বিভাগের আর্কাইভঃ ইতিহাস-ঐতিহ্য

মাঙ্গলিক রবীন্দ্রনাথ …

মাঙ্গলিক রবীন্দ্রনাথ …

প্রেমিকদের মূল মন্ত্র হল ‘প্রেম’। উপনিষদে এই ‘প্রেম’ শব্দটির সমার্থক শব্দ হল ‘আনন্দ’। এই প্রেম আর আনন্দের মধ্যে এক নিবিড় যোগ আছে আর তা হল সত্য। প্রেমের যা দুঃখ একজন প্রকৃত প্রেমিকের কাছে তা পরম আনন্দ। এর সঙ্গে সৌন্দর্যকেও যোগ করে নিতে হবে। কেননা সৌন্দর্যের আশ্বাস মনে প্রেমের জন্ম দেয় আর তার থেকেই আসে আনন্দ আর সেই আনন্দই চিনিয়ে দেয় পরম সত্যকে। এবং এই ভাবের থেকেই ‘মঙ্গল’ শব্দটি মনে আসে। কিন্তু গভীর মরমী চেতনায় সৌন্দর্য, প্রেম, আনন্দ, সত্য এই সমস্ত ভাবের স্তরই একটি পূর্ণতা নিয়ে সৃষ্টি হয়। কিন্তু ‘মঙ্গল’ শব্দটির মধ্যে পূর্ণতা থাকে না। কারন মঙ্গল মানেই অমঙ্গলের অস্তিত্ব। আমরা পরম করুণাময় ঈশ্বর কে মঙ্গলের অধীশ্বর বলে মনে করি তাহলে তো অমঙ্গলের অধীশ্বর হিসেবে শয়তানকে মানতে হয়। তবে তো ‘মঙ্গল’ পূর্ণতা পেল না। তবে প্রকৃতপক্ষে যিনি যেমন মানুষ তার ঈশ্বরকেও তেমনই রূপ দেন। তাই যিনি মানব সত্যের সাধনায় স্বয়ং পূর্ণসত্তায় উত্তীর্ণ হচ্ছেন একমাত্র তাঁর পক্ষেই জগতের পরম একক সত্তাকে উপলব্ধি করা সম্ভব।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আমরা মঙ্গলময় ঈশ্বরের প্রতি তাঁর বিশ্বাসের কথা জানতে পারি।
১. “সত্যমঙ্গল প্রেমময় তুমি, ধ্রুবজ্যোতি তুমি অন্ধকারে।
তুমি সদা যার হৃদে বিরাজ দুখজ্বালা সেই পাশরে-
সব দুখজ্বালা সেই পাশরে।।“

২. “আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর।।
…… বহে জীবন রজনীদিন চিরনূতনধারা,
করুনা তব অবিশ্রাম জনমে মরনে।।
স্নেহ প্রেম দয়া ভক্তি কোমল করে প্রাণ,
কত সান্ত্বন কর বর্ষণ সন্তাপহরনে।।“

৩. “চিরবন্ধু, চিরনির্ভর, চিরশান্তি
তুমি হে প্রভু-
তুমি চিরমঙ্গল সখা হে তোমার জগতে,
চিরসঙ্গী চিরজীবনে।।“

আমরা এই কবিতাগুলি থেকে তিনটি সিদ্ধান্তে আসতে পারি-
১. কবি এখানে সত্য ও পূর্ণের পাশেই ‘মঙ্গল’ কে স্থান দিয়েছেন, সুতরাং তাঁর কাছে সত্য, মঙ্গল সমার্থক।
২. ঈশ্বর শুধু মঙ্গলময় নন, তাঁর করুনা শুধু জীবনে নয় মরনের মধ্যে দিয়েও বর্ষিত হচ্ছে। ঈশ্বর ইহজীবনে নানানভাবে হৃদয়ে সান্ত্বনা বহন করে আনছেন এবং প্রতিনিয়ত দুঃখ হরণ করছেন।
৩. ঈশ্বর সর্বময়ই মঙ্গল। তাঁর মধ্যে ‘অমঙ্গলের’ কোন স্থান নেই ।

আমরা জানি পার্থিব যন্ত্রণার চূড়ান্ত ঘটনা হল মৃত্যু। প্রতিটি মানুষের মধ্যে চেতনালাভের প্রথম দিনটি থেকেই মৃত্যু নামের মধ্যে দিয়ে একটা ভয় কাজ করে। নিজের অহং বিনাশের ভয়, প্রিয়জনের সাথে চিরবিচ্ছেদের ভয়। কিন্তু কবি এই মৃত্যুকে ভয় বলে মানতে রাজি নন। তিনি মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই অমৃতের কাছে পৌঁছতে চেয়েছেন। তাই তো তিনি বলেছেন-
“ দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে তব মঙ্গল-আলোক
তবে তাই হোক।
মৃত্যু যদি কাছে আনে তোমার অমৃতময় লোক
তবে তাই হোক।।“

‘বৃহহদারন্যক’ উপনিষদে যে শাশ্বত বানী আছে।–
“অসতো মা সদ-গময়
তমসো মা জ্যোতির্গময়
মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়।।“

এখানে যেমন মৃত্যু থেকে অমৃতে উত্তরনের কথা বলা হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঔপনিষদিগের ঋষিদেরই সার্থক উত্তরসুরি হিসেবে উপলব্ধি করেছেন। তাই তিনিই বলতে পারেন-
“আমি ভুলবো না সহজেতে, সেই প্রানে মন উঠবে মেতে
মৃত্যু মাঝে ঢাকা আছে যে অন্তহীন প্রাণ।।“

রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই মঙ্গলকে প্রত্যক্ষ করতে চেয়েছেন। পাশাপাশি ব্যবহারিক জগতের অমঙ্গলকে তিনি সহায়ক রূপে গ্রহন করেছেন। কবির নিজের জীবনও নানান দুঃখ, বেদনায় জর্জরিত ছিল। এতো দুঃখ জ্বালার মধ্যেও তিনি স্থির বিশ্বাসে অবিচল থেকেছেন। ব্যাক্তিগত দুঃখের দিনে, সমাজের অবক্ষয়ের দিনে, অমঙ্গলের জয়ডঙ্কার দিনে কবি ‘সত্যমঙ্গল প্রেমময়’কেই শুধু স্মরণ করেছেন। তিনি বলেছেন-
“হিংসায় উন্মত্তপৃথ্বী, নিত্য নিষ্ঠুর দ্ধন্দ্ব;
ঘোর কুটিল পন্থ ইহার, লোভজটিল বন্ধ ।।……
ক্রন্দনময় নিখিল হৃদয় তাপদহনদীপ্ত
বিষয়বিষবিকারজীর্ণ খিন্ন অপরিতৃপ্ত।
দেশ দেশ পরিল তিলক রক্তকলুষগ্লানি,
তব মঙ্গলশঙ্খ আন, তব দক্ষিনপানি-
তব শুভসঙ্গীতরাগ, তব সুন্দর ছন্দ।
শান্ত হে, মুক্ত হে, হে অনন্তপুণ্য,
করুনাঘন, ধরনীতল কর কলঙ্কশূন্য।।“

“অমৃত’ কে জীবনের সার্থকরূপে ছেনে তোলবার সাধনাই ছিল কবি রবীন্দ্রনাথের কর্মযোগের প্রধান লক্ষ্য। কর্মের ক্ষেত্র দুটি; একটি মানস ক্ষেত্র, অপরটি বাস্তবক্ষেত্র। মানসক্ষেত্রের পরম সত্তার সাথে কবির প্রেমের যোগ আর বাস্তব ক্ষেত্রের পরম সত্তার সাথে তাঁর কল্যাণের যোগ। তাই তো সমাজের কল্যাণের মধ্যে দিয়েই পূর্ণের সুসমঞ্জস্য রূপটি কবি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই তো তিনি বলেছেন,- “ জগতের মধ্যে সামঞ্জস্য তিনি শান্তম, সমাজের মধ্যে সামঞ্জস্য তিনি শিবম, আত্মার মধ্যে সামঞ্জস্য তিনি অদ্বৈতম।।“

যে মানুষ সমাজের মঙ্গলের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেন তিনি যদি পরমেশ্বরকে চান তবে তিনি ব্যাক্তিগত ভাবে তাঁর দিকে অগ্রসর হতে পারেন। এখানে তিনি যেমন ব্যাক্তিসাধনায় পরমের দিকে অগ্রসর হন, তেমনি তাঁর একটি বিশ্বগত সাধনার দিকও থাকে আর সেই সাধনার ক্ষেত্র হল সমাজ। সর্বমানবের মধ্যে আপন আত্মার মিলন না হলে নিখিলাত্মা তাঁর মধ্যে প্রস্ফুটিত পদ্মের মতো বিকশিত হতে পারে না।

বিবেকানন্দও এই কারনেই শুধু নিজের মুক্তি চান নি। সমাজের প্রতিটি মানুষের মন মুক্ত না হলে বন্ধন দশা কাটবে না বলেই স্বামীজি মনে করতেন। কবিও এই ধারাতেই ভেবেছিলেন’-
“যারে তুমি ফেল নীচে সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে
পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।
অজ্ঞানের অন্ধকারে
আড়ালে ঢাকিছ যারে
তোমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান।।“

সুতরাং মানবাত্মার মুক্তি খুঁজতে হবে সাধারন মানুষেরই মধ্যে। এখান থেকে ছাড়পত্র না পেলে ‘নিখিল’-এর শতদলের পাপড়ি বন্ধই থেকে যাবে। তাই কবি সমাজের শ্রমজীবী মানুষের কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে মুক্তির রাস্তা খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন।–
‘তিনি গেছেন যেথায় মাটি কেটে
করছে চাষা চাষ-
পাথর ভেঙ্গে কাটছে যেথায় পথ
খাটছে বারোমাস।
রৌদ্র জলে আছেন সবার সাথে,
ধুলা তাহার লেগেছে দুই হাতে;
তারি মতন শুচি বসন ছাড়ি
আয়রে ধুলার ‘পরে।
মুক্তি?

ওরে কোথায় পাবি,মুক্তি কোথায় আছে।
আপনি প্রভু সৃষ্টি বাধন প’রে
বাঁধা সবার কাছে।।“

সমাজ ও মানব কল্যানের জন্য একমাত্র হাতিয়ার হল নিঃস্বার্থ কর্ম। তিনি লিখেছেন।– “আনন্দের ধর্ম যদি কর্ম হয় তবে কর্মের দ্বারাই সেই আনন্দস্বরূপ ব্রহ্মর সঙ্গে আমাদের যোগ হতে পারে। গীতায় একেই বলে কর্মযোগ।“

গীতায় কর্মযোগে বলা হয়েছেঃ
“তস্মাদসক্তঃ সততং কার্যং কর্ম সমাচর।
অসক্তো হ্যাচরন্ কর্ম পরমাপ্নোতি পুরুষ।।“

অর্থাৎ আসক্তি শূন্য হয়ে কর্ম সম্পাদন করলে পুরুষ পরমকে প্রাপ্ত হন। এখানে কবি গীতার কঠিনতা কে অনেকটাই মাধুর্য দিয়ে পূর্ণ করেছেন।‘অনাসক্তি’র প্রকৃত যে তিক্ততা নয় তা যে শুধু ভোগাকাঙ্খা ত্যাগ, সেই কথাটা রবীন্দ্রনাথের আনন্দ মিমাংসার দ্বারা আমরা স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারি। তাঁর কবিতার মধ্যে দিয়েই সেই তত্ত্ব উপলব্ধির সজীবতা প্রকাশিত হয়েছে-
“কর্ম করি যে হাত লয়ে কর্মবাঁধন তারে বাঁধে,
ফলের আশা শিকল হয়ে জড়িয়ে ধরে জটিল ফাঁদে।
তোমার রাখী বাঁধো আঁটি- সকল বাঁধন যাবে কাটি,
কর্ম তখন বীনার মতো বাজবে মধুর মূর্ছনাতে।।“

“আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি’, মানব কল্যান- সমাজ সেবা- কর্মযজ্ঞ- রবীন্দ্রনাথের ‘ব্যাক্তি আমি’তেই সমস্ত উপলব্ধির মূল শিকড় কিন্তু এই মঙ্গলময় ‘পরম আমি’র মধ্যেই নিহিত আছে।

শুরু হলো শোকাবহ আগস্ট!

5884480_n

শোকাবহ আগস্টের প্রথম দিন আজ। ১৯৭৫ সালের এ মাসেই সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক বিপদগামী সদস্যদের নারকীয় হত্যাকাণ্ডে বাঙালি হারিয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

বেঁচে থাকলে এখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বয়স হতো একশ বছর। চলতি বছরে উদযাপিত হচ্ছে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত এই নেতার জন্মশতবার্ষিকী। করোনা মহামারি কালে সীমিত আকারে চলমান এই উদযাপনের মধ্যেই এলো বাঙালি জাতির শোকের মাস আগস্ট। এই মাসে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে সপরিবারে শাহাদাত বরণ করতে হয়েছে। এই মাসেই নারকীয় হামলা হয়েছে তারই কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর। বাঙালি জাতির ইতিহাসের অধ্যায়ে আগস্ট শোকের চাদরে ঢাকা। আজ আগস্টের প্রথম দিন। এ মাসের ১৫ তারিখে ঘাতকরা কেড়ে নিয়েছিল বঙ্গবন্ধু আর তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যদের প্রাণ।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড ছুঁড়ে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল জাতির জনকের কন্যা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। ভাগ্যক্রমে সেদিন তিনি বেঁচে গেলেও এই ঘটনায় সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী ও আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত এবং পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী আহত হন। পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট কালরাতে ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল। পৃথিবীর এই ঘৃণ্যতম হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর সহোদর শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে যুবনেতা ও সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মনি, তার সহধর্মিণী আরজু মনি ও কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও আত্মীয়-স্বজন।

১৫ আগস্টের সকল শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। মহান আল্লাহ সকলকে জান্নাত নসীব করুন।

রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ‘বিটিভি’ এখন আর কেউ দেখে না

428_n

প্রতিদিন রাস্তাঘাটে চলাফেরার মাঝে অনেক জায়গায় থামতে হয়, অনেক চা’র দোকানে বসতে হয়। চায়ের দোকানে বসলেই চোখ যায় দোকানে চালু থাকা রঙিন টেলিভিশনের দিকে। চালু থাকা টেলিভিশনের পর্দায় দেখা মেলেনা রাষ্ট্রীয় ‘বিটিভি’ চ্যানেল। চলতে থাকে আর বসে থাকা কাস্টমাররা মনের আনন্দে ডিশ এন্টেনার ভারতীয় চ্যানেলগুলো। ওইসব দৃশ্য চোখে পড়লেই মনের টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে ওঠে ছোটবেলায় সাদাকালো টেলিভিশনে দেখা বাংলাদেশ টেলিভিশনের কথা। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন (বিটিভি) যে আমরা সমবয়সীরা কতো আনন্দে উপভোগ করতাম, তা আর লিখে শেষ করতে পারবো না। তবে একটু-আধটু লিখে শেয়ার করা যায়।

সময়টা তখন ১৯৭৪ সাল। আমি চার কেলাসের (ক্লাস ফোর)-এর ছাত্র। তখন আমরা সপরিবারে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানাধীন লক্ষ্মণ খোলা গ্রাম সংলগ্ন আদর্শ কটন মিলের ফ্যামিলি কোয়ার্টারে থাকতাম। সেসময় ঘরে ঘরে এতো টেলিভিশন ছিলো না। যা ছিলো, তা কেবল সেসময়কার কিছুকিছু পয়সাওয়ালাদের বাড়িতেই কাঠের বাক্সের মতো একটা সাদাকালো টেলিভিশন থাকতো।

তখন রঙিন টেলিভিশন ছিলোই না। লক্ষ্মণ খোলা পুরো গ্রামে হয়তো দু’একজনের বাড়িতে টেলিভিশন নামের বাক্সটা ছিলো। আদর্শ কটন মিল অভ্যন্তরে থাকা কোনও ফ্যামিলি বাসায় তো দূরের কথা, মিলের শ্রমিক কর্মচারীদের ক্লাবেও একটা টেলিভিশন ছিলো না। শীতলক্ষ্যা নদীর এপার ওপার দু’পারে দু’টি টেলিভিশন ছিলো। একটা টেলিভিশন ছিলো লক্ষ্মণ খোলা জনতা ক্লাবে, আরেকটা ছিলো নদীর পশ্চিম পারে চিত্তরঞ্জন কটন মিলের শ্রমিকদের ক্লাবে। এই দুইটাও ছিলো সাদাকালো ১৭” ইঞ্চি টেলিভিশন।

সেসময়কার টেলিভিশনের ছোট্ট বাক্সটা বর্তমানে অনেক বড়সড় হয়ে গেছে। বর্তমানে টেলিভিশন প্রায় ৪০” ইঞ্চি। তাও আবার অ্যান্ড্রয়েড। সাথে থাকে ইন্টারনেট সংযোগ সিস্টেম। তা-ও আবার প্রায় ঘরে, হাটবাজারে, মহল্লার চায়ের দোকান-সহ বড়সড় সব দোকানেই দেখা যায়।

আর আমাদের সময়ে এই ১৪” ইঞ্চি, ১৭” ইঞ্চি সাদাকালো টেলিভিশনই ছিলো মস্তবড় টেলিভিশন। টেলিভিশন দেখার জন্য শীতলক্ষ্যা নদী পাড়ি দিতে হতো। তারপর সেসময়ের রুস্তম পাইন্না রুস্তমদের কতো যে মাইর, গুতা, খেতে হতো, তা আর লিখে শেষ করতে পারছি না। তবুও সেসময়কার কাঠের বাক্সের ভেতরে শাটানো কাঁচের পর্দার সামনাসামনি বসে থাকতে যে কতো ভালো লাগতো, তা একটু-আধটু লিখে স্মৃতি করে রাখছি মাত্র।

বলে রাখা ভালো যে, তখনকার সময়ে ইন্টারনেট আর ওয়াই-ফাই তো দূরের কথা, ডিশ অ্যানটেনা বা ডিশ লাইনও ছিলো না। ১৪” ইঞ্চি বা ১৭” ইঞ্চি টেলিভিশনের সামনে বসে আমরা যা দেখতাম, তা কেবল আমাদের স্বাধীন বাংলার বাংলাদেশ টেলিভিশনে সম্প্রচারিত খবর, নাটক, সিনেমা, সিনেমার গান ও দেশীয় নৃত্যানুষ্ঠানগুলোই দেখতাম।

তখন সপ্তাহের ৭ দিনই রাত ৮ টা বাংলা সংবাদের পর কোনো-না-কোনো ইংরেজি সিরিজ শুরু হতো। সেসব বাংলা-ইংরেজি সিরিজের নামগুলো এখনো মনে আছে।যেই সিরিজগুলো দেখানো হতো সেগুলো থেকে কয়েকটা সিরিজের নাম এখানে উল্লেখ করছি। “হাওয়াই ফাইভও”, “টারজান”, “দ্য ওয়ার্ল্ড ওয়ার্ল্ড ওয়েস্ট”, “সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান”, “বায়োনিক ওমেন”, “নাইট রাইডার”, “স্পেস নাইন্টিন নাইন্টি নাইন”।

বাংলা নাটকের সিরিজগুলো হলো, ‘সংশপ্তক’ এইসব দিনরাত্রি’, ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’। আরও কিছু বাংলা-ইংরেজি সিরিজের নামগুলো এখন আর মনে নেই। তবে কিছুকিছু দৃশ্য এখনো মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। এইসব দর্শকপ্রিয় নাটকগুলোর নাম আর কথা মনে পড়লেই এখনো টেলিভিশনের রঙিন পর্দায় ফিরে তাকাই। কিন্তু না, সেরকম মনমাতানো নাটক আর ইংরেজি সিরিজ গুলো দেখা মেলেনা।

আগেকার মতো বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) ছায়াছবি, নাটক, ইংরেজি সিরিজ টেলিভিশনের সামনে বসে মনের আনন্দে কেউ উপভোগও করে না। সিনেমা হলে তো যায়-ই-না। এখন টেলিভিশনে ভারতীয় চ্যানেলগুলোতে দেখা যায় ডিজে গান, ডিসকো ড্যান্স, গ্রুপ ড্যান্স, অর্ধনগ্ন পোষাকে হৈ-হুল্লোড়। সেগুলোই যোয়ান-বুড়ো সবাই দেখে। কিন্তু বর্তমানে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ‘বিটিভি’ তো কেউ দেখেই না,  ‘বিটিভি’তে সম্প্রচার হওয়া অনুষ্ঠানও কেউ দেখে না।

অপ্রমিত অর্বাচীনের বাখোয়াজ: রবি ও নজরুল সম্পর্ক

rabi

বাঙালিরা স্বভাবগতভাবে একজনরে ছোটো না কইরা অন্যজনরে বড় করবার পারে না, আর বাঙালি ব্যবসাও বোঝেনা- এই দুইটা কথাই সইত্য। তা না হইলে আজ সারা দুনিয়ায় ছড়াইয়া যাওয়া ‘একজনরে ছোটো বানাইয়া অন্য জনরে বড় প্রমাণ’এর অভ্যাসটার কপিরাইট দাবী কইরা বহুত ফরেন কারেন্সি আদায় করা যাইতো। এইটা বারবার মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কাজী নজরুল ইসলামের অন্ধ ভক্তদের আচরণ দেইখা।

রুই মাছের স্বাদ বেশী না বোয়াল মাছের- এই তুলনা অবান্তর, কারণ দুইটা মাছ হইলেও তাগো মধ্যে তুলনা চলেনা। ফল হইলেও জাম্বুরার লগে নারিকেলের তুলনা চলেনা। পাখি হইলেও কোকিলের লগে ঈগলের তুলনা বেমানান। কারণ, তারা নিজ নিজ স্বাদে ও গুণে ইউনিক। সাহিত্যিক হইলেও রবীন্দ্রনাথের লগে নজরুলের বা নজরুলের লগে রবীন্দ্রনাথের তুলনা চলেনা, তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। দুই জনের বয়সের ফারাক প্রায় ৩৮বচ্ছর, এরপরও দুইজনের সম্পর্কটা মুখামুখির আছিলো না, আছিলো পাশাপাশির।

বড় সাহিত্যিক গো সাট্টিফিকেট পাওয়ার লেগা এইকালে যেমুন অনেক লেখক গোপনে বা প্রকাশ্যে চেষ্টাচরিত্ত করে, ওই কালেও করতো। ওই কালের সবচে বড় সাহিত্যিক হইলেন রবীন্দ্রনাথ, নোবেল প্রাইজ পাইছেন, সারা দুনিয়ায় তার পরিচিতি। তার কাছ থেকা একটা সার্ট্টিফিকেট পাইলে আর লাগে কি! রবীন্দ্রনাথের কাছে লেখা বহুত চিঠিতে এই সার্ট্টিফিকেটের আবদারের প্রমাণ আছে। মাগার কাজী নজরুলরে রবীন্দ্রনাথ এমন এক সার্ট্টিফিকেট দিলেন যে, ওই সময়েই অনেকের কলিজা ফাইট্টা খানখান হইয়া গেলো। নিজের লেখা ‘বসন্ত’ গীতি নাট্য উৎসর্গ কইরা দিলেন কারাবন্দী কাজী নজরুলরে, প্রায় ৬৪ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ ২৪বছর বয়সী নজরুলরে সম্বোধন করলেন কবি বইলা, উৎসর্গে লিখলেন, ‘শ্রীমান কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্নেহভাজনেষু’।

খালি উৎসর্গ করলেও একটা কথা আছিলো, তাগো দু:খ আরও বাড়ায়া দিতে বসন্ত’র একটি কপিতে নিজের নাম স্বাক্ষর কইরা পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে দিয়া রবীন্দ্রনাথ কইলেন, ‘‘তাকে (নজরুল) বোলো, আমি নিজের হাতে তাকে দিতে পারলাম না বলে সে যেন দুঃখ না করে। আমি তাকে আমার সমগ্র অন্তর দিয়ে অকুণ্ঠ আশীর্বাদ জানাচ্ছি। আর বোলো, কবিতা লেখা যেন কোনো কারণেই সে বন্ধ না করে। সৈনিক অনেক মিলবে, কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা জাগাবার কবিও তো চাই।’

রবীন্দ্রনাথের এই ‘বসন্ত’ কাণ্ডে অনেকের কলিজায় গুঁটি বসন্তের জ্বালা শুরু হইলো। তাগো মতে কাজী নজরুলের মতন অপগণ্ড, নিম্নমানের কবিরে বিশ্বকবি গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ কবি বইলা সম্বোধন করবেন, স্বীকৃতি দিবেন, এইটা মাইনা নেওয়া যায় না। এই বিশেষজ্ঞদের মোক্ষম জবাব দিলেন রবীন্দ্রনাথ, ‘নজরুলকে আমি গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছি এবং উৎসর্গপত্রে তাকে ‘কবি’ বলে অভিহিত করেছি। জানি, তোমাদের মধ্যে যারা এটা অনুমোদন করতে পারেনি, আমার বিশ্বাস তারা নজরুলের কবিতা না পড়েই এ মনোভাব পোষণ করেছে। আজ আমি যদি তরুণ হতাম তাহলে আমার কলমেও ওই সুর থাকত।’ আবার অনশন ভাঙার অনুরোধ কইরা নজরুলরে টেলিগ্রামে লিখলেন, ‘Give up your hunger strike, Our literature claims you’ , এইখানে হাঙ্গার স্ট্রাইক ভাঙার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হইলো- ওরে নজরুল, আমাগো সাহিত্যে তোমারে দরকার।

নজরুলও কিন্তু রবীন্দ্রনাথরে ‘সঞ্চিতা’ উৎসর্গ করছিলেন, সেটা রবীন্দ্রনাথের নজরুলরে ‘বসন্ত’ উৎসর্গের প্রায় আট বচ্ছর পর।

রবীন্দ্রনাথের লগে নজরুলের কথাবার্তা হয় ১৯২১সালে, শান্তি নিকেতনে। এই দুইজনের যোগাযোগের মধ্যিখানে ছিলেন আরেক জ্ঞাণী মানুষ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ষাট, নজরুলের মাত্র একুশ। এর এক বচ্ছর পর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের স্মরণ সভায় সভাপতিত্ব করেন রবীন্দ্রনাথ, নিজের পাশে বসান নজরুলরে। আর যায় কই, লগে লগে জ্ঞানী দর্শক আর মাঝারি ও বাচ্চা সাইজের অতি রবীন্দ্রনাথরা চেইতা উঠলো- রবীন্দ্রনাথের লগে একই মঞ্চে পাশাপাশি বয় নজরুল! রবীন্দ্রনাথ ক্যান আশকারা দিয়া নজরুলের মতন এক ফাঁপা সাহিত্যিকরে ঘাড়ে তুলতাছেন, সে পালায়া যাইতে চাইলেও তারে ডাইকা মঞ্চে তুইলা নিজের পাশে বসাইতাছেন- এই অনাচার তো মানাও যায়না, রবীন্দ্রনাথরে কিছু কওনও যায় না। ধূমকেতুর ম্যানেজার শান্তিপদ সিংহ এই পরিস্থিতিরে কলমে ধইরা রাখছেন এভাবে , ‘বিশ্বকবি মঞ্চে প্রবেশ করলেন এবং প্রায় পিছু পিছু কবি নজরুলও একেবারে মঞ্চের উপর। কবি গুরুর ইঙ্গিতে তাঁর পাশের আসনেই বসলেন। নিচে সেই গুনগুনানি। তাদের হিসাব মতে, কবি গুরুর পাশে বসবার যোগ্যতা নজরুলের নেই। অথচ ঘটনাচক্রে তিনি রবীন্দ্রনাথের পাশে বসবার সুযোগ পাচ্ছেন বড় বড় সভায়। কি দুর্দৈব!’

রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাস লইয়া সিনেমা বানানো হইবো, পরিচালক নরেশ মিত্র ‘গোরা’ সিনেমার সংগীত পরিচালক হিসাবে চাইলেন নজরুলরে, নজরুলও রাজী হইলেন। মনে রাখতে হইবো নজরুল তখন শুধু গুরুত্বপূর্ণই নয় জনপ্রিয় গীতিকার ও সুরকার। সিনেমাতো বানানো হইলো, মাগার, গোরা সিনেমার মুক্তি আটকায়া গেলো বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের আপত্তিতে। বোর্ড আপত্তি করলো দুই কারণে, একে তো বোর্ডের অনুমতি না নিয়া রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহার করা হইছে, তার ওপর সুরও ঠিক নাই। সিনেমার প্রযোজক পরিচালকের মাথায় হাত, ভাড়া করা ট্যাক্সিতে নজরুল ফিল্মের প্রিন্ট আর প্রজেক্টর লয়া ছুটলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। ঘটনা শুইনা রবীন্দ্রনাথ ঠাসকি খাইলেন, অনুমতিপত্রে স্বাক্ষর করতে করতে নজরুলরে কইলেন, ‘কী কাণ্ড বলো তো? তুমি শিখিয়েছ আমার গান, আর ওরা কোন আক্কেলে তোমার দোষ ধরে? তোমার চেয়েও আমার গান কি তারা বেশি বুঝবে? আমার গানের মর্যাদা কি ওরা বেশি দিতে পারবে?’

নজরুল আছিলেন গান আর কবিতা পাগল মজলিশি মানুষ। একবার নজরুলের নেতৃত্বে গানের মহড়া চলতাছে, এক পত্রিকার সম্পাদক আইসা গান চায়া রবীন্দ্রনাথরে ছোটো কইরা নজরুলরে বড় করতাছিলেন, যে স্বভাবের কথা লেখার শুরুতেই কইছি। মাগার নজরুলরে তো পাম দিয়া ফুলানো যায় না, তিনি ওই সম্পাদকরে ধমকায়া কইলেন, ‘আমরা যদি কেউ না জন্মাতাম, তাতে কোনো ক্ষতি হতো না, রবীন্দ্রনাথের গান বেদমন্ত্র, তাঁর গান ও কবিতা আমাদের সাত রাজার ধন মানিক। লেখা নিতে এসেছেন, নিয়ে যান, লেখা নিতে এসে এ রকম আমড়াগাছি যেন আর না শুনি।’

রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের এমন চমৎকার সম্পর্কটার মধ্যেও শেষ পর্যন্ত বামহাত ঢুকাইতে সক্ষম হইছিলো একদল লোক, তাগো মুখামুখি দাঁড় করাইতে পারছিলো ওই বদগুলা, আফসোস। ওই সাময়িক ভুল বুঝাবুঝির পরও দুইজনের প্রতি দুইজনের দিলে মোহব্বতের কমতি আছিলো না। ওই কথা আরেকদিন কমুনে, আজ এই পর্যন্তই।

শুভ জন্মদিন প্রিয় কাজী নজরুল ইসলাম।

সম্পর্কে নক্ষত্রেরা : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কাজী নজরুল ইসলাম

সম্পর্কে নক্ষত্রেরা

বাংলা সাহিত্যের দুই দিকপাল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর নজরুল ইসলাম। কেমন ছিলো দুজনের মধ্যে সম্পর্ক? বাংলা সাহিত্যের দুই মহান কবির মধ্যে যে গভীর সুসম্পর্ক ছিল তা আমাদের অনেকেরই অজানা।

রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল সম্পর্ক : ১
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘১৪০০ সাল’ কবিতা লেখেন ১৩০২ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে। কবিতাটিতে রবীন্দ্রনাথ শতবর্ষের পরের পাঠককে বসন্তের পুষ্পাঞ্জলি পাঠিয়েছেন।

“আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতুহলভরে, আজি হতে শতবর্ষ পরে!”

কাজী নজরুল ইসলাম ১৩৩৪ সালের আষাঢ় মাসে তাঁর ‘১৪০০ সাল’ কবিতায় এর উত্তর লেখেন। তাতে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও ভক্তি।

“আজি হ’তে শতবর্ষ আগে
কে কবি, স্মরণ তুমি করেছিলে আমাদেরে
শত অনুরাগে,
আজি হ’তে শতবর্ষ আগে!”

রবীন্দ্রনাথ নজরুল সম্পর্ক: ২
রবীন্দ্রনাথ যেমন অনুজ নজরুলের প্রতি আশীর্বাদ বাণী প্রদান করে প্রীত হয়েছেন, তেমনি নজরুলও অগ্রজের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে হয়েছেন ধন্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর রচিত ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি কাজী নজরুলকে উৎসর্গ করেছিলেন। সেটি ছিল রবীন্দ্র পরিবারের বাইরে প্রথম কাউকে একটি বই উৎসর্গ করার ঘটনা।

রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক বরাবর ছিল ভালো। রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে যে কী স্নেহ করতেন তার আরেকটি উদাহরণ- রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘গোরা’ উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি ছায়াছবিতে নজরুল ছিলেন সঙ্গীত পরিচালক। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ এতে বাধ সাধলে রবীন্দ্রনাথ তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং নজরুলকে সঙ্গীত পরিচালনার স্বীকৃতি প্রদান করেন।

রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সম্পর্ক : ৩
কমরেড মোজাফ্ফর আহমেদ তাঁর স্মৃতি কথায় লিখেছেন, ‘নজরুল ইসলাম বহু রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতেন। তিনি কি করে যে রবীন্দ্র সঙ্গীতগুলো মুখস্ত করেছিলেন তা ভেবে অবাক হই।’ সেকালে যারা নজরুলের কাছে গান শিখেছেন, কবি তাদেরকে রবীন্দ্র-সঙ্গীত শিখিয়েছেন শুরুতে। কাজী মোতাহার হোসেনও নজরুলের কাছে দু’খানি রবীন্দ্র-সঙ্গীত শিখেছিলেন। ‘কে যেন আমারে এনেছে ডাকিয়া এসেছি ভুলে’ এবং ‘তোরা পারবি নাকি যোগ দিতে সেই ছন্দেরে।’ প্রতিভা বসুকে নজরুল প্রথম শিখিয়েছিলেন রবীন্দ্র-সঙ্গীত ‘পথ দিয়ে কে যায় গো চলে।’ উমা মৈত্রকে শিখিয়েছিলেন ‘আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি।’ বিখ্যাত ফজিলাতুন্নেসার বোন শফিকুন্নেসাকে শিখিয়েছিলেন ‘হে ক্ষণিকের অতিথি এলে প্রভাতে কারে চাহিয়া।’

একবার শান্তিনিকেতিনে যাওয়ার সময় নজরুল ডক্টর শহীদুল্লাহকে গীতাঞ্জলির সব গান স্মৃতি থেকে গেয়ে শুনিয়েছিলেন ট্রেনের কামরায় যেতে যেতে। রবীন্দ্রনাথ এই কথা শোনার পর বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। মজার ব্যাপার হল গল্পগ্রন্থ ‘ব্যথার দান’ ও ‘রিক্তের বেদন’ এবং ‘বাঁধনহারা’ পত্রোপন্যাসে রবীন্দ্রনাথের গানের প্রচুর উদাহরণ আছে।

রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সম্পর্ক : ৪
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সরাসরি দেখা হয়েছিল ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে শান্তিনিকেতনে। তখন নজরুলের বয়স ২২ বছর। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে গিয়েছিলেন। বোলপুর স্টেশনে কাজী নজরুল ইসলাম এবং ড. শহীদুল্লাহকে অভ্যর্থনা জানান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একান্ত সচিব কবি সুধাকান্ত রায় চৌধুরী। নজরুল সেদিন রবীন্দ্রনাথের কাছে একটি কবিতার আবৃত্তি শুনতে চেয়েছিলেন। কবিগুরু বললেন, ‘সে কি? আমি যে তোমার গান ও আবৃত্তি শোনবার জন্যে প্রতীক্ষা করে আছি, তাড়াতাড়ি শুরু করে দাও।’ নজরুল আবৃত্তি করেছিলেন, অগ্নি-বীণা’র ‘আগমনী’ কবিতাটি। এছাড়াও তিনি কয়েকটি রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে শোনান। নজরুলের অনুরোধে সেদিন রবীন্দ্রনাথ আবৃত্তি করে শোনান, ‘মাধবী হঠাৎ কোথা হতে, এল ফাগুন দিনের স্রোতে, এসে হেসেই বলে যাই যাই।’…

এরপর বেশ কয়েকবার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সাক্ষাৎ হয়। ১৯২১-এর ডিসেম্বর মাসে বিদ্রোহী কবিতা রচনা করে নজরুল সরাসরি চলে যান জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে। উচ্চকণ্ঠে ‘দে গরুর গা ধুইয়ে’ গাইতে গাইতে নজরুল ঠাকুর বাড়িতে প্রবেশ করে ডাকলেন গুরুদেব আমি এসেছি। উচ্চস্বরে আবৃত্তি করতে থাকেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি। তিনি রবীন্দ্রনাথকে বলেন, গুরুদেব আমি আপনাকে খুন করবো। রবীন্দ্রনাথ ‘বিদ্রোহী’ কবিতা শুনে কবিতার প্রশংসা করেন এবং নজরুলকে জড়িয়ে ধরে বলেন ‘সত্যিই তুই আমাকে খুন করেছিস’।

রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সম্পর্ক : ৫
নজরুলের সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’ প্রকাশিত হয় ১৯২২-এর ১১ আগস্ট (১৩২৯ বঙ্গাব্দের ২৪ শ্রাবণ)।তরুণ কবির অনুরধে রবীন্দ্রনাথ এই পত্রিকার আশীর্বাণী লিখে দেন রবীন্দ্রনাথ নিজের হাতে —

‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু’

“আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
অলক্ষনের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা,
জাগিয়ে দেরে চমক মেরে
আছে যারা অর্ধচেতন।”

এই কাব্যবাণী প্রতি সংখ্যায় ছাপা হতো। এরপর নজরুল সম্পাদনা করেন ‘লাঙ্গল।’ এবারও রবীন্দ্রনাথ শুভেচ্ছায় সিক্ত করেন নজরুলকে। প্রথম প্রকাশ ২৫ ডিসেম্বর, ১৯২৫।

“জাগো জাগো বলরাম
ধর তব মরুভাঙ্গা হল
বল দাও, ফল দাও
স্তব্ধ করো ব্যর্থ কোলাহল।”

মজার কথা হলো, প্রথম শুভেচ্ছাস্তবকটি সবাই জানলেও কোন কারণে পরেরটি তেমন বিখ্যাত হয় নি।

রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সম্পর্ক : ৬
ধূমকেতুর ১২শ সংখ্যায় (২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২) প্রকাশিত নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ নামক একটি প্রতীকধর্মী কবিতা প্রকাশের পর নজরুলকে গ্রেফতার করে তাঁর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহ মামলা করা হয়। ১৯২৩-এর ১৬ জানুয়ারি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহো মামলার রায় দেন। এতে নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ প্রদান করা হয়। এই বছরই ২২ ফেব্রুয়ারি কারাগারে থাকা অবস্থায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। কিন্তু সময় ও শরীর অনুকূল না থাকায় তিনি পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে বইয়ের এক কপি স্বাক্ষরসহ দেন। কবিতায় লেখেনঃ

‘শ্রীমান কবি নজরুল ইসলাম স্নেহভাজনেষু।’
‘সে সুন্দর বহ্নিদগ্ধ মোর বুকে তাই
দিয়েছিলে ‘বসন্তে’র পুষ্পিত মালিকা।’

রবীন্দ্রনাথ পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ডেকে বলেন, ‘জাতির জীবনে বসন্ত এনেছে নজরুল। তাই আমার সদ্য প্রকাশিত ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যখানি ওকেই উৎসর্গ করেছি। সেখানা নিজের হাতে তাকে দিতে পারলে আমি খুশি হতাম, কিন্তু আমি যখন নিজে গিয়ে দিয়ে আসতে পারছি না, ভেবে দেখলাম, তোমার হাত দিয়ে পাঠানোই সবচেয়ে ভালো, আমার হয়েই তুমি বইখানা ওকে দিও।’
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘নজরুলের কাব্যে অসির ঝনঝনানি আছে। আমি যদি তরুণ হতাম তা হলে আমার কলমেও ওই একই ঝংকার বাজতো।’

পবিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে বইটি দিয়ে রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছিলেন, ‘নজরুলকে বলো, আমি নিজের হাতে তাকে দিতে পারলাম না বলে সে যেন দুঃখ না করে। আমি তাকে সমগ্র অন্তর দিয়ে অকুণ্ঠ আশীর্বাদ জানাচ্ছি। আর বলো, কবিতা লেখা যেন কোন কারণেই সে বন্ধ না করে। সৈনিক অনেক মিলবে কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা জোগাবার কবিও তো চাই।’

নজরুল বইটি পেয়েই বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। এ প্রসঙ্গে নজরুল লিখেছেন, ‘এ সময়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত’ নাটক আমায় উৎসর্গ করেন। তাঁর এই আশীর্বাদ-মালা পেয়ে আমি জেলের সর্বজ্বালা, যন্ত্রণা ক্লেশ ভুলে যাই।’ নজরুল ইসলাম তাঁর ‘সঞ্চিতা’ কাব্য গ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেন।

রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সম্পর্ক : ৭
১৯২৩-এর ১৪ এপ্রিল হুগলি জেলে নজরুল অনশন করেন। এই অনশন ভঙ্গ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ প্রেসিডেন্সি জেলের ঠিকানায় নজরুল ইসলামের কাছে টেলিগ্রাম পাঠান। তাতে লেখেন, Give up hunger strike, our literature claims you. জেল কর্তৃপক্ষ টেলিগ্রামটি ফেরত পাঠায়। কারণ, নজরুল তখন ছিলেন হুগলি জেলে। তখন কবিগুরু লেখেন — *একটি ঐতিহাসিক চিঠি*

কল্যাণীয়েষু, রথী,
নজরুল ইসলামকে Presidency Jail এর ঠিকানায় টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলুম। লিখেছিলুম ‘Give up hunger strike, our literature claims you’। জেল থেকে Memo এসেছে The addressee not found; অর্থাৎ ওরা আমার message দিতে চায় না। কেননা, নজরুল প্রেসিডেন্সী জেলে না থাকলেও ওরা নিশ্চয় জানে সে কোথায় আছে। অতএব,নজরুল ইসলামের আত্মহত্যায় ওরা বাধা দিতে চায় না।
শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
[সূত্রঃ ‘বসুমতী’ পত্রিকা]

রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সম্পর্ক : ৮
রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে বোলপুরে শান্তিনিকেতনে থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন সৈনিক নজরুল শান্তিনিকেতনের শিক্ষার্থীদের শারীরিক শিক্ষা দেবেন। কিন্তু অস্থির প্রকৃতির বিদ্রোহী নজরুল কোথায়ও এভাবে নিয়মের বেড়াজালে আটকে থাকতে চাননি। আরও পরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের দার্জিলিংয়ে দেখা হয়। এ সময় নজরুল প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি তো ইতালি গেছেন সেখানে কবি দ্যনুনজিও’র সঙ্গে দেখা হয়েছিল কি না? রবীন্দ্রনাথ হেসে বলেছিলেন দেখা হবে কি করে তিনি যে তোমার চেয়েও পাগল।

রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সম্পর্ক : ৯
নজরুল ১৯৩৫-এর জুন মাসে ‘নাগরিক’ পত্রিকার জন্য রবীন্দ্রনাথের কাছে লেখা চেয়ে চিঠি পাঠান। তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ৭৫ বছর। বেশ অসুস্থ। এর উত্তরে রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৬-এর ১ সেপ্টেম্বর লিখেছিলেন, ‘…তুমি তরুণ কবি, এই প্রাচীন কবি তোমার কাছে আর কিছু না হোক করুণা দাবি করতে পারে। শুনেছি বর্ধমান অঞ্চলে তোমার জন্ম। আমরা থাকি পাশের জেলায় (বীরভুমের বোলপুরে)। কখনো যদি ঐ সীমানা পেরিয়ে আমাদের এদিকে আসতে পারো খুশি হব।’

উক্ত চিঠির জবাবে নজরুল ‘নাগরিক’ পত্রিকায় লেখেন, কবিতা

“হে কবি, হে ঋষি অন্তর্যামী আমারে করিও ক্ষমা।
পর্বত-সম শত দোষত্রুটিও চরণে হল জমা।..
তুমি শ্রষ্টার শ্রেষ্ঠ বিস্ময়-
তব গুণে-গানে ভাষা-সুর যেন সব হয়ে যায় লয়।…
প্রার্থণা মোর, যদি আরবার জন্মি এ ধরণীতে,
আসি যেন শুধু গাহন করিতে তোমার কাব্য-গীতে।”

রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সম্পর্ক : ১০
কাজী নজরুল ইসলাম গুরু বলে মান্য করতেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। নজরুল নিজের কাব্য চর্চা থেকে অন্যত্র মনোনিবেশ করায় রবীন্দ্রনাথ কাজী নজরুলকে বলেছিলেন, ‘তুমি নাকি এখন তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাছো?’ নজরুল উত্তরে লিখেছিলেন, ‘গুরু কন আমি নাকি তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাছি…।’

রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সম্পর্ক : ১১
রবীন্দ্রনাথের বয়স আশি বছর পূর্তি হয় ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে। তখন কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে লিখেন, ‘অশ্রুপুষ্পাঞ্জলি’। ১৯২০ থেকে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পূর্বকাল পর্যন্ত রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক ছিল পারস্পরিক স্নেহ ও শ্রদ্ধার।

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে নজরুল যে গভীরভাবে শোকাভিভূত হয়েছিলেন তার পরিচয় রবীন্দ্রনাথের পরলোকগমনে তাৎক্ষণিকভাবে রচিত নজরুলের বিভিন্ন কবিতা ও গানে পাওয়া যায়। এই দিন (২২ শ্রাবণ’ ১৩৪৮) কাজী নজরুল ইসলাম আকাশবাণী বেতার কেন্দ্র থেকে ধারাবর্ণনা প্রচার করেন। তিনি আবৃত্তি করেন ‘রবিহারা’ কবিতা এবং রচনা করেন ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে’। এ ছাড়া ‘সালাম অস্তরবি’ এবং ‘মৃত্যুহীন রবীন্দ্র’ নামে দুটি কবিতা রচনা করেন।

_____________________

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর এক বছর পরেই নজরুল চিরতরে অসুস্থ এবং ক্রমান্বয়ে সম্বিতহারা ও নির্বাক হয়ে যান। বাংলার দুই মহান কবির কণ্ঠ প্রায় একই সময়ে নীরব হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল বাঙালি জাতি ও বাংলার দুই মহান ব্যক্তি। তাঁদের মহত্ব বাঙালির গর্বের। একজন আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ, অপরজন আমাদের প্রাণের কবি, চিরতরুণ কবি নজরুল ইসলাম। এ বিষয়গুলো সাহিত্যের ইতিহাসে উপেক্ষিত। দুই মহান কবির জীবনের এদিকগুলোয় আলোকপাত হওয়া উচিত।

তথ্য : সংগৃহিত।

এলেবেলে -৩৭

১৯৮৪ তে এরশাদের শাসনামলে দেশের সকল সংবাদপত্র অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। তখন মোবাইল ইন্টারনেট ছিল না। এসএসসি পরীক্ষার ফল স্কুলে পাঠানো হয়েছিল। আমি যে স্কুল থেকে এস এস সি পরীক্ষা দিয়েছি তা বাড়ি থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে। দুরু দুরু বুকে ফল জানতে (আনতে) গিয়েছিলাম। মনে পড়ে গেল।

তারও অনেক পরে বিবিসির সংবাদদাতা আতাউস সামাদ কে জেল বন্ধী করেছিলেন এরশাদ সাহেব। চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে আতাউস সামাদ এর কাছে শুনেছি বন্দি অবস্থায় তিনি কি করেছেন এবং সাংবাদিক সমাজ কিভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন।

আমরা যে সব সংবাদ পত্র বা মাধ্যম কে মূলধারা বলে মনে করি তারা যদি সত্য প্রকাশে বাঁধাগ্রস্ত হয় তো গুজব এবং মিথ্যা তথ্য সাধারণের কাছে পৌঁছবে। এখন ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটার সহ এসএনএস এ গুজব, মিথ্যা, এবং উস্কানি মূলক প্রচুর বক্তব্য আছে।
সত্য প্রকাশে বাধা আসলে মিথ্যার ব্যাপ্তি বাড়বে।

নেওয়াজ আলির অসীমিত সত্য কথা (1,2,3,4,5)

20210

নেওয়াজ আলির অসীমিত সত্য কথা। (১)

(১) আমার আমিঃ
আলি নেওয়াজ ভূঁইয়া আমার দাদার নাম। সামহোয়্যারইন বগ্লে আমার নিক নেইম নেওয়াজ আলি। বাড়ির গেইটে সৌজন্য দাদার নাম, জাষ্ট দাদাকে মনে রাখা।
মুলকুতের রহমান দাদা আমার দাদার চাচাত ভাই। ভূঁইয়া বংশ নিয়ে মুলকুত দাদার গৌরবের কোন শেষ ছিলো না। পুকুর ঘাটে বসে বিকালে দক্ষিণা বাতাস গায়ে লাগিয়ে দাদাদের সাথে কত মজা করেছি কিশোর কালে। মাঝে মাঝে মুলকুত দাদাকে টিট করতাম দুর মিয়া তোমরা কচুর ভূঁইয়া। এমনি শুরু হতো অতীত ইতিহাস বলা। পাশের বাড়ি হিন্দুরাও জমিদার ছিলো, আমাদের সামনে দিয়ে মানুষ হাটতে সালাম করতো আর তুই বলছিস কচুর ভূঁইয়া। ——সবাই মিলে প্রাণ খুলে হাসতাম।
মুলকুত দাদা বলতো আমরা বৃটিশ আমলের ভূঁইয়া। আসলে ভূঁইয়ারা বৃটিশদের অনুগত ছিলো সেই সুযোগে এলাকায় খাজনা ট্যাক্স আদায় করতো আর গরিবদের শোষণ করতো। এখন গরিবদের শোষণ করে আধুনিক নিয়মে আধুনিক পন্থায় নিচ হতে উঠে আসা কিংবা আজীবন উপরে থাকা বড় লোকেরা।

মাজম আলি ভূঁইয়া বাড়ি নানার নিবাস। আবার নানা বিয়ে করেছেন ভূঁইয়ার মেয়ে সেই ধারা আমি বজায় রেখে গিয়ে পড়লাম আনূ ভূঁইয়া বাড়ির মেয়ে বিয়ে করতে, মুহুরী নদীর এপার ওপার নানার বাড়ি আর শুশুর বাড়ি। আমার নামের সাথে এই পদবি লিখতে ইচ্ছে করে না। কোথায়ও আমি লিখি না কারণ সবাই আমরা মানুষ, কর্মই তার পরিচয়।

(২) ফেসবুক, করোনা, বই উপহারঃ
আমি ছোটকাল হতে লিখি এইটা একটা অনিয়মিত নেশা। তবে ফেসবুক আসার পর এইটা নিয়মিত নেশা হয়ে পড়েছে। মনে হয় যেন মনের বড় একটা খোরাক এই সাহিত্য চর্চা। যশ খ্যাতি কোনো কিছুর জন্যই এই নেশা নয়। আত্মীয়-স্বজন এলাকার কিছু লোক বাদ দিলে সাহিত্যিকমনা লোকই এড আমার সাথে। সালু আলমগীর, মাহাবুর রহমান, তপন কুমার বড়ুয়া আরো কয়েকজন লেখকের নাম মনে পড়ছে না মারা গিয়েছেন। খুব খুব মনে পড়ে উনাদের কারণ বন্ধু কম হওয়ায় সবার লেখা পড়ার চেষ্টা করি এতে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে ভালোবাসার।

“মনাব্বর হোসেন” ভাই একজন লেখক ও রাজনীতিক নেতা। উনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কী একটা পদে আছেন। কয়েক বছর আগে হঠাৎ করে বলে ঠিকানা দিন বই পাঠাবো। আমি ঠিকানা দিয়ে বলি বিকাশ নাম্বার দিন। বই উনি ফেনীতে পাঠালেন কিন্তু টাকা নিলেন না। রুদ্র আমিন “আবিরের লাল জামা” দিলেন টাকা নিলেন না। প্রতি বছর আমি মেলা হতে বই কিনি আর তা ফেসবুক বন্ধুদের এবং নতুন লেখকদের। আমার সাথে নামি দামি লেখক এড নাই তাদের বই মেলা হতে কেনাও হয় না তেমন।

গত বছর “জোসেফ জাহাঙ্গীর” এবং “ফারুক এম জাহাঙ্গীর” ভাই বই উপহার দিতে চেয়ে ছিলো আমি নিতে রাজি হই নাই, বলেছি কিনে নিবো কিন্তু দুর্ভাগ্য কিনতে পারি নাই। বেকারত্ব ও করোনার চাপে পড়ে এইবার আর বই কিনতে পারছি না। কিন্ত গতকাল “ইসলাম তরিক” ম্যাসেজ দিয়ে বলে ভাই ঠিকানা দিন বই পাঠাবো। ঠিকানা দিয়ে বলি বিকাশ নাম্বার দিন আপনার, মনাব্বার ভাইয়ের মত সেই একই কথা টাকা লাগবে না এই বই আপনার জন্য উপহার। আমি মনে মনে বলে উঠি ভালোবাসা ভাই ভালোবাসা । উনাদের অনেককে জীবনে দেখি নাই এবং কখনো দেখা হবে কিনা জানি না। আমরা কারণে অকারণে অযথা অন্যকে আনফ্রেন্ড করি, বক্ল করি ভুল করি । আমার অনেক পুরাতন বন্ধু এখন এড নাই বিভিন্ন কারণে হারিয়ে গিয়েছে তাদের বলবো ভালোবাসি হ্যাঁ ভালোবাসি , সাহিত্যপ্রেমিক ভালোবাসি তোমাকেই।

টাকা খরচ করে বই বাহির করতে হয়। এইবার করোনার কারণে পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। খবর বের হয়েছে প্রকাশকগণ বড় রকমের লোকসান দিবে এইবার। লেখকগণও ব্যক্তিগতভাবে লোকসান গুণবে সন্দেহ নাই। তাই বলবো যারা সাহিত্য ভালোবাসেন তাঁরা যেন একটা হলেও বই কিনেন। বই কিনার ইচ্ছা করলে মেলার দরকার হবে না যে কোন মাধ্যমে বই কিনতে পারবেন। লক্ষ লক্ষ লোক ফেসবুকে লেখালেখি করে শুধু তাঁরা একে অপরের বই কিনলে সাহিত্য একটা শিল্পে দাড়িয়ে যাবে। বেশী বেশী পড়লে লেখার মান অনেক উচ্চতায় চলে যাবে। দুইটা পাঠাগারে বই দেওয়ার কথা ছিলো, করোনা পৃথিবীকে তছনছ করায় আমিও লণ্ডভণ্ড। সময়মতো বই দিতে পারছি না বলে ক্ষমা চাই তবে আমি বেঁচে থাকলে অবশ্যই বই দিবো এবং নিজেও পাঠাগার করতে চেষ্টা করবো আপনারা পাশে থাকবেন।

মহামারীর ভিতর যতটুকু সম্ভব নিরাপদ থাকার চেষ্টা করুণ। আশেপাশে লোকজনের খোজখবর রাখতে চেষ্টা করুণ, নিজে না পারলেও সরকারি বেসরকারী যে কোনো সাহায্য পেতে সহযোগিতা করতে চেষ্টা করুণ।
নিজে টিকা নিন, অন্যকেও নিতে বলুন।

নেওয়াজ আলির অসীমিত সত্য কথা। (2)

গোপাল স্যারঃ
একজন শিক্ষক, একটা আদর্শ, উনি পূর্ব দিগন্তে উদিত হওয়া সুর্য। এই সুর্য মেঘে ডাকা সকালের সুর্য নয়। এই সুর্যের আলো এতটাই দ্বীপ্ত প্রখর যে ধুলোতে হারিয়ে যাওয়া সুই খুজে নেওয়ার মত। শান্ত, সৎ এবং জ্ঞানী একজন শিক্ষক। মানুষ গড়ার কারিগর হিসাবে যেইসব উপাধান থাকা দরকার তার সবটি শতকরা একশ ভাগ বিদ্যমান ছিলো উনার ভিতর। আজকাল কোনো শিক্ষকের নৈতিক হীনতা কিংবা লোভী খবর যখন পড়ি তখন মনে পড়ে বাবার মত শতভাগ নিরাপদ আদর্শবান এই মহান গোপাল স্যারের কথা।

তখন আমি দশ শ্রেণীতে পড়ি। এক অলস দুপুরে টিফিন পিরিয়ডে শ্রেণী কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। গোপাল স্যার ডাকলেন আমাকে, বললেন মন খারাপ করে দাড়িয়ে আছিস কেনো? আমি চুপ করে থাকলাম। তারপর অত্যন্ত শান্ত স্বরে বললেন নামাজ কেনো পড়িস না? আমাদের স্কুলের বর্ষীয়ান শিক্ষক হাজ্বি স্যার এবং হুজুর স্যার অনেক ছাত্র নিয়ে তখন স্কুল মসজিদে নামাজরত। উনি বলেন আমি হিন্দু, আমার ধর্মে নামাজ নাই; তুই মুসলিম তোর ধর্মে নামাজ আছে অথচ নামাজের সময় আমরা দুইজনে মসজিদের বাহিরে। তুই মুসলিম হয়ে নামাজ না পড়লে তোর আর আমার মধ্যে পার্থক্য কোথায়!

গোপাল স্যার ধর্ম বিশ্বাসী মানুষ, নিজ ধর্মের রীতিনীতি মেনে চলতেন। আমি তখন লজ্জা পেলেও ধর্মের রীতিনীতি মেনে চলতাম না। এখন বয়স শেষে ধর্মকে আকড়ে ধরতে ছুটছি আর মনে হয় আমার মত এমন বহু মুসলিম আছে। শেষ বয়সে বাংলাদেশের মানুষ হজ্ব করতে ছুটে যান শারীরিক কারণে সঠিকভাবে সুসম্পন্ন করতে বেগ পেতে হয়। তাই সময় থাকতে সময়ের মূল্য দিতে হয়।

নেওয়াজ আলির অসীমিত সত্য কথা । (৩)

গোলাপ হাতে মানস প্রতিমাঃ
সিঁড়ির নিচে দশম শ্রেণীর ক্লাস রুম, শিক্ষক রুম, সহকারী প্রধান শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষক রুম তারপরে ছাত্রীদের বিশ্রামাগার। দক্ষিণমুখী দালানের পূর্বপ্রান্তে শেষ কামরায় ক্লাস আর পশ্চিমপ্রান্তে সব শেষ কামরা ছাত্রী বিশ্রামাগার। বিশ্রামাগারের দিকে আমার চঞ্চল মন লাজুক লাজুক চোখের এক বালিকার খোঁজে। সমস্যা হলো সেই বালিকার কোনো বিশেষত্ব নেই, নেই ঠোঁটে কৃষ্ণচূড়ার মত টকটক লাল লিপস্টিক, নেই চোখে কালো কাজল। কিন্তু মুখটা তার ইতিহাসের সেরা কবিতা তাই আমার চোখ সেই অকৃত্রিম মায়াবী মুখ খোঁজ করে। মনে হয় পাবো তারে এখনি পাবো। আর তখন দৌড়ে গিয়ে একটা রক্তজবা তার খোপায় দিবো আলতো করে।

নব্বই দশকের দিকে এরশাদ সরকারের একজন মন্ত্রী আসবেন স্কুলে তাই সাজ সাজ রব স্কুলময়। বিভিন্ন স্কুল হতে যেমন ছাত্র ছাত্রী আনা হয়েছে তেমনি মন্ত্রীকে দেখার জন্য স্থানীয় লোকজন এসে স্কুল মাঠ লোকারণ্য। পূর্বমুখ করা মঞ্চে দেশাত্মবোধক গান বাজছে। এইদিকে বার বার মঞ্চ হতে ঘোষণা আসছে “অল্প কিছুক্ষণের” মধ্যে মন্ত্রী মহোদয় এসে হাজির হবেন আমাদের মাঝে। নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার আরো পরে ছাত্রীদের হাতে ফুল দিয়ে রাস্তার দু’ধারে দাঁড় করিয়ে দিল অনুষ্ঠানের দায়িত্বপাপ্ত কর্তা ব্যক্তিগণ।

ফুল হাতে লাইনে দাঁড়ানো একজন অপ্সরী আমার হৃদয় মানসে আঁকা ছবির সাথে মিলে যায়। দ্বিধা সংকোচ ঝেড়ে ফেলে আমি তাকে বার বার পলক করতে থাকি। সাহিত্য বিশারদগণ বলেন প্রত্যেক মানুষের হৃদয়ে একটা অদৃশ্য মানবীর ছবি আঁকা থাকে। যখন মানুষ কাউকে দেখে আকৃষ্ট হয় তখন হৃদয়ে আঁকা ছবির সাথে বার বার ওই মানবীকে মিলিয়ে দেখে। যখন মনের ছবি আর জীবন্ত ছবি মিলে যায় তখন মানুষ তাকে ভালোবাসতে থাকে। আর এই মিলে যাওয়া হলো হৃদয়ের মানস প্রতিমা। দেশে আবার বহু গণতন্ত্রের মানস কন্যা আছে যাদের কাজ শাসন করা সেই রকম কিছু মনে করলে ভুল হবে। মাথায় তার গোলাপী জর্জেট ওড়না, গায়ে কালো আর গোলাপীর মিশ্রিত জামা। চোখে এক রাজ্যের লজ্জা, হাতে মন্ত্রীর জন্য গোলাপ ফুল।

চিকন সরু লম্বা নাকটার উপরে একটি কাটা দাগ সিঁথির যেন মাঝখান বরাবর। সাদা সাদা চোখের কালো পর্দায় জলের পাতলা আবরণ টপ করে ঝরে পড়ে যেন আমার ভালোবাসাকে শীতল করবে। আমি তাকে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকি মেয়েটার সেইদিকে কোনো নজরই নেই, মনে হয় আধা একটা বোকা মেয়ে যেন পৃথিবী চিনে, রাধা-কৃষ্ণ বুঝে না।

নেওয়াজ আলির অসীমিত সত্য কথা। (৪)

একটা গান দিও আমার জন্যঃ
ছাদে লাউয়ের ডগা লক লক করে দেখে বুঝা যায় বাহারি ফলন হয়েছে। আর এমনি গানও আসে স্বরে “স্বাদের লাউ বানাইলি মোরে বৈরাগী”। লাউয়ের সাদা সাদা ফুলে মৌমাছি ও প্রজাপতি ঘুরে বেড়ায় আপন মনে। কালো হলদে একটা প্রজাপতি আমার মনে দাগ কাটে তাই তাকে ধরার জন্য পিছু নিই। প্রজাপতিটা বড্ড চালাক ধরতে গেলেই উড়াল দেয় , এইদিক সেদিক তাকাতে থাকি আমি দেখি না আর প্রজাপতি। হয়তো উড়াল দেয় দুর আকাশে। বসন্তকাল সূর্যকিরণে তাপ তেমন না থাকায় আমি চুপচাপ নারিকেল গাছটার নিচে লাউ গাছের পাশে ছাদে বসে পড়ি আরামে। কারণ প্রজাপতি ফুলে ফুলে বিচরণ করে আমাকে পরাজিত করে, ক্লান্ত করে। এই সময় চুপে চুপে আমার হৃদয়ে মানস প্রতিমা এসে হালকা জোয়ার তুলে মনে প্রাণে। তখন মন আবেগী হয় রাক্ষুসে হয় মানস প্রতিমাকে পুজা করতে। এক বোতাম ভালোবাসা চাই টি-শার্টের বুকে রেখে দিতে।

একটা গান লিখা কাগজ পকেটে ছিলো। বের করে নিজ মনে গুন গুন করে পড়ি। সেই বয়সে কিংবা এই বয়সে গান করার গলা আদৌ শ্রুতিমধুর পর্যায় পড়েনি আমার । তবুও একটা সা রে গা মা সুর তুলতে চেষ্টা করি। এই নিরব নির্জন পরিবেশটা আমাকে একটা আমিত্ব দেয় তখনি মনে চায় একটা ভালোবাসার কাননের মালী হতে। এই সুতা ছেড়া ভাবনায় ছেদ ধরায় মোতালেব, পাশে বসেই সেও গান বেসুরে রেওয়াজ করা শুরু করে। আমি উপরে দেখতে থাকি নারিকেল গাছে শুকনা কোনো নারিকেল আছে কিনা। থাকলে ভালো হতো ছিড়ে নিচে পড়লে এই বেসুরো গানের আওয়াজ হতে বাঁচতে পারতাম। একটু পর সে নিজেই গানের কাগজটা নিয়ে চলে যায়, এতে আমার মন খুশিতে নেচে উঠে।

পরে গানের কাগজ মোতালেব ফেরত দেওয়ার কথা থাকলেও ফেরত দেয়নি, আর তার দেখাও মেলেনি। দক্ষিণের ছাদ হতে উত্তরে আসতে দেখি এক দেবী আমার গানের কাগজ হাতে বান্ধবী ও অন্যান্যদের নিয়ে হাই বেঞ্চের উপর বসে গানটার শ্রাদ্ধ করতেছে। মুহুরী নদীর স্বচ্ছ জলে ছোট ছোট মাছের ঝাঁক, উপরে একদল সাদা সাদা গাঙ চিল। টি-শার্ট খুলে ঝাপ দিলাম নদীতে মুক্তার খোজে, আর মুখে গান “এখানে রমণীগুলো নদীর মত,নদীও নারীর মত কথা কয়”। সাহস সঞ্চয় করে সবার সামনে গিয়ে দাড়াই।
এইটা আমার গানের কাগজ।
সবাই মিটমিট হাসে আর বলে আমরা পড়ছি।
এইদিকে আমার সাহস বাড়তে থাকে বাতাসে ভেসে আসা পারফিউমের সুগন্ধিতে।
কাগজটা দিয়ে দাও আমি চলে যাচ্ছি। আমি বলি নিচের দিকে তাকিয়ে অথচ তাকেই প্রতিদিন দেখার জন্য মন ব্যাকুল থাকে আর এখন চোখ মেলানোই দায়।
দে-বো না আমি। মজা করে হেসে হেসে বলে।
না দিলে দেখাবো মজা।
কী করবে শুনি।
আমি কাগজ ধরতে চাইলে চঞ্চলমতি হরিণী বসা হতে উঠে বেঞ্চে হতে বেঞ্চে নৃত্য শুরু করে।
আমি হতবাক হয়ে দাড়িয়ে দৌড়াদৌড়ি দেখতে ব্যস্ত।
নৃত্যের তালে সামাল দিতে না ফেরে গলা হতে ওড়না নিচে পড়ে যায়।
আমি তখন পাথরে পাথরে আগুন জ্বালাই আদিম যুগের মানবের মত।

নেওয়াজ আলির অসীমিত সত্য কথা। (৫)

সত্যকার মুক্তিযোদ্ধা অন্যকে ঘায়েল করে না, নিরব দেশপ্রেমিক হয়ঃ
মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেখুন? এইটা কোন পার্টির দেয়া দলীয় মুক্তিযোদ্ধার সনদ নয়, এটা ২৩ বছর বয়সী একজনের নামে ভারতে বাংলাদেশী যুদ্ধ শিবিরের ইস্যু করা সনদপত্র। পরে স্বাধীন দেশে নতুন করে ইস্যুর জন্য তার কাছে কিছু পরিমান উৎকোচ চাওয়া হয়েছিলো, তিনি প্রত্যাখান করেছিলেন। এই মলিন কাগজটা দেখিয়ে একটি চকচকে সনদ নেয়ার সুযোগ পরেও অনেকবার এসেছিলো, নিম্নবিত্ত পরিবার সে সুযোগ নেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি কখনই।

মুক্তিযোদ্ধা কোটায় প্লট বা ফ্ল্যাট, কোটায় চাকরী কিংবা ভাতাও পান না। এই মুক্তিযোদ্ধা দেশকে ভালোবেসে দায়িত্ব পালন করেছেন। উনার সন্তানেরা চাকরী বা অন্য কোনও সুবিধা চায়নি এবং পায়নি । তাই উনার সন্তানেরা ছোটখাটো চাকরী করে মুক্তিযোদ্ধার পরিচয়ে গর্ব অনুভব করে নিরবে, তবে পরিচয়টা রাস্তাঘাটে বিক্রি করে না। এই রকম শত নিরব মুক্তিযোদ্ধা আছে অতএব সম্মান করা উচিত।

রেমিটান্স যোদ্ধাদের জীবনঃ
করোনায় তছনছ গোটা বিশ্ব। করোনা প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জীবনও তছনছ করে দিয়েছে। অনেকে কাজ হারিয়ে দিশেহারা। কেউ কেউ আক্রান্ত স্বজনদের জন্য হাসপাতালে ছোটাছুটি করছেন। আবার অনেকে নিজে ‘শোক সংবাদ’ হয়ে যাচ্ছেন।
প্রায় প্রতিদিনই বিশ্বে বাংলাদেশির মৃত্যু হচ্ছে। প্রতিদিন যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন দেশ, যেখানে একের পর এক প্রবাসী আক্রান্ত ও মারা যাচ্ছেন। এক সময় করোনায় প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধার মৃত্যুতে যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে যায় সৌদি আরব। এখন পর্যন্ত সৌদি আরবসহ বিশ্বের ২৩টি দেশে ২ হাজার ৭৩৫ জন প্রবাসী বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে করোনায়।

সৌদি আরবে ১ হাজার ২৩০, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২৬৫, কুয়েতে ১০৭, ওমানে ৭০, কাতারে ৩৫, জর্ডানে ১৫ ও বাহরাইনে ৩১ জন বাংলাদেশি মারা গেছেন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে ৪৪৫, যুক্তরাজ্যে ৪১২, ইতালিতে ৩৫, দক্ষিণ আফ্রিকায় ৩০, লেবাননে ১৫, কানাডায় ৯, সুইডেনে ৮, ফ্রান্স ও স্পেনে ৭ জন করে, বেলজিয়ামে ৩, পর্তুগালে ২ এবং ভারত, মালদ্বীপ, কেনিয়া, লিবিয়া ও গাম্বিয়ায় ১ জন করে বাংলাদেশি মারা গেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় আবার সংক্রমণ বাড়তে থাকায় নতুন করে বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে।

এই মারা যাওয়া ২ হাজার ৭৩৫ জন প্রবাসীর লাশ বিদেশে দাফন করা হয়েছে। যুদ্ধে মারা গেলে যেমন দাফন হয় তারচেও নির্মম এই লাশ দাফনের প্রক্রিয়া কিন্ত কিছুই করার নেই। এরা অনেকে দেশে লাখ লাখ টাকা পাঠিয়েছে এতে পরিবার উপকৃত হওয়ার পাশাপাশি দেশও উপকৃত হয়েছে। এই টাকা দেশের উন্নয়নে এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে। আর মরে যাওয়ার পর ভিন্ন দেশের মাটি তাদের দেহ খেয়েছে।
(LinkedIn, amader shomoy)

সব্বাইকে মহান স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা

১৯৭১ থেকে ২০২১ এর ২৬ শে মার্চ-

মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস এর আজ সূবর্ণ জয়ন্তী। বাঙালি জাতির জীবনে অনন্যসাধারণ একটি দিন। বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগায় দিনটি। তাইতো স্বাধীনতার ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধের সূচনার এই সময়টি জাতি নিবিড় আবেগের সঙ্গে স্মরণ করে। স্বাধীনতা এক অমূল্য উপহার যা আমাদের দিয়েছে বীর স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম ও ৩০ লক্ষ শহীদের মহান আত্মত্যাগ এবং অযুত মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমাদের দেশ পেয়েছে একটি স্বাধীন লাল সবুজ পতাকা। স্বাধীনতার এই সুবর্ণ জয়ন্তীতে স্মরণ করি মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই সকল বীর সেনানীদের। তাঁদের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

স্বাধীনতা দিবসে আমরা কত আয়োজন করি। কিন্তু কজন জানি স্বাধীনতার মর্মকথা! নীচে স্বাধীনতা সম্পর্কিত কয়েকটি উক্তি উল্ল্যেখ করলাম যে গুলো আমাদের স্বাধীনতা কি তা উপলব্ধি করতে লেখায়।

“এই স্বাধীনতা তখনি আমার কাছে প্রকৃত স্বাধীনতা হয়ে উঠবে যেদিন বাংলার কৃষক মজুর ও দুঃখী মানুষের সকল দুঃখের অবসান হবে।”
-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

“এখন যদি কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ করতে চায়, তাহলে সে স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য মুজিব সর্বপ্রথম তার প্রাণ দেবে।”
-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

”স্বাধীনতা মানুষের প্রথম এবং মহান একটি অধিকার।“
– মিল্টন

“স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে মৃত্যু বরণ করা পরাধীনতায় সারাজীবন কাটানোর থেকে অনেক ভালো।’
– বব মার্লে

“আমি একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক এর চাইতে বড় গৌরব আর কিসে হতে পারে ?”
– জে. আর লাওয়েল।

“নিজের ইচ্ছামত বাঁচা ছাড়া স্বাধীনতার অর্থ আর কিই বা হতে পারে।”
– অ্যাপিকটিটাস।

“স্বাধীনতা ছাড়া একটি জীবন মানে আত্মা ছাড়া শরীর।”
– কাহলিল জিবরান।

“স্বাধীনতা একটি সুযোগর নাম যার মাধ্যমে আমরা যা কখনই হতে পারার কল্পনা করতে পারি না তা হতে পারি।”
– ড্যানিয়েল যে ব্রুস্টিন।

‘আমি তোমার কথার সাথে বিন্দুমাত্র একমত না হতে পারি, কিন্তু তোমার কথা বলার অধিকার রক্ষার জন্য আমি জীবন দেবো৷‘
– ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার।

“যখন সত্যকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয় না, স্বাধীনতা পূর্ণ হয় না।” – ভ্যাকলাভ হাভেল।

“স্বাধীনতার পক্ষে সবচেয়ে বড় হুমকি সমালোচনার অনুপস্থিতি।” – ওলে সোইঙ্কা।

“সত্যিকারের স্বাধীনতার জন্য আইন ও ন্যায়বিচারের শাসন এবং একটি বিচার ব্যবস্থা প্রযোজ্য, যেখানে অন্যের অধিকার অস্বীকার করে কারও কারও অধিকার সুরক্ষিত হয় না।” – জোনাথন স্যাকস।

“চিন্তার স্বাধীনতা ব্যতীত জ্ঞানের মতো কিছুই হতে পারে না – এবং বাকস্বাধীনতা ছাড়া জনস্বার্থের মতো কিছুই হতে পারে না।” – বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলি।

“যখন তাদের শাসনকর্তাদের লেনদেন তাদের কাছ থেকে গোপন রাখা যায় তখন কোনও মানুষের স্বাধীনতা কখনই ছিল না এবং কখনও নিরাপদ থাকবে না।” – প্যাট্রিক হেনরি।

“বেশিরভাগ মানুষ সত্যই স্বাধীনতা চায় না, কারণ স্বাধীনতার মধ্যে দায়বদ্ধতা জড়িত এবং বেশিরভাগ লোকেরা দায়বদ্ধতায় ভীত।”
– সিগমন্ড ফ্রয়েড।

“স্বাধীনতা মানুষের মনের একটি খোলা জানলা, যেদিক দিয়ে মানুষের আত্মা ও মানবমর্যাদার আলো প্রবেশ।”
– হার্বার্ট হুভার।

উপরের উক্তি গুলো আমরা সকলেই জানি বটে কিন্তু প্রায় কেউই মন থেকে বিশ্বাস করি না৷ স্বাধীনতা মানেই আমরা বুঝি স্বেচ্ছাচারিতা। ভিন্নমত মানেই আমাদের কাছে অপরাধ৷ আমরা শুধু সহমত সহ্য করি, ভিন্নমত নয়৷ ভিন্নমতের জন্য জীবন দেয়া তো দূরের কথা, সুযোগ থাকলে ভিন্নমতের জীবন নিতে চাই আমরা৷

সকলের প্রতি আহবান জানাই আসুন সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, মান-সম্মান যেন আরও বৃদ্ধি পায়, সব সময় যেন অক্ষুণ্ণ থাকে আমাদের পতাকার সম্মান, সকল ভেদাভেদ ভৃলে আজকের এই মহান দিনে সবাই মিলে নতুন সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার অঙ্গীকার গ্রহণ করি……
যে দেশে ঘৃণার কোন স্থান থাকবে না, ভালবাসাই হবে মানুষের একমাত্র ধর্ম….।

সব্বাইকে মহান স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা।

২৬ মার্চ থেকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ৫০ বছর ও মুজিব শতবর্ষ

161077528_

প্রতি বছরই মার্চ মাস আসে, মার্চ মাস গত হয়। কিন্তু আমার মন থেকে সেই ভয়াল মার্চ মাসের স্মৃতি মুছে যায় না। বলছি, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের কথা। যেই মার্চ মাস আমাদের পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতার সূচনালগ্ন। যেই মার্চমাস মুক্তির জন্য মুক্তিযুদ্ধ। যেই মার্চ মাস বাংলার মুক্তিকামী মানুষের মুক্তির সূচনালগ্ন। যেই মার্চমাস আমাদের জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার সূচনালগ্ন। আমি সেই মার্চ মাসের কথাই বলছি।

আমি তখন ৭/৮ বছরের নাবালক শিশু। নাবালক শিশু হলেও আমি তখন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। তখন আমার মোটা-মুটি ভালমন্দ বোঝা এবং স্মৃতিতে ধরে রাখার বয়স হয়েছিল। তাই প্রতিবছর জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি গত হয়ে যখনই মার্চ মাসের আগমন ঘটে, তখনই আমার স্মৃতিতে জমা থাকা সেই ভয়াল মার্চ মাসের কথা মনে পড়ে। আমার মনের টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে ওঠে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর লাগানো আগুনের লেলিহান শিখার কালো ধোঁয়া, আর সেই সময়ে খেয়ে-না-খেয়ে থাকার কষ্টের স্মৃতিগুলো।

তখন আমার বাবা আর বড়দা চাকরি করতেন নারায়ণগঞ্জে। আমি আর আমার চার বড়দি ও মা-সহ থাকতাম নোয়াখালীর গ্রামের বাড়িতেই। আমাদের বাড়িটা ছিল, নোয়াখালী বেগমগঞ্জ থানাধীন বজরা রেল স্টেশনের পশ্চিমে মাহাতাবপুর গ্রামে। আমাদের বাড়িটা ছিল মোটামুটি একটা বড়বাড়ির মতো। আমার বাপ-কাকারা ছিলো তিন-ভাই, আর বাবার জেঠাতো ভাই ছিলো দুইজন। এক বাড়ি হলেও সংসার ছিলো আলাদা-আলাদা ভাবে যারযার মতো। আমাদের বাড়ির ঘরগুলো ছিলো মাটি দিয়ে তৈরি, সেই মাটি আনা হয়েছিল চাটগাঁও (চট্টগ্রাম) থেকে গহনা নৌকা করে। সেজন্য আমাদের বাড়িটাকে সবাই নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় ‘মাইটগা দেলানওয়ালা বাড়ি’ নামেই চিনতো-জানতো।

আমাদের গ্রামে আমার বয়সী সব ছেলেদের মধ্যে আমি ছিলাম একটু দুষ্টু টাইপের। যেকোনো খেলাধুলায়ও ছিলাম সবার আগে সবার ওপরে। আমার স্মৃতিশক্তিও ছিলো খুবই প্রখর! তাই এখনো স্পষ্ট মনে আছে সেই মার্চ পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়ের কথা। মনে পড়ে আমার বয়স যখন ৭/৮ বছর, তখন-ই আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান ৭-মার্চ ঢাকার রেডক্রস ময়দানে দিয়ে দিলেন স্বাধীনতার ডাক, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে বললেন শত্রুর বিরুদ্ধে। এরপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা ২৫ মার্চ কালরাতে শুরু করে দেয় নির্বিচারে গণহত্যা। জ্বালাও পোড়াও আর লুটতরাজের মতো ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড। তখন আমি কেবলমাত্র তৃতীয় শ্রেণি পাস করে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া শুরু করেছিলাম। সেই ভয়াল অগ্নিঝরা মার্চে ১৯৭১ এর কথা এখনো মনে পড়লে শরীর শিউরে ওঠে।

162196494_

সে সময় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ও তাদের দোসররা নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। এ হত্যাযজ্ঞে কতজন বাঙালি নিহত হন, তা নির্ধারণে কোনো সঠিক জরিপ পরিচালিত হয়নি; তবে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এক হিসাব অনুযায়ী নিহতের সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ ধরা হয়। বলা হয় পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক এই গণহত্যা ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের অন্যতম। যাই হোক, এবার আমার জানা আর আমার নিজ চোখে দেখা কিছু স্মরণীয় ঘটনায় আসা যাক।

সে সময় আমার মা স্বামী সন্তানের চিন্তায় পাগলের মতো হয়ে সকাল-সন্ধ্যা ঘুরে বেড়াতো গ্রামের বড়বাড়িতে রেডিওর খবর শোনার জন্য। তখন আমাদের গ্রামে শুধু বড়বাড়িতেই একটা ওয়ান বেন্ডের রেডিও ছিল, টেলিভিশন তো কি জিনিস তা মানুষ বুঝতোই না। গ্রামের মানুষের মনে তখন শুধু আতঙ্ক আর ভয়! কখন যেন শুরু হয়ে যাবে জ্বালাও পোড়াও। এদিকে পাক-হানাদার বাহিনী সারাদেশ রক্তাক্ত করে ফেলছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে খবরও আসতে শুরু করছিল। আমার মায়ের কান্না আরও ভারী হতে শুরু করলো, স্বামী আর সন্তানের জন্য। সেসময় আমার তিন বোন ছিল বিয়ের উপযুক্ত, তাদের নিয়েও আমার মায়ের চিন্তার কোনও কমতি ছিল না। সারাদিন আমার বোনদের চোখে-চোখে রাখলেও রাতে রাখতো ঘরে কাঁড়ের ওপরে, নাহয় ঘরের বাইরে সুপারি বাগানে মাটির নিচে। পাকিস্তানি মিলিটারি আর দেশীয় রাজাকারদের ভয়ে আমার মা আর আমার তিন বোন মিলে গোপনে সুপারি বাগানের মাঝখানে মাটি খুঁড়ে বাংকারের মতো তৈরি করেছিল। যাতে দেশীয় আল-বদরদের থেকে ইজ্জত বাঁচতে পারে। এমনভাবে বাংকার তৈরি করেছিল যে, আমার তিন বোন দলাদলি করে ওই বাংকারে শুয়ে থাকতে পারতো। বাংকারের উপরে বাঁশের চটি বিছানো থাকতো। চটির উপরে থাকতো মাটি আর ছড়ানো-ছিটানো গাছের লতা-পাতা। যাতে অপরিচিত কেউ দেখেও বুঝতে না পারে যে, এটা বাংকার।

এভাবে চলতে-চলতে কেটে গেল প্রায় দুই মাস, এরপর হঠাৎ একদিন বাবার আগমন। ঠিক সকালবেলা সবার অজান্তে বাবা বাড়িতে এসে হাজির। বাবার ক্লান্ত শরীরে ময়লা জামাকাপড়। বাবাকে দেখে আমার তিন বোন আর আমি খুশিতে দৌড়ে গিয়ে বাবাকে ঝাপটে ধরলাম। কিন্তু আমার মা’ তেমন খুশি হতে পারেনি, বড় ছেলেকে সাথে না-দেখে। আমার মা’ আমার বাবাকে বলছিল, “আমার নিমাই কোথায়” মায়ের কথা শুনে বাবার কোনো কথা নেই। বোবা যেন হয়ে গেছে। তখন বাড়ির সবাই বাবাকে জিজ্ঞেস করলো, “নিমাই কোথায়?” বাবা শুধু এইটুকুই বললো যে, জানিনা। তবে শুনেছি ও-নাকি শরণার্থী হয়ে ভারত চলে গেছে। বাবার কথা শুনে তখন বাড়ির সবাই আমার মাকে সান্তনা দিচ্ছিল, আর কান্নাকাটি না-করতে। তারপরও আমার মায়ের কান্নাকাটি থামছিল না।

এদিকে বাবা নারায়ণগঞ্জ থেকে এসেছিল একেবারে খালি হাতে। সাথে তেমন কোনও টাকাও আনতে পারেনি। সংসারে পাঁচজন খানেওয়ালা, জামাকাপড় বাদ দিলেও খাওয়ার খরচ কম নয়। তখন আমার বাবার মনের অবস্থা আমি দেখেছি। বাবা পাগলের মতো হয়ে কাজের সন্ধানে গ্রামের বাড়ি-বাড়ি ঘুরে বেড়াতো। কিন্তু তখন আমার বাবাকে কাজ দিবে কে? সবারই একই অবস্থা! সবার মনে তখন শুধুই আতঙ্ক, কখন কি যেন হয়ে যায়! তারপরও অনেক কষ্ট করে কিছু টাকা সংগ্রহ করে যুদ্ধের পুরোটা সময় বাবা মুড়ির ব্যবসা করে সংসারের চার-পাঁচজনের মুখের আহার জুগিয়েছিল। তারপরও কোনোকোনো দিন তিন বেলার মধ্যে দু’এক বেলা না খেয়েই থাকতে হতো।

আমাদের বাড়ি থেকে দেখা যেতো মার্চের শেষ থেকে পাকবাহিনীর তাণ্ডবলীলা শুরু হওয়ার পর থেকে রাতের-বেলায় আমাদের বাড়ি থেকে দেখা যেতো বজরা বাজারের দোকানগুলিতে লাগানো আগুনের লেলিহান শিখা, আর সাদাকালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী। এসব দৃশ্য দেখে মনে হতো, হানাদার বাহিনী যেন আমাদের গ্রামের আশেপাশেই অবস্থান করছে। এই যেন কারো-না-কারোর বাড়িতে হানা দিচ্ছে। তবে মহান সৃষ্টিকর্তার কৃপায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমাদের গ্রামে পাক-হানাদার বাহিনী প্রবেশ করতে পারেনি। দেশীয় আল-বদর রাজাকার বাহিনীও তেমন কোনও ক্ষতি করতে পারেনি। পারেনি মুক্তিযোদ্ধাদের কারণে।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার দুই মাস পরই আমাদের গ্রামে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা গ্রাম ও গ্রামের নিরীহ মানুষদের বাঁচানোর জন্য সর্বক্ষণ টহল দিতে থাকে। গ্রামের সব বাড়ি থেকে আমাদের গাড়িটিই ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের বেশি পছন্দের। কারণ, আমাদের গ্রামে প্রবেশ করতে হলে প্রথমেই আমাদের বাড়ি পাশ দিয়েই প্রবেশ করতে হবে। মানে আমাদের বাড়িটা ছিলো গ্রাম ঢোকার প্রবেশদ্বার। তাই মুক্তিযোদ্ধার সকাল থেকে রাতদুপুর পর্যন্ত আমাদের বাড়ির উঠানে বসে আমার বড় জেঠার সাথে আলাপ-আলোচনা করতো। চলতো চা-পানের আয়োজন। আমাদের বাড়িতে সে সময়কার মুক্তিযুদ্ধের নিয়ে নিত্যদিনের চা-পানের আয়োজনে আমি সঙ্গী হয়ে। বয়সে ছিলাম খুবই ছোট, তবুও তাদের চারপাশে সর্বক্ষণ ঘুরে বেড়াতাম।

এভাবে চলতে চলতে একসময় পাক-হানাদার বাহিনী ও দেশীয় আল-বদরদের পরাজয়ের ঘণ্টা বেজে ওঠতে শুরু করলো। নভেম্বর গত হয়ে যখন ডিসেম্বরের আগমন ঘটলো, সেসময় পাক-হানাদার বাহিনী ও দেশীয় আল-বদর রাজাকার বাহিনীরা আরও হিংসাত্মক হতে লাগলো। কিন্তু শত প্রাণপণ চেষ্টা করেও পাক-হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার আল-বদর বাহিনীরা কুল-কিনারা পাচ্ছিল না। শেষ অবধি ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে পরাজয় বরণ করে ভারতীয় সেনা ও মুক্তিযুদ্ধের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। সেই থেকে গত গেলো ৪৯ বছর! এখন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ঝাঁপিয়ে পড়া বীর মুক্তিযুদ্ধের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ৫০ বছর ও মুজিব শতবর্ষ।

১৭ মার্চ ২০২০: সংক্ষিপ্ত মুজিবনামা

resize

আজ হতে ঠিক একশত বছর আগে
শেখ লুৎফুর রহমান এবং সায়েরা খাতুনের
ঘর আলোকিত করে
তুমি এসেছিলে এই বাংলায়
মধুমতী নদীর তীরে
গোপালগঞ্জের টুঙ্গি পাড়ায়।

উনিশ্য তেত্রিশ সালে বিয়ে আর
বিয়াল্লিশ সালে ম্যাট্রিকুলেশন,
তেতাল্লিশ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিমলীগের কাউন্সিলর
আর ছিচল্লিশ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক-
ঠিক তখোনি কুখ্যাত “ক্যালকাটা কিলিং” সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু;
তুমি জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলে
রক্ষা করেছিলে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের নিরীহ মানুষদের,
কে জানতো তখন, তুমিই হবে বাঙালি জাঁতির পিতা।

উনিশ্য সাতচল্লিশে ভারত এবং পাকিস্তানের পাশাপাশি
তৃতীয় রাষ্ট্র হিসেবে স্বতন্ত্র স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য
সোহরাওর্দীর সাথে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলে তুমি,
আটচল্লিশ সালে ঢাকা ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগে ভর্তি এবং
ওই বছরই “রাষ্ট্রভাষা উর্দুকে মেনে নিতে হবে” – খাজা নাজিমুদ্দিনের
এই ঘোষণার বিরুদ্ধে তৈরি করেছিলে “সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ”-
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ধর্মঘট পালনকালে সচিবালয়ের সামনে বিক্ষোভরত অবস্থায় তোমাকে গ্রেফতার করা হয়-
আটচল্লিশ সালেই “ছাত্রলীগ” এবং ঊনপঞ্চাশ সালে “আওয়ামীলীগ” প্রতিষ্ঠা করেছিলে।

উনিশ্য বাহান্ন সালে আবার খাজা নাজিমুদ্দিনের ঘোষণা ” একমাত্র উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা”
২১ ফেব্রুয়ারীর ওই দিনে তুমি ছিলে জেলে বন্দি কিন্তু তোমার তৈরি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি নিয়ে একশ চুয়াল্লিশ ধারা ভেঙে মিছিল নিয়ে অগ্রসর হলে
মিছিলের ওপর নির্বিচারে গুলিতে রফিক বরকত সালাম’রা শহীদ হলে
জেলের ভেতরেই আমরণ অনশন শুরু করেছিলে,
অবশেষে ২৭ ফেব্রুয়ারীতে মুক্তি পেয়েই চীনের শান্তি সম্মেলনে গিয়ে বাংলায় বক্তৃতা
দিয়ে ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে গিয়েছিলে বৈশ্বিক অঙ্গনে।

উনিশ্য চুয়ান্ন সালে পুর্ব পাকিস্তানের সাধারন নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সংখ্যা গরিষ্ট আসন
পেলেও কেন্দ্রীয় পাকিস্তান প্রহসনের “ভারত স্বাধীনতা আইন” প্রয়োগ করে
যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রীসভা ভেঙে দিয়ে বাঙালি জাতিকে করেছিলো বঞ্চিত।

উনিশ্য ছাপ্পান্ন সালে মাত্র নয় মাস পর মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিয়েছিলে
বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য।
উনিশ্য আটান্ন সালে আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে
সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করে তোমাকে একের পর এক
মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করে ১৪ মাস পর মুক্তি দিয়ে সেদিনই আবার
জেলগেট থেকে গ্রেপ্তার করেছিলো।

উনিশ্য একষট্টি সালে “স্বাধীন বাংলা বিল্পবী পরিষদ”
বাষট্টি সালে “জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট” এবং
চৌষট্টি সালে “কম্বাইন্ড অপজিশণ পার্টি” গঠন করেছিলে।

উনিশ্য ছিষট্টি সালে ছয় দফা দাবি উত্থাপন করে
পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের শেকড়ে
করেছিলে কুঠারাঘাত।
আটষট্টি সালে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ” রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব” দায়ের করে আইয়ুব সরকার।

উনসত্তর সালে দেশব্যপী টানা গণআন্দোলনের মুখে
আইয়ুব সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সকল বন্দিদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
একই বছরে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তোমাকে “বঙ্গবন্ধু” উপাধিতে ভূষিত করে,
ওই বছরেই তুমি পুর্ব পাকিস্তানের নাম দিয়েছিলে “বাংলাদেশ”।

উনিশ্য সত্তর সালের সাধারণ নির্বাচনে তুমি আওয়ামীলীগের প্রতীক নৌকা বেছে নিয়েছিলে
মাত্র দুটি আসন বাদে সব আসনেই তুমি জিতেছিলে,
কিন্তু উনিশ্য একাত্তর সালে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শুরুর মাত্র দুই দিন আগে
পহেলা মার্চে ইয়াহিয়া অনিদৃষ্ট কালের জন্য অধিবেশন বন্ধ করে দেয়।
মার্চ হয়ে ওঠে উত্তাল, সর্বস্তরের বাঙালি রাস্তায় নেমে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে,
অতঃপর এলো সেই সাতই মার্চ, রেসকোর্সের ময়দান পরিণত হলো জনসমুদ্রে,

পৃথিবী কেঁপে উঠলো তোমার বজ্র কণ্ঠের আওয়াজেঃ
“আর যদি একটা গুলি চলে-
আর যদি আমার লোকদের উপর হত্যা করা হয়-
তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইলো-
প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তলো-
তোমাদের যা কিছু আছে-
তাই নিয়ে-
শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে”
বিশ্বের হাজার কোটি কর্ণকুহরে পৌঁছেছিলো তোমার প্রদীপ্ত কন্ঠঃ
“তেইশ বছরের করুণ ইতিহাস-
বাংলার অত্যচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস
তেইশ বছরের ইতিহাস-
মুমুর্ষ নরনারীর আর্তনাদের ইতিহাস
বাংলার ইতিহাস-
এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস”

সাত কোটি বাঙালির মনে জাগ্রত হয়েছিলো দুর্বার অদম্য সাহসী শক্তি
সেই সাহসী শক্তি পরিণত হয়ে হয়েছিলো অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার এক প্রলংকারী মহাশক্তি
পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী পরাজিত হলো মুক্তিবাহিনীর কাছে
জেগে উঠলো স্বাধীন বাংলার নতুন সূর্য
তৈরি হলো স্বাধীন বাংলা, বাঙালি জাতি এবং জাতীয়তা
সেই থেকে তুমি আছো, তুমি থাকবে চিরকাল হে বাঙালি জাতির পিতা।

ঐতিহাসিক ৭ মার্চ আজ

158082235_k,

🇧🇩 আজ ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। বাঙালি জাতির স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা অবিস্মরণীয় গৌরবের এক অনন্য দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক উত্তাল জনসমুদ্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক দিয়ে বলেছিলেন, ‘…বাঙালি মরতে শিখেছে, তাদের কেউ দাবাতে পারবে না। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

২০১৭ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর এই তেজোদীপ্ত ঘোষণাই ছিল আমাদের স্বাধীনতার ভিত্তি। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের শত নিপীড়ন উপেক্ষা করে বীর বাঙালির অস্ত্র ধারণের পূর্বে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে এদিনই স্বাধীনতার ডাক দেওয়া হয়। এরপরই দেশের মুক্তিকামী মানুষ ঘরে ঘরে চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। একপর্যায়ে দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে।

৭ই মার্চ সকাল থেকেই চারদিক থেকে মানুষের ঢল নামে রেসকোর্স ময়দানে। ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে ময়দান। বেলা ঠিক সোয়া ৩টায় সাদা পাজামা-পাঞ্জাবির ওপর মুজিবকোর্ট পরিহিত বঙ্গবন্ধু যখন মঞ্চে ওঠেন, তখন বাংলার বীর জনতা বজ্রনির্ঘোষে করতালি ও স্লোগানের মধ্যে তাকে স্বাগত জানান। এরপর বঙ্গবন্ধু ২২ মিনিট তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম ও ঐতিহাসিক ভাষণ শুরু করেন এভাবে—‘ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।… আজ বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ অধিকার চায়।’ এরপর গত কয়েক দিনের ঘটনাবলি, শাসক শ্রেণির সঙ্গে আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়া এবং মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় বাঙালির দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু পরবর্তী আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি ভাষণে বলেন, …‘এরপর যদি একটি গুলি চলে, এরপর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।…. সৈন্যরা তোমরা ব্যারাকে থাকো, তোমাদের কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু আর তোমরা গুলি করার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।’

বঙ্গবন্ধু যখন এ ভাষণ দিচ্ছিলেন, ঠিক ঐ দিনই ঢাকায় এসে পৌঁছান জেনারেল টিক্কা খান ও রাও ফরমান আলী। আলোচনার অন্তরালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সামরিক প্রস্তুতির এই পর্যায়ে এ ভাষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করে। সেদিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দেশের জনগণকে দারুণভাবে আন্দোলিত করে। এই একটি ভাষণেই নিরস্ত্র বাঙালিকে সশস্ত্র জাতিতে পরিণত করেন বঙ্গবন্ধু। তাই ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ আমাদের প্রেরণার চিরন্তন উত্স হয়ে থাকবে।

আমার ভাষা আমার অহংকার

28061699_1

“বিদ্যাপতি, চণ্ডী, গোবিন, হেম, মধু, বঙ্কিম, নবীন
ঐ ফুলেরই মধুর রসে বাঁধলো সুখে মধুর বাসা।।
আ মরি বাংলা ভাষা!”

বাংলা আমার মাতৃভাষা। এই মাতৃভাষা নিয়ে আমি গর্বিত, কেননা এই ভাষার রয়েছে গৌরবময় ঐতিহ্য। জনসাধারণের কথ্য ভাষা থেকে এই ভাষার জন্ম। বাংলা ভাষার ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায়, এটি জন্মলগ্ন থেকেই কথ্য ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে এ ভাষা প্রথম ব্যবহৃত হয়। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ’। লিখিত সাহিত্য ছাড়া প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা লোকসাহিত্য তথা প্রবাদ প্রবচন, ছড়া, রূপকথা, পাঁচালী, লোকগাঁথা ইত্যাদিতে বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। মূলত সাহিত্যের বাহন হিসেবে বাংলা ভাষা প্রাচীন, মধ্য এবং আধুনিক যুগে ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হয়েছে। ১৯৪৭ এর দেশভাগের সময় অবিভক্ত বাংলা পূর্ব ও পশ্চিম ভাগে বিভক্ত হয়ে একটি ভারত অপরটি পাকিস্তানের অংশ হয়ে উঠে।

ফাগুনের এমনই শিমুল, পলাশ ফোঁটা দিনে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে শহীদ হয়েছেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার এবং নাম না জানা আরো অনেকে। বাঙালির রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল। সেই অমর শহীদদের স্মরণে আমাদের প্রাণে বারবারই বেজে ওঠে গানের একটি কলি …
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কী ভুলিতে পারি।”

সাধারণভাবে ভাষা আন্দোলন বলতে আমরা ১৯৫২ সালের আন্দোলনকে বুঝি; যা শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সাল থেকে। এই ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে অনেক কবিতা, গল্প-উপন্যাস, নাটক এবং প্রবন্ধ-নিবন্ধ। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে সর্বপ্রথম কবিতা রচনা করেন চট্টগ্রামের ‘সীমান্ত’ পত্রিকার সম্পাদক মাহবুবুল আলম চৌধুরী। তার কবিতার নাম…

“কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি।”

ঢাকায় পুলিশের গুলি চালানোর খবর একুশে ফেব্রুয়ারির বিকালে চট্টগ্রামে পৌঁছালে এই কবিতাটি সন্ধ্যার মধ্যেই রচিত হয়। সেই রাতেই কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসে কবিতাটি ছাপানো হয়। পরের দিন বাইশে ফেব্রুয়ারি লালদীঘির ময়দানে আয়োজিত বিশাল প্রতিবাদ সভায় ওই ‘কাব্যপুস্তিকা’ বিলি করা হয় এবং কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনানো হয়। সেই সময়ের সরকার এক আদেশবলে কবিতাটি প্রায় সাথে সাথে বাজেয়াপ্ত করে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন-
“বাংলা শিক্ষা যখন বহুদূর অগ্রসর হইয়াছে তখন আমরা ইংরেজি শিখিতে আরম্ভ করিয়াছি।”

কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন-
“আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি এমনই হউক, যাহা আমাদের জীবন শক্তিকে ক্রমেই সজাগ, জীবন্ত করিয়া তুলিবে।”

শৈশবে স্বপ্ন দেখেছি যে ভাষায় কৈশোরে কল্পনার মায়াজাল বুনে এই পৃথিবীকে রঙিন করে দেখেছি যে ভাষার আলেখ্যে, সে ভাষা আমাদের বাংলা। স্মরণ করি তাদের, যারা আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের জন্য জীবন দিয়ে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন। পরিশেষে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই তাদের যারা বহুদুরে থেকেও বাংলা ভাষার দাবীতে অনড় থেকেছেন। ক্যানাডার ভ্যানকুভার শহরে বসবাসরত দুই বাঙালী রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব এর কাছে ১৯৯৮ সালে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিনটি জাতিসংঘের সদস্যদেশ সমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে শুধু আমার ভাষাকেই নয়, পৃথিবীর সমস্ত মাতৃভাষাকেই শ্রদ্ধা জানাই…

আ-মরি বাংলা ভাষা আহারে মোঃ আলি জিন্নাহ

20210221

রাজনৈতিক নেতারা একরোখা স্বভাবের হয় তাই মোঃ আলি জিন্নাহ হতে আজকে আধুনিক বাংলাদেশের নেতারাও এইটা ছাড়তে পারে নাই। ৫২তে যদি জিন্নাহ বলতো, যে রাজ্যে যে ভাষা আছে তারই চর্চা হবে তবে ইংরেজি হবে প্রধান ভাব প্রকাশের মাধ্যম। তখন আর গরিব বাঙ্গালী মরতো না। এখন আর ধনী বাঙ্গালীদের সন্তান বিদেশে জন্ম নিয়ে বাংলা ভুলতো না। এই প্রজন্মকে বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি, আরবী, ফরাসি ভাষাও শিখা দরকার।

আজকে যেসব রাজনৈতিক নেতা একদল কর্মী নিয়ে ভোরে শহীদ মিনারে ফুল দিতে গিয়েছে ওইসব নেতাদের শতকরা নব্বইজন লোকের সন্তান বিদেশে বাংলা ব্যতীত অনন্ত তিন চারটা ভাষায় পারদর্শী। আর নেতার পিছনে ভেড়ার পাল বাঃ বাঃ করে জীবন দিতেছে। কর্মীগণ এতই উম্মাদ যে মঞ্চে হিন্দি গানের তালে তালে আজ কোমর নাচাবে। এই কর্মী অনেকে আরবী না জানার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে ভালো কাজ পাবে না। এই কর্মীর অনেকে ইংরেজি না জানার কারণে উন্নত দেশে পড়তে গিয়ে বেগ পাবে। বহু দেশে ফরাসি ভাষা চলে বলে কাজ করতে গিয়ে হা করে থাকবে।

নেতারা কর্মীর আবেগে এমপি মন্ত্রী হবে বিদেশে টাকা পাঠাবে নিরাপদ ও বিলাসী জীবনে তাঁদের পরিবার কাটাবে। আজ ব্লগ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলা ভাষা নিয়ে এত পোষ্ট যে শুদ্ধ বাংলা লজ্জা পাচ্ছে। ধর্ম, জ্ঞান, বিজ্ঞান ও কর্মের জন্য সব ভাষার দরকার। তাই নতুন প্রজন্ম তোমরা মাতৃ ভাষার সাথে সাথে দরকারি ভাষাটাও শিখবে। ভারতে হিন্দি ভাষা প্রধান হলে বহু ভাষার দেশ ভারত তেমনি পাকিস্তানে উর্দু প্রধান হলেও বহু ভাষার দেশ পাকিস্তান। শ্রীলংকা ও নেপালে ইংরেজি সর্বাধিক গুরুত্ব পাচ্ছে। আমরা বাংলা ইংরেজি মিক্স করে বলে নতুন ভাষা সৃষ্টি করি।

শ্রীশ্রী সরস্বতী পূজা ও আমাদের কামনা-বাসনা

images-3

শ্রীশ্রী সরস্বতী পূজা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎসব। এটিকে আবার বিদ্যাদেবী ও বসন্তপঞ্চমী পূজাও বলা হয়ে থাকে। প্রতিবছর বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী মাঘ মাসের পঞ্চমী তিথিতে পালিত হয় বিদ্যার দেবী সরস্বতী পূজা। কিন্তু এবার সরস্বতী পূজা মাঘমাস পেরিয়ে ফাল্গুনী ঋতুরাজ বসন্তের বসন্তপঞ্চমীতে হচ্ছে।

এর কারণ হলো এ-বছর বাংলা আশ্বিন মাস ‘মলমাস’ ছিলো। হিন্দু শাস্ত্রমতে মলমাসে কোনো দেব-দেবীর পূজার্চনা হয় না। যে-কারণে এবার দুর্গাপূজাও কিন্তু গতবারের চেয়ে অন্তত ২০-২৫ দিন পরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আর শ্রীশ্রী সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, ৩০ জানুয়ারি ২০২০, রোজ বৃহস্পতিবার (১৭ মাঘ ১৪২৬ বাংলা)। ওই কারণেই এবার সরস্বতী পূজাও মাঘ পেরিয়ে ঋতুরাজ বসন্তের শুরুতেই হচ্ছে। এমনিতেই সরস্বতী পূজার এই বিশেষ দিনটি বসন্ত পঞ্চমী ছাড়াও শ্রী পঞ্চমী এবং সরস্বতী পঞ্চমী নামেও সুপরিচিত। হিন্দু পুরাণ অনুসারে সরস্বতী হলো জ্ঞান, বিদ্যা, সঙ্গীত ও শিল্পকলার অধিষ্ঠাত্রী দেবী।

প্রতিবছরের মতো এবারও নারায়ণগঞ্জ-সহ সারাদেশে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বিদ্যাদেবী শ্রীশ্রী সরস্বতী পূজা। এই বছর ১৬ ফেব্র‌ুয়ারি পালিত হবে সরস্বতী পূজা। সরস্বতী পূজার সময় পড়েছে ১৬ ফেব্র‌ুয়ারি সকাল ৬টা ৫৯ মিনিট থেকে শুরু হয়ে বেলা ১২টা ৩৫ মিনিট পর্যন্ত। পূজার সময় হাতে থাকবে মোট ৫ ঘণ্টা ৩৭ মিনিট। এই সময়ের মধ্যেই বিদ্যাদেবী শ্রীশ্রী সরস্বতী পূজার কাজ সম্পন্ন করতে হবে।

কথায় আছে, “হিন্দুদের বারোমেসে তেরো পার্বণ।” এই তেরো পার্বণ বা পূজার মধ্যে শ্রীশ্রী সরস্বতী পূজা হলো একটি। এটিকে বিদ্যাদেবীর পূজাও বলে থাকে। সরস্বতী পূজা হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বিদ্যা লাভের আশায় সরস্বতী পূজা করে থাকে। দেবীর এক হাতে বীণা থাকার কারণে, এটিকে সংগীত দেবী বা বীণাপাণিও বলে থাকে। শাস্ত্রমতে সরস্বতী শব্দটির অর্থ, ‘সতত রসে সমৃদ্ধা’। তিনি শুক্লবর্ণা, শুভ্র হংস বাহনা। ‘বীণা-রঞ্জিত পুস্তক হস্তে।’ অর্থাৎ এক হাতে বীণা ও অন্য হাতে পুস্তক।

সেগুলোর রহস্য তথা যথার্থ তাৎপর্য হৃদয়ে ধারণ করেই, সরস্বতী দেবীকে পূজা করা হয়। নয়তো পূজার্চনা যতই হোক না কেন, তা অর্থহীন হয়েই থেকে যায়। শিক্ষার্থীরা বিদ্যাদেবী সরস্বতীর পূজা বেশি করে থেকে এবং প্রায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই সরস্বতী দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই সরস্বতী পূজার দিনেই অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী পরিবারের শিশুদের হাতেখড়ি দেওয়া হয়। এই নিয়মটি প্রাচীন আমলেও ছিল, এখনো কিছু কিছু অঞ্চলে এই নিয়ম আছে বলে মনে করা হয়।

তবে সরস্বতী পূজা শুধু শিক্ষার্থী আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ থাকে না। এই সরস্বতী দেবী বা বিদ্যাদেবীর পূজা, প্রতিটি গ্রামে, প্রতিটি মহল্লায়, প্রতিটি শহরের আনাচে-কানাচেই হয়ে থাকে। কারণ, সরস্বতী দেবী বা বিদ্যাদেবী হলেন, জ্ঞানদায়িনী দেবী সরস্বতী। তিনি বিদ্যা জ্ঞান দানকারী দেবী। তিনি মর্তলোকে সকলকে বিদ্যা আর জ্ঞান দান করেন। তাই মানুষ বিদ্বান আর জ্ঞান লাভের আশায় সরস্বতী দেবী বা বিদ্যাদেবীর পূজা করে থাকেন। মানুষ কালেকালে, যুগেযুগেই জ্ঞান পিপাসু। মানুষ জ্ঞানের সন্ধানে সর্বদাই ব্যস্ত থাকে। জ্ঞান লাভের জন্য মানুষ পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে, এরেক প্রান্তে ঘুরে বেড়ায়। তারজন্য হওয়া চাই শ্রদ্ধাবান, নিষ্ঠাবান ও সৎ চরিত্রের অধিকারী।

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় বর্ণিত আছে, ‘শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞানং তৎপরঃ সংযতেন্দ্রিয়’। (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-৪/৩৯)।

অর্থাৎ শ্রদ্ধাবান ব্যক্তিই জ্ঞান লাভ করে থাকেন। শ্রদ্ধা ছাড়া ভক্তি, জ্ঞান, শিক্ষা সবই মিছে।

যার জ্ঞান নেই, তার ভক্তি-শ্রদ্ধাও নেই। তাই শ্রদ্ধাবোধ গড়ে তোলার জন্য পারিবারিক শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি মানুষের জন্মের পর থেকেই শুরু হয় শিক্ষা-দীক্ষার কলাকৌশল। সেজন্য ছোটবেলা থেকেই পিতামাতা সহ বড় ভাই-বোনরা ছোটদের ধর্মীয় আচার-আচরণের শিক্ষা দিয়ে থাকে। আর এই কলাকৌশলগুলো পরিবারের বড়দের কাছ থেকেই প্রতিটি শিশু শিখে থাকে। তা সে যেই ধর্মের অনুসারীই হোক। তাই প্রতিদিন সকালবেলা দেখা যায়, ছোটছোট ছেলে-মেয়েরা ধর্মীয় বই নিয়ে চলে যায় মক্তবে। কেউ যায় মন্দিরে। কেউ যায় গির্জায়। কেউ আবার চলে যায় বৌদ্ধ মন্দিরে। কেউ চলে যায় স্কুলে বা পাঠশালায়। এই চলা শুধু ধর্মীয় শিক্ষা আর জ্ঞান অর্জনের জন্যই ছুটে চলা।

হিন্দু ধর্মের ছোটদের ধর্মীয় শিক্ষা লাভের পাশা-পাশি সু-শিক্ষায় শিক্ষিত হবার জন্যই শ্রীশ্রী সরস্বতী দেবীর পূজা। পূজার আগের দিন সংযম পালন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম একটি শিক্ষা। তা কিন্তু এই ডিজিটাল যুগে অনেকেই মেনে চলে না। আর বড়রাও এ বিষয়ে শিশুদের শেখায় না। শত ব্যস্ততার মাঝে ধর্মীয় আচার-আচরণ, নিয়ম-কানুন শেখানোর সময়ও পান না। সবাই নিজেদের সুখ-শান্তি লাভের আশায়ই সদা ব্যস্ত থাকে। এটা খুবই দুখের বিষয়।

ছোটবেলা দেখতাম, মা এবং বড়দি’রা সরস্বতী পূজার তিন-চারদিন আগে থেকেই বলতো, ‘অমুক তারিখে সরস্বতী পূজা। পূজার আগের দিন রাতে খাবে, পরদিন পূজায় অঞ্জলি দেওয়ার আগ পর্যন্ত কিছুই খেতে পারবে না।’
বড়দি’রা পূজার দিন ভোরবেলা কলাপাতা, তালপাতা, আর বাঁশের কঞ্চির কলম বানিয়ে রাখতো। সাথে তুলে রাখতো ফুল, তুলসী পাতা, দুর্বা। তৈরি করে রাখতে শ্বেত চন্দন বাটা। সরস্বতী পূজার একটি বিশেষ অর্য্য হল পলাশ ফুল। দেবীর অঞ্জলির জন্য এটি একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। পুরো গ্রামে ঘুরে ঘুরে এই ফুলটিও সংগ্রহ করে রাখতো। কালির দোয়াতে ভরে রাখতো গঙ্গাজল মিশ্রিত দুধ। দুধ মানে, লেখবার কালি। লিখে দিবেন পূজা মণ্ডপের পুরোহিত। পূজামণ্ডপে সরস্বতী দেবীর চরণতলে দিয়ে রাখতেন পড়বার বই। গ্রামের সব শিক্ষার্থীদের কারিকারি বইয়ে ছেয়ে যেত সরস্বতী দেবীর পূজামণ্ডপ। সেই বইগুলোতে পুরোহিত ফুলচন্দন দুর্বা ছিটিয়ে দিতেন। এটাই হলো শিক্ষার্থীদের জন্য বিদ্যাদেবী বা সরস্বতী দেবীর আশীর্বাদ। অঞ্জলির সেই ফুল দুর্বা আর তুলসীপাতা বইয়ের ভেতরে রেখে দিতো। তা একবছর পর্যন্ত প্রতিটি পাঠ্যবইয়ের ভেতরেই থাকতো। পূজায় অঞ্জলি অর্পণের আগপর্যন্ত ছেলে-বুড়ো সবাইকে উপবাসই থাকতে হতো।

এখন আর সেসব নিয়ম, আচার-আচরণ চোখে পড়ে না। অনেকেই সেসব নিয়ম পালন করে না। অনেক শিক্ষার্থী নিয়ম করে সরস্বতী দেবীর পুজায় অঞ্জলিও অর্পণ করে না বা দেয় না। শুধু পূজার দিন দেবী মূর্তি বা প্রতিমার সামনে গিয়ে দু’হাত জোড় করে প্রণাম করে। আর পূজা শেষে সন্ধ্যার পর পূজামণ্ডপে আধুনিক সাজে সজ্জিত হয়ে নৃত্য করে, নাচে। ভক্তি যদি না থাকে নেচে সিদ্ধি লাভ হবে না। বরং পাপের ভাগই বেশি হতে হবে।

তাই বলছি, প্রতিটি শিশুকে বাল্যকাল থেকেই ধর্মীয় আচার-আচরণের শিক্ষা দেয়া প্রয়োজন। সনাতন ধর্মাবলম্বী ছোটদেরকে ধর্মীয় চেতনা দান করার জন্য শ্রীশ্রী সরস্বতী পূজা অন্যতম একটি ধর্মীয় উৎসব। কেননা, পূজার আগের দিন সংযম পালন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের গভীর শিক্ষা দেয়। শ্রীশ্রী সরস্বতী পূজায় সংযমের দিন মাছ-মাংস পরিহার, নিরামিষ আহার, আতপ চালের ভাত খাওয়া, আর উপোস থাকতে হয়। খুব সকালবেলা স্নান করে নতুন জামাকাপড় পরিধান করতে হয়। সরস্বতী দেবীর পূজা শুরুতে অঞ্জলি অর্পণের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। পুরোহিত সরস্বতী দেবীর ঢাকা মুখখানি উম্মুক্ত করেন। অঞ্জলি দেওয়ার জন্য সারিবদ্ধভাবে বসতে বলেন। তারপর সবাইকে সরস্বতী দেবী পূজায় পুষ্পাঞ্জলি দিতে হয়। পুষ্পাঞ্জলি অর্পণে হয় আনন্দঘন এক আয়োজন! সবাই সরস্বতী দেবী বা বিদ্যা দেবীর প্রতিমার সামনে লাইন ধরে বসে অঞ্জলি অর্পণ করে। আর এ সময়ই একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী তথা কোমলমতি শিক্ষার্থীও ধর্মীয় চেতনা পেয়ে থাকে।

লক্ষ্য করা যায় আমরা বড়রা ছোটরা সবাই প্রতিমায় ভক্তি নিবেদন করি। কিন্তু প্রতিমা প্রণাম করার মন্ত্রটুকুও আমরা অনেকে জানি না! প্রণাম নিবেদনেও যে কত আধুনিকতা যুক্ত হয়েছে, তা ভাবলে অবাক হতে হয়! কোনোকোনো সময় দেখা যায় জুতা পায়ে রেখেই, প্রতিমা প্রণাম করছে। পূজামণ্ডপের মূল বেদিতেও জুতা পায়ে অনেকেই প্রবেশ করছে। এটা একেবারেই উচিৎ নয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীসহ সবাই যেন পূজার তাৎপর্য ও মূল আচরণে পূজিত হন সেদিকে সবাইকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

সে কথা বিবেচনায় রেখে সরস্বতী দেবীর বর্ণনায় লক্ষ্য করা যাক:

শ্রীশ্রী সরস্বতী দেবী শুক্লবর্ণা। শুক্লবর্ণ মানে সাদা রং। সত্ত্বগুণের প্রতীকও হলো সাদা। পবিত্র গীতার চতুর্দশ অধ্যায়ের ৬নং শ্লোকে আছে, ‘তত্র সত্ত্বং নির্মলত্বাৎ’ অর্থাৎ সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণের মধ্যে সত্ত্বগুণ অতি পবিত্র গুণ, স্বচ্ছতার প্রতীক, নির্মলতার প্রতীক। আবার ওই অধ্যায়েরই ১৭নং শ্লোকে আছে, ‘সত্ত্বাৎ সংজায়তে জ্ঞানং’ অর্থাৎ সত্ত্বগুণে জ্ঞান লাভ হয়। তাই জ্ঞানময়ী সর্বশুক্লা দেবী শ্রীশ্রী সরস্বতী জ্ঞানে গুণান্বিত বলে তার গায়ের রং শুক্লবর্ণা অর্থাৎ দোষহীনা ও পবিত্রতার মূর্তি। তাই পূজার জন্য দেবী সরস্বতীর মূর্তি শ্বেত বস্ত্র পরিধান করে থাকে। যা পবিত্রতারই নিদর্শন।

আর জ্ঞানদান করেন বলে তিনি জ্ঞানদায়িনী। ‘নহি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে’ (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-৪/৩৯)

অর্থাৎ ‘জ্ঞানের মতো পবিত্র আর কিছু নেই’। আমরাও যেন সে গুণের অধিকারী হতে পারি এ আমাদের প্রার্থনা।

হংসঃ জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতীর বাহন শ্বেতহংস। হাঁস অসারকে ফেলে সার গ্রহণ করে। দুধ ও জল মিশ্রণ করে দিলে হাঁস জল ফেলে শুধু দুধটুকু গ্রহণ করে নেয়। কিংবা কাদায় মিশ্রিত স্থান থেকেও তার খাদ্য খুঁজে নিতে পারে। মায়ের সঙ্গে পূজিত হয়ে আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে- সবাই যেন সবার অসার বা ভেজাল/অকল্যাণকর পরিহার করে সার বা ভালো কিছু অর্থাৎ নিত্য পরমাত্মাকে গ্রহণ করেন এবং পারমার্থিক জ্ঞান অর্জন করে সুন্দর পথে চলতে পারি।

সরস্বতী দেবীর এক হাতে বীণা। জীবন ছন্দময়। বীণার ঝংকারে উঠে আসে ধ্বনি বা নাদ। বিদ্যাদেবী সরস্বতীর ভক্তরা সাধনার দ্বারা সিদ্ধি লাভ করলে বীণার ধ্বনি শুনতে পান। বীণার সুর মধুর। পূজার্থী বা বিদ্যার্থী বা শিক্ষার্থীর মুখ নিঃসৃত বাক্যও যেন মধুর হয় এবং জীবনও মধুর সংগীতময় হয় এ কারণেই মায়ের হাতে বীণা। হাতে বীণা ধারণ করেছেন বলেই, তার অপর নাম বীণাপাণি।

সরস্বতী দেবীর একের হাতে পুস্তক। বিদ্যার্থীর লক্ষ্য জ্ঞান অর্জন। আর সে জ্ঞান ও বিদ্যা অর্জনের জন্য জ্ঞানের ভাণ্ডার ‘বেদ’ তার হাতে রয়েছে। ‘বেদই বিদ্যা’। তিনি আমাদের আশীর্বাদ করছেন- ‘জীবনকে শুভ্র ও পবিত্র রাখ। সত্যকে আঁকড়ে রাখ। মূল গ্রন্থের বাণী পালন কর। জীবন ছন্দময় কর। স্বচ্ছন্দে থাক।’

উল্লেখ্য, প্রতিটি দেব-দেবীর প্রণাম-মন্ত্র ও পুষ্পাঞ্জলি প্রদান মন্ত্র আমাদের সবার জানা উচিত। আর তাই নিম্নোক্ত মন্ত্রগুলি বিদ্যার্থী, শিক্ষার্থী সহ সবাইর অবশ্যই জানা থাকা দরকার।

পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র (৩ বার পাঠসহ)

ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।
বীনারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে।।
নমঃভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ।
বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত-বিদ্যা-স্থানেভ্য এব চ।।
এস স-চন্দন পুষ্পবিল্ব পত্রাঞ্জলি সরস্বতৈ নমঃ।।

প্রণাম মন্ত্রঃ
নমো সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে।
বিশ্বরূপে বিশালাক্ষ্মী বিদ্যাংদেহি নমোহস্তুতে।।
জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।
বীনারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে।।

সরস্বতীর স্তবঃ
শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেত পুষ্পোপশোভিতা।
শ্বেতাম্ভরধরা নিত্যা শ্বেতাগন্ধানুলেপনা।।
শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চ্চিতা।
শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারব‌ভূষিতা
বন্দিতা সিদ্ধগন্ধর্ব্বৈর্চ্চিতা দেবদানবৈঃ।
পূঝিতা মুনিভি: সর্ব্বৈঋষিভিঃ স্তূয়তে সদা।।
স্তোত্রেণানেন তাং দেবীং জগদ্ধাত্রীং সরস্বতীম্।
যে স্মরতি ত্রিসন্ধ্যায়ং সর্ব্বাং বিদ্যাং লভন্তি তে।।

জ্ঞানদায়িনী সরস্বতী মায়ের পূজাতে ফাঁকি না দিয়ে, আমরা যেন সবাই সঠিকভাবে তার পূজা করি। তার পূজার শিক্ষায় আমরা সর্বদা সবাই শুদ্ধ জ্ঞানচর্চায় যেন রত থাকি।

পরিশেষে প্রার্থনা করি-
ওঁ অসতো মা সদ্গময়
তমসো মা জ্যোতির্গময়
মৃত্যুর্মা অমৃতংগময়
আবিরাবির্ম এধি।
অর্থাৎ- হে ঈশ্বর, আমাকে অসৎ থেকে সৎ লোকে, অন্ধকার থেকে আলোতে এবং মৃত্যু থেকে অমৃতে নিয়ে যাও। সবাইকে আলোর পথ দেখাও।

মহান বিজয় দিবসের সাক্ষী হয়ে আজও বেঁচে আছি

061393

বিজয় দিবস হলো, মুক্তিযুদ্ধ। আর মুক্তিযুদ্ধ হলো মুক্তির জন্য যুদ্ধ। যা শুরু হয়েছি, ১৯৭১ সালে সংঘটিত তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র বাঙালির সশস্ত্র সংগ্রাম। যার মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসাবে পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালী নিধনে ঝাঁপিয়ে পড়লে একটি জনযুদ্ধের আদলে মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা ঘটে। তারপর দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাঙালির এই মহান বিজয়।

আমি তখন ৮ বছরের এক নাবালক শিশু। বাবা আর আমার বড়দা চাকরি করতেন নারায়ণগঞ্জ। বাবা চাকরি করতেন নারায়ণগঞ্জ বর্তমান সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন গোদনাইল চিত্তরঞ্জন কটন মিলে। আর বড়দা চাকরি করতেন নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানাধীন লক্ষণখোলা আদর্শ কটন মিলে। আমার মা আর তিন বোন সহ থাকতাম নোয়াখালী বজরা রেলস্টেশনের পশ্চিমে মাহাতাবপুর গ্রামে, আমাদের বাড়িতে। তখনকার সময় ঘরে-ঘরে এত রেডিও টেলিভিশন ছিলো না। পুরো একটা গ্রামে বিত্তশালী কোন ব্যক্তির বাড়িতে হয়তো একটা কাঠের বাক্সের মত রেডিও থাকতো। টেলিভিশন তো ছিল স্বপ্নের সোনার হরিণ! ছিল না বললেই চলে।

আমাদের মাহাতাবপুর গ্রামে এক বাড়িতে ছিল, ওয়ান বেন্ডের একটা রেডিও। বাড়িটার নাম ছিল বড়বাড়ি। খবরের সময় হলে সারা গ্রামের মানুষ ওই বড়বাড়িতে ভীড় জমাতো, খবর শোনার জন্য। মায়ের সাথে আমি আর আমার তিন বড়দিদিও যেতাম খবর শুনতে। শুনতাম পঁচিশে মার্চের কাল রাতের ভয়াবহ ঘটনার কথা। শুনতাম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক ঢাকায় অজস্র সাধারণ নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, বাঙালী পুলিশ হত্যা ও গ্রেফতারের কথা। শুনতাম ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সহ দেশের বহু জেলা শহরে জ্বালাও পোড়াও এর কথা। আমার অভাগিনী মায়ের চোখে তখন ঘুম ছিল না। উদরে ক্ষুধা ছিল না। মুখে হাসি ছিল না। কাঁদতে কাঁদতে মায়ের চোখ নদীতে অবশিষ্ট জল ছিল না।

আমার মা স্বামী আর সন্তানের জন্য মায়ের কান্নাকাটি আর থামছিল না। পাগলের মত হয়ে আমার মা শুধুই ঘুরে বেড়াতেন, স্বামী সন্তানের খবর জানার জন্য। এদিকে ঘরে খাবার নেই, টাক-পয়সা কিছু নেই। তখনকার সময় গ্রামের স্বচ্ছল স্বাবলম্বী গৃহস্থদের বাড়িতে গিয়েও দুই কৌটা চাউল হাওলাৎ পাওয়া যেত না। তাদের কাছে থাকলেও দিত না। কারণ আমার বাবা আর বড়দার কোন খোঁজখবর ছিলো না, তাই। এভাবেই না খেয়ে-না-খেয়ে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটতে লাগলো আমাদের।একসময় তুমুল যুদ্ধ শুরু হলো! যুদ্ধ শুরু হবার পর কেটে গেল দুই মাস।

১৯৭১ সালের মে মাসের দিকে আমার বাবা সহকর্মীদের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করে অনেক কষ্ট করে বাড়িতে আসে। শুনলাম বড়দা শরণার্থী হয়ে চলে গেল ভারতে। তবু বাবার আগমনে মায়ের কান্নাকাটি দূর হলো। আমার মা বাবাকে পেয়ে সন্তান হারা ব্যথা বুকে চাঁপা দিয়ে এই হট্টগোলের মাঝেও বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো।

অনেক কষ্ট করে এক পাড়াপড়শী একজোড়া কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে মুড়ির ব্যবসা শুরু করলো, আমাদের পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য। একদিন বাবা বিক্রি করার জন্য মুড়ির বস্তা বাজারে রাখলো। এমন সময় হৈচৈ শোনা যাচ্ছে, পাকবাহিনী বাজারে হানা দিয়েছে। রাস্তার ধারে কয়েকটা দোকানে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। এই খবর ছড়িয়ে পড়া মাত্রই বাজারের মানুষ এদিক-সেদিক ছোটাছুটি শুরু করে দিলো। বাজারটিতে একেক পণ্যের একেক সাইট ছিলো। বাবার সাথে মুড়ি বিক্রেতা আরও অনেকেই ছিলো। সবাই সবার মুড়ি বস্তা নিয়ে পালাতে শুরু করে দিলো। বাবা আর পালাতে পারছে না, মুড়ির বস্তাটার জন্য। হুড়াহুড়ির কারণে মুড়ির বস্তাটা কেউ আর বাবার মাথায় উঠিয়ে দিচ্ছিল না। বাপ-ছেলে দুইজনেই মুড়ির বস্তাটা নিয়ে অনেক চেষ্টা করলাম, কিন্তু মুড়ির বস্তাটা বাবার মাথায় আর উঠিয়ে দিতে পারলাম না। তখন বস্তাটা ধরেই বাবা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভয়ে বাবাকে ঝাপটে ধরে কাঁদতে শুরু করলাম। মনের ভেতরে ভয়! পাকবাহিনীরা গুলি করে মানুষকে মেরে ফালে, তাই এতো ভয়!

বাবা এক হাতে বস্তা আরেক হাতে আমাকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক কষ্টের মুড়ির চালান। সেজন্য বাবা মুড়ির বস্তা রেখেও পালাতে পারছে না। এরমধ্যে পুরো বাজার জনশূন্য হয়ে গেল। সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেলো। বাজারের কয়েকটা দোকানে লাগানো আগুনের তাপ শরীরে লাগতে শুরু করলো। চারজন পাকবাহিনী বাবার সামনে এসেই রাইফেলের বাঁট দিয়ে বাবাকে আঘাত করলো। বাবা মুড়ির বস্তা ছেড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। বাবাকে বললো কলেমা বাতাও। বাবা কলেমা বলতে পারল না। বাবা কাঁপছে আর কাঁদছে। পাকবাহিনী আমার দিকে বড়বড় চোখ করে কয়েকবার তাকালো। আমি বাবাকে ধরে কান্নাকাটি শুরু করে দিলাম। তাঁদের দয়া হলো। তারা আর আমাদের কিছুই বললো না, সোজা বাজারের দিকে চলে গেল। বড় হয়ে বুঝতে পেরেছি আমার কান্নাতে হয়তো তাদের মায়া লেগেছিল। তাই তারা আমাদের কিছু না বলে সোজা বাজারের ভেতরে চলে গেল। এর কিছুক্ষণ পরই পাকবাহিনী তাদের সাঁজোয়া যান নিয়ে বাজার ত্যাগ করলো। সেদিন আর আমাদের সব মুড়ি বিক্রি হলো না। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাবা কয়েক সের মুড়ি বিক্রি করেছিল। তারপর কোনরকমে বাবা-সহ বাড়ি চলে আসি।

বাবা সেই রাইফেলের আঘাতে পুরোপুরিভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাবা রাইফেলের বাঁটের আঘাতে, ৬/৭দিন আর বাজারে যেতে পারেনি। তখন আমাদের গ্রামে তেমন কোনও নামিদামি ডাক্তারও ছিল না। পুরো গ্রামে কেবল একজন মাত্র ডাক্তার ছিলো, তাও হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। সেই ডাক্তারের ঔষধ মেশানো জলপড়া খেয়ে ক’দিন পর বাবা সুস্থ হলেন। আবার শুরু করে দিলেন মুড়ি নিয়ে জীবনসংগ্রাম।

এর মধ্যে আমাদের বাড়িতে মুক্তিবাহিনীদের সন্ধ্যাকালীন আড্ডার আসর শুরু হলো। এর কারণ– আমাদের বাড়িটা ছিল বজরা রেলস্টেশন থেকে আসতেই মাহাতাবপুর গ্রামের প্রথম বাড়ি, তাই। অর্থাৎ আমাদের বাড়িটিই ছিল গ্রামে প্রবেশদ্বারের প্রথম বাড়ি। আমাদের বাড়ির আগের গ্রাম হলো, ‘হিলমুদ’। হিলমুদ গ্রামের পরেই বজরা বাজার ও রেলস্টেশন। তাই আমাদের বাড়িটা ছিল মুক্তিবাহিনীদের পছন্দের বাড়ি।

আমার দুই জেঠা ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত পাকিস্তানি পুলিশ। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা প্রতিদিন সন্ধ্যার পর আমাদের বাড়িতে আসতো। এসেই আমার দুই জেঠার সাথে বসে গল্প করতো। মাঝেমাঝে চা’র আড্ডা হতো। বাড়িতে বানানো মুড়ির মোয়া থাকতো। নারিকেল কোরা সহ মুড়ি তাদের দেওয়া হতো। তারা আনন্দের সাথে খেতো আর জেঠা মহাশয়ের সাথে কথা বলতো। সময়সময় জেঠার সাথে বসে বসে নিজেও তাদের কথা শুনতাম। মা চা বানিয়ে দিতেন, সেই চা তাদের এনে দিতাম। সেসব হৃদয়বান মুক্তিযোদ্ধাদের কথা কোনদিন ভুলবো না। পাকবাহিনী আর রাজাকার বাহিনীদের ভয়ে অনেক মানুষই গ্রাম ছেড়ে শরণার্থী হয়ে ভারত চলে গেছে। আমাদের তেমন টাকা-পয়সা ছিল না বিধায় আমরা নিজ গ্রামেই থেকে যাই।

আমাদের ভরসাই ছিল একমাত্র হৃদয়বান মুক্তিযোদ্ধারা। সেসব বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সু-নজরের কারণে, রাজাকার আর পাকবাহিনীরা গ্রামের একটা বাড়িতেও ক্ষতি করতে পারেনি। এভাবে চলতে চলতে কেটে গেল দীর্ঘ ৮ মাস। সময় তখন নভেম্বর ১৯৭১ সাল। রেডিওর শুধু সংবাদ ছিল আকাশবাণী কোলকাতার বাংলা সংবাদ। প্রতিদিন সন্ধ্যার পরপর মায়ের সাথে বড়বাড়িতে গিয়ে রেডিওর খবর শুনতাম। মুক্তিবাহিনীদের কাছেও একটা রেডিও ছিলো। যা দিয়ে তারা খবর শুনতো। তখন চারিদিকে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের জয়জয়কার। জাগায় জাগায় ঘটতে লাগলো পাকবাহিনীর পরাজয় এর আত্মসমর্পণ। আর পিছু হঠার খবর। সামনেই ডিসেম্বর মাস। পুরো ডিসেম্বর মাসই ছিল সবচেয়ে বেশি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। কুকুর পাগল হলো যেমন এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি করে মানুষকে কামড়ায়, ঠিক সেই অবস্থাই হয়েছিল পাকবাহিনীদের বেলায়। তারা ঠিক হিংস্র জানোয়ারের মতো হিংসাত্মক হয়ে উঠলো। নিরস্ত্র সাধারণ মানুষদের গুলি করে মারতে লাগলো।

তাদের মুখে ছিলো শুধু ইদুর কাঁহা (হিন্দু)? মুক্তিবাহিনী কোন আদমি হ্যাঁ? এটাই ছিল তাদের প্রথম জিজ্ঞাসা। হিন্দুদের বেশি খুঁজতো এই কারণে যে, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে পার্শ্ববর্তী ভারত সহযোগিতা করছিল, তাই। আমাদের বীর বাঙালিরা ভারত গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করার ট্রেনিং নিয়ে আসছে, তাই। তাই পাকবাহিনীদের প্রথম শত্রুই ছিলো ভারত ও হিন্দু। রাস্তাঘাটে পাকবাহিনীরা চেকপোস্ট বসিয়ে মুক্তিবাহিনী আর হিন্দুদের খুঁজতো। যাকেই ধরতো, আগেই জিজ্ঞেস করতো, ‘তুমি হিন্দু না মুসলমান?’ যদি বলতো, আমি মুসলমান। তাহলে আদেশ আসতো, ‘কলমা পড়ে শোনাও।’ কলমা পড়ে শোনানোর পরও বলা হতো, ‘কাপড়া উঠাও।’ কাপড় উঠিয়ে দেখানোর পরই ওরা নিশ্চিত হতো লোকটি হিন্দু না মুসলমান। হিন্দু হলে মৃত্যু অনিবার্য। আর মুসলমান হলেও তবু সন্দেহ থেকেই যেতো!

সন্দেহ শুধু একটাই, তা হলো, এই লোক সাধারণ মানুষ, না মুক্তিবাহিনী? অনেক সময় সাধারণ মানুষকে মুক্তিবাহিনী সন্দেহ করে মেরেও ফেলেছে ঐ হিংসাত্মক পাকবাহিনীরা। আবার অনেকসময় একটু স্বাস্থ্যবান মানুষদেরও ধরে নিয়ে মেরে ফেলতো। তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে দেশীয় রাজাকারবাহিনীও হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড শুরু করে দিলো। কার বাড়িতে কয়টা যুবতী মেয়ে আছে, সেসব তালিকা পাকবাহিনীদের কাছে পৌঁছাতে লাগলো। সময়-সময় পাকবাহিনীদের মনোরঞ্জনের জন্য, বাড়ি থেকে জোরপূর্বক যুবতী মা-বোনদের তুলে নিয়ে যেতো। এসব দেশীয় আলবদর-রাজাকাররাই পাকবাহিনীদের সবকিছু শিখিয়েছিলো। অচেনা রাস্তাঘাট চিনিয়ে দিয়েছিলো। হিন্দুদের কিভাবে চেনা যায়, সেটাও শিখিয়েছিল।

একসময় ডিসেম্বরের আগমন ঘটলো। সেইসাথে পাকবাহিনী সহ তাদের দোসররাও মানুষ খেকো রাক্ষসের মতন হয়ে উঠলো। ডিসেম্বরের প্রথম থেকে এভাবে চলতে চলতে একসময় সারাদেশেই পাকবাহিনী পরাজয় বরণ করতে লাগলো। ১৫ ডিসেম্বর দেখেছি, মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো থেকে রাজাকারদের হাত বেঁধে রাস্তা দিয়ে নিয়ে যেতে। সেই দৃশ্য দেখার জন্য গ্রামের অনেক মানুষের মধ্যে আমিও রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। মা-বাবা বড় দিদিদের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছি। মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে জয়বাংলা ধ্বনি শুনেছি। গ্রামের হাজার হাজার মানুষের মুখেও শুনেছি জয় বাংলার জয়ধ্বনি। পাকহানাদার বাহিনী পরাস্ত হলো। আল-বদর রাজাকার বাহিনীর শত কুচক্র শলাপরামর্শ ধূলিসাৎ হলো।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকা-সহ সারাদেশে বিজয়ের আনন্দ মিছিল বের হলো। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে আর লক্ষ মা-বোনদের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে বিজয় অর্জিত হলো। বাংলাদেশ নামে একটি দেশ পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান পেলো। বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটলো সারাবিশ্বে। আর আমি এই বিজয়ের সাক্ষী হয়ে আজও বেঁচে আছি।

ছবি: গুগল থেকে সংগ্রহ।