বিভাগের আর্কাইভঃ জীবন

শুভ্র শূন্যতা

আয়না তোমাকে পরিচিত করে তোমার মুখের রেখাগুলোর সাথে অথবা জাগিয়ে তুলে সুপ্ত নার্সিসিজম, নির্ভর করে তুমি কিভাবে ব্যাবহার করছো তোমার নিজস্ব দর্পণটাকে। তবে তুমি যা নও তা দেখতে চেয়োনা। ঠকে যাবে। তোমার বুঝতে হবে, নার্সিসিজমেরও একটা সীমা আছে।

বরং তোমার প্রতিবিম্বটাকে রেখে দাও পাখির চোখের ভেতরে।

কানামাছি খেলায় তোমার চোখে বাঁধা রুমালটা প্রজাপতি হয়ে গেলে, হারজিতের কথা মনে থাকেনা। সামনে তখন কেবল কতগুলো রং অথবা মিলিত বর্ণচ্ছটার রংধনু। রংগুলো আলাদা করে ফেলো। তুমিতো জানোনা কোনটা আসল রং। খুঁজে নাও। কিন্তু মুছে ফেলোনা ডানার পরাগ। সব রংয়ের উৎসতো এটাই।

আয়নার কাচে যখন বিম্বিত হবে রংগুলো তখন দেখবে সব বর্ণসমন্বয়েই ফোটে ওঠে —-শুভ্র শূন্যতা।

একালের রামায়ণ

(নিছক রূপকথা নাও হতে পারে)

দশানন রাবণের দশ মাথার মতো পরেশ লালের দশ মাথা আছে বললে অত্যুক্তি হবে না, বরং রাবণের চেয়ে কয়েক মাথা বেশি হবে তার। দশবার আক্রমণের পরেও যে বহাল তবিয়তে থাকতে পারে তার প্রতি রাবণাশীর্বাদ আছে এটা অস্বীকার করার কোন জো নেই।

পরেশ লাল বারবার বেঁচে যায় এবং তার বেঁচে যাওয়া উদযাপন করতে গিয়ে একটি করে লাশ পড়ে। এই জনপদে পরেশ লাল সাক্ষাত রাবণ, সে এমন রাবণ যে যাবতীয় রাম তার ভয়ে কম্পমান।

রাজাও কিছু নিয়ম-কানুনে বন্দি থাকে, অত্যাচারী রাজাও চাইলে যে কারো মস্তক খণ্ডন করতে পারে না; তাকে কিছু নিয়মের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যার মস্তক খণ্ডনের খায়েশ জেগেছে, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতে হয়, পাইক-পেয়াদা দিয়ে ধরে নিতে হয় প্রহসন হোক তবু বিচারের মুখোমুখি করতে হয়। এসব লোক দেখানো শেষ হলে তবেই না মস্তক খণ্ডন।

পরেশ লালের অত ধৈর্য নেই, অপেক্ষা তার দুচোখের বিষ; ওঠ ছেমড়ি তোর বিয়ের মত মস্তক খণ্ডনের খায়েশ হলে ততক্ষণাত কার্য সমাধা। অন্যের গড়িমসি দেখে নিজেই বেশ ক’বার মস্তক খণ্ডন করেছে।

পরেশ লাল ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দী নয় বরং স্বয়ং ঈশ্বর। জনপদে তার আদেশ অলঙ্ঘনীয়। জনপদের উপসনালয়ে ঈশ্বরের গুণকীর্তনের সময় পাওয়া যায় না, ঈশ্বরের মহিমা প্রচারে মানুষ বিমুখ এটা বলা যাবে না তবে পরেশ ঈশ্বরের ভয়ে মানুষ আসল ঈশ্বরে আত্মসমর্পণ করতে পারে না।

আপনারা হয়তো ভাবছেন এসবই গাঁজাখুরি গল্প; বর্তমান সময়ে প্রকাশ্যে মস্তক খণ্ডন করে কেউ কী পার পেতে পারে! আপনাদের কাছে এসব অবিশ্বাস্য গল্প, অলস মস্তিষ্ক লেখকের বিকৃত চিন্তা। এসব গল্প অসত্য নাও হতে পারে।

আমাকে যখন প্রথম গল্প শোনানো হয় আমিও অসত্য ভেবেছিলাম, বর্ণনাকারী কে উন্মাদ ভেবেছিলাম। একজন মানুষ যতই উন্মাদ হোক না কেন তার চোখের ভয়ে কিছু সত্য লুকানো থাকে, ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলা মিথ্যার নিচে কিঞ্চিৎ সত্য না থাকলে বর্ণনাকারীর উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়।

আমি বর্ণনাকারী কে উপেক্ষা করতে পারতাম, উন্মাদের প্রলাপে মনোনিবেশ করার কোনো দায় আমার ছিলনা কিন্তু মানুষ হিসাবে আমিও কিঞ্চিৎ উন্মাদ। মিথ্যার আড়ালে যে সামান্য সত্য লুকিয়ে আছে তা উদঘাটনের কৌতুহল আমার জন্য কাল হয়েছে।

বর্ণনাকারীর জনপদ দেখার কৌতূহলে তার সঙ্গী হলাম, খবরের কাগজের একটা মোহর আমার কাছে ছিল ভাবলাম বিপদে এই মোহর উদ্ধার করবে।

জনপদে পৌঁছার দ্বিতীয় দিনে ঘটা করে আগুন খেলা হচ্ছিল, পরেশ লালের সাঙ্গাতরা রাধারানী নামে এক বিধবাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। রাধারানী স্বেচ্ছায় যাবে না তাই এই টানা-হেঁচড়া। ঈশ্বরের আদেশ লঙ্ঘন কত ভয়াবহ হতে পারে একটু ক্ষণ পরে টের পেলাম।

বিধবা রাধারানী স্বেচ্ছায় যাবে না টানা হেঁচড়া করতে গিয়ে সাঙ্গাতরা গলর্দম, যখন বোঝা গেল সহজে কর্ম সমাধা হবে না তখন সাঙ্গাতদের একজন রাধারানীর গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিল, ঈশ্বরের আগুনে রাধারানী পুড়ছে দেখে তাদের যে কি আনন্দ!

জনপদের মানুষ স্বাভাবিক, কি ভয়াবহ ঘটনা তাদের সামনে ঘটছে তারা বুঝতেই পারছে না অথবা তারা এসব ঘটনায় অভ্যস্ত। আমি অভ্যস্ত নই তাই দৌড়ে গেলাম, আমার দৌড়ানোতে সাঙ্গাতরা অবাক হল; কয়েকটা চড় থাপ্পড় মেরে আমার গলা চেপে ধরল দুজন সাঙ্গাত। চোখের সামনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল রাধারানী।

আমাকে যখন পরেশ লালের দরবারে হাজির করা হলো, লাল মহাশয় জিজ্ঞেস করলেন ‘কে বেটা তুই’?
জবাব দিলাম ‘আমি সাংবাদিক’।
‘কি সাংঘাতিক? আমিও সাংঘাতিক
কেমন সাংঘাতিক এক্ষুনি টের পাবি’।

পরেশ লালের আদেশে আমার ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল কেটে ফেলা হলো, বাম চোখ অন্ধ করে দেয়া হলো। খবরের কাগজের যে মোহর আমাকে বাঁচাবে বলে ভেবেছিলাম, সে মোহর আমার শিশ্নে ঝুলিয়ে দেয়া হলো।

বর্ণনাকারী আমাকে উদ্ধারকারী ভেবে নিয়ে গিয়েছিল, ইতোমধ্যে যে দশজন ব্যর্থ হয়েছে তার কিছুই জানায়নি। যখন জানলাম তখন অনেক দেরী। তবু হতোদ্যম হলাম না, উন্মাদদের মৃত্যুভয় কিছুটা কম। বৃদ্ধাঙ্গুল বিহীন এক চোখ অন্ধ আমি শিশ্নের অপমান বরদাস্ত করতে পারিনি তাই দশের পরে পুনরায় চেষ্টা করলাম, বলাবাহুল্য রাবণ বধে আমিও ব্যর্থ।

আজ আমাকে বধ করা হচ্ছে। পরেশ লাল নিজ হস্তে আমার মস্তক খণ্ডন করবে। আমি ঈশ্বরের নাম জপতে থাকি কিন্তু দেখলাম ঈশ্বরের নাম স্মরণে আসছে না, আমার মুখ থেকে পরেশ লাল পরেশ লাল আওয়াজ বেরুচ্ছে…

বিকেলে ভোরের গল্প… পর্ব ৪

270115

প্রকৃতির পরিবর্তন কত দ্রুত ঘটতে পারে পূর্ব ইউরোপের ঐ অংশে বাস না করলে হয়ত বুঝতে পারতাম না। শীতের রাজত্ব এ অঞ্চলে প্রশ্নাতীত। সেই যে সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে তুষারপাত শুরু হয় তার শেষ কবে কেউ জানেনা। ডিসেম্বরের শুরুতে বরফ এসে জায়গা করে নেয় তুষারপাতের। জমজমাট শক্ত বরফ এতটাই শক্ত হয় নদীর পানি জমে যায়। সে নদীতে সাদা সাদা পাল তোলা নৌকার বদলে চলে যন্ত্রচালিত ট্রাক। মৎস্য শিকারির দল নদীর উপর তাঁবু গেড়ে রাতের পর রাত কাটিয়ে দেয় শিকারের আশায়। আর আমার মত যারা পৃথিবীর অপর প্রান্ত হতে এ অঞ্চলে পাড়ি জমায় তারা ক্যালেন্ডারের পাতা উলটে প্রহর গোনে বসন্তের। অনেক সময় বসন্তও কথা রাখেনা। মুষলধারার তুষারপাতের নীচে চাপা পরে যায় অপেক্ষার পালা।

মে মাসের নয় তারিখেও তুষারপাতের মোকাবেলা করতে হয়েছিল এক বসন্তে। শীতে তাপমাত্রা মাঝে মধ্যে হিমাংকের নীচে ৪০ ডিগ্রী পর্যন্ত নেমে যায়। স্থবির হয়ে যায় জনজীবন। বরফ ডিঙ্গিয়ে স্কুলে যাওয়া সম্ভব হয়না বাচ্চাদের। অঘোষিত ছুটিতে যেতে হয় তাদের। সাইবেরিয়ার দিকে অবস্থা আরও কঠিন, আরও কষ্টের। সোভিয়েত লৌহ শাসনের গোঁড়ার দিকে যারা বিরুদ্ধচারন তাদের অনেককেই নির্বাসনে পাঠাতো সাইবেরিয়ার কঠিন প্রকৃতির সাথে লড়াই করতে। ঐ দিকটায় শীতের দিকে যাওয়া আমার মত এশিয়ানদের জন্যে আত্মহত্যার দিকে পা বাড়ানো।

কোন এক গ্রীষ্মে ঘটনাচক্রে সৌভাগ্য হয়েছিল রুশ দেশের তুন্দ্রা অঞ্চলে ঘুরে আসার। মনুষ্য জীবন ওখানে কঠিন। বেঁচে থাকতে প্রতিদিন প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করতে হয়। এসব নিয়ে ঐ অঞ্চলের মানুষের খুব যে একটা অভিযোগ আছে তা নয়। বরং খাপ খাইয়ে নিয়েছে প্রকৃতির এসব রুদ্রমূর্তির সাথে।

বসন্ত হঠাৎ করেই চলে আসে। ছাদ হতে বরফের বিশাল সব চাই মাটিতে আছড়ে পরে। ডর্মের রুমটায় বসে সে আওয়াজ শুনলে মন হাল্কা হয়ে যায়। বুঝতে পারি বসন্ত আসছে।

বরফ গলতে শুরু করে। রাস্তা-ঘাট পানি আর কাঁদায় ভরে যায়। তারপর একদিন সূর্য পূব দিগন্তে মুখ তুলে জানায় আগমনী বার্তা। কদিন একনাগাড়ে উত্তাপ ছড়ালে রাস্তা-ঘাট পরিষ্কার হয়ে যায়। গাছে গাছে সবুজের সমারোহ কখন যে জায়গা করে নেয় টেরই পাওয়া যায়না।

পোল্যান্ড সীমান্ত ঢুকে গেছি অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। বেলাওয়াস্তকে ট্রেনের চাকা বদলানোর সময় ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস হাজির হয়। ওদের চেক করার বিশেষ কিছু থাকেনা। কারণ দেশটায় আমার মত যাত্রীরা থাকতে আসেনা। ট্রানজিট ভিসা নিয়ে পাড়ি জমায় পশ্চিমের দিকে। যদিও ষ্ট্যুরিষ্টদের আকর্ষণ করতে সরকারী চেষ্টার অন্ত থাকেনা।

অদ্ভুত এক দেশ এই পোল্যান্ড। সোভিয়েত বলয়ের অন্যতম প্রধান দেশ। ওয়ারশ সামরিক প্যাক্টকে ঘিরে পল্লবিত হয়েছে সোভিয়েত সামরিক শক্তি। অথচ দেশটার সীমান্তে পা রাখলেই চোখে পরে এর দৈন্যতা। চারদিকের বাড়ি-ঘরে ক্ষয়ের চিহ্ন। চোখে পরার মত কোন জৌলুষ নেই। একজন ইমিগ্রেশন অফিসার এসে যখন জিজ্ঞেস করে এক্সচেঞ্জের জন্য ডলার-পাউন্ড আছে কিনা, এক লহমায় ধরে নেয়া যায় দেশটার অর্থনৈতিক ভিত্তি। ঘটনা আরও কয়েক বছর আগে। সে বছর গ্রীষ্মকালীন ছুটি কাটিয়ে লন্ডন হতে সেন্ট পিটার্সবার্গে ফিরে যাচ্ছি। ওয়ারশতে আমার ট্রানজিট। ট্রেন বদলাতে হবে। ইউরোপের আর দশটা দেশ মনে করে কাউন্টারে হাজির হয়ে আমার ফিরতি জার্নির টিকেট দেখাই। রাতে ঘুমানোর মত একটা সীট দরকার আমার।

কাউন্টারে মধ্যবয়সী এক মহিলা ম্যাগাজিন উলটে সাজগোজের কিছু একটা দেখছিল। আমাকে দেখে মুখ কুচকে ফেললো। রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করলো কি চাই।

পূর্ব ইউরোপের মানুষদের গায়ের রঙ নিয়ে এলার্জিতে ততদিনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তাই অবাক না হয়ে বিনয়ের সাথে রাতের ট্রেনের একটা সীট চাইলাম। মহিলা কোনোদিক না তাকিয়ে নিমিষের মধ্যা আমাকে জানিয়ে দিল আগামী ৭ দিনের জন্যে কোন সীট নেই।

মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। আগামী ২৪ ঘণ্টায় আমাকে সোভিয়েত সীমান্তে পা রাখতেই হবে। নইলে কোনদিনই ঢুকতে পারবোনা দেশটায়। কঠিন আইনের দেশ এই সোভিয়েত ইউনিয়ন।

মন খারাপ করে প্লাটফর্মের বেঞ্চে বসে আছি। সম্ভাব্য সব সিনারিও বিশ্লেষণ করছি। পাশে কেউ একজন বসেছে টের পেলাম।

কালো আফ্রিকান একজন। হাতের পোটলা পুটলি দেখে বুঝতে পারলাম সে-ও আমার মত সোভিয়েত ইউনিয়নে যাচ্ছে। পার্থক্য হচ্ছে, ওর মুখে হাসি এবং প্রাণ খুলে মনের আনন্দে গান গাইছে।

আমার সমস্যা তুলে ধরতে হো হো করে হেসে উঠলো। মিনিটের ভেতর সমাধান দিল। কারণ সেও একই সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল।

বুক পকেটে একটা পাঁচ পাউন্ডের নোট রেখে আবারও গেলাম কাউন্টারে। একই মহিলা। আমার মুখ দেখার আগে দেখল আমার বুক পকেট। লম্বা একটা হাসি দিয়ে আবারও জানতে চাইলো আমার প্রয়োজন। উদ্দেশ্য পরিষ্কার করার পর জানতে চাইলো মূল্য পরিশোধ করবো কোন কারেন্সিতে।

সদ্য পরিচিত আফ্রিকান বন্ধুর উপদেশ মত আঙ্গুল তুলে বুক পকেটের দিকে ইশারা দিলাম। মন্ত্রের মত কাজ দিলো। তোতা পাখির মত উত্তর দিল, রাতের জন্যে অপেক্ষা করতে না চাইলে আধাঘণ্টার ভেতর একটা ট্রেন আসবে। গাদানক্স ঘুরে গ্রদনোর দিকে যাবে।

রাতের সীটেই ফয়সালা করলাম। মূল্য ৫ পাউন্ড। সমাজতন্ত্র পৃথিবীর এ অঞ্চলের মানুষকে কতটা কলুষিত করেছিল তার চমৎকার একটা ডিসপ্লে হয়ে গেল এই ট্রেন জার্নি।

ঘণ্টা দেড়েক পর রাজধানী ওয়ারশ এসে থেমে গেলো আমার ট্রেন। এখানে লম্বা একটা বিরতি। রিফ্রেশমেন্টের জন্য সবাই ট্রেন হতে নেমে পরে।

এই নেমে পরায়ও অনেক রকম বিপদ থাকে। এই যেমন পোলিশ মহিলাদের খপ্পর। ভুলিয়ে বালিয়ে নিজেদের আস্তানায় নিয়ে সব কিছু রেখে উলঙ্গ করে ছেড়ে দেয়ার কাহিনীও শুনেছি অনেকের মুখে।

এ পথে এতবার জার্নি করেছি সবকিছু আমার মুখস্থ। কারও চেহারা দেখে বলে দিতে পারি তার উদ্দেশ্য। ষ্টেশনে নেমে কিছু কেনাকাটি করলাম। এখানে সোভিয়েত মুদ্রা রুবেলেও কেনাকাটি করা যায়। পকেটে বেশকিছু রুবেল ছিল, যতটা সম্ভব খরচ করে অতিরিক্ত কিছু খাবার ও পানি কিনে ফিরে গেলাম ট্রেনে।

এবার লম্বা একটা ঘুমের পালা। খুব ভোরে ট্রেন সীমান্ত শহর ফ্রাঙ্কফুর্ট-আন-ডের-ওডের দিয়ে পূর্ব জার্মানিতে ঢুকবে। অবশ্য মাঝখানে পোলিশ শহর পজনানে কিছুক্ষণের জন্যে ট্রেন থামবে যা আমি টের পাবোনা। আমাকে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ঢুকতে হবে সমাজতন্ত্রের ফাইনাল ফ্রন্টিয়ার পূর্ব জার্মানিতে। শেষ রাতের দিকে জার্মান সীমান্ত রক্ষীদের কর্কশ ডাকে ঘুম ভাঙ্গবে।

চলবে

শেষ বেলার গান

দেখতে দেখতে জানুয়ারির তিন তারিখও শেষ হতে চলল। এইভাবে প্রত্যেক বছর আসে, যায়, সঙ্গে নিয়ে যায় আলোর ঝলকানি একের পর এক উৎসব মুহূর্ত। রেখে যায় জলের মধ্যে জলের দাগ, একগুচ্ছ শীতের ঝরাপাতা স্মৃতি।

স্মৃতি থাকে, কিন্তু শতাংশের হিসাবে খুবই সামান্য। স্মৃতি থাকে আমাদের নীরব অন্ধকার নিউরনের বন্ধ কুঠরিতে। ভালো থাকে খারাপ থাকে। তবুও সময়ের দ্রুতগতির ধাবমান চাকায় ধীরে ধীরে পিষে যায় বয়ে চলে যাওয়া বহু খারাপ সময়।

কে কখন এসেছিল, কে কখন চলে গেল সাত ঘোড়ার ফিটন গাড়িতে! শীত শুধু আনন্দ পৌষল্যা দেয় না, শীত শোক এঁকে দেয় দরজার চৌখুপিতে। শীত আসে যন্ত্রণায় ঢাকা মহামারীর হাত ধরে। অখণ্ড অবসরের অনির্দেশ্য দিন আর রাতের হিসাব তালগোল পাকিয়ে শীত আসে কৈশোরের খেজুর রসের সুগন্ধি স্মরণে।

প্রতিশোধস্পৃহা, রাগ, অভিমান সামান্য কিছু সময়ের মনন অতিথি মাত্র। একটা সময়ে সব অপরাধ, সব অবহেলা, সব অপমান ক্ষমা করে দেওয়া হয় কালের প্রলেপে। অজর অমর হয়ে থেকে যায় ভালবাসার স্নিগ্ধ কিছু গান। হাতের ভেতরে থাকে শীতের গোলাপি হাতের ছোঁয়া।

বিকেলে ভোরের গল্প… পর্ব ৩

26985

গল্প আমাকে দিয়ে হয়না। তাই যদি হতো তাহলে পৃথিবীর যত গলিতে পা রেখেছি, যত মানুষের সাথে মিশেছি তাদের সবাইকে নিয়ে লিখতে গেলে জমজমাট গল্প লেখা যেতো। এসব গল্পের প্রেক্ষাপট ছিল। ছিল পার্শ্ব চরিত্র। স্মৃতির গলি হাতড়ালে খুঁজে পাওয়া যাবে নায়িকাদেরও।

মাঝেমধ্যে লিখতে ইচ্ছে করে। পাঠকদের সাথে শেয়ার করতে ইচ্ছে করে জীবন নদীর গল্প। সব গল্প যদি কবরে নিয়ে যাই কষ্ট থেকে যাবে। আর আমার মত ভ্রমণ পিপাসীদের বঞ্চিত করা হবে কিছু কাব্যময় মুহূর্ত হতে। গল্প লিখতে প্রতিভা লাগে। এ প্রতিভা চর্চার ফসল হতে পারেনা। বরং মহা-বিস্ময়ের মহাকালের কোন এক গলিতে ঈশ্বর বলতে কেউ একজন থেকে থাকলে এটা তারই দান।

এ যাত্রায় পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ’তেও ঘটবে এমন একটা ঘটনা যা নিয়ে অনেকেই উপন্যাস লিখতে পারতো। সে গল্প একটু পরের। আমি এখনো সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেতর। ট্রেনের জানালায় বসে বাইরের পৃথিবী দেখছি। তন্ময় হয়ে দেখছি বাইরের জীবন। এ যেন সেলুলয়েডের ফিতায় ধরা বিশাল এক মুভি।

লিথুনিয়ার রাজধানী ভিলনিউস ছাড়ার পর আর কোথাও থামার মত ষ্টেশন নেই। মাঝে মধ্যে ট্রেনের গতি শ্লথ হয়ে আসে। কখনো আবার সময় কভার করার জন্যে ঝড়ো গতিতে ছুটে চলে।

এ অঞ্চলে শীতের প্রভাব অন্য যেকোনো এলাকার চাইতে একটু বেশী এবং দীর্ঘস্থায়ী। ভাল করে তাকালে উঁচু গাছগুলোতে বরফের অবশিষ্ট দেখা যায়।

গ্রীষ্মের স্থায়িত্ব এখানে খুব সংক্ষিপ্ত। জুনের শেষদিকে মধ্যরাতেও সূর্যের দাপট থাকে। আবার মধ্য জানুয়ারিতে চব্বিশ ঘণ্টাই থাকে অন্ধকারের রাজত্ব।

বেলারুশ সীমান্ত পার হয়ে কখন প্রিবাল্টিক এলাকা ত্যাগ করেছি বুঝার উপায় থাকেনা। কারণ আজকের মত সে সময় লিথুনিয়া, লাটভিয়া অথবা এস্তোনিয়া আলাদা কোন দেশ ছিলনা। ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন নামের জগাখিচুড়ির একটা দেশ।

বেলারুশ সীমান্তের শেষ শহর গ্রদনো। ওটাই আমার গন্তব্য। ওখানেই মোকাবেলা করতে হবে সমাজতন্ত্র নামের স্বৈরশাসনের উত্তাপ।

এ সীমান্ত শহরে পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল। সমীকরণটা খুব একটা সহজ নয় এ সীমান্তে। রুশরা এ সীমান্তের বর্ণনা দিতে গেলে অনেকটাই আবেগপ্রবণ হয়ে উঠে। কারণ এ সীমান্ত দিয়েও প্রবেশ করেছিল দখলদার হিটলার বাহিনী।

ছোট এ শহরের প্রতিটা ইট সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকার। অনেক জায়গায় অক্ষত রাখা আছে হিটলার বাহিনীর পৈশাচিকতা।

আমরা যারা এ পথে ভ্রমণ করি তাদের অবশ্য এসব দেখার খুব একটা সময় থাকেনা। ট্রেন থামে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস পার হওয়ার জন্যে।

নিয়ম অনুযায়ী নেমে পরলাম ট্রেন হতে। অপেক্ষা করার জন্যে নির্দিষ্ট একটা জায়গা আছে। কাস্টম অফিসার ও তাদের ট্রেইনড কুকুরগুলো ট্রেনের প্রতিটা ওয়াগন চেক করবে। এমনকি ট্রেনের তলায় পাঠাবো অভিজ্ঞ কুকুরদের। অনেক সময় হোস পাইপ দিয়ে গরম পানি ছুড়ে নিশ্চিত করবে ওখানটায় কেউ লুকিয়ে নেই। অনেক বার বার্লিন ওয়াল অতিক্রম করার সময় দেখেছি একই চিত্র।

সোভিয়েত ইউনিয়ন হতে এক ডলার বাইরে নেয়ারও অনুমতি নেই। অথচ দুই দিন তিন রাতের এ লম্বা জার্নিতে বেঁচে থাকার জন্যেই চাই নগদ অর্থ। সীমান্ত শহর গ্রদনোই হচ্ছে সোভিয়েত অর্থ রুবেল ব্যবহারের শেষ ঠিকানা। সীমান্ত অতিক্রম করে পোল্যান্ডে ঢুকলে বাস্তবতা অন্যরকম। ডলারই একমাত্র বিনিময় মাধ্যম। সোভিয়েতদের জন্যে সমস্যাটা এখানেই। সীমান্ত বাহিনীর মূল কাজ হচ্ছে আমার মত বিদেশীদের বৈদেশিক মুদ্রার উৎস খোঁজা ।

হরেক উপায়ে মানুষ মুদ্রা পাচার করতে বাধ্য হয় এ পথে। বিশেষকরে যারা বিরাট অংকের ডলার নিয়ে বাইরে যায়। আমি কোন বারই ২০০/৩০০ ডলারের বেশী নিয়ে যাইনি। এ যাত্রায় আমার পুঁজি ছিল ৩০০ ডলার। পকেটের এক কোনায় লুকিয়ে দিব্যি ভাল মানুষের আচরণ করে পার পেয়ে যাই।

মনুষ্য ও কুকুর পর্ব শেষ হওয়ার পর আমাদের আমন্ত্রণ জানালো নিজ নিজ ওয়াগনে ফিরে যাওয়ার। ষ্টেশনের ক্যাফেটেরিয়া হতে যথেষ্ট পানি ও ফলমূল কিনে ফিরে গেলাম নিজ সীটে।

ফিরে যা দেখি তাতে কোনদিনও অবাক হইনা। কারণ জানতাম এমনটা হবে। অনেক সময় বালিশ পর্যন্ত কেটে কুটে চেক করে। লণ্ডভণ্ড থাকে বিছানা। ওরা তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেরায় লুকানো গুপ্তধন। আফ্রিকান ছাত্রদের বেলায় কাস্টমস থাকে মার্সিলেস নির্মম। অনেক সময় এখানেই শেষ হয় তাদের ভ্রমণ পর্ব। কারণ একটাই, মুদ্রা পাচার।

ঘণ্টা তিনেক পর গ্রদনো হতে রওয়ানা দিল সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে ছেড়ে আসা ট্রেন। মিনিট দশেক পর হাজির পোলিশ কাস্টম ও সীমান্ত পুলিশ। একটা দেশের ইমিগ্রেশন পুলিশের কাজ যদি হয়ে তার সীমান্ত অক্ষত রাখা, পোল্যান্ড সীমান্তের এ অংশে এলে সে ধারণা পালটে যেতে বাধ্য। তরুণ, বৃদ্ধ, সুন্দরী যে পুলিশই আসুক না কেন, তাদের প্রথম প্রশ্ন, তোমার কাছে কি বিনিময় করার মত ডলার আছে? প্রশ্নটা সরকারীভাবে বিনিময়ের জন্যে নয়, বরং ব্যক্তিগত পর্যায়ের লেনাদেনা। সমাজতন্ত্র মানুষকে কতটা নষ্ট করতে পারে পৃথিবীর এ অংশে না এলে বুঝতে পারতাম না।

আমার কাছে যে ৩০০ ডলার ছিল তার সবটাই এখন বৈধ! পোল্যান্ডে তা বদল করার মত বোকামি করতে গেলাম না। আমাকে এখনো অনেকদূর যেতে হবে। সামনে বেলাওস্তক। ট্রেনের চাকা বদলের জায়গা। সবকিছু প্ল্যান মাফিক শেষ হলে মধ্যরাতে হাজির হবো দেশটার রাজধানী ওয়ারশতে।

চলুন কিছুটা বিশ্রাম নেই। কারণ অনেক ঘটনা ঘটবে পরের দিন। ভিসার জন্যে আমাকে দৌড়াতে হবে বার্লিনস্থ ব্রিটিশ এমবাসিতে। ভিসা পাওয়ার পর লোকাল ট্রেন ধরে যেতে হবে নেদারল্যান্ড এম্বেসিতে বেনেলাক্সের ভিসা নিতে (BENELUX – Belgium, Nederland & Luxembourg).

চলবে

বিকেলে ভোরের গল্প… ২য় পর্ব

269798

ভিলনিউস। পূর্ব ইউরোপ হতে যাত্রা করে পশ্চিম ইউরোপে যাওয়ার পথে প্রথম বিরতি। সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে প্রায় ৭২৫ কিলোমিটার পথ। দু’দিন দু’রাত্রির বিরামহীন ট্রেন জার্নির প্রথম পর্বে সাধারণত কোন বৈচিত্র্য থাকেনা। জানালার বাইরে তাকালে শুধু মাইলের পর মাইল সোভিয়েত জনপদ। কোথাও শূন্য, কোথাও আবার বিচ্ছিন্ন দু’একটা পরিবারের নির্জনতায় বেঁচে থাকার লড়াই।

বছরের প্রায় ন’মাস এদিকটায় তুষারপাত হয়। বরফের আচ্ছাদনে মুখ লুকায় বাড়ি-ঘর, গাছ-পালা সহ গোটা শহর। এর আগেও বেশ ক’বার এসেছি লিথুনিয়ায়। প্রথম আসা ক্লাসমেটদের সাথে শীতের ছুটিতে। দ্বিতীয়বার লন্ডন যাওয়ার পথে অনেকটা বাধ্য হয়ে।

সে বছরের তুষারপাত অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছিল। জনজীবনে নেমে এসেছিল নজিরবিহীন স্থবিরতা। একই পথে লন্ডন যেতে কোন অসুবিধা হয়নি। ভারি তুষারপাতের কারণে ট্রেনের গতি ছিল মন্থর, ছিল অতিরিক্ত সতর্কতা। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল ফেরার পথে।

বার্লিন দেয়াল পেরিয়ে পশ্চিম হতে পূর্ব বার্লিনে পা রাখা মাত্র অনুভব করতে পারলাম পার্থক্যটা। তাপমাত্রা হিমাংকের নীচে প্রায় ৩০ ডিগ্রী। সাথে তীব্র হিমেল বাতাস। ট্রেন সোভিয়েত দেশে ঢুকবে কিনা এ নিয়ে দোটানায় ছিল কর্তৃপক্ষ। পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ’তে অতিরিক্ত সময় বসে থাকতে বাধ্য করল। সার্ভিস ট্রেন লাইন পরিষ্কার করছে। গ্রিন সিগন্যাল পেলেই কেবল সামনে বাড়বে। টেনেটুনে ভিলনিউস পর্যন্ত আসতেই পথচলা একেবারে থেমে গেলো।

আগাথা কৃষ্টির রহস্য উপন্যাস Murder On Orient Express যাদের পড়া আছে অথবা মুভি দেখা হয়েছে তাদের বুঝতে সুবিধা হবে। ইস্তাম্বুল হতে ছেড়ে আসা ট্রেন বেলগ্রেডের কাছাকাছি কোথাও থামতে বাধ্য হয় তুষারপাতের কারণে। এবং সে রাতে ট্রেনে সংগঠিত হয় একটি খুন। ঐ খুন ও ট্রেনে উপস্থিত ডিটেকটিভ হেরকুল প্যুয়ারোকে ঘিরে প্রসারিত হয়েছে সে উপন্যাস।

আমার বেলায় কোন খুন না হলেও গোটা একটা দিন কাটাতে হয়েছিল ভিলনিউসে। পৃথিবীর রঙ এতটা শুভ্র হতে পারে শহরে সময়টা না কাটালে বুঝতে পারতাম না। ট্রেন ষ্টেশনের ক্যাফেটেরিয়ায় বসে বসে সময় হত্যা ছিল আমার জন্যে নতুন অভিজ্ঞতা। মাথার উপর ঝুলছিল ঘরে না ফেরার চরম অনিশ্চয়তা। রেলের লাইন বরফের এতটা নীচেই ডুব ছিল যা পরিষ্কার করার গাড়িগুলো কুলিয়ে উঠতে পারছিলনা। ট্রেনের হিটার বন্ধ করে দেয়ায় ওখানে অপেক্ষা করাও সম্ভব ছিলনা। এমন অনিশ্চয়তার বেড়াজালে আটকে যখন হাবুডুবু খাচ্ছি তখনই পরিচয় হয় মেয়েটার সাথে।

মারিয়া তিশেভিচ। লম্বায় প্রায় ৬ ফুট। পায়ে হাই-হীল বুট। গায়ে ফারের কোট ও মাথায় শীতের টুপি। সবকিছু মিলিয়ে অসম্ভব সুন্দরী এক মহিলা। ক্যাফেটেরিয়ার টেবিলে বসে কফি খাচ্ছি। ভীরের কারণ জায়গা না পেয়ে মারিয়াও যোগ দিল আমার টেবিলে। প্রথম দেখার হাসিটাই বলে দিল আলাপে অপরিচিতার কোন আপত্তি নেই।

প্রতিবেশী অঙ্গরাজ্য লাটভিয়ার রাজধানী রিগার ট্রেনের অপেক্ষায় আছে সে। আমি হেসে জিজ্ঞেস করলাম কোন বাস্কেটবল ম্যাচে অংশ নিতে যাচ্ছে নাকি।

দেখতে অনেকটা বাস্কেটবল খেলোয়াড়ের মতই দেখাচ্ছিল। উত্তরে জানালো, আমার মতই শীতের ছুটি কাটাতে যাচ্ছে। ট্রেন ছাড়ার আগ পর্যন্ত দুজনের আর ছাড়াছাড়ি হয়নি। ঠিকানা ও ফোন নাম্বার বিনিময়ের মধ্যদিয়ে সমাপ্ত হয়েছিল পরিচয় পর্ব। ততক্ষণে জীবন হতে কেটে গেছে প্রায় ২০ ঘণ্টা। মারিয়ার সাথে আবারও দেখা হবে। তবে সেটা ভিন্ন জায়গায়, ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে।

এ যাত্রায় নির্ধারিত ৩০ মিনিটের এক মিনিটও বেশী অপেক্ষা করতে হয়নি। অনেক স্মৃতির এ শহরটায় কেবল ট্রেন ষ্টেশনে কাটাতে একটু কষ্টই হয়েছিল। ভিলনিউসের পুরানো শহর দেখতে তখনো ইউরোপ হতে শত শত পর্যটক ভিড় জমাতো। একসময় এ শহরকে বলা হতো ইউরোপের সাংস্কৃতিক রাজধানী। শহর বাসিন্দাদের অধিকাংশই ছিল ইহুদি। নেপোলিয়ন বলতেন, জেরুজালেম অব দ্যা নর্থ। সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হলেও শহর ও অঙ্গরাজ্যের সবকিছুতে ছিল স্ক্যান্ডিনেভিয়ান প্রভাব। ওদের ভাষায়ও ছিল প্রতিবেশী ফিনিশদের সুর। এস্তোনিয়া, লিথুনিয়া ও লাটভিয়া নিয়ে সোভিয়েত প্রি-বাল্টিক অঞ্চলে রুশরা নিজেদের দখল কোনদিনও শক্ত করতে পারেনি বিভিন্ন কারণে। ওদের সাথে আপন হয়ে মিশলে বিষয়টা সহজেই পরিষ্কার হয়ে যায়।

ট্রেন চলছে তো চলছেই। চার সীটের রুমটায় আরামের কোন ঘাটতি ছিলনা। প্রতি বগিতে একজন করে কন্ডাকটর। ধবধবে সাদা বিছানা ও সাথে গরম চায়ের ব্যবস্থা এক সময় এসব রীতিমত নেশা ধরিয়ে দেয়। সহযাত্রীদেরও কাছে নিয়ে আসে। এ পথে বহুবার জার্নি করেছি। হরেক রকম মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে। একে অন্যের জীবন শেয়ার করেছি। প্রথম দিকের উত্তেজনা ততদিনে থিতু হয়ে আসায় সে যাত্রায় ট্রেনের করিডোরে দাঁড়িয়ে বাইরের পৃথিবীকে দেখতে যাইনি। শুধু সময় গুনেছি কখন পৌঁছবো পরিবর্তী ঠিকানায়।

বেলারুশের এক সীমান্ত দিয়ে ঢুকে অন্য সীমান্ত গ্রদনি ক্রস করলেই পা রাখবো পোল্যান্ডের সীমান্ত শহর বেলাওস্তাকে। ওখানে বদল হবে ট্রেনের চাকা। ব্রডগেজ আর মিটার গেজের মিলন হয় এ সীমান্ত শহরে। ভারী ভারী ক্রেন এক লহমায় উপরে তুলে নেয় ট্রেনের বগী গুলো। বসানো হয় নতুন চাকা। এবং ঘণ্টা খানেকের ভেতর তৈরি হয় নতুন চলা।

একবার এক সহযাত্রী সোভিয়েত জেনারেলকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ওয়ারশ জোটভুক্ত দেশগুলোর মাঝে এ তারতম্যের কারণ। উত্তরে ভদ্রলোক বলেছিলেন, এ সোভিয়েত ওয়ার ষ্ট্রাটেজির আরেকটা অংশ। ভবিষ্যতে যাতে নতুন কোন হিটলার এক দৌড়ে সীমান্ত অতিক্রম করে সোভিয়েত দেশে ঢুকতে না পারে তা নিশ্চিত করতে এই ব্যবস্থা।

ট্রেন লিথুনিয়ার বুক চিড়ে এগিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে সবুজের সমাহার। অনেকক্ষণ বাইরে তাকালে তন্দ্রা এসে যায়। বসন্তের শেষ ও গ্রীষ্মের শুরুতে পৃথিবীর এ অঞ্চলের মানুষ খোলস হতে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। বদলে যায় শরীরের পোশাক। বিশেষ করে তরুণীরা অপেক্ষায় থাকে নিজেদের অপ্রকাশিত যৌবন প্রকাশের জন্যে।

পরবর্তী স্টপেজ সোভিয়েত সীমান্ত শহর বেলারুশের গ্রদনো।

চলবে।

বিকেলে ভোরের গল্প… পর্ব ১

2698

ওটাই ছিল আমার শেষ বিলাত যাত্রা। অনেক স্মৃতি, অনেক কাহিনী, অনেক গল্পের শেষ হবে এ গ্রীষ্মের পর। ১৯৭৬ সালে শুরু হওয়া জার্নির ইতি টানবো এ যাত্রায়। মাঝখানে বাল্টিক সাগরের পানি অনেকদূর গড়িয়ে যাবে। দুই পৃথিবীর দুই জীবন খুব কাছ হতে দেখার সুযোগ হবে। দেখা হবে অনেক দেশ। পরিচয় হবে হরেক রকম মানুষের সাথে। কৈশোর অধ্যায়ের ইতি টেনে পা রাখবো যৌবনে। প্রেম, ভালবাসা, বিরহ, সেক্স অনেক কিছুর সাথে দেখা হবে প্রথমবারের মত। সে জীবন হবে স্বপ্নিল প্রতিশ্রুতিতে ভরা বিশাল ক্যানভাসের এক কাহিনী।

প্রতিবছর জুনের শেষদিকে শুরু হয় আমাদের গ্রীষ্মের ছুটি। ক্যাম্পাস জীবন দু’মাসের জন্যে থমকে যায়। রুশ ছাত্ররা চলে যায় নিজ নিজ শহরে। অনেকের ঠিকানা হয় লেবার ক্যাম্পে। সাইবেরিয়ার গহীন অরণ্যে তৈরি হচ্ছে রেললাইন। শ্রমিক সমস্যা মাথায় রেখে দেশটার কম্যুনিস্ট সরকার উৎসাহ দেয় ছাত্রদের। সারা বছর আর্থিক সমস্যায় ভোগা রুশ ছাত্ররা নাম লেখায় নির্মাণ ব্রিগেডে। সেপ্টেম্বরের শুরুতে ওরা যখন ফিরে আসে পকেটে থাকে খরচ করার মত বেশকিছু রুবেল। আমি নিজেও একবার নাম লিখিয়েছিলাম এমন এক ব্রিগেডে। দু’মাসের কায়িক পরিশ্রমের সে কঠিনতম অভিজ্ঞতা ইতিপূর্বে শেয়ার করেছি পাঠকদের সাথে। ঐ বছরের গ্রীষ্মের ছুটিটা বাদ দিলে বাকি সবকটা ছুটি কাটাতে ছুটে গেছি আরও পশ্চিমে।

১৯৭৭ সালের জুলাই মাসের কোন এক পূর্ণিমা রাতে নেদারল্যান্ডের হোক ভ্যান হল্যান্ড হতে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে চেপে বসি নৈশ ফেরীতে। লম্বা জার্নির এ ছিল শেষ ঠিকানা। শুরুটা ছিল মস্কো হতে ট্রেনে চেপে পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ। ওরারশ হতে পাশের দেশ পূর্ব জার্মানির রাজধানী পূর্ব বার্লিন। প্রথমবারের মত বার্লিন দেয়াল অতিক্রম করে পশ্চিম বার্লিন। এবং ওখানে ট্রেন বদল করে পশ্চিম জার্মানির হ্যানোভার। হ্যানোভারে আরও একবার ট্রেন বদল। এবং সবশেষে নেদারল্যান্ডের রটোড্রাম হয়ে বন্দর শহর হোক ভ্যান হল্যান্ড।

ওভার-নাইট ফেরী জার্নিতেই প্রথম পরিচয় হয় পশ্চিম ইউরোপের খোলামেলা জীবনের সাথে। বিস্মিত না হলেও পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক লৌহ বলয়ের সাথে পার্থক্যটা ধরতে খুব একটা সময় লাগেনি। যতটা ভালবাসা নিয়ে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায় পা রেখেছিলাম ততটা দ্রুতই এ ভালবাসা উবে গিয়েছিল। সমাজতন্ত্রের নামে ১০০ জাতি ও ভাষার একটা দেশকে কি করে কম্যুনিস্ট রেজিম নিজেদের গিনিপিগ বানিয়ে রেখেছিল তা ধরতে অনেকের অনেক সময় লাগলেও আমার খুব একটা লাগেনি। কারণ আমি খুব দ্রুত সমাজের গভীরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। কথা বলেছিলাম মানুষের সাথে। ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির একজন আর্মেনিয়ান কেন রুশদের ভাষা ও সংস্কৃতি নিজেদের করে নেবে এ প্রশ্নের উত্তর খোদ আর্মেনিয়ানদের কাছেও ছিলনা। ওদের সাথে কথা বললে বেরিয়ে আসে ভেতরের চাপা ক্ষোভ ও বলশেভিকদের প্রতি জমে থাকা ঘৃণা।

এসব নিয়ে লিখতে গেলে লেখা যাবে বিশাল ক্যানভাসের এক কাহিনী। যার শুরু থাকলেও হয়ত আমার মত কাঁচা হাতের লেখক টেনেটুনে শেষ করতে পারবেনা। তাই উঠিয়ে রাখছি এ গল্প। আপাতত চলুন তল্পি-তল্পা গুটিয়ে রওয়ানা দেই লন্ডনের দিকে। ওখানে জমা আছে অনেক গল্প। এ যাত্রায় আমাকে আর ব্রিটিশ ভিসার জন্যে মস্কো যেতে হবেনা। ইতিমধ্যে এর বিকল্প আবিষ্কার করে নিয়েছি। রওয়ানা দেবো সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে। প্রথম স্টপেজ লিথুনিয়ার রাজধানী ভিলনিউস।

চলবে।

মানব জীবন

মানব জীবনে কিছু রোগ ধীরে ধীরে শরীরে বসতি স্থাপন করে যেমন স্লো পয়জন। কিছু রোগ তাদের কর্ম দ্বারা শরীরকে আবৃত করে। অবশেষে রোগটি শরীরকে গ্রাস করতে থাকে পরিণত মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়।

আমাদের শারীরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নড়াচড়া থেকে অচল হয়ে পড়লে, জীবন থেকে ফেলে আসা কিম্বা সেই সুন্দর দৃশ্যমান পরিবেশ বুকের ভেতরে কম্পন তোলে অতঃপর পরক্ষনই তা যেনো অন্ধকার ছেয়ে আসে পরিশেষে প্রকৃতির সকল সৌন্দর্য খুব কুৎসিত মনে হয়।

সময় থেকে ছিটকে পড়া মানুষদের জন্য প্রকৃতির এই নির্মম পরিণতি আমাদের চোখের সামনে ঘটতে থাকে অতঃপর এক অনাগত ভবিষ্যত তৈরি করে। যা কীনা, দৃশ্যমান বলেই বিবেচিত হয়।

অবশেষে জীবন বেঁচে থাকার মায়ায় আকৃষ্ট হয় এবং মন সর্বদা বেঁচে থাকার জীবনদাতা শক্তি দ্বারা কল্পনার মহাজাগতিক জগতে নিমজ্জিত হয়। তারপর সময়ের অন্ধকার, আলো ফিরিয়ে দেবে কিনা তা সেই স্থান কাল পাত্র বিবেচনা করে।

অতএব, আমি বলতেই পারি মানবজীবনে সুস্থতা প্রকৃতির পাওয়া সবচাইতে মূল্যবান সম্পদ যা অর্থ বিত্তের চেয়ে মূল্যবান। সকল বন্ধুদের সুস্থতা কামনা করছি, সুন্দর জীবন কামনা করছি, কামনা করছি সুন্দর ভবিষ্যৎ আমাদের মধ্যে যার অর্থ সম্পদ যদি নুন্যতম কিছু নাও থাকে সে ক্ষেত্রে তাঁর যদি সুস্থ দেহ থাকে আমি বলব সেটাই সম্পদের চেয়েও অধিক মূল্যবান যার কোন তুলনা হয় না।

ভালো থাকা না থাকা ২৪

ধীরে ধীরে রাত্রির শ্বাস গাঢ় হয়ে আসছে। মাথার ওপরে পৃথিবীর ছাদ রঙ বদলে যাচ্ছে একটানা, হালকা ছায়া থেকে গভীর, আরও গভীর, আরও গভীরতর। কুমারী হাওয়ায় শরীরের প্রত্যেক খাঁজে লেখা হয়ে যাচ্ছে অলৌকিক কবিতা। নেপথ্যে প্রগাঢ় নিবেশে মান্না ভাসছে – “ক ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ যে তুমি ভালবাসবে…”।

হাতে গোনা দিন দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। কখন যে বৈশাখী উদ্বেলিত মেঘের দল শান্ত হৈমন্তিক রোমান্স পেরিয়ে পৌষের নীল শীতআদরের দরজায় ডেকে যায়, কখন যে সময় ফুরিয়ে যায় কেউই তার হিসেব রাখতে পারে না।

শেষ বাস্তুসাপও মাটির ত্রিশ হাত নীচে আশ্রয় নিয়েছে কুণ্ডলী পাকিয়ে। তার খসখসে আপাত প্রেমবোধশূন্য ত্বক আস্তে আস্তে মোটা হয়ে পরম প্রেমে জড়িয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখবে আসন্ন অন্ধকার শীতের কামড় থেকে। পৃথিবীর শেষ বাস্তুসাপের দু চোখের মাঝখানে বয়ে যায় ছোটনাগপুর মালভূমির স্বচ্ছ একলা ঝোরা।

মাটির ওপরে হেমন্ত কুয়াশার দিকে এক মুঠো তাচ্ছিল্য ছুঁড়ে দিয়ে হেঁটে যায় আজন্ম বালক, যার মস্তিষ্কে আজও পর্যন্ত কোনো ক্ষমতা দখলের গল্প কড়া নাড়েনি। প্রাচীন সিন্ধুর ছলছল ঢেউ তাকে ডেকে বলে, “এ দিল তুম বিন কাঁহি লাগতা নেহি, হাম ক্যায়া করেঁ…”।

বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব সচেতন হই সুস্থ থাকি

সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গু। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য মতে, বছরের শুরুর দিন থেকে শনিবার (২৭ জুলাই) পর্যন্ত ডেঙ্গুর জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১০ হাজার ৫২৮ জন। এর মধ্যে ৭ হাজার ৮৪৯ জন চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরেছেন। আর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে অন্তত আট জন মারা গিয়েছে(বেসরকারি হিসেবে ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে)। ফলে ডেঙ্গুজ্বর নিয়ে মানুষের মাঝে উদ্বেগ, আতঙ্ক তৈরী হচ্ছে। অথচ সামান্য কিছু সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বন করলে এর থেকে নিরাপদ থাকা সম্ভব।

এডিস মশার কামড় থেকে বাঁচতে যা করবেনঃ
১. ডেঙ্গু জ্বরের জন্য দায়ী এডিস মশকী রাতে/অন্ধকারে কামড়ায় না। এডিস মশা মূলত দিনের বেলা, সকাল ও সন্ধ্যায় কামড়ায়, তবে রাত্রে উজ্জ্বল আলোতেও কামড়াতে পারে। তাই এ সময় শরীর ভালোভাবে কাপড়ে ঢেকে রাখতে হবে। শিশুদের হাফপ্যান্টের বদলে ফুলপ্যান্ট বা পায়জামা পরাতে হবে।
২. দিনে ও রাতে মশারি ব্যবহার করতে হবে।
৩. দরজা-জানালায় নেট লাগাতে হবে।
৪. স্প্রে, লোশন, ক্রিম, কয়েল, ম্যাট ব্যবহার করা যেতে পারে।
৫. মশার আস্তানা ধ্বংশ করতে হবে
এডিস মশা পরিষ্কার বদ্ধ পানিতে ডিম পাড়ে। তাই টব, ফুলদানি, অব্যবহৃত কৌটা, ইত্যাদিতে যেন পানি জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড়, জঙ্গল, জলাশয় ইত্যাদি পরিষ্কার রাখতে হবে।

ডেঙ্গু জ্বরে বিশেষ কিছু সতর্কতাঃ
১. ডেঙ্গুর লক্ষণঃ
সাধারণভাবে ডেঙ্গুর লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। ১০১ ডিগ্রি থেকে ১০২ ডিগ্রি তাপমাত্রা থাকতে পারে। জ্বর একটানা থাকতে পারে, আবার ঘাম দিয়েজ্বর ছেড়ে দেবার পর আবারো জ্বর আসতে পারে। এরসাথে শরীরে ব্যথা মাথাব্যথা, চেখের পেছনে ব্যথা এবং চামড়ায় লালচে দাগ (র্যাশ) হতে পারে। তবে এগুলো না থাকলেও ডেঙ্গু হতে পারে।

২. জ্বর হলেই কী চিন্তিত হবেন?
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক এবিএম আবদুল্লাহ বলছেন, “এখন যেহেতু ডেঙ্গুর সময়, সেজন্য জ্বর হল অবহেলা করা উচিত নয়।” জ্বরে আক্রান্ত হলেই সাথে-সাথে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ।তিনি বলছেন, ”ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে যারা মারা গেছেন, তারা জ্বরকে অবহেলা করেছেন। জ্বরের সাথে যদি সর্দি- কাশি, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া কিংবা অন্য কোন বিষয় জড়িত থাকেতাহলে সেটি ডেঙ্গু না হয়ে অন্যকিছু হতে পারে। তবে জ্বর হলেই সচেতন থাকতে হবে।” [উল্লেখ্য, দেশের সব বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গু টেস্টের ফি ৫০০ টাকার বেশি না নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আজ রবিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. মো. আমিনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সুতরাং ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা গেলে কয়েকটা টেস্ট করিয়ে চিন্তামুক্ত থাকুন]

৩. বিশ্রামে থাকতে হবে
সরকারের কমিউনিক্যাবল ডিজিজ কন্ট্রোল বা সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ বিভাগের অন্যতম পরিচালক ড. সানিয়া তাহমিনা বলেন, ”জ্বর হলে বিশ্রামে থাকতে হবে। তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন, জ্বর নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করা উচিত নয়। একজন ব্যক্তি সাধারণত প্রতিদিন যেসব পরিশ্রমের কাজ করে, সেগুলো না করাই ভালো। পরিপূর্ণ বিশ্রাম প্রয়োজন।”

৪. যেসব খাবার খাবেন
প্রচুর পরিমাণে তরল জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে। যেমন – ডাবের পানি, লেবুর শরবত, ফলের জুস এবং খাবার স্যালাইন গ্রহণ করা যেতে পারে। এমন নয় যে প্রচুর পরিমাণে পানি খেতে হবে, পানি জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে।

৫. যেসব ঔষধ খাওয়া উচিত নয়
অধ্যাপক তাহমিনা বলেন, ”ডেঙ্গু জ্বর হলে প্যারাসিটামল খাওয়া যাবে। স্বাভাবিক ওজনের একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি প্রতিদিন সর্বোচ্চ চারটি প্যারাসিটামল খেতে পারবে।”চিকিৎসকরা বলছেন, প্যারাসিটামলের সর্বোচ্চ ডোজ হচ্ছে প্রতিদিন চার গ্রাম। কিন্তু কোন ব্যক্তির যদি লিভার, হার্ট এবং কিডনি সংক্রান্ত জটিলতা থাকে, তাহলে প্যারাসিটামল সেবনের আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে গায়ে ব্যথার জন্যঅ্যাসপিরিন জাতীয় ঔষধ খাওয়া যাবে না। ডেঙ্গুর সময় অ্যাসপিরিন জাতীয় ঔষধ গ্রহণ করলে রক্তক্ষরণ হতে পারে।

৬.প্ল্যাটিলেট বা রক্তকণিকা
ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে প্ল্যাটিলেট বা রক্তকণিকা এখন আর মূল ফ্যাক্টর নয় বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক তাহমিনা।তিনি বলেন, ”প্ল্যাটিলেট কাউন্ট নিয়ে উদ্বিগ্ন হবার কোন প্রয়োজন নেই। বিষয়টি চিকিৎসকের উপর ছেড়ে দেয়াই ভালো।”সাধারণত একজন মানুষের রক্তে প্ল্যাটিলেট কাউন্ট থাকে দেড়-লাখ থেকে সাড়ে চার-লাখ পর্যন্ত।

৭. ডেঙ্গু হলেই কী হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে?
ডেঙ্গু জ্বরের তিনটি ভাগ রয়েছে। এ ভাগগুলো হচ্ছে – ‘এ’, ‘বি’ এবং ‘সি’।প্রথম ক্যাটাগরির রোগীরা নরমাল থাকে। তাদের শুধু জ্বর থাকে। অধিকাংশ ডেঙ্গু রোগী ‘এ’ ক্যাটাগরির।তাদের হাসপাতালে ভর্তি হবার কোন প্রয়োজন নেই। ‘বি’ ক্যাটাগরির ডেঙ্গু রোগীদের সবই স্বাভাবিক থাকে, কিন্তু শরীরে কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন তার পেটে ব্যথা হতে পারে, বমি হতে পারে প্রচুর কিংবা সে কিছুই খেতে পারছে না।অনেক সময় দেখা যায়, দুইদিন জ্বরের পরে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এক্ষেত্রে হাসপাতাল ভর্তি হওয়াই ভালো।’সি’ ক্যাটাগরির ডেঙ্গু জ্বর সবচেয়ে খারাপ। কিছু-কিছু ক্ষেত্রে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউ’র প্রয়োজন হতে পারে।
[ উল্লেখ্য, দেশের সব বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গু টেস্টের ফি ৫০০ টাকার বেশি না নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সুতরাং লক্ষণ দেখা গেলে টেস্ট করিয়ে চিন্তামুক্ত থাকি]

বি. দ্রঃ
সাধারণত জুলাই থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ থাকে। কারণ এ সময়টিতে এডিস মশার বিস্তার ঘটে। আর এখন যেহেতু বর্ষাকাল বাসার ছাদে/অন্য কোথাও পানি জমে আছে কিনা লক্ষ রাখুন(আমি নিজেও ছাদের টব চেক করেছি)। সামান্য অসচেতনায় পানি জমিয়ে রেখে মশা উৎপাদন করে সিটি কর্পোরেশন/সরকারের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে লাভ নেই। আমরা নিজেরা সচেতন হই, সুস্থ্য থাকি।

তথ্যসূত্রঃ বিবিসি বাংলা, বিডি নিউজ২৪

হেফজখানা জীবনের এক রাতের কথা

79a06e

তখন হেফজখানায় পড়ি। সাত – আট সিপারা মুখস্থ করেছি মাত্র। সিপারার সাথে বয়সের তফাৎটাও খুব বেশি না। তো একদিন রাতের কথা। শীতের রাত। সবাই ঘুমিয়ে গেছে। আমার ঘুম আসছে না। ঘুম আসছে না মূলত খিদের কারনে। এশার নামাজের পর আরও কিছুক্ষণ পড়তে হতো। তারপরই ছিল খাবারের সময়। আমার তখন খেতে ইচ্ছে করেনি। এখন সবাই ডালভাত খেয়ে ভরপেটে ঘুমিয়ে আছে কিন্তু আমি খিদের চোটে ঘুমুতে পারছি না।
বোর্ডিং ছিল দূরে। খাবারের সময় খাবার আসতো। খাবারের সময় শেষ হলে সাথেসাথে বাসনপত্র ধুয়ে রেখে দেয়া হত। সুতরাং এত রাতে ভাত পাবার কোন আশা তো নেই। ট্রাঙ্কে অবশ্য বিস্কুট আছে। কিন্তু শীতের এমন নিশ্চুপ রাতে কিছুতেই ট্রাঙ্ক খুলবার সাহস হচ্ছিল না।

অনেকটা সময় এভাবেই কেটে যাবার পরও যখন দেখি ঘুম আসছে না তখন উঠে বসলাম। ডিমলাইটের মিহিন আলোতে দুরুদুরু বুকে ট্রাঙ্কের কাছে গেলাম। খুব ধীরেসুস্থে ট্রাঙ্ক খুলে বিস্কুটের পট থেকে বিস্কুট বেরকরে যেই খেতে যাবো তখনই ট্রাঙ্কের ডালাটা সশব্দে পড়ে গেল। ভয় পেয়ে হাত থেকে বিস্কুটের দূরে ছিটকে পড়ল। সব মিলিয়ে বিরাট রকমের একটা বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরী হয়ে গেল।
পাশ থেকে পর্দা সরিয়ে হুজুর ডাক দিলেন, ‘কে রে এতো রাতে, এই দিকে আয়, আয় বলছি এই দিকে!’
বেশ কয়েকজন ছাত্রও শোয়া থেকে উঠে বসলো তখন। আমি প্রচন্ড ভয়ে ভয়ে হুজুরের কাছে গেলাম। হুজুর জিজ্ঞেস করলেন, এত রাতে ট্রাঙ্ক খুলে কী করোস?। আমি কিছুই বলতে পারলাম না। সামনে কঠিন পরিণাম ভেবে আমি ভয়ে কাট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম।

হুজুর অন্য এক ছাত্রকে বল্ল, ‘দেখ্ তো অয় ট্রাঙ্কে কী করতাসিলো’!
তুলনামূলক বড় একজন ছাত্র তখন লাইট জ্বেলে ট্রাঙ্কের বাইরে পড়ে থাকা বিস্কুটের পটটা নিয়ে হুজুরের কাছে আসলো। হুজুর আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘রাইতে ভাত খাস নাই?’, আমি নিচ দিকে তাকিয়ে ডানেবামে দুইবার মাথা নাড়ালাম শুধু। কথা বলার সাহস সাহস পেলাম না। হুজুর সেই ছাত্রকে কাছে ডাকলো। ভাবলাম বেত আনতে পাঠাবে। এত রাতে সকলের ঘুম নষ্ট করার অপরাধে আমি শাস্তি পাব। কিন্তু
হুজুর তখন ওই ছাত্রটিকে বোর্ডিংয়ে পাঠিয়ে দিলো – খাবার আছে কি না দেখার জন্য। কিছুক্ষণ পর সে শুধু এক প্লেট ভাত নিয়ে এসে জানালো ডাল তরকারি কিছুই পাওয়া যায়নি। তখন হুজুর আমাকে বসিয়ে বল্লেন,
‘পানি আর লবন দিয়া মাখাইয়া সবগুলো ভাত খা’! আমি চুপচাপ হুজুরের আদেশ পালন করলাম।

স্বাদহীন সেই পানিভাত বা নুনভাত খেয়ে আমার সেদিন এতোটাই ভালো লেগেছিলো যে খেয়েদেয়ে বিছানায় যাবার পরও আরও অনেকটা সময় আমি জেগেছিলাম শুধু অপার্থিব এক ভালো লাগায়, নির্মোহ এক স্নেহের উপলব্ধিতে। কী ঘটে গেল, এটা ভেবে ভেবে আমার মুখে কেবল একটা তৃপ্তির হাসি লেগে ছিল…
আমি জানি না, সেই হুজুর এখন কোথায় আছেন। কেমন আছেন। দেশে আছেন না বিদেশে। ইহকালে না পরকালে। যেখানেই থাকেন, আল্লাহ যেন তাকে সদাসর্বদা হাসিখুশিই রাখেন!
____________________
আহমাদ মাগফুর,
লাখনৌ, ভারত

শেষ জীবন (গদ্য কবিতা)

index

আজ আমার বয়স আশি
যে বি এম ডাব্লিউতে এখন যাচ্ছি; সেটা আমারি কেনা
যে বহুতল ভবনের পাশ দিয়ে এখন যাচ্ছি; সেটা আমারি ফ্যাক্টরি
আজ আমার বয়স আশি
আমি আমার পরিবারকে ভালোবাসি
আমার স্ত্রী মারা গেছে আজ দশ বছর
আমার দুই সন্তান আমাকে নিয়ে যাচ্ছে আজ নতুন ঠিকানায়
যেতে রাজি নই তবু যেতে হচ্ছে
শরীর যে দুর্বল শক্তি হারাচ্ছে!
এক ঘন্টা পর আমাকে নামিয়ে দিলো “শেষ জীবন” এ
ঠিকই ধরেছেন; “শেষ জীবন” একটি বৃদ্ধাশ্রমের নাম।
একটি রুমে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম
তারপর আমার সন্তান এসে নিয়ে গেলো একটি রুমে
বললো, বিছানার চাদরটা বেশ পরিষ্কার না?
আমি চুপ করে থাকলাম
তারপর বললো, “বাবা আমি আসি – এখানে তোমার কোনো অসুবিধা হবে না”
আমি চুপ করে থাকলাম
আমার সন্তান আবার বললো, রুমটা বেশ পরিপাটি আর বিছানার চাদর বেশ পরিষ্কার
যাওয়ার সময় আমি শুধু বললাম,জন্মের পর তোর নষ্ট করা ছোটো কাঁথা – বিছানার চাদর আমিই পরিষ্কার করতাম।
এর দু দিন পর, দুপুরের খাবার খেয়ে মনটা আনচান করে উঠলো
আমি রুম থেকে বেরিয়ে দোতালা থেকে নিচের বাগান দেখছিলাম
“তুমি রফিক না?” – একটি ভারি মহিলা কণ্ঠ
আমি বললাম, হ্যাঁ কিন্তু আপনি?
বেল্কুনি থেকে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, আমি মালিহা
মালিহা? মানে বগুড়ার মালিহা?
তারপর কিছুক্ষণ নিরবে কেটে গেলো
আমিই নিরবতা ভাঙলাম, বলেছিলাম না? আমরা একসাথে থাকবো?
মালিহার চোখে এক বিদ্যুৎ ঝিলিক এসে চলে গেল, বললো – আমাকে বিয়ে করলে না কেন?
আকাশে বিজুলি চমকালে বৃষ্টি নামে; মালিহার চোখে জল
আমি বললাম, কাঁদছ কেন?
তুমি এতো বড় শিল্পপতি হয়েও……
থাক না সেসব কথা, বাকিটা জীবন তো একসাথেই আমরা কাটাতে পারি
কিন্তু আমিতো চেয়েছিলাম তুমি আমার যৌবনের অংশ হও – চেয়েছিলাম আমাদের সংসার হোক – আজ যে আমি সত্তর!
একজন পুরুষের কাছ থেকে একজন নারীর জৈবিক চাহিদা এবং সংসার ছাড়া আর কিছু প্রত্যাশা থাকে কি?
মালিহা বললো, থাকে – এক স্বর্গীয় ভালোবাসা যা সংসার জীবনের মতো ক্ষয়িষ্ণু নয় – যা গোলাপের মতো পবিত্র – খাওয়া যায় না অথচ তার সৌন্দর্য তার সুঘ্রাণ কেউ হারাতে চায় না।

খালকাটা

(কাল্পনিক; বাস্তবের সাথে কোন মিল নেই)

জুলেখার পুত্র লায়েক হয়ে গেছে; সে এখন নিজের মতামত দিতে চায়; মাকে প্রভাবিত করতে চায়। জুলেখা নিরুপায়; পুত্রের অযাচিত উপদ্রব মেনে নেয়া ছাড়া কিছু করার নেই। তার চারপাশে অবিশ্বাসী মুখ, কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। যাকেই বিশ্বাস করেছে, সময়-সুযোগের সেই তাকে বাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। জুলেখা ঠেকে শিখেছে কিন্তু পুত্রের ব্যাপারে সে অসহায়।

জুলেখার রাজ্যের নাম ‘খালকাটা’ তার স্বামী কুমিরের চাষ করবে বলে এমন রাজ্যের পত্তন করেছিল। এই কুমির জুলেখার জন্য কাল হয়েছে, তার চারপাশে শুধুই কুমির। হা করা মুখ গিলে খাওয়ার অপেক্ষায় আছে।

জুলেখা কিছুদিন ধরে অসুস্থ। কুমির সম্প্রদায় প্রায়ই তার অসুস্থতাকে উৎসব হিসাবে পালন করে। জুলেখার অসুস্থতার সুযোগে তার পুত্র সর্বেসর্বা বনে গেছে। কিন্তু তাকে কেউ পছন্দ করেনা। সে কুমির শ্রেষ্ঠ হিসাবে পরিচিত।

সে জানে কেউ তাকে পছন্দ করে না তবু মাকে ব্যবহার করে সে তার আখের গোছাতে ব্যস্ত। মায়ের অসুস্থতা তার জন্য এনে দিয়েছে সুবর্ণ সুযোগ। মায়ের চিকিৎসার ব্যাপারে উদাসীন, সুস্থ মায়ের চেয়ে অসুস্থ মা তার কাছে লোভনীয়। মায়ের অসুস্থতা বাইরে বিক্রি করে সে তার কর্ম ভালোভাবেই সম্পন্ন করতে পারছে।

জুলেখার অসুস্থতা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। কাউকে পাচ্ছে না যে একটু পাশে বসে মাথায় বুলিয়ে দেবে মমতার হাত। যারাই আসছে স্বার্থ নিয়ে আসছে। তাদের মুখ হাঁ করা; সুযোগ পেলেই গিলে ফেলবে।

জুলেখা নীরবে অশ্রু ফেলে আর ভাবে, স্বামীর ‘খালকাটা’র প্রায়শ্চিত্ত তাকে করতে হচ্ছে। স্বামীর অসংখ্য কুমির উৎপাদনের খেসারত এখন তাকে দিতে হচ্ছে। স্বামী যদি বুঝতো কিংবা জুলেখা যদি স্বামীকে বুঝাতে পারত কুমিরের চাষ করতে নেই তারা বিশ্বাসী হয় না তাহলে নিজের পুত্র হয়তো কুমির হতো না। পুত্র কুলাঙ্গারে পরিণত হতো না। স্বামীর কর্ম তাকে ভোগ করতে হচ্ছে।

জুলেখা অশ্রু ফেলে আর ভাবে…

আলোমাখা ভোর

26293

আলোমাখা ভোর

ভোর চলে যেতে যেতে রেখে যায় চড়ুইদের ধুলাবালি স্নান, শালিখ সংসার, কাকেদের কনসার্ট, স্কুল বাস আর চায়ের দোকানের উনুনের উপচে পরা কয়লা মাখা ধোঁয়া। এ সব কিছু পেরিয়ে এগিয়ে চলে রোদ পরতে পরতে, যত দূর দেখা যায়, তার থেকেও দূরে। পালিয়ে যেতে চায় মন সেখানে, যেখানে শরৎ শেষে হেমন্তের উঠোন জুড়ে ঝরে পড়ে ঈশ্বরময় গন্ধ।পালিয়ে যেতে চায় মন সেখানে, যেখানে শৈশব জুড়ে বসে থাকে অকৃত্রিম ভালোবাসার ওম। এক আকাশ, কোটি কোটি টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে রূপকথা মন। খুঁজে নেয় আনন্দ আর বেঁচে থাকার রসদ।

ততদিন বিষাদ ফিরে আসিস না তুই।

সাধারণ আমি

26204

সাধারণ মেয়ে মালতির মতই অতি সাধারণ আমি। এতোটাই সাধারণ যে সময়ের নদী তিরতির করে বয়ে, পায়ের পাতার নীচে আকুল হয়ে দাঁড়ায়। তখন আমার ঘরে ফেরার ইচ্ছেরা সব জেগে ওঠে। যে ঘর আছে আমার মনের ছায়ায়, যে ঘর আছে শতেক সময় তীরে।

অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে আমি। একা একাই এক বুক মাটি কেটে রাখি,আর রাখি এক ফালি ফলন্ত জমি,শীতে, ফাগুনের আগেই, যে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছে মান্দাসে। অসংখ্য অবজ্ঞার পরে,পড়ে থাকে নির্ভার আলো, আলগোছে মন ভুলে, থেমে যাই নির্জন এক দ্বীপে।

আমি অতি সাধারণ মেয়ে। লোকালয় থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখি, রাত জাগা তারাদের সাথে চলে নিজেকে চেনার পালা।মাঝে মাঝে কার্ণিশে দাঁড়িয়ে, হাওয়ায় মাপি মুক্তির দৈর্ঘ্য,আলতো করে ছড়িয়ে দিয়ে হাত, কিন্তু ডানাজোড়া যে ছিঁড়েই গেছে কবে।

অত্যন্ত সাধারণ আমি। পৃথিবীর বুক থেক জলছবি জমা হতে থাকে। অভিমান হাত রাখে হাতে, নিশ্চুপ মন আরোও চুপচাপ হয়। ছাদ ঘেরা পাঁচিলের আগাছায়, জমে চলে আজন্ম অনুভূতি, রাত কেড়ে রাত্রি নেমে আসে, হিম হিম কুয়াশায় ভিজে যায় যত ইচ্ছে কুসুম।

আমি অতি সাধারণ মেয়ে। কিছুতেই আমি অসাধারণ হতে পারিনা।

(‘প্রেমিকের নাম আগুন ‘কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া)