হৃদয়ে জেগে ওঠে ফেব্রুয়ারির ভালোবাসা দিবসের গান।

ভালোবাসা দিবস নিয়ে পৃথিবীতে অনেক মতভেদ থাকলেও, সেন্ট ভ্যালেন্টাইন’স এর নাম ভালোবাসা দিবসের ইতিহাসে থেকেই গেল। যার স্মরণে, যার নামে আজকের দুনিয়ায় জয়লাভ করেছে, এই ভালোবাসা দিবস বা ভ্যালেন্টাইন’স ডে। যা ১৪ই ফেব্রুয়ারি মানুষের হৃদয়ে থাকা ভালোবাসার মধ্যদিয়ে উদযাপিত হয় থাকে। দিবসটি শুধু আমাদের দেশেই সাড়ম্বরে উদযাপিত হচ্ছে না, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উদযাপিত হয়। যদিও আমাদের দেশের অনেক ধর্মপ্রাণ মানুষ এই দিনটিকে বেহায়াপনা দিবস হিসেবে গণ্য করে থাকে, তারপরও এই দেশের অগণিত মানুষ এই দিনটিকে স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করে; একে অপরের প্রতি ভালোবাসা বিনিময় করে থাকেন।

ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় ইতালির রোম নগরীতে সেন্ট ভ্যালেইন্টাইন’স নামে একজন খৃষ্টান পাদ্রী ও চিকিৎসক ছিলেন। তৎকালীন রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্রাডিয়াস তাঁকে ধর্ম প্রচার-অভিযোগে বন্দী করেন। কারণ তখন নাকি রোমান সাম্রাজ্যে খৃষ্টান ধর্ম প্রচার নিষিদ্ধ ছিল, তাই। বন্দী অবস্থায় তিনি একজন কারারক্ষীর দৃষ্টিহীন মেয়েকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলেন। এরপর সেন্ট ভ্যালেইন্টাইন’স এর কথা সারা রোম নগরীতে ছড়িয়ে পড়ে। এতে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন’স এর জনপ্রিয়তার প্রতি রোমান সম্রাট ঈর্ষান্বিত হয়ে রাজা তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। সেই দিনটি ছিল, “১৪ই ফেব্রুয়ারি”। অতঃপর ৪৯৬ সালে পোপ সেন্ট জেলাসিউও ১ম জুলিয়াস ভ্যালেইন্টাইন’স স্মরণে ১৪ই ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইন’ দিবস ঘোষণা করেন। যা বর্তমান দুনিয়ায় ভ্যালেন্টাইন’স ডে বা ভালোবাসা দিবস নামে স্বীকৃত।

এমন অনেক প্রচলিত ঘটনা, তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায় ভালোবাসা দিবসের ইতিহাস নিয়ে। একেকজন একেকভাবে এর যুক্তি ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন। তবে এ কথা ঠিক মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা চিরন্তন। আর এ ভালোবাসা থেকেই ভালোবাসা দিবসের উৎপত্তি। তা কে মানল আর কে মানলো না, তা এই বিশেষ দিবসটির কিছুই যায় আসবে না। পৃথিবী নামক গ্রহটি যতদিন জেগে থাকবে, ভালোবাসা দিবসটিও ততদিন আরও সারা জাগাবে।

তবে আমাদের দেশে অর্থাৎ বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবসের আবির্ভাব ঘটে ১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। শুরু হয় বিশিষ্ট সাংবাদিক শফিক রেহমানের হাত ধরে। সম্মানিত শফিক রেহমান সাহেব, লন্ডনে পড়াশোনার সুবাদে পাশ্চাত্যের রীতিনীতিতে তিনি ছিলেন অভ্যস্ত। দেশে ফিরে তিনিই ভালোবাসা দিবসের শুভ সূচনা করেন। সেই থেকে এই বিশেষ দিবসটি নতুন প্রজন্মকে বেশি আকর্ষণ করে এবং সে থেকেই আমাদের দেশে ১৪ ফেব্রুয়ারি হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন’স ডে বা ভালোবাসা দিবস শুরু।

যদিও অনেকে বলে থাকে, ভালোবাসার জন্য নির্দিষ্ট কোনও দিন বা তারিখ নেই! সপ্তাহের সাত দিন এবং বছরের ৩৬৫ দিনই ভালোবাসার দিন। তবু ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ভালোবাসা প্রকাশের একটি প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে বা ভবিষ্যতেও হবে। কেননা, ভালোবাসা শুধু প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ভালোবাসার শেযও নেই। সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা। ভাইয়ে প্রতি বোনের ভালোবাসা। বাবার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা। ছোটদের প্রতি বড়দের ভালোবাসা। গরিবের প্রতি বড়লোকের ভালোবাসা। প্রজার প্রতি রাজার ভালোবাসা। নারীর প্রতি পুরুষের ভালোবাসা। দেশের প্রতি জনগণের ভালোবাসা। সৃষ্টির প্রতি স্রষ্টার ভালোবাসা। পৃথিবীর প্রতি মানুষের ভালোবাসা। শিষ্যের প্রতি গুরুর ভালোবাসা। ছাত্রের প্রতি শিক্ষকের ভালোবাসা। নিশ্বাসের প্রতি দেহের ভালোবাসা সহ আরও শতসহস্র ভালোবাসাই বিরাজমান।

ভালোবাসা শুধু মানুষ মানুষের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়, ভালোবাসা প্রতিটি প্রাণীর মধ্যেই প্রতীয়মান। প্রতিটি জিনিশের প্রতিও মানুষের ভালোবাসা লক্ষণীয়। তাহলে এই বিশেষ দিবসটিকে আমরা অভিন্নভাবে দেখছি কেন? ভালোবাসা দিবসে আমি কি আমার গর্ভধারিণী মাকে ভালোবেসে একটি ফুল বা অন্যকিছু দিতে পারি না? আমি কি ভালোবাসা দিবসে আমার আদরের সন্তানের মাঝে আমার হৃদয়ে থাকা ভালোবাসা বিনিময় করতে পারি না? যাকে নিয়ে ৩০টি বছর একসাথে সংসার করছি, তার সাথে কি ভালোবাসা বিনিময় করতে পারি না? যেই শিক্ষাগুরুর আশীর্বাদের আজ আমি শিক্ষিত বিদ্যান। সেই গুরুর সাথে কি ভালোবাসা বিনিময় করতে পারি না?

পারি, এখানে দোষের কিছু নেই। আছে শুধু আমাদের মনের অভাব। মন থেকেই নাকি ভালোবাসার উৎপত্তি। এই নশ্বর ভবসংসারে ভালোবাসা ছাড়া আর আছে কী? ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই নেই। তাই হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন’স ডে বা ভালোবাসা দিবসে আমার হৃদয়ের ভালোবাসা সবার মাঝে বিলিয়ে দিতে চাই। সবার প্রতি রইল আমার ক্ষুদ্র হৃদয়ের এক নদী ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা। ছড়িয়ে পড়ুক ভালোবাসা দিবসের ভালোবাসা ছোটবড় সকলের মাঝে। জয় হোক ভালোবাসার।

সরস্বতী পূজার্চনা

সরস্বতী পূজার্চনা

আজ হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব সরস্বতী পূজা। সরস্বতী বিদ্যার ও ললিতকলার অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবে পরিচিত। সরস্বতী দেবী শ্বেতশুভ্রবসনা। দেবীর এক হাতে বেদ, অন্য হাতে বীণা। এ জন্য তাকে বীণাপাণি বলা হয়।

সরস্বতী বৈদিক দেবী হলেও সরস্বতী পূজা বর্তমান রূপটি আধুনিক কালে প্রচলিত হয়েছে। তবে প্রাচীন কালে তান্ত্রিক সাধকেরা সরস্বতী-সদৃশ দেবী বাগেশ্বরীর পূজা করতেন বলে জানা যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাঠশালায় প্রতি মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে ধোয়া চৌকির উপর তালপাতার তাড়ি ও দোয়াতকলম রেখে পূজা করার প্রথা ছিল। শ্রীপঞ্চমী তিথিতে ছাত্রেরা বাড়িতে বাংলা বা সংস্কৃত গ্রন্থ, শ্লেট, দোয়াত ও কলমে সরস্বতী পূজা করত। গ্রামাঞ্চলে এই প্রথা বিংশ শতাব্দীতেও প্রচলিত ছিল। শহরে ধনাঢ্য ব্যক্তিরাই সরস্বতীর প্রতিমা নির্মাণ করে পূজা করতেন। বর্ধমান মহারাজার পূজায় বিশেষ সমারোহের আয়োজন করা হয়। দূর দুরান্ত থেকে মানুষ এই পূজার বিসর্জন দেখতে আসত। পূজা উপলক্ষে দুই ঘণ্টা আতসবাজিও পোড়ানো হত।

আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পূজার প্রচলন হয় বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে। শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে, শ্রীপঞ্চমীর দিন সকালেই সরস্বতী পূজা সম্পন্ন করা যায়। সরস্বতীর পূজা সাধারণ পূজার নিয়মানুসারেই হয়। তবে এই পূজায় কয়েকটি বিশেষ উপাচার বা সামগ্রীর প্রয়োজন হয়। যথা: অভ্র-আবীর, আমের মুকুল, দোয়াত-কলম ও যবের শিষ। পূজার জন্য বাসন্তী রঙের গাঁদা ফুলও প্রয়োজন হয়। লোকাচারর অনুসারে, ছাত্রছাত্রীরা পূজার পূর্বে কুল ভক্ষণ করেন না। পূজার দিন কিছু লেখাও নিষিদ্ধ। যথাবিহিত পূজার পর লক্ষ্মী, নারায়ণ, লেখনী-মস্যাধার (দোয়াত-কলম), পুস্তক ও বাদ্যযন্ত্রেরও পূজা করার প্রথা প্রচলিত আছে। এই দিন ছোটোদের হাতেখড়ি দিয়ে পাঠ্যজীবন শুরু হয়।পূজান্তে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার প্রথাটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের দল বেঁধে অঞ্জলি দিতে দেখা যায়।

আসুন, আজ আমরা সকলেই জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বানী-বন্দনায় মেতে উঠি। বানী বন্দনায় মেতে উঠুক আমাদের বাংলা কবিতার আসর। সাথে থাকুন, পাশে রাখুন। দেবীর আরাধনায় আমাদের সকলের কণ্ঠে ধ্বনিত হোক সুর ও সংগীতের গীতবিতান। জয়গুরু! জয়গুরু! জয়গুরু!

সরস্বতী পূজার্চনা
লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

বসন্ত পঞ্চমী তিথি পূণ্য শুভক্ষণে,
বানী বন্দনায় রত ছাত্র-ছাত্রীগণে।
মাঘ মাস শুক্লপক্ষ আসে বিধিমতে,
বাগদেবী বীণাপানি পূজিতা জগতে।

বিদ্যালয় সুশোভিত মণ্ডপ প্রাঙ্গনে,
পুরোহিত করে পূজা বসিয়া আসনে।
সুগন্ধি চন্দন, ধূপ, ঘৃত, মধু আর,
ধান্য, দূর্বা, গঙ্গাজল, যত উপাচার।

পবিত্র মঙ্গলঘটে শোভে আম্র-শাখা,
পুষ্পমালা চারিভিতে আলপনা আঁকা।
পূজাপাঠ, হোমযজ্ঞ হলে সমাপন,
পুষ্পাঞ্জলি দেয় সবে হয়ে শুদ্ধ মন।

পূজাশেষে সব করে প্রসাদ ভক্ষণ,
কবিতা লিখেন কবি শ্রীমান লক্ষ্মণ।

কং সি ফা চাই

কং সি ফা চাই

চন্দ্র বর্ষের প্রথম দিনটিকে চীনারা নববর্ষ হিসেবে পালন করে থাকে।

এই উৎসবকে বলা হয় ‘চুন জি’। ইংরেজিতে যা ‘স্প্রিং ফেস্টিভাল’ নামে পরিচিত। চীনারা তাদের নিজস্ব বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে। নতুন বছর আসলে কোন তারিখ থেকে শুরু হবে এর কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। কারণ এই তারিখ প্রতি বছর পরিবর্তন হয়! এই বছর আজকের দিন থেকে শুরু হচ্ছে ওদের নতুন বছর। অর্থাৎ ৫ই ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখে।

ওদের নববর্ষ আর বসন্ত দু’টোরই আগমন হয় একই সময়ে। উৎসব শুরু হয় বছরের শেষ মাসের মাঝামাঝি, শেষ হয় নতুন বছরের প্রথম মাসে। এই উৎসবকে তারা বসন্ত উৎসবও বলে থাকে। চীনের নববর্ষ তাদের নিজস্ব রীতিতে হয়। নতুন বছরকে তারা একটি প্রাণীর নামে নামকরণ করে থাকে। নির্দিষ্ট ১২টি প্রাণীর নাম ঘুরেফিরে রাখা হয় একেক বছর। এ বছরকে চীনা ক্যালেন্ডারে শূকর বর্ষ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বাকি ১১টি প্রাণী হচ্ছে: ইঁদুর, ষাঁড়, বাঘ, খরগোশ, ড্রাগন, সাপ, ঘোড়া, ভেরা, মোরগ, কুকুর এবং ভল্লুক। গত বছর ছিলো কুকুর বর্ষ।

নববর্ষের আনন্দ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন প্রাণীর যোগ দেওয়ার রীতি রয়েছে চীনা নববর্ষে। চীনে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ তাদের পরিবারের সাথে নতুন বছর উদযাপনের জন্য বহু পথ পাড়ি দেয়। বছরের এই সময়টাতে চীনে এতো মানুষ ভ্রমণ করে যে এটাকে পৃথিবীর সবচাইতে বড় বার্ষিক মনুষ্য ভ্রমণ বলে আখ্যা দেয়া হয়। দীর্ঘদিন জমজমাট বসন্ত পালনের পর যে যার স্থানে ফিরে যান। একে বলা হয় চুনইয়ুন। উৎসব শুরুর আগে নিজেদের বাড়িঘর পরিষ্কারের ধুম পড়ে যায় চীনের ঘরে ঘরে। অনেক বাড়িতে বিশেষ করে দরজা, জানালায় লাল রঙের নতুন প্রলেপ দেয়া হয়। লাল রঙের গৃহসজ্জা সামগ্রী, বিশেষ ঐতিহ্যবাহী প্রবাদ, উপদেশ ও ধর্মীয় বাণী বা চিহ্নসংবলিত লাল ব্যানারে ভরে ওঠে চীনের বাড়িঘর।

বেইজিংয়ের হোইহাই হ্রদে মন্দিরের মেলায় ভিড় জমান উৎসাহীরা। নববর্ষের প্রথম দিনে ধর্মীয় আচার দিয়ে শুরু হওয়া এই উৎসব গড়ায় ১৫ দিন পর্যন্ত। শেষ হয় ১৫তম সন্ধ্যায় প্রদীপ প্রজ্বলন উৎসবের মধ্যে দিনে। চীনারা বিভিন্ন আয়োজনের মধ্য দিয়ে তাদের নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। যেমন – সিংহ নাচ, ড্রাগন নাচ, লাল লণ্ঠন, পটকা, আতশবাজি, লাল কাপড় আর বিভিন্ন রকমের খাবার থাকে উৎসব উদযাপনে। বিশাল ভোজ, পথঘাট সাজসজ্জার পাশাপাশি দেশটির অধিবাসীরা নতুন সাজে নিজেদের সাজিয়ে নেন। লাল খামে করে বাচ্চাদের টাকা দেয়া হয় বর্ষবরণ উৎসবে। লাল প্যাকেটে কমলা লেবু উপহার দেয়া হয় পরস্পরকে। আর বাজি পোড়ানো হয় ভূতপ্রেত তাড়ানোর জন্য৷ চিনের প্রাচীরের একটি অংশে এই দিন বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

বটগাছের মমতায় সমাধিস্থানে নির্মিত একটি মঠ

সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন গোদনাইল চিত্তরঞ্জন কটন মিলস্-এর পুকুরপাড়ে পাগলা সাধুর সমাধি স্থানে নির্মিত মঠ।

একটি বটগাছ পরম মমতায় আঁকড়ে ধরে রেখেছে পাগলা সাধুর সমাধি স্থানে নির্মিত একটি মঠকে। মঠটি ঘিরে কথিত আছে অনেক জানা অজানা কথা। সেসব কথা নাহয় লেখার শেষাংশে প্রকাশ করবো। শুরুতে সুশীতল ছায়াসুনিবিড় দেববৃক্ষ বটগাছের জন্ম কথা নিয়ে কিছু লিখতে চাই।

বটগাছ একটি বৃহদাকার বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ। আমাদের দেশের গ্রাম ও শহরে বট গাছ সাধারণত দুই প্রকারই বেশি দেখা যায়, কাঁঠালিবট ও জিরাবট৷ কাঁঠালি বটের পাতা ঠিক কাঁঠাল পাতার মতো। আর জিরাবটের পাতা পানপাতার মতো দেখা যায়। তাই দুই রকমের বটগাছের দুইটি নাম হয়েছে জিরাবট, আর কাঁঠালি বটগাছ। এই দুই প্রকারের বটগাছ আমাদের দেশের শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জের আনাচে-কানাচে অনেক দেখা যায়। সবচেয়ে বেশি দেখা যায় পুরানো বাড়ির দেয়ালের কার্নিশে, প্রাচীর ঘেরা দেয়ালের ফাটলে।

এর কারণ হচ্ছে, আমাদের দেশে বিভাগীয় শহরগুলোতে এখনো অনেক পুরানো স্থাপনা আছে। খোদ ঢাকা শহরেও অনেক পুরানো স্থাপনা দেখা যায়। ঢাকা শহরের নিকটবর্তী শহর নারায়ণগঞ্জেও অনেক পুরানো স্থাপনা চোখে পড়ে। আগে সিমেন্টের খুবই দাম ছিল। দাম ছিল এই কারণে যে, তখনকার সময়ে আমাদের দেশে কোথাও কোনও সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ছিল না। কোনও জমিদার বংশের কারোর সিমেন্টের দরকার হলে, বিদেশের কথা স্মরণ করতে হতো। তাই সিমেন্ট ছিল বিদেশি এক দুর্লভ পণ্য। যেই পণ্য তখনকার দিনে যেকেউ কিনতে সক্ষম হতো না বা পারতো না। আগের দিনে যার কাছে এক হাজার টাকা থাকতো তাকে বলতো হাজার টাকার মালিক। আর যিনি থাকতো কয়েক হাজার টাকার মালিক, তাকে লোকে বলতো হাজারী।

পাগলা সাধুর সমাধি স্থানে নির্মিত মঠ। মঠটাকে একটি বটগাছে পরম মমতায় আঁকড়ে ধরে রেখেছে। এখন আর এই মঠ থেকে একটি ইটাও খসে পড়বে না, কেউ আর ভেঙেচুড়ে তচনচও করতে পারবে না।

এসব হাজারীদের হাজার হাজার টাকা থাকতেও, তাঁরা বিদেশ থেকে সিমেন্ট এনে তাদের বসতবাড়ি, দালান-কোঠা রড-সিমেন্ট দিয়ে তৈরি করতে পারেনি। তৈরি করতে হয়েছে মোটা মোটা এঙ্গেলের সাহায্যে। আর সিমেন্টের পরিবর্তে সুরকির (ইটের ফাঁকি) সাথে চুনা মিশিয়ে পেঁকমাটির মতন করে ছোট ছোট ইটের সাথে লেপে তাদের স্থাপনাগুলো তৈরি করেছে। কেউ কেউ চুনের খরচের টাকা বাঁচাতে সুরকির পরিবর্তে আঠালো মাটি সাথে ইট গেঁথে বড়সড় দালানকোঠা তৈরি করছে। ওইসব দালান-কোঠা মাটি আর ইটের সুরকি দিয়ে তৈরি বলেই, এসব দালান-কোঠার দালানে, বাড়ির বাউন্ডারি ওয়ালে শেওলা পড়তে দেখা যায়।

দালান-কোঠা বা বাউন্ডারির (প্রাচীর) শেওলায় জন্মায় এক ধরণের উদ্ভিদ। একসময় দেয়ালে জমে থাকা শেওলা থেকে জঙ্গলে পরিণত হয়। এসব জঙ্গলের সাথে জন্মে থাকে কাঁঠালি বটগাছ, জিরা বটগাছ। বটগাছের কোনও বীজ রোপণ করা যায় না। আর বটের বীজ রোপণ করলে বীজ থেকে গাছ জন্মায়ও না। তাহলে পুরানো দেয়াল, আর পুরানো দালান-কোঠা, পুরানো প্রাচীরে বটগাছ জন্মালো কীভাবে?

বটগাছের শিকড়ে ঘেরা পাগলা সাধুর সমাধি স্থানে নির্মিত মঠ।

যেভাবে বটগাছ জন্মায়:
বসন্ত ও শরৎকালে বটগাছে নতুন পাতা গজানোর সময় হয়। একসময় বটগাছের ঢালার মঞ্জরিতে ফুলের কলি বের হতে থাকে। ফুল ফোটে। মঞ্জরির গর্ভে ফুলগুলো লুকানো থাকে। ফুলগুলো খুবই ছোট এবং ফলের মতোই গোলাকার৷ ফলগুলো হুবহু আঙুর ফলের মতো। দেখতে লাল রঙের। এই ফলগুলো পাখিরা মহানন্দে ফল খেয়ে ওদের পেটের ক্ষুধা নিবারণ করে। একসময় পাখিরা মলত্যাগ করে এই বীজ ছড়িয়ে দেয়। পাখিবাহিত এই বীজ দালানের কার্নিশ, পুরানো দালানের ফাটল ও অন্য কোন গাছের কোটরে জমা থাকে। সেই বীজ থেকে আস্তে আস্তে গাছ জন্মাতে থাকে। একারণে উপগাছা বা পরগাছা হিসেবেও বটগাছের বেশ খ্যাতিও আছে। এই বটগাছ এমনই একটা গাছ, তার ফল হইতে বীজ সংগ্রহ করে বপন করলে গাছ জন্মায় না। আবার কোন দালানের কার্নিশ হইতে তৈরি গাছ উঠিয়ে এনে রোপণ করলে হয়। উপযুক্ত পরিবেশে একটি গাছ পাঁচ(৫) থেকে ছয়(৬) শত বছর বেঁচে থাকতে পারে৷ বট বাংলা অঞ্চলের আদিমতম বৃক্ষ। অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী বটগাছকে দেববৃক্ষও বলে।

বটগাছের এসব ঝুরি বা লত বা শিকড়গুলো একদিন বটগাছে পরিণত হবে।

বটের বর্ণনা:
বটের পাতা একান্ত, ডিম্বাকৃতি, মসৃণ ও উজ্জল সবুজ৷ কচি পাতা তামাটে। স্থান-কাল পাত্রভেদে পাতার আয়তনের বিভিন্নতা একাধারে বটের বৈশিষ্ট্য তথা প্রজাতি শনাক্তকরণের পক্ষে জটিলতার কারণও। পরিণত গাছের পাতা আকারে কিছুটা ছোট হয়ে আসে। বটের কুঁড়ি পাংশুটে হলুদ এবং এর দুটি স্বল্পায়ু উপপত্র পাতা গজানোর পরই ঝরে পড়ে। খুব অল্প বয়স থেকেই বট গাছের ঝুরি বা লত নামতে শুরু করে। তবে কাঁঠালি বটের ঝুরি বা লত বেশি নামে। এসব ঝুরি বা লত মাটির সংস্পর্শ পেলেই বাড়তে থাকে। ডালপালার ঝুরিগুলো একসময় মাটিতে গেঁথে গিয়ে নিজেরাই একেকটা কাণ্ডে পরিণত হয়। এভাবেই বট গাছ ধীরে ধীরে চারপাশে বাড়তে থাকে এবং একসময় মহীরুহে পরিণত হয়। তখন সর্বপ্রথম জন্মানো গাছটিকে আর চেনা যায় না। সবই ঝুরি বা লত গাছের মতনই দেখা যায়।

একসময় এই সমাধি স্থানের মঠটির সামনে গড়ে উঠেছিল তুলার গোডাউন। সেই তুলার গোডাউন একসময় আগুন ধরে যায়। সেই আগুনে মঠের উপর বটগাছের একটা ঢালা পুড়ে যায়। পুড়ে যাওয়া সেই ঢালা থেকে এখন নতুন নতুন পাতা বের হচ্ছে।

বট গাছকে ঘিরে বাংলা অঞ্চলে রয়েছে শত সহস্র বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য। (আর এই ঐতিহ্য বহনকারী একটি বট গাছ রয়েছে আমাদের বাংলাদেশেও। জানা যায়, ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ উপজেলার মল্লিকপুর গ্রামে। এ বট গাছের যে বিশাল ব্যাপ্তি তা ডিজিটাল যুগের উন্নত ক্যামেরার ফ্রেমে ধরা সম্ভব নয়। এই গাছটা আঠার(১৮) বিঘা জমির উপর বিস্তৃত। বনবিভাগের উদ্যোগে এর চারপাশ বাঁশ-মূলি দিয়ে ঘেরা হয়েছে গাছটি সুরক্ষিত রাখার জন্য। এই বটগাছটার জন্ম কথা জানে এমন লোক বর্তমানকালে কালিগঞ্জ উপজেলায় নেই। যাকেই জিজ্ঞাসা করা হয়, সে-ই বলে আমার দাদাও বলতে পারেনা, আর আমি বলবো কীভাবে?

জানা যায় এই গাছ হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বটগাছ। উষ্ণ আবহাওয়ায় বিশাল আয়তনের এই ছায়াবৃক্ষটি মানুষের অনেক উপকারে আসে। প্রাচীনকাল থেকেই বটবৃক্ষের ছায়ায় হাট-বাজার বসে, মেলা হয়, লোকগানের আসর বসে। জনসভারও আয়োজন হতো। কারণ হিসেবে বলা যায়, বাংলার গ্রামাঞ্চলে বড় বড় সুশীতল হলরুম ছিল না। আর তাই বড় বড় অনুষ্ঠান ও জনসভাগুলো ছায়াসুনিবিড় বটতলায় অনুষ্ঠিত হতো। এখনো গ্রামাঞ্চলে সেই দৃশ্য অনেকসময় চোখে পড়ে। বটগাছকে ভারত ও বাংলাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বী লোকেরা শিবের (মহাদেব) ছায়াবৃক্ষ হিসেবে মান্য করে থাকে।

মঠের ভেতরে খালি জায়গা আছে। খালি জায়গায় আগে অনেক মানুষ ঘৃতপ্রদীপ জ্বালাতো। দিতো ধূপের ধোঁয়া।

যার কারণে এই বটগাছ ভারত ও বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষেরা কাটেও না,বটগাছের লাকড়ি পোড়ায়ও না। এখনো হিন্দু ঘনবসতি এলাকায় এই বটগাছের নিকটে মন্দির স্থাপন করে পূজা অর্চনা দিতে দেখা যায়। আর বটগাছের নিচে শিবের (মহাদেব) হাতের একটা অস্ত্র(ত্রিশুল) গাড়া থাকতে দেখা যায়। যার কারণে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলসহ দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশে ধর্মীয় কারণে বটগাছ কাটা নিষিদ্ধ।

সমাধি স্থানে নির্মিত মঠে বটগাছ:
উল্লেখ করা যায়, এমন আরেকটি বটগাছ আছে নারায়নগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন গোদনাইল এলাকায়। এই বটগাছটির অবস্থান চিত্তরঞ্জন কটন মিলের পুকুর পাড়ে। বটগাছটি একটি সমাধি স্থানকে অতি আদরে ঘিরে রেখেছে। সমাধি স্থানটি হলো একটি মঠ, (মন্দিরের মত) সমাধি স্থান।

আগেকার সময় কোন সরকারি বা পৌরসভার অধীনে হিন্দুদের জন্য খুব কম সংখ্যক শ্মশানঘাট ছিল। যা চোখে না পড়ার মতো। কাজেই কোন হিন্দু লোক মৃত্যুবরণ করলে তাঁর শবদাহ বা (অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া) করা হতো তার নিজস্ব জায়গাতে। যার জায়গার অভাব ছিলো, তার মরদেহ দাহ (অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া) করা হতো, কোনও এক জলাশয়ের ধারে, না-হয় নদীর পাড়ে। (অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অর্থ হলো: অন্ত:অর্থ=শেষ, ইষ্টি:অর্থ=যজ্ঞ, ক্রিয়া: অর্থ=কার্যসম্পাদন। সুতরাং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শব্দের অর্থ শেষ যজ্ঞ সম্পাদন। এই শেষযজ্ঞ বলতে বোঝায় অগ্নিতে মৃতদেহ অহুতি দেওয়া)৷

১৯৪০ সালের দিকে পাগলা সাধু নামে একজন সাধু ছিলো। তাদের নিজস্ব বাড়ি ছিল নারায়ণগঞ্জ সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন গোদনাইল এলাকায়। বর্তমান চিত্তরঞ্জন কটন মিলস্ পুকুরপাড় সংলগ্ন। এই পাগলা সাধুর মরদেহ বসত বাড়ির পাশে চিত্তরঞ্জন পুকুরপাড় দাহ করা হয়। এরপর তাঁর পুত্র মধু ঘোষ সেখানে একটি মঠ নির্মাণ করে রাখে। একসময় তারা সপরিবারে হিন্দু মুসলিল রায়টের সময় ঘর-বাড়ি ছেড়ে ভারত চলে যায়। রায়টের পর তাদের ঘরবাড়ি সবই বেদখল হয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু পাগলা সাধুর সমাধির মট খানা সেভাবেই থেকে যায়। আর সেই মঠ হতে একটি বটগাছ জন্মে বড় হতে থাকে।

বর্তমানে মঠ থেকে গজে ওঠা বটগাছটি মঠটাকে এমন ভাবে জরিয়ে রেখেছে, এখন আর মঠ(মন্দির) দেখা যায় না। শুধু বট গাছের শিখর আর শিখর। দূর থেকে কেউ বুঝবেও না যে, এখানে একটি মঠ(মন্দির) আছে। আগে এখানে অনেকেই সকাল-সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালাত। দিতো সকাল-সন্ধ্যা ধূপের ধোঁয়া। বর্তমানে এখানে আর কেউ সকাল-সন্ধ্যা ধূপের ধোঁয়া আর মোমবাতি জ্বালায় না। হয় না কোনও বাৎসরিক মেলা বা কোন হরিনাম সংকীর্তন। অনেকের মুখে শুনা যায় যে, আগে এই মঠ বা মন্দিরে মনোবাসনা পূর্ণের আশায় এখানে অনেকেই মানত/নিয়ত বাঁধত। শোনা যায় নিয়ত বা মনের আশা পূর্ণও হয়েছে অনেকের। সমাধিস্থান মঠ থেকে গজে ওঠা বটগাছটি দেখে বুঝা যায় যে, পাগলা সাধুর সব জায়গা বেদখল হলেও এই মঠ বেদখল হতে দিবো না।

এই পবিত্র সমাধি স্থানের মঠটির বটগাছের শিকড়ের ভেতরে আছে বিশালাকার দু’টি সাপ। এই সাপ দু’টি সময় সময় অনেকেরই চোখে পড়ে। কিন্তু কাউকে ক্ষতি করে না। ধরে নেওয়া যায়, এরা পাগলা সাধুর পবিত্র সমাধি স্থানের মঠটির পাহারাদার। তাই দিনের বেলায়ও সমাধিস্থান মঠের সামনে গেলে কেমন যেন শরীরে কাঁপন ধরে। যাই হোক মঠের সামনে গেলে সবচেয়ে অবাক লাগে মঠটিকে আদর করে আঁকড়ে ধরে রাখা বটগাছটি দেখলে। যেন মায়ের আঁচল দিয়ে মঠটিকে ঢেকে রেখেছে। এখন আর কেউ মঠের একটা ইটাও খুলে নিতে পারবে না। প্রতিটি ইটের ভেতরে ভেতরে বটের শিকড় পেছানো আছে।

অনেকে বলে, “এই বটগাছটির জন্যই পাগলা সাধুর সমাধি স্থানের মঠটি রক্ষা পেলো। বটগাছটি না থাকলে তাদের ফেলে যাওয়া জায়গা সম্পত্তির সাথে এই সমাধি স্থানের মঠটিরও অস্তিত্ব হারাতে হতো।” যে যা-ই বলার বলুক! দুঃখের বিষয় হলো, এমন একটি পবিত্র স্থানের দিকে স্থানীয় হিন্দু ধর্মাবলম্বী কেউ ফিরে তাকাচ্ছে না। যদি নিকটবর্তী এলাকার হিন্দু ধর্মাবলম্বী সকলে এই পবিত্র সমাধি স্থানটির দিকে একটু খেয়াল রাখতো, তাহলে এখানেও অন্যান্য মন্দিরের মতন বাৎসরিক মেলা, হরিনাম সংকীর্তন, একনাম অনুষ্ঠিত হতো। পাগলা সাধুর সমাধি স্থানটিও থাকতো সবার মুখে মুখে, আর জায়গাটিও থাকতো আলোতে ঝলমল। কিন্তু না, কেউ আর এরকম উদ্যোগ নিচ্ছে না। অযত্নে আর অবহেলায় পড়ে আছে পাগলা সাধুর পবিত্র সমাধি স্থানের মঠটি।

জয়তু পাগলা সাধু, জয়তু বটগাছ।

মুজিব জাস্ট ল্যান্ডেড ইন হি’জ ল্যান্ড

মুজিব জাস্ট ল্যান্ডেড ইন হি’জ ল্যান্ড

একজন বিদেশি সাংবাদিক ফোনে জানিয়ে দিলেন
সেই সুসংবাদ!
‘মুজিব জাস্ট ল্যান্ডেড ইন হি’জ ল্যান্ড’
একজন কৃষক, একগুচ্ছ ধানী ফসল হাতে নিয়ে
যিনি ছুটে এসেছেন মৈমনসিংহ থেকে-
তিনি আওয়াজ তুললেন- ‘জয় বাংলা’
একজন হকার, গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে
তাকালেন আকাশের দিকে। তেজগাঁও বিমান বন্দরের
সুগভীর নীলাকাশ ভেদ করে উড়ে গেল
একঝাঁক কবুতর।
.
তিনি এয়ারক্রাফট থেকে নেমেই স্পর্শ করলেন
সেই মাটি। যে মাটি পুড়িয়ে গেছে পাক হানাদার,
যে মাটিতে মিশেছে লাখো শহীদের রক্ত,
যে মাটিতে ধর্ষিতা হয়েছেন লাখো নারী!
.
এবং বললেন- আমার কাছে দেবার কিছুই নেই।
আমি ফিরে এসেছি আপনাদের মাঝে,
আমি ফিরে এসেছি তোমাদের কাছে,
আমি বাঙালী, আমি মানুষ!
.
লাখো মানুষ আবারও তাকালেন তাঁর সেই
আঙুলের দিকে। সাতই মার্চে যে শাণিত আঙুল
দেখিয়েছিল সূর্য, দেখিয়েছিল পথ-দেখিয়েছিল স্বাধীনতা।
.
মুজিব এসেছেন, এসেছেন নেতা, এসেছেন সেই অগ্নিপুরুষ
বাংলার আকাশ জুড়ে বিষাদিত আনন্দ রেখা আজ!
দশ জানুয়ারি উনিশ’শ বাহাত্তর এভাবেই লেখা হয়ে যায়
এভাবেই অমর হয়ে থাকে লাল-সবুজের
পতাকা ঘেরা মানচিত্রে।

@
নিউইয়র্ক/ ১০ জানুয়ারি ২০১৯

নারীদের পোশাকের ইতিহাস

নারীদের পোশাকের ইতিহাস

শাড়ী নিয়ে জানার প্রথমেই জানা দরকার এই শব্দটির উৎপত্তি সম্পর্কে… “শাড়ী” শব্দটি এসেছে সংস্কৃত “শাটি” হতে যার অর্থ “এক ফালি কাপড়”। পরবর্তীতে প্রাকৃত এর বিবর্তনের কারণে “শাডি” বা “সাত্তিকা” শব্দ হতে শাড়ী শব্দে পরিণত হয়েছে… শাড়ীর উৎপত্তি জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে সুদূর অতীতে। ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রাচীন ভারতের পোশাক সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে তখন মেয়েরা আংটি, দুল, হার এসবের সঙ্গে পায়ের গোছা পর্যন্ত শাড়ি পরিধান করত, উপরে জড়ানো থাকত আধনা (আধখানা)। শুরুতে নারীরা ছিলেন স্বল্পবসনা। ছিলো শুধু দু টুকরা কাপড়ে নিজেদের শরীর ঢাকতো। মৌর্য এবং সুঙ্গ যুগে নারী ও পুরুষেরা চারকোনা কাপড় পরতো। শরীরের নিচের দিকে কাপড়কে বলতো অন্তরীয় এর উপরের অংশকে উত্তরীয়। পাল আমলের কিছু ভাস্কর্য দেখেই তা অনুমান করা যায়। এই তথ্য অনুযায়ী বলা যায় যে, অষ্টম শতাব্দীতে শাড়ি ছিল প্রচলিত পোশাক। দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে সেলাই করা কাপড় পরার রেওয়াজ আদিম কালে ছিল না। এই সেলাইবিহিন অখন্ড বস্ত্র পুরুষের ক্ষেত্রে “ধুতি” এবং মেয়েদের বেলায় “শাড়ি” নামে অভিহিত হয়। বয়ন শিল্পের উৎপত্তির সঙ্গে শাড়ির সংযোগ রয়েছে। তখন যেহেতু সেলাই করার কৌশল জানা ছিল না তাই সেলাই ছাড়া টুকরা কাপড় পরাই ছিল শাস্ত্রীয় বিধান।

কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’-এ শাড়ির কথা উল্লেখ আছে। ইলোরা অজন্তা গুহার প্রাচীন চিত্রাবলি বলে দেয়, খ্রিস্টাব্দ শুরুর সময়ে শাড়ির অস্তিত্ব ছিল। দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতের নারীরা শাড়িকেই প্রধান বস্ত্র বানিয়েছে। সিন্ধু সভ্যতার ভাস্কর্যে পুরোহিতদের শাড়ীকেই ধুতির মতো পরিহিত অবস্থায় পাওয়া যায় এবং মনে করা হয় ধুতিই শাড়ী প্রচলনের ভিত্তি। অন্য আরেকটি মতবাদে বলা হয়ে থাকে, ভারতবর্ষের কেরালা প্রদেশে ব্যবহৃত দুই প্রস্থের পোশাক “মান্দাম নারিয়াথাম” হতে শাড়ীর উৎপত্তি। মোঘলদের মধ্যে সম্রাট আকবরই ভারতবর্ষের সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা শুরু করেন। সেই ধারাবাহিকতায় শাড়িতেও মোঘলাই আভিজাত্যের সংযোজন। মোঘলদের আগ্রহের জন্য মসলিনের শাড়ির উপস্থিতিও থাকত অন্দর মহলে। মোঘলদের জন্য মসলিন কাপড় সংগ্রহের জন্য সরকারি লোক নিয়োগ দেওয়া হত। তবে সেসময় শাড়ি পড়া হত এক প্যাঁচে।

ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ একেক রকমের কাপড় পরতো। দক্ষিণ ভারতে, এমনকি ঔপনিবেশিক আমলেও, কোনো কোনো নারী তাদের শরীরের ওপরের অংশ ঢেকে রাখতো না। ১৫শ শতাব্দীর পরে পোশাক আশাকে গ্রিক, রোমান, আরব এবং চীনা প্রভাব পড়তে শুরু করল। কি ধরনের কাপড় পরতে হবে তার লিখিত কোনো নির্দেশনা ছিলো না। তবে মুসলিম নারীরা সাধারণত নিজেদেরকে ঢেকে রাখতো। সেজন্যে তারা আলাদা আলাদা কয়েকটি কাপড় পরতো যেখানে থেকে সালওয়ার কামিজের জন্ম। ভিক্টোরিয়ান যুগে ব্লাউজের প্রচলন শুরু হলো। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জনদানন্দিনী দেবী আজকে যেভাবে ব্লাউজ পরা হয় তার ধারণা তৈরি করেন, কারণ শাড়ির নিচে নগ্ন বক্ষের কারণে তাকে ব্রিটিশ রাজের আমলে তাকে ক্লাবে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সেখান থেকেই আজকের ব্লাউজের সূচনা। মূলত শেরশাহর আমলে এক টুকরো কাপড় বুকে বেঁধে রাখা হতো। সে-সময় একে কাঁচুলি বলো হতো। আবার অনেকে বক্ষবন্ধনীও বলতেন। চোলি, উত্তরীয়া, স্তান্নাপাতা, কুরপুশিকা প্রভৃতি নামেরও উল্লেখ আছে অনেক স্থানে।

পেটিকোটের প্রচলন শুরু হয় মুসলমানদের আগমনের সাথে, তারাই ঘাগরা/ পেটিকোট পোশাকের ব্যবহার শুরু করে ভারতবর্ষে এবং শাড়ীতে সেলাইয়ের ব্যপারটি তারাই আরম্ভ করেন। পূর্বে কাপড়ে সেলাইয়ের প্রথাতো ছিলই না বরং কাপড়ে সেলাই কে অপবিত্র মনে করা হত। এভাবেই বিভিন্ন পথ অতিক্রম করে আজকের শাড়ী, ব্লাউজ,পেটিকোট তার নিজ রূপ ধারণ করেছে।

আংশিক তথ্য স্বীকার :

হ্যাপী কাওয়াজা

হ্যাপী কাওয়াজা

“La célébration annuelle de Kwanzaa Célébrée du 26 décembre au 1er janvier, Kwanzaa est une fête familiale, culturelle, spirituelle et historique des Africains et Afrodescendants. Elle a pour but de réaffirmer les liens indestructibles entre l’Afrique et toute sa diaspora à travers le monde.”

কাওয়ানজা একটি অ্যাফ্রো আমেরিকান উৎসব। যা প্রতি বছর উদযাপন করা হয় ২৬ ডিসেম্বর থেকে ১লা জানুয়ারী পর্যন্ত। কাওয়ানজা আফ্রিকান এবং আফরোডিসেন্ডেন্টদের পরিবার, সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিক উদযাপন। কাওয়ানজা একটি সোয়াহিলি ‘mutunda ya Kwanzaa’ শব্দ যার অর্থ “প্রথম ফল”। কাওয়ানজা মূলত কৃষি উৎসবকে ঘিরে এবং পরিবার পুনর্মিলন, পূর্বপুরুষদের স্মৃতি, মৌলিক ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির প্রকাশকে বাড়ায়। অনেকটা আমাদের নবান্ন উৎসবের মতো।

দক্ষিণ আফ্রিকায় southern solstice এর সময় first fruits festival উৎসব হয়। মৌলানা কারেঙ্গা একজন আমেরিকান black power activists and secular humanist. তাকে Ronald McKinley Everett হিসেবেও জানা যায়। মৌলানা কারেঙ্গা ১৯৬৬/৬৭ সালে এই উৎসবের সূচনা করেন। যেটা আফ্রিকান আমেরিকান ছুটির দিন হিসেবে পালন হয়। কারেঙ্গা কিছুটা first fruits festival থেকে উৎসাহিত হয়েছিলেন। কারেঙ্গা তখনই এই উৎসব নিয়ে আগ্রহ দেখায় যখন তিনি জুলু উৎসব ‘Umkhisi Wokweshwama’ সম্বন্ধে পড়েন। যেটা একটি বার্ষিক harvest festival জুলু সম্প্রদায় এর মধ্যে।

তারপর থেকে এটি নিয়মিত পালন করা হয়। সাতটি মোমবাতি একটি ‘কিনারার’ মধ্যে সাজানো হয়। এই উৎসব এর সাতটি নীতিকে প্রতিনিধিত্ব করে।তিনটে লাল মোমবাতি ‘কিনারার ‘ বাঁ দিকে থাকবে, তিনটে সবুজ ডানদিকে আর মাঝে একটা কালো মোমবাতি থাকবে। ‘kinara’ একটি সোয়াহিলি শব্দ যার অর্থ মোমদানী। এই সপ্তাহে প্রতিদিন একটা করে নতুন মোমবাতি জ্বালানো হয়। কালো রঙের মোমবাতি দিয়ে শুরু হয়, তারপর বাঁ দিক থেকে ডানদিকে এক একদিন এক একটা মোমবাতি জ্বালানো হয়। কালো রঙের মোমবাতি আফ্রিকার মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। লাল রঙের মোমবাতি প্রতিনিধিত্ব করে ওদের জীবন সংগ্রাম। আর সবুজ রঙের মোমবাতি প্রতিনিধিত্ব করে ওদের ভবিষ্যত ও আশা যা সেই সংগ্রাম থেকে তারা পেয়েছে।

সাতটি মৌলিক নীতিকে কেন্দ্র করে এই উৎসব গড়ে উঠে যাকে সোয়াহিলি ভাষায় Nguzo Saba বলা হয়; এই নীতিগুলি হল:

১. উমজা বা ইউনিটি – এই নীতিটি পরিবার, সম্প্রদায় এবং জাতির মধ্যে ঐক্য তৈরি এবং বজায় রাখতে আমন্ত্রণ জানায়।

২. কুজিচাগুলিয়া বা আত্মনিরূপণ : এই নীতি অপরিহার্য; সবাইকে সংজ্ঞায়িত করা এবং নিজেদের জন্য কথা বলার সমস্ত সাহস, নিজেদের জন্য ভাল বা মন্দ বলার অধিকার বোঝায়।

৩. উজিমা (যৌথ কাজ ও দায়িত্ব) : ঐক্যবদ্ধ সম্প্রদায় গড়ে তুলতে এবং বজায় রাখা শিখতে সাহায্য করে; ভাই ও বোনদের সমস্যাগুলো নিজেদের সমস্যা মনে করে সমাধান করা।

৪. উজামা (অর্থনৈতিক সহযোগিতা) : এই নীতিটি মৌলিক কারণ নিজেদের ব্যবসা, বাজার গড়ে একসাথে গড়ে তোলা এবং সেখান থেকে লাভ করা; অর্থাৎ যৌথ অর্থনৈতিক শক্তি ব্যবহার করা সমগ্র সম্প্রদায়ের সুবিধার জন্য।

৫. নিয়া (লক্ষ্য ) : পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা। এটি সম্প্রদায়ের সবার জীবনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য এবং এই মিশনটি সমগ্র সম্প্রদায়কে কীভাবে উপকৃত হবে তা নির্ধারণ করা।

৬. কুম্বা (সৃজনশীলতা) : সম্প্রদায়ের মধ্যে সৃ‌ষ্টিশীল কাজ, সৌন্দর্য এবং সম্পদ নির্মাণের জন্য যে ব্যক্তিগত প্রতিভা এবং কল্পনা তা সৃজনশীল কাজে ব্যবহার করা।

৭. ইমানি (বিশ্বাস) : সকল বাধাবোধ, সমস্যা, সত্ত্বেও সবাইকে হৃদয় দিয়ে বিশ্বাস করা। বাবা মা, শিক্ষক শিক্ষিকা, নেতা নেত্রী, অর্থাৎ সবাইকে ঠিকমতো মূল্যায়ন করা, তাদের জীবন সংগ্রাম থেকে জয়ী হওয়াকে বিশ্বাস করতে শেখায়।

কোয়ানজাকে যে যে সিম্বল ব্যবহার করা হয়, তা হলো –
১. Mkeka অর্থাৎ মাদুর। যার ওপরে বাকি সিম্বলগুলো রাখা হয়।
২. Kinara অর্থাৎ মোমদানী
৩. Mishumaa Saba অর্থাৎ সাতটি মোমবাতি
৪. Mazao অর্থাৎ ফসল
৫. Muhindi অর্থাৎ ভুট্টা যে প্রাথমিক সিম্বল খাবার সাজানোর জন্য।
৬. a Kikombe cha Umoja অর্থাৎ ঐক্য কাপ, যা কিনা স্মরণ করতে সাহায্য করে এবং shukrani বা ধন্যবাদ জানানোর জন্য আফ্রিকান পূর্বপুরুষদের।
৭. Zawadi অর্থাৎ উপহার।

_________
রিয়া চক্রবর্তী।

বিখ্যাত ব্যাক্তিদের পছন্দের জলখাবার

বিখ্যাত ব্যাক্তিদের পছন্দের জলখাবার

১৬৬২ সালের আগে ইংরেজরা চা পান করত না। রাজা দ্বিতীয় চার্লসের স্ত্রী ক্যাথেরিন ডি ব্রাগ্যাঞ্জা ব্রিটেনে চায়ের প্রচলন ঘটান। পর্তুগালের মেয়ে ক্যাথেরিনের ছিল চায়ের নেশা। পর্তুগালের রাজদরবারেও চা ছিল প্রিয় পানীয়। সে যাই হোক রানীর চা পানের খবর সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তেই ব্রিটেনেও চায়ের প্রচলন শুরু হয়।

লেখক চার্লস ডিকেন্সের জলখাবারে পছন্দের আইটেম ছিল ক্রিম দেয়া দুই টেবিল চামচ রাম। এছাড়া কেটলি থেকে ঢালা ধোঁয়া ওঠা গরম চা তাঁর প্রিয় ছিল।

চতুর্থ এডওয়ার্ড জলখাবার খেতেন কেবল কর্নফ্লেক্স দিয়ে। রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ড আবার জলখাবারে পছন্দ করতেন পেঁয়াজ দিয়ে রান্না করা মুরগির কলিজা, ক্রিম আর ব্রান্ডি। এছাড়া দিনে ২০টি সিগারেট আর ১২টি চুরুট লাগত তাঁর। এত বেশি ধূমপান করার পরও ৬৪ বছর বাঁচে এডওয়ার্ড।

১৯৫৪ সালের কথা। বিমানে ভ্রমণ করছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার উইনস্টোন চার্চিল। জলখাবারের জন্য তাকে মেন্যু পছন্দ করতে বললে তিনি কি বলেছিলেন কাদাখোঁচা পাখির মাংস। অনেকে মনে করতে পারে, তিনি মজা করেছিলেন। আসলে তিনি সত্যি সত্যিই কাদাখোঁচার মাংস পছন্দ করতেন। দিনের প্রথম খাবারটা তিনি শুরু করতেন নিজের পছন্দের বিশেষ মেন্যু দিয়ে। কয়েক বছর আগে তার হাতে লেখা খাবার মেন্যু নিলামে ওঠার পর ভোজন রসিক চার্চিলের সকালের খাবারের তালিকা দেখে চোখ কপালে ওঠার মতো অবস্থা হয়। কাদাখোঁচার মাংস তো কেবল শুরু! দুটি আলাদা আলাদা ট্রেতে সাজানো থাকত নানা পদের জিভে জল আসা খাবার প্রথম দফায় থাকত ডিম পোচ, টোস্ট, মাখন, জ্যাম আর মাংস। দ্বিতীয় দফায় থাকত পাকা আঙ্গুর, এক বাটি মিষ্টি, হুইস্কি, সোডা আর প্রিয় সিগারেট।

নানা পদ দিয়ে জলখাবার পছন্দ করতেন বিখ্যাত পপ গায়ক এলভিস প্রিসলি। মাখন আর অতিরিক্ত লবণ দিয়ে রান্না করা ছয়টি ডিম, এক পাউন্ড বেকন, আধা পাউন্ড সসেজ বা পিনাট বাটার আর ব্যানানা স্যান্ডউইচ ছিল তার সকালের খাবারের নির্ধারিত মেন্যু।

ফুড জার্নালিস্ট সেভ এমিনা তার ‘দ্য ব্রেকফাস্ট বাইবেল’ গ্রন্থে এই সব তথ্য তুলে ধরেছেন। বইটিতে নানান বিখ্যাত ব্যক্তিদের পছন্দের জলখাবারের বর্ণনা দেয়া হয়েছে।

অন্যভাবে ক্লিওপেট্রা …

অন্যভাবে ক্লিওপেট্রা …

হেনরি হ্যাগার্ডের ক্লিওপেট্রায় ফুটে উঠেছে ক্লিওপেট্রার ব্যক্তিত্ব, উচ্চাভিলাষ আর কিছুটা নারীসুলভ অসহায়তা। এ ছাড়াও ক্লিওপেট্রার চরিত্র নিয়ে লিখেছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক ড্রাইডেন প্লুটার্ক, ড্যানিয়েল প্রমুখ। যিশু খ্রিস্টের জন্মের আগের নারী হলেও বিশ্বজুড়ে আজও তাঁকে নিয়ে কৌতূহলের কোনো কমতি নেই। রহস্যময়ী ক্লিওপেট্রার প্রসঙ্গ আসলেই প্রাচীন মিশর আর রোম সভ্যতার কথা অনিবার্যভাবে ওঠে আসবেই।

সপ্তম ক্লিওপেট্রা সারা বিশ্বের আলোচিত ব্যক্তিত্ব। তার চরিত্রের বিভিন্ন দিক নিয়ে লেখা হয়েছে কালজয়ী উপাখ্যান। জর্জ বার্নড শ’ লিখেছেন সিজার ক্লিওপেট্রা, এতে প্রাধান্য পেয়েছেন রোমান্টিসিজিম। শেক্সপিয়র লিখেছেন অ্যান্টনি ক্লিওপেট্রা। এটিতেও প্রাধান্য পেয়েছে প্রেম ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা। আর সেই সঙ্গে তিনি আশ্চর্য দক্ষতার সঙ্গে বর্ণনা করেছেন ক্লিওপেট্রার রূপের।

এই রূপসী ও তরুণীকে নিয়ে ছড়িয়ে আছে অনেক কল্পকাহিনী আর কিংবদন্তি। মিশর ছিল তখন সবদিক থেকেই সমৃদ্ধ। রোমের দৃষ্টি প্রায় সর্বদাই নিবদ্ধ থাকত সেদিকে, খাদ্য বা অন্য প্রয়োজনে।

ক্লিওপেট্রা একজন মিশরীয় ফারাও। তিনি ছিলেন প্রাচীন মিশরের সর্বশেষ ফারাও। তাঁর মৃত্যুর পর মিশর রোমান প্রদেশের আওতাধীন হয়। ক্লিওপেট্রা ছিলেন প্রাচীন মিশরীয় টলেমিক বংশের সদস্য। মহামতি আলেকজান্ডারের একজন সেনাপতি আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর মিশরে কর্তৃত্ব দখল করেন ও টলেমিক বংশের গোড়াপত্তন করেন। এই বংশের বেশিরভাগ সদস্য গ্রিক ভাষায় কথা বলতেন, এবং তাঁরা মিশরীয় ভাষা শিখতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। ক্লিওপেট্রা মিশরীয় ভাষা শিখেছিলেন এবং নিজেকে একজন মিশরীয় দেবীর পরবর্তী জন্ম হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। ১৮ বছর বয়সে মিশরের সম্রাজ্ঞী হলেন সপ্তম ক্লিওপেট্রা। মিশরীয় নিয়ম অনুযায়ী অষ্টাদর্শী ক্লিওপেট্রা (ফিলোপেটর) তার ছোট ভাই ১০ বছর বয়সী ত্রয়োদশ টলেমিকে বিয়ে করে মিশরের রানী হন। কিন্তু তাঁদের দুজনের মধ্যে ছিল বিরোধ। তখনকার মিশরীয় আইন অনুসারে দ্বৈত শাসনের নিয়মে রানী ক্লিওপেট্রার একজন নিজস্ব সঙ্গী থাকা বাধ্যতামূলক ছিল। কাজেই ক্লিওপেট্রাকে বিয়ে করতে হয় তারই ছোটভাই টলেমি-১৩কে, যখন তার বয়স ১২ বছর। তখনকার মিশরীয় আইনে ক্লিওপেট্রার একজন আপন সঙ্গী থাকা বাধ্যতামূলক ছিল যে কিনা স্বামী, ভাই বা পুত্র যে কেউ হলেই চলতো। ইতিহাসে ক্লিওপেট্রার জীবনে বহু পুরুষের আগমন ঘটেছে, তাদের মধ্যে রোমান বীর জুলিয়াস সিজার, এন্টোনি, হার্মাসীস উল্লেখযোগ্য। ক্লিওপেট্রা নিজের ক্ষমতা সুসংহত করার জন্য নিজের রূপ-কে কাজে লাগিয়েছেন বারংবার। ক্লিওপেট্রা রূপেও ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী।

অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা উইলিয়াম শেকসপিয়র রচিত একটি বিয়োগান্তক নাটক। ১৬২৩ সালের ফার্স্ট ফোলিওতে প্রথম এই নাটকটি মুদ্রিত হয়। এই নাটকে পার্থিয়ান যুদ্ধ থেকে ক্লিওপেট্রার আত্মহত্যা পর্যন্ত ঘটনার বিবরণ রয়েছে। মার্ক অ্যান্টনি মিশরে ক্লিওপেট্রাকে আক্রমণ করতে আসেন এবং তিনি ক্লিওপেট্রার প্রেমে পড়েন। তাদের যমজ সন্তান হয়। এদের একজন আলেকজান্ডার হেলিয়স ও অন্যজন ক্লিওপেট্রা সেলেনি। মিশরের সিংহাসন লাভের জন্য অ্যান্টনি খ্রিস্টপূর্ব ৩৬ অব্দে ক্লিওপেট্রাকে বিয়ে করেন। কিন্তু অ্যান্টনি ছিলেন বিবাহিত, তার স্ত্রী ছিলেন সিজারের উত্তরাধিকারী অক্টাভিয়াসের বোন। ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর পর তার পুত্র সিজারিয়নকে কতিপয় রোমান সিনেটরের ইঙ্গিতে গলাটিপে হত্যা করা হয়, যখন তার বয়স ছিল ১৭ বছর।

হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের ক্লিওপেট্রা মিশর সাম্রাজ্যের টলেমি বংশের শেষ সম্রাজ্ঞী ছিলেন সপ্তম ক্লিওপেট্রা ফিলোপেটর। দ্বাদশ টলেমির (নিয়োজ ডায়োনিসাস) তৃতীয় কন্যা ক্লিওপেট্রা ছিলেন অতি বুদ্ধিমতী ও বিদ্বান তবে শিথিল নৈতিকতাসম্পন্ন নারী। তার শরীরে ছিল গ্রিক রক্ত। মিসরের টলেমি বংশে ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার প্রথম মিশরে আধিপত্য স্থাপন করেন আর তার ইতি টানলেন সপ্তম ক্লিওপেট্রা। ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে প্রাচীন মিশরীয় ফারাও যুগের অবসান ঘটে যদিও তিনি ছিলেন মেসিডোনিয়ান। মিশরে রোমান শাসনকাল শুরু হয়। টলেমীয়রা মেসিডোনিয়ান হয়েও মিশর শাসন করেন। আর ক্লিওপেট্রা ছিলেন সর্বশেষ ফারাও। অসীম সুন্দরী ক্লিওপেট্রা ছিলেন বহু গুণে গুণান্বিত এক রমণী। তার অনেক গুণের মধ্যে ছিল প্রখর বুদ্ধিমত্তা আর মাতৃভূমির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। আচার-আচরণের দিক থেকে ক্লিওপেট্রা ছিলেন অনেকটাই সহজ-সরল প্রকৃতির। ক্লিওপেট্রা নয়টি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন। শুধু তাই নয়, তিনি একজন গণিতজ্ঞ ও ভালো ব্যবসায়ীও ছিলেন। অন্যকে আকর্ষণ করার মতো সহজাত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল ক্লিওপেট্রার। জন্মগতভাবেই তিনি ছিলেন নেতৃত্ব গুণের অধিকারী।

৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ক্লিওপেট্রা যখন রোমে অবস্থান করছিলেন আর একজন রানী হয়ে তারই অধস্তন এক জেনারেলের সঙ্গে রাজপ্রাসাদে একত্রে বসবাসের কারণে চারদিকে কানাঘুঁষা শুরু হলো। এর মধ্যেই ঘটে গেলো আরেক আশ্চর্য ঘটনা। ক্লিওপেট্রার একটি পুত্রসন্তান হলো। আলেকজান্দ্রিয়ার অধিবাসীরা তার নাম দিল সিজারিঅন। ক্লিওপেট্রা বলতেন, টলেমি সিজার। কিন্তু সিজারের আইনসম্মত উত্তরাধিকারী এবং ভাগ্নে অক্টোভিয়ান এটা মেনে নিলেন না। সিজার অবশ্য প্রকাশ্যেই বলে বেড়াতে লাগলেন যে, সিজারিঅন তারই সন্তান। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন যুগের মমি ও নানা প্রত্ননিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। সেই সঙ্গে উঠে এসেছে ইতিহাসের নানা অজানা অধ্যায়ও। কিন্তু রহস্যময়ী ক্লিওপেট্রা যেন রহস্যের আধার হয়েই থেকে গিয়েছিলেন। কিন্তু এবার বোধ হয় সেই রহস্যের জাল ছিন্ন হতে চলেছে। মিশরে টাপোসিরিস ম্যাগনা উপাসনালয়েই মিসরের সর্বশেষ ফারাও শাসক ক্লিওপেট্রার সমাধি পাওয়া যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এন্টনির মৃত্যুর পর একা হয়ে পড়লেন ক্লিওপেট্রা। কিছুদিনের মধ্যেই ক্লিওপেট্রাকে অক্টোভিয়ানের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে অক্টোভিয়ান নিজের বিজয়ে ক্লিওপেট্রার ভূমিকা অনেকটাই হাল্কা করে দিলেন। তিনি বলেন, মিশরের রানীর সঙ্গে তার কোনোরূপ সম্পর্ক, সমঝোতা বা বোঝাপড়ার কোনো বিষয় নেই। ক্লিওপেট্রার শাসনকাল শেষ হয়ে গেছে। এখন তাকে ক্রীতদাসী হিসেবে শহরের রাস্তায় রাস্তায় প্রদর্শন করা হবে। তবে এরকম কিছু ঘটার আগেই ক্লিওপেট্রাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করা হলো। ক্লিওপেট্রাকে মারার জন্য আনা হলো চরম বিষাক্ত সাপ ‘অ্যাসপ’ (মিসরীয় কোবরা। একে জীবন-মৃত্যুর ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়) ফলের ঝুড়িতে লুকিয়ে সেই কোবরাকে আনা হলো ক্লিওপেট্রার সামনে। এই সাপের কামড়েই ৩০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের ১২ আগস্ট ক্লিওপেট্রা মারা গেলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৩৯ বছর। মিশরীয় ধর্মমতে সর্পদংশনে মৃত ব্যক্তিরা হবেন অমর। আর এভাবেই ক্লিওপেট্রা মৃত্যুকালীন ইচ্ছা পূরণ করলেন, যা কেউ কোনোদিন ভুলে যাবে না। আবার আরেকটি মতানুসারে পরাজয়, প্রেমিক এবং রাজ্য হারানোর শোকে ক্লিওপেট্রা তার ব্যক্তিগত কক্ষে একটি সাপ আনিয়ে আত্মহত্যা করেন। সে সময়ে তার সঙ্গে দুই সহচরও আত্মহত্যা করেন। ইতিহাস বলে, ক্লিওপেট্রার সঙ্গে তার দুজন সখী বা সহচরীও মারা যান। কিন্তু একটি সাপই যে তিনজনের মৃত্যুর জন্য দায়ী বা সেখানে তিনটি সাপ আনা হয়েছিল কিনা সেটাও চিন্তার বিষয় ? এমনও সন্দেহ ওঠে, সেই সাপটি আসলেই বিষাক্ত ছিলো কিনা, আর সাপরে কামড়েই যে তিন নারীর মৃত্যু হয়েছে সেটাই বা নিশ্চিত করা গেলো কিভাবে ? তাছাড়া যে সাপটির কথা ইতিহাসে বলা হয়েছে, তার সঙ্গে অ্যাসপ বা মিশরীয় গোখরো সাপের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়, যা সাধারণত ৬ ফিট লম্বা হয়ে থাকে ? এ ধরনের একটি সাপকে সেই কক্ষে আনা হলেও তার জন্য যে ধরনের বড় ঝুড়ি বা জলের জগের প্রয়োজন হয় তা সেখানে ছিল না।

মার্টিনেজ বলেন, তিনি ১৪ বছর ক্লিওপেট্রা সম্পর্কে পড়াশোনা করেছেন এবং তার বিশ্বাস, ক্লিওপেট্রার মৃত্যু ছিল একটি ধর্মীয় ঘটনা এবং ভাইপার জাতের ক্ষুদ্র বিষধর সাপের দংশনে তিনি মারা গিয়েছিলেন। এছাড়া তাকে এই মন্দিরেই সমাহিত করা হয়েছিল। রোমান ঐতিহাসিক প্লুটার্কের লেখাতেও এটা রয়েছে, যে ক্লিওপেট্রাকে এন্থনির সঙ্গেই সমাহিত করা হয়েছিল। তবে সত্যি তারা এখানে চিরনিদ্রায় শায়িত কিনা সেটা সময়ই বলে দেবে। যদি সত্যি তাই হয় তাহলে এই টাপোসিরিস ম্যাগনা সারাবিশ্বের প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য সেটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং দর্শনীয় স্থানে পরিণত হবে। সেই সঙ্গে ক্লিওপেট্রার রহস্যময় জীবন আর তাকে নিয়ে রটনা-ঘটনারও অনেক সত্য প্রমাণ বেরিয়ে আসবে বলে ধারণা করছেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা।

ক্লিওপেট্রার এই ব্যক্তিত্ব, রূপ, গুণাবলীর কাহিনী সমগ্র আফ্রিকা, মধ্যএশিয়া ও ইউরোপজুড়ে বিগত দুই হাজারেরও বেশি বছর যাবত ঘরে ঘরে আলোচনার বিষয় হয়ে আছে। নাটক, থিয়েটার, গল্প, উপন্যাস, মডেলিং, চলচ্চিত্র এমনকি মেয়েদের ব্যক্তিগত স্টাইল ও রূপচর্চ্চার ক্ষেত্র পর্যন্ত দখল করে আছে ক্লিওপেট্রা। আর এভাবেই ক্লিওপেট্রা সর্বকালের সৌন্দর্য্যের শ্রেষ্ঠতম প্রতীক হয়ে রইলেন।

শ্রদ্ধাঞ্জলি_২০১৮

‘আমার দেশের মাটির গন্ধে ভরে আছে সারা মন
শ্যামল কোমল পরশ ছাড়া যে নেই কিছু প্রয়োজন…’

গুনগুন সুরে মন ক্ষণে ক্ষণে গেয়ে ওঠে। কখনো সে সুর আনমনা করে। মন চলে যায় সুদূর অতীতে – দুঃসহ দিন রাত্রির রক্ত রাঙ্গা ডায়রির পাতায়। সেই ডায়রির নাম মুক্তিযুদ্ধ ৭১ ………… বাংলাদেশ ! ‘আমার বাংলাদেশ পাখীর পালক হয়ে স্মৃতির ভিতর ঝরে… স্মৃতির বুকে খোদাই হয়ে আছে এ মাটির শ্রেষ্ঠ সময়ের ইতিহাস।

আগুন…বারুদ… আর্তনাদ…রক্ত…বিচ্ছেদ …অশ্রু … হাহাকার… ক্ষোভ … ঘৃণা … আক্রোশ … জেদ … প্রত্যয় … প্রতিজ্ঞা … যুদ্ধ … বিজয়… সৃষ্টির প্রেরণা …

তীরহারা সেই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিয়ে যারা ভালোবাসার স্বদেশকে স্বাধীনতার সূর্যের দিনের কাছে, সুখী নিরাপদ রাতের কাছে পৌঁছে দেবার স্বপ্ন দেখার সাহস করেছিলেন; ঝর্ণা থেকে হয়ে উঠেছিলেন এক একজন আগ্নেয় গিরি, কঠিন শপথে সহজ হাসি মাখা স্বচ্ছ চোখের জলে জীবন দিয়ে গেছেন, কিম্বা দিয়েছেন খুব প্রিয় কিছু, দিয়েছেন সোনালি সময়, ইতিহাসের পাতায় স্বাক্ষর করেছেন সেরা মানুষ হিসাবে – তাঁদেরকে সালাম। সর্ব শক্তিমান দয়াময় স্রষ্টার কাছে আমরা চির কৃতজ্ঞ। তিনি এই মাটিতে যুগে যুগে পাঠিয়েছেন স্বপ্নচারী সাহসী মানুষ।

’৭১ এবং এর পূর্ববর্তী, পরবর্তী দুঃসাহসী যোদ্ধাদের জন্য আমাদের এই শ্রদ্ধাঞ্জলি!!!

পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে যারা চলে গেছেন তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করি। অন্য পৃথিবীতে তাঁরা সম্মানিত হয়ে থাকুন। যারা এখনো আমাদের মাঝে আছেন তাঁদের সম্মানিত জীবনের সুখ দুঃখের সাথী হবার আশা রাখি। মহান আল্লাহ আমাদের মনের এই একান্ত ইচ্ছা পূরণ করুন। আমরা যেন আমাদের কৃতজ্ঞতা টুকু প্রকাশ করতে পারি, নিজেদের বিবেকের কাছে নিরপরাধী হয়ে ভোগ করতে পারি সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা এবং সুখ।

কিন্তু আমাদের অনেকের ভিতরেই দেখতে পাই কৃতঘ্ন বৈশিষ্ট্য। মাঝে মাঝে মনে হয় বাঙ্গালী স্বাধীনতা চেয়েছিল না সোনার খাঁচা। না হলে স্বাধীনতার সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করেও তারা ‘পাকিস্থানী’ হতে চায়!!! তারেক মাসুদের ‘মুক্তির কথা’ ছবির একটি দৃশ্যের কথা বলতে পারি। সেখানে এক সামান্য মানুষের জবানবন্দী বিধৃত হয়েছে। তার গ্রামে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছে এক রাজাকার। সামান্য মানুষটি বলছেন, ‘ যদি আমরা রাজাকার নির্বাচিত করে থাকি, তাহলে আমরা নব্বই ভাগই তো রাজাকার হয়ে গেছি। কুত্তার মতো হয়ে গেছি, না হলে রাজাকার চেয়ারম্যান বানাই।’ এই উপলব্ধিটা এখনো আমাদের মত সাধারণ মানুষদের ভিতর আছে।

থার্মপলির যুদ্ধে গণতন্ত্র রক্ষা করতে গিয়ে সব গ্রীক সৈন্য নিহত হয়েছিল – তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে যে ফলকটি প্রোথিত হয়েছিল, তার গায়ে প্রাচীন গ্রীক ভাষায় যা লেখা আছে তার ইংরেজী তর্জমা-

“let it not be forgotten, for your to-morrow we have given our to-day”

“ভুলে যেও না, তোমাদের আগামী দিনের জন্য, আমরা আমাদের বর্তমানকে উৎসর্গ করে গেলাম।”

আমাদের বীরশ্রেষ্ঠ গন ও অগনিত নাম না জানা মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের জন্য তাদের বর্তমানকে উৎসর্গ করে গেছেন। আজ তাদের জন্যই আমার মায়ের ভাষায় আজ বিজয় দিবসের প্রাক্কালে আমি এই লেখাটি লিখে যেতে পারছি। আমার এই শ্রদ্ধাঞ্জলি তাদের জন্য এবং যারা বীরত্তের সাথে যুদ্ধ করে এখনো বেঁচে আছেন তাদের জন্য ও। আজ শ্রদ্ধাবনত চিত্তে আমরা সবাই তাদের স্মরণ করছি!!! তোমরা আমাদের জন্য একটি মানচিত্র… ভু-খন্ড … গর্ব করার মত জাতিসত্তা দিয়ে গেছ। এটা রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল আমাদের। জানি না আমরা কতটুকু পারছি? কিন্তু দেশপ্রেমের শক্তিতে উন্মত্ত হয়ে ব্যক্তিসবার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দেবার দৃঢ় অঙ্গীকারের ঘোষণা দেবার সময় এসে গেছে। বিজয় দিবসের এই প্রহর থেকে আসো সবাই প্রতিজ্ঞা করি…

‘… এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পীঠে।
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব-তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপনে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি –
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার। …’

বীরদের কাহিনী থাকুক আমাদের প্রতিদিনের জীবন যুদ্ধের প্রেরণা হয়ে , বিজয়ের আশা হয়ে।।

হানুকা ও আটদিনের উৎসব

হানুকা ও আটদিনের উৎসব

ডিসেম্বর মাসে যেমন বড়দিন বা Jesus christ এর জন্মদিন পালন করা হয় ঠিক তেমনই এই ডিসেম্বরে আরও এক‌টি উৎসব পালিত হয়, তার নাম হানুকা। এটি ইহুদিদের উৎসব। হানুকা শব্দটি হিব্রু শব্দ, যার অর্থ নিজেকে উৎসর্গ করা। এই বছর ২রা ডিসেম্বর এই উৎসব শুরু হয়েছে, চলবে ১০ই ডিসেম্বর পর্যন্ত। আটদিন ধরে এই উৎসব পালিত হয়।

পৌরাণিক ইতিহাস অনুসারে ১৭১ খ্রীষ্ট পুর্বাব্দে সিরিয়া দেশে Antiochus IV Epiphanes নামে এক রাজা রাজত্ব করতেন। রাজাকে ওই সময় অ্যান্টিওকাস এপিফ্যানেস অর্থাৎ দৃশ্যমান ঈশ্বর নামেও ডাকা হতো। তিনি গ্রীক ধর্ম পছন্দ করতেন, তাই তাঁর রাজ্যে গ্রীক ধর্ম প্রচলন করতে চেয়েছিলেন। গ্রীকদের অনেক দেবদেবীর মুর্তি থাকা সত্ত্বেও বারোজন প্রধান দেবতা ছিলেন, এঁরা হলেন- জিউস, হেরা, পোসেইডন, ডিমেটর, এথেনা, অ্যাপোলো, আর্টেমিস, এরিস, অ্যাফ্রোদিতি, হেপাস্টাস, হারমিস, হেস্টিয়া।

ইহুদিধর্ম গ্রীক ধর্মের থেকে একেবারেই আলাদা এক‌টি ধর্ম। ইহুদীরা বিশ্বাস করেন যিহোভাহ অর্থাৎ ঈশ্বর এক নিরাকার। ঈশ্বর পৃথিবীতে তাঁর দূত বা নবীদের পাঠান তাঁর বাণী প্রচার করতে। এইরকম একজন হলেন মোজেস। ইহুদীরা মনে করেন তিনি ছিলেন মালাশী অর্থাৎ সর্বশেষ নবী। ইহুদী মতে যেহেতু ঈশ্বরকে দেখা যায় না তাই এঁদের মন্দিরে কোনো মূর্তি থাকে না। শুধু ঈশ্বরের প্রতীক হিসাবে বিশেষ এক ধরনের বাতিদানে বাতি জ্বালানো হয়। এই বাতিদানকে menorah বলে।

রাজা Antiochus IV Epiphanes এক যুদ্ধে হেরে গিয়ে পালিয়ে জেরুজালেম শহরে আসেন। শহরটি তখন সিরিয়ার অন্তর্গত ছিলো। বর্তমানে ইজরায়েল দেশের অংশ। যুদ্ধ হেরে যাওয়ার জন্য তিনি বেশ রেগে ছিলেন। জেরুজালেমের মত একটি সাজানো ইহুদি শহর দেখে তাঁর রাগ দ্বিগুণ হলো। তখন তিনি সেনাদের আদেশ দিলেন, জেরুজালেম থেকে ইহুদিধর্ম মুছে গ্রীক ধর্মে অনুসারী হোক সবাই। স্যাবাথ নিষিদ্ধ করা হল। দলে দলে ইহুদিদের জোর করে গ্রীক করা হতে লাগল। যারা রাজী হল না তাদের হয় মেরে ফেলা হলো, না হলে ক্রীতদাস করা হলো। মেনেলাউস হলেন ইহুদিদের প্রধান পুরোহিত, সে ইহুদি কম আর গ্রীক বেশি ছিলো। জেরুজালেমকে গ্রীক জীবনযাত্রা, গ্রীক ভাষা এবং গ্রীক নামে ভরিয়ে দেওয়া হল। ইহুদি ধর্মপালন নিষিদ্ধ করে দেওয়া হল। ইহুদি মন্দিরে গ্রীক প্রধান দেবতা জিউসের বিরাট মূর্তি বসানো হলো। মূর্তি জিউসের হলেও, মূর্তির মুখটি রাজা অ্যান্টিওকাসের মতো ছিল। জিউসের মূর্তির সামনে উৎসর্গ হিসেবে শুয়োর বলি দেওয়ার আদেশ দেওয়া হলো। শুয়োর বলি দেওয়ার ফলে ফলে ইহুদিদের মন্দিরটি অপবিত্র হয়ে গেলো।

জেরুজালেমের কাছেই এক গ্রামে ম্যাটাথিয়াস নামে এক ইহুদি ধর্মপ্রাণ পুরোহিত বসবাস করতেন। তিনি জিউসের মূর্তির সামনে শুয়োর বলি দিতে প্রথম অস্বীকার করেন। বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন এবং একজন সিরিয় সৈনিককে মেরেও ফেলেন। তবে তিনি বৃদ্ধ ছিলেন এবং এই ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই মারা যান। তাঁর পাঁচ ছেলে ছিলো। যোহান, সিমন, এলাজার, জোনাথন এবং জুডা। এই পাঁচজন তখন রাজা অ্যান্টিওকাস এবং গ্রীকধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। বিদ্রোহের মূল নেতা ছিলেন ছোটভাই জুডা। তাঁর ডাকনাম ছিল ম্যাকাবি, যার অর্থ হাতুড়ি। তিন বছর ধরে তাঁরা লুকিয়ে চুরিয়ে গ্রীকদের আক্রমণ করতে থাকেন। প্রতিদিনই কিছু ইহুদি লুকিয়ে এসে তাঁর দলে যোগ দিতে লাগল। তিন বছর পর সামনাসামনি যুদ্ধ হলে গ্রীকরা শোচনীয় ভাবে পরাজিত হন। ইহুদিরা সবার আগে জিউসের মন্দির দখল করে সেটিকে আবার ইহুদি মন্দির বানান। মন্দিরে ঢুকে তাঁরা অবাক হয়ে দেখেন যে মার্বেলের মেঝে ফেটে গেছে, ধনরত্ন যা ছিলো সবই চুরি হয়ে গেছে। মন্দিরটি ইহুদি মতানুসারে শুদ্ধ করা হয়।

মন্দিরটি পরিষ্কার করে ইহুদি বিশ্বাসে প্রতি রাতে একটি করে বাতি জ্বালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বাতি জ্বালাতে ব্যবহার করা যেতো একমাত্র বিশুদ্ধ জলপাইয়ের তেল, যা প্রধান পুরোহিতের অনুমোদিত। একমাত্র সেই তেলেই Menorah জ্বালানোর অনুমতি ছিলো। কিন্তু যুদ্ধের পর অনেক খুঁজেও এক বোতলের বেশি এই তেল পাওয়া গেলো না। এই তেল মাত্র এক রাতের জন্য ছিলো। কিন্তু সবাইকে অবাক করে আটরাত আটদিন ধরে menorah জ্বলেছিলো। সেই সময়ের মধ্যে ইহুদিরা আরো অনেক তেল বানিয়ে নিতে পেরেছিলেন। এই আশ্চর্য ঘটনাকে মনে রেখেই আটরাত ধরে হানুকা পালন করা হয়। হানুকার জন্য আলাদাভাবে তৈরি বিশেষ মেনোরার নাম হল হানুকিয়া, অর্থাৎ হিব্রু ভাষায় আটদিন। প্রতি বাতিদানে একটি করে অতিরিক্ত বাতি বা মোমবাতির জায়গা থাকে। তার নাম শামাশ।
ইহুদি ধর্মগ্রন্থ Talmud অনুসারে প্রতি রাতে একটি করে বাতি জ্বালানো হয়। তবে অনেকে একসাথে আটটি বাতিই রোজ রাতে জ্বালান। Christmas এর রঙ বলতে আমরা যেমন লাল আর সবুজ বুঝি, তেমনই হানুকার রঙ হল নীল আর সাদা বা রুপোলী।