বিভাগের আর্কাইভঃ জীবন

হৃদয়ের পোস্টমর্টেম

‘আমার শরীরে ব্রিটেনের রক্ত’ এই কথা শুনে আতকে উঠেছে আমার প্রাণের বন্ধু। যদিও পরিষ্কার কিছু বলেনি তবু বোঝা যায় সে আমাকে লোভী ভাবছে। একটু আরাম-আয়েশ আর ক’টাকার লোভে নিজের শিকড়কে অস্বীকার করে আছি। তার ধারণা আমি আপাদমস্তক একজন লোভী তাই দেশ নিয়ে কোনো কথা আমার খাটে না। দেশ নিয়ে কোন মন্তব্য করা আমার সাজে না।

আমি লোভী অস্বীকার করছি না। একটু ভালো থাকা, ভালো খাওয়া, ভালো পরার লোভ আমাকে দেশান্তরি করেছে এটা অস্বীকার করছি না। কিন্তু এর বিপক্ষে বা পক্ষে আমি হাজারটা যুক্তি দিতে পারি কিন্তু সেসবে না গিয়ে শুধু বলব আমি দেশান্তরি হয়েও এক মুহূর্তের জন্য দেশ ত্যাগ করতে পারিনি। ৩৫ বছর ধরে দেশ থেকে দূরে আছি কিন্তু দেশ আমি থেকে দূরে নেই।

এখনো প্রতিটি সকাল আমি দোয়েলের ভোর দেখি, এখনো প্রতিটি দুপুরে ঘোর লাগা ঘুঘুর ডাক শুনি, এখনো প্রতিটি গোধূলি পশ্চিমের সূর্য হয়ে মনে ধরা দেয়, এখনো প্রতিটি রাত জোনাকির আলো হয়ে লেগে থাকে হাতের তালুতে।

আমি দেশ থেকে দেশান্তরি হয়েছি কিন্তু পালিয়ে আসিনি। দেশ থেকে পালানোর মতো কোনো কারণ ঘটেনি। স্বাভাবিক নিয়মে প্রবাসী হয়েছি কিন্তু আমার মন এখনো প্রবাসে অভ্যস্ত হতে পারেনি।

‘৩৫ বছর ধরে ব্রিটেনে আছি’ স্বাভাবিকভাবেই আমার রক্তে ব্রিটেন ঢুকে গেছে। আমি তাদের নুন খেয়েছি, তাদের ব্রেড, বাটারে হৃষ্টপুষ্ট হয়েছি। আমি নিমকহারাম নই; আমার জীবনে তাদের অবদান কোনভাবেই অস্বীকার করব না। আমি তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশে কুণ্ঠিত নই।

ব্রিটেন আমার রক্তে ঢুকে গেছে বলে বাংলাদেশ নিয়ে মন্তব্য করার কোন অধিকার রাখি না এটা খুবই বালখিল্য চিন্তা বলে আমার মনে হয়। আমি প্রত্যেক বছর কিংবা দু’বছর অন্তর একবার দেশে যাই, লক্ষ্য করেছি যারা ষাট, সত্তর, আশি বছর ধরে বাংলাদেশে আছে তাদের বুকে বাংলাদেশ নেই। তারা বাংলাদেশে থাকে ঠিকই কিন্তু বাংলাদেশ ধারণ করে না। আমি অনেক লোককে জানি যারা দেশের নুন খায় ঠিকই কিন্তু গুণ অন্য দেশের গায়। ১০০ বছর ধরে দেশে থেকেও দেশকে তারা আপন ভাবতে পারেনি।

‘আরাম আয়েসের লোভে দেশান্তরী হয়েছি’ এই বাক্য ১০০ ভাগ সত্য নয়। মানুষ কাজের জন্য, সুবিধার জন্য জায়গা বদল করে। আমিও কিছুটা ভালো সুযোগ সুবিধার জন্য জায়গা বদল করেছি।

দেশান্তর বা জায়গা বদল করলেই দেশের সাথে সম্পর্ক চুকেবুকে যায় না। বরং দেশ থেকে দূরে থাকলে দেশকে আরো গভীর ভাবে পাওয়া যায়, দেশকে আরো গভীরভাবে অনুভব করা যায়। প্রেমের মর্যাদা বিরহী প্রেমিক বুঝে। আমার কাছে দেশের কী মর্যাদা সেটা বুঝতে হলে হৃদয়ের পোস্টমর্টেম করতে হবে কিন্তু সে পোস্টমর্টেমেও দেশের প্রতি গাঢ় ভালোবাসা প্রকাশ পাবে কিনা সন্দেহ থেকে যায়।

ব্রিটেন আমার রক্তে এজন্য আমার বাঙ্গালীত্ব খারিজ হয়ে গেছে এটা সেই ভাবতে পারে যার দেশ প্রেম দোদুল্যমান, যে এখনো দেশ নিয়ে সন্দেহ মুক্ত নয়। যে বাংলাদেশের আলো বাতাসে শ্বাস নেয় কিন্তু অন্য দেশকে মনিব ভেবে সেজদা করে।

বন্ধুর মন্তব্য পড়ে আমার মনে হল সে আস্থাহীনতায় ভুগছে। দেশ নিয়ে সে সন্দেহ মুক্ত হতে পারছে না অথবা অন্য কোন দেশ তার মনে এমন ভাবে আসন গেড়েছে যে সবাইকে তার মত ভাবছে।

দেশ নিয়ে কিংবা দেশ প্রেম নিয়ে যার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ আছে সে হীনম্মন্য হতে বাধ্য, আমরা জানি হীনম্মন্যতা হচ্ছে মানসিক অসুস্থতা। আমার বন্ধুর সুস্থতা কামনা করছি…

বি ব র্ত ন বা দ

3179

আমরা প্রতিদিন স্বাগত জানাচ্ছি বিবর্তনবাদকে, প্রতি মুহূর্তে গত হচ্ছে আমাদের বর্তমান, প্রতি নিয়ত গমন করছি নবীন পটে। আমরা যা শিখেছি পাঠক্রমে, যা কিছু আমাদের মুখস্থ, জানা অজানায় , ঘুরে ফিরে হাজির হচ্ছি স্মৃতিপটে!… সোজা পথ হেঁটে যাচ্ছি,

হেঁটে যাচ্ছি বাঁক- বক্র, ভিন্ন সীমানায়…

সব ছেড়ে একাকী পৌঁছে যাচ্ছি একান্ত ঠিকানায়। সব বুঝেও ভুলে যাচ্ছি চিরন্তন বাণী, আপন চোখ বুজে ডুব দিচ্ছি নিষিক্ত রাতের বুকে, অন্ধকার রহস্যে, গোলকধাঁধায়! অশনি জেনেও হাত বাড়াচ্ছি স্বৈরিণীর ডাকে! যেমন খুঁজে বেড়াচ্ছি অজানা সুখ শশিকান্ত নির্বাণে, বিপন্ন অসুখে, শরীরী সঙ্গমে, স্থবির অক্ষে…

মুহূর্ত গুলো এমনিই- পলকে পলকে বিগত হয়ে যায়, স্মৃতি হয়ে যায়, তিক্ত স্বাদে মিশে যায় স্খলনের একেক একটি ফোঁটা…পুনরায় খুঁজে বেড়াই পুরনো কোন ভোর- শিশির সিক্ততায়

কবিতার মত নরম রোদ্দুরের হাসি, খুঁজে বেড়াই ঝড়ো হাওয়া, নিগূঢ় সন্ধ্যা যাপন!

জলরঙ স্বপ্ন

3168

এক স্বপ্ন থেকে আর এক স্বপ্নের দূরত্ব কয়েক আলোকবর্ষ!

দুই স্বপ্নের মাঝে এসে দাঁড়ায়
সাংঘাতিক ভুল, যা শূন্যতার মুখোমুখি হবার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

স্বপ্নের সারথি ছিল জলরঙ, তেলরঙ, গাছ, পাখি, নদী, ফুল, নৌকো।
কোন এক ঝড়ের রাতে কে যেন তছনছ করে দিয়ে গেছে, ভ্যান গঘের সোনালি ধানক্ষেত।

স্বপ্নেরা ছিল ক্ষণজীবী
মৃত্যুতে কেঁপে উঠেছিল
মেরুদণ্ড, স্নায়ু,মজ্জা, মাংস

আমি এখন স্মৃতি সাম্রাজ্যের পাহারাদার
জেগে থাকি হোয়াং হো-র বুক চিরে।
কোন রাতচরা পাখি ভুল পথে চলে আসে,
আর অবিরাম স্পষ্ট উচ্চারণে জেগে ওঠে
পুরনো রক্তাক্ত স্মৃতি।

নিরাপদ দূরত্ব রেখে সরে যাই এক পৃথিবী থেকে অন্য পৃথিবীতে।

নীপা নদীর গল্প…

3117

অনেক কিছু চাইলেও আর মনে করতে পারিনা। অথবা মনে করতে ইচ্ছে করেনা। সময়ের সাথে বোঝাপড়া হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। আমরা আর আগের মত বন্ধু নই, বরং রেললাইনের মত পাশাপাশি বয়ে যাওয়া অন্তহীন যাত্রার সহযাত্রী মাত্র।

কিছু ঘটনা আছে যার দাগ মুছার নয়। চাইলেও পাতা উলটে অধ্যায়ের ইতি টানা যায়না। নীপা নদীর গল্প তেমনি এক অধ্যায় যা কোনদিনও পুরানো হবেনা। পাতা উলটে অধ্যায়ের ইতি টানা যাবেনা।

আসলে নীপা নামের কোন নদী নেই। মানচিত্র ঘাঁটলে এ নামের কোন নদীর সন্ধান পাওয়া যাবেনা। এ ছিল কৈশোরের একখণ্ড চপলতা, চাঞ্চল্যে ভরা কিছু আবেগের অভয়ারণ্য।

জাপারোঝিয়া। ইউক্রেইনের দক্ষিণ-পূব দিকের অখ্যাত এক শিল্প শহর। কারখানার চিমনি হতে বেরিয়ে আসা ধোঁয়ার চাদরে মুখ ঢেকে রাখে এ শহর। এবং তা বছরের প্রায় ৩৬৫ দিন। শহরের বাতাসও ভারী। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। প্রকট এক উটকো গন্ধ শরীরের সবকটা অঙ্গে লেপটে থাকে। তেমনি এক শহরে লেখা হয়েছিল আমার লম্বা প্রবাস জীবনের প্রথম অধ্যায়।

আঠার বছরের টগবগে তরুণ আমি। অনেকটা মায়ের কোল হতে বেরিয়ে এসে পা রেখেছি বিস্ময়কর এক জীবনে। সকালে ঘুম ভাঙ্গলে কেউ আর টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে অপেক্ষায় থাকেনা। বেলা গড়ানোর আগে দৌড়াতে হয় ক্লাসে। লড়াই করতে হয় হিমাংকের নীচে ২০ ডিগ্রী তাপমাত্রার সাথে। ক্লাস হতে ফিরে আয়োজন করতে হয় রাতের খাবারের। পরদিন ক্লাসের হোম-ওয়ার্ক করতে গিয়ে অনেক সময় মধ্যরাত পেরিয়ে যায়। জাগতিক অনেক চাহিদাকে বিদায় জানাতে হয় পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার কারণে।

এর পরেও শনিবার আসে। রাজ্যের স্বস্তি নিয়ে ঘরে ফিরে ভুলে যাই ফেলে আসা ছয় দিনের ক্লান্তি। ডর্ম হতে বেরুলেই একটা বড় স্টেডিয়াম। দিনের বেলা খেলাধুলার বিদ্যাপীঠ হলেও রাতে তা পরিণত হয় মানব মানবীর মিলন মেলায়। আরও একটু হাঁটলে দেখা মিলবে ওপেন এয়ার ডিস্কোটেক। বাদামি চামড়ার এমন আদমদের সাথে এই প্রথম সাক্ষাৎ এ অঞ্চলের মানুষদের। আগ্রহের সীমা নেই। বিশেষকরে তরুণীদের।

ভাষা স্কুলের ছাত্র আমরা। সংখ্যায় ১৭ জন। এক বছর স্থায়ী এ কোর্সের শুরুতে প্রায় সবাই জড়িয়ে যায় সম্পর্কে। একজনের সাথে এক শিক্ষিকার সম্পর্ক বলে দেয় পরিবেশের। জীবন কঠিন ও রুক্ষ হলেও তাতে রঙের কমতি ছিলনা।

প্রথম স্কলারশিপের রুবেল হাতে আসতে নড়েচড়ে বসি সবাই। এতদিনের জমানো সমীকরণ মেলানোর তাগাটা হঠাৎ করে জীবন্ত হয়ে উঠে। এ সমীকরণ একেক জন্যে ছিল একেক রকম। বান্ধবীদের নিয়ে বেরিয়ে পরার মেনুটা ছিল সবার উপরে। আমি ও আমার রুমমেট সজল দুজনেই ছিলাম ঘরকুনো। স্থায়ী বান্ধবী আমাদের বড়শিতে তখনও ধরা পড়েনি। রুবেল হাতে কি করা যায় এ নিয়ে দুজনেই গবেষণায় বসে যাই।

মদের দোকানটা আমাদের ডর্ম হতে খুব একটা দূরে ছিলনা। ট্রামে চড়লে একটা স্টপেজ। ভাড়া ৫ কোপেক। অবশ্য ৫ কোপেকে যতক্ষণ না ট্রাম হতে বেরিয়ে আসছি শহরের শেষ মাথা পর্যন্ত জার্নি করা যায়। আমাদের দুই বন্ধুর সিদ্ধান্ত ছিল ফেলে আসা ১৮ বছরের জীবনকে চ্যালেঞ্জ করা। এক বোতল ভদকা কেনার সিদ্ধান্তটা ছিল সে চ্যালেঞ্জেরই অংশ।

দোকানে ঢুকতেই ধাক্কা। ভাষা জ্ঞান কম হওয়ার কারণে ইতিপূর্বে রেকি করে যাওয়া দোকানের ভাষা বুঝতে পারিনি। শনিবার সন্ধ্যা ৬টার পর ভদকা বিক্রি বন্ধ। এমনটাই শহর কম্যুনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত। শহরের জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশ শ্রমিক হওয়ার কারণে এখানে এলকোহল সমস্যা আকাশচুম্বী। তাই এ সিদ্ধান্ত।

এক বোতল সস্তা লাল ওয়াইন নিয়ে ডর্মে ফিরে আসি। এখানেও সমস্যা। ডর্মে মদ্যপান বৈধ না। ধরা পরলে দেশে পাঠিয়ে দেয়ার মত কঠিন শাস্তিরও বিধান আছে। কিন্তু তাই বলে স্থানীয় ছাত্র-ছাত্রীরা মদ্যপান হতে বিরত থাকবে এমন দেশ এটা নয়। মদ্যপান এখানে অনেকটা বাধ্যতামূলক। শিশুর জন্ম যেমন উৎযাপন করা করা হয় মদ্যপান দিয়ে একই শিশু বেড়ে উঠে কবরের দিকে রওয়ানা দিলে সেটাও সেলিব্রেট করা হয় মদ দিয়ে।

রাতের খাবারে অতিরিক্ত কিছু যোগ করে তৈরি হই নতুন অধ্যায়ের। দরজা বন্ধ করার আগে বাকি সবাইকে অনুরোধ করি কিছুটা সময়ের জন্যে বিরক্ত না করতে।

সজলের চোখে মুখে দুশ্চিন্তার রেখা ধরতে আমার সময় লাগেনি। বোর্ডের পরীক্ষায় প্রথম হওয়া সজলের চেহারায় ছিল শিশু সুলভ একটা ভাব। বুঝা যায় জীবনের অনেক অধ্যায়ের সাথে দেখা হয়নি।
কারণ জানতে চাইলে সে ভেঙ্গে পরল। তার গলায় ঝুলে থাকা দুটো তাবিজের দিকে ইঙ্গিত দিল। চোখ আর নাকের পানিতে ভেসে কোলের সন্তানকে বিদায় দেয়ার আগে মা অনেক কষ্ট করে যোগার করেছিল তাবিজ দুটো। সজলের ভয় তার গলায় তাবিজ নয়, খোদ মা ঝুলে আছেন এবং চোখ কান খোলা রেখে দেখছেন তার কর্ম।
তাবিজ শরীরে থাকা পর্যন্ত সে মদের গ্লাসে হাত দিতে পারবেনা, এমনটাই তার সিদ্ধান্ত। আমিও বাধা দিতে পারলাম না। কারণ মার স্মৃতি আমারও তখন অনেক কাছের। উঠিয়ে রাখলাম মদের বোতল সে যাত্রায়।

পরদিন প্রস্তাবটা দিতেই সজল রাজী হয়ে গেল।
ট্রাম ধরে আমাদের অনেক দূর যেতে হবে। ঘণ্টা খানেকের পথ। অন্য কোন বিকল্প নেই। ওখানে গেলেই দেখা মিলবে নীপা নদীর। আমার প্রস্তাব ছিল নদীতে ভাসিয়ে দিতে হবে তাবিজ দুটো। মদ্যপানে পাপ বলে কিছু থাকলে তারা তার সাক্ষী হবেনা। বরং নদীর পানিতে ডুবে আরও পুত পবিত্র হয়ে যাবে।
সজলের পছন্দ হয়েছিল আমার বিশ্লেষণ। এবং পরের রোববার খুব ভোরে কাউকে কিছু না বলে দুজনে বেরিয়ে পরি নীপা নদীর সন্ধানে।

নীপা নদীটার আসল নাম না। এর নাম দিনেপ্রর। বিশাল এক নদী। লম্বায় ইউরোপের ৪র্থ বৃহত্তম। ভালদাই পাহাড়ে জন্ম নিয়ে রাশিয়া, ইউক্রেইন ও বেলারুশ হয়ে মিশে গেছে কৃষ্ণ সাগরে। ভলগা, দানিয়ুব ও উরাল নদীর পরেই লম্বার বিবেচনায় দিনপ্রর স্থান। স্থানীয়রা আদর করে এর নাম দিয়েছিল নীপা।

বিশাল একটা হাইড্রোলিক পাওয়ার স্টেশনের বাঁধে এসে থামে আমাদের জার্নি। নদীকে আটকে বিদ্যুৎ তৈরির এমন কারখানার সাথে এটাই আমাদের প্রথম পরিচয়। লেনিনের নামে তৈরি এ বাঁধও সোভিয়েত দেশের গর্ব। বাঁধটার ঠিক মাঝেমাঝে এসে দুজনে থেমে যাই। গলায় ঝোলানো স্বর্ণের চেইন হতে তাবিজ দুটোকে খুলে ছুড়ে ফেলি নদীতে। আমি নিজেও অংশ নেই এ অভিযানে। সজলকে নিশ্চিত করতে চেয়েছিলাম পাপ বলতে কিছু থাকলে তা বন্ধুর সাথে ভাগাভাগি করতে আমার আপত্তি নেই।

এবং এখানেই শেষ ও শুরু দুই জীবনের। বলা চলে সীমান্ত অতিক্রম করা। সীমান্তের ওপারে ছিল মা-বাবা ভাই-বোনদের আদর স্নেহ ও ভালবাসা, আর এপারে ছিল নতুন এক জীবনের হাতছানি।

নীপা নদীর কাছে আশ্রয় চাওয়ার এ ছিল কেবল শুরু। এ নদীতে অনেক পানি বইবে। তার সাথে আমি ও আমরাও পাড়ি দেব অনেক অজানা অচেনা ঘাঁট। নদী পাড়ের এক বছরের জীবন নিয়ে লিখতে গেলে হাজার রজনীর আরব্য উপন্যাস লেখা যাবে। যেখানে থাকবে জীবন যুদ্ধে বেড়ে উঠার সব উপাদান।

নীপা নদীকে এ লেখাটা লেখার তাগাদাটা এসেছে আজকে একটা খবর পড়ে। জাপরোঝিয়ার একটা বিরাট অংশ দখলে নিয়ে পুতিন বাহিনী ওখানে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। কেবল হাইড্রোলিক পাওয়ার ষ্টেশনই না, ইউরোপের বৃহত্তম পারমাণবিক পাওয়ার ষ্টেশনের দখল নিয়ে ব্লাকমেইল করছে স্থানীয়দের জীবন। শহরের পাবলোকিসকাস এলাকার যে মদের দোকানটায় শুরু হয়েছিল জীবনের নতুন এক অধ্যায় তার খুব কাছে দুটো মিসাইল আঘাত হেনেছে। লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে ওখানকার সবকিছু।

শান্ত যে নদীতে এক সময় তাবিজ ডুবিয়ে পুত পবিত্র হওয়ার চেষ্টা করেছি সে নদী এখন অশান্ত। কৈশোর যৌবনের অনেক অলিগলি এখন ক্ষতবিক্ষত। কষ্টটা এখানেই।

নীতির মা

আজ আমাদের ঘরে ‘নীতি’র মা এসেছিলেন। তিনি আশা মানে ভীতিকর পরিস্থিতি। আমাদের যাপিত জীবনে তিনি উৎপাতের মত। তিনি এলে আমরা চুপ করে থাকি; যা বলার তিনি বলে যান; তার বলে যাওয়া অখাদ্য সহ্য করি অথবা গিলি। তিনি চলে গেলে আটকে যাওয়া শ্বাস ছাড়ি, সাথে ছাড়ি তার জোর করে খাওয়ানো নীতি-বাক্য।

তিনি অবশ্য ঘন ঘন আসেন না, মাঝেমধ্যে উদয় হন। তার আসা আমাদের পছন্দ নয় তবু তার মুখের সামনে দরজা বন্ধ করে দিতে পারি না। একবার চেষ্টা করে দেখেছি। জানালা দিয়ে সামনের রাস্তায় দেখলাম তিনি আসছেন আমাদের ঘরই টার্গেট করে আসছেন কিনা নিশ্চিত ছিলাম না তবুও তিনি যাতে অনায়াসে ঘরে ঢুকে পড়তে না পারেন সেজন্য দরজার ট্রিপল লক লাগিয়ে নিলাম। ভেবেছিলাম দরজা খুলতে পারছেন না তাই চলে যাবেন; কিন্তু এমন নির্লজ্জ যে যাওয়ার নামই নিলেন না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরে আমাদেরই ধৈর্যচ্যুতি ঘটলো; দরজা খুলে তাকে ভিতরে আসতে দিতে বাধ্য হলাম। ঢুকেই যথারীতি অযাচিত লেকচার। একই লেকচার বারবার কাহাতক স্বচ্ছ করা যায় বলুন, তবু ‘নীতি’র মা বলে কথা চোখ শরমের কারণেও মুখ বন্ধ করতে বলতে পারি না। তিনি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তার কথাগুলো বলে যেতে থাকেন।

আমরা তাকে এড়িয়ে যেতে চাই তিনি তা ভালো জানেন তবু কেন বারবার অসফল চেষ্টা করেন! তার উপস্থিতিতে আমাদের চোখে মুখে স্পষ্ট বিরক্তি ফুটে উঠে, তাকে কিন্তু কোনদিন এ নিরুৎসাহিত হতে দেখি না। আমাদের মনে মগজে তার কথাগুলো পৌঁছে দিতে বিন্দুমাত্র কসুর তিনি করেন না। মাঝে মাঝে বিভ্রান্ত হয়ে যাই মনে হয় তার কথাগুলি মেনে নিলে মন্দ হয় না। মন যখন কিছুটা দুর্বল থাকে তখন তার কথাগুলোকে প্রাণবন্ত এবং প্রয়োজনীয় মনে হয়। কিন্তু এ দুর্বলতা ক্ষনিকের। বাস্তবের মাঠে নীতির মায়ের হাত ধরে চলা অসম্ভব। অনেকেই চেষ্টা করেছে; কেউ সফল হয়নি।

তার লেকচারে আমরা সাধারণত প্রতিউত্তর করি না, চুপচাপ শুনে যাই। একবার শুধু জানার জন্য জানতে চেয়েছিলাম। বলেছিলাম ‘মা জননী এই যে প্রতিবার কষ্ট করে আসেন, এই যে সময় নষ্ট করে দীর্ঘক্ষণ নীতিবাক্য শুনিয়ে যান আপনার শ্রম যে প্রতিবারই পণ্ডশ্রম হচ্ছে সেটা কী বুঝতে পারেন না’! তিনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে পুত্র স্নেহে বলেন ‘আমি শুধুই সম্ভাবনা দেখি’!

নীতির মা তার মত চেষ্টা করে যান তার কথায় প্রভাবিত হতে অন্তর তাগিদ অনুভব করি। কিন্তু ঘরের বাইরে যেখানে পৃথিবী নামক গ্রহ থাকে সেখানে পা রাখার সাথে সাথে নীতির মায়ের কথা ভুলে যেতে হয়। সেখানে তার কোন অস্তিত্ব থাকে না।

নিমতিতা সরকারি কলোনি

এগারো
“ও-গৃহস্থ, আমার কলোমডা কোথায় বোলতি পারো?… ও-গৃহস্থ, আমার চ্যাবোনপ্রাশের কৌটো পাচ্ছি না”। মনে হবে ভাষকের বয়েস পঁচিশ বছরে আটকে, তেমনি নেশাধরানো গলা। ‘ও-গৃহস্থ’ ডাকে ঘর-উঠোন ভ’রে আছে সারাদিন। মায়াও “একটা কাজ যদি করার উপায় থাকে” এই নকল উষ্মা ঠোঁটে নিয়ে রান্নাঘর থেকে এসে জিনিস খুঁজে দিয়ে যাচ্ছে – কলোম তো নিজির বালিশির তলেই চাপা দিয়ে রাখিছেন।… ডান হাতখান টেবিলের দিকি বাড়ালিই চ্যাবনপেরাশ পাওয়া যায়”। তারপর ফিরে যেতে যেতে মুচকি হেসে শুনিয়ে যাচ্ছে, “শিব মন্দিরটা নড়ে, তবু ওমুক ভট্টাচার্য নড়ে না”।

সেনহাটির সিদ্ধান্তপাড়া গ্রামে তাদের বারবাড়িতে এক গেরুয়া-রঙ শিবদেউল ছিল যার পেছনের বারান্দায় গুচ্ছের চামচিকের বাসা। কর্তাকে নিয়ে বউ যে পারিবারিক প্রবাদ তৈরি করেছে, তাতে মানুষের দেবত্ব (নড়ে না) আর ভগবানের জ্যান্তভাব (নড়ে) প্রমাণিত হয়।

আপাতত একজন মধ্যবিত্ত ভগবানের পেছনে ফোঁড়া উঠেছে। কলোনির অধিবাসীবৃন্দের গায়ে এমন ছরবেছর ফোট গজায় আর চোখে আঞ্জনি। বাসুদেব আর সঞ্জু তারক ডাক্তারের বাড়ি পৌঁছে দেখেছিল, তিনি লুঙি প’রে বেকায়দাভাবে উপুড়, উরুর শুরুতে সবুজ তেলে ভেজানো তুলো লাগানো। ফোঁড়ার মুখ বেরিয়েছে কিনা, বেরোলে ক’টা মুখ, পেকে গেছে কি, পাকলে ফাটবে কবে, কোন তোকমা লাগালে তখনি পুঁজ টেনে নিয়ে ঘা শুকিয়ে দেয় — এমন চর্চায় নিমতিতা সারাক্ষণ গমগম করে। কখনও স্কুল থেকে কোনও হাফ-ছুটি কিশোর খুঁড়িয়ে বাড়ি ফিরছে, তার হাফ প্যান্টের ভেতর থেকে থাই বেয়ে নামা সরু রক্ত দেখে মেয়েরা হাতে মুখচাপা। তো উপুড়শোয়া ডাক্তার একটা ট্যাবলেট ফয়েল থেকে ছিঁড়ে অর্ধেক ভেঙে বাসুর হাতে দিয়েছিল। ওই তাতেই চাঁদের জ্বর সর্বশান্ত হল।

কিন্তু ইঁট পর পর থিয়ে ক’রে সাজিয়ে ঠেলে দিলে যেমন ধারাবাহিক পতনের লাইন আঁকা হয়, তেমনিই ছেলেটার শরীর। জ্বর ছেড়ে যাওয়ার পর মায়ের হাতে তিনচার গাল হাঁসের ডিমের ঝোল-ভাত খেয়ে শুয়ে পড়েছিল, এখুনি কেঁদে জেগে গেল বুকে সাঁই-সাঁই শব্দ নিয়ে। আঁতকে উঠল সন্তান পাহারা দেওয়া দুই মহিলা : “সব্বোনাশ! ও নাদু, ছেলের যে হাঁপির টান উঠিছে!” কাজেই, ব্যস্ত হাতে রান্নাঘরের দরজার শেকল খোলার শব্দ হয়। ফুলকাটা পেতলের বাটিতে সরষের তেল নিয়ে তাতে একমুঠো মাষকলাই ফেলে জনতা স্টোভে বসিয়ে দিল দিদিমা। আর মা ক্রমাগত “চাঁদ আস্তে… চাঁদ চুপ কর…অ্যাখোনি কমে যাবেনে, শোও সোনা… ঘুমোনোর চেষ্টা করো, আচ্ছা, কাল সকালে উঠে অ্যাট্টা নতুন জিনিস খাওয়াবানে তোমারে, ও চাঁদ, শুনলি?…”।

মা তো বোঝে না, শুতে গেলেই দম বন্ধ হয়ে যাবে। মুখ দিয়ে বাতাস টানার চেষ্টা করতে করতে চাঁদের গলা শুকিয়ে এখন কাশি হচ্ছে, প্রতিধ্বনিময় ঘং ঘং — স্টেশানে লোহার তারে ঝোলানো কাটা রেললাইনে হাতুড়ির বাড়ি মারলে যেমন ঘন্টা বাজে। যত শ্বাসকষ্ট বাড়ে, তত সমস্ত পৃথিবীর ‘পরে রাগ তৈরি হয় তার। বোন অবহেলায় নিঃশ্বাস নিচ্ছে, মহানন্দে নাক ডাকছে দিদি, অথচ আমার বুকই আমার শত্রু! পিপারমেন্টের মতো ঠান্ডা হাওয়া চারদিকে, শুধু আমার জীবনেই কেন বাতাস বাড়ন্ত হয়ে যায়? দিদিমা শীতল আঙুলে গরম মাসকলাইয়ের তেল মাখিয়ে তার বুকেপিঠে ড’লে দেয়, তালে তালে ফুসফুস-অ্যাকর্ডিয়ান থেকে নানা সুরের সিম্ফনি…ফুসফুস-জারুলগাছে অনেক পশুপাখালির ডাক। কারও কোলে কোলাব্যাঙের মতো ঝুলে থাকলে কিছুটা আরাম পাওয়া যেত, কিন্তু দিদিমার কাঁখ থেকে তাকে পিছলে যেতে হয় বারবার, মাও একটু পরে হাঁপাতে থাকে, “নাম বাবা, আমি কি পারি, তুমি না বড় হয়ে গেছো!” এখন নিঃশ্বাস নিতে গেলেই চাঁদের পিঠের পেশিতে খিঁচ লেগে দম আটকে আসছে। তখুনি হালকা খুটখুট শব্দ হয় কোথাও, আর মায়া মাথায় ঘোমটা টেনে বসে।

— ও মা, তোমার জামাই দরজায় টোকা দেচ্ছে!
— ওরে না, কালো মেনিডা রাতবিরেতে অমোন দুয়োর হাঁচড়ায়।

নিজের স্বামীকে কীভাবে কতটা চিনেছে, বাইশ বছর বয়েসে বৈধব্যগ্রস্তকে সে বোঝাবে কী ক’রে! একশোটা কাঠের ডাঁটিওলা ছাতা থেকে মায়া স্বামীর ছাতাটি এক মিনিটে চিহ্নিত করে দেবে। স্কুলে যাওয়ার পাঞ্জাবি প’রে ভুলুকভালুক তাকালেই বোঝে হাতঘড়িটা খুঁজছে, স্কুল থেকে ফেরার পথে যখন কলবল করতে করতে হেঁটে আসছে ট্রেনযাত্রীরা, একজন নীরব মানুষের জুতোর আওয়াজ সে মোড়ের মাথাতেই শনাক্ত ক’রে ফেলে। তিন মাসের পোয়াতি জানলায় ব’সে যেমন দূর-মাঠের ঘাসের গন্ধ পায়, স্বামীর ব্যাপারে দিনরাত তেমন গভীর ইন্দ্রিয়শক্তি নিয়ে জেগে থাকে মায়া।

ঘরে ঢুকে নির্মলচন্দ্র ছেলেকে কোলে তুলে নিজের গায়ের লম্বা পুরোনো শালটি তার পিঠের ওপর জড়িয়ে নেয়। পাশের ঘরে ফিরে যেতে যেতে বলে, রাত দুটো বাজে গেছে, তোমরা হেরিকেন নিভোয় শুয়ে পড়ো।

বারো
বাবার গায়ে সারাক্ষণ পুজো-পুজো গন্ধ। যদিও নির্মল বাড়ির পুজো আর স্কুলের সরস্বতীঅর্চনা ছাড়া কোথাও পৌরোহিত্য করে না। কেউ অনুরোধ করলে বলে, আমাদের বংশে যজমানিবৃত্তিতে নিষেধ আছে। বাবার কাঁধে কন্ঠার হাড়দুটো জেগে থাকে। সেই খোঁদলে নিজের থুতনি বসিয়ে নেয় চাঁদ। বাবার তলপেট সামান্য উঁচু, সেখানে তার পাছাটি আশ্রয় পায়। যেন এক উল্টোনো ইজিচেয়ারে শুয়ে সে এই প্রথম সুষুপ্তির ভাবনা ভাবতে পারে।

এদিকে সারা রাত ঘুম ভাঙে আর ঘুম জোড়ে মায়ার, পাশের ঘরে মৃদু পদপাত তবু থামে না। প্রতি অর্ধ-প্রহরে ছেলেকে বিছানায় শোয়াতে যায় বাবা, আর সে চিৎকার ক’রে কেঁদে আবার কোলে উঠে আসে। বাচ্চা কোলে এই অনন্ত পায়চারির মধ্যে শুকনো পাতা মশ-মশ ক’রে বাড়ির পেছন দিয়ে শেয়াল দৌড়ে যায়, রাতের পাখি ডেকে ওঠে আজাদ হিন্দ সংঘের বটগাছে, আর ভেসে আসে মান্নাপাড়া থেকে কীর্তন-আসরের গান — ও মন, ওরে পাগল মন, তুই চিনলি না আপন। পদকর্তার গলা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে :
গৌরীদাসের সঙ্গে চৈতন্যের মিলন হল কোথায়? এ-নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিস্তর বহুমত, কেউ বলছেন শ্রীখণ্ডে, কেউ কাটোয়ায়, কেউ বা কাঞ্চননগর। আমরা বলি, কোন কালে দেখা? কেননা, স্থান গুরুত্বের নয়, কথা হল কাল।
যেথা যেথা নিত্য হরিনাম-সংকীর্তন।
সেথা নিত্য নবদ্বীপধাম, নিত্য বৃন্দাবন।।

বাণীনাথ ভট্টাচার্যের দুই ছেলের ছোট নির্মল, দাদা করুণাময়। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি করুণা ভাইকে বললেন, নিমু আমি হিন্দুস্তানে চলে যাব সপরিবারে। তুই আমার সম্পত্তির অর্ধেক অংশ বাবদ টাকা দিয়ে দে। নির্মল নগদ যা ছিল কুড়িয়েবাড়িয়ে ব্যাংকের জমা টাকা ভেঙে দাদাকে দিয়ে দিয়েছে। কয়েক বছরের মধ্যে তাকেও ভিটে ছাড়তে হল। নারায়ণশিলার নিত্যপুজোয় যাতে বাধা না পড়ে, এক ব্রাহ্মণ পরিবারকে বাড়িতে বসিয়ে পরিবর্তে কিচ্ছুটি না নিয়ে দেশ ছাড়ল লোকটা।

তখন পদাবলী-কথকের গলা :
শ্রীচৈতন্য নিত্যানন্দাদি বন্ধু ও শিষ্যদের নিয়ে নগর-পরিক্রমায় বেরিয়েছেন, বদনে হরিনাম — এমনি সময়ে গৌরীদাস উপস্থিত। তাঁকে দেখেই গৌরাঙ্গের মনে পড়েছে শ্রীরাধার কথা। কেননা, এই গৌরীদাস তো আর কেউ নন, তিনি বৃন্দাবনের সুবল। মহাপ্রভু গৌরীকে জড়িয়ে ধরে “রাধা রাধা” ব’লে উচ্চৈঃস্বরে কাঁদতে লেগেছেন।

তাদের হিন্দুস্তানে চলে আসার তোড়জোড় চলছে, পাশের গ্রাম মহেশ্বরবাসা থেকে মাদারে মুখুজ্জে এসে বলে কি, নির্মল আমাকে তুমি কিছু টাকা দাও তো দত্তপুকুরে ভালো জমি পাওয়া যাচ্ছে, তোমার জন্যে রাখি। নির্মল তার হাতে নিজের শেষ সম্বল দু’হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়েছিল। এ-বঙ্গে এসে দ্যাখে কলোনির জমি সরকারি, কিনতে এক পয়সাও লাগে না। আদাড়ে নামে বেশি পরিচিত মাদারেকে সে আর টাকার কথা শুধোয়নি। যা গেছে, গেছে।

তখন মান্নাপাড়ার কথকঠাকুর :
আহা, সে কী অশ্রু! দৃশ্য দেখে কোনও ভক্ত বলছেন, প্রভুর দুচোখ বেয়ে মুক্তো গড়িয়ে পড়ছে। আবার কোনও ভক্ত বলছেন — না না, গড়িয়ে পড়ছে মুক্তি। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের ভক্তিরূপ গাল বেয়ে মুক্তি গড়িয়ে পড়ছে গো!

এবার জোকার উঠল — হরে হরে কৃষ্ণ, নিতাই নিত্যানন্দে জয় জয়! বলো শ্যামো অঙ্গে, গৌর অঙ্গে বলো জয়। নির্মল টের পায়, শ্বশ্রূমাতা মাটির হাঁড়িতে গোবরজল নিয়ে ছড়া দিচ্ছে উঠোনে। ফার্স্ট ট্রেন ঘটঘট ক’রে স্টেশানে ঢুকল। মাঘী পূর্ণিমা লাগবে সকাল সাতটায়। বচ্ছরকার দিন ছেলেটা অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে। তবু তার গলার বাঁশি-শব্দ এখন অনেক আবছা। সন্তর্পণে শোয়াতে গিয়ে নির্মল দেখে গাল ভিজে ভিজে, কয়েক দানা কৃষ্ণপ্রিয় অশ্রু বাবার চোখ থেকে খ’সে গিয়ে লেগেছে সন্তানের মুখে।

সংস্কৃতে কাব্যতীর্থ উপাধি-র মানুষটা বিড়বিড় করে গীতগোবিন্দ ভাঁজছিল — চন্দনচর্চিত নীল কলেবর পীত বসন বনমালী। কিন্তু জয়দেবের দ্বিতীয় চরণ কেলি চলন্মণি কুণ্ডল মণ্ডিত গণ্ডয়ুগস্মিত শালী-র জায়গায় হঠাৎ মাথায় এল — মাটির বুকে চাঁদের নিমাই, ধরতে গিয়ে জাত খোয়ালি। এটা কোনও বাউলগানের লাইন, নাকি নিজেই সে লিখেছে কখনও! অযাচিত এমন এক সৃষ্টিমুহূর্তেই হয়ত ছোটছেলের নাম রাখা হয়েছিল অযাচক। এখন ঘুমে বিভোর তীক্ষ্ণ-করুণ মুখটার দিকে তাকিয়ে মনে হল, কে জানে জীবনের কাছে কত-কতবার হাত পাততে হবে এই শেকড়-ওপড়ানো শিশুকে; প্রার্থনা, মাঙন, কাতর অনুরোধে ভ’রে থাকবে কিনা এর পরমায়ু! বৈরাগী নামের বোঝা চাপিয়ে একটা দুর্বল ফুসফুসকে আগে থেকেই ক্লান্ত ক’রে তুলব?

চাঁদের ভালো নাম তবে চন্দন, যে সব রকম সৎকারেই লাগে — এই ভেবে তাকে বিছানায় নামাল নির্মলচন্দ্র। বালিশে নতুন নামের গন্ধ নিয়ে সে স্বপ্নের দিকে বয়ে যাক…।

(শেষ)

শীতের ভোরে বিষণ্ণতা

আমার বিষণ্ন জানালার ওপারের আকাশ বিষণ্ণ হয়ে আছে। সে কী আমার মনের কথা জেনে আমার সাথে সহমর্মিতা দেখাচ্ছে! আজ আমার মন বিষণ্ণ। কোন কোন দিন অকারণে মন খারাপের ঘটনা ঘটে; আজ কারণে ঘটেছে। গত দুই তিন দিন ধরে শরীরের অবস্থা ভালো না; মাথা ব্যাথা, জ্বর, কফ শীতকালে সাধারণত যা হয়। জ্বর, কফে সাধারণত বিছানাবাসি হতে হয় না কিন্তু এইবার একটানা চৌদ্দ ঘন্টা বিছানায় কাটাতে হলো; মাথা তুলতে পারিনি।

শীতের ভোরে শীতের পুকুরে কেউ কী সাঁতার কেটেছেন! আমি কেটেছি, পুরো তারুণ্য শীতের পুকুর আমার দখলে ছিল। এখন তাপমাত্রা আঠারোর নিচে নেমে গেলেই ঠান্ডা লেগে যায়। পুকুরে সাঁতার তো দূরের কথা; মুখ ধোয়ার জন্য টেপের পানি প্রায় ৩০ সেকেন্ড ছেড়ে রাখতে হয়; যতক্ষণ না গরম পানি পাওয়া যায়। শার্টের বোতাম খুলে শীতের ভোরে হাটা তখনকার সময়ে স্টাইল ছিল, এখন ৪/৫ প্রস্থ কাপড় পরেও শীত আটকাতে পারি না। আমি প্রায় নিজেকে আঠারো বলি, বলি বটে কিন্তু বয়স যে আঠারোয় আঁটকে নেই সেটা বেশ জানি। অনেকেই মনের বয়সের কথা বলে কিন্তু সে কেবলই কথার কথা। মনের বয়স দিয়ে আপনি কিন্তু জ্বর এবং কফ আটকাতে পারবেন না।

এত গেল আমার শরীর যন্ত্রের কথা, বয়স হয়েছে শরীর খারাপ হবে এটাই ভবিতব্য। কিন্তু আজকের বিষণ্ণতা শুধুমাত্র শরীর খারাপের জন্য নয়। বিছানায় একটানা অনেক ঘন্টা ঘুমের কারণে বেশ কিছু আজগুবি এবং সম্ভাবনার স্বপ্ন আমাকে দেখতে হয়েছে। একটা স্বপ্ন আমাকে বেশ আন্দোলিত করেছে। লেখালেখিতে একঘেয়েমি চলে আসছিল, নতুন কিছুই যেন হাত থেকে বেরুচ্ছে না। সব চিন্তা জড় চিন্তায় পর্যবসিত হচ্ছে। এই স্বপ্ন আমাকে নতুন চিন্তার খোরাক দিচ্ছিল। আমি তরতর করে লিখছিলাম। স্বপ্নে খুব উত্তেজিত ছিলাম। নতুন কিছু সৃষ্টির উন্মাদনায় কাঁপছিলাম। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। ভোর সাড়ে তিনটা। এখনই লিখে না রাখতে পারলে সব হারিয়ে যাবে ভেবে বিছানা ছেড়ে উঠে এলাম। বাথরুমে কয়েক মিনিট প্রাতঃকৃত্য সারতে গিয়ে সব হারিয়ে গেল। অনেক চেষ্টা করেও কিছুই ফিরিয়ে আনতে পারলাম না।

স্বপ্নে আমি যে মন্ত্র গুলো পেয়েছিলাম লিখতে পারলে আমাকে আটকানোর সাধ্য থাকতো না কারো। আফসোস অমিত সম্ভাবনার একজন লেখক শুধুমাত্র স্বপ্ন থেকে বের হতে পারেনি বলে বাংলা সাহিত্য অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হলো। আজ আমার মন খুব বিষণ্ণ; একটাই সান্তনা ভোরের আকাশ আমার মনের খবর জানতে পেরেছে। আমার সহমর্মী হয়ে সেও বিষণ্ণ হয়ে আছে।

এই স্বপ্নের মানে কী

কাল রাতে আজগুবি স্বপ্ন দেখেছি, স্বপ্নের লেজ মাথা খুঁজে পাইনি। আমি একটা পিৎজা সঁপে কাজ করি, কিছুদিন হল আমাকে শিফট ম্যানেজারের দায়িত্ব দিয়েছে। স্বপ্নে দেখলাম আমি পিৎজা বানাচ্ছি, লার্জ স্টাফক্রাস্ট হাফ এন্ড হাফ খুব সহজ, শুধু টপিং গুলো দেখে পিৎজার উপর রাখতে হবে। বানাতে গিয়ে দেখলাম যে টপিং চেয়েছে কিছু আমার সামনে নেই, অথচ এমন হওয়ার কথা না। ফ্রিজ থেকে এনে বানান হল; ওভেন থেকে নামিয়ে যখন কাটতে যাব দেখি আমি যে টপিং দিয়েছিলাম সেগুলো গায়েব। ওভেনে তখন অন্য কোন পিৎজা ছিল না। এদিকে কম্পিউটার স্ক্রিন লাল হয়ে গেছে, অর্থাৎ অর্ডার পাঠাতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। কি আর করা ভুল পিৎজা তো পাঠাতে পারিনা, তাই ফেলে দিলাম। পুনরায় মেকিং টেবিলে গিয়ে পিৎজা বানাবো দেখলাম কিছুক্ষণ আগে যে টপিং গুলো এনে রেখেছিলাম সব গায়েব। পিৎজা বানাতে গিয়ে পুনরায় যখন অর্ডারে ট্যাপ করলাম দেখি যে পিৎজা ভুলের কারণে ফেলে দিয়েছিলাম সেই টপিং এখন দেখাচ্ছে। পুনরায় পিৎজা বানালাম, ডেলিভারি ড্রাইভার এড্রেস ট্যাপ করতে গিয়ে দেখল এটা আমার এড্রেস; অর্থাৎ আমার ঘর থেকে কেউ অর্ডার করেছে। ঘরে ফোন করে দেখলাম ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী কেউ কিছু বলতে পারল না। এমনিতেই আমি থাকি ডেলিভারি এরিয়ার বাইরে, আমার ঘর থেকে অর্ডার আসার সম্ভাবনা নেই। কি আর করা ডেলিভারি ড্রাইভার আমার ঘরে উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল। খাবার পৌঁছে দিয়েও আসল কিন্তু পুনরায় ফোন করে দেখলাম আমার ঘরে খাবার পৌঁছেনি।

কিছু সময় পরে ফোন আসল, পিৎজা ভুল দেওয়া হয়েছে। সামনের স্টাফ আমাকে ফোন সমঝিয়ে দিল ভুল সংশোধন করার জন্য। আমি হ্যালো বলতেই অপর পাশে যে আওয়াজ দিয়ে উঠল সে আমি।

ভয়ে আমার অন্তরাত্মা বেরিয়ে যাওয়ার অবস্থা, ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখলাম পুরো শরীর ঘামে ভিজে গেছে।

এন্ডিসের অসমাপ্ত গল্প…

31459

ভ্রমণ মানেই উপভোগ। অজানাকে জানার অচেনাকে চেনার হাতছানি। সীমিত সামর্থ্যের ভেতর যতটুকু সম্ভব ততটুকুই আমি ঘুরে বেড়াই। অন্যদের তুলনায় এই ঘুরে বেড়ানোর পরিসরটা আমার বেলায় একটু প্রসারিত সুযোগ ও সময়ের কারণে। উপভোগ করি বলেই ভ্রমণ করি। কিন্তু এই উপভোগ মাঝে মধ্যে নাইট্মেয়ার হয়ে দুঃস্বপ্নের মত তাড়া করে। চাইলেও স্মৃতির পাতা হতে মুছে ফেলা যায়না।

দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুর উত্তর দিকে Churin নামের ছোট একটা শহর আছে। ছবির মত সুন্দর। চারদিকে এন্ডিস পর্বতমালা। অনেকটা উপতক্যার মত এই শহরে বছর জুড়েই রাজত্ব করে সুনসান নীরবতা।

শীতকালে পর্যটকরা ভিড় জমায়। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে ন্যাচারাল জলপ্রপাত প্রকৃতি প্রিয় মানুষদের হাতছানি দিয়ে টানে। হোটেল মোটেলেরও অভাব নেই। এ ছাড়া পেরুভিয়ানদের জন্যে আকর্ষণের আরও একটা কারণ হচ্ছে দেশটার লো-ল্যান্ডে যখন শীত এন্ডিসের উচ্চতায় তখন গ্রীষ্মকাল। এর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যা আমার জানা নেই। শুধু জানি একই দেশে একই সময় শীত ও গ্রীষ্মকাল পাশাপাশি দাপিয়ে বেড়ায়।

প্রস্তাবটা ছিল আমার গিন্নীর। মধ্য জুনের কনকনে শীত রাজধানী লিমা কাবু হয়ে থাকে। কুয়াশার ঘোমটা হতে দিনে একবারের জন্যেও মুখ খোলেনা। চারদিকে একধরণের স্থায়ী বিষণ্ণতা। এমন এক পরিবেশে বেশীদিন বাস করলে ডিপ্রেশন চেপে ধরে। গিন্নীর তা জানা ছিল। লিমার মন খারাপ করা আবহাওয়া হতে বেরিয়ে ঝলমলে রোদে যাওয়ার জন্যেই Churin নামটা সামনে আসে। আমার কোন আপত্তি ছিলনা। নতুন কিছু দেখতে নরকে যেতেও প্রস্তুত আমি।

লিমা হতে প্রায় সাড়ে ৪ ঘণ্টার পথ Churin। একদিকে প্রশান্ত মহাসাগর অন্যদিকে মাইটি এন্ডিস পর্বতমালা, যে কারও মন কাড়াতে বাধ্য। যাত্রার শুরুতেই সমস্যা। ঘন কুয়াশায় বাসের গতি ডেড-স্লো করতে বাধ্য হচ্ছে ড্রাইভার। এমন ভৌতিক পরিবেশে বাস জার্নি ভয় ধরিয়ে দেয়। যে কোন সময় বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা নিয়েই বাসগুলো রাস্তায় নামে। বুকে অসীম সাহস না থাকলে এ পথে পা বাড়ানো খুব কষ্টের।

লিমা ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই জনবসতির ঘনত্ব কমে আসতে শুরু করল। শহরের চাকচিক্য ছাপিয়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করল পেরু নামের দেশটার বিবর্ণ চেহারা। ঘণ্টা খানেক চলার পর পীচ-ঢালা রাজপথ ছেড়ে আমাদের ধরতে হবে ইট-সুরকির কাঁচা রাস্তা। গিন্নীর এমন ঘোষণায় অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। মূল কারণ, আমাদের বাস ধীরে ধীরে উপরে উঠছে। SYAN নামের এক জরাজীর্ণ শহরে আমাদের প্রথম স্টপেজ। এক ঘণ্টার মত বিরতি। দুপুরের খাবার সেরে নেয়ার শেষ সুযোগ।

প্রশান্ত মহাসাগরের ফ্রেশ মাছ, সাথে ফ্রাইড পটেটো দিয়ে খাওয়া শেষ করে বিল দিতে গিয়ে অবাক। রেস্টুরেন্টের সবাই আমার গিন্নীকে চেনে। কারণ জিজ্ঞেস করতে জানাল এক সময় এই রেস্টুরেন্টের মালিক ছিলেন গিন্নীর নানী। সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে রাস্তায় বের হতে গিন্নী তাড়া দিল দৌড়ানোর। কিছু বুঝে উঠার আগে শুরু করলাম গিন্নীর পিছু নেয়া। দৌড়ে আরও উচ্চতা ডিঙ্গচ্ছি আমরা। মুখ হতে জিহ্বা বেরিয়ে আসার উপক্রম। কিছুটা পথ পাড়ি দেয়ার পর একটা পরিত্যক্ত বাড়ির সামনে থামলাম আমরা।

বাড়ির সামনের গোপন কুঠুরি হতে ভোজবাজির মত বেরিয়ে এলো একটা চাবি। এবং সেই চাবি দিয়ে মূল ফটকের তালা খুলে ঢুকে পরলাম এন্ডিসের মতই বিবর্ণ চেহারার বাড়িটাতে। এই বাড়ির মালিকও গিন্নীর নানী। তিনি বেঁচে থাকতে বার বার অনুরোধ করে গেছেন আমরা যেন কিছুটা সময়ের জন্যে হলেও এখনটায় থামি। অযত্ন অবহেলার সাক্ষী বাড়ির সবকিছুতে। বুঝা যায় অনেকদিন এখানটায় কেউ আসেনি।

কিছুটা সময় বিছানায় আরাম করে পথের ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করলাম। বাথরুম শেষে রওয়ানা দিলাম উলটো পথে।

এবং এখানেই ছিল পীচ-ঢালা পথের শেষ এবং সমস্যার শুরু।
আকাশের দিকে উঠছি আমরা। হিসাব কষলে ৪৫ ডিগ্রী হবে হয়ত বাসের জিয়োমেট্রি। ঠিক যে ডিগ্রীতে বিমানবন্দর হতে বড় বড় বিমান উড়ে যায়। তলপেটে একধরণের চাপ অনুভব করতে শুরু করলাম। অস্বস্তি বাড়তে লাগলো। সাথে সীমাহীন ভয়। প্রয়োজনে ব্রেক কষলে বাসটা থামানো যাবে কিনা এ নিয়ে সন্দেহ হল।

গিন্নীর দিকে তাকালাম। নির্বিকার হয়ে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। এন্ডিসের বিশালতায় এক ধরণের মায়াবী টান আছে। একবার প্রেমে পরলে সহজে উঠে আসা যায়না।

মাচু পীচুর উচ্চতার কথা মনে হল। একই কায়দায় উপরে উঠেছিলাম। তবে রাস্তা ছিল মসৃণ। ছিল আধুনিক যানবাহনের সব সুবিধা। কিন্তু এ যাত্রায় এ সবের লেশমাত্র ছিলনা। অথচ জানামতে এদিকটায়ও পর্যটকরা নিয়মিত ভিড় জমায়। বিদেশি না হোক স্থানীয়দের সংখ্যাও কম না। জীবনে এই প্রথম বাস জার্নিতে বমির ভাব অনুভব করলাম। কখন কোথায় বেরিয়ে আসবে ভাবতে অস্থির লাগলো। গিন্নীকে বলতে ব্যস্ত হয়ে পরল ড্রাইভারকে বুঝাতে। সময়মত না থামলে নোংরা কাজটা হয়ত ভেতরে সমাধা করতে হতো।

বাসের বাইরে পা রাখতে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। আমি কি রাস্তায় পা রাখছি, নাকি এন্ডিস পর্বতমালার খোলা ফাঁদে পা দিয়ে চিরদিনের জন্যে নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছি বুঝতে পারছিলাম না। নীচের দিকে তাকাতে মাথা ভো করে ঘুরে উঠল। গিন্নী পাশে না থাকলে হয়ত পরেই যেতাম। নিজকে কিছুটা আড়াল করে হর হর করে বমি করে ফেললাম। ড্রাইভারের কাছ হতে যথেষ্ট সময় নিয়েছি তাই গিন্নীর গো-এহেড সিগন্যাল পেয়ে প্যান্টের বোতাম খুলে বাকি কাজটা সেরে নিলাম।

এ যেন অনন্তকালের যাত্রা। ধীরে পিপড়ার গতিতে চলছে আমাদের বাস। ভেতর আমি শক্ত হয়ে প্রহর গুনছি। এক একটা বাঁক পাড় হচ্ছি আর নতুন নতুন ভয় এসে ভর করছে। কি হবে যদি এখানেই আমার ইতি হয়!
বাসের বাকি যাত্রীরা ছিল নির্বিকার। চোখ মুখ ভাবলেশহীন। আমার মত এদিক সেদিক চোখ ঘুরাচ্ছে না। ইট সুরকি আর পাথরের রাস্তা দিয়ে বাসের ভার্টিকেল জার্নিতে ওরা হয়ত অভ্যস্ত। কিন্তু সমতলের মানুষ। কিছুতেই সহজ হতে পারলাম না।

চার ঘণ্টার জার্নি সাত ঘণ্টায় এসে ঠেকল। শেষ কখন তার কোন ইঙ্গিত নেই। গিন্নী ইতিমধ্যে বিরক্ত হয়ে গেছে একই প্রশ্ন বারবার শুনতে গিয়ে। শুধু আশা দিচ্ছে, এই সামনেই আমাদের যাত্রার শেষ।
এন্ডিসের কোল ঘেঁষে শুয়ে আছে ছবির মত সুন্দর একটা লোকালয়। পর্বতমালার বুক-চিড়ে শেষ বাঁকটা পার হতে চোখের সামনে আছড়ে পরল চুরিনের প্যানোরমা।

314699

নাচতে না জানলে

আমি আসলেই খুব ভালো নাচতে জানি। কিন্তু উঠান বাঁকার কারণে নাচতে পারি না। আমাকে নিয়ে যারা অহেতুক ট্রল করছেন, মুখ লুকিয়ে হাসাহাসি করছেন তারা অপেক্ষা করুন। উঠান সোজা করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে তখন দেখিয়ে দিব ভরতনাট্যমে আমি কতটুকু পারদর্শী।

আচ্ছা না হয় নাচতেই জানি না; কিন্তু নৃত্য বিষয়ে আমার জ্ঞান নিশ্চয়ই অস্বীকার করবেন না। দীর্ঘ গবেষণার পরে নৃত্য সাধক হয়েছি, কোনটা নাচ আর কোনটা নাচ নয় সে বিষয়ে ধারণা রাখি। তাই যদি নাচ নিয়ে দু এক কথা বলেই ফেলি মহাভারত কি অশুদ্ধ হয়ে যাবে।

এই যে আমার সামনে লাফালাফি করছেন এটা নাচ নয় এটা শুধুই লাফালাফি। নাচ নামে অভিহিত করতে চাইলে আমাকে অনুসরণ করুন আমি ছাড়া আর কেউ ভালো নাচতে পারে না।

‘নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা’ বলে আমাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছেন এই আমি গত কয়েকদিন আগে নৃত্য শিরোমনি পদকে ভূষিত হয়েছি। তারা নাচের সমজদার; আমার খরচ মাত্র দুই হাজার সাত’শ। নাচের নোবেল আমাকে অফার করেছিল আরো হাজার দুই এক খরচ হত; কিন্তু আমি বিদ্বেষী অনেকে সুযোগের অপেক্ষায় আছে। নোবেল নিয়ে তাদের সে সুযোগ দিতে চাইনি বলেই অফার ফিরিয়ে দিয়েছি।

নৃত্য আমার জন্য কোন ব্যাপারই না উঠানের কারণে মাঝে মাঝে মার খাই বটে তবে উঠান সোজা হয়ে গেলেই বিদ্বেষীদের মুখে ঝামা ঘষে দেব।

এত লম্বা লেখা আমিও লিখতে পারি ভুলে গেছি প্রায়!

3115

প্রকৃতির পরিবর্তন কত দ্রুত ঘটতে পারে পূর্ব ইউরোপের ঐ অংশে বাস না করলে হয়ত বুঝতে পারতাম না। শীতের রাজত্ব ঐ অঞ্চলে প্রশ্নাতীত। সেই যে সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে তুষারপাত শুরু হয় তার শেষ কবে কেউ জানেনা। ডিসেম্বরের শুরুতে বরফ এসে জায়গা করে নেয় তুষারপাতের। জমজমাট শক্ত বরফ এতটাই শক্ত হয় নদীর পানি জমে যায়। সে নদীতে সাদা সাদা পাল তোলা নৌকার বদলে চলে যন্ত্রচালিত ট্রাক। মৎস শিকারীর দল নদীর উপর তাবু গেড়ে রাতের পর রাত কাটিয়ে দেয় শিকারের আশায়। আর আমার মত যারা পৃথিবীর অপর প্রান্ত হতে এ অঞ্চলে পাড়ি জমায় তারা ক্যালেন্ডারের পাতা উলটে প্রহর গোনে বসন্তের। অনেক সময় বসন্তও কথা রাখেনা। মুষলধারার তুষারপাতের নীচে চাপা পরে যায় অপেক্ষার পালা।

মে মাসের নয় তারিখেও তুষারপাতের মোকাবেলা করতে হয়েছিল এক বসন্তে। শীতে তাপমাত্রা মাঝে মধ্যে হীমাংকের নীচে ৪০ ডিগ্রী পর্যন্ত নেমে যায়। স্থবির হয়ে যায় জনজীবন। বরফ ডিঙ্গিয়ে স্কুলে যাওয়া সম্ভব হয়না বাচ্চাদের। অঘোষিত ছুটিতে যেতে হয় তাদের। সাইবেরিয়ার দিকে অবস্থা আরও কঠিন, আরও কষ্টের। সোভিয়েত লৌহ শাসনের গোড়ার দিকে যারা বিরুদ্ধচারন তাদের অনেককেই নির্বাসনে পাঠাতো সাইবেরিয়ার কঠিন প্রকৃতির সাথে লড়াই করতে। ঐ দিকটায় শীতের দিকে যাওয়া আমার মত এশিয়ান কারও পক্ষে যাওয়া মানে আত্মহত্যার দিকে পা বাড়ানো।

কোন এক গ্রীস্মে ঘটনাচক্রে সৌভাগ্য হয়েছিল রুশ দেশের তুন্দ্রা অঞ্চলে ঘুরে আসার। মনুষ্য জীবন ওখানে কঠিন। বেঁচে থাকতে প্রতিদিন প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করতে হয়। এসব নিয়ে ঐ অঞ্চলের মানুষের খুব যে একটা অভিযোগ আছে তা নয়। বরং খাপ খাইয়ে নিয়েছে প্রকৃতির এসব রুদ্রমূর্তির সাথে।

বসন্ত হঠাৎ করেই চলে আসে। ছাদ হতে বরফের বিশাল সব চাই মাটিতে আছড়ে পরে। ডর্মের রুমটায় বসে সে আওয়াজ শুনলে মন হাল্কা হয়ে যায়। আমরা বুঝতে পারি বসন্ত আসছে। বরফ গলতে শুরু করে। রাস্তা-ঘাট পানি আর কাঁদায় ভরে যায়। তারপর একদিন সূর্য পূব দিগন্তে মুখ তুলে জানায় আগমনী বার্তা। কদিন একনাগাড়ে উত্তাপ ছড়ালে রাস্তা-ঘাট পরিস্কার হয়ে যায়। গাছে গাছে সবুজের সমারোহ কখন যে জায়গা করে নেয় টেরই পাওয়া যায়না।

পোল্যান্ড সীমান্ত ঢুকে গেছি অনেকক্ষণ হয়েগেছে। বেলাওয়াস্তকে ট্রেনের চাকা বদলানোর সময় ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস হাজির হয়। ওদের চেক করার বিশেষ কিছু থাকেনা। কারণ দেশটায় আমার মত যাত্রীরা থাকতে আসেনা। ট্রানজিট ভিসা নিয়ে পাড়ি জমায় পশ্চিমের দিকে। যদিও ষ্ট্যুরিষ্টদের আকর্ষণ করতে সরকারী চেষ্টার অন্ত থাকেনা।

অদ্ভূত এক দেশ এই পোল্যান্ড। সোভিয়েত বলয়ের অন্যতম প্রধান দেশ। ওয়ারশ সামরিক প্যাক্টকে ঘিরে পল্লবিত হয়েছে সোভিয়েত সামরিক শক্তি। অথচ দেশটার সীমান্তে পা রাখলেই চোখে পরে এর দৈণ্যতা। চারদিকের বাড়ি-ঘরে ক্ষয়ের চিহ্ন। চোখে পরার মত কোন জৌলুষ নেই। একজন ইমিগ্রেশন অফিসার এসে যখন জিজ্ঞেস করে এক্সচেঞ্জের জন্য ডলার-পাউন্ড আছে কিনা, এক লহমায় ধরে নেয়া যায় দেশটার অর্থনৈতিক ভীত

ঘটনা আরও কয়েক বছর আগে। সে বছর গ্রীস্মকালীন ছুটি কাটিয়ে লন্ডন হতে সেন্ট পিটার্সবার্গে ফিরে যাচ্ছি। ওয়ারশতে আমার ট্রানজিট। ট্রেন বদলাতে হবে। ইউরোপের আর দশটা দেশ মনে করে কাউন্টারে হাজির হয়ে আমার ফিরতি জার্নির টিকেট দেখাই। রাতে ঘুমানোর মত একটা সীট দরকার আমার। কাউন্টারে মধ্যবয়সী এক মহিলা ম্যাগাজিন উলটে সাজগোজের কিছু একটা দেখছিল। আমাকে দেখে মুখ কুচকে ফেললো। রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করলো কি চাই। পূর্ব ইউরোপের মানুষদের গায়ের রঙ নিয়ে এলার্জিতে ততদিনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তাই অবাক না হয়ে বিনয়ের সাথে একটা রাতের ট্রেনের একটা সীট চাইলাম। মহিলা কোনদিক না তাকিয়ে নিমিষের মধ্যা আমাকে জানিয়ে দিল আগামী ৭ দিনের জন্যে কোন সীট নেই। মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরলো। আগামী ২৪ ঘণ্টায় আমাকে সোভিয়েত সীমান্তে পা রাখতেই হবে। নইলে কোনদিনই ঢুকতে পারবোনা দেশটায়। কঠিন আইনের দেশ এই সোভিয়ত ইউনিয়ন।

মন খারাপ করে প্লাটফর্মের বেঞ্চে বসে আছি। সম্ভাব্য সব সিনারিও বিশ্লেষন করছি। পাশে কেউ একজন বসেছে টের পেলাম। কালো আফ্রিকান একজন। হাতের পোটলা পুটলি দেখে বুঝতে পারলাম সে-ও আমার মত সোভিয়ত ইউনিয়নে যাচ্ছে। পার্থক্য হচ্ছে, ওর মুখে হাসি এবং প্রাণ খুলে মনের আনন্দে গান গাইছে।

আমার সমস্যা তুলে ধরতে সে হো হো করে হেসে উঠলো। মিনিটের ভেতর সমাধান দিল। কারণ সেও একই সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল।

বুক পকেটে একটা পাঁচ পাউন্ডের নোট রেখে আবারও গেলাম কাউন্টারে। একই মহিলা। আমার মুখ দেখার আগে দেখলো আমার বুক পকেট। লম্বা একটা হাসি দিয়ে আবারও জানতে চাইলো আমার প্রয়োজন। উদ্দেশ্য পরিস্কার করার পর জানতে চাইলো মূল্য পরিশোধ করবো কোন কারেন্সিতে। সদ্য পরিচিত আফ্রিকান বন্ধুর উপদেশ মত আঙ্গুল তুলে বুক পকেটের দিকে ইশারা দিলাম।

মন্ত্রের মত কাজ দিলো। তোতা পাখির মত উত্তর দিল, রাতের জন্যে অপেক্ষা করতে না চাইলে আধাঘণ্টার ভেতর একটা ট্রেন আসবে। গাদানক্স ঘুরে গ্রদনোর দিকে যাবে। রাতের সীটেই ফয়সালা করলাম। মূল্য ৫ পাউন্ড। সমাজতন্ত্র পৃথিবীর এ অঞ্চলের মানুষকে কতটা কলুষিত করেছিল তার চমৎকার একটা ডিসপ্লে এই ট্রেন জার্নি।

ঘণ্টা দেড়েক পর রাজধানী ওয়ারশ এসে থেমে গেলো আমার ট্রেন। এখানে লম্বা একটা বিরতি। রিফ্রেশমেন্টের জন্য সবাই ট্রেন হতে নেমে পরে। এই নেমে পরায়ও অনেক রকম বিপদ থাকে। এই যেমন পোলিশ মহিলাদের খপ্পর। ভুলিয়ে বালিয়ে নিজেদের আস্তানায় নিয়ে সব কিছু রেখে উলংগ করে ছেড়ে দেয়ার কাহিনীও শুনেছি অনেকের মুখে। এ পথে এতবার জার্নি করেছি সবকিছু আমার মুখস্ত। কারও চেহারা দেখে বলে দিতে পারি তার উদ্দেশ্য। ষ্টেশনে নেমে কিছু কেনাকাটি করলাম। এখানে সোভিয়েত মুদ্রা রুবেলেও কেনাকাটি করা যায়। পকেটে বেশকিছু রুবেল ছিল, যতটা সম্ভব খরচ করে অতিরিক্ত কিছু খাবার ও পানি কিনে ফিরে গেলাম ট্রেনে।

এবার লম্বা একটা ঘুমের পালা। খুব ভোরে ট্রেন সীমান্ত শহর ফ্রাঙ্কফোর্ট-আন-ডের-ওডের দিয়ে পূর্ব জার্মানীতে ঢুকবে। অবশ্য মাঝখানে পোলিশ শহর পজনানে কিছুক্ষণের জন্যে ট্রেন থামবে যা আমি টের পাবোনা। আমাকে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ঢুকতে হবে সমাজতন্ত্রের ফাইনাল ফ্রন্টিয়ার পূর্ব জার্মানীতে। শেষ রাতের দিকে জার্মান সীমান্তরক্ষীদের কর্কশ ডাকে ঘুম ভাঙ্গবে।

নিমতিতা সরকারি কলোনি

আট
অনেক দূরের নক্ষত্রমণ্ডল থেকে ফিরে আসছিল চাঁদ, রিকশা ক’রে। অন্ধকার মহাজগতে চাকার নীচে খোয়ার মতো ছায়াপথ আর গ্রহাণুপুঞ্জের ঝাঁকুনি খেয়ে, রিকশার হ্যান্ডেলের লাগানো টেমি-র আলোয় রাস্তা দেখে দেখে…। হঠাৎ এক একটা উল্কা ছুটছে চারদিক সাদা ক’রে দিয়ে। তখন বোঝা যাচ্ছিল, ধ্রুবলোকের কোথাও ব’সে সিংহ কেশর ঝাঁকাচ্ছে; কোথাও রথের মেলায় তেলেভাজার দোকানে বেসন ফ্যাটানো হচ্ছে; কোথাও পাহাড়ি কেল্লার ছাদ থেকে জরির পোশাক পরা একটা মেয়ে হাত নাড়াচ্ছে তার দিকে।

রিকশাওলা তাদেরই স্টেশান-বাজারের মোতিউরদা, যার কাঁধের গামছায় জ্বলছে নিভছে অনেক জোনাকি। “তারাক’টা বেঁদে নিয়ে আসলাম বলো, কেরোসিনির যা দাম!” ব’লে সে এতক্ষণ বাঁহাতের ব্রেকে আটকে রাখা নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্র খুলে দেয় আর শোঁ-শোঁ ক’রে নীচে নামতে থাকে তিনচাকা গাড়ি। চাঁদের বাড়ির হারিকেন বাধ্য হয়ে রাত ন’টাতে নিভে যেত, কেননা রেশানে এ-সপ্তাহে ‘কেরাসিন’ দেবে তো পরের সপ্তাহে দেবে না, আর মা বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে, “বেলাক-এ তেল কেনা অন্যাই”। দারিদ্র সবচেয়ে ভালো মুখ লুকোতে পারে নৈতিকতার পিঠে। এখন, থকথকে কুয়াশার মধ্যে অবতরণ করতে করতে সে গুনতে থাকে — বড়ঘর, রান্নাঘর, খোপের ঘর, পায়খানা। মোট চারটে তারাজোনাকি যেই চাইতে যাবে মোতিউরদার কাছে, দেখা যায় রিকশা আলো ক’রে চাঁদের গা ঘেঁষে সেই মহাকাশ-দুর্গের মেয়েটা!

নয়
ঘোষপাড়া, চড়কপাড়া, মান্নাপাড়া — এভাবে চলল এ-দেশিয়দের ফাঁকাফাঁকা দালান, সাধারণত হলুদ রঙের, রোয়াকবিশিষ্ট, নিঃঝুম। চওড়া কাঁচা রাস্তাগুলো খেঁকিকুকুর-প্রধান; দুচার পা অন্তর ছোট ছোট মাঠ; আর আছে হরিসভা, ক্লাব নয়তো পুষ্করিণী। বাসিন্দাদের মধ্যে ভুঁড়িয়াল টাকমাথা লোক বেশি; কোমরে আলগোছে ফিতেবাঁধা পাজামা, মাথার চুল-টানা বা পিঠ চুলকোনোর জন্যে বিকেলে কচুরি কিনে দেওয়ার শর্তে বাচ্চাদের ডাকছে। খুব খুঁটিয়ে খবরের কাগজ পড়া হয় এখানে, সকালে কর্তা, তারপর ছেলেমেয়ে, দুপুরে গিন্নি, শেষে সেটি চলে যায় পাশের বাড়ি এবং শ্লীলতাহানির সংবাদের মতো বিধ্বস্ত হয়ে রাতে ফেরত আসে।

অঞ্চলের নাম নিবাধুই। অদ্ভুত নামে আকৃষ্ট হয়ে সুকুমার সেন খোঁজতলাশ ক’রে জানিয়েছিলেন, দুশো বছর আগে আশশ্যাওড়া, আলকুশি, জার্মানিলতার ঝোপে ঢাকা; শিমূল, বাবলা, অক্ষয়বট, বেল, টককুলের বৃক্ষে ছাওয়া এলাকাটির নাম রাখা হয়েছিল নির্বান্ধবপুর। সেখান থেকে নিবন্ধপুর… নিবদ্ধপুর… নিবধই…নিবাধই হয়ে আপাতত নিবাধুই-তে থেমেছে। পুরোনো ও বর্ধিষ্ণু গ্রামটি ১৮৪৮ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চেষ্টায় ছেলেদের হাইস্কুল পেয়েছিল। চার বছর পরে তিনি এখানে বালিকা বিদ্যালয়ও বসিয়ে দিয়ে যান। বিদ্যাসাগরের নিজের সঞ্চয় থেকে অর্থসাহায্য আসত স্কুলদুটোয়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও দীর্ঘদিন ভাতা পাঠিয়েছেন। বর্তমানে এই লোকবসতি “তাদের পানে ভাঁটার টানে যাব রে আজ ঘরছাড়া” গাইছে, শরিকি সম্পত্তি ভাগ হতে হতে এক ভিটেতে তিন-চার পরিবার মাথা গুঁজলে কী আর করা! পাড়ায় কত-না শিক্ষকের বাস, নাট্যকারের ভদ্রাসন; তবু ধরা যাচ্ছে না বাউন্ডারি ওয়ালের সংস্কার, বাড়ির কলি ফেরানো বা পুকুরঘাটে সিঁড়ি মেরামতির কাজগুলো। বাথরুমের কাঠের দরজা ভাঙলে পুরোনো ফ্রেমে একপাল্লার টিন যোতা চলছে।

মোতিউরের রিকশা প্যাঁক ক’রে হর্ন মারে, সাড়ে দশটার অন্ধকার শূন্য রাস্তা থেকে নেমে দাঁড়ায়, আর ডান হাতে ভেসে ওঠে দোলপূর্ণিমার ফাংশানের মাঠ। তারপর জোড়াবটতলা পার হল, যেখানে সারা দুপুর গাছের ঝুরি ধ’রে ঝুল খেতে খেতে এতবার বটনিম্নস্থ পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাচ্চারা যে এই শুনশান রাতেও দুটো পরিচ্ছন্ন ঝুপ শব্দ শোনা গেল। চমকে উঠে মোতিউর দ্যাখে পুকুরের ওপর তির্যক ফলবাগান থেকে নারকোলমুন্ডু খ’সে পড়ে হাসতে হাসতে ভেসে যাচ্ছে জলে।

মান্নাপাড়ার কালীবাড়ি পৌঁছে রিকশা থামবে জানা কথা; এখানে প্রণাম না সেরে কোনও নতুন বউ শ্বশুরবাড়ি ঢোকে না। কিন্তু ভগবানই জানে কখন কোন বৃষ্টিতে চাঁদের সারা গা জবজবে ভিজে আর অসম্ভব বাতাসে জামাটা খুলে উড়ে যেতে চাইছে… গেলও বোধ হয়। এদিকে চুমকিপাড় ওড়নার রাজবালিকা মা-কালীকে গড় ক’রে উঠে দাঁড়াতেই চাঁদ দেখল তার ছিপছিপে গলায় দিদিমার মুখ বসানো! অবাক হওয়ার সময় নেই, উড়নচন্ডে হাওয়া এবার খুলে ফেলেছে তার হাফপ্যান্টের প্রথম বোতামটা…।

দশ
লেপের নীচে অসুস্থের ঘেমো শরীর মুছিয়ে দিতে দিতে সঞ্জু ভাবছিল — সেরে উঠুক, তারপর যা খ্যাপাবো না! একটু আগে রোগি দিদিমাকে জিগেস করেছে, সিঁদুর পরোনি কেন? সন্ধেবেলা কাঁদল আমার মাথাটা খুঁজে পাচ্ছি না ব’লে। যখন পাশ ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কী রাগ —“আস্তে চালাও, মোতিউরদা”, অথচ একমাস হয়ে গেল রিকশাওলা মোতি ট্রেনে কাটা পড়েছে। ধুম জ্বরের মধ্যে এত মজার মজার প্রলাপ বকছিল চাঁদ যে শীতলাতলায় চার আনার বাতাসা মানত করতে হল ছোটভাইকে সারাক্ষণ চড়-থাপ্পড় মারা ছেলেটার।
তখন মা বলল, কাঁদতিছিস কেন, এই সঞ্জু? এই বোকা, ভাইয়ের জ্বর নামে গেছে ব’লেই তো ঘাম দেচ্ছে। কালই দ্যাখবা, তোমারে আবার চিমটি কাটবেনে পড়তি ব’সে।

জননী তারপর রান্নাঘর থেকে এইমাত্র আসা দিদিমার সঙ্গে ইশারাময় সংলাপে ডুবে গেল।
— পালি, নাদু?
— ও মা, কী পাবো!
— সত্যি কোচ্ছিস, গন্দো পাসনি?
— তুমি পাইছো?
— একছিটেও না। আমি ভাবলাম আমার বুঝি সোদ্দি…।
— উনোনে ক’টা মরিচ পোড়াইছিলে?
— তিন-তিনডে। ডালি অ্যাট্টা ফ্যালায় সোম্বোরা দিলিই কাশতি কাশতি পেরান যায়! ফাটানে ঝাল।
— তার মানে তুমি যা ভাবিছো তাই!
— নালি আর কলাম কী?

স্বাভাবিক শত্রু কিন্তু আপৎকালে একজোট দুই রমণী গালে-হাত চোখ-দীঘল ক’রে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর একজনের ঈষৎ গর্বিত গলা শোনা যায়, “আমার চাঁদ হয়ত এট্টু রোগা, কিন্তু মুখটা-মাথাটা টলটল করে”। দিদিমা, যেন নিজেরই প্রশংসা হল, ব্লাশ করে যথারীতি : “বোলতি নেই, যা ফনফনায় উঠিছে, তোর মতোন নাম্বা হবে”। তারপরই মুলিবাঁশের বেড়া কেটে বানানো জানলা দিয়ে কুটিল দৃষ্টি ছোঁড়ে বলরাম দাসের বাড়ির দিকে : “বলা-র বউখান তো না, য্যান্‌ পুতোনা রাক্ষসী”।

এখন সব চোখই দৃষ্টিহীন এই উপনিবেশে। শুধু বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে পা-দুটো ছাড়িয়ে নিল মা-মেয়ে। অসুস্থ সন্তানের মাথার কাছে ব’সে তারা কত রাত ভোর করেছে তার হিসেব হয় না।

(আর একটু)

ঈর্ষা এবং অগ্রজ

ঈর্ষা কত প্রকার এবং কী কী জানতে হলে আমাদের তথাকথিত শ্রদ্ধেয় অগ্রজদের পানে একটু তাকাতে হবে। শ্রদ্ধেয় এর আগে তথাকথিত লাগানোয় অনেকে নাখোশ হবেন কিন্তু একদিন যাদের পরম আরাধ্য ভাবতাম তারা যে শেষ পর্যন্ত ঊনমানুষ হয়ে দেখা দিবেন ভাবতে পারিনি। এতদিন অপাত্রে শ্রদ্ধা নিবেদন করে এসেছি ভেবে নিজেকে ধিক্কার দেই।

প্রিয় কিছু কবিতার পুনর্পাঠ শুরু করেছিলাম। যে কবিতাগুলো বোধের গভীরে গেঁথে আছে ভেবেছিলাম সেগুলো এক এক করে মুক্ত করবো।

প্রথম কবিতা মুক্ত করার সাথে সাথেই ঈর্ষাকাতর কতিপয় অগ্রজ হামলে পড়লো। তারা ভাবল তাদের হেও করা হচ্ছে। ঈর্ষার এমন রূপ আগে আর দেখিনি।

লেখকের স্বাধীনতা নিয়ে আমরা সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে অনেক কথা বলি কিন্তু অধিকাংশই এটা বিশ্বাস করি না। লেখক কী লিখবেন কাকে নিয়ে লিখবেন সেটা কেউ ঠিক করে দিতে পারে না।

এক লেখক কে নিয়ে লিখলে অন্য লেখক যদি তেল-বেগুনে জ্বলে ওঠে তাহলে সেই অন্য লেখক লেখক হওয়া তো দূরের কথা ভালো করে মানুষই হতে পারেনি।

আমি কাকে নিয়ে লিখব সেটা আমার অধিকার তোমাদের জ্বলনে হয়তো কিছুক্ষণের জন্য হৃদয় ব্যথিত হবে কিন্তু তোমাদের মুখোশ উন্মোচনের জন্য ভালোও লাগবে।

হে বদ অগ্রজ তোমাদের ঈর্ষা অন্যকে পোড়াবে না নিজেরাই ভস্ম হয়ে যাবে।

সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী আনি আর্নো

nob

নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মান সূচক পুরস্কার হলো নোবেল। আর আমরা যারা লেখালেখির সাথে সংশ্লিষ্ট তারা সবাই সাহিত্যে নোবেলজয়ী কে হন সেই দিকে সবিশেষ নজর রেখে থাকি। প্রতিবছরের ন্যায় এবারো আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে সুইডেনের স্টকহোমে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। আর সেখানে বিভিন্ন পর্যায়ে অসংখ্য প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে ২০২২ সালের সাহিত্যে নোবেল পদক পেয়েছেন ফরাসি সাহিত্যিক আনি আর্নো। আমরা তাকে আন্তরিক অভিনন্দন এবং ফুলেল শুভেচ্ছা জানাই।

আনি আর্নোর জন্ম হয়েছে ১৯৪০ সালের ১ সেপ্টেম্বর। এখন তার বয়স ৮২ বছর। আনি আর্নোর সাহিত্য মূলত আত্মজীবনীমূলক। তিনি সমাজবিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ১৭তম নারী হিসেবে তিনি এই পুরস্কার জিতেছেন। এই ফরাসি সাহিত্যিক নরম্যান্ডির সাধারণ পরিবারে বেড়ে ওঠেন। তিনি বেশি পরিচিতি পেয়েছেন ওমেন্স স্টোরি, এ মেন্স প্লেস এবং সিম্পল প্যাসনের মতোন আত্মজীবনীমূলক কর্মের জন্য।

তার সাহিত্য ক্যারিয়ার শুরু হয় ১৯৭৪ সালে। তবে আনির এসব সাহিত্যকর্মকে ইংরেজীভাষী সমালোচক ও পাবলিশাররা মাঝে মাঝে আত্মজীবনী বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। অবশ্য আনি নিজে সবসময় বলেছেন, তার কর্মগুলো কল্পকাহিনী। তার অনেক সাহিত্যকর্ম ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করা হয়। ২০১৯ সালে দ্য ইয়ার্স নামে বইয়ের জন্য আন্তর্জাতিক বুকার অ্যাওয়ার্ডের জন্য নমিনেশন পান তিনি। বইটি সম্পর্কে অ্যাকাডেমি বলেছে, এটি তার সবচেয়ে উচ্চাকাঙক্ষী প্রকল্প, যা তাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এবং একদল অনুসারী ও সাহিত্যিক শিষ্য এনে দিয়েছে।

তার লেখা প্রথম উপন্যাস ‘লে আরমোয়ার বিড’ ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয়। কিন্তু ২০০৮ সালে ‘লে আনি’ প্রকাশ হওয়ার পর থেকে তিনি আন্তর্জাতিক পরিচিতি পান। এটি ২০১৭ সালে ‘দ্য ইয়ার্স’ নামে ভাষান্তরিত হয়। বইটি সম্পর্কে অ্যাকাডেমি বলেছে, এটি তার সবচেয়ে ভালো বই।

এ বছরের সম্ভাব্য প্রতিযোগীদের মধ্যে ফেভারিট তালিকায় ছিলেন আনি আর্নোসহ ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক সালমান রুশদি, কেনিয়ার লেখক নগুগি ওয়া থিয়ঙ্গো, জাপানের হারুকি মুরাকামি ও নরওয়ের জন ফোসের মতো লেখক ও সাহিত্যিকদের হারিয়ে পুরস্কার জিতে নিয়েছেন আর্নো।

নোবেল কমিটির স্থায়ী সদস্য ম্যাটস মাম বলেছেন, আনি এর্নো যে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন সেটি তিনি জানেন না। তবে আনি দ্রুতই এ খবর পাবেন বলে জানান ম্যাটস মাম। আনি আর্নোকে সাহিত্যে নোবেল দেওয়ার ব্যাপারে নোবেল কমিটি বলেছে, সাহস ও তীক্ষ্ণতার মাধ্যমে তিনি ব্যক্তিগত স্মৃতির শেকড়, বিচ্ছিন্নতা ও সম্মিলিত সংযম উন্মোচন করেছেন তার জন্য সাহিত্য জগতের সর্বোচ্চ সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। তার সাহিত্যে গর্ভপাত এবং পরিবার মূল উপজীব্য বিষয়।

আবারও বলছি, সাহিত্যে নোবেল মানেই সারাবিশ্বের সমস্ত কবি-লেখকদের জন্য একটি উদ্দীপনা। একটি অনুপ্রেরণা। এটি এই বার্তা বহন করে যে, সাহিত্য হলো বিশ্বজনীন। সর্বকালের সবার। তাই বিশ্বসাহিত্য অধ্যয়ন করতে হবে। তবে সাহিত্য ভাণ্ডার যেমন সমৃদ্ধ হবে; তেমনি সমৃদ্ধ হব আমরা সকলে।

মনু

শৈশবে মনু নদীর সাথে কথা বলতাম
অবিশ্বাস্য মনে হলেও
মনু আমার কথা বুঝতে পারত।

একবার চকলেট চুইয়ে মুখ
ভিজে গেছে, ধুতে হবে
মনুর পাড়ে পৌঁছে দেখলাম জল
অনেক দূরে বললাম
‘আমি তোকে ছুঁতে এলাম;
তুই দূরে চলে গেলি’।

মনু বলল ‘দাঁড়া এক মিনিট’
মিনিট খানেকের মধ্যে জল চলে
এলো পায়ের কাছে। মুখ ধুয়ে
ধন্যবাদ না বলেই চলে যাচ্ছি
হঠাৎ কে যেন জল ছিটকে
পিঠ ভিজিয়ে দিল।

পিছন ফিরে দেখলাম
মনু খিলখিলিয়ে হাসছে
তার সেকি আনন্দ।

মনুর সাথে বন্ধুত্ব ছিল
আমরা একসাথে অনেক পথ হেঁটেছি।

জীবনের বাঁকে হঠাৎ মনুর
সাথে বিচ্ছেদ ঘটে গেল
দীর্ঘদিন কারো সাথে
কারো দেখা নেই। অনেক বছর পরে
আবার যখন দেখা বুঝলাম
বন্ধুত্বের সেই উষ্ণতা নেই।
দু’একবার ডাক দিলাম
সাড়া দেয়ার কোনো দায় দেখলাম না।

মনু অভিমান করে বসে আছে
আমারও গরজ নেই
হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে এসেছি
জীবনের অন্য পর্বে কে আর
শৈশবের বন্ধুকে মনে রাখে।