নিতাই বাবু এর সকল পোস্ট

নিতাই বাবু সম্পর্কে

নিতাই বাবু ২০১৫ সালে তিনি শখের বশে একটা ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করে লেখালেখি শুরু করেন।তিনি লিখতেন নারায়ণগঞ্জ শহরের কথা। লিখতেন নগরবাসীর কথা। একসময় ২০১৭ সালে সেই ব্লগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ব্লগ কর্তৃক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জনাব সাঈদ খোকন সাহেবের হাত থেকে ২০১৬ সালের সেরা লেখক সম্মাননা গ্রহণ করেন। সাথে নগর কথক উপাধিও পেয়ে যান। এরপর সেই ব্লগে লেখালেখির পাশাপাশি ২০১৮ সালের জুলাই মাসে তিনি শব্দনীড় ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করেন। শব্দনীড় ব্লগে উনার প্রথম লেখা "আমি রাত জাগা পাখি" শিরোনামে একটা কবিতা। তিনি চাকরির পাশাপাশি অবসর সময়ে লেখালেখি পছন্দ করেন এবং নিয়মিত শব্দনীড় ব্লগে লিখে যাচ্ছেন।

মুজিব মানে মুক্তির স্লোগান

23523

মুজিব মানে সতেজ তাজা প্রাণ,
মুজিব মানে চিরসবুজ বাংলার ঘ্রাণ।
মুজিব মানে অমর মৃত নয় এমন,
মুজিব মানে প্রতিবাদ বজ্র যেমন।

মুজিব মানে বাঙালির মুক্তির মহানায়ক,
মুজিব মানে বাঙালির দুঃসময়ের সহায়ক।
মুজিব মানে বাংলার লাল-সবুজের পতাকা,
মুজিব মানে মুক্ত আকাশে উড়ন্ত বলাকা।

মুজিব মানে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর বজ্রাঘাত,
মুজিব মানে সোনার বাংলার সুপ্রভাত।
মুজিব মানে কৃষকের মাঠে পাকাধান,
মুজিব মানে স্বাধীনতা মুক্তির শ্লোগান।

দেবতার মন্দির

2454187_n

দেবতার মন্দির দেবতায় ভেঙেছে
আমার তোমার যায় আসে কী,
যার আদেশ ছাড়া নড়ে না পাতা
মন্দির ভাঙ্গার সাহস কারোর হবে কি?

তোমরা দুঃখ কেন করো লাঠি কেন ধরো
প্রতিবাদ হানাহানি-ই-বা কেন করো,
হয় যদি দেবতার মন্দির ধৈর্য ধরো
নিশ্চয়ই হবে সাজা একটু সবুর করো!

যার মন্দির তিনিই ভাঙায় তিনিই গড়ায়
তোমার আমার এতো ভাবনা কী,
পাপ করবে যে ভুগেও সে
অন্যের পাপে কেউ ভুগছে কি?

আমার প্রথম সিনেমা দেখা এবং বর্তমান চলচ্চিত্রের হালচাল ও সিনেমা হল!

images-6a
১৯৭২ সালে নির্মিতি ছায়াছবি ‘মানুষের মন’ এর পোস্টার। আমার জীবনে সিনেমাহলে প্রথম দেখা ছায়াছবি।

ক’দিন আগে নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিলাম আমার বড়দি’র বাসায়। বড়দি’র বাসা থেকে সামান্য একটু দূরেই গুলশান সিনেমা হল। এই সিনেমা হলের সামনে দিয়েই দিদি’র বাসায় যেতে হয়। যখন গুলশান সিনেমা হলের সামনে দিয়ে যেতে থাকি, তখনই মনে পড়ে গেলো সেসময়ের কথা। যেসময় এই গুলশান সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে আসতাম। একটা টিকেট সংগ্রহের জন্য কতরকম চেষ্টা চালাতাম তা লিখে শেষ করা যাবেনা। তবু লিখবো একসময়ের সিনেমা দেখা আর এদেশে অতীত বর্তমান চলচ্চিত্র ও সিনেমা হল নিয়ে কিছু কথা।

IMG_10082021_143753_(500_x_400_pixel)
কোনো একসময়ের গুলশান সিনেমা হল। এর আশেপাশে সকাল থেকেই থাকত শতশত লোকের আনাগোনা। এখন নীরব, শুধু কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই সিনেমা হলটির সামনেই ডায়মন্ড সিনেমা হল, সেটিও এখন নেই। ডায়মন্ড সিনেমা হল এখন বহুতল ভবন নির্মাণাধীন।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস আমার জন্মেরও ৭/৮ বছর আগের। যেহেতু আমার জন্ম ১৯৬৩ সালে। আর বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ ছায়াছবিটি মুক্তি পায় ৩ আগস্ট ১৯৫৬ সালে। এ অঞ্চলের প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে আলোড়ন সৃষ্টি করে ‘মুখ ও মুখোশ’। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন আবদুুল জব্বার খান। আজ থেকে প্রায় ৬৫ বছর আগে বর্তমান আজাদ প্রেক্ষাগৃহে (তৎকালীন মুকুল প্রেক্ষাগৃহ) ছবিটির প্রথম প্রদর্শনী হয়। জানা যায়, প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনীতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শেরেবাংলা একে ফজলুল হক। ছবিটি ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও খুলনায় একযোগে মুক্তি পেয়েছিল।

IMG_10082021_200544_(500_x_400_pixel)
বাংলাদেশের প্রথম ছায়াছবি ‘মুখ ও মুখোশ’ এর পোস্টার। ছবি সংগ্রহ গুগল।

চলচ্চিত্রের কথা বলতে গেলে আগে বলতে হয় এর পূর্বসূরি বায়োস্কোপের কথা। যা আমরা ছোটবেলায় দেখতাম, হাটবাজারে বা কোনো ঐতিহ্যবাহী মেলায় অথবা নিজেদের বাড়ির উঠানে। বায়োস্কোপের সাথে বাঙালিকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার মতো বিশেষ কোনোকিছুর দরকার নেই। বিশেষ করে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের আগেপাছে গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে খুবই এক পরিচিত নাম বায়োস্কোপ। শুধু গ্রামেই এর পরিচিতি ছিলনা, শহরের অলিগলিতে আর বিভিন্ন লোকজ মেলায়ও ছিল এর পরিচিতি। ১৯৮০ দশকের পর যাদের জন্ম, তাদের কাছে মনে হতে পারে বায়োস্কোপ একটি খেলনার বাক্স। আসলে তখনকার সময়ে এই বায়োস্কোপ মোটেই খেলনার বাক্স ছিলনা। সত্যিকারার্থে এই বায়োস্কোপেই ছিল তখনকার আমলের গ্রাম বাংলার মানুষের সিনেমা হল। বায়োস্কোপের বাক্সটা মাথায় নিয়ে বায়োস্কোপওয়ালারা হাতে একটা ঝুনঝুনি বাজিয়ে রাস্তা দিয়ে যখন হেটে যেত, তখন তার পেছনে পেছনে ছোটছোট ছেলেমেয়েরা বায়োস্কোপ দেখার স্বপ্ন নিয়ে দৌড়াতে থাকতো।

91662_172
বাংলার বায়োস্কোপ, যা একসময় ছিল গ্রামবাংলার মা-বোনদের সিনেমাহল।

আমি নিজেও কোনো একসময় বায়োস্কোপ দেখার জন্য দৌড়াতাম। বায়োস্কোপ দেখতাম ধান না হয় চাউল দিয়ে। বায়োস্কোপওয়ালা থাকতে থাকতে দৌড়ে আসতাম বাড়িতে। প্রথমে মায়ের কাছে চাইতাম দুই আনা পয়সা অথবা ধান চালের জন্য। মা যদি দিতে অমত করতো, পরে আবদার করতাম বড়দি’র কাছে। ব্যাস, হয়ে গেল বায়োস্কোপ দেখার খরচ। দৌড়ে যাতাম বায়োস্কোপের সামনে। দেখতাম বায়োস্কোপ। এখন আর সেই বায়োস্কোপ চোখে পড়েনা। টিভি, ভিসিডি আর আকাশ প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে এই বায়োস্কোপ আজ হারিয়ে গেছে। কয়েকবছর পর হয়তো এই বায়োস্কোপ যাদুঘরে প্রদর্শিত করার জন্যও খুঁজে পাবেনা।

বায়োস্কোপের যুগ শেষ করে আমরা পা রেখেছি চলচ্চিত্রের যুগে। চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয় সিনেমাহলে। এই চলচ্চিত্রও কোনো একদিন হয়তো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে কালের বিবর্তনের সাথে তালমিলিয়ে। যাক সেটা পরের কথা। এবার আসি নিজের কথায়।

সিনেমা হলে গিয়ে যখন সিনেমা দেখতাম, তখন চলচ্চিত্র কী এবং কীভাবে এর নির্মাণ কাজ তা আমার জানা ছিলনা। শুধু বুঝতাম চলচ্চিত্র হলো সিনেমা মুভি বা ছায়াছবি আর কী? বর্তমান ডিজিটাল যুগের অনলাইনে বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে বুঝলাম, চলচ্চিত্র এক প্রকারের দৃশ্যমান বিনোদন মাধ্যম। চলমান চিত্র তথা “মোশন পিকচার” থেকে চলচ্চিত্র শব্দটি এসেছে। এটি একটি বিশেষ শিল্প মাধ্যম। বাস্তব জগতের চলমান ছবি ক্যামেরার মাধ্যমে ধারণ করে বা এনিমেশনের মাধ্যমে কাল্পনিক জগৎ তৈরি করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। বাংলায় চলচ্চিত্রের প্রতিশব্দ হিসেবে ছায়াছবি, সিনেমা, মুভি বা ফিল্ম শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়। এবার আলোচনায় আসি আমাদের দেশের চলচ্চিত্র নিয়ে, কখন শুরু এবং বর্তমান অবস্থা কী?

ঢাকায় চলচ্চিত্র নির্মাণ
জানা যায় ১৯২৭-২৮ সালে ঢাকায় প্রথম চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। নওয়াব পরিবারের কয়েকজন তরুণ সংস্কৃতিসেবী নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র সুকুমারী। এর পরিচালক ছিলেন জগন্নাথ কলেজের তৎকালীন ক্রীড়া শিক্ষক অম্বুজপ্রসন্ন গুপ্ত। চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকা ছিলেন খাজা নসরুল্লাহ ও সৈয়দ আবদুস সোবহান। উল্লেখ্য তখন নারীদের অভিনয়ের রেওয়াজ চালু হয়নি। নাট্যমঞ্চের নারী চরিত্রেও পুরুষেরাই অভিনয় করতেন। ছোটবেলায় আমি নিজেও দেখেছি অনেক যাত্রাপালা, মঞ্চনাটক। দেখেছি সেসব যাত্রাপালায় ও মঞ্চনাটকে কোনো মেয়ে নায়িকা ছিলনা। অভিনয়ে যারা ছিল সবাই পুরুষ। ম্যাকাপ আর পরচুলা ব্যবহার করে মেয়ে রূপধারণ করে সেসব যাত্রা আর মঞ্চনাটকে অভিনয় করতো পুরুষেরা। আমি যখন কক্সবাজার সংলগ্ন মহেশখালী লবণের মিলে চাকরি করতাম, তখন সেই মিলে আমরা শ্রমিকেরা যাত্রাপালা করেছিলাম। যাত্রাপালার নাম ছিল ‘চাঁদ কুমারী ও চাষার ছেলে’। সেই যাত্রাপালায় নায়িকা চাঁদ কুমারীর অভিনয় করানো হয়েছে মিলের এক ২০ বছর বয়সী ছেলেকে দিয়ে। এমনভাবে মেকআপ করা হয়েছে, কেউ ধরতেও পারেনি যে এটা পুরুষ। পরদিন এলাকার সবাই আমাদের জিজ্ঞেস করছিলেন, এই নায়িকা আমরা কোত্থেকে এনেছিলাম। সেসব এভাবেই পুরুষদের দিয়েই মেয়েদের কাজ সামলানো হতো।

১৯৫৬ সালের কোনো একসময় আবদুল জব্বার খান পরিচালিত বাংলাদেশের প্রথম সবাক বাংলা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তির মধ্যদিয়ে শুরু হয় এদেশের চলচ্চিত্রের পথচলা। পরিচালক নাকি নিজেই নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন। নায়িকা চরিত্রে ছিলেন চট্টগ্রামের পূর্ণিমা সেন। অন্যান্য চরিত্রে ছিলেন ইনাম আহমেদ, নাজমা (পিয়ারী), জহরত আরা, আলী মনসুর, রফিক, নুরুল আনাম খান, সাইফুদ্দীন, বিলকিস বারী প্রমুখ। চিত্রগ্রাহক কিউ এম জামান, সুরকার সমর দাস, কণ্ঠশিল্পী আবদুল আলীম ও মাহবুবা হাসানাত এই চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান (বঙ্গবন্ধু, পরে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) এর উত্থাপিত বিলের মাধ্যমে পূর্বপাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা (ইপিএফডিসি) প্রতিষ্ঠিত হলে এর সহযোগিতায় ১৯৫৯ সালে থেকে প্রতিবছর চলচ্চিত্র মুক্তি পেতে থাকে। এফডিসি ছাড়াও পপুলার স্টুডিও, বারী স্টুডিও এবং বেঙ্গল স্টুডিও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বিরাট ভূমিকা পালন করে।

এফডিসি প্রতিষ্ঠার পরে চলচ্চিত্র নির্মাণের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় অনেক যোগ্য ব্যক্তি এগিয়ে আসেন। ১৯৫৯ সালে ফতেহ লোহানীর ‘আকাশ আর মাটি’, মহিউদ্দিনের ‘মাটির পাহাড়’, এহতেশামের ‘এদেশ তোমার আমার’ এই তিনটি বাংলা চলচ্চিত্র ছাড়াও এ জে কারদারের ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ উর্দু চলচ্চিত্র নির্মিত হয়।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের শুরুর দশকে নির্মিত পাঁচটি চলচ্চিত্রের প্রতিটিই নানান সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও শিল্পমানে উত্তীর্ণ বলেই চলচ্চিত্রবোদ্ধারা মনে করেন। অর্থাৎ আমাদের চলচ্চিত্রের অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল শুদ্ধতার অঙ্গীকার নিয়েই। উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রও তৈরি হয়েছে সেই শুরু থেকে আজ পর্যন্ত। বেবী ইসলামের ‘তানহাও’ উর্দু ভাষার নির্মিত। এটি ১৯৬০ সালে সেন্সর সার্টিফিকেট পায় কিন্তু মুক্তি পায় ১৯৬৪ সালে। জানা যায় উইকিপিডিয়া থেকে।

১৯৭২ সালে মোস্তফা মেহমুদ পরিচালিত এফডিসি থেকে মুক্তি পায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ছায়াছবি ‘মানুষের মন’। এতে অভিনয় করেন নায়করাজ রাজ্জাক, ববিতা ও আনোয়ার হোসেন। আমার বয়স ৮/৯ বছর। অর্থাৎ ১৯৭২ সাল, দীর্ঘ নয়টি মাস যুদ্ধের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের একবছর অতিক্রম করছিল। সেসময় আমরা সপরিবারে আমাদের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীতে থাকি। বাবা আর বড়’দা থাকতো নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানাধীন আদর্শ কটন মিলে। আমি তখন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম। ভালমন্দ বুঝার একটু-আধটু জ্ঞান তখন আমার হয়েছিল। একদিন আমার মাসিমা আর বড়মামা আমাদের বাড়িতে এসেছিল বেড়াতে। বড়মামাকে দেখে আমরা বাড়ির সবাই মামার কাছে আবদার করলাম সিনেমা দেখার জন্য। আমাদের আবদারে মামা রাজি হয়ে বাড়ির সবাইকে নিয়ে চৌমুহনী দর্পণ সিনেমা হলে নিয়ে যায় সিনেমা দেখানোর জন্য। আহ! কী আনন্দ সবার, সাথে মা, মাসিমা, আমার জেঠিমা, কাকী, দুইজন বড়দিদি। সকাল ৯ টায় মর্নিং শো, ছায়াছবি ‘মানুষের মন’।

তখন নোয়াখালীর দর্পণ সিনেমা হল ইট সিমেন্টের ছিলনা, ছিল টিনের বেড়া। মামা সবার জন্য টিকেট কিনে এনে সবাইকে নিয়ে সিনেমা হলের ভিতরে সিটে বসালো। সবাই সিটে বসলেও আমার ভাগ্যে আর সিট জুটেনি, আমি আমার মায়ের কোলেই বসে থাকলাম। তখন টাকার খুব দাম! সবাইকে সিনেমা দেখানো তো মামার দম যায়যায় অবস্থা। সিনেমার শো শুরু হলো, সিনেমা দেখলাম।

তার কিছুদিন পর আমরা সপরিবারে নোয়াখালী থেকে ঘরবাড়ী নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে চলে আসি নারায়ণগঞ্জে। বড় হতে থাকি আরো দশজন ছেলেপেলের সাথে হেসেখেলে। অনেক ছায়াছবি দেখেছি টেলিভিশনে আর সিনেমাহলে গিয়ে।

p20170604-1824272
আমাদের চৌধুরীবাড়ি থেকে নারায়ণগঞ্জ যেতে প্রথমেই চোখে পড়ে ‘নিউ মেট্রো সিনেমাহল’ এটিও এখন বন্ধ। আগে সবসময় ছিল লোকে লোকারণ্য, এখন নীরব নিস্তব্ধ।

সেসময় একটা ছায়াছবি মুক্তি পাওয়ার একমাস আগে থেকে রেডিও টেলিভিশনে এডভার্টাইজিং করা হতো। মানে রেডিও টেলিভিশনের ছায়াছবির আংশিক সংলাপ ও কিছুকিছু গানের প্রথমাংশ শোনানো হতো। এর কারণ ছিলো সিনেমায় দর্শক বাড়ানো। তখন এমন একটা সময় ছিল যে, সিনেমা সবার কাছে ছিল গ্রহণযোগ্যতা। সিনেমা মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই একসাথে সিনেমাহলে গিয়ে সিনেমা উপভোগ করতো। তখন মানুষের মনে সিনেমা ছিল আনন্দের, শখের। আস্তে আস্তে সেই আনন্দ আর শখ নষ্ট হতে শুরু করে যখন ভিসিয়ারের আগমন ঘটে।

বেশিরভাগ মানুষ তখন ভারতীয় ছায়াছবির দিকে ঝুকে দেশীয় বাংলা ছায়াছবি থেকে মুখ ফেরাতে থাকে। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে দেশের আপামর জনগণ কেন সিনেমা হল বিমুখী হলেন, তার একটা কারণ মোটামুটি সবারি জানা। এর কারণ শুধু একটাই। আর তা হলো ভিসিআর, স্যাটেলাইট চ্যানেল এর আগমনের পাশাপাশি দেশীয় চলচ্চিত্র থেকে যখন সামাজিকতার ছোয়া ওঠে গেলো। আর ভারতীয় চলচ্চিত্র এদেশের ডিসএন্টেনায় সরাসরি দেখার সুযোগে সৃষ্টি হলো, তখন থেকে বাংলাদেশী দর্শকশ্রেণী আস্তে আস্তে দেশীয় চলচ্চিত্র থেকে বিমুখ হতে শুরু করলো। এর ফলে দেশীয় চলচ্চিত্র হলো সবার কাছে একরকম অবহেলিত। আর দেশীয় চলচ্চিত্রের দৈন্যদশার যাত্রা হতে থাকলো শুরু।

আমাদের দেশের মানুষ যখন হল বিমুখী হওয়া শুরু করলেন, ঠিক তখন থেকেই সিনেমার সাথে সাথে হলগুলোর পরিবেশও খারাপ হওয়া শুরু করলো। অবস্থা এতটাই খারাপ হল যে, আমি নিজেও যদি কোনোদিন সিনেমাহলে যাই, তাহলে অন্তত কয়েকবার এদিক সেদিক ভালো করে দেখে নেই, কেউ আবার দেখে ফেললো কিনা। তাহলে তো বিপদ! মানে মানসম্মান যাবে যাবে বলে অবস্থা। আবার হলে গিয়ে সিটে বসে যদি দেখি পাশের সিটে বসা আমার ছেলের ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু, তাহলে তো একেবারেই মানইজ্জত শেষ হবার পালা!

p20170604-182356
চৌধুরীবাড়ি ‘বন্ধু সিনেমাহল’ গত কয়েক বছর আগে এটিও বন্ধ হয়ে যায়। এখন এই বন্ধু সিনেমা কমিউনিটি সেন্টার।

এর কারণ হলো বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বাংলা চলচ্চিত্রের নাম যদি হয় নগ্ন হামলা, খাইছি তোরে, বোমা হামলা, লাল কোট কালো চশমা ইত্যাদি ইত্যাদি, তাহলে বুঝাই যায় যে এসব ছায়াছবিতে কী দেখাবে। ছবিতে দেখা যায় বিশ্রী ভাষায় গালাগালি, অর্ধনগ্ন পোশাকে নাচগান আর কাটপিসের ছড়াছড়ি। আবার খ্যাতিমান নায়ক-নায়িকাদের দেশত্যাগ ও চিত্রজগত ছেড়ে দেওয়া, নায়ক-নায়িকার অভাব। বর্তমানে বাংলা চলচ্চিত্র শুধু শাকিব নির্ভরই বলা চলে। তিনি ছাড়া আর গুটিকয়েক তারকা হয়তো আছে এদেশের চিত্রজগতে।

তাহলে বোঝাই যায় বাংলা চলচ্চিত্রের হালচিত্র বুঝতে মোটেই বেগ পেতে হয় না। যদি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের মতো করে সামাজিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করা না হয়, তাহলে আর কখনো বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালী সুদিন ফিরে আসবে না বলে মনে হয়। এভাবে চলতে থাকলে মানুষ হয়তো একদিন সিনেমা হলের কথাও মনে রাখবে না। এই সময়ের মধ্যেই কিন্তু মানুষের মন থেকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে গেছে বাংলা ছায়াছবি দেখার ইচ্ছা আর স্বাদ ও আনন্দ। বেশিরভাগ সিনেমাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে দর্শকের অভাবে। অনেক সিনেমা হলের নাম চিহ্নও নেই। যা-ও আছে, তা কেবল গুটিকয়েক।

দেশের বিভিন্ন জেলাশহরে তো এই অবস্থা চলছেই, প্রাচ্যের ডান্ডি নামে খ্যাত নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রায় সবগুলো সিনেমাহল এখন আর নেই। কোনোকোনো সিনেমাহলের জায়গায় এখন সুবিশাল মার্কেট, নাহয় গার্মেন্টস। বুঝি করারও কিছুই নেই! দর্শক ছাড়া মাসের পর মাস সিনেমাহলের কর্মচারীদের বেতন, নানাবিধ খরচাদি বহন করা মালিক পক্ষের দ্বারা সম্ভবও নয়। যদি সিনেমাহলে দর্শকই না আসে, তাহলে হল মালিকরা তা পোষাবে কি করে? যারা দর্শক, তারা তো আজ ডিশএন্টেনা সহযোগিতায় ঘরে বসেই দিনেরাতে শ’খানেক ছায়াছবি দেখতে পারে। তাহলে কষ্ট করে হলে যাবে কেন? আর আমাদের দেশের চলচ্চিত্রে তো আগের মতো সামাজিক কাহিনী নেই। আছে ডিজিটাল যুগের ফুফা আর নগ্ন নৃত্যের ঝলকানি। যা সপরিবারে একসাথে বসে দেখা যায়না।

একটা সময়ে অশ্লীল চলচ্চিত্রের দৌরাত্ম্য দেখা গিয়েছিল যে, সেই দুর্গন্ধটা যেন আজীবন বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের গায়ে থেকেই গেল। সেই দুর্গন্ধ দূর করতে হলে চাই সুস্থ্যধারার চলচ্চিত্র নির্মাণ করা, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের তৈরি চলচ্চিত্রগুলি অনুসরণ করা, নতুন নতুন নায়কনায়িকা খুঁজে বের করাও জরুরী। তা নাহলে এদেশ থেকে একদিন বাংলা চলচ্চিত্রের নাম মুছে যাবে। সেই নাম আর কোনোদিন জেগে উঠবে না। তাই ভাবি আমাদের দেশের চলচ্চিত্রের মাঝে নিজের প্রতিচ্ছবি কবে দেখব? নাকি সেই দেখা এই জন্মেও দেখা হবে না। যেসব সিনেমাহল বিলুপ্তি হয়ে গেছে, সেই পরিমাণ সিনেমাহল কী এদেশে আর কখনো গড়ে উঠবে? নাকি যেগুলি আছে সেগুলিও বিলুপ্ত হয়ে যাবে?

সব কষ্ট দূর হয় … মনের কষ্ট দূর হয় না

SAVE_20210723_170844

বন ঘেঁষা এক কাঠুরিয়ার বাড়ি। বাঁশ-খুঁটিতে দাঁড় করানো ছনের ছাউনি ঘরটা ছাড়া কাঠুরিয়ার আর কিছুই নেই। জীবিকার একমাত্র উপায় ছিলো, গহীন বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করা। কাঠুরিয়ার ছেলেমেয়ে নেই। জায়গাজমিও নেই। বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করে তা নিকটস্থ বাজারে বিক্রি করা কাঠুরিয়ার নিত্যদিনের কাজ। তা না হলে কাঠুরিয়ার ঘরে থাকা প্রাণপ্রিয় স্ত্রী-সহ দুজনেই না খেয়ে থাকতে হয়। তাই পেটে ক্ষুধা মেটাতে রোজ সকালে দুমুঠো পান্তাভাত গিলে কাঠ সংগ্রহের জন্য বনে চলে যায়।

একদিন কাঠুরিয়া রোজকার মতো সকালবেলা পান্তাভাত খেয়ে কাঠ সংগ্রহের জন্য বনে চলে যায়। বনের বেশি ভেতরে না ঢুকে বনের সামনেই কাঠ খুঁজতে থাকে। কিন্তু তেমন একটা সুবিশাল করতে না পেরে কাঠ খুঁজতে খুঁজতে বনের গহীনে ঢুকে পড়ে। বনের গহীনে যাবার পর সেখানে অনেক বড় একটা মরা গাছ সে দেখতে পেলো। তা দেখে কাঠুরিয়া মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে দুহাত তুলে ফরিয়াদ করে বললো, “হে বিধাতা, আপনি সত্যিই মহান। আপনার দয়ার বরকতে আজ আমি এই গহীন বনে এসে সারা বছর চলার উপার্জন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। আপনি আমার সহায় থাকুন।”

এই বলেই কাঠুরিয়া হাতে থাকা ধারালো কুড়াল কামড়ে বেঁধে মরা গাছের উপরে উঠে গেলো। গাছের উপরে উঠে গাছের মরা ডাল-পালা কেটে নিচে ফেলতে লাগলো।

এরমধ্যে সাত দিনের অনাহারী এক ক্ষুধার্ত বাঘ ওই গাছে নিচে এসে ক্লান্ত শরীরটা মরা গাছের সাথে লেলিয়ে দিলো। এমন সময় গাছের উপর থেকে বড় মোটা একটা ডালা নিচে পড়লো। ক্ষুধার্ত বাঘ বিরক্ত হয়ে গাছের উপরে তাকালো। দেখতে পেলো একটা মানুষ গাছের উপরে বসে আছে। ক্ষুধার্ত বাঘ গাছের উপরে মানুষ দেখতে পেয়ে মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে ফরিয়াদ করে বলতে লাগলো, “হে দয়াময়, আপনি মহান, সত্যিই মহান। আপনি কাউকে না খেয়ে মরতে দেন না। সাতদিন পর হলেও আপনি সবাইকে আশা জোগাড় করে দেন। আজ যেমনটা আমাকে জোগাড় করে দিলেন। আপনার দরবারে লাখ-লাখ শুকরিয়া।”

এদিকে ক্ষুধার্ত বাঘ যে গাছের নিচে বিশ্রাম নিচ্ছে, তা আর কাঠুরিয়ার দৃষ্টিগোচর হলো না। কাঠুরিয়া মনের আনন্দে গাছের ডাল-পালা কাটতেই লাগলো। হঠাৎ কাঠুরিয়ার চোখ পড়লো বাঘের পর। এখন তো কাঠুরিয়ার প্রাণপাখি উড়ে যায় যায় অবস্থ। কিন্তু গাছের নিচে থাকা ক্ষুধার্ত বাঘ হাঁক-ডাক না দিয়ে চুপ করেই বসে আছে।

গাছের নিচে বসে ক্ষুধার্ত বাঘ মনে মনে বলছে, “যাক, গাছের উপরে থাকা মানুষটা খেয়েই সাত দিনের পেটের ক্ষুধা মেটানো যাবে। তবে হাঁক-ডাক না দিয়ে চুপ করেই বসে থাকি, যতক্ষণ না পর্যন্ত মানুষটি গাছের উপর থেকে না নামে।” এই বলেই ক্ষুধার্ত বাঘ আরও একটু টাইট করে বসে থাকলো।

এদিকে গাছের উপরে কাঠুরিয়া ভয়ে আর কাঠ কাটতে পারছে না, নামতেও পারছে না। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে লাগলো, ক্ষুধার্ত বাঘও গাছের নিচ থেকে সরছে না। কাঠুরিয়াও আর বেশিক্ষণ গাছের উপরে বসে থাকতে পারছে না। এদিকে ক্ষুধার্ত বাঘও এখন তার শরীরে জেদ সামলাতে পারছে না। হাউ-মাউ করে গর্জন করতে শুরু করলো।

ক্ষুধার্ত বাঘের গর্জন শুনে কাঠুরিয়া গাছের উপর থেকে বলতো লাগলো, “বাঘ ভাই, তুমি আমাকে খেয়ো না। আমি জানি তুমি খুব ক্ষুধার্ত! আমাকে খেয়ে তুমি হয়তো তোমার একদিনের পেটের ক্ষুধা মেটাতে পারবে। আর আমাকে না খেলে আমি তোমাকে প্রতিদিন খাওয়াতে পারবো।”

ক্ষুধার্ত বাঘের এখন জবান খুলে গেলো। বাঘ বললো, “আমি তোমার কোনও কথাই শুনবো না। আগে তুমি গাছের উপর থেকে নিচে নামো।”

কাঠুরিয়া বললো, “বাঘ ভাই, আমি নিচে নামলেই তো তুমি আমাকে ধরে খেয়ে ফেলবে। তার আগে তুমি দয়া করে আমার কথা শুনো। আমি তোমার পেটের ক্ষুধা মেটানোর জন্য আমার বাড়ি থেকে অন্তত দুটো ছাগল এনে দিবো। সেগুলো তুমি আরামে বসে বসে খাবে। তবে হ্যাঁ, কথা দিচ্ছি তোমাকে শুধু একদিনের জন্যই নয়, প্রতিদিন একটা করে ছাগল এনে দিবো। তাহলে খাবারের জন্য তোমার আর এদিক-ওদিক দৌড়াদৌড়ি করতে হবে না।”

কাঠুরিয়ার কথা শুনে ক্ষুধার্ত বাঘ শান্ত হয়ে বললো, “শুনো কাঠুরিয়া, তোমার কথা আর কাজে যদি ঠিক থাকে, তাহলে আমিও কথা দিচ্ছি, তোমাকে আমি খাবো না। তুমি গাছের উপর থেকে নির্ভয়ে নামতে পারো।”

ক্ষুধার্ত বাঘের কথা শুনে কাঠুরিয়া ভয়ভয় মনে আস্তে আস্তে গাছের উপর থেকে নিচে নামতে লাগলো। কিন্তু তবুও কাঠুরিয়া ঠিকমতো নামতে পারছে না, মনের ভয়ে। কাঠুরিয়া নামতে দেরি দেখে ক্ষুধার্ত বাঘ জোরে গর্জন করে বলতে লাগলো, “এই কাঠুরিয়া, তুমি কাঁপতে কাঁপতে আস্তেধীরে নামছ কেন? আমিতো তোমাকে কথা দিয়েছি, তোমাকে খাবো না। আমি আবারও বলছি, তুমি নির্ভয়ে তাড়াতাড়ি নামো। আমার বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে। আমি অন্তত সাতদিন যাবত কিছুই খাইনি। পেটের ক্ষুধায় আমার এখন জীবন যায়। তুমি তাড়াতাড়ি গাছ থেকে নেমে তোমার বাড়ি থেকে দু’একটা ছাগল আমার জন্য নিয়ে এসো।”

ক্ষুধার্ত বাঘের আকুতি-মিনতি শুনে কাঠুরিয়া তড়িঘড়ি করে গাছ থেকে নিচে নামলো। কিন্তু মনের ভয় তখনো যাচ্ছিল না, যদি ক্ষুধার্ত বাঘ পেটের ক্ষুধায় ধপ করে তাকে ধরে ফেলে, তাই। তবুও মনে ভয় নিয়ে কাঠুরিয়া গাছ থেকে নেমে বাঘের সামনে হাতজোড় করে দাঁড়ালো।

কাঠুরিয়ার হাতজোড় করা দেখে ক্ষুধার্ত বাঘ শান্ত গলায় বললো, “এখনো তোমার ভয় দূর হয়নি? আমিতো যা বলেছিল, তা সত্যি সত্যি বলেছি। এখনো বলছি, তোমাকে আমি খাবো না। আমি আরও সাতদিন না খেয়ে থাকলেও না। এখন তুমি নির্ভয়ে তোমার বাড়ি গিয়ে আমার জন্য দু’একটা ছাগল নিয়ে আসো। আমি কিন্তু আমার কথা রেখেছি। এখন তুমি তোমার কথা রাখার চেষ্টা করো এবং খুব তাড়াতাড়ি করো। পেটের ক্ষুধায় আমার জীবন যায়।”

বাঘে কথা শুনে কাঠুরিয়া বললো, “ঠিক আছে বাঘ ভাই, তুমি একটুখানি এখানে অপেক্ষা করো। আমি বাড়ি গিয়ে তোমার জন্য ছাগল নিয়ে আসছি।”

কাঠুরিয়া এই বলে বাঘের সম্মুখ থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। ক্ষুধার্ত বাঘ গাছ থেকে কাটা কাঠুরিয়ার শুকনো গাছের ডালগুলোর সামনে বসে রইলো। অনেক্ক্ষণ পর কাঠুরিয়া তার বাড়ি থেকে একটু বড়সড় সাইজের দুইটা ছাগল টানে-হেঁচড়ে বাঘের সামনে এনে দিলো।

বাঘ ছাগল দুটো দেখে খুশি হয়ে বললো, “আজ থেকে তুমি আমার বন্ধু। এই বনের যত গহীনেই তুমি যাও-না-কেন, তোমার কোনও ভয় নেই। আমি এবং আমার বংশধর যারা আছে সকলেই তোমাকে পাহারা দিয়ে রাখবে। এখন তুমি তোমার সংগ্রহ করা গাছের ডালগুলো নিয়ে বাড়ি চলে যাও। আগামীকাল আবার আসবে।”

বাঘের কথা শেষে কাঠুরিয়া তার সংগ্রহ করা গাছের শুকনো ডালগুলো বেঁধে মাথায় করে বাড়ি ফিরে গেলো। ক্ষুধার্ত বাঘ মনের আনন্দে কাঠুরিয়ার দেয়া ছাগল দুটো খেতে শুরু করলো।

পরদিন সকালবেলা কাঠুরিয়া কুড়াল হাতে করে বনের সামনে আসলো। কিন্তু আজও মনের ভেতরে কেমন যেন ভয়! কাঠুরিয়ার চিন্তা, বনের হিংস্র পশু বাঘ। বাঘের কথার কি আর বিশ্বাস আছে? সারা বন ঘুরে খাবার না পেলে শেষাবধি পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য আমাকেই একসময় খেয়ে ফেলবে। এরকম চিন্তা করতে করতে একসময় বনের ভেতরে ঢুকে পড়লো। একটু যেতেই কাঠুরিয়া দেখলো, তার সামনে অনেকগুলো গাছের শুকনো ডাল-পালা পড়ে আছে। কাঠুরিয়া কিছু চিন্তাভাবনা না করতেই গতকালের সেই ক্ষুধার্ত বাঘ কাঠুরিয়ার সামনে আসলো। কাঠুরিয়া বাঘকে দেখে আবার ভয়ে কাঁপতে শুরু করলো। কাঠুরিয়ার মনের আর শরীরের কাঁপুনি বাঘ খেয়াল করলো।

তারপর বাঘ কাঠুরিয়াকে বললো, “বন্ধু তুমি এভাবে কাঁপছ কেন? আমিতো তোমার বন্ধু। তোমার সামনে গাছের যেই ডালগুলো দেখতে পাচ্ছ, এগুলো আমি আমার সাথের আরও বাঘকে নিয়ে সারা বন ঘুরে ঘুরে তোমার জন্য সংগ্রহ করে রেখেছি। যাতে শুকনো ডাল-পালার জন্য তোমার আর কোনও কষ্ট করতে না হয়। এখন তুমি এগুলো বেঁধে তোমার বাড়িতে নিয়ে যাও। বাড়িতে এগুলো রেখে আমার জন্য কিছু খাদ্য নিয়ে আসো।”

কাঠুরিয়া বাঘের কথামতো ঠিক তা-ই করলো। বাড়ি গিয়ে গাছে ডালাগুলো রেখে দুটো ছাগল এনে বাঘকে দিলো।

এভাবে কিছুদিন যেতে-না-যেতেই কাঠুরিয়ার খামারের সব ছাগল শেষ হয়ে গেলো। কাঠুরিয়া পড়ে গেলো ভীষণ চিন্তায়! চিন্তা শুধু বাঘে খাবার। বাঘকে খাবার না দিলে বনে যাওয়া ঠিক হবে না। এই ভেবে কাঠুরিয়া আর বনেও যায় না। বনে না গেলেও কাঠুরিয়ার মন চিন্তামুক্ত হচ্ছে না। চিন্তা শুধু একটাই। তা হলো বাঘ! বাঘ যদি খাবারের জন্য বাড়িতে এসে হানা দেয়? সেই চিন্তায় কাঠুরিয়া একসময় অসুস্থ হয়ে পড়লো। কাঠুরিয়ার স্ত্রী গ্রাম্য ডাক্তার কবিরাজের কাছ থেকে ঔষধাদি এনে সেবন কারানোর পরও কাঠুরিয়া সুস্থ হচ্ছে না। দিনদিন শুকিয়ে কঙ্কাল হয়ে যাচ্ছিলো। কাঠুরিয়ার শরীরে প্রচুর জ্বর। জ্বরও থামছিল না।

এদিকে বনের সেই বন্ধু ক্ষুধার্ত বাঘ দীর্ঘদিন কাঠুরিয়াকে না দেখে প্রায় পাগলের মতো হয়ে গেলো। সাথের বংশধর যারা আছে, তাদের জিজ্ঞেস করলো। কেউ কাঠুরিয়ার খবর দিতে পারলো না। বন্ধু বাঘ মনের ক্ষোভে সাথের বাঘগুলোকে দোষারোপ করতে লাগলো। এ-ও বলছিল, “হয়তো তোরাই আমার প্রিয় বন্ধুকে হজম করেছিস। তা না হলে আমার বন্ধুর কোনও খোঁজখবর নেই কেন? তোদের দ্বারা যদি আমার বন্ধুর কোনও ক্ষতি না হয়, তাহলে ধরে নিলাম আমার প্রিয় বন্ধু অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে। আর তা যদি হয়, তাহলে তোরা যে যেখানেই থাকিস-না-কেন, আগামীকাল সকালে এখানে এসে হাজির থাকবি। তারপর সবাই মিলে আমি আমার বন্ধুর গ্রামের বাড়িতে যাবো। আর হ্যাঁ, যাবার সময় আমার বন্ধুর জন্য গাছের শুকনো ডাল-পালা মুখে করে নিয়ে যাবো। যাতে সেগুলো বিক্রি করে আমার বন্ধু দীর্ঘদিন চলতে পারে। আর বন্ধুর বাড়ি যাবার সময় গ্রামের কোনও গরু-ছাগলের উপর নজর দেয়া যাবে না। আমরা শান্তভাবে যাবো, আবার শান্তভাবে ফিরে আসবো।”

যেই কথা, সেই কাজ। পরদিন সকাল হতে-না-হতেই বনের সব বাঘ নির্ধারিত স্থানে জড়ো হলো। সবার মুখে ছিলো গাছের শুকনো একটা ডাল। তা দেখে কাঠুরিয়ার বন্ধু বাঘ খুবই খুশি হলো। তারপর সব বাঘ একসাথে লাইন ধরে হাঁটতে শুরু করলো। গন্তব্য, কাঠুরিয়ার বাড়ি।

বাঘের দল বন থেকে বের হয়ে যখন গ্রামের ফসলী জমির আইল ধরে কাঠুরিয়ার বাড়ি যাচ্ছিল, তখন গ্রামের লোকজন বাঘের ভয়ে ছোটাছুটি করতে লাগলো। কিন্তু বাঘগুলো কারোর দিকে ফিরেও চাচ্ছিল না, লাইন ধরে বাঘের দল শুধু সামনের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। গ্রামের মানুষের হৈ-হুল্লোড়ে এক কান, দুই কান হতে হতে শেষমেশ বাঘ আসার কথা অসুস্থ কাঠুরিয়ার কানে পৌঁছালো। বাঘ আসার খবর শুনে কাঠুরিয়া অসুস্থ থেকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে গেলো। কাঠুরিয়ার এখন আগের মতো হুঁশ-জ্ঞান বলতে কিছুই রইলো না।

এদিকে বাঘেরা গ্রামের মানুষের হৈ-হুল্লোড় উপেক্ষা করে একসময় বাঘের বন্ধু কাঠুরিয়ার বাড়ি পৌঁছে গেলো। বাঘেরা মুখে করে কামড়ে আনা গাছের শুকনো ডালগুলো কাঠুরিয়ার বাড়ির উঠানে রাখে সব বাঘ উঠোন জুড়ে বসলো।

কিন্তু বাড়ি নির্জন নিঃশব্দ দেখে কাঠুরিয়ার বন্ধু বাঘ জোরে একটা গর্জন করে বললো, “বন্ধু তুমি ঘর থেকে বের হও। দেখো আমরা তোমার জন্য কতো ডাল (লাকড়ি) এনেছি। আমি জানি তোমরা ভয় পেয়েছ। ভয়ের কোনও কারণ নেই। আমরা শুধু তোমাকে দেখতে এসেছি, বন্ধু। তোমাকে এক নজর দেখে আবার আমরা শান্তভাবে বনে ফিরে যাবো। তুমি বের হও।”

কিন্তু বাঘের ভয়ে কাঠুরিয়ার স্ত্রী এর আগেই ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে রেখেছিল। দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরের ভেতরে বসে মহান সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করতে লাগছিল। এখন বাঘের মুখের কথা শুনে কাঠুরিয়ার স্ত্রী কাঠুরিয়াকে বলছে, “ওগো শুনছো, বাঘেরা নাকি তোমাকে দেখতে এসেছে। আসার সময় অনেক ডাল-পালা মুখে করে নিয়ে এসেছে। এতো ডাল-পালা এনেছে যে, বাড়ির উঠোন ভরে গেছে। তুমি ওঠো! বাঘেদের সাথে দেখা করো। তা না হলে ওরা হয়তো ক্ষিপ্ত হয়ে ঘরের দরজা-জানালা ভেঙে ফেলবে।”

কাঠুরিয়া তার স্ত্রীর কথা শুনে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বের হলো। ঘর থেকে বের হয়ে দেখে বাড়ির উঠোন ভর্তি গাছের শুকনো ডাল-পালা। তা দেখে কাঠুরিয়া মনে মনে খুব খুশি হলো। কাঠুরিয়াকে অনেকদিন পর দেখে বনের সেই ক্ষুধার্ত বাঘটাও মনের আনন্দে জোরে গর্জন করলো। বন্ধু বাঘের গর্জনের সাথে সাথে সব বাঘেরাই মনের আনন্দে গর্জে উঠল।

এরপর আস্তে আস্তে কাঠুরিয়া বাঘের সামনে এসে বললো, “বন্ধু আজ কয়েকদিন যাবত আমার শরীর ভালো নেই। শরীরের খুব জ্বর! হাঁটতে পারি না। খেতেও পারছি না। তাই আর বনে গিয়ে তোমার সাথে দেখা করতে পারিনি। এতে তুমি মনখারাপ করো না বন্ধু।”

কাঠুরিয়ার কথা শুনে বাঘের ভীষণ মায়া হলো। তারপর বাঘ কাঠুরিয়াকে বললো, “বন্ধু তুমি এখানে এসে সোজা হয়ে শুয়ে পড়ো। আমি তোমার সমস্ত শরীর চেটে দেই। তাহলেই তুমি মুহূর্তেই ভালো হয়ে যাবে, বন্ধু। তুমি ভয় পেও না। আমি তোমার কোনও ক্ষতি করবো না। তুমি তাড়াতাড়ি আমার সামনে এসে শুয়ে পড়ো।”

বাঘের কথা শুনে কাঠুরিয়া ভয় ভয় মনে নিরুপায় হয়ে বাঘের সামনে সোজা হয়ে বাড়ি উঠোনে শুয়ে পড়লো। তারপর বন্ধু বাঘটা কাঠুরিয়ার সমস্ত শরীর জিভ দিয়ে চাটতে শুরু করলো। বাঘ যখন হা করে মুখের জিভ ভের করে চাটতে লাগলো, কাঠুরিয়া তখন বাঘের মুখের গন্ধে তার নাক চেপে ধরে রাখলো। কাঠুরিয়া যে বাঘের মুখের গন্ধে তার নাক চেপে ধরে রাখছে, তা দেখে বনের বাঘ মনে মনে খুবই কষ্ট পেলো। কিন্তু মনের কষ্ট কাউকে বুঝতে না দিয়ে কাঠুরিয়ার শরীর চাটতেই লাগলো। চাটতে চাটতে একসময় কাঠুরিয়া সত্যি অনেকটা সুস্থ হয়ে গেলো।

তারপর বাঘ কাঠুরিয়াকে জিজ্ঞেস করলো, “বন্ধু সত্যি করে বলতো এখন তোমার কেমন লাগছে?”

কাঠুরিয়া বললো, “সত্যি বলছি, বন্ধু। এখন আমার শরীরটা খুবই ভালো লাগছে। আমি মনে হয় সুস্থ হয়ে গেছি।”

কাঠুরিয়ার কথা শুনে বনের বাঘটা দুঃখ ভরা মনে আনন্দের অভিনয় করে জোরে একটা গর্জন করলো। সাথে সাথে সব বাঘেরা গর্জে উঠল। তারপর বন্ধু বাঘ কাঠুরিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সব বাঘ লাইন ধরে আবার বনে ফিরে গেলো।

তারপর চার-পাচ দিন পর কাঠুরিয়া কাঠ কাটার কুড়াল হাতে নিয়ে বনের দিকে রওনা দিলো। হাঁটতে হাঁটতে একসময় বনের সামনে পৌঁছাল। একটু সামনেই কাঠুরিয়া দেখতে পেলো, সেই বন্ধু বাঘটা অধীর আগ্রহে বসে আছে। তা দেখে কাঠুরিয়া ভাবলো, বন্ধু বাঘটা হয়তো আমার অপেক্ষায় বসে আছে।

কাঠুরিয়া বাঘের সামনে গিয়ে বললো, “কী ব্যাপার বন্ধু, মনখারাপ করে বসে আছো যে? এইতো আমি সুস্থ হয়ে আবার বনে এসেছি। সত্যি বন্ধু, তুমি যদি সেদিন আমার বাড়িতে গিয়ে আমার শরীর চেটে না দিতে, তাহলে হয়তো আমি মরেই যেতাম। সত্যিই তুমি আমাদের মানবজাতির ডাক্তারের চেয়েও ভালো ডাক্তার।”

কাঠুরিয়ার কথা শেষ হতেই বনের বাঘ জোরে একটা গর্জন করে বললো, “চুপ করো বন্ধু। এসব বলতে নেই। আমার কোনও গুণও নেই। আমি আমার মনের ধারণা থেকেই সেদিন মহান সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে তোমার পুরো শরীর চেটেছিলাম। তুমি সুস্থ হয়েছ, মহান সৃষ্টিকর্তার কৃপায়। এতে আমার কোনও অবদান নেই। তবে তুমি এখন পুরোপুরি সুস্থ, এতেই আমি খুশি। কারণ আমিতো তোমাকে বন্ধু বলে বারণ করেছিলাম, তাই। তো বন্ধু আজ তোমাকে আমার একটা কথা রাখতে হবে। যদি কথার বরখেলাপ করো, তাহলে আমি তোমাকে টেনেহিঁচড়ে খেয়ে ফেলবো।”

বাঘের কথা শুনে কাঠুরিয়া ভয়ে কাঁপতে শুরু করলো। কাঠুরিয়া কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞেস করলো, “বলো বন্ধু, আমাকে কী করতে হবে!”

বাঘ তখন বললো, “তোমার হাতের কুড়াল দিয়ে আমার মাথায় একটা কোপ দিতে হবে। এতে আমি বাঁচি বা মরি, তাতে তোমার কিছুই যায় আসবে না। তুমি দেরি না করে আমার মাথায় আঘাত করো।”

এই কথা শুনে কাঠুরিয়া মনে মনে ভাবলো, তাহলে তো ভালোই হয়! কুড়াল দিয়ে খুব জোরে আঘাত করলে তো বাঘ মেরেই যাবে। আর মরে গেলে প্রতিদিন বনের এই হিংস্র পশু বাঘের কাছে ধরনা দিতে হবে না। এমনকি বাড়ির খামারের ছাগলও দিতে হবে না। আমি আবার নিজের স্বাধীনভাবে বনে এসে কাঠ সংগ্রহ করে নিতে পারবো।”

কাঠুরিয়ার ভাবনা চিন্তার মাঝেই বাঘ গর্জন করে বললো, “কী ব্যাপার? তুমি থমকে আছো যে? তুমি আমার কথার বরখেলাপ করলে সত্যিই আমি তোমাকে খেয়ে ফেলবো।”

বাঘের কথা শেষ হতে-না-হতেই কাঠুরিয়া বললো, “ঠিক আছে বন্ধু। আমি তোমার কথার বরখেলাপ করবো না।”

এই বলেই হাতে কুড়াল দিয়ে বাঘের মাথায় খুব জোরে একটা কোপ দিলো। সাথে সাথে বাঘ মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। তা দেখে কাঠুরিয়া বন থেকে দৌড়ে তার নিজের বাড়িতে চলে গেলো।

বেশ কয়েকদিন পর কাঠুরিয়া মনের আনন্দে কুড়াল নিয়ে বনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। কাঠুরিয়া যাচ্ছে আর মনে বলছে, এতদিনে হয়তো বাঘ মরে কঙ্কাল হয়ে গেছে। আমি বরং বনে গিয়েই আগে বাঘের কঙ্কালটা দেখবো। তারপর নিজের কাজ করবো। এই বলেই গ্রামের ফসলী জমির আইল ধরে হেলেদুলে বনের সামনে যেতে লাগলো। বনের খুব সামনে যেতেই দেখে সেই ক্ষুধার্ত বাঘটা তারই অপেক্ষায় বসে আছে। বাঘকে দেখে কাঠুরিয়া যখন পেছনে ফিরে দৌড় দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন বাঘ লাফিয়ে এসে কাঠুরিয়ার সামনে দাঁড়ালো। তখন কাঠুরিয়ার তো জীবন যায় যায় অবস্থা।

কিন্তু বাঘ শান্ত স্বরে বললো, “এই কাঠুরিয়া, শুনো! আমি তোমাকে আজও কিছুই করবো না। তোমার কোনও ভয় নেই। তবে তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। কাজটা হলো, সেদিন তুমি যে তোমার হাতের কুড়াল দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করেছিলে, সেই আঘাতটা কোথায় করেছো তা দেখতে হবে।”

এই বলেই বাঘ তার নিজের মাথাটা কাঠুরিয়ার সামনে এগিয়ে দিয়ে বললো, “দেখ তো, সেদিনের সেই আঘাতের চিহ্নটা আছে কিনা? ভালো করে দেখে আমাকে বলো।”

কাঠুরিয়া ভয়ে ভয়ে বাঘের মাথায় হাত দিয়ে দেখে বললো, “বন্ধু, সেদিনের কুড়ালের আঘাত সেরে গেছে। কিন্তু সামান্য একটু দাগ এখনো আছে।”

বাঘ তখন শান্ত স্বরে বললো, “এই সামান্য দাগও একদিন-না-একদিন আমার শরীরের চামড়ার সাথে মিশে যাবে। সামান্য চিহ্নও থাকবে না। এখন বুজে কতবড় আঘাত আমি সইতে পারি।

“কিন্তু আমি যেদিন তোমার বাড়ি গিয়ে তোমার অসুস্থ শরীরটা চাটছিলাম, সেসময় আমার মুখের সামান্য গন্ধ টুকু তুমি সইতে পারনি। সেদিন আমি খুবই কষ্ট পেয়েছিলাম। আজ তুমি নিজেই দেখলে, তোমার করা কুড়ালের আঘাতের চিহ্ন আস্তে আস্তে মিশে যাচ্ছে। কিন্তু সেদিনের সেই মনোকষ্ট কোনদিন মিশে যাবে না। তাই তোমার সাথে আজ থেকে আমার বন্ধুত্ব শেষ! তুমি এখন যেতে পারো। আর হ্যাঁ, একটা কথা শুনে যাও! জীবনে কাউকে মনে কষ্ট দিও না। তোমার কারণে যদি কেউ মনে কষ্ট পেয়ে থাকে, তাহলে সেই কষ্ট সেই ব্যক্তির মনে চিরস্থায়ী হয়ে লেগে থাকে। তা জীবন থাকতে কোনদিন মন থেকে দূর হয় না। জীবন চলার মাঝে অনেক দুঃখ-কষ্টের শেষেও অনেকে সুখের নাগাল পায়। কিন্তু কেউ কারো দ্বারা মনে কষ্ট পেলে সেই কষ্ট শেষ হয় না।

এই বলেই বাঘ কাঠুরিয়ার কাছ থেকে বনের ভেতরে চলে গেলো। কাঠুরিয়াও লজ্জিত মনে তার নিজের বাড়ি ফিরে গেলো।

.
সমাপ্ত:

এক বিকেলের ভালো লাগা, সারাজীবনের স্মৃতি, পর্ব (২)

nitai-b

সেদিন বিয়ে সম্পাদন হতে রাত প্রায় শেষ হয়ে গেল। অমি আর কানাই সহ এলাকার আরো তিন চারজন বন্ধু বাড়ির বাহিরে পুকুরপাড়ে ছালার চট বিছাইয়ে বসে বসে গল্পগুজব করতে করতেই রাত শেষ করলাম ৷ মাঝে মাঝে ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করে কিরে, তোর কি একটুও খারাপ লাগছেনা? ওদের প্রশ্নের উত্তরের প্রত্যুত্তর দেই লাগলেই কী কিছু করা যাবে? এমন আরো কয়েকজনই সেদিন রাতে সামনে এসে এসে জিজ্ঞেস করলো, একই ধরণের কথা। সবাইকে একই উত্তর দিয়ে বিদায় দিলাম। আমার মা’ও সেদিন একটু ভয় পেয়েছিল আমার জন্য। খানিক পর পরই মা’ আমাদের কাছে এসে কানাইকে ডেকে শুধু আমার মনের গতিবিধি জানতো। কানাই মা’কে বুঝিয়ে শান্তনা দিত কিছুই হবে না মাসিমা। তুমি কোন চিন্তা করো না ঘরে যাও। কানাই এসে আবার আমার কাছে বলতো। মাসিমা এসে তোর খবর নিল, আমি বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিলাম। আর বলে দিলাম কোন চিন্তা যাতে না করে। চিন্তা তো করার কথাই, শত হলেও গর্ভধারিণী মা।

আমাদের হিন্দুধর্মের বিবাহ কয়েকটা পর্বে হয়ে থাকে। যার সবগুলো নিয়ম বর্তমানে বেশিরভাগ মানুষের বিবাহে ওইসব নিয়ম মানতে দেখা যায় না। বিবাহের পর্বগুলি (১) পাটিপত্র, (২) পানখিল, (৩) দধিমঙ্গল, (৪) গায়েহলুদ বা অধিবাস, (৫) শঙ্খ কঙ্কন বা সোনা’কাপড়, (৬) বর বরণ, (৭) শুভ দৃষ্টি, (৮) সাত পাক, (৯) মালা বদল, (১০) সম্প্রদান, (১১) অঞ্জলি, (১২) সিঁদুর দান, (১৩) বিবাহ অনুষ্ঠান, (১৪) বাসিবিবাহ। এইসব পর্বের ভিতরেও টুকিটাকি অনেক পর্ব আছে। যা একেক গোত্রের একেক নিয়মের পর্ব। মূলতঃ পর্ব দুইটা, প্রথম পর্ব হলো “বিবাহ অনুষীঠান” দ্বিতীয় পর্ব হলো “বাসিবিবাহ”। প্রথম পর্বে পুরোহিতের মন্ত্র দ্বারা মেয়ের পক্ষ থেকে কন্যাদান। ছেলের পক্ষ থেকে কন্যাকে গ্রহন করা। তারপর শুরু হয় ছেলে ও মেয়ের গুন জ্ঞানের পরীক্ষার খেলা। পাশাখেলা, আংটিখেলা, চাউল ছিটানীখেলা, মনিমনা খেলা। পরিশেষে সমাপ্তি ঘটে বাসিবিবাহের মধ্য দিয়ে।

ওইসব খেলায় উভয়ই জিততে হবে বা জিতার চেষ্টা করে। কেউ কারো কাছে হার মানতে নারাজ। ওইসব খেলার মধ্যে আংটিখেলা হলো অন্যতম। যে চারটে কলাগাছকে সাক্ষী করে ছেলে মেয়েকে সাতপাক ঘুরানো হয় বিয়েতে। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে, ওই কলাগাছের নিচে ছোট একটা চার কোনা পুকুর বানিয়ে সেই পুকুরে জল ঢেলে দেয়। তারপর ছেলের হাতের আঙ্গুলের শ্রীআংটিখানা সেই পুকুরপাড়ে লুকানো হয়। যা ছেলে লুকোয় তিনবার, আর মেয়ে লুকোয় তিনবার। একজন লুকাবে, অন্যজন বাহির করবে। তখন দেখা যাবে কে কতবার লুকানো আংটিখানা বাহির করতে পারলো। খেলায় যে এগিয়ে থাকবে সেই হবে বুদ্ধিমান। চাউল ছিটানো খেলা ৷ এই খেলাটি ও উভয় পক্ষের শান্তস্বভাব কেমন হবে সেই পরীক্ষা ৷ আংটি খেলার পর, ছেলে মেয়েকে নিয়ে যাবে একটা ঘরে ৷ সেই ঘরের মেঝেতে পাটি বিছাইয়ে সেই পাটি’র উপর বসবে ছেলে-মেয়ে আড়াআড়ি ভাবে। সেখানে থাকে একটা মাটির ঘটে কিছু চাউল ৷ ওই ঘটের চাউল ছেলে পাটি’র উপরে ছিটিয়ে দিবে। আর মেয়ে সমস্ত চাউলগুলি খুঁজে-খুঁজে ঘটে রেখে’ ঘটের ঢাকনাটা এমন ভাবে বসাতে হবে, যাতে করে কোন শব্দ না হয়। যদি শব্দ হয়, তবে গুরুব্যক্তিরা বুঝবে যে, মেয়ের হাঁটা-চলায় শব্দ হবে। এবং উৎপাত করবে বেশি। ছেলের বেলায়ও তাই। মেয়ে চাউলগুলি ঢেলে ছিটিয়ে দিবে, আর ছেলে চাউলগুলি উঠাবে, শব্দ যেন না হয়। মনিমনা খেলা” একটা বড় আকারের বলবাটিতে কিছু জল দিয়ে সেখানে ছেলের মাথার মুকুট থেকে একটু বস্তু ছিঁড়ে, মেয়ের মাথার মুকুট থেকে একটু বস্তু ছিঁড়বে। বস্তুগুলি ওই বলবাটির জলে ছেড়ে দিয়ে হাতে ওই জল ঘুরাইতে থাকবে। সেই সাথে ঘুরতে থাকবে ওই মুকুটের বস্তু দুইটি। বস্তু দুইটি ঘুরতে ঘুরতে যদি একসাথে জোড় লাগে, তবে লোকে বুঝবে স্বামী-স্ত্রী মিলেমিশে থাকবে চিরদিন। আরেকটি খেলা হচ্ছে পাশাখেলা” এখন এই খেলাটি নাই বললেও চলে। কেননা এই খেলাটি খুবই কঠিন খেলা ও হিসেবের খেলা। যা, আজকালকার ছেলেমেয়েদের মাথায় ঢুকে না। আসলে এটিই হচ্ছে বর-কনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ খেলা। এই খেলাটাকে বলা হয় “চতুরাজি” খেলা। এই খেলায় চারটে গুটি থাকে। অনেকটা দাবাখেলার মত। গুটিগুলির নাম: (১) বোড়ে বা রাজা, (২) নৌকা, (৩) ঘোড়া, (৪) গজ, প্রত্যেক দানে দুইটি পাশার গুটির জন্য দুইটি চাল দিতে হয়। বর্তমানে কোন কোন বিয়েতে পাশার পরিবর্তে কড়িখেলা খেলতে দেখা যায়। যে জিতবে সেই হবে বুদ্ধিমান। ওইসব খেলা থেকেই গুরুব্যক্তিরা বুঝে নিবে তাদের সংসার কেমন সুখের হবে। আর কে বেশি বুদ্ধিমান হবে, ছেলে না মেয়ে।

তারপরে হবে বর-কনের খাওয়াদাওয়ার পালা। সাথে থাকবে ছেলের বন্ধুবান্ধব ও জামাইবাবুরা। মেয়ের সাথে থাকবে, মেয়ের বান্ধবীরা বর বউদিরা ও বউদির বোনেরা। যাদের সাথে ঠাট্টাতামাশা করা যায়। আমাদের হিন্দুধর্মে বিয়ের দিন ছেলে এবং মেয়েকে উপবাস থাকতে হয়। বিয়ের প্রথম পর্ব শেষ না হওয়া পর্যন্ত। খাওয়াদাওয়ার জন্য ছেলে-মেয়েকে একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। বড় একটা কাঁসের থালা করে সবপদের তরকারি থালার চারদিকে সাজিয়ে দিয়ে, মাঝখানে দিলো ভাত। এটা হিন্দুধর্মীয় নিয়ম মত যেভাবে দেওয়া হয় ঠিক সেভাবেই দেওয়া হলো তাঁদের। সাথে আছে ছেলের ভগ্নিপতি ও সাথে আসা কয়েকজন বন্ধুবান্ধব। মেয়ের সাথে আছে মেয়েটার ছোট ভাই, ও শ্যামসুন্দর দাদার বাড়ির ভাড়াটিয়া কয়েকজন অল্পবয়সী মেয়ে। আর শ্যামসুন্দর দাদা স্ত্রী। ছেলেকে বসানো হলো এক পিঁড়িতে। তার বিপরীত দিকে এক পিঁড়িতে বাসানো হলো মেয়েকে। ছেলের বন্ধুবান্ধব ও ছেলের জামাইবাবু ভাত খাওয়ার জন্য খাবারে হাত দিলেও, মেয়েটা কিন্তু খাবারে হাত দিচ্ছে না। সবাই বলছে, খাও খাও কিছুতেই খাবারে হাত দিচ্ছেনা মেয়েটা। শ্যামসুন্দর দাদার স্ত্রী রেগে বলল খাওনা কেন? খাও তাড়াতাড়ি করে। খানিক পর সকাল হয়ে যাবে। শুরু হবে আবার বাসি বিয়ের কাজ। মেয়েটা বলল “মামি”, নিতাই দাদা কোথায়? ৷ নিতাই দাদা ছাড়া আমি খাবো না, মেয়েটার সোজা কথা। শ্যামসুন্দর দাদার স্ত্রী তো হতবাক! বলে কী? রেগে বলল। ওর কি পাত্তা আছে? তুমি খাও তাড়াতাড়ি করে। মেয়েটির এক কথা “মামি” নিতাই দা বাহিরে আছে। তাকে আসতে বললেই আসবে। নিতাই দা রাতে খায় নাই। শ্যামসুন্দর দাদার স্ত্রী মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলো। নিতাই রাতে খায়নি তুমি জানলে কী করে? মেয়েটি প্রত্যুত্তরে কিছুই বলল না, শুধু চুপ করে রইল। মেয়েটার অনুরোধে শ্যামসুন্দর দাদার স্ত্রী বাহিরে এসে, সোজা চলে আসলেন পুকুরপাড়। যেখানে আমরা থাকার কথা সেখানে। আমি আর কানাই সহ তিন চারজন বন্ধুবান্ধব মিলে কথা বলছিলাম তখন। এরমধ্যেই শ্যামসুন্দর দাদার স্ত্রী এসে আমার হাত ধরে টানতে লাগল। আমি বললাম বউদি, কী হয়েছে বলেন শুনি! বউদি কানাই’কেও বলছে। কানাই তুইও আয় ওর সাথে। বউদির সাথে খাবার ঘরে গিয়ে দেখি, খাবারের থালা মাঝখানে রেখে সবাই চুপচাপ বসে আছে। আমার বুঝতে আর বাকী রইল না, ঘটনা কী হয়েছে। বউদি বলল কানাইকে নিয়ে মেয়েটার সাথে বস ভাত খেতে। তোদের ছাড়া ও খাবে না, তাই তোদের এখানে টেনে আনলাম, বস-বস তাড়াতাড়ি। কানাই বসলো, আমিও বসলাম কানাই’র সাথে। দেখলাম মেয়েটা কানাইকে কানে-কানে কী যেন বলল। কানাই আমাকে বলল, তুই ওকে প্রথম খাইয়ে দিবি, তারপর ও খাবে। ছেলে পক্ষের সবাই শুধু আমাদের দিকেই তাকাচ্ছিল। কিন্তু কেউ কিছুই বলছেনা। কানাই’র কথা শুনে আমার বিষণ লজ্জা হচ্ছিল। আবার খারাপও লাগছিল। ছেলের পক্ষের কেউ যদি আবার মেয়ে’টাকে সন্দেহের চোখে দেখে! তাই খারাপ লাগছিল। এরপর সবাই বলল, দাদা শুরু করুন সকাল হয়ে গেল। আর কী করা, ভাত মেখে মেয়েটার মুখের সামনে নিতেই, কেঁদে দিল হাউমাউ করে। ওর কাঁদা দেখে আমি কি ঠিক থাকতে পারি? আমিও কাঁদছি। আমার কাঁদা দেখে কানাইও কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতেই বললাম, নাও সারাদিন তো কিছুই খাওনি এখন খাও, আমি খাওয়াইয়ে দিচ্ছি। সবাই বলল খাও-খাও, মেয়েটা আমার হাত ওর দুহাত দিয়ে ধরে, আমার হাতের খাবারগুলি ওর মুখে নিয়ে খাচ্ছে। আবার মেয়েটা ভাত মেখে আমার মুখের সামনে এনে আমাকে খাওয়াইয়ে দিতে চাচ্ছে। এমন সময় আমি ওর দুহাত ধরে বললাম। আগে তোমার স্বামীর মুখে দাও, তারপর আমাকে খাওয়াবে। মেয়েটি আমার কথা মত ওর স্বামীকে খাওয়াইয়ে দিয়ে, পরে আমাকে খাইয়ে দিল। আমিও ওর স্বামীকে ভাত মেখে খাওয়াইয়ে দিলাম। কানাই তখন খুশিতে হাততালি দিতে লাগল। কানাইর দেখাদেখি উপস্থিত সবাই হাততালি দিতে শুরু করল। কেউ কেউ আবার বলছে, একথা আগে বললেই হতো। এভাবেই সেদিন বর-কনের খাওয়াদাওয়ার পর্বটা শেষ করলাম। ওকেও খাওয়ালাম নিজেও খেলাম।

তারপর শুরু হয় দ্বিতীয় পর্ব। দ্বিতীয় পর্ব হলো বাসিবিয়ে। অর্থাৎ পুরোহিতের মন্ত্র দ্বারা ছেলে ও মেয়েকে সূচিত করা বা শুদ্ধ করা। এটা ঠিক সূর্য উদয়ের সাথে সাথে হয়ে থাকে। বাসিবিয়ের বাজনা যখন বাজছিল, তখন বুঝতে পারলাম এই বাজনা বিবাহের শেষ পর্বের। ভাবছিলাম মনে মনে। এমন সময় কানাই আমাকে বলল, চল বিয়ে প্রায় শেষ। বাসিবিয়েটা দেখে আসি। আমি যেতে চাচ্ছিলাম না, কানাই একপর্যায়ে জোর করে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেল। সাথে আছে চার পাঁচজন বন্ধুবান্ধব। সবাই একসাথেই বাড়ির ভিতরে ঢুকলাম। পুরোহিত মহাশয় মন্ত্রপাঠ করছে। আরেক দিকে বাজনাও বাজাচ্ছে জোরে-সোরে। কানাই ও সাথের বন্ধরা বাজনার তালে-তালে নাচতে লাগলো। ওরা নাচছে আর আমাকেও ওদের সাথে নাচার জন্য টানছে। ওদের টানের সাথে সাথে আমার পিছন থেকেও আমাকে ধাক্কাচ্ছে, ওদের সাথে নাচার জন্য। উপায়ান্তর না দেখে আর কী করা ! নাচতে লাগলাম সবাই মিলে। একপর্যায়ে বাসি বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সমাপ্তি ঘোষণা করল পুরোহিত মহাশয়। কিন্তু আমাদের নাচ তো থামছে না। বাড়ির সবাই তখন আমাদের সাথে নাচতে লাগলো। সাথে মহল্লার লোকও যোগ দিলো। বাজনাবাদকেরা বাজনা আর বাজাবেনা বলে বাজনা বন্ধ করে দিল। নাচ থেমে গেল সকলের। তখন সবাই ক্ষেপলো বাজনাবাদকদের উপর। বাজনা আরো বাজাতে হবে‌, বিনিময়ে তাদের আরো বেশি টাকা দেওয়া হবে। এই আশ্বাসের পর আবার শুরু হলো বাজনা। সকলে শুরু করলো নাচ, অনেকক্ষণ পর্যন্ত নাচ চলছিলো বাসি বিয়ের সময়। বাসি বিয়ে বলতে, ছেলে মেয়েকে স্নান করানো একটা পর্ব। স্নান করাইয়া পবিত্র করা বা শুদ্ধ করা। দুজনকে দুই পিঁড়িতে দাঁড় করে, পুকুর থেকে কলশী দিয়ে জল আনবে। পুরোহিত মন্ত্রপাঠ করবে, আর কলশীর জল দুজনের মাথায় ঢালবে। এভাবে স্নান করানোর সময় আমরা নাচছিলাম। আর মেয়েটা সেই নাচের দৃশ্যগুলি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল।

বাসিবিয়ের আনুষ্ঠানিকতার শেষে আমি কানাইকে বলছি। আজতো কাজ করতে পারবো না কানাই। সারারাত ঘুমাইনি, কাজ করবো কী ভাবে। কানাই বলল, তাহলে মিলের কাজ করবে কে? ম্যানেজার রাগ করবে। আমি বললাম তুই মিলে গিয়ে ম্যানেজারকে বলবি ওস্তাদ অসুস্থ, লাঞ্চের পরে আসবে। কানাই বলল, আচ্ছা ঠিক আছে, যাবো আট ঘটিকার সময়। তুই এখন বাসায় গিয়ে ঘুমা, আমিও একটু ঘুমাবো। সারারাত’তো আর ঘুমানো হয়নি।

এসব বলতে বলতে শ্যামসুন্দর দাদা, ও বউদি পুকুরপাড় এসে, আমাকে আর কানাইকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন। আমরা খাওয়াদাওয়া করছি কি না। কানাই বুদ্ধি করে বলল, হাঁ দাদা, আমরা খাওয়াদাওয়া করেছি। আপনারা দুজনে খাওয়াদাওয়া করেছেন তো? শ্যামসুন্দর দাদা বললেন, হ্যাঁ করেছি কোনরকম। আর শোন, কিছুক্ষণ পরে তো ওকে জামাইদের ওখানে নিয়ে যাবে। নিতাই সহ তোরা উপস্থিত থাকিস কেমন ! কানাই বললো, দাদা আপাতত ওকে নিয়ে জামাই কোথায় উঠবে? শ্যামসুন্দর দাদা বললেন, আপাতত শহরের মাসদাইরে উঠবে ওরা। ওখানে জামাইর কাকা থাকে। ওদের বাপদাদার ভিটেবাড়ি কুমিল্লা। ছেলেটা একটু সোজা রকম’তো তাই, আমার দোকানেই রেখে দিব। আর মেয়েটা’তো আমার এখানে থাকবেই। ওদের আলাদা একটা ঘর বানিয়ে দেওয়ার, চিন্তাভাবনা করছি। আটনাইয়রীর পর আর যেতে হবেনা ওদের। আমার বাড়িতেই থাকবে ওরা। শ্যামসুন্দর দাদা বললেন, আর আমি শুধু শুনছিলাম। আমাকে কিছু জিজ্ঞেসও করেনি, আমিও কিছু বলিনি। শ্যামসুন্দর দাদা চলে গেলেন, বাড়ির ভিতরে। দাদার সাথে সাথে বউদিও চলে গেলেন। একটু পরে মেয়েটি পুকুরপাড় এসে আমাদের দেখে সামনে এসে বললো। সারারাত হয়তো ঘুমানো হয়নি আপনাদের। তারপরেও এখনো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন দুজনে? ঘুমাননি তো বেশ করেছেন। কিছুক্ষণ পরে আমাকে হয়তো নিয়ে যাবে তাদের বাড়িতে। যাওয়ার সময় যেন ডাকতে নাহয়। যা চেয়েছিলাম তাতো আর পাওয়া হলো না। না পেলাম দুঃখ নেই, কোনদিন সামনে থেকে তাড়িয়ে দিবেন না, কথা দিন ! আমি আর ওর সাথে কথা বলতে পারছিনা। ওর কথা শুনে আমার কান্না আসতে লাগল। মেয়েটি আমার দুহাত ধরে কথাগুলি বলছিল। হাত আর ছাড়ছে না, ধরেই রাখছে। আমার অবস্থা টের পেয়ে কানাই বলল, আচ্ছা ঠিক আছে তুমি এখন বাড়ি যাও। মেয়েটি বলল, দাদা কিছু বলছেনা কেন? তখন আমি মেয়েটাকে বললাম। তুমি বলছো তোমাকে কথা দিতে হবে, কোনদিন সামনে থেকে যেন তাড়িয়ে না দেই। এটা কী করে সম্ভব? আমি এবাড়ির ভাড়াটিয়া। আজ আছি, কাল এখানে না ও থাকতে পারি। তুমিও এখানে চিরদিন থাকতে তো পারবেনা। একদিন না একদিন, তোমাকে অন্যত্র চলে যেতে হবে। তাহলে তোমাকে আমি কী করে কথা দেই বলো? তবে তোমায় আমি কথা দিলাম। আমি এই পৃথিবীতে যতদিন বাঁচবো, ততদিন তুমি আমার এই অন্তরেই থাকবে সারাজীবন, যাও কথা দিলাম। আমার কথা শুনে মেয়েটি তখন কান্নাকাটি শুরু করে দিল, হাউমাউ করে। ওর কান্না আর থামছে না। আমি মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম। এখন তুমি কান্নাকাটি করলে, লোকে আমাকে কী ভাববে বলো? তখন মেয়েটি আমার দুহাত ছেড়ে দিয়ে বললো। চিরদিন আপনিও আমার অন্তরে থাকবেন। আজ বিদায় বেলা যেন সামনে পাই। এই কথা বলে মেয়েটি চলে গেল বাড়ির ভিতরে।

আমরা দুজনে রওনা হলাম, কোন এক চা’ দোকানের উদ্দেশে। কানাই শুধু বলল, নিতাই অবস্থা বেগতিক। কানাই’র কথায় কোন উত্তর দিলাম না। সোজা হাঁটতে লাগলাম, দোকানের উদ্দেশে। সকাল দশটায় আটজন বরযাত্রী সহ, জড়ো হলো পুকুরপাড়, রিকশার জন্য। পাঁচটা রিকশার দরকার ওদের। দুইটা পেয়েছ, আরো লাগবে তিনটে। যেকোন মেয়েদের বিয়ে দিলে, স্বামীর বাড়ি যাওয়ার সময়, সব মেয়েরাই কান্নাকাটি করে। যাওয়ার আগে মেয়েটিও কাঁদছে। বাড়ির সবাই কাঁদছে পুকুরপাড় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। এমন সময় কানাই আর আমি, দোকান থেকে আসছি। দূর থেকে দেখি পুকুরপাড়ে অনেক লোকের সমাগম। কানাই বলল, মেয়েটা মনে হয় জামাইবাড়ি যাচ্ছে, চল শিগ্‌গির। কানাইকে বললাম, তুই যা আমি বরং মিলের দিকে যাই। কানাই বলল, কেন? তোকে না মেয়েটি বলছে, যাওয়ার সময় সামনে থাকতে? তোকে না দেখলে তো আবার কান্নাকাটি শুরু করে দিবে। আমি বললাম, শোন কানাই। বিদায় বেলা যদি সামনে থাকি, ও আরো কান্নাকাটি বেশি করবে। তখন ওর জামাইবাড়ির লোকজন, ওকে সন্দেহের চোখে দেখবে সবসময়। তুই বরং ,সামনে থেকে ওকে একটু বুঝিয়ে বলিস। যে, নিতাই’র মিলে খুব কাজ ছিল বিধায়, ও তাড়াতাড়ি মিলে গেছে। কাজটা সেরে আসতে সময় লাগতে পারে। তুই যেভাবে পারিস ওকে ম্যানেজ করবি। কানাই’তো আমার কথায় একটুও এদিক সেদিক করবে না করেও না। কানাই সোজাসুজি চলে গেল পুকুরপাড়ে। যেখানে জামাই সহ, মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। রিকশা পাঁচখানা রেডি, সবাই রিকশায় উঠে বসে আছে। মেয়েটা শুধু ওর মা’ আর ছোট ভাইটাকে ধরে কাঁদছে। কানাইকে দেখেই মেয়েটা বলল, কানাই’দা নিতাই দাদা কোথায়? কানাই ওকে উদ্দেশ্য করে মুখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝালো চুপ। মেয়েটি চুপকরে কানাই’র দিকে তাকিয়ে বলল কী? কানাই তখন মেয়েটাকে একটু দূরে টেনে নিয়ে বলল, আমার শিখানো কথাগুলি। কানাই’র কথা শুনে মেয়েটা আরো জোরেসোরে কাঁদতে লাগল। কানাই আর শ্যামসুন্দর দাদার স্ত্রী মিলে, ওর হাত ধরে, জামাই’র সাথে রিকশায় বসিয়ে দিয়ে, সব রিকশাওয়ালাদের যেতে বলল। রিকশা যাচ্ছে,আর পিছন ফিরে তাকাচ্ছে বারবার। আমি দূর থেকে কাঁদছি, আর ওর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি চুপিচুপি ৷

কানাই এসে আমাকে বলল, আয় ঝামেলা শেষ। তুই বাসায় গিয়ে ঘুমা, আমিও বাসায় গিয়ে কিছু খাওয়াদাওয়া করে, খানিক পর, মিলে যাব ম্যানেজারকে বলতে। কানাইকে জিজ্ঞেস করলাম, কী বলেছে মেয়েটা? কানাই বলল, কিছু বলার সুযোগ দেইনি, শুধু তোর দেয়া, মন্ত্রপাঠ করে বিদায় দিলাম। ওতো আবার কাল না হয় পরশু আসবে। আড়াই দিনের একটা নিয়ম তো আছে। কানাই গেল বাসায়, আমিও বাসায় এসে স্নান করে, মায়ের দেওয়া কিছু খাবার খেয়ে ঘুমালাম। সেই ঘুমেই রাত পাড় করলাম, কেউ আর সেদিন আমাকে ডাকও দেয়নি। একদিন পরেই ঠিক বিকালবেলা, মেয়েটি জামাই নিয়ে শ্যামসুন্দর দাদার বাড়ি আসলো, আড়াই দিনের নিয়ম পালন করার জন্য। আমি আর কানাই মিলে কাজ করছিলাম। ছোট দুইটা বাচ্চা ছোলে মিলে গিয়ে দারোয়ানকে বলল, আমাকে ডেকে দিতে। দারোয়ান গিয়ে বলল, বাবু তোমার লোক এসেছে গেইটে। বলালাম, ভিতরে আসতে বলেন কাকা। দারোয়ান কাকা ওদের নিয়ে ভিতরে আসলো। ওরা আমার কাছে গিয়ে বলল, কাকা তোমায় ডাকছে দিদি, শিগ্‌গির আস আমাদের সাথে। কানাই রাগ করে ওদের বলল, যা’ গিয়ে বল আসতে দেরি হবে, কাকা কাজে ব্যস্ত। আমি আর কিছু বললাম না বাচ্চা দুটোকে, ওরা মিল থেকে বাড়ি চলে গেল, আমরা কাজ করছি। ছুটি হবে রাত আটটায়। এখনো তিন ঘন্টা বাকী? আমার আর ভাল লাগছিল না, শুধু ওকে দেখতে মন চাইছে। কানাইকে বললাম আজ আর কাজ করতে মন চায় না, ম্যানেজার সাহেবকে বলে বাসায় যাব। কানাই আর উত্তর দেয়নি আমার কথায়, ম্যানেজারকে বলে মহল্লায় ফিরলাম, বাসার সামনে এক বন্ধুর মুদিদোকানে দাঁড়ালাম আমি আর কানাই। পুকুরপাড়ের দিকে তাকাচ্ছি ওকে দেখা যায় কিনা, দোকানদারের সাথে কথা বলতে বলতেই দেখি পুকুরঘাটে কী যেন করছে। কানাই আমাকে বলল, ওই দেখ তোর …., আমি কানাইকে ইশারায় বলালাম দেখেছি তো! কানাই বলল, যা, গেলাম সামনে, মেয়েটি আমাকে দেখেই একটা হাসি দিয়ে বলল, পরশুদিন ছিলেন না যে? বললাম কাজ ছিল বিস্তর তাই। কেমন আছো তুমি? বলল, ভালও আছি খুব, মনে শান্তি নেই। বললাম শান্তিও হয়ে যাবে আস্তে আস্তে, সংসার করতে থাক মনস্থির করে সব ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করো না।

ওর সাথে কথা বলছিলাম আর শ্যামসুন্দর দাদা দূর থেকে দেখছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, আমি বাসায় গেলাম, মা’ আমাকে বলল, আজ এত তাড়াতাড়ি বাসায় আসলি? মিলে কাজ কম? তো শোন! মেয়েটা বাড়িতে এসেছে, ওর সাথে কথা কম বলবি যাতে কলঙ্ক না হয়। বললাম কেন মা’ কিছু হয়েছে নাকি? মা’বললেন না, আমি’ই বললাম কারণ: মেয়েটার বিবাহ হয়েছে, পরের ঘর, কখন কোন কথা উঠে যায় কে জানে! আমার বিষণ ভয় হয়। বললাম না মা’ তুমি কোন চিন্তা করবেনা, ভয়ের কোন কারণ নাই, তোমার ভয় যাতে না হয়, প্রয়োজনে বাসা বদলে ফেলব। খানিক পর শ্যামসুন্দর দাদা বউদিকে সাথে নিয়ে আমার বাসায় এসে বসলো, আমাকে বলছে তোকে কিছু বলবো বলে আসলাম। আমি বললাম বলেন কী বলবেন! দাদা বললেন মেয়ে’টাকে তো বিয়ে দিয়েছি! মেয়ে’টা এখন পরের ঘরের রমণী, তোর সাথে কী সম্পর্ক সেটা আমি জানিনা, তবে তোর কারণে যদি ওর কোন সমস্যা হয় তবে তোকেই তো এর দায়দায়িত্ব বহন করতে হবে। আমি বলালাম দাদা, এখন আপনি ও বউদি কী বলতে চাইছেন সেটা বললেই হবে। দাদা বলল, ওর সাথে তুই কোন কথাই বলবি না। আমি বুঝতে পারলাম, তাদের মনে সন্দেহের ডানা মেলেছে নতুন করে, এখানে আর থাকা যাবে না, বাসা ছেড়ে দিব শীঘ্রই। দাদাকে বললাম দাদা, আমি কথা দিলাম ওর সাথে আমার যদি কোন কথা হয় তা হয় খনিকের জন্য, এতে ওর কোন অসুবিধা হবে না, আপনি ও বউদি নিশ্চিত থাকুন। শ্যামসুন্দর দাদা ও বউদি চলে হেলেন বাসায়, আমি মা’কে বললাম সামনের একমাস এখানে থেকে বাসা ছেড়ে দিবো। মা’ রাজি হয়ে বলল, তাই কর আমার মোটেই ভাল লাগে না, মেয়েটার বিয়ের পর থেকে।

তাই করলাম, বাসা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তটি দাদাকে জানিয়ে দিলাম খুব গোপনে, যাতে মেয়েটি জানতে না পারে। আড়াই দিনের নিয়ম করে যাওয়ার দিন আর দেখা করি নাই, লোকচক্ষুর ভয়ে, আটনাইয়রীর বেলায় ও খুব কম কথা বলেছি মেয়েটার সাথে, আটনাইয়রীর আসার পর, মেয়ে’টির জামাই সহ এই বাড়িতেই থেকে গেল, জামাই আমাকে দেখলে খুব সম্মান করতো। হয়তো মেয়েটাই বলে দিয়েছিল জামাইকে, জামাইটা সোজা মানুষ, যে যাই বলে তাই শুনে। এই বাড়িতে থাকবো আর কয়েক মাস, আমার একটা চাকরি হওয়ার কথা ফরিদপুর রাজবাড়ির গঙ্গাবর্দি, সেখানে গেলে তো আর মা’কে সাথে করে নেওয়া যাবে না, মা’ থাকবে বড়দাদার সাথে, আমি কানাইকে নিয়ে চলে যাবো ফরিদপুর গঙ্গাবর্দি কানাইপুর হাঁট সংলগ্ন। যা কথা তাই করলাম, চাকরিটা খুব জোর দিয়েই ঠিক করলাম শুধু মেয়েটিকে ভুলে থাকার জন্য, আমার দ্বারা মেয়েটার যাতে কোন কলঙ্ক না হয় সেই জন্য। আমার বড় দাদাকেও মা’ সব খুলে বলেছে, আমার দাদাতো রেগে অস্থির। দাদা মা’কে বারবার বলছে তাড়াতাড়ি বাসা ছেড়ে দিতে, না হয় বিপদ সম্মুখে। মেয়েটি জানতে পারলো যে আমি বাসা ছেড়ে দিচ্ছি অতি শীঘ্র, একদিন মেয়েটি আমাকে পুকুরপাড়ে একা পেয়ে বললো, আমার ভয়ে আপনি বাসা ছেড়ে দিচ্ছেন কেন? আমিতো আপনার কোন ক্ষতি করিনি, আর করবও না কোন দিন, শুধু চোখের সামনে আপনাকে চুপিচাপি একনজর দেখতে পারলেই শান্তি পাই। আমি মেয়েটিকে বুঝিয়ে বললাম যে, দেখ আমি চাকরিজীবী মানুষ, একেক সময় একেক জায়গায় আমার চাকরী করতে হয়, তোমার ভয়ে নয়, চাকরি করে তো চলতে হবে বলো! আর মাত্র পনের ষোল দিনের মধ্যেই আমি আর কানাই ফরিদপুর যাচ্ছি, তুমি আমাকে ভুল বুঝবেনা। মেয়েটি আর কোন কথা না বলে সোজা চলে গেল বাসায়, আমি আর কানাই, এই মাস শেষ না হতেই ফরিদপুরে যাবো, বড় দাদাকেও বলা হয়েছে আগে। আমরা ফরিদপুর যাওয়ার পর মা’ চার পাঁচদিন এই বাড়িতে থাকবে, তারপর দাদা বাসার মালামালগুলি দাদার বাসায় নিয়ে যাবে ভ্যানগাড়ি দিয়ে।

সেদিন ছিল শুক্রবার, ফরিদপুর যাবো কানাই আর আমি, নাইট কোচে যাবো বলে বিকালবেলা থেকেই প্রস্তুতি চলছিল আমাদের। বিকালবেলা মেয়েটি তিনবার জিজ্ঞেস করেছিল, ভুলে যাবেন না আমাকে। আপনি তো আমাকে কথা দিয়েছিলেন, সারাজীবন অন্তরে ঠাঁই দিবেন। বললাম সারাজীবন আমার অন্তরে থাকবে তুমি, এটাই সত্য চিরসত্য। রিকশায় উঠলাম আমি আর কানাই। আমার মা’,কানাই’র মা’, আমাদের বিদায় দিচ্ছে। তাদের সাথে মেয়েটিও আমাদের বিদায় দিলো। তারপর ফরিদপুর থেকে কানাই আর আমি পাঁচ মাস পর ছুটিতে আসলাম। আমি আমার বড় দাদার বাসায় না গিয়ে, কানাই’র সাথে সোজা সেই মহল্লায় গেলাম, মেয়েটিকে দেখবো বলে। দুঃখের বিষয়, মেয়েটি একমাস আগে শ্যামসুন্দর দাদার স্ত্রীর সাথে ঝগড়া করে, জামাই নিয়ে এই বাড়ি থেকে মেয়েটির জামাই’র বাড়ি কুমিল্লা চলে যায়। এইসব কথাগুলি কানাই’র মা,’ মাসিমার কাছ থেকে সেদিনের শোনা। ওই দেখার পর শুধু লোকমারফত খবরাখবর নিতাম, জানা শোনা লোকের কাছ থেকে। কেমন আছে মেয়েটি? ভাল আছে। দুই সন্তানের জননী, শুনতাম লোকের মুখে।

১৯৮৬ সালের শেষদিকের কথা, তখন আমি সবেমাত্র বিয়ে করছি। একদিন বিকেলবেলা গিয়েছিলাম নারায়নগঞ্জ শহরে, নিজের একটা কাজের জন্য। কালিরবাজার, কালীমন্দিরের সামনে রিকশা থেকে নেমে, রিকশা ভাড়া দিচ্ছিলাম রিকশাওয়ালাকে। এমন সময় একটা শিশুবাচ্চা কোলে করে একজন মহিলা, আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আমি রিকশা ভাড়া দিয়ে চলে যাচ্ছিলাম মহিলাকে পাশ কেটে। মহিলা, আমার পিঠে টোকা দিয়ে বলছে, কেমন আছেন? তাকিয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ মহিলার দিকে। বলল, চিনেন না? আমি সেই মেয়েটি। অবাক দৃষ্টিতে আরো কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললাম তুমি সেই ! বলতে বলতেই কেঁদে কেঁদে বললো, হ্যাঁ আমি ! বললাম কোলে? বলল, আমার ছোট ছেলে, বড়ো একজন আছে ! ওর মুখে প্রসাদ দিবো বলে কালীমন্দিরে মানস করেছিলাম। তাই কাকা শশুরের বাসা থেকে এখানে আসলাম। জিজ্ঞেস করলো, বিয়ে করেছেন? বললাম কেবল মাত্র তিনমাস হলো করেছি। আমার সাথে সেদিন ছিল মাত্র চারশ টাকা। সেখান থেকে দুইশ টাকা, ওর ছেলের হাতে দিয়ে বললাম। তোমার কাকা শশুরের বাসার ঠিকানাটা দাও, আমি আগামীকাল তোমার সাথে দেখা করবো। আমার হাত ধরে বললো, না’ না’ তাদের বাসার ঠিকানায় আপনি গেলে তাঁরা সন্দেহ করবে আমারও সমস্যা হবে। আর আমিতো আজকেই বাড়ি চলে যাচ্ছি। এমনিতেই আর বেশিদিন হয়তো থাকবো না, কাকা শশুর সহ সবাই মিলে বাড়ি বিক্রী করে দিবে বলে শুনছি। হয়তো ওপারে হতে পারে আমাদের গন্তব্য। আমার ঠিকানাটা লিখে দিয়ে বললাম চিঠি দিও মাঝে মাঝে। মন্দিরের ভিতর থেকে ডাক পড়ল ওর, বললো যাই, ভালো থাকবেন আর মনে যেন থাকে ! আমিও ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসলাম। আরো অনেক কথাই হলো, শুনলাম, বুঝলাম ওর কথায় জীবন মানেই যন্ত্রণা, শুধু ভালো লাগার কারণে। যেই কাজের জন্য শহরে গিয়েছিলাম, সেই কাজ আর হলো না সেদিন। তারপর লোক মারফত কিছু পাঠাতাম কয়েক বছর, আমার দেয়া কিছু পেলে মেয়েটি যেন আকাশের চাঁদ পেল হাতে, যেই লোক মারফত পাঠাতাম সেই লোক ফিরে এসে আমার কাছে বলতো। এখন আর কাউকে পাই না যে, কিছু পাঠাবো ওর জন্য। আছে কী নেই তাও জানিনা, চার-পাঁচ বছর ধরে খোঁজ নিতে পারি না। এখন আরো বেশি মনে পড়ে মেয়েটিকে। চোখ বুজলেই দেখি যেন সামনে দাঁড়িয়ে বলছে, আমাকে সারাজীবন আপনার অন্তরে রাখবেন বলছিলেন,রেখেছেন কিনা জানিনা। আমি রেখেছি আপনাকে আমার হৃদয়ে যতন করে, ভুলবো না কোনদিন।

আমরা যা করতে পারি!

1600330429

১) আমরা শুরু করি, সংসার করি, ঘর করি,
বাড়ি করি, গাড়ি করি, প্রেম করি,
পিরিতি করি, বিয়ে করি, শাদি করি,
নিকা করি, চাকরি করি, ব্যবসা করি,
বাণিজ্য করি, জায়গা করি, জমি করি,
খরচ করি, হিসাব করি, নিকাশ করি,
বিকাশ করি, ভব করি, ভাবও করি,

২) চাষ করি, বাস করি, জপ করি
তপ করি, ধ্যান করি, ভাণ করি,
বিক্রি করি, খালাস করি, তালাশ করি,
খোঁজ করি, গ্রহণ করি, ত্যাগ করি,
দর করি, দরাদরি করি, দরকষাকষি করি,
মুলামুলি করি, কান্নাকাটি করি, আহাজারি করি,
উপকার করি, অপকার করি, সর্বনাশও করি,

৩) হানা করি, মানা করি, ক্ষমা করি,
কষ্ট করি, দুঃখ করি, সুনাম করি,
দুর্নাম করি, ক্ষতি করি, মতি করি,
বেঈমানি করি, হিংসা করি, অহংকার করি,
মারামারি করি, গালাগালি করি, খুশি করি,
বদনাম করি, তুচ্ছ করি, তাচ্ছিল্য করি,
ঘৃণা করি, জ্বালাতন করি, বকবকও করি।

৪) অপমান করি, অপদস্থ করি, হেনস্তা করি,
হেলা করি, খেলা করি, বেলা করি,
হৈচৈ করি, হৈ হৈ করি, হৈ হুল্লোড় করি,
চিল্লাচিল্লি করি, চিৎকার করি, গণ্ডগোল করি,
সমস্যা করি, সমাধান করি, আলোচনা করি,
সমালোচনা করি, গিবত করি, কুটনামি করি,
অবহেলা করি, স্বীকার করি, অস্বীকারও করি,

৫) দল করি, দলবাজি করি, দালালি করি,
দলাদলি করি, মিল করি, বেমিল করি,
চিন্তা করি, ভাবনা করি, বুদ্ধি করি,
সিদ্ধি করি, সুবুদ্ধি করি, কুবুদ্ধি করি,
ফন্দি করি, সৎ কর্ম করি, অসৎ কর্ম করি,
দলিল করি, কাবিন করি, রেজিস্টার করি,
পোস্ট করি, বড় করি, ছোটও করি।

৬) মিলন করি, মেলা করি, কম করি,
বেশি করি, ঘেনঘেন করি, পেঁনপেঁন করি,
শব্দ করি, জব্দ করি, খেয়াল করি,
খামখেয়ালি করি, সঞ্চয় করি, রপ্ত করি,
তপ্ত করি, শয়তানি করি, দুষ্টামি করি,
ন্যায় করি, অন্যায় করি, চুরি করি,
ডাকাতি করি, খুন করি, গুমও করি,

৭) লেখাপড়া করি, পাস করি, ফেল করি,
মাস্টারি করি, প্রশ্নপত্র ফাঁস করি, বদমাশি করি,
ইমামতি করি, ইয়ার্কি করি, ফাজলামি করি,
বেয়াদবি করি, বিচার করি, বিবেচনা করি,
সম্মান করি, অসম্মান করি, গুণ্ডামি করি,
জুলুম করি, লুচ্চামি করি, রুস্তমি করি,
মাস্তানি করি, নির্যাতন করি, অত্যাচারও করি।

৮) অভিনয় করি, নাটক করি, শুটিং করি,
ভুল করি, ত্রুটি করি, ভণ্ডামি করি,
ঝগড়া করি, দেন করি, দরবার করি,
কারবার করি, মীমাংসা করি, সাধন করি,
সাধনা করি, বাসনা করি, কামনা করি,
আক্ষেপ করি, অপেক্ষা করি, আফসোস করি,
হায়হুতাশ করি, ষণ্ডামি করি, কোলাকুলিও করি।

৯) আমরা গর্ব করি, দর্প করি, খর্ব করি,
গল্প করি, গপ করি, গজব করি,
চেষ্টা করি, অপচেষ্টা করি, ত্রাস করি,
সন্ত্রাসী করি, গায়েব করি, গোপন করি,
কানাকানি করি, হানাহানি করি, মান করি,
মানহানি করি, ইজ্জত করি, বেইজ্জত করি,
আদর করি, কদর করি, সমাদরও করি।

১০) দাহ করি, দাপন করি, কাফন করি,
পূজা করি, রোজা করি, উপোষ করি,
কীর্তন করি, এবাদত করি, বন্দেগি করি,
মানস করি, তপস্যা করি, গোস্বা করি,
রাগ করি, আপ্যায়ন করি, গরিমা করি,
অভিমান করি, উপহাস করি, পছন্দ করি,
অপছন্দ করি, ঘৃণা করি, জিনাও করি।

১১) ভিক্ষা করি, খয়রাত করি, ভরাত করি,
দ্বার করি, কর্জ করি, দেনা করি,
ঋণ করি, শোধ করি, বোধ করি,
গোসল করি, স্নান করি, গান করি,
পান করি, রোপণ করি, বপন করি,
গোপন করি, আত্মগোপন করি, ক্ষোভ করি,
প্রতিবাদ করি, আঘাত করি, জখমও করি।

১২) ইচ্ছা করি, দখল করি, বেদখল করি,
বাহাদুরি করি, নষ্ট করি, স্পষ্ট করি,
চুপ করি, জবাই করি, খতম করি,
কুরবানি করি, সাহস করি, ভয় করি
সমান করি, লেভেল করি, ঢালাই করি,
ক্ষমা করি, ওচা করি, নেচা করি,
হায়হায় করি, তর্ক করি, বিতর্কও করি।

১৩) খাইখাই করি, নাইনাই করি, মজা করি,
হামলা করি, মামলা করি, পূর্তি করি,
রঙ্গ করি, তামাসা করি, কান্না করি,
কান্নাকাটি করি, ইতরামি করি, নেশা করি,
পেশা করি, গোলামি করি, ধূমপান করি,
আহার করি, চা পান করি, জলপান করি,
চোখরাঙা করি, সোঝা করি, বেঁকাও করি।

১৪) ফ্যাশন করি, স্টাইল করি, বাহানা করি,
সাজ করি, ভাজ করি, ঠাট্টা করি,
মশকারা করি, নির্মাণ করি, তৈরি করি,
আবিষ্কার করি, পুরস্কৃত করি, তিরস্কার করি,
জিকির করি, ওয়াজ করি, আওয়াজ করি,
ছোঁয়াব করি, নেক করি, ফরজ করি,
গুনাহ করি, পাপ করি, পুণ্যিও করি।

১৫) হজ্ব করি, জেয়ারত করি, তীর্থ করি,
আল্লাহআল্লাহ করি, ঈশ্বরঈশ্বর করি, ভক্তি করি
চালাকি করি, ছলনা করি, দাওয়াত করি,
ভ্রমণ করি, গমন করি, দমন করি,
ব্যায়াম করি, পেক্টিস করি, খেলা করি,
মুলাকাত করি, আশা করি, ভরসা করি,
নিরাশ করি, ঝগড়া করি, বিবাদও করি।

১৬) মায়া করি, দয়া করি, করুণা করি,
ভর করি, ভরাট করি, কারচুপি করি,
শূন্য করি, ক্ষুণ্ণ করি, পূর্ণ করি,
চূর্ণ করি, জয় করি, ক্ষয় করি,
আপন করি, পর করি, প্রশংসা করি,
ফন্দি করি, বন্দি করি, বৃদ্ধি করি,
হ্রাস করি, জাল করি, নকলও করি।

১৭) অঙ্ক করি, যোগ করি, বিয়োগ করি,
পূরণ করি, ভাগ করি, লসাগু করি,
গসাগু করি, কর্ম করি, ধর্ম করি,
মাপ করি, ক্ষমা করি, চুক্তি করি,
মুক্তি করি, ভক্তি করি,আরতি করি,
নমস্কার করি, প্রণাম করি, সালাম করি,
উৎপন্ন করি, বংশবৃদ্ধি করি, ধ্বংসও করি।

১৮) পরিচালনা করি, ঢং করি, কুয়ারা করি,
যাত্রা করি, থিয়েটার করি, মিছিল করি,
মিটিং করি, সভা করি, মঞ্চ করি,
আলাপ করি, বিলাপ করি, অর্থ করি,
সম্পদ করি, কাম করি, কাজ করি,
ভোজন করি, ভক্ষণ করি, ক্ষুধা নিবারণ করি,
ড্রেসিং করি, ড্রেজিং করি, খননও করি,

১৯) রাজনীতি করি, ধান্দাবাজি করি, হুশিয়ার করি,
এই দল করি, ঐ দল করি, জামাত করি,
শিবির করি, বিএনপি করি, আওয়ামীলীগ করি,
জাতীয় পার্টি করি, ন্যাপ করি, যুক্তফ্রন্ট করি,
ওয়ার্কার্স পার্টি করি, মজলিশ করি, জাকের পার্টি করি,
জোট করি, খারাপ করি, ভাল করি, মন্দ করি,
নিন্দা করি, ধান্ধা করি, ফলও ভোগ করি।

২০) কেইস করি, মামলা করি, মকদ্দমা করি,
গ্রেপ্তার করি, গুলি করি, ক্রসফায়ার করি
ব্রাস করি, হাট করি, ঘাট করি,
ব্যবসা করি, মুনাফা করি, বিক্রি করি,
বাজার করি, সদাই করি, লাভ করি,
লোকসান করি,ভর করি, অর্জন করি,
বর্জন করি, জোর করি, জেরাও করি।

২১) নির্বাচন করি, প্রতিযোগিতা করি, শাসন করি,
শ্বাসরুদ্ধ করি, ধন্দ করি, বন্ধ করি,
খতম করি, জোড়া করি, খোঁড়া করি,
লালন করি, পালন করি, যুদ্ধ করি,
স্বাধীন করি, স্বাধীনতা ভোগ করি, আমোদ করি,
প্রমোদ করি, সঞ্চয় করি, জমা করি,
লোভ করি, লালসা করি, বিলাসিতাও করি।

২২) খেয়াল করি, খামখেয়ালি করি, গড়মিল করি,
গাফিলতি করি, পাঠ করি, খাট করি,
খেতা করি, বালিশ করি, মালিশ করি,
পালিশ করি, নালিশ করি, স্মরণ করি,
বরণ করি, ধরণ করি, গরম করি,
নরম করি, অলসতা করি, সরলতা করি,
লাঠিপেটা করি, ছত্রভঙ্গ করি, দৌড়াদৌড়িও করি।

২৩) অঙ্গীকার করি, প্রতিজ্ঞা করি, ওয়াদা করি,
বরখেলাপ করি, রান্না করি, বান্না করি,
কান্না করি, চিকিৎসা করি, বমি করি,
ভাঁওতাবাজি করি, একগুঁয়েমি করি, জেদ করি,
পাতলা করি, ঘন করি, মনে করি,
শুদ্ধ করি, মুগ্ধ করি, ক্ষুব্ধও করি।

২৪) সময় নষ্ট করি, দেরি করি, ফেরি করি,
সৎসঙ্গ করি, অসৎসঙ্গ করি, গবেষণা করি,
মিল করি, কারখানা করি, উৎপাদন করি,
বিদেশ করি, আমদানি করি, রপ্তানি করি,
প্রচার করি, পাচার করি, স্রষ্টাকে স্মরণ করি,
মাইকিং করি, প্রসার করি, ঈশ্বরকে স্মরণ করি,
সৃষ্টির প্রসংশা করি, বিশ্বাস করি, অবিশ্বাসও করি।

২৫) জয় করি, ক্ষয় করি, নয় করি,
ছয় করি, পার করি, সাইন করি,
স্বাক্ষর করি, নির্বাচন করি, নির্বাচিত করি,
লগইন করি, ভিজিট করি, ব্লগ করি,
ব্লগিং করি, দখল করি, বেদখল করি,
এই করি, সেই করি, এটা করি,
ওটা করি, চিকিৎসা করি, খেদমতও করি।

২৬) চাঁদাবাজি করি, ছিনতাই করি, কবিরাজি করি,
গোল মিটিং করি, শত্রুতা করি, মিত্রতা করি,
ফেসবুক ব্যবহার করি, বন্ধু যোগ করি, বন্ধুত্ব করি,
বন্ধুত্ব স্বীকার করি, বন্ধুত্ব ত্যাগ করি, ব্লক করি,
পোষ্ট করি, বার্তা প্রেরণ করি, মন্তব্য করি,
শুভেচ্ছা বিনিময় করি, গ্রুপ করি, আড্ডা করি,
ইতিহাস সৃষ্টি করি, ইতিহাস ধ্বংস করি, শেষও করি।

এক বিকেলের ভালো লাগা, সারাজীবনের স্মৃতি

nitai-b

নারায়নগঞ্জ নগরখাঁন পুরে বাসা ভাড়া নিলাম, বাড়িওয়ালা আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক, নাম শ্যামসুন্দর সাহা। বাসা ভাড়া মাত্র ১৫০/=টাকা, আমার পরিবারের সদস্য বলতে আমি আর আমার মা। চাকরি করতাম কিল্লার পুল ফাইন টেক্সটাইল, বেতন মোটামুটি ২০০০/=টাকা। তখন চাউলের মূল্য ছিল প্রতি কেজি ৫/= টাকা। সময়টা বোধহয় ১৯৮৪ সালের প্রথম দিকের কথা। বড়দাদার সাথে আয়-রোজগার নিয়ে কথা কাটাকাটি করে নারায়নগঞ্জ নগর খাঁনপুরে বাসা ভাড়া নিলাম, থাকবো মা’কে নিয়ে। যেদিন বাসায় ঢুকবো, সেদিন ছিল শুক্রবার, তারিখটা মনে নেই।

ঠিক দুপুরবেলা হতে দাদার বাসা থেকে কিছু দরকারী মালামাল নিয়ে ভাড়া করা বাসায় আসলাম, মালামালের মধ্যে তেমন কোন দামী মাল বা দামী আসবাবপত্র নেই, তারপরেও মোটামুটি যা আছে গরিব সমাজে চলনসই। নুন আনতে যাদের পান্তা ফুরায়, তাদের তো এর বেশি কিছু থাকার কথাই না, আমার বেলায়ও তাই। রিকশা করে এই মালগুলি আনলাম, বাসার সামনে যখন রিকশা রাখলাম তখন অমার চোখ পড়ল ঐ বাড়িতে থাকা একটা মানুষের উপর।

মানুষটা খুবই সুন্দর ও রূপসী, গায়ের রং ফর্সা, মায়াবী চেহারা, যেন হাতে গড়া এক মাটির মূর্তি দেবী দূর্গা। অটল চেরা চোখ, হাঁটু পর্যন্ত তাঁর মাথার কেশ, অপরূপ এক রূপবতী। আমাদের দিকেই শুধু মেয়েটার নজর, খানিক পরপর শুধু এদিকেই ওর আনাগোনা।

রিকশা-ভ্যান থেকে এই সামান্য মালামাল আর নামাতে ভাল লাগছিল না, লজ্জায়। লজ্জা লাগার কারণও আছে, কারণটা হলো, যেই বাড়িতে বাসা ভাড়া নিলাম, সেই বাড়িতে আরো দুই-তিন ফ্যামিলি ভাড়াটিয়া আছে, তাঁরা সবাই ছোটখাট ব্যবসায়ী। তাদের ঘরে জিনিসের অভাব নাই, তাদের সাথে তো আমার মত গরিব মানুষের খাপ খাবে না, তাই হচ্ছে লজ্জা।

রিকশার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছি কী যে করি! আমার সাথে আছে আমার এক হেলপার, নাম কানাই লাল। ওর বাসাও এই নগর খাঁনপুরে, বহু আগে থেকে ওরা সপরিবারে এই এলাকায় থাকে। ওর অনুরোধেই আবার আসলাম এই এলাকায় মা’কে নিয়ে।

এর বহু আগেও আমরা এই নগর খাঁনপুরেই ভাড়া ছিলাম সপরিবারে, সেই আগের চেনাজানা বলেই আবার বহুদিন পর এই এলাকায় আসলাম বাসা ভাড়া নিয়ে। কানাই শুধু বলছে, কি রে! মালগুলি ধর, ঘরে নিয়ে যাই তাড়াতাড়ি করে। খানিক পর তো আবার সন্ধ্যা হয়ে যাবে, আবার বাজারে যেতে হবে না? নতুন বাসা, কত জিনিসপত্রের দরকার হবে! সবই তো তোর আস্তে আস্তে কিনতে হবে, বলছিল কানাই লাল।

একটু পরে ঐ রূপবতী রূপসী মেয়েটা আমাদের সামনে আসলো, সামনে এসেই বললো, আপনারা দুইজনে না পাড়লে আমি আপনাদের সাহায্য করতে পারি। মামা আমাকে পাঠিয়েছে আপনাদের সাহায্য করতে। আমি একেবারে চুপ করে রইলাম, কোন কথা’ই বলছি না। কানাই বললো না না থাক তোমার লাগবে না, যা আছে সেটা আমরা দুইজনেই পারবো, তুমি যাও। তারপরেও মেয়েটা হাড়ি-পাতিলের বস্তাটা হাতে করে বাড়ির ভিতরে নিয়ে রাখলো, আমি যেই ঘরটা ভাড়া করেছি সেই ঘরে। বাকী মালপত্র কানাই আর আমি মিলে নিলাম, সাথে রিকশাওয়ালাও আছে। আমার মা আসলো বিকালবেলা। মা আসার পূর্বেই ঘরের ভিতরে সব গোছগাছ করে রেখেছি দুইজনে। মালপত্রগুলি গোছানোর সময়ও মেয়েটা বারবার একটু পরপর আমাদের সাহায্য করার জন্য আসছে আমার ঘরে। একটু পরে মা বললেন, যা রান্না করার জন্য কিছু বাজার-সদাই করে নিয়ে আয়। মাকে বললাম বাজারের ব্যাগটা দিন, আর কী কী আনবো বলেন। কী কী লাগবে মা বললেন, ব্যাগ নিয়ে বেরুলাম আমরা দুইজনে বাজারের উদ্দেশ্যে।

রাতের খাবারে কানাইকে নিমন্ত্রণ দিলাম, কানাই ঠিক সময় এসে হাজির হলো আমার ঘরে। মা ভাত খেতে দিলেন দুইজনকে, ভাত খাচ্ছি দুইজনে। এমন সময় আবার মেয়েটা এসে মাকে বললো মাসিমা কী রান্না করলেন এত তাড়াতাড়ি? ইরি চাউলের ভাত, মুশরের ডাইল- মা জবাব দিলেন। মেয়েটা ওদের ঘরে গিয়ে তাড়াতাড়ি করে একটা কাঁসার বাটি করে কিছু তরকারি এনে দিলেন মায়ের হাতে। মা প্রথমে রাখতে চায়নি, মেয়েটা অনুরোধ করলো রাখার জন্য, তখন মা ওর অনুরোধে রাখলো। সেই তরকারি আমাদের দুইজনকে ভাগ করে দিলেন, আমরা দুইজন খেলাম। খাওয়া দাওয়া সেরে হাত-মুখ ধুয়ে বাহিরে বেরুলাম দুইজনে দোকানে যাওয়া জন্য। বাড়ির সাথেই চা দোকান, মুদি দোকান আছে যা রাত বারোটা পর্যন্ত খোলা থাকে সবসময়, মহল্লার দোকান তো তাই।

কানাই লালকে জিজ্ঞেস করলাম যে, মেয়েটা কে? কোথায় বাড়ি, তাঁরা কয় ভাই, কয় বোন ইত্যাদি ইত্যাদি। কানাই লাল বিস্তারিত বললো- মেয়েটার নাম মণিকা, (ছদ্মনাম) ৷ মেয়েটির বাবা নাই, মেয়েটা এই বাড়িওয়ালার এখানে থেকে কাজ করে। বাড়ি মুন্সিগঞ্জ। ওরা একভাই একবোন, মা জীবিত আছে, ওর মাও অন্য একজনের বাসায় কাজ করে। কানাই লাল জিজ্ঞেস করলো, কেন জানতে চাইলি মেয়েটার জীবনী! বললাম একজন কি অন্য আরেক জনের জীবনী সমন্ধে জানতে পারে না? মেয়েটা সারা বিকাল আমাদের খেদমত করার জন্য প্রায় অস্থির, আর শুধু মেয়েটার জীবনী, মেয়েটা কে, মেয়েটা ধনী না গরিব, সেটা জানা কী অপরাধ হবে? কানাই বললো না, কোন অপরাধ হবে না।

রাতে বাসায় ঘুমাতে গেলাম, কানাই ও গেল ওদের বাসায় ঘুমানোর জন্য ৷ওদের বাসা আর আমাদের বাসা পাশাপাশি, তবে বাড়িওয়ালা ভিন্ন। আমি যখন ঘুমানোর জন্য বাসায় আসি মেয়েটা তখন দাঁড়ানো ছিল বাড়িওয়ালার ঘরের সামনের বারান্দায়। আমাকে দেখে বললো এত রাত অবধি বাহিরে থাকবে না, বিপদ হতে পারে। মেয়েটার কথার জবাবের কোন প্রত্যুত্তর দেইনি, সোজাসুজি আমি আমার ঘরে চলে গেলাম। আমি আর সেদিন ঘুমাতে পারলাম না, বিছানায় শুয়ে শুধু ভাবছি, মেয়েটির কথা।

পরদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুতে গেলাম বাড়ির সামনে থাকা পুকুর ঘাটে। ঘাটের সামনে গিয়ে দেখি মেয়েটা থালা-বাসন ধোয়ায় কাজ করছে আপন মনে। আমি বোতলে করে বিক্রী করা দন্তমাজন দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে পুকুর ঘাটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, হাত-মুখ ধোবার আশায়। মেয়েটাকে দেখে সহসা আর নামছি না ঘাটে, আমি আবার অত্যন্ত লাজুক টাইপের একটা মানুষ, আবার সময় মত নির্লজ্জ মানুষও হয়ে যাই। মিলের ডিউটির সময় হয়ে যাচ্ছে, দেরি করা যাচ্ছে না, কানাই সকালের নাস্তা করে ডিউটি ধরার জন্য প্রস্তুত হয়ে আসছে এই পুকুরপাড় দিয়েই। কানাই আমাকে দেখেই রেগে-বেগে অস্থির, সামনে এসে বললো কিরে, এখনো দাঁড়িয়ে আছিস! ডিউটিতে যাবি না? বললাম হ্যাঁ যাবো, কানে-কানে বললাম, মেয়েটা ঘাট থেকে তো উঠছে না, আমি অনেকক্ষণ যাবৎ দাঁড়িয়ে আছি। কানাই রেগে-বেগে মেয়েটাকে বললো ওই মেয়ে উঠ শিগ্‌গির, দেখিসনা দাঁড়িয়ে আছে মুখ ধোয়ায় জন্য! উঠ শিগ্‌গির উঠ। মেয়েটা মুখ কালো করে পুকুরঘাট হতে উঠে আসলো, আমি ঘাটে নামলাম মুখ ধোয়ার জন্য। মুখ ধুয়ে, বাসায় গিয়ে, জামাকাপড় পড়ে, কানাইকে সাথে নিয়ে মিলে রওনা হলাম। সেদিন আর মিলে আগের মত কাজে মন বসলোনা, একটু কাজ করেই দোকানে চলে আসি চা পান করার জন্য, এভাবে দুপুর এক ঘটিকা পর্যন্ত, তারপর হলো দুপুরবেলার লাঞ্চ টাইম, বাসায় ফিরে সেদিন আর মিলে যাওয়া হলো না।

এমন এক শুক্রবার বিকালবেলা আমি বাড়ির সামনে পুকুরপাড় বসে আছি একা একা, মেয়েটা আমাকে পুকুরপাড় বসা দেখে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো, খানিক পর বললো কথা আছে আপনার সাথে। মেয়েটার কথা শুনে আমার শরীর ছম্‌ছম্‌ করতে লাগলো, সাথে ভয়। আমি ভয়ে মেয়েটার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছি না, যদি বাড়িওয়ালা বা অন্য কেহ দেখে ফেলে তো মান-সম্মান বলতে কিছুই থাকবে না এই মহল্লায়। আবারও মেয়েটা বলছে কী শুনতে পান না! ঘাড় ফিরিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললাম আমাকে কিছু বলছো? মেয়েটা বলে উঠলো এতক্ষণে! হ্যাঁ আপনাকেই বলছি কথা আছে। আমি বললাম বলো কী বলবে, ঝটপট বলে ফেল। মেয়েটি বললো, বাড়ির ভিতরে আসেন তারপর বলছি। আমি তখন একপ্রকার রাগ হয়ে গেলাম, বললাম তোমার সাথে আমার এমন কোন কথা নেই যে, বাড়ির ভিতরে গিয়ে তোমার কথা শুনতে হবে, তুমি এখন যেতে পার। একপর্যায়ে মেয়েটি আমার হাত ধরে টানতে লাগলো বসা থেকে উঠানোর জন্য, আমি ভয়ে তো একেবারে কাতর হয়ে গেছি মেয়েটির কাণ্ড দেখে। উঠে দাঁড়ালাম আমি, একটু দূরে ছিল একটা দোকান, দোকানদার পরিচিত তা আবার বন্ধুর মত, নাম দিপক সাহা। দিপক দূর থেকে আমাকে দেখছে আমি কী করছি আর মেয়েটা কী করছে। উপায়ান্তর না দেখে মেয়েটির সাথে বাড়ির ভিতরে আসলাম, বাড়িওয়ালা শ্যামসুন্দর সাহা ও তার পরিবার সেদিন বাড়িতে নেই, শুক্রবার হওয়াতে সপরিবারে কোথায় যেন বেড়াতে গেছেন। আমার মাও বাসায় নেই, বড়দাদাকে দেখতে শহরের নন্দিপাড়ায় গেছেন, আরো যে দুই তিন ফ্যামিলি ভাড়াটিয়া থাকে তাদের ঘরেও তালা দেওয়া, মোটকথা বাড়ি খালি একেবারে শূন্য শুধু আমরা দুইজনে বাড়িতে।

বাড়িওয়ালার ঘরে গিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি হাবার মত, মেয়েটি ধমকের সুরে বললো দাঁড়িয়ে আছেন কেন বসেন। আমি তখন ভয়ে কাঁপছি, মেয়েটি জোর করে টেনে একটা চেয়ারে বসালো আমাকে। আমি বললাম আচ্ছা কী ব্যাপার কী হয়েছে তুমি বলো আমাকে, আমার কাজ আছে এক্ষণি আমাকে একটা জরুরী কাজে মিলে যেতে হবে, না হয় চাকরিটাই থাকবে না আমার। মেয়েটি বললো আপনাকে ভালো লাগে আমার, আমাকে আপনার বিয়ে করতে হবে, প্লাস ভালবাসতে হবে। আমি বললাম আমি গরিব মানুষ, কিছুই নাই আমার, আর তুমি বলছো তোমাকে বিয়ে করতে হবে, ভালবাসতে হবে। এটা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। মেয়েটি বললো দোহাই আপনার, আমাকে নিরাশ করবেন না, আমি আপনার কাছে আমার সব ঘটনা খুলে বলছি, শুনুন!

আমরা একভাই একবোন, ভাই আমার ছোট, আমি বড়, বাবা বেঁচে নেই, মা আছে। মা শহরে এক লোকের বাসায় কাজ করে। আমাদের গ্রামের বাড়ি বিক্রমপুর দিঘীরপাড়, পদ্মানদীর ভাঙ্গনে আমাদের ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে বহুবছর আগে, তখন আমি খুব ছোট ছিলাম। পড়া-লেখা তেমন কিছুই করতে পারিনি অভাব-অনটনের কারণে, আমার পড়া-লেখার জন্য মায়েরও বেশি ইচ্ছা ছিল না, তাই পড়া-লেখা আমার ভাগ্যে জুটেনি। এই বাড়িতে কাজ করছি প্রায় তিনবছর গত হয়ে গেল, আমার মায়ের সাথে বাড়িওয়ালার কথা আমাকে বিয়ে-শাদি দিয়ে দিবে বিনিময়ে কোন টাকাকড়ি আমি বেতন হিসেবে পাবো না। গত একমাস আগে আমার জন্য একটা বর (ছেলে) দেখেছে বাড়িওয়ালা, ছেলে মানসিক প্রতিবন্ধী, তার উপর গরিব। আমি রাজি হইনি, আমার মা এক সরল-সোজা মানুষ যে যেভাবে মাকে বোঝায় আমার মা সেভাবে বোঝে। বাড়িওয়ালার কথা, আমাকে ওই ছেলের কাছে বিয়ে দিয়ে ছেলেটাকে বাড়িওয়ালার মুদি দোকানে কাজ করাবে, আর সারাজীবন আমাকে উনার বাড়িতে গৃহকাজে রেখে দিবে, এই হলো বাড়িওয়ালার ইচ্ছা বা ফন্দি। আমি আপনার ব্যাপারে সমস্ত কিছু জেনেছি, জেনে শুনেই আপনাকে মনে-মনে আপন করে নিয়েছি, আপনি আমাকে নিরাশ করবেন না, কথা দিন, এইসব কথা বলতে বলতে মেয়েটি কাঁদতে লাগলো। আমি আর কিছুই বললাম না, শুধু শুনছিলাম মন দিয়ে। মেয়েটির কান্না আমাকে বিমর্ষ করে ফেলেছিল মুহুর্তে, আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না মেয়েটিকে, ভয়ে আর দুঃখে এমন হয়ে গেছি যে, একপ্রকার বোবা মানুষের মত। মেয়েটির কথা শুনে শুধু বললাম তোমাকে পরে বলবো যা কিছু বলার, এখন আমি যাই, এই বলে মেয়েটির কাছ থেকে বিদায় নিলাম।

বিকেল গড়িয়ে যখন সন্ধ্যা হলো, কানাই লাল আমাকে খুঁজতে লাগলো কোথাও যাবে বলে। আমি মেয়েটির কথা শোনার পর সোজাসুজি চলে গেলাম মিলের সামনে কিল্লার পুল ৷ সেখানে চার-পাঁচখানা চা দোকান ও হোটেল আছে যা সারারাত পর্যন্তই খোলা থাকে ৷একটা চা দোকানে গিয়ে বসলাম, এমন সময় কানাই লাল এসে হাজির আমার সামনে, বললো তোকে অনেক্ষণ ধরে খুঁজছি। আমি কিছুই বলছি না, মন খারাপ করে বসে আছি এক ধ্যানে। কানাই মন খারাপের কারণটা জানতে চাইলো কেন হঠাৎ মনটা খারাপ। কানাইর কাছে খুলে বললাম সবকিছু, কানাই আমাকে জিজ্ঞেস করলো তোর এখন মতটা কী? বললাম- না, মেয়েটা যা বলছে সেটা এই মুহুর্তে আমার দ্বারা সম্ভব নয়।

পরদিন সকালবেলা মিলে আসার সময় মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে পুকুরপাড়ে আমার আগমনের আশায়, হয়তো অনেক্ষণ ধরেই অপেক্ষা করছিল আমার জন্য। মেয়েটিকে পাশকাটিয়ে আমি যখন যাচ্ছিলাম মিলের কাজে, মেয়েটি বললো কিছু বললেন না যে! আমি বললাম, পরে বলবো এখন নয়। মেয়েটি বললো, তাহলে তো আর হবে না মনে হয়, কারণ: সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে এখন শুধু পিঁড়িতে বসার পালা। বুঝতে পারিনি মেয়েটির কথা, সোজা চলে গেলাম মিলে, কানাই বললো কিরে এত দেরি করে আসলি? বললাম হ্যাঁরে একটু কাজ ছিলো তো তাই দেরি হয়েছে। কানাই অনুরোধ করতে লাগলো বারবার, বলনা কেন তোর মনটা এমন খারাপ, খুলে বলনা আমার কাছে। খুলে বললাম বিস্তারিত কানাইর কাছে। ওতো শুনে হতবাক! জিজ্ঞেস করলো তোর অভিমত কী? আমি কী মাসিমা’র কাছে কিছু বলবো? বললাম- আরে না, কী দরকার, জানিনা শুনি না, এক বিকেলের দেখা, তাতেই এতকিছু! আর আমার তো এখনো বিয়ের বয়স’ই হয়নি, আবার মা’কে বলবি! এ লজ্জা রাখবো কোথায় বল। কানাই আমাকে ওস্তাদ হিসেবে যথেষ্ট সম্মান করে সবসময়, ও আর কোন কথা বললো না আমার মুখের উপর। কাজ শেষ করে দুপরবেলা বাসায় এলাম লাঞ্চ করার জন্য।

মা আমাকে ভাত বেড়ে দিচ্ছে আর বলছে, বাড়িওয়ালার ঘরে কাজ করে মেয়েটার বিয়ে আগামি শুক্রবার, তুই কী জানিস? বললাম না তো! মা বললেন গরীব মানুষের মেয়ের বিয়ে, আমাদের নিমন্ত্রণ দিয়েছে খাওয়া-দাওয়া করার জন্য। আমি আর কোন কথা বললাম না মায়ের সাথে, কোনরকম একটু-আধটু খেয়ে তাড়াতাড়ি গেলাম কানাইদের বাড়ি, কানাই কেবল ভাত খাচ্ছে। আমাকে দেখে কানাইর মা আমাকে বসতে দিয়ে বললেন কী রে, নিতাই বিয়েতে কী দিবি? না জানার ভান করে বললাম কার বিয়ে মাসিমা? বললো কেন রে, তোদের বাড়িওয়ালার বাসায় কাজ করে সেই মেয়েটার! জানিস না বুঝি! বললাম না মাসিমা না, মোটেও জানিনা। কানাই হয়তো মাসিমাকে ব্যাপারটা বলেছিল, মাসিমা আমাকে বললেন, মেয়েটিতো বেশ সুন্দর ছিলো রে, তোর সাথে মানাতো বেশ। মেয়েটা গরিবের মেয়ে সংসারিক হতো, এখন যেই ছেলের কাছে বিয়ে দিচ্ছে, মেয়েটার জীবন শেষ করার একটা পন্থা। আমি আর দেরি করলাম না, বসা থেকে উঠে চলে এলাম বাহিরে পুকুরপাড়ে। দূর থেকে দেখি, মেয়েটি ওদের পুকুরঘাটে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমিও তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম অনেক্ষণ। একটুপরে কানাই বাসা থেকে বাহির হলো, কানাইকে নিয়ে একসাথে দুজন হেঁটে আসছি পুকুরপাড় দিয়ে, ঠিক যখন মেয়েটির সামনে আসলাম তখন মেয়েটি শুধু বললো ভালো থাকবেন সারাজীবন প্রার্থনা করি প্রভুর নিকট। কথা শুনে কানাই আর শুধু তাকিয়ে থেকে মেয়েটার কাছ থেকে সরে গেলাম, একটু দূরে গিয়ে কানাই বলছিলো মেয়েটা অসহায় ছিল রে!

আমি মনে মনে বলছিলাম মেয়েটাকে তো আমারও ভালো লেগেছিলো রে, কিন্তু সময় তো পাইনি কিছু করার। এত অল্পসময়ে কী আর করা যায় কার জন্যে, এখানে যদি বছর খানেক থাকতাম, আর মেয়েটির জন্য কিছু করার এক বছর সময় পেতাম, তাহলে কিছু একটা করা যেতো। এই মুহুর্তে মেয়েটি অসহায় নয়, অসহায় হয়ে গেলাম আমি নিজে, কিছুই করতে পারলাম না মেয়েটির জন্য। শুক্রবার আসতে আর মাত্র তিনদিন বাকী আছে, মিল থেকে ৫০০/=টাকা অগ্রীম নিয়ে নিলাম মেয়েটার বিয়ের নিমন্ত্রণে যাওয়ার জন্য। বিয়ের দুদিন আগে বাড়িওয়ালা শ্যামসুন্দর দাদাকে বললাম দাদা, ওর বিয়ের শাড়িটা যদি আমি দেই, তাতে কোন সমস্যা হবে? শ্যামসুন্দর দাদা বললেন না না কোন সমস্যা হবে না। আমরা তো দশজনের কাছ থেকেই সাহায্য উঠিয়ে মেয়েটাকে পাড় করছি, বিয়ের শাড়ি অন্য একজনে দিবে বলেছিল, তাকে না হয় বলবো অন্য কিছু দিতে। মিল হইতে ৫০০/=টাকা আর ঘরে ছিল ৫০০/=টকার মত, সেই টাকা নিযে নারায়নগঞ্জ শহরের কালীর বাজার হতে ৮৫০/=টাকা দিয়ে একটু বিয়ের শাড়ি কিনে আনলাম। বাড়ির সবাই সেই শাড়িখানা দেখে প্রশংসা করলো, বললো খুব সুন্দর মানাবে মেয়েটাকে। শাড়িখানা এনে আমার মায়ের হাতে দিয়ে বললাম, মা এই শাড়িখানা আমি এনেছি মেয়ে’টিকে দিবো বলে, তুমি মা কী রাগ করেছো? মা বললেন না রে, আমি আরো খুশিই হয়েছি, ভাল একটা কাজ করেছিস তুই। মা তাড়াতাড়ি করে শ্যামসুন্দর দাদার স্ত্রীর কাছে নিয়ে গিয়ে বললো, বউমা এই শাড়িখানা আমার ছেলে এনেছে মেয়ে’টিকে দেওয়ার জন্য, আর এই শাড়িই হবে ওর বিয়ের শাড়ি। সাথে সাথে শাড়িখানা নিয়ে মেয়েটিকে দেখালো শ্যামসুন্দর দাদার স্ত্রী, বললো দেখতো তোর পছন্দ হয়েছে কিনা! মেয়েটি শাড়িখানা বুকে ধরে অঝরে কাঁদছে।

শুক্রবার বিয়ের দিন, আগের দিন গেল আদিবাস। বিয়ের দিন ভোরবেলা সবাই ঘুমে থাকতেই আমি বাসা থেকে সোজা মিলে চলে যাই। মিলের সামনে চা দোকানে সকালের কিছু হালকা নাস্তা করলাম, চা পান করলাম, ভাল লাগছিলো না। দোকানেই বসে বসে সময় আটটা পর্যন্ত প্রায় তিনকাপ চা সেরে ফেললাম, সকাল আটটা বাজার সাথে সাথে কানাই এসে হাজির আমার সামনে। ও আমাকে বললো আজ আর কাজ করতে পারবো না, চল মহল্লায় যাই, আজ ত এমনিতেই ওভার টাইম, করলে মজুরী পাবো, না করলে মজুরী পাবো না। বললাম ম্যানেজার সাহেব তো রাগ করবে, কানাই বললো চল ছুটি নিয়ে আসি ম্যানেজারের কাছ থেকে। গেলাম ম্যানেজারের কাছে ছুটির জন্য। ম্যানেজার সাহেব ছুটি দিলেন।

সারাদিন কানাইদের বাসায় ঘুমাইলাম, রাত আট ঘটিকার সমর ব্যান্ডপার্টির বাজনার শব্দ, বরযাত্রী হয়তো আসছে শ্যামসুন্দর দাদার বাড়িতে। রাত এগারটায় বিয়ের লগ্ন নির্ধারণ করা আছে যা যথারীতি হবে। মেয়েটি তখন ছোট একটা বাচ্ছা ছেলেকে পাঠিয়েছে আমাকে খুঁজে বের করে বলতে বাড়িতে আসার জন্য। ছেলেটা আমার খুব আদরের তাই ও আমার ঠিকানাটা জানে যে, আমি কোথায় আছি। ছেলেটা আমার সামনে গিয়ে বললো কাকা তোমাকে দিদি ডাকছে। তুমি আস বাড়িতে, আমার মাও আমাকে খুঁজছে দুপুর থেকে, কোথাও পায়নি। আমাদের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিয়েতে বিয়ের পিঁড়িতে বসার আগে মালা বদল হয়, যা মেয়ে ছেলেকে পড়িয়ে দেয়, আবার ছেলে মেয়েকে পড়িয়ে দেয়। ছেলে এবং মেয়েকে বিয়ের পিঁড়িতে করে আলাদা আলাদা করে চার-পাঁচজনে মিলে মাথার উপরে উঠিয়ে নাচতে থাকে, এর মধ্যেই মালা বদল করা হয়। সেই পিঁড়িটাই আমাকে ধরার জন্য মেয়েটার ইচ্ছা। বর আসলো, বরযাত্রীদের খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হলো, পুরোহিত মহাশয় মালা বদলের অনুমতি দিলেন। মেয়েটাকে সবাই কোলে তুলে আনতে গেলেন, কিন্তু না, মেয়েটি আসছে না কারো সাথে। কী ব্যাপার কেই জানে না মেয়েটি এমন করছে কেন! বাড়িওয়ালা শ্যামসুন্দর দাদা, রেগে-বেগে যখন বললো কী ব্যাপার তুমি উঠছো না কেন? উঠো তাড়াতাড়ি করে লগ্ন পাড় হয়ে যাবে। তখন মেয়েটির সোজাসুজি কথা, নিতাই দাদা কোথায়! উনি না আসলে আমি উঠবো না। এই কথা শোনার পর পুরো বাড়িতে তখন হৈ হাল্লা লেগে গেল, আমার মা ভয়ে কাঁপছে, না জানি কী হয় আজকে। সবাই আমাকে খুঁজতে লাগলো, আমি আর কানাই বাসা থেকে একটু দূরে একটা চা দোকানে বসে কথা বলছিলাম, সেখানে আমাকে পেয়েছে সবাই। আমার হাত ধরে জোর করে টেনে বিয়ে বাড়িতে নিয়ে এলো সবাই, কারণটা জানতে চাইলাম কী ব্যাপার, এত জোরাজুরি কেন? উত্তরে সবাই বললো তোকে ছাড়া বিয়ে হবে না। আসলাম তাদের সাথে, কানাইও আছে পিছনে পিছনে, বাড়িতে আসার পর শ্যামসুন্দর দাদা হেসে দিলে বললো যা’তো তাড়াতাড়ি মেয়ে’টিকে ঘর থেকে বাহির কর, মালা বদল করার জন্য। আমার মাও বললেন যা শিগ্‌গির তাড়াতাড়ি করো। গেলাম মেয়েটার সামনে, আমার পিছনে আরো দশবার জন লোক, আমি সামনে যাওয়ার পরই মেয়েটি উঠে এসে আমাকে ধরে শুধু কাঁদছে হাউমাউ করে, যা দেখে সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। আমিও আর আমার কান্না ধরে রাখতে পারলাম না, কাঁদছি সমান তালে ৷ এই দৃশ্য দেখে আমার মাও কাঁদছে, বাড়ির সবাই কাঁদছে আমাদের এই দৃশ্য দেখে, শ্যামসুন্দর দাদাও কেঁদে কেঁদে বললো, আর কী করা বুঝতে পারি নাই আমি, যা হবার হয়েছে এখন বিয়ের আসরে নিয়ে যা, বললো বাড়ির সবাই। আমি কোলে করে ঘরের বাহির করলাম মেয়ে’টিকে মালা বদল করার জন্য, সাথে কানাই আরো অনেকে মেয়ে’টিকে পিঁড়ির উপড় বসিয়ে, মাথার উপর নিয়ে নাচতে লাগলাম। মালা বদল শেষে পিঁড়িখানা পুরোহিতের সামনে বসিয়ে দিলাম, ছেলেকেও বসিয়ে দিলো সামনাসামনি করে। ধান, দূর্বা, ফুল, তুলসী, আর চন্দ্র সূর্যকে সাক্ষী রেখে মেয়ে’টির বিয়ে সম্পাদন হয়ে গেল, আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে, কিন্তু এখনো মনে পড়ে সেই দিনগুলির কথা। প্রেম করিনি, শুধু ভাল লেগেছিল, তবু যেন ভুলে থাকা যায় না।

কোরবানি

25436_n

অনেক শখের কেনা গোরু
গায়ের রঙ তার সাদা,
আদর করি যত্নও করি
লাগতে দেই না কাদা।

বিধান আছে কোরবানি দিতে
লাগবে নিজের পরিশ্রমের অর্থ,
নাহয় লাগবে নিয়ত সঠিক
এটাই বিধান কোরবানির শর্ত।

দুর্নীতির টাকা, সুদের টাকায়
কোরবানি দেওয়া যাবে না,
যদিও দেয় গায়ের জোরে
তার কোরবানি কবুল হবে না।

কোরবানি দাও মনের পশু
মনে জিইয়ে রাখা শয়তানি,
নিজ মনে শয়তান পুষে
করো না পশু কোরবানি।

.
প্রিয় বন্ধুগণ, আমি হিন্দু।
ভুল হলে ক্ষমাপ্রার্থী।

কলির কালে আবির্ভাব করোনা কালের শেষ কোথায়?

717_134947

শুনেছি কাল তিন প্রকার। এই তিন প্রকার কাল হলো: অতীতকাল, বর্তমানকাল, ভবিষ্যৎকাল। কাল অর্থ সময়। মানে ক্রিয়াপদ যে সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হয়, সেই সময়টাকেই কাল বলা হয়। অর্থাৎ ক্রিয়া সম্পাদনের সময়কে ক্রিয়ার কাল বলে। তবে আমার মনে হয় এই কাল কিন্তু শুধুই ক্রিয়ার কালই নয়। এই কাল আরও অনেক রূপে, অনেক নামে প্রচলিত।

তাই আমি এই লেখায় অন্তত ২৩ প্রকার কাল’র নাম-সহ কাল’র বিশদ বিবরণও উল্লেখ করেছি। কারণ কেউ কেউ এই কালকে অন্যরকমও মনে করে থাকে। তবে হ্যাঁ, কালে কালে এই মানবজাতির অনেক উন্নতি সাধিত হয়েছে। যেমন: বনমানুষ থেকে এপর্যন্ত মানুষ এখন সভ্যজগতে পদার্পণ। সেইসাথে সেসময় থেকে এসময় পর্যন্ত পৃথিবীর অনেককিছুই বদলে গেছে। তাই আবারও উল্লেখ করেছি, কাল কিন্তু একটা সময়। তা হোক সুসময়, দুঃসময়।

আর এই সময়ের কালগুলো হলো: ক্রিয়াকাল, আদিকাল, মহাকাল, শিশুকাল, বাল্যকাল, যুবককাল, অকাল, বয়সকাল, বৃদ্ধকাল, মরণকাল, চিরকাল, গতকাল, আগামীকাল, আজকাল, আধুনিককাল, সকাল, বিকাল, রাত্রিকাল, এযাবতকাল, একাল সেকাল, কলিকাল, করোনাকাল। উল্লেখিত এই ২৩ প্রকার কালগুলো কিন্তু একটা সময়।

আর এই সময়টা হতে পারে দীর্ঘ সময় বা অল্প সময়। যেমন: “গানে আছে, “কতকাল দেখিনি তোমায়”! এখানে একমাসও হতে পারে, আবার একযুগও হতে পারে। যা বারোমেসে একবছর। আবার বারো বছরে একযুগ গণনা করা হয়।

আবার অন্য মতে কাল হলো বিষাক্ত বা জম বা বিপদ! যেমন: কথায় আছে, “সাপের মুখ লাল, মানুষের মুখে কাল”। যদি কারোর উপর কুনজরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কেউ কিছু বলে থাকে, সেটা নাকি কাল হয়ে দাঁড়ায়। মানে জম হয়ে সম্মুখে উপস্থিত হয়।

যার কারণে কারোর শখের একটা নতুন গাছে ফল ধরলে, গাছের মালিক গাছের সাথে ছেঁড়া-ফাঁড়া জুতা বেঁধে রাখে। যাতে কারোর কুনজর শখের গাছের উপর না পড়ে।

আবার ভারতে দেখেছি অনেক গাড়ির মালিকরা তাদের গাড়ির সামনে পেছনে জুতা ঝুলিয়ে রাখে। যাতে কুদৃষ্টি থেকে গাড়িটাকে রক্ষা করা যায়। কিন্তু কেউ রক্ষা পায়, আবার কেউ রক্ষা পায় না। তা পাক আর না পাক তাতে অন্য কারোর কিছুই যায়-আসে না। আমারও না। আমি বরং উপরোল্লিখিত ২৩ প্রকার কালগুলো নিয়ে আলোচনায় আসি। আমার ধারণা থেকে ২৩ প্রকার কাল গুলো নিম্নরূপ:

১. ক্রিয়াকাল: ক্রিয়ার কাল বা ক্রিয়াকাল লেখার প্রথমাংশে উল্লেখ করেছি। এই কাল তিন ভাগে বিভক্ত। যথা: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। ক্রিয়াপদে এই তিন কাল মিলে ক্রিয়াকাল। ক্রিয়াপদ যে সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হয়, সেই সময়টাকেই বলা হয় কাল।

২. আদিকাল: আদিকালে আমার বাবার জন্মও হয়নি। তবে ইতিহাস পড়ে কিছু-না-কিছু জেনেছি। আর যারা আদিকালের ইতিকথার ইতিহাস লিখেছিলেন, তারাও মনে হয় একটু-আধটু আনুমানিক ধারণা থেকেই লিখেছিলেন। যা আমরা বর্তমানে ইতিহাস পড়ে জানতে পারছি।

৩. মহাকাল: যে কালে কোনও মহাপুরুষ, মহামানব ও মহামুনিগণ জন্মগ্রহণ করে, সেই কাল’কে মহাকাল বলতে পারি।

৪. শিশুকাল: আমার নিজেরও একসময় শিশুকাল ছিলো। শিশু কালে মা-বাবা, বড়দা’র হাতে কতো চড়থাপ্পড় খেয়েছি, তার কোনও হিসাব-নিকাশ নেই। তবে এখনো বেশ মনে আছে। এই শিশুকাল পেরিয়ে একসময় আমিও বয়স্কদের কাতারে এসে লাইন ধরেছিলাম। বর্তমানে আমি বৃদ্ধদের কাতারে।

৫. বাল্যকাল: জন্মের পর সবাই শিশুকাল অতিক্রম করে বাল্যকালে উত্তীর্ণ হয়। শিশুকালে সবারই মুখে চুষনী থাকে। আর বাল্যকালে ফুটে ওঠে মুখের বুলি।

৬. যুবককাল: যুবককালে সবাই এক অন্যরকম দিন অতিক্রম করে। কেউ হাসিতে মাতে। কেউ মাতে খেলায়। কেউ মনোনিবেশ করে লেখাপড়ায়। কেউবা আবার কাজে কর্মে। কেউ আবার অকালেই ঝরে পড়ে।

৭. অকাল: অকাল অর্থ অসময়। যা সময়তে হয় না, অসময়ে হয়। হঠাৎ কোনও সুস্থ মানুষ মৃত্যুবরণ করলে, লোকে বলে, “লোকটা অসময়ে চলে গেলো”। কোনও দুর্ঘটনায় কোনও যুবকের মৃত্যু হলে লোকে বলে, “অকালমৃত্যু” আবার অনেকেই বলে, “অকালে ঝরে গেলো”। কারোর দুর্দিনেও বলে, “অসময়ে আছি”। এটাও কিন্তু একটা সময়।

৮. বয়সকাল: যুবককাল পেরিয়ে বয়সকালের হাতছানি। এই বয়সকালে কেউ-না-কেউ খেলাধুলা, লেখাপড়ার পাশাপাশি কাজকর্ম ও সংসার গড়ার পালায় পড়ে। তারমধ্যে আমি নিজেও একজন ছিলাম।

৯. বৃদ্ধকাল: এই বৃদ্ধকালে প্রত্যেক মানুষেই নিজের জীবনের কর্মফলের হিসেব-নিকেশ নিয়ে সময় কাটায়। এই বৃদ্ধকালে সব মানুষের দেহ-মনে শেষ বিদায়ের বার্তা অনুভূত হয়। যেমন: কারোর মাথার কালো কুচকুচে চুল সাদা হয়ে যায়। যাকে বলে পাকা চুল। আসলে কিন্তু শেষ বিদায়ের বার্তা। আবার কারোর মুখের ভেতরে থাকা ৩২টি দাঁতই পড়ে যায়। কারোর অবশিষ্ট দু’একটা আটকে থাকে। তা-ও নড়বড়ে অবস্থায়। এইরূপ অবস্থা কিন্তু শেষ বিদায়েরই বার্তা। এই বৃদ্ধকালে শরীরের টাইট চামড়া বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিবিহীন খড়ায় কাঠফাটা রোদে চৌচির হয়ে যাওয়া কৃষকদের ফসলী জমির মতো হয়ে যায়। যাকে বলে, শরীরের চামড়া মরে গেছে। এর মানেই হচ্ছে মরণের হাতছানি।

১০. মরণকাল: বৃদ্ধকাল মানেই জীবনের শেষকাল। আর বৃদ্ধকাল শেষে মরণ কালের মরণকামড় সবারই সইতে হয়, মরতে হয়। জীব মানেই মরণশীল। এই সুন্দর পৃথিবীর সকল জীবকেই একদিন-না-একদিন মরণকে বরণ করতে হয়। সে থাকুক রাজা, নাহয় বাদশা। হোক সে ফকির, হোক গুণধর সাধু অথবা কোনও হিংস্র প্রাণী। এই পৃথিবীতে যাকিছু আছে, সবকিছুই অনিশ্চিত, কেবল জীবের মরণই নিশ্চিত। মরণকালে অনেক মানুষের মুখের জবান বন্ধ হয়ে যায়। চোখের আলো নিভে যায়। পানাহার বন্ধ হয়ে যায়। অনুভব অনুভূতি হ্রাস পায়। কেউ কেউ প্রিয়জনের কাছে কিছু কথা বলার জন্য ছটফট করতে থাকে। কিন্তু কেউ বলে যেতে পারে, কেউ পারে না। না বলা কথা মরণের সাথে মিশিয়ে দেয়। মরণকালে কারোর প্রাণপাখী উড়ে যায় শান্ত স্বভাবে। কারোর প্রাণপাখী যাওয়ার সময় সমস্ত দেহটা ভেঙেচুরে তচনচ করে ফেলে। তখন মরণকে বরণকারী মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে। তারপর একসময় প্রাণপাখী উড়ে যায়। দেহটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে। সেই দেহটাকে বলে লাশ বা মরদেহ।

১১. চিরকাল: চিরকাল মানে ‘অনন্তকাল’। আর অনন্তকাল মানে চিরকাল, নিত্যতা, যুগযুগান্ত, অপরিমেয়, চিরস্থায়ী। অর্থাৎ যা ছিলো, তা থাকবে। যেমন: আকাশ, বাতাস, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র এমন। কিন্তু আমি থাকবো না। হয়তো আমার বংশধর কেউ থাকবে না।

১২. গতকাল: যে দিন গত হয়। দিন গত রাত শেষে আজও গতকাল হবে। সবার জীবনের কতকিছুই না গত হয়ে গেলো। তবুও মানুষ বেঁচে থাকে আগামী দিনের আশায়। কেউ আগামী দিনের নাগাল পায়, কেউবা হারায়। তবে এই নশ্বর ভবসংসারে কেউ আগামী দিন হারাতে চায় না। সবাই আশায় বুক বেঁধে রাখে আগামী দিনের আশায়।

১৩. আগামীকাল: রাত শেষে সূর্যোদয়ে সাথে শুরু হয় আগামীকাল। আজ নাহয় হলো না দেখা। তাতে কী! দেখা হবে আগামীকাল। তবে আজ যেই কাজটা শেষ করা যাবে, সেই কাজটা যেন কেউ আগামী কালের আশায় ফেলে না রাখে। কারণ, আগামী কালের নাগল পাওয়াটাই অনিশ্চিত!

১৪. আজকাল: আজকাল যা হচ্ছে তো হচ্ছেই। আজকাল মেয়েরা পরে ছেলেদের পোশাক। ছেলেরা পরে মেয়েদের গহনাগাঁটি। কানে ঝুলিয়ে রাখে কানপাশা। হাতে পরে চুড়ি। গলায় ঝুলিয়ে রাখে বড় সাইজের মুতির মালা। আজকাল কেউ কারোর কথা শুনে না। স্ত্রী শুনে না স্বামীর কথা। স্বামী শুনে না স্ত্রীর কথা। রাজা শুনে না প্রজার কথা। প্রজা শুনে না রাজার কথা। আর আজকাল তো ছেলেমেয়েদের কিছু বালাই যায় না। ওরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তাই আজকাল’কে আধুনিককাল বলে।

১৫. আধুনিককাল: “আধুনিক” শব্দটির অর্থ এইমাত্র। আর কাল শব্দটির অর্থ সময়। দুটে মিলিয়ে হয় এইসময়। যা বর্তমান বা সাম্প্রতিক সময়কে নির্দেশ করার জন্য ব্যবহিত হয়। একসময় বুড়ে-বুড়িরা বলতো, “সামনের দিনগুলোতে আরাস্তা (রাস্তার উপযোগী নয় এমন) রাস্তা হবে। আঘাট (ঘাটের উপযোগী নয় এমন) ঘাট হবে। এই আধুনিককালে কিন্তু তা-ই হচ্ছে। তা শহর, বন্দর, গ্রামেও লক্ষনীয়। যেখানে নর্দমা ছিলো, সেটা এখন রাস্তা। যেসব জায়গা দিয়ে মানুষ হেঁটে যেতে ভয় পেতো, সেসব জায়গায় এখন দিনরাত ২৪ ঘণ্টা লোকে লোকারণ্য। এই আধুনিককালে শিল্প কলকারখানা তথা সমগ্র বাংলাদেশের যেমন উন্নতি সাধিত হয়েছে, তেমনি মানুষের জীবনধারণেরও উন্নীত হয়েছে।

১৬. সকাল: শুভ সকাল। আবার কথার কথা “সাতসকাল”। কিন্তু সকাল সাতটা নয়, একটাই। মানে সকাল। যা সূর্যোদয়ের সাথে সাথে আরম্ভ। কিন্তু সকালের সময় আছে। এর সময় সূর্যোদয় হতে ১১.৫৯ মিনিট পর্যন্ত। এই আধুনিককালে আমরা অনেকেই সকালবেলা হাতমুখ ধুয়ে মহান সৃষ্টিকর্তাকে শুভেচ্ছা না জানিয়ে ফেসবুকে থাকা সকল বন্ধুদের শুভ সকালের শুভেচ্ছা জানাই। না জানালে ফেসবুকে থাকা সকল বন্ধুদের মনে কষ্ট পাবে, তাই। যাইহোক, সকালের সময় পেরিয়ে তারপর দুপুর। যাকে বলে শুভ দুপুর। তারপর বিকাল।

১৭. বিকাল: এই বিকাল শুরু হয় দুপুর পেরিয়ে। আমারা কেউ-না-কেউ দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়া সেরে বিশ্রাম নিই। তারপর বিকাল হতে-না-হতেই কেউ-না-কেউ প্রিয় মানুষকে সাথে নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে পড়ি। উদ্দেশ্য একটু হাওয়া-বাতাস গায়ে লাগানোর জন্য। কেউ শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে। কেউ চিত্তরঞ্জন পুকুর পাড়ে। কেউ রাস্তায়। কেউবা আবার মার্কেটে থাকা নামীদামী রেঁস্তোরায়। সকলেই মেতে ওঠে আড্ডায়। সেই আড্ডা চলে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতদুপুর পর্যন্ত।

১৮. রাত্রিকাল: সূর্যাস্তের পর সন্ধ্যা ঘোর হতেই নেমে আসে রাতের আঁধার। তবে শহরাঞ্চলের মানুষ কিন্তু রাতের আঁধার টের পায় না। কারণ এই আধুনিককালে বৈদ্যুতিক বাতির ঝলমল আলো শহরাঞ্চলের রাতের আঁধার কেড়ে নিয়েছে। তাই আমাবস্যা রাতের ঘোর অন্ধকারও কেউ টের পায় না। মোটকথা কেউ বুঝেও না পূর্ণিমা কী আর আমাবস্যা কী? কিন্তু গ্রামাঞ্চলের মানুষ ঠিকই বুঝে, জানে। সন্ধ্যা হতেই তারা তড়িঘড়ি করে বাড়ির সকলের সান্নিধ্যে পৌঁছায়। কারণ গ্রামাঞ্চলে চোর-ডাকাতদের উপদ্রব বেশি। চোর-ডাকাতদের কামাই রোজগারই হয় রাত্রিকালে।

১৯. এযাবতকাল: এ পর্যন্ত সময়ে। মানে শুরু থেকে এ পর্যন্ত। যেমন: “বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পাশাপাশি বাংলাদেশের ইতিহাসে এযাবতকালের মধ্যে সর্ব্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৭.২৮৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে”। আর আমরা দেশবাসী আছি এযাবতকালের সবচেয়ে খারাপ সময়ের মধ্যে। না পারি বলতে, না পারি সইতে, না পারি মরতে।

২০. একাল: এ সময়ে। একালে যার কিছুই নেই, তার একটা মোবাইল ফোন আছে। অনেকের আছে এন্ড্রয়েড টাচস্ক্রীন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির তৈরি স্মার্ট ফোন। এ সময়ে এই অত্যাধুনিক স্মার্ট ফোনের সাহায্যে হাতের মুঠোয় দুনিয়াদারী নিয়ে ঘোরাফেরা করে। মুহূর্তেই পৃথিবীর সব খবরাখবর জেনে যায়। এই অত্যাধুনিক ছোট যন্ত্রটার সাহায্যে সবকিছু দেখা যায়, শোনা যায়। কিন্তু সেকালে এসব কিছুই ছিলো না।

২১. সেকাল: যে কাল গত হয়েছে, তাকেই বলে সেকাল। সেকালে ঘরে ঘরে কালার টেলিভিশন ছিলো না। যা ছিলো, তা-ও সাদাকালো ছোট একটা টেলিভিশন। তা-ও ছিলো দশ গ্রামের ভেতরে দু’একটা বাড়িতে। সবার হাতে হাতঘড়ি ছিলো না। যাদের হাতে হাতঘড়ি থাকতো, তারা ছিলো বড় শিক্ষিত লোক। সবার গলায় ট্রাই বাঁধা ছিলো না। ছিলো রাষ্ট্রপ্রধান ও মন্ত্রীদের গলায়। আর আদালতে থাকা বিচারকের ও অ্যাডভোকেটদের গলায়। আর এখন রাস্তার টোকাইদের গলায়ও ট্রাই বাঁধা থাকে। হাতঘড়ির তো মানসম্মান আরও অনেক আগেই চলে গেছে।

২২. কলিকাল: কলিকাল বা কলির কাল বা করিরযুগ। এই কলিযুগ হিন্দু ধর্মে চার যুগের মধ্যে এক যুগ। যথা: সত্যযুগ, ত্রেতাযুগ, দ্বাপরযুগ, ও কলির যুগ বা কলিযুগ। সত্য যুগের আয়ু ছিলো, ১৭.২৮.০০০ বছর। এই যুগে কোনও পাপ ছিলো না।
ত্রেতা যুগের আয়ু ছিলো, ১২.৯৬.০০০ বছর। এই যুগে পুণ্য ছিলো তিনভাগ, পাপ ছিলো একভাগ।
দ্বাপর যুগের আয়ু ৮.৬৪.০০০ বছর। এই যুগে পুণ্য অর্ধেক, পাপ অর্ধেক।
কলি যুগ বা কলির যুগ বা কলিকাল আক্ষরিকভাবে কলির যুগ, বা “পাপের যুগ।

এই কলির যুগ বা কলির কাল বা কলিকাল হলো হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী চার যুগের শেষ যুগ। এই কলি যুগের আয়ু হলো, ৪,৩২,০০০ বছর। কলি যুগে পুণ্য এক ভাগ, পাপ তিন ভাগ। মানুষের আয়ু প্রায় একশ বছর । মানুষের শরীরের দৈর্ঘ্য নিজের হাতে সাড়ে তিন হাত । প্রাণ বাঁচে ডালভাতে। তীর্থ গঙ্গার জলে। এই যুগে ধর্ম সংকোচিত। মানুষ তপস্যাহীন, সত্য থেকে দূরে অবস্থানরত। রাজনীতি কুটিল। শাসক ধনলোভী। ব্রাহ্মণ শাস্ত্রহীন। পুরুষ স্ত্রীর অনুগত। সৎ মানুষের কষ্ট বৃদ্ধি। দুষ্টের প্রভাব বৃদ্ধি। এই যুগে মানুষের ইচ্ছা পূর্ণ করা প্রায় অসম্ভব। মোটকথা পাপে অনুরক্ত। তাই এতো এতো রোগব্যাধি। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী দেখা দিয়েছে একপ্রকার প্রাণঘাতী ভাইরাস। বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাসের নাম রেখেছে করোনাভাইরাস।

২৩. করোনাকাল: সব কালের শেষকাল করোনাকাল। হিন্দু ধর্মে চার যুগের শেষ যুগ হলো কলির যুগ। অনেকেই বলে কলিকাল। আর কলি কালেরও শেষকাল হতে পারে করোনাকাল। এই করোনা কালের আবির্ভাব গণচীনের উহান শহরে। সময়টা ছিলো ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে। এই করোনাকালের আয়ু হবে কেয়ামত বা প্রলয় পর্যন্ত।এই প্রাণঘাতী ভাইরাস বাতাসে ভেসে বেড়ায়। মানুষের শরীরে প্রবেশ করে হাত-মুখ, চোখ ও নাককান দিয়ে। লক্ষ্মণ সর্দি-জ্বর,কাশি, মাথাব্যথা-সহ আরও কিছু উপসর্গ।

এই করোনাকাল আমাদের সামনে কবে থেকে কবে হাজির হয়েছে, তা এদেশের একটা মাসুম বাচ্চাও জানে। তবে কবে নাগাদ করোনাকাল শেষ হবে তা আর কেউ জানে না। এই করোনাকালে সারা বিশ্বই এখন বিপদগ্রস্ত। এই করোনাকালে সারাবিশ্বে কতো কতো মানুষ যে প্রাণ হারিয়েছে, তা প্রতিদিন খবরে প্রকাশ হচ্ছে। তবে কতো ব্যবসায়ী যে তার পূঁজি বাট্টা সহায়সম্বল শেষ করে দিয়েছে, তার কোনো হিসাব-কিতাব নেই। কতো শিশু যে লেখাপড়া ছেড়ে জীবন বাঁচানোর ধান্দায় রাস্তায় নেমেছে, তারও কোনও হিসাব নেই।

কতো গৃহিণী মা যে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে দিনের পর দিন না খেয়ে আছে, তারও কোনও হিসাব নেই। কতো বৃদ্ধ বাবা যে অবুঝ সন্তানের মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দেয়ার জন্য হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করছে, তারও কোনও হিসাব নেই। হিসাব আছে শুধু মহামারি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কতজন মারা যাচ্ছে, তার হিসাব। কিন্তু কোটি কোটি অসহায় মানুষ যে জীবিত থেকেও নিজেকে মৃত ভাবছে, তার হিসাব কারোর কাছেই নেই।

১৬/১৭ কোটি মানুষের দেশে এই হিসাব রাখাও তো সম্ভব হয়ে পরছে। তবে বর্তমান সরকার এই সময়ে এই করোনাকালে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে, যাতে কেউ যেন না খেয়ে থাকে। পাশাপাশি এই করোনাকালে করোনা সংক্রমণ থেকে মানুষ বাঁচতে সরকার নিরুপায় হয়ে একের পর এক লকডাউন ঘোষণা দিচ্ছে। তবুও কিছুতেই এই করোনা কালটাকে সামলাতে পারছে না। দিনদিন নতুন করে হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেই। জানি না এই করোনা কালের শেষ কোথায়?

খুব মনে পড়ে

741903

তোমার কি মনে পড়ে
সেই পুকুর পাড়ের কথা
পাড়ে ছিল, কত গোলাপফুল
গাঁদাফুল, আর মাধবীলতা!

তোমার কি মনে পড়ে
সেইসব সোনালি দুপর
সকাল-দুপর বিকেল-সন্ধ্যা
বাজতো তোমার সোনার নূপুর

তোমার কি মনে পড়ে
সেই পৌষের সকালের রোদ
দু’জনে বসে গল্পে মাততাম
হতো না মনে বিরক্তি বোধ।

তোমার কি মনে পড়ে
সেদিনের সেসব মধুর স্মৃতি
আমার আজও মনে পড়ে
সকাল-বিকাল দিবা-রাতি।

ছোটবেলার স্মৃতিগুলো

653681

নোয়াখালী জেলার মাহাতাবপুর গ্রামে ছিল আমার বাপদাদার ভিটেমাটি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা আমরা সপরিবারে গ্রামের বাড়িতেই ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি তখন ৮/৯ বছরের নাবালক শিশু। মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হবার আগে এবং পরের সময়েও এদেশে টাকার খুবই দাম ছিল। মানও ছিল। যাঁর-তার কাছে এতো এতো টাকা-পয়সা ছিলো না। কথায় আছে, “যাঁর কাছে হাজার টাকা ছিল, তাঁর টাইটেল ছিল হাজারী।” আর যাঁর কাছে লক্ষ টাকা ছিল, তাঁকে লোকে বলতো “লাখপতি।” তখনকার সময়ে কোটিপতির তালিকায় এদেশে কারোর নাম ছিল না বলেই মনে হয়।

যাক সে কথা। আসি নিজের কথায়! নিজের কথা হলো, আমার ছোটোবেলার কিছু সুখ-দুঃখ আনন্দের কথা। সেসব কথা মনে পড়লে আজও আমাকে কাঁদায়। এখনো যেকোনো পূজাপার্বণে ছোট ছেলে-মেয়েদের পূজোর আনন্দ উপভোগের সাজসজ্জা দেখে নিজের ছোটবেলার দিকে ফিরে তাকাতে হয়।

নোয়াখালী জেলার মাহাতাবপুর গ্রামে ছিল আমার বাপদাদার ভিটেমাটি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা আমরা সপরিবারে গ্রামের বাড়িতেই ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি তখন ৮/৯ বছরের নাবালক শিশু।আমি ছোট থাকতে দেখেছি, আমাদের গ্রামে দুর্গাপূজা হতো না। দুর্গাপূজা হতো টাউনে। গ্রামে হতো লক্ষ্মীপূজা। এর কারণ আগেই বলেছি যে, তখনকার সময়ের টাকার খুবই দাম ছিলো। মানও ছিলো। দুর্গাপূজা করতে হলে অনেক অনেক টাকা-পয়সার দরকার হতো। যা সেসময় পুরো একটা গ্রামে থাকা সব পরিবার মিলেও দুর্গাপূজার খরচ বহন করতে পারতো না।

তাই আমাদের গ্রামের মতো অনেক গ্রামেই তখন কেউ দুর্গাপূজা করতো না বা করার সাহসও পেতো না। যদিও দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব ছিলো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রচলিত একটি ধর্মীয় উৎসব এবং দুর্গাপূজা সমগ্র হিন্দুসমাজেই ছিলো প্রচলিত। তবু্ও তখনকার সময়ে আর্থিক দুরাবস্থার কারণে হিন্দু সমাজের অন্যতম বিশেষ এই ধর্মীয় দুর্গোৎসবটি অনেক গ্রামেই বাদ থেকে যেতো।

এই ব্যয়বহুল সামাজিক ধর্মীয় উৎসবটি বাদ রেখে করা হতো লক্ষ্মীপূজা। তবে কিছু আর্থিক স্বচ্ছলতা পরিবার চৌমুহনী টাউনে গিয়ে দুর্গাপূজা দেখতো, আনন্দ করতো। আর যাঁদের অবস্থা নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো ছিল, তাঁরা থেকে যেতো লক্ষ্মীপূজার আশায়। লক্ষ্মীপূজা হতো দুর্গাপূজার পরেই। অর্থাৎ আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে শুরু হওয়া দুর্গাপূজার বিজয়াদশমীর শেষে প্রথম পূর্ণিমা তিথিতে লক্ষ্মীপূজা হয়ে থাকে। এই লক্ষ্মীপূজাতেই ছিলো সে-সময়ে আমাদের সবচেয়ে আনন্দ-উৎসব।

আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে যখন দুর্গাপূজা আরম্ভ হতো, তখন থেকেই আমাদের গ্রামের সবাই ব্যস্ত থাকতো লক্ষ্মীপূজার আয়োজন নিয়ে। এসব আয়োজনের মধ্যে থাকতো, পরিবারের সকলের জন্য যাঁর যাঁর সাধ্যমতো কম-বেশি নতুন জামাকাপড় কেনা বা বানানো এবং লক্ষ্মীপূজা সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যোগাড় করা। সাথে মা-বোনেরা সবাই চিড়ার মোয়া, মুড়ির মোয়া, নারিকেলের নাড়ু, তিলের নাড়ু ও নানারকম সন্দেশ বানানোর কাজে থাকতো বেশি ব্যস্ত। যাঁদের অভাব অনটন ছিলো না, তাঁরা লক্ষ্মীপূজার দিনে অনেক করতো। যাঁদের তেমন কিছু ছিলো না, তাঁরা নামমাত্র অল্পকিছু করতো। তবুও কষ্টেসৃষ্টে প্রতিটি ঘরে ঘরে লক্ষ্মীপূজা করতো-ই-করতো। তা যেন ছিলো আমাদের গ্রামের হিন্দু সমাজে বাধ্যতামূলক।

তখনকার সময়ে আমাদের মাহাতাবপুর গ্রামে আমাদেরই ছিল বেশি অভাব। মানে অভাবী সংসার। তখন আমাদের ছিল নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো অবস্থা। কারণ, আমার বাবা ছিলেন একজন চাকরিজীবী। তিনি থাকতেন নারায়ণগঞ্জ। চাকরি করতেন নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানাধীন লক্ষ্মণখোলা গ্রাম সংলগ্ন আদর্শ কটন মিলের গ্লাস ফ্যাক্টরিতে। তখনকার সময়ের টাকার যেমন দাম ছিল, শ্রমিকদের বেতনও ছিল যতসামান্য। বাবা বেতন যা-ই পেতেন, তা থেকে নিজের মাসিক খরচ রেখে বাদবাকি বাড়িতে ডাকে পাঠিয়ে দিতেন। আমার মাও বছরের বারোমাস বাবার পাঠানো টাকার আশাই থাকতেন। আমার বড়দাদাও বাবার সাথে নারায়ণগঞ্জই থাকতো। কিন্তু তখনো বড় দাদার পার্মানেন্ট চাকরি হয়েছিল না। বড়দা টেম্পোরারি হিসেবে আদর্শ কটন মিলে উইভিং ডিপার্টমেন্টে কাজ করতো। মাসে যা পেতো, তা বড়দা’র নিজেরই লেগে যেতো। তাই বাবার বেতনের উপরই ছিল আমাদের একমাত্র ভরসা।

সেসময় ধর্মীয় উৎসবের আগমণে মিল কর্তৃপক্ষ মিলে তৈরি কাপড় থেকে বের হওয়া রিজেক্ট কাপড়গুলো শ্রমিকদের মাঝে বিলি-বন্টন করে দিতো। যাতে শ্রমিকরা ওইসব রিজেক্ট কাপড় দিয়ে কিছু নতুন জামা কাপড়ের চাহিদা মেটাতে পারে। দুর্গাপূজার আয়োজন শুরু হলেই আমার মা অপেক্ষায় থাকতেন বাবার আগমণের আশায়। আমার মা আশায় থাকতো, পুজো উপলক্ষে বাবা বাড়িতে আসলে, সাথে করে মিল থেকে পাওয়া সেই রিজেক্ট কাপড় নিয়ে আসবে। আর সেই কাপড় দিয়ে আমাদের লক্ষ্মীপূজার জামাকাপড় বানিয়ে দিবে।

মায়ের আশা কোনও বছর পূরণ হতো, আবার কোনও বছর অপূর্ণ থেকে যেতো। বাবা কোনও পূজায় ছুটি পেলে আসতো। আবার কোনও কোনও পূজায় আসতো না। কিন্তু আমার মা বাবার আগমণের অপেক্ষাই থাকতো বেশি। মা অপেক্ষায় থাকতেন মিলের সেই রিজেক্ট কাপড়ের আশায়। যদি আমার বাবা পূজা উপলক্ষে সময়মতো নারায়ণগঞ্জ থেকে বাড়িতে আসতো, তাহলে বাবা সাথে করে আনা সেই রিজেক্ট কাপড় দিয়ে আমার মা সবার আগে আমার জন্যই শার্ট ও হাফপ্যান্ট নিজ হাতে সেলাই করে বানিয়ে দিতেন। কারণ আমি ছিলাম আমাদের অভাবী সংসারে সবার ছোট। তাই আমারটা থাকতো সবার আগে। এ নিয়ে আমার বড়ো তিন বোন একটু টু-শব্দও করতো না। বরং তাঁরা এতে সবসময় খুশিই থাকতেন।

কোনও কারণবশত বাবা যদি পূজা উপলক্ষে বাড়িতে না আসতে পারতো, তাহলে অন্তত এক-দেড় মাস আগেই চিঠি দিয়ে মা’কে জানিয়ে দিতো। সে-বার আর নতুন জামা-প্যান্ট আর পেতাম না! ছেঁড়া ফাঁড়া পুরানো জামা-প্যান্ট পরেই পূজার আনন্দ উপভোগ করা হতো। কিন্তু লক্ষ্মীপূজা করা বাদ থাকতো না, যেকোনো একভাবে লক্ষ্মীপূজা করা হতো-ই-হতো।

প্রতিবারই লক্ষ্মীপূজাতে চিড়া- মুড়ির মোয়া তৈরি করার জন্য আমারা চার ভাই বোন মিলে গ্রামের কৃষকদের ধান ক্ষেতে ধান কুড়াতাম। আমরা মাঠে ধান কুড়াতাম তখন, যখন ষড়ঋতুর চতুর্থ ঋতু হেমন্ত দেখা দিতো। মানে কার্তিক ও অগ্রহায়ণ, এই দুই মাস। গ্রামের স্বচ্ছল কৃষকরা যখন ক্ষেতের পাকাধান কাটতো, আমরা তখন তাঁদের পেছনে পেছনে থাকতাম ঝরে পড়া ধন কুড়াতে। এই দু’মাস কৃষকদের ধান ক্ষেত থেকে ঝরা ধান কুড়িয়ে রেখে দিতাম, লক্ষ্মীপূজার চিড়া- মুড়ির মোয়া বানানোর জন্য। দুর্গাপূজার শুরু থেকেই আমার মা ও তিন বোন মিলে সেই ধান থেকে চিড়া মুড়ি তৈরি করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তো। ধান সিদ্ধ। ধান থেকে চাল। চাল থেকে চিড়া- মুড়ি। আর নাড়ু সন্দেশ তৈরি হতো নিজেরদের গাছের নারিকেল দিয়ে।

সেসময়ে আমার মতো ছোটো ছেলে- পেলেরা পূজা উপলক্ষে নতুন জামা- কাপড়, নাড়ু, সন্দেশ, চিড়া-মুড়ির মোয়ার চেয়ে বেশি খুশি থাকতো, পূজার দিন ফটকা বা আতশবাজি ফোটাতে পারলে। কিন্তু আমি আমাদের অভাবের কারণে গ্রামের আরও দশটা ছেলের মতো ফটকা বা আতশবাজি ফোটাতে পারতাম না। লক্ষ্মীপূজার দিন গ্রামে পাশের বাড়ির ছেলেরা যখন সন্ধ্যাবেলা ফটকা বা আতশবাজি ফোটাত, তখন আমি মায়ের কাছে গিয়ে কাঁদতাম, আমাকে ফটকা এনে দেওয়ার জন্য। মা তখন সামনের লক্ষ্মীপূজায় ফটকা বা আতশবাজি কিনে দিবেন বলে আমাকে শান্তনা দিয়ে রাখতো। আমার কান্নাকাটি দেখে মা আর বড় দিদিরা শান্তনা দিতেন, “সামনের লক্ষ্মীপূজার আগেই তোর বাবাকে জানিয়ে দিবো, বাড়িতে আসার সময় যাতে তোর জন্য নারায়ণগঞ্জ থেকে ফটকা বোম, বাজি এসব কিনে নিয়ে আসে।” মায়ের কথা, বড় বোনদের কথা মেনে নিয়ে কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করে চুপ করে থাকতাম, সামনের লক্ষ্মীপূজা আগমণের আশায়। এভাবে আশায় থাকতে থাকতে আরেক লক্ষ্মীপূজা শুরু হলেও আমার আর ফটকা ফুটানো কপালে জুটতো না, গ্রামের ছেলেদের ফুটানো ফটকার আওয়াজে নিজের ফটকা ফুটানোর স্বাদ মেটাতাম।

মায়ের আশ্বাস দেওয়া কথায় নিরাশ হয়ে একবার এক লক্ষ্মীপূজা সামনে রেখে নিজেই প্রস্তুতি নিলাম, লক্ষ্মীপূজার দিন ফটকা ফোটানোর। লক্ষ্মীপূজার আগমণের কয়েক মাস আগে থেকে বাড়ির চারদিকে জন্মে থাকা কচুর লতি-সহ সুপারি গাছ থেকে ঝরে পড়া সুপারি কুড়িয়ে হাটের দিন আমার বড় জেঠার সাথে হাটে গিয়ে বিক্রি করতাম। সেগুলো বিক্রি করে যা দুই পয়সা পেতাম, সেই পয়সাগুলো রান্নাঘরের বাঁশের খুটি কেটে জমা করে রাখতাম। উদ্দেশ্য লক্ষ্মীপূজার দিন ফটকা ফুটানোর জন্য। সময়টা তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার একবছর আগের কথা।

সেই লক্ষ্মীপূজার ঠিক চার-পাঁচদিন আগে মায়ের কাছে বলেকয়ে আমার জেঠাতো ভাইয়ের সাথে গেলাম চৌমুহনী টাউনে। উদ্দেশ্য ফটকা বানানোর পটাস(পটাসিয়াম)ও গন্ধক কেনার জন্য। তখনকার সময়ের গ্রামের অনেকেই এই গন্ধক বেটে পাউডারের মতো করে পটাসের সাথে মিশিয়ে একপ্রকার ফটাকা তৈরি করতো। এটা আমার জেঠাতো ভাইও পারতো। তাই আমি আমার জেঠাতো ভাইয়ের সাথে পটাস (পটাসিয়াম) ও গন্ধক কেনার জন্য গিয়েছিলাম। আমার সাথে মাত্র চার টাকা ছিল। এই চার টাকা থেকে দুই টাকার পটাস ও দুই টাকার গন্ধক। আমার জেঠাতো ভাই কিনেছে ১০ টাকার পটাস গন্ধক। তারপর দুইজনে চৌমুহনী টাউন থেকে পায়ে হেঁটে বাড়ি আসলাম।

পটাস (পটাসিয়াম) ও গন্ধক বাড়িতে এনে সেগুলো নিয়ে খুশিতে নাচতে শুরু করলাম। আর মনে মনে ভাবতে লাগলাম, আর কয়েকদিন পর-ই তো লক্ষ্মীপূজা! এবার আমিও গ্রামের সব ছেলেদের শুনিয়ে দিবো ফটকার আওয়াজ। পুরো বাড়ি কাঁপিয়ে দিবো, ফটকার শব্দে! পরদিন আমার জেঠাতো ভাইয়ের দেখাদেখি আমিও ফটকা (কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে বানানো বোমা) বানাতে লাগলাম! ফটকা বানাতে সাহায্য করলো আমার জেঠাতো ভাই। বানালাম বেশ কয়েকটা ফটকা। লক্ষ্মীপূজা আর মাত্র দুইদিন বাকি।

কিন্তু এই দুইদিন যেন দুই বছরের সমান! দুইদিন আর শেষ হচ্ছে না! ফটকাও ফুটাতে পারছি না। মনের ভেতরে কী যে একরকম যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেলো, তা আর লিখে শেষ করা যায় না। বানানো ফটকা সাথে করেই খাওয়া-দাওয়া-ঘুমানো। ফটকা আর চোখের আড়াল হতে দেই না, যদি কেউ নিয়ে যায় বা নষ্ট করে ফেলে, তাই। একসময় অপেক্ষার অবসান হতো। রাত শেষে ভোরে লক্ষ্মীপূজার সূর্য উদিত হতো। লক্ষ্মীপূজার দিন গত সন্ধ্যা হতেই শুরু করে দিতাম ধুমধাম, ঠুসঠাস! শুধু আমি একাই নয়। আমার মতন গ্রামের অনেক ছেলে-পেলেরা যাঁর যাঁর বাড়িতে ফটকা ফুটাতো। তখন পুরো গ্রাম নিজেদের বানানো ফটকার শব্দে কেঁপে উঠতো। এভাবে ঠুসঠাস চলতো রাতদুপুর পর্যন্ত।

এর পরের বছরই ১৯৭১ সাল। মার্চের শেষদিকে শুরু হয়ে গেলো মুক্তির যুদ্ধ! ৯ মাস তুমুল যুদ্ধের পর একসময় দেশ স্বাধীন হলো। এর একবছর পর ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি সময়ের আমরা সপরিবারে চলে আসি নারায়ণগঞ্জ। সেই থেকে আজ অবধি কতগুলো বছর গত হয়ে গেলো! কিন্তু আজও আমার মন থেকে সেসব কষ্টের কথা, আনন্দের কথা মুছে যায়নি। এখনো প্রতিবছর দুর্গাপূজায়, লক্ষ্মীপূজায় অতীতের কষ্টের মাঝে আনন্দের স্মৃতিগুলো মনের মাঝে জেগে ওঠে।

হুজুগে বাঙালি

918608_n

একদিকে দেশে করোনা’র যাতাযাতি
ফেসবুকে ভিনদেশি খেলার মাতামাতি
সরকার ঘোষিত লকডাউন দিন-রাতি
তবুও হাটবাজারে লোকের যাতাযাতি।

আসলে আমরা তো বীর বাঙালি
মিথ্যে ভাষণে দিয়ে থাকি করতালি
অযথা অকারণে ছাড়ি মিথ্যে বুলি
আমরা স্বাধীন দেশের হুজুগে বাঙালি।

তেলবাজি

2154

তেলে তেলবাজি খেলা
খেলছে আনাচে-কানাচে,
নেতার পায়ে মেখে তেল
ডিং-ডিনা-ডিং নাচে।

শরীরে মেখে তেল
করে শরীর তৈলাক্ত,
নেতাদের মেখে তেল
হয়ে যায় তার ভক্ত।

তেলে ভাজা ইলিশ
খেতে বড় মজা,
তেল মাখতে করলে ভুল
ভোগ করে সাজা।

খাঁটি সরিষার তেল
সবার কাছে পছন্দ,
তেল ছাড়া দুর্নীতিবাজরা
পায়না মনে আনন্দ।

তাইতো তেলের মূল্যবৃদ্ধি
দিনদিন অকারণে বাড়ছে,
সরিষা নারিকেল সোয়াবিন
সীমা ছেড়ে যাচ্ছে।

তেল মাখার কৌশল
জানা আছে যার,
তিনিই হয়ে ওঠে
এলাকার পছন্দের সবার।

তেলে হয়েছে তেলতেলা
এই বাংলার রাজনীতি
কর্তাদের মেখে তেল
কোটিপতি হচ্ছে রাতারাতি

তেলে শান্তি তেলে মুক্তি
তেল মেখে ধান্ধাবাজি
তেলে তৈলাক্ত রাজপ্রাসাদ
সদা দুর্নীতি কারসাজি।

লকডাউনের বিকালবেলা

ghfg

এই লকডাউনের বিকালবেলা
চলছে মাঠে খেলা,
চারদিকে লোকে লোকারণ্য
মিলছে যেন মেলা!

কে শোনে কথা চলছে খেলা
দোকানপাটও খোলা,
বিধিনিষেধ মানছে না কেউ
করছে সবাই অবহেলা।

হেলায় হেলায় অবহেলায়
বাড়ছে করোনা সংক্রমণ,
কেউ মরছে গ্রামে, কেউ শহরে
মরছে আপামর জনগণ!

যদি মানতো বিধিনিষেধ
কমে যেতো রোগ সংক্রমণ,
করোনা থেকে রেহাই পেতো
দেশের সব জনগণ।

রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ‘বিটিভি’ এখন আর কেউ দেখে না

428_n

প্রতিদিন রাস্তাঘাটে চলাফেরার মাঝে অনেক জায়গায় থামতে হয়, অনেক চা’র দোকানে বসতে হয়। চায়ের দোকানে বসলেই চোখ যায় দোকানে চালু থাকা রঙিন টেলিভিশনের দিকে। চালু থাকা টেলিভিশনের পর্দায় দেখা মেলেনা রাষ্ট্রীয় ‘বিটিভি’ চ্যানেল। চলতে থাকে আর বসে থাকা কাস্টমাররা মনের আনন্দে ডিশ এন্টেনার ভারতীয় চ্যানেলগুলো। ওইসব দৃশ্য চোখে পড়লেই মনের টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে ওঠে ছোটবেলায় সাদাকালো টেলিভিশনে দেখা বাংলাদেশ টেলিভিশনের কথা। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন (বিটিভি) যে আমরা সমবয়সীরা কতো আনন্দে উপভোগ করতাম, তা আর লিখে শেষ করতে পারবো না। তবে একটু-আধটু লিখে শেয়ার করা যায়।

সময়টা তখন ১৯৭৪ সাল। আমি চার কেলাসের (ক্লাস ফোর)-এর ছাত্র। তখন আমরা সপরিবারে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানাধীন লক্ষ্মণ খোলা গ্রাম সংলগ্ন আদর্শ কটন মিলের ফ্যামিলি কোয়ার্টারে থাকতাম। সেসময় ঘরে ঘরে এতো টেলিভিশন ছিলো না। যা ছিলো, তা কেবল সেসময়কার কিছুকিছু পয়সাওয়ালাদের বাড়িতেই কাঠের বাক্সের মতো একটা সাদাকালো টেলিভিশন থাকতো।

তখন রঙিন টেলিভিশন ছিলোই না। লক্ষ্মণ খোলা পুরো গ্রামে হয়তো দু’একজনের বাড়িতে টেলিভিশন নামের বাক্সটা ছিলো। আদর্শ কটন মিল অভ্যন্তরে থাকা কোনও ফ্যামিলি বাসায় তো দূরের কথা, মিলের শ্রমিক কর্মচারীদের ক্লাবেও একটা টেলিভিশন ছিলো না। শীতলক্ষ্যা নদীর এপার ওপার দু’পারে দু’টি টেলিভিশন ছিলো। একটা টেলিভিশন ছিলো লক্ষ্মণ খোলা জনতা ক্লাবে, আরেকটা ছিলো নদীর পশ্চিম পারে চিত্তরঞ্জন কটন মিলের শ্রমিকদের ক্লাবে। এই দুইটাও ছিলো সাদাকালো ১৭” ইঞ্চি টেলিভিশন।

সেসময়কার টেলিভিশনের ছোট্ট বাক্সটা বর্তমানে অনেক বড়সড় হয়ে গেছে। বর্তমানে টেলিভিশন প্রায় ৪০” ইঞ্চি। তাও আবার অ্যান্ড্রয়েড। সাথে থাকে ইন্টারনেট সংযোগ সিস্টেম। তা-ও আবার প্রায় ঘরে, হাটবাজারে, মহল্লার চায়ের দোকান-সহ বড়সড় সব দোকানেই দেখা যায়।

আর আমাদের সময়ে এই ১৪” ইঞ্চি, ১৭” ইঞ্চি সাদাকালো টেলিভিশনই ছিলো মস্তবড় টেলিভিশন। টেলিভিশন দেখার জন্য শীতলক্ষ্যা নদী পাড়ি দিতে হতো। তারপর সেসময়ের রুস্তম পাইন্না রুস্তমদের কতো যে মাইর, গুতা, খেতে হতো, তা আর লিখে শেষ করতে পারছি না। তবুও সেসময়কার কাঠের বাক্সের ভেতরে শাটানো কাঁচের পর্দার সামনাসামনি বসে থাকতে যে কতো ভালো লাগতো, তা একটু-আধটু লিখে স্মৃতি করে রাখছি মাত্র।

বলে রাখা ভালো যে, তখনকার সময়ে ইন্টারনেট আর ওয়াই-ফাই তো দূরের কথা, ডিশ অ্যানটেনা বা ডিশ লাইনও ছিলো না। ১৪” ইঞ্চি বা ১৭” ইঞ্চি টেলিভিশনের সামনে বসে আমরা যা দেখতাম, তা কেবল আমাদের স্বাধীন বাংলার বাংলাদেশ টেলিভিশনে সম্প্রচারিত খবর, নাটক, সিনেমা, সিনেমার গান ও দেশীয় নৃত্যানুষ্ঠানগুলোই দেখতাম।

তখন সপ্তাহের ৭ দিনই রাত ৮ টা বাংলা সংবাদের পর কোনো-না-কোনো ইংরেজি সিরিজ শুরু হতো। সেসব বাংলা-ইংরেজি সিরিজের নামগুলো এখনো মনে আছে।যেই সিরিজগুলো দেখানো হতো সেগুলো থেকে কয়েকটা সিরিজের নাম এখানে উল্লেখ করছি। “হাওয়াই ফাইভও”, “টারজান”, “দ্য ওয়ার্ল্ড ওয়ার্ল্ড ওয়েস্ট”, “সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান”, “বায়োনিক ওমেন”, “নাইট রাইডার”, “স্পেস নাইন্টিন নাইন্টি নাইন”।

বাংলা নাটকের সিরিজগুলো হলো, ‘সংশপ্তক’ এইসব দিনরাত্রি’, ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’। আরও কিছু বাংলা-ইংরেজি সিরিজের নামগুলো এখন আর মনে নেই। তবে কিছুকিছু দৃশ্য এখনো মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। এইসব দর্শকপ্রিয় নাটকগুলোর নাম আর কথা মনে পড়লেই এখনো টেলিভিশনের রঙিন পর্দায় ফিরে তাকাই। কিন্তু না, সেরকম মনমাতানো নাটক আর ইংরেজি সিরিজ গুলো দেখা মেলেনা।

আগেকার মতো বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) ছায়াছবি, নাটক, ইংরেজি সিরিজ টেলিভিশনের সামনে বসে মনের আনন্দে কেউ উপভোগও করে না। সিনেমা হলে তো যায়-ই-না। এখন টেলিভিশনে ভারতীয় চ্যানেলগুলোতে দেখা যায় ডিজে গান, ডিসকো ড্যান্স, গ্রুপ ড্যান্স, অর্ধনগ্ন পোষাকে হৈ-হুল্লোড়। সেগুলোই যোয়ান-বুড়ো সবাই দেখে। কিন্তু বর্তমানে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ‘বিটিভি’ তো কেউ দেখেই না,  ‘বিটিভি’তে সম্প্রচার হওয়া অনুষ্ঠানও কেউ দেখে না।