বিভাগের আর্কাইভঃ অণুগল্প

শেষ শরতের কাশকন্যা

এই শরতের দ্বিতীয় বসন্তে নীড়ের মাথায় অদ্ভুত একটা ভাবনা চেপেছে দূরের কোন এক কাশবনে ঘুরতে যাবে। ও ঠিক করল, ওর খুব কাছের বন্ধু বিপ্লবকে সঙ্গে নেবে। এত বন্ধুর ভীড়ে এক বিল্পব ওর খুব কাছের বন্ধু। ও হঠাৎ বিপ্লবকে ফোন করল, হ্যালো হ্যালো বিপ্লবের সেল ফোনে নীড়ের নম্বরটা ভাসছে। ফোন রিসিভ করল বিপ্লব হ্যালো নীড়! ক্যামন আছিস? নীড় ছোট্ট উত্তর দিল ভাল। আমার একটা রিকুয়েস্ট রাখবি? বিপ্লব একটু চমকে যায়। বলে, কি রিকুয়েস্ট বল? এভাবে বলছিস কেন? আজ পর্যন্ত তোর কোন কথাটা আমি রাখিনি বল? নীড় বলল, হুম শোন না । শরৎ প্রায় যায় যায় করছে। তুই আমাকে একটা বিকেল দিবি? আমরা সে বিকেলের হাত ধরে দূরের কোন কাশবনে হাঁটতে যাব।

হেসে ওঠে বিপ্লব, ওহ এই কথা। কেন দেব না? চল না কবে যাবি? নীড় বলল, তবে আর দেরী কেন? আজই চল না বিকেলেই বেরিয়ে পড়ি। আজ? বিপ্লব বলল, ওকে ম্যাডাম বিকেল চারটায় আমরা যাচ্ছি তাহলে। নীড় লাইনটা কেটে দিল।
– ওরা বিকেল চারটায় স্বপ্নপুরী যাওয়ার জন্য যাত্রা শুরু করল। শহর ছেড়ে অনেক দূরে। বিপ্লব বাইক নিয়ে এসেছে। যেতে যেতে পথে হালকা বৃষ্টি হল। ওরা দু’ জনেই বৃষ্টিতে ভিজেছে। বিপ্লব বলল, এই নীড় অনেক দিন বৃষ্টিতে ভেজা হয় না। আজ তোর সঙ্গে বৃষ্টি বিলাস করছি বেশ লাগছে। নীড় বলল, হুম বিপ্লব তুই দেখছি বেশ রোমান্টিক হয়েছিস। কবে থেকেরে। বিপ্লব হেসে ওঠে বলল, কেনরে এ যাবৎ আমাকে কি তোর আন রোমান্টিক মনে হয়েছে? এই নীড়, এত কিছু থাকতে তোর হঠাৎ কাশবনে ঘোরার শখ হল কেন? ঘুরতে যাওয়ার আরও অনেক জায়গা ছিল। নীড় বলল হুম, তা হয়ত ছিল। কিন্ত তুই কি জানিস, শরৎ হল দ্বিতীয় বসন্ত। কাশফুল শুভ্রতার ডানায় থোকা থোকা সাদা মেঘের আঁচল বিছিয়ে শরতের আবির্ভাবে আমার মনটা উচ্ছ্বাসিত হয়ে ওঠে। ঠিক কাশফুলের মতো।

আমার মনটাও নরম হয়ে যায়। ও তুই বুঝবি না বিপ্লব। আগে চল কাশবনে তারপর দেখ কি মায়াময় সৌন্দর্যের কারুকার্যের উচ্ছ্বাস লেগে আছে প্রতিটি কাশফুলের ছড়ায় ছড়ায়। আরে আমিতো রীতিমতো কাশরাজ্যে স্বপ্ন বিলাসী কাশ মহল বানানোর কথা ভাবছি। কিন্ত কি জানিস সে স্বপ্ন মহলে মনের মানুষ নেই। আমি বড় একারে!

বিপ্লব হেসে ওঠে, আরে তুই তো আস্ত একটা “কাশকন্যা” শরৎ প্রকৃতির ঠোঁটে। নরম কাশফুলের মতোই সাদা তোর মন। ওরা এক ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেল স্বপ্নপুরী কাশ অরণ্যে। রোদ, বৃষ্টি আর হাওয়ায় দুলছে কাশবন। বিপ্লব কাশবন আর নীড়কে আলাদা করতে পারে না। নীড় আজ পরেছে কাশফুলের মতোই শুভ্র পোশাক। স্বপ্নপুরীর দিগন্ত জোড়া মাঠের পর মাঠ কাশবন। বিস্ময়ে অভিভূত হয়েই সেদিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বিপ্লব। নীড় কাশবনে পা রেখেই ভীষণ উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, ওয়াও বিপ্লব! স্বর্গ যদি কোথাও থেকে থাকে তো এখানেই আছে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

বিপ্লব বলল, সত্যিই নীড় আজ আমি না আসলে খুব খু-উ-ব মিস করতাম এমন হৃদয় কাড়া অপূর্ব দৃশ্য। নীড় বলল, তুই আসবি না মানে? তোকে হাজার বার আসতে হত। তুই ছাড়া আমি অচল জানিস না? তুই ছাড়া এমন দৃশ্য আমি একা দেখবো নাকি? জানিস তো ভীষণ একটা বোরিং লাইফ পার করছিরে। মাঝে মধ্যে তোর সঙ্গ ভীষণ ভাল লাগে। তুই ছাড়া আমার আর কে আছে বল তো?
বিপ্লব বলল, কেনরে তুই না কাইফিকে ভালবাসিস? উত্তরে নীড় বলল, নারে তোর জানায় ভুল আছে। ওটা আমি তোকে বানিয়ে বলেছি। আর তুই তো ক্যাইসাকেই ভালবাসিস বিপ্লব। বিপ্লব বলল, নারে তোর জানাতে ও ভুল আছে। আমিও তোকে বাড়িয়ে বলেছি। তবে ঠিক কোনটা বিপ্লব! আমি তোকে ভাল কথা শেষ করতে পারে না বিপ্লব। ওর গলাটা কেঁপে কেঁপে থেমে গেল। হাতটা বাড়িয়ে দে নীড় । মুহুর্তে নীড়কে কাছে টেনে দু’ হাতে ওর চিবুক উন্মোচন করে বলল, তুই কি আজও আমায় বন্ধু ভাবিস। নাকি বন্ধুর চেয়ে একটু খানি বেশি। এক ঝটকায় নীড়কে বুকে টেনে নিল বিপ্লব। ও বুকে পড়ে নীড় ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। এই একটা সত্য কথা বলতে তুই এতটা সময় নিলি। বিপ্লব বলল, বাহরে! দেরী হলেও আমি তবু তো বলেছি। তুইতো সেটুকুও পারলি না। বোকা মেয়ে। বিপ্লব ফিসফিস করে বলল,

ডেকেছিস কেন এই নিরালায়?
কিছু কি বলবি আমায়? বল না
বল
আমি শুনবো
তোর সব কথা
কি বলবি আমায়?
কেন এত লুকোচুরি খেলা
আর নয় লুকোচুরি ধাঁধাঁ
বরং খোলামেলায় বল
দৃঢ় উচ্চারণে
আমার প্রেমে অঙ্কুরিত
কাশকন্যা তুই
ভালবাসার ফ্রেমে বাঁধা
তোকেই শুধু চাই
বল না
শেষ শরতের কাশকন্যা
আমি শুধুই তোর
তোকেই ভালবাসি
ভালবাসি ভালবাসি কি যে
ভীষণ মিষ্টি কাশফুল ঘ্রাণের মতোই
ভালবাসি !

নিজের বিস্ময় আড়াল করে দ্রুত নিজেকে সামলে নিল নীড়। পর মুহুর্তে বলল, উফ্ আমার কথা ছাড়। এতক্ষণ তুই আমার কথাই বললি। তুই তখন কি যেন বলতে যেয়ে থেমে গেলি। বল না সোনা । যে কথা আজও আমার শোনা হয়নি। হ্যাঁ, বলব বলেই তো হাজার বিকেল থেকে এই একটি বিকেল তুলে রেখেছি তোর জন্য নীড়। কাছে আয় না পাখি আরও কাছে । বিপ্লব নীড়ের কানে ফিসফিস করে বলল, আমি তোকে ভালবাসি নীড় । তুই শুধুই আমার কাশকন্যা। নীড় স্থির চোখে বিপ্লবের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল …

অনেক পথ খুঁজেছি তোকে
কোথাও পাইনি
তুই ছিলি কোন সে অতল
কাশফুলের আদরে
শুভ্রতার আঁচলে
তুই কি ছিলি মিশে জনম জনম ধরে
তিন সত্যিই বলছি
আমি ভালবাসি তোকেই
শরৎ ও একদিন ফিরে আসে নীড়ে
তুই চিরদিন পাশে থাক
আমায় গহীন অরণ্যে কাশকন্যা করে রাখ
দিক্- দিগন্তে ইথারে ভেসে ভেসে
মিষ্টি মধুর কাশঘাণ বার মাস
ছড়াব তোর হৃদয়ে;
তোর সংস্পর্শে ভিজে যাক এ গহন বুক
তুই আমার শরৎ প্রকৃতির সবটুকু সুখ
এ অন্দরে বহু আগেই তোর অনুপ্রবেশ
তোর মতো আমিও আছি তোর
স্বপ্নের ভেতর.!

নীড়ের চোখে জল চিকচিক করে ওঠে। বিপ্লব ওর চোখে চোখের জল মুছে দিতে বলে, তবে কাঁদছিস কেন? আমি তোর। শুধু তোর। নীড় ছল ছল চোখে বলে, জানি। এ জন মুছিস না, এ আমার আনন্দ অশ্রু! তোকে আমার করে পাবার। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। চল আজ আর হাতে সময় নেই। ফেরা যাক। গন্তব্যে ফেরার জন্য
ওরা হৃদয়ের গহীনে পা বাড়ায়।

মামুনের অণুগল্প: ছায়াসঙ্গিনী

নীলা কলেজে যেত একা। একটা ছেলে খুব বিরক্ত করতে শুরু করল। তার অদ্ভুত সব কাজে মেয়েটা সারাক্ষণ উৎকণ্ঠায় থাকতো। পথে ঘাটে, রেস্তোরাঁয়, সাইবার ক্যাফেতে, কলেজে সর্বত্র ছেলেটা নীলাকে বিরক্ত করতো। এমনসব কাণ্ড যে অন্যরা টের পেত না। সে নীরব অনুভূতি নীলার মধ্যে পার করে দিয়ে ওর ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করতো। নিজের মত করে সে হেঁটে যেতো নীলার ছায়া হয়ে।

ছেলেটার কিছু কিছু আচরণে নীলা এত বেশি অপমান বোধ করতো যে সে একদিন ছেলেটাকে খুব অপমান করে। ঐ ঘটনার পর থেকে ছেলেটাকে আর দেখা যায় না। নীলা আগের মত প্রতিদিনের জীবনযাপন করে, তবু সময়ে অসময়ে কেন জানি ছেলেটাকে খুব মিস করে। কলেজে আসা যাওয়ার পথটা মনে হয় জনহীন, শূণ্য। সে হাঁটে কিন্তু বার বার পিছনে তাকায়, তবে আগের মত ওর অনুভূতিতে কেউ বিরক্ত করতে আসে না। পথে-ঘাটে, অফিস-আদালতে কিংবা ক্যাফে-রেস্তোরাঁয় সবকিছু আগের মতই চলে নীলার। তবে সব কিছু ছিন্নভিন্ন ভাবে…
নিঃসঙ্গ নীলা হৃদয়ের খুব গোপন কোন এক তারে ছেলেটার জন্য প্রচণ্ড ভালোবাসা অনুভব করে। কিন্তু ছেলেটাকে সে আর দেখে না।

একদিন ওকে এদিকে ওদিকে তাকাতে দেখে এক অপরিচিত ছেলে এসে খবর দেয়, ওর কথার তীর্যক বাণে সেদিন রাতেই ছেলেটা একটা নাইনলের রশি দিয়ে নিজের বেডরুমে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। পরে হাসপাতালে নেয়া হলে ডাক্তাররা তাঁকে মৃত ঘোষণা করে। ছেলেটার আর নীলার বাসা অন্য দুই ভিন্ন মহল্লাতে হবার জন্য সে জানতে পারেনি। নীলা ছেলেটার কথা শুনে প্রচণ্ড কষ্ট পায়।

এরপর দিন থেকে নীলা চলার পথে আবারো ছেলেটাকে দেখতে পায়। এবার ছেলেটা সরাসরি ওর সাথে কথা বলে। নিজেকে হারিয়ে ফেলে সে। হাজারো মানুষের ভীড়ে সে একাকী একটা মেয়ে অদৃশ্য কোনো একজনের হাত ধরে ঘুরে বেড়ায়… সবাই মেয়েটাকে পাগল ভাবে… মেয়েটা কেয়ার করে না। সে তার হৃদয়ে এক প্রচণ্ড ভালোবাসা নিয়ে অসহ্য গ্লানি থেকে মুক্তি পেতে ছেলেটার হাত ধরে এগিয়ে চলে। একজন ছায়াসঙ্গিনী হয়ে দুঃখী মেয়েটা ঐ মৃত ছেলেটাকে বুকে ধারণ করে বেঁচে থাকে।

পরীর বন্ধুরা

কোলকাতা থেকে বাড়ি ফিরে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে পরী। বাব্বা রে। কী ভীড়! কী ভীড়! গাড়ির শব্দে কান একেবারে ঝালাপালা! রাতদিন ঘরের মধ্যে বন্দি হয়ে থাকা কাঁহাতক ভাল লাগে? গাছপালা নেই, ফুল-পাখি-প্রজাপতি নেই। হাওয়া আছে কিন্তু সে ফ্যান ঘুরিয়ে। পরীর দম আটকে যায় আর কী।

গরমের ছুটিতে পিসতুতো দাদা এসে নিয়ে গিয়েছিল তাদের বাড়িতে। তিনদিন যেতে না যেতেই বাড়ি ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে পরী। অগত্যা ফোন পেয়ে বাবা নিয়ে আসেন বাড়িতে।
জামা কাপড় ছেড়ে সবে জানালার পাশে দাঁড়িয়েছে পরী। হঠাৎ একটা মিষ্টি গন্ধ। বাইরে বাগানের দিকে তাকায় পরী। দেখে, জুঁইফুলেরা সাদা পাপড়ি নেড়ে নেড়ে তাকে ডাকছে- এসো বন্ধু। কতদিন তোমার ভালবাসার পরশ পাই নে।
-আসছি।
একছুটে বাগানে চলে যায় পরী। পাপড়িগুলোয় কোমল হাত বুলায়।
– আমারও তো তোমাদের ছাড়া ভাল লাগেনা বন্ধু । শহরের ওই জনারণ্যে আমার দম আটকে আসছিল। তাইতো ফিরে এলাম আমার আপন গাঁয়ে। তোমাদের কাছে। তোমরা আমার পাশে না থাকলে আমি যে একটুও ভাল থাকতে পারিনে জুঁই।
জুঁইফুলেরা হাসে। ঘ্রাণে ঘ্রাণে ভরে দেয় পরীর মন।
রঙিন পাখা মেলে প্রজাপতি উড়ে আসে। জুঁইয়ের পাতায় বসে। পরী ভালবেসে ওর গায়ে হাত বুলাতে চায়। প্রজাপতি দুষ্টুমিভরা চোখে হাসে। উড়ে গিয়ে পাশের ডালে বসে।
পরী বলে- ও বুঝেছি। অামার উপর তোমার ভারি অভিমান হয়েছে। তোমাদের ছেড়ে চলে গেছিলাম তো, তাই।
প্রজাপতি নকশাকরা পাখা নেড়ে পরীর চারপাশে ঘুরতে থাকে। পরীও ওকে ধরতে চায়। দু’জনের এই দুষ্টু-মিঠা লুকোচুরি দেখে টুনটুনি পাখি দুটো পাশের পেয়ারা গাছে উড়ে এসে বসে। টুইট টুইট করে পরীকে জানান দেয় ওরাও এসে গেছে।
পরী বলে- তোমাদের ছাড়া আমার একদম ভাল লাগে না বন্ধু। ডাকো, আবার ডাকো।
-টুইট, টু-ই-ট।
টুনটুনিরা প্রিয়বন্ধুকে পাওয়ার আনন্দে গান গায়। উড়ে এসে বসে জুঁইয়ের ডালে।
শনশন সুরে বাতাসও ছুটে আসে। আলতো পরশ বুলিয়ে দেয় পরীর সারাগায়ে। আনন্দে পরীর দেহে মনে শিহরণ খেলে যায়।
– তুমিও এসেছো বন্ধু?
বাতাসি আবেগে গাছের ডাল নুয়ে এসে পরীর শরীর ছুঁয়ে দেয়।
ছয় বছরের ছোট্ট পরীর চারপাশে এখন তার বন্ধুরা। গাছ। ফুল। পাখি। প্রজাপতি। বাতাস। সবাই।
প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয় পরী।

ময়না এবং মনু মিয়া

মনু মিয়ার সংসার দারুণ সুখের সংসার। মনু মিয়ার স্ত্রী কোনোদিন স্বামীর মুখের উপর কথা বলে না। স্বামীর ন্যায় অন্যায়ের প্রতিবাদ করে না। পাঁচটা বাড়িতে ছুটা কাজ করে। চার সন্তানের জননী ময়না বেগম বাড়িতে পরিশ্রম করে বাড়ির বাইরেও পরিশ্রম করে। তার স্বামী ফেরেস্তার মতো মানুষ। সকলে তাকে বলে বউ পাগলা।

মনু মিয়া টিটকারির ধার ধারে না। সে গর্বিত বোধ করে নিজেকে নিয়ে। মনু মিয়া প্রতি রাতে যখন ক্লান্ত ময়না বেঘোরে ঘুমায়, ময়নার শরীর নিয়ে খেলে। ময়না চোখের পানি অন্ধকারে কেউ দেখে না। কাজ শেষে বাড়ি ফিরে সন্তানদের দেখভাল ঠিক মতোই করে।

গরম গরম ভাত, তরকারি রাঁধে। মনু মিয়া তৃপ্তির ঢেকুর তোলে। ময়না বেগম ফজরের আজানের সময় উঠে গরম গরম রুটি ভাজে। সে রুটি পেট পুড়ে খেয়ে মনু মিয়ার ঢেকুর উঠে। মনু মিয়ার সুখের সংসারে সবাই সুখে থাকে। মনু মিয়া ময়না বেগমের জন্য শাড়ি কিনে নিয়ে আসে। ময়না বেগম খুশি হতে পারে না, ময়না বেগম মনে মনে মাইনে হিসেবে করে।

ছেলেটাকে ভালো স্কুলে দেবে। মনু মিয়া একদিন একটা টিভি কিনে নিয়ে আসে। ময়না বেগম এক দৌড়ে কল পারে গিয়ে খালি কাঁদে। সে ভাবে মেয়েটার একদিন বিয়ে দিতে হবে। মনু মিয়া একদিন সাহেবদের মতো শার্ট প্যান্ট কিনে নিয়ে আসে। ময়না বেগম বিলাপ করে কাঁদে। মনু মিয়া ধমকে উঠে, ময়না বেগম চুপ করে যায়।

মনু মিয়া সকালে নাস্তা করে আরাম করে ঘুমায়। এক ঘুমে উঠে দুপুর দুটায়। ছেলে মেয়ে রা যার যার মতো একে অপরকে দেখে শুনে রাখে। মনু মিয়া মন দিয়ে রেডিও শুনে। রেডিওর সব গানের অনুষ্ঠান তার মনে ধরে।

শুক্রবার দিন ময়না বেগম দুপুরেই ফিরে আসে। দুপুরের খাবার খেয়ে মনু মিয়া স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে বসে নানা জ্ঞানের কথা বলে। ময়না বেগম কোনো প্রশ্ন করে না।
ফেরেস্তার মতো স্বামীর তথ্য কথা শোনে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলে বাতি জ্বালাতে জ্বালাতে ময়না বেগম শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে।

মনু মিয়ার মন মেজাজ মাঝে মাঝে অতিরিক্ত ভালো যায়। সেদিন সে বউকে বলে, জমি কিনবো, দালান উঠাবো এই দিন দিন নারে বউ। তারপর আয়েশ করে বিড়ি ফোঁকে আর বলে ‘বউ দেখ আরো দুই তিনটা বাসা বাড়িতে কাম পাস্ কিনা। এই কামাইয়ে তো সংসার চলে না রে বউ’।

ময়না কিছু বলে না. ময়না বেগম জন্ম থেকেই বোবা।

অণুগল্প : রুই

মাইকে ঘোষণাটি শুরু হতেই মুহুর্তেরও কম সময়ের জন্য নীরবতা নেমে এসে মিলিয়ে গেলো, সবার মনযোগ কেন্দ্রীভূত হলো কানে।

ফজল দাঁড়িয়ে আছে রফিকের সব্জীর দোকানে। ছেলেবেলার বন্ধু, তবে বহু আগেই দু’জনার দু’টি পথ গেছে বেঁকে। ফজল এক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। বেতনের থেকে ভাব বেশী। রফিকের স্বাধীন ব্যবসা, ভাব থেকে আয় বেশী, চিন্তাও বেশী।

আজকাল জ্যান্ত রুই বিক্রি হয় মাছ বাজারে। মাছগুলো হাঁপানি রোগীর মত শ্বাস টানে। মাঝে মাঝে লেজ ঝাপটায়। এক একবার শরীরের সকল শক্তি একত্রিত করে জলে ছুটে যাবার জন্য লাফিয়ে ওঠে। জলে যাওয়া হয়না, মাছওয়ালার এলুমিনিয়ামের থালাতেই ফের আছড়ে পরে। মাছদের জানা নেই মৃত্যু অমোঘ, মৃত্যু অনিবার্য সত্য, মৃত্যুই চিরমুক্তি হোক তা জলে বা ডাঙায়। ফজল এমনই এক জ্যান্ত রুই কিনেছে। ফজলের ভোজ, রুইয়ের চিরমুক্তি।

আলু, বেগুন আর টমেটো কেনার জন্যই রফিকের দোকানে আসা। রুই দিয়ে আলু, বেগুন, টমেটোর তরকারি যেনো অমৃত। তবে ফজল বিভ্রান্ত। আশ্বিনের শুরুতেই বাজারে উঠেছে শীতের সবজি- সতেজ সিম, ছোটো ফুলকপি, মাঝারি বাঁধাকপি, টসটসে টমেটো। রুই মাছ দিয়ে আলু- ফুলকপি না আলু-সিম- টমেটো দিয়ে রান্না হবে সে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।

ফজলের বিভ্রান্তি দূর হবার আগেই ঘোষণাটি শুরু হলো। পুরো বাজারে মুহুর্তেরও কম সময়ের জন্য নীরবতা নেমে এসে মিলিয়ে গেলো, সবার মনযোগ কেন্দ্রীভূত হলো কানে। মহল্লার মসজিদের মাইক হতে ভেসে আসছে মোয়াজ্জিনের কণ্ঠ- “একটি শোক সংবাদ। একটি শোক সংবাদ। আমাদের মহল্লার মরহুম রমজান হাজির মেঝো ছেলে ফজলুল হক ফজল আজ সকালে ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজেউন। মরহুমের নামাজে জানাজা আজ বাদ আসর বায়তুল আকবর জামে মসজিদে অনুষ্ঠিত হবে। একটি শোক সংবাদ.. একটি শোক সংবাদ.. আমাদের মহল্লার….।

রফিক অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফজলের দিকে। শুধু রফিক নয়, মহল্লার বাজার বলেই বহু পরিচিত চোখ ফজলের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ফজলের খুব অস্বস্তি হচ্ছে। লজ্জায় মাথা নিচু করে রেখেছে। বেঁচে থাকার জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে, একছুটে পালিয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু পা নড়ছে না। রফিক দোকান ছেড়ে বাইরে এসে ফজলকে রিকশায় তুলে দিয়ে বলে, “জলদি বাড়িতে যা, দেখ ঘটনাটা কি। জলদি যা।”

রিকশায় মাথা নিচু করে বসে আছে ফজল। অস্বস্তি হচ্ছে- কেউ না থাকে জীবন্ত অবস্থায় দেখে ফেলে। মহল্লার সীমানা হতে বেরিয়ে এসে সংকোচে মাথা তুলে তাকায়- না, এখানে পরিচিত কেউ নেই। রিকশা বদলে নতুন রিকশায় উঠে বলে- ‘চলো, সামনে যেতে থাকো।’

কোথায় যাবে জানেনা, বাড়িতে ফেরা যাবেনা। সত্যিই যদি সে মরে গিয়ে থাকে তবে তার লাশের পাশে বসে কান্না করছেন মা। রুমু নিশ্চয় জ্ঞান হারাচ্ছে বারবার। আত্মীয় স্বজনরা আসতে শুরু করেছে। ছোটো ভাই বিষাদভরা মুখে দাফনের দায়দায়িত্ব আর আত্মীয়দের আপ্যায়ন তদারকি করছে। ইতোমধ্যে সে কতটা ভালো ছিলো বা ছিলোনা- ওই আলোচনা আর স্মৃতিরোমন্থন চলছে। নাজিয়া কি খবর পেয়েছে-! কি যে প্রেম ছিলো। বেকারের সাথে বিয়ে দেবে না বলে ডেটল খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলো। এখন সুখে টইটুম্বুর। ওর চোখেও হয়তো জল- ব্যর্থ প্রেমিকের জন্য নয়, প্রেমের জন্য। অথবা সবাই প্রতিক্রিয়াহীন। এখন জীবন্ত অবস্থায় হাজির হলে সবাইকে কি বিতিকিচ্ছিরি একটা অবস্থা ফেলা হবে- ভাবতেই তার লজ্জা লাগছে।

রিকশা ছুটছে। কোথায় যাবে জানেনা ফজল। বাজারের থলিতে ঘাই মারছে রুই।

পাটক্ষেত

-মমিন, ও মমিন।
-কে? ও চাচা? আসেন। বসেন।
মমিন বারান্দায় একটা চৌকি পেতে দিতে দিতে বলে- তা, চাচা, এহেবারে বিহানবেলায়!

জমিজিরাত না থাকায় মমিন জনমজুরি করে পরের ক্ষেতে। আর চাচা মানে রহমত মালিতা এলাকার ধনী কৃষক। অনেক জমি আছে তার মাঠে। রহমত চাচার ক্ষেতেই বেশিরভাগ সময় কাজ করে মমিন।

রহমত চাচা বলেন- বলতিছি কি, দক্ষিণির মাঠের পাটগুলোন তো কাটার দরকার। আজ থেকে তাহলি লেগে যা মমিন। আব্দুলকেও বলিছি। তুই আর আব্দুল দুইজনে কাটবি।

পাটক্ষেতের কথা শুনেই মমিনের বুকের ভেতরে যেন ছ্যাঁত করে ওঠে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে চারবছর আগের এক করুণ ছবি।
সেও এই রহমতচাচার পাটক্ষেত। পাটগাছ কাটতে গিয়েছিল মমিন আর পাশের বাড়ির দিলু। পাটক্ষেতের কাছে যেতেই একটা পচা দুর্গন্ধ তাদের নাকে এল। দুর্গন্ধের উৎস খুঁজতে গিয়ে সেদিন তারা যা দেখেছিল, সেই মর্মান্তিক দৃশ্য আজও ভুলতে পারেনি। তারপর থেকে মমিন আর কোনোদিন পাট কাটতেও যায়নি কারো ক্ষেতে। পাটক্ষেতের নাম শুনলেই তার মুখটা যেন ফ্যাকাসে হয়ে যায়। তাকাতে পারে না কোনো পাটক্ষেেতের দিকে। একটা বিভৎস্য ভয়, একটা অসহ কষ্ট তার বুকে চেপে বসে যেন।

অল্পবয়েসের একটা মেয়ের নগ্ন পচাগলা দেহ। গলায় ওড়নার ফাঁস। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঁচড়ের দাগ। পেট, মুখ, বুক যেন কোনো হিংস্র পশু বিষাক্ত দাঁত দিয়ে খুবলেছে। পুলিশ এসেছিল। জানা গিয়েছিল মেয়েটা দূরের কোনো এক গাঁয়ের। যারা ওকে রেপ করে এভাবে খুন করেছিল তাদের শেষপর্যন্ত পুলিশ খুঁজে পেয়েছিল কিনা সে খবর আর পাওয়া যায়নি। তবে প্রথম প্রথম ওদেরও কয়েকবার থানায় যেতে হয়েছিল।

-কি হল, কতা বলতিছিস নে কেন? কী ভাবতিছিস মমিন?

এতক্ষণ মমিন সেই চার বছর আগেকার ভয়ঙ্কর স্মৃতির মধ্যেই ডুবেছিল। চাচার ডাকে স্বাভাবিক হল। ফিরে এল বর্তমানে।

অস্ফূট ভয়ার্ত কণ্ঠে “অ্যাঁ” উচ্চারণ করে মমিন।

-বলতিছি, তা’লি যাচ্ছিস তো পাট কাটতি?

মমিন আস্তে আস্তে বলল- শরীরডা ভাল না চাচা।

আজ ইরাবতীর বিয়ে

রুহিলা বেগমকে আজ সকাল থেকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। তার মুখের ভাব ফ্যাকাসে, ব্লাড প্রেসার লো হয়ে গেছে। এর প্রধান কারন আজ তার একমাত্র মেয়ে ইরার বিয়ে। মেয়ের বিয়েতে মায়েরা বোধ হয় একটু বেশী উদ্বিগ্ন থাকেন। রুহিলার বেলাতেও সেটির ব্যতিক্রম হচ্ছে না। তার চিন্তার আরেকটি কারন আছে তা হল ফয়সালকে চিলেকোটার রুমে আটকে রাখা হয়েছে। অন্য আট-দশটি বিয়ের মত এই বিয়ে নয়। খুব সাধারন পারিবারিক ভাবে ইরার বিয়ে হচ্ছে। সকাল থেকে রুহিলা বেগম রান্নাঘর থেকে বের হয়নি। এক হাতে তিনি সব সামাল দিয়ে যাচ্ছেন। তার কাছে আজ যেন সব কিছু নতুন লাগছে। তিনি মনে মনে ভাবলেন ইরার রুমে গিয়ে একবার দেখে আসা উচিৎ সে কি করছে। ইরার রুমে যাবার সময় রুহিলা বেগম বারান্দায় একবার উকি দিলেন, ইরার বাবা ওসমান সাহেব বারান্দায় বসে এক হাতে সিগারেট, অন্য হাতে খবরের কাগজ ধরে আছেন। দীর্ঘ ৩৫ বছর তিনি সেনাবাহিনীতে চাকুরী করেছেন। এ বাড়ীর সবাই তাকে ভয় পায়। ওসমান সাহেব সব সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পছন্দ করেন। ইরার বিয়েটা তিনি নিজে ঠিক করেছেন কারো সাথে পরামর্শ করেননি। তার ধারনা মেয়ে মানুষের সাথে পরামর্শ করা অহেতুক বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। গত সপ্তাহে রাতের খাবার খেতে খেতে ওসমান সাহেব বললেন, ইরাবতী – আমি তোমাকে এবং তোমার মাকে না জানিয়ে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ইরা বুঝতে পারছে তার বাবা তাকে কঠিন কিছু বলবেন কারন তিনি ইরা থেকে ইরাবতীতে চলে গেছেন। কঠিন কিছু কথা বলার আগে তিনি মানুষের পুরো নাম ধরে ডাকেন। যেমন-তাদের বাড়ীর কাজের লোক সামাদের উপর রাগ হলে তিনি তাকে ‘আব্দুল সামাদ হাওলাদার’ বলে ডাকেন। ইরা তার বাবাকে বুঝতে পারে। ইরার মনে করে তার বাবা খুব সহজ-সরল কিন্তু সে রাগী রাগী মুখ নিয়ে বসে থাকতে পছন্দ করেন।
ইরা খুব স্বাভাবিক বলল- বাবা তোমার সিদ্ধান্তের কথা আমি জানি। তুমি আমার বিয়ে ঠিক করেছ। তাই তো? এবং এও জানি আগামী শুক্রবার আমার বিয়ে।
ওসমান সাহেব আর কিছু বললেন না, চোখ-মুখ শক্ত করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

রুহিলা বেগম মেয়ের ঘরে ঢুকে খানিকটা আবাক হলেন। দিনের বেলা পুরো ঘর অন্ধকার। ইরা দরজা-জানলা, লাইট-ফ্যান বন্ধ করে শুয়ে আছে। মাকে দেখে ইরা স্বাভাবিক ভাবে বলল- লাইট জ্বালাবে না মা। যা বলতে চাও, বলে চলে যাও।
রুহিলা বেগমের খানিকটা মন খারাপ হল। এ বাড়ী সবাই তার সাথে কেমন যেন আস্বাভাবিক আচরন করে। বিশেষ করে ইরা দিন দিন কেমন যেন ওর বাবার মত হয়ে যাচ্ছে। রাগী রাগী ভাব নিয়ে কথা বলে। ইরা আবার বলল- মা, তুমি কি কিছু বলতে চাও?
-ইরা, তুই চাস তোর বাবা আবার স্ট্রোক করুক।
-তুমি এই কথা বলার জন্য এসেছ। তার আগে বলো ফয়সাল কি পাগল?
-পাগল হবে কেন? এ কি কথা বলছিস?
-তাহলে বাবা কেন তাকে চিলেকোটার রুমে আটকে রেখেছে? আমিতো তোমাদের সব কথা মেনে নিয়েছি।
-কেন আটকে রেখেছে সেটা তুই ভাল করেই জানিস। তোর বাবা চায় না তোর বিয়েতে কোন ঝামেলা হোক। আমি এত কিছু শুনতে চাইনা তাড়াতাডি উঠে তৈরী হয়ে নে, বর পক্ষ এখনি চলে আসবে।
ইরা আরো কিছু বলতে পারতো কিন্তু রুহিলা বেগম সে সুযোগ তাকে না দিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলেন।

বিকেল ৫টা। ওসমান সাহেব ড্রয়িং রুমে বসে আছেন। তার সামনের বর পক্ষ বসা। ওসমান সাহেব হাসি হাসি মুখ রাখার চেষ্টা করছেন কিন্তু তা সহজ হচ্ছে না কারন তিনি তরতর করে ঘামাচ্ছেন। ইতিমধ্যে কাজী সাহেব চলে এসেছেন। ওসমান সাহেব হাক ছেড়ে ডাকলেন- আব্দুল সামাদ হাওলাদার ! সামাদ ছুটে এসে বলল- জে স্যার ,আমারে বুলাইছেন ?
-তোর চাচী আম্মারে বল ইরাবতীকে জলদি নিয়ে আসতে।
সামাদ যাওয়ার আগেই রুহিলা বেগম ইরাকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে ঢুকলেন। ওসমান সাহেব ইরার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন, তার মেয়ে যে এত সুন্দর তা আগে কখনো লক্ষ্য করেনি, লাল শাড়ীতে ইরাকে দেখতে পরীর মত লাগছে। ওসমান সাহেবর বুকের মধ্যে ধরফর করে উঠলো তিনি কোন ভাবে ভাবতেই পারেন না এত সুন্দর মেয়েকে কোন এক জানোয়ার কষ্ট দিয়েছে না হলে আজ এই দিন দেখতে হত না, চুপচাপ এভাবে বিয়ে দিতে হত না।
কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করেছেন। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যে সব কিছু ঠিকঠাক ভাবে সম্পূর্ন হয়ে গেল। বিদায় বেলায় ইরা কারো সাথে কোন কথা বলল না স্বাভাবিক ভাবে গাড়ীতে উঠে গেল। ওসমান সাহেব রাস্তায় দাঁড়িয়ে মেয়ের চলে যাওয়া দেখতে লাগলেন, তার কাছে সব কিছু স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে, তবে তার ঘোর কাটল রুহিলার চিৎকার শুনে! ইরা চলে যাবার পর রুহিলা আকাশ ফাঁটিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল- আমার মেয়ে কোন অপরাধ করেনি, আপনি কেন তাকে এভাবে বিয়ে দিলেন? সে যাবার সময় কারো সাথে একটি কথাও বলল না, আপনার কি একটু খারাপ লাগলো না? আপনি এত পাষান বাবা? ওসমান সাহেব কোন কথা বলতে পারলেন না। চুপচাপ বাড়ীর ভেতরে চলে এসে ডাক দিলেন- সামাদ ! চিলেকোঠা রুমের চাবিটা নিয়ে আয়। সামাদ দৌড়ে চাবি নিয়ে এল। সামাদের হাত থেকে চাবি নিয়ে ওসমান সাহেব তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলেন।
ওসমান সাহেব চিলেকোঠা রুমের সামনে দাড়িয়ে আছেন তার হাত কাঁপছে, মনে হচ্ছে তিনি তালা খুললে পারবেন না। অনেকক্ষন যাবত চেষ্টা করার পর ঘট ঘট শব্দে তালা খুলে গেল, শব্দ শুনে ভেতর থাকা ৪ বছর বয়সী ফয়সালের ঘুম ভেঙে গেল, গুটি গুটি পায়ে সে দরজার কাছে এগিয়ে এল, কাছে যেতে ওসমান সাহেব তাকে তাকে কোলে তুলে নিলেন।
ফয়সাল কাঁদো কাঁদো গলায় জিজ্ঞাসা করে- মা কোথায়, নানাজান? আমাকে মার কাছে নিয়ে চল। আমি মার কাছে যাব।
-তোমার মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন বলতেই ওসমান সাহেবের গলা জড়িয়ে আসে। হুঁ হুঁ করে কেঁদে ওঠে ।
ফয়সাল কিছুতেই বুঝতে পারে না শুধু নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে নানাজানের চোখের দিকে।

লেখাটি উৎসর্গ করলাম –
তাহসিন বিনতে উমর।
খুব কাছের অপরিচিত একজন মানুষ।

পাশের বাড়ির দাসের বউ

-ও দিদি,দিদি…
-কে, রাজুর মা?
-হ্যাঁ গো,আমি। দাদা বাড়ি আছেন?
-হ্যাঁ, আছেন।
-আমার খাতাটা একটু হিসেব করতে হবে।
-এসো, বসো।

বারান্দায় এসে মেঝেতে বসে রাজুর মা। পাশের বাড়ির দাসের বউ।

বিড়ির খাতায় কত টাকার কাজ হয়েছে সেই হিসেব করতে এসেছে।

দুপুরে খেয়েদেয়ে ভোলা একটু শুয়েছে। পাশে বউও। ছেলেমেয়ে দুটো স্কুলে।

দাসের বউটা ভারি মিষ্টি। বড্ড নাদুসনুদুস। হলুদ শাড়ি পরে যখন বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়, চুপিচুপি তাকিয়ে থেকে ভোলা মনেমনে কী যেন চেটে যায়। কিংবা যখন বিড়ির কুলো নিয়ে ভোলার বাড়ির সিঁড়ির পরে বসে। তার বউয়ের সাথে গল্প করে। তখন ভোলা গোপনে বসে কল্পনার মউয়ে জিভ চোষে।

বউ বলে- শুনছো, তুমি একটু রাজুর মায়ের বিড়ির খাতাটা হিসেব করে দিয়ে আসো না।

ভোলা বারান্দায় যায়।।
হলুদ শাড়ি আর হাতাকাটা ব্লাউজ। উঃ অসহ্য! ভোলা ভাবে- সুপ্রিমকোর্ট তো পরকীয়ার পক্ষে রায় দিয়েই দিয়েছে। ভয় কী? তাছাড়া স্বামীটাও তো থাকে কেরালায়। একবার এই সুযোগে… বউটাও শুয়ে আছে ঘরে।

ভোলা পাশে গিয়ে বসে।
– কই, দাও।
মুচকি হাসে দাসের বউ- দেখুন তো দাদা, ক’টাকা হলো এ’মাসে বিড়ি বেঁধে।
খাতা এগিয়ে দিতে হাত বাড়ায় বউটা।

কী গোলগাল হাতখানা। একটু চেপে…
ভোলা ঘরে শোয়া বউয়ের দিকে একবার তাকায়। না, শুয়েই আছে। আরো একবার দেখে। তারপর ধীরেধীরে লোভার্ত হাতটা বাড়ায়।

– আমার খাতাটাও তাহলে একবারে হিসেব করে দাও।

পরকীয়া-প্রত্যাশায় ভোলা এতই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল, বউ কখন যে গুটিগুটি পায়ে তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারেনি। বউয়ের দিকে ভোলা আশাহত দৃষ্টিতে তাকায়।

স্বামির বাড়িয়ে দেওয়া হাতে নিজের খাতাটা ধরিয়ে দেয় ভোলার বউ।

অণুনক্ষত্র

ত্রিকালদর্শী বট। অসংখ্য ঝুরি নামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আদিগন্ত মাঠের মধ্যিখানে।
তারই ছায়ার মায়ায় বসে আছে এক রহস্যময়ী নারীমূর্তি। তপস্বিনীর মত। মুখে স্মীত হাসি। অনন্তে নিক্ষিপ্ত দৃষ্টির মধ্যে যেন অন্তহীন মহাকাশ। চিন্তাচর্চিত কপালের ভাঁজেভাঁজে যেন বয়ে চলেছে মহাকালের স্রোত।
দীর্ঘদেহী এক পুরুষমূর্তি সামনে এসে দাঁড়ায়। পথশ্রমে যেন ক্লান্ত। শব্দসম্ভারে যেন নুয়ে পড়েছে তার মস্তক। চোখের ভেতরে যেন যাপনের গল্পরা সন্তরণে ব্যস্ত।

– কবিতা, তুমি এখানে? এই নির্জনে?
– তুমি!
– কথাদের বয়ে বয়ে বড় ক্লান্ত আমি। তোমার পাশে একটু বসবো?

নারীমূর্তি সম্মতিসূচক ইশারা করে।

– আমি তোমাকে ছুঁতে চাই কবিতা।

কবিতা হাসে। হাত বাড়ায়।

পুরুষমূর্তিটি মিশে যেতে চায় কবিতার দেহে। মনে।

কবিতা দেয় হৃদয়।

পুরুষ দেয় কথা।

জন্ম নেয় এক নতুন অণুনক্ষত্রের।

সফল প্রেম কি বিয়ে ছাড়া পূর্ণতা লাভ করে না?

সফল প্রেম কি বিয়ে ছাড়া পূর্ণতা লাভ করে না? কি মনে হয় আপনাদের?

তার ভালোবাসার মানুষের সাথে তার বিয়ে হলো না, আর যার সাথে তার বিবাহিত জীবন তার সাথে ভালোবাসা হলো না। শুধু শারীরিক প্রয়োজনে কাছে আসা, বছর ঘুরে সন্তান আসা এভাবে মেয়েটির মাথার চুল কখন যে শুভ্র হয়ে যায় সে নিজেও টের পায় না। এদিকে তার বিয়ের আগের প্রিয় মানুষটি বাবা মায়ের ইচ্ছেতে তাদের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে এবং সে ও একইভাবে জীবনের একমুখী ট্রেইলে সামনে আগাতে থাকে পিছনে যেতে যেতে। তবে ভার্চুয়ালি এই দু’জনের হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের কোনো এক যোগসূত্র থেকেই যায়।

এক রাতে মেয়েটির ঘরের মানুষটির পাশে বসেই মেয়েটি ওর প্রিয় মানুষটির সাথে ইনবক্সে কথা বলছিলো, এর ভিতরে মেয়েটির ঘরের মানুষটি মেয়েটিকে নিজের বিছানায় নিয়ে যায়। ছেলেটি সব কিছু বুঝে নিজের ভিতরে এক বিচিত্র অনুভবে দগ্ধ হয়। কিন্তু করার কি কিছুই আছে? হয়তো ওরা ঘুমাচ্ছিলোই। তবু ছেলেটা, বয়স যাকে লোকটাতে রুপান্তরিত করতে অক্ষম হয়েছে, সে নিঃশব্দে কিছু ছবি আর শব্দ কল্পনা করতে থাকল, সেই কল্পনা থেকে পাওয়া কষ্ট গুলি সইতে লাগল। রাত বইতে লাগল। ঘুম আর আসে না। মাঝরাতে সে ইনবক্সে এলোমেলো লিখতে থাকে। সে কী এভাবে দূরের কোন শহরের এক বিছানায় নিজের মানুষের শরীর থেকে অন্য পুরুষের হাত সরাতে চায়?

অন্যদিকে মেয়েটা তার বিছানায় নির্ঘুম অনুভব করতে থাকে পুরো গল্পটা। কখনো চুলের ওপর নিয়মিত ছন্দে পড়তে থাকা ঘুমন্ত মানুষটার নিঃশ্বাস, কখনো কল্পনার মানুষটার শরীরের প্রতি কোষের অসহ্য কষ্টগুলি, কখনো নিজের দ্বৈত স্বত্ত্বা – আরো কিছু সত্য যা মেয়েটা একার ভিতর লুকিয়ে রাখে, কাউকে বলে না – সব কিছুই যেন বিমূর্ত শিল্পের মত চোখে ভাসছিল। ঘুম নেই, চোখের কোণে..সে মেসেজ আসার শব্দ পায়। নিরবে জেনে রাখে। উত্তর দেয় না। বরং নিজেকে হাজারো প্রশ্ন করতে থাকে…

এভাবেই হতে থাকে নিরব সংলাপে লেখা এক দীর্ঘ উপন্যাস। রাতের পর দিন, দিনের পর রাত গেঁথে গেঁথে বোনা। হৃদয়ের গহীন গভীরে ভালোবাসার জগত। যে সম্পর্ককে পৃথিবীর কিছুই নাগাল পায় না। অনেকগুলো বছর ধরে ওরা দুজনে সেই সম্পর্কটাকে সযত্নে রেখে দিয়েছে। অনেক কষ্টের, অনেক সুখের সম্পর্ক। অনেক দামী। পার্থিব কোন আকাংখা এই মানুষ দুটিকে টলায় না।

ওরা পৃথিবীর কারো কাছে নিজেদের সম্পর্কের জন্য কিছু দাবী করে না। মেয়েটা ওর স্বামী সংসারকে সুন্দরভাবে দেখে, ছেলেটিও পরিবারের সব কিছু ঠিকভাবে করে। কিন্তু হৃদয়ের ভালোবাসাটা শুধুমাত্র মেয়েটির জন্য। এরা দূরে থেকে একে অন্যের জন্য সমগ্র বিশ্বের সকল ভালোবাসাকে ধারণ করে এক অনুপমেয় গ্রন্থ’ লিখে চলে। তার নাম দেয় ‘প্রেম’।

.
________________________________________
ছবিঃ গল্পকারের ক্রেডিটঃ জ্ঞানীবাবু Labiba Mamun Khan.

চলে গেলে কেনো একা ফেলে

জীবনে তিনজন মানুষকে মাফ করতে নেই, যে ভালো না বেসে অভিনয় করে.. যে বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্কের সুযোগ নিয়ে বেইমানি করে.. যে বিশ্বাসের অমর্যাদা করে- উইকেন্ডে বাসায় ফেরার পথে চলন্ত বাসের ছাদে বসে কোনো কারণ ছাড়াই কথাগুলো হঠাত মনে পড়ে ফরহাদের। কোথায় যেন পড়েছিল। কোথায়.. সেটা মনে পড়ছে না এখন।

কথাগুলো মনের ভিতর ঘুরপাক খায়.. ফাঁকা রাস্তা.. দ্রুতগতির বাস সামনে আগায়। প্রচন্ড বাতাসের তোড়ে বাসের ছাদে চোখ বুজা অনুভবে ফরহাদ পিছনে যেতে থাকে। সময়ের সমান্তরালে।

হঠাৎ বৃষ্টি নামে। অসহায় ফরহাদ বাসের ছাদে বসে সময়ের স্মৃতিতে ধূসর অন্য এক ভিন্ন ছাদে পৌঁছে যায়। ঝাপসা পটভূমে.. এক সাদা-কালো দৃশ্যপটে বৃষ্টিভেজা ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ফরহাদ! অসহায় সেদিনও ছিল সে। রাস্তা জুড়ে নিঃসঙ্গতা.. দূর দূর পর্যন্ত কোথায়ও কেউ নেই। লেপ্টানো বসনে এক যুবতী দেহের বাঁকে বাঁকে প্রলোভনের ডালা সাজিয়ে ফিরে চলেছে!

পারুর সাথে কি ওটা-ই শেষ দেখা ছিল?

বাইরে উত্তাল প্রকৃতি। নিজের ভেতরেও কোথায় যেন দামামা বাজছে। কোথায়ও কিছু পুড়ছে। গন্ধ পায় ফরহাদ। মনটা জ্বলে ওঠে। সামনে বৃষ্টির তোড়ে দৃষ্টি চলে না। চোখ বুজে দেখার চেষ্টা করে।
দেখে কী?
অনুভব করে। অনেক কিছুই।

‘পারু একা-ই আমার সাথে ঐ তিনজনের কাজ করেছে। তারপরও…’
– তারপরও কি? ওকে ক্ষমা করতে চাইছ না তো?
‘তুমি ঠিক বুঝছ না আসলে। একবার কাউকে ভালোবাসলে, সেখানে ক্ষমা শব্দটা আসারই সুযোগ নেই। যাকে ভালোবাসবে, তার অতীত-ভবিষ্যতের সব কিছু ক্ষমা করেই না ভালোবাসার পথে পা বাড়াবে।’
– একটু আগে তবে মনে মনে কি ভাবলে?
‘উদ্ধৃতি বা কারো বাণী-ই কী সবকিছু? এক একজনের জীবন এক একরকম।’
– পারু কি কখনো জানবে তুমি এভাবে ভাবো?
‘নাহ! সে জানবে না.. অনুভব করবে.. কোনো একদিন!’

রাস্তার দুইপাশের গাছগুলি যেন ওদের ডানা নুইয়ে ফরহাদকে ছুঁয়ে দিতে চায়! দুরন্ত মাতাল হাওয়া পাতায় জমা বৃষ্টিকণা দিয়ে আলতো পরশে ওকে সিক্ত করতে চায়.. গাছের পাতা যেন পারুর বৃষ্টিভেজা চুল! ওর একটুকু পরশ ফরহাদের কোথায় যেন কাঁপন ধরিয়ে যায়।।

অনু গল্পঃ কুলসুম

জীবনে একটা মেয়েকেই ভালবেসেছি। কিন্তু কেন বা তার প্রতি ভালবাসার কারণ তা জানি না। তার প্রতি আমার ভালবাসাটা এতটাই তীব্র এখনো তাকে আমি আমার অস্তিত্বে অনুভব করি। অনুভব করি আমার প্রতিটা নিঃশ্বাসের স্পন্দনের সাথে।

যখন ভাবি তাকে আর কখনো আমি পাবনা, তখন আমার নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসে। অর্থহীন লাগে সময়ের প্রতিটা মুহূর্তকে।

পারিবারিক চাপে বিয়ে করেছি। কিন্তু মনের দিক থেকে অনেকটাই উদাসীন ছিলাম। কিন্তু একদিন তুমি যখন বললে – “আমার জন্য তুমি একটা মেয়েকে কষ্ট দিও না। তাকে ঠকাইওনা। যদি কষ্ট দাও মনে করবা আমাকেও কষ্ট দিলা।“ মুহুর্তের জন্য আমি হ্যং হয়ে গেলাম। কোন উত্তর ছিল না আমার কাছে। চুপ চাপ হয়ে শুধু শুনেছি তোমার কথা। মনে আছে তোমার; তুমি জিজ্ঞাস করছিলা যে –“ তোমার বউ এর নাম কি?” উত্তরে বলেছিলাম কুলসুম। তুমিও সাথে সাথেই বলেছিলা “আরে আমাকে বউ ডাকতা আগে ঠিক ছিল। কিন্তু এখন আর আমাকে বউ বলে তিনটা জীবনের অশান্তি তৈরি করিও না।“ তখন আমি কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। ওকে বললাম- একটু চোখটা নামাবা?? একটু রাগের চেহারায় তুমি – কেন? আমি তখন ভালবাসার ভয় নিয়ে বললাম- তুমি মনে হয় একটু রেগে গেছ। আরে আমার মনের বউ আর বিয়া করা বউ দুইজনের নামই কুলসুম। বুঝছ???

তার পর তোমার দিল ছিঁড়া হাসি, আমাকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়। নদীর ঢেউ যেমন তীরে এসে আছড়ে পড়ে তেমনি তোমার শান্ত হাসি আমার বুকে একটা প্রশান্তি ঢেউ তুলে দেয়। আবার পরক্ষণেই এই মধুর মুহুর্তটা আমার কাছে হয়ে উঠে নিংড়ানো কষ্টের নীল কাব্য। অনুভব করতে থাকি আমার ভিতরে কলিজা ছিড়ে রক্ত ক্ষরণের অনুূভূতি।

অই দিনের পর থেকে বলে আসছ তুমি আমাকে ভালবাসনা। কিন্তু আমি বুঝি বা জানি তুমি অনেক ভালবাস আমাকে। কিন্তু তোমার চাপা স্বভাবের কারণে তোমার বুক ফাটবে ত মুখ ফাটবে না।

প্রকৃত ভালবাসা কি একেকটা মহা কাব্য!! নাকি কষ্টের নীল উপাখ্যান?? তোমার নীরবতার কারণেই আজ আমি এই প্রশ্নের মুখোমুখি।

বৃদ্ধাশ্রম দেখতে যাবো

বাংলাদেশের ৮বিভাগীয় শহরের অলি, গলি, পাড়া, মহল্লার বাসা বাড়িতে বুড়ো মানুষের যত কষ্ট! সব বুড়োরা সারাজীবন চাকরি বাকরি করেছে ছেলে পেলের জন্য। চুরি দারি, আর ঘুষ খেয়ে মেদ ভূরি বাড়িয়েছে। বাড়ি করেছে। প্রতি কোরবানি ঈদে বড় সাইজের গরু কিনে কুরবানি দিয়েছে। ঈদের মার্কেট করেছে সিঙ্গাপুর, নাহয় থাইল্যান্ড গিয়ে। এই ছেলে পেলেদের সুখে দিকে চেয়ে কতো গরিব মানুষকে যে ঠকিয়েছে, তার কোনও ইয়াত্তা নেই। স্ত্রীর কথা শুনে নিজের মা বাবাকে নিজের সংসারে রাখেনি। রেখেছে গ্রামের বাটিতে, নাহয় টাকা দিয়ে কোনো এক নিকটাত্মীয়ের কাছে। মা বাবার মৃত্যু সংবাদ শুনে লোক দেখানো দুই ফোটা চোখের জল ফেলেছে মাত্র। মনে মনে আল্লার দরবারে শুকরিয়া আদায় করেছে শতবার।

চলে গেলেন জন্মদাতা পিতা আর গর্ভধারিণী মা। এখন নিজের পালা। চাকরি থেকে অবসর নিয়েছে বেশকিছু দিন গত হলো। নিজ তহবিলে যা ছিল, আদরের নাতি নাতকুরের পেছনে খরচ করতে করতে সব শেষ। সংসারের দায়িত্ব ছেলের বউয়ের কাছে। যাকে বলে সংসার পরিচালনাকারী। ছেলে ব্যাংকার। ছেলের ঘরে এক ছেলে, এক মেয়ে। সুখী সংসার যাকে বলে। দুখের মধ্যে হলো বুড়োটা। এ এক বাড়তি ঝামেলা। মুরুব্বি রিটায়ার হবার কিছু দিন পরেই গ্রামের বাড়ি বিক্রি করে শহরে চার শতাংশ জায়গায় কোনরকম একটা বাড়ি করেছে। চারদিকে প্রাচীর ঘেরা। একতলা টিনসেড দুই রুম বিশিষ্ট দালান ঘর। সাথে গোসলখানা, বাথরুম, রান্নাঘরও আছে। তারপরও বুড়ো বুড়ির থাকার জায়গা হচ্ছে না। সমস্যা বেগতিক!

ছেলের বউয়ের নেকামি দিন দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগলো। কাজের ছেলে আবদুল বলতে একমাত্র বুড়োই আছে। ছেলে বউয়ের কাপড় চোপড়ও সময়তে ধুইয়ে দিতে হয়। ছেলে বউ আবার এক নামী-দামী স্কুলের শিক্ষিকা। সংসারে আর সব কাজের মধ্যে বুড়োর বড় কাজ হলো, নাতি নাতিন দুটো কিন্ডারগার্টেন স্কুলে আনা নেয়া। সময় সময় হাল্কা পাতলা রান্নার কাজও করতে হয় বুড়োকে। যেমন: ডিম ভাজা, ডাল গরম করা, চা বানানো ইত্যাদি। বুড়ো করেও। বুড়ো কোনও কাজে অমত করে না। ছেলে বউ যা বলে, বুড়ো তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। বুড়ো নিজেও তো কোনো এক সময় নিজের বাবা মাকে এমন করেছিল। সেই করা এখন নিজে ভোগ করা। তা বুড়োর বেশ মনে আছে। মনে পড়লেই একা একা কাঁদে। বুড়োর কান্না কেউ দেখতে পায় না। দেখলেও মহাবিপদ হবে। তাই বুড়ো কারোর সামনে চোখের জল ফেলে না। কারোর কাছে মনের দুঃখও প্রকাশ করতে পারে না। এ-ভাবেই কেটে যাচ্ছে বুড়োর দিন আর রাত।

এখন অনেক সময় ঠাণ্ডা, জ্বর, সর্দি, কাশি হলে বুড়োর জন্য প্যারাসিটামল ট্যাবলেট কেনার টাকাও থাকে না ছেলের বউয়ের কাছে। বউ বলে, ঠাণ্ডা জ্বর এমনিতেই সেরে যায়। সামান্য সর্দি জ্বরে ট্যাবলেট সেবন করা ঠিক না। এই বলে বুড়োকে শান্তনা দেওয়া হয়। হাড়ভাঙা খাটুনিতে বুড়ো একসময় দুর্বল হয়ে পড়লো। এখন আর আগের মতো পরিশ্রম করতে পারে না। তাই সংসারের বড় ঝামেলার বোঝা হলেন এই বুড়ো লোকটা। বুড়ো শারীরিকভাবে নিঃশক্তি হবার কারণে এখন আর নাতি নাতিন নিয়ে স্কুলেও যেতে পারে না। সে কারণে ছেলের বউয়ের আরও জ্বলা বেড়ে গেল।

বুড়োর এই অবস্থা দেখে ছেলের বউ বলে, “ওনাকে যে-কোনও বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে রাখো। ওনাকে দিয়ে তো আর সংসারের দুই পয়সার কাজ হচ্ছে না। তা ছাড়া ছেলে মেয়ে দুটো বড় হয়ে যাচ্ছে। ওদের জন্য আলাদা শোবার ঘর দরকার। তোমার বাবাকে যদি বলি বারান্দায় ঘুমান, তিনি মন খারাপ করে। তার চেয়ে বরং কোনও এক বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে রাখো। আজকাল অনেক বৃদ্ধাশ্রম তৈরি হয়ে আছে। বৃদ্ধাশ্রমে খাওয়া দাওয়াও ভালো দেয়। সাথে চিকিৎসাও দেয়। বাড়ি থেকে দুইটি পয়সাও খরচ করতে হবে না। বরঞ্চ ঘরে আরও টাকা আসবে।”

স্বামী অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, “তা কীভাবে ঘরে টাকা আসবে?”
স্ত্রী বললো, “কতো বড়লোকেরা সাহায্য সহযোগিতা করে। জামা দেয়, ঔষধ দেয়, টাকা দেয়, পয়সা দেয়। সেগুলো কি তোমার বাবা একা একা হজম করতে পারবে? খাওয়া- দাওয়াতো সরকারি। উপরি যা পাবে সবই তো আমাদেরই। তাই তাড়াতাড়ি করে একটা ব্যবস্থা করে ফেলো। নাহয় সামনে ওনাকে নিয়ে আরও বিপদ হবে।”

স্বামী তাঁর স্ত্রীর কথামত বৃদ্ধাশ্রমের খোঁজ নিলেন। রাখার ব্যবস্থা করলেন। দিন তারিখ ঠিক করলেন। স্ত্রীকে জানিয়ে রাখলেন। স্ত্রী স্বামীর কাছে বৃদ্ধাশ্রমের কথা শুনে খুবই খুশি হলেন। এই বুঝি বাড়ি থেকে এক ঝামেলার অবসান হতে লাগলো। তারিখ মত সকালবেলা ছেলের বউ বুড়োকে বলছে, “তাড়াতাড়ি দুমুঠো খেয়ে জামা কাপড় পড়ে নিন। দশটার আগে সেখানে যেতে হবে।”

নাতি নাতিন দুটো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছে। নাতি ওর বাবাকে জিজ্ঞেস করছে, “বাবা, দাদাকে কোথায় নিয়ে যাবে?”
বাবা বললো, “তোমাদের দাদার জন্য একটা ভালো জায়গা ঠিক করেছি। আজ থেকে উনি সেখানে থাকবে।” বাবার কথা শুনে ছেলে বললো, “তা কোথায় বাবা?” ছেলের কথায় বাবা বিরক্ত হয়ে সোজাসুজি বলে ফেললো, “বৃদ্ধাশ্রমে।”
ছেলে আবার জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা বাবা, মানুষ বুড়ো হয়ে গেলে কি বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয়? তাহলে তো একদিন তোমাকে আর মাকেও বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হবে। তাই না বাবা?”
ছেলের মা সামনে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন। কিন্তু কোনও প্রত্যুত্তর নেই। ছেলের কথায় বাবার মুখও বন্ধ হয়ে গেল। বুড়ো বারান্দায় বসে সকালের নাস্তা খাচ্ছিলেন। বুড়োর মনটার খারাপ। কিছুক্ষণ পরই স্বাদের সংসার ছেড়ে বুড়োকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হবে, তাই।
নাতি বুড়ো দাদার সামনে এসে বললো, “দাদা, তুমি বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে যেখানে থাকবে, সেই জায়গাটা আমার বাবার জন্য সুন্দর করে রেখে দিও। আমার বাবাও তো একদিন বুড়ো হবে। বুড়ো হলে তো সবাইকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয়। তা আগে থেকে যদি রেডি করা থাকে তো দোষ কী দাদা? চলো দাদা, আমিও আজ তোমার সাথে যাবো। তোমার সাথে গিয়ে বৃদ্ধাশ্রমটা চিনে আসবো। বাবা বুড়ো হলে যাতে দৌড়াদৌড়ি করতে না হয়। চলো দাদা চলো। আমিও আজ তোমার সাথে বৃদ্ধাশ্রমে যাবো। বৃদ্ধাশ্রম কাকে বলে চিনে আসবো।”
এভাবে আমাকেও হয়তো একদিন বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হবে দাদা।

.
গল্পের ঘটনা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। কারোর জীবনের সাথে মিলে গেলে ক্ষমাপ্রার্থী। তবে দায়ী থাকার কথা নয়।

মামুনের অণুগল্প : হারানো সুর

নিজের জনকের চল্লিশা শেষে বউ বাচ্চাদের উদ্দেশ্যে ফিরে চলছে শিহাব। টানা এতগুলি দিন আম্মা এবং ছোট ভাইয়ের সাথে থেকে যেতে কষ্ট হচ্ছে। তারপরও, জীবন জীবিকা অনেক কষ্টকর মুহুর্তকে উপভোগ করতে বাধ্য করে।

প্রচণ্ড বরষায় ভিজে ভিজে সাইডব্যাগটিকে সামলে যখন বাসটির নির্ধারিত আসনে বসে শিহাব, বামপাশের জানালা দিয়ে বাইরে তাকানো পাশের সহযাত্রী বৃষ্টিবিলাসী মনে গভীর তন্ময়তায় মৌণ-বিভোর! পাশে কারো উপস্থিতিতে ঘোর থেকে জেগে ওঠে নারী.. হাজার বছরের রহস্যময়ী কালের সোপান বেয়ে ধেয়ে আসা দৃষ্টির ছুঁয়ে যাওয়ায় নিশ্চুপ শিহাব.. থমকে যাওয়া সময়ের দ্বিতীয় যাত্রী হয়ে নির্নিমেষ চেয়ে থাকে অধর কোণের সেই তিলটির দিকে!

এ-টু সিটে বসে সামনের উইন্ডস্ক্রিনের দিয়ে মেঘবালিকাদের অবিরাম কান্না দেখে দেখে নিজের মনে হাসে শিহাব.. হ্যা, সে! সে-ই তো.. হারানো সুর! এতগুলো বছর পরে.. এভাবে? কোনো একসময়ে শিহাবের হৃদয় হরণ করেছিলো এই মেয়েটি। আজ সে যদিও মেয়ে নয়। এখন সে নারী! পুর্ণাংগ রমনী। কিন্তু অন্য কারো…।

মুহুর্তে সময়ের ধাপের পশ্চাদগতিতে অনেক আগে ফিরে যাওয়া.. স্মৃতিদের কোলাহল আর আন্দোলনে থমকে থাকা কিছু বিশেষ সময়.. সব নিমিষে ভাবনা-চিন্তার এপার ওপার করে দিয়ে ফ্রিজ হয়ে যায়।

বাবার পছন্দ ছিলো না এই মেয়েটি। তারপরও বাবা শিহাবের জন্য রাজী হয়েছিলেন। কিন্তু কেনো জানি সম্পর্কটা হলোই না। জেদী বাবা এক সপ্তাহের ভিতর শিহাবের জন্য নিজের পছন্দের মেয়ে খুঁজে এনেছিলেন।
দেড় দশক আগে!

সময়! কত দ্রুত চলে যায়।
স্মৃতি রেখে যায়..
বাবাও দ্রুত চলে গেলেন।
রেখে গেছেন পছন্দের মেয়েটিকে…

‘তোমার কি পছন্দের নয়?’
এমন প্রশ্নে চমকে ওঠে শিহাব। নিজের দিকে তাকায়। উত্তর খুঁজে ফিরে।

হ্যা! আজ যে মেয়েটি শিহাবের বউ, বাবার পছন্দের হলেও, কিভাবে যেন সে শিহাবেরও পছন্দের মেয়েতে পরিণত হয়ে গেছে!

‘তবে এখনো এ-টু সিটে বসে আছো কি মনে করে?’
হ্যা! তাইতো, বাবার অপছন্দের মেয়েটির পাশে কেনো বসে থাকা? বাবা নেই। স্মৃতি আছে। আছে বাবার পছন্দ-অপছন্দের বিষয়। সিগ্রেট ছেড়েছে, টুকটাক নেশা করতো বাদ দিয়েছে, আড্ডা ছাড়া পেটের ভাত হজম হতো না-বাদ দিয়েছে।
আজ দেড় দশক পরে একদার সেই মেয়েটির পাশের সিটে বসে নস্টালজিক কিছু মুহূর্তকে কেন তবে উপভোগ করা।

পাশের রমনীর চোখে চিনতে পারার দৃষ্টি ফুটে উঠতেই তা নিমিষে বিস্ময়ে পরিণত হয় শিহাবের পরবর্তী কর্মকাণ্ডে। বাস ছেড়ে দিয়েছে। লাফ দিয়ে উঠে শিহাব ড্রাইভারকে বাস থামাতে বলে। বাস থামে। শিহাব সুপারভাইজারের সামনে এ-টু সিটের টিকেটটি ছিড়ে ফেলে বলে,
– আমি নেমে যাচ্ছি। তুমি পথের থেকে কাউকে নিয়ে বসিয়ে দিও না। ঢাকা পর্যন্ত এই সিটটা না হয় খালিই যাক?

প্রচন্ড বৃষ্টির ভিতরে শিহাব মাথা উঁচু করে পিছনে বাস কাউন্টারের দিকে এগিয়ে চলে। ঝাপসা জানালা দিয়ে এক জোড়া বিস্মিত চোখের দৃষ্টি ম্লান হতে হতে বাষ্পরুদ্ধ হয়ে পড়ে! দেখা হয়না শিহাবের।

বাবা চলে গিয়ে বাবার পছন্দ-অপছন্দ বড্ড তীব্রভাবে ‘রিয়্যাক্ট’ করাচ্ছে শিহাবকে! বাবা যদি দেখে যেতে পারতেন!

একজন শিহাব প্রচন্ড বৃষ্টির মাঝে পিচঢালা পথ ধরে যেতে যেতে কিছু যদি এবং কিন্তুর হিসেব মিলায়।
হিসেব মিলে কি?

____________________
#অণুগল্প_২৮২_হারানো_সুর।

আপনি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত লইয়াছেন


শেষপর্যন্ত পরওয়ারদিগারের সাথে হোসেন মোহম্মদ এরশাদের দেখা হইল। কুশল বিনিময়ের পর সৃষ্টিকর্তা বলিলেন…..
– রে এরশাদ, তোর খেরো খাতা খুলিয়া আমি একটা সত্য আবিস্কার করিতে সক্ষম হইইয়াছি। মনে হইতেসে তোর প্রতি আমি অবিচারই করিয়াছি।
– উহা কি, সর্বশক্তিমান?
– তোর পাওনা ১০০ ইচ্ছার মধ্যে ইতিমধ্যে ৯৯টা ইচ্ছা আমি পূরণ করিয়াছি। ১টা ইচ্ছা এখনো বাকি। রে নাদান, ইচ্ছা প্রকাশ কর। আমি নিশ্চয় পূরণ করিব। বান্দার সুখই যে আমার সুখ।
– হে পরওয়ারদিগার, খুবই পুলকিত বোধ করিতেছি। মনে হইতেছে আবেদন জানাইয়া ফিরিয়া যাই প্রেসিডেন্ট টাওয়ারের সেই বাসাটায়। তবে এমন আবেদন আমি পেশ করিতে চাহিনা। কারণ এইখানেই অনেক হুরপরীর সাথে আমার কথা হইয়াছে। বিশেষ বুঝাপরা হইয়াছে। তাই ঐপারে ফিরিয়া যাওয়ার আর কোন ইচ্ছা নাই। আপনি সর্বশক্তিমান, চাইলে সবই পারেন। শেষ ইচ্ছাটা আমি জগত ভ্রমণ শেষে তিনি যখন এইপারে আসিবেন তখনই পেশ করিব।
– ইহার হেতু কিরে ফকিরের বাদশা?
– আছে রাব্বুল আলামিন, আছে।

হঠাৎ করিয়া ফেরেশতাদের একজন আগাইয়া আসিয়া সৃষ্টিকর্তার কানে কি যেন একটা বলিলেন। সর্বশক্তিমান রাগান্বিত হইলেন। উনাকে চিন্তিত দেখাইল। অবশেষে তিনি আবার মুখ খুলিলেন।
– এইমাত্র আমার ইনফরমেশন মন্ত্রী মারফত জানিতে পারিলাম তোর শেষ খায়েশ। তুই অপেক্ষায় আছস মিডনাইট ড্রামাকুইনের। এইখানে এই অনন্তকালেও তুই আশায় আছস তিনি আসিয়া মিডনাইট ক্যু করিয়া আমাকে সরাইয়া দিবেন। এবং তুই তেনার ক্ষমতার রুটি-হালুয়া খাবি।
– আপনি সর্বজান্তা পরওয়ারদিগার। কি করিব বলেন, রুটি-হালুয়া একবার খাইলে বার বার খাইতে ইচ্ছা করে যে! আর আমি জানি এই অবিনশ্বর দুনিয়ায় আসিয়া তিনি নিশ্চয় আপনাকে ক্ষমতাচ্যুত করিবেন। তেনার পিতাকে মুক্ত করিবেন। এবং তেনাকে যাহারা দোজখে হাবিয়ায় পাঠাইছেন তাহাদের সবাইকে বিচারের মুখোমুখি করিবেন।
– রে পাপিষ্ঠ, তেনারও একটা খায়েশ বাকি আছিল। সেইটা আজ পেশ হইয়াছে এবং আমি তা পূরণ করিয়া দিয়াছি।
– সুবহানাল্লাহ! কি সেই খায়েস রাব্বুল আলামিন?
– এইপারে তিনি আমার প্রতিবেশির রাজ্যে অনন্তকাল কাটাইবার খায়েশ করিয়াছেন। নরেন না খগেন মোদি, তিনিই হইবেন তেনার রুম-মেট। আমারে ক্ষমতাচ্যুত করার আর কোন রাস্তা খোলা নাই।

এরশাদকে চিন্তিত দেখাইল। মনোবাসনা ব্যর্থ হইবে এই ভাবিয়া তিনি হতাশ হইলেন।
– সে সর্বশক্তিমান, আপনার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা। আর আপনি যদি তেনার গায়েবি বিচার করিতে চাহেন আমি হইব বিচারের রাজস্বাক্ষী। অনেক কিছু বলিবার আছে। ক্ষমতার আশা যখন তিরোহিত হইয়াছে তখন ভেতরের কথা ভেতরে রাখিয়া লাভ নাই।
তবে যাইবার আগে একটা কারণে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা না জানাইলেই নহে।
– সেইটা কি-রে নাদান?
– ছাত্রলীগের মতিগতি সময়মত ঠাণ্ডা করিয়ে দিবার জন্যে ১৬ কুটি মানুষের পক্ষ হইতে আপনাকে মোবারকবাদ জানাই। আপনি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত লইয়াছেন।
– রে এরশাদ, তোর অবগতির জন্য জানাইতেছি। ছাত্রলীগ এখন আর ছাত্রলীগ না। তাহাদের আমি এডিস মশায় রূপান্তরিত করিয়াছি। ডেঙ্গুর সিরোমে শক্তিশালী করিয়া রোহিঙ্গাদের চাইতেও দ্রুত প্রজননের ক্ষমতা দিয়াছি। তোর কৃতজ্ঞতা গ্রহন করিতে আমি অক্ষম!

এরশাদ ভাবনায় পরিয়া গেল। এডিস কাহাকে আগে কামড়াইবে, রওশন না বিদিশাকে, এই ভাবিয়া চিন্তিত হইয়া পরিল।