বিভাগের আর্কাইভঃ জীবন

মন যেতে চায়!

295tt

আমার বড়ো মেয়ে মৌটুসি ঢাকা ওয়াইডাব্লিউসিএ স্কুলে যখন নার্সারিতে পড়তো, স্কুলের ফাংশানে ওর ক্লাসের এক বন্ধুকে নাচ করতে দেখে ওরও নাচ শেখার শখ হলো।

ঐ স্কুলেই নাচের ক্লাসে ওকে ভর্তি করালাম। সপ্তাহে দুইদিন ওকে নাচের ক্লাসে নিয়ে যাই।
টিচার বাচ্চাদের নাচ শেখাতেন, বাচ্চাদের মায়েরা নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করতো।

আমি মায়েদের গল্পে মনোযোগ না দিয়ে তাকিয়ে থাকতাম নাচের টিচারের দিকে।
টিচার হাতের ইশারায়, হাতের আঙুলের আঁকিবুঁকি দিয়ে নাচের মুদ্রা তৈরি করতেন, আমি মুগ্ধ চোখে দেখতাম।

টিচার যেদিন দুই হাতের আঙুল আর মুঠি দিয়ে ‘পাখি’র মুদ্রা দেখালেন, আমার মাথার ভেতর তোলপাড় শুরু হলো। কোথায় দেখেছি, এমন পাখি কোথায় দেখেছি! কিছুতেই মনে পড়ছিলো না!

মৌটুসি ঘরে ফিরে প্রতিদিন নাচের প্র‍্যাকটিস করার সময় আমাকে বসিয়ে রাখতো। ওর ভুল হলে যেনো ভুলগুলো ঠিক করে দিতে পারি।

‘সুন্দরী কমলা নাচে’ গানের সাথে নাচের মুদ্রা প্র‍্যাকটিস করতে গেলেই হাতের আঙুল আর মুঠি দিয়ে পাখির মুদ্রা করতে হতো।

মৌটুসির হাতের মুদ্রার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই একদিন চট করে মনে পড়ে গেলো, এই পাখি কোথায় দেখেছি!

পূর্ব পাকিস্তান আমলে আমরা থাকতাম নারায়ণগঞ্জের নগর খানপুর এলাকায়। তখন আমি খুব ছোটো ছিলাম।
একজন বুড়ো বেহালা বাজিয়ে ভিক্ষে করতো।
বুড়ো আমাদের কোয়ার্টারেও আসতো ভিক্ষে নিতে।
উনার বেহালার মাথাতেই দেখেছি ঠিক এরকম একটা পাখি (কাঠের তৈরি)!

বুড়ো বেহালা বাজাতো, আমি পাখিটার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতাম।

পূর্বপাকিস্তান পিরিয়ডের কথা বলছি। তখন পথে ঘাটে খুব বেশী ভিক্ষুক ছিলো না।
যারা ভিক্ষে করতে মানুষজনের বাড়ি যেতো, তারাও একেবারে খালি হাতে ভিক্ষে চাইতো না।

কেউ একতারা দোতারা বাজিয়ে গান শোনাতো, কেউ খোল করতাল বাজিয়ে হরে কৃষ্ণ গেয়ে ভিক্ষে করতো।

একজন ফকির বাবা আসতো, আমরা ডাকতাম ‘ মুশকিল আসান’!
কারণ সেই ফকির বাবা বাড়ির উঠোনে পা দিয়েই জোরে বলতো, মুশকিল আসান। সেই থেকেই ফকির বাবার নাম হয়ে গেলো মুশকিল আসান।
মুশকিল আসান বাবা এসে উঠানে দাঁড়ালেই বাচ্চারা সব ছুটোছুটি করে মুশকিল আসানকে ঘিরে ধরতো।
মুশকিল আসানের পোশাক ছিলো বিশাল আলখাল্লার মতো, কতো রঙের কাপড় জোড়াতালি দিয়ে বানানো। গলায় থাকতো এক গোছা বড়ো দানা পুঁতির মালা।
মুশকিল আসান দুই চোখে কাজল দিতো।
উনার কাঁধে থাকতো ঝোলা, হাতে ধরা থাকতো টিনের পাতে তৈরি ধুনুচি। সেই ধুনুচি থেকে ধোঁয়া বের হতো।

মুশকিল আসান হাঁকডাক, হম্বি তম্বি করতেন না। উঠোনে এসে মুশকিল আসান বলে দাঁড়াতেন, তাতেই সাড়া পড়ে যেতো।

আমরা কাছে গেলে মুশকিল আসান আমাদের সবার কপালে ধুনুচি থেকে ছাইকালির টিপ পরিয়ে দিতেন, তাতেই আমরা খুশি হতাম।

মুশকিল আসান খুব শান্ত হলেও উনাকে আমার ভয় করতো। উনার কাছে গিয়ে টিপ পরতাম ঠিকই, কিন্তু উনার কাঁধে ঝুলানো ঝোলার দিকে তাকালেই মনে হতো, হঠাৎ আমাকে ধরে ঐ ঝোলার ভেতর ভরে ফেলবে।

আরেক জন আসতো গাজীর পট নিয়ে। কাপড়ের ক্যানভাসে রঙ দিয়ে আঁকা কত ছবি। কি কি যেন ছড়া কেটে গান করতো গাজীর পট নিয়ে আসা মানুষটা।

গাজীর পটের লোকটাই মনে হয় আমাদেরকে বিচিত্র সব ছবি দেখিয়ে বলতো, পাপ করলে নরকে যাবে। নরকে যমরাজ কঠিন শাস্তি দেয়। মিথ্যেবাদীদের জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলে, তারপর গরম তেলের কড়াইয়ে ফেলে—- আরও কত ভয়ঙ্কর সব কথা! পটে আঁকা নরকের ছবি দেখাতো।

আরও কয়েকজন সাদা থান পরা বৈষ্ণবী আসতো। তাদের নাকে তিলক আঁকা ছিলো। তারা করতাল বাজিয়ে গান গাইতো,
” প্রভাত সময়কালে শচির আঙিনা মাঝে, গৌর চাঁদ নাচিয়া বেড়ায় রে!”

শচি শুনলেই আমার মনে হতো শচি’দার কথা। আমার দাদা বৌদির নতুন সংসারে কাজ করতো শচি’দা। বড়োরা শচি’দাকে ডাকতো শইচ্চা।

এরপর তো মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। নয় মাস যুদ্ধশেষে দেশ স্বাধীন হলো, নতুন দেশে নতুন জীবন শুরু করতে গিয়ে মাত্র নয় মাস আগের জীবনটা পুরনো হয়ে গেলো, নাকি পূর্ব জনমের স্মৃতি হয়ে হারিয়েই গেলো!

স্বাধীন দেশে প্রতিদিন শত শত ভিক্ষুকের ভীড়ে হারিয়ে গেলো পূর্ব জনমে দেখা বেহালা বাদক বুড়ো, মুশকিল আসান, গাজীর পট, “শচির আঙিনা মাঝে গৌর চাঁদ নাচিয়া বেড়ায় রে” গান গাইয়ে বৈষ্ণবীদের মুখ।

বেহালা বাদক কোথায় হারিয়ে গেছে! পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে তাঁর বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেছে হয়তো, হয়তো গুলিতে বেহালার মাথায় বসা পাখিটাও ঝাঁঝরা হয়ে গেছিলো!

স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের নতুন জীবনে সকল পুরাতনেরা হারিয়ে গেছিলো! বেহালা বাদকও হারিয়ে গেছিলেন!

পরের শৈশবেই ভুলে গেছিলাম পূর্বের শৈশবের কথা। ভুলে গেছিলাম বেহালা বাদক বুড়োর কথা।

স্বাধীন দেশে সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া জীবনের প্রতিটি দিন সংগ্রাম করতে করতেই বড়ো হয়ে গেলাম, নিজের সংসার হলো। পাকিস্তান পিরিয়ডে যে মেয়েটি ছোট্টো ছিলো, বাংলাদেশে সেই মেয়েটির কোলে এলো নতুন ছোট্টো মৌটুসি

*********************

স্বাধীনতার অনেক বছর পর, ছোট্টো মৌটুসিকে নাচের মুদ্রা শেখাতে গিয়ে আমার মনে পড়ে গেলো আমার শৈশবে দেখা কত জনের কথা! বেহালা বাদকের কথা, মুশকিল আসানের কথা, গাজীর পটে আঁকা নরকের ছবি!

**************************
সেই ছোট্টো মৌটুসিও আর ছোটো নেই। আমিও বুড়ো হতে চলেছি।

বুড়ো হতে হতেও যেন বুড়ো হতে পারছি না। গতরাতে আবার সেই বেহালা বাদককে স্বপ্নে দেখলাম!

হয়তো স্বপ্নে দেখিনি, আজকাল ঘোরের মধ্যে থাকি তো, থেকে থেকেই নিষ্পাপ নিষ্কলুষ শৈশবের কথা মনে পড়ে!

হয়তো গতরাতেও ঘোরের মধ্যেই বেহালা বাদকের কথা মনে পড়েছে। মনে পড়েছে সেই কাঠের পাখিটার কথা, যে লেজ ঝুলিয়ে বসে থাকতো বেহালার মাথায়।

কান্নার স্যুপ অথবা পুষ্টিকর রিংটোন

ভোরের দেয়ালে লাগানো আয়না। ক্রমশ বদলে যাচ্ছে। আয়নার ভেতর দৃশ্যগুলো ক্লান্ত, বহুকাল।

দৃশ্যের ফাঁকে আমরা বড় একা। আটকে আছি অসুস্থ সময়ের আচ্ছাদনে। তবুও আতঙ্ক আর দীর্ঘশ্বাস গোপন করে আকাশের দিকে তাকাই— দেখি, আমাদের বারান্দায় আকাশ থেকে ঝরছে নতুন চাঁদের ভাঙা আলো।

আমরা আধভাঙা বিশ্বাস নিয়ে— কনফিউজড ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকি সেই বারান্দার দিকে— কখন বেজে ওঠে একটি পুষ্টিকর রিংটোন!

জন্মতিথি

327

আত্মা হে
হে প্রিয় আত্মা আমার
তুমি কি খুঁজে পেয়েছ আমাকে?
আমি তবে কেন পাইনি তোমায়
আমার নিঃশ্বাসের নিবিড়ে থেকেও
কেন যোজন যোজন দূরত্ব তোমাতে আমাতে!

কেন এতো হাহাকার
সহিংসতা
নীরব স্রোতে ভেসে যাওয়া কান্নার শ্লোক
পুলক দুলক ছেদ করে
কোথা হতে আসে এতো দীর্ঘশ্বাস
অর্ঘ্য পোড়া উত্তাপ!
আত্মা হে
আমি কি সে-ই?
যে মাঘী বিকেলের ধোয়াশার ভেলা চড়ে
একফোঁটা শীতের মতো টুপ করে ঝরেছিলেম
পাতা ঝরা বৃক্ষের কর্কশ শরীরে!

নাকি
আদৌ আমি যুদ্ধরত একাকী সৈনিক
যার কদমে কদমে পেচিয়ে আছে গুপ্ত আততায়ী
যার বেদনার্ত চিৎকার
পৃথিবীর মায়া মোহে নামিয়েছে সমগ্র অন্ধকার!..
কিন্তু সেখানে তো
নির্মল হাসিও আর একবিন্দু আলোই যথেষ্ট!

শব্দ বোধন দিনে
আমি ছুঁয়েছি এই মাটি
ছুঁয়েছি একটি নূরবিন্দু
অথচ
সেই আমি খাঁটি রশ্মি হয়েও
রচনা করেছি- এই মোহগ্রস্ত জীবন!
এই অন্ধকার তাড়া করতে করতে
আমি পৌঁছেছি এক অমৃত শব্দের সামনে
একটি উড়ন্ত পাখি ক্লান্ত চিত্তে মেলে আছে ডানা
বৃক্ষের শাখায় স্পন্দিত দীর্ঘশ্বাস
একটি মায়াকণ্ঠী গান
কুয়াশার দেয়াল ভেদ করে দেখেছি স্ফটিক সকাল!

হে আত্মা
হে আমার প্রিয় আত্মা
এতো ডাকি
শুনো হে… ঘুমাইছো নাকি?

.
১২ই মাঘ
২৫/১/২৩

আমাদের বেড়াল আমাদের মতো হয়নি

চার
উঠোনে কঞ্চি দিয়ে মাটি খুঁড়ে তাতে গোড়ালি বসিয়ে এক ঘুর, দুই ঘুর, তিন ঘুর… ব্যাস ব্যাস, পিল তৈরি। হেল্লাস, সেকেন লাস, থাড় লাস। আঁটে না টোক্কায়, আগে বলবি তো!

তারক ডাক্তারের ছেলে ব্যাঁকার মতো যারা বড় গুলিশিল্পী, তাদের সহকারীর হাতে টিনের গ্ল্যাকসো কৌটোয় ঝম্পর-ঝম্পর টল, মাত্তিশ আর এমনি-গুলি। কলোনিতে ব্যাঁকার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বলরাম দাসের ছেলে সেই ফুটবলার পিকু; ব্যাঁকার টিপ বেশি আর পিকুর চোট্টামি বুদ্ধি। খেলার শেষে সবাই জানে মারামারি বাধবে, আজাদ হিন্দ ক্লাবে কাঠের প্যারালাল বারে বুক-ডন আর বেঞ্চে চিৎ হয়ে বারবেল ভাঁজা ব্যাঁকা পিকুকে এমন জাপটে ধরে যে নড়াই মুশকিল! তার মধ্যেও সে হাঁটু তুলে শত্রুর দুই থাইয়ের মাঝখানে মারে বা মাথা দিয়ে থুতনিতে ঢুঁসো লাগিয়ে জিভ কেটে দেয়।

কিন্তু কভি-কভি উদ্বাস্তু-সীমা ছাড়িয়ে গুলিখেলা আন্তর্জাতিক চেহারা নিতে পারে। আজ যেমন মান্নাপাড়া থেকে বর্মন, চালতাবেড়িয়ার ক্ষুদে, এমন অনেক বহিরাগত আর্টিস্ট কলোনির জনার্দন ভক্তের দোআঁশ মাটির টানটান বেডকাভারের মতো সেই প্রাঙ্গনে। কলাকারদের খ্যাতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে খেলতে খেলতে বিড়ি টানার অধিকার। আর ওই শিল্পীসমন্বয়ে হাঁটুঝুল স্কার্ট পরা স্কুলপাড়ার পলি মিত্র যোগ দেওয়ায় সাড়া পড়ে গেছে শরণার্থী তরুণদের হাড়পাঁজরে। আজাদ ক্লাবের বটের ঝুরি ধ’রে যারা দোল খাচ্ছিল, খোয়ারাস্তায় লাফিয়ে প’ড়ে; যারা পড়া মুখস্থ করছিল, জানলায় নিরক্ষীয় জলবায়ুকে হাট ক’রে খুলে, যারা ডোবায় ছিপ পেতেছিল, ছিপ ল্যাটামাছের জিম্মায় রেখে ছুটে এল। যেন মৈত্রী সংঘের পাশে নাগকেশর ফুলের গন্ধমাখা রেশন দোকানে আজ মাইলো দেবে!

তারপর দুই-দুই, চার-চার, আট-আট, ষোল-ষোল গুলির জিত্তাল খেলায় শ্বাসরোধ হয়ে আসে দর্শকের; প্রত্যেকবার টিপ শানানোর আগে জিভে টল ছুঁইয়ে নিচ্ছে ক্ষুদে, যেন সাপের মাথার মণি; স্কার্টের দুটো ফুলে থাকা পকেট নিয়ে পলি উঠোনে হাঁটলে “ঝুমুর-ঝুমুর নুপূর বাজে, নয়নে নয়ন মিলিয়া গেল…”! চকচকে রবিশস্যের মতো এই কাচের ফসল। বড় হয়ে বাসু হিন্দি সিনেমায় দেখেছে এমনই মূল্যবান ডায়মন্ড সাদা কোটপ্যান্টের অজিত অ্যাটাচিকেসে পুরে জোর বাতাসে টাই উড়িয়ে হেলিকপ্টারে উঠে যায়। তারপর সমুদ্রতীরে গিয়ে নামলে সেখানে সুধীর বিদেশি জাহাজে হিরে তুলে দেবে লালমুখো সাহেবের হাতে। পরের সিনে গ্রামের মেলায় নীল ঘাঘরা প’রে নাচছে হেমামালিনী। হেমামালিনীর নাভি দেখে বাসুর ভক্তবাড়ির মসৃণ পিল মনে পড়ে।

যত খেলা গড়াচ্ছিল, চটাং-চটাং আঘাতে গুলির চল্‌টি খ’সে মাটিতে অভ্রর ওয়াগন ওলটানো। এই পথিক-থামানো আনন্দের চারপাশে সদাচারী ব্রতচারী সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিয়ালদা থেকে ফেরা ফলের ব্যাপারি, মাথার পেছনে খালি ঝাঁকার ঘোমটা, লুঙির খুঁট উত্তেজনায় তার মুখে উঠে গিয়ে কোঁচকানো হাফপ্যান্ট প্রকাশিত। উলু হয়ে গিয়ে এক এক ক’রে সরে দাঁড়াচ্ছে খেলোয়াড়, গ্ল্যাকসোর কৌটো প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে উলটে দিয়ে দুঃখিত দর্শক হয়ে যাচ্ছে। যেন নায়ক ব্যাঁকার উড়ন্ত লাথি খেয়ে অজিতের হাত থেকে অ্যাটাচি ছিটকে পড়ল, আর মাটিতে গড়াচ্ছে অসংখ্য উজ্জ্বল গুলির সাঁজোয়া।

লাস্ট ডিলে শেষ শত্রু বর্মনের গুলির দিকে তেরো হাত দূর থেকে টিপ শানাবে ব্যাঁকা। মাথায় ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে বাঁহাতের মধ্যমা আকর্ণ ধনুরাসনে পেছনে বেঁকে, গোটা পৃথিবীর শ্বাস বন্ধ, গাছ থেকে ঝুঁকে দেখছে পেঁপেফুল, বাবুইবাসার দোল থেমে গেছে। আমরা জানি না বুলেট লাগবে কি লাগবে না, শ্রীকৃষ্ণের কী অভিপ্রায়, এবং বেদব্যাসও লেখা থামিয়ে দিচ্ছেন কাকে জেতাবেন ঠিক করতে না পেরে।

পাঁচ
দু’বছর আগে গুলিখেলার বিরল প্রতিভা ব্যাঁকা-চ্যাম্পিয়ানের জীবনের অন্তিম ম্যাচের কথা বললাম এত সময়। ব্যাঁকা আর নেই, অথবা আছে স্বপন হয়ে। ম্যাচের পরের দিন তেরটা কৌটো ভর্তি কম-বেশি দুহাজার গুলি সে বাচ্চাদের বিলিয়ে দেবে। এবার থেকে তাকে কেউ ব্যাঁকা ডাকলেই তেড়ে যাবে — স্বপন বলতে পারিস না! সকালের ব্যায়াম আরও বাড়িয়ে (ভালো কথা, পাজামা প’রে ক্লাবে যাচ্ছে, লুঙি ছেড়েই দিল) দুপুর-দুপুর বালিশা-র চেম্বারে বাবার পাশে একটা ছোট্ট টেবিল পেতে বসা চালু করবে। এই পরিবর্তনে কেউ খুশি হয়, কেউ হয় না, কিন্তু কলোনি আর একজন ডাক্তার পায়, বেশি রাতে ডাকলেও গলায় উত্তরীয়র মতো স্টেথো ঝুলিয়ে খুব গম্ভীর মুখে স্বপন পেশেন্টের ঘরে ঢুকে পড়ছে। শুধু সুধার ছুটোছুটি বেড়ে গেল। সে ময়নার মতো ময়নাতদন্তের খবর মুখে বাড়ি-বাড়ি উড়তে থাকে। “ও কাকি, শুনিছো”? তারপর ঘরের বাচ্চাদের “এই, তোগো এহেনে কী রে? যা, খেলতি যা!” ব’লে তাড়িয়ে চাঁদের মা’র কানের কাছে হাস্যমুখ নিয়ে যায়।

চড়কপাড়ার উকিলের মেয়ে শীলার প্রেমে পড়েছে স্বপন। এঁড়ে বাছুর থেকে বৃষ হয়ে উঠছে তাই। এভাবে দুবছর কেটে গেলে ব্যাঁকা যখন স্বপন থেকে স্বপনডাক্তার ডাক শোনার অপেক্ষায়, তখন আচমকা সবাই খেয়াল করে সে আবার ছেঁড়া স্যান্ডো গেঞ্জি পরে বাজারে চলে যাচ্ছে, বিকেলে ঘুমিয়ে উঠে বটতলায় বসে আগের মতো গুড়াকু ডলছে দাঁতে। তবে গুলিখেলায় ব্যাঁকা আর ফিরে আসেনি, তার আঙুল ওই আশ্চর্য টিপ করার ক্ষমতা ভুলে গিয়েছিল। যেভাবে শীলা ভুলে গিয়েছিল স্বপনকে।

অন্যদিকে ব্যাঁকার বন্ধুর আচম্বিতে বিয়ে হয়ে গেল অচেনা নাক-খ্যাঁদা মেয়েটার সঙ্গে, সঙ্গে অপবাদ জুটল গোপন প্রেমের। টিপু তবু ভোল পালটায়নি। সকালে ভক্তিভরে স্টেশানের গায়ে তার বইয়ের দোকানে গিয়ে বসে। সারাদিনে একটা দুনম্বর খাতা কিম্বা একজোড়া স্লেট পেনসিল বিক্রি হয়। বাড়িতে ছ’জনের কীভাবে দুটো ভাত জুটছে তাকে রহস্য রেখেই ছেলেটা পান খায়, চা খায়, গুলতানি মারে পাশের ওষুধ বা সাইকেল সারানোর দোকানের সঙ্গে। প্রায় দশ বছর হল নন্দ চলে গেছে আমতলাবাড়ি ছেড়ে, শিউলির ক্লাস সেভন, কিন্তু নন্দরাক্ষসকে নিয়ে মেয়েটার সঙ্গে তার গল্পও হয়ত সারা জীবন চলবে।

— টিপুদা, তুমি কী করে খোঁজ পাও নন্দুর? সুন্দরবনে তো যাতি দেখি না!
— নিবাধুইয়ের গোয়ালারা ভিজিট করে যে, জঙ্গলের মধু কিনতি যায় ঝড়খালি সুধন্যখালি। ওরা কালকে খবর দিল, একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটিছে মাতলা নদীতি।

ছয়
জলযান ছুটছে দক্ষিণের নদী দিয়ে। সকাল সাড়ে দশটা, তবু এখনও ধুঁধলা চারপাশ, মাথার ওপর উড়ে বেড়ানো সারসগুলোকে শামুকখোলের মতো লাগছে (সাহিত্যিকদের মতো পরিবেশ তৈরি করছে টিপু)। মাতলার ডানে-বাঁয়ে আস্তে আস্তে পার হয়ে যায় বেলাডোনা নদী, পিয়ালি-নবীপুকুর নদী। লঞ্চের ভেতর ফরেস্ট অফিসার আর গ্রামোন্নয়ন বোর্ডের সভাপতি বসে চা খাচ্ছেন। একজন নদী-বিশেষজ্ঞ, কুক, তার হেল্পার, দুই পাইলট বা সারেং — এই সাত জন নীচে আর লঞ্চের ডেকে বন দপ্তরের চার জন রক্ষী। ওপরে খুব হাওয়া, তারা কানে মাফলার জড়িয়ে রোদ্দুরে পিঠ ক’রে বসেছে, দুজনের রাইফেল ডেকের বাউন্ডারিতে হেলান দেওয়া। অফিস থেকে এভাবেই টহলে বেরনো হয়, কোথায় ম্যানগ্রোভ ভেঙে নদীর জলে মাটিসুদ্ধু তলিয়ে যাচ্ছে, কোথায় কাঠচোর বন উজাড় করে দিচ্ছে বা স্পটেড ডিয়ার মেরে নিয়ে যাচ্ছে কারা… দেখতে দেখতে বোইনচাপি খাল পার হয়ে ধূলিভাসানি গাঙের মুখে দাঁড়াল বন দপ্তরের জলযান। এখানে নদীর মুখ চেপে ছোট হয়ে এসেছে, জঙ্গলও গভীরতর সবুজ, পাখিদের হইচইতে গলা তুলে কথা বলতে হয়। রেঞ্জারবাবু কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ডেকে উঠে আসছিলেন, পেছনে সভাপতি, হঠাৎ কানে এল জলের খলবল আওয়াজ, পরক্ষণেই বাঁদিকে টলে কাত হয়ে গেল লঞ্চ। গার্ডদের স্নায়ু সজাগ, তারা ঝটপট ডেকের ডানদিকে লাফিয়ে এসে রাইফেল কাঁধে নিয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে রেলিংয়ের ফাঁকে বাঘ! প্রথমে শুধু মাথা; সেটা হাঁ হল, হলুদ দাঁত আর লালামাখা জিভের ভেতর দিয়ে মেঘডাকা গর্জন, তারপর এক লাফে রেলিং টপকে ডেকের মেঝেয় পড়ল আস্ত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। একজন গার্ড ফায়ার করেছে, লক্ষ্য পেরিয়ে সেটা গিঁথে গেল ধূলিভাসানির স্রোতে। বাঘ ফিরেও দেখল না, রেলিংয়ে থিয়ে ক’রে রাখা যে দুটো লোডেড রাইফেল, তার একটার হাতল কামড়ে ধরে বারো ফুট ওপর থেকে ঝাঁপাল জলে। গোটা অপারেশান সেরে সাঁতরে ওপারে উঠে জঙ্গলের ভেতর মিশে যেতে তার লাগল আড়াই মিনিট।

স্কুলে দিদিমনিরা যেমন বলে, তেমনি পিন-ড্রপ নীরবতায় শুনছিল চাঁদের বাড়ি। কিন্তু বাঘ তো মরল না, কাউকে মারলও না, সবচেয়ে বড় কথা কাহিনিতে নন্দরাক্ষস কোথায়?

— তোদের বলা হয়নি, নন্দকে ছেড়ে আসা হয়েছিল শুইয়া নদীর পাশে, ওই স্পটের কাছাকাছি।
— তো?
— আজ পর্যন্ত শুনেছিস বাঘ বন্দুক চুরি করে? এই বুদ্ধি তার মাথায় ঢোকাল কে! মনে রাখবি, নন্দবাবু তোদের কাছে, মানে মনুষ্যসমাজে এক বছর ছিল। আমাদের এক মানে বেড়ালের সাত বছর; এই সময়ের মধ্যে মানুষের ভাষা, তার বুদ্ধি সবই সে খুব কাছ থেকে খেয়াল করেছে। তাছাড়া, নন্দকে বন্দুক দেখিয়েই তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।

সবাই স্তম্ভিত, চিন্তিত, শিহরিত। শিউলি কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল, নন্দুকে আবার পুলিশে ধরবে না তো? বাসু বলল, নন্দর মতলব তাহলে কী? মা রান্নাঘরে উঠে যেতে যেতে বলল, আজুড়ে গল্প না দিয়ে টিপু বাড়ি যা। নতুন বউডা না খেয়ে বসে আছে।

টিপু সামান্য গলা চড়ায় — আগামি সপ্তাহের যুগান্তর কাগজে খবরটা পাবে, মিলিয়ে নিয়ো। তারপর বাসুর দিকে ঘুরে — ঘটনা এখনও পর্যন্ত এটুকুই। এর পরে কী হবে, বাঘেরাই ঠিক করবে।

(আরও আছে)

শীতের চাদর বিছানো দিগন্ত

সকালের মৃদু শীতল হাওয়া
সারা শরীর আমেজে জড়ায়
একরাশ জবা ফুল ফুটে আছে পথের ধারে
শীতের চাদর বিছানো দিগন্তে
মিলিয়ে যাওয়া সারি সারি গাছ
রোদ্দুর এসে পড়ে ছাদের কার্নিশ ও উঠোনে
দূর থেকে ভেসে আসে কীর্তনের সুর
বাগানে গোলাপ ও বেলিফুলের গন্ধ
ফুটে ওঠা দিন গোলাপের মত সুবাসিত হয়

পিচার প্ল্যান্ট এবং আলেকজান্দ্রিয়া

295

আর্কাইভ ঘেঁটে পিচার প্ল্যান্টের ছবিটা পেয়েছি।
পিচার প্ল্যান্ট, মানে কলসি গাছ। গাছ থেকে লালচে রঙের ঝুলন্ত বস্তুগুলোই পিচার বা কলসি।

এই গাছের কলসিতে জল রাখা হয় না, এর ভেতর পোকা থাকে। পোকা মাকড় গাছের গায়ে বসলে সেই পোকা কলসির ভেতর পড়ে যায়, সাথে সাথে কলসির মুখ বন্ধ হয়ে যায়।

এই কথাগুলো আমার নয়।

আলেকজান্দ্রিয়া নামে ৮/৯ বছরের মিষ্টি এক বালিকা তার ছোট ভাইকে তথ্যগুলো দিচ্ছিল। পাশে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে আমি শুনছিলাম।

২০১৬ সালের জুলাই মাসে আমি আর উত্তম আরেক বন্ধু দম্পতির সাথে বেড়াতে গেছিলাম নর্থ ক্যারোলাইনা। সেখানে ভ্যান্ডারবিল্ট সাহেবের প্রাসাদ আছে, সেই প্রাসাদের চারদিকে ছড়ানো সাজানো বাগানেই এক জায়গায় অনেকগুলো পিচার প্ল্যান্ট ঝুলছিলো।

আমি বিশাল বাগানের চারদিকে ঘুরছিলাম। তখন পদ্মপুকুরের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। বিশাল বড় পুকুর ভর্তি কত রঙের পদ্ম ফুটে আছে!

দূর থেকে উত্তম আমায় ডাকছিল পিচার প্ল্যান্ট দেখার জন্য।

কিছুক্ষণ আগেই আমি এই পিচার প্ল্যান্টের ছবি তুলেছিলাম। আবার কেন ডাকছে উত্তম!

কাছে আসতেই উত্তম আলেকজান্দ্রিয়াকে দেখিয়ে বলল, দেখো এই বাচ্চাটা গাছ সম্পর্কে কতকিছু জানে।

আমি দেখলাম, কাছাকাছি বয়সী দুটো বাচ্চা ছেলেমেয়ে পিচার প্ল্যান্ট দেখছে। মেয়েটি বড়, সে-ই চোখ মুখ ঘুরিয়ে টক টক করে কথা বলছে, আর বাচ্চা ছেলেটি মনোযোগ দিয়ে কথা শুনছে।

ওদের পাশে দাঁড়িয়ে উত্তমও ওদের কথা শুনছিল।

মেয়েটির নাম আলেকজান্দ্রিয়া, ওর ভাইয়ের নামটা মনে পড়ছে না। আলেকজান্দ্রিয়া খুব গুছিয়ে কথা বলে এবং খুব সম্ভবত কথা বলতে ভালোও বাসে।
আমি যখন আলেকজান্দ্রিয়ার সাথে গল্প করছি, হঠাৎ একজন আমেরিকান নারী আমাকেই জিজ্ঞেস করলো, ” আর ইউ ফ্রম বাংলাদেশ?”

আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, সে কী করে বুঝল আমি বাংলাদেশের মেয়ে!

আমেরিকান মেয়ে বলল, আই এম অলসো ফ্রম বাংলাদেশ।

এবার জানতে চাইলাম, সে বাংলা বলে কিনা।

আমেরিকান মেয়েটি স্পষ্ট বাংলায় বললো, সে বাঙালি। বাংলা তার মাতৃভাষা, তাই বাংলায় কথা বলতে পারে।
তার কথা শুনে নিশ্চিন্তের হাসি হেসে ফেললাম।

মেয়েটির নাম নেলি, ৮৬ সালে আমেরিকায় এসেছে। বিয়ে যাকে করেছে, সে আমেরিকান। আলেকজান্দ্রিয়া আর ওর ভাইয়ের দিকে দেখিয়ে বললো, আমার দুই ছেলেমেয়ে।

ওরা বাংলা বোঝে?

নেলি বললো, আমার বাংলা বোঝে, তবে কেউ বাংলা বলতে পারে না। আমার সাহেব বরও বাংলা বোঝে। আমার সাহেব স্বামীই কিন্তু একটু আগে আমায় ডেকে বলেছে, “দেখো, ঐ ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা মনে হয় বাংলাদেশের, ওদেরকে বাংলায় কথা বলতে শুনেছি মনে হয়।”

বরের মুখে এই কথা শুনেই নেলি আমার কাছে এগিয়ে এসে জানতে চেয়েছিল আমি বাংলাদেশের কিনা।

নেলির বর তখন উত্তমের সাথে গল্প শুরু করেছে, আর আমি গল্প করছি নেলির সাথে।
নেলিকে দেখে কিছুতেই মনে হয় না সে বাঙালি।
ভীষণ নরম স্বভাবের আমেরিকান মেয়ে যেমন হয় দেখতে, নেলি ঠিক তেমন।

সবচেয়ে অবাক হয়েছি আলেকজান্দ্রিয়ার কথা শুনে।
ও আমাকে ইংরেজিতেই জিজ্ঞেস করলো, ” তুমি কি সালোয়ার কামিজ পরেছ? জানো, আমি একটা বাংলা কথা বলতে পারি, “আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
আচ্ছা তুমি কি প্রতিদিন রাইস রান্না করো? আমার মা প্রতিদিন রাইস রান্না করে।”

নেলির ৬ বছরের ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম সে কোনো বাংলা জানে কিনা। ৬ বছরের শিশুবালক হেসে বলল, “শুনতে পাও’?

বললাম, — “শুনতে পাও” কেনো বলো, কাকে বলো?

ছয় বছরের শিশু বললো, মা বলে শুনতে পাও?

নেলি বুঝিয়ে দিল, “আমি যখন বাংলাদেশে কথা বলি, নেটে গোলমাল থাকলে বলি তো, আমার কথা কি শুনতে পাও? সেখান থেকে ও “শুনতে পাও” কথাটা পিক করেছে।

আরও অনেকক্ষণ গল্প করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু আমাদের সফরসংগি কমলেশ আর করবী আমাদের জন্য বাইরে অপেক্ষা করছিল।

নেলির সাহেব বর ইংলিশে বলল, “আমরা খুব সহজে কোন বাংলাদেশির দেখা পাই না। আজ তোমাদের দেখে খুব ভাল লাগল।’

নেলি আর ওর চমৎকার পরিবারকে হাত দেখালাম, ভালোবাসা প্রকাশ করে গার্ডেন থেকে বেরিয়ে এলাম।

পৃথিবীর কত জায়গায় কত বিস্ময় যে অপেক্ষা করে!!

কোথাও নেই কবি

3259

পরম কষ্ট গুলো নিমেষে ঢেকে ফেলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্পচিত্র। নীরবে খসে যায় নক্ষত্র। শূন্য আকাশে শ্রান্তি পরিক্রমা, বিরান ক্যানভাসে উঠে আসে উই পোকার ঢল। নেহাতই নগণ্য
কিছু শব্দ- যাকে পুঁজি করে এতকাল বেঁচেছিলো কবি। সংকোচে- নিঃসংকোচে হেসে ছিলো
পল্লবী চাঁদ! হিংসার আগুন- তাকে সর্বস্বান্ত করে দিয়ে গেছে।নিঃশেষ হয়ে গেছে সুরভী বাতাস। হঠাৎ… অদ্ভুত এক নির্বাণ জাগে, তির্যক চোখে। মৃত আবেগে। উদ্বিগ্ন আর প্রখর দৃষ্টি আটকে যায় দৈনিক পত্রিকার সাময়িকী পাতায়, লিটল ম্যাগে, অনলাইন পোর্টালে…

আজন্মকাল ধরে যে শব্দবীজ বুনেছি বহু যতন করে, যে অক্ষরে ফুটেছে হৃৎপদ্ম, যে স্বরে
দুলেছে চিত্ত, লুটেছে মায়া- হয়েছে তীর্থ; পবিত্র সে অক্ষর গুলো ভেসে যাচ্ছে নগ্ন জোয়ারে
… উলঙ্গ সাঁতারে!… কোথাও নেই কবি!

কবি নেই কবিতার সন্ধ্যার আসরে। মেলার মাঠে। কাদামাটির প্রান্তরে।ধান সিঁড়ি নদীর তীরে। আমি খুঁজেছি তারে- সাম্য সবুজে, সোঁদা অরণ্যে, নীল অনিলে, গোধূলির বর্ণীলে, জ্যোৎস্নার অভিসারে…
কোথাও নেই কবি-

আশ্চর্যজনক ভাবে ক্ষুধার রাজ্য ছেড়ে, পৃথিবীর কবি’রা পাড়ি জমাচ্ছে- ভোগে গদ্যময়
এক মহাসাগরে!

আমাদের বেড়াল আমাদের মতো হয়নি

এক
যদি একাকিত্বের দিকে তাকিয়ে থাকো, থুতনি ধ’রে মুখ এদিকে ফেরানোর জন্যে বেড়াল রয়েছে। সবচেয়ে ভয়ানকের সবচেয়ে মিষ্টি ভোলবদল সে। শীতের দুপুরে দ্যাখো বেড়াল ফাঁকা রাস্তার বাঁদিক ধ’রে… ও দাদা, কোথায় যাচ্ছেন? — নলেন গুড়ের সন্দেশ কিনতে। দোতলার আলসেয় গা এলিয়ে অবলোকন করছে পৃথিবী, আর চাইছে প্রজাপতি বা লাল পিঁপড়ের মতো নুড়িপাথর গাছের মরা পাতা টিপকলের হ্যান্ডেল অল্প নড়ে উঠুক। তার ঝাঁপাতে সুবিধে হতো। মানুষ পায়েস খেতে চায়, বেড়াল পাখি রোজগার করতে। ঝুপসি, বাঁজা, তাই কুঠার-শাসনের ভয়ে থাকা লিচুগাছটার নীচে একদিন একটা ফিঙে পাখি পাকড়েও ফ্যালে! দৌড়ে গিয়ে বাসুদেব দুহাতে বেড়ালের হাঁমুখ টেনে ধরেছিল ব’লে সেই মোস্ট ফরচুনেট ফিঙে গানের মিড়ের মতো উড়ে উঁচু সজনে গাছে বসে, তার দু’সেকেন্ড পরে নীলাকাশ হয়ে যায়।

বেড়ালদের বৈচিত্র এতদূর ছড়ানো যে ছোটবেলা থেকে কেউ মাথা নীচু শাঁ-শাঁ করে হাঁটে আর সামনে যা থাকবে গিয়ে ধাক্কা খায়; একজন সারাক্ষণ হিন্দিতে কিঁউ-কিঁউ; একজন মাইমশিল্পী; কেউ রূপে তোমায় ভোলাবে বলে নিজের গা চেটেই যাচ্ছে; কেউ কোলে উঠলে আর নামবে না, পা ঝিঁ-ঝিঁ লেগে হস্তীপদ হয়ে গেলেও কী যায় আসে?

এ-বাড়িতে স্বর্গীয় বাহার, পুঁচকু, মহীয়সী, ইমরান, সুন্দরী, নন্দবাবু, সিঙাড়া, ট্যাঙোশ, বোকা-বোকা-লম্বা বা আজকের পাখিধরা কিশমিশ — এমন সব বেড়ালের গুচ্ছে যারা নিশ্বাস নিয়েছে, তাদের ফুসফুসে কি অ্যাজমা আর রক্তে মাইক্রোবসের ঘাঁটি? নাহলে ডাক্তার কেন বলে কুকুর থাকুক, বেড়ালটা কাউকে গিফট করে দিন?

উপহার দিতে লাগবে না, একটু ধৈর্য ধরলে সে মরেই যাবে। এক ড্রপার ঘুম, এক চামচ পাড়াবেড়ানো আর এক খুঁচি মৃত্যু দিয়ে বিল্লিজাতি গড়া। ন’টা নহে, সিকিখানা জীবনবিশিষ্ট মার্জার মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত ডিগবাজি খেয়ে যাবে। বেঁচে থাকা নিয়ে তার কোনও সত্তর এমএম অভিমান আছে নিশ্চয়ই। বেড়ালের মা ভালো হয় না, বাবা তো হয়ই না, শীতে জামা হয় না, বৃষ্টিতে ছাতা হয় না, উলটে পুজোয় বাজি মানে বাজে হয়, বাড়িতে অতিথি এলে লুকিয়ে বেড়ানোর জায়গা খোঁজো (অতিথ এসে গিরোস্তো খেদায় — চাঁদের মায়ের সংলাপ)। তবু বিভিন্ন বোঁটায় বিভিন্ন বেড়াল সাজিয়ে একটা টবে বসালেই স্পাইডার ক্রিসানথেমাম।

দুই
মায়া প্রায়ই বলে, ব্রাম্মোনবাড়ির বিড়েলটাও দুপাতা সঙোস্‌কিতো পড়তি পারে। এটা বেড়ালের প্রশংসা নয়, ব্রাহ্মণের আত্মশ্লাঘা। সে কলোনিতে বাস ক’রে মোটেই খুশি নয়; দারিদ্রের চেয়ে অনেক বড় সমস্যা হল, চারিদিকে নীচু জাতের ভিড়। পাকিস্তানে তাদের সিদ্ধান্তপাড়ায় বারো ঘর বাসিন্দার মধ্যে আট ঘরই বামুন ছিল, তিন ঘর কায়েত আর মোটে এক বাড়ি মণ্ডল — নোমোশুদ্দুর। সেই তুলনায় কলোনিতে উঠতে বসতে মালাকার, বিশ্বাস, ভক্ত, হালদারের সঙ্গে গা-ঘেঁষাঘেষি।

ঘটিবাটি হারিয়ে একবার মাথা একবার বুক চাপড়াতে চাপড়াতে যারা একসঙ্গে চালডালশাকমাছমাখা একদলা বমির মতো ভিনদেশে এসে সরকারের দয়ায় দরমার বেড়া দেওয়া ঘরে উঠল, যাদের দুপুরে উনুন জ্বলে তো রাত্তিরে জ্বলে না, তাদের আবার জাত-অজাত কী রে! পণ্ডিতমশাইয়ের বউ এমনিতে জ্যান্ত পঞ্জিকা; মুখে মুখে অমাবস্যা-পূর্ণিমা ব্রত-ষষ্ঠী বিয়ে-শ্রাদ্ধের হিসেব রাখে, কিন্তু বামুন ব’লে বড্ড বাড়াবাড়ি! মাঝমাঝে সরকারবাড়ির বাসন্তীমণ্ডপে ব’সে আর এক সরকার সাধু-র মা এসব ক্ষোভের কথা বলে। “পাকিস্তান থে’ পাছার কাপোড়ডাও আনতি পারেনি, কিন্তু গুমোরডা ঠিক নিয়ে আইছে। কালো কুষ্টি গা’র রঙ নিজির, আবার জাত তুলে কথা কয়। আমার বাবায় ক’তো, কালো বামোন আর ধলা চাঁড়াল, এদের কোনও কালে বিশ্বেস কোত্তি নেই”। কথার ঝোঁকে বুড়ি খেয়াল রাখতে পারে না, মণ্ডপে ফকির বিশ্বাসের ছেলেও বসে আছে, তার গায়ের রঙ শুধু কংসাবতী নদীর বালির মতো চিকচিকে নয়, চোখদুটোও বেড়ালাক্ষি।

এভাবে কাহিনিতে আবার বেড়াল ফিরে আসে, থেকে যায়। মানুষের ছেলেমেয়ে বেড়ে ওঠে সুপুরিবৃক্ষ, আর বেড়াল বড় হয় পেয়ারাগাছ — গোড়া থেকেই চারদিকে সন্তানসন্ততির ডাল ছড়াতে ছড়াতে। এই রকম অমিলের মধ্যে প’ড়ে মায়ার অহংকারও মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে। শিউলি ব্যাজার মুখ ক’রে বলে, জানো মা, আমাদের বিড়েল কিন্তু আমাদের মতো হয়নি।
— কেন রে!
— ধুর, পড়াশুনো ভালোই বাসে না, এখনি জীববিজ্ঞানের বইয়ের উপোরে বমি ক’রে দিচ্ছিল।
— তোগোও যেমন! আপনি মা খাতি পায় না, শঙ্করারে ডাকে। কালই বাসুরে কয়ে পার ক’রে দেবানে ওটারে। এহ, আবার সোয়াগ ক’রে নাম রাখা হইছে কিস্মিস!

একটা কান কালো, সারা গা চকলেট, শুধু ধবধবে সাদা পেছনের ডান পা, দেখলে মনে হবে ভেঙে গেছে তাই প্লাস্টার করা। কলোনির বাড়িতে তো কোনও পাঁচিল, গেট বা মে আই কামিন স্যার থাকে না, একদিন বাজার করে ফেরা নির্মলের পেছন পেছন এসে কিশমিশ ঢুকে পড়ল। তাকে শিউলি অনেক ট্রেনিং দিয়েছে, কিন্তু লক্ষ্মীর আসনে জল আর বাতাসা দেওয়া থাকলেই সে ফাঁকমতো গ্লাসে মুখ ডুবিয়ে জল খেয়ে নেবে।
শিউলি আবার তেঁতুল দিয়ে গেলাস মাজে।
— ও ভাই, গেলাস তো সকালেই পরিষ্কার কল্লাম।
গলা নামিয়ে তাতে এক ছটাক বিষণ্ণতা মেশায় শিউলি।
— জানো তো দিদ্‌মা, কাল সারা রাত্তির কিস্মিস বাড়ির বাইরি ছিল। এদিকে মা হারমোনিয়াম নিয়ে বসলিই চিৎকার পাড়া শুরু করে। আমাদের বিড়েল এট্টুও আমাদের মতো হয়নি!

তিন
শিউলি তখন খুব ছোট, একটা হুলোর বাচ্চা নিয়ে এসেছিল সেজদা গৌরকিশোর। নাক নেই চোখ নেই বড় তুম্বোপানা মুখ, লেজটা গুলে মাছের মতো ছটফট করে, কিছুটা মুদিখানার দোকানদারের ভাবসাব দেখে মা তার নাম দিয়েছিল নন্দবাবু। কিছুদিনের মধ্যে বাবু পালটে রাক্ষস হয়ে গেল। রান্না মাছে মুখ ঘুরিয়ে নিত, কাঁচা দিলে ঠিক আছে। এদিকে আপনমনে তোমার আঙুল চাটতে চাটতে কচ ক’রে দাঁত বসিয়ে দেবে। এভাবে যখন বাড়ির অর্ধেক লোকের হাতে-পায়ে ন্যাকড়ার ব্যান্ডেজ, অদৃশ্য হয়ে গেল নন্দরাক্ষস। বাড়ির লোকই তাকে বিদেয় ক’রে দিয়েছে সন্দেহে শিউলি সবাইকে ঘুষি পাকিয়ে মারতে লাগল; তার পরও যখন তার কান্না আর হিক্কা ওঠা থামছে না, তখন সত্যি খবরটা দিল টিপুদা :

সেদিন শেষ রাত্তিরে আমি পেচ্ছাপ করতে উঠে দেখি তোদের আমতলা-বাড়ির সামনে একটা বড় গাড়ি এসে থেমেছে। তারপর চারজন পুলিশ, চারজন মিলিটারি আর একজন বেড়ালের ডাক্তার নেমে এল।
— বিড়েলের আবার ডাক্তার হয় নাকি!
— বিড়েল, কুকুর, ছারপোকা, আরশোলা, নিমগাছ, মৌরলা মাছ সবার ডাক্তার হয়।

নন্দরাক্ষস তোদের দিদিমার বিছানায় ঘুমত না? একটা পুলিশ জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ফ্যাঁস করে গ্যাস ছেড়ে দিল ঘরের মধ্যে, নাহলে বুড়ির যা পাতলা ঘুম, আমের সময় কলোনির কেউ একটা আমও চুরি করতে পারে? এদিকে চার পুলিশ নন্দর দুই হাত ধ’রে বাইরে আনল চুপিসাড়ে। ডাক্তারের নির্দেশমতো চারজন মিলিটারি ধরল বেড়ালের দুই পা। ডাক্তার ইঞ্জেকশানের সিরিঞ্জটা একজন মিলিটারির দিকে বাড়িয়ে দিল। সে থতমত খেয়ে বলল, আমি তো দিতে জানি না, স্যার। ওহ, ইয়ে… গলা খাঁখারি দিয়ে ডাক্তার কাঁপা হাতে পুশ ক’রে মন্তব্য করল, নন্দ আসলে বেড়ালও নয়, বাঘও নয়, দুইয়ের মাঝামাঝি।
— মাঝামাঝি কেমন ক’রে হয়?

হয়। শিউলিকে বোঝানো যাবে না, কাওরাপাড়ার একটা ছেলে রাস্তা দিয়ে যায় ছাপা লুঙি প’রে, চুলগুলো বড় বড়, মাথা নামিয়ে ঢং ক’রে হাঁটে। ও ছেলে-মেয়ের মদ্দিখানে আছে। তবে নন্দ যত বড় হবে, বাঘের দিকে যাবে — ডাক্তার অভিমত দিল। এরপর ন’জনে মিলে নন্দকে সাবধানে ধরে গাড়িতে তুলে শোঁ করে চলে গেল।
— কুথায় গেল? আমি নন্দুরে ফেরত নিয়ে আসব।

আনবি কী ক’রে? ওকে সুন্দরবনে বাঘদের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে এসেছে তো!

(আরও আছে)

গদ্য না পদ্য না – ইয়ার্কির লেখা

দুটো বিরাট ষাঁড় পাশাপাশি গায়ে গা লাগিয়ে সটান দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি নৈর্ঋতে। ছবিয়ালা যেন এই ভঙ্গিতে রেখে গালে তুলি ঠেকিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে দেখছে। একটু ওপাশে উঁকি দিলেই পাতার ঝালর পরা একটা লোক ল্যাদনা হাতে গোবেচারা মুখ। কপালে হাত রেখে দূর ঠাওর করে। ওই যে হোতা সত্যি একটা ছাগল-চড়ানী বৌ দুপুর হয়ে বসে আলের মাথায়, গালে হাত। মাথায় তার আধখানা ঘোমটায় আধলা চাঁদ উঠেছে দিনের বেলা। হাতের পাঁচন মাটিতে অবহেলায়। তার চারপাশে হাত কয়েকের ভেতর কয়েকটা পোষা ছাগল, দুটো ভেড়া ছানা। তাদের গায়ে পুরু লোম, ঘিয়ে রঙের, কোঁকড়ানো। সামনে রোগা নয়ানজুলি। তাতে একটা বাঁশের ডগালি কয়েকটা ডগা বার করে রেখেছে, আসলে পা বাড়িয়ে। কাউকে ল্যাং দেবার বাহানায়। পানকৌড়ি সেসব গেরাহ্যিমাত্র না করে, বৌটাকেও, সেই ল্যাং সমান ডগায় বসে ডানা মেলে দিয়েছে। একদিকের খুঁট জড়িয়ে অন্যদিকের আঁচল শুকোচ্ছে যেন। সারা মাঠে এখানে ওখানে টিয়াপাতা রঙা বোরো ক্ষেত। বাকিটা ধূ ধূ, ফসলহীন।

ব্যাস! এটুকুই। এটুকুই যেন কী একটা গুমরে মরছে।

মন কথনিকা-৪৬২৭

সত্য কথা লিখে আবার ব্যাকস্পেইসে মুছি,
বললে শুনবো কটু কথা, শুনতে যে নেই রুচি,
সত্য বললে বেজার মানুষ, স্বীকার করতে কষ্ট,
মিথ্যে মোহে মানুষের বাস স্বভাব করে নষ্ট।

মন কথনিকা-৪৬২৮
সত্য বলি তাই বলে তো, কয় না সকল কথা,
বলে দিলে হয় সর্বনাশ, ঝামেলা অযথা,
কাছের মানুষ লুকায় কথা, কীযে কষ্ট লাগে,
মিথ্যেগুলো পারি নাতো আনতে আমার বাগে।

হীনমন্যতা! …..

32

হীনমন্যতা একটি মারাত্মক রোগ।
এটিকে যদিও মানসিক রোগ বলে বিবেচনা করা হয়,কিন্তু ধীরে ধীরে এটি নিজের শারিরীক অসুস্থতার অন্যতম কারন হয়ে দাঁড়ায়।
আর এই থেকে মুক্তি অসম্ভব হয়ে পড়ে যদি না ব্যক্তি তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে না পারে।

হীনমন্যতা শুরু হয়-
#অন্যের সাথে নিজের তুলনা করে
#নিজের যা আছে তাকে অস্বীকার করে ও খাটো করে দেখে।

#নিজেকে অন্যের চেয়ে দুর্বল ভাবে
#এরা কখনোই শোকর গুজার হতে পারে না
#এরা পরিবার, সমাজ, আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের উপর প্রচণ্ড নেতিবাচক প্রভাব ফেলে ও মানসিক অশান্তি তৈরি করে!

#এদের নিজেকে সবসময় সঠিক মনে করে!
অন্যের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত বোধ করে, শুধু তা নয়
(#অন্যের পাকা ঘর দেখে নিজের কাঁচাঘর ভেঙ্গে ফেলার নজিরও অনেক….) এরা নিজের যেটুকু শান্তি আছে তা-ও নষ্ট করে!

অর্থাৎ

#একজন হীনমন্য মানুষ নাশোকর মানুষ!
আর নাশোকর মানুষকে খোদ আল্লাহও পছন্দ করে না।
#এরা মিথ্যা কে সত্যের মতো এমন ভাবে উপস্থাপন করে যে-

যে কেউই এদের সহজে বিশ্বাস করে ফেলে।

# হীনমন্যতা মানুষের ডায়েবিটিস প্রেশার হৃদরোগ হরমোন ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদি কমন কিছু রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বাড়ে।
#হীনমন্য মানুষকে অন্যরা ভালোবাসেনা, কারন তারা নিজেরাই কাউকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসতে পারে না!

(……..হীনমন্যতা দূর করার উপায় নিয়ে আরেকদিন আসবো ইনশাআল্লাহ!)

সারভাইভ্যাল অব দ্য ফিটেস্ট/মুক্তগদ্য

এক প্রচণ্ড ঝড় উঠলো। ধুলোর। যেখানে যা কিছু ছিল স্থির, সব ছিটকে সরে গেল এখান থেকে ওখানে। লণ্ডভণ্ড।

ল্যাম্পপোস্টের গায়ে লেপ্টে থাকা মৃত প্রজাপতির চোখে তখনো সরব হয়ে ছিল এক বিস্মিত তীব্র জিজ্ঞাসা– আলোর কাছাকাছি গেলেই পুড়তে হবে কেন! কিছুক্ষণের ভেতরই মৃতমাংস সন্ধানী পিঁপড়ারা ভীড় করবে এখানে।আত্মাহুতি দেবে আরো কিছু ক্ষুদ্রকায় প্রাণ। প্রখর তাপে পতঙ্গ পুড়ে। পুড়ে খাদ্য সন্ধানী পিপীলিকা এবং যে তীব্রতাপ পুড়ায় পতঙ্গ, সেই খরদহন কখনো কখনো মানুষের নরম হাতগুলোতে ছড়িয়ে দেয় ফোসকার দাগ। আজীবনের।

এই যে মানুষ, পতঙ্গ অথবা পিঁপড়া যারা সন্ধান করে আলো অথবা মাংসের তাদের পরিণতিগুলো, একই সুতোয় বাঁধা। অবসান।

তার চাইতে এই প্রখর উত্তাপের উৎস থেকে দূরেই থাক্‌ ক্ষীণজীবী কীট-পতঙ্গ এবং সমস্ত কোমলতাগুলো। আগুনের কাছাকাছি থাকুক কেবল অগ্নিপ্রতিরোধক ধাতব কাঠিন্য। ‘সারভাইভ্যাল অব দ্য ফিটেস্ট’।

শন শন দমকা হাওয়ায় ইতিউতি উড়ে যাচ্ছে শুকনো জীর্ণ ডালপালা, পাতা, খড়কুটো।

বাতাসের দুর্নিবার আলোড়নে শূন্যে উঠে যাওয়া ঝরা পাতাগুলো পাখি নয়–এই কথাটা কখনো ভুলে যায় আত্মমগ্নতার গভীরে ডুবে যাওয়া কিছু মানুষ। ধূসর বর্ণের বিচ্ছিন্ন ঘূর্ণিতে তারা ভুগতে থাকে উড়ে যাওয়া ডানা বিভ্রমে। অহেতুক।

ঝড় থেমে গেলে এসব ঝরে পড়া ছাইপাশ আবার নেমে আসবে মাটির মাধ্যাকর্ষণের টানে। জায়গা হবে ডাস্টবিনে। মিউনিসিপ্যালিটির আবর্জনার গাড়িতে।

প্রবলবর্ষনের তোড়ে ছাদ উপচে পড়া অবিরাম জলধারাওতো মাঝে মাঝে ঝর্ণার বিভ্রম তৈরি করে ফেলে এক নিমেষে। পাহাড়, ঝর্ণা এবং নদী পিয়াসী মানুষের কাছে এও এক তৃপ্তিদায়ক সান্ত্বনা। উঠোনে মিছেমিছি তৈরি হওয়া এক নদীতে মানুষ ভাসিয়ে দেয় না না রঙের কাগজের নৌকা আর কপোল কল্পনায় ভাবে ‘সপ্তডিঙ্গা মধুকর দিয়েছি ভাসায়ে’।

ভূতের মাসি

3t

জমাট শীতে হঠাৎ এক ঝড়বাদলের রাতে।
ছমছমে এক গভীর রাত
নিজের কাঁধে রাখছি হাত
ভয়েই মরি একলা থাকি
বাঁচার এখন অনেক বাকি
ভূতের মাসি ভাংরা নাচে আনন্দেতে ছাতে।

“অর্বাচীন পদ”

32r

বলার ছিলো অনেক কিছুই বলতে পারিনা,
যাকে আমি ভালোবাসি, ভালো জানি; সেই করে শুধু ছলনা।

বসতে দিলেই শুইতে চায়, আর শুইতে দিলেই ঘুমায়;
শুয়ে শুয়ে যাবর কেটে, নিচ্ছে টেনে কোমায়।

কাকে আমি বলবো ভালো, আর কাকে বলবো খারাপ;
বসার চেয়ার পেলেই তারা, যাচ্ছে ভুলে কে মা, কে বাপ!

ভ্রমর কোয়ো গিয়া

‌যখন নিষেকের আকাঙ্ক্ষায় ধানফুল মেলে দেবে তার গোপন ওষ্ঠপুট। এক আশ্চর্য পৃথিবী খুলে গিয়ে সেই দৃশ্য ডানায় আড়াল করে অন্ধ করে দেবে মানুষের বাচালতা। তখনই ফুলখেলার গন্ধ মাখা বাতাসের প্রবাহ ধরে তুমি আসবে বলেছিলে এই ধুলোর গ্রামদেশে। যেখানে প্রতিটি পথের বাঁকে সরল ঘাসফুলে গোপন বয়ান ফুটে আছে। জলজ শব্দে কেউ পড়ে ফেলবে মঙ্গলকাব্যের কয়েকটি লাইন। সরল পুকুরে ঘাই মেরে উঠে তোমার সম্বর্ধনা উৎসবে স্বাগত ভাষণ দিয়ে যাবে বোয়াল চূড়ামণি। আলপথে হাঁটতে হাঁটতে তোমার পা টলমল করে উঠলে গর্ত থেকে ইঁদুর বেরিয়ে এসে ইয়ার্কি হেসে বলবে, এসেছ ঠাকুর? আমি খুব উৎসাহে তোমাকে দেখাব ঐহিকের দরবারে আমার ধুলোমাখা শৈশব আর যৌবনের হারিয়ে থাকা জড়োয়াগুলি। এসব আলগোছে দেখার ফাঁকে তোমার চোখ খুঁজে নেবে নিবিষ্ট গল্পদের। আমরাই শুধু জানব, তিন হাত আগে পরে হেঁটে যাওয়া জোড়া দেহ দিগন্তের দেহলিতে দীর্ঘ আলিঙ্গনে দাঁড়িয়ে আছে অনন্তকাল।

হাবিজাবি লেখা- ১১

‌প্রকাশিত
‌১৬. ৬.২০২২