বিভাগের আর্কাইভঃ জীবন

মকাইশা মোকাম্মিল

মোকাম্মিলকে আমি ডাকি ‘মকাইশা’, আমরা যখন ছোট তখন মকাইশা নামে এক অদ্ভুত, অলৌকিক মানুষ আমাদের পাড়ায় আসতেন। তিনি আমাদের খুব পছন্দের মানুষ ছিলেন; তাঁর বিচিত্র আচার-আচরণের জন্য। আমাদের পাড়ায় যতগুলো টিউবওয়েল ছিল প্রত্যেক টিউবওয়েলে তাঁর একছত্র রাজত্ব। টিউবওয়েলের পানি তাঁর কথা শুনতো তিনি যা চাইতেন টিউবয়েলের পানি তাই করতো, ঘন্টার পর ঘন্টা তাঁর মাথায় পানি ঝরতেই থাকতো, ঝরতেই থাকতো।

টিউবওয়েলের পানি যেভাবে তাঁর অনুগত ছিল, আমরাও ঠিক সেভাবে তাঁর অনুগত, ভক্ত ছিলাম। তিনি যা বলতেন আমরা তাই করতাম। আমাদের যে ছোটখাটো রাজত্ব ছিল, আমরা তাঁকে সেই রাজত্বের রাজা হিসাবে স্বীকার করেছিলাম। তিনি ছিলেন আমাদের জন্য হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা, তাঁর বাঁশির ডাকে আমরা ছুটে বেরিয়ে আসতাম। তিনি বললে আমরা সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তাম।

আমরা বড় হতে শুরু করলে তিনি তিরোহিত হলেন, কিন্তু তাঁর চিহ্ন থেকে গেল আমাদের হৃদয়ে। বন্ধুবান্ধব যখনই একত্র হই মকাইশাকে খুঁজতে থাকি, ইচ্ছে করে পুনরায় শৈশবে ফিরে যাই, ইচ্ছে করে টিউবওয়েলে ঘন্টার পর ঘন্টা মাথায় পানি ঢালি।

মোকাম্মিলের মাঝে মকাইশার কিছু চিহ্ন আছে। সেও অদ্ভুত স্বভাবের, তার সম্মোহনের ক্ষমতা অসাধারণ! একদিন লক্ষ্য করলাম আমরা তাকে অনুসরণ করছি। একদিন সে আমাদের দলনেতা হিসেবে দেখা দিল।

দেশে গেলে মোকাম্মিল ছাড়া আমার জীবন অচল। বিশ্বাস করুন এক বিন্দুও বাড়িয়ে বলছি না, মোকাম্মিল ছাড়া দেশের কোন আকর্ষণ নেই। আমি যদি বাসা থেকে এক ফুট দূরত্বে যাই, মোকাম্মিলকে সাথে থাকতে হয়। যদিও আমি দেশ থেকে বড় হয়ে এসেছি তবুও কেন জানি মনে হয় মোকাম্মিল সঙ্গে না থাকলে আমি হারিয়ে যাব। অথবা কেউ আমাকে চুরি করে নিয়ে যাবে। যতদিন দেশে থাকি নিজের চেয়ে মোকাম্মিলের উপর ভরসা করতে হয় বেশি।

ব্যক্তিগতভাবে মোকাম্মিল আমার ওস্তাদ। আমার জীবনের ‘প্রথম’ অনেক কিছু তার কাছে শিখেছি। দু একটা উদাহরণ দেই: সিগারেট খাওয়া ক্ষতিকর সবাই জানি, আমাদের পারিবারিক শৃঙ্খলার মাঝে সিগারেটের কোন স্থান নেই। এটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের অতিরিক্ত আকর্ষণ থাকে। আমাদেরও ছিল; কিন্তু নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করে স্বর্গচ্যুত না হওয়া কীভাবে সম্ভব মোকাম্মিল সেটা শিখিয়েছিল। সিগারেট খেয়ে কচি লেবুর পাতা কতক্ষণ চিবুলে সিগারেটের দুর্গন্ধ দূর হয়ে যায়, হাতের আঙ্গুলেও যাতে নাসির বিড়ির দুর্গন্ধ না থাকে সেজন্য কচি লেবুর পাতার রস বানিয়ে হাতে মাখতে হয়।

দুই টাকার বিনিময়ে কুসুমবাগে সিনেমা দেখা যায় সেটাও তার কাছে শেখা। কুসুমবাগের তখনকার যে টিকেট কন্ট্রোলার ছিলেন, তাকে দুই টাকার ঘুষ দিলে তিনি আমাদের থার্ড ক্লাসে বসিয়ে দিতেন, বিরতির পূর্বে শুধুমাত্র ১৫ মিনিটের জন্য বাইরে আসতে হতো তখন হল মালিকের নির্বাচিত লোক পরিদর্শনে আসতো, পরিদর্শন শেষ হওয়া মাত্র পুনরায় সিনেমা দেখার সুযোগ পেতাম।

শবেবরাতের নফল নামাজের জন্য মসজিদের প্রতিটি কোনা যে কভার করা লাগে সেটাও মোকাম্মিলের কাজ থেকে শেখা। আল্লাহ তাঁর রহমত মসজিদের কোন কোনায় বর্ষণ করছেন সেটা আমরা জানি না, সব কোনা কাভার হয়ে গেলে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হলাম না পরীক্ষা পাশও সহজ হয়ে গেল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক যে শেখ মুজিবুর রহমান এই সত্য সে-ই আমাকে প্রথম জানিয়েছিল। তখন খাল কাটার জমানা, বাজারে সাধারণ জ্ঞানের অসংখ্য বই বেরিয়েছে। আমাদের জায়গীর মাস্টার চাকরির ধান্দায় এসব বই গোগ্রাসে গিলছে। সাধারণ জ্ঞানের এক বইয়ে স্বাধীনতার ঘোষক হিসাবে দেখেছিলাম সানগ্লাস মেজরের নাম।

মোকাম্মিল বলেছিল এসব মিথ্যা; মেজর কোনভাবেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারে না তার সেই অধিকার নেই। স্বাধীনতা ঘোষণার অধিকার একমাত্র বঙ্গবন্ধুর, তখন গুগল জামানা ছিল না তাই দলিল, দস্তাবেজ দেখিয়ে প্রমাণ করার সুযোগ ছিল না কিন্তু যাকে সাক্ষী মেনে ছিল তাঁর সত্যবাদীতার কাছে হাজারটা গুগল পৌঁছাতে পারবে না। সাক্ষী ছিলেন সৈয়দ আমজাদ আলী, মোকাম্মিলের পিতা। সত্যবাদিতা এবং সৈয়দ আমজাদ আলী সমার্থক ছিলেন। আমাদের শহরে তাঁর সত্যের সামনে দাঁড়াতে পারে এমন কেউ ছিল না। সত্যের মূর্তপ্রতিক যখন বললেন শেখ মুজিবুর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক; সন্দেহ করার তিল পরিমাণ অবকাশ থাকল না।

মোকাম্মিল সম্পর্কে আমার চাচা, কিন্তু আমাদের সম্পর্ক কোনদিনই চাচা ভাতিজায় রূপ নেয়নি। সেরকম সম্ভাবনা ছিল না। আমাদের জন্ম প্রায় একসাথে দু-চার দিনের কম বেশি হতে পারে, বাসা পাশাপাশি। আমরা যখন বড় হই তখন কে কোন বাসার সে চিন্তা মাথায় আসেনি আমি যেমন অনায়াসে তাদের পাক ঘরে ঢুকে খাবার খেতে পারতাম, সে ঠিক তেমনি আমার সাথে এক পাতে খেতে বসে যেত। মোকাম্মিল আমার বন্ধু, সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। যে গোপন কথা বিবাহিত বউকে বলা যায় না; সে গোপন কথা মোকাম্মিলের সিন্দুকে আজীবন নিরাপদ থাকে।

আমার গায়ের রং কৃষ্ণ অর্থাৎ কালো মোকাম্মিল ফর্সা, মহাভারতের জমানা হলে সব গোপিনী আমার জন্য পাগল হতো কিন্তু এটা কলিকাল। এটা বুক ফেটে যাওয়ার জমানা; আমার ভাগ্যে কোনদিনই কোন গোপিনী জোটেনি, যাকে পছন্দ করি সেও আমার সামনে দিয়ে মোকাম্মিলের হাত ধরে চলে যায়। তবে ভাতিজার জন্য, প্রাণের বন্ধুর জন্য মোকাম্মিল চেষ্টা করেছে অনেক, তাকে পছন্দ করা গোপিনীদের আমার কাছে ভিড়াতে চেয়েছে, কিন্তু কলিকালের কারণে কেউ রাধা হতে রাজী হয়নি।

আমার দুঃখের এক বয়ান দিয়ে এই লেখার সমাপ্তি করি। মোকাম্মিলের সাথে ঢাকায় যাচ্ছি, ট্রেনে শ্রীমঙ্গল থেকে। ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে এমন সময় এক তরুণী আমাদের কামরায় উঠে এলো তরুণীর আলোয় ঝলমল করে উঠলো কামরা। মোকাম্মিল এবং আমি সামনাসামনি বসেছি। আমার পাশের সিট খালি, মোকাম্মিলেরও। তরুণী একবার আমার দিকে তাকিয়ে মোকাম্মিলের দিকে তাকাল, তারপর বলল ‘ভাইয়া আপনার পাশে কী একটু বসতে পারি’। মোকাম্মিল সায় দিলে বসে পড়ল, একটু ধাতস্থ হওয়ার পরে আমার দিকে চেয়ে বলল ‘চাচা কী ঢাকা পর্যন্ত যাচ্ছেন…’

আমার তখন মরমে মরে যাওয়ার অবস্থা…

স্মৃতির দুয়ার

rece

স্মৃতির দুয়ার খুলে দেখি
অনেক প্রাপ্তি তায়,
এই জীবনের শ্রেষ্ঠ আমি
গত বছর টায়।

শিক্ষক হয়ে গর্ব করি
জেলার শ্রেষ্ঠ হয়ে,
কাজের নেশা বাড়িয়ে দেয়
এমন মধুর জয়ে ।

ডিসি স্যার সাহিত্য পদক
দিলেন তুলে হাতে,
ক্ষুদ্র জীবন ভরলো সুখে
সম্মাননা সাথে।

কবি হয়ে পেলাম হাতে
রয়ালিটির টাকা,
এভাবেই চলুক জীবন
সুখে দুখে থাকা।

মধ্যরাত্রির কথা

মাঝে মাঝে কথা বলতে হয়। এমনিতে আমি খুব বেশী কথা বলতে পারি না। কেউ ফোন করলে তিনিই কথা বলেন, আমি সঙ্গত করে যাই। কথা বলার ভয়ে খুব ঘনিষ্ঠ কেউ না ডাকলে কবি সাহিত্যিকদের সম্মেলনে যাই না। ফেনিয়ে ফেনিয়ে প্রচুর কথা বলা তো দূরের কথা, দু একটা কথার পরে কী বলব খুঁজে পাই না। বন্ধুদের আড্ডায় হাসি আর একটু আধটু ফোড়ন দিয়ে চালিয়ে নিই।

কিন্তু কথা বলতে হয় মাঝেমধ্যে। নিজের সঙ্গে, সঙ্গোপনে, মাঝ রাত্তিরে কথার খই ফোটে। সবটুকুই মনে মনে। একটা শব্দও বাইরে আওয়াজ হয়ে বেরিয়ে আসে না। নিজের মনে, নিজের সঙ্গে কথা বলায় আমি খুব স্বতঃস্ফূর্ত। কিন্তু আশ্চর্য জানালার বাইরে কালোর নানারকম প্রজাতির রাত্রি আমার সব কথা বোঝে। হঠাৎ হাওয়ায় ঝোঁক বুঝতে পারে কী বলছি। ওরাও উত্তর দেয়, আমি শুনি। আমি বলি, ওরা শোনে। গাছের ঘুমন্ত ডালে, কোটরে মাঝঘুমে ডুবে থাকা পাখিরা, ছোট ছোট আনুবীক্ষণিক পোকামাকড়ের দল, গাছের পাতা, শেকড়ের দল ঘুমের মধ্যেই এক কান খাড়া করে শুনে নেয় আমার কথা। ওরা বলে না কিছু, তরঙ্গ পাঠায় আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয়ে।

সেইসব কথা চলতে চলতে কখনো বিষাদমালা, কখনো উদ্দাম রক। কথারা কথা থাকে কথার দাগে। আমি শুনতে পাই আগাছার প্রশ্বাস। কুঁড়িদের কচি গলা। আগামীকাল ঝরে পড়ার জন্য তৈরী হতে থাকা হলুদ পাতার শেষ ইচ্ছা। কথা চলে, রাত বৃদ্ধ হয়। মনে মনে আমি লিখতে থাকি আমার শেষ ইচ্ছার উইল।

হিয়া

321

হৃদয় গলে বেরিয়ে আসা প্রাণের স্পন্দন
তুমি বললে অশ্রু
আগুনের খোলা চিতা হতে নির্গত আত্মা
তুমি বললে দীর্ঘশ্বাস!
একবার ও চোখে চোখ রেখে দেখলে না
বহমান নদীর নির্বাক ঢেউ….

তিয়া কিংবা ফিরে আসা তেতুল গাছ

তিয়া তার মায়ের উপর রাগ করেছে, খুব কঠোর রাগ। অকারণে মা তাকে বকেছে। ম্যাক কে শুধু চুমু খেয়েছে, ফিজিক্যাল হয়নি; এতেই মা ম্যাডের মত ব্যবহার করেছে।

তিয়া জানে সে সতেরো, পুরোপুরি এডাল্ট নয়। মায়ের নিষেধ আঠারোর আগে কোন ছেলের সাথে ফিজিক্যাল হওয়া যাবে না। সে এডাল্ট নয় মনে ছিল, তবুও ম্যাকের অনুরোধ না করতে পারেনি। শুধুমাত্র ওয়ান লিপকিস, তাও কয়েক সেকেন্ডের জন্য।

মা তার প্রতি অতিরিক্ত কঠোর, সব সময় চোখে চোখে রাখে। সে আঠারো নয় এজন্য তার যেন কোন স্বাধীনতা নেই। তার বয়সের অন্য মেয়েরা বয়ফ্রেন্ডের সাথে অনেক আগে ফিজিক্যাল হয়েছে, সে এখনো ভার্জিন।

তিয়া মন খারাপ করে বসে আছে। সে অপেক্ষায় আছে কবে আঠারো হবে, কবে মায়ের পিঞ্জর থেকে মুক্ত হবে।

তিয়ার বাবা সামাদ এতো রক্ষণশীল নন, তিনি কারো ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার ঘোর বিরোধী তবু স্ত্রীর সামনে তিয়ার পক্ষ নিতে পারেন না। আঠারো পর্যন্ত তিয়ার স্বাধীনতা সীমিত। মা-বাবার কথা শোনা ছাড়া অন্য উপায় নাই।

বাবা ফিরলে তিয়া মায়ের অভিযোগ করে। বাবাকে বলে ‘আমি তোমাদের চাকর নই, তোমাদের মেয়ে, আমার সাথে চাকরের মত ব্যবহার করতে পারো না। আই হ্যাভ নট ডান এনিথিং রং, শী শুড নট হ্যাভ সাউটেড অ্যাট মি, ইফ ইউ ডোন্ট ওয়ান্ট মি হিয়ার আই ক্যান লিভ, আই ক্যান স্টে উইথ ম্যাক, হিজ প্যারেন্ট ওন্ট মাইন্ড’।

বাবা তিয়াকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। বুঝাবার চেষ্টা করেন মা তাকে ভালবাসে, তার ভাল চায়। এইজন্য একটু কঠোর হয়। বাবা বলেন ‘ইউ নো শী ওয়ান্ট দা বেস্ট ফর ইউ, শী ওয়ান্টস ইউ টু আন্ডাস্ট্যান্ড গুড এন্ড ইভল’। তিয়া বলে ‘আই নো হোয়াট ইজ গুড ফর মি’। বাবা বলে ‘সিওর ইউ ডু, বাট প্যারেন্টস ডিউটি ইজ টু বি কন্সার্ন’। মেয়েকে কোন রকম শান্ত করে স্ত্রীর কাছে যান।

দুপুর বেলা ম্যারি স্কচ হাতে নিয়ে বসে আছে, তার মুখ থমথমে। সামাদ ভয়ে ভয়ে বলে ‘ডোন্ট বি টু হার্স অন হার ম্যারি, শী ইজ অনলি এ চাইল্ড’। ‘একজ্যাক্টলি শী ইজ অনলি এ চাইল্ড, শী শুড নো হার লিমিট’।

‘বাট’ সামাদ আরো কিছু বলতে চাইলো। ম্যারি তাকে থামিয়ে বলল ‘উড ইয়োর সোসাইটি এক্সেপ্ট ইট’? ‘উই আর নট ইন আওয়ার সোসাইটি ম্যারি’। সামাদ বলে। ‘বাট শী ইজ স্টিল ইয়োর ডটার’ ম্যারির উত্তর। ‘হোয়াই ডাজ নট শী আন্ডারস্ট্যান্ড শী এজ ফ্রম এ ডিফরেন্ট কালচার, আই নো উই লিভ ইন ওয়েস্টার্ন ওয়াল্ড, উই ক্যান নট পুট টু মাচ প্রেসার অন হার, বাট শী ক্যান নট ডু হার উইল আনটিল শী ইজ এইটিন, দ্যাটস ফাইনাল’।
ম্যারির সাথে কথাবার্তা আর এগুনো যাবে না ভেবে সামাদ পুনরায় মেয়ের কাছে আসে, মেয়েকে বুঝায় আর মাত্র এক বছর। তারপর সে পূর্ণ স্বাধীন। তিয়া বলে সে যদি ম্যাকের সাথে ফ্লেক্সিবল না হয় ম্যাক অন্য কারো কাছে চলে যাবে। ‘প্লিজ বি প্যাসেন্স মাই ডটার’। সামাদ বলে।

ম্যারি প্রায় বলে ‘ইউ হ্যাভ ফরগটন ইয়োর রুটস সামাদ’। সামাদ কিছু বলে না। একচল্লিশ বছরের মাঝে একবারও দেশে যায়নি, ম্যারি মিথ্যা বলে না। সামাদের কোন রুটস অবশিষ্ট নেই। গ্লাসে স্কচ ঢেলে বসার ঘরে চলে যায় সামাদ। অনেককাল আগে সে যখন দেশে থাকত তখন সতেরো বছরের একটা মেয়ে তেতুল গাছে ঝুলে ছিল, আত্মহত্যা না মেরে কেউ ঝুলিয়ে ছিল জানতে পারেনি। সে তখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তার বয়স তখন আঠারো হয়নি।

সামাদ পালিয়ে ইংল্যান্ড চলে এসেছিল, রিয়াকে তার বাবা চাচারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তার লাশ ঝুলেছিল তেতুলের গাছে।

একা মানে নিঃসঙ্গ নয়

3187

নিজের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অথবা অধীক সমর্থন থাকলেই যে নিজের বা নিজ পক্ষের অবস্থান সঠিক তা কিন্তু ঠিক না;
কখনো কখনো সংখ্যালঘু বা একা পক্ষও বিজয়ী হতে পারে বা সঠিক হতে পারে।

পৃথিবীর ইতিহাসে বেশির ভাগ কালজয়ী বিজয়ী বীরেরা তাদের যুদ্ধ বা পথ চলা একাই শুরু করেছিলেন, নবী রাসুলদের প্রায় সবাই তাদের বিশ্বাস ও প্রথা একাই শুরু করেছিলেন! সেই দলে আছেন অসংখ্য বৈজ্ঞানিক রাজনৈতিক ধর্মযাজক সহ অনেকেই।

এমনিতে বর্তমান সমাজে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ যারা অত্যাধিক তৈলবাজ, মিথ্যা অভিনয়কারী, দুমুখো আচরণকারী, হালে বড়লোক, এবং লোকদেখানো ভাবসাব…
এদের বাহবা পাবার সম্ভাবনা সবসময় বেশীই থাকে। কিন্তু দিনশেষে এরাই আবার মুখ লুকানোর জন্য জায়গা খুজে!..

আসলে মনে রাখা উচিত আপনি সবসময় একা!..
যতোই বন্ধু কিংবা তথাকথিত দোস্তোরা আপনাকে ঘিরে থাকুক না কেন দিন শেষে আপনার বিবেক (যদি থাকে) আপনার আত্মা আপনাকে একা করে দেয়,মুখোমুখি করে দেয় নিজের সামনে নিজেকে।

আরেকটা কথা মনে রাখা উচিত –
লৌকিকতা সবসময় ভঙ্গুর… আপনি হয়তো লৌকিকতার গন্ডিতে পড়ে গেছেন, আর নিজের অবস্থান কে ঠিক জাহির করতে একের পর এক মিথ্যা আবরণে সত্য কে ছাপিয়ে রাখছেন- কিন্তু কতক্ষণ? কতদিন?
একদিন না একদিন সত্য সূর্যের উদয় হবে
তখন সে যখন সমস্ত অন্ধকার গিলে খাবে তখন আপনি লুকাবেন কোন অন্ধকারে…?

(একা মানে নিঃসঙ্গ নয়)

সঞ্জীবনী বুবাই এবং নিম গাছ

আমাদের বাসার সামনের দিকে এক চিলতে উঠান ছিল, এক চিলতেই। সেই উঠানে জাম গাছের পাশাপাশি নিম গাছ ছিল। জাম গাছের ব্যাস, ব্যাসার্ধে নিম গাছকে অন্ত্যজ মনে হত। আমাদের সবার দৃষ্টি জাম গাছের দিকে ছিল, অর্থাৎ জাম গাছ ঘিরে আমরা যেভাবে শোর তুলতাম সে তুলনায় নিম গাছের দিকে ফিরেও তাকাতাম না।

জাম মৌসুমি ফল, স্থায়িত্ব খুব বেশি নয়। তবু বৈশাখ এবং জ্যৈষ্ঠ মাস জামের মাস; জিহ্বা রঙিন করতে জামের কোন বিকল্প নেই। এই দুই মাস জাম গাছের তলায় উৎসব হত, আমাদের সেই এক চিলতে উঠান জাম কলরবে সরব হয়ে উঠতো।

পক্ষান্তরে পাশের নিম গাছ নিজের আভিজাত্যহীনতায় এই দুই মাস আরো কুঁকড়ে যেত। আমাদের জীবনে জামের প্রয়োজন থাকলেও নিমের প্রয়োজন তেমনভাবে কোনদিন অনুভব করিনি। নিম ঔষধি গাছ কিন্তু অসুখ হলে আমরা সোজা ডাক্তারের চেম্বারে দৌড় লাগাই, নিমের কোন চিন্তা মাথায় আসে না।

ছোটবেলা অসুখ-বিসুখ আমার লেগেই থাকতো, খোস পাঁচড়া, সর্দি কাশি নিত্যদিনের সঙ্গী ছিল। আমি প্রায় সময়ই মাটিময় থাকতাম, অর্থাৎ মাটিতে গড়াগড়ি খেতে খুব ভালো লাগতো। আম্মা কিংবা বড় আপা হয়তো আমাকে গোসল করিয়ে স্নো পাউডার মাখিয়ে বাবু সাজিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বসিয়ে রেখে গেছেন। তারা ফিরে আসতে আসতে দেখা গেল আমি যুদ্ধ জয় করে বারান্দায় উঠে আসছি। আমার গায়ে এবং কাপড়ে কাদামাখা। গতকাল বৃষ্টির পরে উঠানে যে পানি জমেছিল এইমাত্র সেখান থেকে সাঁতরে এলাম।

আমাকে পুনরায় গোসল করানো অহেতুক ভেবে বড় আপা অথবা আম্মা টাওয়াল ভিজিয়ে গা মুছে দিতেন। আমি আমার জগতে খুব সুখী ছিলাম খোস পাঁচড়া, সর্দি কাশি তেমন কাহিল করতে পারত না। যদিও আমার নাসিকা অন্তহীন নদীর মত ছিল তবু যেকোনো জলাধার আমাকে আকর্ষণ করত, সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়তাম, সেটা উঠানের গর্ত হলেও।

একবার আমাকে বেশ বড়সড়ো অসুখে ধরলো, সারা গায়ে গুটি গুটি ফোড়া দেখা গেল। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডাক্তার বলল পানি বসন্ত। বসন্ত যদিও আমার পছন্দের ঋতু ছিল কিন্তু এই বসন্ত কোনভাবেই পছন্দ হলো না। সারা গায়ে চুলকানি, দিনে দুই তিনবার জ্বর আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে ফেলল। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই অসুখের কারণে আমি মাটি থেকে দূরে আছি, বাসার কেউ আমাকে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে দিচ্ছে না। আমি ডাকঘরের অমলের মত জানালায় বসে তৃষিত দৃষ্টিতে উঠানে চেয়ে থাকি যেখানে গতকালের বৃষ্টি এখনো জমে আছে।

পানি বসন্তের যত রকম ঔষধ তখনকার সময়ে উপলব্ধ ছিল সব ব্যবহার করে দেখা হয়ে গেছে, কাজে লাগছে না। এলোপ্যাথিক ছাড়াও হোমিওপাত, কবিরাজি প্রয়োগ করে দেখা হচ্ছে কিন্তু কাজ হচ্ছে না। আমাদের বাসায় আম্মার যে সহকারি ছিলেন আমরা সবাই থাকি ‘বুবাই’ বলে ডাকতাম। ‘বুবাই’ অর্থ বড় বোন। আমার জন্মের পরে আম্মা কিছুদিন সুতিকা রোগে ভুগেছিলেন। তখন আমাকে রক্ষণাবেক্ষণ, লালন পালন করার দায়িত্ব পালন করেছিলেন এই ‘বুবাই’।

আমার অসুখে পুনরায় ক্রাতা হয়ে এলেন এই ‘বুবাই’। তিনি আম্মাকে বনজ সমাধান বাতলে দিলেন। তখনই নিম গাছের প্রয়োজন পড়লো। যে নিমগাছ বছরের পর বছর অবহেলিত ছিল, সেই নিম গাছ আমাকে রক্ষা করতে এগিয়ে এলো। গরম পানিতে নিম পাতা ভিজিয়ে রেখে সেই রস হালকা প্রলেপে সারা গায়ে মাখিয়ে নিলে পানি বসন্ত উপশম হয়। অন্তত আমার জন্য এই টোটকা খুবই কার্যকরী ছিল।

আমার মারাত্মক রকম পানি বসন্ত হয়েছিল, সারা গায়ে চামড়া দেখা যেত না এমন। আমার এই অসুখে আব্বা, আম্মার চোখে মুখে দুশ্চিন্তার রেখা দেখা দিয়েছিল। আমি হাত পা নাড়ছি, কাপড়ে কাদামাটি মাখছি অর্থাৎ বাসা জেগে আছে, আমি মনমরা হয়ে বসে আছি অর্থ বাসা বড় কোন বিপদে পড়েছে। আব্বা, আম্মা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছিলেন বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে।

‘বুবাই’ এবং নিমের বদান্যতায় বড় বিপদ থেকে রক্ষা পেলাম। যে নিম গাছের প্রতি আমাদের অবহেলার শেষ ছিল না সেই নিম গাছ আমাদের প্রার্থনা পেতে থাকলো বিশেষ করে আব্বা, আম্মার।

আমরা এখন নিয়মিত নিমের পরিচর্যা করি, আগাছা উপড়ে ফেলি, পানি ঢালি। নিম গাছ দীর্ঘদিন আমাদের এক চিলতে উঠানের গৌরব ছিল। তাকে আমরা প্রচুর কাজে লাগিয়েছি। খোস পাঁচড়া, পেটের পীড়া, ত্বকের নানায় সমস্যার তার স্মরণাপন্ন হয়েছি সে সাধ্যমত উপশম দিয়েছে। কালের পরিক্রমায় সেও একদিন চলে যায়, জাম গাছ আগেই গিয়েছিল। সেই এক চিলতে উঠান আর নেই, ইটের দালান তার দাপট দেখিয়ে জাম নিমকে সাবার করেছে।

পরবর্তীতে আমার আর পানি বসন্ত হয়নি। অনেকদিন পরে আমার ছেলের যখন পানি বসন্ত হল দেখলাম সেও আমার মত ছটফট করছে। ডাক্তারের পরামর্শে ক্যালামাইন লাগিয়েও যখন উপশম হচ্ছে না তখন ইচ্ছে করলো উড়াল দেই পেড়ে আনি কিছু নিমপাতা। কিন্তু চাইলেই উড়াল দেওয়া যায় না, নিম গাছও আর অপেক্ষায় বসে নেই…

শোয়া-পণ্ডিতের গুষ্টি

সাত
— দাঁড়ায় জল খায় না, দিদি। বিষম লাগবেনে।
শিউলি খাটের ওপর খ’সে প’ড়ে গেলাসে চুমুক দিল।
দিদিমাবুড়িরা একটু বকর-বকর করেই থাকে :
— জীবনে আর তিন্‌ডে জিনিস মনে রাইখো। কেউ পান খাওয়াতি চালি খুলে দেখে মুখি দেবা। পাইখানা ক’রে মাটিতি হাত ঘষতি ভোলবা না। আর কোনও দিন ষোলোগুটি খেলার ধারেকাছে গেছো কি মোরিছো।

দু’একটা ক’রে হাবাগোবা মানুষ বাংলার প্রত্যেক গ্রামে পাওয়া যাবে, বুঝি কে বা কারা তাদের পানের রঙিন মশলায় শেকড়-বাকড় বেটে খাইয়ে দিয়েছিল। আর পায়খানা থেকে বেরিয়ে শ্যাওলাপেছল মাটিতে ভালো ক’রে ঘ’ষে নিলে বাঁহাত শুদ্ধ হয়ে যায়। ঘষতে ঘষতে কাঁকর-বালি উঠে চিনেবাদাম-রঙ মাটি বেরিয়ে পড়ে, ধরা যায় কোন হাতের মাপ বাড়ির কোন সদস্যের। বাকি থাকল ষোলোগুটি। পূর্ববঙ্গে এক দিবানা লোক সন্ন্যাস নেবে ব’লে মাঝসংসারে বউ-ছেলেমেয়ে ফেলে গেরুয়া প’রে পিঠটান দিয়েছিল। তিন দিন তিন রাত জলেজঙ্গলে হেঁটে এক গ্রামে পৌঁছে পাকুড়তলায় জিরোতে বসেছে, বৈরাগী ভেবে কোনও গোয়ালা সদ্য দুয়ে আনা এক লোটা দুধ দিয়েছে তাকে। দুধে চুমুক দিতে দিতে, এই যেমন চাঁদভাই খাচ্ছিল আজ, দ্যাখে গাছতলায় ষোলোগুটি-র ছক কাটা। “কী হে, এক-হাত হবে নাকি” বলে সে কোনও পথচারীকে ডেকে বসাল। সেই যে বিবাগী মাতল খেলায়, না হল তার গ্রাম ছেড়ে এগোনো, না সন্নিসি হওয়া। পথিক আসে, পথিক যায়, আর লোকটা মাথা নীচু ক’রে খেলতে খেলতে জিতে গেলে জোকার দেয় বিশ্বেশ্বরের নামে, হারলে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে আবার ইঁটের ঢেলা দিয়ে কোট সাজায়। দেখতে দেখতে তার দাড়ি বুক পর্যন্ত, মাথার চুলে জট, খাওয়া বলতে ওই লোটায় ক’রে কাঁচা দুধ… গ্রামের মানুষ নাম দিয়েছে ঢেলামহারাজ। আশপাশের যোক্তা লোকজন এসে বলল, চলো গঙ্গাসাগর যাই, গেল না। ছ’মাস পরে খোঁজতলাশ করে তার বৌ-ছেলে এল, চিনতে পারল না তাদের। লোকটা পাকুড়তলাকে ‘ষোলোগুটির থান’ বানিয়ে ঢেলামহারাজ নামে কাটিয়ে দিল বাকি জীবন।

বেঁচে থাকা এমনই বিচিত্র কারসাজি, এক দেববিস্ময় মহাজনি কেতা। এইমাত্তর সে মৎস্যচক্ষু বোঝাটানা জীবন, আবার মুহূর্ত পরেই হেঁয়ালি-শিহরনে জম্‌জমা। শ্রীরামপুরের গঙ্গা যেন — কোথাও শ্মশানঘাটে পচা গাঁদাফুল আটকে প’ড়ে আছে তো আছেই; কোথাও কোলের শিশু খসামাত্র তলিয়ে যাবে, হদিশ করতে পারবে না।

এই যে পাড়ায় রামযাত্রা এল, যখন তের্‌পল গুটিয়ে হ্যাজাক নিভিয়ে চলে যাবে, দেখা যাবে তক্ষুনি গ্রামের দু’একটা মেয়েও গায়েব-লোপাট-অনুপস্থিত। প্রতিদিন ভিড় হতো, প্রতিদিন সংলাপমুগ্ধ যুবতীরা মঞ্চের সামনে ব’সে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকত রামের গভীর নাভিকুণ্ডলী, সীতার গলাভর্তি গয়নার দিকে…। তারপর কোন ফাঁকে বাতিল রেল কোয়ার্টার্সের পাশে জানকীবল্লভের অসভ্য ইয়ারকি শুনে ফেলল তারা, সীতার বুকের ঘন লোম তাদের ঝটকা দিয়ে দিল। তারা ডুবে গেল চুঁচড়ো বা অগ্রদীপ বা ধুলিয়ানের গঙ্গার ঘূর্ণিজলে।

আট
ঘরের ছাঁচতলায় গাঁদার চারা লাগিয়েছিল মায়া, তাতে খুব ফুল এসেছে। নির্মল অনেক দিন পরে রুলটানা, তিন ফুটো ক’রে সবুজ সুতোয় সেলাই — তার বাংলা, ইংরাজি আর সংস্কৃতে কবিতা লেখার খাতাটি বের করল বইয়ের তাক থেকে। তখন পাশের ঘরে মায়ার গলা :
— বাহ, বই মুখি দিয়ে সব খাটে শুয়ে পড়িছেন! গ্যাঁট হয়ে ব’সে পড়তি পারিস না? সাধে কী আর বলে, শোয়া-পণ্ডিতির বংশ?
— শোয়া-পণ্ডিত কী, মা?
— এই কাহিনিডা আমার চেয়ে তোমার বাবা অনেক ভালো কোতি পারবে।
মা’র চোখের ইশারা পেয়ে চাঁদ মরা গলায় ডাকে :
— বাবা, ও বাবা, শোয়া-পণ্ডিতির গল্পোটা বলেন না!

ফাউন্টেন পেনের নিব খসখস করছে, নির্ঘাৎ সঞ্জু বা বাসু লুকিয়ে বাবার কলমে হাত দিয়েছিল। নির্মল ধ’রে ধ’রে লিখল :
শুষ্ক স্বর্ণ জিনিয়া বর্ণ,
সুষমার সার রূপ অতুল —
গাঁদাফুল!
তারপর অসমাপ্ত কবিতার জিম্মায় শীতের দুপুরকে রেখে এ-ঘরে এসে দ্যাখে সন্তানদের মুখে একরাশ লাবণ্য। গরীব ভালো থাকে যদি সে ভবিষ্যৎচিন্তা ভুলে যায়। তবে সে-কাজ মহাপুরুষদেরও অনায়াসসাধ্য নয়। তাই ঈশ্বর অসহায়কে আরও একটু সমস্যার মধ্যে ফেলে তারপর সেই অসুবিধেটি মোচন ক’রে দেন। কোনঠাসা লোক আবার পুরনো ঝুটঝামেলার জীবনে এসে পড়ে। কিন্তু খানিকটা নেমে আগের জায়গায় পুনর্স্থাপিত হওয়ায় সে নিজেকে জয়ী এবং সুখী ভাবতে থাকে। চাঁদের অসুখ থেকে ওঠা-ও বাড়িতে তেমনই এক ক্ষণবসন্তের জন্ম দিয়ে গেছে।

নয়
— আমার ঠাকুর্দা ছিলেন স্বর্গীয় শ্রীধর তর্কালংকার, স্বর্গীয় অমূল্যচরণ তর্কালংকার আমার প্রপিতামহ।
— আমিও বিয়ে হয়ে ইস্তক শুনিছি, শ্বশুরবাড়ির বংশে অনেক কাঁচালংকা শুকনো লংকা ছিল। ফোড়ন কাটে মায়া, মুখে আঁচল চাপা দেয়, তারপর বাচ্চাদের দিকে ফিরে : প্রপিতামহ মানে ঠাকুদ্দার বাবা, বুঝতি পারিছো?
নির্মল বাবু হয়ে ব’সে গোপার মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলে যায় :
— মহা-মহা পণ্ডিত ছিলেন তাঁরা। তবে পাড়ার বয়স্করা এ-বাড়ির ছেলেমেয়েদের চিনত ‘শোয়া-পণ্ডিতের বংশ’ ব’লে। সেনহাটির সিদ্ধান্তপাড়ায় বিষ্ণুমন্দিরের মুখোমুখি স্কুলবাড়ির মতো লম্বা দোচালা। টানা বারান্দায় সার দিয়ে তক্তপোশ, ঘরের মধ্যে উঁকি দিলেও ওই খাটিয়া-সাইজ খাটই। তাতে আগাগোড়া বই ডাঁই করা রয়েছে। মাঝখানে খোঁদল ক’রে এক একজন শুয়ে। শুয়ে, ঘুমিয়ে নেই কিন্তু। বই পড়ছে।
এটা ন্যায়শাস্ত্রের খাট, পরেরটা স্মৃতির — দুই জ্যাঠাতো ভাইয়ের সংসার। ভেতরের ঘরে সুশ্রুত খাটে কবিরাজ ছোটকাকা, আবার গীতাভাগবতের পুরনো খট্টাঙ্গটি খোদ বাড়ির বড়কর্তার। দেখলে দূর থেকে বেশ মনে হবে জেলা হাসপাতাল।

যে কাহিনি বলতে যাচ্ছি, ছোট্‌ঠাকুরদার লেখা তালপাতার পুথি থেকে উদ্ধার করেছিলেন আমার বড়দা। চৈতন্যের আবির্ভাবের দুশো বছর পরে খুলনায় জন্মগ্রহণ করেন মধুসূদন, তার মতো ন্যায়-বৈশেষিক শাস্ত্রজ্ঞ ও তার্কিক তখন গোটা বঙ্গদেশে নেই। সেবার বেনারস থেকে এসেছেন দিগ্বিজয়ী দশরথ মিশ্র, জাঁহাবাজ লড়ুয়ে, যাকে তর্কে হেরে যাবে ভয়ে লোকে সম্ভাষণ করতেই ভয় পায়। দশরথের বজরা গঙ্গা বেয়ে ভাটপাড়া কাটোয়ায় নোঙর রেখে শেষে বিজয়পতাকা উড়িয়ে পদ্মা বেয়ে কপোতাক্ষ হয়ে ভৈরবের মুখ পর্যন্ত পৌঁছে ব’সে রইল। সে বজরার এ-মাথা ও-মাথা করছে বাদশাহের মতো আর ছোট-বড় কথা বলছে বাঙালির জ্ঞান-বুদ্ধি নিয়ে। তখন সাতক্ষীরা খুলনার মাতব্বরেরা এসে ধরল — মহাশয়, আপনি রুখে না দাঁড়ালে তো বাংলার মান বাঁচে না। রাজি হতেই হল মধুসূদনকে।

বিতর্কের দিন মেহেরপুরের মাঠে বিরাট শামিয়ানার নীচে দুই পণ্ডিতের বসার ব্যবস্থা। চারপাশে গোল হয়ে এলাকার মান্যিগন্যিরা আসীন, পেছনে উৎসুক জনতা। এসে তো বসলেন, কিন্তু মধু পণ্ডিত একটু যেন উশখুশ করছেন মনে হচ্ছে? দশরথ শুরুর প্রশ্ন একটু হালকা চালে ছেড়েছেন :

— ধর্ম কয় রূপ?
মধুসূদন চুপ!

শুনতে পাননি। মেলা গোল ক’রো না, ওহে লোকজন। রিপিট করা হল প্রশ্ন। মধু এবারও নির্বিকার। দশরথের পাতলা লাল ঠোঁটে হাসি বঙ্কিম হল।

— নির্গুণ আত্মজ্ঞান কার আবিষ্কার?
মধুসূদনের পন্ডিতি ভেঙে ছারখার।

—- ও বাবা, কী বোলতিছেন, মানে বুঝি না তো!
যেন শিউলির গলায় নির্মলের সম্বিত। সে তালকাটা হয়ে তাকায় মায়া, তার অনুবাদিকার দিকে।

(চলছে)

সজ্জন সহোদর হারানো বিলাপ

আতর গোলাপ জলে ধৌত শেষ।
সাদা কাপড়ে মোড়া। নাকে কানে সাদা কাপড়ের টুকরা দেয়া। কপিনের চারপাশ চা’পাতি ঢালা, মাঝখানে নিঃস্তব্ধ নিঃসার সোয়ানো লাশ। মুখোমন্ডল যেন, পেলব প্রশান্তির ছাপ ধরে আছে। চিরতরে, নির্বিকার আর কারো সাথে কোন দিন চলবে না, হাঁটবে না, বলবে না কথা! এ তার কেমন চলে যাওয়া?

দিন রাত্রির, এই যে খেলা।
পঞ্চমীর চাঁদের রাতের দ্রোহ। লক্ষ কোটি নক্ষত্রের ঐ তো ছিল,ধব্রতারা, তাও খসে পড়ল! ভোরের বীণায় যে জাগ্রত সুর বাজে নিত্য। দিন বদলে পারাবার। স্বপ্ন জিইয়ে ছিল, সিঁথানে। গীতবিতানের মর্মধ্যানে যাপিত জীবন, ক্ষয়ে যায় ক্ষণে ক্ষণে।

বুঝেনি কেউ, জানেনি কেউ
নিজের মধ্যে নিজে পুড়েছে বারং বার। যেমন চিতার আগুনে চিতারই পোড়ার মতো সহবোধ। কাউকে জানার ফুরসুত দেইনি। কেউ জানতে চায়নি কখনও? তাই বড়ই অভিমান। মুখের প্রলাপে বুঝেনি কেউ। কি সে ডুবছে সে? মর্মাথ্য বিধানে ঝুঁকেছে। ভেঙেছে, গড়েছে, আপ্লুতো, চলে যাবে বলেই; অবিনাসি বৈভব।

১৪২৩/২৬, অগ্রহায়ণ/হেমন্তকাল।

সর্পবিদ কিংবা গুরু

নাগেশের সাথে প্রথম পরিচয় ভীতিকর ছিল। স্কুলের সীমানা দেয়াল ঘিরে যে প্রাচীন বটগাছ তার ফাঁকফোকরে সাপের আস্তানা। নাগেশ প্রায় দিন স্কুলের সামনে দিয়ে কোর্টে যায়, কোর্টের সামনে বাবার সাথে সাপের খেলা দেখায়।

বটগাছের নীচে বাদামওয়ালা, আইসক্রিমওয়ালা, আচারওয়ালা। তাদের ঘিরে আমরা। হঠাৎ এক পাতালতি গাছ থেকে নেমে আমাদের দিকে তেড়ে আসে। আমরা যারা নিজেদের বিজয়ী ভাবি, যাদের অভিধানে ভয় বলে কোন শব্দ নেই; তারা পিচ্ছি এক সাপ দেখে প্রাণের ভয়ে পালাতে থাকি।

সাপ দেখে আত্মা প্রায় খাঁচাছাড়া এমন সময় রিক্সা থেকে নেমে নাগেশ আসে, পোষা বেড়ালের মত সাপকে মুঠোবন্দী করে ঝুড়িতে ভরে। দূরত্বে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ চোখে নাগেশকে দেখি, এই প্রথম আমাদের মস্তক নত হয়ে আসে। নিজেদের নির্ভয় ভাবনায় এই প্রথম সন্দেহ লাগে, এই প্রথম মনে হয় নাগেশের সাহসের তুলনায় আমরা অতি নগন্য। তার কাছে আমাদের আত্মগরিমা খাক হয়ে যায়।

আমাদের বয়সী একটা ছেলে সাপকে কাবু করতে পারে এটা একটা বিস্ময়। আমরা নাগেশের বন্ধু হওয়ার জন্য উতলা হয়ে উঠি। তাকে গুরুর আসনে স্থান দিতে ব্যগ্র হয়ে উঠি। যে সাপকে জয় করতে পারে তার কাছে অজেয় কিছুই থাকবে না এই ভাবনা আমাদের উদ্বেলিত করে। তাঁর নেতৃত্বে আমরা অজেয় কে জয় করব।

নাগেশ আমাদের বন্ধু হয়ে যায়। বন্ধু না হলেই ভাল হত। যে উৎসাহ, যে উদ্দীপনা, যে আগ্রহে তাকে বন্ধু বানাই সে আগ্রহ দুদিনেই ফুটো হয়ে যায়। সাপের খেলা ছাড়া নাগেশের আর কিছু আসে না। সে অংক কষতে পারে না, দুই ভাগ হাইড্রোজেন এক ভাগ অক্সিজেনের সংমিশ্রণে কি হয় জানে না। আহ্নিক গতি কাকে বলে তাও জানে না।

তাকে নিয়ে পৃথিবী জয়ের যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম; মরে যায়। দেখা যায় সে অতি সাধারণ, সাপ বশ ছাড়া কোন বিশেষত্ব নেই। আমরা আমাদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।

স্কুল থেকে কলেজ। আমাদের রাজ্যের পরিধি বেড়ে যায়। সহপাঠিনীর ওড়না কার মুখের ঘাম মুছে দেবে এই নিয়ে প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়ি। প্রতিদিন মিছিল মিটিং নাগেশের সাথে সঙ্গ কাটানো, সাপ খেলা দেখার সময় হয় না।

তখন এরশাদের জমানা। বিশ্ব বেহায়া এখানে সেখানে লাশের বিছানা ফেলছে। আমরাও বদ্ধ পরিকর; যেকোনো মূল্যে এই বেহায়াকে ঝেড়ে ফেলতে হবে।

এরশাদ বিরোধী মিছিলে গগনবিদারী স্লোগান দিচ্ছি, আজ তাকে সরে যেতে হবে। এরশাদও শেষ কামড় দিতে প্রস্তুত। তার পোষ্য পুলিশ মিছিলে গুলি চালিয়েছে, সবাই ছত্রভঙ্গ; যে যার মত পালাচ্ছে।

পালিয়ে যাব এই চিন্তা যখন মাথায় এসেছে তখনই দেখতে পেলাম একটা তপ্ত সীসার বুলেট আমার দিকে ধেয়ে আসছে, কিছু বুঝার আগেই রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। কে যেন ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। সীসার বুলেট নাগেশের বুক বিদীর্ণ করে গেল।

নাগেশ সাপের খেলা দেখাত। সাপকে কিভাবে পোষ মানাতে হয় জানত কিন্তু বন্ধুর প্রাণ বাঁচাতে সেই সাপের ছোবলে মারা গেল।

এরশাদ সরে গেছে কিন্তু মরে যায় নি। কিছুদিন গর্তে অবস্থান করে বিপুল বিক্রমে ফিরেছে। আহ্নিকগতির জ্ঞান রাখা অনেকে তার সঙ্গী হয়েছে। একদিন যারা তার ছবিতে থুথু ছিটাত তারাই এরশাদের থুথু ভক্ষণ করেছে।
আমরা অংক কষি, বিজ্ঞান চষি। অনেক বিষয়ে পারদর্শী কিন্তু আমাদের চরিত্র বেহায়ার চেয়েও খারাপ। নাগেশ সাপ সঙ্গ পছন্দ করেছিল, চরম অবিশ্বাসী সাপ তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করলেও আমাদের নগর সাপ তাকে লাশ বানিয়ে ছাড়লো।

আমরা তাকে নেতা হিসাবে চেয়েছিলাম, গুরু হিসাবে চেয়েছিলাম; সে যথাযথ দায়িত্ব পালন করেছে। আমরাই যোগ্য শিষ্য হতে পারিনি…

শান্তিপদ

নীতি কথার শান্তি বাবার অশান্তি ধরা পড়েছে, তাকে টেবিলের পায়ার সাথে দড়ি দিয়ে বাধা হয়েছে। স্কুলের সভাপতির কাছে খবর গেছে তিনি এলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত।

শান্তি বাবু স্কুলের সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষক। স্কুলে যেভাবে সমাজের ভালমন্দ নিয়ে উপদেশ দেন, স্কুলের বাইরেও তার উপদেশ বর্ষণের জ্বালায় টিকা মুশকিল।

শিক্ষক মানুষ উপদেশ দিতে চাইলে শুনতে হয়; না শুনে উপায় থাকে না। স্কুলে এবং স্কুলের বাইরে তাকে ভাল, আদর্শবান মানুষ হিসাবে সবাই চিনে, জানে।

মুশকিল হল যারা অতি মাত্রায় আদর্শ কপচায় তাদের নিজের ভিতরে থাকে অন্ধকার। শান্তিপদ শর্মা নিজের ভিতরের অন্ধকার আড়াল করতে অন্যকে উপদেশ বর্ষণ করে।

নন্দিতা ক্লাস সিক্সের ছাত্রী দেবতুল্য শান্তিপদ তার জামা খুলতে চেয়েছে, এটা বিশ্বাস করতে পারছে না। সে ক্রমাগত কাঁদছে তার বিশ্বাস ভেঙ্গে পড়েছে।

শান্তিপদের স্বরূপ উন্মোচিত হলে সবাই অবাক হয়, বিশেষ করে তার ছাত্ররা; যারা তাকে দেবতা জ্ঞানে পুজা করত।

বিশ্বাস ভেঙ্গে গেলে প্রথমেই উপরের ক্লাসের ছাত্রছাত্রী কিলঘুসি দিতে এগিয়ে আসে। শিক্ষকেরা দ্বিধান্বিত বাধা দেবেন কী দেবেন না। স্কুলের দপ্তরী জগদীশ দড়ি জোগাড় করে টেবিলের পায়ার সাথে বেধে ফেলে।
স্কুলের সভাপতি এসেছেন; আসার পথে পুলিশকে ফোন করেছেন। কিছুক্ষণ পরে পুলিশও হাজির। শান্তিপদ শর্মা পুলিশের মেহমান হয়ে চলে গেল।

শান্তিপদের মেয়ে স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী, বাবা চলে যাওয়ায় তার ভীষণ মন খারাপ। জামা খুলতে চাওয়ায় পুলিশে দিতে হবে কেন! বাবাতো প্রায়ই তার জামা খুলে…

স্বর্গপানে

সাত বছর পড়ে গিয়েছি যেখানে
হঠাৎ সেখানে আসা
দীর্ঘ দশবছর পর।
এখানে পড়েছি আজ থেকে
বাইশ বছর আগে সেই ২০০০ সালে অর্থনীতি নিয়ে পড়েছি, তবে
অর্থের অভাব সাথেই ছিল।

আজ আর সেদিন নেই তবে অনেক
আফসোস এসে হাজির হয় মনে
অবলীলায় অবেলায়।

আমার প্রিয় কলেজ সেই
সরকারি ব্রজমোহন বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল।
অনেক পরিবর্তন হয়েছে, এসেছে আধুনিকতা।

আলোয় আলোকিত আজ সব
নেই পুরোনো সেই আঁধারের নিশি
তবে আলো ছড়ায় রোমান্টিকতায়
যা দেখে…
আবার ফিরে আসতে ইচ্ছে হয়
এই স্বর্গপানে।।

শোয়া-পণ্ডিতের গুষ্টি

তিন
আপনি তো বাজারে চলে গেলেন, এদিকে ছেলে আবার চোখ উলটোয় পড়িছিল।
তারক ডাক্তার স্টেথো দিয়ে রোগির বুক-পিঠ ছেনে যথারীতি বাঁহাতে তার কবজি ধ’রে নিজের রিস্টওয়চে ডুবে গেছে। আর দিদিমার বুক ঢিপ ঢিপ, তারক সেই উদ্‌ভুট্টি কথাটা ব’লে বসবে না তো — ঘ্যাঁজ্‌ড়া?

জর্দাপানের গন্ধলাগা পুরিয়া নির্মলের হাতে ধরিয়ে ডাক্তার চলে গেল। তা থেকে এইটুকুন হাফ ট্যাবলেট “ওঁ বিষ্ণু ওঁ বিষ্ণু” ক’রে খাইয়ে দিতেই গায়ে নড়াচড়া লেগে চাঁদের হাঁচি পড়ল একটা। নির্মল বলল, জীব!
কাহিল গলা শ্বাস টানতে টানতে জিগ্যেস করে :
— জীবো মানে কী?
— মানে জীব সহস্রং, হাজার বছর বেঁচে থাকো।
— কেউ হাঁচি দিলি আপনি বাঁচতি বলেন কেন?

উত্তর নেই। আলাম্‌-ফালাম্‌ কথা না ক’য়ে চোখ বুজে এট্টু শুয়ে থাক, বলে মায়া রান্নাঘরে পা বাড়ায়। ছেলে চোখে পলক টেনে দেয়, কিন্তু ভ্রূ কুঞ্চিত থাকে।

মায়ার পড়াশুনো প্রাইমারি স্কুলের চার কেলাস; ওই জ্ঞানবলে সে যে-কোনও বাংলা বই সগৌরবে পড়ে ফেলতে এবং পরিচ্ছন্ন চিঠি লিখতে পারে। তার ওপর শ্রুতি-বিদ্যেয় মহিলার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া মুশকিল — বড় বড় রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন দত্ত বা কুসুমকুমারী ভাতের মাড় গালতে গালতেও টর-টরিয়ে ব’লে যাবে।
শুধু সেলাইফোঁড়াইটা বিশেষ আসে না ব’লে মায়ের ঠেলা খেয়ে জন্মের-মধ্যে-কর্ম একখানাই কুরুশকাঠির আসন বানিয়েছিল। সেটা বড়ঘরের দেওয়ালে ঝুলছে — মুখোমুখি দুই সুতোর ময়ূর আর লেজের নীচে “বেদনার সাধনায় যে জন নির্ভয়, আজ হোক কাল হোক জয় তার জয়”। বর্গীয় জ-এর মাকড়ি কাঁচা হাতের টানে আ-কার হয়ে যাওয়ায় সঞ্জু প্রায়ই তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে পড়ে — বেদনার সাধনায় যে ডান নির্ভয়, আডা হোক কাল হোক ডায় তার ডায়। ছেলে তো না, এট্টি পাকা কলা!

শোনা-বিদ্যেয় ধুরন্ধর মায়া জানত, অথর্ব বেদে বলা আছে — কেউ হাঁচি দিলে ওমনি জীব সহস্রং উচ্চারণ ক’রো, কেননা হঞ্ছিকাকালে মানুষ মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যায়। বাবা সে-কথা ভাঙতে চায়নি অসুস্থ ছেলের কাছে।

চার
— বন্ধুগণ, আগামি কাল সন্ধ্যা ছ’ঘটিকায়… আসুন দেখুন… দশরথ কেঁদে কেঁদে অন্ধ, ভরত শোকে পাথর… মা ইচ্ছাময়ী অপেরার পরিচালনায়… ধনীর দুলালি সীতা আজি পথের ভিখারি…কলোনির সমস্ত অধিবাসীবৃন্দের অনুরোধে… আরও এক সপ্তাহ বাড়ানো হল… রামের বনবাস, রামের বনবাস, রামের বনবাস।
মুখের সামনে খবরের কাগজের চোঙা ধ’রে ক্ষয়াটে চেহারার একজন ভ্যানরিকশায় যেতে যেতে চেঁচাচ্ছে। যেখানে দু’চারটে বাড়ি বা রাস্তার তেমাথা, সজনেগাছের গায়ে বিজ্ঞাপনের কাগজ চিটিয়ে দিচ্ছে লোকটা। তারপর ভ্যানের পেছনে ছোটা বাচ্চাদের একটা পোস্টারের জন্যে আবেদন অগ্রাহ্য ক’রে :
— একই সন্ধ্যায় রূপসী সীতা ও রাক্ষসী শূর্পনখা… সকলের বসিবার সুবন্দোবস্ত… হ্যাজাকের আলোয় দেখুন এই প্রথম গ্রামের মঞ্চে সোনার হরিণ… তাছাড়া ফুলুটে মালতীপুরের খলিফা শিল্পী স্বদেশ পাল… পালা শেষে মুক্ত হস্তে মালা-ডাকের সুযুগ আছে…।

— দিদ্‌মা, আমি রামযাত্রা দেখতি যাবো।
— যাবাই তো। বুকির কষ্ট এট্টু কি কোমিছে, দাদাভাই?

চাঁদ সোয়েটারের ওপর দিয়ে গলার অস্থি এমন আলতো ছোঁয়, যেন সাত দিনের বাসি গোলাপ, দোকা লাগলেই পাপড়ি ঝরে যাবে। তারপর দুবার নিঃশ্বাস টেনে চোখ বড় ক’রে বলে, ব্যথা লাগতিছে না! ঝুপড়ি ভেঙে রাস্তা পাকা করার মতো তার বুকের খাঁচার মধ্যে ফুসফুস হৃদপিণ্ড সব উড়িয়ে দিয়ে শুধু একটা তেলমাখা ঝাঁ-ঝাঁ করা ন্যাশানাল হাইওয়ে, যার ওপর বাতাসের অনন্তপ্রসূন শুধু ফুটেই চলেছে… কড়াইতে উচ্ছ্বসিত খইয়ের মতো। দিদিমা নিজের কপালে যুক্তকর তুলে আনে — জয় মা বিপত্তারিণী! তারকের ওষুদি কথা কয়! তখন বাসু বুড়ির কাঁধ জড়িয়ে ধ’রে ফিসফিসিয়ে জানাচ্ছে, ওষুধে কথা কোতি পারে, কিন্তু জানো, যে হাতঘড়িতি ডাক্তারবাবু রুগির নাড়ি পরীক্ষে করে, সেটা ডাহা অচল; সকালবেলা আড়াইটে বাজে ব’সে আছে। মা সরস্বতীর দিব্যি!

পাঁচ
— আমার চোখের দিকি তাকায় বল, রান্নাঘরে ঢুকে তালের ফোপ্‌ড়া খাইছিস?

চার ভাইবোন দাঁড়িয়ে, মা এক এক ক’রে জেরা করছে। যে হেসে দেবে, সে চোর।
— ভাইয়ের জ্বর ব’লে তার ভাগেরটা রাখে দিছিলাম, সেও গিলতি হ’লো!
আজ শিউলি হেসেছে, কিন্তু কথায় কথায় ফুটফুটে দাঁত দেখায় ব’লেই না সে শিউলি। সঞ্জুকে যেমন “ঘুর ঘুর স্ট্যাচু” খেলাতেও হাসানো যায় না, তার মানে সে সাধুপুরুষ? মা বিরক্ত হয়ে চার বাচ্চাকেই চড়াচ্ছে।

তারপর — বাসু, আমতলাত্থে আমের ডালটা উঠোনে নিয়ে থো, বাবা কুড়োল দিয়ে ফাড়ে দেবেনে। কয়লা ফুরোয় গেছে — ব’লে মায়া চাঁদের কপালে গাল ঠেকিয়ে জ্বর আছে কিনা দ্যাখে।
বাসু ওমনি মারধর ভুলে ভারি আমডালের এক দিক উঁচু করে “মাগো আমার দে না কেন একটি ছোটো ভাই” বলতে বলতে খানিকটা ছেঁচড়ে আনল, দম নিয়ে “দুইজনেতে মিলে আমরা বনে চলে যাই” ব’লে আরও খানিকটা। এভাবে কবিতা ফুরোতে ফুরোতে কাজও শেষ। কিন্তু আরও একটা ছোটো ভাইয়ের শখ নাকি বাসুর? আপ্‌নি শুতি ঠাঁই পায় না, শংকরারে ডাকে!

রান্নাঘরের উঁকি মেরে গোপা দেখল, মা ঠোঁটে হাসি চেপে জ্বাল দেওয়া দুধ একটা কাপে ঢালছে। ঘর জুড়ে যেন শিশুর মুখের গন্ধ…।
— মা, আমার পেটে কিচ্ছু নেই!
— সে কি, অ্যাক্‌খুনি চিঁড়ে দিয়ে কলা দিয়ে খালি যে?
— আমার দুধির ক্ষিদে পাইছে।
মায়া প্রথমে চোখ পাকায়, তারপর হাতছানি দিয়ে মেয়েকে ডাকে, ডেকচি থেকে দু’হাতা দুধ ব’ক্‌নো থালায় ঢেলে ফুঁ দিয়ে হাতে ধরিয়ে ভর্ৎসনা করে : সব দৃষ্টিক্ষিদে। মুখ পুড়োস না। খায়ে চুপ ক’রে বেরোয় যাও।… আগে ঠোঁট মোছ, ঠোঁট মোছ!

ছয়
কাপের দুধে চুমুক দিতে দিতে কাঁথা-গায়ে চাঁদ জানলার ফোকর দিয়ে রাস্তা দেখছিল। সুপুরিগাছের শুকনো খোলার ওপর একটা কচি বাচ্চাকে বসিয়ে তিনটে খুদে টানছে। হ্যাঁচকা টান খেয়ে সে পেছনে উলটে প’ড়ে অপরিমেয় কাঁদতে লাগল। একটা ছেলে চলে গেল চটপটি বাজাতে বাজাতে। মনিদাও খুব সুন্দর চটপটি বানায় — কলাপাতার মোটা ডাঁটি এক-হাত মতো কেটে নিয়ে তার এক মাথা দা দিয়ে লম্বালম্বি তিন ভাগে চিরে দুপাশের ফালিদুটোর গোড়া একটু ভেঙে নিতে হবে। এবার ডাঁটির আর এক মাথা ধ’রে ঘন্টা বাজানোর মতো নাড়লেই চটপট চটপট…। এইসব লোক-চলাচলের ফাঁকে দেখা যাচ্ছে রাস্তার ওপিঠে চন্ডীবাবুদের জমিতে গেঞ্জি আর লুঙি পরা মানুষটাকে; দুটো ইঁটের ওপর ব’সে সামনের দুটো ইঁটে পা বিছিয়ে দু’পায়ের পাতার মাঝখানে ঝামা ইঁট রেখে হাতুড়ি চালাচ্ছে। তিনবার চারবার বাড়ি খেয়ে ইঁট শোকে পাথর না থেকে ভেঙে পড়ছে, হয়ে যাচ্ছে খোয়া।

এমনি ক’রে আস্তে আস্তে ছোট্ট খোয়াটিলা তৈরি হচ্ছিল আর লোকটাও ভেসে উঠছিল টিলার মাথায়… মাটি থেকে তার দূরত্ব বাড়ছে ধিকিধিকি। প্রত্যেকবার হাতুড়ির ঘায়ের সঙ্গে হ্যাহ্‌ নামের একটা গোঙানি বা গর্জন মিশিয়ে দিচ্ছে আর চাঁদের কানে সেই শব্দজোড় পৌঁছোচ্ছে হাতুড়ি ইঁটে পড়ার ভগ্ন-মুহূর্ত পরে। এভাবে সকালে যে ভূমিপুত্র, দুপুরে ভাত খেয়ে এসে তুমি দেখলে কিছুটা পাহাড়ি, আর বিকেলে খেলতে বেরোনোর সময়ে সে গোঁফেগেঞ্জিতে লাল সুরকি লাগা খোয়া-হিমালয়ের ঈশ্বর, শান্তিমতো একটা বিড়ি ধরাচ্ছে। ওদিকে রাস্তার ধারে কোনও বাচ্চা উবু হয়ে বসল, ন্যাংটো পাছার নীচে হলুদ ধোঁয়া-ওঠা অজগর-পাক, শেষে ছুঁচোলো ফনাটা। জানলায় মাজালি বিড়বিড় ক’রে চরে বেড়ায়, এখন রোদ্দুর গোধূমবর্ণ ত্যাগ ক’রে অল্প অল্প চাঁটি মেরে আমাদের পিঠ গরম করার উপযুক্ত। সেই অনবরত ধূপছাঁওয়ের মধ্যে একটা ঝিমধরা খট খট আওয়াজ শোনা গেল। পদপাতহীন কেঠো পা নিয়ে চাঁদের আমতলাবাড়ির পাশ দিয়ে বিজুখোঁড়া দুলে দুলে হেঁটে যাচ্ছে স্টেশানের দিকে।

(আর একটু)

তারা কেনো খসে পড়ে

hqde

খসে যাওয়া তারার জন্য হৃদয় কাঁদে
কখনো কখনো আকাশ পানে চেয়ে
থাকতে থাকতে চোখ ভিজে নোনা জলে।

কালো আধার রাতে খসে পড়া তারার স্মৃতিতে
ব্যাকুল হই,,ব্যথিত হই নীল কষ্টে
ছুটে যাই রাস্তার পাশে কবরের কাছে
তড়িৎ জিজ্ঞাসা করি তারা কেনো খসে পড়ে।

তারার আলোয় চলতো জাহাজ নামক জীবনটা,
দমকা হাওয়ায় ছিড়ে যেত পাল
তারা জ্বল জ্বল করে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেত আপন ঠিকানায়।

তারা যখন আলোকিত করে ঘর
বুঝি না আমরা অনেকে
খসে পড়লে ছুটতে থাকি মিথ্যা মায়া মোহে।

মানুষ

আমাকে যখন বলা হয় মানুষের কাছে যাও
আমি ঘাসের কাছে মনের দুঃখ বলি…

যখন বলা হয় দেখ মানুষের মুখ
আমি উড়ন্ত পাখির ডানায় নীলাকাশ দেখি

মানুষের তৈরি ভজনালয়ে যখন মাথা ঠেকানোর
উপদেশ বর্শিত হয়
আমি নদীর আঁজলা আঁজলা জলে
মুখ ধৌত করি

মানুষ পাঠের ইচ্ছা মরে গেছে
মরে গেছে মানুষ হওয়ার ইচ্ছা

একটা পতঙ্গ যতটুকু কল্যাণ করতে পারে
তার ধারেকাছে পৌঁছাতে পারে না মানুষ

তবু কেউ কেউ মানুষের পুজা করে
আর মানুষ সেই পুজারিকে হত্যা করে…