বিভাগের আর্কাইভঃ জীবন

রাজনীতি

রাজনীতি নিয়ে দীর্ঘদিন লেখি না, এখন সেইফ সাইডে থাকতে ভাল লাগে। বাংলাদেশের রাজনীতি কতটা নষ্ট হয়েছে বলে বুঝানো যাবে না, এখানে আমার মতের বিপরীত অর্থাৎ আমার শত্রু। আওয়ামী শাসনের সমালোচনার অর্থ রাজাকার, দেশদ্রোহী। এতিম আত্মসাৎ অথবা খাম্বা নিয়ে প্রশ্ন করার অর্থ নাস্তিক।

আমি অনেক ভেবে দেখলাম ফুল পাখি লতা পাতা নিয়ে মগ্ন থাকার চেয়ে আরামের কিছু নেই। অহেতুক গালি খেতে কারই বা মনে চায়, তারচেয়ে বরং ‘লাল দোপাট্টা মলমল কা’ শুনে শুনে সহপাঠীনির লাল ওড়নায় জীবনের দিক নির্দেশনা খোঁজাই নিরাপদ।

কিন্তু দিকনির্দেশনা পাই না; মনে প্রশ্ন জেগে উঠে লাল দোপাট্টা আওয়ামীলীগ না বিএনপি। সহপাঠিনী কোন বিশ্বাসে বিশ্বাস করে।

আমার চোখ ফুল, পাখি, লতা, পাতা নিয়ে থাকতে চায় কিন্তু মন সন্দেহ প্রবণ হয়ে যায়, ফুল পাখি কী কোন দলের প্রতি অনুগত, তারা কী ইতোমধ্যে দলকানা হয়ে গেছে।

রাজনীতি মহামারী হয়ে দেখা দিয়েছে, আমরা কোন কিছুই দলছাড়া কিংবা রাজনীতি ছাড়া চিন্তা করতে পারি না।

আমি কবিতার সাধনা করি কিন্তু শেষে দেখা যায় সাধনার কোন কোন মূল্য নেই কবিতা আদতে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি হয়ে গেছে।

আমাদের দেশে যত শিশুর জন্ম হয় তারা এখন আর মানুষের বাচ্চা হয়ে জন্মে না, হয় আওয়ামী লীগ নয় বিএনপি হয়ে জন্মে।

আমি রাজনীতি নিয়ে লেখি না, লিখতে ভালো লাগে না কিন্তু আমার সব লেখাই রাজনৈতিক দুর্গন্ধে ভরপুর। হাজার চেষ্টা করেও এই বদ গন্ধকে দূরে রাখতে পারি না।

কোন কিছু হাসিলে মানুষ শতভাগ সুবিধাবাদী

311s সময়ের বোঝাপড়া যখন অসময়ে তখন তা নিরানন্দের সাথে অমসৃণ স্মৃতি শেষ পর্যন্ত যা দুঃখ ও চোখের জল ছাড়া কিছু নয়, দিতে পারেনা।

তুমি যাদেরকে ভালো জানো, ভালো মানো, বিশ্বস্ত অনুচর অথবা সহচর মনে কর তোমার সেই সকল ম্যাক্সিমাম শুভাকাঙ্ক্ষী তোমাকে প্রেমের প্রলুব্ধ চালে আটকে তোমার ভবিষ্যতের চিন্তাশক্তিকে বাঁধা প্রদান করবে।

আসলে তারা কেহই তোমার, ভালো বন্ধু নয়, শুভাকাঙ্ক্ষী নয়, শুভানুধ্যায়ী নয়, এমনকি কোনভাবেই তারা তোমার শুভ প্রত্যাশী নয় তারা একেকজন যার যার জায়গা থেকে নিজেদের প্রয়োজনেই তোমাকে ভাবছে, তাঁদের প্রয়োজনেই তোমাকে ঝালিয়ে নিচ্ছে।

এদিকে যখন তুমি তাদের শতভাগ বিশ্বাস করবে তাদের প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য নতুন করে চাল তৈরি করবে যখন তুমি তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে ফেঁসে যাবে। তখন তুমি তাদের ব্যবহারের সামগ্রী হিসেবে গণ্য হবে। মনে রাখবে সবাই ভালবাসতে পারেনা সবাই ভালবাসার যোগ্য নয়। ভালোবাসায় অযোগ্যদের উৎপাত অত্যন্ত বেশি হয় প্রলুব্ধ হয় নজর করা হয়। আসলে তারা তাদের বিশেষ প্রয়োজনে তোমার অবস্থান দুর্বল করার জন্য কাজ করছে।

তারা সবাই তোমার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাকারী হিসেবে আবির্ভূত হতে চায়। যখন তুমি সেই সুযোগটি শতভাগ দেবে ঠিক সেদিন থেকে বুঝতে পারবে তাদের কোন ভুলের পথে এতদিন সঙ্গ দিয়েছো। অথবা তোমার সক্ষমতাকে নষ্ট করতে চায় তোমার সক্ষমতাকে দুর্বল করে অক্ষম বলে ঘোষণা করতে চায়।

এদিকে যে তোমার পাশে থেকে তোমার স্পৃহা শক্তি ও সামর্থ্যকে সমর্থন করে, উৎসাহ দেয়, উৎসাহ প্রদান করে, তাকে যত শত্রুই ভাবনা কেন, সেই তোমার প্রকৃত বন্ধু, সেই তোমার প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষী, প্রকৃতজন। আসলে স্বার্থের দুনিয়াতে, তাদের অনেক কিছুই হারাতে হয় আসলে তারা তোমাকে ভালোবাসলেও তাদের দুর্বল অবস্থানের কারণে তুমি কখনোই তাদের প্রতি ফিরে তাকাবে না।

মানুষ তার নিজের জায়গায় কোন কিছু হাসিলের ক্ষেত্রে শতভাগ সুবিধাবাদী। তবে তারাই এসব গ্রহণ করেনা যাঁরা সারাজীবন শুধু দিয়েই যায় কিন্তু কারও কাছে কিছু পাবার প্রত্যাশী নয়। এই মানুষেরা শুধু হেরেই যায় কিন্তু তোমরা জানবে কী হেরে যাওয়ার মাঝেও আনন্দ থাকে সুখ থাকে ভালো লাগা থাকে থাকে ভালোবাসা এমনকি জয়ী হওয়া!

নিমতিতা সরকারি কলোনি

পাঁচ
জ্বর, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ? খগবতীর মৃত্তিকা হইতে। মাটি থেকে মানুষের পায়ের আঙুল বেয়ে আস্তে আস্তে উরু, কোমরে উঠে যাই। ওদিকে হাতের তালু থেকে নাক-গলা হয়ে মাথায়। তারপর দুই ঢেউ এক সঙ্গে ভেঙে পড়ি বক্ষতটে।
এই তরঙ্গ উইপোকার, তার আস্তরণে ঢেকে গেছে সমস্ত শরীর। ভেতরে ব’সে বন্ধ-চোখ গাঢ়-শ্বাসের বাল্মীকি।

— তারক ডাক্তাররে একবার খবর দি’, নাদু? আমার কাছে দেড্‌টা টাকা আছে।
— তুমি থোও দিন! সোদ্দি-গাগরোম; রাত্তিরি সাবু খাক, কাল সকালে ঝজ্‌ঝরে হয়ে যাবেনে।

বিকেলবেলা হঠাৎ শরীরে তাত এসে চাঁদের চলাফেরার সংবিধান বদলে দিল। এখন রঘুনাথের মাঠে বালক-বালিকাদের কিট্টু আর গাদি খেলা; রাস্তা দিয়ে ছেলেরা ঢ্যাব-ঢ্যাব ক’রে বল ড্রপ খাইয়ে নিয়ে যাচ্ছে, চৌরাস্তার মুচির কাছ থেকে সেলাই ক’রে পাম্প দিয়ে মাঠে নামাবে। এখন পড়ন্ত রোদে পাখির ডাক থেকে মনখারাপ খুঁটে নেওয়ার সময় নয়। বরং মা চমকে উঠে জিগ্যেস করবে, আমাদের বাড়ির মাথার ওপর দিয়েই ডেকে গেল নাকি? না না, ফুলিদের বাড়ির ওপর দিয়ে। “বড় বাঁচা বাঁচিছি। মাসের শেষে আসোজন-বসোজন সামলাতি হোলি আর দেখতি হ’তো না!”

জ্বরে ঘুম পায়, ঘুমে দেহতাপ বাড়ে আর আকাশে থইথই করে ফুল্লকুসুমিত অন্ধকার। সেই তমসা কেন্নোর মতো উথলে চাঁদের নাকমুখ দিয়ে ঢুকে যায়, ফুসফুস ভ’রে ওঠে আলকাতরার পাপড়িতে। দিদিমা গল্প করেছে, একবার ঘুমে-কাদা কোনও বাচ্চার কান দিয়ে কেন্নো ঢুকে তার মগজে বংশবিস্তার করেছিল। তারপর পড়া পারেনি ব’লে মাষ্টারমশাই যেই ছেলেটার চুলের মুঠো ধ’রে টান দিয়েছে, চুল সমেত ব্রহ্মতালু, মানে নারকেলের অর্ধেকটা মালা স্যারের হাতে উঠে এল। তখন দেখা যায়, ঘিলুর জায়গায় গিজগিজ করছে শুধু কেন্নো!
সেই থেকে কেউ চুলের মুঠি ধরলে চাঁদ সামান্য চিন্তায় থাকে! কিন্তু এখন যে ত্রস্ত মেয়েলি আঙুল তার মাথার ঢেউয়ে ডুবে গেল… নেমে এল কপালে, গলায়… সে যেন নিজেরই উদ্বিগ্ন হাত :

— ও শিউলি, শিগরির মারে ডাক। ভাইয়ের গা তো পুড়ে যাচ্ছে!

ছয়
প্রথমে জলেচুলে সোহাগ জমবে না, মাথাভর্তি গাঁজানো কেশরাশিতে জল স্লিপ ক’রে বেরিয়ে যাবে। তখন, তিমিরের বাবাকে এতদিন ডাকা হয়নি কেন ব’লে দানা বাঁধবে একটা বিক্ষোভ। ছেলে রেলে গ্যাংম্যানের চাকরি পেলেও আশি-পার বৃদ্ধ এখনও জাত-ব্যবসা ছাড়েনি, হাতে নাপিতের বাক্স দুলিয়ে কুঁজো-হেঁটে চলে আসে কেউ খবর পাঠালেই, আর প্রাণভয়ে ছোটদের কান্না শুরু হয়। ক্লিপ-মেশিনে পটাং পটাং করে ঘাড়ের চুল ছিঁড়তে থাকে অসিত পরামানিক, রক্তকুচি ফোটে সার দিয়ে; তখন স্কন্ধে ফটকিরিপাথর ঘ’ষে একগুচ্ছ জ্বলুনি ফ্রিতে উপহার। এবার সে ময়লা ধুতি গুটিয়ে দুই হাঁটুর মধ্যে শিশু-মাথা চেপে ধরল — চুলে কাঁচি চালাবে। অপরিচ্ছন্ন উরু ও কুঁচকির গন্ধে সেই জানু মধ্যবর্তী স্থানে হাঁচতে থাকে বাচ্চারা।

রাত যত বাড়ের দিকে, চাঁদের শরীরে ঘুমের বদলে ঘোর জন্ম নিচ্ছিল। বাবা স্কুল ছুটির পরে অপারিশ্রমিকের কোচিং পড়িয়ে ফিরেছে, মা ডাকল : এট্টু জপ ক’রে দিয়ে যান না ছেলেডার মাথায়। নির্মলচন্দ্র নিজের জ্বর-সমান উষ্ণ করতল সন্তানের কপালে রেখে অতি মৃদুস্বরে শ্লোক আওড়ান। উপনয়ন হওয়ার আগে গায়ত্রী-আদি কিছু মন্ত্র উচ্চারণ করা নিষেধ। কিন্তু অবাধ্য ছেলের কানে একবার পৌঁছোলে সে হাজার কানমলা খেয়েও সারাদিন ওটাই চেঁচিয়ে বেড়াবে।

আসলে, কনিষ্ঠ পুত্র প্রায় বাবার মতো স্মৃতিধর। আজ থেকে অর্ধ শতক আগে খুলনার অন্তঃপাতী সেনহাটি গ্রামে নির্মলের স্মরণশক্তি ছিল সুবিদিত। যখন তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র, এমনই এক শীতের দিন স্কুল ইন্সপেক্টর এসেছেন পরিদর্শনে। ক্লাসে ঢুকে প্রথম বেঞ্চে বসা ছোট্টখাট্টো চেহারার ধপধপে সাদা বালকটিকে দাঁড় করালেন : বলো, বর্ণপরিচয় বলো। খোকা বুঝতে পারল না কোন ভাগ তাকে আবৃত্তির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অতএব অ, আ, হ্রস্ব ই, দীর্ঘ ই থেকে শুরু হয়ে ঝরঝরিয়ে রাখালের দুষ্টুমির গল্প পর্যন্ত ব’লে প্রথম ভাগ শেষ করল। পরীক্ষককে তবু অপেক্ষমান দেখে সে ঐক্য-বাক্য-মাণিক্যে মহরত ক’রে দ্বিতীয় ভাগ ধ’রে এগোয়, একদমে মুখস্থ বলতে বলতে শেষ অধ্যায় “চুরি করা উচিত নয়”-এর অন্তিম লাইন “তা-হা ক-র না-ই, এ-জ-ন্য, তো-মা-র এ-ই পু-র-স্কা-র।” উচ্চারণ-শেষে হাঁ ক’রে শ্বাস নিচ্ছে যখন, ইন্সপেক্টর এগিয়ে এলেন কয়েক পা, হাত বাড়িয়ে ছাত্রের কপালে রগের ওপর এক দুই এবং তিন — তিনটে টোকা দিয়ে নিশ্চুপে কক্ষত্যাগ করলেন।

সাত
বাসি বেলিফুলের মতো দুমড়ে গেছে ঠোঁটদুটো, দুই গাল ভস্মে-আগুনে মিশে নিভুনিভু উনুন। জ্বরের তাড়সে কাঁপছে গোটা মুখ। মা ক্রমাগত মাথায় জল ঢেলে যাচ্ছে, ঘটি থেকে ধারানি-করা স্রোত কচুপাতা বেয়ে নীচের বালতিতে প’ড়ে চক্রবৎ ঘটিবাহিত হয়ে উঠছে মাথায়। আর দিদিমা গেলাসের জল থেকে চাঁদের চোখের পাতা, ঠোঁট ভিজিয়ে চলেছে।
— ও ভাই, খুব কষ্ট হচ্ছে? এই অ্যাখোনি তোমার জ্বর নামে যাবেনে। কিছু ক’বা নাকি, ও সোনা?

রোগি জাগন্ত কিনা বোঝা যায় না। ঘরে টিনের চালের নীচে পুরোনো শাড়ির যে নিরাপত্তামূলক পর্দা টাঙানো (টিকটিকির লাদি বা আরশোলার ডিম যাতে বিছানায়-খাবারে না পড়ে), তার চোখ সেখানে স্থির। পর্দায় দেখা যাচ্ছে, জলের শিরা-উপশিরা চাঁদের মুণ্ডটি সমস্ত কোণ থেকে জাপটে ধরল — যেমন বলখেলার মাঠে যাওয়ার রাস্তায় রেলের পরিত্যক্ত ভীমবাহু কেবিনকে একটা ধৃতরাষ্ট্র অশত্থগাছ মরণ-আলিঙ্গনে আঁকড়ে থাকে। চাঁদ লক্ষ করছিল, এই বলশালী জাপটাজাপটি তার পাতলা ঘাড় আর নিতে পারছে না। একটু পরেই জলের তোড়ে চাঁদের মাথা ঘাড় থেকে খুলে বালতিতে পড়ে ডুবে গেল। ওমনি তারও দুচোখ দৃষ্টিহীন…।

বাড়িতে একটা কান্নার কোরাস উঠল কি তখুনি? কেউ কি চেঁচিয়ে বলছে, ওরে বাসু দৌড়ে যা বাবা, তারকডাক্তারকে ডেকে নিয়ে আয়? বলরাম দাসের বাড়ির রেডিয়োতে এখনও অনুরোধের আসর শুরু হয়নি, আর সাড়ে ন’টার আগে তারক ঘুমোবে না। কিন্তু বুক-ভরা ইচ্ছে থাকলেও বাসু এক-পা নড়তে পারছে না! ডাক্তারের প্লটের ঠিক আগে ডানহাতে যে-বাড়ির দরজায় মরচেপড়া তালা, আগাছা গজিয়ে গেছে উঠোন জুড়ে, যেখানে দিনেদুপুরে চন্দ্রবোড়া সাপের বাচ্চা কিলবিল করে, সুতরাং সন্ধে থেকে রাস্তাটুকু বড়-বড় হাতহালি দিয়ে হাঁটে সবাই, সেই আস্তানার ইতিহাস কীভাবে ভুলবে বাসুদেব? দেবী — তারই-বয়েস ফর্সা সুন্দরী মেয়েটা সুইসাইড করেছিল সরস্বতীর পুজোর দুপুরে। স্কুল থেকে একপেট খিচুড়ি বেগুনভাজা খেয়ে এসে খবরটা শোনে বাসু এবং ছুটে গিয়ে ডেকরনের ফ্রকপরা মেয়ের ভারি সাদা দুই পা, বগলের বাদামি লোম আর মুখ থেকে ডান দিকে বেরিয়ে যাওয়া কালো জিভ… সব অনুপুঙ্খ দেখে ফ্যালে। এখন এই গভীর রাতে বাসু হাততালি দিলে যদি তালাবন্ধ ঘরের ভেতর থেকে পাল্টা ক্ল্যাপিং-এর শব্দ ওঠে! পাড়ায় এমন প্রহেলিকা ঘটে যাচ্ছে বারবার। কেলেকুষ্টি বাপ-মায়ের কালোকোলো শিশুদল জন্ম নিতে নিতে হঠাৎ এক খইসাদা সন্তান প্রকাশ পায়। উপনিবেশের জনতা অবাক হয়ে দ্যাখে, খাওয়ায়-পরায়, তারপর একদিন অপঘাতে বা আচম্বিতে মৃত্যু হয় তার। যেমন বাসন্তীপুজোর তিন দিন পর বলরামের মেয়ে শীলা নাকমুখ দিয়ে কৃমি উঠে চিতেয় উঠল; “আমি পাপী, তাই বিদায় নিলাম” লিখে রেখে দেবী দিল গলায় দড়ি; মনসাবাড়ির রাজপুত্র মানিক ঢলে পড়ল গোখরোর বিষে…।

বলব সেসব কথা, চাঁদের জ্বরটা আগে ফণা নামিয়ে নিক।

(অসমাপ্ত)

ডোম

3115 আমার বড় ভাই প্রায়ই বলে আমাদের পূর্বপুরুষ ডোম ছিল, শ্মশানে মরা পোড়াত। আমাদের বংশের সবাই এটা অবিশ্বাস করলেও আমি খুব বিশ্বাস করি, কারণ আমার রক্তে আগুন; পোড়াতে ভালোবাসি। প্রতি কয়েক মাস অন্তর একবার আমাকে পোড়াতে হয়, পোড়াতে পোড়াতে এখন দক্ষ হয়ে উঠেছি। যদিও একবার নিজের পুড়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল।

গৌতম ঘোষের ‘অন্তর্জলী যাত্রা’য় দেখেছি শত্রুঘ্ন সিনহা হাতের লাঠি দিয়ে মরাকে চেপে ধরছে। যাতে উঠে দৌড় লাগাতে না পারে। মরা পোড়ানোর সুযোগ এখনো হয়ে উঠেনি কিন্তু কাঠের মাথাকে লাঠি দিয়ে চেপে ধরতে আমার ভালো লাগে। কমলকুমার মজুমদারের ব্রাহ্মণ, দোসর অর্থাৎ পত্নী না পেয়ে মরেনি। কাঠ, কাগজ কিংবা অন্যান্য আবর্জনা সঙ্গী ছাড়া অবলীলায় মরে যায়।

শীত আগত আগামী কয়েক মাস পোড়ানো সম্ভব হবে না, আজ শেডের যাবতীয় জঞ্জাল পুড়িয়ে শেষ করে ফেলছি। মরা পোড়ানো চাকরি হিসাবে মন্দনা, অতীতকালের কথা বলতে পারবো না কিন্তু বর্তমানে ফিনারেল সার্ভিসের কর্মীদের খুব সমীহের চোখে দেখা হয়। শেষকৃত্য পুন্যের কাজ; নিষ্ঠার সাথে এমন কাজ সবার করা উচিৎ।

ভদকা

নিদানের দিনে সে আমাকে যত্ন করে সোমরস পান করিয়েছিল। তখন বেকার; টিউশনির যে তরুণীর সাথে প্রেম হব হব করছে, সে হঠাৎ পছন্দ বদলে ফেলল। ফকিরের পুত্রের সঙ্গে প্রেমে তার পোষাবে না। পছন্দের সাথে সাথে বদলে গেল টিউশন মাস্টার।

বিপর্যস্ত আমি মেসের ম্যানেজারের ভয়ে পালিয়ে থাকি। রাস্তায় তার সাথে দেখা, অনেক বছর পরে। স্কুলের মাস্তান ছিলাম সে ছিল আনকোরা, মাস্তানি দেখাতে গিয়ে পাছায় লাথি মেরে ছিলাম। সে কোন প্রতিবাদ করতে পারেনি। স্কুলে তার দিন যন্ত্রণায় কেটেছে; আমার আনন্দে।

আমি তাকে চিনিনি সে ঠিকই চিনেছে। সামাজিকতার শেষে যখন নিজের দুরবস্থা বর্ণনা করছি, তার চোখে সহমর্মিতা দেখেছি অথবা দেখার ভুল।

সব শুনে দুপুরের খাবারের জন্য পাঁচ তারকায় নিয়ে গেল। দীর্ঘদিন এমন খাবার খাইনি। পাশের টেবিলে সোমরস পান হচ্ছে আমি লোভাতুর চোখে তাকাচ্ছি। আমার চোখ অনুসরণ করে সে বলল ‘খাবি নাকি’! আমি হ্যাঁ বললে সে বলল ‘আমার একটা শর্ত আছে’। আমি অবাক চোখে তাকালে সে বলল ‘তুই যত দামী মদ খেতে চাস খাওয়াব; কিন্তু খাওয়া শেষে সবার সামনে তোর পাছায় লাথি মারব’!

বাংলা মদ দুয়েক বার চেখে দেখেছি বিদেশি মাল স্বপ্নেও দেখিনি, এই সুযোগ একবার চেখে দেখা যায়। পাছায় লাথি দিতে চায়; দিক। জীবনের পাছায় এমনিতেই লাথি খেয়ে আসছি। শর্তে রাজি হয়ে গেলাম।

পুরো এক বোতল ভদকা গলাধঃকরণের পরে টলোমলো অবস্থা, তবু শর্ত ভুলিনি। দাড়িয়ে বললাম ‘এবার নিশ্চিন্তে লাথি কষাতে পারিস’! সে আমার মুখের দিকে চাইল, বললো ‘না থাক তুই আর লাথির যোগ্য নস’। বিল মিটিয়ে সে চলে গেল, ভদকার নির্যাস নিয়ে আমি অনেকক্ষণ বসে থাকলাম।

মায়ের প্রস্থান নাই

301

মাটির গন্ধে মিশে থাকে
নিবিড়তার সুবাস,
শব যাত্রীরা চলে গেলে-
পড়ে থাকে দীর্ঘশ্বাস!
দূর আকাশে উড়ে যায়
স্বজনের কান্না
চল্লিশ কদমে স্মৃতির সংলাপ
বিশদ বিলাপ-
নিষিক্ত বীণা…
চোখে চোখে মায়ার মন্থন
ডুকরে কাঁদে কন্যারা, পুত্রের বুকে গুপ্ত ক্ষরণ…
অসহায় কণ্ঠ জড়িয়ে আসে
দূর কৈলাসে ভালো নেই হিমাংশুর মন;

আজ বুঝি অবুঝ সবাই।
সান্ত্বনার পরশে-
কাছে এসে নির্বাক আপনজন!
মা চলে গেছে
ছিন্ন করে সমস্ত মায়ার বন্ধন-
কেউ জানবে না-
অন্তরে তার কোন প্রস্থান নাই, বিচ্ছেদ নাই
সংসারে যিনি চিরন্তন ছায়া… আশ্রয় আজীবন …
.

(গত ১৫ই আগষ্ট ছিলো আমার শাশুড়ী আম্মার প্রয়াণ দিবস। উক্ত কবিতাটি মমতাময়ী মা কে নিবেদন করে লেখা। আল্লাহ উনাকে জান্নাত নসীব করুন )

প্রাণী প্রেমিক এই আমি ও আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা

Hos

ছোটবেলা, মানে আমার কলেজ জীবন পর্যন্ত কেটেছিলো উত্তরের এক অবহেলিত জেলা শহরে। কিছুটা গ্রামীন আবহে। সে কারণে আজকের এই মানুষটি আমি গর্বিত এবং ভীষণ অহংকারীও বটে কারণ আমি মাটির গন্ধ চিনি। নদী নালা খাল বিল, ফসলের মাঠ, ধান ফুলের গন্ধ, তাজা মাছের স্বাদ, জোনাকির আলো, এ সব আমার মুখস্থ। নদী থেকে স্নান সেরে ভেজা মহিষের পিঠে করে বাড়ি ফেরা ছিলো স্বর্গ সুখ।

সে সময় বাড়িতে এক দেশী কুকুর ছিলো। আমি তার নাম দিয়েছিলাম “বাঘা”। তাকে তিন বেলা খাবার দেয়া হতো নিজেদের স্বার্থেই, কারণ সে ছিলো বাড়ির খুব ভালো পাহারাদার। বাঘার উপস্থিতিতে বাড়িতে চোর ডাকাতের উপস্থিতি ছিলো প্রায় অসম্ভব। একদিন সকালে বাঘার মৃত দেহ পাওয়া গেলো। চোরের বা ডাকাত দলের কেউ তাকে বিষ পানে হত্যা করেছিলো কারণ সে সময় চোর এবং ডাকাতের বেশ উপদ্রব ছিলো এলাকায়।
পরের জীবন বিভাগীয় শহরে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। আমার স্বর্গীয় জীবন। আমার ভালো মন্দ, রাজনীতি অ রাজনীতি, প্রেম অপ্রেম, সব কিছুর সূতিকাগার এই মতিহার চত্বর। এখানেও আমার এক নেড়ী কুত্তা ছিলো সর্বক্ষণের সাথী। সে সময় অনেকেই আমাকেই পাগল বলে এড়িয়ে চলতো, আবার কেউ কেউ এই পাগলামীর কারণেই উন্মাদের মতো ভালবাসতো।

এর পরের জীবন ইউরোপ। এ এক অন্য জগৎ। প্রতি সেকেন্ডে অবাক হই আর শিখি। পুরো ইউরোপ তখন আমার চারণ ভূমি। আজ এখানে তো কাল ওখানে। ছবি তুলি কবিতা লিখি। মাঝে মাঝে প্রেমে পড়ি। আসলে don’t fall in Love, I only make Love আমি প্রেমে পড়ি না, আমি শুধু প্রেম করি। দীর্ঘ সময় আমি তখন যাযাবর। এক সময় উপলব্ধি হয় এ জীবন আমার নয়, অন্য কারো কারণ ততদিনে আমি বুঝে গেছি, জেনে গেছি স্বরসতী আর লক্ষী হচ্ছে দুই সতীন। এরা এক সাথে বসবাস করবে না। আমাকে বেছে নিতে হয় একজনকে। আমি লক্ষী কে পূজা দিয়ে ঘরে ফিরি। সেটি ১৯৯৮। তখন আমি ইতালির এক ফ্যাশন ডিজাইনারের সাথে কাজ করি। সে ডিজাইন করে পাঠাতো আর আমি তা ডেভোলপ্ট করতাম।

আমার এখনো মনে আছে সে সময় সাইফুদ্দীন হাসান চন্দনকে দুইদিনের মডেল শ্যুটের জন্য সন্মানী দিয়েছিলাম দুই লক্ষ টাকা। তখন চন্দন ভাই এর সহযোগী হিসেবে ছিলেন বশীর আহমেদ সুজন। আমরা শ্যুট করেছিলাম, একদিন শফিপুর আনসার ক্যাম্পে আর একদিন লালবাগ কেল্লায়। তখন আমি একা থাকতাম রামপুরা মহানগর আবাসিক এলাকার একটা ফ্ল্যাটে। আমার ফ্ল্যাটে তখন নিজস্ব একটা মিনি বার ছিলো সংগত কারণেই। কারণ তখন আমার অধিকাংশ মেহমান ছিলো বিদেশি। তবে দেশের অনেকেই আসতো তখন আমার বাসায় ফ্রি মদ খেতে। তাদের মধ্যে ছিলো বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। ছিলো সব নামকরা শিল্পী, সাহিত্যিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিমান বালা, রাজনীতিবীদ।

সে সময় আমার সখ জাগলো বানর পোষার। বানর ছিলো তখন আমার সর্বক্ষণের সাথী। নাম দিয়েছিলাম তার রাধা। সারা ঢাকা শহর সে আমার সাথেই থাকতো। কখনো গাড়িতে, কখনো আমার কাঁধে। একদিন বাসায় ফিরে দেখি রাধা আমার বারান্দার গ্রিলে ঝুলে মরে আছে। জানি না সে আমার অন্য প্রেমের অভিমানে আত্মহত্যা করেছিলো নাকি পড়ে গিয়ে গলায় ফাঁস লেগে মরেছিলো।

এরপর আসি ইস্কাটন গার্ডেনের বাসাতে ভাড়াটিয়া হিসেবে। আমার বাসার মালিক তখন অভিনয় শিল্পী রোকেয়া প্রাচী, নিহত সার্জেন্ট আহাদের স্ত্রী। তখন আমি কাটাবন পশু পাখি মার্কেটে একজন তার ছেড়া ক্রেতা হিসেবে ব্যপক পরিচিতি। তখন কাঁটাবন মার্কেটের এমন কোন পাখি নাই যা আমার ছিলো না। তখন আমার গ্রামের বাড়িতে মায়ের সখ পূরনে গড়ে তুলি মিনি চিড়িয়াখানা। আর সে সময় ঢাকার পাখি স্মাগলার গোষ্ঠীর সাথে আমার পরিচয় হয়। জানতে পারি কাঁটাবন মার্কেটের আড়ালে চলে আন্তর্জাতিক পাখি চোরাকারবারী চক্রের কার্যক্রম।

দামী পাখিদের তখন দারুণ চাহিদা বলিউড তারকাদের এবং ঢাকা তখন সেই স্মাগলারদের ট্রানজিট রুট মাত্র। ম্যাকাও, গ্রে প্যারোট, কাকাতুয়া থেকে শুরু করে সব নামি দামী পাখি ঢাকা হয়ে চলে যেতো দিল্লি, বোম্বে এবং পাখি গুলো আসতো মূলত পাকিস্তান থেকে। আমি তখন পাখি কিনতাম সেন্ট্রাল রোডের এক স্মাগলারের কাছ থেকে স্বল্প দামে। তখন আমার হরিণ পালন এবং জবাই করে খাবার লাইসেন্স ছিলো।

যাই হউক রোকেয়া প্রাচীর বাসায় থাকার সময় সখ হলো কুকুর পোষার। সাদা ধবধবে লোমশ ছোট্ট একটা কিউট কুকুর কিনলাম। নাম রাখলাম তার “গুণ্ডা”। বিড়াল ছিলো অনেক গুলো। কিন্তু পড়ে রিয়ালাইজ করলাম, এ সবের পেছনে আমার যতোটা না ভালোবাসা তার চেয়ে অনেক বেশী বিলাসিতা, ট্রেন্ড বাজি, লোক দেখানো ফুটানি। রাস্তার ভিক্ষা করা, ফুল বিক্রেতা কোন মানব শিশু আমার কাছে তখন পশু প্রেমের চেয়ে অনেক বেশী আপন মনে হলো।

আজকাল অনেক পশু প্রেমিক দেখি। কুকুরের মুখে চুমু দিতে দেখি, বিড়ালের মা বাপ হতে দেখি। আর কি কি দেখবো তার সব কিছুই আমার জানা দেখা। জানিনা বাংলাদেশে এর পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। আজ থেকে আরো ৩০ বছর আগে রোমে এক ইতালিয়ান বান্ধবী তার মেয়ের জন্মদিনের দাওয়াত দিয়েছিলো। গিফট সহ গিয়ে দেখি তার বিড়ালের জন্মদিন। নিজে সন্তান নেয় না চাকুরী করে বলে, তাই বিড়ালকে সন্তান বানিয়েছে। অবাক পৃথিবী,অবাক সব মানুষের রীতিনীতি, রুচি।

দেশে আমার অনেক প্রিয় মানুষ কুকুর বিড়ালকে নিজের সন্তান হিসেবে পরিচয় দেন এবং তাতে গর্ব বোধ করেন। সেই সব প্রিয় জনের কাছে অনুরোধ, আপনার কুকুর বা বিড়াল সন্তানের জন্মদিনে আমাকে দাওয়াত দেবেন না প্লিজ।

এখানে সাধারণত বয়স্করা কুকুর বেড়াল পালন করেন তাদের নিঃসঙ্গতা থেকে। আবার কিছু কিছু নারী কুকুরের সাথে সেক্স করার জন্যে তা পালন করে থাকে। এ আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। ২০ বছর আগে রোমে আমার পাশের ফ্ল্যাটের এক নারীকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ এবং তদন্তে জানা যায় রাতে কুকুরের সাথে সেক্স করতে গিয়ে তার মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়াও এখন যে কেউ সোস্যাল মিডিয়াতে সার্চ দিয়ে কুকুরের সাথে মেয়েদের হরদম সেক্স দেখে নিতে পারেন।

তাই ভয় হয় বাংলাদেশের পশু প্রেম কোন দিকে এগুচ্ছে। আমরা তো সব কিছুই শিখি হয় বোম্বে থেকে নয় ইউরোপ থেকে। আল্লাহ,তুমি আমাদের সঠিক পথে রেখো প্লিজ।

আমার ফ্রেন্ড লিষ্টে অনেক পশু প্রেমিক আছেন। প্লিজ আমার এ লিখায় কেউ আহত হবেন না। ভুল বুঝবেন না আমাকে। আমি শুধু আমার জানা এবং দেখার কথা, আমার নিজের কথা শেয়ার করেছি মাত্র। সবার জীবন মঙ্গলময় হউক। সুন্দর হউক।

নিমতিতা সরকারি কলোনি

তিন
তারক অধিকারীই উদ্বাস্তু-মোকামে বাস করা একমাত্র বদ্যি। কেউ কোনওদিন তার ডিগ্রি জানতে চায়নি; ‘নেয়েচি’-খেয়েচি’ বলা ঘটি পরিবার সরকারি কলোনিতে ভিড়ল কীভাবে, সে রহস্যের গিঁট খুলতেও লোকের বয়ে গেছে। কামদেবপুরে তার ডিসপেনসারি, সেখানে গরীব মুসলমানদের সাক্ষাৎ খোদা এই তারকেশ্বর। দুহাতের আঙুলে সাতখানা পাথর আর সমান সংখ্যক সন্তানের মালিকটির কলম ব্যবহারের অভ্যেস নেই, ট্যাবলেট ফয়েল থেকে ছিঁড়ে খবরের কাগজে মুড়ে রোগির হাতে ধরায়, সঙ্গে ঝাঁঝালো মিষ্টি ‘মিক্‌চার’। সবাই তার হাতযশের কথা মানে, এবং যারা চিকিৎসা সত্ত্বেও মরে গেল, তাদের আপনজনের পাশে দাঁড়িয়ে তারক স্বগতোক্তির মতো ব’লে দেয় — রোগটা ঘ্যাঁজ্‌ড়া হয়ে গেছলো। খুলনা-যশোর এই শব্দ চেনে না, ঘ্যাঁজ্‌ড়াকে মহাভারতের কোনও অপরাজেয় রাক্ষস ভেবে নিয়ে মানুষ সংযত থাকে।

চাঁদ যখন অধিকারীবাড়ির পাশ দিয়ে বায়ুবেগী, চেম্বার সেরে বাড়ি পৌঁছে সবে সাইকেল থেকে নামছিল ডাক্তারবাবু। তার ফেরার খবর কীভাবে যেন পেয়ে যায় পাড়ার বাচ্চারা, সাইকেলের পেছনে এর মধ্যেই দশ-বারো জনের জমায়েত। কাগজের ঠোঙা থেকে লজেন্স বের ক’রে সে প্রত্যেকের মুঠোয় একটা ক’রে গুঁজে দিতে লাগল। একটু পরে এসে জুটবে রাস্তার কুকুরের দল, খেয়ে উঠে এক-থাবা ক’রে মাছের কাঁটামাখা ভাত তাদের মুখে ধ’রে দেবে ডাক্তার। চাঁদকে দেখতে পেয়ে সে যেই হাত বাড়িয়েছে, কেঁপে পিছিয়ে গেল ছেলেটা। বাইরের কারও কাছ থেকে কিছু নেওয়া ব্রাহ্মণবাড়িতে মুরগির মাংস তোলার মতোই কঠিনভাবে নিষিদ্ধ। কেননা, দানগ্রহণ মানে নিজেকে ভিখারি প্রমাণ করা, পরিবারের সম্মান ধুলোয় মেশানো। এর শাস্তিও পিঠে বেত ভাঙার মতো সর্বোচ্চ রকমের হয়ে থাকে।

তারক ডাক্তারের ভাইয়ের নাম নারায়ণ ছবিয়ালা। কপালে অনেকগুলো চিন্তাশীল ভাঁজ সমেত শিবনেত্র চোখ, দাদার কাছে আসা-যাওয়া করে একই রকম একখানা সাইকেলে চেপে। দুজনের জামাকাপড়ও সেম টু সেম : টেরিকটনের পাঞ্জাবি, ধুতি; পাঞ্জাবিতে কান্তা সেন্ট আর চারটে ক’রে পেতলের বোতাম লাগানো। নারায়ণ অধিকারী আগে ছিল ভ্রাম্যমান ফটোগ্রাফার : বিয়ে-পৈতে-অন্নপ্রাশন উপলক্ষ্যে ছবি তুলিয়া থাকি। আচমকা ক্যামেরা বিক্রি ক’রে ফটো বাঁধানোর দোকান দিয়েছে কাশিমপুর বাজারে। পেছনের গল্পটা টিপুদা জানে।

কলোনির আপামর কাজে ডাক-পড়া, জলেস্থলে চরকি-কাটা ছেলের নাম টিপু, যার পদবি বলতে লাগে না, পাড়াসুদ্ধু মানুষের জন্যে ইয়োরস ফেথফুলি হয়ে আছে। কোনও বয়স্থা মেয়ে যদি মায়ের কাছে যাত্রা বা গানের জলসা দেখার জেদ ধরে — “পা খুব লম্বা হইছে, না? বাবা শুনতি পালি ঠ্যাং কাটে নেবে। ও আচ্ছা, টিপু নিয়ে যাবে? তালি যাও, ঘুরে আসো”।

টিপু ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার দিন বাড়ি-বাড়ি ভাইফোঁটা নিয়ে কুল করতে পারে না। মাথার চুলে ধানক্ষেত, কপাল মোটা হয়ে যায় ঘি-চন্দনে।

তো, মাস দুয়েক আগে চাঁদের শিউলিদিদি তাকে ফোঁটা দেওয়ার পর খাটে বসে লুচি-আলুরদম খেতে খেতে টিপু শুনিয়েছিল :
মুখার্জিপাড়ায় সিতু মুখার্জির মা মারা গেল না? ছবি তোলার জন্যি নারানকাকুরে ডাকে (ভালো কথা। তারপর?)। কাকু সেদিন ঠিক মার খাতো (ওমা, কেন!)। সিতুর বড়ভাই কংগ্রেস তো! সে শাসানি দিছিল, “ফেরার সময়ে ক্যামেরাটা নন্দসায়রের জলে ফেলে দিয়ে যাস। আর কোনওদিন ফটো তুলতে দেকেচি তো তোর খবর আচে! ফ্রেমে বাঁদিয়ে জবার মালা পরিয়ে ঘরে ঝুলিয়ে দোবোখুনি” (হি হি, টিপু তো জোরদার ঘটিভাষা শিখে গেছে! কিন্তু নারানদার দোষটা কী হলো, কোবি তো?)।

কাকুর সেই প্রথম মরা মানুষির ফটো তোলা। ক্যামেরার পেছনে যেয়ে ডেডবডিরে ব’লে বসিছে “রেডি”? শুনে সবাই হয়রান (ধ্যাস্‌, টিপু বানায় বানায় কচ্ছে)! কিন্তু তাতেও নারানকাকুর চেতনা হয়নি। মাথা তো কালো কাপড়ে ঢাকা। সে এবার আরেট্টু গলা তুলিছে, “এস্‌মাইল”!

চার
যিশুর রুপোলি ক্রসের মতো জেট প্লেন ঝিলিক দেয় আকাশে। তার ধোঁয়া-লেজ প্রথমে কেকের সাদা ক্রিম, আস্তে আস্তে ছানাকাটা দুধ হ’য়ে আকাশেই ভাসতে থাকে। রাস্তায় কমলালেবুর খোসা দেখে চাঁদ তুলে পকেটে পুরে নিল (বোনের চোখে রস দিয়ে দেব), তারপর ঢুকে পড়ল লখাইদিদির বাড়ি। বারান্দায় কেউ নেই, দরজা খোলা পেয়ে সে সোজা ঘরে পৌঁছে দ্যাখে মাসিমাও জেট-প্লেনস্বরূপ, মুখ দিয়ে কড়া গন্ধের ধোঁয়া বেরচ্ছে। ভট্‌চাজবাড়ির পোলাকে দেখে সেই বাষ্প থতমত, আর কোথা থেকে লখাই এসে প’ড়ে “কী হইছে রে, দিদিমা আমাগো বাড়ি আসলি দেখতিই তো পাতিস” বলতে বলতে তাকে ঠেলে ঘরের বাইরে ক’রে দেয়।

এভাবে বারবার চাঁদের ব্যর্থতায় দুঃখিত রোদ্দুর তেঁতুলগাছের পাতা বেয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছিল তো যাচ্ছিলই। যেমন পাড়ার নাইটগার্ডদের একদল ঘুমোতে গেলে অন্যদল পাহারায় দাঁড়ায়, রোদ রেখে যাচ্ছিল ছায়াকে। ব্যাপারটা বাবার মুখে শোনা জয়দ্রথের উপাখ্যানের সঙ্গে পুরো মিলে যাচ্ছে। সূর্যাস্তের পর বিধবাদের ভাত খাওয়ার নিয়ম নেই ব’লে অভিমানী বৃদ্ধা সন্ধে পর্যন্ত আত্মগোপনে, তাকে জটিল ব্যূহের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছে পাড়ার কোনও দুর্যোধন পরিবার! সুতরাং দিদিমাকে বের ক’রে আনার একমাত্র উপায় হল… নিজের ডানহাতের তর্জনীর দিকে তাকায় চাঁদ, কিন্তু সেখানে কোনও সুদর্শন চক্র দেখতে না পেয়ে আবার মুষড়ে পড়ে।

বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে এখানে রাস্তা চারভাগ হয়ে কলোনির অচেনা চার দিকে ছড়ানো। সে মরিয়া হয়ে বড় রাস্তা ধ’রেই ধাবমান, হঠাৎ কী মনে হতে ডান দিকে তাকায়… একটা চেনা চেহারা সরকারবাড়ির দুর্গামণ্ডপে পা ঝুলিয়ে বসে আছে না! কষ্টিপাথর গায়ের রঙ, বেঁটেখাটো শরীর, শুধু চোখদুটো যেন কালিপুজোয় চোদ্দপ্রদীপের ঢল থেকে বেছে এনে বসানো। যত অশ্রুই রাখো, ধ’রে যাবে।

— ওই যে দিদি, বর অ্যাতোক্ষণে তুমারে নিতি আসিছেন।
দিদিমার চেয়েও বয়স্কা সরকারজেঠুর ফোকলাদাঁতি কোলকুঁজো মা তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
— তুমি কীরম জামাই, বউ ঘোনো ঘোনো পলায় যায় ক্যান!”
— আমি কিছু করিনি। মা’র সঙ্গে ঝগড়া…।
— তা বোল্লি তো শোনবো না, মোনি। নিজের ইস্‌তিরি যহোন, যত্ন ক’রে রাখতি হবে। বড় হয়ে ছুঁড়ি বউ অনেক পাতি পারো, কিন্তু কথাডা মিলোয় নিয়ো, এই বুড়ির মহোব্বতের মোটে ধারেকাছেও কেউ আসতি পারবে না।

চাঁদ দ্যাখে, দিদিমা কিশোরীর মতো লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। মাথার ঘোমটা আর একটু টেনে সারাক্ষণের সহচর পানের ডাবরটি হাতে সে নাতির পেছন পেছন নিঃশব্দে মণ্ডপ থেকে নেমে যায়।

রাস্তায় পড়তেই ওদের দুপাশ দিয়ে যেন ভূতের তাড়া খেয়ে ফোঁশ ক’রে উড়ে গেল দুই কিশোর; যাদের চালু নাম বাবু-হাবু। এবং অচিরেই তাদের পাঁচ-ছয় তুলসী চক্রবর্তী দূরত্বে ফুটে উঠল তৃতীয়জন — ভুঁড়ি, ফটফটিয়া চপ্পল, হাতে কঞ্চি আর কোমর থেকে বিপজ্জনক নেমে যাওয়া লুঙি নিয়ে; প্রচলিত নাম জুতোনিমাই। বাচ্চা মানুষ করাকে কেন্দ্র ক’রে কলোনিতে খুবই জনপ্রিয় এই দৌড় প্রতিযোগিতা সারাদিনে দু’ থেকে তিন বার অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

শোনা যাচ্ছিল, নিজের ছেলেদের পৃথিবীর প্রায় সমস্ত জানোয়ারের বাচ্চার নামে ডাকার পর হাঁফাতে হাঁফাতে তাদের কেটে কুচিকুচি ক’রে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে জুতোনিমাই। ধরতে পারলে তবে তো ভাসান? যমজ ভাইদুটো ঘুম ভাঙতেই আজাদ হিন্দ ক্লাবের চাতালে এসে বসে, পাশের শীতলা মন্দিরের ঘট থেকে পয়সা গেঁড়িয়ে মটরভাজা কিনে খায়, কুকুর পেলেই ঢিলোয়, দাঁড়াশ সাপ দেখলে ডান্ডাপেটা ক’রে মারে, শেষে শান্ত হয়ে চাতালে ইঁট দিয়ে ঘর কেটে মাথা গুঁজে ষোলোগুটি খেলতে লেগে যায়। সাধারণত এই সময়েই চিতবাঘের চরিত্র নিয়ে দুজনের ঘেঁটিভাঙার লক্ষ্যে গুঁড়ি মেরে এগোয় তাদের জনক, অথচ ঠিক আগের সেকেন্ডে কীভাবে টের পেয়ে ছাগলের বাচ্চার মতো তিড়িং ক’রে লাফিয়ে পালায় ওরা। তারপর তিনজনের ছুট ক্রীড়াসূচি মেনে।

রান্নাঘরে লোহার মতো ভারি গাঢ় খয়েরি রঙ কাঁঠালপিঁড়িতে বসে বড় বড় ভাতের দলা মুখে পুরছিল দিদিমা। সম্পত্তি বলতে এই পিঁড়ি আর ওই পানের ডাবরই সে ওদেশ থেকে আনতে পেরেছিল। চাঁদ কোলের ওপর লেপ টেনে বড়ঘরের খাটে বসে আছে। ছেলেদের পাকড়াতে আবারও ব্যর্থ জুতোনিমাই বাড়ির পাশ দিয়ে ফিরে যাচ্ছিল তখন :
“আমি শালা পেত্যোহো পঞ্চাশটা লোকেরে জুতো পরাই, এদিকি হারামিদুটো কিছুতি একজোড়া চটি পা’য় দেবে না, গোড়ালিতি বাবলাকাঁটা ফুটোয় খোঁড়াতি লাগিছে! ইচ্ছে ক’রে ছাড়ে দিলাম…।”

(আর একটু)

আমাদের আবু স্যার

হাবিবুর রহমান আবু স্যার পান খেতেন; কেমন পান খেতেন সেটা না দেখলে বুঝা সম্ভব না। চেইন স্মোকার বলে একটা টার্ম আমরা ব্যবহার করি কিন্তু পানখোরের জন্য কোন টার্ম আছে কিনা জানি না। থাকলে স্যার এই টার্মের জন্য যোগ্য প্রার্থী হতেন। পান ছাড়া তাকে কোনদিন দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না। স্যার ক্লাসে যখন কথা বলতেন তাঁর থেকে দূরে থাকতে হত কিন্তু দূরে থাকা সম্ভব না কারণ আবু স্যার চেয়ারে বসে কিংবা টেবিলে ঠেস দিয়ে লেকচার দিতেন না, তিনি হেঁটে হেঁটে লেকচার দিতেন প্রতিটি বেঞ্চের সামনে এসে তাঁর বক্তব্য পেশ করতেন।

তাঁর কথার চোটে আমাদের স্কুল ড্রেসের অবস্থা কেরোসিন হত। পান, চুন এবং জর্দার মিশেলে যে মালাই তৈরি হয় সে মালাই থেকে কোনদিন বাঁচতে পারিনি।

স্যারের পানস্ত্র থেকে বাঁচতে চাইতাম ঠিকই কিন্তু স্যারের ক্লাসের মজা কোনদিন মিস করতে চাইতাম না। স্কুলে স্যারের চেয়ে ভাল, জনপ্রিয় কেউ ছিল না। আমি নিশ্চিত যদি প্রিয় শিক্ষদের প্রতিযোগিতা হয় স্যার নির্দ্বিধায় প্রথম হবেন।

স্যার ইংরেজীর শিক্ষক ছিলেন কিন্তু আমরা তাঁকে বিজ্ঞানে চাইতাম, অর্থনীতির স্যারের অনুপস্থিতির বিকল্প অন্য কেউ এলে আমরা মনমরা হয়ে যেতাম কিন্তু স্যার এলে অর্থনীতি আমাদের কাছে ঝলমলে হয়ে উঠতো। বাংলার ক্লাসে তাঁর বিকল্প ছিল না, কখনো সখনো গনিতেও তিনি পারদর্শীতা দেখাতেন।

ইংরেজী বিজাতীয় ভাষা; কিন্তু খুব মূল্যবান, আমাদের মাঝে কেউ যদি দু-চার লাইন ইংরেজি বলতে পারতো, তাকে আমরা বিলেতের রাণীর মত সমীহ করতাম। কারণ আমাদের জ্ঞান ইয়েস, নো, ভেরি গুডে সীমাবদ্ধ ছিল। স্যারের কাছে ইংরেজী ছিল ডালভাত, তিনি যেভাবে ইংরেজী বলতেন অনেক ইংরেজও হয়তো বলতে পারত না।

অন্য সব বিষয়ে মেট্রিকে পাশের সম্ভাবনা হয়তো আছে কিন্তু ইংরেজী ডুবাবে নিশ্চিত, স্যারকে এই কথা বললে হেসে উড়িয়ে দেন। বলতে ভাল লাগছে স্যারের কারণে ইংরেজীতে ভাল নাম্বার পেয়েছিলাম। স্যার স্কুলের শিক্ষক ছিলেন কিন্তু অবৈতনিক; অর্থাৎ শিক্ষার বিনিময়ে কোন পয়সা নিতেন না।

অমিতাভ বচ্চনের জয়প্রিয়তা আকাশচুম্বী, বোম্বে ফ্লিমে তাঁর অবস্থান এক থেকে বিশ, বাকীরা একুশ থেকে। আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে স্যারের অবস্থান ছিল এক থেকে একশ বাকীরা একশ এক থেকে শুরু।

শিক্ষক বলতে আমরা যে আদর্শ মানুষের চিন্তা করি, আমাদের কল্পনায় যে আদর্শ শিক্ষকের অবয়ব ভেসে ওঠে স্যার ঠিক তেমনি ছিলেন। আমাদের সৌভাগ্য আমরা স্যারের কালে জন্ম নিয়েছিলাম; তাঁর ছাত্র হতে পেরেছি।

বোধন

311 ১.
দুনিয়াটা হলো দুঃস্বপ্নের কারাগার এ দুঃস্বপ্নের কারাগার থেকে আপনি যা কিছুই মনে প্রাণে চান না কেন তা ছিনিয়ে আনতে হয়।

২.
অতঃপর, দুনিয়াটা হলো প্রতিযোগিতার মঞ্চ; যে যত সামনে থাকতে পারে সে ততো মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। আপনি ভালো পোষাক পড়ে আছেন আপনি ভালো চেয়ারে বসে আছেন কিংবা আপনি যেভাবেই থাকুন না কেন মঞ্চের সামনে আপনি যতটা ভালো পারফরম্যান্স ততটাই বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবেন।

৩.
সম্ভাবনা।
যে যত বেশি আলোচিত মানুষ সে ততো বেশি সমালোচিত হয়।

৪.
আলোচিত মানুষদের লাইফস্টাইল ঈশ্বর সমকক্ষ করবেন না তাদেরকে মানুষের কাতারে থাকতে দিন মনে রাখবেন তারা রক্তে মাংসে গড়া মানুষ; তারাও ভুল করে, তাদেরও ভুল হয়¡ তবে তাদের ভুলগুলো যেন সবচেয়ে বেশি আলোড়িত, আলোচিত সমালোচিত সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষক আর এর সবকিছু হয় সে একজন আলোচিত মানুষ বলে। আলোচিত মানুষরা ভুল করলেও সেই সমালোচিত ভুলগুলো মানুষের মেনে নিতে কষ্ট হয়। আমার মনে হয় আলোচিত মানুষদের মানুষই মনে করা হয় না তাদেরকে ঈশ্বরের জায়গায় স্থান দেওয়া হয়। আর ঈশ্বর তুল্য কিছুই নেই জগতে এই বিষয়টা তাদের মস্তিষ্কে এখন পর্যন্ত গ্রথিত হয়নি বলেই এমন চিন্তা উজ্জীবিত থাকে মানব মস্তিষ্কে।

৫.
নির্বোধের মনই ঈশ্বর; বিবেক অপেক্ষা অবিবেচনাবোধ হলো বিশ্বাস। তার মধ্যে যত অজানা সেগুলোই ঈশ্বরকে খোঁজার বাঁধা প্রদানকারী।।

পিনাকীর দুই দিদি

আমাদের বন্ধু পিনাকীর দুই কাজিন ছিল এই দুই কানিজের জন্য পিনাকীর সাথে বন্ধুত্ব করার একটা প্রতিযোগিতা ছিল, বন্ধুত্ব হয়ে গেছে; কিন্তু কে কত ঘনিষ্ঠ, বিশ্বস্ত বন্ধু প্রমাণের জন্য পুনরায় প্রতিযোগিতা হত।

পিনাকী চালাক ছিল আমরা যে তার কাকাত দুই বোনের জন্য প্রয়োজনাতিরিক্ত খাতির যত্ন করি বুঝতে পারত, কিন্তু ভাবেসাবে বুঝতে দিত না। আমাদের খাতির যত্ন সে এনজয় করত।

বলাবাহুল্য তার বোনেরা আমাদের পাত্তা দিত না, কারণ বয়সে আমরা ছোট এবং চালচুলোহীন। আমরা প্রেমে বিশ্বাসী ছিলাম; প্রেমের কাছে বয়স কিংবা অবস্থা বিবেচ্য হয় না। মহান প্রেমিক যারা ছিলেন তাদের চালচুলোর কোন বিবরণ পাওয়া যায় না।

ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার আগে এক মাসের ব্যবধানে পিনাকীর দুই দিদির বিয়ে হয়ে যায়, দুই দিদির বিয়েতে পিনাকী মনমরা, সেটা দিদি বিয়োগে না বন্ধুত্বে ধার কমে যাওয়ার ভয়ে বুঝা না গেলেও সে যে বিমর্ষ স্পষ্ট দেখা গেল।

আমাদের দুই প্রেমিকা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় আমরাও মনমরা কিন্তু এর জন্য পিনাকীর সাথে বন্ধুত্বের কোন হেরফের হল না। পিনাকীর মা অর্থাৎ আমাদের মাসীমা নিজের ছেলের মত যত্ন করে বিভিন্ন পদ রান্না করে খাওয়াতেন, এই নিখাদ ভালবাসা মিস করতে চাইতাম না।

তার দিদিরা পুজোয় বাড়ি আসত ভাইয়ের জন্য কোন উপহার নিয়ে এলে ভাইয়ের বন্ধুদের কখনো ভুলত না।

আমরা দুই দিদির পায়ে প্রেমের অর্ঘ্য দিতাম, দিদিরা সেই অর্ঘ্য স্নেহের সিন্দুকে জমা রাখত। একদিন আবিষ্কার করলাম আমরা আসলে স্নেহের কাঙাল ছিলাম; আমাদের কাঙালপনা ঘুচিয়ে দিতে পিনাকীর দুই দিদি কোন কসুর রাখত না।

পিনাকী এখনো আমাদের বন্ধু, সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু। তার দুই দিদি আমাদের অতিপ্রিয় বড় দুই বোন।

নিমতিতা সরকারি কলোনি

এক
নিমগাছে নতমস্তক হয়ে পড়েছে রোদ্দুর। পুকুরপাড়ে পোঁতা খুঁটির ডগায় ব’সে মাছরাঙা ভাবছে, মাছ ধরতে গেলে সেই তো পায়ে ঠান্ডা লাগবে। কার বাড়ি যেন রেডিয়োতে “বলো না সহজ ক’রে আমায় পেরেছ তুমি বুঝতে”, আর প্রত্যেক গাছের নীচে শুকনো পাতার কবিতাপাঠ।
তখন কলোনির রাস্তা দিয়ে একটা বাচ্চা ছুটছিল।
— ও চাঁদ, কুথায় যাস?
— দিদ্‌মারে খুঁজতি।
ব’লে সে দুটো হাঁচি দেয়। আবার ছোটে।

বলরাম দাসের ভিটের দিকে যাওয়া নেই। শত্তুর পরিবার, দিদিমা হাজার ম’রে গেলেও ও-মুখো হবে না। পরের বাড়ি নবীন বিশ্বাস।
— ও নবীন, তুমি কী কাজ করো?
— মাসিমা, আমার ব্যারাকপুর টেশেনের গা’য় টেশেনারি দোকান।
— কী নারী ক’লে? ভগোবান য্যান্‌ তোমারে সুবুদ্ধি দেন!

হলুদ গায়ের রঙ আর টানা নাকচোখের নবীন; তার সুবুদ্ধি আছে, আবার নেইও। বিক্রিবাটার পয়সা ঘরেই এনে রাখে, তারপর পাড়া-টহলে বেরোয়। প্রত্যেক বাড়ির পাশ দিয়ে নিঃশব্দে ঘুরে বেড়াবে আর উঠোনে কি কলতলায় মেয়েমানুষ দেখলেই এগিয়ে এসে, “বুঝলে, আজ আমার চোখির সামনে তিনডে লোক এক বুড়ির হার ছেনতাই ক’রে দোড় মাল্লো”। এভাবে নীচু গলায় বিরামহীন গল্প শুরু হল, ওদিকে সে-মেয়ে একগাদা জামাকাপড়ে বল-সাবান মাখিয়ে রেখেছে, কাচবে কখন? অথবা,
— দাদা যাই, উনোনের ভাত এইবার পুড়ে যাবেনে!
— আরে, কী ঘটনা হইছে শোনো…

নবীনের বউ কাজল বাইরে থেকে খুব সাদামাটা আর রুগ্ন, কিন্তু তার হৃদয়পিঞ্জর মানুষের জন্যে ভালোবাসা আর একটা মানুষের ’পরে অভিমানে টাপেটোপে ভ’রে আছে। সূর্য মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল তবু কাজল কিছু খাবে না, গ্যাসের অসুবিধে কিন্তু ডাক্তার-কবিরাজ করবে না; আধো-অন্ধকার রান্নাঘরে বসে শুধু রেঁধে যায় — পেঁয়াজ ফোড়ন দিয়ে ভুরভুর গন্ধের মুসুরির ডাল, বড়ি দিয়ে কচি লাউডগার তরকারি, গোটা সরষে দিয়ে ডুমো কুমড়োর ছেঁচকি, পোস্তো দিয়ে কড়কড়ে পলতা পাতার বড়া…। কাজলের মেয়ে সুধা সারাক্ষণ পাড়াময় দৌড়ে বেড়াচ্ছে গলাভর্তি অট্টহাসি নিয়ে। মিন্টুর ঠাকুমা যে বলেছিল, “ও সুদা, শুদা শুদা হাসিস ক্যান”, সেটাই তার এক-লাইনের আত্মজীবনী। সোনাব্যাঙের মতো লাফাতে লাফাতে সবার ঘরে ঢুকে পড়ছে সুধা — কমলাপিসি, আজ কী রাঁধলে গো? মান্তির মা, নিমবেগুন আর পেঁপের ঝোল খেয়ে খেয়ে তোমার অরুচি ধরে না? এক ঘন্টা পরে সে তরকারির বাটি হাতে আবার পৌঁছে যাবে — মা দেছে বিশ্বনাথমামার জন্যি… মা দুঃখীপিসিরে খাতি বোল্লো।

চাঁদকে ছিটে-বেড়ার গেট ঠেলে ঢুকতে দেখে থমকে দাঁড়াল সুধাদিদি :
— কী ব্যাপার, বিদ্যেসাগোর?
— তোমাগো বাড়ি আমার দিদ্‌মা আইছে?
— যাহ, চাঁদের বুড়ি হারায় গেছে!
সুধা পাকা ফুটির মতো ফেটে পড়ল হাসিতে।

দুই
শীতের দুপুরে বাতাস এত ঝাঁঝরা হয়ে থাকে শূন্যতায়, প্রজাপতি উড়তে গিয়ে একটুতেই থ’কে যাচ্ছে। সব উঠোনের রোদ্দুরেই চুলের উকুনবাছা নারীসমাজ দৃশ্যমান। ভক্তবাড়ির পুঁচকে ছেলে কালিদাস ঘেঁটুফুলের ঝোপে নিজের পেছছাপের ধারা দিয়ে ছবি আঁকার চেষ্টায় ব্যস্ত। ফোঁত ক’রে নাক ঝেড়ে রাস্তা দিয়ে আবার ছুটল চাঁদ। এবার বীরেন-ধীরেনের খোলা বাড়ি, মানে দু’হাত অন্তর কচাগাছ পোঁতা নেই প্লটের সীমানা ঘিরে। কয়েক মাস ওদের বাবা মারা গেছে।

আস্তে আস্তে মরে যাওয়াটা কলোনির দস্তুর। যে কাশে, কেশেই যায়; যার হাগা, বারবার গিয়ে বসছে চাড়ি বসানো খাটা-পায়খানাতে। একদিন চাঁদের মা বিকেলে চুল বাঁধতে বাঁধতে বলবে, মালাকারবাড়ির প্রভাতের বুকির রোগডা আবার ঠ্যালা দেছে। ঠোঁট দিয়ে ফিতের একটা দিক চেপে থাকায় কথাটা ভালো বোঝা যাবে না। তারপর একরাতে ভাত খেতে ব’সে গরাস মুখে তুলতে গিয়ে আবার পাতে নামিয়ে রাখবে, “বিরু-ধিরুর বাবা মনে হয়…”। সকালে এবাড়ি থেকে একজন, ওবাড়ি থেকে আর একজন ধীর পায়ে হাজির হচ্ছিল মালাকার-বাড়ির দরজায়। মাতব্বর-গোছের কেউ, প্রায়ই যার নাম বলরাম দাস, চেঁচিয়ে বলছিল, “ওরে বের ক’রে উঠোনে এনে শোয়াও। ঘরের মোদ্দি থাকলি পেরানডা বেরোতি পাত্তিছে না”। শোনামাত্র প্রভাতের বউ কুক দিয়ে কেঁদে উঠেছে। যেন পুজো শুরু হবে কিন্তু দুব্বো তোলা হয়নি মনে পড়ায় কেউ ডেকে আনছে পাড়ার ডাক্তারটিকে। সে আসলে হিন্দি সিনেমার পুলিশ অফিসার, শেষ দৃশ্যে নায়ক ভিলেনকে মেরে পাট-পাট করে দেওয়ার পর হাজির হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত খলনায়ককে হাতকড়া পরিয়ে দেয়।

বাঁহাতের তিন আঙুলে আলগোছে রোগির কব্জি ধরে নিজের কব্জির ঘড়ির দিকে ঠায় তাকিয়ে ছিল তারকডাক্তার। তারপর মাথা নেড়ে ঠোঁট উল্টোয় — ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট।

প্রিয় টিম হেরে যাওয়ার শোক বুকে বয়স্ক প্রতিবেশীরা ফিরে আসছিল — মৃত্যুর সঙ্গে ফাইনাল ম্যাচে পরাজয় নিয়ে মাঠ বা রেফারিকে দায়ি না ক’রেই। তখনও বীরেন-ধীরেনের মা উঠোনে উবু হয়ে শবদেহের পরামর্শ নিতে ব্যস্ত। “বাড়িতি চাট্টে পেট, কী করি কও তো! কোইলকাতায় বাসনমাজার কাজ ধরবো? না আড়তে যেয়ে পচা আলু পচা পেঁয়াজ বাছার জোন খাটতি শুরু করি? আড়ত ভালো, দিনিদ্দিন টাকা; কিন্তু তোমার বেয়াই জগন্নাথ সাহা গা পর্‌শো ছাড়া কথা কোতি পারে না। হারামির হাতদুটো জগন্নাথ ঠাকুরির মতোন ঠুঁটো হয়ে যায় না ক্যান!

সুতরাং কলোনিতে বিধবা গিজগিজ করছে। তাদের বরেরা কেন যে এমন আপোষে মরে যায়! চারদিকে সাদা থান আর প্রত্যেক আঁচলের নীচে তিন-চারটে শুকনো কিশোর মুখ। সময়ের অনেক আগে ডিমের খোলা ভেঙে গেছে, তলতলে কুসুম হয় ভ্যান টানছে কাদা রাস্তায়, নয় দাদ-হাজার মলম নিয়ে উঠে পড়েছে লোকাল ট্রেনে। আর বারো-তেরো বছর থেকেই মেয়েদের জিভের নীচে তরল থলি, অপছন্দের শব্দ শুনেছে কি তাক করে নীল থুতু ছিটিয়ে দেবে। যে বাড়িতে দুতিনটে মেয়ে, খবরদার তাদের লেজে পাড়া দিতে যেয়ো না।

(আরও আছে)

গুড়ের চা

সাত
সকাল থেকে এই নিয়ে চার নম্বর ভিখারি। পেট ডুগ্‌রে গলা সরু একটা ন্যাংটো বাচ্চা কোলে তার মা এসে দাঁড়িয়েছে। বাচ্চাটার দু’নাক দিয়ে মোটা হলদে সিক্‌নি। মাঝেমাঝে নাক টানলে বেরিয়ে পড়ছে সিক্‌নির নীচে দুটো লম্বা লাল ঘায়ের দাগ।

প্রতিবার রান্নার চাল নেওয়ার পর হাঁড়ি থেকে যে ছোট দুই মুঠ তুলে একটা কলসিতে রাখা হয়, সেখান থেকে রেকাবিতে চাল নিয়ে ছোড়দা ঢেলে দিল বৌয়ের পেতে ধরা গায়ের কাপড়ে। চালসমেত শাড়ির অংশ কোমরে গুঁজে নিল সে। তখন মনে হল, কোলের মতো তার পেটেও এক সন্তান।

অন্ধ সেজে আসে অনেকে, ভিক্ষে নিয়েই দে হনহন ক’রে হাঁটা; অনেকের হাতটান খুব, এদিক-সেদিক গেছ কি রান্নাঘরের দাওয়া থেকে বাচ্চার তেলমাখার বাটি নয়ত উঠোনে ছেড়ে রাখা হাওয়াই চটি নিয়ে গায়েব হয়ে যাবে। এমন তাদের মরিয়া সাহস, চার-পাঁচ দিন পরে আবার তোমার বাড়ি, আর ভুলুক-ভালুক তাকাচ্ছে, যদি আরও কিছু গ্যাঁড়ানো যায়।

তবু কোনওভাবে দেশ থেকে দেশে লাখ লাখ মানুষের এই মহাঅভিসরণ, তাদের ক্ষিদে, তাদের মাঙনের হাত-পাতা আর অপমানিত হওয়ার পাঠক্রমকে লঘু করা যাবে না। খালি পায়ে বাদাবন পার হয়ে, রেল লাইন টপকে, দিনে কচুরিপানা-ভর্তি পুকুরে গলা পর্যন্ত ডুবে থেকে রাতে গ্রামের পর গ্রামের ঘুম না ভাঙিয়ে পোয়াতি বউ, দুধের শিশু বা অশক্ত বাবাকে আঁকড়ে এই নিঃশব্দ স্থানান্তর! তারপর অনেকের চুপচাপ মরতে থাকা… রাতে ঘুমের মধ্যে যেমন শিউলি ঝ’রে পড়ে আর সকালে উঠে এক একটা বুক-কাঁপানো “বলো হরি, হরিবোল”, কাঁচা বাঁশের চালির ওপর শুয়ে কেউ চলে যাচ্ছে শুঁটি নদীর গায়ে জুবলিঘাটা শ্মশানের দিকে। উদ্বাস্তু জীবনের মতো শুকিয়ে গেছে সেই সুবর্ণবতীও, যেখানে এক সময় চাঁদ সদাগরের ডিঙা ভাসত। অন্যদিকে দুটো চাল, একবাটি ফ্যান বা একটা তামার পয়সার জন্যে কলোনি জুড়ে বিষণ্ণ পদক্ষেপ। ভিখারি এসেছে ভিখারির কাছে ভিক্ষে চাইতে!

চতুর্থ কাঙাল স’রে গেছে কি যায়নি, একটা রব উঠল কলোনির বাঁ হাতে মান্নাপাড়ার দিক থেকে। ওমনি বড় রাস্তার দুপাশে বাড়িগুলো পিটি করার মতো “সাবধান”। মুহূর্তের মধ্যে এক পাল শুয়োরের কালো প্রবাহ এসে পড়ল রাস্তায়। ঘোঁত ঘোঁত শব্দে কান ভ’রে উঠছে, বানের জলের মতো এপাশ-ওপাশের বাড়িতে ঢুকে পড়ছে দু’চারটে, তখন পালের পেছনে যে দুজন রাখাল, তারা মুখে চুঃ চুঃ ক’রে লাঠির প্রহারে তাদের তুলে আনছে রাস্তায়।

ঢেউটা এগিয়ে আসতেই চাঁদের বাড়ির দুদিকের দুই কচুবাগানে “শুয়োরে চেনে কচু” প্রবাদ মনে রেখে বরাহদল আক্রমণ শানাল। ওমনি কলোনির মেয়েরা অভিশাপ দিতে শুরু পশুর পালকে, আর ছেলেরা তেড়ে গেল তাদের পরিচালকদের দিকে। এই কচুবনদুটো কলোনির বেশ কয়েকটা বাড়ির খাদ্যভাণ্ডার — কচুপাতাবাটা, নুন-লংকা মাখা কচুভাতে, কচুর সব্জি দেওয়া ডাল অথবা অল্প সরষের তেল খরচ করতে পারলে কচুর লতির বাটিচচ্চড়ি। আবার, বাড়িতে মূল্যবান অতিথি এসেছে তো সদ্য-গজানো অর্ধেক মোড়া কচুপাতার মধ্যে ডালের পুর দিয়ে ভেজে এক উচ্চপর্যায়ের ঝোল-তরকারি হতে পারে। বাজার করার পয়সা না থাকলেও ঘরে বসে তুমি চার-পাঁচটা রান্নার পদ পেয়ে যাচ্ছ।

কাদাজমিতে ঢুকে জানোয়ারগুলো পড়পড় ক’রে কচুগাছের গোড়া ওপড়াতে শুরু করেছে, এদিকে বাতাসে শিস কেটে লাঠির বাড়ি পড়ছে পিঠে, গোঙাচ্ছে তারা। কষ্টে ঘেমে যাচ্ছে চাঁদের বুক। ভগবান এইমাত্র ম্যাজিক ক’রে তাকে ওই চার-পাঁচ ডজন শুয়োরের কোনও একটা বানিয়ে দিলেন, চাঁদের চাম-মাংস-হাড় কেটে কেটে বসছিল লাঠির পরিত্রাহি সপাংগুলো!

আট
জাঙাল লণ্ডভণ্ড ক’রে এগিয়ে যায় ইতরসমাবেশ, মেয়েদের গজগজানির তখনও বিরাম নেই।
এ এক বড় ঘেন্নার জীব — চাঁদের মা দত্তকাকুর বউকে বলছে।
— কলতলায় সবে ঠাকুরির বাসন নামাইছি, যদি আসে মুখ দিয়ে দিতো, ক’ন দিদি! পাপটা তো আমারই লাগতো?
— কাওরাগো ব’লে-বোঝায় তুমি কিছু কোত্তি পারবা না, শান্তর মা। ওগো আবাহোনও নেই, বিসজ্জোনও নেই।

কায়পুত্র নামে ডাকলে তারা খুশি হয়, তবু সবাই কাওরাই বলবে। মান্নাপাড়া পেরিয়ে বাজারের ঠিক আগে চৌবাড়ি ময়দান, মাঠের গায়ে লাগানো কাওরাপাড়া। হয়ত মেরেকেটে দশ ঘর, পঞ্চাশ মানুষ। সব্বাই তীক্ষ্ণ কালো আর শুঁটকো, ছেলেরা নেংটি প’রে পায়খানা সাফাই করে, পোষা জীবগুলোর মতোই পাঁক ঘেঁটে মাছ ধ’রে বেচে বাজারে, মেয়েরা খাটছে ঠিকে-ঝি। ছেলেপেলে স্কুলে যায় না, সিগারেটের খোল দিয়ে তাস বানিয়ে জুয়ো খ্যালে, বিড়ি টানে, নিজেদের মধ্যে মুখখারাপ আর মাথা-ফাটাফাটি সারাক্ষণ।

বয়স্করা বাড়িতে পচাই আর তাড়ি বানাচ্ছে, পাশ দিয়ে হাঁটলে বোঁটকা গন্ধ পাবে। কিন্তু আজকাল ভদ্র সমাজও সন্ধেবেলা বড় রাস্তা এড়িয়ে ঘন দাঁতনগাছের ঝোপ ঠেলে কাওরাপাড়ায় হাজিরা দেয়। এভাবে কালে-কালে গোটা এলাকাই মাতালের দখলে চলে যাবে — এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে দত্তবাড়ির বউ ঠাকুরের বাসন মেজে ঘরে ওঠে। চাঁদের মা কনিষ্ঠ সন্তানকে নির্দেশ দিচ্ছিল, যা, দিদ্‌মারে ডাকে নিয়ে যায়। দ্যাখো গে, কলোনির কোন বাড়িতি যেয়ে ব’সে আছেন। এবার সে রান্নাঘরে ঢুকে মায়ের ভাতের থালাটি আগাম সাজিয়ে হাঁড়ির বাকি ভাত নিজের পাতে তুলে নিল। তখনই আজকের ছ’নম্বর ভিখারির শুভ মহরত।

অল্প বয়েসি বউটা রান্নাঘরের গোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে দেখে মা দরজার পাল্লা অর্ধেক ভেজিয়ে এক চিলতে মুখ বাড়ায় — কী চাই?
— দুটো ভাত দেবা, মা গো? কাল দুফোরেত্থে কিসু খাইনি।
— নাম কী তোমার?
— মালোতী
ভেজানো পাল্লা দমাস ক’রে খুলে গেল।
— মিথ্যে কথা কও কিসির জন্যি? তুমি তো মোছলমান।
নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে থাকে সে।
— যাও, একখান কলাপাতা ছিঁড়ে নিয়ে আসো।

পাতিলেবুগাছের নীচে উবু হয়ে বসে পড়ে মালতী… না, মোমতাজ। মা নিজের থালা হাতে বেরিয়ে এসে অর্ধেক ভাত কলাপাতায় ঢেলে দেয়, কুমড়ো-পুঁইশাকের ঘ্যাঁট এক খাবলা রাখে ভাতের পাশে, এবং যে মুসুরির ডাল ঢালে পাতের ওপর, তাতে এমন নিফুটি জল যে পাতা ছাপিয়ে উঠোনের ধুলোয় মিশে যায় ডালের অর্ধেক। লেবুগাছের চারটে পাতা ছিঁড়ে চটকে মেখে খাওয়া সেরে মুখ ধুয়ে মোমতাজ যখন আঁচলে হাত মুছছে, মা গিয়ে সামনে দাঁড়াল :

— তোমরা তো পাকিস্তান থে’ আমাদের খ্যাদায় দিছিলে নিজেরা আরামে থাকপা ব’লে। কিন্তু থাকতি পাল্লে কই? সেই তো হিঁদুগো পেছোন পেছোন ইন্ডিয়ায় চলে আসতি হ’লো!
— কাজ জোটে না মা, ভিক্কেও দেয় না কেউ, কিন্তুক সব্বোনাশ করার লোক আছে। যেই মেয়ে হল অ্যাট্টা, খসোম ছাড়ে দে’ চলি গ্যালো। পাকিস্তান-ইন্ডে দিয়ে আমি কী করবো, পেরানে বাঁচা নিয়ে কথা।
— তোমার মেয়েডা কই?
— সে-কবে তার গোর দেয়া সারা!
ব’লে এমনভাবে উঠোনের একদিকে তর্জনী বাড়ায়, যেন ওখানে খুঁড়লে এখুনি মেয়ের মাটিমাখা হাড়গোড় বেরিয়ে আসবে।

চাঁদ দিদিমাকে খুঁজতে বেরোনোর সময় পেছন ঘুরে দেখছিল — শীতের ফ্যাকাসে দুপুরের ভেতর দাঁড়ানো দুই নারী শূন্য চোখে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে…।

টিকর বাড়ির টিলা

একজন বলল আপনার প্রিয় জায়গার নাম বলুন।
আমি বললাম ‘টিকর বাড়ির টিলা’
-বলেন কী কবরস্থান কী কারো প্রিয় হতে পারে?
-আমার পারে, কারণ এই কবরস্থানে আমার শৈশব প্রোথিত আছে, লাশের সারি দেখে দেখে আমি বড় হয়েছি, শুভ্র কাফনের চেয়ে পবিত্র বস্ত্র আর কিছু হতে পারে না, সংসারের হাজার চাওয়া পাওয়া ‘টিকর বাড়ির টিলা’য় এলে শান্ত; কারণ লাশের কোন অনুযোগ থাকে না। যে ক্যাডবেরি খেত আর যে লেবেঞ্চুস চুষতো ‘টিকর বাড়ির টিলা’য় তারা একাসনে থাকে। যেখানেই জন্ম হোক শেষ পর্যন্ত তাকে ‘টিকর বাড়ির টিলা’য় ফিরতে হবে।

স্বপ্ন দেখি ‘টিকর বাড়ির টিলা’র অখ্যাত কোন কবরে শোয়ে আছি, প্রবল বৃষ্টিতে কবরের দেয়াল ভেঙ্গে পড়েছে, অসীম মমতায় মিউনিসিপাল কর্মী পুনরায় দেয়াল গড়ছে। চতুর্দিকে পরিত্যক্ত হাজার কবর, দশ বছরেও কেউ খোঁজ নেয় না কিন্তু ‘টিকর বাড়ির টিলা’র মিউনিসিপাল কর্মী কখনো মমতা দেখাতে কার্পণ্য করে না।

আলহামদুলিল্লাহ সুস্থ আছি

309

চুমুকে তুলে নিয়ে তৃপ্তি, চোখ রাখি বন্ধ
আল্লাহর নিয়ামত নিয়ে ভাবি, আহা জীবনে কী সুখ ছন্দ,
নেই অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের চিন্তা, কত সুখে আছি,
আল্লাহর দয়ায় এই তো অল্প ব্যথা বেশি সুখেই বাঁচি।

তবুও হা হুতাশে রেখে দেই মন
কষ্ট পাই অল্পতেই খুঁজি নির্জন,
তবুও বিতৃষ্ণা পুষে রাখি মনে,
ভাবি এই, চৈত্রের খরা ছুঁয়েছে মন উঠোনে!

চায়ের কাপে তুলে রাখি কত ভাবনার ছবি,
সুখে নেচে ওঠে সহসা দেহ পল্লবি,
দেহে ফিরে আসে কর্মের শক্তি,
আল্লাহর প্রতি শোকরিয়ার বাড়ে অনুরক্তি।

সকাল হলেই নিঃশ্বাস ফেলে বলি এই তো আছি বেঁচে,
হাত পা নেড়ে হাই তুলি, মন সুখে ওঠে নেচে,
ব্যস্ততাদের দূরে ঠেলে আমি অবসর খুঁজি,
এক বেলা অবসরে চায়ের কাপে ঠোঁট গুঁজি।

আমি চায়ের কাছে দুঃখ বিকিয়ে দেই
সুখ কিনি, সময় কেটে যায় আনন্দেই,
ছুটির দিনগুলো যেন ট্রেন, হুইসেল বাজিয়ে যায় দূরে
কিছু সুখ, কিছু অবসর দিয়ে সময় বাজে করুণ সুরে।

সময় চলে যায়, রেখে যায় এক চিলতে সুখ,
হয়তো ব্যস্ততা এসে দাঁড়াবে ফের সম্মুখ,
তবুও সুখে রেখেছেন আমার আল্লাহ্,
ভালো আছি, বেশ আছি আলহামদুলিল্লাহ।

.
(স্যামসাং এস নাইন প্লাস, ঢাকা।