ট্যাগ আর্কাইভঃ রোমেল আজিজ এর কবিতা

দুঃস্বপ্নের রাত

রাত নেমেছে আজ আবার,
হাজার বছরের নিষিদ্ধ
পূর্ণিমার রাত।

কুয়াশায় মাখা, রক্তে ভেজা
অপার্থিব আলোয় ভেসে যাওয়া
এক দুঃস্বপ্নের রাত।

ঘুম গুলো সব
পড়েছে ঘুমিয়ে,
নিঃশ্চুপ এই আলো আঁধারিতে।
আকাশ ভরা রূপালী আলোগুলো
একা একা থাকে জেগে, তাই
অপেক্ষায়, ফিরে আসার
হারিয়ে যাওয়া সুসময়ের।

রাত নেমেছে আবার আজ,
শূণ্যতা গুলোকে 
আরও শূণ্য করে,
হাজার বছরের আরও এক
মৃত স্বপ্নের রাত।

কালকেতু – ফুল্লরা

কীট দংশনে শিব হয়নি নীল,
নীল হয়েছিল হিংসায় –
নিজ অর্ধাঙ্গি দেবী চণ্ডীর।

ষড়যন্ত্রের ভুল পূজোয়
স্বর্গ হারায় নীলাম্বর।
অভিশাপের মর্তলোকে
জীবন সুতো এক হয় আবার
কালকেতু – ফুল্লরার।

শিব পূজারীর অব্যর্থ শরে
অস্থির সব বনচর,
ছলনাময়ী চণ্ডী ফিরে
রূপ নিয়ে গোধিকার।

আপন পূজোয় তুষ্ট দেবী
বর পায় আবার নীলাম্বর,
ছলনাময়ীকেই ছলনায় ফেলে
করে তারা আবার,
স্বর্গ পুনরুদ্ধার।

জীবন বেদ

শুকতারা না চিনে
কালপুরুষ দেখতে চাওয়া যেমন ভুল,
জীবন বেদ না জেনে
তোমাকে বুঝতে যাওয়াও ছিল ভুল।

গিয়েছিলাম ভুলে,
কচুরিপানা আর পদ্মের,
মৌলিক পার্থক্য।

একজন পাল্টায় ঘাট অবিরাম,
আর অন্যজন ?
অন্যজন জীবন কাটায় স্থির থেকে
হৃদয়ে বাঁধা যে তার অদৃশ্য শিকল !

এক পরাজিত শহরের গল্প

যে শহর ঘুমিয়ে পড়ে অসময়ে,
ক্লান্ত মানুষের শ্রান্তি ভুলে।
জীবন্মৃতের মতন পড়ে রয় 
স্বপ্নগুলো বেহিসাবে যে শহরে;
সেই শহর তো আমার নয়। 

যে শহরে পড়ে থাকে আজ
হাজারো স্বপ্নের লাশ,
রঞ্জিত রাজপথ আর
বারুদের গন্ধে ভরা বাতাস;
সেই শহরতো আমার নয়।

অসভ্য সভ্যতা

আমি মৃত্যুকে দেখেছিলাম সেইদিন,
দাঁড়িয়ে ছিল সে একাকী বিমর্ষ হয়ে ।

কৌতুহলী চোখে দেখছিল দাঁড়িয়ে
রাস্তার পাশের ভাঙা ডাস্টবিনের ধারে,
ময়লার স্তূপ ঘিরে থাকা
বেওয়ারিশ কাক আর কুকুরগুলোকে ।
দেখছিল সে নীল ডুমো মাছির ডানায়
উড়ে চলা জীবাণুর নাচন,
নিয়ে একচিলতে বাঁকা হাসি
ঠোঁটের কোনে ।

হঠ্যাৎ চোখে পড়ল তার,
কাক-কুকুরের টানা হেঁচড়ায়
ছেঁড়া পলেথিন হতে,
বেড়িয়ে থাকা এক
নবজাতকের হাত !

স্তব্ধ হয়ে গেল মৃত্যু তখন,
ভাবতে পারছিলনা সে কখন
এসেছিল ঐ শিশুর কাছে ?
মৃত্যুর চোখে মৃত্যুর ছায়া পড়ে,
ভেসে আসে প্রশ্ন সঙ্গোপনে-
“আর কত বলী হবে নিষ্পাপ শিশু,
এই সভ্যতার, চরম অসভ্যতার ?”

মানুষের গল্প ৯

আমরা জানি না
দিন কিভাবে বদলায়,
শীতে রং হারানো
গাছেরও যে প্রাণ আছে
তা অস্বীকারে গাছের
কী আসে কী যায়?

ঘুমবিহীন চোখ
ছুটে চলে মানুষ,
শহর থেকে শহর
নগর থেকে নগর,
এখন সময়
রাত্রি দ্বিপ্রহর …

এইতো সেদিনও

এইতো সেদিনও
এই পথের প্রতিটি
গাছকে আমি চিনতাম,
নীলচে জারুল অরুণাভ কৃষ্ণচূড়া
অথবা পলাশ রাঙা মেঠোপথ
সবই দূর অতীত এখন।

এ পথের দুপাশের
বুনো ঘাসফুলগুলোর কথা
বড্ড মনে পড়ে এখনো।
শীতের শেষটায় শিশির ভারে
নুয়ে পড়তো এদিক ওদিক।

পাথর, বালি, বিটুমিনের মিশ্রণ
চলন গতিটাই মসৃণ শুধু,
জীবনের পথটা নয়।
তাই পাপী ছুটে পাপের পেছন
আর জীবন ছুটে দিন শেষে
নিয়ে কিছু মিথ্যা সময়..

নিরঞ্জনের না বলা কথা ৩০

হেমন্তের শেষ দিনগুলোতে
জল সবুজ মাঠের রঙ
যেভাবে ধূসর হয়ে যায়,
প্রতিটা প্রাণেরও তেমনি
একটা সময় আসে।

ভরা বর্ষায়ও
থান ইটে চাপা পড়া
ঘাসেরও রঙ বদলায়;
অনেকটা সেভাবেই
বিপাশার পাশে
নিরঞ্জনের গল্প
শুধু হতাশারই!

তবুও অলীক স্বপ্নে
বিভোর নিরঞ্জনকে,
একদিন বললাম –
“প্রতীক্ষা আর অপক্ষা’র
প্রার্থক্য বুঝিস তুই?”

দূরপানে স্থীর চোখে
তাকিয়ে শুধু বললো ;
“হারানো আর না পাওয়ার
মাঝের দেয়াল ভাঙা কি
এতোই সহজ, অরুণ? “

তুমি চলে যাওয়ার পর

তুমি চলে যাওয়ার পর,
আমি দিন দিন একটা
জীবন্ত বৃক্ষে পরিণত হয়েছি ।

পাহাড়ি বৃষ্টি, বসন্তের বাতাস
কিংবা ভোরের কুসুম আলো,
একাকী কিছুই ভালো লাগে না আর ।
শতাব্দীর পর শতাব্দী জেগে থাকা
প্রাচীন নিঃসঙ্গ তারাগুলোর মতোই,
নিজেকে একাকী মনে হয় ।

সময়ের সাথে সাথে বৃক্ষ-
দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়,
বৃদ্ধ বৃক্ষ অফুরান ছায়া দিয়ে যায়
কাউকে দেয় নিরাপদ আশ্রয়,
তবুও কিছু ডাল শূণ্যই থেকে যায়
হারানো পাখি ফেরার আশায়;
একাকী অপেক্ষায়, যায় কেটে সময়
প্রাচীন বৃক্ষ আরো প্রাচীনতর হয়…

প্রতীক্ষা

নারকেলের ডালে স্থির
বসে, কালো কাক;
বুভূক্ষু চাহনিতে তার
জীবনের নির্মম বাস্তবতা,
ভেসে উঠে অস্পষ্ট আলোয়।

পিলপিল করে মানুষগুলো যাচ্ছে
পুরোনো সেই একঘেয়ে কাজে,
তাদের নেই কোন কষ্ট,
নেই কোন আনন্দ, রোমাঞ্চ;
আছে শুধুই হতাশা।
যন্ত্রমানবের মত ঘুরছে তারা,
সমৃদ্ধ করছে এই সভ্যতা।

মাঝে মাঝে তারা থামে
উর্বশীর কৃত্রিম ছায়ায়,
সুরে বেসুরে ঢালে
জমানো সব সুধা।

তবুও কালো কাক
আছে বসে, প্রতীক্ষায়
সময় পরিবর্তনর আশায়;
কিন্তু
ব্যস্ত মানুষগুলোর তাতে আর
কী আসে, কী যায় ???

শর্ত

মধ্য চৈত্রের দুপুরে যে লু হাওয়া
শহরতলীর গলি জুড়ে বয়ে যায়,
অনেকটা সেভাবেই জীবন ছুটে
নানান ভুল শর্তের বেড়া জালে।

ষড়ঋতু নিয়ম মেনেই চলে,
ষড়রিপুর কোন নিয়ম নেই।
হয়তোবা তাই এখন আর-
বিষণ্নতা আমাদের পোড়ায় না
আমরাই বিষণ্নতার আগুনে পুড়ি,
তাই হয়তোবা এখন আর-
বিষণ্নতা আমাদের ডোবায় না
আমরাই বিষণ্ণতার জলে ডুবি।

মদিরা কণ্ঠনালীতে গড়ালেই
সব মানুষ মাতাল হয় না,
মাতাল হয় লোভ-ঘৃণা-পাপে।

নগরস্রোত

ফুটপাত ঘেঁষে দুরন্ত বেগে ছুটে চলা ট্রাকের চাকায়
উড়ে যাওয়া ধূলোর কান্নাও শুনতে পায় পাথরকনা,
পিচ উঠা রাস্তার গর্তে জমে থাকা নোংরা জলেরও
আছে হাজার না বলা দুঃখ গাঁথা।

ডাস্টবিনের বাইরে ছড়িয়ে থাকা আবর্জনার মূল্য
নেড়িকুকুরের চেয়েও কম বুঝেনা পথ শিশু,
চার চাকার কাঁচের দেয়ালের আড়ালে
শীতলতায় ডুবে থাকা দেহ গুলো জানেনা
বৃদ্ধ রিকশা চালকের ঘামের আত্ম অহংকার।

জীবন চলে, জীবন বয়ে যায়
মুখে কুলুপ, চোখে ঠোলা এঁটে,
নগরস্রোতে মানুষ যায় হারিয়ে।

মেঘদূত

যাও মেঘদূত,
চুপিচুপি বলো কথা
তাহার কানে …

যাও মেঘদূত,
চুপিচুপি বলো এই
অসীম আঁধারে …

যাও মেঘদূত, রাত্রি দ্বিপ্রহরে
চুপিচুপি বলো আমার কথা
এই অসীম আঁধারে তাহার কানে …

অনুতাপ

যে মাঝি বৈঠা মারে স্রোতের হীতে,
সেই মাঝিই জানে
জীবন সামনে কি করে ছুটে।

যে নারী করে প্রণয় ভ্রান্ত মোহে,
সেই নারীই বুঝে
সবই একদিন বেলা শেষে।

যে নাবিক মাতাল চোখে দূর আকাশ দেখে,
সেই নাবিকই বুঝে
একাকীত্বের জ্বালা এক সমুদ্র কষ্ট নিয়ে বুকে।

যে পুরুষ করে গমন রমন সুখে,
সে পুরুষই ভুগে
হতাশায়, পুঁড়ে অনুতাপের বহ্নিশিখে…

নীরব কোলাহল

সেই কবেই থেমে গেছে
চৌরাস্তার কোলাহল,
এক এক করে গেছে কেটে
ঊনিশটি বছর !
কিন্তু হুল্লোড় থামেনি আজো
শহরতলীর কোনে ;
একাকী পড়ে থাকা
শেষ বাড়িটায়।

মনে পড়ে এখনো –
ভর দুপুরেও নীরবতায় থাকতো ডুবে,
বুনো অর্কিডে ঘিরে থাকা
অদ্ভুত সেই শেষ বাড়িটা।

রাত গভীর হয়, কাটে সময় ;
শেষ বাড়িটা প্রাণ ফিরে পায়।
শরাব শঙ্খ তনু যখন
মিলেমিশে হয় একাকার ;
সময় যে তখন –
এই রাত্রি দ্বিপ্রহর …