বিভাগের আর্কাইভঃ স্মৃতিকথা

২০ জুন-অরুকথা

FB_IMG_1622

আজ রবিবার। আজকের দিনটা মোটামুটি ভালো কাটল। সকাল সকাল পাখির ডাকের মধ্যেই কেমন কেমন “বিবাহিত বিবাহিত শব্দ ভেসে উঠছিল। কাজ সেরে ভগবানের নাম শুনলাম। খুব ফ্রেস লাগছিল। আজকে রবিবার। রোমান্টিক ওয়েদার। বর আলাদা রুমে। বিবাহিত প্রেম সংসারের রসে মাতা বৌ বৌ ব্যাপারটা আমার মধ্যে ঠিক হয়ে উঠে না। তবে আজকে বর খোঁচায় নি। ঝগড়াটা কম। মারামারি হয়নি। আলাদা রান্না করলেও আমার প্রতি দয়া হল।

আজকে একটু ভালো কাটালাম। আমার যৌবনের দশ বছর কল্পনা করে ভেবে ভেবে কাটল। রোমান্টিক কোন সিনেমা দেখে ভেসে বেড়াতে খুব ভালো লাগে। আগের দিনগুলো বিয়ের প্রথমের দিনগুলো মনে পড়ে গেল। একসঙ্গে খাওয়া। স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমানো এগুলো সব ই একটা মেয়ের জীবনে ভোলার নয় । যতই অসুখী জীবন হোক না কেন এটুকু সুখ সবার জীবনেই আসে।

ঘুমঘুম চোখ। আবছা আবছা বৃষ্টি। ছুটে যাওয়া জল। তাঁর রোমান্সে থইথই মন ভিজে যেন একাকার। বিয়ের পরের দিনগুলো দিনগুলো প্রতিটি মেয়ের জীবনে স্মরণীয়। অরুর মন্দিরে বিয়ে। কেউ মানে না। তবু বিয়ে। বাচ্চা সংসার। সংসারের কাজ। মারধর। যন্ত্রণা। সবকিছুই আছে।

চারিদিকে রিমঝিমিয়ে বৃষ্টি। বিবাহিতদের প্রেম বলতে গলায় জোর ফাঁস। আস্তে আস্তে চাঁদের বেরিয়ে আসা। নিঝুম শান্ত রাতের আকাশ। শুধুই দীর্ঘশ্বাস। মাঝে মাঝে ব্যাকুল বাতাস মনকে আনচান করিয়ে দেয়। কেন যে কবি কবি মনটি সুকান্ত হয়ে ওঠে নির্লজ্জভাবে বুঝতে পারি না। কোমল পাথরগুলো শক্ত পাষান এ মাথা ঠুকরে কাঁদতে থাকে। তবু কোকিলের সঙ্গে গান গাইতে গাইতে ডিমপাড়া আর হয়ে ওঠে না।

বৃষ্টি ঝমঝমিয়ে কাঁপলে আজ আর ভালো লাগে না কেমন উদাস হয়ে গেছে ভাঙা মন। হিংসা আর অত্যাচারের আগুনে সব আশাগুলো ছাই হয়ে গেছে। অর্থ যে সব সেটা শ্বশুড়বাড়ি র লোকেরা আঙুল চোখে দিয়ে দেখিয়ে দেয়। রোজ এক দিন কাটাতে হয় বলে কাটাই বাঁচতে হয় তাই বাঁচি।

মরে গেলে পুড়িয়ে আর একটা বিয়ে করে নেবে। আবার নতুন সংসার করবে। প্যানপ্যান সোহাগরাত আর সংসারের নতুনত্ব গন্ধের প্রথম চারমাসের ন্যাকামি।

আমার আর ছোটবেলা র দিন মনে পড়ে না মাকেও না বাবাকেও না। মনে হয় আমি একা একা ই পৃথিবীতে এসেছি। আমার কেউ নেই। গাছ গুলো আকাশগুলো পাতাগুলো বৃষ্টিগুলো ই আমাকে ভালোভাবে চেনে বৃষ্টির শব্দগুলো ছাড়া কেউ ই আমাকে ভালোভাবে চিনল না।

আমার আমি কে? চিনতে পারছি না ছোটবেলায় চিনেছিলাম এখন হারিয়ে ফেলেছি। সেই স্কুল, বান্ধবীর দল, টিফিন, লাইন মারা, আমি না বান্ধবীদের লাইন মারা দেখতে খুব ভালো লাগত। কেমন একটা ফুরফুরে আবহাওয়া ঘুরে জীবনের আশপাশ।

এখনকার বিবাহিত বেকার বোরিং আর ভালো লাগে না। সংসার জিনিসটাই বিষাক্ত মনে হয়। বিরক্তিকর অসহ্য নরক মনে হয়।

জাবরকাটা ৫

456454

আমাদের ছোটবেলাটা আজকের বাচ্চাদের শৈশবের মতো এমন তুতুপুতু ছিল না। ছিল না এতরকম অনর্থক ‘এটা কোরোনা কার্টসি শেখো, ওটা কোরোনা প্রোটোকল জখম হবে’ র ত্রিবন্ধনী। পড়ার সময় বাদে অন্য সময় চেটেপুটে সদব্যবহার করেছি। দেখেছি দুচোখ মেলে। সেদিনের দেখে শেখা আজও বহু কাজে লাগে। মাঝেমাঝে নিজের মধ্যে নিজে একলা ডুব দিলে দেখা দৃশ্য সিনেমায় রূপান্তরিত হয়ে মনের চোখের পাতায় খেলা করে।

বলতে গেলে ভারতের মোটামুটি প্রায় সব ভাষাভাষী মানুষের সান্নিধ্যে এসেছি। খুব কাছ থেকে দেখেছি তাদের। প্রত্যেক প্রদেশের মানুষের বিভিন্ন অভ্যাসে যে স্বতন্ত্রতা আছে তাকে অনুভব করেছি। উত্তরের খাওয়া আর দক্ষিনী খাওয়া যেমন মেলে না, ঠিক তেমনি দৈনন্দিন আচার, অভ্যাসও আলাদা।
ওড়িয়ারা এমনিতে খুবই শান্ত প্রকৃতির আর স্বভাববাধ্য মানুষ। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে? থাকেও সর্বদাই। কিন্তু শান্ত, সাংঘাতিক কর্মঠ এই মানুষগুলোকে মিশলেই ভালোবেসে ফেলা যায়। ওড়িয়া ভাষাও শিখেছিলাম সেই সময়ে। আজ চর্চার অভাবে ভুলে গেছি।

পখলভাতঅ মানে পান্তাভাত আর রাগঅ মানে ঝাল ওদের খুব পছন্দের খাবার। মাছ বেশি ভালোবাসে মাংসের চেয়ে। সাধারণ নিম্নবিত্তরা গুড়াকুর নিয়মিত নেশা করে। মিষ্টির মধ্যে ওদের প্রিয় মালপোয়া। এটা ওরা প্রত্যেক বাড়ীতেই বানায় উৎসবে, ব্যসনে।

অন্ধ্রের লাগোয়া গঞ্জাম জেলার ওড়িয়ারা তাদের ভাষায়, খাবারে পরিস্কার তেলেগু ছাপ বহন করে। আর মজার ব্যাপার হলো মেয়ের জন্যে ওদের কাছে সবচেয়ে ভালো পাত্র হলো মেয়ের মামা।
আমরা যেমন দোসা খাই ঠিক সেরকমটি তামিল রা খায় না। ওরা নারকেল তেলে ভাজা প্লেন দোসা ভেতরে কোনোরকম পুর ছাড়াই নারকেলের চাটনি দিয়ে খায়। অসম্ভব টক দই ওদের খুব প্রিয়। লুঙ্গির মতো ধুতি যাকে ওরা বলে ভেস্টি, এখনো বহু তামিল, তেলেগু, মালয়ালি পরেন।

গোলগাপ্পা মানে আমাদের ফুচকার ভেতরে গোলাপের পাপড়ি আর বোঁদে দিয়ে কি যে অখাদ্য করে তুলে পরম তৃপ্তিতে পাঞ্জাবীরা খায় সেটা পাঞ্জাবে না গেলে জানতেই পারতাম না। ওদের লস্যির গ্লাস ভারী অদ্ভুত। অনেকটা শঙ্কুর মতো। নীচে সরু ওপরে চওড়া। সাধারণ মানুষেরা কিন্তু খুবই সরল।

বেশিরভাগ রাজস্থানী হিন্দু আর জৈন দু ধর্মই পালন করেন। গরম রুটিতে পাকা ঘি লাগিয়ে উচ্ছে ভাজা আর মাঠঠা মানে ঘোল দিয়ে পরিতৃপ্তির সঙ্গে ওরা খায়। সঙ্গে অবশ্যই লংকা কিম্বা লেবুর আচার আর আগুনে সেঁকা পাঁপড়।

ওই রুটিই আবার গমের বদলে বাজরার আটার হলে গুজরাতিদের প্রিয়। ব্যাসনের লাড্ডু পশ্চিমাঞ্চলের প্রিয় মিষ্টি।

নাগারা শুনেছিলাম কুকুর খায়। সত্যিই খায়। তবে সব নাগারা খায় না। ওদের মধ্যে বিশেষ দু একটা উপজাতি কুকুরের মাংস খায়। এটা ওদের খুব প্রিয় মাংস। তবে কুকুর পুড়িয়ে খাওয়াই ওরা বেশি পছন্দ করে।

বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। এত ছোট্ট পরিসরে এত বলা সম্ভব নয়। কিন্তু, আমি তাদের সেইসময়ে এত কাছ থেকে দেখেছি, খেলেছি, ভাব হয়েছে, ঝগড়া হয়েছে, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে অখন্ড ভারত আছে সেদিন বুঝিনি। আজ একান্তে বসে অনুভব করি গান গাইতে গাইতে শীতের দুপুরে পাঁপড় বেলা মধ্যবয়সীনির দল আর আমার মায়ের মধ্যে একটুও তফাৎ ছিল না সেদিন, আজও নেই।

স্মৃতির পাতা হতে!

hqdefault

সাল ফাল মনে নেই। হবে হয়ত ষষ্ঠ অথবা সপ্তম শ্রেনীতে পড়ি। স্কুলে এই প্রথম বার্ষিক পুরস্কার বিরতনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বলতে গেলে ইউনুস স্যারের একক চেষ্টার ফসল। যাদের সামর্থ আছে তাদের ৫/১০ টাকা করে চাঁদা ধরা হয়েছে। তখনকার দিনে এমন অংক একজন ছাত্রের পক্ষে বহন করা সম্ভব ছিলনা। বাড়িতে অনেক বুঝিয়ে আমিও আমার অংশ স্যারের হাতে তুলে দিতে সমর্থ হয়েছিলাম।

অনুষ্ঠানের দিন সকাল হতে চারদিকে সাজ সাজ রব। স্কুলে নতুন কিছু ঘটতে যাচ্ছে এমন চিন্তায় আমার মত অনেকেরই আগের রাতে ভাল ঘুম হয়নি। তাছাড়া আমিও একটা পুরস্কার পেতে যাচ্ছি চিন্তাটা মাথা হতে ফেলতে পারছিলাম না।

ঢাকা হতে শিল্পীরা আসার কথা। সবাই আমরা অপেক্ষা করছি। কিন্তু কারও দেখা নেই। বশির আহমেদের মত তারকা শিল্পীর দেখা পাওয়া তখনকার দিনে সহজ ছিলনা। তিনিও ছিলেন শিল্পীদের তালিকায়।

বিকেল তখন ৪টা। ইউনুস স্যার আমাকে সামনে পেয়ে আটকালেন। নির্দেশ দিলেন হেডস্যারের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। উনারা সবাই কোথাও যাচ্ছেন কিছুক্ষণের জন্যে। মূল উদ্দেশ্য ঢাকা হতে ইতিমধ্যে কেউ এসে পরলে আমি যেন স্বাগত জানিয়ে স্যারদের ওয়েটিং রুমে বসতে দেই।

তীর্থের কাকের মত আমি দাঁড়িয়ে আছি। কারও দেখা নেই। হতাশ হয়ে ইতিউতি করছি। অপরিচিত একজনকে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। ছোট খাট কালো মত একজন মানুষ। হাতে একটা ডায়রি। গলায় সাদা একটা চাদর। বুঝতে অসুবিধা হলোনা নিশ্চয় আমন্ত্রিত গায়কদের কেউ।
লম্বা একটা সালাম দিলাম।

কারও পরিচয় জানার কিছু পুথিগত ভাষা আছে, ঐ মুহূর্তে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে গেল।
যেকোন ভাবেই হোক জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কে?
মৃদু একটা হাসি দিয়ে বললেন, ‘আমি আবদুল আলিম’
পল্লিগীতির সম্রাট আবদুল আলিম আমার সামনে দাঁড়িয়ে।

আর কারও না হোক, আমাদের বাড়িতে আব্বা ছিলেন এই গায়কের একান্ত ভক্ত। ভাল সময় মন্দ সময়ে তিনি গুন গুন করে গাইতেন এই শিল্পীর মরমী অনেক গান। আব্বাস উদ্দিনও তালিকার বাইরে ছিলেন না।

সময়ের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে যাপিত জীবনের অনেক কিছুই ফিঁকে হয়ে যায়। তবে কিছু স্মৃতি আছে আজীবনের জন্যে মনে গেঁথে যায়। শিল্পী আবদুল আলিমের সাথে দেখা হওয়াটা ছিল তেমনি এক স্মৃতি।

প্রেম প্রবঞ্চিতকে কী দেয় ?

প্রেম আপন গভীরতায় নিজের মধ্যে একটি মোহাবেশ রচনা করে। সেই মোহের দ্বারা যাকে ভালোবাসি আমরা তাকে নিজের মনে মনে মনোমত গঠন করি। যে সৌন্দর্য তার নেই, সে সৌন্দর্য তাতে আরোপ করি। যে গুণ তার নেই, সে গুণ তার কল্পনা করি। সে তো বিধাতার সৃষ্ট কোনো ব্যক্তি নয়, সে আমাদের নিজ মানসোদ্ভূত এক নতুন সৃষ্টি। তাই কুরূপা নারীর জন্য রূপবান, বিত্তবান তরুণেরা যখন সর্বস্ব ত্যাগ করে, অপর লোকেরা অবাক হয়ে ভাবে, “কী আছে ঐ মেয়েতে, কী দেখে ভুললো?” যা আছে তা তো ঐ মেয়েতে নয়– যে ভুলেছে তার বিমুগ্ধ মনের সৃজনশীল কল্পনায়। আছে তার প্রণয়াঞ্জনলিপ্ত নয়নের দৃষ্টিতে। সে যে আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তাহারে করেছে রচনা। জগতে মূর্খরাই তো জীবনকে করেছে বিচিত্র; সুখে দুখে অনন্ত মিশ্রিত। যুগে যুগে এই নির্বোধ হতভাগ্যের দল ভুল করেছে, ভালোবেসেছে, তারপর সারা জীবন ভোর কেঁদেছে। হৃদয় নিংড়ানো অশ্রুধারায় সংসারকে করেছে রসঘন, পৃথিবীকে করেছে কমনীয়। এদের ভুল, ত্রুটি, বুদ্ধিহীনতা নিয়ে কবি রচনা করেছেন কাব্য, সাধক বেঁধেছেন গানচিত্র, ভাষ্কর পাষাণ-খণ্ডে উৎকীর্ণ করেছেন অপূর্ব সুষমা।

জগতে বুদ্ধিমানেরা করবে চাকরি, বিবাহ, ব্যাংকে জমাবে টাকা, স্যাকরার দোকানে গড়াবে গহনা; স্ত্রী, পুত্র, স্বামী, কন্যা নিয়ে নির্বিঘ্নে জীবন-যাপন করবে সচ্ছন্দ সচ্ছলতায়। তবু মেধাহীনের দল একথা কোনদিনই মানবে না যে, সংসারে যে বঞ্চনা করল, হৃদয় নিয়ে করল ব্যঙ্গ, দুধ বলে দিল পিটুলী– তারই হলো জিত, আর ঠকল সে, যে উপহাসের পরিবর্তে দিল প্রেম। অতি দুর্বল সান্ত্বনা। বুদ্ধি দিয়ে, রবি ঠাকুরের কবিতা আবৃত্তি করে বলা সহজ–

জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা
ধূলায় তাদের যত হোক অবহেলা।

কিন্তু জীবন তো মানুষের সম্পর্ক বিবর্জিত একটা নিছক তর্ক মাত্র নয়। শুধু কথা গেঁথে গেঁথে ছন্দ রচনা করা যায়, জীবন ধারণ করা যায় না।যে নারী, প্রেম তার পক্ষে একটা সাধারণ ঘটনা মাত্র। আবিষ্কার নয়, যেমন পুরুষের কাছে। মেয়েরা স্বভাবত সাবধানী, তাই প্রেমে পড়ে তারা ঘর বাঁধে। ছেলেরা স্বভাবতই বেপরোয়া, তাই প্রেমে পড়ে তারা ঘর ভাঙ্গে। প্রেম মেয়েদের কাছে একটা প্রয়োজন, সেটা আটপৌরে শাড়ির মতই নিতান্ত সাধারণ। তাতে না আছে উল্লাস, না আছে বিষ্ময়, না আছে উচ্ছ্বলতা। ছেলেদের পক্ষে প্রেম জীবনের দুর্লভ বিলাস, গরীবের ঘরে ঘরে বেনারসী শাড়ির মতো ঐশ্বর্যময়, যে পায় সে অনেক দাম দিয়েই পায়। তাই প্রেমে পড়ে একমাত্র পুরুষেরাই করতে পারে দুরূহ ত্যাগ এবং দুঃসাধ্যসাধন।জগতে যুগে যুগে কিং এডওয়ার্ডেরাই করেছে মিসেস সিম্পসনের জন্য রাজ্য বর্জন, প্রিন্সেস এলিজাবেথরা করেনি কোনো জন, স্মিথ বা ম্যাকেঞ্জির জন্য সামান্য ত্যাগ। বিবাহিতা নারীকে ভালোবেসে সর্বদেশে সর্বকালে আজীবন নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়েছে একাধিক পুরুষ; পরের স্বামীর প্রেমে পড়ে জীবনে কোনদিন কোনো নারী রয়নি চিরকুমারী। এমন প্রেমিকের জন্য কোন দিন সন্ধ্যাবেলায় তার কুশল কামনা করে তুলসীমঞ্চে কেউ জ্বালাবে না দীপ, কোন নারী সীমন্তে ধরবে না তার কল্যাণ কামনায় সিদুরচিহ্ন, প্রবাসে অদর্শনবেদনায় কোন চিত্ত হবে না উদাস উতল। রোগশয্যায় ললাটে ঘটবে না কারও উদ্বেগকাতর হস্তের সুখস্পর্শ, কোনো কপোল থেকে গড়িয়ে পড়বে না নয়নের উদ্বেল অশ্রুবিন্দু। সংসার থেকে যেদিন হবে অপসৃত, কোন পীড়িত হৃদয়ে বাজবে না এতটুকু ব্যথা, কোনো মনে রইবে না ক্ষীণতম স্মৃতি।

প্রেম জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য, মৃত্যুকে দেয় মহিমা। কিন্তু প্রবঞ্চিতকে দেয় কী? তাকে দেয় দাহ। যে আগুন আলো দেয়না অথচ দহন করে।সেই দীপ্তিহীন অগ্নির নির্দয় দাহনে পলে পলে দগ্ধ হলেন বহু কাণ্ডজ্ঞানহীন হতভাগ্য পুরুষ।। (দৃষ্টিপাত)

=====
লেখকঃ কাতার প্রবাসী সাংবাদিক ও ব্যবসায়ী।

স্মৃতিকথনঃ হয়তো সেই “ভুল মনে হওয়াটা”ও ভুল ছিলো

সবার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিলাম ড্রাইভার বললো,
“একটু ডানে তাকান”।

একজন ত্রিশোর্ধ্ব মহিলা তাকিয়ে ছিলেন।

জানতে চাইলাম,
“কে উনি?”

“কয়েক মাস ধরে যে আপনার সাথে দেখা করতে চেয়েছে।”
পোস্তুন ড্রাইভার জবাব দিলো।

আমার বাঙালি বাবুর্চি খাবার পরিবেশনের সময় বেশ কবার মহিলাটির অনুরোধের কথা জানিয়েছিলো। সে ইউএস প্রবাসী; রহস্যময় কারণে পাকিস্তানে অবস্থান করছিলো। বাবুর্চি ছাড়া আরো কেউ বিষয়টা জানতো ধারণা করিনি।

যে বিশ্বাস নিয়ে তাঁর সাথে দেখা করিনি তখন সেটাকে ভুল মনে হলো।

হয়তো সেই “ভুল মনে হওয়াটা”ও ভুল ছিলো।
কে জানে?!

ভুল মানুষেরই হয়

কথায় আছে, ‘ভুল মানুষেরই হয়! ভুল হয় না শয়তানের।’ তাই আমারও ভুল হওয়াটা স্বাভাবিক! কারণ আমিও তো একজন মানুষ, তাই। তবে জীবন চলার পথে অনেক ভুলই আমার হয়েছিলো। যেমন– চলার পথে রাস্তা ভুলে গিয়ে অন্য রাস্তায় চলে গিয়েছিলাম। ভুল করে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলাম। আবার ঠাণ্ডা পানি মনে করে সেভেনাপ গিলে ফেলেছিলাম। ভুল করে টিপ তালার চাবি ঘরে রেখে দরজায় তালা ঝুলিয়ে গিয়েছিলাম। তরকারির রান্না করার সময় লবণ মনে করে চিনি দিয়েছিলাম অনেকবার! ভোররাতে অন্ধকার ঘরে নিজের লুঙ্গি মনে করে গিন্নীর পেটিকোট পরে রাস্তায় বেরিয়েছিলাম একবার। রাস্তায় হেঁটে যাওয়া অন্যের স্ত্রীকে পেছন থেকে নিজের স্ত্রী ভেবে নাম ধরে ডেকে ক্ষমাও ছিলাম। নিজের ঘনিষ্ঠ পরিচিত মনে করে অন্যজনকে জড়িয়ে ধরিয়ে সরিও বলেছিলাম। নিজের বাবা মনে করে অন্যজনকে বাবা বলে ডেকে লজ্জায় মাথা নিচু করেছিলাম। ভুল করে দোকানে বা যাত্রীবাহী বাসে মোবাইল ফেলে চলে এসেছিলাম। ভুল করে অপরিচিত নাম্বারে কল করেছিলাম অহরহ! তা এখনও সময় সময় হয়ে থাকে। ভুল করে গুরুজনের সাথে অন্যায় করে মাপও চেয়েছিলাম। হিসাবের খাতায় ভুল তো এখনো হয়। ভুল করে প্রেমে করেছিলাম। তারপর বিয়ে। এমন হাজার রকমের ভুলের মধ্যে কয়েকটা ভুলের কথা আজও ভুলতে পারছি না। যেই ভুলগুলো আজও নিজের মনটাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, সেই ভুলগুলোই আজ সবার মাঝে তুলে ধরলাম।

ভুল-১
তখন আমি খুব ছোট ছিলাম। সময়টা হতে পারে ১৯৭৪ সাল। তখন আমরা সপরিবারে থাকতাম, নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানাধীন লক্ষ্মণ খোলা সংলগ্ন আদর্শ কটন মিলের ভেতরে শ্রমিক কলোনিতে। আমার বড় দাদা চাকরি করতেন আদর্শ কটন মিলে। আর বাবা চাকরি করতেন শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম পাড় সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন গোদনাইল এলাকায় চিত্তরঞ্জন কটন মিলে। একদিন সকালবেলা বাবা চিত্তরঞ্জন মিলের উদ্দ্যেশে বাসা থেকে বের হয়। এরপর আমার মা আমাকে বললো, ‘তাড়াতাড়ি গিয়ে তোর বাবাকে বল, মিল থেকে বাসায় আসার সময় যেন আমার জন্য পান সুপারি নিয়ে আসে।’ ততক্ষনে আমার বাবা বাসা থেকে বেরিয়ে গুদারা ঘটে গিয়ে পৌঁছায়।

আমি মা’র কথা শুনে বাবাকে পান সুপারির কথা বলতে দৌড়াচ্ছিলাম। দৌড়াচ্ছি আর দেখছি বাবা মিলের ডিউটি ধরার জন্য দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, পেছন ফিরে তাকাচ্ছে না। আমিও বাবা বাবা বলতে বলতে একসময় বাবার খুব কাছে পেছন থেকে জোরে বাবা বাবা বলে ডাক দিতেই বাবার মতো লোকটি পেছন ফিরে তাকালো। হায় হায়! এ দেখছি আমার বাবা নয়! লোকটি ছিলো অপরিচিত অন্য একজন পথচারী। কিন্তু পেছন থেকে লোকটিকে দেখতে হুবহু আমার বাবার মতই দেখা যাচ্ছিল। তারপর আমার ডেকে লোকটি দাড়ালো। জিজ্ঞেস করলো, ‘এই বেডা, আমারে কিছু কইতাচস?’ আমি অক্কার মা টক্কা হয়ে শরমে মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিলাম, না। লোকটা আমার ভুল হয়েছে বুঝতে পেরে মুচকি হেসে উনার পথে উনি চলে গেলো।

ভুল-২
একসময় আমি আর আমার বড় দাদা ফতুল্লা কাঠের পুল মিলন টেক্সটাইল মিলে কাজ করতাম। আমরা দুই ভাই একজোড়া তাঁত পার্মানেন্ট চালাতাম। বড় দাদা কাজ করতো দিনে, আর আমি করতাম রাতে। তখন আমাদের ফ্যামেলি বাসা ছিলো, নারায়ণগঞ্জ গলাচিপা গোয়াল পাড়া। ফতুল্লা মিলন টেক্সটাইল থেকে আমাদের বাসার দূরত্ব ছিলো প্রায় ৪ কিলোমিটার। প্রতিদিন এই ৪ কিলোিটার পথ পায়ে হেঁটে আসা-যাওয়া করে কাজ করা সম্ভব হচ্ছিল না। আবার তখনকার সময়ে নারায়ণগঞ্জ-টু-ঢাকা যাত্রীবাহী মুড়ির টিন করে আসা-যাওয়া করাও সম্ভব ছিলো না, টাকার খুবই দাম ছিলো বলে।

যদিও তখন নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা সদরঘাট পর্যন্ত মুড়ির টিন স্টার্টবাসে জনপ্রতি ভাড়া ছিলো ১.৫০ পয়স। নারায়ণগঞ্জ থেকে ফতুল্লা পোস্ট অফিস পর্যন্ত ভাড়া ছিলো ০.৬০ পয়সা। তবুও এই ০.৬০ পয়সা করে আসা-যাওয়ায় জনপ্রতি ১.২০ পয়সা খরচ করা কিছুতেই সম্ভব ছিলো না। কারণ প্রতিদিন দুইজনের আসা-যাওয়ায় খরচ ২.৪০ পয়সা তখনকার সময়ের জন্য ছিলো অনেককিছু।

তাই আসা-যাওয়ার খরচ বাঁচানোর জন্য আমরা দুই ভাই মিলের ভেতরেই ব্যাচেলর শ্রমিকদের সাথে আলাদা থাকতাম। প্রতি বৃহস্পতিবার সপ্তাহের বেতন পেয়ে বাসায় যেতাম। শুক্রবার ঘোরাফেরা করে আবার শনিবার সকালে নারায়ণগঞ্জ গোয়াল পাড়া থেকে পায়ে হেঁটে ফতুল্লা মিলন টেক্সটাইল মিলে যেতাম। রান্না-বান্না মিলের ভেতরে ব্যাচেলর কোয়ার্টারে নিজেদের টা নিজেরাই করতাম। দশজনের সাথে মিলে-মিশে ম্যাচে খেতাম না। তো প্রতিদিন আমাদের দুই ভাইয়ের রান্না-বান্না টা বেশিরভাগ সময় আমার কাঁধেই পড়তো। কারণ আমি রাতে ডিউটি করে সারাদিনই থাকতাম ফ্রি, তাই। একদিন সকালবেলা ডিউটি শেষ করে মিলের কোয়ার্টারে এসে হাতমুখ ধুয়ে চা দোকানে গেলাম। চা-বিস্কুট খেলাম। সিগারেট টানলাম। চা দোকান থেকে কোয়ার্টারে আসার সময় নিজের প্রয়োজনমতো কয়েকটা সিগারেট সাথে নিয়ে গেলাম।

ব্যাচেলর রুমে গিয়ে ভাতের হাঁড়িতে দুই ভাইয়ের একবেলা খাবারের আন্দাজমত চাল নিলাম। চালগুলো ধুয়ে স্টোভ জ্বালিয়ে ভাতের হাঁড়ি স্টোভের উপরে বসালাম। স্টোভ জ্বলছে। ভাতের হাঁড়িতে থাকা চাল-সহ পানি গরম হচ্ছে। আমি সারারাত জেগে তাঁতের কাজ করাতে আমার ছিলো ঘুমের ভাব। তখন চোখে ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে চৌকির উপরে শরীরটাকে লেলিয়ে দিলাম। হাতে ছিলো একটা সিগারেট জ্বালানো। দুই আঙুলে চিপায় সিগারেট রেখে কাত হয়ে কোমড়ের উপরে হাত রেখে শুয়ে রইলাম। যেই হাত কোমড়ের উপরে ছিলো, সেই হাতেই ছিলো জলন্ত সিগারেট। হাতে সিগারেট নিয়েই কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম, তা আর একটুও টের পাইনি। এই ঘুমের মাঝেই আমার জ্বালানো সিগারেটটা আঙুলের চিপা থেকে পরনের লুঙ্গিতে পড়ে যায়। সাথে সাথে পরনের লুঙ্গি পুড়তে থাকে। কিন্তু আমি একটুও টের পাচ্ছিলাম না।

টের পেয়েছি তখন, যখন আঙুলের চিপা থেকে সিগারেট পরনের লুঙ্গি পড়ে জ্বলতে জ্বলতে নিজের পা পুড়ছিলো, তখন। সিগারেটের আগুনে যখন পরনের লুঙ্গি পুড়ে পা পুড়ে যাচ্ছিল, তখন ঘুম থেকে জেগে দেখি, আমার পরনের নতুন লুঙ্গিটা জ্বলছে। আবার লুঙ্গির আগুনে আমার দুই পায়ের হাঁটুর উপরিভাগে ঠোসা পড়ে গেছে। ভাতের হাঁড়ির পানিও শুকিয়ে গেছে। তখন বিছানা থেকে তাড়াতাড়ি লাপ দিয়ে উঠে হাউমাউ করে চিল্লাতে চিল্লাতে লুঙ্গির আগুন নেবাতে থাকি। আমার ডাক চিৎকার শুনে পাশের রুম থেকে আরও কয়েকজন তাঁতি দৌড়ে আসলো। মিল থেকে বড় দাদা-সহ আরও অনেকই এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘ঘটনা কী?’ সাথের শ্রমিক ভাইয়েরা আমার বড় দাদাকে পোড়া লুঙ্গিটা দেখিয়ে বললো, ‘দেহেন বাবু আম্নের ছোডু ভাইয়ে কারবার!’ বড় দাদা কপালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘এভাবে নতুন লুঙ্গিটার অর্ধেকের বেশি পুড়লো কীভাবে?’ সবাই হাসতে হাসতে বললো, ‘আরে বাবু, শয়তানে বোমা ফাডাইছে!’

ভুল-৩
আমার একটা ভালোবাসার কুকুর ছিল। এখনো আছে। আদর করে ওর নাম রেখেছিলাম ‘ধলু’। আমি থাকি পরের বাড়িতে ভাড়া। এক বাড়িতে শুধু আমিই ভাড়াটিয়া নয়, একসাথে আরও অনেকেই ভাড়া থাকে। আবার ভাড়া বাড়ির পাশে আরও অনেকের বাড়ি থাকে। পাশের বাড়িতেও কুকুর আছে। এমনিতেই একটা কুকুর আরেকটা কুকুর দেখলেই শত্রু ভেবে ঘেউ-ঘেউ করতে থাকে। আমার ভালোবাসার ‘ধলু’ গরিবে ‘ধলু’ হলেও, ও কখনোই নিজেকে গরিব ভাবতো না। পাশের বাড়ির বড়লোকের কুকুর দেখলেই ‘ধলু’র ঘেউঘেউ শব্দে আরও দশটা বাড়ির লোকজন আতঙ্কিত হয়ে পড়তো। সাথে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়তো আমার পাশে থাকা ভাড়াটিয়ারা। কিন্তু ‘ধলু’ কাউকে কামড় দিতো না। তারপরও পাশের বাড়ির বড়লোকদের জ্বালায় আমার ‘ধলু’কে আর ভাড়া বাড়িতে রাখতে পারলাম না৷ একসময় ভালোবাসার আদরের ‘ধলু’কে শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বপাড় নিয়ে ছেড়ে দিই। সময়টা তখন করোনা কালের লকডাউনে আলামত। তখন নদী পারা-পারে নিয়জিত থাকা প্রায় খেয়া নৌকাও ছিলো বন্ধ। কিন্তু নদী পাড় হতে আমার ‘ধলু’র নৌকার প্রয়োজন হতো না। ও সাঁতরে নদীর পূর্ব পাড় থেকে পপশ্চিম পাড়ে চলে আসতে বীরদর্পে। আবার নিয়ে যেতাম শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পাড়। এভাবে তিন-চার দিন এপার-ওপার করার পর এখন ‘ধলু’ শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পাড়েই স্থায়ীভাবে বসবাস করছে।

ক’দিন আগে ‘ধলু’কে দেখতে গিয়েছিলাম নদীর পূর্ব পাড় চৌরাপাড়া এলাকায়। অনেক খোঁজা-খুঁজির পর ‘ধলু’র সন্ধান পেলাম। নিয়ে গেলাম একটা চা দোকানে। ‘ধলু’কে তিনটা পাউরুটি খাওয়ালাম। আমি চা-বিস্কুট খেলাম। এরপর ‘ধলু’র সাথে খেলা করতে করতে দোকান থেকে বের হলাম। দোকানদার আমার দিকে চেয়েই থাকলো, কিছুই বললো না। আমিও ‘ধলু’র কাছ থেকে কেটে পড়তে পারছিলাম না। ‘ধলু’ কিছুতেই আমার পিছু ছাড়ছিল না। তখন একটা ব্যাটারি চালিত রিকশা ডেকে বললাম, ‘ভাই, আপনার রিকশার যত স্প্রিরিট আছে, সেই স্পিরিটে রিকশা চালাবেন। কারণ এই ‘ধলু’র থেকে আমাকে আড়াল হতে হবে।’ আমার কথা শুনে রিকসাওয়ালা রাজি হলো। আমি রিকশায় উঠলাম। রিকশা চলছে দ্রুত গতিতে। রিকশার পেছনে পেছনে আমার ভালোবাসার ‘ধলু’ও দৌড়ের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে দৌড়াচ্ছে।

এভাবে প্রায় এক কিলোমিটার পথ অতিক্রম করার পর ‘ধলু’কে রাস্তার আরও কয়েকটা কুকুরে আক্রমণ করে ফেললো। ‘ধলু’ অপরিচিত কুকুরগুলোর সাথে ফাইট শুরু করে দিলো। সেই সুযোগে আমি রিকশা নিয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে আবার সেই বাজারে সেই দোকানের সামনে আসলাম। দোকানদার তার বেচা বন্ধ করে আমার দিকে তাকাচ্ছিল। আমি দোকানদারে দিকে চেয়ে লজ্জায় পড়ে গেলাম! দোকানদারে সামনে গিয়ে ১০০/= টাকার একটা নোট বের করে দিয়ে বললাম, ‘ভাই তখন আমার ‘ধলু’র থেকে কেটে পড়ার টেনশনে ছিলাম। তাই আপনার পাউরুটি আর চায়ের দাম দিতে ভুলেই গিয়েছিলাম। এখন আপনার রুটি চায়ের দামটা রেখে দিন। দোকানদার মুচকি হেসে আমার হাত থেকে ১০০/=টাকার নোট খানা নিয়ে আমাকে ৬৫/=টাকা ফেরত দিয়ে বললো, ‘ভাই, সত্যি আমি কিছু মনে করেনি। ভুল তো মানুষেরই হয়! আপনারও হয়েছে, তাতে কী আর এমন হয়েছে!’

ভুল-৪
গেলো ক’দিন আগে সকালবেলা অফিসে গেলাম। অফিসের কাজ সেরে টিক দুপুরবেলা বাসায় ফিরলাম। গিন্নী আমার আগেই খেয়ে-দেয়ে আশা সমিতির একটা মিটিংয়ে যোগ দিতে বাসা থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেলো। যাবার আগে আমাকে বলে গেলো, ‘খাওয়া-দাওয়া কইরা যদি কিছু থাহে, তাইলে ফ্রিজে ঢুকাইয়া থুইও।’ আমি মাথা নেড়ে গিন্নীকে সায় দিলে, গিন্নী তার নিজের কাজে চলে যায়। আমি স্নান করে মনের আনন্দে খেতে বসলাম। মনের আনন্দ শুধু গুড়া মাছের তরকারির জন্য। সেদিন গুড়া মাছ রান্না হয়েছিলো। ভাত খেতে বসে গুড়া মাছের তরকারির ঝোল দিয়ে ভাত মেখে প্রথম নলা মুখে দিয়ে দেখি তরকারিতে লবণ বেশি! মনের আনন্দটা মুহূর্তেই বিলীন হয়ে গেলো। কী আর করা, নামমাত্র দু’মুঠো খেয়ে বাদবাকি তরকারি ফ্রিজে রেখে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে উঠলাম বিকাল পাঁচটার সময়।

ঘুম থেকে উঠেই ভাবছি শখের গুড়া মাছের তরকারির কথা। ভাবলাম স্বাদের তরকারিতে আরেকটু জল মিশিয়ে গ্যাসের চুলায় গরম করলেই তো তরকারির লবণ ঠিক হয়ে যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। ফ্রিজ থেকে তরকারির বাটি বের করলাম। বাটি থেকে তরকারি গুলো একটা ছোট কড়াইতে ঢেলে এর সাথে পরিমাণমতো জল মেশালাম। গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে তরকারির কড়াই বসালাম। চুলা জ্বলছে। স্বাদের গুড়া মাছের তরকারিও গরম হচ্ছে। আমি ঘরে এসে মোবাইল অন করে অনলাইন বিডিনিউজ ২৪ -এ দেশের বর্তমান করোনা পরিস্থিতির খবর পড়ছি। কয়েকটা ব্লগে পরিচিত ব্লগারদের লেখা পড়ছি। পোস্টে মন্তব্য করছি। বেশ কিছুক্ষণ পর নাকে পোড়া পোড়া গন্ধ লাগলো! ওমনি মোবাইল রেখেই রান্নাঘরে গিয়ে দেখি আমার স্বাদের গুড়া মাছের তরকারি পুড়ে ছাঁই হয়ে মৌ-মৌ পোড়া গন্ধে পুরো বাড়ি দুর্গন্ধে একাকার। কী আর করা! নিজের কপালে তিন-চারটা থাপ্পড় মেরে চুলা থেকে তরকারির কড়াই এনে খানাডুলিতে রেখে আবার অফিসের কাজে বেরিয়ে গেলাম। রাতে বাসায় এসে দেখি গিন্নী মুখ ভার করে বসে আছে! আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আমি নরম গলায় বললাম, ‘ভুল তো মানুষেরই হয়!’

ছবি গুগল থেকে সংগ্রহ।

বোন

বোন…!
জীবনে এই একটা সম্পর্কের অভিজ্ঞতা কখনো হয়নি আমার। তবে অনেকের জীবনে বোনের প্রভাব, স্নেহ, ভালোবাসা দেখে কতদিন আর কতরাত যে মন খারাপ করে কাটিয়েছি জানিনা, কখনো কখনো কেঁদেছিও। এইতো কয়েক বছর আগেও আম্মার সাথে বোন নিয়ে ঝগড়া করতাম। সবার বোন আছে আমার কেন নেই ? আম্মা হাসতো আর বলতো তাড়াতাড়িই বোন এনে দেবে যদি তাকে অনেক আদর করি এই শর্তে আর আব্বা বলতো পালক বোন এনে দেবে। এখন বড় হয়েছি তাই এসব আর বলিনা।
.
যখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়তাম তখন আমার এক ক্লাসমেটের বাড়িতে যেতাম মাঝে মাঝেই। দেখতাম ওর বড় বোন ওর জন্য কোনদিন আম ভর্তা করে রেখে দিতো, কোন দিন বড়ই বা জলপাই। তাছাড়া ওর স্কুল ড্রেস ওর বোনই ধুয়ে আয়রন করে রাখতো। কোনদিন সময় না থাকলে খাইয়ে দিতো আর টিফিন রেডি করে রাখতো তাছাড়া ওর হাত খরচের টাকাও ওর বোন দিতো। এতো গেলো স্নেহের কথা আবার অকারণে ঝগড়া করাটাও চোখে পড়তো, সম্পূর্ণ দোষ ভাইয়ের থাকলেও বকা খেতো বোনটা আর আশ্চর্যের বিষয় যে, সে মেনেও নিতো এমনকি কোন প্রতিবাদ বা প্রতিরোধও করতোনা অথচ যেখানে বোনটার এক থাপ্পড়ের উপর কিছু করতে হতোনা সেখানে হামেশাই বোনটাই মার খেতো কিন্তু কখনোই ছোট ভাইটাকে মারতোনা। চোখের সামনে ওর বড় বোনের আদর দেখতাম, ঝগড়ার মাঝেও একটা বিশাল স্নেহের আকাশ ছিলো। সেই স্নেহগুলো ঠিক অন্যরকম, অন্যভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে সেগুলোকে।
.
এছাড়া আরেক বন্ধুর ছোট বোনের প্রতি ভালোবাসাটাও উল্লেখ করার মতো। একবার আমরা পিকনিকে যাই আমার ঐ বন্ধু ওর বোনের জন্য অনেকগুলো খেলনা কিনেছিলো আর আমি কিনতে পারিনি কারণ কাকে দেবো ? তখন আমার ছোট কোন কাজিনও ছিলোনা। তবে ওকে পছন্দ করে দিয়েছিলাম আর মনে মনে কষ্ট পেয়েছি এই ভেবে যে, যদি আমারও ছোট একটা বোন থাকতো।
.
এরপর যখন কলেজে গেলাম তখনও এমন অনেক ভাইয়ের জীবনে বোনদের ভালোবাসাটা অন্যরকমভাবে প্রতিফলিত হতে দেখেছি। সব কথা যেন অকপটে বোনের কাছে বলা যায়, গোপনীয়তা যেন একমাত্র বোনের কাছে এসেই ঠাঁই পায়, কিন্তু আমি আমার মনের কথা অভিভাবক স্বরূপ কাউকে বলতে পারিনি বড় বোন না থাকায়। অনেক দোষত্রুটি বোনের কারণে হাওয়া হয়ে যেতে দেখেছি অনেকের। একবার আমরা কয়েকজন ক্রিকেট খেলা নিয়ে ঝগড়া করেছিলাম তারপর আমার এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে লুকিয়েছিলাম। যখন বিচারটা ওদের বাড়ি পর্যন্ত গেলো তখন ওর বোন অনেককিছু বলে বিষয়টা মিটমাট করে দিলো। ওকে ঘরে রেখেই বললো আজকে আসুক হারামজাদা ওর ঠ্যাং ভাঙ্গমু, অথচ বাদীপক্ষ চলে গেলে ওকে শুধু শাসিয়ে দিলো আর কিছুই করলোনা এমনকি আমাদের সবাইকে মুড়ি ভর্তা করে খাওয়ালো সেদিন। দূরে কোথাও গেলে বোনের বারবার খোঁজ নেয়া দেখেছি তবে এগুলো অন্যদের জীবনে দেখা।
.
কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক আমি বিশ্বাস করি ভাই আর বোন কখনো এক না। ভাইয়ের সাথে খুব একটা বন্ধুত্ব হতে দেখিনি কারো জীবনে আর নিজের জীবনেতো নয়ই, নিজের ভাই থাকলেও আমার থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত সে। ভাইয়ের সাথে সর্বোচ্চ যেটা হয় সেটা সাময়িক মিল। ভাইয়ে ভাইয়ে অনেক মিল থাকলেও বছর কয়েক পরেই জমিজমা নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে বিরোধ হতে দেখেছি কতশত তার কোন হিসেব নেই কিন্তু বোনের সাথে বোনের বা ভাইয়ের সম্পর্কটা স্বার্থের কারণে হতে বা ভাঙ্গতে দেখিনি কখনো।
.
নিজের বোন বলতে কয়েকটা কাজিন আছে তবে কোন এক অজানা কারণে ওরা আপন করে নিতে পারেনি আমাকে। এইতো একবার এক কাজিনের কাছে চিপস চেয়েছিলাম সে বলেছিলো তুমি কি আমার আসল ভাই? তোমারে দিমুনা (যদিও না বুঝেই বলেছিলো তবে কথাটায় গভীরে আঘাত পেয়েছিলাম)। বাবা আর চাচাদের মধ্যে সামান্য ঝগড়া বা কথা কাটাকাটি কাদের বাড়িতে হয়না? এসবের কারণে অনেক সময় ওরা আমার কাছেও আসেনা।
সে যাই হোক এসব ব্যপারে আমি অভিমান করেও করিনা কারণ লাভ নেই।
.

আজ সকালে এক কাজিন কোথা থেকে কিছু খেঁজুর এনেছে জানিনা। আমার সামনে দিয়ে যাচ্ছে আর আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে খেঁজুরগুলো খাচ্ছে। আমি কেন জানিনা বাচ্চাদের মতো চেয়ে বসলাম কিন্তু ও দিবেনা। অনেক জোরাজুরির পরও রাজী হলোনা। পরে পাঁচ টাকা দিয়ে এই একটা খেঁজুর কিনে নিলাম ওর থেকে…!
.
২৭/০৬/২০১৯

শেখ মুজিব

আমি আমার মা কে অসংখ্য বার বলতে শুনেছি যে দিন- যে সময় শেখ মুজিব হত্যার খবর এলো সেদিন সে সময় মা আমার উঠোনে ধান মাড়ানির কাজে ব্যাস্ত, অথচ তখনো তিনি দশ মাসের গর্ববতী আমিই ছিলাম আমার মায়ের গর্ভে। স্বভাবতই তার কয়েকদিন পর আমি ভূমিষ্ট হই, জন্ম নিই বঙ্গবন্ধু হারা শোকার্ত বাংলাদেশে। আমার বাবা ষাটের দশকের ছাত্রলীগ নেতা এবং পরবর্তীকালের আওয়ামীলীগ নেতা ফলে সেই সময়কার ভয়ার্ত পরিস্থিতিতে তিনি আমাকে নিয়ে খুব ভীত সন্ত্রস্ত থাকতেন। কিন্তু মায়ের কাছে শুনেছি বাবা নাকি যখন আমাকে আদর করতেন আদরের ছলে শ্লোগান দিতেন এক মুজিব লোকান্তরে লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে…।

এই জন্যই হয়তো পরবর্তী কালে আমারো ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠার পেছনে জেনেটিকেলি প্রভাব রয়েছে। ৯০এর এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় আমি নবম শ্রেনীর ছাত্র, তখনকার আন্দোলনের কথা আমার স্পষ্ট মনে থাকার কারণ হলো আমরা তখনকার আন্দোলনে বিশেষ করে বড় ভাইদের সাথে মিছিলে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অংশ নিতাম এবং পরবর্তী কালে ৯৬ এর অসহযোগ আন্দোলন এবং তার পূর্বের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে আন্দোলনের ইতিহাস তো অসংখ্য রক্ত, ঘাম মাখা!…

এই যে আমার তারুণ্য আমার উদ্দাম ছুটে চলার এক অদম্য স্পৃহা এসব কিছুর পেছনে যে শক্তি কাজ করেছে সেটাই বঙ্গবন্ধুর চেতনা- বঙ্গবন্ধুর প্রভাব। বাবার মুখে বারবার শেখ মুজিবের নাম, শেখ মুজিবের ইতিহাস, তিনি ছাত্র জীবনে স্কুলে কি করেছেন, কিভাবে দাবী আদায়ের জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সামনে দাঁড়িয়েছেন, কি ভাবে নানান আন্দোলনে শ্লোগান দিয়েছেন, কখন জেলে গেছেন, কখন কেন আহত হয়েছেন এসব শুনে শুনে বড় হওয়া আর সেই সাথে টুক টাক বই পড়ার নেশা তো ছিলই।

পরাধীন বাংলা বা স্বাধীন বাংলা, হাজার বছরের ইতিহাসে তারুণ্যের ঔজ্জ্বল্যে এক ব্যতিক্রমী কিংবদন্তির ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য বঙ্গবন্ধুর সমকক্ষ আর কেউই নাই। ১৯৪০ থেকে ১৯৭৫-এর ১৪ আগস্ট দীর্ঘ ৩৫ বছরের কিছু বেশি সময়ের রাজনৈতিক জীবনে বঙ্গবন্ধুকে একটি মহা শক্তিতে বলিয়ান হতে দেখা গেছে সেটা হচ্ছে তার তারুণ্যের শক্তি… যৌবন উদ্দীপ্ত এক বলিষ্ঠ শক্তি! …তাঁর রাজনৈতিক ইতিহাস, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড এবং চিন্তা-চেতনার পরিধি স্বাধীনতা সংগ্রাম-মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী রাজনীতি বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা বা যোগ্যতা আমার মত ছাপোষা মানুষের কক্ষনো হবেনা। বঙ্গবন্ধু ছিলেন মনেপ্রাণে তরুণ বাঙালি। এ কারণে মুক্তিসংগ্রামের প্রতিটি ক্ষেত্রে দলের আদর্শ, বিশ্বাস ও নিজের জীবনদর্শনকে একীভূত করে নিয়েছেন তিনি। তাঁর স্বপ্ন ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক শোষণহীন রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তোলা। এবং ১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারি স্বাধীন দেশে প্রথম পা রেখেই তিনি উচ্চারণ করেছিলেন `বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি কোনো ধর্মভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ‘যার যার ধর্ম তার তার `ধর্মনিরপেক্ষতার এই অনন্য ব্যাখ্যা বঙ্গবন্ধুই প্রথম উপস্থাপন করেন।

তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে আমরা এদেশের তরুন সমাজের মধ্যে নতুন এক উদ্দীপনা এক অসম্ভব কর্ম চঞ্চলতা দেখতে পাচ্ছি, তরুনরা আজ উদ্যোক্তা, তরুনরা আজ কেবল চাকুরীর জন্য হন্য হয়ে ছুটে না, তারা ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন ও বাস্তবায়নে এবং এর যথাযথ মর্যাদা দিতে নিজেদেরকে তথ্য প্রযুক্তিতে দক্ষ করে তুলছে, বিদেশ না গিয়ে উপার্জন করছে বিদেশী মুদ্রা, শুধু তাই নয়- তরুণ’রা বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষন কে গবেষনা করে নিজদের জীবনে কাজে লাগাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু সে দিন বলেছিলেন …
”যার যা আছে তা নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে” আজ এদেশের তরুণ’রা সেই মন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে যার যা আছে তা দিয়ে পথে নামছে নিজের পায়ে দাঁড়াতে, জীবিকার সন্ধানে আর কোন অপেক্ষা নয় যা আছে তা দিয়ে শুরু করছেন কাজ। আমি নিজেই সেই মন্ত্র ( যার যা আছে তা নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে) জীবনে কাজে লাগিয়েছি বহুবার।

বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় সম্পদের নাম শেখ মুজিব। শেখ মুজিব মহা গ্রন্থ, একটি মহা হাতিয়ার, শেখ মুজিব একটি মহা বিদ্যালয়, একটি মহা স্পন্দন যা ধারণ করতে পারলে জীবনের পরতে পরতে উন্মোচিত হবে বিজয়ের শিখা! … অপূর্ব বিস্ময়কর এক আবেগের নাম শেখ মুজিব। শেখ মুজিবকে না জানলে না বুঝলে না মানলে জীবনের কিছুই বুঝা হবেনা কিছুই জানা হবেনা, মানা হবেনা।

অনেক প্রজন্ম বিগত হয়েছে আরো অনেক প্রজন্ম আসবে – যাবে কিন্তু শেখ মুজিব থেকে যাবে। কারণ শেখ মুজিব চিরকালের তরুণ। তিনি তারুণ্যের জন্য বেঁচেছিলেন তারুণ্যের জন্য লড়েছেন, তারুণ্যের জন্য শত্রুর বুলেটের আঘাতে শাহাদাত বরণ করেও অমর হয়ে আছেন। কারণ তারুণ্যের মৃত্যু নাই। তরুণ’রা যুগে যুগে কালে বেঁচে থাকে, লড়াই করে। আর শুধু বাংলা নয় পৃথিবীর যেখানে লড়াই সেখানেই শেখ মুজিব, সেখানেই বঙ্গবন্ধু…। যেখানে দাবী আদায়ের মিছিল সেখানেই শেখ মুজিব। সেখানে স্বাধীনতাকামীদের তর্জনী উঠবে সেখানে জেগে উঠবে শেখ মুজিব।

স্যার আপনারা হিরো ছাত্রদের জীবনে স্মরণীয় স্মৃতি বরণীয় আজও

গোপাল স্যার আমার বাবার ক্লাসমেট এবং আমার শিক্ষক। উনি লেমুয়া বাজারের দিন অনেক লোকের সামনে আমাকে গালে চড় মেরে ছিলেন। আমি তখন (নব্বই দশকে) একটা ছাত্র সংগঠনের লেমুয়া ইউনিয়নের পদে ছিলাম। গোপাল স্যারকে এলাকায় অনেকে চিনে না কিছু লোক চিনে মরণ বাবুর ভাই হিসাবে। বাজারে রটে গেল মহীকে হিন্দু এক লোক মারছে। আমি চড় খেয়ে লজ্জায় হতবুদ্ধি হয়ে মুখে হাত দিয়ে দাড়িয়ে রয়েছি। অনেক লোক জমা হয়ে যাওয়ায় স্যারও লজ্জা পেলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে চায়ের দোকানে ভিতরে নিয়ে গেলেন। পরে সবাই জানলো উনি আমার শিক্ষক। স্যার আরেক হিন্দু নিখিল বাবুর শশুরের কাছে বেশ কিছু টাকা পাবেন। এই টাকার জন্য লেমুয়া বাজারে অনেক বৈঠক হয়েছে। যারা বৈঠক করে সব দলের প্রভাবশালী মদখোর আর জুয়াচোর। এক বছরেও সমাধান না হওয়ায় আমি কিছু ছেলে নিয়ে গিয়ে পাওনাদারকে দমক দিয়ে আসি।

সেই পাওনাদার পরের দিনই গোপাল স্যারকে ধরলেন। এবং কি বলেছে আমার আজও জানা হয়নি। তবে স্যার আমাকে টাকা নিয়ে দিতে বলেনি। আমিই নিজে বলেছি সেই লোককে। চায়ের দোকানে আমি মাথা নিচু করে বসে থাকি। চা খেতে খেতে স্যার বললেন তুই আমার ছাত্র। তোকে দিয়ে টাকা আদায় করলে নিজের বিবেক মরে যাবে। স্কুলে আমি তোকে নিজের ছেলে পরিচয় দিতাম। বাবা হয়ে থাপ্পর মারলাম।

কর্ম জীবনের প্রথমেই এক লোকের মারফতে একটা সোনালী রংয়ের সিটিজেন ঘড়ি পাঠাই গোপাল স্যারের জন্য। কিছুদিন পর লোকটা ঘড়ি ফেরত দিয়ে বলে স্যার মারা গিয়েছেন। যে স্যার ক্লাস সিক্স হতে টেন পর্যন্ত প্রাইভেট পড়িয়ে একটা টাকাও নেন নাই সেই স্যার মরে গেল। কিন্তু ভালো লোক এত তাড়াতাড়ি, কেন মরবে আজও আমি বুঝি না। দুই / এক বার কিছু টাকা দিয়েছি মাত্র উনার ছোট ছোট বাচ্চাদের জন্য। আমার বাবা মরণ বাবুসহ গিয়ে (মরণবাবু ফালিজপুর কাদেরী হাই স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক) যখন ম্যামকে টাকা দিতেন তখন নাকি ম্যামের মুখটা একটা স্বর্গ হয়ে যেত। আজ উনার সন্তানেরা বড় হয়েছে। কিন্তু একজন সৎ শিক্ষকের অকালে মরে গেলে পরিবারটা কত অসহায় হয় ভুক্তভোগী বুঝে। স্যার, বাবার যে চিঠি পড়ে আপনার মন খারাপ হয়ে ছিলো সেটা আমার কথার কারণে। আমি অংকে নাম্বার কম পেয়ে বাবাকে বলেছি স্যার পড়ায় না। আপনি কখনো কোন ছাত্রের প্রতি অনীহা প্রকাশ করেনি। স্বর্গে আপনি ভালো আছেন বলে আমার প্রচণ্ড বিশ্বাস।

আমরা পরীক্ষার ভালো ফল চাই কিন্তু ভালো শিক্ষক চাই না। ঘুস নিয়ে মাস্টার বানাই। শিক্ষকদের নিশ্চিত জীবন চাই না। শিক্ষককে লাথি উষ্ঠা মারি। আরে ভাই আমি নেতা সালিশ করে, নদীর বালু বিক্রি করে, মাদকের দালালি করে, স্কুলের পরিচালক হয়ে টাকা পাই। সেই টাকায় সংসার চালাই। এইটা খেয়ে আমার পোলা কেমন করে জিপিএ পাঁচ পাবে। আমারতো নীতিই নেই আর আমি পোলারে বলি বেটা পড়াশোনা করে ভালো মানুষ হইবি। ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান এখন স্কুল কলেজের সভাপতি হয়। এরা এতই প্রভাব দেখায় এদের নজর এড়িয়ে ধুলাও নড়চড় হয় না। পুরা পরিচালনা কমিটি রাজনৈতিক লোক দিয়ে করার কারণে শিক্ষকগণ জ্বী জ্বী করে উনাদেরকে (এইসব পরিচালক একই শিক্ষালয়ের ও শিক্ষকের সাবেক ছাত্র)। অবাধ্য হলে নেমে আসে অপমান অপবাদ। যার কারণে গ্রামের স্কুলে পাশের হার অত্যন্ত খারাপ। জেলা শহরে কয়েকটা স্কুল কলেজে লেখাপড়ার মান খুবই ভালো। যেমন ফেনীতে সরকারি পাইলট হাই স্কুল, সরকারি গার্লস হাই স্কুল, ফেনী ক্যাডেট স্কুল এবং কলেজ ও শাহীন একাডেমি (জামাত পরিচালিত)।

মীর স্যার আপনি মেধা সততা দিয়ে স্কুলকে আকাশের চাঁদ বানিয়ে ছিলেন। আশি নব্বই দশকে ( আমাদের সময় ) করৈয়া হাই স্কুল ফেনী জেলায় পাশের হারে শহরের স্কুলকে পিছনে ফেলে দিতো আর আজ সেই স্কুল মৃতপ্রায় হাতি। দশম শ্রেনীতে উঠে রাস্তার ঐপারের একটা হলুদ পাখি (মেয়েটা কোথায় আছে কেমন আছে জানি না ) ধরতে গিয়ে আপনার হাতে মার খেয়ে জ্বর হয়ে ছিল। ভয়ে বলি নাই আপনি মেরেছেন। প্রধান শিক্ষক হিসাবে আপনার ব্যক্তিত্ব সুনাম করৈয়ার মাটি বয়ে বেড়াবে পৃথিবীর শেষ অবধি।

ছবিঃ ফেসবুকের স্কুল গ্রুপ হতে নেওয়া। (মীর স্যার সাবেক প্রধান শিক্ষক)।

আমাদের মায়েরা

তখন আমি একটা কোচিংয়ে জব করি, সংগত কারণেই কোচিংয়ের নাম এবং জায়গার নাম গোপন করছি। একদিন কোচিংয়ের নির্বাহী পরিচালক আমাকে ডেকে পাঠালেন, সন্ধ্যা পিরিয়ডের দুটো ক্লাস নিয়ে পরিচালকের সাথে দেখা করলাম। তিঁনি আমাকে বললেনঃ স্যার, একটা কাজে যেতে হবে। বললামঃ কিসের কাজ আর কখন ? তিঁনি জবাবে বললেনঃ আজ রাতেই ছুটির পরে এক ছাত্রের বাড়িতে যেতে হবে। ছাত্রের পরিচয় জানার পর বললামঃ আমিতো স্যার নতুন, তাছাড়া ওদের বাসাও চিনি না আর সেতো বেশ কয়দিন ধরে কোচিংয়েও আসেনা ঘটনা কী ? পরিচালক বললেন আমিও যাবো আপনার সাথে, ছেলেটার মা আমাকে কয়েকবার ফোন করেছে, আমাকে আর আপনাকে যেতে বলেছে বিশেষভাবে। ঘটনা কিছু বুঝতে পারলাম না, তবে আশ্চর্য হলাম এই ভেবে যে, পরিচালক নিজে যাবে তাও আবার এখনই যেতে হবে কী এমন কাজ! আর এও আন্দাজ করলাম ঘটনা হয়তো গুরুতর হতে পারে।।
.
ছুটির পর স্যারের সাথে ঐ ছাত্রের বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হলাম, যেতে যেতে স্যার আমাকে নিয়ে গেলেন উপশহরের মূল এরিয়া থেকে একদম বাইরে একটা গ্রামের একদম শেষ প্রান্তে, আমি মনে মনে বললাম এতদূর থেকেও আমাদের কোচিংয়ে স্টুডেন্ট যায়। মূল রাস্তা থেকে অনেকটা নির্জন জায়গায় বাড়িটা, সেই বাড়ির আশেপাশে তেমন কোন বাড়ি নেই, ছিমছাম তবে অগোছালো একটা বাড়ি। বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই মাছের বাসি উৎকট গন্ধ নাকে ভেসে এলো, দেখলাম বাড়ির উঠোনে মাছ ধরার জাল আর খাড়ি পড়ে আছে, বুঝতে বাকি রইলোনা এটা একটা জেলে বাড়ি। তারপর পরিচালকের ডাকে ছাত্র বেড়িয়ে এলো কুশল বিনিময় করতে করতে আমাদের একটা রুমে নিয়ে গিয়ে শক্ত একটা তক্তপোশে বসতে বলে ছাত্রটা গিয়ে তাঁর মাকে ডেকে আনলো। মধ্য বয়স্কা একটা রোগা মহিলা এলেন, দেখেই মনে হলো তখনও হয়তো কোন রোগে আক্রান্ত উঁনি। কুশল বিনিময়ের পর তিঁনি পরিচালককে বললেনঃ স্যার, আপনাদের ইংরেজির নতুন স্যারকে নিয়া আইছেন ? স্যার আমাকে দেখিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন, তিনি আমাকে দেখে আরও আবেগ তাড়িত হয়ে পড়লেন। বললেন আপনার কথাই সজীব (ছদ্মনাম) সবসময় বলে, আপনাকে দেখার খুব ইচ্ছা ছিলো আমার। আমার বিষয়ে আরও অনেক কথা বললেন যেগুলো এখানে বলা নিষ্প্রয়োজন।।
.
ভদ্রমহিলার সাথে মোটামুটি অনেক কথাই হলো কথার এক পর্যায়ে বললেন বাপে যা করে ছেলেরও তাই করতে হবে এমন কোন কথা আছে গো স্যার ? ওর বাপে না হয় জাইলা (জেলে) তাই কি ওরও জাইলা হতে হবে ? ওর বাপে ওরে পড়াবোনা তয় আমি পড়াবো। আমি কোচিংয়ে যেতাম অসুস্থ বলে ঘর থেকেই বের হতে পারিনা, না হলে আমি নিজে গিয়ে বলে আসতাম আপনাদের, তাছাড়া সব কথাতো আর ওখানে বলা যাবেনা তাই আপনাদের আসতে বলেছি। ভদ্রমহিলা আরও অনেক কথা বললেন যে কথাগুলোর সারমর্ম এটাই যে, ছেলেটার বাবা পড়াশোনা নিজেও করেনি ছেলেকেও করাবেনা। তিঁনি মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন, ছেলেকেও একই পেশাতে নিতে চান। মায়ের কথা হলো, না! ছেলে তাঁর পড়াশোনা করে বড় চাকরি করবে সরকারী অফিসার হবে। ভদ্রমহিলা আরও অনেক কথা বললেন, এক পর্যায়ে পারিবারিক নানা টানাপোড়েনের কথা বলতে বলতে কান্নাকাটিও করলেন। এও বললেন যদি ওর বাপে টাকা পয়সা না দেয় তবে তিঁনি নিজেই দিবেন সেটা যেভাবেই হোক। আর আমাদের টাকা পয়সা নিয়ে চিন্তা করতে না করলেন। তিঁনি শেষমেশ বললেন দরকার হলে গয়না বেঁচবেন তবুও ছেলেকে পড়াবেন।।
.
ভদ্রমহিলা আমার হাত ধরে বললেনঃ বাবা, আমার পোলাডারে দেইখেন। আমি বললাম আপনার ছেলের প্রতি আমাদের নজর এমনিতেই বেশি, কারণ ও সবথেকে ভালো ছাত্র পি.এস.সিতে যেমন ভালো রেজাল্ট করেছে এবার জে.এস.সিতেও ভালো রেজাল্ট করবে আমরা আশা করি, ভদ্রমহিলা চোখ মুছলেন। বললেন আমি বাবা বড় অসুখে পড়ছি, জানিনা কতদিন বাঁচমু। আমি মরলেইতো ওর বাপে ওরে আর পড়াবোনা। আপনারা আমার পোলারে দেইখেন, ট্যেকা পয়সার চিন্তা করবেন না। আমি সব দিমু গত মাসের বেতন দিতে পারিনাই তাই ও কোচিংয়ে যেতে চায়না আপনেরা ওর কাছে কোন টাকা চাবেন না ও শরম পায়, এই বলে আমার হাতে কয়েকটা নোট গুজে দিলেন আমি টাকাটা পরিচালকের হাতে তুলে দিলাম, তিঁনিও টাকা দেখলেন না, উঠে আসার সময় তক্তপোশের উপর রেখে দিলেন আর বললেন ওর দায়িত্ব কোচিং এর, ও খুব মেধাবী ছাত্র নিয়মিত যেতে বলবেন আর ওকে ডেকে আমরা পরেরদিন থেকে নিয়মিত কোচিংয়ে যাওয়ার কথা বললাম। খেয়াল করলাম ছেলেটা লজ্জায় মাথা নিচের দিকে দিয়ে চোখ মুছতেছে আর তখন ভদ্রমহিলা কিছুটা জোরেই কেঁদে উঠলেন।।
.
তখন রাত প্রায় ১০ টা বেজে গেছে, ছাত্রটা আমাদের উঠোন পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলো তবে তখন আর প্রথমবারের মতো মাছের গন্ধবোধ করলাম না এতক্ষণ থেকে হয়তো গন্ধটা আমার সওয়া হয়ে গিয়েছে। আমরা বের হয়ে রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। বাড়ির বাইরে থেকে ছেলেটার পড়ার শব্দ শোনা গেলো সে জোরে জোরে পড়তেছে The national flag is the symbol of independence…
.
২৭/০৪/২০১৯
#StayAtHome #StaySafe

বোধ

ঘটনা অনেক আগের, তখন আমার শৈশবকাল, বৈশাখের পাকা ধান কাটা হয়ে গেলে খোলা মাঠে ঘুড়ি উড়াতাম। গোপালপুর হাঁট থেকে দাদাকে দিয়ে লাল, নীল কাগজ আনিয়ে, বল্লা গোটার আঠা দিয়ে একটা ঘুড়ি বানিয়েছিলাম। তখন সাধারণত গরমের ছুটিতে স্কুল বন্ধ থাকতো, পড়াশোনার চাপও থাকতোনা তাই কাজ বলতে ছিল ঘুড়ি উড়ানো। সারাদিন উদাম গায়ে দৌড়ে দৌড়ে ঘুড়ি উড়াতাম, বিকেলে ঘুড়ির নাটাই গাছের সাথে বেঁধে সবাই মিলে ফুটবল খেলতাম, কোনদিন আবার বৃষি্ট হলে ঘুড়ি উড়ানো হতোনা তবে ফুটবল খেলা হতো ঠিকই আর দিন শেষে দিঘীতে গোসল করে বাড়ি ফিরতাম।
.
একদিন আমার শখের ঘুড়িটা ভুল করে বারান্দায় রেখে রাতে ঘুমিয়ে পড়ি, মাঝরাতে প্রাকৃতিক প্রয়োজনে ঘুম ভাঙ্গলো। উঠে দেখি একটা ছোট বাচ্চা কুকুর আমার ঘুড়ির উপর আয়েশ করে শুয়ে ঘুমাচ্ছে, এটা দেখে আমার প্রচন্ড রাগ চাপে মাথায়। কী করা উচিত না ভেবেই মোটা একটা লাঠি দিয়ে ঘুমন্ত কুকুরটাকে দিলাম কষে এক বাড়ি। বাচ্চাটার মাজায় লাগলো আর লাফিয়ে পড়ে গেলো দু/তিন হাত দূরে, আর তার অসহায় সুরে কেঁউ-কেঁউ করে উঠলো কয়েকবার, তার করুণ আর্ত চিৎকারে হয়তো সেদিনের অন্ধকার আরও গাঢ় হচ্ছিলো, হঠাৎ কান্নার শব্দে উঠানের আম গাছে থাকা কয়েকটা পাখিও চেঁচা-মেচি শুরু করে দিয়েছিলো কিন্তু এরপরও সেটাকে আর সেখানে থাকতে দেইনি তাড়িয়ে দিয়েছিলাম। সকালে দেখলাম বাচ্চাটা ঠিকমতো হাঁটতে পারছেনা।
.
তারপর কয়েক বছর কেটে গেছে, তখন আর সেই দূরন্ত শৈশব নেই, ঘুড়ি উড়ানো, মাঠে ফুটবল খেলা সব কালের যাত্রায় হারিয়ে গেছে। একদিন কুষ্টিয়া থেকে বাড়িতে ফিরছিলাম, মধুপুর বা গোপালপুরের কোন গাড়ি পাইনি। অগত্যা টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা পর্যন্ত আসতে হলো অন্য একটা গাড়িতে। এলেঙ্গা নেমে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখি রাত প্রায় ১০ টা ছুঁই ছুঁই, কিছুক্ষণ রাস্তায় গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে থাকলাম কিন্তু আমার গন্তব্যের কোন গাড়ি আসলোনা। তখন গাড়ির আশা ছেড়ে ভাবলাম মাসজিদে রাতটা কাটিয়ে পরের দিন সকালে চলে যাবো এই ভেবে ওখানের একটা মাসজিদের বারান্দায় গিয়ে ব্যাগটা মাথার নিচে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। হালকা তন্দ্রা আসছে এমন সময় কারো ডাকে তন্দ্রা কাটলো মাথা তুলে দেখি বেশ কয়েকজন মানুষ। তারা মাসজিদ কমিটির লোক, তারা আমাকে চলে যেতে বললো, এটা হলি আর্টিজেনে জঙ্গি হামলার পরের ঘটনা তখন দেশ ব্যাপী সতর্কতা চলছিলো। কোন ভাবেই তাদের বুঝাতে পারলাম না কিছু। নিরাপত্তার অজুহাতে তারা অবশেষে তাদের অপারগতার কথা জানালো, দু/একজন ক্ষিপ্তও হলো। রাগে দুঃখে বেড়িয়ে পড়লাম ঘুটঘুটে অন্ধকার রাস্তায়, ভয়ে শঙ্কায় চোখ দিয়ে পানি আসছিলো, রাস্তায় এসে ল্যামপোস্টের নিচে দাঁড়াতেই আমাকে দেখে একটা কুকুর দু/তিনবার ডেকে উঠলো। তখন কেন জানিনা মনের অজান্তেই সেই কুকুরটার কথা মনে পড়ে গেলো….
.
৩০/০৩/২০২০
#StayAtHome #StaySafe

অন্তরালে

তখন অনার্স তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা চলছে, বাড়ী থেকে যেয়েই পরীক্ষা দেই। সকাল ৯ টার দিকে বের হলে ফিরতে ফিরতে ৯ টা বা কোন কোন দিন আরও বেশি রাত হয়ে যায়। নাসীরাবাদ কলেজে পরীক্ষা হচ্ছে যার কারণে টাঙ্গাইল বাসস্ট্যান্ড হয়ে আসতে কিছুটা দেরী হয় তাছাড়া প্রান্তিক পরিবহণের সার্ভিসও খুব একটা ভালোনা। তাই আমি আর আমার বন্ধু কামরুল বরাবরই আকুয়া বাইপাস হয়ে আসি।
.
প্রথমে ইসলাম পরিবহণ অথবা রাজিব পরিবহণে মুক্তাগাছা পর্যন্ত আসি তারপর সেখান থেকে সিএনজি হয়ে কালিবাড়ী তারপর সেখান থেকে আবার সিএনজি অথবা মাহিন্দ্রায় আসি মধুপুর পর্যন্ত। ছাত্র হবার অজুহাতেই হোক আর টাকা কম থাকার কারণেই হোক বরাবর ভাড়া দিতে আমরা একটু কার্পণ্যই করি, মানে দশ/পাঁচ টাকা করে কম দেই। এতে করে জন প্রতি কোন কোন দিন মূল ভাড়া থেকে প্রায় ২০ টাকা করে বেঁচে যায় তা দিয়ে আবার মধুপুর থেকে বাড়ী পর্যন্ত আসা যায়।
.
মুক্তাগাছা থেকে সিএনজিতে চড়লাম, তখন ট্রাফিক পুলিশ একটা আইন করে দিয়েছে, সিএনজিতে চারজনের বেশি নেয়া যাবেনা। অথচ তখনও কেউ কেউ পাঁচজন পর্যন্ত নেয়াটা বহাল রেখেছে। আমরা যে সিএনজিতে উঠলাম তিঁনিও প্রথমে চারজন তুলে পরে কিছুদূর এসে আবার পাঁচজন মিল করে রওয়ানা হলেন। যার কারণে কিছুটা দেরী হলো আর এর জন্য পিছনের ছিটে বসা এক ভদ্রলোক ড্রাইভারকে অনেক বকা ঝকাও করলেন কিন্তু তিঁনি কিছু বললেন না।
.
কিছদূর আসার পর ড্রাইভারের ফোন বেজে উঠলো, তিঁনি ফোন রিসিভ করে কানে দিলেন আর তাতেও পিছনে থাকা ভদ্রলোক বিস্তর রেগে গেলেন যার কারণে তিঁনি ফোনটা কান থেকে নামিয়ে হ্যান্ডেলের উপরের দিকে সিএনজিতে যে একটু গর্তের মতো জায়গা থাকে সেখানে লাউড স্পিকার দিয়ে রেখে গাড়ীর গতি কমিয়ে দিলেন। ও পাশ থেকে ছোট একটা মেয়ের গলা শোনা গেলো সে তখন বলছেঃ
-আব্বা, তুমি কোনসুম আবা…? আম্মারতো অসুখ বাড়ছে, আমার জোন্যে আইজকা ব্যাগ আনবাই… লোকটা আস্তে করে “আচ্ছা আনমুনে” বলে বললো তোমার মার কাছে দেও। ওপাশ থেকে পিচ্চির মা বলতেছেঃ
-তোমারেতো আইজকা যাবার না করলাম, এহনতো আমার জ্বরটা বাইড়া গ্যাছেগা, ডাক্তার কইছিলো সেলাইন দেওন লাগবো, আর ও এহন ব্যাগের জোন্যে কান্দিতাছে…
-আমি আওয়ার সোময় ডাক্তার নিয়া আমুনি, এইডা শেষ ট্রিপ, এহন রাহো চলতি গাড়ি।
এই বলে লোকটা ফোন রেখে দিলো, সামনের ছিটে বসার কারণে তাঁদের কথোপকথন আমি ভালোভাবেই শোনলাম। পরে সিএনজি থেকে নামার সময় তিঁনি একা একাই বললেন “আমি চারজন করেই আনি আর চলতি গাড়ীতে মোবাইলও ধরিনা, আসলে আইজকা বাড়ীতে সমস্যা।” সেদিন আর অন্যদিনের মতো কম টাকা দিতে পারিনি। আর জানিনা পিছনের ভদ্রলোক কথোপকথনগুলো শুনেছিলেন কিনা…
.
১৫/০৪/২০২০
#StayAtHome #StaySafe
বিঃদ্রঃ করোনার এই কঠিন সময়ে এই শ্রেণীর মানুষের কাজ কর্ম নেই, আসুন খোঁজ নেই তাঁরা কিভাবে দিন কাটাচ্ছে, আসুন আমরা সবাই যার যার সাধ্য অনুযায়ী এদের পাশে দাঁড়াই…

অগোছালো শোক

সেদিন সকালটা বেশ আলসে ছিলো। দেরী করে উঠে বাসি মুখেই ব্লগে আসি, কমেন্টের রিপ্লাইগুলো দেই। মোবাইলটা রাতে কোথায় ফেলে ঘুমিয়েছি মনে নেই। নতুন প্রজেক্ট নিয়ে এলোমেলো আরকি। বাথরুম চাপলে মোবাইল খুজতে গিয়ে দেখি অনেক গুলো ম্যাসেজ, কল। ফ্রেশ হয়েই জানতে পারলাম বাংলাদেশ সময় দুপুর দুটোয় মা মারা গেছেন। কিছুক্ষন স্তব্ধ, নিথর হয়ে বসেছিলাম। দিনটা স্পস্ট মনে আছে, জুলাইয়ের ২৬ তারিখ; তাপমাত্রা ২৮ হলেও উত্তর পুর্ব দিকে মৃদুমন্দ হাওয়ায় পরক্ষনেই শরীর জুড়িয়ে যায়, আকাশটা ছিলো নীল ক্যানভাস। জানালা বেয়ে হুড়মুড় করে বাতাস ঢুকে উড়িয়ে নেবার তোড়জোড়।

ডায়ালাইসিস নেবার পর মাসল ক্রাম্প সহ নানা রকম যন্ত্রনায় মা কাতরাতেন। একবার এমন হলো তার প্রেসার নেমে গেলো ৪০/৮০ যেখানে একজন মানুষের স্বাভাবিক প্রেসার থাকে ৮০/১২০। সবাই ভেবেছিলো বাঁচবে না। সেবার ঠিকই উতরে গেলেন হাসপাতালে। কিন্তু সেদিন ব্যাথা উঠতেই বাবাকে বলে নিজেই নীচে নামলেন, গাড়ীতে উঠলেন। হাসপাতালে গিয়ে যন্ত্রনা নিয়েই নার্সকে সব বললেন। নার্স ব্যাথানাশক ওষুধ সহ স্যালাইন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। কে জানতো এটাই তার শেষ ঘুম! শেষ ডায়ালাইসিস করাবার আগের দিন ঘন্টাখানেক কথা বললাম। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি, হাসিনা-খালেদা নিয়ে তর্ক, আমার বিয়ের জন্য কেমন পাত্রী হওয়া উচিত এসব নিয়েই চললো কিছুক্ষন। আব্বার দাড়ি নিয়ে হাসাহাসি করলাম। বাবা পাশে বসে শুনছিলেন।

বোনের জামাই তার মৃত্যুসংবাদ ম্যাসেজ করেছিলাম। বাবা বোন কারো সাথেই ফোনে কথা হলো না, কথা বলার মতো পরিস্থিতি নেই। লিসবনে ফোন দিয়ে টিকেটের খোঁজ নিয়ে জানলাম ১ সপ্তাহের মধ্যে ইকোনমি ক্লাসে কোনো টিকেট নেই, সব বিজনেস ক্লাস খালি। চাইলে যেতে পারি। স্টকহোমে ফোন দিতেই টিকেট পেয়ে গেলাম, বেশ সস্তাতেই। শর্ত একটা পরের দিন দুপুরের ফ্লাইট ধরতে হলে রাতেই স্টকহোমে যেতে হবে, এবং সেটা করতে হলে আমাকে সন্ধ্যার আগে লিসবন এয়ারপোর্টে পৌছাতে হবে। তাও অনেক ঝামেলা, ট্রানজিট হবে দুটো জায়গায়: জার্মানী ও তুর্কি।৩০ ঘন্টার জার্নি।

অনেক শখ ছিলো দেশে গিয়ে মা কে নিয়ে ভারত ঘুরে আসবো। সেভাবেই সব প্লান ছিলো। মা এর অপারেশনটা হলে রামপাল, রূপপুর গিয়ে ওখানকার পরিস্থিতি নিজ চোখে দেখে আসবো। তার সাথে দিনাজপুরের যে অববাহিকায় ইউরোনিয়াম পাওয়া গিয়েছিলো, খনিজ মন্ত্রনালয়ের অফিসেও একটু ঘুরে আসবো ডিটেইল কিছু তথ্যের জন্য। কিন্তু এভাবে যে যেতে হবে বুঝতে পারিনি। যখন বাসায় পৌছালাম তখন ফরিদপুর, মুন্সিগন্জ, রংপুর, নারায়ন গন্জ থেকে আগত আত্মীয় স্বজন ফিরে যাচ্ছিলেন। আমাকে দেখে আরেকবার কান্নাকাটির রোল শুরু হলো। তখন ছিলো আছরের সময়। কাকা বললেন ইমামতি করতে। ইসলামী তরিকা অনুযায়ী আমার ফরজ গোসল দরকার, নতুবা অজু হবে না। ফরজ গোসলও যে শেষ কবে করেছি খেয়াল নেই। মন থেকে বিশ্বাস উঠে গেছে অনেক আগেই কিন্তূ এই পরিস্থিতিতে বিনা অজুতেই ইমামতি করতে হলো। মা এর কবর জিয়ারত বেশ সহী ভাবেই করলাম। কাকা ভেবেছিলেন আমি সব ভুলে গেছি হয়তো। কিন্তু আমার তেলাওয়াত শুনে বেশ অবাক হলেন। বললেন তার ছেলে হাফেজী পাশ করেছে কিছুদিন আগে। মৌলানাতে ভর্তি হয়েছে। পরীক্ষা সামনে বলে ফরিদপুর চলে গেছে। যাবার আগে মা এর জন্য কোরান খতম দিয়েছে। তার হাতে গড়া মাদ্রাসাটা ঘুরে দেখার আমন্ত্রন জানালো। যদিও তাকে বলেছিলাম দেশে আসলে একটা কম্পিউটার ল্যাব দেবো ওদের, কিন্তু সেটা নিয়ে আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করলো না।

আম্মা মারা যাবার আগে কিছু কাজ দিয়ে গেছেন। প্রতি সন্ধ্যায় “রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বি ই্যানি ছগীরা” পড়তে হবে। বিয়ে করতে হবে, পছন্দ হোক বা না হোক, সংসারী এ বেলায় হতেই হবে।আমাকে দেশে ফিরতে বারন করেছেন আর আমি যেনো কোনো অপরাধবোধে না ভুগি।

ইসলাম নিয়ে লেখালেখির কারনে বাসায় নানা রকম লোকজন আসতো, বাইরে ভীড় করতো। তিনি অসুস্থ থাকা সত্বেও জঙ্গিদের নির্যাতন বেশ চরমেই ছিলো ধরা যায়। একবার বাসায় এক মহিলা এসে মাকে সরাসরি বলেন আমি যেনো লেখালেখি বন্ধ করি নতুবা তিনি পুলিশ কেস করবেন। তার পরের দিন ডায়ালাইসিস করাবার ডেট ছিলো। স্বভাবতই সেদিনটা ছিলো কস্টের। আম্মা তাকে সরাসরি বাসা থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। আব্বাকে থানায় পাঠান। আব্বা থানায় গিয়ে ঐ মহিলার ব্যাপারে জিডি করতে চাইলে দারুস সালাম থানার ওসি তাকে শান্ত করেন। বললেন নেক্সট টাইম এমন করলে শুধু ফোন করলেই চলবে। সাধারন ডায়েরী করে চলে আসেন।

আব্বা যখন এ কথাগুলো বলছিলেন, বুকের ভেতর বড্ড শূন্যতা কাজ করছিলো। আম্মাকে বাড়ীর কাছেই কবর দেয়া হয়েছে। আব্বা আর এখান থেকে যাবেন না। বোনকে বললাম বোঝাতে, সে শুনলো না।

মামা তাবলীগ করেন প্রায় ১ যুগ ধরে। তিনি বললেন,”তুমি কি সত্যি তার জন্য মন থেকে দোয়া করবা না? তার আত্মা শান্তি পেতো।”

তার দিকে কিছুক্ষন চেয়ে থাকলাম। তার সাথে আমি অনেক কিছুই শেয়ার করি,”মামা, আমাদের আত্মার মধ্যে কি এমন গুন আছে যে মৃত্যুর পর তারা এমন উড়ে উড়ে বেড়াবে? আমাকে একটা কারন বলেন!”

সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। আমি বলতে থাকলাম,”পর্তুগীজ দার্শনিক ইউরি ডি কস্তা ক্যাথলিক পরিবারে জন্মালেও দর্শনের সংস্পর্শে এসে তিনিও এমন প্রশ্ন করলেন। আত্মা এমন কি জিনিস, যেটা আমাদের মৃত্যু হলে দেহ ছেড়ে উড়ে যাবে। সে একসময় রাব্বিনিক ইহুদী মতাদর্শে বিশ্বাস করা শুরু করেন যারা মনে করতেন মানুষের আত্মা বলে কিছু নেই। মানুষ মরে গেলে তার সত্বারও মৃত্যু হয় এবং সে তখন বেচে থাকে তার কর্মে, গুনে, মানুষের স্মৃতিতে। যদিও পরে তিনি সেই ইহুদী ধর্মও ত্যাগ করেন দর্শনের খাতিরে।”

মামা মাথার টুপি খুলে হাত বুলালেন,”কিন্তু এত দিনের বিশ্বাস, এক দুইজনের কথায় তো ভুল হতে পারে না।” আমি হাসলাম,”জরূরী নয় যে সবাই এক পথে চললে আপনাকেও সে পথে চলতে হবে। মা মারা গেছেন, সত্যি বলতে সে হারিয়ে গেছে। তার কাছে অনেক কিছু বলার ছিলো, সে অনেক কিছু বলতে চেয়েছিলেন। সেগুলো আর বলা হবে না, শোনা হবে না। যেটা শিক্ষা হলো, যারা বেঁচে আছেন, তাদের প্রতি আমার কর্তব্যটুকু পরিপূর্নভাবে পালন করা, তাদের সেবা করা। ভালোবাসা মন থেকে। আমার শরীরটা মায়েরই দেহের একটা অংশ। ৯ মাস তার দেহের একটা অংশ ছিলাম, তারপর পৃথিবীর আলো দেখেছি, এত বড় হয়েছি। মা এর একটা অংশ আমার মধ্যেই এখনো বেঁচে আছে। যদি কোনো অনৈতিক বা অযৌক্তিক কাজ করি, তাহলে মাকেই অসম্মান করা হবে। এই যে এত মানুষের ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন, সবাইকেই অপমান করা হবে।”

মামা আর কিছু বললেন না। আমি বাসা থেকে বের হলাম। তিলোত্তমা ঢাকা শহর কিভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে সেটা অনুধাবন করার চেস্টা করলাম। অট্টালিকার অরন্যে আমরা নিজেদেরকে শেকল বন্দী করে মৃত্যুকেই ডেকে আনছি এটা সবাই জানে, বুঝে, তবুও মানুষ সে কাজগুলো করেই চলেছে। দেশের মানুষ এমন গোয়াড় রকমের আত্মঘাতী কেন ঠিক বুঝে উঠতে পারি না।

অদ্ভুত দমবন্ধ পরিবেশ অস হ্য লাগতে শুরু করলো। মোবাইলটা বের করে নেক্সট ফ্লাইট ঘাটতে লাগলাম….।

এসো ফিরে আবার……

এসো ফিরে আবার……

হারিয়ে গেল রূপসী বাংলার কবি
জীবনানন্দ। তার প্রয়াণ দিনে
কবির অমর স্মৃতি আজও অতীতকে
ফিরে পাবার স্বপ্নে বিভোর।
সব পাখি ঘরে আসে,
সব নদী বয়ে চলে নীরবে।
আসেন না জীবনানন্দ!
তাইতো আজও অজয়ের চরে দাঁড়িয়ে
শোকস্তব্ধ কণ্ঠে বলতে ইচ্ছে করে
আমিই রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ…..
বাংলার মাঠে ঘাটে পথে প্রান্তরে উপভোগ
করি রূপসী বাংলার আনন্দ। হেথা নীড়হারা
পাখিরা কবিকে খুঁজে বেড়ায়।
আজও প্রভাতে গেয়ে ওঠে
মাটির গান, মানুষের গান, বাংলার গান।
“এসো এসো হে আবার কবি জীবনানন্দ,
দাঁড়াও জলা ডাঙার কাদাডোবায়
কচুরিপানার বুনো হাঁসগুলি
কালো জলে যেথা কাটে সাঁতার ।
এসো ফিরে আবার হে কবি!
আসিও ফিরে এই বাংলায় আবার।”

-কবি লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

সব পাখি ঘরে আসে, সব নদী,
আসেন না জীবনানন্দ!

জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে লিখছেন দেবাশিস ঘড়াই।
তথ্যসংগ্রহ ও সম্পাদনা – লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
তথ্যসুত্র- আনন্দবাজার পত্রিকা

এক বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে আর বাড়ি ফেরেননি জীবনানন্দ। শহরের ট্রামলাইনে তাঁর পথ চলা থেমে গিয়েছিল। কিন্তু যে ট্রাম তাঁর আজীবনের পথ চলা থামিয়ে দিয়েছিল, সেই ট্রাম পরে নিজেই এক অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত হয়ে যায়! তার আর কোনও অস্তিত্বই নেই। শুধু থেকে গিয়েছে অফুরান শব্দস্রোত!

জীবনানন্দ দাশ
হারিয়ে যাওয়া কয়েকটি খাতা! আর তাতেই শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। সময় নষ্ট না করে বিশেষ দলও তৈরি করে ফেলেছিল কলকাতা পুলিশ। তার পর তন্নতন্ন করে খোঁজা শুরু হয়েছিল কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায়। শেষ পর্যন্ত এক পুরনো বইয়ের দোকান থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল কয়েকটি খাতা। কিন্তু তা-ও সব ক’টা নয়! বইয়ের দোকানদারের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ পৌঁছে গিয়েছিল বইপাড়ারই এক মুদিখানার দোকানে। সেখানে গিয়ে দেখা গিয়েছিল, হারানো খাতার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে তৈরি ঠোঙায় সর্ষে বিক্রি করছেন ওই মুদিখানার দোকানদার! তিনি জানিয়েছিলেন, সাত কিলো ওজনের ওই রদ্দি কাগজপত্র তিনি কিনেছিলেন সাড়ে ১২ টাকায়! শেষ পর্যন্ত যেটুকু অক্ষত ছিল, উদ্ধার করা হয়েছিল তা। যিনি খাতা হারানোর অভিযোগ করেছিলেন, হারানো জিনিস উদ্ধারের খুশিতে পুলিশকর্তাকে নিজের বাবার লেখা একটি বই উপহার দিয়েছিলেন। বইয়ের নাম ‘রূপসী বাংলা’, কবির নাম জীবনানন্দ দাশ। বইয়ের উপরে লেখা ছিল, ‘কৃতজ্ঞতার সাথে মঞ্জুশ্রী দাশ।’ তারিখ ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৮০ সাল।
৩৮ বছর আগের সেই ঘটনার স্মৃতিচারণ করে তৎকালীন ডিসি ডিডি (২) ও প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার প্রসূন মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘জীবনানন্দ দাশের প্রথম জীবনের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি খোয়া গিয়েছে বলে আমাদের জানিয়েছিলেন তাঁর মেয়ে মঞ্জুশ্রীদেবী। যত দূর মনে পড়ছে, তিনি মেচেদা থেকে লোকাল ট্রেনে ফিরছিলেন। ট্রেনের বসার সিটের তলায় রাখা সুটকেসেই জীবনানন্দের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি ছিল। অনেক খাতা ছিল। যখন হাওড়া স্টেশনে নামেন, তখন দেখেন ওই সুটকেসটি নেই। সুটকেসচোর ভেবেছিল গয়না বা টাকাপয়সা আছে। কিন্তু সে সব কিছু না পেয়ে রদ্দি কাগজ হিসেবে বেচে দিয়েছিল। তবে হারানো পাণ্ডুলিপির কিছু অংশ উদ্ধার করা গিয়েছিল। পুরোটা পাওয়া যায়নি!’’ জীবনানন্দের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপির একটা অংশ বাক্স করে আর ফেরত আনা যায়নি। ফলে জানা যায়নি, চিরদিনের মতো হারিয়ে যাওয়া পাণ্ডুলিপিতে আরও কী কী অলৌকিক-শব্দবিস্ময় অপেক্ষা করে ছিল!

নির্জনতম শব্দের দল
বুকজোড়া বরিশাল আর পায়ে কলকাতার উন্মুত্ত প্রান্তরের ঘ্রাণ। শহরের ‘অবিশ্বাসী’ ট্রামলাইন তাঁর দু’পা টেনে নেওয়ার আগে পর্যন্ত ওই দুই ভূখণ্ড কখনও একে অপরকে ছাপিয়ে, কখনও পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। জন্ম নিয়েছিল বাংলা কবিতার নির্জনতম, নিভৃত জগতের— জন্ম নিয়েছিল জীবনানন্দ-ভুবন। বাংলা ভাষার অলৌলিক-অপার্থিব শব্দসম্ভার, নির্জনতম শব্দেরা ব্যক্তিগত জীবনে চূড়ান্ত অসুখী, জীবনভর আর্থিক অনিশ্চয়তায় ভোগা, একের পর এক চাকরি ছাড়া, লোকের সঙ্গে সহজ ভাবে মিশতে না পারা, সমালোচকদের আক্রমণে ধ্বস্ত এক মানুষকে মাধ্যম করে পেয়েছিল নিজেদের বিস্তার! কিন্তু কোথা থেকে জীবনানন্দ পেয়েছিলেন এই শব্দ সংকেত, এই অনন্ত শব্দস্নাত স্পর্শ? পারিবারিক দিক থেকে কবির সেই নির্জন জগতের সন্ধানে বেরোলে কিন্তু হোঁচটই খেতে হবে। জীবনানন্দের ঠাকুরদা সর্বানন্দ দাশগুপ্ত ছিলেন বরিশালের ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম মুখ। ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করে বৈদ্যত্বের চিহ্নস্বরূপ তিনি ‘গুপ্ত’ বর্জন করেছিলেন। মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনে অশ্বিনী দত্তকে হারিয়ে কমিশনারও হয়েছিলেন তিনি। জীবনানন্দের বাবা সত্যানন্দ দাশও ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের এক জন চিন্তক, প্রবন্ধ রচয়িতা, বক্তা, শিক্ষক। মা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন সে সময়ের প্রখ্যাত কবি, যিনি রান্না করতে করতেও অনায়াসে কবিতা লিখতে পারতেন। এমনকি, জীবনানন্দের ভাই অশোকানন্দ পুজোর আগে বিদ্যালয়ে আবৃত্তি করবেন বলে লিখে ফেলেছিলেন ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে’র মতো মুখে মুখে ঘোরা কবিতা! জীবনানন্দের বাবা সত্যানন্দেরা ছিলেন সাত ভাই। জীবনানন্দেরা ছিলেন তিন ভাই-বোন। জীবনানন্দই ছিলেন বড়। ভাই অশোকানন্দ নয় বছর ও বোন সুচরিতা ষোল বছরের ছোট ছিলেন। সব মিলিয়ে একান্নবর্তী পরিবার। ফলে পারিবারিক ওই উষ্ণ আবহে জীবনানন্দ কী ভাবে ওই নির্জন ভূখণ্ডের সন্ধান পেয়েছিলেন, তাতে বিস্ময়ই জাগে।

‘‘কাউকে দেখানোর জন্য নয়, নিজের জন্যই যেন লেখাগুলো লিখতেন। লিখে ট্রাঙ্কভর্তি করে রাখতেন। ছাপাতে দেওয়ার আগে ওখান থেকেই বার করে দিতেন। ছোটবোন সুচরিতা খুব স্নেহের পাত্রী ছিলেন তাঁর। কখনও কখনও তাঁর সামনে তিনি বার করতেন ওই ট্রাঙ্কের লেখা। বাকিরা সেই অর্থে কিছু জানতেনই না। তাঁর জীবদ্দশায় সব ক’টি কাব্যগ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা মিলিয়ে বড়জোর সাড়ে তিনশো লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। বাকি ট্রাঙ্কভর্তি সব লেখাই তো তাঁর মৃত্যুর পরে উদ্ধার করা হয়েছে। সেগুলো যেন একটা আলাদা জগৎ,’’ রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে বসে কথাগুলো বলছিলেন অশোকানন্দের পুত্র অমিতানন্দ দাশ। জীবনানন্দের স্ত্রী লাবণ্য, পুত্র সমরানন্দ, কন্যা মঞ্জুশ্রী অনেক আগেই প্রয়াত হয়েছেন। প্রসঙ্গত, দেশভাগের ক্ষত নিয়ে এ দেশে আসার পরে রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের এই বাড়িতেই জীবনানন্দ কিছু দিনের জন্য আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরে ল্যান্সডাউন রোডের (বর্তমানে শরৎ বসু রোডের) এক ভাড়াবাড়িতে তিনি চলে যান। রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের এই বাড়িতেই ট্রাম-দুর্ঘটনার দু’দিন আগে হন্তদন্ত হয়ে এসে জীবনানন্দ জানতে চেয়েছিলেন, সকলে ঠিক আছেন কি না। কারণ, রাস্তায় কার কাছ থেকে যেন শুনেছেন, পরিবারের কারও ট্রাম অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। সকলে ঠিক আছেন শুনে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন।

বক্স ক্যামেরা, পোশাকবদল
জ্যাঠামশাইয়ের ‘আলাদা জগৎ’-এর সঙ্গে অমিতানন্দের পরিচয় হয়েছিল ছেলেবেলাতেই। তখন তাঁর বয়স বড়জোর সাত। অশোকানন্দ কর্মসূত্রে দিল্লিতে থাকতেন। সেই সুবাদেই দিল্লিতে যাতায়াত ছিল অমিতানন্দদের। এক বার সপরিবার জীবনানন্দও দিল্লি গিয়েছিলেন। সেই সফরের স্মৃতি রোমন্থন করে অমিতানন্দ বলেন, ‘‘এক দিন পরিবারের সকলে মিলে ঘুরতে বেড়িয়েছি। মঞ্জুদির (কবিকন্যা) বয়স তখন বছর কুড়ি হবে। আমি বায়না করাতে মঞ্জুদি হাতের বালা বা গলার হার, কী যেন একটা খুলে আমাকে দিয়েছিল। জিনিসটা বেশ ভারী ও দামি ছিল। কিন্তু আমি সেটা কোনও ভাবে হারিয়ে ফেলি। তা নিয়ে মা (নলিনী দাশ) ও জেঠিমা খুব বকাবকি করছেন। কিন্তু জ্যাঠামশাইয়ের সে সবে কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। যেন এ সব ঘটনা নিয়ে তাঁর কোনও উৎসাহই নেই।’’ অমিতানন্দই জানালেন, জীবনানন্দের যে ছবিটি সমস্ত পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়, তা ওই দিল্লি-সফরের সময়েই তোলা। তুলেছিলেন অমিতানন্দের মা। ‘‘মায়ের তখনকার দিনের একটা বক্স-ক্যামেরা ছিল। তা দিয়েই পারিবারিক গ্রুপ ফোটো তোলা হয়েছিল। জ্যাঠামশাই ধুতির উপরে শার্ট পরতেন। কিন্তু পরে যখন ওই ফোটো ছাপা হয়েছে পত্রপত্রিকায়, সেটা কী ভাবে যেন মেকওভারে পাঞ্জাবি হয়ে গিয়েছে,’’ হাসছিলেন অমিতানন্দ।

কাস্তের আঘাত, বর্মের আড়াল
১৮৯৯ সালে বরিশালে জন্মগ্রহণ, ঘনঘন অসুস্থ হয়ে পড়া শিশু জীবনানন্দকে সারিয়ে তুলতে কুসুমকুমারীর লখনউ, আগ্রা-সহ নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ানো, একটু বেশি বয়সেই বরিশালের ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে ভর্তি, প্রতিটি বার্ষিক পরীক্ষায় বাঁধাধরা পুরস্কার, তার পর ব্রজমোহন কলেজ থেকে ১৯১৭ সালে আই.এ পাশ, ১৯১৯-এ প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে স্নাতক ও পরে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর পাশ করে ১৯২৬ সালে চাকরি জীবনের সূত্রপাত সিটি কলেজে—জীবনের এই মাইলফলক ধরে এগোলে জীবনানন্দের নির্জন-ভূখণ্ডে পৌঁছনোটা প্রায় অসম্ভব! অলৌলিক-ইন্দ্রিয়াতীত জগতের সন্ধানে বেরোলে পিছিয়ে যেতে হবে সেই ছোটবেলায়। যেখানে বগুড়া মোড়ের বিশাল জায়গা জুড়ে বাড়ি, সেই জমির ঝোপের মধ্যে হলুদ ছোপ পড়া আনারস ফল, কাঁঠালগাছ, আমগাছ, শিশির পড়ার টুপটাপ শব্দ, গভীর রাতে সুপুরি নিয়ে ইঁদুরের লড়াই, মাছ ধরা, ঠাকুমার গল্প, মফস্‌সলের নদী-খালের মতো বরিশালের সর্বব্যাপী প্রকৃতির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র উপকরণ, দৃশ্য, মুহূর্তের সঙ্গে ছোটবেলায় তাঁর যে অদৃশ্য, বিনিসুতোর বাঁধন তৈরি হয়েছে, সেই বাঁধন আজীবন তাঁর সঙ্গে চলেছে, সে তিনি যেখানেই যান না কেন! সেই সমস্ত দৃশ্যই হাট করে খুলে দিয়েছে তাঁর কল্পনার দরজা, যার মধ্যে পরবর্তী কালে অনায়াসে প্রবেশ করেছে পারস্য গালিচা, বিলুপ্ত নগরী, নীল সুপুরির বনেরা! বড়মামা ছাদে মাদুর পেতে আকাশের তারাদের চেনাচ্ছেন, জীবনানন্দ বিস্ফারিত চোখে দেখছেন সে সব অগুনতি নক্ষত্র, অসীম- অনন্ত মহাকাশকে, মামাবাড়ির ছাদের উপরের রাতের আকাশ যেন আজীবনের বন্ধুত্ব পাতিয়ে নিচ্ছে ছোটবেলার জীবনানন্দের সঙ্গে, পরে সেই নক্ষত্রপুঞ্জই ফুটে উঠেছে তাঁর কবিতার খাতায়। শব্দের পরে শব্দে, দূরতম নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে আলো এসে পড়ছে যেন, আর তাতে ভেসে যাচ্ছে আকীর্ণ চরাচর! শুধু কি প্রকৃতি, মানুষের সঙ্গে মানুষের যে সম্পর্ক, তারও তো হাতেখড়ি সেই বরিশালেই। যেখানে অবশ্যম্ভাবী ভাবে চলে আসেন ফকিরের মতো দরিদ্র চাষি বা সকালে প্রতিদিন বাড়িতে দুধ দিতে আসা প্রহ্লাদের মতো মানুষেরা। বর্ষাকালে উঠোনে বড় ঘাস জন্মেছে। সত্যানন্দ ফকিরকে ডেকেছেন সেই ঘাস কাটার জন্য। ফকির কাস্তে চালিয়েছেন আর তাতে কাতর হয়েছেন জীবনানন্দ। তখন ফকির তাঁকে বুঝিয়েছেন, ‘‘চিন্তা করবেন না দাদাবাবু। এর পরেই কচি, সবুজ, নতুন ঘাস হবে।’’ কে বলতে পারে, ‘আমারো ইচ্ছা করে এই ঘাসের এই ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো গেলাসে গেলাসে পান করি,’ এই লাইনটি লেখার সময়ে বাল্যকালের সেই মুহূর্ত তাঁর মনের উপরে ছাপ ফেলেনি। তখন ফকির ঘাস কাটতে কাটতে তাঁকে শোনাননি মাটির কথা, ফসলের কথা! বা বাড়িতে দুধ দিতে আসা প্রহ্লাদ দাঁড়িয়ে পড়েছেন, নড়ছেন না। জীবনানন্দ তখন ইংরেজিতে বা বাংলায় হয়তো কোনও কবিতা আবৃত্তি করছেন। পড়া শেষ হলে প্রহ্লাদ তাঁকে বলছেন, ‘আপনি বড় ভাল পড়েন দাদাবাবু।’ যদিও সে কবিতার অর্থ বুঝতে পারার কথা নয় প্রহ্লাদের, কিন্তু সেই শব্দধ্বনিই মুগ্ধ করেছিল তাঁর মতো মাটির কাছের মানুষকেও। মাটি-প্রকৃতি-মানবমনের সঙ্গে তাঁর যে সখ্য, সেই বন্ধুত্ব তাঁর আজীবনের সঙ্গী, সম্বল, সম্পদ। কিন্তু পরে যখন দেখেছেন তাঁর নিজস্ব মনন ক্ষেত্রের সঙ্গে বাইরের জগতের কোনও মিল নেই, তখন তিনি গুটিয়ে নিয়েছেন নিজেকে, একটা বর্ম তৈরি করেছেন! অথচ এক বার সে বর্ম ভাঙতে পারলেই তিনি তাঁর কাছে সহজ মানুষ। অনেকে হয়তো বাড়িতে এসেছেন, বাথরুম ফাঁকা পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার বাথরুম কি ফাঁকা আছে?’ তাঁর সহাস্য উত্তর, ‘দিল্লির মসনদ কি কখনও ফাঁকা পড়ে থাকে!’ বা যখন সজনীকান্ত দাস তাঁর কবিতার ভাষার শ্লীলতা, অর্থ, বোধ নিয়ে শনিবারের চিঠিতে বেআব্রু আক্রমণে নেমেছেন, কখনও লিখেছেন, ‘গণ্ডারমারী কবিতা’ লিখেছেন জীবনানন্দ, আবার কখনও লিখেছেন, জীবনানন্দের লেখা ‘নির্জন পেঁচার মতো প্রাণ যদি অলৌলিক না হয় তা হলে সীতার পাতাল প্রবেশও অলৌলিক নয়।’ আর তাঁর পক্ষ নিয়ে কথা বলতে আসরে নেমেছেন বুদ্ধদেব বসু স্বয়ং। সজনীকান্ত-বুদ্ধদেবের পারস্পরিক কাব্য-দ্বৈরথের উত্তপ্ত আবহেও জীবনানন্দ স্মিত হেসে বলেছেন, ‘সজনীকান্তবাবু তো আমার ভালই প্রচার করছেন।’

কে ছিলেন বনলতা সেন
আসলে বোধহয় জীবনানন্দ চাইতেন না তাঁর ভিতরের নির্জন স্থানটি কোনও ভাবে উপদ্রুত হোক, যেখানে আস্তে আস্তে জন্ম নিচ্ছে ‘ঝরা পালক’, ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, ‘বনলতা সেন’, ‘মহাপৃথিবী’, ‘রূপসী বাংলা’র কবিতারা। কিন্তু সেই নির্জন ভূমিই প্রথম টাল খেল সিটি কলেজে। কর্মজীবনের পাশাপাশি সাহিত্য পত্রপত্রিকায় লেখার শুরু মোটামুটি এই সময়েই। ১৯২৭ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ প্রকাশিত হল। শুরু বিতর্কেরও। তাঁর কবিতায় অশ্লীলতা আছে— এই অভিযোগে তাঁর সিটি কলেজের চাকরি যায়, এমন একটা বহুল প্রচারিত মত আছে। ‘‘আদৌ ব্যাপারটা তা নয়। কলেজে সরস্বতী পুজো নিয়ে একটা গোলমাল হয়েছিল। ছাত্ররা পুজো করতে চেয়েছিল। কিন্তু ব্রাহ্ম কলেজে কেন পুজো হবে, আপত্তি ছিল কলেজ কর্তৃপক্ষের,’’ বলছিলেন অমিতানন্দ। সেই সময়েই জীবনানন্দকে কেউ জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাঁর মত কী? পুজো হলে ক্ষতি কোথায়, এমনই নিরাসক্ত জবাব দিয়েছিলেন তিনি! ব্রাহ্ম হিসেবে চাকরি হওয়া সত্ত্বেও তিনি কেন কলেজের সপক্ষে কথা বলেননি, তাতেই অসন্তুষ্ট হন কর্তৃপক্ষ। তার পর কলেজের ছাত্র সংখ্যা কমে গেলে অনেক জুনিয়র অধ্যাপকের সঙ্গে তাঁরও চাকরি গিয়েছিল, জানাচ্ছেন অমিতানন্দ। আসলে ব্রাহ্ম-আবহে বড় হয়ে ওঠা জীবনানন্দ প্রথম দিকে ব্রাহ্ম সমাজ নিয়ে কবিতা, প্রবন্ধ লিখলেও পরে আর সেই জগতের কাছে ফেরত যাননি। কারণ, তত ক্ষণে জীবনানন্দের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল ধানসিড়ি নদী, নীল হাওয়ার সমুদ্র, শব্দহীন জ্যোৎস্নারা! আর জন্মেছিলেন বনলতা সেন। কিন্তু কে এই বনলতা সেন? অমিতানন্দ জানালেন, ‘‘আমরা যেটুকু শুনেছি তিনি জীবনানন্দের এক খুড়তুতো বোন ছিলেন। তাঁর প্রতি দুর্বল ছিলেন উনি। কিন্তু সম্পর্ক গড়ার সাহস পাননি। তাঁর ছায়াতেই তিনি বনলতা সেন লিখেছিলেন বলে পরিবারের বড়দের মুখে যতটুকু শুনেছি।’’ আবার জীবনানন্দের ডায়রিতে ‘ওয়াই’ বর্ণ সংকেতে এক নারীর প্রসঙ্গ পাওয়া যায়। টীকায় সম্পাদক কবি-গবেষক ভূমেন্দ্র গুহ জানিয়েছিলেন, এই ‘ওয়াই’ জীবনানন্দের খুড়তুতো বোন বুলুর (কমলা দাশগুপ্তের) বান্ধবী। বরিশালেই তাঁকে চিনতেন জীবনানন্দ। অন্তত ১৯৩১-৩২ পর্যন্ত তিনি অনেকখানি মন জুড়ে আছেন জীবনানন্দের। তিনিও বনলতা হতে পারেন। আসলে বনলতা কে, সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সব সময়েই মুচকি হেসেছেন জীবনানন্দ। কোনও উত্তর দেননি।

অসুখী দাম্পত্য
সামগ্রিক কর্মজীবনে পাঁচটিরও বেশি কলেজে কাজ করেছেন জীবনানন্দ। এ যেন এক বিপন্ন বিস্ময়, যা তাঁকে স্থিত হতে দেয়নি। যার সূত্রপাত সিটি কলেজে কাজ যাওয়ার পরপরই। কলকাতায় থাকতে এক দিকে তিনি সমসাময়িক বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে-র চেয়ে বয়সে বড়। কিন্তু তখনও তাঁর কবিতা পত্র-পত্রিকা থেকে ফেরত আসে, নতুন কবিতা সংকলনে তাঁর নাম ছাপা হয় না। অন্য দিকে ব্যক্তিগত, আর্থিক জীবনেও অনিশ্চয়তা। ভাল না লাগায় ১৯২৯ সালে বাগেরহাট কলেজের চাকরি ছেড়ে দেন। সেখা‌ন থেকে দিল্লি। ১৯৩০ সালের মে মাস পর্যন্ত তিনি দিল্লিতে ছিলেন। তার পর বিয়ে করতে বরিশালে এসে আর দিল্লি যাননি। অমিতানন্দের কথায়, ‘‘বিয়ের কয়েক মাস আগে চাকরিটা ছেড়ে দিলেন হঠাৎ। তখন থেকেই তাঁর দাম্পত্য জীবনে সঙ্কট শুরু হয়। যা আর কখনও মেটেনি। জেঠিমা সুন্দরী ছিলেন, শিক্ষিতা ছিলেন, গানও ভাল গাইতেন। কিন্তু তিনি সেই এক্সপোজ়ারটা পাননি। দাম্পত্য জীবনে খামতি থাকার জন্য ছেলে-মেয়েকে খুব প্রশ্রয় দিতেন। ক্ষতিটা হয়তো পুষিয়ে দিতে চাইতেন।’’ অসুখী দাম্পত্য ফুটে উঠেছে তাঁর লেখা একাধিক উপন্যাসেও। অমিতানন্দের খুঁজে পাওয়া একটি ডায়রিতেও দেখা গেল সেই অস্থির জীবনের ছায়া। সেখানে লিখছেন এক জায়গায়, ‘বাড়িতে থাকতে রোজি সন্ধ্যার পর ভাবতাম একটু অন্ধকারে থাকা যাক—জ্যোৎস্না বা লম্ফের আলোতে—কিন্তু একটা না একটা কারণে রোজি আলো জ্বালতে হত—তারপর মেসে চলে গেলাম সেখানে roommateদের জন্য আলোর ব্যবস্থা না হলে চলত না—’ আবার আরেক জায়গায়, ‘চিরদিন দুঃখ ভোগ করে যাওয়াটাই তো জীবনের উদ্দেশ্য নয়…’

অশ্লীলতার অভিযোগ
ব্যক্তিগত জীবনে ত্রস্ত ছিলেন নিঃসন্দেহে। কিন্তু কোথাও তাঁর একটা স্থির বিশ্বাসের ভরকেন্দ্রও ছিল! হয়তো সে বিশ্বাসে শাণিত তরবারির স্পর্ধা ছিল না। কিন্তু সে বিশ্বাস ছিল ফসলসম্ভবা মাটির মতো নরম অথচ ঋজু। না হলে তাঁর বিরুদ্ধে যখন লাগাতার ধূসর, পলায়নকারী মানসিকতা, দুর্বোধ্য, বিশেষণগুলি (নেতিবাচক অর্থেই) ক্রমাগত ব্যবহার করা হচ্ছে, তখন কেন বলবেন, ‘‘আত্মঘাতী ক্লান্তি’ আমার কবিতার প্রধান আবহাওয়া নয়…’ অথবা ‘ক্যাম্পে’ কবিতার অশ্লীলতার অভিযোগ নিয়ে কেন লিখবেন, ‘যদি কোনো একমাত্র স্থির নিষ্কম্প সুর এ কবিতাটিতে থেকে থাকে তা জীবনের— মানুষের-কীট-ফড়িঙের সবার জীবনেরই নিঃসহায়তার সুর।’ কর্মজীবন টালমাটাল হওয়া সত্ত্বেও কেন তিনি নির্দ্বিধায় বলবেন, ‘যে জিনিস যাদের যেভাবে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে সবই অসাড়তার নামান্তর নয় কি?’ এই উচ্চারণের জন্য তো স্পর্ধা লাগে, সাহসও। যেমন ভাবে বিশ্বাস লাগে এই সারসত্যটুকু বলতে, ‘সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি।’ এই নিষ্কম্প বিশ্বাস তাঁর কলকাতার উপরেও ছিল। এমনিতে ছাত্রজীবন থেকে কর্মজীবন, ১৯৩৫ সালে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে অধ্যাপনার চাকরি নিয়ে চলে যাওয়ার আগে এবং আবার কলকাতায় ফেরা পর্যন্ত, এ শহরে তাঁর আবাস-মানচিত্রে ছিল কখনও মেস, কখনও অশোকানন্দের বাড়ি, কখনও ল্যান্সডাউনের ভাড়াবাড়ি। কর্মজীবনে টালমাটাল মুহূর্তে অন্য জায়গায় চাকরির সুযোগ হচ্ছিল, কিন্তু তবু তিনি যাচ্ছিলেন না বলে জানালেন অমিতানন্দ। তাঁর কথায়, ‘‘অসমে, পঞ্জাবে ও অন্যত্র চাকরি হলেও কলকাতা ছেড়ে যেতে রাজি ছিলেন না!’’ দেশভাগের পরে কলকাতায় এসে বন্ধু সঞ্জয় ভট্টাচার্যের চেষ্টায় ‘স্বরাজ’ নামে একটি নতুন দৈনিক পত্রিকার রবিবাসরীয় সাহিত্য বিভাগটি সম্পাদনার কাজ পেয়েছিলেন। ‘স্বরাজ’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে ১৯৫০ সাল নাগাদ কিছু দিন খড়্গপুর কলেজে কাজ করছিলেন। সেখান থেকে শহরে ফিরে কখনও বড়িশা কলেজ, ডায়মন্ড হারবারের ফকিরচাঁদ কলেজ, হাওড়া গার্লস কলেজে কাজ করেছেন। আর শহর ছেড়ে যাননি! এ শহরও তখন তাঁকে আস্তে আস্তে চিনছে। তত দিনে ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, ‘বনলতা সেন’, ‘মহাপৃথিবী’, ‘সাতটি তারার তিমির’, ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ প্রকাশিত হয়েছে (যদিও সব মিলিয়ে অপ্রকাশিত রয়ে গিয়েছে তখনও দেড় হাজারেরও বেশি কবিতা, উপন্যাস, গল্প)। স্বীকৃতি পাচ্ছেন তিনি, জুটেছে পুরস্কারও। তারও আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রশংসায় আপ্লুত হয়েছেন তিনি, আর বুদ্ধদেব বসুর মতো যাঁরা ভাষাবিন্যাসে অচলায়তন ভাঙার সমর্থক, তাঁদের কাছে তিনি তো তখন রীতিমতো আবিষ্কার! তাই শহরের সমস্ত সাহিত্য আলোচনায়, কবিতাপাঠে তিনি আমন্ত্রিত।

মনপবনের নৌকা
কিন্তু তার পর সে দিন! ১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর। আগের দিনই রেডিয়োয় ‘মহাজিজ্ঞাসা’ কবিতাটি পাঠ করেছিলেন। তা নিয়ে সে দিন সকালে বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনাও করেছিলেন। তার পর প্রতি দিনের মতো ল্যান্সডাউন রোডের বাড়ি থেকে বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। ছোটবেলা থেকেই হাঁটা যে তাঁর অভ্যেস। ও পার বাংলায় বাল্যকালের সেই স্টিমারের জেটি। কিছুটা দূরে ঝাউয়ের সারি। লিচু, অজস্র ফুল-ফল সমারোহে বিশাল কম্পাউন্ড নিয়ে ব্রাউন সাহেবের কুঠি। সে সব পার হয়ে ব্রাহ্ম সমাজ সার্কিট হাউসের গির্জা, তা ছাড়িয়ে গেলে শ্মশানভূমি, লাশকাটা ঘর। সে সব পথ হাঁটতে হাঁটতে আকাশে মেঘ দেখে বালক জীবনানন্দ ভাইকে বলতেন, তিনি একটা মনপবনের নৌকা তৈরি করবেন। সে দিনও কি জীবনানন্দ আকাশে মেঘ দেখে মনপবনের নৌকার কথা ভাবছিলেন? না হলে কেন ট্রামের অবিরাম ঘণ্টা বাজানোর আওয়াজ, ট্রাম চালকের চিৎকার শুনতে পাবেন না তিনি! ট্রামের ধাক্কায় গুরুতর জখম জীবনানন্দকে রাস্তা থেকে তুলে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলেন অপরিচিতেরা। সেখানেই আট দিনের লড়াই।

মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ উক্তি ছিল, ‘ধূসর পাণ্ডুলিপির রং সারাটা আকাশ জুড়ে’।
‘‘সেই ট্রামটি এখন আর নেই! এক সময়ে আগুন লেগেছিল। তাতেই পুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছিল ট্রামটি। তবে কবির স্মৃতির উদ্দেশ্যে বনলতা নামে একটা হেরিটেজ ট্রাম চালু হয়েছে,’’ বলছিলেন পরিবহণ দফতরের প্রাক্তন পদস্থ কর্তা। তিনি আরও জানালেন, বহুল আলোচিত ওই ‘নকড ডাউন’-এর কোনও তথ্য এখন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর!

নেমেসিস? হবে হয়তো। না হলে কবির ‘ঘাতক’ ট্রাম নিজেই আগুনে কেন ভস্মীভূত হবে!
শহরের প্রাণঘাতী ট্রামলাইনে তাঁর পথ হাঁটা থেমেছিল, আবহমানের শব্দস্রোত থামেনি!

‘সব পাখি ঘরে আসে— সব নদী’, কিন্তু হয়তো সেই আবহমানের খোঁজে বেরিয়েই জীবনানন্দ আর ফেরেননি! বাংলা কবিতার নির্জন চরাচর ধরে জীবনানন্দ হেঁটে গিয়েছেন দূরে, দূরতম দ্বীপে, একাকী, নিঃসঙ্গ অবস্থায়। তাঁর গা থেকে খসে খসে পড়েছে বাংলা কবিতার অবিশ্বাস্য সব লাইন, অসম্ভব সব শব্দ। তার পর সে সব শব্দ মিশে গিয়েছে আলপথে, মাঠের ধারে, ধানসিড়ি নদীর কিনারে। আর তিনি ছড়িয়ে পড়েছেন এ বাংলায়, দুই বাংলার বিস্তীর্ণ চরাচরে— মাটির ভিতর মাটি হয়ে, ফসলের ভিতর ফসল হয়ে, পাখির ভিতর পাখি হয়ে..

কবি লক্ষ্মণ ভাণ্ডারীর কলমে
তাইতো আজও অজয়ের চরে দাঁড়িয়ে শোকস্তব্ধ করে বলতে ইচ্ছে করে আমিই রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ….. বাংলার মাঠে ঘাটে পথে প্রান্তরে উপভোগ করি রূপসী বাংলার আনন্দ। হেথা নীড় হারা পাখিরা আজও প্রভাতে গেয়ে ওঠে মাটির গান। মানুষের গান, রূপসী বাংলার গান।

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের চেয়েও অনেক নীরব দুর্ভিক্ষ দেখেছি

এই বঙ্গদেশে দুর্ভিক্ষ বলতে কি ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষকে বোঝায়? আমি বলি না! সে-সময় তো বাংলার কিছু মানুষ অল্প ক’দিন ভাতে কাপড়ে কষ্ট করেছিল। তাই বলে এখনো ৭৪-এর দুর্ভিক্ষ অনেক মানুষের মুখে মুখেই থাকছে। আমার মতে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের চেয়েও দেশ স্বাধীন হবার আগে নীরব দুর্ভিক্ষ বাংলার ঘরে ঘরে ছিল। কিন্তু সেই নীরব দুর্ভিক্ষের কথা বাংলার মানুষের হয়তো মনেই পড়ে না। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে দেশ স্বাধীন হবার আগের নীরব দুর্ভিক্ষ অভাবগ্রস্ত পরিবারের আমি একজন অভাবী এখনো বেঁচে আছি এই বাংলার বুকে। সে- সময়ের অভাবের কথা এখনো সময় সময় মনে পড়ে। সে-সময়ের অভাবের কথা ভুলিনি, তা ভোলাও যায় না।

সে-সময়ে শুধু ভাত-কাপড়ের অভাবই ছিল না। অভাব ছিল শিক্ষার। অভাব ছিল শিক্ষা সামগ্রীর। অভাব ছিল ভাত-কাপড়ের। অভাব ছিল টাকা-পয়সার। মোট কথায় মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সবকিছুরই অভাব ছিল। সেই অভাবের মাঝেই আমার বেড়ে ওঠা জীবন। জন্ম আমার ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসের এক সুন্দর সময়ে। সেই অভাবের কথা এই যুগের ছেলে-পেলেদের কাছে বলতে গেলে অনেকেই বলে রূপকথার গল্প শোনাচ্ছি। ওরা উল্টে আমাকে শুনিয়ে দেয় ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ বা অভাবের কথা। আসলে কিন্তু রূপকথার গল্প নয়, যা বলছি তা বাস্তব কাহিনী।

তখনকার সময়ে শিক্ষার অভাব এমন ছিল যে, আমাদের পুরো গ্রামে হাতেগোনা তিন চারজনেই ছিল মোটামুটি শিক্ষিত। আর সবাই ছিল অল্পশিক্ষিত, অশিক্ষিত। শুধু আমাদের গ্রামেই নয়! সে-সময়ে শিক্ষার এমন করুণ অবস্থা এ-দেশের প্রতিটি গ্রাম গঞ্জেই ছিল। আমার বাপদাদারাও বেশি শিক্ষিত ছিল না। যদিও তাঁদের চলার মতো জায়গাজমি ছিল, কিন্তু টাকা-পয়সা কম ছিল বিধায় লেখা-পড়াও ছিল কম। আগেকার মানুষে বলতো, সবার কপালে নাকি লেখা-পড়া জোটে না। একটা গ্রামে বা একটা মহল্লায় যদি ভাগ্যক্রমে একজন মেট্রিক পাস করতে পারতো, তাহলে দুই চার গ্রামের মানুষ মেট্রিক পাস করা মানুষটাকে দেখতে আসতো। আর এখন ঘরে ঘরে আইএ পাস, বিএ পাস, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার পাস করা মানুষের অভাব নেই। সবার কপালে লেখা-পড়া জোটে না, বুড়ো বুড়িদের এমন কথা এখন উলট-পালট।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আস্তে আস্তে নিরক্ষের হার কমে শিক্ষার হার বাড়তে শুরু করলো। তাই বর্তমান যুগে মানুষের আর কিছু থাকুক আর না থাকুক, অন্তত লেখা-পড়া কমবেশি সবার আছে। ধনী গরিব সবাই চেষ্টাও করে, যাতে ছেলে মেয়েদের লেখা-পড়া হয়। কয়েক বছর আগেও টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যেত নিরক্ষরতা দূরীকরণ নিয়ে কতরকম প্রচারাভিযান। বুড়ো বুড়ো মানুষদের স্বাক্ষর শেখানোর জন্য দেশেও গড়ে উঠেছিল কতো সন্ধ্যাকালীন পাঠশালা। টেলিভিশনের পর্দায় এখন আর ওইসব দেখা যায় না। এখন মনে হয় আমাদের দেশে তেমন নিরক্ষর নামের মানুষ নেই। এখন সবাই অক্ষর লিখে স্বাক্ষর করতে জানে। এখন স্ট্যাম্প পেইডের কালি বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলিতে লাগিয়ে টিপ নামের ছাপ দেওয়া মানুষ আছে বলেও মনে হয় না। এখন সবাই কলম ধরে লিখতে জানে। নিজের নাম লিখতে জানে, পড়তে জানে।

কিন্তু আজ থেকে যদি ৪০ বছর আগের দিনে ফিরে তাকাই, তাহলে প্রথমেই দেখা যায় দুই চারটা গ্রামের মধ্যে হাতে গোণা দুইএক জনই ছিল শিক্ষিত। মানে মেট্রিক পাসওয়ালা তাও হয়েছে বংশগত ভাবে, আর নাহয় অভিভাবকদের আপ্রাণ চেষ্টার বিনিময়ে। যাদের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যেত, তাদের সংসারের ছেলে মেয়েদের আর লেখা-পড়া হয়নি। সে-সব অভাবী সংসারের মধ্যে আমাদের সংসার ছিল অন্যতম। তাই আমার বড়দাদার কপালেও লেখা-পড়া তেমন জুটেনি। যৎসামান্য কিছু লেখা-পড়া শিখে সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল। শেষতক বাবার পথে হেঁটে শেষ অবধি নারায়ণগঞ্জে চাকরি নিলো। বাবাও নাকি সেই যুবক থাকতেই নারায়ণগঞ্জ চাকরি করতো। বাবা বেতন পেতো মাসে ১৫০ টাকা। বড়দাদা বেতন পেতো যৎসামান্য।

তারপরও ভাতে- কাপড়ে আমরা অনেক কষ্ট করেছি। চার বোন আমি আর মা থাকতাম গ্রামের বাড়িতে। বাবার পাঠানো সামান্য টাকা দিয়েই চলতো আমাদের ছয়জনের সংসার। কোনও দিন তিন বেলায় দুই বেলা খেয়ে দিন কাটিয়েছি। পুরো গ্রামে আমাদের মতো আরও অনেক মানুষেরই অভাব ছিল। মানুষের টাকার অভাব তো ছিলই, ছিল কাপড়ের অভাবও। কাপড়ের অভাবে জোয়ান বুড়োদের দেখেছি সারাদিন লেংটি পরে থাকতে। লেংটি মানে দেড় হাত লম্বা দোপাট্টা কাপড়। যা কোমড়ে থাকা বাট্টা বা কাইতনের সাথে কোনরকম আটকানো থাকতো। দূর থেকে একরকম উলঙ্গই দেখা যেত। ছোটবেলা নিজেও সারাদিন লেংটি পড়ে থাকতাম। শুধু স্কুল বাদে খেলাধুলায়, দৌড়ঝাঁপে, হাট-বাজারে, সবখানেই থাকতাম যেতাম লেংটি পড়ে। তখন এই লেংটির দিকে কেউ ফিরেও তাকাত না। কারণ, সবার অবস্থা তখন একইরকম ছিল।

সে-সময় মনে হয় লজ্জা নিয়েও কেউ বেশিকিছু ভাবত না। ভাবতো শুধু আগামীকাল কীভাবে বেঁচে থাকবে, সেটাই ছিল বড় ভাবনা। বস্ত্রের অভাবে মানুষ অর্ধনগ্ন হয়ে থাকত। কেউ কারোর দিকে ফিরেও তাকাতো না। এ-সব কাহিনী বেশি দিনের নয়! ঘটনা দেশ স্বাধীন হবার আগের কথা। আমি তখন ৭-৮বছরের বালক। বাবা যেই কাপড়ের মিলে চাকরি করতেন, সেই মিল থেকে প্রতি ৩-মাস পরপর কিছু রিজেক্ট কাপড় পেতো। এটাকে বলা হতো ডাস্টার কাপড়। শুধু আমার বাবা একা পেতেন না, মিলের সব শ্রমিকরাই পেতো। যেহেতু মিলের শ্রমিক, তাই। তাও সীমিত কিছু অর্থের বিনিময়ে।

সেই কাপড় লোক মারফত নাহয় বড়দাদাকে দিয়ে বাড়িতে পাঠাতো। মা সেই কাপড় দা দিয়ে কেটে সুই সূতা দিয়ে সেলাই করে জামা বানিয়ে দিতো, আমরা গায়ে দিতাম। কাপড় কাটার জন্য কেঁচিও ছিল না। টাকার অভাবে কেঁচি কিনতে পারেনি বলেই, দা দিয়ে কাপড় কাটতো। আর হাতে সেলাই করতো। হাফপ্যান্ট বানিয়ে দিতো, হাফশার্ট বানিয়ে দিতো। মায়ের হাতে বানানো জামা প্যান্ট শুধু স্কুলে যাবার সময়ই পরতাম। আর বাকি সময় দোপাট্টা লেংটি পরে থাকতাম। পায়ের জুতা বা স্যান্ডেল তো ছিলই না। খালি পায়েই সারাদিন দৌড়া-দৌড়ি করতাম। হাটে যেতাম, বাজারে যেতাম। রাতে ঘুমানোর আগে বিশেষ ধরনের একপ্রকার জুতা পায়ে দিয়ে পা ধুয়ে বিছানায় যেতাম। জুতো গুলো তৈরি হতো সুপারি গাছের খোল দিয়ে। এখন আর সেই দিন নেই। সেই দিনের কথা বললেও কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। এখন মানুষে তিন-চার হাজার টাকা দামের জুতো ব্যবহার করে থাকে। আগেকার সময়ে লোকের কাছে একজোড়া পায়ের স্যান্ডেল ছিল মহামূল্যবান সম্পদ।

১৯৬৮-১৯৬৯ সালের কথা। তখন যেমন ছিল টাকার দাম, তেমন ছিল অভাব। বাবা বেতন পেলে, ১০০ টাকা দিয়ে বড়দাদাকে বাড়িতে পাঠাতো। বড়দাদা আসা-যাওয়া বাবদ ১০ টাকার মত খরচ করে বাকী ৯০ টাকা মায়ের কাছে দিতো। মা এই টাকা দিয়ে সারা মাস অতি কষ্টেসৃষ্টে আমাদের সংসারটা চালাতেন। এর এখন প্রায় ঘরের ছেলে-পেলেরা বিদেশে চাকরি করে। মাসে মাসে ডলার পাঠায়। স্বাধীনতার আগে যাঁদের অবস্থা ছিল নুন আনতে পান্তা ফুরায়, তাঁদের এখন রাজকীয় অবস্থা। বর্তমানে যাঁরা শহরের বস্তিবাসী, তাঁদের পরনেও থাকে লেহেঙ্গার মত দামী পোশাক। সিনেমার হিরোদের পোষাক জিন্সের শার্ট-প্যান্ট।

মনে পড়ে দেশ স্বাধীন হবার আগের কথা, ১৯৬৯ সাল। সামনে দূর্গাপূজা। গ্রামের বড় গৃহস্তদের বাড়িতে হৈ-হুল্লোড়। বাবা, বড়দাদা নারায়ণগঞ্জে। পূজার আনন্দ নেই আমাদের মতো আরও অনেকের সংসারে। মা আমাকে আশা দিয়ে রেখেছেন, বাবা আসতে নতুন জামা-প্যান্ট কিনে আনবেন। আশায় থাকলাম আমি। আশায় থাকলো আমার বড় তিন বোন। পূজার ঠিক দুইদিন আগে বাবা বাড়িতে আসলেন। কী আনন্দ! বাবা শহর থেকে নতুন জামা-প্যান্ট কিনে এনেছে। আমার জন্য নতুন জামা-কাপড় আনেছে ১০ টাকা দামের গাউনের জামা-প্যান্ট। বোনদের জন্য এনেছিলেন কমদামি ছাপা মার্কিন কাপড়। ওই গাউনের জামা-প্যান্ট পেয়েও মহাখুশি হয়েছিলাম। তখন মনে হয়েছিলো আমি এই ভবসংসারের একজন রাজকুমার। সেই অভাবের দিনে গাউনের পোশাক পরেই রাজার বেশে পূজার আনন্দে মেতেছিলাম। তখন কমদামী আর বেশি দামি বুঝতাম না। অভাব কাকে বলে তাও বুঝতাম না। এখন বুঝি অভাব কাকে বলে। আমি ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ দেখেছি। এর আগেও নীরব দুর্ভিক্ষ দেখেছি।