মামুন এর সকল পোস্ট

মামুন সম্পর্কে

একজন মানুষ, আজীবন একাকি। লেখালেখির শুরু সেই ছেলেবেলায়। ক্যাডেট কলেজের বন্দী জীবনের একচিলতে 'রিফ্রেশমেন্ট' হিসেবে এই সাহিত্যচর্চাকে কাছে টেনেছিলাম। এরপর দীর্ঘ বিরতি... নিজের চল্লিশ বছরে এসে আবারো লেখালখি ফেসবুকে। পরে ব্লগে প্রবেশ। তারপর সময়ের কাছে নিজেকে ছেড়ে দেয়া। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬ তে 'অপেক্ষা' নামের প্রথম গল্পগ্রন্থ দিয়ে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। বইমেলা ২০১৭ তে তিনটি গ্রন্থ- 'ছায়াসঙ্গী'- দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ, 'ঘুঙ্গরু আর মেঙ্গরু'- উপন্যাস এবং 'শেষ তৈলচিত্র'- কাব্যগ্রন্থ নিয়ে সাহিত্যের প্রধান তিনটি প্ল্যাটফর্মে নিজের নাম রেখেছি। কাজ চলছে ১০০০ অণুগল্প নিয়ে 'অণুগল্প সংকলন' নামের গ্রন্থটির। পেশাগত জীবনে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। একজন অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। পোষাক শিল্পের কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। লেখালেখির পাশাপাশি সাংবাদিকতা করছি। লেখার ক্ষমতা আমি আমার ঈশ্বরের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছি। তাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখেই যেতে হবে আমাকে।

মামুনের_অণুগল্প : কাছে_পাবোনা_জানি_তোমাকে_তো_আর

মামুনের_অণুগল্প : কাছে_পাবোনা_জানি_তোমাকে_তো_আর।

তখন খুব দুরন্ত ছিলাম। দলবেঁধে রাস্তার মোড়ে মোড়ে কিংবা গার্লস স্কুলের গেটের রাস্তায় গল্প-আড্ডায় বেশ সময় কেটে যেত। স্কুল ফেরত মেয়েদের দেখে সিটি দেয়াটা বেশ রপ্ত হয়েছিলো। আর নতুন সিগ্রেট ফুঁকতে শিখেছিলাম। সিগ্রেট ফুঁকা একজন রোমিও হয়ে কল্পনার জুলিয়েটের পিছু ধাওয়ায় আমাদের সময় কিভাবে যেন কেটে যাচ্ছিলো। সবাই বখাটে বলতো আমাদের। আর আমি ছিলাম বখাটেদের দলনেতা।

একদিন সেই বখাটে দলনেতার সামনে দিয়ে এক এলোকেশী, নিজের বুকের ওপর দু’হাত ভাঁজ করে, গলির মাথা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে যে কৃষ্ণচূড়া গাছটি ছিলো, ওটার নীচে এসে দাঁড়ায়। কেন জানি হাসছিল সে। তার হরিণী চোখের ওপর এক গোছা উড়ন্ত কালো চুল! শুভ্র দেহে যেন আঁধারের টিপ! এমনই মনে হয়েছিলো সেদিন আমার।

সেদিনই ওড়নাবিহীন সেই তরুনী ঘি ঢেলে দিলো আমার বখাটেপনার উচ্ছলতার আগুনে।

এরপর এক অন্য ইতিহাস…

গলির রাস্তা ধরে পায়ে পায়ে ফিরে চলি… অন্য এক আমাকে দেখি। হাতের সিগ্রেট আনে মুখে বিস্বাদ। গলিগুলো বিস্মৃতির আড়ালে লুকোয় নিঃশ্বাস। সিটিগুলো এখন আর বাজে না মোটেও। অপেক্ষায় বন্ধুরা সব ফেলে দীর্ঘশ্বাস।

আর আমি?

চোখ খুললেই দেখি সেই এলোকেশী, যার তীর্যক চাহনিতে ভাসে অণুক্ষণ রহস্যময় হাসি। হৃদয়ে সুঁই ফোটানো ব্যথায় ভেসে ভেসে অনুভূতির বালুচরে জমে থাকা কষ্টগুলো, একসময় নষ্ট হতে হতে রুপ নেয় নীল অপরাজিতায়!

একদিন সে নিজেই এসে আলাপ করলো। সে এক অসাধারণ অনুভব আমার! সেদিন কত কথা বললো সে। আমি কেবল ওর ঠোঁটের কম্পন দেখছিলাম, শুনছিলাম না কিছুই। ওর শরীরের মিষ্টি ঘ্রাণ, আর ওকে ঘিরে আমার কল্পনার বল্গাহীন ঘোড়া ছুটছিলো অজানা সে কোন তেপান্তরের পানে।

একটা সম্পর্ক তৈরী হলো হঠাৎ করেই। আমাদের দেখা হতো রোজ। কথা হতো। দু’একটা চিঠিও আদান-প্রদান হলো। তখন তো আর মোবাইল ছিলো না। তাই কথাবার্তা সামনাসামনিই যা হতো। আর হতো মনে মনে। যখনই ভাবতাম ওর কথা, মুহুর্তে সে সামনে হাজির। পড়ালেখা মাথায় উঠলো।

তারপর একদিন…

সেই চিরপরিচিত কৃষ্ণচূড়ার নিচে দেখি তাকে ঢেউ খেলানো চুলের এক সুদর্শনের সাথে। মটর বাইকে চড়ে প্রচন্ড গতিতে ধাবিত হয় ওরা আমার হৃদয় মাড়ানো লাল রাজপথ ধরে। সেদিনও সে ওড়নাবিহীন, ভাঁজ করা হাতের নীচে ওর সেই সম্পদটুকু সেদিনও উন্মুক্ত। আর লিলুয়া বাতাসে অস্থির কালো কেশে ঢেকে থাকা একটি চোখ। আমার সামনে দিয়ে সে সেই চোখটি সহ হারিয়ে গেলো… আমি গলির মাথায় দাঁড়িয়ে দূর দূর পর্যন্ত ওদের ক্রমশঃ ক্ষীণ হয়ে আসা বাইকের টেইল লাইটের পানে চেয়ে রইলাম দীর্ঘক্ষণ।

এরপর কি হলো?

আবারো সেই চেনা বন্ধুদের সাথে সিগ্রেট হাতে সেই গার্লস স্কুল.. উল্লসিত গলিতে গলিতে সিটির তীব্রতায় চমকে ওঠে কিশোরীরা! আর চমক উপভোগরত এই আমি… সেই আমি, যার হৃদয়ে সুঁই ফোটানোর ব্যথা। ভালোলাগা পুড়ে পুড়ে প্রেম না হয়েই দীর্ঘশ্বাসের ছাই হয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেলো। তারপরও কোনো কোনো বিরহী বিকেলে বিষণ্নতায় পুড়ে যাই আমি। সিগ্রেটের শেষাংশের মতো ক্রমশঃ নিস্তেজ হতে হতে একটা ভাবনাই দোলা দিয়ে যায় আমায়,

‘এক জীবন আসলে কাউকে ভালোবাসার জন্য খুবই অল্প সময়।’

আহ জীবন!
হায় প্রেম!
‘প্রেম বড় মধুর… কভু কাছে কভু সুদূর।’

অণুগল্প : সুরুজ্জামানের একদিন

অণুগল্প : সুরুজ্জামানের একদিন

কিভাবে গল্পরা লেখকের হৃদয়ে জন্ম নেয় শুনতে চান? এক স্বাভাবিক দুপুরে, বাউরি বাতাসে, মন ভিজে যেতে যেতে পলকের তরে লেখক নিজেকে বিস্মৃত হন। অনেক আগে, প্রচন্ড গরমে পিচ ঢালা তপ্ত পথ ধরে, একজন সুরুজ্জামানের রৌদ্রক্লান্ত দেহের টেনে যাওয়া বড্ড স্পষ্ট ভাবে চোখে ভাসে। এক ছায়াসঙ্গী হয়ে নিজ সৃষ্ট চরিত্রের পিছু নেন লেখক। অসহ্য অলস গতিতে ছায়ার কায়াকে অনুসরণের মত…

প্রচন্ড পানির পিপাসা। যেখানে গন্তব্য, তার মাঝপথে দাঁড়িয়ে জিভ বের করা কুকুরের মত হাঁফাতে থাকে। পেছনের ফেলে আসা পথে, এক গাছের ছায়ায়, একজন শরবত বিক্রী করছে। বরফকুচি মেশানো শরবত বিক্রী করতে দেখার দৃশ্যটা এই মাঝপথে এসে, হঠাৎ বড্ড তীব্র হয়ে অনুভূত হয় সুরুজ্জামানের। খরখরে জিভটা আরো শুষ্ক হয়। পকেটে সম্বল তিন টাকা। এক গ্লাসের দাম দশ টাকা। পিচ থেকে আগুন বের হচ্ছে। গরম বাতাস সেই আগুনকে টেনে এনে ছুঁয়ে যাচ্ছে দেহমন। বড় কষ্টকর জীবন! আসলেই…

সামনে একটা পানির কল। দেখে আগায়। নিঃসঙ্গ এক শালিক নষ্ট কলটির ফোঁটা ফোঁটা পানির অণূকণায় পিপাসা মেটাতে চাইছে। সুরুজ্জামান কাছে যেতেই নিস্ফল আক্রোশে চিৎকার করে উড়ে যায়। তবে একেবারেই চলে যায় না। একটু দূরে নিরাপদ দূরত্বে অপেক্ষমান। রাস্তার পাশের শিরিষ গাছটির নিচু ডালের পাতায় বসে ক্ষোভ জানাতে থাকে শালিকটি।

একপলক দেখে সুরুজ্জামান। ওর ঘোলাটে চোখে কোনো ভাব জাগে না। নীরবে সামান্য সময়ের বিরতিতে নিচের ঘন সবুজ শ্যাওলার বুক ভিজিয়ে দিতেই, পরবর্তী ফোঁটাটি জন্ম নেয় পাইপের বুকের গভীর থেকে। করতল মেলে ধরে অপেক্ষায় থাকে এক দ্বাবিংশ বর্ষীয় যুবক। এক কাঠফাটা দুপুরে।

বাবার অফিসে যখন পৌঁছায়, লাঞ্চ টাইম মাত্র শেষ হয়েছে। অলস কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভাতঘুমের আবেশে ঢলে ঢলে পড়ছে। অলস আয়েসী মুহুর্তগুলি এই প্রতিষ্ঠানটিকে ভেতর থেকে ঘিরে রেখেছে। সোজা একাউন্টস সেকশনে চলে যায় সুরুজ্জামান। এখানেই যেতে বলে দিয়েছেন বাবা।

বাবা! শব্দটা মনে হতেই একজন নুয়ে যাওয়া যুদ্ধক্লান্ত মানুষ চোখে ভেসে ওঠে মুহুর্তে। নুয়ে যাওয়া এক অবয়ব। জীবনের এতগুলি ধাপ পেরিয়ে আসা একজন পরাজিত মানুষ? মাস ছয়েক হল আরো কয়েকজনের সাথে ‘সাসপেন্ড’ অবস্থায় রয়েছেন। কি হয়েছিল না হয়নি, কিছুই জানা হয়নি ওর। জানতেও চায় না সে। তবে না খেয়ে থাকার কষ্টে বিগত দিনগুলিতে কখনো কখনো একেবারেই যে জানতে ইচ্ছে হয়নি, তাও নয়।

মা কি কষ্ট করে এক একটি দিনের খাবার জোগাড় করছেন, এক একজনের অভ্যাসগত পছন্দ-অপছন্দকে সুন্দরভাবে সামাল দিতে মা-কে কতটা কষ্ট সইতে হচ্ছে… সব অনুভব করলেও কিছুই করতে পারেনি সে। নিজেও এতটা বড় হয়ে একটা কাজ যোগাড় করতে পারেনি। পড়ালেখাও শেষ হয়নি। একটা সার্টিফিকেট অর্জনের থেকে সে এখনো বেশ দূরে। ঠিক এই মুহুর্তেই বাবার এই সাসপেন্ডেড অবস্থা।
জীবনটা সাত সদস্যের এই পরিবারটির জন্য আক্ষরিক অর্থেই নরক হয়ে উঠলো!

আত্মীয়স্বজনেরা ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। আসলে বাস্তবতা বড়ই কঠিন। অসময়ে কেউই থাকে না। অথচ সুসময়ে কি রমরমা অবস্থা। দুধের মাছিরা আজ কে কোথায়?

বেতনের একটা অংশ গত ছ’মাসে জমেছে। সেটা নিতেই বাবা ওকে সেই কয়েকশ’ কিলোমিটার দূরত্ব ঠেলে পাঠিয়েছেন। আসার ভাড়াটাই কেবল দিতে পেরেছেন বাবা। মা কিছু খাবার তৈরী করতে রাতের বাড়তি সময়টুকু জেগেছেন। লঞ্চে আসার সময়ে সেগুলি কাজে লেগেছে। সকালেও নাস্তা হিসেবে শেষাংশটুকুর সদ্ব্যবহার করেছে।

একাউন্টসে যিনি টাকা দেবার দায়িত্বে, তিনি ওকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলেন। বাবার নাম শুনেই যেন তিনি আগ্রহ হারালেন। এই লোক ওর পরিচিত নন। ছ’মাস পূর্বের এই শহুরে জীবনের অভ্যস্ত জীবনে সামাজিক আবহে বিভিন্ন পার্বণে কখনো সুরুজ্জামান এই লোকটিকে বাসায় দেখেনি। বাবার কলিগদের সাথেও কখনো এই লোক আসেন নাই। হয়ত নতুন জয়েন করেছেন। তবে একজন সহকর্মী যখন সাসপেন্ডেড থাকেন, তখন অন্যদের কাছে তিনি যেন মৃত! এতগুলি বছরের সৃষ্ট পারষ্পরিক সম্পর্ক যেন কোথায় হারিয়ে যায়! আসলেই কি কোনও সম্পর্ক কখনো তৈরি হয় এদের মাঝে? হলে এত দ্রুত ভাঙ্গেই বা কিভাবে?

সামশু ওনার নাম। তিনি এসে আবেগবিহীন স্বরে টুকটাক কথা বললেন। যেগুলির কোনো অর্থই হয় না। নিরর্থক একা-ই বলে গেলেন। ক্ষুধার জ্বালায় সুরুজ্জামান কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ শুনে গেলো। ওর চোখে পথের পাশের ঝুপড়ি দোকানের ভেতরে সাদা ভাত আর গরুর গোশতের ঝোল ভাসছিল। টাকাগুলি হাতে পেলে, এখান থেকে বের হয়েই প্রথম সুযোগে খেয়ে নিতে হবে। যতটা কম খরচে পারা যায়। চিন্তা-ভাবনার এই পর্যায়ে অভুক্ত ছোট ভাই-বোনদের মুখগুলি ভেসে ওঠায় ভেতরে ভেতরে তাড়া অনুভব করে সে।

হিসাব করে বাবার ছ’মাসের পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে দু’জায়গায় ওর স্বাক্ষর নেন সামশু সাহেব। তাকে সালাম জানিয়ে হাসিমুখে চেয়ার ছেড়ে উঠবে, এমন সময় অন্য একজন রুমের ভেতরে ঢুকেন। সামশু সাহেবের সিনিয়র হবেন। তার পাশের টেবিলে বসে সুরুজ্জামানের দিকে জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকালে সামশু সাহেব জানায়,
– স্যার, মাহতাব সাহেবের ছেলে। ভ্যাটের মাহতাব সাহেব, ঐ যে মাস ছয়েক আগের মেয়র কেলেংকারি…

কথা শেষ না করে উর্ধতনের দিকে তাকায় সামশু। ওর কর্তা ব্যক্তি এবার কথা বলেন,
– তো এখানে কি জন্য এসেছে?
– মাহতাব সাহেবের গত ছ’মাসের হাফ বেতন নিতে এসেছে।
– দিয়েছ নাকি?
– জি স্যর, অনেকক্ষণ হলো এসেছে। সব ফর্মালিটিজ শেষ। এখন চলে যাবে, আপনিও এলেন।
– দেবার আগে আমার কাছে জিজ্ঞেস করবে না? উত্তেজিত স্বরে জানান উর্ধতন কর্তা।

সুরুজ্জামান এবং সামশু দু’জনেই অবাক হয়ে বক্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কর্তা ব্যক্তি সামশুকে লক্ষ্য করে বলেন,
– মাহতাব সাহেব সহ বাকীদের বেতন হেল্ডয়াপ করার ব্যাপারে কমিশনারের নির্দেশ এসেছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো ধরণের লেনদেন না করার জন্য সুস্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে।

নিজের ফাইল কেবিনেটের বিশেষ একটি ফাইলের দিকে অংগুলি নির্দেশ করে সামশুর দিকে তাকান তিনি। একটি প্রতিষ্ঠানের বদ্ধ কেবিনে তিনজন ভিন্ন বয়সী মানুষকে ঘিরে সময় যেন স্থির হয়ে বড্ড বিব্রতবোধ করে।

বাবার অফিস থেকে বের হয়ে একটা দুই টাকার নোট আর এক টাকার কয়েন হাতে সুরুজ্জামান পথে হেঁটে হেঁটে ভাবে, ‘এই তিন টাকায় কি খাওয়া যায়?’ কিভাবে সে বাড়ি ফিরবে কিংবা বাড়িতে ওর টাকার পথ চেয়ে অপেক্ষারত ছয় সদস্যের অভুক্ত মুখ এই মুহুর্তে একবারও ওর চোখে ভাসে না। প্রচন্ড এক ক্ষুধা ওকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়…তিন সংখ্যার গুণাগুণ বড্ড তীব্র হয়ে বাজে একজন দ্বাবিংশ বর্ষের যুবকের হৃদয়ে। প্রচন্ড গরমের এক দুপুরে পিচ ঢালা পথের পেভমেন্ট ধরে হেঁটে চলে সে উদ্দেশ্যবিহীন…।।

#মামুনের_অণুগল্প

অণুগল্প : খুঁজিস যাহারে

খুঁজিস যাহারে

‘এই বয়সে আমার শরীর না, একটা হৃদয় দরকার, যেখানে আমার জন্য ভালোবাসা পূর্ণ থাকবে। সেই হৃদয়ের অধিকারিণী আমাকে ভালোবাসবে, একটু বুঝবে, একটু আমার জন্য ফিল করবে, টেন্সড হবে। সব কিছু আমাকে ঘিরে হবে তার। এমন কেউ কি আছে?’ – একদিন নিজের ভেতর থেকে এমন অনুভবে বিলীন হয় শিহাব।

আরেক দিন এক নির্জন খোলা প্রান্তরের পাশ দিয়ে যাবার সময়, সে খোলা মাঠে গিয়ে চিৎকার করে,
‘এমন কেউ কি আছে?’

মাঠ কোনো উত্তর দেয় নাই… শব্দগুলি আকাশের মোহনায় গিয়ে বাতাসের তোড়ে দূর অনন্ত নক্ষত্রবিথী পানে হারায়…।

সেদিনও নদীর পাড়ে বসে জলের বয়ে যাওয়া দেখে দেখে জলের কাছে জানতে চায়,
‘এমন কেউ কি আছে?’ জল বলে,
‘ঢেউয়ের চোখে তাকাও। দেখো, পাবে।’

কিন্তু ঢেউকে আপন মনে সাগর পানে জলকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া শিহাব আর কিছু-ই দেখতে পেলো না।

তারপর অন্য একদিন যাত্রীপুর্ণ বাসে ভরা যাত্রীদের মাঝে থেকেও শিহাবের নিজেকে একা… বড্ড একা লাগে। প্রচন্ড চলার পথের শব্দে বড্ড নিঃশব্দে নিজেকে নিজের ভিতর থেকে টেনে এনে সে জিজ্ঞেস করে, ‘এমন কাউকে কি তুমি সত্যি-ই চাও?’

উত্তরে ভিতরের ‘শিহাব’ কী জানায়?

প্রচণ্ড এক বজ্র নির্ঘোষে সে জানান দেয়,
‘হ্যা, চাই চাই চাই। আমি তো এটাই চাই। কিন্তু এমন কেউ কি আছে?’

#মামুনের_অণুগল্প

ঝড়ের_রাতে_মামুনের_অণুগল্প

আকাশের এক প্রান্তকে চিরে দিয়ে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত বিদ্যুতের চমকের পর পরই বজ্রপাতের প্রচন্ড শব্দে কানে তালা লেগে যায়। এই অবসরে ওর রুমে ঢুকে পড়া এক যুবতীর দরজার হুক ভেতর থেকে আটকে দেবার শব্দটাও চাপা পড়ে।

মুষলধারে বারিধারা ঝরে পড়ার এমন দিনে কোথায়ও কেউ নেই। এক আঠারো বছরে সদ্য পা দেয়া যুবক অতৃপ্ত এক রমনীর সামনে দাঁড়িয়ে ঢোক গিলে। রমনী বড্ড রমনীয় ভাবে নিজেকে সামনে মেলে ধরে.. তাঁর বুকের আঁচল মাটিতে পড়ে যায়! প্রচন্ড এক অপ্রতিকূল আবহাওয়ায় একজোড়া আদম-হাওয়া, কাছে-দূরের অনুভূতি পার করতেই বুঝি নৈঃশব্দের প্রহর শেষ হবার অপেক্ষায় থাকে!

#ঝড়ের_রাতে_মামুনের_অণুগল্প

।। লোভ // মামুনের অণুগল্প ।।

কসাইয়ের দোকানটা মাছ বাজারের সাথেই। দুটি গোশতের দোকান পাশাপাশি। একই মালিকের। গরুর দুইটা রান ঝুলছে। এর বিপরীত দিকে রাস্তার ওপারে, এক বুড়ো কুকুর দুপায়ের উপর মাথা রেখে চুপচাপ হামাগুড়ি দিয়ে আছে। তবে দৃষ্টি গোশতের দিকে নিবদ্ধ। ওর হাত পাঁচেক তফাতে, এক পঙ্গু বৃদ্ধ ভিক্ষুক। সামনে ‘অ্যালুমিনিয়ামের’ পুরনো থালা নিয়ে বসে আছে। কিছু মলিন নোট আর খুচরা পয়সা দেখা যাচ্ছে।

একটা সাদা প্রাইভেট কার এসে রাস্তার পাশে থামে। মালিক মধ্যবয়ষ্ক। জুলফির কাছে কিছু শুভ্র কেশের উপস্থিতি তাকে কেমন আলাদা ভাবগাম্ভীর্যে ভারিক্কী করে তুলেছে। তিনি ড্রাইভারকে সাথে নিয়ে মাছ বাজারে ইলিশ বিক্রেতার সামনে গিয়ে দাঁড়ান। দরদাম করে মূল্য পরিশোধ করেন। এক হালি বড় সাইজের ইলিশ নিয়ে ওনার ড্রাইভার গাড়ির ‘বুটে’ রেখে দেয়। পঙ্গু ভিক্ষুকের নির্ণিমেষ দৃষ্টির সামনে মাছগুলি ‘বুটের’ ভেতর চালান হয়ে যায়। মুখটা লোভের লালায় ভরে উঠে ভিক্ষুকটির।

প্রাইভেট কারে বসে, ইলিশের ক্রেতা বিষয়টি লক্ষ্য করেন। পরক্ষণেই মানিব্যাগ থেকে দুটি বঙ্গবন্ধুর ছবিওয়ালা পাঁচ টাকার কয়েন, ভিক্ষুকের থালা লক্ষ্য করে ছুড়ে দেন। নির্ভুল লক্ষ্য!

ঝনঝন শব্দে সে দুটি থালায় গিয়ে পড়ে। এরকম গাড়িওয়ালাদের লক্ষ্য সবসময়েই নির্ভুল হয়। কয়েন দুটির যথাস্থানে পড়াতে, গাড়ির মালিকের চোখ দুটি আত্মতৃপ্তিতে বুজে আসে। তাকে নিয়ে সাদা গাড়িটি রাস্তার ধুলা উড়িয়ে সগর্বে চলে যায়।

ধুলার ভিতর আরো কিছু ধুলা মেখে বৃদ্ধ ভিক্ষুকটি কুকুরটির দিকে চেয়ে থাকে। এই মাত্র গোশতের দোকান থেকে এক টুকরা বাতিল হাড্ডি কুকুরটির সামনে ছুড়ে দিয়েছে কসাই লোকটা। কুকুরটি মুহুর্তে সজাগ হয়ে কান খাড়া করে। এগিয়ে হাড্ডিটা মুখে নিয়ে নিজের আগের জায়গায় ফিরে আসে। এরই ভিতর একবার কসাইয়ের দিকে তাকায়। সেই চোখে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি। দেখে কসাই ও আত্মতৃপ্তিতে ভোগে।

বৃদ্ধ ভিক্ষুকের চোখে জিঘাংসা! না পাওয়ার ক্ষোভ। সেই অকৃতজ্ঞ দৃষ্টি নিয়ে সে কুকুরটির দিকে চেয়ে থাকে। কল্পনায় ওর এক হালি ইলিশ। এই মাছগুলি ওর মুখে যে লোভের লালা তৈরী করেছে, সেগুলি একত্রীত করে সে। অদৃশ্য সাদা প্রাইভেট কারটির মালিককে উদ্দেশ্য করে এক দলা থুথু নিক্ষেপ করে। যদিও একটু আগে, সেই মানুষটি তাকে দশটি টাকা দান করেছে! কিন্তু কল্পনায় ভাজা ইলিশের সুঘ্রাণ তাকে সেটা বিস্মৃত করায়।

ওদিকে শুকনা গোশত বিহীন একটা হাড্ডি মুখে নিয়ে কুকুরটি লেজ নাড়ে… আর কিছুক্ষণ পর পর কসাইয়ের দিকে কৃতজ্ঞ চোখে চেয়ে থাকে।।

#মামুনের_অণুগল্প

অণুগল্প : শান্তি নাই

শান্তি নাই

‘সন্ধ্যা হয়—চারিদিকে শান্ত নীরবতা ;
খড় মুখে নিয়ে এক শালিখ
যেতেছে উড়ে চুপে ;
গোরুর গাড়িটি যায় মেঠো পথ
বেয়ে ধীরে ধীরে;
আঙিনা ভরিয়া আছে সোনালি খড়ের ঘন স্তূপে ;

পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে;
পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে;
পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দু’জনার মনে ;
আকাশ ছড়ায়ে আছে শান্তি হয়ে
আকাশে আকাশে।’ *

আমিও এক নিঃসঙ্গ শালিখ। পার্থক্য আমার মুখে খড় নেই, উড়তেও পারি না আমি। আমার বাড়ি নেই। তাই সঙ্গীও নেই। নেই খড়.. ছোট্ট ঘর। আর ঘর বানানোর ইচ্ছেরাও মৃতপ্রায়।

একজন ব্যর্থ লেখকও আমি বটে। ইঁদুর ও তেলাপোকার খাবারে পরিণত হয়েছে আমার গ্রন্থগুলি। লেখালেখিতেও শান্তি খুঁজে পেলাম না। জীবনানন্দ দাশ ট্রামে কাটা পড়ে শান্তি পেয়েছিলেন! আমার শান্তি কোথায়?

_________________
#মামুনের_অণুগল্প
* “সন্ধ্যা হয়—চারিদিকে” —-জীবনানন্দ দাশ

অণুগল্পঃ যন্ত্রণা বুঝে আসে?

অণুগল্পঃ যন্ত্রণা বুঝে আসে?

– কি বাল লিখবো?

হৃদয়ের ইনবক্সে শিহাবের ম্যাসেজ। দুই ভ্রুর মাঝে কুঁচকে থাকা চামড়ায় বিরক্তির কাঁপন, অনুভবে ভিতরের শিহাবকেও তিরতির করে কাঁপায়।

কি-বোর্ডে প্রজাপতি নেচে যায়.. শুরু হয় কথা, একার সাথে একা।
– সংযত হয়ে কথা বলো।
– তুই বল! ব্যাটা পাকনা কোথাকার।
ভিতরের শিহাবকে জানায় বাইরের চামার শিহাব।

এভাবেই কেটে যায় অশুভ সময়। মহাকালের বুকে এক চরম অসামাজিক তার পরম বৈরী সময়ে, হৃদয়ে হিমু আর মিসির আলীকে নিয়ে জীবনের পথ পাড়ি দিতে যায়। জীবনের পাতায় পাতায় রঙ এর খেলা! একজন খেলে চলে.. দিনদিন প্রতিদিন।

হৃদয়ে বসন্ত বেলা, থেমে থেমে চলে খেলা। জীবন বড্ড একঘেঁয়ে এখন। সে যেন বিধবার সাদা শাড়ির অদৃশ্য রঙিন আঁচলে ছুঁয়ে থাকা এক কুহকী প্রহর। অণুক্ষণ বিবর্ণ জ্বালা! ইদানিং জীবন কখনো সধবার বুকের রঙিন চাদর তো অধিক সময় বিবর্ণতায় ভেসে বেড়ানো নীল শালুক!

ধান্ধাবাজীর জীবন, প্যারায় প্যারায় লুকোনো এক মারা খাওয়ার জীবন। নিজের ভিতরের মি. হাইড আর ড. জেকিলের অণুক্ষণ সংঘর্ষে বয়ে চলে জীবন। আহ জীবন।

দুইয়ে মিলে এক হবার যন্ত্রণা কারো বুঝে আসে?

– বাল বুঝে আসে।

চামার শিহাবের চামারসুলভ মন্তব্যে ভিতরের শিহাব কষ্ট পায়। এক ভ্রষ্ট সময়ে নিজের নষ্ট জীবনে একজন শিহাব, ভিতরের লেখক এবং সাংবাদিকের নিরন্তর সংগ্রামের ভিতর দিয়ে মানুষ হয়ে উঠতে চেষ্টা করে।

কোথায় মানুষ?

#মামুনের_অণুগল্প

।। কবিতাঃ একটা গল্প বলি শোনো ।।

[ একটি উপন্যাস লিখে চলেছি অনেক বছর ধরে। প্রথম খন্ড শেষ করে দ্বিতীয় খন্ডের কাজ চলছে। এই সমগ্র উপন্যাসটিকে একটি গদ্য কবিতায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম আমি। আমার কাব্যগ্রন্থ শেষ তৈলচিত্রে এই দীর্ঘ কবিতাটি স্থান পেয়েছে। যারা টেনে কবিতা আবৃত্তি করতে কিংবা এমন ‘টাইপ’ এর কবিতা শুনতে ভালোবাসেন, তারা সাথে থাকতে পারেন ধৈর্য্য নিয়ে; বাকীরা এখান থেকেই ফিরে গেলে চরম বিরক্তিকর বিষয় ‘ধৈর্য্য’র পরীক্ষা দেবার হাত থেকে রক্ষা পাবেন। ]

একটা গল্প বলি শোনো

মিথিলা বাবু!
আজ তোমায় একটা গল্প বলি শোনো
তোমার বাবার গল্প এটা
বাবাতে মিশে থাকা তোমার মাটি, জল, হাওয়া, রোদ
এ সব মিলিয়েই আজ আজকের তুমি জেনো।

তোমার মত হাসপাতালে জন্ম হয়নি আমার
বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্মেছিলাম
রহস্যময় কাঠের দোতলা বাড়িতে, আলো-আঁধারিতে
সেথায় রহস্য ছিল অপার।

আমরা পড়া-লেখা করেছি
কেরোসিনের ল্যাম্প ও হ্যারিকেনের আলোয়
বড় একটা উঠান ঘিরে বড় পরিবার
বড় বড় টিনের চৌচালা চারটা ঘরের প্রশস্ত উঠান
ফসল তোলার দিনে গোবর দিয়ে লেপা থাকত
সেখানে ধান মাড়াই হতো গরুর মুখে ঠুসি লাগিয়ে
আমাদের শোরগোলে কাটতো দিন
কেউ দাড়িয়া বান্ধা কিংবা ডাংগুলি খেলতো
উঠানের এক কোণে রান্নাবান্না অথবা ইচিং বিচিং চিচিং।

আমার শৈশবের গ্রাম ছিল নিখাদ নিসর্গ
সূর্য উঠার সাথে সাথে দিনের কর্মচাঞ্চল্যের শুরু
সুর্য ডোবার সাথে সাথে দিনের কোলাহল আর ব্যস্ততার শেষ
সন্ধ্যা নামায় পৃথিবী নিঝুম তখন
তবুও রয়ে যেত ভালোলাগার একটু রেশ।

সারাদিনে যা কিছু দেখতাম-শুনতাম, জানতাম-বুঝতাম
তা থেকে জন্মাতো প্রশ্ন হাজার শত শত
মা’কে, বাবাকে, দাদুকে – যখন যাকে কাছে পেতাম
তার কাছেই জানতে চাইতাম সে সব
উত্তরগুলি একটার সাথে অন্যটা
জোড়া দিয়ে দিয়ে জীবনকে বোঝার চেষ্টা করতাম ততো।

তোমার দাদাভাইয়েরা ছিলেন তিন ভাই
বাবা আমার ছিলেন আর্থিক দিক থেকে সবচেয়ে গরীব
বড় চাচার দুইটি নিয়ে তিন পরিবারের চারটি টিনের ঘর
অসাধারণ জীবনবোধে ছাওয়া সে এক বিচিত্র সংসার।

সব ঘর বাইরে থেকে দেখতে একই ছিল
উপরে টিনের শীর্ষে চাঁদ তারার নক্সা
আর বিভিন্ন ডিজাইন করা কাঠের সিঁড়িটাও অপুর্ব বেশ
একান্নবর্তী মানুষগুলির কি বিচিত্র সাংসারিক জীবন!
কিছু বুঝতাম কিছু বুঝতাম না
এখন বুঝি, এখন ভাবি, কত সুন্দর ছিল সময় তখন
রাগ, অনুরাগ, উদ্বেগ, উৎকন্ঠা, স্বপ্ন , চেষ্টা নিরন্তর
ব্যর্থতা, কান্না, সফলতা, হাসি-আনন্দ উচ্ছ্বাস
জীবন সাদাসিধা তবু ছিল কত উজ্জ্বল স্বাস্থ্যকর।

বাবা মায়েরা কখনো কেউ কাউকে ভালোবাসি বলেছে
বাবুটা এমন স্মৃতি আমার নাই
দেখেছি তবু তাদের সুখ দুঃখের নিঃশব্দ ভাগাভাগিটাতে
একের জন্য অন্যের শ্রদ্ধা, টান
বড্ড স্পষ্ট ছিলো তখন স্যাক্রিফাইসটা-ই।
তাদের চিন্তাগুলি, কথাগুলি ছিলো হয়ত নিতান্তই সাধারণ
আমাদের থাকা খাওয়া সুখ অসুখ বা পড়ালেখা সংক্রান্ত
তাই দিয়ে যে সংসার গড়েছিলেন তারা
তার মহিমা ভুলে যাচ্ছি আজ আমরা বড্ড রণক্লান্ত।

বিশ্বাস, নির্ভরতা আর বিশ্বস্ততায়
বছরের পর বছর ধীরে ধীরে মহীরুহ হয়ে ওঠা
বাবা মায়ের সেই প্রেমকে তারা
র‍্যাপিং কাগজে মোড়ানো দামী উপহারের মতই লুকিয়ে রাখতেন।
সকলের চোখের আড়ালে মাটির নিচে
নিরবে বইতো তাদের ভালবাসার ফল্গুধারা
তার জল হাওয়ায় সতেজ স্বাচ্ছন্দ্যে বেড়ে উঠেছি
আজ আমরা এই পুরানা আছি যারা।

বড় চাচার বাড়িতে প্রতিদিনই ভালো ভালো রান্না হতো
সেগুলোর ঘ্রাণ আসত আমাদের বাড়িতে
মা বাবা তাদের দুই সন্তানের জন্য প্রতিদিন
পারতেন না এই খাবার সংগ্রহ করতে
অতি সাধারণ খাবার তখন আমার মায়ের বিবর্ণ হাড়িতে।

তোমার ছোট চাচু মাকে জিজ্ঞেস করতো ,
‘মা, আজ আমাদের ঘরে মুরগী রান্না করেছো?’
বা হয়ত বলে বসতো, ‘মাংস খেতে ইচ্ছে করছে’
মা এক একদিন কাঁদতেন
এক একদিন রাগ করতেন,
‘তোমাদের যা আছে তা কি সবার আছে? নিজেরটা নিয়ে খুশি হও না কেন?’
বাবা কোন কোনদিন বোঝাতেন,
‘অন্যের জিনিসে চোখ দিতে নেই’।

বাবার কত অসহায় লাগতো এখন তা বুঝি
তাদের কষ্টগুলি সীমাহীন হতো অন্য দুই পরিবারের
স্বাচ্ছন্দ্য আর প্রাচুর্যের সাথে অসম প্রতিযোগিতায়।
মাঝে মাঝে চাচীরা এটা ওটা দিলে মা আরো সংকোচ করতেন
তিনি এর সমান কিছু দিতে পারবেন না জানতেন
তবু কখনো পিঠা পায়েস করতে পারলে দিতেন।
মায়ের মুখটা হাসিতে আলো হয়ে থাকতো তখন!
এদের ভিতরের সুপ্ত ভালোবাসা মাঝে মাঝে চোখ মেলতো
যা অর্থের নিরিখে এক ধরণের দূরত্ব ধরে রাখত
এই তিনটি পরিবার এক সাথে তবু তাদের খাবার ছিল আলাদা
ঈদ কুরবানে বিয়েশাদীতে যাদের পোশাকে আশাকে তারতম্য
তবুও কখনো পাশের বাড়ির সাথে সীমানা নিয়ে বিরোধে
কিম্বা তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণকে ধরে ঝগড়া বিবাদে
তিনটি পরিবার ঠিকই এক হয়ে ফুঁসে উঠত সরোবে।

এক রাত্রে খাওয়া শেষে দুই ভাই শুয়ে আছি
আম্মা খাটে উঠে বসেছেন, আব্বা পড়ার টেবিলের
একমাত্র চেয়ারটাতে বসা।
আমি চোখ বন্ধ করে দু’জনের কথা শুনতে পেলাম
সেই রাতে আমার চোখে গ্রামের নতুন একটা ছবি ধরা পড়লো!
অবারিত নীল আকাশ আর দিগন্ত ছোঁয়া সবুজ মাঠ
খালের স্রোত আর স্কুলের উদ্দাম উচ্ছ্বাস কোলাহলকে পিছনে রেখে
সামনে এসে দাঁড়ালো মানুষ!
নোংরা, হিংস্র রাজনীতির সাথে পরিচয় হলো
জোতদার ভুমিপতিদের শক্তি
আর সেই শক্তি দিয়ে দুর্বল সামর্থ্যের মানুষকে শিকারের নিয়ম জানলাম!
আব্বা আম্মার অচেনা এক রূপ দেখলাম
জানলাম – আমরা গরীব! শক্তিহীন!
শক্তিমানের নির্যাতনের শিকার হবার জন্য উপযুক্ত!

জীবনে প্রথম নিজেকে ঘৃণা করলাম!
ঘৃণায় কী শক্তি তা না জেনেই দুই হাত মুঠো করে শপথ করলাম
বড় হবো! হতে হবেই!
কত আলগোছে সমাজের নির্যাতিত অংশ ছেড়ে
প্রতিবাদী অংশে উঠে গিয়েছি আমরা সেদিন
প্রিয় মিথিলা বাবু!
তা জেনেছিলাম আরো অনেক পরে।

সারা পৃথিবীতে তখন কম্যুনিষ্ট আন্দোলনের ধাক্কা
যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের প্রথম দিনগুলিতে তার কম্পন বেশ ভালোই উঠেছিল
শুরুতে টগবগে আবেগ আর দিন বদলের তীব্র আকাংখা
যারা মন প্রাণ সমর্পণ করেছিল তাদের সাথে প্রাণের টানে
বিশ্বাসের আকর্ষণে তোমার এই বাবাও যোগ দিয়েছিল মিথিলা বাবু!
অনেক ভালো ভালো চিন্তা ছিল
কঠিন আদর্শ ছিল
মনে মনে প্রত্যেকেই আমরা এক একজন চে’গুয়েভারা!
পৃথিবীর কোথায় কোন কোণায় সমাজতন্ত্র আন্দোলনে নেমে
‘রে রে ‘ রবে পুঁজিবাদকে তাড়া করেছে
প্রতিদিনের জয় পরাজয়ের খবর স্নায়ুকে টানটান করে রাখতো।
যে কোন রকম ভাংচুর
যে কোন লোকসানের বিনিময়ে হোক যৌথখামার হতেই হবে!
জীবনের কী দাম যদি দুনিয়াকে বদলাতে না পারি?
অনাচার অবিচার বন্ধ করার জন্য যা দরকার
যেভাবে দরকার করতেই হবে!
ধনী – দরিদ্রের বিভক্ত পৃথিবীকে এক পৃথিবী করার জন্য
অন্তত একটা সুখী, দু:খ -দারিদ্র্য-অশান্তিমুক্ত দেশের জন্য
যুগ যুগান্ত ধরে চলে আসা ‘দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার ‘ শেষ করার জন্য
একটা দুটো জীবন বলি দিলে কী আসে যায়?
একটা দুটো পরিবারের সাময়িক কষ্ট তো নগন্যই
এই উৎসর্গের মহিমা অপার!

দলে তো ঢুকলাম
এক এক করে খুলতে লাগলো এক এক অচেনা জগতের প্রবেশ দুয়ার।
এক সময় আবিষ্কার করলাম
দলে টিকে থাকার জন্য, দলকে টিকিয়ে রাখার জন্য
কখন অজান্তেই দুর্বলের দল ছেড়ে সবলের দলে যোগ দিয়েছি!
শৈশবের চোখে নিজেকে দেখে বংশ পরম্পরায় চেয়ারম্যান পরিবারের
চেয়ারম্যানদের সাথে নিজের খুব বেশি তফাত পেলাম না
বাঘের বদলে শিয়াল হয়ে বাঘ চরাতে শুরু করেছি!
স্রেফ একটি চাঁদাবাজ এবং গলা কাটার রাজনৈতিক দলের সদস্যে পরিণত হয়েছি!
প্রিয় বাবুটা আজ বলছি তোমায় শোনো
তাত্ত্বিকেরা কেবল টাকাই চিনেছে শুধু
মানুষ চিনেনি কোনো।

মিথিলা বাবু!
তোমার দাদা ভাই খুবই চাপা স্বভাবের ছিলেন
চেয়ারম্যানের সাথে এক গন্ডগোলের পর
বড় দুই ভাই উল্টো ওদের পক্ষ নেয়ার ক্ষোভ- দুঃখ
বাবা কোন দিনই ভুলতে পারেননি।
মনের কষ্টে শেকড় উপড়ে একা একজন মানুষ
এই ইটপাথরের প্রানহীন শহরে এলেন
সম্পূর্ণ নতুন এক জীবন শুরু করলেন।

চিরকালই রাজনীতির শিকার হয়ে সাধারন মানুষেরা
জোতদার ভুমিপতিদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়
তাদের সাথে বিবাদে যাওয়া জলে থেকে কুমিরের সাথে লড়াইয়ের মতই
তাতে জিততে হলে সেই জলের বাইরে এসে আরো বড় কুমির হয়ে ফিরতে হয়।

আমার বাবা একদিন সকালে- শীতের সকাল ছিল সেটা
আমাদেরকে নিয়ে গ্রাম ছাড়লেন।
আজ এই এতোদিন পরে স্মৃতিগুলোও কুয়াশাচ্ছন্ন
অনুভূতিতে বড্ড ঝাপসা মনে হয়।
তবুও মনে পড়ে- আমি, আমার ছোট ভাই মা-বাবার হাত ধরে
আমাদের টিনের দোতলা বাড়িটা ছেড়ে বের হয়ে এসেছি
দুই চাচা তাদের ঘরের ভিতর থেকে ক্ষোভে বেরও হলেন না
চাচীরা অবশ্য কাঁদছিলেন.. আর দাদী?
তিনি পাথরের মত নির্বাক হয়ে ঘরের দরোজায় অটল দাঁড়িয়ে!
তার ভিতরে কি ভাবের আদান-প্রদান চলছিল?
তখন বুঝিনি কিছু.. আজ অনেকটা অনুভব করতে পারছি।

খালের পারে এসে দেখি নৌকা তৈরী
সেখানে আমাদের সাথের মালামাল নিয়ে
আমাদের দূর সম্পর্কের চাচা মেরাফ অপেক্ষা করছেন
আমাদেরকে দেখে স্বভাবসুলভ হাসি হাসলেন
হাসিতে বিষন্নতা
মায়ের চোখ অশ্রুসজল
মাফলারে আর কানটুপিতে আবৃত বাবাকে দেখেও
দাদীর মত ভাবহীন অটল পাথরের কথা সেই শিশু বয়সেও মনে হয়েছিল
আমাদেরকেও কান টুপীতে ঢেকে বাবা হাত ধরে নৌকায় তুলেছিলেন
নৌকা ছেড়ে দিল।

আমার চোখের সামনে দিয়ে আমার পরিচিত গাছপালা
সেই খালের পার, পার থেকে নুয়ে বাঁকা সেই হিজল গাছটি
যার তলায় ছাবি দিয়ে চিংড়ি মাছ ধরতাম, কত স্মৃতি!
বড় হয়ে বিভূতিভূষনের লিখা পথের পাঁচালি পড়েছিলাম
সেখানে অপুর বোন দুর্গা মারা যাবার পরে
অপু যখন গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছিল
তখন অপুর চোখে যে দৃশ্যগুলো ধরা পরেছিল
তা পড়তে পড়তে আমার সেই দিনটা, সেই দিন দেখা সব কিছু,
সেদিনের শোনা সব শব্দ মনে পড়ছিল।
অপুকে মনে হচ্ছিল আমি
আম আঁটির ভেঁপু’র মত রেলের হুইসেলের মত বেজে ওঠা
লঞ্চের সেই ঘাট ছেড়ে যাবার বাঁশীর শব্দে
ব্যথাভরা মনে তোলপাড় করেছিল শুধু একটা প্রশ্ন, ‘আর কি ফিরবো?’

নদীর কিনারের সাথে গ্রামটা যখন ধীরে ধীরে চোখের আড়ালে চলে যাচ্ছিল
সেই সময়ে আমার শিশু মনে গুমরে কাঁদছিলো
বড়দের বিরুদ্ধে নিস্ফল – নি:শব্দ অভিযোগ
‘ কেন ওরা কেউ কারো সাথে একটু ভালো হয়ে থাকতে পারলো না?’
হু হু কান্নায় বুক ভেংগে যাচ্ছিলো
নিরবে চোখের পানি বয়ে যাচ্ছিলো নদীর চেয়ে তুমুল স্রোতে
মূহুর্তে মূহুর্তে ভেসে উঠছিল প্রিয় মুখগুলি,
আমার চিরপরিচিত গ্রাম, প্রতিদিনের খেলার সাথীরা
সরু খাল, খালের উপর সাঁকো, খেলার জায়গাগুলো,
প্রিয় পথঘাট, স্কুল, দোকানপাট
যা কিছুই চোখে পড়ছিলো তাকেই মন বলছিলো,
‘বিদায় বন্ধু! আবার দেখা হবে।‘
কিছু দেখছিলাম চোখে.. কিছু দেখছিলাম মনে মনে।
যা কিছুই মনে পড়ছিলো তাকেই মন বলছিলো,
‘বিদায় বন্ধু! বড় হয়ে ফিরে আসবো! ‘

ছেড়ে যাবার সেই অসীম ব্যথা বহুদিন বুকে টনটন করে উঠেছে
ফিরে যাবার সেই আশাও রয়ে গিয়েছিল অনেক বছর
কতদিন বুকে হাত রেখে ভেবেছি,
‘বড় হই! বড় হয়ে যখন ফিরবো
কেউ আমাদেরকে কিছুতেই গ্রাম থেকে বের করে দিতে পারবে না। ‘

সেই পুরনো স্মৃতি!
আমাদের নৌকা যখন ছাড়ে
বৈঠার ওঠা নামার তালে তাল মিলিয়ে
ছলকে ছলকে উঠতে নামতে থাকা পানির সাথে
ছোট্ট বুকটাতে ছলকে উঠছিলো অচেনা কষ্ট!
নদীর পাড় বেয়ে মাঝির গুণ টেনে যাওয়া দেখে মনে হচ্ছিলো
সে যেন টেনে টেনে আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে!
যখন লঞ্চে উঠলাম, লঞ্চ ঘাট ছেড়ে যাবার সময়
মেরাফ চাচা বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লে মনে হচ্ছিল
আমার হৃদয়ে কিছু একটা যেন ভাঙ্গাচুরা হচ্ছে।
শুধু কি একটা গ্রাম ছেড়ে এসেছিলাম সেদিন ?
সে তো ছিলো নিজের জীবনের সাথে বিচ্ছেদ ।

সেদিনের আগে নদীটাকে দেখলেই কতদিন ভেবেছি,
‘জানতে পারতাম – এই নদী কোথায় যায়!’
জানার দিন যেদিন এলো সেদিন সেই নদীকে মনে হলো শত্রু
মনে হলো, ‘কেন নদী এতদূরে বইলো?
নইলে কি এই লঞ্চটা এভাবে আমাদেরকে সবার কাছ থেকে এত দূরে নিয়ে যেতে পারতো?’
আজ হাসি.. যার যেতেই হতো।
নদী হোক না হোক, তাকে তো পথ খুঁজে নিতেই হতো।

গ্রামে চেয়ারম্যানদের থেকে পেয়েছিলাম প্রথম দফায়
শহরে এসেও শ্রেণীবৈষম্য আমার মনে দ্বিতীয় দফায় দাগা দিয়ে গেল
কী ছেড়ে এলাম! কেন সব ছেড়ে এই অচেনা শহরে এলাম?
গ্রামের চেয়ে শহর কিসে আলাদা হলো?
শহুরে সমাজের শ্রেনী বিভেদ আমাকে হতাশ করলো।
মিথিলা বাবু!
আমরা তোমাদেরকে শোষণ মুক্ত একটি সমাজ দিয়ে যেতে পারি নাই
কিন্তু আমরা যে ভুল করেছি, সেগুলো দেখিয়ে দিয়ে যেতে চাই
তোমরা আমাদের মত এই ভুল পথে পা বাড়াবে না
এখন বড় হয়েছো। ভালো মন্দ বুঝতে পারছো
তোমাকে আমাদের সময়টা দিলাম
এতে মিশে যাও
এ থেকে নিজের মত করে যা ভালো নিয়ে নিজেকে পুর্ণ করে নাও
এ এক আয়নাও
এতে দেখতে কি নিজেকে তোমার অন্যরকম লাগছে?

সেই দেশ এখনো আছে
আমরা বড় হয়েছিলাম
কি করে যেতে পারলাম জানিনা
তোমরা কি আমাদেরকে দোষী ভাবছো?
ব্যর্থ ভাবছো? যথেষ্ট চেষ্টা করিনি ভাবছো?
তোমাদের সময়টা কি আমাদের সময়ের চেয়ে অনেক সামনে চলে গেছে?
হয়তো পিছনের মানুষ আমরা
তবু তোমাদের পথের শুরুটা আমাদের এলোমেলো পায়ে চলা থেকেই
তুমি কি এভাবে ভাবো মিথিলা বাবু?
তোমাদের রাজপথের পিচের নিচে আমাদের কাঁচা মাটির পথ এখনো আছে
তার ধুলোমাটির ঘ্রাণ পাও?

এখন যদিও চরম বৈরী সময়
দুঃস্বপ্নগুলি সময়ের বুকে আঁকা
সুসময়গুলোকে কেড়ে নিয়ে এসো
এখন এভাবেই ভালো থাকা।
.
বাবুটা আমার প্রিয় মিথিলা তুমি
গল্প বলছি শোনো
জীবনবোধের পাতায় জড়ানো গল্পটা মোর
সব বাবাদেরই জেনো।।

___________
প্রচ্ছদঃ চারু পিন্টু

অণুগল্প : হুমায়রা

এই অণুগল্পটি শ্রেফ একটি নাম শুনেই অনেক আগে লিখেছিলাম। কেন জানি ‘হুমায়রা’ নামটি ভালো লেগেছিল, যেভাবে ‘শিহাব’ অনেক ভালো লাগা একটি নাম। এজন্যই আমার অনেক অণুগল্পে পুরুষ প্রধান চরিত্রে শিহাবের উপস্থিতি।

।। অণুগল্প : হুমায়রা ।।

পিচঢালা পথটিকে পিছনে ফেলে দীর্ঘকায় মানুষটি চায়ের দোকানের সামনে এসে থামে। বেঞ্চে কয়েকজন খদ্দের বসে অলস সময় কাটাচ্ছে। সে নিজেও বসে। চায়ের অর্ডার দেয়। দোকানদার একবার তাকে দেখে একপলক। শেষে নির্দিষ্ট কাপটি গরম পানি দিয়ে ধুয়ে নেয়।

তপনের একটা গান বাজছে সিডি প্লেয়ারে। ‘ফরেষ্ট হীলে এক দুপুরে’। একটু অবাক হয় লোকটি। আজকাল এরকম গান সচরাচর চা’র দোকানে বাজে না! নিজের দৃষ্টিসীমায় সর্পীল পথটি চলে গেছে বহু দূর… পথের দু’পাশের ইউক্যালিপটাস গাছগুলোর ঝাঁঝালো পাতা বসন্তের এই মাতাল হাওয়ায় ইতস্ততঃ ঝরে পড়ছে। কালো পিচের পথটি, জায়গায় জায়গায় জীবন্মৃত পাতাদের সবুজ-হলদেটে আভায় উদ্ভাসিত হয়ে আছে। সেই পথ ধরে পাতাঝরার মুর্ছনায় আন্দোলিত হয়ে হেঁটে আসছে এক তরুণী। অচেনা… একা… শেষ বিকেলের সবুজ আলোয় তাকে কেমন নরম লাগছে!

সামনে পিছনের দুটি পথ মুহুর্তে বিস্মৃত হয়… স্মৃতির অনেক গভীর থেকে উঠে আসা এক নষ্ট অতীত, যেন হিরণ্ময় দ্যুতিতে আলোকিত করে টেনে আনে এক কুহকী প্রহর। দীর্ঘ মানুষটি একবার ভাবে, ‘আচ্ছা, হুমায়রা কেমন আছে এখন? অপেক্ষার প্রহরগুলোতে বিরক্ত হতে হতে ওর ভ্রু-গুলো কি এখনো কুঁচকে থাকে?’

একটু হাসে সে। একটি গান কত স্মৃতিই না ধারণ করে।

____________
#মামুনের_অণুগল্প

অণুগল্পঃ প্রেম তো ছিল না ছিল শুধু প্রহসন!

অণুগল্পঃ প্রেম তো ছিল না ছিল শুধু প্রহসন!
_____________________________________________
একজন চিত্রশিল্পী ‘ন্যুড’ চিত্রকর্মকে যেভাবে নিজের দক্ষতায় অসাধারণ শিল্পকর্মে রুপ দিতে পারেন, একজন গল্পকারও অক্ষরের সাথে অক্ষরের পরিমিত মাত্রার মিলনে, আপন দক্ষতায় অনুভবের চাদর পরিয়ে, নগ্নতাকেও শিল্পে পরিণত করতে পারে। আমিও অনেক আগে এমনই এক অপচেষ্টা করেছিলাম। গল্পটি শেয়ার করছি আরো একবার…

_______________________________________________
একটা ছায়া ক্লান্ত হয়ে অপর ছায়ার উপর থেকে নেমে আসে। বাউরি বাতাসে উষ্ণতা পাক খেতে খেতে ঘন হয়… শ্রান্তিতে ভেঙ্গে পড়ে সঙ্গিনীর পাশেই একদণ্ড বিশ্রামে শান্তি খোঁজে যেন মৌণ সময়। আলতো ছুঁয়ে থাকার ভেতরে কি থাকে? সম্পর্কহীন সম্পর্কের মাঝে ভালোলাগা কতটুকু?

আলতো স্পর্শের স্মৃতি হয়তো কারো সবটুকু অনুভুতিকে আচ্ছন্ন করে রাখে এক সেকেন্ড; শেষে বিদ্যুতের মতো ঝাঁকি দিয়ে শরীরের ভিতর দিয়ে কোথাও চলে যায় … কোথায় যায়?

‘ভালোলাগা সুন্দর,
ভালোবাসা আরো সুন্দর,
কারণ –
প্রেম আসে
ভালোবাসায় পুড়ে পুড়ে ..’ – কে যেন একদিন বলেছিল শিহাবকে!

সেই কারো হৃদয়ের উজ্জ্বল আলোয় স্পর্শের নাগালের বাইরে থেকে দেখা ঝিলিক দিয়ে ওঠা হাসিমুখ … বড্ড মনে পড়ে হঠাৎ! কি যেন পর পর স্পষ্ট হতে হতে অস্পষ্ট হয়ে মিলিয়ে যায়। চেনা কিছু ছিলো । চোখ? মুখ? রঙ? ভঙ্গি? ভঙ্গি ! কার মতো !!
কণার!!!

চিন্তাটা বিবশ করে তোলে ওকে। পাশের সম্পর্কহীনার ক্ষীণ কটিতে এক হাত, বেডরেষ্টে অন্য হাত স্থির হয়ে থাকে শিহাবের। আসলে মাঝে মাঝে কোনো হিসাব নিকাশ ছাড়াই দু’জন মানুষ দু’জনের জন্য তীব্র টান অনুভব করে। ঠিক কী কারণে, বুঝা সম্ভব হয় না। এই অবস্থায় শরীরের যে চাহিদাটুকু তৈরি হয়, তা বুঝা সহজ বলে বোধ হয় মানুষ চট করে শরীরেই জড়িয়ে যায়। আর যত তারা শরীর খুঁড়ে সত্যগুলি খুঁজতে থাকে, তত দিশাহারা হতে থাকে মনটার অসহায়ত্ব দেখে । সে যে কী পেলো না, তা জানার জন্য মাথা আছড়াতে থাকে ঢেউয়ের মতো হাহাকারে; নির্দয় বোধ কিছু বলে না ; ঢেউ গুলি আছড়ে পড়ে ফেনা হয়ে যায় – আবার ঢেউ হয়ে ফিরে আসে – আবার …এভাবেই মানুষ বেঁচে থাকে!

পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকা এক ছায়া এজন্যই কি অপর ছায়ার প্রতি ঝুঁকে পড়েছে? এই ঝুঁকে পড়ায় ভালোলাগা থাকলেও সেখানে ভালোবাসা ছিল কি? তাই প্রেমও ছিল না… একটুও! ছিল কেবল জৈবিক তাড়নায় রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রহসন… তৃপ্তির ভান করার মূর্ত উপহাস!

অতৃপ্ত এক ছায়া তৃপ্তির মহাসাগরে ভেসে যাওয়ায় ব্যকূল ছিল… শিহাব হারানো ছায়াসঙ্গিনীর খোঁজে নিজেও ভেসে বেড়াচ্ছিল… অন্দরে… বন্দরে.. অন্তরে অন্তরে… নিরন্তর! অতৃপ্ত রমনী তাই ভেসে বেড়ানো শ্যাওলা ভেবে শিহাবকে আঁকড়ে ধরে। শিহাবও হারানো সঙ্গিনীর চেহারার সাথে কিছু কিছু মিল খুঁজে পেয়ে রমণীর তৃপ্তির উপকরণ হয়।

এভাবেই ছায়ারা সঙ্গিনী হয়ে উঠে… এভাবেই পরিচিত রমনী অপরিচিত কায়ায় ভর করে হৃদয়ের কার্ণিশে ঝুলে থাকে। কিন্তু তারা কায়ায় তৃপ্ত হতেই এই দোদুল্যমান জীবন বেছে নিয়েছে। তাই হৃদয়ের খোঁজ নেবার একটুও প্রয়োজন মনে করে না।

এক হৃদয়বান ছায়া, কায়া হারিয়ে এক ছায়াসঙ্গিনীর কায়ায় মিশে যেতে আবারো ব্যস্ত হয়ে পড়ে। একসময় ঢেউ হয়ে যায়… ফেনা হয়… আবারো ঢেউ… এভাবেই বেঁচে থাকা! সেখানে ভালোলাগা ভালোবাসায় রুপ নিয়ে প্রেম হয়ে উঠে না। এখানে কেবলি প্রহসন.. আর নৈঃশব্দের মূর্ত উপহাস!

#মামুনের_অণুগল্প

।। ছোটগল্পঃ ইচ্ছেপূরণ ।।

।। ছোটগল্পঃ ইচ্ছেপূরণ ।।

নিজের ছোট্ট রুম থেকে বের হয়ে চারপাশটা দেখলেন। কিছুটা মুগ্ধ হয়েই। এরপর দরজায় তালা লাগালেন। প্রতিবারই এমন হয়। কিছুক্ষণ নীল আকাশ ও সাদা মেঘের উড়ে যাওয়া দেখে মনে মনে বললেন, ‘সুবহানাল্লাহ!’

বহুদিনের অভ্যাস।
এখন আপনা আপনিই মন থেকে ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে যায়। মহান সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিসমূহ দেখতে থাকলে মনের অগোচরেই তার পবিত্রতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে! এর জন্য আলাদা ভাবে মুখ দিয়ে উচ্চারণের প্রয়োজন হয় না। আর মহান আল্লাহপাক এই মনকেই দেখেন… সেখানেই বসত গড়েন। কিন্তু তার জন্য চাই সাদা…স্ফটিকের মত মন।

আজ দুই মাস হতে চলল গাজীপুরের এই এলাকার মসজিদের ইমাম হিসাবে আব্দুল জাব্বার সাহেব নিয়োগ পেয়েছেন। এর আগে ফেনীর একটি প্রত্যন্ত এলাকায় এক মসজিদের ইমাম ছিলেন। ইমাম-কাম-মোয়াজ্জিন… একাই তাকে এই দুটো দায়িত্ব পালন করতে হতো। সেখানের মসজিদ কমিটি কোনোমতে তাকে খাইয়ে-পরিয়ে আর মাসিক থোক কিছু টাকা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিল।

ভাবনায় হোঁচট খেলেন।
এইতো একটা নাফরমানী চিন্তা করে ফেলেছেন। মসজিদ কমিটির কি সাধ্য তাকে বাঁচিয়ে রাখে? আল্লাহপাক চেয়েছেন বলেই না সেখানে তার রিযিক এসেছে… সেটা পরিমাণে যাই আসুক না কেন।

মনে মনে কয়েকবার ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ (হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করুন) পড়লেন। সাথে সাথে একথাও তার মনে পড়ল, সেই গ্রামের মসজিদে আল্লাহ পাক তার জন্য যে পরিমাণে রিযিক পাঠাতেন, সেটা দিয়ে তার নিজের এবং ভোলায় তার পরিবারের প্রতি মাসের খাওয়া খরচই মিটানোই মুশকিল হয়ে যেত। অন্যান্য কিছুর কথা তো বাদই দিলেন। টাকাগুলো সব কুরিয়ারে বাড়িতে পাঠাতেন। নিজের তিনবেলা খাবার এক এক দিন এক এক বাড়িতে নির্ধারিত ছিল। ভাল-মন্দ খাওয়া হয়েই যেত। এটাও আল্লাহপাকের ইচ্ছা।

তবে প্রতিবেলায় নিজের উদরপুর্তি করে ভালো ভালো খাবার খাওয়ার সময় চোখের সামনে ভেসে উঠত ভোলায় বৃদ্ধা মা, বউ আর তিন সন্তানের অভুক্ত চেহারাগুলো। কিন্তু খাবার নষ্ট করা যাবে না ভেবে জোর করে হলেও সেগুলো গলাধঃকরণ করতে হয়েছে। নিজের চোখের পানিকে মনের ভিতরের রক্তক্ষরণের সাথে মিশিয়ে ফেলতে হয়েছে। পাছে তার চোখে পানি দেখে খেতে কষ্ট হচ্ছে ভেবে যিনি খাওয়াচ্ছেন তিনি আবার কষ্ট পান!

কতটা গরিবী হালতে রয়েছে তার পরিবার যে তিনবেলা পেটভরে খাবারও খেতে পারে না। নদী ভাঙ্গনে তাদের সহায়-সম্পদ নদীর গর্ভে চলে গেছে। গুচ্ছগ্রামের বাড়ীটা পাওয়াতে তাদের মাথাগোঁজার একটা ঠাই হয়। এখানে তার কাছে যে সবাইকে এনে রাখবেন, সেই সামর্থ্যও তার নেই। নিজে কোনোমতে মসজিদের সাথের ছোট্ট খুপড়িতে থাকেন। পরিবারের বাকী ৫ জনকে এনে কোথায় রাখবেন? আল্লাহপাক সবরকারীদের সাথে থাকেন। সেই সবরই তিনি করছেন। এই অজ পাড়াগাঁ এ আজ পাঁচটি বছর ধরে পড়ে থাকা কি কম সবরের কাজ?

একদিন গাজীপুরের এই মসজিদটির ইমাম নিয়োগের খবর পান আরেক পরিচিত গ্রামবাসীর কাছ থেকে। সে গাজীপুরেই থাকে। তার কথামত দরখাস্ত করেন… ইন্টারভিয়্যু দেন এবং সিলেক্ট হয়ে আজ এখানে।

ভাবতে ভাবতে মসজিদ ছাড়িয়ে আরো অনেকটা এগিয়ে গেলেন। আজ জুম্মাবার। আজানের এখনো ঘন্টা খানিক বাকী আছে। এখান থেকেই বাজারের শুরু। এই এলাকায় বেশ বড় একটি গার্মেন্টস কারখানা রয়েছে।বেশ দূরে আরো কয়েকটি। এগুলোকে কেন্দ্র করেই এই এলাকাটার গড়ে উঠা। নাহলে একসময় এই এলাকা ইটভাটার জন্য কুখ্যাত ছিল। ধীরে ধীরে ফ্যাক্টরী গড়ে উঠল, কাজের জন্য শ্রমিকেরা এলো। তাদের জন্য ঘর-বাড়ি বানানো শুরু হল… ইটের ভাটার ইট দিয়ে বাড়ী হল… একসময় ভাটা বিলুপ্ত হল… দোকান-পাট তৈরী হল। এভাবেই.. একসময় বড় বড় মার্কেটগুলো এবং ফ্ল্যাট বাড়ীগুলোও অস্তিত্ব পেল। আর এগুলোর পাশে সেলাই দিদিমনিদের জন্য টিন শেডের ‘গার্মেন্টস বসতি’ কিছুটা বেমানান হলেও এদেরকে কেন্দ্র করেই এই জমজমাট আজকের এলাকা।

কাঁচা বাজার থেকে শুরু করে স্বর্ণের দোকান- সবই হয়ছে। আর সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ছোট্ট মসজিদটিও বাড়তে থাকে। ফাউন্ডেশন দিয়ে একতলা শেষ করে এখন দুই তলার ছাদের ঢালাই চলছে। আর এ সবই আল্লাহ পাকের ইচ্ছেতে সবার সহযোগিতায় হয়েছে।

প্রায় ছ’ফুটের কাছাকাছি দেহ নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় আব্দুল জাব্বার সাহেব না চাইতেই সবার সমীহ আদায় করে নেন। একেতো ধর্মীয় নেতা (ইমামের অর্থ তাই), তার ওপর বিশাল দেহ… সম্মান তো আসবেই। কিন্তু তাকে যারা পরিচালনা করেন সেই মসজিদ কমিটির সদস্যদের কাছে নয়। এটাই এখন সিস্টেমে পরিণত হয়েছে। যাদের ভিতর ন্যুণ্যতম ধর্মীয় জ্ঞান নেই, আজকাল এরাই বেশীরভাগ মসজিদের কমিটিতে পদ নিয়ে আছে। আর তার মত আরবী শিক্ষায় শিক্ষিত ইমামদেরকে চলতে হয় কিনা এদের নির্দেশনা মত?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুদী দোকান এর পাশের চা’র দোকানের দিকে আগাতে থাকেন। এখানের এই চা বিক্রেতা নয়ন কে বেশ ভাল লেগেছে ওনার। যা বলে সরাসরি বলে ফেলে। কাউকে ডরায়ও না, ছাড় দিয়েও কথা বলে না।

তাকেকে দেখে সালাম দিয়ে বসতে বলল নয়ন। এরপর চা খাবে কিনা জানতে চাইলে আব্দুল জাব্বার সাহেব সম্মতি দেন। নয়ন চা বানায় আর পাশের খদ্দেরের সাথে কথা বলে। সময় বয়ে যায়..

মসজিদ কমিটির সভাপতি পাটোয়ারী সাহেবের বলা কথা গুলো এখনো মনে আছে। একটু বেশীই মনে আছে। কারণ কথাগুলোর ভিতরে বিশেষ কিছু ছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘ আপনাকে আপনার এই বিশাল দেহ দেখেই আমরা বেশী পছন্দ করেছি। কারণ ফিগার একটা বড় ফ্যাক্টর। নাহলে আপনার থেকে আরো বেশী জানেন এমন ইমাম আমরা পেয়েছিলাম।’

পাটোয়ারী সাহেব সরকারী চাকুরে। নিজের চার তলা বাড়ী আছে। সেগুলোর ভাড়া পান। আর টাকা ধার দেবার সমিতি রয়েছে। সোজা কথায় বললে ‘সুদে টাকা লাগানো’ হয় এই সমিতির মাধ্যমে। এলাকায় এরকম অনেক সমিতি রয়েছে। যে সকল শ্রমিকেরা এখানে চাকরী করে, প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে এরাই এই সব সমিতি থেকে টাকা সুদে ধার নেয়। তাই এখানের স্থানীয় সকলেই এখন এক একটা সমিতির মালিক। এটাই অর্থ আয়ের সহজ পথ ভাবেন তারা। এদিকে আবার বেশীরভাগ ক্ষেত্রে এরাই হয় মসজিদ কমিটির সদস্য!

ওনাদের বাড়ীতেই মসজিদের ইমাম হিসেবে পালাক্রমে এক একদিন এক একজনের বাসায় আব্দুল জাব্বার সাহেবকে খেতে হয়।

ইসলাম ধর্মে আছে, হালাল খাবার খেতে হবে। অথচ সুদের কারবার যারা করে মসজিদের ইমাম সাহেবকে তাদের বাড়িতেই খেতে হয়! আর এ ছাড়া কিছু করারও তো নেই। তাকে যা বেতন দেয়া হয়, সেটা একেবারে ফেলে দেবার মত না। গ্রামের বাড়ীর সবাইকে নিয়ে এখানে এনে রাখতে পারবেন এখন। কিন্তু এলাকার এটাই রেওয়াজ। তিনি যদি না করে দেন, তাতে বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিবে। নাহয় বাড়ি বাড়ি খেলেন না, কিন্তু কোনো না কোনো সময়ে তো কারো না কারো বাড়ি খেতে যেতেই হবে। তখন?

আগের ইমাম সাহেবও খুব কামেল লোক ছিলেন। এই মসজিদের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে, ওয়াজ এর আয়োজন করে এই মসজিদ এতোদুর নিয়ে এসেছেন।

অথচ তাকে বাদ দিয়ে দেয়া হল।
কারণ তিনি জুমুয়ার খুতবাতে সুদের বিরুদ্ধে বলতেন। কমিটির লোকেরা ওনাকে এই ব্যাপারে না বলার জন্য অনেক অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কারো কথাই শুনলেন না। অবশেষে তাকে চলে যেতে হল।

চা খেয়ে বিল দিয়ে আবার ফিরতি পথ ধরলেন। আজানের আর বেশী বাকী নেই। পথে দেয়ালে দেয়ালে সিনেমার পোস্টার। অর্ধনগ্ন নারীদেহের রঙিন ছবি। এরকম কিছুদুর পরপর রয়েছে। সেদিকে চোখ চলে গেলেও দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নিতে পারেন। সাধারণ পাবলিকের সাথে এখানেই তার পার্থক্য। দীর্ঘদিনের অনুশীলন বলে কথা।

হাঁটতে হাঁটতে পাটোয়ারী সাহেবের আর একটি কথা মনে পড়ল। প্রথম দিন অনেক কিছুর সাথে তাকে এই কথাটিও বলেছিলেন, ‘আপনি ইমাম। মানুষের আখিরাতের মুক্তির জন্য কোরআন হাদিসের আলোকে বয়ান করবেন। সেটা আপনার এক্তিয়ার। কিন্তু সুদের বিষয়টি বাদ দিয়ে বয়ান করবেন। আমাদের এই এলাকার বেশীরভাগ মানুষই হয় সুদের ব্যবসা করে, না হয় সুদে টাকা ধার নিয়েছে। এখন এই বিষয়ে আলোচনা করলে সকলেরই শরীরে লাগে।’

সেই সময় একবার চিন্তা করলেন, পাটোয়ারি সাহেবকে বলেন যে, তবে এই ব্যবসা বাদ দিচ্ছেন না কেন?
কিন্তু অনেক কিছু চাইলেই আমরা বলতে পারি না।

যখনই মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন যে, না, এভাবে নিজেকে ছোট করে ইমামতি করা যায় না। তখনই ফেনীর সেই ৫ বছরের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের কথা মনে পড়ে… ইমাম হবার পরও তাকে জমিতে হালের বলদ নিয়ে চাষে সাহায্য করতে হয়েছে… জায়গীর থাকার মত ছোট ছোট ছেলে মেয়েদেরকে দিনের পর দিন বিনা বেতনে পড়াতে হয়েছে… মসজিদের দেখাশুনা করা তো ছিলই।

আর ছিল পরিবারের সবাইকে ফেলে একা একা থাকা… দিনের পর দিন! আহ! অসহ্য যন্ত্রনাকর সেই দিনগুলোকে ফেলে এখন যখনই না একটু সুদিন আসি আসি করছে, তিনি কি নিজের বিবেকের দংশনে জর্জরিত হয়ে সেটিকে পায়ে মাড়িয়ে আবার সেই কষ্টকর দিনগুলোতে ফিরে যাবেন? মা-বউ ও তিন বাচ্চাকে এখানে সামনের মাসে নিয়ে আসবেন চিন্তা করেছেন। পাটোয়ারী সাহেব একটা দু’রুমের বাসাও তার জন্য অল্প ভাড়াতে ঠিক করে দিয়েছেন। পাশেই স্কুল আছে। সেখানে ছেলেমেয়ে তিনজনকে ভর্তি করাতে পারবেন। একটা মাদ্রাসা করার চিন্তা করেছে মসজিদ কমিটি, সেটাও তাকে চালাতে হবে। সেদিক থেকেও কিছু টাকা আসবে। আর সকালে এখন তার কাছে প্রায় ৫০-৬০ জনের মত আরবী পড়ছে। সেখান থেকেও অনেক টাকা আসছে।

এই সব কিছুকে ছেড়ে যেতে হবে একেবারে খালি হাতে, যদি কমিটির সদস্যদের কথার বাইরে নিজের বিবেকের কথা মত চলেন।

কি হবে আবার ফিরে গেলে?
মাকে ফোনে সেদিন বলেছেন, ‘চিন্তা কইরো না। আমার কাছে তোমাদের সবাইকে নিয়ে আসছি। আর কষ্ট করা লাগবে না।’

মা এর হাসিমুখ এতো দূর থেকেও তিনি দেখতে পেলেন। বউ এর খুশী অনুভব করতে পারলেন। ছেলেমেয়েদের বাবার কাছে আসার… একটু পেট ভরে খেতে পারার আনন্দকে নিজের হৃদয়ে উপলব্ধি করতে পারছেন।

এসবই স্রেফ উবে যাবে!
তার একটি সিদ্ধান্তের দ্বারা।

মসজিদের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে জুতো জোড়া হাতে নিতে নিতে ভাবেন, একটা হাহাকার জীবনে সবসময় থেকেই যায়। সেটাকে কেউই অতিক্রম করতে পারে না।দারিদ্র্যতা জীবনের একটা অলংকারের মত তার জীবনে রয়েই গেলো। তবে যে এই দারিদ্র্যতাকে মেনে নিতে পেরেছে, তাকে কখনো শান্তির পিছনে ছুটতে হয় নাই। বরং শান্তিই তার পিছু নিয়েছে।

বড় করে শ্বাস নিয়ে মিম্বরের দিকে চলে যান। আজান দিতে হবে।

পুরো মসজিদে পিনপতন নীরবতা না থাকলেও মোটামুটি সকলেই নীরব। এই নতুন ইমাম এর কথার ভিতরে একরকম যাদু আছে। শুনতে বেশ ভালোই লাগে। খুৎবার আগে ইমাম সাহেব বাংলায় কিছু বয়ান করেন। এখন সেটাই দিতে যাচ্ছেন নতুন ইমাম আব্দুল জাব্বার সাহেব। তিনি সালাম দিয়ে শুরু করলেন,

– আল্লাহ পাক সুদকে হারাম করেছেন… যাকাতকে করেছেন ফরয।।

#মামুনের_ছোটগল্প

ছোটগল্প : ফিরতি পথে

ফিরতি পথে ।। ছোটগল্প

– এতো রাতে ফোন করলি কেন? তোর হাজব্যান্ড কোথায়? তারিকের আওয়াজে বিরক্তির ঝাঁঝ।
– আনহ্যাপি মহিলারাই এত রাতে এইভাবে ফোন করে।

মিলার মুখ গাল কান থেকে গরম ভাপ উঠতে লাগলো, কঠিন গলায় বললো,
– রাত সাড়ে দশটা, তুই তখন বললি বলেই ফোন করলাম। যাকে তাকে রাত্রে ফোন করি না আমি। রিসিভ ও করি না।

তারিকের মেজাজ একই রকম খারাপ,
– তাতে কী? ঘুম ভেংগে দিলি কেন? এখন আমি কি করবো?

মিলা অপ্রস্তুত,
– sorry , ঘুমা। রাখি।

তারিক ধমক লাগালো,
– রাখবি না। সারা রাত কথা বলবি।
– sorry

গম্ভীর হয়ে ফোন কেটে দিলো মিলা।
অনেকগুলি খারাপ অনুভুতি একসাথে হচ্ছে ওর। বিশ্রী লাগছে। সত্যি সত্যি ও বাসায় একা। ঘুম আসছে না। কী বললো তারিক? মিলা কি এই জন্য তারিককে ফোন করেছে?

মনটা খারাপ হয়ে গেলো মিলার।
টিভির, বই এর নেশা ও ছুটে গেছে অনেক বছর আগে। ভালো লাগে না। অনেক বছর ধরে নির্ঘুম রাত, নি:সঙ্গ দিন, কারণে অকারণে লোকজনের খারাপ ব্যবহারকে স্বাভাবিক বলে বুঝে নিয়েছে ও। তবু তারিকের ব্যবহারে খুব অপমান লাগলো।

আবার এক রকম মমতাও যেন টের পাচ্ছিলো। বেচারার ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। একা মানুষ। আর হয়তো সহজে ঘুমটা আসবেও না।

অপরাধী মনে হতে লাগলো নিজেকে মিলার। মাথা নিচু করে বাগানের চেয়ারটাতে বসে ভাবতে লাগলো ও।
অনেকক্ষণ পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
‘সমস্যা আছে।’

তার মন ওয়ার্নিং দিলো।
সতর্ক মিলা মনে মনে তারিককে দুটো প্রশ্ন করলো,
‘এত কিছু থাকতে কেন তোর মনে হলো আমি আনহ্যাপি? কেমন আছিস তুই?’
….

ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে। চাইলেও টিভি দেখে বা বই পড়ে সময় কাটাতে পারে। হয়তো তাইই করা উচিত। নিজের এলাকার বাইরে পা ফেলাটা বোকামি। তারিকের কথাগুলি মনে পড়লেই নিজের উপর নিজের রাগ লাগতে থাকলো মিলার। তার একা থাকারই অভ্যাস। এক এক সময় এক এক কাজের ভুতে পায় ওকে। তাই নিয়ে ব্যস্ত থাকে।

বন্ধু বলতে শেয়ারিং কেয়ারিং এর ইনফর্মাল যা ইচ্ছা তাই বলার কেউ মিলার কোনদিন কেউ ছিলো না। অনেক বন্ধু নিয়ে একটা কাজ চিন্তায় আসার পর সে ফর্মাল বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করেছিলো।

মোটামুটি একটা সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গেলেই আইডিয়াটা বলা যাবে ভেবে সে সবার সাথে বেশ নিয়মিত কথাবার্তা বলতে লাগলো।

এই রকম একটা অবস্থায় সে তারিককে পেলো বন্ধুদের আড্ডায়। ভার্সিটি তে পড়ার সময়ে কমন দুই এক জন বন্ধুর আড্ডায় দেখা হয়েছে দুই একবার। সৌজন্যই। ঠিক বন্ধুত্ব নয়। ক্লাসমেট।

আঠারো বিশ বছর পর যোগাযোগে নিজেদের পুরানা দিনের জন্য ভালোবাসাটাই নিজেদের অজান্তে একে অন্যের সাথে শেয়ার করতে শুরু করলো। মধ্যবয়সের সয়ে যাওয়া নিঃসঙ্গতা হঠাৎ অসহনীয় হয়ে উঠলো।
তারুণ্য নয়, মন চাইলো প্রথম কৈশোর ফিরে পেতে।

যে যার নিজের অতীতে ফিরে গেলো। হৈ হল্লা, ঝগড়াঝাঁটি, অভিযোগের গোলমালে তাদের আসল বয়সটা কখন হারিয়ে গেলো কেউ খেয়ালই করতে পারলো না। সময়ের সাথে সত্যি সত্যি বুদ্ধি শুদ্ধিও চলে গেলো। যার চিন্তায় যা প্ল্যান ছিলো সমস্তই ভেসে গেলো। দুজন ব্যস্ত রইলো কথা কাটাকাটি, ঝগড়ায়।
কোন কথাটা বলার, কোনটা নয় খেয়াল ও রইলো না কারো। অবশেষে যখন হুঁশ হলো তখন দুজনই সত্যিকার সমস্যায় পড়ে গেলো।

তবে, যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। পথ তো থাকেই। তারা কানাগলির শেষ থেকে আবার বড় রাস্তায় ফিরে চললো।
…….

তারিকের প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল।
সাধারণত ঘুম ভেঙ্গে গেলে, সহজে আর ঘুমাতে পারে না। এজন্যই মিলার ফোনে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতে এতটা চটেছিল। আর রাগটা আরো বেড়ে গেলো কথা শেষ না করেই হুট করে ফোনটা কেটে দেয়াতে।

বছর যদি ৩৬৫ দিনে ধরা হয়, তবে তারিক ২৮৭ দিন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একজন ‘বিবাহিত ব্যাচেলর’ রুপে দিন কাটায়। প্রাইভেট কোম্পানির গোলামি বলে কথা। দেশের ভিতরে থেকেই বিদেশে চাকরি করার অনুভূতি! কেমন এক বিশাল প্রাপ্তি মনে হয় তারিকের কাছে। ভিসাবিহীন… খরচাবিহীন মুফতে অনুভূতি লাভ!

নিজের পরিবারের সদস্যদেরকে এক জেলায় রেখে, নিজে অন্য এক জেলায় থাকে। একা। একটি ১৩০ বর্গফিটের ছোট্ট রুমের ভিতরে রাত ৮টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত কাটাতে হয়। এরপর রুমে ঢুকেই কোনোমতে খেয়ে নিয়েই বিছানায় পিঠ এলিয়ে দেয়া। ছোট্ট একটা টিভি নিজের মত চলতে থাকে। বিনোদনের ব্যবস্থা এই টিভি আর মোবাইল ফোন। প্রায় রাতই টিভি চলতে থাকে, তারিক ঘুমিয়ে পড়ে। মোবাইলে কথা বলার থেকে নেট ব্যবহারই করে বেশী।

আজও নেট ব্যবহার করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল… মিলার কলটা যখন আসল, রিংটোনের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গতেই মোবাইলটা পিঠের নিচে আবিষ্কার করে।

ডিসপ্লেতে মিলার নামটা দেখেই প্রচন্ড একটা সুপ্ত ক্রোধের ধীরে ধীরে জেগে উঠাটা টের পায়। বুকের গভীরে একটা আগ্নেয়গিরির গভীর তলদেশ থেকে প্রচন্ড জমাট বাঁধা কিছু নির্বাক অভিব্যক্তি খুব দ্রুত কিছু শীতল অনুভূতিকে সাথে নিয়ে ক্রমেই উপরে উঠতে থাকে। আর উত্তরোত্তর উত্তপ্ত হতে থাকে।

কেন এই রাগ? মিলার সাথে ওর সম্পর্কটা কেমন? দু’জনের ভিতরের এই সম্পর্ককে তারিক কিভাবে দেখছে? নিজের মনে এতোগুলো প্রশ্ন শুধু যে কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতে এখনই উঠেছে, তা নয়। কাজের ভিতরে কি কাজের অবসরে, এই প্রশ্নগুলো বহুবার ওর মনে উঠেছে। কিন্তু কখনোই সদুত্তর সে পায়নি।

পায়নি নাকি পেয়েও উপলব্ধি করাতে চায় না?
নিজের বউ বাচ্চা রয়েছে… মিলার স্বামী সন্তান। এসব কিছুকে অতিক্রম করে কেমন এক দুর্বোধ্য সম্পর্কের মায়াজালে নিজেকে জড়িয়ে নিয়ে ক্রমশঃ আরো গভীরে নেমে যাচ্ছে সে।

এই বয়সে সে কি মিলাকে ভালোবেসে ফেলেছে?
জীবনের অনেকটা পথ অন্য কারো হাত ধরে হেঁটে হেঁটে এই বিষণ্ন বেলাভূমে নতুন অন্য কাউকে নিয়ে একটি অচেনা ফিরতি পথ ধরে এক আনন্দময় ট্রেইলের কল্পনা করাটা কি ঠিক হচ্ছে? শোভন হচ্ছে?

তবে এই ভাবনায় যে কিছু বৈসাদৃশ্য রয়েছে, বিছানায় উঠে বসে ভিতরে ভিতরে কাঁপতে থাকা অবস্থায় তারিক অনুধাবন করে। ওর এই মুহুর্তের চিন্তাধারায় ‘বিষন্ন বেলাভূমি’ এবং ‘অচেনা ফিরতি পথ’ ধরে ‘এক আনন্দময় ট্রেইলের’ কল্পনা করা হয়েছে। বিষন্ন বেলাভূমি কখনো আনন্দময় ট্রেইলের উৎপত্তি ঘটাতে পারে না। আর ফিরতি পথ অচেনা হয় কিভাবে? যে পথে সামনে আগানো হয়েছে, আবার সেই পথে ফিরে যাওয়া হয় বলেই না সেটাকে ফিরতি পথ বলে।

কিন্তু নিজেই নিজের ভাবনাগুলোর উত্তর দেয়। ফিরতি পথ অবশ্যই অচেনা হতে পারে। যখন অচেনা কাউকে সাথে নিয়ে হাত ধরে নিজের চিরচেনা পথে ফিরে আসা হয়, তখন পরিচিত পথটিও অচেনা হয়ে উঠে।

তবে কি মিলা ওর অপরিচিত? যাকে নিয়ে সে জীবনের বাকি পথটুকু এক আনন্দময় ভ্রমনে ক্রমশঃ প্রগলভ হয়ে উঠতে চায়!

কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতি হতে থাকে তারিকের।
একটা ঘোরের ভিতরে চলে যায় সে। ওর এই রুমের বাথরুমের শাওয়ারটির নিচে দাঁড়ালে মাঝে মাঝে সে এই অনুভূতি পেয়ে থাকে। প্রচন্ড পানির গতি… উপর থেকে সারা শরীরে আছড়ে পড়ার অদ্ভু্ত মাদকতার পরশ বুলিয়ে যাওয়ার অনুভূতি! বেশ আগে ছেলেবেলায় এক বৃষ্টির দিনে প্রচন্ড স্রোতের ভিতরে খালে নেমেছিল সে। অল্প অল্প সাঁতার শিখেছিল কেবল। হঠাৎ স্রোতের টানে খালের পানির ঘূর্ণিতে তলিয়ে যেতে যেতে চোখে ভাসছিল পানির ভিতর থেকে গজিয়ে উঠা হোগলা গাছের লম্বা ফুলের হলুদাভ অবয়বটি। বৃষ্টির পানির ঠান্ডা অনুভূতিকে ছাপিয়ে কেমন উষ্ণ আরামদায়ক অনুভূতি এনে দিচ্ছিল খালের পানি। আর ডুবে যেতে যেতে নাকে মুখে পানি প্রবেশের সময়ের সেই প্রচন্ড সাইনাস পেইনের অনুভূতিও মুহুর্তে অনুভব করে।

সেবার অবশ্য নিয়তিই ওকে তীরে এনে ফেলেছিল। ওহ! পায়ে যখন মাটির স্পর্শ পেয়েছিল, আর বুক সমান পানিতে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিকণার শীতল ছুঁয়ে দেয়ার মাঝে ঝাপসা চোখে কালো আকাশকে দেখেও যে অসাধারণ ভালোলাগার অনুভূতি জেগেছিল!
আজ মিলাকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনার সময়েও কি এই সবগুলো অনুভূতি ক্রমান্বয়ে তারিককে ঘিরে ধরেছিল না?

মিলা! মিলাকে নিয়ে অচেনা ফিরতি পথ ধরে আনন্দময় ট্রেইলের সন্ধান লাভের চিন্তাটা শাওয়ারের প্রচন্ড গতিতে শরীরে পানির স্পর্শের সুখানুভূতি কি এনে দেয় না? আর চলমান বাস্তবতা এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট বৃষ্টির শীতল ফোটার সাথে খালের স্রোতে তলিয়ে গিয়ে খাবি খাওয়ার অনুভূতি-ই কি নয়? আর এসব কিছুকে ছাপিয়ে জীবনের পিছনের ট্রেইল মুছে দিয়ে, এতোদিনের সম্পর্কগুলোকে নষ্ট করে, মিলার হাত ধরে অচেনা ফিরতি পথে চলার মত মনোবলের অভাব সেই তীব্র সাইনাস পেইন হিসেবে কাজ করে।

একটা ১৩০ বর্গফুটের রুমের ভিতরে তারিক নামের এক মধ্যবয়সী নিজের জীবনের মাঝামাঝি এসে হঠাৎ যেন দিক হারিয়ে ফেলে। অনুভূতিতে একজন সম্পর্কহীনা সকল সম্পর্কের মূল উৎস হতে চেয়েও কেন জানি হতে পারে না। শুধুমাত্র হৃদয়ের অনুভূতি দিয়েতো আর জীবন যেখানে অন্তরীণ, সেই ক্ষেত্রকে অতিক্রম করা যায় না। তাই তারিকও জীবনের বাস্তবতাকে এড়িয়ে যেতে পারে না।

বহু যত্নে হৃদয়ে লালিত একটি ফিরতি পথ ধরে অচেনা কাউকে সাথে নিয়ে পথচলা আর হয়তো ওর হয়ে উঠবে না।।

_____________
#মামুনের_ছোটগল্প

জাতির জনকের জন্মদিবস এবং কিছু কথা

আজ জাতির জনক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ৯৯-তম জন্মদিন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে চলছে তুমুল স্মৃতিচারণ, শুভেচ্ছা জ্ঞাপন। টক-শোগুলিতে ধুমায়িত কফির মগ সামনে রেখে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা। সবাই যার যার মতো নিজেকে কঠিন বঙ্গবন্ধুর অনুসারী জাহির করাতে সচেষ্ট।

কিন্তু কথা হলো, এখন আওয়ামীলীগের সুবর্ণ সময়। টানা দশ বছর পার করে এই ঐতিহ্যবাহী দলটি পরপর তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় রয়েছে। তাই স্বভাবতই এখন ‘বসন্তের কোকিলদের’ আগমন। এইসব কোকিলেরা ‘হাইব্রিড আওয়ামীলীগার’ হিসেবেই কোনো কোনো মহলে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। এরা ‘চাম্পু’ টাইপেরও বলতে পারেন। ‘চাম্পু টাইপ’ কী সেটা জানতে চাইলে অন্য কোনো সময় এ বিষয়ে জ্ঞানগম্ভীর আলোচনা করা যাবে।

বলছি বসন্তের কোকিলদের কথা। আওয়ামীলীগের দুঃসময়ে এদেরকে পাওয়া যায় না। তখন এরাই ১৫ আগস্ট সহ বিভিন্ন দিবসে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাজাতে বাঁধা সৃষ্টি করে অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে (এ ব্যাপারে আমার নিজের দেখা বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে)। বহু পুরনো সময়ের প্রতিনিধিত্ব করছে এমন বসন্তের কোকিলরাও রয়েছেন। আবার এইসব হাইব্রিড লীগাররাই আওয়ামীলীগের বিরোধীদের থেকে সুবিধা গ্রহণ করে তাদেরকে বিভিন্ন সুবিধা পাইয়ে দিতে সদা তৎপর। এরা আসলে আওয়ামীলীগের অভ্যন্তরে বসবাস করা ক্ষতিকারক নেংটি ইঁদুর। এসব ইঁদুর থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়।

বলছিলাম পুরনো সময়ের বসন্তের কোকিলদের কথা। পুরনো সময় বলতে আমি ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট পরবর্তী সময়কেই ধরলাম। তখন সময় এমন ছিলো যে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কথা বলে কিংবা সপরিবারে তাকে নৃশংস ভাবে হত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় অথবা পত্রিকায় দু’কলম লিখবে- এমন কাউকেই তখন পাওয়া যায়নি। অথচ বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর সাথে সামান্যতম লিংক আছে এমন দিবস এলেই এইসব পুরনো কোকিলেরা জাতির জনকের স্তুতিগানে নিজেদের মুখের ফেনা তুলে ফেলে এমন অবস্থা।

আজ জাতির জনকের শুভ জন্মদিনে কেন তাঁর মৃত্যু দিবসের প্রসঙ্গ তুলে আলাপ করছি- অনেকেই হয়তো এমনটি ভাবছেন। ভাবুন। ভাববার মতো বিষয়ই বৈকি।

আমার মতে আজ এবং জাতির জনকের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি দিবসে এই দেশে কেবলমাত্র কবি নির্মলেন্দু গুণই শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কিছু বলার, লেখার কিংবা গাইবার অধিকার রাখেন। কেন? বলছি শুনুন…

১৯৭৭ ইং সাল। ভয়ংকর একটা সময় পার করছে বাংলাদেশ। পাথরচাপা সেই অন্ধকার সময়ে বাংলা একাডেমির একুশের কবিতা পাঠের আসরে প্রথম দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’ শীর্ষক প্রথম কবিতাটি লিখেছিলেন তিনিই। ১৯৭৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যতরুণ গোষ্ঠীর একুশে স্মরণিকা ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’ এ এই কবিতাটি প্রকাশিত হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এটিই ছিল প্রথম প্রতিবাদী কবিতার সংকলন।

‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’ কবিতায় নির্মলেন্দু গুণ বললেন-

‘সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি,
রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপ
গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।

শহিদ মিনার থেকে খসে-পড়া একটি রক্তাক্ত ইট গতকাল আমাকে বলেছে,
আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
সমবেত সকলের মতো আমিও পলাশ ফুল খুব ভালোবাসি, ‘সমকাল’
পার হয়ে যেতে সদ্যফোটা একটি পলাশ গতকাল কানে কানে
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।

শাহবাগ এ্যভিন্যুর ঘূর্ণায়িত জলের ঝরনাটি আর্তস্বরে আমাকে বলেছে,
আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।

সমবেত সকলের মতো আমারো স্বপ্নের প্রতি পক্ষপাত আছে,
ভালোবাসা আছে_ শেষ রাতে দেখা একটি সাহসী স্বপ্ন গতকাল
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।

এই বসন্তের বটমূলে সমবেত ব্যথিত মানুষগুলো সাক্ষী থাকুক,
না-ফোটা কৃষ্ণচূড়ার শুষ্কভগ্ন অপ্রস্তুত প্রাণের ঐ গোপন মঞ্জরীগুলো কান পেতে শুনুক,
আসন্ন সন্ধ্যার এই কালো কোকিলটি জেনে যাক_
আমার পায়ের তলায় পুণ্য মাটি ছুঁয়ে
আমি আজ সেই গোলাপের কথা রাখলাম, আজ সেই পলাশের কথা
রাখলাম, আজ সেই স্বপ্নের কথা রাখলাম।

আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি,
আমি আমার ভালোবাসার কথা বলতে এসেছিলাম।’

তাই, আওয়ামীলীগের দুঃসময়ে যারা বঙ্গবন্ধুর জয়গান গাইতে ভয়-ভীতি শংকা কিংবা অন্য কোনো প্রলোভনে নিশ্চুপ থেকেছে, যে সব লেখক/কবি/সাহিত্যিকের লেখনি স্তব্ধ থেকেছে- আজও তাঁদের নিশ্চুপ থেকে দুঃসময়ের নিশ্চুপতার প্রায়শ্চিত্ত করা উচিৎ।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কবি নির্মলেন্দু গুণ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ‘প্রচ্ছদের জন্য : শেখ মুজিবুর রহমানকে’, ‘সুবর্ণ গোলাপের জন্য’, ‘শেখ মুজিব ১৯৭১’, ‘সেই খুনের গল্প ১৯৭৫’, ‘ভয় নেই’, ‘রাজদণ্ড’, ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’, ‘মুজিব মানে মুক্তি’, ‘শেষ দেখা’, ‘সেই রাত্রির কল্পকাহিনী’, ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো’, ‘শোকগাথা : ১৬ আগস্ট ১৯৭৫’, ‘পুনশ্চ মুজিবকথা’, ‘আগস্ট শোকের মাস, কাঁদো’, ‘প্রত্যাবর্তনের আনন্দ’ প্রভৃতি কবিতা লিখেছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তার লেখা প্রথম কবিতা ‘প্রচ্ছদের জন্য : শেখ মুজিবুর রহমানকে’, ১৯৬৭ সালের ১২ নভেম্বর এ কবিতাটি তিনি যখন লেখেন তখন মুজিব কারাগারে।

আজ জাতির জনকের ৯৯তম জন্মদিবসে আমিও কোনো শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করবো না। আমিও আরেকটি কবিতা (এটি গানও) দিয়ে লেখা শেষ করবো-

‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত, বঙ্গবন্ধু মরে নাই।
যদি রাজপথে আবার মিছিল হতো, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই।
তবে বিশ্ব পেত এক মহান নেতা, আমরা পেতাম ফিরে জাতির পিতা।

যে মানুষ ভীরু কাপুরুষের মতো, করেনি কো কখনো মাথা নত।
এনেছিল হায়েনার ছোবল থেকে আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা।
কে আছে বাঙ্গালি তার সমতুল্য, ইতিহাস একদিন দেবে তার মুল্য।
সত্যকে মিথ্যার আড়াল করে, যায় কি রাখা কখনো তা।

যদি রাত পোহালে শোনা যেত, বঙ্গবন্ধু মরে নাই।
যদি রাজপথে আবার মিছিল হতো, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই।
তবে বিশ্ব পেত এক মহান নেতা, আমরা পেতাম ফিরে জাতির পিতা।’

youtu.be/VdphdjUQMc8

মামুনের অণুগল্প : শূণ্য

শূণ্য

একটা পর্দা। দুটি দেহ। এক হতে চেয়েছিল অনেকের সাথে থেকেও। একজনের ভুলের কারণে বিচ্ছিন্ন হল। চাইলেই তাঁরা এক হতে পারে।

দূরত্বটা বেশী ছিল না। কিন্তু সংকোচ ওদের ভিতর এতোটা দুরত্ব এনে দিলো… পর্দার আড়াল থেকেও অ…নে…ক অনেক দূরে সরে গেল তাঁরা। এতোটা দূরে সরে যাবে কল্পনায় ও আসেনি তাদের! এখন ভাবে, পর্দার বাইরেই তো ভাল ছিল!

‘Every time we touch
I get this feeling
Every time we kiss
I swear I can fly
Can’t you feel
My heart beat, so..
I can’t let You go
Want You in my life..’

“মানুষের হৃদয়, বিবেক, স্বপ্ন আর আশা তার সুখ দুঃখ গুলির মতোই মানুষের নিজের কাছে থেকে যায়। কেউ চাইলেই শূণ্য হতে পারে না “- শিহাবকে অনেক আগে কেউ একজন বলেছিল।

সেই থেকে নিজেকে শূণ্য করার চেষ্টায় ব্যতিব্যস্ত রেখেছে শিহাব। হৃদয় আর বিবেকের গলা টিপে ধরে দুঃখগুলো দূরে তাড়াতে চাইছে। সুখগুলো স্বপ্নভঙ্গের কারণে আগেই আশাহীন হয়ে সেই ‘কেউ একজনের’ পিছু পিছু চলে গেলো। সেই থেকে যদিও একা… কিন্তু শূণ্য হতে পেরেছে কি?

_____________
#মামুনের_অণুগল্প

মামুনের অণুগল্পঃ কায়া

“তেরোই জুলাই কথা দিয়েছিলে আসবে।
সেই মত আমি সাজিয়েছিলাম আকাশে
ব্যস্ত আলোর অজস্র নীল জোনাকি।
সেই মত আমি জানিয়েছিলাম নদীকে প্রস্তুত থেকো,
জলে যেন ছায়া না পড়ে মেঘ বা গাছের।
তেরোই জুলাই এলে না।
জ্বর হয়েছিল? বাড়িতে তো ছিল টেলিফোন
জানালে পারতে। থার্মোমিটার সাজতাম।
নীলিমাকে ছুঁয়ে পাখি হতো পরিতৃপ্ত।” *

জীবনের শুরুতে, এরকম অনেকগুলি তেরোই জুলাই মিস হয়েছিলো শিহাবের কণাকে ঘিরে। ইচ্ছে-অনিচ্ছায় কিংবা কার ভুলে? আজ আর তার স্মরণের কোনো প্রয়োজন দেখে না সে।

এরপর বিস্মৃতির আড়ালে অনেকগুলি বছর… হারানো এক অন্য জীবন! আদৌ সেটা জীবন ছিলো কিনা সে অনেক গবেষণার বিষয় হতে পারে, তাই সেদিকেও যেতে চায় না শিহাব।

তারপর? অপ্রত্যাশিতভাবে একদিন আরেক ভিন্ন প্ল্যাটফরমে আবারও দেখা হলো দু’জনের। হাসলে গালে টোল পড়ত কণার। যদিও সেদিন টোল পড়েছিল, কিন্তু কোথায় সেই হাসিমুখ? অপূর্ব মুখশ্রীর সেই মেয়েটি সেদিন শিহাবের সামনে দাঁড়িয়ে মুখে হাসি ধরে রাখলেও, সেই হাসিটুকু শিহাবের জন্য ছিলো না! সে এখন অন্য কারও জন্য হাসে!

নীলিমাকে ছুঁয়ে পরিতৃপ্তি পেতে, মাত্র একজীবন, অনেক পাখির জন্যই খুবই অল্প সময়।।

_____________________________
#মামুনের_অণুগল্প … কায়া // অণুগল্প ৫৩৮।

* কথোপকথন_২২ঃ পূর্ণেন্দু পত্রী