নিতাই বাবু এর সকল পোস্ট

নিতাই বাবু সম্পর্কে

নিতাই বাবু ২০১৫ সালে তিনি শখের বশে একটা ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করে লেখালেখি শুরু করেন।তিনি লিখতেন নারায়ণগঞ্জ শহরের কথা। লিখতেন নগরবাসীর কথা। একসময় ২০১৭ সালে সেই ব্লগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ব্লগ কর্তৃক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জনাব সাঈদ খোকন সাহেবের হাত থেকে ২০১৬ সালের সেরা লেখক সম্মাননা গ্রহণ করেন। সাথে নগর কথক উপাধিও পেয়ে যান। এরপর সেই ব্লগে লেখালেখির পাশাপাশি ২০১৮ সালের জুলাই মাসে তিনি শব্দনীড় ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করেন। শব্দনীড় ব্লগে উনার প্রথম লেখা "আমি রাত জাগা পাখি" শিরোনামে একটা কবিতা। তিনি চাকরির পাশাপাশি অবসর সময়ে লেখালেখি পছন্দ করেন এবং নিয়মিত শব্দনীড় ব্লগে লিখে যাচ্ছেন।

স্মৃতিগুলো

28351_n

মন বলে আজ ফিরে যাই সেই ছোটেলায়
যেসময় কেটেছিল দিনগুলো খেলায় খেলায়
ঘুরেফিরে কেটেছিল সময় মেলায় মেলায়
দিন মাস বছর ফুরিয়েছে হেলায় হেলায়।

মন বলে আজ সময়তো বেশি নেই হাতে
যেটুকু সময় ছিল তা হয়েছে শেষ অজান্তে
তবুও যে হায় মন চলে যায় সেই ছোটবেলাতে
জীবনের শেষ সময়েও পারিনা মনটাকে মানাতে।

তা কি হায় সেখানে কি আর ফিরে যাওয়া যায়?
ফিরে দেখা যায়, স্মৃতিগুলো যে মনের মণিকোঠায়
স্মৃতিগুলো যাবেনা মুছে, যদিও চলে যাই ঐ চিতায়
স্মৃতিগুলো রয়ে যাবে যখন থাকবো না দুনিয়ায়।

সোনালী অতীত ক্লাবের জন্য শুভকামনা

20347966_n

ছোটবেলায় স্কুলে যাবার সময় কান্নাকাটি করেও দশ পয়সা তো দূরের কথা, পাচটি পয়সাও সময়তে পেতাম না। মায়ের কাছেও না, বড়দা ও বড় দিদিদের কাছ থেকে না। যা পেতাম, তা কেবল বাবা ও বড়দা বেতন পেলে। সবসময় না পাবার কারণ হলো, তখনকার সময়ে টাকার খুবই মান ছিলো। দামও ছিলো। সেসময়কার টাকার সাথে এসময়কার টাকা তুলনা করতে গেলে, সেসময়কার দশ টাকার সমান বর্তমান সময়ের ১০০/= টাকারও উপরে হতে পারে, তা আমি পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত।

সেসময়ে টাকার ওইরকম দাম আর মানের জন্যই আমাদের ছোটবেলার সময়টাই ছিলো টাকার অভাব। টাকার সেই অভাবে দিনে লেখাপড়ার পাশাপাশি ফুটবল খেলার খুবই শখ ছিলো, আমার। কিন্তু আমাদের সমবয়সী কারোর কাছেই ফুটবল ছিলো না। চামড়ায় মোড়ানো ফুটবল তো ছিলো সোনায় মোড়ানো এক হরিণ। সেই সোনায় মোড়ানো ফুটবল ছিলো সবারই কল্পনার বাইরে। বর্তমান বাজারে কমদামি প্লাস্টিকের মোড়ানো ফুটবলও তখন সবার কাছে ছিলো না। যে ক’জনের কাছে থাকতো, সামান্য একটু ঝগড়াঝাটি হলেই সে তার শখের প্লাস্টিকের ফুটবলটা আর খেলতে দিতো না।

তো কেউ কারোর শখের ফুটবল মন খারাপ করে না দিলেও সমস্যা হতো না। আমার মতো কাঙাল সমবয়সীদের ফুটবল খেলাও আর বন্ধ হতো না। প্রতিদিন স্কুল পর বই খাতা মাঠের কোণায় রেখেই শুরু হতো খেলা। তো অনেকেই প্রশ্ন করতে পারে, তাহলে বল পেলে কোত্থেকে?

ফুটবল ছিলো কাপড়ের মিল থেকে ফেলে দেওয়া সূতার জুট দিয়ে মোড়ানো। ফুটবল তৈরি করা হতো দু’এক দিন পরপর। প্রতিদিন স্কুলে যাবার সময় আমরা কেউ-না-কেউ একজন নিজেদের বানানো একটা ফুটবল সাথে করে নিয়ে যেতাম। তা লুকিয়ে রেখে দিতাম স্কুলমাঠের এক কোণায়, জঙ্গলে। দুপুরবেলা টিফিনের সময়ও শুরু করে দিতাম খেলা। আর স্কুল ছুটির পর তো পুরোদমেই চলতে।

সেই বলগুলো বানানো হতো বিশেষ কায়দায়। সূতার জুটগুলো প্রথমে টেনিস বলের মতো করে দলা করা হতো। তারপর এর উপরে শক্ত রশি দিয়ে পেচানো হতো, আর পেচানোর সাথে সাথে আরও আরও বাতিল জুট ঐ টেনিস বলের সাথে পেচানো হতো। দীর্ঘসময় পেচাতে পেচাতে একসময় খেলার উপযুক্ত এক চামড়ায় মোড়ানো ফুটবল আবিস্কার হয়ে যেতো। তার উপরে জুট থেকেই পাওয়া নোংরা ছেঁড়া-ফাড়া কাপড়ের টুকরা সুন্দরভাবে আরও ভালো করে পেচানো হতো। তাই সেটাকে অনেকই বলতো, “তেনার বল”।

তা দিয়েই আমরা কয়েকজন কাঙালি সমবয়সী মনের আনন্দে প্রতিদিন স্কুল ছুটির পর স্কুলের মাঠেও খেলতাম, আদর্শ কটন মিলস্-এর মাঠেও খেলতাম। আমরা খেলতাম। আমাদের সেসময়কার খেলা মিলের শ্রমিকরা মাঠের চার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতো। খেলা দেখে তারাও আনন্দ উপভোগ করতো, আমরাও আনন্দ পেতাম।

একসময় মিল অভ্যন্তরে থাকা শ্রমিক-কর্মচারীদের কয়েকজন নেতা আমাদের একটা চামড়ায় মোড়ানো ফুটবল কিনে দিলো। কথা থাকে, এই বল তাঁরাও খেলবে, আমরাও খেলবো। খেলা শেষ হবার পর ফুটবলটা থাকবে শ্রমিদের ক্লাবে। তা-ই হতো।

তাঁদের কথা মেনেই প্রতিদিন খেলা হতো। যেদিন কোনও কারণবশত সময়মতো ক্লাব থেকে ফুটবল বের করতে না পারতাম, সেদিন আমাদের নিজেদের তৈরি “তেনার বল” দিয়ে যথাসময়ে খেলা শুরু করে দিতাম।

তখন একটা সময় ছিলো, শুধু ফুটবলেরই সময়। বাংলাদেশে যে ক’টা সরকারি বড়বড় প্রতিষ্ঠান ছিলো, সব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব খেলার টিম ছিলো। শীতলক্ষ্যা নদীর এপারওপার থাকা প্রতিটি মিল ইন্ডাস্ট্রিরও নিজস্ব ফুটবল খেলার টিম ছিলো। আদর্শ কটন মিলেরও টিম ছিলো। তা-ও আবার মাসিক বেতনভোগী খেলোয়াড়। এখন আর সেসব মিল ইন্ডাস্ট্রিও নেই, ফুটবল খেলাও তেমনটা নেই। তখনকার সময়ের মতো ফুটবল প্রেমীও নেই। এখন শুধু ঘরে ঘরে ক্রিকেট প্রেমী।

মনে পড়ে, ঢাকা স্টেডিয়ামে যখন মোহামেডান আবাহনী খেলা হতো, তখন সেই খেলার উত্তেজনা আমাদের চারপাশেও বিরাজ করতো। যেদিন খেলা হতো, সেদিন সেই খেলা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রেডিওতে সম্প্রচার করা হতো। সেই উত্তেজনাকর খেলা উপভোগ করতাম রেডিওতে সম্প্রচার শুনে। সেসময় ঘরে ঘরে টেলিভিশন ছিলো না। রঙিন টেলিভিশন তো দূরের কথা, দশ গ্রাম খুঁজে একটা সাদা-কালো টেলিভিশন পাওয়া যেতো না। দেশ-বিদেশের খবর, খেলার খবর শোনা হতো, একমাত্র রেডিওতে।

সে সময়ের সেই ফুটবল খেলা যেন দিনদিন পশ্চিমাকাশের সূর্যাস্তের মতো ডুবেই যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো একদিন একসময়ের জনপ্রিয় ফুটবল খেলা হয়তো দেশ থেকে চিরতরে বিদায় নিবে। সেদিন হয়তো আর বেশি দূরে নেই। তো আমার মতো যারা আছে, তারা সবসময়ই সেসময়কার জনপ্রিয় ফুটবল খেলাকে মনে গেঁথে রাখবে বলে বিশ্বাস করি।

আজ আমি প্রায় বুড়ো। খেলার জো নেই ঠিক, কিন্তু ফুটবল খেলা দেখার স্বাদ মনে ঠিকই রয়ে গেছে।

তাই প্রতিদিন বিকেলবেলা গোদনাইল চৌধুরীবাড়ি চিত্তরঞ্জন ফুটবল খেলার মাঠে অন্তত একবার হলেও চুপি দিই। সময়তে কিছুক্ষণের জন্য হলেও মাঠের কোণে দাঁড়িয়ে খেলা দেখি। আমার চাকরির অফিসের মালিক দু’জনও ভালো খেলোয়াড়। উনারাও প্রতিদিন এই মাঠেই ফুটবল খেলে। তাই মাঠ ঘেঁষে যেতে আরও ভালো লাগে। তাই প্রতিদিনই যাওয়া হয়। যখনই মাঠের দিকে তাকাই, তখনই মনে পড়ে আমাদের সময়কার ‘তেনার বল’-এর (ফুটবল) কথা। বেঁচে থাকুক “সোনালী অতীত ক্লাব”, বেঁচে ফুটবল, বেঁচে থাকুক বিশ্বের ফুটবল ভক্ত বৃন্দরা। ফুটবল ও ‘সোনালী অতীত ক্লাব’র জন্য রইলো শুভকামনা।

ছবিটি আজ ৩০-০৬-২০২১ ইং, চিত্তরঞ্জন কটন মিলস্ ঐতিহাসিক ফুটবল খেলার মাঠ থেকে তোলা।

ছবিতে ‘সোনালী অতীত ক্লাব’র কয়েকজন খেলোয়াড় (ফুটবলার)।
ছবি উঠাতে উৎসাহদানে: “সোনালী অতীত ক্লাব”, গোদনাইল সিদ্ধিরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।

মনের আশা

20232_n

তোরাই আমার দেহের নিশ্বাস
স্বপ্ন তোদের ঘিরে,
পাই খুঁজে পাই বাঁচার আশ্বাস
এই দুঃখের নীড়ে।

হাঁটি হাঁটি পা পা করে
অনেক বড় হবে,
সেই আশাই রাখছি ধরে
আশা পূর্ণ হবে কবে?

একদিন আগে পরে

16000_n

কেউ থাকে দালান কোঠায়, কেউ রাজপ্রাসাদে,
কেউ থাকে ঝুপড়ি ঘরে, কেউ রাস্তাতে কাঁদে।
কেউ ঘুরে দেশ বিদেশে, কেউ ঘুরে মনের স্বাদে,
কেউবা আবার বিনা দোষে পড়ে যায় ফাঁদে।

কেউ সম্পদশালী কেউ ক্ষমতার বড়াই দেখায়,
কেউ আবার বস্তিবাসী, না খেয়ে দিন কাটায়।
কেউ অহংকার দেখায়, কেউ নীরবে সহে যায়,
অথচ ধনী-গরিব মৃত্যুর পর এক জাগাতেই যায়।

কেউ যায় শ্মশানে, কেউ যায় মাটির কবরে,
প্রতিদিনই হচ্ছে মৃত্যু কোনো-না-কোনও ঘরে।
সে হোক রাজা, হোক না জন্ম তার ধনীর ঘরে,
যেতে হবে সবারই, একদিন আগে আর পরে।

কথায় বলে

195

কথায় বলে,
দুষ্ট লোকের মিষ্টি কথা,
ঘনিয়ে বসে পাশে।
কথা দিয়ে কথা নেয়,
প্রাণে মারে শেষে!

কথায় বলে,
নদীর জল ঘোলাও ভালো
জাতের মেয়ে হোকনা কালো,
নাই মামা কানাও ভালো
অন্ধ সন্তানও ঘরের আলো।

কথায় বলে,
অভাবে নাকি হয় স্বভাব নষ্ট
বাতে ধরলে হয় বুদ্ধিনাশ,
অসৎসঙ্গে হয় সন্তান নষ্ট
সঙ্গদোষে হয় সর্বনাশ!

কথায় বলে,
গাছে বেল পাকলে কাকের কি?
কাক বলে তাকিয়েছি দোষ কি?
নিজের নিজে করলে কার কি?
বিনা লাভে তুলোর বোঝা বহে কি?

কথায় বলে,
মায়ের থেকে বেশি ভালো
হয়তো সে হয় ডাইনি,
বাবার চেয়ে বেশি ভালো
সেই জন করে শয়তানি!

কথায় বলে,
ছোটবেলা যে করে বেশি দুষ্টুমি
বড় হয়ে সে পায় সম্মানী,
বোকা মানুষ করে না বোকামি
অতি পণ্ডিতগণ করে যত ভণ্ডামি।

কে জ্বালাবে আলো?

95564_n

আমরা দু’জন

নেই জায়গা নেই জমি
নেই যে বাড়িঘর,
পরের বাড়িই আমার বাড়ি
ভাড়া একটা ঘর।

ঘরখানা মোর ছোটখাটো
ভাড়া চার হাজার,
টোনাটুনি দু-জনই থাকি
আমার সামান্য রোজগার!

ছেলে ছিলো মেয়েও ছিলো
এখন ছেলে পরপারে,
মেয়েটা থাকে তার শ্বশুরবাড়ি
তিন মানিক ওর ঘরে।

দুটো মেয়ে একটা ছেলে
সুখের স্বামীর ঘর,
শ্বশুর শ্বাশুড়ি ননদ-ননদী
কেউ-তো নয় পর।

আমরা দুজন আছি এখন
চলছি ফিরছি খাচ্ছি,
কদিন পরে যাবো মারা
কী রেখে যাচ্ছি?

যা ছিল মোর বংশের প্রদীপ
অকালে নিভে গেলো,
মৃত্যুর পরে মোদের সমাধিতে
কে জ্বালাবে আলো?

হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নামের পূর্বে শ্রী ব্যবহারের মর্মার্থ

index

“শ্রী” একটি বিশেষ্য পদ। ‘শ্রী’ শব্দটি সংস্কৃত শব্দ। ভারত উপমহাদেশীয় সংস্কৃতিতে বিশেষ করে সনাতন ধর্মে নামের পূর্বে ‘শ্রী’ লিখে থাকেন। তা নারীপুরুষ সকলের নামের সাথেই শ্রী যুক্ত করা হয়। যেমন: পুরুষের নামে পূবে ব্যবহার করা হয়, “শ্রী লক্ষ্মণ চন্দ্র দাস” আর একজন বিবাহিত নারীর নামের পূর্বে “শ্রী মতি কল্পনা রাণী দাস” এভাবেই ‘শ্রী’ শব্দটির ব্যবহার। তবে আধুনিক সমাজে অনেকেই মনে করে থাকে এটি জনাব- জানাবা’র বিকল্প ব্যবহার। আসলে কিন্তু তা নয়। এটি সনাতন ধর্ম সৃষ্টিলগ্ন থেকেই। যেমন: সনাতন ধর্মের ৩৩ প্রকারের দেবদেবীর নামের পূর্বেও ‘শ্রী’ শব্দটি অন্তত দুইবার “শ্রীশ্রী” ব্যবহার করা হয়। ‘শ্রী’ শব্দটি তিনটি অক্ষরে গঠিত। এটি সংস্কৃত ভাষার সবচেয়ে ছোট শ্লোক।

আবার হিন্দু ধর্মমতে বিশেষভাবে লক্ষীদেবী এবং সরস্বতী দেবীকে ‘শ্রী’ সম্মোধন করা হয়। এছাড়াও বাংলাতে ঐশ্বর্য, সৌভাগ্য, সৌন্দর্য এবং রূপ-লাবণ্যকেও ‘শ্রী’ বলে। অর্থাৎ নামের আগে ‘শ্রী’ লেখার অর্থ আপনি উপরোক্ত বিশেষণে ভূষিত। ‘শ্রী’ সম্মানের প্রতীক। ‘শ্রী’ সুন্দরের প্রতীক। অন্যার্থে আপনি উপরোক্ত অর্থে শ্রীযুক্ত হোন বলে আশীর্বাদ। শ্রদ্ধা এবং ভক্তি প্রকাশের জন্যও নামের পূর্বে ‘শ্রী’ যুক্ত করা হয়।

তবে অনেক বিখ্যাত পণ্ডিতগণ মনে করে থাকেন যে, ‘শ্রী’ লেখা কোনও শাস্ত্রীয় বিধান নয়। ধর্ম চিহ্নও নয়। বরং দেবদেবীদের নামের পূর্বে “শ্রীশ্রী” থেকে প্রাচীন যুগ থেকেই হিন্দু সমাজে এই ‘শ্রী’ ব্যবহার প্রচলিত হয়েছে। আবার কেউ কেউ মনে করে থাকেন সংস্কৃত থেকে আগত বলেই ‘শ্রী’ শব্দটি হিন্দু সমাজে ব্যবহৃত।

অভিধান ঘেঁটে দেখা যায়, নামের আগে ব্যবহৃত ‘শ্রী’ মূলত ‘শ্রীযুক্ত, শ্রীযুত, শ্রীল এগুলোর সংক্ষিপ্ত রূপ। যেমন: “শ্রীযুক্ত, শ্রীযুত-বিণ. সৌভাগ্যযুক্ত, মহাশয় (মান্য পুরুষের নামের পূর্বে প্রযুক্ত)। শ্রী-বিণ. সৌভাগ্যবান, লক্ষ্মীমন্ত (বিশেষত মান্য পুরুষের নামের পূর্বে প্রযুক্ত)। শ্রীমান-বিণ. 1 সুন্দর, ক্লান্তিময়; 2 সৌভাগ্যশালী; 3 লক্ষ্মীমন্ত”। এতেই বোঝা যায় যে নামের পূর্বে ‘শ্রী’ মানে সনাতন ধর্মাবলম্বী সকলেই শোভিত হোন। সৌভাগ্যবান হোন।

এজন্যই সনাতন ধর্মাবলম্বী সকলে নিজ নামের পূর্বে সম্মানসূচক সম্মোধন বিশেষ ‘শ্রী’ ব্যবহার কর থাকে।নিজের নাম স্বাক্ষরের পূর্বে ‘শ্রী’ লেখা সঙ্গত। কারণ ‘শ্রী’ কেবল জীবিত ব্যক্তির নামের পূর্বেই বসে। যে ব্যক্তি নিজেই স্বাক্ষর করবে, সে তার নামের জীবদ্দশায় সহি করেছে এটা তার প্রমাণ হবে।

সর্বে ভবস্ত্ সুখিনঃ সর্বে সন্ত নিরাময়াঃ।
সর্বে ভদ্রাণি পশ্যন্ত, মা কশ্চিদ দুঃখভাগ্ ভবেৎ।।

সকলেই সুখী হোক, সকলেই নিরাময় থাকুক।
সকলের মঙ্গল হোক, কেউ যেন দুঃখ ভোগ না করে।

সোর্স: উইকিপিডিয়া ও বাংলা পঞ্জিকা নিবেদিত। ইষত পরিমার্জিত সংশোধিত।

স্বাদের সেলফি

19663

সেলফি’র ঢং, কত-না হয় রঙ-বেরঙে
কেউবা রাস্তায়, কেউ রেল জংশনে
কেউ নদীর পাড়ে, কেউ আগানে-বাগানে
কেউ আকাশ পানে, কেউ মিশে যায় মরণে।

.
ছবিটি চিত্তরঞ্জন গুদারা ঘাট সংলগ্ন নবনির্মিত একটা ভবন।

যেসব কারণে সনাতন ধর্মে মুখাগ্নি করা হয়!

images (12)_1623182876946

মুখাগ্নি বা অন্ত্যোষ্টি বা অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া হলো, জীবনের শেষ যজ্ঞ। অন্ত+ইষ্টি=অন্ত্যোষ্টি বা অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া। অন্ত মানে শেষ আর ইষ্টি মানে যজ্ঞ আর ক্রিয়া মানে কার্য। আমরা জানি আমাদের সুপ্রাচীন পূর্বপুরুষদের বৈদিক সমাজ ছিল যজ্ঞপ্রধান সমাজ। জীবনের শুরু থেকে শেষাবধি সবই হতো যজ্ঞের মাধ্যমে ঈশ্বরকে উদ্দেশ্য করে। অশ্বমেধ যজ্ঞ, অগ্নিহোত্র যজ্ঞ ইত্যাদি যজ্ঞে ইশ্বরের উদ্দেশ্য হবি উৎসর্গ করা হতো।

এ হলো ঈশ্বরের দেয়া জীবন ও দেহ দ্বারা ঈশ্বরের সৃষ্ট প্রকৃতির উপাদান সমুহ ভোগ করার প্রেক্ষিতে ঈশ্বরের উদ্দেশ্য কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তার উপাসনা করা। তাই অন্ত্যোষ্টি তথা জীবনের শেষ যজ্ঞে ঈশ্বর প্রদত্ত দেহ ঈশ্বরের উদ্দেশ্যেই হবি রূপে উৎসর্গ করা। এটা সত্যিই একটা চমৎকার ব্যাপার!

কথায় আছে ও সবারই জানা আছে যে, “জন্মিলে মরিতে হয়” এ কথা ধ্রুব সত্য। এটা আমরা অস্বীকার করতে পারি না। এ পৃথিবীতে যে কয়টি ধ্রুব সত্য আছে তারমধ্যে অন্যতম সত্য হলো প্রাণী বা জীবের মৃত্যু। যে প্রাণী জন্মগ্রহণ করবে, প্রকৃতির নিয়মানুযায়ী তাকে একসময় মরতেই হবে। অর্থাৎ দেহ ত্যাগ করতে হবে।

এই দেহ ত্যাগের জন্য সনাতন ধর্মের অনুসারীরা বিশ্বাস করে যে, মানুষ মৃত্যুর পর স্বর্গবাসী হয়। অর্থাৎ দেবলোকে যায়। কিন্তু, তিনি স্বর্গে বা দেবলোকে যাবেন কীভাবে?

বৈদিক নিয়মানুসারে দেবলোকে বা স্বর্গলোকে পাঠাতে হলে দেবতাদের পুরোহিত অগ্নিতে আহুতি দিতে হয়। অগ্নিদেবই সে অর্চনা বা আহুতি দেবলোকে নিয়ে যান। কাজেই যিনি মৃত্যুবরণ করেছেন বা দেহ ত্যাগ করেছেন তার প্রাণবায়ু অগ্নিদেবকে আহুতি না দিলে তিনি কি করে স্বর্গবাসী হবেন? প্রাণবায়ু মুখ দিয়ে বের হয় বলে মুখে অগ্নিসংযোগ করে মন্ত্রপাঠ করতে হতে হয়।

“ওঁ কৃত্বা তু দুষ্কৃতং কর্মং জানতা বাপ্য জানতা।
মৃত্যুকাল বশং প্রাপ্য নরং পঞ্চত্বমাগতম্
ধর্মাধর্ম সমাযুক্তং লোভ মোহ সমাবৃতম্
দহেয়ং সর্বগাত্রানি দিব্যান্ লোকন্ স গচ্ছাতু”

(ক্রিয়াকান্ড বারিধি)

অনুবাদ: তিনি জেনে বা না জেনে অনেক দুষ্কর্ম করে থাকতে পারেন। কালবশে মানুষ মৃত্যুবরণ করে থাকে। এ দেহ ধর্ম, অধর্ম্, লোভ, মোহ প্রভৃতি দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল। হে অগ্নিদেব, আপনি তার সকল দেহ দগ্ধ করে দিব্যলোকে নিয়ে যান।

সনাতন ধর্মাবলম্বী কেউ মৃত্যুবরণ করলে মরদেহ আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়। যা সনাতন ধর্মে বলা হয় শবদাহ। এর আধ্যাত্মিক কারণ হলো: সনাতন ধর্মের অনুসারীরা পুনর্জন্মে বিশ্বাসী। এই ত্রিতাপদগ্ধ সংসারে পুনরায় জন্মগ্রহণ করে মানুষ দুঃখ-কষ্ট ভোগ করুক এটা কেউ চায় না।

যে দেহে তিনি এতদিন বাস করেছেন, তাকে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছেন, পৃথিবীর যাবতীয় সুখের স্বাদ তাকে দিয়েছেন, ঐ দেহের প্রতি আকর্ষণ ও মায়া থাকা স্বাভাবিক। মনে করা হয় মৃতব্যক্তি তার দেহের প্রতি আকর্ষণে পুনঃ দেহ ধারণে তার আকাঙ্ক্ষা জাগতে পারে। তাই ঐ আকাঙ্ক্ষা দূর করার উদ্দেশেই আকর্ষণের বস্তু দেহটাকে পোড়ানো হয়।

সামাজিক কারণ: আর্য ঋষিদের ভবিষ্যৎ চিন্তা এতে প্রতিফলিত হয়েছে। মানুষ সৃষ্টি হবে এবং এমন একদিন আসতে পারে যখন স্থানাভাব দেখা দেবে। মানুষের দেহ না পুড়িয়ে মাটিতে পুঁতে রেখে দিলে ক্রমশ মাটিতে রাখার জায়গার অভাব দেখা দিতে পারে। আবার মানুষ মরণশীল। যেকোনো একভাবে না একভাবে মানুষকে মরতে হয়। এরমধ্যে বেশিরভাগ মৃত্যু হয় রোগে। এইসকল রোগব্যাধিতে মরা মরদেহ মাটিতে পচন ধরলে পরিবেশের উপর বিভিন্ন রোগজীবাণু ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। এসব চিন্তা মাথায় রেখেই হয়তো আর্য ঋষিগণ শবদেহ পোড়াবার বিধি দিয়েছেন।

পরিশেষে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জেনে রাখা ভালো:
পুরুষের মৃত্যু সংবাদ শ্রবণে বলুন– “দিব্যান্ লোকান্ স গচ্ছাতু”।
কোনও নারীর মৃত্য সংবাদ শ্রবণে বলুন– “দিব্যান্ লোকান্ সা গচ্ছাতু”।

সোর্স: sonatonvabona

সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে

194823323_38

একদিন এসেছিলাম ভবে, সময় নিয়ে হাতে,
সময় কত? কত বছর? কত মাস? কত দিন?
কত ঘণ্টা? কত মিনিট আর বাঁচবই বা কত দিন?
জানা নেই কিছুই আমার, তবুও সমস্যা নেই তাতে।

হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে, বছরের পর বছর ধরে,
চলছি, ফিরছি, ঘুরছি, খাচ্ছি, বেড়াচ্ছি, দেখছি,
এদিকে সময় যে ফুরিয়ে যাচ্ছে একটুও না ভাবছি!
অথচ সবকিছু আমার বলেই যাচ্ছি ৫৭ বছর ধরে।

শুনেছি আমি আয়ু মানি বায়ু, নিশ্বাস মানি বাতাস,
এই আছে তো এই নেই, জীবন আছে তো মৃত্যু আছে
বায়ু আছে আয়ু আছে, বাতাস আছে তো নিশ্বাস আছে
একদিন সময় ফুরিয়ে যাবে, অন্ধকার হবে এই আকাশ।

.
সবাইকে শুভ জন্মদিনের শুভেচ্ছা। কেবল ৫৮ বছরে পদার্পণ।

আকাশের রং বদলাতে দেখেছি

068_n

মাঝে মাঝে আকাশের রংটাও বদলাতে দেখেছি,
কখনও কখনও লাল হলুদে মিশে যেতে দেখেছি
আবার পুরো নীল আকাশটা কালো হতে দেখেছি
কখনও কখনও রেগেমেগে বৃষ্টি ঝরাতে দেখেছি

সময়তে আকাশটাকে ভীষণ রাগে কাঁপতে দেখেছি
সেসময় আকাশের চারদিকে প্রলয় নিত্য দেখেছি
বৃষ্টির আর বাতাসের সাথে বজ্র ফেলতে দেখেছি
পূর্ণিমা রাতে চাঁদের সাথে পাশা খেলতে দেখেছি

সেসময় সাথের তারাদের মিটিমিটি হাসি দেখেছি
কখনও কখনও খুশিতে সূর্যকে নিয়ে খেলতে দেখেছি
এসময় মেঘেদের নির্ভয়ে আকাশে ভাসতে দেখেছি
পরন্তু বিকেলে সূর্যের বিদায় লগ্নে সাজতে দেখেছি
আবার মহান স্রষ্টার গুণকীর্তন করে হাসতেও দেখেছি!

মুজিব মানে মুক্তির মহানায়ক

1080645

যদি গাইতে চাও শেখ মুজিবের গুনগান
হবে নাতো গাওয়া শেষ,
তিনি ছিলেন মুক্তির মহানায়ক বাঙালির প্রাণ,
এটা তারাই স্বপ্নের বাংলাদেশ!

মুজিবের বজ্র কণ্ঠে ছিলো প্রতিবাদী ভাষা
তার প্রমাণ ৭ই মার্চের ভাষণ,
সেই ভাষণে জুগিয়েছিল বাঙালির মনের আশা
দখলদার ছেড়েছিল ক্ষমতার আসন!

তাই মুজিব মানেই বাঙালির মুক্তির মহানায়ক
মুজিব মানে জাতির পিতা,
মুজিব মানে পরাধীনতা থেকে মুক্তির ঘোষক
মুজিব মানে বাংলার স্বাধীনতা!

মায়ের কথা

163435075_3

মা বলেছিলেন, “শোন শোন ওরে মানিক রতন
পরের ধন খাবিনে লুটে-পুটে, খাবিরে তুই খেটেখুটে,
মানে রাখিস সারাজীবন, পরের ধন হয় না আপন
যদিও কেউ করে আপন, শেষমেশ পরেই খায় লুটে-পুটে!

“নিজের থাকে যা, ভেবে নিবি এটাই তোর কপালটা
কর্ম করে খাবি খোকা, কর্মতেই দেবতা বিশ্বকর্মা,
কর্ম যদি না করিস খোকা, আগুনে পুড়বে সংসারটা
কর্মতেই হবে সুখ, কর্ম ছাড়া লোকে বলবে অকর্মা!”

তাই আমি প্রতিদিন সকাল থেকে রাতদুপুর পর্যন্ত কর্মেই থাকি,
একটু সুখের আশায়!

মানুষ বড় বেঈমান

মানুষ বড় স্বার্থপর, নিজের স্বার্থই বুঝে,
পরের চিন্তা করে সে, নিজের সুখই খুঁজে!
কে খেলো আর কে খেলো না
তাতে তার কি-ই-বা আসে-যায়?
সবকিছু নিজেই গিলে ফেলতে–
এদিক-সেদিক দিগ্বিদিক ঘুরে বেড়ায়!

মানুষ বড় বেঈমান, এর চেয়ে বেঈমান আর নেই,
যতই ভালোবাসো তাকে, একটু পরে যেই – সেই!
কীসের প্রেম, ভালোবাসা, আদর
বেঈমানের কাছে সবই অর্থহীন,
কীসের মা-বাবা, ভাই-বোন, পাড়াপড়শি
সবাই বেঈমানের কাছে মূল্যহীন।

মানুষের মতো বড় বেঈমান প্রাণী আর কেউ দেখেনি,
অন্যসব প্রাণির আছে ভক্ষণে চিন্তা বেঈমানী শেখেনি।
শয়তান যা করে, বেঈমানও করে তা
যদিও সে মানুষ, তবুও মনুষ্যত্ব বৃথা,
মানুষ বেশী বেঈমান বলে, “আমিই সব!”
বেঈমান কখনোই করে না প্রকাশ কৃতজ্ঞতা!

২৬ মার্চ থেকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ৫০ বছর ও মুজিব শতবর্ষ

161077528_

প্রতি বছরই মার্চ মাস আসে, মার্চ মাস গত হয়। কিন্তু আমার মন থেকে সেই ভয়াল মার্চ মাসের স্মৃতি মুছে যায় না। বলছি, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের কথা। যেই মার্চ মাস আমাদের পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতার সূচনালগ্ন। যেই মার্চমাস মুক্তির জন্য মুক্তিযুদ্ধ। যেই মার্চ মাস বাংলার মুক্তিকামী মানুষের মুক্তির সূচনালগ্ন। যেই মার্চমাস আমাদের জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার সূচনালগ্ন। আমি সেই মার্চ মাসের কথাই বলছি।

আমি তখন ৭/৮ বছরের নাবালক শিশু। নাবালক শিশু হলেও আমি তখন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। তখন আমার মোটা-মুটি ভালমন্দ বোঝা এবং স্মৃতিতে ধরে রাখার বয়স হয়েছিল। তাই প্রতিবছর জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি গত হয়ে যখনই মার্চ মাসের আগমন ঘটে, তখনই আমার স্মৃতিতে জমা থাকা সেই ভয়াল মার্চ মাসের কথা মনে পড়ে। আমার মনের টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে ওঠে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর লাগানো আগুনের লেলিহান শিখার কালো ধোঁয়া, আর সেই সময়ে খেয়ে-না-খেয়ে থাকার কষ্টের স্মৃতিগুলো।

তখন আমার বাবা আর বড়দা চাকরি করতেন নারায়ণগঞ্জে। আমি আর আমার চার বড়দি ও মা-সহ থাকতাম নোয়াখালীর গ্রামের বাড়িতেই। আমাদের বাড়িটা ছিল, নোয়াখালী বেগমগঞ্জ থানাধীন বজরা রেল স্টেশনের পশ্চিমে মাহাতাবপুর গ্রামে। আমাদের বাড়িটা ছিল মোটামুটি একটা বড়বাড়ির মতো। আমার বাপ-কাকারা ছিলো তিন-ভাই, আর বাবার জেঠাতো ভাই ছিলো দুইজন। এক বাড়ি হলেও সংসার ছিলো আলাদা-আলাদা ভাবে যারযার মতো। আমাদের বাড়ির ঘরগুলো ছিলো মাটি দিয়ে তৈরি, সেই মাটি আনা হয়েছিল চাটগাঁও (চট্টগ্রাম) থেকে গহনা নৌকা করে। সেজন্য আমাদের বাড়িটাকে সবাই নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় ‘মাইটগা দেলানওয়ালা বাড়ি’ নামেই চিনতো-জানতো।

আমাদের গ্রামে আমার বয়সী সব ছেলেদের মধ্যে আমি ছিলাম একটু দুষ্টু টাইপের। যেকোনো খেলাধুলায়ও ছিলাম সবার আগে সবার ওপরে। আমার স্মৃতিশক্তিও ছিলো খুবই প্রখর! তাই এখনো স্পষ্ট মনে আছে সেই মার্চ পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়ের কথা। মনে পড়ে আমার বয়স যখন ৭/৮ বছর, তখন-ই আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান ৭-মার্চ ঢাকার রেডক্রস ময়দানে দিয়ে দিলেন স্বাধীনতার ডাক, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে বললেন শত্রুর বিরুদ্ধে। এরপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা ২৫ মার্চ কালরাতে শুরু করে দেয় নির্বিচারে গণহত্যা। জ্বালাও পোড়াও আর লুটতরাজের মতো ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড। তখন আমি কেবলমাত্র তৃতীয় শ্রেণি পাস করে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া শুরু করেছিলাম। সেই ভয়াল অগ্নিঝরা মার্চে ১৯৭১ এর কথা এখনো মনে পড়লে শরীর শিউরে ওঠে।

162196494_

সে সময় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ও তাদের দোসররা নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। এ হত্যাযজ্ঞে কতজন বাঙালি নিহত হন, তা নির্ধারণে কোনো সঠিক জরিপ পরিচালিত হয়নি; তবে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এক হিসাব অনুযায়ী নিহতের সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ ধরা হয়। বলা হয় পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক এই গণহত্যা ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের অন্যতম। যাই হোক, এবার আমার জানা আর আমার নিজ চোখে দেখা কিছু স্মরণীয় ঘটনায় আসা যাক।

সে সময় আমার মা স্বামী সন্তানের চিন্তায় পাগলের মতো হয়ে সকাল-সন্ধ্যা ঘুরে বেড়াতো গ্রামের বড়বাড়িতে রেডিওর খবর শোনার জন্য। তখন আমাদের গ্রামে শুধু বড়বাড়িতেই একটা ওয়ান বেন্ডের রেডিও ছিল, টেলিভিশন তো কি জিনিস তা মানুষ বুঝতোই না। গ্রামের মানুষের মনে তখন শুধু আতঙ্ক আর ভয়! কখন যেন শুরু হয়ে যাবে জ্বালাও পোড়াও। এদিকে পাক-হানাদার বাহিনী সারাদেশ রক্তাক্ত করে ফেলছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে খবরও আসতে শুরু করছিল। আমার মায়ের কান্না আরও ভারী হতে শুরু করলো, স্বামী আর সন্তানের জন্য। সেসময় আমার তিন বোন ছিল বিয়ের উপযুক্ত, তাদের নিয়েও আমার মায়ের চিন্তার কোনও কমতি ছিল না। সারাদিন আমার বোনদের চোখে-চোখে রাখলেও রাতে রাখতো ঘরে কাঁড়ের ওপরে, নাহয় ঘরের বাইরে সুপারি বাগানে মাটির নিচে। পাকিস্তানি মিলিটারি আর দেশীয় রাজাকারদের ভয়ে আমার মা আর আমার তিন বোন মিলে গোপনে সুপারি বাগানের মাঝখানে মাটি খুঁড়ে বাংকারের মতো তৈরি করেছিল। যাতে দেশীয় আল-বদরদের থেকে ইজ্জত বাঁচতে পারে। এমনভাবে বাংকার তৈরি করেছিল যে, আমার তিন বোন দলাদলি করে ওই বাংকারে শুয়ে থাকতে পারতো। বাংকারের উপরে বাঁশের চটি বিছানো থাকতো। চটির উপরে থাকতো মাটি আর ছড়ানো-ছিটানো গাছের লতা-পাতা। যাতে অপরিচিত কেউ দেখেও বুঝতে না পারে যে, এটা বাংকার।

এভাবে চলতে-চলতে কেটে গেল প্রায় দুই মাস, এরপর হঠাৎ একদিন বাবার আগমন। ঠিক সকালবেলা সবার অজান্তে বাবা বাড়িতে এসে হাজির। বাবার ক্লান্ত শরীরে ময়লা জামাকাপড়। বাবাকে দেখে আমার তিন বোন আর আমি খুশিতে দৌড়ে গিয়ে বাবাকে ঝাপটে ধরলাম। কিন্তু আমার মা’ তেমন খুশি হতে পারেনি, বড় ছেলেকে সাথে না-দেখে। আমার মা’ আমার বাবাকে বলছিল, “আমার নিমাই কোথায়” মায়ের কথা শুনে বাবার কোনো কথা নেই। বোবা যেন হয়ে গেছে। তখন বাড়ির সবাই বাবাকে জিজ্ঞেস করলো, “নিমাই কোথায়?” বাবা শুধু এইটুকুই বললো যে, জানিনা। তবে শুনেছি ও-নাকি শরণার্থী হয়ে ভারত চলে গেছে। বাবার কথা শুনে তখন বাড়ির সবাই আমার মাকে সান্তনা দিচ্ছিল, আর কান্নাকাটি না-করতে। তারপরও আমার মায়ের কান্নাকাটি থামছিল না।

এদিকে বাবা নারায়ণগঞ্জ থেকে এসেছিল একেবারে খালি হাতে। সাথে তেমন কোনও টাকাও আনতে পারেনি। সংসারে পাঁচজন খানেওয়ালা, জামাকাপড় বাদ দিলেও খাওয়ার খরচ কম নয়। তখন আমার বাবার মনের অবস্থা আমি দেখেছি। বাবা পাগলের মতো হয়ে কাজের সন্ধানে গ্রামের বাড়ি-বাড়ি ঘুরে বেড়াতো। কিন্তু তখন আমার বাবাকে কাজ দিবে কে? সবারই একই অবস্থা! সবার মনে তখন শুধুই আতঙ্ক, কখন কি যেন হয়ে যায়! তারপরও অনেক কষ্ট করে কিছু টাকা সংগ্রহ করে যুদ্ধের পুরোটা সময় বাবা মুড়ির ব্যবসা করে সংসারের চার-পাঁচজনের মুখের আহার জুগিয়েছিল। তারপরও কোনোকোনো দিন তিন বেলার মধ্যে দু’এক বেলা না খেয়েই থাকতে হতো।

আমাদের বাড়ি থেকে দেখা যেতো মার্চের শেষ থেকে পাকবাহিনীর তাণ্ডবলীলা শুরু হওয়ার পর থেকে রাতের-বেলায় আমাদের বাড়ি থেকে দেখা যেতো বজরা বাজারের দোকানগুলিতে লাগানো আগুনের লেলিহান শিখা, আর সাদাকালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী। এসব দৃশ্য দেখে মনে হতো, হানাদার বাহিনী যেন আমাদের গ্রামের আশেপাশেই অবস্থান করছে। এই যেন কারো-না-কারোর বাড়িতে হানা দিচ্ছে। তবে মহান সৃষ্টিকর্তার কৃপায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমাদের গ্রামে পাক-হানাদার বাহিনী প্রবেশ করতে পারেনি। দেশীয় আল-বদর রাজাকার বাহিনীও তেমন কোনও ক্ষতি করতে পারেনি। পারেনি মুক্তিযোদ্ধাদের কারণে।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার দুই মাস পরই আমাদের গ্রামে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা গ্রাম ও গ্রামের নিরীহ মানুষদের বাঁচানোর জন্য সর্বক্ষণ টহল দিতে থাকে। গ্রামের সব বাড়ি থেকে আমাদের গাড়িটিই ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের বেশি পছন্দের। কারণ, আমাদের গ্রামে প্রবেশ করতে হলে প্রথমেই আমাদের বাড়ি পাশ দিয়েই প্রবেশ করতে হবে। মানে আমাদের বাড়িটা ছিলো গ্রাম ঢোকার প্রবেশদ্বার। তাই মুক্তিযোদ্ধার সকাল থেকে রাতদুপুর পর্যন্ত আমাদের বাড়ির উঠানে বসে আমার বড় জেঠার সাথে আলাপ-আলোচনা করতো। চলতো চা-পানের আয়োজন। আমাদের বাড়িতে সে সময়কার মুক্তিযুদ্ধের নিয়ে নিত্যদিনের চা-পানের আয়োজনে আমি সঙ্গী হয়ে। বয়সে ছিলাম খুবই ছোট, তবুও তাদের চারপাশে সর্বক্ষণ ঘুরে বেড়াতাম।

এভাবে চলতে চলতে একসময় পাক-হানাদার বাহিনী ও দেশীয় আল-বদরদের পরাজয়ের ঘণ্টা বেজে ওঠতে শুরু করলো। নভেম্বর গত হয়ে যখন ডিসেম্বরের আগমন ঘটলো, সেসময় পাক-হানাদার বাহিনী ও দেশীয় আল-বদর রাজাকার বাহিনীরা আরও হিংসাত্মক হতে লাগলো। কিন্তু শত প্রাণপণ চেষ্টা করেও পাক-হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার আল-বদর বাহিনীরা কুল-কিনারা পাচ্ছিল না। শেষ অবধি ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে পরাজয় বরণ করে ভারতীয় সেনা ও মুক্তিযুদ্ধের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। সেই থেকে গত গেলো ৪৯ বছর! এখন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ঝাঁপিয়ে পড়া বীর মুক্তিযুদ্ধের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ৫০ বছর ও মুজিব শতবর্ষ।