বিভাগের আর্কাইভঃ অণুগল্প

অগ্রযাত্রা

মা আজ জিডিপি’র গ্রোথ রেটের সাথে মাথাপিছু আয়ের ভুনা রান্না করেছেন। ফ্রিজে একটু স্যাটেলাইট ভাজি ও সাবমেরিন ভর্তা ছিলো। মা উন্নয়নের আঁচে ওসব গরম করেছেন। আহ, কি ঘ্রাণ!

ভুনা, ভাজি আর ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে খেতে মনটা চিন্তায় আচ্ছন্ন হলো। বাইরে বৃষ্টি নেমেছে, তুমুল বৃষ্টি। চিন্তা হচ্ছে পদ্মা সেতুর স্প্যানটা ঠিক সময়মত বসবে তো! প্রকৃতিও দেখি ষড়যন্ত্র শুরু করেছে।

টকশোর চাটনি দিয়ে পত্রিকার কলামের সালাদ মাখাতে মাখাতে মা বললেন, ষড়যন্ত্র কে করছে তা বোঝা যাচ্ছেনা, তবে ষড়যন্ত্র যে হচ্ছে এটা বোঝা যাচ্ছে। আম্মুর কথায় বাধা দিয়ে চাচ্চু বললেন, ভাবী মিক্সড সালাদে ক’চামচ বিটিভি প্রতিবেদন মাখাতে ভুলো না, খুব টেশ।

সালাদে বিটিভি প্রতিবেদন মাখাতে মাখাতে মা বললেন, বৃষ্টি হলেই ঢাকা শহর লেক সিটি হয়ে যায়, ষড়যন্ত্রকারীরা বলে জলাবদ্ধতা। কারো জ্বর হলেই বলে ডেঙ্গু। ভাবা যায়!

বাবা শোনালেন আরও ভয়ের কথা, দেশে না কি অনেক গরীব ঢুকে পরেছে। রোহিঙ্গাদের তো তবু চেনা যায়, গরীবদের আলাদা করে চেনা যায়না। এরা এদেশের মানুষের মত, এদের বাপ-দাদারা না কি এদেশে ছিলো। এদের আলাদা করা খুব কঠিন। এরা ডায়েট করে, অথচ বদনাম রটায় যে খেতে পায়না।

চাচ্চু খুব আয়েশ করে একটুকরো উন্নয়ন চিবুতে চিবুতে বললেন, অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় আমরা ওদের নেবো না। ওরা আমেরিকাগামী ল্যাপটপ রপ্তানীর জাহাজে হাহাকার ভরে দেবে। ওরা আমাদের টেমসের পানি দূষিত করে দেবে। ওরা আমাদের লাসভেগাস গড়তে দেবেনা।

‘দেশে কোনো গরীব নেই’ মার্কা ঘড়ির নিচে দু’টো টিকটিকি বিভ্রান্ত, তারা রোহিঙ্গা না গরীব বুঝতে পারেনা, তাদের ঠাণ্ডা রক্ত আরও ঠাণ্ডা হয়ে আসে।

মামুনের অণুগল্প : একদিন স্রোতের অনুকূলে

একজন পুরুষ গল্পকার এবং একজন নারী কবি, নিজেদের বৈবাহিক জীবনের শেষ প্রান্তে এসে অনুভব করেন, নিজ নিজ বিবাহিত জীবনে তারা অতৃপ্ত! শারিরীক সম্পর্কের দিক থেকেই এই অতৃপ্তি।
অথচ তাদের যার যার জুটি তাদের জন্য সব কিছুই করে চলেছেন।

এরপরও তারা মনোদৈহিক অতৃপ্তি মেটানোর বিকল্প পথ খুঁজেন। কিন্তু পথের শেষে দাঁড়ানো এই দু’জন সামাজিক ও পারিবারিক লোকলজ্জা এবং আনুষঙ্গিক আরো নানা বাঁধার কারণে কাছে আসতে পারেন না।

এক বিষণ্ণ বিকেলে, কবি ভার্চুয়ালি কাছে আসতে চান গল্পকারের। গল্পকার নিজের ভূবনে মগ্ন। তীব্র শারিরীক চাহিদা ছাপিয়ে তার ভিতরে তখন অক্ষরের উল্লাসে মেতে ওঠার সাগরসম আকর্ষণ! তিনি কবিকে উপেক্ষা করে অপেক্ষা করতে বলে নিজে সেকথা বিস্মৃত হন।

গল্পকারের উপেক্ষায় জীবন নদীর অপর পাড়ে বসে থাকা কবি’র ভিতরে যন্ত্রণার উদ্রেক করে। তিনি গল্পকারের কাছে আসার জন্য মনে মনে সেতু তৈরী করে চলেন.. ভালোলাগার নুড়ি পাথর একটা একটা করে কুড়িয়ে জমা করেন।

গল্পকার নিজের পাড়ে বসে ভাবনাবিলাস থেকে হঠাৎ জেগে ওঠেন। চোখ মেলেন। দেখেন, ওপাড়ে অপেক্ষমান বিবশ নারী।

নদীতে তীব্র স্রোত.. তাতে গল্প-কবিতা সব হারিয়ে যায়। ভালোলাগা আর ভালোবাসায় পুড়ে পুড়ে সকল অতৃপ্তি, লোকলজ্জা আর বাঁধা ভেসে যায়। সামনে এসে দাঁড়ায় ‘প্রেম’!

তখনও নদীতে তীব্র স্রোত..
স্রোতের অনুকূলে আদিম আকর্ষণে ভেসে চলেন এক জোড়া মানব-মানবী।।

মামুনের অণুগল্প : খেলা খেলা সারাবেলা

নিজে পিতা হয়ে পিতার অনুভবে আব্বাজানের ভালোবাসাটুকু যে অনুভবে এসেছে, তাকে কি জানাতে পারলাম? তাকে আর জানানোই হলো না। যাদের বাবা এখনও কাছে আছেন, বাবার আরও কাছে যান, তাকে অনুভব করান আপনার প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা আপনার অনুভবে এসেছে।

ভিন্ন এক জেলা শহরে চাকরি করি তখন। পরিবারের সদস্যরা থাকে আরেক শহরে। সপ্তাহে উইকেন্ডে বাসায় আসি। বাকি দিনগুলি মধ্যবর্তী এক ‘নো-ম্যানস ল্যান্ড’ এর বাসিন্দা আমি। একদিন অফিসে ব্যস্ত। লাঞ্চের ঠিক আগ মুহুর্তে বউ এর ফোন এলো। রিসিভ করলাম,
– কি ব্যাপার? আজ পৌঁছায়ে ফোন করলে না যে?

প্রতি শনিবার বাসা থেকে সেই ভিন্ন শহরের রুমে পৌঁছে আগে বউকে ফোন দেই। সামনে কোরবানির ঈদ। সেদিন গরুর ট্রাকের কারণে সৃষ্ট জ্যাম এর হাত থেকে রক্ষা পেতে, আমার যাতায়াতের নিয়মিত রুট চান্দোরা না গিয়ে বাইপাইল থেকে টার্ণ নিয়ে নরসিংহপুর দিয়ে কাশিমপুর হয়ে কোনাবাড়ি এসেছি। সাধারণত প্রতিবার সকাল ৭ টার পরে পৌঁছাই। সেইদিন ৬ টা ১৫ তে রুমে। এরপর আর বউকে ফোন করতে মনে নেই।

আর বউও সেটা মনে করিয়ে দিলো ঠিক ১টার সময়!
হয়তো অপেক্ষা করেছে, আমি ফোন করি কিনা?
যেভাবে অপেক্ষা করে থাকে, হাসলে ওর গালে এখনও টোল পড়ে কিনা, এটা দেখে ওকে কিছু একটা বলি। কোনো এক ভালো মুডে থাকাকালীন এক সুবর্ণক্ষনে সে জানিয়েছিল আমায়!

কিন্তু আমি জেনেও ওকে বলি না। অপেক্ষায় রাখি।
যাইহোক, আমি ঠিকভাবে পৌঁছলাম কিনা বউয়ের এটা জানার ব্যকুলতা আমাকে অনুভবের গভীরে স্পর্শ করায়। সাভারে থেকেও ওর এই কেয়ারটুকু, কোনাবাড়িতে অবস্থানরত অফিসে ব্যস্ত আমার গালে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে যায়। কেমন এক ভালোলাগার বিহ্বলতায় ডুবে যেতে থাকি আমি।

এরকম আরও এক পরশ পাই আমি খুলনা থেকে…

গাজীপুর ও ইপিজেডে শ্রমিক আন্দোলন চলছে। বিভিন্ন গার্মেন্টসে ভাংচুর চলছে। মিডিয়ার মাধ্যমে সারা দেশ জেনে গেছে। কিন্তু আমি কেমন আছি কাছের মানুষদের অনেকেরই সেটা জানার জন্য তেমন ব্যাকুলতা দেখি না।

হঠাৎ আম্মার ফোন,
– তোর ওখানে কোনো সমস্যা নাই তো?
– না মাদার, আমাদের ফ্যাক্টরী রাস্তা থেকে অনেক ভিতরে। সমস্যা নাই।
– তারপরও সতর্ক থাকিস।

মাত্র তো এই কয়েকটি কথা। তবুও এখান থেকে ৪০০ কিলোমিটার দূর থেকে আম্মার এই আদর মাখা কেয়ারটুকু ইথারে ভেসে ভেসে আমার মন-প্রাণ জুড়িয়ে দেয়।

আমাকে ঘিরে আমার মা আর বউ এর এই উৎকণ্ঠা আমাকে কোথায় যেন নিয়ে যায়…। আরেক বুধবার রুটিনের বাইরে গিয়ে সাভারের বাসায় এলাম। কোরবানির গরু’র ট্রাক থেকে পুলিশের প্রকাশ্য চাঁদাবাজির কারণে ২ ঘন্টার পথ সাড়ে ৪ ঘন্টা লাগিয়ে যখন বাসায় ফিরলাম, ভিতরে প্রচন্ড ক্রোধ ছিলো। ক্রোধ নিজের ওপর। কেন জন্মালাম এই দেশে?

সে রাতে আমার ছোট কন্যা কি কারণে যেন একটু পাকামো করে বসেছিলো। বকা দিলাম। সচরাচর আমার এই কন্যাটিকে আমি কিছু বলি না। সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত সে নাকি কান্না করেছিলো (ওর মায়ের সাথে সে রাতে ঘুমায়। তার মা আমাকে পরে বলেছে)। আমিও ভিতরে ভিতরে অস্থির বোধ করেছি। রাতে ঘুমের ভিতর বার বার চমকে উঠেছি।

বৃহস্পতিবার অফিসে এসে কোনাবাড়ী থেকে খুব ভালো একটা খেলনা কিনে আনালাম। একটা অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পেতে আমিও ‘ঘুষ’ নামক এই “অধিকাংশ জনপ্রিয়” জিনিস কে ব্যবহার করলাম।

বৃহস্পতিবার আমার বাসায় ফেরার দিন। অফিসের কলিগেরা সবাই দিনটিকে ‘বউ দিবস’ হিসেবেই পালন করতাম। যাইহোক, সেই বৃহস্পতিবারটিকে আমি বউ দিবস থেকে ‘ছোট কন্যা’ দিবসে পরিণত করতে চাইলাম।

সে রাতে বাসায় ফিরে দুই বাপ-বেটি সব কাজ বাদ দিয়ে খেলনা নিয়ে পড়ে রইলাম। ওর মনের গ্লানি-কষ্ট সেদিন রাতেই কান্নার সাথে ধুয়ে গেছিল। আর আমার বুকের ভিতর যে ভারী জিনিসটা ছিল, তাও ওর সাথে ছেলেমানুষি করতে করতে শেষ হল। মেয়ের সাথে বসে অবচেতনে ভাবনা-চিন্তায় আমি স্মৃতির অনেক আগে ফিরে গেলাম। মনে পড়লো আমাদের আব্বাজানও আমাকে এমন ‘ঘুষ’ দিয়েছেন।
একবার না। অ…নে…ক বার। তখন তার সেই দেয়াটা ওভাবে বুঝে আসে নাই।

কিন্তু সেদিন নিজের ভিতরের এক পিতার কর্মকাণ্ড এবং তার এ সংক্রান্ত অনুভব আমাকে আমার পিতার অনুভবকে নতুনভাবে অনুভব করালো।

তখন সবে ‘পাওয়ারড গ্লাস’ ব্যবহার করতে শুরু করেছি। কখন যে চশমার কাঁচ ঘোলা হয়ে উঠেছে টের পাইনি। যখন অনুভবে এলো, চোরের মত এদিক সেদিক দেখে কান্নাটুকু লুকিয়ে ফেললাম। কিন্তু মনের ভিতরে আব্বার জন্য যে বোবা কান্না জমাট বাধা তা কি লুকোতে পারলাম?

নিজে পিতা হয়ে পিতার অনুভবে আব্বাজানের ভালোবাসাটুকু যে অনুভবে এসেছে, তাকে কি জানাতে পারলাম? তাকে আর জানানোই হলো না। :(

একান্ত কাছের মানুষদের সাথে সহাবস্থানের টুকরো টুকরো ভালোবাসার মোড়কে যে অফুরন্ত মায়া জড়ানো, তাদের সেই মায়ার মোহ নিজে অনুভব করার জন্য এক জীবন আসলেই খুব অল্প সময়। অবেলায় কেটে যায় মনুষ্য জীবন খেলায় খেলায় অবহেলায়।

প্রণয়জনিত

১.
ডিসেম্বর, ১৯৯১। কলেজে ছুটি চলছে। শীতের দুপুরগুলো খুব দ্রুত বিকেলে গড়ায়। এমন এক হবো হবো বিকেলে ল্যাণ্ড ফোন বেজে উঠলো, রিসিভার কানে দিতেই প্রিয় কণ্ঠের ফিসফিস-
: হ্যালো, নটরডেম?
: ভিকারুননিসা! এই অসময়ে তুমি!
: সবাই ঘুমোচ্ছে। কোচিং নেই। তাই ফোন দিলাম।
: তাই বলো– একদিন শীত দুপুরে আমরাও এমন ঘুমাবো আর আমাদের মেয়ে..
কথা শেষ করার আগেই ভিকারুননিসার লাজুক কণ্ঠ–
: ইশশ! শোনো নটরডেম, কাল একবার বেইলি রোডে আসবে?
: কেনো গো?
: কতদিন তোমাকে দেখিনা, প্লিজ কাল আসো। তোমাকে না দেখলে ঠিক ঠিক মরে যাবো। আসো প্লিজজজজ…
: আহা রে! কটায় আসবো?
: শার্প সাড়ে তিনটায়। আর শোনো, স্কাই ব্লু জিন্স, হোয়াইট পুলওভার গেঞ্জির সাথে ছাইরঙা ব্লেজারটা পরে আসবে। চুল ভালো করে ব্রাশ করবে– মনে থাকবে!
: মনে থাকবে। কিন্তু শেরোয়ানি পড়ে এলে ভালো হতো, তাই না!
: শখ কত!! ফাজিল একটা। চুপ।
: আচ্ছা চুপ করলাম কিন্তু।
: ঢং কত! নটরডেম, আমি কি পড়ে আসবো বলবে?
: ভিকারুননিসা, তুমি গরু রচনাটা পড়ে এসো, ইংরেজীতে দ্য কাউ।
ঢাকা কলেজের এক সিনিয়র গরু যেভাবে তোমার পিছনে লেগেছে! গরু সম্পর্কে জানা থাকা দরকার..
: হিহিহি, আচ্ছা, তাই করবো। কাল দেরী কোরোনা– এক মিনিট দেরী হলে আমি ঠিক ঠিক মরে যাবো।

২.
বিকাল তিনটা। বেইলি রোড। নটর ডেম অপেক্ষারত। ভিকারুননিসা আসে তিনটা বিশে। ফাস্টফুডশপে মুখোমুখি দুজন–
: ভিকারুননিসা, আকাশী আর শাদা কম্বিনেশনের কার্ডিগানটা বেশ সুন্দর তো! গর্জিয়াস।
: আব্বু আয়ারল্যান্ড ট্যুরের সময় এনেছিলেন। আজ প্রথম পড়লাম। সত্যি সুন্দর?
: হ্যা, সুন্দর।
: আমি কি সুন্দর নই?
: না, তুমি সুন্দর নও।

ভিকারুননিসার মন খারাপ হয়, স্বরে অভিমান এনে বলে-
: তবে কে সুন্দর?
: ‘কে’ সুন্দর জানিনা। ‘কি’ সুন্দর জানি।
: কি সুন্দর বলো নটরডেম?
: আমার বিছানাটা জানালার পাশে। রোজ সকালে একফালি রোদ তেরছাভাবে বিছানার কোনায় লুটিয়ে পড়ে। আর কিছু অংশ ফ্লোরে। সে রোদ সুন্দর।
: ওহ! আর?
: ছাদের রেলিংয়ে পিপড়ার সারি দেখেছো! সারি ছেড়ে দুই একটা পিপড়ার এলোমেলো ছোটাছোটি, তারপর দলে মিশে যাওয়া– পুরো ব্যাপারটাই সুন্দর।
: তাই? আর কি সুন্দর শুনি–
: আবার আকাশের অনেক উঁচুতে চিলের গোল হয়ে উড়া সুন্দর। কাশবনে জোতস্না, নদীর ঢেউয়ে ঢেউয়ে গলে যাওয়া চাঁদ, তুমুল বৃষ্টিতে নীরব পথ ধরে হাটা, জোনাকীর আলো, বৃষ্টি ধোয়া সবুজ পাতায় শুঁয়াপোকার অলস চলন, গাছের ডালে ফড়িংয়ের ধ্যান, প্রজাপতির চঞ্চল নাচানাচি, মেঘের চলন, বিকালের মায়াময় ছায়া– সব সুন্দর।
: আর কিছু নেই?
: আছে, এমন কি তোমার কপালে নেমে আসা কয়েকটা অবাধ্য চুল– অবর্ণনীয় সুন্দর।
: এখানেই শেষ?
: চারদিকে সুন্দরের এত ছড়াছড়ি, ক’টার কথা আর বলবো!
: বাহ! বাহ! তোমার কাছে পিপড়া সুন্দর, চিল সুন্দর, কিলবিলে শুঁয়োপোকাও সুন্দর। আর আমি বিশ্রী?

নটরডেমের স্বরে মায়া ঝরে —
: ভিকারুননিসা, তুমি সুন্দর নও। বিশ্রীও নও।
: তবে আমি কি! আজ সত্যটা বলতেই হবে। না বললে ঠিক ঠিক মরে যাবো, হু।
: তুমি সকালের রোদ নও, রোদের উষ্ণতা। শুধু অনুভব করা যায়, ভালোলাগাটা ভাষায় প্রকাশ করা যায়না।
: ইশশ! আর?
: তুমি বৃষ্টি বা নীরব পথ নও, তুমি বৃষ্টিতে নীরব পথে ভেজার অপার আনন্দ।
: আর কি কি — সব বলো..
: তুমি দলছুট পিপড়ার চঞ্চল ছোটাছুটির মত সুন্দর নও– তার আপন দলে মিশে যাবার আকুল পিছুটানের গভীরতা। তুমি অরণ্যের নির্জনতা, বেলী ফুলের ঘ্রাণের তীব্রতা, ভোরের শিউলি আভার মাদকতা।
: নটর ডেম, এভাবে আমাকে ভাবো! আমাকে খুব ভালোবাসো, তাই না!
: আমরা কেউই কাউকে ভালোবাসি না।
: আমি তোমাকে ভালোবাসি.. বাসি..বাসি।
: না, তুমিও আমাকে ভালোবাসো না।
: তবে?
: আমরা আসলে যুদ্ধ করছি, দুজন দুজনকে জয় করার। আপন করে পাবার। এ এক অন্যরকম যুদ্ধ। এ যুদ্ধে জয় নেই, হয় ড্র না হয় পরাজয়।
: নটর ডেম, আমি এই যুদ্ধে আমি হারবো না, তুমিও হেরোনা প্লিজ। তুমি হারলে আমি ঠিকঠিক মরে যাবো।
: তুমি থেমে যেওনা। যুদ্ধ শেষ হবার আগে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে নিজেকে গুটিয়ে নিওনা। মনে রেখো– সব যুদ্ধ থেমে যাওয়া মানে শান্তি নয়। কিছু কিছু যুদ্ধ থেমে যাওয়া মানে অসহ্য যন্ত্রণা আর অশান্তি।
: আমি যুদ্ধে হারবো না। জানি তুমি আমাকে হারতে দিবে না।
: কেউ হারতে চাইলে কি আর তাকে আটকে রাখা যায়!
: ধ্যাত! বাজে কথা বলোনা। ঐ গানটা একবার গুনগুন করে গাও না প্লিজ-
নটর ডেম গুনগুন করে গাইতে শুরু করে–
You fill up my senses like a night in the forest,
like the mountains in springtime, like a walk in the rain,
like a storm in the desert, like a sleepy blue ocean.
You fill up my senses, come fill me again.
Come let me love you, let me give my life to you,
let me drown in your laughter, let me die in your arms…

৩.
হঠাত সেদিন–

ফেসবুক ইনবক্স।
১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬।
নটরডেম, কেমন আছো? ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট না করলেও, প্লিজ ব্লক কোরো না।

১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬।
নটরডেম, কথা বলো প্লিজ। তুমি এখনো রেগে আছো?

১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬।
নটর ডেম, প্রতিটা ম্যাসেজ সিন হচ্ছে। মানে তুমি পড়ছো। ঠিক করেছো উত্তর দিবেনা!!

২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬।
শোনো নটর ডেম, এ মাসের লাস্ট উইকে দেশে ফিরছি। অক্টোবরের চার তারিখে বিকাল চারটা থেকে সাতটা পর্যন্ত বেইলি রোডের সুইসে অপেক্ষা করবো। জানি তুমি আসবেনা, তবুও অপেক্ষা করবো। যদি হঠাত তোমার ইচ্ছা হয়, যদি আসো।

২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬।
নটরডেম, তোমার কন্টাক্ট নাম্বারটা দিবে! আমার সেল নাম্বার ০১৭৫*******। ৪তারিখের কথা ভুলে যেওনা প্লিজ।

০৩ অক্টোবর, ২০১৬
কাল বিকেল চারটায় সুইসে থাকবো। আমার কন্টাক্ট নাম্বার আবার দিলাম ০১৭৫*******।
প্লিজ, এসো, ৭টা পর্যন্ত অপেক্ষা করবো।

৪.
৪অক্টোবর, মধ্যরাত, ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার।
: নটর ডেম, শেষ পর্যন্ত এলেই না। অথচ একদিন এক পলক দেখার জন্য কত ছটফটানি ছিলো।
: কে বললো আসিনি!
: এসেছিলে?? সত্যি!
: হুম। জামদানি শাড়িতে তোমাকে বেশ সুন্দর লাগছিলো। তোমার বয়স ততটা বাড়েনি।
: ক’টা পর্যন্ত ছিলে?
: তুমি আমার সামনে দিয়েই সাড়ে সাতটায় মুখ কালো করে চলে গেলে। আমি আরো আধঘণ্টা ছিলাম।
: দেখা করলে না কেনো?
: তুমি দেখা করার কথা বলোনি, শুধু আসতে বলেছিলে।
: ধ্যাত! এটা কি আলাদা করে বলতে হবে?
: অবশ্য বললেও দেখা করতাম না।
: কেনো? জানতে পারি?
: না, পারো না।
: ও। আচ্ছা। এতোটা কাছে– তবু দেখা না করে থাকতে পারলে?
: হাহাহাহাহা
: কান্না পাচ্ছে। তুমি হাসছো কেনো– এটা জানতে চাইতে পারি?
: হ্যা পারো-
: বলো।
: মাত্র তিন বছর না যেতেই তুমি খুঁজে পেলে রাজপুত্র। হঠাত করে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করলে। কোনো কিছু জানাওনি। একবার দেখা করে বললে আমি তোমাকে আটকাতাম না। তীব্র কষ্ট পেতাম, সে কষ্ট আড়াল করে হাসিমুখে মেনে নিতাম।
: সর‍্যি, এক্সট্রিমলি সর‍্যি..
: ফোনেও কোনো কথা বলোনি, আমার স্বর শুনলেই লাইন কেটে দিয়েছো। এক একটা দীর্ঘ দিন আর দীর্ঘতম রাত কেটে গেছে শুধু এটুকু আশা করে যে তুমি একবার ফোন দিবে, একবার অন্তত বলবে তুমি আর আমার নও। একবার শুধু তোমার গলার স্বর শুনবার ছছটফটানি। সেই তুমি দুই যুগ পরে জিজ্ঞেস করছো ‘দেখা না করে থাকতে পারলাম!!’ হাহাহাহা, কোয়াইট ফানি!
: সর‍্যি, নটরডেম। এভাবে বলো না।
আমি ঠিক ঠিক মরে যাবো।
: ‘সর‍্যি’ হবার মত কিছু আর আজ অবশিষ্ট নেই। তুমিময় একটা ডাইরি ছিলো, সেটা তো দু’বছর আগেই ফিরিয়ে দিয়েছি।
: তুমি এখনো রাগ পুষে আছো?
: নাহ! মনসুখিয়ার যাত্রীকে রাগ পুষে রাখতে নেই। রাগ পুষে রাখলে অভ্রজোনাক পথ ভুলিয়ে দেয়, দূরে সরে সরে যায়।
মনসুখিয়ায় অভ্রজোনাকের কাছে পৌছতেই হবে– এ আমার একার যুদ্ধ।
: মনসুখিয়া কোথায়– জানতে চাইতে পারি?
: হ্যা পারো।
: মনসুখিয়া কোথায়?
: বলতে ইচ্ছে করছেনা।
: ওহ! অভ্রজোনাক কে?
: বলবো না।
: অভ্রজোনাক কি আমি?
: নো, নেভার। তুমি এখন যে কোনো একটা নাম– এর বেশী কিছু নও।
: তবু একবার, শুধু একবার তোমার সাথে দেখা করতে চাই। উত্তর দাও প্লিজ..
: আমি আর কোনো উত্তর দিবোনা। গুড বাই। ভালো থেকো। আর সাবধান– ডানহাতের বুড়ো আঙুলে ব্যাথা পাওয়া কাজের কথা নয়।
: এই ব্যান্ডেজও খেয়াল করেছো?

নটরডেম আর কোনো উত্তর দেয়না। রাত গভীর হয়, হাভানা সিগারের গাঢ় ধোয়া পাক খেয়ে খেয়ে হাওয়ায় মিলায়।

৫.
মনসুখিয়ায় যাবার পথ নটর ডেমের চেনা নেই, অভ্রজোনাকের মনের ঠিকানাও অজানা। দিনের শেষে রাত আসে, ফের দিন। একদিন রাতশেষে দিন আর আসবেনা— ইশ! তার আগেই যদি যাওয়া যেত মনসুখিয়ায়–হীরকফুলের আলোয় আলোয়, অভ্রজোনাকের কাছে অভ্রজোনাকের পাশে।

মনসুখিয়ায় যাবার আগেই যদি ফুরোয় দিন; ওগো রাতের হাওয়া, নটরডেমের হয়ে অভ্রজোনাকের কানেকানে বলে দিও–
Hell is living without your love
Ain’t nothing without your
Touch me
Heaven would be like hell
Is living without you…

.
__________
#মনসুখিয়া/২৬

উইশ

১.
মাঝরাত হতে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মাঝে কমে আসছে, কিন্তু থামছে না। অন্ধকার কিছুটা ফিকে হয়ে এসেছে। বৃষ্টির তালের সাথে আজানের সুর মিশে এক মোহনীয় সিম্ফনি ভেসে আসছে- খায়রুন মিনান নাউম… খায়রুন মিনান নাউম…।

আড়মোড়া ভেঙ্গে বারান্দায় যাই। সারারাত আন্ধকার দূর করা ক্লান্ত বাতিটাকে নিভিয়ে গ্রীলের পাশে দাঁড়াই। একটা সিগারেট ধরাতেই কথা বলে ওঠে খাঁচায় পোষা ঘুঘু দম্পতির বউটি-
: সক্কাল সক্কাল সিগারেট! খুব খারাপ। খুউউব খারাপ।

বউটির কথার প্রতিবাদ করে স্বামী ঘুঘুটি বলে, ‘খাক না একটা সিগারেট। হয়তো টেনশনে আছে, দেখলে না সারারাত ঘুমোয়নি।

কথা শেষ হতে না হতে ঘুঘুবউটি চোখ পাকিয়ে এমনভাবে স্বামীর দিকে তাকালো যে বেচারা করুণ সুরে ডাকতে লাগলো। আমি হেসে উঠতেই ঘুঘুবউ ধমক লাগালো-
: হাসছো যে খুব! এখখনি সিগারেট ফেলো। আজ বারান্দায় কোনো সিগারেট খাওয়া চলবে না। ইট ইজ এন অর্ডার, পুরো ৫৭ ধারা।

মেঘের নরম ভোরে তর্কে যেতে ইচ্ছে করলো না। সিগারেটটি প্যাকেটে ভরে ঘুঘুবউকে জিজ্ঞেস করলাম-
: বারান্দায় ৫৭ধারা জারী হলো কবে?
: আজ, এবং এখন।
: বাহ! জারী করলেন কে?
: কে আবার জারী করবে! আমিই করেছি।
: মহামান্য আদালত, কতদিনের জন্য বারান্দায় ৫৭ ধারা জারী থাকবে?
: ২৪ঘণ্টার জন্য।
: মাত্র ২৪ ঘণ্টার জন্য! কেনো?
: কারণ, আজ আমাদের বাবুর প্রথম জন্মদিন। ওর জন্মের দিনে বারান্দায় কাউকে বাজে কাজ করতে দিবো না।

দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললাম-
: বেশ! আজ বারান্দায় কোনো বাজে কাজ হবেনা। যাই, একটু ছাদ থেকে ঘুরে আসি।

২.
বারান্দা হতে ঘরে ফিরি। খুব সাবধানে শব্দ না করে দরজা খুলি। সিড়ি ভেঙে একতলার চিলেকোঠায় দাঁড়াই। এলোমেলোভাবে কাকের কা কা শব্দ ভেসে আসছে। প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে সিগারেট ধরিয়ে টান দিতেই টিকটিক করে ওঠে এক টিকটিকি-
: ধুত্তোরি! সারা রাত সিগারেট খেয়েছো, আবার ভোরেও শুরু করেছো?
: হুম, আজ বড়ো সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়েছে। তৃষ্ণা মিটছে না।
: মানুষ! তোমার যে কি হয় এক একটা দিন! কিসের কিসের যে তৃষ্ণা পায়! সিগারেটের তৃষ্ণা, চায়ের তৃষ্ণা, গানের তৃষ্ণা, স্মৃতির তৃষ্ণা, শিমুল তুলো ওড়ানোর তৃষ্ণা, তারা গোনার তৃষ্ণা, গজলের তৃষ্ণা, কবিতার তৃষ্ণা, অভ্রবকুলের তৃষ্ণা, হারালো যে জন অন্ধকা….

কথা শেষ হবার আগেই ওকে থামিয়ে দিয়ে বলি-
: সব মুখস্থ করে রেখেছো দেখছি! আর কোনো কাজ নেই তোমার!
: দেখে দেখে মুখস্থ হয়ে গেছে।
: বাহ! বাহ। তুমি দেখি এক্কেবারে জিপিএ ফাইভ।
: জিপিএ ফাইভ না ছাই! তবে আজ বেশ কষ্ট পেয়েছি। তাই বারান্দা থেকে তোমার পিছুপিছু এলাম।

নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলাম-
: কে তোমাকে কষ্ট দিলো টিকটিমনি!
: কে আবার দিবে! তুমিই দিয়েছো, মানুষ।
: কখন কষ্ট দিলাম!
: ঘুঘুবউটি বললো আজ তাদের বাবুর জন্মদিন, আর তুমি একটু উইশও করলে না! আমার ভীষণ কষ্ট লেগেছে। মানুষ, তুমি এমন কেনো!
: এজন্য এতো কষ্ট!
: হু
: কিন্তু এ কষ্ট যে অর্থহীন।
: অর্থহীন! কেনো বলো তো!
: শোনো টিকটিমনি, উইশের ফিতায় কি মাপা যায় জন্মের পরিধি!
: কি যে বলো! কিছুই বুঝিনা।
: কিছু বোঝার দরকার নেই। মনে রেখো প্রতিটা দিনই জন্মদিন। প্রতিটা দিনই নতুন করে জন্মায় তার আগের দিনের স্মৃতি ও বিস্মৃতি নিয়ে, সাথে সাথে আমরাও জন্মাই প্রতিদিন। তবে এমন একটা দিন আসে, আমরা আর জেগে উঠিনা, সেখানে জম্মের শেষ।

টিকটিমনি একটা লম্বা হাই তুলে বললো-
: তাই না কি, মানুষ! তোমার কথা শুনে ঘুম পাচ্ছে।

টিকটিকির কথার উত্তর দেইনা। নিজের অজান্তেই দীর্ঘতম কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে, ছড়িয়ে পরে ভেজা হাওয়ায়। তুমুল বৃষ্টির একটানা শব্দকে কাঁপিয়ে তারস্বরে শিস দিয়ে যাচ্ছে দুটো দোয়েল, কে জানে এই সকালে কোন কারণে এমনতর কান্না!

৩.
আজ বৃষ্টি আর থামবে না। অপাকস্থালীর জীবন আকুতি জানায়- ‘আজ নিজের ভেতরে সাঁতার কাটো, তালদুপুরে মনপুকুরে দাও ডুব।’ কিন্তু খেঁকিয়ে ওঠে পাকস্থলীর জীবন, ‘সকাল সকালই আকাজের উস্কানি দিচ্ছো যে! কাজ না করলে খাবে কি! পেটে ক্ষিধে থাকলে তখন দেখা যাবে কোথায় থাকে তালদুপুর আর খালপুকুর, হু।’ যে জীবন পাকস্থলীর সে জীবন বোঝেনা পাখির ভাষা, পতঙ্গের আহ্লাদ, বৃষ্টির রোদন। সে জীবন জানে শুধু কামলার ব্যকরণে দীর্ঘশ্বাস গোপনের সকল কৌশল।

রাস্তায় জমে আছে ছিপছিপে পানি। হাটতে হাটতে রাস্তার মোড়ে যাই। সব রিকশা এখনো বের হয়নি, তাদেরও হয়তো উস্কানি দিয়েছে অপাকস্থলীর জীবন। স্বল্প পরিচিত এক রিকশাওয়ালা এগিয়ে আসেন-
: ভাই, ওঠেন।
: কোথায় যাবো জানেন?
: হ, জানি।

রিকশায় উঠে বসি। বৃষ্টির বেগ আবার বেড়েছে। তিনি প্লাস্টিকের পর্দাটা ভালো করে খুলে দেন, হুডেও গুজে দেন কিছু অংশ। রিকশা চালাতে শুরু করেন। রিকশা চলছে, পথে পথে অলস সকালের ঘুম ভাঙছে, পাকস্থলীর টানে ছুটেছে কামলা কামলাগিরির জেলে। রিকশাওয়ালা নীরবতা ভেঙে জানতে চান-
: এমুন আকাইল্যা বাদলা দেখছেন!
: এখন সব কালই আকাল। এই যে অপনি রিকশা চালাইতাছেন, আমি অফিসে যাইতাছি তার কারণও আকাল।
: কন কি ভাই! আকাল হইবো ক্যান!
: অকাল না হইলে তো ঘরে বইসা গপসপ করতাম, পেঁয়াজ কাঁচামরিচ আর চাইল ভাজা সরষা ত্যালে মাখায়া কুচুরমুচুর কইরা খাইতাম। দুপুরে বেগুন ভাজা, ইলশা ভাজা, মিষ্টি কুমড়া দিয়া গোশতের ঝাল তরকারি মাখায়া খিচুরী খাইতাম। আকাল বইলাই এই বাদলার মধ্যে আপনে প্যাডেল মারেন আর আমি কলম মারতে যাইতাছি।

রিকশাওয়ালা হেসে ওঠেন। তারপর বলেন-
: আইজ মাসের ২১তারিক, বাড়ির ভাড়া দিতে দেরী হইছে। জ্বরের লেগা ৭দিন গাড়ি চালাই নাই। আইজ ভাড়া না দিলে বাড়িওয়ালা পিডাইবো কইছে হাহাহাহাহাহাহা…. আকাইল্যাই তো..

মাথার ভিতর ঘুরতে থাকে আজ ২১তারিখ… আজ ২১মে… আজ ২১মে… আজ ২১মে। মাত্র চারটা ২১মে, ছোটো ছোটো কত যে স্মৃতি, আহ ২১শে মে…।

৪.
তুমুল রোদের দিন ছিলো সেদিন। বেইলি রোডের ফাস্টফুড শপে কলেজ ফাঁকি দিয়ে মুখোমুখি দুজন। ভিকারুন্নেসা আহ্লাদি গলায় বলে ওঠে-
: নটরডেম, আজ আমার জন্মদিন। খুব সুন্দর একটা উইশ করো, তা না হলে ঠিক ঠিক মরে যাবো।
: একটা উইশ না পেয়ে জন্মদিনের দিন ঠিক ঠিক মরে যাওয়া কাজের কথা না।
: এহহহ! অবশ্যই কাজের কথা। তোমার সুন্দর উইশ না পেলে ঠিক ঠিক মরে যাবো, তখন দেখো, হু।

ভিকারুন্নেসার মুখে মেঘ জমতে শুরু করে। বাইরে ঝাঝালো রোদ। নটরডেম কাঁপা হাতে ভিকারুন্নেসার কপালে নেমে আসা অবাধ্য এক গোছা চুল কানের পাশে সরিয়ে দিয়ে বলে-
: শুভ জন্মদিন, প্রিয় ভিকারুন্নেসা। মানুষ হয়ে ওঠো প্রতিদিন।

তীব্র অভিমান ভিকারুন্নেসার কণ্ঠে-
: আমি মানুষ নই! তোমার সাথে আজ আমার প্রথম জন্মদিন, আর তুমি এভাবে বলতে পারলে! নটরডেম, তুমি এভাবে
বললে!

ভিকারুন্নেসার চোখ ছলছলিয়ে ওঠে, নটরডেমের বুকে কেনো যে ব্যাথা লাগে! ব্যাথা চেপে সে বলে-
: ভিকারুন্নেসা, উইশে ‘মানুষ হয়ে ওঠো’ থেকে গভীর কিছু আর খুঁজে পাই না যে। এর থেকে দামী উইশ কি আছে!
: এটা দামী উইশ!
: অবশ্যই দামী উইশ। কেনো অমূল্য তা কি শুনতে চাও?
: হ্যা, চাই। শোনার পরে যদি দামী মনে না হবে তবে কিন্তু ঠিকঠিক মরে যাবো, জেনে রাখো, নটর ডেম।

নটর ডেম বলতে শুরু করে-
: প্রতিজন মানুষ জন্মায় মানুষ হয়ে। তারপর একদিন মানুষ হতে না পেরে মরে যায়।
: যাহ! মানুষ তো মানুষ হয়েই মরে।
: না, ভিকারুন্নেসা। প্রতিজন মৃত মানুষই আসলে মানুষ হতে না পারা একজন মানুষ।
: কি যে বলো না, নটরডেম!
: জন্মানোর পরে মানুষকে মানুষ করে তুলতে শুরু করে পরিবার। তাকে শুধু মানুষ হলেই চলবেনা- তাকে হতে হবে সভ্য মানুষ, সফল মানুষ, শিক্ষিত মানুষ।
: তা তো হতে হবেই।
: ভিকারুন্নেসা, সেখানেই তো সমস্যা, মানুষের আর মানুষ হয়ে ওঠা হয়না।
: ধ্যাত! এর অর্থ কি!
: জন্মানোর পরেই বাবা-মা মানুষ করে তোলার অভিযানে নামেন। এই অভিযানে যোগ দেন আত্মীয়স্বজন আর পাড়া প্রতিবেশী। স্কুল-কলেজের স্যাররাও নামেন মানুষ গড়ার কাজে, তারা সেই মানুষ গড়ে তুলতে চান যে মানুষ তারা হতে চেয়েছিলেন কিন্তু হতে পারেননি। কবি সাহিত্যিক ডাক্তার মোক্তার সবাই মানুষকে মানুষ বানাতে চায়। নিজের নিজের ছায়ার মাপের মানুষ, নিজের নিজের এইম ইন লাইফের মানুষ, নিজের নিজের বৃত্তভাঙার মানুষ।
: একটু থামো, নটরডেম। দম নাও। কিছুটা বুঝতে পারছি।
: গুড। তারপর কি হয় বুঝতে পারছো!
: কি হয়!
: অন্যদের মাপে মানুষ হতে হতে একটা সময় মানুষ নিজের মুখোমুখি দাঁড়ায়। সে বুঝতে পারে যে মানুষটি সে হতে হয়েছিলো সে মানুষটি সে হতে পারেনি। তার দিন কেটে গেছে অকারণ অর্থহীন এক মানুষ হবার মোহে। তার আর মানুষ হয়ে ওঠা হয় না, বেলা ফুরোয়, খেলা ফুরোয়, মানুষ হতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে জীবনও ফুরোয়।

গভীর বিস্ময় নিয়ে নটরডেমের দিকে তাকিয়ে থাকে ভিকারুন্নেসা। টেবিলের উপরে রাখা হাতটা শক্ত করে ধরে জানতে চায়-
: আমি কেমন মানুষ হবো- বলে দাও।
: ভিকারুন্নেসা, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পৌছানোর যাত্রাটাই হলো মানুষ হবার জার্নি। প্রতিদিন নিজের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন কোরো ‘কতটা মানুষ হবার পথে এগোলাম, কতটা পিছিয়ে পরলাম।’ প্রতিদিন একটু একটু মানুষ হয়ে ওঠো, নিজের মত মানুষ, যে মানুষটি তুমি হতে চাও অবিকল সে মানুষ।
: থ্যাংক ইউ নটর ডেম।

কিছুটা বিরতি দিয়ে ভিকারুন্নেসা আবেগঘণ স্বরে বলে-
: যতই মানুষ হয়ে উঠি না কেনো! তোমাকে না পেলে ঠিকঠিক মরে যাবো, হু।
: কথায় কথায় মরতে হবেনা, মনে রেখো– জীবন অনেক বড়। এক একটা জীবন জীবন থেকেও বড়, দীর্ঘতর আর দীর্ঘতম।
: এতোকিছু জানিনা নটরডেম। মানুষ হবার জার্নিতে যেনো কখনোই তোমাকে না হারাই।

হাসতে হাসতে নটর ডেম বলে-
: ভিকারুন্নেসা, এই একটা মাত্র জীবনে তুমি আমার বামপাশে থেকো, হারিয়ে যেওনা।

পৃথিবীতে আর কোনো শব্দ নেই, দুজন মুখোমুখি বসে থাকে, দুজনের চোখ মিনতি করে যায়- হারিয়ে যেওনা… হারিয়ে যেওনা… হারিয়ে যেওনা…

৫.
বৃষ্টির আজ কি যে হলো! বৃষ্টি বাড়ছে তো বাড়ছেই। ভাবনা হয়- বৃষ্টির ছাটে কি ভিজে যাচ্ছে ঘুঘুদম্পতির খাঁচা! ভিজুক, আজ তাদের কষ্টের দিন। ঠিক আজকের দিনেই ডিমফুটে বের হওয়া তাদের প্রথম বাবুকে পিপড়ার দল কামড়ে কামড়ে মেরে ফেলেছিলো। তার আর ঘুঘু হয়ে ওঠা হয়নি। মানুষ হবার জার্নিতে আজ কতটা এগিয়েছে ভিকারুন্নেসা জানা নেই, সে থাকেনি বামপাশে।

রিকশা ছুটেছে তাই ছপছপ শব্দ হচ্ছে পথে, কামলা ছুটেছে রিকশার পিঠে চেপে। জানি, এ রিকশা মনসুখিয়ায় যাবেনা, সে চিনেনা মনসুখিয়ার পথ। হঠাৎ, বাতাসে কাঁঠালচাঁপার ঘ্রাণ ভেসে আসে, তাকে ফিসফিসিয়ে বলি, ‘প্রতিদিন মনসুখিয়ার দিকে ছুটে চলেছি আমি। অভ্রবকুল নিবে তো আমায়! আমার যে আর কোথায় যাওয়ার নেই!’ কোনো উত্তর পাইনা, শুধু কাঁঠালচাঁপার ঘ্রাণ তীব্রতর হয়ে ওঠে, বাতাসে বিষাদ ছড়িয়ে একটা দোয়েল মাথার ভিতরে গেয়ে চলে-
‘চল মন মনসুখিয়ার কাছে
তার গভীরে জোছনা রঙা রৌদ্রনদী আছে…’

_______________________
গ্রন্থঃ মনসুখিয়া/আবু সাঈদ আহমেদ।

অধরা ও সমুদ্রের গল্প

দৃশ্যপট : ১
এ কোন বিশাল শূন্যতায় ডুবে যাচ্ছে মন ? নিজেকে বড্ড বেশি একা লাগে আজকাল। অধরার সাথে সেই কবে কথা হয়েছিলো, তা ঠিক মনে নেই। ভেতরটা কেমন যেন খালি, খালি লাগে। শরৎ এসে চলে যায় কাশফুল গুলো অভিমানে ঝরে যায়। এমন করে কয়টা শরৎ যে কেটে গেলো তুমিবিহীন, অধরা তোমারও কি আমার জন্য মন কাঁদে? আমার মতো তোমারও কি মনে পড়ে সেই শরতের কথা?
সমুদ্রের অনেক দূরে জলরাশি আর আকাশ যে মিলেমিশে রাতের এই জ্বলে থাকা বাতির আলোতে এক হয়ে গেছে। সেই দূরে তাকিয়ে থেকে অনেক চেঁচিয়ে এই কথাগুলো বলছিলো আলিফ। ঠিক এমন সময়-

‘আপনার মনে কি অনেক কষ্ট ? আচমকা পিছু তাকায় আলিফ, ডানে বামে কেউ নেই, আমাকে বলছেন?’
‘হুম আপনাকেই বলছি। আমি আপনাকে প্রায় অনেকটা সময় ধরেই দেখছিলাম, এই বিশাল সমুদ্রের তীরে শূন্য দৃষ্টি নিয়ে কী দেখছিলেন এমন করে?’
‘দেখছিলাম রাতের এই নির্জনতায় রূপালী চাঁদের আলোয় ঢেউ গুলো দেখতে কেমন লাগে।’
‘আপনিতো অনেক সুন্দর করে কথা বলেন!’
‘আলিফ একটু মৃদু হেসে বলল, আপনার মনটা এখনো অনেক সুন্দর, তাই হয়তো আপনার কাছে শুধু আমার কথা নয়, সব কিছুই সুন্দর লাগবে।’

“নিয়ম” ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন আমার এই মনটা কোনো একদিন আর সুন্দর থাকবেনা?’
‘আমি কিছুই বলতে চাচ্ছিনা, এটাই প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু আপনার নামটা..? আমি কি আপনাকে চিনি বা আপনি আমাকে?’

দৃশ্যপট : ২
‘এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবেন, চলেন একটু হাঁটি।’
‘হুম চলোন, নামটা কিন্তু বললেন না।’
‘একদম ভুলে গেছি, আমার নাম “নিয়ম”। ঢাকা উত্তরা থেকে আসছি।’
‘আমি “আলিফ” ঢাকা আজিমপুর আমার বাসা। ”নিয়ম” আপনার নামটা কিন্তু খুব সুন্দর।’
‘থ্যাংকস, আমার এই নামটা আমার আব্বু রেখেছেন।’
‘আপনার আব্বুকে বলবেন এরকম আর একটা সুন্দর নাম যেনো আমার জন্য রাখেন।’
‘কেন! আপনার নামটাতো সুন্দর।’
‘আরে আমার জন্য না। আমার অনাগত ভাগনির জন্য।’
‘এক গাল হেসে বলল নিয়ম, মেয়েই যে হবে আপনে কি করে জানেন ?’
‘আমার বিশ্বাস।’
‘আচ্ছা বলবো।’
‘আপনে কী একাই আসছেন ? বলল আলিফ।’
‘না আমার ভাইয়া আর ভাবি আসছে, ভাইয়ার নতুন বিয়েতো, তাই হানিমুনে আসছে। আমি হলাম আমার ভাইয়টার সব, তাই যখন যেখানে যাবে আমাকে সঙ্গে নিবেই, আর আমি কেন একা, একা হাঁটছি তাতো বুঝতেই পারছেন।’
‘তবে আমার জন্য কিন্তু খুব ভালো হয়েছে বলল আলিফ।’
‘তা কেমন ভালো?
‘এই যে আমাকে সঙ্গ দিচ্ছেন, আমি একজন সঙ্গী পেলাম।’
‘কেন, আপনার সাথে কেউ আসেনি?’
‘আমি একটা শূন্য মানুষ একটু পূর্ণতার আশায় এই বিশাল সমুদ্রের কাছে আসি। কে আসবে আমার সঙ্গে বলুন ?’
‘এতটা শূন্য কীভাবে হলেন ?’
‘বলবো, যদি এই নির্জন সমুদ্র সৈকতে সঙ্গী হন তো !’
‘খানিক গালে হেসে নিয়ম বলল হলাম না হয় সঙ্গী। তা কতদিন আছেন ?’
‘আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল আলিফ জানি না। এমন সময় “নিয়মের” মুঠোফোনটা বেজে উঠলো।” নিয়মের” ভাই ফোনের ও প্রান্ত থেকে।
‘কিরে নিয়ম কই তুই। তাড়াতাড়ি আয়, রুমে চলে যাবো।’
‘আচ্ছা ভাইয়া আসছি। “আলিফ” সাহেব আজ আমাকে যেতে হবে, আসি।’
‘অবশ্যই যাবেন, ভাল থাকবেন। কাল আসবো ঠিক এখানেই, আসবেন তো ?’
‘নিয়ম একটু হাসি দিয়ে বলল আসবো।’

দৃশ্যপট : ৩
আজকের দিনটা গত কাল থেকে একেবারেই ভিন্নতর। চোখ দুটো কোনো ভাবেই এমন মধুর ঘুম মিস্ করতে চাচ্ছে না। সকালের সোনালি রোদ জানালার গ্রীলের ফাঁক দিয়ে বার বার উঁকি দেয়। সে আলোয় আলিফের আর ঘুম হলো না। এক মগ ব্লাক কফি, আর একটা কবিতার বই নিয়ে চলে গেল বারান্দায়। এ ভাবেই সারাটা সকাল কাটিয়ে দিলো। দুপুরবেলা আবার ঘুম। ঘুম থেকে উঠে দুপুরের খাবার শেষ করে আবার সেই সমুদ্র তীরের কাছাকাছি অনেক গুলো গাছের নিচে একা দাঁড়িয়ে।

‘কখন এলেন? বলল “নিয়ম”।’
‘এইতো অনেকক্ষণ। আপনি আসবেন ভাবিনি।’
‘ভ্রু বাঁকা করে তাকায় নিয়ম। এমন কেন মনে হলো? আমিতো কথা দিয়েছি আসবো।’
‘না,মানে আমি অপরিচিত একজন মানুষ কেমন না কেমন তাই ভাবলাম হয়তো আসবেন না।’
‘হুম তা অবশ্যই ঠিক, আপনি অপরিচিত ছিলেন কিন্তু এখন পরিচিত। আর দেখে তো মনে হয় অতটা খারাপ হবেন না। বলেই অনেক হাসতে লাগলো, আলিফও সাথে সাথে হেসে দিলো।’
‘এখানে কি করছেন। একা একা ভাল লাগে ?’
‘ঝরে পড়া শুকনো পাতাদের ঝরে পড়ার শব্দ শুনছিলাম। আমার বুকের ভেতর যেমন শব্দ হয় ঠিক তেমন শব্দ।’
‘আপনি যে কি অদ্ভুত কথা বলেন। যাই হোক আজ আর অন্য কোনো কথা নয়। কেন এমন শূন্য আপনার জীবন। তাই শুনবো।’
‘তাই, ঠিক আছে বলবো চলেন সমুদ্রের কাছে গিয়ে বসি।’
প্রায় পাঁচ বছর আগের কথা। ২০০৮, এর রোজার ঈদের পর আমি আর আমার কয়েক জন বন্ধু মিলে এইখানে মানে এই কক্সবাজার ঘুরতে আসি। তারপর একদিন হঠাৎ করেই ঠিক এখানে দেখা হয়ে যায় অধরার সাথে। যাকে আমি অনেক ভালবাসি। আমার অস্তিত্ব জুড়ে যার বসবাস। যার জন্য আমি এখনও দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ফিরে আসি এখানে।

দৃশ্যপট : ৪

‘নিয়ম অবাক হয়, অধরা! জানেন আমার ভাবির নাম ও অধরা। তারপর ?’

তারপর অধরার সাথে পরিচয়, এক সাথে সমুদ্র দেখা, শেষে বিকেলের সূর্য ডুবা দেখা, রাগ অনু রাগ ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা। খুব ভালো ভাবেই যাচ্ছিল আমাদের সম্পর্কটা। এতটাই ভালোবেসে ছিলো সে আমাকে, কত রাত জ্যোৎস্নার জল আর এই সমুদ্রের জলে স্নান করেছি দুজন তার কোন হিসেব নেই। এখনও এই সমুদ্রের জল তার সাক্ষী বহন করে। অধরার পায়ের নখ থেকে মাথা পর্যন্ত আমি জানি। তার পশমের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে রয়েছে আমার স্পর্শ। আচ্ছা “নিয়ম” এত কিছুর পর কি কোনো মেয়ে ভুলে যেতে পারে ?’

‘আমি অন্যদের কথা জানিনা, তবে আমি হলে বিষ পান করে মরতাম, তবু ভালবাসার মানুষকে ছাড়া এক দিনও থাকার চিন্তা করতাম না। তারপর ?’

‘তারপর কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ফিরি একই সাথে। অধরার বাড়ি ছিলো মোহাম্মদপুর। তার সাথে আমার নিয়মিতই দেখা হতো কথা হতো। ঢাকা শহরের এমন কোনো জায়গা নেই যে – দু’জনের পায়ের ছাপ পরেনি। জীবনের যত স্বপ্ন ছিলো সবই অধরাকে ঘিরে।

কিন্তু হঠাৎ করেই সে একদিন ফ্রান্স চলে যায়। আমাকে কোনো কিছু না জানিয়ে। আজ দু’বছর হয়। তার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। সে কেমন আছে তাও জানিনা। শুধু তার এক বান্ধবীর কাছে একটা ছোট্ট চিঠি রেখে গিয়েছিলো। যা আজও আমি যত্ন সহকারেই রেখে দিয়েছি। চিঠিতে শুধু লেখা ভাল থেকো চিন্তা করোনা আমি তোমার আছি- তোমারই থাকবো। তুমি শুধু আমার অপেক্ষায় থেকো।

আর তার সেই কথা মনে রেখেই আমি আজও তার অপেক্ষায় আছি। সে আমায় বলেছিল যদি কোনদিন হারিয়ে যাই। ঐ সেই সমুদ্র সৈকতে এসো আমাকে পাবে। আর আজ তার সেই কথা মনে রেখে আজও তার অপেক্ষায় আছি যদি সত্যি সে ফিরে আসে, তাই এই সমুদ্রের কাছেই আজও বসে থাকি তার অপেক্ষায়। হাজারও স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এই সমুদ্রের মাঝে। সমুদ্রের মাঝ থেকে শোঁশোঁ করে যে হাওয়া আসে। সে হাওয়ায় আমি এখনও শুনতে পাই অধরার” সেই কণ্ঠস্বর। তাই বারবার এই সমুদ্র আমায় টানে। মনে হয় এখানে আসলেই আমার সব সুখ।’

‘আপনি এখনও তার অপেক্ষায় আছেন ? যে আপনাকে শূন্য করে দিয়ে গেলো, কি লাভ তার কথা মনে রেখে ? সব ভুলে কি আবার নতুন…! আলিফ “নিয়মের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলল,
‘না আমি পারবোনা, আমি অধরাকে ভুলতে পারবোনা। অধরাকে ভুলে যাওয়া মানে নিজেকেই ভুলে যাওয়া। তার পর শূন্য দৃষ্টি নিয়ে অনেকক্ষণ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে দুজন। হঠাৎ করে ভেসে আসা দমকা হাওয়ার ধাক্কায় ঘোর কাটে দুজনের।’

‘আচ্ছা আলিফ আপনি এত ভালো কেন বলেন তো ?’
‘আলিফ অনেক শব্দ করে হাসে, আমি যদি ভালো মানুষ হতাম তবে কি “অধরা” আমাকে এভাবে ছেড়ে চলে যেত !!’

“অধরা” হয়তো কোনোদিন আপনাকে ভালবাসতে পারেনি। তাই হয়তো চিনতে পারেনি আপনাকে। আলিফ একটা কথা বলি?’

‘বলেন?’

‘কেউ যদি আপনাকে ভালবাসে নতুন করে একটা সুন্দর জীবনের গল্প লিখে দেয় আপনার জীবন খাতায়, তা হলে কী অনেক বড় ভুল হবে?’

‘আমি কিছুই বলতে পারবো না, শুধু জানি অধরার সাথে একবার হলেও আমার দেখা হওয়া প্রয়োজন। আমি একটিবার তার মুখোমুখি হতে চাই।’

‘আমি আল্লাহর কাছে দোয়া চাইবো যেন আপনার মনের আশা পূরণ হয়। আজ তাহলে উঠি কাল আবার আসবো। আমি কি আপনার মোবাইল নাম্বারটা পেতে পারি?’

‘অবশ্যই এটা হলো আমার নাম্বার ০১৯১১…
‘আজ তা হলে আসি ভাল থাকবেন।’

দৃশ্যপট : ৫

“নিয়ম” নিজের অজান্তেই আলিফের মায়ায় পড়ে যাচ্ছে। কিসের সেই মায়া তা সে নিজে ও জানে না। আজকাল নিজের অজান্তেই আলিফকে নিয়ে যা-তা ভাবছে। সারাক্ষণ কি যেন একটা ঘোরের ভেতর থাকে। আলিফের সমস্ত দুঃখ কষ্ট যেন তার নিজস্ব।

নিয়মের ভাবি “অধরা” প্রায় ভাবে কিছু একটা জিজ্ঞেস করবে নিয়মকে। কিন্তু জিজ্ঞেস করা আর হয়না। তবে আজ বলেই ফেলল।
‘কিগো আমার মিষ্টি ননদিনী সারাদিন কি একাই হাঁটো, একাই সমুদ্র দেখো। একা সমুদ্র দেখতে ভালো লাগে?’

‘হুম তোমাকে তো বলাই হয়নি সমুদ্র আমার অনেক প্রিয়, এই সমুদ্র আমায় অনেক কিছু দিয়েছে। এই সমুদ্র আমায় ভালবাসতে শিখিয়েছে। একা বললে ভুল হবে, একজন আসে প্রতিদিন সমুদ্র দেখতে, ওনার সাথেই সময় দেই, মানুষটা খুব ভালো, তবে অনেক কষ্ট মানুষটার মনের ভেতর।’

‘তাই বুঝি!! তবে একদিন নিয়ে আসো মানুষটার সাথে কথা বলি। তুমি চাইলে আজি ডিনারে আসতে বলতে পার।’

‘সত্যি বলছো ভাবি আজ ডিনারে আসতে বলবো! কিন্তু ভাইয়া ?’

‘তোমার ভাইয়াকে আমি ম্যানেজ করবো।’

‘আমার লক্ষী ভাবি। আমি এক্ষণি আসার জন্য বলছি। নিয়ম অনেক আনন্দ নিয়ে ফোন করলো আলিফকে। ফোনের ও প্রান্ত থেকে…
‘হ্যালো কে বলছেন ?’

‘আমি, আমি নিয়ম”।’

‘অহ্ আপনি। তা ভালো আছেন তো ?’

‘হ্যাঁ ভালো আছি, আমি একটা কথা বলার জন্য ফোন করেছি। আমার কথাটা রাখবেন তো ?’

‘আমি যদি আপনার কথাটা রাখি তবে কি অনেক খুশি হবেন ?’

‘আমি যে কতটা খুশি হবো তা আমি আপনাকে বুঝাতে পারব না।’

‘তাই ?’

‘হ্যাঁ তাই ?’

‘আচ্ছা কথা দিলাম রাখবো।’

‘আজকের ডিনারটা আমাদের সাথে করবেন। ভাবিকে আপনার কথা বলেছি। কি আসবেন না ?’

‘কথা যেহেতু দিয়েছি আসতেই তো হবে। আসবো। কোথায় কখন আসতে হবে?’

‘আমাদের হোটেলের নিচে যেই রেস্টুরেন্টটা আছে এখানে। ঠিক রাত নয়টার সময়। কি আসবেন তো ?’

‘আচ্ছা আসবো।’

দৃশ্যপট : ৬
আলিফ আকাশি রঙের একটা শর্ট পাঞ্জাবী আর কালো রঙের জিন্স প্যান্ট পড়ল। আজ অনেক দিন পর এক নয়, কারোর সাথে ডিনার করবে তাই একটু ভাল লাগছে ভাবতেই।

”অধরার” সাথেই অনেক গুলো রাত ডিনার করে ছিলো এক সাথে এই রেস্টুরেন্টে, তবে অনেক কিছুর মতো ঐ সেই রাতের কথা ভুলতে পারেনি আলিফ। এমন সময় আলিফের মুঠোফোনটা হঠাৎ বেজে উঠলো। ফোনটা আর কারোর নয় ”নিয়মের”।

‘এই যে আলিফ সাহেব কোথায় আপনি। আমারা আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।’

‘আমি আসছি পাঁচ মিনিট লাগবে।’

”নিয়ম” হাত দিয়ে ইশারা করলো আলিফকে। ‘হাই! আপনার ভাইয়া ভাবি কোথায় ?’
‘ভিতরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। চলুন যাওয়া যাক।’

নিয়ম” আর ”আলিফ” যখন রেস্টুরেন্টের ভেতর প্রবেশ করলো, আর ঠিক তখনি ”অধরার” চোখ পড়লো ”আলিফের দিকে। অধরার সমস্ত পৃথিবী যেন ঘোলাটে হয়ে গেলো। এমন একটা অনাকাঙ্ক্ষিত সময় যে অধরার জীবনে আসবে তা কোনো দিন কল্পনা করেনি। অধরা বসা থেকে দাঁড়িয়ে উঠলো। অনেক হাসি আনন্দ নিয়ে যখন আলিফ অধরার দু-চোখের সামনে দাঁড়িয়ে, আলিফ কিছুতেই বিশ্বাস করতে পাড়ছিলনা নিজের চোখ দুটোকে। হঠাৎ করেই যেন আলিফের সমস্ত শরীরের রক্ত গুলো জমাট বেঁধে গেলো। যে ”অধরাকে” আর একবার দেখবে বলে মাসের পর মাস সমুদ্র সৈকতে কাটিয়ে দিলো; সেই ”অধরাকে” এমন ভাবে দেখবে আলিফ তা কখনও ভাবেনি। লাল শাড়ি হাত ভরতি চুড়ি কপালে টিপ, নাকে নাকফুল, দুহাত ভরতি মেহেদীর আল্পনা। অনেক করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল দুজন দুজানার দিকে।

‘ভাবি আমি তোমাকে যে মানুষটির কথা বলে ছিলাম উনি হলেন সেই মানুষ। আলিফ উনি হচ্ছেন আমার ভাবি, আর উনি হলেন আমার ভাইয়া।’

‘হাই আমি ইমতিয়াজ আহম্মেদ। দাঁড়িয়ে কেন বসুন, খেতে খেতে না হয় কথা বলবো।’

‘হ্যাঁ শিওর, বলল আলিফ।’

‘তারপর কোন হোটেলে উঠেছেন ?’

‘এইতো শাপলা হোটেলে।’

‘তাই আমরাও তো এই হোটেলেই। তা কোন রুম আপনার ?’

‘আমার ১৩৭ নাম্বার রুম।’

‘তাই !! আমাদের ১৪০-৪১ নাম্বার রুম। পাশাপাশি তো আছি। তা একাই আসছেন ?’

‘আলিফ আড়চোখে ”অধরার দিকে তাকিয়ে বলল, একা মানুষ তো একাই আসবো।’

‘তাই কোনো ব্যাবসায়িক কাজে নাকি ঘুরতে আসছেন ? আলিফ আবার ”অধরার দিকে তাকায় এবার অধরার চোখে চোখ রেখে বলল, না ব্যবসা বা ঘুরতে কোনটাই নয়। আমি প্রায় দু-বছর আগে একজনকে হারিয়ে ফেলেছি তাকে খোঁজতেই এখানে আসা।

‘তাই তাহলে তো আরো কিছু দিন থাকবেন তাইনা ?’

‘না ভাবছি কাল চলে যাবো।’
“অধরা” আবারও তাকায় আলিফের দিকে। ‘নিয়ম প্রশ্ন করে কেন চলে যাবেন কেন ?’

‘যাকে খোঁজার জন্য এখানে আসা, কিন্তু আজ হঠাৎ করে জানলাম তাকে আর কোনো দিন পাবোনা। তাই ভাবছি কাল চলে যাবো।’

‘কি ব্যাপার ভাবি তুমি কিছু বলছোনা যে?’ অধরা চমকে যায় ”নিয়মের” কথায়।

‘ না মানে ইমতিয়াজ, আমার অনেক খারাপ লাগছে, মাথাটা অনেক ধরেছে। প্লিজ আমি একটু রুমে যাই। তোমরা ডিনার শেষ করে না হয় এসো, বলল অধরা।’

‘অনেক বেশী খারাপ লাগছে ? ড. ডাকতে হবে।’

‘আরে না তেমন কিছু না। ড. ডাকতে হবেনা। আমি আসি।

‘একা যেতে পারবে তো ?’

‘হ্যাঁ পারবো। তোমরা ডিনার শেষ কর এসো।’

দৃশ্যপট : ৭

অধরা রুমে গিয়ে বালিশের ভেতর মুখ লুকিয়ে কাঁদতে লাগলো। আলিফ এখনও এতো ভালবাসে, এখনও এই সমুদ্রের কাছে শুধু তার জন্য বসে থাকে! এই ভেবে অধরার কান্না আরো বেড়ে যাই। আগের আলিফ আর এখনকার আলিফের মধ্যে অনেক ফারাক। আলিফের দু’চোখের নিচে কালো দাগ পরে গেছে। শুকিয়ে গেছে অনেক। মনে হয় অজস্র রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে। অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছে আলিফের সাথে। ইচ্ছে করছে আলিফকে একবার জড়িয়ে ধরে কান্না করতে। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও তা সম্ভব নয়। তার পরও অধরার অবচেতন মন কিছুতেই মানছে না। তাই ঠিক করে ফেলল আজ যে ভাবেই হোক কথা বলবেই।

‘ইমতিয়াজ সাহেব আজ তাহলে উঠছি ভাল থাকবেন। ভাল থাকবেন “নিয়ম”। আমি আপনাদের কোন দিন ভুলবো না।’

‘তো কাল কি সত্যিই চলে যাবেন ? বলল ”নিয়ম”।’

‘হ্যাঁ আমি কালকেই চলে যাবো। আসি ভাল থাকবেন।’

”নিয়মের” আজ অনেক কষ্ট হচ্ছে। আর সেই কষ্টটা শুধুই আলিফের জন্য। “নিয়ম” আজ সত্যি বুঝতে পারছে আলিফকে সে ভালবেসে ফেলেছে। কিন্তু আলিফ কাল সকালে চলে যাবে। তাহলে কি আর কক্ষনো আলিফকে বলা হবেনা কতটা ভালবাসে। আর কি কক্ষনো এক সাথে সমুদ্র দেখা হবেনা ? যে ভাবেই হোক আলিফকে বলতেই হবে। হ্যাঁ আমি আজ রাতেই বলবো আমি কতটা ভালবাসি তাকে সে কথা।’

শেষ -দৃশ্যপটঃ-

আর ওদিকে অধরা অস্থির হয়ে আছে শুধু আর একবার আলিফের সাথে কথা বলার জন্য। কিন্তু কীভাবে? ইমতিয়াজকে রেখে কীভাবে যাবে সে- অধরার ভাবনার মধ্যেই হঠাৎ ইমতিয়াজ সাহেব ডাক দিলেন।

‘অধরা আমার ঘুমের ঔষধ আর এক গ্লাস পানি দিয়ে যাও তো।’

ইমতিয়াজ সহেবের প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে ঘুমের ঔষধ না খেলে তার ভালো ঘুম হয়না। আর অধরা ইমতিয়াজ সাহেবের সেই বদঅভ্যাসের সুযোগ নিতে একটুও ভুল করেনি। তাই তো ”অধরা” দুটো ঘুমের ঔষধ পানির সাথে মিশিয়ে দিলো, আর একটা হাতে করে নিয়ে গেল। ইমতিয়াজ সাহেব ঘুমের ঔষধ খাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন। আর অধরা দরজা খুলে ধীরে ধীরে চলে গেলো আলিফের রুমে। রাত প্রায় একটার কাঁটা ছুঁই ছুঁই। হঠাৎ করেই আলিফের রুমের কলিংবেলটা বেজে উঠলো। আলিফ রুমের ভিতর থেকে
‘এত রাতে আবার কে আসলো। দরজা খুলতেই কোনো কিছু না বলেই হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকে পড়ে অধরা।

‘এত রাতে তুমি! ‘
‘হ্যাঁ আমি।’
‘তুমি কেন আসছো এখানে, চলে যাও কেউ দেখে ফেললে তোমার সংসার ভেঙে যাবে। আমি চাইনা তোমার ঐ সুন্দর হাতের মেহেদি শুকানোর আগেই মুছে যাক।’

আর ওদিকে “নিয়মের” আর দেরি সইছে না, আলিফকে ভালবাসি কথাটি না বলা পর্যন্ত নিয়মের দু-চোখে ঘুম নেই, সেই একটি মাত্র কথা ভালবাসি। তা বলার জন্য আলিফের রুমের দিকে যেতে লাগলো হঠাৎ নিয়মের চোখ পড়লো আলিফের রুমের জানালাটার দিকে। জানালার পর্দার আড়ালে দুজন মানুষের ছায়া দেখা যাচ্ছে, আর খুব ভাল করেই বুঝা যাচ্ছে একটা মেয়ে, আর একটা ছেলে। নিয়মের হিসেব যেন কিছুতেই মিলছে না। আলিফের রুমে এমন মধ্য রাতে মেয়ে মানুষ !! নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হতো না। তাই কৌতূহল নিয়ে ”নিয়ম” জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।
আর রুমের ভিতর অধরা বলছে – ‘না আমি যাব না।’

আলিফ অধরার কথায় হাসে, হা হা হা, যাবেনা, কেন যাবেনা?
‘আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি…।’

‘আলিফ অধরার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ভালোবাস তুমি আমাকে? এই বলে আলিফ আবার হাসে, হাসি থামিয়ে চীৎকার করে বলে, লজ্জা করে না তোমার! সারা দিন রাত অন্য একজনের সাথে এক খাটে ঘুমিয়ে আমাকে এসে বলছো ভালবাসার কথা !! আমার স্বপ্নগুলো তো ভেঙেই দিয়েছ, এবার যাকে স্বপ্ন দেখালে তার স্বপ্ন গুলো আর ভেঙ্গো না।’

‘অধরা কান্না করে আর বলে আলিফ শুধু একবার আমার কথা গুলো শোনো, আমি কেন তোমার সাথে…।’
‘আলিফ আবার থামিয়ে দেয় অধরাকে। আলিফ কাঁদে আর বলে, তুমি এই মুহূর্তে আমার সামনে থেকে যাও। আমি তোমার এই মুখটা আর দেখতে চাইনা। আমি তোমার কোনো কথা শুনতে চাইনা। তুমি যাও, তুমি যাও।’

অধরা বের হয়ে যাওয়ার সময় ”নিয়মের” সামনে পড়ে যায়। অধরা কিছু বলতে পারে না। মাথা নিচু করে শুধু কাঁদছে।
”নিয়ম” ”অধরার” মুখটাকে দু’হাত দিয়ে তোলে দু’চোখের পানি মুছে দিয়ে শুধু একটি কথাই বলল, ভাবী তুমিই কী সেই ”অধরা”…
?
———সমাপ্ত—–
অধরা ও সমদ্রের গল্প //

প্রথম প্রকাশ ২০১৩ (সাতকাহন)
২য় প্রকাশ (ঢাকা টাইমস)
৩য় প্রকাশ (শব্দ নীড় ব্লক)
৪থ প্রকাশ ( গল্প কবিতা ডটকম)
৫ম প্রকাশ ২০১৯( মোলাকাত)

©আদেল পারভেজ

মদাঞ্জলী

মদাঞ্জলী

১.
বহুবছর পর বালক বারে ফিরেছে। একটা সময় এই বার ছিলো প্রতি দিনের গন্তব্য। কতশত বিবর্ণ বিকেল ডান কোনার টেবিলে নিদ্রাহীন রাতের কাছে খুন হয়েছে। গ্লাসের বাইরে জমে থাকা ঘামের প্রতি বিন্দুর একাকীত্ব গুনে গুনে কেটেছে সময়। চুমুকে চুমুকে জেগেছে বিষাদের ঘোর।

সব দরজা বন্ধ হয়। বারের দরজাও বন্ধ হত। শহরে মধ্যরাতের নির্জনতা ভেঙে রিকশায় ঘুরতে ঘুরতে বাড়ি ফেরা। সোডিয়াম আলোয় বিষণ্ন সড়ক। মাথার ভিতরে গানের আসর। নিস্পৃহ বুকের ভিতরে ডি এল রায় গুনগুনাতেন “মনরে কৃষি কাজ জানোনা/এমন মানব জমিন রইলো পতিত আবাদ করলে ফলতো সোনা..।” সবাই কি আর সোনা হয়! আবাদ করেও কেউ কেউ পতিত জমিই রয়ে যায়।

২.
বালক বারে ঢুকে কাউন্টারে দাঁড়ায়। আধো আলো আধো অন্ধকারে ম্যানেজার বিষ্ময়পূর্ণ হাসি দিয়ে উচ্ছসিত–
: আরে এতো বছর পরে তুই! এতোদিন কোথায় ছিলি?
: রুবেল ভাই, কোথাও ছিলাম না।
: হাহাহা, আবার হেঁয়ালিভরা কথা বলছিস! কত বছর পরে এলি বলতো?
: এগারো বছর হবে। ভাই, আমি কি কর্নার টেবিলে বসতে পারবো!
: কর্নার টেবিলের মায়া এখনো ছাড়তে পারিসনি! টানা তিন বছর প্রতিটা দিন ঐ টেবিলে বসেছিস। সবার জানা হয়ে গিয়েছিলো– কেউ বসতো না।
: আজ বসা যাবে?
: গেস্ট আছে। একটু ওয়েট কর। ব্যবস্থা করছি। (তিনি পাশে বসা ক্যাশিয়ারকে ইশারা দিলেন)। এত দিন পরে কি মনে করে এলি?
: বলতে ইচ্ছে করছেনা। তোমার কাছে সিগারেট আছে!
: সিগারেট ধরলি কবে? হাতে নিয়ে বসতে দেখেছি, কখনো তো টানতে দেখিনি।
: ধরি নাই। আজ প্রবল তৃষ্ণা পাচ্ছে। ধোঁয়ার তৃষ্ণা, পানির তৃষ্ণা।
: কোনো কারণে মন খারাপ! চাপে আছিস! কষ্ট ভুলতে চাইছিস!
: মদ খেয়ে কষ্ট ভুলে কোন পাগলে!! বরঞ্চ কষ্ট আর যন্ত্রণা উপভোগ করা যায়।
: কষ্ট আর যন্ত্রণা উপভোগের জিনিস!! আর ইউ ক্রেজি!
: পুরো জীবনটাই উপভোগ্য। তীব্র কষ্ট, অসহ্য যন্ত্রণা, গভীর বিষাদও জীবনের অংশ। তারাও উপভোগ্য, তীব্রতরভাবে তাদের উপভোগ করতে হয়।
: তোর সাথে কথা বললে মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। এই এগারো বছরে কি একটুও ড্রিংক করিস নাই!
: করেছি, খুব বেশী হলে সাত আটবার– কখনোই পাঁচ পেগের বেশী নয়।
: বলিস কি! এত কম! তোর লিমিট তো নয় পেগ।
: হাহাহাহাহা তোমার মনে আছে!
: হ্যা, ভুলা যায়! তুই তো ভোলার মত ক্যারেক্টার না।
: হাহাহাহা, মানুষ দিব্যি ভুলে যায়, ভুলে গেছে, ভুলে আছে।
: না রে, মানতে পারলাম না। তোকে এড়িয়ে চলা সহজ, ভোলা অসম্ভব।
: তাই! কেনো?
: যারা এড়িয়ে চলে তারাও বোঝে তুই তাদের কতটা ভালবাসিস। কতটা মায়া করিস।
: হাহাহাহা, যতই ভাবের কথা বলো আজ থেকে আমার লিমিট হলো বারো পেগ এবস্যুলেট ভদকা আর বারোটা বেনসন রেগুলার।
: হাহাহাহা আচ্ছা। প্রসঙ্গ ঘোরানোর অভ্যসটা আগের মতই আছে। আজ প্রথম তিন পেগ তোকে গিফট করলাম।

বালক বিষ্ময় গোপন করে। এতো ভালোবাসা, এতো স্নেহ জমা হয়ে আছে! ওহ মাই আঈভ (আল্লাহ ঈশ্বর ভগবান)!

৩.
কর্নার টেবিল। আলো আলো অন্ধকার। খয়েরি কাঁচের বিশাল দেয়াল। এখান থেকে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা আর সন্ধ্যভুক রাত্রি দেখা খুব প্রিয়। বাইরে ব্যস্ত সড়ক। ট্রাফিক সিগন্যালে থেমে যাচ্ছে গাড়ির সারি। আবার চলছে। সন্ধ্যায় জ্বলে উঠবে হেড লাইট– আলোর মালা।

বিয়ারের বড় গ্লাস। অর্ধেক বরফের মিহি কুঁচিতে ভরা। বাকী অর্ধেকে ভদকা আর টমেটুজুসের মিশ্রণ ঢেলে নেড়ে নেয় বালক। গ্লাসের গায়ে ঘাম জমে। ঘামের প্রতিবিন্দুতে আপন প্রতিবিম্ব। অস্পষ্ট। প্রতিটা প্রতিবিম্বই কি ভীষণ একা! নিঃসঙ্গ! গ্লাসের গা বেয়ে নামতে নামতে রিনরিনিয়ে ওঠে-
: কর্নার টেবিলে আবার ফিরে এলে?
: কর্নার টেবিলে ফিরিনি তো। নিজের কাছে ফিরেছি।
: এ কেমন ফেরা?
: একজন মানুষ অসংখ্যবার অসংখ্যভাবে নিজের কাছে ফেরে। সরল ফেরা।
: কি জানি! এত জটিল কথা বুঝতে পারিনা। তোমার ছাদে এখনো শালিখের দল দুপুরে ভাতদানা খেতে আসে?
: আসে। হররোজ আসে।
: খোঁড়া শালিখটা আসে?
: না, বহুবছর হলো আসেনা।
: আহা রে, কোথায় চলে গেছে কে জানে!
: হয়তো মানুষের মত সেও ফিরে গেছে নিজের কাছে।
: কি জানি! তুমিও আবার চলে যাবে। আর কখনোই ফিরবেনা। কতদিন তোমার পথ চেয়ে ছিলাম।
: স্ট্রেঞ্জ!! আমার পথ চেয়ে ছিলে!
: বা রে! তিন বছর প্রতিটা দিন এসেছো। কতদিন পুরো বারে তুমি একা। আমি নীরবে দেখে গেছি। হঠাত আসা বন্ধ করে দিলে– পথ চেয়ে থাকবো না?
: আমরা সবসময় ভুল জনের জন্য পথ চেয়ে থাকি; আত্না দিয়ে ভুল জনকে ভালোবাসি। তাই বলে তুমিও!
: সে সব কথা থাক! এবার যাবার আগে বলে যেও।
: তোমাকেই বলে যাবো ‘যাই, গ্লাসের প্রিয় ঘাম’ ..হাহাহাহা। খুশি?
: হুম। তোমার প্রিয় একটা কবিতা শুনবে?
: প্রিয় কবিতাও মনে রেখেছো!! শোনাও তবে–
: যে নক্ষত্র দেখ নাই কোনোদিন, দাঁড়ায়েছি আজ তার তলে!
সারাদিন হাঁটিয়াছি আমি পায়ে পায়ে
বালকের মতো এক — তারপর, গিয়েছি হারায়ে
সমুদ্রের জলে,
নক্ষত্রের তলে!
রাত্রে, অন্ধকারে!
তোমার পায়ের শব্দ শুনিব না তবু আজ — জানি আমি,
আজ তবু আসিবে না খুঁজিতে আমারে!

৪.
চুমুকে চুমুকে গ্লাস শেষ হয়ে আসে। নতুন গ্লাস ভরে ওঠে। সিগারেটের ধোঁয়া আলো আঁধারে মিশে যায়। গ্লাসের মিহি বরফকুচি গলে যেতে যেতে ফিসফিসিয়ে বলে–
: মানুষ, তোমার কি হয়েছে?
: জানিনা, সত্যিই জানিনা।
: ইচ্ছে করে সবাই মিলে তোমাকে একদিন মাতাল বানিয়ে দেই। চিৎকার করে মনখুলে সব বলো। চারদিক লণ্ডভণ্ড করে দাও। ক্লান্ত হয়ে বাচ্চাদের মত হুহু করে কাঁদো। তারপরে বেঘোরে ঘুমোও। শান্তির ঘুম– লাশের মত।
: প্লিজ, মাতাল বানিয়ে দাও। মনসুখিয়ার কাছে যাবার আগে একবার মাতাল হতে চাই। আপদমস্তক মাতাল।
: তোমাকে মাতাল বানাবার সাধ্য কারো নেই। তুমি রক্তে মাংসে আত্নায় মনসুখিয়ায় মাতাল হয়ে আছো। মনসুখিয়ার ডাক শোনার জন্য কান পেতে আছো।
: আলো আধারির দোহাই– শুধু একবার মাতাল করে দাও। একবার ঘুমোতে দাও মৃত্যুর মত গাঢ় আর প্রত্যাখ্যানের মত গভীর ঘুমে।
: সম্ভব নয়। তীব্র কষ্টে মাতাল হতে চাইছো মনসুখিয়ায় পৌছানোর পথ পাচ্ছোনা বলে.. অভ্রজোনাক তোমায় ডাকছেনা বলে। একবার ডাকলে সব ছেড়ে সবাইকে ছেড়ে ছুটে যাবে মনসুখিয়ায়, অভ্রজোনাকের কাছে।
: হবে হয়তো! অথচ দিনশেষে এ জীবন অর্থহীন আর মৃত্যুরও কোনো অজুহাত নেই, তাই না!
: হুম। গন্তব্যের পথ চেনো না। এদিকে ঘরের ঠিকানাও হারিয়ে ফেলেছো। সবাইকে কোথাও না কোথাও যেতে হয়– তুমি যে কোথায় যাবে?

উত্তর খুঁজে পাইনা। পুড়ে যেতে যেতে সিগারেটের ধোঁয়া খলবলায়-
: নিজের ভিতরে গুমরে গুমরে মরাই তোমার নিয়তি। তোমার ভবিতব্য। গোপন কান্নাই অমোঘ নিদান।

৫.
হঠাত কোথা হতে বহু বছর আগের দুপুরবেলার খোঁড়া শালিকটা উড়ে আসে। আলো আধারির কর্নার টেবিলে বসে। মুখোমুখি। তাকিয়ে থাকে নিষ্পলক। বালকের খোঁড়ামনে দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘতর হয়ে পাক খায়। কোনো কারণ ছাড়াই চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে। কি আশ্চর্য! শালিখও কাঁদছে না কি? আহা রে!

_______________________
গ্রন্থঃ মনসুখিয়া/আবু সাঈদ আহমেদ।

অণুগল্পঃ পারুর_বুকে_জোনাক_জ্বলে

পারুর বুকে জোনাক জ্বলে

কোনো একসময়ে আমি নিজের থেকেও নিজেকে লুকিয়ে রাখতাম। অন্যরাও দেখতে পেতো না আমাকে। এক ছায়াজীবনে নিজের কায়া হারিয়ে ফেলেছিলাম।

তখন ছায়ামানবের এক চিলতে আশার আলো ছিলো আয়তাকার এক জীবন। তাও ছিলো গণ্ডীতে আবদ্ধ। সীমার বাইরে যেতে দিতো না। ছটফট করতো অসীম মন আমার!

সেই সময় আমার বসবাসের এক চিলতে বারান্দাই ছিলো আমার একমাত্র আনন্দনগর! এপারে অন্ধকার, ওপারে সব আলো।

আমাকে আঁধারে ডুবিয়ে আলোরা ওপারে চলে গেলো সব পারুর কাছে! ইতোমধ্যে সে আমাকে নিজের অন্ধকারগুলোও ধার দিয়েছে।

সেই থেকে নিজের তমসাঘন আঁধারে ডুবে পারুর অন্ধকারগুলোও বুকে জড়িয়ে আছি। অন্ধকারের বুকে আরেক গোপন আঁধার। আমি দূর থেকে পারুর বুকে জোনাক জ্বলতে দেখি। অপেক্ষা করি… যদি সে ফিরে আসে এক টুকরো আলো হাতে!

আলোয় বসবাসকারী পারু কি কখনো এক টুকরো আলো নিয়ে অন্ধকারে ফিরে আসবে আমার কাছে? মৌচাক নগরে পারুর বুকে মধু মাছি ঘুরে ফিরে উড়ে বেড়ায়.. জোনাকী পোকারা নিজেদের একাংশ আলোকিত করে পারুর বুকে লেপ্টে থাকে। ওদের বাকী অংশ আমার মতো আঁধারে হাবুডুবু খায়।

এক কোটি বছর ধরে অপেক্ষায়.. চেয়ে আছি ওপারের আলোয় ঝলমলে জীবন থেকে এপারের অন্ধকারে এক টুকরো আলো নিয়ে আসবে পারু!

‘..আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী..’

প্রান্তিক_গেটে_একদিন_মামুনের_অণুগল্প

পকেটে দশটি টাকাই শেষ সম্বল। সামনে গোটা একটা দিন। তিন বেলা খেতে হবে। আচ্ছা একবেলা না হয় বাদই দিলো। বাকি দুই বেলা? সে দেখেছে পকেটে যখন টাকা থাকেনা ক্ষিদেগুলোও চাগাড় দিয়ে ওঠে, কেমন রাক্ষসের মতো শুধু খাই খাই করে।

রাক্ষসের কথা কেন মনে হল? সে রাক্ষস দেখেছে কি কখনো?
নাহ!
তবে?
এমনি-ই মাথায় চলে এলো।

বাহ! এমনি এমনি মাথায় চলে এলো! তবে সামনের ঐ ফার্স্টফুডের দোকানের কাঁচের নীচের খাবারগুলো এমনি এমনি ওর পেটে ঢুকে যেতে পারে না?

ঐ তো দু’জন বসে বসে সমুচা খাচ্ছে। একজন বোতল থেকে সস বের করছে। টকটকে লাল টমেটো সস বোতলটিকে কাত করে ক্ষুদে প্লেটটিতে ঢালছে। অন্যজনের ডান হাতে একটা সমুচা। সে ওটা বাম হাতে রেখে ডান হাতের একটা আংগুল দিয়ে একটুখানি সস তুলে জিহ্বায় নিয়ে চোখ বুঝে স্বাদ নিতে লাগলো। ব্যাটা সস মনে হয় কোনোদিন খায়নি। তার হাতের নখগুলো বেশ বড়… এবং ময়লায় কালো দেখাচ্ছে। অন্যজন দেখেও দেখলো না। নির্বিকারভাবে সসের বোতল খালি করায় ব্যস্ত। দোকানিও নির্লিপ্ত ভাবে চেয়ে আছে। তবে ফাইফরমাস খাটা ছোট ছেলেটা বিরক্তিভরা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। হয়তো মনে মনে বলছে,
– খাবি তো ব্যাটারা মোটে দুইটা সমুচা । খালি করছিস পুরো সসের বোতল!

ময়লা নখওয়ালা এবার সমুসায় মাখন মাখানোর মতো করে সস লাগিয়ে বড় এক কামড় বসায়। ওর মুখের অবস্থা দেখবার মত হয়। শব্দ করে চাবানোর সাথে সাথে মুখের দু’পাশ থেকে ঝুরঝুর করে সমুচার অংশবিশেষ তার নিজের শরীরে পড়ছে। সেখান থেকে তুলে আবার মুখে পুরছে।

ওদের থেকে সামান্য দূরত্বে দাঁড়িয়ে পকেটে দশটাকা নিয়ে শিহাব এসব দেখছে। আর ভাবছে, এইসব গিদার যারা ভদ্রভাবে খেতেও জানেনা- এদের পকেটেই অফুরন্ত টাকা! আরো একটু কাছে গিয়ে সে ওদের সমুচা খাওয়া দেখতে থাকে। চোখ খাবারের দিকে… ইচ্ছে করে মুখের পাচকরস সহ দৃষ্টিকটু ভঙ্গীতে দু’বার ঢোক গিলে, জিহ্বা বের করে নীচের ঠোঁট ভিজিয়ে লোভীর ভঙ্গী করে। আবার ঢোক গিলে।

শিহাব শুনেছে, খাবার সময়ে অভুক্ত কারো নজর খাবারের দিকে পড়লে নাকি যে খায় তাঁর পেট ব্যথা করে। সে চাইছে এই গিদার দুটোর উপর তার নিজের অভুক্ত নজর পড়ুক। ব্যাটাদের প্রচন্ড পেট ব্যথা হোক। ব্যথায় ওরা মেঝেতে গড়াগড়ি দিক। অবশ্য দু’জনের হাতের নখের যা ছিরি (শ্রী), পুরো ডাস্টবিনেও মনে হয় এমন ভয়ানক উপাদান নেই । ওর নজরের প্রয়োজন হবেনা, এমনিতেই গড়াগড়ি দেবার কথা।

এভাবে একজন অপরিচিত মানুষ ওদের খাওয়া দেখছে, তাও এতোটা অশোভন ভাবে। এক গিদার মুখের খাবারটুকু কোৎ করে গিলে ওকে লক্ষ্য করে বলে,
– কিছু বলবেন ভাইয়া?

দোকানির চোখেও শিহাবকে ঠিক কাস্টমারের মতো লাগে না। মানে ক্যাম্পাসের এই দোকানগুলোতে যেরকম মানুষ আসে তাঁদের মতো আর কি। আবার ভিক্ষুকের মতোও যে লাগছে তাও ভাবতে পারছে না সে। একটা লম্বা ফুলহাতা শার্ট প্যান্টের সাথে ততোটা বেমানান লাগছে না। উপরে একটা খাকি রঙ এর কোটি। চোখে সানগ্লাস। তবে পায়ে একটা স্পঞ্জের স্যান্ডেলই জাত মেরে দিয়েছে ওর। নীল ফিতাওয়ালা স্যান্ডেল। সামনের অংশে অতিরিক্ত পানি লেগে লেগে শ্যাওলা ধরা কালো দাগ পরেছে। তেলতেলে একটা ভাব স্পষ্ট বোঝা যায়। সাধারণত বাথরুমে অবহেলায় এ ধরণের স্পঞ্জগুলো মাসের পর মাস পড়ে থাকে, আর ফিতে ছেড়ার অপেক্ষায় প্রহর গোনে।

যাহোক দোকানি একটু বিব্রত হলেও ওর স্লাভিক চৌকো চেহারায় কোনো ভাব ফুটে ওঠে না। হয়তো ওঠে কিন্তু স্বভাবজাত নির্লিপ্ততার আড়ালে তা ঢাকা পড়ে যায়।

শিহাবকে প্রশ্ন করা গিদারটির গোঁফ রয়েছে। সেখানেও সমুচার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ চুম্বকের সাথে লোহার গুড়া যেভাবে আটকে থাকে, সেভাবে লেগে রয়েছে। কালো গোঁফে হলুদ খাদ্যকণা। হলুদ দেখাতেই শিহাবের কাছে এক ‘বিশেষ পদার্থের’ কথা মনে হল। সে মনে মনে এই প্রশ্নকারী গিদারের নাম দিলো ‘গুইয়্যা গুঁফো’। নবাবদের মতো করে নামকরণ হলে এর নাম হতো ‘গুইয়্যা গুঁফো গিদার নাম্বার ওয়ান ফ্রি সসের বোতল ঝাঁকানেওয়ালা।’

এবার শিহাব ‘গুইয়্যা গুঁফো’র প্রশ্নের উত্তর দেয়,
– হ্যা, অবশ্যই। বলতেই তো এসেছি।

দুই গিদারসহ দোকানের চারজনই ওর দিকে তাকায়। তিনজনের চোখে আগ্রহ আর একজন নির্লিপ্ত।

শিহাব ‘সস চাটা গিদার নাম্বার টু’ এর রানের উপরে সমুচার চর্বিত একটা টুকরোর দিকে নির্দেশ করে বলে,
– খাবার অপচয় করা যাবে না। অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই বলা হয়েছে। তাই ওটা এখুনি খেয়ে নিন।

শুনে গিদার নাম্বার টু এর চোখ বড় বড় হয়ে যায়। নিজের অজান্তেই সে সমুচার ঐ চর্বিত টুকরোটি নিয়ে মুখে পুরে দেয়।

এবার শিহাব ‘গুইয়্যা গুঁফোকে’ বলে,
– আপনার গোঁফেও লেগে রয়েছে। তবে গোঁফে লেগে থাকা খাবার খাওয়া হারাম হবে। পানি খেতেও সাবধানে খাবেন। এজন্যই গোঁফকে ছেটে ছোট রাখতে বলা হয়েছে।

ওর কথায় দুই গিদার একটু ভড়কে যায়। ভীত কন্ঠে নাম্বার টু বলে,
– আপনি কে ভাই?

উত্তর না দিয়ে শিহাব একটু সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েও আবার ফিরে আসে। খুব গম্ভীর স্বরে জানায়,
– আমি কে সেটা জানা এতোটা জরুরী নয়। তবে আমাকে পাঠানো হয়েছে ঐ গুলো দেখার জন্য।

দুই গিদারের হাতের নখের দিকে নির্দেশ করে কথাগুলো বলে শিহাব।

দোকানি এবং তাঁর কর্মচারী এবার গিদারদের নখের দিকে তাকায়। গিদার দু’জন নিজেরাও তাকায়। নিজেদের সৃষ্ট নোংরামি দেখে লজ্জা পায় এবং আরো একটু ভড়কে যায়। একবার নিজেদের নখের দিকে এবং পরক্ষনেই শিহাবের মুখের দিকে তাকায়। শিহাব আর কথা না বলে সামনের দিকে চলে যায়।

চারজন মানুষকে সকালবেলাতেই বিভ্রান্ত করে দিতে পেরেছে! এই আনন্দ নিয়ে সে রাস্তার ওপাশের যাত্রী ছাউনিটির দিকে এগিয়ে যায়। পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা… পকেটে দশটি টাকা। সবে দশটা বাজে। আরো কয়েক বেলার খাবার কীভাবে ম্যানেজ হবে তাঁর জন্য মনের ভিতরে দুশ্চিন্তা!

ছাউনিতে বসে বসে ওর থেকে অনেক ছোট দুই ছোকরা সিগ্রেটে গাঁজা ভরছিল। একজন সিগারেটের ভিতর থেকে ‘সুকা’ (তামাক) ফেলে দিচ্ছে। অন্যজন তাঁর হাতের চেটোতে (তালু) গাঁজা রেখে নখ দিয়ে খুটে খুটে ছিড়ছে। এক্ষেত্রে নখ ব্লেডের কাজ করছে।

শিহাবকে হঠাৎ ছাউনির ভিতরে ঢুকতে দেখে দুজনেই ‘ফ্রিজ’ হয়ে যায়। সিগারেটের ‘সুকা’ যে ফেলছিল সে ওটাকে স্বাভাবিক ভাবে ধরে রাখে। যেন এখুনি সিগারেট ধরাতে যাচ্ছিল। আর হাতের চেটোতে গাঁজা নিয়ে যে ছিড়ছিল, সে অন্য হাতকে গাঁজা রাখা হাতের সাথে মিলিয়ে বসে রইলো।

একপর্যায়ে দুই ছোকরা অর্থহীন কথা বলা শুরু করে,
– আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবো দোস্তো? একটা বাসও তো আসছে না।
উত্তরে অন্যজন বলে,
– বসে থাক, আসবে।
অথচ একের পর এক বাস আসছে আর যাচ্ছে।

শিহাব যেন ওদেরকে দেখেও দেখে না। তবে পকেট থেকে মোবাইল বের করে একটা কাল্পনিক নাম্বারে ডায়াল করে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ওপাশের অদৃশ্য ব্যক্তির ফোন রিসিভ করার জন্য।

এরপর কথা শুরু করে,
– হ্যা স্যার, আপনার ইনফর্মেশন ঠিকই ছিল। আমি জায়গামতোই এসেছি। ফোর্স আশেপাশেই রয়েছে। …কি বললেন? দু’জন?

এবার সে ছেলে দুটির দিকে তাকায়… একটু দেখে এবং আবার কথা শুরু করে,
– হ্যা হ্যা, অল্পবয়সী। ওরাই… আজকাল এরাই সিন্ডিকেটের সদস্য হয়ে থাকে। জি… স্যার… স্যার… ওকে। আইল ইনফর্ম ইউ ল্যাটার।

মোবাইল হাতে নিয়ে কল কেটে দেবার ভান করে। এতক্ষণে ছেলে দু’টির অবস্থা প্রায় কেরোসিন। না পারছে ছাউনি থেকে বের হতে… না বসে থাকতে। এদিকে ওরা ভাবছে শিহাব একা, দু’জন দু’দিকে দৌড় দিলে সে কাকে ধরবে আগে? কিন্তু ঐ যে ফোর্স আশেপাশে রয়েছে শুনে তাও করতে পারছে না। সাথে রয়েছে গাঁজা। এটা না থাকলে কোন বাল্টা ফালাইতো তাও দেখতো নাহয়। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন।

শিহাব ওদের দু’জনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ওরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওর দিকে তাকায়। সে হাত পাততেই যার হাতের চেটোতে গাঁজা রয়েছে সে সবটকু দিয়ে দেয়। অন্যজন খালি করা সিগ্রেটের খোসাটিও দিয়ে দেয়। এবার প্রথমজন পকেট থেকে গাঁজার পোটলাটি বের করে শিহাবের হাতে ধরিয়ে দেয়।

সব দেয়া শেষ হলে শিহাব বলে,
– তোমাদের বয়স অল্প বলে আজ ছেড়ে দিলাম। আর কখনো এগুলো ছোঁবে না, বুঝেছ?

ছেলে দু’জন ঘাড় কাত করে তাঁদের সম্মতির কথা জানায়।

শিহাব বলে যেতে থাকে,
– এখন সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে রাস্তার দু’দিকে দেখেশুনে রাস্তা পার হবে। এরপর সোজা বাসায়। একবারও পিছনে ফিরে তাকাবে না।

ছেলে দুটি যেন মুক্তির স্বাদ পেয়ে বাতাসের বেগে ভেগে যেতে চায়। কোনোমতে ছাউনি থেকে বেরিয়ে রাস্তার দু’দিক ভালোভাবে দেখে নেয়। এরপর পার হয়ে ফাস্টফুডের দোকানগুলোর পাশ দিয়ে দ্রুত ক্যাম্পাসের ভিতরে অদৃশ্য হয়।

ওরা চলে গেলে শিহাব ‘স্টিকটি’ বানানো শেষ করে।
পকেট থেকে ম্যাচ বের করে ধরায়… আয়েশ করে মিষ্টি গন্ধের কটু ধুঁয়া গিলতে থাকে আর ভাবে,
– জিরো-টলারেন্স! মাই-ফুট।

নিজের মনে হাসে সে। হাতের নাগালে সবই পাওয়া যায়। মেথর পট্টি, নিরিবিলি, আনারকলি, কলমা- এসব জায়গা এখন সে যেখানে বসে আছে সেটার আশেপাশেই। মাদকের স্পট এগুলি। সবই পাওয়া যায়। অথচ কত নাটক! জিরো-টলারেন্স 😀

গাঁজার স্টিকে দম দিতে থাকে শিহাব। যদিও জানে এতে তাঁর ক্ষুধা আরো বেড়ে যাবে। পকেটে মাত্র দশ টাকার একটি বঙ্গবন্ধুওয়ালা নোট, অথচ খেতে হবে তিনবেলা। বিদ্যমান ক্ষুধাকে কিছু সময়ের জন্য ভুলে গিয়ে গাঁজার স্টিকটিতে একের পর এক দম দেয় সে। ওর ফুসফুস ধুঁয়ায় ভরে যায়। চোখ দুটোতে ঝিম ধরে… তবুও সেই ঝিমধরা দৃষ্টির পেছন থেকে অফুরন্ত এক ক্ষুধা উঁকি দিতেই থাকে। এভাবেই আবহমানকাল ধরে ক্ষুধা বিষয়টি নিজের উপস্থিতি জাহির করে আসছে। একে কেন্দ্র করেই সভ্যতার শুরু… একদিন পতনও হবে হয়তো একে কেন্দ্র করেই।

#প্রান্তিক_গেটে_একদিন_মামুনের_অণুগল্প_৫৪৫

ভোগ

বাবাজী ভারী অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন।

বীভৎস গরম। গাড়ীর ভেতরে এসি চলা সত্বেও গিয়ার বক্সের পেছনে রাখা বোতলের জল পানের অযোগ্য। রাস্তার ধারে একটাও ঠিকঠাক দোকান চোখে পড়ছে না যেখান থেকে জল কিনে আপাততঃ বাঁচার মত অবস্থায় ফিরি। হঠাৎই বাঁ দিকে চোখ চলে গেল।

বেশ চমৎকার একটা সবুজ ঘেরা আশ্রম। ছিটে বেড়ায় ঘেরা দুপাশে বাগানের শেষে একতলা একটা বাড়ী। গাড়ীর গতি কম ছিল। পরিষ্কার দেখতে পেলাম ছিটে বেড়ার গেটে বড় বড় হরফে আলকাতরায় লেখা আছে গুরু সম্মোহনানন্দজীর যোগাশ্রম। আর দেখলাম বাড়ীর পাশেই আহা মরুভূমির মরুদ্যান একটা টিউবওয়েল।

একটুও চিন্তা না করে রাস্তা থেকে গাড়ী নামিয়ে গেটের ধারে পার্ক করে সোজা গেট ঠেলে ভেতরে। ওইটুকু ক্যাঁচ শব্দ শুনেই খোলা বারান্দায় বেরিয়ে এলেন ছবিতে দেখা বেশ ভারিক্কি জটাজুট ওয়ালা এক সাধু। খালি গা, নীচে একটা ধুতি গেরুয়া রাঙিয়ে লুঙ্গির মত করে পরা।
কোনো প্রশ্ন করার আগেই বললাম, “জল!”

হাত নেড়ে ইশারা করে বারান্দায় বসতে বলে ভেতর থেকে ঝকঝকে এক পেতলের ঘটি তে জল আনতেই আমি ঢকঢক করে আস্ত ঘটি শেষ করে থামলাম। এতক্ষণে নিজে একটু ধাতস্থ হলাম বলে মনে হল। আর ঠিক তক্ষুনি নাকে এল মাংস রান্নার আহ্লাদিত গন্ধ।

থতমত খেয়ে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, “আপনি সাধুসন্ত হয়ে মাংস খান?”
ভীষণ অবাক হয়ে আমাকে দেখলেন সেই সাধু। ঠিক যেন দেখছেন চোখের সামনে এক নধর বোকাসোকা ছাগল ম্যাঅ্যাঅ্যা করে ডাকলো।

-“আমি খাই কি রে! এ তো তাঁর প্রসাদ!”
-“কার? ভগবানের? তিনি মাংস খান!”
আমি আরও ভোম্বল হয়ে তাকালাম।
-“তিনি সর্বভূক। তাঁর কি কোনো বিচার আছে রে পাগলা!”
-“কিন্তু ভগবান আমিষ খান জানতাম না।”
-“আমিষ! জয় রাম! জয় রাম! কি সব অলুক্ষুণে কথা বলিস! তোরা সাহেবই হয়েছিস। শাস্ত্র একেবারেই পড়িস নি। তাঁর ভোগের মাংস পেঁয়াজ ছাড়া প্রস্তুত করতে হয়। তাহলে আমিষ কোথায় হল? একেবারে শুদ্ধ নিরামিষ মাংসভোগ।”

সম্মোহনানন্দজীর সম্মোহনে আমি কাত।

বাড়ি_ফেরা_গল্পগ্রন্থ_অপেক্ষা

অনেক আগে লেখা আমার একটি ছোটগল্প শেয়ার করছি। তখন কোনাবাড়িতে গোলামী করি। সপ্তাহে একদিন বাসায় আসি। সেই সাপ্তাহিক একদিনের বাড়ি ফেরার মুহুর্তের অনুভূতি নিয়েই এই গল্পটি:

________________
বাসায় ফেরার দিনে সময়টা খুব দ্রুত কেটে যায়। সকল কাজকর্ম অন্যদিনের তুলনায় একটু আগেই শেষ করে ফেলতে ইচ্ছে হয়। সে ও করে। একটু তাড়া থাকেই। সহকর্মীদের মৃদু হাসি… আসন্ন কোনো ষড়যন্ত্রের আভাস কি? যার উৎপত্তি ওদের যার যার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে।

বাইরে বের হতে হতে সোয়া সাতটা বেজে যায়। অন্যরা আরো পনের মিনিট আগেই বের হয়েছে। অফিস গেটের সামনের চায়ের দোকানগুলোতে অলস আড্ডা দিচ্ছে কেউ কেউ। ফুটপাথে আমের ঝুড়ি এবং কাঁঠাল সাজিয়ে নিয়ে বসেছে একজন। পাশের দুটো গাছে কাপড়ের ব্যানার, ‘এখানে ফরমালিনমুক্ত আম-কাঁঠাল পাওয়া যায়।’ হাঁটতে হাঁটতে ভাবে , যে হারে ফরমালিন মিশানো ফল খেয়ে এসেছে এতোগুলো বছর, তাতে এখন হঠাৎ ফ্রেশ ফল খেলেই বরং অসুবিধে।

রাস্তায় বের হলে দুই ধরণের মানুষ দেখা যায়। যারা নিজের গাড়িতে চলাফেরা করে আর অন্যরা পাবলিক পরিবহন ব্যবহার করে। প্রাইভেট কারের ভিতরে যারা থাকে তারা ট্রাফিক জ্যামের বিড়ম্বনাটুকু এসির ভিতরে বসে উপভোগ করা ছাড়া আর তেমন কিছু অনুভব করে কি? যত কষ্ট সব তো পাবলিক পরিবহনের যাত্রীদের। একটা রিক্সা নিয়ে হাইওয়ে দিয়ে যেতে থাকে। বাম-ডান দু’পাশ দিয়েই বাস-ট্রাক আর ম্যাক্সির ভীড়। যে যেভাবে পারছে ফাঁক পেলেই ঢুকিয়ে দিয়ে অলস বসে থাকছে। রিক্সাগুলো পথচারীদেরকে হঠাৎ চমকে দিয়ে বেল বাজিয়ে ফুটপাথের সংকীর্ণ জায়গাটুকুও দখল করে নিচ্ছে। এরা সবাই পোশাক শ্রমিক। সারাদিনের পরিশ্রান্ত দেহটিকে একটু আরাম দেবার জন্য হাতে হটপট নিয়ে বাসায় ফিরছে। ওর খুব ভালো লাগে এই বাড়ি ফেরা মানুষগুলোকে দেখতে।

একটা ব্যাংকের সামনে রিক্সা থামে। অনেক ফলের দোকান অবৈধভাবে চলাচলের পথে গড়ে উঠেছে। সেখান থেকে পুলিশ এবং ক্ষমতাসীন দলের পাতি নেতারা টাকা খায়। এরা খায় না কি তা-ই ভাবে সে। পাঁচ বছর ক্ষমতায় আসে সবাই। তাই যত পারে খেয়ে নিতে চায়। সপ্তাহের শেষ দিনে বাড়ি ফেরা মানুষের ভীড়টা অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু বেশী-ই থাকে। বাসের ছাদে মানুষ, ভিতরে বাদুড় ঝোলা হয়ে ঝুলছে। তারপরও সবাই উঠতে চায়। গেটে কয়েকজন ঝুলে ঝুলে চলছে। একটা ইঞ্জিন চালিত অটো এসে থামতেই মিছিল করে সবাই কে কার আগে উঠবে সেই প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। সে অপেক্ষা করতে থাকে একটু অপেক্ষাকৃত কম ভীড়ওয়ালা বাহনের।

একটা ম্যাক্সীর সামনে ড্রাইভারের পাশে একজনের জায়গায় দু’জন বসে রওয়ানা হল। চাপাচাপি এবং দুর্ঘটনার শিকার হলে একেবারে নেই হয়ে যাবার শঙ্কাকে বুকে নিয়ে পথ চলা। এক ধরণের থ্রীলও অনুভব করে। তবে ড্রাইভার ব্যাটার বকবকানি কানকে এবং তার ধরানো সিগ্রেটের ধোঁয়া পরোক্ষভাবে ফুসফুসকে ঝালাপালা করে দেয়। কিন্তু কিছুই করার নেই। যে দেশে আইন হলেও বিধিমালার অভাবে আইন ‘এক্সিকিউট’ হয়না, সেখানে এইটুকু নাগরিক ‘টর্চার’ তো সহ্য করতেই হয়।

ম্যাক্সী থেকে নেমে কিছুটা হাঁটতে হয়। এসময় তলপেটে চাপ অনুভব করে। কিন্তু রাস্তার পাশে তো আর ভারমুক্ত হওয়া যায় না। তাই মনের দুঃখ মনেই চেপে রেখে পরবর্তী রুটের বাহনের খোঁজে রাস্তায় ভীড় করা ‘পাবলিকে’র সাথে মিশে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়।

এভাবে আরো দু’বার বাহন পরিবর্তন… সেই একই বিড়ম্বনা… প্রচন্ড ভীড়ে মানুষের ঘামের দুর্গন্ধে শরীর গুলিয়ে ওঠা… বিড়ি-সিগ্রেটের ধোঁয়ায় জ্বালা করা চোখের রক্ত বর্ণ লাভ … স্বল্প পরিসর জায়গায় কোনো যুবতীর পাশে বসে তার শরীরের সাথে লেপ্টে থেকে তার অসহায়ত্বটুকু অনুভব করে ম্রিয়মান হওয়া… আর অতিরিক্ত ভাড়া চাওয়া নিয়ে যাত্রী এবং কন্ডাক্টরের ভিতরের বচসা শুনে ক্লান্ত হতে হতে একসময় নিজের বাড়ির পথের প্রান্তসীমায় পৌঁছানো। নিজের অজান্তেই স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসা। এ যেন প্রচন্ড একটা উত্তেজনামুখর স্টেডিয়ামের ভিতর থেকে বের হয়ে একটি ‘সাউন্ডপ্রুফ’ রুমে প্রবেশ করা।

দেড় ঘন্টার পথ পৌনে তিনঘণ্টায় অতিক্রম করাতে বাড়ির রাস্তাটি একদম নীরব… স্তব্ধ… কোথাও কেউ নেই। রাস্তার কুকুরগুলোকেও দেখা যায়না। দু’পাশে গাছ নিয়ে অন্ধকারে একটা সোজা রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে সে বাড়ির পরিচিত রাস্তাটিতে এসে পৌঁছায়। এমন সময় মোবাইল বেজে উঠে। যে মেয়েটি সপ্তাহ ধরে ওর জন্য আগ্রহ ভরে অপেক্ষা করছে সে খুব মোলায়ে স্বরে জানতে চায়, ‘তুমি কোথায়?’ এতোক্ষনের জ্বালা-যন্ত্রণা টেনশন-হতাশা মুহুর্তেই উধাও হয়ে সেখানে আসন্ন এক ভালোলাগার সুখানুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে মন। হাঁটার গতি কিছুটা বেড়ে যায়। অন্ধকারে মিশে থাকা গাছগুলোকে এতোক্ষণ অশরিরী’র মতো মনে হচ্ছিল। এখন ওদেরকে কত চেনা পরম বন্ধু মনে হয়। ওরাও পথের দু’পাশে পরম হিতৈষীর মতো ডাল নুইয়ে পাতা দুলিয়ে স্নেহের পরশ বইয়ে দিয়ে যায়। তাতে ওর হৃদয়মন দুই-ই শান্ত হয়।

লাইফ ইজ বিউটিফুল!
তবে এ দেশে জীবন আমাদেরকে কিছু কিছু সময়ে এই অনুভূতির উদ্রেক করায়। বাকিটা সময়ে ওর কাছে জীবনকে ইদানিং কেমন এক বোঝা মনে হয়। যা থেকে মুক্তির একটা পথ কখনো কখনো এ হৃদয় পেতেও চায়…।

‘… এ বোঝা টানার দিন কবে শেষ হবে?
রাত শেষ হয়ে সুর্য উঠবে কবে?
ঘরেতে অভাব, পৃথিবীটা তাই মনে হয় কালো ধোঁয়া,
পিঠেতে টাকার বোঝা, তবু এই টাকাকে যাবে না ছোঁয়া-
রাত নির্জন, পথে কত ভয়, তবুও রানার ছোটে,
দস্যুর ভয়, তারো চেয়ে ভয় কখন সুর্য উঠে।’ *

সে একজন রানার… ছুটে চলাই যার নিয়তি। এর ভিতরেই যা কিছু উপভোগ করা… অপেক্ষায় থাকা কোনো এক বনলতার ফোন পেয়ে বেঁচে থাকার প্রেরনা লাভ করা… কোনো এক নির্জন তাল গাছের থেকে একটু দূরে ভারমুক্ত হওয়া… যানবাহনের ভীড়ে কোনো অচেনা তরুনীর সাথে লেপ্টে থেকে নিজের মনের ভিতরের কালো সাপকে দমন করা… এসব কিছু মিলিয়েই বর্ণীল জীবন।

আর জীবনের প্রয়োজনেই সে একজন রানার। সিঁড়িদের বুক মাড়িয়ে অনেক উঁচুতে উঠে যাওয়া… কিন্তু পদস্খলনের ভয়ে পিছিয়ে যাওয়া নয়। জীবন তো কেবলি সামনের দিকেই এগিয়ে যায়।

সে ও যায়।।
__________

#বাড়ি_ফেরা_গল্পগ্রন্থ_অপেক্ষা
* সুকান্তের কবিতার লাইন

অনুগল্প -১

কলম খুঁজতে গিয়ে ব্যাগের সাইড পকেট খুলে দেখি হাজার টাকার একটা নোট! কোন ভাবেই বুঝতে পারছিনা টাকাটা এখানে এলো কীভাবে!? অনেক্ষণ ধরে টাকার উৎস খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোন মতেই পেলাম না। অবেশেষে বিগব্যাং তত্তের কথা মনে পড়লো, কোন প্রকার মালিকের নির্দেশ ছাড়াই শুধুমাত্র আপনা আপনি একটা বিকট বিস্ফোরণের মাধ্যমে যদি এত বড় পৃথিবী, গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি… … সৃষ্টি হতে পারে, তবে এই সামান্য টাকাটা কেন নয়? দ্বিগুন উৎসাহে টাকাটার সৎব্যবহার করতে বন্ধুসহ হোটেল থেকে কাচ্চি খেয়ে আসলাম। বাসায় এসে দেখি ফোনে অনেকগুলো মিসড কল। বড় আপা ফোন দিয়েছিল, হট্টগোলে থাকায় বুঝতে পারিনি। ফ্রেস হয়ে কল ব্যাক করলাম।
– আপা বললো, “তোর ব্যাগের সাইড পকেটে ১০০০টাকা রাখা আছে, ভালো দেখে একটা শার্ট কিনিস।”
– টাকার কথা শুনে চোখে আন্ধার দেখতে লাগলাম। কোনমতে বললাম, “ঠিক আছে”। ফোন রেখে মানিব্যাগ চেক করলাম। সব মিলিয়ে ১০০টাকাও হয় না। শার্টের কথা জিজ্ঞেস করলে কী উত্তর দেব, সেটাই এখন ভাবছি…

– (হাতুড়ে লেখক)

সন্ধ্যা_নেমে_এলো_মামুনের_ছোটগল্প

আমাদের দেশে সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে, এমন মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা। এই ছোটগল্পটি সোনার চামচ মুখে দেয়া যুবকদের সম্পূর্ণ বিপরীত শ্রেণির এক যুবকের। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষে চাকুরি না পেয়ে অক্ষম যন্ত্রণায় সময় কাটায়। আমাদের অনেকের জীবনেই এমন মুহুর্ত এসেছে। চলুন নিজের জীবনের সাথে মিলে কিনা দেখে আসা যাকঃ-
___________________________
এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে।
রংধনুর রং এর লুকোচুরি দেখতে দেখতে পথ হাঁটছি। সোনালী বিকেলটাকে আবার এতো তাড়াতাড়ি যে ফিরে পাবো ভাবিনি। কিছুক্ষণ আগেই নীলচে কালো মেঘেরা সব গুড়ুম গুড়ুম করে আকাশটাকে দখল করে নিলো। টিউশন শেষ করে মেসে ফেরার তাড়া ছিল না। তাই উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটাহাঁটি আর ঠোঁট না নাড়িয়ে গুনগুন, ‘কত যে কথা ছিল, কত যে বেদনা…’। ঠোঁট না নেড়ে কখনো গুনগুন করেছ? এটা নাকের বাঁশী ও কন্ঠনালী ব্যবহার করে করতে হয়। গানের কলি শুনলে মনে হচ্ছে যে কতটা দুঃখ হৃদয়ে নিয়ে হেঁটে চলেছি। আসলে তা নয়। তবে একেবারেই যে দুঃখ নেই তাও না। সুখও নেই, দুঃখও নেই। এটাকে এক কথায় প্রকাশ করলে কি যেন হয়?

পকেটে একটা টাকাও নেই। রিক্সার দশ টাকার পথ হেঁটে মেয়েটিকে পড়াতে যেতে হচ্ছে। আজ তিনদিন ধরে। মাসের ছাব্বিশ তারিখ। এই মাস আবার একত্রিশে । কেন, সব মাসগুলো ত্রিশ দিনে হলে কি হয়? আরো পাঁচ দিন এভাবে যেতে হবে। অন্যরা সপ্তাহে তিন কি বেশী হলে চার দিন পড়ায়। আর আমার বেলায় একদিন বন্ধ রেখে প্রতিদিন। আমার চেহারায় কিছু একটা আছে হয়তো। অভিভাবকেরা প্রথম দেখায়-ই বুঝে যায়। কলুর বলদ একটাকে পাওয়া গেছে। অবশ্য আমি বলদ হলেও পড়াই ভালো। যাদের রেফারেন্সে টিউশন দিতে আসি, তাঁরা আমার সম্পর্কে ভালোই বলে। অন্তত আমার একাডেমিক রেকর্ডও সে কথাই বলে।

আজ দেড় বছর এই টিউশন এর ওপরই বেঁচে আছি। এটা বললে মোল্লারা আবার ক্ষেপে যাবে না তো? ‘আস্তাগফিরুল্লাহ! লা হাওলা ওয়ালা কুয়্যাতা…’ বলে শাপলা চত্বরে আমার বিরুদ্ধে আমরণ অনশনে না বসে যায়। কি করব বলো। চাকরি পাই না। প্রথমদিকে অনেক ইন্টারভিয়্যু দিয়েছি। একটা হ্যান্ডবুকই লিখে ফেলতে পারতাম মনে হয়। ‘দ্য হ্যাণ্ডবুক অফ আনএমপ্লয়েড ভ্যাগাবন্ড’ নামটি কেমন হয়? আসলে চাকরির জন্য যে যোগ্যতা লাগে তা আমার নেই। এখন যদি তোমরা কেউ জিজ্ঞেস করো, কি ‘যোগ্যতা’ লাগে, আমার অনেক সময় নষ্ট হবে। এমনিতেই আমার সময় নেই… এখন সাড়ে পাঁচটা বাজে। পৌনে ছ’টায় নির্দিষ্ট একটা জায়গায় আমাকে থাকতে হবে।
একজন অপেক্ষা করবে।

আজ ক’দিন ধরে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। কোনোভাবেই আজ পালানো যাবে না। তাহলে আমাকে রাত কাটাতে হবে কোনো পার্কে বা স্কুলের বারান্দায়। কারণ সে সোজা আমার মেসে চলে আসবে। আমি জানি। এবং ওকে আমার থেকেও বেশী জানি। কলি এ ধরনেরই মেয়ে!

একটা বিড়ি খাইতে পারলে মন্দ হতো না। বিড়ি শুনে আবার নাক কুঁচকে ফেলো না যেন। সিগ্রেটকে আমি বিড়িই বলি। বিড়ি হোক আর সিগ্রেট হোক… জ্বালিয়ে ছারখার করবে তো সেই আমাকেই। এ জীবনের মত! একটু পা চালিয়ে যাবার চেষ্টা করি। সামনে এক ভদ্রলোক (নাহ! তাঁকে ভদ্রলোক বলা যাবে না। সে প্রকাশ্যে ধুমপান করছে… আইন ভাঙছে। ভদ্রলোকেরা আইন মেনে চলবে।) ধুমপান করতে করতে হাঁটছেন। ওনার সিগ্রেট টা ফেলে দিলে না হয় দু’তিন টান দিতে পারবো। এভাবে অনেক কুড়িয়ে ফেলে দেওয়া সিগ্রেট টেনেছি আমি। কোথাও এইগুলিকে ‘মোতা’ সিগ্রেট বলে।

অভদ্রলোকটির ফেলে যাওয়া সিগ্রেটের শেষাংশে কষে তিনটি টান দিতে পারলাম। নিকোটিনের বিষে ফুসফুসকে ভরিয়ে দিতে যে কি আনন্দ! এই একই আনন্দ পাই যখন কলির পাশে বসে বসে ওর বকা শুনি… ‘এটা পারো না… কেন এমন হল… এত দেরী কেন… এই, তুমি আবার সিগ্রেট খেয়েছ’ ইত্যকার হাজার রকমের কেন শুনে শুনে এতোটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে, এখন আর না শুনলে ভালো লাগে না। কলি আমার ভ্যাগাবন্ড জীবনের অন্যতম নেশা!

আজ কলিকে আমার নিজের একটি অনুভুতির কথা বলতে হবে। আরে, অন্য কিছু ভেবে বস না আবার। সেদিন হেলাল হাফিজের একটি কবিতা আবৃত্তি করছিলাম। কলি চুপচাপ আমার আবৃত্তি শুনল। আমার শেষ হলে বলল, ‘ আমাকে স্পর্শ কর, নিবিঢ় স্পর্শ কর নারী’ এই লাইন আমাকে বুঝিয়ে দিবে। এখানে প্রথমবার স্পর্শ দিয়েও কি তাঁর অনুভুতি হয়নি, আবার নিবিঢ় স্পর্শ কথাটি কেন বললেন?’
কি বিপদে পড়লাম দেখ দেখি। ওকে খুশী করার জন্য রাত জেগে জেগে কবিতা মুখস্ত করি। আমার একাডেমিক পরীক্ষাগুলোর আগে এর ছিটেফোঁটাও যদি করতাম… হয়তো আরো… বেটার কিছু হতো।
কে যেন পিছন থেকে বলল, ‘বালটা হইত… তুই ব্যাটা এখনো যা আছিস, তখনো তাই-ই থাকতিস… এখন হাঁটার উপরে থাক।’ চারপাশে তাকাই। কিন্তু কাউকে দেখি না। সকালে স্টিকে টান দিয়েছিলাম বলে তো মনে পড়ছে না।

যখন কলির কাছে পৌঁছলাম, অলরেডি দশ মিনিট দেরী হয়ে গেছে। বসের সামনে দাঁড়ানোর মতো কাঁচুমাচু হয়ে আছি। আমাকে অবাক করে দিয়ে এই প্রথম দেরীর কারন জানতে চাইল না সে। বলল,
– তোমাকে যে কাজ দিয়েছিলাম, করেছ?
‘ কোন কাজটা যেন?’
এমন ভাবে আমার দিকে তাকালো, আমার তাতেই হয়ে গেল। বললাম,
‘না, মানে এতো ব্যস্ত থাকি যে সব কিছু কেমন আউলা হয়ে যায়। একটু মনে করে দিলে ভালো হয় ডার্লিং!’
– দেখ, আমার সাথে তুমি ফাজলামো করবে না। তুমি হেঁটে আসার পথে এইগুলো নিয়েই ভাবছিলে। কি, মিথ্যে বলেছি?
আমি ভেবে পেলাম না, ও কীভাবে জানল আমি কি ভাবতে ভাবতে এসেছি ! বললাম,
‘ডার্লিং, বললে তুমি বিশ্বাস করবে না… আমি ঐ কবিতার লাইনটির অর্থ নিয়ে ঘন্টার পর ঘণ্টা সময় কাটিয়েছি। কিন্তু…’
– কিন্তু কি?
‘আমার মাথায় একটা গান ঘুরপাক খাচ্ছে। সেই গতকাল থেকে। কোনোভাবেই বের হচ্ছে না…’
– কোন গানটা?
‘দুশমনি করো না প্রিয়তমা’ এইটা। মাথায় বাজতে বাজতে শেষে ‘দুষ্টুমি করো না প্রিয়তমা’ হয়ে যাচ্ছে।’

দাঁড়ানো অবস্থা থেকে কলি বসে পড়ল। ওর মুখ থমথমে… নাকের নীচে হাল্কা ঘাম জমেছে… বড়ই ভালো লাগছে! আমার বুকের ভিতরে কিসে যেন টান মারল… আমি ভাবলাম, কেন ওর সাথে এরকম করছি? ও যা চায়, সেটা করলে ক্ষতি কি? পরক্ষণেই ভাবি, নাহ, আমার মত ভ্যাগাবন্ডের সাথে ওকে মানায় না। আমি ওকে কোনো সুখই দিতে পারব না। তবে কেন ওর সাথে মায়ায় জড়ানো?

আমাকে ও ওর পাশে বসতে বলল। আমি বসলাম। ওর শরীর থেকে খুব সুন্দর হাল্কা অচেনা পারফিউমের ঘ্রাণ পেলাম। ওকে আরো বেশী করে একজন নারী মনে হল… খুব কাছে পেতে ইচ্ছে হল। কিন্তু একটু আগের নিজের অনুভুতির কথা ভেবে এখনকার অনুভুতির গলা টিপে ধরলাম। সে আমার একটা হাত ধরল… আমি কেঁপে উঠলাম। আমাকে বলল,
– আর আমার মাথায় জগজিৎ বসে আছে… ভাবোতো রেইল লাইন ধরে হাঁটছি… খুব চেনা পথটি ধরে… আর জগজিৎ কানে কানে বলছে…’মুঝে তুম সে মোহাব্বাত হো গ্যায়ি হ্যায়… ইয়ে দুনিয়া খুবসুরৎ হো গ্যায়ি হ্যায়… উফ! কখন যে সন্ধ্যা হবে!

আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম। ভাবলাম কলি পাগল টাগল হয়ে গেলো না তো! ওর হাত ধরা অবস্থায় ওর শরীরও তেমন গরম অনুভব করলাম না। নিশ্চিন্ত হলাম। সে ও মনে হয় আমার সাথে দুষ্টুমি করছে। বললাম,
‘সন্ধ্যা হলে কি তুমি খুশী হও?’
– হ্যা! কেন তুমি হও না?

‘নাহ, সন্ধ্যা হলেই আমার সেই মেসের জীবন শুরু হবে। তুমি তো তোমার বাসায় চলে যাবে। আমার একেলা জীবন… একেবারে সেই পরেরদিন তোমার সাথে দেখা হবার আগ পর্যন্ত।’

– একেলা জীবন মানে মেসের জীবন কি খুব কষ্টের?

আমি হাসলাম। কলি একটু বিব্রত হল। বললাম,
‘সন্ধ্যা নামতেই যখন চারিদিকে আঁধার হয়ে যাবে… আমার মেসের দরোজা আমার জন্য উন্মুক্ত হবে। রাত আমার কাছে কোনো আনন্দই আনে না। কাঠের চৌকি আর অন্ধকারের স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে ছারপোকারা আমাকে কুঁরে কুঁরে খাবে…ইদুর দৌড়ে যাবে রাতের অন্ধকারে… আমি ওদের গাঁয়ের ঘ্রাণ পাবো…রুম মেটের নাক ডাকার শব্দে আমার বিনিদ্র রজনি কেটে যাবে…

দিনের বেলায় আবার আমি সেই সবার চির পরিচিত আমি…হাসবো… হাসাবো… কিন্তু কাঁদব একা একা! ভাবতে পারো? একজন মানুষ কতটা রূপ নিতে পারে… আমি আমার জীবনের বিভিন্ন ধাপে অনেকগুলো ফেইক আইডি বানিয়ে এক একজনের চরিত্রকে আমার নিজের ভিতরে ধারণ করতে চেয়েছিলাম…

কখনো আমি নর…কখনো নারী… কিংবা বয়ষ্ক প্রেমিক পুরুষ অথবা নাবালিকা শিশু।

সব রূপেই আমি আমাকে চিনতে চেয়েছি… মানুষ কে উপলব্ধি করতে চেয়েছি…কিন্তু বারে বারে ফিরে পেয়েছি এই আমিকে…এখন যেমন রয়েছি…সেই আদি ও অকৃত্রিম আমাকে।’

কলি আমার হাত ধরে বসে আছে… ওর দু’চোখ বেয়ে জল পড়ছে… ধীরে ধীরে সে আমার কাছে আসে… এতোটা কাছে যে আমাদের দুজনের নাকে নাক লেগে যায়… জীবনে এই প্রথম সে আমার ঠোঁটে তাঁর ঠোঁট ছোঁয়ায়… আমি ও সাড়া দিতে বাধ্য হই… নিজেকে মনে হচ্ছিল একজন শিক্ষানবিস। যে তাঁর টিচারের কাছ থেকে ‘ডিপ কিস’র লেসন নিচ্ছে।

ভালোভাবে লেসন নেয়া হয়ে গেলে কলির চোখে চোখ রেখে বললাম,
‘তোমার কবিতার উত্তর নিশ্চয়ই পেয়ে গেছ?’
– কিভাবে?
বললাম, ”আমাকে স্পর্শ কর, নিবিঢ় স্পর্শ কর নারী” – এখানে তুমি প্রথমে আমার হাত ধরে ছিলে… নিজের অজান্তে। সেটিই ছিল আমাকে স্পর্শ করা… একজন নারীর সাধারণ স্পর্শ। আর চোখের জ্বলে সিক্ত হয়ে পরবর্তীতে যে স্পর্শ করলে, সেটি ছিল আমার প্রতি প্রগাঢ় মমতায় তোমার স্বেচ্ছায় কাছে আসা। এই স্পর্শকেই কবি নিবিঢ় স্পর্শ বুঝিয়েছেন।’
-বাহ! এতো সুন্দর করে বুঝালে!
‘আমি কোথায় বুঝালাম? সবতো তুমি ই…’

সন্ধ্যা নেমে এলো… বলাকাদের মতো আমরা দু’জনেও ফিরে যাচ্ছি… যে যার ডেরায়। আমার এখন আর মেসের পরিবেশকে অসহনীয় মনে হচ্ছে না। ছারপোকা এবং ইঁদুরদেরকেও বড্ড আপন মনে হচ্ছে। মায়া লাগছে…

মায়ার এক অফুরন্ত জগতের ভিতর নিজেকে জড়িয়েছি যে!

ফ্রাঙ্কফুর্টের বনলতা সেন

শেষ বিকেলের আলোয় যখন তাকে দেখলাম, তখন পৃথিবীর পথে হাঁটছিলাম ক্লান্ত অবসন্ন আমি। খুব চেনা কিছু বৈশিষ্ট্যে দৃষ্টি আটকে গেলো।

নতুন হেয়ার স্টাইলে চুল হয়তো মেঘ কালো নেই আর, কিন্তু পাখির নীড়ের মত চোখ এখনো আছে। সাথে যুক্ত হয়েছে স্নিগ্ধ সম্মোহনী হাসি। তার চোখে দেখলাম আমারই মত কৌতূহল। আছে আত্মবিশ্বাস, বুদ্ধিমত্তা, কর্মদক্ষতার ঝিলিক আর আধুনিক শিক্ষার কিঞ্চিত অহম।

হাঁটছিলামই, সব মিলিয়ে ৪ সেকেন্ড হবে। এর মধ্যেই এতো চিন্তা চলে আসলো মনে। রসিকতা করা স্বভাব আমার, এলোমেলো ধাপগুলোকে একটু নিয়মে নিয়ে আসলাম। ভাবখানা এমন করলাম, যেন স্যালুট ঠুকব। তাই প্যারেড করে এগুচ্ছি। সেও তড়িৎ মাথা ঝুঁকিয়ে দিলো, যেন স্যালুটের জবাবটা দিয়ে দিলো।

বাঙালী রমণীটিকে অতিক্রম করে চলে এসেছি। সে নিশ্চয় পিছন থেকে দেখছে আমাকে। কি দেখছে? কুঁচকানো ছাইরঙা শার্ট, ডান কাঁধে ঝুলছে একটা ব্যাগ। নীল জিন্সের প্যান্ট পড়া লম্বা এক বাঙালী যুবক এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। আমার অগোছালো, আত্মভোলা প্রকৃতি তারও নজর এড়াবে না।

মুহূর্তেই সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো। পিছনে না ফিরেই ভাবছি নামতো জিজ্ঞেস করিনি, জায়গাটা যেন কি? মনে পড়লো, ফ্রাঙ্কফুর্ট।

একজন_উর্ধতন_কর্মকর্তার_পাইপজীবন_মামুনের_অসমাপ্ত_গল্প

[অনেক আগে লেখা আমার একটি অসমাপ্ত গল্প। গল্প না বলে একে গল্পের মুখবন্ধ বলা যায়। একে টেনে একটা চমৎকার উপন্যাসে রুপ দেবো ভেবেছিলাম..]

মধ্য আষাঢ়। ঝুম বৃষ্টি। বাইরে আঁধার। যদিও শিহাব যেখানে এখন শুয়ে আছে, সেটার দুই প্রান্ত ছালার চট দিয়ে ঘেরা, তাই ভেতরে সবসময়েই অন্ধকার থাকে। তারপরও ভেতরের অন্ধকার ছাপিয়েও কিছুটা আলো থেকেই যায়। আজ বাইরে আকাশের মন খারাপ। তাই আঁধারের মাঝে আরো কিছুটা আঁধারে ঢেকে আছে এক অন্ধকারের মানুষ, যার ভেতরটা আলোয় ভরা।

এখন দিন-রাত্রির কোনো প্রভেদ নাই। সবকিছু-ই একইরকম। কালো। রেললাইন সংলগ্ন এই পাইপজীবন তেমন খারাপ লাগছে না ওর কাছে। এখানে কোনো কাজ নেই। অখন্ড অবসর। সময়টা কাটে তাই চিন্তায় চিন্তায়। তবে এই চিন্তা কিছুদিন আগের চিন্তার মত না। তখন চিন্তার সাথে সাথে থাকত কিছু দীর্ঘশ্বাস, হতাশা, একটু আনন্দ। এখন চিন্তার সাথে শ্রেফ প্রশান্তি বিরাজ করে। আসলে কাছের সম্পর্কগুলো থেকে সরে আসায়, কাউকে নিয়ে মোটেও চিন্তা করতে হয় না শিহাবকে। যখন একজন মানুষ ছিল, তখন সবাইকে নিয়ে চিন্তা ছিল।

‘এখন কি তবে তুমি মানুষ নও?’

নিজের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে একটু ভাবে। ইদানিং নিজেকে নিয়েই চিন্তা-ভাবনায় মশগুল শিহাব। মানুষ কে? এর কি কোনো সর্বজন স্বীকৃত নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা আছে? না থাকারই কথা।
যখন মানুষ ছিল তখন সবাইকে নিয়ে চিন্তা করত। এই সবাই কি মানুষ ছিল?

প্রশ্নের উত্তর আরো প্রশ্ন নিয়ে আসে.. সেগুলো আরো। এভাবে মুহুর্তগুলি কেটে যায় দুপুরের খাবার নিয়ে যখন পাশের ‘পাইপে বাস করা’ ঝর্ণা, ছালার ওপারে গলাখাকারি দিয়ে বলে,
‘মামু, জাইগা আছ? তোমার লাগি খানা লিয়ে আইছি।’

ঝর্ণা শিহাবের দখল করা পাইপটির পাশের পাইপ-পরিবারের সব চেয়ে ছোট সদস্য। পঙ্গু ভিক্ষুক আজমত আলীর দুই মেয়ে। লিলি আর ঝর্ণা। লিলি-ঝর্ণার মা বছর পাঁচেক আগে মারা গেছে। সেই থেকে ওরা এই পাইপে পাইপে জীবন কাটাচ্ছে। তবে ওদের জীবনের শুরুটা ঠিক এমন ছিল না। গ্রামের বাড়িতে সবাই মোটামুটি নিশ্চিন্ত ছিল। আজমত আলী তখন সুস্থ। নিজের জমিজমা চাষ করে দিনগুলি ভাল-ই কেটে যেত। নদী-ভাঙ্গনের শিকার হয়ে এই পরিবারটি আরো কিছু পরিবারের মত পথে বসে গেল। উপায় না দেখে আজমত আলী ঢাকা এলো। শুরু হল রিক্সাওয়ালা আজমত আলীর বস্তিজীবন। ঝর্ণার মা ছালেহা ঠিকা ঝি’র কাজ নেয় মানুষের বাসায়। নতুন স্বপ্ন চোখে নিয়ে সামনের দিকে আগাতে থাকে এই পরিবারটি।

একদিন এক সড়ক দুর্ঘটনায় আজমত আলীর রিক্সাটি দুমরে মুচরে গেল। শরীরের নিচের অঙ্গ থেতলে যায়। একটা পা কেটে বাদ দিলে উপহার স্বরূপ ‘ক্রাচ’ লাভ করে আজমত আলী। বিধাতার উপহার?
তখন পুরো পরিবারটির দায়িত্ব ছালেহা বেগমের ওপর পড়ে। দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম করে সে। শ্রেফ স্বামী ও দুই মেয়ের জন্য দু’বেলা খাবার জোগাড়ের জন্য। বড় মেয়ে লিলি মায়ের সাথে কাজে যায়। কিন্তু মানুষের অমানুষ সুলভ আচরণে সে বাসায় কাজ করতে পারে না। নারী লোভী বেশ কিছু জানোয়ার আমাদের সমাজে মানুষের বেশে ঘুরে বেড়ায়। এরাই লিলিদেরকে খেয়ে-পরে বাঁচার ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে।

একদিন সকালবেলা ছালেহা বেগম আর কাজে যায় না। আজমত আলী ডাকতে গিয়ে দেখে, আর কখনো সে কাজে যাবে না। বিধাতার থেকে দ্বিতীয় পুরষ্কার লাভ করে আজমত আলী। ভিক্ষুক জীবনের শুরুটা সেদিন থেকেই। এবার বাপের সাথে ভিক্ষুকের সহকারী হিসেবে লিলি কাজে নামে। ঝর্ণা বাসায় থাকে। কিছুদিন বস্তিতে থাকলেও পরে এই পরিবারটি পাইপে শিফট হয়ে আসে। বাপ আর বড় বোন সারাদিন ভিক্ষা করে যা নিয়ে আসে, ঝর্ণা সেগুলো রান্না করে। এ ছাড়াও সে টুকটাক কাজ করে। কাজের তো আর শেষ নেই কোনো পরিবারে। হোক না সেটা পাইপ-পরিবার।

এই হল এক নজরে ভিক্ষুক আজমত আলীর পরিবারের গল্প। এরকম অনেকগুলি পরিবার এই রেললাইন সংলগ্ন পাইপে বাস করছে। এদের সবার-ই যার যার মত করে আলাদা আলাদা গল্প রয়েছে। একজন উর্ধতন কর্মকর্তা শিহাব, এদের মত না হয়েও এদের সাথে থাকছে। পঙ্গু ভিক্ষুক আজমত আলী তার একটা পাইপ ওর জন্য ছেড়ে দিয়েছে। কেন দিলো কিংবা শিহাব এখানে কেন?.. সে আরেক গল্প। ওটাও আমরা জানবো, তবে যে শিহাবকে আশ্রয় দিয়েছে, খাবারের ব্যবস্থা করছে, সেই আজমত আলীর অনুভবেই একজন উর্ধতন কর্মকর্তার পাইপজীবনের গল্পটিও আমরা শুনবো। তবে অন্য কোনো এক সময়…হয়তোবা।।

___________________________________________
#একজন_উর্ধতন_কর্মকর্তার_পাইপজীবন_মামুনের_অসমাপ্ত_গল্প।