বিভাগের আর্কাইভঃ গল্প

শান্তির সংসার

28321 শান্তির সংসারে শান্তি হল আকাশের বিজলির মতোন। এই আছে এই নেই। তবুও শান্তির মনে তেমন একটা অশান্তি নেই। ছিলোও না। সে তার স্বামী নাদিমকে খুব ভালোভাবে চিনে। লোকটা মানুষ হিসাবে একেবারে মন্দ না। মনের মধ্যে কোনো জিলাপির প্যাচ নেই। ভোঁতা দা এর মতোন রাগ নেই বললেই চলে। কিন্তু কোনো কারণে হঠাৎ যদি রাগ উঠে তাহলে আর রক্ষা নেই। শান্তিকে পিটিয়ে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে মক্কা পাঠানোর যোগাড় হয়। এখন পর্যন্ত নাদিমের পিটানোতে শান্তির তিন তিনবার হাসপাতাল বাসের সৌভাগ্য হয়েছে। একবার তো একহাত এবং একপায়ের হাড্ডি ভেঙেই গিয়েছিল। সেই থেকে প্লাস্টার করানোর কতটা জ্বালা সে বেশ ভালোই বুঝে। তবুও শান্তি নাদিমের উপর ডোমিনেট করতে ছাড়ে না। অবশ্য অনেকেই তখন নাদিমের সংসার ছাড়ার জন্য শান্তিকে সুপারিশ করেছিল। শান্তি সেসব কানে নেয়নি। শান্তি বরং গর্ব ভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে প্রতিবেশী করিমনকে বলেছিল, তোরা শুধু হের ( নাদিমের) মাইরটা চোখে দেখলি; কিন্তু মাইরের পরে যে শিশুর মতোন হাউমাউ কইরা কাঁদে, আমার দুই পা ধইরা একশ একবার মাফ চায়… সেসব দেখলি না। মাইরের সময় তোরা দশ চোখ বাইর কইরা দেহস, আর অন্যসময় চোখের মধ্যে কালা গামছা প্যাচাইয়া রাহস।

শান্তির স্বামী বেচারা নাদিম ট্রাকের হেলপার। বলা যায়, সেও ট্রাকের মতোই বেপরোয়া। শীত নেই, গ্রীষ্ম নেই সারাদিনই খালি গায়ে থাকে। প্যান্ট পরে না, লুংগি পরে না। একটা হাফপ্যান্টেই দিবারাত্রি ২৪ ঘন্টা চলে। চলতে থাকে। একবার শান্তি নাদিমের জন্য রোজার ঈদে একটা টিশার্ট কিনে এনেছিল। সেকি ভুতুড়ে কাণ্ড! সেই টিশার্ট পরার পর নাদিমের সারাশরীরে বেশুমার চুলকানি। চুলকাতে চুলকাতে দফারফা। তবুও চুলকানি আর থামে না। সেই সুযোগে শান্তিও নাদিমের শরীরে নখের আঁচড় বসিয়ে মাইরের প্রতিশোধ নেয়। কিছুক্ষণ পরে আবার আফসোসও করে। মনে মনে ভাবে, “কাজটা আমি ভালা করি নাই। তওবা… তওবা… । আর কোনোদিন এমন করুম না।”

সেই শান্তি আর নাদিমের বিয়ের আজ তের বছর। শুভ হোক আর অশুভ হোক বিবাহবার্ষিকী বটে! নাদিমের মনে আছে কিনা.. কে জানে, তবে শান্তির ঠিক ঠিক মনে আছে। প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে শান্তি নাদিমকে একটা ঘুষি দিয়েছিলো। আর আজ দিবে তেরটা ঘুষি! বিবাহবার্ষিকী উদযাপনের এই অভিনব পন্থাটা প্রথম দিন বুঝতে না পারলেও এখন নাদিম মনে মনে প্রস্তুত থাকে। তবে শান্তিকে বুঝতে দেয় না। এই তেরটা বছর বড় কম সময় নয়। যদিও মহাকালের হিসেবে এর কোনো ধর্তব্য নেই। সময় নিজেও একটা চোরা ফাঁদ। একেকজনের কাছে একেকরকম। সুখের সময়গুলো তাড়াতাড়ি যায় আর অ-সুখের সময়গুলো যায় না। যেতে চায় না। এ যেন নাদিমের কুচকুচে কালো শরীরের মতোন। শান্তি যতই ঘষামাজা করে, ততই কালো বের হয়। ফর্সা হয় না। অবশ্য বিবাহের প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও এখন আর শান্তির খারাপ লাগে না। শান্তি জানে, এই কালো মুখই কালো ভ্রমরের মতোন…ওতেই তার বাঁচা… ওতেই তার মরা।

এখন রাত এগারোটা একত্রিশ মিনিট। আর মাত্র ঊনত্রিশ মিনিট পরেই নাদিম-শান্তির তেরতম শুভ বিবাহবার্ষিকী। এই উপলক্ষে শান্তি মাছ, মাংস, মশলা, তেল এসব কিনতে বাজারে গিয়েছিলো। এই একটা দিন অন্তত ভালো খাবার খাওয়া চাই৷ নাদিম অত্যন্ত ভোজনরসিক মানুষ। কিন্তু সাধ্য আর সাধ্যের মধ্যে কেবল গড়মিল। নইলে যে সব খাবার বড়লোকেরা প্রতিদিন খায়… নাদিম-শান্তিও সেসব খাইত। কিছুমাত্র কমতি রাখতো না। আজ বাজারে এসে জিনিসপত্রের দশ তলা উঁচু বিল্ডিং এর মতোন চড়া দাম দেখে শান্তির শরীর ঘামছিল। এখন সে বুঝতে পারছে.. নাদিমকে কিছু একটা কিনে আনতে বললে কেন সে এতো ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে, কোচর-মোচড় করে..। নাদিমের অসহায় মুখের মানচিত্রটা চোখের সামনে ভাসতেই সে দুই চোখ বন্ধ করে দিল। তবুও নাদিমকে চোখের তারা থেকে সরাতে পারলো না। সে কৃষ্ণগহবরের মতো আরও বড় হতে লাগলো। আরও বড়…!

এই যখন শান্তির অবস্থা, ঠিক তখনই দরজায় ঠাস ঠাস করে তিনবার আওয়াজ হল। এই দিগম্বর আওয়াজ শান্তির খুব পরিচিত। নাদিম এসেছে। বাসর ঘরের মতো শান্তির সারা শরীর ঠক ঠক করে কাঁপছে। এই কাঁপা-কাঁপির কোনো মানে শান্তি খুঁজে পেল না। যার সাথে সুখে-দুখে তেরটা বছর… তার এই সামান্য শব্দে এইরকম অযাচিত কাঁপার কোনো মানেই হয় না। শান্তি মনে মনে লজ্জার লাগাম টানতে লাগলো। পারলো না। তবুও সাথে সাথেই দরজা খুলে দিল। কী আচানক ব্যাপার! নাদিমের হাতে মাঝারি সাইজের একটা গিফট বক্স। রেপিং পেপার দিয়ে সুন্দরভাবে মোড়ানো। নাদিমের মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে সাথে সাথেই শান্তি চোখ নামিয়ে নিলো। কালো মুখটি আরও কালো লাগছে। তার সাথে ভর করে আছে কয়েক বস্তা বিষন্নতা, হতাশা আর গ্লানি। শান্তি কিছু একটা বলার জন্য আঁকুপাঁকু করছে। কিন্তু সাহস পেল না। নাদিমও কিছু বলল না। গিফট বক্সটি শান্তির হাতে দিয়ে ধড়াম করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। রাত তখন ঠিক বারোটা বেজে এক মিনিট। শান্তি আকাশ-পাতাল করতে করতে গিফট বক্সটি খুলেই চমকে উঠল। একটা পুতুল। যেন সদ্য জন্ম নেওয়া ফুটফুটে একটি মেয়ে। মুহুর্তেই শান্তির ধবধবে ফর্সা মুখটি গভীর অন্ধকারে ছেয়ে গেল। সে অন্ধকারের সাথে মিশে আছে শান্তির নারী জন্মের আজন্ম হাহাকার। এই তেরো বছরেও নাদিমকে একটি সন্তান উপহার দিতে না পারার হাহাকার….!

শুভ হউক শান্তি ও নাদিমের আগামী বিবাহবার্ষিকী।।

গোধূলি বেলায় তোমার চেহারা

GS4B

এখানে দুঃখিত হওয়ার কিছুই নেই মিতালি। তুমি আমার মা-বাবার প্রতি রাগান্বিত থাকা স্বাভাবিক। তা ঠিক এক সময় প্রচণ্ড রাগ ছিলো উনাদের উপর, কারণ অনেক কটু কথা আমাকে বলেছে। এখন উনারা মৃত, আর মৃত ব্যক্তির উপর রাগ করে থাকা উচিত নয়। এখন সব সময় উনাদের আত্মার পরম শান্তি কামনা করি। তাছাড়া তুমিই যেহেতু আমার খবর নাওনি সেখানে উনারা বিরক্ত হওয়াই স্বাভাবিক। যদি পারো মা-বাবার সাথে সাথে আমাকেও ক্ষমা করে দিও, সবাইকে হারিয়ে আমি একটা জীবিত লাশ। শুধু দেহ নামক মেশিনটা বয়ে বেড়াই দেশ বিদেশ।

হাঃ হাঃ হাঃ।
এখানে হাসির কী হলো মিতালি।
তুমি এখন স্পেনবাসী। বাড়ি, গাড়ি, টাকা ও নারী ফুঁ দিলে পেয়ে যাবে।
আগে এক জনের ভালোবাসার মোহ ছিলো এখন কোনো কিছুর প্রতি মোহ নাই আর আমি বহুগামী নই।
তাহলে,কেনো তুমি আমাকে——-রোহিত।
স্পেন যেতে পথে পথে কাটে বহুদিন বহু বিপদে। রোজগার করার উপযুক্ত হতে হতে তুমিও হারিয়ে যাও চিরতরে, তখন নিজেকেও হারিয়ে ফেলি।

নিজেকে হারিয়ে ফেলি কাজের ভিতর। রোজগার করতে গিয়ে কোনো পিছুটান ছিলো না একমাত্র শুধূ ছিলো হৃদয় ভেঙ্গে যাওয়ার ঝনঝন শব্দ। যে শব্দ আমাকে আকুল করতো , কখনো কখনো করতো কান্নায় মাতাল।
কখনো খোঁজ খবর নিতে চেষ্টা করো নাই কেনো ?
খোঁজ নিতে বহুবার চেষ্টা করেছি মিতালি ।
তবে, আমার পরিবারের বারণ ছিলো প্রচণ্ড রকম। রাগ করে চিঠি দেওয়া বন্ধ রাখতাম। কিন্তু আমি যে তাদেরই সন্তান মা বাপকে ফেলে দেওয়া সম্ভব হয়নি। আমার মা লিখতো মিতালি একজন বিবাহিত নারী যোগাযোগ করলে তার সমস্যা হবে। আস্তে আস্তে মায়ের যুক্তিসংগত কথায় আমার মন বুঝ মানে। টাকা উপার্জনে মনোযোগী হয়ে প্রচুর টাকার মালিক হই কিন্তু অমনোযোগী হই নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে। সময় এবং সুযোগ যেহেতু আমাকে যাযাবর করেছে এইভাবে কেটে যাবে বাকি জীবন।

যাযাবর ভাবছো কেনো নিজেকে। সারা পৃথিবী মানুষের হাতের মুঠোয় এখন। এক সেকেন্ডে পৃথিবীর এক পান্থ হতে অন্য পান্থের খবর মানুষ নিমিষে পেয়ে যাচ্ছে। এক সেকেন্ডে বিশ্বের যে কোনো পান্থ হতে প্রবাসীদের টাকা এসে যায়।
হাঃ হাঃ হাঃ। তা ঠিক মিতালি। কিন্তু প্রবাসীদের লাশ নিমিষে আসে না। বহু দেনদরবার করে টাকা পয়সা খরচ করে তারপর লাশ আনতে হয়। এই জন্য অনেকের লাশ বিদেশেই পড়ে থাকে। হয়তো আমার লাশও পড়ে থাকবে বিদেশে।

মানুষের ব্যক্তিত্ব হলো একটি দোকান। মুখ হচ্ছে তালা। তালা খুললেই বুঝা যায় এটা কী হিরার দোকান নাকি কয়লার দোকান। সোজা কথা হল, কথা বলা একটি আর্ট বা শিল্প, এর শক্তি বিস্ময়কর। সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে সঠিক শব্দ প্রয়োগ করে সুন্দরভাবে গুছিয়ে বললে যে কাউকে বশ করা যায়। চুপ করে থাকলে, উল্টো দোষী হতে হয় , অনেক সময় ভুল বুঝে মানুষ। জীবন জীবিকাও ঠিক তাই সুন্দর করে সাজাতে হয়, না হয় এলোমেলো হয়ে যায় সব। আর এইটা অনেক সময় টাকা থাকলেও কিছু লোক করতে পারে না তাদের ভিতর হয়তো আমিও একজন। আর তুমি সঠিক সময় সঠিক কাজ করে এবং স্বামীর সাথে সঠিক আচরন করে জীবন সুন্দর করেছো। জয় হয়েছে তোমার।

ফয়জুল মহী।

(শেষ)

মামুনের ছোটগল্প: সন্ধ্যা নেমে এলো

2888

এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে।
রংধনুর রঙ এর লুকোচুরি দেখতে দেখতে পথ হাঁটছি। সোনালী বিকেলটাকে আবার এতো তাড়াতাড়ি যে ফিরে পাবো ভাবিনি। কিছুক্ষণ আগেই নীলচে কালো মেঘেরা সব গুড়ুম গুড়ুম করে আকাশটাকে দখল করে নিলো। টিউশন শেষ করে মেসে ফেরার তাড়া ছিল না। তাই উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটাহাঁটি আর ঠোঁট না নাড়িয়ে গুনগুন,
‘কত যে কথা ছিল, কত যে বেদনা…’।

ঠোঁট না নেড়ে কখনো গুনগুন করেছ? এটা নাকের বাঁশী ও কন্ঠনালী ব্যবহার করে করতে হয়। গানের কলি শুনলে মনে হচ্ছে যে কতটা দুঃখ হৃদয়ে নিয়ে হেঁটে চলেছি। আসলে তা নয়। তবে একেবারেই যে দুঃখ নেই তাও না। সুখও নেই, দুঃখও নেই। এটাকে এক কথায় প্রকাশ করলে কি যেন হয়?

পকেটে একটা টাকাও নেই। রিক্সার দশ টাকার পথ হেঁটে মেয়েটিকে পড়াতে যেতে হচ্ছে আজ তিনদিন ধরে। মাসের ছাব্বিশ তারিখ। এই মাস আবার একত্রিশে । কেন, সব মাসগুলো ত্রিশ দিনে হলে কি হয়? আরো পাঁচ দিন এভাবে যেতে হবে। অন্যরা সপ্তাহে তিন কি বেশী হলে চার দিন পড়ায়। আর আমার বেলায় একদিন বন্ধ রেখে প্রতিদিন। আমার চেহারায় কিছু একটা আছে হয়তো। অভিভাবকেরা প্রথম দেখায়ই বুঝে যায়, কলুর বলদ একটাকে পাওয়া গেছে। অবশ্য আমি বলদ হলেও পড়াই ভালো। যাদের রেফারেন্সে টিউশন দিতে আসি, তাঁরা আমার সম্পর্কে ভালোই বলে। অন্তত আমার একাডেমিক রেকর্ডও সে কথাই বলে।

আজ দেড় বছর এই টিউশন এর ওপরই বেঁচে আছি। এটা বললে মোল্লারা আবার ক্ষেপে যাবে না তো? ‘আস্তাগফিরুল্লাহ! লা হাওলা ওয়ালা কুয়্যাতা…’ বলে শাপলা চত্বরে আমার বিরুদ্ধে আমরণ অনশনে না বসে যায়।

কি করব বলো। চাকরি পাই না। প্রথমদিকে অনেক ইন্টারভিয়্যু দিয়েছি। একটা হ্যান্ডবুকই লিখে ফেলতে পারতাম মনে হয়। ‘দ্য হ্যাণ্ডবুক অফ আনএমপ্লয়েড ভ্যাগাবন্ড’ নামটি কেমন হয়? আসলে চাকরির জন্য যে যোগ্যতা লাগে তা আমার নেই। এখন যদি তোমরা কেউ জিজ্ঞেস করো, কি ‘যোগ্যতা’ লাগে, আমার অনেক সময় নষ্ট হবে। এমনিতেই আমার সময় নেই। এখন সাড়ে পাঁচটা বাজে। পৌনে ছ’টায় নির্দিষ্ট একটা জায়গায় আমাকে থাকতে হবে।

একজন অপেক্ষা করবে।

আজ ক’দিন ধরে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। কোনোভাবেই আজ পালানো যাবে না। তাহলে আমাকে রাত কাটাতে হবে কোনো পার্কে বা স্কুলের বারান্দায়। কারণ সে সোজা আমার মেসে চলে আসবে। আমি জানি। এবং ওকে আমার থেকেও বেশী জানি। কলি এ ধরনেরই মেয়ে!

একটা বিড়ি খাইতে পারলে মন্দ হতো না। বিড়ি শুনে আবার নাক কুঁচকে ফেলো না যেন। সিগ্রেটকে আমি বিড়িই বলি। বিড়ি হোক আর সিগ্রেট হোক, জ্বালিয়ে ছারখার করবে তো সেই আমাকেই। এই জীবনের মত!

একটু পা চালিয়ে যাবার চেষ্টা করি। সামনে এক ভদ্রলোক (নাহ! তাঁকে ভদ্রলোক বলা যাবে না। সে প্রকাশ্যে ধুমপান করছে, আইন ভাঙছে। ভদ্রলোকেরা আইন মেনে চলবে।) তিনি ধুমপান করতে করতে হাঁটছেন। ওনার সিগ্রেটটা ফেলে দিলে না হয় দু’তিন টান দিতে পারবো। এভাবে অনেক কুড়িয়ে ফেলে দেওয়া সিগ্রেট টেনেছি আমি। কোথাও কোথাও এইগুলিকে ‘মোতা’বলে।

অভদ্রলোকটির ফেলে যাওয়া সিগ্রেটের শেষাংশে কষে তিনটি টান দিতে পারলাম। নিকোটিনের বিষে ফুসফুসকে ভরিয়ে দিতে কি যে আনন্দ! এই একই আনন্দ পাই যখন কলির পাশে বসে বসে ওর বকা শুনি,
‘এটা পারো না.. কেন এমন হল.. এত দেরী কেন… এই, তুমি আবার সিগ্রেট খেয়েছ’ ইত্যকার হাজার রকমের কেন শুনে শুনে এতোটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে, এখন আর না শুনলে ভালো লাগে না। কলি আমার ভ্যাগাবন্ড জীবনের অন্যতম নেশা!

আজ কলিকে আমার নিজের একটি অনুভুতির কথা বলতে হবে। আরে, অন্য কিছু ভেবে বস না আবার। সেদিন হেলাল হাফিজের একটি কবিতা আবৃত্তি করছিলাম। কলি চুপচাপ আমার আবৃত্তি শুনল। আমার শেষ হলে বলল,
‘ আমাকে স্পর্শ কর, নিবিঢ় স্পর্শ কর নারী’ এই লাইন আমাকে বুঝিয়ে দিবে। এখানে প্রথমবার স্পর্শ দিয়েও কি তাঁর অনুভুতি হয়নি, আবার নিবিঢ় স্পর্শ কথাটি কেন বললেন?’

কি বিপদে পড়লাম দেখ দেখি। ওকে খুশী করার জন্য রাত জেগে জেগে কবিতা মুখস্ত করি। আমার একাডেমিক পরীক্ষাগুলোর আগে এর ছিটেফোঁটাও যদি করতাম, হয়তো আরো.. বেটার কিছু হতো।

কে যেন পিছন থেকে বলল, ‘বালটা হইত… তুই ব্যাটা এখনো যা আছিস, তখনো তাই-ই থাকতিস… এখন হাঁটার উপরে থাক।’ চারপাশে তাকাই। কিন্তু কাউকে দেখি না। সকালে স্টিকে টান দিয়েছিলাম বলে তো মনে পড়ছে না।

যখন কলির কাছে পৌঁছলাম, অলরেডি দশ মিনিট লেট হয়ে গেছে। বসের সামনে দাঁড়ানোর মতো কাঁচুমাচু হয়ে আছি। আমাকে অবাক করে দিয়ে এই প্রথম দেরীর কারন জানতে চাইল না সে। বলল,
– তোমাকে যে কাজ দিয়েছিলাম, করেছ?
‘কোন কাজটা যেন?’

এমন ভাবে সে আমার দিকে তাকালো, আমার তাতেই হয়ে গেল। বললাম,
‘না, মানে এতো ব্যস্ত থাকি যে সব কিছু কেমন আউলা হয়ে যায়। একটু মনে করে দিলে ভালো হয় ডার্লিং!’

– দেখ, আমার সাথে তুমি ফাজলামো করবে না। তুমি হেঁটে আসার পথে এইগুলো নিয়েই ভাবছিলে। কি, মিথ্যে বলেছি?

আমি ভেবে পেলাম না, ও কীভাবে জানল আমি কি ভাবতে ভাবতে এসেছি ! বললাম,
‘ডার্লিং, বললে তুমি বিশ্বাস করবে না, আমি ঐ কবিতার লাইনটির অর্থ নিয়ে ঘন্টার পর ঘণ্টা সময় কাটিয়েছি। কিন্তু…’
– কিন্তু কি?
‘আমার মাথায় একটা গান ঘুরপাক খাচ্ছে। সেই গতকাল থেকে। কোনোভাবেই বের হচ্ছে না…’
– কোন গানটা?
‘দুশমনি করো না প্রিয়তমা’ এইটা। মাথায় বাজতে বাজতে শেষে ‘দুষ্টুমি করো না প্রিয়তমা’ হয়ে যাচ্ছে।’

দাঁড়ানো অবস্থা থেকে কলি বসে পড়ল। ওর মুখ থমথমে। নাকের নিচের জায়গাটায় হাল্কা ঘাম জমেছে। বড়ই ভালো লাগছে! আমার বুকের ভিতরে কিসে যেন টান মারল। আমি ভাবলাম, কেন ওর সাথে এরকম করছি? ও যা চায়, সেটা করলে ক্ষতি কি? পরক্ষণেই ভাবি, নাহ, আমার মত ভ্যাগাবন্ডের সাথে ওকে মানায় না। আমি ওকে কোনো সুখই দিতে পারব না। তবে কেন ওর সাথে মায়ায় জড়ানো?

আমাকে সে ওর পাশে বসতে বলল। আমি বসলাম। ওর শরীর থেকে খুব সুন্দর হাল্কা অচেনা পারফিউমের ঘ্রাণ পেলাম। ওকে আরো বেশী করে একজন নারী মনে হল। খুব কাছে পেতে ইচ্ছে হল। কিন্তু একটু আগের নিজের অনুভুতির কথা ভেবে এখনকার অনুভুতির গলা টিপে ধরলাম। সে আমার একটা হাত ধরল। কেঁপে উঠলাম আমি! আমাকে বলল,

– আর আমার মাথায় জগজিৎ বসে আছে। ভাবোতো রেইল লাইন ধরে হাঁটছি, খুব চেনা পথটি ধরে। আর জগজিৎ কানে কানে বলছে, ‘মুঝে তুম সে মোহাব্বাত হো গ্যায়ি হ্যায়.. ইয়ে দুনিয়া খুবসুরৎ হো গ্যায়ি হ্যায়.. উফ! কখন যে সন্ধ্যা হবে!
আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম। ভাবলাম কলি পাগল-টাগল হয়ে গেলো না তো! ওর হাত ধরা অবস্থায় ওর শরীরও তেমন গরম অনুভব করলাম না। নিশ্চিন্ত হলাম। সে ও মনে হয় আমার সাথে দুষ্টুমি করছে। বললাম,
‘সন্ধ্যা হলে কি তুমি খুশী হও?’
– হ্যা! কেন তুমি হও না?
‘নাহ, সন্ধ্যা হলেই আমার সেই মেসের জীবন শুরু হবে। তুমি তো তোমার বাসায় চলে যাবে। আমার একলা জীবন। একেবারে সেই পরেরদিন তোমার সাথে দেখা হবার আগ পর্যন্ত।’
– একলা জীবন মানে মেসের জীবন কি খুব কষ্টের?

আমি হাসলাম। কলি একটু বিব্রত হল। ওকে বললাম,
‘সন্ধ্যা নামতেই যখন চারিদিকে আঁধার হয়ে যাবে, আমার মেসের দরজা আমার জন্য উন্মুক্ত হবে। রাত আমার কাছে কোনো আনন্দই আনে না। কাঠের চৌকি আর অন্ধকারের স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে ছারপোকারা আমাকে কুরে কুরে খাবে। ইঁদুর দৌড়ে যাবে রাতের অন্ধকারে। আমি ওদের গাঁয়ের ঘ্রাণ পাবো। রুম মেটের নাক ডাকার শব্দে আমার বিনিদ্র রজনি কেটে যাবে।

দিনের বেলায় আবার আমি সেই সবার চির পরিচিত আমি। হাসবো.. হাসাবো.. কিন্তু কাঁদব একা একা! ভাবতে পারো? একজন মানুষ কতটা রূপ নিতে পারে? আমি আমার জীবনের বিভিন্ন ধাপে অনেকগুলো ফেইক আইডি বানিয়ে এক একজনের চরিত্রকে আমার নিজের ভিতরে ধারণ করতে চেয়েছিলাম। কখনো আমি নর, কখনো নারী- কিংবা বয়ষ্ক প্রেমিক পুরুষ অথবা নাবালিকা শিশু।

সব রুপেই আমি আমাকে চিনতে চেয়েছি। মানুষকে উপলব্ধি করতে চেয়েছি, কিন্তু বারে বারে ফিরে পেয়েছি এই আমাকে।

কলি আমার হাত ধরে বসে আছে। ওর দু’চোখ বেয়ে জল পড়ছে। ধীরে ধীরে সে আমার কাছে আসে! এতোটা কাছে যে আমাদের দু’জনের নাকে নাক লেগে যায়। জীবনে এই প্রথম সে আমার ঠোঁটে তাঁর ঠোঁট ছোঁয়ায়..আমি ও সাড়া দিতে বাধ্য হই। নিজেকে মনে হচ্ছিল একজন শিক্ষানবিস। যে তাঁর টিচারের কাছ থেকে ‘ডিপ কিস’ এর লেসন নিচ্ছে।

ভালোভাবে লেসন নেয়া হয়ে গেলে কলির চোখে চোখ রেখে বললাম,
‘তোমার কবিতার উত্তর নিশ্চয়ই পেয়ে গেছ?’
– কিভাবে?

বললাম, ‘আমাকে স্পর্শ কর, নিবিঢ় স্পর্শ কর নারী – এখানে তুমি প্রথমে আমার হাত ধরে ছিলে নিজের অজান্তে। সেটিই ছিল আমাকে স্পর্শ করা। একজন নারীর সাধারণ স্পর্শ। আর চোখের জ্বলে সিক্ত হয়ে পরবর্তীতে যে স্পর্শ করলে, সেটি ছিল আমার প্রতি প্রগাঢ় মমতায় তোমার স্বেচ্ছায় কাছে আসা। এই স্পর্শকেই কবি নিবিঢ় স্পর্শ বুঝিয়েছেন।’

-বাহ! এতো সুন্দর করে বুঝালে!
‘আমি কোথায় বুঝালাম? সবতো তুমি ই…’।

সন্ধ্যা নেমে এলো। বলাকাদের মতো আমরা দু’জনেও ফিরে যাচ্ছি.. যে যার ডেরায়। আমার এখন আর মেসের পরিবেশকে অসহনীয় মনে হচ্ছে না। ছারপোকা এবং ইঁদুরদেরকেও বড্ড আপন মনে হচ্ছে। মায়া লাগছে.. মায়ার এক অফুরন্ত জগতের ভিতর নিজেকে জড়িয়েছি যে!

#সন্ধ্যা_নেমে_এলো_মামুনের_ছোটগল্প

বৃক্ষছক

Screenshot

মা বুনেছিলেন লাউ গাছ। এক ছুটির দিনে বাবা বেঁধে দিলেন মাচা। মায়ের যত্নে গাছটা তরতরিয়ে বেড়ে উঠল। মাচার ওপরটা ভরে গেলো খসখসে সবুজ পাতায়। একদিন দেখা গেলো মাচার নিচে ঝুলছে নধর নধর লাউ।

মায়ের যত্ন আর থামেনা। গোড়ায় পানি দেন। সার দেন। মাটি নিড়ান। পাতায় পাতায় হাত বুলান। আদর যত্নে আহ্লাদী লাউগুলো বেড়ে ওঠে দ্রুত। মা লাউ দিয়ে শোল মাছ রান্না করেন। আমরা খাই। লাউ-ইলিশ রান্না করেন। আমরা খাই। লাউ চিংড়ি রান্না করেন, আমরা খাই। খুব ঘনঘন আমাদের ঘরে মাছ বা মাংস থাকে না, সেসব দিনগুলোতে মা লাউ দিয়ে ডাল রান্না করেন। আমরা খাই। আমাদের শরীর থেকে লাউয়ের ঘ্রাণ বের হয়। মাচায় লাউ হয়ে ঝুলছি, মা কাটতে আসছেন- মাঝে মাঝে এমন স্বপ্ন দেখে আঁতকে উঠি। সারারাত জেগে থাকি।

বাবার কাছে টাকা না থাকলে মা বিষন্ন মনে লাউ কেটে দেন। বাবা খুব সঙ্কোচে মায়ের গোপন দীর্ঘশ্বাস লাউ বিক্রি করতে বাজারে নিয়ে যান। যেতে যেতে সস্তা শার্টের রংচটা হাতায় চোখ মুছেন। মা আঁচলে মুখ ঢাকেন, কিছুক্ষণ স্থবির হয়ে থাকেন। বুকের ব্যথাটা যন্ত্রণা দিলে লাউ গাছের পাশে পিড়ি পেতে বসেন। বড় আপা মা’র মাথায় তেল দিয়ে দেয়, আমি পা টিপে দেই। ব্যাথা চেপে মা হাসেন। মলিন হাসি। মন খারাপ হয়।

বাবার সঙ্কোচ বাড়তে থাকে। মা গাছ লাগিয়ে যান। মা’র যত্নে তিনটে পেঁপে গাছ বেড়ে উঠেছে। পুইশাকে ভরে গেছে আরেকটা মাঁচা। কাকরোল গাছে অনেক কাকরোল ধরেছে। মা যে কি খুশি! এক একদিন লাউ বাদ দিয়ে মা পেঁপে রান্না করেন। এক একদিন পেঁপে বাদ দিয়ে পুঁইশাকের চচ্চরি করেন। এক একদিক সব বাদ দিয়ে কাকরোল ভাজেন। আমরা খাই। একদিন খাচ্ছি, এমন সময় রান্নার পাট চুকিয়ে, গাছের মায়া ছাড়িয়ে মা চলে গেলেন। মা খুব বেশী দূরে যান নাই। খুব কাছাকাছি আছেন। বাড়ির পেছনের পরিত্যক্ত জমিতে আমড়া গাছের নিচে তাকে রোপন করে দিলো সবাই।

আমি রোজ লুকিয়ে লুকিয়ে আমড়া গাছের নিচে যাই, উঁচু হয়ে থাকা মাটিতে সকাল বিকাল পানি দেই। হাত বুলাই। ওপরের মাটি নেড়ে চেড়ে দেই। ঝরে পড়া পাতা পরিস্কার করি। রোজ ভোরে গিয়ে দেখি- মা গাছের বীজ ফুটে পাতা বের হয়েছে কি না।

এলিয়েনের সঙ্গে এক বিকাল

28868

এখন পড়ন্ত বিকাল। ছাদের বাগানে একা একা বসে আছে আকিব। সে পুরাতন ঢাকার একটি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। ভালো ছাত্র হিসাবে তার সুখ্যাতি আছে। সবচেয়ে বড় কথা হল, আকিবের আই কিউ অনেক বেশি। ক্লাসে টিচার যখন পড়ান, তখন সে একটি শব্দ শোনার পর পরের শব্দটি বলে দিতে পারে। একটি বাক্য শোনার পর পরের বাক্যটি বলে দিতে পারে। এজন্য ক্লাসের সকল ছাত্রছাত্রী এবং টিচার সবাই তাকে খুব ভালোবাসে। খুব পছন্দ করে। তাকে নিয়ে গৌরব বোধ করে।

সেই আকিবের কাছে আজকের বিকালটা খুবই নীরস নীরস মনে হচ্ছে। প্রাণহীন লাগছে। বাসার আশেপাশে কোনো খেলার মাঠ নেই। একটু জোরে নিশ্বাস ফেলার মতোন জায়গা নাই। এমনকি রাস্তার ফুটপাত.. তাও নাই। রাস্তার মধ্যে কেবল খানাখন্দ আছে। গাদাগাদি রিকশা, ভ্যান, অটো আছে। ফলে আকিবের মতোন অনেক কোমলমতি শিশুদের আজকাল একই অবস্থা। তার উপর আকিবের স্কুলেও মাঠ নেই। ক্যাম্পাস নেই। বিল্ডিং এর উপর বিল্ডিং। এইরকম পরিবেশ তার ভালো লাগে না। ভালো লাগার কথাও নয়। সে প্রজাপতির মতোন উড়তে চায়। মেঘের মতোন এদিক-সেদিক ঘুরতে চায়। রাজহাঁসের মতোন সাঁতার কাটতে চায়। কিন্তু কিছুই আর হয়ে উঠে না। যে বিকেলগুলো রঙিন হওয়ার কথাছিল, সেই বিকেলগুলো ছাদের বাগানে কাটছে। কাটাতে হচ্ছে।

এমনি মানসিক অবস্থায় আকিব কী মনে করে আকাশের দিকে তাকাল। সাথে সাথে তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। তার ঠিক মাথার উপরে একটি উড়ন্ত সসার। দ্রুতবেগে তার দিকেই নেমে আসছে। আকিবের শরীরের সমস্ত লোম এক মুহুর্তেই দাঁড়িয়ে গেল। তার ভাবনার চেয়ে কম সময়ে উড়ন্ত সসারটি একেবারে তার ছাদের ঠিক উপরে চলে এলো। চোখের পলক পড়ার আগেই সসারটি থেকে একজন এলিয়েন বেরিয়ে আসলো। ভুতপ্রেতের মতোন এতো বিশাল আকারের নয়। আকিবের সমবয়সী হতে পারে। এলিয়েনটি সোজা আকিবের দিকে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। আকিবও ভয়ে ভয়ে হাত বাড়ালো। করমর্দন করতে করতে এলিয়েনটি বলল, হাই… আকিব, আমি ইকুচু। নেপচুন থেকে এসেছি। তুমি কেমন আছ?
আকিব বলল, আমি খুব ভালো আছি।

ইকুচু বলল, তুমি মিথ্যা কথা বলছো। তুমি মোটেই ভালো নেই। তোমার মন খুউব খারাপ। একা একা ছাদের বাগানে সময় কাটাতে তোমার ভালো লাগে না। আমি নেপচুন থেকে তোমার উপর দৃষ্টি রাখছিলাম। কারণ তুমি আমাদের গ্রহের বিজ্ঞানীদের পছন্দের তালিকায় আছো। তোমার আই কিউ অত্যন্ত বেশি। আচ্ছা আকিব, তোমাদের পৃথিবীতে কি মিথ্যা বলার ট্রেনিং সেন্টার আছে?

এমন অদ্ভুত প্রশ্ন শোনে আকিব খুব বিস্মিত হল। কিন্তু মুখে কিছু না বলে মাথা নেড়ে জানাল, নেই।

তাহলে তোমরা এতো সুন্দর করে ইনিয়েবিনিয়ে কীভাবে মিথ্যা বল? তোমরা কি জান না, মিথ্যা বলা মহাপাপ?

আকিব বলল, সব মানুষই এটা জানে। তবুও তারা মিথ্যা বলে। কারণ মিথ্যা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। আমিও এটা পছন্দ করি না। তবুও মাঝে মাঝে বলি। বলতে হয়।

ইকুচু বলল, মিথ্যা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি… এটিও একটি বড় মিথ্যা আকিব। যাক আসল কথা বলি, আমি একটি মিশনে এসেছি। তোমাকে আমাদের নেপচুন গ্রহে নিয়ে যাওয়ার মিশন। তুমি কি স্বেচ্ছায় যাবে নাকি জোর করে নিয়ে যেতে হবে?

আকিব এবার মনে মনে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো। কিন্তু মুখের মানচিত্রে ভয়-ডর কিছুই প্রকাশ করল না। বুদ্ধি খাটাতে লাগলো। হঠাৎ তার ষষ্ঠইন্দ্রিয় জেগে উঠল। আকিবকে কিছু নির্দেশনা দিলো। সে মোতাবেক আকিব বলল, তোমাদের গ্রহে তো মিথ্যার কোনো স্থান নেই। কিন্তু আমি এখনো মিথ্যা মুক্ত হতে পারিনি। তবে আমি চেষ্টা করছি। যদি আমি সে চেষ্টায় সফল হতে পারি, তাহলে আমার নেপচুন যেতে আপত্তি নেই।

এমন সময় ইকুচুর স্যুটের ভেতর ক্রিং ক্রিং আওয়াজ হল। আকিবও সেই আওয়াজ শুনতে পেল, কিন্তু কিছুই বোঝে উঠতে পারল না। ইকুচু বলল, হাইকমান্ড নির্দেশ দিয়েছে, তুমি এবার সঠিক বলেছ। আমরা তোমার মিথ্যা মুক্ত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করব। আমার হাতে আর সময় নেই। বাই আকিব…. বাই…

আকিবের বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি। তবুও ইকুচু’র দিকে হাত নেড়ে জানালো, বাই ইকুচু… বাই।।

জীবন যেখানে যেমন

বৃহস্পতিবার রাত এবং শুক্রবার সারাদিন মেস বন্ধ থাকে, যাদের সাথে মেসে খাই তাদের প্রায় সবার বাড়ি মোটামুটি কাছে হবার কারণে তারা সাপ্তাহিক ছুটি কাটাতে বাড়ি চলে যায় তারজন্যই মূলত মেস বন্ধ থাকে, আমার বাড়ি দূরে হবার কারণে যেতে পারিনা। সাধারণত এই সময়ের খাবারটা আমার হোটেলে খেতে হয়, শুরু থেকে ইচ্ছেটা এমন যে প্রতিবার নতুন নতুন হোটেলে খাবো এতে ঘুরাঘুরি হবে সাথে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদও পাবো।
.
প্রথম কয়েক সপ্তাহ এমনটাই করলাম কিন্তু এখন সেটা করিনা একটা ছেলের জন্য। মেস বন্ধ থাকলে এখন ওর ওখানেই যাওয়া হয়, আমি গেলে ওকে আর বলতে হয়না কখন কী খাবো। আর সম্ভবত ও আমার অপেক্ষা করে কারণ আজকে দুপুরে জিজ্ঞেস করলো “এত দেরি করলেন যে ?” আর আমাকে ও যতটা যত্নের সাথে খাওয়ায় আর কাউকে ততটা যত্নের সাথে খাওয়ায় কিনা জানিনা।
.
বিষয়টা পরিস্কারভাবে বোঝার জন্য একটু পিছনে যেতে হবে। সপ্তাহ দুই আগে ওই হোটেলে দুপুরে খাবার জন্য যাই, রীতিমতো খাওয়ার শেষের দিকে জিজ্ঞেস করলাম কোন পানীয় হবে কিনা ? একজন ওয়েটার বললো আমাদের এখানে নেই তবে বাইরে থেকে এনে দেয়া যাবে। যশোরে এতবেশী গরম যে দুপুরের দিকে ঠাণ্ডা পানীয় না খেলে চলেনা।
.
সে যাইহোক সর্দার টাইপের ওয়েটার একটা ছেলেকে ডেকে আমার জন্য পানীয় আনতে বললো। আমি ওয়ালেট থেকে টাকা বের করে ছেলেটাকে দিলাম, বড় নোট দিলাম যাতে সেটা ভাঙতিও হয়। ছেলেটার বয়স ৯-১০ বছর, এই বয়সের একটা ছেলে পড়াশোনা আর খেলাধুলায় মত্ত থাকার কথা অথচ ও এই হোটেলের সবথেকে কনিষ্ঠ ওয়েটার, ছেলেটা রোদের ভিতর বাইরে চলে গেলো। এদিকে প্রায় পাঁচ-সাত মিনিট পার হয়ে গেলো ছেলেটা আসছেনা, আমার খাওয়াও শেষ হয়ে গেলো।
.
যিনি তাকে বাইরে পাঠালেন তিনি এগিয়ে এসে বললেন হয়তো নোট খুচরা করতে পারেনি, আপনি ক্যাশে দিলেইতো খুচরা করতে পারতেন। আমি বললাম ওহ তাইতো আমার খেয়ালই ছিলোনা, মনে মনে ভাবলাম ছেলেটা কি চলে গেলো ? তারপর বললাম আমি তাহলে বাইরে যাই, পথেই নিয়ে নেবো ওর থেকে, আমার আবার একটু কাজ আছে। এই বলে বিল চুকিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম।
.
বের হয়ে একটু আগাতেই দেখি পাশের এক দোকানের বেঞ্চিতে বসে ছেলেটা কোলাকোলার বোতল ওর গালে, কপালে ঘাড়ে চেপে ধরতেছে। আমাকে দেখতেই হচকয়িয়ে গেলো, আমি জিজ্ঞেস করলাম দেরি করতেছো কেন ? ও কোন উত্তর দিলোনা, ওর থেকে বোতল আর টাকা বুঝে নিয়ে বললাম ঠিক আছে। আর মনে হলো হয়তো ওর কোক খেতে ইচ্ছে করতেছে তাই বললাম দাঁড়ায়ও আর আমি কিছুটা খেয়ে বাকিটা ওকে সাধলাম, ও বললো নিবেনা ওর জ্বর, ঠাণ্ডা খাওয়া যাবেনা। বললাম ওষুধ খাওনি ? মাথায় পানি দেওনি ? মাথা নেড়ে জানালো কিছুই করেনি।
.
কপালে হাত দিয়ে দেখলাম সত্যি সত্যি অনেক জ্বর, তখন বোঝলাম কেন কোকের ঠাণ্ডা বোতল ওইভাবে চাপতেছিলো। তারপর বললাম এই জ্বর নিয়ে তুমি কাজ করতেছো কেন ? মালিকরে বলে বাড়ি চলে যাও, ও বললো যেতে দিবেনা আর গেলে হাজিরা দিবেনা। তারপর ওর সাথে আরও কথা হলো, ওর বাবা বেঁচে নাই, ওর মা বাসায় কাজ করে, ও স্কুলে পড়েছে থ্রি পর্যন্ত আর ওর বাবা মারা যাবার পর থেকে এখানে আছে। জোর করে ওকে একটা নরমাল কোক আর নাপা এক্সট্রা কিনে দিলাম, ও নিবেইনা, কারণ হিসেবে বললো মালিক জানলে বকবেনি, আমি বললাম এখানে খেয়ে যাও কোন সমস্যা হবেনা। ছেলেটা দ্রুত কোক খেলো, আমার সামনে টেবলেট খেতে বললাম, তারপর টেবলেট খেলো আমি বললাম হোটেলে গিয়ে মাথায় পানি দিবা। ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসলো তারপর শরীরে জ্বর নিয়েই আবার হোটেলের দিকে চলে গেলো…
.
১০/০৬/২০২০

স্মৃতি লিখে রাখি

269a

— কি সেলাই করেন!
শীতের রাত, প্রায় সাড়ে ১১টা বাজে, জেলা সদরের নির্জন ফুটপাতে উদোম শরীরে বসা এক লোক, একপাশে মুচিদের ব্যবহার করার মত বাক্স, নিয়নের আলোয় স্যান্ডেল সদৃশ কিছু সেলাই করছিলেন। প্রশ্ন শুনে মাথা না তুলেই উত্তর দিলেন,
— নসীব।
এমন উত্তর আশা করিনি। বিস্ময় কাটিয়ে জানতে চাইলাম,
— কার নসিব!

এবার লোকটি মুখ তুলে তাকালেন। চেহারায় বয়সের ছাপ, পরিচর্যাহীন শাদা দাড়িগোঁফ, ভাঁজপূর্ণ ত্বক, কিন্তু নিয়নের আলোতেও তার চোখ অস্বাভাবিক উজ্জ্বল। একটু হেসে বললেন,
— কার নসিব সেলাই করি? আপনা নাসিব.. বাবা, আপনা নাসিব..

খেয়াল করলাম, তার উচ্চারিত ‘নসিব’ হঠাৎ করেই ‘নাসিব’ হয়ে গেছে। এসব ছোটো ছোটো পরিবর্তন সবসময়ই কৌতূহলী করে তোলে। তাকে বললাম,
— আপনার পাশে বসে একটু নাসিব সেলানো দেখি?

তিনি মাথা নিচু রেখেই উত্তর দিলেন,
— আপনার ইচ্ছা। আমার নাসিব সেলানো দেইখা কার কি লাভ!

তার পাশে বসলাম৷ প্রায় দশ মিনিট একটা স্যান্ডেলের সোল তিনি সুতো ছাড়া সেলাই করে গেলেন। সেলাই শেষ করে বক্সের ভিতর সোলটা রেখে আরেকটা সোল বের করে সেলাই শুরু করলেন। স্বভাব দোষে প্রশ্ন করলাম,
— এটা কার নাসিব!
— এটা নাসিব না রে বাবা, এটা জিন্দেগী
— কার জিন্দেগী?
— আপনা জিন্দেগী।
পাঁচ মিনিট জিন্দেগী সেলাই করে বক্সে রাখতে বললাম,
— আসেন, শীতের রাতে গরম গরম ভাত খাই।
— তিনি উঠে দাঁড়ালেন।

বড় হাসপাতাল, রেলস্টেশন, বাস আর লঞ্চ টারমিনাল সংলগ্ন কিছু হোটেল সারারাত খোলা থাকে। এমন এক হোটেলের উদ্দেশ্যে রিকশা নিলাম, তিনিও বসলেন। শীতে কাঁপছি, তিনি নির্বিকার। উনার খাওয়ার অর্ডার দিলাম, আমি ঘরে ফিরে খাবো। খাওয়া শেষে তাকে ভাড়া বাবদ কিছু টাকা সাধলাম, তিনি নিলেন না। ঠোঁটে শিশুর মত হাসি, বললেন,
— আলহামদুলিল্লাহ! টাকা দিয়া কি করবো! টাকা দিয়া নসিব আর জিন্দেগী সেলাই করা যায় না বাবা..

আর কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনি হাঁটতে শুরু করলেন, বয়সের তুলনায় দ্রুতই হাঁটছেন। অথবা যারা রাতে নির্জন পথে নিজের নসিব আর জিন্দেগী সেলাই করেন তারা হয়তো দ্রুতই হাঁটেন।

.
স্মৃতি লিখে রাখি| ২৫ডিসেম্বর (২৪ডিসেম্বর দিবাগত রাত)

জলে ভাসা পদ্ম আমি

246710

সামিয়া রেখার সেই স্কুল জীবন থেকে সব সুখ দু:খের অংশীদার। এবার সে বেশ অনেকদিন পর এসেছে।
ছুটির দিনের সকালটা নানা রকম রান্নায় ব্যস্ত থাকল রেখা। সামিয়া কাজে হাত লাগাল। দুপুর দুটোর মধ্যে টেবিল ভরে গেল নানান রং, সুগন্ধ আর স্বাদে। আজ মিনার মাহমুদ কোন এক সংবর্ধনায় গেছেন। বান্ধবীকে পেয়ে রেখা বাসায় থেকে গেছে।

দুপুরে খাওয়ার পর বিছানায় আধশোয়া হয়ে পাশাপাশি বসে অলস আলাপে মন দিলো দুই বান্ধবী।

গল্পের ফাঁকে ফাঁকে বান্ধবীর মুখের দিকে তাকাচ্ছিল সামিয়া। একটু দ্বিধা নিয়ে শেষে এক সময় বলল, ‘কয়েকদিন আগে এক মহিলা আমার কাছে এসেছিল একটা নতুন বাচ্চা নিয়ে। বাচ্চাটা ওর দরজায় কে যেন রেখে গেছে। ফুটফুটে মেয়েটা। একটু দুর্বল। চোখগুলি বড় বড়। অনেক পাপড়ি। ফর্সা। আমার কাছে আছে। সপ্তাহখানেক হল। আমার ছেলেরা ওকে পেয়ে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।’

রেখার মুখটা সাদাটে হয়ে গেল। চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ পর আস্তে বলল, ‘মিনার যদি কষ্ট পায়?’

সামিয়া বান্ধবীকে একটু সময় দিল। তারপর সমস্যার ভিতরটা দেখাল বান্ধবীকে।

‘এভাবে থাকলে খারাপ লাগাটা সারাক্ষণ থেকে যাবে। উনার স্বাস্থ্য দেখলাম অনেক খারাপ হয়ে গেছে। তোকেও দুর্বল দেখাচ্ছে। একবার ফেইস করে ফেল। নেহায়েত রিয়্যাক্ট করলে জোর করার কিছু নাই। আমার তো মেয়ে নাই। আমি রেখে দেব।’

সেই রাতটা রেখা ঘুমাতে পারল না। স্বামীকেও কিছু বলতে পারল না।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বিছানা ছাড়ার আগে স্বামীর মুখের দিকে তাকাল। জানালা দিয়ে আসা আলো ফ্লোরে পড়ে সারা ঘর আলো হয়ে আছে। মানুষটার ফর্সা মুখটা বাচ্চা ছেলের মুখের মত মায়াভরা। সে অপলক তাকিয়ে রইল।

নিষ্পাপ মুখটার চোখের নিচে কালি দেখে রেখার মনে আবেগ ভরা নদীর বান জাগাল। যে কোন অবস্থায় সে তার স্বামীর সাথে থাকতে চায়। তাকে সুখী দেখতে চায়। আর কাউকে সে তার মানুষের ভাগ দিতে পারবে না। কিছুতেই তাকে ফেলে যেতেও পারবে না। আর কারো সাথে জীবন কাটানোর চিন্তাও সে করতে পারে না।

এত বছরের সঙ্গী! পরম মমতায় দুই হাতে স্বামীর মুখটা বুকে নিয়ে বসে থাকে। সকালের আলোয় রেখার মুখ উজ্জ্বল। সে সিদ্ধান্ত নেয়, বাচ্চাটার কথা স্বামীকে বলবে। ঘুম ভেঙ্গে রেখার আদরটুকু লেখককে বিয়ের সেই প্রথম সময়টাতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়..।

নাশতার টেবিলে স্ত্রীর মুখে বাচ্চাটার কথা শুনে মিনার মাহমুদ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সকালটা মনে পড়ল। ব্যথা আর শান্তি একসাথে অনুভব করলেন।

মন দিয়ে অনুভব করলেন স্ত্রীর মনে সন্তান না পাওয়ার গভীর বেদনা। আবিষ্কার করলেন, সন্তানের জন্য প্রকৃতি তার স্ত্রীর মনে যে অফুরন্ত ভালোবাসা দিয়েছে তা অবলম্বন না পেয়ে লেখককেই আঁকড়ে লতিয়ে উঠেছে!

নতুন বাচ্চাটা এলে তার সেই আদর ভাগাভাগি হবে জেনেও তিনি সস্নেহে স্ত্রীর ইচ্ছায় সম্মতি দিলেন।
অলক্ষ্যে লতার মুখটা কি লেখকের মনে ভেসে উঠল? চিনচিনে একটা ব্যথা?

নাশতা শেষে লেখক ঘর থেকে বের হবার আগে স্ত্রীর মুখ ছুঁয়ে আদর করে হাসলেন, ‘নতুন মানুষ পেয়ে আমাকে ভুলে যাবে নাতো?’

দোয়েলের মন

: তারপর?
: তারপর দোয়েল পাখিটা উড়তে উড়তে চলে গেছে নীলপরীর দেশে। গিয়ে দেখে নীলপরী রানীর কাপড়ে নীল দিচ্ছে আর ফুলের সুবাস মাখাচ্ছে।
: তারপর?
: এদিকে হয়েছে কি লালপরীতো নীলপরীকে দাওয়াত দিয়েছে। কিন্তু পোলাও মাংস কোপ্তা কাবাব সর্ষে ইলিশ রান্না করবে কিভাবে! সব জিনিসের যা দাম!
: তারপর?
: তখন সাদা প্রজাপতি বলল, ‘শুটকি মাছের ঝাল ভর্তা বানাও, আলুর দম রান্না কর, আম ডাল হলে বেশ হয়, সাথে কাচা মরিচ আর পেয়াজ কুচি তো আছেই। রোজ রোজ মধু খেতে একটুও ভালো লাগে না।’
: তারপর?

: এই না শুনে রাজা বললেন -খাবে তো খাও বেগুন ভাজা আর কাঁচকলা। বেগুন ভাজার কথা শুনে রাণীমা মন খারাপ করলেন। উনার আবার বেগুনে এলার্জি। খুব চুলকানি হয়। কাঁচকলা খেতে হবে বলে রাজপুত্র কান্না শুরু করে দিল। কান্নার ভ্যা ভ্যা শব্দে মন্ত্রীর মুখের লেবেঞ্চুস ধপাস করে মাটিতে পরে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। তাই না দেখে সেনাপতি খুকখুক করে হেসে দিলেন।
: তারপর?
: রাজা বললেন, ‘তাই’তো বলি মন্ত্রীর দাঁতে পোকা কেনো! সেনাপতি, তুমি এক্ষুণি মন্ত্রীর দাতের পোকাগুলোর মাথা কেটে ফেল।’
: তারপর?
: সেনাপতি বলল -মন্ত্রীর মুখে গন্ধ। সামনেই যাওয়া যায় না। লেবেঞ্চুস খেয়ে তিনি দাঁত মাজেন না। তাই শুনে রাজা বললেন, ‘তবে আগে নিজের নাক কাটো। তারপর মন্ত্রীর মুখের পোকার মাথা কাটতে হবেই হবে।’
: তারপর?
: দোয়েল বলল, ‘সবাই দেখি নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। টোনা আর টুনি মজা করে পিঠা খাচ্ছে। রাজপুত্র রাজকন্যাকে বিয়ে করবে বলে দৈত্য মারতে যাচ্ছে। রাজা আর তার লোকেরা কাটাকাটি করছে, রাজ্যের প্রজাদের লুটপুটে খাচ্ছে, অত্যাচার করছে। দুয়োরাণী বিউটি পারলারে ফেসিয়াল করছে, সুয়োরানী হার্বাল উপটান মাখছে। বাঘের গলায় হাড় ফুঁটলে বক তা বের করে দিচ্ছে। কিন্তু আমার যে বেশী করে কিশমিশ দেয়া পায়েস খেতে খুব ইচ্ছে করছে সেটা নিয়ে কারো একটুও চিন্তা নেই। আমি কি তোমাদের কেউ নই! আমি কি তোমাদের কিছুই হই না!’
: তারপর?

: এদিকে ছাতা হারিয়ে ব্যাংয়ের মন ভালো নেই। বৃষ্টিতে ভিজে সর্দি লেগেছে। দোয়েলের কথা শুনে সে বলল, ‘ তেপান্তরের মাঠ পেরুলে দুধের সাগর। সেই সাগর পেরুলে মাখনের পাহাড়। নরম নরম মাখনের পাহাড় পার হলে তবেই রূপকথার দেশ। সে রূপকথার দেশেই পোলাও পাওয়া যায়, কোর্মা কোপ্তা পাওয়া যায়, ইলিশ ভাজা আর রুই মাছ ভুনা পাওয়া যায়। পায়েস পাওয়া যায়। ব্যাংয়ের হারানো সিল্কের ছাতাও পাওয়া যায়, ব্যাংয়ের সর্দির ওষুধও পাওয়া যায়।’
: তারপর?
: দোয়েল বলল – আমি যাব রূপকথার দেশে। পায়েস খাবো। লালপরী নীলপরীর জন্য পোলাও কোর্মা আনবো, ব্যাংয়ের জন্য সিল্কের ছাতা আর সর্দির ওষুধও আনবো।
: তারপর?

: জলদস্যু বলে ‘তবে এই নাও রূপকথার দেশে যাবার মানচিত্র, কাঠের জাহাজ আর দূরবীন।’ দোয়েল পাখি মানচিত্র খুলে দূরবীনে চোখ লাগাতেই আম্মু ডাকতে শুরু করেন, বলেন ‘তাড়াতাড়ি উঠো। সেই কখন সকাল হয়েছে। কাজে যেতে হবে। উঠো.., উঠো..।’
: তারপর?
: তারপর দোয়েল পাখিটা সকাল সকাল কাজে যায়। হোটেল ঝাড়ু দেয়, বেঞ্চ আর টেবিলগুলো মুছে। জগে পানি ভরে। নাস্তা করতে আসা লোকগুলোর টেবিলে টেবিলে পরোটা আর সাথে ভাজি, হালুয়া বা ডিম ভাজা দেয়।
: তারপর?
: আম্মুর মত এই লোকগুলোও বুঝতে পারে না দোয়েলের মন প্রতিটা মুহূর্তে রূপকথার দেশে যাবার জন্য ভীষণ ছটফট করে। টেবিলে বিছানো প্লাস্টিকের কভারকে তার মনে হয় রূপকথার দেশে যাবার মানচিত্র, বেঞ্চকে জাহাজ আর গ্লাসগুলোকে দূরবীন।

মুচির ছেলে গৌরাঙ্গ আমাদের_বন্ধু

গৌরাঙ্গ আমাদের বন্ধু, বাপ, দাদার আদি পেশা জুতা সেলাই; অর্থাৎ তারা মুচি। তার বাবা কাকারা চৌমুহনার মোড়ে ঝুপড়ি ঘরে বসে জুতা সেলাই করে।

মুচির ছেলের সাথে বন্ধুত্ব তখনকার সমাজ ব্যবস্থায় সম্ভব ছিল না, এখনো সম্ভব নয়; তবুও বন্ধুত্ব হয়ে গেল। অবশ্য হওয়ার বিবিধ কারণ ছিল।

প্রধান কারণ হচ্ছে গৌরাঙ্গ ছিল দরাজ দিল, বন্ধুদের জন্য খরচ করতে কৃপণতা দেখাতো না। আমরা সপ্তাহে পাঁচ শিকা খরচ করতে পারতাম না, সে অনায়াসে পাঁচ সাত টাকা খরচ করে ফেলত। অন্য কারণের মধ্যে ছিল সে ভালো গান গাইতো, ভালো ছবি আঁকতো। পদ্য লেখায় তার বেশ মুন্সিয়ানা ছিল।

সে ছিল তার ঠাকুরদার আদরের নাতি। তাদের পরিবারের কেউ জীবনে স্কুলে যায়নি। জন্ম থেকেই তাদের জুতা পাঠ শেখানো হয়, অক্ষর পাঠ তাদের জন্য বিলাসিতা। গৌরাঙ্গের ঠাকুরদা দেখলেন এই ছেলের জুতা পাঠে মন নেই, জুতা সেলাই করতে দিলে এই ছেলে সুঁই দিয়ে মাটিতে ছবি আঁকতে লেগে যায়। জুতা সেলাইয়ের চেয়ে গানে মনোযোগ বেশি, মুখে মুখে বেশ ভাল পদ্য বানাতে পারে।

ঠাকুরদা নাতির প্রতিভায় মুগ্ধ। ভাবলেন একে স্কুলে পড়াতে পারলে নিশ্চয় বংশের গৌরব হবে। চাই কি কালে কালে জজ ব্যারিস্টার হয়ে যেতে পারে। একদিন সন্ধ্যায় তিনি ঘোষণা করলেন নাতীকে তিনি স্কুলে পাঠাবেন; তাঁর এই অদ্ভুত ঘোষণায় গৌরাঙ্গের বাবা, কাকারা অবাক হল। স্কুল কেন আরেকটু বড় হলে তো পুরোদস্তুর রোজগারে লেগে যেতে পারবে। কিন্তু বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু বলার সাহস তারা করল না।

স্কুলে ভর্তি হবে বললেই তো আর হলো না, মুচির ছেলে অন্ত্যজ জাত; অভিজাত যারা তারা নিশ্চয়ই চাইবে না মুচির ছেলে তাদের ছেলেদের সাথে পড়ুক। নাতিকে স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে গৌতমের ঠাকুরদা অনেক ঝামেলায় পড়লেন।

অনেক স্কুলে সিট নাই অজুহাতে ফিরিয়ে দেওয়া হল কিন্তু হাল ছাড়লেন না গৌরাঙ্গের ঠাকুরদা। আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক মুক্তিযোদ্ধা, দেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে। সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হবে এসময় জাতপাত, উঁচু-নিচু চিন্তা করে আর বিভাজন বাড়ানো যাবে না। গৌরাঙ্গকে তিনি সাদরে গ্রহণ করলেন। গৌরাঙ্গ তৃতীয় শ্রেণীতে আমাদের সহপাঠী হয়ে গেল। আমাদের কোনো কোনো অভিভাবক গাঁইগুঁই করেছিলেন বটে কিন্তু প্রধান শিক্ষকের প্রতাপের কাছে পরাস্থ হতে হল।

প্রধান শিক্ষক তাকে সাদরে গ্রহণ করলেন ঠিক, আমরা করলাম না। জুতা সেলাই এর ছেলেকে বন্ধু ভাবতে কোথায় যেন দ্বিধা থেকে গেল। অথচ আমাদের কারোরই বয়স দশ হয়নি।

সমাজ বাস্তবতা কাউকে শিখিয়ে দিতে হয় না, বোধে এমনিতেই এসে যায়। জুতা সেলাই যে অতি নিম্নমানের কাজ, মুচিরা যে অতি নিম্ন জাত দশ বছর হওয়ার আগেই এসব জেনে গেছি।

গৌরাঙ্গের সাথে কেউ মিশে না, পাশে বসে না, সে একেবারে পেছনের বেঞ্চে একা বসে থাকে। কিছুদিন পরে দেখা গেল তার হাতে অফুরন্ত টাকা। আমরা চার আনার বাদাম কিনতে পারি না, সে দিব্যি এক টাকার বাদাম কিনে ফেলে। বাদামের লোভে আমরা তার পাশে ভিড়লাম, সে আমাদের নিরাশ করল না; ভাগ দিতে শুরু করল। ক্রমে সে আমাদের বন্ধু, আমাদের একজন হয়ে গেল।

গৌরাঙ্গের ঠাকুরদা বেশ মালদার ছিলেন, তিন পুত্রের রোজগারে তাঁর দিন ভালই কাটছিল। আদরের নাতির পকেট খরচের জন্য প্রতি সপ্তাহে দশ টাকা বরাদ্দ রেখেছিলেন। প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে তাদের বাড়িতে চোলাই বাংলা মদের আসর বসতো। ঠাকুরদা, বাবা, কাকারা একসাথে বসে মদ্যপান করত, কখনো কখনো মা, কাকীরাও সঙ্গ দিতে হাজির থাকতো। মদের আসরে বাচ্চাদের হাজির হওয়ার কোন বিধি-নিষেধ না থাকলেও গৌরাঙ্গের ঠাকুরদা তাকে কাছে ভিড়তে দিতেন না। মদ্যপান কিংবা বিড়ি-সিগারেট থেকে দশ হাত দূরে রাখতেন।

অচিরেই গৌরাঙ্গের অন্যান্য প্রতিভা আমাদের সামনে প্রকাশ হতে থাকল। গান, আঁকা, পদ্য লেখায় সে অনন্য ছিল। আন্তস্কুল বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সে স্কুলের জন্য সুনাম কুড়াতে লাগল। আমরা তার বন্ধু থেকে ভক্ত, গুণমুগ্ধে পরিণত হলাম। নেতৃত্ব দেওয়ার একটা সহজাত গুণ তার ছিল; একদিন লক্ষ করলাম সে আমাদের দলপতি হয়ে সামনে হাঁটছে, পিছন পিছন আমরা তাকে অনুসরণ করছি।

নবম শ্রেণী পর্যন্ত গৌরাঙ্গ আমাদের বন্ধু ছিল, দলপতি ছিল কিন্তু এর পরে তার প্রতি আমাদের মোহ ভঙ্গ হল। সে যে অন্ত্যজ শ্রেণী প্রমাণ রাখল। তার ঠাকুরদা কিংবা বাবা-কাকারা আদতে যে মুচি কোন সন্দেহ থাকল না।
রিতা রায়ের বাবা প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট। রীতা রায় সুন্দরী, স্মার্ট সে আমাদের প্রেমিকা। আমাদের প্রত্যেকের মনে রীতা রায় থাকে। এই রীতা রায় কে প্রেমের আহ্বান জানালো মুচির ছেলে গৌরাঙ্গ। রীতা রায় অবাক হলো ঠিকই কিন্তু উত্তেজিত হলো না কিম্বা রাগ করল না, শুধু গৌরাঙ্গ কে ডেকে বলল ‘এ হবার নয়’।

রীতা রায় রাগ করেনি কিন্তু আমরা ক্রোধে ফেটে পড়লাম, মুচির ছেলের এত সাহস রীতা রায় কে প্রেমপত্র লিখে। রীতা রায় কে প্রেমপত্র লেখার অধিকার একমাত্র আমাদের। মুচির ছেলের স্পর্ধার একটা হেস্তনেস্ত অবশ্যই হতে হবে। নিমিষেই ভুলে গেলাম সে আমাদের বন্ধু, গত কয়েক বছরে হাজার টাকার বাদাম সে আমাদের খাইয়েছে। ভুলে গেলাম আমরা তাকে দলপতি মেনে অনেক অসম্ভব কে জয় করেছি।

ইতোমধ্যে দেশে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে, সবকিছু নতুন করে শুরু করার স্বপ্ন নিয়ে যে মুক্তিযোদ্ধা প্রধান শিক্ষক স্কুলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি অবসরে চলে গেছে। যে স্বপ্নবান পুরুষ স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে জাতিকে একটা দেশ উপহার দিয়েছিলেন তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশে একদিন সূর্যোদয় হয়েছিল এখন স্থায়ী অমাবস্যা আসন গেড়েছে। আশা জাগানিয়া শুরু দুঃস্বপ্নে রূপান্তরিত হয়ে গেছে।

আমাদের শহরের সবচেয়ে দুষ্টগ্রহ, মুক্তিযুদ্ধ চলা কালে যে পাকিস্তানের লেজুড় ছিল সে এখন স্কুলের দায়িত্বে। ম্যাজিস্ট্রেটের মেয়েকে প্রেমপত্র লেখার দায়ে গৌরাঙ্গের বাবা-কাকারা জেলে। রাজাকার প্রধান শিক্ষক গৌরাঙ্গের ঠাকুরদাকে আসতে বলেছে। মুচির বাচ্চাদের পায়ের নিচে থেতলে দিতে হবে।

গৌরাঙ্গকে সাথে নিয়ে ঠাকুরদা এলে প্রধান শিক্ষকের কথায় রীতা রায় স্কুলের বারান্দায় থুতু ফেলেছে। গৌরাঙ্গ এবং তার ঠাকুরদা রীতা রায়ের থুতু চেটে খেয়েছে। মুচির বাচ্চার জন্য স্কুলের বারান্দা চিরদিনের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেটের গুস্সা প্রশমিত হওয়ায় বাবা চাচারা শেষ পর্যন্ত ছাড়া পেয়েছে।

গৌরাঙ্গ তার বংশের জন্য সুনাম কুড়াতে পারেনি। সে এখন চৌমুহনার ঝুপড়ি ঘরে একমনে জুতা সেলাই করে। আমরা কখনও কখনও তার ঝুপড়ি ঘরে হাজির হই, জুতা পালিশ করতে সে কসুর করে না।

(সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে)

মামুনের অণুগল্পঃ নষ্ট কষ্ট

28456a

নিউমার্কেটের চারটি প্রবেশদ্বার। পূর্বপাশের পার্কিং এরিয়ায় বসা অবস্থায়ই বাইক স্ট্যান্ড করায় শিহাব। চাবি খুলে নিয়ে ঘাড় লক করে। নামে না, আকাশের দিকে তাকায় একপলক। গুমোট হয়ে আছে। ঘোমটার আড়ালে মেঘবালিকাদের ভ্রু কুঁচকে আছে, স্পষ্ট অনুভব করে।

স্মরণকালের ভয়াবহ তাপদাহ। ঝুলফির দু’পাশ দিয়ে ঘামের ধারা বয়ে চলেছে। বুক ভেসে যাচ্ছে। ভেজা অস্বস্তিকর অনুভব। উফফ! যদি একটু বৃষ্টি হতো।

আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে দু’হাত উঁচু করে ইশ্বরের কাছে অভিযোগ জানাতে উদ্যত হতেই, আচমকা ফ্রিজ হয়ে যায় সে।

হ্যা!
পারু!
পারুই তো!
একটি তুলতুলে বাবু পারুর হাত ধরে নিউ মার্কেটের গেট দিয়ে বের হয়ে আসছে। এখনো দেখতে একই রকম আছে ও!

কোথায়ও কি কিছু পুড়ছে?
গন্ধ পায় শিহাব। মুহুর্তে আঠারো বসন্ত পিছনে গিয়ে, সেই পারু দৃষ্টিগোচর হয়। অনুভবে.. কল্লনায়!

শিহাবের হৃদয় একটু কি জ্বলে ওঠে? অদৃশ্য পর্দা ভেদ করে আবার সেই মেয়েটির উপস্থিতিতে একটু কি বেসামাল হয়?

ভাবনার অবসরে ওরা কেউ কাউকে দেখতে পায় না। ইজি বাইকে পারু মেয়েকে নিয়ে হারিয়ে যায়। মোড়ের ওপাশের তিন রাস্তার যে কোনো একটি দিয়ে ভিড়ের মাঝে গন্তব্য খুঁজে নেয় পারুকে বহন করা যান্ত্রিক বাহনটি।

আবারো হারালো পারু?

এমন ভাবনা আসায় সম্বিৎ ফিরতেই
ডান পায়ের জোরালো কিক স্টার্টারে। পারুকে অবচেতনে নিয়ে, গলির মোড়ের দিকে ধাবমান শিহাব। রাস্তা জুড়ে চলে যাওয়া পারুর শরীরের ঘ্রাণ অনুভব করতে চেষ্টা করে সে। সেই আগের মতো- ঠিক যেভাবে পারুর হেঁটে চলা রাস্তা ধরে ধরে.. আরও পরে পারুর বুকের উপত্যকায় নিজেকে ডুবিয়ে ভালোবাসার ঘ্রাণ পাওয়ার জন্য যেভাবে .. ঠিক আঠারো বছর আগে যেভাবে.. আজও সেভাবেই!

মোড়ে এসে আবারো থেমে যায় শিহাব। কেন জানি হারানো মেয়েটির শরীরের সেই হারানো সুরে একটুও উদ্দীপ্ত হয়না। অনুভব করে, পুরো রাস্তা জুড়ে এখন কেবলি শিহাবের বউয়ের ঘ্রাণ! শিহাবের অনুভবের গভীরতর প্রদেশ এখন কেবলি বউময়।

শিহাবের শরীর জুড়েও এখন কেবল বউয়েরই ঘ্রাণ! বাইক ঘুরিয়ে ফিরে চলে সে। বউ অপেক্ষা করছে। হাসে নিজের মনে শিহাব।

হ্যা!
শিহাবের জীবন এখন কেবল বউময়!
থাকুক হারোনো মেয়েটি তার নিজের মতো যা সে চেয়েছিলো।

তারপরও.. শিহাবের কি একটু একটু কষ্ট হয়?

#মামুনের_অণুগল্প

কান্না সুখের যতিচিহ্ণ

Scre

দুই বান্ধবী। দুজনেই বড়লোকের বেটি। একজনের নাম ঝর্ণা, আরেকজনের নাম বর্ণা। নামের মিল থাকার কারণে হাইস্কুল থেকেই দু’জনের বন্ধুত্বের বন্ধন শুরু। দুজন একইসাথে হাইস্কুল শেষ করে একই কলেজে ভর্তি হয়। লেখাপড়ার জীবনে আনন্দের সময়ই নাকি কলেজ জীবন। এই সময়টা খুবই ভাবনা চিন্তার সময়ও বটে। কারণ এই সময়টাতেই যার যার ভাগ্য নির্ধারণ করতে হয়। কে কী হবে! কে কোনটা নিয়ে পড়বে! কে ডাক্তার হবে আর কে ইঞ্জিনিয়ার হবে, এসব নিয়েই থাকে বেশি চিন্তায়!
আবার ধনীর ছেলে-মেয়েদের মধ্যে কেউ কেউ ওইসব চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে ভাবে অন্যটা। যেমন– কাকে ভালোবাসবে। কাকে ভালোবাসলে জীবনে বেশি সুখশান্তি ভোগ করা যাবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।

তো ঝর্ণা আর বর্ণা তারা দুজনেই ছিলো ধনীর দুলারি। কাজেই তাদের চিন্তা-ভাবনাও কোন ধরনের ছেলেকে বিয়ে করলে সারাজীবন সুখে-শান্তিতে থাকতে পারবে। দুই বান্ধবীর মধ্যে ঝর্ণা একটু অহংকারী, আর বর্ণা বড়লোকের মেয়ে হলেও ও ছিলো খুবই বিনয়ী ও শান্ত! এই দুই বান্ধবী প্রায় দিনই কলেজের ক্লাস শেষে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়েই আলাপচারিতায় মেতে ওঠে।

একদিন কলেজ চলাকালীন সময়ে দুপুরের টিফিনের সময় ঘনিয়ে এলো। টিফিনের সময় সবাই বের হয়ে যার যার মতো খাবার খেতে চলে গেলো। ঝর্ণা ও বর্ণা টিফিন করার এক ফাঁকে শুরু হয় তাদের ভবিষ্যৎ ভাবনার আলাপ।
ঝর্ণা–কিরে লেখাপড়া শেষ করার পর তুই কেমন ছেলেকে বিয়ে করবি?
বর্ণা–তুই আগে বল, কেমন ছেলেকে বিয়ে করবি?
ঝর্ণা–আমি? আমি একজন হ্যান্ডসাম সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ইঞ্জিনিয়ার অথবা বড় ব্যবসায়ী ছেলেকে বিয়ে করবো। যাতে সারাটা জীবন সুখে-শান্তিতে সংসার করে যেতে পারি। আমার সংসারে চাকরবাকর থাকবে। নিজস্ব বাড়ি থাকবে। গাড়িও থাকতে হবে। এবার বল তুই কেমন ছেলেকে বিয়ে করবি?’
বর্ণা–আমার বাড়ি-গাড়ির প্রতি লোভ লালসা নেই। শুধু একজন মনের মত মানুষ হলেই হবে।
ঝর্ণা–বলিস কি? টাকা-পয়সা ছাড়া শুধু মন দিয়ে কী করবি?
বর্ণা–আরে শোন, আমি যেই ছেলেকে বিয়ে করবো ওর মন আর আমার মন একসাথে বেঁধে মিলেমিশে সংসার করবো। টাকা-পয়সা যদি হয় হবে। নাহয় তো নেই। মনের মানুষ তো সবসময় কাছে থাকবে! তাতেই আমি খুশি থাকবো।
–আচ্ছা, যাদের টাকা-পয়সা প্রচুর আছে, তাদের কি মন নেই?
–অনেক আছে। আবার অনেকেরই থাকে না। তো যাদের মন থাকে না, তাদের থাকে ধনসম্পদ আর অর্থবিত্তের প্রতি খুবই নেশা। সেই নেশায় আসক্ত হয়ে তারা সময়তে নিজের স্ত্রী সন্তানকেও দূরে ফেলে দেয়। এমনকি নিজের জন্মদাতা পিতা গর্ভধারিণী মাকেও দূরে রাখে। আবার কেউ কেউ তো মা বাবার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বৃদ্ধাশ্রমেই রাখে। আমি বাবা এমনটা চাই না। আমি একটা গরিব মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে চাই। আর এরকম একটা ছেলে আমি নিজেই পছন্দ করে রেখেছি। সময় হলে তোকে বলবো।
–ওহ্ আচ্ছা, তা বল! কে তোর মনের মানুষটি? আমি কি তাকে চিনবো? বল না!
–হ্যাঁ, অবশ্যই চিনবি! ও-ই যে, সেদিন যে ছেলেটার সাথে আমি কথা বললাম, সেই ছেলেটা।
–আরে, ও-ই লোকটা তো নেহাৎ গরিব! কিছুদিন আগে ওর বেতন মওকুফ করার জন্য প্রিন্সিপালের কাছে আবেদনপত্র জমা দিয়েছিল। সেটা কি তুই জানিস?
–জানি! আরও জানি, ওর বেতন মওকুফের আবেদন পত্রটি মঞ্জুর হয়নি। তবে বেতন পরিশোধ ঠিকই হয়েছে।
–তা কীভাবে? আমি নিজেই দিয়েছি, ওর বকেয়া বেতনের টাকা। সেই টাকা দিয়েই ও বকেয়া বেতন পরিশোধ করেছে।
–তুই কিন্তু ভুল করছিস! ভুল করছিস এই কারণে যে, তুই একজন বিত্তশালীর মেয়ে। তোর বাবার অঢেল সম্পত্তি। শহরে নিজেদের ব্যবসা। গাড়ি আছে। তোর বাবার ব্যাংক ভর্তি টাকাও আছে। ও-ই ছেলেটার কী আছে?
–ও-ই ছেলেটার একটা সুন্দর মন আছে। এমন সুন্দর মন আর দশজনেরও নেই।
–আচ্ছা, নিজেদের তো একটা বাড়িও থাকা চা-ই-ই। সেটা কি আছে?
–আছে। তবে ওদের বাড়িঘরে কোনও সময় যাওয়া হয়নি আমার। তো তাও না থাকুক, সমস্যা নেই। একসময় হয়তো হয়েও যেতে পারে। তাতেও কোনও সন্দেহ নেই। কারণ আমিও শিক্ষিত। ছেলেটা গরিব হলেও শিক্ষিত। বিয়ের পর ভেবেচিন্তে একটাকিছু করা যাবে।
–নিজের ঘরদোর না থাকলে থাকবি কই?
–ছেলেটার মনটাই একটা বিশাল বাড়ি। আর সেই বাড়ির ঘরগুলো হলো ছেলেটার মনের ভেতরে থাকা মনিকোঠা। সেই কোঠাতেই দুজন খুব সুন্দরভাবে থাকতে পারবো। তাছাড়া আমার বাবার তো আছে। আমার বাবা কি আমাদের জন্য কিছুই করবে না।
–মনে কর যদি না-ই-বা করলো?
–তাতেও সমস্যা নেই। ও যদি একটা চাকরি করে, তাহলে আর সমস্যা কোথায়, বল? আর আমিতো শিক্ষিত। আমিও কি বসে থাকবো? দুজনের ভালোবাসা আর দুজনের দুই মন একসাথে বেঁধে নিজেদের ঘর বাঁধার কাজে গেলে যাবো। তার জন্য তুই আমার জন্য চিন্তা করবি না। আমি দোয়া করি তুই তোর স্বামীর সংসারে সবসময় সুখে থাকিস।
এই বলেই সেদিনের মতো দুই বান্ধবীর আলাপচারিতা শেষ করে যার যার গন্তব্যে চলে যায়।

একসময় ঝর্ণার বিয়ে হয় এক আমেরিকা প্রবাসী ছেলের সাথে। ঝর্ণার বিয়ের দাওয়াত বর্ণা পেয়েছিল। বিয়ের দিন বর্ণা একটা উপহারের বাক্স হাতে নিয়ে ঝর্ণার বিয়ের দাওয়াতে যায়। খাওয়া-দাওয়ার পর বর্ণা ঝর্ণার সাথে দেখা করতে গেলে, ঝর্ণা হাসিমুখে বর্ণাকে কাছে ডাকে। বর্ণা ঝর্ণার কাছে গিয়ে এতোদিনের বন্ধুত্বের শেষ হাসি বিনিময় করে পাশে বসে।

ঝর্ণা বর্ণার কাঁধে হাত রেখে বললো, ‘আমিতো এখানে বেশিদিন থাকছি না। বরের সাথেই আমেরিকা চলে যাবো। তোর সাথে তো আর শীঘ্রই যোগাযোগ হবে না। কিন্তু আমার মন, ভালোবাসা সবসময়ই তোর সাথে থাকবে। আর হ্যাঁ, যদি পারিস, তাহলে তোর ভবিষ্যৎ বিয়ের ভাবনাটা পরিবর্তন করে, ভালো ব্যবসায়ী অথবা ভালো একজন প্রবাসী ছেলের দিকে দৃষ্টি দিবি। গাঁও গেরামের ছেলে-পুলেরা তোর মতন মেয়ের মনের ইচ্ছা পূরণ করতে পারবে না, তা আমি শতভাগ নিশ্চিত! তো আর কিছুই আমার বলার নেই, আমার কথাগুলো সময়মতো ভেবে দেখবি’।

ঝর্ণার কথাগুলো বর্ণা শুধু শুনেই গেল, প্রত্যুত্তর কিছুই দেয়নি। শুধু ঘাড় কাত করে হ্যা ভাব প্রকাশ করলো। এরপর ঝর্ণাদের বাড়ি থেকে নিজের বাড়ি ফিরে এলো।

এদিকে বর্ণা বিএ পাস করে বাপের ঘরে। আর বর্ণার সেই মনের মানিক ছেলেটিও একই সময়ে বিএ পাস করে, লেখাপড়ার ইতি টানে। বিএ ফাইনাল পরীক্ষা শেষে ছেলেটা নিজেদের গ্রামের বাড়িতে চলে যায়। ছেলেটার গ্রামের বাড়িতে মা-বাবা আছে, কিন্তু বসতভিটা ছাড়া আর কোনও জায়গাজমি বর্তমানে নেই। যা ছিলো, তা বাড়ির মুরুব্বি একমাত্র ছেলের লেখাপড়ার খরচ চালাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পরের জমিতে দিন মজুরের খেটে খায়। তবুও ছেলেটার বাবার মনে কোনও দুঃখ নেই, আছে শুধু আশা! আশা হলো, ছেলেটা যদি ভালো একটা চাকরিবাকরি পায়, তাহলে জীবনের কষ্ট স্বার্থক হবে। এই আশা নিয়েই একমাত্র ছেলের মুখপানে চেয়ে আছে।

ছেলেটা বাড়ি গিয়ে বাবার এতো কষ্ট দেখে আর ভালো লাগছিল না। দুই-তিনদিন বাড়িতে থেকে আবার সে তার আগের গন্তব্যে পৌঁছে। গন্তব্য ছিলো কলেজের পাশে থাকা এক বাড়ির ব্যাচেলর বাসা। একটা ব্যাচেলর বাসায় তিন-চারজন মিলে থাকতো। খাওয়া-দাওয়া হতো মেসে। শহরে এসে ছেলেটা একটা চাকরির জন্য এখানে সেখানে আবেদন করার পাশাপাশি কলেজ বান্ধবী বর্ণার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে। এভাবে ক’দিন যেতে-না-যেতেই ভালো একটা রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানে ভালো বেতনে ছেলেটা চাকরি পেয়ে যায়। চাকরিটা ব্যাচেলর বাসায় আর মেসে খেয়ে ছেলেটা যখন মনোযোগ সহকারে করতে ছিলো, কলেজ পড়ুয়া বর্ণা নামের মেয়েটির আকুতি-মিনতি শুরু হয়।

বর্ণার আকুতি আর মিনতির কারণও ছিলো। কারণ হলো, বর্ণার বাবা। বর্ণার বাবা মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগে যায়। এই ঘটক, সেই ঘটক, এই পাত্র, সেই পাত্র করতে করতে একরকম মাথা নষ্টের পালা। যত পাত্রই দেখাক, বর্ণার প্রাত্র পছন্দ হয় না। বর্ণার মনের এরকম ভাব দেখে বর্ণার বাবা জিজ্ঞেস করে কোথাও কারো মন দিয়েছে কিনা! প্রত্যুত্তরে বর্ণা তার পছন্দের কথা জানালে, বর্ণার বাবা একরকম ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। বাবার এরকম অবস্থা দেখেই বর্ণা ছেলেটাকে তাড়াতাড়ি বিয়ে করার জন্য চাপ সৃষ্টি করে।

কিন্তু ছেলেটা একরকম নিরুপায়! নতুন চাকরি। বাড়িতে বাবার ঋণের টাকা। তার উপর আবার বাড়িতে ভালো ঘরদোর নেই। এমতাবস্থায় যদি ছেলেটা মা-বাবার অনুমতি ছাড়া বিয়ে করে নতুন বউ নিয়ে বাড়িতে ওঠে, তাহলে মা-বাবার মনে যদি কষ্ট পায়? ছেলেটা এরকম মনোভাব বর্ণাকে জানালে, বর্ণা বলে, ‘আমিই সবকিছু ম্যানেজ করে নিবো, তাতে কোনও সমস্যা হবে না। বর্ণার মুখে একথা শুনে ছেলেটা মা-বাবাকে না জানিয়ে একদিন কোর্ট ম্যারেজ করে ফেলে।

কোর্ট ম্যারেজ করে বর্ণাকে নিয়ে সোজা নিজের বাড়িতে চলে যায়। ছেলের সাথে এক যুবতী মেয়ে দেখে ছেলেটার মা-বাবা কাঁদতে শুরু করে। তখন ছেলেটার আগেই নতুন বধু বর্ণা নতুন শ্বশুর-শ্বাশুড়ির পায়ে ধরে ক্ষমা প্রার্থনা করে। এতে ছেলেটার মা-বাবার মনটা অনেক হালকা হয়ে যায়। তারপর তাদের চোখের জল মুছে নতুন বউকে সমাদরে ঘরে তুলে। ছেলেটা বর্ণাকে মা-বাবার কাছে সঁপে দিয়ে একদিন পরই আবার শহরের চলে যায়, নিজের নতুন চাকরি বাঁচানোর জন্য।

এর ক’দিন পরই বর্ণার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি বুঝতে পারছে যে, নতুন বউ ভাঙাচোরা ঘরে ওঠার পর থেকে গরিবের অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘর যেন দিনে দিনে আলোকিত হচ্ছে। শত অভাবের মাঝেও যেন অভাব নেই! ঘরে কিছু না থাকলেও কোনও হাহাকার নেই! সবদিক যেন পরিপূর্ণ! এছাড়াও ছেলের বউয়ের আচার-ব্যবহারে শ্বশুর শ্বাশুড়ি দুইজনই মহাখুশি! এভাবেই বর্ণা খেয়ে-না-খেয়ে শ্বশুর শ্বাশুড়ির খেদমত করে সংসার পরিচালনা করার ফাঁকে গ্রামের দু’একটা ছেলে-মেয়েদের প্রাইভেট পড়ানো শুরু করে। এতে যেই টাকা পায়, সব টাকাই বৃদ্ধ শ্বশুরের কাছে দিয়ে দেয়। বর্ণার স্বামীও শহর থেকে মাসে একবার বাড়িতে এসে চাকরি বেতনের অবশিষ্ট টাকা বৃদ্ধ মা-বাবার কাছে বুঝিয়ে দেয়। এভাবেই চলতে থাকে বর্ণার সংসার।

এদিকে বর্ণার বান্ধবী ঝর্ণা স্বামীর সাথে আমেরিকা গিয়ে সংসার শুরু করলেও, ঝর্ণার সেই সংসার বেশিদিন টিকেনি। বছর খানেক ঝগড়া-ঝাটির মধ্যে সংসার করে অবশেষে প্রবাসী স্বামীকে ছেড়ে দেশে ফিরে আসে। ঝর্ণা দেশে ফিরে এসেই সবার আগে বান্ধবী বর্ণার খবর জানতে বর্ণার বাবার বাড়িতে যায়। ঝর্ণা বর্ণার বাবার বাড়িতে গিয়ে দেখে বর্ণার মা-বাবা দুজনই গুরুতর অসুস্থ! বর্ণা মা-বাবা একমাত্র মেয়ে। বর্ণা ছাড়া বর্ণার মা-বাবার আর কোনও সন্তান নেই, বর্ণাই একমাত্র সন্তান। কিন্তু বর্ণা নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করাতে তার বাবা বর্ণাকে তাদের অসুস্থতার কথা জানায়নি। না জানালেও বর্ণার মা-বাবা মনে মনে সবসময়ই বর্ণা বর্ণা কাঁদে। কিন্তু প্রকাশ করে না। ঝর্ণাকে দেখে বর্ণার মা-বাবা জানতে চায়, ‘আমাদের বর্ণা কেমন আছে’?

প্রত্যুত্তরে ঝর্ণা বলে, ‘আমিতো এই ক’দিন হয় আমেরিকা থেকে এসেছি, খালু। আমি আপনাদের বাড়ি এসেছি বর্ণার সাথে দেখা করতে। তো ও এখন কোথায়’?

বর্ণার বাবা বিষ্মিত চোখে ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কী আশ্চর্য! তুমি কি কিছুই জানো না? ও-তো ওর কলেজ বন্ধু ছেলেকে বিয়ে করে তাদের গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। ওখানেই নাকি স্থায়ীভাবে থাকবে। তুমি কি ওদের গ্রামের বাড়ি চেনো? যদি চেনো, তাহলে গিয়ে বলো, আমাদের দেখে যেতে আর আমার স্থাবর অস্থাবর সবকিছু বুঝে নিতে। ও ছাড়াতো আমাদের আর কেউ নেই’।

বর্ণার মা-বাবার কথা শুনে ঝর্ণা বুঝতে পেরেছে যে, ‘বর্ণা হয়তো স্বামীর সংসারে খুব ভালো আছে। যার কারণে ও-ই গ্রামের ছেলেটার হাত ধরে চলে যাবার পর ও এখানে আর আসেনি। তা-ই যদি হয়, তাহলে বর্ণার ভবিষ্যৎ চিন্তাই কি ঠিক ছিলো’?

এসব ভেবেচিন্তে ঝর্ণা কলেজ পড়ুয়া আরও সহপাঠীদের কাছ থেকে ছেলেটার গ্রামের বাড়ির ঠিকানা যোগাড় করে একদিন ছেলেটার গ্রামের বাড়ি রওনা দিলো। সংগ্রহ করা ঠিকানামতো ঝর্ণা ঠিকঠাক পৌঁছে গেলো, বর্ণাদের বাড়িতে। গিয়ে দেখে বাড়ির ঘরের বারান্দায় এক বৃদ্ধ বসে বসে হুক্কা ফুঁকছে। ঝর্ণাকে দেখামাত্র বারান্দায় বসা বৃদ্ধ লোকটা বউমা বউমা বলে ডাক দেয়ার সাথে সাথে বর্ণা ঘর থেকে বের হয়ে বললো, ‘আব্বা ডাকলেন’?
বর্ণনা শ্বশুর বললো, ‘হ্যাঁ বউমা, দেখতো মেয়েটি কাকে খুঁজছে’?

শ্বশুরের কথা কানে যেতেই বর্ণা ঘাড় ফিরিয়ে দেখে, এ যে ঝর্ণা! বর্ণা আর দেরি না করে দৌড়ে ঝর্ণার কাছে এসে বললো, ‘আমেরিকা থেকে কবে এলি, বল? কেমন-ই-বা আছিস’? ভালো আছিস তো? তোর স্বামীকে সঙ্গে আনিসনি কেন? লোকটা কোথায়? তোর সাথে এসেছে’?
ঝর্ণা বললো, ‘না, ও সাথে আসেনি। আমি একাই এসেছি, ক’দিন হলো মাত্র’।
‘কেন আসেনি’? জানতে চাইল বর্ণা। কিন্তু ঝর্ণা বর্ণাকে সদুত্তর কিছুই দেয়নি, শুধু এড়িয়ে গেল। এসব কথা বলাবলির মাঝেই বর্ণা ঝর্ণাকে ঘরে নিয়ে বসতে দিলো। খাবার দিলো। খাবার খাওয়ার মাঝেই ঝর্ণা বর্ণাকে তার স্বামীর কথা জিজ্ঞেস করলো, ‘তোর স্বামী কোথায়’?

বর্ণা বললো, ‘ও-তো শহরে চাকরি করে। মাসে একবার আসে। মাঝেমধ্যে প্রতিষ্ঠান থেকে কোনও বন্ধ পেলে চলে আসে’। ছুটি শেষে আবার চলে যায়। আমি আমার বৃদ্ধ শ্বশুর শ্বাশুড়ি নিয়ে বাড়িতেই থাকি। ঝর্ণা জিজ্ঞেস করলো, ‘তোর বাবার বাড়িতে যাসনে কেন? তোর বাবা-মা তো অসুস্থ। আমি আমেরিকা থেকে এসেই তোর খোঁজে তোদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তোর মা-বাবা তোকে যেতে বলেছে। তাদের সমস্ত স্থাবর অস্থাবর হয়তো তোর নামেই দিয়ে দিবে। তুই সময় করে তোর স্বামীকে নিয়ে বাবার বাড়িতে যাবি। তোর মা-বাবা হয়তো রাগ-গোস্বা ভুলে গিয়ে তোকে বুকে টেনে নিবে’।

ঝর্ণার কথা শুনে বর্ণা কিছুক্ষণ চুপ করে বললো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আমার মা-বাবাকে দেখতে যাবো। তবে তাদের ধন সম্পত্তির লোভে নয়। গর্ভধারিণী মা ও জন্মদাতা পিতার শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আর তাদের ভালোবাসার টানেই যাবো।

এখন বল, তুই কী সুখে আছিস’?
বর্ণার কথার জবাব দিতে গিয়ে ঝর্ণার দুচোখ বেয়ে জল ঝরতে লাগলো! একরকম কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো, ‘না বর্ণা, আমি ভালো নেই। কলেজ জীবনে আমার ভবিষ্যৎ ভাবনা ছিলো ভুল! তাই আমি প্রবাসী স্বামী পেয়েও সুখী হতে পারিনি, যতটা তুই গ্রামের ছেলেকে বিয়ে করে সুখী হয়েছিস। আমি সুখী হতে পারিনি এই কারণে যে, আমি একটু বেশি সুখী হতে চেয়েছিলাম। তাই আমি আজ দুখী! বর্ণা তুইই সুখী!

বিভ্রম

unt

আমরা রজব আলীকে এখনই গাবতলী বাস স্ট্যান্ডে নামাবো এবং নামার সাথে সাথে সে প্রচণ্ড ধাক্কা খাবে। তাকে এমন ধারণা দেওয়া হয়েছে যে ময়মনসিংহের তুলনায় ঢাকা শহরে শীত কম। অথচ বাস থেকে নেমে সে জমে যেতে শুরু করবে। তার মনে প্রশ্ন জাগবে তাকে কেনো মিথ্যে বলা হলো।

ময়মনসিংহ থেকে যাত্রী নিয়ে যাতায়াত পরিবহনের বাসটা এক ঘণ্টা দেরীতে ঢাকার গাবতলী বাস স্ট্যান্ডে পৌছেছে। দেরীর কারণ ঘন কুয়াশা। ভোর হতে সামান্য দেরী, রজব আলী বাস থেকে নামতেই বরফ মেশানো ঠাণ্ডা হাওয়ার স্রোত অন্ধ আক্রোশে তার শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়লো। সে জমে যাচ্ছে, তবু কেনো মিথ্যে তথ্য দেওয়া হলো এ প্রশ্ন না তুলে অস্ফুট স্বরে বলল, ‘আক্কলের খাইছে মাডি/বাফে ফুতে কামলা খাডি।’

আশ্চর্য! রজব আলী কথা বলছে কেনো! ওর শুধু নিরবে জমে যাওয়ার এবং মনে প্রশ্ন জাগার কথা ছিলো। আপাতত বিষয়টা উপেক্ষা করা যাক, এখন রজবের শরীরে একটা সস্তা দামের খয়েরি রঙের শাল জড়িয়ে দেয়া যাক। শীতের বিরামহীন কামড় সহ্য করতে না পেরে রজব শালে মাথা আর কান ঢেকে নিবে। রজবকে বাস স্ট্যান্ড লাগোয়া চায়ের টং দোকানে যাবে, পরপর দুই কাপ চা খাবে। সূর্য ওঠার অপেক্ষা করবে, কিন্তু কুয়াশা এবং আকাশ ভরা মেঘের কারণে আজ সূর্য উঠবে না।

রজব ঠকঠক করে কাঁপছে। শীতের হাওয়া শরীরে আছড়ে পড়ছে। অগ্রহায়ণ মাসের শেষে হঠাৎ নামা প্রবল শীতের হাওয়ায় সে পাকা ধানের ঘ্রাণ পাচ্ছে। সে জানে এ অসম্ভব—ক্ষেতে ক্ষেতে ধান কাটা প্রায় শেষ, এ শহরে ধানের ঘ্রাণ নিষিদ্ধ না হলেও হাওয়ায় চেপে ঘ্রাণের শহর পর্যন্ত পৌছানো সম্ভব নয়। ঘ্রাণটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। খয়েরী রংয়ের সস্তা শালে কান আর মাথা মুড়ে সে চায়ের দোকানের দিকে পা বাড়ায়। দুই কাপ চায়ে একটা বনরুটি ভিজিয়ে খায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে সময় বুঝার চেষ্টা করে, কিন্তু সময় ধরতে পারে না। সে নিশ্চিত — কুয়াশার যে ভাবগতিক তাতে সূর্য উঠবে না। সে বিড়ি ধরায়, হাত মুঠ করে ছিলিমের মত টান দিয়ে বিরবির করে বলে, “বিড়ি-মাডি-ছাই/তিন গরিবের ভাই।”

রজবের যা করার কথা নয়, তাই করছে। শুধু ২কাপ চা খাওয়ার কথা সে বনরুটিও খেয়েছে। অপচয় ১০টাকা। শীতের হাওয়ায় বিপর্যস্ত হওয়ার কথা, সে পাকা ধানের ঘ্রাণ পাচ্ছে। সূর্য ওঠার জন্য অপেক্ষা করার কথা, সে ধরে নিয়েছে সূর্য উঠবে না। এবারও তার অবাধ্যতা উপেক্ষা করা যাক। এখন তাকে আবার বাসে তুলে দিবো, গন্তব্য বঙ্গ বাজার। ঝিমুতে ঝিমুতে গন্তব্যে পৌছবে। ওখানে অপেক্ষায় আছে দেশী ভাই হাফিজ। দু’জনে সাক্ষাৎ হবে, কুসুম কুসুম বিষাদে আক্রান্ত হবে এবং নাস্তা খাওয়া শেষে দু’জন মিলে দায়িত্বটা পালন করবে।

রজব নিজের ৪৭বছর বয়সী শরীরটাকে ক্রাচের ওপর ভর করে টানতে টানতে মূল সড়কে এনে দাঁড়ায়। বাসে উঠতে যাবে, হঠাৎ কি মনে হওয়ায় হাঁটতে শুরু করে। এ শহর দেড় দশকে অনেক বদলে গেছে, তবু বলাকা বাসের সাবেক হেল্পার রজব পথ চিনে চিনে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। রজব হাঁটছে, মাথার ভেতর ভাসছে সামাদ হাজীর কলোনি। নিচ তলায় ছোট বারান্দা শেষে একটা ঘর। বারান্দার ডান পাশের কোনে রান্না করছে রোকেয়া। মাথার চুল খোঁপা করে বাঁধা, ফর্সা ঘাড়, গরমে ব্লাউজ ভিজে গেছে। বারান্দার মাঝখানে খেলছে রুখসানা, ওদের প্রথম সন্তান। রজব চোখ বড়বড় করে মেয়েকে বললো, ‘পরের ঘরের পিডা, দাতে লাগে মিডা।’ কথা শেষ হবার আগেই খলখলিয়ে হেসে উঠলো মেয়েটা। বয়স মাত্র ৩ বছর, সব কথাতেই হাসে, চোখ বড় করে বকলে বেশী হাসে।

রজবকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হচ্ছে। ও অদ্ভূত আচরণ করেই যাচ্ছে, করেই যাচ্ছে। বাসে ওঠার কথা, ওঠেনি। ঝিমানোর কথা, না ঝিমিয়ে স্মৃতি কচলাচ্ছে। স্মৃতি কচলানো খুব খারাপ অভ্যেস, একবার শুরু হলে চলতেই থাকে। এক স্মৃতির লেজ ধরে উপস্থিত হয় দশ স্মৃতি, দশটার লেজে লেজে জড়িয়ে থাকে আরও দশটা করে স্মৃতি। কচলানোর সময় নিজের সাথে দেখা হয়ে যায়, তারপর একশো রকম সুখের কথা হাজার রকম কান্নাকাটি। এখন রজবের মনে পড়বে মেয়েকে নিয়ে বাসে করে কতবার সায়েদাবাদ থেকে গাজীপুরে ঘুরতে গেছে। মনে পড়বে দুর্ঘটনায় পা হারানোর কথা, কঁচি হাত বুলিয়ে মেয়েটার বলা — ‘বাজান, তোমার ঠ্যাং কই? কাউয়ায় লয়া গেছে!’ মনে পড়বে অভাবের সংসারের ভাড় বইতে না পেরে মেয়েকে রেখে এক দুপুরে রোকেয়ার পালিয়ে যাওয়া। টিটি পাড়ার সংসার ছেড়ে মেয়েকে নিয়ে গ্রামে ফেরা। মনে পড়বে শরীরটা আস্তে আস্তে অকেজো হওয়ায় সংসারের হাল ধরলো মেয়ে, ঢাকায় রুখসানা গার্মেন্টসে চাকরী নেওয়া। প্রতি মাসে বাবাকে টাকা পাঠানো, নতুন করে সংসার সাজানো শুরু হওয়া। অথচ রজবের এখন এসব ভাববার সময় নয়, ও শুধু ঝিমুবে, ঝিমুতে ঝিমুতে দেখা করবে হাফিজের সাথে। আমরা ওর পায়ে একটু ব্যথা তৈরী করে দেই, ওর বাসে ওঠা জরুরী।

রজব স্মৃতি কচলে হাঁটতে হাঁটতে মোহম্মদপুর পর্যন্ত চলে এসেছে। শহরের ব্যস্ততা এখনো শুরু হয়নি। ঢাকা শহর কি জাগবে না— প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যেয়ে রজবের মনে পড়ে আজ শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটির সাথে যোগ হওয়া শীতের প্রকোপে এ শহর আজ ঘুমে কাতর, যার জাগবার অনিবার্য বাধ্যবাধকতা নেই সে ছাড়া সবাই নিদ্রামগ্ন। রজবের বিড়ির নেশা পেয়েছে, ফুটপাতের এক পাশে দাঁড়িয়ে বিড়ি ধরায় এবং বুঝতে পারে পিঠ ব্যথা করছে। ব্যথায় মাথার শিরাগুলো দপদপ করছে। বিড়ি শেষ করে নিরুপায় হয়ে রজব বাসে ওঠে।

শেষ পর্যন্ত আমরা রজবকে বাসে তুলে দিতে পেরেছি। কিন্তু ওর পায়ে ব্যথা সৃষ্টি করেছি, ও ব্যথা বোধ করছে মাথা আর মেরুদণ্ডে। ওর মাথা ব্যথায় আপাতত আমাদের মাথা ব্যথা হবার কারণ নেই। এটা একদিকে ভালোই হয়েছে, অসুস্থ শরীরে ক্রাচে ভড় করে একটানা এতটা পথ হাঁটার ক্লান্তি এবং মাথা ব্যথার সম্মিলিত আঘাতে তার ঘুম পাবে। সে বাসে বসে ঘুমোক। দ্রুতই হাফিজের সাথে দেখা হবে, দুজনে মিলে কাজ শেষ করবে। কাজ শেষে হাফিজকেও ওর সাথে ময়মনসিংহে মানে গ্রামের বাড়িতে পাঠাবো, প্রয়োজনের অতিরিক্ত এক মিনিটও এ শহরে ওদের অবস্থান করার সুযোগ দেওয়া ঠিক হবে না।

এই প্রথম রজব অবাধ্যতা না করে বাসের সিটে ঘুমিয়ে পড়লো। বাস বঙ্গবাজারে পৌঁছতে হেল্পার ওকে ডেকে তুললো, বাস থেকে নেমে মনে পড়লো পাঞ্জাবীর পকেটে মোবাইল সেট রয়েছে এবং সেটা বেজে যাচ্ছে। ফোনে যোগাযোগ করে হাফিজের সাথে দেখা হলো। দুই দেশী ভাই পরস্পরকে শক্ত আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে রাখলো কিছুটা সময়।

রজব এবং হাফিজের কুসুম কুসুম বিষাদে আক্রান্ত হওয়ার কথা — কি আশ্চর্য, তা হয়নি। এই না হওয়াটা মেনে নেওয়া যায়, তাছাড়া স্মৃতি কচলানোর মত কুসুম কুসুম বিষাদও গাঢ় হয়ে ভয়াবহ আকার নিতে পারে। এখন তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করিয়ে যে কোনো মূল্যে ওদের এ শহর থেকে বিদায় করতে হবে। বেশী ক্ষণ অবস্থানের সুযোগ দিলে এরা শহরের বাতাসকে দূষিত করে তুলবে।

রজব তার সকল অভাব মেনে নিয়েই পরম মমতায় রুখসানাকে বড় করেছে, নাজমাকে কোলেপিঠে করে বড় করেছে হাফিজ, দু’জন বাচ্চাদের মত হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে — পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া বস্তুগুলো সত্যিই তাদের প্রিয়তম সন্ততির দেহ! অভাবের তাড়নায় গার্মেন্টসে কাজ করতে এসে পুড়ে কুকড়ে যাওয়া প্রতিটি দেহকে মনে হচ্ছে নিজের মেয়ের লাশ, পরক্ষণেই মনে হচ্ছে কোনোটাই তাদের মেয়ের লাশ নয়।

আমরা চেষ্টা করছি রজব আর হাফিজ যে কোনো দু’টা লাশ নিয়ে দ্রুত চলে যাক, দূষিত হবার হাত থেকে রক্ষা পাক শহরের মানবিক বাতাস। এমন নয় যে রুখসানা এবং নাজমার লাশ মূল্যবান, লাশপিছু ক্ষতিপূরণের পরিমাণ সমান। তবু দুই বেকুব মিলে অযথা দেরী করিয়ে দিচ্ছে।

বিভ্রম | গল্প
৫ নভেম্বর ২০২১

জলে জলাঞ্জলি

2782

০১
বিকেলটা জলে দেব ঠিক করেই বাসা থেকে বের হয়েছিলাম। কিন্তু এমনিভাবে জলাঞ্জলি হবে কোনোদিন ভাবিনি। ভাবতে পারিনি। আজকাল মাঝেমাঝেই ব্রহ্মপুত্র দেখতে যাই। যদিও সে এখন আর দেখার মতোন কেউ নেই। হাতি ছোট হতে হতে চামচিকা হলে যেমন কদাকার দেখায়; ব্রহ্মপুত্রকেও এখন তেমনি দেখায়। এর না আছে গুণ, আর না আছে রুপ। তবুও ব্রহ্মপুত্রের মায়া কাটাতে পারিনা। তবুও পৈতৃক বাড়ির মতো সে আমাকে বারবার কাছে টানে। এখানে আকাশ যতোটা কাছে পৃথিবীর অন্য কোথাও ততোটা না। ব্রহ্মপুত্রের বাতাস যতোটা খানদানী ততোটা পৃথিবীর আর কোনোখানে নেই। দুই পড়ের কাশফুলগুলো যেন অষ্টাদশী নর্তকীর মতো আমার হৃদয়ে চোরাগোপ্তা ঝড় তুলে। কানের কাছে আনত মুখে ফিসফিসিয়ে জীবনের কথা বলে। যদিও আমার জীবন এখন বেশির ভাগ সময় মেঘলা আকাশের সাথে মিতালি পাতাতে ব্যস্ত থাকে।

আমার প্রিয়তমা ময়মনসিংহ শহরে একটু জোরে নিঃশ্বাস নেওয়ার মতোন জায়গা খুব একটা নেই। তবুও পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের দুই ধার বেশ লাবণ্যময়। এখানে প্রতিদিনই অতিথি পাখির মতো হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়। তাদের পায়ের ধূলিতে যেমন সাইমুম সৃষ্টি হয়; তেমনি তাদের কথার কাকলিতে নিষ্প্রাণ ব্রহ্মপুত্র সেও ধন্য হয়। বিশেষ করে গাঙের পানিতে যাদের নতুন পানির জোয়ার এসেছে তাদের কথা না বললেই নয়। শ্রুতি আর প্রতিশ্রুতির মেঘ ডাকে, মুষলধারে বৃষ্টি সেও বসে থাকে না। এমনি পাগলা হাওয়া কার না ভালো লাগে? আর আমার মতোন আলো-আঁধারির আধামানুষ হলে তো কোনো কথাই নেই!

ব্রহ্মপুত্রে যদিও এখন মন ভরানো জল নেই; তবুও পায়ে হেঁটে ওপারে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থাও নেই। অনেকদিন ধরে যে ব্রীজটি হওয়ার কথা আকাশে-বাতাসে ভাসছে; তারও কোনো সুগন্ধ নেই। যা আছে সেটা সেই সনাতনী পদ্ধতি! খেয়া করে একবার ওপারে যাও; আরেকবার এপারে আসো। অবশ্য এই পদ্ধতিটা ভ্রমণ বিলাসী মানুষের জন্য মন্দ নয়। মোটামুটি একটা নৌ-এ্যাডভেঞ্চার হয়ে যায়। বাকি থাকে কেবল দুই পাড়ের অগণিত আমজনতা। অবশ্য তাদের কষ্টের নামতা শোনার মতো মানুষের অভাব এই দুনিয়ায় নেই; কেবল কষ্ট দূর করার তেমন কোনো মানুষ নেই। এ নিয়ে দুই পাড়ের মানুষের যেমন হতাশা আছে, তেমনি বুক ভরা আশাও আছে। দু’চোখ উপচানো স্বপ্ন আছে। আর সেই স্বপ্ন যেমন-তেমন স্বপ্ন নয়। একদিন তারা ব্রহ্মপুত্রের বুকের উপর দিয়ে জুতা পায়ে মচমচ করে হেঁটে এপার-ওপার করবে! মস্তবড় জলহস্তীর মতোন বড় সেই জলজ্যান্ত স্বপ্ন! শত হতাশার মাঝেও আমার তালগাছ সমান বিশ্বাস আছে- আজ হোক, কাল হোক কিংবা পরশু হোক একদিন না একদিন তাদের সেই স্বপ্নের পাখা গজাবেই!

আমি সেই ব্রহ্মপুত্র নদের যে পাড়ে ঈশ্বর আছেন; সেই পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমার আশেপাশে ছেলেবেলার দেখা আখড়ার মেলার মতোন এলোপাথাড়ি মানুষের খেলা। কেউ হাসছে। কেউ হাসতে হাসতে কাঁদছে। আর কেউ কারো হাত থেকে উষ্ণতা ছিনিয়ে নিচ্ছে। মশা তাড়ানোর ছল করে গাল লাল করে দিচ্ছে। আর আমি একজন নিতান্ত আলাভোলা আধাআধি মানুষের মতোন প্রিয়তমা ব্রহ্মপুত্রের দিকে দুই চোখ মেলে উদাস চেয়ে আছি। আমার সেই চোখ যখন ব্রহ্মপুত্রের হারানো যৌবন খুঁজে ফিরছে; ঠিক তখনই কাউনের মিহি দানার মতোন সরু একটি অচেনা কণ্ঠস্বর আমার দিকে ধেয়ে আসলো। স্যার ওই পাড়ে যাবেন নাকি?

০২
যেই জল আমাকে সবসময় সতেজ ঘাসের মতোন সুতীব্র আকর্ষণ করে, সেই জলই হল এই আহবানের উৎসমুখ। সাধারণতঃ মেয়েদের কণ্ঠ এমন মিহি হয়। কিন্তু এ যে দেখছি সাক্ষাৎ খেয়া পাড়ের মাঝি! ব্রহ্মপুত্রের সমাহিত জলের উপর শান্ত, সৌম্য, মোলায়েম এক চেহারার সুঠামদেহী তরুণ। চোখে, মুখে নগদ দীপ্তির ছাপ মুদ্রিত অক্ষরের মতো শোভা পাচ্ছে। প্রথম দর্শনেই আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা হোঁচট খেলাম। ছেলেটিকে মাঝি ভাবতে কিছুতেই আমার মন সায় দিচ্ছে না। কেবলই মনে হচ্ছে কিছু একটা গণ্ডগোল তো অবশ্যই আছে। যা আমাকে জানতে হবে। জানতেই হবে।

মাঝির প্রশ্নের জবাব মুখে না দিয়ে নৌকায় আরোহন করলাম। নৌকাটি মাঝারি গোছের। না ছোট। না বড়। তবে ভ্রমণ পিয়াসী মানুষদের জন্য চমত্কার উপযোগী। দুই পাশে পাটাতন দিয়ে বসার সুব্যবস্থা আছে। রঙিন পাল বাতাসে উড়ছে। এতোসব আয়োজনের মাঝেও আমাদের দু’জনের মধ্যে অস্বাভাবিক নিরবতার কাফন মুচকি মুচকি হাসছে। এই অবস্থার অবসান কল্পে আমি যেই মুখের লাগাম খুলে দিতে উদ্যত হলাম, তখনই আমাকে হারিয়ে দিয়ে মাঝি ছেলেটি বলে উঠল, আপনাকে আমি চিনি স্যার। আপনার নাম অচল। আপনি খুব ভালো কবিতা লিখেন। আমি মন ভালো করার জন্য আপনার কবিতা সবসময় পড়ি। আপনার কবিতায় হতাশা আর আশা সমান তালে পথ চললেও জীবনের সুগন্ধ পাই; দিক-নির্দেশনা পাই। মাঝ নদী থেকে কীভাবে তীরে ভিড়তে হয়, ভিড়তে হবে, সেই অনুপ্রেরণা পাই।

পৃথিবী থেকে একলাফে চাঁদে পৌঁছে গেলে একজন সাধারণ মানুষ যতটা আনন্দিত হবে, মাঝির কথা শুনে আমি ঠিক ততোটাই পুলকিত হলাম। এরচেয়ে এক আঙুল কমও না; আবার বেশিও না। তবুও এতো খুশি ধরে রাখার কোনো বন্দোবস্ত আপাতত আমার কাছে নেই। জামার বুক প্যাকেট, বুকের ইন পকেট, প্যান্টের সামনে-পেছনে, ডানে-বামে সব পকেটে কেবল খুশি আর খুশি। অতঃপর কিছু খুশি চোখে, কিছু মুখে মাখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কী উদাস মাঝি?

কবিতার প্রসঙ্গ না টেনে নাম জিজ্ঞেস করায় মাঝি কিছুটা না হতাশ হয়েছে, আমি তার নাম বলে দেওয়ায় এরচেয়ে কয়েক কোটি গুণ বেশি অবাক হয়েছে। আমতা আমতা করে বলল, জী স্যার আমার নাম উদাস। কিন্তু আপনি আমার নাম জানলেন কীভাবে?

আমি উদাসের প্রশ্নের জবাব দিলাম না। জবাব দেওয়ার জন্য ভেতর থেকে তাড়া অনুভব করলাম না। উদাস নামটি কিছুটা মেঘাচ্ছন্ন মনে হলেও আমার কাছে খুব লাবণ্যময়। আমি বিশ্বাস করি, শিল্পের যেখানে শেষ হয়, লাবণ্যের সেখান থেকে শুরু হয়। মনের ভাবনা মনের ভেতরেই তালা মেরে মুখে বললাম, পড়াশোনা কর বুঝি?

আমি জানি, একজন মাঝিকে করা আমার এই প্রশ্নটা কোনো প্রশ্ন নয়। বলা চলে হালের আধমরা বলদের মতোন জীর্ণ-শীর্ণ একটি প্রশ্ন। উদাসও আমার প্রশ্নের নগদ কোনো জবাব দিলো না। কেবল সুপারি গাছের মতো সুদীর্ঘ একটি দীর্ঘশ্বাস ব্রহ্মপুত্রের জলের সাথে মিশিয়ে দিয়ে বলল, স্যার ঐ পাড়ে যাবেন? নাকি….

আমি বললাম, না। আমি কোন পাড়ে-টারে যাব না। দিনমণি ডোবার যতক্ষণ সময় বাকি আছে, ততক্ষণ তোমার যেদিকে ইচ্ছে সেদিকে যাও। তাছাড়া তুমি এটাও করতে পার যে, ব্রহ্মপুত্রের ঠিক বুক বরাবর নৌকাটি নিয়ে যাও। অতঃপর বৈঠা নৌকার উপর রেখে দাও। নৌকা তার ইচ্ছে মত চলবে। চলুক। যে পৃথিবীতে সবাই স্বাধীনতা প্রিয়; তাই আমি মনে করি তোমার নৌকারও কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার আছে। তুমি কি বল উদাস? উদাস বলল, অবশ্যই স্যার।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, এজন্য তোমাকে কত টাকা দিতে হবে উদাস?
আমার কথা শোনে উদাস যেন লজ্জাবতী লতার মতো মাটিতে মিইয়ে গেলো। কিন্তু উদাসের মুখ বসে থাকলো না। সে সাফ জবাব দিল, মাফ করবেন স্যার। আপনার কাছে আমি কোনো টাকা-পয়সা নিতে পারব না।
এবার আমি নিশ্চিত না হয়ে পারলাম যে, উদাস কোনো সাধারণ মাঝি নয়। একজন সাধারণ মানুষের হৃদয়ের যতটা বিশালতা থাকা দরকার এই ছেলের এরচেয়ে ঢের বেশি আছে। প্রকৃত পক্ষে ধন থাকলেই যে মানুষ ধনী হয় না, মন থাকতে হয়—এই কথার সত্যতা আবারও আমার কাছে দিবালাকের মতো স্পষ্ট হল।

০৩
আমি জানি, আবেগের জায়গায় খোঁচা পড়লে মানুষ এমন কিছু বলে যা স্বাভাবিক অবস্থায় বলে না। বলতে পারে না। তাই আমি উদাসের এই জায়গাটিতে খোঁচা দিয়ে বললাম,
এমন রাজপুত্রের মতো চেহারা ছবি এবং প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত এই তোমাকে আর যাই কিছু হোক মাঝি হিসাবে একেবারেই বেমানান উদাস।

উদাস আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দুই, তিন চিমটি মাত্র সময় নিল। অতঃপর কী মনে করে জানি না একবার আকাশের দিকে মুখ তুলে সাথে সাথেই একটা গভীর অনুশ্বাস সংগোপনে গোপন করে বলল, দুঃখের কথা কী বলব স্যার, আমি আনন্দ মোহন কলেজ থেকে দর্শনে অনার্স, মাস্টার্স পাশ করেছি। দুটোতেই প্রথম শ্রেণি। আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আমারও দু’চোখে হাজার চোখের স্বপ্ন ছিল। আমাকে ঘিরে বাবা-মায়ের আকাশ ছোঁয়া প্রত্যাশা ছিল। দরিদ্র পিতামাতার একমাত্র ছেলে সন্তান হিসাবে একটি চাকুরির জন্য কম চেষ্টা করিনি স্যার। কিন্তু কিছুতেই আমার ভাগ্যের ছেঁড়া শিঁকে জোড়া লাগেনি। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইনি এমন কোন রেকর্ড আমার অভিধানে নেই। আমার জানা এবং বিশ্বাস মতে, প্রতিটি ভাইভা যেভাবে ফেস করা উচিত, আমিও ঠিক সেভাবেই ফেস করেছি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। রাগে দুঃখে, অপমানে একদিন আমি কী করেছি জানেন স্যার?

যৎসামান্য ঔষধেই এমন ভালো কাজ হবে আমি ভাবতেই পারিনি। তবুও আমি মুখে কিছু না বলে উদাসের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই সে বলতে থাকলো, একদিন হঠাৎ রাত্রিবেলা বাবা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন।

পরদিন সংসার চালানোর মত ঘরে তেমন কিছুই নেই। বাবা খুব কাঁদছিলেন। অবশ্য বাবার চেয়ে মা আরও বেশি কাঁদছিলেন। অতঃপর আমি বাবা-মাকে না জানিয়েই বৈঠা হাতে তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বাবা, মা, ছোটবোন দুটি না খেয়ে থাকবে এটা আমার পক্ষে মেনে নেওয়া কিছুতেই সম্ভব ছিল না স্যার। অবশ্য আগের দিন আমার সরকারী চাকুরির বয়সও শেষ হয়েছিল। সেদিন আমি সারারাত কেঁদেছি। একফোঁটাও ঘুমাইনি। অতঃপর সমস্ত রাত্রি অন্ধকার ভেলায় ভাসতে ভাসতে আমি একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিলাম। ভোর বেলায় সমস্ত জীবনের শ্রেষ্ঠতম অর্জন সার্টিফিকেটগুলো নিয়ে ব্রহ্মপুত্রের ঠিক মাঝখানে আসলাম। তারপর চোখের জলে ভিজতে ভিজতে সবগুলো সার্টিফিকেট কুটিকুটি করে ব্রহ্মপুত্রের জলে ভাসিয়ে দিলাম। সেই থেকে আমি ব্রহ্মপুত্রের মায়া কাটাতে পারি না স্যার। যেই জলে আমি আমার সমস্ত জীবনের অর্জন জলাঞ্জলি দিয়েছি, বাবা, মা এবং আত্মীয়-স্বজনের স্বপ্ন যেই জলে সমাহিত করেছি; আপনিই বলুন স্যার সেই জল আমি কীভাবে ছাড়তে পারি?

এরপর উদাস আর কিছুই বলল না। বলতে পারলো না। ঘামে ভেজা হাত দিয়ে বারবার কেবল চোখের জল মুছতে লাগল। আর আমি জীবনে এই প্রথমবারের মত নিজের কাছে নিজেই হেরে গেলাম। আমাদের দেশে যেভাবে হাটে-বাজারের মতোন যেখানে-সেখানে পাত্র-অপাত্র না দেখে ছেলেমেয়েদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করা হচ্ছে, আমি জানি না পরিকল্পনা বিহীন এই উচ্চ শিক্ষার বিড়ম্বনা আদৌ হালে পানি পাবে কিনা! এই হতাশার বোঝা জাতি বইতে পারবে কিনা? প্রকৃত মেধাবিরা যেখানে চাকুরি পাচ্ছে না; সেখানে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা এমনকি শিক্ষকের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার ভয়ে যে ছাত্রটি সারা ছাত্রজীবন ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে মুখ লুকিয়ে চুপচাপ বসে থাকতো, পেছনের দরজা দিয়ে সে-ই আজ দেখা পেয়ে যাচ্ছে চাকুরি নামের সোনার হরিণটির। আমি জানি না, এর মাশুল আমাদের আরও কত প্রকারে গোনতে হবে!

০৪
আমি জানি, উদাসের এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার কোনো জ্ঞান-বুদ্ধি এই মুহূর্তে আমার নেই। আমি এখন কালিহীন কলমের মত হতবুদ্ধি। তবুও কথার পিঠে কথা ছাড়া যেমন প্রেম হয় না, প্রেম ছাড়া যেমন বৃষ্টি হয় না; তেমনি এই উদগীরিত লাভার অবস্থান থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। অংশুমালি পশ্চিম দিকে যাত্রার আয়োজন যথারীতি প্রায় সুসম্পন্ন করে নিয়ে নিয়েছে। আমি বিদায়ের আয়োজন করার জন্য উদাসকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার বাবা কেমন আছেন?

উদাস বলল, স্যার আপনি যেভাবে বাবার কথা বললেন, মনে হচ্ছে আপনি আমার বাবাকে চিনেন। জানেন। আসলেই কি তাই স্যার?

আমি বললাম, না উদাস। তুমি বলছিলে তোমার বাবা অসুস্থ। তাই আমার এই জিজ্ঞেস করা। উদাস বলল, বাবার অবস্থা অত্যন্ত খারাপ স্যার। বিছানা ছেড়ে একেবারেই উঠতে পারেন না। স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারেন না। কাউকে তেমন চিনতে পারেন না। সবকিছু গুলিয়ে ফেলেন।

উদাসের কথা শুনতে শুনতে বুঝতে পারছিলাম আমার ভেতরে হিমালয় হিমালয় ভাব জেগে উঠছে। আমি জানি, এই অবস্থায় আমি যা বলব, তাই ফলে পরিণত হবে। এই আমি মূলত আমি না। আমার মাঝে অন্য কেউ। এখন আমার সব কথার উড়ন্ত ডানা থাকবে। আমার কথারা দোয়েল পাখির মতোন গান গাইবে। ব্রহ্মপুত্রের হারানো স্রোতের মতো অব্যর্থ হবে। বললাম, তোমার বাবা বিগত তিন বছর তের দিন ধরে প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় আছেন। তাই না উদাস?

চোখের সামনে প্রেতাত্মা দেখলেও উদাস এতোটা হতবাক হতো কিনা আমি জানি না। হাতের বৈঠা গলুইয়ে রেখে তাড়াতাড়ি করে আমার দু’পা ছুঁয়ে সালাম করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। নৌকা তার নিজের মতো করে যেদিকে খুশি চলছে। আর এমনি এক মোবারক সময়ে আমার মুখ থেকে একটি আচানক তাঁরছেঁড়া কথা বের হয়ে আসলো। আমি বললাম,
”উদাস, তুমি বাড়িতে ফিরে দেখবে তোমার বাবা উঠানে পায়চারি করছেন। আর এক আঙুল সময় দেরি না করে তুমি ঝটপট বাবার কাছে চলে যাও। এই নাও পাঁচশত টাকা। এই টাকা দিয়ে তোমার বাবার জন্য এক প্যাকেট মিষ্টি কিনে নিয়ে যেও। তোমার বাবা মিষ্টি খেতে খুব পছন্দ করেন।‘’

কিংকর্তব্যবিমূঢ় উদাস কী করবে আর কী করবে না— তেমনি এক সিদ্ধান্ত সাগরে হাবুডাবু খাচ্ছিলো। আমি বললাম, তাড়াতাড়ি যাও উদাস। তাড়াতাড়ি যাও…. তোমার বাবা তোমাকে খুঁজছেন…..। সাথে সাথে উদাস নিজেকে ফিরে পেলো। দৌড়ের নৌকার মতোন বাড়ির দিকে প্রাণপণে ছুটতে লাগলো!!

সখিনার স্বপ্ন

27776

০১
সখিনা তাড়াতাড়ি হাত চালায়। এখনও অনেক কাজ বাকি। পাশের বাড়ির মজা পুকুরে একবার যেতেই হবে। ওখানে কলমি শাক পাওয়া যায়। কারো চাষ করা নয় । একদম নিরেট প্রাকৃতিক। ভেজালের যুগে এই ঢের! কলমি শাক কদম আলীর খুব পছন্দ। যেদিন কলমি রান্না হয় ; সেদিন কদম আলী এমন ভাবে খায় যে , এর চেয়ে মজার খাবার আর ত্রিভুবনে নেই। সখিনা ঘোমটার আড়ালে মুখ টিপে টিপে হাসে। আর মনে মনে বলে – বড় লোকেরা কোর্মা পোলাও ও এত মজা করে খায় না। বিয়ের আগে সখিনা ময়মনসিংহ শহরে এক স্যারের বাসায় কাজ করত। স্যারের ছোট ছেলেটি সে কি দুষ্টু ! যাকে বলে কলি কালের পোলা।

এই কদম আলী লোকটা সখিনার স্বামী। বিয়ে হয়েছে দু বছর। তখন সখিনার বয়স আঠার। কদম আলীর আটাশ। এই দু বছরে তাদের কোন সন্তান হয়নি। অবশ্য হয়নি বললে কিছুটা ভুল হবে ; কারণ সখিনা সন্তান নেয়নি। ঝামেলা ঝামেলা লাগে। সে লুকিয়ে লুকিয়ে পরিকল্পনা আপার কাছ থেকে সুখী পিল সংগ্রহ করে নিয়মিত খায়। কদম আলী বিষয়টি বুঝতে পারে না। কদম আলীর সন্তানের প্রতি খুব আগ্রহ। কিন্তু সখিনা কোন ভুল করতে রাজি নয়। সে আধা শহুরে মেয়ে। তাছাড়া কিছুটা শিক্ষিত। গ্রামের স্কুলে চতুর্থ শ্রেণী পাশ দিয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে উঠে ছিল। বাবার অভাবের সংসার। তা না হলে রাহেলার মত সেও এখন কলেজে পড়ত!

সখিনার বিয়ের দিন তুমুল বৃষ্টি। সারা বাড়িতে কাদা। তবু বিয়ের আনন্দ থেমে থাকেনি। পাড়ার মেয়েরা দল বেঁধে গীত গেয়ে , হাসি তামাশা করে পুরো বাড়ি মাতিয়ে তুলে। মাঝ রাতে কদম আলীর সাথে সখিনার বিয়ে পরানো হয়। ১০ হাজার টাকা দেন মোহর। নাকের ফুল, কানের দুল আরও ইত্যাদি ইত্যাদি মিলে পাঁচ হাজার টাকা উসুল। মা-বাবা , ভাই, বোনকে কাঁদিয়ে সখিনা শ্বশুর বাড়ি যায় সেদিন শেষ রাতে। তখনও বৃষ্টি পুরোপুরি থামেনি।

বাসর ঘর। এক পাশে মাটির পিদিম। সখিনা প্রায় ২৪ ঘণ্টার অভুক্ত। ঘরের এখানে সেখানে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। সখিনার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সারা দেহ, মনে ভয় ও আনন্দের অভূতপূর্ব মিলন মেলা। লুঙ্গি পড়া কদম আলী বাসর ঘরে প্রবেশ করে। গায়ে কোন জামা নেই। সখিনা আড় নয়নে স্বামীর দিকে তাকায়। প্রায় অন্ধকারে কদম আলীর কালো শরীর আরও কালো লাগে। সখিনা জড়সড়। মাটির দিকে মুখ। মাথায় বার হাত লম্বা ঘোমটা! কদম আলী সখিনার দু হাত ধরে। ঘোমটা সরিয়ে দেয়।

সখিনা একটু পেছনে যায়। কদম আলী একটু এগিয়ে আসে। বলে, এই ভয় পাছ নাকি? আমি তো তোর স্বামী । নিজের স্বামীকে আবার ভয় কিসের? এই বলে কদম আলী আরও নিবিড় হবার চেষ্টা করে। সখিনা কথা বলে না । কদম আলী ফুঁ দিয়ে বাতি নিবিয়ে দেয়। আবার ডাকে আদুরে গলায় , এই সখিনা! এই সখি!
এই বার সখিনা চুপ থাকতে পারে না। মুরুব্বিদের মুখে শুনেছে, আল্লার পরে নাকি স্বামীর স্থান। আধো আধো গলায় বলে , কি বলেন?
কদম আলী হা হা হা করে হেসে উঠে। বলে, এই তো আমার সখির মুখে কথা ফুটছে। আবার বলে, একখান কথা কইতাম সখি?
সখিনা বলল, কী?
আমারে মোহরানার টাকাটা মাফ কইরা দে।
সখিনা আমতা আমতা করে বলে, মাফ করতে পারি ; তবে আমারও একটা শর্ত আছে।
কি শর্ত? এই বলে কদম আলী সখিনার আরও কাছে আসে।
সখিনা বাঁধা দেয় না। স্বামীকে বাঁধা দেওয়ার চেয়ে বড় পাপ আর নেই। বলে, শর্তটি হল–আমারে সারা জীবন ভাল বাসন লাগব আর —- এইটুকু বলে সখিনা থেমে যায়।
কদম আলী ব্যাকুল চিত্তে বলে , আর কী?
সখিনা কথা বলে না । মনে মনে ভয় পায়। পাছে স্বামী মাইন্ড করে । তাকে স্বার্থপর , লোভী ভাবে।
কদম আলী ব্যাপারটি বুঝতে পারে । বলে, আল্লা তোরে আর আমারে জোড়া মিলাইছে। আমি কথা দিতাছি , তোরে সারা জীবন ভালা বাসবাম। আর কী সেইটা তাড়াতাড়ি কইয়া ফালা। ডরের কিছু নাই।
এইবার সখিনার মন থেকে ভয়ের কালো মেঘ সরে যায়। স্বামীর বুকে মুখ রাখে। বলে , আমারে একটা জামদানি শাড়ী দেওন লাগব। আমার বহুদিনের স্বপ্ন। ময়মনসিংহ থাকতে স্যারের বউকে দেখতাম পড়ত। আহা কি সুন্দর শাড়ি ! স্যারের বউ আমারে সব সময় বলত , সখি, জামদানি শাড়ী পরলে তোমাকে পরীর মত লাগবে। আমি তোমার জন্য একদিন পরী সাজবার চাই। এক নিঃশ্বাসে এত গুলো কথা বলে সখিনা স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরে।

কদম আলী একটু হতচকিত হয়। সে জীবনে জামদানী শাড়ীর নাম শুনেনি। কত দাম , কোথায় পাওয়া যায় কিছুই জানে না। একটা গাভীর দুধ ও করগাঁও বাজারে সবজি বিক্রি করে কদম আলীদের সংসার কোন মতে খেয়ে না খেয়ে চলে যায়। ঘরে বৃদ্ধ মা বাবা। ছোট ছোট কয়েকটি ভাই বোন। বড় তিন ভাই বউদের পরামর্শে আলাদা খায়। বলা যায়, সমস্ত সংসারের জোয়াল কদম আলীর কাঁধে। তবু আজকের এই মধুরাতে কদম আলী বউয়ের মন পূর্ণিমার আলোর মত রাঙিয়ে দিতে চায়। বলে, অবশ্যই দিবাম। কি খুশী ত?
সখিনা স্বামীর গলা আরও শক্ত করে ধরে রাখে। বলে, খুব খুশী খুব খুশী! খুব খুশি।
কদম আলী বলে, আমারও একটা কথা আছে।
কী কথা?
আমারে কিন্তু আপনে কইরা কইতে পারবি না। পর পর লাগে।
সখিনা হাসতে হাসতে বলে, না, আমি পারুম না। আমার শরম লাগে।
কদম আলী আরও জোরে সখিনাকে বুকে টেনে নেয়। বলে, আয় তোর শরমটা একটু ভাঙাইয়া দেই।

০২
আজ বাদে কাল ঈদ। ঈদুল ফিতর। এইবারের ঈদ সখিনার জন্য অন্যরকম। আজ কদম বাজার থেকে ফিরলেই দুজনে মিলে ভাঙবে মাটির ব্যাংক। গত দু বছরে জমানো টাকা গুনবে। অতঃপর কদম যাবে শহরে। কিনে আনবে সখিনার স্বপ্নের জামদানি। এখনও কদম আসছে না কেন? সখিনা যত্ন করে ভাত বাড়ে। হাতে নেয় তাল পাতার পাখা । কয়েক দিন যাবত বেজায় গরম । সখিনার শরীরে ঘামাচি। একবার ভেবেছিল কদমকে বলবে একটি ট্যালকম পাউডার কিনার জন্য । পরক্ষণেই মনকে বুঝিয়েছে – তাহলে শাড়ী কিনার টাকা যদি কম পড়ে!

এই সখি, এই সখি, তাড়াতাড়ি ভাত দে – এই বলে কদম আলী ঘরে ঢুকে। সখিনা বলে, অনেক দেরী কইরা ফেললা। শহরে যাইবা না?
যামুরে পাগলী যামু। অনেক আগেই আইতে চাইছিলাম। কিন্তু আইজ অনেক কাস্টমার। মেলা বিক্রি অইছে।
সখিনা খিল খিল করে হাসে। বলে, আমার শাড়ীর জন্যই কিন্ত আল্লা রহমত করতাছে। কদম আলীও হাসে । সে হাসিতে আনন্দ যেমন আছে ; তেমনি আছে গোটা সংসারের কষ্টের মানচিত্র!
দুজনে মিলে ব্যাংক ভাঙল। খুব মজা করে টাকা গুনল। কদম আলীর মনে হল, পৃথিবীতে টাকা গুণার চেয়ে আনন্দের আর কিছুই নেই। সর্বমোট এক হাজার সাতশ একুশ টাকা। কে জানে এই টাকায় শাড়ী পাওয়া যাবে কি না! কদম আলীর বুকটা দুরু দুরু করে। কিন্ত সখিনারে বুঝতে দেয় না। বলে, সখি আমি তাইলে শাড়ী কিনতে যাই । সখিনার চোখে মুখে বিশ্ব জয়ের আনন্দ!

আমারে নিবা না —– এই কথা বলে সখি অন্যদিকে মুখ ফিরায়। আকাশের এক কোণে ঘন কালো মেঘ। অনেক গুলো চিল উড়ছে। ঝড়ের আগমনী বার্তা। সখিনার বিয়ের দিনের কথা মনে পড়ে।
কদম আলী মুচকি হেসে বলে, তর যাওনের কাম নাই । আব্বা রাগ করব । মেয়ে মানুষ শহরের বাজারে পুরুষ মানুষের সাথে চলব এইডা আমারও ভালা লাগে না ।
সখিনা আর কথা বাড়ায় না। শুধু বলে, সুন্দর দেইখা কিনবা কিন্তু।
কদম আলী সখিনার কপালে আলতো করে একটি চুমো খায়। সখিনা দেখে কদমের চোখে জল। বুঝতে পারে এই কান্না কষ্টের নয় ; ভালবাসার। গর্বে সখিনার বুক ভরে যায়। আর কদম আলী জোড় কদমে শহরের দিকে পা বাড়ায়।

০৩
কদম আলী পিকাপে উঠে। বসার সিট নাই। দাঁড়িয়েও থাকা যায় না। পিকাপের ছাদে মাথা লেগে যায়। গন্তব্য কিশোরগঞ্জ শহর। গৌরাঙ্গ বাজার। ড্রাইভার যথেষ্ট জোরে চালাচ্ছে । কিন্তু কদম আলীর তর সইছে না। ক্ষণে ক্ষণে ভেসে উঠছে সখিনার মায়াবী মুখ। সেই মুখ যেন কদম আলীরে জাদু করেছে। রাস্তার দু পাশে গাছের সারি। বর্ষার পানি কিছুটা নামতে শুরু করেছে। আকাশের সেই কালো মেঘ এখন আর নেই। কদম আলীর মনে প্রশান্তির ঢেউ। ইতিমধ্যে গাড়ী কিশোরগঞ্জ রেল স্টেশনের পেছনে এসে থামল। কদম আলী সবার আগে নেমে পড়ল।

এই দোস, এই দোস ডাক শুনে কদম আলী পেছনে ফিরে থাকায়। একজন লোক। জীর্ণ-শীর্ণ, রোগা, পাতলা। শরীরের তুলনায় পেট অনেক বড়। হলুদ, কোটরাগত চোখ । মাথার বেশির ভাগই টাক। লাঠি ভর দিয়েও ভাল ভাবে হাঁটতে পারছে না। মনে হয় প্রতিবন্ধী । কদম আলী লোকটার দিকে এগিয়ে যায়। জিজ্ঞেস করে, আমারে কিছু কইছেন?

লোকটি যেন আকাশ থেকে পড়ে। বলে, আমারে চিনতে পারলা না দোস! আমি মরম আলী। ছোট কালে তুমার বাপে আর আমার বাপে আমরারে দোস্তি পাতাইছিল। অবশ্যি না চিনার অই কথা। সেই আমি আর এই আমি এক না। আকাশ পাতাল ফারাক।

কদম আলীর মাথা ঝিম ঝিম করে। পায়ের তলায় মাটি আছে কি না বুঝতে পারে না।
হা ডু ডু খেলায় মরম আলী ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। গায়ে সিংহের মত শক্তি। কেউ তাকে আটকাতে পারত না। একি হাল হয়েছে তার ! কদম আলীর বিশ্বাস করতে মন চাইছে না।
কদম আলী, মরম আলীকে জড়িয়ে ধরে। দু জনেরই চোখের জল বাঁধ মানে না। দু বন্ধু মিলে রেল স্টেশনের উত্তর পাশের বড় বট গাছটার নিচে বসে। কদম আলী জিজ্ঞেস করে, দোস এই অবস্থা কেমনে অইল? আমারে একবার খবর দিলা না কেন?

মরম আলী কথা বলে না। চোখের পানি সব প্রশ্নের জবাব দেয় । অবশেষে চোখের জল বুঝি ফুরিয়ে আসে ! মরম আলীর মনের ঝড় কিছুটা থামে। বট গাছে বসা একটি পাখি কদম আলীর হাতে হাগু করে দেয়। মরম আলী পাখিটাকে বিশ্রি একটা গালি দেয়।

কদম আলী আবার জিজ্ঞেস করে, দোস এই শরীল নিয়া শহরে আইছ ক্যান?
মরম আলী ভাবলেশহীন ; অথচ দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দেয়, – তিনডা কাম ঠিক করছি দোস।
কোন তিনডা?
ভিক্ষা করবাম। চুরি করবাম। এই দুইডাতে কাম না অইলে রেল গাড়ীর নিচে ঝাঁপ দিবাম।
কদম আলীর মাথা ঘুরে যায় । বলে, দোস, একটা কামও ভালা না।
এ ছাড়া আমার যে আর কিছু করার নাই । আল্লা আমারে মরণ দেয় না ক্যান?
এই কথা কইতে নাই দোস । আল্লা নারাজ অইব। আসল ঘটনাডা একটু খোলাসা কইরা কও।

মরম আলী একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে। আর তার অন্তরের কষ্ট গুলো বাতাস ভেদ করে কদম আলীর হৃদয়ে এসে ক্ষেপা সাগরের ঢেউয়ের মত আঁচড়ে পড়ে। অতঃপর মরম আলী বলা শুরু করে — দোস,
অনেক সুন্দর মেয়ে দেইখ্যা বাপ মা বিয়া দিছিল। দুই বছরে দুইডা পোলা অইল। সারাদিন কাম করি। সন্ধ্যার সময় অইলে ঘরে আই। বউয়ের সাথে, পোলা পানের সাথে সোহাগ করি। ভালা সুখেই দিন যাইতাছিল। এরপর আমি কডিন অসুখে পড়লাম। ডাকতর বলল, ঠিক মত অসুধ খাইতে না পারলে বাঁচার আশা নাই। বউ–পোলা পানরে খাওন দিতে পারি না। কাপড় দিতে পারি না। শেষতক ভিটে মাটি বেইচা দিলাম। অহন থাহনের কোন জায়গা নাই। বউরে মিয়া বাড়িতে কামে পাডাইলাম। হে অইখানে আর যাবার চায় না। মিয়া সাব নাকি শরীর ধরতে চায়। ওর দিকে তাকানো যায় না। একটা ছিঁড়া কাপড়। বদলাইয়া গোসল দিবার পারে না । দিন রাইত আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে । শুধু চইল্যা যাইতে চায়। ফাঁস দিয়া মরবার কথা কয় । এই ঈদে —–।

কদম আলী আর শুনতে পারে না। চোখের পানি গাল বেয়ে পড়ে । সখিনার কথা ভুলে যায়। ভুলে যায় সখিনার স্বপ্নের কথা। আস্তে আস্তে হাত ঢুকিয়ে দেয় পকেটে। বের করে আনে এক হাজার সাতশ একুশ টাকা। গুঁজে দেয় বাল্যকালের দোস মরম আলীর হাতে। মরম নিতে চায় না। কদম আলীর দু হাত ধরে কাঁদতে থাকে।


সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। কিছুক্ষণ পরই গ্রাস করবে অন্ধকার। কদম আলীর মনে আলো আর আঁধারের সমান খেলা। এক চোখে বিজয়ের হাসি। বন্ধুর জন্য কিছু করতে পারার আনন্দ। অন্য চোখে জল। কোনটির দাম বেশি কদম আলী বুঝতে পারে না। তার শুধু মনে হয়, মানুষের জীবনে কেন এমন হয়? বিধাতা তো ইচ্ছে করলেই সবাইকে সুখী করতে পারে।

কদম আলী বাড়ির কাছে এসে পড়েছে। বাড়ির সামনের আম গাছটার নিচে সখিনা দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সখিনাকে দেখে আজ তার পা কাঁপছে কেন? পা আর সামনে চলতে চাইছে না কেন? কদম আলীর অজান্তেই হাত দুটো তার পেছনে চলে যায়। সখিনা হয়ত এই হাতের দিকেই তাকিয়ে আছে।
——————————————–