নজরুল কাব্যে দ্রোহ, অসাম্প্রদায়িকতা এবং প্রেম

ja

যে কীর্তিমান মহাপুরুষের জন্ম না হলে বাংলা সাহিত্য অপূর্ণ থাকতো, তিনিই আমাদের বাঙ্গালি জাতিসত্তার কবি, প্রাণের কবি, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। যার সম্পর্কে অল্প কথায় কিছুমাত্র বলার সাধ্য আমার নেই। এক সমুদ্র জল থেকে এক ‘আজলা ভরে যতটা তুলে আনা যায় ঠিক ততটুকু অথবা তারচেয়েও কিছুটা কম। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস সাহিত্যে প্রতিভার বিচারে তাঁর ধারে কাছেও কেউ নেই। তিনি এক অবিসংবাদিত, অতুলনীয় এবং অলৌকিক প্রতিভার অধিকারী। সাহিত্যের সকল শাখায় যার রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল পদচারণা। কবিতা, ছড়া, গান, ছোটগল্প, উপন্যাস সহ সকল ক্ষেত্রেই তিনি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। জীবন ও জগতের সুগভীর দর্শন তাঁর লেখনির মাধ্যমে প্রকাশ করে আমাদেরকে ঋণী করে গেছেন। যেই ঋণের দায় পরিশোধ করা আমাদের জন্য অসাধ্য। তবে তাঁর চিন্তা, চেতনা, দর্শন আমাদের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনে বাস্তবায়নের মাধ্যমে কিছুটা হলেও এই দেনা লাঘবের সুযোগ রয়েছে। চলুন এবার আসা যাক মহাপ্রাণ এই সত্তার বিদ্রোহী সত্তায়। কবি বলেছেন,

“যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ, ভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।” বিদ্রোহী/ কাজী নজরুল ইসলাম —- আজ কোথায় সেই চিরায়ত বিদ্রোহের সুর? যেখানে অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন — সেখানেই কোথায় প্রতিবাদ? তেলবাজ, পদলেহী, চাটুকারদের দৌরাত্ম্য আজ সাহিত্য জগত থেকে শুরু করে সবখানে উন্মাদ জলের মতোন সয়লাব। প্রতিবাদহীন এই নপূংশক সমাজ চারাগাছ থেকে আজ বিশাল মহীরুহ। সবাই কেবল নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত। যে যেভাবে পারছে সেভাবেই তিরতির করে উঠে যাচ্ছে খাটের তলা থেকে আগরতলা। পারলে ছুঁয়ে দেয় আকাশ! মানবতার নূণ্যতম বালাই নেই। নেই পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, পরমতসহিষ্ণুতা। মানবিক বোধের দরজা-জানলা বন্ধ করে সবাই যেন মেতে উঠছে অমানবিক এক পৈশাচিক খেলায়। বলতে কিছুমাত্র দ্বিধা নেই যে, এতে করে মানুষ হিসাবে আমরা কেবলই পরাজিত হচ্ছি। কোনো এক অজানা অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছি। এমন এক অন্ধকূপ অথবা জন্মান্ধ গুহায় নিজের ঠিকানা খুঁজে নিজেই খুঁজে নিচ্ছি যেখান থেকে মুক্তির কোনো পথ নেই। মুক্তির কোনো পথ থাকবেও না।

তবে কি এভাবেই আমরা তলিয়ে যাব? এভাবেই তলিয়ে যেতে থাকব? অথচ গর্ব করার মতোন বিষয় মানুষ হিসাবে আমরাই মহাবিশ্বের সবচেয়ে উন্নত প্রাণি! আমাদের পতাকা এখন চাঁদে উড়ছে, মংগলে উড়ছে। ভবিষ্যতে শনি, বুধ, বৃহস্পতি, নেপচুন, প্লুটো সহ ছায়াপথ, গ্যালাক্সি জুড়ে চলতে থাকবে আমাদের জয়রথ। শুধু আফসোস থেকে যাবে এতোকিছুর পরেও আমরা কেবল মানুষ হব না– সত্যিকারের মানুষ! সাম্যের কবি, প্রাণের কবির “মানুষ” কবিতাটির অংশ বিশেষ পড়া যাক—

মানুষ/ কাজী নজরুল ইসলাম
গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।-
পূজারী, দুয়ার খোলো,
ক্ষুধার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে পূজার সময় হলো!’

, হ্যা.. আমরা অবশ্যই মানুষ; তবে তা নামিক মানুষ। নাম সর্বস্ব মানুষ। প্রশ্ন থেকে যায়, এইসব নাম খাওয়া স্ত মানুষ আর ইতর প্রাণির মাঝে কতটুকু পাথর্ক্য আছে? বনের সিংহ নিরীহ হরিণের মাংশ খুবলে খায়, মহিষের তাজা খুনে উৎসব পালন করে। এরাও কেউ নিজের মাংশে হাড়ি চাপায় না, উদরপূর্তি করে না। প্রকৃতির দেয়া নিয়ম-কানুন তারা যথার্থই নেমে চলে। কেবল আমরা মানুষেরা মানুষের রক্তে হাত রাঙাই। ভাই ভাইয়ের অধিকারে খড়গ হস্ত হই, দুর্বলের টুটি চেপে ধরে হাতুড়ি চালাই, শাবল, চালাই, গাইতি চালাই, বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দিই অনাগত স্বপ্ন। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হয়েও কেবল নিজস্ব স্বার্থ এবং পশু প্রবৃত্তির তাগিদে, ক্ষমতা এবং প্রভাব প্রতিপত্তির লিপ্সায় পশুদের সাথে একই কাতারে দাঁড়াই। দাঁড়াতে এতোটুকুও দ্বিধা করি না। এই যদি হয় আমাদের প্রকৃত অবস্থা, তাহলে আমার বলতে দ্বিধা নেই, যে থুতু আজ আমরা অন্যের দিকে নিক্ষেপ করছি, তা একদিন অবশ্যই কালের চক্রে নিজের দিকেই ফিরে আসবে। আসবেই। আসতেই থাকবে। মানবতা, সাম্য এবং মূল্যবোধের অবক্ষয় মানব নামের এই জাতিটিকে নিশ্চিতভাবেই আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করবে। এতে কোনোরকম সন্দেহ নাই। অসাম্যের বিরুদ্ধে চির সোচ্চার কবি এজন্যই বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলতে পেরেছেন, “আমি এই দেশে, এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশের, এই সমাজেরই নই, আমি সকল দেশের সকল মানুষের।”

নজরুল সত্তায় নারী প্রেম যেন এক চিরজাগ্রত চেতনা। নারীকে ইতিহাসের পানশালা থেকে, নর্দমার পঙ্কিল আবর্ত থেকে হাত ধরে, বুকে আগলে, মাথায় তুলে যে মহাপুরুষ পুরুষের সাথে একই সারিতে এনে দাঁড় করিয়েছেন… তিনিই আমাদের জাতি সত্তার, আমাদের ভালোবাসার কবি, প্রেমের কবি নজরুল। যে নারী একদিন কেবল ছিল পুরুষের সেবাদাসী, পুরুষের শষ্যার নিরীহ এবং নিষ্পৃহ সংগিনী… সেই অবহেলিত, বঞ্চিত, পদদলিত নারী সম্পর্কে তিনি বলেছেন,
বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।“(উৎস- ‘নারী’ কবিতা)

কী অসাধারণ সরল স্বীকারোক্তি! শুধু তাই নয়, এ যেন শিশ্নধারী প্রবল প্রতাপশালী পুরুষের উঁচু নাকে একটা ঘুষি, ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের সুউচ্চ সিংহাসন থেকে পুরুষকে টেনে হিচঁড়ে নারীর কাতারে নামিয়ে আনার নামান্তর। পুরুষের আজন্ম লালিত অহংকার ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার শামিল। ঘরে-বাইরে, সমরে-সংগমে নারীর অবদানের স্বীকৃতি দিতে তিনি আরও বলেছেন,
কোনকালে একা হয়নিকো জয়ী, পূরুষের তরবারী; প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়াছে, বিজয়-লক্ষী নারী।” (উৎস -‘নারী’ কবিতা)।

নারী ও পুরুষের চিরন্তন ভালোবাসার স্বীকৃতি তাঁর লেখায় মানব শরীরের ধমনীতে প্রবাহিত রক্তের মতোন প্রোজ্জ্বল। কিশোর প্রেমের স্মৃতি আওড়াতে তিনি তাঁর “চৈতি হাওয়া” কবিতায় বলেছেন, “হাস্‌তে তুমি দুলিয়ে ডাল/ গোলাপ হ’য়ে ফুটতো গাল”। কী দুর্দান্ত অথচ সাবলীল উপমার মায়াজাল! নারী আর চিরমোহিনী প্রকৃতি যেন একই রুপের চিরন্তন আঁধার। নারী-পুরুষের প্রেম-ভালোবাসার এই স্বীকৃতির পাশাপাশি প্রেমের নামে৷ ভালোবাসার নামের শরীর ভোগ করার বিষয়ে চরম হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, কামনা আর প্রেম দুটি হচ্ছে ম্পুর্ণ আলাদা। কামনা একটা প্রবল সাময়িক উত্তেজনা মাত্র আর প্রেম হচ্ছে ধীর প্রশান্ত ও চিরন্তন।”

তিনিই নজরুল যিনি সারাজীবন সাম্যের গান গেয়েছেন, অসাম্প্রদায়িক চেতনার জয়গান গেয়েছেন, সাম্প্রদায়িক বিষবৃক্ষের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে হুংকার দিয়েছেন। মানুষকে জাত-পাত, সাদা-কালো, উঁচু-নিচু নয়—- কেবলই মানুষ হিসাবে মূল্যায়ন করেছেন। হৃদয় থেকে প্রতিটি মানুষকে শ্রদ্ধা করেছেন, ভালোবেসেছেন। প্রিয় পাঠক, আসুন প্রিয়কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাম্যবাদী কবিতাটির অংশবিশেষ একবার পাঠ করা যাক।

সাম্যবাদী// কাজী নজরুল ইসলাম
গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্‌লিম-ক্রীশ্চান।

এই একটি কবিতাই প্রমাণ করে দেয়, “অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি এবং লেখকদের মধ্যে নি:সন্দেহে কাজী নজরুল ইসলাম শীর্ষস্থানীয়। তিনি তার অসংখ্য কবিতা, গল্প এবং প্রবন্ধে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিয়েছেন। বিশ্বের সমস্ত মানুষকে মানবতার একই পতাকা তলে সমবেত হওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন,
“মোরা এক বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান/ মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ/ এক সে আকাশ মায়ের কোলে/ যেন রবি শশী দোলে/ এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান’।

প্রেমের কবি, বিদ্রোহের কবি, সাম্যের কবি, অসাম্প্রদায়িকতার কবি, মানবতার কবি নজরুলকে বোঝার জন্য কিংবা বোঝানোর জন্য উৎকৃষ্ট উদাহরণ তার সৃষ্টি অসংখ্য এমন চরণ। বিদ্রোহী হয়ে ওঠা বা বিদ্রোহ প্রকাশের ধরন যে কোনো ব্যক্তির ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ থেকে উৎক্ষিপ্ত। মানবসত্তা বিকাশের জয়গান মূলত যে কোনো বিদ্রোহী সুরের সঙ্গেই একাট্টা হয়ে অনুরণিত হয় ব্যক্তিমানসে। যা থেকে প্রথমে দ্রোহ এবং পরবর্তীতে বিদ্রোহী চেতনার জন্ম নেয়। কাজী নজরুল ইসলাম তার সময়কে ভেদ করে এগিয়েছেন। যেটুকু কাব্য ও সাহিত্য চর্চার সময় তিনি পেয়েছেন ব্যক্তি জীবনে; কাজ করে গেছেন সাম্য ও অসাম্প্রদায়িকতার জন্যই।
গাহি সাম্যের গান-, যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান, যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম-ক্রীশ্চান। এটি নজরুলে অসাম্প্রদায়িকতার প্রতিচ্ছবি।

নজরুলের মানবসত্ত‍া এবং তার বিদ্রোহ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কেউ কেউ নজরুলকে বহুবিধ বিশ্লেষণে ভূষিত করেছেন। যার মধ্যে বিদ্রোহী কবি, সাম্যের কবি, মানবতার মুক্তিদূত এবং সর্বতোভাবে প্রেমের কবি অন্যতম। শুধু তাই নয় প্রেম প্রকাশের ক্ষেত্রে নজরুলের আরেক ধরনের বিদ্রোহ সামনে ভেসে আসে। যেখানে কখনও প্রেমিকসত্তা নিরঙ্কুশভাবে বিলীন প্রেমাস্পদের কাছে অথবা কখনও বা প্রেমবিদ্রোহ জাগরুক থাকে বিরহের যূপকাষ্ঠে নিজেকে বলি দিয়ে।

আগের বলেছি, বিশাল সমুদ্র থেকে এক আজলা ভরে যতটা জল আনা যায়, আমার আলোচনাও তাই। একজন সত্যিকার মানুষ হিসাবে, একজন কবি-লেখক হিসাবে, একজন শিল্পী হিসাবে, একজন অভিনেতা হিসাবে, একজন প্রেমিক হিসাবে, একজন পিতা হিসাবে, একজন স্বামী হিসাবে নজরুল সত্তার কোনো তুলনা নাই। তাঁর তুলনা কেবল তিনি নিজেই। মানুষকে কতটা ভালোবাসলে একজন মানুষ বলতে পারেন, “মিথ্যা শুনিনি ভাই
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনও মন্দির-কাবা নাই।“

সবশেষে প্রাণের কবি, মন, মানস, বোধের কবি, বাঙালি জাতিসত্তার কবি চির বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।।
——————–

আকাশ আমার ভরলো আলোয়

ch

ভোরের আকাশে ঝুলে আছে শরতের আলো;
শ্রাবণের রঙ নেই নীলে, হলো না আর মেঘ কালো;
শ্রাবণ যায় বৃথা, বৃষ্টির ধারা আর বইলো না
তীব্র উষ্ণতায় মনে শান্তি আর রইলো না।

এই শ্রাবণ যেন তুমি, আগুন খরা
যেন আগুন দিয়ে গড়া
কেমন অহম বলো তার, ঠিক যেন তুমি,
একটু খানি বৃষ্টি হয়ে ঝরে না শ্রাবণ,
ভরলো না সুখে মনের জমি।

কেমন যেন হয়ে গেল শ্রাবণ, তোমার মত
বর্ষার মৌসুমে হিম জল না ঢেলে বুকে বাড়ালো তাপের ক্ষত;
উষ্ণতার আচে পুড়ে যাই
কী করে বুকের তারে বলো সুখ বাজাই।

বৈরী হাওয়ায় ভেসে যাই, ডুবে যাই
কী করে সুখের ফুল দিয়ে মনঘর সাজাই?
শ্রাবণ যেন তুমি হয়ে গেল
আগুন আগুন, করে দিল জীবন এলোমেলো।

তুমি শরত হও না, হলে না হেমন্ত
কেমন বিতৃষ্ণায় পুড়ছে এ মনতো;
শ্রাবণ তাকালো না ফিরে, শ্রাবণ যেন তুমি
করেই গেল কী দিন কী রাত, একই গোয়ার্তমি।

তুমি শরতের মেঘের মত হলে না নরম,
আর শ্রাবণ ঝরায় না বৃষ্টি, ঢেলে দিল গরম
পুড়ে পুড়ে ছাই, নেয়ে ঘেমে বিতৃষ্ণা ডুবে ডুবে
সুখের স্বপ্ন গেল কর্পূরের মত উবে।

.
(স্যামসাং এস নাইন প্লাস, চুনারুঘাট)

বৃষ্টিভেজা শব্দেরা

ria

মাঝেমধ্যে মনে হয় নিরপেক্ষ ব্যবচ্ছেদ হোক। সময়ের আবর্তনে মনের অলিগলি বড় ক্লান্ত। আকাশও উপচে পড়ছে। এক ফোঁটা-দু ফোঁটা, তারপর মুষলধারে আঙুল বেয়ে, চিবুক ছুঁয়ে, হাতের পাতায়।

একাই বন্ধ ঘরে নিজের সঙ্গে তর্কে কখনো হেরে যাই, কখনো জয়ী। মাঝরাতে দেখি একটা একটা করে তারা জমায় আকাশ, কখনো আধখানা, কখনো বা পুরো চাঁদ অপেক্ষায় থাকে। কতকিছুই যে আবোল তাবোল ভেবে চলি! মাঝেমধ্যে স্বপ্নগুলো কাছে টেনেই পরমুহূর্তে আবার দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া মন্দ লাগে না।

কিন্তু শব্দেরা যখন ছেড়ে যায়, ঠিক তখনই ইচ্ছে করেই নিজেকে আঁকড়ে ধরি। বৃষ্টি ফোঁটায় ফোঁটায় দাগ কাটে কাচ রঙা চোখে, সোঁদা গন্ধে ধুয়ে যায় চুল, সবুজ হাওয়া এসে বলে যায় শরৎ এসেছে। মন টেনে নিয়ে যায় মনখারাপী আবরণ ফেলে আনমনে কোনো কাশবনে।

ওহে জয়দেব

এক
মাটি থেকে ছিটকে উঠে মাটিতেই ভেসে যাবে,
জানা।
ঝরনা হল মাথার পাগড়ি, তাতে গোঁজা ময়ূরের ডানা
ঝরনার কোমরে বাঁকা নদী, চার চাঁদের আলোয় ঝলসাচ্ছে কাজল
ও মন ময়না ময়না ময়না… কৃষ্ণকথা বল

দুই
আমার যে ভবঘোরা — সুন্দর হবে
বনপাস স্টেশনে আচমকা ট্রেন থেমে গেলে
ব্যাগ থেকে বের করব রিভল…, নাহ বিস্কুট
কষ্টের নাড়িভুঁড়ি দুহাতে ভেতরে ঠেলে
গুণছুঁচ দিয়ে খুলি সেলাই করেছি
এবার এক প্যাকেট সবুজ আমলকি… খুচরো পয়সা
মেঝেয় ফেলে দিয়ে হকার মেয়ের পা ছোঁব।
ছায়ায় দাঁড়িয়ে সিগারেটে টান থাকবে এ-জীবনে;
প্রুফে একটা বানান ভুল তন্ন তন্ন করার মতো
আমি খুঁজব প্রেম…

খুঁজতেই তো এসেছি

তিন
সে গৌরহরি সেবাশ্রমই হোক, কি
পবন বাউলের আখড়া
আমাকে দুপুরদুপুর ভাতে বসিয়ে দাও
সে হোক অজয়ে সোয়া-নগ্ন মেয়েবউ, কি
লোভে ফাজিল সাধু
আমাকে ঘুরঘুর করাও গাঁজাকলকের চারপাশে
গোল অন্ন-মুগডাল গোল পাতে
গোল ডাবুহাতায় বিতরণ করো
সে ফানাফানা কলার কাঁদি হোক, বাস্‌নায় জড়ানো,
মুসলমান কুটুমবাড়ি নেবে
কিম্বা দুশোমতো কুঠোভিখিরি
নদীকাটা দুধারি রাস্তায়;
আমাকে ভ’রে উঠতে দাও কান্নাসজলে

যেটুকু যাবে, তার সঙ্গে অবশিষ্ট উব্‌জে চলে যায়
তারপর যাবজ্জীবন আমার পরিবেশনা
আর তোমাদের ‘দারুণ খেলাম’!

দাঁড়াও, আগে নিজে মুগ্ধ হয়ে নি’

চার
তোমাকে কৃষ্ণনগরে দেখেছি না, দাঠাকুর?
আমি রবি, বউ খুঁজে পাচ্ছি না, সেবাইতকাকা।
জয়দেব-পদ্মাবতী মিলনমন্দির থেকে নেমে
আমরা আলাদা হয়ে গেনু। মেলায় পুলিশ আছে
নাম জিগ্যেস করার জন্যে। লিখে নিয়ে
চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মাইকে অ্যালাউন্স ক’রে দেবে।
কিন্তু বউটা বড় কাঁচা আমার, পূর্ণিমা।
এবারে যে-সে ডাক দেবে — পূর্ণিমা ধীবর,
এদিকে এসো; পূর্ণিমা ধীবর, চলো আমার সঙ্গে…

বউ হারিয়ে গেছে, ফিরে পাব
চলে গেলে আর ফেরত আসবেনি

পাঁচ
গৌরীদাসের সঙ্গে চৈতন্যের মিলন হল কোথায়?
কেউ বলছেন শ্রীখণ্ডে, কেউ কাটোয়ায়,
কেউ বা মাধাইতলা। আমরা বলি,
স্থান গুরুত্বের নয়, কথা হল কাল।
কোন কালে দেখা?
যেথা যেথা নিত্য হরিনাম সংকীর্তন।
সেথায় নিত্য নবদ্বীপধাম, নিত্য বৃন্দাবন।।

গোরাচাঁদ নিত্যানন্দাদি বন্ধু ও শিষ্যদের নিয়ে নগর-পরিক্রমায় বেরিয়েছেন, বদনে হরিনাম — এমনি সময়ে গৌরীদাস উপস্থিত। তাকে দেখতেই গৌরাঙ্গের মনে পড়েছে শ্রীরাধার কথা। কেননা,
এই গৌরীদাস তো আর কেউ নন,
তিনি বৃন্দাবনের সুবল। মহাপ্রভু গৌরীকে জড়িয়ে ধ’রে “রাধা রাধা” ব’লে উচ্চস্বরে…

আহা, সে কী অশ্রু! কোনও ভক্ত বলছেন
প্রভুর দু’চোখ বেয়ে মুক্তো গড়িয়ে পড়ছে। আবার কোনও ভক্ত — না না, গড়িয়ে পড়ছে মুক্তি। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের ভক্তিরূপ গাল বেয়ে মুক্তি গড়িয়ে পড়ছে গো!

.
[প্রথম অংশ। ‘ভুবনভোজন চলছে’ কাব্যগ্রন্থ থেকে।]

একটা যাপন

হলুদ কুসুমের ভেতর লুকিয়ে থাকা মহিরুহ যাপন
বেরিয়ে এসো, এই রাজ হাওয়া ঘড়ির অবুঝ
মহাপয়ার ধরে পোস্টমর্টেম করো মৃত চোখ,
এমন বিঘ্নিতসুন্দর থেকে আরও কাছের হয়ে ভেবে দেখো
কবে বেদখল হয়ে গেছে পরস্পর পায়চারি-
শেয়ালের যথাযথ আধুলি শব্দ
সেই অভিনব বরফে ভিজে ওঠে পাহাড়ের বড় ছায়া
কচ্ছপের মতো সারারাত, শুয়ে থাকা মাটি—ফসল
পৃথিবীর লতামূল নদী…
এই খুনসুটি খুলে দেয় গোপন গ্রন্থের অর্গান থেকে
পূর্ণ সমর্থন, সেই গান, যার কোনোটাই তুমি দেখনি…

একগুচ্ছ বনের আদেশ আঁকতে পারো, শেষ ছবির
সঙে সন্তপ্ত রঙের ইটচাপা দুর্বাঘাসের নগর—
শ্রেষ্ঠ সংবিধানে শিশুরা নির্লিপ্ত হাসি রেখে যাচ্ছে
এই হামাগুড়ি মানুষের নৈঃশব্দ্য আলাদা করে কেন?

জোনাক জ্বলা একটি রাতে

ch

জোনাক জ্বলা একটি রাতে
তুই কী আমার পাশে হাঁটবি?
সারি সারি গাছের তলে
হেঁটে তুই কী কথা বাটবি?

আয় না একদিন গাঁয়ের পথে
হেঁটে হেঁটে শান্তি কুড়াই
চাঁদের আলোয় জোছনা মেখে
দেহ আর মন একটু জুড়াই।

তুই কি আমার সঙ্গী হবি
আঁধার রাতে হাঁটবি পথে
উঠবি নাকি এক রাত্রিরে
হাতটি ধরে আলোর রথে।

মিষ্টি হাওয়া বইবে যেদিন
যদি জানাই নিমন্তন্ন
সকল কর্ম ফেলে তুই কি
চলে আসবি আমার জন্যয?

ধরবি হাতে দিবি স্পর্শ
ভালোবাসবি আমায় কি তুই?
আসবি একদিন হাঁটবি পাশে
অপেক্ষাতে থাঁকি নিতুই।

তুই আমার পাখি হবি
মনের মাখে বসবি এসে
জোনাক পোকা হবি কি তুই
যাবি বন্ধু সুখে ভেসে?

জোনাক জ্বলা রাত প্রহরে
হাঁটতে ইচ্ছে তোকে নিয়ে
আয় না একদিন দুজন মিলে
সুখ মুগ্ধতা নিই ছিনিয়ে।

ড্রামা ও ড্রাকুলা

পর্দা নামার আগেই সরে যাচ্ছে খলনায়কের দল। যারা
বাঁশি বাজিয়েছিল, পরিচালক কেড়ে নিচ্ছে তাদের হাতের
বাঁশি। নেপথ্যের সুরে যারা দিয়েছিল কণ্ঠ- ধমক দিয়ে
কেউ থামিয়ে দিচ্ছে তাদের গলা।

কেউ কেউ বদলে দিতে চাইছে রক্তদাগ মুছে ফেলার পদ্ধতি।
বলছে, একাত্তরেও রক্তাক্ত হয়নি এই মাটি,
যারা’ ভুল করে যুদ্ধ করেছিল, এখন বরং তারাই
করছে অনুতাপ’ – এমন কথাও বলছে কেউ কেউ।

তারপরও শরতের চাঁদকে সাক্ষী রেখে একটি কিশোরী
পা ভিজাচ্ছে কর্ণফুলী নদীতে। ভরা আশ্বিনে সাইকেল
চালাতে চালাতে একটি কিশোর রোমন্থন করছে তার
বালকবেলা। যুবা কৃষকের লাঙল আর অষ্টাদশী তরুণীর
সেলাই মেশিনে ভর করে এগিয়ে যাচ্ছে প্রিয় বাংলাদেশ।
#

শালপাতায় পবিত্র প্রসাদ

সারাজীবন ধরে দেখলাম
অদ্ভুত কিছু প্রজাপতি
খেয়ে যায় প্রেমের লার্ভা
সবুজ ধানের পাকা ছোঁয়া
তালশাঁস নরম হৃদয় আমার

সারাজীবন প্রেমিকদের দেখলাম
ধূর্ত শেয়াল অথচ
প্রজাপতিগুলোর সামনে
শালপাতায় পবিত্র প্রসাদ যেন
এতই চতুর, এতই বোকা

আশা

আসবে কিনা জানিনা
তবুও বলি এসো,
জনম জনম আমায় তুমি যেন ভালোবাসো।

থাকবে কিনা জানিনা
তবুও বলি থেকো,
জনম জনম আমায় তুমি এরূপ পাশে রেখো।

হাসবে কিনা জানিনা
তবুও বলি হেসো,
জনম জনম হাসবার জন্য আমার পাশে এসো।

বলবে কিনা জানিনা
তবুও বলি বলো,
জনম জনম আমায় তুমি সঙ্গী করে চলো।

নেবে কিনা জানিনা
তবুও বলি নিও,
জনম জনম আমায় তুমি আদর যত্ন দিও।

রচনাকালঃ
০৮/০৬/২০২৩

চাপা

চাপা ক্রোধে
চপলা চাপাতি উন্মত্ত করি নৃশংস নৃত্যে
যতক্ষণ না
দ্বিখণ্ডিত হচ্ছে কাধে চাপানো ক্রোধানল…
শানিত বুকে
শোণিতের শীৎকার
মুখরিত শ্লোগান চাপিয়ে
নিংড়ে তুলি অতলের শেকড়, আসল অস্তিত্ব!
প্রাগৈতিহাসিক নিস্তব্ধতায় চেপে থাকা ঝড়
মুখোমুখি বেধড়ক হাঙ্গামা, অজস্র শব্দ-স্বর….

নিড়ানি পেয়ে উঠে আসে বিবস্ত্র যুগ
কালের গহ্বরে ডুবন্ত আবেগ, পুরনো অসুখ!

হয়তো আমি নির্বোধ
বুঝিনা কিছু
এবার বেরিয়ে পড়বো অনন্তের পথে
তোরা আসিস না কেউ
এদিকে ফিরেও তাকাস না কেউ
আমি একা চলতে চাই.. একদম একা
আমার সহ্য হচ্ছে না ক্রোধ!…

২১/৯/২৩

একটি কবিতার চারাগাছ

আখাম্বা সময় একদিন একটা গাধা ছিলো..
এখন সে দুরন্ত টগবগে ঘোড়া হয়েছে;
ছায়াপথের মায়া ছেড়ে সে এখন আমার
এই শহরে এসে আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে!

তবুও আমি পিতলের মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ করি
ভাগ্যিস ভাগ্যের চাকা এখন যত্রতত্র ওড়ে
আর আমার বুভুক্ষু সময় কেবলই মাটি খুঁড়ে!

এতোকিছুর পরেও আমার হৃদয় ফুঁড়ে
একটি কবিতার চারাগাছ জন্ম নেয়; সেও জন্মান্তরে
পত্রিকার পাতার হাত ধরে বৈতরণী খুঁজতে চায়
আমি ছাড়া আর সব তা পাখিরা জানে
আমার সেই চারাগাছ আজ বড় হতে চায়!
আমার সেই চারাগাছ আগাগোড়া জল চায়!

সে জানে না.. সমুদ্রে কত বিশাল জলরাশি
কেবল পান করার মত কোনো জল নাই..!!

মিথীলার জন্মদিনে সকলের কাছে মিথীলার জন্য আশির্বাদ চাই

376t প্রতি বছর মিথীলার জন্মদিনে একই কথা আমি লিখি, মিথীলার জন্মের পর কেঁদেছিলাম। লিখি, কারণ এটাই আমার কৃত অপরাধের জন্য নিজেকে শাস্তি দেয়ার উপায়। ১৯৯৯ সালের ১০ই সেপ্টেম্বরের সকাল ৯টায় সিজারিয়ান অপারেশানের মাধ্যমে যখন আমার তৃতীয় কন্যার জন্ম হলো, আমি খুব কেঁদেছিলাম। কেঁদেছিলাম কারণ, প্রথম দুই কন্যার জন্মের পর “দুটি সন্তানই যথেষ্ট” ভেবে দুই সন্তান নিয়েই জীবন কাটাবো সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তারপরেও খাঁটি বাঙালি মায়ের মনে এক টুকরো আক্ষেপ ছিলো, দুটি কন্যা না হয়ে যদি আমার কন্যা এবং পুত্র দুইই থাকতো, তাহলে দুজন দুরকম মানুষ হতো।

কে আমায় বেশি ভালোবাসতো! পুত্র নাকি কন্যা? নিশ্চয়ই কন্যা তার বাবাকে বেশি ভালোবাসতো, পুত্র বেশি ভালোবাসতো তার মাকে। কিন্তু আমার তো দুটোই কন্যা, পুত্র সন্তান কেমন হয় ভেবে তো লাভ নেই! দুই কন্যা নিয়েই আমরা সুখী ছিলাম। ওরা একটু বড়ো হতে অস্ট্রেলিয়ার ইমিগ্রেশন ভিসা নিয়ে মেলবোর্ন চলে গেলাম। মেলবোর্নের আলো বাতাসে দুই কন্যাই লেখাপড়া নাচ গান আবৃত্তি অংকনে তুখোড় হয়ে উঠছিল। দুই কন্যার মেধার প্রকাশ দেখতে দেখতে কখন যে পুত্র সন্তানের জন্য আক্ষেপ মিটে গেলো টেরই পাইনি। এরপর অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্ট হাতে আমরা আবার দেশে ফিরে এলাম। দেশে ফিরেই আমি একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে যোগ দেই। অই স্কুলে ক্লাস ওয়ান- টু’র ক্লাস টিচার হিসেবে সারাক্ষণ বাচ্চাদের মাঝেই কেটে যেতো।

বাচ্চাদের মাঝে থাকতে থাকতেই দ্বিতীয় কন্যার জন্মের আট বছর পর তৃতীয় সন্তানের অপ্রত্যাশিত আগমন টের পেলাম। ভাবলাম, না চাইতেই যখন ঈশ্বর আরেকটি সন্তান আমার কাছে পাঠাচ্ছেন, নিশ্চয়ই পুত্রসন্তান হবে।
ঈশ্বর তো ভক্তের মনের কথা জানেন, আমি যে আগে খুব চাইতাম আমার একটা ছেলে একটা মেয়ে হলে ভালো হতো! তাই বোধ হয় ঈশ্বর এবার পুত্র সন্তান পাঠাচ্ছেন। এদিকে ভয়ও পাচ্ছিলাম ভেবে, প্রথম দুটি সিজারিয়ান অপারেশানের পর তৃতীয় বারেও নিশ্চয়ই সিজারিয়ান অপারেশান হবে! পর পর তিন বার সিজারিয়ান অপারেশন হলে আমিই যদি মরে যাই! মনকে বুঝ দিলাম, আমি তো দুই কন্যা নিয়েই সুখে ছিলাম, পুত্রের কথা ভুলেও গেছিলাম। তারপরেও ঈশ্বর যখন পাঠাচ্ছেন পুত্রকে, ঈশ্বরই রক্ষা করবেন।

প্রায় ভুলে যাওয়া পুত্র সন্তানের ইচ্ছে আবার আমার মনকে চাঙ্গা করে তুললো। আমি পুত্রের মুখ দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে নয় মাস কাটিয়ে দিলাম। দুই কন্যার অফিশিয়াল নামের আদ্যক্ষর ঋ, আর পুত্রের বাপের নামের আদ্যক্ষর জ। আমি ঋ এবং জ দিয়ে পুত্রের নাম বের করতে ব্যস্ত, কন্যার নাম খুঁজিই নি। ডাক্তার হাফিজ যখন সিজারিয়ান অপারেশন করে তৃতীয় কন্যার আগমন ঘোষণা করলেন, আমি ভেবেছি ডাক্তার আমার সাথে মজা করছে। আমার শিয়রে দাঁড়ানো ডা: হাসি ভাবীর দিকে তাকালাম, ভাবী আমার হাতে একটু চাপ দিয়ে ইশারায় বললো, মেয়ে হয়েছে।

আমার মনে হলো, ঈশ্বর আমার সাথে ঠাট্টা করেছেন, অকারণে ঈশ্বর আমার সাথে চরম ফাঁকিবাজি করলেন! ঈশ্বরের প্রতি প্রচন্ড অভিমানে অপারেশান টেবিলেই আমার দুই চোখ ফেটে জল এলো। আমি একেবারে চুপ হয়ে গেলাম। হাসি ভাবী আমার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বলে চলেছেন, মৌটুসির আম্মু, কাঁদছেন কেন? কী সুন্দর পুতুলের মতো বেবি হয়েছে। আমি তখন কারো সাথে কথা বলতে রাজী নই। সেই যে কান্না শুরু হলো, অঝোরে দুই চোখ দিয়ে জল গড়াতেই লাগলো। কেবিনে উপস্থিত- অনুপস্থিত আত্মীয় বান্ধব স্বজন সকলেই ধরে নিলো, ছেলে সন্তানের আশায় আমি তৃতীয়বার বাচ্চা নিয়েছি, তৃতীয় বারেও মেয়ে হওয়ায় আমি এভাবে কাঁদছি।

তাদের কারোরই জানার কথা নয়, আমি ঈশ্বরের সাথে অভিমান করে কাঁদছি। আমি তো খুশিই ছিলাম দুই কন্যা নিয়ে, পুত্র যদি ভাগ্যে নাই তবে কেন ঈশ্বর আমায় এত বছর পরে আরেকটা মেয়ে দিয়ে আত্মীয় বন্ধুদের কাছে হাসির পাত্র সাজিয়ে দিলো! আমার আত্মীয় স্বজনেরা অবশ্য মনে মনে যেটাই বলুক, আমার সামনে সকলেই ভালো কথা বলেছে। তাদের কথা শুনে মনে হয়েছে, তৃতীয় কন্যার জন্ম বিশাল সৌভাগ্যের ব্যাপার, আর কন্যা যদি হয় এমন চাঁদের মতো, তাহলে পাঁচ কন্যাতেও ক্ষতি নেই! বর্তমান যুগে মেয়েরাই ছেলের চেয়ে ভালো হয়, মেয়ে বিয়ে দিলে এখন জামাই ছেলে হয়ে যায়! কারো কোনো আশার বাণী, উচ্ছ্বাসের বাণীই আমার অভিমান ভাঙাতে পারেনি।

তৃতীয় দিনে আমার সমস্ত অভিমান ভেঙে সত্যিকারের বোধ জেগেছিলো মায়ের দুটো কথায়। মা বলেছিলো, “মিঠু তুই যে এভাবে কানতেছিস, তুই তো ঈশ্বরের দানকে অবজ্ঞা করছিস। ফুলের মতো শিশুটা নয় মাস তোর পেটে বড়ো হলো, এখন তারে দেখে তুই এমন মরাকান্না জুড়ে দিছিস, ঈশ্বর নাকি তোরে অপমান করেছে! এই ছোট্ট শিশুটা তো মান অপমান কিছুই বোঝে না। সে তোর কোলে এসেছে আর তুই কিনা মরা কান্না কেঁদে দুই দিন বয়সের শিশুটাকে অপমান করতেছিস। বেশী বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু ভগবান অসন্তুষ্ট হবেন। কান্না বন্ধ কর। তৃতীয় মেয়ে হইছে বলে কানতেছিস, দুই মেয়ে যখন কলেজ ইউনিভার্সিটি চলে যাইবো, এই তিন নাম্বার মেয়েই তোর মাঝবয়সে একলা সময়ের সাথী হবে।”

মায়ের কথায় আমি ঝাঁকুনি খেলাম। ছোট্টো শিশুটির নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে মরমে মরে যেতে ইচ্ছে করলো। বাড়ি ফিরলাম। দুই কন্যার ডাক নামের আদ্যক্ষর ম। আমার দাদু নাম পাঠালো মধুমিতা, মামাতো ভাই নাম দিলো মুর্ছনা, আরও কয়েকটি নাম। কোনো নামই আমার মনে ধরে না। বাবা তো জানতে পেরেছে তৃতীয়বার কন্যা সন্তান পেয়ে আমার পাগলামির কথা। আমাকে খুশি করার জন্য সবাই চেষ্টা করছে, আমার সিংহ পুরুষ বাবাও চেষ্টা করলো খুশি করতে। বললো, তোর মেয়ের নাম রাখ মিথীলা। ব্যস, মিথীলা নাম মনে ধরে গেলো আমার। এটাও ভাবলাম, আমার মায়ের কথায় যে বাচ্চার দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছি, আমার বাবার দেয়া নামে ওকে ডাকবো।

এবার মিথীলার জন্য অফিশিয়াল নাম রাখতে হবে। আমি তো ছেলের নাম ঠিক করে রেখেছিলাম, ক্লিনিকে তো বাচ্চার নাম দিতে হবে। আমি তো তখন কেঁদেই আকুল, কন্যার বাবা চট করে কন্যার নাম দিয়েছে আয়ুষী। যখন আমি ধাতস্থ হয়েছি, আয়ুষী নাম বাতিল করে দিয়েছি। বড় দুই কন্যা ঋত্বিকা ঋজয়া, ছোটোটার নামও তো ঋ দিয়ে হতে হবে। ঝট করে মনে হলো, ঋষিজা। মাকে জিজ্ঞেস করলাম, মা আত্মজা মানে যদি আমার কন্যা হয়, তাহলে ঋষিজা তো ঋষির কন্যা হবে।
মা বলল, হ্যাঁ। বললাম, আমি তো দজ্জাল মা হলেই কি, কন্যার বাবা তো সাক্ষাৎ ঋষি। তাহলে ওতো ঋষির কন্যাই হলো, ওর নাম হোক ঋষিজা। ঋষিজা রায় মিথীলা।

মিথীলা হয়ে গেলো ওর দুই দিদির খেলার পুতুল। মিথীলাকে আমি বড়ো করে তোলার সুযোগই পেলাম না। ওর দুই দিদি কলেজে যাওয়ার আগ পর্যন্ত মিথীলাকে নিজেদের মন মতো খাইয়ে সাজিয়ে বড়ো করেছে। এরপর দুই দিদিই যখন কলেজ ইউনিভার্সিটি চলে গেলো, আমাদের ফাঁকা বাড়িতে মিথীলাই হয়ে গেলো বুড়ো বাবা মায়ের জিয়নকাঠি। আমার মায়ের কথাই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। বড় দুই কন্যা বাপ সোহাগি হলেও মিথীলা রয়ে গেলো মা সোহাগি হয়ে। মেয়ের হাতের সেবা যত্ন পাওয়ার জন্য আমাকে বুড়ো হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি।

মিথীলা যখন ক্লাস ফোরে পড়ে, তখন থেকেই ও আমাকে ঘরের কাজে হেল্প করে। মাঝরাতে চা বানিয়ে খাওয়ায়, কাজ থেকে মাথা ব্যথা নিয়ে ফিরলে মাথা টিপে দেয়। আমি বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত মিথীলা না খেয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করে। রান্নাঘর পরিষ্কার করা, কাপড়চোপড় গোছানো, ঘর গোছানো, খাবার দাবার গরম করা– প্রতিটি বিরক্তিকর কাজ মিথীলা অসীম ধৈর্যের সাথে করে।

মিথীলার জন্মের সময় আমার বয়স পঁয়ত্রিশ। একটা ভয় ছিলো, পারবো তো মিথীলার পায়ের তলায় মাটি এনে দিতে! বেঁচে থাকবো তো ততোদিন! মিথীলা যখন স্কুল গ্র‍্যাজুয়েশন শেষ করে এমোরি ইউনিভার্সিটিতে আন্ডারগ্রাড করতে যাবে, ওর বয়স ১৮ হয়নি। ওকে ডেকে বললাম, মা গো, তুমি আমার অধিক বয়সের সন্তান। তোমার দুই দিদি আমাকে যতদিন পেয়েছে, তুমি তার চেয়ে অনেক কম সময় আমাকে পাবে।

তুমি যখন লেখাপড়া শেষ করে চাকরি বাকরি করবে, বিয়ে করে সংসার করবে— আমি হয়তো ততদিন বেঁচে থাকবো না। ভালো কিছু দেখলে, ভালো কিছু পেলে তুমি হয়তো মনে মনে আফসোস করবে, মা থাকলে মাকেও দেখাতাম। হয়তো ভাববে, মায়ের খুব শখ ছিলো অনেক আরাম বিলাসে থাকার। মা থাকলে মাকে অনেক আরাম দিতে পারতাম। যখনই তোমার আফসোস হবে, তুমি আমার আজকের কথা স্মরণ করো। তুমি অলরেডি আমাকে সারাজীবনের সুখ দিয়েছো মিথীলা। যখন সুখ তোমার কাছে আসবে, তুমি সুখটা উপভোগ করবে। তোমার দেহটা তো আমার দেহ থেকেই তৈরি হয়েছে, তাই তুমি সুখি হলেই আমার সুখ।

এখন মিথীলা ইউনিভার্সিটি ডিগ্রি শেষ করে চাকরির জগতে ঢুকে গেছে। ওর দুই দিদি কবেই পড়াশুনা শেষ করে যার যার প্রফেশন নিয়ে ব্যস্ত। এত ব্যস্ততার মধ্যেও ওরা মিথীলার জন্য মন প্রাণ উজাড় করে দেয়। আর মিথীলা? সত্যিই মিথীলা ঈশ্বরের পাঠানো এক পরম উপহার। মিথীলা সত্যিই আমার একলা সময়ের অনেক বড়ো অবলম্বন। আমি আজও নিজের কাছেই নিজে লজ্জিত হই আমার তৃতীয় কন্যার আগমনে কেঁদেছিলাম বলে। আজও নিজের কাছেই নিজে দুঃখ প্রকাশ করি সেদিনের কৃতকার্যের জন্য।

মিথীলা চাকরি শুরু করার পর আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। মিথীলা ওর বেতন থেকে আমাকে হাতখরচ বাবদ টাকা দেয়। কয়েক মাসের টাকা একসাথে একটা খামের ভেতর ভরে এতো ভদ্রভাবে বিনয়ের সাথে খামটা আমার হাতে দেয়, আমার চোখে জল চলে আসে। এটাও বলে, মা এই খাম থেকে টাকা নিয়ে তুমি খরচ করবে। তোমার তো ওয়ালমার্টে গেলেই শুধু গাছ কিনতে ইচ্ছে করে, বাসনকোসন কিনতে ইচ্ছে করে, তুমি কিনবে।
টাকা ফুরিয়ে গেলে আমাকে বলবে, টাকা জমিয়ে রাখবে না।

গত মাসে ওয়াশিংটন ডিসি বেড়াতে গেলাম মিশার কাছে, মিথীলা আমাকে নিয়ে কত জায়গা বেড়ালো। সাজগোজের দোকান সেফোরাতে গেছিলো নিজের জন্য পারফিউম কিনতে। কয়েক বছর আগে সেফোরা থেকে আমার মামাতো বোন টুম্পা অনেক দাম দিয়ে আমাকে একটা লিপস্টিক কিনে দিয়েছিলো। তখন মিথীলা স্কুলে পড়ে, লিপস্টিকটা আমার এতো প্রিয় ছিলো, কিন্তু কোথায় যে হারিয়ে গেছে!

এরপর থেকে আমি ওয়ালমার্ট থেকেই লিপস্টিক কিনি রেগুলার ব্র্যান্ডের। সেদিন সেফোরাতে গিয়ে মিথীলার মনে পড়েছে লিপস্টিকটার কথা। আমাকে তখনই সেই একই রঙের লিপস্টিক কিনে দিলো, কনসেলার কিনে দিলো। আমার কেবলই মনে পড়ছিলো মায়ের কথাগুলো। সেদিন আমার কান্না থামাতে মা তিরস্কার করে যে কথাগুলো বলেছিলো, মায়ের সেদিনের তিরস্কারের কথাগুলোই আমার জন্য আশির্বাদ হয়ে গেছে!

মিথীলা করোনার সময়টাতে এনভায়রনমেন্টাল হেলথ এবং কেমিস্ট্রি, দুই সাবজেক্টে অনার্স কমপ্লিট করেছে এবং গত বছর এনভায়রনমেন্টাল হেলথে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে। পাঁচ বছরের পড়া সোয়া চার বছরে কমপ্লিট।
মিথীলাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম পিএইচডি করতে চায় কিনা! মিথীলা দুই হাত জোড় করে, ‘ না, মা আর পড়তে পারবো না” বলে দিয়েছে! তাতে আমি একটু আশাহত হয়েছি।

আমি চেয়েছিলাম আমাদের মেয়েরা ওদের বাবার মতো পড়ুয়া হোক, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তিন কন্যাই তাদের মায়ের মতো লেখাপড়া বিমুখ হয়েছে, কী আর করা! গত বছর চাকরি খোঁজার আগে আমি বলেছি, মিথ তোমার পড়া শেষ, কিছুদিন বাবা মায়ের সাথে সময় কাটাও। চাকরিতে ঢুকে গেলে সারাজীবন ক্যালেন্ডারের পাতা আর ঘড়ির কাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। বাবা মায়ের সাথে নিরলস সময় কাটানোর সুযোগ পাবে না! পাপা ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দুই মাসের জন্য ভারত যাচ্ছে, আমিও যাচ্ছি।
তুমিও চলো, আমরা ভারত ঘুরে আসি।

তীর্থ ক্ষেত্রে যাবো, গঙ্গায় ডুব দিয়ে মনের যত কালি, গ্লানি সব বিসর্জন দিয়ে আসবো। তুমি ইয়াং জেনারেশনের প্রতিনিধি, বুড়ো বাবা মায়ের সাথে থাকলে অজানা অচেনা জায়গায় আমরা মনে বল পাবো। তাছাড়া তুই সবার আদরে আহ্লাদে বড়ো হয়েছিস বলে জীবনের কঠিন বাস্তবতাকে চোখের সামনে দেখিসনি। আমাদের সাথে তুইও ভারতে চল, এরপর বাংলাদেশেও নিয়ে যাবো।

জীবন কি, জীবনের পথ কেমন, জীবনের পথ চলতে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা কত ঠোক্কর খায়, সব নিজের চোখে দেখে আসবি। অভিজ্ঞতা হওয়া দরকার। মিথীলা মহানন্দে রাজী হয়েছে। গত বছর এই সময়ে আমরা ভারতের উত্তরাখণ্ডের রাজধানী দেরাদুন পৌঁছেছি। দেরাদুন থেকে তীর্থক্ষেত্র হরিদ্বার, ঋষিকেশ ঘুরেছি, দিল্লী আগ্রা জয়পুর আজমের ঘুরেছি, কলকাতার দুর্গাপূজা দেখেছি, আপনজনদের সাথে দেখা করেছি। মিথীলা দারুণ এনজয় করেছে। লাক্সারি বাসেও যেমন চড়েছে, ভীড়ের ট্রেন, টেম্পো গাড়ি, ভ্যান রিক্সাও চড়েছে।

376 গত বছর মিথীলার জন্মদিনে আমরা দেরাদুন ছিলাম। এই বছর মিথীলা আছে ওয়াশিংটন ডিসিতে মিশার কাছে। মিশা দুই দিন আগে থেকেই মিথীলাকে প্রতিদিন ট্রিট দিচ্ছে। মৌটুসি ডালাস থেকে ট্রিট পাঠাচ্ছে। মিথীলা ভোজন রসিক। নানা স্বাদের খাবার পেলে মিথীলা খুশি হয়। ওর দুই দিদি সেভাবেই ওকে ট্রিট দেয়।

আমি যখন লেখাটি শেষ করে এনেছি, দেখি ঘড়িতে রাত এগারো, অর্থাৎ ভার্জিনিয়ায় রাত ১২টা। লেখা থামিয়ে মিথীলাকে ফোন করলাম। এক রিং হতেই মিথীলা কল রিসিভ করেছে। আমি সেই চিরাচরিত প্রথায় গান গেয়ে মিথীলাকে হ্যাপি বার্থডে বললাম। মিথীলা বললো, মা এবার তো তোমার গান দ্য বেস্ট হয়েছে। আমি তো রেকর্ড করতে পারিনি! দ্য বেস্ট হওয়ার কারণটা বলে দেই: মিথীলাকে একেক জন একেক নামে ডাকে। আমি প্রতিটা নাম মেনশন করে গানে গানে উইশ করেছি। এতো অল্পেই মিথীলা এতো বেশি খুশি হয়।

প্রতি বছর জন্মদিনে একই কথা আমি লিখি, অই যে মিথীলার জন্মের পর কেঁদেছিলাম। লিখি, কারণ এটাই আমার কৃত অপরাধের জন্য নিজেকে শাস্তি দেয়ার উপায়। আমার একটাই চাওয়া, জীবনে যদি ভালো কিছু করে থাকি, তার পুরস্কার হিসেবে ঈশ্বর যেনো আমাদের তিন কন্যাকে সুস্থদেহে দীর্ঘজীবী করেন। মিথীলার জন্মদিনে সকলের কাছে মিথীলার জন্য আশির্বাদ চাই।

এক আশ্চর্য মায়ায় বেধেছো আমায়

happy

মায়া আর মাধুর্যে তুমি এক অনিন্দ্য জাদুকর
আমি ঠিক কবে এতটা মুগ্ধতা নিয়ে
কাউকে হৃদয়ে ধারণ করেছি, মনে পড়েনা।

প্রিয় নিয়মের বেড়াজাল ভেঙ্গে
স্রোতের বিপরীতে এসে
যদি জড়িয়ে রাখতে পার;
তোমার বাহুডোরে……

তবে হয়তো এ পৃথিবীর সকল সীমাবদ্ধতা
সকল সংকীর্ণতাকে ছুড়ে ফেলে
একক এবং অন্যতম করে অনন্তের পথে
শুধু তোমাকেই বাঁধতাম আমার যাপনে!

প্রিয়তম, কী এক আশ্চর্য মায়ায়
বেধেছো আমায়।।
তোমার প্রহরের পথে অকারণে অপ্রয়োজনে
তোমার প্রতি আমারও মুগ্ধতা
শুধু বেড়েই চলেছে কেন যে এমন হয়

কোন ফাল্গুনের স্মৃতি ধরে
হৃদয়ের গভীরে জমিয়ে থাকা বসন্তের দাবানল
নিমিষে এই পৃথিবীকে তুলেছে কাঁপন

আজকাল তোমার সাথে কথা না হলে
খুব অসহ্য ব্যথায় হৃদয়ে রক্তক্ষরণের
কি এক কষ্ট ভেঙ্গে দিচ্ছে ট্রিলিয়ন বছরের অহংকারের প্রবাল প্রাচীর
যেন আমার চারপাশে মহাসাগর শূন্যতায় হাবুডুবু
আর হবেনা পলকে ফেরা।

সমাজের চেপে দেওয়া আতঙ্ক,
বিস্মৃতির বিধি নিষেধকে তোয়াক্কা না করে চলে এসো, চলে এসো এই অনন্য বেলার পড়ন্ত বিকেলে এখানে জমা রয়েছে হাজার বছরের অতৃপ্ততা।

ভেঙ্গে চৌচির করে দাও সকল অহমিকা,
জমে থাকা জিদ, যা বরাবরই জীবনকে নষ্ট করেছে।

নতুন করে শুরু করা
নতুন করে,বেঁচে থাকার এক অনন্য প্রচেষ্টায়
আমি গ্রহণ করতে পারি হাজার বসন্ত।

চলে এসো, এ জীবনে জলস্নাত
শুভ্র এক কদম ফুল হয়ে, এখানে জমা
মহাবিশ্বের সকল অন্ধকার
এই গভীর অন্ধকারে এসে আলোয় বিমোহিত করো আমায় আমার অধরা বসন্ত।

রক্ত জবার মত মন আমার

ch

কেবল যে তুমিই কষ্ট দাও তা নয়
কর্মস্থলও আমায় হৃদয়ে তুলে দেয় ব্যথার ভার
তুমি অথবা কর্মস্থল কারো সাথেই নেই আর প্রণয়
আমি একলা নেই যেন কোথাও আমার পরিবার।

বুকে যে রক্ত ক্ষরণ হয় তা কেব তুমিই দাও না
কর্মস্থলও আমায় ভাসায় ব্যথায়
সবারই স্বার্থ যেন আমার কাছেই পাওনা;
কত খোটা কত লাঞ্ছনা পাই কথায় কথায়।

সবাই রক্ত জবার রঙ চিনে, রক্ত ক্ষরণ কী চিনে না
আমি বড্ড আবেগী ছিলাম, মন ছিল সবুজ
কত করে সমস্যাগুলো বলি, বলতে বলতে মুখে তুলি ফেনা
কেউ বুঝে না আমায়, তোমরা বড্ড অবুঝ।

আমার মন বুঝলো না কেউ, না অফিস, না তুমি
বুকের ব্যথা দেখাবো আর কারে
আমি রক্ত জবা, ঝরেই যাবো, বুকের নদীতে ব্যথার ঊর্মি
আমি যেন আমারও নই, আমি ডুবি ব্যথার বালিচরে।

কেউ রাখেনি কথা, সবাই চাপিয়ে দেয় কষ্ট
কাউকে কিছু বলিনি, কেদেছি শুধু
আমার মূল্যবান সময়গুলো তোমরাই করেছো নষ্ট
বুকের উঠোন আজ মরু ধুঁধু।

রক্ত জবা গাছ বুক উঠোনে করেছি বপন
দেখে যেয়ো রক্ত ক্ষরণের রঙ কেমন
একদিন সব পাবো ফিরে দেখে যাই দিবা স্বপন
এসব ভেবে ভেবে কষ্ট পাই, আমি এবেলা আনমন।

.
(ক্যানন, চুনারুঘাট)

অজানা গন্তব্যের প্রতি ভালোবাসা

shamim

অজানার রাজ্যে, ভালবাসা তার পথ খুঁজে পায়,
একটি অজানা যাত্রা, যেখানে হৃদয় দুলতে সাহস করে।
অনিশ্চয়তার কুয়াশার মধ্য দিয়ে, আমরা দুজনেই অন্বেষণ করি,
একটি প্রেমের গল্প উদ্ঘাটন, চিরকাল আমরা অনুনয়.

রাতের গভীরে, আমাদের আত্মা উড়ে যায়,
তারা দ্বারা পরিচালিত, কখনও এত উজ্জ্বল উজ্জ্বল.
কোন মানচিত্র নেই, কোন কম্পাস নেই, শুধু আমাদের হৃদয়ে বিশ্বাস,
আমরা এই ভালবাসা পরিক্রমণ করার সময়, যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত প্রদান করে।

যদিও পথ মোচড় দিতে পারে, এবং সন্দেহ দেখা দিতে পারে,
আমাদের ভালবাসা বাতিঘর, আমাদের চূড়ান্ত পুরস্কার।
এই অজানা রাজ্যে, আমরা অনন্তকাল ঘুরে বেড়াব,
প্রেমের গন্তব্যের জন্য, আমরা এটিকে আমাদের বাড়ি করব।