রিয়া রিয়া এর সকল পোস্ট

আগমনী

24331114_n

শরতের পেঁজা তুলোর মতো মেঘেদের সাথে, সোনাঝুরি রোদগুলো যেন ভিতরে বাইরে লুকোচুরি খেলছে। ওই যে দূরে নীলাম্বরের নীল সরোবরে কতগুলো সাদা মেঘ, মনে হয় যেন সাদা হাঁস, মনের আনন্দে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে। চারিদিকে ঝলমল করছে অথচ পোড়াচ্ছেনা মনটাকে।

একটা সুন্দর অনুভুতিতে মাখিয়ে রাখছে। শরৎ রানীর আগমনে সোনালি রোদ, পেঁজা তুলোর মতো মেঘেদের সাথে মিশে দখিনা বাতাসকে সাথে নিয়ে গান গাইছে। কয়েকদিন আগেই বৃষ্টিরা এসে পরিপাটি করে ধুয়ে মুছে দিয়েছে মাঠ, ঘাট, প্রান্তর। শিউলি, ছাতিম, কাশ তাদের ফুলের ডালি সাজিয়ে অপেক্ষায়। রাত পোহালেই তিনি আসছেন যে। তাই দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে তার আগমন বার্তা।

ভাসানিয়া

150965271_405

টুং টাং টুং সুর তোলে
মেঘছানার দল
ছল ছলানো মেঘ প্রপাতে
নৌকা ভাসাই চল
চল না ভাসাই-চল…

গাছ সবজে আবীর মাখে
আকাশ মাখে নীল
ফুলেরা রংধনু মেখে
দিচ্ছে কাকে দিল!
আরে রংবেরঙের দিল…

সমুদ্রটাও বন্ধকীতে
ঝিনুক বুকে জল
ঝমঝমিয়ে এলে তখন
নৌকা ভাসাই চল।
ভাসি-ভাসাই
নৌকা ভাসাই চল…

বৃষ্টি ভেজা শব্দেরা

242250

মাঝেমধ্যে মনে হয় নিরপেক্ষ ব্যবচ্ছেদ হোক। সময়ের আবর্তনে মনের গলি বড় ক্লান্ত। আকাশ আজ উপচে পড়ছে। এক ফোঁটা-দু ফোঁটা, তারপর মুষলধারে আঙুল বেয়ে, চিবুক ছুঁয়ে, হাতের পাতায়।

একা একা বন্ধ ঘরে নিজের সঙ্গে তর্কে কখনো হেরে যাই, কখনো জয়ী। মাঝরাতে দেখি একটা একটা করে তারা জমায় আকাশ, কখনো আধখানা, কখনো বা পুরো চাঁদ অপেক্ষায় থাকে। কতকিছুই যে আবোল তাবোল ভেবে চলি! এই ভাবনাটুকুই সম্বল। মাঝেমধ্যে স্বপ্নগুলো কাছে টেনে মুহূর্তে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া মন্দ লাগে না।

আবার শব্দেরা যখন ছেড়ে যায়, ঠিক তখনই ইচ্ছে করেই নিজেকে আঁকড়ে ধরি। বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায় দাগ কাটে কাচ রঙা চোখে, সোঁদা গন্ধে ধুয়ে যায় চুল, সবুজ হাওয়া এসে মন টেনে নিয়ে যায় শরীরের আবরণ ফেলে কোনো কাশবনে।

মূল কবিতা : পাবলো নেরুদা

21315

আমার অত্যন্ত প্রিয় কবি পাবলো নেরুদার আজ একশো সতেরোতম জন্মদিন। এই বছরটি হল ওঁর নোবেল পুরস্কার লাভের পঞ্চাশতম বছর। তাঁর একটি কবিতার অনুবাদ করে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন …

অনুবাদ : রিয়া চক্রবর্তী

বেশি দূর যেওনা কখনো, এক দিনের জন্যেও না।
কারণ …
কারণ, আমি জানি না কিভাবে বলবো,
এক একটি দিন কতখানি দীর্ঘ।
তবুও আমি নিবিড়ভাবে অপেক্ষায় থাকবো তোমার,
সব ট্রেন একে একে ঘুমোতে চলে গেলে,
যেমন নির্জনে থাকে একটি স্টেশন।

কখনো ছেড়ে যেওনা, এক ঘন্টার জন্যেও না,
কারণ
বিন্দু বিন্দু তীব্র যন্ত্রণা তখন মুহূর্তেই নদী হয়ে যাবে
ঘরছাড়া ধোঁয়ারা অবিরাম ঘর খুঁজতে খুঁজতে
আমার ভেতরে ঢুকে শ্বাসরুদ্ধ করে দেবে হারানো হৃদয়।

সমুদ্রের ধারে হাঁটার সময় ছায়াচিত্রের মতো মিলিয়ে যেও না কখনো
তোমার চোখের পাতা যেন শূন্যতায় কেঁপে না ওঠে
এক মুহূর্তের জন্যেও ছেড়ে যেও না, প্রিয়তমা আমার।

কারণ ঠিক সেই মুহূর্তেই হয়ত অনেক দূরে হারিয়ে যাবে তুমি
আর আমি উন্মাদের মতো সমস্ত পৃথিবী উল্টেপাল্টে,
আর্তনাদ করে বিভ্রান্তের মতো,প্রশ্ন করবো,
তুমি কি আসবে?
মৃত্যুর কাছে এইভাবে রেখে যাবে আমায়?

আমার কথারা

24588_n

ওই নীল আকাশে আছে আমার জমানো যত কথা। কিছু তবুও থেকে যায় অনুক্ত। কিছু নিজের কাছে আগলে রাখি। আর ওই যে টুকরো টুকরো স্বাধীন মেঘ, তাদের মাঝে লুকিয়ে রাখি কিছু ব্যথা। তারা ভেসে চলে নিজেদের মতো। আমার ভালোবাসাও তো আকাশের মতোই বিশাল। তবুও আমি যতবার কেঁদেছি সেই কান্না ওই স্বাধীন মেঘেদের থেকে নরম বৃষ্টি হয়ে ঝরেছে।

বৃষ্টির রিমঝিম সুরে কিছু কথা শুধু চোখের জলকে বলি। তখন শরতের খুব সকালে নরম রোদের আদরের মতো জড়িয়ে থাকি নিজেকে। তবুও কিছু কথা একা একা আছড়ে পড়ে বুকের গভীরে উচ্চারিত শব্দের পায়ে পায়ে। অনেক কথা এড়িয়ে চলি।

আমার নিঃসঙ্গ ছায়ারা যতবার ঠিকানা খুঁজে ফিরেছে ততবারই স্বপ্ন হেসে উড়িয়ে দিয়েছে কিছু না বলা কথা। কিছু আগুনে পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তবুও মনের কুলুঙ্গিতে জমিয়ে রেখেছি এক আকাশ রঙিন মেঘেদের। এখনও যখন মন খারাপেরা ভীষণ ভাবে ঘিরে ধরে, আকাশের দিকে তাকাই। কিছু কথারা তখন বিদ্রোহ করে। মাথার ভেতরে বেজে চলে রণ দামামা। যন্ত্রণায় গুটিয়ে যাই।

নিজেকে লুকিয়ে রাখতে রাখতে বলি – পুরো আকাশটাই তো আমার! ওই সাদা কালো ধূসর রঙিন সব মেঘেরা?
– আমারই তো?

রূপকথা মন

1706431

সারাদিনের প্রখর তাপের পরে বিকেলে যখন সূর্য পশ্চিমে হেলে যায়, আর সারা আকাশ সোনালি রঙের ঘোমটা টেনে নেয় ঠিক তখনই আমি অপলক তাকিয়ে থাকি সেই কনে দেখা আলোর দিকে। আমি দেখি আস্তে আস্তে আলো নেমে আসে ওই দূরের নারকোল গাছের পাতা থেকে আমার মনের উঠোনে। তারপর সেই উঠোন পেরিয়ে, বারান্দা পেরিয়ে ভরিয়ে দিচ্ছে আমার ঘর, পড়ার টেবিল, আর মনের কুলুঙ্গিতে রাখা রংচটা ছবিগুলো, সবশেষে ছাদের কার্নিশ। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি মা পাখিরা দিনান্তে ফিরে আসছে, অনন্ত ক্লান্তি আর অফুরান হাসি নিয়ে তাদের বাসায় আর ভরিয়ে দিচ্ছে ছানাদের পালকের ওমে।

আকাশের গা থেকে যখন সোনালি চাদর খসে পড়বে বিকেলের মন-কেমনিয়া রূপকথার মতো। আর একটু একটু করে আকাশের গায়ে ঝিলিমিলি জেগে উঠবে, শান্ত অথচ স্নিগ্ধ হাওয়ার মতো ঘিরে ধরবে মায়া। তখন কিছুতেই আর সন্ন্যাসে ফিরতে পারবে না মন। অতি ধীরে পরাজিত সম্রাটের মতো মিলিয়ে যাবে মন খারাপেরা। আমাকে জড়িয়ে নেবে স্বপ্ন বা স্বপ্নের মতো জাদুকাঠি। জানি এ আমার শুধুই কল্পনা। বাস্তব থেকে অনেক দূরে।

আসলে চাতকের হাহাকার থেকে আকাশ শুধু ছুড়ে দেবে পরিহাস, ব্যাঙ্গ করবে পরিজন। আমি সবকিছু তাচ্ছিল্য করে শুধু দেখবো, গ্রীষ্ম পেরিয়ে অভিমানী আকুল বর্ষা একটু একটু করে ভরে তুলছে নদী, পুকুরে, ধুয়ে দিচ্ছে পথঘাট, পরম মমতায় স্নান করিয়ে দিচ্ছে গাছেদের। এঁকে দিচ্ছে প্রাচীন সেই সব গাছেদের শরীরে বৃষ্টির আলপনা। ধীরে ধীরে শহরে নেমে আসছে সন্ধ্যা। পরিযায়ী স্বপ্নেরা ডানায় করে বয়ে আনবে মায়াবী রাত। জোনাকির ডানা থেকে ঘুম ভাঙবে এক একটা তারার। আকাশ জুড়ে কেউ বিছিয়ে দেবে রুপোলি শামিয়ানা। আর এক আকাশ অযুত কোটি টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়বে আমার রূপকথা মন। খুঁজে নেবে কিছু অর্থহীন বেঁচে থাকার রসদ, ততদিন মনখারাপের আর বাড়ি ফেরা হবেনা।

রবীন্দ্র শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসের জন্মদিন

239055

ইতিহাসে পড়েছি যে তানসেন গান গাইলে নাকি বৃষ্টি নামতো! আর দেবব্রত বিশ্বাস গাইলে? মন প্রাণ জুড়িয়ে যেতো। আজ এই প্রিয় কণ্ঠশিল্পীর জন্মদিন। আজ সারাদিন আমি তাঁর গাওয়া গান শুনছিলাম। যেমন- ‘আবার এসেছে আষাঢ়’ অথবা ‘বহুযুগের ওপার হতে আষাঢ়’- তাঁকে শুনছি আর আকাশ জুড়ে মেঘের আনাগোনা কিছু পরেই বৃষ্টি। খুব অবাক হয়েছিলাম। মুগ্ধ হয়ে শুনছি গানের জগতের এই আপোষহীন সম্রাটের গান। তারপর মনে হল “আষাঢ়” শব্দটি কি আমরা নির্ভুল উচ্চারণ করতে পারি? তিনি ‘আষাঢ়’ শব্দটি যেভাবে উচ্চারণ করলেন মনে হয় না আমরা কেও সেইভাবে উচ্চারণ করতে পারি।

পল রবসনের তথাকথিত ‘চ্যুতি’ যেমন ইতিহাসের মাত্রা পায়, তেমন ভাবে জর্জ বিশ্বাস কে খোঁজার জন্য জাতীয় চৈতন্যের গহন শিকড়ে নেমে যেতে হয়। পল রবসনের কথা মনে হল কারণ – দেবব্রত বিশ্বাসও শেষপর্যন্ত একজন আমাদের অতি প্রিয় আশ্রমিক গীতিকার ও সুরকারকে আমাদের সামনে নতুনভাবে নিয়ে আসার প্রয়াস করেছিলেন। রবসন যেমন নিগ্রো আধ্যাত্মিকতাকে ক্রমশ মুক্তি দিতে চাইছিলেন মার্কিনি শ্রমজীবীর মূল সংস্কৃতিতে তেমনই দেবব্রত বিশ্বাস তাঁর পূজা পর্যায়ের গানে রক্ষণশীলতাকে মুক্তস্রোত করে দিয়েছিলেন। সেই সময় রবীন্দ্রসংগীতের মৌলবাদ তাকে ব্রতভ্রষ্ট মনে করেন কিন্তু জর্জ বিশ্বাস রবীন্দ্রচর্চা সীমানার বাইরেও জনসমর্থন পেয়ে যান; অনেকটাই রবসন যেমন কালো সমাজের।

দেবব্রত বিশ্বাস যখন সক্রিয়, তখনও আমরা বুঝিনি সংস্কৃতির নির্দিষ্ট ফ্রেমের বাইরে কীভাবে চলে যাওয়া যায়। আজ হয়ত দেবব্রত বিশ্বাস রবীন্দ্রগানের একটি উপসংস্কৃতিও হয়ে উঠতে পারেন, যেমন হয়ত বিটল ঘরানায় পল ম্যাকার্টনি। নিগ্রো স্পিরিচুয়াল ও ব্রাহ্ম উপাসনারীতি আসলে উপলক্ষ ছিল। বিপ্লবী হয়ে ওঠা ছিল এদের নিয়তি।

মাঙ্গলিক রবীন্দ্রনাথ …

মাঙ্গলিক রবীন্দ্রনাথ …

প্রেমিকদের মূল মন্ত্র হল ‘প্রেম’। উপনিষদে এই ‘প্রেম’ শব্দটির সমার্থক শব্দ হল ‘আনন্দ’। এই প্রেম আর আনন্দের মধ্যে এক নিবিড় যোগ আছে আর তা হল সত্য। প্রেমের যা দুঃখ একজন প্রকৃত প্রেমিকের কাছে তা পরম আনন্দ। এর সঙ্গে সৌন্দর্যকেও যোগ করে নিতে হবে। কেননা সৌন্দর্যের আশ্বাস মনে প্রেমের জন্ম দেয় আর তার থেকেই আসে আনন্দ আর সেই আনন্দই চিনিয়ে দেয় পরম সত্যকে। এবং এই ভাবের থেকেই ‘মঙ্গল’ শব্দটি মনে আসে। কিন্তু গভীর মরমী চেতনায় সৌন্দর্য, প্রেম, আনন্দ, সত্য এই সমস্ত ভাবের স্তরই একটি পূর্ণতা নিয়ে সৃষ্টি হয়। কিন্তু ‘মঙ্গল’ শব্দটির মধ্যে পূর্ণতা থাকে না। কারন মঙ্গল মানেই অমঙ্গলের অস্তিত্ব। আমরা পরম করুণাময় ঈশ্বর কে মঙ্গলের অধীশ্বর বলে মনে করি তাহলে তো অমঙ্গলের অধীশ্বর হিসেবে শয়তানকে মানতে হয়। তবে তো ‘মঙ্গল’ পূর্ণতা পেল না। তবে প্রকৃতপক্ষে যিনি যেমন মানুষ তার ঈশ্বরকেও তেমনই রূপ দেন। তাই যিনি মানব সত্যের সাধনায় স্বয়ং পূর্ণসত্তায় উত্তীর্ণ হচ্ছেন একমাত্র তাঁর পক্ষেই জগতের পরম একক সত্তাকে উপলব্ধি করা সম্ভব।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আমরা মঙ্গলময় ঈশ্বরের প্রতি তাঁর বিশ্বাসের কথা জানতে পারি।
১. “সত্যমঙ্গল প্রেমময় তুমি, ধ্রুবজ্যোতি তুমি অন্ধকারে।
তুমি সদা যার হৃদে বিরাজ দুখজ্বালা সেই পাশরে-
সব দুখজ্বালা সেই পাশরে।।“

২. “আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর।।
…… বহে জীবন রজনীদিন চিরনূতনধারা,
করুনা তব অবিশ্রাম জনমে মরনে।।
স্নেহ প্রেম দয়া ভক্তি কোমল করে প্রাণ,
কত সান্ত্বন কর বর্ষণ সন্তাপহরনে।।“

৩. “চিরবন্ধু, চিরনির্ভর, চিরশান্তি
তুমি হে প্রভু-
তুমি চিরমঙ্গল সখা হে তোমার জগতে,
চিরসঙ্গী চিরজীবনে।।“

আমরা এই কবিতাগুলি থেকে তিনটি সিদ্ধান্তে আসতে পারি-
১. কবি এখানে সত্য ও পূর্ণের পাশেই ‘মঙ্গল’ কে স্থান দিয়েছেন, সুতরাং তাঁর কাছে সত্য, মঙ্গল সমার্থক।
২. ঈশ্বর শুধু মঙ্গলময় নন, তাঁর করুনা শুধু জীবনে নয় মরনের মধ্যে দিয়েও বর্ষিত হচ্ছে। ঈশ্বর ইহজীবনে নানানভাবে হৃদয়ে সান্ত্বনা বহন করে আনছেন এবং প্রতিনিয়ত দুঃখ হরণ করছেন।
৩. ঈশ্বর সর্বময়ই মঙ্গল। তাঁর মধ্যে ‘অমঙ্গলের’ কোন স্থান নেই ।

আমরা জানি পার্থিব যন্ত্রণার চূড়ান্ত ঘটনা হল মৃত্যু। প্রতিটি মানুষের মধ্যে চেতনালাভের প্রথম দিনটি থেকেই মৃত্যু নামের মধ্যে দিয়ে একটা ভয় কাজ করে। নিজের অহং বিনাশের ভয়, প্রিয়জনের সাথে চিরবিচ্ছেদের ভয়। কিন্তু কবি এই মৃত্যুকে ভয় বলে মানতে রাজি নন। তিনি মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই অমৃতের কাছে পৌঁছতে চেয়েছেন। তাই তো তিনি বলেছেন-
“ দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে তব মঙ্গল-আলোক
তবে তাই হোক।
মৃত্যু যদি কাছে আনে তোমার অমৃতময় লোক
তবে তাই হোক।।“

‘বৃহহদারন্যক’ উপনিষদে যে শাশ্বত বানী আছে।–
“অসতো মা সদ-গময়
তমসো মা জ্যোতির্গময়
মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়।।“

এখানে যেমন মৃত্যু থেকে অমৃতে উত্তরনের কথা বলা হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঔপনিষদিগের ঋষিদেরই সার্থক উত্তরসুরি হিসেবে উপলব্ধি করেছেন। তাই তিনিই বলতে পারেন-
“আমি ভুলবো না সহজেতে, সেই প্রানে মন উঠবে মেতে
মৃত্যু মাঝে ঢাকা আছে যে অন্তহীন প্রাণ।।“

রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই মঙ্গলকে প্রত্যক্ষ করতে চেয়েছেন। পাশাপাশি ব্যবহারিক জগতের অমঙ্গলকে তিনি সহায়ক রূপে গ্রহন করেছেন। কবির নিজের জীবনও নানান দুঃখ, বেদনায় জর্জরিত ছিল। এতো দুঃখ জ্বালার মধ্যেও তিনি স্থির বিশ্বাসে অবিচল থেকেছেন। ব্যাক্তিগত দুঃখের দিনে, সমাজের অবক্ষয়ের দিনে, অমঙ্গলের জয়ডঙ্কার দিনে কবি ‘সত্যমঙ্গল প্রেমময়’কেই শুধু স্মরণ করেছেন। তিনি বলেছেন-
“হিংসায় উন্মত্তপৃথ্বী, নিত্য নিষ্ঠুর দ্ধন্দ্ব;
ঘোর কুটিল পন্থ ইহার, লোভজটিল বন্ধ ।।……
ক্রন্দনময় নিখিল হৃদয় তাপদহনদীপ্ত
বিষয়বিষবিকারজীর্ণ খিন্ন অপরিতৃপ্ত।
দেশ দেশ পরিল তিলক রক্তকলুষগ্লানি,
তব মঙ্গলশঙ্খ আন, তব দক্ষিনপানি-
তব শুভসঙ্গীতরাগ, তব সুন্দর ছন্দ।
শান্ত হে, মুক্ত হে, হে অনন্তপুণ্য,
করুনাঘন, ধরনীতল কর কলঙ্কশূন্য।।“

“অমৃত’ কে জীবনের সার্থকরূপে ছেনে তোলবার সাধনাই ছিল কবি রবীন্দ্রনাথের কর্মযোগের প্রধান লক্ষ্য। কর্মের ক্ষেত্র দুটি; একটি মানস ক্ষেত্র, অপরটি বাস্তবক্ষেত্র। মানসক্ষেত্রের পরম সত্তার সাথে কবির প্রেমের যোগ আর বাস্তব ক্ষেত্রের পরম সত্তার সাথে তাঁর কল্যাণের যোগ। তাই তো সমাজের কল্যাণের মধ্যে দিয়েই পূর্ণের সুসমঞ্জস্য রূপটি কবি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই তো তিনি বলেছেন,- “ জগতের মধ্যে সামঞ্জস্য তিনি শান্তম, সমাজের মধ্যে সামঞ্জস্য তিনি শিবম, আত্মার মধ্যে সামঞ্জস্য তিনি অদ্বৈতম।।“

যে মানুষ সমাজের মঙ্গলের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেন তিনি যদি পরমেশ্বরকে চান তবে তিনি ব্যাক্তিগত ভাবে তাঁর দিকে অগ্রসর হতে পারেন। এখানে তিনি যেমন ব্যাক্তিসাধনায় পরমের দিকে অগ্রসর হন, তেমনি তাঁর একটি বিশ্বগত সাধনার দিকও থাকে আর সেই সাধনার ক্ষেত্র হল সমাজ। সর্বমানবের মধ্যে আপন আত্মার মিলন না হলে নিখিলাত্মা তাঁর মধ্যে প্রস্ফুটিত পদ্মের মতো বিকশিত হতে পারে না।

বিবেকানন্দও এই কারনেই শুধু নিজের মুক্তি চান নি। সমাজের প্রতিটি মানুষের মন মুক্ত না হলে বন্ধন দশা কাটবে না বলেই স্বামীজি মনে করতেন। কবিও এই ধারাতেই ভেবেছিলেন’-
“যারে তুমি ফেল নীচে সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে
পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।
অজ্ঞানের অন্ধকারে
আড়ালে ঢাকিছ যারে
তোমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান।।“

সুতরাং মানবাত্মার মুক্তি খুঁজতে হবে সাধারন মানুষেরই মধ্যে। এখান থেকে ছাড়পত্র না পেলে ‘নিখিল’-এর শতদলের পাপড়ি বন্ধই থেকে যাবে। তাই কবি সমাজের শ্রমজীবী মানুষের কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে মুক্তির রাস্তা খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন।–
‘তিনি গেছেন যেথায় মাটি কেটে
করছে চাষা চাষ-
পাথর ভেঙ্গে কাটছে যেথায় পথ
খাটছে বারোমাস।
রৌদ্র জলে আছেন সবার সাথে,
ধুলা তাহার লেগেছে দুই হাতে;
তারি মতন শুচি বসন ছাড়ি
আয়রে ধুলার ‘পরে।
মুক্তি?

ওরে কোথায় পাবি,মুক্তি কোথায় আছে।
আপনি প্রভু সৃষ্টি বাধন প’রে
বাঁধা সবার কাছে।।“

সমাজ ও মানব কল্যানের জন্য একমাত্র হাতিয়ার হল নিঃস্বার্থ কর্ম। তিনি লিখেছেন।– “আনন্দের ধর্ম যদি কর্ম হয় তবে কর্মের দ্বারাই সেই আনন্দস্বরূপ ব্রহ্মর সঙ্গে আমাদের যোগ হতে পারে। গীতায় একেই বলে কর্মযোগ।“

গীতায় কর্মযোগে বলা হয়েছেঃ
“তস্মাদসক্তঃ সততং কার্যং কর্ম সমাচর।
অসক্তো হ্যাচরন্ কর্ম পরমাপ্নোতি পুরুষ।।“

অর্থাৎ আসক্তি শূন্য হয়ে কর্ম সম্পাদন করলে পুরুষ পরমকে প্রাপ্ত হন। এখানে কবি গীতার কঠিনতা কে অনেকটাই মাধুর্য দিয়ে পূর্ণ করেছেন।‘অনাসক্তি’র প্রকৃত যে তিক্ততা নয় তা যে শুধু ভোগাকাঙ্খা ত্যাগ, সেই কথাটা রবীন্দ্রনাথের আনন্দ মিমাংসার দ্বারা আমরা স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারি। তাঁর কবিতার মধ্যে দিয়েই সেই তত্ত্ব উপলব্ধির সজীবতা প্রকাশিত হয়েছে-
“কর্ম করি যে হাত লয়ে কর্মবাঁধন তারে বাঁধে,
ফলের আশা শিকল হয়ে জড়িয়ে ধরে জটিল ফাঁদে।
তোমার রাখী বাঁধো আঁটি- সকল বাঁধন যাবে কাটি,
কর্ম তখন বীনার মতো বাজবে মধুর মূর্ছনাতে।।“

“আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি’, মানব কল্যান- সমাজ সেবা- কর্মযজ্ঞ- রবীন্দ্রনাথের ‘ব্যাক্তি আমি’তেই সমস্ত উপলব্ধির মূল শিকড় কিন্তু এই মঙ্গলময় ‘পরম আমি’র মধ্যেই নিহিত আছে।

আজ আন্তর্জাতিক বন্ধু দিন

225726

আজ আন্তর্জাতিক বন্ধু দিন। বন্ধুত্ব তো তা-ই, যাকে নিক্তি দিয়ে মাপা যায় না। প্রকাশ করা যায় না সংজ্ঞা দিয়ে। মানুষ যুগে যুগেই বন্ধুত্বকে উদযাপন করেছে। কিন্তু বন্ধু দিবস কীভাবে এল?

আসলে বহু বছর আগে ১৯৫৮ সালে প্যারাগুয়েতে প্রথম এই দিনটি সেলিব্রেট করা হয়। ডাক্তার রামন আর্টেমিও ব্রাকো ২০শে জুলাই তাঁর বন্ধু পুয়ার্ত পিনাস্ক এর সঙ্গে প্রথম ডিনার করে এই দিনটি পালন করেন। তারপর ডাক্তার রামন আর্টেমিও ব্রাকোই ১৯৫৮ সালে প্রথম ৩০শে জুলাই প্রস্তাব রাখেন ওয়ার্ল্ড ফ্রেন্ডশিপ ক্রুসেডে। সেদিন থেকেই ৩০শে জুলাইকে আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব দিবস হিসাবে পালন করা হয়।

যদিও অনেক দেশে এই দিনটি তারিখে পালন করা হয়। যেমন- ভারতে এই দিনটি পালন করা হয় অগাস্ট মাসের প্রথম রবিবার। ব্রাজিল, উরুগুয়ে তে ২০ জুলাই, এরপর ২০১১ সালে ২৭ এপ্রিল জেনারেল অ্যাসেম্বলি অফ দ্য ইউনাইটেড নেশন ৩০শে জুলাই তারিখটিকে অফিসিয়ালি আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব দিবস হিসেবে ঘোষিত করে।

যদিও আজকাল বন্ধু শব্দটি ভীষণ ভাবায়। সত্যিই কী বন্ধু কেউ হয় সেইভাবে? ছোটবেলায় বন্ধু শব্দের অর্থ না বুঝেই কতো বন্ধু ছিলো, যাদের সাথে ছুটোছুটি করে বড় হয়ে ওঠা। তারপর একদিন বড় হয়ে যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে যাওয়া। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, কর্মস্থলে কতো বন্ধু, কিন্তু সত্যিই কী তারা প্রকৃত বন্ধু হয়ে উঠতে পারে? ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। আর ব্যতিক্রম আছে বলেই বন্ধু শব্দ এখনও অভিধানে আছে।

বন্ধু নিয়ে কিছু বিখ্যাতদের বাণী –
“উৎসবে, বিপদে, দুর্ভিক্ষে, শত্রুর সঙ্গে সংগ্রামকালে, রাজদ্বারে এবং শ্মশানে যে সঙ্গে থাকে, সে-ই প্রকৃত বন্ধু” চাণক্য বলেছেন।

সিসেরো বলেছেন – “কখনো কোন বন্ধুকে আঘাত করো না, এমনকি ঠাট্টা করেও না।”

এরিস্টটল বলেছেন-
“প্রত্যেক নতুন জিনিসকেই উৎকৃষ্ট মনে হয়। কিন্তু, বন্ধুত্ব যতই পুরাতন হয়,ততই উৎকৃষ্ট ও দৃঢ় হয়।”
“বন্ধু কি? এক আত্মার দুইটি শরীর।”

চার্লি চ্যাপলিন বলেছেন –
“আমার সব থেকে ভালো বন্ধু হল আয়না, কারন আমি যখন কাঁদি তখন সে হাসে না।”

এইরকম বহু বাণীই তুলে ধরা যায়। কিন্তু বাস্তবে এইরকম বন্ধু পাওয়া কাঁঠালের আমসত্ত্বের মতো।
অথচ বন্ধু মানে বুঝি, যে সবরকম পরিস্থিতিতে হাত ধরে থাকবে। আপনার শক্তি হবে। বন্ধু হলো সেই যে আপনার চোখের জল সহ্য করতে পারবে না। বন্ধু হলো সে যে আপনার ভালোবাসা, বিশ্বাস নিয়ে খেলা করবে না। বন্ধু হলো সে যে আপনাকে প্রাধান্য দেবে, ঝগড়া হবে, মান – অভিমান হবে, অথচ একে অপরকে সম্মান করবে, ভুলেও অপমান করবে না। দোষ করলে ইগো সরিয়ে একে অপরকে ‘সরি’ বলবে। প্রকৃত বন্ধু ঠিক খড় কুটোর মতো আপনার হাতের সাথে আটকে থাকবে।

বন্ধু দিবসে সবার জন্য শুভেচ্ছা রইলো।

বিষাদ ও রূপকথা

79131

বিষণ্ণ নদীর ধারে চুপচাপ পাহারায় বসে
রাতচরা পাখি, ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে
মেঘেদের দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক।
রেখে যায়, এক টুকরো বিশ্বাস, তখন‌ও
আঁজলা ভরে জল তুলে নেওয়া বাকি।

একটুকরো মেঘ কার্নিশে এসে
দাঁড়ায়, রজনীগন্ধা হতে চেয়ে। অজস্র
ক্রিস্টালের মতো বৃষ্টি নামে, বুক জুড়ে,
উঠোন জুড়ে। গ্রীষ্মের ঝিমলাগা দুপুরে
ঝলসে যেতে যেতে মন ভাবে …

“আমার মতো সুখী কে আছে, আয় সখী
আয় আমার কাছে”।

স্বপ্ন

28069

স্বপ্নে আমার পাহাড়পুরে বাস
ছুটছে দেখো পাহাড়ি এক নদী
বিষাদ নিয়েই কাটতো বারোমাস
তোমার সাথে দেখা না হতো যদি

তোমার শ্বাসে রাখা আমার শ্বাস
দুঃখ সবই সরছে দূরে দুরে
জীবনজুড়েই তোমাকে বিশ্বাস
মায়ার কুসুম যাকনা উড়ে উড়ে

তোমায় নিয়েই অহংকারী আমি
তারায় তারায় তোমারই ছবি আঁকি
ভালোবাসা জানি সবার চেয়ে দামী
ইচ্ছে ভীষণ জড়িয়ে তোমায় থাকি

তোমার পরশ আমার শরীর পেলে
উঠবে বেজে সারেঙ্গি সাত সুর
আকাশ কুসুম স্বপ্নে সাগর এলে
দুঃখ যত যাকনা বিষাদপুর।

বৃষ্টি

21142aa

একপশলা বৃষ্টি বয়ে নিয়ে এলো তোমার সুবাস। একলা হয়ে যাওয়া দুপুরের কাপাসিয়া মেঘে ভেসে আসে তোমার কথারা। এক একটা দিনের সাথে মিশে যায় গুঁড়ো গুঁড়ো ভালোবাসার অনুভূতি। মন জুড়ে, কোল পেতে, এক বুক আকাশ নিয়ে বসে থাকি তোমার অপেক্ষায়। দিগন্তের চিহ্ন বরাবর মনে মনে হেঁটে আসি তোমার সাথে …

.
___________________
ছবি : Anushka Saha ❤️
মডেল : Jayoti Saha ❤

বর্ষা বিলাস

12721386_n

হঠাৎ একটা আর্তনাদ এসে জমাট বেঁধে রইল আমার হাতের মুঠোয়। অন্তহীন জলরেখায় এক জ্বলন্ত মোমের মতো। মানুষের মুখোশ চারপাশে ঘিরে থাকে আর ছায়া অপচ্ছায়ার বীভৎস মুখ।

শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও পড়ে রইল কিছু শব্দ, কিছু না বলা কবিতা, একরাশ ঘৃণা, আর এক আকাশ অভিমান। জমাট বাঁধা কান্নায় চিহ্নিত করে গেলাম আমার পথ, এই উদভ্রান্ত বর্ষায়।

গাছপালা উপড়ে দিলেই বন্ধ্যা মাটি, আর গোলাপের কাঁটার ছোঁয়ায় রক্তে ভরে যায় হাত, সমুদ্রের নোনা ঢেউ নেচে ওঠে দুচোখের কোণে। ঠিক যেন নিষ্ঠুর গাংচিলের মাছ শিকার।

কাল রাতেই মিশিয়ে ফেললাম নিজেকে বর্ষার বৃষ্টির সাথে, চোখের জলের সাথে,এদের সাথে বন্ধুত্ব আমরণ। মিশিয়ে নিলাম কিছুটা ফুল,পাতা আর একফালি পাথরের সাথে।

মাঝে মাঝেই নেচে ওঠে স্বপ্ন ছুরির ফলায়, বুকের ভেতরে উথাল পাথাল ঢেউ, আর, জ্যোৎস্নায় ঝড়ের মুকুট পড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি, সেই প্রাচীন পাহাড়ের চূড়োয়; একা আমি।

প্রতিদিন যে নিজের বুকে আঁকে ক্রুশ চিহ্ন।

বৃষ্টি সই

198525104_43

আমার কাছে বৃষ্টি আসে রোজই, শার্সি ভেজায়, আরশি ভেজায়, ঝাপসা চোখে ইচ্ছে মেখে, চুপিচুপি জানলায় এসে আমায় ডাকে, কুচি কুচি বৃষ্টি ছুঁয়ে যায় আমার মুখ। হালকা মাটির গন্ধ নিয়ে, আলতো হাতে আমার চুল উড়িয়ে, বেলা অবেলায় ডাক দিয়ে যায়, ঝিরঝিরিয়ে, আমার ডাকনাম ধরে স্পষ্ট বলে,

“টুউউউকিইইই”…

আমার কাছে বৃষ্টি আসে রোজই। মুচকি হেসে, সবুজ পাতায় নেচে নেচে, আলতো পায়ে কখন এসে দরজা খুলে, আমার গালে টুসকি মেরে, চিলতে খানেক ভিজিয়ে আমায়, হটাৎ ডাক নামেতে ডেকে বলে,

“কুমিরডাঙ্গা খেলবিইই আয়”

আমার কাছে বৃষ্টি আসে রোজই। মন খারাপের উজান বেয়ে, যখন তখন চমক মেখে,মেঘের দেশের হদিশ হতে, বৃষ্টি আসে মন উঠোনে, রিমঝিম তার গানের সুরে, আমায় বলে কানে কানে,

“দেখবি তোকে লুকিয়ে ফেলি”
আমার কাছে বৃষ্টি আসে রোজই!
******
.
আঁকা : রিয়া চক্রবর্তী।

সম্পর্কে নক্ষত্রেরা : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কাজী নজরুল ইসলাম

সম্পর্কে নক্ষত্রেরা

বাংলা সাহিত্যের দুই দিকপাল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর নজরুল ইসলাম। কেমন ছিলো দুজনের মধ্যে সম্পর্ক? বাংলা সাহিত্যের দুই মহান কবির মধ্যে যে গভীর সুসম্পর্ক ছিল তা আমাদের অনেকেরই অজানা।

রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল সম্পর্ক : ১
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘১৪০০ সাল’ কবিতা লেখেন ১৩০২ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে। কবিতাটিতে রবীন্দ্রনাথ শতবর্ষের পরের পাঠককে বসন্তের পুষ্পাঞ্জলি পাঠিয়েছেন।

“আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতুহলভরে, আজি হতে শতবর্ষ পরে!”

কাজী নজরুল ইসলাম ১৩৩৪ সালের আষাঢ় মাসে তাঁর ‘১৪০০ সাল’ কবিতায় এর উত্তর লেখেন। তাতে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও ভক্তি।

“আজি হ’তে শতবর্ষ আগে
কে কবি, স্মরণ তুমি করেছিলে আমাদেরে
শত অনুরাগে,
আজি হ’তে শতবর্ষ আগে!”

রবীন্দ্রনাথ নজরুল সম্পর্ক: ২
রবীন্দ্রনাথ যেমন অনুজ নজরুলের প্রতি আশীর্বাদ বাণী প্রদান করে প্রীত হয়েছেন, তেমনি নজরুলও অগ্রজের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে হয়েছেন ধন্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর রচিত ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি কাজী নজরুলকে উৎসর্গ করেছিলেন। সেটি ছিল রবীন্দ্র পরিবারের বাইরে প্রথম কাউকে একটি বই উৎসর্গ করার ঘটনা।

রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক বরাবর ছিল ভালো। রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে যে কী স্নেহ করতেন তার আরেকটি উদাহরণ- রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘গোরা’ উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি ছায়াছবিতে নজরুল ছিলেন সঙ্গীত পরিচালক। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ এতে বাধ সাধলে রবীন্দ্রনাথ তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং নজরুলকে সঙ্গীত পরিচালনার স্বীকৃতি প্রদান করেন।

রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সম্পর্ক : ৩
কমরেড মোজাফ্ফর আহমেদ তাঁর স্মৃতি কথায় লিখেছেন, ‘নজরুল ইসলাম বহু রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতেন। তিনি কি করে যে রবীন্দ্র সঙ্গীতগুলো মুখস্ত করেছিলেন তা ভেবে অবাক হই।’ সেকালে যারা নজরুলের কাছে গান শিখেছেন, কবি তাদেরকে রবীন্দ্র-সঙ্গীত শিখিয়েছেন শুরুতে। কাজী মোতাহার হোসেনও নজরুলের কাছে দু’খানি রবীন্দ্র-সঙ্গীত শিখেছিলেন। ‘কে যেন আমারে এনেছে ডাকিয়া এসেছি ভুলে’ এবং ‘তোরা পারবি নাকি যোগ দিতে সেই ছন্দেরে।’ প্রতিভা বসুকে নজরুল প্রথম শিখিয়েছিলেন রবীন্দ্র-সঙ্গীত ‘পথ দিয়ে কে যায় গো চলে।’ উমা মৈত্রকে শিখিয়েছিলেন ‘আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি।’ বিখ্যাত ফজিলাতুন্নেসার বোন শফিকুন্নেসাকে শিখিয়েছিলেন ‘হে ক্ষণিকের অতিথি এলে প্রভাতে কারে চাহিয়া।’

একবার শান্তিনিকেতিনে যাওয়ার সময় নজরুল ডক্টর শহীদুল্লাহকে গীতাঞ্জলির সব গান স্মৃতি থেকে গেয়ে শুনিয়েছিলেন ট্রেনের কামরায় যেতে যেতে। রবীন্দ্রনাথ এই কথা শোনার পর বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। মজার ব্যাপার হল গল্পগ্রন্থ ‘ব্যথার দান’ ও ‘রিক্তের বেদন’ এবং ‘বাঁধনহারা’ পত্রোপন্যাসে রবীন্দ্রনাথের গানের প্রচুর উদাহরণ আছে।

রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সম্পর্ক : ৪
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সরাসরি দেখা হয়েছিল ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে শান্তিনিকেতনে। তখন নজরুলের বয়স ২২ বছর। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে গিয়েছিলেন। বোলপুর স্টেশনে কাজী নজরুল ইসলাম এবং ড. শহীদুল্লাহকে অভ্যর্থনা জানান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একান্ত সচিব কবি সুধাকান্ত রায় চৌধুরী। নজরুল সেদিন রবীন্দ্রনাথের কাছে একটি কবিতার আবৃত্তি শুনতে চেয়েছিলেন। কবিগুরু বললেন, ‘সে কি? আমি যে তোমার গান ও আবৃত্তি শোনবার জন্যে প্রতীক্ষা করে আছি, তাড়াতাড়ি শুরু করে দাও।’ নজরুল আবৃত্তি করেছিলেন, অগ্নি-বীণা’র ‘আগমনী’ কবিতাটি। এছাড়াও তিনি কয়েকটি রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে শোনান। নজরুলের অনুরোধে সেদিন রবীন্দ্রনাথ আবৃত্তি করে শোনান, ‘মাধবী হঠাৎ কোথা হতে, এল ফাগুন দিনের স্রোতে, এসে হেসেই বলে যাই যাই।’…

এরপর বেশ কয়েকবার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সাক্ষাৎ হয়। ১৯২১-এর ডিসেম্বর মাসে বিদ্রোহী কবিতা রচনা করে নজরুল সরাসরি চলে যান জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে। উচ্চকণ্ঠে ‘দে গরুর গা ধুইয়ে’ গাইতে গাইতে নজরুল ঠাকুর বাড়িতে প্রবেশ করে ডাকলেন গুরুদেব আমি এসেছি। উচ্চস্বরে আবৃত্তি করতে থাকেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি। তিনি রবীন্দ্রনাথকে বলেন, গুরুদেব আমি আপনাকে খুন করবো। রবীন্দ্রনাথ ‘বিদ্রোহী’ কবিতা শুনে কবিতার প্রশংসা করেন এবং নজরুলকে জড়িয়ে ধরে বলেন ‘সত্যিই তুই আমাকে খুন করেছিস’।

রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সম্পর্ক : ৫
নজরুলের সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’ প্রকাশিত হয় ১৯২২-এর ১১ আগস্ট (১৩২৯ বঙ্গাব্দের ২৪ শ্রাবণ)।তরুণ কবির অনুরধে রবীন্দ্রনাথ এই পত্রিকার আশীর্বাণী লিখে দেন রবীন্দ্রনাথ নিজের হাতে —

‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু’

“আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
অলক্ষনের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা,
জাগিয়ে দেরে চমক মেরে
আছে যারা অর্ধচেতন।”

এই কাব্যবাণী প্রতি সংখ্যায় ছাপা হতো। এরপর নজরুল সম্পাদনা করেন ‘লাঙ্গল।’ এবারও রবীন্দ্রনাথ শুভেচ্ছায় সিক্ত করেন নজরুলকে। প্রথম প্রকাশ ২৫ ডিসেম্বর, ১৯২৫।

“জাগো জাগো বলরাম
ধর তব মরুভাঙ্গা হল
বল দাও, ফল দাও
স্তব্ধ করো ব্যর্থ কোলাহল।”

মজার কথা হলো, প্রথম শুভেচ্ছাস্তবকটি সবাই জানলেও কোন কারণে পরেরটি তেমন বিখ্যাত হয় নি।

রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সম্পর্ক : ৬
ধূমকেতুর ১২শ সংখ্যায় (২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২) প্রকাশিত নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ নামক একটি প্রতীকধর্মী কবিতা প্রকাশের পর নজরুলকে গ্রেফতার করে তাঁর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহ মামলা করা হয়। ১৯২৩-এর ১৬ জানুয়ারি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহো মামলার রায় দেন। এতে নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ প্রদান করা হয়। এই বছরই ২২ ফেব্রুয়ারি কারাগারে থাকা অবস্থায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। কিন্তু সময় ও শরীর অনুকূল না থাকায় তিনি পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে বইয়ের এক কপি স্বাক্ষরসহ দেন। কবিতায় লেখেনঃ

‘শ্রীমান কবি নজরুল ইসলাম স্নেহভাজনেষু।’
‘সে সুন্দর বহ্নিদগ্ধ মোর বুকে তাই
দিয়েছিলে ‘বসন্তে’র পুষ্পিত মালিকা।’

রবীন্দ্রনাথ পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ডেকে বলেন, ‘জাতির জীবনে বসন্ত এনেছে নজরুল। তাই আমার সদ্য প্রকাশিত ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যখানি ওকেই উৎসর্গ করেছি। সেখানা নিজের হাতে তাকে দিতে পারলে আমি খুশি হতাম, কিন্তু আমি যখন নিজে গিয়ে দিয়ে আসতে পারছি না, ভেবে দেখলাম, তোমার হাত দিয়ে পাঠানোই সবচেয়ে ভালো, আমার হয়েই তুমি বইখানা ওকে দিও।’
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘নজরুলের কাব্যে অসির ঝনঝনানি আছে। আমি যদি তরুণ হতাম তা হলে আমার কলমেও ওই একই ঝংকার বাজতো।’

পবিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে বইটি দিয়ে রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছিলেন, ‘নজরুলকে বলো, আমি নিজের হাতে তাকে দিতে পারলাম না বলে সে যেন দুঃখ না করে। আমি তাকে সমগ্র অন্তর দিয়ে অকুণ্ঠ আশীর্বাদ জানাচ্ছি। আর বলো, কবিতা লেখা যেন কোন কারণেই সে বন্ধ না করে। সৈনিক অনেক মিলবে কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা জোগাবার কবিও তো চাই।’

নজরুল বইটি পেয়েই বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। এ প্রসঙ্গে নজরুল লিখেছেন, ‘এ সময়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত’ নাটক আমায় উৎসর্গ করেন। তাঁর এই আশীর্বাদ-মালা পেয়ে আমি জেলের সর্বজ্বালা, যন্ত্রণা ক্লেশ ভুলে যাই।’ নজরুল ইসলাম তাঁর ‘সঞ্চিতা’ কাব্য গ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেন।

রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সম্পর্ক : ৭
১৯২৩-এর ১৪ এপ্রিল হুগলি জেলে নজরুল অনশন করেন। এই অনশন ভঙ্গ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ প্রেসিডেন্সি জেলের ঠিকানায় নজরুল ইসলামের কাছে টেলিগ্রাম পাঠান। তাতে লেখেন, Give up hunger strike, our literature claims you. জেল কর্তৃপক্ষ টেলিগ্রামটি ফেরত পাঠায়। কারণ, নজরুল তখন ছিলেন হুগলি জেলে। তখন কবিগুরু লেখেন — *একটি ঐতিহাসিক চিঠি*

কল্যাণীয়েষু, রথী,
নজরুল ইসলামকে Presidency Jail এর ঠিকানায় টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলুম। লিখেছিলুম ‘Give up hunger strike, our literature claims you’। জেল থেকে Memo এসেছে The addressee not found; অর্থাৎ ওরা আমার message দিতে চায় না। কেননা, নজরুল প্রেসিডেন্সী জেলে না থাকলেও ওরা নিশ্চয় জানে সে কোথায় আছে। অতএব,নজরুল ইসলামের আত্মহত্যায় ওরা বাধা দিতে চায় না।
শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
[সূত্রঃ ‘বসুমতী’ পত্রিকা]

রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সম্পর্ক : ৮
রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে বোলপুরে শান্তিনিকেতনে থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন সৈনিক নজরুল শান্তিনিকেতনের শিক্ষার্থীদের শারীরিক শিক্ষা দেবেন। কিন্তু অস্থির প্রকৃতির বিদ্রোহী নজরুল কোথায়ও এভাবে নিয়মের বেড়াজালে আটকে থাকতে চাননি। আরও পরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের দার্জিলিংয়ে দেখা হয়। এ সময় নজরুল প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি তো ইতালি গেছেন সেখানে কবি দ্যনুনজিও’র সঙ্গে দেখা হয়েছিল কি না? রবীন্দ্রনাথ হেসে বলেছিলেন দেখা হবে কি করে তিনি যে তোমার চেয়েও পাগল।

রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সম্পর্ক : ৯
নজরুল ১৯৩৫-এর জুন মাসে ‘নাগরিক’ পত্রিকার জন্য রবীন্দ্রনাথের কাছে লেখা চেয়ে চিঠি পাঠান। তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ৭৫ বছর। বেশ অসুস্থ। এর উত্তরে রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৬-এর ১ সেপ্টেম্বর লিখেছিলেন, ‘…তুমি তরুণ কবি, এই প্রাচীন কবি তোমার কাছে আর কিছু না হোক করুণা দাবি করতে পারে। শুনেছি বর্ধমান অঞ্চলে তোমার জন্ম। আমরা থাকি পাশের জেলায় (বীরভুমের বোলপুরে)। কখনো যদি ঐ সীমানা পেরিয়ে আমাদের এদিকে আসতে পারো খুশি হব।’

উক্ত চিঠির জবাবে নজরুল ‘নাগরিক’ পত্রিকায় লেখেন, কবিতা

“হে কবি, হে ঋষি অন্তর্যামী আমারে করিও ক্ষমা।
পর্বত-সম শত দোষত্রুটিও চরণে হল জমা।..
তুমি শ্রষ্টার শ্রেষ্ঠ বিস্ময়-
তব গুণে-গানে ভাষা-সুর যেন সব হয়ে যায় লয়।…
প্রার্থণা মোর, যদি আরবার জন্মি এ ধরণীতে,
আসি যেন শুধু গাহন করিতে তোমার কাব্য-গীতে।”

রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সম্পর্ক : ১০
কাজী নজরুল ইসলাম গুরু বলে মান্য করতেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। নজরুল নিজের কাব্য চর্চা থেকে অন্যত্র মনোনিবেশ করায় রবীন্দ্রনাথ কাজী নজরুলকে বলেছিলেন, ‘তুমি নাকি এখন তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাছো?’ নজরুল উত্তরে লিখেছিলেন, ‘গুরু কন আমি নাকি তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাছি…।’

রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সম্পর্ক : ১১
রবীন্দ্রনাথের বয়স আশি বছর পূর্তি হয় ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে। তখন কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে লিখেন, ‘অশ্রুপুষ্পাঞ্জলি’। ১৯২০ থেকে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পূর্বকাল পর্যন্ত রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক ছিল পারস্পরিক স্নেহ ও শ্রদ্ধার।

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে নজরুল যে গভীরভাবে শোকাভিভূত হয়েছিলেন তার পরিচয় রবীন্দ্রনাথের পরলোকগমনে তাৎক্ষণিকভাবে রচিত নজরুলের বিভিন্ন কবিতা ও গানে পাওয়া যায়। এই দিন (২২ শ্রাবণ’ ১৩৪৮) কাজী নজরুল ইসলাম আকাশবাণী বেতার কেন্দ্র থেকে ধারাবর্ণনা প্রচার করেন। তিনি আবৃত্তি করেন ‘রবিহারা’ কবিতা এবং রচনা করেন ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে’। এ ছাড়া ‘সালাম অস্তরবি’ এবং ‘মৃত্যুহীন রবীন্দ্র’ নামে দুটি কবিতা রচনা করেন।

_____________________

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর এক বছর পরেই নজরুল চিরতরে অসুস্থ এবং ক্রমান্বয়ে সম্বিতহারা ও নির্বাক হয়ে যান। বাংলার দুই মহান কবির কণ্ঠ প্রায় একই সময়ে নীরব হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল বাঙালি জাতি ও বাংলার দুই মহান ব্যক্তি। তাঁদের মহত্ব বাঙালির গর্বের। একজন আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ, অপরজন আমাদের প্রাণের কবি, চিরতরুণ কবি নজরুল ইসলাম। এ বিষয়গুলো সাহিত্যের ইতিহাসে উপেক্ষিত। দুই মহান কবির জীবনের এদিকগুলোয় আলোকপাত হওয়া উচিত।

তথ্য : সংগৃহিত।