আবু মকসুদ এর সকল পোস্ট

পরিবর্তন

2751

গঞ্জে অনেকদিন পর এসেছি।
টং দোকানের চা’য়ে গুড়ের
চুমুক দিয়ে পঞ্চাশ বছরের বেঞ্চের
দিকে তাকালাম; উপরে যে ছনের
ছাদ ছিল, উধাও। তর্জার বেড়া
বদলে গেছে ইটের দেয়ালে,
সিলিং ফ্যানের বালাই ছিল কিনা
মনে করতে পারছি না কিন্তু
এখন শীততাপিত একটা যন্ত্র দেখতে
পেলাম। আশ-পাশের লোকের
দিকে তাকালাম,
দেখলাম প্যান্ট কোর্ট টাইয়ের
প্রাধান্য। লুঙ্গী, মলিন সার্টের
অভাবে নিজেকে নিঃস্ব
মনে হল। ফোমের সোফার
আরামে পাছা দ্রবীভূত হতে
থাকলে কাপের ধোঁয়ায় পেলাম
কফির গন্ধ। দুই টাকার লিকার
কখন যে ১২০ টাকার নেসক্যাফ
হয়ে গেছে বুঝতেই পারলাম না।

পঞ্চাশ বছরে অনেক পরিবর্তন
মন তবু অপরিবর্তিত থেকে যায়!

কুদালি ছড়া

ছোটবেলা আমাদের এক হাটুনদী ছিল। আমরা ‘কোদালি ছড়া’ নাম দিয়েছিলাম। আমাদের বয়স যখন দশ তখনো এই নদী আমাদের হাটু ডুবাতে পারেনি। হাটুর বয়সী নদীর জন্য অত্যাধিক দরদ ছিল। এই নদী ইয়ার কিংবা দোস্ত ছিল। তার বুকে সারাক্ষণ দাপাদাপি করতাম। এখন আমাদের বয়স পঞ্চাশের অধিক, অনেকের হাটুতে বাত এসে ভর করেছে, ব্যথায় ভাল করে হাঁটাচলা করতে পারি না। যে নদী তখন আমাদের হাটুর সমান ছিল, এখন সে প্রত্ন গবেষকদের আগ্রহের বিষয় হওয়ার কথা কিন্তু এখানে চিত্র একেবারেই ভিন্ন। এখন এই নদী পেরুতে গেলে আমাদের কোমর ডুবে যাবে।

আমাদের মধ্য বয়সে সে যৌবনপ্রাপ্ত হচ্ছে, এজন্য ঈর্ষা বোধ করলেও শ্লাঘা অনুভব করছি। আমরা জীবনে অনেক উচ্চে যেতে চেয়েছিলাম, গতির ঘোড়ায় চড়ে এভারেস্ট মাড়াতে চেয়েছিলাম। আমাদের খুব তাড়াহুড়া ছিল, অতি অল্প সময়ে অতি অধিক এর পিছনে আমরা ছোটাছুটি করছিলাম। তার কোনো তাড়াহুড়ো ছিল না, সে অতি ধীরে তার চলা অব্যাহত রাখছিল। আমরা খরগোশ গতিতে কিছু দূর গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সে জানতো কচ্ছপের জয় হয়, আজ সে জয়ী হয়েছে। আমাদের খেলার সাথী পুনঃ যৌবন প্রাপ্ত হয়েছে দেখে খুব ভালো লাগছে।

আধুনিক

আধুনিকে অভ্যস্ত
বাটি উলটিয়ে মাড় খাই না
স্যুপের চামচে কায়দা করে
মুখে ঢালি।

লুঙ্গির অন্ত হয়েছে
রিলাক্স মুডে পরি
সিল্কের ঝোলা প্যান্ট।

সাইকেল গেঞ্জি বড্ড
গেয়ো, টি-শার্টের আভিজাত্য
গেঞ্জিতে পাওয়া যায় না।
পুশ-মি অঙ্কিত টি-শার্ট
আধুনিকতার পরিপূরক।

ভাত ভাজা কবে যে
ফ্রাইড রাইস হয়ে গেছে
টের পাইনি, ভাতের অরুচি
মেটাতে চাইনিজে
ফ্রাইড রাইসে ডিনার সারি।

আলু ভাজার বদলে
খাই চিপস, হাতের আঙুলকে
অহেতুক পানির ঝামেলা
থেকে মুক্তি দিতে
ব্যবহার করি কাঁটাচামচ।

প্রতিদিন সকালে বউ
সি অফ করে, শুভ সকাল
বড্ড সেকেলে; গুড মর্নিং
উচ্চারণে মর্নিং সত্যি
গুড হয়ে যায়।

প্রয়োজন না হলে
বাংলা বলি না, এ গ্রাম্যতা
পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারলেই
বেশ হত কিন্তু

হাজার চেষ্টার পরেও
জন্মদায়িনী মাকে
আধুনিক করা গেল না;
মা এখনো অতি বিটকেল
আঞ্চলিক ভাষায়
খিস্তি ঝাড়ে।

অতি আধুনিক আমি
এই জায়গায়
বারবার পরাস্ত হই,
আমার সমস্ত আধুনিকতা
মায়ের আঞ্চলিকতাকে
মাড়াতে পারে না।

আমার আদি অকৃত্রিম মা
এখনো আদি অকৃত্রিম
রয়ে গেছে; এখনো
বাংলাকেই জড়িয়ে আছে।

আসছি

কে যেন ডাকছে! ঘুম চোখ; তলিয়ে যেতে চাচ্ছে,
পারছে না। ক্রমাগত ডাকছে!
জীবনানন্দের মুখোমুখি বসে আছি,
সব পাখি ইতোমধ্যে ঘরে ফিরেছে।
মুছে যাওয়া রঙে অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি;
মনঃসংযোগের চেষ্টা করছি,
পারছি না। কে যেন ডাকছে।

মলে প্রচণ্ড ভিড়, চিৎকারে কান পাতা দায়।
দোকানীর নজর আকর্ষণের চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে।
পিছনে দাঁড়ানো মানুষ অস্থির হচ্ছে
আমিও অস্থির
হঠাৎ শুনি; কে যেন ডাকছে।

শা শা করে ছুটে যাচ্ছে গাড়ি
সবাই অপেক্ষায়
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে।
অনুমোদিত সীমা অতিক্রম করে
ছুটে চলেছি, রিয়ার ভিউ মিররে
চোখ রাখতেই শুনি কে যেন ডাকছে।

জরুরী পারিবারিক আলোচনা,
গৃহকর্তী গৃহকর্মের সবক দিচ্ছেন;
কী কী করলে আরেকটু সাশ্রয় হবে,
কানে কিছুই ঢুকছেনা। আমাকে ডাকছে,
তার ডাকেই আমার পুরো মনঃসংযোগ।

কে ডাকছে, দেশ!
আসছি!

বেদনা

অনেক দিন পরে গচ্ছিত বেদনা
দেখতে তোমার কাছে এলাম
টকটকে লাল এমন রঙ
ধারণ করেছে…

আমার বেদনা তোমাকেও নীল
করে দেবে ভাবতে পারনি; কিন্তু
নিজে কত আর নীল হব
সহ্যের মাত্রা

ছাড়িয়ে গেলে মানুষ অপারগ
হয়। অপারগ পথিকেরে ক্ষমা
করে দিও। যদি একদিন ফুল
ফোটে, প্রথম পুষ্প

তোমার চরণে অর্ঘ্য দেব হে
দেবী। আমরা বেদনা ফিরিয়ে
নিয়ে তোমাকে মুক্ত করে দেব;
বিশ্বাস রেখো…

তিল আঁচিল

বাম গালে অনিন্দ্য সুন্দর তিল;
আমার নিশানায় সবসময় বিদ্ধ
হয়। ডান গাল সতীনের ঈর্ষায়
জ্বলতে থাকে। অবজ্ঞা, অপমান
আত্মহননে প্ররোচনা দেয়।

অবজ্ঞার কারণে কিনা জানিনা
ডান গালে হঠাৎ আঁচিল দেখা
দিল। ধীরে ধীরে ফোঁড়ায়
রূপ নিলে সব নিশানা লক্ষ্যভ্রষ্ট
হতে থাকে। একদিন এম্বুলেন্স

সাইরেন বাজিয়ে দরোজায়
হাজির হলে বাম গালের তিলকেও
ভীত মনে হল। মনে হল অনুশোচনায়
পুড়ছে। দুই গাল অবশ্য অক্ষত ফিরে
এল, তবে কারো কোন শ্রেষ্ঠত্ব থাকল না।

মেহেদী গাছ

উঠানের কোনে সাড়ে তিন ফুটের
মেহেদী গাছ। জাতের ডাট অন্যদের
তুলনায় বেশি। তাকে ঘিরে ফুফু, ভাবিদের
ভীড়। হাতের তালু, আঙুল, আঙুলের
নখ রাঙাতে মেহেদীর বিকল্প নেই।

উঠানের অন্যান্য গাছ যত্নের
অভাবে আধমরা। মেহেদী
আভিজাত্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

পাশের বাড়ির বুলবুলি সবেমাত্র
ফুটতে শুরু করেছে। তার হাতের
আঙুল মেহেদী ছাড়াই রঙিন। তবু
আমি প্রতিদিন জল ঢালি, মেহেদীর
যত্ন নেই; যদি কোনদিন বাড়তি
রঙের প্রয়োজন হয়, মেহেদী যেন
বিমুখ না করে।

আমি প্রতিদিন মেহেদী গাছে নিজেকে
সমর্পণ করি। বুলবুলি আসবে আলগোছে
আঙুলে জড়াবে; এমন ভাবনা
মেহেদী পরিচর্যায় প্ররোচনা
দেয়। স্বপ্ন দেখি বুলবুলির
রঙিন আঙুল; আমাদের মেহেদী জীবন।

সন্ধ্যা নামছে

নামছে সন্ধ্যা, ফিকে হয়ে আসছে রঙ।
তপ্ত রোদের খোলস ধীরে ধীরে
খসে পড়ছে। দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে
লাল কাপড় বেধে ফিরে এলে
বরুণার আতরের গন্ধমাখা
ওষ্ঠ তৃপ্তি দিয়েছিল। গায়ের পথে
দেখা দিলে বিভ্রান্ত বাজিকর;
তাড়া করি, তীব্র ঘোড়ায় চড়ে
ফিরিয়ে আনি লুণ্ঠিত সম্মান।

পেশীর সৌরভে সূর্য ম্লান হয়।
গায়ের ঘরে ঘরে প্রতিদিন সূর্যের
বদলে আমি উদিত হওয়ায়
ঘোষণা অবিনশ্বরের স্বপ্ন দেখায়।

পেশী চুপসে গেছে, মরে গেছে
রোদের তেজ। চোখের জ্যোতি অন্ধকারে
সখ্য খোঁজে। বাঘের সাথে মল্লযুদ্ধে
যে পা মাটি আকড়ে দাঁড়িয়েছিল
সেই পা যুগল লাঠির অপেক্ষায়
থাকে। সন্ধ্যা নেমেছে। যৌবনের
আঁকাবাঁকা স্রোতস্বিনী নদী গর্তে ঢুকছে।
সোজা হয়ে গেছে একদা’র দীপ্ত লেজ।

শুক্রবার

শুক্রবারের পবিত্র বাতাস
আত্মসমর্পনের আহ্বান জানায়

ধূলিসম গরিমা, উচ্চাকাঙ্ক্ষার
পারদ তলানিতে এসে ঠেকে।

পাপের ময়লা সাবান দিয়ে ধুয়ে
সুগন্ধি আতরের কাপড়
পরিশুদ্ধ পথের দিকে টানে।

প্রতিটি শুক্রবার ডাকে;
ভুলের পথ ছেড়ে সত্য আঁকড়ানোর
আওয়াজ দেয়। এখনো দেরী হয়নি,
এখনো আশ্রয় নিলে প্রভুর স্মরণে
মুছে যাবে বিগতের পাপ।

প্রতিটি শুক্রবার বলে
চাইলেই পুনরায় শুরু করা যাবে।

একালের রামায়ণ

(নিছক রূপকথা নাও হতে পারে)

দশানন রাবণের দশ মাথার মতো পরেশ লালের দশ মাথা আছে বললে অত্যুক্তি হবে না, বরং রাবণের চেয়ে কয়েক মাথা বেশি হবে তার। দশবার আক্রমণের পরেও যে বহাল তবিয়তে থাকতে পারে তার প্রতি রাবণাশীর্বাদ আছে এটা অস্বীকার করার কোন জো নেই।

পরেশ লাল বারবার বেঁচে যায় এবং তার বেঁচে যাওয়া উদযাপন করতে গিয়ে একটি করে লাশ পড়ে। এই জনপদে পরেশ লাল সাক্ষাত রাবণ, সে এমন রাবণ যে যাবতীয় রাম তার ভয়ে কম্পমান।

রাজাও কিছু নিয়ম-কানুনে বন্দি থাকে, অত্যাচারী রাজাও চাইলে যে কারো মস্তক খণ্ডন করতে পারে না; তাকে কিছু নিয়মের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যার মস্তক খণ্ডনের খায়েশ জেগেছে, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতে হয়, পাইক-পেয়াদা দিয়ে ধরে নিতে হয় প্রহসন হোক তবু বিচারের মুখোমুখি করতে হয়। এসব লোক দেখানো শেষ হলে তবেই না মস্তক খণ্ডন।

পরেশ লালের অত ধৈর্য নেই, অপেক্ষা তার দুচোখের বিষ; ওঠ ছেমড়ি তোর বিয়ের মত মস্তক খণ্ডনের খায়েশ হলে ততক্ষণাত কার্য সমাধা। অন্যের গড়িমসি দেখে নিজেই বেশ ক’বার মস্তক খণ্ডন করেছে।

পরেশ লাল ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দী নয় বরং স্বয়ং ঈশ্বর। জনপদে তার আদেশ অলঙ্ঘনীয়। জনপদের উপসনালয়ে ঈশ্বরের গুণকীর্তনের সময় পাওয়া যায় না, ঈশ্বরের মহিমা প্রচারে মানুষ বিমুখ এটা বলা যাবে না তবে পরেশ ঈশ্বরের ভয়ে মানুষ আসল ঈশ্বরে আত্মসমর্পণ করতে পারে না।

আপনারা হয়তো ভাবছেন এসবই গাঁজাখুরি গল্প; বর্তমান সময়ে প্রকাশ্যে মস্তক খণ্ডন করে কেউ কী পার পেতে পারে! আপনাদের কাছে এসব অবিশ্বাস্য গল্প, অলস মস্তিষ্ক লেখকের বিকৃত চিন্তা। এসব গল্প অসত্য নাও হতে পারে।

আমাকে যখন প্রথম গল্প শোনানো হয় আমিও অসত্য ভেবেছিলাম, বর্ণনাকারী কে উন্মাদ ভেবেছিলাম। একজন মানুষ যতই উন্মাদ হোক না কেন তার চোখের ভয়ে কিছু সত্য লুকানো থাকে, ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলা মিথ্যার নিচে কিঞ্চিৎ সত্য না থাকলে বর্ণনাকারীর উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়।

আমি বর্ণনাকারী কে উপেক্ষা করতে পারতাম, উন্মাদের প্রলাপে মনোনিবেশ করার কোনো দায় আমার ছিলনা কিন্তু মানুষ হিসাবে আমিও কিঞ্চিৎ উন্মাদ। মিথ্যার আড়ালে যে সামান্য সত্য লুকিয়ে আছে তা উদঘাটনের কৌতুহল আমার জন্য কাল হয়েছে।

বর্ণনাকারীর জনপদ দেখার কৌতূহলে তার সঙ্গী হলাম, খবরের কাগজের একটা মোহর আমার কাছে ছিল ভাবলাম বিপদে এই মোহর উদ্ধার করবে।

জনপদে পৌঁছার দ্বিতীয় দিনে ঘটা করে আগুন খেলা হচ্ছিল, পরেশ লালের সাঙ্গাতরা রাধারানী নামে এক বিধবাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। রাধারানী স্বেচ্ছায় যাবে না তাই এই টানা-হেঁচড়া। ঈশ্বরের আদেশ লঙ্ঘন কত ভয়াবহ হতে পারে একটু ক্ষণ পরে টের পেলাম।

বিধবা রাধারানী স্বেচ্ছায় যাবে না টানা হেঁচড়া করতে গিয়ে সাঙ্গাতরা গলর্দম, যখন বোঝা গেল সহজে কর্ম সমাধা হবে না তখন সাঙ্গাতদের একজন রাধারানীর গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিল, ঈশ্বরের আগুনে রাধারানী পুড়ছে দেখে তাদের যে কি আনন্দ!

জনপদের মানুষ স্বাভাবিক, কি ভয়াবহ ঘটনা তাদের সামনে ঘটছে তারা বুঝতেই পারছে না অথবা তারা এসব ঘটনায় অভ্যস্ত। আমি অভ্যস্ত নই তাই দৌড়ে গেলাম, আমার দৌড়ানোতে সাঙ্গাতরা অবাক হল; কয়েকটা চড় থাপ্পড় মেরে আমার গলা চেপে ধরল দুজন সাঙ্গাত। চোখের সামনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল রাধারানী।

আমাকে যখন পরেশ লালের দরবারে হাজির করা হলো, লাল মহাশয় জিজ্ঞেস করলেন ‘কে বেটা তুই’?
জবাব দিলাম ‘আমি সাংবাদিক’।
‘কি সাংঘাতিক? আমিও সাংঘাতিক
কেমন সাংঘাতিক এক্ষুনি টের পাবি’।

পরেশ লালের আদেশে আমার ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল কেটে ফেলা হলো, বাম চোখ অন্ধ করে দেয়া হলো। খবরের কাগজের যে মোহর আমাকে বাঁচাবে বলে ভেবেছিলাম, সে মোহর আমার শিশ্নে ঝুলিয়ে দেয়া হলো।

বর্ণনাকারী আমাকে উদ্ধারকারী ভেবে নিয়ে গিয়েছিল, ইতোমধ্যে যে দশজন ব্যর্থ হয়েছে তার কিছুই জানায়নি। যখন জানলাম তখন অনেক দেরী। তবু হতোদ্যম হলাম না, উন্মাদদের মৃত্যুভয় কিছুটা কম। বৃদ্ধাঙ্গুল বিহীন এক চোখ অন্ধ আমি শিশ্নের অপমান বরদাস্ত করতে পারিনি তাই দশের পরে পুনরায় চেষ্টা করলাম, বলাবাহুল্য রাবণ বধে আমিও ব্যর্থ।

আজ আমাকে বধ করা হচ্ছে। পরেশ লাল নিজ হস্তে আমার মস্তক খণ্ডন করবে। আমি ঈশ্বরের নাম জপতে থাকি কিন্তু দেখলাম ঈশ্বরের নাম স্মরণে আসছে না, আমার মুখ থেকে পরেশ লাল পরেশ লাল আওয়াজ বেরুচ্ছে…

জীবন

নির্জন রাস্তায় কে যেন
গুনগুন করে

বিপর্যস্ত চিন্তায় এই সুর
পুনরায় জীবনমুখী করলো

ঘুমিয়ে যাব বলে সার্টের
খোলা বোতাম লাগিয়ে নিয়েছিলাম,
একটু পরে তীব্র শীত জাকিয়ে
বসবে; তার আগে একটু উষ্ণতা।

পুনরায় খুলে দিলাম সার্টের বোতাম;
সুরের অনুসন্ধানে গিয়ে দেখলাম

ডাস্টবিনে খাবার হাতড়ানো
ছোট্ট মেয়ে গুনগুন করছে
গানের কলি, আমি শুধালাম
কে তুই? মেয়েটা বলল
আমি জীবন, তোমাকে
বাঁচতে শিখিয়ে গেলাম।

প্রেম

পৃথিবীর সব লজ্জা
রিয়াকে ঘিরে রেখেছ, সে এখনো
লেপের নীচে। মাথা বের করে
ঘরের আলো দেখতেও লজ্জিত
হচ্ছে। সাতটা বেজে গেছে;
ক্লাসে যেতে হবে, কিন্তু সবাইকে মুখ
দেখাবে কেমন করে!

ভীষণ ভাললাগায় তার বুক
ধুকপুক করছে। এই অনুভূতি
আগে কখনো হয়নি। লজ্জা এবং
ভাললাগার যৌথ অনুভূতির
নাম প্রেম। রিয়া প্রেমে পড়েছে।
ভোরের আলো ফোটার আগেই
এসেছে কাঙ্ক্ষিত টেক্সট।

লেপের নীচে মোবাইলের স্ক্রীনে
ভেসে উঠেছে ভালবাসি।
রিয়া আজ ভালবাসায় স্নাত হয়েছে।

জলির প্রেমিক

জলির সাথে আমার প্রেম আছে, একতরফা প্রেম; জলি পাত্তা দেয় না। জলির বাবা ম্যাজিস্ট্রেট, আমার বাবাও একেবারে হেলাফেলার কেউ নয়। জেলার সবচেয়ে বড় চাউলের আড়ত আমাদের। চাউলের কারবার ছাড়াও দুটো সিএনজি ফিলিং স্টেশন আছে। আরো আছে ট্যানারি বা চামড়ার ব্যবসা।

টাকা পয়সা যা আছে একজন ম্যাজিস্ট্রেট কে কর্মচারী রাখা কোন ব্যাপারই না। তবু জলি আমাকে পাত্তা দেয় না। সামনে আমার বাবাকে সবাই সমীহ করে, বাবার সামনে গলা উঁচু করে কথা বলতে কেউ সাহস করে না। সে ডিসি কিংবা ম্যাজিস্ট্রেটই হোক না কেন। কিন্তু আমরা জানি আড়ালে সবাই তাকে খালুয়া বলে, পশুর খালের ব্যবসার জন্য আড়ালে বাবার নাম ‘খালুয়া রশীদ’

অথচ আমরা অভিজাত পরিবারের সন্তান, আমাদের পূর্বপুরুষ বাগদাদ থেকে এদেশে এসে আস্তানা গেড়ে ছিলেন। বাবার নাম সৈয়দ রশীদ হায়দার, আমার নাম সৈয়দ রফিক হায়দার। ঈর্ষীত মানুষ আমাদের কাঙ্খিত মর্যাদা দিতে চায় না। আমাদের প্রচুর টাকা-পয়সা। আমরা দুহাতে খরচ করি, দান করি। জেলার এমন কোন মসজিদ মাদ্রাসা স্কুল হাসপাতাল নেই যেখানে আমরা মুক্ত হস্তে দান করিনি। তবু আমরা কাঙ্খিত সম্মান পাই না, মানুষ আমাদের পছন্দ করে না।

আমার বাবা সাংঘাতিক দরাজ দিল। যেভাবে আয় করেন সেভাবেই ব্যয় করে যান। আগেকার দিনে এমন মানুষকেই দানবীর হিসাবে আখ্যায়িত করা হতো কিন্তু ঈর্ষিত মানুষ আমাদের উদারতা কিংবা দান দেখে না। কোন এক কালে চামড়া রপ্তানিতে কিছু হেরফের করেছিলেন বাবা, ছাগলের চামড়ার সাথে কিছু কুকুরের চামড়া মিশিয়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকে বাবার নাম ‘কুত্তা রশীদ’ কিংবা ‘খালুয়া রশীদ।

বাবার চামড়ার ব্যাবসায় আমার তেমন আগ্রহ নেই, আমাদের ছোট চাচা ওটা দেখাশুনা করেন। ট্যানারি ফ্যাক্টরির ধারেকাছেও আমি যাইনা, তবুও আমার গায়ে নাকি চামড়ার পচা গন্ধ আছে।

জলির বাবার সাথে আমার বাবার দারুন দোস্তি। একজন ম্যাজিস্ট্রেট হয়েও কৃপাপ্রার্থী মত বাবার আশেপাশে ঘুরঘুর করেন। জলিদের বাসায় আমার অবাধ যাতায়াত, যখন ইচ্ছা তখনই যেতে পারি। জলির বাবা-মা আমাকে খুবই পছন্দ করেন, ভবিষ্যৎ জামাতা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে রেখেছেন। বাবার সাম্রাজ্যের একমাত্র উত্তরাধিকারী আমি, আমার কাছে তাদের মেয়ে সুখে থাকবে এ ব্যাপারে তারা শতভাগ নিশ্চিত।

ম্যাজিস্ট্রেটের বাস্তব জ্ঞান সাধারণ মানুষের চেয়ে উন্নত, অস্বীকার করার উপায় নেই। বিষয় বুদ্ধির হিসাবে আমার চেয়ে যোগ্য পাত্র তাদের মেয়ের পক্ষে জোগাড় করা অসম্ভব সেটা তারা খুব বুঝতে পারছেন। আফসোস মেয়ে এটা স্বীকার করতে চাচ্ছে না। মেয়েকে বুঝানোর চেষ্টা ক্রমাগত করে যাচ্ছেন, অনড় মেয়ে এক চুলও নড়ছে না।

তার একটাই কথা খালুয়ার ছেলেকে আমি বিয়ে করবো না তার গায়ে চামড়ার পচা গন্ধ। আমাকে অপমানের জন্য যেন এটুকুই যথেষ্ট নয়। চেহারা নাকি বাঁদরের মতো, কথা বলার ঢং জানি না, মুখে দুর্গন্ধ, কথা বলার সময় থুথু বেরোয়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে আমি নাকি চরম অশিক্ষিত।

অশিক্ষিত কথাটা মিথ্যা নয় দুই বার চেষ্টা করেও এসএসসি পাশ করতে পারিনি। তৃতীয় বার চেষ্টা করতে মন সায় দেয়নি। এসএসসি পাশ করিনি কিন্তু সিভিতে ডিগ্রী পাস লেখা আছে। বাবা আমার জন্য এসএসসি ইন্টারমিডিয়েট এবং ডিগ্রির সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে রেখেছেন। জেনুইন সার্টিফিকেট, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগও ভুল প্রমান করতে পারবে না।

টাকা থাকলে সবই হয়, সার্টিফিকেট কিংবা ম্যাজিস্ট্রেটকেও পোষ মানানো যায়। কিন্তু অঢেল টাকা দেখিয়েও মামুলি একটা মেয়েকে বশ করতে পারছি না।

জলি আমার সম্বন্ধে অশিক্ষিত ছাড়া যা বলেছে চরম মিথ্যা। অশিক্ষিত হতে পারি অসংস্কৃত নই। গড়পড়তা মানুষের মুখের চেয়ে আমার মুখশ্রী সুন্দর। সাহিত্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কথা বলার জন্য আমাকে দাওয়াত করে নিয়ে যায়। মুখে দুর্গন্ধ চরম শত্রুও তা বলতে পারবে না। কথা বলার সময় থুথু বের হয় এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কেউ সতর্ক করে দেয় নি।

জলি আমাকে পছন্দ করে না মেনে নিতে পারি, মিথ্যাচার মেনে নিতে পারি না। আমি চাইলে জলিকে উঠিয়ে নেয়া কোন ব্যাপার না, তার ম্যাজিস্ট্রেট বাবাও আমাকে ছুঁতে পারবে না। কিন্তু জানি জোর করে প্রেম ভালবাসা হয় না, আমি অশিক্ষিত কিন্তু অসভ্য, অসংস্কৃত নই…

আকাশ আগল খুলেছে

2619130

বরফ ভেঙ্গে যে সাদা মেয়েটা
আসছে; তাকে দেখেই
আকাশ আগল খুলেছে।
তার চোখ, নাক, ঠোঁট,
চিবুক এমন মোহনীয়

বরফকুচিও লোভ সংবরণ
করতে পারছে না। তাকে
আবৃত করতে রীতিমত প্রতিযোগিতা
শুরু করেছে। বরফের প্রতি
মেয়েটা উদাসীন অথবা
উটকো ঝামেলা মনে করছে।

বরফ নিয়ে আমার আদিখ্যেতা
নেই, ঠাণ্ডা বিষয়ক কোন
কিছুতে আপ্লুত হই না।

আকাশ ভেঙ্গে বরফ ঝরছে
একটা দালানের শেডে দাঁড়িয়ে
বিড়ির সাথে দোস্তি করছি।

মেয়েটা আসছে, মেয়েটা
বরফ হয়ে আসছে। বিড়ির
দোস্তি শীত মানছে না দেখে
ভাবি এই শুভ্র বসনাকে
যদি আলিঙ্গন করা যেত!

ঠিক এমন সময় মেয়েটা
সামনে এসে দাঁড়ায়, ‘একটা
বিড়ি ধার হবে’ মেয়েটা বলে।
তার তুষার ভেজা ঠোঁটের
দিকে তাকাই, এই মুহূর্তে
বিড়ির চেয়ে চুম্বনই যুথসই হতো।
ইচ্ছা করছিল বলি ‘লেটস
হ্যাভ এ কিস’ সংবরণ করি।

মেয়েটা পুনরায় বলে, ‘একটা
বিড়ি হবে’? আমি বিড়ির প্যাকেট
এগিয়ে দেই, ধন্যবাদ বলে
মেয়েটা উল্টো পথে পা বাড়ায়।

মেয়েটা বিড়িখোর, আর কিছু নয়।
কিন্তু চুম্বন প্রবলভাবে আমাকে
আকড়ে ধরে। বরফ ভেঙ্গে
ঘরের দিকে হাঁটতে থাকি।

কীট

আমার অনেক কিছু হওয়ার কথা ছিল
অনেক ভারী কিছু, শৈশবে
মিতালীরা বাড়ি যেত। বড়োসড়ো ওজনদার
তালা সদর দরজায় ঝুলিয়ে
দুই-তিন সপ্তাহের জন্য তারা হাপিস হয়ে যেত;
ইচ্ছে করতো আমি পাহারাদার হই,
তাদের সদর দরজায় তালা হয়ে ঝুলে থাকি।

চালের আড়তে বিশ কিলো ওজনের
বাটখারা খুব পছন্দ ছিল, ইচ্ছে ছিল
বাটখারা হব। আড়তের বৃদ্ধ কর্মচারীর
কষ্ট লাঘবে এগিয়ে গেলে;
সমস্ত শক্তি দিয়ে একচুল নড়াতে পারতাম না;
ঈর্ষার চোখে চাইতাম, আশেপাশে দেখতাম
বিশ কিলো মানুষের জীবন। মানুষকে
ভালোবেসে বাটখারা হতে চাইতাম।

চেরাই কাঠের
করাত ভীতি জাগাত, বিশাল বৃক্ষকে
নিমিষেই ফালাফালা করে ফেলত।
করাতের দোর্দণ্ড প্রতাপের কাছে
বৃক্ষের বিশালতা কত অসহায়। একদিন
মানুষের বুকে চির ধরাবো এই আশায়
করাত হতে চাইতাম।

আনসার মাঠ তছনছ করে
উঠছে সাত মহলা বাড়ি; অসহায় আমি
দূরে দাঁড়িয়ে সহ্য করছি হাতুড়ির আঘাত।
একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব
হারিয়ে যাচ্ছে স্মৃতি, হাতুড়ির প্রতি ক্রোধে
তোলপাড় হচ্ছে প্রাণ প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষায়
বিশালাকার হাতুড়ি হতে চাইতাম।

হাতুড়ি কেড়ে নিয়েছে শৈশব
আনসার মাঠে রোদের চিহ্ন নেই;
ইটের জঙ্গলে কেউ শৈশব খুঁজে না।

শৈশব হারিয়ে গেলে
কিছু হওয়ার ইচ্ছে মরে যায়
ওজনদার কোনকিছু লালায়িত করে না
এখন আমি অন্য অনেকের মত মানুষরূপী কীট।