বিভাগের আর্কাইভঃ ইতিহাস-ঐতিহ্য

মোবাইল যুগে ডাকবাক্স নিয়ে স্মৃতিকথা


নারায়ণগঞ্জ হাজীগঞ্জ এলাকার কিল্লারপুল সংলগ্ন ড্রেজার সংস্থার গেইটের সামনে ময়লার স্তুপে পড়ে থাকা ডাকবাক্স। ছবি মোবাইল দিয়ে তোলা

একসময় দেশের প্রতিটি পোস্ট অফিসের সামনে, আর গ্রাম গঞ্জের হাট-বাজারের রাস্তার পাশে দেখা যেতো ডাকবাক্স। এখনো সারাদেশ জুড়ে যত্রতত্র দেখা মেলে ডাকবাক্স। তবে আগের মতো ডাকবাক্সের তেমন একটা কদর নেই। আগেকার সময়ে ডাকবাক্সে মানুষ চিঠি ফেলতো। ডাকপিয়ন সময়মত ডাকবাক্সের তালা খুলে চিঠি বের করতো। তারপর চিঠিগুলো একটা বস্তা ভরে নিকটস্থ পোস্ট অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হতো। ডাকপিয়নের হাতে থাকতো একটা হারিকেন, আর একটা বল্লম। পায়ে বাঁধা থাকতো ঘুংগুর। ডাকপিয়ন চিঠির বস্তা কাধে নিয়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে পথ চলতো। আর বলতে শোনা যেতো হুশিয়ার সাবধান! এভাবে রাতবেরাতে ডাকপিয়ন গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে হাঁটতে থাকতো। ডাকপিয়নের গলার আওয়াজ আর পায়ে বাঁধা সেই ঘুংগুরের শব্দে মানুষ ঘুম থেকে জেগে উঠতো।

ডাকপিয়ন কতো বাধা আর ঝড়বৃষ্টি, চোর ডাকাতের ভয় উপেক্ষা করে চিঠির বস্তা পৌঁছে দিতো হেড পোস্ট অফিসে। হেড পোস্ট অফিসের মাধ্যমে চিঠি চলে যেতো দেশের বিভিন্ন জেলাশহরে। পৌঁছে যেতো প্রাপকের কাছে। সেসময় এই ডাকবাক্সের অনেক আদর ছিল, কদর ছিল, যত্ন ছিল। মানুষ চিঠি প্রেরণের জন্য, টাকা পাঠানোর জন্য ছুটে যেতো নিকটস্থ পোস্ট অফিসে। আবার অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে থাকতো ডাকপিয়নের আশায়। লেখাপড়া না জানা মানুষ চিঠি হাতে পেয়ে কেউ আবার হাউ-মাউ করে কাঁদতো। মনে করতো কী যেন দুঃসংবাদ এসেছে। অনেকে খুশিতে হয়ে যেতো আত্মহারা। এখন আর সেইদিন নেই। মানুষ এখন চিঠি বা পত্র লেখা প্রায় ভুলেই গেছে। পোস্ট অফিসেও আগের মতো তেমন ভিড় দেখা যায় না। ডাকবাক্সে মানুষ এখন চিঠি ফেলে না। ডাকবাক্সে পড়ে থাকে ময়লা আবর্জনা আর ধুলোবালি।

একসময় মোবাইল ওয়াপ পদ্ধতির স্মার্ট ফোন নেটওয়ার্ক চালু হবার পর থেকে ডাকবাক্সের কদর কমতে থাকে। সেইসাথে যোগ হয়েছে বর্তমান সময়ের মোবাইল ব্যাংকিং সেবা। তাই হাট-বাজারে, রাস্তার পাশে থাকা ডাকবাক্সে শেওলা পড়তে শুরু করেছে। মানুষ ভুলতে শুরু করেছে চিঠি লেখা। মানুষ একরকম পোস্ট অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। একেবারে যে পোস্ট অফিসে যায় না, তা কিন্তু নয়! যায় অনেকের দরকারি কাজে। তবে বর্তমানে মানুষ যে ডাকবাক্সের ধারেকাছেও যায় না সেটা সত্য এবং বাস্তব।

সেদিন নারায়ণগঞ্জ থেকে আসার পথে কিল্লার পুল সংলগ্ন ড্রেজার সংস্থার মেইন গেইটের সামনে একটা ডাকবাক্স চোখে পড়ে। ডাকবাক্সটি পড়ে আছে অযত্নে অবহেলায়, ময়লা আবর্জনায়। ডাকবাক্সটি ময়লার স্তুপের উপর ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। বাক্সের চারপাশে জঙ্গলে একাকার। দেখে মনে হয় হয়তো মাসে, নাহয় বছরে একবার এই ডাকবাক্সটির তালা খোলা হয়।

একসময় এদেশের প্রতিটি মানুষের কাছে ডাকবাক্স ছিল খুবই সম্মানী বস্তু। এই ডাকবাক্স ছিল অগণিত মানুষের সুখ-দুঃখের সাথি। এসবের জ্বলন্ত সাক্ষী আমি নিজেই। দেখতাম একটা চিঠির অপেক্ষায় আমার মা ডাকপিয়নের বাড়িতেও দৌড়াতে। বাবার প্রেরিত চিঠি মা হাতে পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতো। চিঠি হাতে পেয়ে ডাকপিয়নকে কতনা অনুরোধ করতো, চিঠি পড়ে শোনানোর জন্য।

ছোটবেলার স্মৃতিগুলো এখনো মাঝে মাঝে মনে পড়ে। মনে হয় তখন, যখন একটা পোস্ট অফিসের সামনে অথবা রাস্তার ধারে ডাকবাক্স চোখে পড়ে। ছোটবেলা দেখতাম আমার মা চিঠির মাধ্যমে বাড়ির সুসংবাদ, দুঃসংবাদ বাবাকে জানাতেন। বাবা থাকতেন নারায়ণগঞ্জ। চাকরি করতেন সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন চিত্তরঞ্জন কটন মিলে। মা সংবাদ পোঁছাতেন চিঠির মাধ্যমে। আমার মা লেখা-পড়া জানতেন না। চিঠি লেখাতেন গ্রামে থাকা পাশের বাড়ির শিক্ষিত মানুষ দিয়ে। এখনকার মতন তো শিক্ষিত মানুষ তখনকার সময়ে ছিল না। কোনও কোনও গ্রামে একজন মেট্রিক পাস মানুষও ছিল না। যদি একটা গ্রামে একজন মানুষ ভাগ্যক্রমে মেট্রিক পাস করতো, দু’একটা গ্রামের মানুষ তাকে দেখার জন্য ভিড় জমাতো। আমাদের গ্রামে একই বাড়িতে তিনজন শিক্ষিত মানুষই ছিলেন। তাঁরা তিনজনই ছিলেন স্কুলের মাস্টার। সেই কারণেই তাদের বাড়ির নাম হয়েছিল মাস্টার বাড়ি। তাদের নাম ছিল, দক্ষিণা মাস্টার, প্রমোদ মাস্টার ও সুবল মাস্টার।

মাকে যিনি সবসময় চিঠি লিখে দিতেন, তিনি ছিলেন সুবল মাস্টার। সম্পর্কে নিজেদের আত্মীয়স্বজন। চিঠি লেখাও একটা বিরক্তের কাজ। চিঠি লিখতে হলে সময় লাগে, মন লাগে, ধৈর্য লাগে, তারপর চিঠি লিখা। সব শিক্ষিত মানুষ চিঠি লিখে দেয় না, চিঠি লিখতে পারে না, জানেও না। সুবল মাস্টার সম্পর্কে আমার জেঠা মশাই। আমার বাবার খুড়াতো ভাই (চাচাতো ভাই)। আমার বাবার বয়স থেকে সুবল মাস্টার অল্প কয়েকমাসের বড়। তাই আমার মায়ের ভাশুর। মা জেঠাদের বাড়িতে গিয়ে অনেকসময় ফিরে আসতেন, চিঠি না লেখাতে পেরে। এভাবে দু’তিনদিন যাবার পর একদিন শ্রদ্ধেয় জেঠা মশাই মাকে সময় দিতেন, চিঠি লিখে দিতেন। জেঠা-মশাই কাগজ কলম হাতে নিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করতেন কী ব্যাপারে চিঠি দিবে? মা বলতেন, ঘরে চাল নেই, ডাল নেই, তেল নেই, হাট-বাজার করার মতো টাকা-পয়সাও নেই। এই নিয়েই আপনি সুন্দর করে লিখে দেন, যাতে ওর বাবা বুঝতে পারে।

তখনকার সময়ে শর্টকাট চিঠি লিখতে পোস্টকার্ডই বেশি ব্যবহার করতো। একটা পোস্টকার্ডের মূল্য ছিল মাত্র ১৫ পয়সা। আর একটা ইনভেলাপের মূল্য ছিল মাত্র চার আনা(২৫) পয়সা মাত্র। তখনকার সময়ে দশ পয়সার খুবই মূল্য ছিল। সহজে বিনা দরকারে কেউ পাঁচটি পয়সাও খরচ করতো না। পোস্টকার্ড আর ইনভেলাপের মূল্য দশ পয়সা এদিক সেদিক হওয়াতে মানুষ অল্প কথার জন্য পোস্টকার্ডই বেশি ব্যবহার করতো। পোস্টকার্ডে জেঠা মশাই চিঠি লিখে মাকে পড়ে শুনাইতেন, মা শুনতেন। পোস্টকার্ড বুকে জড়িয়ে বাড়ি চলে আসতেন। পরদিন সকালবেলা আমি স্কুলে যাবার সময় আমার কাছে পোস্টকার্ডটা দিয়ে বলতেন– বাজারে গিয়ে চিঠিটা পোস্ট অফিসের সামনে থাকা বাক্সে ফেলে দিবি! মায়ের কথামত পোস্টকার্ডটা খুব যত্নসহকারে বইয়ের ভেতরে রেখে বাড়ি থেকে রওনা হতাম।

আমাদের বাড়ি থেকে পোস্ট অফিসের দূরত্ব ছিল প্রায় এক কিলোমিটার। বাজারে যাবার রাস্তার পাশেই ছিল স্কুল। চিঠি নিয়ে সোজা বাজারে চলে যেতাম। ডাকবাক্সে পোস্টকার্ডটা ফেলে দিয়ে তারপর আসতাম স্কুলে। স্কুল ছুটি হবার পর বাড়ি আসার সাথে সাথেই মা জিজ্ঞেস করতেন– চিটি বাক্সে ফেলেছিস? বলতাম, হ্যাঁ মা ফেলেছি! এরপর থেকে মা অপেক্ষায় থাকতেন ডাকপিয়নের আশায়। মানে বাবার দেওয়া চিঠির আশায়। কখন আসবে বাবার চিঠি বা মানি অর্ডার করা টাকা। পোস্ট অফিস থেকে (ডাকপিয়ন) যিনি বাড়ি বাড়ি চিঠি পৌঁছে দিতেন, তিনি গ্রামের সবার নাম জানতেন এবং বাড়িও চিনতেন। ডাকপিয়ন আমাদের পাশের গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন।

পোস্ট অফিসে চিঠি বা মানি অর্ডার করা টাকা আসার পরপরই ডাকপিয়ন চিঠি পৌঁছে দিতেন বাড়িতে। বকসিস হিসেবে ডাকপিয়নকে এক টাকা বা লাড়ু-মুড়ি খাওয়াইয়ে আপ্যায়ন করে দিতেন। এতে ডাকপিয়ন সাহেব খুব খুশি হতেন। বাবা যদি মানি অর্ডার করে টাকা পাঠাতেন, তাহলে আমার মা বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেই টাকা রেখে দিতেন। আর যদি টাকার বদলে চিঠি আসতো, তাহলে হাতে পাওয়া চিঠি ডাকপিয়ন সাহেবকে দিয়ে পড়াতেন, না হয় চিঠি নিয়ে দৌড়াতেন মাস্টার বাড়ি। মায়ের চিন্তা শুধু কী সংবাদ এলো চিঠির মাধ্যমে। জেঠা মশাই মাকে দুঃখসুখ নিয়ে বাবার লেখা চিঠি পড়ে শুনাইতেন। মা চুপ করে বসে শুনতেন। সেসময়ে আমার মায়ের মতো এমন আরও অনেক মা ছিল, যারা লেখা-পড়া জানতো না। তাঁরা ডাকপিয়ন থেকে চিঠি হাতে পেলে অনেকেই দুঃচিন্তায় পড়ে যেতো। ভাবতো সুসংবাদ এলো, না দুঃসংবাদ এলো?

এখন আর সেই সময় নেই। চিটির যুগ প্রায় শেষপ্রান্তে এসে গেছে। এখন মোবাইল ফোনের যুগ। কথা হয় মোবাইলে। বিদেশে থাকা প্রিয়জনের সাথে কথা বলার জন্য টেলিফোন এক্সচেঞ্জেও কাউকে যেতে হয় না। জরুরি কোনও সংবাদ টেলিগ্রাফ করতে পোস্ট অফিসে যেতে হয় না। পোস্ট অফিসে গিয়ে লাইন ধরে চিটির খাম ওজন দিয়ে আর রেজিস্টার করতে হয় না। এখন সব কাজ সমাধা হয়ে যাচ্ছে ছোট একটা যন্ত্র মোবাইল ফোনেই। চিঠির মতন লেখা হয় মেসেজের মাধ্যমে। যখন খুশি তখন যেকোনো সময়।

বিদেশ থেকে প্রিয়জনের পাঠানো টাকা আসে ব্যাংকে, আর মোবাইলে। টাকার পরিমাণ এবং কোন ব্যাংকে টাকা পাঠানো হয়েছে, তা মোবাইল মেসেজের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয় প্রিয়জনকে। মোবাইলের মাধ্যমে নিমিষেই সব হয়ে যাচ্ছে। যখন খুশি টাকা উঠানো, টাকা পাঠানো, মোবাইল ফোনে রিচার্জ করার মত সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। এতে ব্যাংকে যাওয়া কিংবা ব্যাংকের লাইনে দাঁড়ানোর বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি মিলছে মানুষের। দিন যত গড়াচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের জনপ্রিয়তাও তুঙ্গে উঠছে। বাড়ছে লেনদেনের পরিমাণও। কদর কমছে পোস্ট অফিস আর ডাকবাক্সের।

মোবাইল ব্যাংকিং জনপ্রিয় হওয়ায় গ্রামীণ জনজীবন অনেক সহজ হয়েছে। এ সেবার মাধ্যমে ঘরে বসেই অনেক কাজ করা যাচ্ছে। বাস, ট্রেনের টিকিট থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতনও পরিশোধ করা যাচ্ছে মানুষের হাতের মুঠোয় থাকা ছোট্ট যন্ত্রটির মাধ্যমে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে যেসব কাজ করা যায় সেগুলো হলো– রেমট্যান্স পাঠানো, ক্যাশ ইন, ক্যাশ আউট। একজনের অ্যাকাউন্ট থেকে অন্যজনের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো। ইউটিলিটি বিল দেওয়া। মোবাইল ফোনের এয়ার টাইম কেনা।

পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে মার্চেন্ট পেমেন্ট। সরকারি প্রতিষ্ঠানে বেতন দেওয়া। পানির বিল পরিশোধ করা। মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ অন্যান্য ভাতা, বিমা প্রিমিয়াম, ডিপিএস দেওয়া যায়। আরও আছে ভিডিও কল। কথা বলার সাথে সাথে প্রিয়জনের ছবি বা ভিডিও দেখা যাচ্ছে মোবাইল স্কিনে। মনে হয় প্রিয়জনের সাথে সামনাসামনি বসে কথা হচ্ছে। এটা ছিল কোনোএক সময়ে মানুষের কল্পনাতীত। কিন্তু এখন তা বাস্তব। এতকিছুর শর্টকাট সুবিধা পাওয়ার পর, কে যায় কষ্ট করে পোস্ট অফিসে? আর কে-ই-বা যায় চিঠি লিখে ডাকবাক্সে ফেলতে? কেউ যাক আর না যাক, হারানো দিনের স্মৃতি হিসেবে যেন ডাকবাক্স সবসময় আমাদের পাশে থাকে, এই কামনাই করি।

KB-01- 00 - Copy

অধিবর্ষের আদি-অন্ত

অধিবর্ষ বা লিপইয়ার
Leap year

২০২০ সালটা হবে লিপইয়ার।
সাধারণ সৌর বছর গুলি ৩৬৫ দিনে হয়ে থাকে, কিন্তু লিপইয়ার হয় ৩৬৬দিন। ফেব্রুয়ারি মাস সাধারণত ২৮ দিনে হলেও লিপইয়ারের এই অতিরিক্ত ১দিন ফেব্রুয়ারি মাসে যোগ করে ২৯দিনে ফেব্রুয়ারি মাস গোনা হয়।

বর্তমানে আমরা যেই ক্যালেন্ডার ব্যবহার কি সেটি হচ্ছে গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার। এই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৪ বছর পর পর ফেব্রুয়ারি মাসে অতিরিক্ত ১টি দিন যোগ করে আমরা তাকে অধিবর্ষ বা লিপইয়ার বলি।

কিন্তু কেন এই লিপইয়ার?

আমরা হিসাব করি ৩৬৫ দিনে এক বছর অর্থাৎ পৃথিবী সূর্যের চার দিকে একবার ঘুরে আসে ৩৬৫ দিনে। কিন্তু বছরের প্রকৃত দৈর্ঘ্য হল ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড , অর্থাৎ পৃথিবীর এই সময়টুকু লাগে সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করতে। তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রতি বছর আমরা ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড সময় পিছিয়ে যাচ্ছি হিসেবে না ধরার দরুন। ফলে ৪ বছর পরে এই বাদ যাওয়া সময়টুকু দাঁড়ায় ২৩ ঘণ্টা ১৫ মিনিট ৪ সেকেন্ড বা প্রায় ২৪ ঘণ্টা। এই প্রায় ২৪ ঘণ্টাকে সমন্বয় করার জন্যই লিপইয়ারের আবিষ্কার।

লিপইয়ারের প্রচলন।

খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০ সালের পূর্বে ধরে নেয়া হয়েছিল ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টায় ১ সৌর-বছর হয়। গ্রীক জ্যোতির্বিদ হিপার্কাস খুব বেশী সম্ভব খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০ সালের দিকে ত্রিকোণমিতির সাহায্যে বের করেন পৃথিবী ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট ১২ সেকেন্ডে সময়ে সূর্যকে একবার ঘুরে আসে।

খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬ সালে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার এবং তার সহকারী জ্যোতির্বিদ সোসিজেনিস ৩৬৫ দিনে এক বছর হবে এবং প্রতি ৪ বছরে ১ দিন যোগ করে ৩৬৬ দিনে বছর গণনা হবে বলে নতুন গণনা পদ্ধতি শুরু করেন। সেটাই আজকের এই লিপইয়ার।

বেচারা ফেব্রুয়ারি

তখনকার নিয়মানুযায়ী বছরের ৭টি মাস হত ৩০ দিনে আর বাকি ৫টি মাস হত ৩১ দিনে। জুলিয়াস সিজার তৎকালীন পঞ্চম মাস কুইন্টালিসকে নিজের নামানুসারে জুলিয়াস নাম দেন, সেইটাই আজকের সপ্তম মাস জুলাই।

জুলিয়াস সিজার তখনকার প্রচলিত মাসের ক্রম পরিবর্তন করে তৎকালীন একাদশ মাস জানুয়ারিয়াস থেকে বছর গণনা শুরু করে। পরবর্তী রোমান সম্রাট অগাস্টাস পূর্ববর্তী ষষ্ঠ মাস সেক্সটিলিস এর নাম পাল্টে রাখেন অগাস্ট।

দুই রোমান সম্রাটই নিজেদের নামের মাস দুটিকে ৩১ দিন করে বরাদ্দ দেন । দুঃখজনক ভাবে এই দুটি দিনই দুই সম্রাট কেটে নেন বেচারা ফেব্রুয়ারির কোঠা থেকে, ফলে ফেব্রুয়ারির ৩০ দিনের দৌড় গিয়ে থেমে যায় ২৮ দিনে। এই জন্যই বেচারা ফেব্রুয়ারির প্রতি দয়া দেখিয়ে লিপইয়ারের অতিরিক্ত ১টি দিন গিয়ে তার ভাগ্যে জোটে।

আরও কিছু সমস্যা

সম্রাট জুলিয়াস সিজার এর তৈরি এই লিপইয়ারও কিন্তু সময়ের সমস্যা পুরোপুরি দূর করতে পারেনি, কারণ সেখানে ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টায় এক সাধারণ সৌর-বছর ধরেছিলেন আর প্রতি চার বছর পরপর ৬×৪ = ২৪ ঘণ্টা বাড়িয়ে ৩৬৬ দিনে লিপইয়ার ধরেছিলেন। ফলে প্রতি বছরেই অতিরিক্ত কয়েক মিনিট যোগ হতে থাকে।

পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরী দেখেন যে ৩৬৫ দিনে বছর ধরলে চার বছরে ২৩ ঘণ্টা ১৫ মিনিট ৪ সেকেন্ড সময় অতিরিক্ত থেকে যায়, আবার ১ দিন বাড়ালেও কিছুটা অতিরিক্ত বাড়ানো হয়।

তিনি হিসাব করে দেখলেন যে ৪০০ বছরে মোট ৯৬ দিন ২১ ঘণ্টা ৫ মিনিট ৪০ সেকেন্ড বাড়ানো দরকার, কিন্তু ৪ দিয়ে বিভাজ্য সাল গুলিকে লিপইয়ার ধরলে দিনের সংখ্যা হয় ১০০টি। দেখা যাচ্ছে ৪০০ বছরে ১০০টি লিপইয়ার না হয়ে ৯৭টি লিপইয়ার হলেই সমস্যা অনেকটাই কাটিয়ে উঠা যায়। তাই তিনি ঠিক করলেন যে সমস্ত সাল গুলি ১০০ দিয়ে বিভাজ্য হবে সেগুলিকে লিপইয়ার হতে হলে অবশ্যই ৪০০ দিয়েও বিভাজ্য হতে হবে। এই হিসাব অনুযায়ী ২১০০, ২২০০, ২৩০০ সাল লিপইয়ার হবে না তবে ২৪০০ সাল লিপইয়ার হবে ।

১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরী হিসাব করে দেখলেন যে, সম্রাট জুলিয়াস সিজারের ক্যালেন্ডারে চলতে চলতে সূর্যের সাথে সঠিক সময় না মানায় আমরা প্রায় ১০ দিন এগিয়ে আছি। তাই তিনি সূর্যের সাথে প্রকৃত সামঞ্জস্য আনার জন্য ক্যালেন্ডার থেকে ১০ দিন বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করেন । কিন্তু তার সেই প্রস্তাব তখন আমলে আনা হয় না, পরবর্তীতে ১৭৫২ সালে যখন ইংল্যান্ডে ক্যালেন্ডার সংশোধন করা হয় ততদিনে ১০ দিনের জায়গায় ১১ দিন বাদ দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। ফলে ১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দে ২রা সেপ্টেম্বরের পরে ১১ দিন বাদ দিয়ে সরাসরি ১৪ সেপ্টেম্বরে চলে যেতে হয়। আর রাশিয়াতে এই সংস্কার করা হয় গত শতকে ১৩ দিন বাদ দিয়ে ।

কিন্তু এখানেই হিসাবের শেষ নয়।
উপরের হিসাবে ৪০০ বছরে মোট ৯৬ দিন ২১ ঘণ্টা ৫ মিনিট ৪০ সেকেন্ড এর বদলে আমরা বাড়িয়েছি ৯৭ দিন। তাহলে ৪০০ বছরে ২ ঘণ্টা ৫৪ মিনিট ২০ সেকেন্ড ঘাটতি রয়ে যায়। এই হিসাবে প্রতি ৩৩০৫ বছরে ১ দিন কম পড়েগ্রেগরীর সংস্কার ১৬০০ সাল থেকে কার্যকর ধরে ৪৯০৫ সালে ১ দিন পুরো হয়ে যাবে। এই ১ দিনকে সমন্বয় করতে ৪৯০৪ অথবা ৪৯০৮ সালকে নন-লিপইয়ার ধরতে হবে । যদি ৪৯০৪ সালের লিপইয়ার বাদ দেওয়া হয় তবে ৪৮৯৬ সালের পর লিপইয়ার হবে ১২ বছর পর ৪৯০৮ সালে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে লিপইয়ারের ২টি সূত্র রয়েছে।
১। যে সালগুলি ৪ দ্বারা বিভাজ্য হবে সেগুলি লিপইয়ার।
২। যে সমস্ত সাল গুলি ১০০ দিয়ে বিভাজ্য হবে সেগুলিকে লিপইয়ার হতে হলে অবশ্যই ৪০০ দিয়েও বিভাজ্য হতে হবে।

ঐতিহ্যবাহী বিবি মরিয়ম সমাধি বা মাজারটি রয়ে গেল লোকচক্ষুর আড়ালে


মোগল আমলে নির্মিত বিবি মরিয়ম সমাধি বা মাজার।

প্রাচ্যের ডান্ডি নামে খ্যাত নারায়ণগঞ্জের ইতিহাস বিশ্বজুড়ে। প্রাচীনকাল থেকেই নারায়ণগঞ্জ সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে সুপরিচিত। নারায়ণগঞ্জে মোগল আমলের স্থাপত্য এখনো অনেক জায়গায় কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারমধ্যে একটি হলো বিবি মরিয়ম সমাধিসৌধ বা বিবি মরয়ম মাজার। এই সমাধিসৌধটি স্থানীয় মানুষের কাছে বিবি মরিয়ম মাজার নামেই সুপরিচিত। বিবি মরিয়ম সমাধি বা মাজারটি নারায়ণগঞ্জের হাজীগঞ্জ এলাকার কিল্লারপুল সংলগ্ন অবস্থিত। নারায়ণগঞ্জ টু ডেমরা-চিটাগাং রোড আসা-যাওয়ার মাঝপথেই বিবি মরিয়ম মাজারটির অবস্থান।

বিবি মরিয়ম মাজারের ভেতরের সামনে থেকে তোলা।

কিল্লার পুল হলো আমাদের নারায়ণগঞ্জের একটা ঐতিহ্যবাহী পুল। যা হাজীগঞ্জ কেল্লার নামে নামকরণের ফলে পুলটির নাম হয় কিল্লার পুল। এই হাজীগঞ্জ কেল্লা নিয়ে এর আগেও একদিন শব্দনীড় ব্লগে আলোচনা করেছিলাম। আজকে বিবি মরিয়ম সমাধিসৌধ বা মাজার নিয়ে কিছু লিখতে চাই। সেই সাথে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই, এই ঐতিহ্যবাহী প্রাচীনতম বিবি মরিয়ম সমাধিসৌধ বা মাজারটির সাথে।

এই বিবি মরিয়ম মাজারের সাথে মিশে আছে আমার আত্মা, মন-প্রাণ সবই। একসময় ভালোলাগা, না লাগার বেশিরভাগ সময়টা কাটাতাম এই পবত্র মাজারটির আশেপাশে। সমায়টা ছিল ১৯৮৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে। যখন কিল্লার পুল ‘ফাইন টেক্সটাইল’ মিলে কাজ করতাম তখন। বিবি মরিয়ম মাজারের সুবিশাল প্রাচীরের পাশেই ছিল ‘ফাইন টেক্সটাল’ মিল। বর্তমানে ফাইন টেক্সটাইল মিল মুন্সিগঞ্জ চান্দের বাজার সংলগ্ন আউটশাহী এলাকায়। সেখানেও কিছুদিন কাজ করেছিলাম। যাক সেসব কথা, আসা যাক বিবি মরিয়ম সমাধিসৌধ বা মাজার প্রসঙ্গে।

বিবি মরিয়ম সমাধি বা মাজারের প্রধান গেইট। এই গেইটের বাইরে ছিল ফাইন টেক্সটাইল মিলস্।

ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, বিবি মরিয়মের সমাধি মুঘল আমলে নির্মিত একটি সমাধিসৌধ। এটি তৎকালীন মুঘল সম্রাট নিয়োজিত সুবেদার শায়েস্তা খাঁন কতৃক নির্মিত বলে ধারণা করে থাকেন ঐতিহাসিকরা । ঐতিহাসিকরা এ-ও ধারণা করেন যে, এই সমাধিসৌধটি ও এর লাগোয়া মসজিদের নির্মাণ কাল ১৬৬৪-৮৮ খৃষ্টাব্দে। সমাধিতে শায়িত ‘বিবি মরিয়ম’কে তৎকালীন বাংলার মুঘল সুবাদার শায়েস্তা খানের কন্যা এবং ইরান দখত এর বোন তুরান দখত হিসেবে মনে করেন।

বিবি মরিয়ম মাজারের ভেতরে থাকা মসজিদ।

সমাধিসৌধটি সুউচ্চ প্রাচির দিয়ে ঘেরা একটি আয়তাকার প্রাঙ্গনের মাঝখানে ভুমি থেকে অনেক উচুতে নির্মিত। বর্গাকার ইমারতটিতে একটি গম্বুজও রয়েছে। এছাড়াও ভবনের চারদিকে খিলান ছাদ বিশিষ্ট বারান্দা আর অনেকগুলো জানালা রয়েছে সমাধিসৌধটিতে। সমাধিসৌধটির কেন্দ্রস্থলে চতুস্কোন কক্ষে রয়েছে তিন ধাপ বিশিষ্ট সমাধি। সমাধিটি শ্বেত পাথরে নির্মিত ও লতা পাতার নকশা অঙ্কিত। এছাড়া ও কবর ফলক ও সমাধি লাগোয়া বারান্দায় বেশ কয়েকটি সাধারণ কবরও রয়েছে, যা সমাধিসৌধটির সামনে গেলেই সবার চোখে পড়ে ।

মাজারের সামনে সারিবদ্ধভাবে থাকা কয়েকটি কবর।

এছাড়াও রয়েছে সমাধিসৌধটির পশ্চিম পাশে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ, যার নির্মাণকাল সমাধিসৌধটির সমসাময়িক অর্থাৎ ১৬৬৪-৮৮ খৃষ্টাব্দে। এটিও শায়েস্তা খাঁন নির্মাণ করেছিলেন বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। তার কারণেই হয়তো সমাধিতে শায়িত ‘বিবি মরিয়ম’ এর নামেই একে ‘বিবি মরিয়ম’ এর মসজিদ নামকরণ করা হয়েছে। সূত্র: উইকিপিডিয়া থেকে।

স্বাধীনতা পরবর্তি সময় থেকে এখানে গড়ে ওঠেছে ‘বিবি মরিয়ম’ সমাধির নামে একটি স্কুল, যার নাম রাখা হয় ‘বিবি মরিয়ম উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়’। চতুর্দিকের প্রাচীর ঘেঁসে স্থায়ীভাবে গড়ে ওঠেছে বহু দোকানপাট। সন্ধ্যা হলেই সমাধিসৌধটি হয়ে পড়ে একটা ভুতুড়ে বাড়ির মতো। সমাধিসৌধটি ছাড়া এর আশেপাশে কোনো লাইট বা কোনো আলোর ব্যবস্থা নেই। সমাধিসৌধ সংলগ্ন মসজিদে লাইট থাকলেও পুড়ো সমাধিসৌধটি জায়গা থাকে অন্ধকার। বিবি মরিয়ম সমাধিসৌধটির চারদিকে স্থায়ীভাবে দোকান-পাট, শিল্প প্রতিষ্ঠান, জনবসতি গড়ে ওঠার কারণে এই ঐতিহ্যবাহী পবিত্র মাজারটি রয়ে গেছে লোকচক্ষুর আড়েলে।

বর্তমানে এটি নিয়ন্ত্রন দেখভাল করছে, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, ঢাকা বিভাগ। কিন্তু বহু প্রাচীনতম এই সমাধিসৌধটির কোনো সংস্কার হচ্ছে না বহুবছর ধারে। যার কারণে সমাধিসৌধটির প্রাচীরের পুরানো ইটগুলিও ধসে পড়ছে। সেইসাথে সমাধিসৌধ বা মাজারটিও। ধারণা করা যায়, যখন এই সমাধিসৌধটি তৈরি করে তখন কোনো সিমেন্টের আবিষ্কার হয় নাই, বা তখন কোনো সিমেন্ট-ই ছিলনা। সেইজন্যই পুড়ো সমাধিসৌধটি চুনা আর সুরখি দিয়ে নির্মিত হয়। তাই অনেক পুরানো স্থাপনা হওয়াতে সমাধিসৌধটির প্রাচীর সহ এর মূল স্থাপনাও শেওলায় ঢাকা পড়ে যায়। একযুগ বা দুই যুগ পরে রাষ্ট্রের সুনজরে শুধু সমাধিসৌধটি কিছুটা সংস্কার হলেও, এর পাশে থাকা স্থাপনাগুলো সংস্কারবিহীন পড়ে থাকে যুগযুগ ধরে। আর মোঘল আমলের নির্মিত ঐতিহ্যবাহী বিবি মরিয়ম সমাধিসৌধ বা মাজারটি পড়ে থাকে আড়ালে আবডালে।

ছবি গত দুইবছর আগে নিজের মোবাইল ফোন দিয়ে তোলা।

মৌণ সঙ্গীত (ঢাকা মহানগরী)

ছবি কথা বলে আবার মাঝে মাঝে নীরবে গানও শোনায়। ঢাকা শহরের তেমনি কিছু সঙ্গীতের সাথে দেখুন তার বিভিন্ন সময়ের কিছু রূপ। আমার বিশ্বাস যা সে নিজেই বলতে পারবে।

1._lead_photo_nawabpur_road_in_1954

1-2

2._pilkhana_area_1880

3._elephant_road_1905

4-2

5-2

6._air_port_area_kurmitola_1964

6-2

7-2

15._bsmmu-_the_then_shahbagh_hotel_1954

21._dhaka_street_in_1975

46._nawab_bari_boat_race_year_unknown

50._paltan_maidan_1950s

1000 Rupee Note-1938

amiruddin-darogahs-mosque-near-to-babubazar-ghat-on-the-bank-of-buriganga-1912

baitul-mukarram-1967-web

book-fair-1987

buriganga-1974

buriganga-from-ahsan-manzil-1974

chawkbazar-iftar-market-1974

dacca-1933-shantinagar-british-army-barrak

Dhaka 1975

Dhaka college-1

Dhaka college-2

dhaka-1887-after-the-tornado

Dhaka-1947 (1)

Dhaka-1947 (3)

Dhaka-1947 (4)

dhaka-1961-people-gathered-in-ramna-race-course-to-see-queen-elizabeth-ii

dhaka-club-1890

dhaka-race-course-1890s

dhaka-stadium-1950

Dhanmondi 1960

Dhanmondi 1960-

dhanmondi-1966-bridge-on-road-7-8

dhanmondi-rd-29-1964

dholai-khal-1870

Dholair khal Lohar pul

dilkhusha_1970s

dilkusha-bhulbhulaiya-garden-1880

eid-in-paltan-maidan-1954-2

eid-prayer-paltan-maidan-1954

farmgate-in-1979

farrukh-siyars-mosque-now-lalbagh-shahi-jaame-mosque-1880

Fulbari Rail Stn- 1947

Gulistan dacca-1963-hall

gulistan-1957

kamlapur-railway-station-1966

Kazi Nazrul Islam in Dhaka

mirpur-1966-gabtoli-haat

motijheel-shapla-chattar-1980s

nawabs-shahbagh-garden-modhur-canteen-dhaka-university-1904

new-bedford-buses-were-launched-dhaka-1966

pallabi-housing-society-mirpur-dhaka-1960s

Picture1

Picture2

Postal in 1947

Race-course-and-ramna-kali-mandir-from-bardhaman-house-bangla-academy-1960

race-course-dhaka-1890

Ramna gate-Now Doel Chattar-1904

sadarghat-area-dhaka-1965

sadarghat-august-1962

sodorghat-1962

stadium-area-bangabandhu-avenue-1960

st-gregory-high-school-1882

tejgaon-1880

Village (1)

Village (2)

Village man

Village

Z1000 (1)

Z1000 (2)

Z1000 (3)

আমার নাবলা কথা এবং ফেবু মেমোরি থেকে একটা পোষ্ট

Ben এর সাথে এক দশকের মধ্যে আমার তিনবার দেখা হয়। সর্বশেষ ২০১৬ এর প্রথম দিকে। তিনবারই আফ্রিকায়; তিনটা ভিন্ন দেশে। সে আমার অনেক সিনিয়র এবং হেডকোয়ার্টারে একজন বিগশট। শেষবার খাবার টেবিলে সে আমাকে একটা প্রশ্ন করেছিল, “সব কথা কী পরিবারের সাথে শেয়ার করেছো?” জবাবে বলেছিলাম, তাঁরা কিছু তো জানেই; ফেইস বুকেও শেয়ার করেছি”। তবে কিছু কথা বলা হয়নি। যুদ্ধের সময়ের কিছু দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা।

আসলে কিছু কথা বলার ইচ্ছে হয়নি। কিছুদিন আগ পর্যন্তও এই ইচ্ছেটা জাগেনি। কিন্তু গত দু’ তিনদিন ধরে কেন জানি সেইসব নাবলা কথা লিখে রাখতে ইচ্ছে হচ্ছে। আজ থেকেই লিখবো ভাবছিলাম। ফেবু ওপেন করে দেখি, মেমোরিতে দুটি পোস্ট। একটা আমার ফেবু ওয়ালে অনলি মি-তে (১৫ নভেম্বর ২০১৭) লেখা একটা কবিতা বইয়ের ড্রাফট রিভিউ। দ্বিতীয়টা পাকিস্তানে এক সন্ধ্যায় সিন্ধ নদ অতিক্রম করার সময় আমার অনুভূতি নিয়ে একটা পোস্ট (১৫ নভেম্বর ২০১২)।

এখন খুব সংক্ষেপে এই সিন্ধ পাড়ে প্রাচীন সভ্যতা, রিসেন্ট ইতিহাস এবং আমার অপূর্ণ ইচ্ছার কথা শেয়ার করতে ইচ্ছে করছে। আফ্রিকার যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতার নাবলা বিষয়গুলি আজ তাই পেন্ডিং রেখে দিলাম।

আমি ইতিহাস খুব কম জানি। কিন্তু প্রাচীনতম ইতিহাসগুলি জানার আমার ভীষণ আগ্রহ রয়েছে। তবে পড়ে পড়ে নয়; দেখে দেখে জানার আগ্রহ। যদি সিন্ধু সভ্যতার কিছু চিহ্ন দেখতে পাই তাই সিন্ধ নদের পাড় ঘেষে গড়ে ওঠা শহরগুলিতে আমি গিয়েছি।

ঐতিহাসিক স্থাপনার জন্য সিন্ধ পাড়ে লারকানা এবং ঠাট্টা উল্লেখযোগ্য ছিল। মহেঞ্জোদারোর কথা তো সবাই জানে। ওটা লারকানা জেলা শহরের কাছে (প্রায় ২০ কিলো দূরে)। দেশটাতে কয়েক বছর ছিলাম। বেশ কবার এটেম্পট নিয়েও লারকানা বা মহেঞ্জোদারোতে যাওয়া হয়নি। এই না যেতে পারার আফসোস আমি এখনো অনুভব করি। তবে ঠাট্টায় গিয়েছি।

করাচী থেকে ঠাট্টায় যাওয়ার কথা বলি। পথে বামপাশে ঝিরক হাসপাতাল। ওখানে নামলাম। আমার আগ্রহের কারণে ওরা আমাকে কায়েদে আযম এর গ্রামে নিয়ে গেল। যতদূর মনে পড়ে ৭-৮ মিনিটের ড্রাইভ। উনার জন্মস্থান নিয়ে দুটি মত থাকলেও ওখানকার গ্রামবাসীরা দৃঢ়তার সাথে জানালো, ওটাই কায়েদে আযম এর জন্মস্থান। তারা আমাকে সিন্ধ নদের একটা ঘাটে নিয়ে গেল যেখানে তিনি (কায়েদে আযম) বাল্যকালে খেলতেন; সাঁতার কাটতেন। সিন্ধের ঐ অংশটা শুকিয়ে একেবারে খালের মতো সরু হয়ে গেছে। উজানে বাঁধের কারণে। ঘাটটায় কিছুক্ষণ বসে থাকলাম এবং ভিন্ন একটা অনুভূতি টের পেলাম।

ঝিরক থেকে ঠাট্টা প্রায় ৪৫ মিনিটের ড্রাইভ। কুড়ি মিনিট ড্রাইভ করার পর পাথরের একটা ঘর দেখলাম। কথিত আছে প্রায় হাজার বারশো বছর আগে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী এক অন্ধ লোক ঘরটা বানিয়েছিলেন। এলাকার লোকদের কাছে ওটা একটা বিস্ময়। ভিতরে যেতে চাইলাম। সবাই মানা করল। কিন্তু কেন? বুঝা গেলোনা।

ঠাট্টা সার্কিট হাউজে রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে ডিসি এবং জেলা এক্সেকিউটিভ হেলথ অফিসারের সাথে দেখা করি। একইদিন শহর প্রান্তে মাক্লি নামক জায়গায় ওয়ার্ল্ড বিগেস্ট সিমেট্রিতে (কবরস্থান) গেলাম। ঠিক মনে নেই, সম্ভবত হাজার বছরের পুরান এই সিমেট্রি। রাজা মহারাজাদের পরিবারের সদস্যদের সাড়ে তিন হাত মাপের ঘর। অসাধারণ দেখতে প্রতিটা কবর। বহুক্ষণ ধরে দেখছিলাম কিন্তু আগ্রহ কমেনি। ওখানে যারা শুয়ে আছেন তাঁদের অনেকেই ইতিহাসখ্যাত। অসাধারণ সব কারুকাজময় হাজার হাজার সমাধি। তাঁদের কেউই সাধারণ ছিলেন না; সবাই পরাক্রমশালী। দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, “পরাক্রমশালী লোকগুলির সাথে ঐ সময়ের চাষামজুরদের এখন পার্থক্য কি? মাটি!

এসব দেখে একই পথে ফিরছিলাম। হায়দারাবাদ শহরে রাত্রি যাপন করব। যখন সিন্ধ নদ অতিক্রম করছিলাম তখন সন্ধ্যা নামে নামে। তখনই এই পোস্টের কথাগুলি আমার অনুভূতিতে আসে। হায়দারাবাদে হোটেলে ওঠে এই ছবি সহ পোস্টটা দিয়েছিলাম। আজ কেন জানি এখানে শেয়ার দিতে ইচ্ছে হল। কেউ “ক্ষণিক আমাকে ভাবে” এই কথাটা পোস্টে লিখেছি; কিন্তু কে সে জানতামনা। অদ্ভূত হিউম্যান সাইকোলজি; যা মানুষ নিজেও নিজেরটা জানেনা!

মেমোরি থেকে ১৫ নভেম্বর ২০১২ র পোস্টঃ
“আজ যখন সিন্ধু নদি অতিক্রম করছিলাম তখন সন্ধ্যা নামে নামে। কিছু পাখি সিন্ধুর জাগা-চরে বসেছিল; আর কিছু ঘরে ফিরছিল। তখন মনে
হয়েছিল আমার একটা নদি আছে-সেখানেও সন্ধ্যা নামে। সেখানে হয়তো কেউ সন্ধ্যাবাতি জ্বালাতে গিয়ে ক্ষণিক আমাকে ভাবে”!

ফুটেছে নাইট কুইন সৌরভ ছুটেছে


হযরত জলিল শাহ-এর মাজারে ফোটা দুর্লভ নাইট কুইন। দেখতে ঠিক পদ্মফুলের মতো।

নারায়নগঞ্জ গোদনাইল হাজারীবাগের হজরত জলিল শাহ মাজারে ফুটেছে দুর্লভ নাইট-কুইন ফুল। দেখতে অনেকটা পদ্ম ফুলের মতো। নাইট কুইন ফুলের রঙ ধবধবে সাদা ৷ মৃদু একটা সৌরভ আছে এই ফুলের। ফুল ফুটে থাকে রাতের শুরু থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত। মধ্য রাত পার হলেই ফুল মিলিয়ে যেতে শুরু করে। আর সেই রাতের অন্ধকারে হয় নাইট-কুইন ফুলের জীবনাবসান। তাই হয়তো এই ফুলের নাম হয়েছে রাতের রাণী নাইট-কুইন (night-queen)। যাকে বলা হয় দুর্লভ একটি ফুল। এর প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, এটা যতটা দুর্লভ ফুল ভাবা হয়, আসলে ততখানি নয়। কিছুটা বিরল ক্যাকটাস জাতীয়।


লম্বা লম্বা পাতায় লতার মতো গাছে দেখা যাচ্ছে সৌভাগ্যের প্রতীক নাইট কুইন ফুল।

জানা যায় নাইট কুইন ফুলটির আদি নিবাস আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চল এবং মেক্সিকোতে। নাইট-কুইনের বৈজ্ঞানিক নাম ( peniocereus greggii )। যার দেখা মেলে গাছ লাগানোর আনেক দিন পর। প্রচলিত ধারণায় এটাকে সৌভাগ্যের প্রতীকও মনে করে থাকে অনেকে। তবে দুর্লভ ফুল হিসাবে নয়, ফুলের চির স্নিগ্ধ শুভ্র-প্রবিত্র রূপকে সবাই বেশি পছন্দ করে। আর নাইট কুইন ফুলের সৌন্দর্য নিয়ে কেউই দ্বিমত পোষণ করে না। নাইট-কুইন ফুল নিয়ে পৃথিবী জুড়ে বহু কাহিনী ছড়িয়ে আছে। সবচেয়ে বিখ্যাত কাহিনীর অবতারণা ঘটেছিল দু’হাজার বছর আগে বেথেলহ্যাম নগরীতে।

m.youtube.com/watch?v=oaGwCSfrk_Q
গতবছর ইউটিউবে আমার আপলোড করা একটা ভিডিও।

তখন নগরীর প্রত্যেক বাড়িতে নাইট-কুইন ফুলগাছ ছিল। এক রাতে ঘটল আশ্চর্যজনক ঘটনা! প্রত্যেক বাড়ি নাইট-কুইন গাছে ফুলে-ফুলে ছেয়ে গেল। এই ঘটনায় কৌতূহলী নগরবাসী এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিল। তাঁরা বুঝে উঠতে পারল না প্রকৃতি কেন এক অজানা উৎসবে মেতে উঠেছে। পরে অবশ্য সবাই আসল ঘটনা বুঝতে পেরেছিল নগরবাসী। সেই রাতে বেথেলহ্যামের ঘোড়ার আস্তাবলে জন্ম হয়েছিল এক মহাপুরুষের। যিনি ছিলেন যিশু খ্রীষ্ট। বেথেলহ্যামের সব নাইট-কুইন সে রাতে মেতে উঠেছিল যিশুখ্রীষ্টের জন্মোৎসবে। এ জন্য আজও অনেকের কাছে এ ফুলটি বেথেলহ্যাম ফ্লাওয়ার নামেও পরিচিত ৷


মাজারে দায়িত্বে থাকা এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব মহিউদ্দিন সাহেব ও সৌন্দর্যের প্রতীক দুর্লভ নাইট কুইন ফুল।

আর আজ থেকে প্রায় বিশবছর যাবৎ এই দুর্লভ নাইট-কুইন ফুলটা নিয়মিত ফুটছে নারায়নগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন গোদনাইল হাজারীবাগ হযরত জলিল শাহ’র মাজার শরিফে। সন্ধ্যার পর-পর প্রবিত্র এই মাজারে প্রবেশ করলেই এই ফুলের স্নিগ্ধ সৌরভে মন-প্রাণ বিচলিত হয়ে উঠে। আমার জানামতে এই দুর্লভ নাইট-কুইন ফুলটি নারায়নগঞ্জের আর কোথাও নেই। গাছের পাতা থেকে ফুলের কলি, তারপর ফুল। আবার পাতা থেকে গাছের জন্ম। পাতা মাটিতে পরলেই কিছুদিন পর আস্তে আস্তে পাতা থেকে শিকড় গজায়। এরপর হয় গাছের জন্ম। গাছগুলো লম্বা লম্বা পাতায় লতা আকৃতির হয়ে থাকে।


এবার শুরুতেই অনেক নাইট কুইন ফুল ফুটেছে। যা গতবছরের চেয়েও অনেক বেশি।

এই মাজার শরিফ থেকে অনেকেই নাইট-কুইন ফুল গাছের পাতা নিয়ে রোপণ করেছিল ফুল জন্মানোর আশায়, কিন্তু হয় নাই। এই মাজার শরীফের ওরশ মোবারক প্রতি বছর তিনবার হয়ে থাকে, যথাক্রমে পহেলা ফাল্গুন, আটাশে ভাদ্র, একুশে কার্তিক। ওরশ উপলক্ষ্যে এই মাজারে বহু লোকের সমাগম ঘটে। এই মাজারের ওরশ মোবারক উপলক্ষ্যে সবচেয়ে বেশি লোকের সমাগম ঘটে একুশে কার্তিক। কারণ শুধু একটাই, তা হলো এই দুর্লভ নাইট কুইন ফুলের জন্য। আগত লোকজনের দৃষ্টি থাকে এই নাইট কুইন ফুলের দিকে। প্লাস্টিকের বড় ড্রাম আকারের টবে সারিবদ্ধভাবে রাখা ফুল সহ গাছগুলো খুব সুন্দর দেখা যায়।

শিবলিঙ্গ নিয়ে ভুল ধারনা দূর হোক


দূর হোক শিবলিঙ্গ নিয়ে মানুষের ভুল ধারনা।

আমরা সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী বলে বর্তমানে এই উপমহাদেশে আমারা ‘হিন্দু’ নামে পরিচিত। তাই এদেশের কিছুকিছু মানুষ যখন-তখন বলে ফেলেন, চাড়াল, মালাউন, ডেডাইয়া, বিধর্মী। তার মানে হলো, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একরকম ঘৃণার চোখেই দেখা। দৈনন্দিন জীবন চলার মাঝে মুসলমান বন্ধুরাও অনেকসময় অনেক প্রশ্ন করে বসে থাকেন। কেউ কেউ প্রশ্ন করে সনাতন ধর্মের মানুষের মৃত্যু হলে পোড়ায় কেন? বারোমাসে তেরো পূজার নাম কী? ৩৩কোটি দেবতার নাম জানা আছে? লিঙ্গপূজা করা হয় কেন এবং কী কারণে করা হয়? এতো টাকাপয়সা খরচ করে মাটি দিয়ে মূর্তি বানিয়ে পূজা করে আবার ফেলে দেওয়া হয় কেন ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার অনেকেই মনে করে থাকেন, হিন্দু ধর্ম হচ্ছে শুধু মূর্তিপূজা এবং হরিনাম সংকীর্তন করাই হিন্দু ধর্মের মূলমন্ত্র। যা নিত্যান্তই একটি ভুল ধারণা।

তবে এই সনাতন (পুরাতন বা প্রাচীন) ধর্মের ভিত্তি বৈদিক শাস্ত্রের কোথায়ও ‘হিন্দু’ শব্দটির উল্লেখ নেই। এই হিন্দু শব্দটি আধুনিক কালে (ঊনবিংশ শতাব্দীতে) সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করা হয়। বা কালক্রমে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে সনাতন ধর্মকে ‘হিন্দু ধর্মে’ পরিণত করা হয়েছে বলে ধারনা করা হয়। ‘হিন্দু’ একটি নির্দিষ্ট জাতি! ‘হিন্দু ধর্ম’ বলতে বোঝায়, হিন্দু জাতির ধর্ম!

জানা যায় ‘হিন্দু’ শব্দের উৎপত্তি প্যারসিক শব্দ থেকে। প্রাচীন কালে নাকি প্যারসিক বলা হত ইরানিদের। হিনস্‌র ভাষায় ‘হিন্দু’ শব্দের অর্থ হল যিনি হিংসা করে না। অতএব যিনি হিংসা করে, তিনি হিন্দু হতে পারে না। অথচ এই হিংসা আর অহংকারে আজ সনাতন ধর্ম তথা হিন্দু ধর্মের অস্তিত্ব দাঁড়িয়েছে শূন্যের কোঠায়। হিংসা আর অহংকার করে বড়বড় পণ্ডিতরাও মানুষকে সঠিক তথ্য দেয় না। মন্দিরে থাকা পুরোহিতের কাছে কেউ ধর্ম বিষয়ে বুঝতে চাইলেও বোঝায় না। আবার নামকরা গুরুদেবরা থাকে শুধু মানুষকে মন্ত্র দিয়ে শিষ্য বানানোর ধান্ধায়ই থাকে ব্যস্ত। যত শিষ্য তত সুনাম, তত তার বাৎসরিক মুনাফা। অথচ ধর্ম বিষয়ে কেউ কিছু জানতে চাইলে গুরু, মহাগুরু, পুরোহিত আর পণ্ডিতেরা বলেন, “এখনো বোঝার জ্ঞান হয় নাই! গুরুর নাম নিতে হবে, তা হলেই আস্তে আস্তে বুঝতে পারবে।”

গুরু মহাগুরুদের এসব কথায় উপর বিশ্বাসী হয়ে সাধারণ মানুষ আর বিশেষ কোনও তথ্য ঘাঁটতে চায় না। গুরুদেবের কথার মাঝেই থেকে যায়। অজানা থেকে যায় ধর্মের তথ্য। তথ্য বা এর মূল ব্যাখ্যা না জানার করণে, আজ বেশিরভাগ মানুষই ‘হিন্দু ধর্ম’ বিষয়ে রয়ে গেছে অজ্ঞ। বৈদিক শাস্ত্রের কোথায়ও কোন জাতি, গোষ্ঠী, বর্ণ বা সমাজের ধর্ম হিসেবে সনাতন ধর্মকে অভিহিত করা হয়নি। অভিহিত করা হয়েছে মানব জাতির বা জৈব ধর্ম (জীবের ধর্ম) বা আর্য ধর্ম হিসেবে। আর এই ‘হিন্দু’ নামের কোনও শব্দ কোনও শাস্ত্রগ্রন্থে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাহলে এই হিন্দু শব্দটা আসলো কোথা থেকে? মূলত ‘আর্য’ ধর্মের পরিবর্তিত নাম হল ‘হিন্দু’ ধর্ম।

আর্য হিন্দুদের আদি-নিবাস ছিল, ইরানের ইউরাল পর্বতের পাদদেশের দক্ষিণে তৃণভূমি অঞ্চলের কিরঘিজিস্তান নামক স্থানে। কোনও একসময় আর্য জনগোষ্ঠী কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ/ ভূমিকম্প অথবা অন্য গোত্রদের আক্রমণের কারণে ইরান থেকে বিতাড়িত হয়। এরপর আর্য ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী ভারতীয় উপমহাদেশের দিকে অগ্রসর হয় এবংবর্তমান ভারতর্ষে বসতি স্থাপন করেন। আশ্রয় নেয় সিন্ধু নদীর পাড়ে, তখন তাদের পরিচয় ছিলো ‘সিন্ধু’ নামে। কিন্তু তখনকার সমর অনেকেই সিন্ধু শব্দ উচ্চারণ করতে পারতো না। উচ্চারণ হতো ‘স’ এর পরিবর্তে ‘হ’। তাই সিন্দুর বদলে বলতো হিন্দু। সে থেকেই আজ অবধি এই ‘হিন্দু’ নামেই বিশ্বের কাছে পরিচিত। তাই সেই প্রাচীনকাল থেকে আমরা বর্তমান হিন্দু ধর্মাবলম্বী সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী। সে সাথে মূর্তিপূজা ও বিভিন্ন দেবদেবীর পূজার্চনায়ও বিশ্বাসী। আর প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা ৩৩কোটি দেবতাকেই আমরা কেউ-না-কেউ স্মরণ করে থাকি। তবে সংস্কৃতে কোটি শব্দের দুটি অর্থ, একটি হল ‘সর্বোচ্চ’ এবং অপরটি হল ‘কোটি’ (Crore)। বেদে তেত্রিশ কোটি (সংস্কৃত: ত্রয়স্তিমাশতি কোটি) দেবতা বলতে বেদে তেত্রিশ রকমের দেবতার কথা বলা হয়েছে। শতপথ ব্রাহ্মণ এবং অন্যান্য গ্রন্থে এটি পরিষ্কার ভাবে ব্যখ্যা করা হয়েছে। অথর্ব বেদের দশম অধ্যায় সপ্তম সুক্তের ত্রয়োদশ শ্লোকে বলা হয়েছে-
যস্য ত্রয়স্ত্রিংশদ্ দেবা অঙ্গে সর্বে সমাহিতাঃ।
স্কম্মং তং ব্রুহি কতমঃ স্বিদেব সঃ।।

অর্থাৎ, পরম ঈশ্বরের প্রভাবে এই তেত্রিশ জন দেবতা বিশ্বকে বজায় রেখেছে।

শুরুতে ঋক্ বেদে তিন (৩) রকমের দেবতার কথা বলা হয়েছিল। এনারা ছিলেন- অগ্নি, বায়ু এবং সূর্য্য। ঋক্ বেদে পরবর্তী অধ্যায়ে সেই দেবতার সংখ্যা বেড়ে তেত্রিশ (৩৩) রকমের হয়। এনাদের মধ্যে এগারো জন পৃথিবীতে, এগারো জন বায়ুতে এবং বাকি এগারো জন মহাকাশ বা অন্তরিক্ষে অবস্থান করছেন।

এই সনাতন ধর্মের প্রকৃত রূপ উন্মোচনের জন্য আমাদের কতকগুলি ধর্মগ্রন্থ আছে। যে ধর্মগ্রন্থগুলি পাঠ করা প্রত্যেক হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য আবশ্যক। ধর্মগ্রন্থগুলি হলো– ১। বেদ-৪টি (ঋকবেদ, সামবেদ, যর্জুবেদ, অথর্ববেদ) ২। উপনিষদ-১০৮টি ৩। গীতা-১টি (৭০০শ্লোক) ৪। ভাগবত-১টি (১৮,০০০শ্লোক) ৫। মহাভারত-১টি (৬০,০০০শ্লোক) ৬। পুরাণ-১৮টি ৭। রামায়ণ-১টি
৮। চৈতন্য চরিতামৃত-১টি
এই গ্রন্থগুলোর পাঠ করলে জানা যাবে সনাতন ধর্মের কলেবর কতো বিশাল আর জ্ঞানগভীর। তবে রামায়ন আর মহাভারতে বৈদিক যুগের ইতিহাস লিপিবদ্ধ। ধর্মের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পেতে আমাদের আশ্রয় নিতে হবে ভাগবতের। তবে উল্লেখিত প্রতিটি গ্রন্থই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং নিত্যপ্রয়োজনীয়ও বটে। তবে আমি আর্য/হিন্দু ধর্ম নিয়ে কোনও আলোচনা করছি না। আমি শুধু শিবরাত্রি বা শিবলিঙ্গ পূজা নিয়ে কিছু আলোচনা করতে চাই।

কথিত আছে আমাদের চারপাশ ঘিরে আছে তেত্রিশ কোটি দেবতা। আসলে কিন্তু ৩৩কোটি নয়, ৩৩ রকমের দেবতা। জানা নেই, ৩৩ রকমের দেবতার পূজার বিধানও। শুধু হাতেগোনা কিছুসংখ্যক দেবদেবীর পূজার্চনাই আমরা করে থাকি। এক কথায় যাকে বলে বারমাসে তেরো পূজা। তারমধ্যে একটি আলোচিত পূজার নাম হলো ‘লিঙ্গ’ পূজা। যে পূজা শুদ্ধভাবে বলা হয় ‘শিবলিঙ্গ’ পূজা বা শিবরাত্রি। আর ‘লিঙ্গ’ পূজা নামে যেই শব্দটি প্রচলিত, তা আসলে বিকৃত শব্দ। এই পূজাটি বছরে ১৬টি সোমবারে অনেকেই করে থাকে। তবে শিবের নামে যেই পূজাগুলো হয়ে থাকে, তা হলো ‘শিব পূজা’, শিবরাত্রি বা শিবলিঙ্গ পূজা।

শিবরাত্রি:
সব ব্রতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হল এই মহাশিবরাত্রি। এই মহাশিবরাত্রি ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণ পক্ষের চতুর্দশী তিথিতে পালিত হয়। মহাশিবরাত্রি হল হিন্দুধর্মের সর্বোচ্চ আরাধ্য দেবাদিদেব মহাদেব শিবের মহারাত্রি। ব্রত/পূজার আগের দিন ভক্তগণ নিরামিষ আহার করে। রাতে বিছানায় না শুয়ে মাটিতে শোয়া হয়। ব্রতের দিন তারা উপবাসী থাকে। তারপর রাত্রিবেলা চার প্রহরে শিবলিঙ্গকে দুধ, দই, ঘৃত, মধু ও গঙ্গাজল দিয়ে স্নান করানো হয়। তারপর বেলপাতা, নীলকন্ঠ ফুল, ধুতুরা, আকন্দ, অপরাজিতা প্রভৃতি ফুল দিয়ে পূজা করা হয়। আর ‘ওঁ নমঃ শিবায়’ নমঃ, এই মহামন্ত্র জপ করা হয়। ছোটবেলায় আমার মা-বোনদেরও এই শিবরাত্রি ব্রত করতে দেখেছি। শিবরাত্রি সবচেয়ে বেশি জাঁকজমকভাবে শিবরাত্রি উদযাপন করা হয়, হিন্দু রাষ্ট্র নেপালে।

এই নিয়ে দৈনন্দিন জীবন চলার মাঝে অনেক মুসলিম বন্ধুদের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। তারা অনেকে একে পুরুষাঙ্গের পূজা হিসেবে ব্যাখ্যা করে অশ্লীলতা বলে মনে করেন। তা একেবারেই ভুল ধারণা আর এটা একরকম তাদের মনগড়া কথাই বলা চলে। অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও এর মূল তথ্য জানে না। না জানার করণেই, প্রশ্নকারীর প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারে না। তখন প্রশ্নকারী নিজেই এর ভুল ব্যাখ্যা দিতে থাকেন। আর উত্তরদাতা উত্তর না দিতে পেরে লজ্জায় বরফ হয়ে যায়। আসলে এখানে কোনও অশ্লীলতার ছোঁয়া নেই, লজ্জার কোনও ব্যাপারও নেই। আছে শুধু অনেককিছু দেখার ও বোঝার। হিন্দু ধর্মে শিবকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বলে মনে করা হয়। কাজেই তার শিবলিঙ্গ যে দেবতা শিবের প্রতীকী পূজা, তা বোঝা প্রয়োজন।

শিবলিঙ্গ:
শিব কথার অর্থ, সত্য, সুন্দর ও মঙ্গল। আর লিঙ্গ কথার অর্থ, প্রতীক। এ হলো হিন্দুদের দেবতা শিবের একটি সত্যে ও মঙ্গলের প্রতীক চিহ্ন। শিবকে এই প্রতীকের সাহায্যেই প্রকাশ করা হয়। শিব থাকেন ব্রহ্মের ধ্যানে লীন, আর সব মানুষকেও ব্রহ্মের প্রতি ধ্যানমগ্ন হতে উপদেশ দেন। শিব লিঙ্গের উপরে ৩টি সাদা দাগ থাকে যা শিবের কপালে থাকে। তাই শিবলিঙ্গ যদি কোন যৌনইন্দ্রিয় বুঝাত, তা হলে শিবলিঙ্গের উপরে ঐ ৩টি সাদা তিলক রেখা থাকত না। এখানেও অনেকের অনেককিছু বোঝাবার প্রয়োজন বলে মনে করি।

শিবরাত্রি বা শিবলিঙ্গের পূজা হিন্দুদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। যেসব শিব মন্দিরে শিবলিঙ্গের মূর্তি তৈরি করা আছে, সেসব মন্দিরে পূজা হয়। এই পূজাটির প্রচলন বহু প্রাচীন যুগ থেকেই ভারত-সহ বাংলাদেশেও প্রচলিত রয়েছে। আর এই শিবলিঙ্গ পূজার রীতি সম্পর্কেও রয়েছে অনেক ভুল ধারণা। অনেক মানুষ সোজা কথায় বলে ফেলে লিঙ্গ পুজা। আসলে এটি লিঙ্গ পূজা নয়, এটি দেবতা শিবের প্রতীকী পূজা বা শিবরাত্রি পূজা। এই শিবরাত্রিতে শিবলিঙ্গে জল, দুধ, ঢালা হয় বলে অনেকে ভুল বুজে নানা কুৎসা রটায়।

গুণীজনরা শিবলিঙ্গকে মোট তিনভাগে ভাগ করে এর আলাদা আলাদা নামও দিয়েছে।
১। সবচেয়ে নীচের চারমুখী অংশটি থাকে মাটির নীচে।
২। মাঝখানের অংশটি আটমুখী, যা বেদীমূল হিসেবে কাজ করে।
৩। উপরের অর্ধবৃত্তাকার অংশটি পূজিত হয়।

এই তিনটি অংশের সবচেয়ে নীচের অংশটি ব্রহ্মা, তার উপরের অংশটি বিষ্ণু ও একেবারে উপরের অংশটি শিবের প্রতীকী চিহ্ন। বেদীমূলে একটি লম্বাকৃতি অংশ রাখা হয়, যা শিবলিঙ্গের মাথায় ঢালা জল বেরিয়ে যেতে সাহায্য করে। এই অংশের নাম গৌরীপট্ট, যা মূলত যোনিপ্রতীক। যেই পথ অনুসরণ করে পৃথিবীতে আসেছি আমরা সবাই। আসেছে মুনি মহামুনিগণ, আসেছে রাজা বাদশা আর ফকির সাধু গুরু মহাগুরুও। শিবলিঙ্গ পূজার মধ্যে কোনও অশ্লীলতা নেই। শিবলিঙ্গ একই সঙ্গে শিবের সৃজনাত্মক ও ধ্বংসাত্মক রূপের প্রতীক। শিবলিঙ্গ ব্রহ্মাণ্ডের প্রতীক আর সত্যের প্রতীক। শিবলিঙ্গ যেহেতু ব্রহ্মাণ্ডের প্রতীক, সেহেতু ‘লিঙ্গ’ শব্দটির অর্থ কিন্তু পুরুষাঙ্গ নয়, বরং একটা প্রতীকী চিহ্ন মাত্র।

সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা প্রচলিত বিশ্বাস হল এই যে, এই শিব লিঙ্গ পূজা শুধু অবিবাহিত মেয়েরাই করে থাকে। কিন্তু না, অবিবাহিত আর বিবাহিত মেয়েরা শিবলিঙ্গের কাছে যাওয়াও অনুচিত। কারণ, মেয়েদের শরীর সবসময় পবিত্র থাকে না, তাই। আবার নারীই পুরুষের ধ্যানভঙ্গের প্রধান কারণ বলে বিবেচিত। কুমারী নারীর সান্নিধ্যে পুরুষের চিত্তবিচলন ঘটার সম্ভাবনা আরও বেশি। সেই পুরুষ সাধু হলেও নিয়ম অন্যরকম নয়। কাজেই শিবের কাছাকাছি যাওয়ার ব্যাপারে কুমারী মেয়েদের কিছু বিধিনিষেধ আছে।

আর যেসব জায়গায় বসে দেবতা শিব ধ্যান জপতেন, সেই জায়গাগুলি ছিল অত্যন্ত পবিত্র। শিবের ধ্যানক্ষেত্রের আশেপাশে স্বয়ং দেবতাদেরও প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। কারণ, সকলকেই খেয়াল রাখতে হত, শিবের ধ্যানে যাতে কোনওভাবে বিঘ্ন না ঘটে। শিবের ধ্যানে কোনওরকম বাধা পড়লেই শিব অসন্তুষ্ট হবেন। আর শিব একবার অসন্তুষ্ট হলে মহাবিপদ। এমনিতেই শিব হলেন, ধ্বংসলীলার দেবতা, তিনি অসন্তুষ্ট হলে মুহূর্তেই ধ্বংসলীলায় পতিত হবে পৃথিবী।

তাই বলে কি মেয়েদের শিব পূজায় কোনও নিষেধাজ্ঞা আছে? না। এখনো ভারতসহ বাংলাদেশের বহু কু‌মারী মেয়েরা দেবতা শিবের পূজা করে। তারা শিবরাত্রি/শিবলিঙ্গকে অনুস্মরণ করে ১৬টি সোমবারে ব্রত করে থাকেন। ফাল্গুন মাসের শিবরাত্রি ছাড়াও এই শিবের পূজা মেয়েরা বারোমাসই করে। শিবের ব্রত করার সময় মেয়েরা উপবাস রাখেন। পণ্ডিতরা বলেছেন, শ্রাবণ মাসে এই ব্রত রাখলে নাকি বিশেষ উপকার পাওয়া যায়। বিবাহিত মেয়েরা শিবরাত্রি বা শিবলিঙ্গ পূজা করে স্বামীর সুখ আর আয়ু বৃদ্ধির জন্য। আর অবিবাহিত মেয়েরা পূজা করে তার জীবনে একটা শক্তিমান ও আদর্শবান পুরুষ আসার কামনায়। পৃথিবীর সব ধর্মের অবিবাহিত মেয়েরাই চায়, তার জীবনে একজন সৎ এবং আদর্শবান পুরুষ আসুক। তাই সারা দুনিয়ার হিন্দু ধর্মের অবিবাহিত মেয়েরা শিবরাত্রি বা শিবলিঙ্গ ব্রত/পূজা করে। আগে এবং বর্তমানেও শিবলিঙ্গের পূজা সারা ভারত-সহ বাংলাদেশেও জনপ্রিয়। শুদ্ধ পঞ্জিকা মতে প্রতিবছর নির্ধারিত দিনে শিবরাত্রি / শিবলিঙ্গের পূজা করা হয়।

আমি ১৪০০ বাংলা সনের প্রথম দিকে একবার ভারতে গিয়েছিলাম। সেখানে অবস্থান করেছিলাম প্রায় বছর দেড়েকেরও বেশি। সেখানে থাকা অবস্থায় দেখেছি সেখানকার শিবরাত্রি উদযাপনের দৃশ্য। সেখানকার মানুষের মুখে শুনেছি, দিল্লি, চেন্নাই, হরিয়ানায় খুবই জাঁকজমকভাবে এই দিবসটি পালিত হয়। শিবের পূজার দিনে মেয়েরা পু‌রুষদের সাহায্যকারী হিসেবেও কাজ করেন‌। যেমন, ধোয়ামোছা, শঙ্খ বাজানো, উলুধ্বনি দেওয়া।
আবার আমাদের দেশেও দেখা যায়, মেয়েরা স্নানের পর, শিবলিঙ্গের মাথায় জল ঢেলে ভক্তি দেয়। মেয়েদের শিবভক্তির নানা উল্লেখ রয়েছে শিব পুরাণেও। শিবকে সন্তুষ্ট করতে পারলে নাকি মেয়েরা শিবের মতোই শক্তিমান ও আদর্শবান স্বামী লাভ করেন।

পরিশেষে:
বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে হাতে-হাতে মোবাইল ফোন। থাকে ইন্টারনেট সংযোগের সুবিধা। আর ইন্টারনেট মানে হলো সারা দুনিয়া ভ্রমণ করা। ইন্টারনেট মানে হলো তথ্যের ভাণ্ডার থেকে তথ্য সংগ্রহ করা। তথ্য সংগ্রহ করা মানে না জানা অনেককিছু জানা। এই ইন্টারনেট গুগল-এ অথবা ইয়াহুতে সার্চ করলেই পৃথিবীর সবকিছুই সহজে জানা যায়, দেখা যায়। তবু আমরা সঠিক তথ্যের দিকে না তাকিয়ে মনগড়া কথা বলে বিভ্রান্তি ছড়াই। সৃষ্টি করে তুলি দাঙ্গাহাঙ্গামা, ছোট করি একে অপরের ধর্মকে। তাই সবশেষে আবারও বলছি, হুন্দু ধর্মে বা আর্য ধর্মে একক শব্দ ‘লিঙ্গ’ পূজার কোনও অস্তিত্ব নেই। আছে ‘শিবরাত্রি বা শিবলিঙ্গ’ ব্রত/পূজা।

অথচ এমন একটা সত্যকে আড়ালে রেখে, কিছু মানুষ এই পূজাকে নানাভাবে কলঙ্কিত করছে। দিচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন বানোয়াট তথ্য, রটাচ্ছে অকথ্য কথ।বিশ্ববিখ্যাত সার্চ ইঞ্জিন গুগলে সার্চ করলেই দেখা যায়, এই পূজা বিষয়ে নানাধরনের কথা। দেখা যায় বর্তমান যুগের স্বাদের ফেসবুক পেইজেও। যাই হোক কেউ জেনেও নিন্দা করে, আবার কেউ না জেনে না শুনেও নিন্দায়। আসল ঘটনায় খুব কম মানুষেই তাকায়। আশা করি মহান সৃষ্টিকর্তা সবাইকে বোঝবার শক্তি দান করবেন। তার দয়ায় দূর হবে শিবলিঙ্গ নিয়ে মানুষের ভুল ধারনা। সবাই বুঝবে যেখানে সত্য, সেখানেই শিব। যেখানে শিব, সেখানেই সুন্দর। যেখানে সত্যের প্রতীক, সেখানেই ‘শিবলিঙ্গ’।
সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্

লেখার বিস্তারিত হিন্দু ধর্মবিষয়ক তথ্য বিভিন্ন অনলাইন সাইট এবং শিব পুরাণ থেকে সংগৃহীত।
ছবি ইন্টারনেট থেকে।

অযত্নে অবহেলায় মোগল স্থাপত্য ঐতিহ্যবাহী হাজীগঞ্জ কেল্লা


আড়ালে পড়ে থাকা নারায়ণগঞ্জের হাজীগঞ্জ দুর্গ বা হাজীগঞ্জ কেল্লা।

প্রাচ্যের ডান্ডি নামে খ্যাত নারায়ণগঞ্জে রয়েছে মোগল আমলের অনেক স্থাপনা। তার মধ্যে একটি হলো হাজীগঞ্জ দুর্গ বা হাজীগঞ্জ কেল্লা দুর্গটি রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি নারায়ণগঞ্জ থেকে চিটাগাং রোড যেতে মাঝপথে নবীগঞ্জ গুদারাঘাটের একটু সামনেই, হাজীগঞ্জ ফায়ার ব্রিগেডের পরই হাজীগঞ্জ দুর্গ বা হাজীগঞ্জ কেল্লাটির অবস্থান। নারায়ণগঞ্জ সিটির হাজীগঞ্জ এলাকায় শীতলক্ষ্যার পশ্চিম তীরেই এই ঐতিহ্যবাহী কেল্লাটি অযত্নে অবহেলায় এখনো কালের সাক্ষী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।

কোনো একসময় এটি খিজিরপুর দুর্গ নামেও সবার কাছে পরিচিত ছিল। নারায়ণগঞ্জ-চিটাগাং রোড ভায়া ডেমড়া আসা যাওয়ার মাঝেই এই কেল্লাটি সবার চোখে পড়ে। দেশ স্বাধীন হবার আগে থেকে এই কেল্লাটির চারপাশে গড়ে উঠেছিল টিনশেড পাটের গোডাউন। সেসময় নারায়ণগঞ্জ পাট ও বস্ত্রশিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। এখন সেই নাম-কাম না থাকলেও, কেল্লাটির চারপাশে গোডাউনগুলো এখনো দিব্বি রয়ে গেছে। পাটের নামগন্ধ নেই, অথচ গোডাউনগুলো চলছে ভাড়ায়। টিনশেড গোডাউন গুলোর জন্য মোগল আমালের প্রাচীনতম এই স্থাপনাটি অনেকেরই চোখে পড়ে না। কাজেই ইতিহাস ঐতিহ্যের সৌন্দর্য হারাতে বসেছে মোগল স্থাপত্য এই কেল্লাটি।

জানা যায়, কোনও একসময় ঢাকা শহর কে রক্ষা করতে এই কেল্লাটি নির্মাণ করেছিলেন। সপ্তদশ শতকের আগে পরে যে তিনটি জল দুর্গকে নিয়ে ত্রিভূজ জল দুর্গ বা ট্রায়াঙ্গল অব ওয়াটার ফোর্ট গড়ে তোলা হয়েছিল। তারই একটি হলো এই হাজীগঞ্জ দুর্গ বা কেল্লা। সম্ভবত মুঘল সুবাদার ইসলাম খান কর্তৃক ঢাকায় মুঘল রাজধানী স্থাপনের পরে নদীপথে মগ ও পর্তুগীজ জলদস্যুদের আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে এই দুর্গটি নির্মিত হয়েছিল। জলদুর্গের বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত দুর্গটি শীতলক্ষ্যার সঙ্গে পুরাতন বুড়িগঙ্গার সঙ্গমস্থলে নির্মিত হয়। কেল্লাটি চতুর্ভূজাকৃতির। কেল্লাটিতে চার পাঁচটি প্রবেশদ্বার আছে। প্রবেশদ্বারগুলো দেখে মনে হয়, রাজা, বাদশাহ বা সম্রাটরা নৌযান থেকে নেমেই; খুব অল্পসময়ের মধ্যেই কেল্লায় পৌঁছে যেতে সক্ষম হতো।

কেল্লাটি সুউচ্চ প্রাচীর ঘেরা। প্রাচীরের ভেতরের সাইটে প্রায় তিন হাত চওড়া সরু রাস্তার মতো আছে। মনে এই রাস্তা দিয়ে সৈন্যদল হাঁটতো আর কেল্লার বাইরে নজর রাখতো। প্রাচীরে রয়েছে বন্দুক ঢুকিয়ে গুলি বা বল্লম ছোড়ার উপযোগী ফোকর। আরও আছে চারকোণে গোলাকার বুরুজ। চারকোণের প্রতিটি বুরুজের অভ্যন্তর ভাগে দুর্গ প্রাচীরের শীর্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত সিঁড়ি। এই বুরুজে কর্তব্যরত প্রহরী পাহারা দিতো। আছে কামান বসানোর উপযোগী সুউচ্চ বেদীর অবস্থান, এটি হলো দুর্গটির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।


ঐতিহ্যবাহী মোগল স্থাপত্য হাজীগঞ্জ কেল্লার সুউচ্চ সিঁড়ির প্রধান ফটক।

কেল্লাটির ভেতরে বিশাল জায়গা। দেখে মনে হয় এ যেন একটা ফুটবল খেলার মাঠ। হয়তো এই মাঠেই সৈন্যদল ট্রেনিং অথবা শত্রুপক্ষের সাথে যুদ্ধ করতো। মাঠের এক কোণে একটা সুরঙ্গ পথ ছিল। জানা যায় এই সুরঙ্গ পথ নাকি শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বপাড়ে অবস্থিত বন্দর কেল্লার সাথে সংযোগ ছিল। বিপদের আশংকা টের পেলে সৈন্যদল এই সসুরঙ্গপথ দিয়ে অন্য কেল্লায় পলায়ন করত। তবে বর্তমানে সুরঙ্গটি পুরোপুরিভাবে বন্ধ আছে। এই কেল্লাটি দক্ষিণ পাশে একটি খাল রয়েছে। এই খাল দিয়ে সেসময়ের রাজপ্রতিনিধিরা তাদের রাজকীয় নৌযান নিয়ে কেল্লায় আসতো। তাই এই খালটির নামকরণ করা হয়েছে কেল্লা খাল।

নারায়ণগঞ্জ টু ডেমড়া সড়কের মাঝপথেই এই খাল। মানুষ আর যানবাহন চলাচলের জন্য এই খালের উপরে প্রাচীন আমলেই একটা ব্রিজ তৈর করা হয়েছিল। হাজীগঞ্জ কেল্লার নামানুসারে এই ব্রিজের নামকরণ করা হয় কিল্লার পুল। ব্রিজটির পাশেই রয়েছে বিবি মরিয়মের সমাধিস্থান। যা বিবি মরিয়মের মাজার নামে সবার কাছে পরিচিত। জানা যায় সমাধিতে শায়িত বিবি মরিয়মকে তৎকালীন বাংলার মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খানের কন্যা এবং ইরান দখত এর বোন তুরান দখত হিসেবে ঐতিহাসিকরা ধারনা করে থাকেন।


কেল্লার ভেতরের পরিতপ্ত যুদ্ধের ময়দান। স্থানীয় ছেলেপেলেদের ফুটবল আর ক্রিকেট খেলার মাঠ। রাখাল ছেলের গরুছাগল ছড়ানোর জায়গা।

হাজীগঞ্জ কেল্লাটির উত্তর পাশে এম সার্কাস নামক স্থানে রয়েছে একটি শাহী মসজিদ। মসজিদটি এম সার্কাস শাহী মসজিদ নামে সুপরিচিত। জানা যায়, আগেকার সময়ে কেল্লায় আসা রাজপ্রতিনিধিরা এই শাহী মসজিদেই নামাজ আদায় করতো। তাই এই মসজিদটি স্থানীয় মানুষের কাছে শাহী মসজিদ নামে পরিচিতি লাভ করে।

বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী হাজীগঞ্জ কেল্লাটি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিলীন হতে বসেছে। হাজীগঞ্জ গুদারাঘাট বা নবীগঞ্জ গুদারাঘাট হতে কেল্লায় প্রবেশ করার সিঁড়িটিও খসে খসে পড়ছে। প্রাচীরে শেওলা জমে একাকার। কেল্লার ভেতরে দিনের বেলা থাকে ছেলেপেলেদের খেলাধুলা আর গোরু ছাগলের ভিড়। রাতেবেলা কেল্লাটি সহ এর চারপাশ থাকে চোর বদমাশ আর নেশাখোরদের দখলে। সন্ধ্যার পর কেল্লাটির আশেপাশে সৃষ্টি হয় এক ভূতুরে পরিস্থিতি। এমনিতেই কেল্লাটির চারপাশে রয়েছে আগেকার সময়ে গড়া টিনের চালের বিশাল বিশাল পাটের গোডাউন। কালের বিবর্তনে এখন আর আগের মতন পাটের জয়জয়কার সময় নেই বলে, এসব গোডাউন এখন ব্যক্তিমালিকানাধীন বিভিন্নরকম বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে এই ঐতিহ্যবাহী কেল্লাটি এসব টিনের গোডাউনের আড়ালে আবডালেই থেকে যাচ্ছে।

এ অবস্থা চলতে থাকলে, হয়তো কোনও একদিন সত্যি সত্যিই নারায়ণগঞ্জের এই ঐতিহ্যবাহী কেল্লাটি ঝোপ জঙ্গলে ঢেকে যাবে। তাই এখন থেকেই স্থানীয় প্রশাসনের উচিৎ মোগল আমলের স্থাপনা কেল্লাটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেওয়া। তা না হলে হয়তো একদিন কেল্লাটি আর কারোর চোখেই পড়বে না। এমনটা যাতে না হয়, সেই আশাই করছি।

জীবনে কতটুকু শুদ্ধ থাকলে শান্তভাবে মৃত্যুকে বরণ করা যায়!

জীবনে কতটুকু শুদ্ধ থাকলে শান্তভাবে মৃত্যুকে বরণ করা যায়!

সক্রেটিস হলেন উদাহরণ, বিচারের শেষ মুহূর্তে শাস্তি এড়াতে না পারলেও মৃত্যুদণ্ডকে এড়াতে পারতেন সক্রেটিস। তখন এথেন্সের বিচার ব্যবস্থায় অপরাধ চিহ্নিত হবার পর অপরাধীকে জিজ্ঞেস করা হতো, সে কী শাস্তি চায়। পাঁচশ’ জুরির উপস্থিতিতে সক্রেটিসকেও জিজ্ঞেস করা হলো, তিনি কী শাস্তি চান। কিন্তু যেহেতু তিনি নিজেকে অপরাধী মনে করতেন না, তার আচরণ ছিলো স্বভাবসুলভ অনমনীয়। তিনি শাস্তির পরিবর্তে পুরস্কারের প্রস্তাব করেন! উদ্বেগহীন সক্রেটিস প্রস্তাব করলেন, প্রাইটেনিয়াম হলে তাকে নিয়ে যেন বিশেষ এক ভোজের আয়োজন করা হয়। এটি প্রথাগতভাবে গ্রীসের বীরদের জন্য করা হতো। তাই জুরিরা ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন এবং বিপক্ষের জুরি সংখ্যা হঠাৎই ১৮০ থেকে ২২০ এ উঠে গেলো। বিচার নিয়ে ঠাট্টাকারী সক্রেটিসের জন্য কঠিন শাস্তির প্রস্তাব আসলো। মৃত্যুদণ্ড বা শাস্তি নিয়ে সক্রেটিসের উদাসীনতার এখানেই শেষ নয়। শিষ্য আর বন্ধুরা মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত সক্রেটিসের জন্য মৃত্যুদণ্ডের পূর্ব পর্যন্ত এক মাস পেরোলে মুক্ত রাখার আবেদন করেছিলেন। তাতে আদালত মুক্তিপণ হিসেবে ৩০০০ দ্রাকমা দাবী করে, কিন্তু সক্রেটিস মাত্র ১০০ দ্রাকমা দিতে রাজি হন। অতএব জেলেই থেকে গেলেন দণ্ডপ্রাপ্ত সক্রেটিস। ওদিকে সময় হয়ে এলো হেমলক পানের।

মৃত্যুর দিনের সন্ধ্যেবেলা সক্রেটিস তার শিশুপুত্র মিনেজেনাস কে বললেন, তুমি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। স্বাভাবিকভাবে হাসিখুশি এবং শান্ত সক্রেটিস। তাকে ঘিরে বসে আছেন তার ভক্ত শিষ্য ও বন্ধুরা। মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই তাদের গুরুর মৃত্যুর দৃশ্য মঞ্চায়িত হবে। সাক্ষী হতে হবে এক অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর। শিষ্যরা সকলেই হতাশা আর আসন্ন বিচ্ছেদের বেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে আছেন। ওদিকে সক্রেটিস তার মৃত্যুর পরের পোশাক গোছানো নিয়ে ব্যস্ত। তিনি পড়ে নিচ্ছেন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পোশাক, কারণ তিনি চান না মৃত্যুর পর কেউ তার গায়ে হাত দিক। শিষ্য আর বন্ধুদের কাছ থেকে কিছু সময় আলাদা হয়ে পরিবারের সকলের সাথে কথা বলে নিলেন।

জেল কর্মকর্তা একটু সময় আগে শেষ বিদায় জানিয়ে গেলেন। তার দু’চোখ ছিলো অশ্রুতে পূর্ণ। তিনি বলে গেলেন যে, সক্রেটিস ছিলেন তার অভিজ্ঞতায় শ্রেষ্ঠ আসামি, সবচেয়ে ভদ্র আর অসম্ভব সাহসী। কিছুক্ষণ পরই হেমলকের রসে পূর্ণ পাত্র নিয়ে প্রবেশ করলো জল্লাদ। তীব্র এই হেমলক হৃদপিণ্ডে গিয়ে পৌঁছে নিমিষে শরীরকে অসাড় করে দেয়। জল্লাদ নিরাবেগ কণ্ঠে বললো, এই পাত্রে এক ফোঁটা হেমলকও যেন বাইরে না পড়ে! সবটুকু পান করতে হবে! সক্রেটিস জল্লাদকে নিশ্চয়তা দিয়ে বললেন, একটি ফোঁটাও নষ্ট হবে না। তারপর তিনি কিছুক্ষণ প্রার্থনা করলেন। রুদ্ধ নিঃশ্বাসে সকলেই তাকিয়ে আছে সক্রেটিসের উদ্বেগহীন শান্ত মুখটির দিকে। মানসিকভাবে সকলেই অস্থির, একমাত্র সক্রেটিস ছাড়া। প্রার্থনা শেষ করে বিষের পাত্র তুলে নিলেন সত্তর বছরের সক্রেটিস। পান করে নিলেন সবটুকু হেমলক রস, এক নিঃশ্বাসে। বিকৃত মুখভঙ্গি দেখলেই বুঝা যায় কেউ বিষ পান করছে, কিন্তু সক্রেটিসকে দেখে তা বুঝার উপায় নেই। তার মুখ বিন্দুমাত্র বিকৃত হয় নি। জলপানের মতো পান করেছিলেন তিক্ত বিষ। উপস্থিত সকলে উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলেন। একজন শিষ্য মৃগীরোগীর মতো কাতরাচ্ছিলেন। সক্রেটিস তাকে কোলে নিয়ে চোখেমুখে জল দিয়ে সুস্থ করলেন।

পাষণ্ড জল্লাদ এবার দিলো তার নিষ্ঠুরতম নির্দেশটি। জল্লাদ বললো, এবার সক্রেটিসকে কিছুক্ষণ হাঁটাচলা করতে হবে যেন বিষটুকু ভালোভাবে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। শিউরে ওঠে শিষ্যরা না না ধ্বনিতে মুখর করে তুললো জেলকক্ষটি। ভাবলেশহীন সক্রেটিস তা-ই করলেন। নিজের জীবনের বিনিময়েও তিনি জল্লাদের দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা দিতে চান। তিনি উঠে পায়চারি করতে লাগলেন। একসময় নিস্তেজ হয়ে এলো তার পা যুগল। অসাড় হয়ে এলো তার বিশালাকৃতির শক্ত দেহখানি। নিজের হাতেই মুখ ঢেকে শুয়ে পড়লেন তিনি। এবার সবাই শান্ত, একটি শব্দও নেই কারও মুখে। কিছুক্ষণ সবই নিশ্চুপ, শান্ত। হঠাৎ মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে সক্রেটিস বললেন, ক্রিটো, একটি মুরগি ধার করেছিলাম আমাদের পরিবারের জন্য। মনে করে তা আসক্লিপিয়াসকে শোধ করে দিও। এই তার শেষ বাক্য, যেন শেষ মুহূর্তে নিজেই নিজের বিচার করছিলেন। তারপর সবকিছু আবারও নিশ্চুপ। আর কোন শব্দ হয়নি।

এর থেকেই বোঝা যায়, জীবনটা কতটুকু শুদ্ধ হলে এ’পাড়া থেকে ও’ পাড়ায় যাবার মতো করে পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়া যায়।

ঋণ স্বীকার :
প্লেটো’র ‘এপোলজি’ এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বরণীয় মানুষ স্মরণীয় বিচার।

বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থায় পাট বেলিং এবং পাট শ্রমিকদের বর্তমান দিনকাল

নারায়ণগঞ্জ সিটি ১০ নং ওয়ার্ড গোদনাইল। এই এলাকাটির অবস্থান নারায়ণগঞ্জ শহর থেকে ৪ কিলোমিটার উত্তরে সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন। বর্তমানে এই গোদনাইলে গড়ে উঠেছে যত্রতত্র বহু শিল্প প্রতিষ্ঠান। এসবের মধ্যে রয়েছে রপ্তানিমুখী নীট গার্মেন্ট, ডাইং ইন্ডাস্ট্রিজ, রি-রোলিং মিলস্ সহ শতাধিক নামী দামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কোনও একসময়ের এশিয়া মহাদেশের বিখ্যাত দুটি বস্ত্র শিল্পও (টেক্সটাইল মিলস্) এই গোদনাইল এলাকায় ছিল। যা এখন একটি পুরোপুরি বন্ধ। আর একটিতে প্লট আকারে গড়ে উঠতে শুরু করছে পল্লী টেক্সটাইল। গোদানাইল এলাকায় আগেও ছিল পাট রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান, যা এখনও আছে। বাংলার সোনালি আঁশ পাট আর বস্ত্র শিল্পই একসময় নারায়ণগঞ্জকে এনে দিয়েছিল প্রাচ্যের ডান্ডি উপাধি।


বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থার প্রেস ঘর। সামনে প্রেসের কয়েকজন কর্মচারী।

আগে নারায়ণগঞ্জে যত্রতত্র দেখা যেত বিশাল বিশাল পাটের গোডাউন। দেখা যেত পাটকে বেলিং করার মতো কয়েটা জুট প্রেস। এখন আর সেসব পাটের গোডাউন আর পাট বেলিং করার জুট প্রেসও নেই। আছে মাত্র দুই একটা। জানামতে পাট বেলিং(জুট প্রেস) একটা আছে নিউ মেট্রো সিনেমাহল সংলগ্ন কুমুদিনী “ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্ট অফ বেঙ্গল” অপরটি হলো গোদনাইল এলাকায়। গোদানাইল এলাকাটি হলো প্রাচ্যের ডান্ডি নারায়ণগঞ্জের সুনাম অর্জনকারী শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম পাড়ে।

শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পাড় হলো বন্দর থানাধীন এলাকা। এই এলাকাতেও ছিল বস্ত্রশিল্প, জুট বেলিং(জুট প্রেস), নৌযান মেরামতের জন্য ডকইয়ার্ড, কদম রসূল মাজার সহ আরও অনেককিছু। এসবের মধ্যে পবিত্র কদম রসূল মাজারটি এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই পবিত্র মাজারে প্রতিবছরই ঈদ-এ- মিল্লাদুন নবী উপলক্ষে ৩দিনব্যাপী ওরস মোবারক অনুষ্ঠিত হয়। যাক সেই কথা। এসব নিয়ে আরেকটা পোস্টে আলোকপাত করার ইচ্ছে আছে। এবার আসি মূল কথায়।

আমরা জানি নারায়ণগঞ্জে সূতা ও রং-এর জন্য সারাদেশে এখনও সুখ্যাতি বহাল আছে। বাংলাদেশের যেখানেই টেক্সটাইল মিল আর ডাইং ইন্ডাস্ট্রিজ থাকুক-না-কেন, সূতা রং নারায়ণগঞ্জ থেকেই নিতেই হবে। তা ছাড়া আর উপায় নাই। যদিও কালের বিবর্তনের ফলে বস্ত্রশিল্পের বিলুপ্তি ঘটেছে, রয়ে গেছে পাট বেলিং জুটপ্রেস, পাট যাচাই-বাছাই সহ পাট আমদানি রপ্তানিকারক সংস্থা। এমন একটি জুটপ্রেসের সাথেই সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিতে আর পাট শ্রমিক তথা পাটের একাল-সেকাল নিয়েই আমার আজকের এই আয়োজন। আশা করি সবাই সাথে থাকবেন। জুট প্রেসটি হলো নারায়ণগঞ্জ সিটি ১০ নং ওয়ার্ডে অবস্থিত। নাম- “বাংলাদেশের সমবায় শিল্প সংস্থা(সীঃ)”।


বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থার ভেতরে থাকা সারিবদ্ধভাবে পাট রাখার গোডাউন।

বাংলার সোনালী আঁশের কথা সেই ছোটবেলা থেকেই পাঠ্যপুস্তকে আমরা অনেক পড়েছি। এখনও এই প্রজন্মের ছেলেপেলেরাও পাঠ্যপুস্তক হতে পাট সম্বন্ধে বিস্তর তথ্য জ্ঞান অর্জন করছে। বাংলার সোনালী আঁশ আমাদের গর্ব, পাটের জন্য আমরা গর্বিত। তা আজ থেকে নয়! পাটের জন্য আমরা গর্বিত হয়েছি সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই। তাই ছোট-বড় ছেলে-বুড়ো সবাই জানে বাংলার সোনালী আঁশের কথা। প্রাথমিক শিক্ষা পাঠ্যপুস্তক থেকেই সোনালী আঁশের শিক্ষা শুরু হয়, বাংলার গৌরব গাঁথা এই সোনালী আঁশের ইতিহাস। এই পাটই বাংলার শত বর্ষের ঐতিহ্য। বিভিন্ন তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়; পাট মূলতঃ দুই ধরনের জন্মায়- (১) corchorus capsularis (সাধা পাট) এবং (২) corchorus olitarius (তোষা পাট ); পাট Tiliaceae পরিবারের অন্তর্গত একটি উদ্ভিদ। পাটকে আরো একাধিক নামে ডাকতে শোনা যায়। যেমন- দেশী পাট, কেনাফ পাট, মোস্তা পাট ও বগি পাট। আর ইংরেজি নামতো সবারই জানা (jute) জুট। কিন্তু আমরা অনেকেই জানিনা কীভাবে এই বাংলার খ্যাতনামা পাটকে বেলিং করে বাজারজাতকরণ করা হয়। আর এই গৌরব গাঁথা সোনালি আঁশ রক্ষণাবেক্ষণকারী কৃষক শ্রমিকরা-ই-বা কী সুখে থাকছে! পাট শ্রমিকদের সুখদুঃখ নিয়ে পরে আলোচনা করবো। আগে আলোচনায় আসি কীভাবে পাট শ্রমিকেরা পাট বেলিং করে।

পাট একটি বর্ষজীবী ফসল। এর জীবনকাল ১০০ থেকে ১২০ দিন পর্যন্ত। চৈত্র-বৈশাখ থেকে আষাঢ় শ্রাবণমাস পর্যন্ত। পাট একটি লাভজনক ফসল, যা অধিকতর বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহকারী একটি কৃষিজাত ফসল। এই পাট শুধু আমাদের দেশেই বেশি জন্মায়, এবং দেশের সব জেলায়, সবখানেই জন্মায়। এই পাটের সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের দেশের হাজার হাজার নারী-পুরুষ শ্রমিক ও কৃষক-কৃষাণীর আত্মা ও জীবিকা। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে কৃষকেরা জমি থেকে পাটগাছ কেটে আঁটি বেঁধে পানিতে জাঁক দিয়ে ডুবিয়ে রাখে। ১০ থেকে ১২ দিন পর পানি থেকে খুব যত্ন সহকারে ডোবানো পাটগাছের আঁটিগুলো উঠিয়ে আনে। ১০/১২ দিনে পানিতে ডুবিয়ে রাখার ফলে আঁটি বাঁধা পাট পঁচে যায়।

আসলে কিন্তু পাটগাছের পাট পঁচে যায়নি, দীর্ঘদিন পানির নীচে থাকার কারণে গাছ থেকে পাট নরম হয়ে যায়। নরম হওয়ার কারণেই খুব সহজে গাছ থেকে পাট বা আঁশকে আলাদা করা যায়। (পাটগাছ থেকে পাটের আঁশ আলাদা করার পর, সেই গাছ হয়ে যায় পাটখড়ি। এই পাটখড়ি দিয়েও অনেক কাজ হয়, পাটখড়ি জ্বালানির কাজে ব্যবহৃত হয়, আবার ঘরের বেড়া তৈরির কাজে লাগে। আবার বর্তমান আধুনিক যুগে পাটখড়ি দিয়ে অনেক নামীদামী বোর্ড তৈরি হয়। যেসব বোর্ড দিয়ে ফ্যামিলি ফার্নিচারের আসবাবপত্র তৈরি হয়)। পচনধরা পাটগাছ কৃষক কৃষাণী এই মূল্যবান পাট সংগ্রহ করে। এরপর পাট রোদে শুকিয়ে বাজারে নিয়ে বিক্রি করে তাদের জীবিকা উপার্জন করে। কৃষকের কাছ থেকে কিনে নেয় দেশের বড় বড় পাট ব্যবসায়ীরা।


বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থা (সীঃ) পাট বেলিং করার নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান।

সেই পাট কিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান করে, কিংবা ব্যবসায়ীদের নিজস্ব মিলে বা গোডাউনে জমা রাখে। এরপর বিদেশে রপ্তানী করার জন্য শুরু হয় যাচাই-বাছাইয়ের কাজ। যাচাই-বাছাইয়ের পর বিদেশে রপ্তানীর আগে এই পাটকে বেল আকারে তৈরি করার জন্য দরকার হয় জুটপ্রেসের। জুট প্রেস হলো, পাটকে বেল আকারে তৈরি করার স্থান। যেই জুট প্রেসের নাম আগেই বলে রেখেছি। একটি হলো নারায়ণগঞ্জ শহরে নিউ মেট্রো সিনেমাহল সংলগ্ন “কুমুদিনী ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্ট ওফ বেঙ্গল”। অপরটি হলো নারায়ণগঞ্জ সিটি ১০নং ওয়ার্ড “বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থা(সীঃ)। আলোচনা করবো “বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থা নিয়ে। কারণ এই সংস্থাটির সাথে আমার অনেক দিনের সংপৃক্ততা। এই সংস্থার প্রতিটি পাট শ্রমিক আমার আপন ভাইয়ের মতো। একসময় প্রতিদিন প্রতিক্ষণ এই সংস্থার ভেতরে বাইরেই ছিল আমার প্রেম, ভালোবাসা, আড্ডা, জীবিকা সহ জীবনের সবকিছু।


নৌকা থেকে পাটের বোজা আমদানি শ্রমিকরা মাথায় করে গোডাউনে নিয়ে যাচ্ছে।

এই সংস্থাটি পাট বেলিং এর জন্যই খ্যাত এবং সুনাম অর্জনকারী। এই সংস্থাটি অনেক পুরানো। এই সংস্থার অভ্যন্তরে আছে পাট রাখার বিশাল বিশাল গোডাউন। আছে পাট বেল করার জন্য সেই প্রাচীন আমলের প্রেস মেশিন। পাটের ভরা মৌসুমে দেশের বিভিন্ন জেলা, উপ-জেলা থেকে এখানে পাট আসে নৌপথে ও স্থলপথে। আগে এই সংস্থা সাথে রেল যোগাযোগও ছিল। বর্তমানে রেল যোগাযোগ নেই, আছে নৌপথ আর স্থলপথ। নৌকা ও ট্রাক থেকে এই পাটকে নামানো হয় নারী-পুরুষ শ্রমিক দ্বারা। তাঁদের বলা হয় আমদানি শ্রমিক।


ট্রাক আসা পাট আমদানি শ্রমিকরা ট্রাক থেকে নামিয়ে গোডাউনে নিয়ে রাখছে।

তাদের পারিশ্রমিক দেওয়া হয় দৈনিক মজুরী হিসেবে। এই কাজই হলো পাট বেলিং করার প্রথম ধাপ। নৌকা বা ট্রাক থেকে আমদানি শ্রমিকেরা পাট নামিয়ে নিয়ে যায় গোডাউনে। সেখান থেকে শুরু হয় পাটের ওজন সহ যাচাই বাছাই-এর কাজ। যারা পাট ওজন করে তাদের বলা হয় কয়েলি। গোডাউনে পাটকে কয়েক ভাগে ভাগ করা হয়। করা হয় পাটের গোড়া ছাটাই। যারা পাটের গোড়া বাছাই করে তাদের বলা হয় খাতাদার। তাদের কাজই শুধু পাটের শক্ত গোড়া কেটে, ৫০ কেজি করে বোজা বেঁধে রাখা।


বোজা শ্রমিক পাটের বোজা মাথায় করে জুট প্রেসে যাচ্ছে। এরপর পাট বেল আকারে তৈরি হবে।

এরপর পাট বেলিং হওয়ার জন্য যাবে প্রেসে। যারা গোডাউন থেকে ৫০কেজি পাটের বোজা মাথায় করে প্রেসে নিবে তাদের বলা হয় বোজাওয়ালা বা বোজা শ্রমিক। প্রেসে যেসব শ্রমিক কাজ করে সেসব কাজের ভিন্ন ভিন্ন নাম থাকে। যেমন; বোজা শ্রমিক, কয়েলি, খালাসি, শিক গাঁথা, কাঁচা-পাকা ও রপ্তানি শ্রমিক। বোজা শ্রমিক পাটের বোজা নিয়ে যাবে প্রেসের উপরে, সেখানে কয়েলি (যিনি পাট ওজন করে ) ১৮৫ কেজি করে আলাদা-আলাদাভাবে রাখে। সেখান থেকে খালাসি শ্রমিক ওজন করা পাট টেনে নিয়ে ফেলে প্রেসের বোঙ্গায় (বিশাল গর্ত। গর্তের নীচে থাকে হাউস। হাউসে থাকে মবিল তৈল)। তখন প্রেস ড্রাইভার (যিনি প্রেস চালায়) গিয়ার চেপে দিলে নীচ থেকে আস্তে আস্তে মবিল তৈলের প্রেশারে ১৮৫ কেজি পাটকে একটা বেল আকারে তৈরি করে ফেলে।


পাকা শ্রমিকরা পাটের বেলটাকে রশি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিচ্ছে। এরপর ফেলে দিবে বোঙ্গায়।

এই বেলটাকে বলে কাঁচা বেল। যারা এই কাজ করে তাদের বলে কাঁচা শ্রমিক। তারপর বেলটা যায় পাকা করার জায়গায়। যারা বেলটাকে পাকা করবে, তাদের বলে পাকা শ্রমিক বা খালাসি শ্রমিক। সেখানেই বেলটাকে আরো একটু বেশি টাইট করে রশি দিয়ে পেঁচানো হয়। তাই বলা হয় পাকা। মানে পাট বেলা হবার এটাই শেষ ধাপ। পাটের বেলটাকে শক্ত করে বাধার জন্য যিনি রশি তৈরি করে দিচ্ছে, তাকে বলে শিকগাঁথা শ্রমিক। খালাসি শ্রমিক বেল তৈরি সম্পূর্ণ করে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় বোঙ্গায়। বোঙ্গা হলো উপর থেকে নীচ পর্যন্ত সরু একটা ড্রেনের মতো রাস্তা। তৈরিকৃত বেলটা বোঙ্গা দিয়ে নেমে আসে নীচে। নীচে প্রস্তুত আছে রপ্তানি শ্রমিক। বেলটা উপর থেকে বোঙ্গা থেকে বের হবার সঙ্গে সঙ্গে রপ্তানি শ্রমিকরা তৈরিকৃত বেলটা টেনে ট্রলিগাড়িতে উঠিয়ে দিবে।


রপ্তানি শ্রমিকরা প্রেস থেকে আসা, পাটের বেল বোঙ্গার সম্মুখ থেকে টেনে ট্রলিগাড়িতে উঠিয়ে দিচ্ছে। এরপর যাবে গোডাউনে অথবা নৌকায়, নাহয় ট্রাকে।

রপ্তানি শ্রমিক সেই তৈরিকৃত বেলটাকে প্রথমে নিয়ে যায় গোডাউনে নয়-তো-বা সরাসরি ডেলিভারি দেওয়ার জন্য ট্রাকে না-হয় নৌকায় নিয়ে উঠিয়ে দেয়।। এরপর পাটের বেলগুলো চলে যায় দেশের বিভিন্ন জেলার জুটমিলে বা দেশের বাইরে কোনো অজানা গন্তব্যে। বিনিময়ে আমাদের দেশে আসে বৈদেশিক মুদ্রা। এবার বলি পাট শ্রমিকদের সুখদুঃখ নিয়ে কিছু কথা …


রপ্তানি শ্রমিকরা পাটের তৈরিকৃত বেল গোডাউন থেকে ট্রাকে উঠায়।

যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে বিদেশ থেকে দেশে আসে বৈদেশিক মুদ্রা, তাঁরা বেশি একটা সুখে নেই শান্তিতে নেই। প্রাচ্যের ডান্ডি নারায়ণগঞ্জে পাট শ্রমিক ইউনিয়ন থাকলেও, শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য পাওনা বিধিমালার ধারেকাছেও ভিড়তে পারে না বা পায়ও না। পাট শ্রমিকরা দিন মজুরিতে কাজ করে। কাজ করলে মুজরি, কাজ না করলে তার মুজরি নেই। ১৮৫কেজি পাট উঠানামা করানোর সময় অসাবধানতা বশত অনেকেরই হাত-পা ভেঙে যায়। প্রেসে কাজ করার সময়ও অনেকে দুর্ঘটনাক্রমে আহত হয়। হাত ভাঙে, পা ভাঙে, হাতের আঙুল কেটে যায়, পায়ের আঙুর কেটে যায়। যখন এরকম দুর্ঘটনার শিকার হয়, তখন দৈনিক নামমাত্র মুজরি আর হাসপাতালের ১০টাকা টিকেটের চিকিৎসা ছাড়া অন্যকিছু তাদের কপালে জোটে না। জানা যায় মিল ইন্ডাস্ট্রিজে কাজ করার সময় যদি কোনও শ্রমিকের হাত-পায়ের আঙুল বা দেহের অন্য কোন অঙ্গহানি হয়, তাহলে আহত শ্রমিক তাঁর অঙ্গহানির ক্ষতিপূরণ পাবে। বা প্রতিষ্ঠানের মালিক বা সরকারি প্রতিষ্ঠান হলে সরকার আহত শ্রমিককে দিতে বাধ্য।

কিন্তু দুঃখের কথা হলো, বাংলার সোনালি আঁশ পাট শ্রমিকরা কর্মরত অবস্থায় আহত নিহত হলে নামমাত্র চিকিৎসা ছাড়া আর কিছুই পায় না। এই লেখায় যেই সংস্থাটির কথা উল্লেখ করেছি, এই সংস্থায় এমনও শ্রমিক আছে যে, তাদের পূর্বপুরুষরা এই সংস্থায় কাজ করতে করতে বুড়ো হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। তাদের সন্তানরাও বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। তাদের কোনও ধরনের সুবিধাদি নেই বা পায়ও না। আছে শুধু সংস্থা অভ্যন্তরে মুরগির খামারের মতন ছোট একটা বাসা। যেই বাসায় পরিবারবর্গ নিয়ে একসাথে থাকা খুবুই দুষ্কর। তাও কারোর বাসা আছে আবার কারোর নেই। আবার কোনও কারণ বশত যদি একসাথে একমাস কাজ করা থেকে বিরত থাকে, তাহলে তাকে সংস্থার ভেতর থেকে বিতাড়িত করা হয়। তবুও খেয়ে না খেয়ে বাংলার সোনালি আঁশ পাট শ্রমিকরা নিরুপায় হয়ে কাজ করে যাচ্ছে, বাংলার গৌরব অক্ষত রাখার জন্য। সরকার আসে সরকার যায়, কিন্তু কোনও সরকারই পাট শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার ন্যায্য পাওনা আনায় আনায় বুঝিয়ে দেয় না। তাই আজ বাংলার গৌরব গাঁথা সোনালি আঁশ পাট শ্রমিকরা কাজ করে অতি কষ্টে দিনাতিপাত করছে। পাট শ্রমিকদের দেখার কেউ নেই, তাদের দাবি আদায় করে দেওয়ারও কেউ নেই। ওরা আজ বড় অসহায়।

শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসমান ডকইয়ার্ড


ভাসমান ডকইয়ার্ড বন্দর চৌরাপাড়া নারায়ণগঞ্জ।

প্রাচ্যের ডান্ডি নারায়াণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর নাম শোনেনি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কোনও এক সময়ের স্বচ্ছ পানির জন্য সুনাম অর্জনকারী শীতলক্ষ্যার সেই সুনাম বর্তমানে না থাকলেও, নদীর দুই পাড় নিয়ে সুখ্যাতি আজও অখ্যাত রয়ে গেছে। যা প্রাচ্যের ডান্ডি নারায়ণগঞ্জ নামে পৃথিবী জুড়ে রয়েছে সুনাম। বর্তমানেও শীতলক্ষ্যার দুই পাড়ে রয়েছে প্রচুর মিল-ইন্ডাস্ট্রি, ব্যবসা বাণিজ্য সহ আরও অনেককিছু। এসব নিয়ে লিখে শেষ করা যাবে না। লিখতে চাই শীতলক্ষ্যা নদীর বিষাক্ত কেমিক্যালের পানির উপরে ভেসে থাকা বি.আই.ডব্লিউ. টি.সি’র ভাসমান ডকইয়ার্ড নিয়ে কিছু কথা। এই ঐতিহ্যবাহী ভাসমান ডকইয়ার্ডটিও প্রাচ্যের ডান্ডি নারায়ণগঞ্জের ইতিহাসের একটা ঐতিহ্য। যা যুগযুগ ধরে নারায়ণগঞ্জের ঐতিহ্য বহন করে চলছে। পানিতে চলাচলকারী জাহাজ, লঞ্চ-ইস্টিমার, কার্গো, ট্রলার সহ আরও বহুরকম নৌযান মেরামত বা তৈরি করার স্থান বলতে আমরা দেখি বা বুঝি ডকইয়ার্ড। যা সচরাচর দেখতে পাই নদীর পাড় ঘেঁষা খোলা জায়গায়। আর ভাসমান ডকইয়ার্ড হলো সম্পূর্ণ পানির উপরে ভাসমান অবস্থায় থাকা নৌযান মেরামত করার উপযোগী স্থান। জানা যায়, এরকম ভাসমান ডকইয়ার্ড এই বঙ্গদেশে আছে মাত্র তিনটি। একটি বরিশাল, আরেকটি বন্দরনগরী চট্টগ্রাম, অপরটি প্রাচ্যের ডান্ডি নারায়ণগঞ্জ। নারায়ণগঞ্জ বন্দর উপজেলার চৌরাপাড়ায় বিআইডব্লিউটিসির নৌযান মেরামতের ইর্মাজেন্সি বিভাগ হিসেবে পরিচিত ভাসমান ফ্লোটিং ডকইয়ার্ড।


ছবি মোবাইল দিয়ে তোলা।

ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি এই বিআইডব্লিউটিসির নৌযান মেরামত করার ডকইয়ার্ডটিকে। এই ডকইয়ার্ডের সাথেই ছিল আমাদের বসবাস, সাবেক আদর্শ কটন মিলস্, বর্তমান শোহাগপুর টেক্সটাইল মিলস্। স্কুলে যাবার আগে বন্ধুদের সাথে শীতলক্ষ্যায় ঝাঁপ দিয়ে ভাসতে ভাসতে আসতাম এই ডকইয়ার্ডে। এসেই সবাই মিলে শুরু করে দিতাম লাফালাফি আর ডকের ভেতরে দৌড়াদৌড়ি। এসব করার সময় ডকইয়ার্ডে কর্মরত কর্মচারীদের অনেক বকুনিও খেয়েছি। আবার কোনো কোনো দিন বিকালবেলা মাছ ধরার জন্য বর্শি নিয়ে চলে আসতাম ডকইয়ার্ডে। এই ডকইয়ার্ডটির চারিপাশ ছিল মাছের অভয়ারণ্য। বাংলাদেশের ছয়-ঋতুর প্রায় সব ঋতুতেই এর চারদিক মাছে থাকত ভরপুর। বর্শি ফেলার সাথে সাথেই পাওয়া যেত নানারকম মাছ। বর্তমানে শীতলক্ষ্যার পাড়ে বহুরকম ড্রাইং কারখানা গড়ে উঠেছে। সেসব ডাইং কারখানার নির্গত কেমিক্যালের পানি শীতলক্ষ্যায় মিশ্রিত হয়ে পুরো নদীর পানি এখন বিষাক্ত হয়ে গেছে। যার কারণে আর ডকইয়ার্ডের আশেপাশে আগের মতো মাছ থাকে না। সেসব কথা না-হয় আরেকদিন বেলবো। এখন ডকইয়ার্ডটির খুঁটিনাটি নিয়ে কিছু জানাতে চাই।


ছবি নিজের মোবাইল ফোন দিয়ে তোলা।

জানা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকার জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান আলফেজ উইলিয়ামস এন্ড ডোভস লিমিটেড ১৯৪৫ সালে এটি নির্মাণ করে। জাহাজের ত্রুটিপূর্ণ তলদেশ মেরামত এবং দ্রুত বিকল ইঞ্জিনের ত্রুটি সারানোর কাজে এই ভাসমান ফ্লোটিং ডকইয়ার্ডের জুড়ি নেই। এ ডকইয়ার্ডে ৫ টি পন্টুন আছে। পন্টুনগুলোর অভ্যন্তরে বৈদ্যুতিক মটর পাম্পের সাহায্যে ডকইয়ার্ডটির ভেতরে পানি ঢুকিয়ে সম্পূর্ণ ডকইয়ার্ডটি পানিতে ডুবিয়ে দেয়া হয়। তখন ডকিংয়ে ত্রুটি সারতে আসা জাহাজটিকে আরেকটি ছোট ইঞ্জিনচালিত জাহাজে ঠেলে ইয়ার্ডের ভিতরে নিয়ে যায়। তখন ত্রুটিপূর্ণ জাহাজটিকে বসানোর জন্য থাকা সমান উচ্চতায় থরে থরে সাজানো কাঠের বড় বড় স্তম্ভের উপর বসিয়ে দেয়া হয়। এরপর পাম্পের সাহায্যে পন্টুনের পানি আবার সেঁচতে শুরু করে দেয়, ডকইয়ার্ডে এই কাজে নিয়োজিত থাকা কর্মচারী। পুরো ডকে পানি ঢুকিয়ে ডকইয়ার্ডটি ডুবাইতে যতক্ষণ সময় লেগেছিল, তার চাইতে অধিক সময় ব্যয় করে জাহাজসহ নিমজ্জিত ডকটি জাগিয়ে তোলা হয় আস্তে-ধীরে।

এরপর শুরু হয় ত্রুটিপূর্ণ জাহাজটির সংস্কার কাজ। একেকটা জাহাজ মেরামত করতে অনেকদিন সময় লেগে যায়। কোনোকোনো জাহাজ মাস খানেক যাবত এই ডকইয়ার্ডে থাকতে হয়। সম্পূর্ণ মেরামতের পর জাহাজটি নামাতে একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। যখন বছরের শেষ ডিসেম্বর মাসের আগমন ঘটে, তখন নদীতে এমনিতেই পানি কমে যায়। সেসময় ডকইয়ার্ডটি ডুবাইতে আর জাগাতে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় ডকইয়ার্ডে দায়িত্বে থাকা কর্মচারীদের। কারণ: এই ডকইয়ার্ডটি চৌরাপাড়া গুদারাঘাট সংলগ্ন নদীর পাড় ঘেঁষা। সেই কারণে বর্ষা মৌসুম ছাড়া সেখানে পানি থাকে খুব কম। ডকইয়ার্ড ডুবাইতে জাগাইতে তা মাটিতে ঠেকে যায়। তখন সবার অপেক্ষা করতে হয় জোয়ারের জন্য। নদীতে জোয়ার না-হওয়া পর্যন্ত আর মেরামত হওয়া জাহাজটিকে ডেলিভারি দিতে পারেনা ডক কর্মচারীরা। যখন জোয়ার আসে তখন আবার শুরু হয় ডকইয়ার্ড ডুবানো জাগানোর পালা। এভাবেই চলছে এর কাজ, আর কালের সাক্ষী হয়ে ভেসে আছে শীতলক্ষ্যার বিষাক্ত কেমিক্যালের পঁচা পানির উপরে।

পরিশেষে:
যুগের পর যুগ ধরে ভেসে থাকা ডকইয়ার্ডটি যেভাবে শীতলক্ষ্যা নদীর উপর ভেসে আছে, যেন আরও অনেক যুগ পর্যন্ত এভাবেই ভেসে থাকে এই কামনাই করি। ভাসমান ডকইয়ার্ডটি কালের সাক্ষী হয়ে বেঁচে থাকুক আমাদের পাশে। আমাদের আগামী প্রজন্ম যেন দেখতে পারে এই ঐতিহ্যবাহী ভাসমান ডকইয়ার্ড।

সকালবেলার আলোয় বাজে বিদায়ব্যথার ভৈরবী

সকালবেলার আলোয় বাজে বিদায়ব্যথার ভৈরবী

সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের দশমী তিথিতে দেবী কৈলাস পাড়ি দেন। সেই কারণেই ‘বিজয়া দশমী’ নাম। কিন্তু এই দশমীকে ‘বিজয়া’ বলা হয় কেন? তার পৌরাণিক ব্যাখ্যা খুঁজতে গেলে একাধিক কাহিনি সামনে আসে।

দুর্গা পূজার অন্ত চিহ্নিত হয় বিজয়া দশমীর মাধ্যমে। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, এই দিনেই পিতৃ-আবাস ছেড়ে দেবী পাড়ি দেন স্বামীগৃহ কৈলাসের দিকে। এই দিনেই তাই দেবীর প্রতিমা নিরঞ্জন করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই দিনটিকে ‘বিজয়া দশমী’ বলা হয় কেন? কোন ‘বিজয়’-কেই বা চিহ্নিত করে দিনটি?

পুরাণে মহিষাসুর-বধ সংক্রান্ত কাহিনিতে বলা হয়েছে, মহিষাসুরের সঙ্গে ৯ দিন ৯ রাত্রি যুদ্ধ করার পরে দশম দিনে তার বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করেন দেবী। শ্রীশ্রীচণ্ডীর কাহিনি অনুসারে, আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে দেবী আবির্ভূতা হন, এবং শুক্লা দশমীতে মহিষাসুর-বধ করেন। বিজয়া দশমী সেই বিজয়কেই চিহ্নিত করে।

উত্তর ও মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই দিনে দশেরা উদযাপিত হয়, ‘দশেরা’ শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত ‘দশহর’ থেকে, যা দশানন রাবণের মৃত্যুকে সূচিত করে। বাল্মীকি রামায়ণে কথিত আছে যে, আশ্বিন মাসের শুক্লা দশমী তিথিতেই রাবণ-বধ করেছিলেন রাম। কালিদাসের রঘুবংশ, তুলসীদাসের রামচরিতমানস, কিংবা কেশবদাসের রামচন্দ্রিকা-য় এই সূত্রের সঙ্গে সংযোগ রেখেই বলা হয়েছে, রাবণ-বধের পরে আশ্বিন মাসের ৩০ তম দিনে অযোধ্যা প্রত্যাবর্তন করেন রাম, সীতা ও লক্ষ্মণ। রাবণ-বধ ও রামচন্দ্রের এই প্রত্যাবর্তন উপলক্ষেই যথাক্রমে দশেরা ও দীপাবলি পালন করা হয়ে থাকে। আবার মহাভারতে কথিত হয়েছে, দ্বাদশ বৎসর অজ্ঞাতবাসের শেষে আশ্বিন মাসের শু‌ক্লা দশমীতেই পাণ্ডবরা শমীবৃক্ষে লুক্কায়িত তাঁদের অস্ত্র পুনরুদ্ধার করেন এবং ছদ্মবেশ-মুক্ত হয়ে নিজেদের প্রকৃত পরিচয় ঘোষণা করেন। এই উল্লেখও বিজয়া দশমীর তাৎপর্য বৃদ্ধি করে।

যাইহোক, তিথি অনুযায়ী দশমী হলেও। বাড়ির প্রতিমা, মন্দিরের প্রতিমা একটাও বিসর্জন হয় নি এখনও। ঢাক তো বলেই দিচ্ছে আজ “ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন।” আবার তো সেই এক বছরের অপেক্ষা।

যারা এখনই “শুভ বিজয়া” পাঠিয়েছেন তাদের বলি, একটু সবুর করুন বন্ধুরা, আমার বাড়ির প্রতিমা নিরঞ্জন না হওয়া পর্যন্ত আমি কাউকেই “শুভ বিজয়া ” জানাতে পারবো না। :)

দুর্গাপূজায় কলা বৌ কী এবং কেনো?

আমরা অনেকেই জানিনা দুর্গাপূজায় কলা বৌ কি এবং কেনো?

দুর্গা পূজার সময় যদি আমরা মণ্ডপে গিয়ে শ্রী গণেশ কে দেখি, ত দেখতে পাই তাঁর পার্শ্বে লাল পেড়ে শাড়িতে ঘোমটা তে ঢাকা একটি কলা বৃক্ষ দেখি । আসলে এটি কী? অনেকেই বলে থাকেন এটি কলা বৌ বা দুর্গাপুত্র গণেশের স্ত্রী! আসলে এটি কি শ্রী গণেশের স্ত্রী? আসলে কিন্তু আদৌ এটি শ্রী গণেশের স্ত্রী বা বৌ নয় । এটিকে বলা হয় ‘নবপত্রিকা’। এটি মা দুর্গা। অর্থাৎ গণেশের জননী । গণেশের স্ত্রীর নাম রিদ্ধি ও সিদ্ধি ।

নবপত্রিকা কী?
নবপত্রিকার আক্ষরিক অর্থ বোঝায় নয়টি পাতা । কিন্তু এখানে নয়টি উদ্ভিদ দিয়ে নবপত্রিকা গঠন করা হয় । এই নয়টি উদ্ভিদ মা দুর্গার নয়টি শক্তির প্রতীক । সনাতন ধর্মের লকেরা বৃক্ষকে তাদের সকল কর্মকান্ডের একমাত্র উপকরন হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন । পূজা পার্বণে নৈবদ্য থেকে শুরু করে দেব দেবীদের উপাসনা সহ সকল ক্ষেত্রে বৃক্ষ ও তার অংশ বিশেষ যথাঃ ফুল, ফল, পাতা, বীজ প্রভৃতি অতি প্রাচীনকাল তথা আর্য সভ্যতা থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে । যেমন দুর্গাপূজায় ব্যবহৃত কলা বৌ’র শাস্ত্রীয় নাম হচ্ছে নবপত্রিকা । নবপত্রিকা বলতে নয়টি গাছের চারা বুঝায় । এগুলো হচ্ছে :

১) কদলী (উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Musa sapientum)
২) কালো কচু (Alocasia sapientum)
৩) হরিদ্রা বা হলুদ (Curcuma domestica)
৪) জয়ন্তী (Sesbania sesban)
৫) বেল বা বিল্ব (Aegle mermelos)
৬) দাড়িম্ব (Punica granatum)
৭) অশোক (Saraca indica)
৮) মানকচু (Alocasia indica)
৯) ধান্য (Orgzasativa)
এই নয়টি গাছের চারাকে শ্বেত অপারাজিতা লতা দিয়ে বেষ্টন করে কলা বৌ সাজানো হয় । সমষ্টিগতভাবে মা দূর্গার প্রতিনিধিরূপে এদের অর্চনা করা হয় । এজন্য এ বৃক্ষগুলোকে নিয়ে চন্ডিতে একটি শ্লোক আছে।

“রম্ভা কচ্ছী হরিদ্রাচ জয়ন্তী বিল্ব দাড়িমৌ
অশোক মানকশ্চৈব ধান্যঞ্চ নব পত্রিকা”

তাই একটি সপত্র কলাগাছের সাথে অপর আট টি সপত্র উদ্ভিদ একত্র করে দুটি বেলের সাথে সাদা অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে লাল পাড় সাদা শাড়ি পড়িয়ে ঘোমটা দিয়ে বধূর আকার দেওয়া হয় । তারপর তাতে সিঁদুর দিয়ে দুর্গা দেবীর ডান পাশে রাখা হয় । এটি গণেশের ডান পাশে দেখা যায় ।

শুধু তাই নয় এই নয়টি গাছের প্রত্যেকের আবার অধিষ্ঠাত্রী দেবতা আছেন।
১) কদলী (কলা) এর অধিষ্ঠাত্রী দেবতা হলেন ব্রাক্ষ্মণী
২) কচ্চি (কালো কচু) এর অধিষ্ঠাত্রী দেবতা হল কালিকা
৩) হরিদ্রা বা হলুদ এর অধিষ্ঠাত্রী দেবতা হল দুর্গা
৪) জয়ন্তী এর অধিষ্ঠাত্রী দেবতা হল কার্তিকা
৫) বেল বা বিল্ব এর অধিষ্ঠাত্রী দেবতা হল শিবা
৬) দাড়িম্ব এর অধিষ্ঠাত্রী দেবতা হল রক্তদন্তিকা
৭) অশোক এর অধিষ্ঠাত্রী দেবতা হল শোকরহিতা
৮) মানকচু এর অধিষ্ঠাত্রী দেবতা হল চামুন্ডা
৯) ধান্য এর অধিষ্ঠাত্রী দেবতা হল লক্ষ্মী

লক্ষ্য করা যায় দুর্গা পূজোর প্রথম দিন সপ্তমীর দিন সকালে পুরোহিত নিজেই নবপত্রিকা কে নিয়ে নিকটস্থ কোন নদী বা পুকুরে স্নান করাতে নিয়ে যান। সাথে মহিলারা উলু ধ্বনি ও শঙ্খ ধ্বনি করতে করতে যান, ঢাকী রাও ঢাক বাজাতে বাজাতে যান। শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী স্নান করানোর পর নবপত্রিকাকে নতুন শাড়ি পরানো হয়। তারপর পূজামণ্ডপে নিয়ে এসে নবপত্রিকাকে দেবীর ডান দিকে একটি কাষ্ঠসিংহাসনে স্থাপন করা হয়। পূজামণ্ডপে নবপত্রিকা প্রবেশের মাধ্যমে দুর্গাপূজার মূল অনুষ্ঠানটির প্রথাগত সূচনা হয়। নবপত্রিকা প্রবেশের পর দর্পণে দেবীকে মহাস্নান করানো হয়। এরপর বাকি দিনগুলিতে নবপত্রিকা প্রতিমাস্থ দেবদেবীদের সঙ্গেই পূজিত হতে থাকেন। বিশেষভাবে লক্ষণীয় হল, নবপত্রিকা প্রবেশের পূর্বে পত্রিকার সম্মুখে দেবী চামুণ্ডার আবাহন ও পূজা করা হয়। পত্রিকাস্থ অপর কোনো দেবীকে পৃথকভাবে পূজা করা হয় না।

আজ এই পর্যন্ত পরের পর্বে বৃক্ষ পূজার ধর্মীয় গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা কর হবে।

মা দুর্গাদেবীকে প্রণাম করার মন্ত্র:
সর্ব মঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ সাধিকে।
শরণ্যে ত্রম্বকে গৌরি নারায়নী নমস্তুতে।।

অর্থঃ
হে দেবী সর্বমঙ্গলা, শিবা, সকল কার্য সাধিকা, শরণযোগ্য, গৌরি ত্রিনয়ণী, নারায়নী তোমাকে নমস্কার।।

তথ্যসংগ্রহ সনাতন ভাবনা অনলাইন থেকে।

শুভ নবমী

“যেও না নবমী নিশি লয়ে তারা দলে”
তুমি গেলে দয়াময়ী এ পরাণ যাবে।”

এটাই তো আমাদের সবার মনের একান্ত কথা হয় নবমীর দিনে। সারা বছর ধরে যে উৎসবের জন্য আমরা অপেক্ষা করে থাকি, তার বিদায় ঘন্টা বাজিয়ে দেয় এই নবমী নিশি। তাই নবমী নিশিকে আমরা সবাই ধরে রাখতে আকুতি জানাই। আমাদের সমস্ত তিথি-নক্ষত্র হিসাব করা হয় চন্দ্রের অবস্থান দেখে। সেই অনুযায়ী মাসের তিরিশ দিনকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে, পনেরো দিন করে। ভাগ দুটো হলো শুক্ল পক্ষ ও কৃষ্ণ পক্ষ। মহানবমী এই শুক্লা নবমী যাকে শাস্ত্রে বলে ‘উগ্রপদা’। কথিত আছে নবমী তিথিতে মানুষের নাকি উত্তেজনা বাড়ে অর্থাৎ মানুষের মধ্যে অপরাধের প্রবণতা বাড়ে, অশুভত্বের দিকে মানুষ এই তিথিতে বেশী ঝুঁকে যায়। কিন্তু, এই অশুভত্বকে বিনাশ করে শুভশক্তির জয়ের জন্য তাই এই মহানবমী তিথিকেই অন্য নবমী তিথির মধ্যে শুভ ধরা হয়। জপ, তপ, উপাসনা এইসব তাই এই তিথিতে বেশি করে করা হয়। তাই নবমী পূজা ও বলিদান পর্ব আছে। ‘বলি’ শব্দের অর্থ উৎসর্গ, ত্যাগ। আমাদের অহঙ্কার, কাম-ক্রোধ ইত্যাদি হলো স্বরূপ বোধের প্রতিবন্ধক। এগুলিকে বিসর্জন দেওয়াই বলির তাৎপর্য।
তন্ত্রশাস্ত্রে আছে —
“কামক্রোধৌ ছাগবাহৌ বলিং দত্ত্বা প্রপূজয়েৎ”।

অর্থাৎ কামক্রোধরূপী ছাগ ও মহিষকে বলি দেওয়া। এই পূজার ক্ষণটিতে মায়ের চরণে স্ব স্ব অন্তরে স্থিত চন্ডমুন্ডরূপ যেমন, কাম-ক্রোধকে বিসর্জন দিয়ে থাকেন।

শ্রীশ্রীচন্ডীতে আছে, মহারাজ সুরথ ও সমাধি বৈশ্য নদীপুলিনে দেবীর পূজা করে নিজেদের শরীর থেকে রক্ত নিয়ে বলি দান করেন বা উৎসর্গ করেন। জীবশরীরে রক্ত মূল্যবান বস্তু। তাকে দান অর্থাৎ আত্মনিবেদন করলেন। এই পূজার শেষ পর্যায়ে হয় ‘হবন’ বা যজ্ঞ। দেবীর সামনে তাঁর নামে অগ্নিস্থাপন করে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। কিন্তু যজ্ঞ হলো একটি সম্পূর্ণ পৃথক পূজা। আগে যেমন প্রতিমাতে, ঘটে যে পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল তারই অনুষ্ঠান এখন অগ্নিতে অর্থাৎ যজ্ঞে। বৈদিক যুগের অনুকল্প হিসাবে এই কার্য হয়ে থাকে। অগ্নিকে সাক্ষী রেখে কল্পারম্ভে সঙ্কল্পিত কার্যের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

নবমীর বিশেষত্ব যদি কিছু থাকে তা হল এই হোম-যজ্ঞ অনুষ্ঠানের মধ্যে নবমীতেই মূলত হোম হয়ে থাকে, ব্যতিক্রমী নিয়মও থাকতে পারে। মূলত আঠাশটা বা একশো আটটা নিখুঁত বেলপাতা লাগে। বালি দিয়ে যজ্ঞের মঞ্চ বানিয়ে বেলকাঠ ঠিকভাবে নিয়মমতো সাজিয়ে পাটকাঠি দিয়ে আগুন ধরিয়ে ঘি’তে চুবিয়ে বেলপাতাগুলো নিবেদন করা হয়। তারপর সবার শেষে একটি কলা চেলীতে বেধে পান নিয়ে সেটা ঘি’তে চুবিয়ে পূর্ণাহুতি দেওয়া হয়। তারপর তার মধ্যে দই দেওয়া হয় ও দুধ দিয়ে আগুন নেভানো হয়।

আমার মনে হয় দুর্গামূর্তির মধ্যে এক রাজকীয় ভাব আছে, ছেলেমেয়ে (জানি তারা কেউই তার নিজের সন্তান নয় ) সবাইকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক যোদ্ধা, যিনি রূপং দেহি, যশং দেহি,আবার একজন সাধিকা, আমাদের সকলের কল্যাণকারি, আমরা যাকে মা বলি। এই মৃন্ময়ী মুখে তাঁর চিন্ময়ী রূপ দেখে মায়া হয়। মনে হয় আমাদের ঘরের মেয়ে। আমরা যতই নবমী তিথিকে বিদায় দিতে না চাইনা কেন, সে তো যাবেই। শুধু আমাদের মন বলে যাবে …

“ওরে নবমী নিশি ! না হৈওরে অবসান।
শুনেছি দারুণ তুমি, না রাখ সতের মান।।

শুভ নবমী।

শুভ অষ্টমী

আজ অষ্টমী পূজা, আজ সক্কাল সক্কাল স্নান সেরে নতুন পোশাক পরে অঞ্জলী দেবার দিন। যদিও অঞ্জলী সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত দেওয়া যায়!

অঞ্জলি:
অষ্টমী মানেই কিন্তু পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া নতুন জামাকাপড় পড়ে। স্নান করে শুদ্ধ বস্ত্রে ঠাকুরের সামনে তিনবার হাতে গঙ্গাজল নিয়ে আচমন করে এবার হাতে ফুল নিন ও তিনবার পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র পড়ে ঠাকুরের চরণে তা প্রদান করুন। এবার প্রণাম মন্ত্র অর্থাৎ “ওঁ সর্বমঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ সাধিকে, শরণ্যে ত্রম্ব্যকে গৌরী নারায়ণী নমস্তুতে” ইত্যাদি বলে অঞ্জলি শেষ করে মায়ের পায়ে ফুল দিতে হয়।

কুমারী পুজো:
সকল মেয়েই মা দুর্গার অংশ, তাই মৃন্ময়ী প্রতিমাকে পুজো করার পাশাপাশি কম বয়সের ছোট মেয়েদেরও পুজো করা হয়। পৌরাণিক কাহিনি অনুসরণে কুমারী পূজার উদ্ভব হয় কোলাসুরকে হত্যার মধ্য দিয়ে। উল্লেখ্য, কোলাসুর নামক অসুর এক সময় স্বর্গ-মর্ত্য অধিকার করে নেয়। ফলে বিপন্ন দেবরা মহাকালীর শরণাপন্ন হন। দেবতাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে দেবী মানবকন্যা রূপে জন্মগ্রহণ করেন কুমারী অবস্থায় কোলাসুরকে হত্যা করেন। এই সূত্রে কুমারী পূজার প্রচলন হয়।

বেলুড় মঠে স্বামী বিবেকানন্দ প্রথম কুমারী পূজা করেন ১৯০১ সালে। ষোলো বছরের মেয়ে পর্যন্তই কুমারী হিসাবে পুজো করা যায়। একটি মেয়েকে প্রথমে আমন্ত্রণ করে তাকে শাড়ি ও গয়না উপহার দিতে হয়। সেই শাড়ি ও গয়না তাকে পড়িয়ে মাতৃমূর্তির সামনে এনে উঁচু আসনে বসাতে হয়। কুমারীর পা জল দিয়ে ধুয়ে দেওয়া হয়। তারপর তার পূজা শুরু হয়। তাকে মিষ্টান্নাদি নৈবেদ্য প্রদান করা হয়। তার উদ্দেশে অঞ্জলি দেওয়া হয়। এইদিন ওই কুমারীকে দেবী দুর্গার রূপ হিসাবেই ধরা হয়।

বয়সের ক্রমানুসারে পূজাকালে এই সকল কুমারীদের বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। যেমন:
এক বছরের কন্যা – সন্ধ্যা
দুই বছরের কন্যা – সরস্বতী
তিন বছরের কন্যা – ত্রিধামূর্তি
চার বছরের কন্যা – কালিকা
পাঁচ বছরের কন্যা – সুভগা
ছয় বছরের কন্যা – উমা
সাত বছরের কন্যা – মালিনী
আট বছরের কন্যা – কুষ্ঠিকা
নয় বছরের কন্যা – কালসন্দর্ভা
দশ বছরের কন্যা – অপরাজিতা
এগারো বছরের কন্যা – রূদ্রাণী
বারো বছরের কন্যা – ভৈরবী
তেরো বছরের কন্যা – মহালপ্তী
চৌদ্দ বছরের কন্যা – পীঠনায়িকা
পনেরো বছরের কন্যা – ক্ষেত্রজ্ঞা
ষোলো বছরের কন্যা – অন্নদা বা অম্বিকা

শ্রীরামকৃষ্ণের মতে— সব স্ত্রীলোক ভগবতীর এক একটি রূপ। শুদ্ধাত্মা কুমারীতে ভগবতীর বেশি প্রকাশ। দুর্গাপূজার অষ্টমী বা নবমীতে সাধারণ ৫ থেকে ৭ বছরের একটি কুমারীকে প্রতিমার পাশে বসিয়ে পূজা করা হয়। চণ্ডীতে বলা হয়েছে:
যা দেবী সর্বভূতেষু
মাতৃরূপেণ সংস্থিতা
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তসৈ নমঃ নমঃ

সন্ধি পুজো:
মা দুর্গার আরেক রূপ হল মহিষাসুর-মর্দিনী। মহিষাসুর মর্দিনী অর্থাৎ তিনি এই অসুরের নিধন করেছিলেন। কিন্তু দুর্গা পুজোর পিছনে আরো অসুরবধের কাহিনী আছে, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সন্ধিপূজা। অষ্টমী শেষ হয়ে যখন নবমী তিথি শুরু হয়ে তখন সন্ধিপূজার মাধ্যমে মায়ের আরাধনা করা হয়। এই সন্ধিপূজা হল সেই সন্ধ্যার প্রতীক যখন মা দুর্গা চন্ড ও মুন্ড নামে দুই ভয়ঙ্কর অসুরকে বধ করেছিলেন।মূলত অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিস্থলে অর্থাৎ অষ্টমী শেষ হবার ২৪ মিনিট ও নবমী শুরু হবার ২৪ মিনিট এই সময়ের মধ্যে এই পূজা হয়। এই সময়ে মূলত দেবী চামুন্ডার পূজা করা হয়। এই পূজাতেই ১০৮ টি পদ্মফুল দেবীকে উৎসর্গ করা হয়। এর মূলে রামায়ণের কাহিনী আমরা সবাই জানি। রাবণ বধের জন্য রাম ১০৮ পদ্ম দিয়ে দেবীর পূজা করেন ও তারপর রাবণ নিধন হয়। সেই সূত্রেই এই সন্ধি পূজা করা হয়। দেবীর সামনে নানা রকম খাদ্যদ্রব্য কাঁচা অবস্থায় এবং রান্না করা ভোগ হিসাবেও রাখা হয়। ১০৮ টি মাটির প্রদীপ দেবীর সামনে জ্বালানো হয়।

কোনো কোনো জায়গায় এই দিন বলিও দেওয়া হয়। বলি হিসাবে পশুবলি নিয়ে অনেক নিষেধাজ্ঞা জারি আছে বলেই আঁখ, চালকুমড়ো এইসব বলি হিসাবে প্রদত্ত হয়।কোনো বছর অষ্টমী, নবমীর সন্ধিক্ষণ রাত ৮টাতেও হতে পারে আবার কোনো বছর ভোররাতেও হতে পারে। সেই সময় দেবীর গাত্রবর্ণ বা গায়ের রঙ ছিল স্বর্ণাভ বা সোনালী এবং তিনি হলুদ শাড়ি পরে অবতীর্ণ হন। তাঁর দশ হাত সজ্জিত ছিল দশ ধরণের অস্ত্রে। যখন মহিষাসুরের সঙ্গে ভয়ানক যুদ্ধে তিনি ব্যস্ত, সেইসময় মহিষাসুরের দুই বন্ধু চন্ড এবং মুন্ড পিছন থেকে দেবীকে আক্রমণ করে। রণনীতির চুক্তি ভঙ্গ হওয়ায় দেবী অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হন এবং রাগে তাঁর মুখ নীল হয়ে যায়। দেবী তাঁর ত্রিনয়ন উন্মীলিত করেন এবং চামুন্ডা রূপ ধারণ করেন। ঘনীভূত রক্তের কালীরই অন্য রূপ হল চামুন্ডা রূপ। চামুন্ডা রূপে দেবী দুর্গা চন্ড এবং মুন্ডের মাথা কেটে নেন তাঁর হাতের খড়গ দিয়ে। দেবীর এই চামুন্ডারূপেরই আরাধনা করা হয় সন্ধি পূজার মাধ্যমে।

শুভ অষ্টমী।