বিভাগের আর্কাইভঃ অণুগল্প

অণুগল্পঃ মুহিতের কোটি বছরের পাঠ

বিষয়টা কাকতালীয় কিনা মুহিতের জানা নেই। এই সপ্তাহে আজ নিয়ে তিনদিন সে দিনের কিছুটা সময় বাসায় একা থেকেছে; যা সচরাচর ঘটেনা এবং বেছে বেছে এই তিন দিনই ঠিক একা থাকাকালীন সময়ে সামিয়া বাসায় এসেছে। প্রথম দুদিন মুহিত তাকে দরজার ওপার থেকে বিদায় করে দিয়েছিল।

সামিয়া ইসলাম; সম্পর্কে মুহিতের অল্প দূরত্বের শ্যালিকা। মুহিতের বিয়ের পর পর সামিয়া বিশেষ কারণে প্রায় মাস খানেক এই বাসায় ছিল। সহজ সরল এবং খুব বিনয়ী। কাছের লোকেরা বলে, “একেবারে ফার্স্ট ক্লাস একটা মেয়ে”!

সামিয়া আজ শীতের পিঠা নিয়ে এসেছে। হয়তো “ভ্যালেন্টাইন ডে” মাথায় রেখে। হার্ট-শেপ পিঠা। মুহিত মনে মনে ভাবে, মেয়েটা কেন তার বোনকে ফোন করে আসেনা? ওর বাসা বেশি দূরে নয়- কেবল এজন্যই কী?

-তোমার বোন দুই ব্লক পরেই একটা বাসায় গেছে; তোমার আসার কথা ওকে জানাচ্ছি
-না থাক, আমি এখনি চলে যাবো।
কথাটা বলার সময় সামিয়ার মুখটা যেন কেমন হয়ে গেল।

-আচ্ছা, ঠিক আছে।
মুহিত জবাব দিলো।

ডাইনিং স্পেসে বসতে দিয়ে সে সামিয়ার মেয়ের কুশল জেনে নিলো। বছর দেড়েক আগে সে বিধবা হয়েছে। উনত্রিশ বছর বয়সে। মুহিতের মাও প্রায় একই বয়সে বিধবা হয়েছিলো। সামিয়াকে আবার সংসার করার জন্য তার পরিবারের পক্ষ থেকে কয়েকবার বলা হয়েছে। কিন্তু যতোবার এসব নিয়ে কথা হয়েছে ততোবার সে কেঁদে দুচোখ ভাসিয়ে দিয়েছে।

“উনত্রিশে তো অনেকে বিয়ে করে”, মুহিত ভাবলো এবং বিষন্ন হয়ে সে একবার সামিয়ার দিকে তাকালো।

-তোমার বাবার শরীর এখন কেমন?
সামিয়ার বাবা গ্রামের বাড়িতে থাকেন। হার্ট ফাউন্ডেশনে ডাক্তার দেখাতে তিনি মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে ওঠেছেন।

-বুঝতে পারছিনা। এঞ্জিওগ্রামে ব্লক এসেছে। কিন্তু ডক্টর রিং পরাননি। ওপেন হার্ট সার্জারির পরামর্শ দিয়েছেন।
সামিয়া জবাব দিলো।

এরপর দুজন কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। সামিয়ার গা থেকে পারফিউমের তীব্র গন্ধ তার নাকে আসছে। মুহিত চাইছিলো সামিয়া তাড়াতাড়ি চলে যাক; তাই সে অনর্থক কথা বাড়াচ্ছেনা। আসলে আগের দুদিন ঘরে ঢুকতে না দেয়ার অপরাধবোধ থেকে সে আজ ওকে ভিতরে বসতে দিয়েছে। নইলে আজও তাকে কৌশলে দরজা থেকে বিদায় করে দিত। মহিলা বলে নয়; একা থাকলে সে কাউকেই ভিতরে আনার আগ্রহ দেখায়না। একাকীত্ব নয়; “কিছু সময় একা থাকা” সে উপভোগ করে। তখন সে নিজের ভিতরের আরেকজন মুহিতকে খুঁজে পায়। সে বিশ্বাস করে, দিনের কিছুটা সময় একা থাকতে পারলে তখন মানুষ কার্যকরভাবে একাকীত্ব দূর করতে পারে। বহুজনে মানুষ বরং বেশি নিঃসঙ্গ হয়!

-কিছু বলবে সামিয়া?
নিরবতা ভেঙ্গে মুহিত জানতে চাইলো। কিছুদিন আগে সামিয়া বেশ কিছু টাকা ধার নিয়েছিল। মুহিত ভাবলো, আজ হয়তো সেজন্যই এসেছে। লজ্জায় বলতে পারছেনা।

কিন্তু সামিয়া কোন জবাব দিলোনা। সে মাথা নিচু করে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ফ্লোর ঘষতে লাগলো।

মুহিত আবার প্রশ্নটা করলো।
এবার সামিয়া মাথা তুলে তাকালো।

মুহিত দেখলো সামিয়ার দুচোখে বিশ্বটাকে পুড়িয়ে দেয়ার জন্য ক্রমাগত আগুন জমা হচ্ছে। সেগুলিকে মুহিত তার হিসেবের যন্ত্রে নিয়ে যোগ বিয়োগ করার চেষ্টা করলো। সে অনুমান করলো, গত দেড় বছরে সামিয়ার চোখে এতো বেশী আগুন জমা হয়েছে যে তা পড়তে কোটি বছর লেগে যাবে।

সামিয়া চেয়ার থেকে ওঠে দাঁড়ালো। কিন্তু মুখে বললোনা যে, “আসি”। এর মানে, যাওয়ার জন্য সে ওঠে দাঁড়ায়নি। মুহিতের বুঝতে অসুবিধা হলনা যে সামিয়া হঠাৎ খুব সাহসী হয়েছে; সে এখনি হয়তো তার দিকে পা বাড়াবে।

তার ধারণাই ঠিক হলো।

কিন্তু সামিয়া যতোই এগোতে থাকলো মুহিতের ভিতরের মুহিত ততো প্রবল ভাবে জেগে ওঠতে লাগলো। সেই মুহিত তখন সামিয়ার আঁচল জুড়ে লেখা কেবল একটা শব্দই বৃহৎ হতে বৃহত্তর হতে দেখলো, “মা”!

অণুগল্প : কয়েদী জীবন

সবাই অফিস থেকে চলে গেছে। আমি একাই আছি। কোথায় যাবো? গেলে তো সেই ১০ ফুট বাই ৮ ফুট, ৬ দিনের অস্থায়ী জেলখানায় যেতে হবে। সপ্তাহের ১ দিন যা ও বা ছুটি পাই; সারাদিন শুধু ঘুমাতেই ইচ্ছে করে।

কিন্তু বাসার সবাই তো চায় তাদেরকে নিয়ে কোথাও থেকে ঘুরে আসি। এ দিকে অফিসে বসে থেকে থেকে আলুর মত সাইজ হয়ে যাচ্ছে আমার। সকালে উঠে যে একটু হাঁটবো, তাও পারি না। অবশ্য হাঁটার অনেক সুন্দর জায়গা আছে আমার। অফিসের বিশাল ছাদ-ই তো আছে, যার চারদিকে ৩০ বার ঘুরলেই ৪৫ মিনিট কেটে যায়।

তার পরও হয়ে উঠে না।

এ দিকে মাথার চুল সব সাদা হয়ে যাচ্ছে; শরীর হচ্ছে ভারী। মনটা কেমন যেন নির্জীব-অসহায় হয়ে থাকছে। বার বার শুধু মনে হয় সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে; কিন্তু করা হলোনা কিছুই।

না এই দুনিয়ার- না ওই দুনিয়ার। এক ধরনের অক্ষমতা-ক্রোধ-ক্ষোভ – এ সব কিছু মিলিয়ে নিজের উপরেই প্রচন্ড ঘৃণা হচ্ছে।

কয়েদী জীবন।
মনে হয় সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে একটা রেললাইন ধরে হেটে চলি।

কয়েদীমানবের সমান্তরাল পদচারণ.. অনিশ্চিত পথচলা। কোথায় যাবো??

____________________
#কয়েদী_জীবন_অণুগল্প_৪৪৪

অণুগল্পঃ ঈশ্বরকন্যা

তিনি চায়ের কাপটা হাতে নিয়েছেন মাত্র; মন্ত্রী মহোদয় কক্ষে প্রবেশ করলেন। আগুন্তক খুব সংক্ষেপে তার পরিচয় দিলেন।

-একটা এ্যাপিল নিয়ে এসেছি ইয়োর এক্সেলেন্সি, আমপাতি যাবো
-কেন জনাব?
-এক মহিয়সী থাকেন; তাঁকে সালাম জানাতে।

একাত্তুরের শরণার্থীদেরকে যখন কেউ আশ্রয় দিতে সাহস পাচ্ছিলোনা; স্বয়ং ঈশ্বর যেন তার কন্যাকে দনু নদির পাড়ে পাঠালেন।

মায়াবী দনু নদি;
মেঘালয়;
সাং আমপাতি।

আগুন্তক নিজ থেকে এসব বলে যাচ্ছিলেন।

ছয় বছরের শিশু পুত্রকে বুক থেকে একপাশে সরিয়ে রেখে সেখানে প্রায় অর্ধ লক্ষ বাংলাদেশী শরণার্থীর জন্য তিনি জায়গা করে দিয়েছিলেন। প্রতিদিন সকল শরণার্থীর জন্য খাবারের আয়োজন করতেন। একসাথে সেই খাবার খেয়ে তিনি সারাক্ষণ তাদেরই একজন হয়ে থাকতেন।

আগুন্তকের কথা মন্ত্রী নিরবে শুনছিলেন। তিনি কক্ষ থেকে অন্য সবাইকে চলে যেতে বললেন।

কলেরা মহামারীতে যখন দনুপাড় সয়লাব তখন তিনি ফ্লোরেন্স নাইটেংগল হলেন। সেই মহামারীতে প্রায় তিন হাজার শরণার্থী মৃত্যু বরণ করে। ইয়োর এক্সেলেন্সি আপনি নিশ্চয়ই জানেন, সেই দিনগুলিতে কলেরার আরেক নাম ছিল যমদূত । নিজের জীবন বিপন্ন করে তিনি সেই যমের সাথে লড়েছিলেন।

আমি তাঁকে দেখতে যেতে চাই।

-তাঁর নাম তো রওশন আরা সাংমা
মন্ত্রী বললেন।

-প্রযত্নে ঈশ্বর
আগুন্তক যোগ করলেন।

-মা তো ঈশ্বরের কাছে ফিরে গেছেন !

কথাটা বলে মন্ত্রী জানালা দিয়ে মেঘালয়ের আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন;

পিন পতন নিরবতা!

আগুন্তক চোখ খুললেন; কক্ষটা শূণ্য!
কোথাও কেউ নেই; কেবল একজন ছয় বছরের শিশু এবং চারচোখ দনু নদি ছাড়া !

জীবন-অতিজীবনের গল্প: নাগর

ঝর্ণার পা দুটো কোলে নিয়ে সুরুজ তাতে আলতা মেখে ছবি আঁকছে; আর স্বগোক্তি করছে,

“এটা সন্ধ্যার দুখিতারা, এটা একশ রাজপুত্তুরের রক্তে ভেজা জবা”

ঝর্ণা তন্ময় হয়ে শুনছে।

“এটা অন্তর নদি, এটা ঈশ্বরের হৃৎপিন্ড”

মুগ্ধতায় ঝর্ণার চোখ বুজে আসে। এক মহারাজের কোলে তার পা!
নিজেকে সে স্বপ্নের রাণি ভাবে; পুরো আকাশ তার আঁচলে।

চোখ থেকে মেঘ খুলে দিয়ে সে সুরুজকে বললো,
“এখানে আমার একটা বাড়ি আছে; একঘর জল আছে। এসো বাসর করি”।

ঝর্ণার একেকটা পায়ে সুরুজ ততোক্ষণে একটা করে রাতের আকাশ নামিয়ে এনেছে। বিছিয়ে দেবে বলে ঝর্ণা বুকের আঁচল সরালো; কারণ এখনি ঝড় ওঠবে!

হঠাৎ দরজার ওপারে বুড়িকন্ঠে একজন খেঁকিয়ে বললো,

“বাচ্চাডা কাইন্দা নীল হইয়া যায়; নাগর বিদায় কর”!

ছোট গল্প – পাপীর সাজা


ছোট গল্প – পাপীর সাজা
===============
তুমিই ছিলে আমার প্রথম সিড়ি, যে সিড়ি বেয়ে আমি রঙীন স্বপ্ন দেখেছিলাম পৃথিবীর। আজও তুমিই হলে আমার পরবর্তী সিড়ি, যে সিড়ি বেয়ে আজ আমি প্রতিষ্ঠিত। আজ কী নেই আমার, অর্থ, যশ, খ্যাতি, সম্পত্তি, গাড়ি বাড়ি; সবই আছে, ক্যানো না আজ আমি প্রতিষ্ঠিত।

কিন্তু ভুলেই গিয়েছিলাম জোয়ার ভাটার কথা, অহংকারের কথা, নিজেকে হারিয়ে ফেলার কথা। অনেকটা বিরতির পর আজ ভাটার সামান্য ঢেউয়ের শব্দ আমাকে বিচলিত করে তুলেছে, বুঝতে পারছিলাম আমার নিন্মমুখী সিড়ির দৃশ্যপট। বাড়িতে ফেরার পর যখন তুমি আমাকে বুঝতে জিজ্ঞেস করতে বিবর্ণ মুখের বর্ণনা, আমি মুখ ফিরিয়ে তোমাকে আড়াল করে দিতাম। একাএকাই যুদ্ধ করে যাচ্ছিলাম।

হঠাৎ করেই আজ আবার তুমি এলে, শর্ত জুড়ে দিলে, শর্ত সাপেক্ষে উর্ধ্বমুখী সিড়ির দৃশ্যপট চোখে ভাসতেছিলো। শর্ত না জেনেই শর্ত মেনে নিলাম, প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আরেক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার কথা ভেবে। পুনরায় আলোকিত হতে শুরু করলো আমার সবটা স্বপ্ন।

তুমি ডাকলে শর্ত পূরণের দাবিতে, শর্ত শুনে শর্ত আমাকে ভেঙে চুরে চুরমার করে দিলো, বললে ছোট একটি শর্ত যা কিনা কাউকে খুন করতে হবে। শর্ত ভাঙতে পারছি না, আঘাত করছো পিছনের স্মৃতিকে, খুন সেও করতে পারছি না, বারংবার খুন করতে গিয়ে ফিরে আসছি, ভাবনায় প্রতিটি সিড়ির ধাপ মনে করিয়ে দিচ্ছিলো অতীতের ভুল সিদ্ধান্তের কথা। ভেবে ভেবে আজ নিজেকে জ্যান্ত মৃত মনে হচ্ছে।

হঠাৎ খুন না করেও খুনের দায়ে খুনের আসামী হলাম, তোমাকে বিশ্বাস করাতেই পারছিলাম না আমি খুন করিনি, অবশেষে বিশ্বাস করলে আমি খুনী নই। একদিন মুক্তি পেলাম, পুলিশকে জিজ্ঞেস করতেই বলে দিলেন, খুন আপনি করেননি, খুন করেছে আপনার স্ত্রী, একটি অডিও বার্তার স্বীকারোক্তি পেয়েই তাকে গ্রেফতার।

জেল থেকে বেড়িয়ে জানতে চাইলাম, তোমার শর্ত পূর্ণ হয়েছে; কিন্তু ক্যানো তুমি এমন করলে? জানতে পারলাম, আমার স্ত্রীও জিম্মি ছিলো তার কাছে, যার কাছে তাকে তুলে দিয়ে সিড়ির ধাপ খুঁজে পেয়েছিলাম, আজ তুমি বলে দিলে পাপ কখনোই পাপীকে ছাড়ে না। আজ তুমি আছো, কিন্তু তোমার পাশে কেউ নেই, শুধু কান্নাই তোমার সঙ্গী, তোমার স্ত্রীও আমার মতো অন্যের দ্বারা ব্যবহৃত।

ইরেজারের ঘ্রাণ … মনসুখিয়া পর্ব

ইরেজারের ঘ্রাণ

মাঝদুপুর। অফিসে ব্যস্ততার মাঝে কিছুটা অলস সময়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র অফিসঘরে মাঘমাসকে ডেকে এনেছে। জানলার পর্দা সরাতেই একফালি রোদ ঢুকে পরলো। রোদের সাথে সাথে ঢুকে পরেছে ইশকুলে যাবার ছেলেবেলার ভোর।

এক আত্নভোলা শিশু ইশকুলে যাবে। মায়ের হাত ধরে। গুটিশুটি পায়ে। নীল-শাদা বরফিকাটা সোয়েটারে সঞ্চারিত ফুপুমার স্নেহের ওম। হাতে পাকা লেবু রঙা ঢেউঢেউ ইরেজার। অপার বিষ্ময়ে ইরেজারের সুঘ্রাণ নেয়- আহ কত মিষ্টি! ঘ্রাণ যেন হারিয়ে না যায়- শক্ত মুঠোর ভিতরে ইরেজার ধরে রাখে।

অলস দুপুরের একফালি কমলা রোদ বলে-

: যাবে না কি সেই ইরেজারের ঘ্রাণের দেশে?
: সেখানে যাওয়া যায় না কি!
: যাবেনা কেন! অবশ্যই যায়।
: যাবো, একটু দাঁড়াও, হাতের অল্প ক’টা কাজ ঝট করে শেষ করে নেই।
: হাহাহাহাহাহাহাহাহাহাহাহাহা
: এতে হাসির কি হলো!
: ঘ্রাণের দেশে তোমার কোনোদিন যাওয়া হবেনা হাহাহাহাহা।
: কেন?
: তোমার অল্প একটু কাজ থেকেই যাবে। সে কাজ শেষ করতে দেরী হয়ে যাবে। এদিকে একটু একটু করে ঘ্রাণের জগত অনেক দূরে সরে যাবে।

রোদের কথা শুনে বিষণ্ন হই। বিরক্তও হই সামান্য। মুহুর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার কথা শুরু করি-
: তুমি ঠিকানা দিয়ে যাও- নিজেই খুঁজে নেবো ইরেজারের ঘ্রাণের জগত।
: তাহলে সোজা চলে যাও মনসুখিয়া।
: মনসুখিয়াই তাহলে ইরেজারের ঘ্রাণের জগত!
: না, মনসুখিয়া ইরেজারের ঘ্রাণের জগত নয়। মনসুখিয়ার রাজকন্যার চুলে ইরেজারের ঘ্রাণ আছে।
: রাজকন্যার চুলের ঘ্রাণ দিয়ে আমি কি করবো?
: আররে বোকা, রাজকন্যার চুলের ঘ্রাণে ইরেজারের দেশে পৌছানোর গোপন নকশা আছে।
: তাই না কি! রাজকন্যা কি আর আমাকে পাত্তা টাত্তা দিবে।
: দিবেনা কেন! সোনাকাঠি আর রূপোকাঠি আছে কি করতে!
: আমি গরীব অফিস মজুর। আমার কি আর সোনাকাঠি রূপোকাঠি আছে!
: সবার ভিতরেই একটা করে সোনাকাঠি আর রূপোকাঠি আছে। সবার ছায়াতেই একটা করে ডাইনিবুড়ি আছে। সে ডাইনিবুড়ি রাজকন্যাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে।
: তাই না কি!
: হ্যা, ডাইনি বুড়ির প্রাণভোমরা থাকে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে চিনিফুলের বন পেরিয়ে সাতসমুদ্দুরের মাঝখানে এক পাথরের কৌটায়। সোনাকাঠি আর রূপোকাঠি দিয়ে রাজকন্যাকে জাগিয়ে ছুটতে হয় ডাইনিবুড়ির প্রাণভোমড়ার পাখা ভেঙে দিতে।
: তারপর?
: তারপর আর কি! রাজকন্যার চুলে শুকে নিবে ছেলেবেলার ইরেজারের ঘ্রাণ, ইশকুলের চারকোনা রোদমাখা মাঠ, নীলশাদা বরফিকাটা সোয়েটার। কে জানে- হয়তো রাজকন্যাই ইরেজারের ঘ্রাণের দেশ হয়ে যাবে তোমার স্পর্শে।
: হা: হা: হা: তুমি আমার মত বুড়োকে রূপকথা শোনাচ্ছো!

রোদ তীব্র প্রতিবাদ করে ওঠে-
: রূপকথা শোনাবো কেন! আমার কি দায় পরেছে! একবার মনসুখিয়ায় ঘুরে এলেই পারো।

রোদ অভিমানে একটু একটু করে সরে যাচ্ছে। পর্দা টেনে দিলে এখনি চলে যাবে। পর্দা না টেনে বসে থাকি, এই রোদ সামান্য নয়। ছেলেবেলার ঘুড়ি ওড়ানোর দুপুর থেকে পালিয়ে এসেছে আমাকে দেখবে বলে, মনসুখিয়ার রাজকন্যার চুলে ইরেজারের ঘ্রাণের দেশে পৌছানোর নকশা আছে জানাতে।

সবাই তো চলে যায়, রোদও যাবে, যাবার আগে ডুবে থাকি, নিজেকে ডুবিয়ে রাখি রোদের কণায় কণায় কিছুটা সময়।

_________
#মনসুখিয়া/৬

একদিন দুজনায় : অণুগল্প ৩৭৭

রিক্সাটি ভিসি হিলকে পাশ কাটিয়ে শহীদ মিনারের সামনে গিয়ে থামে। ওরা নেমে আসে। হাসিব ভাড়া মিটায়। রিক্সা চলে গেলে দু’জনায়-ই চুপচাপ। একসময় নীরবতা অসহ্য ঠেকে। পুরনো শহীদ মিনারটিকে নতুন ভাবে তৈরী করা হয়েছে। বড্ড নান্দনিক স্থাপত্যের নিদর্শন! দু’জনেই কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাত রেখা হাসিবকে জিজ্ঞেস করে,
: কেন বিয়ে করে সুখী হলে না?
: সুখের নমুনা তো তোমাকে দিয়েই দেখতে পাচ্ছি।
: সবাই যে রেখা হবে, এমন কথাও তো নেই।
: হ্যাঁ! সবাই রেখা নয় বলেই বিয়ে করি নাই।

রেখার হৃদয়ের ভিতরে কথাটা একাধারে ভাললাগার এবং কষ্টের অনুভুতি নিয়ে আসে। ওর পাশের এই একরোখা মানুষটির জন্য এই মুহুর্তে ওর ভিতরে এক প্রচন্ড ভালবাসা তৈরী হয়েছে। কিন্তু কিভাবে প্রকাশ করবে বুঝতে পারছে না। নিজেকে সম্পূর্ণ বিলিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে ওর সামনে। কিন্তু ওর কি আছে, যা দিয়ে ওর জন্য চীরকুমার এই মানুষটাকে কিছুটা হলেও শান্তি দিতে পারে?

ভিতরে ভিতরে ডুকরে কেদে উঠে রেখা। ‘ইস! যদি আর একটু সময় পেতাম!!’

#একদিন_দুজনায়_অণুগল্প_৩৭৭
Photo Credit: Akm Azad

অণুগল্পঃ উপরি

গাড়িতে উঠে বসেছি মাত্র; মিষ্টি হেসে মেয়েটি কাছে এলো
-কিছুক্ষণ আগে আপনার সাথেই কি ফোনে কথা বলেছি?
-আপনার ভুল হচ্ছে; মৃদু হেসে জবাব দিলাম
-ও আচ্ছা
কথা না বাড়িয়ে সে একটু দূরে সরে কারো জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। বয়স তিরিশ বত্রিশ হবে। স্বাভাবিক সাজসজ্জা। হাবেভাবে বেশ রুচির ছাপ আছে।

পাশের এক রিকশাচালক কী একটা মন্তব্য করলো বুঝা গেলনা। সম্ভবত মেয়েটির প্রতি ঋণাত্মক কিছু। গাড়িটা সেইফ পার্ক করে কেন জানি কী মনে করে মেয়েটার কাছে গেলাম। এই আচরণ নিজের কাছেই কিছুটা অস্বাভাবিক মনে হলেও আফ্রিকান সংস্কৃতির প্রচ্ছন্ন প্রভাবে তা সহজ হয়ে গেলো।
-আজ বেশ ঠান্ডা পড়েছে;
গায়ে পড়ে কথা বলা শুরু করলাম

-ঠান্ডা সহ্য করতে পারেন না? মুচকি হেসে মেয়েটা প্রশ্ন করলো
-তা কিছুটা
-কেন?
-মরুভূমিতে অভ্যস্ত; তাই
-মরুভূমিতে কি করেন?
-বাড়ি বাড়ি রুম হিটার সাপ্লাই দেই

মেয়েটা শব্দ করে হেসে উঠলো। এটা দেখে দুই রিক্সাওয়ালা টিপ্পনি কাটল
-তো এখানে কি করেন?
-একজনের জন্য অপেক্ষা করছি; জবাব দিলাম

অল্প দূরে এক লোক ঝালমুড়ি বিক্রি করছিলো। চোখে চোখ পড়তেই সে মুচকি হেসে বললো
-মামা দেবো এক ঠোঙ্গা?
ঝালমুড়িওয়ালার আমন্ত্রণ মেয়েটাকে রেফার করে বললাম;
-দেবে এক ঠোঙ্গা?
আমার নিমন্ত্রণে সে একটু অবাক হয়ে জবাব দিলো;
-জ্বী, আ…চ…ছা

মুড়ি খেতে খেতে জানতে চাইলাম,
-বাড়ি আশেপাশেই?
-হুম;
মফস্বল শহরে বড় হয়েছি। শেষ পর্যন্ত মাস্টার্স পরীক্ষাটা দেয়া হয়নি। ঢাকাতে বছর আটেক। শুরুতে একটা বেসরকারি অফিসে জব করেছি।কামরাঙ্গি চরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকি।
-আচ্ছা
-তো আপনি কি করেন?
-হিউমেনিটেরিয়ান
-সেটা আবার কি?
-টেলিভিশনে দেখেননি? যুদ্ধ লেগেছে; মানবিক বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য জতিসংঘ বা অন্যান্য লোক কাজ করছে। ওরা হিউমেনিটেরিয়ান
-একটু আগে না বললেন, রুম হিটার সাপ্লাই দেন!

মুড়িওলার হাত থেকে কৌটা নিয়ে স্পেশাল করে সে আমার জন্য আরেক ঠোঙ্গা ঝালমুড়ি বানালো।
তার জন্যও; নিজেরটাতে অনেক ঝাল যোগ করলো! বুঝতে বেগ পেতে হলোনা দুজনের মধ্যে পূর্ব পরিচয় আছে।

-এখন কি করেন?
মেয়েটা আগেই উল্লেখ করেছে যে, সে একটা বেসরকারী অফিসে জব করেছে। এখন কী করে সেটা না বলার যথেষ্ট কারণ আছে বুঝেও তাকে বোকার মতো প্রশ্নটা করে বসলাম।

সে আমার প্রশ্নের জবাব দেয়ার সুযোগ পেলোনা; অথবা দিলনা। তার মোবাইলে কল এসেছে।
আগে যে ফোন করেছিলো হয়তো সে; অথবা অন্যকেউ।
-আমরা তিনজন
“ওরা তিনজন”; ফোনের অন্যপাশ থেকে আসা এই সংবাদে মেয়েটার মন ভার হলো।

ওদের কথাগুলো আমি বেশ পরিষ্কার শুনছিলাম।

“উহ, ঝাল! চোখে জল চলে এসেছে”, আমাকে শুনিয়ে বলতে বলতে মেয়েটা চলে গেলো।

কিন্তু অন্যপাশ থেকে আসা শেষ কথাটাই কেবল আমার কানে বাজতে লাগলো,

“সমস্যা নাই; উপরি পাবি!”

অণুগল্প : দ্বিতীয় মৃত্যু

অতঃপর ভগবান মর্ত্যলোকের হিসাবে ৭৪ বছর পরে রবীন্দ্রনাথের একদিনের ছুটি মঞ্জুর করিলেন। রবীন্দ্রনাথ প্রথমবারের মত নিজের জন্মদিন উদযাপন দেখিতে ধরায় আগমন করিবার সুযোগ পাইলেন। ধরায় যাত্রার প্রাক্কালে চিত্রগুপ্ত একখানা তালিকা হাতে ধরাইয়া দিয়া কহিলেন, ‘কবি, এই তালিকার অনুষ্ঠানসমূহ কোনক্রমেই মিস করিওনা।’

নিজ জন্ম উৎসব উপভোগ করিবার জন্য কবিগুরু তালিকার এক নম্বর অনুষ্ঠান চ্যানেল আইয়ের রবি মেলায় উপস্থিত হইলেন। এতটা তিনি আশা করেন নাই। তাহার সম্পর্কে বিভিন্ন বক্তার বক্তব্য শুনিয়া নিজেকে অচেনা মনে হইতে শুরু করিল। নিজেকে নতুন করিয়া আবিষ্কার করিতে লাগিলেন। বিভিন্ন বক্তা তাহার এমনসব গুনের বিষয়ে আলোকপাত করিতেছিলেন যাহা তাহারও অজ্ঞাত, অজানা। শাইখ সিরাজ নামে এক পণ্ডিত বলিতে শুরু করিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মানব উন্নয়ন কর্মী। তিনি মানব উন্নয়নে…।’ আর যাহাই হউক নিজেকে জমিদার হইতে একটানে এনজিও’র মাঠকর্মী বানাইয়া দেয়াটা রবীন্দ্রনাথ সহ্য করিতে পারিলেন না। তিনি প্রবল বেগে না-সূচক মাথা দোলাইতে লাগিলেন। কিন্তু তাহাতে বক্তার বক্তব্য থামিবে কেন!

বক্তাদের ব্যস্ততা আর কমে না। তবু বহু কষ্টে কবিগুরু বক্তাদের নিকটে যাইতে সক্ষম হইলেন। বক্তাদের বিভিন্ন বক্তব্যের বিষয়ে বিনয়ের সহিত প্রতিবাদ জানাইতেই তাহারা সমস্বরে চিতকারিয়া কবিগুরুকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনে রবীন্দ্রনাথকে আমাদের’ত্তে বেশী চিনেন? আমাদের’ত্তে বেশী জানেন?’ সৈয়দ হক নিরাপত্তা রক্ষীদের রবীন্দ্রনাথকে দেখাইয়া কহিলেন, ‘সুষ্টু মেলার স্বার্থে ও বাঙ্গালী চেতনা সমুন্নত রাখিবার জন্য এই বুড়ো মৌলবাদী জংগীটাকে এক্ষুনি গলা ধাক্কা দিয়া মেলা হইতে বাহির করিয়া দাও।’ কবিগুরু এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হইবার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি বুকের বামপাশে তীব্র ব্যাথা অনুভব করিতে লাগিলেন। ব্যাথা তীব্র হইতে তীব্রতর হইয়া উঠিল।

রবীন্দ্র পূজারীরা জানিল না তাহাদের পূজার মন্ত্র সহ্য করিতে না পারিয়া রবীন্দ্রনাথ ১৫৪তম জন্মদিনে দ্বিতীয়বার মৃত্যু বরণ করিলেন।

ছায়া ৩

ছায়া ৩

বেরিয়ে অবাক। মা শুয়ে আছে মেঝেতে। বউ রাখী আরেকদিকে। কি হলো? মা’র শরীর খারাপ? কিন্তু একি সিঁড়ি দিয়ে পিলপিল করে এত লোক উঠে আসছে কেন? মুহূর্তে বারান্দাটা ভর্তি হয়ে সুজনের চোখের আড়ালে চলে গেল মা আর রাখী। ব্যস্ত হয়ে সামনে এগিয়ে গেল সে। ভীড় ঠেলে এগোতে গিয়ে আরও বিরক্ত হলো সে। লোকগুলো সবই তার পাড়ার। সবাই চেনা। কিন্তু এখন ওকে কেউ সামনে এগোতে দিচ্ছে না কেন? এমন শক্ত এঁটুলির মত দাঁড়িয়ে আছে সবাই যে কাউকে সরিয়ে এগোতেও পারছে না সে।

তার দিকে তাকাচ্ছে না কেউ। সবাই সামনের দিকে তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। হঠাৎ কে যেন জোরে কেঁদে উঠলো। কি হয়েছে বোঝার জন্যে মরীয়া হয়ে সামনের দিকে উঁকি দিল ও। আরে! মেঝেতে স্ট্রেচারের মত কিসে কে যেন শুয়ে আছে না? কে রে বাবা! তার বাড়ীতে তো আর কেউ নেই। রাখীর বাচ্চাকাচ্চাও হয় নি। তাহলে! কার কি হলো!

লোকগুলো কলকল করছে নিজেদের মধ্যেই। কে কার কথা শুনছে কে জানে!
– কি করে হলো?
– আরে বাস থেকে নামতে গিয়ে।
– পেছনের টায়ারে…
– এত তাড়াহুড়ো করে কেউ…
– ইস্ ফ্যামিলিটা ভেসে…

বারান্দার রেলিং এর পাশে একফালি জায়গা দিয়ে কোনোরকমে সামনে এগিয়ে এল সে। ঝুঁকে পড়ে সামনের দিকে তাকাল। আর তাকিয়েই মাথা ঝনঝন করে উঠলো তার। স্ট্রেচারের মত একটা কিছুতে ও কে শুয়ে আছে! চোখ বোজা। মাথার ডানদিকে একটা কাপড় দিয়ে ঢাকা, যেটা রক্তে ভেজা পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু… কিন্তু…

বজ্রাহত হয়ে সে দেখলো যে শুয়ে আছে সে সুজনের মতই হুবহু দেখতে।

অবাক হয়ে খেয়াল করল নিজেকে তুলোর চেয়েও হালকা লাগছে তার।

(শেষ)

নারী তুমি এমন কেন ? – ০২

চির সৌন্দর্যের কবি জন কিটস বলেছেন:
‘Anything of beauty is always fun:
Its beauty increases;
This is never lost in void. ‘

যে সৌন্দর্য ভাল না বাসে, হয় তার রুচিতে সমস্যা আছে কিংবা হয়তো জীবনে সে কখনো সৌন্দর্য দেখেনি। সৌন্দর্যের প্রতি ভাল লাগা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। একজন মানুষের ভিতরগত রূপটি দেখার জন্য তার কাছাকাছি অবস্থান করা, তাকে প্রতিক্ষেত্রে পর্যবেক্ষন করা অতি জরুরী হয়ে পড়ে। নিখুঁত পর্যবেক্ষন শক্তিই একজন অতি কাছের মানুষকেও চিনতে সহায়তা করে। আজ আমি যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি তা আমার মনোজগতকে সাময়িকভাবে নাড়া দিয়েছে। একজন মানুষ কিভাবে এতকিছু করতে পারে ? এত ধৈর্য, এত ইচ্ছা শক্তি কিভাবে সে ধারন করে ? এ নারী প্রায়ই বলে প্রচুর অর্থ সম্পদ আর টাকা থাকলেই মানুষের মন বড় হয় না বা মানুষ সুখী হয় না দুঃখকে অতিক্রম করেই সুখকে স্পর্শ করতে হয়। আবার মাঝে মাঝে যে সুখ আসে তাও দুঃখমিশ্রিত। অবিমিশ্র সুখ বলে কিছু নেই। তারপরও কোনো কোনো দুঃখ, বিরহ লক্ষ্য করা যায়। তবে এসব কোনো বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। সেটা জীবনেরই অংশ। জীবন যে সব মিলিয়ে সামনে চলার। তাই সব রকম চিত্রই কম বেশি সব সময় দেখা যায়। জীবনের মধ্যেই তা ধরা দেয়। বড় মনের পরিচয় প্রকাশ পায় তার ব্যবহার আর আচার আচরনের মাধ্যমে। যে মানুষ অন্য মানুষের প্রাপ্ত অধিকারকে পাশ কাটিয়ে নিজের বুঝটা পুরোপুরি বুঝে তাকে কি মানুষ হিসাবে গন্য করা যায় ? নিজের সব কিছু বিলিয়ে দিয়ে অন্যের যে সামান্যতম উপকারে আসে সেই তো প্রকৃত মানুষ।

মাঝে মাঝে আমি নিজেই নিজেকে চিনতে চেষ্টা করি। মনে করি এটা আমার জীবনের পরীক্ষা ক্ষেত্র। কিন্তু সবগুলো জিনিস কেমন যেন চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে আমাকে। হতবুদ্ধি হয়ে কঠিন সময়কে আমি কেবল আলিঙ্গন করে চলেছি। কোথায় চলছি তা জানিনা।এমন কিছু মানুষ থাকে পৃথিবীতে যারা কাছে এলে অন্য সব ভুলে যেতে চায় মন। জীবনের এই শেষ বেলায়, যখন আকাশে অস্তরাগ আর ছায়া দ্রুত নেমে আসছে আবাদভূমিতে, যখন গাছের ডালে পাখিরা শেষ বেলার কথাগুলি বলে নিচ্ছে, তখনও এ নারীর সন্দর্শনে মন পাগল হয়ে যায়। আর এভাবেই জীবন চলে যাবে নদীতে ভেসে ভেসে যাওয়া ডিঙ্গি নৌকার মতো। তারপরও তাকে পরিপূর্ণ ভাবে দেবার বাসনা শেষ হবে না। কান্না নাকি মানুষের মানবিক অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ কোন কোন বেদনা ও অপমান একে অন্যের সাথে ভাগ করে নেয়। এ কেবল তাদেরই উপলদ্বির বিষয়। সেইসব বেদনায় এক নারীর অশ্রু অন্য নারীর চোখকে আর্দ্র করে। এ এক অনিবার্য ভাগাভাগি, অন্যরূপ সহমর্মিতা। কিন্তু এ নারীর বেলায় নয় কেন ? এ নারী কি শুধু দিয়েই যাবে ? কিছু কি পাবে না অন্যের কাছ থেকে ? এ কেমন বিচার ? কিছুই কি চাইবার নাই তার ?

তার যুক্তি দুঃখ মানুষের ছায়ার মতো। অন্ধকারে মিশিয়ে থাকে কেবল। আলো পেলেই ফুটে বেরোয়। ভাবনায় তুমি জগৎ সংসার ত্যাগ করতে পারো, কিন্তু জগৎ সংসার তোমাকে ছাড়বে না। আমৃত্যু তুমি সকল দুঃখ-কষ্টে, রোগে-শোকে জড়িয়ে থাকবে। নানান ভুল-ত্রুটি, মর্যাদা-অমর্যাদা তোমাকে আচ্ছন্ন করে রাখবে। এর পরও তোমাকে সকলকে নিয়ে সামনে এগুতে হবে। এত কিছুর পরও এ নারীকে আমি কিছুই দিতে পারিনি, শুধুই নিয়েছি। তারপরও আমার ভালবাসার কোন কমতি নেই তার জন্য আমিও মনপ্রান উজার করে ভালবাসি। আরো ভালবাসতে চাই। তাই জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে আমার প্রিয় শিল্পী মানবেন্দ্র এর বিখ্যাত গান দিয়ে আমার ভালবাসার, শ্রদ্ধার বর্হিপ্রকাশ করতে চাই …

“আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি
তবু এ যেন গো কিছু নয়,
কেন আরো ভালবেসে যেতে পারে না হৃদয়” ?

চলবে ……

অণুগল্প : আখের

আখের

নেতাইগঞ্জে আইজ য্যান পুরা দ্যাশের মানোষ আইসে হামলে পইড়েছে। মাইনষের মাথা মাইনষে খায়। রাইস্তে জুইড়ে লাইনে লাইনে বাত্তি ঝকমক কইরছে। পোয়া মাইল বাদে বাদে গেইট বাইন্ধেছে- আলিপ লাইলার কিইস্যার বাদসায়ী দরজার লাহান।

দ্যাশের বেবাক পাপী-তাপী আর দুখি মানোষ, ভালা আর মন্দ মানোষ সব আইসেছে বাবার দরবারে। রাইত আরেকটু বাইড়লেই আখেরি মোনাজাইত কইরবে বাবা। বাবার মোনাজাইতে দিল ঢাইলে হাত তুইললে সবার মনের আশা পূরণ হইবে, কুনু সইন্দেহ নাই। অহনও মানোষ খালি আইতেই আছে, নজরানা নিয়া আইতেছে, আইতে আছে নাজরানা ছাড়া।

রাইত বারোটায় মোনাজাইত ধইরেই কাইন্দা কাইন্দা চেল্লায় উঠলেন জিন্দাপীর কয়লা বাবা- ‘ইয়ে সোনা ঝুটা হ্যায়.. লাখো কয়লা ভুখা হ্যায়.. মাওলা গো, ও দয়াল সাঁই, সবার মনস্কাম পূর্ণ কইরে দাও, আমারে দাও হজম কইরবার শক্তি… মাওলাআআআআআ গোওওওওও…।’ ওরশের শেষ দিনে বাবার লাখ লাখ ভক্ত আশেকান মোনাজাতে কাইন্দে জারে জার.., মাইঝ রাইতের নিশুতি খুন কইরে নেতাইগঞ্জের আসমান জমিন কাইপে কাইপে ওঠে তাগো ‘ইয়া বাবা.. ইয়া বাবা..’ ধ্বনিতে।

অণুগল্প : তুমি এক জোড়া তিল এবং তিনটি ছবি

প্রচণ্ড বরষায় ভিজে ভিজে সাইডব্যাগটিকে সামলে যখন বাসটির নির্ধারিত আসনে বসে শিহাব, বামপাশের জানালা দিয়ে বাইরে তাকানো পাশের সহযাত্রী বৃষ্টিবিলাসী মনে গভীর তন্ময়তায় মৌণ-বিভোর! পাশে কারো উপস্থিতিতে ঘোর থেকে জেগে ওঠে নারী.. হাজার বছরের রহস্যময়ী কালের সোপান বেয়ে ধেয়ে আসা দৃষ্টির ছুঁয়ে যাওয়ায় নিঃশ্চুপ শিহাব.. থমকে যাওয়া সময়ের দ্বিতীয় যাত্রী হয়ে নির্নিমেষ চেয়ে থাকে অধর কোণের সেই তিলটির দিকে!

এ-টু সিটে বসে সামনের উইন্ডস্ক্রিণ দিয়ে মেঘবালিকাদের অবিরাম কান্না দেখে দেখে নিজের মনে হাসে শিহাব.. না, সে না! তার তিল ছিলো দুইটি। একটি বড়, অন্যটি বাবু তিল। অধর কোণে না… অন্য এক জায়গায়। তিলোত্তমা সেই বালিকা.. শিহাবের হারানো সুর! এতগুলো বছর পরে.. এভাবে সামান্য একটি ভুল জায়গার তিল বালিকাকে মনে করিয়ে দিলো?

তিল! সামান্য?
আহ! বালিকা.. এখনো মনে পড়াও, জ্বালা ধরায়। পুড়ে যায়.. এ হৃদয়। দম বন্ধ হয়ে খাবি খায়.. নিঃসংগতার নিঝুম নিমগ্নতায়।
ওহ! বালিকা.. তুমি কোথায়?

দুই পাশে এ্যাকাশিয়া গাছের টানেলের মাঝ দিয়ে সতর্ক ড্রাইভার কালো পিচের রাস্তা দিয়ে সামনে আগায়।

শিহাবের স্রষ্টা ওকে নিয়ে অনেক খেলা খেলেছেন। শিহাব কেন সেই খেলায় অংশ নিলো কিংবা নিতে বাধ্য হলো- সেসব আরেক প্রসংগ। সেদিকে যাবার কিংবা সেসব জানার প্রয়োজন দেখি না।

তবে একদিন ঘুম থেকে উঠে শিহাব দেখে, তার মাথার চুল অধিকাংশই সাদা। পার হয়ে গেছে বউয়ের সাথে হেলা খেলায় এক কুড়ি বছর। দুইটা বাবু নিজেদের মত বড় হচ্ছে… বউয়ের গৃহিনী অবয়বের মাঝে নেই সেই অচেনা প্রথম ফুলশয্যা রাতের মেয়েটি। সময় মেয়েটিকে পূর্ণ রমনীর বাইরের শেষ ধাপে নিয়ে গেছে। এখন শরীর শরীর খেলার ভিতরে নিরুত্তাপ আবেগ। হৃদয়ের সেই গলে যাওয়া অনুভব রুদ্ধ হয়ে এখন আর অনুভূতি আনে না। এখন মনের টানে শরীর আসে না। কিংবা শরীরের টানে মন। এখন কেবলি যন্ত্রের সাথে যন্ত্রের মিলন.. যেখানে সুদূর প্রবাসী মন।

এই যখন শিহাবের বর্তমান জীবন, হঠাত একদিন অন্যরকম কিছু ঘটলো। জোর করে টেনে চলা জীবনের কোনো এক ফাক গলে মন সমেত এক দেহধারী নারীর আগমন। ত্রিশংকু অবস্থায় শিহাব। ধুর, যা হয় হোক না। নিজেকে জীবনের অপভ্রংশ স্তরের ভিতরে ঠেলে দিয়ে, অন্ধকার গহবরের একচিলতে কালো আলোয় নিজেকে দেখবার চেষ্টা করে শিহাব।

সেই নারী ভার্চুয়ালি রাতের পর রাত.. দিনের শুরু কিংবা মধ্য প্রহর পার হয়ে কখনো পিদিম জ্বলা সাঁঝের বেলা, নিরবে অনুভবের ভিতর অনুভূতি শেয়ারের চেষ্টা চালায়। শিহাব এর কোনোটিই নেয় না। আবার লোভও সামলাতে পারে না। পুরুষের ইন্দ্রিয় সুখের তীব্রতর প্রক্ষেপণ বেশ কয়েক দশক আগেই থিতু হতে শুরু করেছে। এই নারী সেই ছাইচাপা আগুনকে উস্কে দিয়ে দাবানল সৃষ্টিতে রত। বেশ বুঝে শিহাব।

একদিন মধ্যরাতে এলোমেলো শিহাব। বউয়ের থেকে অনেক দূরে। প্রায় পক্ষকাল। বউয়ের পাশে ঘুমানোর অভ্যস্ততার সাময়িক অনভ্যস্ততার সুযোগ পেয়ে উথলে ওঠা তীব্র শারিরীক চাহিদা, তীব্র সাইনাস পেইনের মতো যন্ত্রণাকর হয়ে ওঠে। সামনে আসে সেই নারী। পরনারী। যাকে শাস্ত্রে পরিত্যাজ্য ঘোষনা করা হয়েছে।

কে করেছে? শিহাব নিজের কাছে জানতে চায়, ‘তুমি কি করেছ?’ মন নেতিবাচক উত্তর দিলে আগুন জ্বলে ফাগুনের মোহনায়। দুই নদী এক হতে চায় এক বিষণ্ণ মধ্য রাতে।

দূরে থেকে অনুভবের মাঝে অনুভূতির ছুয়ে দেবার এক অস্বাভাবিক প্রেম প্রেম খেলায়, নারী নিজেকে দেখায়.. কাছে টানায়, কিন্তু দূরেই রয়। সে অসম্পূর্ণ সমর্পণ করে শিহাবের কাছে। শিহাব এলোমেলো.. সম্পূর্ণ দেখতে চায় নারীকে ভার্চুয়ালি।

নারী তিনটি ছবিতে নিজেকে দেখায়।

প্রথম ছবিতে বিছানায় বসা নারী। স্বচ্ছ নেটের মশারির ভিতরে ল্যাপটপে কাজ করছে এক অচেনা মধ্যবয়সী পুরুষ। ক্যামেরার দিকে তার পিঠ। নারী নিজের সংক্ষিপ্ত ঘুমানোর পোশাকে ক্যামেরার দিকে চেয়ে আছে। গলার কাছটায় অনেকটা উন্মুক্ত!
প্রথম ধাক্কা খায় শিহাব। হারানো সুর গুনগুন করে বিস্মৃতির অতল গহবর থেকে কিছু একটা মনে করিয়ে দিতে চায়! তিল!

দ্বিতীয় ছবিতে বিছানায় শুয়ে আছে নারী। একা। পাশের পুরুষের অংশবিশেষ ছায়ার মতো দেখা যায়। নারীর মাথার চুল এলোমেলো। চোখে আগুন জ্বলে উঠে নিভে গিয়ে তৃপ্তির চকমকে আভা! শারিরীক চাহিদা শেষে নিজের বিছানায় বউয়ের চোখে এই একই চকমকে উজ্জ্বলতায় অনেক অনেক বার চোখ ধাঁধিয়ে গেছে শিহাবের! রমন শেষে পরিতৃপ্ত রমনী শিহাবকে লণ্ডভণ্ড বিছানায় নিজের পুরুষের কায়াহীন ছায়ার পাশে শুয়ে থেকে দ্বিতীয় ছবিটি পাঠায়। বড় তিলটি গলার সেই নির্দিষ্ট জায়গাটিতেই একই রকম দৃশ্যমান!

হ্যা! ত্রিশ বছর পরে সেই হারানো বালিকা পূর্ণ রমনী হয়ে আজ নিজেকে শিহাবের সামনে এক আয়তাকার ভার্চুয়াল জীবনের অপর পারে এক ভিন্ন পুরুষের বিছানায় শুয়ে থেকে নিজেকে দেখায়! ভিন্ন পুরুষটি এখন সেই একদার বালিকার নিজের পুরুষ।

তৃতীয় ছবি! দুইটি তিল সহ সেই নারীর বালিকা হবার অপপ্রয়াস! যেভাবে কোনো একসময় তিলে তিলে ছুয়ে ছুয়ে বালিকার ভিতরের নারীর অনুভবে অনুভূতি জাগানোর চেষ্টা করতো শিহাব! সেই একই ভংগীমা.. একই হাসি.. মদির চোখের একইভাবে জ্বলে ওঠা, অত:পর মিইয়ে যাওয়া.. আবার জ্বলা.. নিভা.. এভাবে বারবার… হ্যা! সে সেই মেয়েটিই।

সময় যাকে নারীতে পরিণত করেছে। কিন্তু স্বভাবে সে একই সেই বালিকাই রয়ে গেছে। ত্রিশ বছরের যন্ত্রণা আবার নতুন করে শিহাবকে পেয়ে বসে, নতুনভাবে কষ্টকর সেই সময়ের তীব্রতায় ক্ষয়ে যেতে থাকে শিহাব। গলে যায় যন্ত্রনায়। বুকের কোথায় যেন চিনচন করে। এখন আর শারিরীক চাহিদা অনুভব করে না। বালিকার দুইটি তিল সময়ের পথ পরিভ্রমণ শেষে এক নারীর বুকের গোপন বিউটি স্পটে পরিণত হয়েছে- যার শরীরটা কিছুক্ষণ আগেও ভীষণভাবে দুমরে মুচরে দলিত মথিত করে ছিড়ে খুবলে একাকার করে দিতে চেয়েছিলো শিহাব। কিন্তু প্রথম প্রেমের সেই বালিকা সামনে আসায় কোথায় হারালো সেই উন্মত্ততা? অসুরতা?

তৃতীয় ছবিতে বুক খোলা নারীর বুকের উপর তার পুরুষের ঘুমন্ত অবহেলায় পড়ে থাকা একটি হাত নেটের মশারির বাইরে থেকেও দেখা যায়। নারী চেয়ে আছে শিহাবের দিকে.. একটা ছবিই তো.. কিন্তু শিহাবের দিকে নির্নিমেষ চেয়ে থাকা দুটি চোখ, খোলা বুক আর নিঃসংগ এক জোড়া কালো তিল- শিহাবকে কাছে টানতে চায়! শিহাব শীতল থেকে শীতলতর.. ক্রমশঃ আরো অধিক শীতলতম প্রদেশের একমাত্র বাসিন্দা হয়ে যায়।

মৃত্যুর ওপার থেকে জীবনের ডাক শুনতে পায় শিহাব! বালিকা ত্রিশ বছর আগেও তার সাথে শরীর শরীর খেলায় মেতে উঠতে চেয়েছিল। যা শেষ হয়নি, এর আগেই…

আজ ত্রিশ বছর পরেও সেই একই বালিকা নিজের পুরুষটির পাশে থেকেও ভার্চুয়ালি আরেক অন্য পুরুষের অনুভবে অনুভূতি ঢেলে দেবার চেষ্টারত!

হায় বালিকা!
নিজের সাময়িক পথভ্রষ্টতায় নিজের থেকে দূরে সরে যাওয়ায় শিহাব দূর থেকে আবার নিজের কাছে আসার চেষ্টা করে। ফিরে আসার নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। পদস্খলন অনুভবেই এলেই আবার নতুনভাবে শুধরে নেবার সময় থেকেই যায়।

নিজের বউকে বড্ড মনে পড়ে হঠাত। বউয়ের পরিচিত শরীরের ঘ্রাণ পায় অনুভবে-কল্পনায়! এক গভীর রাতে বালিকা এবং বালিকার নারীরুপ- উভয়ের প্রেম প্রেম খেলায় ভালোবাসা ছিলনা এটা বড্ড প্রকটভাবে অনুভবে আসে আজ শিহাবের। বাতাসে বউয়ের ঘ্রাণ.. নিজের শরীর ছাপিয়েও বউয়ের এক কুড়ি বছর পাশে থাকার ঘ্রাণ! মোবাইলের বহু পরিচিত নাম্বারটি আংগুল নিজেই প্রেস করে যেতে থাকে… দীর্ঘদিন পরে যান্ত্রিক শরীর ছাপিয়ে নিজের মনকে আবিষ্কার করে শিহাব। বুক ধুকধুক করে, প্রথম রাতের উত্তেজনায় দৃঢ় হয়ে ওঠে শিহাবের ভিতরের শিহাব।

ঘুমজড়ানো কন্ঠে বউয়ের অসাধারণ কণ্ঠস্বর আরো এ্যাপিল এনে দেয় শিহাবকে.. ফুলশয্যার সেই রাতটিতে ফিরে যায় শিহাব।
– হ্যালো
বউয়ের আওয়াজ আজ কেন জানি আরো মধুর লাগে। উত্তেজনায় কম্পিত স্বরে শিহাব বলে,
– এ্যাই! কাছে আসো!
– এত রাতে ঘুম ভাংগায়ে ঢং করতে আসছে
একথা বলেই বউ ফোন রেখে ঘুমিয়ে পড়ে।

মৃদু হেসে শিহাব ব্যালকনিতে এসে রাতের শেষ সিগ্রেটটি জ্বালায়। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আরো বেগবান হয়েছে। অন্ধকারে দূর থেকে জ্বলন্ত সিগ্রেটের আগুনকে ম্লান করে তোলে শিহাবের জ্বলতে থাকা দুই চোখ। সেখানে আজ পূর্ণরুপে ভালোবাসার চমক জমেছে।

হৃদয়ে ভালোবাসা জন্ম নিতে সময় লাগে না। ত্রিশ বছর কেনো, এক কোটি বছর প্রয়োজনে অপেক্ষা করুন, ভালোবাসার জন্ম হবেই। আর একজীবনে যদি সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষের সাথে একটি রাতও কাটাতে না পারেন, সেই জীবন মূল্যহীন।

ভালোবাসার মানুষের সাথে থাকুন… ভালো থাকবেন।।

______________________________________

#তুমি_এক_জোড়া_তিল_এবং_তিনটি_ছবি_অণুগল্প_৪৪২

ছায়া ২

ছায়া ২

আর আজকেই যত বাঁধা পরপর আসছে। ফ্যাক্টরী থেকে বেরোনোর সময়ে ঝামেলা। সেকশন ইনচার্জ দেখতে পেয়ে পাক্কা পনের মিনিট পরের দিনের কাজ বোঝালেন। বেরিয়ে রিটায়ার্ড বোসবাবুর সঙ্গে দেখা। কারো কথাই না শুনে নিজেই বকে যান। কোনোক্রমে পাশ কাটিয়ে স্টপেজে এসে বাস নেই। বেশ কিছুক্ষণ পরে যেটা এল সেটাতে ঠাসা ভীড়। অন্যদিন হলে এটা ছেড়ে দিত সুজন। কিন্তু আজ উপায় নেই। এমনিতেই প্রায় ছ’টা বেজে গেছে, আটটার মধ্যে রিপেমেন্ট না করতে পারলে প্রচুর পেনাল্টি লেগে যাবে। ঠাসা ভীড়েই উঠে পড়েছিল।

বাস থামার আগেই নেমে দৌড়। পেছনে একটা হৈ হৈ আওয়াজ শুনে একবার তাকিয়ে দেখেছিল কিছু লোক দৌড়ে যাচ্ছে বাসের দিকে। হয়তো পকেটমার ধরা পড়েছে। ও নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় ছিল না। ঘড়ির দিকে তাকালো সে। প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে। অবশ্য বাড়ী পৌঁছেও গেছে সে।

বাইরের দরজা হাট করে খোলা। খুব বিরক্ত হলো সে। কতবার বলেছে সবাইকে এই সন্ধ্যেবেলায় দরজা খোলা না রাখতে। শুনলে তো! যেদিন সব সাফ করে বেরিয়ে যাবে কেউ, সেদিন বুঝবে। ঢুকেও কাউকে দেখতে পেলো না সে। মায়ের ঘরে উঁকি দিয়ে মাকেও দেখতে পেল না। এখন ওসব ভাবার সময়ও নেই। নিজের ঘরে ঢুকে ল্যাপটপটা ঝটপট অন করে বসলো সুজন।

টাকাটা পাঠিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত। ভাবনার জ্বর ছেড়ে যাবার পরে এখন চা তেষ্টা পেল ওর। অথচ এতক্ষণ বাড়ী ফিরেছে কেউ একবার সেটা দেখার কথা ভাবলোই না। বাড়ীটা খুব উশৃঙ্খল হয়ে গেছে। এভাবে তো বাড়ীতে ডাকাতি হয়ে গেলেও কেউ টের পাবে না। ভাবতে ভাবতে আর রাগতে রাগতে ঘর থেকে বেরোলো সে।

(চলবে)

ছায়া

ছায়া

ছোট্ট একটা ইঁটের টুকরো পায়ে লেগে ছিটকে পাশের দেওয়ালে লাগলো। ঠিক ছোটবেলায় লাথি মেরে ফুটবলের দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মত। একটা ছায়া স্যাঁত করে সরে গেল। মনে মনে হাসলো সুজন। অন্যরা হলে এতক্ষণে ভয়ে হাত পা পেটের মধ্যে সেঁদিয়ে ফেলতো। মনের ভেতরে থাকা হাসিটা ফিক করে সুজনের ঠোঁটে চলকে উঠলো।

সেই ছোট থেকেই সুজন আলাদা ঘরে থাকে। আলাদা শোয়, আলাদা জগত গড়ে নিয়েছে নিজের। সেই জগতে আর যাই হোক কোনো অশরীরির জায়গা হয় নি। অনেককে দেখেছে বড় হওয়ার পরেও যারা একা থাকতে বা শুতে পারে না। ওদের জন্যে রীতিমত অনুকম্পা বোধ হয় ওর। ওপরের দিকে তাকালো সুজন। নির্ঘাত এক বাড়ীর ছাদ থেকে আরেক বাড়ীর ছাদে কোনো বেড়াল লাফিয়েছে। বড় বড় বাড়ীগুলো এত গা ঘেঁষে উঠেছে এখানে যে গলিটাই দু দিকের দেওয়ালের চাপে কেমন সেই মধ্যযুগের গা ছমছমে অন্ধগলির চেহারা নিয়েছে। ছাদের আলোর নীচে কিছু রাখলে তার ছায়া বিরাট হয়ে নীচে পড়ে। এও সেই রকমই কিছু হবে।

মনটা অন্য দিকে চলে গেছিল। তাড়াতাড়ি পা চালালো সে। আজ যে ওর হাউস বিল্ডিং লোনের রিপেমেন্ট করার শেষ দিন সেটা কাজের চাপে মনেই ছিল না। হঠাৎ মোবাইলে একটা মেসেজ দেখেই ওর মাথা খারাপ। ফ্যাক্টরিতে ওদের সেকশনে নেট কাজ করে না বলে স্মার্টফোন আনে না। ব্যাঙ্কের ব্র্যাঞ্চ অনেক দূরে। অন্য ব্র্যাঞ্চ থেকে যে টাকা দেবে সে উপায়ও নেই, এটিএম কার্ড আনে নি। কোনো সাইবার কাফেতে বসে নেট ব্যাংকিং করার ভরসা হয় না ওর, যদি কোনোভাবে পাসওয়ার্ড ফাঁস হয়ে যায়! একমাত্র উপায় বাড়ী ফিরে নেটব্যাংকিং। আরেকটু জোরে পা চালালো সে।

(চলবে)