বিভাগের আর্কাইভঃ জীবন

ব্যক্তিগত দিনলিপি – ০২

অনেক দিন হলো নতুন কিছু লিখতে পারি না।
কাজের ব্যস্ততা আর ক্লান্তিতে শরীর ও মন দুটোই বিবস্ত্র হয়ে গেছে। কোনো কিছু লিখতে গেলেই মাথা ধরে আসে। কোনো কিছু তেমন আর মাথায় নিয়ে আসতে পারি না। সারাদিন যে হৈচৈ এর ভিতর কাটে। এত এত কথাবার্তায় সময় যায় যে এত কথার ভিড়ে আমার কবিতার কথাগুলো হারিয়ে যায় দূর অজানায়।
কবে যে সময় মিলবে জানি না।

এ দিকে স্মার্ট ফোনটাও নিয়ে থাকতে পারি না।
নতুন একটা কিনবো এটাও পারছি না।

মাঝে মাঝে কাজের ভিতর থাকাকালীন অনেক কিছু মাথায় আসে, অনেক থিম ভাসে মনে অথচ, লিখতে পারি না তা সময়ই পাই না।
এই যে মধ্যবৃত্ত জীবন আমাদের শুধুই ব্যস্ততা ঘেরা।

কোথাও এতটুকুও সময় নেই।

তবুও স্বপ্ন দেখি, একদিন সময় হবে অনেক কিছু
লিখে রাখার। একদিন সময় হবে কবিতা লেখার।

ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টার!

29 আজ রবিবার, নভেম্বরের শেষ। আমার কাজের স্কেজিউল ছিলো সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যে সাতটা পর্যন্ত। যদিও অভ্যাসবশে এখনও সন্ধ্যে সাতটা বলি, আসলে এদেশে শীতকালে বিকেলে ঘড়িতে পাঁচটা বাজতেই সন্ধ্যে নেমে যায়। শীতকালে সাতটার সময় সন্ধ্যে থাকে না, রাত হয়ে যায়।

আজ বিকেলের দিকে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক ( কৃষ্ণাঙ্গ) প্রিপেইড ফোন কিনতে এসেছিলেন। আজ সারাদিন ফটোল্যাবেই কেটেছে আমার। বিকেলে চা বিরতি থেকে ফিরে সবে ইলেক্ট্রনিক ডিপার্টমেন্টের ফ্লোরে এসে দাঁড়িয়েছি। তখনই সেই কৃষ্ণাঙ্গ সাহেব প্রিপেইড ফোন দেখতে চাইলেন। ফোন পছন্দ করে দাম দেয়ার সময় হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন,
— আরে, তোমার নাম রিটা! আমার X- wife এর নামও রিটা!

আমিও অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে বললাম, — তাই নাকি! এক্স ওয়াইফের নাম রিটা, তোমার Present wife-এর নাম কি?
ভদ্রলোক মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, দাঁড়াও এক মিনিট। আমার বর্তমান ওয়াইফের নাম পেটে আছে, মুখে আসছে না!

কৃষ্ণাঙ্গ সাহেবের অবস্থা দেখে আমি সত্যিই অবাক হলেও হেসে ফেলেছি। সাহেবের পাশে দাঁড়ানো এক শ্বেতাঙ্গ তরুণ কাস্টমারও হেসে ফেলেছে। এদিকে এক মিনিটেও সাহেবের প্রেজেন্ট ওয়াইফের নাম পেট থেকে মুখে আসছিলো না! ভদ্রলোক খুব বিব্রত ভঙ্গিতে হাসছিলেন। আমি খিল খিল করেই হেসে ফেললাম। বললাম, তোমার এক্স ওয়াইফ তো দারুণ লাকী! তোমার জীবন থেকে সরে গিয়েও তোমার হৃদয় জুড়ে আছে সে।
ভদ্রলোক তখনও মাথা চুলকাচ্ছে।
বললাম, এমনটা সবারই হয়। মাঝে মাঝে অতি প্রিয়জনের নাম মনে পড়ে না! ঘাবড়ে যেয়ো না, তোমার প্রেজেন্ট ওয়াইফ তো আর জানতে পারছে না যে তার নাম তুমি ভুলে গেছো!
— না না ভুলিনি, এখনই মনে পড়বে প্রেজেন্ট ওয়াইফের নাম।
বললাম, আসলে Rita নামের মেয়েরা খুবই পাওয়ারফুল হয়। খারাপই হোক অথবা ভালোই হোক, অত সহজে রিটাকে ভোলা যায় না।
দেখো, তোমার জীবন থেকে এক্স হয়ে গেছে যে রিটা, এখনও তার নামটাই তোমার মনে আছে।
ভদ্রলোক এবার ‘ ইউরেকা ইউরেকা’ ভঙ্গিতে বললেন,– মনে পড়েছে আমার প্রেজেন্ট ওয়াইফের নাম!
ওর নাম রেনে-এ!

বললাম, রে-নে-এ খুব সুন্দর নাম। আমার এক রাশান বন্ধুর নাম ছিলো রে-নে-এ।
সাহেব এবার বললেন, — তুমি কি বিবাহিত?
বললাম, – আমি বিবাহিত। আমার নামও রিটা এবং আমিও একজন পাওয়ারফুল লেডি। তবে আমি যদি কখনো আমার হাজব্যান্ডের এক্স ওয়াইফ হয়ে যাই, সে আমাকে ভুলতে না পারলেও আমার নাম ভুলে যাবে।
ভদ্রলোক বলে, ইমপসিবল! তোমার নাম সে ভুলতেই পারবে না!
হাসতে হাসতে বললাম,– আমি এতোটাই পাওয়ারফুল যে সে আমাকে নাম ধরে ডাকতে ভয় পায়!
– তাহলে তোমার হাজব্যান্ড তোমাকে কি নামে ডাকে?
– ইশারায় ডাকে।
-হোয়াট! ইশারায় ডাকে কেন?
– না, হাতের ইশারায় ডাকে না। সাউন্ড ইশারায় ডাকে।
– সাউন্ড ইশারা কি?
– তোমরা যেভাবে হেলো, হাই সাউন্ডে কাউকে ডাকো, অথবা স্ত্রীকে বেইবি বলো, আমার হাজব্যান্ড ওগুলোকেই একসাথে অনলি একটা সাউন্ড তৈরি করে আমাকে ডাকে।
– স্ট্রেইঞ্জ! সব মিলিয়ে একটা সাউন্ড! শুধু তোমাকে ডাকার জন্য স্পেশাল সাউন্ড ইশারা?
– হ্যাঁ। আমার হাজব্যান্ড আমাকে রিটা ডাকে না, ‘ এই’ বলে আওয়াজ দিলেই আমি বুঝে যাই, আমাকেই ডাকছে!
– আ-ই?
– না, আ-ই না, এ-ই!
– আ-ই সাউন্ডের চেয়ে রিটা ডাকা সহজ নয়?
— তোমার কাছে সহজ, কারণ তুমি এ-ই সাউন্ড করতে পারো না। রিটা নামটা তোমার কাছে এতো সহজ, তারপরেও তুমি এক্স ওয়াইফ রিটার ভয়ে প্রেজেন্ট ওয়াইফের নাম ভুলে গেছো।

আর আমার হাজব্যান্ডের রিটা নামেই এত ভয় যে, আমি এক্স হওয়ার আগেই আমার নাম ভুলে গেছে! কৃষ্ণাঙ্গ সাহেব প্রাণখোলা হাসিতে বলেই ফেললো, তোমার হিউমার সেন্স অত্যন্ত ভালো। ইয়েস, আমার এক্স ওয়াইফ খুবই জাঁদরেল ছিলো। তবে মানুষ হিসেবে সে ভালো।
— এই পৃথিবীর সকল রিটা জাঁদরেল হলেও মানুষ হিসেবে ভালো হয়। আমিও নাকি মানুষ হিসেবে ভালো— আমার হাজব্যান্ড বলেছে।
–সত্যিই রিটা ইজ আ পাওয়ারফুল নেইম, পাওয়ারফুল উয়োম্যান, আমি যেমন জানি তোমার হাজব্যান্ডও নিশ্চয়ই সেটা জানে।

– ‘ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টার’ স্ক্রিপ্ট থেকে।

বিমূর্ত সকাল

322

এই যে
এতো বাঁচার নেশা,
সুখের আকুতি,
জীবনের উন্মাদনা…
মগ্ন জুয়ার আসর, জেতার সম্ভাবনা…
প্রার্থনার গভীরে গুপ্ত প্রার্থনা
এত প্রাপ্তি-
এত দেনা
এত মোহ, মৌজ- মাস্তি;
ভোগের বাহানা!

এই যে
এতো হাসি.. বিনয়,
এই অভিনয়, রাগ- অনুরাগ, গড়িমসি..
উত্তর দেবে-
মৃত্যুর মোহনায় দু’ফোটা নীরব অশ্রু
অথবা রক্ত মিশ্রিত ঘাম!
কেউ না কেউ। কিংবা সবাই…
গোপনে বলবে- আসলে
“লোকটা কে ভালবাসতাম”!…
একটি বিমূর্ত সকাল
ধুয়ে যাবে বৃষ্টির শীতল জলে….

কে আছে – আছো কেউ?

রাতের সমুদ্রের সামনে ঠাকুমা আমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল ছেলেবেলায়। অন্ধকারে ছুটে আসা ঢেউগুলো দেখে মনে হয়েছিল জমাট কালো দলমার চলমান পাহাড় ধেয়ে আসছে। তার যেন শেষ নেই। তারা করাল শুঁড়ে জড়িয়ে আমায় দূরে ছুঁড়ে ফেলে চূর্ণ করে দেবে একেবারে। ভয়ে ছুটে পালিয়ে এসেছি সমুদ্র সৈকত থেকে। স্বপ্নেও সে দৃশ্য দেখে ঘুম ভেঙে গেলে ঠাকুমা আলো জ্বেলে দিয়ে জড়িয়ে ধরে ভয় তাড়াত আমার।

আজও যেন মনে হচ্ছে, সারা পৃথিবী জুড়ে নিরেট অন্ধকারের অতিকায় ঢেউ ছুটে আসছে ক্রমাগত, আর আছড়ে পড়ছে অনিঃশেষ। হাঁসফাঁস করে বাতাসে ভেসে উঠতে না উঠতে আবার -! দিগ্বিদিক বিরাট সেই কালো পাহাড় আমাকে চাপা দিচ্ছে, গুঁড়িয়ে যাচ্ছি কখনও। অন্ধকারের ভেতর অন্ধের মতো হাতড়াচ্ছি – এখান থেকে কোথায় পালাব?

কোথাও এতটুকু আলো নেই। জ্বেলে দেবার কেউ নেই। অন্ধকার ঘর থেকে ছুটে পালিয়ে এলে বাইরে শূন্য রোয়াক। সেখানে ঝরে পড়ছে বালি, পলেস্তারা। … এরপর… কোথায়?

পালাতে পালাতে বারবার এসে পড়ি অন্ধকার সমুদ্রেরই সামনে। তবে কি এর থেকে পরিত্রাণ নেই, পালাবার পথ নেই? ভবিতব্যের হাতে তবে এভাবেই মার খেতে হবে? নাকি কেউ আসবে বরাভয় নিয়ে আর আলো জ্বেলে দেবে? কে আছে – আছো কেউ?

স্বপ্ন শেফিল্ডে শহীদ মিনার

33

মনে পড়ে ছেলেবেলার একুশের ভোর। সারারাত জেগে এবাড়ি ওবাড়ি ঘুরে, ভিক্ষা করে, চুরি-চামারি করে যে ফুল সংগ্রহ করতাম তা-ই সুন্দর করে সাজিয়ে অঞ্জলি দিতাম শহীদ বেদীতে। দীর্ঘদিন নগ্ন পায়ে হাঁটা হয় না দীর্ঘদিন প্রাণ খুলে গাওয়া হয় না ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…’। অমর এ গান অনেকবার চোখ ভিজিয়েছে। শহীদ মিনারে ফুল দিতে গিয়ে অনেকবার হাউমাউ কেঁদে উঠেছি। সালাম রফিক বরকত জব্বার আমার কাছে শুধু একেকটি নাম নয়; এক একটি অগ্নি গোলক। তারা পুড়েছে; পুড়িয়েছে বলেই আমরা মন খুলে কথা বলতে পারি, নিজের ভাষায় চিৎকার করতে পারি। ছেলেবেলায় তাঁদের জন্য বুকের ভিতরে যে ভালবাসা জন্মেছিল দীর্ঘ প্রবাস বাসের কারণে সে ভালোবাসা গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। এখনো একটি অক্ষরের অনুপস্থিতি বুক-কে খালি করে দেয়।

গত কয়েক বছর ধরে যে শহরে থাকি; প্রায় হাজার দশেক বাঙালির বাস। বলতে ভালো লাগছে না; তবু সত্য হচ্ছে শহরের অধিকাংশ বাঙ্গালী বাংলা থেকে দূরে সরে গেছে। তাদের বুকে বাংলার শ্যামল রূপ আর দোলা দেয় না। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য নিয়ে তারা ভাবিত নয়।

বাঙ্গালীদের জাতীয় দিবস পালনের আগ্রহ এ শহরের বাঙ্গালীদের মাঝে দেখা যায় না। তৃতীয় প্রজন্মের কথা নয়, দ্বিতীয় প্রজন্ম যারা দেশ থেকে বড় হয়ে এসেছে তারাও দেশ একেবারে ভুলে গেছে। প্রতিদিনের জীবন সংগ্রামে দেশ কিছু দূরে সরে যায় এটা অস্বীকার করার উপায় নেই কিন্তু কোন বাঙ্গালী অবসরে দেশ স্মরণ না করে কীভাবে থাকতে পারে! দুঃখ বেদনা আনন্দ খুশিতে দেশ হানা দেয় না এটা ভাবতে অবাক লাগে।

বাঙ্গালীর জাতীয় দিবস গুলি আসে যায়। কিন্তু এক নদী রক্তের বিনিময়ে ভাষা, এক সাগরে রক্তের বিনিময়ে দেশ পেয়েও আমরা দেশ স্মরণ করিনা; সেই আত্মত্যাগী মানুষদের সামান্য কৃতজ্ঞতা দেখাই না। মাঝেমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলি দিবসের নামে ব্যানার লাগিয়ে ফটো সেশন করে, সেখানে সাধারণ মানুষের দেখা পাওয়া যায় না।

এ শহরের বাঙ্গালীদের নেতৃস্থানীয় কয়েকজনের সাথে এ বিষয়ে অনেকবার কথা বলে দেখেছি কিন্তু সাহিত্য, সংস্কৃতি কিংবা দেশ নিয়ে তাদের আগ্রহী করতে পারিনি। তারা দেশের শিল্প, সাহিত্য নিয়ে বলতে আগ্রহী নয় কিন্তু দেশের অবক্ষয়ে, যুব সমাজের অবক্ষয়ে বিদ্রোহী। হাজারবার বলেও তাদের বুঝাতে পারিনি শিল্প সাহিত্যের অনুপস্থিতিতে যে কোন দেশ যেকোনো সমাজ মূঢ় হতে বাধ্য।

একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু শহীদ দিবস নয় এখন এটা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসও। আমার মনে ইচ্ছে ছিল এই শহরে শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা করার। ১০ হাজার বাঙ্গালী অধিষ্ঠিত একটা শহরের জন্য এটা খুব বড় বিষয় নয়। প্রয়োজন দেশপ্রেম এবং একতা। দল-মত নির্বিশেষে সবাই শহীদ মিনারের জন্য একমত হতে পারে। কোন রাজনৈতিক, ধর্মীয় মতদ্বৈততা এখানে বাধা হতে পারে না।

আমি খুব ক্ষুদ্র মানুষ; যারা নিজেদের বড় মানুষ বলে দাবি করেন তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও শহীদ মিনারের জন্য প্রয়োজনীয় সমর্থন আদায় করতে পারিনি। আমাদের তৃতীয় প্রজন্ম এমনিতেই দেশ বিমুখ, দেশের রাজনৈতিক ঝগড়া তারা নিতে পারে না।

তবু পিতৃভূমির জন্য তাদের মনে কিছুটা দুর্বলতা আছে টের পাওয়া যায়। বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের সাফল্যের কথা শুনে তাদের চোখ যেভাবে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তাতে বুঝা যায় মনে মননে কিছু পরিমাণ হলেও বাঙ্গালীত্ব আছে। বিশ্বব্যাংকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজের পয়সায় যখন পদ্মা সেতু বানাতে দেখে তখন তাদেরও বুক ফুলে যায়। তাদেরকে দেশের প্রতি আরো আগ্রহী করতে শহীদ মিনার বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে। শহীদ মিনারই একমাত্র দল এবং রাজনীতি নিরপেক্ষ। শহীদ মিনারের ইতিহাস জানার মধ্য দিয়ে তারা বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে পারবে, পিতৃভূমির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সম্পর্কে আগ্রহী হতে পারবে।

একটা শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন খুব বড় স্বপ্ন নয়। চাইলেই বাস্তব করা সম্ভব। শুধু প্রয়োজন দেশের প্রতি ভালোবাসা। শুধু প্রয়োজন আত্মত্যাগী মানুষের প্রতি সামান্য কৃতজ্ঞতা দেখানো। আমরা যে মাকে মা ডাকি, তাদের রক্তের বিনিময়ে এ ডাক। মা ডাকের সাথে থাকে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার। তাদের আমরা কোনভাবেই ভুলতে পারি না।

শহীদ মিনার হতে পারে কৃতজ্ঞতার স্মারক। শহীদ মিনার হতে পারে বিদেশের বুকে এক টুকরো বাংলাদেশ …

বিদায় বেলা

33

আবারও অবিশ্বাসের কাঁটাগাছ দরজায় টোকা দিয়েছে। ভালো করে দেখতে চায় মানদণ্ড সোজা আছে কিনা। এতটুকু হেরফেরে ছেড়ে যাওয়া ভালোবাসার বাসভূমি। চলে যাব বলাটা নতুন নয়। শুনে চলা ছোটো থেকেই। তবুও বার বার একই কথার আবর্তে ঘোরা। আবার চিতার দহন।

নীল আকাশে কখনো ওড়া হয়নি। বারবার ডানা ভেঙেছে। যেতে চেয়েছে। যেতে দিয়েছি বিনা তর্কে, জিজ্ঞেস করিনি কেন এই শাস্তি? কেন এতো অবিশ্বাস? স্বপ্ন এঁকেছি আবার বিসর্জন দিয়েছি অশ্রুনদীতে।

যে ভালবাসা ভালোলাগার ডানা মেলে উড়তে চেয়েছিল আলো মেখে, বাসা বাঁধতে চেয়েছিল ভালোবাসার বুকে, সেও বিশ্বাস অবিশ্বাসের মানদণ্ডে পরীক্ষা করতে চেয়েছে। ডানাজোড়া কেটে রেখে দিয়েছে তারই কাছে।
আজও আমি গুণে রাখা তারাদের মাঝে মাঝে দেখি, কেউ যদি ভুল করেও চিনতে পারে। কেউ যদি সত্যিই বোঝার চেষ্টা করে!

খুব ভোরে হালকা ঠান্ডা বাতাসে চাদর টেনে নিই গায়ে। বিগত দিনগুলোর কথা বড় বেশি মনে পড়ছে। তোমাকে মনে পড়ছে। ফুসফুসে জমে থাকে অনেকটা কথা, তোমার কথা। মনের কুলুঙ্গিতেই শুধু নয়, মগজের অলিতেগলিতে শুধু নয়, ফুসফুসের কুঠুরিতে, কুঠুরিতেও শুধু নয়, আমার প্রতিটি শিরায় উপশিরায় রেখেছিলাম তোমাকে ন্যায্য দাবীতে, পরম বিশ্বাসে, ভালবাসায়।

ফাগুনের চোখেও বর্ষা! মনে জ্বলছে আগুন। তবুও বর্ষা নেমেছে দু’চোখে। একটা একটা করে ফোঁটা ঝরে পড়ছে আর সেই ফোঁটা নিয়ে বিন্দু বিন্দু করে মনকে সাজিয়েছি বিরহিণী রাধার মতো। আজ মৃত্যুকে মনে হয় চিরসখা,
“মরণরে তুঁহু মম শ্যাম সমান”

আমাদের বেড়াল আমাদের মতো হয়নি

বারো
মাঠের নাম রঘুনাথ। রেল কোম্পানির জমি, রঘুনাথ নামের ঝাড়েবংশে একা এক বিহারি গ্যাংম্যান তার কোণে ঝুপড়ি তুলেছিল। সকালে উঠে লোটা হাতে চলে যেত বাতিল কেবিনের কাছে গরুভাগাড়ের দিকে। তারপর প্রান্তরের পাশের ডোবায় ডুবকি লাগিয়ে স্টেশান-লাগোয়া হোটেলে রুটিতরকারি খেয়ে ডিউটিতে। রাতে তার তাঁবুর হারিকেন-আলো অন্ধকারের সমুদ্রে কম্পাসের মতো দেখা যেত কলোনি থেকে। এভাবে চলতে চলতে একদিন সকালে ঝুপড়ির ঝাঁপ ঠেলে আর বেরলো না রঘুনাথ। গরীব মানুষ ঠিক বেড়ালের মতো, মৃত্যুর সমীপবর্তিতা কাউকে টের পেতে দেয় না। অথবা গরীবকে সবাই বেড়াল ভাবে ব’লে তার ক্রমপতন চোখ এড়িয়ে যায়। যাই হোক, গ্রামের মানুষ এক স্থায়ী উত্তরের ঠিকানা হারিয়ে রেলের মাঠটাই লিখে দিয়েছিল বিহারির নামে।

আজ প্রচুর ভিড় জমেছে রঘুনাথে — পাঁচ দিন ব্যাপী অবিরাম সাইকেল চালনা এইমাত্র শুরু হল। এখন থেকে গুনে গুনে একশো কুড়ি ঘন্টা বাবলু গিরি নামে ওই কালো প্যাত্‌পেতে ছেলেটার মাটির সঙ্গে আড়ি, হাগু-হিসু বন্ধ, দুচোখের পাতা এক করবে না, মাডগার্ডহীন সাইকেলে ব’সেই স্নান সেরে মায়ের হাতে দুটো খেয়ে আবার গোলচক্কর কাটবে ঘাসের ওপর। হ্যাঁ, সেই চন্দ্রকোণা মেদিনীপুর থেকে মা এসেছে ছেলের সঙ্গে। রঘুনাথের এক কোণে ত্রিপল খাটিয়ে পাশেই মাটি খুঁড়ে উনুন সাজিয়েছে।

বাবলুর জামায় পোষা পাখির মতো দুটো এক টাকার নোট গাঁথা। বিকেলে ব্যালান্সের খেলা দেখাবে যখন, পালিত কবুতরের টানে অনেক শালিক-চড়াই-ময়না ওর শরীরে ব’সে ডানা ঝাপটাবে। আর মাইকে মুহুর্মুহু ঘোষণা : কলোনির শ্রী সবুজ বিশ্বাস এইমাত্র বাবলু গিরির খেলা দেখিয়া…, মান্নাপাড়া নিবাসী শ্রীমতি বিলাসী দেবী বাবলু গিরিকে আশীর্বাদ স্বরূপ…, কাশিমপুরের শ্রী অনাদি বসু বাবলু গিরির সাহসিকতায় মুগ্ধ হইয়া…।

খবর না দিয়ে যেমন হঠাৎ ক’রে বাড়িতে অতিথি চলে আসে, বিনোদনও গ্রামের নিরুপায় মেহমান। অঘ্রানের এক ভোরে উঠে শোনা গেল গ্রামে রামযাত্রা এসেছে, আবার মাঘের এক দুপুরে সে সহসা গায়েব। ততদিন অধিকারীসমেত রাম, সীতা, মন্দোদরী, লক্ষণ, শূর্পনখা…নানা ডিজাইনের আটন’টা ছেলেকে ক্লাবঘরের দরজাহীন প্রবেশপথে রঙিন শাড়ি টাঙিয়ে ‘প্রতি বছরের ন্যায়’ রাখার ব্যবস্থা। প্রথম এক মাস তারা দুতিনটে গ্রুপে ভাগ হয়ে গ্রামের এ-বাড়ি ও-বাড়ি অন্নসেবা করবে, খাতির পাবে ফিল্মস্টারের মতো। তখন রাতে অভিনয় হচ্ছে রামায়ণের ছোট ছোট টুকরো, মালা-ডাকে পয়সাও মন্দ না।

কিন্তু যত দিন যায়, গরীব ফতুয়ার পকেটে টান পড়ে, বেস প্রাইস লজ্জাজনক ভাবে নামিয়ে আনলেও জানকীকন্যার স্পঞ্জলাঞ্ছিত বুকে ঘসটানিখাওয়া মালা ডেকে নিতে কোনও আধাবুড়ো উঠে দাঁড়ায় না! আস্তে আস্তে অতিথিসেবা বন্ধ হয়ে ক্লাবঘরেই শিল্পীদের স্বপাক আহার চালু। এই অবস্থায় রামায়ণ ইউএসপি ধরে রাখতে পারছে না বুঝে অধিকারী সামাজিক পালায় সরে আসে। নিমতিতার মতোই কোনও গ্রামের গল্প, পাড়ার দুটো ছেলেমেয়ে ভালোবাসা করেছে — শিবনাথ (ডাকনাম শিবে, ভূমিকায় রাম) আর পার্বতী (অভিনয়ে সীতা)।

ততদিনে শীতের খোলা আকাশের নিচে নেহা-কুয়াশা লেগে অভিনেতাদের নাকে পুরোদস্তুর গোদরেজের তালা। কাজেই, রামযাত্রার দল গ্রাম ছাড়ার পর পাড়ার দাদাবৌদিরা রগুড়ে সন্তুকে পেলেই ধ’রে বসে, সেই সিনটা কর না, মনা। সন্তু কানু মালাকারের নিষ্কর্মা ছেলে, শিস দিয়ে গান, নাটক-থিয়েটার দেখা আর মাঝেমাঝে বাড়ি থেকে হাওয়া হয়ে যাওয়া তার সাধারণ গুণাবলী।
— কোন সিন?
সেই যে শিবনাথ পার্বতীকে কানে কানে কী একটা প্রস্তাব দিল, শোনামাত্র নায়িকা উত্তেজনায় থরো-থরো।

সন্তু ওমনি ঘাড় একদিকে বেঁকিয়ে কাঁধে ঝটকা দেয় :
(পার্বতী) : টা টা টা, আমি পাপোটা, আমি পাআপোটা। তুমি আমায় অপোন কথা পোলপে না, শিপেটা! তুমি যডি অপোন করো, আমি সপাইকে পোলে টেপো।
(শিবনাথ) : (গলায় হাসিমাখা প্রশ্রয়) কী পোলপি?
(পার্বতী) : আমি পোলপো, আমি পোলপোও… (সন্তু দুহাতে মুখ ঢেকে পেছন ঘুরে যায়) টাআআ, আমার লট্টা করে!

হা হা ক’রে হাসতে হাসতে নির্মলকে এসে সেই খবর দিচ্ছিল সুধা।
— মামনিদের বাড়িতি ব’সে সন্তুমামা রামযাত্রার নকোল কোত্তিছে। না-না-নারে বলতিছে টা-টা-টা। শোনবা?
মায়া চেঁচায় : ওরে দামড়ি মেয়ে, জ্যাঠারে এসব কোতি হয় নাকি!

নির্মল মজা পায় খুব।
— শোন, আমি যখন খুলনার দৌলতপুর স্কুলে মাস্টেরি করতাম, আমাদের এক বাংলা টিচার ছিল, কমলেশবাবু নাম। খুব নস্যি নিত নাকে, কিন্তু সবাইরে সাবধান করত, খবরদার এই নেশা ক’রো না। কারণটা কী?

“লিয়মিত লাকে লস্য লইলে দোলতোল ল-গুলি ল-বৎ উচ্চারল হয়। যেমল, অরুলববরুলকিরলমালা পরিলত হয় অরুলবরুলকিরলমালা-য়। যদি জিজ্ঞাসা করো, আপোলার ক্যালো এরূপ হয় লা? আমি বলিব, ইহা অভ্যাসের গুল!”

খিলখিল খলখল হাসির ওপর দিয়ে দুটো কুড়ির বনগাঁ লোকাল পাস ক’রে গেল। মায়া জানে, সাত কথার এক উত্তর দেওয়া ভটচাজমশাই আসলে একটি মিচকে শয়তান। স্কুল থেকে ফিরে কাল সে সঞ্জুকে ইংরাজি পড়াতে বসেছিল। মায়ার কানে এল বাবা ছেলেকে বলছে, আমি যে তোমারে এত বোঝাই, তা যে তুমি বোঝ না, তা যে আমি বুঝি, তা কি তুমি বোঝ!

এসব মস্করার মধ্যে ট্রেন থেকে নামা লোকজন আমতলাবাড়ি পার হয়ে যাচ্ছে। তাদের পেছনে এক পরিবার হেঁটে আসে আস্তে, দোনোমনা পায়ে — বৌ আগে, সঙ্গে বছর বারোর ছেলে, কিছু পেছনে তার স্বামী, হাতে ধরা পাঁচ-ছ’বছরের বাচ্চাটা হাঁটছে না, লাফাচ্ছে। সেদিকে চোখ পড়তে মায়া কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে গাঢ় চাপা স্বরে বলে উঠল, সারিছে!

ননীবালাও দেখেছে যা দেখার।
— আজ দু’দিন আমার বাঁ-চোখ নাচা বন্ধ হোতিছে না। তখনই ভাবিছি…।
মায়া একটা হালকা গর্জন ছাড়ল মায়ের দিকে।
— একদম মুখি তালা মেরে থাকো। তোমার মেয়ের শ্বশুরবাড়ির কুটুম।
তারপর হাঁক পাড়ল শিউলিকে।
— যা তো মা, বলরামকাকার বাড়িত্থে শিগ্‌গির এক খুচি চাল নিয়ে আয়। বলবি, সামনের সপ্তায় ফেরত দেব।

তেরো
প্রত্যেক পাড়ায় একটা পাগল, একটা মদখোর থাকে; আর আজন্ম মুখ-খারাপ একজন। এদের অস্পৃশ্যজ্ঞানে এক হাত দূরে রাখবে বাকিরা, কিন্তু সমাজ থেকে সরাতে তো পারবে না। আজ অবিরাম সাইকেলচালনার প্রথম বিকেলে কানাই তফাদারকে দেখা গেল রঘুনাথে। কানাইবুড়োর বয়েস আশি-পঁচাশি, বারাসাত কোর্টে মুহুরির কাজ করত, ভিড়ের মধ্যে কখন সে চাঁদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
— দাদু, তুমি শোনলাম ইশকুলি ভোত্তি হইছ? আ-কার ই-কার শিখিছ নাকি?
— হ্যাঁ
— তালি বলো দেহি, ক-য় আ-কার ল কী হয়?
— কাল
— বেশ। ত-য় আ-কার ল?
— তাল
— এবার কও, ব-য় আ-কার ল কী?
এপাশ-ওপাশ থেকে লোকে খ্যা-খ্যা ক’রে হাসে। চাঁদ থমকে যায়।
— ব-য় আ-কার ল হল তালশাঁস, বুঝিছ? বাড়ি যেয়ে দিদিমারে ক’বা, কানাইদাদু শিকোয় দেছে।
বাসু এসে চাঁদের হাত ধ’রে টেনে নিয়ে যেতে যেতে রাগি গলায় বলে, দাদু, তুমি কিন্তু আমার ভাইটারে খারাপ ক’রে দেচ্ছো।
— বন্নোপরিচয়ে যে শব্দডা নেই, পড়ায় দিলাম। তোদের দেহি ‘ভালো কোল্লি মোন্দো হয় কলিকালের ফলে’!

চোদ্দ
তখন মাইকে ‘অজীব দাস্তাঁ হ্যায় ইয়ে’ বাজছিল, বাবলু আকাশে টুপি ছুঁড়ে দিয়ে সাইকেলে এক পাক ঘুরে নিলে উড়ন্ত টুপি বাজপাখির মতো নেমে আসছে মাথায়। সিটে উপুড় শুয়ে দুহাতে প্যাডেল করছে, যেন চাকার প্রতিটা স্পোক তার কথা শোনে। এবার সুতোয় বাঁধা কুড়িটা ব্লেড গিলে ফেলছে বাবলু, এই দৃশ্যে তার মা প্যাঁচা-সাদা মুখ ঘুরিয়ে আছে উল্টোদিকে। পাঁচ দিন সাইকেল চালাতে চালাতে অর্ধেক হয়ে যাবে ছেলেটা, কিন্তু এক সেকেন্ডের জন্যে পায়ের টো-ও মাটি ছোঁবে না, কথা ইজ কথা! ধুঁকে ধুঁকে একশো উনিশ ঘন্টা পঞ্চান্ন মিনিট শেষ করার পর হঠাৎ বুনো ঘোড়া হয়ে যাবে সে, হঠাৎ হেলিকপ্টার। শাঁই শাঁই করে দশ-পনেরো পাক দিতে দিতে চোঙামাইকে যেই সময় সমাপ্তির ঘোষণা, মাটিতে নেমেই দড়াম ক’রে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে। তখন ছেলেরা জোরসে হাততালি আর মেয়েরা মুখে আঁচল-চাপা। মাইকের গানও পালটে গেছে — সও সাল প্যাহলে, মুঝে তুমসে প্যার থা।

এমনটাই নিয়ম; আগের বছর মছলন্দপুর থেকে বিজু মল্লিক এসেছিল, তার আগের বার গাইঘাটার বিশ্বজিৎ পরামানিক, সবাই লাস্টে জ্ঞান হারায়। এর পরেও দম থাকলে মাঠের এক পাশে যে কবর খোঁড়া হয়েছে, বস্তায় শরীর পুরে তার মধ্যে ঢুকে যায় অবিরাম সাইকেলচালক। চার ঘন্টা মাটিচাপা থাকার পরে যখন তোলা হল, দর্শকেরা মোটামুটি নিশ্চিত — টেঁসে গেছে। পাখার বাতাস, হাতপায়ের তেলো ঘষা এবং ‘সংঘের পক্ষ হইতে একুশ টাকা পুরস্কার ঘোষণা’র পর সে চোখ খোলে।

সন্ধে হয়ে আসছে, খেলা ভেঙে আবার একঘেয়ে চক্রগতিতে ফিরে গেছে কাঙাল জাদুকর। মাঠে ঘাসের তরোয়ালে শিশিরমুন্ডু বিঁধিয়ে আস্ফালন করছে শীতঋতু। ছড়িয়ে পড়া ভিড়ের মধ্যে টিপুদাকে দেখে দৌড়ে গিয়ে ধরে শিউলি।
— তারপরে নন্দরাক্ষসের কী হল বললে না তো?
— বলবানে। এখন দোকান খুলতি হবে, বুন্‌ডি।
— জানো, নন্দু সুন্দরবনেত্থে পালায় একা-একা বাড়ি আসতিছে। আমি স্বপ্নে দ্যাখলাম।

(আরও আছে)

ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টার!

2979

“আজ বন্ধু দিবস। এখন পর্যন্ত এক জন বন্ধুকেও শুভেচ্ছা জানাতে পারিনি। কারণ আজ কাজে চলে এসেছি সকাল ৯টায়।

ওয়ালমার্টে কাজের ফ্লোরে থাকলে ফোন ব্যবহার করার নিয়ম নেই। প্রায় কেউই এই নিয়ম মানে না, কিন্তু আমি নিয়ম মানি। আমি আইনকানুন মেনে চলা সভ্য নাগরিক। ওয়ালমার্টের আইন মেনে চলি তাই এখন পর্যন্ত ফেসবুকে ঢুকতে পারিনি, কাউকে হ্যাপি ফ্রেন্ডশিপ ডে উইশও করতে পারিনি। আমি ওয়ালমার্টের ইলেকট্রনিক ডিপার্টমেন্টেই বেশী সময় থাকি, মানে থাকতে হয়। কারণ ফোন, ফটোল্যাব, ইলেকট্রনিকস, ফেব্রিকস, টয়স ডিপার্টমেন্টগুলো গায়ে গায়ে লাগানো এবং সকল কাজের কাজী আমি।

ইলেক্ট্রনিকস ডিপার্টমেন্টে ডিসপ্লে আইলের ওয়ালে বিশাল সাইজের অনেকগুলো টিভি চালু থাকে। টিভিতে বিভিন্ন চ্যানেলের প্রমোশনাল প্রোগ্রাম দেখায়। তার মধ্যে ট্র্যাভেল চ্যানেল অন্যতম। যখন ট্র্যাভেল চ্যানেল দেখায়, আমি কর্ম জগত ভুলে হা করে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকি। পৃথিবীর কতো সুন্দর সুন্দর জায়গা দেখায়, আমি দু’চোখ ভরে দেখি। যখন যে জায়গা দেখায়, কল্পনায় নিজেকে সেখানেই আবিষ্কার করি।

সেখানে আমি একা নই, পাশে থাকে ‘সে’। ‘সে’-কে পাশে নিয়ে মুগ্ধ নয়নে উপভোগ করি পৃথিবীর সৌন্দর্য্য। ‘সে’ আমার নাম জানে, আমি ‘সে’-র নাম জানি না। সে দেখতে কেমন তাও জানি না। শুধু জানি, নির্জন নিরালায় যখন নিজেকে খুঁজে পাই, ঠিক তখন ‘সে’ এসে চুপটি করে আমার বাম পাশে বসে।

‘সে’-র সাথে আমার মনের খুব মিল। দুটিতে পাশাপাশি বসে পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ স্পর্শ অনুভব করি, প্রকৃতির সরবতার সাথে তাল মিলিয়ে আমি গুন গুন করি! যদিও আমি ‘সে’-কে দেখতে পাই না, তবে অনুভব করি ‘সে’ তন্ময় হয়ে আমার গান শোনে। আজও আমি আর ‘সে’ নৌকায় বসে ভেনিসের রূপ দেখছিলাম আর গুন গুন করছিলাম ” দূরে কোথায় দূরে দূরে, আমার মন যে বেড়ায় ঘুরে ঘুরে”

হঠাৎ এক ক্যাঁচ ক্যাঁচ কণ্ঠে ‘এক্সকিউজ মি, আই নিড হেল্প’ শুনে সম্বিত ফিরে পাই!

তখনই আমার বাম পাশ থেকে ‘সে’ হারিয়ে যায়,
আমি ভেনিস থেকে সরাসরি ফিরে আসি কর্মজগতে।
এই কর্মজগত এখন আর ভালো লাগে না। এখানে শান্তিতে আমি আর ‘সে’ দুই দন্ড সময় কাটাতে পারি না! কতোবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, চাকরিটা আজই ছেড়ে দেবো, মুক্ত বিহঙ্গের জীবন বেছে নেবো।

৩৫ বছরের বিবাহিত জীবনে ১৮ বছরের কর্মজীবন, বাকী ১৭ বছর স্বামী কন্যা আত্মীয় পরিজন নিয়ে কেটেছে। কোনো জীবনই খারাপ কাটেনি। চাকরি ছাড়া জীবনে পরিবারের সকলেই ছিলো আমার কাছাকাছি, শুধু ‘সে’ ছিলো না। ‘সে’ ভীড় পছন্দ করে না, কারণ ভীড়ের মাঝে সে আমার কাছে আসতে পারে না, ভীড় থেকে আমাকে আলাদা করতে পারে না। আমি নিজেও পরিবারের মাঝে থাকলে নিজেকে খুঁজি না, অথবা নিজেকে খুঁজে দেখার কথা মনেই পড়ে না! নিজেকে খুঁজলেই তাকে কাছে পেতাম। আসলে আমিও ভীড়ের মাঝে নিজেকে আলাদা করতে পারি না!

শুধু ‘সে’-র কথা ভেবে ভেবে চাকরিটা আর ছাড়া হয় না! অথচ চাকরিটা ছেড়ে দিলেই আবার পরিবারের মাঝে ফিরে আসবো, কাস্টমারের ক্যাঁচোর ম্যাচোরের মাঝে থাকতে হবে না। তবে চাকরি ছেড়ে দিলেই ‘সে’ কে হারিয়ে ফেলবো!

বুঝতে পারি না, আমি কাকে পাশে চাই!
কর্মব্যস্ত আত্মীয় পরিজন নাকি ওয়ালমার্টে কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমার অলস সময়ে টুপ করে হাজির হওয়া ‘সে’-কে!

শুভ বন্ধু দিবস ‘সে’! তুমি যতক্ষণ আমাকে খুঁজে নিবে, ততক্ষণ আমি তোমার থাকবো।
আজ তোমায় পাঠালাম জুঁই ফুলের সৌরভ। ”

‘ওয়ালমার্ট সুপারসেন্টার’ স্ক্রিপ্ট থেকে।

ভালো থাকার জন্য কী এবং কী ধরনের সঙ্গী প্রয়োজন?

8ab

১. বিশ্বস্ততা – আপনি বিশ্বাস করতে পারেন এমন একজন অংশীদার একটি শক্তিশালী এবং সুস্থ সম্পর্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

২. সততা – সততা যে কোনো ভালো সম্পর্কের ভিত্তি। আপনার সাথে সৎ একজন অংশীদার একটি শক্তিশালী এবং বিশ্বস্ত বন্ধন তৈরি করতে সহায়তা করে।

৩. যোগাযোগ – একটি সুস্থ সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য যোগাযোগ অপরিহার্য। একটি দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কের জন্য কার্যকরভাবে শুনতে এবং যোগাযোগ করতে ইচ্ছুক একজন অংশীদার প্রয়োজনীয়।

৪. মানসিক সমর্থন – একজন অংশীদার যে মানসিক সমর্থন প্রদান করতে পারে একটি সুস্থ সম্পর্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

৫. সামঞ্জস্যতা – একজন অংশীদার যে আপনার মূল্যবোধ, আগ্রহ এবং লক্ষ্যগুলি ভাগ করে তার সাথে থাকা সহজ হবে এবং অপ্রয়োজনীয় দ্বন্দ্ব এড়াতে সাহায্য করতে পারে৷

৬. সম্মান – যে কোনও সম্পর্কের ক্ষেত্রে পারস্পরিক শ্রদ্ধা গুরুত্বপূর্ণ। একজন অংশীদার যে আপনাকে এবং আপনার সীমানাকে সম্মান করে বিশ্বাস এবং একটি শক্তিশালী বন্ধন তৈরি করতে সাহায্য করবে।

৭. নমনীয়তা – একজন অংশীদার যে আপস করতে ইচ্ছুক এবং নমনীয় একটি দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে।

৮. সংক্ষেপে, একজন ভাল অংশীদার হলেন এমন একজন যিনি বিশ্বস্ত, সৎ, একজন ভাল যোগাযোগকারী, মানসিক সমর্থন প্রদান করেন, সামঞ্জস্যপূর্ণ, শ্রদ্ধাশীল এবং নমনীয়।

মৌন পাথর

3208

অনন্তকাল গুনেছি প্রহর
প্রতিক্ষার প্রদীপ জ্বেলে,
অনন্তকাল পুড়েছে অন্তর
বয়েছে গেছে নদী নিরবধি
বুকের বরফ গলে!….

আসেনি ফিরে প্রাণ সুজন
মেঘের কৈলাশ
রয়েছে দাঁড়িয়ে
একা
বিস্তৃত মৌন পাথর।

বসন্ত, রিডিংক্লাসের জানালায়

328

বললে, চলো- আরেকবার রিডিংক্লাসে ঢুকে পড়ি!
বললাম, সঙ্গে তো আনি’নি রিডিংগ্লাস!
বললে, তাহলে শ্রুতিপাঠ হোক…
বললাম, তবে কী হিম হাওয়া ভেদ করে, এই শহরে
জেগে উঠলো বাসন্তী অশোক…

#

নিউইয়র্ক / ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
সোমবার

ভালোবাসা হচ্ছে শরমের ব্যাপার

বহুব্রীহি নাটকে হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন ‘ভালোবাসা হচ্ছে শরমের ব্যাপার’! আমার কাছে ব্যাপারটা শরম ছাপিয়ে আরো জটিল পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল।

আমাদের পাড়ায় ভাড়াটিয়া হিসেবে আকমল হুজুর এসেছেন। অভিভাবকেরা ঠিক করেছেন তাঁর কাছে আমরা আরবি পড়ব। পাড়ার নাবালক শিশু কিশোর নিয়মিত পড়তে শুরু করলাম। হুজুর তার বৈঠকখানায় আমাদের পড়ান। আমি যেখানে বসি তার উল্টা দিকে হুজুরের শোবার ঘর। হুজুর দরজার দিকে পিঠ দিয়ে বসেন। আরবি খুব আদবের সাথে পড়তে হয়। ভুল পাঠে কঠিন গুনাহ। প্রতিদিন মনোযোগের সাথেই পড়ি ভুল যাতে না হতে পারে। কিন্তু শয়তান তার ওয়াসওয়াসা নিয়ে সর্বত্র হাজির থাকে। কুরআনের মাহফিলও বাদ পড়ে না।

একদিন গভীর মনোযোগে তালিম নিচ্ছি হঠাৎ কিভাবে যেন শয়তানের ধোকায় হুজুরের শোবার ঘরে চোখ চলে গেল। দরজায় এক কিশোরীর মুখ দেখে চমকে উঠলাম। শ্যামলা রঙ; চোখ দুটো যেন চকিত হরিণী। আরবি গেল গোল্লায় । হরিণ চোখ হৃদয় তোলপাড় করে দিল। বয়স সবেমাত্র টিন-এজ এ পৌঁছাচ্ছে। এই বয়স যে ভীষণ খতরনাক হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। সেদিন পড়া হল না; হুজুরের শোবার ঘরে কিশোরীর মুখ দর্শন হলো।

পরের দিন আমার নির্ধারিত জায়গায় অন্যজনকে বসা দেখলাম, হুজুর তখনো এসে পৌঁছাননি। তাকে জায়গা থেকে উঠে অন্য কোথাও বসতে বললাম সে রাজি না। অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়েও যখন রাজি করানো যাচ্ছে না তখন ঝগড়া বাধার উপক্রম। জায়গা নিয়ে হুজুরের সামনে ঝগড়া করা যাবে না বিধায় তাকে ঘুষ অফার করা হলো। টিফিনের জন্য বরাদ্দ টাকা আগামী একমাস তাকে দিয়ে দিব এই শর্তে সে স্থান ছাড়তে রাজি হল।

যে গভীর মনোযোগ নিয়ে তালিম শুরু করেছিলাম সে মনোযোগ আর রক্ষা করা গেল না। কারণ মন এবং চোখ বারবার শোবার ঘরের দরজায় উঁকি মারে। কয়েকবার সেই কিশোরীর সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। অপর তরফেও যে আগ্রহ আছে বেশ বুঝতে পারলাম। হুজুর আমার অমনোযোগিতা লক্ষ্য করলেন। আরবি পাঠে মন না দিয়ে তার শোবার ঘরের দরজায় বার বার তাকাচ্ছি বুঝতে পারলেন।

কিশোরীটি হয়তো হুজুরের মেয়ে। হুজুরের মেয়ে হলেও তাকে পর্দা করতে দেখা গেল না। হয়তো ঘরে পর্দা করার নিয়ম নেই। আমি পর্দা বেপর্দা নিয়ে ভাবিত হলাম না। চোখাচোখির পরে কিভাবে এগোনো চিন্তা করতে লাগলাম।

পরের দিন আরবি পড়তে গিয়ে পুরোপুরি দমে গেলাম। বৈঠকখানা এবং শোবার ঘরের দরজায় নতুন পর্দা লাগানো হয়েছে। বুঝা গেল আমার আর কিশোরীর মাঝে কিছু একটা হচ্ছে বুঝতে পেরে সতর্কতা মূলক ব্যবস্থা। এত সাবধানতার পরেও চোখ পর্দা মানল না। আমি পর্দায় চোখ রাখি আর পর্দা সরিয়ে কিশোরী।

চোখাচোখির দ্বিতীয় পর্বে চিঠি চালাচালি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলাম। আর জানা গেল কিশোরী আসলে হুজুরের তৃতীয় তরফ। হুজুরনীর সাথে ভালবাসাবাসির শাস্তি হিসেবে বড় ভাই আমাকে একশবার কান ধরে উঠবস করালেন।

আমার কাছে ভালবাসা মানে কান ধরে একশবার উঠবস করা…

ভালোবাসাই ধর্ম!…

329

এক জন বিশ্বাসী মানুষের আচার আচরণ
আর এক জন অবিশ্বাসীর আচার আচরণে পার্থক্য থাকবে, থাকে।
আচার আচরণে সুশীলতা
কিংবা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তুষের আগুনের মত শক্তি শালী; আপনি যতোই ধামাচাপা দিতে চাইবেন সে ততোই শক্তি পাবে।
তুষের আগুন যখন মিন মিন করে তখনো প্রজ্বলিত
আর যখন দাউ দাউ করে তখনো প্রজ্বলিত; পার্থক্য হচ্ছে একটা দৃশ্যমান- আরেক টা অদৃশ্য!
বিখ্যাত সাধক মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রাজ্ঞ ব্যাক্তি মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি রা:
বলেছেন –
ভালোবাসা হল সুস্থ থাকার উপায়। ভালোবাসা হলো শক্তি। ভালোবাসা হল সবকিছু বদলে দেওয়ার জাদু। ভালোবাসা হল স্বর্গীয় সুখ দেখার আয়না।।। এস আবারো ভালোবাসায় নিমগ্ন হই। এসো। ভালোবাসায় এই পৃথিবীর সমস্ত ধূলিকণা। চকচকে সোনায় রূপান্তর করি।
যখন কাউকে ঠকাতে যাবেন, বা ঠকাবেন
মনে রাখবেন তাকে ঠকিয়ে আপনি হয়ত একটা কিছু জিতে নিচ্ছেন
কিন্তু যা হারাচ্ছেন তা হচ্ছে আপনার আপন সত্তা;
আর আপন সত্তা যখন হারিয়ে যায় তখন দুনিয়ার কিছুই আপন থাকে না।
পক্ষান্তরে যিনি ঠকছেন
তিনি হয়তো বিশেষ বিজয় বা বিশেষ অর্জন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, তাতেও তিনি সন্তুষ্ট!
কারণ তিনি আপনাকে বিশ্বাস করেছিল
আপনার উপর আস্থা ও ভালোবাসায় নিজেকে লীন করেছেন।

ভালোবাসা একটা ধর্ম!
পরম ধর্ম!
এই ধর্মের একটা আদর্শ হচ্ছে দুনিয়ার সবার কাছে সে সুপ্ত, অথবা গুপ্ত থাকলেও
যেই মানুষের ভালোবাসা সে লালন করে তার কাছে সে স্বচ্ছ, পরিষ্কার!
দু’জনের দু’টি মন এক-বৃন্তে লীন না হলে কখনো ভালোবাসা তার স্বরূপ মর্যাদা লাভ করে না।
অন্য সবার কাছে আপনি যা-ই হওন
এক জনের কাছে আপনি চির উন্নত মম শির এর মত
যদি আপনি তাঁকে পায়ের ধুলো ভাবেন, কিংবা আর সবার মত একি দৃষ্টিভঙ্গি তে দেখেন-
তাতে তার কিছু করার নাই
কিন্তু আপনাকে সে যেই স্থানে অধিষ্ঠিত করেছেন, আপনার ক্ষীণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আপনি তার দেয়া সেই মর্যাদা ,
সেই স্থানের অবমাননা করলেন।

এই যে বিশ্বাস
এই যে ভালোবাসা
মর্যাদা
সম্মান
এই সব ঘিরে গড়ে উঠা যেই স্বপ্নের স্থাপত্য
ধীরে ধীরে এই স্থাপত্য নড়বড়ে হয়ে উঠে! ভঙ্গুর হয়ে উঠে!
যার ফলে একটি প্রলয় একটি দুর্যোগের জন্ম নেয় যার প্রভাব শুধু আপনার একার অথবা সংশ্লিষ্ট সেই মানুষ টার উপর পড়ে না,
বরং এর প্রভাব পড়ে আশা পাশের চারদিকে।
একটা নেতিবাচক অনুরণন এর প্রভাব ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে।

মানুষ তখনি সব ভুলে ভুল পথে পা বাড়ায় যখন সে ঠকতে ঠকতে নিজের উপর আর মায়া থাকে না।
যখন নিজের উপর মায়া থাকে না তখন সে ভুলে যায় তার ব্যক্তিত্ব, তার স্ট্যাটাস …… আনুষঙ্গিক সব।

সুতরাং নিজেদের মধ্যে যতটুকু সম্ভব স্বচ্ছতা রাখুন।
কারণ ভুলে যাবেন না
আপনি একা নয়।।

আমাদের বেড়াল আমাদের মতো হয়নি

সাত
ননীবালা উঠোনে ব’সে খেজুরপাতার পাটি বুনতে বুনতে ঘরের দিকে মুখ বাড়াল : ও ভাই, ও দিদি, গলার আওয়াজ পাচ্ছি না যে? না পড়লি কিন্তু চাকরি পাবা না, বাকরি পাবা না, শেষে মস্‌সোবাসার মুখ্যু জামাই হয়ে থাকতি হবে।

শুধু মহেশ্বরবাসা কেন, ননীবালার আমলে পুব-পাকিস্তানে অনেক পুরুষই স্কুল কী বস্তু চিনত না। তো, এক বিয়েবাড়ির বাসররাতে কনের বান্ধবীরা বরের পড়াশুনোর পরীক্ষা নেবে ঠিক করল। একটা পোস্টকার্ড এনে তার হাতে দিয়ে বলল, সইয়ের কাকা বিয়েতে আসতে না পেরে এই চিঠিখানা লিখেছে। আমরা মুখ্যু অবলা নারী, একটু যদি পড়ে শোনান।

জামাইয়ের বিদ্যে না থাক, বুদ্ধিতে সে মহামতি আকবর। পোস্টকার্ডটা নেড়ে-চেড়ে আবার মেয়েদের হাতে ফেরত দিয়ে বলল, কী আর পড়ব, সবই মায়াদয়ার কথা!

চাঁদের মা এমন হাসিয়ে গল্প ক’রে শাসনবার্তা দিতে পারে না। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে ছেলেমেয়েদের পড়াশুনোয় ঢিলে ভাব আসে — স্কুলের ছুটি, সরস্বতীপুজো, নতুন ক্লাসে ওঠা, রামযাত্রা, সার্কাস… আর ততই সে “না পড়লি খাবি কী? জোন-খাটার মুরোদও তো নেই” ব’লে বাচ্চাদের আত্মায় আতঙ্ক গুঁজে দেয়। যেন পণ্ডিতবাড়িতে একটা যজ্ঞই চালু থাকবে — পুস্তকহোম; স্কুলের মার্কশিটই মানুষের আত্মপরিচয় হবে।

পাঁচ ভাইবোনের শরীরে তাই স্মৃতি ছাড়া কোনও শক্তি নেই; এমন সব ছত্রপতি চেহারা, ইলশেগুঁড়ির সঙ্গেও লড়ে জিততে পারে না। তাদের বাবা জানলা থেকে এসব লক্ষ করে পরীক্ষার খাতা দেখতে দেখতে। এর মধ্যেই তুড়ুক ক’রে কিশমিশ ঘরে ঢুকলে থিন বিস্কুট চারভাগ ক’রে এক টুকরো ছুঁড়ে দিল। ছেলেমেয়ের বেড়ালপ্রীতি নির্মলকে খুশি রেখেছে। কুকুরপোষা মানুষের অনেক দাবী পোষ্যের কাছে — বশম্বদ হও, নিরাপত্তা দাও, চোরডাকাত ধরো; কিন্তু যে বেড়ালকে বুকে টেনে নেয়, তার তাকত আছে কিছু পাওয়ার আশা না ক’রেই ভালোবাসার।

এসব ঘটনার মাঝখানে তর্‌বোরে-কে দেখা গেল — ফোকলা দাঁতে তড়বড় ক’রে কথা বলা সদাবিরক্ত এক ভগ্নদূত। হাড়-সম্বল শরীরে শায়াব্লাউজহীন একখানা কোরা কাপড় জড়িয়ে খালি পায়ে খরখর ক’রে পাড়া টহল দিয়ে বেড়ায়। নিমতিতা কলোনির সমস্ত ভালো খবর তুমি যেমন সুধার মুখে পাও, দুঃসংবাদপত্র এই তর্‌বোরে।

— চারপেয়ে নিয়ে আর আদিখ্যেতা করবেন না, মাস্টারমশাই। অ্যাহোনি দেহে আসলাম বিড়েলের হাঁচোড় খায়ে মোন্‌সাবাড়ির ছোটো ছেলেডা অজ্ঞান!

আট
চার বছরের বাচ্চা দুলুকে শুইয়ে রাখা হয়েছে মনসাভিটের বারান্দায়। তর্‌বোরের বাসি খবরে দুটো ভুল — অজ্ঞান নয়, সে মারা গেছে। বেড়ালদংশিতও হয়নি, বোড়া সাপের কামড় খেয়েছে মানিক দাসের ছেলে।

ঘটনার পুনর্নির্মাণ এভাবে করা যায় :
মানিকের বাড়ির পেছনে দাঁতনগাছ আর জার্মানিলতার ঘন ঝোপ; সকালে বাড়ির মেয়েরা সংসারে ব্যস্ত হলে দুলু তার ম্যাও বেড়ালকে নিয়ে সেই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে শুকনো ডোবা পেরিয়ে অশথের থানের দিকে যাচ্ছে। গাছটার কোটরে বৌদ্ধ সময়ের কষ্টিপাথরে গড়া এক যক্ষমূর্তি এমনভাবে ঝুরি আর শেকড়ের গরাদে আটকানো যে মূর্তিচোর আজও তুলে নিয়ে যেতে পারেনি। গ্রামের লোক তাতে শিবজ্ঞানে ফুল বেলপাতা চড়িয়ে থাকে। তো, এই রাস্তাতেই এক তাল গোবরের মতো পড়ে থাকা চন্দ্রবোড়ার ঘাড়ে দুলুর পা পড়ল, দুলুকে ছোবল মেরে গোড়ালি পেঁচিয়ে ধরল সাপটা, ম্যাও হাঁচড়ে-কামড়ে সরাল তাকে। অবোধ শিশু সেই অবস্থায় ঘুরতে থাকল জঙ্গলে, কুল কুড়িয়ে খেল। তারপর যখন স্নায়ু বিকল হয়ে আসছে, বাড়ি ফিরে গড়িয়ে পড়ল উঠোনে।

মনসাতলার সামনের রাস্তায় ভিড়ে মিশে দাঁড়িয়েছিল সঞ্জু, আর শক্ত ক’রে দাদার হাত ধ’রে চাঁদ। বাঁশের চটায় ঘেরা ছোট গরীব মন্দিরে চারটে আবছা নাগেশ্বরী প্রতিমা দেখা যায়, মূর্তির চেয়েও ভয়ানক লাগে মাথা ঘিরে জ্যোতিশ্চক্রের মতো সাপের ফণাগুলো। মানিক দাসের বাড়িতে দুটো ভিন্ন স্রোত পাশাপাশি বইছিল — দুলুর মা মৃতদেহের পাশে উপুড়, বাড়ির মেয়েদের কুক দিয়ে মরনকান্না; এদিকে দুই ছেলে উঠোনে আসন গোছাচ্ছে, বাজারে ছুটছে; শোক কম, প্রতিজ্ঞা বেশি তাদের চোখেমুখে। আর পাড়ার মহিলাদের মাথায় চাঁদ সদাগরের আখ্যান — সাপে কাটলে ছ’দিন পর্যন্ত প্রাণ থাকে। স্বয়ং মায়ের জাগ্রত থান যে-বাড়িতে, পদ্মাবতী তাদের সন্তানেরই প্রাণ হরণ করবেন, হয় নাকি? এ-সবই দেবীর লীলা, তিনি ভক্তের পরিক্ষে নিচ্ছেন।

তখন মানিকের বড় ছেলে শিবুর সঙ্গে ঝোলা কাঁধে দুজন বেঁটে বলশালী মানুষ ঢুকল বাড়িতে। জুতো খুলে উঠে গেল মনসামণ্ডপে, ওসমান নামের লোকটা মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলল জমায়েতকে, আর সুলেমান দুলুর শরীরের ওপর ঝুঁকে পড়ে তার বুকে চাপ দিল হাতের তালু দিয়ে। ফুস ক’রে শ্বাস বেরিয়ে এল কি নাক থেকে, গলায় হালকা গোঙানি শোনা গেল? দুলুর মা “আমার দুলদুল বাঁইচে আছে! আমি কোইছিলাম না” ব’লে শিশুর শরীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে গেলে তাকে একহাতে আটকে গলা চড়াল সুলেমান, “বাচ্চাকে সুস্‌তু ক’রে দেব, তিন দিন টাইম লাগবে”। প্রচুর হৈচৈ শুরু হল এর ফলে, দেবীকৃপাধন্য মানিক দাস ফেরেশতাজ্ঞানে ওঝার পা জড়িয়ে ধরল। এগিয়ে এল নিমতিতা কলোনির আপনি-মাতব্বর বলরাম, “সাওয়ালডারে যদি বাঁচাতি পারেন, আপনাগো নামে বেদী বানায় দেয়া হবে”।

ধূপধুনো, এক বালতি জল, ভাঙা নিমডাল, কাচের বাটিতে পাতিলেবু আর হাতপাখা — ছয় পদে সাজানো উঠোন। দুলুর শরীর নামিয়ে পূর্বাস্য ক’রে শোয়ানো হলে শীতের সন্ধেয় ঝপঝপিয়ে বালতির জল বাচ্চার গায়ে ঢেলে দিল সুলেমান। গা মুছিয়ে পায়ের ক্ষতয় ভালো ক’রে মলমপট্টি করল দুই ওঝা; মা পদ্মাবতীর নাম নিয়ে হাঁটুর ওপরে ধুলো-বাঁধন দিল। এবার আসনে ব’সে হাতে তুলল নিমডাল :

তিরপুনিয়ে তিরপুনিয়ে সঙ্গে ব’সে কান্দে রে
আও সখী বাও বন চৌষতি যাব না…

সঞ্জু বুঝতে পারে না এটা কোন ভাষা। একটা লাইন ধরতে গিয়ে পরেরটা মিস হয় :

উরবোড়া উরবোড়া, আরেক জায়গায় খাইয়ে মরা
চৌসবা মারবো লাত্থি, গায়ে হবে শব্দ, মুখে বিষ পাতাল ধায়…

মানিক দাস ওসমান-সুলেমানের ঠিক মুখোমুখি উবু হয়ে হাতজোড় ব’সে, যেন তারই বিষ ঝাড়ানো চলছে :

গ্যাল ফেলতে গেল নিয়া খেড়কা নদীর পার
গ্যাল ফেলতে গ্যাল ফেলতে ছিঁড়ল গলার হার

ওসমান এবার জিগ্যেস করছে :

ওরে ওরে ডোংকোর শোংকোর ভাই
কী সে সাপ কামড়াইল কও দেখি মোর ঠাঁই?

সুলেমান উত্তর দিল :

বিদ্যাপতি মরোলা পাইট্যা আছে যার
চল্লিশ কোটি বোড়ার বিষ শিব দিল সে

আবার দুজনে একসঙ্গে :

কোন কোন বোড়া, এর বোড়া শিব বোড়া
কোইয়া জিকুরিয়া চক্করিয়া কাদুরিয়া মান্ডলিয়া
সদাই উড়ে পড়ে রক্তে তোলপাড় করে
মানুষ-গোরু যে যেখানে পায়
ফুঁ দিয়া উড়িয়া তার গা’য়

দুজনে হামাগুড়ি দিয়ে দুলুর কাছে পৌঁছে নিমডালের ঝাপটা মারে তাকে :

ছাপ্পান্ন কোটি বোড়া বিষ যে নালে আসিয়াছিস
সেই নালে যা-গা রে বিষ
বিষে বিষহরি আইগ্যা
নাই বিষ মা পদ্মা, নাই

ভিড় থেকে নাগমাতার নামে জোকার উঠলে মানিক ও তার বউ আভূমি প্রণাম করে।

এবার হাতে তালি দিয়ে গান শুরু। কপালে অ্যাত্তো বড় গোলা সিঁদুরের টিপ একটা বউ কুলোর ওপর মনসার ঘট বসিয়ে কলোনির বাড়ি-বাড়ি সিধে তুলে বেড়াত। সঞ্জুর তাই চেনা লাগল কথাগুলো :

বন্দিলাম বন্দিলাম মাগো যন্ত্রে দিয়া ঘা
অবধান করো মা গো জগৎগৌরী মা
হংস বাহনে বন্দম দেবী পদ্মাবতী
অষ্টনাগ সহিত মা এসো শীঘ্রগতি

এবার “ওগো মা, পুরাও মনের বাসনা” ব’লে ধুয়ো টানল দুই ওঝা, গলা মেলাল পাড়ার সবাই।

নয়
বাকি পদ লিখতে পারছি না, মায়া এসে সঞ্জু-চাঁদকে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে গেছে। কিন্তু খবর তো ঘনত্বহীন তরল, অণুছিদ্র পেলেই চুঁইয়ে পড়ে। শোনা গেল, রাতে কলকাতায় ফিরে পরের দিন দুপুর-দুপুর এসে দুই ওঝা আবার লেগেছে বিষ নামানোর কাজে। কী আশ্চর্য, আস্তে আস্তে শুকনো কাঠ হয়ে যাওয়া শরীর নরম হচ্ছে, চোখের পাতা অল্প ফাঁক হল দুলুর, হাতের মুঠো খুলে গেল তার একটু পরে — ততক্ষণে চোঁয়ানো জলে ভিজে গোটা নিবাধুই গ্রাম ভেঙে পড়েছে মনসাবাড়িতে। শেষে দুলু পেছছাপ ক’রে দিতেই আত্মবিশ্বাসী জনতা জয়ধ্বনি দিল বিষহরার নামে।

ছেলেটাকে মণ্ডপের ভেতরে রেখে গায়ে কাঁথা চাপা দিয়ে দুই ওঝা বিদায় নিচ্ছে আজকের মতো — কাল ভোরে রোগি চোখ মেলবে, এক কাপ গরম দুধ যেন প্রস্তুত থাকে। কিন্তু পরের দিন থেকে আর মুখ দেখাল না ওসমান-সুলেমান, না জাগল দুলদুল। উলটে তার ছোট্ট উদর ফুলে ঢোল, সারা গায়ে চাকা-চাকা কালো দাগ, ভক করে দুর্গন্ধ নাকে আসছে মন্দিরের দরজা খুললেই। তর্‌বোরে আবার “ও দিদি, শুনিছেন” ডাক দিয়ে চাঁদের বাড়িতে।

— সত্য, তেতা, দ্বাপর পার হয়ে কলিতি আইছি। চাদ্দিক পাপে পরিপুন্নো। এ-যুগি জ্যান্ত মানুষ মরে যায়, তার মরা বাঁচবে কী ক’রে!
তারপর গলা নামিয়ে — মান্‌কে মনে হয় পাগোল হয়ে যাবেনে।

এগারো
“শালার মোনোশা” বলতে বলতে মন্দিরের মধ্যে একবার ক’রে ঢুকছে মানিক দাস আর এক একটা প্রতিমা তুলে এনে উঠোনে আছাড় মারছে। মূর্তির মুকুট খুলে গড়াচ্ছে মাটিতে, ধড় থেকে মুন্ডু খ’সে গোঁজের লাঠি বেরিয়ে পড়ছে। কখনও পতনের ধাক্কায় দেবীর বুক দুই স্তনের মাঝখান দিয়ে ফেটে গিয়ে হাঁ ক’রে পড়ল ভেতরের খড়মাটি। শোনা গেল, ওঝাদের খোঁজ নিতে শিবু কলকাতার রাজাবাজারে গিয়েছিল, সেখানে দুই জোচ্চোর তাকে মেরেধ’রে টাকাপয়সা কেড়ে নিয়ে ভাগিয়ে দিয়েছে।

কাঁচাখেগো দেব্‌তাদের পুজো করতে যারা ডরায় — পাছে আচারবিচারে ভুল হয়ে দেবীর কোপদৃষ্টিতে পড়ে — ঈশ্বরহত্যায় মেতে ওঠা লোকটাকে দেখে তারা সরে যাচ্ছিল। হঠাৎ মানিকের হাত থেকে পাকা কলার মতো সাপের ফণার এক সজ্জা মাটিতে সবেগে প’ড়ে এদিক-ওদিক ঠিকরে গেল, আর পেছনে কাঠি গোঁজা একটা ফণা, যার মুখে দুটো লোহার তার চেরা-জিভের অনুকরণে বসানো, ছিটকে এসে অবিকল ছোবলের মতো ফুটে গেল চাঁদের পায়ের আঙুলে। মুহূর্তের ঘবরাহট আর ব্যাথায় কেঁদে উঠেছে সে। তখনই পেছন থেকে কারও রোগা উষ্ণ করতল “কিচ্ছু হয়নি” শব্দের সঙ্গে মিশে তার পায়ের পাতাটা মুঠোয় তুলে নিল, যেন সোনার গয়না মুড়ে রাখা হল সিল্কের কাপড়ে। আহ, যে বাবা সর্বত্র অনুপস্থিত, ফতুয়ার ওপর ধুতির খুঁট জড়িয়ে কখন কলোনির রাস্তায় ছেলের গা ঘেঁষে এসে দাঁড়িয়েছে!

পরমব্রহ্ম কারও দায়িত্ব নেন না, আগে থেকেই হাত তুলে দিয়েছেন, তাই নির্বিষ তাত্ত্বিক ছাড়া তিনি শত্রুহীন। কিন্তু লৌকিক দেবতার বেলায় যদি ভক্ত মরে, তবে ভগবানেরও ছাড়ানকাটান নেই। সাপ ঘুরছে বনেবাদাড়ে, বেড়াল পাবে রাস্তায়, জঙ্গল নিশ্চিত বাঘস্থান, তাছাড়া গরমে ঘরে ঘরে ভেদবমি আর মারু বেহাগ তো নয়, মারী বসন্ত। মানুষের সঙ্গে একই সংসারে একই প্রকৃতিতে বাস করছেন দেবতারা, দুধটা-কলাটা নিচ্ছেন গরীবের, তাই বিশ্বাসঘাতকতা করলে ফল ভুগতে তো হবেই। ছেলে নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে নির্মল এসব ভাবে। ব্রহ্মের সাধনা হল অর্থনীতির মূলসূত্র মুখস্থ করার মতো, তাতে চাকরিতে মাইনে বাড়বে না। কলকাতায় খাদ্য আন্দোলনের মিছিলে পা মেলানো মানুষ যেমন সরকারকে ভোট দিয়েও অভুক্ত থাকে, মানিক দাসও সেভাবে নিজেকে প্রতারিত মনে করছে। এটা কবিতার বিষয় হতে পারে, না প্রবন্ধের — নির্মল সহসা ঠিক করে উঠতে পারল না।

(আরও আছে)

তবে সেই মহান শক্তিটি কি?

3299 তবে সেই মহান শক্তিটি কি?
তা আপনার দৃষ্টিতেই বোঝার উপায় রয়েছে। মহান শক্তি জীবনকে প্রভাবিত করে কিংবা (আমি মনে করি আপনার বিশ্বাস দ্বারা সেই শক্তিকে ফাইন্ড আউট করবেন যাকে আপনি চেনেন জানেন বিশ্বাস করেন।)
মহান শক্তি দ্বারা প্রভাবিত না হলে জীবন অর্থহীন।

ভূমিকা:
“মহান শক্তি দ্বারা প্রভাবিত না হলে জীবন মূল্যহীন” এই বিবৃতিটি নির্দেশ করে যে উচ্চতর শক্তি বা শক্তির প্রভাব ছাড়া জীবনের কোন অর্থ বা উদ্দেশ্য নেই। মানবজীবনকে প্রভাবিতকারী একটি মহান শক্তির ধারণাটি মানব ইতিহাস জুড়ে বিভিন্ন আকারে উপস্থিত রয়েছে এবং এটি অনেক দার্শনিক, ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের একটি কেন্দ্রীয় বিষয়। এই আর্টিকেলটি সেই বিবৃতিটির অর্থ এবং মহান শক্তির বিভিন্ন ব্যাখ্যা যা মানব জীবনের গঠন এবং উদ্দেশ্য প্রদান করতে পারে তা অন্বেষণ করবে।

ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা
অনেক ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক বিশ্বাস মনে করে যে ঈশ্বর বা ঐশ্বরিক শক্তির মতো উচ্চতর শক্তি মানুষের জীবন গঠন এবং এর উদ্দেশ্য নির্ধারণের জন্য দায়ী। এই ব্যাখ্যা গুলিতে, মহান শক্তিকে সমস্ত সৃষ্টির উত্স এবং মহাবিশ্বের ধারক হিসাবে দেখা হয়। উদাহরণস্বরূপ, খ্রিস্টধর্মে, ঈশ্বর বিশ্ব এবং সমস্ত জীব সৃষ্টি করেছেন বলে বিশ্বাস করা হয় এবং প্রতিটি ব্যক্তির জীবনের জন্য একটি পরিকল্পনা রয়েছে। একইভাবে, হিন্দুধর্মে, মহান শক্তিকে চূড়ান্ত বাস্তবতা বা ব্রহ্ম দ্বারা প্রতিনিধিত্ব করা হয়, যা সমস্ত অস্তিত্বকে পরিব্যাপ্ত বলে বিশ্বাস করা হয়। এই ঐতিহ্য গুলিতে, এটি বিশ্বাস করা হয় যে জীবনের উদ্দেশ্য হল মহান শক্তির পরিকল্পনা পূরণ করা এবং তার সাথে মিলন অর্জন করা।

দার্শনিক ব্যাখ্যা
দার্শনিকরা মানবজীবনকে প্রভাবিত করে এমন একটি মহান শক্তির ধারণাও অন্বেষণ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, ইমানুয়েল কান্ট, একজন জার্মান দার্শনিক, বিশ্বাস করতেন যে নৈতিক আইন, যাকে তিনি “নির্দিষ্ট বাধ্যতামূলক” বলে অভিহিত করেছেন, সেই মহান শক্তি যা মানুষের জীবনকে রূপ দেয়। কান্টের মতে, শ্রেণীগত বাধ্যবাধকতা হল একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতা যা ব্যক্তিদের সর্বদা সর্বজনীন নীতি অনুসারে কাজ করতে হবে। এই দৃষ্টিতে, জীবনের উদ্দেশ্য হল নৈতিক আইন অনুসারে জীবনযাপন করা এবং অন্যের মঙ্গলকে প্রচার করা।

মহান শক্তির আরেকটি দার্শনিক ব্যাখ্যা অস্তিত্ববাদী দর্শনে দেখা যায়। অস্তিত্ববাদীরা বিশ্বাস করেন যে জীবনের কোন অন্তর্নিহিত অর্থ বা উদ্দেশ্য নেই এবং ব্যক্তিদের অবশ্যই তাদের নিজস্ব অর্থ এবং উদ্দেশ্য তৈরি করতে হবে। এই দৃষ্টিতে, মহান শক্তি কোন উচ্চ শক্তি বা দেবতা নয়, কিন্তু ব্যক্তির নিজস্ব ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং পছন্দ। জীবনের উদ্দেশ্য, তাহলে, স্বতন্ত্র কর্ম এবং প্রতিফলনের মাধ্যমে অর্থ এবং উদ্দেশ্য তৈরি করা।

একটি মহান শক্তি হিসাবে প্রাকৃতিক বিশ্ব
কিছু ব্যাখ্যায়, মহান শক্তিকে প্রাকৃতিক বিশ্ব এবং এর প্রক্রিয়া হিসাবে দেখা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি ধরে রাখে যে প্রকৃতির নিয়ম এবং ভৌত মহাবিশ্ব মানুষের জীবনকে গঠন করে এবং এর উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে। উদাহরণস্বরূপ, বিবর্তনের ধারণা, যা প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রজাতির ক্রমান্বয়ে বিকাশকে বর্ণনা করে, পৃথিবীতে জীবনকে রূপদানকারী মহান শক্তি হিসাবে দেখা হয়। এই দৃষ্টিতে, জীবনের উদ্দেশ্য হল প্রাকৃতিক জগতে মানিয়ে নেওয়া এবং বেঁচে থাকা।

উপসংহার অথবা আমার অনুভূতি বিশ্লেষণ ও ফলাফল।
“মহান শক্তি দ্বারা প্রভাবিত না হলে জীবন মূল্যহীন” এই বিবৃতিটি বিভিন্ন উপায়ে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। একটি উচ্চ শক্তি বা দেবতা, একটি নৈতিক আইন, ব্যক্তিগত বিষয়গত অভিজ্ঞতা, বা প্রাকৃতিক বিশ্ব হিসাবে দেখা হোক না কেন, মানব জীবনকে গঠন করে এবং এটিকে উদ্দেশ্য প্রদান করে এমন একটি মহান শক্তির ধারণাটি অনেক দার্শনিক, ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের একটি কেন্দ্রীয় বিষয়। শেষ পর্যন্ত, মহান শক্তির ব্যাখ্যা এবং মানব জীবন গঠনে এর ভূমিকা ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিশ্বাসের বিষয় বলেই আমি মনে করি।