শংকর দেবনাথ এর সকল পোস্ট

শংকর দেবনাথ সম্পর্কে

শংকর দেবনাথ জন্মঃ ২১ অক্টোবর, ১৯৭৪ প্রকাশিত গ্রন্থ - কবিতার বইঃ ১) আত্মহনন অথবা মৈথুন ২) শিয়রে নীলাভ জ্বর ৩) পরকীয়া ঘুম ছড়ার বইঃ ১) দুধমাখা ভাত ২) টক ঝাল তেতো কড়া ৩) ফাটকা কথার টাটকা ছড়া ৪) লাগ ভেল্কি লাগ ৫) রসে কষে ভরা প্রবাদের ছড়া গল্পগ্রন্থঃ ১) দুই শালিকের গল্প ২) গাছের জন্মদিন পিডিএফ ছড়ার বই: ১. ফাটকা কথার টাটকা ছড়া ২. সুজন পাখির কূজন ৩. অথৈ প্রাণের ধারা ৪. ছন্দ মাতে বন্দনাতে ৫. কিম্ভুতকিমাকার ৬. অপ্রচলিত ছড়া ৭. আমার সুকুমার ৮. প্রাণের ঠাকুর ৯. গাছপাগলের পদ্য ১০. ছড়ায় পড়া ১১. শব্দ নিয়ে মজা ১২. ভূত আছে ভূত নেই ১৩) ঠাকুরদাদার বউ ১৪) তাই রে না না ১৫) খুশি মনে পুষি ছড়া ১৬) স্বরবর্ণের ঘর সম্পাদিত পত্রিকাঃ ছোটদের ভোরের পাখি ভেল্কি ছড়াপত্র ঠোঁটকাটা মাসিক ছড়াপত্রিকা পুরষ্কার ও সম্মাননাঃ ১। নিখিলবঙ্গ শিশুসাহিত্য সংসদ প্রদত্ত " কবি কৃত্তিবাস সম্মাননা" -২০১৮ ২। দীনবন্ধু রাখালদাস বিভূতি বিনয় একাডেমি প্রদত্ত " কবি যোগীন্দ্রনাথ সরকার সাহিত্য সম্মান -২০১৯

অণুনক্ষত্র

ত্রিকালদর্শী বট। অসংখ্য ঝুরি নামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আদিগন্ত মাঠের মধ্যিখানে।
তারই ছায়ার মায়ায় বসে আছে এক রহস্যময়ী নারীমূর্তি। তপস্বিনীর মত। মুখে স্মীত হাসি। অনন্তে নিক্ষিপ্ত দৃষ্টির মধ্যে যেন অন্তহীন মহাকাশ। চিন্তাচর্চিত কপালের ভাঁজেভাঁজে যেন বয়ে চলেছে মহাকালের স্রোত।
দীর্ঘদেহী এক পুরুষমূর্তি সামনে এসে দাঁড়ায়। পথশ্রমে যেন ক্লান্ত। শব্দসম্ভারে যেন নুয়ে পড়েছে তার মস্তক। চোখের ভেতরে যেন যাপনের গল্পরা সন্তরণে ব্যস্ত।

– কবিতা, তুমি এখানে? এই নির্জনে?
– তুমি!
– কথাদের বয়ে বয়ে বড় ক্লান্ত আমি। তোমার পাশে একটু বসবো?

নারীমূর্তি সম্মতিসূচক ইশারা করে।

– আমি তোমাকে ছুঁতে চাই কবিতা।

কবিতা হাসে। হাত বাড়ায়।

পুরুষমূর্তিটি মিশে যেতে চায় কবিতার দেহে। মনে।

কবিতা দেয় হৃদয়।

পুরুষ দেয় কথা।

জন্ম নেয় এক নতুন অণুনক্ষত্রের।

ক্ষুদিরাম বন্দনা

১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট ক্ষুদিরাম ফাঁসির মঞ্চে দেশমাতৃকার চরণে আত্মাহুতি দেন। তাঁকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই…

একটি কিশোর ছেলে
পাখির ডানা মেলে-
যার বেড়ানোর কথা ছিল
শুধুই হেসে- খেলে।

ভাবনাবিহীন বুকে
খই ফোটানো মুখে-
বন্ধুগণের সঙ্গে থাকার
কথা মনের সুখে।

সেই সে কিশোর ছেলে
সবকিছুকেই ফেলে-
বেরিয়ে পড়ে আঁধার পথে
আলোর প্রদীপ জ্বেলে।

অকুতোভয় মনে
ঝাঁপিয়ে পড়ে রণে-
ভারত-মায়ের পায়ের শেকল
ভাঙার দৃঢ়- পণে।

ভিনদেশিদের ছলে
ফাঁসির দড়ি গলে-
প্রাণ দিল সে অবহেলেই
মায়ের চরণ- তলে।

সে তুমি আর আমি
সবাই জানি নামই-
বঙ্গমায়ের অঙ্গভূষণ
শহীদ ক্ষুদি- রামই।

শ্রাবণের ধারার মত

আমাদের জীবনে আজ নিরস খরা
হৃদয়ে ঘর বেঁধেছেে নষ্ট জরা।
মননে লালসা বিষ তুলছে ফণা,
দু’চোখে বিভেদ-ঘৃণার অগ্নিকণা।

পুড়ে যায় আগুণ হাওয়ায় প্রাণের চারা,
ঘিরেছে অন্ধকারের বন্ধ কারা।
সবুজের অন্তরে আজ ঝরার ভীতি,
বুকে নেই সুখ আবেগের প্রীতির গীতি।

আমাদের নেই কিছু আর এই বেদিনে,
কেমনে তোমার কাছে যাই গো চিনে?
গুরুদেব তুমিই এখন সামনে এসে,
দাঁড়াও আর বাড়াও দু’হাত ভালোর বেশে।

হে কবি শোনাও তোমার অভয়বাণী,
ভিজাও আজ রুক্ষতাময় জীবনখানি।
তোমার ওই আলোর সুধা ঘর ও দোরে,
“শ্রাবণের ধারার মত পড়ুক ঝরে।”

স্বপ্নচারী (ছড়া সংলাপ)

ছড়া-সংলাপ
**************
স্বপ্নচারী
শংকর দেবনাথ

সূত্রধরঃ
মা আর বাবা আপিস ঘরে
হাপিস হয়ে থাকে,
কাজের মাসি পাশের রুমে
ঘুমিয়ে নাক ডাকে।

গ্রীষ্মদিনের নিঝুম দুপুর
দৃশ্য ভাসে চোখে,
মন হেঁটে যায় মেঠো পথের
কোন সে অরূপলোকে।

পথের পাঁচালি বইখানা
সামনে আছে খোলা,
বুকের ভেতর কল্প-সুখের
গল্পরা দেয় দোলা।

আঁখির মাঝে পাখির ডানা-
আকাশি নীল আঁকে,
মন হারানো কোন বাউলা
অচীন দেশে ডাকে?

অট্টালিকার কটমটানির
বন্দি জীবন-গোঠে,
সর্বনাশা ভালবাসায়
মন হাঁফিয়ে ওঠে।

ভাল্লাগে না একলা এমন
ছোট্ট ছেলে তপুর-
মন হতে চায় সঙ্গী কেবল
দুর্গা এবং অপুর।

নিরুদ্দেশে নি-উদ্দেশে
কেবল চেয়ে থাকে,
মিষ্টি সুরের বৃষ্টি ঢেলে
হঠাৎ কে গো ডাকে ?

কণ্ঠস্বরঃ
ভাই রে তপু! বাইরে এসো,
প্রাণের ডানা নেড়ে-
নাই রে বাঁধা, যাই রে চলো 
বন্দি জীবন ছেড়ে!

তপুঃ
সঙ্গীহারা কারাগারের
নিদয় হৃদয়পুরে-
কে তুমি গো ডাকছো আমায়
অমন মধুর সুরে?

কণ্ঠস্বরঃ
অমন করে ডাকলে তুমি
কেমন করে দুরে –
থাকব বলো। তাইতো এলাম
তোমার স্বপ্নপুরে।

তোমার প্রাণের বন্ধু আমি
নিশিন্দিপুর বাড়ি-
আমিই অপু। ডাকলে তুমি
না এসে কি পারি?

তপুঃ
সত্যি তুমি দুর্গার ভাই?
কিন্তু কেমন করে-
এই শহরে দুই পহরে
আসলে আমার দোরে?

অপুঃ
শব্দরেখায় আঁকা তোমার
সামনে রাখা ওই
পথের পাঁচালির ভেতরে
গল্প হয়ে রই।

এবং থাকি তোমার মত
সব ছোটদের মনে-
বেরিয়ে পড়ি চোখ এড়িয়ে
মনহারানোর ক্ষণে।

তোমার মনে লুকিয়ে ছিলাম
মুখিয়ে ছিলাম একা
সুযোগ পেলাম- সামনে এলাম
এবং হলো দেখা।

তপুঃ
মুক্তিসুখে বুকটি ভরে
পাখির মত উড়ে,
মাঠ-ঘাট-বন ইচ্ছেমতন
বেড়াও তুমি ঘুরে।

ইশকুল এবং পড়ায় আমার
দিন-রাত্তির কাটে,
ঘোরার সময় পাই না মোটে
যাই না খেলার মাঠে।

রুটিন মানা জীবনখানা
ভাল্লাগে না মোটে,
কষ্টগুলো ‘পষ্ট ব্যথায়
বুকের মাঝে ফোটে।

নদীর ধারে মাঠের পারের
দূরের কোনো দেশে,
সমস্তদিন তাধিন তাধিন
বেড়াতে চাই হেসে।

সবুজ মায়ায় গাছের ছায়ায়
বুনোফুলের ঘ্রাণে,
খেলবো দু’জন সুজনসখা
ইচ্ছে জাগে প্রাণে।

অপুঃ
ইচ্ছে যখন দিচ্ছে তাড়া
মনের ভেতর থেকে,
যাই চলো ভাই আমার সাথে
বন্দিজীবন রেখে।

মাঠ-ঘাট-বন ঘুরবো দু’জন
উড়বো ডানা মেলে,
ভাবনাবিহীন সারাটা দিন
বেড়াবো আজ খেলে।

তপুঃ
নাই রে ছুটি, যাই কেমনে!
হায় রে তোমার সাথে!
আসবে টিচার। আমার কী ছার
সময় আছে হাতে?

গড়তে জীবন পড়তে হবে
মা-বাবার আদেশ এ’,
ফাঁকি দিলেই লাল আঁখিরা
সামনে দাঁড়ায় এসে।

ইচ্ছেগুলো দিচ্ছে মেরে
কণ্ঠ চেপে ওরা,
হুলের ঘায়ে ভুলেই গেছি
খেলা এবং ঘোরা।

নাই তো উপায়, যাও তুমি ভাই
পারলে আমায় ভুলো,
আমার এখন গিলতে হবে
বইয়ের আঁখরগুলো।

অপুঃ
সাচ্চা কথা বলছো তুমি?
আচ্ছা আসি তবে,
রাখলে মনে, ডাকলে আমায়
আবার দেখা হবে।

সূত্রধরঃ
যাচ্ছে ফিরে ধীরে ধীরে
আপন দেশে অপু,
কষ্টে-শোকে নিষ্পলকে
দেখছে চেয়ে তপু।

ভাবছে মনে এই জীবনে
নেই মজা-সুখ কিছু,
ভালই হতো যেতাম যদি
অপুর পিছুপিছু।

খেদ ও রাগে হঠাৎ জাগে
অদম্য জিদ মনে,
এই কারাগার ভেঙে এবার
যাবেই মাঠে-বনে।

“দাঁড়াও অপু” – বলল তপু
চেঁচিয়ে জোরে জোরে,
“চাই যেতে ভাই, নাও না আমায়
তোমার সাথি করে।”

বলেই দাঁড়ায়। এক পা বাড়ায়।
যাবেই অপুর কাছে,
তাকিয়ে দেখে চোখ পাকিয়ে
স্যার দাঁড়িয়ে আছে।

তন্দ্রাঘোরে মনরা কেবল
স্বপ্নে বেড়ায় ভেসে,
বুঝলো তপু। খুঁজলো আর
বন্ধু অপুকে সে।

অথবা

উঠে আসে এক আশ্চর্য বালিকা –
মধ্যরাতে অকস্মাৎ
তোমার গায়ের গন্ধ থেকে –
যে আমার ব্রহ্মচর্য বিষয়ক
সমস্ত পান্ডুলিপি গিলে খায় আর
মৃত্যুবমণমন্ত্র শেখানোর ছলে
বিষদাঁত ভেঙে দিয়ে
হো হো করে হেসে ওঠে-

আমি শকুন তলায় বসে
শকুন্তলার মত গর্ভবান হতে থাকি-

মশারিমহল জুড়ে আততায়ী ঘাম
অধিকারনামা লেখে-

প্রতিটি মৃত্যু- আত্মহত্যা
অথবা পুনর্জন্ম –
””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””

মোরগ ও মুরগী

মোরগ বলে – মুরগী তোমার
ভালবাসার দামই-
দেবার জন্যে সকলকিছুই
করতে পারি আমি।

সবই পারো ? – মুরগী বলে
দুইটি ডানা ঝেড়ে-
আমার জন্য একখানা ডিম
দেখাও দেখি পেড়ে।

নববর্ষের শুভেচ্ছা

সকল জীবন ধকলবিহীন
নকলবিহীন সুখে-
শান্তিতে থাক ক্লান্তিবিহীন
ভ্রান্তিবিহীন বুকে।

ফুল ফুটুক আর ডাকুক পাখি
মাখুক আঁখি আলো,
ঘৃণার ঘরে বীণার স্বরে
মুছুক মনের কালো।

কেউ না যেন দুঃখে থাকে
রুক্ষে থাকে একা-
ইচ্ছে ছড়াই ছড়ায় ছড়ায়-
গন্ধে জড়াই লেখা।

ছড়ার দেশে

ছড়ার দেশে
বেড়ায় ভেসে
ছন্দ জলে-বাতাসে,
ছন্দে চলে
ছন্দে বলে
ছন্দে নাড়ে মাথা সে।

শব্দ হাসে
পথের পাশে
মাঠ-ঘাট-বাট-উঠোনে,
ইচ্ছেমতন
শব্দ-রতন
কুড়িয়ে মুঠো মুঠো নে।

ভাবরা নাচে
কাছেকাছে
আলোর দেহ ছড়িয়ে,
ভাবার আগে
আদর-ফাগে
যায় মননে জড়িয়ে।

বিষয় ঘোরে
দোরে দোরে
সাজিয়ে প্রাণের পসরা,
পরশ পেলে
হরষ ঢেলে
যায় হয়ে সব বশ ওরা।

মন্দ-ভুল ও
দ্বন্দ্বগুলো
ফুলের রঙ ও সুবাসে,
দুঃখ-জ্বরা
রুক্ষ-খরা
ভুলেই সবাই খুব হাসে।

ছড়ার দেশে
ভালোর বেশে
আলোর শিশুর মতনই,
ছন্দে-ছড়ায়
সবাই জড়ায়
ছড়ায় প্রাণের রতনই।

ছন্নছাড়ার
নষ্টপাড়ার
কষ্ট ছেড়ে সকলে-
শিশুর বেশে
ছড়ার দেশে
যেতেই পারো শখ হলে।

ছড়াক্কায় গল্পঃ চাঁদের দেশে প্রভাত

রাত্রি গভীর। জোছনা ভরা। চারপাশও সুনসান।
রাতজাগা এক-দুইটা পাখি –
হঠাৎ হঠাৎ উঠছে ডাকি।
প্রভাত সোনার দুচোখ ধুধু।
ঘুম নেই। সে ভাবছে শুধু।
ক্লাসের পড়া। চাঁদের কথা। চন্দ্র অভিযান।

আর্মস্ট্রং কলিন্সেরা চাঁদের দেশে ঘুরে-
দেখে এলেন যেমন করে
দেখতে যদি পারতো ওরে
তেমন করে চাঁদকে ছুঁয়ে
ভাবছে প্রভাত শুয়ে শুয়ে।
হঠাৎ কে সে ডাকলো এসে মিষ্টি মধুর সুরে।

অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে ভয় পেয়ে যায় ভারি-
একদম তার দেহের কাছে
কে যেন ঠিক দাঁড়িয়ে আছে
দুষ্টমিঠে মুচকি হাসি
অঙ্গজুড়ে ফুলের রাশি
পরনে তার অপূৃর্ব এক শুভ্রময়ী শাড়ি।

হিম হয়ে যায় শরীর ভয়ে। প্রভাত তো… তো… ক’রে-
বলল কাঁপা গলায় শেষে-
কে তুমি গো পরীর বেশে
এলে আমার ঘরের মাঝে?
বুঝতে কিছুই পারছি না যে।
বলেই প্রভাত কাছ থেকে যায় একটু দূরে সরে।

মিহিন মোহন কণ্ঠে বলে আগন্তুকা হেসে-
ভয় পেয়ো না লক্ষ্মী-মাণি’
আমি হলাম পরীর রানি।
ইচ্ছে তোমার চাঁদের দেশে
ঘুরবে অভিযাত্রি-বেশে।
তাইতো এলাম তোমায় নিয়েই যাবো চাঁদের দেশে।

প্রভাত বলে- পরীর রানি, ইচ্ছে আমার ভারি
হাঁটবো চাঁদের বুকের পরে
দেখবো চাঁদের বুড়ির ঘরে
কেমন ভাবে আছে কী কী
ভূগোল বইয়ের সব কি ঠিকই?
কিন্তু আমার নেই কোনো যান – দিই কেমনে পাড়ি?

পরীর রানি, বলছো তুমি আমায় নিয়ে যাবে-
আবিস্কারের নেশায় মেতে
ভালই হতো পারলে যেতে।
কিন্তু সে তো অনেক দূরে
তেমন করে উড়ে উড়ে-
যাবার মতন বৈজ্ঞানিকের যানটি কোথায় পাবে?

মুচকি হেসে পরীর রানি বলল – এসো, ভাই!
মহাকাশ যান লাগবে কেন?
থাকতে পাখা আমার হেন।
আমার পিঠে চাপবে তুমি
পৌঁছে যাব চাঁদের ভুমি-
এক নিমেষে কেমন করে দেখবে শুধু তাই।

আনন্দে মন ডগমগ উৎসাহে মন ভরে-
বলল প্রভাত – সত্যি তা কি?
একটুও নেই মিথ্যে ফাঁকি?
চাঁদের দেশে পৌঁছোতে চাই
তবেই চলো এক্ষুনি যাই।
প্রভাত ওঠে পরীর পিঠে এবং পরী ওড়ে।

শোঁ শোঁ করে উড়ছে পরী। কী মজা আ মরি!
লক্ষ তারা চতুর্পাশে
মিটমিটিয়ে কেবল হাসে।
দেখছে প্রভাত মুগ্ধ চোখে
ছুটছে দ্রুত চন্দ্রালোকে।
ইচ্ছেগুলো দিচ্ছে ধরা। নাচছে তো মন-পরী।

সাধটা পূরণ করতে ক্রমে চাঁদ কি বড় হবে?
মহাশুন্যের আঁধার দেশে
সোনার আলোর মোহন বেশে
একটা বিশাল থালার মত
চাঁদটা হাসে অবিরত।
কল্পনারই সেই চাঁদে আজ যাচ্ছে সে বাস্তবে।

পরীর রানির মিষ্টি বাণী হঠাৎ আসে কানে-
প্রভাত, সোনা ভাইটি আমার
সময় হলো এবার নামার।
দু’চোখ মেলে দেখো তুমি
ওই দেখা যায় চাঁদের ভূমি-
ঊষর ধূসর খাত ও পাহাড় ছড়িয়ে সবখানে।

ঘামছে প্রভাত আনন্দে খুব। নামছে চাঁদে ধীরে-
কল্পনা নয় বাস্তবে সে
ঘুরবে এখন চাঁদের দেশে।
ভাবতে কী যে শিহরণে
পুলক মাখায় দেহমনে।
বলবে সবই বন্ধুদেরই পৃথিবীতে ফিরে।

নামিয়ে চাঁদে পরীর রানি বলল -দেখো ঘুরে-
যা পড়েছো বইয়ের পাতায়
কল্পনা যা তোমার মাথায়
মিলিয়ে দেখো মজায় মেতে
থাকছি আমি এইখানেতে।
যত্তো খুশি বেড়াও ছুটে নিকট কি বা দূরে।

হস্তে নিয়ে চাঁদের মাটি একটুখানি শোঁকে।
তারপরে সে অঙ্গে মাখে।
মজায় মেতে হাঁটতে থাকে।
দারুণ মজা। হালকা ভারি
লাগছে কেন শরীর তারই?
হচ্ছে মনে যাচ্ছে উড়ে কোন সে অরূপলোকে।

পাহাড় টিলা গর্ত কত নিমেষে এক লাফে-
যায় পেরিয়ে হায় কী আরাম!
নেই কষ্টের একটুও ঘাম।
গাছপালাহীন ধুসর মাঠে
মাইল মাইল কেবল হাঁটে।
থামতে গেলেই পড়ছে শুধু একটুখানি চাপে।

কুড়ায় নুড়ি পাথর চাঁদের ভুমির থেকে দু’টো –
পকেট ভরে যত্নে রাখে
দেখাবে সে মা বাবাকে।
সহপাঠির ভুল ভাঙাতে
প্রমাণটুকু থাকবে হাতে।
অবাক চোখে দেখবে সবাই খুলবে যখন মুঠো।

চরকা কাটা চাঁদের বুড়ির নেই কোনো ঘর-বাড়ি,
প্রভাত জানে- মিথ্যে সবই
কল্পনাতে আঁকা ছবি।
প্রাণহারা এক নিরস দেশ এ’
মহাকাশেই বেড়ায় ভেসে।
সূর্যালোকেই এই অপরূপ জোছনা হাসি তারই।

চাঁদের আকাশ কালোয় ভরা, নয়তো মোটেও নীল-
নেই বায়ু তাই পরাণহীনা
বাজে না সুর- শব্দবীণা।
নীলের বিশাল একটা দেহে
ঝুলছে একা ওইটা কে হে?
ঠিক পৃথিবী। প্রাণের-জলের আলোতে ঝিলমিল।

হঠাৎ প্রভাত চমকে ওঠে। আড়ষ্ট গা-খানি।
থমকে দাঁড়ায় ভয়েই শেষে।
সামনে ওটা বিকট বেশে-
পাহাড় নাকি? কিন্তু তাহার-
প্রভাত বুঝি হবেই আহার।
ভেবেই ভয়ে চেঁচিয়ে ডাকে-বাঁচাও পরীরানি।

কী হয়েছে? চেঁচাস কেন? কী হয়েছে তোর?
মা এসে ক’ন তার শিয়রে-
স্বপ্ন দেখেছিস কি ওরে?
কোথায় নুড়ি? পকেট খোঁজে-
এবার প্রভাত সবই বোঝে।
ভূগোল বইটা খোলাই আছে মাথার পাশে ওর।

আমার ছিল

আমার ছিল একটা নদী
থৈ থৈ তার বুকে –
ভাসিয়ে দিতাম কল্প-পালে
স্বপ্ন-ডিঙা সুখে।

সেই নদীর আজ মন মজেছে
লোভের পলি জমে-
বুকের উপর দুখের পানা
বাড়ছে ক্রমে ক্রমে।

শীর্ণ দেহের দীর্ণ বুকের
সেই নদীমনটাকে-
স্বপ্নে শুধু ডাগর আশার
সাগর হৃদয় ডাকে।

চতুর দশপদী-২

কবিতা আসে না আর-বসে না চৌকাঠে
শুধু কিছু শব্দ এসে চেঁচামেচি করে
ভাব-ভালবাসা নাশা আধুনিক খাটে
কবির শরীর ঘামে অনির্ণীত জ্বরে

বিষয় বিছানো থাকে সারাঘর জুড়ে
ব্যাগভরা অর্থ শুধু স্বৈরসুখ বোনে
বাক্য মরে সাঁকোহীন নদীপথে ঘুরে
কবির হৃদয় পোড়ে জলীয় দহনে

শব্দহীন ঘোরে কবি বসে থাকে একা
কখনও কবিতা এসে দেয় যদি দেখা

বন্ধু হবে? এসো!

তোমার বাড়ি আকাশ পাড়ি –
স্বর্গের রঙ মাখা,
আমার বাড়ির নষ্ট দু’চাল
কষ্ট দিয়ে ঢাকা।

তোমার পথে আলোর ঝালর,
ফুলের হাসাহাসি,
আমার পথে অমার প্রেতে
জমায় নাচানাচি।

তোমার বুকে সুখের নদী
ছলাৎ ছলাৎ করে,
আমার বুকে ধুকপুকিয়ে
ছোট্ট নদী মরে।

তোমার চোখে স্বপ্নকাজল
ছায়ার আঁচল মেলে,
আমার চোখে সু-ধার ক্ষুধা
আগুন আগুন খেলে।

তবু আমার নেই অভিমান,
কষ্ট এবং দ্বেষও,
হাত বাড়িয়েই দাঁড়িয়ে আছি,
বন্ধু হবে? এসো!

কথা মরে গেলে

কথা মরে যায় তবু কবিতার মত
চেয়ে থাকে চোখ –
জেগে থাকে সুরের আবিল-
ছেয়ে থাকে ঘুমের মতন কিছু
স্মৃতি-
মনের মাস্তুল থেকে
শব্দ পোড়া ধোঁয়া ঘণীভূত প্রেমে
নিঃশব্দে সাজায় ঘর-

গর্ভধারণের মত গর্ব ধারণ করে
অসীমার হাত মহাকাশ খোঁজে
আর নীরবতা ফুল হয়ে
কস্তূরী ছড়ায় মনময়-

কথা মরে গেলে
শব্দহীন অন্ধকারে নক্ষত্র জন্মায়…

চতুর-দশপদী

তুমি যদি বলো- নদী হতে পারি ছলোছলো অধিকারে
বুকের বদ্বীপে সবুজ সদীপে ঘর দাও যদি তারে
তুমি যদি ডাকো- শুন্যের ফাঁকও সাঁকো দিয়ে দেবো জুড়ে
অধীর আঁধারে মদিরতা মেখে হৃদি সুরে দেবো মুড়ে

তুমি যদি চাও- হতে পারি নাও শাড়িখানা হলে পাল
যতিহীন বায়ে গতিসুখ এঁকে পাড়ি দেবো মহাকাল
মহাকাল থেকে একটি সকাল আমরা দু’জনে রোজ
কূজনের ছলে ভরে দেবো বলে করে নেবো শুধু খোঁজ

নীল নীল ঘোরে কিলবিল ঘর- জ্বর সারা মন জুড়ে
হই চখাচখি হাত ধরে সখি নিয়ে যাও হৃদপুরে