বিভাগের আর্কাইভঃ অণুগল্প

… অতঃপর একাকী একজন

… অতঃপর একাকী একজন।

জুলফিকার মনস্থির করেছে, আজকেই বলবে। আলিশাকে সে ভালোবাসে। বছর তিনেক হলো, একসাথে পড়াশুনা, লাইব্রেরিতে বসা, হৈ হুল্লোড় সবই হচ্ছে, ভালোবাসার কথা বলা হচ্ছে না।

আজ জুলফিকারের জন্মদিন। আজকের দিনটা ভালো একটা দিন। আজই বলতে হবে। রোকনের সাথে আলিশা বন্ধুত্বের মাহাত্ম জুলফিকারের মাথায় আসছে না। কাল ক্যাম্পাসে ঢুকেই দেখলো আলিশা গা লাগালাগি করে বসে আছে। জুলফিকারের বুকের উপর দিয়ে বিরাট এক একটা বুলডোজার চলাচল করেছে অনেকক্ষণ। আলিশা এমন এক মেয়ে যার ব্যাপারে আগাম কোনোকিছুই প্রেডিক্ট করা সম্ভব না। থাপ্পড় টাপ্পর দিয়ে বসতে পারে। জুলফিকার মনে মনে প্ল্যান করছে, প্রথমে বলবে, চল কোনো একটা কফি শপে যাই, তোর সাথে জরুরি কথা আছে।

তারপর কফি খেতে খেতে কি বলবে, সেটা নিয়ে মাথায় তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। একবার ভেবেছে, সোজা সাপ্টা বলবে, এই শোন আমি তোকে খুব ভালোবাসি, তুইও কি আমাকে ভালোবাসিস ?
বিছানায় শুয়ে শুয়ে কয়েকবার প্র্যাকটিস করলো। নাহ! কেমন ক্ষ্যাত ক্ষ্যাত শুনাচ্ছে। জুলফিকার ভাবছে, আচ্ছা এরকম বললে কেমন হয়, আলিশা শোন, সারাটা জীবন তোর সাথে কাটাতে চাই। তুই কি বলিস?

যে ডেঞ্জারাস মেয়ে পুরা ইউনিভার্সিটি জানিয়ে দেবে। নইলে এসব নিয়ে হাসি তামশা করবে। জুলফিকারের চেহারা ছবি ভালো, মফস্বল থেকে ঢাকায় পড়তে এসেছে। ইউনিভার্সিটির প্রথম দিন, একটা মেয়ে এসে বললো, তোমার কি ? ঠাণ্ডা লাগছে, এরকম কুঁজো হয়ে আছো কেন ? তারপর বললো ‘ওইইয়ার্ড ‘ বলে ক্লাসে তার পাশেই বসলো। জুলফিকার ইংরেজিতে ভীষণ কাঁচা, সব শব্দের মানে জানেনা। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি বাবার জমি বিক্রি করে ভর্তি হয়েছে, এরকম
পরিবেশের সাথেও পরিচিত নয়। প্রথম ক্লাসে স্যার কি বললো তার মাথায় কিছুই ঢোকেনি। সময়ের সাথে ধীরে ধীরে ইংরেজিতে লেকচার শুনায় অভ্যস্ত হয়েছে। কাপড় চোপড়, চলনবলন ধীরে ধীরে শহুরে ভাব চলে আসলো, লেখায় পড়ায় সে বরাবরই দারুণ ভালো।

তারপর প্রথম দিন থেকে আলিশার মতো প্রাণবন্ত একজন বন্ধুর মতো পাশে আছে। এই মেয়ে কোনোদিন তার প্রিয়তমা হবে তা সে কল্পনাও করেনি। আজ ভালোবাসার কথা জানানোর পর যদি তাদের প্রেমটা হয়, বাবা মা কে আলিশার ব্যাপারে জানানোর ব্যাপারটাও ভয়াবহ ব্যাপার।

টিশার্ট জিন্স পড়া একটা মেয়েকে মায়ের সামনে নিয়ে গিয়ে যখন বলবে, এই হলো আলিশা। মা তো মনে হয় হাট এ্যাটাক করে ফেলবে। বাবার নিশানা ভালো না, বাবা বন্দুক দিয়ে এলোপাথাড়ি গুলি করে সবাইকে বোধহয় মেরে ফেলবে। জুলফিকার আর ভাবতে পারছেনা। অসহ্য লাগছে তার। বিছানা ছেড়ে উঠলো সে,
৭/৮ জন মিলে দুই রুমের একটা বাসায় তারা থাকে। ঘুম থেকে উঠেই বাথরুম খালি পাবার মতো ভাগ্য প্রতিদিন থাকেনা।

আজ তার জন্মদিন। তার ভাগ্য ভালো। বাথরুম খালি পাওয়া গেছে। তার রুম মেট অফিসে যাবার জন্য রেডি হচ্ছে। জুলফিকার তাকে বললো, ভাই আপনার বেল্টটা যদি আজকে দিতেন, সন্ধ্যায় এসে দিয়ে দিবো। ধুর মিয়া, একটা বেল্ট কিনতে পারো না, ছিড়া বেল্ট দিয়ে আর কয়দিন চালাইবা। সুন্দর বান্ধবীদের নিয়ে ঘুরবা, সুন্দর করা চলবে না ? আচ্ছা যাও আজকে দিলাম। মাইন্ড ইট এরপর আমার জিনিসপত্র ধার পাবে না। রফিক ভাই পাশের রুমে থাকে, তুলনামূলক ভাবে তিনি উদার মানুষ। বাথরুম সেরে জুলফিকার পাশের রুমে গেলো। ভাই এক হাজার টাকা দেন। মাসের টাকা এলেই দিয়ে দেব। রফিক ভাই আন্তরিক ভাবে শুভেচ্ছা জানালেন, এক হাজার টাকা দিলেন। আর নতুন একটা শেভিং ফোম দিয়ে বললেন, এটা তোর বেটা। প্রতিদিন অন্যের শেভিং ফোম নিয়ে খেচখেচ হয়, আজ থেকে
তোরটা তুই ব্যাবহার করবি. আর টাকা ফেরত দেয়া লাগবে না, তুই যখন বড় চাকরি করবি, তুইও কোনো না কোনো জুলফিকারকে মায়া করবি এটা হলো এক বড় ভাইয়ের উপদেশ। পারবি না ?

জুলফিকার চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না। রফিক ভাইকে জড়িয়ে ধরলো। রফিক ভাই হোহো করে হাসতে হাসতে বললেন, আরে পাগল যা তোর ইউনিভার্সিটি দেরি হয়ে যাচ্ছে।

জুলফিকার দূর থেকে আলিশা দেখলো। আলিশা হাত নেড়ে নেড়ে রোকন কে কি যেন বুঝাচ্ছে। জুলফিকারের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। সে কাছে আসতেই ওরা তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালো। জুলফিকারের মন ভালো হয়ে গেলো। রাজীব গিটার নিয়ে দূরে বসে টুংটাং করছিলো, এখন গাইতে শুরু করলো, সবাই গান শুনছে মন দিয়ে। জুলফিকার আলিশার কাছেই বসে পড়লো। হঠাৎ কি যে হলো, আলিশা নিজের হাতটা আলতো করে জুলফিকারের হাতে রাখলো। জুলফিকারের হৃদয় কেঁপে কেঁপে উঠলো। আলিশা চোখে চোখ পড়তেই এত মিষ্টি করে সে হাসলো, জুলফিকার মনে মনে বললো, ‘তোর জন্য একটা জীবন দিয়ে দিতেই পারি’।

গান শেষে সবাই যার যার ক্লাসে চলে গেলো। রোকন, আলিশা জুলফিকার বসে আছে. তারা আজ ক্লাস করবেনা বোধহয়। জুলফিকার রোকনকে বললো, তুই বসে আছিস কেন? যা ক্লাসে যা। আমার আলিশার সাথে কথা আছে। রোকন মুচকি হাসছে। আলিশা বললো, তোকে একটা কথা বলা হয়নি, ‘রোকনের পরিবার আমাদের পরিবারে প্রস্তাব দিয়েছে। বাবা মা রাজি। আমাদের পড়াশুনা শেষ হলেই বিয়ে। তোকে কেমন সারপ্রাইস দিলাম দেখলি ?’

জুলফিকার কিছুই বলতে পারলো না। বুকের ভেতরটা যেন ফেটে যাচ্ছে, গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। এখান থেকে এই মুহূর্তে থেকে দৌড়ে পালাতে পারলে যেন সে বাঁচতো। জুলফিকার বললো, শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। আজ কোথাও যাবো না। তোরা থাক আমি বাসায় গেলাম।

কাউকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে জুলফিকার চলে গেলো …

ভালো থাকুক ভালোবাসা!

রাফি ভাইকে কখনো কাঁদতে দেখি নি। শত আঘাতেও সবসময় হাসিমুখ করে থাকতেন। কিন্তু যেদিন তার স্ত্রী সামান্য আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন, সেদিন তার চোখে আমি পানি দেখেছিলুম, ভালোবাসার আকুলতা দেখেছিলাম। একটা সময় পর রাফি ভাইয়ের চাকুরি চলে গেল। সংসারে খুব অভাব ছিল কয়েক বছর। সেই সময়টাতে তার প্রিয়তমা স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যায় ‘খোলা তালাক’ নিয়ে। সেদিন রাফি ভাইকে আমি দ্বিতীয়বার কাঁদতে দেখেছিলাম।

রাফি ভাইয়ের ঘরে আবারো প্রাচুর্য ফিরে এসেছে, খুব ভালো একটা চাকুরি হয়েছে তার। রাফি ভাই একদিন এসে বললেন-
: ভাই, বৌটা কান্নাকাটি করে বলছে ভুল হয়ে গেছে। এখন সে আবার সংসারে ফিরতে চায়।
: যে মেয়ে আপনার বিপদে আপনাকে তালাক দিয়ে চলে গেছে, তাকে আবার জীবনে আনতে চান, ভাই?
: সবই ঠিক আছে, কিন্তু আমি তারে ভালোবাসছিলাম তো!
: ভাই! ভালো তো সেও আপনাকে বেসেছিলো! কি প্রতিদান পেলেন!

রাফি ভাইয়ের চোখে আবারো পানি দেখলাম, তৃতীয়বারের মত…।

খুব বলতে ইচ্ছে করছে- রাফি ভাই, সে আপনার ভালোবাসা পাবার যোগ্যই নয়। কিন্তু…. থাক…। রাফি ভাইরা হয়তো এযুগের মানুষ নয়, এযুগের মানুষগুলো এতটা ভালো হয় না। ভালো থাকুক রাফি ভাইয়ের ভালোবাসা। আল্লাহ ভালো রাখুন তাকে।

[Re-writing: Kamal Uddin Mehedi.
একটি সত্য জীবনগল্প অবলম্বনে ছায়াগল্প। মূল কাহিনীর লেখকদ্বয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা রইলো।]

(পুরনো গল্প) বোকা বোকা লম্বা (শেষ পর্ব)

(পুরনো গল্প) বোকা বোকা লম্বা
(শেষ পর্ব)

মা
সরকারবাড়ির পুকুরে অর্ধেক জল, বাকি অর্ধেক ঢেকে গেছে কলমি-বেতো শাকে। সেখান থেকে ঢাল বেয়ে ওপরে উঠলে লম্বা ঘাসভরা জমি, মুখ না তুলে হাঁটো যদি, নাকে সুড়সুড়ি খেয়ে হাঁচি আসতে বাধ্য। তারপর বাতাবিলেবু গাছ একটা, যেখানে সোমঋতাদের দুধেল গরু আব্বুলিশ বাঁধা থাকে। জগন্নাথ সরকার বারাসাতে বাড়ি ক’রে ফ্যামিলি সমেত উঠে যাওয়ার পর এই সবুজ মাঠের টুকরোটা পাড়ার বেড়ালদের আড্ডা বা সেমিনারের জায়গা। বিবিল সেখানে দাঁড়িয়ে বারবার তাকাচ্ছিল কীর্তনবাড়ির দিকে। মিনিট খানিক পরেই, ঠিক যা ভেবেছি, সে-বাড়ির গেট পেরিয়ে দিশা মেয়েটা এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে সুড়ুত করে কাঠটগর গাছের জঙ্গলে ঢুকে পড়ল।

দিশার পুরো নাম অনেকগুলো সিংঘে, নায়েকে, আর্থার, পেরেরা দিয়ে বানানো, তিংসা বগির ট্রেনের মতো (তিংসা মানে বারো)। ও আসলে শ্রীলংকার খ্রিস্টান বেড়াল, কলোম্বোর বিখ্যাত উকিল মেন্ডিস পেরেরার কাছে মানুষ হয়েছে। ওই বাড়িতেই দুবছর ভাড়া ছিলেন কীর্তনবাড়ির ডক্টর রামবিলাস কীর্তনিয়া। দেশে ফেরার সময় বাচ্চাটাকে সঙ্গে নিয়ে আসেন।

কাঠটগর-বন পেরিয়ে জামরুল গাছের আড়াল দিয়ে দিশা খুব জোরে ছুটে এল মাঠটুকু। তারপর বিবিলের নজরে আসার ঠিক আগে থেমে গিয়ে হেলেদুলে হাঁটতে লাগল। মুখের আহ্লাদি ভাব লুকিয়ে চোখদুটো উদাসীন-মতো করে বলল, আবার কী হ’ল? ডাকছিলিস কেন!
—এই, “আডমিটিকার” মানে কী রে?

মেয়েটা তো হেসেই বাঁচে না। “ওটা অ্যাডমিট কার্ড, ওতে রোল নম্বর, ছবি, সব দেওয়া থাকে। না নিয়ে গেলে পরীক্ষার হলে ঢুকতেই দেবে না। আমাদের বাড়ির বন্দনাদিও ন’টা বেয়াল্লিশের ট্রেনে যাচ্ছে, ওর আবার বিধাননগর কলেজে সিট পড়েছে তো!

আমি আকাশের দিকে মুখ তুলে রোদের হেলানো রশ্মি দেখতে পেলাম। মনে মনে অল্প একটু পরিমিতি ক’ষে নিয়ে বললাম, আর ঠিক আধ ঘন্টা বাকি। কিন্তু এখন আমাদের আর কী-ই বা করার আছে!

আছে অনেক কিছু। বুন্নিদির অ্যাডমিট কার্ড আমি গতকালই দেখেছি ওর হাতে। নিশ্চয়ই ওই ঘরের মধ্যে কোথাও….। বিবিল যেন কুকুরের তাড়া খেয়েছে, শরীরটা এমন ছোট্ট করে ছুট দিল দত্তবাড়ির দিকে। দিশা চেঁচিয়ে বলল, “ঝামেলা মিটল কিনা বিকেলবেলা এসে জানিয়ে যাস”। তারপর আমার দিকে চোখ পড়তে থতমত খেয়ে ক্যাবলার মতো হাসল, “আপনিও আসবেন, কাকিমা”।

কিন্তু সেসব দেখার সময় নেই এখন। প্রাণপণ দৌড়ে বড়রাস্তা লাগোয়া কচুবাগানের কাছে ধরে ফেললাম বিবিলকে। তোর কি মাথা খারাপ হল যে মানুষকে সাহায্য করতে ছুটছিস! ওরা এক্ষুনি বুঝতে পেরে যাবে আমরা বাংলা ভাষা জানি। তারপর বাকি জীবন কুকুর হয়ে কাটাতে পারবি তো?

একটা অ্যাডমিট কার্ড খুঁজে দিলাম, আর এতকিছু ঘটে গেল!

শোনো, তোমারই মতো বোকা একটি সারমেয় মানুষের কথা শুনে একবার শুধু আহ্লাদে লেজ নেড়ে ফেলেছিল। বাকিটা ইতিহাস। এখন কুকুরদের সারারাত জেগে বাড়ি পাহারা দিয়ে আবার ভোরের আলো ফুটতেই বাড়ির বুড়োবুড়িকে মর্নিং ওয়াকে নিয়ে ছুটতে হয়। তারপর সকালের খবরের কাগজ মুখে করে নিয়ে আসা থেকে বাজারের ব্যাগ বওয়া, দুপুরে বৌদি ঘুমোলে বাচ্চার নজরদারি, দুবেলা বাড়ির ছোটদের সঙ্গে ফুটবল প্র্যাক্টিস —এসব তো আছেই। রেডিও-টিভিতে, সিনেমায়, এমনকি মোবাইল ফোনের বিজ্ঞাপনে পর্যন্ত খাটছে কুকুর, অথচ কোনও কুকুরের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির লিস্টিতে একটা নোকিয়া বা স্যামসাং বা এলজি-র চোদ্দশো টাকার সেট-ও খুঁজে পাওয়া যাবে? আর, সবচেয়ে দুঃখের কথা কী জানিস? পুলিশ-মিলিটারিতেও কুকুর গিজগিজ করছে। মানুষ নিজের কাজ করাচ্ছে কুকুরকে দিয়ে।

আবেগে চোখে জল এসে গেছিল। বিবিল পেছনের দরজা দিয়ে দত্তদের ঘরে ঢুকে তক্ষুনি বেরিয়ে এসে বলল, কেন, ওরা মোটা মাইনেও তো পায়? তাছাড়া কুকুর কতো বিশ্বাসী প্রাণী সেটা বল? পেট ভরা থাকলে রান্নাঘরে ঢুকে খাবারে মুখ দেবার কু-স্বভাবটা নেই।

শুনে মেজাজ এত গরম হয়ে গেল, বাঁ হাত তুলে ওর মাথায় এক থাবা বসালাম, “জিভ খসে পড়বে নিজের জাতের বদনাম করিস তো। আমাদের দেবতা বেড়াদাস বলেছেন, চুরিই হচ্ছে খাঁটি বেড়ালধর্ম। বুঝলি ইঁদুরটা!

“আমার অতশত বুঝে-সুঝে কাজ-টাজ নেই। বুন্নিদি আমাকে ভালোবাসে। দিদি পরীক্ষা দিতে না পারলে খুব কষ্ট হবে, ব্যাস।”

দেখলাম, বিবিল দত্তভিলার পেছন দিকটায় চলে গেল। তার মানে পেঁপে গাছ বেয়ে ছাদে উঠে স্টোররুমের ফোঁকর গলে দোতলায় ঢুকে তারপর সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামবে। যে মানুষ ওকে ঘরে ঢুকতে দেখলেই তাড়িয়ে দেয়, উনি চললেন তাদের উদ্ধার করতে। হুঁহ্‌!

ছেলে
শুনেছি, এর আগে তিন দফায় আমার মোট পাঁচটা দাদা-দিদি হয়েছিল। মা তখন যে বাড়িতে, সেই হালদারবাবুরা আড়াল দিলে ওরা হয়তো শেয়ালের পেটে যেত না। তারপর থেকেই মা একটু মানুষ-বিরক্ত। যাহোক, অনেকদিন পরে স্টোররুমে ঢুকে অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম। এই ঘরই আমার জন্মস্থান কিনা! ওই তো সেই প্লাইউডের বাক্স যার মধ্যে খেলা করে আমার “বৈশব” (বেড়ালের শৈশব আর কি) কেটেছে। কিন্তু পুরনো খবরের কাগজ লাট করে রাখার জায়গাটা যেন কোথায়?

বুন্নিদির খাটের ওপর বইপত্র আর খবরের কাগজ নিয়ে পড়তে বসার ওভ্যেস। অ্যাডমিট কার্ড বইয়ের সঙ্গে উঠে গিয়ে থাকলে এতক্ষণে শেলফ ঘেঁটে খুঁজে পাওয়ার কথা। কিন্তু রাঁধুনি নিরুমাসি বা অন্য কেউ যদি পেপারের সঙ্গে তুলে ফেলে? কাগজের স্তূপ থেকে এক একটা করে কামড়ে নামিয়ে ফের মুখে তুলে ঝাঁকাতে লাগলাম। নাহ, কিচ্ছু নেই, শুধু ধুলোয় গা-মাথা ভরে গেল। হঠাৎ মনে হল, নতুন কাগজের ডাঁই হলে তো এত ধুলো জমার কথা নয়! দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নামছি, বুন্নিদির গলায় চাপা কান্নার আওয়াজ! ইস, মা মারা যাওয়ার পর আমাকে তুলোয় করে দুধ খাইয়ে বাঁচিয়েছে যে, সেই দিদিটার জন্যে কিছুই করতে পারব না!

ঠিক এমন সময় সিঁড়ির ঠিক নিচে গৌরীকাকুর সাইকেল আর গ্যাস সিলিন্ডারের মাঝখানটায় চোখে পড়ল, আরও কিছু খবরের কাগজ ভাঁজ করে সাজানো, আর তার প্রথমটা ধরে টান দিতেই নিচে থেকে বুন্নিদির ছবি বেরিয়ে এসেছে। অ্যাডমিট কার্ড মুখে করে ছুটতে যাচ্ছিলাম ও-ঘরে, মনে পড়ল মা-র সাবধান-বাণী! আমাদের ধর্মগ্রন্থ (পড়ব পড়ব করে আর পড়া হয়ে ওঠেনি) “বেড়াভাগবতে” নাকি লিখেছে, বেড়ালের বুদ্ধির কথা জানতে পারলে মানুষ তাদের রকেটে করে মহাশূন্যে পাঠিয়ে দেবে। আর সেখানে তাদের গায়ের লোম ঝরে গিয়ে চেহারাটা ঝাঁটার শলার মতো হয়ে উঠলে নিজেরাই নিজেদের তেলাপিয়া মাছের কাঁটা ভেবে খেয়ে ফেলবে তারা। আমি অ্যাডমিট কার্ডের ওপরে বসে পরিত্রাহি চেঁচাতে লাগলাম। গৌরীকাকু এসে “সোবাতাং জিয়াও মুনি” (বাড়ি মাথায় করেছিস কেন?) বলে ঝুলঝাড়ু দিয়ে জোরসে পিঠের ওপর একখানা কষিয়ে দিল। কিন্তু ভয় পেলে সাহসের কাজ করা চলে না। আমি চিৎকারের ভল্যুম বাড়িয়ে দেওয়ামাত্র শুনতে পাচ্ছি তরুকাকিমার গলা, “বেজিনা লুসিও। পিং সে কাই অরন তুদা।“ (তুমি পারবে না। গায়ে জল ঢেলে দিলে ও শায়েস্তা)। এই রে, পরীক্ষার প্রবেশপত্রও যে ভিজে সপসপে হয়ে যাবে! তরুকাকি এলে তেড়ে যাব কিনা ভাবছি, বুন্নিদি এতক্ষণে সিঁড়ির ঘরে ঢুকল — “সব সময় একটা অবলা জীবের পেছনে লেগে আছো কেন! সকালে খেতে পায়নি বলে চিৎকার করছে সেটাও বুঝলে না?”

“ইচিদং ত্রামে সোহা” (তোর জন্যেই এটা মাথায় উঠেছে) বলতে বলতে দুজনে বেরিয়ে গেলে আমি মেঝেয় পড়ে থাকা অ্যাডমিট কার্ডটার চারপাশে পাক খেতে লাগলাম। বুন্নিদি তক্ষুনি লাফিয়ে এসে কাগজটা তুলে নিয়ে একদম অবাক হয়ে গেছে। “কোথায় পেলি এটা? এত বুদ্ধি তোর! এবার তো সিসিল বলে ডাকতে হবে ওস্তাদকে, মানে চালাক-চালাক-লম্বা! আমার কিন্তু প্রথম থেকেই সন্দেহ হত বাংলা ভাষাটা তুই কব্জা করে ফেলেছিস…হ্যাঁ রে, হাঁ করে দেখছিস কী?

আমার মাথার অনুবাদ-যন্ত্র ঘুমিয়ে পড়েছে। বুন্নিদির কথা শোনামাত্র বুঝে ফেলছি আমি। তার মানে মানুষই হোক, বা পশু-পাখি বা গাছপালা, ভালোবাসার ভাষা সবার বেলাতেই এক। একজনের মুখ ফুটলেই আরেকজন টের পেয়ে যাবে। এমনকি উচ্চারণ করারও দরকার নেই। যেমন বুন্নিদি এখন আমার গলায় সুড়সুড়ি দিতে দিতে মনে মনে বলছে, কিন্তু তুই ইংরিজি কী করে শিখলি, বিবিল? নিশ্চয়ই তোর সেই শ্রীলংকান বান্ধবীর কাছে!

অণুগল্প : পীতনগর

পীতনগর

রাজধানী শহরে বিজয় দিবস উদযাপন শেষে শফিক বাড়ি ফিরছে। ডিসেম্বরের শীত শীত রাতে কুয়াশা কেটে কেটে কুড়িগ্রামের দিকে ছুটছে বাস।

পুরো বাসে নেমে এসেছে ঘুম, শফিকের ঘুম আসছেনা। ওর মনের ভিতর মার্চ পাস্ট করে যাচ্ছে প্যারেড গ্রাউন্ডের কুচকাওয়াজ, যুদ্ধ বিমানের হাওয়ায় ডাইভ দিয়ে উর্ধ্বমুখী উড়াল, টিএসসি’র কনসার্ট আর বাসে ওঠার সময় কণার জলে ভেজা চোখ।

বাস ছুটছে, আবার ফিরবে বলেই ভার্সিটির ছুটিতে বাড়ি ফিরছে শফিক। শীতের হবো হবো ভোরে পলাশবাড়ি পেরুতেই কিছু একটা হলো, খুব জোড়ে ধাক্কা খেয়ে মহাসড়কের পাশের জলাশয়ে ছিটকে পড়লো বাস- শফিকের স্পষ্ট মনে আছে। কিন্তু ও কিছুতেই তা মেলাতে পারছে না। কারণ, ওর জ্ঞান ফিরতেই অচেনা এলাকায় আবিষ্কার করে নিজেকে।

এক ব্যস্ত শহরের পথে পথে হাটছে শফিক। রোদের নরম রোদে জাগছে শহর। শিশুরা ব্যাগ কাঁধে ছুটছে স্কুলে, বড়রা অফিসে। দোকানপাট খুলছে ধীরে ধীরে। বাসের হেল্পার ‘সিট খালি.. সিট খালি’ বলে চেঁচাচ্ছে। সাই সাই করে পাশ কেটে যাচ্ছে ঝকঝকে গাড়ি। ফুটপাতে যারা একটু আগেও শুয়ে ছিলো, তারা দিব্যি জাদুর মত নাই হয়ে গেছে। সূর্য যত উপরে উঠছে, শহর তত ব্যস্ত হচ্ছে। কারো দিকে তাকাবার সময় কারো পর্যন্ত নেই।

শফিকের ক্ষিধে পাচ্ছে, প্রচণ্ড ক্ষিধে। ও একটা হোটেলে ঢুকে নাস্তা সারে। তারপর আবার হাটতে শুরু করে, এ এক আজব শহর বা দেশ। কত উঁচুউঁচু দালানের সারি, রঙচঙ কত বিলবোর্ড। দু তিন মোর পার হতে না হতেই মাথার ওপর ফ্লাইওভার। এ শহরও সেজেছে বিজয় দিবসের জৌলুস সাজে, হলুদ নিশান আর হলুদ ব্যানার, ফেস্টুন ও বিলবোর্ডে।

এমন এক ফ্লাইওভারের নিচেই একটা বাস থেতলে দিয়ে গেছে কারো মাথা- সেখানেও মিডিয়ার লোকজন ছাড়া আর কারো কোনো শোক- কৌতূহল বা হা-হুতাশ নেই।কোনো একটা বাহিনীর সদস্যরা কারো চোখ বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে প্রকাশ্য দিবালোকে- কারো কোনো প্রশ্ন নেই। মিছিলে আটকে আছে সম্ভবত শহরের ব্যস্ততম শহর কারো কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।

শফিক অবাক হয়ে লক্ষ্য করে এ শহরে মিডিয়া, বাহিনী, ড্রাইভার সবার পোশাক হলুদ, এমন কি শহরবাসির পোশাকেও হলুদ রঙের নাগরিকত্বের ব্যাজ। এ শহরে সবাই ব্যস্ত, একমাত্র ওর কোনো তাড়া নেই। ওর সাথে হাটতে হাটতে সকাল পৌছে গেছে বিকেলে, এখন বিকেলও বলছে যাই যাই। তবু ওর হাঁটা থামেনা।

ব্যস্ত শহরে সন্ধ্যা পেরিয়ে নামছে রাত। শহরবাসীর ফেরার জন্য প্রবল তড়িঘড়ি। এই প্রথম শফিকের গায়ের পশম আতঙ্কে দাঁড়িয়ে যায়, একটার পর একটা শীতল স্রোত মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে আসে, দাঁড়িয়ে থাকার মত জোড় হারায় হাঁটু। ও ফুটপাতে বসে পড়ে, আর দেখে- এ শহরে কোনো বাড়ি নেই, শহরবাসীরা নিজ নিজ কবরের দরজা খুলে ঢুকে পড়ছে। কবরের ভিতরে জ্বলে উঠছে আলো, হাওয়ায় ভেসে আসছে খাওয়ার ঘ্রাণ আর টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের আওয়াজ।

আবৃত্তি_মামুনের_ছোটগল্প

যারা ভালোবাসার গল্প পছন্দ করেন, অনেক আগে লেখা আমার নিচের ছোটগল্পটি সময় থাকলে পড়তে পারেন…

জীবনের এক বিষম সময়ে পারুর সাথে আমার পরিচয়। বেঁচে থাকার কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। জীবন এক দুর্বিসহ দূর্ণিবার রুপে আমার সামনে উপস্থিত। শব্দে সেই রুপ আমি ব্যাখ্যা করতে অক্ষম। এমনই সময় ছিলো তখন।

টুকটাক লেখালেখির অভ্যাস ছিলো। এভাবে লিখতে গিয়ে লেখকদের এক গ্রুপের সদস্য হয়েছিলাম। আড্ডাবাজি আর লেখালেখির সমালোচনামূখর সময় কাটতো ওখানে। অনেকেই আসতো। সবার সাথে সেভাবে পরিচয় না হলেও, অনেককে মুখ চেনা চিনতাম। তাদের ভিতরে পারুও ছিলো!

তখনো মুঠোফোন যন্ত্রটি এদেশে আসে নাই। অ্যানালগ টেলিফোন দূরালাপনী যন্ত্র হিসেবে একমাত্র বিলাসিতা কিছু কিছু অবস্থাপন্ন মানুষের ঘরে। আমি যে মেসে থাকতাম, সেখানে এই যন্ত্রটি ছিলো। মেস ম্যানেজারের কৃপা দৃষ্টি ছিলো আমার প্রতি। কেন তা জানি না। কখনো জানতেও চেষ্টা করিনি আমি।

একদিন রাতে- ভয়াবহ ঝড়-বৃষ্টির রাত ছিলো সেটা। বিদ্যুত ছিলো না। তখন হারিকেনের অস্পষ্ট আলোয় মেসরুমগুলির বাসিন্দারা নিজেদের যৎসামান্য কাজ চালাতো। আর মোমবাতির অপেক্ষাকৃত উজ্জ্বল আলোর ব্যবহার আমাদের কাছে ছিলো বিলাসিতা। যাইহোক, মেস ম্যানেজার সেই রাতে আমাকে নিচে তলব করলেন। গেলাম।

কালো টেলিফোনের রিসিভারটি অবহেলায় ওনার সামনের নড়বড়ে চারপায়ার ওপরে পড়ে আছে। দাঁত খিলাল করতে করতে সেটার দিকে বাম হাতের অঙ্গুলি হেলন করে আমাকে বললেন,
– তোমার ফোন।

অবাক হলাম। কারণ এই শহরে আমাকে ফোন করার মতো কেউ থাকতে পারে, আমার কল্পনায়ও ছিলো না। বিস্ময়াভিভূত হৃদয়ে রিসিভার কানে ধরতেই ওপাশ থেকে ঝড়-বৃষ্টির কোলাহলকে ছাপিয়ে মিষ্টি একটা কন্ঠ আমার কানে মধু ঢেলে দিলো!

টেলিফোনের ওপাশের মানূষটির সাথে আলাপ শুরু করতে প্রথমেই নাকি ‘হ্যালো’ বলতে হয়। আমিও ঐ বিজাতীয় শব্দটা উচ্চারণ করলাম। ওপাশ থেকে জলতরঙ্গের মতো দু’টি শব্দ আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
– কেমন আছেন?

সেই-ই পারুর সাথে আমার প্রথম আলাপ। বিনা তারে এক অদৃশ্য সংযোগের সেই-ই প্রথম সূত্রপাত।

পারু যে ওর নাম সেটা কীভাবে জানলাম? সে-ই বলেছিলো আমায়। এরপর অনেক জল গড়ালো আমার সেই মফঃস্বল শহরটিকে ঘিরে বয়ে চলা একমাত্র নদীটির বুকের ওপর দিয়ে। দিনের পর দিন, অনেকগুলি রাত আমাকে মেস ম্যানেজার ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তার বিরক্তিভরা ভ্রুকুঠি অগ্রাহ্য করার মত মানসিক শক্তি আমাকে দিয়েছিলো, কালো রিসিভারের ওপাশের পারু নামের অচেনা একটি মেয়ে। নারী বললাম না; কারণ মেয়ে শব্দটি আমার কাছে খুব ভালো লাগতো। নারী বললে এক পূর্ণ যৌবনা সম্পন্ন কাউকে মনে হতো আমার সবসময়।

তবে পারু টেলিফোনে কথা বললেও কখনো ওর আসল পরিচয় তখনো আমাকে জানায় নাই। আমার লেখা কবিতা ওর নাকি খুব ভালো লাগতো! সে আমাকে টেলিফোনে দু’একটা আবৃত্তি করেও শুনিয়েছিলো।

এরপর ওর লেখা চিঠি আমার মেসের ঠিকানায় আসা শুরু হলো। অসাধারণ হস্তাক্ষর! চিঠিগুলির কাগজে কেমন ভালোবাসার ঘ্রাণ জড়িয়ে ছিলো! হাসছেন? হাসুন। ভালোবাসারও নির্দিষ্ট ঘ্রাণ আছে। আপনারা যারা কখনো ভালোবেসেছেন, সহজেই অনুভব করতে পারছেন আমার সেই ঘ্রাণের অনুভূতিটুকু।

আমিও নতুন উদ্যমে পারুকে নিয়ে অনেক অনেক কবিতা লেখা শুরু করলাম। একটা কবিতার কয়েকটা লাইন শুনতে চান? শুনুন তবে,

“প্রিয়দর্শিণী পারু! তুই কেমন আছিস?
তোর বুকের ওম মাখা প্রহরগুলি
এখন আমার শীতল ঘরের ফায়ারপ্লেস!
সেখানে আমি ইচ্ছেমতো পুড়ি-শীতল হই…
তুই কি বুঝিস?”

প্রথম প্রেমের পাগলাটে কিছু অনুভব! তবে আমার মনে ঐ সময় একটাই ইচ্ছে ছিলো। আমার শহরকে আগলে রাখা সেই ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে, এক তারা জ্বলা রাতে, ঘাসের বুকে পাশাপাশি বসে , পারুকে নিয়ে আমার লেখা কবিতা ওর নিজের মুখে আবৃত্তি শোনার!
সেই কথাটি পারুকে লিখে জানালাম। ওর সাথে দেখা করার সেই মাহেন্দ্রক্ষণটির অপেক্ষায় ওর দেবদাস অধীর ভাবে অপেক্ষমাণ। চিঠি চালাচালির সেই সময়ে টেলিফোনে কথা বলাটা কমে গেছিলো। কারণ আমাদের দু”জনের এমন অনেক কথা ছিলো, যেগুলি আমাকে পছন্দ করা সেই মেস ম্যানেজারের সামনেও বলা যেতো না! এমনই সব কথাবার্তা। বুঝতেই পারছেন?

একদিন চিঠিতে পারু জানালো, সে দেখা করবে! সেই অনুভূতি শব্দে কীভাবে প্রকাশ করি বলুন তো? ইঁদুরের শরীরের গন্ধে ভরপুর আমার মেস রুমকে মনে হচ্ছিলো জান্নাতুল ফেরদৌসের সবুজ গালিচাময় স্থান! আমি ভেসে যাচ্ছিলাম… কি করবো,কখন সন্ধ্যা হবে সেই অপেক্ষায় সময়ই যেন কাটছিলো না।

হ্যাঁ! ঠিকই ধরেছেন। আগেই বলেছিলাম, নদীর তীরের সবুজ ঘাসের বুকে পাশাপাশি বসে ওর আবৃত্তি শুনবো।

নির্দিষ্ট সময়ে আমি নির্দিষ্ট স্থানটিতে পৌছালাম। ওখানে আগেই পারু বসে আছে দেখলাম দূর থেকে। কম্পিত হৃদয়ে গুটি গুটি পায়ে ওর সামনে হাজির হলাম। প্রথম প্রেমের প্রথম অভিসার! আমার পারু চুপচাপ বসে আছে। আকাশের তারাগুলির ধার করা আলোয় চারপাশটা দেখার মতো উজ্জ্বলতায় ভরপুর ছিলো। আমি পারুর পাশে বসলাম। ওর শরীর ছাপিয়ে কি এক অজানা সুগন্ধি আমায় গ্রাস করে চলেছিলো। আমি ডুবে যাচ্ছিলাম… ক্রমশঃ এক বিহ্বলতার গভীর থেকে আরো গভীরতর প্রদেশে প্রবেশ করছিলাম! একি ভালো লাগা! একি ভালোবাসা! এমনই অ-অনুভবেয় এক অনুভূতি আমায় গ্রাস করে চলেছিলো।

আমি পারুকে নিয়ে লেখা আমার সেই ঐতিহাসিক কবিতাটি নিচের দিকে তাকিয়ে থাকা পারুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
– চোখ তোলো! চেয়ে দেখো আমায়।

পারু তাকালো আমার দিকে! নিঃশ্বাস রুদ্ধ এক মুহুর্তে আমার ভিতরের অন্তর্চক্ষু দিয়ে আমি ওর চোখের আলোয় জ্বলে উঠলাম। বললাম,
– নাও, আবৃত্তি করো।

মুহুর্তে দু’টি কম্পমান ঠোঁটের মৃদু নড়াচড়ার সাথে তারা জ্বলা আকাশ থেকে বর্ষণ শুরু হলো। আমার দিকে নির্ণিমেষ চেয়ে থাকা দু’টি নীল চোখ মুহুর্তে রঙ পালটে কালো হয়ে গেলো দেখলাম। সেখান থেকে বারিধারা টুপ টুপ করে পড়ছে। অবাক বিস্ময়ে আমি কম্পমান পারুর হাত থেকে এক টুকরো কাগজ নিলাম। গুটি গুটি অক্ষরের আমাকে লেখা পারুর শেষ চিঠিতে ছিলো,

– টেলিফোনে তোমার সাথে আমার বান্ধবী কথা বলেছে। আমিই তোমার আসল পারু। আমি কথা বলতে পারি না। আমার ৪ বছর বয়সে গলায় কী যেন হয়েছিল। সেই থেকে আমি বোবা হয়ে গেছি। আমায় ক্ষমা করো গো! আমি আবৃত্তি করে তোমায় শোনাতে পারলাম না!

ভালোবাসার মানুষটির পাশে আমি চুপচাপ স্থানুর মতো বসে রইলাম। সে ও নিশ্চুপ। ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে রাতের নিঃশব্দতাকে আরো নৈঃশব্দের গভীরে নিয়ে চলেছিলো জলের বয়ে চলার শব্দ। হৃদয়ে ভালোবাসায় মাখামাখি হয়ে বইছিলো পারু! আমার পারু! তীব্র ইলেট্রিক ব্লু আলোয় মাখামাখি হয়ে আছে বিশ্বচরাচর। সেই রাতের নীলচে আলোয় পারু এবং আমাকে, হৃদয়ের অধিপতি আমাদের ঈশ্বর – সস্নেহ ভালোবাসায় জড়িয়ে রেখেছিলেন দীর্ঘক্ষণ !!

#আবৃত্তি_মামুনের_ছোটগল্প

নীলমাছি

নীলমাছি

পায়ের কাছে জানলা খোলা। বাইরে ঝাঝা রোদ। গ্রীষ্ম দুপুরের তালুফাটা গরম। জানালার গ্রীলে তিন চড়ুই শলাপরামর্শ করছে। ধীর গতিতে পাখা ঘুরছে।

কাঁথা মুড়ে শুয়ে আছি। তিন দিন ধরে ভীষণ জ্বর। আবার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে। তৃষ্ণা পাচ্ছে, বরফ চিবিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে। জ্বর বাড়ছে আর বিছানাটা কেমন সবুজ মাঠ হয়ে যাচ্ছে। দূর্বা ঘাসের ঘ্রাণ, মাথার কাছে ফুটে আছে ঘাসফুল। ফড়িংয়ের ঝাক উড়ে গেলো- এলোমেলো। একটা চকচকে নীল ডুমো মাছি নাকের কাছে অনেকক্ষণ ভনভনালো। কোথায় উড়ে গিয়ে ফিরে এলো। কাঁথার উপরে বসলো-
: আবার জ্বর বাঁধিয়েছো?
: জ্বর কি ছবির ফ্রেম না পুকুরের ঘাট যে বাঁধাবো?
: হাহাহাহাহা… ভনভনানিতে রাগ করেছো?
উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না। কিছুক্ষণ নীরব থেকে মাছি কথা শুরু করলো-
: ভনভনিয়ে কি খুঁজছিলাম জানো?
: কি?
: পাকা ল্যাংড়া আমের রসের ঘ্রাণ।
প্রচন্ড বিরক্ত হলাম-
: আমি কি ল্যাংড়া আম?
: ধ্যাত, ল্যাংড়া আম হবে কেনো! সেই জ্বর জ্বর দুপুরের কথা মনে নেই!
: কোন দুপুরের কথা?
: সেই যে চারদিন আগে তোমার দাদিজান মারা গেছেন। উনার চেহলাম। দুপুরে কয়েকজনকে খাওয়ানো হবে। মা কুঁচো চিংড়ি দিয়ে করলাভাজী, পুঁইশাক দিয়ে বড় চিংড়ি, লাউ দিয়ে ইলিশ মাছ, আলু-বেগুন দিয়ে রুই মাছ রান্না করেছেন। রুইমাছের তরকারীতে জিরা ভেজে গুড়ো করে দিয়েছেন। সজনের ডাল থেকে ধোঁয়া উড়ছে। শোক আর ঘ্রাণে উথলে ওঠা দুপুর। নামাজ শেষে মিলাদ, তারপরে খাওয়ানোর পর্ব শুরু হবে। মনে আছে?
: হ্যা, মনে আছে। তুমি এসব জানো?
: জানবো না কেনো! আমিও যে ছিলাম।
: নীলমাছি, তুমিও ছিলে?
: হুম। সেদিন তোমার বেশ জ্বর। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে মা মাথায় পানি দিচ্ছেন। জ্বর কমছে বাড়ছে, এক্কেবারে ছেড়ে যাচ্ছে না। ঘরের এক কোনে শুয়ে আছো- গুটিশুটি ছোটো মানুষ।
: হুম, গায়ে লেপ। দাদিজানের কাফনের মত শাদা কভার। ন্যাপথলিনের কড়া গন্ধ।
: তোমার স্মৃতি খুব টনটনে। মেহমানদের জন্য ফল আনা হয়েছে- ল্যাংড়া আম, শক্ত কোষের কাঁঠাল আর তরমুজ। বাবা এক টুকুরো আম কেটে তোমার মুখে দিলেন। সেই আমের রস টুপ করে শাদা কাভারে পরলো।
: বাবা মারা গেছেন বাইশ বছর হয়ে এলো। সে কথা থাক, তোমার কথাই বলো-
: গরমে আর ক্ষিধের জ্বালায় অস্থির ছিলাম। চিন্তা না করেই লেপের কভারে পরা দু’তিন ফোঁটা রস খেতে শুরু করলাম। অবাক হয়ে খাওয়া দেখছিলে।
: খাবার দেখছিলাম না, তোমার নীল শরীরে আলোর ঝিলিমিলি দেখছিলাম।
: খাওয়া শেষে ভাবলাম একটু জিরোই। তুমি অসুস্থ বাচ্চা- আমায় কি আর ধরতে পারবে!
: হিসেবে ভুল করেছিলে-!
: হ্যা, ভুল করেছিলাম। হঠাৎ মুঠোর ভিতরে ধরে ফেললে। সে কি ভয়! জীবন হারানোর আশংকা! পায়ে সুতো বেধে আমৃত্যু উড়াবে- ভাবতেই বুক ফেঁটে কান্না এলো।
: আহারে! হাহাহাহাহাহাহা…
: হাসছো কেনো! তখন কি জানতাম যে কয়েক মুহূর্ত দেখে ছেড়ে দিবে!
: আজ সেসব কথা ভনভনাতে এসেছো?
: রূপকথার অভিশাপে অমরত্ব পেয়েছি। মরে যাই- আবার একজীবনের স্মৃতি নিয়ে জন্মাই। আজ দুপুরে সেই দুপুরের কথা মনে হতেই ছুটে এলাম।
: নীল মাছির আগমন, শুভেচ্ছায় স্বাগতম। তা কি দেখলে?
: তোমার মুখে এখনো আমের রসের ঘ্রাণ লেগে আছে।
: এখনো ঘ্রাণ লেগে আছে? কত বছর আগের কথা! সময় চলে গেছে কত!
: ধ্যাত! সময় যাবে কোথায়! সময় তার প্রতিটা বিন্দুতে স্থির।
: নীলমাছি, সময় কোথাও যায়না?
: না, যায়না। সময় প্রতি বিন্দুতে স্মৃতি সঞ্চিত করে রাখে।
: আর আমাদের যে বয়স বাড়ে? দিন ফুরোয়?
: বয়স বাড়বে না কেনো বলো! তোমাদের মানুষ হবার কত তাড়া। পায়ের তলায় সর্ষে। বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই, শুধু যাওয়া আর যাওয়া।
: সবাই তো যায়, কি যায় না?
: যেয়ে লাভ কি! সময়বিন্দুকে অতিক্রম করে যেতে যেতে একদিন একেবারে থেমে যাওয়া। থেমে যাবার আগে মনে হওয়া- এই ইঁদুর দৌড়, এই দিনযাপন অর্থহীন… সব অর্থহীন! শুনতে পাওয়া কে যেনো ডাকনাম ধরে ডেকে বলে “তোমার না মনসুখিয়া যাবার কথা ছিলো!”

কথা খুঁজে পাইনা। নীল মাছি বিজ্ঞের মত বলে-
: এসব কথা থাক। এত ঘনঘন তীব্র মাথাব্যাথা আর গাঢ় জ্বর আসার লক্ষণ মোটেও ভালো নয়। তুমি কি পুষছো?
: জ্বরের লক্ষণ বিচার পরে করো। ও নীল মাছি, মনসুখিয়ায় কবে যেতে পারবো! ছুঁতে পারবো অভ্রজোনাকের পাখা!

নীল মাছি কোনো উত্তর দেয় না। জ্বর বাড়ছে, তৃষ্ণা তীব্রতর হচ্ছে। ঘরের সিলিং কখন নীলাকাশ হয়ে গেছে। মেঘে মেঘে কত প্রিয়মুখ। সবুজ ঘাসে দাঁড়িয়ে আম কাটছেন বাবা। ধবেধবে শাদা পাঞ্জাবী হাওয়ায় উড়ছে যেন মনসুখিয়ার নিশান।

চান্দ

চান্দ

: বাপু, রাইতের বয়স বাড়িলে পাহাড়ের মাথায় চান্দ নামিয়া আসিতো। বুদ্দার বাপ গলায় মাহুয়া ঢালিয়া কাহিতো, “বুদ্দার মা, আমি চান্দের সুবাস পাই, আমি জোৎসনার ঘিরান পাই…”

: তারপর?

: বাপু, তিন দিন ভুখা। তার লগে কাজিয়া কারিলাম। সে গলায় মাহুয়া ঢালিয়া কাহিলো, “আজ রাইতে চান্দ নামিয়া আসিলে তাহাকে শিকার কারিবো। পেট ভরিয়া খাইবো।”

: তারপর?

: বাপু, চৈত মাসের রাইত। পেটে খিদা। আসমানে বিশাল চান্দ। তিন বছরের বুদ্দা খিদায় কান্দিতে কান্দিতে নিন্দ গেছে। সে বুদ্দাকে চুম্মা খায়া বাহির হ ইলো। সে শিকার করিয়া আনিলে আমরা পেট ভরিয়া চান্দ খাইবো।

: তারপর?

: বাপু, মানুষটা সে রাইতে পাহাড় চূড়ায় এক চান্দ শিকার কারিয়া সুখের ঘর বান্ধিয়াছে। সে ঘরে দুইটা বাচ্চা হইয়াছে।

: তারপর?

: বাপু, আর কি কাহিবো! পুন্নিমার জোৎসনায় পাহাড় ভাসিলে বুদ্দা অস্থির হোয়া উঠে আর কহে, “মা’গো জোৎসনায় আমি মাহুয়ার সুবাস পাই.. শরীরে খুন ঝিলিক দেয়!! আমি চান্দ শিকারীর লগে শিকার শিকার খেলিতে পাহাড় চূড়ায় যামু…”

: তারপর?

: বাপু, আমি সাতারো বছরের বুদ্দাকে চিনিতে পারিনা। আমার ডর লাগে। চান্দের আলোয় বুদ্দার হাতে চিকচিক করে জানোয়ার শিকারের শান দেয়া হাসুয়া…

.
________________________________
গল্পগ্রন্থ: লংকা কিন্তু জ্বলছে না/আবু সাঈদ আহমেদ।

চোর_এবং_নাকফুল_মামুনের_অণুগল্প

[একটা সময় ছিলো- শ্রেফ একটা ছবি দেখেই গল্প লিখতে পারতাম। শব্দের সাথে শব্দ আপনাতেই পাশাপাশি এসে নিজেদের জায়গা করে নিতো। এখন লেখালেখি চলছে কেবল সাংবাদিকতার প্রয়োজনে। গল্পরা হারিয়েছে একজন মফঃস্বল সাংবাদিকের প্রতিদিনের প্রতিবেদনের আড়ালে।

যাই হোক, পোষ্টের সাথের ছবিটি আমার একজন ফেসবুক বন্ধুর। এই ছবিটি দেখেই কয়েক বছর আগে ‘চোর এবং নাকফুল’ নামের অণুগল্পটি লিখেছিলাম। আবারও শেয়ার করছি… ]

_______________
অন্ধকারের ও কী নিজস্ব কোনো আলো থাকে? কেন জানতে চাইছি?
বলছি, একটু পরেই।

এক লোড শেডিং এর রাত। মফঃস্বল শহরের ছোট্ট একটা প্ল্যাটফর্ম। শেষ ট্রেন দাঁড়ানো। অল্প কিছু যাত্রী ওয়েটিং রুমে। এদের বেশীরভাগই বরযাত্রী। মশার আক্রমন থেকে নিজেদের বাঁচাতে ব্যস্ত সবাই। বিরক্ত, বিব্রত আর ঘরে ফেরায় উন্মুখ।

ওয়েটিং রুম ছাড়িয়ে কালো ধাতব বিবর্ণ বয়স্ক ট্রেনটির অবয়ব অন্ধকারেও কিভাবে যেন চোখে পড়ে। এজন্যই বলছিলাম অন্ধকারেরও বুঝি নিজস্ব কোনো আলো থাকে। ব্রডগেজ দু’সারি লাইনের ওপারে একটা প্রাচীন চাম্বল গাছ। ওটার পিছনে চোরের মতো লুকানো আমি। নির্নিমেষ চেয়ে আছি ওয়েটিং রুমের খোলা দরোজার দিকে।

এক প্রবাসী ভদ্রলোকের হাত ধরে যখন স্টেশনের মূল গেট দিয়ে সুস্মিতা হেঁটে আসলো, বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না – স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। এত দূর থেকেও দেখলাম ওর বিষণ্ন নাকফুল নির্নিমেষ চেয়ে আছে আমার পানে… দীর্ঘক্ষণ আমি জগত সংসারের সকল আলোআঁধারি ভেদ করে দেখতেই লাগলাম!

রাতের ট্রেনের দীর্ঘ হুইসেল বিষাদের সুরভি মেখে মেখে, বাতাসে ভেসে ভেসে আরও বিষণ্ণ করে তুলেছিলো সে রাতের কুহকী প্রহর! সেই থেকে বিষণ্নতার প্ল্যাটফর্মের একমাত্র স্টেশনমাস্টার এই আমি!

অনেক কিছুই করার ছিলো আমার। ছিলো অনেক কিছুই দেবার। ছিলো না কেবল কারও কাছ থেকে কিছুই চাওয়া-পাওয়ার অধিকার। কারণ ঐ যে আগেই বলেছি, চোরের মতো ছিলাম। লুকোনো স্বভাব নিয়ে এক জীবনে সেভাবে কখনোই সামনে আসতে পারলাম না আমি!

সেই থেকে এক চোরের অনুভবে-কল্পনায় একটি নাকফুল, নৈশব্দের প্রহর গোনা ভালোলাগায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে আজও বিষণ্নতায় ছুঁয়ে যাওয়া একটি রংগীন চাদর! যার বর্ণে বর্ণে লুকোনো এক বিচ্ছিন্ন অতীত.. যা ক্রমশঃ শীতের নরম রোদের মায়াবী কোমল আদর হয়ে অন্তর্চক্ষু বুজিয়ে দিয়ে যায়!

সেই থেকে শূন্যতায় ডুবে আছি আমি
যার বুক জুড়ে
শুধু তুমিই
শুধু তুমি!

‘পিরিতি আরতি পিরিতি সারথি, পিরিতি গলার মালা রে…।’

আহ হারে পিরিতি! বিষম পিরিতি

কতটা ভালোবাসি – বলাই হলো না তাকে।। :(

___________________________
#চোর_এবং_নাকফুল_মামুনের_অণুগল্প।

লেজ

লেজ

মন্তাজ মেম্বার জাদরেল লোক। আপদমস্তক জনসেবক। জনসেবার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন রাজনীতি। তার ইউনিয়নের মানুষদের কল্যাণ এবং উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনে যে কোন ব্যক্তিকে নিজের কোলে, কাঁধে বা মাথায় তুলতে পারেন। দুঃখে সুখে পাশে এসে দাঁড়াতে দ্বিধা করেননা। আবার উন্নয়ন আর কল্যাণের রাজনীতির জন্যই মানুষকে খুন করতে পারেন। ভিটি ছাড়া করতে পারেন। মন্তাজ মেম্বার এতটা জাদরেল যে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও তার কথার অবাধ্য হবার তাগদ রাখেন না। ইউনিয়নের সবাই জানেন এই মেম্বারকে সমীহ করে চলাতেই সকলের মঙ্গল।

দুলু মিয়া ৭০ বছরের বৃদ্ধ। মুখ ভর্তি সাদা দাড়ি। গায়ের বসন এলোমেলো। জিজ্ঞাসাময় দৃষ্টি। কিছুদিন হল মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। বৃদ্ধ দুলু মিয়াকে নিয়ে মন্তাজ মেম্বার বিশাল সমস্যায় জর্জরিত। এই বৃদ্ধ মন্তাজ মেম্বারের কষ্টার্জিত ইজ্জত হুমকীর মুখে ফেলে দিয়েছেন। কিন্তু বৃদ্ধকে তিনি খরচ করে ফেলতে পারছেন না। কারন বৃদ্ধ দুলু মিয়া হলেন মন্তাজ মেম্বারের পিতা।

দুলু মিয়া ধীর পায়ে হাটেন। একা একা সমগ্র ইউনিয়নে ঘুরে বেড়ান। খুব মন দিয়ে হারিয়ে যাওয়া ল্যাঞ্জা (লেজ) অনুসন্ধান করেন। তার শখের লেজটা হারিয়ে গেছে। এই লেজটাকে খুঁজে পেতে হবে। তিনি সারা দিন হারিয়ে যাওয়া লেজের বিরহে কাতর হয়ে থাকেন। মানুষ জনকে প্রশ্ন করেন, “আমার যে ল্যাঞ্জাটা (লেজটা) আছিল, হেইডা কেডা নিছে?” সবাই দুলু মিয়ার এই অনুসন্ধানে নির্দোষ আনন্দ পেলেও মন্তাজ মেম্বার বিব্রত হন। মাঝে মাঝে ভাবেন দড়ি দিয়ে পিতাকে বেঁধে রাখবেন। কিন্তু নিজের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হওয়ার ভয়ে সেই পথে যাননা।

ইউনিয়ন পরিষদের সভা চলছে। সরকারী কাজের ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সভা। স্থানীয় এমপি নিজে এসেছেন। মন্তাজ মেম্বার এমপির পাশ ঘেষে বসেছেন। ভাগ বাটোয়ারার জটিল আলোচনার মাঝে আচমকা দরজা খুলে ঘরে ঢুকলেন দুলু মিয়া। মন্তাজ মেম্বারের মানসিক ভারসাম্যহীন পিতা। মন্তাজ মেম্বার রাগান্বিত এবং সংকোচিত। কিন্তু মুখে স্মিত হাসি এনে বললেন, “আব্বা, আপনি বাসায় যান। আরাম কইরা ঘুমান। ”কিন্তু দুলু মিয়া স্থির। তিনি অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে সকলের চোখের দিকে তাকালেন। তারপর সরাসরি এমপির চোখে রোখ রেখে বললেন, “আমার ল্যাঞ্জাটা কে য্যান চুরি কইরা লয়া গেছে। আমার ল্যাঞ্জাটা পাইতাছি না।”

এমপি: আপনার ল্যাঞ্জা ছিলো না কি?

দুলু মিয়া: আছিল’তো। কুত্তার মতন একটা ল্যাঞ্জা আছিল।

এমপি: চাচা! মানুষের ল্যাঞ্জা থাকেনা। আপনারও ছিলোনা।

দুলু মিয়া: আমার আছিল’তো। কুত্তার মতন একটা ল্যাঞ্জা আছিল।

এমপি: কিভাবে জানলেন যে আপনার ল্যাঞ্জা আছিল?

দুলু মিয়া : ল্যাঞ্জা না থাকলে মন্তাজের মতন কুত্তার বাচ্চারে পয়দা করলাম কেমনে!! তোমার বাবারে জিগাও। তারও একটা ল্যাঞ্জা আছিল।”

এমপি নির্বাক। মন্তাজ মেম্বার মাটির দিকে তাকিয়ে আছেন। সভায় উপস্থিত সকলের চোখের সামনে পিতাদের মুখচ্ছবি ভেসে উঠছে। সত্যিই কি পিতাদের একটা করে ল্যাঞ্জা ছিল!! কুকুরের মত ল্যাঞ্জা!!

#গ্রন্থ: লংকা কিন্তু জ্বলছে না
#লেখক: আবু সাঈদ আহমেদ।

সাক্ষাৎ – ২য় ও শেষ পর্ব

প্রথম পর্ব এখানে

রেস্টুরেন্ট থেকে যখন বের হয়েছি, বাইরে তখন বেশ কম গাড়িঘোড়া। কেবল সন্ধ্যা হয়ে এসেছে বলেই হয়ত সবাই যার যার মত ঘরে ছুটে গেছে, আর যার ঘর নেই সে গেছে অপরের কাছে৷
আমার আর অমিত কারও কোনো তাড়া ছিল না। তুলনামূলক কম গাড়ি, কম ট্রাফিক দেখে বেশ ভালোই লাগছিল। যেন গল্পের মত পরিবেশ। উইকেন্ড বলেই হয়ত ফাঁকা ফাঁকা।

হাঁটছি পাশাপাশি৷ পাশাপাশি হাটার কারণে অমিতকে ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না, ইচ্ছে করেই দু’পা পিছিয়ে গেলাম। উদ্দেশ্য ও’কে দেখে নেয়া। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা নয়, যতদূর দেখলে পরবর্তীতে ও’কে মনে রাখতে সুবিধে হয় ততটা।
অমিত একটা কালোমতো জামা পরেছে, সাথে হালকা জিন্সের প্যান্ট। পায়ে কেজ্যুয়াল জুতো৷ জামা জুতো সবকিছুই একেকটা একেক রঙের। ভেবেচিন্তে পরেছে বলে মনে হয় না। ভেবেছিলাম পাঞ্জাবী পরবে অন্তত! এতটুকু রোমান্টিসিজম সে দেখাতেই পারতো।

যেসব ছেলেদের বাড়ি পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তান তারা তো সারাদিনই পাঞ্জাবী পরে থাকে। সেসব স্থানের নারীদের কাছে তাদের পুরুষগণ কি সবসময়েই রোমান্টিক? নয় নিশ্চয়! এসব ভাবতেই মনে হল পাঞ্জাবি না পরে আসাটা বোধহয় তাহলে তেমন কোন অপরাধ না, এবারের মত মাফ করে দেয়া হলো। কিন্তু আমি তো শাড়ি পরেছি, সেটাই হয়েছে অস্বস্তি।

রেস্টুরেন্টে খাবারের মেন্যুটা প্রথমে অমিত আমার দিকে এগিয়ে দিয়েছে। তারপর নিজে অর্ডার করেছে। সি ফুড আমার পছন্দ। ডেজার্টের মধ্যে কাস্টার্ড। এ-দুটোই দিলাম। অমিত শুধুমাত্র একটা কফি। আর যেচে আমার জন্যও একটা কফি দিল, তাও আবার অনুমতি নিয়ে তবে৷ সবচেয়ে বড় কাণ্ডটি করেছে বিল দেয়ার সময়। আমার হাতটা টেবিলের উপরেই ছিল, ওয়েটার এসে বিল বুকটা রেখে যাওয়া মাত্রই ও’র বাম হাতে আমার ডান হাতটা ঈষৎ চেপে ধরে বললে,

• এলাউ মি প্লিজ!

বলেই এমনভাবে তাকালো যেন চোখ দিয়ে কিছু একটা চাইছে, করুন আকুতি সে চাহনিতে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি কিছু মুহূর্তের জন্য নির্বাক হয়ে-গিয়েছিলাম। অমিত হাত ধরবে সেটা যেন জানাই ছিল, কিন্তু ভাবতেই পারিনি এভাবে বিল দেবার বাহানায় হাত চেপে ধরবে।
যখন হাতটা ছেড়ে দিলো, মৃদু একটা চাপ দিয়ে কী বুঝাতে চাইলো? ‘আমি আছি, নির্ভরতা!? কী জানি এমনও হতে পারে বেচারা কিছু না বুঝেই হাত ধরে ফেলেছে। আমিই হয়ত ছয় লাইন বেশি ভেবে ফেলছি।

ফুটপাত ধরে হাঁটছি, সামনের পা’দুটো অমিতের, পেছনের দু’টো আমার। কিছু কথাবার্তা হচ্ছে।
এই যেমন,

• আজকের আবহাওয়া বেশ গরম।
• বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নেই মনে হয়।
• সাবধানে হাঁটুন, দেখে।
• রাস্তা পার হই?

রাস্তা ক্রস করলাম ফুট ওভারব্রিজ দিয়ে। ওভারব্রিজে লাইটগুলো টিমটিমে৷ মৃদু আলোতে ইচ্ছে করছিলো ব্রিজের উপরে দাড়িয়ে থাকি৷ মৃদু বাতাস আসিছিলো উত্তর থেকে। খুবই মিহি বাতাস। এই ধরনের বাতাস’কে ইংরেজরা খুব কদর করে। আদর করে ওরা নাম দিয়েছে ‘জেন্টেল ব্রিজ’।
কিন্তু আমার যে এই স্টিলের ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে খুব জেন্টেল ব্রিজ খেতে ইচ্ছে করছিলো সেকথা সাথে থাকা জেন্টলম্যানকে কিকরে বুঝাই!
হঠাতই খেয়াল করলাম হাটার সময় আমি যে ইচ্ছে করেই দুইপা পিছিয়ে গিয়েছিলাম সেটা কেমন করে যেন এক লেভেলে এসে গেছে৷ রাস্তা পার হয়ে রিক্সা নিলাম। নিলাম বলতে আমিই নিলাম। অমিতকে দিয়ে কিছু হবে না। সে হয়ত সারা রাত আমাকে রাস্তায় হাঁটিয়েই রাখবে।

অমিতকে আমি কিভাবে কি মূল্যায়ন করব বুঝতে পারছি না। রিক্সা ডাকা মাত্রই সে এমনভাবে হাসি দিল যেন সেও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। যেন সেও আর হাঁটতে চাইছিল না। তাহলে বাবা রিক্সা ডাকলে না কেন! এই গাধা-গিরির কোনো মানে হয়?

যখন রিক্সায় উঠতে যাব, সে গিয়ে ঘুরে হাত ধরে সাহায্য করলো৷ শাড়ি পরে যে রিক্সায় ওঠা একটু ঝামেলার অমিত কী করে জানে সে কথা!

রিক্সা চলছে কোনদিকে কেউ জানি না। অমিতকে মনে হলো বেশ চিন্তিত,
কিছু সমস্যা? জিজ্ঞেস করতেই উত্তর দিল,

• রাস্তাটা বেশ এবড়োখেবড়ো – শক্ত করে ধ’রে রাখবেন।

আচ্ছা! এই চিন্তা তাহলে? অমিত কি আমাকে খুকি ভাবে? রিক্সা থেকে পড়ে যাব? নিজেকে এতটা স্মার্ট ভাববার কি আছে!
পরক্ষণেই একটা স্পিড ব্রেকারের সাথে একটু জোরেই ধাক্কা খেল রিক্সা, পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিয়ে ফিরে দেখি অমিত অতি ইতস্ততভাবে আমার হাত ধরে আছে।
মনে মনে হেসে নিলাম। একটু গুছিয়ে বসে এবার অমিতের দিকে তাকালাম। এবার নিজেই অমিতের হাতটা টেনে ওর আঙ্গুলগুলোর সাথে আমার আঙুল গুলো জড়িয়ে বললাম,

• দেখবেন, যেন আবার পড়ে না যাই।

রিক্সা এগিয়ে চললো।

অমিতের সাথে রিক্সায় চেপে ঘুরে বেড়াচ্ছি আমার চেনাজানা শহরে। এই রাস্তা, এই বাতিগুলো সবই আমার চেনা। তবুও যেন মনে হচ্ছে সবকিছু অচেনা। যেন অচেনা পথে সামনের মোড়টা পার হয়ে কী আসবে দোকান না সিনেমা হল সেটা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে এগুচ্ছি।
রিক্সায় আর কারও কোনো কথা হলো না। যেন কথা হচ্ছে সব মনে মনে ইথারে ইথারে। পাশাপাশি হাত ধরে বসে এভাবে চুপচাপ থাকাকে কি বলব? মৌন দ্যোতনা? নাকি গভীরতা? নাকি যাতনা!
রিক্সা এসে থামল ঈদগা মাঠের কোনায়। রোজা প্রায় শেষ হয়ে আসছে। লাইট জ্বালিয়ে ঈদগা তৈরির প্রস্তুতি চলছে। রিক্সা থেকে নেমে অমিত নীরবতা ভাঙল।
বলল,
• আপনার কি ঘরে ফেরার তাড়া আছে?
সন্ধ্যা অনেক আগেই শেষ হয়েছে। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অমিত’ই বলল,
• ন’টা কুড়ি৷

ঘরে ফেরার তাড়া যে নেই তা নয়। দেরী করে ফিরলেও সমস্যা কিছু হবে না। দুইটা বড় বড় অজুহাত প্রস্তুত করাই আছে।
তবুও পালটা প্রশ্ন করলাম,

• তাড়া থাকলে কী করবেন?

সময় ও আবেগের গ্রাভিটি কাটিয়ে উঠে অমিত কোনো উত্তর দিতে পারলো না। একটু দূরত্বে দাঁড়িয়েছিলাম, এবার অমিত দুইপা সামনে এগিয়ে আসলো। আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
অমিত আমার দিকে তাকিয়ে রইলো, কী বলতে চাইছে সে? আমি কি সত্যিই জানি না কী বলার থাকতে পারে অমিতের! তবুও কেন ইচ্ছে হচ্ছে নিজের মুখের বলুক সে। নিজেকে সে প্রকাশ করুক।

মুহূর্তের পর মুহূর্ত অমিত নিবিড়ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। দাঁড়িয়ে রইলাম আমিও। ভালোবাসা শব্দটিকে আজকাল এত তাচ্ছিল্য-ভরে দেখা হয়, যেন এর থেকে হাস্যকর শব্দ বাংলা ভাষায় আর নেই। অমিত সেই হাসির পাত্র হতে চাইলো না কেন? সে কেন বলল না, ‘ভালোবাসি’।

অমিত এবং আমার দুজনেরই মূলত একই সমস্যা, দুজনেই ভাবছি আমরা অন্যদের থেকে আলাদা, একটু মৌলিকত্ব আছে দুজনের মধ্যেই। কথাটা একেবারেও মিথ্যে নয়। তাই বলে সর্বসাধারণের সাথে মিশে যাওয়া যাবে না এমন কোনো বৈরিতাও তো নেই আমাদের অন্যদের সাথে।
মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম, অমিত যদি ভালোবাসার কথা জানায় জিজ্ঞেস করবো, কেন ভালোবাসে?

আজ পর্যন্ত এই প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারে নাই। কেউ কেউ বলে মানুষ অন্যকে ভালোবাসে নিজেকে ভালোবাসে বলে, কেউ বলে নিজে ভালো থাকবে বলে অন্যকে ভালোবাসে। কেউ বলে একজন অন্যকে ছাড়া সম্পূর্ণ নয়, তাই ভালোবাসা। সত্যি বলতে আমিও জানি না এর সঠিক জবাব কী হতে পারে?
সত্যিই, কেন একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে ভালোবাসে। মানুষ কি সত্যিই পারে ভালোবাসোতে? সেটা কী আবেগ নয়? মোহ নয়—নেশা নয়?
যদি ধরেও নেই একজন মানুষ সত্যি সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছে আরেকজনকে, তাহলেও বা কে দেবে এই জবাব, কেন সে বেসেছে ভালো!
অনেকক্ষণ হয়ে গেলেও অমিত কিছু বলছে না দেখে আমিই বলে ফেললাম,

– অমিত, কেন আমাকে ভালোবাসো?

অমিতের চোখমুখ দেখে মনে হলো না যে সে এই প্রশ্ন শুনে বিস্মিত হয়েছে। এত কনফিডেন্স মানুষ কোথায় থেকে পায়? উলটো কি আমিই অবাক হচ্ছি, বিস্মিত হচ্ছি অমিতের এই নির্লিপ্ত ভাব দেখে! অথচ আমার তো কোনোকিছুতেই বিস্মিত হবার কথা ছিল না। আজ সেভাবেই মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করে বের হয়েছি।

অমিত এই প্রশ্নের যে উত্তর দিলো যার বিষয়বস্তু এই যে,
ভালোবাসাকে একটা বইএর সাথে সাথে তুলনা করলে মনে হয় একটু স্পষ্ট হয়। একটা বই যখন পড়া শেষ হয়, এবং যখন মনে হয় লেখক আমার কথাগুলোই বলেছেন, তিনি আমার হয়েই লিখেছেন- তার পুরো বইটা পড়তে পড়তে যখন একই ধরনের চিন্তা হতে থাকে তখন সে’ই বইটিকে ভালোবেসে ফেলা যায়। লেখক’কেও ভালোবেসে ফেলা যায় তবে সেটা অতটা প্রকট নয়।
এই যে বইএর মধ্যে আমি আমাকে খুঁজে পেলাম, এই আমি’টা খুঁজে পাওয়াকেই আমার কাছে মনে হয় ভালোবাসা। কেউ যদি কারও মধ্যে নিজেকে খুঁজে পায় সেটাই ভালোবাসা।
কথাটা ঠিক কিছুটা, একজন অন্যকে ছাড়া সম্পূর্ণ নয়; এমনটা মনে হলেও কিছুটা যেন আলাদা, কোথায় যেন একটু বৈচিত্রতা আছে। যাক! একটা অন্যরকম উত্তর তো পাওয়া গেল অমিতের থেকে। এই বা কম কিসে!

রাত বেড়ে যাচ্ছে, আমাকে সত্যিই এবার ঘরে ফিরতে হবে। অমিতকেও ফিরতে হবে অনেক দূরে। আমার সাথে ঘুরতে ঘুরতে বেচারা অনেক দূরে চলে এসেছে। বিদায় কীভাবে নেব এসব চিন্তা করতে করতেই হঠাত অমিত বলল,

– ফ্লোরা, একটা জায়গায় যাবেন !

পুরোটা দিন শেষে এই প্রথম অমিত আমার নাম ধরে ডাকল, ওর মুখে নিজের নাম শুনে একটা হার্ট-বিট যেন মিস হয়ে গেল। নিজেকে সামলে বললাম,
– কোথায়?

আমার দিকে তাকিয়ে অমিত এমনভাবে হাসল যেন, নিশ্চিত না হয়ে যাওয়া যাবে না কোথাও! আগে থেকেই ঠিকানা যেনে নিতে হবে; কে বলবে এ ছেলে ছেলেধরা নয়!

অমিতের এমন হাসি দেখে, আমিও হেসে দিলাম। ভুলে গেলাম বাড়ি ফেরার কথা। অমিতের সাথে যেতে থাকলাম কিছুটা দূরে, আরও কিছুটা দূরে— তখনো জানি না কোন জায়গায় যাচ্ছি আমি, কোথায় আমাকে নিয়ে যাচ্ছে অমিত!

মায়া মরীচিকা

কাটা কাটা চেহারার মেয়েটাকে দেখেই আমার মন খারাপ হলো। এত সুন্দর হয় মানুষ ?
মেয়েটার পা মোমের মতন – সাদা পাথর দেয়া একটা সেন্ডেল পড়েছে যেটা তার পায়ের রঙ এর সাথে মিলে গিয়ে একধরণের আলো ছড়িয়ে দিয়েছে –
আমি মন খারাপ করে মেয়েটার পিছু পিছু কিছুক্ষণ ঘুরলাম – আসলে এই শপিং মলে আসার যোগ্যতাও আমার নেই – আমার পকেট শুন্য প্রায় –
তবু এই গরমে ঢুকে গিয়েছি একটু এসির বাতাসে ভালো লাগবে বলে –
মেয়েটা আড়চোখে আমাকে দেখে একটু হাসি দিলো কি ?
আমি জানি সে আমার জন্য নয় –
সরে গিয়ে একটা র‌্যাকে সারি সারি বিদেশী পারফিউম দেখছি –
ছুঁয়ে দেখার ও সাহস নেই আমার –
কি লাগবে স্যার ?
কোনটা দেব ?
না না দেখছি ” ভাবছি কোনটা নেব ? বললাম খুব স্মার্ট কেতাদুরস্ত ছেলেটাকে –
মলের নিজস্ব ড্রেস আছে – ড্রেস পড়া ছেলেটা এখানের চাকুরে হবে –
লম্বা সুন্দর ছেলেটাকে নিশ্চয় নায়ক হলে বেশ লাগবে –
ভাবলাম –
দেয়ালে আয়নায় চোখ পড়লো আমার –
নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে বেশ লাগে – লালচে চুল খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা নিজেকে খুব ইন্টেলেকচুয়াল মনে হয় – আসলে কি তাই??
আচ্ছা এই শপিং মলে আমার একটা চাকুরী হলে তো বেশ হয় –
সেটা ভাবনা পর্যন্তই থাকে —
ইতস্তত করে বের হয়ে আসলাম –
সুন্দরী মেয়েটাও আমার পেছনে –
এক ঝলক আলো তার চোখে —
একটা অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ — ম ম –
আমি আচ্ছন্ন —
হুস করে একটা গাড়ি এসে থামলো মেয়েটার সামনে —
একজন প্রৌঢ় নেমে এসে মেয়েটার কোমড়ে হাত দিল –
মেয়েটার আনত মুখে একটু আরক্তিম ছায়া –
আমার দিকে ফের চোখ তুলে তাকালো –
আমি তেমনি দাঁড়িয়ে –
মেয়েটার পায়ে নুপুর হলে আরো বেশ লাগতো –
ভাবছিলাম –
গাড়িটা ধুলো উড়িয়ে হাওয়া হয়ে গেলো চোখের সামনে থেকে –
আমার চোখে দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর ——-

কিছু_বলে_গেলে_না_মামুনের_অণুগল্প

এক পাতা ঝরার দিনে, ধরা হাত শিথিল হয়ে দু’জনের পথ দুটি দিকে বেঁকে যেতেই, প্রশান্ত মহাসাগরীয় হাবুডুবু খাওয়া আর থেকে থেকে অনুভবে তীব্র সাইনাস পেইনে জর্জরিত হওয়ার শুরুটা সেদিন থেকেই।

কাছের সম্পর্কগুলোর মুখোশের আড়ালের চেহারা বড্ড তীব্র ভাবে উৎকট দুর্গন্ধ ছড়িয়ে প্রকট হতে দেখে বিমর্ষ হয়েছিল তখন শিহাব।

তবে সব কিছু ছাপিয়ে একটা ভাবনায়ই অণুক্ষণ ডুবে থেকে ভাবে সে এখনো, ‘পারু এটা একটা কাজ করলো! কিছু বলে গেল না, দু:খগুলোও জেনে গেল না!’

সেই থেকে পারুর শহর অভিমুখী হৃদয়কে উন্মুক্ত ছেড়ে দিয়ে নিজের শহরের স্টেশন মাস্টার, একজন হৃদয়হীন শিহাব অপেক্ষায় থাকে, পারুর হৃদয়ের খবর নিয়ে নিজহৃদয় ফিরে এসে আবার তাকে হৃদয়বান বানাবে! অপেক্ষার প্রহরগুলিতে হৃদয়হীনের শুণ্য গহবরে অনন্ত নীল জোছনা বিরাজ করে!

‘পারু কিছু একটা বলে গেল না, ওরা এমন কেন?’ এক বিষন্ন মাঝরাত শুণ্য এক গহবরে নির্জনতার কুহকী প্রহর বুকে নিয়ে নীল জোছনায় পাক খেতে থাকে..।

“অতন্দ্রিলা,
ঘুমোওনি জানি
তাই চুপি চুপি গাঢ় রাত্রে শুয়ে
বলি, শোনো,
সৌরতারা-ছাওয়া এই বিছানায়
—সূক্ষ্মজাল রাত্রির মশারি—
কত দীর্ঘ দুজনার গেলো সারাদিন,
আলাদা নিশ্বাসে—
এতক্ষণে ছায়া-ছায়া পাশে ছুঁই
কী আশ্চর্য দু-জনে দু-জনা—
অতন্দ্রিলা,
হঠাৎ কখন শুভ্র বিছানায় পড়ে জ্যোৎস্না,
দেখি তুমি নেই “। *

_______________________________
* কবিতাঃ রাত্রি, কবিঃ অমিয় চক্রবর্তী
#কিছু_বলে_গেলে_না_মামুনের_অণুগল্প_৫৪২

সাক্ষাৎ – ১

সোজাসুজিই বলি, একজন মানুষকে ভালবাসতাম। খুব বেশী ভালো বাসতাম। কীভাবে বললে বুঝবেন খুব, খুব এর গভীরতা কীভাবে বুঝাই? সবাই বলে প্রেমিকার চোখে গভীরতা থাকে, আমি নিজেকে আয়নায় দেখেছি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, আমার চোখে কোনো গভীরতা নাই। চোখের পাপড়ি এলোমেলো, চোখ দেখলে কেউ প্রেমে পড়ত না।

তাহলে কীভাবে বুঝাই গভীরতা? এতটাই গভীর ছিল সে অনুভূতিগুলো যে আমি কখনোই তাকে ছুঁতে পারতাম না, যত ভাবতাম এই বুঝি ধরে ফেলেছি তার শব্দ, আওয়াজ- ঠিক তক্ষুনি সে চলে গেছে আরও আরও গভীরে, যেন একটা নোঙ্গর শিকল ছিঁড়ে ডুবে যাচ্ছে সমুদ্রে।
যখন প্রথম অমিতের চোখের দিকে তাকাই, কিছুক্ষণ তাকিয়েই ছিলাম। ওর ভালোবাসা যতটা গভীর ছিল, চোখ ততটাই সমতল ছিল। যেন গভীর থেকে উঠে আসা ঢেউ এসে এখানেই মিলিয়ে যাচ্ছে, এই বেলাভূমিতে।

চোখ সম্পর্কে অমিত বলতো, ‘মানুষের চোখের গভীরতা এমন হতে পারে যে, সেখানে এসে নোঙ্গর করতে পারে এথেন্স-গামী বাণিজ্য জাহাজ।’

অমিতের চোখ অতটা গভীর নয়, তবুও তাকিয়েছিলাম অমিতের ভাসা ভাসা চোখের দিকে, ওর চোখের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও মুগ্ধকর বিষয় ছিল ওর চোখে যেন সবসময়য় এক ফোটা জল এসে চিকচিক করত। যেন সূর্যের আলো এসে এইমাত্র পবিত্রতায় ভরিয়ে দিয়ে গেল দুটি চোখ, এখন যা দেখবে সবই মনে হবে শুদ্ধ, সবই মনে হবে পবিত্র। পরে জেনেছিলাম, ওটা ওর চোখের অসুখ। ওর চোখ দিয়ে প্রায়ই জল পড়ত। কি জানি ওর ঐ অসুখটাই আমার কাছে সুখের কারণ হতে লাগলো।

ছেলেদের সাধারণত বেশী ফর্সা হতে নেই, বেশী ফর্সা হলে কেমন একটা গাধা টাইপের মনে হয়। অমিত ছিল এই গাধা লেভেল ফর্সার থেকে একটু উপরে। ওকে দেখে ঠিক গাধা টাইপ ফর্সা মনে হয়ত না। তবে কখনো ভাবিনি কোনো ফর্সা ছেলের সাথে প্রেম করবো। এমনিতে আমি নিজেই ফর্সা, তাই সবসময়েই একটু কালো ছেলেদের প্রতি আকর্ষণ ছিল। কিন্তু ওর চোখদুটো দেখে দেখতেই থাকলাম! অমিতের সব রহস্য যেন সব ওর চোখে। চোখের নিচ দিকটায় কালো কালো দাগ, ডার্ক সাইকেল। কতদিন ঘুমায়-নি এই মানুষটা? এত রাত সে কেন জাগে? তার কি অনেক দুঃখ? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতাম ওর চোখে।

সত্যি বলতে ভালোবাসা, প্রেম এই শব্দগুলোর সাথে আমার কখনোই কোনো বিরোধ ছিল না। আমার কাছে ভালোবাসা মানে খারাপ কিছু না। যখন যে আমাকে ভালবেসেছে আমিও তখন চেষ্টা করেছি তাকে তার প্রাপ্যটুকু বুঝিয়ে দিতে। ভালোবাসা একটা অদ্ভুত মাদকতা, অনেক প্রশ্নের উত্তর দেয় আপনা আপনিই।
এমন কোনো মহৎ ভালোবাসার অপেক্ষায় কখনো থাকিনি যা এসে আমাকে কানায় কানায় পূর্ণ করে দিয়ে যাবে। মনে হত, জীবনে বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য খেতে হয় ভালোবাসাও তেমন পেতে হয়, দিতে হয়। কখনো কখনো দুঃখ পেতে হয়, আবার দুঃখ দিতেও হয়। হৃদয়ের এই দাবীকে কখনোই অস্বীকার করতে পারিনি।

অমিতের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল একটা খোলা রাস্তায়। এমন না যে সে’ই আমাদের প্রথম পরিচয়। পরিচয় হয়েছিল অনেক আগেই। আমাদের কথা হত টেলিফোনে, চিঠিতে ভাবের আদান প্রদান হয়ত। অমিত বলত, ‘ওর কোনো ভাব নেই, আছে কেবল অভাব।’ অমিতের সবগুলো কথাকে আমি নোট করতাম, যেগুলো মনে হয়ত টুকে রাখা দরকার, টুকে রাখতাম। জন্মদিন, বিশেষ বিশেষ দিন তারিখ, বিশেষ বিশেষ মুহূর্ত সবকিছুই টুকে রাখতাম।

রাস্তা থেকে আমরা চলে গেলাম পাশেই একটা রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্ট সম্পর্কে অমিতের ধারণা তেমন ছিল না। আমারও তেমন ভালো জানাশোনা কোনো রেস্তোরা ছিল না। তাই অমিত যেখানে নিয়ে যায় সেখানেই যাব বলে স্থির করলাম। অমিত যা যা অর্ডার করবে সেগুলোই তৃপ্তি নিয়ে খাব, আমি আজ শুধু অমিতের কথা শুনব; মোটামুটি কোনো অতিরিক্ত আশা রাখব না, কোনো প্রত্যাশা রাখব না- বাসা থেকে বের হবার সময় এমনভাবেই নিজেকেই মাইন্ড সেটআপ করে বের হয়েছি।

যদিও কথাবার্তায়, চিঠিতে খুব ভদ্র ও মার্জিত, তবুও হয়ত মানুষ চিঠিতে এক রকম আর বাস্তবিক আরেক রকম। অমিত’কে তাই বেশী মানবীয় ভাবতে ইচ্ছে করছে না। অমিত’কে ভাবছি নিজের জানাশোনা মানুষদের দিয়েই। তাদের দিয়েই অমিতের মানসিকতা মাপছি। অথচ চেয়েছিলাম কোনো মাপজোক করব না, একদম বিচারবুদ্ধি সব বাসায় রেখে বের হব। কিন্তু পারছি কই?

রেস্টুরেন্টে যখন পৌঁছলাম, সন্ধ্যা প্রায় হবে হবে। অমিতের কাছে শুনেছি সন্ধ্যা সময়টা বেশ পবিত্র। রেস্টুরেন্টের সামনে গিয়ে সে কাচের দরজার হাতল ধরে দরজা খুলে, আমাকে সম্ভাষণের মত করে হাত বাড়িয়ে কুর্নিশ করে আগে যেতে বইলো। আমি ভেতরে যাওয়া মাত্র একটা টেবিল বেছে নিয়ে টেবিলের থেকে চেয়ারটা টেনে আমাকে বসতে বললো। তারপর আমার থেকে সামনে গিয়ে চেয়ারের হাতল ধরে আমার দিকে তাকিয়ে বেশ নম্র স্বরে জানতে চাইলো,
– মে আই হ্যাভ এ সিট?
আমি এই অদ্ভুত আতিথেয়তার কি উত্তর দেব ভেবে পাচ্ছিলাম না, ফিক করে হেসে দিলাম।

(চলবে )

অণুগল্প : অনেক অনেক দূরের তবু যেন আপন

ইন্দু মেয়ের রুমে ঢুকে দেখে -রাহিন ফোন কানে নিয়ে বেসুরে গাইছে, “চূড়া লিয়া টু নে দিল কো”। পরীক্ষা চলছে। দুইদিন বাদে আর একটা পরীক্ষা যে মেয়ের, সে মেয়ে নিশ্চিন্তে ফোন কানে পেতে গান গাইছে। ইন্দুর রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে, বহু কষ্টে রাগ সামলে ইন্দু মেয়েকে বললো, কার সাথে কথা বলিস এত রাতে ? রাহিন গানের সুরে মা কে বলে, গান শুনি মা। তুমি শুনবে ?
ইন্দু ছেন ছেন করতে করতে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়।

আজ ইন্দুর মেজাজ কিন্তু সপ্তমে। রাহিন পড়া শেষ করে সেহরির সময় সবাইকে জাগিয়ে দিয়ে তারপর ঘুমোতে যাওয়ার কথা। ঘটনা ঘটেছে ভিন্ন। রাহিন পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছে, বাড়ির কেউ আজ সেহরি করেনি। বাকিদের খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না, ইন্দু সেহরির সময় প্রতিদিন প্রেশারের ওষুধ খায়। আজ সে সুযোগ হয়নি। সকাল থেকে তাই আজ রাহিনদের বাড়িতে হট্টগোল; ইন্দু একটু একটু পর অস্থির বোধ করছে। ইন্দু জানে প্রেশারের ঔষধ না খেলে তার প্রেসারে বেড়ে যায়। আজ বাড়ছে না। কেন প্রেসার বাড়ছে না তাই নিয়ে অস্থির ইন্দু। মাথায় এক গাদা তেল দিয়ে ফেনের নিচে বসে আছে।

ওপাশের রুম থেকে, ইন্দুর স্বামী, টিটকারির সুরে বলছে, ওগো তোমার শরীর তো বেজায় খারাপ, চলো তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। হাসপাতাল নিয়ে এই বাড়িতে প্রায় মজার মজার ঘটনা ঘটে। ইন্দু যখনি সবার মনোযোগ চায়, তখনি তার প্রেশার উঠে। একা একা হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হয়ে যায়। হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স সবাই বোঝানোর চেষ্টা করে … আপা আপনার কিছুই হয়নি, বাড়ি যান। ইন্দু হাল ছাড়ে না। যদি প্রেসার বেড়ে যায় তাহলে এক রাত থেকে যাবে। এই চলছে, মমতাময়ী ইন্দুর জীবনে।

রাহিন মোটেও গান শুনছে না। রাত যতো বাড়ে রাহিনদের আড্ডা ততো জমে উঠে। রাহিন এতক্ষণ গ্রুপ কলে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলো। মা রুমে ঢুকলেই, সে আনমনে গান গায়, ফোনের বন্ধুরা বুঝে গেছে, রাহিন গান ধরলে বুঝতে হবে মা রুমে আছে। ওপাশ থেকে সবাই চুপ করে যায়। রাহিনের নতুন বন্ধু ভীষণ দুষ্ট, সে মাঝে মাঝে ফিশফিশিয়ে বলে, দে ফোনটা তোর মাকে, আজ নাহয় তার সাথেও আড্ডা হবে। অপর বন্ধু বলে, আন্টি কিন্তু আজকে বেশি জ্বালাচ্ছে !! রাহিন কোনো কথার উত্তর দেয় নেয়া। একটু পর পর গেয়ে উঠে, রাহিনের গলার স্বর দারুণ মিষ্টি। মাঝে মাঝে বন্ধুরা চুপ করে রাহিনের গান শুনে।

কেউ কখনো খুব একটা প্রশংসা করে না, বন্ধুরা জানে, রাহিন এসবের ধার ধারে না। বিন্দাস নিজের মর্জি মতো চলে। রাহিনের মনটা ভীষণ ভালো তাই বন্ধুরা তাকে ভীষণ ভালোবাসে। রাহিনও বন্ধুদের জান প্রাণ। ভেতরে ভেতরে দারুণ চঞ্চল সে, উপর থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। তারা তিন বন্ধু মিলে দারুণ একটা স্বপ্ন দেখছে। স্বপ্নে বিভোর তিন বয়সের তিন বন্ধু মনে মনে চাঁদের কপালে টিপ্ পরিয়ে দিয়ে আসে। মাঝে মাঝে রাহিন বন্ধু আয়নার সাথে চুটিয়ে ঝগড়া করে। একটু পর সব ঠিকঠাক। দেখলে মনে হবে একই মায়ের দুই কন্যা।

ইন্দুর বর্তমান স্বামী কিন্তু রাহিনের নিজের বাবা নয়। বন্ধুরা ব্যাপারটা এখনো জানেনা। প্রয়োজন পড়েনি তাই রাহিনের বলা হয়ে উঠেনি। তার বর্তমান বাবা তার ভীষণ রকম প্রিয় মানুষ। তাদের সম্পর্ক অনেকটাই বন্ধুর মতো। তবুও আজ পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় রাহিনের খুব ইচ্ছে করছিলো, আজ যদি তার নিজের বাবা কাছে থাকতো, নিশ্চয়ই তার সাথে যেত। সারা রাস্তা বাবার সাথে গুটুর গুটুর গল্প করতো। বাবার ঘাড়ে মাথা রেখে আহ্লাদে গদ গদ হয়ে বলতো, বাবা তুমি আমার নীল আকাশের নীল ফানুস।

ঠিক পরীক্ষার আগের দিন অথবা পরীক্ষার দিন রাহিনের বুকের ভেতরটা এলোমেলো হয়ে যায়। রাহিন কাউকে কিছু বলে না। মনের ইচ্ছে মনেই রেখে ইচ্ছে ঘুড়ি নীল আকাশে উড়িয়ে দেয়। খুব বেশি কষ্ট হলে, মায়ের কাছে গিয়ে মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আজও তাই করেছে, ইন্দু বলেছে, কি হয়েছে, পরীক্ষার প্রিপারেশন ভালো তো ? পড়াশুনার তো বালাই নেই।

ইন্দু মেয়ের সাথে তেমন করে আল্লাদ করেন না। তার স্বভাবে নেই। রাহিন যেন খুব ছোট বয়সে বুঝে গেছে ওকে তাড়াতাড়ি বড় হতে হবে। হয়েছেও তাই। রাহিন বয়সের তুলনায় অনেক বুঝদার, তবুও কেন জানি রাহিনের ইচ্ছে করে, মা একটু আলগা আল্লাদ করুক। যদিও রাহিন নিজেকে গুটিয়ে রাখে, সুপ্ত বাসনা আপন মনে বাজতে থাকে। রাহিন আনমনে আলতো করে চোখের ভেজা পাতা মোছে আর মনে মনে বলে; ”আমার আছে সে জন, সাত তারার একটি ধন। যে কিনা অনেক অনেক দূরের তবু যেন কেমন আপন।”

ওয়াসিফের মুখের আদল মনে করে, রাহিন তখন মিষ্টি করে হাসে …

মামুনের অণুগল্প : বিস্ময় ছিলে তুমি স্বপ্ন আমার

কিছু কিছু গল্প আছে, যা বছর ঘুরে বার বার সামনে এলেও পড়তে বিরক্তি আনে না। কয়েক বছর আগের আমার লেখা এই পুরনো গল্পটিও তেমনই একটি… আবার শেয়ার করলাম।

_____________
ছাব্বিশ বছর!
অনেক সময় তাই না? দুই লক্ষ সাতাশ হাজার সাতশত ষাট ঘন্টা! অসহ্য অলস আবেশে কেটেই গেলো।

ছাব্বিশ বছর আগে তাঁর মনে হতো, সেই মেয়েটির সাথে তার সম্পর্ক ছিলো। ভালোবাসা ছিলো কিনা কখনো মনকে সেভাবে জিজ্ঞেস করা হয়নি। কি মন, ছিলো কি?

মন কোনো উত্তর দেয় না। বরাবরের মতো নিশ্চুপ থাকে। হ্যা! তখন সে মেয়ে-ই ছিলো। বালিকা বয়স থেকে ভালোলাগতো ওকে তাঁর। সে কি জানতো?
হ্যা, ঠিক ধরেছেন- বালিকার জানার ব্যাপারে বলছেন তিনি। আজো জানো হলো না তাঁর।

সময় ঘুরে ঘুরে, অনেক অসময় আর দু:সময়ের পিঠে চড়ে বর্তমান সময়ে এসে হাজির হয়। জিন্স পরতে বলেছিলো মেয়েটি তাকে ‘ম্যানলি’ লাগবে বলে। এমনই আনুষঙ্গিক আরো অনেক টুকরো টুকরো মেয়েটির চাহিদায় (নির্দেশই ভাবতেন তখন তিনি ওগুলো) তাকে চলনসই মেয়ে বলেই মনে হতো তখন। ‘আপটুডেট’ বললে কি একটু শ্রুতিমধুর হয়? এই ভাষাটির প্রতি আমাদের অনেকেরই কেন জানি ঈর্ষণীয় আনুগত্য রয়েছে :)

নিজের জনক চলে গেলেন। অনেকেই এলো মাকে দেখতে, দু:খ শেয়ার করতে। অপ্রত্যাশিত ভাবে সেই মেয়েটিও এসে আচমকা সামনে দাঁড়ালো! সময় ইতোমধ্যে সেই একদার বালিকাকে মেয়েলি অপভ্রংশ স্তরের ভিতর দিয়ে নিয়ে, মহিলায় রুপান্তরিত করে ফেলেছে! এখন সে একজন সম্পুর্ণ মহিলা। পূর্ণ রমনী হতে পেরেছে কি? রমনীয় তো ছিলোই সে।

নাহ! ওভাবে ভাবনাটা এলো না তাঁর নিজের বাড়িতে বসে। এক মুখ দাড়ি গোঁফের জঙ্গলাবৃত তিনি মায়ের পাশে বসে আছেন। দরোজা দিয়ে কালো নেকাবে মুখ আবৃতা সে শ্রেফ চোখ দু’টি দৃশ্যমান রেখে, জীবনের এই প্লাবন পর্বে আবারো একবার প্রবেশ করলো! এক পলক সেই চোখের দিকে তাকিয়ে তিনি উঠে গেলেন অন্যরুমে। চার চোখের মিলন হলো কি হলো না ঠিক অনুভবে এলোনা তাঁর।

মিষ্টি এক সময়ের ঘ্রাণে ভেসে ভেসে, স্বপ্ন প্রহরগুলি মনের চারপাশে দৃষ্টিকটু নির্লজ্জতায় উঁকি দিতে শুরু করলো :(
এখন প্লাবন প্রহর! বড্ড দু:সময়। তাই মনকে কঠোরভাবে দমিয়ে রাখতে চাইলেন তিনি।

ভ্যাপসা মধ্য ভাদ্রের অসহ্য গরম আরো তেজোদীপ্ত হয়ে উঠতে শুরু করে.. গলার কাছে কিছু একটা আটকে আসতে থাকে.. দমবদ্ধ এক তীক্ষ্ণানুভূতিতে আচ্ছন্ন হৃদয়, তীব্র সাইনাস পেইনে খাবি খেতে থাকে। অসহ্য অলস আবেশে সহস্র ধারালো তরবারির আঘাত হৃদয়কে ফালা ফালা করে চলে।

রাস্তা ধরে প্রিয় অনুজকে সাথে নিয়ে, নি:শব্দে পিচের পথ ধরে হাঁটতে থাকেন তিনি। বিরক্ত বিবর্ণ বিস্মিত সময় বিরহে কাঁপতে থাকে। সময়ের ঘ্রান প্রথম প্রেমের মৌময় আবেশে আচ্ছন্ন করতেই, নিজের বউয়ের কথা মনে পড়ে! মোবাইলের দ্বারস্থ হয়ে বউকে কাছে টানার কি এক প্রবল আবেশে ভেসে যান। আসলেই কি এভাবে ভাসা যায়? মনের ভিতর-বাহির তন্ন তন্ন করে খুঁজলে হয়তো উত্তর পাওয়া যেতো। কিন্তু বিহ্বল তিনি উত্তর খুঁজতে আগ্রহ প্রকাশ করেন না।

মায়ের পাশে পরিবর্তিত সময়ের সেই মহিলা যখন নিজের ঘ্রাণে সময়কে আপ্লুত করে চলেছিলো, তিনি তখন তাঁর নিজের শরীর ছাপিয়ে, মনের অনেক দূর দূর পর্যন্ত নিজের বউয়ের শরীরের পরিচিত ঘ্রাণ খুঁজে ফিরছিলেন!

– কেন এমন করছো?
গহীন মনের পরিচিত কণ্ঠের এমনতর বিব্রতকর প্রশ্নে ব্যথিত হয়ে একটু রাগান্বিত হন তিনি।
– কেনো করছি বুঝিস না?
মনকে ধমক মারার অপপ্রয়াস কি নিজের থেকে পালানোর চেষ্টা?

তীব্র ইলেক্ট্রিক ব্লু ফ্রেমে ছাব্বিশটি বছর আগের সময়ের এক ফ্রেমবদ্ধ জীবন্ত তৈলচিত্র, আজ কালো নেকাবে আবৃতা মহিলার দৃশ্যমান দুটি চোখ! শুধুই চোখ? পলকের তরে থমকে থাকা দৃষ্টিতে শত সহস্র অ-অনুভবেয় সময় কি ছিলো না? যা চিৎকার করে করে বলছিলো.. ‘কেনো থাকলে না.. কেনো থাকলে না আমার হয়ে?’

ম্লান হাসেন তিনি :)
– একটু বেশী ভাবা শুরু করেছিস নাকি আজকাল!
মনও ম্লান হেসে ডিপ্লোম্যাটিক উত্তর দেয়। শেষে জানতে চায়,
– বেশী ভাববার মতো কিছুই কি ঘটেনি? চারিদিকে কি হৃদয় পোড়া ঘ্রাণ পাওনা?
– নাহ! হৃদয়ের পুনর্গঠন চলছে.. আমার বউময় জীবনে কোনো পোড়া ঘ্রাণের স্থান নেই। সব তোর কল্পনা। আমার দেহমন জুড়ে এখন কেবলি আমার বউ আর ওর ঘ্রাণ..! অফ যাও।

এক পড়ন্ত বিকেলে নিজের অনুজের পাশাপাশি হেঁটে চলেন তিনি… নিজের মনের ভিতর-বাহির তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফেরেন.. কিন্তু কি যে খুঁজেন, তিনি আর মন, কেউই বুঝে ওঠে না!

কোথায় যেনো চিনচিনে ব্যথা.. নি:সীম নিঃসঙ্গতায় তীব্রতর কষ্টের প্রক্ষেপণে ক্রমশ: বেড়েই চলে…।।