মামুন এর সকল পোস্ট

মামুন সম্পর্কে

একজন মানুষ, আজীবন একাকি। লেখালেখির শুরু সেই ছেলেবেলায়। ক্যাডেট কলেজের বন্দী জীবনের একচিলতে 'রিফ্রেশমেন্ট' হিসেবে এই সাহিত্যচর্চাকে কাছে টেনেছিলাম। এরপর দীর্ঘ বিরতি... নিজের চল্লিশ বছরে এসে আবারো লেখালখি ফেসবুকে। পরে ব্লগে প্রবেশ। তারপর সময়ের কাছে নিজেকে ছেড়ে দেয়া। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬ তে 'অপেক্ষা' নামের প্রথম গল্পগ্রন্থ দিয়ে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। বইমেলা ২০১৭ তে তিনটি গ্রন্থ- 'ছায়াসঙ্গী'- দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ, 'ঘুঙ্গরু আর মেঙ্গরু'- উপন্যাস এবং 'শেষ তৈলচিত্র'- কাব্যগ্রন্থ নিয়ে সাহিত্যের প্রধান তিনটি প্ল্যাটফর্মে নিজের নাম রেখেছি। কাজ চলছে ১০০০ অণুগল্প নিয়ে 'অণুগল্প সংকলন' নামের গ্রন্থটির। পেশাগত জীবনে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। একজন অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। পোষাক শিল্পের কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। লেখালেখির পাশাপাশি সাংবাদিকতা করছি। লেখার ক্ষমতা আমি আমার ঈশ্বরের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছি। তাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখেই যেতে হবে আমাকে।

ধারাবাহিক উপন্যাসঃ দ্য গডফাদার পর্ব-৩

ও.সি মনোয়ার তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে আগে কখনো এমন অনুভূতির সম্মুখীন হননি। কেমন যেন তালগোল পাকানো। অনুভবের খরায় আক্রান্ত হলেন কিনা ভাবেন। গতকালের খুনের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিলেন নিজের কক্ষে বসে।

টেবিলের উপর চা ঠান্ডা হয়ে আছে। সেদিকে খেয়াল নাই। তিনি আবার আগুন-গরম চা ছাড়া পছন্দ করেন না। বসে আছেন ‘পোষ্ট মর্টেম’ রিপোর্টের জন্য। ব্যাটা ড্রাগ-ডিলার নিজে মরে অন্য সবাইকে ঝামেলার ভিতর ফেলে গেছে। গতকাল থেকে প্রশাসনের বেশ উপর মহলের কর্তা ব্যক্তিরা দফায় দফায় তাঁর সাথে কথা বলছেন। নরম-গরম কথার দ্বারা সবাই-ই এই বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে দ্রুত বের হয়ে আসতে চাইছেন, সেটা তাকে পরিস্কার ভাবে জানিয়েও দিয়েছেন। সেই থেকে ভাবছেন এই খুনের মোটিভ নিয়ে।

পারিবারিক দ্বন্দ্ব থেকে হতে পারে? তবে সে সম্ভাবনা নাই। নিহতের পারিবারিক ইতিহাস ঘেঁটে, তেমন কিছুই সামনে আসেনি। এই পরিবারটির নিজেদের ভেতরের মিল ঈর্ষণীয়। এলাকায় আধিপত্য নিয়েও নেই কোনো কোন্দল। এমনিতেই তারা সম্পদশালী। রাজনৈতিক ক্ষমতার সাথে সাথে, এলাকাভিত্তিক প্রভাবের জন্য অন্য যে কারও তাদের সামনে দাঁড়াবার সুযোগই নেই বলতে গেলে।

দলীয় কোন্দল? তেমনও হতে পারে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। তাকে সমর্থন করেছেন থানার দলীয় সভাপতিও। তিনি আরো এক কাঠি এগিয়ে বলেছেন, ‘আমরা সবাই এক মায়ের সন্তানের মত। নিজেদের ভিতর কোনো বিভক্তি নাই।’

নারী ঘটিত কিছু হতে পারে? প্রতিহিংসা? কিংবা পরকীয়া কোনো ব্যাপার! তবে নিহতের কুন্ডলি ঘেঁটে দেখেছেন তিনি। অন্য অনেক খারাপ গুণ থাকলেও, নারী সংক্রান্ত এমন কোনো অতীত রেকর্ড নেই লোকটির। বিস্ময়কর ভাবে এটাই সত্যি, নিজের স্ত্রীর প্রতি গভীর অনুরক্ত ছিল মানুষটি। পারিবারিক গন্ডিতে সে ছিল এক আলাদা মানুষ।

তবে কেন?
কোন বালের জন্য কাউকে এভাবে মেরে ফেলা হল? অস্ফুটে ‘বিশেষণটি’ মুখ দিয়ে বের হয়ে আসে তার।

কারও আসার শব্দে চিন্তার জাল ছিন্ন হয়।
এস আই জিল্লুর। পোষ্ট মর্টেম রিপোর্টের কপি টেবিলে রাখে সে। কিছু না বলে তার দিকে তাকান মনোয়ার। নীরবে মাথা নিচু করেন সামান্য। চলে যাবার ইশারা।

এস আই চলে গেলে চিরতার অভিব্যক্তি নিয়ে রিপোর্টটি হাতে নেন। নিস্পৃহ দৃষ্টি ক্রমশ জ্বলে উঠতে থাকে। মৃত্যুর কারণ ওভারডোজ হেরোইন শরীরে ইজেক্ট করা। তবে চেতনা নাশক এমন কিছুও প্রথমে শরীরে প্রবেশ করেছে। ডার্ট-গান জাতীয় কিছু দিয়ে ঘাড়ের ডান পাশে বিদ্ধ করা হয়েছে। তাতে থাকা ক্যামিকেল দ্রুত স্নায়ুকে অবশ করে নির্বাক করে দেয়। অবশ্য ওটার পরিমান বেশী হলেও মৃত্যু ঘটতে পারে।

চমকে গেলেন পরবর্তী বিষয়টি জেনে। পাকস্থলীতে ফেটে যাওয়া ইয়াবার এক প্যাকেটের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে! যেভাবে কুরিয়াররা নিজের শরীরে টেপে
মোড়ানো ইয়াবার চালান নিয়ে আসে, সেরকমই কিছু।

কিন্তু বিস্ময়ের সাথে ভাবেন, নিহত এমন কাজ কখনোই করবে না। এসব কাজের জন্য তার আলাদা লোক রয়েছে।

তবে বসা থেকে প্রায় উঠে গেলেন রিপোর্টের পরের অংশে যেতেই। হেরোইনে বিষ মেশানো ছিল! এটাই যন্ত্রনাকর মৃত্যুর কারণ। সিরিঞ্জে করে শরীরে প্রবেশ করেছে বিষ মেশানো হেরোইন। আবার মুখ দিয়েও অন্ননালী হয়ে পেটে ঢুকেছে।

খুনির নৃসংশতায় ধাক্কা খান ওসি। চোখে ভাসে গতকাল দেখা চেয়ারে বসে থাকা লাশের ছবি। যন্ত্রণায় দেহ মুচরে যেতে চেয়েছে। কিন্তু চেয়ারের হাতলে দুই হাতের তালু পেরেকে বিদ্ধ থাকায় নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টাই করেছে শুধু। বিষাক্ত এবং ওভারডোজ হেরোইন কতটা নিষ্ঠুর ভাবে জীবনকে স্থবির করে
দিতে পারে, জানা আছে তাঁর। সে বেশ আগের কথা।

সব কিছু মিলিয়ে অবস্থা কি দাঁড়ালো? যে তিমিরে ছিলেন, সেই তিমিরেই রয়ে গেছেন। অস্থির ভাবে এক মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কক্ষে পায়চারি শুরু করেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা।

মোটিভ কী হতে পারে? কেন এভাবে কাউকে খুন করা হল? মারতে চাইলে আরো সহজ পথ ছিল। সেদিকে না যেয়ে খুনি কেন এমন নৃশংস পথ বেছে নিলো! কেন? সে কি কোনো ম্যাসেজ দেবার চেষ্টা করেছে? নিজের এত বছরের অভিজ্ঞতা আজ কোনো কাজেই আসছে না বলে মনে হয় ওসি মনোয়ারের। নিজের অজান্তেই কেন জানি এক অশুভ অশনিসংকেত বেজে ওঠে মনের গভীরে।

বেল চেপে কাউকে ডাকেন। নির্দিষ্ট কনস্টেবল এলে, এএসআই হারুনকে আসতে বলেন। এই অবসরে পোষ্ট মর্টেম রিপোর্টের গোড়া থেকে আরো একবার চোখ বুলিয়ে যান। এমন কিছু বাদ পড়ল কিনা যা চোখে পড়েনি আগে। মনের চোখ।

এএসআই হারুন এলে তাকে পুলিশ স্কেচ শিল্পীর করা সম্ভাব্য খুনির স্কেচগুলো নিয়ে আসতে বলেন। গতকাল অপরাধ স্থলের চা’র দোকানে কথা বলে সাদা পোশাকের পুলিশেরা এক অচেনা আগন্তকের বর্ণনা জেনেছিল। শেষে নিজেদের স্কেচ শিল্পীকে দিয়ে কয়েকটি ছবি আঁকিয়েছে। দেখা যাক, এখান থেকে কিছু পাওয়া যায় কিনা। পুলিশ ডাটাবেজে সংরক্ষিত অপরাধী কারও সাথে চেহারা মিলে কিনা তাও দেখতে হবে।

টেবিলের উপর রাখা চা’র কাপের দিকে এবার মনোযোগ দেন। চিন্তা না করেই এক চুমুক দিলে, ঠান্ডা চা মনটাকেও কেমন বিস্বাদের কটু অনুভবে বিরক্ত করে তোলে। চা’র কাপের দিকে ভ্রু-কুঁচকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। মনের চোখ তখন অন্য কোনো জায়গায়..।
… …
আবাসিক এলাকার শেষ প্রান্ত। রাস্তাটা সব শেষের এই পাঁচ তলা বাড়ির সাথেই এসে শেষ হয়ে গেছে। এটা ডেড-এন্ড। মাঝে রাস্তা রেখে দু’পাশে সারি সারি বাড়ি। নানা রঙয়ের। ভিন্ন ডিজাইনের। এক বর্ণীল ছোট কংক্রিট নগর। এমনই মনে হয় তাঁর কাছে। টপ ফ্লোরে নিজের ব্যালকনিতে বসে অলস সময়ে আশপাশটাকে অনুভবে ছুঁয়ে চলেছেন এক পৌঢ়। অসহ্য অলস অবসর কাটাতেই এই ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছেন গত মাসে। একা একজন মানুষ। সামনেও কেউ নেই। পেছনের মানুষগুলি সম্পর্কহীনতার মাঝে নিজেদেরকে গুটিয়ে নিয়েছে। তাই এই একা থাকা। এমনই বলেছিলেন বাড়িওয়ালা ভদ্রলোককে বাসা ভাড়া নেবার সময়।

হাতে আজকের পত্রিকা। নীরবে চোখ বুলিয়ে যান। বেশ বড় করেই ছেপেছে খবরটা। ইতোমধ্যে একবার পড়েছেন। আরও একবার চোখ বুলানো শুরু করেন। যেভাবে লিখেছে, আসল ঘটনা হয়ত তেমন নয়। সাংবাদিকেরা মূল ঘটনার চেয়ে নিজেদের কল্পনার ডানা অধিক মেলে দিতে পছন্দ করে।

এমন একটা এলাকা যেখানে নাগরিক সমাজ দ্বিধা বিভক্ত। নৈতিকতার ধার কেউ এখন ধারে না। ভাল গুণগুলি ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছে। সে জায়গা দ্রুত দখল করে নিচ্ছে আমাদের ভিতরে থাকা পৈশাচিকতা। এভাবেই কি আমরা এক একজন পিশাচ মানবে পরিণত হবো এক দিন?

ভাল লাগে না আর। নিজের রুমে চলে আসেন। আয়নার সামনে দাঁড়ান। যে মানুষটিকে দেখা যাচ্ছে, তিনি কি এমনই? ভিতরের মানুষটা কেমন? আমরা বাহ্যিক চোখে যা দেখি, আসল দেখার ওপারের মানুষটি কি সেভাবেই থাকেন? দেখা আর না দেখার বাইরের বিমূর্ত রুপটি কেমন?

একটা ছিমছাম এলাকা। চর্ম্য চোখে এর অনাবিল সৌন্দর্য ভাললাগায় আপ্লুত করে মন। কিন্তু এই নগরের ভিতরের ছোট্ট নগরটির এমন অনেক কদর্য রুপ রয়ে গেছে যে, মুহুর্তেই বিরুপ মনোভাবে ছেয়ে যাবে যে কারও মন। এখানে রাতের আঁধারে চলে মরণ নেশায় মেতে উঠার মহা উৎসব। বয়সের কোনো সীমারেখা নাই সেখানে। উঠতি বয়সী কিশোর থেকে শুরু করে, মধ্য বয়স্ক কিংবা নারী! ইদানিং হচ্ছেটা কি এসব? এই এলাকাতেই রয়েছে ভদ্রবেশী পতিতাদের অবৈধ কার্যকলাপ। সভ্যতার মুখোশে ঢেকে থাকা এক আদিম সমাজে মুহুর্তেই কেন জানি চলে যাই আমরা সভ্য মানুষেরা। পদস্খলনের নিষিদ্ধ লোবানের আকর্ষণে পা পিছলাতে সময় লাগে না আমাদের। আবাসিক এলাকাগুলিতে প্রশাসনের প্রচ্ছন্ন সম্মতিতে চলে অবৈধ নেশা সামগ্রীর অবাধ বেচাকেনা। এ এক বিশাল চক্র। কোটি কোটি টাকার ছড়াছড়ি। ভদ্রবেশী সমাজপতিরা অর্থের জোগানদার। ‘করাপ্টেড’ নেতারা রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে সব সামলে নেবার কাজে অতিশয় দক্ষ। দিনে দিনে তারা আরও দক্ষ হয়ে উঠছেন।

এমন এক নাগরিক সমাজে একজন অদক্ষ সাধারণ মানুষ, এক শেষ বিকেলে, রাতের অপেক্ষায় উন্মুখ থাকেন। নির্জনতার খোঁজে কিনা তা জানা যায় না। একেবারে ছাদে চলে আসেন। পাঁচতলার এই বাড়িটির ছাদ পাশের বাড়িটির ছাদের সাথে মিলানো। দু’টি বাড়ির মালিক একজনই। একটা করিডোর রয়েছে। গ্রিল দিয়ে ঘেরা।

আকাশে রংয়ের মেলা। ঈশ্বর তাঁর নিজের মত করে বর্ণে বর্ণে সাজিয়েছেন। অপুর্ব! আকাশের পানে তাকিয়ে থাকেন অনেকক্ষণ। কতক্ষণ থাকতেন বলা যায় না। পাশের ছাদে কারও উপস্থিতি তাঁর একাগ্রতা বিনষ্ট করে। ফিরে তাকান। এক মধ্যবয়সী। মাথায় পাকা চুলের আধিক্য বেশী। বেশ সুপুরুষ। অভিজাত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করছেন। প্রথম দেখাতে এমনই মনে হবে যে কেউ দেখলে। তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসছেন। কিন্তু সুপুরুষটির চোখ দুটি হাসছে না। বাইরের খোলসটিকে আমরা পরিচ্ছদ আর অভিব্যক্তিতে যতই সাজাবার চেষ্টা করি না কেন, ভেতরে কদর্যতা থাকলে ঠিকই বের হয়ে আসে। চোখ হল সেই বের হবার পথ। মানুষের নিজেকে চেনানোর পথ।

হাসি হাসির জন্ম দেয়। তিনিও মৃদু হেসে অভিবাদন জানান। প্রথম পরিচয়ের মুহুর্ত কাটে নিরব অন্তরঙ্গতায়! দু’জন কাছাকাছি বয়সী মানুষ পরিচয় পর্ব সাঙ্গ করেন এক বেলা শেষের ক্ষণে। কথা হয় তাদের মাঝে আরও দীর্ঘক্ষণ। অতঃপর রাতের খাবারের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে প্রথম পৌঢ় নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে যান।

চোখ হাসে না এমন সুপুরুষটি, কৌতূহল নিয়ে পৌঢ়ের চলে যাওয়া দেখে। বাইরে তখন বিষণ্ণ সাঁঝের উলুধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে ঘরে ফেরা পাখিদের শেষ সংকেত জানায়।

(ক্রমশঃ)

ধারাবাহিক উপন্যাস : দ্য গডফাদার পর্ব ২

লোকাল থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছায় সকাল ন’টার পরে। একটু বেশীই তৎপর মনে হল তাদের। এর পিছনে কারণ তো অবশ্যই রয়েছে। পুলিশের গাড়িটি দেখে প্রথমে কেউ কেউ সরে যায়। পরে কৌতুহলের কাছে ভয় পরাজিত হলে, তারা আবার ঘুরঘুর শুরু করে। এতক্ষণ মাতম চলছিল ঐ বাড়িতে। এলাকার একেবারে কেন্দ্রস্থলে এমন একটি রোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড এলাকার সবাইকে ভীত এবং বিহ্বল করে তুলেছে।

সাদা পোষাকের আইনশৃংখলা রক্ষাবাহিনীর সদস্যরাও ভিড়ের মাঝে মিশে গেলো। সবাই মিলে একটা ‘টিম’ হয়ে কাজ করবে। স্থানীয় থানার ও.সি (ভারপ্রাপ্ত
কর্মকর্তা) নিজেই এসেছেন। জোন এস.পি’র কড়া নির্দেশে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছেন সদ্য এই থানায় পোষ্টিং পাওয়া কর্মকর্তা।

ঘটনার সময়ে বাড়িতে ‘ভিকটিম’ একাই ছিলেন। অন্যরা এক বিয়ের অনুষ্ঠানে ছিল। সকালে দুধওয়ালা দুধ দিতে এসে মেইন দরোজা খোলা পায়। অনেকক্ষণ বেল বাজালেও কেউ না আসায়, সে ভিতরে প্রবেশ করেই বিভৎস্য ব্যাপারটি দেখতে পায়। তাঁর চিৎকার-চেচামেচিতে সকলে জড় হয়। পরে আত্মীয়স্বজনদের খবর দেয়া হয়। তাছাড়া নিহত ব্যক্তি এই এলাকারই। বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছাড়াও তারা সকল ভাইয়েরা যার যার নিজের বাড়ি করেছে। অন্য ভাইয়েরা এসে মৃতের স্ত্রী-পুত্রকে ফোন করে জানায়। তারাও এই কিছুক্ষণ হলো এসে পৌঁছেছে।

একজন এ.এস.আই কে ডেকে নিলেন ও.সি মনোয়ার। সে কাছে আসতেই ওকে নিয়ে ‘ডেড-বডি’র কাছে গেলেন। নিজের বেডরুমে ‘ভিকটিম’ একটা কাঠের চেয়ারে বসে আছে। তবে এমনভাবে দেহটা বেঁকেচুরে রয়েছে, প্রথম দেখাতেই তিনি বুঝতে পারলেন, মৃত্যুর আগে অসহ্য শারিরীক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে মানুষটিকে।

একটু কোলাহলের শব্দ কানে যেতেই পিছনে ফিরে তাকান তিনি। মৃতের স্ত্রী হবে বোধহয়। বিলাপ করতে করতে ভিতরে ঢুকবার চেষ্টা করছেন। তাকে সামলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে চলে এক যুবক। নিহতের ছেলে হবে হয়তো। এ.এস.আই আগুয়ান মহিলাকে দরজায়ই নিবৃত্ত করে। তাকে তদন্তের কাজে বাঁধা না দিতে অনুরোধ করলে ছেলে মাকে জোর করে বাইরে নিয়ে যায়।

ও.সি সাহেব তাঁর অধীনস্থকে জিজ্ঞেস করেন,
– সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি কর। ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্টদের খবর দেয়া হয়েছে?
লাশের দিকে তাকিয়ে থাকা এ.এস.আই তার সিনিয়রের দিকে ফিরে উত্তর দেয়,
– স্যার! হ্যা, ফরেনসিক টিম যে কোনো মুহুর্তেই চলে আসবে।
– গুড। প্রথম যে লোকটি ডেড-বডি দেখেছে, তাকে নিয়ে এসো। আর আমরা আসার আগে, এই রুমে কেউ ঢুকেছে কিনা খোঁজ নাও।
– স্যার!

এ.এস.আই বের হয়ে যায়। ও.সি লাশের খুব কাছে যান। নিহতের পরণে লুঙ্গি। উর্ধাঙ্গ খালি। কাঠের চেয়ারের হাতলে দুই হাত চামড়ার স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধা। পেরেক দুই হাতের তালু ভেদ করে কাঠের গভীরে প্রবেশ করেছে। যেখানটায় পেরেক ঢুকেছে, তার চারপাশ বৃত্তাকারে কালচে-নীল হয়ে আছে। শুকনা রক্ত দলা হয়ে আছে পেরেক দু’টিকে ঘিরে। মুখে অ্যাডহেসিভ টেপ লাগানো। এজন্যই লোকটির অমানুষিক চিৎকারের আওয়াজ বাইরে কারো কানে যায়নি। লাশের মুখে কোনো আঘাতের চিহ্নও নেই। বাহ্যিকভাবে শরীরের অন্য কোথায়ও আঘাত এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। তবে দুই চোখ বিস্ফারিত হয়ে আছে। পিঙ্গল দু’টি মণি স্থির। সেখানে কোনো ভাব নেই। অনুভূতির অনেক উর্ধে চলে গেছে এই মানুষটি। মুখের কসা বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ার দাগ দেখতে পান। কালচে রক্ত!

দুধওয়ালাকে বাইরের রুমে দাঁড় করিয়ে রেখেছে এ.এস.আই। দেখতে পেয়ে ওসি মনোয়ার বাইরে আসেন। লোকটি বয়স্ক। চুল সাদা হয়ে আছে। মেহেদির রঙে রাঙ্গানো। মুখে কয়েকদিনের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। সব সাদা। লোকটি নার্ভাস হয়ে আছে। থেকে থেকে জিভ দিয়ে শুকনা ঠোঁট ভিজিয়ে নিচ্ছে।

ওসি লোকটির সামনে এসে দাঁড়াতেই ফরেনসিক টিম পৌঁছে যায়। তাদেরকে নীরবে ভেতরটা নির্দেশ করে ওসি দুধওয়ালাকে নিয়ে ভিতরের আরেকটি রুমের দিকে আগান। মুখে তাঁর প্রসন্ন হাসি। ফর্মাল জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া, দুধ বিক্রেতা সেই হাসি দেখে আরও ভড়কে যায়। ঢোক গিলে সে ভাবে, আজ কপালে নিশ্চয়ই খারাবি আছে।

ফরেনসিক টিম তাদের কাজ শেষ করে বের হবার অনেক আগেই ওসি সাহেব দুধ বিক্রেতাকে ছেড়ে দিয়েছেন। লোকটির কাছ থেকে তেমন কিছুই জানা যায়নি। দেখে মনে হচ্ছে, খুনটা গভীর রাতে হয়েছে। আর দুধওয়ালা তার রুটিন মাফিক রোজকার মত আসাতেই সর্বপ্রথম দেখতে পায়। ওকে টুকটাক অনেক কিছু জিজ্ঞেস করেন তিনি। শেষে এ.এস.আই’র কাছে নাম-ঠিকানা লিখিয়ে আপাতত তাকে চলে যেতে বলেন।

লাশ ময়না তদন্তের জন্য নিয়ে যাবার হুকুম দিয়ে বাইরে অপেক্ষমান অন্যদের কাছে ফিরে আসেন ওসি মনোয়ার। এলাকার মেম্বার এবং কাউন্সিলর এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। সেদিকে আগাতেই এস.পি সাহেবের ফোন আসে। দু’জনের ভিতরে কিছুক্ষণ কথা হয়,
– মনোয়ার সাহেব, এবার বলুন?
– স্যার! ভিকটিম সম্পুর্ণ একা ছিলেন ঘটনার সময়। পরিবারের বাকিরা বিয়ের অনুষ্ঠানে ছিল। খুনের মোটিভ এখনো জানা যায়নি। বাড়ি থেকে দামি কোনো কিছুও নেয়া হয়নি। আসলে জিনিসপত্র কিছুই নেয়নি খুনি এমনটাই যতদূর বুঝতে পেরেছি। কোনো ধরণের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি। তবে খুনি স্যাডিস্ট কিনা তাও সম্পূর্ণভাবে বুঝা যাচ্ছে না। ময়না তদন্তের রিপোর্ট এলে স্যার বাকিটা জানা যাবে।
– হুমম.. উপর থেকে আমার কাছে বারবার ফোন আসছে। হোমরা-চোমরা কেউ নাকি ভিকটিম?
– না স্যার। সরকারি দলের স্থানীয় নেতা।

এবার কণ্ঠস্বর একটু নিচু করে ওসি তার উপরওয়ালাকে জানায়,
– তবে স্যার, ভিকটিম ‘ড্রাগ রিংয়ের’ একেবারে নিচের সারির একজন। এই এলাকায় ‘ড্রাগ-সাপ্লাইয়ের’ কাজটা সে-ই দেখাশুনা করে। স্থানীয়। এলাকায় পারিবারিক প্রভাব-প্রতিপত্তি অনেক। থানায় সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকলেও, আমাদের ব্যাড-বুকে তার নাম আছে।
– আমাকে উপরে জবাব দিতে হচ্ছে। যতই ব্যাড-বুকে নাম থাকুক, এর পেছনের মানুষগুলো অনেক ক্ষমতাধর। আমি কি বলতে চাইছি বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই?
– স্যার!
– আই ওয়ান্ট ইমিডিয়েট অ্যাকশন। যে কোনো ভাবেই হোক, ফাইন্ড আউট দ্য কিলার।
– সকল ফ্যাক্টস একত্রিত করা হচ্ছে। আশাকরি ভাল কিছু জানাতে পারব, স্যার।
– আই ডোন্ট নিড ফ্যাক্টস। আই ওয়ান্ট রেজাল্ট.. গট ইট? আমি খুনিকে চাই।
– স্যার! আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাব।

ওপাশ থেকে লাইন কেটে দেয়া হল। একটু বিরক্ত হন ওসি মনোয়ার। উপস্থিত সকলের দিকে তাকান পালা করে। তার চোখে চোখ পড়তেই সবাই চোখ নামিয়ে নেয়। এটা দেখে মনটা আরো বিষিয়ে উঠে তার। এরা সবাই যেন চোর, চোর স্বভাবের। না হলে চোখ নামিয়ে নেবার কী প্রয়োজন? এরকম দু’একটা ড্রাগ-ডিলার মারা যাওয়াটা সমাজের জন্য নিশ্চয়ই খারাপ নয়। ভালো।

হঠাৎ নিজের দুই ছেলের কথা মনে পড়ে। ওরাও যে কোনো সময় এই ড্রাগের খপ্পরে পড়তে পারে। পলকের তরে একজন বাবা হিসেবে নিজের ভেতরে কেমন এক অসহায় অনুভবে বিলীন হন ওসি মনোয়ার। তবে সেটা সামান্য সময়ের জন্য। একজন পোশাকধারী কর্মকর্তা যখন সামনে আসেন, ভেতরের বাবাটা কোথায় যেন হারিয়ে যায়।

নিজের মনে এলোমেলো ভাবেন। একা একা। আমাদের সিস্টেম গোড়া থেকেই খোকলা হয়ে আছে। এই থানায় পোষ্টিং নিতে তাকে কোটি টাকার উপরে ঢালতে হয়েছে। কেন ঢেলেছেন?

নিজের প্রশ্নে নিজেই বিব্রত হন। অনেক প্রশ্ন এমন আছে, যেগুলো নিজের কাছেও জানতে চাওয়া যায় না।

হাতের ইশারায় দূরে দাঁড়ানো এ.এস.আই কে ডাকেন।
– খোঁজ নাও তো, কন্ট্রাক্ট কিলাররা কে কোথায় আছে? গত রাতে কোথায় ছিল, তাদের মোবাইল লোকেশণ ট্র‍্যাক করো কিংবা যা ইচ্ছে তাই করো। কিভাবে কি করবে জানি না। প্রয়োজনে সবাইকে তুলে আনো।
হাগায়ে দাও। কিন্তু আসল সত্যটা আমার জানা চাই।
– স্যার।

নীরবে বেরিয়ে যাওয়া এ.এস.আই’র পেছন দিকটা অনেকক্ষণ ধরে দেখেন ওসি মনোয়ার।

বাজারে। চা’র দোকান। সাদা পোশাকের পুলিশ বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এলাকায় অচেনা কেউ এসেছিল কিনা, নিহত লোকটির কোনো শত্রু আছে কিনা, পারিবারিক সহায় সম্পত্তি নিয়ে নিজেদের ভেতর কোন্দল আছে কিনা- এরকম সকল এঙ্গেল থেকে কৌশলে জানতে চাওয়া হয়। তবে বাঙালি সহজে মুখ খুলতে চায় না। তবে একবার খুললে, তা আর বন্ধও হতে চায় না।

অচেনা কেউ এসেছিল কিনা? এই প্রশ্নের উত্তরে একজনের কথা জানায় তারা। কিন্তু রাতের আঁধারে সেভাবে কেউই মানুষটিকে দেখতে পায়নি। কেউ বলে
লোকটির গালে হাল্কা দাঁড়ি আছে, তো অন্যজন জানায় সে ক্লিন সেভড ছিল। চোখের মণি কেউ কালো বললে, অন্য একজন বলে সেটা নীল ছিল। এভাবে যে যার মত রঙ লাগিয়ে বর্ণনা করে যেতে থাকে। সাদা পোশাকের পুলিশেরা বিরক্ত এবং বিব্রত হয়। শেষে মনে মনে লোকগুলোকে জঘন্য গালি দিয়ে সরে আসে তারা। উপরওয়ালাকে কি জবাব দেবে, ভেবে ভেবে সেটার একটা রুপরেখা দাঁড় করায়।

বয়স্ক মানুষটি বাজারের ব্যাগ হাতে সাধারণ এক আবাসিক এলাকার ভাঙ্গা রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেন। জায়গায় জায়গায় রাস্তা এতটাই ভাঙ্গা, হাঁটতে কষ্ট হয়
তাঁর। রিক্সা পান নাই। বাধ্য হয়ে হেঁটে আসা। গরমে ঘেমে গেছেন। শ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। হয়ত হাঁফানির টান আছে। কেমন ঘোলা চোখের দৃষ্টি। বেশ মেদ জমেছে শরীরের মধ্য ভাগে। হাঁসফাঁস করার সেটাও একটা কারণ।

রাস্তার দু’পাশের বাড়িগুলোতে এখন অখন্ড অবসর। অনেকেই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে কাছের মানুষদের সাথে অলস আড্ডায় মগ্ন। কেউ কেউ তাকিয়ে সাদা চুলের পঞ্চাশোর্ধ মানুষটিকে হেঁটে চলে যেতে দেখে। অচেনা মানুষ। তবে এই নগর জীবনে কে কাকে চেনে? হয়ত প্রতিবেশীই হবে মানুষটি তাদের। চোখ ফিরিয়ে নিতে নিতেই বৃদ্ধ লোকটির কথা ভুলে যায় তারা।

হেঁটে চলা মানুষটি এমনই। মনে রাখবার মত কেউ নন তিনি।

(ক্রমশঃ)

ধারাবাহিক উপন্যাস : দ্য গডফাদার পর্ব ১

ধারাবাহিক উপন্যাস : দ্য গডফাদার ১ম পর্ব

টিপটিপ বৃষ্টি। লোকাল বাস। স্টপেজে থামতেই দু’দল মানুষের উঠানামা। ক্ষনিকের বিরতিতে এলোমেলো সময়। মানুষগুলোও পলকের দ্বিধায় ভোগে। কেউ অপেক্ষমান রিক্সার খোঁজে তাকায়। দু’একজন চায়ের দোকানের দিকে চেয়ে ভাবে- তেষ্টা মেটানো জরুরী, না বাসায় ফেরা? সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে অনেকেই। তবে কেউ কেউ ডানে-বামে না তাকিয়ে সোজা হাঁটা ধরে।

এমনই একজন হেঁটে চলেছে। মহাসড়কের সাথের শান বাঁধানো চত্বরের কদম গাছটির নিচে আসতেই, পুরা এলাকার বিদ্যুৎ চলে যায়। নিমেষে ঘিরে ধরে আঁধার।
লোডশেডিং।
নাগরিক বিড়ম্বনা। অথচ…দেশজুড়ে কত আগডুম বাগডুম এই নিয়ে।

ঘরে ফেরা সেলাই দিদিমনিদের পিছু হেঁটে সে ও সামনে বাড়ায়। পথ একটাই। সামনে এগিয়ে গেছে।
জীবনের মত?

অনেকটা পথ হাঁটতে হয়। সামনে দিয়ে আঁধারে জোনাকির মত মিটমিটে বাতি নিয়ে ব্যাটারিচালিত রিক্সা চলে যায়। পেছন থেকে যাত্রীবোঝাই অটোরিক্সাগুলি, ডানে-বামে হেলতে দুলতে তাকে পাশ কাটায়। অন্ধকারে মানুষগুলি কেন জানি নিশ্চুপ থাকে।

বাজারের একটা চা’র দোকানে অচেনা লোকটি বসে। অর্ডার দেয়। চায়ের। দোকানি একপলক তাকায়। দেখে কী? একজন খদ্দের চারটা গোল্ডলিফ চায়। চা বানাবার ফাঁকে দোকানি তাকে বিদায় করে।

চা’র কাপে আলগা পাতি দেবে কিনা জানতে চাইলে, লোকটি নিরবে মাথা নেড়ে জানায় লাগবে না। চা’টা খারাপ হয়নি। চুমুক দিয়ে কাপ হাতে নিয়ে সে ভাবে।
অনেক বদলে গেছে এই এলাকাটি। সময়ের সাথে আমরা ও যেমন পালটে যাই, অঞ্চল ও কি আমাদেরকে অনুসরণ করে?
সামনের মার্কেটটি নতুন হয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে সে নিরবে কাপ মুখের কাছে আনে।

দুই যুবক আসে। একজন বাম পায়ে ভর দিয়ে বাঁকা হয়ে দাঁড়ায়। দূর থেকে হেঁটে আসায় একটু রিল্যাক্স করতে চায় বুঝি। অন্যজন সিগ্রেট চায়। তিনটা গোল্ড লিফ আর ছয়টা ম্যারিজ। দাম পরিশোধ করে দ্রুত চলে যায় ওরা। তাড়া আছে। অন্য কেউ হয়ত ওদের জন্য অপেক্ষা করছে।

চা’র দোকানে বসেই পুরা এলাকার খবর জানা যায়। এই যে দুই যুবক, দু’ধরনের সিগ্রেট নিলো। হয়ত এরা গাঁজায় আসক্ত। ওদের চোখ দেখে তার এমনই মনে হয়েছে। সিগ্রেটের দামের তারতম্য এবং ভিন্ন ব্রান্ডের হওয়ায়, শ্রেফ ধুমপানের জন্য কম দামিগুলি নেয়া হয়নি। অনেক দেখেছে সে।

আরো দীর্ঘক্ষণ বাজারের ঐ দোকানটিতে, জেনারেটর বালবের আলোয়-অচেনা লোকটি বসে থাকে। কেউ কেউ তাকে দেখলেও মনে রাখে না। তিনি এমনই। মনে থাকার মত কেউ নন।

লোকটি দাম মিটিয়ে যখন আধাঁরে মিলিয়ে যায়, বাজারে তখনও যুবতী রাতের কোলাহল। বেশ জমে গেছে। প্রতিদিনই এমন এখানে।

পরের দিন সকালে এলাকার এক বাড়িতে, নৃশংসভাবে খুন হওয়া একজনের লাশ পাওয়া যায়।

(ক্রমশঃ)

অণুগল্পঃ পারুর_বুকে_জোনাক_জ্বলে

পারুর বুকে জোনাক জ্বলে

কোনো একসময়ে আমি নিজের থেকেও নিজেকে লুকিয়ে রাখতাম। অন্যরাও দেখতে পেতো না আমাকে। এক ছায়াজীবনে নিজের কায়া হারিয়ে ফেলেছিলাম।

তখন ছায়ামানবের এক চিলতে আশার আলো ছিলো আয়তাকার এক জীবন। তাও ছিলো গণ্ডীতে আবদ্ধ। সীমার বাইরে যেতে দিতো না। ছটফট করতো অসীম মন আমার!

সেই সময় আমার বসবাসের এক চিলতে বারান্দাই ছিলো আমার একমাত্র আনন্দনগর! এপারে অন্ধকার, ওপারে সব আলো।

আমাকে আঁধারে ডুবিয়ে আলোরা ওপারে চলে গেলো সব পারুর কাছে! ইতোমধ্যে সে আমাকে নিজের অন্ধকারগুলোও ধার দিয়েছে।

সেই থেকে নিজের তমসাঘন আঁধারে ডুবে পারুর অন্ধকারগুলোও বুকে জড়িয়ে আছি। অন্ধকারের বুকে আরেক গোপন আঁধার। আমি দূর থেকে পারুর বুকে জোনাক জ্বলতে দেখি। অপেক্ষা করি… যদি সে ফিরে আসে এক টুকরো আলো হাতে!

আলোয় বসবাসকারী পারু কি কখনো এক টুকরো আলো নিয়ে অন্ধকারে ফিরে আসবে আমার কাছে? মৌচাক নগরে পারুর বুকে মধু মাছি ঘুরে ফিরে উড়ে বেড়ায়.. জোনাকী পোকারা নিজেদের একাংশ আলোকিত করে পারুর বুকে লেপ্টে থাকে। ওদের বাকী অংশ আমার মতো আঁধারে হাবুডুবু খায়।

এক কোটি বছর ধরে অপেক্ষায়.. চেয়ে আছি ওপারের আলোয় ঝলমলে জীবন থেকে এপারের অন্ধকারে এক টুকরো আলো নিয়ে আসবে পারু!

‘..আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী..’

প্রান্তিক_গেটে_একদিন_মামুনের_অণুগল্প

পকেটে দশটি টাকাই শেষ সম্বল। সামনে গোটা একটা দিন। তিন বেলা খেতে হবে। আচ্ছা একবেলা না হয় বাদই দিলো। বাকি দুই বেলা? সে দেখেছে পকেটে যখন টাকা থাকেনা ক্ষিদেগুলোও চাগাড় দিয়ে ওঠে, কেমন রাক্ষসের মতো শুধু খাই খাই করে।

রাক্ষসের কথা কেন মনে হল? সে রাক্ষস দেখেছে কি কখনো?
নাহ!
তবে?
এমনি-ই মাথায় চলে এলো।

বাহ! এমনি এমনি মাথায় চলে এলো! তবে সামনের ঐ ফার্স্টফুডের দোকানের কাঁচের নীচের খাবারগুলো এমনি এমনি ওর পেটে ঢুকে যেতে পারে না?

ঐ তো দু’জন বসে বসে সমুচা খাচ্ছে। একজন বোতল থেকে সস বের করছে। টকটকে লাল টমেটো সস বোতলটিকে কাত করে ক্ষুদে প্লেটটিতে ঢালছে। অন্যজনের ডান হাতে একটা সমুচা। সে ওটা বাম হাতে রেখে ডান হাতের একটা আংগুল দিয়ে একটুখানি সস তুলে জিহ্বায় নিয়ে চোখ বুঝে স্বাদ নিতে লাগলো। ব্যাটা সস মনে হয় কোনোদিন খায়নি। তার হাতের নখগুলো বেশ বড়… এবং ময়লায় কালো দেখাচ্ছে। অন্যজন দেখেও দেখলো না। নির্বিকারভাবে সসের বোতল খালি করায় ব্যস্ত। দোকানিও নির্লিপ্ত ভাবে চেয়ে আছে। তবে ফাইফরমাস খাটা ছোট ছেলেটা বিরক্তিভরা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। হয়তো মনে মনে বলছে,
– খাবি তো ব্যাটারা মোটে দুইটা সমুচা । খালি করছিস পুরো সসের বোতল!

ময়লা নখওয়ালা এবার সমুসায় মাখন মাখানোর মতো করে সস লাগিয়ে বড় এক কামড় বসায়। ওর মুখের অবস্থা দেখবার মত হয়। শব্দ করে চাবানোর সাথে সাথে মুখের দু’পাশ থেকে ঝুরঝুর করে সমুচার অংশবিশেষ তার নিজের শরীরে পড়ছে। সেখান থেকে তুলে আবার মুখে পুরছে।

ওদের থেকে সামান্য দূরত্বে দাঁড়িয়ে পকেটে দশটাকা নিয়ে শিহাব এসব দেখছে। আর ভাবছে, এইসব গিদার যারা ভদ্রভাবে খেতেও জানেনা- এদের পকেটেই অফুরন্ত টাকা! আরো একটু কাছে গিয়ে সে ওদের সমুচা খাওয়া দেখতে থাকে। চোখ খাবারের দিকে… ইচ্ছে করে মুখের পাচকরস সহ দৃষ্টিকটু ভঙ্গীতে দু’বার ঢোক গিলে, জিহ্বা বের করে নীচের ঠোঁট ভিজিয়ে লোভীর ভঙ্গী করে। আবার ঢোক গিলে।

শিহাব শুনেছে, খাবার সময়ে অভুক্ত কারো নজর খাবারের দিকে পড়লে নাকি যে খায় তাঁর পেট ব্যথা করে। সে চাইছে এই গিদার দুটোর উপর তার নিজের অভুক্ত নজর পড়ুক। ব্যাটাদের প্রচন্ড পেট ব্যথা হোক। ব্যথায় ওরা মেঝেতে গড়াগড়ি দিক। অবশ্য দু’জনের হাতের নখের যা ছিরি (শ্রী), পুরো ডাস্টবিনেও মনে হয় এমন ভয়ানক উপাদান নেই । ওর নজরের প্রয়োজন হবেনা, এমনিতেই গড়াগড়ি দেবার কথা।

এভাবে একজন অপরিচিত মানুষ ওদের খাওয়া দেখছে, তাও এতোটা অশোভন ভাবে। এক গিদার মুখের খাবারটুকু কোৎ করে গিলে ওকে লক্ষ্য করে বলে,
– কিছু বলবেন ভাইয়া?

দোকানির চোখেও শিহাবকে ঠিক কাস্টমারের মতো লাগে না। মানে ক্যাম্পাসের এই দোকানগুলোতে যেরকম মানুষ আসে তাঁদের মতো আর কি। আবার ভিক্ষুকের মতোও যে লাগছে তাও ভাবতে পারছে না সে। একটা লম্বা ফুলহাতা শার্ট প্যান্টের সাথে ততোটা বেমানান লাগছে না। উপরে একটা খাকি রঙ এর কোটি। চোখে সানগ্লাস। তবে পায়ে একটা স্পঞ্জের স্যান্ডেলই জাত মেরে দিয়েছে ওর। নীল ফিতাওয়ালা স্যান্ডেল। সামনের অংশে অতিরিক্ত পানি লেগে লেগে শ্যাওলা ধরা কালো দাগ পরেছে। তেলতেলে একটা ভাব স্পষ্ট বোঝা যায়। সাধারণত বাথরুমে অবহেলায় এ ধরণের স্পঞ্জগুলো মাসের পর মাস পড়ে থাকে, আর ফিতে ছেড়ার অপেক্ষায় প্রহর গোনে।

যাহোক দোকানি একটু বিব্রত হলেও ওর স্লাভিক চৌকো চেহারায় কোনো ভাব ফুটে ওঠে না। হয়তো ওঠে কিন্তু স্বভাবজাত নির্লিপ্ততার আড়ালে তা ঢাকা পড়ে যায়।

শিহাবকে প্রশ্ন করা গিদারটির গোঁফ রয়েছে। সেখানেও সমুচার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ চুম্বকের সাথে লোহার গুড়া যেভাবে আটকে থাকে, সেভাবে লেগে রয়েছে। কালো গোঁফে হলুদ খাদ্যকণা। হলুদ দেখাতেই শিহাবের কাছে এক ‘বিশেষ পদার্থের’ কথা মনে হল। সে মনে মনে এই প্রশ্নকারী গিদারের নাম দিলো ‘গুইয়্যা গুঁফো’। নবাবদের মতো করে নামকরণ হলে এর নাম হতো ‘গুইয়্যা গুঁফো গিদার নাম্বার ওয়ান ফ্রি সসের বোতল ঝাঁকানেওয়ালা।’

এবার শিহাব ‘গুইয়্যা গুঁফো’র প্রশ্নের উত্তর দেয়,
– হ্যা, অবশ্যই। বলতেই তো এসেছি।

দুই গিদারসহ দোকানের চারজনই ওর দিকে তাকায়। তিনজনের চোখে আগ্রহ আর একজন নির্লিপ্ত।

শিহাব ‘সস চাটা গিদার নাম্বার টু’ এর রানের উপরে সমুচার চর্বিত একটা টুকরোর দিকে নির্দেশ করে বলে,
– খাবার অপচয় করা যাবে না। অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই বলা হয়েছে। তাই ওটা এখুনি খেয়ে নিন।

শুনে গিদার নাম্বার টু এর চোখ বড় বড় হয়ে যায়। নিজের অজান্তেই সে সমুচার ঐ চর্বিত টুকরোটি নিয়ে মুখে পুরে দেয়।

এবার শিহাব ‘গুইয়্যা গুঁফোকে’ বলে,
– আপনার গোঁফেও লেগে রয়েছে। তবে গোঁফে লেগে থাকা খাবার খাওয়া হারাম হবে। পানি খেতেও সাবধানে খাবেন। এজন্যই গোঁফকে ছেটে ছোট রাখতে বলা হয়েছে।

ওর কথায় দুই গিদার একটু ভড়কে যায়। ভীত কন্ঠে নাম্বার টু বলে,
– আপনি কে ভাই?

উত্তর না দিয়ে শিহাব একটু সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েও আবার ফিরে আসে। খুব গম্ভীর স্বরে জানায়,
– আমি কে সেটা জানা এতোটা জরুরী নয়। তবে আমাকে পাঠানো হয়েছে ঐ গুলো দেখার জন্য।

দুই গিদারের হাতের নখের দিকে নির্দেশ করে কথাগুলো বলে শিহাব।

দোকানি এবং তাঁর কর্মচারী এবার গিদারদের নখের দিকে তাকায়। গিদার দু’জন নিজেরাও তাকায়। নিজেদের সৃষ্ট নোংরামি দেখে লজ্জা পায় এবং আরো একটু ভড়কে যায়। একবার নিজেদের নখের দিকে এবং পরক্ষনেই শিহাবের মুখের দিকে তাকায়। শিহাব আর কথা না বলে সামনের দিকে চলে যায়।

চারজন মানুষকে সকালবেলাতেই বিভ্রান্ত করে দিতে পেরেছে! এই আনন্দ নিয়ে সে রাস্তার ওপাশের যাত্রী ছাউনিটির দিকে এগিয়ে যায়। পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা… পকেটে দশটি টাকা। সবে দশটা বাজে। আরো কয়েক বেলার খাবার কীভাবে ম্যানেজ হবে তাঁর জন্য মনের ভিতরে দুশ্চিন্তা!

ছাউনিতে বসে বসে ওর থেকে অনেক ছোট দুই ছোকরা সিগ্রেটে গাঁজা ভরছিল। একজন সিগারেটের ভিতর থেকে ‘সুকা’ (তামাক) ফেলে দিচ্ছে। অন্যজন তাঁর হাতের চেটোতে (তালু) গাঁজা রেখে নখ দিয়ে খুটে খুটে ছিড়ছে। এক্ষেত্রে নখ ব্লেডের কাজ করছে।

শিহাবকে হঠাৎ ছাউনির ভিতরে ঢুকতে দেখে দুজনেই ‘ফ্রিজ’ হয়ে যায়। সিগারেটের ‘সুকা’ যে ফেলছিল সে ওটাকে স্বাভাবিক ভাবে ধরে রাখে। যেন এখুনি সিগারেট ধরাতে যাচ্ছিল। আর হাতের চেটোতে গাঁজা নিয়ে যে ছিড়ছিল, সে অন্য হাতকে গাঁজা রাখা হাতের সাথে মিলিয়ে বসে রইলো।

একপর্যায়ে দুই ছোকরা অর্থহীন কথা বলা শুরু করে,
– আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবো দোস্তো? একটা বাসও তো আসছে না।
উত্তরে অন্যজন বলে,
– বসে থাক, আসবে।
অথচ একের পর এক বাস আসছে আর যাচ্ছে।

শিহাব যেন ওদেরকে দেখেও দেখে না। তবে পকেট থেকে মোবাইল বের করে একটা কাল্পনিক নাম্বারে ডায়াল করে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ওপাশের অদৃশ্য ব্যক্তির ফোন রিসিভ করার জন্য।

এরপর কথা শুরু করে,
– হ্যা স্যার, আপনার ইনফর্মেশন ঠিকই ছিল। আমি জায়গামতোই এসেছি। ফোর্স আশেপাশেই রয়েছে। …কি বললেন? দু’জন?

এবার সে ছেলে দুটির দিকে তাকায়… একটু দেখে এবং আবার কথা শুরু করে,
– হ্যা হ্যা, অল্পবয়সী। ওরাই… আজকাল এরাই সিন্ডিকেটের সদস্য হয়ে থাকে। জি… স্যার… স্যার… ওকে। আইল ইনফর্ম ইউ ল্যাটার।

মোবাইল হাতে নিয়ে কল কেটে দেবার ভান করে। এতক্ষণে ছেলে দু’টির অবস্থা প্রায় কেরোসিন। না পারছে ছাউনি থেকে বের হতে… না বসে থাকতে। এদিকে ওরা ভাবছে শিহাব একা, দু’জন দু’দিকে দৌড় দিলে সে কাকে ধরবে আগে? কিন্তু ঐ যে ফোর্স আশেপাশে রয়েছে শুনে তাও করতে পারছে না। সাথে রয়েছে গাঁজা। এটা না থাকলে কোন বাল্টা ফালাইতো তাও দেখতো নাহয়। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন।

শিহাব ওদের দু’জনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ওরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওর দিকে তাকায়। সে হাত পাততেই যার হাতের চেটোতে গাঁজা রয়েছে সে সবটকু দিয়ে দেয়। অন্যজন খালি করা সিগ্রেটের খোসাটিও দিয়ে দেয়। এবার প্রথমজন পকেট থেকে গাঁজার পোটলাটি বের করে শিহাবের হাতে ধরিয়ে দেয়।

সব দেয়া শেষ হলে শিহাব বলে,
– তোমাদের বয়স অল্প বলে আজ ছেড়ে দিলাম। আর কখনো এগুলো ছোঁবে না, বুঝেছ?

ছেলে দু’জন ঘাড় কাত করে তাঁদের সম্মতির কথা জানায়।

শিহাব বলে যেতে থাকে,
– এখন সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে রাস্তার দু’দিকে দেখেশুনে রাস্তা পার হবে। এরপর সোজা বাসায়। একবারও পিছনে ফিরে তাকাবে না।

ছেলে দুটি যেন মুক্তির স্বাদ পেয়ে বাতাসের বেগে ভেগে যেতে চায়। কোনোমতে ছাউনি থেকে বেরিয়ে রাস্তার দু’দিক ভালোভাবে দেখে নেয়। এরপর পার হয়ে ফাস্টফুডের দোকানগুলোর পাশ দিয়ে দ্রুত ক্যাম্পাসের ভিতরে অদৃশ্য হয়।

ওরা চলে গেলে শিহাব ‘স্টিকটি’ বানানো শেষ করে।
পকেট থেকে ম্যাচ বের করে ধরায়… আয়েশ করে মিষ্টি গন্ধের কটু ধুঁয়া গিলতে থাকে আর ভাবে,
– জিরো-টলারেন্স! মাই-ফুট।

নিজের মনে হাসে সে। হাতের নাগালে সবই পাওয়া যায়। মেথর পট্টি, নিরিবিলি, আনারকলি, কলমা- এসব জায়গা এখন সে যেখানে বসে আছে সেটার আশেপাশেই। মাদকের স্পট এগুলি। সবই পাওয়া যায়। অথচ কত নাটক! জিরো-টলারেন্স 😀

গাঁজার স্টিকে দম দিতে থাকে শিহাব। যদিও জানে এতে তাঁর ক্ষুধা আরো বেড়ে যাবে। পকেটে মাত্র দশ টাকার একটি বঙ্গবন্ধুওয়ালা নোট, অথচ খেতে হবে তিনবেলা। বিদ্যমান ক্ষুধাকে কিছু সময়ের জন্য ভুলে গিয়ে গাঁজার স্টিকটিতে একের পর এক দম দেয় সে। ওর ফুসফুস ধুঁয়ায় ভরে যায়। চোখ দুটোতে ঝিম ধরে… তবুও সেই ঝিমধরা দৃষ্টির পেছন থেকে অফুরন্ত এক ক্ষুধা উঁকি দিতেই থাকে। এভাবেই আবহমানকাল ধরে ক্ষুধা বিষয়টি নিজের উপস্থিতি জাহির করে আসছে। একে কেন্দ্র করেই সভ্যতার শুরু… একদিন পতনও হবে হয়তো একে কেন্দ্র করেই।

#প্রান্তিক_গেটে_একদিন_মামুনের_অণুগল্প_৫৪৫

বাড়ি_ফেরা_গল্পগ্রন্থ_অপেক্ষা

অনেক আগে লেখা আমার একটি ছোটগল্প শেয়ার করছি। তখন কোনাবাড়িতে গোলামী করি। সপ্তাহে একদিন বাসায় আসি। সেই সাপ্তাহিক একদিনের বাড়ি ফেরার মুহুর্তের অনুভূতি নিয়েই এই গল্পটি:

________________
বাসায় ফেরার দিনে সময়টা খুব দ্রুত কেটে যায়। সকল কাজকর্ম অন্যদিনের তুলনায় একটু আগেই শেষ করে ফেলতে ইচ্ছে হয়। সে ও করে। একটু তাড়া থাকেই। সহকর্মীদের মৃদু হাসি… আসন্ন কোনো ষড়যন্ত্রের আভাস কি? যার উৎপত্তি ওদের যার যার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে।

বাইরে বের হতে হতে সোয়া সাতটা বেজে যায়। অন্যরা আরো পনের মিনিট আগেই বের হয়েছে। অফিস গেটের সামনের চায়ের দোকানগুলোতে অলস আড্ডা দিচ্ছে কেউ কেউ। ফুটপাথে আমের ঝুড়ি এবং কাঁঠাল সাজিয়ে নিয়ে বসেছে একজন। পাশের দুটো গাছে কাপড়ের ব্যানার, ‘এখানে ফরমালিনমুক্ত আম-কাঁঠাল পাওয়া যায়।’ হাঁটতে হাঁটতে ভাবে , যে হারে ফরমালিন মিশানো ফল খেয়ে এসেছে এতোগুলো বছর, তাতে এখন হঠাৎ ফ্রেশ ফল খেলেই বরং অসুবিধে।

রাস্তায় বের হলে দুই ধরণের মানুষ দেখা যায়। যারা নিজের গাড়িতে চলাফেরা করে আর অন্যরা পাবলিক পরিবহন ব্যবহার করে। প্রাইভেট কারের ভিতরে যারা থাকে তারা ট্রাফিক জ্যামের বিড়ম্বনাটুকু এসির ভিতরে বসে উপভোগ করা ছাড়া আর তেমন কিছু অনুভব করে কি? যত কষ্ট সব তো পাবলিক পরিবহনের যাত্রীদের। একটা রিক্সা নিয়ে হাইওয়ে দিয়ে যেতে থাকে। বাম-ডান দু’পাশ দিয়েই বাস-ট্রাক আর ম্যাক্সির ভীড়। যে যেভাবে পারছে ফাঁক পেলেই ঢুকিয়ে দিয়ে অলস বসে থাকছে। রিক্সাগুলো পথচারীদেরকে হঠাৎ চমকে দিয়ে বেল বাজিয়ে ফুটপাথের সংকীর্ণ জায়গাটুকুও দখল করে নিচ্ছে। এরা সবাই পোশাক শ্রমিক। সারাদিনের পরিশ্রান্ত দেহটিকে একটু আরাম দেবার জন্য হাতে হটপট নিয়ে বাসায় ফিরছে। ওর খুব ভালো লাগে এই বাড়ি ফেরা মানুষগুলোকে দেখতে।

একটা ব্যাংকের সামনে রিক্সা থামে। অনেক ফলের দোকান অবৈধভাবে চলাচলের পথে গড়ে উঠেছে। সেখান থেকে পুলিশ এবং ক্ষমতাসীন দলের পাতি নেতারা টাকা খায়। এরা খায় না কি তা-ই ভাবে সে। পাঁচ বছর ক্ষমতায় আসে সবাই। তাই যত পারে খেয়ে নিতে চায়। সপ্তাহের শেষ দিনে বাড়ি ফেরা মানুষের ভীড়টা অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু বেশী-ই থাকে। বাসের ছাদে মানুষ, ভিতরে বাদুড় ঝোলা হয়ে ঝুলছে। তারপরও সবাই উঠতে চায়। গেটে কয়েকজন ঝুলে ঝুলে চলছে। একটা ইঞ্জিন চালিত অটো এসে থামতেই মিছিল করে সবাই কে কার আগে উঠবে সেই প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। সে অপেক্ষা করতে থাকে একটু অপেক্ষাকৃত কম ভীড়ওয়ালা বাহনের।

একটা ম্যাক্সীর সামনে ড্রাইভারের পাশে একজনের জায়গায় দু’জন বসে রওয়ানা হল। চাপাচাপি এবং দুর্ঘটনার শিকার হলে একেবারে নেই হয়ে যাবার শঙ্কাকে বুকে নিয়ে পথ চলা। এক ধরণের থ্রীলও অনুভব করে। তবে ড্রাইভার ব্যাটার বকবকানি কানকে এবং তার ধরানো সিগ্রেটের ধোঁয়া পরোক্ষভাবে ফুসফুসকে ঝালাপালা করে দেয়। কিন্তু কিছুই করার নেই। যে দেশে আইন হলেও বিধিমালার অভাবে আইন ‘এক্সিকিউট’ হয়না, সেখানে এইটুকু নাগরিক ‘টর্চার’ তো সহ্য করতেই হয়।

ম্যাক্সী থেকে নেমে কিছুটা হাঁটতে হয়। এসময় তলপেটে চাপ অনুভব করে। কিন্তু রাস্তার পাশে তো আর ভারমুক্ত হওয়া যায় না। তাই মনের দুঃখ মনেই চেপে রেখে পরবর্তী রুটের বাহনের খোঁজে রাস্তায় ভীড় করা ‘পাবলিকে’র সাথে মিশে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়।

এভাবে আরো দু’বার বাহন পরিবর্তন… সেই একই বিড়ম্বনা… প্রচন্ড ভীড়ে মানুষের ঘামের দুর্গন্ধে শরীর গুলিয়ে ওঠা… বিড়ি-সিগ্রেটের ধোঁয়ায় জ্বালা করা চোখের রক্ত বর্ণ লাভ … স্বল্প পরিসর জায়গায় কোনো যুবতীর পাশে বসে তার শরীরের সাথে লেপ্টে থেকে তার অসহায়ত্বটুকু অনুভব করে ম্রিয়মান হওয়া… আর অতিরিক্ত ভাড়া চাওয়া নিয়ে যাত্রী এবং কন্ডাক্টরের ভিতরের বচসা শুনে ক্লান্ত হতে হতে একসময় নিজের বাড়ির পথের প্রান্তসীমায় পৌঁছানো। নিজের অজান্তেই স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসা। এ যেন প্রচন্ড একটা উত্তেজনামুখর স্টেডিয়ামের ভিতর থেকে বের হয়ে একটি ‘সাউন্ডপ্রুফ’ রুমে প্রবেশ করা।

দেড় ঘন্টার পথ পৌনে তিনঘণ্টায় অতিক্রম করাতে বাড়ির রাস্তাটি একদম নীরব… স্তব্ধ… কোথাও কেউ নেই। রাস্তার কুকুরগুলোকেও দেখা যায়না। দু’পাশে গাছ নিয়ে অন্ধকারে একটা সোজা রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে সে বাড়ির পরিচিত রাস্তাটিতে এসে পৌঁছায়। এমন সময় মোবাইল বেজে উঠে। যে মেয়েটি সপ্তাহ ধরে ওর জন্য আগ্রহ ভরে অপেক্ষা করছে সে খুব মোলায়ে স্বরে জানতে চায়, ‘তুমি কোথায়?’ এতোক্ষনের জ্বালা-যন্ত্রণা টেনশন-হতাশা মুহুর্তেই উধাও হয়ে সেখানে আসন্ন এক ভালোলাগার সুখানুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে মন। হাঁটার গতি কিছুটা বেড়ে যায়। অন্ধকারে মিশে থাকা গাছগুলোকে এতোক্ষণ অশরিরী’র মতো মনে হচ্ছিল। এখন ওদেরকে কত চেনা পরম বন্ধু মনে হয়। ওরাও পথের দু’পাশে পরম হিতৈষীর মতো ডাল নুইয়ে পাতা দুলিয়ে স্নেহের পরশ বইয়ে দিয়ে যায়। তাতে ওর হৃদয়মন দুই-ই শান্ত হয়।

লাইফ ইজ বিউটিফুল!
তবে এ দেশে জীবন আমাদেরকে কিছু কিছু সময়ে এই অনুভূতির উদ্রেক করায়। বাকিটা সময়ে ওর কাছে জীবনকে ইদানিং কেমন এক বোঝা মনে হয়। যা থেকে মুক্তির একটা পথ কখনো কখনো এ হৃদয় পেতেও চায়…।

‘… এ বোঝা টানার দিন কবে শেষ হবে?
রাত শেষ হয়ে সুর্য উঠবে কবে?
ঘরেতে অভাব, পৃথিবীটা তাই মনে হয় কালো ধোঁয়া,
পিঠেতে টাকার বোঝা, তবু এই টাকাকে যাবে না ছোঁয়া-
রাত নির্জন, পথে কত ভয়, তবুও রানার ছোটে,
দস্যুর ভয়, তারো চেয়ে ভয় কখন সুর্য উঠে।’ *

সে একজন রানার… ছুটে চলাই যার নিয়তি। এর ভিতরেই যা কিছু উপভোগ করা… অপেক্ষায় থাকা কোনো এক বনলতার ফোন পেয়ে বেঁচে থাকার প্রেরনা লাভ করা… কোনো এক নির্জন তাল গাছের থেকে একটু দূরে ভারমুক্ত হওয়া… যানবাহনের ভীড়ে কোনো অচেনা তরুনীর সাথে লেপ্টে থেকে নিজের মনের ভিতরের কালো সাপকে দমন করা… এসব কিছু মিলিয়েই বর্ণীল জীবন।

আর জীবনের প্রয়োজনেই সে একজন রানার। সিঁড়িদের বুক মাড়িয়ে অনেক উঁচুতে উঠে যাওয়া… কিন্তু পদস্খলনের ভয়ে পিছিয়ে যাওয়া নয়। জীবন তো কেবলি সামনের দিকেই এগিয়ে যায়।

সে ও যায়।।
__________

#বাড়ি_ফেরা_গল্পগ্রন্থ_অপেক্ষা
* সুকান্তের কবিতার লাইন

সন্ধ্যা_নেমে_এলো_মামুনের_ছোটগল্প

আমাদের দেশে সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে, এমন মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা। এই ছোটগল্পটি সোনার চামচ মুখে দেয়া যুবকদের সম্পূর্ণ বিপরীত শ্রেণির এক যুবকের। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষে চাকুরি না পেয়ে অক্ষম যন্ত্রণায় সময় কাটায়। আমাদের অনেকের জীবনেই এমন মুহুর্ত এসেছে। চলুন নিজের জীবনের সাথে মিলে কিনা দেখে আসা যাকঃ-
___________________________
এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে।
রংধনুর রং এর লুকোচুরি দেখতে দেখতে পথ হাঁটছি। সোনালী বিকেলটাকে আবার এতো তাড়াতাড়ি যে ফিরে পাবো ভাবিনি। কিছুক্ষণ আগেই নীলচে কালো মেঘেরা সব গুড়ুম গুড়ুম করে আকাশটাকে দখল করে নিলো। টিউশন শেষ করে মেসে ফেরার তাড়া ছিল না। তাই উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটাহাঁটি আর ঠোঁট না নাড়িয়ে গুনগুন, ‘কত যে কথা ছিল, কত যে বেদনা…’। ঠোঁট না নেড়ে কখনো গুনগুন করেছ? এটা নাকের বাঁশী ও কন্ঠনালী ব্যবহার করে করতে হয়। গানের কলি শুনলে মনে হচ্ছে যে কতটা দুঃখ হৃদয়ে নিয়ে হেঁটে চলেছি। আসলে তা নয়। তবে একেবারেই যে দুঃখ নেই তাও না। সুখও নেই, দুঃখও নেই। এটাকে এক কথায় প্রকাশ করলে কি যেন হয়?

পকেটে একটা টাকাও নেই। রিক্সার দশ টাকার পথ হেঁটে মেয়েটিকে পড়াতে যেতে হচ্ছে। আজ তিনদিন ধরে। মাসের ছাব্বিশ তারিখ। এই মাস আবার একত্রিশে । কেন, সব মাসগুলো ত্রিশ দিনে হলে কি হয়? আরো পাঁচ দিন এভাবে যেতে হবে। অন্যরা সপ্তাহে তিন কি বেশী হলে চার দিন পড়ায়। আর আমার বেলায় একদিন বন্ধ রেখে প্রতিদিন। আমার চেহারায় কিছু একটা আছে হয়তো। অভিভাবকেরা প্রথম দেখায়-ই বুঝে যায়। কলুর বলদ একটাকে পাওয়া গেছে। অবশ্য আমি বলদ হলেও পড়াই ভালো। যাদের রেফারেন্সে টিউশন দিতে আসি, তাঁরা আমার সম্পর্কে ভালোই বলে। অন্তত আমার একাডেমিক রেকর্ডও সে কথাই বলে।

আজ দেড় বছর এই টিউশন এর ওপরই বেঁচে আছি। এটা বললে মোল্লারা আবার ক্ষেপে যাবে না তো? ‘আস্তাগফিরুল্লাহ! লা হাওলা ওয়ালা কুয়্যাতা…’ বলে শাপলা চত্বরে আমার বিরুদ্ধে আমরণ অনশনে না বসে যায়। কি করব বলো। চাকরি পাই না। প্রথমদিকে অনেক ইন্টারভিয়্যু দিয়েছি। একটা হ্যান্ডবুকই লিখে ফেলতে পারতাম মনে হয়। ‘দ্য হ্যাণ্ডবুক অফ আনএমপ্লয়েড ভ্যাগাবন্ড’ নামটি কেমন হয়? আসলে চাকরির জন্য যে যোগ্যতা লাগে তা আমার নেই। এখন যদি তোমরা কেউ জিজ্ঞেস করো, কি ‘যোগ্যতা’ লাগে, আমার অনেক সময় নষ্ট হবে। এমনিতেই আমার সময় নেই… এখন সাড়ে পাঁচটা বাজে। পৌনে ছ’টায় নির্দিষ্ট একটা জায়গায় আমাকে থাকতে হবে।
একজন অপেক্ষা করবে।

আজ ক’দিন ধরে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। কোনোভাবেই আজ পালানো যাবে না। তাহলে আমাকে রাত কাটাতে হবে কোনো পার্কে বা স্কুলের বারান্দায়। কারণ সে সোজা আমার মেসে চলে আসবে। আমি জানি। এবং ওকে আমার থেকেও বেশী জানি। কলি এ ধরনেরই মেয়ে!

একটা বিড়ি খাইতে পারলে মন্দ হতো না। বিড়ি শুনে আবার নাক কুঁচকে ফেলো না যেন। সিগ্রেটকে আমি বিড়িই বলি। বিড়ি হোক আর সিগ্রেট হোক… জ্বালিয়ে ছারখার করবে তো সেই আমাকেই। এ জীবনের মত! একটু পা চালিয়ে যাবার চেষ্টা করি। সামনে এক ভদ্রলোক (নাহ! তাঁকে ভদ্রলোক বলা যাবে না। সে প্রকাশ্যে ধুমপান করছে… আইন ভাঙছে। ভদ্রলোকেরা আইন মেনে চলবে।) ধুমপান করতে করতে হাঁটছেন। ওনার সিগ্রেট টা ফেলে দিলে না হয় দু’তিন টান দিতে পারবো। এভাবে অনেক কুড়িয়ে ফেলে দেওয়া সিগ্রেট টেনেছি আমি। কোথাও এইগুলিকে ‘মোতা’ সিগ্রেট বলে।

অভদ্রলোকটির ফেলে যাওয়া সিগ্রেটের শেষাংশে কষে তিনটি টান দিতে পারলাম। নিকোটিনের বিষে ফুসফুসকে ভরিয়ে দিতে যে কি আনন্দ! এই একই আনন্দ পাই যখন কলির পাশে বসে বসে ওর বকা শুনি… ‘এটা পারো না… কেন এমন হল… এত দেরী কেন… এই, তুমি আবার সিগ্রেট খেয়েছ’ ইত্যকার হাজার রকমের কেন শুনে শুনে এতোটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে, এখন আর না শুনলে ভালো লাগে না। কলি আমার ভ্যাগাবন্ড জীবনের অন্যতম নেশা!

আজ কলিকে আমার নিজের একটি অনুভুতির কথা বলতে হবে। আরে, অন্য কিছু ভেবে বস না আবার। সেদিন হেলাল হাফিজের একটি কবিতা আবৃত্তি করছিলাম। কলি চুপচাপ আমার আবৃত্তি শুনল। আমার শেষ হলে বলল, ‘ আমাকে স্পর্শ কর, নিবিঢ় স্পর্শ কর নারী’ এই লাইন আমাকে বুঝিয়ে দিবে। এখানে প্রথমবার স্পর্শ দিয়েও কি তাঁর অনুভুতি হয়নি, আবার নিবিঢ় স্পর্শ কথাটি কেন বললেন?’
কি বিপদে পড়লাম দেখ দেখি। ওকে খুশী করার জন্য রাত জেগে জেগে কবিতা মুখস্ত করি। আমার একাডেমিক পরীক্ষাগুলোর আগে এর ছিটেফোঁটাও যদি করতাম… হয়তো আরো… বেটার কিছু হতো।
কে যেন পিছন থেকে বলল, ‘বালটা হইত… তুই ব্যাটা এখনো যা আছিস, তখনো তাই-ই থাকতিস… এখন হাঁটার উপরে থাক।’ চারপাশে তাকাই। কিন্তু কাউকে দেখি না। সকালে স্টিকে টান দিয়েছিলাম বলে তো মনে পড়ছে না।

যখন কলির কাছে পৌঁছলাম, অলরেডি দশ মিনিট দেরী হয়ে গেছে। বসের সামনে দাঁড়ানোর মতো কাঁচুমাচু হয়ে আছি। আমাকে অবাক করে দিয়ে এই প্রথম দেরীর কারন জানতে চাইল না সে। বলল,
– তোমাকে যে কাজ দিয়েছিলাম, করেছ?
‘ কোন কাজটা যেন?’
এমন ভাবে আমার দিকে তাকালো, আমার তাতেই হয়ে গেল। বললাম,
‘না, মানে এতো ব্যস্ত থাকি যে সব কিছু কেমন আউলা হয়ে যায়। একটু মনে করে দিলে ভালো হয় ডার্লিং!’
– দেখ, আমার সাথে তুমি ফাজলামো করবে না। তুমি হেঁটে আসার পথে এইগুলো নিয়েই ভাবছিলে। কি, মিথ্যে বলেছি?
আমি ভেবে পেলাম না, ও কীভাবে জানল আমি কি ভাবতে ভাবতে এসেছি ! বললাম,
‘ডার্লিং, বললে তুমি বিশ্বাস করবে না… আমি ঐ কবিতার লাইনটির অর্থ নিয়ে ঘন্টার পর ঘণ্টা সময় কাটিয়েছি। কিন্তু…’
– কিন্তু কি?
‘আমার মাথায় একটা গান ঘুরপাক খাচ্ছে। সেই গতকাল থেকে। কোনোভাবেই বের হচ্ছে না…’
– কোন গানটা?
‘দুশমনি করো না প্রিয়তমা’ এইটা। মাথায় বাজতে বাজতে শেষে ‘দুষ্টুমি করো না প্রিয়তমা’ হয়ে যাচ্ছে।’

দাঁড়ানো অবস্থা থেকে কলি বসে পড়ল। ওর মুখ থমথমে… নাকের নীচে হাল্কা ঘাম জমেছে… বড়ই ভালো লাগছে! আমার বুকের ভিতরে কিসে যেন টান মারল… আমি ভাবলাম, কেন ওর সাথে এরকম করছি? ও যা চায়, সেটা করলে ক্ষতি কি? পরক্ষণেই ভাবি, নাহ, আমার মত ভ্যাগাবন্ডের সাথে ওকে মানায় না। আমি ওকে কোনো সুখই দিতে পারব না। তবে কেন ওর সাথে মায়ায় জড়ানো?

আমাকে ও ওর পাশে বসতে বলল। আমি বসলাম। ওর শরীর থেকে খুব সুন্দর হাল্কা অচেনা পারফিউমের ঘ্রাণ পেলাম। ওকে আরো বেশী করে একজন নারী মনে হল… খুব কাছে পেতে ইচ্ছে হল। কিন্তু একটু আগের নিজের অনুভুতির কথা ভেবে এখনকার অনুভুতির গলা টিপে ধরলাম। সে আমার একটা হাত ধরল… আমি কেঁপে উঠলাম। আমাকে বলল,
– আর আমার মাথায় জগজিৎ বসে আছে… ভাবোতো রেইল লাইন ধরে হাঁটছি… খুব চেনা পথটি ধরে… আর জগজিৎ কানে কানে বলছে…’মুঝে তুম সে মোহাব্বাত হো গ্যায়ি হ্যায়… ইয়ে দুনিয়া খুবসুরৎ হো গ্যায়ি হ্যায়… উফ! কখন যে সন্ধ্যা হবে!

আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম। ভাবলাম কলি পাগল টাগল হয়ে গেলো না তো! ওর হাত ধরা অবস্থায় ওর শরীরও তেমন গরম অনুভব করলাম না। নিশ্চিন্ত হলাম। সে ও মনে হয় আমার সাথে দুষ্টুমি করছে। বললাম,
‘সন্ধ্যা হলে কি তুমি খুশী হও?’
– হ্যা! কেন তুমি হও না?

‘নাহ, সন্ধ্যা হলেই আমার সেই মেসের জীবন শুরু হবে। তুমি তো তোমার বাসায় চলে যাবে। আমার একেলা জীবন… একেবারে সেই পরেরদিন তোমার সাথে দেখা হবার আগ পর্যন্ত।’

– একেলা জীবন মানে মেসের জীবন কি খুব কষ্টের?

আমি হাসলাম। কলি একটু বিব্রত হল। বললাম,
‘সন্ধ্যা নামতেই যখন চারিদিকে আঁধার হয়ে যাবে… আমার মেসের দরোজা আমার জন্য উন্মুক্ত হবে। রাত আমার কাছে কোনো আনন্দই আনে না। কাঠের চৌকি আর অন্ধকারের স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে ছারপোকারা আমাকে কুঁরে কুঁরে খাবে…ইদুর দৌড়ে যাবে রাতের অন্ধকারে… আমি ওদের গাঁয়ের ঘ্রাণ পাবো…রুম মেটের নাক ডাকার শব্দে আমার বিনিদ্র রজনি কেটে যাবে…

দিনের বেলায় আবার আমি সেই সবার চির পরিচিত আমি…হাসবো… হাসাবো… কিন্তু কাঁদব একা একা! ভাবতে পারো? একজন মানুষ কতটা রূপ নিতে পারে… আমি আমার জীবনের বিভিন্ন ধাপে অনেকগুলো ফেইক আইডি বানিয়ে এক একজনের চরিত্রকে আমার নিজের ভিতরে ধারণ করতে চেয়েছিলাম…

কখনো আমি নর…কখনো নারী… কিংবা বয়ষ্ক প্রেমিক পুরুষ অথবা নাবালিকা শিশু।

সব রূপেই আমি আমাকে চিনতে চেয়েছি… মানুষ কে উপলব্ধি করতে চেয়েছি…কিন্তু বারে বারে ফিরে পেয়েছি এই আমিকে…এখন যেমন রয়েছি…সেই আদি ও অকৃত্রিম আমাকে।’

কলি আমার হাত ধরে বসে আছে… ওর দু’চোখ বেয়ে জল পড়ছে… ধীরে ধীরে সে আমার কাছে আসে… এতোটা কাছে যে আমাদের দুজনের নাকে নাক লেগে যায়… জীবনে এই প্রথম সে আমার ঠোঁটে তাঁর ঠোঁট ছোঁয়ায়… আমি ও সাড়া দিতে বাধ্য হই… নিজেকে মনে হচ্ছিল একজন শিক্ষানবিস। যে তাঁর টিচারের কাছ থেকে ‘ডিপ কিস’র লেসন নিচ্ছে।

ভালোভাবে লেসন নেয়া হয়ে গেলে কলির চোখে চোখ রেখে বললাম,
‘তোমার কবিতার উত্তর নিশ্চয়ই পেয়ে গেছ?’
– কিভাবে?
বললাম, ”আমাকে স্পর্শ কর, নিবিঢ় স্পর্শ কর নারী” – এখানে তুমি প্রথমে আমার হাত ধরে ছিলে… নিজের অজান্তে। সেটিই ছিল আমাকে স্পর্শ করা… একজন নারীর সাধারণ স্পর্শ। আর চোখের জ্বলে সিক্ত হয়ে পরবর্তীতে যে স্পর্শ করলে, সেটি ছিল আমার প্রতি প্রগাঢ় মমতায় তোমার স্বেচ্ছায় কাছে আসা। এই স্পর্শকেই কবি নিবিঢ় স্পর্শ বুঝিয়েছেন।’
-বাহ! এতো সুন্দর করে বুঝালে!
‘আমি কোথায় বুঝালাম? সবতো তুমি ই…’

সন্ধ্যা নেমে এলো… বলাকাদের মতো আমরা দু’জনেও ফিরে যাচ্ছি… যে যার ডেরায়। আমার এখন আর মেসের পরিবেশকে অসহনীয় মনে হচ্ছে না। ছারপোকা এবং ইঁদুরদেরকেও বড্ড আপন মনে হচ্ছে। মায়া লাগছে…

মায়ার এক অফুরন্ত জগতের ভিতর নিজেকে জড়িয়েছি যে!

একজন_উর্ধতন_কর্মকর্তার_পাইপজীবন_মামুনের_অসমাপ্ত_গল্প

[অনেক আগে লেখা আমার একটি অসমাপ্ত গল্প। গল্প না বলে একে গল্পের মুখবন্ধ বলা যায়। একে টেনে একটা চমৎকার উপন্যাসে রুপ দেবো ভেবেছিলাম..]

মধ্য আষাঢ়। ঝুম বৃষ্টি। বাইরে আঁধার। যদিও শিহাব যেখানে এখন শুয়ে আছে, সেটার দুই প্রান্ত ছালার চট দিয়ে ঘেরা, তাই ভেতরে সবসময়েই অন্ধকার থাকে। তারপরও ভেতরের অন্ধকার ছাপিয়েও কিছুটা আলো থেকেই যায়। আজ বাইরে আকাশের মন খারাপ। তাই আঁধারের মাঝে আরো কিছুটা আঁধারে ঢেকে আছে এক অন্ধকারের মানুষ, যার ভেতরটা আলোয় ভরা।

এখন দিন-রাত্রির কোনো প্রভেদ নাই। সবকিছু-ই একইরকম। কালো। রেললাইন সংলগ্ন এই পাইপজীবন তেমন খারাপ লাগছে না ওর কাছে। এখানে কোনো কাজ নেই। অখন্ড অবসর। সময়টা কাটে তাই চিন্তায় চিন্তায়। তবে এই চিন্তা কিছুদিন আগের চিন্তার মত না। তখন চিন্তার সাথে সাথে থাকত কিছু দীর্ঘশ্বাস, হতাশা, একটু আনন্দ। এখন চিন্তার সাথে শ্রেফ প্রশান্তি বিরাজ করে। আসলে কাছের সম্পর্কগুলো থেকে সরে আসায়, কাউকে নিয়ে মোটেও চিন্তা করতে হয় না শিহাবকে। যখন একজন মানুষ ছিল, তখন সবাইকে নিয়ে চিন্তা ছিল।

‘এখন কি তবে তুমি মানুষ নও?’

নিজের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে একটু ভাবে। ইদানিং নিজেকে নিয়েই চিন্তা-ভাবনায় মশগুল শিহাব। মানুষ কে? এর কি কোনো সর্বজন স্বীকৃত নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা আছে? না থাকারই কথা।
যখন মানুষ ছিল তখন সবাইকে নিয়ে চিন্তা করত। এই সবাই কি মানুষ ছিল?

প্রশ্নের উত্তর আরো প্রশ্ন নিয়ে আসে.. সেগুলো আরো। এভাবে মুহুর্তগুলি কেটে যায় দুপুরের খাবার নিয়ে যখন পাশের ‘পাইপে বাস করা’ ঝর্ণা, ছালার ওপারে গলাখাকারি দিয়ে বলে,
‘মামু, জাইগা আছ? তোমার লাগি খানা লিয়ে আইছি।’

ঝর্ণা শিহাবের দখল করা পাইপটির পাশের পাইপ-পরিবারের সব চেয়ে ছোট সদস্য। পঙ্গু ভিক্ষুক আজমত আলীর দুই মেয়ে। লিলি আর ঝর্ণা। লিলি-ঝর্ণার মা বছর পাঁচেক আগে মারা গেছে। সেই থেকে ওরা এই পাইপে পাইপে জীবন কাটাচ্ছে। তবে ওদের জীবনের শুরুটা ঠিক এমন ছিল না। গ্রামের বাড়িতে সবাই মোটামুটি নিশ্চিন্ত ছিল। আজমত আলী তখন সুস্থ। নিজের জমিজমা চাষ করে দিনগুলি ভাল-ই কেটে যেত। নদী-ভাঙ্গনের শিকার হয়ে এই পরিবারটি আরো কিছু পরিবারের মত পথে বসে গেল। উপায় না দেখে আজমত আলী ঢাকা এলো। শুরু হল রিক্সাওয়ালা আজমত আলীর বস্তিজীবন। ঝর্ণার মা ছালেহা ঠিকা ঝি’র কাজ নেয় মানুষের বাসায়। নতুন স্বপ্ন চোখে নিয়ে সামনের দিকে আগাতে থাকে এই পরিবারটি।

একদিন এক সড়ক দুর্ঘটনায় আজমত আলীর রিক্সাটি দুমরে মুচরে গেল। শরীরের নিচের অঙ্গ থেতলে যায়। একটা পা কেটে বাদ দিলে উপহার স্বরূপ ‘ক্রাচ’ লাভ করে আজমত আলী। বিধাতার উপহার?
তখন পুরো পরিবারটির দায়িত্ব ছালেহা বেগমের ওপর পড়ে। দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম করে সে। শ্রেফ স্বামী ও দুই মেয়ের জন্য দু’বেলা খাবার জোগাড়ের জন্য। বড় মেয়ে লিলি মায়ের সাথে কাজে যায়। কিন্তু মানুষের অমানুষ সুলভ আচরণে সে বাসায় কাজ করতে পারে না। নারী লোভী বেশ কিছু জানোয়ার আমাদের সমাজে মানুষের বেশে ঘুরে বেড়ায়। এরাই লিলিদেরকে খেয়ে-পরে বাঁচার ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে।

একদিন সকালবেলা ছালেহা বেগম আর কাজে যায় না। আজমত আলী ডাকতে গিয়ে দেখে, আর কখনো সে কাজে যাবে না। বিধাতার থেকে দ্বিতীয় পুরষ্কার লাভ করে আজমত আলী। ভিক্ষুক জীবনের শুরুটা সেদিন থেকেই। এবার বাপের সাথে ভিক্ষুকের সহকারী হিসেবে লিলি কাজে নামে। ঝর্ণা বাসায় থাকে। কিছুদিন বস্তিতে থাকলেও পরে এই পরিবারটি পাইপে শিফট হয়ে আসে। বাপ আর বড় বোন সারাদিন ভিক্ষা করে যা নিয়ে আসে, ঝর্ণা সেগুলো রান্না করে। এ ছাড়াও সে টুকটাক কাজ করে। কাজের তো আর শেষ নেই কোনো পরিবারে। হোক না সেটা পাইপ-পরিবার।

এই হল এক নজরে ভিক্ষুক আজমত আলীর পরিবারের গল্প। এরকম অনেকগুলি পরিবার এই রেললাইন সংলগ্ন পাইপে বাস করছে। এদের সবার-ই যার যার মত করে আলাদা আলাদা গল্প রয়েছে। একজন উর্ধতন কর্মকর্তা শিহাব, এদের মত না হয়েও এদের সাথে থাকছে। পঙ্গু ভিক্ষুক আজমত আলী তার একটা পাইপ ওর জন্য ছেড়ে দিয়েছে। কেন দিলো কিংবা শিহাব এখানে কেন?.. সে আরেক গল্প। ওটাও আমরা জানবো, তবে যে শিহাবকে আশ্রয় দিয়েছে, খাবারের ব্যবস্থা করছে, সেই আজমত আলীর অনুভবেই একজন উর্ধতন কর্মকর্তার পাইপজীবনের গল্পটিও আমরা শুনবো। তবে অন্য কোনো এক সময়…হয়তোবা।।

___________________________________________
#একজন_উর্ধতন_কর্মকর্তার_পাইপজীবন_মামুনের_অসমাপ্ত_গল্প।

আবৃত্তি_মামুনের_ছোটগল্প

যারা ভালোবাসার গল্প পছন্দ করেন, অনেক আগে লেখা আমার নিচের ছোটগল্পটি সময় থাকলে পড়তে পারেন…

জীবনের এক বিষম সময়ে পারুর সাথে আমার পরিচয়। বেঁচে থাকার কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। জীবন এক দুর্বিসহ দূর্ণিবার রুপে আমার সামনে উপস্থিত। শব্দে সেই রুপ আমি ব্যাখ্যা করতে অক্ষম। এমনই সময় ছিলো তখন।

টুকটাক লেখালেখির অভ্যাস ছিলো। এভাবে লিখতে গিয়ে লেখকদের এক গ্রুপের সদস্য হয়েছিলাম। আড্ডাবাজি আর লেখালেখির সমালোচনামূখর সময় কাটতো ওখানে। অনেকেই আসতো। সবার সাথে সেভাবে পরিচয় না হলেও, অনেককে মুখ চেনা চিনতাম। তাদের ভিতরে পারুও ছিলো!

তখনো মুঠোফোন যন্ত্রটি এদেশে আসে নাই। অ্যানালগ টেলিফোন দূরালাপনী যন্ত্র হিসেবে একমাত্র বিলাসিতা কিছু কিছু অবস্থাপন্ন মানুষের ঘরে। আমি যে মেসে থাকতাম, সেখানে এই যন্ত্রটি ছিলো। মেস ম্যানেজারের কৃপা দৃষ্টি ছিলো আমার প্রতি। কেন তা জানি না। কখনো জানতেও চেষ্টা করিনি আমি।

একদিন রাতে- ভয়াবহ ঝড়-বৃষ্টির রাত ছিলো সেটা। বিদ্যুত ছিলো না। তখন হারিকেনের অস্পষ্ট আলোয় মেসরুমগুলির বাসিন্দারা নিজেদের যৎসামান্য কাজ চালাতো। আর মোমবাতির অপেক্ষাকৃত উজ্জ্বল আলোর ব্যবহার আমাদের কাছে ছিলো বিলাসিতা। যাইহোক, মেস ম্যানেজার সেই রাতে আমাকে নিচে তলব করলেন। গেলাম।

কালো টেলিফোনের রিসিভারটি অবহেলায় ওনার সামনের নড়বড়ে চারপায়ার ওপরে পড়ে আছে। দাঁত খিলাল করতে করতে সেটার দিকে বাম হাতের অঙ্গুলি হেলন করে আমাকে বললেন,
– তোমার ফোন।

অবাক হলাম। কারণ এই শহরে আমাকে ফোন করার মতো কেউ থাকতে পারে, আমার কল্পনায়ও ছিলো না। বিস্ময়াভিভূত হৃদয়ে রিসিভার কানে ধরতেই ওপাশ থেকে ঝড়-বৃষ্টির কোলাহলকে ছাপিয়ে মিষ্টি একটা কন্ঠ আমার কানে মধু ঢেলে দিলো!

টেলিফোনের ওপাশের মানূষটির সাথে আলাপ শুরু করতে প্রথমেই নাকি ‘হ্যালো’ বলতে হয়। আমিও ঐ বিজাতীয় শব্দটা উচ্চারণ করলাম। ওপাশ থেকে জলতরঙ্গের মতো দু’টি শব্দ আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
– কেমন আছেন?

সেই-ই পারুর সাথে আমার প্রথম আলাপ। বিনা তারে এক অদৃশ্য সংযোগের সেই-ই প্রথম সূত্রপাত।

পারু যে ওর নাম সেটা কীভাবে জানলাম? সে-ই বলেছিলো আমায়। এরপর অনেক জল গড়ালো আমার সেই মফঃস্বল শহরটিকে ঘিরে বয়ে চলা একমাত্র নদীটির বুকের ওপর দিয়ে। দিনের পর দিন, অনেকগুলি রাত আমাকে মেস ম্যানেজার ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তার বিরক্তিভরা ভ্রুকুঠি অগ্রাহ্য করার মত মানসিক শক্তি আমাকে দিয়েছিলো, কালো রিসিভারের ওপাশের পারু নামের অচেনা একটি মেয়ে। নারী বললাম না; কারণ মেয়ে শব্দটি আমার কাছে খুব ভালো লাগতো। নারী বললে এক পূর্ণ যৌবনা সম্পন্ন কাউকে মনে হতো আমার সবসময়।

তবে পারু টেলিফোনে কথা বললেও কখনো ওর আসল পরিচয় তখনো আমাকে জানায় নাই। আমার লেখা কবিতা ওর নাকি খুব ভালো লাগতো! সে আমাকে টেলিফোনে দু’একটা আবৃত্তি করেও শুনিয়েছিলো।

এরপর ওর লেখা চিঠি আমার মেসের ঠিকানায় আসা শুরু হলো। অসাধারণ হস্তাক্ষর! চিঠিগুলির কাগজে কেমন ভালোবাসার ঘ্রাণ জড়িয়ে ছিলো! হাসছেন? হাসুন। ভালোবাসারও নির্দিষ্ট ঘ্রাণ আছে। আপনারা যারা কখনো ভালোবেসেছেন, সহজেই অনুভব করতে পারছেন আমার সেই ঘ্রাণের অনুভূতিটুকু।

আমিও নতুন উদ্যমে পারুকে নিয়ে অনেক অনেক কবিতা লেখা শুরু করলাম। একটা কবিতার কয়েকটা লাইন শুনতে চান? শুনুন তবে,

“প্রিয়দর্শিণী পারু! তুই কেমন আছিস?
তোর বুকের ওম মাখা প্রহরগুলি
এখন আমার শীতল ঘরের ফায়ারপ্লেস!
সেখানে আমি ইচ্ছেমতো পুড়ি-শীতল হই…
তুই কি বুঝিস?”

প্রথম প্রেমের পাগলাটে কিছু অনুভব! তবে আমার মনে ঐ সময় একটাই ইচ্ছে ছিলো। আমার শহরকে আগলে রাখা সেই ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে, এক তারা জ্বলা রাতে, ঘাসের বুকে পাশাপাশি বসে , পারুকে নিয়ে আমার লেখা কবিতা ওর নিজের মুখে আবৃত্তি শোনার!
সেই কথাটি পারুকে লিখে জানালাম। ওর সাথে দেখা করার সেই মাহেন্দ্রক্ষণটির অপেক্ষায় ওর দেবদাস অধীর ভাবে অপেক্ষমাণ। চিঠি চালাচালির সেই সময়ে টেলিফোনে কথা বলাটা কমে গেছিলো। কারণ আমাদের দু”জনের এমন অনেক কথা ছিলো, যেগুলি আমাকে পছন্দ করা সেই মেস ম্যানেজারের সামনেও বলা যেতো না! এমনই সব কথাবার্তা। বুঝতেই পারছেন?

একদিন চিঠিতে পারু জানালো, সে দেখা করবে! সেই অনুভূতি শব্দে কীভাবে প্রকাশ করি বলুন তো? ইঁদুরের শরীরের গন্ধে ভরপুর আমার মেস রুমকে মনে হচ্ছিলো জান্নাতুল ফেরদৌসের সবুজ গালিচাময় স্থান! আমি ভেসে যাচ্ছিলাম… কি করবো,কখন সন্ধ্যা হবে সেই অপেক্ষায় সময়ই যেন কাটছিলো না।

হ্যাঁ! ঠিকই ধরেছেন। আগেই বলেছিলাম, নদীর তীরের সবুজ ঘাসের বুকে পাশাপাশি বসে ওর আবৃত্তি শুনবো।

নির্দিষ্ট সময়ে আমি নির্দিষ্ট স্থানটিতে পৌছালাম। ওখানে আগেই পারু বসে আছে দেখলাম দূর থেকে। কম্পিত হৃদয়ে গুটি গুটি পায়ে ওর সামনে হাজির হলাম। প্রথম প্রেমের প্রথম অভিসার! আমার পারু চুপচাপ বসে আছে। আকাশের তারাগুলির ধার করা আলোয় চারপাশটা দেখার মতো উজ্জ্বলতায় ভরপুর ছিলো। আমি পারুর পাশে বসলাম। ওর শরীর ছাপিয়ে কি এক অজানা সুগন্ধি আমায় গ্রাস করে চলেছিলো। আমি ডুবে যাচ্ছিলাম… ক্রমশঃ এক বিহ্বলতার গভীর থেকে আরো গভীরতর প্রদেশে প্রবেশ করছিলাম! একি ভালো লাগা! একি ভালোবাসা! এমনই অ-অনুভবেয় এক অনুভূতি আমায় গ্রাস করে চলেছিলো।

আমি পারুকে নিয়ে লেখা আমার সেই ঐতিহাসিক কবিতাটি নিচের দিকে তাকিয়ে থাকা পারুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
– চোখ তোলো! চেয়ে দেখো আমায়।

পারু তাকালো আমার দিকে! নিঃশ্বাস রুদ্ধ এক মুহুর্তে আমার ভিতরের অন্তর্চক্ষু দিয়ে আমি ওর চোখের আলোয় জ্বলে উঠলাম। বললাম,
– নাও, আবৃত্তি করো।

মুহুর্তে দু’টি কম্পমান ঠোঁটের মৃদু নড়াচড়ার সাথে তারা জ্বলা আকাশ থেকে বর্ষণ শুরু হলো। আমার দিকে নির্ণিমেষ চেয়ে থাকা দু’টি নীল চোখ মুহুর্তে রঙ পালটে কালো হয়ে গেলো দেখলাম। সেখান থেকে বারিধারা টুপ টুপ করে পড়ছে। অবাক বিস্ময়ে আমি কম্পমান পারুর হাত থেকে এক টুকরো কাগজ নিলাম। গুটি গুটি অক্ষরের আমাকে লেখা পারুর শেষ চিঠিতে ছিলো,

– টেলিফোনে তোমার সাথে আমার বান্ধবী কথা বলেছে। আমিই তোমার আসল পারু। আমি কথা বলতে পারি না। আমার ৪ বছর বয়সে গলায় কী যেন হয়েছিল। সেই থেকে আমি বোবা হয়ে গেছি। আমায় ক্ষমা করো গো! আমি আবৃত্তি করে তোমায় শোনাতে পারলাম না!

ভালোবাসার মানুষটির পাশে আমি চুপচাপ স্থানুর মতো বসে রইলাম। সে ও নিশ্চুপ। ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে রাতের নিঃশব্দতাকে আরো নৈঃশব্দের গভীরে নিয়ে চলেছিলো জলের বয়ে চলার শব্দ। হৃদয়ে ভালোবাসায় মাখামাখি হয়ে বইছিলো পারু! আমার পারু! তীব্র ইলেট্রিক ব্লু আলোয় মাখামাখি হয়ে আছে বিশ্বচরাচর। সেই রাতের নীলচে আলোয় পারু এবং আমাকে, হৃদয়ের অধিপতি আমাদের ঈশ্বর – সস্নেহ ভালোবাসায় জড়িয়ে রেখেছিলেন দীর্ঘক্ষণ !!

#আবৃত্তি_মামুনের_ছোটগল্প

চোর_এবং_নাকফুল_মামুনের_অণুগল্প

[একটা সময় ছিলো- শ্রেফ একটা ছবি দেখেই গল্প লিখতে পারতাম। শব্দের সাথে শব্দ আপনাতেই পাশাপাশি এসে নিজেদের জায়গা করে নিতো। এখন লেখালেখি চলছে কেবল সাংবাদিকতার প্রয়োজনে। গল্পরা হারিয়েছে একজন মফঃস্বল সাংবাদিকের প্রতিদিনের প্রতিবেদনের আড়ালে।

যাই হোক, পোষ্টের সাথের ছবিটি আমার একজন ফেসবুক বন্ধুর। এই ছবিটি দেখেই কয়েক বছর আগে ‘চোর এবং নাকফুল’ নামের অণুগল্পটি লিখেছিলাম। আবারও শেয়ার করছি… ]

_______________
অন্ধকারের ও কী নিজস্ব কোনো আলো থাকে? কেন জানতে চাইছি?
বলছি, একটু পরেই।

এক লোড শেডিং এর রাত। মফঃস্বল শহরের ছোট্ট একটা প্ল্যাটফর্ম। শেষ ট্রেন দাঁড়ানো। অল্প কিছু যাত্রী ওয়েটিং রুমে। এদের বেশীরভাগই বরযাত্রী। মশার আক্রমন থেকে নিজেদের বাঁচাতে ব্যস্ত সবাই। বিরক্ত, বিব্রত আর ঘরে ফেরায় উন্মুখ।

ওয়েটিং রুম ছাড়িয়ে কালো ধাতব বিবর্ণ বয়স্ক ট্রেনটির অবয়ব অন্ধকারেও কিভাবে যেন চোখে পড়ে। এজন্যই বলছিলাম অন্ধকারেরও বুঝি নিজস্ব কোনো আলো থাকে। ব্রডগেজ দু’সারি লাইনের ওপারে একটা প্রাচীন চাম্বল গাছ। ওটার পিছনে চোরের মতো লুকানো আমি। নির্নিমেষ চেয়ে আছি ওয়েটিং রুমের খোলা দরোজার দিকে।

এক প্রবাসী ভদ্রলোকের হাত ধরে যখন স্টেশনের মূল গেট দিয়ে সুস্মিতা হেঁটে আসলো, বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না – স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। এত দূর থেকেও দেখলাম ওর বিষণ্ন নাকফুল নির্নিমেষ চেয়ে আছে আমার পানে… দীর্ঘক্ষণ আমি জগত সংসারের সকল আলোআঁধারি ভেদ করে দেখতেই লাগলাম!

রাতের ট্রেনের দীর্ঘ হুইসেল বিষাদের সুরভি মেখে মেখে, বাতাসে ভেসে ভেসে আরও বিষণ্ণ করে তুলেছিলো সে রাতের কুহকী প্রহর! সেই থেকে বিষণ্নতার প্ল্যাটফর্মের একমাত্র স্টেশনমাস্টার এই আমি!

অনেক কিছুই করার ছিলো আমার। ছিলো অনেক কিছুই দেবার। ছিলো না কেবল কারও কাছ থেকে কিছুই চাওয়া-পাওয়ার অধিকার। কারণ ঐ যে আগেই বলেছি, চোরের মতো ছিলাম। লুকোনো স্বভাব নিয়ে এক জীবনে সেভাবে কখনোই সামনে আসতে পারলাম না আমি!

সেই থেকে এক চোরের অনুভবে-কল্পনায় একটি নাকফুল, নৈশব্দের প্রহর গোনা ভালোলাগায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে আজও বিষণ্নতায় ছুঁয়ে যাওয়া একটি রংগীন চাদর! যার বর্ণে বর্ণে লুকোনো এক বিচ্ছিন্ন অতীত.. যা ক্রমশঃ শীতের নরম রোদের মায়াবী কোমল আদর হয়ে অন্তর্চক্ষু বুজিয়ে দিয়ে যায়!

সেই থেকে শূন্যতায় ডুবে আছি আমি
যার বুক জুড়ে
শুধু তুমিই
শুধু তুমি!

‘পিরিতি আরতি পিরিতি সারথি, পিরিতি গলার মালা রে…।’

আহ হারে পিরিতি! বিষম পিরিতি

কতটা ভালোবাসি – বলাই হলো না তাকে।। :(

___________________________
#চোর_এবং_নাকফুল_মামুনের_অণুগল্প।

কিছু_বলে_গেলে_না_মামুনের_অণুগল্প

এক পাতা ঝরার দিনে, ধরা হাত শিথিল হয়ে দু’জনের পথ দুটি দিকে বেঁকে যেতেই, প্রশান্ত মহাসাগরীয় হাবুডুবু খাওয়া আর থেকে থেকে অনুভবে তীব্র সাইনাস পেইনে জর্জরিত হওয়ার শুরুটা সেদিন থেকেই।

কাছের সম্পর্কগুলোর মুখোশের আড়ালের চেহারা বড্ড তীব্র ভাবে উৎকট দুর্গন্ধ ছড়িয়ে প্রকট হতে দেখে বিমর্ষ হয়েছিল তখন শিহাব।

তবে সব কিছু ছাপিয়ে একটা ভাবনায়ই অণুক্ষণ ডুবে থেকে ভাবে সে এখনো, ‘পারু এটা একটা কাজ করলো! কিছু বলে গেল না, দু:খগুলোও জেনে গেল না!’

সেই থেকে পারুর শহর অভিমুখী হৃদয়কে উন্মুক্ত ছেড়ে দিয়ে নিজের শহরের স্টেশন মাস্টার, একজন হৃদয়হীন শিহাব অপেক্ষায় থাকে, পারুর হৃদয়ের খবর নিয়ে নিজহৃদয় ফিরে এসে আবার তাকে হৃদয়বান বানাবে! অপেক্ষার প্রহরগুলিতে হৃদয়হীনের শুণ্য গহবরে অনন্ত নীল জোছনা বিরাজ করে!

‘পারু কিছু একটা বলে গেল না, ওরা এমন কেন?’ এক বিষন্ন মাঝরাত শুণ্য এক গহবরে নির্জনতার কুহকী প্রহর বুকে নিয়ে নীল জোছনায় পাক খেতে থাকে..।

“অতন্দ্রিলা,
ঘুমোওনি জানি
তাই চুপি চুপি গাঢ় রাত্রে শুয়ে
বলি, শোনো,
সৌরতারা-ছাওয়া এই বিছানায়
—সূক্ষ্মজাল রাত্রির মশারি—
কত দীর্ঘ দুজনার গেলো সারাদিন,
আলাদা নিশ্বাসে—
এতক্ষণে ছায়া-ছায়া পাশে ছুঁই
কী আশ্চর্য দু-জনে দু-জনা—
অতন্দ্রিলা,
হঠাৎ কখন শুভ্র বিছানায় পড়ে জ্যোৎস্না,
দেখি তুমি নেই “। *

_______________________________
* কবিতাঃ রাত্রি, কবিঃ অমিয় চক্রবর্তী
#কিছু_বলে_গেলে_না_মামুনের_অণুগল্প_৫৪২

পিছু_ফেরা_মামুনের_অণুগল্প

সেই ছেলেবেলায় আব্বা আমাকে আর আম্মাকে গ্রামে রেখে শহরের মেসে ফিরবার সময়, লঞ্চে উঠে একবারও পিছু ফিরে তাকাতেন না.. তখন বাবু মনের অভিমানে বড্ড ফুলে থাকতাম- আব্বা কেন ফিরে তাকালেন না? আরো অনেক পরে, আব্বা-আম্মাকে রেখে ভার্সিটিতে ফিরবার কালে, বাড়ির গ্রিল ধরে দাঁড়ানো আব্বা-আম্মা পেছনেই থাকতেন, না বুঝেই পিছু না ফিরে সামনে আগাতাম, ফিরে দেখবার ইচ্ছেটা কেন জানি মনে আসত না।

এরপর… চাকরি জীবনের কোনো একসময়ে সপ্তাহের প্রতি শনিবার, বেলা শুরুর ক্ষণে- গ্রিলের পেছনে আমার ফিরে তাকানোর অপেক্ষায় থাকা এক নারীর প্রতীক্ষা, হৃদয়ে অনুভব করেও আমি পেছন ফিরি নাই.. ভালোবাসা পুড়ে পুড়ে বাতাসে উড়ে উড়ে হারিয়েছে সুদূরে.. তারপরও পিছু ফিরি নাই, যেভাবে কখনো আব্বা ও ফিরতেন না!

আরও কিছুকাল পরে… গ্রিলের ওপারে বসে থাকা আব্বা নির্বাক হয়ে কেবলি অনুভবক্ষম রইলেন। তবুও তো ছিলেন। তারপর একদিন…

এখনো ব্যালকনি এবং গ্রিল যার যার জায়গায় একইভাবে থাকলেও গ্রিলের ওপাশটায় কেউ নেই! একজন মানুষের পিছু ফেরার অপেক্ষায় সেই বাবু বেলা থেকে এই শেষ বেলা পর্যন্ত অপেক্ষায় রইলাম! ফিরলেনই না তিনি আর :(

এখন নিঃসীম নিঃসঙ্গতায় ছুঁয়ে থাকি আমি একা! একদিন আমিও জ্ঞানী বাবুটাকে রেখে…

বাবাদের কি এমনই হতে হয়?

মামুনের_অণুগল্প : চোখের_আলোয়_দেখেছিলেম

অনেক আগের একটি লেখা আবারও পোষ্ট করলাম…

প্রতি সপ্তাহে শনিবারটা আমার কাছে মন খারাপের একটি দিন। এদিন বাসার সবাইকে ঘুমে রেখে অফিসের উদ্দেশ্যে চলে আসি। অন্য জেলায় অফিস। সপ্তাহে একদিন বাসায় আসি। নিজভুমে পরবাসি হবার জন্য।

পহেলা মে এবং শুক্রবার- দু’দিন সবার সাথে বেশ কাটালাম।

কাছের এক বন্ধু মুসার মৃত্যু আমার বাসার সদস্যদেরকেও শোকাহত করেছে। গত কোরবানির ঈদে বউয়ের শহর থেকে ঢাকায় ফেরার সময় বাস কাউন্টারে প্রয়াত বন্ধু এসেছিল। আমাদেরকে বিদায় জানাতে। আমার মেয়েদেরকে চিপস কিনে দিয়েছিল।আমার বউ’র সাথেও কিছুক্ষণ কথা বলেছিলো। বৃষ্টির ভিতরে বন্ধু আমার অনেকক্ষণ ছিলো। এইভাবেই আমার দুই বাবু এবং বউ’র স্মৃতিতে সেই রাতে কিছুক্ষণের জন্য বন্ধু নিজের অস্থায়ী আসন গেড়ে রেখেছিল। যা তাঁর মৃত্যু সংবাদে ওদেরকে ও শোকাতুর করে।

আমার বউ এবং আমি-দু’জনেই বন্ধুর এই অসময়ে চলে যাওয়াতে দুঃখ পেলেও, একজন অপরজনের সাথে আরো নিবিড় ভাবে রুটিন জীবন থেকে বের করা অল্প সময়টুকুকে কাজে লাগাতে চেষ্টা করি। দু’জনের মনের গভীরে বোধহয় বেজে উঠেছে, ‘সময় বেশী নাই’? প্রয়াত বন্ধু একটি উদাহরণ হয়ে আমাদের সামনে দৃশ্যমান।

আজ সকালে অ্যালার্ম ঘড়ি তাঁর ডিউটি পালন করলেও আমার কান সেটা পৌঁছাতে ছিল ব্যর্থ। তাই যেখানে সাড়ে চারটায় উঠার কথা, বউ এর ডাকে ৫টা ২২ মিনিটে ঘুম ভাঙ্গল। দ্রুত অজু-নামাজ শেষ করে রেডি হলাম। বাসা থেকে বাসস্টপ পর্যন্ত হেঁটেই যাই সচরাচর। তবে আজ দেরী বলে কথা। জুতোর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে কীভাবে দ্রুত পৌঁছানো যায় ভাবছিলাম। এমন সময় বউ বারান্দা থেকে বলল, ‘একটা রিক্সা খালি যাচ্ছে, দাঁড় করিয়েছি’। বাহ! ভালোই হলো। নীচের কেচি গেটের তালাও খুলে রেখেছে সে নিজে।

চমৎকৃত হলাম!

রিক্সায় উঠে বারান্দার দিকে তাকাতেই ভোরের তাজা ফুলের মত আমার বউ কে দেখলাম… হাত নেড়ে বিদায় জানালো সে।

মনের কোথায় যেন মোচর দিয়ে উঠল। হাত নেড়ে প্রতি উত্তর দিতে দিতেই ইঞ্জিনচালিত রিক্সাটি আমাকে আমার প্রিয়ার থেকে দূরে নিয়ে এলো।

এই মেয়েটির জন্য আমার আরো অনেক কিছু করা বাকি আছে। ভাবতে ভাবতে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ চোখের কোণে এসে কি জমা হল? সামনের সব কিছু না হলে ঝাপসা দেখছি কেন?

বন্ধু আমার নিজে চলে গিয়ে আমাদের ভিতরের সুপ্ত ভালবাসার অপ্রকাশিত কিছু উৎস মনে হয় খুলে দিয়ে গেছে!

মামুনের অণুগল্প : বিস্ময় ছিলে তুমি স্বপ্ন আমার

কিছু কিছু গল্প আছে, যা বছর ঘুরে বার বার সামনে এলেও পড়তে বিরক্তি আনে না। কয়েক বছর আগের আমার লেখা এই পুরনো গল্পটিও তেমনই একটি… আবার শেয়ার করলাম।

_____________
ছাব্বিশ বছর!
অনেক সময় তাই না? দুই লক্ষ সাতাশ হাজার সাতশত ষাট ঘন্টা! অসহ্য অলস আবেশে কেটেই গেলো।

ছাব্বিশ বছর আগে তাঁর মনে হতো, সেই মেয়েটির সাথে তার সম্পর্ক ছিলো। ভালোবাসা ছিলো কিনা কখনো মনকে সেভাবে জিজ্ঞেস করা হয়নি। কি মন, ছিলো কি?

মন কোনো উত্তর দেয় না। বরাবরের মতো নিশ্চুপ থাকে। হ্যা! তখন সে মেয়ে-ই ছিলো। বালিকা বয়স থেকে ভালোলাগতো ওকে তাঁর। সে কি জানতো?
হ্যা, ঠিক ধরেছেন- বালিকার জানার ব্যাপারে বলছেন তিনি। আজো জানো হলো না তাঁর।

সময় ঘুরে ঘুরে, অনেক অসময় আর দু:সময়ের পিঠে চড়ে বর্তমান সময়ে এসে হাজির হয়। জিন্স পরতে বলেছিলো মেয়েটি তাকে ‘ম্যানলি’ লাগবে বলে। এমনই আনুষঙ্গিক আরো অনেক টুকরো টুকরো মেয়েটির চাহিদায় (নির্দেশই ভাবতেন তখন তিনি ওগুলো) তাকে চলনসই মেয়ে বলেই মনে হতো তখন। ‘আপটুডেট’ বললে কি একটু শ্রুতিমধুর হয়? এই ভাষাটির প্রতি আমাদের অনেকেরই কেন জানি ঈর্ষণীয় আনুগত্য রয়েছে :)

নিজের জনক চলে গেলেন। অনেকেই এলো মাকে দেখতে, দু:খ শেয়ার করতে। অপ্রত্যাশিত ভাবে সেই মেয়েটিও এসে আচমকা সামনে দাঁড়ালো! সময় ইতোমধ্যে সেই একদার বালিকাকে মেয়েলি অপভ্রংশ স্তরের ভিতর দিয়ে নিয়ে, মহিলায় রুপান্তরিত করে ফেলেছে! এখন সে একজন সম্পুর্ণ মহিলা। পূর্ণ রমনী হতে পেরেছে কি? রমনীয় তো ছিলোই সে।

নাহ! ওভাবে ভাবনাটা এলো না তাঁর নিজের বাড়িতে বসে। এক মুখ দাড়ি গোঁফের জঙ্গলাবৃত তিনি মায়ের পাশে বসে আছেন। দরোজা দিয়ে কালো নেকাবে মুখ আবৃতা সে শ্রেফ চোখ দু’টি দৃশ্যমান রেখে, জীবনের এই প্লাবন পর্বে আবারো একবার প্রবেশ করলো! এক পলক সেই চোখের দিকে তাকিয়ে তিনি উঠে গেলেন অন্যরুমে। চার চোখের মিলন হলো কি হলো না ঠিক অনুভবে এলোনা তাঁর।

মিষ্টি এক সময়ের ঘ্রাণে ভেসে ভেসে, স্বপ্ন প্রহরগুলি মনের চারপাশে দৃষ্টিকটু নির্লজ্জতায় উঁকি দিতে শুরু করলো :(
এখন প্লাবন প্রহর! বড্ড দু:সময়। তাই মনকে কঠোরভাবে দমিয়ে রাখতে চাইলেন তিনি।

ভ্যাপসা মধ্য ভাদ্রের অসহ্য গরম আরো তেজোদীপ্ত হয়ে উঠতে শুরু করে.. গলার কাছে কিছু একটা আটকে আসতে থাকে.. দমবদ্ধ এক তীক্ষ্ণানুভূতিতে আচ্ছন্ন হৃদয়, তীব্র সাইনাস পেইনে খাবি খেতে থাকে। অসহ্য অলস আবেশে সহস্র ধারালো তরবারির আঘাত হৃদয়কে ফালা ফালা করে চলে।

রাস্তা ধরে প্রিয় অনুজকে সাথে নিয়ে, নি:শব্দে পিচের পথ ধরে হাঁটতে থাকেন তিনি। বিরক্ত বিবর্ণ বিস্মিত সময় বিরহে কাঁপতে থাকে। সময়ের ঘ্রান প্রথম প্রেমের মৌময় আবেশে আচ্ছন্ন করতেই, নিজের বউয়ের কথা মনে পড়ে! মোবাইলের দ্বারস্থ হয়ে বউকে কাছে টানার কি এক প্রবল আবেশে ভেসে যান। আসলেই কি এভাবে ভাসা যায়? মনের ভিতর-বাহির তন্ন তন্ন করে খুঁজলে হয়তো উত্তর পাওয়া যেতো। কিন্তু বিহ্বল তিনি উত্তর খুঁজতে আগ্রহ প্রকাশ করেন না।

মায়ের পাশে পরিবর্তিত সময়ের সেই মহিলা যখন নিজের ঘ্রাণে সময়কে আপ্লুত করে চলেছিলো, তিনি তখন তাঁর নিজের শরীর ছাপিয়ে, মনের অনেক দূর দূর পর্যন্ত নিজের বউয়ের শরীরের পরিচিত ঘ্রাণ খুঁজে ফিরছিলেন!

– কেন এমন করছো?
গহীন মনের পরিচিত কণ্ঠের এমনতর বিব্রতকর প্রশ্নে ব্যথিত হয়ে একটু রাগান্বিত হন তিনি।
– কেনো করছি বুঝিস না?
মনকে ধমক মারার অপপ্রয়াস কি নিজের থেকে পালানোর চেষ্টা?

তীব্র ইলেক্ট্রিক ব্লু ফ্রেমে ছাব্বিশটি বছর আগের সময়ের এক ফ্রেমবদ্ধ জীবন্ত তৈলচিত্র, আজ কালো নেকাবে আবৃতা মহিলার দৃশ্যমান দুটি চোখ! শুধুই চোখ? পলকের তরে থমকে থাকা দৃষ্টিতে শত সহস্র অ-অনুভবেয় সময় কি ছিলো না? যা চিৎকার করে করে বলছিলো.. ‘কেনো থাকলে না.. কেনো থাকলে না আমার হয়ে?’

ম্লান হাসেন তিনি :)
– একটু বেশী ভাবা শুরু করেছিস নাকি আজকাল!
মনও ম্লান হেসে ডিপ্লোম্যাটিক উত্তর দেয়। শেষে জানতে চায়,
– বেশী ভাববার মতো কিছুই কি ঘটেনি? চারিদিকে কি হৃদয় পোড়া ঘ্রাণ পাওনা?
– নাহ! হৃদয়ের পুনর্গঠন চলছে.. আমার বউময় জীবনে কোনো পোড়া ঘ্রাণের স্থান নেই। সব তোর কল্পনা। আমার দেহমন জুড়ে এখন কেবলি আমার বউ আর ওর ঘ্রাণ..! অফ যাও।

এক পড়ন্ত বিকেলে নিজের অনুজের পাশাপাশি হেঁটে চলেন তিনি… নিজের মনের ভিতর-বাহির তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফেরেন.. কিন্তু কি যে খুঁজেন, তিনি আর মন, কেউই বুঝে ওঠে না!

কোথায় যেনো চিনচিনে ব্যথা.. নি:সীম নিঃসঙ্গতায় তীব্রতর কষ্টের প্রক্ষেপণে ক্রমশ: বেড়েই চলে…।।

আমার_হিয়ার_মাঝে_লুকিয়ে_ছিলে

কোথায় যেন ধূপের গন্ধ..বাতাসে ভাসে। দমকা বাতাস দ্রুতধাবমান বাসের গতির সাথে পাল্লা দিয়ে ঘ্রাণকে উড়িয়ে নেয়। অখন্ড অবসর উপভোগরত ফুটপাত দিয়ে হেঁটে চলা সাজ্জাদের জটিল এক আইডিয়ার বিশ্লেষণরত ব্রেইনকেও সতেজ করে এই ধুপের ঘ্রাণ।

ডাইনে-বামে অহেতুক তাকিয়ে ঘ্রাণের উৎস খুঁজে দেখার অপচেষ্টা চালায় সে। তবে পরবর্তী ক’সেকেন্ডেই অন্যান্য আরো অনেক অতীত মৃত চিন্তার মত এটাও ডিলিট হয়ে সোজা রিসাইকেল বিনে জায়গা করে নেয়।

এইমাত্র যা করলো সেটা ভাবতেই আনন্দ অনুভব করে। এখন হেঁটে হেঁটে তা উপভোগ করছে।

সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়ানোর জন্যই ওর নাম টো টো সাজ্জাদ হয়ে গেছে। বন্ধুমহল থেকে শুরু করে ওর বাসার সবাই- এমনকি শায়লা পর্যন্ত জানে।

শায়লা!
নামটিই কেমন এক প্রশান্তি এনে দেয়। সবসময়।

মটর বাইকে করে এলাকায় অস্থির অলসতায় ঘুরে বেড়ানোর সাথে সাথে কিছু প্রয়োজনীয় কাজও সে করে। বাসায় বৃদ্ধ বাবা-মাকে দেখাশুনা করাটাই প্রধান কাজ। আর মাসের শেষে বাড়ির ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করা, পানি-গ্যাস-বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করা- এ সবই সে করে। ওর বড় ভাই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা। প্রতিমাসে একবার বাবা-মাকে দেখতে আসেন। তাই বাবা-মার প্রতি ভালবাসার বড় ভাই এর অংশটুকুও সে প্রতিদিন নিজের মত করে।

এর মাঝে নিজের বিকৃত মস্তিষ্কের কিছু চাহিদাও তাকে পূরণ করতে হয়। বিকৃত কথাটা বলা একটুও ভুল হচ্ছে না। সাজ্জাদের খুব প্রিয় একটি কাজ হচ্ছে, এলাকায় নতুন কেউ এলে ইচ্ছেকৃত সে ভুল ঠিকানা দেখিয়ে দেয়। আর নতুন মানুষটি যখন এক গলি থাকে অন্য গলিতে ঘুরপাক খায়, সে বাইকে করে দূর থেকে দেখে আনন্দ পায়।

আলমগীর মুন্সীর চায়ের দোকানের পাশে ওর বাইকটা স্ট্যান্ড করা। বাইকের ঘাড়ের লক খুলে স্টার্ট বাটন পুশ করে আশপাশ সচকিত করে একটা ইউ টার্ণ নিয়ে বেরিয়ে পড়া সুদর্শণ সাজ্জাদ মুহুর্তে টো টো সাজ্জাদে পরিণত হয়। ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত হাসি। এইমাত্র নতুন একটি আইডিয়ার জন্ম হয়েছে ওর উর্বর মস্তিষ্কে।

শায়লা অনেকক্ষণ ধরে রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছে। যা ও বা পাচ্ছে সবই ওর উল্টো পথের। এই ভরদুপুরে সবাই যার যার বাসায় কিংবা নিরাপদ কোনো ছায়াঘেরা জায়গায় যেতে চায়। বান্ধবী রিতার বাসায় এসে ফেসে গেছে শায়লা। একটা অটো নিয়ে চলে যাবে কিনা ভাবল একবার।

দূর থেকে শায়লাকে দেখছে সাজ্জাদ। সে যেখানে আছে সেখান থেকে শুধু শায়লাকেই দেখা যাবে। শায়লা ওকে সেইভাবে দেখতে পাবেনা। বাইকের লুকিং গ্লাস দিয়ে বিপরীত দিক থেকে শায়লাকে দেখছে সে। শায়লা যদিও এদিকে তাকায় তবে শুধু পিছনের অংশই দেখতে পাবে। পিছন থেকে দেখেও কি সে চিনবে সাজ্জাদকে?

এই মেয়েটিকে দেখলেই কেমন যেন হয়ে যায় সাজ্জাদ। ওদেরই ভাড়াটিয়া। বৃদ্ধা মা এবং ছোট এক বোনকে নিয়ে থাকে ওরা। তৃতীয় তলার ডান পাশের ফ্ল্যাটে। একেবারে সাজ্জাদদের সরাসরি নীচের ফ্ল্যাট। শায়লার বড় এক ভাই আছেন। সে ঢাকায় এক পোশাক কারখানায় ভালো পোষ্টে চাকরি করে। সেখানেই দুই মেয়ে আর বউকে নিয়ে থাকে। তবে মা ও বোনদেরকে দেখার জন্য প্রতি মাসে একবার আসবেই। যতই কাজ থাকুক না কেন। নিজের ফুল ফ্যামিলি নিয়ে আসে সে।

সেই কটা দিন শায়লার খুব আনন্দে কাটে। দিন না বলে ক’টা রাত বললেই বেশী মানানসই হয়। ভাইয়া তো বৃহষ্পতিবার এসে আবার শুক্রবার রাতে চলে যায়। তবে ভাবী ও বাচ্চারা কখনো দু-তিনদিন থেকে যায়। এই ভাড়া বাসাটি তখন শায়লার কাছে নিজের বাড়ির মত শান্তি এনে দেয়। সেই যে বাবা বেঁচে থাকতে ওদের গ্রামের বাড়িতে সবাই মিলে একসাথে থাকার সময় যা অনুভব করত, সেরকম। আসলে পরিবারের সবাই এক সাথে থাকার আনন্দের সাথে অন্য কোনো কিছুর তুলনাই হয় না।

গরমে ঘেমে অস্থির হয়ে আছে। বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু স্টপেজে কোনো বাস ও আসছে না সেই অনেকক্ষণ হয়ে গেলো। শায়লা বিরক্তির একেবারে চরমে পৌঁছে গেলো। ঠিক তখনই উল্টো দিকে সাজ্জাদের পিছনটা সে দেখতে পায়।

এবং চিনে ফেলে।

মেয়েদের ভিতরে অনেক অদ্ভুত জিনিস আছে। একইসাথে এদের অতিরিক্ত একটি ইন্দ্রিয় রয়েছে। অদৃশ্য কিছু অতি সহজে বুঝে ফেলার… দ্রুত উপলব্ধি করার এমন কিছু সহজাত ক্ষমতা পুরুষের থেকে এদের বেশী। তবে এই এরাই আবার খুব কাছ থেকে সহজ অনেক কিছুও অনেক দেরীতে বুঝে।

সাজ্জাদ নামের এই ছেলেটি যে ওকে কেন্দ্র করেই চিন্তা-ভাবনার এলোমেলো জগতে সর্বক্ষণ অবস্থান করে সেটাও মেয়েলি এই বিশেষ ক্ষমতাবলে সে বুঝে গেছে।

বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে হেঁটে হেঁটে সাজ্জাদের বাইকের পাশে এসে দাঁড়ায় শায়লা। লুকিং গ্লাসে শায়লাকে ওর দিকে আসতে দেখেও একচুল নড়তে পারেনা সাজ্জাদ। চোরের মত ধরা পড়া অভিব্যাক্তি নিয়ে ফুটপাতের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।

কাছে এসে বেশ স্বাভাবিকভাবেই শায়লা বলে,
– চলুন, বাসায় যাই।

নীরবে শায়লাকে বাইকে বসার জায়গা করে দিয়ে একটু সামনে সরে বসে সাজ্জাদ। ওরা দু’জন যখন বাইকে করে চলে যায়, নিজের খুব কাছে স্বপ্নের রাজকন্যা থাকা সত্বেও কেন জানি চিরতার পানি পান করেছে এমন অভিব্যক্তি নিয়ে থাকে সাজ্জাদ। এই অপ্রত্যাশিত ঘটনায় সে কেন জানি কোনো আনন্দ পায়না।

ওর সকল আনন্দের উৎস বিশ্লেষণধর্মী ব্রেইনে এই মুহুর্তে কোনো অনুভুতিই নেই। সব শূন্য হয়ে আছে। শুধু নিয়ম মেনে বাইক চালিয়ে বাসায় পৌঁছানোতেই ব্রেইনের সবটুকু অংশ মগ্ন।

_________________________
#আমার_হিয়ার_মাঝে_লুকিয়ে_ছিলে।